All posts by pavel

ইরান পরিচিতি : কাশান

-কামাল মাহমুদ
ইরানের ইসফাহান প্রদেশের অন্যতম প্রসিদ্ধ শহর কাশান। এটি কাচান নামেও অভিহিত। ২০১১ সালের হিসেব অনুযায়ী এখানকার জনসংখ্যা প্রায় ১১ লক্ষ। বসবাসযোগ্য ভূমি ২,১০০ হেক্টর। কাশানের একটি বড় অংশ জুড়ে আছে মরুভূমি। যেমন- মারানযাব, দাসতে কাবীর প্রভৃতি মরুভূমি। ব্যুৎপত্তিগতভাবে ‘কাশিয়ান’ অধিবাসীদের নামানুসারে এখানকার নাম কাশান। যারা প্রায় ৯০০০ (নয় হাজার) বছর আগে এ অঞ্চলে বসবাস করত। ১২ শতক থেকে ১৪ শতকের মাঝামাঝি সময়ে কাশান হয়ে ওঠে মানসম্মত মৃৎশিল্প ও টাইল্স উৎপাদনের কেন্দ্রবিন্দু। ফারসি শব্দভা-ারে কাশী শব্দটি এ কাশান থেকে উদ্ভূত। কাশান শহর দুটি বড় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। একটি হলো ‘কাকাশ চেইন’ বা মাউন্ট জারজাসÑ যা কাশানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত। এখানে ইরানের সবচেয়ে বড় অ্যাস্ট্রলজিক্যাল টেলিস্কোপ স্থাপিত হয়েছে। অপরটি হলো ‘মাউন্ট আরদেহাল’Ñ যা কাশানের পশ্চিমে অবস্থিত। এটি কাশানের দামাভান্দ নামেও খ্যাত। এর চূড়া ইরানের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গের অন্যতম।
প্রাগৈতিহাসিক যুগেই এখানে সভ্যতার সূচনা হয়েছিল। প্রায় ৭০০০ বছর পূর্বের সভ্যতার অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন আজো কালের সাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কাশানের অনেক নিদর্শন প্যারিসের লুভার যাদুঘর, নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটন যাদুঘর এবং ইরানের জাতীয় যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
সালজুক-স¤্রাট প্রথম সুলতান মালিক শাহ কাশানের মধ্যবর্তী স্থানে একটি নগর দুর্গ গড়ে তোলার নির্দেশ প্রদান করেন। যাকে বলা হয় গ¦ালে জালালী। যা আজো কাশানের আইকন হিসেবে মর্যাদার আসনে সমাসীন হয়ে আছে।
সাফাভী সম্্রাটদের অবকাশ যাপন কেন্দ্র হিসেবে কাশানের ব্যাপক খ্যাতি রয়েছে। বিশেষ করে ‘বাগে ফিন’ বা ফিন গার্ডেন ইরানের বিখ্যাত বাগান যা কাশানে অবস্থিত। চমৎকার হ্রদবিশিষ্ট এ বাগানের ডিজাইন করেন শাহ আব্বাস। সাফাভী আমলের পরে কাজার স¤্রাটরাও কাশানের উন্নয়ন ও সৌন্দর্য বর্ধনে আত্মনিয়োগ করেন। এখানে রয়েছে ৭০০০ বছরের পুরাতন হ্রদ যা ‘চাশমে সোলায়মান’ বা সোলায়মান হ্রদ হিসেবে খ্যাত। এ বাগানেই আমীর কবির তাকী যান্দকে হত্যা করা হয়েছিল। বর্তমানে ইরানের শীর্ষ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়টি হলো তেহরানের আমীর কবির বিশ্ববিদ্যালয়।
১৭৭৮ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্প কাশানকে এবড়ো থেবড়ো করে দেয় এবং সাফাভী আমলের অধিকাংশ ইমারত ও ঐতিহাসিক নিদর্শন মাটির সাথে মিশে যায়। কিন্তু কাশানের অধিবাসীরা আবার কাশানকে বিনির্মাণ করেন যা পর্যটকদের কাছে বেশ আকর্ষণীয় ও উপভোগ্য। ১৮ শতক থেকে ১৯ শতকের কাজার শিল্পীদের হাতের ছোঁয়ায় কাশান নবরূপ লাভ করে। এখানে প্রতি বছর হাজার হাজার বিদেশি পর্যটক কাশানের সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসেন। কাশানের পাশেই রয়েছে ‘কামসার’ ও ‘আবিয়ান’ নামক দুটি নগরী যেখানে প্রায় সারা বছর পর্যটকদের আনাগোনা থাকে। এর নিকটেই রয়েছে কৃত্রিম গিরিগুহা ও ফায়ার প্যালেসÑ যা পর্যটকদের বিমোহিত করে।

শিল্প : কাশান আন্তর্জাতিকভাবে কার্পেট, রেশমি কাপড় ও অন্যান্য বস্ত্রশিল্পের জন্য বিখ্যাত। কাশানে রয়েছে ইরানের বিখ্যাত যান্ত্রিক ও হস্তনির্মিত কার্পেট কারখানা। পাথর ও তামাজাত দ্রব্য তৈরিতে কাশানের সুনাম সুদীর্ঘকালের। কার্পেট ও গোলাপ পানি কেনাকাটার জন্য ব্যবসায়ী ও পর্যটক উভয় শ্রেণির মানুষ কাশানেই বেশি ভীড় করে থাকে।

দর্শনীয় স্থান : কাশানের দর্শনীয় স্থানের মধ্যে রয়েছে আগা বুযুর্গ মসজিদ (১৮ শতকে নির্মিত, ওস্তাদ আলী মারিয়াম এর ডিজাইন করেন), আমেরী হাউজ (১৯ শতক), জালালী কটেজ, বোরুযারদী হাউজ (১৮ শতকে নির্মিত), আব্বাসী হাউজ (১৮ শতক), তাবাতাবায়ী হাউজ, আত্তারী হাউজ, সুলতান আমীরের মাযার, ৪০ দুখতারান দুর্গ, আবু লুলুয়ার মাযার (১১ শতক), ফিন গার্ডেন, ফিন গোসলখানা, কাশান জামে মসজিদ, কাশান বাজার, মসজিদ ময়দান, তাবরিজিয়া মসজিদ প্রভৃতি।

রেস্টুরেন্ট ও হোটেল : কাশানের বিখ্যাত রেস্টুরেন্টের মধ্যে রয়েছে মনুচেহরী রেস্টুরেন্ট, আব্বাসী টি হাউজ এন্ড ট্রেডিশনাল রেস্টুরেন্ট, মোজাফফারী ট্রেডিশনাল রেস্টুরেন্ট, সারায়ে আমেরিয়া রেস্টুরেন্ট, শাহনেশীন আমীনদোভলে রেস্টুরেন্ট, রোজ হাউজ, নেজীন রেস্টুরেন্ট, গোলশান রেস্টুরেন্ট, সাজীদ ফাযার, মাহীনেস্তান রাহেব, কামালুল মুল্ক হাউজ রেস্টুরেন্ট, মারীয়াম রেস্টুরেন্ট, সোহরাব রেস্টুরেন্ট প্রভৃতি। আবাসিক হোটেলগুলোর মধ্যে ঈশান হাউজ, গোলেস্তান হোটেল, আমীর কবির হোটেল, সারীয়ে হোটেল প্রভৃতি বিখ্যাত। স্থানীয় খাবারের মধ্যে কোলবে কাশান বিখ্যাত।

যাতায়াত : যাতায়াতের জন্য রয়েছে বিমান, বাস, ট্রেন, ট্যাক্সি ও মোটর সাইকেল। তেহরান এবং ইসফাহানের মধ্যে কাশানের অবস্থান। তেহরান থেকে সড়ক পথে ২৫০ কিলোমিটার উত্তরে এবং ইসফাহান থেকে দক্ষিণে ২২০ কিলোমটিার। কোম-কেরমান-কাশান হাইওয়ে রোড কাশানের কানেক্টিং রোড, এছাড়া কাশান-কোম-তেহরান হাইওয়ে, ইসফাহান-আরিয়ান-কাশান প্রভৃতি হাইওয়ে রয়েছে। বাস স্টেশনের মধ্যে কাভে বাস স্টেশন, মোল্লা সাদরা বাস স্টেশন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া কাশান-মাশহাদ-গোরগানসহ কতক রেল রুট রয়েছে। রেল ও বাস স্টেশনে রয়েছে টিভি ও অন্যান্য বিনোদন ব্যবস্থা।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : কাশানের বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে কাশান ইউনিভার্সিটি। এটি ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮৯ সালে এটি কাশান টিচার্স ট্রেনিং বিশ^বিদ্যালয়ে পরিণত হয়। ১৯৯৪ সালে এতে বিভিন্ন অনুষদ যুক্ত হয়। ১৯৯৫ সালে আর্টিটেকচার, ইঞ্জিনিয়ারিং, মানবিক প্রভৃতি অনুষদ চালু হয়। ৫৩০ হেক্টর ভূমি বা ৮০,০০০ স্কয়ার মিটার নিয়ে এর অবস্থান। এর মধ্যে রয়েছে খেলাধুলা, কমপ্লেক্স ও ডরমেটরি। তেল ও অ্যানার্জি গবেষণা কেন্দ্র এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিশেষত্ব।
ইসলামিক আযাদ ইউনিভার্সিটি অব কাশান : আযাদ ইউনিভার্সিটির কাশান শাখা ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। অ্যাকাউন্টিং, সাহিত্য, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং তিনটি অনুষদ নিয়ে এর যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে ৪০০০ শিক্ষার্থী, ২৭৫ জন ট্রেইনার, ১৭৫ জন পূর্ণকালীন শিক্ষক, ১৭০ জন অতিথি শিক্ষক নিয়ে কর্ম চালিয়ে যাচ্ছে এ বিশ^বিদ্যালয়। প্রতিবছর এ প্রতিষ্ঠান থেকে বিপুল সংখ্যক গ্রাজুয়েট কর্মক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ে। এ বিশ^বিদ্যালয়ের আয়তন ৫৩ হেক্টর বা ৩০০০ মিটার। এছাড়া কাশান ইউনিভার্সিটি অব মেডিকেল সাইন্স চিকিৎসা ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

খেলাধুলা : খেলাধুলার জন্য কাশানে রয়েছে কাশান অ্যাকাডেমিসহ কয়েকটি ফুটবল ক্লাব ও স্টেডিয়াম।

ব্যক্তিত্ব : কাশান যে সকল বিখ্যাত ব্যক্তিকে লালন করেছে তাঁদের মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য হলেন সোহরাব সেপেহরী, জামসিদ কাশানী, কামাল আল মুল্ক, ওস্তাদ আলী মারইয়াম, সাইয়্যেদ হোসাইন নাসের প্রমুখ।
কাশান তেহরানের ও ইসফাহানের নিকটেই এক প্রাচীন শহর। যেখানে প্রাগৈতিহাসিক যুগেই সূচনা হয়েছিল প্রাচীন সভ্যতার। বিশে^র বিভিন্ন যাদুঘরে আজো তার নিদর্শন বিদ্যমান। কাশানের টাইল্স ও গোলাপ পানি বিশ^খ্যাত। বিশেষত হাতে বোনা কার্পেট ও তামাজাত দ্রবাদি সমগ্র বিশে^র ক্রেতাদের মন কেড়ে নেয়। ইরানের সবচেয়ে উন্নতমানের ও সর্বাধিক পরিমাণ গোলাপ পানি, আতর, গোলাপের পাপড়িজাত অন্যান্য দ্রব্য কাশানেই উৎপাদিত হয়। কাশানের মনোমুগ্ধকর দৃশ্যাবলি পর্যটকদের নিকট আকর্ষণীয় দর্শনীয় স্থান হিসেবে বিবেচিত।

কাশানের গোলাপ : কাশানের বিশ্বখ্যাতি গোলাপ, গোলাপ পানি ও গোলাপ দিয়ে তৈরি নানাবিধ খাবারের জন্য। বসন্তকাল (২১ এপ্রিল থেকে ২১ মে) গোলাপ সংগ্রহ করার উত্তম সময়। তবে বিভিন্ন কাজে ব্যবহারের জন্য মে মাসের শুরু থেকে জুন মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত অধিকাংশ গোলাপ আহরিত হয়ে থাকে। কিছু কিছু স্থানে সারা বছর গোলাপ পাওয়া গেলেও মূলত বাণিজ্যিক ও স্থানীয়ভাবে বসন্তকালেই গোলাপ তোলা হয়। এপ্রিল থেকেই গোলাপের সৌরভ কাশান ও কামসার থেকে আশেপাশের অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
কাশানের গোলাপ উৎসব পর্যটক ও স্থানীয়দের কাছে খুবই প্রিয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে, এমনকি বিদেশ থেকেও পর্যটকরা গোলাপ উৎসবে যোগ দিতে কাশানে আসেন। এ সময় কাশানে অতিরিক্ত প্রায় ৮০,০০০ (আশি হাজার) লোকের সমাগম ঘটে। প্রতি বছর মে মাসের মাঝামাঝি কাশানে গোলাপ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এ সময় কাশান যেন নববধূর মতো রঙিন হয়ে ওঠে। সেলজুক শাসনামল থেকে এর প্রচলন হয়ে আসছে। কামসারে ‘মায়দানে মসজিদ’ নির্মাণের সময় এক রোমান ভদ্রলোক ‘কুহে আসবী’ পাহাড়ের পাদদেশ থেকে কয়েকটি গোলাপ চারা এনে এখানে রোপন করেন। তারপর সময়ের বিবর্তনে নানা জাতের গোলাপ আজ কাশান ও কামসারকে সুরভিত করে আসছে।
কাশানের গোলাপ বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত হয়। এখানকার গোলাপ উৎপাদন ও গোলাপ পানি ও গোলাপ দিয়ে নানা রকম সুরভিত খাবারের রেওয়াজ সুপ্রাচীন। প্রায় ২৫০০ বছর থেকে এখানকার মানুষ গোলাপের বহুবিধ ব্যবহার করে আসছে। মুসলিম-হিন্দু-খ্রিস্টানসহ নানা ধর্মের মানুষ গোলাপ পানি ধর্মীয় কাজে ব্যবহার করে থাকে। আবে জমজম পানির সাথে মোহাম্মাদী গোলাপের প্রক্রিয়াজাত পানি মিশিয়ে পবিত্র কা’বা ঘর ধৌত করা হয়ে থাকে। এখানকার গোলাপ ও গোলাপের সৌরভ মিশিয়ে নানা জাতীয় খাবার, মিস্টান্ন, পারফিউম, প্রসাধনী ও ঔষধ তৈরি করা হয়। গোলাপ পানির সাথে চিনি মিশ্রণ করে সিরাপ তৈরি করা হয়। এছাড়া চা, কফি, আইসক্রীম, হালুয়া, রাইস পুডিং, লাচ্ছি, ফলের জুস, ¯œ্যাক্স প্রভৃতির সাথে গোলাপ মিশিয়ে খাবার তৈরি করা হয়Ñ আরব দুনিয়ায় যার চাহিদা অপরিসীম।
গোলাপের প্রক্রিয়াজাতকরণের পরে যে উচ্ছিষ্ট থাকে তা পশুখাদ্য ও জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। গোলাপ দিয়ে আধুনিককালে তৈল উৎপাদন আরম্ভ হয়েছে। যা সাধারণত কসমেটিক তৈরিতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অতীতে স্থানীয়ভাবে হাতে গোলাপ প্রক্রিয়াজাত করলেও আধুনিককালে কাশানে মেশিনের মাধ্যমে কারখানাজাত হয়ে সুবাসিত গোলাপ পৌঁছে যায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে, যদিও এখনও প্রাচীন পদ্ধতিতে গোলাপ প্রক্রিয়াজাতকরণ অব্যাহত আছে। নানা প্রকার গোলাপের মধ্যে এক ধরনের গোলাপ আছে যার নাম মোহাম্মাদী গোলাপ। এর ঘ্রাণ খুবই মিষ্টি এবং এ দিয়ে উন্নতমানের পারফিউম ও সুরভিত খাবার তৈরি করে স্থানীয় চাহিদা মেটানো হয় ও রপ্তানিও হয়ে থাকে। বিশেষত আরব দেশসমূহ, মালয়েশিয়া, ভারত, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশে মোহাম্মাদী গোলাপ পানি, আতর ও সুরভিত খাবার রপ্তানি হয়ে থাকে। সাধারণত ৩০ কেজি গোলাপের পাপড়ি দিয়ে প্রক্রিয়াকরণের মধ্য দিয়ে ৮০ লিটার গোলাপ পানি উৎপাদিত হয়।
১৯৭৪-৭৫ সাল থেকে বাণিজ্যিকভাবে কাশানে গোলাপ ফুল দিয়ে নানাবিধ সামগ্রী উৎপাদিত হতে শুরু করে। এখন কাশানে গোলাপ ফুলের পণ্য তৈরির জন্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক গড়ে উঠেছে কাশান ও কামসারে। তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বমানের গোলাপ সুগন্ধি হতে হলে প্রতি ১০০ মি.লি-এ ৩৫ মি. গ্রাম বা ৩৩০ পিপিএম থাকতে হয় যা কাশান ও কামসারের মোহাম্মাদী গোলাপ থেকে উৎপাদিত হয়ে থাকে। প্রতি বছর প্রায় ৬০০০ টন গোলাপ এখানে উৎপাদিত হয়।

 

‘মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ (সা.)’ ছায়াছবি দর্শকদের কাছে ব্যাপক সমাদৃত

মো. আশিকুর রহমান
অস্কার মনোনীত ইরানের খ্যাতনামা চলচ্চিত্র পরিচালক মাজিদ মাজিদির নির্মিত মহানবী (সা.)-এর জীবনালেখ্যভিত্তিক ছায়াছবি ‘মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ (সা.)’ বিশ্বের দর্শকদের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। প্রদর্শনী শুরু হওয়ার এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে ছবিটি ১০ এর মধ্যে ৮.৯ রেটিং অর্জন করেছে। চলচ্চিত্র বিষয়ক ওয়েবসাইটগুলো এ হিসাব দিয়েছে।
মহানবী (সা.)-কে নিয়ে নির্মিত ট্রিলজি বা তিন খণ্ডের ছায়াছবির এই প্রথম খণ্ডে তাঁর মক্কার জীবনালেখ্য তুলে ধরা হয়েছে। ১৭১ মিনিটের এ ছায়াছবি নির্মাণে সাত বছর সময় লেগেছে। ইরানের সবচেয়ে ব্যয়বহুল এ ছবি নির্মাণে ৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার ব্যয় হয়েছে। মুহাম্মাদ মাহদি হায়দারিয়ান প্রযোজিত এ ছবির চিত্র ধারণ করা হয়েছে ইরান এবং দক্ষিণ আফ্রিকার শহর বেলা-বেলাতে।
ছবিটি নির্মাণে চলচ্চিত্র জগতের আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বরা সহযোগিতা করেছেন। এতে কাজ করেছেন ইতালির তিনবারের অস্কার জয়ী সিনেমাটোগ্রাফার ভিত্তোরিও স্তোরারো, ইতালির ফিল্ম এডিটর রোবাতো পেরপিগানি, মার্কিন ¯েপশাল এফেক্ট শিল্পী স্কট ই অ্যান্ডারসন, ইতালির মেকআপ আর্টিস্ট গিয়ানেত্তো ডি রোসি এবং ভারতীয় প্রখ্যাত সুরকার আল্লা রাখা রহমান (এ আর রহমান)।
এক সাক্ষাৎকারে পরিচালক মাজিদ মাজিদি বলেন, ‘২০০৬ সালে এমন একটি ফিল্ম নির্মাণের চিন্তা করি। ২০০৬ সালে যখন কয়েকজন ড্যানিশ কার্টুনিস্ট মহানবী (সা.)-কে ব্যঙ্গ করে কার্টুন ছাপে তখন তার প্রতিবাদে ড্যানিশ ফিল্ম ফেস্টিভাল থেকে আমার ‘দি উইলো ট্রি’ ছবিটি প্রত্যাহার করে নিয়ে আমি সেই ফেস্টিভাল বর্জন করি।’ জনাব মাজিদি বলেন, ‘তখন থেকেই আমি মহানবী (সা.)-এর অবমাননার প্রতিবাদে আরো বাস্তবধর্মী কোন কর্মসূচির কথা চিন্তা করতে থাকি।… অজ্ঞতা ও ইসলামভীতির বিপক্ষে ইসলামের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা চালাই। যেখানে পশ্চিমা বিশ্ব ইসলামের একটি খারাপ চিত্র তুলে ধরার প্রয়াস চালাচ্ছে।… ইসলামী বিশ্বের সবার মাঝে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে আমি চেষ্টা করেছি। মহানবীর জীবনীভিত্তিক এ চলচ্চিত্র নির্মাণে সবার কাছে স্বীকৃত ইতিহাসের ওপরই আমি নির্ভর করেছি।’
উল্লেখ্য, পরিচালক মাজিদ মাজিদি ফিল্মের স্ক্রিপ্ট লেখা, সংশোধন ও চূড়ান্ত করার আগে বড় বড় বিশেষজ্ঞ আলেমের সাথে আলোচনা করেন যাঁদের সকল মাযহাব ও চিন্তাধারার আলোকে মহানবী (সা.)-এর জীবনীর ওপর লেখা পুস্তকের ওপর গভীর পাণ্ডিত্য রয়েছে।
গত ২৭ আগস্ট ২০১৫ ইরানের রাজধানী তেহরানসহ ১১ শহরের ১৪৩টি প্রেক্ষাগৃহে এই ছায়াছবির প্রথম পর্বের প্রদর্শনী শুরু হয়। একই সময়ে কানাডার মন্ট্রিল চলচ্চিত্র উৎসবের আওতায় সেখানকার দুটি সিনেমা হলে দেখানো হয় ইরানের ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল এই ছায়াছবি। ইরানে প্রদর্শনীর টিকিট বিক্রি থেকে প্রথম রাতেই উঠে আসে ২০০ কোটি ইরানী রিয়াল।
৩৯তম আন্তর্জাতিক মন্ট্রিল ফিল্ম ফেস্টিভালের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেই ‘মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ (সা.)’ ফিল্মটি প্রদর্শিত হয়। ব্যাপক দর্শক চাহিদার দিকে তাকিয়ে আয়োজক গোষ্ঠী ফেস্টিভাল চলাকালে (২৭ আগস্ট – ৭ সেপ্টেম্বর) আবারো প্রদর্শনীর আয়োজন করে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মন্ট্রিল আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভালের প্রেসিডেন্ট সার্জ লোসিক বলেন, ‘আমরা গর্বিত যে, এমন একটি উচ্চমার্গের ও উচ্চ শিল্পমানসমৃদ্ধ ফিল্মের অংশগ্রহণে এবারের ফেস্টিভাল শুরু হলো, যা ব্যাপক দর্শকগোষ্ঠীকে আকৃষ্ট করবে।’ তিনি বলেন, ‘অতীতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, যেমন মূসা, ঈসা, গৌতম বুদ্ধকে নিয়ে অনেক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, কিন্তু ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মাদ (সা.)-কে নিয়ে এটি মাত্র দ্বিতীয় ফিল্ম নির্মিত হলো।’
চলচ্চিত্র ও টিভি অনুষ্ঠান সংক্রান্ত জনপ্রিয় ও নির্ভরযোগ্য উৎস ইন্টারন্যাশনাল মুভি ডাটাবেজ বা আইএমডিবি’র হিসাব অনুযায়ী, বিশাল বাজেটের এ চলচ্চিত্রটি দর্শকরা ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেছেন। আইএমডিবি’র ওয়েবসাইটে এ ছবি নিয়ে নিজেদের আনন্দ অনুভূতি তুলে ধরতে দ্বিধা করেন নি পরিতৃপ্ত দর্শকরা। এক দর্শক লিখেছেন, ‘শেষ ছবি নির্মাণের আট বছর পর আবারও চমক দেখালেন মাজিদ মাজিদি। এবারে তাঁকে ছবি নির্মাণে সহায়তা করেছেন চলচ্চিত্র জগতের খ্যাতিমান অনেকেই; ক্যামেরার পেছনে ছিলেন তাঁরা। তাঁদের নিয়েই মহানবীর শিশুকালের ওপর ভিত্তি করে ছবি তৈরি করেছেন মাজিদ মাজিদি।’
ছবিটির এ দর্শক আরো লিখেছেন, ‘এ পর্যন্ত যেসব ছবি দেখেছি তার মধ্যে সিনেমাটোগ্রাফির দিক থেকে এটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ। চলচ্চিত্রটিতে কম বয়সী নায়কের সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরা যেন উড়ে বেড়িয়েছে।’ ছবিটি দেখতে গিয়ে গ্যালারিতে অনবদ্য চিত্রকলা দেখার অনুভূতি হয় বলে মন্তব্য করেন এ দর্শক।
কানাডার অপর এক দর্শক আইএমডিবি’তে লিখেছেন, ‘আর্ট ফিল্মের জগতের রাজাধিরাজ হলেন মাজিদ মাজিদি। ইরানের অনেক বড়মাপের এ সিনেমা প্রকল্প বাস্তবায়নে নানা চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হয়েছে তাঁকে। এ ছবি দর্শককে বিচিত্র রঙের লহরীতে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আর মহিমান্বিত সুর লহরী নির্মাণই মাজিদ মাজিদির বৈশিষ্ট্য। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সিনেমাটোগ্রাফার ভিত্তোরিও স্তোরারোর কুশলী তৎপরতা। তবে কোথাও কোথাও তাঁর কাজ মাত্রা অতিক্রম করেছে বলেও মনে হতে পারে। সব মিলিয়ে যে চিত্রকল্প তৈরি করতে চেয়েছিলেন তা নান্দনিকভাবেই শীর্ষে নিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা দেখিয়েছেন মাজিদ মাজিদি।’
এ ছবিটি নির্মাণ প্রসঙ্গে পরিচালক মাজিদ মাজিদি বলেন, ‘ইসলামের সঠিক ভাবমর্যাদা বিশ্বে তুলে ধরার লক্ষ্যেই তৈরি করা হয়েছে ছায়াছবি ‘মুহাম্মাদ (সা.)’।
মন্ট্রিলে এ ছবির প্রিমিয়ারে তিনি বলেন, ‘দুভার্গ্যক্রমে এখন ইসলামের নামে উগ্র এবং সহিংস রূপ তুলে ধরা হচ্ছে, অথচ এটি ইসলামের পরিচয় নয়। ইসলামের ছদ্মাবরণে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীরা যে বর্বরোচিত সন্ত্রাসী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে তার সঙ্গে ইসলাম ধর্মের কোনো স¤পর্কই নেই।’
সিরিয়া ও ইরাকে তাকফিরি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএসআইএল’র মানুষ হত্যা এবং সাংস্কৃতিক স¤পদ ধ্বংসের কথাই পরোক্ষভাবে বলেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘শান্তি, বন্ধুত্ব এবং ভালোবাসার ধর্ম ইসলাম। এ ছবিতে আমি তা-ই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। ইসলাম স¤পর্কে যাঁরা জানেন না, তাঁদের গবেষণার সূচনা করতে পারে এ ছবি।’
এএফপি’কে দেয়া সাক্ষাৎকারে ৫৬ বছর বয়সী মাজিদ মাজিদি বলেন, ‘পশ্চিমা বিশ্বে ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। পবিত্র ইসলাম ধর্মের সঙ্গে এর কোনো স¤পর্ক নেই।’
সাক্ষাৎকারে মুসলিম বিশ্বে মহানবীর জীবনালেখ্যের ভিত্তিতে নির্মিত ছায়াছবির চাহিদার কথাও তুলে ধরেন তিনি। মাজিদ মাজিদি বলেন, ‘সৌদি আরবের মতো হাতেগোণা কয়েকটি দেশে এ চলচ্চিত্র নিয়ে সমস্যা থাকতেই পারে। কিন্তু তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়াসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশই এ ছবির বিষয়ে প্রচণ্ড আগ্রহ দেখিয়েছে।’
মহানবীর জীবনীভিত্তিক প্রথম ছায়াছবি নির্মাণ করেছিলেন সিরীয়-আমেরিকান চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা আক্কাদ। ওই ছায়াছবির নাম ‘দ্য ম্যাসেজ’। ১৯৭৬ সালে তা মুক্তি পাওয়ার পর মুসলিম বিশ্বের কোনো কোনো মহল তাঁর কঠোর সমালোচনা করেছিল। মহানবী (সা.)-এর জীবনীভিত্তিক ছবি নির্মাণকে কেন্দ্র করে বিশ্বের কোনো কোনো মুসলমানের উদ্বেগের বিষয়টি অনুধাবন করে মাজিদ মাজিদি বলেন, ‘ছবিতে বিকল্পভাবে মহান নবীকে উপস্থাপন করা হয়েছে। চলচ্চিত্রে মহানবীর চরিত্রে রূপদানকারী ক্যামেরার দিকে পেছন ফিরে ছিলেন। তাঁর অবয়ব দেখা গেছে। কিন্তু তাঁর চেহারা দেখানো হয়নি।’
বিশ্ববরেণ্য এ চিত্রনির্মাতা সহাস্যে বলেন, ‘পুরো ছবিতে নায়কের দুর্দান্ত উপস্থিতি রয়েছে, কিন্তু তাঁর চেহারা দেখানো হয় নি, সত্যিই এটি একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ ছিল।’ এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিশেষ পদ্ধতির আশ্রয় নেন মাজিদি এবং তিনবার অস্কার বিজয়ী ইতালির সিনেমাটোগ্রাফার ভিত্তোরিও স্তোরারো।
মাজিদি বলেন, ‘ছায়াছবিতে মহানবীকে তুলে ধরার জন্য বিশেষভাবে তৈরি স্টেডিক্যাম ব্যবহার করা হয়। চলচ্চিত্রটির যে দৃশ্যেই রাসূল (সা.)-কে দেখানো হয়েছে সেখানেই দৃশ্যটি নবীর দৃষ্টিভঙ্গি অর্থাৎ চলচ্চিত্রের ভাষায় ক্যারের্ক্টাস পয়েন্ট অব ভিউ বা পিওভি থেকে দেখানো হয়েছে।’ এমনকি নবীজির শৈশবের দৃশ্য এভাবে চিত্রায়িত হয়েছে বলে জানান তিনি।
মাজিদি বলেন, ‘চলচ্চিত্রটিতে সবাই মুহাম্মাদ (সা.)-কে দেখার জন্য উদগ্রীব থাকবে, কিন্তু কেউ তাঁর পবিত্র মুখমণ্ডল দেখতে পাবেন না। তাঁর অবয়ব দেখা যাবে বা ক্যামেরার দিকে পেছন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেনÑ এমন দৃশ্যই কেবল দেখা যাবে।’
এছাড়া বাকি দুই খণ্ড নির্মাণের ক্ষেত্রে কী সমস্যায় পড়তে হবে তাও তুলে ধরেন তিনি। মাজিদ মাজিদি বলেন, ‘নবুওয়াত লাভের পর মহানবীর সংলাপ নিয়েও বেশ সমস্যা দেখা দেবে।’ অবশ্য এ সমস্যা উতরানো যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
চলচ্চিত্রটির নির্মাণ ও মুক্তি পাওয়া নিয়ে মুসলিম বিশ্বসহ অন্যান্য জাতি-ধর্মের মানুষের মধ্যেও যেমন ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা ও অধীর আগ্রহ-উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তেমনি একটি বিশেষ মহলের মধ্যে এর বিপরীত চিত্রটিও পরিলক্ষিত হচ্ছে।
এই চলচ্চিত্রের ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ থাকাই স্বাভাবিক। কারণ, বিশ্বনবীর যুগান্তরী ও বৈশ্বিক জীবনাদর্শ এবং মানব ইতিহাসে তাঁর সর্বজনীন ভূমিকা যুগে যুগে মানুষকে উৎসাহিত করে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ এই নবীর ব্যাপারে জানতে। এই মহান ও যুগোপযোগী কীর্তিটির বিরুদ্ধে যাঁরা অবস্থান নিয়েছেন, তাঁদের এই অযৌক্তিক বিরোধী অবস্থানের কারণ অনুসন্ধান করে যে ধারণা পাওয়া যায় তা হলো-
কোন কোন মহল নিছক জাতীয়তাবাদ, মাযহাবগত বিদ্বেষ, রাজনৈতিক অবস্থান প্রভৃতি কারণে উক্ত চলচ্চিত্রটির বিরুদ্ধাচরণের পথ বেছে নিয়েছে।
একদল অজ্ঞ ও অন্ধ ব্যক্তির মধ্যে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে আছে যে, ইসলামে চিত্র বা চলচ্চিত্র স¤পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তাই তারা শিল্প ও প্রচারমাধ্যমটির উদ্দেশ্যের দিকে একেবারেই লক্ষ্য না করে খোদ মাধ্যমটিকেই পরিহার করে চলছে; ফলে তারা ভালো-মন্দ, নৈতিক-অনৈতিক, ধর্মীয়-অধর্মীয়, মার্জিত-অশ্লীল প্রভৃতি সর্বপ্রকারের চলচ্চিত্রকে একই দৃষ্টিভঙ্গিতে মূল্যায়ন করছে ও তার বিরোধিতা করে আসছে।
বিশ্ব যায়নবাদী ও নাস্তিক্যবাদী শক্তিগুলো ও তাদের দালালরা চাচ্ছে না যে, ইসলামের নবী (সা.)-এর ওপর কোন চলচ্চিত্র নির্মিত ও প্রচারিত হোক। কারণ, এতে তাদের গোপন শয়তানি মিশনের অপরিসীম ক্ষতি সাধিত হবে। আবার কেউ কেউ এমন রয়েছে যে, শুধু শুনেই চলচ্চিত্রটির বিরোধিতায় নেমেছে, আবার একই সাথে তারা চলচ্চিত্রটি দেখার ব্যাপারেও আগ্রহী! আসলে তারা অধিক বিরোধিতাকারীদের অপপ্রচার ও অপতৎপরতার প্রভাবে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তবে আশা করা যায় যে, তারা চলচ্চিত্রটি দেখার পর এর বিরোধিতা করা পরিহার করবে।
লক্ষণীয় বিষয় হলো এ পর্যন্ত হযরত ঈসা (আ.)-কে নিয়ে প্রায় ২৫০টি, হযরত মূসা (আ.)-কে নিয়ে প্রায় ১২০টি, অন্য নবী-রাসূলদের নিয়ে প্রায় ৮০টি চলচ্চিত্র এবং গৌতম বুদ্ধকে নিয়ে প্রায় ৪০টির মতো চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে; অথচ সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল মুহাম্মাদ (সা.)-কে নিয়ে চলচ্চিত্রের সংখ্যা দুইয়ের অধিক নয়! অথচ এখন পর্যন্ত বিভিন্ন মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্বের কাছে ইসলামের নবীর বাণী সঠিকভাবে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গিতে সকল নবী-রাসূলই মুসলমানদের কাছে সম্মানিত। তাহলে অন্য নবী-রাসূলদের ওপর নির্মিত চলচ্চিত্রসমূহের ব্যাপারে কোনই আপত্তি ও বিরোধিতা আসছে না, কেবল মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর নির্মিত চলচ্চিত্রটির ব্যাপারেই কেন রহস্যজনকভাবে এত আপত্তি ও বিরোধিতা!
কিছুদিন আগে সৌদি আরব ও কাতারের যৌথ উদ্যোগে হযরত উমরের জীবনীভিত্তিক একটি দীর্ঘ সিরিয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে হযরত উমর, হযরত আবু বকর, হযরত উসমানসহ হযরত আয়েশাকেও দেখানো হয়েছে। ওই সিরিজটির ব্যাপারে যারা অত্যন্ত উচ্ছ্বাস প্রদর্শন করেছিল, অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে তারাই রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর চলচ্চিত্রটির ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করছে, যদিও চলচ্চিত্রটিতে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মুখাবয়ব দেখানো হয়নি।
কয়েক বছর আগে যখন টেরি জোন্স আমাদের প্রাণপ্রিয় রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে নিয়ে ব্যাঙ্গাত্মক চলচ্চিত্র ‘ইনোসেন্স অব মুসলিম্স’ নির্মাণ করে তখন মধ্যপ্রাচ্যের গ্রান্ড মুফতি, খতিবগণ ও বাদশাহদের কেউই ওই জঘন্য চলচ্চিত্রটির বিরুদ্ধে টু শব্দটিও করেননি; অথচ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সম্মানে ও ভালোবাসায় তাঁর মহা পবিত্র জীবনীর ওপর নির্মিত চলচ্চিত্রটির বিরুদ্ধে অযৌক্তিকভাবে নেতিবাচক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।
যায়নবাদীরা ও বিভ্রান্ত খ্রিস্টানরা তাদের বিকৃত আকীদা-বিশ্বাস অনুযায়ী হযরত মূসা (আ.) ও হযরত ঈসা (আ.)-এর মহান ও পবিত্র চরিত্রকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে বিভিন্ন চলচ্চিত্র বানাচ্ছে। তাঁরা হয়তো সেগুলোর খোঁজও রাখেন না কিংবা জেনেও সে স¤পর্কে কিছুই বলেন না।
আরেকটি বিষয় হলো বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের বিভিন্ন ধারা-উপধারার নেতৃবৃন্দও তাঁদের কর্মসূচিসমূহের ব্যাপারে নানা রকম ভিডিও ডকুমেন্টারি, চলচ্চিত্র, ভিজুয়াল রিপোর্ট প্রভৃতি নিজেরাই নির্মাণ ও প্রচার করে থাকেন। তাঁদের নেতাদের বায়োগ্রাফি টাইপের ভিডিও প্রচার করে এরা অত্যন্ত সন্তুষ্ট থাকলেও সন্দেহজনকভাবে রাসূল (সা.)-এর মহান বায়োগ্রাফি প্রচার করলে তাঁরা অসন্তুষ্টি প্রকাশ করছেন।
ইসলামী ইরান এর আগেও বিভিন্ন নবী-রাসূলের জীবনীর ওপর চলচ্চিত্র ও সিরিয়াল নির্মাণ করেছে। যেমন হযরত ইউসুফ (আ.), হযরত ঈসা (আ.), হযরত সুলাইমান (আ.), হযরত ইবরাহীম (আ.), হযরত আইয়ুব (আ.) প্রভৃতি। এসব চলচ্চিত্রের বিরুদ্ধে কখনই কোন প্রতিবাদ করা হয় নি, অথচ ‘মুহাম্মাদ (সা.)’ চলচ্চিত্রটির বিরোধিতা করা হচ্ছে!
মোদ্দা কথা, স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে, বিশ্ববিখ্যাত ইরানী চলচ্চিত্র নির্মাতা মাজিদ মাজিদির নির্মাণ করা ‘মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ (সা.)’ চলচ্চিত্রটির বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী বৈশ্বিক ষড়যন্ত্র চলছে; আর এই ষড়যন্ত্রের মূল কারণ কখনও রাসূলবিদ্বেষ, কখনও শিয়াবিদ্বেষ, আবার কখনও বা ইরানবিদ্বেষ…
যদিও নবী-রাসূলগণের জীবনীর উৎস হচ্ছে পবিত্র কুরআন, হাদিস ও ইতিহাসভিত্তিক সিরাত গ্রন্থসমূহ। আর চলচ্চিত্র হচ্ছে সেই জীবনী জানার ও প্রচারের একটি মাধ্যম মাত্র, তা নিজেই কোন মৌলিক উৎস নয়। যেভাবে বর্তমানে পবিত্র কুরআনের ঊষবপঃৎড়হরপ ঝড়ভঃ ঈড়ঢ়ু বের হয়েছে, যেভাবে হাদিসসমূহ এখন ডবন ঝবৎাবৎ এ পাওয়া যায়, সেভাবেই রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র জীবনী এখন ঊষবপঃৎড়হরপ ঠবৎংরড়হ এর মাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে। এটা সিরাত গ্রন্থেরই একটি আধুনিক ও শক্তিশালী রূপ। যেহেতু ধর্ম প্রচার একটি দীর্ঘমেয়াদি চলমান ও গতিশীল প্রক্রিয়া সেহেতু এতে নতুন ও আধুনিক মাত্রা যোগ হবে এটাই বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক।
উপরন্তু এই চলচ্চিত্রে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর চেহারা মুবারক মোটেও দেখানো হয়নি। আর এতে যদি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি অবমাননাকর কিছু প্রদর্শন করা হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই তার প্রতিবাদ করা উচিত।
আশা করি চলচ্চিত্রটি মুসলমানদের ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের দৃষ্টান্ত হবে ও মাযহাবগত সংকীর্ণতার গণ্ডি পেরিয়ে ইসলাম প্রচারের মাধ্যম হবে; কারণ, যাঁর মহা পবিত্র জীবনীর ওপর চলচ্চিত্রটি বানানো হয়েছে, তিনি শিয়া-সুন্নি, মুসলিম-খ্রিস্টান, সাদা-কালো, আরব-অনারব সব ধরনের সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব ও মহান আল্লাহ পাকের কাছে সবচেয়ে প্রিয় ও সম্মানিত ব্যক্তি- মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ (সা.)।

ইরানে মানবাধিকার বিষয়ক আইনের সংক্ষিপ্তসার

অনুবাদ : মিয়া আবদুল আউয়াল
(গত সংখ্যার পর)
২.০ শিশু-কিশোরবিষয়ক বিধানাবলি
মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিশুদের শিক্ষার আবশ্যকতা এবং পরিবার ও শিশুদের অধিকার সম্পর্কিত বেশ কিছু সাংবিধানিক ধারার সংশোধনী আনা হয়েছে। এতে শিশু-কিশোরদেরকে দেশের ভবিষ্যতের ভিত্তিস্তম্ভ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে এবং তাদের সুরক্ষায় ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের আইন পরিষদ বহু আইন ও বিধিবিধান অনুমোদন দিয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ কয়েকটি উল্লেখ করা হলো :
২.১ অপ্রাপ্তবয়স্ক ও মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের মায়েদেরকে তাদের অভিভাবকত্ব প্রদান; অনুমোদন কাল : ১৯৮১ সালের ২৯ ডিসেম্বর। এ আইন অনুযায়ী যেসব অপ্রাপ্তবয়স্ক ও মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুর পিতা শহীদ হয়েছেন কিংবা পরলোকগন করেছেন, মায়েদেরকে তাদের অভিভাবকত্ব দান করা হয়। এ সকল শিশুর প্রচলিত মানের ভরণ পোষণের ব্যবস্থা হয় তাদের উত্তাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি থেকে করা হবে নতুবা সরকার এ খরচ প্রদান করবে অথবা তাদের মায়েদের কোন বিপ্লবী সংস্থার দায়িত্বে দিয়ে দেয়া হবে। তবে, কোন আদালত কর্তৃক এ সকল মায়ের কেউ অযোগ্য ঘোষিত হলে অন্য কথা।
ইরানের ইসলামি মজলিস ১৯৮৫ সালের আগস্ট মাসে এ আইনটির সংশোধনী পাস করে।
২.২ জাতিসংঘ শিশু অধিকার দলিল অনুমোদন আইন; অনুমোদনকাল : ২০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৩।
জাতিসংঘ সনদের প্রাসঙ্গিক ধারাসমূহের উপর ভিত্তি করে এ আইনটি অনুমোদন করা হয়। এতে মানব পরিবারের সকল সদস্যের সমঅধিকারের স্বীকৃতি দান করা হয় যাতে বিশ্বে স্বাধীনতা, সুবিচার ও শান্তির ভিত্তি স্থাপিত হতে পারে। এই সম্মেলনে শিশুদেরকে মানবজাতির সর্বাধিক দুর্ভোগের শিকার হিসেবে বিবেচনা করা হয় যাদের উপর নির্ভর করছে বিশ্বের ভবিষ্যৎ। এই দলিলটিতে ৫৪টি ধারা এবং একটি ভূমিকা রয়েছে। শিশুদের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজন এমন সব বিষয় এ দলিলে বিবেচনা করা হয়েছে। ইরানের সংসদ ১৯৯৩ সালে এই দলিলটি অনুমোদন করে।
২.৩ শিশু অধিকার কনভেনশন সংশোধনী গ্রহণ আইন; অনুমোদনকাল : ১০ জুলাই ২০০১। জাতিসংঘ প্রস্তাব নং এ ৫০/১৫৫- ২১ ডিসেম্বর ১৯৯৫ অনুযায়ী দলিলটি ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের জাতীয় সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত হয়।
২.৪ নিকৃষ্টতম শিশুশ্রম নিষিদ্ধকরণ ও বিদূরণে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণ সম্পর্কিত দলিল অনুমোদন আইন; অনুমোদনকাল : ৩০ অক্টোবর ২০০১। ১৯৯৯ সালের ১৭ জুন দলিলটি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সাধারণ সম্মেলনে গ্রহণার্থে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সামনে উপস্থাপিত হয় যা ২০০১ সালের অক্টোবরে ইরানের পার্লামেন্টে উপস্থাপিত হয়। পার্লামেন্ট দলিলটি অনুমোদনের পর ৩টি নোটে উল্লেখ করে যে, ইরানের ৩টি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তথা খনি ও শিল্প মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও শ্রম ও সমাজবিষয়ক মন্ত্রণালয় দলিলটির প্রযোজ্য বিধানাবলি বলবৎ করবে।
২.৫ শিশু-কিশোর নিরাপত্তা সুরক্ষা আইন : অনুমোদন কাল : ২০ আগস্ট ২০০২। অনুর্ধ ১৮ বছর বয়সের শিশু-কিশোরদের হয়রানি এবং শারীরিক ও মানসিক আঘাতের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের উপর গুরুত্বারোপ করে এই আইনটি অনুমোদন করা হয়। ইরানের ইসলামি সংসদ এ ধরনের অপরাধের হোতাদের জন্য বিশেষ কিছু শাস্তি নিশ্চিত করে আইনটিতে অনুমোদন দেয়।
২.৬ অইরানী পুরুষের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ ইরানী মহিলার সন্তানের নাগরিকত্ব সম্পর্কিত আইন; অনুমোদনকাল : ২২ সেপ্টেম্বর ২০০৬। এই আইন অনুযায়ী অইরানী স্বামীর ঔরশে ইরানে জন্ম হওয়া ইরানী মহিলার গর্ভজাত সন্তান কিংবা এ আইনটি গৃহীত হওয়ার অনুর্ধ্ব এক বছরের মধ্যে ইরানে জন্ম হওয়া সন্তানগণ তাদের বয়স আঠারো বছর পূর্ণ হলেই ইরানী নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবে। এ ধরনের আবেদন ইরানী নাগরিকত্ব প্রদানের জন্য গৃহীত হবে যদি তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কিংবা নিরাপত্তাবিষয়ক কোন রেকর্ড না থাকে এবং তাদের অইরানী নাগরিকত্ব প্রত্যাখ্যাত না হয়ে থাকে।
২.৭ শিশু বিক্রয়, পতিতাবৃত্তি ও পর্নোগ্রাফি সম্পর্কিত শিশু শ্রমিক কনভেনশনের ঐচ্ছিক প্রটোকল ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান কর্তৃক স্বাক্ষর বিষয়ক আইন : অনুমোদনকাল ৩১ জুলাই ২০০৭। আলোচ্য প্রটোকলটি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কর্তৃক ২০০০ সালের ২৫ মে তারিখে গৃহীত হয়। উল্লেখ্য, প্রটোকলটির কোন কোন বিধান ইসলামি মজলিসের পরবর্তী আইন প্রণয়নকালে অধিকতর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এর একটা স্পষ্ট দৃষ্টান্ত হলো, সাইবারনেটীয় অপরাধ আইন যাতে শিশুর অপব্যবহার সম্পর্কিত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। আরো তাৎপর্যপূর্ণভাবে এই আইন অনুর্ধ্ব ১৮ বছর বয়সীদের অপব্যবহার বিষয়ক সাইবারনেটীয় অপরাধের বিশ্বজনীন যোগ্যতা বিবেচনা করে।
২.৮ সামাজিক নিরাপত্তা আইন ও অন্যান্য পেনশন তহবিলের অধীনে মৃত মাতার সন্তানদের বৃত্তি প্রদান আইন: এ আইন অনুযায়ী, পরলোকগত মাতা এবং একই রূপে পরলোকগত পিতারা তাদের মৃত্যুত্তোরকালে বৃত্তি প্রাপ্য হবেন। এই আইনটি অভিভাবকের অবর্তমানে সন্তানদেরকে নানারূপ দুর্ভোগ থেকে লক্ষণীয় সুরক্ষা সুবিধা দান করে।
২.৯ অভিভাবকহীন শিশু-কিশোরদের সুরক্ষায় আইনি বিল প্রস্তাব; উত্থাপনকাল : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৯। সর্বশেষ বিরাজমান পরিস্থিতির সাথে ১৯৭৪ সালে অনুমোদিত ‘অভিভাবকহীন শিশু-কিশোরদের সুরক্ষা আইনটি’কে খাপ খাইয়ে নেয়া, দুর্দশায় নিপতিত এই শ্রেণিটির সুরক্ষায় অপেক্ষাকৃত উত্তম ও যথেষ্ট ভিত্তি প্রস্তুতকরণ এবং সেই সাথে ইসলামি মানদণ্ডের আলোকে পরিবারের পবিত্র মর্যাদা সংরক্ষণে বিলটি উত্থাপিত হয়। সংবিধানের ২৯ ধারার কাঠামোর মধ্যে প্রস্তুত বিলটি উপযুক্ত পরিবারসমূহকে যোগ্য শিশু-কিশোরদের অভিভাবকত্ব অর্পণে অধিকতর ব্যাপক একটা ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে। এর উদ্দেশ্য হলো অভিভাবকগণ কর্তৃক শিশুদের যতেœ উন্নততর কৌশল বাস্তবায়ন এবং উল্লিখিত শিশুকিশোরদের সাথে তাদের পিতা-মাতা ও অভিভাবকগণের সম্পর্কোন্নয়ন ত্বরান্বিতকরণ, যাতে তাদের লালন-পালন ও ব্যক্তিত্বের বিকাশে মানসিক ও শারীরিকভাবে একটা স্থিতিশীল পরিবেশ নিশ্চিত হয়। পূর্বেকার আইনটিতে এ ব্যাপারে কিছু ঘাটতি ছিল, সেকারণে এ বিলটি সংসদে আনা হয় যা বর্তমানে আলোচনাধীন আছে।
৩. নাগরিকগণের সম্মান ও গোপনীয়তা
এ বিষয়টি সংবিধানের ২২, ২৩ ও ২৫ নং ধারায় বিবেচিত হয়েছে। বিষয়টির উপর ইসলামিক সংসদে স্বাধীন ও ব্যাপকভিত্তিক কোন আইন পাস না হলেও বর্তমান আলোচ্যসূচিতে এর উপর একটা বিষয় আলোচনাধীন আছে। যাহোক, এ বিষয়ে প্রধান আইনগুলো নিম্নরূপ :
৩.১ গোপনীয়তা প্রস্তাব; উত্থাপনকাল : ২৮ জুন, ২০০৬। প্রস্তাবটি ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের ৮ম সরকার ক্ষমতাশীন থাকাকালে একটি বিল আকারে সংসদে উত্থাপিত হলেও পরে তা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। এর আগে ৭ম সংসদে বিষয়টি উত্থাপিত হয় এবং এর সাধারণ দিকগুলো পাস হয়। তবে চূড়ান্তভাবে গৃহীত হওয়ার জন্য আর কোন বিতর্ক আলোচনা হয়নি। সংবিধানের ২৩ ও ২৫ ধারার অধীনে প্রস্তাবটি শুধু যে আবশ্যকীয় তা নয়; বরং এর ব্যাপকতার কারণে এটি অন্য আরো কিছু ক্ষেত্রে দরকারিও বটে, যদিও চূড়ান্তভাবে গৃহীত হওয়ার জন্য প্রস্তাবটিতে কিছু কিছু সংশোধনী প্রয়োজন।
সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা এবং আন্তর্জাতিক সামরিক ও রাজনৈতিক অধিকার কনভেনশনসহ কিছু কিছু আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক মানবাধিকার কনভেশনে আমাদের দেশের অংশগ্রহণের প্রেক্ষিতে এই বিষয়টির বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। কেননা, এ সকল অধিকার বিষয়ে আমাদের যুক্ত থাকতে ও তা মেনে চলতে হবে, সে অনুযায়ী কিছু কিছু অভ্যন্তরীণ আইন প্রণয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, প্রস্তাবটিতে আছে ৭টি অধ্যায়। ‘সংজ্ঞা ও সাধারণবিধি’ শীর্ষক প্রথম অধ্যায়ে রয়েছে প্রযোজ্য কিছু ধারণা, বিশেষত গোপনীয়তা ও ব্যক্তিগত মর্যাদা এবং সেই সাথে আরো কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয়। দৈহিক গোপনীয়তার উপর ২য় অধ্যায়ে বিবেচিত হয়েছে কিছু বিষয়, যেমন কীভাবে কোন ব্যক্তিকে তদন্ত বা অনুসন্ধান করা যেতে পারে। স্থান ও বাড়িঘরের গোপনীয়তা সম্পর্কিত ৩য় অধ্যায়টিতে অন্যান্য বিষয়ের সাথে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহের কর্মপ্রক্রিয়াকে সংজ্ঞায়িত ও সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। ৪র্থ অধ্যায়ে রয়েছে কর্মক্ষেত্রের গোপনীয়তা বিষয়ক বিধানাবলি এবং ৫ম অধ্যায় বিবেচনা করা হয়েছে তথ্য গোপনীয়তার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি। অপরদিকে ৬ষ্ঠ অধ্যায়ে আছে বিশেষত যোগাযোগের ক্ষেত্রে গোপনীয়তার বিষয়টি এবং সবশেষে ৭ম অধ্যায়ে রয়েছে গোপনীয়তা লঙ্ঘন থেকে উদ্ভূত বিষয়সমূহের শ্রেণিবিন্যাস।
৩.২ তথ্য প্রকাশ সম্পর্কিত গৃহীত বিলের অংশবিশেষ ও তথ্যে অবাধ প্রবেশগম্যতা; ২৯ জানুয়ারি, ২০০৯। এই আইনের ভিত্তি হচ্ছে সরকারি তথ্যে স্বচ্ছতা প্রবর্ধন, যা পরবর্তী অংশগুলোতে দেখা যাবে। অবশ্য এ আইনে কিছু তথ্যকে ব্যতিক্রম হিসেবে শ্রেণিকরণ করা হয় যার মধ্যে পড়ে ৪র্থ অধ্যায়ে বিধৃত ব্যক্তির গোপনীয়তাবিষয়ক আইন।
৩.৩ সাইবারনেটীয় আইনের ক্ষেত্রসমূহ; গ্রহণকাল : ৩১ মে ২০০৯। এই আইনের ১৬ ও ১৭ অনুচ্ছেদ অনুসারে কম্পিউটার কিংবা যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যবহারের মাধ্যমে কৃত যে কোন কর্ম যা ব্যক্তিকে হেয়করণের জন্য করা হয় সেগুলোকে অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছেÑ যা শাস্তিযোগ্য। অধিকন্তু এ আইনের ২য় অনুচ্ছেদে বর্ণিত ব্যক্তিগত গোপনীয় যোগাযোগের ক্ষেত্রে আড়িপাতা অপরাধ হিসেবে গণ্য। ব্যক্তিগত ইলেক্ট্রনিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে এরূপ নিয়ম লঙ্ঘনে উপযুক্ত শাস্তির বিধান করা হয়েছে। তদুপরি, এই আইনের ২য় অংশে বা সাইবারনেট সংক্রান্ত অপরাধের ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহের জন্য আইনি প্রক্রিয়া সম্পর্কিত কিছু বিশেষ সুরক্ষা বিধান দেয়া হয়েছে যেগুলো তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারকারীদের সম্পর্কে হস্তান্তরযোগ্য তথ্য ও উপাত্ত উপস্থাপন সম্পর্কিত (ধারা ৩২-৩৫ এবং ধারা-৪৯)।
৪. মত প্রকাশ ও তথ্য স্বাধীনতা
সংবিধানের ৪ নং, ২৬ নং ও ২৭ নং ধারা এই বিষয় ও প্রাসঙ্গিক অন্যান্য দিক সম্পর্কিত। অবশ্য সংবাদপত্র সম্পর্কিত সংবিধানের ১৬৮ নং ধারা মতে এ ধরনের মামলার বিচার হওয়া উচিত প্রকাশ্যে এবং জুরিগণের উপস্থিতিতে।
৪.১ বিভিন্ন দল, গোষ্ঠী, রাজনৈতিক ও বাণিজ্য সমিতি এবং স্বীকৃতি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কর্মতৎপরতা (সম্পর্কিত) আইন; গ্রহণকাল : ২০ আগস্ট, ১৯৭১। এ আইন অনুযায়ী, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাধারণ নীতিমালার ভিতর সুনির্দিষ্টরূপে সুরক্ষা অধিকার ও মানদণ্ডের অধীনে এ ধরনের দল বা গোষ্ঠী গঠন অনুমোদিত।
৪.২ সংবাদপত্র আইন; গ্রহণকাল : ৩রা মার্চ, ১৯৮৫। লক্ষণীয় যে, এ আইনটি এক শতাব্দীরও অধিক আগে অর্থাৎ ১৯০৭ সালে প্রণীত। তবে ১৯৮৯ সালে এটিতে মৌলিক পরিবর্তন আনা হয় এবং ইসলামি সংসদ কর্তৃক পাস হয়। অতঃপর আইনটিতে কিছু কিছু সংশোধনীও আনা হয়। যার মধ্যে রয়েছে ইলেক্ট্রনিক প্রকাশনাকে অন্তর্ভুক্ত করে বিধান-১ এ একটা নোট যুক্তকরণ। যাতে এ আইনের অধীনে উপযুক্ত আইনি সুরক্ষা হিসেবে ই-প্রকাশনার মালিকগণ কর্তৃক সংঘটিত অপরাধের বিচার উপযুক্ত ক্ষমতাসম্পন্ন আদালত কর্তৃক জুরিগণের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হবে।
৪.৩ তথ্য প্রদান ও অবাধ তথ্য প্রবেশগম্যতা বিল; গ্রহণকাল : ২৯ জানুয়ারি, ২০০৯। পাস হওয়া এ বিলটিতে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের জনগণের অন্যতম মৌলিক মানবাধিকার তথা সরকারি তথ্যে প্রবেশগম্যতা প্রতিফলিত হয়েছে। বিলটি এখনও জাতীয় উপযুক্ততা পরিষদের (ইক্্সপিডিয়েন্সী কাউন্সিল) অনুমোদন প্রক্রিয়াধীন, কেননা, এটি অভিভাবক পরিষদের আপত্তির মুখে পড়েছে যা সংসদ কর্তৃক পরিবর্ধিত হয়নি। এই অধিকারটি যাতে অব্যব্যহারিক না হয় সেজন্য এর কিছু কিছু অধ্যায়ে এমন ব্যাখ্যাদানের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে যাতে এগুলোতে তথ্য প্রবেশগম্যতা থাকে এবং সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্তব্যাদি সন্নিবিষ্ট থাকে। অধিকন্তু, একটি উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্তৃপক্ষকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে যাতে তারা একটা তথ্য প্রদান ও অবাধ তথ্য প্রবেশগম্যতা কমিটি গঠন করে যাদের দায়িত্ব হবে সম্ভাব্য সর্বোত্তম পন্থায় এ আইনটি প্রয়োগ করাÑ পরিকল্পনা থেকে নিয়ন্ত্রণ পর্যন্ত। এ ছাড়াও যেহেতু সরকারিভাবে শ্রেণিকরণকৃত তথ্য এবং জনগণের নিকট প্রদানযোগ্য অন্যান্য তথ্যের ব্যাপারে প্রয়োগযোগ্য আর কোন ব্যাপকভিত্তিক আইন নেই সেহেতু এ আইনটি প্রয়োগে যেকোন ব্যর্থতা রোধে বিশেষত এমন ব্যর্থতা যা ইরানী জনগণকে তাদের প্রতিষ্ঠিত অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে, আইনটিতে একটা আলাদা অধ্যায় সংযোজিত হয়েছে। সবশেষে, এ আইনের বিধানসমূহ লঙ্ঘনের অপরাধের শাস্তিমূলক ব্যবস্থাসহ কিছু কিছু বিষয়ে সুনিশ্চয়তার বিধান রাখা হয়েছে।
৪.৪ সাইবারনেট সংক্রান্ত অপরাধ আইনের অংশসমূহ; অনুমোদনকাল : ৩০ মে, ২০০৯। সাইবার পরিবেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সুরক্ষার্থে এ আইনের অধীনে উপযুক্ত বিধানাবলি বিবেচনা করা হয়েছে। একই সাথে এতে সংবাদ ওয়েবসাইটসমূহকে অবাঞ্ছিত মতপ্রকাশ পরিবীক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে ওয়েবসাইট পরিবীক্ষণ নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে থাকে। ধারা-২১ এর অধীনে শুধু ফৌজদারি অপরাধের ঘটনার ক্ষেত্রসমূহেই পরিবীক্ষণ করা হবে, অনৈতিক কাজের ক্ষেত্রে নয়। প্রসিকিউটার জেনারেলের সভাপতিত্বে কর্মতৎপর ১১ সদস্যের একটি সরকারি ওয়ার্কিং গ্রুপ যথোপযুক্ত ও প্রয়োগযোগ্য রুলিং জারি করবে। অধিকন্তু, ওয়েবসাইট পরিবীক্ষণের বিষয়টি যদি ব্যক্তিগত অভিযোগ হয়, তবে শুধু প্রাসঙ্গিক বিচারিক কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের নির্দেশের ভিত্তিতেই পদক্ষেপ গৃহীত হবে। ২১ ধারার ১ নং নোটের অধীনে বিধৃত অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল, কোন কোন অবস্থায় অপরাধী পক্ষের ওয়েবসাইট পরিবীক্ষণ করা হবে না এবং এতদসম্পর্কিত আইনসঙ্গত বিষয়বস্তুতে মানুষের প্রবেশগম্যতা বজায় রাখা হবে। কোন কোন অবস্থায় এই আদেশটি বলবৎযোগ্য যাতে ঐ ওয়েবসাইটটির অপরাধের প্রকৃতি তৎক্ষণাৎ অকার্যকর হয়ে যায়।
৫. নৃগোষ্ঠীগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু
বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুর অধিকার প্রতিপালনের উপর গুরুত্ব দিয়ে সংবিধানে অনেক ধারা রয়েছে। যাতে তাদের বিশেষ রীতিনীতি ও আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি শ্রদ্ধা প্রতিফলিত হয়েছে। এসকল ধারার মধ্যে রয়েছে সংবিধানের ১২ থেকে ১৫, ১৯ এবং ২০ নং ধারা। লক্ষণীয় যে, ইসলামি প্রজাতন্ত্রের আইন প্রণেতাগণ সব সময়েই এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছেন বা দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে এসেছেন। অধিকন্তু এ সকল ধারা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ইরানের ইসলামি সংসদ এ ব্যাপারে বিভিন্ন সুরক্ষামূলক আইন প্রণয়ন করে এসেছেন। নিম্নে বর্তমানে প্রযোজ্য এ ধরনের কিছু আইনের অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো :
৫.১ বর্ণবাদী বৈষম্যের সকল রূপ মূলোৎপাটনে আন্তর্জাতিক কনভেনশন সম্পর্কিত আইন; ২১ জুলাই, ১৯৬৮। একটি ভূমিকা ও ২৫টি ধারা সম্বলিত এই কনভেনশনটি জাতিসংঘের সকল সদস্য কর্তৃক সমগ্র মানবজাতির প্রশংসা ও তাদের সমতা ও সমযোগ্যতার নীতির প্রতি সম্মানার্থে গৃহীত হয়েছিল। এ দলিলে স্বাক্ষরকারী হিসেবে আমাদের দেশের তৎকালীন জাতীয় পরামর্শ সভা কর্তৃক এটি পাস হয়েছিল।
৫.২ বর্ণবাদী বৈষম্য প্রচারের শাস্তি আইন; পাসকাল : ২১ জুলাই ১৯৭৭। এই আইনের ধারা-১ অনুযায়ী গণমাধ্যমের দ্বারা বর্ণ, নারী-পুরুষ এবং বর্ণবাদী বিদ্বেষভিত্তিক যেকোন বৈষম্যমূলক ধারণার প্রচার-প্রকাশ এবং বর্ণ ও নারী-পুরুষভিত্তিক কোন উস্কানিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সেই সাথে বর্ণবাদী প্রকৃতির কোন কর্ম তৎপরতায় আর্থিকসহ যেকোন সাহায্য-সহযাগিতা প্রদানকে নিষিদ্ধ করা হবে এবং অপরাধীকে জেল এবং আর্থিক দণ্ড পেতে হবে।
৫.৩ আন্তর্জাতিক বর্ণবাদী অপরাধ নিষিদ্ধকরণ ও শাস্তি প্রদান কনভেনশনে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের যোগদান আইন; অনুমোদনকাল : ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫। বর্ণবাদী, লিঙ্গভিত্তিক, ভাষাভিত্তিক এবং ধর্মীয় বৈষম্যের সকল রূপের বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রক্রিয়ার সাথে সামঞ্জস্য রেখে এবং মানবগোষ্ঠীর মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধার স্বাক্ষরস্বরূপ এই দলিলটি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কর্তৃক ৩০ নভেম্বর ১৯৭৩ সালে গৃহীত হয়। ১৯৮০ সালে ইরানের ইসলামি জাতীয় সংসদ অভিভাবক পরিষদের অনুমোদনক্রমে এটি পাস করে।
৫.৪ ক্রীড়ায় বর্ণবাদবিরোধী আন্তর্জাতিক কনভেনশন ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সম্মতি আইন; অনুমোদনকাল : ২৯শে সেপ্টেম্বর, ১৯৮৭। একটি ভূমিকা ও ২২টি ধারা সম্মলিত এই দলিলটি জাতিসংঘ সদস্যদের নিকট উপস্থাপিত হয় ১৯৮৫ সালের ১০ ডিসেম্বর তারিখে। ক্রীড়াক্ষেত্রে সকল বৈষম্য সৃষ্টিকারী বিষয়কে দূর করার লক্ষ্যে একটি দলিল হিসেবে এটি জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে গৃহীত হয়।

(অসমাপ্ত)

আত্মত্যাগ ও কারবালার শিক্ষা

শাহ সূফী মোখলেছুর রহমান
যে কথা শোনামাত্রই প্রতিটি মুসলমানের মন ও শরীর শিউরে ওঠে, ব্যথা অনুভব হয় হৃদয়ে, অশ্রুসিক্ত হয় নয়ন তা হলো সেই শোকাবহ ‘কারবালা’। হক আর বাতিলের পার্থক্যকারী ‘আমর বিল মারুফ নাহী আনিল মুনকার’ তথা সৎ কাজের আদেশ দান ও অন্যায় থেকে নিষেধ করার বাস্তব নমুনা হলো এই ‘কারবালা’। যে নাম মযলুম অসহায় জনগোষ্ঠীর প্রাণে সাহস যোগায়, আপোষহীন যুবকের মনে সৃষ্টি করে প্রত্যয় এই সেই হৃদয়বিদারক ‘কারবালা’। সত্যপথের যাত্রী মুমিনদের মুখে এ নামটি যতবার উচ্চারিত হবে, যতবার হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) ও আহলে বাইতের গগনবিদারি ফরিয়াদ কানে পৌঁছবে ততবার তাদের ধমনির রক্ত নতুন গতি লাভ করবে।
একজন মুমিন যখন কারবালার দিকে তাকায় তখন তার মানসপটে ফুটে ওঠে ফোরাতকুলে দুলদুল পৃষ্ঠে রাসূল (সা.)-এর কলিজার টুকরা, দুজাহানের নেত্রী মা ফাতিমার নয়নমণি, বিশ্ব মুসলিমের প্রাণপ্রিয় নেতা, বেহেশতে যুবকদের সর্দার ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মায়াময় প্রতিকৃতি। ইমাম হোসাইন তাহাজ্জুদের সময় তাঁবুগুলোর চারদিক ঘুরে আসছেন আর সঙ্গী-সাথিদের জড়ো করে বলছেন : ‘হে আমার পরিবার-পরিজন! হে আমার সঙ্গী-সাথিগণ! ওরা শুধু আমারই জীবন নিতে চায়। তোমরা যে যেদিকে পার চলে যাও।’ ইমামের এ ভাষণ শোনামাত্র তাঁর ভাই হযরত আব্বাস ইবনে আলী এবং হযরত জাফর তাইয়্যারের সন্তানগণ বলে উঠলেন : ‘আমরা কেন এমন কাজ করব, আপনাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে আমরা পালিয়ে যাব? যেন কখনোই এমন কাজ আমাদের দ্বারা সংঘটিত না হয়।’
সৈন্যবেষ্টিত যুদ্ধক্ষেত্রে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একজন ব্যক্তিও ইমাম হোসাইন (আ.)-কে পরিত্যাগ করে গেলেন না। পবিত্র কারবালাই সত্যিকার ঈমানদারদের পরীক্ষা। দুঃখের দিনেই সত্যিকার বন্ধুর পরিচয়। একে একে সবাই শপথ করলেন একফোটা রক্ত থাকতে কেউ ইমামকে ছেড়ে যাবেন না। মাতা তাঁর প্রাণপ্রিয় পুত্রকে রণসাজে সাজিয়ে দিচ্ছেন, আর পতœী তাঁর প্রিয় পতিকে যুদ্ধের পোশাক পরিয়ে দিয়ে অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছেন। ধর্মের জন্য, সত্যের জন্য, ন্যায়ের মর্যাদা রক্ষার জন্য মুসলমানরা যে হাসিমুখে মৃত্যুবরণ করতে পারেন, ইমাম হোসাইন (আ.) ও তাঁর অনুসারী ৭২ জন মুসলমান কারবালা প্রান্তরে শাহাদাত বরণ করে তারই অক্ষয় স্বাক্ষর রেখে গেছেন। নেতার প্রতি এরূপ আনুগত্য ও ভক্তি প্রদর্শন ইতিহাসের পাতায় আর একটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারবালায় ৭২ জনের লাশ পড়ে আছে… পাষাণ শিমার বলছে : ‘এসব লাশের ওপর দিয়ে ঘোড়া দাবরিয়ে দাও।’ এসব লাশের মধ্যে রয়েছে ইমাম হোসাইনের পবিত্র দেহ যে দেহে বিদ্ধ হয়েছে ৩৩টি বর্শা ও আর রয়েছে তরবারির ৪৩টি আঘাত। কী মর্মান্তিক দৃশ্য! যে কদম মোবারক চুমু খাওয়ার জন্য দুনিয়া পাগল, আজ কারবালায় এ লাশ নিয়ে চলছে তা-ব। মাথা মোবারক বর্শায় গেঁথে পাষ- ইয়াযীদ বাহিনী চলছে কুফার দিকে।
ইমাম হোসাইন (আ.) ও তাঁর সঙ্গী শহীদগণের নাম এবং কারবালায় তাঁদের রক্ত¯্রােতের দৃশ্য বারবার মুমিনের মাঝে ঈমানী চেতনা সৃষ্টি করে। ইমাম হোসাইনকে কারবালা প্রান্তরে দেখতে পাই ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, আত্মত্যাগের এক অপূর্ব নজির হিসাবে। চোখের সামনে ক্ষুধা-পিপাসায় কাতর, আপন পরিজনের ম্লানমুখ, নিশ্চিত মৃত্যু তাঁকে সংকল্পচ্যুত করতে পারেনি। শিশুপুত্র আসগারের মর্মান্তিক মৃত্যু তাঁকে বিচলিত করতে পারেনি। ভ্রাতুষ্পুত্র নওজোয়ান কাসেমের মৃত্যু তাঁকে কর্তব্যকর্ম থেকে বিরত রাখতে পারেনি।
সত্যের পরীক্ষায় জয়যুক্ত হয়ে শহীদ হলেন কিন্তু আদর্শহীন ইয়াযীদের নিকট বাইআত করতে সম্মত হননি। একদিকে অতুল ঐশ্বর্য, অপ্রতিহত ক্ষমতা ও অগাধ সম্মান, আর একদিকে দুঃখ-নির্যাতন, নিষ্ঠুর নিষ্পেষণ ও নিশ্চিত মৃত্যু। সত্যিকার মুসলমান ঈমানের পরীক্ষা দিতে শেষের পথই বেছে নেন। এরা চিরদিনই মুষ্টিমেয়, কিন্তু পরিণামে বিজয়মালা এদেরই পদতলে লুণ্ঠিত হয়। এজন্যই কবি বলেছেনÑ ‘ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হার কারবালা কি বাদ।’
৬১ হিজরির ১০ মুহররম। মরুময় ‘কারবালা’ প্রান্তরে পাপিষ্ঠ ফাসিক ইয়াযীদ অন্যায়ভাবে রাসূলে করীম (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)-কে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। হত্যা করেছিল নবীবংশের অনেক সদস্যকে। তাই ১০ মুহররম ‘আশুরা’ জন্ম দেয় মহাশোকের। মহান আল্লাহর রাসূলের বংশের ওপর সংঘটিত অন্যায় ও অত্যাচারের প্রতিবাদ যারা করবে তারাই হবে মুহাম্মাদী দ্বীনের প্রকৃত অনুসারী। রাসূলে করীম (সা.)-কে যারা প্রকৃতই ভালোবাসে ও আহলে বাইতকে বিশ্বাস করে তারা কিয়ামত পর্যন্ত শোকের মাধ্যমে তাঁর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র ও বংশধরদের হত্যাকাণ্ডের স্মরণ ও প্রতিবাদ করতেই থাকবে।

লেখক: পীরজাদা শাহ সূফী মোখলেছুর রহমান,
ঐতিহ্যবাহী মানিকগঞ্জ গড়পাড়া এমামবাড়ির সাজ্জাদানশীন পীর ও
সভাপতি, পাক পাঞ্জাতন অনুসারী পরিষদ, বাংলাদেশ

ইতিহাস কথা : দশই মুহররম

মরুভূমির লাল সূর্যটা দিগন্তের ওপারে মুখ লুকালো। সে হয়তো লজ্জায় দুঃখে পালিয়ে বাঁচল। ইমামশিবিরের করুণ আহাজারি হয়তো তারও সহ্য হয়নি। পিপাসায় কাতর প্রাণ ওষ্ঠাগত। কচি শিশুদের দুঃখে পাষাণ হৃদয়ও বিচলিত হয়। কিন্তু নরাধম ইয়াযীদ বাহিনীর হৃদয়ে কোন দয়ামায়া নেই। তিনদিন ধরে নবীবংশের প্রিয়জনরা পানিও পাচ্ছে না। দুরাত্মা ইয়াযীদ পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। একি নিষ্ঠুরতা! ইমাম বাহিনীর সবাই পরম ধৈর্যের সাথে তাদের জীবনের শেষ রাতটি ইবাদত-বন্দেগিতে কাটালেন। অন্তঃপুরে নারী-শিশুদের করুণ কান্নার ধ্বনি কারবালার সেই রাত্রিকে আরো ভারী করে তুলেছিল। গভীর নিশিথের মরু হাওয়া যেন অশুভ সংকেত নিয়ে ছুটে গেল কোন অজানার পথে। এরপর আযানের ধ্বনি যেন হৃদয়কে স্পর্শ করল। এই সুমধুর ধ্বনি করুণ আর্তনাদ হয়ে যেন বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিল- তোমরা কে কোথায় আছ, দেখে যাও আজ কী ঘটতে চলেছে! বর্ণিত আছে, হযরত আলী আকবরের কণ্ঠস্বর ছিল মহানবী (সা.)-এর অনুরূপ। তাঁর কণ্ঠে আযানের ধ্বনি এমনকি ইয়াযীদ বাহিনীর মাঝেও বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু পিশাচদের মাঝে তার কোন প্রতিক্রিয়া হয়নি। আশুরার দিন ভোরে ফজরের নামাযের ইমামতি করলেন ইমাম হোসাইন (আ.)। আল্লাহর সৈনিকদের এই নামায শেষ হবার আগেই ইয়াযীদ বাহিনীর আক্রমণ শুরু হয়ে যায়। দুরাচার সেনাপতি ওমর ইবনে সাদ প্রথমে একটি তীর নিক্ষেপ করে যুদ্ধ শুরু করে। তীরবৃষ্টির মধ্যেই ইমাম ও তাঁর সাথিরা নামায শেষ করলেন। ইমাম তাঁর সাথিদেরকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হবার নির্দেশ দিয়ে দায়িত্ব ভাগ করে দিলেন। ভাই আব্বাসকে দিলেন পতাকা রক্ষার দায়িত্ব। এ সত্যের পতাকাবাহী হযরত আব্বাস ‘আব্বাস-ই-আলমদার’ নামে বিখ্যাত। পথভ্রষ্ট দুরাত্মাদেরকে আবারও বোঝাবার চেষ্টা করলেন ইমাম হোসাইন। ভুল সংশোধনের শেষ সুযোগ দিয়ে ইয়াযীদ বাহিনীর উদ্দেশে বললেন : “হে জনসাধারণ, ক্ষান্ত হও। তোমরা কি জান আমি কে? আমাকে হত্যা করা কি উচিত হবে? আমি কি তোমাদের নবীর কন্যা ফাতেমার সন্তান নই? আলী মুর্তাজা কি আমার পিতা নন? তোমরা কি জান না, মহানবী (সা.) বলেছেন : ‘আমি ও আমার ভাই বেহেশতে যুবকদের সরদার? আমার কথা যদি বিশ্বাস না হয় তাহলে তোমরা জাবির ইবনে আবদুল্লাহ আনসারী, আবু সাঈদ খুদরী, সাহল ইবনে সা’দ সাঈদী, যায়েদ ইবনে আরকাম, আনাস ইবনে মালিকের কাছে প্রশ্ন করে জেনে নাও। এরপরও কি তোমরা আমাকে হত্যা করা থেকে বিরত থাকবে না?”
কিন্তু পাষাণহৃদয় দুরাচারদের মাঝে কোন ভাবান্তর হলো না। ওমর সাদ, শিমারসহ অন্যান্য পাপিষ্ঠ যুদ্ধ করার জন্য সৈন্যদের লেলিয়ে দিল। এই অবস্থায় ইয়াযীদ বাহিনীর এক সেনাপতি হোরের মাঝে ভাবান্তর হলো। ইমামের ভাষণ শুনে তিনি নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। ইমাম হোসাইনের কাছে এসে তিনি বললেন : ‘হযরত আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। আমি অনেক পাপ করেছি। আমি আপনাকে বাধা দিয়ে এখানে নিয়ে এসেছি। আপনাদের এই অবস্থার জন্য আমি দায়ী। আমি অনুতপ্ত হয়ে আপনার কাছে ফিরে এসেছি, আমার তওবা কি কবুল হবে?’ ইমাম মৃদু হেসে তাঁকে আশ্বাস দিলেন। হোর দেরী না করে তলোয়ার চালাতে চালাতে ইয়াযীদ বাহিনীর দিকে ছুটে গেলেন। হোরের সাথে তাঁর ছেলে, ভাই এবং ক্রীতদাসও ইয়াযীদ বাহিনী ত্যাগ করে ইমাম বাহিনীতে এসে যোগ দিলেন। তাঁরা সকলে লড়াই করতে করতে শহীদ হয়ে গেলেন। মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের লড়াই তীব্র আকার ধারণ করল। এ ছিল অসম যুদ্ধ। মাত্র ৭০/৮০ জন মুসলমানের সাথে হাজার হাজার মুনাফেকের যুদ্ধ। এ ছিল এক অসহায় মুষ্টিমেয় ঈমানদারের প্রতিরোধ যুদ্ধ। একদল ধর্মপ্রাণ আল্লাহর বান্দাকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে হিংস্র নেকড়ের দল। ছোট্ট একদল মুমিন কারবালার এই মরু প্রান্তরে যে অসীম সাহসিকতা, বীরত্ব ও ধৈর্যের পরিচয় দিলেন, মানব ইতিহাসে তেমনটি আর কখনো দেখা যায় নি এবং ভবিষ্যতেও হয়তো দেখা যাবে না। তিন দিন ধরে পিপাসায় কাতর ইমাম বাহিনী ছিলেন ঈমানের তেজে বলীয়ান। পার্থিব শক্তি-সামর্থ্য তখন ছিল গৌণ ব্যাপার। ধৈর্য আর ঈমানের পরীক্ষাই ছিল মুখ্য। মহানবীর পবিত্র আহলে বাইতকে রক্ষা করার জন্য ইমাম হোসাইনের সাথিরা সিংহবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লেন শত্রুসৈন্যের ওপর। প্রচ- আক্রমণে অসংখ্য ইয়াযীদ সৈন্য খতম করে নিজেরা শহীদ হতে লাগলেন। এভাবে একে একে ইমাম বাহিনীর বিখ্যাত বীরেরা শহীদ হয়ে গেলেন। তাঁরা সকলেই ইমাম হোসাইন ও তাঁর পরিবারের চারপাশে প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করে যুদ্ধ করেছেন। ইমামের দিকে ছুটে আসা তীর ও বর্শার আঘাত তাঁরা বুক পেতে নিয়েছেন। ইমামের সামনে তাঁরা একে একে শহীদ হয়ে গেছেন। বাকি রইলেন শুধু পরিবারের সদস্যগণ।
মহাকালের এই মহা কোরবানির জন্য এবার ইমাম হোসাইন ও তাঁর পরিবার প্রস্তত হলেন। কারবালার আকাশে প্রচ- তেজে জ্বলছে সূর্য। লু হাওয়ার করুণ দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। আল্লাহর প্রিয়তমদের প্রতি শয়তানদের আক্রমণে বিস্ময়বিমূঢ় হয়ে আছে বিশ্ব প্রকৃতি। নবীজীর প্রিয় নাতনী হযরত যায়নাব তাঁর দুই শিশুসন্তান আউন এবং মুহাম্মাদকে ডেকে বললেন : ‘এখনও তোমরা বসে আছ? আল্লাহর পথে শহীদ হবার সময় তো এসে গেছে।’ ১০ বছর ও ৯ বছরের দুই ভাই সমস্বরে বলে উঠলেন : ‘না মা, আমরা শুধু পবিত্র ইমামের হুকুমের অপেক্ষায় আছি।’ হযরত যায়নাব ভাই ইমাম হোসাইনের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে তাঁর দুই সন্তানকে ইয়াযীদ বাহিনীর বিরুদ্ধে পাঠিয়ে দিলেন। ক্ষুদে বীর আউন এবং মুহাম্মাদ অসাধারণ বীরত্ব ও সাহসের সাথে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়ে গেলেন। ইমাম হোসাইন (আ.) ও হযরত আব্বাস ছুটে গিয়ে তাঁদের পবিত্র দেহ দুটি এনে হযরত যায়নাবের সামনে রাখলেন। হযরত যায়নাব নিজ সন্তানদের নূরানি মুখে চুমু খেতে খেতে বললেন : ‘প্রিয় বাছারা আমার! এখন আমি তোমাদের ওপর খুশি হয়েছি। তোমরা সত্যের জন্য যুদ্ধ করে আল্লাহ ও তাঁর নবীকে খুশি করেছ।’ ছোট্ট শিশু দুটির শাহাদাতের পর আহলে বাইতের অন্য ছেলেসন্তানদের মধ্যে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। ১৪ বছরের কিশোর কাসিম ইবনে হাসান ইমামের অনুমতি নিয়ে যুদ্ধ করতে গেলেন। ইমাম হাসান (আ.)-এর ছেলে কাসিম একাকী তলোয়ার চালাতে চালাতে শত্রুবাহিনীর ভেতর ঢুকে পড়লেন। তিনি পাঁচজন শত্রুসেনাকে খতম করে শহীদ হয়ে গেলেন। ইমাম হোসাইন ভাইপোর মৃতদেহ তুলে আনার আগেই শয়তানের দল তাঁর ওপর ঘোড়া চালিয়ে দেয়। কাসিমের শাহাদাতে ইমামশিবিরে কান্নার রোল পড়ে যায়। ইমাম হোসাইন সকলকে শান্ত করে যুদ্ধ পরিচালনা করতে লাগলেন। কাসিমের মৃত্যু দেখে মহাবীর আব্বাস আর সহ্য করতে পারলেন না। তিনি ইমামকে সালাম করে ইয়াযীদের সেনাবাহিনীর ওপর প্রচ- আক্রমণ শুরু করলেন। তাঁর ঘোড়া বিদ্যুৎ গতিতে শত্রুব্যুহ ভেদ করছে। আব্বাসের তলোয়ারের আঘাতে শত্রুসেনারা কচুকাটা হচ্ছে। এই মহাবীরের সামনে সহজে কেউ আসার সাহস পাচ্ছে না। আব্বাস শত্রুসেনাদের মাঝখান দিয়ে পথ করে ফোরাতের তীরে এসে পৌঁছলেন। তাঁকে কেউ আটকে রাখতে পারল না। প্রচ- পিপাসাকাতর আব্বাস পানি খাওয়ার জন্য নিচু হলেন। কিন্তু সাথে সাথে আঁজলা থেকে পানি ফেলে দিলেন। ইমামশিবিরের কচি শিশুদের কথা তাঁর মনে পড়ল। দুধের বাচ্চারা এক ফোটা পানির জন্য কাতরাচ্ছে। তাদের ফেলে তিনি কী করে পানি পান করবেন? একটি থলেতে পানি ভরে ফিরতে লাগলেন আব্বাস। অমনি গোপন জায়গা থেকে অসংখ্য তীর এসে তাঁকে আঘাত করল। যুদ্ধাহত বীর আব্বাস ফোরাতের তীরেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন। মহাবীর আব্বাস শহীদ হওয়ার পর ইমাম হোসাইনের ছেলে হযরত আলী আকবর ময়দানে এলেন। আলী আকবর ছিলেন দেখতে অনেকটা মহানবী (সা.)-এর মতো। তাঁকে যুদ্ধের ময়দানে দেখে শত্রুসেনারা থমকে গেল। কেউ তাঁকে আঘাত করার সাহস পেল না। বীর আলী আকবর প্রচণ্ড বেগে তলোয়ার চালাতে চালাতে শত্রুসেনাদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দিলেন। বহু শত্রুসেনা খতম করে আলী আকবর ইমামের কাছে ফিরে এসে বললেন : ‘আব্বাজান! আমি বড় পিপাসার্ত।’ ইমাম হোসাইন পুত্রকে সান্ত¡না দিয়ে আবার যুদ্ধের ময়দানে পাঠিয়ে দিলেন। আলী আকবর বিপুল উদ্দীপনা নিয়ে আবার যুদ্ধের ময়দানে ফিরে গেলেন। ইয়াযীদ বাহিনীর বিরুদ্ধে আবার যুদ্ধ শুরু করলেন। হঠাৎ একটি তীর এসে তাঁর কণ্ঠে বিদ্ধ হলে তিনি ধরাশায়ী হন। এভাবে ইমাম হোসাইনের চোখের সামনেই তাঁর পুত্র, ভ্রাতুষ্পুত্র ও বন্ধুরা একে একে প্রাণ বিসর্জন দিলেন। এ আত্ম বিসর্জনে কারো মাঝে কোন প্রকার ভয়ভীতি বা দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল না। সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইমাম হোসাইনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সত্যকে প্রতিষ্ঠার জন্য মিথ্যার বিরুদ্ধে সংগ্রামে নিজেদের বিলীন করে দিয়েছেন। ইমাম হোসাইন দেখলেন চূড়ান্ত সময় এসে গেছে। পৃথিবীর বুকে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে যাচ্ছেন তিনি। মহানবী (সা.)-এর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী আদর্শকে সমুন্নত রাখার জন্য যে প্রতিরোধের প্রয়োজন ছিল সেটাই তিনি উপস্থাপন করে বিশ্ব তাগুতী শক্তিকে হতবাক করে দিলেন। ইমাম হোসাইন ও তাঁর সাথিরা ইয়াযীদি ইসলামের মোকাবেলায় মুহাম্মাদী ইসলামের ঝাণ্ডাকে উঁচিয়ে ধরলেন। বাতিল শক্তির মুখোশ উন্মোচন করে সত্যের মশালকে প্রজ্বলিত করলেন। সকলকে হারিয়ে আজ এই মুহূর্তে কারবালার মরু প্রান্তরে দাঁড়িয়ে আছেন ইমাম হোসাইন। এত বিষাদ, এত বেদনা, এত বিরহের মাঝেও নিজ মিশনকে কৃতকার্য করার দ্বারাপ্রান্তে এসে পৌঁছেছেন তিনি। এখন তো কেবল শেষ আঁচর দেয়াই বাকি। তিনি নিজে এই মহাকা-ের সমাপ্তি টানবেন। দুধের শিশু আলী আসগরকে দেখার সাধ জাগল। ইমাম হোসাইন তাঁবুতে গিয়ে কচি শিশু আলী আসগরকে দুহাতে বুকে তুলে নিলেন। পিপাসায় কাতর এই শিশুকে দেখে ইমাম আর স্থির থাকতে পারলেন না। শত্রুদের উদ্দেশে বললেন : ‘হে জনসাধারণ! তোমরা আমার সাথে যুদ্ধ করছ, আমাকে হত্যা করাই তোমাদের উদ্দেশ্য। এই শিশু তো কোন দোষ করেনি, একে অন্তত একটু পানি দাও।’ ইমামের এই আহ্বানের জবাবে একটি বিষাক্ত তীর এসে ইমামের হাতে বিদ্ধ হলো। তীরের ফলা ইমামের হাত ভেদ করে শিশু আলী আসগরের কণ্ঠ এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল। ইমাম সেই রক্তমাখা হাত আকাশের দিকে তুলে ফরিয়াদ জানালেন : ‘হে প্রভু! তুমি এর বিচার কর।’ শিশুপুত্রকে মাটিতে রেখে ইমাম হোসাইন চূড়ান্ত ফায়সালার জন্য প্রস্তুত হলেন। তাঁবুতে অসুস্থ পুত্র যায়নুল আবেদীনের কাছে ইমামতের দায়িত্বভার তুলে দিয়ে পরিবারের সকলের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। ইমাম হোসাইন যুদ্ধের ময়দানে এসে মূর্খ সেনাদের উদ্দেশে শেষবারের মতে আবারো উপদেশ দিতে চাইলেন। ইয়াযীদ বাহিনীকে সম্বোধন করে তিনি বললেন : ‘হে জনসাধারণ! তোমরা কেন আমাকে হত্যা করতে চাও? আমার কী অপরাধ?’ শত্রুদের কাছ থেকে কোন উত্তর পেলেন না তিনি। শত্রু পরিবেষ্টিত ইমাম একাকী দাঁড়িয়ে আছেন। তীরের আঘাতে জর্জরিত তাঁর দেহ থেকে রক্ত ঝরছে। তিনি আবার ডাক দিলেন : ‘হাল মিন নাসিরিন ইয়ানসুরুনা?’- ‘আমাদের সাহায্য করার কেউ আছে কি?’
কারো কাছ থেকে কোন উত্তর না পাওয়ায় ইমাম আবার বললেন : ‘তোমরা কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ না? তোমাদের মধ্যে একজন মুসলমানও কি নেই?’ কিন্তু পাষাণ হৃদয়গুলোতে কোন ভাবান্তর হলো না। শত্রুবাহিনী তীর ছুড়ে তার জবাব দিল। শেরে খোদার সন্তান মহাবীর হোসাইন স্থির থাকতে পারলেন না। ‘আমার মৃত্যু ব্যতীত যদি মুহাম্মাদের ধর্ম টিকে না থাকে তাহলে হে তরবারিসমূহ আমাকে গ্রহণ কর!’- একথা বলে প্রচ- হুংকারে তিনি শত্রুদের দিকে ছুটে গেলেন। শেরে খোদার পুত্রকে রণমূর্তিতে দেখে ইয়াযীদবাহিনী ভয়ে পিছু হটতে লাগল। ইমাম হোসাইন প্রচ- বেগে তলোয়ার চালাতে চালাতে শত্রুদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দিলেন। তাঁর তলোয়ারের প্রচ-তায় কেউ টিকতে পারছে না। শত্রুসেনারা পালিয়ে যাবার পথ পাচ্ছে না। ওমর ইবনে সাদ, শিমার, সেনান প্রমুখ দুরাচার পাপিষ্ঠ সৈন্যদের উসকে দিতে লাগল একযোগে ইমামের ওপর আঘাত হানতে। এদিকে তীরের আঘাতে জর্জরিত ইমামের দেহ থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণের ফলে ধীরে ধীরে তাঁর দেহ নিস্তেজ হয়ে আসছিল। তিনি আর তলোয়ার চালাতে পারছিলেন না। একসময় তিনি অশ্বপৃষ্ঠ থেকে মাটিতে পড়ে গেলেন। এ সময় পাপিষ্ঠরা চারদিক থেকে তাঁর ওপর আক্রমণ চালায়। ইমাম হোসাইন তাঁর বুক থেকে তীরের ফলা টেনে বের করে শেষবারের মতো বিশ্ব প্রভুর দরবারে ফরিয়াদ জানালেন : ‘হে আল্লাহ! দেখ, তোমার হোসাইনের প্রতি এরা কেমন আচরণ করল!’
ওমর ইবনে সাদের নির্দেশে ইয়াযীদের নিষ্ঠুর সৈনিকরা মহানবী (সা.)-এর দৌহিত্রের শির মোবারকও কেটে ফেলে। সেনান মতান্তরে শিমার জিলজওশান নামের নরাধম এই নিষ্ঠুরতম কাজটি করেছিল। ইমামের শির যখন কেটে বর্শার আগায় বিদ্ধ করা হয় তখনো ইমামের পবিত্র কণ্ঠ দিয়ে উচ্চারিত হলো : ‘আল্লাহু আকবার।’ এভাবে নিষ্ঠুরতার বিকট উল্লাসের মোকাবেলায় আত্মত্যাগের চরম দৃষ্টান্ত মহাকালের পাতায় চির উজ্জ্বল হয়ে থাকল। ইমাম হোসাইন ও তাঁর সাথিরা নতুন করে যেন স্থাপন করলেন ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কালেমার ভিত্তি।
তারপরের ঘটনা আরো করুণ ও হৃদয়বিদারক। কারবালার শহীদদের পবিত্র দেহ থেকে শির ছিন্ন করে নেয়া হয় এবং অশ্ববাহিনী ছুটিয়ে পবিত্র দেহগুলোকে দলিত-মথিত করা হয়। এরপর ইয়াযীদের বর্বর সেনারা ইমাম পরিবারের মহিলাদের তাঁবু লুট করে তাতে আগুন লাগিয়ে দেয়। নবীবংশের অসহায় নারী ও শিশুরা আগুনের লেলিহান শিখা থেকে বাঁচার জন্য এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করে এবং বহু শিশু আগুনে পুড়ে মারা যায়। ইতিহাসের করুণ ও ভয়াল রাত নেমে এলো। কারবালার আকাশ আজ রাতে রক্তিম আভায় আবৃত। ইতিহাসে এ রাত ‘শামে গারীবান’ নামে পরিচিত। সত্যিই এর চেয়ে করুণ ও হৃদয়বিদারক আর কী হতে পারে? ধরাপৃষ্ঠের সর্বোত্তম পরিবারের সদস্যরা অভিভাবকহীন অবস্থায় পোড়া তাঁবুগুলোর মধ্যে বসে শহীদদের স্মরণে কাঁদছিলেন, আহাজারি করছিলেন। রাসূলে খোদা তাঁর কর্মকা-ের প্রতিদান হিসেবে চেয়েছিলেন মুসলিম উম্মত যেন তাঁর বংশধর ও আহলে বাইতকে ভালোবাসে। অথচ তাঁর আহলে বাইতের প্রতি মুসলিম নামধারীদের এ কী আচরণ! একদিকে ইয়াযীদি সৈনিকদের অট্টহাসি আর উন্মত্ততা আর অন্যদিকে মস্তকবিহীন শহীদদের পবিত্র লাশ ঘিরে নবীবংশের নারীদের বুকভাঙা আহাজারি!
পরদিন ইয়াযীদের সৈন্যরা পৈশাচিক উল্লাসে আহলে বাইতের নারী ও শিশুদেরকে দড়িতে বেঁধে ও গলায় দড়ি লাগিয়ে খালি উটের পিঠে তুলে দেয়। ৭২ জন শহীদের মাথা বর্শার ফলায় বিদ্ধ করা হয়। নবীবংশের সম্মানিতা মহিলাদের পর্দা কেড়ে নেয়া হয়। কথিত আছে, অসুস্থ ইমাম যায়নুল আবেদীনকে কাটাওয়ালা লোহার বেড়ি পরিয়ে দিয়ে খালি পায়ে টেনে হিঁচড়ে কারবালা থেকে কুফা এবং কুফা থেকে দামেশকে নিয়ে যাওয়া হয়। এসময় মহিয়সী নারী যায়নাব এবং ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) আশুরার এই বিপ্লবের বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেন। কারবালার এই নিষ্ঠুর অত্যাচার-অবিচারের কাহিনী জনসাধারণের কাছে তুলে ধরেন। ইসলামের বিপ্লবী নেত্রী হযরত যায়নাব যদি না থাকতেন তাহলে কারবালার আত্মত্যাগের কাহিনী মানুষের কাছে অজানা থেকে যেত। সাইয়্যেদুশ শোহাদা ইমাম হোসাইন ইসলামী বিপ্লবের যে ভিত্তি স্থাপন করে গেছেন তার পরবর্তী আরাধ্য কাজ অঞ্জাম দেয়ার দায়িত্ব নিয়েছিলেন হযরত যায়নাব। ‘হাল মিন নাসিরিন ইয়ানসুরনা’ অর্থাৎ আমাদেরকে সাহায্য করার কেউ আছে কি?- ইমাম হোসাইনের এই কালজয়ী আহ্বানকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন হযরত যায়নাব। আজো সেই আহ্বান মুসলমানদের স্মরণ করিয়ে দেয় আশুরার বিপ্লব থেকে শিক্ষা নেয়ার এবং ইসলামকে নতুন করে জানার।
[সূত্র: ইন্টারনেট]

সম্পাদকীয়

হজ : মুসলিম উম্মাহ্র ঐক্যের প্রতীক
হজ ইসলামের মূল স্তম্ভসমূহের অন্যতম। কা‘বা গৃহে পৌঁছার মতো সামর্থ্যরে অধিকারী প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জীবনে অন্তত একবার হজ করা ফরয।
কা‘বা গৃহ হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘আলার ইবাদতের উদ্দেশ্যে হযরত আদম (আ.) কর্তৃক নির্মিত সর্বপ্রথম গৃহÑ যা কালের প্রবাহে বিধ্বস্ত হয়ে যাবার পর হযরত ইবরাহীম (আ.) পুনঃনির্মাণ করেন। এ গৃহের তাওয়াফ, হযরত হাজেরা (আ.)-এর স্মৃতি পুনরুজ্জীবনে ছ¡াফা’ ও র্মাওয়া পাহাড়ের মাঝে সা‘ঈকরণ, হযরত আদম (আ.)-এর স্মৃতিবিজড়িত ‘আরাফায় সমাবেশ, হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর স্মৃতিবিজড়িত মিনায় শয়তানের প্রতীকের ওপর কঙ্কর নিক্ষেপ ও কোরবানিসহ হজের প্রতিটি আনুষ্ঠানিকতাই দুনিয়ার বুকে আল্লাহ্র খলীফা হিসেবে বিশেষভাবে নবী-রাসূলগণের আগমন ও দায়িত্ব পালনের কথা গভীরভাবে স্মরণ করিয়ে দেয়। এভাবে একজন হজযাত্রী নিজেকে তাঁর প্রভু আল্লাহ্ তা‘আলার ঘনিষ্ঠতম নৈকট্যে অনুভব করেন। এ হচ্ছে ইসলামের আধ্যাত্মিক শিক্ষার সবচেয়ে বড় বাস্তব চর্চা।
তবে হজ কেবল ইবাদত হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এর সামাজিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বও অপরিসীম। হজের সমাবেশে বর্ণ-গোত্র-ভাষা নির্বিশেষে সারা দুনিয়ার মুসলমানরা একত্রিত হন, পরস্পরের সাথে পরিচিত হন, দ্বীনী ও সাংস্কৃতিক বিষয়াদিতে পরস্পর মতবিনিময় করেন এবং মুসলমানদের প্রতিটি জাতি ও গোষ্ঠীর সমস্যাবলিসহ গোটা উম্মাহ্র অভিন্ন সমস্যাবলির সমাধান উদ্ভাবনের লক্ষ্যে পরস্পর পরামর্শ ও মতবিনিময় করেন। এভাবে হজের সমাবেশ সারা দুনিয়ার মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতির চেতনা দৃঢ়তর করে এবং অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রায়তনে হলেও এ সমাবেশ প্রতিনিধিত্বমূলকভাবে মুসলিম উম্মাহ্র বাস্তব রূপ পরিগ্রহ করে।
এ বছরের হজের সময় দু’টি দুঃখজনক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, তা হচ্ছে, মসজিদুল হারামে ক্রেন বিধ্বস্ত হয়ে ও মিনায় ভীড়ে পদদলিত হয়ে বহু সংখ্যক হাজীর মর্মান্তিক মৃত্যুবরণ। আমরা এ ঘটনায় নিহত হাজীদের পরিবারবর্গ ও আহতদের প্রতি এবং সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্র প্রতি শোক ও সমবেদনা জানাচ্ছি।
উল্লেখ্য যে, উক্ত দুর্ঘটনার কারণে সারা বিশ্বের মুসলমানদের মধ্যেই হজের সময়কার নিরাপত্তা প্রশ্নে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে এবং অনেকের মনেই ভবিষ্যতে হজে গমন সম্পর্কে দ্বিধাদ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে। তাই অনেকে যেমন প্রস্তাব করেছেন, হজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্র প্রতিনিধিত্বশীল ওলামায়ে কেরাম, ইসলামী চিন্তাবিদ ও নগর বিশেষজ্ঞগণের সমন্বয়ে একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করে তার ওপর হজ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্পণের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে বলে মনে হয়।
শোকাবহ আশুরা
দশই মুহররম আশুরাÑ সাইয়্যেদুশ্ শুহাদা ও বেহেশতে যুবকদের নেতা হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাত বার্ষিকী। ৬১ হিজরির এ দিনে কারবালায় তিনি তাঁর স্বজন ও সহচরগণসহ ইয়াযীদী বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেন।
কারবালার ঘটনার প্রেক্ষাপট প্রতিটি মুসলমানেরই জানা। হযরত আলী (আ.)-এর শাহাদাতের ঘটনার পরে হযরত ইমাম হাসান (আ.) মুসলিম উম্মাহ্কে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও সম্ভাব্য রোমান হামলা থেকে রক্ষার লক্ষ্যে আমীরে মু‘আবিয়ার সাথে কয়েকটি শর্তে একটি সন্ধি করেন। আমীরে মু‘আবিয়া হযরত ইমাম হাসান (আ.)-এর সাথে কৃত সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করে মৃত্যুকালে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর হাতে খেলাফতের দায়িত্ব হস্তান্তরের পরিবর্তে স্বীয় চরিত্রহীন পাপাচারী পুত্র ইয়াযীদকে খেলাফতে অধিষ্ঠিত করে গেলে ইয়াযীদ ইমামের কাছ থেকে শক্তিপ্রয়োগে বাই‘আত আদায়ের জন্য মদীনার উমাইয়াহ্ প্রশাসককে নির্দেশ দেয়। কিন্তু হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর ন্যায় ব্যক্তি ইয়াযীদের আনুগত্য করলে যে কারো জন্য তা ইসলামী মূল্যবোধ বিসর্জনের সপক্ষে দলিল হিসেবে গণ্য হতো। এ কারণে তিনি ইয়াযীদের অনুকূলে বাই‘আত্ করা থেকে বিরত থাকেন এবং রক্তপাত এড়াবার লক্ষ্যে মদীনা ত্যাগ করে মক্কায় চলে যান। সেখানে তিনি লোকদের মধ্যে মুসলমানদের হুকুমাতের ক্রমাবনতি ও উম্মাহ্্র সামাজিক ও নৈতিক অবস্থার ভয়াবহ স্খলন সম্বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টির কাজে আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু ইয়াযীদ সেখানে তাঁকে হজের ভীড়ে হত্যার জন্য গুপ্তঘাতক পাঠালে ইমাম পবিত্র স্থানে রক্তপাত এড়াবার লক্ষ্যে মক্কা ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন এবং কুফার জনগণের দাও‘আতে সাড়া দিয়ে সেখানে পৌঁছার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে কারবালায় উপনীত হন। সেখানে ইয়াযীদী বাহিনী দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। কিন্তু ইয়াযীদী বাহিনী তাঁর ওপরে ইয়াযীদের অনুকূলে বাই‘আত্ করার জন্য চাপ দেয় এবং তিনি তা না করায় এক অসম যুদ্ধে তাঁকে স্বজন ও সহচরসহ হত্যা করে।
দুর্ভাগ্যজনক যে, কারবালার ঘটনা সম্পর্কে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসা মতৈক্যের বরখেলাফে ইদানিং কিছুসংখ্যক লোক ইয়াযীদকে নির্দোষ প্রমাণের ঘৃণ্য অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তারা বলছে, ইয়াযীদের অনুমতি ছাড়াই কারবালার ঘটনা ঘটানো হয়েছিল। আমরা এ ব্যাপারে তাদের বিবেকের কাছে একটাই প্রশ্ন করব : যদি তা-ই হয়ে থাকে তাহলে যারা এ জন্য দায়ী ইয়াযীদ কি তাদেরকে শাস্তি দিয়েছিল?

স্মরণীয় বাণী

মহানবী (সা.) বলেন : হে আলী! আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় কাজ তিনটি : যে ব্যক্তি আল্লাহ্ কর্তৃক তার ওপর ফরযকৃত কাজগুলো পালন করে সে হলো সবচেয়ে আবেদ লোক, আর যে ব্যক্তি আল্লাহ্ কর্তৃক নিষেধকৃত কাজগুলো থেকে বেঁচে চলে সে হলো সবচেয়ে সংযমী লোক। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তার জন্য যে জীবিকা নির্ধারিত করেছেন তাতেই তুষ্ট থাকে, সে হলো সবচেয়ে সামর্থ্যবান লোক।

মহানবী (সা.) বলেন : যে ব্যক্তির সকাল ও সন্ধ্যা অতিবাহিত হয় এ অবস্থায় যে, তার তিনটি জিনিস থাকে, তবে তার ওপর দুনিয়ার নেয়ামত পরিপূর্ণ হয়ে যায়। যার সকাল ও সন্ধ্যা অতিবাহিত হয় সুস্থ অবস্থায়, তার মনে প্রশান্তি থাকে আর তার নিকট একদিনের জীবিকা থাকে। আর যদি চতুর্থ বস্তুটিও তার থাকে তাহলে তার দুনিয়া ও আখেরাতের সকল নেয়ামত পূর্ণ হয়। আর সেটা হলো ঈমান।

মহানবী (সা.) বলেন : যে ব্যক্তি না জেনে জনগণের মধ্যে ফতোয়া প্রদান করে তার ওপরে আসমান ও জমিনের ফেরেশতারা অভিসম্পাত বর্ষণ করেন।

আমীরুল মুমিনীন ইমাম আলী (আ.) বলেন : ধৈর্য দু’ধরনের : বিপদে ধৈর্যধারণ- যা সুন্দর বটে। আর এর চেয়ে উত্তম হলো হারাম কাজ বর্জনে ধৈর্যধারণ। আর যিকির দু’ধরনের : বিপদের সময় যিকির করা- যা ভালো এবং প্রশংসনীয়। আর তার চেয়ে উত্তম হলো হারাম কাজের সম্মুখে আল্লাহর যিকির তথা স্মরণ করা যাতে তা থেকে বিরত থাকে।

আলী (আ.) বলেন : ইমাম সৌভাগ্যবান সেই ব্যক্তি যে আল্লাহর আনুগত্যের উদ্দেশ্যে লোকদের সাথে বন্ধুত্ব করবে আর লোকেরা তার সাথে বন্ধুত্ব করবে।

ইমাম হাসান (আ.) তাঁর এক পুত্রকে বলেন : প্রিয় বৎস! কোনো লোকের সাথেই ভ্রাতৃত্ব কর না যতক্ষণ না জানবে যে, সে কোথায় কোথায় যাওয়া আসা করে, আর তার বংশ পরিচয় ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কী। যখন তার অবস্থা সম্পর্কে ভালোভাবে জানবে এবং তার আচরণ পছন্দ করবে তখন তার সাথে ভ্রাতৃত্ব কর একটি শর্তে। তা হলো যেন ভুলত্রুটিকে ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখে আর দুর্দিনে পাশে থাকে।

ইমাম হোসাইন (আ.) বলেন : যেন এমন কাজ কর না যার জন্য ক্ষমা চাইতে হয়। কারণ, মুমিন ব্যক্তি অকাজ করে না, ক্ষমাও চায় না। আর মুনাফিক প্রত্যেক দিন খারাপ কাজ করে এবং ক্ষমা চায়।

ইমাম হোসাইন (আ.) বলেন : আমি তোমাদেরকে আল্লাহকে ভয় করে চলার উপদেশ দিচ্ছি। কারণ, যে ব্যক্তি তাকওয়াবান হয় আল্লাহ তাঁর জন্য জামিনদার হন; তার খারাপ অবস্থা থেকে তাকে ভালো অবস্থায় নিয়ে যাবেন এবং যে পথ দিয়ে সে ধারণাও করেনি সেখান থেকে তার রুজির ব্যবস্থা করবেন। আর এমন না হয় যে, তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত হবে যে আল্লাহর অন্যান্য বান্দার পাপে উৎকণ্ঠিত থাকবে, অথচ নিজের পাপ থেকে নির্ভাবনায় থাকবে। কারণ,আল্লাহ তাঁর বেহেশতের ব্যাপারে ধোঁকার শিকার হবেন না। আর তাঁর নিকটে যা আছে সেটা আনুগত্য ব্যতীত অর্জন করা যায় না।

ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) বলেন : আল্লাহর সবচেয়ে বড় অধিকার হলো তাঁকে ইবাদত করবে এবং কোনো কিছুকেই তাঁর অংশীদার বলে মানবে না। যদি নিষ্ঠার সাথে একাজ কর তাহলে আল্লাহ নিজ দায়িত্বে তুলে নিয়েছেন যে, তোমার দুনিয়া ও পরকালের কাজের জন্য তিনিই যথেষ্ট হবেন। আর তুমি তাঁর নিকট থেকে যা চাইবে সেটা তোমার জন্য সংরক্ষিত রাখবেন।

ইমাম মূসা আল কাযেম (আ.) বলেন : উত্তম প্রতিবেশিত্ব কেবল কষ্ট না দেয়া নয়; বরং উত্তম প্রতিবেশিত্ব হলো প্রতিবেশী কষ্ট দিলে ধৈর্যধারণ করা।

ইমাম মূসা আল কাযেম (আ.) বলেন : তোমার ও তোমার ভাইয়ের মধ্যে সবকিছুই (প্রকাশ্য ও গোপনীয় বিষয়) একাকার করে ফেল না। পর্দা বজায় রাখ। কারণ, তা না থাকলে লজ্জা চলে যায়।

ইমাম কাযেম (আ.) বলেন : লোকেরা যতই নতুন নতুন গোনাহ করে, যা আগে করত না, আল্লাহ্ও নতুন নতুন বিপদ তাদেরকে দেন যা তারা চিন্তাই করত না।

ইমাম আলী ইবনে মূসা আর রেযা (আ.) বলেন : ইমাম হলেন আল্লাহর ও তাঁর সৃষ্টির মাঝে তাঁর আমানতদার (বিশ্বস্ত রক্ষক)। আর তাঁর বান্দাদের ওপরে তাঁর হুজ্জাত এবং তাঁর দেশে দেশে তাঁরই খলীফা এবং আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী আর আল্লাহর (দীনের) সীমার প্রতিরক্ষাকারী। ইমাম গোনাহ থেকে পবিত্র এবং ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে মুক্ত, জ্ঞানে বিশেষায়িত ও সহিষ্ণুতায় খ্যাত; দীনের শৃঙ্খলাবিধায়ক, মুসলমানদের সম্মান প্রতিষ্ঠাকারী, মুনাফিকদের ক্রোধের কারণ, আর কাফেরদের ধ্বংসকারী।

স্মরণীয় দিবস

৪ নভেম্বর : ইরানে ছাত্র দিবস। ১৯৭৯ সালের এই দিনে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মার্কিন দূতাবাস অবরোধ করে কূটনীতিকের ছদ্মাবরণে থাকা গোয়েন্দাদের আটক করে।
৬ নভেম্বর : বাংলাদেশের বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক শাহেদ আলীর মৃত্যুবার্ষিকী।
৮ নভেম্বর : আহলে বাইতের চতুর্থ ইমাম হযরত যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর শাহাদাত দিবস।
১১ নভেম্বর : ইতিহাসখ্যাত সাহিত্যিক ‘বিষাদ সিন্ধু’র রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেনের জন্মদিবস।
১৪ নভেম্বর : বিশ্ব ডায়াবেটিক রোগীদের সহায়তা দিবস।
১৫ নভেম্বর : বিশ্ব পুস্তক ও পুস্তক পাঠ দিবস, বিশ্ব গণমাধ্যম দিবস।
১৭ নভেম্বর : বাংলাদেশের মযলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যুবার্ষিকী।
১৯ নভেম্বর : *অবিভক্ত ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অমর শহীদ মীর নিসার আলী তিতুমীরের শাহাদাত বার্ষিকী।
* আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস।
২০ নভেম্বর : বাংলাদেশের প্রখ্যাত মহিলা কবি সুফিয়া কামালের মৃত্যুবার্ষিকী।
১ ডিসেম্বর : বিশ্ব এইডস প্রতিরোধ দিবস।
২ ডিসেম্বর : ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের চল্লিশতম দিবস (আরবাইন)।
*শিল্পী কামরুল হাসানের জন্মদিন।
৩ ডিসেম্বর : ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর প্রথম সংবিধান গৃহীত হওয়ার দিবস।
* বাংলাদেশের কচিকাঁচার আসরের প্রতিষ্ঠাতা রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাইয়ের মৃত্যুবার্ষিকী।
* বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস।
৫ ডিসেম্বর : অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী।
১০ ডিসেম্বর : সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর ওফাত দিবস।
*আহলে বাইতের ধারার দ্বিতীয় ইমাম ও বেহেশতের যুবকদের নেতৃদ্বয়ের প্রথম ব্যক্তিত্ব ইমাম হাসান (আ.)-এর শাহাদাত বার্ষিকী।
১২ ডিসেম্বর : আহলে বাইতের ধারার অস্টম ইমাম আলী ইবনে মূসা আর-রেযা (আ.)-এর শাহাদাত বার্ষিকী।
১৬ ডিসেম্বর : বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবস। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর এই দিনে বাংলাদেশ বিজয় লাভ করে।
* বিশ্ব গবেষণা দিবস।
১৮ ডিসেম্বর : ড. মুহাম্মাদ মুফাত্তেহর শাহাদাত দিবস। এ দিবসটি ইরানে ‘ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (হাওযা) ও বিশ্ববিদ্যালয় এর মধ্যে ঐক্য দিবস’ হিসাবে পালিত হয়।
২০ ডিসেম্বর : ইমাম আল-হাসান ইবনে আলী আল-আসকারী (আ.)-এর শাহাদাত দিবস।
২১ ডিসেম্বর : ইরানে বছরের সবচেয়ে দীর্ঘতম রাত (শাবে ইয়ালদা)
২৫ ডিসেম্বর : মহানবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তাফা (সা.)-এর জন্মদিবস। (আহলে সুন্নাতের প্রসিদ্ধ রেওয়ায়াত অনুযায়ী)
*হযরত ঈসা (আ.)-এর পবিত্র জন্মদিবস।
২৭ ডিসেম্বর : প্রলয়ংকরী সুনামীর বার্ষিকী। এ দিনে ভয়াবহ সুনামীতে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপসহ এ অঞ্চলের দেশগুলোর কয়েক লাখ লোক মৃত্যুবরণ করে।
৩০ ডিসেম্বর : মহানবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তাফা (সা.)-এর জন্মদিবস। (আহলে বাইতের রেওয়ায়াত অনুযায়ী)
*মহানবীর বংশধারার ষষ্ঠ ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর জন্মদিবস।

ইরানী প্রবাদ বাক্য

زاغ سیاه کسی را چوب زدن
উচ্চারণ : যা’গে সেয়া’হ কেসী রা’ চূব যাদান
অর্থ : কালো কাক কাউকে লাঠি মারা।
মর্মার্থ : কাউকে পেছন থেকে অনুসরণ করা। কারো গোপন তথ্য উদ্ধার করা।
زبان چرب و نرم داشتن
উচ্চারণ : যাবা’নে চার্ব ও নারম দা’শতান
অর্থ : চর্বিদার ও ন¤্র ভাষার অধিকারী হওয়া
মর্মার্থ : খুব শান্ত ও বিন¤্রভাবে কথা বলা। মিষ্টভাষী হওয়া অর্থে এ প্রবাদটির ব্যবহার বর্তমান ইরানেও ব্যাপক।
زبان خوش مار را از سوراخ بیرون می آورد.
উচ্চারণ : যাবা’নে খোশ মা’র রা’ আয সূরা’খ বীরূন মী আ’ওয়ারাদ
অর্থ : সুন্দর ভাষা সাপকে গর্ত হত বের করে আনে।
মর্মার্থ : অধিকাংশ ঝামেলা ও সমস্যা বিন¤্র ভাষায় আন্তরিকতাপূর্ণ কথা দিয়ে সমাধান করা যায়- এ বিষয়টি বুঝানোর জন্য এ প্রবাদটির ব্যাপক প্রচলন রয়েছে।
زبانزد شدن
উচ্চারণ : যাবা’নযাদ শোদান
অর্থ : মুখেমুখে হওয়া।
মর্মার্থ : মানুষের মুখে মুখে চর্চিত হওয়া। ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করা।
زبانم مو در آورد.
উচ্চারণ : যবা’নাম মূ দার আ’ওয়ার্দ
অর্থ : আমার জিহ্বায় চুল গজিয়েছে।
মর্মার্থ : এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমি বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। অনেক বলেছি, আর না। কোন ব্যাপারে তাগাদা দিতে গিয়ে ক্লান্ত হওয়ায় বিরক্তি প্রকাশ করতে প্রবাদটি ব্যবহৃত হয়।
زخم زبان از زخم شمشیر بدتر است.
উচ্চারণ : যাখ্মে যবা’ন আয যাখ্মে শামশীর বাদতার আস্ত
অর্থ : জিহ্বার আঘাত তরবারির আঘাতের চেয়ে মারাত্মক।
মর্মার্থ : তার মানে হচ্ছে, যে আঘাত কথার মাধ্যমে মনের উপর দেয়া হয়, তা শরীরে তরবারির আঘাতের চেয়ে মারাত্মক।
زدوبند کردن.
উচ্চারণ : যাদ-ও-বান্দ কার্দান
অর্থ : মারা ও বন্ধ করা।
মর্মার্থ : গোপনে কারো সাথে আঁতাত করা। কোন খারাপ উদ্দেশ্যে গোপনে চুক্তি করা।
زر بر سر پولاد نهی نرم شود.
উচ্চারণ : যার বার সারে পূলা’দ নাহী র্নাম শাওয়াদ
অর্থ : টাকা যদি ইস্পাতের উপর রাখ, তাতে নরম হয়ে যাবে।
মর্মার্থ : অর্থ ও ক্ষমতা থাকলে সবকিছু করা যায়Ñ একথা বুঝাতে প্রবাদটি ব্যবহৃত হয়। কথায় বলে, পয়সা মারলে পাত্থর ছেদে।
زل زل نگاه کردن.
উচ্চারণ : যুল যুল নেগা’হ কারদান
মর্মার্থ : কারো দিকে অপলক চেয়ে থাকা। কোন দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখা।

অনুবাদ : ড. মাওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

ইরানে অবরোধ বনাম স্বাধীন ও প্রতিরোধবান্ধব অর্থনীতি

রাশিদুল ইসলাম

আপনি যদি ইরানের দিকে তাকান তাহলে দেখবেন পশ্চিমা দেশগুলো উদগ্রীব হয়ে আছে দেশটিতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার জন্য। কিন্তু এক দশক আগেও দেশটির অবস্থা এমন ছিল না। পশ্চিমা মিডিয়ায় প্রায় প্রতিদিন খবর প্রকাশিত হত এই আমেরিকা বা ইসরাইল ইরানে আক্রমণ করে বসল আরকি! ইরান পারমাণবিক বোমা বানিয়ে ফেলছে এমন অপপ্রচার ছিল দুনিয়াশুদ্ধ। যদিও ইরানের ধর্মীয় নেতা ঘোষণা দিয়েছিলেন ইরান কখনোই পারমাণবিক বোমা বানাবে না বা এধরনের বোমা বানানো ইসলামে নিষিদ্ধ। কারণ, যুদ্ধক্ষেত্রে এধরনের বোমা মানুষ ছাড়াও প্রকৃতি ও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করে থাকে যা যুগ যুগ ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বয়ে বেড়াতে হয়। শান্তিপূর্ণভাবে ইরান পারমাণবিক প্রযুক্তি ব্যবহার করবে সস্তায় জ্বালানি উৎপাদন ও চিকিৎসাসহ মানব কল্যাণে। এতেই মাথা ঘুরে যায় পশ্চিমা দেশগুলোর। কারণ, জ্বালানি একটি অতাবশ্যকীয় কৌশলগত পণ্য হওয়ায় পশ্চিমা দেশগুলো এ নিয়ে একচেটিয়া ব্যবসাই শুধু করে না, মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে তামাম দুনিয়ার দেশগুলোর জ্বালানি সম্পদ বিনিয়োগের নামে কুক্ষিগত করে রাখে, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য উৎপাদন ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করে নিজেরা রফতানি সক্ষমতায় এগিয়ে থাকে। আর নিজেদের সেরা প্রযুক্তি হাতে রেখে সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে অন্যদেশগুলোকে সেই সব পুরোনো প্রযুক্তি হস্তান্তর করে। এছাড়া উচ্চ সুদ আর অতিরিক্ত মূল্যের জ্বালানিসহ নানা জটিলতায় বিনিয়োগের নামে যাতে কোনো দেশ আন্তর্জাতিক বাজারে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে টিকে থাকতে না পারে এমন সংকট থেকেই যায়। একমাত্র সস্তা শ্রম বা শ্রমিককে ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে কিছুটা লাভের মুখ দেখে থাকে দেশগুলো যা অর্থনৈতিক বৈষম্যকে আরো বাড়িয়ে দেয় এবং আদতে অর্থনীতির কোনো টেকসই উন্নয়ন হয় না। এধরনের ছলচাতুরি ইরান খুব ভালভাবেই উপলব্ধি করতে পারে। ইরান যে শান্তিপূর্ণ কাজে পারমাণবিক গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে তার একটি উদাহরণ হচ্ছে দেশটি প্রথমবারের মতো পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করে হাসপাতাল নির্মাণ করতে যাচ্ছে।
লক্ষ্য করুন, বিপ্লবের পর ইরান মাথা গরম করে সাদ্দাম হোসেনের মতো কুয়েতে আগ্রাসন চালায়নি। বরং পশ্চিমা দেশগুলোর মদদে যে সাদ্দাম হোসেন দেশটির ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল তার পরিণতি এখন সবার জানা। এখন আইএস জঙ্গিরা দেশটির তেল-সম্পদ চুরি করে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছেই বিক্রি করছে। অন্যদিকে ইরাক পুনর্গঠনে সাহায্য করে যাচ্ছে ইরান।
পশ্চিমা দেশগুলো ইরানের ওপর যে অবরোধ চাপিয়ে দিয়েছিল তা বছরের পর বছর ধরে শান্তিপূর্ণ উপায়ে দরকষাকষির মধ্য দিয়ে এমন একটি ফয়সালার দিকে এগিয়েছে যে, পশ্চিমা দেশগুলো এখন বলতে শুরু করেছে, সিরিয়া সমস্যা নিরসনে ইরানের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।
ইরান যখন তার উপর আরোপিত অবরোধকে আশীর্বাদে পরিণত করেছে এবং এই অবরোধ যখন বাস্তবেই কার্যকারিতা হারিয়েছে তখন তা অবশিষ্ট রেখে লাভ কি? ফল দাঁড়িয়েছে, ইরানের ওপর অবরোধ থাকলে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতি তা বুমেরাং হয়ে আঘাত হানছে। কেমন করে? কারণ, ইরান অবরোধের মধ্যে চীন, রাশিয়া, ভারত, লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, ইউরোপসহ এমন সব দেশের সঙ্গে বিশাল বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে তাতে পশ্চিমা দেশগুলোর অবরোধ কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে। এখন ইসরাইল কী বলল তাতে কিছু যায় আসে না। বরং কে কার আগে ইরানে বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ করবে রীতিমত তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে । ভারত ও চীন অবরোধ উপেক্ষা করে ইরানের কাছ থেকে বিশেষ সুবিধায় তেল এনেছে। তাহলে পাকিস্তান কেন ইরান থেকে গ্যাস আনবে না? আর সেই গ্যাস কেন ভারতে যাবে না? হ্যাঁ, ভারত থেকে সে গ্যাস বাংলাদেশে নিয়ে আসার ব্যাপারেও সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। দুনিয়ায় টিকে থাকতে হলে কীভাবে লড়াই করে টিকে থাকতে হয় তা দেখিয়েছে ইরান।
লক্ষ্য করুন, ইরান গত বছরের তুলনায় পারস্য উপসাগরে বাঙ্কারিং অর্থাৎ জাহাজ থেকে তেল খালাস কিংবা মজুত বাড়িয়েছে ৩০ ভাগ। এটা বেড়েছে হরমুজ প্রণালি দিয়ে অন্তত ১৭০টি জাহাজে প্রায় ১১ লাখ টন অতিরিক্ত তেল সরবরাহের ফলে। অবরোধ কাগজপত্রে যেটুকু টিকে আছে তা উবে গেলে কয়েক সপ্তাহে ইরান দিনে আরো অতিরিক্ত ৫ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদনের অপেক্ষায় আছে। আর তা হলে ইরান সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামবে তেল খালাস ও মজুতে। ইতিমধ্যে ইরানের জাতীয় তেল উৎপাদন সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসের সাজ্জাদি বলেছেন, বাঙ্কারিং করে এখাতে আয় গত ৬ মাসে ২০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। অবরোধ উঠে গেলে ওমান সাগর দিয়ে অন্য দেশে ইরানের তেল সরবরাহ বাড়বে। গত দুই বছরে বাঙ্কারিং থেকে ইরান আয় করেছে ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি। তার মানে ইরানের কাছ থেকে তেল না কেনার যে নিষেধাজ্ঞা ছিল তা কাজে আসেনি।
ইরানের কাস্টমস বলছে, গত সাত মাসে তেল ছাড়া অন্যান্য বাণিজ্যে আয় হয়েছে ৪৮ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। মূলত অবরোধকে পাশ কাটিয়ে চীন, ইরাক, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভারত ও আফগানিস্তান ইরান থেকে শীর্ষ ৫ পণ্য আমদানিকারক দেশ হিসেবে অবস্থান করছে। এর আগে চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক ও ভারত ইরানে শীর্ষ ৫ পণ্য রফতানিকারক দেশ ছিল। ইরানের খনিজ ও বাণিজ্য উপমন্ত্রী মোজতাবা খোসরোতাজ বলেছেন, তাঁর দেশ আগামী সাত মাসে তেল ছাড়া সাড়ে ৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রফতানির লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এগিয়ে যাচ্ছে।
দিন কয়েক আগে মালয়েশিয়ার জাতীয় তেল অনুসন্ধান ও উৎপাদন প্রতিষ্ঠান পেট্রোনাসের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক পরিচালক ইখলাস আবদুল রহমান বলেছেন, অবরোধ উঠে গেলে তাঁর দেশ ইরান থেকে পুনরায় দিনে ৫০ থেকে ৬০ হাজার ব্যারেল তেল আমদানি শুরু করবে। তেহরানে পেট্রোনাসের অফিস অবরোধ উঠে গেলে পুনরায় সচল হয়ে উঠবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এর আগে ইতালির এনি এস পিএ ও ফ্রান্সের টোটাল এস এ একই ধরনের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। ইতালি ও ফ্রান্স তেল প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ করার জন্য অপেক্ষা করছে।
এর পাশাপাশি ইরানের জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মোহাম্মদ বাখের নওবখ্ত গত সপ্তাহে জানান, ইউরোপের একটি প্রতিষ্ঠান দেশটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে ৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ছাড়াও অতিরিক্ত একটি বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করবে দেশটি। গত অক্টোবরে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি বলেন, অবরোধ উঠে গেলে ইরানে বিনিয়োগের ঢেউ আসবে। প্রযুক্তি ও বিনিয়োগে ইরান সবসময় উদার বলে তিনি জানান।
আমেরিকায় ইরানের কার্পেট ও চিংড়ি মাছ রফতানি হয়েছে, যদিও তা পরিমাণে কয়েক লাখ টন মাত্র। আসবাবপত্র, ফুল ও জাফরানও রফতানি হচ্ছে দেশটিতে। আর একই সময়ে আমেরিকা ইরানে রফতানি করছে ৩৭ মিলিয়ন ডলারের পণ্য।
এরই মধ্যে ইতালির দানিয়েলি ও ফাতা কোম্পানি ইরানে স্টিল খাতে চার বিলিয়ন ইউরোর এক বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়েছে। ভারী ইস্পাত ছাড়াও স্পঞ্জ আয়রন ও অ্যালুমিনিয়াম খাতে এ বিনিয়োগ হবে ২৫ বছরের।
ইরানে এধরনের বিনিয়োগ কিংবা বিনিয়োগের প্রস্তাবের ফিরিস্তি দিয়ে শেষ করা যাবে না। বরং নজর দেয়া যাক, কীভাবে ইরান এধরনের পথ পরিক্রমা তৈরি করল সেদিকে। একদিকে মাথার ওপর অবরোধ, অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে একঘরে করে দেয়ার পশ্চিমা নীতি আর ইসরাইলের ইন্ধনে ইরানে আক্রমণের হুমকি কেন পরোয়া করল না দেশটি? কিভাবে সে শক্তি পেল এসব ষড়যন্ত্র রুখে দাঁড়ানোরÑ যা অন্যান্য দেশের জন্য অনুসরণযোগ্য হয়ে উঠছে?
এজন্য চরম ধৈর্যের পরিচয় দিতে হয়েছে দেশটির রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক ও চিন্তাবিদদের। এক দশকের বেশি সময় ধরে আলোচনায় তাঁরা জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছে ইরান পারমাণবিক বোমা নয়, বরং এ প্রযুক্তি ব্যবহার করছে শান্তিপূর্ণ কাজে এবং অন্য যে কোনো দেশের মত ইরানের সে অধিকার আছে। এ তো গেল আলোচনার টেবিল। এর বাইরে ইরান বিকল্প শক্তির উৎস খুঁজেছে। অন্য দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করেছে। এসব বিষয় ইরানকে সমঝোতা ও দরকষাকষিতে শক্তি যুগিয়েছে। এধরনের লড়াই ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মত নিজেদের তেল-সম্পদ ও মেধা পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে কখনো বন্ধক রাখতে চায়নি ইরান। রাজা-বাদশাহদের মত বংশ পরিক্রমায় যুগ যুগ ধরে ক্ষমতা আঁকড়ে না ধরে একটা মেধা ও মননের শাসনব্যবস্থা ও জ্ঞাননির্ভর সমাজ তৈরিতে অনেক দূর এগিয়েছে ইরান।
লক্ষ্য করুন, এক দশক ধরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে কীভাবে ইরান নিজেকে উপস্থাপন করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৪ জুলাই ভিয়েনায় সফলতা পেয়েছে দেশটি। ইরাকের কূটনীতিকরা বাড়ি ফিরেছেন বিজয়ীর বেশে। নাইন ইলেভেনের পর আমেরিকা ও ইসরাইল ইরানকে ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্র’ বলে যে প্রচারণা শুরু করে তা বিফল করে দিয়েছেন ইরানের কূটনীতিকরা। টানা ১৫ বছর ধরে আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য করেছেন পশ্চিমা দেশের প্রতিনিধিদের। প্রেসিডেন্ট বুশ ইরানকে সন্ত্রাসীর তকমা দিয়ে ‘এক্সিস অব ইভিল’ বলেছিলেন, এখন ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, মিসর, সিরিয়া পরিস্থিতিতে প্রমাণ হয়ে গেছে কারা আসল সন্ত্রাসী। প্রেসিডেন্ট বুশের পিতা সিনিয়র বুশ তাঁর ভিয়েনা আলোচনায় ইরানের সঙ্গে চুক্তি হওয়ার আগে যে ১৫৯ পাতার শর্ত রচিত হয়েছে তা হয়ত অদূর ভবিষ্যতে পর্যালোচনা করবে আন্তর্জাতিক বিশ্ব। এরই মধ্যে এডওয়ার্ড ¯েœাডেন রাশিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছেন আর তার মাধ্যমে এটা পরিষ্কার যে, আমেরিকা মিডিয়া, অর্থনীতি ও জাতিসংঘকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বিশ্বকে খেয়াল খুশি মত পরিচালনা করে থাকে। জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ যে সব দলিল ফাঁস করে দিয়েছেন তাতে এসব বিষয় আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। জীবনে অনেকে কত উপন্যাসই পড়ে থাকেন। কিন্তু ইরান যে ১৫ বছর ধরে দরকষাকষি করল তার ব্যাখ্যা বা বিবৃতি কিংবা ধরন, এ নিয়ে ভবিষ্যতে কোনো উপন্যাস, চলচ্চিত্র বের হলে তা হবে আন্তর্জাতিক রাজনীতির দিক থেকে খুবই চিত্তাকর্ষক। আর তা রচনা করেছেন ইরানের কূটনীতিকরা। তবে এজন্যে যদি পশ্চিমা মিডিয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকেন তাহলে কিছুই টের পাবেন না।
বরং ইরানের কূটনীতিকরা মধ্যপ্রাচ্যে নতুন ভূ-রাজনৈতিক যুগের সূচনা করেছেন। পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে ও ধারাবাহিক সংলাপের মধ্য দিয়ে এ যুগের সূচনা হয়েছে। যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে যে, আগামী বছর শুরু হবার আগেই ইরানে পশ্চিমা দেশগুলোর বিনিয়োগ ¯্রােত একটা ঘূর্ণায়মান পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। কারণ, এতদিন এ বিনিয়োগের ¯্রােতকে আটকে রাখা হয়েছিল বাঁধে পানি আটকানোর মত করে। কারণ, অবরোধের পর দীর্ঘদিন ধরে এধরনের বিনিয়োগ ইরানে প্রবেশের সুযোগ পায়নি। মনে রাখতে হবে অবরোধ চাপিয়ে দেয়ার আগে ইরান ৪০ ভাগ তেল রফতানি করত ইউরোপে। তেলনির্ভর শিল্পগুলো চালাতে বিকল্প পথে জ্বালানি সংগ্রহ করতে হয়েছে, কখনো তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে শিল্পব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় ইউরোপে যে মন্দা রয়েছে তাতে এ অবরোধ কিন্তু একটা ভূমিকা রেখেছে। এ কারণেই ইরানের সঙ্গে ফের নতুন বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠেছে তামাম বিশ্ব। ইরান বর্তমানে পূর্ব এশিয়ায় দশ লাখ টন তেল রফতানির বাজারকে সুসংহত করে নজর দিতে শুরু করবে অবরোধে তার হারিয়ে যাওয়া বাজারের দিকে।
পারমাণবিক গবেষণা বা অবরোধ নিয়ে ইরান যে আলোচনার পথ তৈরি করেছে তা যে কোনো আন্তর্জাতিক সংকট নিরসনে একটি বাতিঘর হিসেবে বিবেচিত হবে। এমনকি ইসরাইল গুপ্তচর পাঠিয়ে ইরানে পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের হত্যা করার পরও ইরান আলোচনা থেকে সরে দাঁড়ায়নি।
আলোচনার চেয়ে সামরিক আগ্রাসন কখনো বিশ্বশান্তি আনতে পারে না তা প্রমাণ হয়েছে কিউবার সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক পুনরায় স্থাপনের মধ্যে দিয়ে। এজন্য ওয়াশিংটন ও মস্কোর মধ্যে লাল টেলিফোনের ভূমিকা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। বরং আমেরিকা এ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে পারে।
তবে পারমাণবিক ইস্যু নিয়ে ইরানের সঙ্গে বছরের পর বছর যে দরকষাকষি হয়েছে তাতে ফ্রান্স, জার্মানি ও ব্রিটেনের মত দেশ ও ইউরোপিও ইউনিয়ন গঠনমূলক যুক্তিকে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। ভিয়েনা চুক্তির ফলে এসব দেশ ইরানে বিনিয়োগ থেকে এখন লাভবান হবে। এজন্য ইরানে বিনিয়োগে দেশগুলো এত আগ্রহী হয়ে উঠেছে। রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভারশীলতা কমিয়ে ইরান থেকে জ্বালানি সংগ্রহে সহজে মনোযোগী হতে চায় ইউরোপ। তাই বিপি, টোটালের মত দেশগুলো বিনিয়োগ প্রস্তাব দিতে শুরু করেছে ইরানকে।
তবে ইরানের এ দীর্ঘ আলোচনায় আমেরিকা, ইউরোপ, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানির মত সক্রিয় ছিল না রাশিয়া। ইরানের মত রাশিয়াও এখন অপেক্ষা করছে কখন অবরোধ পুরোপুরি উঠে যাবে। ইতিমধ্যে চীন ও রাশিয়া ইরানের সামরিক খাতে সহায়তা দিতে চুক্তি করেছে। শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকে নয় ভূকৌশলগত স্বার্থে সিরিয়ার ব্যাপারে ইরান ও রাশিয়া একই অবস্থান নিয়েছে। তাই অবরোধ প্রত্যাহার হলে সামরিক ও অর্থনৈতিক বিশেষ করে জ্বালানি খাতে বিশাল বিনিয়োগ করার জন্যই রাশিয়া উন্মুখ হয়ে আছে। বরং বলা যায় ইউরোপের তেলগ্যাস কোম্পানির সঙ্গে রাশিয়ার রসনেফট ও গ্যাজপ্রম পাল্লা দিয়ে ইরানে বিনিয়োগ প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হবে।
ইরানের ধীরে চল নীতি ও আঘাত না আসা পর্যন্ত দ্রুত শত্রুকে মোকাবেলার সক্ষমতা অর্জনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়নে এগিয়ে যাওয়ার কৌশলেই দেশটিকে ইরাক, লিবিয়া বা সিরিয়ার মত পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি।
আজকাল মিশেল ফুকোর মত অনেক বুদ্ধিজীবী বলছেন, জ্ঞানই আসল শক্তি। কিন্তু তারও আগে অন্তত আটটি সভ্যতার সংমিশ্রণের দেশ ইরানের অনেক বুদ্ধিজীবী বলেছেন, জ্ঞানই আসল শক্তি। সেই শক্তির আরাধনা করছে ইরান। ইরানের ধর্মীয় নেতা আগেই বলেছেন, পারমাণবিক বোমা তৈরি করে ধ্বংসযজ্ঞের পথে তাঁর দেশ ইসলামের কারণেই কখনো যেতে পারে না, যাবে না।
ইরানের সঙ্গে ভিয়েনা চুক্তিকে কম সফলতা হিসেবে বর্ণনা করেননি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। কৌশলগতভাবে ভিয়েনা চুক্তির লাভ ইরান ছাড়াও এ প্রচেষ্টার সঙ্গে জড়িত সবগুলো দেশ নিতে চাইবে। ওয়াশিংটন উল্লসিত এ চুক্তি নিয়ে আর তেহরান নাছোর বান্দার মত ভিয়েনা চুক্তি করেই ছেড়েছে। এজন্য উভয়পক্ষকে অনেক ছাড় দিতে হয়েছে, শর্ত মেনে নিতে হয়েছে। আর পারস্য উপসাগর ও মধ্যপ্রাচ্যে একটা বিরাট ভারসাম্য সৃষ্টি করেছে এই ভিয়েনা চুক্তি। এর ফলে ইরাক দখল করার পর ওই অঞ্চলে যে একতরফা সামরিক আগ্রাসনের পথ প্রশস্ত হয়েছিল তা এখন সংকুচিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ইরানের বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্ব বেশ ভালই ওয়াকিবহাল যে, ইসরাইল তাদের দোসরদের নিয়ে সুযোগ পেলে ইরানের ওপর হামলা করতে বা সহায়তা দিতে কোনোভাবেই পিছপা হবে না। তবে ইরানি নেতৃবৃন্দ সে ধরনের সুযোগ না দেয়ার প্রজ্ঞা রাখেন। চিন্তা, মতানৈক্য কিংবা মতভেদ কিভাবে আলোচনার টেবিলে ঘুরপাক খায় এবং সেখান থেকে কিভাবে জাতীয় ও আঞ্চলিক স্বার্থে দরকষাকষি করে নির্দ্বিধায় সিদ্ধান্ত নিতে হয় তা ইতিমধ্যে দেখিয়ে দিয়েছেন ইরানিরা।

*লেখক সিনিয়র সাংবাদিক ও মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক