ইসলামী সরকারের ভিত্তি রচিত হয় আল্লাহর প্রতি আনুগত্য থেকে-অন্য কিছু থেকে নয়


বিশেষ সাক্ষাৎকার আয়াতুল্লাহ জাভাদী আমোলী

 ধর্ম এবং সরকারের মধ্যে সম্পর্ক

[জার্মানির টিভি চ্যানেল ২-এর প্রধান প্রফেসর স্টুলটে (Stulte) তাঁর দু’জন সহকারীসহ কোম শহরে আসেন। সেখানে তাঁরা হযরত আয়াতুল্লাহ জাভাদী আমোলীর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন।

সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে স্টুলটে জানতে চান ইসলামের দৃষ্টিতে ধর্মের সাথে সরকারের সম্পর্ক কী এবং ইসলামী শাসন ব্যবস্থায় জনগণের ক্ষমতার অবস্থান কোথায়…। তাঁরা বর্তমান সময়ে খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে আয়াতুল্লাহ জাভাদী আমোলীর মতামত জানতে চান। তাঁরা আরও জানতে চান হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) যখন ক্রেমলিনে গর্বাচেভের উদ্দেশ্যে একটি বাণী পাঠিয়েছিলেন সে সময়ে আয়াতুল্লাহ জাভাদী আমোলীর ব্যক্তিগত অনুভূতি কী ছিল। এখানে সাক্ষাৎকারটি মুদ্রিত হলো।]

প্রফেসর স্টুলটে : ধর্ম এবং সরকারের মধ্যে সম্পর্ক কী?

আয়াতুল্লাহ জাভাদী আমোলী : একটি প্রশ্নের জবাব জানা গেলে এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করা সম্ভব। জার্মান টেলিভিশনের একটি অংশের প্রধান হিসাবে আপনি টিভি অনুষ্ঠানের খুঁটিনাটি দিকগুলোর সাথে পরিচিত। যিনি টিভি প্রস্তুত বা নির্মাণ করেন তিনি এর প্রস্তুত ও ব্যবহার প্রণালি সম্পর্কিত একটি পুস্তিকা তৈরি করেন। বিশ্বের স্রষ্টা যিনি তিনিও মানুষের জন্য দিকনিদের্শনা গ্রন্থ দিয়েছেন যাকে আমরা বলি ধর্মগ্রন্থ। হযরত ঈসা (আ.)-এর ওপর অবতীর্ণ ইঞ্জিল আর মহানবী (সা.)-এর ওপর অবতীর্ণ আল কুরআন হলো দু’খানা ধর্মীয় গ্রন্থ। এগুলো দুনিয়ার জীবনের দিক-নিদের্শক গ্রন্থ। যিনি টিভি প্রস্তুত করেন তিনি যেমন সবচেয়ে ভালোভাবে এর ব্যবহারবিধি বলতে পারেন তেমনিভাবে ধর্ম যতটা ভালোভাবে কোন সরকারের রূপরেখা নির্ধারণ করতে পারে অন্য কোনভাবে সেটি সম্ভব নয়।

এ সংক্ষিপ্ত ভূমিকার পর আমি বলতে চাই, ধর্ম মানুষকে অমর করে এমন এক পর্যায়ে উপনীত করে যে, মৃত্যুতেই ধর্মপরায়ণ মানুষের জীবন শেষ হয়ে যায় না। মানুষ গাছ নয় যে, সে ষাট বছর পরে মরে যাবে। বরং মৃত্যু হলো এমন একটা প্রক্রিয়া যার তুলনা চলে খাঁচামুক্ত পাখির সঙ্গে। খাঁচার দরজা খুলে দিলে পাখি যেমন উড়ে যায় তেমনি মৃত্যুতে মানুষের আত্মার মুক্তি ঘটে। এ অর্থে বলতে হয় ধর্ম হলো সমাজ নিয়ন্ত্রণের একটি সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি। এটি মানুষকে শ্রদ্ধা জানায় এবংতাদের মতামতকে মূল্য দেয়। কিন্তু পাশাপাশি এটি মানুষের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে এবং ধর্মীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করে। এ কারণে বলা যায় ধর্ম মানুষকে সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলে এবং মানুষ সরকার ছাড়া চলতে পারে না। ধর্ম একক এবং যৌথ উভয় ধরনের দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ করে থাকে। ধর্মের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরকার গঠিত হবে আল্লাহর নিদের্শিত আইন অনুযায়ী, আল্লাহর তরফ হতে। ধর্মের শিক্ষা হলো, কেউই অন্য একজনের ওপর শাসন করবে না। নবিগণ এবং তাঁদের উত্তরসূরিগণ হলেন স্বর্গীয় আইনের বার্তাবাহক। এ কারণে মানুষ মুক্তি ও শান্তির আইনের প্রতি অনুগত থাকে এবং এ ব্যাপারে তারা নম্রতা প্রকাশ করবে।

এ হলো সরকার এবং ধর্মের সংক্ষিপ্ত চিত্র।

কিন্তু এর সামগ্রিক রূপরেখা এবং কাঠামো নিম্নরূপ :

প্রধানত জ্ঞান এবং বিচার-বিবেচনাবোধকে কেন্দ্র করে সরকার পরিচালিত হয়। বলা হয়, শাসকগণ অবশ্যই সমাজের স্বার্থ সম্পর্কে জানবেন এবং তাদের শ্রমকে কেন্দ্রীভূত করবেন সমাজের স্বার্থ পূরণের লক্ষ্যে। কারণ, সরকারের ভিত্তি রচিত হয় আল্লাহর প্রতি আনুগত্য থেকে, অন্যকিছু থেকে নয়। এটি অবশ্যই সত্যি যে, সরকার হবে জ্ঞান ও বিচারবোধসম্পন্ন।

এ কারণেই যেমন কোন ধরনের অনাচার-অত্যাচার মেনে নিবে না তেমনি নিজেও কাউকে অত্যাচার বা বঞ্চিত করবে না। এ বিষয়ের মূর্ত প্রমাণ হলো আল্লাহর প্রেরিত নবিগণ। সরকারের চালিকাশক্তি ধর্ম হলে এটি মানুষকে উপলব্ধি করতে সহায়তা করে যে, তিনি একমাত্র আল্লাহর আদেশের নিকট মাথা নত করবেন এবং কোন ধরনের যুলুমকে সহ্য করবেন না এবং যুলুমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সত্য প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হবেন। সকল নবীর বাণীর সার কথা হলো : অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে যিনি যুদ্ধ করবেন তিনি হয় গাজী হবেন অথবা শহীদ হবেন। কিন্তু তারা দু’জনেই জয়ী হবেন। যদিও বিশ্বে প্রচলিত দাম্ভিকতা ও ঔদ্ধত্যবাদ ইরানে ধর্ম এবং সরকারের মাঝে চমৎকার সম্পর্ক গড়ে উঠতে দিতে চায় না। ধর্ম এবং সরকার একে অপরকে কিভাবে পরিচালনা করে অর্থাৎ এদের মাঝের সম্পর্কটি ১৩ বছরের সংক্ষিপ্ত সময়ে পরিষ্কারভাবে প্রতিভাত হয়েছে।

রাজনৈতিক সমাজে যে নিপীড়ন, নির্যাতন চলছে এটি নির্ধারণ কে করবে? ধর্ম এবং সরকারের মধ্যে অবিচ্ছেদ্য এক সম্পর্ক রয়েছে, এ বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে যাঁরা গবেষণা করছেন এবং যাঁরা ধর্মীয় আলেম তাঁরা অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কটি নির্ধারণ কাজ করছেন। যখন একজন ব্যক্তি কিংবা কোন সমাজ রোগে আক্রান্ত হয় তখন তার রোগমুক্তির জন্য দক্ষ এবং অভিজ্ঞ একজন চিকিৎসকের প্রয়োজন পড়ে। একইভাবে সমাজ জীবনের সুস্থতা বজায় রাখতে বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ইমাম খোমেইনী (রহ.) কোম শহরে ধর্মীয় বিষয়ে ৪০ বছর গবেষণা করেন এবং উপলব্ধি করেন পাহলভী শাসন ইসলামবিরোধী। তিনি তাঁর এ বোধ বা উপলব্ধিকে ইসলামী উম্মাহর মাঝে ছড়িয়ে দেন। ধর্মে বিশেষ জ্ঞান ও দক্ষতা ছাড়াও তাঁর ছিল নেতৃত্ব দেবার মতো সাহস। সংগ্রাম করার মতো ধৈর্য সহিষ্ণুতাও তাঁর ছিল। তিনি নির্বাসিত হতে বাধ্য হন। প্রথমে তিনি তুরস্কে যান। তারপর ইরাকে। সেখানে অনেকদিন ছিলেন। তাঁর কোন স্বাধীনতা ছিল না।

এক পর্যায়ে ইরাক সরকার বাধ্য হয় ইমাম খোমেইনী (রহ.)-কে দেশ হতে বিতাড়িত করতে এবং অন্য দেশগুলো তাঁকে গ্রহণ না করার আদেশপ্রাপ্ত হয়। অবশেষে এ সম্মানিত ব্যক্তি কুয়েত সীমান্তে চলে যান। কুয়েত তাঁকে প্রবেশ করতে দিল না। এ ঘটনার পর ইমাম খোমেইনী (রহ.) বললেন : ‘আমি যদি এভাবে এক বিমান বন্দর হতে অন্য বিমান বন্দরে যেতে বাধ্য হই তবে আমি এ কথাই বলব যে, যে আল্লাহর রাস্তায় বের হয় আল্লাহ স্বয়ং তাকে সাহায্য করেন।’

নবিগণ এবং হযরত ঈসা (আ.)- যাঁকে আপনারা বিশ্বাস করেন, তাঁদেরকে আল্লাহ সাহায্য করেছেন, ইমাম খোমেইনী (রহ.) তেমনিভাবে আল্লাহর সাহায্য পেলেন। তিনি এমনভাবে ইরানে প্রবেশ করলেন যা কারো ধারণায় ছিল না। নিজেদের সর্বশক্তি প্রয়োগেও পাহলভী শাসক ইমাম খোমেইনীকে প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয় এবং ইমাম খোমেইনী চূড়ান্তভাবে বিজয় অর্জন করেন। ইসলামের আলেমগণ যাঁরা বহু বছর যাবৎ এর চর্চা করেছেন তাঁরা এবার নিপীড়ন দূর করায় আত্মনিয়োগ করলেন।

প্রফেসর স্টুলটে : ধরুন আপনার মতো কেউ কোন একটি অপরাধ করল এটি কে নির্ধারণ করবেন?

আয়াতুল্লাহ জাভাদী আমোলী : এটি নির্ধারণ করার দু’টি উপায় রয়েছে। একটি হলো আইনসিদ্ধ সরকার। অন্যটি ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সরকারের মধ্যে দু’টি প্রতিষ্ঠান বা কমিটি রয়েছে। অভিভাবক পরিষদ রয়েছে, যাদের কাজ সংসদে অনুমোদিত বিষয়াবলিকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করা। অন্যটি হলো দক্ষ ব্যক্তিদের পরিষদ। এই দু’টি আইনসিদ্ধ কমিটির প্রতিটিতে একদল আলেম থাকেন। এবার অন্য দিকটি জানা যাক, যেটি গঠিত হয় একদল দক্ষ আলেম দ্বারা। এঁরা ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। এঁরা এ প্রক্রিয়ার বন্ধু বা সাহায্যকারী রূপে কাজ করেন। এঁরা উপদেষ্টা হিসাবেও কাজ করেন। প্রক্রিয়া বা রীতির কোন দুর্বল দিক খুঁজে পাওয়া গেলে এর সমাধানে যেমন তাঁরা পরামর্শ দেন তেমনিভাবে পুরো প্রক্রিয়াকে গতিশীল করার কাজটিও এঁরা করেন। বোঝার জন্য একটি বিষয় ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। সমাজে এমন কিছু লোক আছে যারা প্রচলিত রীতিনীতির মাঝে দুর্বলতা খুঁজে পায়। কারণ, তারা প্রক্রিয়াটিকে দুর্বল দেখতে চায়। আর অন্যরা রয়েছেন যাঁরা প্রচলিত রীতি-নীতির মাঝে দুর্বলতা খুঁজে পান প্রক্রিয়াটিকে আরো সবল করার প্রত্যয়ে। যেমন ধরুন, একজন ব্যক্তি সুস্থ ও সবল, কিন্তু তার শরীরে একটি ফোড়া হলো, ঐ ব্যক্তি শুধু ফোড়াটিই দেখবে এবং মনে মনে সমস্ত শরীর নিয়ে দুর্ভাবনায় পড়বে। ঐ একই ব্যক্তি চিকিৎসকের নিকট গেলে চিকিৎসক ফোড়াটি দেখবেন। কিন্তু তফাত হলো চিকিৎসক তাকে দুর্বল না ভেবে ঐ ফোড়াটি কী করে ভালো করা যায় তা দেখবেন।

যদি সরকারের মধ্যে কোন দুর্বলতা থাকে তবে আলেমগণ ঐ দুর্বলতাকে দেখবেন চিকিৎসকের দৃষ্টিতে। কিন্তু যারা অনিষ্ট চায় তারা ফোড়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির মতো করে বিষয়টি দেখবে। এর ফলে কি হবে, ইসলামী সরকারের মাঝে কোন ভুল দেখতে পেলে ইসলাম বিষয়ে দক্ষ ব্যক্তিগণ তা দূর করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। অন্য যে দিকটি এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন তা হলো প্রত্যেক সাধারণ ব্যক্তি ভুল করতে তো পারেন, যে কারণে মনুষ্য সমাজে নবীর প্রয়োজন যাঁরা ভুল করেন না। হযরত ঈসা (আ.) কখনো ভুল করেননি। আর আমাদের মহানবী (সা.) কখনো কোন ধরনের ভুল করেননি।

প্রফেসর স্টুলটে : বর্তমান সময়ের খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে আপনার মতামত কী?

আয়াতুল্লাহ জাভাদী আমোলী : বিপ্লব-পূর্ব ইসলামের মতো বর্তমানের খ্রিস্টধর্মের জন্য নেতৃত্ব প্রয়োজন। তথাকথিত মুসলিম দেশের কোন কোন সরকার প্রধান মনে করেন ধর্ম রাজনীতি হতে আলাদা এবং দূরবর্তী কোন বিষয়। ধর্ম যদি রাজনীতি হতে দূরবর্তী কোন বিষয়ই হবে, তবে নবিগণ সংগ্রাম করতেন না এবং শহীদ হতেন না। ইরানে যেভাবে ইমামের আর্বিভাব হলো এবং তিনি যেভাবে হযরত মুহাম্মাদ (সা.) প্রচারিত সত্য ইসলামকে মার্কিনী ইসলাম হতে পৃথক করেছেন একইভাবে খ্রিস্টধর্মে একজন নেতার প্রয়োজন যিনি সত্যিকারের খ্রিস্টধর্মকে মার্কিনী খ্রিস্টধর্মের কবল হতে উদ্ধার করবেন। যিনি আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত তিনি কখনো নিপীড়ন সহ্য করতে পারেন না। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, তিনি বসনিয়া-হার্জেগোভিনা পরিস্থিতি দেখে নিশ্চুপ থাকতে পারেন না। দেখুন আধুনিক বিশ্বে কী হচ্ছে, শক্তিমান বা শক্তিশালী লোক দুর্বলকে শোষণ করছে, অত্যাচার করছে। ইসলাম ও খ্রিস্ট উভয় ধর্মে বলা হয়েছে, কেউ যদি দেখতে পায় অন্য একজন আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে এবং দেখার পরও আঘাতপ্রাপ্তের সাহায্যের জন্য ছুটে যাবে না, তখন যিনি ঘটনাটি দেখবেন তিনিও আঘাতকারীর সম দোষে দোষী হবেন।

এমন আরো অনেক বিষয় রয়েছে যে ব্যাপারে ইসলাম ও খ্রিস্ট উভয় ধর্ম একই ধারণা পোষণ করে। সাম্রাজ্যবাদীরা যদি সঠিকভাবে খ্রিস্টধর্ম চর্চার ব্যবস্থা গ্রহণ করে তবে ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মের মধ্যে অনেক বিষয়ে মিল খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে।

প্রফেসর স্টুলটে : জনাব! আপনি হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর দূত রূপে ক্রেমলিনে গিয়েছিলেন ইমাম খোমেইনীর বাণী নিয়ে। মস্কো পৌঁছে আপনার অনুভূতি কেমন হয়েছিল এবং ক্রেমলিনের জাঁকজমক দেখে ও গর্বাচেভের মুখোমুখি হওয়ার সময় আপনার মনের অবস্থা কেমন ছিল?

আয়াতুল্লাহ জাভাদী আমোলী : যে সংবাদটি আমি বহন করে নিয়ে গিয়েছিলাম ঐটির গুরুত্ব সব ধরনের অনুভূতির ওপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। জাঁকজমকপূর্ণ ক্রেমলিন কিংবা গর্বাচেভের খ্যাতি কোনটাই আমাদের ওপর কোন প্রভাব বিস্তার করেনি। একজন মহান ব্যক্তির দূত হিসাবে আমার সামনে দু’টি বিষয় ছিল : ১. বিষয়টি যাতে যথার্থ মর্যাদা পায়, তার প্রয়োজন ছিল। ২. এই প্রেক্ষাপটে ক্রেমলিনের গৌরব বা গর্বাচেভের খ্যাতি আমার নিকট কোন বিষয় নয়। জাঁকজমকপূর্ণ স্থানটি আমার নিকট প্রকৃত অর্থে একটি সাধারণ মানের ঘিঞ্জি এলাকা মনে হয়েছে। কারণ, পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী আলোচনাটি ছিল প্রতিক্রিয়াহীন, যদিও আলোচনাকালে মি. গর্বাচেভ বলেননি যে, আমরা সঠিক (আমরা যা বলছি), কিন্তু আমি সঠিক বুঝতে পারছিলাম তিনি আমাদের কথাগুলো অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করছেন। আমরা যখন তাঁর ওখানে যাই তখন পর্যন্ত তিনি জানতেন না আমাদের সাথে আনা বার্তাটির মধ্যে কী রয়েছে। ধরে নেয়া হয়েছিল ইরান ওখানে যাবে অর্থনৈতিক সাহায্য চাওয়ার জন্য। বার্তাটি পড়ার পর তিনি ইসলামের ধর্মীয় দিকটি অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করলেন এবং আমাদেরকে যেভাবে আন্তরিকতার সাথে স্বাগত জানিয়েছিলেন একইভাবে বিদায় দিলেন। এ ঘটনার কিছুদিন পরে তিনি বিশেষ দূত মি. প্রিমাকোভকে আমাদের নিকট পাঠালেন। অতঃপর তিনি এখানে এসে আপনি যেখানে বসেছেন ঠিক সে জায়গাতেই বসেছিলেন।

প্রফেসর স্টুলটে : ইসলামী সরকার ব্যবস্থায় জনগণের ক্ষমতা চর্চার অবস্থান কী?

আয়াতুল্লাহ জাভাদী আমোলী : ইরানের জনগণ ইসলাম নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। ইসলামের সাধারণ দিকগুলো তাদের সামনে অত্যন্ত পরিষ্কার হয়ে প্রতিভাত হয়। তারা ইসলাম সম্পর্কে জানে এবং অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে তা পালন করে। খোদা মাফ করুন, এ ৬০ বছর বয়সেও আমি যদি কোন ভুল-ত্রুটি করে বসি, অথচ আমি নিজে ৪০ বছর পর্যন্ত ধর্মতাত্ত্বিক কেন্দ্রসমূহের সাথে সংশ্লিষ্ট আছি, তা হলেও জনগণ আমার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। এর মানে পশ্চিমা মাধ্যমগুলো এ কথা বলতে পারে না যে, আমাদের দেশের কর্মকর্তারা নিজেদের খেয়াল-খুশি মতো সিদ্ধান্ত নেয় এবং তার বাস্তবায়ন ঘটায়।

প্রফেসর স্টুলটে : দু’সপ্তাহ আগে আমি মি. গর্বাচেভের সাথে দেখা করেছি। অতীতের তুলনায় তাকে মনমরা এবং ক্লান্ত মনে হয়েছে। তার এমনটি কেন হলো বলে আপনি মনে করেন?

আয়াতুল্লাহ জাভাদী আমোলী : গর্বাচেভের জন্য যা হয়েছে এমনটা বুশের জন্যও হতে পারে (উল্লেখ্য, এ সময় বুশ ক্ষমতায় ছিলেন)। ফেরদৌসী একজন নামকরা মুসলিম কবি। তাঁর মহাকাব্যে তিনি বলেছেন, ইতিহাসের বিখ্যাত যোদ্ধা রুস্তমের একটি ঘোড়া ছিল। ঘোড়ার পিঠে একটি জিন ছিল যাতে তিনি বসতেন। কোন এক যুদ্ধের ঘটনায় দেখা যায়, তিনি ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী এলো এবং জিনটি মাটিতে নামিয়ে রাখলো (রুস্তম তখনও তাতে ছিলেন) এবং ঘোড়াটি নিয়ে গেল। রুস্তমের ঘুম ভাঙলে সে দেখতে পেল সেখানে ঘোড়াটি নেই। এখানে ফেরদৌসী বলেন,

‘এটিই পৃথিবীর নিয়ম,

কখনো একজন জিনের ওপর বসে

আবার কখনো জিন পিঠে বয়ে নিয়ে যায়।’

একদিন গর্বাচেভ ছিলেন ক্ষমতার আসনে উপবিষ্ট। এখন তিনি আর ক্ষমতায় নেই। আমরা অবশ্যই আমাদের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি মোকাবিলা করব। (আমাদের) কিছু লোক রয়েছেন যাঁদের পদ ব্যতীত অন্য কিছুই নেই। একদিন আমরা সবাই প্রকৃতিগতভাবে কিংবা রাজনৈতিকভাবে আমাদের কাজ থেকে সরে যাব।

পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, সব-কিছুই পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হয়। কোন কিছু হারিয়ে দুঃখ পেও না আবার কোন কিছু পেয়ে আনন্দিত হয়ো না। নিজের মধ্যে এমন কিছু গড়ে তোল যার ধ্বংস নেই। সেটি হলো নৈতিক উৎকর্ষ।

উপসংহারে আমি স্মরণ করব লাইলী ও মজনুর কাহিনী। আমাদের সাহিত্যে নিজামী গাঞ্জভী লিখেছেন :

‘লাইলী অসুস্থ হয়ে পড়ল। সে তার যৌবনের লাবণ্যতা হরাল। তার মা তার বিছানায় বসে তার সর্বশেষ আকাঙ্ক্ষা কী তা জানতে চাইল। লাইলী বলল : “আমার সংবাদটি মজনুকে দিও। তাকে বল, ‘যদি তুমি প্রেমে পড়তে চাও তবে এমন কারো প্রেমে পড়বে যার মৃত্যু নেই।”

নৈতিক উৎর্কষ বা ধর্ম ছাড়া আর যা কিছুর প্রেমেই আমরা অন্ধ হই না কেন তা একদিন চলে যাবে আমাদের রেখে (একই ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে গর্বাচেভের বেলায় যা আপনি দেখতে পেয়েছেন)।

(নিউজলেটার, নভেম্বর ১৯৯৩)