All posts by pavel

ইরানি প্রবাদ

زنگوله پای تابوت بودن
উচ্চারণ : যাঙ্গুলে পা’য়ে তা’বূত বূদান
অর্থ : তাবুতের পায়ায় ঘণ্টা থাকা।
মর্মার্থ : বুড়ো বয়সে সন্তান জন্ম দেয়া অর্থে এ প্রবাদটি ব্যবহৃত হয়।
زنی که جهاز ندارد اینهمه ناز ندارد.
উচ্চারণ : যানী কে জেহা’য নাদা’রাদ ইনহামে না’য নাদা’রাদ
অর্থ : যে মহিলার মোহরানার সরঞ্জাম নেই, তার এসব ঠমক দেখানোর কিছু নেই।
মর্মার্থ : মহিলারা বিয়ের সরঞ্জাম নিয়েই বড়াই দেখাতে পারে অর্থে প্রবাদটি প্রচলিত।
زن یک دنده اش کم است.
উচ্চারণ : যান য়্যক দান্দেআশ কাম আস্ত
অর্থ : মেয়েদের একটি গিয়ার কম আছে।
মর্মার্থ : খুব সহজে ধোঁকা খায় অর্থে প্রবাদটি প্রচলিত। যেমন বলা হয়, মেয়েদের আকলে ঘাটতি আছে।
زور بیجا زدن.
উচ্চারণ : যূর বীজা’ যাদান
অর্থ : অযথা জোর খাটানো।
মর্মার্থ : অনর্থক কষ্ট করা বুঝাতে প্রবাদটি ব্যবহৃত হয়।
زور تپان (چپان) کردن.
উচ্চারণ : যূর তাপা’ন (চাপা’ন) কারদান
অর্থ : জোর করে চিবানো।
মর্মার্থ : গলায় আটকে যাবে এমন গ্রাস নেয়া। আন্দাযের বাইরে এবং কোন পাত্রে ধরবে না এমন জিনিস রাখা অর্থে এটি প্রচলিত।
زور خود را آزموده است.
উচ্চারণ : যূরে খোদ রা’ আযমূদে আস্ত
অর্থ : নিজের শক্তি পরীক্ষা করেছে।
মর্মার্থ : সে তার সাধ্য বাজিয়ে চেষ্টা করেছে বুঝাতে এটি ব্যবহৃত হয়।
زورش به خر نمی رسد پالانش را می زند.
উচ্চারণ : যূরাশ বে খার নেমী রেসাদ পা’লা’নাশ রা’ মী যানাদ
অর্থ : সে গাধার উপর জোর খাটাতে পারে না, পালানে গিয়ে আঘাত করছে।
মর্মার্থ : অন্যের উপর মনের ক্ষোভ ঝাড়া। প্রতিপক্ষের সাথে না পেরে কোন দুর্বল লোকের উপর গিয়ে মনের রাগ মিটানো অর্থে এটি ব্যবহৃত হয়।
زهر چشم از کسی گرفتن.
উচ্চারণ : যাহরে চাশ্ম আয কেসী গেরেফতান
অর্থ : কারো চোখের বিষ তুলে নেয়া।
মর্মার্থ : কাউকে ভয় দেখিয়ে তার সম্মুখ থেকে চলে আসা অর্থে এটি প্রচলিত।
زهر خود را ریختن.
উচ্চারণ : যাহরে খোদ রা’ রীখতান
মর্মার্থ : (কারো উপর) নিজের বিষ ঢেলে দেওয়া।
মর্মার্থ : কারো উপর নিজের শত্রুতা ও বিদ্বেষের রাগ ঢালা, মনের ক্ষোভ মিটানো এর প্রচলন ব্যাপক।

অনুবাদ : আবু আব্দুল্লাহ

বই পরিচিতি

ইরানের পথে প্রান্তরে
রচনা : মোঃ মুমিত আল রশিদ
প্রকাশক : এ কে নাহির আহমেদ সেলিম
কাকলী প্রকাশনী
৩ ও ৪, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০
প্রচ্ছদ- অনন্ত আকাশ
বর্ণবিন্যাস- সূচনা কম্পিউটার্স
মুদ্রণ : এঞ্জেল প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স
প্রকাশকাল : বইমেলা-২০১৬
মূল্য : ৩০০ টাকা মাত্র

‘ইরানের পথে প্রান্তরে’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোঃ মুমিত আল রশিদ রচিত একটি সমৃদ্ধ ইরান গবেষণাগ্রন্থ। গ্রন্থটিতে ইরান ভ্রমণসহ ইরান সম্পর্কিত বহুবিধ তথ্য একত্রে গ্রন্থাবদ্ধ হয়েছে। ইরানের পথ-ঘাটের বর্ণনা ছাড়াও লেখক ধারাবাহিক ভাবে মজাদার শব্দাবলির আড়ালে তত্ত্ব ও তথ্যের ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছেন। সেই সাথে গেঁথে দিয়েছেন ইরানের সাথে বাংলাদেশের সুমধুর অতীত সম্পর্ক ও বর্তমান সময়ের সকল সরকারের সুসম্পর্কের বিষয়-আশয়। বইটি ইরান-প্রেমিক জনগণ তা বটেই, যে কোন ইরান-গবেষককে আকৃষ্ট করবে।
ইরান সম্পর্কে কিছুই জানেন না এমন ব্যক্তিও দু’শ’ ত্রিশ পৃষ্ঠার এই বইতে পেয়ে যাবেন ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের একটি সামগ্রিক চিত্র। ইসলাম-পূর্ব ইরানের শাসনকাল, পাহলভী শাসনামল পর্যন্ত রাজনৈতিক অবস্থা, ইসলামি বিপ্লব ও বর্তমান ইরানের সাংবিধানিক ব্যবস্থা, ইরানি লোকজনের শিষ্টাচার, ঐতিহ্যবাহী ইরানি খাবার, উৎসব ইত্যাদি বিষয়ের বর্ণনা। নওরোজ, বায়েজিদ বোস্তামির শহর, মার্কোপোলোর নন্দিত স্বর্গ পারসেপোলিশ বা তাখতে জামশীদ, চোগাযানবিল, ইরানের প্রাচীনতম বিশ্ব ঐতিহ্য বাম নগরী, সোলেমানের সিংহাসন, জরথুস্ত্র ও অগ্নি মন্দির, ইরানের বিয়ের রীতি, শবেবরাত, আশুরা, ইরানে ঈদ উৎসব ইত্যাদি বিষয় বর্ণনার ফাঁকে ফাঁকে প্রাসঙ্গিক খুঁটিনাটি বিষয়গুলোও বাদ যায়নি। বিভিন্ন শহর ও অঞ্চলসমূহ ভ্রমণ করতে করতে ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক, প্রাকৃতিক বিষয়ের সাথে আবহাওয়া ও জলবায়ুর বর্ণনা দিতেও ভুলেননি লেখক। মাঝে মাঝে বর্ণিত হয়েছে টুকরো স্মৃতি। হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত পারস্য তথা ইরান নিয়ে জানার আকাক্সক্ষার কমতি ছিল না কোন কালেই। বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাস পারস্য সভ্যতা ছাড়া কল্পনাই করা যায় না। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত শাসক জুলকারনাইনও ইরান শাসন কারছেন। জুলকারনাইনের শান্তিরাজ্য ব্যাপক বিস্তৃত ছিল বলে কথিত আছে। গোলাপের দেশ, কবি ও কবিতার দেশ, হাফিজ, সাদী, খৈয়াম, রুমীর দেশ বলে সকলেই ইরানকে জানে।
ইসলামের আগমনে ইরানি ঐতিহ্য যেমন আরো উজ্জ্বল হয়েছে তেমনি হাজার বছর পর বিংশ শতাব্দীতে ইরানের ইসলামি বিপ্লবও মানবতার কল্যাণে ইরানীদের অবদানকে বিশ্বমাঝে আরেকবার উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে।
বাংলা ভাষায় ইরানের উপর বহু গ্রন্থ রচিত হয়েছে। মুমিত আল রশিদ রচিত আলোচ্য গ্রন্থটিও বাংলাভাষী পাঠকদের ইরান ভাবনাকে আরো সমৃদ্ধ করবে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। আমরা বইটির বহুল প্রচার কামনা করছি।
আমিন আল আসাদ

শেখ ফরিদ উদ্দিন আত্তার ও তাঁর সী-মোরগ কাহিনী

মুহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন খান

বিশ্বের অত্যন্ত খ্যাতিমান আধ্যাত্মিক কবি, সাধক ও পীর-মুর্শিদগণের অন্যতম হলেন শেখ ফরিদ উদ্দিন মুহাম্মদ আত্তার নিশাপুরী রহমাতুল্লাহি আলাইহ্। বর্তমান ইরানের খোরাসান প্রদেশস্থ’ নিশাপুর শহরে ৫৪০ হিজরি মুতাবিক ১১৪৫ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ এবং ৬১৮ হিজরি মুতাবিক ১২২১ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর আসল নাম আবু হামিদ মুহাম্মদ বিন আবি বকর ইবরাহীম। আত্তার ও ফরিদ উদ্দিন তাঁর কলমী নাম।
মাওলানা জালালুদ্দীন রুমী রহমাতুল্লাহি আলাইহ্ কিশোর বয়েসে বয়োবৃদ্ধ শেখ আত্তারের সাক্ষাৎ ও দোয়া লাভ করেন। তিনি শেখ ফরিদ উদ্দিন আত্তার সম্পর্কে লিখেছেন :
‘আত্তার করেছেন সফর প্রেমের সপ্তনগর
আমরা এখনও ঘুরছি এক
কানা গলির ভেতর।’
সাধারণ মুসলমানদের কাছে শেখ ফরিদ উদ্দিন মুহাম্মদ আত্তার নিশাপুরী তাঁর জগদ্বিখ্যাত গদ্য গ্রন্থ ‘তাযকিরাতুল আউলিয়া’র জন্য বিশেষভাবে পরিচিত হলেও তাঁর রচিত কাব্যসমূহ আধ্যাত্মিক মনীষীবৃন্দ ও গবেষক সাধকদের মননকে সবিশেষ সমৃদ্ধ করেছে এবং অনেক গ্রন্থ বিভিন্ন ভাষাতেও অনূদিত হয়েছে।
শেখ আত্তারের গ্রন্থসমূহের অন্যতম হচ্ছে ‘মানতেকুত্তায়ির’, ‘দিওয়ান’, ‘পান্দ নামা’, ‘খসরু নামা’, ‘মুখতার নামা’, ‘মসিবত নামা’, ‘ইলাহী নামা’, ‘জাওয়াহির নামা’, ‘শারহুল কাল্্ব্’, ‘আসরার নামা’, ‘হিলাজ নামা’, ‘মনসুর নামা’, ‘বিসার নামা’, ‘অশতুর নামা’ প্রভৃতি। গবেষকদের মতে তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ১১৪টি যা আল-কুরআনের সূরাসমূহের সংখ্যা। আমরা আজকের আলোচনায় শেখ আত্তারের ‘মানতেকুত্তায়ির’ কাব্যগ্রন্থ নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করব।
শেখ ফরিদ উদ্দিন মুহাম্মদ আত্তারের রচনাবলির ভেতর ‘মানতেকুত্তায়ির’ বা পাখিদের ভাষা, যুক্তি ও প্রজ্ঞাগ্রন্থের নামকরণ করা হয়েছে আল-কুরআনে বর্ণিত হযরত সুলায়মান আলাইহিস সালামের কাহিনীতে ব্যবহৃত পরিভাষা তথা মানতেকুত্তায়ির থেকে যাতে প্রাসঙ্গিকভাবে হুদহুদ নামের এক জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান পাখির সাথে হযরত সুলায়মানের আলোচনা উদ্ধৃত হয়েছে।
শেখ আত্তারের ‘মানতেকুত্তায়ির’ কাব্যগ্রন্থ এক বিস্ময়কর আধ্যাত্মিক পথনির্দেশনার গ্রন্থ যা রূপক হিসেবে পাখিদের ভাষা ও আচরণে বলা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে লাখো পাখির সমাবেশ মানুষেরই সমাবেশ। মানুষের স্বভাব-চরিত্র ও আচার-ব্যবহার পাখিদের জবানে ও আচরণে তুলে ধরা হয়েছে। প্রায় আটচল্লিশ হাজার শব্দের এ গ্রন্থে রয়েছে মানবমনের হাজার হাজার পর্দার কাহিনী এবং তা বিদীর্ণ করে মাশুকে মুতলাক আল্লাহ তা‘আলার দীদারে গমনের পথ পরিক্রমার অনন্য এক দিকনির্দেশনা। পাখিদের সমাবেশ ও অভিযাত্রার এ গ্রন্থ শুরু হয়েছে রাব্বুল আলামীনের প্রশংসা বাক্য দিয়েÑ
‘আফরিন জান আফরিনে পাক রা
অন্কে জান বাখ্শিদ ও ঈমান খাক রা’
অর্থাৎ ‘প্রশংসা পবিত্র সেই সত্তার যিনি জীবন সৃষ্টি করেছেন-
যিনি মাটির মাঝে প্রাণ ও জীবন দান করেছেন।’
‘মানতেকুত্তায়ির’ এর ইংরেজি অনুবাদ হয়েছে কন্ফারেন্স অব দ্য বার্ডস, অ্যাসেম্ব্লি অব দ্য বার্ডস, পার্লামেন্ট অব দ্য বাড্র্স্ প্রভৃতি পরিভাষায়। স্বনামধন্য ইংরেজ কবি ফিট্জিরাল্ড পুরো গ্রন্থটাই ইংরেজি কাব্যে অনুবাদ করেছেন। তিনি ছাড়াও আরো কয়েকজন এর অনুবাদ করেছেন।
এ গ্রন্থের শুরুতে হাম্দ, না’ত ও প্রচলিত দোয়া-দরূদের পর মূল কাহিনীতে বলা হয়েছে :
চন্দ্রবিহীন এক মধ্যরাতে চিন দেশে সী-মোরগ তার রূপের বাহার মেলে ধরল। সী-মোরগের পাখা থেকে একটি পালক ছুটে পড়ল জমিনে। পালকের রূপের আলোতে চমক লাগল দেশ-বিদেশ ও সারা জাহানে। এত রূপ দেখে দেশের পাখিরা জমা হলো বিশাল ময়দানে। সবার এক কথাÑ পৃথিবীর সব দেশেই রাজা-বাদশাহ রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে বাদশাহ নেই। এ কারণে সবখানে অরাজকতা, অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, অশান্তি, যুদ্ধ, হত্যাকা-, বৈষম্য, হিংসা, বিদ্বেষ ইত্যাদি চলছে। আমাদের প্রয়োজন একজন ন্যায়বিচারক দরদি বাদশাহ। কিন্তু কোথায় পাব তাকে? কে নিয়ে আসবে এমন একজন প্রজ্ঞাবান প্রজাবৎসল বাদশাহ। পাখিদের এমনসব কথাবার্তা ও কোলাহলে উপস্থিত হলো হুদহুদ। হুদহুদ অত্যন্ত জ্ঞানী, বুদ্ধিমান, প্রজ্ঞাবান ও কষ্টসহিষ্ণু পাখি। সব পাখিই তার গুণাবলিতে মুগ্ধ। সবাই মিলে তাকে ধরল এবং তাদের দাবির কথা জানালো। হুদহুদ পাখিদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনল এবং তাদের মনের কথা বুঝে নিল। সমবেত পাখিরা তাকেই নেতা ও মুখপাত্র হিসেবে মনোনীত করলো। কেননা, হুদহুদ হযরত সুলায়মানেরও ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত পাখি। সবার কথা ও দাবি শোনার পর হুদহুদ বলল : ‘আমাদের জন্য একজন যোগ্যতম বাদশাহ বা স¤্রাট হওয়ার যোগ্যতা রয়েছে কেবল সী-মোরগের।’ সী-মোরগ এক আধ্যাত্মিক কল্পিত পাখির নাম। ফারসি সাহিত্যে সী-মোরগ বলা হয় ইনসানে কামেল ও পীরে কামেলকে যিনি রাব্বুল আলামীন আল্লাহ পাকেরই খাঁটি প্রতিনিধি।

হুদহুদ পাখিদের বলল : ‘সী-মোরগের সন্ধান ও সাক্ষাৎ পাওয়া এত সহজ নয়। সী-মোরগের আবাসে যেতে হলে অত্যন্ত কঠিন ও সংগ্রামময় অভিযান জরুরি। সী-মোরগ থাকে ‘কুহে কাফে’। কুহে কাফে যেতে হলে আমাদের এদেশ ও এ বেশ ছাড়তে হবে। আমাদের নফসানি লেবাস ও রেশ থাকা অবস্থায় কুহে কাফে যাওয়া সম্ভব নয়। আর সেখানে যেতে না পারলে সী-মোরগের দীদার লাভও অসম্ভব।’
এ অভিযান ও অভিযাত্রা নিয়ে পাখিদের মাঝে শুরু হলো নানা তর্ক-বিতর্ক ও বাদানুবাদ। প্রত্যেকেই যার যার স্বার্থ, যুক্তি ও অবস্থানের আলোকে নিজেকে এ অভিযান থেকে দূরে রাখার চেষ্টা চালাল। বুলবুল, ময়ূর, চড়–ই, কবুতর, ঘুঘু, দোয়েল, হাঁস, কাক, শুকুন, বাজ, ঈগল প্রভৃতি হাজার হাজার নামের পাখি সাত মরু-বিয়াবান পাড়ি দেয়ার নাম শুনেই ছিটকে পড়তে ও সটকে পড়তে যুক্তি দেখাতে লাগল। হুদহুদ সবাইকে তার প্রজ্ঞা দিয়ে বুঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালালো। বলল : ‘আমাদের মুক্তির একমাত্র পথই এ সংগ্রামী অভিযানে জীবনপণ করে নামা। নইলে এই অরাজকতাপূর্ণ, অশান্তির ও ধ্বংসাত্মক পৃথিবীর কারাগার থেকে আমাদের মুক্তি নেই। আত্মত্যাগ ও সংগ্রামই একমাত্র উপায়। লোভ-লালসা, স্বার্থপরতা, হিংসা-বিদ্বেষ, স্বাধীনতা ইত্যাদির সাত ভয়াবহ ময়দান পাড়ি দিতেই হবে। তবেই আমরা চিরন্তন শান্তিময় জীবন পাব এবং সী-মোরগের পরশ লাভে ধন্য হব।’
শেখ মুহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন আত্তার তাঁর চিত্তাকর্ষক ও আধ্যাত্মিক তাৎপর্যপূর্ণ এ গ্রন্থে উল্লেখ করেন-
অবশেষে পাখিদের সমাবেশ থেকে হাজার হাজার পাখি রওয়ানা হলো কুহে কাফের দিকে হুদহুদের নেতৃত্বে। ভয়াবহ সাত মরু পাড়ি দিতে গিয়ে হাজার হাজার পাখি মারা গেল, হারিয়ে গেল এবং নানা আকর্ষণ ও ফাঁদে আটকে পড়ল।
শত শত মঞ্জিলে হুদহুদ সঙ্গী-সাথিদের উপদেশ ও পথনির্দেশ দিয়ে প্রাণ সঞ্চার করতে লাগল। সাহসী এ বীর পাখিরা দীর্ঘ কঠিনতম পথ পরিক্রমা শেষে যখন কুহে কাফে পৌঁছল তখন তাদের সংখ্যা দাঁড়ালো মাত্র তিরিশে। ফারসিতে তিরিশকে বলা হয় ‘সী’। তিরিশ পাখি অর্থাৎ সী-মোরগ! সী-মোরগ বা তিরিশ পাখি যখন কুহে কাফে মহান বাদশাহ সী-মোরগের আবাসে পৌঁছল তখন তাদের অবস্থা কাহিল, প্রাণ যায় যায়। পথে পথে হাজার হাজার সাথি পাখি বিদায় নিয়েছে বা ধ্বংস হয়েছে। কত হৃদয়বিদারক এ কাহিনী! কিন্তু সবাই ঠিকানাবিহীন গহীন অন্ধকার যুলুমাতের দেশে ও দীনহীন বেশে ঘুরপাক খাচ্ছে।
শেষ পর্যন্ত সী-মোরগ বা তিরিশ বীরবিক্রম পাখি অধীর চিত্তে অপেক্ষা করতে লাগল অন্তরের আরাধ্য সী-মোরগের দেখা পাওয়ার সৌভাগ্য অর্জনের জন্য। সেখানে ছিল এক বিশাল অতি স্বচ্ছ হ্রদ। অপেক্ষমাণ সী-মোরগরা হ্রদের স্বচ্ছ সলিলের দিকে এগিয়ে গেল। একি! সী-মোরগের সবার চেহারাই হ্রদের পানিতে ফুটে উঠেছে। প্রত্যেকেই নিজের ছবিতে দেখল মহামান্য ন্যায় বিচারক অতিশয় দরদি সী-মোরগের হুবহু চেহারা। তারা তো বিস্ময়ে হতবাক! তখন ছবি-প্রতিচ্ছবি থেকে চোখ ফিরিয়ে যার যার দেহের দিকে তাকিয়ে দেখে তারাই এখন সী-মোরগ! সী-মোরগের সন্ধানে, ধ্যানে, স্মরণে ও অভিযানে গিয়ে তারাই হয়ে গেছে সী-মোরগ। কুহে কাফের সী-মোরগ। চিরশান্তির সী-মোরগ। একত্ব ও একাকারের তাওহিদী হৃদয়ের প্রশান্তি, দরদ ও ইশকে তারা মাতোয়ারা।
তাদের চোখে-মুখে, কানে ও সর্বাঙ্গে এবং রুহে সর্বত্র বাজছে এক মধুর তান-
‘আমি এক আহাদ, অদ্বিতীয় সামাদ-
আমাকেই বানাও তোমার একক লক্ষ্য ও প্রেমময় প্রাসাদ-
আমার উপস্থিতিই যথেষ্ট হোক তোমার মনে-
আমিই তোমাদের মাওলা-মাবুদ বরণ কর অনিবার্য জেনে-
দমে দমে জপ আমার নাম
বিভোর থাক হু আর আল্লাহু স্মরণে।
(১৪ এপ্রিল ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে পালিত হয়েছে শেখ মুহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন আত্তার নিশাপুরী দিবস।)

(লেখক পরিচিতি: অধ্যাপক ও পরিচালক, ইউআইটিএস রিসার্চ সেন্টার,
ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেস (ইউআইটিএস)

ফুলের সুবাসে চির-অম্লান

শেখ সা’দীর গুলিস্তান
ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
‘গুলিস্তান’ একটি গ্রন্থের নাম। ফারসি ভাষায় লেখা হয়েছে এই গ্রন্থ। তাও সাম্প্রতিককালে নয়, আজ থেকে প্রায় সাড়ে ৭শ’ বছর আগে। এরপরও এ নামটির সাথে আমরা পরিচিত। বড় সুন্দর মধুর মনে হয় এ নামটি। মনে হয় একান্ত কাছের। অথচ এর লেখক আমাদের দেশি কেউ নন। এদেশেও আসেননি কখনো। তাঁর জন্ম ইরানে। কবি ও গোলাপের নগরী শিরাযে। প্রাচীন পারস্যের রাজধানী শিরায। শিরাযের ফুলের বাগানে বসে কবি শেখ সা‘দী এ কিতাব লেখেন। কালের দীর্ঘ সিঁড়ি বেয়ে গ্রন্থটি এখনো সমাদৃত ফারসি সাহিত্যের সোনালি জলসায়। শুধু সমাদৃত নয়, প্রাতঃস্মরণীয়। ইরানের কবি-সাহিত্যিকদের গলার তাবিজ ‘গুলিস্তান’।
প্রশ্ন জাগে, [‘গুলিস্তান’ এর এত খ্যাতির কারণ কী? কারণ, এর অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য। ফুলকে সবাই ভালবাসে। ফুলের বাগানে বিচরণ করলে কার না প্রাণ জুড়ায়! শেখ সা’দীর ‘গুলিস্তান’ও যেন ফুলবাগান। ফারসিতে গুল মানে ফুল, স্তানের অর্থ বাংলায় স্থানের মতই। অর্থাৎ ফুলের স্থান, ফুল বাগান। সত্যিই ‘গুলিস্তান’ একটি অক্ষয় ফুলবাগান। সেখানে নিত্য বসন্ত ফুলের সুরভি বিলায়। বরং মানবসভ্যতার বসন্ত নিজেই সৌরভ আহরণ করে সা’দীর ‘গুলিস্তান’ হতে। গুলিস্তানের পরশে মানব বাগানে প্রস্ফুটিত হয় রঙ-বেরঙের ফুল। মানুষের মন হয় সুরভিত, সুবাসিত, গুলে গুলযার।]
আমাদের বাড়ির আঙ্গিনায় যে বাগান, তাতে ফুলের সমারোহ আসে বসন্তে। বছরে একবারের বেশি নয়। বসন্তের প্রস্থানে থাকে না ফুলের সেই সৌরভ, বাগানের জৌলুস। কিন্তু ‘গুলিস্তান’-এ হিকমত, উপদেশ, বাক্যালংকার ও উপমার যে ফুলের জলসা সাজিয়ে রেখেছেন শেখ সা’দী, তাতে নিত্য বসন্ত বিরাজমান। এক মুহূর্তের জন্যও ম্রিয়মাণ হয় না। ‘গুলিস্তান’ পড়ে সজীব হয় মানুষের প্রাণ। পবিত্র আনন্দের শিহরণ আসে হৃদয়-মনে। কাজেই ‘গুলিস্তান’ অবারিতভাবে ফুলের সুষমা বিলিয়ে সমৃদ্ধ করেছে মানবসভ্যতাকে, সমৃদ্ধ করছে আমাদের প্রিয় বাংলাভাষাকেও। ‘গুলিস্তান’ এর এই অনন্য বৈশিষ্ট্যের প্রতি শেখ সা’দীর নিজেরও সজাগ নজর ছিল। তিনি এর ভূমিকায় বলেন-
বে ছে কা‘র অ‘য়াদাত যে গুল তাবাকী
আয্ গুলেস্তা‘নে মান বেবার ওয়ারাকী।
তোমার কি কাজে আসবে ফুলের স্তবক
আমার গুলিস্তান হতে নাও একটি পল্লব।
গুল হামীন পাঞ্জ রুয ও শীশ বা’শাদ
ওয়ীন গুলিস্তা‘ন হামীশে খোশ বা’শাদ।’
ফুল তো থাকবে কেবল পাঁচ-ছয় দিন,
এই ফুলবন থাকবে প্রাণবান চিরদিন।।
গুলিস্তান থেকে
‘গুলিস্তান’ এর রচনাকাল ৬৫৬ হিজরি। আগের বছর তিনি ‘বূস্তা‘ন’ লিখেন। ‘বূস্তা‘ন’ সম্পূর্ণ পদ্যে। ফারসি সাহিত্যের অনবদ্য কিতাব। ‘গুলিস্তান’ পদ্য ও গদ্যের মিশ্রণে লেখা। যার দৃষ্টান্ত এর আগেকার ফারসি সাহিত্যে নেই। পরে গুলিস্তানের আদলে আবদুর রহমান জামীর ‘বাহারিস্তা‘ন’ এর ন্যায় গ্রন্থ রচনার জন্য অনেক চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু কোনটিই ‘গুলিস্তান’-এর সমকক্ষ হয়নি। ‘বাহারিস্তা‘ন’ ছাড়া কোনটি কাছেও ঘেঁষতে পারেনি। ‘গুলিস্তান’-এর বাচনভঙ্গি অপূর্ব, প্রাঞ্জল, গতিময়, প্রাণচঞ্চল। গদ্যে-পদ্যে শব্দে শব্দে ঝংকার, ভাবের তরঙ্গ, আনন্দের উচ্ছ্বলতা, তত্ত্বের সমাহার। মনে হবে, দুনিয়ার কোন কাব্য বা পদ্য সা’দীর গদ্যের সমকক্ষতায় আসতে পারবে না। কিন্তু যখন গদ্যের মাঝে শ্লোক, খণ্ড-কবিতা প্রভৃতি পদ্যের সুন্দর সংযোজন দেখবেন, মনে হবে পদ্য-গদ্যের সকল সীমা চুরমার করে দিয়েছে ‘গুলিস্তান’। প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি শ্লোক মুখস্ত রাখার মত। তাই ইরানিদের মুখে মুখে চর্চিত ‘গুলিস্তান’ এর এসব বাক্য। কথায় কথায় উদ্ধৃতি টানে সা’দীর উক্তির। অফুরন্ত জ্ঞান, তত্ত্ব ও উপদেশ উপচে পড়ে ‘গুলিস্তান’ এর প্রতিটি বাক্য বিন্যাসে।
হযরত শেখ সা’দী (রহ.) জীবনের শেষ ভাগে, দীর্ঘ সফর ও অভিজ্ঞতার সঞ্চয় মানবজাতির জন্য সাজিয়ে গেছেন ‘গুলিস্তা‘ন’ ও ‘বূস্তা‘ন’-এ। যেগুলোর আবেদন চিরন্তন। গবেষকদের মতে, ‘গুলিস্তান’ ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের মাইলফলক। প্রাচীন পাহলভী ভাষা থেকে ফারসির রূপান্তরের পর এ ভাষা চিরতারুণ্যে প্রাণবন্ত। ফেরদৌসীর ‘শাহনামা’ রচনার পর দীর্ঘ হাজার বছরে ফারসিতে মৌলিক পরিবর্তন আসেনি, আসতে দেয়নি ‘গুলিস্তান’, ‘বূস্তা‘ন’, ‘মসনবী’ ও ‘দিওয়ানে হাফেয’ এর মত শত শত কিতাব। ফলে হাজার বছরের পুরনো ফারসি কিতাব পড়লে মনে হবে, সম্পূর্ণ নতুন আধুনিক কোন বই পড়ছি। অন্তত ‘মসনবী’, ‘গুলিস্তান’, ‘বূস্তা‘ন’, ‘দিওয়ানে হাফেয’ এবং নিযামী ও জামীর রচনার বেলায় এ কথা একশ’ ভাগ সত্য।
নিঃসন্দেহে ফারসি ভাষার স্বকীয়তা-নিজস্বতা রক্ষায় এসব গ্রন্থ ও মনীষীর অমূল্য অবদান অবিস্মরণীয়। মাঝখানে ফারসিকে আরবির আধিক্য ও ইসলামি পরিভাষা থেকে আলাদা করার প্রয়াস কম হয়নি। কিন্তু মহীরূহের মত দাঁড়িয়ে ‘গুলিস্তান’ তা বাস্তবায়িত হতে দেয়নি। কারণ, ‘গুলিস্তান’কে বাদ দিয়ে তো ফারসি সাহিত্য হবে না। আর ‘গুলিস্তান’-এ রয়েছে আরবি, ইসলামি ও নৈতিক শিক্ষার অফুরন্ত ভাণ্ডার।
নজরুল যেভাবে বাংলায় ফারসি-আরবির সুন্দর হৃদয়গ্রাহী মিশ্রণ ঘটিয়েছেন, শেখ সা’দী তার চেয়েও মোহনীয়ভাবে কুরআন, হাদীসের শিক্ষা ও শব্দ সম্ভারের মিশ্রণ ঘটিয়েছেন ফারসিতে। ফলে অক্ষয় আল্লাহর তাওহীদের বাণী ও শিক্ষা বুকে ধারণ করায় ফারসি হয়েছে অপরিবর্তনীয়, অক্ষয়। একই সুবাদে ‘গুলিস্তান’ও দাবি করতে পারে কেয়ামত পর্যন্ত বিশ্বসাহিত্যের সিংহাসনে অধিষ্ঠানের। ‘গুলিস্তান’ আমাদের দেশেও পড়ানো হয় মাদ্রাসাগুলোতে। তাও আবার নিচের ক্লাসে। ফলে সাহিত্য ও বাক্যালংকারের রসবোধহীন ছাত্ররা ‘গুলিস্তান’-এর মাধুর্যের কিছুই বুঝতে পারে না। আমাদের দেশে মাদ্রাসায় ‘গুলিস্তান’-এর কিছু কিছু গল্পই বুঝানো হয় ক্লাসে। তাও এখন বিলুপ্তপ্রায়। অথচ এর প্রতিটি বাক্য ও শিক্ষার আবেদন কীরূপ কালজয়ী তা সাহিত্যের বোদ্ধা ছাড়া বোঝা ও বোঝানো অসম্ভব। তাই ইরানে ‘গুলিস্তান’ পড়ানো হয় ফারসি সাহিত্যের বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের ছাত্র-ছাত্রীদের।
আট বেহেশতের সংখ্যা সামনে রেখে শেখ সা’দী ‘গুলিস্তান’কে ৮টি ‘বাব’ বা অধ্যায়ে বিন্যস্ত করেছেন। প্রথমে রয়েছে ভূমিকা। ফারসিতে বলা হয় দীবাচা। ষোল পৃষ্ঠা জুড়ে দীর্ঘ দীবাচায় শুরুতে আল্লাহর প্রশংসা ও রসূলে পাক (সা.)-এর তারিফ। তারপর ‘গুলিস্তান’ রচনার প্রেক্ষাপট বর্ণনাসহ অমূল্য উপদেশ সম্ভার।
এরপর ১৭-৬৬ পৃষ্ঠাব্যাপী প্রথম অধ্যায়ে আছে ‘রাজা-বাদশাহদের জীবনচরিত’। শেখ সা’দী (রহ.) যে যুগের মানুষ সে যুগে কাব্য ও সাহিত্যচর্চা বলতে বুঝাতো রাজা-বাদশাহদের স্তুতিগান ও চাটুকারিতা। শাসকদের বিরুদ্ধে টু শব্দ করার অর্থ ছিল তরবারির সামনে গর্দানটা এগিয়ে দেয়া। শেখ সা’দী সে যুগেই তাঁর ক্ষুরধার লেখনীতে এক অভিনব পন্থায় রাজা-বাদশাহদের সমালোচনা ও সংশোধন করেন। তিনি পূর্ববর্তী রাজা-বাদশাহরা কী কী কারণে ধ্বংস ও পরাজিত হয়েছিলেন, তার সরস বর্ণনার পাশাপাশি ন্যায়পরায়ণ বাদশাহদের প্রশংসা তুলে ধরেন। তারই মধ্য দিয়ে সমকালীন ও অনাগত শাসকদের সংশোধন হওয়ার সুযোগ করে দেন। একই সঙ্গে অধীনস্তদের ওপর যুলুমের করুণ পরিণতি আর ন্যায়-ইনসাফকারীদের জীবনের সৌভাগ্য ও সুনাম-সুখ্যাতি বর্ণনায় গল্পের ছলে মোট ৪২টি উপমা দিয়েছেন এ অধ্যায়ে। মাঝে মাঝে উপদেশনির্ভর কবিতার ব্যঞ্জন তো আছেই।
দ্বিতীয় অধ্যায় ‘দরবেশদের আখলাক’ সম্বন্ধে। যারা দরবেশ, দুনিয়াবিরাগী, লোভ-মোহ থেকে মুক্ত, পবিত্র জীবনের অধিকারী তাঁদের প্রশংসা করেছেন আর ভণ্ড তাপসদের মুখোশ উন্মোচন করেছেন। ৬৭ থেকে ১০৮ পৃষ্ঠাব্যাপী ৪৮টি উপমার সাহায্যে গদ্য ও পদ্যে তিনটি কাহিনীসহ সাজিয়েছেন এ অধ্যায়।
তৃতীয় অধ্যায় ‘অল্পে তুষ্টির ফযিলত বা মাহাত্ম্য’ প্রসঙ্গে। ১০৯ থেকে ১৪১ পৃষ্ঠায় ৩০টি দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে পদ্যে ও গদ্যে অনুপম ভঙ্গিমায় মানবজীবনের অনিবার্য অলংকার ‘কানাআত’ বা অল্পে তুষ্টির পথ দেখিয়েছেন।
চতুর্থ অধ্যায় ‘নীরবতার সুফল’ প্রসঙ্গে। ১৪২ হতে ১৪৯ পৃষ্ঠা পর্যন্ত কম কথা বলা, সময় মত বলা বা বাক্য সংযমের রীতিনীতির সরস বর্ণনা স্থান পেয়েছে এ অধ্যায়ে।
পঞ্চম অধ্যায়ে ১৫০ পৃষ্ঠা হতে ১৭৮ পৃষ্ঠা জুড়ে ‘প্রেম ও যৌবন’ প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে। ২১টি উপমার সাহায্যে একটি কাহিনীসহ যৌবন তরঙ্গের নানা আপদ, চারিত্রিক বিচ্যুতির অপকারিতা প্রভৃতির হিকমতপূর্ণ আলোচনা বিধৃত।
ষষ্ঠ অধ্যায় ‘দুর্বলতা ও বার্ধক্য’ সম্বন্ধে। ১৭৯ হতে ১৮৭ পৃষ্ঠাব্যাপী একটি ছন্দোবদ্ধ কাহিনীসহ ৭টি উপমার সাহায্যে যৌবন ও বার্ধক্যের নানা অভিজ্ঞতার সরস উপদেশ উপস্থাপন করেছেন।
সপ্তম অধ্যায় ‘শিক্ষা-দীক্ষার প্রভাব’ সম্পর্কে। ১৮৮ হতে ২১৬ পৃষ্ঠাব্যাপী এ অধ্যায়ে ১৯টি দৃষ্টান্ত ও একটি দীর্ঘ কথোপকথন স্থান পেয়েছে পদ্য ও গদ্যে।
অষ্টম অধ্যায়ে রয়েছে ২১৭ হতে ২৫৬ পৃষ্ঠায় ‘সাহচর্যের আদব ও শিষ্টাচার’ প্রসঙ্গ। গবেষকদের মতে এ অধ্যায়টি ‘গুলিস্তান’-এর সবচেয়ে হৃদয়গ্রাহী অংশ। কারো কারো মতে, ‘গুলিস্তান’ শেষ থেকে অধ্যয়ন শুরু করে সবশেষে ভূমিকা পাঠ করলেই উত্তম।
‘গুলিস্তান’ শুরু হয়েছে আল্লাহ পাকের প্রশংসা দিয়ে। সৃষ্টিলোকের কোন্ নেয়ামতটির জন্য শেখ সা’দী আল্লাহর প্রশংসা করে অন্তর জুড়াবেন! অসংখ্য-অগণিত নেয়ামতরাজির মধ্যে একটি ছোট্ট নিঃশ্বাসকে বেছে নিয়েছেন তাই। যেন এর মাধ্যমে মানবজীবনের স্বরূপ ও সৃষ্টিরহস্য উদ্ঘাটিত হয়। আর প্রতিটি মুহূর্তে মানুষ আল্লাহর কী পরিমাণ নেয়ামতে নিমজ্জমান তারও তথ্য ভেসে আসে। গদ্যে ছোট্ট ক’টি বাক্য, অথচ ছন্দ-ঝংকারে ভাব-আবেদন অপরিমেয়।
‘প্রতিটি শ্বাস যা ভেতরে প্রবেশ করে, জীবন বাড়ায় আর যখন বেরিয়ে আসে, দেহমনে স্বস্তি আনে, আনন্দ দেয়। কাজেই প্রতি নিঃশ্বাসে দু’টি নেয়ামত বিদ্যমান আর প্রত্যেক নেয়ামতের জন্য একটি করে কৃতজ্ঞতা কর্তব্য।’ গুলিস্তান, ভূমিকা
স্বীকার করতেই হয়, ‘গুলিস্তান’ থেকে যথার্থভাবে ভাষান্তরের ক্ষমতা বাংলার নেই। অন্য কোন ভাষারও নেই। ভাষার চাইতেও বড় কথা অনুবাদক। নজরুলের মত শক্তিমান কোন কবির পক্ষেই এ ক্ষেত্রে কৃতকার্য হওয়ার আশা করা সম্ভব। কাজেই এই দুর্বল কলমের অনুবাদ পড়ে কেউ আশাহত হলে ক্ষমার আর্জি জানানো ছাড়া উপায় নেই।
প্রতি মুহূর্তে আমরা শ্বাস-প্রশ্বাস নেই। কিন্তু আমরা কি এত গভীরে গিয়ে চিন্তা করেছি, যেমনটি শেখ সা’দী (রহ.) করেছেন। যুক্তির বিচারে প্রতিটি নেয়ামতের জন্য একটি করে শোকরিয়া-কৃতজ্ঞতা জানানো কর্তব্য। একদিকে আল্লাহর অপরিসীম নেয়ামতের স্বীকৃতি, অপরদিকে মানবজীবনের স্বরূপ ও খোদানির্ভরতার প্রতি প্রাজ্ঞ দৃষ্টিপাত।
আরো সুন্দর সাবলীল ছন্দোময়-প্রাণোচ্ছল সাহিত্যিক বর্ণনার পর তিনি আবার বলছেনÑ
‘আব্র ও বা’দ ও মা’হ ও খোরশীদ ও ফলক দরকা’র আন্দ
তা’ তো না’নী বেদাস্ত অ’রী ওয়া বেগফ্লাত ন খোরী’
মেঘ-বৃষ্টি, চাঁদ-সূর্য, আকাশ কর্মে নিয়োজিত
যেন রুটি রুজি হাতে পাও, না খাও অবহেলায়।
হামে আয বাহরে তো র্সাগাশতে ও ফরমা’ন বরদা’র
শর্তে ইনসাফ ন বা’শদ কে তো ফরমা’ন ন বরী
সবাই দিশেহারা তোমার সেবায়, ব্যস্ত আজ্ঞাবহ,
বড় বেইনসাফী হবে যদি তার আদেশ অমান্য কর । গুলিস্তান,ভূমিকা
মানুষের জীবিকার ব্যবস্থা হচ্ছে সমস্ত সৃষ্টির সম্মিলিত প্রয়াসে। মানুষের খেদমতেই নিয়োজিত রেখেছেন আল্লাহ তাঁর সমস্ত সৃষ্টিকে। কাজেই অবহেলা-গাফিলতির মধ্যে যেন মানুষ ডুবে না যায়।
শেখ সা’দী রসূলে পাক (সা.)-এর প্রশস্তি গেয়ে গদ্য ও পদ্য রচনা করেছেন অসংখ্য। কিন্তু ‘গুলিস্তান’-এর ভূমিকায় আরবিতে লেখা ১টি পঙ্ক্তিমালা যে স্বীকৃতি ও জনপ্রিয়তা পেয়েছে তা বিশ্বসাহিত্যে অতুলনীয়। আরব-অনারব তাবৎ কবি-সাহিত্যিক, মনীষী হৃদয়ের সকল ভালবাসা উজাড় করে বহু রাসূল প্রশস্তি লিখেছেন। কিন্তু সবই যেন ‘গুলিস্তান’-এর এই পঙ্ক্তিমালার সামনে নি®প্রভ। কারণ, শেখ সা’দী প্রতিটি ছত্রে ভাব, ছন্দ, সুর, আবেগ ও রাসূলে পাকের পরিচয়ের যে প্রকাশ ঘটিয়েছেন তা অতুলনীয় অবর্ণনীয়। এ কারণেই এ দু’টি ছত্র ইরানের সীমা পেরিয়ে সাড়ে ৭শ’ বছর পরও আমাদের দেশের প্রতিটি মানুষের কণ্ঠে ভক্তি ও বিশ্বাসে, প্রেম ও ভালবাসার আবেগে শ্রদ্ধাভরে পঠিত, উচ্চারিত হয়-
‘বালাগাল উলা বিকামা’লিহী
কাশাফাদ দুজা বিজামা’লিহী
হাসুনাত জামিয়ু খিসা’লিহী
সাল্ল¬ুু আলাইহি ওয়া আ’লিহী। গুলিস্তান,ভূমিকা
এই অনুপম পঙ্ক্তিমালার যথার্থ অনুবাদের অনেক চেষ্টা বাংলা ভাষায়ও হয়েছে। কিন্তু কেউ দাবি করতে পারেননি সঠিক ও যথার্থ অনুবাদ হয়েছে বলে। মোটামুটি এভাবে তার অনুবাদ করা যায়-
সুউচ্চ শিখরে সমাসীন তিনি নিজ মহিমায়
তিমির-তমসা কাটিল তাঁর রূপের প্রভায়,
সুুন্দর আর সুন্দর তাঁর স্বভাব-চরিত্র তামাম
পড়ো তাঁর ও তাঁর বংশের ‘পরে দরূদ-সালাম।
‘গুলিস্তান’-এর ভূমিকায় বিধৃত এই পঙ্ক্তিমালা শত শত বছর ধরে মুসলিম সমাজের ধর্মীয় মাহফিলগুলোতে রাসূলে পাকের আশেকগণ ভক্তি ও শ্রদ্ধায় অবনত কণ্ঠে সমস্বরে পাঠ করে অনাবিল তৃপ্তি ও নির্মল আনন্দ পান।
বাংলায় আমরা বলি সৎসঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎসঙ্গে সর্বনাশ। মাওলানা রূমী (রহ.) বলেছেন,
‘সোহবতে সা’লেহ্ তোরা’ সা’লেহ কুনাদ
সোহবতে তা’লেহ্ তোরা’ তা’লেহ কুনাদ।’
সৎলোকের সাহচর্য তোমাকে সৎ বানাবে
মন্দের সাহচর্য তোমাকে হতভাগা করবে।
এই নীতিবাক্যটি বিশ্বের প্রত্যেক জাতির নিজস্ব ভাষায় থাকতে পারে, থাকবে। কিন্তু শেখ সা’দী বিষয়টিকে যেভাবে পেশ করেছেন তার তুলনা বিশ্বসাহিত্যে আছে কিনা আমার জানা নেই। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের একটি কবিতা ছোট বেলায় স্কুল-জীবনে পড়েছিলাম। কবিতাটির কয়েকটি ছত্র সম্ভবত এরূপ ছিল-
একদা স্নান আগারে পশিয়া
হেরিনু মাটির ঢেলা।
হাতে নিয়ে তারে শুকিয়া দেখিনু
রয়েছে সুবাস মেলা।
কহিনু তাহারে কস্তুরি তুমি,
তুমি কি আতর দান?
তোমার গায়েতে সুবাস ভরা
তুমি কি গুলিস্তান।

এই কবিতার আসল রচয়িতা শেখ সা’দী এবং বাংলা ভাষ্যটি এর অনুবাদ। শেখ সা’দী (রহ.)-এর ‘গুলিস্তান’-এর ভূমিকার এই কবিতাটিই সত্যেন বাবু অনুবাদ করেছেন। দেখুন, ফারসি ভাষায় সাড়ে ৭শ’ বছর আগের লেখা শেখ সা’দীর এ কবিতা এখনো কত আধুনিক, প্রাণবন্ত ও রসাত্মক! একে কবিতায় অনুবাদের সাহস আমার নেই। তাই ভাষার অলংকার না হলেও ভাব ও আবেদনের ঐশ্বর্য তুলে ধরার প্রয়াস পাব-
একদা হাম্মামে একটি সুগন্ধ ঢেলা
এক বন্ধুর হাত হয়ে আসল আমার হাতে।
বললাম তাকে, তুমি কি মেশক নাকি আম্বর?
তোমার প্রাণস্পর্শী সুবাসে মাতাল হলো অন্তর?
বলল, আমি ছিলাম অতি তুচ্ছ কাদামাটি
তবে কিছুকাল কাটিয়েছি হয়ে ফুলের সাথি।
আপন সাথির পূর্ণতার গুণে আমি প্রভাবিত
নচেৎ আমি তো সেই মাটি, এখনো পতিত। (গুলিস্তান,ভূমিকা)
কী চমৎকার দৃষ্টান্ত! অপূর্ব অনবদ্য ছন্দোভঙ্গি যদিও ভাষান্তরিত হয়নি, তবুও কবিতার ভাব ঐশ্বর্যে চমৎকারিত্বে হৃদয়গ্রাহীতায় আঁচ করা যায় তার আবেদন কত কালজয়ী!
সত্যিই জীবনকে সুন্দর, সার্থক, সুবাসিত করতে হলে ফুলের মত সুন্দর যাঁদের জীবন তাঁদের সাহচর্য চাই। আল্লাহর অফুরন্ত রহমত বর্ষিত হোক শিরাযের সাদিয়ায় শেখ সা’দীর পবিত্র কবরের ওপর।

ইমাম খোমেইনী (রহ.) : ইসলামি বিপ্লব ও ইসলামি জাগরণ

মূল : তাহের আমেনী গোলেস্তানী

আমাদের আধ্যাত্মিক বিপ্লব স্বল্পকালের মধ্যেই বিশেষজ্ঞগণের মতামতকে অকার্যকর প্রমাণ করে দিল। বস্তুতন্ত্রের নিরিখে তৈরি করা বস্তুবাদীদের অনুসিদ্ধান্তÑ খালি হাতে একটি জাতি কখনও পরাশক্তির মোকাবেলায় দাঁড়াতে পারে নাÑ ভুল হিসেবে প্রমাণিত হলো। তারা প্রশ্ন তুলেছিল বিভিন্ন গ্রামে-গঞ্জে ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োজিত আনাড়ি যুবকদের অথবা শ্রেণিকক্ষে পাঠদানরত শিক্ষকদের পক্ষে একটি সুসংহত রাষ্ট্রশক্তি- যার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সবকিছু, তাকে পরাভূত করা কি আদৌ সম্ভব? তাদের বস্তুতান্ত্রিক এ ধারণাকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে আমাদের আধ্যাত্মিক বিপ্লবের টিকে থাকা। বস্তুবাদী বিশ্লেষকদের সব ধরনের বিশ্লেষণ এখানে হার মেনেছে। তাহলে এখানে কী ঘটেছে? এখানে আধ্যাত্মিক ব্যবস্থাপনা পুরো ঘটনার পেছনে সর্বদা ক্রিয়াশীল ছিল। মহান আল্লাহ নিজের হাতে পুরো ঘটনা সাজিয়ে দিয়েছেন। কোন মানুষের কর্ম-প্রচেষ্টায় এরকম একটি আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব নয়, এরকম একটি অভূতপূর্ব শক্তি গড়ে তোলা সম্ভব নয়। মানবজাতির পক্ষে সম্ভব নয় নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, যুবাÑ একটি দেশের সকল জনগোষ্ঠীকে স্বীয় জীবন উৎসর্গের মন্ত্রে দীক্ষিত করা। এটা ছিল খোদায়ী শক্তির বহিঃপ্রকাশ এবং ঐশী অনুপ্রেরণা, যা জনগোষ্ঠীর সকল স্তরের মানুষের মাঝে ভ্রাতৃত্বের সেতুবন্ধন তৈরি করেছিল, পরস্পরকে ভাইয়ে রূপান্তরিত করেছিল; আর বস্তুবাদী পণ্ডিতদের সকল গবেষণা নিষ্ফল করে দিয়েছিল।১
১৯৭৯ সালে ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর নেতৃত্বে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের বিজয় বিংশ শতাব্দীর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত। সমস্ত দুনিয়া প্রত্যক্ষ করলো ইসলামি বিশ্বে ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর আবির্ভাব এবং তাঁর সর্বাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বে পরিণত হওয়া। তাঁর আবির্ভাব ইরানে ঘটলেও তাঁর ব্যক্তিত্ব তাঁকে বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে এক অনন্য পরিচিতি এনে দেয়। ইসলামের প্রতি তাঁর একনিষ্ঠতা ইরানে ইসলামি বিপ্লবের বিজয়কে দৃঢ় ভিত্তি দান করে যা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশকে অনুপ্রাণিত করে।
ইরানি বিপ্লব (যা ‘ইসলামি বিপ্লব’ অথবা ‘১৯৭৯ বিপ্লব’ নামে খ্যাত) পাহলভী রাজবংশের মুহাম্মাদ রেযা শাহ্কে উৎখাত করার অবিস্মরণীয় ঘটনার সাথে জড়িত। এর মাধ্যমে ইরান আয়াতুল্লাহ ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর নেতৃত্বে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান-এ রূপান্তরিত হয়।২
বিপ্লব-পরবর্তী যুগে প্রচলিত কিছু ধর্মীয় রীতিনীতি আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠে যেগুলোর সাথে রাজনীতির কোনরূপ সম্পর্ক নেই। এই আলোচনাসমূহ ‘মহানবী (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের অনুসরণের স্কুল অব থট’কে বিভিন্নভাবে বিকশিত করেছে।
ইসলামি বিপ্লব জনগণের ক্ষমতার সম্প্রসারণ ঘটায় এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও বিভাগগুলোতে পরিবর্তন এনে মন্দ পরিস্থিতিসমূহ বিদূরিত করে গ্রহণযোগ্য পরিস্থিতি নিশ্চিত করে।
কতিপয় বিশ্লেষক ইসলামি বিপ্লবকে নি¤েœাক্তভাবে বিশ্লেষণ করেনÑ বস্তুত ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর বিপ্লব সফল হওয়ার আগে এ রকম কোন বিপ্লবের নজির বিশ্বে ছিল না। এর আগে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে কিছু সামাজিক বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে যা প্রচলিত কিছু রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছে মাত্র। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ বিপ্লবগুলো দরিদ্রতা অথবা অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে সংঘটিত হয়েছিল। জাতীয়তাবাদী বিপ্লবসমূহও মূলত শাসকের অত্যাচার, নিষ্পেষণ থেকে মুক্ত হবার অদম্য বাসনা থেকে সৃষ্ট প্রতিবাদেরই বহিঃপ্রকাশ ছিল। ইরানের ইসলামি বিপ্লবের নেপথ্যেও এ সকল কারণ ক্রিয়াশীল ছিল, কিন্তু এসব কারণের বাইরেও কিছু কারণ ছিল যা এ বিপ্লবকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। বিপ্লবের এ নতুন ধারণা শুধু অত্যাচারী শাসকের নিপীড়ন থেকে মুক্ত হওয়ার বিষয়ই ছিল না; বরং বিপ্লব প্রচলিত ধর্ম ও বিজ্ঞানের মুখোমুখি সাংঘর্ষিক অবস্থার তত্ত্বেও বিপ্লব ঘটিয়ে দেয় এবং এক্ষেত্রে একটি বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রবর্তন করে।৩
ইরানের ইসলামি বিপ্লব ইসলামের পুনর্জাগরণ ঘটায়। বিভিন্ন উপলক্ষে ইমাম খোমেইনী (রহ.) তাঁর বক্তৃতায় বলেন : “এসত্য কারো কাছে গোপন নয় যে, ইরানে ইসলামি বিপ্লবের মূল উদ্দেশ্য এবং বিপ্লবের বিজয়ের পেছনে যার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি তা হলো স্বয়ং ইসলাম; আর আমাদের ইরানি জাতির জনগণ, হোক সে রাজধানীর বা অন্য কোন শহরের অথবা অখ্যাত কোন গ্রামের অধিবাসী, তাদের আত্মত্যাগ, তাদের রক্ত ও তাদের ‘আল্লাহ আকবার’ ধ্বনি।৪ তাঁরা ইসলামি প্রজাতন্ত্রের দাবি প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং অসংখ্য জনতার উপস্থিতিতে নজিরবিহীন ও অবিস্মরণীয় গণভোটে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের পক্ষে ভোটদান করেছেন এবং ফলে মুসলিম ও অমুসলিম নির্বিশেষে সকল দেশ ইরান নামের ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্র’-কে স্বীকৃতি প্রদান করে।’ উপরিউক্ত কারণসমূহের দ্বারা ইরানে যে সংবিধান পাশ হয় এবং আইন প্রণীত হয় তা শতভাগ ইসলামের উপর ভিত্তি করে রচিত হয়। যদি ছোট একটি অনুচ্ছেদও ইসলামের বিশ্বাসের পরিপন্থি হয় তবে সেটা হবে প্রজাতন্ত্রের এবং দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতার মতের পরিপন্থি।”৫
কিছুসংখ্যক বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞের মত হলো, ইরানের ইসলামি বিপ্লবের ধারা মুসলমানদের মাঝে ইসলামের জাগরণ সৃষ্টি করেছে এবং বিভিন্ন মুসলিম সমাজে তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমাজে ইমাম খোমেইনী (রহ.) রাজনৈতিক ইসলামকে পুনঃপ্রচলন করেন এবং এই ইসলামকে তিনি খাঁটি মুহাম্মাদী ইসলাম হিসেবে রূপায়িত করেন। তিনি ধর্ম এবং রাজনীতির মধ্যে এমনভাবে সমন্বয় করেন যাতে সমাজ এবং রাজনীতির প্রাণশক্তিতে পরিণত হয় ইসলাম। যার ফলে ইরানি জনগণের মাঝে শাহাদাত, মহান আল্লাহর জন্য আত্মত্যাগ এবং শাসকের যুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামের চেতনা উদ্দীপ্ত হয়। ইসলামি বিপ্লব আধুনিক বিশ্বে ইসলামের সম্মান বাড়িয়ে দিয়েছে।

ইসলামি বিপ্লবের বৈশিষ্ট্যাবলি
ইসলামি বিপ্লব ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একটি সমন্বিত বহুমাত্রিক ধারা সৃষ্টি করে। বিপ্লবের ফলে বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি হয় এবং তাদের মাঝে আত্ম-সচেতনতা, আত্মবিশ্বাস ও আস্থাবোধ সর্বোপরি ইসলামি চেতনার উন্মেষের বিকাশ ঘটার ক্ষেত্র তৈরি হয়। এই বিপ্লব বিভিন্ন মুক্তি আন্দোলন ও নব উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মুক্তির আদর্শ, সামাজিক ন্যায়-বিচার, বহিঃশক্তির প্রতিরোধ, রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে টেকসই গতিশীল ব্যবস্থাপনার ব্যবহার করতেও এটি তাগিদ দেয়।

ইসলামি বিপ্লবের কিছু বৈশিষ্ট্য
১. স্বৈরাচার থেকে মুক্তি
২. ঐক্যের শক্তি
৩. আইন ও ন্যায় বিচার
৪. আত্মবিশ্বাস ও নিজের সম্পর্কে উচ্চ ধারণা
৫. স্বকীয় সত্তা (না পূর্ব, না পশ্চিম)
৬. ইসলাম সম্পর্কে বৈশ্বিক ধারণা

অধিকন্তু ইসলামি বিপ্লব এখনও পশ্চিমা শক্তি ও বিভিন্ন অপশক্তির নানামুখি অপপ্রচারের শিকার। শুরু থেকে ইসলামি বিপ্লব পরাশক্তির সাথে আপোস করেনি। ঈমানের বলে বলীয়ান হওয়ায় এই বিপ্লব পরাশক্তির সামরিক শক্তির ভীতিকে মোকাবেলা করতে পেরেছে। ইরান শত্রুর সকল ধরনের চাপের মধ্যে সময় অতিবাহিত করছে। তাই এই বিপ্লবকে মজবুত বিশ্বাসের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে।
এত কিছুর পরও জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের প্রাপ্তি অনেক। ইসলামি দুনিয়ায় বিভিন্ন অংশে সঠিক ইসলামের পুনঃপ্রচলন ও ইসলামি আন্দোলনকে প্রভাবিত করছে এই বিপ্লব। এই বিপ্লব ইমামের আদর্শকে ধারণ করে সমস্ত ধরনের গোষ্ঠীবিদ্বেষ থেকে মুক্ত হয়ে নিঃসন্দেহে বিশ্ব মুসলিমকে জাগ্রত করছে।

Reference:

  1. Sahifeh Noor, vol 7, P-174
  2. Islamic Revolution of Iran, MS Encarta, Archived October 31, 2009
  3. The financial press, vol. 20, no. 387, Regd No. DA 1589
  4. God is Greater than everything and to be described
  5. Sahifeh Noor, vol. 9, P-280

অনুবাদ : সেলিনা পারভীন

স্মরণীয় বাণী

মহানবী (সা.) বলেন : দু’টি কাজের চেয়ে উত্তম কোনো পুণ্যের কাজ নেই : আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এবং আল্লাহর বান্দাদের উপকার করা। আর দু’টি কাজের চেয়ে জঘন্য কোনো কাজ নেই : আল্লাহর প্রতি শিরক করা আর আল্লাহর বান্দাদের ক্ষতি করা।

মহানবী (সা.) বলেন : হে আলী! তিনটি জিনিস রয়েছে যা কোনো ব্যক্তির মধ্যে না থাকলে তার কর্ম সফল হয় না : আত্মসংযংম- যা তাকে মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের অবাধ্যতা থেকে বাঁচায়, বিদ্যা- যা তাকে অজ্ঞতা থেকে রক্ষা করে, আর বুদ্ধিমত্তা- যা দ্বারা সে মানুষের সাথে মানিয়ে চলবে।

রাসূলুল্লাহ্্ (সা.)-এর কাছে আরজ করা হলো : কোন্ সঙ্গীরা উত্তম? তিনি বললেন : যখন তুমি তাকে স্মরণ করবে, তখন তোমাকে সাহায্য করবে; আর যখন ভুলে যাবে তখন তোমাকে স্মরণ করিয়ে দেবে। আরো বলা হলো : নিকৃষ্টতম লোক কারা? তিনি বললেন : জ্ঞানী লোকেরা যখন নষ্ট হয়ে যায়।

মহানবী (সা.) বলেন : মুমিনকে কোন কাঠিন্য, অসুস্থতা ও দুঃখ স্পর্শ করলে তাতে যদি তার সামান্য কষ্টও হয় আল্লাহ সেটির বিনিময়ে তার পাপসমূহ খণ্ডন করেন।

ইমাম আলী (আ.) বলেন : তোমার বন্ধুর সাথে ধীর গতিতে চল (অতি ঘনিষ্ঠ হয়ো না)। হয়তো একদিন সে তোমার শত্রুতে পরিণত হতে পারে। আর তোমার শত্রুর সাথে ধীর গতিতে চল (শত্রুতার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি কর না), হয়তো একদিন সে তোমার বন্ধুতে পরিণত হতে পারে।

ইমাম আলী (আ.) বলেন : ঈমানের সাথে ধৈর্যের সম্পর্ক হলো দেহের সাথে মাথার ন্যায়। যার ধৈর্য নেই তার ঈমান নেই।

ইমাম আলী ইবনুল হোসাইন যায়নুল আবেদীন (আ.) বলেন : যে ব্যক্তি আল্লাহর দেওয়া বরাদ্দে সন্তুষ্ট থাকে সে সবচেয়ে অভাবমুক্ত মানুষ।

ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) বলেন : এমন লোক কত রয়েছে, মানুষ তাকে ভালো বলত, অথচ সে ধোঁকা খেয়েছে। আর এমন লোক কত রয়েছে, আল্লাহ তার গোপন দোষ ঢেকে রাখার কারণে সে অহংকারী হয়েছে। আর এমন লোক কত রয়েছে, আল্লাহর (তাকে অধিক শাস্তির দিকে ধাবিত করার উদ্দেশ্যে) তার প্রতি অনবরত নেয়ামত প্রেরণ করেছেন যা তাকে উদাসীন করেছে।

ইমাম আলী ইবনে মূসা আর-রেযা (আ.) বলেন : প্রত্যেক মানুষের বুদ্ধিই হলো তার বন্ধু আর তার মূর্খতাই তার শত্রু।

ইমাম রেযা (আ.)-কে প্রশ্ন করা হয় : নীচ কে? ইমাম বললেন : যে ব্যক্তির এমন কিছু রয়েছে যা তাকে আল্লাহর (স্মরণ) থেকে বিরত রাখে।

ইমাম রেযা (আ.) বলেন : বদান্যতার অধিকারী ব্যক্তি অন্যদের খাবার থেকে খায় যাতে তারা তার খাবার থেকে খায়। আর কৃপণ অন্যদের খাবার থেকে খায় না যাতে তারা তার খাবার থেকে না খায়।

ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে আলী আত-তাকী (আ.) বলেন : মুমিনের প্রয়োজন আল্লাহর পক্ষ থেকে তৌফিক, নিজের থেকে উপদেশ আর কেউ উপদেশ দিলে তা গ্রহণ করা।

ইমাম তাকী (আ.) বলেন : তওবা বিলম্বিত করা (পিছিয়ে দেওয়া) ধোঁকা খাওয়ার শামিল। কোনো কাজে দ্বিধা করা দিশাহারা অবস্থার পরিচায়ক। আল্লাহর সামনে (নির্দেশ পালনে) বাহানা বের করা ধ্বংসের নামান্তর। আর গোনাহর ওপর পীড়াপীড়ি করা (গোনায় লিপ্ত থাকা) হলো নিজেকে আল্লাহর গোপন পরিকল্পনা (শাস্তি) থেকে নিশ্চিত ভাবা। আর ক্ষতিগ্রস্ত লোকেরা ব্যতীত আল্লাহর গোপন পরিকল্পনা থেকে (আর কেউ) নিশ্চিত হয় না।

মহাকাশ গবেষণা

মহাকাশ গবেষণা একটি বিস্তৃত ক্ষেত্র যার আওতায় বৈজ্ঞানিক, বাণিজ্যিক, শিল্প এবং সামরিক গবেষণা পরিচালিত হয়। ইরানের মহাকাশ গবেষণা কার্যক্রম বেশ কিছু বেসামরিক ও সামরিক প্রকল্প সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে সাফল্যজনক অধ্যায় অতিক্রম করছে। বর্তমানে এ মহাকাশ শিল্প সামনের বছরগুলোতে জ্যামিতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য তৈরি। ইরানে কিছু মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের পর অর্জিত সাফল্য নিয়ে বিদ্যমান নিবন্ধে আলোচনা করা হচ্ছে।

আলবোর্জ মহাকাশ কেন্দ্র
আলবুর্জ মহাকাশ কেন্দ্র ৪২ হেক্টর বিস্তৃত এলাকা নিয়ে ১৯৭২ সালে স্থাপিত হয়। উপগ্রহ ডাটা সরাসরি আহরণের জন্য ইরানে ১৯৭৪ সালে একটি কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং আমেরিকা ও কানাডার সহায়তায় ১৯৭৬ সালে এটি উপগ্রহ তথ্য অনুসন্ধান এবং আহরণ উপযোগী হয়ে উঠে।
ইরানে ইসলামী বিপ্লবের সমসাময়িক সময়ে পূর্ণাঙ্গ তিন সেট ল্যান্ডসেট ইনফরমেশন ইরানের হস্তগত হয়। ইরানে ইসলামী বিপ্লবের সাফল্যের পর যুক্তরাষ্ট্র এ খাতে সহায়তা থেকে হাত গুটিয়ে নেয়।

মাহদাস্ত মহাকাশ কেন্দ্র
চতুর্থ উন্নয়ন পরিকল্পনা গৃহীত হওয়ার পর মাহদাস্ত গবেষণা কেন্দ্রকে নতুন করে উপগ্রহ তথ্য অনুসন্ধান এবং আহরণ উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়। বর্তমানে এ কেন্দ্রে যে সমস্ত উপগ্রহ তথ্য আহরণ কেন্দ্র রয়েছে তা হলো ঞঊজজঅ, গঙউওঝ, ঘঙঅঅ/ঐজচঞ এবং ঋণ২ঈ. এ কেন্দ্রে প্রতিদিন স্যাটেলাইট ইমেজ আহরণ করা হচ্ছে এবং আর্কাইভে সংরক্ষণ করা হচ্ছে।

মহাকাশ গবেষণায় ইরানের কিছু সাফল্য
সিনা-১ স্যাটেলাইট
সর্বপ্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ এবং মহাকাশ যান সিনা-১ স্যাটেলাইট ২০০৫ সালের ২৮ অক্টোবর রাশিয়ার কসমস-৩এম উৎক্ষেপণ কেন্দ্রের মাধ্যমে ইসলামী ইরানের নিজস্ব কক্ষপথে স্থাপন করা হয়। কক্ষপথে এ উপগ্রহ স্থাপনের মাধ্যমে ইরান মহাকাশ গবেষণা ক্লাবের সদস্য হিসেবে পরিগণিত হয়।

সাফির-ই-উমিদ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপক যান
ইসলামী ইরান মহাকাশ গবেষণায় স্বয়ম্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যে সাফির-ই-উমিদ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপক যান তৈরি করে। এ উৎক্ষেপকের মাধ্যমে ৫০ কেজি ওজনের বস্তু খাড়াভাবে ৩০০-৪৫০ কিলোমিটার উর্ধ্বের কক্ষপথে উৎক্ষেপণ সম্ভব।

উমিদ স্যাটেলাইট
স¤পূর্ণ নিজস্ব নকশা এবং যন্ত্রাংশের মাধ্যমে তৈরি ইরানের প্রথম স্যাটেলাইট হলো উমিদ। ইসলামী বিপ্লবের ৩০তম বার্ষিকীর কাছাকাছি সময়ে ২০০৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি এটি কক্ষপথে স্থাপিত হয়। ২৭ কেজি ওজনের এ স্যাটেলাইটটি টেলিযোগাযোগ স্যাটেলাইট যেটি তথ্যাদি টঐঋ ব্যান্ডে রূপান্তরিত করতে সক্ষম। এটি মোট ৫০ দিন কার্যক্ষম ছিল।
রাশাদ স্যাটেলাইট
রাশাদ স্যাটেলাইট ইরানের প্রথম ইমেজিং স্যাটেলাইট যা সাফির বি ক্যারিয়ার রকেটের মাধ্যমে ২০১১ সালের ৬ জুলাই কক্ষপথে স্থাপন করা হয়েছে। ১৫.৩ কেজি ওজনের তিন সপ্তাহের আয়ুস্কালস¤পন্ন এ স্যাটেলাইটটি সোলার প্যানেলের মাধ্যমে শক্তি উৎপাদন করতে এবং ১৫০মিটার রেসুলিউশনের ইমেজ পাঠাতে সক্ষম ছিল।

নাভিদ স্যাটেলাইট
ইরানের তৈরি তৃতীয় স্যাটেলাইট নাভিদ একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি স্যাটেলাইট যা ইরানের বিজ্ঞান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি ১ম স্যাটেলাইট যা ২০১২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি কক্ষপথে স্থাপন করা হয়েছে। এ স্যাটেলাইটের উদ্দেশ্য ছিল ভূপৃষ্ঠের ৭৫০মিটার রেসুলিউশনের একক ব্যান্ডের ইমেজ পাঠানো।

পিশগাম মহাকাশ যান
পিশগাম ইসলামী ইরানের প্রথম মহাকাশ যান যা তিন বছর বয়সী একটি পুরুষ বানরকে নিয়ে নির্দিষ্ট কক্ষপথ পরিভ্রমণ শেষে আবার ভূপৃষ্ঠে প্রত্যাবর্তন করতে সক্ষম হয়। এ মহাকাশ যানে বানরের বেঁচে থাকার উপযোগী পরিবেশ এবং মহাকাশ যাত্রায় ধকল সহ্য করার মতো উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছিল।
অনুবাদ: কৃষিবিদ ড. মো. আলতাফ হোসেন

ইরান পরিচিতি : আহওয়াজ

-এডভোকেট কামাল মাহমুদ
আহওয়াজ দক্ষিণ ইরানের একটি প্রাচীন শহর। এখানে প্রায় ২,৪৩২,৯৬৫ পরিবার বসবাস করে। এ শহর অতীতকাল থেকে বাণিজ্যিক শহর হিসেবে পরিচিত। একই কারণে এখানে বায়ু দূষণও রয়েছে। আহওয়াজ কারুন নদীর তীরে খুজেস্তান প্রদেশে অবস্থিত। এটি খুজেস্তানের সবচেয়ে জনবহুল শহর এবং এর রাজধানী শহরের মর্যাদায় অভিষিক্ত।
উৎপত্তি : اهواز ফারসি শব্দ; দেহ্খোদা অভিধানে এর অর্থ করা হয়েছে ‘সাওক আল-আহওয়াজ’ যার অর্থ আহওয়াজের বাজার বা খুজিস বাজার। এখানে সাওক বলতে বিশ্ববাজার বুঝানো হয়েছে। اهواز বহুবচন, এর একবচন হচ্ছে ‘হাওজ’। অনেক অভিধানে এর অর্থ হিসেবে ‘হুজির জনগণ’ বা ‘হুজিদের ভূমি’ বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। প্রাচীন ফারসিতে একে বলা হতো ঝঁং (সুস) বা ঝঁংরহধ (সুসিনা) যা ইলামী ভাষায় তাদের ধর্মকে বুঝানো হতো। পরবর্তীকালে এর ঝঁং (সুস) এর আদ্যক্ষর ঝ কে ঐ এ রূপান্তর করে ঐঁং (হুজ) নামে ডাকা হতো এবং এ নামই পরবর্তীকালে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে । অন্যমতে আভাজ, আভাজা শব্দের অপভ্রংশ রূপ হচ্ছে আহওয়াজ। দারিয়ুশের সময়কালে এ অঞ্চলের নাম ছিল আভাজ। যা নাকশে রুস্তমে অংকিত আছে। ইতিহাসবিদরা মনে করেন এটি ছিল প্রাচীন তারীয়ানা (ঞধৎুধহধ) শহর এর পার্শ্বে অবস্থিত যেটি ছিল হাখামানেশী সা¤্রাজ্যের একটি আদর্শ শহর। যেখানে গ্রীস সভ্যতার ছোঁয়া লেগেছিল। অহুর মাজদা আরদেশীর খ্রিস্টপূর্ব ২৩০ সালে এ শহরের গোড়াপত্তন করেন। (এনসাইক্লোপিডিয়া অব ইরানিকা-আল মুকাদ্দেসী) আহুর মাজদা এ শহরের নামকরণ করেন যা হুমসার (ঐঁসংধৎ) নামে পরিচিত ছিল। সাসানি সময়কালে প্রচুর খাল-নদী-নালা খনন ও পয়ঃনিষ্কাষণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। যেমন- বান্দে বালা রুদ, বান্দে মিজান, বান্দে র্বোজ্ আয়ার, বান্দে খাক্ প্রভৃতি। হুমসারকে পরবর্তীকালে সুসা নামে ডাকা হতো যা সাসানি রাজধানী হিসেবে পরিগণিত ছিল, তারও পরে সুসা থেকে সুস্তার নামকরণ করা হয়। এখানকার কারুন নদীকে কেন্দ্র গড়ে ওঠে ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল। কাজার সা¤্রাজ্যকালে নাসির উদ্দিন শাহ কাজার এ শহরের নামকরণ করেন নাসেরী।
উনিশ শতকে এ শহরের প্রসার ঘটতে থাকে। প্রায় ১৫০০ থেকে ২০০০ পরিবার এখানে বসবাস করতে আরম্ভ করে। ১৮৮০ সালে কারুন নদীর তীর পর্যন্ত রেল লাইন সম্প্রসারিত হয় এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি অধিকতর ত্বরান্বিত হয়। কারুন নদী ব্যবসায়ের লিংক হিসেবে কাজ করে। সুয়েজ খাল খননের পরে এটির পরিসর আরো বাড়তে থাকে। আহওয়াজের পাশে নদী বন্দর গড়ে ওঠে এবং নাসির উদ্দিন শাহ কাজারের সম্মানার্থে এর নামকরণ করা হয় বন্দরে নাসিরী। বিংশ শতকে আহওয়াজে তেলক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়। এর পর থেকে এ শহর নতুন রূপলাভ করে। ১৮৭৯-১৯২৫ পর্যন্ত এ শহরের শাসনকর্তা ছিলেন হাশমাতুদ দৌলা কাচার। তাঁর সময়ে শহরের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। যিনি ছিলেন গভর্নর শারহাঙ্গ রেজা গোলী খান আরগুন এর সেনাপতি। পরবর্তীকালে কাজল খান বা শেখ কাজল, সরদার আসাদ বখতিয়ারী, আমীর মোজাহেদী বখতিয়ারী প্রমুখ এ অঞ্চল শাসন করেন।
পাহলভী শাসনকালে নেসারী থেকে এ শহর আবার তার পুরোনো নাম আহওয়াজ ফিরে পায়। ১৯২৯ সালে ট্রান্স ইন্ডিয়ান রেল লাইন কারুন নদীর তীর পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। পরবর্তীকালে এখানে আরবসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে বণিকরা এসে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বসবাস করতে আরম্ভ করে এবং নগরীর পরিসর বৃদ্ধি লাভ করতে থাকে। ১৯৮০ সালে ইরাকের তৎকালীন স্বৈরাচারী সাদ্দাম সরকার আহওয়াজে আক্রমণ করে এবং ইরাক-ইরান যুদ্ধ (১৯৮০-১৯৮৮ইং) সংঘটিত হয়। ১৯৮৯ সালে ফুলাদ আহওয়াজ স্টীল কোম্পানি প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং বাণিজ্যের আরো সম্প্রসারণ ঘটে। এ কোম্পানি ইরানের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন খেলায় প্রধান স্পন্সর হিসেবে ভূমিকা পালন করে থাকে।
অবস্থান : আহওয়াজ আবাদান থেকে ১০০ কিমি উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। আহওয়াজ দু’ভাগে বিভক্ত। নতুন আহওয়াজ হচ্ছে প্রশাসনিক কার্যক্রম, ইন্ডাষ্ট্রি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল। অন্যদিকে পুরাতন আহওয়াজ হচ্ছে মূলত: আবাসিক এলাকা।
আবহাওয়া : আহওয়াজের আবহাওয়া সাধারণত শুষ্ক। এখানকার আবহাওয়া গ্রীষ্মকালে প্রচ- উষ্ণ যা বিশ্বের অন্যতম উষ্ণ শহর হিসেবে পরিগণিত। বিশেষত জুলাই-আগস্ট মাসে এর তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায়। আর শীতকালে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসে। তবে ইরানের অন্যান্য অঞ্চলের মতো এখানে বরফ পড়তে দেখা যায় না। গ্রীষ্মকালে এখানে প্রায়শই ধুলাঝড় হয়। এখানকার বার্ষিক বৃষ্টিপাত গড়ে ২৩০ মিমি।
যাতায়াত : আহওয়াজে যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম রেলপথ ও সড়ক পথ। এখানকার রেলব্যবস্থা খুবই উন্নত ও কার্যকরী। এছাড়া মেট্রোরেল ও বিমান পথও রয়েছে। এখানে রয়েছে আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর। যেখান থেকে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটে বিমান চলাচল করে। বিমানসমূহের মধ্যে রয়েছে ইরান এয়ার, কাস্পিয়ান এয়ারলাইন্স, মাহান এয়ার লাইন্স, এয়ার র্টুস ইরান, অসেমান এয়ারলাইন্স প্রভৃতি। দুবাই, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন, জাপান, ভিয়েতনাম সহ অন্যান্য অনেক দেশের বিমান এখানে ওঠানামা করে থাকে। সড়ক পথে তেহরান থেকে ১০ ঘণ্টার দূরত্ব। এখানে অনেকগুলো বাসরুট রয়েছে। যেমন আহওয়াজ-তেহরান, আহওয়াজ-ইসফাহান, আহওয়াজ-শিরাজ, আহওয়াজ-মাশহাদ, আহওয়াজ-র্খোরামাবাদ প্রভৃতি। ৪টি প্রধান বাস টার্মিনাল রয়েছে আহওয়াজে। এছাড়া শহরে চলাচলের জন্য ২৪ ঘণ্টা ট্যাক্সি তো রয়েছেই।
খেলাধুলা : এখানে দুটি বিশাল সরকারি ক্রীড়া কমপ্লেক্স রয়েছে। একটির নাম তাকী স্টেডিয়াম অপরটির নাম গাদীর স্টেডিয়াম। এছাড়া একটি প্রাইভেট স্টেডিয়াম রয়েছে যার নাম ফুলাদ এফসি স্টেডিয়াম। যা ফুলাদ স্টীল কোম্পানির উদ্যোগে নির্মিত। এছাড়া খেলাধুলার জন্য ছোট ছোট ক্রীড়া কমপ্লেক্স, সুইমিং পুল, জিমনেশিয়াম তো রয়েছেই। এখানকার প্রধান খেলা ফুটবল। বিখ্যাত ক্লাবগুলোর মধ্যে রয়েছে ফুলাদ এফসি, ইস্তেকলাল এফসি, খুজেস্তান এফসি, এস্তেকলাল আহওয়াজ এফসি প্রভৃতি। ক্লাবগুলো ইরানের প্রিমিয়ার লীগ, প্রো-লীগ সহ নানা অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে থকে।
কেনাকাটা : কেনাকাটার জন্য এখানে প্রধান মার্কেট হচ্ছে তালেকানী স্ট্রীটের পুরাতন বাজার। এছাড়া চামরান এভিনিউ, যাইতুন এভিনিউ প্রভৃতি। এখানকার আইসক্রীম, কাবাব ও পিজা খুবই বিখ্যাত। এছাড়া কফিশপ, ফাস্টফুডের প্রচুর দোকান রয়েছে। থাকার জন্য নাদেরী হোটেলসহ অনেক আবাসিক হোটেল রয়েছে।
দর্শনীয় স্থান : এখানকার কারুন নদীর তীরবর্তী বিভিন্ন পার্ক পর্যটকদের প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। এছাড়া সুইডিস ইঞ্জিনিয়ারদের দ্বারা নির্মিত প্রায় ৮০ বছরের পুরোনো সাদা ব্রীজ অন্যতম দর্শনীয় স্থান যে ব্রীজ কারুন নদীর এপার-ওপারকে এক করে দিয়েছে।
শিক্ষা : শিক্ষাক্ষেত্রে আহওয়াজের সুনাম রয়েছে। এখানে অনেক স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেমন-আহওয়াজ জুন্দিসাপুর ইউনিভার্সিটি অব মেডিকেল সাইন্স, পেট্রোলিয়াম ইউনিভার্সিটি, শহীদ চামরান ইউনিভার্সিটি অব আহওয়াজ, ইসলামিক আযাদ ইউনিভার্সিটি অব আহওয়াজ প্রভৃতি।
বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ : আহওয়াজ প্রাচীনকাল থেকে অনেক ক্ষণজন্মা ব্যক্তিবর্গের জন্ম দিয়েছে। যেমন ইবনে হাশিম মাজুসী আহওয়াজী (বিজ্ঞানী), আলী ইবনে আব্বাস মাজুসী আহওয়াজী (প্রফেসর), আবু ইয়াকুব ইবনে ইসা (প্রফেসর), হেলাল আহওয়াজী, আবু নাওয়াজ ইবনে আহওয়াজী (কবি), কিয়ানুস আইয়ারী (চলচ্চিত্র নির্মাতা), আহমেদ মাহমুদ, আলী সামখানী, বাবাক রেজা যাদেহ, জালাল কামেলী মোফরাদ, আলী হাশেমী (ইরাক-ইরান যুদ্ধের প্রধান কমান্ডার), মারিয়াম হায়দারী (কবি), রেজা এস্কেন্দারী, মনুচেহর শাহরোখী, রেযা জোযাদেহ (চলচ্চিত্র নির্মাতা) প্রমুখ।
আহওয়াজ ইরানের প্রাচীন শহরসমূহের অন্যতম। আহওয়াজের বাণিজ্যিক ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। ইরানের অন্যতম নদীবন্দর এখানে অবস্থিত। প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত আহওয়াজ নানা চড়াই-উৎরাই পার করে বর্তমান অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। আহওয়াজে নানা দেশের ব্যবসায়ীদের সম্মিলন ঘটেছে সুপ্রাচীনকাল থেকেই। আধুনিক কালে তেলক্ষেত্র আর সাদা ব্রীজ আহওয়াজকে বিশেষভাবে পরিচিত করে তুলেছে । বিজ্ঞান শিক্ষায় আহওয়াজ অন্যান্য অনেক শহর থেকে অগ্রগামী। অতীতের মতোই বর্তমানেও আহওয়াজ এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

বৃষ্টির নামায এবং ইমাম রেযা (আ.)-এর দোয়া কবুল হওয়া

হাকেম নিশাবুরী শাফেয়ী তাঁর ‘ইতিহাস’ গ্রন্থের মধ্যে লিখেছেন, যখন খলিফা মামুন ইমাম রেযা (আ.)-কে স্বীয় যুবরাজ পদে আসীন করেন, ঘটনাক্রমে সে সময়ে ছিল বৃষ্টির মৌসুম। কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছিল না। আর এ ঘটনাই ইমাম রেযা (আ.)-এর আশপাশের ও যুবরাজ পদের বিরোধিতাকারীদের মধ্য থেকে কিছুসংখ্যক লোকের জন্য একটি বাহানা হলো এবং তারা ইমামকে যন্ত্রণার মধ্যে ফেলতে চাইলো। তাদের কথা ছিল : ‘আলী ইবনে মূসা আর-রেযা আমাদের যুবরাজ হয়ে আমাদের থেকে বৃষ্টি ছিনিয়ে নিয়েছেন।’ এসব কথা মামুনের কানেও পৌঁছল। মামুনও তাদের এসব অবান্তর কথাবার্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়লেন। তিনি এক জুমআর দিন ইমাম রেযা (আ.)-কে বললেন : ‘বেশ কিছুদিন বৃষ্টি হচ্ছে না। আপনি যদি দোয়া করেন তাহলে হয়তো বৃষ্টি হতে পারে, এতে খুবই ভালো হতো।’ ইমাম বললেন : ‘দোয়া করব।’ মামুন জিজ্ঞেস করলেন : ‘কখন দোয়া করবেন?’ ইমাম বললেন : “সোমবারে। গতরাত্রে আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) ও আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)-কে স্বপ্নে দেখেছি। রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাকে বললেন : ‘হে আমার সন্তান! সোমবার পর্যন্ত সবুর করো। সোমবারে মরুভূমিতে যাবে এবং বৃষ্টির জন্য দোয়া করবে। আল্লাহ তাঁর আপন করুণায় তাঁর রহমতের বৃষ্টি এ জনগণের ওপরে বর্ষণ করবেন। বৎস আমার! তোমার প্রতি আল্লাহর বিশেষ করুণার নমুনা জনগণের সামনে প্রকাশ করো। তারা জানুক যে, তুমি আল্লাহর কাছে কোন মর্যাদার অধিকারী!”
সোমবার দিন সমাগত হলে ইমাম রেযা (আ.) ও জনগণ মরুভূমির দিকে রওয়ানা হলেন। ইমাম একটি উঁচু টিলার ওপরে দাঁড়ালেন এবং আল্লাহর হাম্দ ও স্তুতি পাঠ করার পর তাঁর দরবারে এভাবে প্রার্থনা করলেন : ‘হে আল্লাহ! প্রতিপালক আমার! তুমি আমাদের আহলে বাইতের সম্মানকে উচ্চকিত করেছ এবং এরা আমাদের প্রতি যেমনটা তুমি নির্দেশ দিয়েছ তেমনই তাওয়াসসুল করেছে, এরা সাবই তোমার করুণা ও অনুগ্রহের প্রতি পথ চেয়ে বসে আছে। কাজেই এদেরকে এক উপকারী, সর্বজনীন এবং ক্ষতিমুক্ত বৃষ্টি দ্বারা পরিতৃপ্ত করো। আর এ বৃষ্টি বর্ষণ শুরু হোক এরা এ ময়দান থেকে নিজ নিজ ঘরে ফিরে যাবার পর থেকে।’
বর্ণনাকারী বলেন : সেই আল্লাহর কসম, যিনি মুহাম্মাদ (সা.)-কে নবী হিসাবে প্রেরণ করেছেন! আলী ইবনে মূসা আর-রেযা’র প্রার্থনার পর অচিরেই বৃষ্টি বহনকারী মেঘমালা আকাশে ভীড় করলো, বজ্র ও বিদ্যুতের চমকানি আকাশকে এমনভাবে পূর্ণ করে দিল যে, লোকেরা অচিরেই বৃষ্টি নামার ভয়ে ঠাঁই খুঁজছিল। ইমাম রেযা (আ.) বললেন : ‘হে লোকসকল! এসব মেঘ তোমাদের প্রাপ্য নয়। এগুলো অন্য অঞ্চলের জন্য।’ এরূপ ঘটনা দশবার ঘটলো এবং ইমাম রেযা (আ.) বললেন : ‘এ মেঘগুলো অমুক অঞ্চলের জন্য।’ একাদশ বারের সময় ইমাম রেযা (আ.) বললেন : ‘হে লোকসকল! মহান আল্লাহ এ মেঘগুলোই তোমাদের জন্য প্রেরণ করেছেন। কাজেই আল্লাহ প্রতি এ নেয়ামত ও করুণার জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করো। তোমরা যতক্ষণ নিজ নিজ ঘরে ফিরে না যাবে ততক্ষণ বৃষ্টি বর্ষিত হবে না। সুতরাং তোমরা নিজ নিজ ঘরে ফিরে যাও। যাতে আল্লাহর রহমত তোমাদের ওপর নাযিল হয়।’
বর্ণনাকারী বলেন : আলী ইবনে মূসা আর-রেযা মিম্বর থেকে নিচে নেমে এলেন এবং গৃহের দিকে রওয়ানা হলেন। লোকজনেরাও তা-ই করলো। যখন লোকেরা তাদের বাড়ি-ঘরে পৌঁছে গেল, মেঘগুলো বৃষ্টি বর্ষণ করতে শুরু করলো এবং গোটা শহর জুড়েই বৃষ্টি হতে লাগলো। জনগণও অতিশয় আবেগাপ্লুত হয়ে ইমাম রেযা (আ.)-এর প্রতি প্রশংসা ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে লাগলো। তারা বলছিল : ‘রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সন্তানের ওপরে আল্লাহর এ কারামাত মোবারক হোক!’ ইমাম রেযা (আ.)ও এই অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে মানুষদেরকে উপদেশ ও নসিহত করলেন। তিনি বললেন : ‘হে লোকসকল! আল্লাহর নেয়ামতসমূহের বিপরীতে তাকওয়া অবলম্বন করো এবং গোনাহের মাধ্যমে এ নেয়ামতকে নিজেদের থেকে দূরে সরিয়ে ফেলো না; বরং আল্লাহর অনুগত এবং নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করার মাধ্যমে নিজেদের নেয়ামতের বৃদ্ধি ঘটাও। জেনে রাখ যে, আল্লাহর প্রতি ঈমানের পরে এবং আল্লাহর আউলিয়া কেরাম ও তাঁর মহান নবী (সা.)-এর আহলে বাইতের অধিকার সম্পর্কে মারেফাত অর্জনের পরে কোন কাজই তোমাদের মুমীনদের মধ্যে দুনিয়াবি কাজে পরস্পর ভাইয়ে ভাইয়ে সহযোগিতা করার চেয়ে শ্রেয়তর নয়। এটা হলো তাদের সেই অতিক্রমস্থল যেখান দিয়ে তারা বেহেশত অভিমুখে অগ্রসর হয়। যারা এরূপ কাজে উদ্যোগী হয় তারা আল্লাহর দরবারে বিশেষ মর্যাদাপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়।’
অতঃপর ইমাম রেযা (আ.) একটি আশ্চর্যজনক ঘটনার বর্ণনা দেন। তিনি বলেন : ‘রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে খবর দেয়া হলো যে, অমুক সাহাবী ধ্বংস হয়েছে। কারণ, সে অমুক গোনাহর কাজ করে।’ রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন : ‘বরং সে নাজাত পেয়েছে এবং আল্লাহ তার পরিণতি শুভ করেছেন, তার সমস্ত গোনাহ মুছে দিয়েছেন এবং তদস্থলে তার পুণ্যের কাজগুলো লিখে দিয়েছেন।’
ঘটনাটি হলো : একদিন সে একটি পথ দিয়ে যাচ্ছিল। এসময়ে এমন একজন মুমীনের সাথে দেখা হলো যার লজ্জাস্থান উন্মুক্ত ছিল। সে লোকটি এমনভাবে তার লজ্জাস্থান ঢেকে দিল যেন ওই মুমীন ব্যক্তিটি বুঝতে না পারে এবং লজ্জায় না পড়ে। কিন্তু পরে ওই মুমীন ব্যক্তি ঘটনা এবং লোকটির নিয়্যত বুঝতে পারলো এবং তার জন্য এরূপে দোয়া করলো : ‘আল্লাহ তোমাকে সর্বোত্তম পুরস্কার দান করুন এবং তোমার হিসাব সহজ ও অনায়াস করে দিন।’
রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন : ‘ওই মুমীন বক্তির দোয়ার কারণে এ লোকটির পরিণাম শুভ হলো।’
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর এ কথা ঐ লোকটির কানে পৌঁছল এবং এ কথার বরকতেই সে তার পাপ কাজ থেকে তওবা করলো এবং পুনরায় সে ওই কাজে লিপ্ত হয়নি। আল্লাহও তার তওবা কবুল করলেন। অবশেষে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নেতৃত্বে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।
ইমাম রেযা (আ.) এ কথাগুলো বললেন এবং প্রস্থান করলেন।
বর্ণনাকারী বলেন : আল্লাহ রেযা (আ.)-এর দোয়াক্রমে দেশে দেশে অশেষ বরকত দান করেছেন।১
এ কারামত ইমাম রেযা (আ.)-এর মহান ব্যক্তিত্বের অংশবিশেষ তুলে ধরে এবং তাঁর ইমামতের জ্ঞানের একটি নমুনা উপস্থাপন করে। আর তার চেয়েও বড় কথা হলো তিনি জনগণের অন্তরসমূহকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র বাণীর প্রতি আকৃষ্ট করতে সক্ষম হলেন।
অনুবাদ : আব্দুল কুদ্দুস বাদশা
১. ফারায়িদুস সামত্বাঈন ফি ফাযায়িলিল মুরতাযা ওয়াল বাতুলি ওয়াস সিবত্বাঈনী ওয়াল আয়িম্মাতি মিন যুররিয়াতিহিম (আ.), খ. ২, পৃ. ২১২-২১৪, হাদীস নং- ৪৯০, তারিখে নিশাবুর থেকে বর্ণিত;

সম্পাদকীয়

৬ জাতি ও ইরানের সমঝোতা : একটি ঐতিহাসিক সঙ্কটের শান্তিপূর্ণ সমাধান
বিশ্বের ছয়টি শক্তিধর দেশ ও ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের মধ্যে জেনেভায় স্বাক্ষরিত সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে একটি ঐতিহাসিক বৈশ্বিক সঙ্কটের শান্তিপূর্ণ সমাধান হয়েছে। যদিও এ সমঝোতা চুক্তি ইরানের মজলিসে শূরায়ে ইসলামী (পার্লামেন্ট) ও অপর পক্ষের দেশসমূহের পার্লামেন্ট কর্তৃক অনুমোদিত হওয়ার পরেই কার্যকর হবে, তবে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ইতিমধ্যেই এটি অনুমোদন করেছে এবং আশা করা যাচ্ছে যে, উভয় পক্ষের পার্লামেন্টসমূহ কর্তৃকও যথারীতি অনুমোদিত হবে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর বিধায় এ সমঝোতা গোটা বিশ্বের উৎসুক দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং সকল মহল এ সমঝোতার সকল দিক নিয়ে জল্পনা-কল্পনা ও পর্যালোচনা করছে। সকলেই জানতে ও বুঝতে চান যে, এ সমঝোতার মাধ্যমে উভয় পক্ষের কে কী কী অর্জন করলো এবং কী কী হারালো।
জেনেভা সমঝোতার প্রেক্ষাপট ও বিষয়বস্তু বিবেচনা করলে যে কারো কাছে সুস্পষ্ট হতে বাধ্য যে, এ সমঝোতায় উভয় পক্ষের জন্যই অনেকগুলো অর্জন রয়েছে এবং কোনো পক্ষকেই কিছু হারাতে হয় নি। তাই এ সমঝোতা সম্পর্কে নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে যে, এতে উভয় পক্ষেরই জয় হয়েছে এবং কোনো পক্ষেরই পরাজয় ঘটে নি। তবে ইরানের অর্জনের পাল্লা অধিকতর ভারী।
এ সমঝোতার ফলে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ওপর আরোপিত নিরাপত্তা পরিষদের নিষেধাজ্ঞা ইতিমধ্যেই তুলে নেয়া হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট ছয় জাতির আরোপিত নিষেধাজ্ঞা সংশ্লিষ্ট পার্লামেন্টসমূহ কর্তৃক চুক্তিটি অনুমোদিত হওয়ার সাথে সাথেই উঠে যাবে। বিনিময়ে ইরানকে তার পারমাণবিক কর্মসূচির ওপরে আট বছরের জন্য কিছুটা সীমাবদ্ধতা মেনে নিতে হবে। তবে এ সময়েও ইরান ছয় হাজারেরও বেশি সেন্ট্রিফিউয্ ব্যবহার করতে পারবেÑ যা তার শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচির গতিধারা অব্যাহত রাখার জন্য যথেষ্ট। শুধু তা-ই নয়, সমঝোতা অনুযায়ী বাইরের দেশসমূহ ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে সব রকমের সহায়তা করতে পারবে। এছাড়া বিদেশে ইরানের যে বিপুল পরিমাণ অর্থ আটক রয়েছে তা ছেড়ে দেয়া হবে এবং ইরানের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাঙ্কিং তৎপরতা ও পুঁজি বিনিয়োগসহ সকল রকম অর্থনৈতিক সম্পর্কের ওপর ইতিপূর্বে আরোপিত নিষেধাজ্ঞাসমূহ উঠে যাবে।
যাঁরা মনে করেন যে, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান স্বীয় পারমাণবিক কর্মসূচির ওপর সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়ে সঠিক কাজ করে নি বা ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদন করা উচিত ছিল, তাঁদেরকে পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিতে হয় যে, ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে ইরানের সর্বপ্রধান করণীয় হচ্ছে যে কোনো পরিস্থিতিতে ও যে কোনো মূল্যে ইসলামী মূল্যবোধের অনুসরণ অব্যাহত রাখা। আর এটা সর্বজনজ্ঞাত যে, পারমাণবিক অস্ত্র হচ্ছে ব্যাপক গণবিধ্বংসী অস্ত্র যার ব্যবহার পুরোপুরি মানবতাবিরোধী। এ কারণেই ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ্ ‘উয্মা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী অনেক আগেই পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদন, সংরক্ষণ ও ব্যবহারকে হারাম বলে ফত্ওয়া দিয়েছেন। তাই ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদনের বিষয়টি কখনোই অন্তর্ভুক্ত ছিল না। অন্যদিকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান স্বীয় প্রতিরক্ষা স্ট্র্যাটেজিকে এমনভাবে বিন্যস্ত করেছে এবং অ-পারমাণবিক অস্ত্রসহ স্বীয় সামরিক প্রস্তুতিকে এতোখানি উন্নত করেছে যে, তার প্রতিরক্ষা নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কোনোই কারণ নেই। এছাড়া জেনেভা সমঝোতায় ইরানের অ-পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদন ও সামরিক প্রস্তুতির ওপর কোনো ধরনের বিধিবিষেধ তো আরোপিত হয়ই নি, অধিকন্তু ইরানের ওপর আরোপিত অস্ত্রনিষেধাজ্ঞা উঠে যাচ্ছে যার ফলে ইরানের পক্ষে বিশ্বের যে কোনো দেশের সাথে অস্ত্র ক্রয়-বিক্রয়সহ যে কোনো ধরনের পারস্পরিক সামরিক সহযোগিতা সম্ভব হবে।
জেনেভা সমঝোতার ফলে আমেরিকাসহ পাশ্চাত্যজগতের একটি বড় অর্জন হচ্ছে এই যে, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান যে, পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদনের চেষ্টা করছে না এ ব্যাপারে তারা মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিক নিশ্চিন্ততা অর্জন করতে পেরেছে। যদিও এ ক্ষেত্রে ইরান কিছুই হারায় নি, কারণ, ইরান কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে চায় নি, কিন্তু তারা এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হতে পারছিল না; জেনেভা সমঝোতার মধ্য দিয়ে তারা এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হলো। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই যে, ইরান তার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই স্বীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির গতিধারা অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়, কিন্তু পাশ্চাত্যজগৎ ইরানের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ইরানে পুঁজি বিনিয়োগ করতে না পারায় তাদের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে অনেক বেশি। জেনেভা সমঝোতার ফলে তাদের আর এ ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে না।
সর্বোপরি, মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের একটি বড় শক্তি হিসেবে ইরানের সাথে বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর বিরোধ নিষ্পত্তির ফলে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের সমস্ত সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের সম্ভাবনা অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে- যা এর আগে আর কখনোই হয় নি। তাই নির্দ্বিধায় বলা চলে যে, ইরান ও ছয় জাতির মধ্যকার জেনেভা সমঝোতা বাস্তবায়িত হলে তা বিশ্বের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ইতিহাসে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।