All posts by pavel
স্মরণীয় দিবস
২ সেপ্টেম্বর : ইরানে মুদ্রণশিল্প দিবস।
৪ সেপ্টেম্বর : বিজ্ঞানী ও দার্শনিক আবু রায়হান বিরুনী স্মরণে দিবস।
৫ সেপ্টেম্বর : আয়াতুল্লাহ কুদ্দুসীর শাহাদাত।
৮ সেপ্টেম্বর : ১৭ই শাহরিভারের গণজাগরণ ও পাহলভী সরকারের নির্দেশে গণহত্যা।
১০ সেপ্টেম্বর : ইসলামী বিপ্লবের পর তেহরানের প্রথম জুমআ ইমাম আয়াতুল্লাহ তালেকানীর ইন্তেকাল।
১১ সেপ্টেম্বর : মুনাফেকদের হাতে আয়াতুল্লাহ মাদানীর শাহাদাত। *ইরানের ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।
১২ সেপ্টেম্বর : ইরানে সিনেমা দিবস।
১৪ সেপ্টেম্বর : নবীবংশের নবম ইমাম তাকী (আ.)-এর শাহাদাত দিবস।
১৫ সেপ্টেম্বর : আহলে বাইতের প্রথম ইমাম আলী (আ.) এবং নবীকন্যা হযরত ফাতিমা (আ.)-এর বিবাহ বার্ষিকী। ইরানে দিবসটি বিবাহ দিবস হিসেবে উদ্যাপিত হয়।
১৮ সেপ্টেম্বর : ইরানে কবিতা ও ফারসি সাহিত্য দিবস হিসেবে পালিত হয়। কবি সাইদ মুহাম্মাদ হোসাইন শাহরিয়ার স্মরণে দিবস।
২০ সেপ্টেম্বর : বাংলা ভাষার প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক আবুল খায়ের মুসলেহ উদ্দিনের মৃত্যুবার্ষিকী।
২১ সেপ্টেম্বর : নবীবংশের পঞ্চম ইমাম বাকের (আ.)-এর শাহাদাত দিবস।
২২ সেপ্টেম্বর : ইরাকের সাদ্দাম সরকার এদিনে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। ইরানের পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধের শুরু।
২৩ সেপ্টেম্বর : আরাফাত দিবস (৯ যিলহজ)।
২৪ সেপ্টেম্বর : ঈদুল আযহা বা কোরবানির ঈদ।
২৭ সেপ্টেম্বর : নবীবংশের অষ্টম ইমাম মূসা কাযেম (আ.)-এর জন্মদিবস। *বিশ্ব পর্যটন দিবস।
২৯ সেপ্টেম্বর : নবীবংশের দশম ইমাম আলী নাকী (আ.)-এর জন্মদিবস।
৩০ সেপ্টেম্বর : বিশ্ববিখ্যাত মরমি কবি মওলানা জালালউদ্দিন রুমির (মৌলভী রুমি) জন্মবার্ষিকী। *বিশ্ব বধির দিবস।
১ অক্টোবর : ফিলিস্তিনের শিশু-কিশোরদের সাথে সংহতি প্রকাশের জন্য দিবসটি পালিত হয়। *বাংলাদেশের প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও বহু গ্রন্থ প্রণেতা মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রহ.)-এর মৃত্যুবার্ষিকী।
৫ অক্টোবর : হযরত ইমাম খোমেইনী ইরাক থেকে ফ্রান্সে হিজরত করেন (১৯৭৮)।
৮ অক্টোবর : মহানবী (সা.)-এর সাথে খ্রিস্টান পাদ্রিদের মুবাহিলা দিবস। *বিশ্ব শিশু দিবস।
১২ অক্টোবর : বিশ্ব বিখ্যাত কবি হাফিজ স্মরণে দিবস।
১৪ অক্টোবর : ঈদ-ই গাদীর দিবস। বিদায় হজ থেকে ফেরার সময় মহানবী (সা.) ১৮ যিলহজ হাজীদের সমাবেশে ইমাম আলীকে মহানবীর ওফাত পরবর্তীকালে উম্মতের মাওলা ঘোষণা করেন।
১৫ অক্টোবর : হিজরি ১৪৩৭ সাল শুরু। *ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর মুনাফিকদের হাতে আয়াতুল্লাহ আশরাফী ইসফাহানীর শাহাদাত দিবস। *বিশ্ব সাদা ছড়ি দিবস (অন্ধদের কল্যাণে)।
১৭ অক্টোবর : বাংলাদেশের মরমি বাউল সংগীতের জনক লালন শাহের মৃত্যুবার্ষিকী।
১৮ অক্টোবর : ইরানে শরীরচর্চা ও খেলাধুলা দিবস হিসেবে পালিত হয়।
১৯ অক্টোবর : বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ফররুখ আহমদের মৃত্যুবার্ষিকী।
২৩ অক্টোবর : ইমাম খোমেইনীর সুযোগ্য পুত্র আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ মুস্তাফা খোমেইনীর শাহাদাত দিবস। *মুহররম মাসের নবম দিবস।
২৪ অক্টোবর : পবিত্র আশুরা। ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শাহাদাত দিবস। *উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম, সাহিত্যিক, সাংবাদিক মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর মৃত্যুবার্ষিকী।
২৬ অক্টোবর : নবীবংশের চতুর্থ ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর শাহাদাত দিবস। *অবিভক্ত বাংলার নেতা প্রজাতিহৈষী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের জন্মবার্ষিকী।
২৯ অক্টোবর : কবি বেনজীর আহমদের জন্মবার্ষিকী। *কবি তালিম হোসেনের জন্মবার্ষিকী।
৩০ অক্টোবর : কিশোর (১৩ বছর) মুহাম্মাদ হুসাইন ফাহমিদেহ এর শাহাদাত দিবস। ইরানে এটি কিশোর স্বেচ্ছাসেবী দিবস হিসেবে পালিত হয়।
ইরানী প্রবাদ
বাংলা ভাষায় ফারসি শব্দের ব্যবহার
ফারসি রূপ আধুনিক ফারসি উচ্চারণ
হাসেল/হাছিল (অর্জন/কাজ উদ্ধার) حاصل হ-ছেল
হাজির حاضر হ-যের
হাকিম (বিচারক) حاكم হ-কেম
হাল (অবস্থা) حال হ-ল্
হালত (অবস্থা) حالت হ-লাত্
হরফ (অক্ষর) حرف র্হাফ
হিসাব حساب হেস-ব
হেফাযত حفاظت হেফ-যাত
হক (সঠিক) حق হাক্ব
হুকুম حكم হোক্ম
হলফনামা حلف نامه হালাফনমে
হালুয়া حلوا হালভা
হামলা حمله হাম্লে
হুর حور র্হু
হাউজ حوض হাউজ্
হায়া (লজ্জা) حياء হাইয়া
হয়রানি حيرانى হেইর-নী
খাদেম خادم খ-দেম
খারিজ خارج খ-রেজ
খাস خاص খ-স
খাতির خاطر খ-তের
খাকী (রং) خاكى খ-কী
খালেস (খাঁটি) خالص খ-লেস্
খালু خالو খ-লু
খালা خاله খ-লে
খালি خالى খ-লী
খামখেয়ালী خام خيالى খ-ম খিয়া-লী
খান্দান خاندان খ-নদ-ন
খানকাহ্ خانقاه খ-নকা
খানা (ঘর) خانه খ-নে
খানাতল্লাশী خانه تلاشى খ-নে তাল-শী
খবরদার خبردار খাবারদ-র
খবরদারী خبردارى খাবার দ-রী
খবীস خبيث খাবীছ্
খতম ختم খাত্ম
খতনা ختنه খাতনে
খেদমত خدمت খেদমাত্
খারাপ خراب খার-ব
খরগোশ خرگوش র্খাগুশ্
খোরমা خرما খোরম-
খরিদ خريد খারীদ
খদ্দের خريدار খারীদ-র
ইরানী প্রবাদ বাক্য
روزه شک دار گرفتن.
উচ্চারণ : রোযে শাকদা’র গেরেফতান
অর্থ: সন্দেহজনক রোযা রাখা।
মর্ম : ব্যর্থতা বা পরাজয়ের সম্ভাবনা রয়েছেÑ এমন কাজ বা বিষয়ে তৎপর হওয়া বুঝাতে প্রবাদটি ব্যবহৃত হয়।
روغن ریخته جمع نمی شود.
উচ্চারণ : রওগান রীখতে জাম্ নেমী শাওয়াদ
অর্থ : পড়ে যাওয়া তেল জমা হবে না।
মর্ম : এই প্রবাদটি ব্যবহৃত হয় অন্য একটি প্রবাদের সমান অর্থে। অর্থাৎ বলা হয়ে থাকে: প্রেম করতে গিয়ে খরচ হওয়া টাকা ঝুলিতে ফিরে আসে না।
رو نیست سنگ پا است.
উচ্চারণ : রো নিস্ত সাঙ্গে পা’ আস্ত
অর্থ : চেহারা নয়, পায়ের পাথর।
মর্ম : অত্যন্ত বেহায়া, বেয়াড়া লোকের সাথে কথা বলা বুঝাতে প্রবাদটি ব্যবহৃত হয়।
روی سر و کله کسی خراب شدن.
উচ্চারণ : রূয়ে সারো কাল্লে কাসী খারাব শোদান
অর্থ : কারো মাথা ও কল্লা খারাপ হওয়া।
মর্ম : অনাহুত কারো মেহমান হওয়া, হঠাৎ করে কারো ঘরে মেহমান হওয়া এবং তার জন্য ঝামেলার কারণ হওয়া।
ریشش را در آسیاب سفید کرده است.
উচ্চারণ : রীশাশ রা’ দার আ’সিয়া’ব সাফিদ কারদে আস্ত
অর্থ : তার দাড়ি যাঁতাকলে সাদা করেছে ।
মর্ম : খুব ঝানু, দক্ষ ও অভিজ্ঞ লোক বুঝাতে প্রবাদটির প্রচলন ব্যাপক।
روغن شد و به زمین رفت
উচ্চারণ : রওগান শুদ ও বে যমীন রাফ্্ত
অর্থ : তেল হল আর মাটিতে চলে গেল।
মর্ম : সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে গেল এবং আর কখনো পাওয়া যায় নিÑ একথা বুঝাতে এটি ব্যবহৃত হয়।
روی پای خود بند نبودن
উচ্চারণ : রূয়ে পা’য়ে খোদ বন্দ নাবূদান
অর্থ : নিজের পায়ের উপর বন্ধন নাথাকা।
মর্ম : আনন্দের কারণে এক স্থানে স্থির না হওয়া, তাড়াহুড়া করা ও অস্থিরচিত্ত হওয়া।
ریخت و پاش کردن
উচ্চারণ : রীখ্ত ও পা’শ কারদান
অর্থ : ফেলা আর ছড়িয়ে দেয়া।
মর্ম : দান-খয়রাত করা, বেহিসাব খরচ করা।
ریش چیزی در آمدن
উচ্চারণ : রীশে চীযী দার অ’মাদান
অর্থ : কোন কিছুর দাড়ি গজানো।
মর্ম : কোন কিছুর মূল্যমান ও ঔজ্জ্বল্য কমে যাওয়া বা ব্যবহারের অনুপযোগী হওয়া অর্থে এটি ব্যবহৃত হয়।
বই পরিচিতি
কুরআন ও হাদীসে মহানবী (সা.)-এর আহলে বাইত (আ.) [নবী পরিবার]
সংকলন: আয়াতুল্লাহ মুহাম্মাদ মুহাম্মাদি রেইশাহরি
বাংলা অনুবাদ: এ. কে. এম. রাশিদুজ্জামান
সম্পাদনা: মো. হারুনুর রশিদ, মুহাম্মাদ ইরফানুল হক ও মো. আলমগীর হোসেন
প্রকাশক: ওয়াইজম্যান পাবলিকেশনস
প্রকাশকাল: ৩ অক্টোবর, ২০১৫
মূল্য: ৬৮০ টাকা
মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠ রাসূল, সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তাফা (সা.)-এর পবিত্র আহলে বাইত (আ.) হলেন তাঁর পরিবারের ঐসব সম্মানিত সদস্য যাঁদেরকে বাছাই করা হয়েছে রাসূলের ইন্তেকালের পর মুসলিম উম্মাহ্্র নৈতিক ও আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শন ও সামগ্রিক বিষয়াবলিতে নেতৃত্বের জন্য। আয়াতুল্লাহ মুহাম্মাদ রেইশাহরি সংকলিত ‘কুরআন ও হাদীসে মহানবী (সা.)-এর আহলে বাইত (আ.)’ শিরোনামের এ গ্রন্থে মহানবীর আহলে বাইতের পরিচয় এবং তাদের প্রতি মুসলমানদের করণীয় সম্পর্কে হাদীসের মাধ্যমে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
আয়াতুল্লাহ মুহাম্মাদ রেইশাহরি ১৯৪৬ সালে ইরানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তাঁর জ্ঞানচর্চার একটি বড় সময় কাটিয়েছেন ইরানের কোম ও ইরাকের নাজাফ শহরে। তিনি হাদীসশাস্ত্রের বিজ্ঞ প-িতগণের একজন যিনি শত শত গ্রন্থের হাজার হাজার হাদীস গবেষণা করে বিষয়ভিত্তিক সুশৃঙ্খলভাবে সাজানো হাদীস গ্রন্থ ‘মীজান আল-হিকমাহ’ [১৫ খ-] সংকলন করেন যা পাঠকদের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বর্তমান গ্রন্থটিও এমনই আরেকটি গভীর গবেষণালব্ধ উপস্থাপনা যা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আহলে বাইতের সামগ্রিক পরিচয় তুলে ধরার ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা রাখবে বলে আশা করি।
কবি শাহরিয়ার ও তার ফারসি কবিতা
আহসানুল হাদী
মোহাম্মদ হোসাইন শাহরিয়ার ইরানের কাব্যজগতের একটি সুপরিচিত নাম। ফারসি কবিতায় আধুনিক গজলের সূচনা তিনিই করেছিলেন। তিনি ১২৮৫ সৌর হিজরি (হি. শা.) মোতাবেক ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে ইরানের তাবরিয শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হাজি মির ওগা খোসগোনাবি আর মাতার নাম কাওকাব খানম, যিনি ‘খানম নানে’ নামেও পরিচিত ছিলেন। একজন দ্বীনদার ও ধর্মভীরু নারী হিসেবে তিনি প্রসিদ্ধ ছিলেন।
শাহরিয়ার ছিলেন স্বভাবকবি। কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাৎক্ষণিক কবিতা লিখে ফেলতেন। সেগুলোকে লিখেও রাখতেন না। এভাবে তাঁর অলিখিত অনেক কবিতা কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে।
মাত্র নয় বছর বয়সে তিনি ফারসি ভাষায় কবিতা লিখতে শুরু করেন। সৌভাগ্যক্রমে সেই সময়ের লেখা তিনটি বেইত (দ্বিপদী শ্লোক) এখনো পাওয়া যায়। একবার শাহরিয়ারের মা তাঁর উপর রাগ করলে মাকে খুশি করতে গিয়ে তিনি নি¤েœাক্ত কবিতাটি লিখেন :
من گنه کار شدم واي به من
مردم آزار شدم واي به من
অর্থ:
হায় কপাল! আমি গোনাহের কাজ করে ফেললাম,
হায় আফসোস! মানুষের কষ্টের কারণ হলাম!
শাহরিয়ার তাবরিযের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় সেখানকার একজন তরুণ কবি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন এবং প্রথম বারের মত তাঁর কবিতা বেহজাত কাব্যনামসহ আদাব পত্রিকায় ছাপা হয়।
সৌর ১৩১০ হিজরিতে (১৯৩১ খ্রিস্টাব্দ) শাহরিয়ারের প্রথম কাব্যগ্রন্থ মালেকুশ্ শোয়ারায়ে বাহার, সাঈদ নাফিসি ও পুজমান বাখতিয়ারের ভূমিকাসহ প্রকাশিত হয়।
শাহরিয়ারের পদ্য সাহিত্যকর্মই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শাহরিয়ারের সাহিত্যকর্মকে প্রধানত দু’ভাগে ভাগ করা যায় : ক. ফারসি কবিতা ও খ. তুর্কি কবিতা। তিনি ফারসিতে প্রায় ২৮ হাজার বেইত ও তুর্কিতে প্রায় ৩ হাজার বেইত লিখে গেছেন। ফারসি ভাষায় ৫৪৭টি গযল, ১০০টি কাসিদা, ২৫টি দীর্ঘ মাসনাভি, ১৫০টি কেতআ কবিতা, অন্যান্য বিভিন্ন গঠনের ১২৩টি খণ্ড কবিতা এবং ইসলামি বিপ্লব নিয়ে ৩৯টি কবিতা লিখেছেন। আর তুর্কি কবিতার মধ্যে হায়দার বাবায়ে সালাম (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড), সাহান্দিম ও তুর্কি মুক্ত কবিতাসমূহ বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
সৌর ১৩২৮ হিজরিতে (১৯৪৯ খ্রি.) শাহরিয়ারের দিভান বা কাব্যসংকলনের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়। ইমাম খোমেইনি (রহ.) শাহরিয়ারকে তাঁর মৃত্যুবার্ষিকিতে ‘بلبل داستانسراي غزل فارسي’ ফারসি গযলের ‘বুলবুল পাখি’ বলে উল্লেখ করেন।
১৩৩৫ হিজরিতে (১৯৫৬ খ্রি.) তাঁর দিভান এর দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড এবং ১৩৪৬ হিজরিতে (১৯৫৬ খ্রি.) চতুর্থ ও পঞ্চম খণ্ড প্রকাশিত হয়। বর্তমানে তেহরানের এন্তেশারাতে নেগাহ শাহরিয়ারের দিভান বা কাব্যসমগ্র দুটি খণ্ডে প্রকাশ করেছে। তাঁর দিভান-এ গজল, কাসিদা, মাসনাভি, দো বেইতি, রুবায়ি, কেতআত, মোতার্ফারেকে ও কিছু মুক্ত কবিতা দেখতে পাওয়া যায়। অর্থাৎ ফারসি সাহিত্যে প্রচলিত প্রায় সবধরনের কবিতাই তিনি লিখেছেন।
তবে শাহরিয়ার তাঁর সাহিত্যপ্রতিভার পুরোটাই ‘গযল’-এ ঢেলে দিয়েছেন। শাহরিয়ারকে বুঝতে হলে তাঁর গযলকে বুঝতে হবে। শাহরিয়ার পুরো জীবনের অভিজ্ঞতাকে তাঁর গযলে নিয়ে এসেছেন। ‘কবিতা লেখার জন্য তিনি গযলকে নির্বাচন করেননি; বরং জীবন কাহিনীই তাঁকে গযল নির্বাচন করতে বাধ্য করেছে।’
বিষয় বৈচিত্র্যের মাঝে প্রেমই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। শাহরিয়ার প্রায় সব ধরনের বিষয়বস্তু নিয়ে কবিতা লিখেছেন। তাঁর কবিতাগুলো নিজের জীবনের খুব কাছাকাছি ছিল। ছোটবেলার বিভিন্ন স্মৃতি, না পাওয়ার বেদনা, জীবনের ব্যর্থতা, প্রেম, বিরহ, নিজস্ব ধর্মবিশ্বাস প্রভৃতি দ্বারা শাহরিয়ারের কবিতাগুলো পরিপূর্ণ ছিল।
শাহরিয়ার ছিলেন সাধারণ মানুষের কবি। সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়া, দুঃখ-বেদনার চিত্র তাঁর কবিতার মধ্যে ফুটে উঠেছে। তিনি দেশ নিয়ে কবিতা লিখেছেন, দেশের মানুষের কথা বলেছেন।
পুরো ফারসি সাহিত্য জুড়েই, বিশেষ করে ফারসি গযলে অধ্যাত্মবাদের একটি প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। শাহরিয়ারের গযল দুনিয়া ত্যাগ, পার্থিব জীবনের প্রতি অনীহা, আখেরাতের প্রতি আগ্রহ প্রভৃতি আধ্যাত্মিক বিষয়বস্তু দ্বারা পরিপূর্ণ। حاتم درويشان، باده ي حسرت، کارگاه آدم سازي، دروغ اي دنيا، راز و نياز প্রভৃতি গযলে উপরিউক্ত বিষয়াবলি দেখতে পাওয়া যায়।
শাহরিয়ারের কিছু কিছু কবিতা সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও জাতীয় বিষয়াবলি নিয়ে লেখা। বিশেষ করে বিভিন্ন উৎসব, যুদ্ধ-বিগ্রহ, যোদ্ধাদের মাহাত্ম্য বর্ণনা, বিভিন্ন যুগের সাংস্কৃতিক রীতি-নীতি, ইরানের হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনার আকাক্সক্ষা প্রভৃতি বিষয়বস্তু নিয়ে কবিতাগুলো লেখা হয়েছে। شب و علي، به پيشگاه آذربايجان، تخت جمشيد، کودک قرن طلا، ماتم پدر প্রভৃতি কবিতাগুলো এই সমস্ত বিষয়বস্তু নিয়ে লেখা।
ইসলামি বিপ্লব নিয়েও তিনি অনেক কবিতা লিখেছেন। ইমাম খোমেইনির প্রশংসা, বিপ্লবের বৈশিষ্ট্যাবলি, এই বিপ্লবে সাধারণ জনতার অংশগ্রহণ ও তাদের মনোভাব ইত্যাদি বিষয়সমূহ তাঁর বিপ্লবী কবিতায় স্থান পেয়েছে।
শাহরিয়ারের কবিতাগুলো আধুনিক ও ক্ল্যাসিক ধারার সংমিশ্রণে লিখিত। তাতে একদিকে নিযামি, হাফিয, অওহেদি ও সালমান সাওজির কবিতার বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান, অন্যদিকে আধুনিক কবিতার ভাষাগত বৈশিষ্ট্য তাঁর কবিতাকে ফারসি সাহিত্যের শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসিয়েছে।
তাঁর গযলগুলো হৃদয়গ্রাহী ও অত্যন্ত স্পর্শকাতর। শাহরিয়ার নিজের চিন্তা-চেতনা, আবেগ-অনুভূতি ও জীবনের অভিজ্ঞতাগুলোকে গযলের ভেতর উজাড় করে দিয়েছেন। বাহ্যিক, অভ্যন্তরীণ ও অর্থগত ছন্দের সামঞ্জস্যের মাধ্যমে গযলগুলো আধুনিক যুগের শ্রেষ্ঠ গযলের মর্যাদা লাভ করেছে। দিভান-এর চারশ’ গযল, গযল রচনায় তাঁর পারদর্শিতার প্রমাণ বহন করছে। মালেকুশ শোয়ারায়ে বাহারসহ অন্যান্য গবেষকের মতে : হাফিযের পর শাহরিয়ারই ফারসি গযলকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন।
শাহরিয়ারের গযলগুলোকে দু’টি যুগে ভাগ করা যায়। প্রথমটি মানবীয় প্রেমের জ্বালা-যন্ত্রণার যুগ। দ্বিতীয়টি বিষণœতার যুগ বা আধ্যাত্মিক প্রেমের যুগ। নিমা ইউশিয, শাহরিয়ারের هذيان دل (হেযইয়ানে দেল) গযলটিকে শ্রেষ্ঠ গযল হিসেবে উল্লেখ করেছেন। سه تار গযলটিও শাহরিয়ারের প্রসিদ্ধ গযলসমূহের মধ্যে একটি, এই গযল দু’টিতে কবি তাঁর জীবনচিত্র তুলে ধরেছেন। গযল লেখার ক্ষেত্রে শাহরিয়ার অধিকাংশ জায়গায় হাফিযকে অনুসরণ করেছেন। হাফিযের চিন্তা-চেতনাকে আধুনিক ভাষায় গযলের ভেতর নিয়ে এসেছেন।
গযল ছাড়াও শাহরিয়ার কিছু উল্লেখযোগ্য মাসনাভি লিখেছেন। منظومهي تخت جمشيد তাঁর একটি বিখ্যাত মাসনাভি। এই মাসনাভিতে তিনি ইরানের প্রাচীন শৌর্য-বীর্যের ইতিহাস তুলে ধরেছেন ও এর সাথে বর্তমান ইরানের একটি তুলনামূলক আলোচনা করেছেন।
ক্ল্যাসিক গঠনরীতির পাশাপাশি আধুনিক গঠনের কবিতা বা নিমা ইউশিযের মুক্ত কবিতা অবলম্বনে বেশকিছু কবিতা লেখেন। پيام اينشتين তাঁর লেখা মুক্তধারার একটি কবিতা। এই কবিতায় তিনি একজন আইনস্টাইন চেয়েছেন, যার সাথে নিজস্ব প্রতিভাকে বিনিময় করবেন এবং এর দ্বারা সমাজের নিপীড়িত মানুষের দুঃখ-দুর্দশাকে দূর করা সম্ভব হবে। دو مرگ بهشت তাঁর আধুনিক কবিতার আরেকটি উদাহরণ, যেখানে স্বপ্নের ভেতর পারস্পরিক কথাবার্তার মাধ্যমে নিজের আধ্যাত্মিক চিন্তা-চেতনাকে তুলে ধরেছেন। سهنديه কবিতার মাধ্যমে শাহরিয়ার আধুনিক মোস্তাযাদ কবিতার দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন।
শাহরিয়ার তাঁর তেজোদীপ্ত, গতিশীল, আন্তরিক, কোমল ও হৃদয়গ্রাহী ভাষার মাধ্যমে অবিস্মরণীয় ছন্দময় কবিতার দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন। তাঁর কিছু কবিতার ভাষা এতই সহজ-সরল যা শুনলে দৈনন্দিন কথা-বার্তার মত মনে হয়। সাধারণ মানুষের মুখের প্রচলিত শব্দগুলো তাঁর কবিতায় ব্যবহার করেছেন। যদিও অধিকাংশ সাহিত্য সমালোচক কবিতায় এই সাধারণ শব্দ ব্যবহারের সাহসিকতাকে প্রশংসা করেছেন, তবে কারো কারো মতে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই ব্যবহার তাঁর কবিতার মূল্যকে কমিয়ে দিয়েছে। এ ধরনের শব্দ তাঁর কবিতার অনেক জায়গায় দেখতে পাওয়া যায়। যেমন :
آن بيد کناره جاده ده
آيا که پس از منش گذر کرد
هر برگي از آن زبان دل بود
با من چه فسانه ها که سر کرد
او ماند و جوان عاشق از ده
شب همره کاروان سفر کرد
অর্থ :
গ্রামের রাস্তার পাশে অবস্থিত ঐ বীদ বৃক্ষ!
আমার পরে কি আর কেউ তার পাশ দিয়ে চলে গেছে?
সেই বৃক্ষের প্রতিটি পাতায় হৃদয়ের ভাষা ছিল,
আমার কাছে কত গোপন কল্প-কাহিনী বর্ণনা করেছে।
সে দাঁড়িয়ে ছিল আর গ্রামের প্রেমিক যুবকেরা,
রাতের কাফেলার সাথে তার পাশ দিয়ে ভ্রমণ করেছে ॥
এই কবিতায় بيد، کناره جاده ده، منش، چه فسانه ها প্রভৃতি শব্দগুলো সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা।
গযলের ক্ষেত্রেও সাধারণ শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। গযলের ক্ষেত্রেও এই সাধারণ শব্দের ব্যবহার ফারসি সাহিত্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এরকম কতগুলো গযলের মাত্বলা ছিল নিম্নরূপ :
آمدي جانم به قربانت ولي حالا چرا
بي وفا حالا که من افتاده ام از پا چرا
অর্থ :
এসেছ! আমার জীবন তোমার জন্য উৎসর্গিত! কিন্তু এখন কেন এলে?
বিশ্বাসঘাতক, যখন আমি নিঃশেষ হয়ে গেছি তখন কেন এলে?
تا هست اي رفيق نداني كه كيستم
روزي سراغ وقت من آيي که نيستم
অর্থ :
যতক্ষণ ছিলাম বুঝলে না হে! বন্ধু আমি ছিলাম কে,
একদিন আমার খোঁজে তুমি আসবে, সেদিন আর আমি রইব না যে ॥
****
আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার ছিল শাহরিয়ারের কবিতার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। যেমন :
با خلق مي خوري مي و با ما تلوتلو
قربان هر چه بچه ي خوب سرش بشو
অর্থ :
মানুষের সাথে মদ খাও আর মাতলামি কর আমার সাথে,
তোমাকে কোরবানি করে দিলাম যা ভাল মনে চায় তাই হও ॥
শাহরিয়ারের কবিতায় প্রকৃতির প্রভাব বিশেষভাবে দেখা যায়। সুনিপুণ দক্ষতার সাথে কবি প্রকৃতিকে কবিতায় নিয়ে এসেছেন এবং চমৎকারভাবে প্রকৃতিকে উপস্থাপন করেছেন। জঙ্গল, পাহাড়, সকাল, চাঁদ, ঝরনা, রাত ইত্যাদির বর্ণনা ও উপমা প্রায়ই নিয়ে এসেছেন। যেমন : তিনি তাঁর درياچة اشک বা অশ্রুর সাগর কবিতায় বলছেন :
سرو من صبح بهار است به طرف چمن آي
تا نسيمت بنوازد به گل افشاني ها
گر بدين جلوه به درياچة اشکم تابي
چشم خورشيد شود خيره ز رخشاني ها
অর্থ :
ওগো আমার চিরসবুজ বৃক্ষ! বসন্তের এই সকালে তৃণভূমিতে এস,
তোমার কোমল বাতাস ফুলের গায়ে আদর বুলিয়ে দেবে।
যদি তুমি এই আলো আমার অশ্রুর সাগরে ছড়িয়ে দাও,
তবে সেই বিস্ময়কর আলোয় আমার চোখ যেন সূর্য হয়ে যাবে ॥
শাহরিয়ারের কবিতার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো গ্রাম্য ভাষার ব্যবহার। হায়দার বাবায়ে সালাম, সাহান্দিয়ে ও আরো বিশেষ কয়েকটি কবিতাকে বিশ্লেষণ করলে নিঃসংকোচে তাঁকে ‘পল্লিকবি’ বলা যায়। বিশেষ করে হায়দার বাবায়ে সালাম-এর মধ্যে পল্লি মানুষের জীবনধারা, তাদের সামাজিক অবস্থান, আচার-ব্যবহার, রীতি-নীতি, ভাষা ও সংস্কৃতি প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। ফারসি কবিতার আধুনিক যুগের অন্য কোন কবি গ্রাম্য উপাদান নিয়ে এত কবিতা লেখেন নি।
শাহরিয়ারের কবিতায় তেহরানের অঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার ও তেহরান সংক্রান্ত আলোচনা অত্যধিক প্রাধান্য পেয়েছে। তাবরিযের কিছু ভাষাও কবিতায় দেখতে পাওয়া যায়, তবে তুলনামূলকভাবে তিনি তেহরানকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। تهران و ياران নামক গযলে বলেন :
من نه آنم كه فراموش كنم تهران را
شب تهران و شعاع و شفق شمران را
অর্থ :
আমি এমন নই যে, তেহরানকে ভুলে যাব,
তেহরানের সূর্যকিরণ ও সন্ধ্যায় লালিমার দৃশ্য উপভোগ করাকে ॥
চিত্রকল্প ব্যবহারের ক্ষেত্রে শাহরিয়ার বেশ পারদর্শিতার পরিচয় দেন। তাঁর চিত্রকল্পগুলো ছিল জীবন্ত ছবির মত। পরিপূর্ণ দক্ষতার সাথে জীবন্ত চিত্রকল্প ব্যবহারের মাধ্যমে তিনি তাঁর কবিতার ভাষাকে বেশ সমৃদ্ধ করেছেন। যেমন : پيشة عشق বা প্রেমের পেশা শিরোনামের গযলে তিনি বলছেন :
به کاخ وصل تو پر مي فشاندم از سر شوق
کنون ز سنگ جدايي شکسته بال شدم
به دست تير و کمان آمدم به پيشة عشق
شکار شير نگاه تو اي غزال شدم
অর্থ :
অনেক আশা নিয়ে পাখা মেলেছিলাম তোমার মিলন প্রাসাদ দিকে,
তোমার বিচ্ছেদের পাথরের আঘাতে এখন ডানা ভাঙা (পাখির) মত হয়ে গেছি।
তীর আর ধনুক হাতে প্রেমের পেশায় নেমেছিলাম,
কিন্তু হায়! তোমার ব্যাঘ্র দৃষ্টির কাছে শিকারি হরিণে পরিণত হয়েছি ॥
এখানে কবি নিজের ভালবাসা, প্রেম, বিরহ, বিচ্ছেদ, প্রেমিকার নির্দয় আচরণ ও প্রেমের শেষ পরিণতিকে শিকারি, বাঘ, হরিণ, ডানাভাঙা পাখি প্রভৃতি চিত্রকল্প দ্বারা চমৎকারভাবে চিত্রিত করেছেন।
সহানুভূতি বা অনুকম্পা প্রদর্শন শাহরিয়ারের কবিতার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। অপরের ব্যথায় তিনি ব্যথিত হয়েছেন, অন্যর দুঃখ-কষ্টে নিজেও কষ্ট পেয়েছেন। এই সহানুভূতিশীলতার মূল উৎস ছিল তাঁর জীবনের ব্যর্থ প্রেম। طوطی خوش لهجه (সুসময়ের তোতা পাখি) حالا چرا (এখন কেন), نی مخزون (চিন্তিত বাঁশি), سه تار من (আমার সেতারা), نيما غم دل بگو (নিমা হৃদয়ের ব্যথা বল), وحشی شکار (শিকারির পাশবিকতা) প্রভৃতি গযলে তাঁর অনুকম্পার প্রতিফলন দেখা যায়।
শাহরিয়ারের লিখিত গযলসমূহ তাঁর আবেগ-অনুভূতি ও ব্যক্তিগত চরিত্রের প্রতিফলন ঘটিয়েছে। যে সমস্ত কবিতায় তাঁর সূক্ষ্ম অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় সেগুলো হলো اي وي مادرم، کودک و خزان، بهشت گمشده، صبا مي ميرد، প্রভৃতি।
ইরানের ইসলামি বিপ্লবের প্রতি শাহরিয়ারের পূর্ণ সমর্থন ছিল। ইসলামি বিপ্লবে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাঁদের প্রশংসায় কবিতা লিখেছেন। শাহরিয়ারের কবিতাগুলো নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে মিশে ছিল। তিনি কোরআন ও আহলে বাইতের আশেক ছিলেন। রাসূলে পাক (সা.), তাঁর পরিবারবর্গ, আহলে বাইত সদস্যদের নিষ্পাপ চরিত্র ও হযরত আলী (আ.)-এর প্রশংসায় তিনি অসংখ্য কবিতা লিখেছেন। যেমন : داغ حسين নামক কবিতায় বলেন :
محرم آمد و نو كرد درد و داغ حسين
گريست ابر خزان هم به باغ و راغ حسين
هزار و سيصد و اندي گذشت سال و هنوز
چو لاله بر دل خونين شيعه داغ حسين
অর্থ :
মুহররম এল, হোসাইনের ব্যথাভরা ক্ষতকে নতুন করে জাগিয়ে তুলল,
শরৎ এর মেঘগুলোও যেন হোসাইনের বাগানে ও তাঁর উপত্যকায় কাঁদছে।
তেরশ’ বছরের চেয়ে আরো বেশি কিছু সময় অতিক্রান্ত হয়েছে, কিন্তু এখনো,
অনুসারীদের রক্তাক্ত বুকে টিউলিপ ফুলের মত হোসাইনের ক্ষত রয়ে গেছে।
اي هماي رحمت را بسرايد که কবিতাটিকে তাঁর সর্বোৎকৃষ্ট সাহিত্যকর্মের মধ্যে গণ্য করা হয়।
শাহরিয়ারের কবিতার ধর্মীয় বিষয়াবলিকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। ক. রাসূলে পাক (সা.) ও তাঁর পরিবারবর্গের প্রতি অকৃত্রিম অনুরাগ, খ. ইসলামি বিপ্লবের প্রতি সমর্থন, গ. আধ্যাত্মিক বিষয়াবলি।
বিশেষ করে তাঁর প্রসিদ্ধ কাসিদা দু’টি قيام محمد، علي اي هماي رحمت আল্লাহর রাসূল ও হযরত আলী (আ.)-এর প্রশংসায় লিখেছেন। যেমন : علي اي هماي رحمت কবিতায় তিনি বলছেন :
علي اي هماي رحمت تو چه آيتي خدا را ؟
كه به ما سوا فكندي همه سايه ي هما را
অর্থ :
হে আলী! তুমি সৌভাগ্যময় রহমতের পাখি, তুমি খোদার কী অনুপম নিদর্শন!
তুমি আমাদের জন্য সকল সৌভাগ্যের আলো-ছায়াকে ছড়িয়ে দিয়েছ ॥
শাহরিয়ারের কবিতায় কোরআনের বিষয়াবলি নিয়ে তালহমিহ! লক্ষ্য করা যায়। যেমন : قاف عزلت শিরোনামের গযলে তিনি সূরা আরাফের ১৪৩ নম্বর আয়াতের অর্থাৎ ولما جاء موسي لميقاتنا و كلمه ربه قال رب ارني انظر اليك قال لن تراني . . এর ঘটনা বর্ণনায় বলছেন :
جلوه كن كه سخن با تو كنم چون موسي
سينه ام سوخته در حسرت سينا گشتن
অর্থ :
তোমার নিজেকে প্রজ্বলিত কর; কারণ, তোমার সাথে মূসার মত কথা বলব,
সিনা পর্বতের অনুশোচনায় আমার হৃদয় পুড়ে গেছে ॥
পরিশেষে বলা যায়, শাহরিয়ার ছিলেন একজন আধুনিক কবি। নতুনত্বের প্রতি কবি শাহরিয়ারের প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল। তিনি তাঁর কবিতাগুলোকে নতুন ভাষা, চিত্রকল্প, বিষয়বস্তু ও চিন্তা-চেতনার দ্বারা নতুন আঙ্গিকে সাজানোর চেষ্টা করেছেন। নব যৌবনের উদ্দীপনা ও আধুনিক ভাবনা তাঁর কবিতার সর্বত্র প্রতিফলিত হয়েছে। دکتر غلامحسين يوسفي বলেন : ‘তাঁর বয়স ত্রিশ বছরের বেশি ছিল না, কিন্তু তাঁর কবিতাগুলো ছিল পরিপক্ব, এক কথায় বলা যায়, একটি সার্থক কবিতার জন্য যে সমস্ত শর্ত প্রয়োজন, যেমন : সুস্পষ্ট চিন্তা, সূক্ষ্ম শব্দচয়ন ও বিষয়বস্তুর প্রভাব, সবকিছুই তাঁর কবিতায় পাওয়া যায়।’
সহকারি অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মওলানা জালালুদ্দিন রুমি : আত্মার বাঁশিবাদক
ড. আবদুস সবুর খান
ইসলামের শাশ্বত দর্শন আর পবিত্র কুরআনের অমিয় বাণীকেই আরও সাবলীল ব্যাখ্যায় অস্থিরচিত্ত মানুষের আত্মার প্রশান্তির জন্য বাঙ্ময় করে তুলেছেন মানবতা ও আত্মার বাঁশিবাদক কবি মওলানা জালালুদ্দিন রুমি তাঁর মাসনাভি শরিফ-এ। তাই বর্তমান বিশ্ব জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে শান্তিপিয়াসী মানুষের আত্মায় ঠাঁই করে নিয়েছে তাঁর কবিতার অমোঘ বাণী। রুমি তাঁর কবিতায় প্রেমের যে অমিয় সুধা বিলিয়েছেন, তৃষ্ণার্ত মানবাত্মা আজও সেই সুধা পান করে স্বর্গীয় প্রশান্তিতে পরিতৃপ্ত হচ্ছে। বর্তমান বস্তুবাদী সভ্যতার চূড়ান্ত উৎকর্ষের যুগে বিশ্বমানবতা যখন হত্যা, জিঘাংসা, প্রতিহিংসা আর প্রতিশোধ পরায়ণতায় নিত্য-কলহে লিপ্ত; জাতিতে-জাতিতে, সভ্যতায়-সভ্যতায়, দেশে-দেশে, এমনকি ভাইয়ে-ভাইয়ে স্বার্থের দ্বন্দ্বে জর্জরিত হয়ে অসহায় মানবতা যখন অস্থির-অশান্তÑ একটু প্রশান্তি, একটু ভালবাসা, একটু সৌহার্দের বাণীর প্রত্যাশায় সদা উৎকর্ণ, ফারসি ভাষার সর্বজনীন মানবতার কবি জালালুদ্দিন রুমিকেই আমরা তখন আত্মার বাঁশিবাদক হিসেবে কাছের মানুষ হিসেবে দেখতে পাই। তপ্ত মরুর বুকে কাক্সিক্ষত মরূদ্যানের মতো তাঁর কবিতার অমিয় বাণী তৃষ্ণার্ত মানবাত্মার রুক্ষ অলিন্দে শীতল হাওয়ার পরশ বুলায়।
১২০৭ খ্রিস্টাব্দের ৩০ সেপ্টেম্বর তদানীন্তন পারস্যের খোরাসান প্রদেশের (বর্তমানে আফগানিস্তানের অন্তর্গত) বাল্খ শহরের একটি অভিজাত পরিবারে রুমির জন্ম। তাঁর পিতা বাহাউদ্দিন ওয়ালাদ ছিলেন সেই সময়ের একজন বিখ্যাত আলেম, সূফীসাধক ও প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাঁর পাণ্ডিত্যের কারণে তাঁকে ‘সুলতানুল উলামা’ (জ্ঞানীদের সম্রাট) বলা হতো।
রুমির ¯েœহময়ী মাতা ছিলেন আলাউদ্দিন মুহাম্মদ খাওয়ারয্ম শাহ্-এর বংশধর। অন্য এক বর্ণনামতে তিনি ছিলেন খাওয়ারয্ম শাহ্-এর কন্যা। তাঁর নাম মালাকায়ে জাহান। খাওয়ারয্ম শাহ্ ছিলেন খোরাসান হতে ইরাক পর্যন্ত বিশাল সাম্রাজ্যের প্রতিপত্তিশালী বাদশাহ।
রুমির পিতা বাহাউদ্দিন একজন অত্যন্ত উঁচু মাপের আলেম ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তি ছিলেন, যে কথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁর অসংখ্য ছাত্র ও ভক্ত ছিল। তিনি রাজ-পরিবারে বিয়ে করেছিলেন। স্বয়ং সুলতান ছিলেন তাঁর একজন গুণমুগ্ধ ভক্ত। এই অভিজাত ও ইলমি পরিবেশেই রুমির প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়েছিল। তিনি তাঁর মহান পিতার কাছ থেকে পবিত্র কুরআন, হাদিস ও ইসলামের অন্যান্য শাখায় প্রভূত জ্ঞান অর্জন করেন। মাত্র আঠার বছর বয়সে বিয়ে করেন এবং উনিশ বছর বয়সে তাঁর প্রথম সন্তানের জন্ম হয়। তাঁর সন্তানদের মধ্যে দু’জনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রথম সন্তান সুলতান ওয়ালাদ এবং অপর সন্তান আলাউদ্দিন। সুলতান ওয়ালাদ পিতার অনুগত ছিলেন এবং পরবর্তীকালে তাঁর আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারী মনোনীত হন।
রুমি তাঁর পিতার জীবদ্দশায় তাঁর বিশিষ্ট মুরিদ সাইয়্যেদ বুরহানুদ্দিন মুহাক্কিক তিরমিজীর তত্ত্বাবধানে চার-পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত অতিবাহিত করেন। রুমির বয়স যখন পাঁচ বছর তখন তাঁর পিতা সপরিবারে কুনিয়ার উদ্দেশে বাল্খ ত্যাগ করেন। তাঁর এই জন্মভূমি পরিত্যাগ করার কারণ নিয়ে একাধিক বর্ণনা পাওয়া যায়। এর মধ্যে সুলতানের বিরাগভাজন হওয়া ও তাতারীদের আক্রমণের আশঙ্কা অধিকতর গুরুত্ব পেয়েছে। বাহাউদ্দিন পথে ওয়াখ্শ এবং সমরকান্দে কিছুদিন কাটিয়ে নিশাপুর আসেন। এখানে বিখ্যাত কবি ও আধ্যাত্মিক পুরুষ শেখ ফরিদুদ্দিন আত্তারের সাথে তাঁর সাক্ষাত ঘটে। পিতার সাথে ছয় বছরের বালক রুমিও ছিলেন। আত্তার রুমির জন্য বিশেষ দোয়া করেন এবং তাঁকে তাঁর রচিত আসরার নামে গ্রন্থের একটি কপি উপহার দিয়ে ভবিষ্যতে তিনি একজন কামিল ব্যক্তি বা আধ্যাত্মিক পুরুষ হবেন বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেন।
অন্য এক বর্ণনা মতে রুমির পিতা বাহাউদ্দিন ১২১৭ খ্রিস্টাব্দে মালাতিয়া পৌঁছান। ১২১৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি সিভাস-এ আসেন এবং ইবজিন জান-এর কাছাকাছি আকশিহির নামক স্থানে চার বছর অবস্থান করেন। ১২২২ খ্রিস্টাব্দে তিনি লারিন্দা গমন করেন এবং সেখানে সাত বছর অবস্থান করেন। এখানে শারফুদ্দিন লালার কন্যা জাওহার খাতুনের সাথে রুমির বিয়ে হয়। সালজুক সুলতান আলাউদ্দিন কায়কোবাদের আমন্ত্রণে রুমির পিতা ১২২৮ খ্রিস্টাব্দে তুরস্কের কুনিয়ায় এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। এখানেই ১২৩১ খ্রিস্টাব্দে বাহাউদ্দিনের ইন্তেকাল ঘটে।
পিতার মৃত্যুর পর রুমি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন এবং ভক্তদের শিক্ষাদান, ওয়াজ-নসিহত ও ইলমে মারেফাত চর্চায় সময় কাটাতে থাকেন। রুমির পিতার মৃত্যুর এক বছর পর তাঁর মুরিদ বুরহানুদ্দিন মুহাক্কিক স্বীয় পীরের সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে কুনিয়া আসেন। এসময় রুমি তাঁর কাছে মুরিদ হন এবং নয় বছরকাল তাঁর সাহচর্যে কাটান।
রুমি তাসাউফ শাস্ত্রে অধিকতর জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে পরবর্তীকালে আলেপ্পো গমন করেন। এখানে ১২৩১-৩২ খ্রিস্টাব্দে তিনি হালাবিয়া মাদ্রাসায় কামালুদ্দিন ইবনুল আদিম-এর কাছ থেকে উচ্চতর জ্ঞান অর্জন করেন। এরপর তিনি দামেস্কের মাদ্রাসা মুকাদ্দাসিয়ায় অবস্থান করেন এবং সর্ব-শায়খ মুহিউদ্দিন ইবনুল আরবি, সাদুদ্দিন হামাবী, উসমান রুমি, আওহাদুদ্দিন কিরমানি ও সাদরুদ্দিন কুনুবির সাহচর্য লাভ করেন এবং তাঁদের কাছ থেকে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করে ১২৩৬-৩৭ খ্রিস্টাব্দের দিকে কুনিয়ায় ফিরে আসেন। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি এখানেই বসবাস করেন এবং ১২৭৩ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ডিসেম্বর এখানেই ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর পর তাঁকে কুনিয়াতেই সমাহিত করা হয়।
তদানীন্তন কালে বর্তমান তুরস্ককে বলা হতো রোম বা পূর্ব রোম। কুনিয়া ছিল পূর্ব রোমের রাজধানী। এই রোম-এর নামানুসারে মওলানা জালালুদ্দিন ‘রুমি’ নামেই সমধিক পরিচিত।
১২৩০ খ্রিস্টাব্দে ইবনুল আরাবির মৃত্যুর পর শায়খ সদরুদ্দিনসহ বেশ ক’জন আলেম কুনিয়ায় চলে আসেন এবং এসময় থেকে কুনিয়া জ্ঞানচর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। রুমি শিক্ষাদান, ওয়াজ-নসিহত ও ফতোয়া প্রদানে নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন। এ সময় তাঁর প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল চার শতাধিক। ১২৪৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রুমির জীবনধারা এভাবেই চলছিল। এবছরই অকস্মাৎ শামসুদ্দিন তাবরিজি নামক একজন রহস্যময় ভ্রাম্যমাণ দরবেশ রুমির সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাঁর সাক্ষাতের পর রুমির চিন্তা, কর্ম ও জীবনধারায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। তিনি তাঁর গতানুগতিক কর্মপদ্ধতি পরিহার করে সামা তথা সূফী নৃত্য ও আধ্যাত্মিক সংগীতে মেতে ওঠেন। ছাত্র-মুরিদ-ভক্তদের পাঠদান, ওয়াজ-নসিহত সবকিছু পরিত্যাগ করে তিনি তাবরিজির সাথে একান্তে সময় কাটাতে থাকেন। এতে সংশ্লিষ্ট সবাই হতাশ ও বিরক্ত হয়ে পড়ে। তাদের সব ক্ষোভ গিয়ে পড়ে তাবরিজির ওপর। তারা তাঁকে নানাভাবে উত্যক্ত করে তোলে। এক পর্যায়ে শাম্স তাবরিজি সবার অগোচরে কুনিয়া পরিত্যাগ করে চলে যান। এতে রুমি ভীষণভাবে ভেঙে পড়েন এবং সবকিছুর প্রতি মনোযোগ হারিয়ে ফেলেন। অনেক চেষ্টা করে শাম্সকে কুনিয়ায় ফিরিয়ে আনা হয়। এতে রুমি যেন নতুন জীবন ফিরে পান, কিন্তু আবারো তিনি সামা-সংগীত ও শাম্সের সাথে একান্তে সময় কাটাতে থাকেন। ভক্তরা আবারো বিরক্ত হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে তারা শাম্সকে হত্যা করে অথবা শাম্স চিরদিনের জন্য নিখোঁজ-নিরুদ্দেশ হয়ে যান।
অনেক খোঁজাখুঁজির পর তাঁকে না পেয়ে রুমি তাঁর এক ভক্ত সালাউদ্দিনের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তাঁর মৃত্যুর পর রুমি আরেক ভক্ত হুসামুদ্দিনের সাথে অনুরূপ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এসব ব্যক্তির সাথে ঐকান্তিক মানবিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে রুমি আধ্যাত্মিক চেতনার এক নবতর স্তরে উপনীত হন। স্রষ্টার স্বরূপ ও সৃষ্টি, বিশেষ করে মানুষের সাথে স্রষ্টার সম্পর্কের ভিত্তি ও বিস্তার নিয়ে ধর্মসাধনার এক নতুন পদ্ধতি তিনি আবিষ্কার করেন। যা অস্থির অতৃপ্ত মানব-হৃদয়কে তৃপ্ত ও প্রশান্ত করে তুলতে সক্ষম।
শাম্সে তাবরিজির সাথে রুমির সাক্ষাৎ ঘটে ৩৮ বছর বয়সে। এ বয়সেই তিনি যথেষ্ট খ্যাতিমান হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু তাবরিজির সাথে সাক্ষাৎ-পরবর্তী ঘটনাবলি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় রুমি তাঁর পূর্ববর্তী জীবনের যশ-সুখ্যাতির প্রতি মোটেও আকৃষ্ট ছিলেন না। সবাই তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হলেও তিনি অতৃপ্ত আত্মা নিয়ে এক মহাপরিবর্তনের অপেক্ষায় ছিলেন। শাম্সে তাবরিজির সাথে সাক্ষাতের মাধ্যমেই সেই মহাপরিবর্তন সাধিত হয়। তাবরিজি রুমির চিন্তাদর্শন, জীবনধারা সবই একেবারে বদলে দেন। মূলত মওলানা রুমির প্রকৃত আধ্যাত্মিক জীবনের সূচনা হয় এখান থেকেই। যা তাঁর রচনাবলির মাধ্যমে বিশ্বজোড়া ছড়িয়ে পড়ে এবং সমাদৃত হয়।
রুমির সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ মাসনাভি শরিফ। মূলত এর মাধ্যমেই তাঁর বিশ্বজোড়া পরিচিতি ঘটলেও এর বাইরেও তাঁর আরও কিছু রচনা রয়েছে। এগুলো হচ্ছে: দিওয়ানে শাম্স তাবরিজি, গদ্যগ্রন্থ ফিহ্ মা ফিহ্, মাকতুবাত, মাজালিসে সাব’আ এবং রুবাইয়াতে রুমি।
দিওয়ানে শাম্সে তাবরিজি মূলত রুমির গজল সংকলন। এতে গজল ও তারজিবান্দ-এর পঙ্্ক্তি সংখ্যা পঞ্চাশ হাজার। রুবাইয়াতে রুমি-তে রুবাইর পঙ্ক্তি সংখ্যা ৩৬৭৬। তবে তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা মাসনাভি শরিফে পঙ্্ক্তি সংখ্যা ছাব্বিশ হাজার। মোট ৬টি দাফতার বা পর্বে এটি সম্পন্ন হয়েছে। এ গ্রন্থে রুমি তাঁর দার্শনিক বক্তব্যকে অত্যন্ত সহজ-সরল প্রাঞ্জলভাবে উপস্থাপনের জন্য নানা গল্পের অবতারণা করেছেন এবং মানবাত্মাকে বাঁশির সাথে তুলনা করে বলতে চেয়েছেনÑ যে বাঁশির সুর আমাদের পুলকিত করে, বিমোহিত করে, আলোড়িত করে, আসলে তা কিন্তু সুর নয়; বরং তা হচ্ছে বাঁশির কান্না। কেন তাঁর এই কান্না? এর উত্তরে মওলানা বলেছেন, কারণ, তাকে তার মূল আবাস বাঁশঝাড় থেকে কেটে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। তাই সে তার মূল আবাস অর্থাৎ বাঁশঝাড়ে ফিরে যেতেই আজীবন কেঁদে চলেছে। আর আমরা বাঁশির সেই কান্নাকে বলছি বাঁশির সুর।
রুমির দৃষ্টিতে মানবাত্মাও মূলত পরমাত্মা তথা মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্র কাছ থেকে ছিন্ন হয়ে এই নশ্বর মানবদেহ-পিঞ্জরে আটকা পড়েছে। সে তার মূল আবাস পরমাত্মার সান্নিধ্যে ফিরে যেতে সদা উদ্গ্রীব। পৃথিবীর সব পাওয়াও তাকে পরিতৃপ্ত করতে পারে না। মনের কোন গহীনে যেন একটা অতৃপ্তি, একটা শূন্যতা, একটা না পাওয়ার বেদনা সব সময় উসখুস করতে থাকে। সেই অতৃপ্তি, সেই শূন্যতা, সেই না পাওয়ার বেদনা মূলত আর কিছুই নয়, পরমাত্মা তথা খোদা তাআলার সান্নিধ্য না পাওয়ার বেদনা, পরমাত্মার সাথে মিলন না হওয়ার বেদনা। যা শুধু ‘লেক্বায়ে রাব্বি’ বা পরম স্রষ্টার সান্নিধ্যের মাধ্যমেই বিদূরিত হওয়া সম্ভব। তাই সেই বাঁশির সুরের বর্ণনার মাধ্যমেই রুমি তাঁর মাসনাভি শুরু করেছেন:
بشنو از نی چون حکايت می کند از جدای ها شکايت می کند
کز نيستان تا مرا ببريده اند از نفيرم مرد و زن ناليده اند
[কী কাহিনি বলছে বাঁশি অন্তর দিয়ে শোন তা বিরহের আর্তি এ যে করুণ সুরে বাজছে আহা।
যেদিন আমায় বাঁশঝাড় থেকে আনল কেটে সেদিন থেকেই আমার বিরহ-ব্যথায় নারী-পুরুষ পড়ছে ফেটে।]
এভাবেই রুমি আত্মাকে বাঁশির রূপক-এর সাথে তুলনার মাধ্যমে অতৃপ্ত মানবাত্মার অতৃপ্তির কারণ আবিষ্কার করেছেন, আজ থেকে প্রায় সাড়ে সাতশ’ বছর আগে।
মাসনাভির মূল সুর বা কেন্দ্রগত প্রসঙ্গ প্রেম। প্রেমকে তিনি বিশ্বের আত্মা বলে অভিহিত করেছেন। প্রেমেই বিশ্বের সৃষ্টি, প্রেমই তার স্থিতি, আর প্রেমেই নবতর সৃষ্টি সম্ভাবনার উদ্দেশ্যে বস্তুজগতের বিলয়। সঞ্চরণমাণ জীবনের মূলে রয়েছে প্রেম। প্রেমই জীবনের নিগূঢ়তর রহস্য। প্রেমের জন্যই বাঁশির বুকে সংগীত-সুর ধ্বনিত হয়। জীবনের উৎসের মূলে গিয়ে পৌঁছার জন্যই প্রেম বিচ্ছেদের হাহাকারে কাঁদতে থাকে। প্রেমের তাগিদ না থাকলে সুন্দরের দিকে কেউ চোখ মেলে থাকত না। প্রেমের উন্মাদনায়ই প্রেমিক পরমাত্মার রহস্যের পর্দা উন্মোচনে প্রয়াসী হয়ে ওঠে। এই প্রেম-সত্যই ধ্বনিত হয়েছে রুমির সমস্ত রচনায়, সমস্ত চেতনায়, চিন্তা-দর্শনে। মাসনাভির বিখ্যাত অনুবাদক ও ভাষ্যকার অধ্যাপক আর. এ. নিকলসন-এর ভাষায়:
ঞযরং ইড়ড়শ ড়ভ গধঃযহধরি, যিরপয রং ঃযব ৎড়ড়ঃ ড়ভ ঃযব ৎড়ড়ঃং ড়ভ ঃযব (গঁযধসসধফধহ) জবষরমরড়হ রহ ৎবংঢ়বপঃ ড়ভ (রঃং) ঁহাবরষরহম ঃযব সুংঃবৎরবং ড়ভ ধঃঃধরহসবহঃ (ঃড় ঃযব ঞৎঁঃয) ধহফ ড়ভ পবৎঃধরহঃু; ধহফ যিরপয রং ঃযব মৎবধঃবংঃ ংপরবহপব ড়ভ এড়ফ ধহফ ঃযব পষবধৎবংঃ (ৎবষরমরড়ঁং) ধিু ড়ভ এড়ফ ধহফ ঃযব সড়ংঃ সধহরভবংঃ বারফবহপব ড়ভ এড়ফ.
রুমির মতে প্রেম বা এশক হচ্ছে কারো সাথে অথবা কোনো সত্তার সাথে হৃদয়ের আবেগপূর্ণ সম্পর্ক। কোনোকিছু কামনার উৎসারিত আকর্ষণ। আল্লাহ্র সন্ধানে যে দীর্ঘ পথ-পরিক্রমা মানুষের সামনে রয়েছে, যার প্রান্তসীমায় আল্লাহ্র মিলনÑপরমাত্মার সাথে মানবাত্মার মিলনÑসেই পথ অতিক্রম করার একমাত্র বাহন হলো প্রেম। ইবনুল আরাবি এই প্রেমকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনটি শ্রেণিতে বিন্যস্ত করেছেন: স্বাভাবিক প্রেম বা মানবীয় প্রেম, আধ্যাত্মিক প্রেম এবং ঐশী প্রেম। আরাবির মতে, মানবীয় প্রেম কখনো একজন সাধককে আল্লাহ্র সান্নিধ্যে পৌঁছে দিতে পারে না। কেবল ঐশী প্রেমই প্রেমিক ও প্রেমাস্পদরূপী মানবাত্মা ও পরমাত্মার মিলন ঘটিয়ে সমগ্র সত্তায় ঐক্যানুভব ঘটায়। রুমিও আরাবির এই মত সমর্থন করেছেন।
অধ্যাত্ম দর্শনে প্রেম সমস্যা একটি মৌলিক সমস্যা। ইসলামি অধ্যাত্মবাদে প্রেম বিষয়টি অত্যন্ত গভীর ও সূক্ষ্ম বিষয়। সত্যের আলোয় অবগাহন করে নিজেকে পূতঃ-পবিত্র করা যায় এমন আলোকচ্ছটাই হচ্ছে প্রেম। এই প্রেম-সত্যই ধ্বনিত হয়েছে রুমির সমগ্র রচনায়। রুমির অধ্যাত্মবাদের মূল উৎস হচ্ছে এই ঐশী প্রেম। প্রেমকে তিনি ব্যবহার করেছেন একটি অতীন্দ্রিয় আধ্যাত্মিক চেতনা ও শক্তি হিসেবে। পবিত্র কুরআনে বিধৃত প্রেমের ধারণাকে তিনি শুধু ধর্মীয় ও নৈতিক জীবনের ভিত্তি হিসেবেই ব্যবহার করেননি, একই সাথে তাকে সর্বস্তরের সব সত্তার মধ্যে একটি সৃষ্টিশীল, সংস্কারধর্মী ক্রমবিকাশমান প্রবণতা বা শক্তি হিসেবে দেখেছেন। প্রেমকে তিনি চিত্রিত করেছেন মানবাত্মার সাথে পরমাত্মার বিচ্ছেদের পর পুনর্মিলনাকাক্সক্ষা হিসেবে। এই পুনর্মিলনে প্রেমের সাথে প্রজ্ঞারও প্রয়োজন। এই দৃষ্টিকোণ থেকেই রুমি প্রেম ও প্রজ্ঞার দূত, আত্মার বাঁশিবাদক।
রুমির মতে, ঐশী প্রেম সব ব্যাধির মহৌষধ। প্রেম যেমন মনকে মলিনতা ও পাপাসক্তি থেকে মুক্ত রাখে, তেমনি তা আত্মাকে নির্মল ও উন্নত করে। তাই প্রেমকে তিনি অবিনশ্বর প্রাচুর্য হিসেবে দেখেছেন। দেখেছেন জীবনদায়ী শক্তি হিসেবে, আনন্দের উৎস হিসেবে। এই গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে রুমি তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেছেন। রুমি তাঁর মুর্শিদ শাম্স তাবরিজির মাধ্যমে যে প্রেমের সন্ধান লাভ করেছিলেন তার প্রভাব তিনি ব্যক্ত করেছেন এভাবে:
مرده بدم زنده شدم گريه بدم خنده شدم
دولت عشق آمد و من دولت پاينده آمد
[মৃত ছিলাম, জীবিত হলাম কান্নারত ছিলাম, সহাস্য হলাম।
প্রেমের প্রাচুর্য এলো তাইতো আমি অবিনশ্বর প্রাচুর্য হলাম।]
রুমির আধ্যাত্মিক দর্শনের মূল বিষয় এই প্রেম। রুমির মতে, মানবাত্মা ও পরমাত্মার মধ্যকার শাশ্বত ঐক্যই হচ্ছে এই প্রেমের মূল। এই প্রেম বর্ণনাতীত। জীবন ও প্রেমের ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। সংগীতের মাধ্যমে এর আংশিক প্রকাশ করা যায় মাত্র। তাঁর মতে:
প্রেমের যতই করি না কেন ব্যাখ্যা-বর্ণনা যখন নিজে প্রেমে পড়ি তার জন্য হই লজ্জিত
মুখের ভাষা যদিও সুস্পষ্ট কিন্তু ভাষাহীন প্রেম তার চেয়ে সুস্পষ্টতর।
রুমির মতে, দেহ মানবাত্মা ও পরমাত্মার মিলনের অন্তরায়। তাই দৈহিক নিয়ন্ত্রণই আত্মার মুক্তি। দেহের অভ্যন্তরে লুক্কায়িত যে কামনা মানুষকে সত্যপথ থেকে বিচ্যুত করে, তাকে লক্ষ্যচ্যুত করে, ভোগলিপ্সু করে তোলে, তার নাম নাফ্স। নাফ্সের দমনেই দেহের কর্তৃত্বের অবসান বা দেহের ধ্বংস এবং আত্মার স্বাধীনতার দ্বারস্বরূপ। তাই নাফ্সের বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম জীবনব্যাপী। এই সংগ্রাম সেদিনই শেষ হবে, যেদিন নাফ্স সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয়ে আত্মার আজ্ঞাবহ হবে। দেহ আত্মার মুক্তিলাভের পথে অন্তরায় না হয়ে এর বাহনরূপে ব্যবহৃত হবে। অধ্যাত্মবাদী দার্শনিকদের ভাষায় এরই নাম হচ্ছে ‘ফানা’ বা লয়। এই স্তর অতিক্রম করে যখন আল্লাহ্র সাথে পুনর্মিলনের স্তরে পৌঁছা যায়, তখনই এক নবজীবনের অধিকারী হওয়া যায়। মানবাত্মা খুঁজে পায় তার আজীবন-আরাধ্য অভীষ্টকেÑ তার মূল উৎসস্থলকে, যা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সে এই মর্তলোকে এসে দেহ-পিঞ্জরে বন্দি হয়েছিল, যার সাথে মিলনাকাক্সক্ষায় সে অস্থির ছিল প্রতিক্ষণ, যার কারণে পৃথিবীর কোনোকিছুই তাকে পূর্ণ পরিতৃপ্ত করতে পারেনি কোনোদিন। সূফী দার্শনিকদের ভাষায় এই স্তরের নাম হচ্ছে ‘বাকা’।
লক্ষ করার বিষয় হচ্ছে, রুমি তাঁর মাসনাভির কোথাও সরাসরি কোনো তত্ত্ব উপস্থিত করেননি। ছোট ছোট হেকায়াত বা গল্পের মাধ্যমে, গল্পের প্রতীকী চরিত্রের মাধ্যমে ইশারা-ইঙ্গিতে তাঁর তত্ত্ব ব্যক্ত করেছেন এবং এগুলোর উপস্থাপন এতটাই সাবলীল ও সুস্পষ্ট যে, এসব তত্ত্বের তাৎপর্য উদ্ধারের জন্য তত্ত্বাভিজ্ঞ পণ্ডিতের প্রয়োজন হয় না। যে কোনো সাধারণ পাঠক মাত্রই তার তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারেন।
মানবচিত্তের তৃপ্তি অর্থ, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি কোনোকিছুতেই নেই। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনী অথবা সেরা ক্ষমতাধর কেউই তার স্ব-অবস্থানে পরিতৃপ্ত নয়। মূলত সত্যের সাধনাই মানবহৃদয়ের চরম ও পরম সাধনা। পরম সত্যকে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে, প্রতিটি কাজের মধ্যে অনুভব করাই মানুষের শ্রেষ্ঠ সাধনা, পরম তৃপ্তি। যে যতটুকু এই পরম সত্যকে অনুভব করতে পেরেছে, সে ততটাই পরিতৃপ্ত হয়েছে। এই জগৎ, এই জীবন, এই অনন্ত সৃষ্টির উৎসে যিনি রয়েছেন এবং থাকবেন, যিনি চিরসত্য, অনন্ত, অবিনশ্বর, সর্বব্যাপী, যিনি আমাদের ভালবাসেন অকাতরে, জাতি-ধর্ম-বর্ণ কোনো পরিচয়ই যাঁর কাছে মুখ্য হয়ে ওঠে না, সবই তাঁর সৃষ্টিÑ এই পরিচয়ই যাঁর কাছে মুখ্য, সেই অশ্রুত পরমাত্মাকে ঘিরেই রয়েছে মানুষের প্রচ্ছন্ন সাধনা ও পরম আত্মতৃপ্তি। সেই স্রষ্টা আল্লাহ্কে হৃদয়ে ধারণ করা, তাঁর সাথে মিশে যাওয়া বা একাত্মতা ঘোষণা করা, সর্বপ্রকারে সত্য, সুন্দর ও পূর্ণ হয়ে ওঠাই তো জীবনের পরম আরাধ্য। এই আরাধনার পরিপূর্ণ রূপ আমরা দেখি আধ্যাত্মিক ও অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন সাধক মহাপুরুষ মওলানা জালালুদ্দিন রুমির জীবনে। রুমির বিশ্ববিশ্রুত মাসনাভিতে পবিত্র কুরআনের মর্মকথা রূপক ও উপমার মাধ্যমে কাহিনি ও কাব্যে চিত্রিত হয়েছে বলেই এ গ্রন্থকে ফারসি ভাষার কুরআন বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
আত্মার বিরহ-ব্যথার বাঁশির সুরেই আত্মাকে পরিতৃপ্ত করার প্রয়াস চালিয়েছেন রুমি। রুমি তাঁর কবিতার বাঁশির সুরের মূর্চ্ছনায় আত্মার অন্তঃস্থলে যে অপূর্ব দ্যোতনা সৃষ্টি করেছেন বিশ্বসাহিত্যের আর কোনো কবির কবিতায় তার তুলনা আছে বলে আমাদের জানা নেই।
রুমি তাঁর সমগ্র রচনার মূল বক্তব্য এবং তাঁর আচরিত ব্যক্তিগত জীবনধারার মাধ্যমে ঐশী প্রেমের ভিত্তিতে এক সর্বজনীন মানবিক সম্পর্ক গড়ে তোলাকেই সব ধর্মের অন্যতম মূল লক্ষ্য বলে স্থির করেন। স্রষ্টার স্বরূপ ও সৃষ্টি, বিশেষ করে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের সাথে স্রষ্টার সম্পর্কের ভিত্তি ও বিস্তার নিয়ে ধর্মসাধনার এক নতুন পদ্ধতি তিনি আবিষ্কার করেন। এই পদ্ধতির মাধ্যমে তিনি ইসলামি সূফী সাধনার ক্ষেত্রে ‘মাওলাভিয়া’ নামে একটি নতুন তরিকার সূচনা করেন। ‘নৃত্যশীল দরবেশ’ নামে সারা পৃথিবীতে এটি পরিচিতি লাভ করেছে। সূফী সাধনার ক্ষেত্রে কেবল নয়, আজকের দিনে যাকে মনঃসমীক্ষণ (চংুপযড়ধহধষুংরং) বলা হয় তারও তিনি অন্যতম পথিকৃৎ পুরুষ। শুধু তাই নয়, পাশ্চাত্যের একমুখী ও বিশেষ ধরনের মনঃসমীক্ষণের বিপরীতে রুমীর মনঃসমীক্ষণ পদ্ধতি অনেক বেশি বহুমুখী, গভীর, ব্যাপক ও সব বয়সের মানুষের জন্য সমান প্রযোজ্য। কেবল ব্যাপকভিত্তিক ও সবার জন্য প্রযোজ্য মনঃসমীক্ষণ পদ্ধতি নয়, বরং পাশ্চাত্যে এখন চযরষড়ংড়ঢ়যরপধষ ও ঞযবড়ষড়মরপধষ অহঃযৎড়ঢ়ড়ষড়মু নামে যে জ্ঞান-শাখা গড়ে উঠেছে, রুমিকে তার অন্যতম জনকও বলা যেতে পারে।
মানুষের বিচ্ছিন্নতা অতিক্রম করে সামগ্রিকতায় উপনীত হওয়া, খণ্ডবোধ থেকে অখণ্ডের উপলব্ধি লাভ করা, সর্বোপরি মানবত্ব থেকে ঐশ্বরিকত্বে (ভৎড়স যঁসধহরঃু ঃড় ফরারহরঃু) উপনীত হওয়ার জন্য এক গভীরতম অনুভূতি, যাকে তিনি এশক বলেছেন। এজন্য তাঁকে ‘প্রেমের দূত’ (গবংংধহমবৎ ড়ভ খড়াব) বলা হচ্ছে। তবে তাঁর এ প্রেম সংকীর্ণ রূপক মোহ বা কোনো সসীম লক্ষ্য-তাড়িত নয়, এটি সর্বব্যাপক, সর্বপ্লাবী সর্বজনীন প্রেম। যার লক্ষ্য পরম স্রষ্টার নৈকট্য লাভ, সৃষ্টি তথা মানবীয় সংকীর্ণতা, সসীমতা ও আংশিকতাকে অতিক্রম করে একক, পূর্ণ, অসীম ও অখণ্ড সত্তার দিকে ধাবিত হওয়া, তাঁর অসীম ইচ্ছার মধ্যে নিজের সসীম ইচ্ছাকে বিলীন (ফানা) করে দিয়ে স্থায়িত্ব (বাকা) লাভ করা।
প্রকৃত অর্থে আমরা প্রতিটি মানুষই এক একটি বিচ্ছিন্ন এবং খণ্ড সত্তা এবং নিজের অন্তর্জগতে একা। বস্তুত পক্ষে সৃষ্টি যেদিন থেকে তার স্রষ্টা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই মর্তলোকে ছিটকে পড়েছে, সেদিন থেকেই সে একা হয়ে গেছে। তাই সে হাজার কোলাহলের মাঝেও একাকিত্ব অনুভব করে, তাই তার স্রষ্টা বা মূলের কাছে ফিরে যাওয়ার আকুতি। মূলত এই সত্যই বিবৃত হয়েছে রুমির রচনা সমগ্রে। বিশেষ করে তাঁর মাসনাভিতে। আর সে কারণেই পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের যে কোনো ধর্মের মানুষের কাছেই রুমির সমান সমাদর। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, যতই দিন যাচ্ছে রুমির পাঠকপ্রিয়তা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভাষান্তরিত হয়ে ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়ার বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর শ্রেণিতে দর্শনের ছাত্রদের পাঠ্যসূচিভুক্ত হওয়ার পাশাপাশি সাধারণ পাঠকদেরও দৃষ্টি আকৃষ্ট করছে রুমির কবিতা। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে রুমির মাসনাভি (মূল এবং বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ মিলে) এ পর্যন্ত প্রায় পৌনে দুই কোটি কপি বিক্রি হয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো কাব্যগ্রন্থের বিক্রি সংখ্যার এটিই সর্বোচ্চ রেকর্ড। এটি সম্ভব হয়েছে এ কারণে যে, রুমি মানুষের মনের কাছাকাছি যেতে পেরেছিলেন, মানুষের মনের অস্থিরতা প্রশমিত করার মূলমন্ত্র রুমি জানতেন। তাই মানুষের খণ্ডত্ব বা একাকিত্বের অবসান ঘটিয়ে অখণ্ড ও চিরন্তন স্রষ্টার সাথে সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে রুমির কবিতা ও চিন্তা-দর্শন সংযোগ-সেতু হিসেবে পথ করে দিয়েছে। বাঁশি হয়ে সুর তুলেছে আত্মার একাকিত্বের শূন্যতার নৈঃশব্দে।
*চেয়ারম্যান, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সংবাদ বিচিত্রা (বিদেশী সংবাদ)
নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত থাকা যৌথ সমন্বিত কর্মপরিকল্পনার লঙ্ঘন : রাহ্বার
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা ইসলামী বিপ্লবের বর্তমান রাহ্বার হযরত আয়াতুল্লাহ্ উযমা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী বলেন, ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত থাকা নির্দেশ করে এমন যে কোনো মন্তব্য ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পর্কে ইরান ও ৫+১ জাতির মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির লঙ্ঘন বলে বিবেচিত হবে। তিনি গত ২১শে অক্টোবর (২০১৫) তারিখে প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানিকে লেখা পথনির্দেশক একটি পত্রে এ কথা বলেন।
ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার তাঁর এ পত্রে বলেন, যে কোনো স্তর থেকে বা যে কোনো বাহানায় যদি এমন কোনো মন্তব্য করা হয় যাতে এরূপ ইঙ্গিত থাকে যে, ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা বহাল আছে বা নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে তাহলে তা হবে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সংক্রান্ত যৌথ সমন্বিত কর্ম পরিকল্পনা (জেসিপিওএ)-র লঙ্ঘন।
উল্লেখ্য, গত ১৪ই জুলাই (২০১৫) তারিখে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় এক পক্ষে ৫+১ জাতি গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্য দেশ আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, চীন ও রাশিয়া এবং জার্মানি, আর অপর পক্ষে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের মধ্যে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সংক্রান্ত যৌথ সমন্বিত কর্ম পরিকল্পনা (জেসিপিওএ)-এর পাঠ (ঃবীঃ) চূড়ান্ত করা হয়।
ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী তাঁর এ পত্রে বলেন, ইরানের বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা অপসারণের পর্যায় এলে সে ক্ষেত্রে অপর পক্ষ যাতে কোনোভাবেই তা লঙ্ঘন করতে না পারে সে ব্যাপারে যথেষ্ট নিশ্চয়তার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী প্রেসিডেন্ট রুহানির উদ্দেশে লিখিত তাঁর এ পত্রে আরাকের পারমাণবিক চুল্লির উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য নির্দেশ প্রদান করেন এবং বলেন, ইরানের মওজূদ উন্নয়নকৃত ইউরেনিয়াম বিক্রির প্রক্রিয়া কেবল ‘ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির সম্ভাব্য সামরিক দিকসমূহ (পিএমডি)’ শীর্ষক ফাইল বন্ধ হবার এবং যথেষ্ট গ্যারান্টিসহ চুক্তি সম্পাদনের পর শুরু করতে হবে।
ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেন যে, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির মোকাবিলায় আমেরিকা একটি শত্রুতামূলক ও বিঘœ সৃষ্টিকারী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল এবং ভবিষ্যতেও এ ব্যাপারে দেশটির মনোভাবে পরিবর্তন ঘটার সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী আরো বলেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পর্কে ইরান ও ৫+১ শক্তির মধ্যকার দীর্ঘ আলোচনায় আমেরিকা যে অবস্থান গ্রহণ করে ও যে ধরনের আচরণ করে তা প্রমাণ করে যে, তাদের কাছে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয়টি ছিল ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে শত্রুতা চরিতার্থ করারই অংশবিশেষ।
বিশ্বের ছয়টি বড় শক্তির সাথে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পর্কিত আলোচনায় ইরানী আলোচকগণ যে দৃঢ় ও অটল ভূমিকা পালন করেন সে জন্য তাঁদের প্রশংসা করে ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার বলেন, বিভিন্ন প্রসঙ্গে তাঁরা দেশের অনেক বড় বড় ক্ষতি প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছেন।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সরকারি কর্মকর্তাদেরকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ইরানী কর্মকর্তাগণ যদি সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ের প্রতি অনবরত সূক্ষ্ম ও গভীরভাবে দৃষ্টি না রাখেন তাহলে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সংক্রান্ত যৌথ সমন্বিত কর্ম পরিকল্পনার যে কোনো অস্পষ্টতা বর্তমানে ও ভবিষ্যতে দেশের জন্য বিরাট ক্ষতি বয়ে নিয়ে আসতে পারে।
ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী ইরান বর্তমানে যে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে তা কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে প্রতিরোধের অর্থনীতির বাস্তবায়ন অব্যাহত রাখার জন্য ইরান সরকারের কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানান।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী প্রেসিডেন্ট রুহানীকে লেখা তাঁর এ পত্রে আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, পরিপূর্ণ দৃঢ়তা সহকারে এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য চেষ্টা চালানো অব্যাহত থাকবে এবং জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির প্রতি বিশেষ দৃষ্টি প্রদান করা হবে।
অভিভাবক পরিষদ কর্তৃক যৌথ সমন্বিত কর্ম পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সংক্রান্ত বিলে অনুমোদন প্রদান
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধানের অভিভাবক পরিষদ একটি বিলে অনুমোদন প্রদান করে দেশের সরকারকে ইতিপূর্বে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পর্কে ইরান সরকার ও ছয় জাতির দ্বারা গৃহীত যৌথ সমন্বিত কর্ম পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অনুমতি দিয়েছে। মজলিসে শূরায়ে ইসলামী (ইরানী পার্লামেন্ট) কর্তৃক গত ১৩ই অক্টোবর (২০১৫) তারিখে পাশকৃত এ বিলে পরদিন ১৪ই অক্টোবর অভিভাবক পরিষদের পক্ষ থেকে অনুমোদন দেয়া হয়।
এ বিলে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সরকারকে কতগুলো শর্ত সাপেক্ষে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যৌথ সমন্বিত কর্ম পরিকল্পনা (জেসিপিওএ) বাস্তবায়নের অনুমতি প্রদান করা হয়েছে। এর আগে ১২ই অক্টোবর তারিখে মজলিসে শূরায়ে ইসলামী বিলটির রূপরেখায় অনুমোদন প্রদান করে।
বিলটিতে যৌথ সমন্বিত কর্ম পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দেশের প্রশাসনের ওপর কতগুলো দায়িত্ব ও শর্ত নির্ধারণ করে দেয়া হয়। বিলটির প্রথম ধারায় ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার হযরত আয়াতুল্লাহ্ উযমা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ীর ফতওয়ার আলোকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রশাসনের জন্য পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদন বা ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং এ ধরনের অস্ত্রের হুমকির মোকাবিলার উদ্দেশ্যে যে কোনো আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক প্রচেষ্টায় অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
বিলটির অন্যান্য ধারায় যেসব বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে তার অন্যতম হচ্ছে, চুক্তির দুই পক্ষের মধ্যে সহযোগিতা ও পারস্পরিক সম্মান প্রদর্শন নিশ্চিত করতে হবে, ইরানের বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার ক্ষেত্রে অপর পক্ষের সম্ভাব্য ব্যর্থতা বা সম্ভাব্য পুনঃ নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রতি ইরানী প্রশাসনকে পরিপূর্ণরূপে মনোযোগী হতে হবে এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ (এসএনএসসি)-এর অনুমতি ব্যতীত আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) কর্তৃক ইরানের যে কোনো সামরিক এলাকায় প্রবেশের প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করতে হবে।
উল্লেখ্য, ভিয়েনায় গৃহীত উক্ত যৌথ সমন্বিত কর্ম পরিকল্পনা (জেসিপিওএ) অনুযায়ী, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচিতে কতগুলো সীমাবদ্ধতা মেনে নেবে এবং তার বিনিময়ে ইরানের বিরুদ্ধে ইতিপূর্বে আরোপিত সব ধরনের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হবে।
অবশ্য ইরানী কর্মকর্তারা ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছেন যে, ৫+১ জাতির সদস্য কোনো দেশ যদি চুক্তি লঙ্ঘন করে তাহলে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান স্বীয় শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মতৎপরতার ক্ষেত্রে উক্ত যৌথ সমন্বিত কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণের পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরে যাবার অধিকার সংরক্ষণ করে।
আয়াতুল্লাহ খাজ-আলীর ইন্তেকালে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার শোক প্রকাশ
গত ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ইসলামী ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী বিশিষ্ট আলেম আয়াতুল্লাহ আবুল কাসেম খাজ-আলীর ইন্তেকালে শোক প্রকাশ করে বার্তা দেন। তিনি ইরানের প্রভাবশালী জাতীয় সংস্থা অভিভাবক ও বিশেষজ্ঞ পরিষদের সাবেক এই সদস্যকে খোদাভীরু এবং বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ব্যক্তিত্ব বলে প্রশংসা করেন।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আবুল কাসেম খাজ-আলীর পরিবারের কাছে পাঠানো শোক-বার্তায় শাহের স্বৈরশাসন চলাকালীন জনাব খাজ-আলীর বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার এবং ইসলামী বিপ্লবের পর গুরুত্বপূর্ণ নানা পদে তাঁর দায়িত্ব পালনের প্রশংসা করেন।
ইসলামী বিপ্লবের আগে শাহের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে আয়াতুল্লাহ খাজ-আলীকে কয়েকবার কারাগারে নেয়া হয়েছিল।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ আয়াতুল্লাহ খাজ-আলী ৯০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। আয়াতুল্লাহ আবুল কাসেম খাজ-আলী ছিলেন আন্তর্জাতিক গাদির ফাউন্ডেশনের মহাসচিব ও পবিত্র কোমের ধর্মতাত্ত্বিক শিক্ষা কেন্দ্রের একজন খ্যাতিমান শিক্ষক।
মক্কা দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ইরানের মহাকাশ বিজ্ঞানী
ইরানের যোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তিমন্ত্রী মাহমুদ ওয়ায়েজি গত ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫ জানান, মক্কায় যে ইরানী হাজীরা নিহত হয়েছেন তার মধ্যে রয়েছেন ইরানের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের বোর্ড মেম্বার অধ্যাপক ড. আহমাদ হাতামি। তাঁর মৃত্যুতে মন্ত্রী মাহমুদ ওয়ায়েজি গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন এবং তার পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানান।
মিনা দুর্ঘটনায় ইরানের আন্তর্জাতিক খ্যাতিস¤পন্ন ক্বারীর শাহাদাত
গত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫ মিনায় পদদলিত হয়ে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশের প্রায় সাড়ে তিন হাজার হাজী প্রাণ হারান। দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ইরানের আন্তর্জাতিক খ্যাতিস¤পন্ন ক্বারী মুহসেন হাজি হাসানি কারগারও ছিলেন। তিনি চলতি বছরে মালয়েশিয়ায় আন্তর্জাতিক কুরআন প্রতিযোগিতার প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন।
ঢাকা-তেহরান শক্তিশালী স¤পর্ক গড়বে : ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী
ঢাকা সফরকালে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাওয়াদ জারিফ বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে শক্তিশালী স¤পর্ক গড়তে চায় ইরান। বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের জন্য ইরান অন্যতম উৎস হতে পারে। শুধু তাই নয়, বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য, সংস্কৃতি, ধর্মসহ সার্বিক বিষয়ে ঢাকা-তেহরান শক্তিশালী স¤পর্ক গড়বে।
গত ১৬ অক্টোবর ২০১৫ ঢাকার হোটেল সোনারগাঁওয়ে এক সংবাদ সম্মেলন এ তথ্য জানান ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এর আগে সফরের শুরুতে তিনি বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে বৈঠক করেন।
বাংলাদেশ সফরের উদ্দেশ্য স¤পর্কে জাওয়াদ জারিফ বলেন, গত জুলাইয়ে রাশিয়া, আমেরিকা, ব্রিটেন, চীন, ফ্রান্স ও জার্মানির সঙ্গে সই হওয়া পরমাণু চুক্তি স¤পর্কে বাংলাদেশকে অবহিত করতে তিনি এ সফরে এসেছেন।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও উদার মধ্যপন্থী মুসলিম দেশ। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আমাদের এই সংগ্রামে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশ আমাদের পাশে থেকেছে। তাই সমস্যা সমাধানের পর কীভাবে এই অর্জন হলো, সেটি বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম জনগণ ও সরকারকে জানাতে এসেছি। সেই সঙ্গে ইরানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পর এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে দুই দেশের স¤পর্ক কীভাবে এগিয়ে নেওয়া যায় তা নিয়ে কথা বলতে এসেছি।’
জাওয়াদ জারিফ জানান, ব্যবসা-বাণিজ্য, বেসরকারি পর্যায়ে বিনিয়োগ এবং কর্মী নিয়োগ বিষয়ে অচিরেই দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করা হবে। এ ছাড়া শীঘ্রই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের নেতৃত্বে বাংলাদেশের ৮ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ইরান সফর করবেন। ওই সফরে বেসরকারি পর্যায়ের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিও থাকবে।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, জ্বালানি, টেক্সটাইল, শিল্প, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, শিক্ষা এবং বেসরকারি খাতের উন্নয়নে দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করতে পারে।
ইরান থেকে পাকিস্তান হয়ে ভারত পর্যন্ত যে গ্যাস পাইপলাইন হবে তা থেকে বাংলাদেশ কোনোভাবে উপকৃত হতে পারে কিনা গণমাধ্যম কর্মীদের এমন প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ জাওয়াদ জারিফ বলেন, ত্রি-দেশীয় গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে ইরান পাকিস্তান এবং ভারতে গ্যাস রপ্তানি করবে। এই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশও উপকৃত হতে পারে। ওই পাইপলাইন বাংলাদেশ পর্যন্ত সম্প্রসারিত হতে পারে। এ জন্য দুই দেশের জ্বালানি মন্ত্রণালয় আলাপ-আলোচনা করবে। দুই দেশের মধ্যে এই বিষয়ে একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হবে।
ইরানের প্রশংসায় রাশিয়ার গ্রান্ড মুফ্তি
রাশিয়ান ফেডারেশনের মুফ্তি পরিষদের চেয়ারম্যান গ্রান্ড মুফ্তি রাভীল আইনুদ্দীন আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারে পথপ্রদর্শকের ও ইসলামের প্রধান পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকা পালনের কারণে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রশংসা করেছেন।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সংস্কৃতি ও ইসলামী নির্দেশনাবিষয়ক মন্ত্রী আলী জান্নাতী মস্কোয় আয়োজিত আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় সফরে রাশিয়া গেলে গত ৪ঠা সেপ্টেম্বর (২০১৫) মস্কোতে তাঁর সাথে সাক্ষাতে গ্রান্ড মুফ্তি আইনুদ্দীন ইরান সরকারের এ ভূমিকার প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সরকার মুসলিম জাহানে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও স্থিতিশীলতা আনয়নের লক্ষ্যে তার সমস্ত প্রচেষ্টাকে কেন্দ্রীভূত করেছে।
রাশিয়ান গ্রান্ড মুফ্তি প্রসঙ্গক্রমে তাকফিরি সন্ত্রাসীদের হুমকির বিরুদ্ধে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন। তিনি বলেন, তাকফিরি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো ইসলামের ওপরে গুরুতর ধরনের আঘাত হেনেছে এবং তারা মহান দ্বীন ইসলামের চেহারাকে কলঙ্কিত করেছে। তিনি বিশালায়তন গ্রান্ড মসজিদ নির্মাণের কথা উল্লেখ করেন এবং এ মসজিদের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য মন্ত্রী জান্নাতীকে এবং তাঁর মাধ্যমে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ্ উয্মা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ীকে এবং প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানিকে দাওআত করেন। তিনি বলেন, এ মসজিদ শিয়া ও সুন্নি নির্বিশেষে রাশিয়ার তিন কোটি মুসলমানের, বিশেষ করে মস্কো শহরে বসবাসরত তিরিশ লক্ষ মুসলমানের ঐক্যের প্রতীক।
রাশিয়ায় সুন্নি ও শিয়া মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখার ক্ষেত্রে গ্রান্ড মুফ্তি আইনুদ্দীন যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন সে কারণে জনাব জান্নাতী তাঁর প্রশংসা করেন।
ছাত্র বিনিময় কর্মসূচি গ্রহণের জন্য ইরান ও তুরস্কের শিক্ষাবিদগণের আহ্বান
তুরস্ক ও ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের শিক্ষাবিদগণ দু’দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ছাত্র বিনিময়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন এবং এ লক্ষ্যে একটি কর্মসূচি গ্রহণের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।
গত ৭ই সেপ্টেম্বর (২০১৫) তুরস্কের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকগণের একটি প্রতিনিধিদল ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সফরে এলে ঐতিহাসিক শীরায নগরীতে ইসলামী সংস্কৃতি ও নির্দেশনাবিষয়ক প্রাদেশিক দফতর তাঁদের সম্মানে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। উক্ত অনুষ্ঠানে ইরান ও তুরস্কের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকগণ এ আহ্বান জানান।
তুরস্ক থেকে আগত প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে তুর্কি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক সেভিম্ য়িল্মায্ বলেন, তুরস্কের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ইরান সফরের ক্ষেত্রে এবং তারা যা শিখেছে প্রকৃত পরিবেশে তা চর্চা করার লক্ষ্যে ফারসি ভাষা শিক্ষা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে ইরান ও তুরস্কÑ এ দুই প্রতিবেশী দেশের সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পক্ষ থেকে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা অপরিহার্য।
এ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তুরস্ক ও ইরানের শিক্ষাবিদগণ উল্লেখ করেন যে, ইরান ও তুরস্কের মধ্যকার সম্পর্কের ইতিহাস অনেক পুরনো এবং এ সম্পর্ক এখনো শক্তিশালী ও টেকসই।
অনুষ্ঠানে শীরায বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষার অধ্যাপক জনাব মোহাম্মাদ ইউসুফ নায়েরী তাঁর বক্তৃতায় ইরান ও তুরস্কের মধ্যকার সুদীর্ঘকালীন ও ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক বিনিময় সম্পর্কের প্রশংসা করেন।
উল্লেখ্য, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান ও তুরস্ক বিগত দুই দশক যাবত বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারস্পরিক সম্পর্ক সম্প্রসারণের জন্য চেষ্টা চালিয়ে আসছে। বিশেষ করে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান হচ্ছে তুরস্কের সবচেয়ে বড় জ্বালানি সরবরাহকারী দেশ, অন্যদিকে তুরস্ক ইরানে মোটা অঙ্কের পুঁজি বিনিয়োগ করেছে। এছাড়া তুরস্কের পণ্য রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে ইরান, অন্যদিকে ইরানী পর্যটক ও ব্যবসায়ীদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্যস্থল হচ্ছে তুরস্ক। দুই দেশই আগামী কয়েক বছরের মধ্যে পারস্পরিক বাণিজ্যিক বিনিময় বহু গুণ বৃদ্ধি করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ্য যে, গত ৭ই এপ্রিল (২০১৫) তেহরানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বৃদ্ধি সম্পর্কে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সরকার ও তুরস্ক সরকারের মধ্যে আটটি সহযোগিতা চুক্তি ও একটি যৌথ বিবৃতি স্বাক্ষরিত হয়। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের উপস্থিতিতে এক অনুষ্ঠানে দুই দেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রিগণ ও উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাগণ এসব সহযোগিতা চুক্তি ও যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন। উক্ত অনুষ্ঠানে ইরান ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট দু’দেশের মধ্যে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সম্পর্ক ও সহযোগিতা আরো বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
ইরান ও জার্মানির মধ্যে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক সম্প্রসারণের ওপর গুরুত্ব আরোপ
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান ও জার্মানি সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সম্পর্ক সম্প্রসারণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। গত ৮ই সেপ্টেম্বর তেহরানে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সংস্কৃতি ও ইসলামী নির্দেশনাবিষয়ক মন্ত্রী আলী জান্নাতী ও ইরানে নিযুক্ত জার্মান রাষ্ট্রদূত মিখায়েল ফ্রেইহার ভন উঙ্গার্ন-স্টার্ন্্বার্গের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
বৈঠকে জনাব জান্নাতী বলেন, ইরানী ও জার্মান এ দুই জাতির মধ্যে দূর অতীত কাল থেকে গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান এবং যেহেতু টেকসই সাংস্কৃতিক বন্ধন দু’দেশের মধ্যে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে গ্যারান্টি হিসেবে কাজ করতে সক্ষম সেহেতু আমাদেরকে এই দুই জাতির মধ্যকার সাংস্কৃতিক বন্ধন শক্তিশালী করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এছাড়া তিনি জার্মানিতে ইরানী সাংস্কৃতিক সপ্তাহ অনুষ্ঠান পুনরায় চালু করার জন্য আহ্বান জানান যাতে জার্মানিতে বিভিন্ন ইরানী চলচ্চিত্র ও যন্ত্রসংগীত দল প্রেরিত হবে।
জার্মান রাষ্ট্রদূত উঙ্গার্ন-স্টার্ন্্বার্গ্ তাঁর বক্তব্যে জোর দিয়ে বলেন যে, সাংস্কৃতিক সম্পর্ক সঙ্কট নিরসনে সহায়ক হবে। তিনি বলেন, সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ব্যতিরেকে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক টেকসই হতে পারে না, সুতরাং আমাদেরকে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক আরো বেশি সম্প্রসারিত করার জন্য চেষ্টা করতে হবে।
উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বিশেষ করে গত ১৪ই জুলাই (২০১৫) তারিখে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পর্কে ৫+১ জাতি ও ইরানের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ইরান ও জার্মানি বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক সম্প্রসারিত করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে দু’দেশের মধ্যে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা পর্যায়ে সফর বিনিময় অব্যাহত রয়েছে। এ লক্ষ্যে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাসউদ সুলতানীফার- যিনি একই সাথে তাঁর দেশের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার, হস্তশিল্প ও পর্যটন বিষয়ক সংস্থা (আইসিএইচএইচটিও)-এরও প্রধানÑ গত মার্চ মাসে জার্মানি সফর করেন। এ সময় তিনি বার্লিনে অনুষ্ঠিত ৪৯তম আইটিবি পর্যটন প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন এবং জার্মান পার্লামেন্টের পর্যটন কমিটির সদস্যদের ও শীর্ষস্থানীয় আইটিবি কর্মকর্তাগণসহ জার্মান সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তার সাথে সাক্ষাৎ করেন।
জান্নাতীর সাথে রুশ সাংস্কৃতিক উপমন্ত্রীর সাক্ষাৎ
রাশিয়ার সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী গ্রিগোরি পেত্রোভিচ্ ইভ্লিয়েভ্ গত ৫ই সেপ্টেম্বর তেহরানে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সংস্কৃতি ও ইসলামী নির্দেশনাবিষয়ক মন্ত্রী আলী জান্নাতীর সাথে সাক্ষাতে সকল ক্ষেত্রে, বিশেষ করে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে দু’দেশের মধ্যকার সম্পর্ক ও পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন।
উক্ত সাক্ষাতে জনাব জান্নাতী ও মি. ইভ্লিয়েভ্ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক বিষয়ে, বিশেষ করে দু’দেশের যৌথ উদ্যোগে একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ ও কমপক্ষে দশটি গুরুত্বপূর্ণ ইরানী সাহিত্য কর্ম রুশ ভাষায় অনুবাদকরণ সম্পর্কে আলোচনা করেন।
এ সাক্ষাতে জনাব জান্নাতী উল্লেখ করেন যে, ১৯৬০-এর দশকে মহাকবি ফেরদৌসীর মহাকাব্য শাহ্নমে রুশ ভাষায় অনূদিত হয় এবং সম্প্রতি মাওলানা জালালুদ্দীন রূমীর মাস্নাভী রুশ ভাষায় অনূদিত ও দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে এবং তা রুশভাষী পাঠকদের দ্বারা ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন যে, এসব গ্রন্থ এমনই পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে যে, এমনকি মস্কোর মেট্রো স্টেশনগুলোতেও এগুলো বিক্রি হচ্ছে এবং মেট্রোর যাত্রীরা তা সংগ্রহ করছে।
বৈঠক শেষে জনাব জান্নাতী সাংবাদিকদের কাছে বলেন, আমরা অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে দু’দেশের যৌথ উদ্যোগে একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্পর্কেও আলোচনা করেছি এবং এ ব্যাপারে একটি চুক্তিতে উপনীত হয়েছি।
রাশিয়ার সাংস্কৃতিক উপমন্ত্রী বলেন যে, তাঁর দেশ ইরানী বিশেষজ্ঞ ও অনুবাদকদেরকে স্বাগত জানাবার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। মি. ইভ্লিয়েভ্ আরো বলেন, ইতিমধ্যেই অনেক ইরানী লেখক রাশিয়া সফর করেছেন এবং সেখানে তাঁদের সাহিত্যকর্মকে পরিচিত করে তুলেছেন।
উল্লেখ্য, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান ও রাশিয়া সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধির লক্ষ্যে সম্প্রতি প্রচেষ্টা জোরদার করেছে। ইতিপূর্বে ২০১২ সালের জুন মাসে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সংস্কৃতি ও ইসলামী যোগাযোগ সংস্থার প্রধান মোহাম্মাদ্ বাক্বের র্খোরামশদ রাশিয়া সফর করেন এবং উক্ত সফরে তিনি মস্কোতে রাশিয়ার সাংস্কৃতিক উপমন্ত্রী আন্দ্রেই বুসিগীন্-এর সাথে এক বৈঠকে মিলিত হন। এ বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্র চিহ্নিত করা হয়। এ বৈঠকে উভয় পক্ষ দু’দেশের সংস্কৃতি, সাহিত্য ও শিল্পকলার প্রতি পারস্পরিক আগ্রহের কথা উল্লেখ করে এসব ক্ষেত্রে ব্যাপকতর সহযোগিতা গড়ে তোলার ওপরে গুরুত্ব আরোপ করে।
ইরান ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে ষষ্ঠ দফা ধর্মীয় সংলাপ অনুষ্ঠিত
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান ও অস্ট্রিয়ার কর্মকর্তাদের মধ্যে গত ২৯শে সেপ্টেম্বর অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় ষষ্ঠ দফা আন্তঃধর্ম সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। এতদসংক্রান্ত বৈঠকে ভিয়েনাস্থ ইরান দূতাবাসের কালচারাল অ্যাটাচে এবং অস্ট্রিয়া সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্তঃধর্ম সংলাপবিষয়ক মহাপরিচালকের মধ্যে ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির পন্থা সম্পর্কে আলোচনা হয়।
অস্ট্রিয়া সরকারের পক্ষ থেকে আন্তঃধর্ম সংলাপের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের আন্তঃসভ্যতা সংলাপবিষয়ক কেন্দ্রের সমন্বয়ের মাধ্যমে এ সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়।
উল্লেখ্য, এর আগে গত মার্চ মাসে (২০১৫) তেহরানে অস্ট্রিয়ার রাষ্ট্রদূত ফ্রিয়েডরিক স্টিফ্ট ও ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ইসলামী সংস্কৃতি ও যোগাযোগ সংস্থার প্রধান আলী মোহাম্মাদ হেলমী অস্ট্রিয়া ও ইরানের মধ্যে ধর্মীয় সংলাপ অনুষ্ঠান সম্পর্কে আলোচনা ও মত বিনিময় করেন।
এ বৈঠকে অস্ট্রিয় রাষ্ট্রদূত দু’দেশের মধ্যে ইতিপূর্বে অনুষ্ঠিত পাঁচ দফা আন্তঃধর্ম সংলাপকে সফল হিসেবে অভিহিত করেন এবং আশাবাদ প্রকাশ করেন যে, দু’দেশের মধ্যে আন্তঃধর্ম সংলাপ অব্যাহত থাকবে।
এছাড়া তিনি উল্লেখ করেন যে, অস্ট্রিয়ায় অনেক মুসলমান বসবাস করেন। তিনি আরো উল্লেখ করেন যে, অস্ট্রিয়া এক শতাব্দীরও বেশিকাল পূর্বে ইসলামকে অস্ট্রিয়দের অন্যতম ধর্ম হিসেবে সরকারিভাবে স্বীকৃতি প্রদান করেছে।
অস্ট্রিয় রাষ্ট্রদূত আরো উল্লেখ করেন যে, অস্ট্রিয়ার পার্লামেন্টে সাত জন মুসলিম এমপি রয়েছেন।
এ বৈঠকে জনাব আলী মোহাম্মাদ হেলমী আন্তঃধর্ম সংলাপের ক্ষেত্রে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান ও অস্ট্রিয়ার পারস্পরিক সম্পর্কের প্রশংসা করেন।
ইরানী ও অস্ট্রীয় প্রতœতত্ত্ববিদগণ পারস্পরিক অভিজ্ঞতা বিনিময় করবেন
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান ও অস্ট্রিয়ার প্রত্বতত্ত্ববিদগণের মধ্যে পারস্পরিক অভিজ্ঞতা বিনিময়ের লক্ষ্যে দু’দেশের মধ্যে একটি প্রতœতাত্ত্বিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। গত ৯ই সেপ্টেম্বর (২০১৫) তারিখে ইরানের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান মোহাম্মাদ বেহেশতী ও অস্ট্রিয়ার বিজ্ঞান অ্যাকাডেমির প্রধান অ্যান্টন যেইলিঙ্গার তেহরানে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এ চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এ চুক্তিতে বিশেষ করে দু’দেশের মিউজিয়াম ও প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনাদিসমৃদ্ধ স্থান সমূহের সংরক্ষণ ও মেরামতের ক্ষেত্রে পারস্পরিক অভিজ্ঞতা বিনিময়ের ওপরে জোর দেয়া হয়।
এছাড়াও ইরান ও অস্ট্রিয়া এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বিনিময় এবং গবেষণা সহযোগিতার ব্যাপারে সম্মত হয়।
উল্লেখ্য যে, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পর্কে গত ১৪ই জুলাই (২০১৫) তারিখে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় ইরান ও ছয় জাতির মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পর অস্ট্রিয়া সরকার ইরানের সাথে তার অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ইতিমধ্যেই দু’দেশের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এক ডজনেরও বেশি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়েছে যার আর্থিক পরিমাণ কয়েক কোটি ডলার।
এ পরিপ্রেক্ষিতেই দু’দেশের মধ্যকার সকল সম্পর্কের সর্বাত্মক সম্প্রসারণ সম্পর্কে আলোচনার উদ্দেশ্যে গত ৭ই সেপ্টেম্বর অস্ট্রিয়ার প্রেসিডেন্ট হেইন্য ফিশার-এর নেতৃত্বে সে দেশের একটি উচ্চপদস্থ প্রতিনিধিদল তেহরান সফরে আসেন।
ইরানের সা‘দী ফাউন্ডেশন ও দক্ষিণ কোরীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বোনিঅদে সা‘দী (সা‘দী ফাউন্ডেশন) ও দক্ষিণ কোরিয়ার বুসান ইউনিভার্সিটি অব্ ফরেন স্টাডিজ (বিইউএফএস)-এর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার লক্ষ্যে পাঁচ বছর মেয়াদি একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। বিইউএফএস-এ ফারসি ভাষার কোর্সের উন্নয়নের লক্ষ্যে গত ১২ই সেপ্টেম্বর তেহরানে এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বিইউএফএস-এর প্রতিনিধি ইউন ইয়ং ও সা‘দী ফাউন্ডেশনের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপপরিচালক মোহাম্মাদ রেযা দারবান্দী নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
পাঁচ বছর মেয়াদি এ চুক্তি অনুযায়ী দুই পক্ষ যৌথ প্রকল্প বাস্তবায়ন ও বিইউএফএস-এ ফারসি ভাষা শিক্ষাদান সম্প্রসারণের পন্থা উদ্ভাবনের লক্ষ্যে গবেষণা করবে এবং পরস্পরের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ছাত্র ও গবেষণা প্রতিনিধিদল বিনিময় করবে।
উল্লেখ্য, বিইউএফএস হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ার একটি বেসরকারি খ্রিস্টান বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বিদেশি ভাষাসমূহে বিশেষজ্ঞ গড়ে তোলা হয়। অন্যদিকে সা‘দী ফাউন্ডেশনের প্রধান কাজ হচ্ছে ফারসি ভাষার সম্প্রসারণ ও শিক্ষাদান।
ইতিপূর্বে গত মার্চ মাসে (২০১৫) ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সরকার ইতালির বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ফারসি ভাষা শিক্ষাদানের কোর্সসমূহের সংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইতালি সরকারের সাথে একটি সমঝোতা স্মরক (এমওইউ) স্বাক্ষর করে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান মহাশূন্য সহযোগিতা সম্পর্কে পাঁচটি দেশের সাথে আলোচনা করবে
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান মহাশূন্য ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আন্তঃক্রিয়া সম্প্রসারণের লক্ষ্যে রাশিয়া, ফ্রান্স ও জাপানসহ পাঁচটি দেশের সাথে আলোচনা করার পরিকল্পনা করেছে। ইরানের মহাশূন্য সংস্থার উপপ্রধান জনাব জাফার রোওশানীয়ান গত ২১শে অক্টোবর (২০১৫) তারিখে সংস্থার এ পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেন।
জনাব রেওশানীয়ান বলেন, মহাশূন্য ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের মহাশূন্য সংস্থা রাশিয়া, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান ও চীনের সাথে আলোচনা করার পরিকল্পনা করেছে।
জনাব রোওশানীয়ান আরো জানান যে, ইতিপূর্বে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের মহাশূন্য সংস্থা নিজস্ব প্রযুক্তিতে ‘মেসবাহ’ (প্রদীপ) নামে যে কৃত্রিম উপগ্রহ তৈরি করেছিল এবং ২০০৩ সালে চূড়ান্ত গবেষণামূলক পর্যালোচনার জন্য ইতালিতে পাঠানোর পর যা নিষেধাজ্ঞার কারণে বাযেয়াপ্ত করা হয়েছিল ইরান সরকার তা ফেরত পাবার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি জানান যে, সেটি ফেরত আনার পর মহাশূন্যে উৎক্ষেপণের জন্য প্রস্তুত করতে তিন মাস সময় লাগবে।
জনাব রোওশানীয়ান জানান যে, ইরানের মহাশূন্য সংস্থা আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে জিইও যোগাযোগ উপগ্রহসমূহের ডিজাইনকরণ ও মহাশূন্যে মানুষ পাঠানো। তিনি আরো উল্লেখ করেন যে, দেশের অভ্যন্তরে তৈরি করে মহাশূন্যে উৎক্ষেপণের জন্য একেকটি কৃত্রিম উপগ্রহের ক্ষেত্রে ৮ থেকে ১০ বছর সময় লাগে। তিনি আশাবাদ প্রকাশ করেন যে, ইরানী মহাশূন্য সংস্থার হাতে বর্তমানে যে প্রকল্পগুলো রয়েছে তা ২০২৫ সালের মধ্যে সমাপ্ত হবে।
ইউনেস্কোর ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক উত্তরাধিকারবিষয়ক প্রাথমিক তালিকায় ইরানের ১৫০টি উত্তরাধিকারের নাম
ইউনেস্কোর ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক উত্তরাধিকারবিষয়ক প্রাথমিক তালিকায় ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ১৫০টি উত্তরাধিকারের নাম স্থানলাভ করেছে। ইরানের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার, হস্তশিল্প ও পর্যটন সংস্থা (আইসিএইচটিও)-র রেজিস্ট্রেশন অফিসের জেনারেল ম্যানেজার জনাব র্ফাহাদ নাযারী গত ২১শে অক্টোবর (২০১৫) তারিখে এ খবর দিয়ে বলেন, আগামী এক মাসের মধ্যে এ প্রাথমিক তালিকা থেকে বাছাই করে চূড়ান্ত অনুমোদিত তালিকা প্রস্তুত করা হবে এবং তাতে চল্লিশটিরও বেশি স্থানের নাম অন্তর্ভুক্ত হবে। তিনি বলেন, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক উত্তরাধিকারবিষয়ক ইউনেস্কোর প্রাথমিক তালিকা অনেক দিন যাবত হালনাগাদ করা হয় নি এবং এতদসংক্রান্ত রেজিস্ট্রেশন কমিটিতে ইরানের ১৫০টি স্থানের নাম পুনঃপরীক্ষার অপেক্ষায় রয়েছে। বর্তমানে ইরানের ৪০টি ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক উত্তরাধিকারের নাম ওয়েটিং লিস্টে রয়েছে।
জনাব র্ফাহাদ নাযারী বলেন, ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার ও প্রাকৃতিক উত্তরাধিকার সম্পর্কে ইউনেস্কোর মাত্র একটি প্রাথমিক তালিকা রয়েছে এবং প্রতি বছর এ লিস্টে উভয় ধরনের উত্তরাধিকার মিলিয়ে মাত্র দু’টি রেকর্ড রেজিস্ট্রেশন করা যেতে পারে। কারণ, একটিমাত্র কনভেনশনের ভিত্তিতে এ উভয় ক্যাটেগরি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং তা একটিমাত্র বৈঠকে পরীক্ষা করা হবে। তবে ইউনেস্কোর ইন্টারন্যাশন্যাল কাউন্সিল অন মনুমেন্ট্স অ্যান্ড সাইট্স (আইসিওএমওএস)-এর বিশেষজ্ঞগণ ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করে থাকেন, অন্যদিকে ইন্টারন্যাশন্যাল ইউনিয়ন ফর কন্জারভেশন অব ন্যাচার (আইইউসিএন)-এর বিশেষজ্ঞগণ প্রাকৃতিক উত্তরাধিকার সম্পর্কে পর্যালোচনা করেন, এরপর উভয় কমিটির আলোচনার ফলাফল চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য জুরি-র কাছে সরবরাহ করা হয়।
জনাব নাযারী আরো বলেন, ওহঃধহমরনষব ঐবৎরঃধমব-এর ক্ষেত্রে কতক সুনির্দিষ্ট আইটেম কয়েকটি দেশের পক্ষ থেকে বহুজাতিক পন্থায় রেজিস্ট্রেশন করা হয়ে থাকে এবং ঞধহমরনষব ঐবৎরঃধমব-এর তালিকায়ও কতক রেকর্ডে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত অনেকগুলো ঐতিহাসিক সৌধ অন্তর্ভুক্ত থাকে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণস্বরূপ, ইরানের নয়টি বাগানের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে যেগুলো যুগপৎভাবে রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে।
জনাব নাযারী বলেন, ইউনেস্কোর জন্য ইরান স্বীয় ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক উত্তরাধিকার সমূহের যে তালিকা তৈরি করছে তা সমাপ্ত হতে যাচ্ছে এবং অচিরেই এ সম্পর্কিত চূড়ান্ত তালিকা ইউনেস্কোকে সরবরাহ করা হবে।
রুশদীকে দাওআতের প্রতিবাদে ফ্রাঙ্কফুর্ট গ্রন্থমেলা বর্জনের জন্য মুসলিম দেশসমূহের প্রতি ইরানের আহ্বান
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সংস্কৃতি ও ইসলামী নির্দেশনাবিষয়ক মন্ত্রী আলী জান্নাতী ১৪ থেকে ১৮ই অক্টোবর অনুষ্ঠেয় ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলায় দ্বীন ইসলামের জন্য অবমাননাকর ঘৃণ্য গ্রন্থ স্যাটানিক ভার্সেস্-এর লেখক কুখ্যাত সালমান রুশদীকে দাওআত ও উক্ত মেলায় তার পরিকল্পিত উপস্থিতির বিরুদ্ধে নিন্দা জানানোর ও জার্মান সরকার আয়োজিত উক্ত গ্রন্থমেলা বর্জনের জন্য মুসলিম দেশসমূহের প্রতি আহ্বান জানান।
জনাব জান্নাতী গত ৯ই অক্টোবর (২০১৫) জানান যে, তিনি এ বিষয়ে মুসলিম দেশ সমূহের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রি ও ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার মহাসচিব বরাবরে পত্র পাঠিয়েছেন। এ পত্রে তিনি রুশদীকে উক্ত গ্রন্থমেলায় অংশগ্রহণের জন্য দাওআত করে জার্মান সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে তার বিরুদ্ধে নিন্দা জানানোর জন্য মুসলিম দেশ সমূহের প্রতি আহ্বান জানান।
জনাব জান্নাতী বলেন, রুশদী কেবল ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানকেই অবমাননা করে নি, বরং সে ইসলামের পবিত্রতার ও পবিত্র ব্যক্তিত্বগণের এবং সকল ঐশী ধর্মের অবমাননা করেছে।
উল্লেখ্য, এর আগে গত ৬ই অক্টোবর তারিখে প্রায় এক ডজন ইরানী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের মালিক ও পরিচালকগণ ফ্রাঙ্কফুর্ট গ্রন্থমেলার পরিচালক বরাবরে একটি পত্র লিখে উক্ত গ্রন্থমেলায় সালমান রুশদীকে দাওআত ও এতে তার পরিকল্পিত উপস্থিতির বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন। তাঁরা উক্ত গ্রন্থমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য রুশদীকে যে দাওআত করা হয়েছে তা পুনর্বিবেচনার জন্য ফ্রাঙ্কফুর্ট গ্রন্থমেলার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান।
এছাড়া ঐ দিনই ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সরকারের সংস্কৃতি ও ইসলামী নির্দেশনা মন্ত্রণালয় থেকে এ ব্যাপারে গৃহীত কঠোর অবস্থানের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয় যে, সালমান রুশদী লিখিত ইসলামের জন্য অবমাননাকর স্যাটানিক ভার্সেস্ বইটি প্রকাশিত হবার পর ১৯৮৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের মহান স্থপতি হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) রুশদীকে হত্যা করার জন্য মুসলমানদের প্রতি নির্দেশ দিয়ে একটি ফতওয়া জারি করেন; এ ফতওয়া সব সময়ই জীবন্ত ও বহাল থাকবে, সুতরাং ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান কিছুতেই ফ্রাঙ্কফুর্ট গ্রন্থমেলায় রুশদীর উপস্থিতিকে মেনে নিতে ও তার উপস্থিতিতে তাতে অংশগ্রহণ করতে পারে না।
উল্লেখ্য, সালমান রুশদীর স্যাটানিক্ ভার্সেস্ বইটি প্রথম বারের মতো ১৯৮৮ সালে যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত হয়। বইটি প্রকাশিত হবার পর মুসলিম পাঠক-পাঠিকাগণ অভিযোগ করেন যে, এতে ইসলামের অবমাননা করা হয়েছে ও রুশদী সুস্পষ্টতঃই মুরতাদ হয়ে গিয়েছে। অভিযোগের যথার্থতা সম্বন্ধে নিশ্চিত হবার পর ১৯৮৯ সালে হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) রুশদীকে হত্যার জন্য মুসলমানদের প্রতি নির্দেশ দিয়ে একটি ফতওয়া জারি করেন। তখন থেকে রুশদী প্রাণের ভয়ে ভীত অবস্থায় কড়া নিরাপত্তাধীনে ও প্রধানত গোপন জীবন যাপন করে আসছে।
ইরানী গবেষকগণের সাফল্য আলযেইমার চিকিৎসার ক্ষেত্রে নতুন আশাবাদ সৃষ্টি করেছে
ইরানের আমীর কাবীর বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ইরানী গবেষকগণের গবেষণার সাফল্য আলযেইমার রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে নতুন আশার আলো দেখিয়েছে। তাঁরা আলযেইমারসহ স্নায়বিক রোগসমূহের চিকিৎসার লক্ষ্যে হাড়ের মজ্জার কোষকে স্নায়ুর কোষে রূপান্তরিত করার একটি ননটক্সিক পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। তাঁরা এক ধরনের পলিমার ও কার্বন ন্যানোটিউব ব্যবহার করে এ পন্থা উদ্ভাবন করেন।
উক্ত গবেষণা প্রকল্পের প্রকল্প ব্যবস্থাপক মারইয়াম মেহ্দীযাদে জানান, এতদসংক্রান্ত গবেষণায় কার্বন ন্যানোটিউবকে পলি-এপ্সিলোন-ক্যাপরোল্যাপ্টোন (পিসিএল) নামক এক ধরনের নরড়ফবমৎধফধনষব পলিমার দ্বারা আবৃত (পড়ধঃবফ) করা হয় এবং এরপর তা প্লাস্মা-এন্হ্যান্স্ড্ কেমিক্যাল ভ্যাপোর ডিপোজিশন প্রক্রিয়া (পিইসিভিডি)-এর মাধ্যমে সিলিকন-এর স্তর সমূহের (ষধুবৎং) ওপরে খাড়াভাবে বৃদ্ধি করা হয় ও সুসমন্বিত করা হয়।
তিনি বলেন যে, এ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ছিল মস্তিষ্কের নিউরন উৎপাদন করা। তিনি আরো বলেন, যেহেতু আলযেইমার ও এ ধরনের অন্যান্য রোগে মস্তিষ্কের নিউরন ধ্বংস হয়ে যায় সেহেতু আমরা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিজের শরীর থেকে এ ধরনের কোষ উৎপাদন করার ও ধ্বংসপ্রাপ্ত কোষের পরিবর্তে তা প্রতিস্থাপনের লক্ষ্যে উপায় উদ্ভাবনের জন্য চেষ্টা করছিলাম।
মারইয়াম মেহ্দীযদে আরো জানান যে, এ ব্যাপারে গবেষণার জন্য হাড়ের মজ্জার কোষ ব্যবহার করা হয়। তিনি বলেন, তাছাড়া এ ধরনের কোষকে খুব সহজেই অন্য ধরনের কোষে রূপান্তরিত করা সম্ভব; আমরা সংশ্লিষ্ট যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ও প্রয়োজনীয় কেমিক্যাল ফ্যাক্টরসমূহ ব্যবহার করে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হাড়ের মজ্জার কোষকে মস্তিষ্কের নিউরন কোষে রূপান্তরিত করতে পারি।
তিনি আরো বলেন, এ প্রক্রিয়ার বিকাশ ঘটানোর পর তা স্নায়বিক ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীদের মস্তিষ্কের ক্ষতিগ্রস্ত নিউরন পরিবর্তন করার কাজে এবং সেই সাথে আলযেইমার রোগের চিকিৎসার কাজেও ব্যবহার করা যেতে পারে।
লিভার প্রতিস্থাপনে বিশ্বে শীর্ষ স্থানে ইরান
মহাকবি হাফিয ও শেখ সাদীর স্মৃতিধন্য ইরানের শিরাজ শহর যকৃত বা লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য বিশ্বের শীর্ষ শহরে পরিণত হয়েছে।
২০১৪ সালে এই শহরের সার্জনরা ৫০০ লিভার প্রতিস্থাপন করেন এবং চলতি বছর এই সংখ্যা ৬০০ ছাড়িয়ে যাবে বলে ইরানের হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্ট কাউন্সিল জানিয়েছে।
কাউন্সিলের সদস্য আলী মালেক হোসাইনি জানিয়েছেন, গড়ে প্রতি বছর শিরাজে ৩০০ লিভার প্রতিস্থাপন হচ্ছে। এ ছাড়াও চিকিৎসাবিষয়ক শিক্ষার জন্য বিখ্যাত এই শহরে প্রতি বছর অগ্নাশয় অস্ত্রোপচার এবং অন্যান্য অঙ্গ প্রতিস্থাপনও করা হচ্ছে। ফলে শিরাজ শহর ও এর চিকিৎসকরা এসব ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছেন।
শিরাজ চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রান্সপ্ল্যান্ট বিভাগের প্রধান মালেক হোসাইনি জানান, শিরাজে এ সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞদের প্রশিক্ষণ দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের বহু দেশের ছাত্র এবং বিশেষ করে সুদান, তাজিকিস্তান, লেবানন, ইরাক ও সিরিয়ার ছাত্ররা শিরাজে এসে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন বলে তিনি জানান।
রাহবার আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ীর হজবাণী
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ দ্বীনী ও রাজনৈতিক নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ্ উয্মা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী এবারের হজ উপলক্ষে মক্কা মু‘আয্যামায় গমনকারী হজযাত্রীদের উদ্দেশে প্রদত্ত এক বাণীতে তাঁদের নৈতিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ব-কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দিতে গিয়ে তাঁদেরকে ইসলামের দুশমনদের ষড়যন্ত্র ও অপতৎপরতা সম্পর্কে সচেতন করে দেন।
রাহ্বারের বাণীর পূর্ণ বিবরণ নিচে দেয়া হলো :
বিস্মিল্লার্হি রাহ্মানির রাহীম ওয়াল্-হাম্দু লিল্লাহি রাব্বিল্ ‘আলামীন্, ওয়াছ¡্্-ছ¡ালাতু ওয়াস্-সালামু ‘আলা সাইয়্যিদিল্ খাল্ক্বি আজ্মা‘ঈীন্ মুহাম্মাদিউঁ ওয়া আলিহিত্ব-ত্বাহিরীন্, ওয়া ছ¡াহ্বিহিল্ মুন্তাজাবীন্, ওয়া ‘আলাত্-তাবি‘ঈনা লাহুম্ বি-ইহসান্ ইলা ইয়াওমিদ্দীন।
তাওহীদের ঘাঁটি মহান কা‘বার প্রতি সালাম- যে কা‘বা মুমিনদের তাওয়াফের স্থান ও ফেরেশ্তাদের অবতরণস্থল! সালাম মাসজিদুল হারামের প্রতি। আরাফাতের ময়দান, মাশ্‘আর ও মিনার প্রতি সালাম! একইভাবে বিনয়ী অন্তরগুলোর প্রতিও সালাম। সালাম যিক্র ধ্বনিময় মুখগুলোর প্রতি, উন্মুক্ত অন্তর্দৃষ্টির অধিকারীদের প্রতি, সঠিক পন্থার দিশারি চিন্তাধারার প্রতিও সালাম। সালাম হজ পালনকারী সেই সৌভাগ্যবানদের প্রতি যাঁরা আল্লাহ্র আহ্বানে সাড়া দিয়ে ‘লাব্বায়িক’ বলার তাওফীক লাভ করেছেন এবং ঐশী নে‘আমতে পরিপূর্ণ দস্তরখানে বসার সুযোগ পেয়েছেন।
সর্বপ্রথম দায়িত্ব হলো এই সর্বজনীন, ঐতিহাসিক ও বিশ্বজনীন ‘লাব্বায়িক’ নিয়ে চিন্তাভাবনা করা। ‘ইন্নাল্ হাম্দা ওয়ান্-নি‘মাতা লাকা ওয়াল্-মুল্ক্, লা শারীকা লাকা লাব্বায়িক।’ সকল প্রশংসা এবং সকল কৃতজ্ঞতা শুধু তাঁরই জন্য, সকল নে‘আমত তাঁরই পক্ষ থেকে এসেছে এবং সকল রাজত্ব ও সকল ক্ষমতার মালিক তিনিই। একজন হজ পালনকারীর প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে এই গূঢ় অর্থপূর্ণ ঐশী হুকুম বা বিধান পালনের ক্ষেত্রে উপরিউক্ত বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টি দেয়া উচিত।
এই ফরয বিধান পালনের ধারাবাহিকতায় একজন হাজীকে হজের আনুষ্ঠানিকতাগুলোর সাথে মিশে যেতে হবে। তাহলেই হজ পালনকারী হজের অবিস্মরণীয় ও অবিনশ্বর শিক্ষাগুলো আত্মস্থ করতে পারবেন এবং সেই সব শিক্ষার আলোকে নিজের জীবনের কর্মসূচিগুলো সাজিয়ে নিতে পারবেন। হজের দাবি এটাই। এ মহান শিক্ষা অর্জন করার পর তদনুযায়ী আমল করা হলে জীবনটা এমনই বরকতপূর্ণ হয়ে উঠবে যে, একজন মুসলমান সেই রহমত ও বরকতের সাহায্যে নিজের জীবনকে জীবন্ত, প্রাণবন্ত এবং আনন্দময় করে তুলতে পারবেন। জীবনের প্রতিবন্ধকতাগুলো এ সময় তো বটেই, সব সময়ের জন্যই তিনি কাটিয়ে উঠতে পারবেন।
আত্মপূজা বা ভোগবিলাসের মূর্তি, গর্ব-অহঙ্কার ও কামনা-বাসনার মূর্তি, আধিপত্য মেনে নেওয়া এবং আধিপত্যকামিতার মূর্তি, বিশ্বসাম্রাজ্যবাদ ও বলদর্পিতার মূর্তি, দায়িত্বহীনতা এবং অলসতার মূর্তি, মানবজীবনের মূল্যকে তুচ্ছ করে তোলার মূর্তি ইত্যাদি সকল মূর্তি অন্তরের গহীন থেকে আসা ইবরাহিমী এই উচ্চ ধ্বনির মাধ্যমে ভেঙেচুরে খানখান হয়ে যাবে। ক্লান্তি, অবসন্নতা, দুরবস্থা, পরনির্ভরশীলতা ইত্যাদির পরিবর্তে জীবনে নেমে আসবে প্রশান্তি, সম্মান, মর্যাদা এবং স্বাধীনতার সুখ ও আনন্দ।
হজ পালনকারী প্রিয় ভাইবোনেরা! আপনাদের যিনি যে দেশ থেকেই কিংবা যে জাতি থেকেই এসে থাকুন না কেন আপনাদের উচিত ঐশী পরম জ্ঞানপূর্ণ এ কথাগুলো নিয়ে একবার ভালোভাবে চিন্তা করা এবং তারই শিক্ষার আলোকে বর্তমান মুসলিম বিশ্বের বিশেষ করে উত্তর আফ্রিকা এবং পশ্চিম এশিয়ার সমস্যাগুলোর দিকে দৃষ্টি দেয়া। সেই সাথে সবার উচিত যার যার ব্যক্তিগত ও পারিপার্শ্বিক সামর্থ্য অনুযায়ী কর্তব্য নির্ধারণ করে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করা।
আজ মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার দুষ্ট নীতি মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের জনগণের জন্য বয়ে এনেছে যুদ্ধ, রক্তপাত ও ধ্বংসলীলা, সৃষ্টি করেছে উদ্বাস্তু সমস্যা, দারিদ্র, পশ্চাদপদতা এবং মাযহাবী ও জাতিগত বিরোধ। অন্যদিকে ফিলিস্তিনে যায়নবাদী ইসরাইলের অপরাধযজ্ঞ ও বর্বর আচরণ নৃশংসতা ও নির্দয়তার চরমে পৌঁছেছে।
যায়নবাদীরা বার বার মসজিদুল আকসার অবমাননা করছে। পাশাপাশি তাদের দমন-পীড়নে নির্যাতিত ফিলিস্তিনী জনগণের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছে। আমেরিকা ও যায়নবাদী ইসরাইলের এ ঘৃণিত আচরণ আজ গোটা মুসলিম জাহানের প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আপনাদের উচিত এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা এবং এর মোকাবিলায় ইসলামের দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী নিজেদের কর্তব্য নির্ধারণ করা।
এ ব্যাপারে মুসলিম বিশ্বের আলেম সমাজ এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ববর্গের কর্তব্য অনেক বেশি; কিন্তু দুঃখজনকভাবে তাঁদের বেশিরভাগই গভীর ঘুমে বিভোর রয়েছেন। আলেমদের জন্য মাযহাবী বিভেদের আগুন জ্বালানো বর্জন করা কর্তব্য, রাজনৈতিক নেতাদের উচিত শত্রুর মোকাবিলায় ভাবলেশহীনতা পরিহার করা এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের উচিত আনন্দ-ফুর্তিতে গা ভাসিয়ে দেয়া বন্ধ করা। আর তাঁদের সকলের উচিত মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে বড় বেদনা চিহ্নিত করে তা উপশমের ব্যবস্থা করা। কারণ, আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনের দরবারে একদিন তাঁদেরকে এই কর্তব্য পালনের ব্যাপারে জবাবদিহি করতে হবে।
মধ্যপ্রাচ্যের ক্রন্দন উদ্রেককারী ঘটনাপ্রবাহ, বিশেষ করে ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন, বাহরাইন, জর্দান নদীর পশ্চিম তীর, গাযা এবং এশিয়া ও আফ্রিকার আরো কতক দেশের ঘটনাবলি বর্তমান মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে বড় সঙ্কট। এ সব সঙ্কটে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ষড়যন্ত্র খুঁজে বের করে তা নস্যাতের উপায় নিয়ে ভাবতে হবে। মুসলিম জাতিগুলোকে তাদের সরকারগুলোর কাছে এ দাবি জানাতে হবে এবং সরকারগুলোকে তাদের গুরুদায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে।
হজের মহা আড়ম্বরপূর্ণ সমাবেশ হচ্ছে এই ঐতিহাসিক কর্তব্য পালনের ক্ষেত্র সৃষ্টি ও দায়িত্ব বণ্টনের সর্বোত্তম স্থান। বারাআত বা মুশরিকদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা হচ্ছে হজের মহাসম্মিলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আনুষ্ঠানিকতাÑ যা সকল দেশের সকল হাজীরই গুরুত্ব সহকারে পালন করা উচিত।
এ বছর মাসজিদুল হারামের দুঃখজনক ও প্রাণহানিকর ঘটনা হজযাত্রীদের পাশাপাশি মুসলিম জাতিগুলোকে বেদনাসিক্ত করেছে। এই দুঃখজনক ঘটনায় নিহত ব্যক্তিরা নামায ও তাওয়াফসহ অন্যান্য ইবাদতে মশগুল ছিলেন এবং মহান আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভের আকাক্সক্ষা নিয়ে সেখানে গিয়েছিলেন। কাজেই পৃথিবীর নিরাপদতম স্থানে বসেই তাঁরা সৃষ্টিকর্তার দীদার লাভ করে থাকবেন, ইন্ শাআল্লাহ্।
এটি মহাসৌভাগ্যের বিষয় এবং তাঁদের নিকটজনদের জন্য এটিই সান্ত¡না। তবে যাঁরা আল্লাহর ঘরের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছেন এর মাধ্যমে তাঁদের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাঁরা তাঁদের প্রতিশ্রুতি ও গুরুদায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবেনÑ এটাই আমাদের একান্ত প্রত্যাশা।
ওয়াসসালামু আলা ইবাদিল্লাহিস সালিহীন
সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী
৪ যিলহজ ১৪৩৬ হিজরি মোতাবেক ২৭ শাহরিভার ১৩৯৪ ফারসি সাল।
মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে রাহবার (কয়েকটি ভাষণের সারসংক্ষেপ)
৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫, বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্যদের সাথে সাক্ষাতে রাহবার
(ইরানের) সাংবিধানিক অভিভাবক পরিষদকে চিন্তাগত স্বাধীনতার অধিকারী হতে হবে। এই চিন্তাগত স্বাধীনতা কিসের ভিত্তিতে হবে সে সম্পর্কে দু’একটি কথা বলতে চাই। আসল কথা হচ্ছে, আধিপত্যবাদীদের চাপিয়ে দেয়া চিন্তার ছকে বন্দি হওয়া যাবে না। আধিপত্যবাদী শক্তির পক্ষ হতে রাতদিন হরদম এক ধরনের চিন্তাধারা, এক জাতীয় ভাবধারা বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আমরা যেন কোন অবস্থাতেই এর কাছে বন্দি হয়ে না যাই। এই সুপারিশ ও পরামর্শ কেবল বিশেষজ্ঞ পরিষদের উদ্দেশে নয়: বরং দেশের সর্বস্তরের দায়িত্বশীলদের প্রতি এই সুপারিশ। রাষ্ট্রের সকল কর্মকর্তা, এমনকি সর্বস্তরের অভিজ্ঞ মহল, রাজনৈতিক অভিজ্ঞ মহল, সমাজ নিয়ে চিন্তাশীল শ্রেণি এবং ধর্মীয় অভিজ্ঞ মহলকে এ ব্যাপারে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।
শক্তিমদমত্ত গোষ্ঠীর চেষ্টা হচ্ছে, তাদের কাক্সিক্ষত সেই ছক বিশ্বের সকল মানুষের ওপর চাপিয়ে দেবে। সকল জাতির মন-মগজে বিস্তৃত করবে। বিশেষ করে যাঁরা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেন, রাষ্ট্রযন্ত্রে যাঁরা প্রভাব বিস্তার করেন, পার্লামেন্ট সদস্যবৃন্দ, সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীরা, সিদ্ধান্ত প্রস্তুতকারীরাÑ তাদের ভাষায় যাঁরা থিঙ্ক ট্যাঙ্কÑ তাঁদের সবার ওপর এই চিন্তাগত ছক ছাপিয়ে দিতে ও এগুলোকে তাঁদের চিন্তার পরিমণ্ডলে প্রবেশ করাতে চায়। তাদের ইচ্ছা হলো, সবাই যেন বিশ্বকে তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে। যেসব ভাবধারাকে তারা বিশেষ অর্থে ব্যবহার করে, এর দ্বারা যে যে ভাবার্থ তারা গ্রহণ করতে চায়, সেই চেতনা, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে যেন সবাই এগুলোকে গ্রহণ করে ও একই ভাবধারায় প্রয়োগ করে।
এই দৃষ্টিভঙ্গি তাদের আধিপত্যবাদী চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। এই আধিপত্যবাদী মানসিকতার মাধ্যমে তারা কোন কোন পরিভাষা রচনা করে, অথবা অন্য কোন পরিভাষায় কারসাজি করে নিজেদের ইচ্ছামত এর অর্থ উদ্ভাবন করে। তারা চায়, সবাই যেন তাদের আরোপিত অর্থ অনুযায়ী এসব পরিভাষা বোঝে ও ব্যবহার করে। সবাই যেন নিজেদের লেখালেখি ও সাহিত্যে সেভাবে এসব পরিভাষা ব্যবহার করে।
ধরুন, ‘টেররিজ্ম’ বা সন্ত্রাসবাদ একটি পরিভাষা। বিশ্ব শক্তিমদমত্তরা একে এক বিশেষ অর্থে ব্যবহার করে থাকে। কিংবা ‘মানবাধিকার’ বা ‘গণতন্ত্র’ এর কথা ধরতে পারেন। মনে করুন, ছয়মাস ধরে একটি মুসলিম দেশের ওপর বোমা হামলা চালানো হলে, তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস, স্কুল, হাসপাতাল ইত্যাদি ধূলিসাৎ করা হলেও তা সন্ত্রাস হিসেবে গণ্য নয়। শতশত, এমনকি হাজার-হাজার নারী-শিশু, নিরীহ, নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা সন্ত্রাস নয়। গাযায় ও গাযার বাইরে ফিলিস্তিনি এলাকার ওপর বারবার হামলা করা সন্ত্রাস নয়। অথচ ফিলিস্তিন ও লেবাননে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের কার্যকলাপ সন্ত্রাস বলে গণ্য। ফিলিস্তিনে বা লেবাননে যেসব দল প্রতিরোধ করে যাচ্ছে, যারা আগ্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, যারা নিজেদের ঘরবাড়ি ও আপন ভূখণ্ডের প্রতিরক্ষায় লড়ছে তার নাম দেয়া হয়েছে টেররিজ্ম। দুনিয়ার যালিম দেশগুলোতেÑ যারা এতদঞ্চলে আধিপত্যবাদের ও আমেরিকার সাঙ্গ-পাঙ্গ ও লেজুড় বলে পরিচিত, সেসব দেশে যাকিছু ঘটছে তা নাকি মানবাধিকারের পরিপন্থী নয়। কিন্তু ধরে নিন, যে অপরাধী নিজের অপরাধের কথা স্মরণ করল এবং এখনো করছে অথবা কোন দুষ্কৃতকারী যদি কোন একটি দেশে শত সহ¯্র লোককে মাদকাসক্ত করে, তাকে শাস্তি দেয়া হলে তা মানবাধিকারের পরিপন্থী হয়।
তার মানে পরিভাষাগুলোর অর্থ তারাই নির্র্ধারণ করে। তারা আরো চায় যে, যেভাবে তারা অর্থ করে অন্যরা যেন সেভাবেই তা বোঝে এবং তাদের সাহিত্যের রীতিতে বা তাদের ভাষাতেই যেন সবাই কথা বলে। ইরানের পারমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যা করা সন্ত্রাস নয়। অথচ যায়নবাদীরা প্রায় পরিষ্কার ভাষায় স্বীকার করেছে যে, এ কাজ তাদেরই ছিল। কোন কোন ইউরোপীয় দেশ অনেকটা স্বীকারোক্তি করে বলেছে যে, ওরা এ কাজে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিল। আসলেই এটি তাদের দৃষ্টিতে সন্ত্রাস বলে বিবেচিত হয় না এবং এর নিন্দা করারও প্রয়োজন নেই। কিন্তু অন্যত্র সামান্য একটা কিছু সংঘটিত হওয়ার সাথে সাথে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক বসে। তার মানে, বিশ্বের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এটিই। এরা পরিভাষা তৈরি করে, তাতে কারসাজি করে। কোন একটি পরিভাষার ওপর জোরজবরদস্তি করে একটি ভাবধারা চাপিয়ে দেয়। আর প্রত্যাশা করে যে, দুনিয়ার সবাই এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে আমরাও তাদের আরোপিত সেই বুঝ ও অর্থমাফিক পরিভাষাটি যেন বুঝি আর তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করি। তাদের শেখানো কায়দা-কানুনে যেন কথাবার্তা বলি। এরা আমাদের কাছ থেকে এটিই কামনা করে। এটি আধিপত্য ও শক্তিমদমত্ততার একটি প্রকৃষ্ট নমুনা বা উদাহরণ। অথচ স্বয়ং ইসলামী বিপ্লবের নিজস্ব একটি স্বতন্ত্র চিন্তাধারা আছে।
২২ আগস্ট ২০১৫ ইরানের হজ কাফেলার দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সাক্ষাতে রাহবারের অভিব্যক্তি
হজ কেবল আমরা, ইরানীদের সাথে জড়িত নয়। হজের সম্পর্ক স্বয়ং ইসলামের সাথে। গোটা ইসলামী উম্মাহ্র সাথেই এর সম্পর্ক। হজ ইসলামের অব্যাহত গতিধারার গ্যারান্টি। হজের মাসসমূহের সম্মান অতি উচ্চে। আল্লাহ তাআলা নিজেই হজের মাসসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছেন। আসলে সময়ের বিরাট মূল্যমান আছে। স্থানের মর্যাদা আছে। এগুলো প্রমাণ দেয় যে, হজের বিধিবিধান সত্যিই বিশাল মর্যাদাপূর্ণ।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, হজের দু’টি ভিন্ন ও পরস্পর পরিপূরক বৈশিষ্ট্য আছে। একটি ব্যক্তিগত। অপরটি সামাজিক বা সমষ্টিগত। উভয় বৈশিষ্ট্যের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে ও সমানভাবে পরিচর্যা করতে হবে। হজের ব্যক্তিক বৈশিষ্ট্যটি প্রত্যেক হাজীর সাথে জড়িত। প্রত্যেক হাজীকে এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ সময়টিতেÑহজ ও ওমরা পালনের এই সময়কালেÑনিজেকে আল্লাহ তাআলার সাথে যুক্ত করতে হবে। তওবা-ইস্তিগফার করতে হবে এবং নিজের জন্য সহায় সম্বল যোগাড় করতে হবে।
হজ সম্পর্কিত পবিত্র কুরআনের আয়াতসমূহে বর্ণিত আছে : ্রوَ تَزَوَّدوا فَاِنَّ خَیرَ الزّادِ التَّقوی (তোমরা পাথেয় ও সম্বল যোগাড় কর…)। এতে উপদেশ দেয়া হয়েছে যে, হাজী সাহেবদের মধ্যে এই সৌভাগ্য যাঁদের নসিব হয়েছে তাঁদের এই চিন্তা থাকতে হবে যে, তাঁদের পাত্র যেন ভরপুর হয়ে যায়। তাঁদের ঝুলি যেন ভরে যায়। وَاَنِاستَغفِروا رَبَّکُم তাঁদেরকে ইস্তিগফার করতে হবে। তওবা করতে হবে। আল্লাহর দিকে নিবেদিত হতে হবে। দোয়া করতে হবে। আল্লাহর কাছ থেকে চাইতে হবে। আল্লাহর সামনে নিজের ভবিষ্যতের জন্য ওয়াদাবদ্ধ হতে হবে। নিজের জীবন ও কর্মতৎপরতার ব্যাপারে আল্লাহর সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে। এ হচ্ছে পবিত্র হজে ব্যক্তিগত কাজ।
হজের এই ব্যক্তিক বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে প্রত্যেক হাজীকে তার যাবতীয় তৎপরতা ও আত্মিক সফরের মাধ্যমে নিজেকে আল্লাহর সান্নিধ্যে নিয়ে যেতে হবে। নিজের অভ্যন্তরকে পাকসাফ করতে হবে। জীবনের বাদবাকি সময়ের জন্য পাথেয় সংগ্রহ করতে হবে। ব্যক্তির আধ্যাত্মিক উন্নতি ও বরকতের ঝরনাধারা এ ধরনের সফরের মধ্যেই নিহিত। এ জাতীয় আমলের মধ্যেই এসব সম্পদ গচ্ছিত। হজের এই দিনগুলোর মর্যাদা হাজী সাহেবদের উপলব্ধি করতে হবে। তাঁদের মনে রাখতে হবে যে, এমন কিছু বিষয় আছে যেগুলো কেবল এই সফরের মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব। ব্যক্তিগত ইবাদত হিসেবে কা‘বা শরীফের দিকে তাকিয়ে থাকা ইবাদত। কা‘বা শরীফের তাওয়াফ করা ইবাদত। মসজিদুল হারামে নামায পড়া ইবাদত। নবী করীম (সা.)-এর কবর যিয়ারত করা ইবাদত। আরাফাত হচ্ছে আল্লাহর কাছে মনের কথা খুলে বলা ও মোনাজাতের ময়দান। মুজদালিফা মহান আল্লাহর দিকে নিবিষ্ট হওয়ার আঙ্গিনা। মীনাও তা-ই।
এর প্রত্যেকটি আমল থেকে হাজীকে লাভবান হতে হবে। নিজের অভ্যন্তরকে পবিত্র করার উদ্দেশ্যে প্রত্যেক আমলকে কাজে লাগাতে হবে। গোটা জীবনের জন্য তা থেকে সঞ্চয় গড়ে তুলতে হবে। এ হচ্ছে হজের ব্যক্তিক বৈশিষ্ট্য।
হজের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সামাজিক বা সামষ্টিক। হজ ইসলামী ঐক্যের উদ্ভাস। বিভিন্ন বর্ণ, ভিন্ন ভিন্ন রং, বিচিত্র জাতীয়তা, নানা পরিচয়, ভিন্ন ভিন্ন মাযহাব আর বিচিত্র রুচি-প্রকৃতির মানুষ পরস্পরের পাশে একই আকৃতি ধারণ করে তাওয়াফ করেন। একই সঙ্গে সাঈ করেন। একই কাতারে শামিল হয়ে আরাফাত ও মুজদালিফায় উকূফ (অবস্থান) করেন। এই ঐক্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইসলামী সহমর্মিতা, ইসলামী সংহতি ও সমভাষিতার বাস্তব অনুশীলন হয় হজের মধ্যে। শুধু ইরানী জাতির জন্য নয়; বরং দুনিয়ার সকল মুসলমানের জন্য। আল্লাহর লা‘নত বর্ষিত হোক সেই লোকদের প্রতি, যারা ইসলামী উম্মাহর হাকিকত, ইসলামী উম্মাহর গুরুত্ব মানুষের মন থেকে মুছে ফেলার জন্য চেষ্টা করেছে। যারা মুসলমানদেরকে বিভিন্ন গোষ্ঠী ও নানা চিন্তা-চেতনায় বিভক্ত করেছে। ইসলামী উম্মাহর বিশালত্বের মোকাবিলায় বিভিন্ন জাতিসত্তার পরিচয়কে বড় করে তুলে ধরেছে। বিভিন্ন জাতিকে পরস্পর থেকে পৃথক করেছে। অথচ ইসলামী উম্মাহই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বিশালত্ব ইসলামী উম্মাহর সাথেই জড়িত। আল্লাহ তাআলা ইসলামী উম্মাহর ওপরই আপন রহমত নাযিল করেন। হজ হচ্ছে ইসলামী উম্মাহ গঠনের উদ্ভাস। এক মুষ্টি খড়কুটো দূর-দূরান্তের প্রত্যন্ত অঞ্চল হতে مِن کُلِّ فَجٍّ عَمیق সবদিক হতে দূর-দূরান্তের পথ পাড়ি দিয়ে মুসলমানরা জমায়েত হয় পরস্পরের পাশে। কত বিরাট সুযোগ পরস্পরের সাথে কথা বলার! পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশের কী সুবর্ণ সুযোগ! একে অপরের সুখ-দুঃখের কথা শোনার, পরস্পর সহানুভূতি প্রকাশের কী অবারিত অবকাশ! হজ ছাড়া আর কিসে এমন সুযোগ পাওয়া সম্ভব! বস্তুত হজের একটি সামাজিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ঐক্য, একতা।
হজের অপর সামাজিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ইসলামী উম্মাহর বিশালত্বের প্রদর্শনী। কয়েক লক্ষ হাজীর একটি নির্দিষ্ট আনুষ্ঠানিকতায় একত্রে জমায়েত হওয়াÑ এটি ইসলামী উম্মাহকে একত্রিতভাবে দেখানোর আয়োজন। মনে করুন, সাত-আট কোটি মানুষের একটি দেশ থেকে পঞ্চাশ হাজার, ষাট হাজার বা আশি হাজার লোক অংশগ্রহণ করেছে, আর তাতে এই হয়েছে। এর মাধ্যমে ইসলামী উম্মাহর প্রদর্শনী হয়েছে।
আহলে বাইত বিশ্ব সংস্থা, ইসলামী রেডিও ও টেলিভিশন ইউনিয়নের সদস্যদের সাক্ষাতে প্রদত্ত ভাষণের সারসংক্ষেপ (১৭ আগাস্ট ২০১৫)
আহলে বাইত বিশ্ব সংস্থা সম্পর্কে কথা হচ্ছে, এই সংস্থার গুরুত্বের মূলে রয়েছে আহলে বাইত আলাইহিমুস সালামের সঙ্গে এই সংস্থার সংশ্লিষ্টতা। যেহেতু আল্লাহ পাক নিজে কুরআন মজীদে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে পয়গাম্বর (আ.)-এর আহলে বাইত (পরিবারবর্গ) সম্বন্ধে এমন বর্ণনা দিয়েছেন, যে ধরনের বর্ণনা অন্য কোন জনসমষ্টি সম্বন্ধে আসে নি। আর তা হচ্ছে. اِنَّما یُریدُ اللهُ لِیُذهِبَ عَنکُمُ الرِّجسَ اَهلَ البَیتِ وَ یُطَهِّرَکُم تَطهیرًا. (নিশ্চয়ই আল্লাহ পাকের ইচ্ছা হলো, তোমরা আহলে বাইতের কাছ থেকে নাপাকিসমূহ দূর করবেন। আর তোমাদেরকে যথাযথভাবে পূতঃপবিত্র করবেন।)Ñ এই আয়াত হচ্ছে আহলে বাইতের পরিচিতিমূলক এবং আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে তাঁদের পবিত্রতার ঘোষণা।
হ্যাঁ, এই পবিত্রকরণের বহু দিক বয়েছে। কোন সংস্থা যদি নিজেকে আহলে বাইতের ইমামগণের মধ্যে বলে গণ্য করে, তাহলে এমন কিছু শর্ত রয়েছে যেগুলো তাদেরকে অবশ্যই মেনে চলতে হবে।
মহান ইমামগণ যে চেষ্টা-সাধনা করেছেন তার মধ্যে ছিল কয়েকটি লক্ষ্য অর্জনের জন্য নিরলস সাধনা। প্রথমত ইসলামের প্রকৃত জ্ঞানসমূহ জীবন্ত রাখা। ইসলামের মূলনীতি ও শিক্ষাসমূহের পরিচর্যা।
যালিম ও তাগুতি সরকারগুলোর চেষ্টা ছিল ইসলামী জ্ঞান ও শিক্ষাসমূহকে হয়ত ধ্বংস করবে কিংবা এর বিকৃতি সাধন করবে। ইমামগণের আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি কর্মসূচি ছিল এজাতীয় পরিস্থিতির মোকাবিলা করে ইসলামী জ্ঞান ও শিক্ষার হেফাযত, পরিচর্যা ও পুনরুজ্জীবন দান করা।
ইমামগণের (আলাইহিমুস সালাম) আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল আল্লাহর হুকুম-আহকাম বাস্তবায়ন করা। যখন রাষ্ট্রক্ষমতা তাঁদের হাতে ছিল তখন যেমন, তেমনি যখন রাষ্ট্রক্ষমতা তাঁদের নাগালের বাইরে ছিল, তখনো তাঁদের চেষ্টা নিয়োজিত ছিল সমাজে যেন আল্লাহর হুকুম-আহকাম জারি হয়।
ইমামগণের আরেকটি কাজ ছিল আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ। যেমনটি আপনারা যিয়ারতনামায় পড়েন, أشهَدُ أنّکَ جاهَدتَ فِیاللهِ حَقَّ جِهادِه (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেছেন যেভাবে জিহাদ করা উচিত।) ‘যেভাবে জিহাদ করা উচিত’ মানে তাঁরা কোনকিছুই বাদ দেন নি; কোন কর্তব্যই বাদ রাখেন নি; বরং আল্লাহর রাস্তায় নিজের গোটা অস্তিত্ব দিয়ে, সকল শক্তি ও সহায় সম্বল নিযুক্ত করে জিহাদ করেছেন।
তাঁদের সাধনা ও জিহাদের এই অধ্যায়টি এতই সমৃদ্ধ যে, তা আলাদা আলোচনার দাবি রাখে। তাতে ছিল যুলুম ও যালিমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। ইমামগণের জীবনের আগাগোড়াই যুলুম ও যালিমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। তাঁদের ওপর এত চাপ সৃষ্টি, এত বিষ প্রয়োগ ও এত শহীদ হওয়া বা এজাতীয় সবকিছুর পেছনে কারণও ছিল এটিই। এটিই ছিল আহলে বাইতের ইমামগণের জীবন। আমরা যদি এখন আহলে বাইতের অনুসারী হতে চাই, তাহলে আমাদেরকে এসব বিষয় মেনে চলতে হবে। ইসলামী শিক্ষা ও জ্ঞানের পরিচর্যা করতে হবে। আল্লাহর হুকুম-আহকাম বাস্তবায়নকে আমাদের জীবনের মূল লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।
আমাদের গোটা অস্তিত্ব দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করতে হবে। যুলুমের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। যালিমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে। এটিই আমাদের দায়িত্ব। হ্যাঁ, জিহাদ শুধু সশস্ত্র লড়াইয়ের নাম নয়। জিহাদ একটি ব্যাপক পরিভাষা। সব ধরনের সংগ্রাম, আন্দোলনÑ সাংস্কৃতিক আন্দোলন থেকে নিয়ে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সংগ্রাম সবকিছুই এই জিহাদের আওতায় রয়েছে।
কাজেই জিহাদ বললে আমাদের চিন্তা যেন সবসময় সশস্ত্র লড়াইয়ের দিকে না যায়। হ্যাঁ, কোথাও সশস্ত্র লড়াইয়ের প্রয়োজন দেখা দেয়; কিন্তু জিহাদ বলতে একমাত্র সেটাকেই বুঝায় না।
আজকের দিনে আমাদের সম্মুখেÑ আমরা আহলে বাইতের অনুসারীদের সামনে জিহাদ-এর প্রতিপাদ্য হচ্ছে ইসলামী অঞ্চলে বিশ্ব শক্তিমদমত্ত চক্রের নীলনকশার মোকাবিলায় সংগ্রাম চালানো। আজকের সবচেয়ে বড় জিহাদ এটিই। বিশ্ব শয়তানি চক্রের নীলনকশার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে। এর জন্য প্রথমেই এসব নীলনকশা চিনতে হবে।
আগে দুশমনকে জানতে হবে। জানতে হবে সে কী কাজ করতে চায়। এরপর আমাদেরকে পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। দুশমনের যে লক্ষ্য তার মোকাবিলা করতে হবে। কেবল প্রতিরক্ষা, আত্মরক্ষা বা প্রতিক্রিয়া দেখানো নয়। সংগ্রাম বলতে তাতে আত্মরক্ষা থাকবে আবার আক্রমণাত্মক ভূমিকাও থাকবে। এক সময় আছে যখন মানুষকে আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে থাকতে হয়। কখনো আক্রমণাত্মক ভূমিকা পালন করতে হয়। উভয় অবস্থাতেই লক্ষ্য থাকে শক্তিমদমত্ত গোষ্ঠীর পরিকল্পনার মোকাবিলা করা আর এই দুশমনই হচ্ছে এতদঞ্চলে এবং সকল অঞ্চলে আসল ও মৌলিক শত্রু। বিশেষত এই অঞ্চলেÑ যা এশিয়ার পশ্চিমে অবস্থিত। এ অঞ্চল, যাকে ইউরোপিয়ানরা জোরপূর্বক ‘মধ্যপ্রাচ্য’ নামে আখ্যায়িত করতে চায়। অর্থাৎ প্রাচ্য কোন্্টি, পাশ্চাত্য কোন্্টি, তা তারা ইউরোপের নিরিখে বিচার করে। এক স্থান দূরপ্রাচ্য, কোথাও মধ্যপ্রাচ্য। আবার কোথাও নিকট প্রাচ্য। ইউরোপিয়ানদের এই অহংকারটা [দেখুন]। শুরু থেকেই এখানটা হয়েছে মধ্যপ্রাচ্য। মধ্যপ্রাচ্য নামটি ভুল। এখানে আমরা এশিয়ার পশ্চিমে অবস্থিত। এশিয়া এক বিশাল মহাদেশ। আমাদের অবস্থান এশিয়ার পশ্চিমে। এই অঞ্চলটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। অগ্রগামিতার বিচারে গুরুত্বপূর্ণ, সামরিক বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ, ভূগর্ভস্থ সম্পদের কারণে গুরুত্বপূর্ণ, এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকাÑ এই তিন মহাদেশের যোগাযোগ সুবিধার বিচারে গুরুত্বপূর্ণ। এই মহাদেশকে নিয়ে তাদের পরিকল্পনা আছে, নীলনকশা আছে। আমাদেরকে দেখতে হবে যে, তাদের নীলনকশা কী? তারপর এগুলোর মোকাবিলা করতে হবে। এর নামই হচ্ছে জিহাদ। কুরআন আমাদেরকে বলছে : جٰهِدوا فِی اللهِ حَقَّ جِهادِه ‘তোমরা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ কর, যেভাবে জিহাদ করা উচিত।’ জিহাদ ফিল্লাহ আজকের দিনে এটিই।
ইসলামী জাহানের বিরুদ্ধে বিশেষ করে এই অঞ্চলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র আজ নতুন নয়। অনেক বছর আগে থেকে; শতশত বছর পূর্ব থেকে; প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে নিয়ে এই অঞ্চল বিশ্বের দাম্ভিক শক্তিগুলোর ব্যাপক চাপের মধ্যে রয়েছে। হ্যাঁ, এক সময় ছিল ইংরেজরা আর এক সময় আমেরিকা। একটি অধ্যায়ে ছিল ফরাসিরা। বিশ্বের শক্তিমদমত্তরা একশ’ বছর বা তার চেয়েও বেশিকাল ধরে এখানে ব্যস্ত। কিন্তু এসব চাপ ও এতসব পরিকল্পনা ও এসব চক্রান্ত ইরানে ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের পর নতুন মাত্রা পেয়েছে ও তীব্রতর হয়েছে। কেননা, ইরানের মতো গুরুত্বপূর্ণ, স্পর্শকাতর ও বিরাট দেশে ইসলামের বিজয় লাভের ঘটনা বিশ্বশয়তানি চক্রের জন্য বিব্রতকর ছিল। প্রথম দিকে কিছু সময় তো এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দাঁড় করানোর শক্তিও এদের কাছ থেকে রহিত হয়েছিল।
আমরা পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছিলাম। দেখছিলাম। শুরুতে তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। পরে তারা আত্মস্থ হয়। চাপ প্রয়োগ করা শুরু করে দেয়। তাদের চাপ প্রয়োগের কেন্দ্রবিন্দুও ছিল ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান। প্রথম পর্যায়ে তাদের উদ্যমটা ছিল অন্যন্য দেশে যেন এই অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি না হয়। এটাই ছিল লক্ষ্য। কাজেই তারা ইরানের ওপর একের পর এক চাপ বৃদ্ধি করার কৌশল গ্রহণ করে। এখন ৩৫ বছর হয়ে গেল, দুশমনের শত্রুতার সাথে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। ইরানী জাতি চাপের সাথে অভ্যস্ত হয়েছে। চাপ, হুমকি-ধমকি, বয়কট. বিচিত্র ধরনের ষড়যন্ত্র, নিরাপত্তার চাপ। ৩৫ বছর ধরে আমরা নানা ধরনের চাপের মুখে রয়েছি। ইরানে বিপ্লব বিজয়ের পর থেকে এ অবস্থা চলছে। তবে চার-পাঁচ বছর আগে উত্তর আফ্রিকায় যে ইসলামী জাগরণ শুরু হয়েছে মিসর, তিউনিসিয়া ও অন্যান্য স্থানে, তার পর থেকে দুশমনের শত্রুতার মাত্রা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ সত্যিকার অর্থেই দুশমন উঠেপড়ে লেগেছে। তারা বহু ধরনের কাজ করেছে। এখনো অব্যাহত রয়েছে। তবে ধারণা হচ্ছে, তারা কিনা ইসলামী জাগরণ আন্দোলনকে থামিয়ে দিয়েছে। তবে এই নগণ্যের দৃষ্টিকোণ হলো, ইসলামী পুনর্জাগরণ অবদমিত হওয়ার জিনিস নয়। এটা ঠিক যে, তারা কিছু একটা করেছে। কিন্তু এই আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। হয়ত একটু আগে কিংবা একটু পরে ইসলামী পুনর্জাগরণ তার অবস্থান খুঁজে নেবে। তবে এই কয় বছরে তারা তাদের প্রচেষ্টা বৃদ্ধি করেছে। বহু কাজ তারা করেছে এবং বহু উপাদানকে এ ক্ষেত্রে কাজে লাগাচ্ছে।
ইসলামী জাহানে মতবিরোধ বৃদ্ধি করাটা নিষেধ। কোন কোন শিয়া গোষ্ঠী যেসব আচরণ করে, যার ফলে বিরোধ সৃষ্টি হয়, আমরা তার সম্পূর্ণ বিরোধী। আমরা পরিষ্কার ভাষায় বলেছি যে, আহলে সুন্নাতের কাছে পবিত্র হিসেবে গণ্য বিষয়াদির প্রতি অবমাননার আমরা বিরোধী। এ দিক থেকে কিছু সংখ্যক আর ওদিক থেকে কিছু সংখ্যক এসে শত্রুতার আগুন বৃদ্ধি করছে। অধিকতর তীব্রতর করছে। তাদের অনেকের নিয়্যত বা উদ্দেশ্যও ভালো, কিন্তু দূরদৃষ্টির অভাব রয়েছে। দূরদৃষ্টি থাকতে হবে। দুশমনের নীলনকশা কী, দেখতে হবে। দুশমনের প্রথম নীলনকশা হচ্ছে মতবিরোধ সৃষ্টি করা।
দুশমনের দ্বিতীয় নীলনকশা হলো অনুপ্রবেশ করা। তারা ইসলামী দেশগুলোতে এবং এতদঞ্চলের দেশসমূহে এমন প্রভাব বিস্তার করতে চায় যা কয়েক দশক পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। আজকের দিনে এতদঞ্চলে আমেরিকার সেই আগের দিনের সম্মান নেই। সেটি এখন পুনরুদ্ধার করতে চায়। আমাদের দেশেও তাদের লক্ষ্য এটাই।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে প্রেসিডেন্ট রুহানির সরকারের বিগত দুই বছরের কর্মকাণ্ডের প্রতি এক নজর
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. রুহানির সরকার ক্ষমতায় এসেছে এখন থেকে দুই বছর আগে। দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে সরকারের কর্মকাণ্ডকে বিভিন্ন আঙ্গিক থেকে পর্র্যালোচনা করা হচ্ছে। এ সম্পর্কিত সরকারের নিজস্ব প্রতিবেদনটি আমরা নিউজলেটারের পাঠকদের সামনে তুলে ধরছি।
দেশের ভবিষ্যতের ব্যাপারে জাতির মাঝে আশা জাগানোর লক্ষ্য নিয়ে জনগণের সেবায় নিয়োজিত সরকারি কর্মকর্তারা কর্মকাণ্ড শুরু করেছিলেন দুই বছর আগে। আজ আমরা গর্বের সাথে বলতে চাই যে, দেশের অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থা ও সংস্কৃতিতে স্থিতিশীলতা ও প্রশান্ত অবস্থা সৃষ্টির যে লক্ষ অর্জনের জন্য সরকার প্রচেষ্টা শুরু করেছিল, তাতে আমাদের কর্মপ্রচেষ্টা সফলকাম হয়েছে। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার পথ ধরে সরকারের এই অর্জনে সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা এবং সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে এবং জনসাধারণ উন্নততর ভবিষ্যতের ব্যাপারে আশাবাদী হওয়ার অবলম্বন খুঁজে পেয়েছে। এক কথায় তা সুষ্ঠু রাষ্ট্রপরিচালনার ব্যাপারে জাতির মনে নতুন আশা জাগ্রত করেছে। একই সাথে বিনয়ের সাথে বলতে চাই যে, সরকারের এ সাফল্য দেশের জনগণের প্রাপ্য অধিকারের তুলনায় অতি নগণ্য এবং দেশবাসীর এর চেয়ে অনেক বেশি খেদমত পাওয়া উচিত ছিল।
দেশের বিভিন্ন পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং আন্তর্জাতিক নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠানসমূহের পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে অনায়াসে বলা যায় যে, সরকারের নিয়োজিত সেবকদের প্রতি জনগণের আস্থা, অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণের বেলায় জ্ঞান ও দক্ষতার প্রয়োগ এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গের কার্যকর সমর্থন ও সহযোগিতা প্রভৃতির কারণে দেশের অর্থনৈতিক অঙ্গনে যে অস্থিরতা বিরাজ করছিল তার অবসান হয়েছে। পক্ষান্তরে ইরানের অর্থনীতির মূল বৈশিষ্ট্যের রূপ নিয়ে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিরাজমান হয়েছে।
বিগত ২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পেয়েছিল শতকরা ৪০ ভাগের বেশি। চলতি সালের জুলাই মাসে সেই হার শতকরা ১৫.৬ ভাগে হ্রাস পেয়েছে। এর অর্থ দাঁড়ায় সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ২৪ মাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে মুদ্রাস্ফীতি শতকরা ২৫ ভাগ হ্রাস পেয়েছে। আমরা ২০১৬ সাল নাগাদ মুদ্রাস্ফীতির হার এক অঙ্কের কোটায় নামিয়ে আনার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
ইসলামী ইরানের এগারতম সরকারের অর্জনসমূহের শিরোভাগে রয়েছে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে প্রাণচাঞ্চল্য, নতুন নতুন কর্মসংস্থান, কর্মস্থল, ব্যবসাকেন্দ্র ও পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্রসমূহের পরিবেশগত উন্নতি ও সহজলভ্যতা। গেল বছর কর্মপরিবেশের সহজতার ক্ষেত্রে ইরানের অবস্থান যেখানে বিশ্বে তালিকার ১৫২ নম্বর ক্রমিকে ছিল আমরা সেখানে তা ১৩০তম ক্রমিকে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি। আমরা আয়-উপার্জন ও কর্মপরিবেশকে আরো উন্নত করার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি এবং আশা করছি যে, ২০১৭ সালে তালিকায় আমাদের ক্রমিক ১০০-এর আগে নিয়ে আসতে সক্ষম হব।
বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মাত্র ২৪ মাসে সরকার আন্তঃদেশীয় বাণিজ্য ইউনিটের উইন্ডোজ খুলে কাস্টমস কার্যক্রমের মেয়াদ ২৪ দিন থেকে ৪ দিনে কমিয়ে এনেছে। কাস্টমসের প্রচুর পরিমাণ কাগজপত্র বর্তমানে অনলাইনে পূরণ করা হয়। এছাড়া সমন্বিত কৃত্রিম কাস্টমস গেইট খোলা হয়েছে এবং দেশের প্রধান কাস্টম্স কেন্দ্রগুলোতে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট সিস্টেম চালু করা হয়েছে।
অর্থনীতি ও অবকাঠামোগত খাতগুলোতে সরকারের অর্জন
শিল্প ও খনিজ খাতে- দেশের অর্থনীতির শতকরা ১.৩ ভাগ যার সাথে জড়িত- সংযোজিত মূল্যের হার যেখানে ২০১৩ সালে শতকরা ২.৯ ভাগ ছিল, সেখানে ২০১৪ সালে তা শতকরা ৫ ভাগে উন্নীত হয়। শিল্পকারখানা খাতে ৮০০০ হাজারের অধিক অর্ধ সমাপ্ত প্রকল্প সম্পূর্ণ এবং পুরোদমে চালু হয়েছে।
তেলের ক্ষেত্রে- তেলের উৎপাদন দৈনিক ২.৭ মিলিয়ন ব্যারেলের স্থলে বর্তমানে ২.৯ মিলিয়ন ব্যারেলে উন্নীত হয়েছে। আর তেল ও গ্যাস অয়েলের রপ্তানি দৈনিক ১২ লক্ষ ব্যরেলের স্থলে বর্তমানে দৈনিক সাড়ে ১৩ লক্ষ ব্যারেলে দাঁড়িয়েছে।
গ্যাস এর ক্ষেত্রে- ২০১৪ সালে দৈনিক ৭৫ মিলিয়ন ঘনফুট পরিশোধনের ক্ষমতাসম্পন্ন ফেজ-১২ যেখানে চালু আছে, সেখানে ফেজ-১৩, ১৬ ও ১৭ নং প্রকল্পগুলো চালু করা হয়েছে। যার সর্বমোট উৎপাদন ক্ষমতা হচ্ছে ১২০০ মিলিয়ন ঘনমিটার। গ্যাসের পরিশোধন ও সরবরাহ ২০১৩ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে প্রায় শতকরা ১২ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে।
ছোট ছোট শহর ও গ্রামাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের কাজ বর্তমান সরকার পুরোদমে চালিয়ে যাচ্ছে। এর আওতায় ২০১৭ সালের মাঝামাঝি প্রায় আড়াই লক্ষ নতুন পরিবার দেশের গ্যাস নেটওয়ার্কের আওতায় চলে আসবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এ হিসেবে দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৯৫ ভাগ গ্যাস সরবরাহ সিস্টেমের আওতায় চলে আসবে। সিস্তান ও বেলুচিস্তান প্রদেশে গ্যাস সরবরাহের কাজও এ বছর পূর্ণতা পাবে। এই বঞ্চিত অঞ্চলের জনগণ এবার গ্যাস সুবিধা পুরোপুরি ভোগ করতে পারবে। পেট্রোকেমিক্যাল উৎপাদনের পরিমাণ ২০১৪ সালে সাড়ে ২২ মিলিয়ন টনে উন্নীত হয়েছে। এর মধ্যে ১৫.৯ মিলিয়ন টন বিদেশে রপ্তানি হয়েছে আর ১৬.৭ মিলিয়ন টন দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে বিক্রি হয়েছে। এই পরিমাণ উৎপাদন আগের বছরের তুলনায় শতকরা ৯.৬ ভাগ বৃদ্ধির প্রমাণ বহন করে।
কৃষিক্ষেত্রে আমরা
দেশের খাদ্যজাত পণ্যের নেতিবাচক ভারসাম্যকে- যা ২০১৩ সালে ৮ বিলিয়ন ডলার ছিল, ২০১৪ সালের শেষে তা ৫.৪ বিলিয়ন ডলারে কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। এছাড়া
- খাদ্যজাত পণ্য রপ্তানির পরিমাণ শতকরা ২৭ ভাগ বৃদ্ধি করা হয়েছে।
- খাদ্যজাত পণ্য আমদানির পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে শতকরা ৯ ভাগ।
- চিনি উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে শতকরা ২০ গুণ।
- নিরাপত্তামূলক অভ্যন্তরীণ গম ক্রয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়েছে ৪০৮ টনের স্থলে ৬০৭ মিলিয়ন টন।
- মুরগির গোশত ও মুরগির ডিমের ক্ষেত্রে বর্তমানে ভাল রেকর্ড অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। যেমন ২০১৩ সালের পর থেকে এই খাতে আমরা বিদেশ থেকে কোনরূপ আমদানি করি নি। এছাড়াও গত বছর আমরা ৭৬,০০০ টন মুরগি ও ৭০,০০০ টন মুরগির ডিম দেশের বাইরে রপ্তানি করেছি। তাতে ২০১৩ সালের তুলনায় মুরগির গোশত উৎপাদনে শতকরা ৬৭ ভাগ এবং ডিম উৎপাদনে ৮৫ ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে।
- টাটকা গোশতের ক্ষেত্রে আমদানির পরিমাণ ২০১২ সালে ছিল ২০৭,০০০ টন আর ২০১৪ সালে তা ৬৮,০০০ টনে হ্রাস পেয়েছে। তা ছাড়াও ২০১৪ সালে ৭০০০০০টি গবাদি পশু এবং ১৫ সালে এ পর্যন্ত ৪২০০০০টি গবাদি পশু জীবিত রপ্তানির আওতায় প্রতিবেশী দেশগুলোতে রপ্তানি করা হয়েছে। টাটকা গোশত আমদানির পরিমাণ হ্রাস পাওয়া এবং জীবিত গবাদি পশু রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া এ কথার সাক্ষ্য বহন করে যে, দেশে টাটকা গোশতের উৎপাদন ও ভোগ ব্যবহারের ভারসাম্য সমান্তরালে চলে আসছে এবং এতে আমরা বড় ধরনের স¦নির্ভরতা অর্জন করতে যাচ্ছি।
- কৃষিপণ্য, মৎস সম্পদ, পশু-পাখিজাত উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমরা শতকরা ৬০৬ ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি।
- দেশের পরিবহন খাতে ২৭০০ কিলোমিটার নতুন সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। তাতে শামিল রয়েছে ২২০ কিলোমিটার উন্মুক্ত সড়কপথ, ১৫০০ কিলোমিটার মহাসড়ক।
- এছাড়া ২৮০ কিলোমিটার রেলপথ চালু এবং প্রায় ৭০০ কিলোমিটার রেলপথ জুড়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ করা হয়েছে।
- রেলযোগে মালামাল পরিবহনে প্রবৃদ্ধির পরিমাণ ছিল ২০১৪ সালে শতকরা ৫৬ ভাগ আর চলতি ইরানী সালের প্রথম চার মাসে ছিল শতকরা ৯২ ভাগ। রেলখাতে তিন হাজার পরিবহন ওয়াগন এবং ১০০টি যাত্রীবাহী ওয়াগন তৈরির বিষয়ে প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। রেলের সুবিধা গ্রহণ সম্পর্কিত আনুষাঙ্গিক খরচ ২০১৩ সালে শতকরা ৫৭ ভাগের তুলনায় বর্তমানে শতকরা ৩২ ভাগে উন্নীত হয়েছে।
- ১০০০ কিলোমিটার প্রধান সড়কপথ এবং ৩০০০ কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক নির্মাণও এর আওতাভুক্ত রয়েছে।
- সামুদ্রিক জলযান নির্মাণে আমরা শতকরা ১১ ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি।
- তদুপরি বাণিজ্যিক বন্দরগুলোতে মালামাল ওঠানামার ধারণক্ষমতায় প্রবৃদ্ধি এসেছে শতকরা ১১ ভাগ।
- বাণিজ্যিক সমুদ্র বন্দরগুলোতে নৌপথে যাত্রী পরিবহণের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা ২৫ ভাগ।
প্রতিরোধমূলক অর্থনীতি, স্থানীয়করণ নির্ভরশীলতা হ্রাস করার লক্ষ্যমাত্রা
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের যাবতীয় পদক্ষেপ পরিচালিত হচ্ছে প্রতিরোধমূলক অর্থনীতি বাস্তবায়নের সামগ্রিক নীতিমালা বাস্তবায়নের লক্ষ্যকে সামনে রেখে। এক্ষেত্রে অন্যতম লক্ষ্য ছিল তেলখাতে আয়ের ওপর জাতীয় বাজেটের নির্ভরশীলতা কমানো। ২০১১ সালে যেখানে এই নির্ভরতার পরিমাণ ছিল শতকরা ৪৮ ভাগ, সেখানে তা ২০১৪ সালে ৩৬.১ ভাগে নেমে এসেছে।
প্রতিরোধমূলক অর্থনৈতিক পরিকল্পনার আওতায় তেলবহির্ভূত পণ্য রপ্তানি বৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে, তাতে ২০১৪ সালে শতকরা প্রায় ১৯ ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। একই সময়ে আমদানি বৃদ্ধির যে পরিমাণ শতকরা ৬ ভাগ অর্জিত হয়েছে তা তেলবহির্র্ভূত বৈদেশিক বাণিজ্যের ভারসাম্যে ইতিবাচক প্রবণতা নির্দেশ করছে। তদুপরি আমদানি পণ্যের শ্রেণিভুক্তির বিষয়েও আমাদের লক্ষ্য ছিল মৌলিক ও মাধ্যম শ্রেণির পণ্য আমদানি। হস্তশিল্প জাতীয় পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি, দুই হাজারের অধিক হস্তশিল্প কারখানা চালু করা এবং ১৩ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে হস্তশিল্পজাত পণ্য শতকরা ৪০ ভাগ বৃদ্ধি পাওয়া অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকারের প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হওয়ার ইঙ্গিত বহন করে।
স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, নিরাপত্তা ও সামাজিক সহায়তাসমূহ
২০১৪ সালে সরকারি হাসপাতালসমূহে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল ৬০ লক্ষের অধিক। তবে ভর্তি ও চিকিৎসা সেবার ব্যয় হ্রাস ছিল দেশে সুস্বাস্থ্য রক্ষা ও চিকিৎসা সেবায় এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত। সরকারি হাসপাতালসমূহে জনগণের পক্ষ হতে প্রদেয় ফির পরিমাণ শতকরা ৩৭ ভাগ হতে গড়ে শতকরা ৪.৫ ভাগে হ্রাস করা হয়েছে। চিকিৎসা সেবায় একে সর্ববৃহৎ অর্জন হিসেবে গণ্য করা যায়। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য আনুমানিক ৩ হাজার বিলিয়ন তুমান অর্থ যোগান দিতে হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, বিভিন্ন কোম্পানি ও হাসপাতালসমূহ এবং বাইরে থেকে হাসপাতালের সরঞ্জাম ইত্যাদি যোগান দেয়ার ক্ষেত্রে যেসব অসুস্থ সম্পর্ক ছিল সেগুলো সম্পূর্ণ ছিন্ন করা হয়েছে।
- ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের কর্মকর্তাদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল দেশের সাধারণ জনগণকে বীমা পলিসির অন্তর্ভুক্ত করা। সৌভাগ্যবশত গেল বছর তা বাস্তবায়িত হয়েছে। অর্থাৎ এক বছরে প্রায় এক কোটি লোক বীমার আওতায় এসেছে। এর ফলে রোগাক্রান্ত হলে চিকিৎসা সেবা পাওয়ার ব্যাপারে জনগণের দীর্ঘদিনের দুশ্চিন্তার অবসান হবে।
- গেল এক বছরে সরকারি হাসপাতালসমূহে ৪৮০০০০-এর অধিক স্বাভাবিক সন্তান প্রসব সম্পন্ন হয়েছে।
- ঔষধ শিল্পে সত্যিকার অর্থেই অসামান্য কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এ অর্জনটি কেবল তারাই বুঝবে যারা এই ক্ষেত্রটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ঔষধ এবং চিকিৎসা সরঞ্জামের মূল্য, বিশেষ করে যেগুলো আমদানিকৃত, সেগুলো গত দুই বছরে অন্তত শতকরা ৩০ ভাগ পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে।
- কেন্দ্রীয়ভাবে টেন্ডার এবং ক্রয় ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনার ফলে অসদুপায়ের সকল পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আর ঔষধ আমদানির পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে শতকরা ৩০ ভাগ।
- মূল্য হ্রাসের পাশাপাশি চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসা সরঞ্জামাদির ব্যাপক হারে সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে।
সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ
- সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য অনুকূল পরিবেশ গড়ে তোলা, ব্যাপকভাবে বই-পুস্তক মুদ্রণ ও প্রকাশ, পত্রিকা প্রকাশের অনুমতি প্রদান প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা এবং লেখক, প্রকাশক ও সংবাদপত্র মালিক ও প্রকাশকদের মনে আশার সঞ্চারের ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য অসামান্য। শুধু বিগত সালেই ৭২ হাজার বই প্রকাশের অনুমতিপত্র প্রদান করা হয়েছে, যার সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় ৮ হাজার বেশি।
- শিল্পী ও চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মাঝে উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্রী ব্যবস্থার সাথে তাদের ঘনিষ্ঠতা মজবুত করার ক্ষেত্রেও সরকারের সাফল্য প্রসংশনীয়। উদাহরণস্বরূপ, খনেয়ে সিনেমা পুনরায় চালুকরণ, তেহরানের সিম্ফোনিক অর্কেস্ট্রা ও মিল্লী অর্কেস্ট্রা পুনঃচালুকরণ, শিল্পী, লেখক ও সাংবাদিকদের বীমার আওতায় আনা সরকারের সাফল্যের তালিকার এক একটি ফলক।
- এর সাথে রয়েছে সংবাদপত্রের মূল্য যুক্তিগ্রাহ্য করা।
- প্রচার ও সম্প্রচার আইন প্রণয়ন।
- দেশজুড়ে ক্রুআন বিষয়ক কর্মসূচি বাস্তবায়ন এবং কুরআন প্রশিক্ষণ বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাসমূহকে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান বিগত দুই বছরে সরকারের সাফল্যকে উজ্জ্বল করেছে। যেমন ২০১৪ সালে প্রায় ৫০০ কুরআন বিষয়ক প্রতিষ্ঠানকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
শিক্ষা সম্প্রসারণ
- শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে নিয়ে কাজ করার ফলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় স্টান্ডার্ড মান নিশ্চিত হয়েছে।
- দ্বিতীয় মাধ্যমিক স্তরে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা ৮২.২৪ ভাগ। এই হারটি আগে ছিল ৭৭.৫ ভাগ। তন্মধ্যে ছাত্রীদের অনুপাত ৭৯.৫৬ ভাগ এবং ছাত্রদের হার ৮৪.১৫ ভাগ।
- প্রাথমিক স্তরে লেখাপড়া থেকে বাদপড়া ৩৫১৪৫ জন শিশু-কিশোরকে পাঠশালায় নিয়ে আসতে পারা নিশ্চয়ই সরকারের উল্লেখযোগ্য সাফল্য।
- ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে প্রাইমারি পর্যায়ে শিক্ষার্থীর হার ছিল শতকরা ৯৭.৪ ভাগ। ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে তা উন্নীত হয়েছে ৯৮.৫ ভাগে।
- প্রথম মাধ্যমিক স্তরে ছাত্রছাত্রীর হার ছিল শতকরা ৯০ ভাগ। এটি শতকরা ৯০ ভাগে উন্নীত হয়েছে। এতে ছাত্রদের হার শতকরা ৯৫.৫৮ ভাগ আর ছাত্রীদের হার শতকরা ৯২.১৭ ভাগ।
- প্রাক-প্রাইমারি শিক্ষার হার ২০১৩-১৪ সালে ছিল ৩৮.২ ভাগ। ২০১৪-১৫ সালে তা শতকরা ৫২.৪ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর তাতে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে দেশের বঞ্চিত অঞ্চলগুলোর দিকে।
- বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। যেমন আগের শতকরা ৮.৫ ভাগের স্থলে ১০.৫৩ ভাগে উন্নীত হয়েছে।
- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ ও সম্প্রসারণে দানশীল ব্যক্তিদের প্রতিশ্রুতি বৃদ্ধি পেয়েছে ৬৯৪ বিলিয়ন তুমান। এ পর্যায়ে দাতাদের সহায়তায় ১৬০০ স্কুল এবং ১৩০০.০০০ বর্গমিটার আয়তনের ৯০০০ ক্লাসরূম নির্মিত হয়েছে।
- প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষাখাতে বাজেট বরাদ্দের পরিমাণ ২০১৩ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে ২১.৮ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে এই বৃদ্ধি ঘটেছে ২৪.৪ ভাগ। আর মোট শিক্ষাখাতে বাজেট বরাদ্দ ২০১৩ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে শতকরা ৮ ভাগ এবং ২০১৫ সালে ৯.২ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে।
- সরকার এরই মধ্যে ৬৫০টি দারুল কুরআন প্রতিষ্ঠা করেছে।
- প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শতকরা ৩০ ভাগ ক্লাসে শ্রেণি পাঠাগার চালু করা হয়েছে।
- স্কুল পর্যায়ে অলিম্পিয়াড আয়োজন, জ্ঞান প্রতিযোগিতায় ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে উদ্দীপনা সৃষ্টি, আন্তঃস্কুল অলিম্পিয়াডে ৪৫০০০ স্কুলের প্রায় সাড়ে তিন মিলিয়ন ছাত্রছাত্রীর অংশগ্রহণ শিক্ষাখাতে সরকারের সাফল্যের তালিকার অন্তর্ভুক্ত।
- পেশাগত দক্ষতা ও আগ্রহ সৃষ্টি এবং শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষকদের শ্রেণিবিন্যাস ও তা কার্যকর করা হয়েছে।
- ৩ লক্ষ ৩০ হাজার আফগান শিশুকে শিক্ষার আওতায় আনা হয়েছে।
- উচ্চ শিক্ষাক্ষেত্রে দক্ষতাকে সমন্বিত করার লক্ষ্যে যথাযথ মানসম্পন্ন নয়- এমন প্রতিষ্ঠানগুলোকে একীভূত করা হয়েছে।
- বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০০-এর অধিক শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
- বিশ্বের প্রভাবশালী ও শ্রেষ্ঠতর ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় প্রথমবারের মতো ইরানের ১২টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান করে নিয়েছে। (লায়ডেন এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী)
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে
- জোট নিরপেক্ষ দেশসমূহের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, গবেষণা ও উদ্ভাবনবিষয়ক মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন অনুষ্ঠান।
- ৪০০০-এর অধিক বিদেশি ছাত্র ভর্তির ব্যবস্থা করা। তন্মধ্যে ২৮৯ জন ছাত্র ভর্তি করা হয়েছে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে।
- বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৩২ জন ভিজিটিং প্রফেসর প্রেরণ। এছাড়া ৪২টি ফারসি ভাষা শিক্ষাদান চেয়ার পরিচালনা।
- ইরানের অভ্যন্তরীণ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ৩০০ বিদেশি ছাত্রকে শিক্ষাবৃত্তি প্রদান।
- ১৫-এর অধিক উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদলের ইরান সফর এবং মন্ত্রী বর্গের সঙ্গে তাদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা।
- বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৪৭ জন অধ্যাপককে ইরানে অধ্যাপনা, গবেষণা ও শিক্ষাশিবিরসমূহ বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে আমন্ত্রণ ও তাদের আতিথ্য করা।
- প্যারিসে ইউনেস্কো অফিসকে সক্রিয় করা এবং ইউনেস্কোর মহাসচিবের তেহরান সফর।
- তাবরীযে ককেশাস অঞ্চলের ৫০ জন ভাইস-চ্যান্সেলরের বৈঠক অনুষ্ঠান।
- কাস্পিয়ান সাগরের তীরবর্তী দেশসমূহের জোটভুক্ত ৩০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বৈঠক আয়োজন।
- গণিত, কম্পিউটার, পদার্থ ও রসায়নবিষয়ক বিভিন্ন অলিম্পিয়াডের আয়োজন, বিজ্ঞানবিষয়ক অলিম্পিয়াডসমূহের মানোন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান প্রতিযোগিতাসমূহের অঙ্গন হতে ৩২টি মূল্যবান পুরস্কার হস্তগত করা।
পররাষ্ট্রনীতি
- বর্তমান সরকারের পররাষ্ট্রনীতির প্রতি সর্বসাধারণের আস্থার মান উন্নত করা। সবচেয়ে কঠিন ও জটিল ইস্যুর মোকাবিলার ক্ষেত্রে জাতীয় ভূমিকার প্রতি মানুষের আস্থা অর্জন।
- পারমাণবিক আলোচনা এগিয়ে নেয়া, এর পাশাপাশি আমেরিকান ও যায়নবাদী ভূমিকাকে দুর্বল করা এবং ইরানের অবস্থানকে সংহত করা।
- ইরান আতঙ্ক বা ইসলামী প্রজাতন্ত্রকে হুমকি মনে করার প্রবণতা অপেক্ষাকৃত হ্রাস পাওয়া এবং বিশ্বজনমতের কাছে ইরানের ভাবমূর্তি উন্নত হওয়া।
- ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মহলে যে জোট ছিল, তার মাঝে অনৈক্য সৃষ্টি করা এবং ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি হুমকিপূর্ণ বলে যে ভুল ধারণা ছিল তা ভেঙে দেয়া।
- ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির স্বীকৃতি, ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার ব্যাপারে ইরানের অধিকারের বিষয়টি সংহত হওয়া, বিদ্যমান পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর সংরক্ষণ, বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও উন্নয়ন স্থগিত না হওয়া ইত্যাদি ব্যাপারে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়।
- আন্তর্জাতিক ও এতদঞ্চলের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ইরানের অনুকূলে পরিবর্তিত হওয়া এবং আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পরিমণ্ডলে ইরানের সক্রিয় ভূমিকা পালনের পরিবেশ তৈরি হওয়া।
- আন্তর্জাতিক ভারসাম্যে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের শক্তিমত্তার স্বীকৃতি অর্জন এবং এই উপলব্ধি জোরদার হওয়া যে, ইরান হচ্ছে আঞ্চলিক সংকটসমূহ নিরসনের অন্যতম অংশ।
- বিদেশনীতি দর্শনীয়ভাবে সক্রিয় হওয়া এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদলের সফর বিনিময়।
- জনগণশাসিত ধর্মীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিচ্ছন্নতা আসায় ইরানের ভূমিকা সুসংহত হওয়া।
- আন্তর্জাতিক পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে বিশেষত সন্ত্রাসবাদ, সহিংসতা, উগ্রবাদ প্রভৃতির মোকাবিলা এবং গণবিধ্বংসী অস্ত্রের বিস্তার রোধে ইরানের গঠনমূলক ভূমিকা পালন।
- ইউরোপ ও এশিয়ায় সনাতনভাবে সুসম্পর্ক ছিল- এমন দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক পুনর্গঠন।
- মুসলিম ও মযলুম জাতিসমূহ, বিশেষত ফিলিস্তিন ও ইয়েমেনের জনগণের প্রতি সাহায্য ও সমর্থন প্রদান।
- দেশের বৈদেশিক নীতি নির্ধারণে প্রভাব বিস্তার করতে পারে- দেশের ভেতরকার এ ধরনের সংস্থা, প্রতিষ্ঠান ও মহলগুলোর সাথে সক্রিয় যোগাযোগের মাধ্যমে বিদেশনীতির বিষয়ে সমন্বিত মতামত গঠন।
অনুবাদ : ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী


