বৃহস্পতিবার, ১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৪ঠা আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

আমার ইরান ভ্রমণ

পোস্ট হয়েছে: এপ্রিল ৬, ২০১৬ 

সাবিনা সিদ্দিক

ঘুম ভাঙার পর সকালে প্রথম যে চিন্তাটা মাথায় এলো তা হলো- আমি এখন কোথায়?
তেহরান? মাসহাদ? কোম? ঢাকা?
অবশেষে বুঝলাম আমি ঢাকায়। গত কয়েকদিন এমনভাবে তেহরান, কোম আর মাসহাদ ঘুরেছি যে, মনে হয় ঘুমের জন্য দুঘণ্টাও সময় পাইনি। তাই ঢাকায় ফিরে প্রথমেই একটা লম্বা ঘুম দিলাম।
ওংষধসরপ ঈঁষঃঁৎব ধহফ জবষধঃরড়হ ড়ৎমধহরুধঃরড়হ আয়োজিত ৬ঃয জবভৎবংযবৎ ঈড়ঁৎংব ড়হ ডড়সবহ ধহফ ঋধসরষু ঝঃঁফরবং চৎড়মৎধস এ অংশগ্রহণ করতে ইরান গিয়েছিলাম। হাফিজ, ফেরদৌসী, সা’দী, রুমীর ইরান। যে ইরান সেই ছোটবেলা থেকেই মনের মধ্যে স্বপ্নের দেশ হয়ে জেগে ছিল। ঠিক কবে প্রথম আমি ইরানকে ভালোবেসেছিলাম মনে করার চেষ্টা করি।
আমাদের বাড়িতে সাহিত্যচর্চা চলত খুব। বিভিন্ন গল্পের আর কবিতার বই, পত্রিকা, নিউজপেপার, এসব নাড়াচাড়া করেই বড় হয়ে উঠছিলাম। একদিন বড় ভাইয়ের টেক্সট বইয়ে পেলাম হাফিজের স্বপ্ন কবিতা। ভাই পড়তেন আর আমরা শুনতাম। স্বপ্নে কবি হাফিজের কাছে যে মেয়েটি এসেছিল- ‘আংগুরের মতো অলোক গুচ্ছে গোলাপের মালা পড়ি’, তাকে আমার অতিশয় আপন করে নিজের মূর্তিতে আনার চেষ্টায় একমাত্র বাধা হয়ে দাঁড়াতো আমার চুল।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অনবদ্য অনুবাদের কারণে অনেক ফারসি কবিতা বাংলায় পড়ার সুযোগ হয়েছে। ইরানের কবিদের কারণে ইরানের প্রতি টান দিন দিন বাড়ার সাথে সাথে একটা অপূর্ণতা সব সময় ছিল, তা হলো ভাষা। মনে হতো, ‘আহা যদি ফারসিতে কবিতাগুলো পড়তে পারতাম!’ একদিন সেই সুযোগও এসে গেল।
ওৎধহ ঈঁষঃঁৎধষ ঈবহঃৎব এ ভাষা শিক্ষা কোর্সে ভর্তি হলাম। জুনিয়র ও সিনিয়র কোর্স শেষ করলাম। তখন একটু একটু ফারসি পারি। সামান্য কথোপকথন। পরিচয়, নাম বলা অথবা কুশল বিনিময়। আমি শিক্ষকদের বার বার বিরক্ত করি এটা জিজ্ঞেস করে যে, কবে সাহিত্য, কবিতা পড়ব, কবে বই পড়ে বুঝব। উনারা বলেন, ‘ধৈর্য ধরেন। উরঢ়ষড়সধ ঈড়ঁৎংব করলে তখন কবিতা বুঝবেন।’
একদিন ফোন এলো ওৎধহ ঈঁষঃঁৎধষ ঈবহঃৎব থেকে। উরঢ়ষড়সধ শুরু হচ্ছে। আর ঞবধপযবৎ একজন ইরানী খানুমে খসরুয়াবাদী। আমি একদিনও নষ্ট না করে ভর্তি হয়ে এলাম।
ক্লাস শুরু হলো। অত্যন্ত হতাশ হয়ে লক্ষ্য করলাম যে, ক্লাসের পড়া আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। এমনকি শিক্ষক মিসেস খসরুয়াবাদীর ভাষাও ধরতে পারছি না। (গত চার বছরে) জুনিয়র ও সিনিয়র কোর্সে যা কিছু শিখেছিলাম চর্চার অভাবে সব ভুলে গেছি। অন্যান্য ছাত্রছাত্রীর অসুবিধা হচ্ছে না। কারণ ওরা ওদের পূর্বের কোর্স শেষ হবার সাথে সাথে উরঢ়ষড়সধ ঈড়ঁৎংবটা পেয়েছে। আমার মতো চার বছর গ্যাপ হয়নি। আমি মন খারাপ করে ক্লাসে যাই। আবার মন খারাপ করে বাসায় ফিরি। মনে হয় আমার আর কোনদিন ফারসিতে কবিতা পড়া হবে না। ভাষাটাও জানা হবে না। কিন্তু আমি ক্লাসে যাওয়া বন্ধ করি নি। চুপচাপ ক্লাসে বসে থাকি আর ম্যাডামের কথা শুনি। এভাবে চলতে চলতে হঠাৎ একদিন মনে হয়, আমি হারব না। আমাকে পারতেই হবে। এতদূর এসে আমি হাল ছেড়ে দিতে পারি না। আমি আমার দিন-রাত এক করে ফেললাম। সারাক্ষণ পড়তে থাকলাম। বাংলা ও ফারসি ভালো জানেন এমন অনেকের সাহায্য নিলাম। আমার ক্লাসের বইয়ের পড়া বোঝার জন্য ম্যাডামও অনেক সাহায্য করলেন।
ধীরে ধীরে আমার চোখের সামনে উন্মুক্ত হতে থাকল এক নতুন ইরান। এ যেন স্বপ্নের চেয়েও আশ্চর্যময়। কবিতার চেয়েও রহস্যময় এক বিপুল ধনরতœ সমৃদ্ধ ঞৎবধংঁৎব ওংষধহফ। প্রাকৃতিক, ঐতিহাসিক আর সাহিত্যের এত এত ধনরতœ নিয়ে নিভৃতে বসে আছে। আমি অভিভূত হয়ে গেলাম যখন পড়লাম ফেরদৌসীর সেই বিখ্যাত কবিতা-
توانا بود هرکه دانا بود
زگهواره تاگور دانش بجوی
জ্ঞানই শক্তি। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অšে¦ষণ করো।
অথবা ওমর যৈয়মের কথাই
اسرار ازل را ن تو دانی و نه من
وین حل معما نه تو دانی و نه من
পরকালের রহস্য না তুমি জানো, না আমি….
আবার কখনো হাফিজের
اگر آن ترکی شرازی به دست آد دل مارا
به خاله هند ویش بخشم سمرقند و بخارا را
যদি সিরাজ শহরের সেই তুকি মেয়ে আমার হৃদয়ে আসে তবে তার কালোতিলের বিনিময়ে বিলিয়ে দিব সামারখান্দ, বোখারী
অথবা সাদীর
بنی آدم اعضای یک پیکرند
کم در آفرینش ز یک گوهرند
সকল মানব জাতির এক।
এভাবে একে একে হাফিজ, ফেরদৌসী, সা’দী, খৈয়াম, বাহসি বাফি, রাহী মোয়ায়ীরি ছাড়িয়ে প্রাকৃতিক ইরানে ঘুরেছি কল্পনায় যা কিনা এশিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত একটি অপূর্ব দেশ। এর উত্তরে আযারবাইজান, আর্মেনিয়া, তুর্কমানিস্তান, পূর্বে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, পশ্চিমে তুর্কি ও ইরাক অবস্থিত।
পারস্য উপসাগর ও এর দ্বীপগুলো রয়েছে দক্ষিণে যেখানে প্রচুর তেল ও গ্যাস রয়েছে। কাস্পিয়ান সাগর আলবোর্জ পর্বত, জঙ্গল নিয়ে উত্তর সেজেছে তার আপন সৌন্দর্যে। কেন্দ্র ও পূর্বে রয়েছে এর লবণাক্ত মরুভূমি। তাই প্রায় সাত মিলিয়ন জনসংখ্যার অধিকাংশই বাস করে পশ্চিম-উত্তরে।
ইন্দো-ইউরোপীয়ান থেকে আর্য, তারপর ইরানী হয়ে ওঠা এই জাতির ইতিহাসত ও সভ্যতা অতি সমৃদ্ধ। সাহিত্য, চিকিৎসাবিদ্যা শিল্প, স্থাপনা কোন কিছুতেই কম নেই। এখানে ইসলাম-পূর্ব এবং ইসলাম-পরবর্তী দুই যুগে ভাগ হয়ে আছে এর সংস্কৃতি।
ইসলাম-পূর্ববর্তী চারটি বিশাল সাম্রাজ্যের কিছু ধ্বংসাবশেষ আজো সংরক্ষিত রয়েছে। যেমন হাখামানেশি শাসকদের উৎসবের মূল ভবন শিরাজের তাখ্তে জামশীদÑ যা উৎসবের মূলভবন এবং বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিবর্গের অভ্যর্থনা কক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। আলেকজান্ডার ইরান জয় করে এতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আর রাজন্ডুত্র দায়িয়ুসের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে বলে, ‘ভেঙে ফেল এর কবর। আমাকে দেখাও, সে এমন কী ছিল যে, সারা পৃথিবী শাসন করেছে!’
একটা ঘোরের মধ্যে কখন যেন ছয় মাস পার হয়ে গেল আর আমার উরঢ়ষড়সধ’র ফাইনাল পরীক্ষাও শেষ হয়ে গেল। রেজাল্ট আনতে গেলাম। দেখি ম্যাডাম হাসছেন। আমাকে নিজে নিয়ে গেলেন নোটিশ বোর্ডের সামনে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না আমি, ৯৬% নাম্বার পেয়েছি। আর আমি ম্যাডামের সাথে ফারসিতে কথা বলছি আর উনার কথা বুঝতেও পারছি।
আমার অবাক হবার আরো বাকি ছিল। ম্যাডাম বললেন, ‘একমাস পর তেহরানে একটা ডড়ৎশংযড়ঢ় হবে। বাংলাদেশ থেকে আমরা তোমার নাম পাঠাচ্ছি। প্রস্তুতি নাও তুমি সিলেক্ট হয়ে গেলে যাবে তো?’ আমি আনন্দে কিছু সময়ের জন্য বোবা হয়ে গেলাম। ঘরে ফিরলাম এক অদ্ভুত অনুভূতি নিয়ে।
এরপর একদিন জানতে পারলাম যে, ইরান থেকে আমাকে সিলেক্ট করা হয়েছে। ইরানের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দাওয়াতপত্রও চলে এলো একদিন। ৬ই অক্টোবর ২০১৫ আমি তেহরান পৌঁছলাম। আমার যাত্রা ছিল ঢাকা থেকে দুবাইতে ট্রানজিট নিয়ে সেখান থেকে তেহরান। বিশাল এমিরেট-এ বসে আছি। জানালা দিয়ে আকাশ দেখছি। সকাল ১০.১৫ তে ফ্লাইট ছিল, কিন্তু এক ঘণ্টা লেইট। আমার তেহরান পৌঁছতে সন্ধ্যা ৭টা বেজে যাবে। আমি এই প্রথম একা দেশের বাইরে এতদূর যাচ্ছি। একটুও ভয় করছে না। মনে হয়, ইরান যাচ্ছি সেই জন্য। আনন্দ এত বেশি ছেয়ে আছে যে, মনের মধ্য ভয়ের কোন জায়গা নেই। আরেকটা ব্যাপার কাজ করছে, তা হলো মনে হচ্ছে খুব চেনা খুব আপন কোন জায়গায় যাচ্ছি।
তেহরান এয়ারপোর্টে নেমে খুব ভালো করে মাথায় স্কার্ফ জড়িয়ে নিলাম। কারণ, মেয়েদের হিজাব এখানকার নিয়ম। একটি কাগজে ফারসিতে আমার নাম লিখে অপেক্ষা করছিলেন জনাব লুতফি। আমি কাছে গিয়ে পরিচয় দিতেই উনি হাসিমুখে আমাকে নিয়ে গেলেন একটি অপেক্ষমাণ বাসের দিকে। সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল পাকিস্তান ও ভারত থেকে আগত মেয়েরা। ওদের ফ্লাইট আমার আগে পৌঁছেছে, তাই ওরা আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
রাতের অন্ধকারে বাস ছুটে চলেছে তেহরানের পথে। তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না, তবু আমরা খোলা জানালায় স্কার্ফ উড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকি। ঠা-া বাতাস, তবে সহনীয়।
উধহবংয চধলড়ড়যধহ ঈড়সঢ়ষবী এ পৌঁছলাম অনেক ক্লান্তি নিয়ে। এর মধ্যেই নিজেদের মধ্যে পরিচয় আলাপ সেরে নিচ্ছি। প্যাকেট ডিনার সাথে নিয়ে রুমে পৌঁছলাম। ক্ষিদে নেই একদম। বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। অন্ধকারেও বোঝা গেল সামনে খোলা চত্বর। রাস্তায় আলো জ্বলছে। মনে হলো যেন সামনে উঁচু পাহাড়। আমার রুম এগারো তলায়। এত উঁচু থেকে রাস্তা ও বাড়ির আলোগুলো বিন্দুর মতো মনে হলো। বাতাসে নতুন শহরের গন্ধ। আমি এই শহরের প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ করব।
ঘুম ভাঙল অনেক ভোরে। তখনও অন্ধকার, পুরোপুরি সকাল হয়নি। আমার রুমমেট পাকিস্তানের নাদিন নামায পড়ছে আর ওর সঙ্গী রেজিয়া কোরআন শরীফ পড়ছে। আমিও ওজু করে নামায ও কোরআন পড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। রাতের ধারণাই ঠিক। সামনে বিশাল পাহাড়। রাস্তা এঁকে-বেঁকে চলে গেছে পাহাড়ের মধ্য দিয়ে। এক কথায় অপূর্ব!
একটা ফ্লোর ওপরেই আমাদের নাস্তার আয়োজন। তার পাশের রুমেই অডিটোরিয়াম হল। নান, বাটার, পনির, দুধ, চা, মধু খেয়ে আমরা ওরিয়েন্টেশনে উপস্থিত হই।
আমাদের ঐড়ংঃ মিসেস হেজদি উধহবংয চধুযড়ড়যধহ ঈড়সঢ়ষবী-এ বেলা ১১টায় আমাদের পরস্পরের সাথে পরিচয়ের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সূচনা করলেন।
উৎ. ঔধারফ এবং গং. ঝযধয গড়ৎধফর প্রথম যে খবপঃঁৎবটি দিলেন তার বিষয় ছিল অহ ধহধষুংরং ধহফ ংঢ়বপরভরপধঃরড়হ ড়ভ যঁসধহ ৎরমযঃং ভৎড়স ঃযব ঢ়বৎংঢ়বপঃরাব ড়ভ ওংষধস ধহফ ঃযব ডবংঃ রিঃয ধহ বসঢ়যধংরং ড়হ ড়িসবহ’ং ৎরমযঃং.
খবপঃঁৎব-এ আমরা সব দেশ অর্থাৎ ইরান, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত সবাই অংশ নিলাম।
দুপুরের খাবার সবাই একসাথে খেতে বসলাম। একটা প্লেটে রাইস সাথে মাছ। আমাদের দেশের মতো ঝোল নয়, অনেকটা তন্দুরির মতো ফ্রাই। রাইসটাও খুব চিকন চালের এবং জাফরান মাখানো। সাথে ছোট একটা রসালো লেবু দু’টুকরো করা। একপাশে আলু সেদ্ধ আর কয়েকটা ছোট ছোট জলপাই সেদ্ধ। আরেকটি বাটিতে বেশ কিছু সব্জি, যেমন বাঁধা কপি, ক্যাপসিকাম, গাজর, শশা ইত্যাদি থাকে থাকে সুন্দর করে কেটে সাজানো। আরেকটা ছোট বাটিতে দই। আর কোল্ড ড্রিংকস। এই হলো লাঞ্চ। খুবই স্বাস্থ্যকর।
বিকালের প্রোগ্রাম ছিল প্রেস টিভি ভিজিট। আমরা বের হয়ে এলাম দিনের আলোয়। ঠবষবহলধশ ঝঃ. এর উধহবংয ঢ়ধুযঁযধহ ঈড়সঢ়ষবী যেটাকে বলা হয় চবধপশ ড়ভ ঃযব হড়ৎঃয ড়ভ ঞবযৎধহ.
দিনের আলোর যেন ঝলমল করছে উড়ৎসরঃড়ৎু প্রাঙ্গন। নিচে ফুলের বাগান। কত রকম যে গোলাপ সেখানে! লাল, সাদা, হলুদ… আমরা অবাক হয়ে চারদিক দেখতে থাকলাম। ইরানে এখন فصل پایيز অর্থাৎ শরৎ ঋতু। আকাশও শরতের মতো হালকা সাদা মেঘ আর নীলে ভরা। মৃদু মন্দ বাতাস। বিকেলের পড়ন্ত রোদের আভা ছড়িয়েছে কাছের পাহাড়ে। এত কাছে যে রাস্তা পার হলেই ছোঁয়া যাবে। আর এত উঁচু যে, ওপারের আকাশ ঢেকে গেছে।
আমরা মুগ্ধ হয়ে চারদিক দেখতে দেখতে বাসে উঠলাম। তেহরান শহরের মধ্য দিয়ে বাস চলছে। আমি অবাক হয়ে ভাবছি যে, সত্যিই আমি এখন ইরানে আছি! তখনও সন্ধ্যা হয়নি। পড়ন্ত বেলার হালকা আলোয় দেখা গেল রাস্তার পাশের কৃত্রিম ঝরনা, গোলাপ বাগান আর কাশফুল। ইরানে কাশফুল হয় দেখে খুব ভালো লাগলো। হালকা বাতাসে দুলতে থাকা কাশ ছাড়িয়ে আমাদের বাস এগিয়ে চলল।
আমরা চৎবংং ঞঠ ঐবধফয়ঁধৎঃবৎ পৌঁছলাম। তখন মাগরিবের আযান হচ্ছে। ‘ঘবংি অহব’ি ঝষড়মধহ নিয়ে আট বছর আগে ২০০৭ সালের ৪ জুলাই ওংষধসরপ জবঢ়ঁনষরপ ড়ভ ওৎধহ-এর এই ডড়ৎষফরিফব ঊহমষরংয ইৎড়ধফপধংঃরহম ঈযধহহবষ শুরু হয়, যেখানে রয়েছে ঊহমষরংয হবংি এবং উড়পঁসবহঃধৎু হবঃড়িৎশ, ষরাব ঢ়ৎড়মৎধস। সারা পৃথিবীতে এদের অফিস ও ব্যুরো রয়েছে, যেমন খড়হফড়হ, ইবরৎঁঃ, উধসধংপঁং, কধনঁষ এবং এধুধ ঝঃৎরঢ়, এমনকি বাংলাদেশেও এদের সাংবাদিক রয়েছে।
চৎবংং ঞঠ-এর মূল রহস্য হলো এরা সত্য খবর প্রচার করে। এদের খবর এতই বিশ্বাসযোগ্য যে, ঈঘঘ ও ইইঈ এদের কাছ থেকে খবর কিনে নেয়।
আমরা খরাব ঝঃঁফরড় দেখছিলাম। এৎববহ ঈড়াবৎ করা বিশাল ঝঃঁফরড়, পেছনে বিশাল ঞঠ ঝপৎববহ। ঠিক মাঝখানে খবর পাঠকের বসার স্থান। তাঁর পায়ের কাছে একটা ঝঃধহফ, সেটাতে প্রয়োজন মতো চাপ দিয়ে নিজেই স্ক্রিন থেকে লেখা খবরগুলো গড়াব করতে পারেন।
আমাদের কথার মধ্যেই খরাব খবরের সময় হয়ে এল। আমরা কাঁচের ঘরের একপাশে ফিরে এসে দেখলাম পাঠক খবর পড়ছেন আর অন্যদিকে পেছন ফিরলেই দেখতে পেলাম ঞঠ-তে তাঁর খবরটি প্রচার হচ্ছে। পরদিন সকাল ১০টায় আমরা নির্ধারিত বাসে চড়ে ঐড়ষু ঈরঃু ছড়স এর দিকে রওয়ানা হলাম। প্রথমে ডড়সবহ ধহফ ঋধসরষু ঝঃঁফরবং ঈবহঃৎব ঠরংরঃ করলাম। এদের জবংবধৎপয ঈবহঃৎবটি খুবই সমৃদ্ধ আর বিশাল। মাশহাদের পরে কোমকে ২য় ঐড়ষু ঈরঃু বলা হয় ইরানে।
তখন প্রায় দুপুর। আমরা পথের ধারের ব্যাংকে আমাদের উড়ষষধৎ বদলে জরধষ করে নিলাম। তখনও আমরা কেউ ইরানী সীম কার্ড পাইনি। অপেক্ষা করছি, কোন একটা সুযোগে কিনে ফেলতে হবে।
রাস্তার ওপারেই ঞযব ঐড়ষু ঝযৎরহব ড়ভ খধফু ঋধঃরসধ গধংঁসবয (ঝঅ)। এর অপূর্ব কারুকাজ সত্যি মুগ্ধ করার মতো। যিনি ছিলেন ৮ম ইমাম রেযা (আ.)-এর বোন। আমরা ঝযৎরহব’ং জবংঃধঁৎধহঃ এ খঁহপয করে মাযারের ভেতরে গেলাম। মাযারের প্রতিটি দেয়ালে কারুকাজ। বিশাল চত্বর। আমরা আমাদের নামায সেরে মাযার যিয়ারত করে জবংধষধঃ ওহংঃরঃঁঃব-এ এলাম গং. ঞঁৎশরধহ এর ‘গড়ফবংঃু ধহফ ঐরলধন রহ ওংষধস ধহফ ঃযব অংরধ’-এর ওপর খবপঃঁৎব-এ অংশ নেয়ার জন্য। সন্ধ্যায় গেলাম ঔধসশধৎধহ সড়ংয়ঁব।
যামারান যাওয়া খুবই উল্লেখযোগ্য ছিল আমাদের জন্য। তেহরানের উত্তরে এই ছোট শহরটি এক সময় একটি ছোট্ট স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম ছিল। এর সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো এটি ইরানের ইসলামী বিপ্লবের মহান নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেইনী (রহ.)-এর বাড়ি এবং ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ওহংঃরঃঁঃব ড়ভ উরধষড়মঁব অসড়হম ঈঁষঃঁৎবং ধহফ ঈরারষরুধঃরড়হং-এর অবস্থান ঔধসধৎধহ ঈড়সঢ়ড়ঁহফ এর মধ্যেই।
ভ্রমণের মধ্যেই আমরা কখনো বইয়ের দোকান, কখনো বাজার সবই ছুঁয়ে যাচ্ছি একটু করে। আমাদের মধ্যে অনেকেই কখনো বই কিনছি, কখনো পেস্তা, জাফরান বা মিষ্টি গজ যার যা পছন্দ ইরানের ঐতিহ্যবাহী খাবার কিনে নিচ্ছি।
আমি সারাক্ষণ খুঁজছি হস্তশিল্পের দোকান। গাইডদের বার বার মনে করে দিচ্ছি صنايع دستى বলে। ওরা হেসে জবাব দিচ্ছে যে, সময় হলেই নিয়ে যাবে।
আমাদের সাথে দু’জন ঞৎধহংষধঃড়ৎ ছিলেন। একজন ইরানী; তাঁর নাম এলহাম। আর একজন কুর্দি, নাম শিরিন। দু’জনই এত মিশুক যে, দু’জনের সাথেই বন্ধুত্ব হয়ে গেল। আর সুযোগ পেয়ে ফারসিতে কথা বলতে থাকলাম। কখনো ফারসি কবিতা-গান, কখনো ইতিহাস। ওরা প্রায়ই বলত, ‘তুমি তো দেখছি ইরানের অনেক কিছু জান।’ এলহামের ঠোঁটের ওপর একটা সুন্দর তিল। আমি ওকে ডাকতাম হাফিজের কবিতার تركى شرازى বলে। এভাবে দিন দিন আমাদের বন্ধুত্ব বেড়ে চলল। সন্ধ্যায় গেলাম মিলাদ টাওয়ার বা برج ميلاد দেখতে। একে ঞবযৎধহ ঞড়বিৎ-ও বলা হয়। ২০০৭ সালে নির্মিত এই টাওয়ারটি ঝযধযৎধশ-ব এযধৎন এবং এরংযধ ফরংঃৎরপঃ এর মাঝে অবস্থিত। এর উচ্চতা মাটি থেকে অ্যান্টেনা পর্যন্ত ১.৪২৭ ফিট। এর একেবারে ওপরে ১.০৩৩ ফিটের কাছে রয়েছে ১২তলা। যেখানে ঋরাব ঝঃধৎ ঐড়ঃবষ, ঈড়হাবহঃরড়হ ঈবহঃৎব, ডড়ৎষফ ঞৎধফব ঈবহঃবৎ এবং ওঞ চধৎশ সত্যি দেখার মতো! ওপর থেকে আলো জ্বলা শহর দেখতে খুবই চমৎকার!
একেবারে ওপর তলায় ট্রেড ফেয়ার চলছিল। আমি ঘুরতে ঘুরতে দেখি একটি ছোট দোকানে সারি সারি সাজানো আংটি। প্রতিটিতে সুন্দর সুন্দর কবিতা লেখা। গাইড বলল, ‘এগুলো নিও না, এখানে অনেক দাম।’ আমি একটা আংটি তুলে দেখলাম। খুব সুন্দর। কবিতাটা ক্যালিগ্রাফিতে লেখা, তাই বুঝতে পারছি না। অর্থ জিজ্ঞেস করতেই গাইড বলল, “এখানে লেখা আছেÑ ‘তুমি পাশে থাকলে আমি দশটা মরুভূমি আনায়াসে পার হয়ে যেতে পারব।” বললাম, ‘যত দাম হোক, এটা আমি নিবই।’
আমার হাজবেন্ডের জন্য আংটিটি স্যুভেনির হিসাবে নিয়ে আমার খুবই ভালো লাগল। এর চেয়ে ভালো বাক্য আর কি হতে পারে যা আমি তাকে বলতে পারি? আজ তার জন্যই তার সহযোগিতার কারণেই আমি আমার স্বপ্নের ইরানে আসতে পেরেছিÑ যেটি আমার কাছে দশটি মরুভূমি পার হবার মতোই।
পর পর দু’দিন কাটল আমাদের খবপঃঁৎব, আলোচনা আর মাঝে মাঝে মার্কেট ও বাগানে ঘুরে। উৎ. ঘধভরংর-এর ডড়সবহ’ং ঝঃধঃঁং ধহফ জরমযঃং রহ ছঁৎধহরপ ঠবৎংবং ধহফ ঃযব চৎড়ঢ়যবঃরপ খরভব ঝঃুষব ঞৎধফরঃড়হ, উৎ. গড়বরহর ঋধৎ এর জড়ষবং ধহফ জবংঢ়ড়হংরনরষরঃরবং ড়ভ ডড়সবহ ধহফ ঋধসরষু জবষধঃবফ ঐধৎসং এবং গৎ. ঝড়ফধমধৎ এর অহ ঊীঢ়ষধহধঃরড়হ ড়ভ ঃযব ওংষধসরপ খবমধষ ঝুংঃবস রহ ঃযব ঋরবষফ ড়ভ ডড়সবহ ঈড়সঢ়ধৎধঃরাব অহধষুংরং ড়ভ ডড়সবহ’ং জরমযঃং রহ ওংষধস ্ ঃযব ডবংঃ ও সেই সাথে ডড়সবহ রহ জবষরমরড়ঁং ঊঢ়রংঃবসড়ষড়মু ধহফ খবমধষ ঝুংঃবস-এর ওপর খবপঃঁৎব, আলোচনা-সমালোচনা ও বিভিন্ন মত বিনিময়ের মধ্য দিয়ে।
সারা দিন আমরা সময় পেতাম না। রাতে এত ক্লান্ত থাকতাম যে, বিছানায় শোয়ামাত্রই ঘুম। কিভাবে যে দিনগুলো কাটতে থাকল! এর মধ্যেই হাসি-আনন্দ নিয়ে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইরান, ভারতের সঙ্গী-সাথিরা মিলেমিশে এক হয়ে এক পরিবারের মতোই হয়ে গেলাম। কেউ অসুস্থ হলে তার দেখাশোনা, কেউ খেতে না পারলে তার জন্য অন্য খাবার জোগার করাÑ যেন এই বিদেশ বিভূঁইয়ে পরিবার-পরিজন ছেড়ে আসা মানুষগুলো কেউ নিজেকে একা মনে না করে।
রাতে আমরা পার্কে গেলাম। এত রাতেও পার্কে এত মানুষ! ছেলে-মেয়ে স্বাধীনভাবে ঘুরছে। গাইডকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখানে মেয়েদের নিরাপত্তা কেমন?’ গাইড গর্ব করে বলল, ‘কোন অসুবিধা নেই, যত রাত ইচ্ছা পার্কে থাক, কেউ কিছু বলবে না। মেয়েরা এখানে নিরাপদ। এটা ইরান।’ শুনে খুবই ভালো লাগল।
কবে যে আমরাও এমন গর্ব করে বলতে পারব, ‘মেয়েরা এখানে নিরাপদ, এটা বাংলাদেশ।’
খুবই ইন্টারেস্টিং ছিল গৎং গধফধহর-এর ঞযব ওসঢ়ধপঃ ড়ভ ঃযব গবফরধ ড়হ খরভবংঃুষব রহ এবহবৎধষ ্ ওংষধসরপ খবপঃঁৎবটি। আমেরিকার তৈরি কার্টুনগুলো কিভাবে শিশুমনে ওহফরারংঁধষরঃু-কে স্থাপন করে দিচ্ছে অথবা ওংষধসরপ ঐবৎড়-দের কিভাবে তাদের মন থেকে সরিয়ে সেখানে একই গল্প দিয়ে সাধারণ কোন জন্তু বা সেই রকম কোন প্রাণীকে স্থাপন করছে তা সত্যিই শিক্ষামূলক ও সচেতনতামূলক।
গং অষধংাধহফ-এর খবপঃঁৎব-এর বিষয় ছিল অ ঈৎরঃরপধষ জবারবি ধহফ অহধষুংরং ড়ভ ঃযব উড়পঁসবহঃং ধহফ ওহঃবৎহধঃরড়ধষ ঈড়হাবহঃরড়হ ড়হ ডড়সবহ ধহফ ঋবসরহরংস এবং উৎ তধৎরভধহ বললেন খরভবংঃুষব নিয়ে। আমরা উরহহবৎ-এ গেলাম শহরের মেয়রের মি. রেযায়ীর আমন্ত্রণে।
সময় ফুরিয়ে যেতে থাকল। তেহরানে অবস্থানের শেষ দিন চলে এলো। আমি সেই রাতে ঞৎধহংষধঃড়ৎ শিরিনের রুমে ছিলাম। এলহাম একদিনের জন্য জরুরি কাজে ওর বাড়িতে গেছে। শিরিন ওর রুমে একা। আমরা এশার নামায শেষে যে যার রুমে ঘুমাতে যাচ্ছি। হঠাৎ দেয়ালে চোখ পড়ল। এতদিন খেয়ালই করিনি। দেয়ালে একটা ক্যালেন্ডার টাঙ্গানো। ফারসিতে মাস ও দিন লেখা আর ওপরে একটা ছবি। প্রাচীন ধ্বংসস্থাপত্য। ওটা তাখ্তে জামশিদ বা চবৎংবঢ়ড়ষরং স্থাপত্যের নিদর্শন। আমি ওটার সামনে দাঁড়িয়ে ছবিটা দেখতে থাকলাম। হঠাৎ কখন শিরিন আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে জানি না। ও জিজ্ঞেস করল, ‘কি দেখছ এত মনোযোগ দিয়ে?’ আমি বললাম, ‘এটা তাখ্তে জামশিদ না?’ শিরিন অবাক হয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, তবে এটাও জান তুমি? আশ্চর্য! তুমি সত্যি করে বল তো, কে তুমি? ইরানের সবকিছু তুমি জান কিভাবে? বলো তুমি কে?’ আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘কাউকে বলবে না, বল?’ শিরিন বলল, ‘না, বলব না।’ বললাম, ‘আমি দারিয়ুসের মা।’ শিরিন আমাকে হাসতে হাসতে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আরে, আমি তো দারিয়ুসের বোন।’ ‘আচ্ছা তাহলে আমাদের দেখা হয়ে গেল’, বললাম ওকে। তারপর দু’জনে ছবির দিয়ে তাকিয়ে কত স্মৃতিচারণ করলাম! ‘সেই দিনগুলো কত সুন্দর ছিল তাই না শিরিন? যখন তাখ্তে জামশিদে উৎসব হতো!’ ‘হ্যাঁ! কত রকম রান্না হতো। সারা প্রাসাদ সাজানো হতো।’ ‘আর বিভিন্ন দেশ থেকে কত রাজারা কত উপহার নিয়ে আসত।’ ‘কি সুন্দর ছিল সেই ইরান।’
আমার মধুর স্মৃতিচারণের মধ্যেই শিরিন বলল, ‘এবার আমার ক্ষিদে পেয়েছে।’
‘তুমি রাতে খাওনি?’
‘না।’
‘কেন?’
‘খেতে ইচ্ছে করছে না। যাই ঘুমাই গিয়ে।’
আমি ওর হাত ধরে ডাইনিং টেবিলের কাছে এনে একটা চেয়ারে বসালাম। ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে আনলাম। তারপর গরম করে প্লেটে এনে বললাম, ‘এবার খাও।’
শিরিন বলল, ‘বিশ্বাস কর, আমি এত ক্লান্ত যে, খাবার চিবিয়ে খাবার শক্তিও নেই।’
‘আমি হাত ধুয়ে এসে বললাম, ‘তাহলে তো তোমাকে খাইয়ে দিতেই হবে।’
শিরিন তো অবাক! ‘আমাকে তুমি খাইয়ে দিবে?’
‘নয়তো কি? তুমি না খেয়ে ঘুমাবে তা কি হয়? বাংলাদেশে আমরা হাত দিয়ে ভাত মেখে খাই।’ এভাবে বলে ভাতের সাথে মাংস ও সালাদ মেখে ওর মুখের সামনে ধরে বললাম, بگو آ !
শিরিন হেসে বলল, آ, আর ওর মুখে আমি ভাত তুলে দিলাম।
শিরিন বলল, ‘এভাবে খাওয়া যায় আমি জানতাম না। দেখ, মাংসটাও কেমন নরম করে দিয়েছ। আশ্চর্য!’
সেই রাতে শিরিন ঘুমালো খুব আনন্দ নিয়ে। আমি খুব শান্তি পেলাম ওর আনন্দ দেখে। পরদিন খুব সকালে ঘুম ভাঙলো না। সাড়ে সাতটায় শিরিনের রুমে গিয়ে দেখি ও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। অথচ প্রতিদিন সকালে সে-ই সবাইকে ঘুম থেকে তুলে সাতটার মধ্যে নাস্তার রুমে নিয়ে আসে। কারণ, সাড়ে আটটায় খবপঃঁৎব শুরু হয়। একরাত শুধু ওকে খাইয়ে দিয়েছি, ব্যস, ও আদুরে বাঙালি মেয়ে হয়ে গিয়েছে। মনে পড়ল, আমি বাড়িতে আমার ইউনিভার্সিটি পড়–য়া মেয়েকে এখনো খাইয়ে দিই। আর ওকে সকালে ঘুম থেকে ডেকে তুলে দিতে হয়।
‘শিরিন ওঠো, সাড়ে সাতটা বাজে।’ আমার ডাক শুনে শিরিন তাড়াতাড়ি উঠে বসল।
‘কি বলো, সাড়ে সাতটা!’ বলে আঁৎকে উঠল ও।
আমরা দু’জন প্রায় ছুটতে ছুটতে ওপরে নাস্তার রুমে এলাম।
চৎবংং ঞঠ-র গৎং ঐধংযবসর-এর খবপঃঁৎব সৌভাগ্যক্রমে সেদিন একটু দেরীতেই শুরু হলো। এরপর উৎ. ঋড়ধফ খুধফর-এর ‘ঞযব অসবৎরপধহ ঈঁষঃঁৎব চড়ষরপরবং রহ ঃযব ডবংঃবৎহ অংরধ জবমরড়হ’। হাতে সময় ছিল খুব কম। আমরা ছুটতে ছুটতে অফসরহরংঃৎধঃরড়হ ঐধষষ-এ পৌঁছলাম। ওখনে আমাদের লাঞ্চ হলো। তারপর উৎ. ঝধফৎর-এর জড়ষব ড়ভ ডড়সবহ রহ ঊফঁপধঃরড়হ খবপঃঁৎব-এর পাশাপাশি ঈষড়ংরহম ঈবৎবসড়হু। ড. হেজদি সত্যিই অভিভূত হয়ে গেলেন যখন আমি তাঁর কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় তাঁকে উপহার দিলাম বাংলাদেশের ঊীঢ়ড়ৎঃ ছঁধষরঃু পোশাক, কোরআন শরীফ, যা একই সাথে বাংলা, ইংরেজি আর আরবিতে লেখা আর সম্প্রতি নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত ৭০তম টঘ অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফলতা ও অর্জনের কিছু ডকুমেন্ট।
সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় নূর ট্রেনে আমাদের মাশহাদ যেতে হবে। আমাদের স্টেশনে পৌঁছতে দেরী হয়ে গেল। যদিও বা আমরা পৌঁছলাম, দেখা গেল আমাদের লাগেজ তখনও এসে পৌঁছায় নি। এলহাম আজই ফিরেছে বাড়ি থেকে।
প্রথমে কথা ছিল এলহাম ও শিরিন আমাদের সাথে মাশহাদ যাবে না। পরে সিদ্ধান্ত হয়েছে ওদের নেয়ার। এতে আমরা সবাই এত খুশি হয়েছি যে, বলার মতো নয়। মাশহাদে কোন পড়াশুনা নয়। শুধু ছুটি, কিন্তু ওরাতো ততদিনে আমাদের কাছে শুধু ট্রান্সলেটর নয়, আমাদের বন্ধু হয়ে গিয়েছে। বন্ধু ছাড়া ছুটিতে কেমন করে মজা করব! তাই শিরিন আর এলহাম শুধু ইরানের অধিবাসী নয়, বাংলাদেশ, ইরান, ভারত আর পাকিস্তান মিলে যে পরিবার সেটার সদস্য।
লাগেজ আসা পর্যন্ত এলহাম, শিরিন ও অন্যান্য গাইড মিলে অনেক অনুনয় বিনয় করে ট্রেন গার্ডকে বোঝালো যে, আমরা ওৎধহ এড়াবৎহসবহঃ-এর মেহমান। আর সত্যিই কাজ হলো। আমাদের লাগেজ আসা পর্যন্ত প্রায় ১০/১৫ মিনিট ট্রেন অপেক্ষা করল।
ট্রেন ছাড়ল। অতি আধুনিক ট্রেন। মেঝেতে কার্পেট বিছানো। একেকটা রুমে চারজন। সেই সাথে চা, বিস্কুট, বাদাম, কেকসহ প্রচুর খাবার। মাথার ওপরে ঘুমানোর জন্য দু’টি বাংকার। নিচে দু’পাশে দু’জন আর ওপরে দু’জন এভাবে চারজন অনায়াসে ঘুমিয়ে রাত পার করে দিতে পারবে। প্রত্যেকের জন্য আলাদা ব্যাগে কম্বল, বালিশ ও রয়েছে।
কিন্তু আমার প্ল্যান তো অন্যরকম। ঠিক করেছি রাতে ঘুমাব না। এখন তো ছুটি, প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ করব। ইরানের রাতের প্রতিটা প্রহর, দিনের প্রতিটা ঘণ্টা আমি পলে পলে সাজিয়ে রাখব আমার স্মৃতিতে।
পাশের কম্পার্টমেন্টে গিয়ে বললাম : ‘কে জাগবে আমার সাথে সারারাত?’ এলহাম ছিল সেখানে। সে হাত তুলে বলল : ‘আমি।’
ওর রুমে পাকিস্তান থেকে আসা তাহসিনা ততক্ষণে গান শুরু করে দিয়েছে। ওদের গান গাইতে দিয়ে আমার রুমে এসে ঠিক মাথার ওপরের ছোট্ট আলোটা জ্বালিয়ে বই পড়তে শুরু করলাম। ঔড়হধঃযধহ ইষধপশ-এর ‘ঞযব ঝবপৎবঃ ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ঃযব ডড়ৎষফ’। বলা হয় উধহ ইৎড়হি তাঁর ‘ঞযব খড়ংঃ ঝুসনড়ষ’ এই বই পড়েই লিখেছেন। বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছি, তাই সারাটা সময়ই শাড়ি পড়েছি। আজ পড়েছি লাল পাড়ের সাদা শাড়ি। রাতে একটু শীত পড়ে তাই লাল পাড়ের সাথে মিলিয়ে লাল কোট। ইরানী যাত্রীরা ঘুরে ঘুরে আমার শাড়ি দেখছে। কেউ কেউ অতি আগ্রহে জিজ্ঞেস করছে ازكجاست؟ মানে কোথা থেকে এসেছ? হেসে বলছি, বাংলাদেশ।
আমার জ্বালানো আলোতে আমার সহযাত্রীদের ঘুমের অসুবিধা হতে পারে ভেবে একটা জায়গা খুঁজছিলাম জেগে বই পড়ার বা জানালা দিয়ে অন্ধকারের রূপ দেখার জন্য। আমার ওপরের বাংকারে পাকিস্তানের নাদিন শুয়ে পড়েছে। পাশের বাংকারে ইন্ডিয়ান সহযাত্রী সাবিহা ও পাশে ইন্ডিয়ান সহযাত্রী। ওরা সবাই ডিনার সেরে শুয়ে পড়েছে। আমি ধীরে ধীরে উঠে এলাম। আমার সাথে এল আতেনা আর কাভিয়ানী। ওরা এখন থেকে আমাদের সাথে থাকবে। আতেনা সাংবাদিক আর কাভীয়ানী গাইড। কয়েকটা কম্পার্টমেন্ট পার হয়ে আমরা ট্রেনের রেস্টুরেন্টে এসে বসলাম। এত দিনে ১০ ডলার খরচ করে ইরানী সীম কার্ড পেয়ে গেছি। প্রতি মুহূর্তে আমার ভালোলাগা অনুভূতিগুলো ঝগঝ করে হাজব্যান্ড ও মেয়ের সাথে শেয়ার করছি।
ট্রেনের রেস্টুরেন্টটা খুব সুন্দর করে সাজানো। আমরা সুন্দর একটা জায়গা নিয়ে বসে পড়লাম। আতেনা একপাশে ইন্টারভিউ নিতে থাকল ভারতের হাশিমীর। আর এদিকে আমি আর কাভিয়ানী বসলাম। আমি টেবিলের ওপর ল্যাপটপ রেখে প্রয়োজনীয় কিছু কাজ সারতে থাকলাম। কাভিয়ানী চা-এর অর্ডার দিয়ে তার ব্যাগ থেকে নানান রকম বাদাম বের করে টেবিলের প্লেটে রেখে আমাকে বলল : ‘খাও।’
জিজ্ঞেস করলাম : ‘তোমরা ইরানীরা সব সময় এমন বাদাম খাও?’
কাভিয়ানী বলল : ‘প্রায় সময়। আমাদের বাড়িতেই বাদামের গাছ আছে। গাছ থেকে নিয়ে যখন ইচ্ছা খাই। ছোট বেলায় আরো মজা হতো।’
বেশ ভালোই সময় কাটতে থাকল। রেস্টুরেন্টে লোকজন কমতে থাকল। তখন মাঝরাত। ট্রেনের হালকা দুলুনি আর ঝকঝকে আলো, অল্প কিছু লোকজনের চলাচল সব মিলিয়ে একটা মায়াবি পরিবেশ।
রাত বাড়ছে ইরানে। নূর ট্রেনের মধ্যে মাশহাদের পথে।
আতেনা এবার আমার কাছে এল ওর ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে। বসল ঠিক আমার সামনে। ওর যত প্রশ্ন সব ইরানের সুপ্রিম লিভার অুধঃড়ষষধয কযড়সবরহর-কে নিয়ে। আমি তাঁর সম্পর্কে জানি কিনা অথবা জানলে কী কী জানি।
সুপ্রিম লিডার। যদিও সুপ্রিম শব্দটি ইরানের সংবিধানে নেই, সেখানে শুধু লিডার বা নেতা বলা আছে। তবু জনগণ অধিক সম্মান দেখানোর জন্য সুপ্রিম শব্দটি ব্যবহার করে। ইরানে প্রেসিডেন্টের চেয়ে ক্ষমতার অধিকারী হচ্ছেন লিডার।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের মহান নেতা অুধঃড়ষষধয ঝধুুরফ জঁযঁষষধয কযড়সবরহর যিনি ৩ ডিসেম্বর ১৯৭৯ সাল থেকে ৩ জুন ১৯৮৯ সাল তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত ইরানের লিডার ছিলেন। যিনি ইরানে ইসলামী বিপ্লব ঘটিয়ে ১৯৭৯ সালে ইরানকে রেযা শাহ পাহলভীর শাসন থেকে মুক্ত করে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে পরিণত করেন এবং এখন পর্যন্ত ইরান ও বিশ্বের অনেক মুসলিম জাতিকে মুগ্ধ করে রেখেছেন তাঁর জ্ঞান, খোদাভীতি, আত্মত্যাগ ও অতি সাধারণ জীবন যাপনকে দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরে। তাঁর মৃত্যুর পর বর্তমানে অর্থাৎ ৪ জুন ১৯৮৯ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত লিডার আছেন অুধঃড়ষষধয ঝধুুরফ অষর কযধসবহবর যিনি পূর্বে ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৮৯ সালে ওসধস কযড়সবরহর-এর মৃত্যু পর্যন্ত ইরানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। বিপ্লবী নেতা ওসধস কযড়সবরহর সম্পর্কে আমার অভিমত জানানোর সুযোগ পেয়ে খুব ভালো লাগল। আমার আর আতেনার কথার মাঝেই জানতে পারলাম যে, রেস্টুরেন্ট বন্ধ হবার সময় হয়ে গেছে।
আমি আর আতেনা কড়িডোরের শেষ মাথায় এসে পৌঁছলাম। এতক্ষণে আতেনার ভিডিও ক্যামেরার কথা মনে পড়েছে। ও আমার দিকে ক্যামেরা তাক করে বলল : ‘কিছু বল।’
আমি বললাম وحشى بافر এর কবিতা থেকে,
موستان شرح بریشانی من گوش کنید
داستان غم بنهانی من گوش کنید…
ঙ ভৎরবহফং, যবধৎশবহ ঃড় ঃযব ধপপড়ঁহঃ ড়ভ সু ফবংঃৎঁপঃরড়হ. ঐবধৎশবহ ঃড় ঃযব ঃধষব ড়ভ সু যরফফবহ ংড়ৎৎড়.ি তারপর আমরা হাসতে হাসতে আমাদের বগিতে পৌঁছলাম। দেখি, সেখানে অনেকেই দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছে। এলহাম আর শিরিন ছোট্ট করিডোরে শুধু দাঁড়িয়ে আছে। ওদের চোখ ভর্তি ঘুম। বললাম : ‘কি, ঘুম পাচ্ছে?’ ওরা দু’জনই মাথা নেড়ে বলল : ‘হ্যাঁ।’
এলহাম আর শিরিন ওদের রুমে চলে গেল ঘুমাতে আর আমি আমার রুমের দরজা লক করে দিলাম। এবার সত্যি অন্ধকার হয়ে এল রুম। রাত আর বেশি বাকি নেই। চোখ বুজে ভাবতে থাকলাম। ইরান পৌঁছানোর পর থেকে আজ পর্যন্ত। একজন রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আমাদের কত গর্ব! অথচ প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত ইরানে কত যে জ্ঞানী আর সুফি সাধক রয়েছেন তার হিসাব নেই। আশ্চর্য দেশ, আর কি বিশাল এর জ্ঞান ভাণ্ডার!
জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম, একটু একটু করে দিনের আলো ফুটছে, পাহাড়ি পথের পাশ দিয়ে ছুটছে ট্রেন। সূর্যের প্রথম আলোয় সোনার মতো রং ফুটে রয়েছে পাহাড়ের গায়ে। তার মাঝে সারি সারি উইন্ডমিলের চাকা। আমি জানালায় গাল রেখে ক্যামেরায় ধরতে থাকলাম এই অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য। দিনের আলো ভালোভাবে ফুটে ওঠার পর আমরা মাশহাদ পৌঁছলাম। মাশহাদ, ঞযব ঐড়ষু ঈরঃু। এখানে অষ্টম ইমাম রেযা (আ.)-এর মাযার আছে।
কালচারাল গেস্ট হাউসে পৌঁছে সবাই যখন রেস্ট নিচ্ছে আমি তখন আমার বিশাল রুমে বসে পরবর্তী একদিনের পুরো প্ল্যান করে ফেললাম। কী কী কিনব তার লিস্ট করলাম। সঙ্গী-সাথিদের বাংলাদেশ থেকে আনা এরভঃ গুলো কাকে কাকে দেব আর আমার টিকিট, টাকা সব ঠিকমত চেক করে ব্যাগ ভালোভাবে গুছিয়ে ফেললাম যেন পরে আমার সময় নষ্ট না হয়। আমাদের মধ্যে থেকে কেউ কেউ তেহরান ফিরে যাবে তারপর যেখান থেকে তাদের দেশে আর কেউ মাশহাদ থেকে দেশে ফিরবে। আমি মাশহাদ থেকে দুবাই হয়ে একই রুটে বাংলাদেশে ফিরব। আমরা দুপুরে লাঞ্চ সারলাম ঘরেই। বিশাল বিশাল নানরুটি, রাইস, ফিশ আর বেগুন দিয়ে বানানো একটা সব্জি। বিকেলে তৈরি হয়ে নিলাম ইমাম রেযার মাযারে যাবার জন্য। তেহরানের মতো মেয়েদের জন্য শুধু স্কার্ফ এখানে যথেষ্ট নয়। ওপরে বড় একটা চাদর পড়তে হবে। আমরা প্রস্তুত হয়ে রওয়ানা হলাম।
এত বিশাল মাযার, এত নিঁখুত তার কারুকাজ! আমরা মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এত শিল্পজ্ঞান সত্যি প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। মাশহাদ শব্দের অর্থ অ ঢ়ষধপব যিবৎব ধ সধৎঃুৎ যধং নববহ নঁৎৎরবফ.
৮১৮ খ্রিস্টাব্দে আব্বাসী খলিফা আল মামুন কর্তৃক ইমাম রেযা (ওসধস অষর ধষ-জরফযধ) নিহত হয়ে শহীদের মর্যাদা পেয়েছিলেন। এখানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। এরপর থেকে এই স্থানকে মাশহাদ বলা হয়। তারপর থেকেই শিয়া সুন্নি সকল মুসলমান এখানে যিয়ারত করতে আসেন।
এখানকার মসজিদে প্রায় ৫ লক্ষ মানুষের নামাযের ব্যবস্থা রয়েছে এবং একে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মসজিদ বলা হয়। ৬,৪৪৩,৮৯০ ঝয়ভঃ-এর মসজিদ চত্বরে রয়েছে মিউজিয়াম, লাইব্রেরি, সেমিনার হল, কবরস্থান, ঞযব জধুধার টহরাবৎংরঃু, ডাইনিং হল, বিশাল নামায চত্বর এবং অন্যান্য বিল্ডিং।
এক দফায় এই মাযার দেখা শেষ হবে না। ফিরে আসার সময় সিদ্ধান্ত হলো এখানে ফজরের নামাযের সময় আবার আসব। সেই জন্য গেস্ট হাউস থেকে রওয়ানা দিতে হবে রাত দু’টায়। তাই যারা যেতে চায় তারা যেন রাতে না ঘুমায়। আর ঠিক দু’টার সময় যেন নিচে ওয়েটিং রুমে চলে আসে। সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে আমরা সেই রাতেই শপিং-এ গেলাম আর ফেরার পথে চরুুধ চরুুধ ফাস্ট ফুডের দোকানের দারুন পিৎজা খেলাম।
কোনভাবেই যেন বাদ পড়ে না যাই সেই জন্য দু’টা বাজার ১০ মিনিট আগেই নিচে নেমে পড়লাম। তখনও কেউ আসেনি। আমি সিঁড়িতে একা বসে থাকলাম। ল্যাপটপ খুলে আমার কাজ করতে থাকলাম। একে একে কয়েকজন বাদে অন্যরা এলে সেই গভীর রাতে আমরা আমাদের বাসে চড়ে রওয়ানা দিলাম। সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা! গভীর রাত, তবু মাযার চত্বর লোকজনে ভরা। আমরা গিয়ে বসলাম ঠিক সোনার গেটের সামনে যেটা পার হলেই মাযার। ওপরের বড় গম্বুজটিও সোনার। আলোয় চকচক করছে সোনা আর সেই আলো দ্বিগুণ উজ্জ্বল হয়ে ঠিকরে পড়ছে মেঝেতে। খোলা আকাশের নিচে ঠা-া বাতাসের মধ্যে আমি, এলহাম আর শিরিন তাহাজ্জুদের নামায আদায় করলাম। অন্যরাও আছে আশে-পাশে।
একটা ধূসর রং-এর কবুতর নির্ভয়ে মেঝের কার্পেটের ওপর হাঁটহাঁটি করছে। ওটা হাঁটতে হাঁটতে আমাদের কাছে চলে এল। শিরিন বলল : “এই পাখিকে এখানে বলে ‘ইয়া কারিম’।”
দেখলাম একজন ভদ্রমহিলা ছোট-ছোট দানাজাতীয় খাবার ওকে খেতে দিলেন নামায শেষে। আর পাখিটিও মনের আনন্দে খেতে থাকল।
ফজরের নামায হলো জামায়াতে। এরপরও আমরা অনেকক্ষণ সেখানে বসে থাকলাম। এমনি শুধু ভালো লাগছিল, তাই বসে থাকা।
সকাল হলে আমরা প্রশান্ত মনে গেস্ট রুমে ফিরে এলাম। কেউ হয়তো ঘুমালো, কিন্তু আমি গোসল আর নাস্তা সেরে সন্ধ্যার প্রস্তুতি নিয়ে নিলাম। কারণ, সন্ধ্যায় আমার প্লেন। আজই রওয়ানা দিব বাংলাদেশে। গত রাতে সামান্য কিছু কেনাকটা করেছি। শেষ পর্যন্ত প্রাচীন হস্তশিল্পের দোকান খুঁজে পেয়েছি। মিনিয়েচার আর্ট সংগ্রহ করতে পারিনি, কিন্তু হাতে তৈরি ছোট কার্পেট পেয়েছি। এর মধ্যে একটি হলো কার্পেটে তৈরি ব্যাগ। অনেক নকশা সেই ব্যাগের মধ্যে। এটি একটি প্রাচীন শিল্প। দোকানদার বললেন : ‘এই ব্যাগের মধ্যে লবণ রাখা হতো। একটি ঊহমষরংয ঃড় চবৎংরধহ ডিকশনারিও পেয়েছি। সব গুছিয়ে রেখে আমরা আবার বেরিয়ে পড়লাম।
এবার আমরা যেখানে যাচ্ছি সেটার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। এটি ৫০ বছর পুরনো একটি ওহংঃরঃঁঃব, গধশযঃধনব গধৎলবং (রসধসলধসধ)। এখানে কোরআন অনুসারে মেয়েদের শিক্ষা ও ট্রেনিং দেয়া হয়।
সেখানে আসন্ন মুহররমের প্রস্তুতি চলছে। অতি সম্মানে আমাদের স্বাগত জানালেন স্কুল কর্তৃপক্ষ।
অপূর্ব হাতের কাজে সাজানো হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির একেকটা রুম। আমরা একটা হলরুমে এসে দাঁড়ালাম। দূর থেকে ভেসে আসছিল কান্নার সুরে গান। কাছে এসে দেখলাম, একটা বড় হলরুমের মাঝখানে কালো পোশাকে প্রায় ২০/২৫ জন নারী দাঁড়িয়ে ধীর লয়ে মর্সিয়া গাইছেন। তাদের ডান হাত হালকা করে বুকের বাম পাশে তালে তালে স্পর্শ করছে। তাদের দু’চোখ বেয়ে পড়ছে অশ্রু।
মুহূর্তেই বুঝে গেলাম কী হচ্ছে। ফারসি গানের প্রতিটা শব্দের অর্থ না বুঝলেও এর সুর আমাদের মন ছুঁয়ে গেল। ‘হোসাইন’ শব্দটাও ঘুরে ঘুরে কানে আসতে থাকল।
আমরা ওদের কাছেই স্টেজে এসে দাঁড়ালাম। ওদের গানে তাল দিয়ে বুকে হাত রাখলাম আর আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম আমাদের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু!
৬৮০ সালে (মুহররম ১০, ৬১ হি.) ঘটে যাওয়া কারবালা প্রান্তরের যুদ্ধ ফুটে উঠল চোখের সামনে। আমন্ত্রণ পেয়ে মদীনা থেকে কুফার পথে চলেছে ইমাম হোসাইনের পরিবারসহ কাফেলা, কিন্তু কুফা পৌঁছানোর আগেই তাঁদেরকে কারবালায় নিয়ে যাওয়া হয়। উমাইয়া খলিফা ইয়াযীদের আনুগত্য স্বীকার না করার জন্য শুরু হয় যুদ্ধ।
মুহররমের ৯ তারিখ রাতে ইমাম হোসাইন তাঁর দলের সকলকে তাঁকে ছেড়ে চলে যাওয়ার অনুমতি দিলেও কেউ তাঁকে ছেড়ে যান নি। ইমাম হোসাইন সারারাত নামায পড়েন। ফজরের নামাযও পড়েন। কারবালার প্রান্তরে ইয়াযীদের নির্দেশে কয়দিনের পানির কষ্টের পাশাপাশি যুদ্ধের এক পর্যায়ে ইমাম হোসাইন একাই রীরত্বের সাথে লড়াই করে শাহাদাত বরণ করেন। তাঁর শিশু সন্তানদেরও হত্যা করা হয়। ইসলামের শেষ নবী ও আল্লাহর প্রেরিত রাসূলের আদরের নাতির এমন হৃদয়বিদারক শাহাদাত ঘটে কারবালা প্রান্তরে।
ঝাপসা চোখে দেখলাম সামনের একটি বড় টেবিলে ইরাকের কারবালায় ইমাম হোসাইনের সমাধি থেকে আনা একটি কারুকাজ খচিত চাদর ধরে অঝরে কাঁদছে সবাই। আমাদের সঙ্গী পাকিস্তান থেকে আসা তাহমিনা যে সবসময় হাসিখুশি আর দুষ্টুমিতে মেতে থাকে সে কাঁদছে সবচেয়ে বেশি। কী নিঃস্বার্থ সেই অনুভূতি! কী চরম দুঃখবোধ! আমাদের প্রিয় নবীকে যদি আমরা ভালোবাসি তবে তাঁর প্রিয় ও অতি আপন জনের এমন করুন মৃত্যুত তো আমরা কাঁদবই। আমরা দুঃখ-ভারাক্রান্ত মনে বিদায় নিয়ে ফিরে এলাম ইমাম রেযার মাযারে। আর সত্যিই অভিভূত হয়ে ভাবছিলাম, কি রকম শান্ত, সংগঠিত ও মার্জিত উপায়ে শোক পালন করছে এরা। সত্যিই খুবই শিক্ষামূলক। ইমাম রেযার মাযারের লাইব্রেরিটা যেমন বিশাল তেমনি প্রাচীন। এখানে ১৯টি ভাষার বই রয়েছে। হাজার বছরের পুরনো এই লাইব্রেরিটি আধুনিক প্রযুক্তির সাথে যুক্ত। এখানে বই খুঁজে আনার জন্য একটি ছোট বাক্স সংযুক্ত দেয়ালের সাথে লাগানো একটি যন্ত্র রয়েছে। যেখানে প্রয়োজনীয় বইয়ের লিস্ট দিলে যন্ত্রটি নিজেই পুরো লাইব্রেরি খুঁজে বই এনে নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছে দেবে। এতে তার সময় লাগে ১০ মিনিট, অথচ একই কাজ অক্সফোর্ড লাইব্রেরির যন্ত্র করে ৫ ঘণ্টায়।
টেকনোলজী সম্পর্কিত ছোট এই উদাহরণ দেখে বুঝতে পারলাম যে, ইরান শুধু ধর্ম নিয়েই চর্চা করে না, আধুনিক টেকনোলজিতেও অনেক এগিয়ে আছে।
লাইব্রেরি ঘুরে দেখার পর লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে সেমিনার রুমে নিয়ে এলেন। এত বড় হলরুম আর দেয়ালে বিশাল বিশাল প্রাচীন আর্টের নিদর্শন দেখে আমরা যেন থ’ হয়ে গেলাম। উনি আমাদের জানালেন এই আর্টগুলো সব নিখুঁতভাবে হাতে আঁকা। ভদ্রলোক আমাদের একেবারে স্টেজের সামনে এনে ঠিক সামনের সারিতে বসিয়ে বললেন, এই সেমিনার হলে অতি উচ্চ পর্যায়ের সভা হয়। আপনারা যে চেয়ারে বসেছেন সেখানে শুধু বিভিন্ন দেশের আমন্ত্রিত রাষ্ট্রপ্রধানরা বসেন।
দুপুরের খাবার আমরা মাযারের ডাইনিং হলে খেলাম। আর ফিরে আসার সময় ডাইনিং হলের বাইরে গেটের অপর পাশে অনেক অপেক্ষমাণ মানুষ দেখলাম। জিজ্ঞেস করে জানলাম যে, রোগমুক্তির জন্য ইমাম রেযার মাযারের তাবারুকের জন্য তারা অপেক্ষা করছে।
হলের একপাশে চিত্র প্রদর্শনী চলছে। সারা পৃৃথিবীতে মুসলিমদের ওপর যে অত্যাচার চলছে তার স্থির চিত্র। একসাথে এতগুলো করুণ ছবি দেখে আমাদের সত্যিই মন খারাপ হয়ে গেল।
ফিরে আসছি। পথে বাসের মধ্যে একদম অন্য পরিবেশ। সবাই চুপচাপ। অথচ অন্যদিন সারা পথ হৈচৈ, হাসি, আনন্দ করতে করতে আমরা ফিরি। পথও এমন সুন্দর যে, সে দৃশ্য দেখেও মন ভালো হয়ে যায়।
এক সময় হঠাৎ থেমে যায় বাস। কি ব্যাপার? আমরা কেউ জানি না কী হয়েছে। আমাদের গাইড নেমে পড়েন। তারপর সবার জন্য আইসক্রিম নিয়ে আসেন। অমনি হৈচৈ করে ওঠে সবাই। ইরানে এসে আইসক্রিম খাওয়াটাই বাকি ছিল। চলন্ত বাসে চামচ দিয়ে কেটে কেটে কেকের মতো দেখতে দারুন সুস্বাদু আইসক্রিম খেতে খেতে গন্তব্যে পৌঁছলাম। অতিথিপরায়ণতায় জুরি নেই ইরানীদের। সময় নেই হাতে বেশি। তড়িঘড়ি করে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এলাম। এয়ারপোর্ট যেতে হবে। রাত আটটায় ফ্লাইট। আমার সাথে দু’জন পাকিস্তানী সঙ্গী রেজিয়া ও নাদিন। ওরা দুবাই থেকে পাকিস্তান চলে যাবে আর আমি বাংলাদেশ। ভারতীয় ও পাকিস্তানী অন্য সঙ্গীরা পরদিন তেহরান থেকে ফিরবে।
প্লেনে বসে আছি। এবারও এমিরেট। আর একটু পরে ঢাকা পৌঁছবে। অবাক হয়ে ভাবছি আমার সফর শেষ হয়ে গেল। ৬-১৫ অক্টোবর কিভাবে যেন ঘোরের মধ্যে কাটল।
সকাল সাড়ে আটটায় পৌঁছলাম ঢাকায়। সারা রাত প্লেনে একটুও ঘুমাইনি। শুধু ভেবেছি, কিভাবে ইরানে আমার দিনগুলো কেটেছে। আমি এতটাই অভিভূত যে, গত তিন রাত আমি যে ঘুমাইনি অথচ তা আমার শরীরকে এতটুকু কাবু করে নি। ইরান আমাকে এমনই আচ্ছন্ন করে রেখেছে।