কাওসারে আপনাকে স্বাগতম Archive » 2014 » এপ্রিল » 27

নেতৃত্বের বিশ্বায়নে ইরান : মুসলিম বিশ্বের নতুন আত্মপরিচয় ও পশ্চিমা শক্তির মেরুকরণ

ড.মুহাম্মদ ইকবাল হোছাইন*
পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ও গতিশীল সভ্যতার ধারক বর্তমান ইরানের পক্ষে বা বিপক্ষে আগ্রহান্বিত বিশ্বের সকল দেশ ও সংস্থা, এমনকি প্রতিটি সচেতন মানুষ। রেজা শাহ পাহলভীর রাজকীয় ও ঐতিহ্যবাহী চাল-চলন, পশ্চিমাকরণ ও প্রাসাদীয় সংস্কৃতি একধরনের মানুষকে যেমন ইরানের ব্যাপারে আগ্রহী করেছে, অপরদিকে চিন্তা ও নেতৃত্বের ধারার প্রবর্তনে এবং চোখধাঁধানো, মন-মাতানো ঐতিহাসিক ইরানী ইসলামী বিপ্লবও সারা বিশ্বে আলোচনার ঝড় তুলেছে। কাঁপিয়েছে বিশ্বের ক্ষমতাধর অনেক মসনদের খুঁটি। বিশ্বকে নতুন নেতৃত্ব ও পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখিয়েছে। বিশেষ করে হতাশাগ্রস্ত ও নেতৃত্বহীন মুসলিম বিশ্বের আম জনতা ইমাম খোমেইনী (র.)-এর ন্যায় নেতৃত্ব পেয়ে আশার চেতনায় উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। মুসলিম বিশ্বের প্রথম কিবলা আল-কুদস্ মুক্তির জন্য তাঁর আহ্বানেই মুসলিম বিশ্ব ফুঁসে উঠেছিল। আজও বিশ্বের সকল স্থানে মুসলমানরা মাহে রমজানের শেষ শুক্রবারকে ‘আল-কুদ্স’ দিবস হিসেবে পালন করে। মানবতার মুক্তির দিশারী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে নিয়ে ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্য করায় সকল রাঙানো চোখকে উপেক্ষা করে সালমান রুশদীর ফাঁসির আদেশ জারির একমাত্র কৃতিত্ব ও যোগ্য নেতৃত্বের অধিকারী ছিলেন আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ ইমাম খোমেইনী। সকল পরাশক্তিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মুসলিম বিশ্বের আর কেউ এমন সাহসী উচ্চারণের দৃঢ়তা দেখাতে পারেনি। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত  রুশদীর পৃথিবী সংকুচিত হয়ে আসে। যতদূর জানা যায়, ইহুদিবাদীদের সকল শক্তি ও সমর্থন অব্যাহত রাখার পরও ঘৃণিত এ ব্যক্তি স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারে না।
আজকের ইরানী জাতি হাজার হাজার বছরের সমৃদ্ধ সভ্যতা ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী। ইসলামের প্রাথমিক যুগে ইসলামের অগ্রযাত্রায় সালমান ফার্সীর বুদ্ধিভিত্তিক পরামর্শ ইরানীদের প্রত্যুৎপন্নমতিত্বকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ইসলামের অগ্রযাত্রায় অনেক সভ্য জাতির সাথে যুদ্ধের দামামা বাধলেও ইরানীরা সহজেই ইসলামের সত্যকে উপলব্ধি করেছিলেন। অগ্রসরমান ইসলামের ঝাণ্ডার প্রতিদ্বন্দ্বী না হয়ে বরং পারস্যে ইসলামকে স্বাগত জানানো হয়েছিল। সফল ও অগ্রসরমান ইরানীরা আধুনিকতার নামে পশ্চিমা উচ্ছৃংলতাকে স্বাগত জানায়নি। আধুনিকতার নামে পশ্চিমাকরণে শাহের কূটকৌশল যত বৃদ্ধি পেয়েছে, ইরানীরা ততই ইমাম খোমেইনীর নেতৃত্বকে আলিঙ্গন করেছে।
১৯৭৯ সাল। ইরানীদের মূল ধারায় ফিরে যাওয়ার মহাবিপ্লবের সিপাহীরা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে ইরানের ইতিহাসের চাকা ঘুরিয়ে দিলেন। বিশ্ববাসী জনমানুষের অংশগ্রহণে এক মহাবিপ্লব প্রত্যক্ষ করল। শাহের পতন ঠেকানোর এমন কোন প্রক্রিয়া বিশ্ব ক্রীড়নকেরা বাদ রাখেনি। কিন্তু জনতার বিপ্লবের কাছে সকলের ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। কেতাদুরস্ত নিরন্তর লোভাতুর রেজা শাহ পাহলভী ইরান থেকে এমনভাবে বিতাড়িত হলো যে, মৃত্যুর পরও জাতি তাকে গ্রহণ করেনি। ইরানে বিপ্লবের মাধ্যমে জাতি এমন সময় নিজেদের মুক্তি ছিনিয়ে এনেছিল যখন মিসরের আরেক ক্রীড়নক আনোয়ার সাদাত ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির মাধ্যমে জাতিকে যায়নবাদী শক্তির কাছে পদানত করেছিল।
বিপ্লবোত্তর ইরানে মহান নেতার প্রত্যাবর্তন অপশক্তির জন্য ছিল এক সতর্কবার্তা। কূটনৈতিক ভাষায় যাকে বলা হয় straw in the wind। সতর্কবার্তার কারণে জাতি অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় তাদের মহান নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহকে আগলে রেখেছেন নিজেদের মনের মণিকোঠায়। পার্লামেন্টে আক্রমণ করে জাতিকে নেতৃত্বশূন্য করা বা ইরাকের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের মাধ্যমে বিপ্লবের অর্জনকে নস্যাৎ করার সকল প্রচেষ্টাকে মাড়িয়ে বিপ্লবের মাধ্যমে গড়ে ওঠা নেতৃত্ব ইরানকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়ন ও স্বাতন্ত্র্যের এক মডেল ও বিস্ময় হিসেবে আজকের ইরান সামনে এগিয়ে যাচ্ছে এবং যাবেই।
ইরানের ইসলামী বিপ্লব জাতিকে এমন নেতৃত্ব উপহার দিয়েছে যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতির কোন অভিযোগ ওঠেনি। বিপ্লবের মহানায়কের ইন্তেকালের সময় তাঁর বসবাসের ঘরের যে চিত্র বা পরিবারের সম্পদের যে হিসাব ইরানীরা সহ সারা বিশ্ব পেয়েছে তাতেই আশার আলো খুঁজে পাই। এমন স্বচ্ছতায় একজন সাধারণ নাগরিক ও ইরানের জাতীয় নেতৃবর্গের মধ্যে পার্থক্য করার তেমন কিছুই থাকে না। এমন উদাহরণ একজন মুসলমান হিসেবে আমাকে আবেগাপ্লুত ও আশান্বিত করে তোলে। হতাশাগ্রস্ত মুসলিম জাতির মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করে। আবারো হৃদয়ের চেতনায় ইরান-তুরান ও কাবার পথ একাকার হয়ে যায়।
গত নির্বাচনে হাসান রুহানীর বিজয়ের পর তাঁর ব্যাপারে একটু খোঁজ-খবর নেয়ার ইচ্ছা জাগল। ব্যক্তি রুহানীকে স্টাডি করতে গিয়ে অনেক বেশি উৎসাহ বোধ করি। কোমের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অধ্যাত্মবাদের শিক্ষাকে হৃদয়ে ধারণ করে পাশ্চাত্য সভ্যতাকে নিজে প্রত্যক্ষ করেছেন, সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েছেন এবং আবারো ইরানে ফিরে এসে ইসলামী বিপ্লবের সহযোদ্ধাদের কাতারে দাঁড়িয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। জাতীয় নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন থেকে শুরু করে জাতি গঠনের প্রতিটি স্তরে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। তাঁর সবচেয়ে বড় অর্জন ইরানের যুব সমাজ তথা নব প্রজন্মকে আস্থায় নিতে পেরেছেন, তাদেরকে সারা পৃথিবীর উচ্ছৃংখলতা থেকে সত্যিকার নীতি-নৈতিকতার পথে ধরে রাখতে পেরেছেন। এজন্যই নিউইয়র্ক টাইমস্ তাঁর সম্পর্কে বলেছে : Most Influential Man in the World রুহানীর এ অর্জন বিপ্লবোত্তর নেতৃত্বের ব্যক্তিগত ইমেজ, দেশপ্রেম, ইসলামের নৈতিক চেতনার ধারণের কারণেই সম্ভব হয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। বিপ্লবের চেতনা এভাবে ধরে রাখতে পারলে আশা করা যায়, সাফল্য ও নেতৃত্ব ইরানের হাতেই থাকবে। মুসলিম বিশ্বের এ করুণ অবস্থায় ইরানের সাফল্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে নিঃসন্দেহে বলা যায়।
বর্তমান বিশ্বকে বলা হয় ‘গ্লোবাল ভিলেজ’। বিশ্বপল্লির অংশ হিসেবে ইরান বিশ্বপরিস্থিতি হতে বিচ্ছিন্ন নয়। ইসলামী বিপ্লবের নেতৃত্বকে প্রতি মুহূর্তে পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের মোকাবিলায় অতন্দ্র প্রহরীর মতো থাকতে হয়েছে। একদিকে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বকে কৌশলে পরিহার করে বিশ্ব চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করা, অপরদিকে ইরানকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নেয়ার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ খুব সহজ ব্যাপার নয়। উভয়বিধ সমস্যাকে মাড়িয়ে ইরান আজ পারমাণবিক শক্তি অর্জনের পর অনেকটাই এগিয়ে গেছে। ইরানকে নিয়ে ইহুদি যায়নবাদীদের অনেক ভয়। তারা জানে, ইরানের অব্যাহত অগ্রগতি ইসরাইলসহ সকল মুসলিমবিরোধী শক্তির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। ধীরে ধীরে ইরানের পারমাণবিক শক্তি অর্জন হওয়াকে তাদের ভয় ও চ্যালেঞ্জের বাস্তবরূপ বলে ইহুদিবাদীরা মনে করতে থাকে। এ জন্য কোনোভাবেই ইরানকে পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হতে দেবে না বলে সুস্পষ্ট ঘোষণা দেয়। কিন্তু ইরানের গবেষক ও নেতৃবৃন্দের মেধাভিত্তিক কৌশল ও প্রচেষ্টা ছয় জাতি গ্রুপকে আলোচনায় রাখতে বাধ্য করেছে এবং স্বস্তির এক চুক্তিতে উপনীত হয়েছে যা ২০ জানুয়ারি ২০১৪ থেকে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। এ চুক্তি ইরানী জাতি তথা সারা মুসলিম বিশ্বের জন্য এক বিজয়ই বলতে হবে। রুহানীর গতিশীল নেতৃত্বে ইরানের এ কূটনৈতিক বিজয় ভবিষ্যৎ ইরান তথা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি ও এ অঞ্চলের ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতা অর্জনে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে বলেই পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। যুদ্ধবাজ পশ্চিমা অনেক রাষ্ট্র এখন ইরানের ব্যাপারে তাদের পূর্বের নীতি পরিবর্তনের চিন্তা করছে এজন্য যে, ইরানের বর্তমান নেতৃত্ব জনগণের সমর্থনে আগের যে কোন সময়ের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী।
নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়নে ইরানের নারী সমাজের বিস্ময়কর অগ্রগতি সকলকে আকৃষ্ট করেছে বৈকি। শিক্ষা ব্যবস্থাসহ সকল পর্যায়ে নারীদের সুসংহত অবস্থান মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশের জন্যই অনুকরণীয়। নারীদের এ অগ্রগতিকে রুহানীর নীতি সর্বান্তকরণে সমর্থন করে বলেই মনে হয়। তিনি তাঁর সরকারের একজন ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মহিলা নিয়োগ করে এর প্রমাণ দিয়েছেন। শোনা যাচ্ছে, নারীদের উন্নয়নে একটি পৃথক মন্ত্রণালয়ের দিকেও সরকার অগ্রসর হচ্ছে।
এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, ইরানের বিপ্লবকে সারা বিশ্বে বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বে  বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়। স্বার্থবাদী নেতৃত্ব এ বিপ্লবকে তাদের ক্ষমতার জন্য হুমকি মনে করেন। বিষয়টি একেবাবের তথ্যের বিকৃতি বা ইরানের বিপ্লবের বিরোধী শক্তির অপপ্রচার বলেই মনে হয়। কেননা, যে বিপ্লব ইরানের বিজ্ঞান গবেষণাকে মুসলিম বিশ্বের প্রথম সারিতে নিয়ে গেছে, দারিদ্র বিমোচন, শিক্ষা ও সংস্কৃতিক অগ্রগতির সাথে সাথে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছে, সে বিপ্লবকে বাঁকা চোখে দেখার কোন কারণ নেই। বিপ্লবের ভালো শিক্ষাগুলো অবশ্যই আমরা চর্চা করতে পারি। বিপ্লবের সফলতার এমনকি ছোটখাট অপূর্ণতার দিকগুলোও সার্বিকভাবে প্রচারের দায়িত্ব ইরানকেই নিতে হবে। মুসিলম বিশ্বের সার্বিক ঐক্যপ্রচেষ্টাকে আরো জোরদার করতে হবে। ইরানকে মনে রাখতে হবে মুসলিম বিশ্বে বর্তমানে যে নেতৃত্বশূন্যতা আছে তা স্থায়ী নয়। এ শূন্যতা যদি ইরানের দ্বারা পূর্ণ হয় তবেই ইসলামী বিপ্লব ও এর মহান নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ ইমাম খোমেইনীর স্বপ্নের বাস্তবায়ন হবে।

* অধ্যাপক, দাওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া


কৃষি ক্ষেত্রে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের দৃষ্টিগ্রাহ্য অগ্রগতি

ড. হোসেন শাহ্বায

ভূমিকা
প্রাপ্ত প্রামাণ্য তথ্যাদি থেকে যতটা জানা যায়, বিশ্বের বুকে ইরান হচ্ছে প্রথম দেশ যেখানে কৃষিকাজ ও পশুপালন শুরু হয় এবং প্রাথমিক যুগের মানুষেরা ইরানে কৃষিকাজ ও পশু পালনে মশগুল হয়েছিল।
ইরানের বাইরে ইরান সম্পর্কে যখন কথা ওঠে তখন সাধারণত শ্রোতার মনে যে চিত্রটি ভেসে ওঠে তা হচ্ছে ইরানের ইতিহাস, সভ্যতা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, শিল্পকলা, আদব-রসম ও যুদ্ধবিগ্রহ। কিন্তু ইরানের কৃষিকাজের কথা সাধারণত কারো চিন্তায় আসে না। ইরানের শুষ্ক আবহাওয়া সম্পর্কে শ্রোতার মনে যে চিত্র ভেসে ওঠে তা-ও পুরোপুরি সঠিক। কিন্তু তাই বলে ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না যে, ইরানের শুষ্ক আবহাওয়া ইরানীদের জন্য কৃষিকাজের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি; বরং ইরানে বিরাজমান জলবায়ুর প্রতিকূল বৈশিষ্ট্যসমূহ সত্ত্বেও সব সময়ই এ দেশে কৃষিকাজ হয়ে আসছে।
সম্ভবত এখানকার শুষ্ক বা আধা শুষ্ক আবহাওয়ার কারণেই ইরানের অধিবাসীরা কৃষি সংশ্লিষ্ট কতক সমস্যার সমাধানে নব উদ্ভাবনে ও মূল্যবান উন্নতি ও অগ্রগতি হাসিল করতে সক্ষম হয়েছে। এখানে উদাহরণ স্বরূপ এ ধরনের কয়েকটি বিষয়ে সংক্ষিপ্তআভাস দেয়া যাচ্ছে :

১. শুষ্ক এলাকায় গাছপালার জন্য পানি সরবরাহ-কৌশল
ইরানের শুষ্ক এলাকাগুলোতে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই গাছপালাকে সারা বছর বাঁচিয়ে রাখার জন্য এগুলোর গোড়ায় প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহের জন্য এক অভিনব পন্থার আশ্রয় নেয়া হতো। যেহেতু পানির প্রাপ্যতার স্বল্পতা ছাড়াও সকল গাছপালার গোড়ায় নিয়মিত বয়ে আনা পানি দেয়া অত্যন্ত আয়াসসাধ্য ছিল, কারণ, গাছের গোড়ায় দেয়া পানির বেশির ভাগই চুঁইয়ে অনেক নিচে চলে যায় বলে প্রতিদিন একাধিক বার ও বেশি পরিমাণে পানি দিতে হয়, সেহেতু লোকেরা সূক্ষ্ম ছিদ্রযুক্ত মাটির পাত্র গাছের শিকড়ের কাছে পুঁতে তা পানি দিয়ে ভরে রাখত। ফলে ঐ সব পাত্র থেকে ধীরে ধীরে ও ফোঁটায় ফোঁটায় পানি বেরিয়ে গিয়ে গাছপালার প্রয়োজন যথাযথভাবে পূরণ করত এবং বেশ কয়েক দিনের ব্যবধানে পাত্র খালি হলে তারা আবার সেগুলোকে পূরণ করে রাখত।
এ ব্যবস্থাটি প্রাগৈতিহাসিক ইরানে পানি সেচের ক্ষেত্রে এক বিপ্লব সাধন করে। এভাবে ফোঁটায় ফোঁটায় চোঁয়ানো পদ্ধতিতে পানি সিঞ্চনের কৌশল প্রাগৈতিহাসিক ইরানীদের অভিজ্ঞতা থেকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে স্থানান্তরিত হয়।

২. পানির সঞ্চয়-আধার গড়ে তোলা
বিশ্বের ইতিহাসে মানুষের দ্বারা পানি সঞ্চয়ের আধার গড়ে তোলার কাজটি সর্ব প্রথম ইরানে সংঘটিত হয়। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে অর্থাৎ এখন থেকে দুই হাজার সাতশ’ বছর আগে ইরানের গোনাবাদ নামক স্থানে খাবার পানি ও সেচের পানি সরবরাহের জন্য পানির আধার তৈরি করা হয়।

৩. পানি স্থানান্তর ব্যবস্থা
প্রাগৈতিহাসিক আমলের ইরানীরা এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায়- প্রধানত পানিসমৃদ্ধ এলাকা থেকে শুষ্ক ও আধা শুষ্ক এলাকায়-পানি সরবরাহের জন্য ‘ক্বানাত’-এর সাহায্য নিত। ক্বানাত হচ্ছে এমন এক ধরনের ভূগর্ভস্থ নালা যা ভূগর্ভস্থ কোনো প্রকৃতিক পানির আধারের সাথে স্বল্প গভীর অন্য জায়গাকে সংযুক্ত করেছে এবং সেখান থেকে উদ্দিষ্ট স্থানে পানি সরবরাহ করে। বলা বাহুল্য যে, ক্বানাতের সাহায্যে পানি সরবরাহের জন্য পানির আধারের তুলনায় পানি ব্যবহারকারী জায়গাটি অপেক্ষাকৃত নিচু হওয়া অপরিহার্য।

ইরান ভূখণ্ড : আয়তন ও ভূপ্রকৃতি
বর্তমান ইরানের আয়তন হচ্ছে ১৬ লক্ষ ৪৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার এবং আয়তনের বিচারে বিশ্বের দেশসমূহের মধ্যে ইরান হচ্ছে ১৮তম দেশ। ইরানের এ বিশাল আয়তন ভূখণ্ডের শতকরা ৪০ ভাগ এলাকা পুরোপুরি শুষ্ক ও অত্যন্ত উষ্ণ। এছাড়া কোনো কোনো এলাকার মাটি খুবই লোনা- চাষাবাদের জন্য পুরোপুরি অনুপযোগী।
উল্লেখ্য যে, এ পর্যন্ত বিশ্বের যেসব জায়গাকে খুবই গরম জায়গা হিসেবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে সর্বশেষ প্রাপ্ত খ্রিস্টীয় ২০১০ সালের তথ্য অনুযায়ী সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গরম জায়গাটি ইরানে অবস্থিতÑ যেখানকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৭২ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড রেকর্ড করা হয়েছে। ইরানের মরু এলাকার এ জায়গাটিতে যে বাতাস খুবই গরম কেবল তা-ই নয়, বরং সেখানে পানির সামান্যতম অস্তিত্বও নেই। কারণ, সেখানে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ শূন্য। তাছাড়া সেখানকার মাটি লোনাও বটে। তাই এ জায়গাটি কোনো ধরনের কৃষিকার্যের জন্যই উপযোগী নয়।
ইরানের মোট আয়তনের শতকরা ৭ ভাগ জায়গা হচ্ছে বনভূমি এবং আরো শতকরা ৭ ভাগ জায়গা জুড়ে রয়েছে দেশের সবগুলো শহর, সড়ক ও মহাসড়ক, শিল্প এলাকা ও গ্রাম বসতিসমূহ। দেশের মাত্র শতকরা ১২ ভাগ এলাকা (অর্থাৎ প্রায় এক লাখ ৮০ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা তথা দুই কোটি হেক্টর জায়গা) কৃষিকার্যের আওতায় রয়েছে। তবে এর বাইরে প্রায় সম পরিমাণ জায়গা এমন যেখানকার মাটির গুণগত বৈশিষ্ট্য কৃষিকাজের উপযোগী; কেবল যথেষ্ট পরিমাণে পানি সরবরাহ করা সম্ভব হলেই উক্ত পরিমাণ জায়গা কৃষিকার্যের আওতায় আনা যেতে পারে।

ইরানের খাদ্য-নিরাপত্তা
বিভিন্ন সংস্থা খাদ্য-নিরাপত্তার বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছে এবং একটি দেশের খাদ্য-নিরাপত্তার অবস্থা নির্ণয়ের জন্য এসব সংস্থা সংশ্লিষ্ট দেশের বিভিন্ন বিষয়ের তথ্য ও উপাত্ত ব্যবহার করে থাকে। তবে খাদ্য-নিরাপত্তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সর্বাধিক পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা দিয়েছে বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (ফাও)। ফাও প্রদত্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী একটি দেশের খাদ্য-নিরাপত্তা তখনি পুরোপুরি অর্জিত হয়েছে বলে মনে করতে হবে যদি অবস্থা এমন হয় যে, সব সময়ই যথেষ্ট পরিমাণে স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য তার আওতার মধ্যে থাকে।
উপরোক্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী বর্তমানে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান শতকরা ৯৬ ভাগ খাদ্য-নিরাপত্তার অধিকারী। জনগণের গড় মাথাপিছু খাদ্যজাত এনার্জি বা পুষ্টি গ্রহণের বিচারে বর্তমানে ইরানী জনগণের পুষ্টি বা খাদ্যজাত এনার্জি গ্রহণ বিশ্বের মাথাপিছু গড়ের তুলনায় অনেক ওপরে। বর্তমানে সারা বিশ্বের জনগণের মাথাপিছু গড় এনার্জি বা পুষ্টি গ্রহণের পরিমাণ হচ্ছে দৈনিক দুই হাজার ২৫০ ক্যালোরি, কিন্তু ইরানী জনগণের দ্বারা গ্রহণের গড় পরিমাণ হচ্ছে দৈনিক তিন হাজার ৪০ ক্যালোরি। এদিক থেকে বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের অবস্থান হচ্ছে ৫৫তম। এর মানে হচ্ছে এই যে, ইরানী জনগণ অনেক দেশের তুলনায় মাথাপিছু কম আয়ের অধিকারী হলেও এরূপ অনেক দেশের জনগণের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি খাদ্য গ্রহণ করতে সক্ষম। এটা সম্ভব হওয়ার পিছনে নিহিত কারণসমূহের মধ্যে সম্ভবত অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে এই যে, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বার্ষিক মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি)- যার ক্রয় ক্ষমতার মান (Purchase Power Parity-  PPP) এক ট্রিলিয়ন (এক লক্ষ কোটি) ডলারের সমান এবং এ ক্ষেত্রে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে ১৭তম অবস্থানের অধিকারী।
যদিও ইরানে পানির সমস্যা একটি বড় সমস্যা এবং গ্রীন হাউজ এফেক্ট ও আবহাওয়ার পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়ার কারণে এ সমস্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তথাপি ইরান স্বীয় কৃষিকার্যের মাধ্যমে বছরে গড়ে দশ কোটি টন খাদ্য উৎপাদন করে দেশের খাদ্য চাহিদা মিটাতে সক্ষম হচ্ছে।
ইরানী জনগণের প্রধান খাদ্য হচ্ছে রুটি। এ কারণে ইরানে কৃষিক্ষেত্রে খাদ্যশষ্য উৎপাদনের বেলায় গমকে প্রাধান্য দেয়া হয় এবং বর্তমানে ইরানে বছরে এক কোটি চল্লিশ লক্ষ টন গম উৎপাদিত হয়। ইরানে খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে এরপর দ্বিতীয় অবস্থান পশুজাত প্রোটিন, প্রধানত দুগ্ধ উৎপাদন- বছরে যার পরিমাণ এক কোটি টন। অন্যান্য খাদ্যোপকরণ উৎপাদনের মধ্যে টমেটোর উৎপাদন বিশেষভাবে লক্ষ্য করার মতো; ইরানে বছরে ৭০ লক্ষ টন টমেটো উৎপাদিত হয়।
যদিও ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান বিশ্বের দেশসমূহের মধ্যে জনসংখ্যার বিচারে ১৭তম ও ভূখণ্ডের আয়তনের বিচারে ১৮তম, তবে এখানে বহু রকমের কৃষিজাত দ্রব্য উৎপাদিত হয়ে থাকে; এগুলোর মধ্যে প্রায় অর্ধ শত কৃষিজাত দ্রব্যের উৎপাদনের পরিমাণ অনেক বেশি- যেগুলো উৎপাদনের দিক থেকে ইরানের অবস্থান বিশ্বের দেশসমূহের প্রথম দশটি দেশের মধ্যে। [এ ব্যাপারে বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (ফাও) কর্তৃক প্রকাশিত এতদ্সংশ্লিষ্ট বিস্তারিত তথ্য অত্র নিবন্ধের ১ নং চার্টে উল্লেখ করা হয়েছে।]
চার্ট নং ১ : পরিমাণের বিচারে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে উৎপাদিত কৃষিজাত দ্রব্যদির বৈশ্বিক অবস্থান

অবস্থান    উৎপাদিত দ্রব্যের নাম
১    পেস্তা, যেরেশ্ক্ , ক্যাভিয়ার , যাফরান, শক্ত খোসাযুক্ত ফল, জাম।
২    খেজুর, এপ্রিকট , আখরোট।
৩    তরমুজ, চেরি, তালেবী  ও অনুরূপ ধরনের রসালো অন্যান্য ফল, আপেল, ডুমুর, ছোট জাতের শশা।
৪    দুম্বা, তাজা ফলমূল, বেহ্ , পশম, কাঠ বাদাম।
৫    আনীসুন (রূমী জিরা), বদিয়ান , রযিয়ান , ধনে, লুবিয়া , রেশম- গুটি।
৬    ফান্দোক্ব , মোষের দুধ, টম্যাটো।
৭    আঙ্গুর, পিয়াজ, টক চেরি, দুম্বার দুধ, কীভী ফল।
৮    মশলা, হুলু , শালীল্ , কমলা, নরেঞ্জ , মাল্টা, লেবু, জাম্বুরা, ছাগলের দুধ,  লাউ, স্কোয়াশ, কুমড়া।
৯    ‘আদাস ।
১০    খোরমালু ।

কৃষি গবেষণা
কৃষি ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য, বিশেষ করে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য, কৃষি গবেষণা কেন্দ্র নিঃসন্দেহে অন্যতম প্রধান নিয়ামক উপাদান। এ কারণে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সরকার শুরু থেকেই কৃষি গবেষণার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি প্রদান করে এবং এতদ্সংক্রান্ত কেন্দ্রগুলোকে প্রয়োজনীয় যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে আসছে। এর ফলে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের কতক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র বৈশ্বিক দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে এবং বিভিন্ন দেশে এসব কেন্দ্রের গবেষণা প্রকাশনাসমূহকে তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
কর্মতৎপরতার দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের কৃষি গবেষণা কেন্দ্রগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে :

১. প্রাদেশিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রসমূহ
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ৩১টি প্রদেশের প্রতিটিতেই কমপক্ষে একটি প্রাদেশিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে। কিন্তু কতক প্রদেশে, যেমন : কেরমান প্রদেশেÑ যেখানে সবচেয়ে বেশি কৃষিকাজ হয়ে থাকে, দু’টি করে কৃষি  গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে। এসব গবেষণা কেন্দ্র সরাসরি কৃষি জিহাদ মন্ত্রণালয় ও প্রাদেশিক কৃষি জিহাদ সংস্থার তত্ত্বাবধানে কর্মতৎপরতা চালাচ্ছে। এসব কেন্দ্র সংশ্লিষ্ট প্রদেশের মাটি, সার, পানি, সেচ, কৃষি-আপদ (পোকা লাগা ইত্যাদি) ও অন্যান্য সমস্যা এবং কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি সম্পর্কে গবেষণা করে থাকে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট প্রদেশসমূহের কৃষি-আপদ মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব এসব কেন্দ্রের ওপর অর্পিত হয়েছে।

(২) জাতীয় কৃষি গবেষণা কেন্দ্রসমূহ
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে প্রাদেশিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রসমূহ ছাড়াও কতগুলো জাতীয় কৃষি গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে। এসব কেন্দ্র প্রধানত জাতীয়ভিত্তিক কৃষিবিষয়ক সমস্যাবলি নিয়ে গবেষণা করে থাকে। এসব কেন্দ্র সাধারণত বিভিন্ন ধরনের কৃষিজাত দ্রব্যাদি, যেমন : ধান, পেস্তা, চা ইত্যাদি সম্পর্কে এবং কৃষি-উৎপাদন যা কিছুর ওপর নির্ভরশীল, যেমন : মাটি, কৃষি যন্ত্রপাতি, সার, কৃষি-আপদ ও ফসলের রোগব্যাধি ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, জাতীয় কৃষি-আপদ ও কৃষি-ব্যাধি গবেষণা কেন্দ্র সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জাতীয় ভিত্তিতে গবেষণা করে থাকে। অনুরূপভাবে কৃষি-ব্যাধি ও ভাইরাস গবেষণা কেন্দ্র সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গবেষণা করে থাকে এবং এ কেন্দ্রের গবেষণার ফলাফল বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক অঙ্গনে তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। (ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের অন্যান্য কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের মধ্য থেকে কয়েকটির নাম স্বতন্ত্রভাবে অত্র নিবন্ধে সংযোজিত ২ নং চার্টে উল্লেখ করা হলো।)
চার্ট নং ২ : ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের কৃষি  গবেষণা কেন্দ্রসমূহের আংশিক তালিকা
১.    এগ্রিকালচারাল বায়োটেকনোলজি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব ইরান
২.    এগ্রিকালচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব ইরান
৩.    এনিম্যাল সায়েন্স রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব ইরান
৪.    ডেট, পাম এন্ড ট্রপিক্যাল ফ্রুট রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব ইরান
৫.    ড্রাই ল্যান্ড এগ্রিকালচারাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব ইরান
৬.    ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ ইন্স্টিটিউট অন মেশিনারিজ অব ইরান
৭.    ইরান ফিশারিজ রিসার্চ অর্গানাইযেশন
৮.    ইরান সিটরাস রিসার্চ ইনস্টিটিউট
৯.    ইনস্টিটিউট ফর কটন রিসার্চ অব ইরান
১০.    ইরান পিস্টাচিও রিসার্চ ইনস্টিটিউট
১১.    ইন্টারন্যাশন্যাল র্স্টাজিওন রিসার্চ ইনস্টিটিউট
১২.    ন্যাশন্যাল স্যালিনিটি রিসার্চ সেন্টার অব ইরান
১৩.    প্লান্ট পেস্টস এন্ড ডিজিজেস রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব ইরান
১৪.    রাযী ভ্যাকসিন এন্ড সিরাম রিচার্চ ইনস্টিটিউট
১৫.    রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট এন্ড রেঞ্জল্যান্ড অব ইরান
১৬.    রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব ইরান
১৭.    রুরাল রিসার্চ সেন্টার অব ইরান
১৮.    সীড এন্ড প্লান্ট সার্টিফিকেশন রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব ইরান
১৯.    সীড এন্ড প্লান্ট ইমপ্রুভমেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব ইরান
২০.    সিল্কওরম রিসার্চ ইন্স্টিটিউট অব ইরান
২১.    সয়েল এন্ড ওয়াটার রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব ইরান
২২.    সয়েল কনজারভেশন এন্ড ওয়াটারশেড ম্যানেজমেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব ইরান
২৩.    সুগার- বীট সীড রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব ইরান
২৪.    টী রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব ইরান
২৫.    বেভারেজেস এন্ড ফ্রুট- জুসেস ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ সেন্টার অব ইরান

(৩) বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের কৃষি গবেষণা কেন্দ্র
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের বেশির ভাগেরই এবং অনেক সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বিভাগেরও নিজস্ব কৃষি গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে। এসব গবেষণা কেন্দ্র প্রধানত সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা ও গবেষণার সাথে সংশ্লিষ্ট। ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা সমাপনী গবেষণাপত্র প্রস্তুতকরণে সহায়তা করা এগুলোর অন্যতম প্রধান কাজ। উল্লেখ্য, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও ডক্টরেট পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য তাদের শিক্ষা কোর্সের সমাপ্তিতে একটি গবেষণাপত্র জমা দেয়া অপরিহার্য।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ কৃষি গবেষণা কেন্দ্রসমূহের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে : তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, শীরায্ বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, আহ্ওয়াযের চামরান বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, মাশহাদের ফেরদৌসী বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, তাবরীয বিশ্ববিদ্যালয় কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, যানজন বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, যাহিদান বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি গবেষণা কেন্দ্র ও অযার বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি গবেষণা কেন্দ্র।

কৃষি সংশ্লিষ্ট শিল্প
কৃষি সংশ্লিষ্ট শিল্পসূহের মধ্যে রয়েছে জমি চাষ, বীজ বপন, ফসল কাটা ও মাড়াই করার যন্ত্রপাতি উৎপাদনের শিল্প, সার উৎপাদন শিল্প, কীটনাশক ওষুধ শিল্প, বীজ উৎপাদন শিল্প, সেচ যন্ত্র উৎপাদন শিল্প ও কৃষিজাত দ্রব্য পরিবহন শিল্প। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে ছোট-বড় অনেকগুলো কৃষি সংশ্লিষ্ট শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলোর মধ্যে আছে ট্রাক্টর উৎপাদন শিল্প, কম্বাইন্ড কৃষি যন্ত্র উৎপাদন শিল্প, সেচ সরঞ্জাম শিল্প, বীজের অঙ্কুরোদ্গম ঘটানোর সরঞ্জামাদি উৎপাদন শিল্প, কৃষিজাত দ্রব্যাদি পরিবহন যান (যেমন : গোশ্ত, মাছ, দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত সামগ্রী পরিবহনের জন্য ডিপ ফিজবিশিষ্ট ট্রাক) উৎপাদন শিল্প এবং কৃষি সংশ্লিষ্ট অন্যান্য যন্ত্রপাতি উৎপাদনের শিল্প। এ ক্ষেত্রে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান স্বনির্ভরতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে।

খাদ্য সংশ্লিষ্ট শিল্প
যে কোনো দেশের খাদ্য নিরাপত্তার সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে খাদ্য সংশ্লিষ্ট শিল্প তথা ফসল কাটার পর খাদ্যশস্য সংরক্ষণ ও ব্যবহারের উপযোগী করা ও রাখার সাথে সংশ্লিষ্ট শিল্প। বিশেষ মওসূমে তোলা যে কোনো খাদ্যশস্য ও ফলমূল ইত্যাদি এ ধরনের শিল্পের সহায়তায় সংরক্ষণ করে বছরের সকল মওসূমে বাজারে সরবরাহ করা ও ভোক্তার কাছে পৌঁছে দেয়া যেতে পারে এবং এর মাধ্যমে একই সাথে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। তেমনি এ ধরনের শিল্পের সাহায্যে খাদ্যবৈচিত্র্য বৃদ্ধি করা যেতে পারে, এমনকি বিশেষ ধরনের লোকদের জন্য প্রয়োজনীয়, যেমন : রোগীদের জন্য, বিশেষ ধরনের খাদ্যদ্রব্যাদি উৎপাদন করা যেতে পারে। এছাড়া কৃষিজাত দ্রব্যাদি, বিশেষত খাদ্যদ্রব্যের অপচয় কমিয়ে আনা যেতে পারে। ফলে সার্বিকভাবে দেশের খাদ্য-নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা যেতে পারে এবং একই সাথে পূর্ণ মানসম্পন্ন খাদ্যশষ্য, ফলমূল, তরিতরকারি, মাছ, গোশ্ত, ডিম ইত্যাদি ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য বাজারজাতকরণের নিশ্চয়তা বিধান করা যেতে পারে। অর্থাৎ ফসল তোলার পর থেকে খাদ্যশস্য, ফলমূল, তরিতরকারি ইত্যাদি ও অন্যান্য খাদ্যোপকরণ প্রক্রিয়াজাতকরণ সংশ্লিষ্ট সমস্ত কাজই এ শিল্পের আওতাভুক্ত। এর মধ্যে রয়েছে হিমাগার শিল্প, খাদ্যশস্য ও অন্যান্য খাদ্যোপকরণ প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, খাদ্যশস্য, অন্যান্য খাদ্যোপকরণ ও খাদ্যদ্রব্যাদি পরিবহন সংশ্লিষ্ট শিল্প। এছাড়া খাদ্যশস্য, অন্যান্য খাদ্যোপকরণ ও খাদ্যদ্রব্যাদিকে বিভিন্ন ক্যাটেগরিতে বিভক্ত ও বিন্যস্তকরণ, প্যাকিং, ধৌতকরণ, শুকানো ও আরো অনেক কাজ এ শিল্পের আওতাভুক্ত।
যে কোনো দেশের জন্য কৃষি এবং খাদ্যশস্য, অন্যান্য খাদ্যোপকরণ ও খাদ্যদ্রব্যাদি উৎপাদনের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে উৎপাদিত খাদ্যশস্যাদি ও খাদ্যদ্রব্য সংশ্লিষ্ট শিল্পে তা প্রবেশের অনুপাত। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে কৃষি ক্ষেত্রে উৎপাদিত খাদ্যশস্য ও অন্যান্য খাদ্যোপকরণের শতকরা ৫০ ভাগ এতদ্সংশ্লিষ্ট শিল্পে প্রবেশ করে- যা অবশ্যই সন্তোষজনক।
ইরানের এ শিল্পের আওতাভুক্ত দ্রব্যাদির কতগুলো বিশ্বব্যাপী সুপরিচিতির অধিকারী। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে প্রক্রিয়াজাতকৃত বিভিন্ন ধরনের শুকানো ভক্ষণীয় বীজ, শুকানো ফলমূল, কিশ্মিশ্ ও খেজুর। এছাড়া চকলেট উৎপাদন শিল্প এবং বিভিন্ন ধরনের ফলের রস ও শরবত প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে খুবই অগ্রগতি অর্জন করেছে এবং মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশেই এগুলো রফতানি করা হচ্ছে। এতদ্সংশ্লিষ্ট কতক ক্ষেত্রে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান নব উদ্ভাবনীর পরিচয় দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে অ্যালকোহলমুক্ত হালাল যবের পানীয় উৎপাদন হচ্ছে এবং বিশ্বের ৩০টি দেশে তা রফতানি হচ্ছে।
প্রয়োজনীয় খাদ্য সংশ্লিষ্ট শিল্প থাকার কারণে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের কৃষকগণ অধিক পরিমাণে খাদ্যশস্য ও অন্যান্য খাদ্যোপকরণ উৎপাদনে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন এবং তাঁরা কোন্ ধরনের ফসল ফলাবেন সে সম্পর্কে অধিকতর স্বাধীনতা সহকারে নিজেরাই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারছেন।
কৃষি ক্ষেত্রে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের উন্নতি ও অগ্রগতি সম্বন্ধে এখানে সামান্য আভাস দেয়া হলো মাত্র। এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ ধারণা লাভের জন্য আরো অনেক বিস্তারিত তথ্যের প্রয়োজন যা তুলে ধরা এ নিবন্ধের সীমিত পরিসরে সম্ভব নয়। হয়তো পরবর্তীকালে এ বিষয়ের ওপর অধিকতর আলোকপাত করা সম্ভব হতে পারে।

অনুবাদ : আবূ মা‘রূফ্


শান্তি ও উন্নয়নের অগ্রপথিক ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান

এখন থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে বিশ্ববাসী ইরানের বুকে এক মহান ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে তৎকালীন ইরানের শাহ্ মোহাম্মাদ রেযা পাহ্লাভীর একনায়কতান্ত্রিক সরকারের পতন প্রত্যক্ষ করে। এ ঘটনা বিপ্লবের মহান নেতা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-এর প্রজ্ঞাময় খাঁটি দ্বীনী নেতৃত্ব এবং স্বৈরাচারী পরপদলেহী সরকারের হাত থেকে মুক্তির লক্ষ্যে ইরানী জনগণের সুদৃঢ় ইচ্ছার ফলেই সম্ভব হয়েছিল।
ইসলামী বিপ্লব সংগঠনের জন্য উত্থানের শুরু থেকেই ইরানী জনগণের লক্ষ্য ও স্লোগান ছিল ‘স্বাধীনতা, মুক্তি, ইসলামী প্রজাতন্ত্র’ (ইস্তেক্বলাল্ আযাদী জোম্হূরীয়ে ইসলামী)। আর বিপ্লব বিজয়ী হবার পরে হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-এর নির্দেশে দেশের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও সরকার কাঠামো নির্ধারণের জন্য এক গণভোটের আয়োজন করা হয় এবং এতে অংশগ্রহণ করে ইরানী জনগণ শতকরা ৯৮ শতাংশ ভোটে ইসলামী প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা অনুমোদন করে। এরপর থেকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে বিভিন্ন পর্যায়ের তিরিশটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং এসব নির্বাচনের প্রতিটিতেই জনগণ স্বীয় ভাগ্য নির্ধারণের জন্য ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনা সহকারে অংশগ্রহণ করে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের বুকে জনপ্রতিনিধিত্বশীল শাসন ব্যবস্থার অধিকারী এমন একটি দেশ যে দেশটি একদিকে যেমন কাস্পিয়ান সাগর ও পারস্য উপসাগরের মাঝখানে অবস্থান করছে, অন্যদিকে পশ্চিম এশিয়া ও পূর্ব এশিয়াকে পরস্পরের সাথে সংযুক্ত করেছে। সুতরাং এটা অনস্বীকার্য যে, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য এলাকা ও পশ্চিম এশিয়ার ওপরে এবং এর দূর প্রসারী প্রভাবে বিশ্ব শান্তির ওপরে বিরাট প্রভাব ফেলতে বাধ্য। এ কারণে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পররাষ্ট্র নীতির প্রধান দিকগুলো হচ্ছে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়ন এবং ব্যাপক ভিত্তিক আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা; ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান তার এ লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে ও আন্তরিকতা সহকারে কাজ করে যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহুবিধ সাফল্যের অধিকারী হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে অর্জিত উন্নয়ন ও অগ্রগতির ফলে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের জনগণের জীবন মানে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নিরক্ষরতার হার ন্যূনতম পর্যায়ে নেমে আসা, নিয়মিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, পর্যটন সহ সেবামূলক বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন, নারীদের জীবন মানের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি, উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি এবং ভারী শিল্পে, বিশেষ করে অটোমোবাইল শিল্পে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে উন্নয়ন। এগুলো হচ্ছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নের কয়েকটি দৃষ্টান্ত মাত্র। বিশেষ করে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান এমন ব্যাপক উন্নতির অধিকারী হয়েছে যার ফলে এসব ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে, বিশেষ করে আঞ্চলিক মানদণ্ডে, সহযোগিতার সক্ষমতা অর্জন করেছে।
অত্র নিবন্ধে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের কয়েকটি দিকের ওপর সংক্ষেপে আলোকপাত করা হচ্ছে।

পর্যটন
বিশ্বে এমন দেশের সংখ্যা খুবই কম যেসব দেশে একই সময় দেশের বিভিন্ন অংশে চার ঋতুর উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায়। যেসব পর্যটক শীতকালে দক্ষিণ ইরানে সফর করেন তাঁরা সেখানে খুবই আরামদায়ক আবহাওয়া উপভোগ করেন এবং একই সাথে সেখানে স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানিতে সাঁতার কাটতে পারেন। অথচ সেখান থেকে মাত্র পঁয়ত্রিশ মিনিটের পথের ব্যবধানে তাব্রীযে ও রাজধানী তেহরানে তখন প্রচণ্ড- শীত- যেখানে স্কী সহ বিভিন্ন ধরনের শীতকালীন খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করা যেতে পারে। একই সময় দেশের এক অংশে দেখা যায় সফেদ বরফে আবৃত পর্বতের নয়নাভিরাম দৃশ্য, অন্য অংশে বর্ষণ মুখর ঘন বনজঙ্গল এবং অপর এক অংশে মরু এলাকার প্রচ- খরতাপ- এই হলো ইরানের আবহাওয়া বৈচিত্র্য। এর ফলে ইরানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ক্ষেত্রেও বৈচিত্র্যের সৃষ্টি হয়েছে।
বস্তুতঃ অত্যন্ত উন্নত সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার এবং অসংখ্য মহামূল্য ও শোভনীয় ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক দৃশ্যপট ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানকে বিশ্বের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা প্রদান করেছে।
অন্যদিকে সুপ্রাচীন কাল থেকে ইরান বহু বিখ্যাত সভ্যতার সূতিকাগার। তাই ইরানের রয়েছে বহু মহামূল্য সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের ভার- যার মধ্যে অনেক কিছুই দশ হাজার বছরেরও বেশি কাল যাবৎ সগৌরবে এ ভূখণ্ডে অবস্থান করছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে অসংখ্য স্থাপত্য নিদর্শন ও ভাস্কর্য। এর পাশাপাশি হাজার হাজার বছর ধরে ইরানে চলে আসছে বহু রকমের হস্তশিল্প। বিশেষ করে কার্পেট হচ্ছে ইরানের প্রাচীনতম হস্তশিল্প, বরং ইরান হচ্ছে কার্পেটের সূতিকাগার।
ইরানের স্থাপত্য শিল্পের শৈল্পিক রীতি অনন্য ও সদা নব উদ্ভাবনমূলক। ইরানের প্রাচীন স্থাপত্য নিদর্শনসমূহের মধ্যে পার্সেপোলিস্ ও পার্সাগাদ্ এবং ইস্ফাহানের নাকশে জাহান্ স্কোর্য়া, এক কথায়, সারা বিশ্বের মধ্যে অনন্য ও অতুলনীয়।
ইরানের স্থাপত্য নিদর্শনসমূহের মধ্যে ধর্মীয় স্থাপত্যসমূহ এ দেশের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ও পর্যটন শিল্পে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান দখল করে আছে। ইতিহাসের বিভিন্ন যুগে গড়ে ওঠা এসব স্থাপত্য নিদর্শন শিল্পকলারও অত্যন্ত টেকসই ও চমকপ্রদ সুন্দর নিদর্শন।
বর্তমানে সারা বিশ্বে পর্যটন ক্রমেই অধিকতর জনপ্রিয় হচ্ছেÑ যা দেশসমূহের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। যদিও  বৈশ্বিক পর্যটন শিল্পে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অংশ মাত্র শতকরা ২ দশমিক ১ ভাগ, তবে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান স্বীয় অসংখ্য ঐতিহাসিক সৌধ, হস্তশিল্প ও নয়নাভিরাম স্থাপত্য নিদর্শন চিহ্নিত করার মাধ্যমে পর্যটন ক্ষেত্রে স্বীয় সম্ভাবনা ও সামর্থ্য বৃদ্ধি করার জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
বিশ্ব পর্যটন সংস্থা (ডব্লিউটিও) ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানকে একটি বিশ বছর মেয়াদি উচ্চাভিলাষী পর্যটন উন্নয়ন মাস্টার প্লান্ প্রণয়নের ব্যাপারে সহায়তা করছে। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান আশা করে যে, এ পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নের ফলে ইরান বিশ্বের মোট বার্ষিক আন্তর্জাতিক পর্যটকদের-যাদের সংখ্যা বর্তমানে দুই কোটি-মধ্য থেকে কমপক্ষে শতকরা ১ দশমিক ৫ ভাগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হবে। আর এটা কোনো অবাস্তব লক্ষ্য নয়। কারণ, জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (ইউনেস্কো) ঐতিহাসিক সৌধ, মিউযিয়াম ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক আকর্ষণীয় নিদর্শনাদির বিচারে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানকে বিশ্বের মধ্যে সপ্ত স্থানের অধিকারী বলে চিহ্নিত করেছে। আর এ পর্যটন সম্ভাবনাকে বিকশিত ও এর বিকাশের দ্রুতায়নের লক্ষ্যে ঐতিহাসিক সৌধ ও অন্যান্য স্থাপত্য নিদর্শন ও পর্যটন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অবকাঠামো সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারের জন্য ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সরকার ছয়শ’ কোটি ডলার ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
মেহমানদারির জন্য সুপরিচিত ইরানী জনগণ এবং সেই সাথে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সরকার ইরানের বিপুল পর্যটন আকর্ষণ উপভোগ করার জন্য আপনাকে প্রতি বছর ইরান সফরের জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।

মুক্ত বাণিজ্য এলাকা
পুনঃরফতানি এলাকার ভূমিকার পাশাপাশি প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে শুল্ক মুক্ত বাণিজ্যিক তৎপরতার জন্য মুক্ত বাণিজ্য এলাকার গুরুত্ব খুবই বেশি। এ কারণেই ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সরকার মুক্ত বাণিজ্য এলাকা গড়ে তুলেছে। সেই সাথে সরকার কারিগরি, প্রযুক্তি ও শিল্প ক্ষেত্রে উন্নয়নের পথে বিদ্যমান যে কোনো ধরনের জটিলতার অবসান ঘটিয়েছে। ফলে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান এক ব্যাপক উন্নয়নের পথে পা বাড়াতে সক্ষম হয়েছে।
ইরানের রয়েছে বিশাল তেল ও গ্যাস সম্পদ। এ কারণে ইরান সব সময়ই একটি সাশ্রয়ী বাজার হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এই সাথে বর্তমানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বিশেষ করে তেল, গ্যাস, পেট্রোকেমিক্যাল, ইস্পাত, বিদ্যুত প্রভৃতি ক্ষেত্রে যেভাবে শিল্প ও উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে তার ফলে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান অচিরেই একটি অনেক বড় শক্তিশালী বাজারে পরিণত হবে বলে আশা করা যায়।

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে নারীর মর্যাদা ও ভাগ্যোন্নয়ন
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে নারীরা সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সকল প্রকার তৎপরতা চালোনোর ব্যাপারে পুরুষদের সাথে সমতা ও সম্মানের অধিকারী। তারা উৎপাদন মূলক ভূমিকা পালনের পাশাপাশি মর্যাদার সাথে জীবন যাপন করছে।
স্মর্তব্য যে, প্রায় পুরো বিংশ শতাব্দীব্যাপী ইরানী নারীরা মানবিক ও রাজনৈতিক অধিকারের জন্য সংগঠিত হয়েছে ও আন্দোলন করেছে। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিককার সংবিধান বিপ্লবে (মাশ্রূত্বাহ্) অংশগ্রহণ থেকে শুরু করে শতাব্দীর শেষ দিকে এসে স্বৈরাচারী শাহ্কে উৎখাতকারী ইসলামী বিপ্লবে তারা ব্যাপকভাবে ও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে। বিশেষ করে ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-এর নেতৃত্বে সংঘটিত ইসলামী বিপ্লবে তারা অত্যন্ত শক্তিশালীভাবে অংশগ্রহণ করে।
ইসলামী বিপ্লব বিজয়ী হওয়ার পরে ইরানে ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ইসলামী মানদ- ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে ইরানী সমাজকে পুনর্গঠিত করা হয়।
স্মর্তব্য যে, ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ী হবার আগে রাজতান্ত্রিক যুগের ইরানের সংস্কৃতি ছিল পুরোপুরিভাবে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত- যে পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে নারীকে একটি বাণিজ্যিক ভোগ্যপণ্য হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামী বিপ্লবোত্তর ইরানে আমদানি করা বিজাতীয় সংস্কৃতির পরিবর্তে প্রকৃত ইসলামী আদর্শ ও সংস্কৃতি প্রচলনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়- যে আদর্শে ও সংস্কৃতিতে নারীকে অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখা হয় এবং তাকে সমস্ত অধিকার প্রদান করা হয়।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনার ১১১ নম্বর ধারা অনুযায়ী সরকারের অন্যতম কর্তব্য হচ্ছে সমাজে নারীদের ভূমিকা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সকল প্রকার পদক্ষেপ গ্রহণ করা, নারীদের জন্য প্রয়োজনীয় সকল প্রকার সুযোগ- সুবিধা সৃষ্টি করা এবং সকল কাজে তাদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সরকার সর্বোত্তমভাবে এ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। বস্ততঃ ইসলামী সরকার ও ইসলামী প্রজাতন্ত্রের নীতিনির্ধারকগণ যে নারী সমাজের উন্নয়ন ও মর্যাদা বৃদ্ধির ব্যাপারে আগ্রহী ও তৎপর তার প্রচুর দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যেতে পারে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে নারীরা দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে পুরোপুরি সক্রিয় এবং তাঁরা সরকারের বিভিন্ন উচ্চ পদে এবং সরকারী ও বেসরকারী অফিসসমূহে বহু গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত। দেশের পার্লামেন্ট (মজলিসে শূরায়ে ইসলামী), প্রেসিডেন্টের দফতর ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে নারীদের ব্যাপক ও শক্তিশালী উপস্থিতি হচ্ছে এর অল্প কয়েকটি দৃষ্টান্ত। অন্যদিকে বেসরকারী ক্ষেত্রে, নারীরা বিভিন্ন ধরনের অনেক বেসরকারী প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন যেগুলো সমাজের অত্যন্ত প্রভাবশালী কেন্দ্র এবং সেই সাথে তাঁরা বিভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও জনকল্যাণ মূলক অঙ্গনে ব্যাপকভাবে সক্রিয়।
তবে এসব ক্ষেত্রে ইরানী নারীদের অংশগ্রহণ তাদেরকে ভারসাম্যহীন ও একদেশদর্শীতে পরিণত করতে পারে নি। এটা অনস্বীকার্য যে, সমাজ সংস্থার গঠন উপাদানসমূহের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক উপাদান হচ্ছে পরিবার। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও অন্যান্য কর্মকাণ্ডে  ইরানী নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ইরানের পারিবারিক ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে নি।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান কেবল সাংবিধানিকভাবে ও আইন প্রণয়নের মাধ্যমে নারীদের মর্যাদার উন্নয়ন, সকল ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণ ও পারিবারিক ব্যবস্থার মর্যদার হেফাযতের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে ক্ষান্ত থাকে নি, বরং এ লক্ষ্যে বহু বাস্তব ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। পারিবারিক ব্যবস্থার স্বার্থে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সরকার শিশুদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় এবং তাদের বিকাশ ও বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ হতে একদিকে যেমন কর্মজীবী নারীদের শিশু সন্তানদের জন্য নার্সারি সুবিধার নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে, অন্যদিকে তারা যাতে খুব তাড়াতাড়ি তাদের পরিবারের সাথে মিলিত হতে পারে সে লক্ষ্যে সরকারী অফিসগুলোতে নারীদের জন্য কর্মঘণ্টা কমিয়ে দেয়া হয়েছে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে নারীদের অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা এ সীমিত পরিসরে সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে দৃষ্টান্ত হিসেবে কেবল একটি তথ্য উল্লেখ করাই যথেষ্ট। খ্রিস্টীয় ২০১২ সালে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের মোট জনসংখ্যার মধ্যে নারীদের হার ছিল শতকরা ৪৯ দশমিক ৬ ভাগ এবং পুরুষদের হার ছিল শতকরা ৫০ দশমিক ৪ ভাগ, কিন্তু ঐ বছর ইরানী শিক্ষার্থীদের মধ্যে উচ্চ শিক্ষায় পুরুষ শিক্ষার্থীদের হার ছিল শতকরা ১৮ দশমিক ২ ভাগ এবং এর বিপরীতে নারী শিক্ষার্থীদের হার ছিল শতকরা ১৮ দশমিক ৪ ভাগ।

পারমাণবিক শক্তি সংক্রান্ত কার্যক্রম
যেসব বিষয়কে কেন্দ্র করে কতক পশ্চিমা দেশ ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানকে বিতর্কিত করার জন্য অপচেষ্টা চালাচ্ছে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে পুরোপুরি শান্তিপূর্ণ লক্ষ্যে পরিচালিত ইরানের পারমাণবিক তৎপরতা।
ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের পরে তৎকালীন মার্কিন সরকার তেহরানের পরমাণবিক চুিল্লর জন্য প্রয়োজনীয় পারমাণবিক জ্বালানি সরবরাহ করার ব্যাপারে তখনকার শাহী সরকারের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। কিন্তু বিপ্লবের বিজয়ের পরে আমেরিকা চুল্লিটিতে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এছাড়া ইউরোপে ইরানের ৬০ টন ইউএফ-৬ ছিল; তা এখনো ইরানকে সরবরাহ করা হয় নি। ইরান তার বুশেহ্র পারমাণবিক চুল্লির জন্য সিমেন্স কোম্পানির কাছ থেকে যে প্রাথমিক জ্বালানি ক্রয় করেছিল, ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের পরে তা বাযেয়াপ্ত করা হয় এবং এ অবস্থায় ২৬ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর এ পণ্যটি ইরানে রফতানির জন্য ইস্যুকৃত সরকারী রফতানি পারমিট বাতিল করা হয়। এছাড়া ইউরোডিফ্ এন্রিচ্মেন্ট ফ্যাক্টরির শতকরা দশ ভাগের মালিকানা ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের হওয়া সত্ত্বেও চিকিৎসা কার্যে ব্যবহার্য রেডিও-আইসোটপ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় হলেও ইরানকে উক্ত কারখানা থেকে আজ পর্যন্ত এক গ্রাম ইউরেনিয়ামও দেয়া হয় নি।
পাশ্চাত্যের এসব অন্যায় আচরণের প্রেক্ষাপটে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান স্বীয় প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কার্যক্রমের ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা অর্জনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম পুরোপুরি শান্তিপূর্ণ এবং ইরান সব সময়ই আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ)র তদারকীর অধীনে স্বীয় পারমাণবিক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম পুরোপুরি শান্তির লক্ষ্যে নিবেদিত হওয়ায় তা কোনো দেশের জন্যই কোনোরূপ হুমকির সৃষ্টি করে নি। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা এবং সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাগণ বার বার ঘোষণা করেছেন যে, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিরক্ষা নীতিতে ব্যাপক ধ্বংসাত্মক অস্ত্রের (ডব্লিউএম্ডি) কোনো স্থান নেই।
বাস্তব অবস্থা হলো এই যে, যেসব দেশ ব্যাপক ধ্বংসাত্মক অস্ত্রের প্রধান শিকার ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান স্বয়ং সেসব দেশের অন্যতম। এ কারণে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান হচ্ছে প্রথম দেশ যে দেশটি মধ্যপ্রাচ্যকে পারমাণবিক অস্ত্র থেকে মুক্ত রাখার পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে প্রস্তাব দিয়েছে এবং ইরান তার এ অবস্থানে অনড় রয়েছে ও এ বিষয়টির ওপর বার বার গুরুত্ব আরোপ করেছে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক নীতি ও দেশটির শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কার্যক্রম সম্বন্ধে যে বিভ্রান্তির ধূম্রজাল তৈরি করা হয়েছে তার অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে ইসলামী সরকার সর্বোচ্চ সংযম ও সদিচ্ছা প্রদর্শন করেছে। এ লক্ষ্যে ইরান সরকার আস্থা সৃষ্টিকারী পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে এতোদূর অগ্রসর হয়েছে যা তার দায়িত্বের চেয়ে অনেক বেশি।
প্রকৃতপক্ষে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সরকার আইএইএ-র পরিদর্শকদের ও সংশ্লিষ্ট অন্য সকলের সাথে সর্বোচ্চ মাত্রায় সহযোগিতা করেছে। এ ব্যাপারে ইরান সব সময়ই, ‘আরো কোনো অস্পষ্টতা থেকে থাকলে’ আলাপ- আলোচনার মাধ্যমে তার সমাধান করার জন্য স্বীয় প্রস্তুতির কথা ঘোষণা করে আসছে।
আইএইএ-র পরিদর্শকগণ নিয়মিত ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো  ও এগুলোর কার্যক্রম পরিদর্শন করে চলেছেন। এছাড়া ইরান সরকার স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বীয় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সংক্রান্ত সকল কার্যক্রম আড়াই বছরেরও বেশি কালের জন্য স্থগিত রাখে। আইএইএ-র পরিদর্শকদেরকে ইরানের সকল পারমাণবিক স্থাপনা ও পারমাণবিক উপাদান পরিদর্শনের জন্য অবারিত সুযোগ প্রদান করা হয়। এছাড়া স্থাপনাগুলোতে তাঁদেরকে বিধিবদ্ধ তৎপরতার বাইরেও অতিরিক্ত তৎপরতা চালাবার সুযোগ দেয়া হয়। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান এর সবকিছুই করেছে অস্পষ্টতা ও সন্দেহ- সংশয় দূর করার উদ্দেশ্যে।
অন্যদিকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান এখনো ‘সামগ্রিক নিরাপত্তা চুক্তি’ (Comprehensive Safeguards Agreement) অনুযায়ী সমস্ত বাধ্যবাধকতা মেনে চলছে। বস্তুতঃ উক্ত চুক্তি অনুযায়ী আইএইএ-র পরিদর্শন কার্যক্রম যথাযথভাবে এবং কোনো রকম বাধাবিঘœ বা বিলম্ব ছাড়াই অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া আইএইএ-র মহাপরিচালক বার বার ঘোষণা করেছেন যে, সংস্থাটি ইরানে অবস্থিত ঘোষিত পারমাণবিক পদার্থ স্থানান্তরিত না করার বিষয়টি তদন্ত করে দেখতে সক্ষম এবং এসব কার্যক্রম শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে ব্যবহারের আওতায় রয়েছে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিপক্ষ ভালোভাবেই জানে যে, ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ কেবল বিরূপ প্রতিক্রিয়াই সৃষ্টি করবে এবং তার সাহায্যে কোনোভাবেই ইরানকে তার ন্যায্য অধিকার ও বৈধ পারমাণবিক কার্যক্রম থেকে বিরত রাখা যাবে না। তাই ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান আশা করে যে, তার প্রতিপক্ষ সাম্প্রতিক জেনেভা অ্যাকশন্ প্লানের কাঠামোর আওতায় এতে সৃষ্ট সুযোগের সর্বোত্তম ব্যবহার করবে এবং অযথা সৃষ্ট সঙ্কটের সমাধানের সর্বোচ্চ যুক্তিসঙ্গত ও চূড়ান্ত সমাধান উদ্ভাবনের লক্ষ্যে উভয় পক্ষের জন্যই লাভজনক উপসংহারকামী মূলনীতির ভিত্তিতে সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা সহকারে গুরুত্বের সাথে আলোচনা চালাবে।

ন্যানোটেকনোলজি
ন্যানোটেকনোলজি হচ্ছে একটি সর্বোচ্চ বহুমুখী প্রযুক্তিক ক্ষেত্র যা দ্বারা ব্যাপকভিত্তিক একটি ফলিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রকে বুঝানো হয়ে থাকে যার সমন্বিত সারকথা হচ্ছে পারমাণবিক ও মলিক্যুলার পরিমাপকের সাহায্যে পদার্থের নিয়ন্ত্রণÑ যে পরিমাপক সাধারণভাবে ১ থেকে ১০০ ন্যানোমিটার হয়ে থাকে, আর সেই সাথে এতদসংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি তৈরি।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে খ্রিস্টীয় ২০০১ সালের শুরুর দিক থেকে ন্যানোটেকনোলজির কার্যক্রম শুরু হয়। অতঃপর দেশের প্রেসিডেন্টের নির্দেশক্রমে ২০০৩ সালের আগস্ট মাসে ন্যানোটেকনোলজি কার্যক্রমকে যথাযথভাবে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে ইরান ন্যানোটেকনোলজি ইনিশিয়েটিভ্ (আইএন্আই) অনুমোদিত হয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ভাইস প্রেসিডেন্টকে এর প্রধান করা হয় এবং এর সদস্য করা ছয় জন মন্ত্রী ও পাঁচজন সিনিয়র ন্যানোটেকনোলজি বিশেষজ্ঞকে।
এরপর ২০০৫ সালের জুলাই মাসে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সরকারের কেবিনেট মন্ত্রীদের বৈঠকে প্রথম জাতীয় ন্যানোটেকনোলজি পরিকল্পনা গৃহীত হয় এবং অবিলম্বে এর বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু হয়। দুই বছরের স্বল্প মেয়াদ, পাঁচ বছরের মধ্যম মেয়াদ ও দশ বছরের দীর্ঘ মেয়াদে বিন্যস্ত এ কৌশলগত পরিকল্পনাটির বাস্তবায়ন চলতি ২০১৪ সালে শেষ হবে। এ পরিকল্পনার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানকে ন্যানোটেকনোলজির ক্ষেত্রে বিশ্বের ১৫টি শীর্ষস্থানীয় দেশের অন্যতমে উন্নীত করা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে এ অবস্থানের অধিকতর উন্নয়নের জন্য চেষ্টা চালানো।
বর্তমানে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে পনেরটিরও বেশি কোম্পানি ন্যানোটেকনোলজি ক্ষেত্রে তৎপরতা চালাচ্ছে। এ কোম্পানিগুলোর অর্ধেক ব্যাপকভিত্তিক উৎপাদনের পর্যায়ে রয়েছে এবং বাকি অর্ধেক তাদের চূড়ান্ত উৎপাদিত পণ্যকে বাজারজাতকরণের পর্যায়ে রয়েছে।
যেহেতু ন্যানোটেকনোলজির সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন প্রতি বছর একটি দেশের সকল ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক উন্নয়নের সাথে সম্পর্কযুক্ত সেহেতু আইএন্আই-এর জরীপ ও বিশ্লেষণ গ্রুপ প্রতি বছর এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের কার্যক্রম সংক্রান্ত তথ্য ও উপাত্তের সাহায্যে দেশের ন্যানোটেকনোলজি বিষয়ক গবেষণা প্রবন্ধসমূহ মূল্যায়ন করে এবং এ ক্ষেত্রে আইএস্আই-এর তথ্য ব্যাংকের সাহায্য নেয়া হয়। এভাবে ন্যানোটেকনোলজির ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের তুলনায় ইরানের ক্রম নির্ধারণ করা হয়।
এভাবে মূল্যায়নের ফলাফলে দেখা যায় যে, এ ক্ষেত্রে খ্রিস্টীয় ২০০১ সালে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ক্রমিক অবস্থান ছিল ৫২তম এবং ঐ বছর সারা বিশ্বের ন্যানোটেকনোলজি কার্যক্রমে ইরানের অংশ ছিল মাত্র শূন্য দশমিক শূন্য আট শতাংশ (০.০৮%), আর এ সংক্রান্ত গবেষণা প্রবন্ধের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৭টি। কিন্তু ২০০৭ সালে এ ক্ষেত্রে ইরানের ক্রমিক অবস্থান দাঁড়ায় ২৫তম এবং বিশ্বের ন্যানোটেকনোলজি কার্যক্রমে ইরানের অংশ দাঁড়ায় শূন্য দশমিক সাত নয় ভাগে (০.৭৯%)। আর এ বছর ইরানে রচিত এ বিষয়ক গবেষণা প্রবন্ধের সংখ্যা ছিল ৪৬৫টি।
২০০১ সালের তুলনায় ২০০৭ সালে ন্যানোটেকনোলজি বিষয়ক গবেষণা প্রবন্ধের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের ক্রমিক অবস্থানের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় যে, ন্যানো- বিজ্ঞান উৎপাদনের ক্ষেত্রে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সর্বোচ্চ বার্ষিক অগ্রগতির অধিকারী হয়েছে; এ সময়ে এ ক্ষেত্রে ইরানের গড় বার্ষিক অগ্রগতির পরিমাণ ছিল শতকরা ৮০ দশমিক ০২ ভাগ (৮০.০২%)। এ ক্ষেত্রে উন্নয়নের ব্যাপারে ইরানের পরের অবস্থানে ছিল যথাক্রমে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, পর্তুগাল, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া ও নরওয়ে।
একই সময়ে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে ন্যানোটেকনোলজি বিষয়ক গবেষণা প্রবন্ধের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে এ বিষয়ক গবেষণা প্রবন্ধসমূহের মানেরও উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন ঘটে। গবেষণা প্রবন্ধসমূহের প্রতিটির মানের গড়ের ভিত্তিতে দেখা যায় যে, এ ক্ষেত্রে ২০০১ সালে ইরানের অবস্থান ছিল বিশ্বর মধ্যে ৪৩তম এবং ২০০৬ সালে তা দাঁড়ায় ২৫তম, আর ঐ বছর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের অবস্থান দাঁড়ায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহের মধ্যে সর্বশীর্ষে।

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পররাষ্ট্র নীতি
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পররাষ্ট্র নীতির প্রধান লক্ষ্যসমূহ হচ্ছে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়ন এবং ব্যাপক ভিত্তিতে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উন্নয়ন আর ইরান তার এসব লক্ষ্য অর্জনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিগত বছরগুলোতে পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের গুরুত্বপূর্ণ অর্জনসমূহের অন্যতম হচ্ছে আঞ্চলিক উত্তেজনা প্রশমনের লক্ষ্যে বিভিন্ন কৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান বিশ্বের বিভিন্ন মহাদেশের বেশির ভাগ দেশের সাথেই গঠনমূলক ও আন্তঃক্রিয়ামূলক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছে। এছাড়া ইরান বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংস্থার সদস্য। এগুলো হচ্ছে : জাতিসংঘ, ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি), জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন (ন্যাম), এডিসি, সাংহাই গ্রুপ, ডি-৮, অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংস্থা (ইসিও) ইত্যাদি। স্থিতিশীলতা সৃষ্টির লক্ষ্যে আঞ্চলিক বিরোধ ও সংঘাতসমূহ নিরসনে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বিশেষ করে ইরাকে ও আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়াসের ক্ষেত্রে ইরানের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অধিকন্তু পারস্য উপসাগর এলাকার ও এশিয়া মহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের সাথে ইরান তার সম্পর্কের যথেষ্ট উন্নয়ন করেছে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সব সময়ই উত্তেজনা ও সঙ্কটের বিরোধী এবং যে কোনো ধরনের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিশ্বাসী। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে ও বৈশ্বিক অঙ্গনে ইরান যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে চলেছে তার অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সন্ত্রাসবাদ।
ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের পর থেকেই ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সন্ত্রাসবাদের শিকার হয়ে আছে। ইরানের বহু দ্বীনী ও রাজনৈতিক নেতা, ইসলামী চিন্তাবিদ, গুরুত্বপূর্ণ সরকারী কর্মকর্তা, বিজ্ঞানী ও বহু সাধারণ মানুষ সন্ত্রাসবাদীদের ঘৃণ্য সহিংসতার শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে ইরানের ইসলামী সরকার শুরু থেকেই বার বার ঘোষণা করে আসছে যে, সন্ত্রাসবাদী হামলা ও নিরীহ মানুষের হত্যা যে কোনো ধরনের বা যে কোনো নামেই হোক না কেন ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান তার নিন্দা করে এবং ইরান সরকার বিশ্বব্যাপী সমভাবে ও যে কোনো ধরনের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য আহ্বান জানিয়ে আসছে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান মনে করে যে, বেছে বেছে কতক সুসংগঠিত সন্ত্রাসবাদী তৎপরতার বিরুদ্ধে লড়াই ও কতক সুসংগঠিত সন্ত্রাসাদী তৎপরতাকে উপেক্ষা করার পরিবর্তে নির্বিশেষে এ অশুভ উপাদানটির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে এবং সেই সাথে কোনো ধরনের সন্ত্রাসবাদেরই যাতে উত্থান না ঘটে সে লক্ষ্যে এর পিছনে নিহিত কারণ ও ভিত্তিসমূহ, যেমন : দারিদ্র, বেকারত্ব, বৈষম্য, অন্যের ভূমি জবরদখল ইত্যাদিকে চিহ্নিত করতে ও দূরীভূত করতে হবে যাতে মানব প্রজন্ম তাদের উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ও নিরাপত্তা সহকারে বসবাস করতে পারে।

অনুবাদ : মোহাম্মাদ আবূ মাসউদ


‘এস-২০০ ব্যবস্থায় নিজস্ব ক্ষেপণাস্ত্র বসিয়েছে ইরান’

এস-২০০ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থায় নিজস্ব প্রযুক্তির ক্ষেপণাস্ত্র বসিয়েছে ইরান। সাইয়্যাদ বা হান্টার-৩ নামের এ ক্ষেপণাস্ত্র ইরানের বিজ্ঞানীরা তৈরি করেছেন এবং এটা অত্যন্ত নিখুঁতভাবে দ্রুতগতিতে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে।S-200, saiyed missle

ইরান ২০১০ সালের নভেম্বর মাসে দেশে তৈরি এস-২০০ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার সফল পরীক্ষা চালায়।

খাতামুল আম্বিয়া বিমান ঘাঁটির ডেপুটি কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহরুখ শাহরাম আজ (শনিবার) জানিয়েছেন, সাইয়্যাদ-৩ ক্ষেপণাস্ত্রকে এস-২০০ ব্যবস্থার উপযোগী করে উন্নয়ন ঘটানো হয়েছে। এ ক্ষেপণাস্ত্র মধ্য আকাশের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারবে। মধ্যম পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সাইয়্যাদ-২ এর উন্নত সংস্করণ হচ্ছে সাইয়্যাদ-৩।

জেনারেল শাহরাম আরো জানান, দেশে তৈরি মেরসাদ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থায় আগে শালামচেহ ক্ষেপণাস্ত্র যোগ করা হয়েছিল কিন্তু এখন খাতামুল আম্বিয়া ঘাঁটির বিশেষজ্ঞরা মেরসাদ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থায় সাইয়্যাদ-২ ক্ষেপণাস্ত্র বসিয়েছেন। সাইয়্যাদ-২ হচ্ছে ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ৩৫০ কিলোমিটার পাল্লার একটি ক্ষেপণাস্ত্র যা আকাশে শত্রুর ক্ষেপণাস্ত্রসহ বিভিন্ন ধরনের হেলিকপ্টার, ড্রোন ও ছোট আকারের রাডার ধ্বংস করতে পারে।

রেডিও তেহরান, ২৬ এপ্রিল, ২০১৪


তেহরান পরমাণু চুল্লির সর্বাধুনিক কন্ট্রোল রুম উদ্বোধন

জাতীয় পরমাণু প্রযুক্তি দিবস উপলক্ষে ‘তেহরান পরমাণু চুল্লি’র সর্বাধুনিক কন্ট্রোল রুম উদ্বোধন করা হয়েছে। এটাকে ইরানের পরমাণু প্রযুক্তির ক্ষেত্রে একটি বড় অগ্রগতি হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে।ali akber salehi about nuclear technology

পরমাণু চুল্লির সর্বাধুনিক কন্ট্রোল রুমটি ইরানেই নির্মাণ করা হয়েছে এবং এটি নির্মাণে প্রায় চার বছর সময় লেগেছে। জাতীয় পারমাণবিক শক্তি সংস্থার প্রধান আলী আকবর সালেহি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, তেহরান পরমাণু চুল্লির কন্ট্রোল রুমের উদ্বোধন পরমাণু কর্মসূচির ক্ষেত্রে আরেক ধাপ অগ্রগতি।

তিনি বলেন, তেহরান পরমাণু চুল্লির কন্ট্রোল রুমে ব্যবহৃত প্রযুক্তিটি ছিল প্রায় ৫০ বছর আগের। এখানে অ্যানালগ সিস্টেমে তথ্য সংগ্রহ করা হতো। কিন্তু এখন এনালগ ও ডিজিটাল সিস্টেমের সমন্বয়ে সর্বাধুনিক কন্ট্রোল রুম তৈরি করা হয়েছে। পরমাণু ক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্য বিভিন্ন অঙ্গনে কাজে লাগানো হবে বলেও তিনি জানান।

রেডিও তেহরান, ১০ এপ্রিল, ২০১৪


‘ইরান-ওমান সামরিক সম্পর্ক মধ্যপ্রাচ্যে নিরাপত্তা জোরদার করবে’

ইরান ও ওমানের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা ক্রমেই বাড়ছে। আজ (মঙ্গলবার) ওমানে নিযুক্ত ইরানের সামরিক অ্যাটাচে ক্যাপ্টেন মুহাম্মদ রেজা পুরজাসেম বলেছেন, দুই দেশের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা মধ্যপাচ্যে শান্তি ও নিরাপত্তা জোরদার করতে পারে। তিনি আরও বলেছেন, ইরান ও ওমানের মধ্যে সামরিক সম্পর্ক অতীতের ভ্রাতৃত্ব ও মর্যাদার ওপর নির্ভরশীল।relation between Iran and Oman

জাতীয় সেনাবাহিনী দিবস উপলক্ষে মাসকাটে অবস্থিত ইরানি দূতাবাসে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। পুরজাসেম আরও বলেছেন, দুই দেশের মধ্যে যৌথ সামরিক কমিটি গঠন, যৌথ নৌমহড়ার আয়োজন ও সামরিক ক্যাডেট বিনিময়ের ঘটনা তেহরান ও মাসকাটের মধ্যে শক্তিশালী সামরিক সহযোগিতারই প্রমাণ। দুই দেশের নেতারাই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চায় বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।

গত মাসে ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি ওমান সফর করেছেন। এ সময় দুই দেশের শীর্ষ নেতারা সামরিক সম্পর্ক জোরদারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

তেহরান রেডিও, ২২ এপ্রিল, ২০১৪


ইরানে খোদায়ী বালু-সেনারা অলৌকিকভাবে হারিয়ে দেয় আমেরিকাকে

আজ থেকে ৩৪ বছর আগে ১৯৮০ সালের এই দিনে ইরানে হামলা করতে আসা ৫ টি মার্কিন সামরিক বিমান ও হেলিকপ্টার অলৌকিক ধূলি-ঝড়ের শিকার হয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। তাবাস মরুতে পড়ে থাকে সেইসব সামরিক বিমান ও হেলিকপ্টারের জ্বলন্ত ধ্বংসাবশেষসহ পাইলট, নিহত কমান্ডো সেনা আর ক্রুদের পুড়ে যাওয়া দেহ।ৃanother image of tabas morubumi

রাতের আঁধারে পরিচালিত এই হামলার উদ্দেশ্য ছিল তেহরানে বিপ্লবী ছাত্রদের হাতে দখল হওয়া মার্কিন দূতাবাস এবং সেখানে গুপ্তচরবৃত্তির জন্য অভিযুক্ত ও আটক মার্কিন কূটনীতিকদের উদ্ধার করা। তেহরানস্থ তৎকালীন মার্কিন দূতাবাস ইরানের ইসলামী সরকারসহ এ অঞ্চলের জনগণের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র ও গুপ্তচরবৃত্তির আস্তানা হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকায় বিপ্লবী ছাত্ররা তা দখল করে নেয় এবং কূটনীতিকের ছদ্মবেশধারী মার্কিন গুপ্তচরদেরকে ৪৪৪ দিন পর্যন্ত আটক করে রাখে। এখানে তারা অস্ত্র ও গুপ্তচরবৃত্তির নানা সামগ্রী এবং নানা ষড়যন্ত্রের দলিল-প্রমাণ উদ্ধার করে। অবশ্য মার্কিন সরকার ও তাদের স্থানীয় অনুচররা কৌশলে বহু দলিল ধ্বংস করে ফেলে।
এই ঘটনার পর মার্কিন সরকার ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। তাবাসে হামলা ব্যর্থ হওয়ায় তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ও তার ডেমোক্রেট দল আমেরিকার নির্বাচনে ভরাডুবির শিকার হয়।

ইরানের ইসলামী বিপ্লবের রূপকার মরহুম ইমাম খোমেনী (র.) এই ঘটনাকে ইসলামী এই দেশের জন্য আল্লাহর অদৃশ্য সাহায্য বলে উল্লেখ করেন। তিনি অলৌকিক এই ঘটনাকে আবাবিল পাখির মাধ্যমে আবরাহার বিশাল হস্তি-বাহিনী ধ্বংস হওয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন যা পবিত্র কুরআনের সুরা আল ফিলে উল্লেখ করেছেন মহান আল্লাহ। আবরাহার বাহিনী পবিত্র কাবা ঘর ধ্বংস করতে এসেছিল। ইমাম খোমেনী (র.) তাবাস মরুর ধূলি বা বালুকে খোদার নিযুক্ত বালু-সেনা বলে উল্লেখ করেন।

রেডিও তেহরান, ২৫ এপ্রিল, ২০১৪


ইরানে পালিত হচ্ছে তাবাস মরুভূমিতে মার্কিন ব্যর্থ অভিযানের বার্ষিকী

আজ (শুক্রবার) ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের তাবাস মরুভূমিতে মার্কিন বাহিনীর ব্যর্থ অভিযানের ৩৪তম বার্ষিকী পালিত হচ্ছে। পারস্য উপসাগর থেকে চালানো এ অভিযানের মাধ্যমে তেহরানস্থ মার্কিন দূতাবাসের আটক কর্মীদের উদ্ধারের পরিকল্পনা করেছিল মার্কিন বাহিনী। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লব সফল হওয়ার পর তেহরানের মার্কিন দূতাবাসের এসব কর্মীকে গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে আটক করা হয়।tabas morubumi

আমেরিকার ব্যর্থ এ অভিযানের বার্ষিকী উপলক্ষে একটি মসজিদে আয়োজিত আজকের বিশেষ অনুষ্ঠানে তাবাস শহর ও আশপাশের এলাকার শত শত মানুষ অংশ নিয়েছেন। ইরানের সংসদ স্পিকার ড. আলী লারিজানিসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

১৯৮০ মালের ২৫ এপ্রিল মার্কিন বাহিনী ওই অভিযান চালায় এবং তা চরমভাবে ব্যর্থ হয়। তারা এ অভিযানের নাম দিয়েছিল ‘অপারশেন ঈগল ক্ল’। রাতের আঁধারে চালানো ওই অভিযান ধূলিঝড়ের কবলে পড়ে এবং বেশ কয়েকটি হেলিকপ্টার, গানশিপ ও জঙ্গিবিমান ধ্বংস হয়। একইসঙ্গে নিহত হয় আট মার্কিন সেনা। পরে এ অভিযান বাতিল করতে বাধ্য হয় মার্কিন বাহিনী।

অভিযান ব্যর্থ হওয়ার পর পরিদর্শনে দেখা যায়- একটি হেলিকপ্টার এবং সি-১৩০ হারকিউলেস পরিবহন বিমান পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ধ্বংস হয়েছে এবং পাঁচটি হেলিকপ্টার ও গানশিপ বালির মধ্যে পড়ে রয়েছে। অভিযানে অংশ নেয় মার্কিন সেনা, বিমান ও নৌবাহিনী এবং মেরিন কমান্ডোরা। সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের আমলে তাবাসের এ ঘটনা ঘটে। অনেকেই মনে করেন- তাবাস মরুভূমির ব্যর্থ অভিযানের কারণে ১৯৮০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিমি কার্টারের ভরাডুবি হয়। তাবাস মরুভূমিতে মার্কিন অভিযান ব্যর্থ হওয়ার ঘটনাকে ইরানিরা তাদের প্রতি আল্লাহর বিশেষ রহমত হিসেবে গণ্য করেন।

২৫ এপ্রিল, রেডিও তেহরান, ২০১৪