All posts by pavel

স্মরণীয় বাণী

মহানবী (সা.) বলেন : দয়া কর সেই সম্মানিতের ওপর যে লাঞ্ছিত হয়েছে, আর সেই ধনীর ওপর যে নিঃস্ব হয়েছে আর ঐ জ্ঞানীর ওপর যে মূর্খদের কবলে পড়েছে।

মহানবী (সা.) বলেন : যখন তোমাদের নেতারা হয় তোমাদের উত্তম লোকেরা আর তোমাদের সামর্থ্যবানরা হয় তোমাদের দানশীল লোকেরা, আর তোমাদের কাজকর্ম হয় তোমাদের সকলের পরামর্শ সহকারে তখন তোমাদের জন্য মাটির উপরিভাগই মাটির অভ্যন্তরের চেয়ে উত্তম হবে। আর যখন তোমাদের নেতারা হয় তোমাদের নিকৃষ্টরা আর তোমাদের সামর্থ্যবানরা হয় তোমাদের কৃপণরা আর তোমাদের কাজকর্ম ন্যস্ত হয় তোমাদের নারীদের ওপর তখন তোমাদের জন্য মাটির ওপরের চেয়ে নিচে থাকাই শ্রেয়।

মহানবী (সা.) বলেন : সেই ব্যক্তি অভিশপ্ত যে নিজের রুজির ভার অন্যের ওপর ন্যস্ত করেছে।

রাসূলুল্লাহ্্ (সা.) বলেন : অন্তরসমূহ ঐ সকল লোকের বন্ধুত্বে বাধা পড়ে যারা তাদের প্রতি সদাচার করেছে আর ঐ সকল লোকের শত্রু হয় যারা তাদের প্রতি অনিষ্ট করেছে।

ইমাম আলী (আ.) বলেন : বন্ধু বন্ধু নয় যতক্ষণ না নিজের বন্ধুকে রক্ষা করে কষ্টের সময়ে, তার অনুপস্থিতিতে এবং তার মৃত্যুর পরে।

ইমাম আলী (আ.) বলেন : যে ব্যক্তি দীনকে রুজি রোজগারের মাধ্যম করে তার জন্য দীন থেকে অর্জন হলো সেটুকুই যা সে ভক্ষণ করে।

ইমাম আলী (আ.) বলেন : ঈমান হলো পছন্দনীয় কথা, কৃত কাজ আর অন্তর দ্বারা মারেফাত অর্জন।

ইমাম হাসান (আ.) বলেন : নিশ্চয় পূর্ণ দৃষ্টিবান চোখ হলো সেই চোখ যা কল্যাণের মধ্যে প্রবেশ করে। আর সবচেয়ে শ্রবণক্ষম কান হলো সেই কান যা সতর্কবার্তা শোনে এবং তা থেকে লাভবান হয়। আর নিখুঁততম অন্তÍর হলো সেই অন্তর যা দ্বিধা-সংশয় থেকে মুক্ত থাকে।

ইমাম হাসান (আ.)-কে পৌরুষ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলো। উত্তরে তিনি বলেন : পৌরুষ হলো দীনের বিষয়ে অকার্পণ্য, সম্পদের শুদ্ধি আর অধিকার রক্ষা।

ইমাম হোসাইন (আ.) বলেন : যে লোক আল্লাহ্্র অবাধ্যতার মাধ্যমে কারো নৈকট্য লাভ বা কিছু অর্জন করে সে যা আশা করে অতি দ্রুত তা হারায় আর যা কিছু থেকে সতর্ক হয়ে চলে অধিক দ্রুত তাতে আক্রান্তÍ হয়।

ইমাম হোসাইন (আ.) বলেন : স্বনামধন্য ও সর্বমান্য হওয়ার চিহ্নাবলির নির্দেশকসমূহের মধ্যে একটি হলো বুদ্ধিমানদের সাথে ওঠাবসা। আর মূর্খতার কারণসমূহের একটি চিহ্ন হলো মুসলমানদের সাথে বিবাদ করা। আর বিজ্ঞতার একটি চিহ্ন হলো নিজের বক্তব্যের পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করা এবং তত্ত্ববিদ্যাসমূহের (চিন্তার বিভিন্ন পদ্ধতির) সারসত্য জানা।

ইমাম আলী ইবনুল হোসাইন যায়নুল আবেদীন (আ.) বলেন : তিনটি জিনিস রয়েছে (যেগুলো) মুমিনদের নাজাত দেয় : মানুষের ওপর অপবাদ আরোপ, নিন্দা ও গীবত করা থেকে জিহ্বাকে বিরত রাখা, নিজেকে দুনিয়া ও আখেরাতে যা তার জন্য উপকারী সেকাজে প্রবৃত্ত করা আর তার গোনাহর জন্য অধিক ক্রন্দন করা।

ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) তদীয় পুত্র মুহাম্মাদ (আ.)-কে বলেন : যে কেউ তোমার কাছে ভালো কিছু চায় তার জন্য কাজ কর। যদি সে তার উপযুক্ত হয় তাহলে যথাযথ কাজ করলে, আর যদি সে তার উপযুক্ত না-ও হয় তাহলে তুমি নিজে তার উপযুক্ত। আর যদি কোনো লোক তোমার ডান পাশ থেকে তোমাকে গালমন্দ করে অতঃপর তোমার বাম পাশে এসে দাঁড়ায় এবং তোমার কাছে ক্ষমা চায় তাহলে তাকে ক্ষমা করবে।

ইমাম আলী ইবনে মূসা আর-রেযা বলেন : নীরবতা হলো প্রজ্ঞার দরজাসমূহের মধ্যে একটি দরজা। নিশ্চয় নীরবতা বন্ধুত্ব আনে এবং নিশ্চয় তা সকল কল্যাণের নির্দেশক।

ইমাম রেযা (আ.) বলেন : আল্লাহ্্্ বেশি কথা বলা, সম্পদ বিনষ্ট করা ও বেশি কামনা করাকে ঘৃণা করেন।

সংবাদ বিচিত্রা

শায়খুল আজহার : শিয়া ও সুন্নী ইসলামেরন দুটি ডানা : আল- আজহারের আলেমগণ ও শিয়া আলেমগণ পরস্পর সাক্ষাত করুন
ইসলামী জাহানে অনৈক্য সৃষ্টিকারী ফিতনা তীব্রতর হওয়া এবং তাকফিরী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর পক্ষ হতে নিরপরাধ মুসলমানদের হত্যাকান্ড ও ধ্বংসাত্মক নীতি অব্যাহত থাকার একই সময়ে শায়খুল আযহার গুরুত্ব আরোপ করেন এবং বলেন, শিয়া ও সুন্নী ইসলামের দুটি ডানা আর উভয়ের মধ্যে নৈকট্য গড়ে তোলা একান্ত জরুরী।
আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা তাসনীম আল আহাদ সংবাদ ইউনিটের বরাত দিয়ে জানায়। মিশরের আল আজহারের শায়খ আহমদ আত তাইয়েব বলেন, শিয়া ও সুন্নী ইসলামের দুটি ডানা আর এ কারণে উভয়ের মধ্যে পারস্পরিক নৈকট্য ও ঘনিষ্টতা গড়ে তোলা একান্ত জরুরী। তিনি শিয়া ও সুন্নীদেরকে পরস্পরের ভাই বলে সম্বোধন করেন।
তিনি শিয়া বা সুন্নী নির্বিশেষে যে কোন মুসলমানকে হত্যা করা হারাম এ কথার উপর পুনরায় গুরুত্ব আরোপ করেন এবং সবইকে ইসলামী ঐতিহ্যের প্রাণসত্তার দিকে ফিরে আসার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, পারস্পরিক দয়া, ভালোবাসা, উদারতা এবং যেকোন ধরনের বাড়াবাড়ি উগ্রপন্থা ও সাম্প্রদায়িকতা পরিহার করা একান্ত জরুরি।
ইন্দোনেশীয় মুসলিম পরিষদেও সদস্যদের সাথে সাক্ষাত শেষে আলাপকালে শায়খুল আজহার ইসলামী জাহানের আলেমদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টির ব্যাপারে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন, ইসলাম এমন এক ধর্ম যে ধর্মের মধ্যে সব মাযহাবকে পক্ষপাতিত্ব বা উগ্রপন্থা ব্যতিরেকে আত্মস্থ করা হয়েছে।
শায়খ আহমদ আত তৈয়ব অনুরূপভাবে মুসলমানদের কাফের ফতোয়া দেয়া হারাম ঘোষণা করে বলেন, কাফের আখ্যা দেয়া বড়ই বিপজ্জনক প্রবণতা। কারো অধিকার নাই যে, অন্যদেরকে কাফের আখ্যায়িত করবে। এ বিষয়টি একমাত্র উলুল আমর এর হাতেই ন্যস্ত।
তিনি ইসলামী ঐতিহ্যে প্রত্যাবর্তনের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে বলেন, এই ঐতিহ্য হচ্ছে পারস্পরিক দয়া, ভালোবসা, উদারতা এবং উগ্রপন্থা বর্জন করা। তিনি ইসলামী উম্মাহর আলেমদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতির আহ্বান জানিয়ে বলেন, ইসলাম হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা ও হিংসা বর্জিত একটি দ্বীন।
আল আজহারের শায়খ স্মরণ করিয়ে দেন যে, ঐক্য কোন চিন্তাগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক মত পার্থক্য কোন অস্বাভাবিক বিষয় নয়; বরং তা হতে পারে। কিন্তু তার অর্থ অনৈক্য ও মতভেদ সৃষ্টি করা নয়। কেননা মতপার্থক্যকে ইসলামও সমর্থন করে। তবে সর্বাবস্থায় আমাদেরকে মতবিরোধ পরিহার করে চলতে হবে।

‘আলীঅফ’ এর সাক্ষাতে ইসলামী বিপ্লবের নেতা রাহবার বলেন :
শিয়া মতাদর্র্শের প্রসার সমস্যাদির মোকাবিলায় আল্লাহর সাহায্য লাভের কারণ হবে
ইরানের ইসলামী বিপ্লবের নেতা আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট এর সাক্ষাতে বলেন, ইরান ও আজারবাইজানের মধ্যকার রাজনৈতিক সম্পর্ক ও দুই দেশের অভিন্ন সূত্রসমূহ প্রচুর বিশেষত উভয় দেশের ধর্মীয় অভিন্নতাসমূূহ খুবই চমৎকার। তিনি বলেন, ইসলামী আদর্শ ও শিক্ষাদীক্ষার বিস্তার এবং ইসলামী আদর্শেও সৌন্দর্য ও নিদর্শনগুলোর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হলে সাধারণ মানুষ তাকে স্বাগত জানাবে এবং বিভিন্ন হুমকির মোকাবিলায় জনগণের সাহায্য ও সমর্থন লাভ করা সহজতর হবে।
ইসলামী বিপ্লবের মহান নেতা রাহবার সৈয়দ আলী খামনেয়ী আজারবাইজানের প্রেসিডেন্টের সাক্ষাতে বলেন, আজারবাইজান ও ইরানের মধ্যে চমৎকার রাজতৈক সম্পর্ক বিদ্যমান এবং উভয় দেশের জনগণের মাঝে প্রচুর ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অভিন্ন সূত্র রয়েছে। রাহবার এ বিষয়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন যে, ধর্মীয় নিদর্শন ও ঐতিহ্যগুলোর প্রতি যদি সম্মান প্রদর্শন করা হয় তাহলে দেশের জনগণ তা স্বাগত জানাবে এবং বিভিন্ন হুমকির মোকাবিলায় জনগণের সাহায্য ও সমর্থন পাওয়া সহজতর হবে।
সংবাদ সংস্থা ‘ইন্তিখাব’ এর রিপোর্ট অনুযায়ী মহামান্য রাহবার সৈয়দ আলী খামনেয়ী সম্প্রতি আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলীবফকে দেয়া সাক্ষাতে বলেন, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান আজারবাইজানের জনগণের প্রতি বন্ধুত্ব ও প্রতিবেশিত্বেও চাইতেও ভ্রাতৃত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে তাকায়। রাহবার বলেন, আজারবাইজানের জনগণের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, শান্তি ও জনকল্যাণ আমাদের কাছে সবিশেষ গুরুত্ব রাখে। তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন যে, দুই দেশের মানুষের মাঝে আত্মিক সমঝোতা ও একাত্মতা থাকা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক লেনদেন ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধি পাওয়া জরুরী।
ইসলামী বিপ্লবের নেতা ইরান ও আজারবাইজানের জনগণের ধর্মীয় অভিন্নতার কথা উল্লেখ করে বলেন, আজারবাইজানের জনগণের ইসলামী ও শিয়া আকিদা বিশ্বাস মহামূল্যবান সম্পদ। আর সরকার জনসাধারণের এই ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি যত অধিক সম্মান ও আগ্রহ দেখাবে সে পরিমাণে সরকারের প্রতি জনগণের সমখর্থন ও কোন কোন বৃহৎশক্তির মোকাবিলায় তাদের প্রতিরোধ তত শক্তিশালী হবে।
ওাহবার বলেন, বিভিন্ন দেশ ও জাতির মাঝে তাকফিরী গোষ্ঠীসমূহ যে সব ফিতনা ছড়াচ্ছে তার মোকাবিলার একমাত্র পন্থা হচ্ছে, ইসলামী তৎপরতা বৃদ্ধি করা। রাহবার বলেন, আজারবাইজান এলাকা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অনেক ঐতিহ্যবাহী এবং বড় বড় আলেমের জন্মস্থান। আর সেখানকার জনগণও খুবই সজাগ ও সতর্ক জাতি। কাজেই তাদের ধর্মীয় কর্মকান্ডে সহযোগিতা করা হলে তাদেও আবেগ ও সংবেদনশীলতা আকৃষ্ট র্কও ক্ষে্েরত্র তা অত্যন্ত প্রভাবশালী হবে।
ওাহবার আজারবাইজানের প্রেসিডেন্টের এ বক্তব্যকে স্বগত জানান যে, উভয় দেশের বিরুদ্ধে যে সব হুমকি দেয়া হচ্ছে, তার অধিকাংশের উৎস অভিন্ন। তিনি বলেন যে, ইসলাম ও শিয়া মাযহাবের প্রসার ঘটানো হলে তা সমস্যা ও সংকট এবং হুমকিসমূহের মোকাবিলায় আল্লাহর রহমত ও পবিত ইমামগণের সুদৃষ্টি আকর্ষণের কারণ হবে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের মাননীয় প্রেসিডেন্ট ড. রূহানীও উপস্থিততে রাহবরের সাথে এই সাক্ষাতকালে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলীভফ বলেন, বাকু ও তেহরানের মধ্যকার সম্পর্ক অতিশয় ঘনিষ্ট। তিনি ইরানে তার আলোচনাসমূহ অত্যন্ত গঠনমূলক হয়েছে বলে উল্লেখ করে বলেন, অভিন্ন ধর্ম, ইতিহাস ও সংস্কৃতি ইরান ও আজারবাইজানের মধ্যে গভীর সম্পর্ক সৃষ্টি করেছে।
তিনি বাকু ও তেহরানের মধ্যে ১০টির অধিক সহযোগিতা সনদ স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা উল্লেখ করে তেহরান ও বাকুর সম্পর্ক ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দপূর্ণ এবং অত্যন্ত উচ্চ পর্যায়ের বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, ব্যবসা, পরিবহন, এনার্জি ও শিল্পক্ষেত্রে সহযোগিতার বড় বড় পদক্ষেপ গ্রহল করা হয়েছে। তিনি বলেন. আমরা অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে এই সহযোগিতা সম্প্রসারিত করার জন্য চেষ্টা অব্যাহত রাখব।
আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট বাকু ও তেহরানকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে একই চিন্তাধারার অনুসারী বলে উল্লেখ করে বলেন, ইরান বিশ্বে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বলবৎ করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আমরা ইরানের নিরাপত্তাকে আমাদের নিজেদের নিরাপত্তা হিসেবে মূল্যায়ণ করি।
ইলহাম আলীভফ আরো বলেন, উভয় দেশের বিরুদ্ধে যে হুমকি তা একই জায়গা থেকে উৎসারিত হয়। তিনি আরো বলেন যে, এ সফরে এ ব্যাপারে সমঝোতা হয়েছে যে, আমরা ইরানের সহায়তায় সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করব। যাতে এতদাঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বলবৎ হয়।
তিনি ইসলামী মূল্যবোধ সমূহের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আজারবাইজান সরকারের ধর্মীয় সেবামূলক পদক্ষেপসমূহের বর্ণনা দেন এবং বলেন, আজারবাইজানের স্বাধীনতার সময়কালে দুই হাজার মসজিদ নির্মিত হয়েছে। এর মধ্যে অর্ধেক নির্মিত হয়েছে আমি দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে।
আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইসলাম বিরুধী তৎপরতাসমূহের নিন্দা করে সে দেশের বিরুদ্ধে শত্রুতার কারণ জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাস বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, আজারবাইজানে ইসলাম ও শিয়া মজহাবকে জনগণ অত্যন্ত ভালোবাসে। আর এতদ এলাকায় আপনার মত বিরাট ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি আমাদেরকে বিরাট শক্তি ও মনোবল যোগায়।

পরমাণু আলোচনায় সফলতার স্বীকৃতি : পদক পেলেন ইরানী আলোচক দল
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাওয়াদ জারিফকে সম্মানসূচক পদকে ভূষিত করেছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি। ইরানর সঙ্গে ছয় জাতিগোষ্ঠীর ঐতিহাসিক পরমাণু সমঝোতায় ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ গত ৯ ফেব্রুয়ারী জারিফসহ পদস্থ কয়েকজন কর্মকর্তাকে সম্মানসূচক পদকে ভূষিত করা হয়।
ইরানের শহীদ পরমাণু বিজ্ঞানীদের পরিবারের সম্মানে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে জারিফকে ‘মেডেল অব মেরিট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট’ দেয়া হয়। পাশাপাশি ‘মেডাল অব কারেজ’ দেয়া হয় ইরানরর আণবিক শক্তি সংস্থার প্রধান আলী আকবর সালেহী এবং ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হোসেইন দেহকানকে।
এছাড়া, যৌথ সমল্বিত কর্মপরিকল্পনা বা জেসিপিওএ-র সঙ্গে জড়িত অন্যান্য কূটনীতিবিদ, কারিগরি এবং আইন সংক্রান্ত কর্মকর্তাকেও সম্মাননা দেন প্রেসিডেন্ট রুহানি।
অনুষ্ঠানে দেয়া ভাষণে রুহানি বলেন, ইরানের শান্তিপূর্ণ পরমাণু কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে চাপিয়ে দেয়া নিষেধাজ্ঞা পরমাণু আলোচক দলেল প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে উঠে গেছে। তিনিনি বলেন, সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উষমা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ীর দিকনির্দেশনা এবং জনগণের জাতীয় ঐক্য ছাড়া ইরানের পক্ষে বিজয়ী হওয়া সম্ভব ছিল না।

ইরানে ৩৭তম বিপ্লব বার্ষিকী উদ্যাপন
গত ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ৩৭তম বিপ্লব বার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে ইরানের কোটি কোটি মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। রাজধানী তেহরানের আজাদি স্কয়ারে বিপ্লব বার্ষিকীর মূল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ইরানের ইসলামী বিপ্লব চূড়ান্তভাবে বিজয়ী হয়। সে দিনের স্মরণে ইরানের সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় নেমে বিজয় উদ্যাপন করেন। ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে রাজতান্ত্রিক পাহলভি সরকারের পতন হয়।
রাজধানী তেহরানে বিজয় বার্ষিকীর শোভাযাত্রায় প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি, সংসদ ¯িপকার ড. আলী লারিজানি ও বিচার বিভাগের প্রধান আয়াতুল্লাহ অমুলি লারিজানিসহ দেশের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা অংশ নেন। সেখানে ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর কুদ্স ইউনিটের কমান্ডার মেজর জেনারেল কাসেম সুলাইমানিও ছিলেন।
বিজয় শোভাযাত্রা চলাকালে প্রেসিডেন্ট রুহানি সাংবাদিকদের বলেন, নিরাপত্তার দিক থেকে ইসলামী ইরান এখন গোটা মধ্যপ্রাচ্যে আদর্শ স্থাপন করেছে। ইরানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পাঁচ হাজার ২০০ সাংবাদিক দেশব্যাপী বিজয় বার্ষিকীর নানা আয়োজনের খবর সংগ্রহ ও সরবরাহ করেন।
প্রেসিডেন্ট রুহানির ইতালি সফর
ইরানের সঙ্গে ছয় জাতিগোষ্ঠীর পরমাণু সমঝোতা বাস্তবায়নের পর তিন ইউরোপীয় দেশ সফরের প্রথম পর্যায়ে ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি গত ২৫ জানুয়ারি ২০১৬ ইতালির রাজধানী রোমে পৌঁছেন। এ সফরে যান প্রেসিডেন্ট রুহানি। রোমের সিয়ামপিনো এয়ারপোর্টে ড. রুহানিকে স্বাগত জানান ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাওলো গেনটিলোনি।
এ সফরে একটি উচ্চ ক্ষমতাস¤পন্ন প্রতিনিধি দল প্রেসিডেন্ট রুহানির সঙ্গী ছিলেন। প্রতিনিধি দলটিতে সরকারি কর্মকর্তা, ইরানী পুঁজি বিনিয়োগকারী এবং ব্যবসায়ীরা ছিলেন।
রোম সফরকালে ইতালির প্রেসিডেন্ট সের্গেই মাত্তারেলা এবং প্রধানমন্ত্রী মাত্তিও রেনজির সঙ্গে রুহানি সাক্ষাৎ করেন। এ ছাড়া, তিনি ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের পবিত্র নগরী ভ্যাটিকান সফর করেন এবং পোপ ফ্রান্সিস এর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন।
রোম সফর শেষে ড. রুহানি গত ২৭ জানুয়ারি ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের উদ্দেশে রওয়ানা হন এবং সেখানে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
ইউরোপের উদ্দেশে তেহরান ত্যাগ করার আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ করার সময় রুহানি বলেন, ইরানের সঙ্গে ছয় জাতিগোষ্ঠীর পরমাণু সমঝোতার পর একটি ঐতিহাসিক যুগ সন্ধিক্ষণে এ সফর অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

ইরান-ইতালি বিশাল অর্থের বাণিজ্য চুক্তি সই
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানির ইতালি সফরের সময় দু’দেশের মধ্যে সাড়ে ১৮শ’ কোটি ডলারের চুক্তি সাক্ষর হয়েছে। রাজধানী রোমে গত ২৫ জানুয়ারি ২০১৬ চুক্তি সই অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট রুহানি ও ইতালির প্রেসিডেন্ট সের্গিও মাত্তারেলা উপস্থিত ছিলেন।
বিশাল এ অর্থের চুক্তির আওতায় স্বাস্থ্য, পরিবহন, কৃষি ও জ্বালানি খাত রয়েছে। এর মধ্যে তেল খাতে প্রায় ৫০০ কোটি ডলারের একটি চুক্তি রয়েছে। এছাড়া চুক্তির আগে ইতালির ই¯পাত কো¤পানি ড্যানিয়েলি জানিয়েছে, তারা ইরানের সঙ্গে ৬১০ কোটি ডলার মূল্যের চুক্তি করবে। অবকাঠামো নির্মাণবিষয়ক কো¤পানি কনদোত্তে ডি’আকুয়া বলেছে, তারা ৪৩০ কোটি ডলারের চুক্তি করবে।
ইউরোপের তিনটি দেশ সফরের অংশ হিসেবে ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি গত ২৫ জানুয়ারি ইতালি যান। ইতালি থেকে তাঁর ফ্রান্সে যান। ইরান ও ছয় জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে পরমাণু ইস্যুতে সমঝোতা হওয়ার পর তিনি ইউরোপ সফর গেলেন।

রুহানির সঙ্গে বৈঠক উপলক্ষে রোম জাদুঘরের নগ্ন মূর্তিগুলো ঢেকে দেয়া হলো

গত ২৬ জানুয়ারি ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সঙ্গে ইতালির প্রধানমন্ত্রী মাত্তিও রেনজির বৈঠক উপলক্ষে রোমের ক্যাপিটোলাইন জাদুঘরের নগ্ন মূর্তিগুলো সাদা কাঠের বাক্স দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়।
রোমের এক মুখপাত্র বলেন, এ বৈঠককে কেন্দ্র করে সব সিদ্ধান্ত রেনজির দফতর থেকে নেয়া হয়েছে। প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, রোমক সম্রাট মার্কাস অরেলিয়াসের অশ্বারোহী মূর্তির পাশে কথা বলছেন রুহানি-রেনজি।
ইতালির সংবাদ সংস্থা এনএনএসএ’র খবরে বলা হয়, সফররত ইরানী প্রেসিডেন্টের প্রতি সম্মান জানিয়ে নগ্ন মূর্তিগুলো ঢেকে দেয়া হয়। এ ছাড়া, রুহানির সম্মানে দেয়া ইতালির রাষ্ট্রীয় ভোজসভায় মদও পরিবেশন করা হয় নি। সফররত মুসলিম ব্যক্তিত্বদের প্রতি সম্মান জানানোর কূটনৈতিক শিষ্টাচার হিসেবে এ পদক্ষেপ নেয়া হয়।

মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতায় ইরান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে : ইতালি
ইতালির প্রধানমন্ত্রী মাত্তো রেনজি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা রক্ষায় ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তিনি আরো বলেন, ইরান বহু বছর ধরে চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে।
ইতালির রাজধানী রোমে সফররত ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানির সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে গত ২৬ জানুয়ারি এসব কথা বলেন তিনি।
ইতালির প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, সন্ত্রাসবাদ, বর্বরতা ও দুষ্টুচক্রের নানা তৎপরতা যৌথভাবে মোকাবেলায় ইরানের প্রেসিডেন্টের এ সফর বিশেষভাবে কার্যকরী হবে।
সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট রুহানি বলেন, ইরান সবসময় সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াইয়ের অগ্রভাগে ছিল। তবে সামরিক উপায়ে এ সমস্যার সমাধান হবে না; বরং রাজনৈতিক উপায়ে সমাধান খোঁজা দরকার।
পরমাণু সমঝোতা মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় রোল মডেল হিসেবে কাজ করতে পারে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

পরমাণু বাজারে শক্তিশালী প্রতিযোগিতা করার পরিকল্পনা করেছে ইরান : সালেহি

ইরান বলেছে, ভারি পানিসহ পরমাণু জ্বালানি সংক্রান্ত পণ্য বিপণন করতে শুরু করেছে তেহরান। পরমাণু পণ্য নিয়ে বাজারে আন্তর্জাতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে শক্তিশালী প্রতিযোগিতা করার পরিকল্পনা করেছে বলেও জানিয়েছে ইরান।
ইরানের আণবিক শক্তিসংস্থা বা এইওআই’এর প্রধান আলী আকবর সালেহি ১৫ ফেব্রুয়ারি এ কথা বলেন। তিনি আরো বলেন, ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ায় আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে এইওআই’এর সহযোগিতার পথ তৈরি হয়েছে। বিশ্ব বাজারের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সক্ষমতা অর্জনের জন্য এরই মধ্যে এইওআইভুক্ত সংস্থাগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি। এ ছাড়া, এ সব সংস্থাকে এইওআই থেকে স্বতন্ত্র করে দেয়ার পদক্ষেপ নেয়া হবে এবং তারা স্বাধীন সংস্থা হিসেবে বিদেশের সঙ্গে ব্যবসাও করতে পারবে বলে জানান সালেহি।

চীনা প্রেসিডেন্টের ইরান সফরÑ ইরানের সঙ্গে স¤পর্কে ‘নতুন অধ্যায়’ চান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং
ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানির আমন্ত্রণে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং দুই দিনের সরকারি সফরে গত ২২ জানুয়ারি ২০১৬ ইরানে পৌঁছেন। ১৪ বছর পর চীনের কোনো প্রেসিডেন্ট এই প্রথম ইরান সফর। ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর তেহরান সফরে আসা প্রথম রাষ্ট্রপ্রধানও তিনি। মেহরাবাদ বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানান ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মাদ জাওয়াদ জারিফ। সফরকালে জিনপিং ইরানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করেন।
২৩ জানুয়ারি তেহরানের সা’দাবাদ প্রাসাদে ড. রুহানির সাথে সাক্ষাৎ করেন জিনপিং। সাক্ষাতে তিনি ইরানের সঙ্গে চীনের ঐতিহ্যবাহী বন্ধুত্ব ও অর্থনৈতিক স¤পর্ক শক্তিশালী করার আশা প্রকাশ করেন। কৌশলগত অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে ইরানের সঙ্গে স¤পর্কে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করার আগ্রহও প্রকাশ করেন তিনি।
সাক্ষাৎ শেষে অর্থনীতি, শিল্প, সংস্কৃতি ও বিচার বিভাগীয় খাতে দু’দেশের মধ্যে ১৭টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।
উল্লেখ্য, বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল আমদানিকারক দেশ চীন ইরান থেকে বিপুল পরিমাণ তেল আমদানি করে। এমনকি পরমাণু কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ইরানের ওপর পাশ্চাত্যের কঠোর নিষেধাজ্ঞার সময়ও তেল আমদানি বন্ধ করেনি চীন।
২০১৪ সালে তেহরান ও বেইজিং-এর মধ্যে বাণিজ্য বিনিময়ের পরিমাণ ছিল ৫,২০০ কোটি ডলার। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমে যাওয়ায় ২০১৫ সালে ওই পরিমাণ কমে গিয়েছিল। ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় চলতি বছর ইরান ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য বিনিময়ের পরিমাণ আবার বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।

দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উভয় দেশ ও বিশ্বকে লাভবান করবে : হলান্দে
তেহরান-প্যারিস অর্থনৈতিক সহযোগিতা ব্যাপকতর হবে : ড. রুহানি
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানী আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, তাঁর প্যারিস সফরের ফলে দু’দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ব্যাপকতর হবে। অন্যদিকে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া হলান্দে অভিমত ব্যক্ত করেন যে, ইরান ও ফ্রান্সের মধ্যকার সম্পর্ক উভয় জাতি, মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চল ও বিশ্বকে লাভবান করবে। প্রেসিডেন্ট রুহানির সাম্প্রতিক প্যারিস সফরের সমাপ্তিতে গত ২৮ জানুয়ারি (২০১৬) দুই দেশের প্রেসিডেন্টের যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তাঁরা এ অভিমত ব্যক্ত করেন।
প্রেসিডেন্ট রুহানির এ সফরকালে দুই দেশের মধ্যে যে ২০টি সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ উদ্যোগ এ আভাসই দেয় যে, তেহরান ও প্যারিস পারস্পরিক সহযোগিতার ব্যাপারে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
প্রেসিডেন্ট রুহানি বলেন যে, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া হলান্দের সাথে ও শীর্ষস্থানীয় ফরাসি কোম্পানিগুলোর সাথে তাঁর যে আলোচনা হয়েছে তা ফলপ্রসূ ও লাভজনক হয়েছে। তিনি বলেন, ইরান ও ফ্রান্সের মধ্যকার সহযোগিতা কেবল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির অঙ্গনে উভয় দেশের মধ্যে একশ’ বছরেরও বেশিকাল যাবত যে পারস্পরিক সহযোগিতা রয়েছে সে সহযোগিতাকেও গভীরতর করা হবে।
ফ্রান্সে অনুষ্ঠেয় পরিবেশ বিষয়ক বৈশ্বিক শীর্ষ সম্মেলন প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট রুহানি বলেন, ইরান এ শীর্ষ সম্মেলনে ফ্রান্স ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে থাকবে। তিনি বলেন, আমরা এ ক্ষেত্রে সহযোগিতার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছি।
প্রেসিডেন্ট রুহানি বলেন, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পর্কে স্বাক্ষরিত যৌথ সমন্বিত কর্ম পরিকল্পনা (ঔঈচঙঅ) ও এর সংযোজনীসমূহে প্রদত্ত স্বীয় অঙ্গীকারসমূহ অপর পক্ষ যতদিন পালন করে চলবে ততদিন ইরান সরকারও এতে প্রদত্ত স্বীয় সমস্ত অঙ্গীকার আন্তরিকতার সাথে পালন করে যাবে।
প্রেসিডেন্ট রুহানি বলেন, মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং আমরা এ অঞ্চলের উত্তেজনা নিরসনের জন্য কূটনীতিকে অগ্রাধিকার প্রদান করি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সিরীয় জনগণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিতে পারে না।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট বলেন, ইরানের জন্য মানবাধিকার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং আমরা সকলের জন্য সমান অধিকার সমর্থন করি, তা তারা শরণার্থীই হোক বা নাগরিকই হোক। তিনি বলেন, সিরিয়ার মূল সমস্যা হচ্ছে সন্ত্রাসবাদ এবং তারা যারা আইএ্সআইএস-এর কাছ থেকে তেল ক্রয় করে, তাদেরকে অস্ত্র সরবরাহ করে ও রাজনৈতিকভাবে তাদেরকে সমর্থন দেয়।
প্রেসডেন্ট রুহানি বলেন, বিশ্বের সকল দেশেরই মানবাধিকার সমস্যার প্রতি দৃষ্টি দেয়া উচিত, কিন্তু এ ব্যাপারে পশ্চিমা দেশ সমূহ যে নিজেদেরকে ত্রুটিহীন মনে করে এটা ভুল।
এ যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া হলান্দে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির প্যারিস সফরে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, তেহরান ও প্যারিসের মধ্যকার সম্পর্ককে সুদৃঢ় করা হরে এবং তা উভয় জাতিকে, মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলকে ও বিশ্বেকে লাভবান করতে সক্ষম।
প্রেসিডেন্ট হলান্দে জোর দিয়ে বলেন যে, প্যারিস তেহরানের সাথে স্বীয় সম্পর্ককে পুনরায় সৃদৃঢ় করতে বদ্ধপরিকর। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট রুহানির প্যারিস সফরকালে দুই সরকারের মধ্যে ও দুই দেশের বেসরকারি খাতের মধ্যে কতগুলো ভালো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। তিনি বলেন, ফ্রান্স এসব চুক্তির সবগুলোই কার্যকরকরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
সন্ত্রাসবাদকে একটি সর্বাত্মক হুমকি হিসেবে অভিহিত করে প্রেসিডেন্ট হলান্দে বলেন, সন্ত্রাসবাদ কেবল আমাদের শত্রুই নয়, বরং সন্ত্রাসবাদ কোনোরূপ ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে বিশ্বের অন্য সকল জাতির বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালায়। তিনি বলেন, ইরান ও ফ্রান্সের মধ্যে সহযোগিতা বিশ্বশান্তি ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য লাভজনক হতে পারে।
প্রেসিডেন্ট হলান্দে আরো বলেন, গোটা মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে যে সঙ্কট চলছে তা নিরসনে ইরান ও ফ্রান্স সিদ্ধান্তকর ভূমিকা পালনে সক্ষম এবং মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় দুই দেশ পরস্পরের পাশে দাঁড়াতে পারে।
ইরান ও ফ্রান্সকে দু’টি মহান দেশ হিসেবে উল্লেখ করে প্রেসিডেন্ট হলান্দে বলেন, ইরান ও ফ্রান্সের মধ্যে বহু ক্ষেত্রে গভীরভাবে অভিন্নতা রয়েছে, আর এ কারণে দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ ও ব্যাপক পারস্পরিক সহযোগিতা রয়েছে।
দুই দেশের মধ্যে ২০টি সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির প্যারিস সফরকালে দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ২০টি সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পর্কে স্বাক্ষরিত যৌথ সমন্বিত কর্ম পরিকল্পনা স্বাক্ষর পরবর্তী নতুন পরিস্থিতিতে তেহরান ও প্যারিসের মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার পথ উন্মুক্ত করণের লক্ষ্যে এ সব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
প্যারিসে ফরাসি প্রেসিডেন্টের সরকারি ভবন এলিসি প্যালেসে প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি ও প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া হলান্দের উপস্থিতিতে এ চুক্তিগুলো স্বাক্ষরিত হয়। ‘ইরান ও ফ্রান্স পারস্পরিক সহযোগিতা উন্নয়ন বিষয়ক পথ পরিকল্পনা’ বিষয়ক প্রথম দলিলটি দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কর্তৃক স্বাক্ষরিত হয়। আরেকটি দলিলে স্বাক্ষর করেন দুই দেশের অর্থমন্ত্রীদ্বয়।
দুই দেশের মধ্যে শিল্প ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইরান ও ফ্রান্সের শিল্পমন্ত্রীদ্বয় একটি সমঝোতা স্মারকে (গঙট) স্বাক্ষর করেন। এছাড়া দুই দেশের যোগাযোগ মন্ত্রী একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। আরেকটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেন ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পরিবেশ সংস্থার প্রধান এবং ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
এছাড়া ইরানের পর্যটন সংস্থার প্রধান ও ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যটন সম্পর্কিত একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন এবং দুই দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রীদ্বয় স্বাস্থ্য বিষয়ক একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
প্রেসিডেন্ট রুহানির প্যারিস সফরকালে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত অন্যান্য চুক্তির মধ্যে রয়েছে কৃষি গবেষণা, উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণা, পরিবহন, সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার, বিমান পরিবহন, আইকেআইএ বিমান বন্দর উন্নয়ন, মাশহাদ ও ইস্ফাহান বিমান বন্দরের জন্য নতুন টার্মিনাল নির্মাণ, জাহায টার্মিনাল, তেল, তেহরানের পানি এবং গ্রীনহাউজ শাকসব্জি উৎপাদন বিষয়ক চুক্তি।

গ্রিক প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সিস সিপ্রাসের ইরান সফর

গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সিস সিপ্রাস সরকারি সফরে গত ৭ ফেব্রুয়ারি ইরান সফর করেন। শক্তিশালী একটি রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন সিপ্রাস। প্রতিনিধিদলে ছিলেন গ্রিসের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোস কোটাজিয়াস, পরিবেশ ও জ্বালানিমন্ত্রী পানাগিওটিস স্কাউরলেটিস, অর্থ, উন্নয়ন এবং পর্যটনমন্ত্রী জর্জিয়াস স্টাথাকিস এবং উপ পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রিস মারডাসসহ ৫০ সদস্য। এ দলে গ্রিসের শিল্পপতি এবং ব্যবসায়ীরাও ছিলেন।
তেহরানে অবস্থানকালে দ্বিপাক্ষিক স¤পর্কোন্নয়ন এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে ইরানের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন তিনি। তাঁর এ সফরকালে ইরান ও গ্রিস বাণিজ্য, অর্থ, পর্যটন, সংস্কৃতি, গৃহায়ন, সড়ক নির্মাণ, কৃষি এবং ওষুধ শিল্পখাতে চুক্তি সই করে।

ইরানের বাণিজ্য প্রতিনিধিদলের ঢাকা সফর
ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)-এর আমন্ত্রণে সম্প্রতি ইরানের ১৫ সদস্যের একটি বাণিজ্য প্রতিনিধিদল ঢাকা সফর করেন। ইরানের ট্রেড প্রমোশন সংস্থার ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং দেশটির বাণিজ্যবিষয়ক মন্ত্রীর উপদেষ্টা মোহাম্মদ রেযা মওদুদির নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলটি পাঁচ দিনের সফরে গত ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পৌঁছেন। ঢাকা অবস্থানকালে ইরানের বাণিজ্য প্রতিনিধিদলের সাথে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী ও শিল্প উদ্যোক্তা এবং এফবিসিসিআই ও ঢাকা চেম্বারের সদস্যরা মতবিনিময় করেন। এছাড়া ইরানী প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী, বিনিয়োগ বোর্ড এবং রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো’র শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাৎ ও দ্বিপাক্ষিক স¤পর্ক জোরদারের বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র সদস্যদের সাথে এক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে ইরানের প্রতিনিধিদলের সদস্যরা সিমেন্ট, ক্লিংকার, রেলপথ যোগাযোগ, পলিমার, পেট্রোকেমিক্যাল, প্লাস্টিক শিল্প, এলপিজি, এলএনজিসহ প্রভৃতি খাতে যৌথ উদ্যোগে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও ইরানের বাজারে কৃষিজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য এবং তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্যের প্রবেশাধিকারের বিষয়ে সহযোগিতা প্রদানের আহ্বান জানানো হয়।
বৈঠকে ইরানের রাষ্ট্রদূত ড. আব্বাস ভায়েজী দেহনাভী ও দেশটির ট্রেড প্রমোশন সংস্থার ভাইস প্রেসিডেন্ট রেযা মওদুদিও উপস্থিত ছিলেন। ইরানের রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশের সাথে দীর্ঘ মেয়াদে বাণিজ্য স¤পর্ক গড়ে তুলতে চায় ইরান। এখানে সিলিন্ডার তৈরির কারখানা স্থাপন করে গ্যাস সরবরাহের সম্ভাবনাকেও ইরান কাজে লাগাতে চায়। বাংলাদেশের জ্বালানি ও খনিজস¤পদ মন্ত্রীর আসন্ন ইরান সফরের সময় এসব নিয়ে আলোচনা হবে। এছাড়া বাংলাদেশ থেকে মানস¤পন্ন ওষুধ আমদানি করতে তাঁর দেশ আগ্রহী বলে তিনি জানান।
এদিকে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, ইরানের দেওয়া প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ইরান থেকে শিগগিরই তরল পেট্রলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) আমদানি করবে বাংলাদেশ। সচিবালয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে সফররত ইরানের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বাণিজ্যমন্ত্রী এ সিদ্ধান্তের কথা জানান।
এসময় ইরানী প্রতিনিধিদলের প্রধান মোহাম্মদ রেযা মওদুদি বলেন, ১২ বছর ধরে আমাদের ওপর অন্যায়ভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। এখন ইরানের ওপর থেকে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা উঠে গেছে। এতে প্রমাণিত হয়েছে যে, মিথ্যা অপবাদ ছিল আমাদের বিরুদ্ধে। এখন সারা বিশ্বে ইরানকে নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। বিশ্বের ব্যবসায়ী মহল ইরান সফর করছেন। এখন তাঁরা ইরানের সঙ্গে বাণিজ্য সম্প্রসারণে উদ্যোগ নিচ্ছেন। বাংলাদেশ ইরানের সঙ্গে আরও বড় পরিসরে ব্যবসায় যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

পাকিস্তানের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে ইরান ও সৌদি
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ বলেছেন, ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যকার চলমান টানাপড়েন নিরসনে ইসলামাবাদের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে তেহরান এবং রিয়াদ। তাঁর এ উদ্যোগ সফল হবে বলে তিনি আশা করেছেন।
নওয়াজ শরীফ বলেন, ‘উত্তেজনা কমাতে দু’দেশের নেতারাই পাকিস্তানের উদ্যোগের প্রতি সমর্থন দিয়েছেন। আমি তাদের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছি এবং তাতে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত।’
ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি, প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসহাক জাহাঙ্গিরি ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী হোসেইন দেহকানের সঙ্গে তেহরানে বৈঠকের পর সফরসঙ্গী সাংবাদিকদের গত ২০ জানুয়ারি তিনি এসব কথা বলেন। নওয়াজ শরীফ জানান, পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে ইরান ও পাকিস্তান গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যক্তিকে বিষয়টি নিয়ে তৎপরতা চালানোর দায়িত্ব দেবেন। তাঁরা পূর্ণ সময় এ বিষয়ে কাজ করবেন। এ ইস্যুতে সৌদি আরবকে একজন ব্যক্তির নাম দেয়ার জন্য তিনি অনুরোধ করবেন বলেও জানান পাক প্রধানমন্ত্রী।
এ সফরে পাক সেনাপ্রধান জেনারেল রাহিল শরীফ আলাদাভাবে ইরানের জাতীয় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা পরিষদের সচিব আলী শামখানি ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী হোসেইন দেহকানের সাথে বৈঠক করেন।

হাঙ্গেরিকে পারমাণবিক সহায়তা দেবে ইরান
হাঙ্গেরিকে ২৫ মেগাওয়াট শক্তিস¤পন্ন পারমাণবিক রিঅ্যাক্টর স্থাপনে প্রকল্প সহায়তা দেবে ইরান। পরবর্তীকালে এ রিঅ্যাক্টরের শক্তি ১শ’ মেগাওয়াটে উন্নীত করা হবে। ইরানের ভাইস প্রেসিডেন্ট আলী আকবর সালেহি বলেন, শুধু হাঙ্গেরি নয়, এশিয়া ও আফ্রিকার অন্যান্য দেশকেও এধরনের পারমাণবিক সহায়তা দেবে তাঁর দেশ।
হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ইরানের ভাইস প্রেসিডেন্ট আরো বলেন, এধরনের ছোট আকৃতির পারমাণবিক চুল্লি অপেক্ষাকৃত কম খরচে স্থাপন করা যায় এবং তা বিদ্যুৎ তৈরিসহ শান্তিপূর্ণ কাজে ব্যবহার করা সম্ভব। এধরনের চুল্লিতে কম ভারী পানি প্রয়োজন হয়। যা এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশ ব্যবহার করতে পারে।
আলী আকবর সালেহী বলেন, হাঙ্গেরির সঙ্গে ইরানের সহযোগিতায় এধরনের ছোট আকৃতির পারমাণবিক চুল্লি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা গেলে অন্যান্য দেশেও একই ধরনের সহায়তা দেবে ইরান। তবে এজন্য বেশ কয়েক বছর কঠিন পরিশ্রম করতে হবে। সালেহী ইরানের পারমাণবিক সংস্থারও পরিচালক। তিনি হাঙ্গেরি ছাড়াও আগ্রহী বিভিন্ন দেশকে ছোট আকারের পারমাণবিক চুল্লি প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থ ছাড়াও কারগরি সহায়তা দেবার আশ্বাস দেন।
বৈঠকের পর হাঙ্গেরির পররাষ্ট্রমন্ত্রী পিটার সিজার্তো বলেন, ইরানের কাছ থেকে তাঁর দেশ পারমাণবিক ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ নেবে। এছাড়া ইরানের জ্বালানি খাতেও হাঙ্গেরি বেশ আগ্রহী বলে জানান পিটার।
হাঙ্গেরিতে বর্তমানে ১১শ’ ইরানী ছাত্রছাত্রী লেখাপড়া করছে এবং এ সুযোগ আরো বৃদ্ধি করা হবে বলে জানান পিটার সিজার্তো।

বিমান পরিবহনের আঞ্চলিক কেন্দ্র হতে পারে ইরান
গত ২৬ জানুয়ারি আমেরিকার হেইকো অ্যারো¯েপস পার্টস গ্রুপের ভাইস প্রেসিডেন্ট জিম ও সুলিভ্যান বলেছেন, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান আঞ্চলিক বিমান পরিবহনের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করতে সক্ষম। বিশাল এলাকার কেন্দ্রস্থলে ইরানের অবস্থান হওয়ায় তেহরানের হাতে এ সুযোগ রয়েছে।
রাজধানী তেহরানে ‘সিএপিএ ইরান অ্যাভিয়েশন সামিট-২০১৬’র অবকাশে তিনি এ কথা বলেন।
২৪ ও ২৫ জানুয়ারি তেহরানে এ সম্মেলনে অনুষ্ঠিত হয়। সিএপিএ হচ্ছে বিশ্বব্যাপী বিমান সেবার ক্ষেত্রে একটি সংস্থা যা স্বতন্ত্র বিমান মার্কেটে বুদ্ধি-পরামর্শ, বিশ্লেষণ ও তথ্য সরবরাহ করে থাকে।
আমেরিকার ওই ব্যবসায়িক কর্মকর্তা বলেন, ইরানের বিমান পরিবহন ক্ষমতা অক্ষত রয়েছে এবং বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে তারা একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনা তৈরি করতে সক্ষম। তিনি বলেন, বিদেশি কো¤পানির আগমন ইরানের বাজারে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করবে। ইরানের বাজারে সবার জন্য সুযোগ রয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
জিম ও সুলিভ্যান বলেন, তাঁর কো¤পানি ইরানের বাজারে বিনিয়োগের বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখছে।
তেহরানে অনুষ্ঠিত সিএপিএ সম্মেলনে বিশ্বের ৩৫টি দেশের ৮৫টি বিমান প্রস্তুতকারক কো¤পানির ১৬০ জন প্রতিনিধি অংশ নেন। সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে ইরানের সড়ক ও পরিবহন মন্ত্রী আব্বাস আখুন্দি বলেন, ইহুদিবাদী ইসরাইল ছাড়া বিশ্বের সব দেশের বিমান কো¤পানির কাছ থেকে তেহরান সহযোগিতা নিতে প্রস্তুত রয়েছে।
ইরানের সঙ্গে বাণিজ্য শুরু করল মিশর
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সঙ্গে বাণিজ্য শুরু করেছে মিশর। ইরানের মেহের নিউজের বরাত দিয়ে প্রেস টিভি জানায়, গত কয়েক বছরের মধ্যে ২৫ জানুয়ারি ২০১৬ প্রথবারের মতো পেট্রোকেমিক্যাল পণ্য নিয়ে ইরানের একটি কার্গো জাহাজ মিশরের উদ্দেশে রওয়ানা দেয়।
বর্তমানে দু’দেশের মধ্যে কোনো কূটনৈতিক স¤পর্ক নেই। এর পাশাপাশি ২০১২ সালে ইরানের ওপর মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হওয়ার পর ইরান ও মিশরের মধ্যে যোগাযোগের সর্বশেষ মাধ্যমটিও বন্ধ হয়ে যায়। তবে গত কয়েক মাস ধরে দু’দেশের কর্মকর্তারাই আশা করছিলেন, তেহরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে আবার বাণিজ্য স¤পর্ক প্রতিষ্ঠা হবে। এর পাশাপাশি কূটনৈতিক স¤পর্কও প্রতিষ্ঠা হবে বলে আশা করেন তাঁরা।
ইরানের জাতীয় তেল কো¤পানির মহা ব্যবস্থাপক রোকনুদ্দিন জাভাদি জানান, মিশরের কাছে তেল ও তেলজাত পণ্য রপ্তানি করতে তেহরানের জন্য কোনো সীমাবদ্ধতা নেই; বরং তারা যখনই সরকারিভাবে কোনো অনুরোধ করবে তখন তা বিবেচনা করে দেখবে ইরান।

ইরান প্রতিদিনই নিজ প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়াবেÑ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হোসেইন সালামি
ইরান প্রতিদিনই নিজ প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়াবে এবং ক্ষেপণাস্ত্রের উন্নয়ন ঘটানো অব্যাহত রাখবে। ইরানের ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি’র সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হোসেইন সালামি গত ২৪ জানুয়ারি এ ঘোষণা দেন। তিনি আরো বলেন, ইরানের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য যে কোনো আগ্রাসনের দাঁতভাঙ্গা জবাব দেয়া হবে।
ইরানী টেলিভিশনে প্রচারিত সরাসরি সাক্ষাৎকারে এ ঘোষণা দেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হোসেইন সালামি। তিনি বলেন, ইরানের সশস্ত্র বাহিনী দেশের ভৌগোলিক অখ-তা এবং জাতীয় স্বার্থ বজায় রাখতে দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
পানিসীমায় অনুপ্রবেশের দায়ে ১০ মার্কিন মেরিন সেনাকে ইরান সম্প্রতি আটক করেছিল। এ ঘটনা তুলে ধরে জেনারেল সালামি বলেন, এর মধ্য দিয়ে ইরানী নৌবাহিনীর শক্তির প্রমাণ দেয়া হয়েছে। এ ঘটনাকে গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে ইরানের পরিষ্কার বিজয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।
পারস্য উপসাগরীয় এলাকার ঘটনাবলির ওপর ১০ মেরিন সেনা আটকের বিষয়টি সিদ্ধান্তমূলক প্রভাব ফেলেছে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, এতে বিদেশি সেনারা নতুন এক বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে পেরেছে। এ ছাড়া, এটি গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ এবং ভৌগোলিক অখ-তা রক্ষায় ইরানের শক্তিমত্তা স¤পর্কে বিদেশিদের মূল্যায়নেরও পরিবর্তন ঘটিয়েছে বলে জানান তিনি।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হোসেইন সালামি আরো ঘোষণা করেন, জাতীয় সার্বভৌমত্ব এবং ভৌগোলিক অখ-তা রক্ষায় প্রচলিত অস্ত্রের উন্নয়ন করার অধিকার ইরানের রয়েছে।

বিদেশি কো¤পানির কাছে এলএনজি শেয়ার বিক্রি করা হবে না : ইরান
বিদেশি কো¤পানিগুলোর কাছে ইরানের এলএনজি প্রকল্পের শেয়ার বিক্রির পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে যে খবর বের হয়েছে তা নাকচ করে দিয়েছে তেহরান। ইরানের ন্যাশনাল গ্যাস কো¤পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলীরেযা কামেলি গত ২০ জানুয়ারি তেহরানে এক সাক্ষাৎকারে একথা জানান।
এর আগে একই কো¤পানির অন্য এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে কতিপয় বার্তা সংস্থা জানিয়েছিল, এই কো¤পানির এলএনজি প্রকল্পের অন্তত ২০% শেয়ার বিদেশি কো¤পানিগুলোর কাছে বিক্রি করা হবে।
আলীরেযা কামেলি এ স¤পর্কে বার্তা সংস্থা মেহেরকে জানান, বিদেশি বিনিয়োগকারী ও তেল কো¤পানিগুলোর কাছে এলএনজি উৎপাদন প্রকল্পের শেয়ার বিক্রির কোনো পরিকল্পনা ইরানের জাতীয় গ্যাস কো¤পানির নেই।
ইরানের প্রাকৃতিক গ্যাসের তিনটি প্রকল্পের একটি হচ্ছে এলএনজি। হল্যান্ডের শেল এবং ফ্রান্সের টোটাল কো¤পানির সহযোগিতায় এই প্রকল্পের উৎপাদন শুরু করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে তেহরান। শেয়ার বিক্রির পরিবর্তে এসব কো¤পানির কারিগর সহযোগিতা নেবে ইরান।
২০১২ সালে ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পর পার্স এলএনজি ও পার্সিয়ান এলএনজি প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এ স¤পর্কে কামেলি বলেন, এখন পুঁজি বিনিয়োগ করার পর এসব প্রকল্পের কাজ শেষ হতে যাচ্ছে।
বিশ্বের বৃহত্তম প্রাকৃতিক গ্যাসের অধিকারী দেশ ইরানের ভূগর্ভে রয়েছে ৩৪ ট্রিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস। অথচ আন্তর্জাতিক গ্যাসের বাজারে ইরানের অংশগ্রহণ শতকরা মাত্র এক ভাগ। তেহরানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর এই খাতে ৪,০০০ কোটি ডলারের বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগ হবে বলে আশা করছে ইরান। দেশটি আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে দৈনিক ১২০ কোটি ঘনমিটার গ্যাস উত্তোলন করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। বর্তমানে ইরানে উৎপাদিত গ্যাসের পরিমাণ ৮০ কোটি ঘনমিটার।

৪০ লাখ ব্যারেল তেল নিয়ে ইউরোপে ইরানি ট্যাংকার

৪০ লাখ ব্যারেল তেল নিয়ে ইরানের কয়েকটি ট্যাংকার ইউরোপের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছে। এসব ট্যাংকার থেকে ফ্রান্স, ¯েপন ও রাশিয়ার চারটি তেল কো¤পানিকে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অপরিশোধিত তেল সরবরাহ করা হবে। ইরানের জাতীয় তেল কো¤পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রোকনুদ্দিন জাওয়াদি গত ১৩ ফেব্রুয়ারি এ ঘোষণা দেন। তিনি ইরানের জ্বালানি নিউজ নেটওয়ার্ক ‘শানা’কে জানান, মোট তেলের মধ্যে ২০ লাখ ব্যারেল কিনেছে ফ্রান্সের টোটাল কো¤পানি এবং বাকি ২০ লাখ ব্যারেল কিনেছে ¯েপন ও রাশিয়ার দুটি কো¤পানি। এসব তেল ইউরোপে শোধন করা হবে।
ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর গত ১১ ফেব্রুয়ারি দেশটি প্রথমবারের মতো ইউরোপীয় ক্রেতাদের জন্য প্রতিযোগিতামূলক দাম ঘোষণা করে। সৌদি আরবের চেয়ে প্রতি ব্যারেলে এক ডলার কম দাম ধরা হয়েছে।
গত ১৮ জানুয়ারি রোকনুদ্দিন জাওয়াদি জানিয়েছিলেন, নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর ইরানের তেল মন্ত্রণালয় প্রতিদিন পাঁচ লাখ ব্যারেল তেল উত্তোলন বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে। নিষেধাজ্ঞা পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে ইরান প্রতিদিন দশ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল বিক্রি বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে।

মার্কিন বাজারে প্রবেশ করল ইরানী কার্পেটের প্রথম চালান
ইরানী কার্পেটের প্রথম চালান মার্কিন বাজারে প্রবেশ করেছে। পরমাণু সমঝোতা বাস্তবায়নের পর এ কার্পেটের চালান লস অ্যাঞ্জেলসের বাজারে প্রবেশ করেছে বলে জানায় দৈনিক লস অ্যাঞ্জেলস টাইম্স গত ৬ ফেব্রুয়ারি। ইরানী কার্পেটের এ চালান গত সপ্তাহে মার্কিন শুল্ক বিভাগ থেকে ছাড়া পায়। আর এর মাধ্যমে ইরানী কার্পেটের জন্য মার্কিন ব্যবসায়ীদের অনেক বছরের আগ্রহের অবসান ঘটে।
লস অ্যাঞ্জেলসের ওয়েস্টউডের ইরানী কার্পেট ব্যবসায়ী আলেক্স হেলমি বেশ আবেগী হয়ে পড়েন। দৈনিকটিকে তিনি বলেন, ইরানী কার্পেট এসেছে শুনে আনন্দে আমার কান্না পাচ্ছিল। হাতে বোনা ৪০টি কার্পেট সংগ্রহের জন্য দ্রুত নিজ কর্মীদের লস অ্যাঞ্জেলস বিমান বন্দরে পাঠান তিনি।
হেলমির এ চালানে ১৩টি বড় কার্পেটও ছিল। এগুলোর কোনো কোনোটি একশ’ বছরের বেশি পুরানো। এসব কার্পেটের বেশির ভাগ খাঁটি রেশম তন্তুতে বোনা। আর কোনো কোনোটিতে রেশম এবং স্বর্ণ তন্তু মেশানো আছে। বড় কার্পেটগুলো এক লাখ এবং ছোটগুলো ১০ হাজার ডলারে বিক্রি হবে বলে জানান তিনি।
বেলগ্রেডে দেওয়ানে হাফিজ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ
পারস্যের মহাকবি হাফিজের কবিতা (দেওয়ানে হাফিয) সার্বিয় ভাষায় প্রকাশিত হল বেলগ্রেডে। এটি অনুবাদ করেছেন সার্বিয় অনুবাদক স্লোবোদান ডিজুরোভিক।
২০ ফেব্রুয়ারী বেলগ্রেডের ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে এই কাব্যগ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বেলগ্রেডে ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছাড়াও দুটি দেশের কর্মকর্তারা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। সার্বিয়ার ন্যাশনাল লাইব্রেরির পরিচালক লাসলো ব্লাস্কোভিস অনুষ্ঠানে বলেন, হাফিজের কাব্যগ্রন্থ (দেওয়ানে হাফিয) প্রকাশনার আয়োজন লাইব্রেরির জন্যে একটি বিশেষ দিনের মধুর স্মৃতি হয়ে থাকবে।এ কাব্যগ্রন্থ লাইব্রেরির সংগ্রহকে আরো সমৃদ্ধ করবে।
অনুষ্ঠানে সার্বিয়ায় ইরানের রাষ্ট্রদূত মাজিদ ফাহিম বলেন, পারস্য কবিতায় মহাকবি হাফিজের কবিতার অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হাফিজের মরমী চিন্তা ও সাধনা বিশ্বসাহিত্যে রঙ্গীন পালক হয়ে আছে।
মারকোভিস বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি প্রধান অধ্যাপক আলেক্সান্ডার জারকভ অনুষ্ঠানে বলেন, তার লাইব্রেরিতে দেওয়ানে হাফিজের দুটি কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও ৬৮০টি প্রাচ্য পাণ্ডুলিপি রয়েছে। একই সঙ্গে তিনি ইউরোপ ও প্রাচ্যের সাহিত্য সম্পর্ক নিয়েও আলোকপাত করেন। সূত্র: তেহরান টাইমস

চালু হলো প্রাচীন সিল্ক রোড : চীনা মালবাহী ট্রেন ইরানে
গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ প্রাচীন আমলের সিল্ক রোড দিয়ে শেষ পর্যন্ত চীনের একটি পণ্যবাহী ট্রেন ইরানে এসে পৌঁছেছে। চীন থেকে ইরানে আসতে ট্রেনটির ১৪ দিনের বেশি সময় লাগে এবং ট্রেনটি ১০,৩৯৯ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়। গত ২৯ জানুয়ারি চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের বাণিজ্য কেন্দ্র ই ওয়াং শহর থেকে ইরানের উদ্দেশে রওয়ানা দিয়েছিল এ মালবাহী ট্রেন।
ইরানের গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ট্রেনটিতে বাণিজ্যিক পণ্যবাহী ৩২টি কন্টেইনার রয়েছে। নতুন সিল্ক রোড দিয়ে চীন থেকে কাজাখস্তান ও তুর্কমেনিস্তান হয়ে ট্রেনটি ইরানের রাজধানী তেহরানে এসে পৌঁছে। ইরানের রেল বিভাগের প্রধান মোহসেন পুরসাইয়্যেদ আকায়ি বলেন, ১৪ দিনে ১০,৩৯৯ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে চীনা ট্রেনের ইরানে পৌঁছানো নজিরবিহীন ঘটনা। তিনি বলেন, স্বাভাবিক অবস্থায় এত পথ পাড়ি দিতে ৩০ দিন লাগার কথা। সিল্ক রোড চালু করার ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
ইরানের এ কর্মকর্তা জানান, প্রতি মাসে একটি করে ট্রেন আসবে, তবে প্রয়োজন হলে তা বাড়ানো হবে। ইরানের এ কর্মকর্তা আরো জানান, চীনের সাংহাই সমুদ্রবন্দর থেকে ছেড়ে আসা পণ্যবাহী জাহাজ ইরানের বন্দর আব্বাসে ভিড়তে যে সময় লাগে তার চেয়ে এ ট্রেনের তেহরান এসে পৌঁছাতে ৩০ দিন কম সময় লেগেছে। মোহসেন পুরসাইয়্যেদ জানান, এ রোড তেহরান এসে থেমে যাবে না; বরং তা ইউরোপ পর্যন্ত যাবে।
সিল্ক রোডে আসা চীনা ট্রেনকে স্বাগত জানাতে তেহরানের রেলরোড স্টেশনে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। মোহসেন পুরসাইয়্যেদ আকায়িসহ ইরানে নিযুক্ত চীন, কাজাখস্তান ও তুর্কমেনিস্তানের রাষ্ট্রদূতগণ এতে উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, প্রাচীনকালে সিল্ক রোড ব্যবহার করে ব্যবসায়ীরা এশিয়া থেকে ইউরোপে মালামাল আমদানি-রপ্তানি করতেন। চীন সেই পথকে আবার চালু করার উদ্যোগ নেয়। ২০১৩ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং নতুন ‘সিল্ক রোড ইকনোমিক বেল্ট এবং ২১তম সমুদ্র সিল্ক রোড’ উদ্বোধন করেন যাতে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের সঙ্গে শক্তিশালী যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে ওঠার ব্যবস্থা হয়। এর অংশ হিসেবে মহাসড়ক, রেলপথ ও বিমানবন্দর নির্মাণ করা হবে। এ প্রকল্পসহ এশিয়ায় যোগাযোগের অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্য চীন এরই মধ্যে ১৪ হাজার কোটি ডলারের তহবিল গঠন করেছে।
মধ্যপ্রাচ্যের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ইরানের অবস্থান এবং এ দেশের সঙ্গে ১৫টি দেশের স্থল ও পানিসীমা রয়েছে। চীন মনে করে, নতুন সিল্ক রোড প্রকল্পে ইরান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এর মাধ্যমে ইরান মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরেশিয়ার সঙ্গে চীনের যোগাযোগ স্থাপন করিয়ে দিতে পারে। আগামী ছয় বছরে ইরান নতুন সিল্ক রোডে ৬০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

তেহরানে রাশিয়ার পর্যটন অফিস
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ইরানের রাজধানী তেহরানে রাশিয়ার প্রথম পর্যটন অফিস খোলা হয়েছে। তেহরানে নবম আন্তর্জাতিক পর্যটন সম্মেলনকে সামনে রেখে রাশিয়া এ অফিস চালু করল। রাশিয়ার টুরিজ্ম ফেডারেল এজেন্সির পরিচালক ওলেগ স্যাফোনভ তেহরানে ওই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে রয়েছে এক প্রতিনিধি দল। ইরানের পর্যটন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে রাশিয়ার প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বাণিজ্য নিয়ে পরামর্শ করেছেন।
পর্যটন নিয়ে এর আগে রাশিয়া ও ইরানের মধ্যে চুক্তি অনুসারে বিভিন্ন কর্মশালা, প্রশিক্ষণ ও পর্যটন শিক্ষার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। রাশিয়ার পর্যটন পরিচালক ওলেগ স্যাফোনভ ইরানের কালচারাল হেরিটেজ, টুরিজ্ম ও হ্যান্ডিক্রাফ্টস অর্গানাইজেশনের উপ পরিচালক মোরতেজা রাহমানি মোভাহেদ-এর সঙ্গে দুদেশের মধ্যে পর্যটন খাতে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য পরিচালনা নিয়ে বৈঠক করেছেন। দু’টি দেশের নাগরিকরা সহজে কিভাবে ভিসা পেতে পারে সে বিষয়টি এ বৈঠকে প্রাধান্য পায়।
স্যাফোনভ তেহরানে আন্তর্জাতিক পর্যটন সম্মেলনকে তাঁর দেশ ছাড়াও অন্যান্য দেশের সঙ্গে পর্যটন ব্যবসার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ যোগসূত্র হিসেবে কাজ করবে বলে অভিমত ব্যক্তি করেন। রাশিয়ার অনেক বেসরকারি পর্যটন প্রতিষ্ঠান ইরানে ব্যবসা করতে আগ্রহী এ কথা জানিয়ে স্যাফোনভ বলেন, এজন্যই আমরা তেহরানে অফিস খুলেছি। ১৬ থেকে ১৯ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে রাশিয়া ছাড়াও আরো ষোলটি দেশের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করে।

ইরানে শাখা খুলছে ওমানের মাস্কাট ব্যাংক

ইরানের রাজধানী তেহরানে শাখা খুলতে যাচ্ছে ওমানের সর্ববৃহৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠান মাস্কাট ব্যাংক। গত মাসে ইরানের ওপর থেকে অর্থনৈতিক অবরোধ তুলে নেয়ার পর এই প্রথম তেহরানে কোনো আন্তর্জাতিক ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। ইরানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এ খবর দিয়েছে টাইমস অব ওমান।
ইরান ও ওমানের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক শক্তিশালী হওয়ায় সামনের দিনগুলোতে দুদেশের মধ্যে অর্থনৈতিক কাজ বেড়ে যাবে এবং এ লক্ষ্যেই ওমানের মাস্কাট ব্যাংক তেহরানে শাখা খোলার উদ্যোগ নিয়েছে। অবশ্য অবরোধ চলাকালেও বিদেশি ব্যাংকগুলো তেহরানে তাদের কার্যক্রম চালু রাখে। কিন্তু ৬ জাতির সঙ্গে পারমাণবিক ইস্যু নিয়ে চুক্তি হবার পর এই প্রথম নতুন কোনো বিদেশি ব্যাংকের শাখা তেহরানে চালু হতে যাচ্ছে। সূত্র: ফিন্যান্সিয়াল ট্রিবিউন

বায়ু দূষণ কমিয়ে আনতে তেহরানে নামছে হাইব্রিড ট্যাক্সি
ইরানের রাজধানী তেহরানের পরিবহন বহরে আগামী ৩ বছরে আরো ১০ হাজার হাইব্রিড ট্যাক্সি যুক্ত হবে। তেহরান সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তা মেইসাম মোজাফফার গত ২১ ফেব্রুয়ারি এক সাংবাদিক সম্মেলনে এ তথ্য জানান। এ অনুষ্ঠানে ৫০টি হাইব্রিড ট্যাক্সি তেহরান শহরে চলাচলের জন্য চালু করা হয়। মেইসাম জানান, আগামী ২০১৭ সালের মার্চের মধ্যে আরো আড়াই হাজার ট্যাক্সি তেহরানে চলাচল শুরু করবে। আর এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে বেসরকারি খাত।
যানজট ও বায়ু দূষণের দিকটি বিবেচনা করে এধরনের হাজার হাজার হাইব্রিড ট্যাক্সি চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, তেহরান শহরে চলাচলকারী একটি মাইক্রোবাস যে পরিমাণ বায়ু দূষণ করে, ৬৬টি হাইব্রিড ট্যাক্সি চলাচল করলে একই পরিমাণ বায়ু দূষণ ঘটে। তাই হাইব্রিড ট্যাক্সি বৃদ্ধি করে তেহরান শহরে বায়ু দূষণ কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এছাড়া হাইব্রিড ট্যাক্সির জ্বালানির খরচ অনেক কম।

 

অবরোধ পরবর্তী পরিস্থিতিতে ইরান

খন্দকার মোঃ মাহফুজুল হক

১৯৭৯ সালে যে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ইরানে ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা ছিল বিংশ শতাব্দীর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর একটি। তখন বিশ্বজুড়ে এমন একটা ধারণা বদ্ধমূল ছিল যে, পুঁজিবাদী ও সমাজতন্ত্রী দুই পরাশক্তির কর্তৃত্ব অস্বীকার করে কোন রাষ্ট্র বা শাসনব্যবস্থা টিকে থাকা তো দূরের কথা, মাথা উঁচু করারই সামর্থ্য রাখে না। এমনই এক সময়ে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী দুই পরাশক্তিকে ভ্রুক্ষেপ না করে মরহুম ইমাম খোমেইনী (র) সু¯পষ্টভাবে ঘোষণা করলেন, ‘আমরা পাশ্চাত্যও চাই না, প্রাচ্যও চাই না, আমরা চাই ইসলামী প্রজাতন্ত্র।’ ফলে অনেকে ধরেই নিয়েছিলেন ইসলামী বিশ্বাস ও চেতনাকে পুঁজি করে ধর্মীয় নেতারা স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে এই বিপ্লবের আদর্শ বেশি দিন টিকিয়ে রাখতে পারবেন না।
অবশ্য পরাশক্তিগুলো শুরু থেকেই ইসলামের নব জাগরণকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে নি। নতুন ইসলামী প্রজাতন্ত্রকে অঙ্কুরেই ধ্বংস করে দেয়ার উদ্দেশ্যে তারা প্রকাশ্যে এবং গোপনে নানা তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছিল। এর পরিণতিতে বিপ্লব-পরবর্তী বছরগুলোতে ইরানে হত্যা ও গুপ্ত হত্যার অনেকগুলো ঘটনা ঘটে।
পরাশক্তিগুলোর পরোক্ষ কারসাজিতে পরিস্থিতি এতটাই সঙ্গীন হয়ে পড়ে যে, দূর নিয়ন্ত্রিত বোমা বিস্ফোরণের এক ঘটনায় দেশটির ¯িপকারসহ ৭২ জন শীর্ষস্থানীয় বিপ্লবী নেতা শহীদ হন। এর কাছাকাছি সময়ে অপর আরেকটি ঘটনায় ইসলামী সরকারের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী শাহাদাত বরণ করেন। এই অবস্থা সামলে ওঠার আগেই নব প্রতিষ্ঠিত এই ইসলামী রাষ্ট্রটির ওপর চাপিয়ে দেয়া হয় ভয়াবহ যুদ্ধের দানব। যে যুদ্ধ অব্যাহত থাকে দীর্ঘ আট বছর। ১৯৮৮ সালের আগস্ট মাসে জাতিসংঘের কূটনৈতিক তৎপরতায় ইরান যুদ্ধ-দানবের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়। এরপর দেশটির ইসলামী সরকার যখন দেশ পুনর্গঠনের কাজে হাত দেয় ঠিক তখনই সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যকামী শক্তিগুলো নানা বাহানায় ইরানের ওপর একের পর এক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো পরমাণু কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ইসলামী ইরানকে একঘরে করার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালায়।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ১৯৭৯ সালে বিপ্লব বিজয়ের পর ৩৭টি বছর গত হয়েছে, কিন্তু কোনভাবেই ইরানকে ইসলামী বিপ্লবের আদর্শ থেকে বিচ্যুত করা সম্ভব হয় নি। প্রচণ্ড চাপে ফেলেও ইরানকে বাগে আনা যায় নি। বরং নানা ক্ষেত্রে সফলতা ও উন্নতির বিশাল ঝাঁপি নিয়ে দেশটি গত ১১ ফেব্রুয়ারি ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের ৩৭তম বার্ষিকী উদ্যাপন করেছে। বিশ্ব আজ লক্ষ করছে পাহাড়সম বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে এগিয়ে চলেছে ইরান। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা ও প্রযুক্তি, শিল্প ও গবেষণাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরানের অভাবনীয় উন্নতি বৈরী রাষ্ট্রগুলোকে রীতিমত বিস্মিত করেছে। এসবের মধ্যে সম্প্রতি যোগ হয়েছে বিশাল কূটনৈতিক সফলতা। একঘরে করে রাখার পশ্চিমা নীলনকশা থেকে ইরান নিজেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে নিজস্ব কূটনৈতিক দক্ষতায়। যোগ্য ও বিচক্ষণ নেতৃত্ব ও প্রত্যয়ী কোন জাতির উন্নতি ও অগ্রগতি যে কোন ভাবেই রোধ করা যায় না তারই বাস্তব উদাহরণ সৃষ্টি করেছে আজকের ইরান।
প্রায় চার দশক আগে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের বিজয় যেমন বিশ্বজুড়ে আলোচনা-পর্যালোচনার ঝড় তুলেছিল এবং ইমাম খোমেইনীর আধ্যাত্মিক ও বিচক্ষণ নেতৃত্ব জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে গোটা বিশ্বের নজর কেড়েছিল, ঠিক তেমনি আজ সাঁইত্রিশ বছর পর বিশ্বের ছয় প্রভাবশালী দেশের সাথে ইরানের সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরের ঘটনা দুনিয়াজুড়ে আলোচনার প্রধান বিষয়ে পরিণত হয়েছে। ফলে এই চুক্তির ভবিষ্যৎ এবং বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ইরানের সম্ভাব্য প্রভাবের বিষয় নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা। এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে আমরা এই চুক্তির নানা দিক নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করব।
যুদ্ধ নয়, শান্তি ও কূটনীতির মাধ্যমেই অর্জন সম্ভব
দীর্ঘ কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পর গত বছরের জুলাই মাসে ইরান ও প্রভাবশালী ছয় রাষ্ট্রের মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ঐ সমঝোতার ভিত্তিতে গত ১৬ জানুয়ারি পশ্চিমা বিশ্ব ইরানের ওপর থেকে অবরোধ তুলে নেয়। যুদ্ধ ও সন্ত্রাসবাদ যখন গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থির করে তুলেছে ঠিক তখন ইরানের সাথে ছয় জাতির সমঝোতা চুক্তিকে শান্তির বিজয় হিসেবেই মনে করা হচ্ছে। ফলে যায়নিস্ট ইসরাইল এবং ঈর্ষাকাতর কয়েকটি আরব রাষ্ট্র ব্যতীত বাদ বাকি বিশ্ব এই চুক্তি এবং ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এই চুক্তির পর তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, এ পদক্ষেপ বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। ইইউ’র পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান ফেডেরিকা মঘেরিনিও একই ধরনের মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, সারা বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য এটা একটা আশার প্রতীক, আন্তর্জাতিক স¤পর্কেও এর মাধ্যমে একটা নতুন দিগন্তের সূচনা হলো। এমনকি কলিন পাওয়েল ও ম্যাডেলিন অলব্রাইটের মতো যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা এই চুক্তিকে সঠিক সিদ্ধান্ত বলে মন্তব্য করেছেন। অর্থনীতিবীদরা বলছেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ইরানের মতো শক্তিশালী দেশ পুনরায় স¤পৃক্ত হওয়া বিশ্ব অর্থনীতির মন্দাবস্থা কাটিয়ে উঠতে সহায়ক হবে। ইরানও এই চুক্তি থেকে লাভবান হবে এবং বিভিন্ন দেশে আটক থাকা ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি স¤পদ আস্তে আস্তে ফেরত পাবে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের যায়নিস্ট লবির অযৌক্তিক লম্ফঝম্ফকে দেশটির বেশির ভাগ মানুষ পাত্তা দেয় নি।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. জাভাদ জারীফ এ বিষয়টির দিকে ইঙ্গিত করে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘আপনি তাদেরকে বলুন, যুদ্ধ করে যা অর্জন করা সম্ভব হয় না, শান্তি ও কূটনীতির মাধ্যমে তা অর্জন সম্ভব।’
অবরোধ-পরবর্তী কৌশলগত ভূরাজনীতি ও অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে ইরানের অবস্থান পশ্চিমা বিশেষজ্ঞদের কাছে আগে থেকেই পরিষ্কার ছিল। তবে বিশ্বের আপামর মানুষের কাছে এটা সু¯পষ্ট হতে থাকে ইরানের সাথে প্রভাবশালী ছয় রাষ্ট্রের সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরপরই। সুইজারল্যান্ডের লুজান শহরে অর্জিত সমঝোতার ভিত্তিতে গত ১৪ জুলাই ২০১৫ ইরান ও প্রভাবশালী ছয় রাষ্ট্র (জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পাঁচ সদস্য রাষ্ট্র ও জার্মানি) একটি সমঝোতা চুক্তি সই করে। আর ২৯ জুলাই ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লঁরা ফ্যাবিউস ইরান সফরে গিয়ে বলেন, পরমাণূ কর্মসূচি নিয়ে বিরোধ নি®পত্তি হওয়ার পর এ দুই দেশের মধ্যে স¤পর্ক উষ্ণতর করার এখনই সময়। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা দু’টি বড় ও স্বাধীন দেশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহের কারণে এ দু’টি দেশের মধ্যে শীতল স¤পর্ক বিরাজ করলেও চুক্তি স্বাক্ষরের পর এখন তা আর নেই। তিনি ইরানের সাথে অর্থনৈতিক স¤পর্ক জোরদার করার আগ্রহ ব্যক্ত করেন।
এরপর আগস্ট মাসে সফর করেন ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাত্তিও রেনজি। তিনি ইরানের সাথে কূটনৈতিক স¤পর্ক জোরদারের পাশাপাশি অর্থনীতির নানা খাতে সহযোগিতা বাড়াতে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
ইউরোপের আরেক বড় শক্তি জার্মানি এই দৌড়ে পিছিয়ে থাকতে চায় নি। গত ২ ফেব্রুয়ারি একটি উচ্চ পর্যায়ের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল নিয়ে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টেইন মেয়ার ইরান সফরে যান। তাঁর এই সফর আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
ইউরোপের প্রভাবশালী এই তিন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তেহরান সফরকালে নিজ নিজ দেশের সরকারপ্রধানের আমন্ত্রণপত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানির হাতে তুলে দেন। এই প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্ট রুহানি গত ২৫ জানুয়ারি ইতালি ও ফ্রান্স সফর করেন। তাঁর এই সফরকালে দেশ দু’টির সাথে বেশ কিছু অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ইতালির সাথেই হয়েছে ১৮.৪ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য চুক্তি। ফ্রান্সের সাথে বিভিন্ন বাণিজ্যিক চুক্তির পাশাপাশি ইরান এয়ারবাসের সাথে ১১৮টি যাত্রীবাহী বিমান ক্রয় চুক্তি করেছে। এ জন্য ইরানকে পরিশোধ করতে হবে ১০.৫ বিলিয়ন ডলার।
চীন ও রাশিয়াকে ইরানের কৌশলগত ও পুরানো বন্ধু মনে করা হয়। স¤পর্কের নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হওয়ায় এই দুই দেশের সাথে ইরানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স¤পর্কে ভাটা পড়তে পারে বিশেষজ্ঞরা এমন কোন সম্ভাবনা দেখছেন না। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং গত ১৯ জানুয়ারি তেহরানে বলেছেন, তাঁর দেশ ইরানের সাথে স¤পর্কের এক নতুন অধ্যায় উন্মুক্ত করতে চায়। এ যাত্রায় তাঁর উপস্থিতিতে দুই দেশের মধ্যে ৬০ হাজার কোটি ডলারের বাণিজ্য চুক্তিসহ ১৭ দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। অপরদিকে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, আগামী এক দশকে বেইজিংয়ের সঙ্গে তেহরানের বাণিজ্যের পরিমাণ ৬শ’ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। রাশিয়ার সঙ্গেও ইরানের অংশীদারীর পরিসর বাড়তে পারে। আঙ্কারার সঙ্গে মস্কোর স¤পর্কের ক্ষেত্রে সম্প্রতি যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে, তাতে মস্কো ইউরোপ থেকে পণ্য এবং তুরস্ক থেকে ফল ও সবজি আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, কিন্তু অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের মধ্য দিয়ে রাশিয়া আবার সেই ঘাটতি মেটাতে পারছে না। এই পরিস্থিতিতে রাশিয়ার জন্য ইরান ভালো বিকল্প হতে পারে।
ইরান কী ভাবছে?
অবরোধ উঠে যাওয়ার পর ইরানের সাথে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক স¤পর্ক বিস্তৃত করতে যে কোন দেশের চেয়ে শক্তিশালী দেশগুলোই প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রয়েছে। ইরানের প্রতি বিশ্বের এই প্রচণ্ড আগ্রহের বিষয়টি দেশটির নেতারা কিভাবে সামাল দেবেন তাই এখন দেখার বিষয়। ইতিমধ্যেই ইরানের অর্থনীতিবীদ এবং বাজার বিশেষজ্ঞরা সতর্ক বাণী উচ্চারণ করেছেন। তাঁরা দেশের নীতিনির্ধারকদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, অবরোধ-পরবর্তী পরিস্থিতিতে সবকিছু যদি পরিকল্পিত ও সুসমন্বিতভাবে করা সম্ভব না হয় তাহলে অর্থনৈতিক অবস্থা অবরোধকালীন সময়ের চেয়ে খারাপ হবে। যে কোন ভুল সিদ্ধান্তের কারণে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও দেশীয় শিল্প-কারখানা ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।
এ প্রসঙ্গে তেহরানের চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের প্রেসিডেন্ট এহিয়া আলে ইসহাক বলেছেন, অবরোধের সময়ের চেয়ে অবরোধ-পরবর্তী সময়ের পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা অনেক বেশি কঠিন হবে। এ ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারকদেরকে অনেক বেশি দায়িত্বশীল এবং সতর্ক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তিনি বলেন, ‘পশ্চিমা দেশগুলো এখন ইরানের বাজারে প্রবেশ করার জন্য হন্যে হয়ে আছে। কাজেই আমাদেরকে সতর্ক থাকতে হবে যাতে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
গণমাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদনে আশংকা প্রকাশ করা হচ্ছে, অবরোধ উঠে যাওয়ায় ইরান হয়তো তেল উত্তোলনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেবে, পরিণতিতে বিশ্ববাজারে তেলের দর আরেক দফা হ্রাস পাবে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইরানের পক্ষ থেকে এমন পদক্ষেপ নেয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। কারণ, ইরান পারতপক্ষে তার জাতীয় স¤পদ ক্ষতিগ্রস্ত করে কোন কাজ করবে না। তাছাড়া বর্তমানে তেল-বহির্ভূত খাতে ইরানের রপ্তানি আয় ৬০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে, যা দিয়ে দেশটি তার আমদানি ব্যয় মিটাতে প্রায় সক্ষম। ফলে অবরোধ-পরবর্তী পরিস্থিতিতে ইরান নিয়ে যত আগ্রহ ও উদ্দীপনাই তৈরি হোক না কেন দেশটির নীতি নির্ধারকরা যে কোন সিদ্ধান্ত ধীরে সুস্থে ও পরিকল্পিতভাবেই গ্রহণ করবেন বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।

লেখক : মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশ্লেষক

স্মরণীয় দিবস

১ জানুয়ারি : ইসলামী বিপ্লবের মহান নেতা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) ১৯৮৯ সালের এ দিনে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভের কাছে এক ঐতিহাসিক চিঠি প্রদান করেন। এ চিঠিতে ইমাম খোমেইনী গর্বাচেভকে ইসলাম সম্পর্কে ব্যাপক পড়াশোনার আহ্বান জানান।
১০ জানুয়ারি : মীর্যা তাকী খান আমীর কাবীর এর শাহাদাত বার্ষিকী।
১২ জানুয়ারি : ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর নির্দেশে ১৯৭৯ সালের এই দিনে ইসলামী বিপ্লবী পরিষদ গঠন করা হয়।
১৬ জানুয়ারি : ১৯৭৯ সালের এ দিনে ইরান থেকে শাহানশাহ রেযা শাহ পাহলভী পলায়ন করেন।
*নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহর ৯২তম মৃত্যুবার্ষিকী।
১৯ জানুয়ারি : আহলে বাইতের এগারতম ইমাম হাসান আসকারী (আ.)-এর পবিত্র জন্মদিবস।
২১ জানুয়ারি : মহিয়সী নারী হযরত মাসূমা (আ.)-এর ওফাত দিবস।
২৬ জানুয়ারি : ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়ে আরব বিশ্বের দেশ মিসর সর্বপ্রথম এ দিন লজ্জাজনক ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষর করে। এর প্রতিবাদে তখন আরব লীগ থেকে মিসরকে বহিষ্কার করা হয়।
*বাংলা ভাষার সনেট কাব্যের জনক ও ‘মেঘনাদবধ’ মহাকাব্যের রচয়িতা মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মবার্ষিকী।
২৯ জানুয়ারি : আততায়ীর গুলিতে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা মহাত্মা গান্ধী নিহত হন।
১ ফেব্রুয়ারি : দীর্ঘ ১৫ বছর নির্বাসনে থাকার পর ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের প্রাক্কালে এ দিনে বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেইনী স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন।
৩ ফেব্রুয়ারি : ইরানে মহাকাশ প্রযুক্তি দিবস।
৮ ফেব্রুয়ারি : ইরানে বিমান বাহিনী দিবস।
১০ ফেব্রুয়ারি : হযরত ইমাম খোমেইনীর নির্দেশে ১৯৭৯ সালের এই দিনে পূর্বতন শাহ সরকারের বিলুপ্তি ঘোষিত হয়।
১১ ফেব্রুয়ারি : ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিপ্লবের বিজয়বার্ষিকী। ইরানে আড়াই হাজার বছরের রাজতন্ত্রের পতন।
১৩ ফেব্রুয়ারি : ‘শাহনামা’র পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদক কথাসাহিত্যিক মনিরউদ্দীন ইউসুফ এর জন্মদিবস।
১৪ ফেব্রুয়ারি : হযরত ফাতেমা ও আলী (আ.)-এর কন্যা হযরত যায়নাব সালামুল্লাহ আলাইহার জন্মবার্ষিকী।
*মহানবী (সা.), অন্যান্য নবী (আ.) এবং পবিত্র ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কে অবমাননাকর উক্তি করার দায়ে ১৯৮৯ সালের এ দিনে ইমাম খোমেইনী সালমান রুশদীর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেন।
২১ ফেব্রুয়ারি : আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ১৯৫২ সালের এ দিনে বাংলা ভাষা আন্দোলনে শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিক, জাব্বার, শফিকসহ বেশ কয়েকজন বাঙালি তরুণ।
২২ ফেব্রুয়ারি : নবীকন্যা হযরত ফাতিমা (আ.)-এর শাহাদাত দিবস (একটি রেওয়ায়াত অনুযায়ী)।
২৪ ফেব্রুয়ারি : খাজা নাসিরউদ্দিন তূসী স্মরণে দিবস। এটি ইরানে প্রকৌশল দিবস হিসেবেও উদ্যাপিত হয়।

ইরানী প্রবাদ

زمانه با تو نسازد تو با زمانه بساز
উচ্চারণ : যামা’নে বা’ তো নাসা’যাদ, তো বা’ যামা’নে বেসা’য।
অর্থ : যুগ তোমার সাথে খাপ খাবে না, তুমিই যুগের সাথে খাপ খাও।
মর্মার্থ : তুমি যদি জীবনের নানা সমস্যা দূর করতে না পার, তাহলে অন্তত তার সাথে খাপ খেয়ে চল।
زمستان رفت و روسیاهی به زغال ماند.
উচ্চারণ : যামেস্তা’ন রাফ্ত ও রূসিয়া’হী বে যুগা’ল মা’ন্দ
অর্থ : শীতকাল চলে গেছে আর কালিমাযুক্ত চেহারা রয়ে গেছে কয়লার জন্য।
মর্মার্থ : লজ্জা অপমান কেবল তার জন্যই যার বন্ধুবান্ধব বলতে কেউ নেই। কাজেই কোন ব্যাপারে তোমার লজ্জায় জড়োসড় হওয়া ও হীনমন্যতায় ভোগার কারণ নেই।
زمین را به آسمان دوختن (زدن).
উচ্চারণ : যামীন রা’ বে আ’সেমা’ন দূখ্তান (যাদান)
অর্থ : যমীনকে আসমানের সঙ্গে সিলাই করা। (লাগানো)
মর্মার্থ : বিরামহীন চেষ্টা চালানো। এদকি ওদিক সবখানে ঢু মারা বুঝাতে প্রবাদটি ব্যবহৃত হয়।
زمینه سازی کردن.
উচ্চারণ : যামীনে সা’যী কার্দান
অর্থ : ক্ষেত্র তৈরি করা।
মর্মার্থ : নিজের উদ্দেশ্য সিদ্ধি করার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করা বুঝাতে প্রবাদটির ব্যবহার সর্বত্র।
زن باید با چادر بیاید و با کفن برود.
উচ্চারণ : যান বা’য়াদ বা’ চা’দার বিয়া’য়াদ ওয়া বা’ কাফান বেরাওয়াদ
অর্থ : নারীকে চাদর নিয়ে আসতে হয় আর যেতে হয় কাফন গায়ে।
মর্মার্থ : উত্তম স্ত্রী সে, যে শেষ পর্যন্ত নিজের স্বামীর সাথে খাপ খেয়ে চলে। এ কথা বুঝাতে প্রবাদটি ব্যবহৃত হয়।
زن بلا است، هیچ خانه بی بلا نباشد.
উচ্চারণ : যান বালা’ আস্ত, হীচ খা’নে বী বালা’ নাবা’শাদ
অর্থ : নারী একটা মুসিবত, মুসিবত ছাড়া কোন ঘর নেই।
মর্মার্থ : বিয়ে করা যদিও হাজার রকমের ঝামেলার কাজ এবং তাতে পুরুষের যার পর নেই যন্ত্রণা পোহাতে হয়, কিন্তু ঘরবাড়ি ও স্ত্রী ছাড়া তো জীবন পরিচালনাও সম্ভবপর নয়।
زنده بگور شدن.
উচ্চারণ : যেন্দে বেগূর শোদান
অর্থ : জীবন্ত কবরস্থ হওয়া।
মর্মার্থ : দারুন দুঃখ-কষ্টের মধ্যে পতিত হওয়া। কোন প্রতিকূল স্থানে ঝামেলায় জড়িয়ে যাওয়া।
অনুবাদ : আবু হানিফ

ভ্রমণ : বৌলাই বাড়ি- এক কবির জন্মস্থান

আমিন আল আসাদ

বৌলাই বাড়ি। বাংলা সাহিত্যের এক খ্যাতনামা কবির জন্মস্থান। বৌলাই বাড়ি কিশোরগঞ্জের একটি সুন্দর স্থান। ঐতিহাসিক শোলাকিয়া বা সোয়ালাখিয়া ঈদগাহ মাঠের অদূরেই এর অবস্থান। আসলে বৌলাই বাড়িকেতো পরিচয় করিয়ে দেয়ার কথা নয়। স্বনামেই পরিচিত হবার কথা এ স্থান। কারণ বাংলা সাহিত্যের এক অসামান্য কবির জন্ম হয়েছিলো এখানে যিনি ফারসী ভাষারএক অসামান্য গ্রন্থের অনুবাদ করেছিলেন। যা ছিলো বাংলা ভাষায় এক বড় রকমের কাজ। সে গ্রন্থটি হচ্ছে ইরানের বিখ্যাত কবি এবং জাতীয় কবি মহাকবি ফেরদৌসী রচিত অমর মহাকাব্য শাহানামা। এই শাহনামা মহাকাব্যের মতো মহাকবি ফেরদৌসীও যেমন বিখ্যাত তেমনি বাংলা ভাষায় এর পূর্ণাঙ্গ অনুবাদক কবি মনিরউদ্দীন ইউসুফও তাঁর সফল অনুবাদ কর্মের জন্যে বিখ্যাত। আসলে যত বড় যার কাজ তত বড় তাঁর সুনাম। কিন্তু আফসোসের বিষয় হচ্ছে আমরা আমাদের বিখ্যাত ব্যক্তি ও সম্মানী মানুষদের কোন খোজখবরই রাখিনা। বহুভাষাবিদ ও পন্ডিত ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ বলেছিলেন যে দেশে গুণের কদর নেই সে দেশে গুণী জন্মাতে পারেনা। যাগ্গে সেসব কথা। কি বলতে এসেছি আর কি বলতে শুরু করেছি। বলছিলাম কবিতীর্থ বৌলাই বাড়ির কথা। যেখানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন শাহনামার অনুবাদক কবি মনিরউদ্দিন ইউসুফ। আমরা গিয়েছিলাম একবার সে গ্রামে। কবির ৮৯ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে কবি পরিবার ও কিশোরগঞ্জ সাহিত্য পরিষদ-এর যৌথ উদ্যেগে জমজমাটভাবে উৎযাপিত হয়েছিলো কবির জন্মোৎসব। আমরা ঢাকা থেকে ৪০ জন কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, গবেষক, শিল্পী, কণ্ঠশিল্পী, সম্পাদক, লেখক, সাহিত্য প্রেমিক, সাহিত্য সেবী, জ্ঞানী-গুণী, আলেম, আইনজীবি সহ আটটি মাইক্রো ও ৩ টি প্রাইভেট কার যোগে যেনো মিছিল করতে করতে যোগ দিয়েছিলাম সে জন্মোৎসবে। সে আনন্দময় দিনটির কথা এখনো আমার মনে আছে। জলজল করছে চোখের সামনে। রাস্তা দিয়ে গাড়ি বহর যখন যাচ্ছিলো, পথচারিরা ভাবছিলো আমরা বোধহয় বনভোজনে যাচ্ছি অথবা আমরা কোন বিয়ের বরযাত্রি। আসলে আমরা এর চেয়েও আনন্দঘন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছিলাম। ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জের বৌলাইবাড়ি যাওয়া আসার এ ব্যাবস্থাও করেছিলো কবি পরিবার। আমাদের সহযাত্রি ছিলেন কবি বেলাল চৌধুরী, কবি আসাদ চৌধুরী, ইতিহাস গবেষক ও নৃতত্ত্ববিদ এবং কিশোরগঞ্জ সাহিত্য পরিষদ-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আশরাফুল ইসলাম, কবি আবদুল হাই শিকদার, অধ্যাপক সিরাজুল হক, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত নিউজলেটারের সম্পাদক ড. জহিরউদ্দিন মাহমুদ, অধ্যাপক ড. কে এম সাইফুল ইসলাম খান, জনাব ফজলে রাব্বী, হুজ্জাতুল ইসলাম আবদুল কুদ্দুস বাদশা, কবি শামিমা চৌধুরী, গবেষক আবদুল হাই, কবি ও আবৃত্তিকার রহিমা আক্তার কল্পনা, লেখক গবেষক আবুল কালাম মো ইলিয়াস প্রমূখ। ঢাকা থেকে ও কিশোরগঞ্জ থেকে আরো যোগ দিয়েছিলেন মোহাম্মদ আবদুল লাতিফ এ্যাডভোকেট মোজাম্মেল হক খান রতন, নাসিরউদ্দিন ফারুকী, শামিম জামানভি, সাবির আলী সাবির, কবি মুহিবুর রহিম। আরো ছিলেন উর্দু কবি জালাল আজিমাবাদী, শিয়াবউদ্দিন আহমদ, কবি জাহিদুল হক, শোয়েব সিদ্দিকী, উর্দু কবি আহমেদ ইলিয়াস, আয়ুব হোসেন, শামিম সিদ্দিকী, আনোয়ার জেবুন্নাহার, এহতেশাম আহমেদ পারভেজ, কবি ইকবাল আজীজ, কবি জাহাঙ্গির ফিরোজ, মাহিউল বিদাদ চৌধুরী, শিহাব সিদ্কিী প্রমূখ। ২০০৭ সালের ২২ র্ফেরুয়ারী খুব ভোরে বাসা থেকে বেড়িয়ে আমি চলে আসি শেকড় সন্ধানী কবি, নজরুল গবেষক ও ইতিহাস চিন্তক কবি আবদুল হাই শিকদার ভাইয়ের বাসায়। সেখান থেকে উনার গাড়িতে চড়ে চলে আসি ধানমন্ডির যে স্থান থেকে আমরা যাত্রা শুরু করবো সেখানে। সকাল সাতটার ভেতরে আমরা জড়ো হলাম এবং আটটায় যাত্রা শুরু করলাম বিসমিল্লাহ বলে কবির জন্মভুমি সেই ঐতিহাসিক বোৗলাই বাড়ির উদ্দেশ্যে। ঢাকা থেকে এই যাত্রা বা অভিযানের আগাগোড়া তদারকি করলেন কবিপুত্র সাঈদ আহমেদ আনিস।
আমরা ছুটে চলেছি কিাশোরগঞ্জের উদ্দেশ্যে, সকালের সুশীতল বাতাসের সিহরণ অনুভব করে করে। আমি যে মাইক্রোটিতে ছিলাম সেখানে আমার সাথে ছিলেন অধ্যাপক সিরাজুল হক, ড. জহির উদ্দিন মাহমুদ, ড. কে এম স্ইাফুল ইসলাম খান, গবেষক হুজ্জাতুল ইসলাম আবদুল কুদ্দুস বাদশা, লেখক আবুল কালাম মুহাম্মদ ইলিয়াস, গবেষক আবদুল হাই এবং জনৈক এ্যাডভোকেট।
ঢাকার যানজট সেদিন আমাদের বাধা হয়ে দাড়াঁয়নি। সহজেই আমরা প্রবেশ করলাম কিশোরগঞ্জের প্রবেশ দ্বারে। পথিমধ্যে অধ্যাপক সিরাজুল হক ও ড, কে এম সাইফুল ইসলামের খোশগল্প শুনতে শুনতে নানাবিধ টক ঝাল, স্বাদ-বিস্বাদ অনুভর করছিলাম। কিশোর গঞ্জের লোকজন, প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে শহর ও গ্রামের রাস্তা পেরিয়ে আমরা উপস্থিত হলাম বৌলাই বাড়ি। তখন বাজে সকাল সারে এগারোটা।
বৌলাই বাড়ি ঐতিহাসিকভাবে এক বনেদী পরিবারের বাড়ি। এর ঠাট-মান, শান-শওকত এখনো এর প্রাচীন ইমারত ও শানবাধানো দিঘিতে জড়িয়ে আছে। বাড়িটি একটি ঐতিহাসিক ও প্রতœতাত্মিক নিদর্শণ। আর কবি মনিরউদ্দীন ইঊসুফের কারণে এটি হয়েছে আরো মহিমান্বিত ও উজ্জল।
আমরা পৌছতেই সকালের নাস্তা দেয়া হলো। পিঠা পায়েস, ফল-ফলাদি সহ নানা আয়োজন। এরপর শুরু হলো প্রথম পর্বের অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান পরিচালনা করছিলেন কিশোরগঞ্জ সাহিত্য পরিষদ-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ইতিহাস ও প্রাচীনকীর্তি গবেষক, নৃতত্ত্ববিদ আশরাফুল ইসলাম ও কবি, আবৃত্তিকার রহিমা আক্তার কল্পণা। পবিত্র কালামে পাক থেকে তেলাওযাতের মাধ্যমে মুল অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে ব্যান্ড পার্টি যোগে ব্যান্ডের তালে তালে কিশোরগঞ্জের বৌলাই বাড়ির ঐতিহ্যবাহি লাঠিখেলা প্রদর্শিত হলো। যেটি ছিলো অনুষ্ঠানের অন্যতম প্রধান আকর্ষন।
আরেকটি প্রধান আকর্ষন ছিলো কিশোরগঞ্জ সাহিত্য পরিষদ-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আশরাফুল ইসলাম সাহেবের ৮৯ বছর বয়স্কা, অশিথিপর বৃদ্ধা মাতার দীর্ঘ ২৭ মিনিটের বক্তৃতা। অনর্গল তিনি ফার্সী, উর্দু ও নাগরী বলে যাচ্ছিলেন। এবং বৌলাই বাড়ীর কৃতি সন্তান কবি মনিরউদ্দীন ইউসুফ-এর পূর্বপুরুষ ও উত্তর পুরুষদের নাম ধরে ধরে বৌলাই বাড়ির ইতিহাস তিনি বর্ণনা করছিলেন যে সে এক অসাধারণ ব্যাপার। কবি সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবিরা বৃদ্ধার ফার্সী, উর্দু, নাগরী কবিতা ও কথাবার্তা তন্ময় হয়ে উপভোগ করছিলেন যেনো বৌলাই বাড়ির প্রাচীন কীর্তির মতো এক জীবন্ত কিংবদন্তির সন্ধান পেয়ে গেছে সবাই॥
উক্ত বৃদ্ধার কন্ঠে ফার্সী বয়ানই প্রমাণ করে আমাদের ঐতিহ্যের সাথে ইরানের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সম্পর্ক কতটা নিবিঢ়। বিষয়টি সেদিন রেডিও তেহরানেও প্রচারিত হয়েছিলো।
ঐ অনুষ্ঠানের আরেকটি আকর্ষণ ছিলো কবি বেলাল চৌধুরীকে মনিরউদ্দীন পদক ও সম্মাননা প্রদান করা হয়েছিলো। উম্মুক্তভাবে চলছিলো আলোচনা, কবিতা আবৃত্তি, গান ও স্মৃতিচারণ। দিনটি শুক্রবার হওয়ায় জুমার নামাজ ও মধ্যান্যভোজের বিরতি দেয়া হলো। আমরা বৌলাইবাড়ির জামে মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করলাম। নামাজের পর জহির ভাই, আমি, অধ্যাপক সিরাজুল হক, ড. কে এম সাইফুল ইসলাম খান ও হুজ্জাতুল ইসলাম আবদুল কুদ্দুস বাদশা ভাই কবি মনিরউদ্দীন ইউসুফ-এর পূর্বপুুরুষ জনৈক মহান ব্যাক্তির কবরের পাশে ফার্সী ভাষায় লেখা প্রাচীন শিলালিপি দেখছিলাম। কুদ্দুস বাদশা ভাই এবং কে এম সাইফুল ইসলাম ভাই সেই শিলালিপিটির পাঠোদ্ধার করছিলেন এবং আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। কিন্তু একটা অংশ অস্পষ্ট থাকায় বোঝাঁ যাচ্ছিলো না। ড. কে এম সাইফুল ইসলাম খান সেটি মোটামুটি ধরতে পেরেছেন এবং এর ভাবার্থ আমাদের কাছে পেশ করছিলেন। আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিলো যা ছিলো আরো জমজমাট আয়োজনের। যা ছিলো অধিক উপাদেয়্। সেটি ছিলো বনেদী পরিবারের বনেদী মধ্যাহ্নভোজ। এর কৃতিত্ত্ব পুরোটাই কবি পরিবারের। গরু বা মুরগীর গোস্তের চেয়ে আমার কাছে আকর্ষনীয় মনে হয়েছিলো রুই মাছের বড় বড় খন্ডগুলো। আসলে ভোজনের চেয়ে পরিবেশষনের সৌন্দর্যটাই উপভোগ্য ছিলো বেশী। সত্যিই তা ছিলো রাজকীয় ব্যাপার। বৌলাই জমিদার বাড়ির ঠাট মান যেনো আবারো আমরা অনুভব করেছিলাম।
আসলে কবি মনির উদ্দীন ইউসুফ-এর পূর্বপুরুষরা ছিলেন মোঘল ও পাঠান উভয় ধারার সাথে সংযুক্ত। ইশা খান, সোনারগাও কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ির গবেষণার ভেতর দিয়ে তাদের পূর্বপুরুষদের পরিচয় বেড়িয়ে আসে। আর সেকারণেই ফার্সি ভাষা ও সাহিত্যের সাথে ছিলো তাদের পারিবারিক যোগাযোগ।
মধ্যাণ্য ভোজের পর দ্বিতীয়ার্ধের অনুষ্ঠান শুরু হলো। শুরু হলো আলোচনা, পর্যালোচনা, স্মৃতিচারণ, কবির কবিতা থেকে পাঠ, কবিকে নিবেদিত স্বরচিত কবিতা পাঠ। কখন যে দুপুর-বিকেল গড়িয়ে সন্ধা ছুই ছুই করছিলো টের পাইনি আমরা। পশ্চিমাকাশ তখন ডুবন্ত সূর্যেও লাল আভায় রক্তিম হয়ে ওঠেছিলো।
অনুষ্ঠানটা আরো উপভোগ্য হয়েছিলো এ কারণে যে, অনুষ্ঠানটি হয়েছিলো বৌলাই রাজবাড়ির সামনের খোলা প্র্রাঙ্গণে। বৌলাই বাড়িটি একটি প্রাচীন কীর্তি। যদিও তা রাজার আবাস ছিলোনা। কিন্তু প্রাচীন ইমারতকে আমাদের দেশে বিশেষ করে জমিদার বাড়িকে রাজবাড়িই বলা হয়ে থাকে।
চা বিরতির পর আবার অনুষ্ঠান চললো। শুরু হলো পালা পরিবেশন ও বৃন্দ আবৃত্তি। ্এর পর মাগবেবের নামাজের বিরতি। মাগরেবের নামাজের পর অনুষ্ঠান আরো অনেকদূর গড়িয়েছিলো। অনুষ্ঠান শেষে আমরা ক’জন অর্থাৎ আমি, জহির ভাই, কুদ্দুস ভাই, সাইফুল ভাই, গবেষক আবদুল হাই ভাই, আবুল কালাম মোহাম্মদ ইলিয়াস অধ্যাপক সিরাজুল হক সাহেব আমাদের নির্দিষ্ট মাইক্রোতে এসে ঢাকার উদ্দেশ্যে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। আমাদের যেতে হবে অনেকদূর। আমাদের সাথে এবার অতিরিক্তিভাবে যুক্ত হয়েছেন কবি বন্ধু মুহিবুর রহিম। তিনি অবশ্য ব্শ্বিরোডের মাথায় বি-বাড়িয়ার পখে নেমে গেছেন। তিনি বি-বাড়িয়া কলেজের অধ্যাপক।
আমরা কিশোরগঞ্জ যাওয়ার পথে জ্যাম আমাদের বাধা হয়ে না দাড়ালেও ঢাকার কাচপুরে এসে যে ভয়াবঞ ও দূর্বিসহ জ্যামের মূখে পড়েছিলাম তা আমার জীবনের অনেকগুলো দূঃসহ অভিজ্ঞতার অন্যতম ছিলো। কিশোরগঞ্জ থেকে কাঁচপুওে আসতে সময় লাগলো তিন ঘন্টা আর কাঁচপুর থেকে শাহবাগ আসতে সময় লেগেছিলো সাড়ে চার ঘন্টা একেবারে দূর্বিসহ অবস্থা। কিন্তুু আমাদের কাছে তার কিছুটা কষ্ট কমিয়ে দিয়েছিলো অধ্যাপক সিরাজুল হক সাহেবের নানা কৌতুকময় অভিজ্ঞতার আলাপচারিতা শুনতে শুনতে। তার পরও বলবো ‘কবিতীর্থ বৌলাই বাড়িতে সেদিনের সেই উৎসব আর এ উপলক্ষে মজাদার ভ্রমণটি ভ’লবার নয়।কারণ সেটি ছিলো আমার জীবনে প্রথম কোন কবির জন্মভুমি দর্শন। প্রার্থনা শুধু এই যে আল্লাহপাক কবি মনিরউদ্দীন ইউসুফকে জান্নাতে রাখুন শান্তিতে কেবল একারণে যে তিনি ছিলেন আমাদের জাতীয় সাহিত্যের এক বড় খাদেম।

আমার ইরান ভ্রমণ

সাবিনা সিদ্দিক

ঘুম ভাঙার পর সকালে প্রথম যে চিন্তাটা মাথায় এলো তা হলো- আমি এখন কোথায়?
তেহরান? মাসহাদ? কোম? ঢাকা?
অবশেষে বুঝলাম আমি ঢাকায়। গত কয়েকদিন এমনভাবে তেহরান, কোম আর মাসহাদ ঘুরেছি যে, মনে হয় ঘুমের জন্য দুঘণ্টাও সময় পাইনি। তাই ঢাকায় ফিরে প্রথমেই একটা লম্বা ঘুম দিলাম।
ওংষধসরপ ঈঁষঃঁৎব ধহফ জবষধঃরড়হ ড়ৎমধহরুধঃরড়হ আয়োজিত ৬ঃয জবভৎবংযবৎ ঈড়ঁৎংব ড়হ ডড়সবহ ধহফ ঋধসরষু ঝঃঁফরবং চৎড়মৎধস এ অংশগ্রহণ করতে ইরান গিয়েছিলাম। হাফিজ, ফেরদৌসী, সা’দী, রুমীর ইরান। যে ইরান সেই ছোটবেলা থেকেই মনের মধ্যে স্বপ্নের দেশ হয়ে জেগে ছিল। ঠিক কবে প্রথম আমি ইরানকে ভালোবেসেছিলাম মনে করার চেষ্টা করি।
আমাদের বাড়িতে সাহিত্যচর্চা চলত খুব। বিভিন্ন গল্পের আর কবিতার বই, পত্রিকা, নিউজপেপার, এসব নাড়াচাড়া করেই বড় হয়ে উঠছিলাম। একদিন বড় ভাইয়ের টেক্সট বইয়ে পেলাম হাফিজের স্বপ্ন কবিতা। ভাই পড়তেন আর আমরা শুনতাম। স্বপ্নে কবি হাফিজের কাছে যে মেয়েটি এসেছিল- ‘আংগুরের মতো অলোক গুচ্ছে গোলাপের মালা পড়ি’, তাকে আমার অতিশয় আপন করে নিজের মূর্তিতে আনার চেষ্টায় একমাত্র বাধা হয়ে দাঁড়াতো আমার চুল।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অনবদ্য অনুবাদের কারণে অনেক ফারসি কবিতা বাংলায় পড়ার সুযোগ হয়েছে। ইরানের কবিদের কারণে ইরানের প্রতি টান দিন দিন বাড়ার সাথে সাথে একটা অপূর্ণতা সব সময় ছিল, তা হলো ভাষা। মনে হতো, ‘আহা যদি ফারসিতে কবিতাগুলো পড়তে পারতাম!’ একদিন সেই সুযোগও এসে গেল।
ওৎধহ ঈঁষঃঁৎধষ ঈবহঃৎব এ ভাষা শিক্ষা কোর্সে ভর্তি হলাম। জুনিয়র ও সিনিয়র কোর্স শেষ করলাম। তখন একটু একটু ফারসি পারি। সামান্য কথোপকথন। পরিচয়, নাম বলা অথবা কুশল বিনিময়। আমি শিক্ষকদের বার বার বিরক্ত করি এটা জিজ্ঞেস করে যে, কবে সাহিত্য, কবিতা পড়ব, কবে বই পড়ে বুঝব। উনারা বলেন, ‘ধৈর্য ধরেন। উরঢ়ষড়সধ ঈড়ঁৎংব করলে তখন কবিতা বুঝবেন।’
একদিন ফোন এলো ওৎধহ ঈঁষঃঁৎধষ ঈবহঃৎব থেকে। উরঢ়ষড়সধ শুরু হচ্ছে। আর ঞবধপযবৎ একজন ইরানী খানুমে খসরুয়াবাদী। আমি একদিনও নষ্ট না করে ভর্তি হয়ে এলাম।
ক্লাস শুরু হলো। অত্যন্ত হতাশ হয়ে লক্ষ্য করলাম যে, ক্লাসের পড়া আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। এমনকি শিক্ষক মিসেস খসরুয়াবাদীর ভাষাও ধরতে পারছি না। (গত চার বছরে) জুনিয়র ও সিনিয়র কোর্সে যা কিছু শিখেছিলাম চর্চার অভাবে সব ভুলে গেছি। অন্যান্য ছাত্রছাত্রীর অসুবিধা হচ্ছে না। কারণ ওরা ওদের পূর্বের কোর্স শেষ হবার সাথে সাথে উরঢ়ষড়সধ ঈড়ঁৎংবটা পেয়েছে। আমার মতো চার বছর গ্যাপ হয়নি। আমি মন খারাপ করে ক্লাসে যাই। আবার মন খারাপ করে বাসায় ফিরি। মনে হয় আমার আর কোনদিন ফারসিতে কবিতা পড়া হবে না। ভাষাটাও জানা হবে না। কিন্তু আমি ক্লাসে যাওয়া বন্ধ করি নি। চুপচাপ ক্লাসে বসে থাকি আর ম্যাডামের কথা শুনি। এভাবে চলতে চলতে হঠাৎ একদিন মনে হয়, আমি হারব না। আমাকে পারতেই হবে। এতদূর এসে আমি হাল ছেড়ে দিতে পারি না। আমি আমার দিন-রাত এক করে ফেললাম। সারাক্ষণ পড়তে থাকলাম। বাংলা ও ফারসি ভালো জানেন এমন অনেকের সাহায্য নিলাম। আমার ক্লাসের বইয়ের পড়া বোঝার জন্য ম্যাডামও অনেক সাহায্য করলেন।
ধীরে ধীরে আমার চোখের সামনে উন্মুক্ত হতে থাকল এক নতুন ইরান। এ যেন স্বপ্নের চেয়েও আশ্চর্যময়। কবিতার চেয়েও রহস্যময় এক বিপুল ধনরতœ সমৃদ্ধ ঞৎবধংঁৎব ওংষধহফ। প্রাকৃতিক, ঐতিহাসিক আর সাহিত্যের এত এত ধনরতœ নিয়ে নিভৃতে বসে আছে। আমি অভিভূত হয়ে গেলাম যখন পড়লাম ফেরদৌসীর সেই বিখ্যাত কবিতা-
توانا بود هرکه دانا بود
زگهواره تاگور دانش بجوی
জ্ঞানই শক্তি। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অšে¦ষণ করো।
অথবা ওমর যৈয়মের কথাই
اسرار ازل را ن تو دانی و نه من
وین حل معما نه تو دانی و نه من
পরকালের রহস্য না তুমি জানো, না আমি….
আবার কখনো হাফিজের
اگر آن ترکی شرازی به دست آد دل مارا
به خاله هند ویش بخشم سمرقند و بخارا را
যদি সিরাজ শহরের সেই তুকি মেয়ে আমার হৃদয়ে আসে তবে তার কালোতিলের বিনিময়ে বিলিয়ে দিব সামারখান্দ, বোখারী
অথবা সাদীর
بنی آدم اعضای یک پیکرند
کم در آفرینش ز یک گوهرند
সকল মানব জাতির এক।
এভাবে একে একে হাফিজ, ফেরদৌসী, সা’দী, খৈয়াম, বাহসি বাফি, রাহী মোয়ায়ীরি ছাড়িয়ে প্রাকৃতিক ইরানে ঘুরেছি কল্পনায় যা কিনা এশিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত একটি অপূর্ব দেশ। এর উত্তরে আযারবাইজান, আর্মেনিয়া, তুর্কমানিস্তান, পূর্বে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, পশ্চিমে তুর্কি ও ইরাক অবস্থিত।
পারস্য উপসাগর ও এর দ্বীপগুলো রয়েছে দক্ষিণে যেখানে প্রচুর তেল ও গ্যাস রয়েছে। কাস্পিয়ান সাগর আলবোর্জ পর্বত, জঙ্গল নিয়ে উত্তর সেজেছে তার আপন সৌন্দর্যে। কেন্দ্র ও পূর্বে রয়েছে এর লবণাক্ত মরুভূমি। তাই প্রায় সাত মিলিয়ন জনসংখ্যার অধিকাংশই বাস করে পশ্চিম-উত্তরে।
ইন্দো-ইউরোপীয়ান থেকে আর্য, তারপর ইরানী হয়ে ওঠা এই জাতির ইতিহাসত ও সভ্যতা অতি সমৃদ্ধ। সাহিত্য, চিকিৎসাবিদ্যা শিল্প, স্থাপনা কোন কিছুতেই কম নেই। এখানে ইসলাম-পূর্ব এবং ইসলাম-পরবর্তী দুই যুগে ভাগ হয়ে আছে এর সংস্কৃতি।
ইসলাম-পূর্ববর্তী চারটি বিশাল সাম্রাজ্যের কিছু ধ্বংসাবশেষ আজো সংরক্ষিত রয়েছে। যেমন হাখামানেশি শাসকদের উৎসবের মূল ভবন শিরাজের তাখ্তে জামশীদÑ যা উৎসবের মূলভবন এবং বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিবর্গের অভ্যর্থনা কক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। আলেকজান্ডার ইরান জয় করে এতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আর রাজন্ডুত্র দায়িয়ুসের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে বলে, ‘ভেঙে ফেল এর কবর। আমাকে দেখাও, সে এমন কী ছিল যে, সারা পৃথিবী শাসন করেছে!’
একটা ঘোরের মধ্যে কখন যেন ছয় মাস পার হয়ে গেল আর আমার উরঢ়ষড়সধ’র ফাইনাল পরীক্ষাও শেষ হয়ে গেল। রেজাল্ট আনতে গেলাম। দেখি ম্যাডাম হাসছেন। আমাকে নিজে নিয়ে গেলেন নোটিশ বোর্ডের সামনে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না আমি, ৯৬% নাম্বার পেয়েছি। আর আমি ম্যাডামের সাথে ফারসিতে কথা বলছি আর উনার কথা বুঝতেও পারছি।
আমার অবাক হবার আরো বাকি ছিল। ম্যাডাম বললেন, ‘একমাস পর তেহরানে একটা ডড়ৎশংযড়ঢ় হবে। বাংলাদেশ থেকে আমরা তোমার নাম পাঠাচ্ছি। প্রস্তুতি নাও তুমি সিলেক্ট হয়ে গেলে যাবে তো?’ আমি আনন্দে কিছু সময়ের জন্য বোবা হয়ে গেলাম। ঘরে ফিরলাম এক অদ্ভুত অনুভূতি নিয়ে।
এরপর একদিন জানতে পারলাম যে, ইরান থেকে আমাকে সিলেক্ট করা হয়েছে। ইরানের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দাওয়াতপত্রও চলে এলো একদিন। ৬ই অক্টোবর ২০১৫ আমি তেহরান পৌঁছলাম। আমার যাত্রা ছিল ঢাকা থেকে দুবাইতে ট্রানজিট নিয়ে সেখান থেকে তেহরান। বিশাল এমিরেট-এ বসে আছি। জানালা দিয়ে আকাশ দেখছি। সকাল ১০.১৫ তে ফ্লাইট ছিল, কিন্তু এক ঘণ্টা লেইট। আমার তেহরান পৌঁছতে সন্ধ্যা ৭টা বেজে যাবে। আমি এই প্রথম একা দেশের বাইরে এতদূর যাচ্ছি। একটুও ভয় করছে না। মনে হয়, ইরান যাচ্ছি সেই জন্য। আনন্দ এত বেশি ছেয়ে আছে যে, মনের মধ্য ভয়ের কোন জায়গা নেই। আরেকটা ব্যাপার কাজ করছে, তা হলো মনে হচ্ছে খুব চেনা খুব আপন কোন জায়গায় যাচ্ছি।
তেহরান এয়ারপোর্টে নেমে খুব ভালো করে মাথায় স্কার্ফ জড়িয়ে নিলাম। কারণ, মেয়েদের হিজাব এখানকার নিয়ম। একটি কাগজে ফারসিতে আমার নাম লিখে অপেক্ষা করছিলেন জনাব লুতফি। আমি কাছে গিয়ে পরিচয় দিতেই উনি হাসিমুখে আমাকে নিয়ে গেলেন একটি অপেক্ষমাণ বাসের দিকে। সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল পাকিস্তান ও ভারত থেকে আগত মেয়েরা। ওদের ফ্লাইট আমার আগে পৌঁছেছে, তাই ওরা আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
রাতের অন্ধকারে বাস ছুটে চলেছে তেহরানের পথে। তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না, তবু আমরা খোলা জানালায় স্কার্ফ উড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকি। ঠা-া বাতাস, তবে সহনীয়।
উধহবংয চধলড়ড়যধহ ঈড়সঢ়ষবী এ পৌঁছলাম অনেক ক্লান্তি নিয়ে। এর মধ্যেই নিজেদের মধ্যে পরিচয় আলাপ সেরে নিচ্ছি। প্যাকেট ডিনার সাথে নিয়ে রুমে পৌঁছলাম। ক্ষিদে নেই একদম। বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। অন্ধকারেও বোঝা গেল সামনে খোলা চত্বর। রাস্তায় আলো জ্বলছে। মনে হলো যেন সামনে উঁচু পাহাড়। আমার রুম এগারো তলায়। এত উঁচু থেকে রাস্তা ও বাড়ির আলোগুলো বিন্দুর মতো মনে হলো। বাতাসে নতুন শহরের গন্ধ। আমি এই শহরের প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ করব।
ঘুম ভাঙল অনেক ভোরে। তখনও অন্ধকার, পুরোপুরি সকাল হয়নি। আমার রুমমেট পাকিস্তানের নাদিন নামায পড়ছে আর ওর সঙ্গী রেজিয়া কোরআন শরীফ পড়ছে। আমিও ওজু করে নামায ও কোরআন পড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। রাতের ধারণাই ঠিক। সামনে বিশাল পাহাড়। রাস্তা এঁকে-বেঁকে চলে গেছে পাহাড়ের মধ্য দিয়ে। এক কথায় অপূর্ব!
একটা ফ্লোর ওপরেই আমাদের নাস্তার আয়োজন। তার পাশের রুমেই অডিটোরিয়াম হল। নান, বাটার, পনির, দুধ, চা, মধু খেয়ে আমরা ওরিয়েন্টেশনে উপস্থিত হই।
আমাদের ঐড়ংঃ মিসেস হেজদি উধহবংয চধুযড়ড়যধহ ঈড়সঢ়ষবী-এ বেলা ১১টায় আমাদের পরস্পরের সাথে পরিচয়ের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সূচনা করলেন।
উৎ. ঔধারফ এবং গং. ঝযধয গড়ৎধফর প্রথম যে খবপঃঁৎবটি দিলেন তার বিষয় ছিল অহ ধহধষুংরং ধহফ ংঢ়বপরভরপধঃরড়হ ড়ভ যঁসধহ ৎরমযঃং ভৎড়স ঃযব ঢ়বৎংঢ়বপঃরাব ড়ভ ওংষধস ধহফ ঃযব ডবংঃ রিঃয ধহ বসঢ়যধংরং ড়হ ড়িসবহ’ং ৎরমযঃং.
খবপঃঁৎব-এ আমরা সব দেশ অর্থাৎ ইরান, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত সবাই অংশ নিলাম।
দুপুরের খাবার সবাই একসাথে খেতে বসলাম। একটা প্লেটে রাইস সাথে মাছ। আমাদের দেশের মতো ঝোল নয়, অনেকটা তন্দুরির মতো ফ্রাই। রাইসটাও খুব চিকন চালের এবং জাফরান মাখানো। সাথে ছোট একটা রসালো লেবু দু’টুকরো করা। একপাশে আলু সেদ্ধ আর কয়েকটা ছোট ছোট জলপাই সেদ্ধ। আরেকটি বাটিতে বেশ কিছু সব্জি, যেমন বাঁধা কপি, ক্যাপসিকাম, গাজর, শশা ইত্যাদি থাকে থাকে সুন্দর করে কেটে সাজানো। আরেকটা ছোট বাটিতে দই। আর কোল্ড ড্রিংকস। এই হলো লাঞ্চ। খুবই স্বাস্থ্যকর।
বিকালের প্রোগ্রাম ছিল প্রেস টিভি ভিজিট। আমরা বের হয়ে এলাম দিনের আলোয়। ঠবষবহলধশ ঝঃ. এর উধহবংয ঢ়ধুযঁযধহ ঈড়সঢ়ষবী যেটাকে বলা হয় চবধপশ ড়ভ ঃযব হড়ৎঃয ড়ভ ঞবযৎধহ.
দিনের আলোর যেন ঝলমল করছে উড়ৎসরঃড়ৎু প্রাঙ্গন। নিচে ফুলের বাগান। কত রকম যে গোলাপ সেখানে! লাল, সাদা, হলুদ… আমরা অবাক হয়ে চারদিক দেখতে থাকলাম। ইরানে এখন فصل پایيز অর্থাৎ শরৎ ঋতু। আকাশও শরতের মতো হালকা সাদা মেঘ আর নীলে ভরা। মৃদু মন্দ বাতাস। বিকেলের পড়ন্ত রোদের আভা ছড়িয়েছে কাছের পাহাড়ে। এত কাছে যে রাস্তা পার হলেই ছোঁয়া যাবে। আর এত উঁচু যে, ওপারের আকাশ ঢেকে গেছে।
আমরা মুগ্ধ হয়ে চারদিক দেখতে দেখতে বাসে উঠলাম। তেহরান শহরের মধ্য দিয়ে বাস চলছে। আমি অবাক হয়ে ভাবছি যে, সত্যিই আমি এখন ইরানে আছি! তখনও সন্ধ্যা হয়নি। পড়ন্ত বেলার হালকা আলোয় দেখা গেল রাস্তার পাশের কৃত্রিম ঝরনা, গোলাপ বাগান আর কাশফুল। ইরানে কাশফুল হয় দেখে খুব ভালো লাগলো। হালকা বাতাসে দুলতে থাকা কাশ ছাড়িয়ে আমাদের বাস এগিয়ে চলল।
আমরা চৎবংং ঞঠ ঐবধফয়ঁধৎঃবৎ পৌঁছলাম। তখন মাগরিবের আযান হচ্ছে। ‘ঘবংি অহব’ি ঝষড়মধহ নিয়ে আট বছর আগে ২০০৭ সালের ৪ জুলাই ওংষধসরপ জবঢ়ঁনষরপ ড়ভ ওৎধহ-এর এই ডড়ৎষফরিফব ঊহমষরংয ইৎড়ধফপধংঃরহম ঈযধহহবষ শুরু হয়, যেখানে রয়েছে ঊহমষরংয হবংি এবং উড়পঁসবহঃধৎু হবঃড়িৎশ, ষরাব ঢ়ৎড়মৎধস। সারা পৃথিবীতে এদের অফিস ও ব্যুরো রয়েছে, যেমন খড়হফড়হ, ইবরৎঁঃ, উধসধংপঁং, কধনঁষ এবং এধুধ ঝঃৎরঢ়, এমনকি বাংলাদেশেও এদের সাংবাদিক রয়েছে।
চৎবংং ঞঠ-এর মূল রহস্য হলো এরা সত্য খবর প্রচার করে। এদের খবর এতই বিশ্বাসযোগ্য যে, ঈঘঘ ও ইইঈ এদের কাছ থেকে খবর কিনে নেয়।
আমরা খরাব ঝঃঁফরড় দেখছিলাম। এৎববহ ঈড়াবৎ করা বিশাল ঝঃঁফরড়, পেছনে বিশাল ঞঠ ঝপৎববহ। ঠিক মাঝখানে খবর পাঠকের বসার স্থান। তাঁর পায়ের কাছে একটা ঝঃধহফ, সেটাতে প্রয়োজন মতো চাপ দিয়ে নিজেই স্ক্রিন থেকে লেখা খবরগুলো গড়াব করতে পারেন।
আমাদের কথার মধ্যেই খরাব খবরের সময় হয়ে এল। আমরা কাঁচের ঘরের একপাশে ফিরে এসে দেখলাম পাঠক খবর পড়ছেন আর অন্যদিকে পেছন ফিরলেই দেখতে পেলাম ঞঠ-তে তাঁর খবরটি প্রচার হচ্ছে। পরদিন সকাল ১০টায় আমরা নির্ধারিত বাসে চড়ে ঐড়ষু ঈরঃু ছড়স এর দিকে রওয়ানা হলাম। প্রথমে ডড়সবহ ধহফ ঋধসরষু ঝঃঁফরবং ঈবহঃৎব ঠরংরঃ করলাম। এদের জবংবধৎপয ঈবহঃৎবটি খুবই সমৃদ্ধ আর বিশাল। মাশহাদের পরে কোমকে ২য় ঐড়ষু ঈরঃু বলা হয় ইরানে।
তখন প্রায় দুপুর। আমরা পথের ধারের ব্যাংকে আমাদের উড়ষষধৎ বদলে জরধষ করে নিলাম। তখনও আমরা কেউ ইরানী সীম কার্ড পাইনি। অপেক্ষা করছি, কোন একটা সুযোগে কিনে ফেলতে হবে।
রাস্তার ওপারেই ঞযব ঐড়ষু ঝযৎরহব ড়ভ খধফু ঋধঃরসধ গধংঁসবয (ঝঅ)। এর অপূর্ব কারুকাজ সত্যি মুগ্ধ করার মতো। যিনি ছিলেন ৮ম ইমাম রেযা (আ.)-এর বোন। আমরা ঝযৎরহব’ং জবংঃধঁৎধহঃ এ খঁহপয করে মাযারের ভেতরে গেলাম। মাযারের প্রতিটি দেয়ালে কারুকাজ। বিশাল চত্বর। আমরা আমাদের নামায সেরে মাযার যিয়ারত করে জবংধষধঃ ওহংঃরঃঁঃব-এ এলাম গং. ঞঁৎশরধহ এর ‘গড়ফবংঃু ধহফ ঐরলধন রহ ওংষধস ধহফ ঃযব অংরধ’-এর ওপর খবপঃঁৎব-এ অংশ নেয়ার জন্য। সন্ধ্যায় গেলাম ঔধসশধৎধহ সড়ংয়ঁব।
যামারান যাওয়া খুবই উল্লেখযোগ্য ছিল আমাদের জন্য। তেহরানের উত্তরে এই ছোট শহরটি এক সময় একটি ছোট্ট স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম ছিল। এর সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো এটি ইরানের ইসলামী বিপ্লবের মহান নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেইনী (রহ.)-এর বাড়ি এবং ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ওহংঃরঃঁঃব ড়ভ উরধষড়মঁব অসড়হম ঈঁষঃঁৎবং ধহফ ঈরারষরুধঃরড়হং-এর অবস্থান ঔধসধৎধহ ঈড়সঢ়ড়ঁহফ এর মধ্যেই।
ভ্রমণের মধ্যেই আমরা কখনো বইয়ের দোকান, কখনো বাজার সবই ছুঁয়ে যাচ্ছি একটু করে। আমাদের মধ্যে অনেকেই কখনো বই কিনছি, কখনো পেস্তা, জাফরান বা মিষ্টি গজ যার যা পছন্দ ইরানের ঐতিহ্যবাহী খাবার কিনে নিচ্ছি।
আমি সারাক্ষণ খুঁজছি হস্তশিল্পের দোকান। গাইডদের বার বার মনে করে দিচ্ছি صنايع دستى বলে। ওরা হেসে জবাব দিচ্ছে যে, সময় হলেই নিয়ে যাবে।
আমাদের সাথে দু’জন ঞৎধহংষধঃড়ৎ ছিলেন। একজন ইরানী; তাঁর নাম এলহাম। আর একজন কুর্দি, নাম শিরিন। দু’জনই এত মিশুক যে, দু’জনের সাথেই বন্ধুত্ব হয়ে গেল। আর সুযোগ পেয়ে ফারসিতে কথা বলতে থাকলাম। কখনো ফারসি কবিতা-গান, কখনো ইতিহাস। ওরা প্রায়ই বলত, ‘তুমি তো দেখছি ইরানের অনেক কিছু জান।’ এলহামের ঠোঁটের ওপর একটা সুন্দর তিল। আমি ওকে ডাকতাম হাফিজের কবিতার تركى شرازى বলে। এভাবে দিন দিন আমাদের বন্ধুত্ব বেড়ে চলল। সন্ধ্যায় গেলাম মিলাদ টাওয়ার বা برج ميلاد দেখতে। একে ঞবযৎধহ ঞড়বিৎ-ও বলা হয়। ২০০৭ সালে নির্মিত এই টাওয়ারটি ঝযধযৎধশ-ব এযধৎন এবং এরংযধ ফরংঃৎরপঃ এর মাঝে অবস্থিত। এর উচ্চতা মাটি থেকে অ্যান্টেনা পর্যন্ত ১.৪২৭ ফিট। এর একেবারে ওপরে ১.০৩৩ ফিটের কাছে রয়েছে ১২তলা। যেখানে ঋরাব ঝঃধৎ ঐড়ঃবষ, ঈড়হাবহঃরড়হ ঈবহঃৎব, ডড়ৎষফ ঞৎধফব ঈবহঃবৎ এবং ওঞ চধৎশ সত্যি দেখার মতো! ওপর থেকে আলো জ্বলা শহর দেখতে খুবই চমৎকার!
একেবারে ওপর তলায় ট্রেড ফেয়ার চলছিল। আমি ঘুরতে ঘুরতে দেখি একটি ছোট দোকানে সারি সারি সাজানো আংটি। প্রতিটিতে সুন্দর সুন্দর কবিতা লেখা। গাইড বলল, ‘এগুলো নিও না, এখানে অনেক দাম।’ আমি একটা আংটি তুলে দেখলাম। খুব সুন্দর। কবিতাটা ক্যালিগ্রাফিতে লেখা, তাই বুঝতে পারছি না। অর্থ জিজ্ঞেস করতেই গাইড বলল, “এখানে লেখা আছেÑ ‘তুমি পাশে থাকলে আমি দশটা মরুভূমি আনায়াসে পার হয়ে যেতে পারব।” বললাম, ‘যত দাম হোক, এটা আমি নিবই।’
আমার হাজবেন্ডের জন্য আংটিটি স্যুভেনির হিসাবে নিয়ে আমার খুবই ভালো লাগল। এর চেয়ে ভালো বাক্য আর কি হতে পারে যা আমি তাকে বলতে পারি? আজ তার জন্যই তার সহযোগিতার কারণেই আমি আমার স্বপ্নের ইরানে আসতে পেরেছিÑ যেটি আমার কাছে দশটি মরুভূমি পার হবার মতোই।
পর পর দু’দিন কাটল আমাদের খবপঃঁৎব, আলোচনা আর মাঝে মাঝে মার্কেট ও বাগানে ঘুরে। উৎ. ঘধভরংর-এর ডড়সবহ’ং ঝঃধঃঁং ধহফ জরমযঃং রহ ছঁৎধহরপ ঠবৎংবং ধহফ ঃযব চৎড়ঢ়যবঃরপ খরভব ঝঃুষব ঞৎধফরঃড়হ, উৎ. গড়বরহর ঋধৎ এর জড়ষবং ধহফ জবংঢ়ড়হংরনরষরঃরবং ড়ভ ডড়সবহ ধহফ ঋধসরষু জবষধঃবফ ঐধৎসং এবং গৎ. ঝড়ফধমধৎ এর অহ ঊীঢ়ষধহধঃরড়হ ড়ভ ঃযব ওংষধসরপ খবমধষ ঝুংঃবস রহ ঃযব ঋরবষফ ড়ভ ডড়সবহ ঈড়সঢ়ধৎধঃরাব অহধষুংরং ড়ভ ডড়সবহ’ং জরমযঃং রহ ওংষধস ্ ঃযব ডবংঃ ও সেই সাথে ডড়সবহ রহ জবষরমরড়ঁং ঊঢ়রংঃবসড়ষড়মু ধহফ খবমধষ ঝুংঃবস-এর ওপর খবপঃঁৎব, আলোচনা-সমালোচনা ও বিভিন্ন মত বিনিময়ের মধ্য দিয়ে।
সারা দিন আমরা সময় পেতাম না। রাতে এত ক্লান্ত থাকতাম যে, বিছানায় শোয়ামাত্রই ঘুম। কিভাবে যে দিনগুলো কাটতে থাকল! এর মধ্যেই হাসি-আনন্দ নিয়ে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইরান, ভারতের সঙ্গী-সাথিরা মিলেমিশে এক হয়ে এক পরিবারের মতোই হয়ে গেলাম। কেউ অসুস্থ হলে তার দেখাশোনা, কেউ খেতে না পারলে তার জন্য অন্য খাবার জোগার করাÑ যেন এই বিদেশ বিভূঁইয়ে পরিবার-পরিজন ছেড়ে আসা মানুষগুলো কেউ নিজেকে একা মনে না করে।
রাতে আমরা পার্কে গেলাম। এত রাতেও পার্কে এত মানুষ! ছেলে-মেয়ে স্বাধীনভাবে ঘুরছে। গাইডকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখানে মেয়েদের নিরাপত্তা কেমন?’ গাইড গর্ব করে বলল, ‘কোন অসুবিধা নেই, যত রাত ইচ্ছা পার্কে থাক, কেউ কিছু বলবে না। মেয়েরা এখানে নিরাপদ। এটা ইরান।’ শুনে খুবই ভালো লাগল।
কবে যে আমরাও এমন গর্ব করে বলতে পারব, ‘মেয়েরা এখানে নিরাপদ, এটা বাংলাদেশ।’
খুবই ইন্টারেস্টিং ছিল গৎং গধফধহর-এর ঞযব ওসঢ়ধপঃ ড়ভ ঃযব গবফরধ ড়হ খরভবংঃুষব রহ এবহবৎধষ ্ ওংষধসরপ খবপঃঁৎবটি। আমেরিকার তৈরি কার্টুনগুলো কিভাবে শিশুমনে ওহফরারংঁধষরঃু-কে স্থাপন করে দিচ্ছে অথবা ওংষধসরপ ঐবৎড়-দের কিভাবে তাদের মন থেকে সরিয়ে সেখানে একই গল্প দিয়ে সাধারণ কোন জন্তু বা সেই রকম কোন প্রাণীকে স্থাপন করছে তা সত্যিই শিক্ষামূলক ও সচেতনতামূলক।
গং অষধংাধহফ-এর খবপঃঁৎব-এর বিষয় ছিল অ ঈৎরঃরপধষ জবারবি ধহফ অহধষুংরং ড়ভ ঃযব উড়পঁসবহঃং ধহফ ওহঃবৎহধঃরড়ধষ ঈড়হাবহঃরড়হ ড়হ ডড়সবহ ধহফ ঋবসরহরংস এবং উৎ তধৎরভধহ বললেন খরভবংঃুষব নিয়ে। আমরা উরহহবৎ-এ গেলাম শহরের মেয়রের মি. রেযায়ীর আমন্ত্রণে।
সময় ফুরিয়ে যেতে থাকল। তেহরানে অবস্থানের শেষ দিন চলে এলো। আমি সেই রাতে ঞৎধহংষধঃড়ৎ শিরিনের রুমে ছিলাম। এলহাম একদিনের জন্য জরুরি কাজে ওর বাড়িতে গেছে। শিরিন ওর রুমে একা। আমরা এশার নামায শেষে যে যার রুমে ঘুমাতে যাচ্ছি। হঠাৎ দেয়ালে চোখ পড়ল। এতদিন খেয়ালই করিনি। দেয়ালে একটা ক্যালেন্ডার টাঙ্গানো। ফারসিতে মাস ও দিন লেখা আর ওপরে একটা ছবি। প্রাচীন ধ্বংসস্থাপত্য। ওটা তাখ্তে জামশিদ বা চবৎংবঢ়ড়ষরং স্থাপত্যের নিদর্শন। আমি ওটার সামনে দাঁড়িয়ে ছবিটা দেখতে থাকলাম। হঠাৎ কখন শিরিন আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে জানি না। ও জিজ্ঞেস করল, ‘কি দেখছ এত মনোযোগ দিয়ে?’ আমি বললাম, ‘এটা তাখ্তে জামশিদ না?’ শিরিন অবাক হয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, তবে এটাও জান তুমি? আশ্চর্য! তুমি সত্যি করে বল তো, কে তুমি? ইরানের সবকিছু তুমি জান কিভাবে? বলো তুমি কে?’ আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘কাউকে বলবে না, বল?’ শিরিন বলল, ‘না, বলব না।’ বললাম, ‘আমি দারিয়ুসের মা।’ শিরিন আমাকে হাসতে হাসতে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আরে, আমি তো দারিয়ুসের বোন।’ ‘আচ্ছা তাহলে আমাদের দেখা হয়ে গেল’, বললাম ওকে। তারপর দু’জনে ছবির দিয়ে তাকিয়ে কত স্মৃতিচারণ করলাম! ‘সেই দিনগুলো কত সুন্দর ছিল তাই না শিরিন? যখন তাখ্তে জামশিদে উৎসব হতো!’ ‘হ্যাঁ! কত রকম রান্না হতো। সারা প্রাসাদ সাজানো হতো।’ ‘আর বিভিন্ন দেশ থেকে কত রাজারা কত উপহার নিয়ে আসত।’ ‘কি সুন্দর ছিল সেই ইরান।’
আমার মধুর স্মৃতিচারণের মধ্যেই শিরিন বলল, ‘এবার আমার ক্ষিদে পেয়েছে।’
‘তুমি রাতে খাওনি?’
‘না।’
‘কেন?’
‘খেতে ইচ্ছে করছে না। যাই ঘুমাই গিয়ে।’
আমি ওর হাত ধরে ডাইনিং টেবিলের কাছে এনে একটা চেয়ারে বসালাম। ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে আনলাম। তারপর গরম করে প্লেটে এনে বললাম, ‘এবার খাও।’
শিরিন বলল, ‘বিশ্বাস কর, আমি এত ক্লান্ত যে, খাবার চিবিয়ে খাবার শক্তিও নেই।’
‘আমি হাত ধুয়ে এসে বললাম, ‘তাহলে তো তোমাকে খাইয়ে দিতেই হবে।’
শিরিন তো অবাক! ‘আমাকে তুমি খাইয়ে দিবে?’
‘নয়তো কি? তুমি না খেয়ে ঘুমাবে তা কি হয়? বাংলাদেশে আমরা হাত দিয়ে ভাত মেখে খাই।’ এভাবে বলে ভাতের সাথে মাংস ও সালাদ মেখে ওর মুখের সামনে ধরে বললাম, بگو آ !
শিরিন হেসে বলল, آ, আর ওর মুখে আমি ভাত তুলে দিলাম।
শিরিন বলল, ‘এভাবে খাওয়া যায় আমি জানতাম না। দেখ, মাংসটাও কেমন নরম করে দিয়েছ। আশ্চর্য!’
সেই রাতে শিরিন ঘুমালো খুব আনন্দ নিয়ে। আমি খুব শান্তি পেলাম ওর আনন্দ দেখে। পরদিন খুব সকালে ঘুম ভাঙলো না। সাড়ে সাতটায় শিরিনের রুমে গিয়ে দেখি ও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। অথচ প্রতিদিন সকালে সে-ই সবাইকে ঘুম থেকে তুলে সাতটার মধ্যে নাস্তার রুমে নিয়ে আসে। কারণ, সাড়ে আটটায় খবপঃঁৎব শুরু হয়। একরাত শুধু ওকে খাইয়ে দিয়েছি, ব্যস, ও আদুরে বাঙালি মেয়ে হয়ে গিয়েছে। মনে পড়ল, আমি বাড়িতে আমার ইউনিভার্সিটি পড়–য়া মেয়েকে এখনো খাইয়ে দিই। আর ওকে সকালে ঘুম থেকে ডেকে তুলে দিতে হয়।
‘শিরিন ওঠো, সাড়ে সাতটা বাজে।’ আমার ডাক শুনে শিরিন তাড়াতাড়ি উঠে বসল।
‘কি বলো, সাড়ে সাতটা!’ বলে আঁৎকে উঠল ও।
আমরা দু’জন প্রায় ছুটতে ছুটতে ওপরে নাস্তার রুমে এলাম।
চৎবংং ঞঠ-র গৎং ঐধংযবসর-এর খবপঃঁৎব সৌভাগ্যক্রমে সেদিন একটু দেরীতেই শুরু হলো। এরপর উৎ. ঋড়ধফ খুধফর-এর ‘ঞযব অসবৎরপধহ ঈঁষঃঁৎব চড়ষরপরবং রহ ঃযব ডবংঃবৎহ অংরধ জবমরড়হ’। হাতে সময় ছিল খুব কম। আমরা ছুটতে ছুটতে অফসরহরংঃৎধঃরড়হ ঐধষষ-এ পৌঁছলাম। ওখনে আমাদের লাঞ্চ হলো। তারপর উৎ. ঝধফৎর-এর জড়ষব ড়ভ ডড়সবহ রহ ঊফঁপধঃরড়হ খবপঃঁৎব-এর পাশাপাশি ঈষড়ংরহম ঈবৎবসড়হু। ড. হেজদি সত্যিই অভিভূত হয়ে গেলেন যখন আমি তাঁর কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় তাঁকে উপহার দিলাম বাংলাদেশের ঊীঢ়ড়ৎঃ ছঁধষরঃু পোশাক, কোরআন শরীফ, যা একই সাথে বাংলা, ইংরেজি আর আরবিতে লেখা আর সম্প্রতি নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত ৭০তম টঘ অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফলতা ও অর্জনের কিছু ডকুমেন্ট।
সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় নূর ট্রেনে আমাদের মাশহাদ যেতে হবে। আমাদের স্টেশনে পৌঁছতে দেরী হয়ে গেল। যদিও বা আমরা পৌঁছলাম, দেখা গেল আমাদের লাগেজ তখনও এসে পৌঁছায় নি। এলহাম আজই ফিরেছে বাড়ি থেকে।
প্রথমে কথা ছিল এলহাম ও শিরিন আমাদের সাথে মাশহাদ যাবে না। পরে সিদ্ধান্ত হয়েছে ওদের নেয়ার। এতে আমরা সবাই এত খুশি হয়েছি যে, বলার মতো নয়। মাশহাদে কোন পড়াশুনা নয়। শুধু ছুটি, কিন্তু ওরাতো ততদিনে আমাদের কাছে শুধু ট্রান্সলেটর নয়, আমাদের বন্ধু হয়ে গিয়েছে। বন্ধু ছাড়া ছুটিতে কেমন করে মজা করব! তাই শিরিন আর এলহাম শুধু ইরানের অধিবাসী নয়, বাংলাদেশ, ইরান, ভারত আর পাকিস্তান মিলে যে পরিবার সেটার সদস্য।
লাগেজ আসা পর্যন্ত এলহাম, শিরিন ও অন্যান্য গাইড মিলে অনেক অনুনয় বিনয় করে ট্রেন গার্ডকে বোঝালো যে, আমরা ওৎধহ এড়াবৎহসবহঃ-এর মেহমান। আর সত্যিই কাজ হলো। আমাদের লাগেজ আসা পর্যন্ত প্রায় ১০/১৫ মিনিট ট্রেন অপেক্ষা করল।
ট্রেন ছাড়ল। অতি আধুনিক ট্রেন। মেঝেতে কার্পেট বিছানো। একেকটা রুমে চারজন। সেই সাথে চা, বিস্কুট, বাদাম, কেকসহ প্রচুর খাবার। মাথার ওপরে ঘুমানোর জন্য দু’টি বাংকার। নিচে দু’পাশে দু’জন আর ওপরে দু’জন এভাবে চারজন অনায়াসে ঘুমিয়ে রাত পার করে দিতে পারবে। প্রত্যেকের জন্য আলাদা ব্যাগে কম্বল, বালিশ ও রয়েছে।
কিন্তু আমার প্ল্যান তো অন্যরকম। ঠিক করেছি রাতে ঘুমাব না। এখন তো ছুটি, প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ করব। ইরানের রাতের প্রতিটা প্রহর, দিনের প্রতিটা ঘণ্টা আমি পলে পলে সাজিয়ে রাখব আমার স্মৃতিতে।
পাশের কম্পার্টমেন্টে গিয়ে বললাম : ‘কে জাগবে আমার সাথে সারারাত?’ এলহাম ছিল সেখানে। সে হাত তুলে বলল : ‘আমি।’
ওর রুমে পাকিস্তান থেকে আসা তাহসিনা ততক্ষণে গান শুরু করে দিয়েছে। ওদের গান গাইতে দিয়ে আমার রুমে এসে ঠিক মাথার ওপরের ছোট্ট আলোটা জ্বালিয়ে বই পড়তে শুরু করলাম। ঔড়হধঃযধহ ইষধপশ-এর ‘ঞযব ঝবপৎবঃ ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ঃযব ডড়ৎষফ’। বলা হয় উধহ ইৎড়হি তাঁর ‘ঞযব খড়ংঃ ঝুসনড়ষ’ এই বই পড়েই লিখেছেন। বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছি, তাই সারাটা সময়ই শাড়ি পড়েছি। আজ পড়েছি লাল পাড়ের সাদা শাড়ি। রাতে একটু শীত পড়ে তাই লাল পাড়ের সাথে মিলিয়ে লাল কোট। ইরানী যাত্রীরা ঘুরে ঘুরে আমার শাড়ি দেখছে। কেউ কেউ অতি আগ্রহে জিজ্ঞেস করছে ازكجاست؟ মানে কোথা থেকে এসেছ? হেসে বলছি, বাংলাদেশ।
আমার জ্বালানো আলোতে আমার সহযাত্রীদের ঘুমের অসুবিধা হতে পারে ভেবে একটা জায়গা খুঁজছিলাম জেগে বই পড়ার বা জানালা দিয়ে অন্ধকারের রূপ দেখার জন্য। আমার ওপরের বাংকারে পাকিস্তানের নাদিন শুয়ে পড়েছে। পাশের বাংকারে ইন্ডিয়ান সহযাত্রী সাবিহা ও পাশে ইন্ডিয়ান সহযাত্রী। ওরা সবাই ডিনার সেরে শুয়ে পড়েছে। আমি ধীরে ধীরে উঠে এলাম। আমার সাথে এল আতেনা আর কাভিয়ানী। ওরা এখন থেকে আমাদের সাথে থাকবে। আতেনা সাংবাদিক আর কাভীয়ানী গাইড। কয়েকটা কম্পার্টমেন্ট পার হয়ে আমরা ট্রেনের রেস্টুরেন্টে এসে বসলাম। এত দিনে ১০ ডলার খরচ করে ইরানী সীম কার্ড পেয়ে গেছি। প্রতি মুহূর্তে আমার ভালোলাগা অনুভূতিগুলো ঝগঝ করে হাজব্যান্ড ও মেয়ের সাথে শেয়ার করছি।
ট্রেনের রেস্টুরেন্টটা খুব সুন্দর করে সাজানো। আমরা সুন্দর একটা জায়গা নিয়ে বসে পড়লাম। আতেনা একপাশে ইন্টারভিউ নিতে থাকল ভারতের হাশিমীর। আর এদিকে আমি আর কাভিয়ানী বসলাম। আমি টেবিলের ওপর ল্যাপটপ রেখে প্রয়োজনীয় কিছু কাজ সারতে থাকলাম। কাভিয়ানী চা-এর অর্ডার দিয়ে তার ব্যাগ থেকে নানান রকম বাদাম বের করে টেবিলের প্লেটে রেখে আমাকে বলল : ‘খাও।’
জিজ্ঞেস করলাম : ‘তোমরা ইরানীরা সব সময় এমন বাদাম খাও?’
কাভিয়ানী বলল : ‘প্রায় সময়। আমাদের বাড়িতেই বাদামের গাছ আছে। গাছ থেকে নিয়ে যখন ইচ্ছা খাই। ছোট বেলায় আরো মজা হতো।’
বেশ ভালোই সময় কাটতে থাকল। রেস্টুরেন্টে লোকজন কমতে থাকল। তখন মাঝরাত। ট্রেনের হালকা দুলুনি আর ঝকঝকে আলো, অল্প কিছু লোকজনের চলাচল সব মিলিয়ে একটা মায়াবি পরিবেশ।
রাত বাড়ছে ইরানে। নূর ট্রেনের মধ্যে মাশহাদের পথে।
আতেনা এবার আমার কাছে এল ওর ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে। বসল ঠিক আমার সামনে। ওর যত প্রশ্ন সব ইরানের সুপ্রিম লিভার অুধঃড়ষষধয কযড়সবরহর-কে নিয়ে। আমি তাঁর সম্পর্কে জানি কিনা অথবা জানলে কী কী জানি।
সুপ্রিম লিডার। যদিও সুপ্রিম শব্দটি ইরানের সংবিধানে নেই, সেখানে শুধু লিডার বা নেতা বলা আছে। তবু জনগণ অধিক সম্মান দেখানোর জন্য সুপ্রিম শব্দটি ব্যবহার করে। ইরানে প্রেসিডেন্টের চেয়ে ক্ষমতার অধিকারী হচ্ছেন লিডার।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের মহান নেতা অুধঃড়ষষধয ঝধুুরফ জঁযঁষষধয কযড়সবরহর যিনি ৩ ডিসেম্বর ১৯৭৯ সাল থেকে ৩ জুন ১৯৮৯ সাল তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত ইরানের লিডার ছিলেন। যিনি ইরানে ইসলামী বিপ্লব ঘটিয়ে ১৯৭৯ সালে ইরানকে রেযা শাহ পাহলভীর শাসন থেকে মুক্ত করে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে পরিণত করেন এবং এখন পর্যন্ত ইরান ও বিশ্বের অনেক মুসলিম জাতিকে মুগ্ধ করে রেখেছেন তাঁর জ্ঞান, খোদাভীতি, আত্মত্যাগ ও অতি সাধারণ জীবন যাপনকে দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরে। তাঁর মৃত্যুর পর বর্তমানে অর্থাৎ ৪ জুন ১৯৮৯ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত লিডার আছেন অুধঃড়ষষধয ঝধুুরফ অষর কযধসবহবর যিনি পূর্বে ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৮৯ সালে ওসধস কযড়সবরহর-এর মৃত্যু পর্যন্ত ইরানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। বিপ্লবী নেতা ওসধস কযড়সবরহর সম্পর্কে আমার অভিমত জানানোর সুযোগ পেয়ে খুব ভালো লাগল। আমার আর আতেনার কথার মাঝেই জানতে পারলাম যে, রেস্টুরেন্ট বন্ধ হবার সময় হয়ে গেছে।
আমি আর আতেনা কড়িডোরের শেষ মাথায় এসে পৌঁছলাম। এতক্ষণে আতেনার ভিডিও ক্যামেরার কথা মনে পড়েছে। ও আমার দিকে ক্যামেরা তাক করে বলল : ‘কিছু বল।’
আমি বললাম وحشى بافر এর কবিতা থেকে,
موستان شرح بریشانی من گوش کنید
داستان غم بنهانی من گوش کنید…
ঙ ভৎরবহফং, যবধৎশবহ ঃড় ঃযব ধপপড়ঁহঃ ড়ভ সু ফবংঃৎঁপঃরড়হ. ঐবধৎশবহ ঃড় ঃযব ঃধষব ড়ভ সু যরফফবহ ংড়ৎৎড়.ি তারপর আমরা হাসতে হাসতে আমাদের বগিতে পৌঁছলাম। দেখি, সেখানে অনেকেই দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছে। এলহাম আর শিরিন ছোট্ট করিডোরে শুধু দাঁড়িয়ে আছে। ওদের চোখ ভর্তি ঘুম। বললাম : ‘কি, ঘুম পাচ্ছে?’ ওরা দু’জনই মাথা নেড়ে বলল : ‘হ্যাঁ।’
এলহাম আর শিরিন ওদের রুমে চলে গেল ঘুমাতে আর আমি আমার রুমের দরজা লক করে দিলাম। এবার সত্যি অন্ধকার হয়ে এল রুম। রাত আর বেশি বাকি নেই। চোখ বুজে ভাবতে থাকলাম। ইরান পৌঁছানোর পর থেকে আজ পর্যন্ত। একজন রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আমাদের কত গর্ব! অথচ প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত ইরানে কত যে জ্ঞানী আর সুফি সাধক রয়েছেন তার হিসাব নেই। আশ্চর্য দেশ, আর কি বিশাল এর জ্ঞান ভাণ্ডার!
জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম, একটু একটু করে দিনের আলো ফুটছে, পাহাড়ি পথের পাশ দিয়ে ছুটছে ট্রেন। সূর্যের প্রথম আলোয় সোনার মতো রং ফুটে রয়েছে পাহাড়ের গায়ে। তার মাঝে সারি সারি উইন্ডমিলের চাকা। আমি জানালায় গাল রেখে ক্যামেরায় ধরতে থাকলাম এই অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য। দিনের আলো ভালোভাবে ফুটে ওঠার পর আমরা মাশহাদ পৌঁছলাম। মাশহাদ, ঞযব ঐড়ষু ঈরঃু। এখানে অষ্টম ইমাম রেযা (আ.)-এর মাযার আছে।
কালচারাল গেস্ট হাউসে পৌঁছে সবাই যখন রেস্ট নিচ্ছে আমি তখন আমার বিশাল রুমে বসে পরবর্তী একদিনের পুরো প্ল্যান করে ফেললাম। কী কী কিনব তার লিস্ট করলাম। সঙ্গী-সাথিদের বাংলাদেশ থেকে আনা এরভঃ গুলো কাকে কাকে দেব আর আমার টিকিট, টাকা সব ঠিকমত চেক করে ব্যাগ ভালোভাবে গুছিয়ে ফেললাম যেন পরে আমার সময় নষ্ট না হয়। আমাদের মধ্যে থেকে কেউ কেউ তেহরান ফিরে যাবে তারপর যেখান থেকে তাদের দেশে আর কেউ মাশহাদ থেকে দেশে ফিরবে। আমি মাশহাদ থেকে দুবাই হয়ে একই রুটে বাংলাদেশে ফিরব। আমরা দুপুরে লাঞ্চ সারলাম ঘরেই। বিশাল বিশাল নানরুটি, রাইস, ফিশ আর বেগুন দিয়ে বানানো একটা সব্জি। বিকেলে তৈরি হয়ে নিলাম ইমাম রেযার মাযারে যাবার জন্য। তেহরানের মতো মেয়েদের জন্য শুধু স্কার্ফ এখানে যথেষ্ট নয়। ওপরে বড় একটা চাদর পড়তে হবে। আমরা প্রস্তুত হয়ে রওয়ানা হলাম।
এত বিশাল মাযার, এত নিঁখুত তার কারুকাজ! আমরা মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এত শিল্পজ্ঞান সত্যি প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। মাশহাদ শব্দের অর্থ অ ঢ়ষধপব যিবৎব ধ সধৎঃুৎ যধং নববহ নঁৎৎরবফ.
৮১৮ খ্রিস্টাব্দে আব্বাসী খলিফা আল মামুন কর্তৃক ইমাম রেযা (ওসধস অষর ধষ-জরফযধ) নিহত হয়ে শহীদের মর্যাদা পেয়েছিলেন। এখানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। এরপর থেকে এই স্থানকে মাশহাদ বলা হয়। তারপর থেকেই শিয়া সুন্নি সকল মুসলমান এখানে যিয়ারত করতে আসেন।
এখানকার মসজিদে প্রায় ৫ লক্ষ মানুষের নামাযের ব্যবস্থা রয়েছে এবং একে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মসজিদ বলা হয়। ৬,৪৪৩,৮৯০ ঝয়ভঃ-এর মসজিদ চত্বরে রয়েছে মিউজিয়াম, লাইব্রেরি, সেমিনার হল, কবরস্থান, ঞযব জধুধার টহরাবৎংরঃু, ডাইনিং হল, বিশাল নামায চত্বর এবং অন্যান্য বিল্ডিং।
এক দফায় এই মাযার দেখা শেষ হবে না। ফিরে আসার সময় সিদ্ধান্ত হলো এখানে ফজরের নামাযের সময় আবার আসব। সেই জন্য গেস্ট হাউস থেকে রওয়ানা দিতে হবে রাত দু’টায়। তাই যারা যেতে চায় তারা যেন রাতে না ঘুমায়। আর ঠিক দু’টার সময় যেন নিচে ওয়েটিং রুমে চলে আসে। সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে আমরা সেই রাতেই শপিং-এ গেলাম আর ফেরার পথে চরুুধ চরুুধ ফাস্ট ফুডের দোকানের দারুন পিৎজা খেলাম।
কোনভাবেই যেন বাদ পড়ে না যাই সেই জন্য দু’টা বাজার ১০ মিনিট আগেই নিচে নেমে পড়লাম। তখনও কেউ আসেনি। আমি সিঁড়িতে একা বসে থাকলাম। ল্যাপটপ খুলে আমার কাজ করতে থাকলাম। একে একে কয়েকজন বাদে অন্যরা এলে সেই গভীর রাতে আমরা আমাদের বাসে চড়ে রওয়ানা দিলাম। সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা! গভীর রাত, তবু মাযার চত্বর লোকজনে ভরা। আমরা গিয়ে বসলাম ঠিক সোনার গেটের সামনে যেটা পার হলেই মাযার। ওপরের বড় গম্বুজটিও সোনার। আলোয় চকচক করছে সোনা আর সেই আলো দ্বিগুণ উজ্জ্বল হয়ে ঠিকরে পড়ছে মেঝেতে। খোলা আকাশের নিচে ঠা-া বাতাসের মধ্যে আমি, এলহাম আর শিরিন তাহাজ্জুদের নামায আদায় করলাম। অন্যরাও আছে আশে-পাশে।
একটা ধূসর রং-এর কবুতর নির্ভয়ে মেঝের কার্পেটের ওপর হাঁটহাঁটি করছে। ওটা হাঁটতে হাঁটতে আমাদের কাছে চলে এল। শিরিন বলল : “এই পাখিকে এখানে বলে ‘ইয়া কারিম’।”
দেখলাম একজন ভদ্রমহিলা ছোট-ছোট দানাজাতীয় খাবার ওকে খেতে দিলেন নামায শেষে। আর পাখিটিও মনের আনন্দে খেতে থাকল।
ফজরের নামায হলো জামায়াতে। এরপরও আমরা অনেকক্ষণ সেখানে বসে থাকলাম। এমনি শুধু ভালো লাগছিল, তাই বসে থাকা।
সকাল হলে আমরা প্রশান্ত মনে গেস্ট রুমে ফিরে এলাম। কেউ হয়তো ঘুমালো, কিন্তু আমি গোসল আর নাস্তা সেরে সন্ধ্যার প্রস্তুতি নিয়ে নিলাম। কারণ, সন্ধ্যায় আমার প্লেন। আজই রওয়ানা দিব বাংলাদেশে। গত রাতে সামান্য কিছু কেনাকটা করেছি। শেষ পর্যন্ত প্রাচীন হস্তশিল্পের দোকান খুঁজে পেয়েছি। মিনিয়েচার আর্ট সংগ্রহ করতে পারিনি, কিন্তু হাতে তৈরি ছোট কার্পেট পেয়েছি। এর মধ্যে একটি হলো কার্পেটে তৈরি ব্যাগ। অনেক নকশা সেই ব্যাগের মধ্যে। এটি একটি প্রাচীন শিল্প। দোকানদার বললেন : ‘এই ব্যাগের মধ্যে লবণ রাখা হতো। একটি ঊহমষরংয ঃড় চবৎংরধহ ডিকশনারিও পেয়েছি। সব গুছিয়ে রেখে আমরা আবার বেরিয়ে পড়লাম।
এবার আমরা যেখানে যাচ্ছি সেটার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। এটি ৫০ বছর পুরনো একটি ওহংঃরঃঁঃব, গধশযঃধনব গধৎলবং (রসধসলধসধ)। এখানে কোরআন অনুসারে মেয়েদের শিক্ষা ও ট্রেনিং দেয়া হয়।
সেখানে আসন্ন মুহররমের প্রস্তুতি চলছে। অতি সম্মানে আমাদের স্বাগত জানালেন স্কুল কর্তৃপক্ষ।
অপূর্ব হাতের কাজে সাজানো হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির একেকটা রুম। আমরা একটা হলরুমে এসে দাঁড়ালাম। দূর থেকে ভেসে আসছিল কান্নার সুরে গান। কাছে এসে দেখলাম, একটা বড় হলরুমের মাঝখানে কালো পোশাকে প্রায় ২০/২৫ জন নারী দাঁড়িয়ে ধীর লয়ে মর্সিয়া গাইছেন। তাদের ডান হাত হালকা করে বুকের বাম পাশে তালে তালে স্পর্শ করছে। তাদের দু’চোখ বেয়ে পড়ছে অশ্রু।
মুহূর্তেই বুঝে গেলাম কী হচ্ছে। ফারসি গানের প্রতিটা শব্দের অর্থ না বুঝলেও এর সুর আমাদের মন ছুঁয়ে গেল। ‘হোসাইন’ শব্দটাও ঘুরে ঘুরে কানে আসতে থাকল।
আমরা ওদের কাছেই স্টেজে এসে দাঁড়ালাম। ওদের গানে তাল দিয়ে বুকে হাত রাখলাম আর আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম আমাদের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু!
৬৮০ সালে (মুহররম ১০, ৬১ হি.) ঘটে যাওয়া কারবালা প্রান্তরের যুদ্ধ ফুটে উঠল চোখের সামনে। আমন্ত্রণ পেয়ে মদীনা থেকে কুফার পথে চলেছে ইমাম হোসাইনের পরিবারসহ কাফেলা, কিন্তু কুফা পৌঁছানোর আগেই তাঁদেরকে কারবালায় নিয়ে যাওয়া হয়। উমাইয়া খলিফা ইয়াযীদের আনুগত্য স্বীকার না করার জন্য শুরু হয় যুদ্ধ।
মুহররমের ৯ তারিখ রাতে ইমাম হোসাইন তাঁর দলের সকলকে তাঁকে ছেড়ে চলে যাওয়ার অনুমতি দিলেও কেউ তাঁকে ছেড়ে যান নি। ইমাম হোসাইন সারারাত নামায পড়েন। ফজরের নামাযও পড়েন। কারবালার প্রান্তরে ইয়াযীদের নির্দেশে কয়দিনের পানির কষ্টের পাশাপাশি যুদ্ধের এক পর্যায়ে ইমাম হোসাইন একাই রীরত্বের সাথে লড়াই করে শাহাদাত বরণ করেন। তাঁর শিশু সন্তানদেরও হত্যা করা হয়। ইসলামের শেষ নবী ও আল্লাহর প্রেরিত রাসূলের আদরের নাতির এমন হৃদয়বিদারক শাহাদাত ঘটে কারবালা প্রান্তরে।
ঝাপসা চোখে দেখলাম সামনের একটি বড় টেবিলে ইরাকের কারবালায় ইমাম হোসাইনের সমাধি থেকে আনা একটি কারুকাজ খচিত চাদর ধরে অঝরে কাঁদছে সবাই। আমাদের সঙ্গী পাকিস্তান থেকে আসা তাহমিনা যে সবসময় হাসিখুশি আর দুষ্টুমিতে মেতে থাকে সে কাঁদছে সবচেয়ে বেশি। কী নিঃস্বার্থ সেই অনুভূতি! কী চরম দুঃখবোধ! আমাদের প্রিয় নবীকে যদি আমরা ভালোবাসি তবে তাঁর প্রিয় ও অতি আপন জনের এমন করুন মৃত্যুত তো আমরা কাঁদবই। আমরা দুঃখ-ভারাক্রান্ত মনে বিদায় নিয়ে ফিরে এলাম ইমাম রেযার মাযারে। আর সত্যিই অভিভূত হয়ে ভাবছিলাম, কি রকম শান্ত, সংগঠিত ও মার্জিত উপায়ে শোক পালন করছে এরা। সত্যিই খুবই শিক্ষামূলক। ইমাম রেযার মাযারের লাইব্রেরিটা যেমন বিশাল তেমনি প্রাচীন। এখানে ১৯টি ভাষার বই রয়েছে। হাজার বছরের পুরনো এই লাইব্রেরিটি আধুনিক প্রযুক্তির সাথে যুক্ত। এখানে বই খুঁজে আনার জন্য একটি ছোট বাক্স সংযুক্ত দেয়ালের সাথে লাগানো একটি যন্ত্র রয়েছে। যেখানে প্রয়োজনীয় বইয়ের লিস্ট দিলে যন্ত্রটি নিজেই পুরো লাইব্রেরি খুঁজে বই এনে নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছে দেবে। এতে তার সময় লাগে ১০ মিনিট, অথচ একই কাজ অক্সফোর্ড লাইব্রেরির যন্ত্র করে ৫ ঘণ্টায়।
টেকনোলজী সম্পর্কিত ছোট এই উদাহরণ দেখে বুঝতে পারলাম যে, ইরান শুধু ধর্ম নিয়েই চর্চা করে না, আধুনিক টেকনোলজিতেও অনেক এগিয়ে আছে।
লাইব্রেরি ঘুরে দেখার পর লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে সেমিনার রুমে নিয়ে এলেন। এত বড় হলরুম আর দেয়ালে বিশাল বিশাল প্রাচীন আর্টের নিদর্শন দেখে আমরা যেন থ’ হয়ে গেলাম। উনি আমাদের জানালেন এই আর্টগুলো সব নিখুঁতভাবে হাতে আঁকা। ভদ্রলোক আমাদের একেবারে স্টেজের সামনে এনে ঠিক সামনের সারিতে বসিয়ে বললেন, এই সেমিনার হলে অতি উচ্চ পর্যায়ের সভা হয়। আপনারা যে চেয়ারে বসেছেন সেখানে শুধু বিভিন্ন দেশের আমন্ত্রিত রাষ্ট্রপ্রধানরা বসেন।
দুপুরের খাবার আমরা মাযারের ডাইনিং হলে খেলাম। আর ফিরে আসার সময় ডাইনিং হলের বাইরে গেটের অপর পাশে অনেক অপেক্ষমাণ মানুষ দেখলাম। জিজ্ঞেস করে জানলাম যে, রোগমুক্তির জন্য ইমাম রেযার মাযারের তাবারুকের জন্য তারা অপেক্ষা করছে।
হলের একপাশে চিত্র প্রদর্শনী চলছে। সারা পৃৃথিবীতে মুসলিমদের ওপর যে অত্যাচার চলছে তার স্থির চিত্র। একসাথে এতগুলো করুণ ছবি দেখে আমাদের সত্যিই মন খারাপ হয়ে গেল।
ফিরে আসছি। পথে বাসের মধ্যে একদম অন্য পরিবেশ। সবাই চুপচাপ। অথচ অন্যদিন সারা পথ হৈচৈ, হাসি, আনন্দ করতে করতে আমরা ফিরি। পথও এমন সুন্দর যে, সে দৃশ্য দেখেও মন ভালো হয়ে যায়।
এক সময় হঠাৎ থেমে যায় বাস। কি ব্যাপার? আমরা কেউ জানি না কী হয়েছে। আমাদের গাইড নেমে পড়েন। তারপর সবার জন্য আইসক্রিম নিয়ে আসেন। অমনি হৈচৈ করে ওঠে সবাই। ইরানে এসে আইসক্রিম খাওয়াটাই বাকি ছিল। চলন্ত বাসে চামচ দিয়ে কেটে কেটে কেকের মতো দেখতে দারুন সুস্বাদু আইসক্রিম খেতে খেতে গন্তব্যে পৌঁছলাম। অতিথিপরায়ণতায় জুরি নেই ইরানীদের। সময় নেই হাতে বেশি। তড়িঘড়ি করে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এলাম। এয়ারপোর্ট যেতে হবে। রাত আটটায় ফ্লাইট। আমার সাথে দু’জন পাকিস্তানী সঙ্গী রেজিয়া ও নাদিন। ওরা দুবাই থেকে পাকিস্তান চলে যাবে আর আমি বাংলাদেশ। ভারতীয় ও পাকিস্তানী অন্য সঙ্গীরা পরদিন তেহরান থেকে ফিরবে।
প্লেনে বসে আছি। এবারও এমিরেট। আর একটু পরে ঢাকা পৌঁছবে। অবাক হয়ে ভাবছি আমার সফর শেষ হয়ে গেল। ৬-১৫ অক্টোবর কিভাবে যেন ঘোরের মধ্যে কাটল।
সকাল সাড়ে আটটায় পৌঁছলাম ঢাকায়। সারা রাত প্লেনে একটুও ঘুমাইনি। শুধু ভেবেছি, কিভাবে ইরানে আমার দিনগুলো কেটেছে। আমি এতটাই অভিভূত যে, গত তিন রাত আমি যে ঘুমাইনি অথচ তা আমার শরীরকে এতটুকু কাবু করে নি। ইরান আমাকে এমনই আচ্ছন্ন করে রেখেছে।

ইরানে সামাজিক নিরাপত্তা

মোহাম্মদ রেজওয়ান হোসেন

ইতিহাসের বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ১৯৭৯ সালে ইরানে সংঘটিত হয় ইসলামী বিপ্লব। নবী-রাসূলদের ঐশী চিন্তা-ভাবনা ও খোদাপ্রদত্ত বিধিনিষেধ বাস্তবায়ন করাই যার প্রধান উদ্দেশ্য।
মহানবী (সা.) ও পবিত্র আহলে বাইতের (আ.) অনুসারী আলেম ও জনতা বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সংগ্রামের পর ইরানে ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের মধ্য দিয়ে এমন এক উন্নত সমাজের ভিত্তি স্থাপনে সফল হয়েছেন যেখানে মানুষ নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবে, চলাফেরা করবে স্বচ্ছন্দে এবং সর্বক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তা অনুভব করবে। সত্যিকারের ইসলামী সমাজব্যবস্থার অসংখ্য সুফলের মধ্যে এসব হচ্ছে অন্যতম।
পৃথিবীর সব দেশ ও সমাজেই কম-বেশি অন্যায় ও অপরাধ সংঘটিত হয়, রয়েছে সামাজিক নানা সংকট ও নিরাপত্তাহীনতা। বর্তমানে ইসলামী ইরানও এসব সমস্যা থেকে মুক্ত নয়। তবে সেই সমস্যার মাত্রা কোন্ সমাজে কতটুকু সেটাই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামী বিপ্লবের পর পর্যবেক্ষকরা ইরানের ইসলামী সমাজব্যবস্থার সঙ্গে মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য দেশের সমাজব্যবস্থার, এমনকি পাশ্চাত্যের সমাজব্যবস্থার পার্থক্য খোঁজার চেষ্টা করছেন। চরম নৈরাজ্য, ধ্বংস ও অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হওয়া গোটা মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোসহ হাজারো দুর্দশায় জর্জরিত অন্যান্য মুসলিম দেশের সঙ্গে ইরানের তুলনা করলে এ পার্থক্য ¯পষ্ট হয়ে উঠবে।
যে কোনো দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধির বিষয়টি অনেকাংশই নির্ভর করে সেই দেশের সামাজিক নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার ওপর। ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর দেশটির সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। তাই তো সারা বিশ্বের নজর আজ শান্ত ও স্থিতিশীল ইরানের দিকে, দেশটির সামাজিক নিরাপত্তার দিকে। যেখানে ইউরোপ ও আমেরিকার মতো উন্নত দেশের মানুষ সারাক্ষণ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, আত্মরক্ষার জন্য বাধ্য হয় অস্ত্র বহন করতে, বর্ণবৈষম্য, সামাজিক বৈষম্য, সংখ্যালঘুদের অধিকার হরণ, খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, চরম নৈতিক অবক্ষয়, গভীর পারিবারিক সংকট, তালাক প্রভৃতি যেখানে নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার সেখানে ইরানে বিরাজ করছে উল্টো চিত্র। এ প্রসঙ্গে ইরানের সামাজিক নিরাপত্তার কিছু দিক তুলে ধরলে বিষয়টি আরো ¯পষ্ট হয়ে উঠবে।
পার্ক : তেহরানের পার্কগুলোসহ গোটা ইরানের পার্কের দিকে তাকালে ইরানীদের পরিবেশ ও সৌন্দর্য-সচেতনতার ছাপ পাওয়া যায়। আর এ বাগবাগিচা ইরানী স্থাপত্যকলার অনিবার্য অনুষঙ্গ। ইরানে প্রাচীনকাল থেকেই বাগবাগিচা ও পার্কের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হতো, তবে বিশেষ করে ইসলামী বিপ্লবের পর পার্ক তৈরির দিকে আলাদা দৃষ্টি দেয়া হয়। জনবহুল রাজধানী তেহরানের কথাই ধরা যাক। তেহরানের যেখানেই একটু ফাঁকা জায়গা পড়ে আছে, সেখানেই তেহরান সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে গাছ লাগিয়ে ছায়াময় পরিবেশ গড়ে তোলার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
সময়ের ব্যবধানে যুগের প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিনোদন উপযোগী করে এখনকার পার্কগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে। পুরনো তেহরানে পার্কের ব্যবস্থা একটু কম। তবে আধুনিক তেহরান শহরের যে বিশাল এলাকা তাতে ঢাকার রমনা বা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মতো কিংবা তার চেয়েও অনেক বড় পার্ক আছে শতাধিক। এছাড়া, মাঝারি ও ছোট আকারের পার্ক তো প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় রয়েছে। প্রতিটি পার্কে রয়েছে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। শিশু-কিশোরদের জন্য যেমন খেলাধুলার ব্যবস্থা থাকে, তেমনি বড়দের জন্যও থাকে নানা আয়োজন। অনেক পার্কে রয়েছে সাইকেল চালানোর ব্যবস্থা। সব পার্কেই রয়েছে নানা রকমের ব্যায়াম করার স্থায়ী যন্ত্রপাতি। এসব যন্ত্রপাতি নিরাপদেই থাকে; চুরি হওয়ার আশঙ্কা নেই। বন্ধের দিনগুলোতে তেহরানের লোকজনকে দেখা যাবে বিকাল হলেই গাড়িযোগে স্ত্রী-পরিজন ও সন্তানাদি নিয়ে পার্কে যেতে। তাদের রাতের খাবারের আয়োজন সঙ্গেই থাকে। বয়োবৃদ্ধদের জন্য পার্কগুলো খোশগল্প করার উত্তম স্থান।
যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, পার্কগুলোর অসাধারণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। প্রতিটি বড় কিংবা মাঝারি আকারের পার্কে পুলিশ বক্স রয়েছে। আর মহল্লার মধ্যে অবস্থিত ছোট পার্কগুলোতে সাধারণ পাহারাদারের ব্যবস্থা রয়েছে। গভীর রাত পর্যন্ত পরিবার-পরিজন নিয়ে মানুষ নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ায়। সেখানে রয়েছে টয়লেট ও খাওয়ার পানির সুব্যবস্থা। কেউ এখানে অনাকাক্সিক্ষত কিছু করা বা কাউকে উত্যক্ত করার সাহস পায় না। এছাড়া, কোন কোন দেশে পার্ক হচ্ছে পথভ্রষ্ট ও উচ্ছন্নে যাওয়া যুবক-যুবতীদের অনৈতিক কর্মকাণ্ড ও আড্ডার স্থল। কিন্তু ইরানে আমরা দেখতে পাই ঠিক তার উল্টো চিত্র।
সরকারি ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি পার্কে আগমনকারী সাধারণ মানুষও বেশ সচেতন। অপ্রয়োজনে কেউ পার্কের ঘাস মাড়ায় না, গাছ থেকে কেউ ফুল ছেঁড়ে না। যেখানে সেখানে কেউ থুথু নিক্ষেপ করে না। কেউ যত্রতত্র ময়লা ফেলে না। এমনকি বাচ্চারাও জানে পার্কের ফুল ছিঁড়তে হয় না এবং ময়লা ডাস্টবিনে ফেলতে হয়। কয়লার আগুনে কাবাব বানাতে চাইলে তার জন্যও রয়েছে আলাদা ব্যবস্থা যাতে আগুনের তাপে ঘাস নষ্ট না হয়। পার্কে রয়েছে ওজু ও নামাযের ব্যবস্থা।
তেহরানের পার্কগুলোতে নিরাপত্তার বিষয়টি আরো ¯পষ্ট হয়ে ওঠে ফারসি ১৩ ফারভারদিন (সিজদা বেদার) অর্থাৎ ‘ন্যাচারাল ডে’-তে। এদিনে তেহরানসহ অন্য সব এলাকার মানুষজন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাবা-মা, সন্তান, ভাই-বোনসহ সপরিবারে কিংবা কয়েকটি পরিবার মিলে দল বেধে সারা দিন পার্কে অবস্থান করে। এদিনে কেউ ঘরে থাকে না। এদিনে পার্কে লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতি উৎসবের আমেজ নিয়ে আসে। এতো মানুষের নিরাপত্তা বিধান সত্যিই বিস্ময়কর। এ নিরাপত্তা যে ইরানে ইসলামী বিপ্লবেরই সুফল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
রাস্তা-ঘাট : রাজধানী তেহরানসহ ইরানের ছোট-বড় সব শহরেই রাস্তা-ঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন; সাজানো গোছানো পরিপাটি। সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত পরিচ্ছন্ন কর্মীরা রাস্তার সব অলি গলি ঝাড়– দেয়, নর্দমা পরিষ্কার করে। ফলে দিনের বেলা ধুলাবালি তেমন চোখে পড়ে না। রাতের অন্ধকারেই প্রতিটি মহল্লায় ডাস্টবিনে রাখা শহরের বাসাবাড়ির আবর্জনা নিয়ে যাওয়া হয়। ফলে আবর্জনা পরিষ্কার করার দৃশ্যও দেখতে হয় না। কোথাও কোনো গন্ধ থাকে না। ব্যস্ততম শহরেও ময়লা ও ধুলামুক্ত পরিবেশ পাচ্ছে সবাই। এতে মানুষের স্বাস্থ্য ভালো থাকে। অন্যদিকে সাধারণ মানুষও শহরের রাস্তা-ঘাট, ফুটপাত নোংরা করে না। ময়লা-আবর্জনা ফেলার জন্য রাস্তার পাশে, পার্কে কিংবা দোকানের সামনে সব জায়গায় ছোট ছোট ডাস্টবিন রাখা আছে।
দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, রাস্তা-ঘাটের নিরাপত্তা। কেউ যদি রাস্তা অতিক্রম করতে চায় তাহলে সাথে সাথে গাড়ি থেমে যায়। রাস্তার নীতিই হচ্ছে রাস্তা গাড়ির জন্য নয়, মানুষের পথ চলার জন্য। তাছাড়া, আইন কড়াকড়ি হওয়ায় ও তা বাস্তবায়িত হওয়ায় গাড়ি চালকরা সর্বোচ্চ সতর্ক থাকেন। ইরানে যিনি চালক তিনিই গাড়ির মালিক। পথিকের মৃত্যু হলে চালককে অনেক বছরের জেল প্রদান করা হয় কিংবা প্রচুর পরিমাণ অর্থ জরিমানা করা হয়। গাড়ির চালক পালিয়েও যেতে পারে না। কারণ, সব জায়গায় সিসি ক্যামেরা বসানো রয়েছে। গাড়ির নম্বর দেখে কয়েক মিনিটের মধ্যে চালককে ঠিকই ধরে ফেলবে পুলিশ। কিন্তু তারপরও দুর্ঘটনা ঘটে না, এটা বলা যাবে না, তবে সেটা অহরহ নয়। এছাড়া, রাস্তার বিভিন্ন স্থানে এমন সব ক্যামেরা পাতা থাকে যার ফলে নির্ধারিত গতির সীমা ছাড়িয়ে জোরে গাড়ি চালালেই নম্বর প্লেটসহ গাড়ির পেছন থেকে অটোমেটিক ছবি তুলে রাখা হয় এবং মাস শেষে দ্রুত গাড়ি চালানোর অপরাধে জরিমানার একটি বিল গাড়ির চালক বা মালিকের হাতে পৌঁছে দেয়া হয়।
তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে, যারা গাড়ি চালানোর জন্য ড্রাইভিং লাইসেন্স নিতে চায় তাদের অবস্থা অনেকটা সমুদ্র পাড়ি দেয়ার মতো। তেহরানে অসংখ্য গাড়ি চালনা প্রশিক্ষণ সেন্টার রয়েছে। কিন্তু সরকারের যে বিভাগটি লাইসেন্স দেবে সেখানে কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়। থিওরি কিংবা প্র্যাকটিক্যালে সামান্য ভুল হলে ফের প্রশিক্ষণ সেন্টারে পাঠানো হয়। ফলে সাধারণ মানুষ রাস্তা-ঘাটে অনেক বেশি নিরাপত্তা অনুভব করে।
চতুর্থ বিষয়টি হচ্ছে, নিরাপদ ফুটপাত। তেহরানে রাস্তার ফুটপাতে অবৈধভাবে পণ্য সাজিয়ে বিক্রি বা ব্যবসা করা নিষিদ্ধ। ফুটপাতে কেনাবেচা নিষিদ্ধ হলেও তুলনামূলক কম দামের জিনিস বেচাকেনার সুবিধার্থে তেহরানের বিভিন্ন স্থানে সপ্তাহে একদিন খোলা মাঠে মিনি বাজারের আয়োজন করা হয়। সেই বাজারে কমদামে পোশাকসহ গৃহস্থালিতে ব্যবহৃত নানা ধরনের পণ্য সরাসরি মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। এভাবে ফুটপাতে কাউকে বসার অনুমতি না দিয়ে এমন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে যাতে কম আয়ের মানুষজন স্বল্প মূল্যে পণ্য কিনতে পারে অন্যদিকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদেরও স্বার্থ রক্ষা হয়। ফলে মানুষ চলাচলের জন্য ফুটপাত থাকছে নিরাপদ। যেখানে কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইউরোপের কোনো কোনো দেশে ফুটপাতে ব্যবসা চলে সেখানে ইরানে ফুটপাতের চেহারা অনেকটাই ভিন্ন। বিশেষ করে ইরানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাজার করে মহিলারা। ফলে অনায়াসে তাঁরা ফুটপাতে হাঁটাচলা করতে পারছেন এবং বাজার এলাকায় মহিলাদের বিব্রত হতে হয় না। এ ছাড়া, কর্মজীবী মানুষও দ্রুত পায়ে হেঁটে গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে পারছেন। এখানে পুলিশকে ম্যানেজ করে ফুটপাত দখলের কোনো সুযোগ নেই। এভাবে তেহরানের রাস্তা-ঘাটকে সাধারণ মানুষের চলাচলের জন্য নির্ঝঞ্ঝাট ও নিরাপদ রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
পরিচয়পত্র : প্রত্যেক ইরানী নাগরিকের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে পরিচয়পত্র নেয়া বাধ্যতামূলক। পরিচয়পত্রের সঙ্গে নাগরিকত্ব, শিক্ষা, চিকিৎসা, ভ্রমণ, হোটেল ও বাড়ি ভাড়া নেয়া, চাকরি, নাগরিক সব সুযোগ-সুবিধা জড়িত। ওই ব্যক্তির রক্তের গ্রুপসহ যাবতীয় পরিচয় ও ইতিহাস ক¤িপউটারে এন্ট্রি করা থাকে। পরিচয়পত্রের নম্বর থাকে। নম্বর দিয়ে ক¤িপউটারে সার্চ দিলে সঙ্গে সঙ্গে তার যাবতীয় পরিচয় উদ্ঘাটন করা সম্ভব। এ কারণে ইরানে কোনো ব্যক্তি যদি অপরাধ করে তাহলে তার পরিচয় উদ্ঘাটন করা কঠিন কোনো কাজ নয়। অপরাধীকে ধরা পড়তেই হবে। এত সব নিয়মের বেড়াজালে থাকার কারণে মানুষের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা অনেকটাই কম।
সামাজিক নিরাপত্তা : সামাজিক নিরাপত্তা নিয়েই মূল কথাটা বলতে চাই। আসলে রাজধানী তেহরানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখে অবাকই হতে হয়। এখানে নেই কোন মারামারি, নেই চুরি-ছিনতাই, নেই গোলাগুলি-অস্ত্রবাজি। প্রতিদিনের পত্রিকায় কিংবা টেলিভিশনের খবরে খুন-হত্যাকাণ্ডের খবর ‘মাস্ট আইটেম’ হিসেবে থাকে না যা অনেক উন্নত দেশেও কল্পনা করা যায় না। এখানে মানুষ অনেক বেশি নিরাপদে পথ চলে। সেই নিরাপত্তা দিনে-রাতে একই রকম। রাতের আঁধার নামার সঙ্গে সঙ্গে এখানে ভয় নেমে আসে না। নিশ্চিন্তে পথ চলা যায় একাকী। ভাবতেও হয় না- ‘কেউ জানতে চাইবে কাছে কী আছে!’
বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে- এই নিরাপত্তা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্য সমান। একজন নারী কিংবা তরুণী যদি একাকী রাতের বেলায় পথে হেঁটে যায় তাকেও আলাদা করে ভাবতে হয় না নিরাপত্তার কথা। পথ চলতে গেলে ডাকাত-ছিনতাইকারীর সামনে পড়ার ভয় নেই। রাস্তায় নেই কোন উটকো মাস্তানি। কেউ পথ আগলে দাঁড়াবে না, কেউ অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করবে না বা শিস দেবে না। এ এক অন্যরকম সমাজ; সামাজিক নিরাপত্তাই যার বড় বৈশিষ্ট্য। সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি আসলে ইরানকে নিয়ে গেছে অন্যরকম উচ্চতায়।
যেখানে আমেরিকা, ব্রিটেন কিংবা কানাডার মতো উন্নত ও ধনী দেশে সামান্য সময় বিদ্যুতের অনুপস্থিতিতে খুন, ডাকাতি, রাহাজানি, ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ সংঘটিত হয় অবলীলায়; সেখানে ইরানে এগুলো কল্পনাই করা যায় না। বিশ্বের বহু দেশ অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে যখন হিমশিম খাচ্ছে তখন ইরানে এমন ধরনের নিরাপত্তা একেবারেই স্বাভাবিক ব্যাপার। এ নিরাপত্তার কারণ হলো দীর্ঘ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ধর্মীয় চেতনা এবং সর্বোপরি জনগণের কল্যাণকামী ইসলামী বিপ্লবী সরকার ব্যবস্থা। তবে সামাজিক অপরাধের ঘটনা যে একেবারেই ঘটে না তা কিন্তু নয়। তবে এসব যতটুকু ঘটে তা পাশ্চাত্য কিংবা তৃতীয় বিশ্বের অন্য দেশের তুলনায় এতটাই সামান্য যে, তা হিসাবেই ধরা হয় না।
নারীর সামাজিক অবস্থান : ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে নারীর অধিকার ও তাদের সামাজিক মর্যাদা কিংবা তাদের নিরাপত্তা কেমন? এ প্রশ্ন প্রতিটি সচেতন মানুষের বিশেষ করে নারী সাংবাদিক ও নারী-অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত সবার। ইরানের সংবিধানের ৩য় পরিচ্ছেদের ১৯ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘জাতি-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল ইরানী নাগরিকের সমান অধিকার রয়েছে। বর্ণ, গোত্র, ভাষা এবং নারী-পুরুষ ভেদে কাউকে পার্থক্য করা হবে না।’
২০ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল নাগরিকই রাষ্ট্রীয় আইনের দ্বারা সমানভাবে সুরক্ষিত এবং ইসলামী মাপকাঠিতে সকল প্রকার মানবিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকার ভোগ করে থাকে।’
২১ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘ইসলামী আদর্শের মাপকাঠিতে নারীদের অধিকার-এর নিশ্চয়তা বিধানের দায়িত্ব রয়েছে সরকারের।’
ইরানে নারীর অধিকার ও তাদের সামাজিক নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলার আগে প্রথমেই যে কথাটি বলা দরকার তা হচ্ছে, এ ইস্যুতে পশ্চিমা সরকার ও গণমাধ্যমগুলো অপপ্রচার চালায়। পশ্চিমা গণমাধ্যমের খবর দেখলে মনে হবে ইরানে নারীর অধিকার বলতে কিছু নেই; তারা ঘরের ভেতরে বন্দি, কর্মক্ষেত্রে তারা যৌন হেনস্থার শিকার ইত্যাদি। কোথাও বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা ঘটলেও সেটাকে তিল থেকে তাল বানিয়ে প্রচার চালায় পাশ্চাত্য মিডিয়াগুলো। কিন্তু বাস্তবতা স¤পূর্ণ ভিন্ন। আবার ইরানে নারীঘটিত ব্যাপার নিয়েও মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা চালানো হয় ইরানে নারীরা নির্যাতিত, অধিকারবঞ্চিত এবং তারা সুবিচার পায় না। উদাহরণস্বরূপ, কিছুদিন আগে ইরানে রেহানা জাব্বারি নামে এক মহিলার মৃত্যুদণ্ড নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও পাশ্চাত্য মিডিয়ার অপপ্রচারের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ওই অপপ্রচারের ঢেউ বাংলাদেশের মিডিয়াতেও আছড়ে পড়ে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ গণমাধ্যমের সীমাবদ্ধতা হলো বিদেশি খবরের ব্যাপারে যাচাই-বাছাই করার তেমন সুযোগ নেই। সে কারণে পশ্চিমা গণমাধ্যম বিশেষ করে এএফপি, রয়টার্স, এপি, ভোয়া বা বিবিসি যা প্রচার করে তা-ই অনুসরণ করতে হয়।
পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোতে বলা হচ্ছে রেহানাকে অন্যায়ভাবে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। আরো বলা হচ্ছে, ধর্ষণ থেকে আত্মরক্ষা করতে গিয়ে মহিলাটি ওই লোকটিকে খুন করেছেন। অর্থাৎ নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে, ধর্ষণ প্রতিরোধ করতে গিয়ে খুনের ঘটনাটি ঘটেছে। তারপরও তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে! তার মানে হচ্ছে নারীর এই প্রতিরোধকে স্বীকার করা হলো না। নারীর অধিকারকে স্বীকার করা হলো না। কেউ কেউ বলছেন, এই বিচারের মাধ্যমে ধর্ষণকে উৎসাহ দেয়া হলো। অথচ প্রকৃত বিষয় হলো, রেহানা ধর্ষণ প্রতিরোধ করতে গিয়ে খুন করেন নি। ঘটনাটি ভুলভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। ইরানের বিচার বিভাগ নারীবিদ্বেষী নয় যে, অন্যায়ভাবে একজন নারীকে ফাঁসি দেবে। হত্যাকাণ্ডটি পূর্বপরিকল্পিত ছিল। ওই মহিলা তার দোষও স্বীকার করেছেন আদালতে। রেহানা নিজেকে নির্দোষ প্রমাণেও ব্যর্থ হয়েছেন।
ঘটনাটি হচ্ছে দু’জনের অবৈধ স¤পর্কের জের ধরে এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে টানাপড়েন সৃষ্টি হয় এবং এই খুনের ঘটনা ঘটে। সে ক্ষেত্রে পুরুষ লোকটি যে ভালো মানুষ ছিলেন তা বলার সুযোগ নেই। টানাপড়েনের একটি পর্যায়ে বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। যার কারণে রেহানা লোকটিকে খুনের সিদ্ধান্ত নেন। এ ছাড়া, এই মহিলার সঙ্গে ইরানের আদালতের এমন কোনো ঘটনা ঘটে নি যে, তাকে ফাঁসি দিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় দিয়ে দেবে। অথবা এই মহিলা ইরানের জন্য কোনো হুমকি ছিলেন সে কারণে তাঁর ফাঁসি কার্যকর করা হলো। বরং যদি এমন হতো যে, খুনের ঘটনা সংঘটিত হয় নি; বরং অবৈধ স¤পর্ক বা ধর্ষণের ঘটনার বিচার হচ্ছে, তাহলে ওই পুরুষ লোকটাও মৃত্যুদণ্ডের মুখে পড়ত এবং এ ক্ষেত্রেও ইরানের আইন অনুসরণ করা হতো। দেখা হতো না যে, কে পুরুষ আর কে নারী। যেমনটি দেখা হয় নি রেহানার ক্ষেত্রে। বাস্তবতা হচ্ছে, এটা নিতান্তই পশ্চিমা গণমাধ্যম ও কথিত মানবাধিকার কর্মীদের প্রচারণা। বরং মুখ্য হচ্ছে আইন এবং তার বাস্তব প্রয়োগ। ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর বহু খুনের ঘটনার বিচার হয়েছে এবং দোষীদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে; সেখানে নারী-পুরুষ কখনো বিবেচ্য বিষয় হয়ে ওঠে নি; বিচার হয়েছে অপরাধের। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। ইরানে নারীরা প্রায় সব ধরনের কাজই করতে পারেন এবং করে থাকেন। ইরানের বর্তমান সরকারের ১০ জন ভাইস প্রেসিডেন্ট রয়েছেন, তার মধ্যে চারজন হচ্ছেন নারী। চারজন ভাইস প্রেসিডেন্ট সবাই আবার বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী। শুধু ভাইস প্রেসিডেন্ট নয়, ইরানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি ক্ষমতায় আসার পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন মারজিয়ে আফখাম। তিনি একজন নারী। সম্প্রতি মারজিয়ে আফখামকে মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এসব রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ছাড়াও ইরানের যে কোনো মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা সংস্থায় গেলে দেখা যাবে নারীর ব্যাপক উপস্থিতি। তেহরানের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাংক, বীমা, রেডিও-টেলিভিশন সব জায়গাতেই নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণ রয়েছে। হাসপাতালগুলোতে গেলে দেখা যাবে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে নারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যাই বেশি। সহজ কথায় বলা যায়, সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদ থেকে শুরু করে এমন কোনো বিভাগ নেই যে বিভাগে নারীর উপস্থিতি নেই। তেহরান শহরে ট্যাক্সি সার্ভিসের কথাই বলি। তেহরান ট্যাক্সি সার্ভিসে চালক হিসেবেও বহু নারী কাজ করে থাকেন। আর ব্যক্তিগত গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে ইরানী নারীদের রয়েছে অবাধ স্বাধীনতা। তেহরানে বড় বিআরটি বাসের চালক একজন নারী হওয়ায় সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। যে কোনো নারীই পারেন প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নিয়ে গাড়ি চালাতে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কোনো বাধা নেই। অথচ বহু আরব দেশে নারীর গাড়ি চালানোর কোনো স্বাধীনতা নেই।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, তেহরানে যেসব বাস চলাচল করে সেগুলোর মাঝখানে পার্টিশন দেয়া থাকে। সম্মুখভাগে মহিলাদের বসার জায়গা আর পেছনের অংশটা পুরুষদের জন্য। ফলে প্রচণ্ড ভীড়ের মধ্যেও কাউকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় না। মেট্রো রেলেও মহিলাদের জন্য আলাদা বগি রয়েছে। তাই বাসে বা অন্য পরিবহনে চলাচলের ক্ষেত্রে ইরানের নারীরা অত্যন্ত নিরাপদে থাকেন এবং তাঁদেরকে ভোগান্তির শিকার হতে হয় না।
রাস্তা কিংবা বাসে নিরাপত্তার বিষয়টি ছাড়াও তেহরানে যত ধরনের সেবামূলক প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার বেশির ভাগ জনশক্তি হচ্ছে নারী। তেহরান শহরের টেলিফোন অফিসগুলোতে কিংবা মেট্রো স্টেশনগুলোতে দেখা যাবে নারী জনশক্তিই বেশি। একই চিত্র দেখা যাবে খাবার রেস্টুরেন্ট কিংবা বড় মার্কেটগুলোতে। আর এসবই সম্ভব হয়েছে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকার কারণে।
বাসাবাড়িতেও নারীর পদচারণা একই রকম; পরিবারগুলোতে নারীর প্রভাব অনেক বেশি। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার কারণেই শরীরচর্চা ও ক্রীড়াঙ্গনেও ইরানী মেয়েদের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তবে তেহরান তথা ইরানের নারীদের যে কাজটি অবশ্যই করতে হয় তা হচ্ছে হিজাব পরা। এটি বাধ্যতামূলক; কোনো নারী চাইলেই হিজাববিহীন চলাফেলা করতে পারেন না।
কারণ, ইসলামী বিপ্লবের পর ইরান ইসলামী আইন অনুসারে পরিচালিত হচ্ছে। সে কারণে ইরানে নারীর জন্য হিজাব বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সম্ভবত এ হিজাবব্যবস্থাকে পুঁজি করেই পশ্চিমা দেশগুলো ইরানে নারীর স্বাধীনতা নেই, নারীর মর্যাদা নেই, নারীর সামাজিক নিরাপত্তা নেই বলে নানা নেতিবাচক প্রচারণা চালায়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, হিজাব বাধ্যতামূলক করার কারণে ইরানে নারীর মর্যাদা বেড়েছে বৈ কমে নি। এ প্রসঙ্গে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেয়ীর একটি বক্তব্য উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেছেন, ‘ইসলামী বিপ্লবের আগে নারী স্বাধীনতার নামে নারীদের শুধু পোশাকহীন করে প্রদর্শনের সামগ্রী বানানোর সংস্কৃতি ছিল। কিন্তু ইসলামী বিপ্লব নারীকে কার্যকর অর্থেই সম্মানের স্থানে উন্নীত করে যাচ্ছে এবং বেড়েছে তাদের সামাজিক নিরাপত্তা।’
মাদক : বিশ্বের অন্য দেশের মতো মাদক ইরানের যুবসমাজের জন্যও বিরাট হুমকি। মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা ইরানেও তৎপর। বিশেষ করে নির্জন পাহাড়ী এলাকায়। তবে সরকারও মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। বিভিন্ন স্থানে গোপন ক্যামেরা বসিয়ে কিংবা গোয়েন্দা বাহিনী দিয়ে অপরাধীদের ধরা হয়। মাদকের ভয়াবহ থাবা থেকে সবাইকে রক্ষা করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত সীমান্তে ইরানের নিরাপত্তা বাহিনীকে মাশুল দিতে হচ্ছে। ইরানে মাদকসহ ধরা পড়লে তার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। এসংক্রান্ত বিচারে অপরাধীদের জেল-জরিমানা হচ্ছে, ফাঁসিও হচ্ছে। সাধারণ মানুষকে সতর্ক থাকার জন্য সরকার নানাভাবে গণসচেতনতামূলক প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। মাদক সমস্যা থাকলেও সরকারের কড়া নীতির কারণে ইরানের যুবসমাজ অন্তত এদিক থেকে অনেকটাই নিরাপদে রয়েছে যা খুব কম দেশেই দেখা যায়। এছাড়া, যারা ইরানে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে সরকারি উদ্যোগে তাদের জন্য রয়েছে আলাদা চিকিৎসাব্যবস্থা। চিকিৎসাশেষে অনেকেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে।
এছাড়া, আফগানিস্তান থেকে মাদক উৎপাদিত হয়ে বিভিন্ন রুটে তা পাচার হচ্ছে। অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রুট হিসেবে ইরানকে ব্যবহারের চেষ্টা করে মাদক ব্যবসায়ীরা। ইরান থেকে সেই মাদক মধ্য-এশিয়া ও ইউরোপে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু মাদকের বিরুদ্ধে ইরান সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে একদিকে যেমন ইরানের যুবসমাজ রক্ষা পাচ্ছে অন্যদিকে মধ্য-এশিয়া ও ইউরোপীয় সরকারগুলোও সর্বনাশা মাদকের ছোবল থেকে নিজ দেশের জনগণকে অনেকাংশে রক্ষা করতে পেরেছে। এ ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশগুলো ইরানের কাছে ঋণী।
সাংস্কৃতিক আগ্রাসন : বিজাতীয়দের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনও সামাজিক সমস্যার অন্যতম মারাত্মক ও বিপজ্জনক দিক। শত্রুরা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালিয়ে ভেতর থেকে ইরানের ইসলামী সমাজব্যবস্থা ও মানুষের চিন্তাচেতনাকে ধ্বংসের চক্রান্ত করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। আধুনিকতার নামে মানুষকে ধর্ম থেকে দূরে সরিয়ে বস্তুবাদের দিকে ধাবিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে তারা ফারসি ভাষায় অসংখ্য রেডিও ও টিভি অনুষ্ঠান চালু করেছে। ইরানের জনগণকে বিভ্রান্ত করতে এবং সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালাতে শত্রুরা চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে ইরানের নীতিনির্ধারকগণ ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন মোকাবেলা করার জন্য বহু পদক্ষেপ নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে ইরান অনেকটাই সফলতার পরিচয় দিয়েছে যেখানে অন্য মুসলিম দেশগুলো বহুগুণে পিছিয়ে রয়েছে।
অভিযোগ কেন্দ্র ‘১১০’ : এটি হচ্ছে পুলিশের কাছে অভিযোগ জানানোর জন্য পুলিশ দপ্তরের বিশেষ নম্বর। তেহরানে যেকোনো ব্যক্তি যদি বিপদ অনুভব করে, কিংবা কারো দ্বারা কোনো লাঞ্ছনা বা হুমকির সম্মুখীন হয়, যদি ঝগড়া-বিবাদ লাগে অথবা প্রতিবেশীর কোনো অন্যায় আচরণের সম্মুখীন হয়, জোরজবরদস্তি কিংবা অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে, এলাকায় কেউ উৎপাত করলে, এমনকি যদি ফোনে কেউ বিরক্ত করে তাহলে যে কেউ ‘১১০’ নম্বরে ফোন করে পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে পারে। অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ডিউটিরত স্থানীয় পুলিশকে অবহিত করার পর তৎক্ষণাৎ পুলিশ গিয়ে হাজির হয় অভিযোগকারী ব্যক্তির কাছে। পুলিশ তখন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়। অর্থাৎ এখানে কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নেয় না। আদালতে গিয়ে মানুষ বিচার পাচ্ছে, অপরাধী তার সাজা পাচ্ছে।
ইসলামী সরকারব্যবস্থা থাকার কারণে এবং বিচারকরা নিজের ধর্মীয় অনুভূতির কারণে সঠিকভাবে বিচার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। ফলে মানুষ অন্তত নির্ভরযোগ্য একটা আশ্রয় পাচ্ছে। আর এ সবই ইরানের ইসলামী বিপ্লবী সরকারেরই অবদান নিঃসন্দেহে।
সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ : ইরানের ইসলামী বিপ্লবী সরকারের আরেকটি বড় অবদান হচ্ছে অনাচার ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন। যে কোনো ব্যক্তি তার নিজস্ব কাজের জন্য প্রশাসনের বিভিন্ন বিভাগে যাচ্ছে নির্দ্বিধায়। স¤পত্তি কিংবা বাড়ি রক্ষা, গাড়ি নিয়ে সমস্যা, টেলিফোন লাইন সমস্যা, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি সমস্যা, পরিচয় পত্র নিয়ে যে কোনো কাজের জন্য অর্থাৎ পৌরসভায় যেকোনো কাজের জন্য কেউ গিয়ে হয়রানির স্বীকার হয়েছে এমন অভিযোগ শোনা যায় না বললেই চলে।
তবে হ্যাঁ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রসেসিংয়ের কারণে কিংবা কর্তব্যে অবহেলা বা ঢিলেমির কারণে ব্যক্তির কাজ আঞ্জাম দেয়া হয়তো কিছু দেরি হতে পারে কিন্তু সে নিরাশ হবে না। আর যদি কোনো ব্যক্তি সমস্যার সম্মুখীন হয় কিংবা অসহযোগিতা করা হয় তাহলেও তার অভিযোগ করার সুযোগ রয়েছে। কারণ, প্রশাসনে জবাবদিহিতার ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে ঘুষ দুর্নীতির কথা শোনা যায় না। ফাইলও আটকে থাকে না। মানুষ ভাবতেই পারে না ঘুষ দিয়ে পৌরসভা কিংবা সরকারি অফিস থেকে নাগরিক সুবিধা আদায় করে নিতে হবে।
সবশেষে যে কথা না বললেই নয় তা হচ্ছে, সন্ত্রাসবাদ কিংবা জঙ্গিবাদ সমস্যা নেই ইরানেÑ যা বর্তমানে সারা বিশ্বের মানুষের ঘুম কেড়ে নিয়েছে, ব্যাহত হচ্ছে তাদের সামাজিক নিরাপত্তা। ইরান হচ্ছে বর্তমান জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে একখণ্ড বরফের টুকরার মতো। অর্থাৎ উত্তর আফ্রিকা থেকে শুরু করে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য এবং পশ্চিম এশিয়াজুড়ে বিস্তীর্ণ এলাকা আজ উগ্র সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন নিহত হচ্ছে অগণিত নিরীহ মানুষ, ঘরবাড়ি ছাড়া হচ্ছে লাখ লাখ আদমসন্তান। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের হিংস্র থাবা থেকে রেহাই পাচ্ছে না পাশ্চাত্যের দেশগুলোও। প্রতিটি মুহূর্ত আশঙ্কায় কাটছে এসব দেশের সরকার ও জনগণের। এত সব দুর্যোগের মধ্যেও ইরানে শান্ত অবস্থা বিরাজ করছে। সাধারণ মানুষ শঙ্কামুক্ত। শত্রুরা সীমান্ত দিয়ে ইরানের মধ্যে সন্ত্রাসীদের অনুপ্রবেশ ঘটানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। এ ব্যর্থতার মূল কারণ হচ্ছে ইরানে রয়েছে শক্তিশালী ও স্থিতিশীল সরকার এবং দেশের মধ্যে কোনো বিভাজন নেই। রয়েছে শক্তিশালী নেতৃত্ব ও ধর্মীয় নেতাদের প্রতি জনগণের আনুগত্য। অন্যদিকে সীমান্ত রক্ষা করতে গিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর বহু সদস্যকে জীবন দিতে হয়েছে। কিন্তু রক্ষা পাচ্ছে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও মূল্যবান মানব স¤পদ। এ ভাবে সামাজিকসহ সার্বিক নিরাপত্তা বিধানে ইরান আজ সারা বিশ্বের মডেলে পরিণত হয়েছে।
লেখক : রেডিও তেহরানের সংবাদকর্মী

হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-এর প্যারিস গমনে ইরানে ও বহির্বিশ্বে প্রতিক্রিয়া

ইরানের ইসলামী বিপ্লবের মহান নেতা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) অনেকগুলো বছর ইরাকের ধর্মীয় নগরী নাজাফে নির্বাসিত জীবন যাপন করেন। ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের চার মাস আগে যখন ইরাকের একনায়কতান্ত্রিক সরকারের পক্ষ থেকে ইরানের তৎকালীন শাহ্কে খুশি করার উদ্দেশ্যে হযরত ইমামের ওপর রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ত্যাগ করে নীরবতা অবলম্বন অথবা ইরাক ত্যাগের যে কোনো একটি পথ বেছে নেয়ার জন্য চাপ দেয়া হয় তখন ইমাম ইরাক ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। প্রথমে তিনি প্রতিবেশী দেশ কুয়েতে যাবার সিদ্ধান্ত নেন এবং এ উদ্দেশ্যে স্থলপথে কুয়েত সীমান্তে পৌঁছেন। কিন্তু কুয়েত সরকার ইরানের শাহ্কে সন্তুষ্ট করার লক্ষ্যে তাঁকে কুয়েতে প্রবেশ করতে দিতে অস্বীকৃতি জানায়। এমতাবস্থায় ইমাম তাঁর পুত্র আহ্মাদ খোমেইনী ও তাঁর সাথে আগত বন্ধু-বান্ধবদের সাথে পরামর্শক্রমে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে গমনের সিদ্ধান্ত নেন এবং ১৯৭৮ সালের ৬ই অক্টোবর বিমানযোগে প্যারিসে উপনীত হন। কিন্তু ইমামের প্যারিস গমন অচিরেই বিজাতীয় ঔপনিবেশিক শক্তিকে এবং ইরানের শাহ্ ও তার সরকারকে আতঙ্কিত করে তোলে।
যদিও ইমামের প্যারিস গমনের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর প্রথমে বাহ্যিক দৃষ্টিতে অনেকেরই মনে হয়েছিল যে, ইরানের সাথে দীর্ঘ সীমান্তের অধিকারী প্রতিবেশী দেশ ইরাক থেকে সুদূর প্যারিসে চলে যাওয়ার ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর আহ্বানে সংঘটিত ইরানের ইসলামী জনতার গণ-অভ্যুত্থানের অপমৃত্যু ঘটবে, কিন্তু তিনি প্যারিসে প্রবেশের পর পরই তাঁর গৃহীত পদক্ষেপসমূহের পরিপ্রেক্ষিতে সকলের কাছেই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, ইমাম খোমেইনী (রহ্.) সেখানে যাবার কারণে ইরানের ইসলামী বিপ্লবকে একটি বৈশ্বিক বিপ্লবে পরিণত করতে পেরেছেনÑ যা তাঁর অপরিসীম প্রজ্ঞার পরিচায়ক। তাই বিভিন্ন বৈদেশিক সরকার ও তৎকালীন ইরানের শাহী সরকার ইমামের প্যারিসে অবস্থানের ব্যাপারে নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে।
যেহেতু ইমাম খোমেইনীর ইরাক থেকে প্যারিস গমন ইরানের ইসলামী বিপ্লবের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সমূহের অন্যতম সেহেতু ইরানের ইসলামিক রেভ্যুলুশন্ ডকুমেন্ট্ সেন্টার (আইআরডিসি) ঐ সময় এ ঘটনায় ইরানের অভ্যন্তরে ও ইরানের বাইরে যেসব প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তা সংগ্রহ ও সংকলিত করেছে। এ সবের মধ্য থেকে দৃষ্টান্ত স্বরূপ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি প্রতিক্রিয়া এখানে পরিবেশন করা হচ্ছে :
ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-এর প্যারিস যাত্রায় ইরানের অভ্যন্তরে সংঘটিত প্রতিক্রিয়া
ইরাকের একনায়কতান্ত্রিক বাথ পার্টি সরকার সব সময়ই হযরত ইমাম খোমেইনীর ওপর কড়াকড়ি আরোপ করে আসছিল, আর ইমামের একনিষ্ঠ অনুসারী ইরানের আলেমসমাজ সব সময়ই এসব খবর রাখতেন। তাই তাঁরা যখন তাঁর ইরাক ত্যাগ করে প্যারিসের উদ্দেশে যাত্রার সংবাদ জানতে পারলেন সাথে সাথে তাঁরা ফরাসি সরকারের কাছে অসংখ্য টেলিগ্রাম পাঠিয়ে ইমামকে সাদর অভ্যর্থনা জানানোর জন্য অনুরোধ জানান। আর এভাবে ইমামের প্যারিস গমন ও ইরানী ওলামায়ে কেরামের টেলিগ্রাম প্রেরণের সংবাদ ইরানী সংবাদপত্র সমূহে ফলাও করে প্রকাশিত হয় ও বিদেশি বার্তা সংস্থাসমূহও তা বিশেষ গুরুত্বের সাথে প্রচার করে। বার্তা সংস্থা এএফপি তার ব্রেকিং নিউজে বলে : ‘আয়াতুল্লাহ্ খোমেইনী গোপনে ও বেশি হৈচৈ না করে প্যারিসে প্রবেশ করেছেন এবং তাঁর বন্ধুদের সাথে একটি অজ্ঞাত স্থানে গিয়েছেন।’
ইরানে এর অনেক আগে থেকেই অনবরত বিক্ষোভ চলছিল। এমতাবস্থায় ইমামের সাথে যে ধরনের আচরণ করা হয় তার প্রতিবাদে নতুন করে প্রতিবাদের বন্যা শুরু হয় এবং বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে ধর্মঘট শুরু করে ও অব্যাহত রাখে।
এ সময় তেহরানের ওলামায়ে কেরাম হযরত ইমাম খোমেইনীর প্যারিস গমন সম্পর্কে একটি ঘোষণাপত্র প্রকাশ করে। হযরত আয়াতুল্লাহ্ সাদূক্বী ইমাম বরাবরে একটি টেলিগ্রাম পাঠান। এ টেলিগ্রামে তিনি বলেন যে, ইয়ায্দের ওলামায়ে কেরাম হযরত ইমামের পথনির্দেশ কার্যকর করার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত রয়েছেন।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ সাদূক্বী ফরাসি প্রেসিডেন্টের কাছেও একটি পত্র প্রেরণ করেন। এ পত্রে তিনি বলেন : ‘আয়াতুল্লাহ্ খোমেইনী বিশ কোটি শিয়া মুসলমানের নেতা। তাই আশা করি, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ও ফ্রান্সের মহান জনগণÑযাঁরা গণতন্ত্র ও মুক্তিকে সমর্থন করেনÑতাঁদের এ মহান মেহমানের যথাযথ আতিথেয়তা ও তাঁকে সাহায্য করা থেকে বিরত থাকবেন না।’

ইমাম খোমেইনীর প্যারিসে অবস্থানে ফরাসি ও ইরান সরকারের প্রতিক্রিয়া
ইমাম খোমেইনী (রহ্.) ফরাসি সরকারকে আগে থেকে কোনো কিছু না জানিয়ে সহসাই তাঁর বন্ধুদের সাথে নিয়ে প্যারিসে গিয়ে হাযির হনÑ যা সেখানে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। যেহেতু হযরত ইমামের ইরাকে অবস্থানের ফলে ইরাক সরকার খুবই অস্বস্তি বোধ করছিল এবং এ নিয়ে সৃষ্ট অচলাবস্থার অবসান ঘটাতে চাচ্ছিল সেহেতু ইমাম খোমেইনী যখন প্যারিসে যাবার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন তখন ইরাক সরকার তাঁকে ও তাঁর বন্ধুদেরকে একটি ইরাকী বিমানযোগে প্যারিসে পাঠিয়ে দেয় এবং বিষয়টি যাতে কেউ জানতে না পারে সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করে।
ইমাম খোমেইনী প্যারিসে উপনীত হলে ফ্রান্সের ইমিগ্রেশন ব্যুরো ফরাসি সরকারের একটি আনুষ্ঠানিক নির্দেশ ও তদসহ ইরাকের প্রেসিডেন্টের একটি পত্র লাভ করে।
ইরাকের প্রেসিডেন্টের পত্রে বলা হয় : মি. খোমেইনীকে জানানো হয়েছে যে, তাঁর ফ্রান্সে অবস্থানকে স্রেফ একজন পর্যটকের অবস্থান হিসেবে গণ্য করা হবে এবং এর মেয়াদ হবে সীমিত। সুতরাং তাঁর ফ্রান্সে অবস্থানকালে তাঁকে যে কোনো ধরনের রাজনৈতিক তৎপরতা হতে বিরত থাকতে হবে।
প্যারিসে অধ্যয়নরত ইরানী ছাত্ররা যখন জানতে পারল যে, হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) প্যারিসে এসেছেন তখন তারা একটি সমাবেশের আয়োজন করল এবং ইমামকে তাতে অংশগ্রহণের জন্য দাওআত করল। জুমু‘আ নামাযের পরে সমাবেশ করা হবে এবং তাতে হযরত ইমাম খোমেইনীর ভাষণের পরে একটি সংবাদ সম্মেলন করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু ফরাসি সরকারের প্রতিনিধিগণ ইমামের সাথে সাক্ষাৎ করে জানান যে, তিনি এ ধরনের কোনো কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।
ইমাম খোমেইনীর ওপর ফরাসি সরকারের এ কড়াকড়ির সংবাদে তেহরানে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। দৈনিক এত্তেলাআত্ লিখে : ‘ফরাসি সরকার হযরতকে প্যারিসে থাকাকালে রাজনৈতিক তৎপরতা হতে বিরত থাকতে বলেছে।’
এছাড়া দৈনিক কেইহান্ লিখে : ‘তথ্যাভিজ্ঞ সূত্র জানিয়েছে যে, ফরাসি সরকার যদি আয়াতুল্লাহ্র রাজনৈতিক তৎপরতাকে প্রতিহত করে তাহলে তিনি শীঘ্রই ঐ দেশ ত্যাগ করবেন।’
এর পর পরই ইরানের বহু সংখ্যক সুপরিচিত আলেম ও বিভিন্ন সংগঠন ফরাসি সরকারের কাছে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-এর প্রতি যথোচিত মেহমানদারির পরিচয় দেয়ার জন্য অনুরোধ জানান। এসব টেলিগ্রামের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ইরানের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় র্মাজা‘ (ধর্মীয় নেতা) হযরত আয়াতুল্লাহ্ র্মা‘আশী নাজাফীর টেলিগ্রাম।
এ সময় আল্জেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-কে লেখা এক পত্রে বলেন যে, তাঁর দেশ ইমাম খোমেইনীকে নিজেদের মধ্যে পেতে খুবই আগ্রহী।
এছাড়া ইন্দোনেশিয়ার ওলামায়ে কেরাম হযরত ইমাম খোমেইনীর কাছে একটি টেলিগ্রাম পাঠিয়ে তাঁকে তাঁদের দেশে গিয়ে থাকার জন্য অনুরোধ জানান।
জানা যায় যে, এ পরিস্থিতিতে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমাম খোমেইনীকে ফ্রান্স থেকে বহিষ্কার করার নির্দেশ সম্বলিত একটি নোটে স্বাক্ষর করেছিলেন, কিন্তু বিষয়টি প্যারিসস্থ ইরান দূতাবাসের মাধ্যমে ইরানের শাহ্কে জানিয়ে তার মতামত জানতে চাওয়া হলে এ ব্যাপারে শাহের সম্মতি না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত ফরাসি সরকার তা কার্যকর করা হতে বিরত থাকে। এ ব্যাপারে শাহের সম্মত না হওয়ার পিছনে কারণ ছিল, শাহের ভয় হচ্ছিল, এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হলে ইরানী জনগণের মধ্যে তার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক বিদ্রোহ সংঘটিত হবে। তাই প্যারিসের ইরান দূতাবাসের মাধ্যমে ফরাসি সরকারকে জানানো হয় যে, ইরান সরকার এ ধরনের পদক্ষেপের পক্ষে নয়। ইরান সরকারের এ মেসেজ ফরাসি কর্মকর্তাদের মধ্যে অস্থিরতার সৃষ্টি করে।
এরপর তেহরানস্থ ফরাসি রাষ্ট্রদূত লিখেন : ‘ইরানের প্রধানমন্ত্রীর সাথে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে জানানো হয় যে, ঐ দেশের (ফ্রান্সের) আইন-কানুন ও নিয়ম-নীতির আওতায় খোমেইনীর ফ্রান্সে অবস্থানে কোনো সমস্যা নেই। ইরানের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে একমাত্র যে অনুরোধ জানানো হয় তা হচ্ছে এই যে, আয়াতুল্লাহ্র তৎপরতা সংক্রান্ত খবরাখবর যেন তাঁকে অবহিত করা হয়। সুতরাং এটাই করা হয়।’
মাহ্মূদ রেযা পাহ্লাভীর অহংবিৎ ঃড় ঐরংঃড়ৎু বইয়ে ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-এর ফ্রান্সে অবস্থান সম্পর্কে তার বিরোধিতার কথা উল্লেখের পর বলা হয়েছে : ‘আমি বিশ্বাস করতাম যে, তিনি প্যারিসে থাকা অবস্থায় যেমন তেমনি অন্য কোথাও থাকলেও ধ্বংসাত্মক হতে পারতেন, তা হামবুর্গেই হোক বা যুরিখেই হোক। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে কোনো যৌথ ফ্রন্ট্ গড়ে তোলার মতো ক্ষমতা আমার ছিল না।’
ইমাম খোমেইনীর প্যারিস যাত্রা সম্পর্কে ব্রিটিশ ও মার্কিন রাষ্ট্রদূতের মন্তব্য
ইরানে নিযুক্ত তৎকালীন ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত মনে করতেন যে, ইরানের তৎকালীন শাহী সরকারের প্রধানমন্ত্রী শারীফ্ এমামী এ ক্ষেত্রে একটি বড় ভুল করেন যা তাঁর বাস্তবতা সম্পর্কে যথাযথ ধারণার অভাবজনিত ও সুস্থ সিদ্ধান্ত গ্রহণে অক্ষমতাজনিত অন্যান্য ভুল থেকে অধিকতর গুরুতর ভুল। ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত বলেন, তিনি (শারীফ্ এমামী) মনে করতেন যে, যেহেতু ইরাকের ধর্মীয় নগরী নাজাফে ইমাম খোমেইনীর উপস্থিতি ছিল শাহের জন্য ঘাড়ে ব্যথার সমতুল্য সেহেতু তাঁকে যদি ঐ শহর থেকে সরিয়ে দেয়া যায় তাহলে তা ইমাম খোমেইনীর অনুসারীদের পরিকল্পনাকে ভণ্ডুল করে দেবে। তিনি মনে করতেন যে, যেহেতু ইমাম খোমেইনী ইরাকে গমনকারী ইরানী যিয়ারতকারীদের সাথে যোগাযোগ করবেন এবং তাদেরকে স্বীয় টেপ রেকর্ডকৃত বাণী প্রদান করবেন, সেহেতু তাঁকে যদি ঐ এলাকা থেকে সরিয়ে দেয়া যায় তাহলে তাঁর অনুসারীদের পক্ষে তাঁর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা অপেক্ষাকৃত কম সম্ভব হবে। তাঁর (ইরানী প্রধানমন্ত্রীর) পরিকল্পনাটি যখন বাস্তবায়ন করা হলো এবং আয়াতুল্লাহ্ খোমেইনী প্যারিসের উদ্দেশে ইরাক ত্যাগ করলেন তখন শারীফ্ এমামী আমাকে ও (ইরানে নিযুক্ত তৎকালীন) মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে বলেন : ‘খোমেইনী প্যারিসে পদার্পণ করার সাথে সাথে (ইরানী জনগণের) মস্তিষ্ক সমূহ থেকে মুছে যাবেন।’
ইরানে নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত তাঁর লিখিত এক গ্রন্থে বলেন : অক্টোবরের শুরুর দিকে শারীফ্ এমামী আমাকে ও আমার ব্রিটিশ সমপক্ষকে আয়াতুল্লাহ্ খোমেইনীর ইরাকের বাইরে চলে যাওয়া সম্পর্কে অবহিত করেন। তিনি বলেন যে, প্রকৃতপক্ষে খোমেইনী স্থলপথে দক্ষিণ দিকে কুয়েত অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছেন। তখন শারীফ্ এমামী সম্ভবত মনে করতেন যে, খোমেইনী যদি একবার সেখানে (কুয়েতে) পৌঁছতে পারেন তাহলে যে কোনো মুহূর্তে সহসাই পারস্য উপসাগরের প্রবেশদ্বারের বাইরে বেরিয়ে গিয়ে একটি মোটর বোটে আরোহণ করে ইরানের দিকে অগ্রসর হতে এবং ইরানের উপকূলে অবতরণ করতে সক্ষম হবেন। তখন তিনি (শারীফ্ এমামী) মনে করতেন যে, খোমেইনীকে যদি (কুয়েতে গমন থেকে) বিরত রাখা না যায় তাহলে তিনি (সহজেই ইরানে প্রবেশ করতে ও) স্বাধীনভাবে ইরানের সর্বত্র ঘুরে বেড়াতে সক্ষম হবেন এবং সরকারের পতন ঘটাবেন।
সূত্র : ইসলামিক রেভ্যুলুশন্ ডকুমেন্ট্ সেন্টার (আইআরডিসি)
অনুবাদ : নূর হোসেন মজিদী

ইরান পরিচিতি : বন্দর আব্বাস

-কামাল মাহমুদ
ইরানের বন্দর আব্বাস সুদীর্ঘকাল থেকে অনেকগুলো নামে সুপরিচিত ছিল। নদীবন্দর হবার সুবাদে পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি এখানে এসেছে, ব্যবসা-বাণিজ্য করেছে, দখল করেছে, বিভিন্ন নামে ডেকেছে। পর্তুগীজরা বন্দর আব্বাসের নাম দিয়েছিল ‘ক্যামবারাত’ বা ‘পোর্ট কমোরাও’। ইংল্যান্ডের ব্যবসায়ীরা এর নাম দিয়েছিল ‘গোমবারান’, ডাচরা ডাকতো ‘গামরুন’ বা ‘গোমরুন’ বলে। এটি মূলত দক্ষিণ ইরানের একটি নদীবন্দর এবং হরমুজান প্রদেশের রাজধানী যা পারস্য উপসাগরের উপকূলে অবস্থিত। এখানে রয়েছে ইরানী নৌবাহিনীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি। এখানে ২৪টি জেটি রয়েছে। বন্দরের আয়তন ২৪৬৭৭০০ স্কয়ার মিটার। ২০১২ সালের হিসেব অনুসারে বন্দর আব্বাসের জনসংখ্যা ৫,৬৭,৫০৮ জন এবং পরিবার সংখ্যা ১,৫০,৪০৪টি। তেহরান থেকে বন্দর আব্বাসের দূরত্ব হলো ১৫০১ কিলোমিটার। আর হরমুজান প্রদেশের কেন্দ্র থেকে ৩২ কিলোমিটার।
ইতিহাস
প্রাচীনকাল থেকেই বন্দর আব্বাস নদীবন্দর হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করে। এর প্রাচীন নাম ছিল ‘গোমরুন’ যার অর্থ কাস্টম হাউস বা শুল্ক ভবন। গ্রীক নাম ছিল ‘কোমেরকীয়ান’ ও ল্যাটিন নাম ‘কোমারসিয়াম’Ñ ইংরেজিতে যার অর্থ দাঁড়ায় কমার্স (বাণিজ্য)।
প্রাক-ইসলামী যুগের ইতিহাস থেকে দেখা যায় যে, প্রথম দারিউশের সময়কালে (খ্রিস্টপূর্ব ৫২২ থেকে ৪৮৬ পর্যন্ত) দারিউশের কমান্ডার জাহাজে চড়ে প্রথম বন্দর আব্বাস থেকে যাত্রা করে লোহিত সাগর দিয়ে ভারত গমন করেন। আলেকজান্ডারের সময়কালে বন্দর আব্বাসের নামকরণ করা হয় ‘হরমিজাদ’। পর্তুগীজ আমলে ১৬ শতকে বন্দর আব্বাসের নামকরণ করা হয় ‘গামরুন’। ১৫৬৫ সালে ইউরোপীয় নাবিকরা এর নামকরণ করেন ‘বামদেশ গোমরুম’ যার অর্থ বন্দর গোমরুম বা শুল্ক ভবন পোর্ট- যা তুর্কি নাম থেকে উদ্ভূত।
১৫১৪ খ্রিস্টাব্দে বন্দর আব্বাস পর্তুগীজদের দখলে চলে যায় এবং পারস্য উপসাগর হয়ে ভারতের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। ১৬১৪ সালে শাহ আব্বাস পর্তুগীজদের হাত থেকে দখল মুক্ত করেন। ইংল্যান্ডের নৌবাহিনীর সহায়তায় শাহ আব্বাস এ নদীবন্দর ও পার্শ্ববর্তী এলাকার ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেন। ১৬২২ সালে পর্তুগীজ ও ইংরেজি নাম একত্র করে নামকরণ করা হয় ‘কোমরু’ বা ‘কম্বো’। যদিও সেখানকার অধিবাসীরা বন্দর আব্বাস বলেই ডাকতো। স্যার থমাস হার বার্য বলেন, বন্দর আব্বাসের অফিসিয়াল ইংরেজি নাম ছিল ‘গোমবোরুন’Ñ যার উচ্চারণ করা হতো ‘গোমরুন’। তাঁর ভাষ্যমতে ১৬৩০ সালে কতিপয় অফিসিয়াল লিখতো ‘গামবৌ’ এবং অন্যরা লিখতো ‘গোমর’ আবার কেউ কেউ লিখতো ‘গামেরুন’। ১৬২২ সালে শাহ আব্বাস ব্রিটিশ ও পর্তুগীজদের পরাজিত করে সম্পূর্ণরূপে বন্দরকে নিজের করায়ত্ত করেন। এ বিজয়ের স্মারক স্বরূপ পোর্টের নামকরণ করেন ‘বন্দর আব্বাস’। বর্তমানে এটিকে ‘শহীদ রাযী পোর্ট’ নামেও অভিহিত করা হয়। যা বর্তমানে ইরানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর, নদীবন্দর ও বাণিজ্য কেন্দ্র। শুধু বন্দরের বিস্তৃতি ২৪০০ হেক্টর। এ বন্দরে প্রতিদিন প্রায় ৭০ মিলিয়ন টন মালামাল ওঠানামা করা হয়।
১৭৯৪ সাল থেকে ১৮৬৮ সাল পর্যন্ত বন্দর আব্বাস একটি লীজ চুক্তির মাধ্যমে ওমান ও যানযীবর সালতানাতের অধীনস্থ হয়, যে চুক্তিটি ফারসি ও আরবি ভাষায় লেখা হয়েছে। ওমান সালতানাত ১০০ মাইল সমুদ্র তীরবর্তী এলাকা (সাজীদ থেকে খামীর পর্যন্ত) এবং যানযীবর সালতানাত ৩০ মাইল সমুদ্র তীরবর্তী এলাকা নিয়ন্ত্রণ করত যার বিস্তৃতি ছিল সামীল পর্যন্ত। তারা হরমুজ প্রণালি ও কেসম আইল্যান্ডও নিয়ন্ত্রণ করতো।
১৮৫৪ সালে সুলতান যানযীবরের সময় ইরানীরা বন্দরকে পুনরুদ্ধার করে। কিন্তু ব্রিটিশ চাপের মুখে ১৮৫৬ সালে অ্যাংলো-পার্সিয়ান যুদ্ধের সময় পারসীয়ানরা আবার ওমানের সাথে লীজ নবায়ন করে; তবে অনেক সহজ শর্তে, যা পারস্যের জন্য লাভজনক ছিল। যেখানে একটি শর্ত ছিল যে, বন্দর আব্বাসে নিয়মিত পার্সিয়ান পতাকা উড্ডীন হবে এবং ভাড়ার হার পূর্বের তুলনায় অনেকগুণ বেশি হবে।
১৮৬৮ সালে ব্রিটিশদের চাপের মুখে পুনরায় পারস্য চুক্তি নবায়ন করে; তবে এবার ভাড়ার রেট ছিল খুব চড়া ও সময়কাল ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত। চুক্তি নবায়নের দুই মাস অতিবাহিত হতে না হতেই পারস্য সরকার চুক্তি বাতিল করে এবং বন্দর ওমানীদের হাত থেকে দখলমুক্ত করে।
পরবর্তীকালে রেযা শাহ পাহলভী বন্দর আব্বাসের উন্নয়নে মনোযোগী হন এবং তাঁর সময়কালে পোর্টের অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেন। প্রতি বছর অনেক পর্যটক বন্দর আব্বাস পরিদর্শন করতে আসেন। বন্দর আব্বাসে শুধু আমদানি-রপ্তানির মালামাল ওঠানামা করে তাই নয়, এখানে একটি ফিশিং পোর্টও রয়েছে। ১৯৯০ সালের রিপোর্ট মতে ইরানের প্রায় ৭৫% পণ্য বন্দর আব্বাস পোর্ট হয়ে আসে। এখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি ফিশিং ইন্ডাস্ট্রি শিপ ইয়ার্ড। সমুদ্র লেভেল থেকে ৩০ ফুট উচ্চতায় বন্দর আব্বাস অবস্থিত।
এখানে বিভিন্ন প্রকৃতির জাহাজ আসা-যাওয়া করে। যেমন : কার্গো শিপ, লাইটার, বাল্ক কেরিয়ার, কোস্টার, বার্জ, সিমেন্ট কেরিয়ার, কন্টেইনার শিপ, ড্রাই কার্গো, অয়েল কেরিয়ার, লাইভস্টক কেরিয়ার, রো-রো শিপ, ভেসেল কেরিয়ার, ফরেস্ট প্রোডাক্ট কেরিয়ার, ট্যাঙ্কার, কেমিক্যাল কেরিয়ার, লিকুইড গ্যাস কেরিয়ার, প্যাসেঞ্জার শিপ, মটর বোট, হাইড্রোগ্রাফিক শিপ, আইস ব্রেকার, পেট্রোল শিপ, হসপিটাল শিপ, ক্রুজার, এয়ারক্রাফ্্ট কেরিয়ার, ট্রেনিং শিপ, মেডিকেল ট্রান্সপোর্ট প্রভৃতি।
আবহাওয়া : বন্দর আব্বাসের আবহাওয়া সাধারণত উষ্ণ। গ্রীষ্ণকালে এখানকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা প্রায় ৪৯০ সেন্টিগ্রেড (১২০ ফারেনহাইট) আবার শীতকালে ৫০০ সেন্টিগ্রেড (৪১ ফারেনহাইট) এ নেমে আসে। বার্ষিক বৃষ্টির গড় ১৭০ মিলিমিটার এবং গড় আর্দ্রতা ৬৫%।
যাতায়াত : বন্দর আব্বাস মূলত পোর্টের কারণে বিখ্যাত হলেও এটি একটি শহরও বটে। এখানে রয়েছে ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট যেখানে যাত্রীবাহী বিমানের পাশাপাশি অনেক কার্গো বিমানও ওঠানামা করে। বন্দর আব্বাস থেকে সিরজান পর্যন্ত ৩০০ কিলোমিটার, কেরমান পর্যন্ত ৪৮৪ কিলোমিটার, সিরাজ পর্যন্ত ৬৫০ কিলোমিটার এবং যাহেদান পর্যন্ত ৭২২ কিলোমিটার সড়কপথ রয়েছে। ১৯৯৩ সালে বন্দর আব্বাস থেকে ইয়ায্্দ, কোম, তেহরান ও কাজভীনসহ ইরানের বিভিন্ন এলাকার সাথে রেল যোগাযোগ শুরু হয়। নদী পথে যাতায়াতের জন্যও বন্দর আব্বাস ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
ভাষা : বন্দর আব্বাসের লোকেরা সাধারণত আঞ্চলিক ফারসি ‘বন্দরী’ ভাষায় কথা বলে। বন্দরী ভাষাতে ইউরোপীয়, আরবি, ফারসি ও বেলুচী শব্দের মিশ্রণ রয়েছে।
দর্শনীয় স্থান : এখানে দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে- মসজিদ, মাযার ও সিমেট্রি। বিখ্যাত আবাসিক হোটেলের মধ্যে রয়েছে হরমুজ হোটেল, এটিলার হোটেল, বন্দর আব্বাস হোমা হোটেল, পার্সিয়ান গাল্ফ হোটেল, দরিয়া হোটেল, হোটেল আমিন, হাফ্্ত রঙ প্রভৃতি।
রপ্তানি পণ্য : বন্দর আব্বাস থেকে যে সকল পণ্য রপ্তানি করা হয় তন্মধ্যে রয়েছে টেক্সটাইল, রিফাইন্ড অয়েল, অ্যালুমিনিয়াম, স্টীল, ক্রোমিয়াম, রেড অক্সাইড, লবন, সালফার, মাছ, মৃৎশিল্প, খেজুর, লেবু, তামাক প্রভৃতি। কেনাকাটার জন্য রয়েছে সিটি সেন্টার মল।
খেলাধুলা : বন্দর আব্বাসের খেলাধুলার মধ্যে ফুটবল সবচেয়ে জনপ্রিয়। জনপ্রিয় ফুটবল ক্লাবগুলোর মধ্যে রয়েছে অ্যালুমিনিয়াম হরমুজগান ও শহরদারী বন্দর আব্বাস।
শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান : বন্দর আব্বাসের বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ইউনিভার্সিটি অব মেডিকেল সাইন্স, ইউনিভার্সিটি অব হরমুজগান, ইসলামিক আযাদ ইউনিভার্সিটি অব বন্দর আব্বাস প্রভৃতি।
বন্দর আব্বাসের রয়েছে সুদীর্ঘকালের ঐতিহ্য। নানা উত্থান-পতনের সাক্ষী এই বন্দর আব্বাস। নানা হাত বদল হয়ে বন্দর আব্বাস আজ স্বমহিমায় অবস্থান করছে। ইরানের নদীপথের ঐতিহ্য অনেকখানি বন্দর আব্বাসকে ঘিরেই। ইরানের পণ্য আমদানি ও রপ্তানিতে বন্দর আব্বাস ব্যাপক ভূমিকা পালন করে আসছে সুদীর্ঘকাল থেকেই। ইরানী ও বহিঃবিশ্বের পর্যটকদের কাছে বন্দর আব্বাস একটি আকর্ষণীয় ও দর্শনীয় স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।