আত্মত্যাগ ও কারবালার শিক্ষা
পোস্ট হয়েছে: এপ্রিল ২৫, ২০১৬
শাহ সূফী মোখলেছুর রহমান
যে কথা শোনামাত্রই প্রতিটি মুসলমানের মন ও শরীর শিউরে ওঠে, ব্যথা অনুভব হয় হৃদয়ে, অশ্রুসিক্ত হয় নয়ন তা হলো সেই শোকাবহ ‘কারবালা’। হক আর বাতিলের পার্থক্যকারী ‘আমর বিল মারুফ নাহী আনিল মুনকার’ তথা সৎ কাজের আদেশ দান ও অন্যায় থেকে নিষেধ করার বাস্তব নমুনা হলো এই ‘কারবালা’। যে নাম মযলুম অসহায় জনগোষ্ঠীর প্রাণে সাহস যোগায়, আপোষহীন যুবকের মনে সৃষ্টি করে প্রত্যয় এই সেই হৃদয়বিদারক ‘কারবালা’। সত্যপথের যাত্রী মুমিনদের মুখে এ নামটি যতবার উচ্চারিত হবে, যতবার হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) ও আহলে বাইতের গগনবিদারি ফরিয়াদ কানে পৌঁছবে ততবার তাদের ধমনির রক্ত নতুন গতি লাভ করবে।
একজন মুমিন যখন কারবালার দিকে তাকায় তখন তার মানসপটে ফুটে ওঠে ফোরাতকুলে দুলদুল পৃষ্ঠে রাসূল (সা.)-এর কলিজার টুকরা, দুজাহানের নেত্রী মা ফাতিমার নয়নমণি, বিশ্ব মুসলিমের প্রাণপ্রিয় নেতা, বেহেশতে যুবকদের সর্দার ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মায়াময় প্রতিকৃতি। ইমাম হোসাইন তাহাজ্জুদের সময় তাঁবুগুলোর চারদিক ঘুরে আসছেন আর সঙ্গী-সাথিদের জড়ো করে বলছেন : ‘হে আমার পরিবার-পরিজন! হে আমার সঙ্গী-সাথিগণ! ওরা শুধু আমারই জীবন নিতে চায়। তোমরা যে যেদিকে পার চলে যাও।’ ইমামের এ ভাষণ শোনামাত্র তাঁর ভাই হযরত আব্বাস ইবনে আলী এবং হযরত জাফর তাইয়্যারের সন্তানগণ বলে উঠলেন : ‘আমরা কেন এমন কাজ করব, আপনাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে আমরা পালিয়ে যাব? যেন কখনোই এমন কাজ আমাদের দ্বারা সংঘটিত না হয়।’
সৈন্যবেষ্টিত যুদ্ধক্ষেত্রে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একজন ব্যক্তিও ইমাম হোসাইন (আ.)-কে পরিত্যাগ করে গেলেন না। পবিত্র কারবালাই সত্যিকার ঈমানদারদের পরীক্ষা। দুঃখের দিনেই সত্যিকার বন্ধুর পরিচয়। একে একে সবাই শপথ করলেন একফোটা রক্ত থাকতে কেউ ইমামকে ছেড়ে যাবেন না। মাতা তাঁর প্রাণপ্রিয় পুত্রকে রণসাজে সাজিয়ে দিচ্ছেন, আর পতœী তাঁর প্রিয় পতিকে যুদ্ধের পোশাক পরিয়ে দিয়ে অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছেন। ধর্মের জন্য, সত্যের জন্য, ন্যায়ের মর্যাদা রক্ষার জন্য মুসলমানরা যে হাসিমুখে মৃত্যুবরণ করতে পারেন, ইমাম হোসাইন (আ.) ও তাঁর অনুসারী ৭২ জন মুসলমান কারবালা প্রান্তরে শাহাদাত বরণ করে তারই অক্ষয় স্বাক্ষর রেখে গেছেন। নেতার প্রতি এরূপ আনুগত্য ও ভক্তি প্রদর্শন ইতিহাসের পাতায় আর একটিও খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারবালায় ৭২ জনের লাশ পড়ে আছে… পাষাণ শিমার বলছে : ‘এসব লাশের ওপর দিয়ে ঘোড়া দাবরিয়ে দাও।’ এসব লাশের মধ্যে রয়েছে ইমাম হোসাইনের পবিত্র দেহ যে দেহে বিদ্ধ হয়েছে ৩৩টি বর্শা ও আর রয়েছে তরবারির ৪৩টি আঘাত। কী মর্মান্তিক দৃশ্য! যে কদম মোবারক চুমু খাওয়ার জন্য দুনিয়া পাগল, আজ কারবালায় এ লাশ নিয়ে চলছে তা-ব। মাথা মোবারক বর্শায় গেঁথে পাষ- ইয়াযীদ বাহিনী চলছে কুফার দিকে।
ইমাম হোসাইন (আ.) ও তাঁর সঙ্গী শহীদগণের নাম এবং কারবালায় তাঁদের রক্ত¯্রােতের দৃশ্য বারবার মুমিনের মাঝে ঈমানী চেতনা সৃষ্টি করে। ইমাম হোসাইনকে কারবালা প্রান্তরে দেখতে পাই ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, আত্মত্যাগের এক অপূর্ব নজির হিসাবে। চোখের সামনে ক্ষুধা-পিপাসায় কাতর, আপন পরিজনের ম্লানমুখ, নিশ্চিত মৃত্যু তাঁকে সংকল্পচ্যুত করতে পারেনি। শিশুপুত্র আসগারের মর্মান্তিক মৃত্যু তাঁকে বিচলিত করতে পারেনি। ভ্রাতুষ্পুত্র নওজোয়ান কাসেমের মৃত্যু তাঁকে কর্তব্যকর্ম থেকে বিরত রাখতে পারেনি।
সত্যের পরীক্ষায় জয়যুক্ত হয়ে শহীদ হলেন কিন্তু আদর্শহীন ইয়াযীদের নিকট বাইআত করতে সম্মত হননি। একদিকে অতুল ঐশ্বর্য, অপ্রতিহত ক্ষমতা ও অগাধ সম্মান, আর একদিকে দুঃখ-নির্যাতন, নিষ্ঠুর নিষ্পেষণ ও নিশ্চিত মৃত্যু। সত্যিকার মুসলমান ঈমানের পরীক্ষা দিতে শেষের পথই বেছে নেন। এরা চিরদিনই মুষ্টিমেয়, কিন্তু পরিণামে বিজয়মালা এদেরই পদতলে লুণ্ঠিত হয়। এজন্যই কবি বলেছেনÑ ‘ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হার কারবালা কি বাদ।’
৬১ হিজরির ১০ মুহররম। মরুময় ‘কারবালা’ প্রান্তরে পাপিষ্ঠ ফাসিক ইয়াযীদ অন্যায়ভাবে রাসূলে করীম (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)-কে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। হত্যা করেছিল নবীবংশের অনেক সদস্যকে। তাই ১০ মুহররম ‘আশুরা’ জন্ম দেয় মহাশোকের। মহান আল্লাহর রাসূলের বংশের ওপর সংঘটিত অন্যায় ও অত্যাচারের প্রতিবাদ যারা করবে তারাই হবে মুহাম্মাদী দ্বীনের প্রকৃত অনুসারী। রাসূলে করীম (সা.)-কে যারা প্রকৃতই ভালোবাসে ও আহলে বাইতকে বিশ্বাস করে তারা কিয়ামত পর্যন্ত শোকের মাধ্যমে তাঁর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র ও বংশধরদের হত্যাকাণ্ডের স্মরণ ও প্রতিবাদ করতেই থাকবে।
লেখক: পীরজাদা শাহ সূফী মোখলেছুর রহমান,
ঐতিহ্যবাহী মানিকগঞ্জ গড়পাড়া এমামবাড়ির সাজ্জাদানশীন পীর ও
সভাপতি, পাক পাঞ্জাতন অনুসারী পরিষদ, বাংলাদেশ