মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে রাহবার (কয়েকটি ভাষণের সারসংক্ষেপ)
পোস্ট হয়েছে: এপ্রিল ২৬, ২০১৬
৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫, বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্যদের সাথে সাক্ষাতে রাহবার
(ইরানের) সাংবিধানিক অভিভাবক পরিষদকে চিন্তাগত স্বাধীনতার অধিকারী হতে হবে। এই চিন্তাগত স্বাধীনতা কিসের ভিত্তিতে হবে সে সম্পর্কে দু’একটি কথা বলতে চাই। আসল কথা হচ্ছে, আধিপত্যবাদীদের চাপিয়ে দেয়া চিন্তার ছকে বন্দি হওয়া যাবে না। আধিপত্যবাদী শক্তির পক্ষ হতে রাতদিন হরদম এক ধরনের চিন্তাধারা, এক জাতীয় ভাবধারা বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আমরা যেন কোন অবস্থাতেই এর কাছে বন্দি হয়ে না যাই। এই সুপারিশ ও পরামর্শ কেবল বিশেষজ্ঞ পরিষদের উদ্দেশে নয়: বরং দেশের সর্বস্তরের দায়িত্বশীলদের প্রতি এই সুপারিশ। রাষ্ট্রের সকল কর্মকর্তা, এমনকি সর্বস্তরের অভিজ্ঞ মহল, রাজনৈতিক অভিজ্ঞ মহল, সমাজ নিয়ে চিন্তাশীল শ্রেণি এবং ধর্মীয় অভিজ্ঞ মহলকে এ ব্যাপারে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।
শক্তিমদমত্ত গোষ্ঠীর চেষ্টা হচ্ছে, তাদের কাক্সিক্ষত সেই ছক বিশ্বের সকল মানুষের ওপর চাপিয়ে দেবে। সকল জাতির মন-মগজে বিস্তৃত করবে। বিশেষ করে যাঁরা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেন, রাষ্ট্রযন্ত্রে যাঁরা প্রভাব বিস্তার করেন, পার্লামেন্ট সদস্যবৃন্দ, সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীরা, সিদ্ধান্ত প্রস্তুতকারীরাÑ তাদের ভাষায় যাঁরা থিঙ্ক ট্যাঙ্কÑ তাঁদের সবার ওপর এই চিন্তাগত ছক ছাপিয়ে দিতে ও এগুলোকে তাঁদের চিন্তার পরিমণ্ডলে প্রবেশ করাতে চায়। তাদের ইচ্ছা হলো, সবাই যেন বিশ্বকে তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে। যেসব ভাবধারাকে তারা বিশেষ অর্থে ব্যবহার করে, এর দ্বারা যে যে ভাবার্থ তারা গ্রহণ করতে চায়, সেই চেতনা, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে যেন সবাই এগুলোকে গ্রহণ করে ও একই ভাবধারায় প্রয়োগ করে।
এই দৃষ্টিভঙ্গি তাদের আধিপত্যবাদী চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। এই আধিপত্যবাদী মানসিকতার মাধ্যমে তারা কোন কোন পরিভাষা রচনা করে, অথবা অন্য কোন পরিভাষায় কারসাজি করে নিজেদের ইচ্ছামত এর অর্থ উদ্ভাবন করে। তারা চায়, সবাই যেন তাদের আরোপিত অর্থ অনুযায়ী এসব পরিভাষা বোঝে ও ব্যবহার করে। সবাই যেন নিজেদের লেখালেখি ও সাহিত্যে সেভাবে এসব পরিভাষা ব্যবহার করে।
ধরুন, ‘টেররিজ্ম’ বা সন্ত্রাসবাদ একটি পরিভাষা। বিশ্ব শক্তিমদমত্তরা একে এক বিশেষ অর্থে ব্যবহার করে থাকে। কিংবা ‘মানবাধিকার’ বা ‘গণতন্ত্র’ এর কথা ধরতে পারেন। মনে করুন, ছয়মাস ধরে একটি মুসলিম দেশের ওপর বোমা হামলা চালানো হলে, তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস, স্কুল, হাসপাতাল ইত্যাদি ধূলিসাৎ করা হলেও তা সন্ত্রাস হিসেবে গণ্য নয়। শতশত, এমনকি হাজার-হাজার নারী-শিশু, নিরীহ, নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা সন্ত্রাস নয়। গাযায় ও গাযার বাইরে ফিলিস্তিনি এলাকার ওপর বারবার হামলা করা সন্ত্রাস নয়। অথচ ফিলিস্তিন ও লেবাননে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের কার্যকলাপ সন্ত্রাস বলে গণ্য। ফিলিস্তিনে বা লেবাননে যেসব দল প্রতিরোধ করে যাচ্ছে, যারা আগ্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, যারা নিজেদের ঘরবাড়ি ও আপন ভূখণ্ডের প্রতিরক্ষায় লড়ছে তার নাম দেয়া হয়েছে টেররিজ্ম। দুনিয়ার যালিম দেশগুলোতেÑ যারা এতদঞ্চলে আধিপত্যবাদের ও আমেরিকার সাঙ্গ-পাঙ্গ ও লেজুড় বলে পরিচিত, সেসব দেশে যাকিছু ঘটছে তা নাকি মানবাধিকারের পরিপন্থী নয়। কিন্তু ধরে নিন, যে অপরাধী নিজের অপরাধের কথা স্মরণ করল এবং এখনো করছে অথবা কোন দুষ্কৃতকারী যদি কোন একটি দেশে শত সহ¯্র লোককে মাদকাসক্ত করে, তাকে শাস্তি দেয়া হলে তা মানবাধিকারের পরিপন্থী হয়।
তার মানে পরিভাষাগুলোর অর্থ তারাই নির্র্ধারণ করে। তারা আরো চায় যে, যেভাবে তারা অর্থ করে অন্যরা যেন সেভাবেই তা বোঝে এবং তাদের সাহিত্যের রীতিতে বা তাদের ভাষাতেই যেন সবাই কথা বলে। ইরানের পারমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যা করা সন্ত্রাস নয়। অথচ যায়নবাদীরা প্রায় পরিষ্কার ভাষায় স্বীকার করেছে যে, এ কাজ তাদেরই ছিল। কোন কোন ইউরোপীয় দেশ অনেকটা স্বীকারোক্তি করে বলেছে যে, ওরা এ কাজে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিল। আসলেই এটি তাদের দৃষ্টিতে সন্ত্রাস বলে বিবেচিত হয় না এবং এর নিন্দা করারও প্রয়োজন নেই। কিন্তু অন্যত্র সামান্য একটা কিছু সংঘটিত হওয়ার সাথে সাথে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক বসে। তার মানে, বিশ্বের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এটিই। এরা পরিভাষা তৈরি করে, তাতে কারসাজি করে। কোন একটি পরিভাষার ওপর জোরজবরদস্তি করে একটি ভাবধারা চাপিয়ে দেয়। আর প্রত্যাশা করে যে, দুনিয়ার সবাই এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে আমরাও তাদের আরোপিত সেই বুঝ ও অর্থমাফিক পরিভাষাটি যেন বুঝি আর তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করি। তাদের শেখানো কায়দা-কানুনে যেন কথাবার্তা বলি। এরা আমাদের কাছ থেকে এটিই কামনা করে। এটি আধিপত্য ও শক্তিমদমত্ততার একটি প্রকৃষ্ট নমুনা বা উদাহরণ। অথচ স্বয়ং ইসলামী বিপ্লবের নিজস্ব একটি স্বতন্ত্র চিন্তাধারা আছে।
২২ আগস্ট ২০১৫ ইরানের হজ কাফেলার দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সাক্ষাতে রাহবারের অভিব্যক্তি
হজ কেবল আমরা, ইরানীদের সাথে জড়িত নয়। হজের সম্পর্ক স্বয়ং ইসলামের সাথে। গোটা ইসলামী উম্মাহ্র সাথেই এর সম্পর্ক। হজ ইসলামের অব্যাহত গতিধারার গ্যারান্টি। হজের মাসসমূহের সম্মান অতি উচ্চে। আল্লাহ তাআলা নিজেই হজের মাসসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেছেন। আসলে সময়ের বিরাট মূল্যমান আছে। স্থানের মর্যাদা আছে। এগুলো প্রমাণ দেয় যে, হজের বিধিবিধান সত্যিই বিশাল মর্যাদাপূর্ণ।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, হজের দু’টি ভিন্ন ও পরস্পর পরিপূরক বৈশিষ্ট্য আছে। একটি ব্যক্তিগত। অপরটি সামাজিক বা সমষ্টিগত। উভয় বৈশিষ্ট্যের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে ও সমানভাবে পরিচর্যা করতে হবে। হজের ব্যক্তিক বৈশিষ্ট্যটি প্রত্যেক হাজীর সাথে জড়িত। প্রত্যেক হাজীকে এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ সময়টিতেÑহজ ও ওমরা পালনের এই সময়কালেÑনিজেকে আল্লাহ তাআলার সাথে যুক্ত করতে হবে। তওবা-ইস্তিগফার করতে হবে এবং নিজের জন্য সহায় সম্বল যোগাড় করতে হবে।
হজ সম্পর্কিত পবিত্র কুরআনের আয়াতসমূহে বর্ণিত আছে : ্রوَ تَزَوَّدوا فَاِنَّ خَیرَ الزّادِ التَّقوی (তোমরা পাথেয় ও সম্বল যোগাড় কর…)। এতে উপদেশ দেয়া হয়েছে যে, হাজী সাহেবদের মধ্যে এই সৌভাগ্য যাঁদের নসিব হয়েছে তাঁদের এই চিন্তা থাকতে হবে যে, তাঁদের পাত্র যেন ভরপুর হয়ে যায়। তাঁদের ঝুলি যেন ভরে যায়। وَاَنِاستَغفِروا رَبَّکُم তাঁদেরকে ইস্তিগফার করতে হবে। তওবা করতে হবে। আল্লাহর দিকে নিবেদিত হতে হবে। দোয়া করতে হবে। আল্লাহর কাছ থেকে চাইতে হবে। আল্লাহর সামনে নিজের ভবিষ্যতের জন্য ওয়াদাবদ্ধ হতে হবে। নিজের জীবন ও কর্মতৎপরতার ব্যাপারে আল্লাহর সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে। এ হচ্ছে পবিত্র হজে ব্যক্তিগত কাজ।
হজের এই ব্যক্তিক বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে প্রত্যেক হাজীকে তার যাবতীয় তৎপরতা ও আত্মিক সফরের মাধ্যমে নিজেকে আল্লাহর সান্নিধ্যে নিয়ে যেতে হবে। নিজের অভ্যন্তরকে পাকসাফ করতে হবে। জীবনের বাদবাকি সময়ের জন্য পাথেয় সংগ্রহ করতে হবে। ব্যক্তির আধ্যাত্মিক উন্নতি ও বরকতের ঝরনাধারা এ ধরনের সফরের মধ্যেই নিহিত। এ জাতীয় আমলের মধ্যেই এসব সম্পদ গচ্ছিত। হজের এই দিনগুলোর মর্যাদা হাজী সাহেবদের উপলব্ধি করতে হবে। তাঁদের মনে রাখতে হবে যে, এমন কিছু বিষয় আছে যেগুলো কেবল এই সফরের মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব। ব্যক্তিগত ইবাদত হিসেবে কা‘বা শরীফের দিকে তাকিয়ে থাকা ইবাদত। কা‘বা শরীফের তাওয়াফ করা ইবাদত। মসজিদুল হারামে নামায পড়া ইবাদত। নবী করীম (সা.)-এর কবর যিয়ারত করা ইবাদত। আরাফাত হচ্ছে আল্লাহর কাছে মনের কথা খুলে বলা ও মোনাজাতের ময়দান। মুজদালিফা মহান আল্লাহর দিকে নিবিষ্ট হওয়ার আঙ্গিনা। মীনাও তা-ই।
এর প্রত্যেকটি আমল থেকে হাজীকে লাভবান হতে হবে। নিজের অভ্যন্তরকে পবিত্র করার উদ্দেশ্যে প্রত্যেক আমলকে কাজে লাগাতে হবে। গোটা জীবনের জন্য তা থেকে সঞ্চয় গড়ে তুলতে হবে। এ হচ্ছে হজের ব্যক্তিক বৈশিষ্ট্য।
হজের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সামাজিক বা সামষ্টিক। হজ ইসলামী ঐক্যের উদ্ভাস। বিভিন্ন বর্ণ, ভিন্ন ভিন্ন রং, বিচিত্র জাতীয়তা, নানা পরিচয়, ভিন্ন ভিন্ন মাযহাব আর বিচিত্র রুচি-প্রকৃতির মানুষ পরস্পরের পাশে একই আকৃতি ধারণ করে তাওয়াফ করেন। একই সঙ্গে সাঈ করেন। একই কাতারে শামিল হয়ে আরাফাত ও মুজদালিফায় উকূফ (অবস্থান) করেন। এই ঐক্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইসলামী সহমর্মিতা, ইসলামী সংহতি ও সমভাষিতার বাস্তব অনুশীলন হয় হজের মধ্যে। শুধু ইরানী জাতির জন্য নয়; বরং দুনিয়ার সকল মুসলমানের জন্য। আল্লাহর লা‘নত বর্ষিত হোক সেই লোকদের প্রতি, যারা ইসলামী উম্মাহর হাকিকত, ইসলামী উম্মাহর গুরুত্ব মানুষের মন থেকে মুছে ফেলার জন্য চেষ্টা করেছে। যারা মুসলমানদেরকে বিভিন্ন গোষ্ঠী ও নানা চিন্তা-চেতনায় বিভক্ত করেছে। ইসলামী উম্মাহর বিশালত্বের মোকাবিলায় বিভিন্ন জাতিসত্তার পরিচয়কে বড় করে তুলে ধরেছে। বিভিন্ন জাতিকে পরস্পর থেকে পৃথক করেছে। অথচ ইসলামী উম্মাহই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বিশালত্ব ইসলামী উম্মাহর সাথেই জড়িত। আল্লাহ তাআলা ইসলামী উম্মাহর ওপরই আপন রহমত নাযিল করেন। হজ হচ্ছে ইসলামী উম্মাহ গঠনের উদ্ভাস। এক মুষ্টি খড়কুটো দূর-দূরান্তের প্রত্যন্ত অঞ্চল হতে مِن کُلِّ فَجٍّ عَمیق সবদিক হতে দূর-দূরান্তের পথ পাড়ি দিয়ে মুসলমানরা জমায়েত হয় পরস্পরের পাশে। কত বিরাট সুযোগ পরস্পরের সাথে কথা বলার! পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশের কী সুবর্ণ সুযোগ! একে অপরের সুখ-দুঃখের কথা শোনার, পরস্পর সহানুভূতি প্রকাশের কী অবারিত অবকাশ! হজ ছাড়া আর কিসে এমন সুযোগ পাওয়া সম্ভব! বস্তুত হজের একটি সামাজিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ঐক্য, একতা।
হজের অপর সামাজিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ইসলামী উম্মাহর বিশালত্বের প্রদর্শনী। কয়েক লক্ষ হাজীর একটি নির্দিষ্ট আনুষ্ঠানিকতায় একত্রে জমায়েত হওয়াÑ এটি ইসলামী উম্মাহকে একত্রিতভাবে দেখানোর আয়োজন। মনে করুন, সাত-আট কোটি মানুষের একটি দেশ থেকে পঞ্চাশ হাজার, ষাট হাজার বা আশি হাজার লোক অংশগ্রহণ করেছে, আর তাতে এই হয়েছে। এর মাধ্যমে ইসলামী উম্মাহর প্রদর্শনী হয়েছে।
আহলে বাইত বিশ্ব সংস্থা, ইসলামী রেডিও ও টেলিভিশন ইউনিয়নের সদস্যদের সাক্ষাতে প্রদত্ত ভাষণের সারসংক্ষেপ (১৭ আগাস্ট ২০১৫)
আহলে বাইত বিশ্ব সংস্থা সম্পর্কে কথা হচ্ছে, এই সংস্থার গুরুত্বের মূলে রয়েছে আহলে বাইত আলাইহিমুস সালামের সঙ্গে এই সংস্থার সংশ্লিষ্টতা। যেহেতু আল্লাহ পাক নিজে কুরআন মজীদে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে পয়গাম্বর (আ.)-এর আহলে বাইত (পরিবারবর্গ) সম্বন্ধে এমন বর্ণনা দিয়েছেন, যে ধরনের বর্ণনা অন্য কোন জনসমষ্টি সম্বন্ধে আসে নি। আর তা হচ্ছে. اِنَّما یُریدُ اللهُ لِیُذهِبَ عَنکُمُ الرِّجسَ اَهلَ البَیتِ وَ یُطَهِّرَکُم تَطهیرًا. (নিশ্চয়ই আল্লাহ পাকের ইচ্ছা হলো, তোমরা আহলে বাইতের কাছ থেকে নাপাকিসমূহ দূর করবেন। আর তোমাদেরকে যথাযথভাবে পূতঃপবিত্র করবেন।)Ñ এই আয়াত হচ্ছে আহলে বাইতের পরিচিতিমূলক এবং আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে তাঁদের পবিত্রতার ঘোষণা।
হ্যাঁ, এই পবিত্রকরণের বহু দিক বয়েছে। কোন সংস্থা যদি নিজেকে আহলে বাইতের ইমামগণের মধ্যে বলে গণ্য করে, তাহলে এমন কিছু শর্ত রয়েছে যেগুলো তাদেরকে অবশ্যই মেনে চলতে হবে।
মহান ইমামগণ যে চেষ্টা-সাধনা করেছেন তার মধ্যে ছিল কয়েকটি লক্ষ্য অর্জনের জন্য নিরলস সাধনা। প্রথমত ইসলামের প্রকৃত জ্ঞানসমূহ জীবন্ত রাখা। ইসলামের মূলনীতি ও শিক্ষাসমূহের পরিচর্যা।
যালিম ও তাগুতি সরকারগুলোর চেষ্টা ছিল ইসলামী জ্ঞান ও শিক্ষাসমূহকে হয়ত ধ্বংস করবে কিংবা এর বিকৃতি সাধন করবে। ইমামগণের আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি কর্মসূচি ছিল এজাতীয় পরিস্থিতির মোকাবিলা করে ইসলামী জ্ঞান ও শিক্ষার হেফাযত, পরিচর্যা ও পুনরুজ্জীবন দান করা।
ইমামগণের (আলাইহিমুস সালাম) আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল আল্লাহর হুকুম-আহকাম বাস্তবায়ন করা। যখন রাষ্ট্রক্ষমতা তাঁদের হাতে ছিল তখন যেমন, তেমনি যখন রাষ্ট্রক্ষমতা তাঁদের নাগালের বাইরে ছিল, তখনো তাঁদের চেষ্টা নিয়োজিত ছিল সমাজে যেন আল্লাহর হুকুম-আহকাম জারি হয়।
ইমামগণের আরেকটি কাজ ছিল আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ। যেমনটি আপনারা যিয়ারতনামায় পড়েন, أشهَدُ أنّکَ جاهَدتَ فِیاللهِ حَقَّ جِهادِه (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেছেন যেভাবে জিহাদ করা উচিত।) ‘যেভাবে জিহাদ করা উচিত’ মানে তাঁরা কোনকিছুই বাদ দেন নি; কোন কর্তব্যই বাদ রাখেন নি; বরং আল্লাহর রাস্তায় নিজের গোটা অস্তিত্ব দিয়ে, সকল শক্তি ও সহায় সম্বল নিযুক্ত করে জিহাদ করেছেন।
তাঁদের সাধনা ও জিহাদের এই অধ্যায়টি এতই সমৃদ্ধ যে, তা আলাদা আলোচনার দাবি রাখে। তাতে ছিল যুলুম ও যালিমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। ইমামগণের জীবনের আগাগোড়াই যুলুম ও যালিমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। তাঁদের ওপর এত চাপ সৃষ্টি, এত বিষ প্রয়োগ ও এত শহীদ হওয়া বা এজাতীয় সবকিছুর পেছনে কারণও ছিল এটিই। এটিই ছিল আহলে বাইতের ইমামগণের জীবন। আমরা যদি এখন আহলে বাইতের অনুসারী হতে চাই, তাহলে আমাদেরকে এসব বিষয় মেনে চলতে হবে। ইসলামী শিক্ষা ও জ্ঞানের পরিচর্যা করতে হবে। আল্লাহর হুকুম-আহকাম বাস্তবায়নকে আমাদের জীবনের মূল লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।
আমাদের গোটা অস্তিত্ব দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করতে হবে। যুলুমের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। যালিমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে। এটিই আমাদের দায়িত্ব। হ্যাঁ, জিহাদ শুধু সশস্ত্র লড়াইয়ের নাম নয়। জিহাদ একটি ব্যাপক পরিভাষা। সব ধরনের সংগ্রাম, আন্দোলনÑ সাংস্কৃতিক আন্দোলন থেকে নিয়ে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সংগ্রাম সবকিছুই এই জিহাদের আওতায় রয়েছে।
কাজেই জিহাদ বললে আমাদের চিন্তা যেন সবসময় সশস্ত্র লড়াইয়ের দিকে না যায়। হ্যাঁ, কোথাও সশস্ত্র লড়াইয়ের প্রয়োজন দেখা দেয়; কিন্তু জিহাদ বলতে একমাত্র সেটাকেই বুঝায় না।
আজকের দিনে আমাদের সম্মুখেÑ আমরা আহলে বাইতের অনুসারীদের সামনে জিহাদ-এর প্রতিপাদ্য হচ্ছে ইসলামী অঞ্চলে বিশ্ব শক্তিমদমত্ত চক্রের নীলনকশার মোকাবিলায় সংগ্রাম চালানো। আজকের সবচেয়ে বড় জিহাদ এটিই। বিশ্ব শয়তানি চক্রের নীলনকশার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে। এর জন্য প্রথমেই এসব নীলনকশা চিনতে হবে।
আগে দুশমনকে জানতে হবে। জানতে হবে সে কী কাজ করতে চায়। এরপর আমাদেরকে পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। দুশমনের যে লক্ষ্য তার মোকাবিলা করতে হবে। কেবল প্রতিরক্ষা, আত্মরক্ষা বা প্রতিক্রিয়া দেখানো নয়। সংগ্রাম বলতে তাতে আত্মরক্ষা থাকবে আবার আক্রমণাত্মক ভূমিকাও থাকবে। এক সময় আছে যখন মানুষকে আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে থাকতে হয়। কখনো আক্রমণাত্মক ভূমিকা পালন করতে হয়। উভয় অবস্থাতেই লক্ষ্য থাকে শক্তিমদমত্ত গোষ্ঠীর পরিকল্পনার মোকাবিলা করা আর এই দুশমনই হচ্ছে এতদঞ্চলে এবং সকল অঞ্চলে আসল ও মৌলিক শত্রু। বিশেষত এই অঞ্চলেÑ যা এশিয়ার পশ্চিমে অবস্থিত। এ অঞ্চল, যাকে ইউরোপিয়ানরা জোরপূর্বক ‘মধ্যপ্রাচ্য’ নামে আখ্যায়িত করতে চায়। অর্থাৎ প্রাচ্য কোন্্টি, পাশ্চাত্য কোন্্টি, তা তারা ইউরোপের নিরিখে বিচার করে। এক স্থান দূরপ্রাচ্য, কোথাও মধ্যপ্রাচ্য। আবার কোথাও নিকট প্রাচ্য। ইউরোপিয়ানদের এই অহংকারটা [দেখুন]। শুরু থেকেই এখানটা হয়েছে মধ্যপ্রাচ্য। মধ্যপ্রাচ্য নামটি ভুল। এখানে আমরা এশিয়ার পশ্চিমে অবস্থিত। এশিয়া এক বিশাল মহাদেশ। আমাদের অবস্থান এশিয়ার পশ্চিমে। এই অঞ্চলটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। অগ্রগামিতার বিচারে গুরুত্বপূর্ণ, সামরিক বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ, ভূগর্ভস্থ সম্পদের কারণে গুরুত্বপূর্ণ, এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকাÑ এই তিন মহাদেশের যোগাযোগ সুবিধার বিচারে গুরুত্বপূর্ণ। এই মহাদেশকে নিয়ে তাদের পরিকল্পনা আছে, নীলনকশা আছে। আমাদেরকে দেখতে হবে যে, তাদের নীলনকশা কী? তারপর এগুলোর মোকাবিলা করতে হবে। এর নামই হচ্ছে জিহাদ। কুরআন আমাদেরকে বলছে : جٰهِدوا فِی اللهِ حَقَّ جِهادِه ‘তোমরা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ কর, যেভাবে জিহাদ করা উচিত।’ জিহাদ ফিল্লাহ আজকের দিনে এটিই।
ইসলামী জাহানের বিরুদ্ধে বিশেষ করে এই অঞ্চলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র আজ নতুন নয়। অনেক বছর আগে থেকে; শতশত বছর পূর্ব থেকে; প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে নিয়ে এই অঞ্চল বিশ্বের দাম্ভিক শক্তিগুলোর ব্যাপক চাপের মধ্যে রয়েছে। হ্যাঁ, এক সময় ছিল ইংরেজরা আর এক সময় আমেরিকা। একটি অধ্যায়ে ছিল ফরাসিরা। বিশ্বের শক্তিমদমত্তরা একশ’ বছর বা তার চেয়েও বেশিকাল ধরে এখানে ব্যস্ত। কিন্তু এসব চাপ ও এতসব পরিকল্পনা ও এসব চক্রান্ত ইরানে ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের পর নতুন মাত্রা পেয়েছে ও তীব্রতর হয়েছে। কেননা, ইরানের মতো গুরুত্বপূর্ণ, স্পর্শকাতর ও বিরাট দেশে ইসলামের বিজয় লাভের ঘটনা বিশ্বশয়তানি চক্রের জন্য বিব্রতকর ছিল। প্রথম দিকে কিছু সময় তো এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দাঁড় করানোর শক্তিও এদের কাছ থেকে রহিত হয়েছিল।
আমরা পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছিলাম। দেখছিলাম। শুরুতে তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। পরে তারা আত্মস্থ হয়। চাপ প্রয়োগ করা শুরু করে দেয়। তাদের চাপ প্রয়োগের কেন্দ্রবিন্দুও ছিল ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান। প্রথম পর্যায়ে তাদের উদ্যমটা ছিল অন্যন্য দেশে যেন এই অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি না হয়। এটাই ছিল লক্ষ্য। কাজেই তারা ইরানের ওপর একের পর এক চাপ বৃদ্ধি করার কৌশল গ্রহণ করে। এখন ৩৫ বছর হয়ে গেল, দুশমনের শত্রুতার সাথে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। ইরানী জাতি চাপের সাথে অভ্যস্ত হয়েছে। চাপ, হুমকি-ধমকি, বয়কট. বিচিত্র ধরনের ষড়যন্ত্র, নিরাপত্তার চাপ। ৩৫ বছর ধরে আমরা নানা ধরনের চাপের মুখে রয়েছি। ইরানে বিপ্লব বিজয়ের পর থেকে এ অবস্থা চলছে। তবে চার-পাঁচ বছর আগে উত্তর আফ্রিকায় যে ইসলামী জাগরণ শুরু হয়েছে মিসর, তিউনিসিয়া ও অন্যান্য স্থানে, তার পর থেকে দুশমনের শত্রুতার মাত্রা বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ সত্যিকার অর্থেই দুশমন উঠেপড়ে লেগেছে। তারা বহু ধরনের কাজ করেছে। এখনো অব্যাহত রয়েছে। তবে ধারণা হচ্ছে, তারা কিনা ইসলামী জাগরণ আন্দোলনকে থামিয়ে দিয়েছে। তবে এই নগণ্যের দৃষ্টিকোণ হলো, ইসলামী পুনর্জাগরণ অবদমিত হওয়ার জিনিস নয়। এটা ঠিক যে, তারা কিছু একটা করেছে। কিন্তু এই আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। হয়ত একটু আগে কিংবা একটু পরে ইসলামী পুনর্জাগরণ তার অবস্থান খুঁজে নেবে। তবে এই কয় বছরে তারা তাদের প্রচেষ্টা বৃদ্ধি করেছে। বহু কাজ তারা করেছে এবং বহু উপাদানকে এ ক্ষেত্রে কাজে লাগাচ্ছে।
ইসলামী জাহানে মতবিরোধ বৃদ্ধি করাটা নিষেধ। কোন কোন শিয়া গোষ্ঠী যেসব আচরণ করে, যার ফলে বিরোধ সৃষ্টি হয়, আমরা তার সম্পূর্ণ বিরোধী। আমরা পরিষ্কার ভাষায় বলেছি যে, আহলে সুন্নাতের কাছে পবিত্র হিসেবে গণ্য বিষয়াদির প্রতি অবমাননার আমরা বিরোধী। এ দিক থেকে কিছু সংখ্যক আর ওদিক থেকে কিছু সংখ্যক এসে শত্রুতার আগুন বৃদ্ধি করছে। অধিকতর তীব্রতর করছে। তাদের অনেকের নিয়্যত বা উদ্দেশ্যও ভালো, কিন্তু দূরদৃষ্টির অভাব রয়েছে। দূরদৃষ্টি থাকতে হবে। দুশমনের নীলনকশা কী, দেখতে হবে। দুশমনের প্রথম নীলনকশা হচ্ছে মতবিরোধ সৃষ্টি করা।
দুশমনের দ্বিতীয় নীলনকশা হলো অনুপ্রবেশ করা। তারা ইসলামী দেশগুলোতে এবং এতদঞ্চলের দেশসমূহে এমন প্রভাব বিস্তার করতে চায় যা কয়েক দশক পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। আজকের দিনে এতদঞ্চলে আমেরিকার সেই আগের দিনের সম্মান নেই। সেটি এখন পুনরুদ্ধার করতে চায়। আমাদের দেশেও তাদের লক্ষ্য এটাই।