ইরানে ইসলামী বিপ্লবের ৩৭তম বিজয় বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে ১১ই ফেব্রুয়ারী তেহরানের বিশাল জনসমাবেশে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলেমীন ড. হাসান রুহানি তাঁর দেয়া ভাষণে সব রকমের মতবিরোধকে জাতীয় স্বার্থ ও কল্যাণের পরিপন্থী বলে মন্তব্য করেন এবং বলেন, বিভিন্ন দল-উপদলে দ্বন্দ্ব সংঘাতের সময় এখন নয়; বরং আজকের দিন ঐক্য ও সংহতির দিন। আমাদের সবার উচিত পরস্পর হাতে হাত মিলিয়ে ইসলামী ইরানকে সাজানো।
প্রেসিডেন্ট রুহানি দীর্ঘমেয়াদি পারস্পরিক সহযোগিতার ব্যাপারে রাশিয়া, চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে ইরানের সমঝোতার কথা উল্লেখ করে বলেন, দুনিয়া এখন বুঝতে পেরেছে যে, ইরানী জাতিকে অবরোধ ও তাচ্ছিল্য করার যুগ শেষ হয়ে গেছে। আর ইরানী জাতির সাথে সম্মানবোধ ও মর্র্যাদার সাথে কথা বলতে হবে।
প্রেসিডেন্ট রুহানি বলেন, ইরানের ১১তম সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে দেশের ব্যাপক উন্নয়ন ও উন্নত ইরান গঠন করা। তিনি এই লক্ষ্য বাস্তবায়ন এবং জনগণের অবস্থার উন্নয়নে গৃহীত ব্যাপক কর্মসূচির বর্ণনা দিয়ে বলেন, ইরানের মহান জাতি কোন চাপ বা হুমকির সম্মুখে নত হয় নি এবং ভবিষ্যতেও হবে না। আর আজকে এ কথাটি সব শক্তিই বুঝতে পেরেছে যে, ইরানী জাতির মহানত্বের সম্মুখে সবাইকে নতশির হতে হবে।
প্রেসিডেন্ট গুরুত্ব আরোপ করে বলেন যে, সরকার তার সর্বশক্তি দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি ও সার্বিক অবস্থার উন্নয়ন সাধনের জন্য জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে। আর আগামী বছর হবে ইরানের উন্নতি ও বিকাশের বছর।
ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের প্রধান তাঁর ভাষণে ইরানের বিরুদ্ধে যুলুমপূর্ণ অবরোধ ব্যর্থ হওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, আজ সেদিন এসেছে যেদিন যারা যারা বিদ্বেষের কারণে ও জনগণের বিপ্লবী তৎপরতা সম্বন্ধে ভুল ধারণার বশে কিংবা ক্ষতি সাধনের চিন্তা থেকে ইরানের জনগণের উপর চাপ সৃষ্টি করতে চেয়েছিল তারা সবাই ইরানী জনগণের মাহাত্ম্যের কাছে মাথা নত করেছে। তারা তাদের অতীতের পদক্ষেপসমূহের ব্যাপারে নিরাশ হয়ে গেছে।
ড. রুহানি আরো বলেন, পারমাণবিক সমঝোতার ব্যাপারে ইরানের মহান জনগণের বিজয়ের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বাবাসী বুঝতে পেরেছে যে, এই মহান জাতি শুধু যুদ্ধ ও প্রতিরক্ষার ময়দানে নয়; বরং বিশ্ব পরাশক্তিগুলোর মোকাবিলায় রুখে দাঁড়াতে এবং তাদেরকে পরাজিত ও দিশেহারা করে দিতে পারে; বরং কূটনীতি, যুক্তি ও বিতর্কের ময়দানেও বিশ্ববাসীর মোকাবিলায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের শক্তি রাখে। অনুরূপভাবে সে আপন জাতির অধিকার ও দাবি দাওয়া আদায় করে নিতে সক্ষম। আইনগত ও রাজনৈতিক যুক্তিপ্রমাণ, জাতীয় ঐক্য ও সংহতি এবং রাহবারের দিক-নির্দেশনার ছায়াতলে ইরানী জাতির বিরুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদ ও শাসক পরিষদের সকল অন্যায় প্রস্তাবাবলিকে ইরান ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছে এবং বিশ্ববাসীর সামনে প্রমাণ করেছে যে, ইরান এতদঞ্চলের দেশগুলোর উপর হুমকি সৃষ্টি করতে চায় মর্মে ইরানের বিরুদ্ধে যে প্রচারণা রয়েছে আর ইরান পারমাণবিক অস্ত্র হস্তগত করতে চায় মর্মে যে অপপ্রচার রয়েছে তা সর্বৈব মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।
প্রেসিডেন্ট রুহানি এ কথার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন যে, ইরানের জনগণ হচ্ছে শান্তিপ্রিয় জনগণ, যারা এতদকল ও বিশ্বে শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা জনগণের সহযোগিতা এবং বিপ্লবের দূরদর্শী মহান নেতার দিকনির্দেশনা অনুযায়ী সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিতে সক্ষম হয়েছি। আর দুনিয়াকে এ কথা বুঝিয়ে দিতে পেরেছি যে, ইরানের জনগণ হচ্ছে যুক্তিবাদী ও এতদ অঞ্চলের সকল বন্ধুপ্রতীম দেশের পাশাপাশি শান্তিপ্রিয় জীবন যাপনে বিশ্বাসী একটি জাতি।
ইরানের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের সভাপতি ড. রুহানি তাঁর ভাষণে আরো বলেন, আমরা প্রতিরোধমূলক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে ইরানকে গঠন করব। আজকে আমরা আট কোটি জনশক্তি নিয়ে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী, আত্মমর্যাদাবোধে উদ্বুদ্ধ যুবশক্তি, দেশের অভ্যন্তরের অত্যন্ত শক্তিশালী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণকারী তরুণ প্রজন্মের অধিকারী এবং আমাদের এই সামর্থ্য রয়েছে যে, অর্থনৈতিক ও শিল্পের দিক থেকে সারা দুনিয়ার সাথে প্রতিযোগিতা করতে পারব। আজকে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও ইরানী জনগণের সাথে অংশীদারিত্ব ও এক সাথে কাজ করা ও নানামুখি তৎপরতা চালানোর জন্য সম্পূর্র্ণ প্রস্তুত। আর আমরা এ পথটি অব্যাহত রাখব।
প্রেসিডেন্ট আরো গুরুত্ব আরোপ করেন যে, আমরা সামগ্রিক জাতীয় পদক্ষেপ কর্মসূচির (বারজামে-২) দিকে তাকিয়ে আছি। আমাদের সবার উচিত ইরানকে গঠন করার জন্য এই সম্মিলিত পদক্ষেপে অংশ নেয়া। ইরানী জাতির শক্তি ও সামর্থ্য, আমাদের যুবকদের শিক্ষা-দীক্ষা, দেশের নিজস্ব বস্তুগত ও প্রাকৃতিক সুযোগ সুবিধাসমূহের সমন্বয় আমাদেরকে খুব সুন্দরভাবে বস্তুগত ও নৈতিক জীবনে উন্নতি ও অগ্রগতির শিখরে পৌঁছে দিতে সক্ষম।
ড. রুহানি ষষ্ঠ উন্নয়ন পরিকল্পনায় দেশের অর্থনীতি শতকরা ৮ ভাগ প্রবৃদ্ধির জন্য ইসলামী বিপ্লবের মহান নেতা যে তাকাদা দিয়েছেন তার কথা উল্লেখ করে বলেন, এই লক্ষে পৌঁছার জন্য আমাদের অভ্যন্তরীণ সকল সম্পদকে সক্রিয় এবং তার পাশাপাশি বার্ষিক ৩০ থেকে ৫০ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক পুঁজি আকৃষ্ট করতে হবে।
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের সভাপতি বলেন, গত দুই বছরে আমরা এনার্জি ক্ষেত্রে ঘর-বাড়ি ও শিল্প কারখানায় ব্যবহারের জন্য গ্যাস উৎপাদনের পরিমাণ দৈনিক ১৯০ মিলিয়ন ঘনমিটার বৃদ্ধি করে দক্ষিণ পার্স এর ৭ম ফেজকে উৎপাদনের গতিধারায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি। আর সম্মিলিত তেলক্ষেত্রগুলোতে, যার সামষ্টিক উৎপাদন ক্ষমতা ছিল দৈনিক ৬৯ হাজার ব্যারেল, তাতে দৈনিক উৎপাদনের পরিমাণ ১১০ হাজার ব্যারেলে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছি। আর এ বছরের শেষ নাগাদ তা দৈনিক ২৩০ হাজার ব্যারেল এবং বর্তমান সরকারের শেষ মেয়াদ পর্যন্ত ৩৫০ হাজার ব্যারেলে উন্নীত করতে সক্ষম হব।
প্রেসিডেন্ট বলেন, পেট্রো কেমিক্যাল সেক্টরে অতীতে এবং ২০১০ সালের মূল্যমানের ভিত্তিতে বার্ষিক আয়ের পরিমাণ ছিল ১৬ বিলিয়ন ডলার। সেই পরিমাণটি এখন বর্তমান বাজার দর অনুসারে বার্র্ষিক ১৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। আগামী বছর এবং বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়া নাগাদ তা ২৪ বিলিয়ন ডলারে উপনীত হবে। আর এর অর্থ হচ্ছে, আমাদের দেশ এমনকি কঠিন পরিস্থিতিতেও এগিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য রাখে।
ড. রুহানি এ পর্যায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে এতদঞ্চলে ইরানের প্রথম স্থান অধিকার করার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, এ সময়ের মধ্যে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা ৫ হাজার মেগাওয়াট বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন ৬৯ হাজার মেগাওয়াট থেকে ৭৪ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। ৪০০টি বাঁধ নির্মাণ সম্পূর্ণ হয়েছে এবং সারা দেশের বাঁধে পানি সংরক্ষণের পরিমাণ ১ মিলিয়ন ও ৯০ লাখ ঘনমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে।
ড. রুহানি আধুনিক সেচ পদ্ধতিতে কৃষি জমিগুলো প্রস্তুত করার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, গত আড়াই বছরে দেশের ২৭০ হাজার হেক্টর জমি আধুনিক সেচ ব্যবস্থার আওতায় এনে সম্পূর্ণ প্রস্তুত করা হয়েছে, যা বিপ্লবের শুরু থেকে এ ক্ষেত্রে সম্পাদিত কাজের শতকরা ২০% ভাগের সমান। খাদ্যজাত পণ্য উৎপাদন ও কৃষিপণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক গড় ছিল মাইনাস ৮.১%। ফলে ঘাটতি পূরণের জন্য বাইরে থেকে খাদ্যদ্রব্য আমদানি করতাম। আর এখন মাইনাস ৮.১% সংখ্যাটি গত বছর মাইনাস ৫.৪ এ পৌঁছেছে। এটা প্রমাণ করে যে, খাদ্যজাত পণ্য আমদানিতে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় এবং খাদ্যশস্য ও কৃষিপণ্য আমদানি পরিমাণগত দিক থেকে ৩০% হ্রাস পেয়েছে।
প্রেসিডেন্ট রুহানি বলেন, গত দুই বছরে আমরা ১১ মিলিয়ন লোককে স্বাস্থ্য বীমার আওতায় আনতে সক্ষম হয়েছি। আগামী বছর অবসরপ্রাপ্তদের মধ্যে যাদের বেতন ১.৫ মিলিয়ন তুমানের চেয়ে কম তারা উল্লেখযোগ্য সুযোগ সুবিধার লাভ করতে পারবে। অনুরূপভাবে আগামী বছর শিক্ষা ও সংস্কৃতিসেবীদেরও বিশেষ ভাতা প্রদান করা হবে। আর সরকার সর্বপ্রকার শক্তি নিয়ে জটিলতাসমূহ সমাধান করতে সক্ষম হবে। এভাবে আগামী বছর হবে ইরানের বিকাশ ও উৎকর্ষের বছর।
প্রেসিডেন্ট রুহানি তাঁর ভাষণের অপর অংশে ২৬ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের বিষয়টির দিকে ঈঙ্গিত করেন এবং বলেন, আমাদের বিপ্লব হচ্ছে নারী-পুরুষ উভয়ের, বিশেষ করে তরুণ সমাজের সামনে সুযোগ ও সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়ার বিপ্লব। ইমাম আমাদের জন্য এই রাস্তাটি নির্ণয় করে গেছেন। আর বিপ্লবের মূল ভিত্তি হচ্ছে জনগণের মৌলিক অধিকার পূরণে এবং ইসলামী চরিত্র বজায় রাখার ক্ষেত্রে জনগণের স্বাধীনতা, মতামত এবং আইনের শাসনের প্রাধান্য।
ড. রুহানি এ বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন যে, বিপ্লব হচ্ছে সকল জনগণের বিপ্লব। এ বিপ্লব কোন বিশেষ দল বা গ্রুপের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। তিনি বলেন, ইরানের বিপ্লবের পরিচয় দিতে হলে ইরান, ইসলাম, চরিত্র ও জাতীয় ঐক্য প্রভৃতি পরিভাষার আওতায় তা ব্যাখ্যা করতে হবে। বিপ্লবের মহামূল্যবান উত্তরাধিকার কোন বিশেষ গোষ্ঠীর সম্পত্তি নয়; বরং তা ইরানের মহান জাতি এবং বিশ্বের সকল স্বাধীনতাকামী মানুষের বিপ্লব।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট বলেন, ইসলামী বিপ্লব বলতে বুঝায় নৈতিকতা, সভ্যতা ও নাগরিকত্বের চেতনায় প্রত্যাবর্তন। তিনি বলেন, আমাদেরকে ইসলামী বিপ্লবের ৩৮তম বসন্তে সে কথাটি দ্বিতীয়বার পাঠ করতে হবে এবং দেখতে হবে যে, কীভাবে আমরা বিগত ৩৮ বছর পর্যন্ত সব ধরনের সমস্যা মোকাবিলায় রুখে দাঁড়াতে সক্ষম হলাম। আসলে আমরা যেহেতু ইরানী ও ইসলামী আত্মপরিচয়ে প্রত্যাবর্তন করেছি সেহেতু অটল অবিচলভাবে রুখে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছি।
ড. রুহানি আরো বলেন, আমাদের বিপ্লব ঐক্য ও সংহতির ছায়াতলেই সকল সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে। তিনি বলেন, ইসলাম হচ্ছে সকল ইরানীর এবং যারাই এদেশে বসবাস করে তাদের সবার আশ্রয়। যদি কেউ মুসলমান না হন তিনিও অনুভব করেন যে, ইসলাম হচ্ছে তাঁর আশ্রয়। আজকের দিনে আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব হচ্ছে এই মহান বিপ্লব এবং তার কালজয়ী আশা-আকাক্সক্ষাগুলোর ভালোভাবে হেফাযত করা।
ইসলামী ইরানের প্রেসিডেন্ট এ কথার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন যে, বিপ্লব ও ভারসাম্য, বিপ্লব ও নীতিবাদ এবং বিপ্লব ও ইসলামের মধ্যে কোন তফাৎ নেই। তিনি বলেন, নীতিবাদী, সংস্কারবাদী ও সত্যিকার ভারসাম্যবাদী সবাই হচ্ছেন বিপ্লবী। বিপ্লবের আওয়াজকেই আমাদের জোরদার করতে হবে। আমরা হলাম আলোচনা, সংলাপ, যুক্তি, আলোচনা ও সমঝোতাপন্থী। আমাদের যুগে বিপ্লবী মানে হচ্ছে, বিপ্লবী চেতনা, অন্যের সাথে মানিয়ে চলা ও প্রতিরোধে অংশীদারিত্বপন্থী হওয়া। অর্থাৎ এই চেতনা লালন করা যে, আমার দেশের পণ্য অন্য দেশের বাজারে প্রতিযোগিতা করার যোগ্যতা থাকতে হবে। আর তার মানে হচ্ছে আশাবাদী হওয়া, প্রাণচাঞ্চল্য থাকা ও গঠনমূলক চিন্তায় চালিত হওয়া।
ড. রুহানি আরো বলেন, আজকের দিনের যিনি বিপ্লবী তিনি চান যে, ইরানকে গঠন করবেন এবং ইরানকে অধিকতর মর্যাদার আসনে উন্নীত করবেন। তিনি বলেন, আজকের যিনি বিপ্লবী তিনি চান, যাতে দুনিয়ার সামনে ইসলামের দয়ার্দ্রতা ও মানবিক পরিচয় ফুটে ওঠে। তিনি দুনিয়াকে এ কথা বলতে চান যে, যারা আজ এতদঞ্চলে মিথ্যামিথ্যি ইসলামের দোহাই দেয় এবং মানুষ হত্যা করে তারা মুসলমানও নয়, বিপ্লবীও নয়। আজকে যে কেউ দেশ থেকে কোন বিপদাশংকা দূর করবেন এবং ঐক্য ও দেশের উন্নতির জন্য উদ্যোগ নেবেন ও চেষ্টা করবেন তিনিই হলেন বিপ্লবী।
প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি বলেন, আজ আমাদেরকে একটি সমন্বিত তৎপরতা, জাতীয় ঐক্য ও সহমর্মিতার জন্য জাতীয় প্রত্যয় ও মহান নেতার দিকনির্দেশনার আলোকে সম্মুখে এগিয়ে যেতে হবে। ড. রুহানি ব্যাখ্যা করেন যে, সামনে যে নির্বাচন আসছে সেটিই এই জাতীয় সংলাপের প্রতিপাদ্য। আমাদের বিপ্লব ভোটবাক্সের কাছেই উদ্ভাসিত হবে এবং মরহুম ইমাম ১৯৯৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি (যেদিন ইরানে ইসলামী বিপ্লব সফল হয়েছিল)-এর ২২ দিন পর আমাদেরকে নির্বাচনে ভোটবাক্সে আহ্বান করেছিলেন। তখন আমরা ইসলামী প্রজাতন্ত্রের পক্ষে রায় দিয়েছিলাম। কাজেই আমাদের প্রতিরোধ ও শক্তিমত্তার উৎস হচ্ছে আমাদের অংশগ্রহণ। কেউ যেন ভোটের বাক্সের সাথে রাগ না করেন (ভোট দানে বিরত না থাকেন।)
প্রেসিডেন্ট রুহানি ভোট কেন্দ্রে উপস্থিত হওয়ার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, বিপ্লবের মহান নেতা যেভাবে বলেছেন, ধরে নিন, যদি কারো সরকার বা প্রশাসনের প্রতি সমালোচনাও থাকে তাদেরও উচিত নয় ভোটের বাক্সের সাথে রাগ করা। এই ভোটবাক্স হচ্ছে মানুষের অধিকার। সবার উচিত এই ভোটবাক্সের প্রতি সম্মান দেখানো। আমাদের সামাজিক সম্পদ ও পুঁজি রয়েছে এই ভোটের বাক্সের গোড়ায়।
ড. রুহানি আরো বলেন, মনে করুন, আজ যদি কারো কোন অনুযোগ থাকে। কোন নাগরিক বা কোন রাজনৈতিক মহল কোন অপ্রীতিকর কিছু দেখে থাকেন, তাঁদেরও সক্রিয়ভাবে ভোট দিতে যাওয়া উচিত। নিঃসন্দেহে জাতির রায়ই শেষ কথা বলে দেবে। ২৬ ফেব্রুয়ারি আপনাদের রায় সন্দেহাতীতভাবেই ভবিষ্যতের আশাবাদ, যৌক্তিকতা, আইন ও প্রতিরক্ষার পক্ষে জাতীয় অধিকারের অন্তর্ভুক্ত।
প্রেসিডেন্ট বলেন, ২৬ ফেব্রুয়ারির রায় হবে সংলাপ ও আস্থার ভিত্তিমূলে প্রিয় ইরানকে গঠন করার রায়। আমাদের রায় সেসব লোকের প্রতি নয়, যারা আইনকে অশ্রদ্ধা করতে চায়। ঐসব লোকের প্রতিও এই রায় নয়, যারা ঝগড়া বাধায় এবং বাড়াবাড়ির পক্ষে। আমাদের রায় হবে আশার দিকে, আবাদ ও মুক্ত স্বাধীন ইরানের পক্ষে। আমরা ইরানকে গঠন করব। আমরা জাতীয় ঐক্য, সংহতি ও সহযোগিতার মাধ্যমে এই দেশ ও জাতির মর্যাদাকে কাক্সিক্ষত চূড়ায় অবশ্যই পৌঁছাব।
গণমিছিল শুরুর প্রাক্কালেও ড. রুহানি তাঁর ভাষণে অত্যাচারী শাহের শাসন আমলে ইরানী জনগণের ভাগ্যের উপর বিদেশী শক্তিগুলোর, বিশেষ করে আমেরিকার কয়েক বছরের আধিপত্যের কথা উল্লেখ করে বলেন, ইরানের জনগণ তিনটি সেøাগানের আওতায় ৩৭ বছর পূর্বে বিদেশী আধিপত্যের পতন ঘটাতে সক্ষম হয়। আর ইসলামের কাঠামো, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও বিশ্ববাসীর শ্রদ্ধা ও সমীহের ভিত্তিতে একটি স্বাধীন শাসনব্যবস্থা বলবৎ করতে সক্ষম হয়।
প্রেসিডেন্ট রুহানি স্মরণ করিয়ে দেন যে, ইমাম খোমেইনী (র) বলেছিলেন যে, ইসলামী প্রজাতন্ত্র। এর মধ্যে এক শব্দ বেশিও নয়, এক শব্দ কমও নয়। তিনি বলেন, জনগণ কয়েক দশক ধরে ইমাম ও রাহবারের এই বাণীর মধ্যে নিজেদের ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষা প্রতিফলিত হিসেবে দেখেছে। আর বিশ্ববাসী গৌরবদীপ্ত, মহান ও জননন্দিত বিপ্লবের সম্মুখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছে। তারা ভাবছে যে, কীভাবে একজন আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় নেতা সমকালীন বিশ্বে মানুষের মাঝে এতখানি প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
ড. রুহানি আরো বলেন যে, ইসলামী বিপ্লব যদিও রাজনীতির সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে; কিন্তু এটি নিছক অর্থে একটি রাজনৈতিক বিপ্লব নয়। এই বিপ্লবে সবচেয়ে বড় বিষয়টি হচ্ছে নৈতিকতা। সবসময়ই নৈতিকতা রাজনীতির উপর অগ্রগামী ছিল। ইমাম ইসলামী নৈতিকতার সমন্বয়ে বিপ্লবকে অত্যন্ত বিজ্ঞতা ও বিচক্ষণতার সাথে ঘৃণা ও প্রতিশোধ স্পৃহাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে নিতে পেরেছেন। যদি ইমামের এই শৈল্পিক কর্মটি না হতো, তাহলে বছরের পর বছর দেশ গৃহযুদ্ধে আক্রান্ত হয়ে থাকত। এই জনগণই ইমামের নেতৃত্ব ও ইসলামী চরিত্র দিয়ে বন্দুকের নলের মাথায় ফুল গেঁথে দিয়েছিল এবং দেখিয়ে দিয়েছিল যে, বিপ্লবের আকর্ষণ শক্তি কত বেশি, যা সবাইকে সত্য ও ন্যায়ের পথে আকর্ষণ করে নিতে পারে।
প্রেসিডেন্ট রুহানি বলেন, ইরানের ইসলামী বিপ্লব হলো নৈতিক ও শান্তিপ্রিয় বিপ্লব, যেখানে কোনরূপ চরিত্রহীনতা নেই। নেই কোন প্রকার সহিংসতা। তিনি বলেন, ইসলাম ধর্ম সবার জন্য ইনসাফ, ভারসাম্য, দয়া, সহানুভূতি ও ভ্রাতৃত্বের বার্তাবাহক।
All posts by pavel
ইসলামী বিপ্লবের মূল লক্ষ্যসমূহকে সব সময় জীবন্ত রাখতে হবে
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী ১১ই ফেব্রুয়ারি (২০১৬) ইরানের ইসলামী বিপ্লবের ৩৭তম বিজয় বার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর সাথে সাক্ষাৎকারী ইরানের বিমান বাহিনীর একদল অধিনায়ক ও বিভিন্ন স্তরের সদস্যদের উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে এ মন্তব্য করেন। তিনি তাঁর ভাষণে ইসলামী বিপ্লবের বিজয় বার্ষিকীর সমাবেশে ইরানী জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণকে দুশমনদের জন্য হতাশার কারণ হিসেবে অভিহিত করেন।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী ১১ই ফেব্রুয়ারীর বিপ্লব বার্ষিকী ও জাতীয় নির্বাচনকে ইরানী জাতির জন্য দু’টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ আনন্দজনক উৎসব হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি বিপ্লব বার্ষিকীর গণমিছিল ও নির্বাচন উভয়েই জনগণের জন্য দুশমনদের চূর্ণকারী রূপে ব্যাপক ও দৃষ্টিগ্রাহ্য অংশগ্রহণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, ২৬শে ফেব্রুয়ারির নির্বাচনেও জনগণের সর্বাত্মক অংশগ্রহণ একটি দেহে নতুন রক্ত সঞ্চালনের ন্যায় ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের শক্তিমত্তা ও দেশের ইসলামী শাসনব্যবস্থার জন্য বীমাস্বরূপ কাজ করবে এবং ষড়যন্ত্রকারী প্রতারক দুশমনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যসমূহকে অকেজো করে দেবে।
ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার প্রতি বছর ইসলামী বিপ্লবের বিজয়বার্ষিকী উদ্যাপন কর্মসূচিতে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণের প্রশংসা করে বলেন, দীর্ঘ সাঁইত্রিশ বছর যাবত ইরানী জনগণ তাদের দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি এবং ইসলামী বিপ্লবের প্রতি তাদের ভালোবাসা ও পৃষ্ঠপোষকতা সহকারে নিয়মিত ১১ই ফেব্রুয়ারির বিপ্লববার্ষিকীর মিছিলে উপস্থিত হয়ে আসছেন। আর এ বছরও আল্লাহ্র অনুগ্রহে এ উপলক্ষে তাঁদের ব্যাপকভাবে ও দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে রাস্তায় নেমে আসার বিষয়টি ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের দুশমন ও অকল্যাণকামীদের জন্য চরম হতাশা সৃষ্টিকারী।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা ১১ই ফেব্রুয়ারির গণমিছিলকে ইসলামী বিপ্লবের বিজয়োৎসবের আনন্দময় পুনরাবৃত্তি হিসেবে অভিহিত করে বলেন, কোনো ব্যাপারে জনগণের আনন্দময় অনুষ্ঠানের এভাবে অব্যাহত থাকা বিশ্বের বুকে নজিরবিহীন। তিনি বলেন, ইরানের জনগণ ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের শুরু থেকে এ পর্যন্ত পরিবেশগত কঠিন অবস্থা ও ব্যক্তিগত কারণে অনেকের মনের খারাপ অবস্থা নির্বিশেষে সর্বাবস্থায়ই নিয়মিত ইসলামী বিপ্লবের বিজয়োৎসবে অংশগ্রহণ করে আসছে।
ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যারা ইসলামী বিপ্লবের বিজয়বার্ষিকীর মিছিলে অংশগ্রহণ করেছে তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই তাদের বয়সের বিচারে এমন যারা ইসলামী বিপ্লবের দিনগুলোকে ও ১৯৭৯ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের দিনটিকে দেখে নি। এ থেকে সুস্পষ্ট যে, এ ধারাবাহিকতা কোনোদিন সমাপ্ত হবে নাÑ যা ইসলামী বিপ্লবের নব সৃজনশীল শক্তিরই প্রমাণ বহন করছে।
ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের এ বিরাট ও মহান ঘটনার স্মৃতি কিছুতেই বিস্মৃত হতে দেয়া যাবে নাÑ এ কথা উল্লেখ করে হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, ইসলামী বিপ্লবের প্রকৃত অবস্থা সর্বাবস্থায় ও সব সময় জনগণের অন্তরে ও মন-মস্তিষ্কে জাগ্রত রাখতে হবে। কারণ, প্রকৃতপক্ষে ইসলামী বিপ্লব এখনো তার মাঝপথে রয়েছে। তাই এর ভিত্তিসমূহকে সুদৃঢ়ীকরণ এবং এর সুমন্নত ও মহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহের বাস্তব রূপায়নের লক্ষ্যে এ বিপ্লবের মূল্য লক্ষ্যসমূহকে সব সময় জীবন্ত রাখতে হবে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা জনগণকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, ইসলামী প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অকল্যাণকামীদের সকলে যে এর বিরুদ্ধে এক ব্যাপক বিস্তৃত রণাঙ্গনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে তাদের সমস্ত অপচেষ্টার লক্ষ্য হচ্ছে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানকে স্বীয় মর্যাদা সৃষ্টিকারী ও শক্তি সৃষ্টিকারী লক্ষ্যসমূহের অভিমুখে অভিযাত্রা অব্যাহত রাখা হতে বিরত রাখা এবং ইরানের বুকে বিজাতীয়দের আধিপত্যকে পুনরায় ফিরিয়ে আনা।
ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার বলেন, ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার লক্ষ্য হচ্ছে এমন একটি সমাজ গড়ে তোলা যা জ্ঞান-বিজ্ঞান, সুবিচার, উন্নত নৈতিক চরিত্র, সম্মান ও মর্যাদা এবং উন্নতি ও অগ্রগতির অধিকারী থাকবে। তিনি বলেন, দুশমন ফ্রন্টের আসল লক্ষ্য হচ্ছে এ মহান ও সমুন্নত লক্ষ্যসমূহকে বিস্মৃতির কবলে নিক্ষেপ করা, নিদেনপক্ষে ইরানী জনগণের আচরণে ও ইসলামী প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অভ্যন্তরীণ বা গুণগত পরিবর্তন ঘটানো।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, দুশমনের আসল লক্ষ্য হচ্ছে ইসলামী প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বৈপ্লবিক প্রকৃতি ও চরিত্রবৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন ঘটানো। তিনি উল্লেখ করেন যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধে কোনো কঠিন যুদ্ধের সম্ভাবনা নেই, তবে তা একেবারে অসম্ভবও নয়। তিনি বলেন, বর্তমানে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে দুশমনদের সবচেয়ে বড় কর্মসূচি হচ্ছে ংড়ভঃ ধিৎ Ñ যার লক্ষ্য হচ্ছে ইরানের ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও ইরানী জনগণকে যা কিছু গ্রথিত করে রেখেছে তার বিলুপ্তি ঘটানো।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা একটি জাতির শক্তির গ্রথিতকারী উপাদানগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়াকে সে জাতির জন্য দুশমনদের সামনে আত্মসমর্পণের সমার্থক বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, একটি জাতি যদি দুর্বল হয়ে পড়ে তাহলে আর তার বিরুদ্ধে মোকাবিলা করার জন্য কোনো কঠিন যুদ্ধের প্রয়োজন হয় না।
ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার বলেন, এ ধরনের ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি প্রতিহত করার একমাত্র পথ হচ্ছে কর্ম, আচরণ, লক্ষ্য নির্ধারণ এবং আইন-কানুন ও বিধি-বিধান প্রণয়নে তথা সকল ক্ষেত্রে বিপ্লবী চিন্তাধারার হেফাযত ও প্রহরা প্রদান।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী তাঁর ভাষণের ধারাবাহিকতার এক পর্যায়ে নির্বাচনকে দেশ ও জাতির দেহে নতুন রক্ত ও নতুন চেতনা প্রবেশ করানো এবং তার শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য নতুন হাওয়া সরবরাহের সাথে তুলনা করেন। তিনি বলেন, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের জনগণ স্বীয় প্রাকৃতিক অধিকারকে কাজে লাগিয়ে বার বার নির্ধারিত সময়ে মঞ্চে আগমন করে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য তারা ইতিপূর্বে যেসব দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে নির্বাচিত করেছিল তাদের মধ্যে কে কে থাকবে ও কে কে বিদায় নেবে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা নির্বাচনকে জাতির শক্তির নবায়ন ও ইসলামী বিপ্লবের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যসমূহের সাথে জনগণের নতুন করে বাই‘আত হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, আমি এ কারণে নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করি যে, নির্বাচনে জনগণের সর্বাত্মক অংশগ্রহণ দেশ ও দেশের শাসনব্যবস্থার জন্য সম্মান ও মর্যাদার পরিচায়ক এবং তার জন্য বীমাস্বরূপ তথা তার সুুরক্ষার নিশ্চয়তা বিধানকারী। সুতরাং এ বিরাট ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় জনগণের অংশগ্রহণ করা একটি অবশ্য কর্তব্য বিষয়।
ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার বলেন, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের জনগণ ও সরকারের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করা এবং দু’টি বিপজ্জনক কৃত্রিম ও মিথ্যা মেরু তৈরিকরণ হচ্ছে ইসলামী বিপ্লবের দুশমন ফ্রন্টের সব সময়ের লক্ষ্যসমূহের অন্যতমÑ তিনি বলেন, নির্বাচনে জনগণের ব্যাপক উপস্থিতি এবং জনগণ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যকার সম্পর্ককে নতুন করে শক্তিশালীকরণের মানে হচ্ছে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বিজয় এবং দুশমনের এ লক্ষ্যসমূহের অসফল থেকে যাওয়া। আর আল্লাহ্ তা‘আলার সত্য ওয়াদার ভিত্তিতে এটা সুনিশ্চিত যে, তাদের এ উপস্থিতি আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে বিজয় ও সাহায্য বয়ে নিয়ে আসবে।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী তাঁর ভাষণে ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের পর থেকেই দুশমনরা এর বিরুদ্ধে যেসব অপতৎপরতা চালিয়েছে ও যেসব ষড়যন্ত্র করেছে তার কথা স্মরণ করিয়ে দেন, বিশেষ করে তিনি ইরানকে বিভক্ত করার অপচেষ্টা, সামরিক অভ্যুত্থান, আট বছরব্যাপী চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ ও ক্রমবর্ধমান নিষেধাজ্ঞার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি বলেন, কিন্তু দেশের জনগণ সব সময়ই এ সকল ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ইসলামী প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার জন্য এগিয়ে আসে। আর তাই মহান আল্লাহ্ ও ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানকে ও ইরানী জাতিকে সাহায্য ও বিজয় প্রদান করে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের একটি আঞ্চলিক শক্তিতে পরিণত করেছেন এবং কতক ব্যাপারে বৈশ্বিক অঙ্গনে একটি প্রভাবশালী শক্তিতে রূপান্তরিত করে দিয়েছেন।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা দেশের জনগণকে সম্বোধন করে বলেন যে, দেশ ও জাতির, সম্মান, মর্যাদা, গৌরব ও শক্তিমত্তা বিপ্লবী দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের মধ্যে নিহিত রয়েছে। আর নির্বাচনে অংশগ্রহণ হচ্ছে এ সবের মধ্য থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব-কর্তব্যসম্যূহের অন্যতম।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা নির্বাচনকে সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে অভিহিত করেন। তবে তিনি স্মরণ করিয়ে দেন যে, এ বিষয়টির সমস্ত রকমের গুরুত্ব সত্ত্বেও এটি একটি সাময়িক বিষয়; কিন্তু যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো এরপরও অব্যাহত থেকে যাবে তা হচ্ছে অর্থনীতিকে প্রতিরোধমূলক করে গড়ে তোলাসহ দেশের মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি।
ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার ইরানের শিক্ষিত ও লক্ষ্যাভিসারী জনশক্তির বিরাট সম্ভাবনা, আঞ্চলিক অবস্থানগত বৈশিষ্ট্য এবং প্রাকৃতিক সম্পদের কথা পুনরায় উল্লেখ করে দেশের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের উদ্দেশে বলেন, এ নজিরবিহীন পুঁজির ওপর নির্ভর করে দেশের অর্থনীতিকে এমনভাবে প্রতিরোধমূলক করে গড়ে তুলুন যাতে দুশমনরা তাদের লক্ষ্য হাসিলের জন্য ইরানের ওপর চাপ সৃষ্টি থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয়।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, দেশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের দায়িত্ব হচ্ছে দেশের পুঁজিসমূহকে দ্রুত গতিতে শিল্প ও কৃষি উৎপাদন, উৎপাদন বৃদ্ধি, অচলাবস্থার সমস্যার সমাধান এবং দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির দিকে পরিচালিত করা যাতে দুশমনরা বুঝতে বাধ্য হয় যে, ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞায় তাদের কোনোই লাভ হবে না।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা বিগত দশ-বারো বছর যাবত জাতীয় অর্থনীতির অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধির ওপর যে গুরুত্ব আরোপ করে আসছেন দেশের দায়িত্বশীল সরকারি কর্মকর্তাদেরকে তা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, এ লক্ষ্য বাস্তবায়িত হলে দেশের যুবশক্তির কর্মসংস্থানের সমস্যা, বেকারত্ব ও অর্থনীতির অন্যান্য সমস্যারও যথাযথ সমাধান পাওয়া যাবে।
ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার দুশমনদের ব্যাপক বিস্তৃত ফ্রন্টের সকল ষড়যন্ত্র ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের প্রতি পুরোপুরি সতর্ক দৃষ্টি রাখা অপরিহার্য বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, যারা নিজেদের দুশমনদের ব্যাপারে উদাসীন থাকে এবং তাদের ব্যাপারে যাদের অন্তর নিশ্চিন্ত তারা কখনোই জনগণের প্রিয়পাত্র হতে পারবে না। এ ধরনের লোকদের উদ্দেশে তিনি বলেন : দুশমন মৃদু হাসি উপহার দেয়, জবাবে তোমরাও তাদেরকে মৃদু হাসি উপহার দাও; কিন্তু দুশমনের মৃদু হাসির পিছনে কী প্রতারণাময় অপকৌশল লুকিয়ে আছে সে ব্যাপারে তোমাদের সচেতন থাকা উচিত।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, ইরানী জাতির নিরাপত্তা, ভালোভাবে জীবন যাপন, সংস্কৃতি ও যুব সমাজের ব্যাপারে দুশমনের ষড়যন্ত্রসমূহ, সামাজিক ক্ষতিসমূহ ও অন্যান্য সমস্যাকে বুঝতে হবে এবং এগুলোর মোকাবিলা করার লক্ষ্যে যথাযথ নীতি নির্ধারণ করতে হবে, আইন প্রণয়ন করতে হবে, পদক্ষেপ নিতে হবে ও কথা বলতে হবে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা মিষ্টভাষী খ্যাতনামা ইরানী কবি শেখ সা‘দী শীরাযীর একটি উক্তির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, দুশমন যখন বন্ধুত্বের জন্য বার বার ছুটে আসে তখন সে বন্ধুত্বের পোশাক পরিধান করে এমন কাজ করে যা কোনো দুশমনই করতে পারে না।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা বলেন, আল্লাহ্ তা‘আলার রহমতে দুশমনের মোকাবিলায় ইরানী জাতি সব সময়ই পুরোপুরি সতর্ক ছিল এবং এখনো সতর্ক। তিনি বলেন, ইরানী জাতির মহান অভিযাত্রা এ পর্যন্ত ষড়যন্ত্রকারী ও প্রতারণাময় অপকৌশলের আশ্রয় গ্রহণকারী দুশমনের সকল ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে দিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও তাদেরকে অপদস্থ করবে।
ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার তাঁর সাথে সাক্ষাৎকারী ইরানের বিমান বাহিনীর একদল অধিনায়ক ও বিভিন্ন স্তরের সদস্য এবং বিমান বিধ্বংসী কামানের দায়িত্বে নিয়োজিতদের উদ্দেশে প্রদত্ত এ ভাষণের শুরুতে ১৯৭৯ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি ইরানের বিমান বাহিনী কর্তৃক ইসলামী বিপ্লবের মহান নেতা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-এর কাছে বাই‘আত্ করার ঘটনাকে স্মরণ করেন এবং এ ঘটনাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী ঘটনা এবং ইসলামী বিপ্লবের ইতিহাসে একটি দিকনির্দেশক ঘটনা হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, ৮ই ফেব্রুয়ারি তারিখে ইরানের বিমান বাহিনী জনগণের কাতারে শামিল হয়ে দেশের ভিতরকার রাজনৈতিক ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন সৃষ্টি করে এবং সাথে সাথে জনগণের পক্ষ থেকে এ পদক্ষেপকে স্বাগতম জানানো হয়। আর এটা প্রমাণ করে যে, ‘জনগণ হওয়া’র ফল হচ্ছে জনগণের সমর্থন লাভ।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বিগত সাঁইত্রিশ বছর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিমান বাহিনী যে কর্মতৎপরতা চালিয়েছে তা প্রকৃতই খুবই ভালো বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বর্তমানে ইরানের গোটা বিমান বাহিনী পুরোপুরিভাবে সুদৃঢ়, শক্তিশালী ও উদ্ভাবনী শক্তির অধিকারী এবং তারা জনগণের পাশে আছে; তাদের এ দৃঢ়তা, শক্তি, সক্ষমতা ও জনগণের সাথে সম্পর্ক দিনের পর দিন আরো বৃদ্ধি করতে হবে। [সংক্ষিপ্ত]
ইরানে ইসলামী বিপ্লব, লক্ষ্য ও অর্জন
রাশিদুল ইসলাম
দেখতে দেখতে ইরানে ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের ৩৬ বছর অতিক্রম হয়ে গেছে। কিন্তু আজো এ বিপ্লব কতটা সফল হয়েছে কিংবা লক্ষ্য অর্জন করতে পেরেছে তার বিরাট অংশই বিশ্ববাসীর কাছে অজানা রয়ে গেছে এবং তা পর্যাপ্ত পরিমাণে উন্মোচিত হয়নি। এর প্রধান কারণ হচ্ছে পশ্চিমা ও পশ্চিমা ভাবধারার মিডিয়ায় ইরান নিয়ে অব্যাহত অপপ্রচার। ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরি করছে বা করেছে এমন মিথ্যা অপবাদে দীর্ঘদিন ধরে অবরোধ ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা টিকিয়ে রাখা হয়েছে, যদিও তা শেষ পর্যন্ত অপসারিত হবার বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করছে। কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব হল যখন বিশ্ব পরাশক্তি একদিকে আর অন্যদিকে ইরান, তখন বলতেই হয় ইরানের ইসলামী বিপ্লব এধরনের বিরাট অর্জনের পেছনে অবশ্যই চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। কিভাবে করেছে তা বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
এ বিশ্লেষণ এজন্য জরুরি যে, ইরানে ইসলামী বিপ্লব থেকে দেশটি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সক্ষমতা অর্জন করলেও অধিকাংশ মুসলিম দেশই এ সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে ওয়াকিবহাল নয়। বরং মুসলিম দেশগুলোতে ভুল ধারণা আছে। আর পশ্চিমা অপপ্রচারের ফলে শিয়া ও সুন্নির মধ্যে এক কাল্পনিক বিভেদের বিষয়টি তাদেরকে এমনভাবে বিভ্রান্তিতে ফেলে যা থেকে তারা বের হয়ে আসতে পারে না। অথচ ইরানে ইসলামী জাগরণের বহুমাত্রিকতা রয়েছে যা এই আধুনিক বিশ্বে অন্যান্য মতবাদের তুলনায় গুণগত বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে অনেক এগিয়ে আছে। আর এটা নীতি ও নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা ছাড়াও সুশাসন কায়েমের মধ্য দিয়ে কার্যকর জীবনযাপনে সক্ষমতা অর্জনে ভিত্তি গড়ে দেয়। যাঁরা এতদিন ভাবতেন ইরানে তথাকথিত মোল্লাতন্ত্র চলছে তাঁরাই এখন নড়েচড়ে বসছেন এবং অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছেন বিপ্লবের অপার সৌন্দর্যÑ যা তাঁদেরকে বিমোহিত না করে পারছে না।
এজন্যই ইরানের ইসলামী বিপ্লব নিয়ে আলোচনা করতে গেলে একধরনের সৌন্দর্যের আরাধনা করতে হয় যা জীবনযাত্রাকে পবিত্রতম করে তোলে। বিশুদ্ধ এক জীবনযাপন পদ্ধতির মধ্য দিয়ে শত্রুকে বন্ধু করে তোলা এবং ভুল ভাঙ্গিয়ে চারপাশের মানুষকে কাছে টেনে আনার এ কৌশলকে আগ্রাসন কিংবা হুমকি দিয়ে স্তব্ধ করে দেয়ার হুঙ্কার দেয়া যায় বটে, কিন্তু তা কোনো কাজে আসে না। কারণ, জ্ঞাননির্ভর সমাজে অস্ত্র নয়, মেধা ও ধীশক্তি অনেক বেশি শক্তিশালী। ইরানের ইসলামী বিপ্লব সেই চর্চার পথ খুলে দিয়েছে। উম্মাহ্র জন্য ভোগবিলাস ও নতজানু জীবন থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর এক মেধাবি পথ রচনা করতে পারে এ বিপ্লব। কারণ, বিপ্লবের মূল মর্মবাণী ছিল, এস্তেগলল, অযদী, জমহুরিয়ে ইসলামী, যার অর্থ হলো স্বাধীনতা, মুক্তি, ইসলামী প্রজাতন্ত্র। লালন শাহ যেমন এই বাংলার মাঠে ঘাটে গেয়ে বেরিয়েছেন, ‘সত্য বল সুপথে চল, ওরে আমার মন’, ইরানের মহান নেতা আয়াতুল্লাহ ইমাম খোমেইনি দেখিয়ে গেছেন সেই সত্যের পথে যে বাধা বিপত্তি আছে তার সাথে লড়াই করে কিরূপে অবিচলভাবে টিকে থাকতে হয়। এজন্য বিপ্লবের মূল মন্ত্রই হচ্ছে সত্য, এর প্রতিষ্ঠা ও কিভাবে সবধরনের ঝুঁকি মোকাবেলা করে আপোসহীন থাকতে হয়, সেই ধরনের পথরচনা। বিন্দু যত ছোটই হোক একটি বৃত্ত রচনায় বা পরিধি নির্দেশনায় তা জরুরি বটে তেমনি ইসলামী বিপ্লবের লক্ষ্য ও অর্জন বুঝতে ইসলাম সম্পর্কে কার্যকরভাবে জানা ও বুঝে ওঠা জরুরি। ইসলামোফোবিয়া কখন ইরানোফোবিয়ায় পরিণত হয়েছে কিংবা প্রাচ্য, পাশ্চাত্য ও পুঁজিবাদ কিভাবে শোষণের রকমফের পরিবর্তন করছে তা জানতে ও এর মোকাবেলায় নিবিড়ভাবে সত্য তথ্য সংগ্রহ ও ইসলামী জ্ঞানই অন্যতম অস্ত্র। ইতিহাস, বর্তমান ও ভবিষ্যতের বিবেচনায় ইসলামী জ্ঞান থেকে ইরানের ইসলামী বিপ্লব রসদ সংগ্রহের অন্যতম কৌশল শিখিয়েছে। তাই তাকে প্রকৃতি ও চারপাশ সম্পর্কে গভীর ভাবতে ও চিন্তাশীল হতে হয়। আর এর নিরিখে ইসলামের মর্মবাণী কী তা নিরূপণ করতে হয়।
দ্বিতীয়ত, বিপ্লব সম্পর্কে যে বিশ্বাস তা খুবই যৌক্তিক। তৃতীয়ত একজন বিশ্বাসীর আবেগ তার বিশ্বাস দিয়েই পরিপূর্ণ। তার আবেগ ও অনুভূতি সম্পূর্ণভাবে বিপ্লবের উপাদানগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। চতুর্থত ইসলাম একজন বিপ্লবীর জীবনের যেসব বাস্তব ও ব্যক্তিগত দিক রয়েছে তাকে উদ্ভাসিত করে তোলে। একজন অনুসারী তার ধর্মীয় নেতা বা ইসলামী শাসকের কাছ থেকে জীবন সংগ্রামের যেসব রসদ পায় তা তাকে এতটাই সমৃদ্ধ করে তোলে যে, কোনো আগ্রাসী শক্তিকেই সে ভয় পায় না। তার উপলব্ধি অটুট থাকে। কারণ, সে তার লক্ষ্যমাত্রা ও অর্জনের পথগুলো সম্পর্কে পরিষ্কার জ্ঞান অর্জন করে। ইমাম খোমেইনি তাঁর অনুসারীদের কাছে ইসলামী জাগরণের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পরিষ্কার একটি ধারণা দিতে সক্ষম হন যা তাদের মধ্যে বিশ্বাসে পরিণত হয়েছিল।
এভাবেই এক ধরনের দৃঢ় আস্থা নিয়ে ইসলামী বিপ্লবের অনুসারীরা একের পর এক বাধা অতিক্রম করতে পেরেছে। তৎকালীন ইরাকের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ, পরাশক্তিগুলোর অবরোধ কিংবা বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইরানের মানুষ কঠিন মনোবল নিয়ে বছরের পর বছর লক্ষ্য অর্জনে ধাবিত হতে পেরেছে।
ইরানে বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন। অন্যদিকে দেশটি ভৌগোলিক নিরাপত্তা অর্থাৎ নিজস্ব নিরাপত্তা বলয় ও প্রতিরক্ষা শক্তি এমনভাবে গড়ে তুলেছে যে, আশেপাশের অধিকাংশ দেশে রক্তপাত হলেও ইরানে তা অনুপস্থিত। ন্যানো টেকনোলজি থেকে শুরু করে বিজ্ঞান ও প্র্রযুক্তিগত উন্নতিতে ছেলেদের সঙ্গে মেয়েরা সমান পাল্লা দিচ্ছে। সুস্থ ধারার সাংস্কৃতিক আবহের ইরানী চলচ্চিত্র আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ্যতার সঙ্গেই বিবেচিত হচ্ছে এবং অ্যাওয়ার্ড লাভ করছে। এত বাধা ও অবরোধের মধ্যেও দেশটির স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলা এবং তাদেরদের আত্মবিশ্বাস বিশ্বব্যাপী আজ এক মডেল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
এখন যখন অবরোধ উঠে যাচ্ছে তখন ইরানে অন্তত চারশ’ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ সম্ভাবনার আভাস দিচ্ছে দি গার্ডিয়ান, রয়টার্স, ইন্ডিপেন্ডডেন্ট, ব্লুম বার্গের মতো পশ্চিমা মিডিয়াগুলো। বাস্তবে ইসলামী বিপ্লবের ধারায় এধরনের বিনিয়োগ আহরণ করার মত দক্ষ জনবল, পরিবেশ, নিরাপত্তা সহ সার্বিক সহায়ক পরিবেশ গড়ে তুলেছে ইরানের জনগণ। তাদের উপলব্ধি ছিল পারমাণবিক বোমা বানানো যে তাদের ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী নিষিদ্ধ এবং তাদের ধর্মীয় নেতা সে পথ থেকে তাদের যথাযথ অভিভাবকের মতই দূরে সরিয়ে রেখেছেন সে সম্পর্কে বিশ্বের ভুল একদিন ভাঙবেই। ভেঙেছেও তাই। সস্তায় জ্বালানি শক্তি অর্জন ছাড়াও প্রযুক্তিগতভাবে শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের জন্যই ইরান এতদিন পারমাণবিক গবেষণা চালিয়ে আসছিল দরকষাকষির মধ্য দিয়ে তা প্রমাণ করতে সমর্থ হয়েছে দেশটি। তাই বলে প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে ইরান ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে কোনো ছাড় দেবে না তা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে। এধরনের দৃঢ় মনোবল ও আপোসহীন মনোভাব ইরান কোত্থেকে পায়? প্রকৃত ইসলাম সম্পর্কে জানা ও সঠিকভাবে তা বুঝে ওঠা যে কত জরুরি এখান থেকে তা সহজেই উপলব্ধ হয়ে ওঠে। কারণ, ইসলামী বিপ্লব ইরানের জাতিগত বৈশিষ্ট্যকে সেভাবেই গঠন করতে সাহায্য করছে যে, পরাশক্তির হুমকিতে সে থাকবে নির্বিকার এবং লক্ষ্য অর্জনে সে কখনোই পিছপা হবে না।
ইসলামী জাগরণ যে কত বাস্তব ও মননচর্চার একটি ব্যাপার তা ইমাম খোমেইনী বিশ্ববাসীর সামনে কীভাবে তুলে ধরেছেন! বিপ্লব সম্পর্কে যে আশাবাদ তিনি জাগিয়েছিলেন তা আড়াই হাজার বছরের রাজতন্ত্রকে তুচ্ছ খড়কুটোর মতো ভাসিয়ে নিয়ে গেছে; তা এখন ইতিহাসের জাদুঘরের বিষয়বস্তু বটে। এজন্য যে ত্যাগ করতে হয়েছে, তা অবলীলায় স্বীকার করে নেয়ার দীক্ষাও তিনি দিয়েছেন। এভাবে প্রাকৃতিকভাবেই বিপ্লবের প্রতি আশা ইমামের অনুসারীদের ধাবিত করেছে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যপানের দিকেÑ যা এখনো অব্যাহত রয়েছে।
সেই কবে ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার বিষয়টি অনুধাবন করে ইমাম খোমেইনী বিশাল সা¤্রাজ্যের অধিপতি গরবাচেভকে চিঠি দিয়েছিলেন যখন অন্যান্য বিশ্বনেতা তা কল্পনাও করতে পারেননি। সেই চিঠিতে ইমাম খোমেইনী লেখেন, কমিউনিজম নিয়ে বরং ভালো গবেষণা হতে পারে এবং তা বিশ্বের কোনো জাদুঘরে রেখে দেয়ার মতো বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। আধ্যাত্মিক নেতৃবর্গ এভাবেই আল্লাহর ইচ্ছার প্রতিচ্ছবি দেখতে পান।
ইমাম বলেছিলেন, মুসলিম দেশগুলো যদি এক হয়ে এক বালতি করে পানি ঢালে তাতে ইসরাইল ভেসে যাবে। দুর্ভাগ্য সেই ঐক্য এখনো সোনার হরিণ হয়ে ধরা দেয়নি। কিন্তু ইসলামোফোবিয়ার কারণে কারা মহান ইসলাম ধর্মকে হেয় করতে তালেবান থেকে শুরু করে হালে আইএস জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, অস্ত্র দিচ্ছে তা স্পষ্ট হয়ে গেছে। ইসরাইল ফিলিস্তিনে কী করছে, ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, পাকিস্তানে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস দমনে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে তা দশক পেরিয়ে গেলেও কেন দমন করা সম্ভব হচ্ছে না সেটি বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সামরিক আগ্রাসনের পরিবর্তে আলোচনার পথে পারমাণবিক ইস্যুতে একটি ফয়সালার পথ রচনায় ইরানের কূটনীতিকরা দরকষাকষি করে যে সফলতার পথ দেখিয়েছেন নিঃসন্দেহে তা ইসলামী বিপ্লবের শিক্ষা থেকেই অনুসারিত। মুসলিম দেশ থেকে শুরু করে ঔপনিবেশিক নিগড়ে বাধাপড়া দেশগুলো এ থেকে শিক্ষা নিবে কি না তা তাদের ব্যাপার। তবে পশ্চিমা বিশ্ব বরাবরই ইরানের ইসলামী বিপ্লবকে অস্বীকার করে আসছে। এর কারণ হচ্ছে বৈষম্যপূর্ণ সমাজে কী ঘটছে তা জীবন্ত হয়ে ধরা পড়ে যখন তার কাছে সত্যিকার তথ্য উপস্থাপন করা সম্ভব হয়ে ওঠে। সুতরাং আদতেই আমাদের চারপাশে কী ঘটছে তা জানা জরুরি এবং ইসলামী বিপ্লব সেই শিক্ষাই দেয়।
মানবধর্মের মতো ইসলাম ইরানীদের মাঝে উৎসারিত হয়েছে, উপলব্ধ হয়ে উঠেছে কঠিন সংকল্পের যেখানে পশ্চিমা অবরোধ কিংবা বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা বরং শাপে বর হয়ে দেখা গেছে। কারণ, সবধরনের বাধার মধ্যে নিরলস সংগ্রামের মধ্য দিয়েই স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পেরেছে ইরান। প্রায় সত্তর হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি বিদ্যুৎ উৎপাদন, প্রতিরক্ষায় ব্যালেস্টিক মিসাইল তৈরি, পর্যটন থেকে শুরু করে তেল ও গ্যাস সম্পদের ভোগবাদি ব্যবহারের পরিবর্তে উৎপাদনশীল ব্যবহার, চীন থেকে ইউরোপে রেলপথ নির্মাণ, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ক্রয়ের বদলে নিজেরাই উৎপাদনে চলে যাওয়া, প্রযুক্তি ও পুঁজির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে বিশাল কর্মযজ্ঞ সৃষ্টি ইসলামী বিপ্লবের শিক্ষা থেকে রস সংগ্রহ করেছে, যেমন একটি উদ্ভিদ মাটি থেকে সংগ্রহ করে বিশাল বৃক্ষে পরিণত হয়।
এখন কারো ইসলামী বিপ্লব ভালো লাগুক আর না-ই লাগুক সেটি ব্যাপার নয়; বরং লাতিন আমেরিকা থেকে শুরু করে ভারত, চীন, আফ্রিকা, ইউরোপ, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র সবাই ইরানের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়তে পাল্লা দিচ্ছে। কারণ, এধরনের বিজয়ের জন্য প্রতিশ্রুতিবান কৃতি নারী-পুরুষ গড়ে তুলেছে ইসলামী বিপ্লবের ধারা। যা অন্য কোনো দেশ পছন্দ না করলেও তা গ্রহণযোগ্য ও যৌক্তিক হয়ে উঠছে। এখানে মযলুমের শক্তি বরং আগ্রাসী শক্তির চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। আগ্রাসী শক্তি যখন মযলুমকে ভয় দেখিয়ে নিষ্পেষণ করতে চায় তখন ইসলাম মযলুমকে শক্তভাবে দাঁড় করিয়ে দেয় এবং বিজয়ের প্রান্তরে নিয়ে যায়। এখানে ইসলামী বিপ্লবের নেতারা মযলুমদের সত্যিকারের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের মেধা ও মননকে এমনভাবে গড়ে তুলেছেন যে, তারা নিঃশঙ্ক চিত্ত হয়ে ওঠে। সে ইতিমধ্যে তার শিক্ষা-প্রশিক্ষণকে আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে সংমিশ্রণ ঘটিয়ে এক অপূর্ব শক্তি অর্জন করে ফেলেছে যা আগ্রাসী শক্তিকে ভ্রুক্ষেপই করে না।
ইরানের ইসলামী বিপ্লবকে অনেক রাষ্ট্রই হেয় করতে চায় যাদের জবাব দিতে গিয়ে সম্প্রতি ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মাদ জাওয়াদ জারিফ টুইটারে লিখেন, ‘কূটনীতি হচ্ছে পরিপক্বদের কর্মক্ষেত্র; বলদর্পী নব্য-ধনীদের নয়।’
১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লব বিজয়ে পর মানুষের মধ্যে যে তীব্র আকাক্সক্ষা ও প্রত্যাশা জেগে ওঠে বিপ্লবের নেতৃবৃন্দের জন্য তা পূরণ করা বেশ সময়সাপেক্ষ ও কঠিন দায়িত্ব হয়ে পড়ে। এখানেই নেতৃত্ব দ্বিতীয় কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। তাকে যেমন চোরাগোপ্তা হামলা সামলাতে হয়, বিজ্ঞানীদের হেফাজত করতে হয় তেমনি সম্পদের সুষম বণ্টনের পাশাপাশি অপচয়ের পথ বন্ধ করে নতুন নতুন গবেষণা ও উদ্যোক্তার বিকাশ ঘটাতে হয়। বিপ্লব-পরবর্তী ইরানের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে আপনি তা টের পেতে পারেন। একদিকে পরাশক্তির ইন্ধনে চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ সামলানো, দেশ পুনর্গঠনের কাজ, ভর্তুকি দিয়ে বাজার ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে পড়তে না দেয়া, ভোগবাদে সক্রিয় হয়ে যাতে দুর্নীতির আশ্রয় কেউ না নেয় সেদিকে নজর রাখা এবং সর্বোপরি দারুণ এক পরিশীলিত সমাজ বিনির্মাণে এগিয়ে যাওয়া চাট্টি খানি কথা নয়। এপর্যায়ে প্রতিপক্ষ শক্তি ও বিদেশি শক্তি আপনাকে পরখ করতে থাকে, ফাঁদ পেতে দেয় যাতে আপনি সহজে পা ফেলতে পারেন, লোভনীয় আবেদন জানাতে থাকে এবং চাটুকারদের কোনো অভাব হয় না। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার অপপ্রচার মোকাবেলা করতে হয় নির্মোহভাবে।
এভাবে বিপ্লবের পর ইরানের নেতৃত্ব অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা, ঘষামাজা করে শাসনব্যবস্থা সৃষ্টি করেছেন যাতে ফাঁকফোকর গলে বিপ্লবের অস্তিত্ব বিপন্ন না হয়ে পড়ে। কারণ, আন্তর্জাতিক রীতিনীতির অনেক কিছুই ইরানের জাতীয় স্বার্থবিরোধী ছিল যা ইরানের নেতৃত্ব পরখ করে সাবধানতার সঙ্গে এড়িয়ে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে দেননি; বরং তার চেয়ে টেকসই ও উন্নত অবস্থান নিয়ে দেশ ও দেশের মানুষকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। নির্বাচন ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের আস্থা রয়েছে। যারা নির্বাচিত হন, তারাও স্বাধীনভাবে দেশ পরিচালনা করতে পারছেন। জনগণের জন্যে নির্বাচিত প্রতিনিধি জনগণের হয়ে কাজ করতে পারছেন। প্রকৃত অর্থে ইরান তা অর্জন করেছে। ৩৭ বছরে ৩২টি নির্বাচন হয়েছে। স্থানীয়, পার্লামেন্ট ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়েছে সরাসরি জনগণের ভোটে। ইরান আজ প্রকৃত অর্থে স্বাধীন।
এজন্যে তাদের অনেক সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়েছে। একটা সময় পর্যন্ত বিমানের খুচরা যন্ত্রাংশ না পাওয়ায় ইরানে কিছু বিমান উড়তে পারেনি। কিন্তু সক্ষমতা যখন অর্জন হয়ে গেছে তখন শত শত বিমান ক্রয়ের জন্য চুক্তি করতে ইরানের অর্থনীতিতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। বিরাট এক পর্যায়ে বিপ্লবের পরও ত্যাগ ও তীতিক্ষার বিনিময়ে ইরানের মানুষ অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য দিন গুণেছেন। রাতে অপেক্ষা করেছেন কবে নতুন সূর্য উদিত হবে। হ্যাঁ রাত পোহাবার অনেক বিলম্ব ছিল, কিন্তু জনগণকে ইরানি নেতৃত্ব পুনরায় হতাশার চোরাগলিতে ঠেলে দেননি। পাখি যেমন তার বাচ্চাকে পালক দিয়ে আগলে রাখে, দিনভর খাদ্য অন্বেষণের পর ছানাটির মুখে তুলে খাইয়ে দেয় তেমনি ইরানের নতুন প্রজন্ম এখন সঠিক নেতৃত্বের কারণে গড়ে উঠেছে মর্যাদার সঙ্গে নিত্যনতুন আবিষ্কার আর কঠিন লড়াইয়ে জয়ের তৃপ্তি নিয়ে। তা যে মোটেই সহজ ছিল না এটি সত্যি। অবরোধ ছিল বলে জীবনরক্ষাকারী ওষুধের অভাবে হাসপাতালে রোগীদের কখনো কখনো কঠিন সময় পার করতে হয়েছে। তবু পরাশক্তিদের ধংসাত্মক সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি ইরানের শাসকরা। কারণ, তারা যদি বিদেশি চাপ মেনে নিতেন তাহলে হয়ত অনেক সস্তায় দেশের তেল ও গ্যাস সম্পদ তুলে দিতে হত অন্যদেশের হাতে এবং তা বিক্রি করে যে প্রচুর অর্থ পেতেন তা খরচ করতে হত তাদেরই তৈরি অস্ত্র সম্ভার ক্রয়ে। এভাবেই বানরের পিঠা ভাগের মত উন্নয়ন তত্ত্ব কখনোই মেনে নেননি ইরানের শাসকরা। কারণ, বিপ্লবের কাছে তাদের প্রতিশ্রুতি ছিল, ছিল কঠিন সংকল্প। তাদের নিজের খেয়াল-খুশি কখনই প্রাধান্য পায়নি। বিশ্বজুড়ে যে ক্ষমতা ও প্রভাবের খপ্পড়ে পড়ে জঙ্গলের আইনকে মেনে নেয়া থেকে বেরিয়ে আসতে মুক্তিপাগল ইরানি জনগণ অনেক রক্ত দিয়েছে। দাসত্ব থেকে মুক্তি পেতেই নতুন কাঠামো বিনির্মাণ করতে হয়েছে। কারণ, বিপ্লবের চাওয়া ছিল একটি আদর্শ ভবিষ্যৎ ও স্থিতিশীল পরিবেশ যা দেখে কেবল বিদেশি বিনিয়োগকারীরাই নয়, পর্যটকরাও ছুটে আসবে সেই বিস্ময়কর অনুসন্ধানের জন্য। বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো সেই আভাসই দিচ্ছে। এবছর ইরান হবে বিশ্বপর্যটকদের দ্বিতীয় গন্তব্য।
ইরান দাঁড়িয়ে আছে এমন সব দৃঢ় কৌশলের ওপর যার ভিত্তিমূল হচ্ছে ইসলামী বিপ্লব। এজন্য সারা বিশ্বে ইরান অন্য ধরনের বিশেষ মর্যাদা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এ কৌশলের কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারমাণু শক্তি বিষয়ে সম্পর্ক গড়ে উঠছে, ইরান যুক্তরাষ্ট্রে ভারী পানি রপ্তানি করতে যাচ্ছে। অথচ পশ্চিমাশক্তি একদিন ইরানের দিক থেকে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়েছিল। ইসলামোফোবিয়া ও ইরানোফোবিয়াকে এক করে ফেলেছিল। আড়াই হাজার বছরের রাজতন্ত্র কিন্তু কম শক্তিশালী ছিল না কিংবা তার পক্ষে পরাশক্তির নেক নজরে ছিল না, তা নয়। কিন্তু জনগণের ইচ্ছা ও মানুষের শক্তি সেখানে রাষ্ট্রক্ষমতায় প্রতিফলিত হয়নি। ইসলামী বিপ্লব সে সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। কি রাজনৈতিক কি সামরিক কি অর্থনৈতিক কি সামাজিক সবদিক থেকেই ইরান এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে অন্যদেশের জন্য উদাহরণ সৃষ্টি করছে। এজন্যে সন্ত্রাস থেকে শুরু করে সকল ধরনের আন্তর্জাতিক অপকৌশল মোকাবেলা করতে হয়েছে দেশটিকে। ইউরোপের দ্বারপ্রান্তে থেকে মধ্য এশিয়ার প্রতিবেশী হয়ে ইরান এখন এশিয়া ও ইউরেশিয়াকে যোগাযোগের সেতু বন্ধনে মিলিত হতে উদ্যোগ নিয়েছে। এখন চীন থেকে এগিয়ে আসছে মনতুন সিল্ক রেল পথ দিয়ে প্রথম ট্রেনটি। দেশটির জিনজিয়াং প্রদেশ থেকে ট্রেনটি কাজাকস্তান ও তুর্কমেনিস্তান হয়ে ইরানের রাজধানী তেহরানে এসে পৌঁচেছে ১৪ দিনে ১০ হাজার ৩৯৯ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে। মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে রেলপথে চীনের এ যোগাযোগ পথে যোগ দিতে যাচ্ছে জার্মানির ডুইসবার্গ ও স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদ। ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া এভাবেই নতুন রেলপথে যুক্ত হয়ে বিকল্প অর্থনীতির খোঁজ দিচ্ছে।
২০১৩ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং নতুন ‘সিল্ক রোড ইকনোমিক বেল্ট এবং ২১তম সমুদ্র সিল্ক রোড’ উদ্বোধন করেন যাতে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের সঙ্গে শক্তিশালী যোগাযোগ ব্যবস্থায় মহাসড়ক, রেলপথ ও বিমানবন্দর নির্মাণ হচ্ছে। খরচ হচ্ছে ১৪ হাজার কোটি ডলার। মধ্যপ্রাচ্যের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ইরানের সঙ্গে ১৫টি দেশের স্থল ও জলসীমা রয়েছে। স্বভাবতই নতুন সিল্ক রোড প্রকল্পে ইরান মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরেশিয়ার সঙ্গে চীনের যোগাযোগ করিয়ে দিতে আগামী ছয় বছরে ইরান নতুন সিল্ক রোডে ৬০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে।
হ্যাঁ, এ হচ্ছে এমন একটি দেশ যার আগামী বাজেটে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮ শতাংশ। এজন্যে প্রয়োজন ৫০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ। ইতিমধ্যে ইতালির সঙ্গে ১৭ ও ফ্রান্স এর সঙ্গে ৪০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ চুক্তি সই করেছে ইরান। পশ্চিমা অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা এ বিনিয়োগের পরিমাণ আগামী কয়েক মাসে চার’শ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে। একদিকে ১২ বছরের অর্থনৈতিক অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা আলোচনার টেবিলে মীমাংসায় কূটনৈতিক ধীশক্তির ব্যবহার করে সফল পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়া এবং আরেকটি হচ্ছে সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তান সহ মধ্যপ্রাচ্যের সংকটগুলোকে সামরিক শক্তি ব্যবহারের পরিবর্তে আলোচনার টেবিলে এনে মীমাংসার পথে এগিয়ে নেয়ার একটি সম্ভাবনা সৃষ্টি করা। জাতিসংঘ, পরাশক্তিগুলো এখন ইরানের এ দুটি পথকে অনুসরণ করবে বলেই মনে হচ্ছে। ইসলামী ইরানের বিপ্লব এমন এক অর্থনৈতিক ভিত গড়ে দিয়েছে যে দেশটিতে বিভিন্ন খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে শুরু করে চীন, ভারত, লাতিন আমেরিকা, এমনকি খোদ যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে বহুজাতিক ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিমান তৈরির কোম্পানিগুলো ধেয়ে আসছে। অর্থনৈতিক অবরোধ ছিল কোথায়? ইরানের কাছ থেকে তেল গ্যাস না কিনে উৎপাদনশীলতা বিনষ্ট হওয়ায় ইউরোপ নিশ্চিত হয়েছে যে মন্দা থেকে বের হতে হলে তার ইরানের সঙ্গে বন্ধুত্বের কোনো বিকল্প নেই।
আশির দশক থেকে ইসরাইল বলছে ইরান পারমাণবিক বোমা বানিয়ে ফেলল, দেশটির ওপর আক্রমণ করা উচিত ইত্যাদি। এতদিনে এটা পরিষ্কার যে, এধরনের হুঙ্কার দিয়ে বিশ্বের নজর অন্যদিকে সরিয়ে ফিলিস্তিনিদের ওপর কি না ধংসযজ্ঞ চালিয়েছে ইসরাইল। তখন মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশের জঙ্গি বিমান ওই আগ্রাসন ঠেকাতে আকাশে উড়েনি। কিন্তু ইয়েমেনে ঠিকই নিরস্ত্র জনগণের ওপর হামলে পড়েছে বিমানগুলো। পরাশক্তির চোখ রাঙ্গানি ও সামরিক বৈভবের মোকাবেলায় যুক্তি দিয়ে ইরানের বিদগ্ধ আলোচকরা শুধু সমঝোতায় নিয়ে আসেননি; বরং সহযোগিতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। ঢাকায় নিযুক্ত ইরানের রাষ্ট্রদূত ড. আব্বাস ভায়েজী দেহনাভী তাই এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেছেন, যে সব দেশ এতদিন ইরানের বিরুদ্ধে ছিল তারা অচিরেই ইরানের বন্ধু দেশে পরিণত হবে।
ইরান আসলে যা করেছে তা হচ্ছে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ নির্মাণ, সুশাসনের চর্চা, রাজতন্ত্রের পথ পরিহার, প্রযুক্তি ও সম্পদ সৃষ্টির কৌশল আয়ত্ত। ইরান যদি পারমাণবিক বোমা বানাতে অগ্রসর হত তাহলে । বরং দেশটি অর্থনীতিতে সংকট এড়িয়ে প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি করে কিভাবে বেকারত্ব দূর করতে বিনিয়োগ কৌশল সফল করে তোলা যায় সেখানেই মনোযোগ দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট রুহানি সম্প্রতি ইউরোপ সফরে বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে নিরাপদ এবং স্থিতিশীল দেশ ইরান। রুহানি আশ্বস্ত করে বলেছেন, ‘উগ্রপন্থা মোকাবিলার জন্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে একমাত্র উপায়। বেকারত্ব সন্ত্রাসবাদের জন্ম দেয়।’ রুহানি বলেন, ইরানের মত একটি স্থিতিশীল ও অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত গতিশীল একটি দেশের এখন প্রয়োজন বিশাল ও ব্যাপক বিনিয়োগ। শুধু বিনিয়োগ নয় প্রযুক্তিকে স্বাগত জানাই এবং সৃষ্টিশীল নতুন রপ্তানি বাজার তৈরি করতে চাই।
রয়টার্স এক প্রতিবেদনে বলছে, শুধু ইতালি কিংবা ফ্রান্স নয়, চীন, ভারত, জার্মানি, গ্রিস, ওমান, দক্ষিণ কোরিয়া, সুইজারল্যান্ড, তুরস্ক, ব্রিটেনের বিনিয়োগকারীরা গভীর আগ্রহের সঙ্গে ইরানে বিনিয়োগে অপেক্ষা করছে।
ইরানের জন্য আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কেন পশ্চিমা ধাঁচের অর্থনীতি মার খাচ্ছে তা লক্ষ্য রেখে বিকল্প ধাঁচের অর্থনীতি সৃষ্টি করা যেখানে বৈষম্য হ্রাস পাবে, বিনিয়োগে বেকারত্ব কমলেও বিনিয়োগে জনগণের সঞ্চয় স্ফীত হয়ে তা সমাজকে ভোগবাদিতায় নিমজ্জিত করবে না। একটা আর্থসামাজিক ভারসাম্য সৃষ্টি হলে ইরানের বিনিয়োগে উল্টো অন্যান্য দেশে যেতে শুরু করবে। একটি কল্যাণময় অর্থনৈতিক গতিধারা সৃষ্টি ইরানের অথনীতির জন্যে চ্যালেঞ্জ হিসেবে কাজ করবে। কারণ, বিশ্বঅর্থনীতি তেলনির্ভরতা কমাতে ব্যাপক বিকল্প প্রযুক্তিভিত্তিক হয়ে উঠতে শুরু করেছে।
ইসলামী বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেইনি ইসলামী বিপ্লব সম্পর্কে যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তা সত্যে পরিণত হয়েছে। এক ধর্ম ও রাজনীতির সঙ্গে এক চমৎকার বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়ে মতাদর্শগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিপ্লবের উত্তরণ ঘটেছে। দুই, কোনো রাজতন্ত্র বা পরাশক্তির সঙ্গে এ বিপ্লব আপোস করেনি। তিন, নিবিড় অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে ইজতেহাদের বিশুদ্ধতা ও গতিময়তাকে কাজে লাগিয়ে ব্যক্তি ও সমাজকে পরিশুদ্ধ করে তুলছে এ বিপ্লব। চার. সর্বোপরি স্বৈরশাসন ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে এ বিপ্লব অনুশীলনের মাধ্যমে সংঘবদ্ধ হয়ে ইরানের জনগণকে এমন এক মুক্তির স্বাদ দিয়েছে যা দিয়ে সাম্রাজ্যবাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব হচ্ছে।
ইরানে ইসলামী বিপ্লবের ৩৭তম বিজয়বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র কর্তৃক গত ৫ ফেব্রুয়ারী, বিএমএ মিলনায়তনে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রবন্ধটি পঠিত হয়।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক
সম্পাদকীয়
ইসলামী বিপ্লবের অব্যাহত বিজয়ধারা
ইরানী বর্ষপঞ্জির ২২শে বাহ্মান ১৩৯৪ (মোতাবেক ১১ই ফেব্রুয়ারি ২০১৬) ইরানের মহান ইসলামী বিপ্লবের ৩৭তম বিজয় বার্ষিকী। এদিন থেকে ৩৭ বছর আগে মহান নেতা হযরত ইমাম খোমেইনীর (রহ্.) নেতৃত্বে ইরানের সংগ্রামী জনগণ আড়াই হাজার বছরের স্বৈরাচারী তাগূতী রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ও বিজাতীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির তাঁবেদার শাহ্ ও তার সরকারকে উৎখাত করে ইসলামী শাসনব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করেন এবং তারই ধারাবাহিকতায় ইরানকে একটি ইসলামী প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হন।
বিশ্বের তাবত পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে ইরানের ইসলামী বিপ্লব শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা- যা কেবল একটি সরকারের পরিবর্তন ঘটায় নি; বরং সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও নৈতিকসহ ইরানী জনগণের জীবনে আমূল পরিবর্তন সৃষ্টি করেছে। শুধু তা-ই নয়, এ বিপ্লব সমগ্র বিশ্বের জনগণকে সকল দিক দিয়ে প্রভাবিত করেছে এবং শত্রু-মিত্র সকলের ওপর বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে বিশ্বপরিস্থিতির ভারসাম্যে এক আমূল পরিবর্তন সংঘটিত করেছে।
‘স্বাধীনতা, মুক্তি ও ইসলামী প্রজাতন্ত্র’- এ সেøাগানের মাধ্যমে ইরানের শান্তিপ্রিয় দ্বীনদার নিরস্ত্র জনগণ সুযোগ্য নেতার অধীনে তাদের ঈমানী শক্তির বদৌলতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় সামরিক শক্তির অধিকারী শাহী সরকারের পতন ঘটাতে সক্ষম হয়। এ বিপ্লবের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যসমূহ এ সেøাগানের মধ্যেই নিহিত ছিল এবং বিপ্লবের বিজয়ের পর বিগত ৩৭ বছরে এ লক্ষ্য-উদ্দেশ্যসমূহ উল্লেøখযোগ্য পরিমাণে অর্জিত হয়েছে। এ লক্ষ্য-উদ্দেশ্যসমূহ ছিল : বহিঃশক্তির তাঁবেদারী থেকে স্বাধীনতা, অভ্যন্তরীণ স্বৈরতন্ত্র থেকে মুক্তি, নিজেদের ভাগ্যনিয়ন্ত্রণকে নিজেদের হাতে গ্রহণ করা, জনপ্রতিনিধিত্বমূলক ও ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, স্বকীয় সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশের পথ উন্মুক্তকরণ এবং অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা অর্জন। ইরানের জনগণ ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের বদৌলতে বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান ও নিজেদের ভাগ্যনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা নিজেদের হাতে গ্রহণের লক্ষ্য পরিপূর্ণভাবে অর্জনসহ অন্যান্য লক্ষ্য-উদ্দেশ্যও উল্লেখযোগ্য মাত্রায় অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের পর মুহূর্ত থেকেই বিপ্লবের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক দুশমনরা এ বিপ্লবকে নস্যাৎ ও পথচ্যুত করার লক্ষ্যে সর্বাত্মক অপচেষ্টা চালিয়ে আসছে। এ লক্ষ্যে তারা বিপ্লবের বিজয়ের পর পরই সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে এ বিপ্লবের অগ্রসেনানী অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতা, ইসলামী চিন্তাবিদ, আলেম ও বিপ্লবী কর্মীকে হত্যা করেছে, ইসলামী ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে- যা সর্বশক্তি নিয়োগ করে আট বছর পর্যন্ত অব্যাহত রাখে এবং এ দেশকে সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে পঙ্গু করে আত্মসমর্পণে বাধ্য করার লক্ষ্যে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয়। সর্বোপরি তারা বিশ্বের জনগণকে সকল ক্ষেত্রে এ বিপ্লবের ইতিবাচক প্রভাব থেকে বঞ্চিত করার লক্ষ্যে বিপ্লব ও ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও বিভ্রান্তি ছড়াবার উদ্দেশ্যে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয়সাপেক্ষ পরিকল্পিত প্রচারযুদ্ধ চালিয়েছে- যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু আল্লাহ্ তা‘আলার অশেষ রহমতে তাদের সমস্ত ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়ে গিয়েছে এবং ইসলামী বিপ্লবের সেই ছোট্ট চারাগাছটি দিনের পর দিন যথাযথ বিকাশ ও বৃদ্ধির অধিকারী হয়ে আজ বিরাট ফলবান বৃক্ষে পরিণত হয়েছে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান বিগত ৩৭ বছরে বহু চড়াই-উৎরাই পার হয়ে জনজীবনের সকল ক্ষেত্রে বিরাট ও উল্লেখযোগ্য উন্নতি ও অগ্রগতির অধিকারী হয়েছে। এসব ক্ষেত্রের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বঞ্চিত জনগণের ভাগ্যোন্নয়ন, সাধারণ জনসেবা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, সকল ধরনের জ্ঞানগবেষণা, বিশেষ করে পারমাণবিক বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি ও ন্যানোটেকনোলজি, সুস্থ সংস্কৃতি ও শিল্পকলা, রুচিশীল চলচ্চিত্র নির্মাণ ও অন্যান্য ক্ষেত্র।
এ বিপ্লবের আরেকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য হচ্ছে সাধারণভাবে সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে এবং বিশেষভাবে তরুণ ও যুব প্রজন্মের ও সরকারি দায়িত্বশীলদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি। উদাহরণস্বরূপ, তাঁদের মধ্যে যে সচেতনতা ও আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে তার বদৌলতে দেশের পরিচালকগণ সাফল্যের সাথে দেশের ও জনগণের বৈধ স্বার্থের প্রতিরক্ষা করতে সক্ষম হয়েছেন। ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প সম্বন্ধে বিশ্বের ছয়টি শক্তিধর দেশের সাথে দীর্ঘ ১৮ মাস ব্যাপী আলোচনায় ইরানী কর্মকর্তাগণ যে দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন ও দেশের জন্য বিরাট সাফল্য নিয়ে এসেছেন তা-ই এর প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।
সবচেয়ে বড় কথা, ইরানের ইসলামী বিপ্লব রাজনৈতিক ও আদর্শিক দিক থেকে বিশ্ববাসীর সামনে একটি নতুন দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে এবং প্রমাণ করে দিয়েছে যে, এ যুগেও ইসলামী নীতি-আদর্শ ও বিধি-বিধানের ভিত্তিতে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং দ্বীনী ও পার্থিব উভয় দিক থেকে সাফল্যের সাথে পরিচালনা করা সম্ভবপর।
ইসলামী বিপ্লবের ৩৭তম বিজয় বার্ষিকী উপলক্ষে আমরা এ বিপ্লবের মহান রূপকার হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) এবং বিপ্লবের বিজয় ও প্রতিরক্ষার জন্য যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাঁদেরকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি এবং বিপ্লবের বর্তমান রাহ্বার হযরত আয়াতুল্লাহ্ ‘উয্মা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের জনগণ ও পরিচালকবৃন্দ, বিদেশে অবস্থানরত ইরানী নাগরিকগণ, বিশ্বের তাবত মুসলিম ও মুস্তায্‘আফ্ জনগণ এবং বিশেষভাবে নিউজলেটারের পাঠক-পাঠিকাগণ সহ বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের প্রতি অভিনন্দন জানাচ্ছি এবং সকলের জন্য সুস্থতা ও উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করছি।
স্মরণীয় বাণী
মহানবী (সা.) বলেন : ধন্য সেই ব্যক্তি যে বর্তমান ভোগ-বিলাসকে পরিহার করে এমন প্রতিশ্রুতির আশায় যা সে দেখে নি।
মহানবী (সা.) বলেন : আমি কি তোমাদের সংবাদ দেব না যে, তোমাদের মধ্যে কোন্ ব্যক্তি চরিত্রের দিক থেকে আমার অধিক সদৃশ? সবাই বলল : অবশ্যই, হে রাসূলুল্লাহ্! তখন তিনি বললেন : তোমাদের মধ্যে যে সবচেয়ে চরিত্রবান এবং সবচেয়ে সহিষ্ণু এবং তার আত্মীয়দের প্রতি সর্বাধিক সদাচারী, আর সন্তুষ্টি ও রাগান্বিত উভয় অবস্থায় নিজের পক্ষ থেকে সবচেয়ে বেশি ন্যায়-ইনসাফ রক্ষা করে চলে।
মহানবী (সা.) বলেন : আল্লাহ্ যাকে কোনো কাজের জন্য সওয়াবের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা তিনি রক্ষা করবেন। আর যাকে কোনো কাজের জন্য শাস্তির হুমকি দিয়েছেন সেটা ক্ষমা করার ইখতিয়ার তাঁর রয়েছে।
মহানবী (সা.) বলেন : ঈমানের দু’টি ভাগ। অর্ধেক ধৈর্যের মধ্যে আর অর্ধেক কৃতজ্ঞতার মধ্যে।
ইমাম আলী (আ.) বলেন : ঈমানের খুঁটি চারটি : আল্লাহ্্র ওপর ভরসা, কাজকে আল্লাহ্্র ওপর ছেড়ে দেওয়া, আল্লাহ্্র নির্দেশের প্রতি আত্মসমর্পণ করা এবং আল্লাহ্্র বিচারে সন্তুষ্ট থাকা। আর কুফ্রের খুঁটি চারটি : আসক্তি, ভীতি, ক্রোধ এবং প্রবৃত্তির কামনা।
ইমাম আলী (আ.) বলেন : হে লোকসকল! আল্লাহ্্কে ভয় করে চল। কারণ, আল্লাহ্্র আযাবে ধৈর্যধারণ করার চেয়ে তাকওয়ার জন্য ধৈর্যধারণ করা সহজতর।
ইমাম আলী (আ.) বলেন : সম্পদ আর সন্তান হলো দুনিয়ার ফসল। আর সৎকর্ম হলো পরকালের ফসল। আল্লাহ্্ মানুষের জন্য দুটিরই বন্দোবস্ত করেছেন।
ইমাম হোসাইন (আ.) বলেন : কৃপণ সেই ব্যক্তি যে সালাম প্রদানে কার্পণ্য করে।
ইমাম আলী ইবনুল হোসাইন যায়নুল আবেদীন (আ.) বলেন : হে আদমসন্তান! নিশ্চয় তুমি ততক্ষণ অবধি কল্যাণের মধ্যে রয়েছ যতক্ষণ তুমি নিজেই নিজের উপদেশদাতা হবে এবং নিজের হিসাব নিজেই কষবে এবং আল্লাহ্্র ভয়কে তোমার বহিঃআবরণ আর সতর্কতাকে তোমার অভ্যন্তরীণ পরিচ্ছদ করবে। হে আদমসন্তান! তুমি মৃত্যুবরণ করবে এবং পুনরুত্থিত হবে এবং আল্লাহ্্র সম্মুখে দণ্ডায়মান হবে। কাজেই তাঁর জন্য জবাব প্রস্তুত কর।
ইমাম মুহাম্মাদ আল-বাকের (আ.) বলেন : কোনো জিনিসই অপর জিনিসের সাথে এত উত্তমরূপে মিশে না যেমনটা অধ্যবসায় জ্ঞানের সাথে মিশে।
ইমাম বাকের (আ.) বলেন : আল্লাহ্্ অপছন্দ করেন যে, মানুষ পরস্পর থেকে চাওয়ার ক্ষেত্রে পীড়াপীড়ি করবে। কিন্তু তিনি তাঁর কাছে চাওয়ার ব্যাপারে পীড়াপীড়িকে পছন্দ করেন। মহান আল্লাহ্্ পছন্দ করেন যে, তাঁর কাছে প্রার্থনা করা হোক এবং যা তাঁর কাছে রয়েছে তা চাওয়া হোক।
ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেন : যে ব্যক্তি বিচক্ষণতা ছাড়া কাজ করে সে হলো সেই ব্যক্তির ন্যায় যে বিপথে চলে। যার দ্রুত চলা কেবল গন্তব্য থেকে তাকে দূরেই সরিয়ে দেয়।
ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেন : যে ব্যক্তি আহার করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তার সওয়াব সেই ব্যক্তির ন্যায় যে আল্লাহর জন্য রোযা পালন করে। আর কৃতজ্ঞ সুস্থ লোকের সওয়াব হলো ধৈর্যশীল বিপদাপন্ন ব্যক্তির ন্যায়।
শিশুদের সাথে ওয়াদা রক্ষার গুরুত্ব
আল্লাহতায়ালা শিশুদের সাথে প্রতিশ্রুতি রক্ষার ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। যেমন- আল্লাহর এক নবী হযরত ইসমাইল (আ.) সম্পর্কে বলেছেন, “স্মরণ করো, এই কিতাবে উল্লেখিত ইসমাইলের কথা। সে ছিল প্রতিশ্রুতি পালনে সত্যাশ্রয়ী এবং সে ছিল রাসূল ও নবী।” (সূরা মরিয়ম : ৫৪)।
একজন ধর্মপ্রাণ ও সত্যনিষ্ঠ মানুষ তাঁর কৃত যে কোন প্রতিশ্রুতি বা ওয়াদা রক্ষা করেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা মুসলমানদেরকে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও অন্যান্য সব ধরনের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার আদেশ দিয়ে বলেছেন, “হে মুমিনগণ! তোমরা অঙ্গীকার পূরণ করবে।” (সূরা মায়িদা : ১)।
পবিত্র কুরআনের অন্যত্র আল্লাহতায়ালা বলেছেন, “অবশ্যই সফলকাম হয়েছে মুমিনগণ এবং যারা নিজেদেরকে নামাজে যতœবান থাকে।” (সূরা মুমিনুন : ১ ও ৯)। পবিত্র কুরআনে আরো বলা হয়েছে, “এবং প্রতিশ্রুতি পালন করবে; প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে।” (সূরা বনী ইসরাইল : ৩৪)
কোন ব্যক্তি যদি তার কৃত ওয়াদা পূরণ না করে তাহলে তার উপর থেকে অন্যের আস্থা বিনষ্ট হয়। কোন সমাজে বা সামাজিক জীবনে এমনটি ঘটলে ঐ সমাজ বা সামাজিক জীবনের জন্য তা হবে আত্মঘাতী।
প্রতিশ্রুতি পূরণ শিশুদের আস্থা অর্জনের উপায়
হে পিতা-মাতাগণ! আপনাদের সন্তানদের দীপ্তিমান চক্ষুযুগল আপনাদের আচরণ প্রত্যক্ষ করে এবং আপনারা যে সব শব্দ উচ্চারণ করেন, সন্তানদের কান তা শুনতে পায়। ছোট ছোট নিষ্পাপ বাচ্চারা আজকে যে পরিবেশে গড়ে উঠছে এবং তাদের সাথে যে ব্যবহার করা হচ্ছে আগামী দিনে তারই প্রতিফলন ঘটবে তাদের জীবনে।
তাদের দৃষ্টিতে আপনাদের চেয়ে অধিক মহৎ ও অধিক জ্ঞানী আর কেউ নেই। তারা আপনাদের উপর আস্থা রাখে। সেই সাথে আপনারা যা করেন এবং যা বলেন সে ব্যাপারেও তারা মনোযোগী থাকে।
পিতা-মাতাকে তাদের সন্তানদের সাথে সকল কাজ ও আচরণে সৎ হতে হবে এবং তাদের সাথে কৃত সকল প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হবে। শিশুরা যখন বুঝবে যে, তাদের পিতা-মাতা তাদেরকে দেয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করবে, তখন তারা তাদের দুষ্টুমি বন্ধ করবে। শিশুরা মনে মনে ভাবে মিথ্যা বলা, রাগান্বিত ও মেজাজী হওয়া, জিদ করা বা কথা ভঙ্গ করা, কোন নৈতিক ত্রুটি নয়। তাই এর বিপরীতে পিতা-মাতাকে সৎ ও প্রতিশ্রুতি পূরণকারী হতে হবে এবং কখনই মিথ্যা বলা চলবে না। মহানবী (সা.) জনসাধারণকে তাদের সন্তানদের ভালবাসতে, তাদের সাথে সদয় ব্যবহার করতে এবং তাদেরকে দেয়া সকল প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে বলেছেন। (তাফসিল ওয়াসা’ইলুস শিয়া, তৃতীয় খ-, পৃষ্ঠা-১৩৪)
বাট্রান্ড রাসেল বলেছেন, “যে সব পিতা-মাতা তাদের সন্তানদের সাথে সদাচারণ করেন, তারাই তাদের আস্থা অর্জন করেন। শিশুরা আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে যে, বড়রা তাদেরকে যা বলে তা সব সত্য এবং সত্যিকার অর্থেই বড়রা শিশুদেরকে যা বলেছে তা সত্য বলে যদি তারা বুঝতে পারে, তাহলে খুব সহজেই বড়দের উপর আস্থাশীল হবে।
কথিত আছে যে, একবার এক মার্কিন রাষ্ট্রদূত এক সরকারী কর্তৃত্বশালী ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন। সেখানে উপস্থিত ছিল ঐ কর্তৃত্বশালী ব্যক্তির এক পুত্র। রাষ্ট্রদূত ছেলেটিকে বলেছিলেন, তিনি তার হাতঘড়ির সোনার চেইনটি তাকে দিয়ে দেবেন। কিন্তু রাষ্ট্রদূত তাঁর প্রতিশ্রুতি পূরণ করেননি।
ছেলেটি দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে, কিন্তু রাষ্ট্রদূত বুঝতে পারেন না ছেলেটি কেন দাঁড়িয়ে রয়েছে। পরে ছেলেটির পিতা এসে বলেন, আপনি আপনার প্রতিশ্রুতি পূরণ করবেন এটি দেখার জন্যই সে দাঁড়িয়ে আছে। কেননা কেউ প্রতিশ্রুতি দিল অথচ তা পূরণ হলো না, এমনটি সে কখনো দেখেনি। রাষ্ট্রদূত এই মৃদু সমালোচনায় লজ্জাবোধ করলেন।
বাট্রান্ড রাসেল বলেছেন, পিতা-মাতা বা বড়দের অত্যন্ত খারাপ একটি মনোভাব হলো শিশুদের শাস্তি দেয়ার হুমকি দেয়া। অথচ আপনি নিজেই প্রকৃতপক্ষে তাকে সাজা দিতে আগ্রহী নন।
ড. বেলার্ড তাঁর এক গ্রন্থে বলেছেন, পরিবর্তনীয় কঠোরতা কখনও কাউকে কোন কিছুতে ভীতু বা হুমকিগ্রস্ত করে না। আপনি যদি কোন কঠোরতা দেখান তাহলে তা বজায় রাখুন।
শিশুদের সাথে বিতর্ক করবেন না এবং তাদের সাথে নিজস্ব ভাষায় কথা বলুন
মহানবী (সা.) বলেছেন, শিশুদের সাথে এমনভাবে কথা বলা উচিত যাতে তারা বুঝতে পারে। শিশুদের সাথে আচরণে সহনশীল ও দয়াপরবশ হও এবং তাদেরকে বুঝতে চেষ্টা করো।
রুশো বলেন, শিশুদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করতে হবে তাদের ধারণা ও বোধগম্যতার মধ্যে থেকে। অন্যথায় তারা আপনার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবে না।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন লক পরামর্শ দিয়েছেন, শিশুদের সাথে এমন সব যুক্তি সহকারে কথা বলতে হবে যা নিত্যদিনের সাধারণ ঘটনাবলীর মতো সহজ। রুশো এ ধরনের পরামর্শ নাকচ করে দিলেও তা প্রয়োগ করে দেখা যেতে পারে বলে স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, যে শিশুর সামনে বেশী যুক্তি উপস্থাপন করে তার মতো বোকা পৃথিবীতে নেই।
মানবকুলের মানসিক প্রতিভা, যুক্তি-তর্ক, অন্যান্য প্রতিভার সমন্বয়ে সর্বশেষ যে ধারণা গড়ে ওঠে তা অধিক কঠিন। তাই যুক্তি-তর্ক মানুষের প্রতিভার বিকাশ ঘটায় এমনটি ধারণা করা পুরোপুরি সঠিক নয়।
শিশুদের গড়ে তোলার সর্বোত্তম শিক্ষা হচ্ছে তাদেরকে যুক্তিগ্রাহ্য করা। কিন্তু এমনভাবে কথা বলা, যাতে তারা বুঝতে পারে।” (তাফসির ওয়াসা’ইলুস শিয়া ৩য় খ-, পৃষ্ঠা-৩১৫)
কথিত আছে যে, একদা মহানবী (সা.) তাঁর কয়েকজন সাহাবীকে নিয়ে বাইরে বেড়াতে যাচ্ছিলেন। সেখানে তিনি তাঁর দৌহিত্র ছোট বালক ইমাম হোসাইন (আ.) কে তাঁরই বয়সী একটি মেয়ের সাথে ছুটাছুটি করতে দেখলেন। মহানবী (সা.) তাঁর কাছে গেলেন। কিন্তু তিনি এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করতে লাগলেন। মহানবী (সা.)ও শিশুসুলভ দৌড় দিয়ে তার দৌহিত্রকে হাসিয়ে তুললেন। তিনি তাঁর একটি হাত শিশু হোসাইনের থুতনির নীচে এবং একটি তার মাথার উপর রেখে বলেন, “আমি হোসাইন থেকে এবং হোসাইন আমা থেকে। আল্লাহ তাকে ভালোবাসেন এবং তিনি আল্লাহকে ভালোবাসেন।” (আল খুলকুল কামিল, দ্বিতীয় খ-, পৃষ্ঠা-১৮৩) মহানবী (সা.) আরো বলেছেন, “যারা তাদের জ্ঞানের বাইরে জনসাধারণের সাথে কথা বলে, তাদের সে সব কথা তাদের কারো কারো কাছেই বিপরীতার্থক হতে পারে।”
কুরআন ও হাদীসের আলোকে হযরত আলী (আ.)-এর পরিচয়
মুহাম্মদ আলী আলী রেজায়ী
তাওহীদপন্থীদের ইমাম (ইমামুল মুওয়াহহেদীন) হযরত আলী (আ.)-এর শাহাদাত উপলক্ষে সকল মুসলমানের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করে আল্লাহ পাকের দরবারে মুনাজাত করছি, তিনি যেন আমাদেরকে তাঁর সত্যিকার অনুসারী হওয়ার তাওফীক দান করেন।
মাহে রমযানে তাঁর শাহাদাত উপলক্ষে কিছু কথা লেখা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেই মহান ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে সামান্যতম আলোচনা করাও কারো পক্ষে সম্ভব নয়- তাঁর মহান শাহাদাত উপলক্ষে বিস্তারিত আলোচনা করা তো অনেক দূরের কথা। কেননা, তিনি এমন একজন ব্যক্তিত্ব, যার পুরো জিন্দেগী অবিস্মরণীয় গৌরব ও বীরত্বগাথায় পরিপূর্ণ। যিনি সর্বাবস্থায় মহানবী (সা.)-এর হুকুম ও আদেশ পালনে প্রস্তুত ছিলেন। যিনি বলেছিলেন যে انا عبد من عبيد محمد ‘আমি মুহাম্মদের গোলামদের মধ্য থেকে একজন গোলাম।’ অর্থাৎ তিনি নিজেকে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর একান্ত অনুগত বলে মনে করতেন এবং সর্বাবস্থায় তাঁর সঙ্গী ও সাহায্যকারী ছিলেন। তিনিই সর্বপ্রথম পয়গাম্বরের (সা.) প্রতি ঈমান আনেন। জীবনের শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত দীনে মুহাম্মদীর সাহায্য ও প্রতিরক্ষায় চরম ত্যাগ ও কুরবানী করেন।
শেষ পর্যন্ত একই পথে পবিত্র রমযান মাসের ১৯ তারিখ আঘাতপ্রাপ্ত হন এবং ২১ রমযান শাহাদাত বরণ করেন। ঐ সময় তিনি বলেছিলেন : فزت و رب الکعبة ‘কা’বার প্রভুর শপথ, আমি বিজয়ী হয়েছি।’
এহেন ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা যে কারো সাধ্যের বাইরে। তাঁর সর্বোত্তম পরিচয়দাতা হচ্ছে কুরআন মজিদের বিভিন্ন আয়াত ও শিয়া-সুন্নী সূত্রে বর্ণিত বিভিন্ন হাদীস। আমরা এখানে উদাহরণ হিসাবে হযরত আলী (আ.) সম্পর্কিত কুরআন মজিদের কয়েকটি আয়াত ও রাসূলে পাকের কয়েকটি হাদীস আহলে সুন্নাতের তথ্যসূত্রসহ উল্লেখ করছি।
এক :
من المؤمنين رجال صدقوا ماعاهدوا الله عليه فمنهم من قضي نحبه ومنهم من ينتظر وما بدلوا تبديلا
“মুমিনদের মধ্যে এমন পুরুষ রয়েছে যারা আল্লাহর সাথে কৃত প্রতিশ্রুতির (আল্লাহর রাস্তায় আত্মত্যাগ) উপর অবিচল রয়েছে। তাদের মধ্যে কিছুলোক তাদের ওয়াদা পূর্ণ করেছে। আর কিছু লোক অপেক্ষায় আছে এবং তাদের প্রতিশ্রুতিতে কোনরূপ পরিবর্তন করেনি।” (সূরা আহজাব : ২৩) এ আয়াতে কাকে উদ্দেশ্য করে কথা বলা হয়েছে তা নিয়ে মুফাসসীরদের বিভিন্ন মত রয়েছে। নিশ্চিতভাবে শাহাদাতের জন্য অপেক্ষমান লোকদের মধ্যে হযরত আলী (আ.) অন্যতম। আহলে সুন্নাতের কোন কোন মুফাসসীর এ মতটির কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন- (১) হাকেম আবুল কাসেম হেসকানী হানাফী ‘শাওয়াহেদুত্ তানযীল’ কিতাবের ১ম ও ২য় খ-ে ৬২৭ ও ৬২৮ নম্বর হাদীসে হযরত আলী (আ.) থেকে এ মর্মে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন :
رجال صدقوا
আয়াতটি আমাদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। খোদার কসম, আমি কি সেই ব্যক্তি যে শাহাদাতের জন্য অপেক্ষা করছি! আমি কখনো নিজের কর্মপন্থা পরিবর্তন করিনি, আমি আমার প্রতিশ্রুতির উপর অবিচল রয়েছি।’
(২) কান্দুযী হানাফী প্রণীত ‘ইয়ানাবিউল মুওয়াদ্দাত’ ইস্তম্বুলে মুদ্রিত পৃষ্ঠা : ৯৬ এবং হায়দারিয়া ছাপাখানায় মুদ্রিত, পৃ: ১১০।
(৩) মানাকেবে খাওয়ারেজমী হানাফী, হায়দারিয়া ছাপাখানায় মুদ্রিত, পৃষ্ঠা : ১৯৭।
(৪) তাযকেরায়ে ইবনে জাওযী হানাফী- পৃঃ ১৭।
(৫) আসসাওয়ায়েকুল মুহরেকা পৃঃ ৮০।
(৬) শাবলাঞ্জী নূরুল আবসার, সাদীয়া প্রেসে মুদ্রিত- পৃঃ ৭৮
(৭) তাফসীরে খাজেম ৫ম খ-, পৃষ্ঠা ঃ ২০৩।
(৮) ফাজায়েলুল খাম্সা মিনাস সেহাহ আস্ সিত্তা ১ম খ-, পৃঃ ২৮৭।
আয়াতটি খন্দকের যুদ্ধ প্রসঙ্গে অবতীর্ণ। ঐ সময় কাফের ও মুশরিকদের বিশাল বাহিনী মদীনার দিকে অভিযান পরিচালনা করে।
রসূলে খোদা (সা.) তাদের অভিযান সম্পর্কে অবহিত হয়ে পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেন যে, মদীনার চার পাশে খন্দক খনন করা হবে, যাতে দুশমন মদীনার অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে না পারে। খন্দক খননের পর শত্রু বাহিনী এ অবস্থায় মুখোমুখি হয়ে হোঁচট খায়। এরপর মাত্র কয়েকজন ব্যতীত শত্রুসৈন্যরা খন্দক বেষ্টনীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারেনি। অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে আমর ইবনে আবদু ছিল প্রচ- বীরত্বের অধিকারী। সে মল্লযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে প্রতিদ্বন্দীর জন্য হাঁক দিতে থাকে। মুসলমানরা তখন ইতস্তত বোধ করছিলেন। এ সময় হযরত আলী (আ.) তার সাথে সম্মুখ যুদ্ধে লড়তে প্রস্তুত হন। ঠিক ঐ সময় নবী করিম (সা.) হযরত আলীর জন্য দোয়া করেন এবং এ বিখ্যাত উক্তিটি করেন-
برز الايمان كله الشرك كله
অর্থাৎ “সমগ্র ঈমান (আলী) সমগ্র কুফরের মুখোমুখি হয়েছে।”
আলী যদি পরাজিত হয় প্রকৃতপক্ষে ইসলাম ও ঈমান পরাজয় বরণ করবে আর যদি আমর ইবনে আবদু পরাজিত হয় তাহলে সমস্ত কুফরই যেন পরাজিত হবে। শেষ পর্যন্ত হযরত আলী (আ.) জয়লাভ করেন। তিনি আমর ইবনে আবদুকে হত্যা করেন। এ প্রসঙ্গে নবী করিম (সা.) বলেন,
لضربة علي يوم الخندق افضل من عبادة الثقلين
অথবা
ضربة علي يوم الخندق افضل من اعمال امتي الي يوم القيامة
“খন্দকের দিন আলীর আঘাতের মর্যাদা মানব ও জ্বিন উভয় জাতির ইবাদতের চাইতে উত্তম।” অথবা “খন্দকের দিন আলীর একটি আঘাতের মর্যাদা উম্মতের কিয়ামত পর্যন্ত সময়ের ইবাদতের চাইতে উত্তম।”
শত্রুর উপর হানা হযরত আলীর একটি আঘাতের এতখানি মূল্য কেন সে বিষয়টিও পরিষ্কার। কেননা, হযরত আলীর এ আঘাত যদি সেদিন না হত তাহলে হয়ত কুফরী শক্তি জয়লাভ করত। পরিণামে ইসলামের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে যেত। অন্যদের ইবাদত-বন্দেগী করার অবকাশ তখন কিভাবে থাকত? এ বর্ণনাটি সুন্নী আলেমগণ তাদের কিতাবে উল্লেখ করেছেন। যেমন-
(১) আল্লামা ইযযুদ্দীন ঈজী প্রণীত ‘কিতাবে মুওয়াফেক’ ইস্তামবুলে মুদ্রিত-পৃঃ ৬১৭।
(২) ফখরুদ্দীন রাজী প্রণীত নেহায়াতুল উকুল ফি দেরায়াতিল উসুল। পা-ুলিপি-পৃঃ ১১৪।
(৩) আল্লামা তাফতাযানী প্রণীত সারহুল সাকাসেদ ২য় খ-, পৃঃ ২৩০
(৪) আল্লামা কান্দুযী প্রণীত “ইয়ানাবিউল মুওয়াদ্দাত’ ৯৫ ও ১৩৭ পৃষ্ঠা। ইস্তামবুলে মুদ্রিত।
(৫) আল্লামা মওলভী আদ দেহলভী প্রণীত ‘তাজহীযুল যাহিশ-পা-ুলিপি পৃঃ ৪০৭।
(৬) আল্লামা বেহজাত আফিন্দী প্রণীত “তারিখে আলে মুহাম্মদ’ পৃঃ ৫৭।
দুই :
“লোকদের মধ্যে এমন অনেক আছে, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির বিনিময়ে নিজেদের প্রাণকে বিক্রি করে, আল্লাহ তার বান্দাদের প্রতি দয়াশীল।” (সূরা বাকারা ঃ ২০৬)
ومن الناس من يشري نفسه ابتغاء مرضات الله والله رؤف بالعباد
এ আয়াতও হযরত আলী (আ.) প্রসঙ্গে অবতীর্ণ হয়েছে। পয়গাম্বর (সা.) যখন মক্কা থেকে মদীরায় হিজরত করার সিদ্ধান্ত নেন এবং মক্কার মুশরিকরা রাতে হযরতের উপর হামলা করে তাঁকে হত্যার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তখন আল্লাহ তায়ালা পয়গাম্বর (সা.)কে মুশরিকদের নীল নকশা সম্পর্কে অবহিত করেন। তখন হযরতের বিছানায় শুয়ে থাকার জন্য হযরত আলী (আ.) তৈরী হন।
সে রাতটি ‘লাইলাতুল মুবিত’ নামে প্রসিদ্ধ হয়। কোন কোন সুন্নী আলেমও সে বর্ণনাটি সমর্থন করেছেন। যেমন-
(১) হাসকানী হানাফী প্রণীত শাওয়াহেদুত তানযীল ১ম খ-, পৃঃ ১৩৩ থেকে ১৪১।
(২) ইবনে সাব¦াগ মালেকী প্রণীত “ফসুলুল মুহিম্মাত” হায়দারিয়া ছাপাখানায় মুদ্রিত-পৃঃ ৩১।
(৩) সাবত ইবনে জাওযী প্রণীত ‘তাযকিরাতুল খাওয়াস’ হায়দারিয়া ছাপাখানায় মুদ্রিত- পৃঃ ৩৫ ও ২০০।
(৪) কান্দুযী হানাফী প্রণীত ‘ইয়ানাবিউল মুওয়াদ্দাত’ ইস্তামবুলে মুদ্রিত, পৃঃ ৯২।
(৫) ফাখরুদ্দীন রাযীর তাফসীরে কবীর ৫ম খ- পৃঃ ২২৩। মিশরে মুদ্রিত।
(৬) শাবলাঞ্জী প্রণীত ‘নূরুল আবসার’ ওসমানিয়া জাপাখানায় মুদ্রিত, পৃঃ ৭৮
(৭) মুসনাদে আহমদ ১ম খ- পৃঃ ৩৪৮।
তিন :
انما انت منذر ولكل قوم هاد
“হে নবী ঃ তুমি ভয় প্রদর্শনকারী ঃ প্রত্যেক জাতির জন্য রয়েছে পথ প্রদর্শক (সূরা রা’দ ঃ ৭)
শিয়া ও সুন্নীদের অনেক কিতাবে পয়গাম্বর (সা.)-এর নিকট থেকে বর্ণিত যে, পয়গাম্বর (সা.) বলেছেন, আমি ভয় প্রদর্শনকারী আর হযরত আলী পথপ্রদর্শক। আহলে সুন্নাতের যে সব সূত্রে এ বর্ণনাটি এসেছে তন্মধ্যে রয়েছে ঃ
(১) ফখরে রাযী প্রণীত তাফসীরে কাবীর- ৫ম খ- পৃঃ ২৭১। দারুত তাবাআহ আমেরাহ্, মিশরে মুদ্রিত এবং এছাড়া অন্য এক সংস্করণের ২১তম খ-, পৃষ্ঠা ঃ ১৪
(২) তাফসীরে ইবনে কাসীর- ২য় খ-, পৃষ্ঠা ঃ ৫২
(৩) দুররুল মানসুর-সুয়ূতী ৪র্থ খ-, পৃষ্ঠা ৪৫।
(৪) আলুসী প্রণীত রুহুল মায়ানী ১৩তম খ-, পৃঃ ৭৯।
(৫) হাসকানী হানাফী প্রণীত “শাওয়াহেদুত তানযীল” ১ম খ- পৃঃ ২৯৩ ও ৩০৩, হাদীস নং ৩৭৮-৪১৬।
(৬) তাফসীরে শওকানী ৩য় খ-, পৃঃ ৭০।
(৭) ইবনুস সাব¦াগ মালেকী, ফসুলুল মুহিম্মাত পৃঃ ১০৭।
(৮) শাবলেবখী প্রণীত ‘নূরুল আবসার’ পৃঃ ৭১। ওসমানিয়া ছাপাখানায় মুদ্রিত, মিশর।
(৯) কান্দযী হানাফী প্রণীত ‘ইয়ানাবিউল মুওয়াদ্দাত’ পৃঃ ১১৫ ও ১২১ হায়দারিয়া ছাপাখানায় মুদ্রিত।
চার :
انما وليكم الله و رسوله والذين أمنوا الذين يقيمون الصلوة ويؤتون الزكوة وهم راكعون
“নিশ্চয়ই তোমাদের অভিভাবক হচ্ছেন আল্লাহ, তাঁর রসূল এবং যারা ঈমান এনেছে আর রুকু অবস্থায় যাকাত দান করে।” (সূরা মায়েদা ঃ ৫৫)
হযরত আলী (আ.)-এর ব্যাপারে এ আয়াত নাযিল হয়েছে। ঘটনাটি ছিল এই যে, একজন ভিখারী মসজিদে প্রবেশ করে সাহায্যের প্রার্থনা জানায়। কিন্তু কেউ তাতে সাড়া দেয়নি। ঐ সময় হযরত আলী (আ.) নামাযে রুকুতে ছিলেন। ঐ অবস্থাতেই তিনি আঙ্গুলের ইশারা করেন। ভিখারী কাছে আসে এবং হযরত আলীর হাত থেকে তাঁর আংটিটি খুলে নেয়।
এ আয়াতের শানে নযূল যে হযরত আলী (আ.) তা আহলে সুন্নাতের মুফাসসীরগণও সমর্থন করেছেন এবং তাদের তাফসীরের কিতাবে তা উদ্বৃত করেছেন।
যেমন-
মুুহিউদ্দীন তাবারী প্রণীত যাখায়েরুল ওকবা পৃঃ ৮৮, কায়রোর মাকতাবাতুল কুদসী হতে মুদ্রিত।
১. তাফসীরে রুহুল মাআনী ৬ষ্ঠ খ-, পৃঃ ১৪৯ মিশরের মুনিরিয়া ছাপাখানায় মুদ্রিত।
২. তাফসীরে ইবনে কাসীর ২য় খ-, পৃঃ ৭১, মিশরে মুদ্রিত।
৩. শেখ আবুল হাসান আলী ইবনে আহমদ আল ওয়াহিদ আন নিশাপুবী আসবাবুল নুযূল পৃ ১৪৮ হিন্দিয়া প্রকাশনী থেকে মুদ্রিত (১৩১৫ হিজরী) মিশর।
৪. জালালুদ্দীন সুয়ূতী প্রণীত লুবাবুন নূকুল মুস্তাফা আল হালাবী ছাপাখানা হতে মুদ্রিত, পৃঃ ৯০।
৫. তাফসীরে বায়যাভী-আনোয়ারুত তানযীল প্রাচীন মিশরে মুদ্রিত, পৃঃ ১২০।
৬. তাফসীরে তাবারী ৬ষ্ঠ খ-, পৃষ্ঠা ১৬৫, মিশরে মুদ্রিত।
৭. আল্লামা নাসাফী ১ম খ- পৃঃ ২৮৯।
৮. আল্লামা যামাখশারী প্রণীত ‘আল কাশশাফ’ ১ম খ- পৃঃ ৩৪৭। আত্তেজারাত ছাপাখানা থেকে মুদ্রিত,
৯. মিশর।
১০. ফাখরে রাযীর তাফসীরে কাবীর ১২তম খ-, পৃঃ ২৬-নতুন মুদ্রণ, মিশর হতে।
১১. শেখ আবু বকর আহমদ ইবনে আলী আর রাযী হানাফী প্রণীত আহকামুল কুরআন ২য় খ-, পৃঃ ৫৪৩ মিশর হতে মুদ্রিত।
১২. কুরতুবী প্রণীত আল জামে লি আহকামিল কুরআন-৬ষ্ঠ খ- পৃঃ ২২১, মিশরে মুদ্রিত।
১৩. তাফসীরে আদদুররুল মানসুর ২য় খ- পৃঃ ২৯৩, প্রথম প্রকাশ ঃ মিশর।
পাঁচ :
الذين ينفقون اموالهم باليل والنهار سرا وعلانية فلهم اجرهم عند ربهم ولاخوف عليهم ولاهم يحزنون
“যারা রাতে ও দিনে গোপনে ও প্রকাশ্যে নিজেদের সম্পদ ব্যয় করে তাদের জন্য তাদের প্রভুর কাছে প্রতিদান রয়েছে। তাদের জন্য কোন ভয় নেই, তারা চিন্তিতও হবে না।” (সূরা বাকারা ঃ ২৭৪)।
আহলে সুন্নাত সহ বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে যে, এ আয়াত হযরত আলী (আ.) সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। যেমন-
(১) কাশশাফে যামাখশারী ১ম খ- পৃঃ ৩১৯। বৈরুতে মুদ্রিত, ১ম খ-, পৃষ্ঠা ঃ ১৬৪ মিশর হতে মুদ্রিত।
(২) ইবনে জাওজী হানাফী প্রণীত তাযকেরাতূল খাওয়াস’ পৃঃ ১৪।
(৩) ফখরে রাযীর ‘তাফসীরে কবীর’ ৭ম খ-, পৃঃ ৮৯, মিশরে মুদ্রিত
(৪) তাফসীরে কুরতুবী ৩য় খ- পৃঃ ৩৪৭।
(৫) তাফসীরে ইবনে কাসীর ১ম খ- পৃঃ ৩২৬।
(৬) আদ দুররুল মানসূর ১ম খ- পৃঃ ৩৬৩।
(৭) কান্দুযী হানাফী প্রণীত ‘ইউনাবিউল মুওয়াদ্দাত’ পৃঃ-৯২ ইস্তামবুলে মুদ্রিত পৃঃ ২১২।
ছয় :
والذي جاء بالصدق وصدق به ألاءك هم المتقون
‘যিনি সত্য বাণী নিয়ে এসেছেন এবং যিনি তা সত্য বলে সাক্ষ্য দিয়েছেন তারা পরহেযগার।’-সূরা যুমার ঃ ৩৩
এ আয়াতের তাফসীরে কোন কোন মুফাসসীর বলেছেন যে, ‘যিনি সত্য বাণী নিয়ে এসেছেন বলতে এখানে পয়গাম্বর (সা.)- এর কথা বলা হয়েছে। আর যিনি তা সত্য বলে সাক্ষ্য দিয়েছেন তিনি হযরত আলী (আ.)। নিঃসন্দেহে প্রথম যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর উপর ঈমান আনেন তিনি ছিলেন হযরত আলী (আ.)। আহলে সুন্নাতের কোন কোন মুফাসসীরও তাদের তাফসীর গ্রন্থে উল্লেখিত আয়াতটি হযরত আলী (আ.) সম্পর্কে বলে অভিমত দিয়েছেন।
(১) হাসকানী হানাফী প্রণীত শাওয়াহেদুত তানযীল ২য় খ-, পৃঃ ১২০
(২) সূয়ূতী প্রণীত দুররুল মানসূও ৫ম খ- পৃঃ ৩২৮।
(৩) তাফসীরে কুরতুবী, পঞ্চদশ খ-, পৃঃ ২৫৬।
(৪) কিফায়াতুত তালিব কুঞ্জী শাফেয়ী পৃঃ ২৩৩ হায়দারিয়া ছাপাখানায় মুদ্রিত।
সাত :
يايها الذين امنوا اتقوا الله وكونوا مع الصادقين
“হে ঈমানদাররা তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাক।” (সূরা তওবা ঃ ১১৯)
কোন কোন মুফাসসীর বলেছেন যে, আয়াতে সাদেকীন বা সত্যবাদী বলতে হযরত আলী (আ.) ও তাঁর সঙ্গীদের বুঝানো হয়েছে। সত্যিকার অর্থে এর উজ্জ্বল প্রতিপাদ্য (মিসদাক) হচ্ছেন হযরত আমীরুল মুমেনীন (আ.)
(১) ইবনে জওযী হানাফী প্রণীত তাযকেরাতুল খাওয়াস পৃঃ ১৬।
(২) মানাকেবে খাওয়ারেজমী হানাফী পৃঃ ১৭৮।
(৩) দুররুল মানসূর-সূয়ুতী ৩য় খ-, পৃঃ-৩৯০।
(৪) আলূসী প্রণীত তাফসীরে রুহুল মাআনী ১ম খ-, পৃঃ ৪১।
আট :
انما يريد الله ليذهب عنكم الرجس اهل البيت و يطهركم تطهيرا
“আল্লাহ কেবল চান যে, তোমাদের আহলে বাইত থেকে গোনাহ ও অপবিত্রতা দূর করবেন এবং তোমাদেরকে পুরোপুরি পবিত্র করবেন।”-সূরা আহজাব ঃ ৩৩
শিয়া মুফাসসীরগণ এবং কোন কোন সুন্নী মুফাসসীর বলেছেন যে, আহলে বাইত বলতে হযরত আলী (আ.), হযরত ফাতেমা (আ.), ইমাম হাসান (আ.), ইমাম হোসাইন (আ.)। কাজেই হযরত আলীও তাদের অন্তর্ভুক্ত যাদেরকে গোনাহ ও অপবিত্রতা থেকে আল্লাহ পাক দূরে রাখতে চেয়েছেন এবং সম্পূর্ণ পাক রেখেছেন। আহলে সুন্নাতের সূত্রে বহু রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে যে, আহলে বাইত মানে সেই পাঁচজন। উদাহরণস্বরূপ-
ছহীহ মুসলিম ৪র্থ খ- ১৮৮৩ পৃষ্ঠায় আহলে বাইতের ফজিলত অধ্যায়ে উম্মুল মু’মেনীন আয়েশা থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, পয়গাম্বর (সা.) হযরত আলী (আ.), হযরত ফাতেমা (আ.), হযরত ইমাম হাসান (আ.) ও ইমাম হোসাইন (আ.)-কে আহলে বাইত হিসাবে উল্লেখ করেছেন। রেওয়ায়েতের মূল পাঠ নিম্নরূপ-
حدثنا ابو بكر بن ابي شيبة و محمد بن عبد الله بن نمير (واللفظ لأبي بكر) قالا : حدثنا محمد بن بشر عن زكريا عن مصعب بن شيبة عن صفية بنت شيتة قالت: قالت عايشة : خرج النبي ص غداة و عليه مرط مرحل من شعر أسود فجاء الحسن بن علي فأدخله ثم جاء الحسين فأدخله معه ثم جاءت فاطمة فادخلها ثم جاء علي فأدخله ثم قل انما يريد الله ليذهب عنكم الرجس اهل البيت و يطهركم تطهيرا
উম্মুল মু’মেনীন হযরত আয়েশা বলেন, পয়গাম্বর (সা.) ভোরে ঘর থেকে বের হন। তার সাথে ছিল কালো পশমের মোটা ‘আবা’। তখন হাসান ইবনে আলী (আ.) আসলেন, পয়গাম্বর (সা.) তাকে ‘আবা’র ভেতর ঢুকিয়ে নিলেন, এরপর হুসাইন আসলেন তিনি তাকেও ‘আবা’র মধ্যে ঢুকিয়ে নিলেন। এরপর ফাতেমা আসলেন পয়গাম্বর (সা.) তাকেও ‘আবা’র মধ্যে ঢুকিয়ে নিলেন। এরপর আলী (আ.) আসলে পয়গাম্বর (সা.) আলীকেও ‘আবা’র মধ্যে ঢুকিয়ে নিলেন। এরপর পয়গাম্বর (সা.) এ আয়াত পাঠ করলেন।
انما يريد الله ليذهب عنكم الرجس اهل البيت و يطهركم تطهير
আহলে সুন্নাতের আলেমগণ তাদের কিতাবে এ ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন।
১. ছহীহ মুসলিম ৫ম খ-, পৃঃ ১৮৮৩ বৈরুতে মুদ্রিত।
২. শাওয়াহেদুত তানযীল হাসকানী হানাফী ২য় খ-, পৃঃ-৩৩
৩. মুস্তাদরাকে হাকেম ৩য় খ-, পৃ- ১৪৭।
৪. আদদুররুল মানসুর ৫ম খ-, পৃঃ- ১৯০।
৫. ফতহুল কাদীর শাওকানী ৪র্থ খ-, পৃঃ- ২৭৯।
৬. যাখায়েরুল ওকবা পৃঃ ২৪।
নবীপত্নী উম্মে সালমা বলেন, ‘পবিত্রতার আয়াত’ আমার ঘরে নাযিল হয়। এর পর পয়গাম্বর (সা.) এক লোককে হযরত ফাতেমার ঘরে পাঠান। যাতে আলী, ফাতেমা, হাসান ও হুসাইনকে তাঁর কাছে নিয়ে আসা হয়। তাঁরা আসলেন। তখন তিনি বললেন, হে আল্লাহ! এরা আমার আহলে বাইত। উম্মে সালামা বলেন, আমি বললাম, ইয়া রসুলুল্লাহ আমি কি আপনার আহলে বাইতের মধ্যে শামিল নই? তিনি বললেন, তুমি আমার পরিবারের ভালো লোকদের মধ্যে শামিল। কিন্তু এরা আমার আহলে বাইত। আহলে সুন্নাতের আলেমরাও এই রেওয়ায়েতটি তাদের কিতাবে উল্লেখ করেছেন-
১. ফতহুল বারী শরহে সহীহ বুখারী ৩য় খ-, পৃ-৪২২।
২. তাফসীরে ইবনে কাছীর ৩য় খ-, পৃঃ- ৪৮৪, ৪৮৫।
৩. যাখায়েরুল ওকবা পৃঃ ২১, ২২।
৪. উসদুল গাবা (ইবনে আসীর প্রণীত) ২য় খ-, পৃ-১২, ৩য় খ-, পৃ-৪১৩, ৪র্থ খ-, পৃঃ-২৯।
৫. সহীহ তিরমিযী ৫ম খ-, পৃ-৩১ ও ৩৬১।
৬. হাসকানী হানাফী প্রণীত শাওয়াহেদুত তানযীল ২য় খ-, পৃ-২৪।
৭. তাফসীরে তাবারী ২২তম খ-, পৃ-৭ ও ৮। মিশওে মুদ্রিত।
৮. ইয়ানাবিউল মুওয়াদ্দাত পৃ-১০৭ ও ২২৮ ইস্তামবুলে মুদ্রিত।
৯. সুয়ূতীর দুররুল মানসুর ৫ম খ-, পৃ-১৯৮।
এছাড়াও আহলে সুন্নাতের বহু কিতাবে উল্লেখ রয়েছে যে, আহলে বাইত হচ্ছেন হযরত আলী, ফাতেমা, হাসান ও হুসাইন।
যেমন-
১. মাসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বল ১ম খ-, ১৯৩ ও ৩৬৯ পৃষ্ঠা। মিশরে মুদ্রিত।
২. মানাকেবে খাওয়ারেজমী হানাফী পৃঃ ২৩।
৩. তাফসীরে কাশশাফ-যামাখশারী ১ম খ- পৃঃ ১৯৩ এবং মিশরে ছাপা ১ম খ-, পৃষ্ঠা ৩৬৯।
৪. তাযকিরাতুল খাওয়াস ইবনে জওযী হানাফী পৃঃ- ২৩৩।
৫. তাফসীরে কুরতুবী ১৪ তম খ-, পৃ ১৮২ প্রথম প্রকাশ কায়রো, মিশর।
৬. তাফসীরে ইবনে কাসীর ৩য় খ-, পৃঃ ৪৮৩, ৪৮৪ ও ৪৮৫ মিশরে মুদ্রিত।
৭. তাফসীরে এতকান সুয়ূতী ৪র্থ খ- পৃষ্ঠাঃ ২৪০, মিশরে মুদ্রিত।
৮. উসদুল গাবা-ইবনে আসীর ২য় খ- পৃঃ ১২। ৩য় খ-, পৃঃ ৪১৩, ৪র্থ খ-, পৃ- ২৬, ২৯।
৯. আসসাওয়ায়েকুল মুহরেকা ঃ ইবনে হাজার আসকালানী পৃঃ ১১৭, ১৪১ মিশরে মুদ্রিত।
১০. তাফসীরে কাবীর ফখরে রাযী ২য় খ- পৃঃ-৭০০।
নয় :
قل لا اسءلكم عليه اجرأ الا المودة في القربي
“হে নবী! তুমি বলে দাও, আমি রেসালাতের বিনিময়ে তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান চাই না, একমাত্র আমার নিকটাত্মীয়দের সাথে ভালোবাসা পোষণ ছাড়া।” (সূরা শূরা ঃ ২৩)
আহলে সুন্নাত ও শিয়া সূত্রে বহু বর্ণনা আছে যে, আয়াতে কুরবা বা নিকটাত্মীয় বলতে হযরত আলী (আ.), হযরত ফাতেমা, হযরত ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনের কথা বলা হয়েছে অর্থাৎ তাঁদের সাথে ভালোবাসা পোষণ করা অবশ্য কর্তব্য বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে। এখানে আহলে সুন্নাতের সূত্রগুলো উল্লেখ করা গেল-
১. তাফসীরে তাবারী ২৫ খ-, পৃঃ ২৫ মিশওে মুদ্রিত।
২. তাফসীরে কাশশাফ ৩য় খ- পৃঃ- ৪০২/৪র্থ খ-, পৃঃ ২২০, মিশরে মুদ্রিত।
৩. তাফসীরে কাবীর ২৭ তম খ- পৃঃ-১৬৬ মিশকুরআন ও হাদীসের আলোকে হযরত আলী (আ.)-এর পরিচয় মুদ্রিত।
৪. তাফসীরে বায়যাভী ৪র্থ খ-, পৃঃ ১২৩ মিশকুরআন ও হাদীসের আলোকে হযরত আলী (আ.)-এর পরিচয় মুদ্রিত।
৫. তাফসীরে ইবনে কাছির ৪র্থ খ-, পৃষ্ঠা ঃ ১১২।
৬. তাফসীরে কুরতুবী ১৬তম খ-, পৃষ্ঠা ঃ ২২।
৭. দুররুল মানসুর ৬ষ্ঠ খ-, পৃঃ ৭
৮. ইয়ানাবিউল মুওয়াদ্দাত-কান্দুযী হানাফী পৃঃ ১০৬, ১৯৪, ২৬১ ইস্তামবুলে মুদ্রিত।
৯. তাফসীরে নাসাফী ৪র্থ খ-, পৃঃ ১০৫।
উল্লেখিত সব বর্ণনাতেই একথা বলা হয়েছে যে, যখন পয়গাম্বর (সা.)-এর কাছে ‘কুরবা’ বা নিকটাত্মীয় কারা তা জানতে চাওয়া হয় তখন তিনি নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করেন যে, তারা হলেন হযরত আলী (আ.), ফাতেমা (আ.), ইমাম হাসান (আ.) ও হুসাইন (আ.)। (ক্রমশঃ)
ইরানী মিউজিক
ইরানী বাদ্যযন্ত্র এর ক্লাসিক্যাল মিউজিক