ইরাকের সাথে যুদ্ধ শুরুর ১১ বছর পর জাতিসংঘের রিপোর্ট : ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে ইরাকই হামলাকারী


ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধে ইরাকের সর্বাত্মক হামলার ১১ বছর পর জাতিসংঘ ইরাককে আক্রমণকারী হিসাবে আখ্যায়িত করে। জাতিসংঘের বিদায়ী মহাসচিব জেভিয়ার পেরেজ দ্য কুয়েলার গত ডিসেম্বর মাসে নিরাপত্তা পরিষদে পেশকৃত একটি রিপোর্টে সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, ইরাক ১৯৮০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালিয়েছিল। তিনি রিপোর্টে জোর দিয়ে বলেন, ১৯৮০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ইরানের বিরুদ্ধে হামলাকে জাতিসংঘ সনদ, স্বীকৃত কোন আইন-কানুন ও নীতি, আন্তর্জাতিক আইন কিংবা আন্তর্জাতিক নৈতিকতার কোন নীতি-আদর্শের দৃষ্টিতে মেনে নেয়া যায় না এবং যুদ্ধের দায়-দায়িত্ব অনিবার্যভাবেই ইরাকের উপর বর্তায়।

জাতিসংঘ মহাসচিব দুই পক্ষের প্রদত্ত জবাব, অতীতে দুই পক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে জাতিসংঘের সরকারি দলিলপত্র থেকে সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি এবং নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে প্রাপ্ত মতামতের ভিত্তিতে এই রিপোর্ট প্রণয়ন করেন। রিপোর্টে বলা হয়, এমনকি যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে ইরান যদি ইরাকী ভূখণ্ডে অনধিকার প্রবেশ করেও থাকে তাহলে যুদ্ধের সময়কালে শক্তি প্রয়োগের নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে একের পর এক ইরানী এলাকা ইরাকের দখল করে নেয়াকে কোন যুক্তিতেই মেনে নেয়া যায় না।

নিরাপত্তা পরিষদের ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাবের ৬ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ইরান-ইরাক যুদ্ধের জন্য কে দায়ী তা নির্ধারণ করে রিপোর্ট পেশের দায়িত্ব দেয়া হয় জাতিসংঘ মহাসচিবকে। তিনি ১৯৯১ সালের প্রথমভাগে প্রতিশ্রুতি দেন যে, তাঁর মেয়াদকাল (৩১ ডিসেম্বর, ১৯৯১) শেষ হওয়ার আগেই ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব বাস্তবায়ন করার কাজ সম্পন্ন করবেন। গত ১৪ আগস্ট তিনি ইরান ও ইরাক সরকারকে ৬ নম্বর অনুচ্ছেদের বিষয়বস্তু সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যতদূর সম্ভব বোধগম্য পন্থায় বিস্তারিতভাবে তাঁকে জানানোর জন্য অনুরোধ করেন।

ইরান গত ১৫ সেপ্টেম্বর মহাসচিবকে ব্যাপকভিত্তিক একটি রিপোর্ট প্রদান করে। এতে ইরানের বিরুদ্ধে ইরাকের আগ্রাসনের ঐতিহাসিক ও আইনগত প্রমাণসমূহ বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়। যদিও ইতিমধ্যেই ইরাকী আগ্রাসন একটি সুস্পষ্ট ও প্রতিষ্ঠিত সত্য এবং অনেক আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব তা স্বীকার করেছেন।

ইরাক ২৬ আগস্ট জবাব দেয়। এই জবাবকে পেরেজ দ্য কুয়েলার যথোপযুক্তনয় বলে অভিহিত করেন। সুতরাং গত ১১ বছর ধরে ইরাক যেসব ব্যাখ্যা দিয়েছে মহাসচিব সেগুলোর উপর ভিত্তি করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, এসব ব্যাখ্যা যথেষ্ট বলে মনে হয় না কিংবা বাস্তব বলে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে এগুলো গ্রহণযোগ্যও নয়।

মহাসচিব তাঁর রিপোর্টে আন্তর্জাতিক মানব হিতৈষী আইন লঙ্ঘনের অনেক দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন। তিনি বিশেষ করে বেসামরিক নাগরিকদের উপর ইরাকের রাসায়নিক বোমা ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেন।

জাতিসংঘ মহাসচিব ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাবের অন্যান্য অনুচ্ছেদ বাস্তবায়নে তাঁর প্রচেষ্টা সম্পর্কে একটি রিপোর্ট ডিসেম্বরের প্রথমদিকে পেশ করেন। প্রস্তাবের ৭ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তিনি জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারী জেনারেল আবদুল রহিম আবি ফারাহর নেতৃত্বে দুটি মিশন ইরানে প্রেরণ করেন। এই মিশন দুটির দায়িত্ব ছিল যুদ্ধে ইরানের ক্ষয়-ক্ষতি নিরূপণ এবং পুনর্গঠনে আন্তর্জাতিক প্রয়োজনীয় সাহায্যের হিসাব প্রণয়ন। ফারাহ নিরাপত্তা পরিষদে পেশকৃত তাঁর প্রথম রিপোর্টে চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের ফলে ইরানের যে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে তার বিবরণ তুলে ধরেন। ফারাহর দ্বিতীয় মিশনের কাজ ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সম্পন্ন  হয়েছে এবং তাঁর চূড়ান্ত রিপোর্টে যুদ্ধের ক্ষয়-ক্ষতি ও পুনর্গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদের ব্যাপারে অধিকতর সুস্পষ্ট হিসাব তুলে ধরবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

(নিউজলেটার, জানুয়ারি ১৯৯২)