All posts by pavel

সমঝোতা অনাস্থার দেয়াল ও নিষেধাজ্ঞার অবসান ঘটাবে

– প্রেসিডেন্ট রুহানি
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন ড. হাসান রুহানি বলেন, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প সম্বন্ধে ৬ জাতি ও ইরানের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত সমঝোতা উভয় পক্ষের মধ্যে বিরাজমান অনাস্থার দেয়ালের ইটগুলোকে ধীরে ধীরে তুলে নিতে সক্ষম হবে; আমরা কাউকে এ সুযোগ দেব না যে, মিথ্যাচার, অপবাদ ও অনুচিত বক্তব্যের দ্বারা আমাদের জনগণের আশা-আকাক্সক্ষাকে বিনষ্ট করবে। এ সমঝোতার ফলে সমস্ত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হবে; স্থগিত হবে না।
প্রেসিডেন্ট রুহানি গত ১৪ই জুলাই (২০১৫) ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান টেলিভিশনের মাধ্যমে ইরানী জনগণের উদ্দেশে প্রদত্ত এক ভাষণে এ কথা বলেন।
বার্তা সংস্থা এন্তেখাব-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট রুহানি তাঁর এ ভাষণে বলেন, আমি ঘোষণা করছি যে, কেউ যদি এ সমঝোতার সমালোচনা করতে চান তাহলে আন্তরিকতার সাথে সমালোচনার অধিকার সকলেরই রয়েছে। কিন্তু দেশের জনগণ এ দেশের যে সমুজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রত্যাশা করছে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রত্যাশা করছে এবং দেশের ও মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের শান্তি ও নিরাপত্তার প্রত্যাশা করছে; কেউ যদি মিথ্যাচার, অপবাদ ও অশোভন উক্তির দ্বারা সেসব প্রত্যাশাকে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করে তাহলে আমরা কাউকে তার অনুমতি দেব না। বস্তুত আজকের দিনটি মহান ইরানী জাতির শেষের দিন নয়, বরং শুরুর দিন- নতুন যাত্রা শুরুর দিন, নতুন আনন্দ-উৎসব শুরুর দিন, নতুন আশার সূচনার দিন, আমাদের তরুণ ও যুব সমাজের জন্য উন্নততর ভবিষ্যৎ শুরুর দিন, আমাদের প্রিয় দেশ ইরানের উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে দ্রুততর কর্মতৎপরতা শুরুর দিন।
প্রেসিডেন্ট রুহানি তাঁর এ ভাষণে ৫+১ জাতি ও ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের মধ্যে ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প নিয়ে অনুষ্ঠিত আলোচনা সম্পর্কে জনগণকে বিস্তারিতভাবে অবহিত করেন। ভাষণের শুরুতে তিনি নবী-রাসূলগণ (আ.) ও আল্লাহ্র ওয়ালিগণ (রহ্.), বিশেষ করে হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) ও আহ্লে বাইতের পবিত্র ও নিষ্পাপ ইমামগণের (আ.) প্রতি, আরো বিশেষভাবে সাইয়্যেদুশ শুহাদা হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর প্রতি এবং পারমাণবিক প্রকল্পের খেদমতে নিয়োজিত থাকার কারণে যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাঁদের সহ সকল শহীদের প্রতি দরূদ ও সালাম প্রেরণ করেন। অতঃপর তিনি ইমামে যামান হযরত ইমাম মাহ্দী (আল্লাহ্ তাঁর আত্মপ্রকাশ ত্বরান্বিত করুন)-এর প্রতি সালাম ও অভিনন্দন পেশ করেন।
তিনি বলেন, পবিত্র মাহে রমযান সব সময়ই কল্যাণ, বরকত ও আল্লাহ্ তা‘আলার নৈকট্য হাসিলের মাস; আমি জানতে পেরেছি, এবারের রমযান মাসে অনেক লোকই তাঁদের দো‘আসমূহে এবং লাইলাতুল্ ক্বাদ্রের সম্ভাব্য রাত সমূহে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পক্ষ থেকে পারমাণবিক বিষয়ক আলোচনায় অংশগ্রহণকারী দলের সদস্যদের জন্য এবং তাঁরা যাতে একটি উত্তম ও কল্যাণকর সমঝোতায় উপনীত হতে পারেন সে লক্ষ্যে আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে দো‘আ করেছেন। আর আমি এখন মহান ইরানী জাতির খেদমতে আরয করতে চাই যে, আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে তাঁদের দো‘আ কবুল হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট রুহানি বলেন, আমরা আজ আমাদের দেশের ও আমাদের বিপ্লবের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ক্রান্তিকালের এবং মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের এক গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতির মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছি। আমি বলতে চাই, এ হচ্ছে এমন একটি পরিস্থিতি যে, বিগত বারো বছর ধরে বিভিন্ন শক্তির পক্ষ থেকে অনবরত এক ধরনের দুর্বোধ্যতা ও কাল্পনিক ধারণা তৈরি ও বিশ্ববাসীর মধ্যে প্রচার করা হচ্ছিলÑ যার ফলে বিশ্বজনমত বিভ্রান্ত হচ্ছিল। কিন্তু আজ সে দুর্বোধ্যতা ও বিভ্রান্তির পৃষ্ঠা উল্টানো হয়েছে এবং একটি নতুন পৃষ্ঠা উন্মুক্ত হয়েছে ও তাতে নতুন লেখার সূচনা করা হয়েছে। তিনি বলেন, এ নতুন পৃষ্ঠাটিতে যে লেখার সূচনা হয়েছে তার ভিত্তি হচ্ছে এই যে, বিশ্বের বুকে বিরাজমান সঙ্কট ও অচলাবস্থাসমূহের সমাধানের জন্য সংক্ষিপ্ততর ও কম ব্যয়সাপেক্ষ পথও রয়েছে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট বলেন, ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পের বিষয়টি একদিকে এমন একটি রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে পরিণত হয়েছিল যে, এর ফলে তা জাতিসংঘের ঘোষণাপত্রের সপ্তম অধ্যায়ের আওতায় নিরাপত্তা পরিষদের বেশ ক’টি নিষেধাজ্ঞা বিষয়ক সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হয়েছে। অন্যদিকে এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে বিশ্ব সমাজে ইরান-ভীতি তৈরি হয়েছিল; ধারণা গড়ে উঠেছিল যে, ইরান গণবিধ্বংসী ও পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে।
তিনি বলেন, বিষয়টির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে এই যে, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির দৃষ্টিকোণ থেকে এ বিষয়টি আমাদের দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অন্যদিকে সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি আমাদের জন্য একটি জাতীয় গৌরব ও সম্মানের বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। আর অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে হয় যে, নিষেধাজ্ঞা আরোপকারীরা আমাদের দেশের ওপর যেসব চাপ সৃষ্টি করেছিল তা আমাদের সমাজের জন্য একটি কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। যদিও, ইতিপূর্বেও যেমন উল্লেখ করেছি, এ নিষেধাজ্ঞা কখনোই সফল হয় নি, তবে এতদসত্ত্বেও তা আমাদের জনগণের জীবন যাত্রার ওপর প্রভাব বিস্তার করেছিল।
প্রেসিডেন্ট রুহানি বলেন, আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে, বিশ্বের ছয়টি শক্তির সাথে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ২৩ মাসব্যাপী আলোচনার শেষে আজ আমরা একটি নতুন পয়েন্টে উপনীত হতে পেরেছি। অবশ্য বর্তমান সরকারের জন্য মাহে রমযান সব সময়ই কল্যাণ ও বরকতের মাস এবং ভাগ্য নির্ধারণী মাস ছিল। ইতিপূর্বে দু’বছর আগে ২৫শে রমযান তারিখে বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং ২৬শে রমযান মজলিসে শূরায়ে ইসলামিতে শপথ গ্রহণ করে। আর আজ ২৭শে রমযান সামগ্রিক যৌথ কর্মসূচির লক্ষ্যে বিশ্বের ছয় শক্তির সাথে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট বলেন, পারমাণবিক কর্মসূচি বিষয়ক অচলাবস্থা নিরসনের জন্য আমাদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজন ছিল। রাজনৈতিক দিক থেকে আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রস্তুতি গ্রহণ করার প্রয়োজন ছিল। আমাদের জন্য বিশ্ব জনমতকে এটা জানানোর প্রয়োজন ছিল যে, আলোচনা মানে প্রস্তাব পাঠ করা নয়, বরং আলোচনা মানে হচ্ছে নিতেও হবে, দিতেও হবে। তিনি বলেন, আমরা যে জন্য চেষ্টা করেছি তা হচ্ছে, আলোচনা যেন আমাদের জাতীয় স্বার্থ ও কল্যাণ নিশ্চিত করে, দেয়া ও নেয়ার বিষয়টি যেন ন্যায়সঙ্গতভাবে ও ভারসাম্য সহকারে এগিয়ে যায় এবং আমরা যে লক্ষ্যে উপনীত হতে চেয়েছি তাতে যেন উপনীত হতে পারি। আমরা কারো কাছে দান-ভিক্ষা চাই নি যে, কেউ আমাদেরকে তা বিনা মূল্যে দিয়ে দেবে, আর আমরা তা নিয়ে নেব। আমরা সব সময়ই এ বিষয়টির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছি যে, এ আলোচনায় কোনোরূপ হার-জিত থাকবে না। কারণ, আলোচনা যদি হার-জিতের লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত হয় তাহলে সে আলোচনা থেকে কোনো স্থায়ী সুফল পাওয়া যাবে না। কেবল এমন আলোচনা ও সমঝোতার ফলই টেকসই ও স্থায়ী হতে পারে যা উভয় পক্ষের জন্যই জিত বা লাভ নিয়ে আসবে। আমরা এ বিষয়টি ইতিপূর্বেই আমাদের জনগণের সামনে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছিলাম, আর আমাদের আলোচকগণ তেইশ মাস আগে এর ভিত্তিতেই কাজ শুরু করেন এবং আলোচনায় বসেন।
ড. রুহানি বলেন, আলোচনায় সাফল্যের অধিকারী হওয়ার জন্য অভ্যন্তরীণ ও জাতীয় মতৈক্য থাকা অপরিহার্য। অবশ্য এটা সুস্পষ্ট যে, আমাদের দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং দল ও গ্রুপসমূহ সকলে অভিন্ন চিন্তা ও অভিন্ন মত পোষণ করেন না। তবে সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, আমরা আমাদের দেশের মুক্ত ও গণতান্ত্রিক পরিবেশে জাতীয় স্বার্থ, জাতীয় নিরাপত্তা ও জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে- পারমাণবিক প্রকল্পের বিষয়টি যে তিনটি ক্ষেত্রের সাথেই জড়িত- মতৈক্যে উপনীত হতে সক্ষম হয়েছি। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার দায়িত্বে আসার অনেক আগেই অর্থাৎ বারো বছর আগে আমাদের পারমাণবিক প্রকল্প নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়ার পর প্রথম দিনেই আমাদের মহান রাহ্বারের মতামতের ভিত্তিতে আলোচনার পন্থা নির্ধারণ করা হয়েছিল এবং সেভাবেই আলোচনা চলে আসছিল। আমরা তখন থেকেই কখনো তেহরানে, কখনো আমাদের প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশের রাজধানীগুলোতে এবং কখনো ইউরোপীয় ও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশের রাজধানীতে আলোচনা অনুষ্ঠিত হতে দেখেছি এবং আমরা আলোচনায় অংশগ্রহণ অব্যাহত রাখি। তবে আমাদের জনগণ দু’বছর আগে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাঁদের মতামত ব্যক্ত করেন। ঐ সময় জনগণ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন, আমরা এমন একটি সরকার চাই যে সরকার পারমাণবিক ক্ষেত্রের অর্জন সমূহের ওপর শান্তি সহকারে এবং দেশের ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন তৎপরতা ও জনগণের কল্যাণ সহকারে গুরুত্ব আরোপ করবে। আর বর্তমান সরকার সে পথই বেছে নেয় এবং সে পথে চলতে শুরু করে।
হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন রুহানি বলেন, অবশ্য মহান ইরানী জাতি সব সময়ই একটি ভদ্র জাতি এবং যৌক্তিক পন্থা অনুসরণকারী জাতি। আর আমি যেদিন শপথ গ্রহণ করি আমার দায়িত্ব গ্রহণের সেই প্রথম দিনেই আমি বলেছিলাম, পাশ্চাত্য কেবল তখনি আমাদের সাথে আন্তঃক্রিয়া করতে সক্ষম হবে যদি তারা আমাদেরকে হুমকি প্রদান ও তুচ্ছ করার পন্থা বর্জন করে চলে এবং সম্মান প্রদর্শনের পথ অনুসরণ করতে শুরু করে। আজকে যৌথ পদক্ষেপের লক্ষ্যে যে সামষ্টিক কর্মসূচিতে উপনীত হওয়া সম্ভব হয়েছে তার মূল কারণ হচ্ছে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পক্ষ থেকে আন্তঃক্রিয়া এবং ৫+১ জাতির পক্ষ থেকে ইরানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন; এ দু’টি বিষয় না হলে আমরা আজ এ বিষয়ে কোনো অর্জনের অধিকারী হতে পারতাম না।
প্রেসিডেন্ট রুহানি বলেন, এ আলোচনায় অংশগ্রহণের পিছনে আমাদের চারটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ছিল। আমাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল এই যে, আমরা আমাদের পারমাণবিক সামর্থ্য ও পারমাণবিক প্রযুক্তিকে সংরক্ষণ করব এবং এমনকি পারমাণবিক কর্মতৎপরতাকেও দেশের অভ্যন্তরে অব্যাহত রাখব। আমাদের দ্বিতীয় লক্ষ্য ছিল ভ্রান্ত, অন্যায় ও মানবতাবিরোধী নিষেধাজ্ঞার অবসান ঘটাব। আমাদের তৃতীয় লক্ষ্য ছিল এই যে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক আমাদের দেশের বিরুদ্ধে গৃহীত যেসব প্রস্তাব আমাদের দৃষ্টিতে বেআইনি সেগুলোর কার্যকরিতার অবসান ঘটাব। আর আমাদের চতুর্থ লক্ষ্য ছিল, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প সংক্রান্ত ফাইলটিকে জাতিসংঘের ঘোষণাপত্রের সাত নং অধ্যায়ের আওতা থেকে এবং মূলগতভাবে নিরাপত্তা পরিষদের আওতা থেকে বের করে আনব। আজ যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হলো এবং যৌথ পদক্ষেপের যে সামগ্রিক কর্মসূচি গৃহীত হলো তার ফলে আমাদের এ চারটি লক্ষ্যের সব ক’টিই অর্জিত হয়েছে। অবশ্য আমরা যাতে রেড লাইন অতিক্রম না করেই আমাদের লক্ষ্য সমূহে উপনীত হতে পারি সে জন্য বিগত তেইশ মাস যাবৎ আলোচনা চলাকালে আমাদের দেশের কূটনীতিকগণ, আইনজীবিগণ, অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞগণ এবং সেই সাথে পারমাণবিক বিজ্ঞানিগণ সর্বান্তকরণে তাঁদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন।
ড. রুহানি বলেন, আলোচনার প্রথম দিকের দিনগুলোতে আমাদের প্রতিপক্ষ বলছিল যে, পারমাণবিক সীমাবদ্ধতার মেয়াদে-আজকের সমঝোতায় যার মেয়াদ আট বছর নির্ধারিত হয়েছে- ইরান মাত্র একশ’ সেন্ট্রিফিউজের অধিকারী থাকতে পারবে। অনেক আলোচনার পরে তারা এক হাজার সেন্ট্রিফিউজের ব্যাপারে সম্মত হয়। কিন্তু আমাদের দিক থেকে ব্যাপকভাবে প্রতিরোধের ফলে শেষ পর্যন্ত তারা চার হাজার সেন্ট্রিফিউজের ব্যাপারে সম্মত হয় এবং বলে যে, এর আর পরিবর্তন হবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আজকের সমঝোতায় তা ছয় হাজার সেন্ট্রিফিউজের ওপরে উন্নীত করা হয়েছে- যার মধ্যে পাঁচ হাজারের বেশি সেন্ট্রিফিউজ নাত্বান্জ্ পারমাণবিক প্রকল্পে এবং এক হাজারের বেশি সেন্ট্রিফিউজ ফারদো পারমাণবিক প্রকল্পে থাকবে। এছাড়া নাত্বান্জ্ পারমাণবিক প্রকল্পের সমস্ত সেন্ট্রিফিউজের সমৃদ্ধকরণ অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, এছাড়াও তারা বলছিল যে, আমাদের ওপর আরোপিতব্য সীমাবদ্ধতার মেয়াদ হবে প্রথম ধাপে বিশ বছর এবং এর পরের ধাপে আরো পঁচিশ বছর। পরে তারা বলে যে, এ মেয়াদ হবে যথাক্রমে ২০ বছর ও ১০ বছর। সবশেষে বলে, ২০ বছর এবং এটাই শেষ কথা। কিন্তু আমরা নতি স্বীকার করি নি। সবশেষে, শেষের দিককার দিনগুলোর আলোচনায় তা হ্রাস করে আট বছরে নির্ধারিত হয়।
প্রেসিডেন্ট রুহানি বলেন, গবেষণা ও উন্নয়ন সম্পর্কে তারা বলছিল যে, ইরানের পক্ষে কেবল আইআর-১-এ তা আঞ্জাম দেয়া সম্ভবপর। বস্তুত এ ছিল একটি হাস্যকর ও অর্থহীন কথা। কারণ, এটা তো আমাদের ছিলই এবং এ ক্ষেত্রে গবেষণা ও উন্নয়নের কথাটির কোনো অর্থ ছিল না। পরে তারা বলে যে, আইআর-২-এ। কিন্তু আমরা এ বিষয়ে যে সমঝোতা চেয়েছিলাম আলোচনার শেষ দিনে তা-ই হলো; আমরা চেয়েছিলাম যে, আইর্আ-৮-এ গ্যাস ইনজেক্ট করার কাজ শুরু হবে এবং আমরা তা-ই অর্জন করেছি। তিনি বলেন, তারা আরাক-এর পারমাণবিক প্রকল্প সম্পর্কে বলত, সেখানে পারমাণবিক রিঅ্যাক্টর থাকবে, কিন্তু হেভি ওয়াটার থাকার কোনো মানে হয় না, আর এটাই হচ্ছে চূড়ান্ত রেড লাইন। কিন্তু আজ এমন এক অবস্থায় সমঝোতা হয়েছে যে, যৌথ সমঝোতায় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আরাকের পারমাণবিক রিঅ্যাক্টরে হেভি ওয়াটারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর সমঝোতায় উল্লিখিত সেই বৈশিষ্ট্য সমূহ সহকারেই- সেই হেভি ওয়াটারের প্রকৃতি সহকারেই- এ রিঅ্যাক্টর পূর্ণতা লাভ করবে। আর ফারদো পারমাণবিক প্রকল্প সম্পর্কে তারা বলত, ফারদো (যার মানে ‘আগামী কাল’) নামটি উচ্চারণ করা কঠিন এবং তা শুনতেও আরো বেশি কঠিন, তাই না আপনারা এ নামটি বলবেন, না আমরা এটি শুনব। পরে তারা বলে, ফারদো প্রকল্পে কোনো সেন্ট্রিফিউজ থাকবে না, বরং এটা হবে কেবল একটি গবেষণা কেন্দ্র। পরে তারা বলে, এখানে আইসোটোজি গবেষণার কাজ করা যাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আজকের সমঝোতা অনুযায়ী এতে এক হাজারেরও বেশি সেন্ট্রিফিউজ থাকবে। আর ফারদো প্রকল্পের অংশবিশেষ টেকসই আইসোটোজি সম্পর্কে গবেষণা ও তার উন্নয়নের কাজে ব্যবহৃত হবে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট বলেন, নিষেধাজ্ঞা সম্বন্ধে তারা বলত, কয়েক মাস সময় নেয়া হবে; প্রথমে আমাদের মধ্যে আস্থার সৃষ্টি হতে হবে, এরপর ধীরে ধীরে নিষেধাজ্ঞা স্থগিত করা হবে, পরোপুরি তুলে নেয়া হবে না; আপনারা তুলে নেয়ার কথা বলবেন না। তারা বলল, কয়েক বছর পর আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) যদি ইতিবাচক রিপোর্ট দেয় এবং আমাদের মধ্যে যদি আস্থা সৃষ্টি হয় তাহলে ধাপে ধাপে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হবে। কিন্তু আমি আজ মহান ইরানী জাতির সামনে ঘোষণা করছি যে, প্রতিষ্ঠিত সমঝোতা অনুযায়ী, সমঝোতা কার্যকর হওয়ার দিনেই অস্ত্র নিষেধাজ্ঞাসহ সমস্ত রকমের নিষেধাজ্ঞা, এমনকি মিসাইল নিষেধাজ্ঞাও- ঠিক যা যা নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্তে অন্তর্ভুক্ত আছে তার সবই- উঠে যাবে। আর্থিক, ব্যাঙ্কিং, বীমা সংক্রান্ত, যোগাযোগ ও পরিবহন, পেট্রো-রসায়ন সংক্রান্ত, মূল্যবান ধাতব সংশ্লিষ্ট, এক কথায়, সমস্ত রকমের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি উঠে যাবে, স্থগিত হবে না। এমনকি অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জামাদির ওপর থেকেও নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হবে; অবশ্য এ ক্ষেত্রে পাঁচ বছরের জন্য এক ধরনের সীমাবদ্ধতা থাকবে, এরপর তা পুরোপুরি উঠে যাবে। তিনি উল্লেখ করেন, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধে যেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয় সেগুলো সম্পর্কে তারা বলে, আপনারা তো এগুলো মেনেই চলেন নি, এমতাবস্থায় কীভাবে আমরা এগুলো তুলে নেব? বলল, অন্তত ছয় মাসের জন্য এগুলো কার্যকর করুন। কিন্তু আজকে যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হলো তার ভিত্তিতে আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ একটি নতুন প্রস্তাব পাশের মাধ্যমে ইতিপূর্বে ইরানের বিরুদ্ধে গৃহীত ছয়টি প্রস্তাবের সবগুলোকেই তুলে নেবে। আর ইরানবিষয়ক ফাইল চিরদিনের জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের আওতার বাইরে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তারা বলছিল যে, এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ)-র প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে এবং আইএইএ যদি ইতিবাচক রিপোর্ট দেয় তাহলে এটা করা হবে এবং এ জন্য তারা প্রথমে বিশ বছর পরে করার কথা বলে ও পরে পনর বছর পরে করার কথা বলে। কিন্তু আজ যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হলো তাতে আইএইএ-র রিপোর্টের শর্তারোপ ছাড়াই সমঝোতা কার্যকর হবার দশ বছর পর ইরানবিষয়ক ফাইল পুরোপুরিভাবে নিরাপত্তা পরিষদের আওতার বাইরে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি বলেন, আপনারা হয়তো প্রশ্ন করবেন যে, এ সমঝোতা কি ৫+১ জাতির ওপর আস্থার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কারণ, তা-ই যদি হয়ে থাকে তাহলে দীর্ঘ তেইশ মাস যাবৎ আলোচনা চলার, বিশেষ করে বিগত আঠারো দিন যাবৎ দিন-রাত অবিরত আলোচনার কোনোই প্রয়োজন ছিল না। এ প্রশ্নের জবাবে জানাতে চাই, আমাদের দিক থেকে সমঝোতা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আস্থার বিষয়টি একটি পরীক্ষা। কারণ, এ সমঝোতা যদি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে ও ভালোভাবে বাস্তবায়িত হয় তাহলে ধাপে ধাপে এ সমঝোতার বাস্তবায়ন ধীরে ধীরে অনাস্থার দেয়ালের ইটগুলো তুলে নিতে পারে। কারণ, এটা সুস্পষ্ট যে, যেসব দেশ ইরানের প্রতি অত্যন্ত মন্দ মনোভাব প্রদর্শন করতো ও যেসব দেশ ইরানের প্রতি মন্দ মনোভাব প্রদর্শন না করলেও ভালো মনোভাব প্রদর্শন করে নি তাদের ওপর আস্থা রাখা ছাড়াই আমরা পরিপূর্ণ সতর্কতা সহকারে ও সমঝোতার প্রতি দৃষ্টি রেখে আমাদের কাজকর্মকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব। তিনি বলেন, অবশ্য এ সমঝোতা হচ্ছে একটি দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা। আমরা সমঝোতার এক দিকে কষ্টি পাথর স্থাপন করি, আর তা ছিল ইতিপূর্বে জেনেভায় প্রতিষ্ঠিত সাময়িক সমঝোতা এবং এর ভিত্তিতে আমরা চূড়ান্ত সমঝোতার জন্য পদক্ষেপ নেই। আর আজ সমঝোতার বাস্তবায়নের বিষয়টি দ্বিপাক্ষিক। তারা যদি এ সমঝোতার যথাযথ অনুসরণ করে তাহলে আমরাও সমঝোতার যথাযথ অনুসরণ করব। আর ইরানী জাতি তার ইতিহাসে সব সময়ই যখনই কোনো অঙ্গীকার করেছে ও চুক্তি সম্পাদন করেছে তখন তাতে আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছে। সুতরাং এ চুক্তির ক্ষেত্রেও আমরা আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার পরিচয় দেব, তবে শর্ত হচ্ছে এই যে, আমাদের প্রতিপক্ষকেও এর প্রতি আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার পরিচয় দিতে হবে। তিনি বলেন, অবশ্য এ সমঝোতার কয়েকটি পর্যায় রয়েছে। আজ ছিল এর প্রথম পর্যায় অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট সাতটি দেশের সকলেই সমঝোতার মূল পাঠ (টেক্সট্) ও এর পাঁচটি সংযোজনীর ব্যাপারে মতৈক্যে উপনীত হয়েছে ও তা গ্রহণ করে নিয়েছে। পরবর্তী পর্যায় হচ্ছে, আগামী দিনগুলোতে এ সমঝোতার টেক্সট্ এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবের জন্য যে টেক্সট্ তৈরি করা হবে তা নিরাপত্তা পরিষদে পাশ হতে হবে। এরপর, সংশ্লিষ্ট দেশ সমূহের যেসব পর্যায় রয়েছে সেসব ক্ষেত্রে এ পর্যায় সমূহ অব্যাহত থাকবে। এসব পর্যায় অতিক্রম করার পর যে দিনটি আসবে সে দিনটির নাম হবে সমঝোতার দিন। প্রকৃতপক্ষে আজকের দিনটি ছিল যৌথ বিবৃতির দিন। আর কয়েক দিন পর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ যখন তার প্রস্তাব পাশ করবে সে দিনটি হবে এ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হবার দিন। মোটামুটি দুই মাস পরে আমরা সমঝোতার দিনে উপনীত হব। সমঝোতার দিনটি হবে এমন একটি দিন যে দিনে ইউরোপ ও আমেরিকা তাদের ইরানবিরোধী সকল নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার কথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করবে। তখন থেকে ইরানের পক্ষ থেকে নতুন নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ শুরু হবে- যাতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হবে। সম্ভবত এ সময়টি দুই মাসেরও বেশি হবে। সেই দিনটিই হবে সমঝোতা বাস্তবায়নের দিন অর্থাৎ আগামী কয়েক মাস পর সমঝোতার পূর্ণ বাস্তবায়নের দিন আসবে।
ড. রুহানি বলেন, তবে আজকের দিনটি হচ্ছে বিগত বারো বছরের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। কারণ, বিশ্বের বৃহৎ দেশসমূহ ও শক্তিবর্গ তাদের ইতিহাসে আজকের এ দিনটিতে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক কর্মতৎপরতাকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। অতঃপর বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে আমরা সমঝোতার দিনে উপনীত হব। তিনি বলেন, দীর্ঘ বারো বছর পর বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলো ঘোষণা করেলো যে, তারা পারমাণবিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ও আধুনিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানকে সাহায্য করবে। আজকে হচ্ছে এমন একটি দিন যেদিন বৃহৎ শক্তিবর্গ ঘোষণা করলো যে, ইরানের ওপর আরোপিত সমস্ত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হবে এবং ইরানের সাথে সাধারণ ও স্বাভাবিক সম্পর্ক শুরু হবে। বস্তুত আজ হচ্ছে একটি সমাপ্তির দিন ও একটি শুরুর দিন। আজকের দিন হচ্ছে মহান ইরানী জাতির প্রতি অন্যায় এবং ভ্রান্ত ও অসঙ্গত অপবাদ সমূহের অবসানের দিন এবং বিশ্বে সহযোগিতার ক্ষেত্রে একটি নতুন প্রক্রিয়ার সূচনার দিন। আজকের দিনে যেহেতু আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ওপর একের পর এক আরোপিত নিষেধাজ্ঞার শৃঙ্খল ছিন্ন হতে চলেছে সেহেতু আজকের দিনটিতে কেবল শীরায, ইসফাহান, তাবরীয, খোরাসান, আহ্ওয়ায, তেহরান, কেরমান ও ইরানের অন্যান্য শহরের তথা সমগ্র ইরানের জনগণই আনন্দিত নয়, বরং জর্দান নদীর পশ্চিম তীরের অধিবাসী ফিলিস্তিনি জনগণ, গাযার জনগণ, কুদ্সের জনগণ এবং লেবাননের জনগণও আনন্দিত। কারণ, ফিলিস্তিনগ্রাসী যায়নবাদী সরকার বিগত তেইশ মাস যাবৎ যে অপচেষ্টা চালিয়ে আসছিল তা ব্যর্থ হয়ে গিয়েছে। আজকে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের জনগণও আনন্দিত। কারণ, ইরান পারমাণবিক বোমা বানাতে চায়- এ মর্মে ভিত্তিহীন বাহানা তুলে মধ্যপ্রাচ্যের জনগণের ওপরে বিভিন্নভাবে যুলুম-নির্যাতন করা হয়েছিল এবং চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল; আজ সে বাহানার অবসান ঘটছে।

হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন রুহানি বলেন, ৫+১ জাতির কতক দেশ যদি ঘোষণা করে, আমরা ইরানকে পারমাণবিক বোমা বানানো থেকে বিরত রাখতে সক্ষম হয়েছি তাতে কিছু আসে-যায় না, কারণ, সারা দুনিয়ার মানুষ জানে যে, ইসলামী বিপ্লবের মহান রাহ্বারের ফতওয়া অনুযায়ী পারমাণবিক বোমা তৈরি করা একটি ভ্রান্ত ও মানবতাবিরোধী হারাম কাজ এবং এ কারণে বৃহৎ শক্তিবর্গের সাথে সমঝোতা হোক বা না-ই হোক এবং সমঝোতা হবার পর তা বাস্তবায়ন হোক বা না-ই হোক, কোনো অবস্থায়ই ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান কখনোই পারমাণবিক বোমা তৈরির চেষ্টা করবে না। তাই সকলের উচিত এ সমঝোতার প্রকৃত অর্জন সম্পর্কে কথা বলা, তা হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে আজ একটি নতুন পরিবেশ তৈরি হয়েছেÑ যার ফলে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে ও সমগ্র বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতার সম্প্রসারণ ঘটবে।

এ গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দিবসে উপনীত হবার জন্য যাঁরা ভূমিকা পালন করেন ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. রুহানি তাঁর ভাষণে তাঁদের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। তিনি বিগত বারো বছর যাবৎ বিভিন্ন ধরনের অন্যায় ও ভ্রান্ত চাপের মোকাবিলায় প্রতিরোধের পরিচয় দেয়ার জন্য ইরানী জাতির প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। তিনি মহান রাহ্বারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে গিয়ে বলেন, জাতির পথপ্রদর্শক হিসেবে তিনি সব সময়ই কঠিন পরিস্থিতিতে যথাযথ পথনির্দেশ প্রদান করে জনগণ, দেশ, ইসলামী প্রজাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ও সরকারকে সাহায্য করেছেন এবং এ চলার পথে তিনি তাঁর দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি ও সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ সহকারে স্বীয় স্কন্ধে এক বিরাট ভারী বোঝা বহন করেছেন। প্রেসিডেন্ট রুহানি এ ব্যাপারে সব সময় জনগণ, ইসলামী প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সরকারকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের কারণে মজলিসে শূরায়ে ইসলামী (পার্লামেন্ট), মজলিসের স্পিকার, বিচার বিভাগ এবং দেশের সশস্ত্র বাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনী সমূহের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। সেই সাথে তিনি রাষ্ট্রীয় কল্যাণ নির্ধারণ পরিষদ, নেতা নির্বাচনী বিশেষজ্ঞ পরিষদ, দ্বীনী শিক্ষাকেন্দ্র সমূহের ছাত্র-শিক্ষকগণ, দ্বীনী নেতৃবৃন্দ, বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের ছাত্র-শিক্ষকগণ, ওলামা ও বুদ্ধিজীবিগণ, যুবসমাজ, মহিলাগণ ও সর্বোপরি দেশের সর্ব স্তরের জনগণের প্রতিÑ যাঁরা সব সময়ই স্বীয় দৃঢ়তা সহকারে হাসিমুখে এ ব্যাপারে সরকার ও যথাযথ কর্তৃপক্ষকে সমর্থন করেছেন ও আশার বাণী শুনিয়েছেন, তাঁদের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।
ভাষণের শেষ পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি ইরানী জনগণকে সম্বোধন করে বলেন, মহান ইরানী জনগণ! আজকের দিন হচ্ছে শুরুর দিন- একটি নতুন তৎপরতা শুরু করার দিন, নতুন আনন্দের শুরুর দিন, নতুন আশার শুরুর দিন, আমাদের তরুণ ও যুবসমাজের জন্য উন্নততর ভবিষ্যৎ শুরুর দিন, আমাদের প্রিয় দেশের প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের লক্ষ্যে দ্রুততর কর্মতৎপরতা শুরু করার দিন।
তিনি বলেন, আমি সবশেষে বলতে চাই যে, মধ্যপ্রাচ্যের জাতিসমূহ তথা আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলো যেন ইরানী জাতির অকল্যাণকামীদের ও যায়নবাদী সরকারের অপপ্রচার দ্বারা প্রতারিত না হন। বস্তুত ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের শক্তি সব সময়ই কার্যত আপনাদেরই শক্তি। আমরা মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের নিরাপত্তাকে আমাদের নিজেদের নিরাপত্তা বলে মনে করি। আমরা মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের দেশ সমূহের স্থিতিশীলতাকে আমাদের নিজেদের স্থিতিশীলতা বলে মনে করি। আমাদের দেশের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন আমাদের প্রতিবেশীদের স্বার্থে ব্যবহৃত হবে। ইরান কখনোই গণবিধ্বংসী অস্ত্র হস্তগত করার জন্য চেষ্টা চালায় নি। ইরান কখনোই মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সমূহের ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করে নি এবং কখনো করবে না। আমি মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের দেশ সমূহের উদ্দেশে বলতে চাই, আমাদের ও আপনাদের মধ্যকার সম্পর্ক আজ একটি নতুন সূচনার অধিকারী। আমরা আরো বেশি আন্তরিকতা, আরো বেশি ঘনিষ্ঠতা, আরো বেশি ভ্রাতৃত্ব, অধিকতর ঐক্য এবং সম্পর্কের অধিকতর সম্প্রসারণ চাই।
প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি এই বলে তাঁর ভাষণ শেষ করেন : মহান ইরানী জনগণ! আপনাদের প্রচেষ্টা, কর্মতৎপরতা ও আনন্দের প্রত্যাশা করে এবং সরকারের ওপর আপনাদের আস্থা প্রত্যাশা করে আমরা পারস্পরিক সহযোগিতায় পথের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত সাফল্যের সাথে চলা অব্যাহত রাখব। ওয়াস্-সালামু আলাইকুম ওয়া রাহ্মাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ্।

অনুবাদ : নূর হোসেন মজিদী

ঈদুল ফিতরের খোৎবায় রাহবার সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী

পারমাণবিক সমঝোতায় ইরানী জাতির শক্তিমত্তা প্রমাণিত হয়েছে

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার হযরত আয়াতুল্লাহ্ আল-‘উয্মা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পর্কিত জেনেভা সমঝোতাকে ইরানী জাতির শক্তিমত্তার পরিচায়ক হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, বিশ্বের ছয়টি শক্তিধর দেশ শেষ পর্যন্ত ইরানের জন্য কয়েক হাজার সেন্ট্রিফিউজের ব্যবহার এবং পারমাণবিক প্রযুক্তি নিয়ে ইরানে গবেষণা ও তৎপরতা চালানোর বাস্তবতা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। এটা ইরানী জাতির শক্তিমত্তার পরিচয় ছাড়া আর কিছু নয়।
রাহ্বার গত ১৭ই জুলাই (২০১৫) তেহরানের ঈদগাহ্ মুসাল্লায়ে বোযোর্গে প্রদত্ত ঈদুল ফিত্র-এর খোত্বায় এ কথা বলেন।
রাহবার খোত্বার শুরুতে পবিত্র ঈদুল ফিত্র উপলক্ষে ইরানের জনগণ ও দুনিয়ার সকল মুসলমানের প্রতি শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেন এবং তাকওয়া অবলম্বন, প্রবৃত্তির নিয়ন্ত্রণ ও গুনাহ থেকে দূরে থাকার জন্য নসিহত করেন। তিনি বলেন, এ বছরের রমযান মাস প্রকৃত অর্থেই একটি বরকতময় মাস ছিল। এ মাসে এ জাতির ওপর আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ হতে অফুরান বরকত নাযিল হয়েছেÑ যার নিদর্শন প্রচ- গরমের মধ্যে ও দীর্ঘ দিবসে রোযা রাখা, দেশের সর্বত্র কোরআন মজীদের ব্যাপক চর্চা, হাজার হাজার রোযাদার নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে অসংখ্য দোয়ার মজলিস অনুষ্ঠান, আল্লাহ্র দরবারে প্রত্যেকের হৃদয় নিংড়ানো আকুতি ও দো‘আ-মোনাজাত, আল্লাহর রাস্তায় দান-খায়রাত, ব্যাপক ইফতারের আয়োজন- সৌভাগ্যজনকভাবে কয়েক বছর থেকে মসজিদে, হাটে বাজারে, পাড়ায়-মহল্লায় যার ব্যাপক প্রচলন হয়েছে এবং সর্বশেষ আল-কুদ্স দিবসের বিশাল মিছিল। এগুলোর প্রত্যেকটিই আল্লাহ্র রহমত নাযিল হওয়ার একেকটি নিদর্শন।
ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার বলেন, কুদ্স্ দিবসের আগের রাতে- ২৩শে রমযানে শবে ক্বদরে রাত জেগে ইবাদত, অথচ পরদিন উত্তপ্ত দুপুরে কুদ্স দিবসের মিছিলে অংশগ্রহণ- এগুলোই ইরানী জাতিকে চেনার সঠিক নিদর্শন। তিনি বলেন, ইরানী জাতি একদিকে ইবাদতের মেহরাবে নিজের পরিচয় এভাবেই দেয়, আবার বিশ্বের শক্তিমদমত্তদের মোকাবিলায় মাঠে-ময়দানে সদা উপস্থিত থাকে। ইরানী জাতিকে বিজাতীয়দের বিদ্বেষপ্রসূত দৃষ্টিকোণ থেকে চেনার চেষ্টা করলে হবে না। ইরানী জাতিকে চিনতে হবে তাদের নিজেদের মাধ্যমে, তাদের স্লোগান, তাদের আন্দোলন ও তৎপরতার মাধ্যমে। বস্তুত ইরানী জাতি মাহে রমযানে তার পরিচয়ের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছে। আমরা ইনশাআল্লাহ আজ ঈদের দিনে আল্লাহ পাকের তরফ হতে রমযানে আমাদের আমলসমূহ কবুল হওয়ার প্রতিদান গ্রহণ করব। এর ফলে আমরা নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতিতে সমৃদ্ধ হব।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, ইরানী জাতির স্লোগানসমূহ প্রমাণ করেছে আমাদের নীতি-আদর্শের স্বরূপ কী। আল-কুদ্স দিবসের মিছিলে শুধু তেহরান বা বড় বড় শহরে নয়; বরং ইরানের সর্বত্র জনগণ ‘আমেরিকা মুর্দাবাদ, ইসরাঈল ধ্বংস হোক’ স্লোগানে মুখর ছিল।
প্রথম খোত্বার শেষভাগে রাহবার আল্লাহ্র দরবারে অফুরান রহমত ও মাগফিরাত লাভের জন্য দো‘আ করেন।
ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার দ্বিতীয় খোত্বায় মাহে রমযানে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের ঘটনাপ্রবাহের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, দুঃখজনকভাবে পবিত্র মাহে রমযানে ইয়েমেনে, বাহরাইনে, ফিলিস্তিনে ও সিরিয়ায় মু’মিন মুসলমানদের অনেকেই শত্রুর কালো কুৎসিত জিঘাংসার শিকার হয়ে দিনাতিপাত করেছে। এসব ঘটনার সবগুলোই ইরানী জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, এর মধ্যে একটি বিষয় আমাদের অভ্যন্তরীণ। আর তা হলো পারমাণবিক ইস্যু। এ ব্যাপারে কয়েকটি বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করা জরুরি মনে করছি।
রাহ্বার বলেন, প্রথমে এ দীর্ঘ ও শ্বাসরুদ্ধকর আলোচনার সাথে সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। বিশেষ করে সম্মানিত প্রেসিডেন্ট ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের জন্যÑচুক্তির যে পাঠ তৈরি হয়েছে, তা নিয়মতান্ত্রিক আইনি প্রক্রিয়ায় অনুমোদিত হোক বা না হোকÑসওয়াব ও প্রতিদান সংরক্ষিত আছে। বিষয়টি এই ভাইদেরকেও আমি নিকট থেকে বলেছি। অবশ্য এ খসড়া অনুমোদনের জন্য একটি নিয়মতান্ত্রিক আইনি প্রক্রিয়া আছে। এ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে হবে এবং তা হবে ইন্ শাআল্লাহ্। আমাদের প্রত্যাশা, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাবৃন্দ খুব সতর্কতার সঙ্গে দেশের ও জাতির স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখবেন। তাঁরা আপন জাতির কাছে যা অর্পণ করবেন, তা যেন উন্নত শিরে মহান রাব্বুল ‘আলামীনের কাছেও পেশ করতে পারেন।
রাহ্বার বলেন, এ চুক্তি অনুমোদিত হোক বা না হোক, ইন্ শাআল্লাহ্, এ চুক্তির কোন ধরনের অপব্যবহারের সুযোগ দেয়া হবে না। ইসলামী প্রজাতন্ত্রের মূলনীতিতে কোন আঁচড় দেয়ার অনুমতি কাউকে দেয়া হবে না। দেশের নিরাপত্তার সীমানা ও প্রতিরক্ষার সক্ষমতাগুলো ইন্ শাআল্লাহ্ সংরক্ষিত থাকবে। যদিও জানি যে, দুশমন এ বিষয়টি অত্যধিক গুরুত্বের সাথে দেখছে। তবে ইসলামী প্রজাতন্ত্র তার নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সক্ষমতার হেফাযতে, বিশেষ করে দুশমনদের হুমকিপূর্ণ পরিবেশে, কোন অবস্থাতেই দুশমনের আধিক্যলিপ্সার কাছে আত্মসমর্পণ করবে না।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, এ চুক্তি অনুমোদিত হোক বা না হোক, আমরা এতদঞ্চলে আমাদের বন্ধুদের প্রতি সাহায্য-সমর্থন থেকে পিছপা হব না। ফিলিস্তিনের মযলুম জনগণ, ইয়েমেনের মযলুম জনগণ, সিরিয়ার সরকার ও জনগণ, ইরাকের সরকার ও জনগণ, বাহরাইনের মযলুম জনগণ, লেবানন ও ফিলিস্তিনের সত্যিকার প্রতিরোধযোদ্ধারা- এদের সকলেই আমাদের সাহায্য ও সমর্থনপুষ্ট থাকবে।
তিনি বলেন, এসব আলোচনা এবং যে খসড়া প্রস্তাব তৈরি হয়েছে, তাতে কোন অবস্থাতেই আমেরিকার শক্তিমদমত্ত সরকারের প্রতি আমাদের নীতি-অবস্থানে কোন পরিবর্তন হবে না। যেমনটি ইতিপূর্বে বহুবার উল্লেখ করেছি, বিভিন্ন বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ইস্যুতে আমেরিকার সাথে আমাদের কোন আলোচনা নেই, দ্বিপক্ষীয় বিষয়াদি নিয়েও আমাদের আলোচনা নেই। কখনো কখনো ব্যতিক্রমী বিষয়ে, যেমন এই পারমাণবিক বিষয়ে, কল্যাণ বিবেচনায় আমরা আলোচনা করেছি। আর তা এই প্রথম বার ছিল না; ইতিপূর্বেও কয়েক বার হয়েছে-  যা আমি পূর্বেও সর্বসাধারণের উদ্দেশে দেয়া বক্তব্যগুলোতে উল্লেখ করেছি।
রাহ্বার বলেন, এতদঞ্চলে আমেরিকার নীতির সাথে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের নীতির ব্যবধান ১৮০ ডিগ্রি। আমেরিকানরা হিয্বুল্লাহ্কে এবং লেবাননের প্রতিরোধ আন্দোলনকে- যারা একটি দেশের সবচেয়ে আত্মত্যাগী প্রতিরক্ষা বাহিনীর নমুনা- সন্ত্রাসী বলে অভিযুক্ত করে। এর চেয়ে বড় অবিচার আর কিছু হতে পারে না। এর বিপরীতে তারা যায়নবাদী সন্ত্রাসী, শিশুহত্যাকারী ইসরাইল সরকারকে সর্বপ্রকার সাহায্য-সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের একটি নীতির সাথে কীভাবে আপস করা যায়? কীভাবে আলোচনা করা যায় বা কীভাবে সম্মত হওয়া যায়?
রাহ্বার বলেন, বিগত আলোচনা শেষ হবার পর এই কয়েক দিনে আমেরিকার সম্মানিত কর্তাব্যক্তিরা হুঙ্কার দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। অবশ্য এসব বিষয় নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। তাঁদের অভ্যন্তরীণ সমস্যাই তাঁদেরকে এসব আস্ফালনে বাধ্য করছে। তাঁরা বলছেন, আমরা ইরানকে আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য করেছি, আমরা ইরানের পরমাণু অস্ত্রের পথে প্রতিবন্ধক হয়েছি। কিন্তু আসল ব্যাপার তো অন্যখানে। এ প্রসঙ্গের সাথে আমেরিকা বা অন্য কারো সাথে আলোচনার কোন সম্পর্ক নেই। কারণ, আমরা কোরআন ও ইসলামী শরীয়ার আলোকে পরমাণু অস্ত্রের উৎপাদন, সংরক্ষণ ও ব্যবহারকে হারাম মনে করি, তাই এ ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নেই নি। তাঁরা নিজেরাও জানেন যে, এটাই হলো বাস্তব। এরপরও তাঁরা আস্ফালন করে বলছেন, আমরা ইরানকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেছি। ইরানের আত্মসমর্পণ নিয়ে তাঁরা স্বপ্ন দেখেন মাত্র। ইসলামী বিপ্লবের শুরু থেকে যেসব মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইরানকে বশীভূত করার স্বপ্ন দেখেছেন, তাঁরা হয় মারা গেছেন অথবা ইতিহাসে হারিয়ে গেছেন। আপনারাও তাঁদের মতোই। আপনাদের এ আশা কোনদিনও পূরণ হবে না।
রাহ্বার বলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্টের এ ক’দিনের কথাবার্তায় একটি বিষয় লক্ষণীয় ছিল। তা হলো, আমেরিকার অতীতের ভুলভ্রান্তি সম্পর্কে স্বীকারোক্তি। সাদ্দাম হোসেনকে সাহায্য করার মতো দু’তিনটি ভুলের কথা তিনি স্বীকার করেছেন, কিন্তু কয়েক ডজন ভুলের প্রসঙ্গে কোন কথা বলেন নি। শাহের ২৫ বছরের যুলুমপূর্ণ শাসন, অত্যাচার-নিপীড়ন, হত্যা, অপরাধযজ্ঞ, ইরানী জাতির মর্যাদা ভূলুণ্ঠিতকরণ, ইরানের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক স্বার্থগুলোকে পদদলিতকরণ, সাগর থেকে ইরানের যাত্রীবাহী বিমানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কথা তিনি বলেন নি। আমি উপদেশের সুরে এসব মহারথিকে একটি কথা বলতে চাই, আপনারা ২৮ মোরদাদের* ঘটনা বা ইরানের ৮ বছরের যুদ্ধ ও ইরানের প্রতিরক্ষার লড়াইয়ের ব্যাপারে স্বীকার করছেন যে, ভুল করেছেন। আমি বলতে চাই যে, ঠিক এখনো ইসলামী ইরান এবং অন্যান্য জায়গায় আপনারা একই ধরনের ভুল করছেন। আপনারা যেমন অতীতের ভুলের মুখোশ উন্মোচন করছেন তেমনি পরে অন্যরা এসে আপনাদের ভুলের মুখোশ উন্মোচন করবেন। কাজেই ভুল থেকে বেরিয়ে আসুন এবং বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিন।
রাহবার বলেন, আমি দেশের জনগণের খেদমতে যা আরয করতে চাই, তা হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার সাহায্যে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান শক্তিশালী ও মজবুত এবং দিন দিন আরো শক্তিশালী হচ্ছে। গত দশ-বারো বছর যাবৎ বিশ্বের ৬টি শক্তিশালী দেশ-যারা অর্থনৈতিক সম্পদ ইত্যাদির কারণে বিশ্বের শক্তিধর দেশ হিসেবে পরিগণিত- ইরানের মোকাবিলায় অবস্থান নিয়েছিল, ইরানকে পারমাণবিক প্রযুক্তি থেকে বিরত রাখার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছিল। তাঁরা এ কথা পরিষ্কার ভাষায় আমাদের কর্মকর্তাদের বলেছেন। তাঁরা এখনো সেই আশা পোষণ করছেন। ইরানের সাথে এই দশ-বারো বছরের টানাপড়েন দ্বারা ফল এতটুকু হয়েছে যে, এই ছয় শক্তি ইরানে কয়েক হাজার সেন্ট্রিফিউজের ব্যবহার মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। পারমাণবিক প্রযুক্তি নিয়ে ইরানে গবেষণা ও তৎপরতা চালানোর বাস্তবতা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছে। এটা ইরানী জাতির শক্তিমত্তার পরিচয় ছাড়া আর কিছু নয়। এটা আমাদের জাতির অবিচলতা, আমাদের পরমাণু-শহীদদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আল্লাহ্র রহমত ছাড়া আর কিছু নয়।
ইরানের সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করে দিতে পারার আস্ফালন সম্পর্কে রাহ্বার বলেন, এমন আস্ফালনের জবাব দেয়াটা আমি শোভন মনে করছি না। তবে যাঁরা এ জাতীয় কথা শোনেন তাঁরা অতীতের অভিজ্ঞতা সামনে আনলে ঠিকই জবাব পেয়ে যাবেন। অবশ্য আমরা পরিষ্কার বলতে চাই যে, আমরা কোন যুদ্ধকেই স্বাগত জানাব না। আমরা কোন যুদ্ধে তৎপর হব না, আগে পদক্ষেপ নেব না। তবে যদি যুদ্ধ বেধেই যায়, তো যুদ্ধের ময়দান থেকে যে পরাজয় বরণ করে বেরিয়ে যাবে, সে হচ্ছে সীমালঙ্ঘনকারী ও অপরাধী আমেরিকা।
রাহবার সূরা নাস্র্ তেলাওয়াতের মাধ্যমে তাঁর খোত্বা শেষ করেন।

* ১৯শে আগস্ট ১৯৫৩। শাহের প্রথম বারের মতো দেশ থেকে পলায়নের পর এদিন সিআইএ-র সহযোগিতায় সংঘটিত এক সামরিক অভ্যুত্থানের ফলে শাহের পক্ষে পুনরায় ইরানে ফিরে এসে ক্ষমতা গ্রহণ করা সম্ভব হয়।

ইরানের পার্লামেন্ট কর্তৃক পাসকৃত মানবাধিকার বিষয়ক আইনের বিধানসমূহের সংক্ষিপ্ত সার

ভূমিকা : আইন এমন এক নিরাপত্তা বলবৎকারী বাধ্যতামূলক দলিল যাতে ব্যক্তির অধিকার ও দায়িত্বসমূহ সংজ্ঞায়িত থাকে। অন্য কথায়, মানবসমাজের অধিকার রক্ষার জন্যই আইন তৈরি ও অনুমোদিত হয়ে থাকে। দায়িত্বের কথা উল্লেখ করার অর্থ হলো এ ধরনের অধিকারের ওপর এক প্রকার গুরুত্বারোপ যাতে এ সকল অধিকার যতটা সম্ভব কঠোরভাবে প্রতিপালন করা হয়। অল্প কথায় আইন হচ্ছে এমন এক দলিল যা ব্যক্তির বৈধ অধিকার নিশ্চিত করে। স্পষ্টতই ‘বৈধ কর্তৃত্বশালী’র পৃষ্ঠপোষকতায় আইনের অস্তিত্বের অর্থ এ নয় যে, ব্যক্তির অধিকার নিরাপদ হয়েছে- যার বিপরীতে বলা যায় যে, আইনবঞ্চিত সমাজ মানেই অসভ্য সমাজ।

বিভিন্ন শাসনব্যবস্থায় এমন শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অধীনে প্রধানত সর্বস্তরের জনগণের বৈধ অধিকার রক্ষায় গঠিত আইন ও আইন প্রণয়নবিষয়ক বিধি-ব্যবস্থা থাকার পরও কি কারণে মানবাধিকার নামে আরেকটা শাখা চালু করা হল যা তাত্ত্বিক, গবেষক, রাজনীতিক এবং নাগরিকগণের ব্যাপক দৃষ্টি আকর্ষণ করল? এর অর্থ এই যে, আইন ও আইন প্রণয়ন সংস্থা উভয়ই তাদের কর্তব্যের ওপর যথাযথ গুরুত্ব দেয়নি এবং নাগরিকগণের বৈধ অধিকারের প্রতি সরকারি স্বীকৃতি দানের উদ্দেশ্যেই এই নতুন শাখাটির প্রবর্তন করা হয়। নাকি অন্য কোন উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এটা করা হয়েছে যা বিবেচনায় আনতে হবে?
যেসব কারণে মানবাধিকার নীতি ও ধারণাসমূহের উদ্ভব ঘটেছে সেগুলো যাচাই করতে হলে প্রয়োজন অধিকতর ব্যাপক ও গভীর বিশ্লেষণ। মানবাধিকারের সপক্ষে বিভিন্ন তত্ত্বগত ও আদর্শগত যুক্তি যা-ই থাকুক না কেন, এ বিষয়ের অধীনে উত্থাপিত প্রশ্নগুলো থেকে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না যে, এটি সেই সব মূল্যবোধের পক্ষে পুনঃপুন সমর্থন ব্যক্ত করতে চায় যেগুলো অনেকসময় জাতীয় সার্বভৌম সরকার কর্তৃক লঙ্ঘিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এভাবেই দেখা যায় অধিকতর সার্বভৌম সরকারসমূহ হঠকারিতা ও স্বৈরশাসন থেকে দূরে থেকেছে এবং গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ব্যবস্থার অধীনে শাসনকার্য পরিচালনা করতে গিয়ে তারা ‘মানবাধিকার মানদ-সমূহ’ শিরোনামের অধীন মূল্যবোধগুলোর প্রতি অধিকতর সম্মান প্রদর্শন করে থাকে।
হঠকারি ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অবসান ঘটানোর উদ্দেশ্যে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ব্যবস্থা ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল । প্রজাতান্ত্রিকতার ওপর ভিত্তি করে বিশ্বে বিভিন্ন শাসনব্যবস্থা থাকলেও ইরানের শাসনব্যবস্থা অন্যান্য ব্যবস্থা থেকে সুস্পষ্টভাবে আলাদা। কেননা, এটি ইসলামের মহান ও পূতঃপবিত্র খোদায়ী বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিতÑ যা ধর্মীয় গণতন্ত্রের অধীনে শাসনব্যবস্থার একটা আদর্শ বা নমুনার প্রচলন করেছে। এমন একটা ব্যবস্থার অধীনে মানবাধিকারের সাথে যুক্ত মূল্যবোধসমূহের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধা করা হবে বলে স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশা করা হয়ে থাকে। বিশেষত জাতীয় সার্বভৌম সরকার কর্তৃক। কেননা, পবিত্র ধর্ম ইসলামের মধ্যে রয়েছে এমন সুমহান বিশ্বাসসমূহ যেগুলো মানবাধিকার কর্তৃক গৃহীত মূল্যবোধগুলোর জন্য অধিকতর সম্মান ও মর্যাদা বিবেচনা করে থাকে। শাসনব্যবস্থার প্রজাতান্ত্রিকতার সাথে এমন বিশেষত্ব বা বৈশিষ্ট্য যুক্ত হওয়ার সাথে সাথেই মানবাধিকার মূল্যবোধসমূহের প্রতি এক অসাধারণ শ্রদ্ধাবোধের প্রকাশ ঘটে থাকে।
ফলস্বরূপ, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের আইন প্রণয়ন সংস্থা তথা ইসলামী সংসদের (মজলিস) ভূমিকা মানবাধিকার মানদ-সমূহের রক্ষায় অনেক বেশি উচ্চকিত ও দৃশ্যমান হয়। মানবাধিকারের ওপর এই আইন প্রণয়ন সংস্থা কর্তৃক গৃহীত যেকোন সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে মূলত ধর্মীয় কর্তব্য ও বিশ্বাসের প্রতি এর আনুগত্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। বস্তুত এই সংস্থাটিই এ ব্যাপারে কোন লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দানকালে প্রাসঙ্গিক ধর্মীয় নির্দেশের আইনগত বৈধতা প্রদান করে। এ সত্যটির আলোকে বলা যায়, জনগণের দ্বারা সত্যিকার অর্থে নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে একজন আইন প্রণেতা নির্বাচকম-লীর বৈধ অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষা ও সুনিশ্চিতকরণে তাঁর দায়িত্ব পালন করে থাকেন।
এখানে সংক্ষেপে উল্লিখিত আইন এবং সংসদে পাসকৃত বিধিবিধান এবং তৎসঙ্গে পরীক্ষাধীন অন্যান্য বিষয়ের (বিল ইত্যাদি) সংগ্রহ বা সমাহার অংশত সেই সকল মানবাধিকার মানদ-ের প্রতি আইন প্রণেতাদের সমর্থনের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় যেগুলো কয়েক দশক আগে গৃহিত হয়েছে। ২০০৯ সালের মে মাসে ‘বেসামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার’ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ইরানী সরকারের যোগদানের অনুমতি দিয়ে সংসদে এক আইন অনুমোদিত হয়েছিল। এই আইন বলে বৈশ্বিক স্বাধীনতা, সুবিচার এবং শান্তির ওপর ভিত্তি করে মানবপরিবারের সকল সদস্যের জন্য স্বীকৃত হয় এক সমান ও হস্তান্তর অযোগ্য প্রাকৃতিক এবং আইনগত বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতা, যদিও আইন প্রণয়নের এই ক্ষেত্রটির সূচনা হয় বহু বছর আগে, তথা ১৯২১ সালে। নিচে কতকগুলো দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা হলো যেগুলো এ কথারই সাক্ষ্য দেয় যে, আমাদের দেশ এক সমৃদ্ধ সংস্কৃতি এবং সুমহান ধর্ম দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আধুনিক ধারণা অনুযায়ী মানবাধিকার মানদ-সমূহের সুরক্ষায় অগ্রণী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। অবশ্য, একথা অনস্বীকার্য যে, একটা আদর্শ অবস্থায় পৌঁছতে আরো অনেক দূর যেতে হবে এবং এতে আইন প্রণেতাদের কঠোর পরিশ্রমেরও প্রয়োজন পড়বে।
এ প্রতিবেদনে ৮টি অধ্যায়ে বেশ কিছুসংখ্যক প্রামাণ্য দলিল সন্নিবেশিত হল। এই শ্রেণিকরণের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধান : তৃতীয় অধ্যায় : জাতির অধিকার। বিপ্লবের মহান নেতা এ দলিলটিকে বর্ণনা করেন এভাবে : ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধান ইরানী জাতির দাবি ও আদর্শসমূহের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে গণ্য। এটি ইসলামী ব্যবস্থার বিধিবিধান ও নীতিসমূহের সূত্রবদ্ধকরণে একটা সার্বিক কাঠামোর অধীনে জনগণের জন্য রয়েছে সার্বিক পথনির্দেশ। এ সংবিধানের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্য হলো যে, এটি বিরাজমান পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে চলে এবং বিভিন্ন সমস্যার সমাধান খুঁজে নেয়। এ উদ্দেশ্যে এই সংবিধনে বিশেষজ্ঞগণের প্রাজ্ঞ মতামত গ্রহণের ব্যবহারিক ও বাস্তবসম্মত পন্থারও প্রচলন করেছে। আশা করা যায়, এ প্রতিবেদনটি পবিত্র ইসলাম ধর্ম ও সংবিধানের কাঠামোর ভিতর মানবাধিকার মানদ-সমূহের সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় আইনের ক্ষেত্রে সাড়া দেয়ার জন্য একটা যথোপযুক্ত ভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারবে।

১.০ নারী ও পরিবারের অধিকার : ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধানের ২১ নং অনুচ্ছেদ নারীদের অধিকার সুরক্ষার বিষয়টি তুলে ধরে। অবশ্য আরো কিছু অনুচ্ছেদেও প্রাসঙ্গিক অন্যান্য সুরক্ষামূলক বিধিবিধান রয়েছে। সাধারণভাবে সংবিধানের ৩টি অনুচ্ছেদে নারীরাই কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে রয়েছে। এগুলো হলো : অনুচ্ছেদ ২, ২০ ও ২১। আবার একই সাথে পরিবার হচ্ছে আরেকটি বিষয় যা ৪০টি অনুচ্ছেদে উল্লিখিত হয়েছে। যথা : অনুচ্ছেদ ১০, ২১, ৩১ ও ৪৩। অধিকন্তু বেশ কিছু সাধারণ আইনেও নারী অধিকার সুরক্ষায় কিছু কিছু আইন অনুমোদিত হয়েছে। এগুলো নিম্নরূপ :

১.১ পরিবার সুরক্ষা আইন (১৯৬৭ সালের ১৫ জুন অনুমোদিত) : ইসলামী বিপ্লব-পূর্ব আইন হলেও কিছু কিছু সংশোধনীসহ আইনটি আজও প্রয়োগযোগ্য বিবেচিত। এই আইনে তালাক প্রক্রিয়া চলাকালে নারীর সুরক্ষার প্রতি অধিকতর গুরুত্ব প্রদান করে এমন কিছু ধারা সন্নিবেশিত আছে।

১.২ অভিভাবকহীন নারী ও শিশুদের ভরণপোষণ আইন: আইনটি ১৯৮৩ সালে অসমর্থিত হয় এবং পরবর্তীকালে ইরানের সংসদে আরো ব্যাপকভাবে সংশোধিত হয়ে ২০০২ সালের নভেম্বর অনুমোদিত হয় এবং অভিভাবক পরিষদের চূড়ান্ত স্বীকৃতি লাভ করে। ১০টি অনুচ্ছেদ এবং ৮টি নোট সম্বলিত আইনটিতে বিশেষ আর্থিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক এবং সেই সাথে কর্ম-সুরক্ষা ও কর্ম-সহায়তার বিধানসমূহ রয়েছে।

১.৩ বিশেষায়িত চিকিৎসা আবাস কোটা আইন : ১৯৯৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর এই আইনের বিধান অনুযায়ী স্বাস্থ্য, রোগের চিকিৎসা ও চিকিৎসা শিক্ষায় নারীদের জন্য কমপক্ষে ২৫% ভাগ আবাসিক সুবিধা বরাদ্দ করবে। সেই সাথে শিক্ষার অন্যান্য শাখায় এই কোটা হবে ন্যূনতম ৫০% ভাগ।

১.৪ শিশুদের বুকের দুধ খাওয়ানো এবং বুকের দুধ খাওয়ানোকালীন মায়েদের সুরক্ষা আইন : ১৩ মার্চ ১৯৯৬ সালে অনুমোদিত এবং পরবর্তী সংশোধনীসমূহ ১৩ মার্চ ১৯৯৬ ও ২৭ জুন ২০০৭ সালে অনুমোদিত। এই আইনের বিধান অনুযায়ী বুকের দুধ দানকারী মায়েদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হয়েছে বিশেষত কর্মজীবী মায়েরা মাতৃত্বকালীন ছুটিসহ কিছু কিছু বিশেষ সুবিধা ভোগ করে থাকে।

১.৫ সংবাদপত্র আইনের ধারা ও এর সাথে একটি অনুচ্ছেদ ও একটি নোট যুক্তকরণ আইন : ২২ আগস্ট ১৯৯৮ সালে আনুমোদিত। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নারী কিংবা পুরুষ যে-ই হোক, কারো ছবিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে নারীর প্রতি অবমাননাকর এবং অসম্মানজনক আচরণ এবং অবৈধ বা বেআইনি প্রচারণা নিষিদ্ধ করা হয়। এরূপ অপরাধীকে ইসলামী শাস্তি বিধানের ৬৯৮ ধারা মতে উপযুক্ত সাজা দেয়া হবে।

১.৬ নারী ও পরিবার সম্পর্কিত তৎপরতায় সহযোগিতামূলক চুক্তি আইন : ২০০৩ সালের ১৩ মে অনুমোদিত নারী ও পরিবারবিষয়ক তিউনিশীয় মন্ত্রীর আমন্ত্রণে ইরানী প্রেসিডেন্টের মহিলাবিষয়ক উপদেষ্টা এবং সেন্টার ফর উ্যমেন পার্টিসিপেইশন প্রধান কর্তৃক ১৬-২১ এপ্রিল ২০০০ তিউনিশিয়া সফরকালে এ দলিলটি স্বাক্ষরিত হয়। ৮টি বিষয় সম্বলিত দলিলটি পরিবারে ও পরিবার সংশ্লিষ্ট পরিবেশে নারীর তৎপরতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে পারস্পরিক সম্পর্কবিষয়ক একটি দলিল।

১.৭ অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নারীর অধিকার ও দায়িত্ব সুরক্ষা আইন : ৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ সালে অনুমোদিত। এটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে নারীর অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কিত সনদের ওপর ভিত্তি করে আনীত আইনি প্রস্তাব। ২০০৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর প্রস্তাবটি সংসদে পাশ হয়। আইনটি দ্বারা হাই কাউন্সিল অব কালচারাল রেভল্যূশন সরকারকে বাধ্যতামূলকভাবে ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নারীরা যাতে কার্যত তাদের ন্যায্য অধিকার ও দায়িত্ব লাভ করতে পারে সে ব্যাপারে সরকারকে সংবিধানের ২০ ও ২১ ধারার অধীনে এবং সেই সঙ্গে ফরোয়ার্ড-লুকিং ডকুমেন্ট-এর আলোকে সহায়তা দানের দায়িত্ব প্রদান করে।

১.৮ পঙ্গু ও নারীপ্রধান পরিবারসমূহকে স্টেট ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেইশন কর্তৃক ক্রমবর্ধমান হারে পুনর্বাসন ও সুরক্ষাদান আইন : ২০০৮ সালের ২৬ জুন অনুমোদিত। এ আইনের বিধান অনুযায়ী সরকারকে কর্তৃত্ব প্রদান করা হয়েছে যাতে তারা এক লক্ষ পঙ্গু ও ৩০ হাজার নারীপ্রধান পরিবারকে ক্রমান্বয়ে সেবা প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় সেবা কার্যক্রম হাতে নিতে পারে।

১.৯ দেওয়ানি আইন আংশিক সংশোধন আইন : ২০০৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি অনুমোদিত। এই আইন
অনুযায়ী দেওয়ানি আইনের ৯৪৬ এবং ৯৪৮ নং ধারা এমনভাবে সংশোধন করা হয় যাতে স্ত্রী স্থাবর সম্পত্তি ছাড়াও ভবন ও জায়গা জমিসহ অস্থাবর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারে।

[চলবে]
অনুবাদ : মিয়া আবদুল আউয়াল

আমার ইরান ভ্রমণ

সাবিনা সিদ্দিক
(গত সংখ্যার পর)
তেহরানের যামারান যাওয়া খুবই উল্লেখযোগ্য ছিল আমাদের জন্য। এর সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো বিপ্লবের পর এই এলাকার একটি বাড়িতে অবস্থান করেছেন ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেইনী (রহ.)। এছাড়া ইরানের International Institute of Dialogue Among Cultures and Civilizations- এর অবস্থান Jamaran Compound মধ্যেই।
ভ্রমণের মধ্যেই আমরা কখনো বইয়ের দোকান, কখনো বাজার সবই ছুঁয়ে যাচ্ছি একটু করে। আমাদের মধ্যে অনেকেই কখনো বই কিনছি, কখনো পেস্তা, জাফরান বা গজ মিষ্টি যার যা পছন্দ ইরানের ঐতিহ্যবাহী খাবার কিনে নিচ্ছি।
আমি সারাক্ষণ খুঁজছি হস্তশিল্পের দোকান। গাইডদের বার বার মনে করে দিচ্ছি صنايع دستى (সানায়ে দাস্তি) বলে। ওরা হেসে জবাব দিচ্ছে যে, সময় হলেই নিয়ে যাবে।
আমাদের সাথে দু’জন Translator ছিলেন। একজন ইরানী; তাঁর নাম এলহাম। আর একজন কুর্দি, নাম শিরিন। দু’জনই এত মিশুক যে, দু’জনের সাথেই বন্ধুত্ব হয়ে গেল। আর সুযোগ পেয়ে ফারসিতে কথা বলতে থাকলাম। কখনো ফারসি কবিতা-গান, কখনো ইতিহাস। ওরা প্রায়ই বলত, ‘তুমি তো দেখছি ইরানের অনেক কিছু জান।’ এলহামের ঠোঁটের ওপর একটা সুন্দর তিল। আমি ওকে ডাকতাম হাফিজের কবিতার تركى شرازى (তুর্কি সিরাজী) বলে। এভাবে দিন দিন আমাদের বন্ধুত্ব বেড়ে চলল। সন্ধ্যায় গেলাম মিলাদ টাওয়ার বা برج ميلاد (বোর্জে মিলাদ) দেখতে। একে Tehran Tower-ও বলা হয়। ২০০৭ সালে নির্মিত এই টাওয়ারটি Shahrak-e Gharb এবং Gisha district এর মাঝে অবস্থিত। এর উচ্চতা মাটি থেকে অ্যান্টেনা পর্যন্ত ১৪২৭ ফুট। এর একেবারে ওপরে ১০৩৩ ফুটের কাছে রয়েছে ১২তলা। যেখানে Five Star Hotel, Convention Centre, World Trade Center এবং IT Park সত্যি দেখার মতো! ওপর থেকে আলো জ্বলা শহর দেখতে খুবই চমৎকার!
একেবারে ওপর তলায় ট্রেড ফেয়ার চলছিল। আমি ঘুরতে ঘুরতে দেখি একটি ছোট দোকানে সারি সারি সাজানো আংটি। প্রতিটিতে সুন্দর সুন্দর কবিতা লেখা। গাইড বলল, ‘এগুলো নিও না, এখানে অনেক দাম।’ আমি একটা আংটি তুলে দেখলাম। খুব সুন্দর। কবিতাটা ক্যালিগ্রাফিতে লেখা, তাই বুঝতে পারছি না। অর্থ জিজ্ঞেস করতেই গাইড বলল, “এখানে লেখা আছে- ‘তুমি পাশে থাকলে আমি দশটা মরুভূমি আনায়াসে পার হয়ে যেতে পারব।” বললাম, ‘যত দাম হোক, এটা আমি নিবই।’
আমার হাজবেন্ডের জন্য আংটিটি স্যুভেনির হিসাবে নিয়ে আমার খুবই ভালো লাগল। এর চেয়ে ভালো বাক্য আর কী হতে পারে যা আমি তাঁকে বলতে পারি? আজ তাঁর সহযোগিতার কারণেই আমি আমার স্বপ্নের ইরানে আসতে পেরেছি- যেটি আমার কাছে দশটি মরুভূমি পার হবার মতোই।
পর পর দু’দিন কাটল আমাদের Lecture, আলোচনা আর মাঝে মাঝে মার্কেট ও বাগানে ঘুরে।Dr. Nafisi-এর Women’s Status and Rights in Quranic Verses and the Prophetic Life Style Traditon, Dr. Moeinifar এর Role and Responsibilities of Women and Family Related Harms এবং Mr. Sodagar এর An Explanation of the Islamic Legal System in the Field of Women Comparative Analysis of Women’s Rights in Islam & the West ও সেই সাথে Women in Religious Epistemology and Legal System-এর ওপর Lecture, আলোচনা-সমালোচনা ও বিভিন্ন মত বিনিময়ের মধ্য দিয়ে।
সারা দিন আমরা সময় পেতাম না। রাতে এত ক্লান্ত থাকতাম যে, বিছানায় শোয়ামাত্রই ঘুম। কিভাবে যে দিনগুলো কাটতে থাকল! এর মধ্যেই হাসি-আনন্দ নিয়ে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইরান, ভারতের সঙ্গী-সাথিরা মিলেমিশে এক হয়ে এক পরিবারের মতোই হয়ে গেলাম। কেউ অসুস্থ হলে তার দেখাশোনা, কেউ খেতে না পারলে তার জন্য অন্য খাবার জোগার করাÑ যেন এই বিদেশ বিভূঁইয়ে পরিবার-পরিজন ছেড়ে আসা মানুষগুলো কেউ নিজেকে একা মনে না করে।
রাতে আমরা পার্কে গেলাম। এত রাতেও পার্কে এত মানুষ! ছেলে-মেয়ে স্বাধীনভাবে ঘুরছে। গাইডকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখানে মেয়েদের নিরাপত্তা কেমন?’ গাইড গর্ব করে বলল, ‘কোন অসুবিধা নেই, যত রাত ইচ্ছা পার্কে থাক, কেউ কিছু বলবে না। মেয়েরা এখানে নিরাপদ। এটা ইরান।’ শুনে খুবই ভালো লাগল।
কবে যে আমরাও এমন গর্ব করে বলতে পারব, ‘মেয়েরা এখানে নিরাপদ, এটা বাংলাদেশ!’
খুবই ইন্টারেস্টিং ছিল গৎং গধফধহর-এর ‘ঞযব ওসঢ়ধপঃ ড়ভ ঃযব গবফরধ ড়হ খরভবংঃুষব রহ এবহবৎধষ ্ ওংষধসরপ’ খবপঃঁৎবটি। আমেরিকার তৈরি কার্টুনগুলো কিভাবে শিশুমনে ওহফরারংঁধষরঃু-কে স্থাপন করে দিচ্ছে অথবা ওংষধসরপ ঐবৎড়-দের কিভাবে তাদের মন থেকে সরিয়ে সেখানে একই গল্প দিয়ে সাধারণ কোন জন্তু বা সেই রকম কোন প্রাণীকে স্থাপন করছে তা সত্যিই সচেতনতামূলক।
গং অষধংাধহফ-এর খবপঃঁৎব-এর বিষয় ছিল অ ঈৎরঃরপধষ জবারবি ধহফ অহধষুংরং ড়ভ ঃযব উড়পঁসবহঃং ধহফ ওহঃবৎহধঃরড়ধষ ঈড়হাবহঃরড়হ ড়হ ডড়সবহ ধহফ ঋবসরহরংস এবং উৎ. তধৎরভধহ বললেন খরভবংঃুষব নিয়ে। আমরা উরহহবৎ-এ গেলাম শহরের মেয়র মি. রেযায়ীর আমন্ত্রণে।
সময় ফুরিয়ে যেতে থাকল। তেহরানে অবস্থানের শেষ দিন চলে এলো। আমি সেই রাতে ঞৎধহংষধঃড়ৎ শিরিনের রুমে ছিলাম। এলহাম একদিনের জন্য জরুরি কাজে ওর বাড়িতে গেছে। শিরিন ওর রুমে একা। আমরা এশার নামায শেষে যে যার রুমে ঘুমাতে যাচ্ছি। হঠাৎ দেয়ালে চোখ পড়ল। এতদিন খেয়ালই করিনি। দেয়ালে একটা ক্যালেন্ডার টাঙ্গানো। ফারসিতে মাস ও দিন লেখা আর ওপরে একটা ছবি। প্রাচীন ধ্বংসস্থাপত্য। ওটা তাখ্তে জামশিদ বা চবৎংবঢ়ড়ষরং স্থাপত্যের নিদর্শন। আমি ওটার সামনে দাঁড়িয়ে ছবিটা দেখতে থাকলাম। কখন যে শিরিন আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে জানি না। ও জিজ্ঞেস করল, ‘কি দেখছ এত মনোযোগ দিয়ে?’ আমি বললাম, ‘এটা তাখ্তে জামশিদ না?’ শিরিন অবাক হয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, তবে এটাও জান তুমি? আশ্চর্য! সত্যি করে বল তো, কে তুমি? ইরানের সবকিছু তুমি জান কিভাবে? বল তুমি কে?’ আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘কাউকে বলবে না, বল?’ শিরিন বলল, ‘না, বলব না।’ বললাম, ‘আমি স¤্রাট দারিয়ুসের মা।’ শিরিন আমাকে হাসতে হাসতে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আরে, আমি তো দারিয়ুসের বোন।’ ‘আচ্ছা তাহলে আমাদের দেখা হয়ে গেল’, বললাম ওকে। তারপর দু’জনে ছবির দিয়ে তাকিয়ে কত স্মৃতিচারণ করলাম! ‘সেই দিনগুলো কত সুন্দর ছিল তাই না শিরিন? যখন তাখ্তে জামশিদে উৎসব হতো!’ ‘হ্যাঁ! কত রকম রান্না হতো। সারা প্রাসাদ সাজানো হতো।’ ‘আর বিভিন্ন দেশ থেকে কত রাজা কত উপহার নিয়ে আসত।’ ‘কী সুন্দর ছিল সেই ইরান!’
আমার মধুর স্মৃতিচারণের মধ্যেই শিরিন বলল, ‘এবার আমার ক্ষিদে পেয়েছে।’
‘তুমি রাতে খাওনি?’
‘না।’
‘কেন?’
‘খেতে ইচ্ছে করছে না। যাই ঘুমাই গিয়ে।’
আমি ওর হাত ধরে ডাইনিং টেবিলের কাছে এনে একটা চেয়ারে বসালাম। ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে আনলাম। তারপর গরম করে প্লেটে এনে বললাম, ‘এবার খাও।’
শিরিন বলল, ‘বিশ্বাস কর, আমি এত ক্লান্ত যে, খাবার চিবিয়ে খাবার শক্তিও নেই।’
‘আমি হাত ধুয়ে এসে বললাম, ‘তাহলে তো তোমাকে খাইয়ে দিতেই হবে।’
শিরিন তো অবাক! ‘আমাকে তুমি খাইয়ে দিবে?’
‘নয়তো কি? তুমি না খেয়ে ঘুমাবে তা কি হয়? বাংলাদেশে আমরা হাত দিয়ে ভাত মেখে খাই।’ এভাবে বলে ভাতের সাথে মাংস ও সালাদ মেখে ওর মুখের সামনে ধরে বললাম, বল, ‘অ’।
শিরিন হেসে ‘অ’ বলতেই মুখ হা হল, আর আমি ওর মুখে ভাত তুলে দিলাম।
শিরিন বলল, ‘এভাবে খাওয়া যায় আমি জানতাম না। দেখ, মাংসটাও কেমন নরম করে দিয়েছ। আশ্চর্য!’
সেই রাতে শিরিন ঘুমালো খুব আনন্দ নিয়ে। আমি খুব শান্তি পেলাম ওর আনন্দ দেখে। পরদিন খুব সকালে ঘুম ভাঙলো না। সাড়ে সাতটায় শিরিনের রুমে গিয়ে দেখি ও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। অথচ প্রতিদিন সকালে সে-ই সবাইকে ঘুম থেকে তুলে সাতটার মধ্যে নাস্তার রুমে নিয়ে আসে। কারণ, সাড়ে আটটায় খবপঃঁৎব ংবংংরড়হ শুরু হয়। একরাত শুধু ওকে খাইয়ে দিয়েছি, ব্যস, ও আদুরে বাঙালি মেয়ে হয়ে গিয়েছে। মনে পড়ল, আমি বাড়িতে আমার ইউনিভার্সিটি পড়–য়া মেয়েকে এখনো খাইয়ে দিই। আর ওকে সকালে ঘুম থেকে ডেকে তুলে দিতে হয়।
‘শিরিন ওঠো, সাড়ে সাতটা বাজে।’ আমার ডাক শুনে শিরিন তাড়াতাড়ি উঠে বসল।
‘কি বল, সাড়ে সাতটা!’ বলে আঁৎকে উঠল ও।
আমরা দু’জন প্রায় ছুটতে ছুটতে ওপরে নাস্তার রুমে এলাম।
চৎবংং ঞঠ-র গৎং ঐধংযবসর-এর খবপঃঁৎব সৌভাগ্যক্রমে সেদিন একটু দেরীতেই শুরু হলো। এরপর উৎ. ঋড়ধফ খুধফর-এর ‘ঞযব অসবৎরপধহ ঈঁষঃঁৎব চড়ষরপরবং রহ ঃযব ডবংঃ অংরধ জবমরড়হ’। হাতে সময় ছিল খুব কম। আমরা ছুটতে ছুটতে অফসরহরংঃৎধঃরড়হ ঐধষষ-এ পৌঁছলাম। ওখনে আমাদের লাঞ্চ হলো। তারপর উৎ. ঝধফৎর-এর জড়ষব ড়ভ ডড়সবহ রহ ঊফঁপধঃরড়হ খবপঃঁৎব-এর পাশাপাশি ঈষড়ংরহম ঈবৎবসড়হু। ড. হেজাজী সত্যিই অভিভূত হয়ে গেলেন যখন আমি তাঁর কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় তাঁকে উপহার দিলাম বাংলাদেশের ঊীঢ়ড়ৎঃ ছঁধষরঃু পোশাক, কোরআন শরীফ- যা একই সাথে বাংলা, ইংরেজি আর আরবিতে লেখা আর সম্প্রতি নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত ৭০তম টঘ অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফলতা ও অর্জনের কিছু ডকুমেন্ট।
সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় নূর ট্রেনে আমাদের মাশহাদ যেতে হবে। আমাদের স্টেশনে পৌঁছতে দেরী হয়ে গেল। যদিও বা আমরা পৌঁছলাম, দেখা গেল আমাদের লাগেজ তখনও এসে পৌঁছায় নি। এলহাম আজই ফিরেছে বাড়ি থেকে।
প্রথমে কথা ছিল এলহাম ও শিরিন আমাদের সাথে মাশহাদ যাবে না। পরে সিদ্ধান্ত হয়েছে ওদের নেয়ার। এতে আমরা সবাই এত খুশি হয়েছি যে, বলার মতো নয়। মাশহাদে কোন পড়াশুনা নয়। শুধু ছুটি, কিন্তু ওরাতো ততদিনে আমাদের কাছে শুধু ট্রান্সলেটর নয়, আমাদের বন্ধু হয়ে গিয়েছে। বন্ধু ছাড়া ছুটিতে কেমন করে মজা করব! তাই শিরিন আর এলহাম শুধু ইরানের অধিবাসী নয়, বাংলাদেশ, ইরান, ভারত আর পাকিস্তান মিলে যে পরিবার সেটার সদস্য।
লাগেজ আসা পর্যন্ত এলহাম, শিরিন ও অন্যান্য গাইড মিলে অনেক অনুনয় বিনয় করে ট্রেনের গার্ডকে বোঝালো যে, আমরা ওৎধহ এড়াবৎহসবহঃ-এর মেহমান। আর সত্যিই কাজ হলো। আমাদের লাগেজ আসা পর্যন্ত প্রায় ১০/১৫ মিনিট ট্রেন অপেক্ষা করল।
ট্রেন ছাড়ল। অতি আধুনিক ট্রেন। মেঝেতে কার্পেট বিছানো। একেকটা রুমে চারজন। সেই সাথে চা, বিস্কুট, বাদাম, কেকসহ প্রচুর খাবার। মাথার ওপরে ঘুমানোর জন্য দু’টি বাংকার। নিচে দু’পাশে দু’জন আর ওপরে দু’জন এভাবে চারজন অনায়াসে ঘুমিয়ে রাত পার করে দিতে পারবে। প্রত্যেকের জন্য আলাদা ব্যাগে কম্বল, বালিশও রয়েছে।
কিন্তু আমার প্ল্যান তো অন্যরকম। ঠিক করেছি রাতে ঘুমাব না। এখন তো ছুটি, প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ করব। ইরানের রাতের প্রতিটা প্রহর, দিনের প্রতিটা ঘণ্টা আমি পলে পলে সাজিয়ে রাখব আমার স্মৃতিতে।
পাশের কম্পার্টমেন্টে গিয়ে বললাম : ‘কে আমার সাথে সারারাত জাগবে?’ এলহাম ছিল সেখানে। সে হাত তুলে বলল : ‘আমি।’
ওর রুমে পাকিস্তান থেকে আসা তাহসিনা ততক্ষণে গান শুরু করে দিয়েছে। ওদের গান গাইতে দিয়ে আমার রুমে এসে ঠিক মাথার ওপরের ছোট্ট আলোটা জ্বালিয়ে বই পড়তে শুরু করলাম। ঔড়হধঃযধহ ইষধপশ-এর ‘ঞযব ঝবপৎবঃ ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ঃযব ডড়ৎষফ’। বলা হয় উধহ ইৎড়হি তাঁর ‘ঞযব খড়ংঃ ঝুসনড়ষ’ এই বই পড়েই লিখেছেন। বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছি, তাই সারাটা সময়ই শাড়ি পড়েছি। আজ পড়েছি লাল পাড়ের সাদা শাড়ি। রাতে একটু শীত পড়ে তাই লাল পাড়ের সাথে মিলিয়ে লাল কোট। ইরানী যাত্রীরা ঘুরে ঘুরে আমার শাড়ি দেখছে। কেউ কেউ অতি আগ্রহে জিজ্ঞেস করছে ازكجاست؟ মানে কোথা থেকে এসেছ? হেসে বলছি, বাংলাদেশ।
আমার জ্বালানো আলোতে আমার সহযাত্রীদের ঘুমের অসুবিধা হতে পারে ভেবে একটা জায়গা খুঁজছিলাম জেগে বই পড়ার বা জানালা দিয়ে অন্ধকারের রূপ দেখার জন্য। আমার ওপরের বাংকারে পাকিস্তানের নাদিন শুয়ে পড়েছে। পাশের বাংকারে ইন্ডিয়ান সহযাত্রী সাবিহা। ওরা সবাই ডিনার সেরে শুয়ে পড়েছে। আমি ধীরে ধীরে উঠে এলাম। আমার সাথে এল আতেনা আর কাভিয়ানী। ওরা এখন থেকে আমাদের সাথে থাকবে। আতেনা সাংবাদিক আর কাভীয়ানী গাইড। কয়েকটা কম্পার্টমেন্ট পার হয়ে আমরা ট্রেনের রেস্টুরেন্টে এসে বসলাম। এত দিনে ১০ ডলার খরচ করে ইরানী সীম কার্ড পেয়ে গেছি। প্রতি মুহূর্তে আমার ভালোলাগা অনুভূতিগুলো ঝগঝ করে হাজবেন্ড ও মেয়ের সাথে শেয়ার করছি।
ট্রেনের রেস্টুরেন্টটা খুব সুন্দর করে সাজানো। আমরা সুন্দর একটা জায়গা নিয়ে বসে পড়লাম। আতেনা একপাশে ইন্টারভিউ নিতে থাকল ভারতের হাশিমীর। আর এদিকে আমি আর কাভিয়ানী বসলাম। আমি টেবিলের ওপর ল্যাপটপ রেখে প্রয়োজনীয় কিছু কাজ সারতে থাকলাম। কাভিয়ানী চা-এর অর্ডার দিয়ে তার ব্যাগ থেকে নানান রকম বাদাম বের করে টেবিলের প্লেটে রেখে আমাকে বলল : ‘খাও।’
জিজ্ঞেস করলাম : ‘তোমরা ইরানীরা সব সময় এমন বাদাম খাও?’
কাভিয়ানী বলল : ‘প্রায় সময়। আমাদের বাড়িতেই বাদামের গাছ আছে। গাছ থেকে নিয়ে যখন ইচ্ছা খাই। ছোট বেলায় আরো মজা হতো।’
বেশ ভালোই সময় কাটতে লাগল। রেস্টুরেন্টে লোকজন কমতে থাকল। তখন মাঝরাত। ট্রেনের হালকা দুলুনি আর ঝকঝকে আলো, অল্প কিছু লোকজনের চলাচল সব মিলিয়ে একটা মায়াবি পরিবেশ।
রাত বাড়ছে ইরানে। নূর ট্রেনের মধ্যে মাশহাদের পথে।
আতেনা এবার আমার কাছে এল ওর ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে। বসল ঠিক আমার সামনে। ওর যত প্রশ্ন সব ইরানের সুপ্রিম লিডার অুধঃড়ষষধয কযড়সবরহর-কে নিয়ে। আমি তাঁর সম্পর্কে জানি কিনা অথবা জানলে কী কী জানি।
সুপ্রিম লিডার। যদিও সুপ্রিম শব্দটি ইরানের সংবিধানে নেই, সেখানে শুধু লিডার বা নেতা বলা আছে। তবু জনগণ অধিক সম্মান দেখানোর জন্য সুপ্রিম শব্দটি ব্যবহার করে। ইরানে সাংবিধানিক সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হচ্ছেন লিডার।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের মহান নেতা অুধঃড়ষষধয ঝধুুরফ জঁযঁষষধয কযড়সবরহর ১ ফেব্রুয়ারী ১৯৭৯ সাল থেকে ৩ জুন ১৯৮৯ সালে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত ইরানের লিডার ছিলেন। তিনি ইরানে ইসলামি বিপ্লব ঘটিয়ে ১৯৭৯ সালে ইরানকে রেযা শাহ পাহলভীর শাসন থেকে মুক্ত করে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে পরিণত করেন এবং এখন পর্যন্ত ইরান ও বিশ্বের অনেক মুসলিম জাতিকে মুগ্ধ করে রেখেছে তাঁর জ্ঞান, খোদাভীতি, আত্মত্যাগ ও অতি সাধারণ জীবন যাপন। তাঁর মৃত্যুর পর বর্তমানে অর্থাৎ ৪ জুন ১৯৮৯ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত লিডার আছেন অুধঃড়ষষধয ঝধুুরফ অষর কযধসবহবর যিনি ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৮৯ সালে ওসধস কযড়সবরহর-এর মৃত্যু পর্যন্ত ইরানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। বিপ্লবী নেতা ওসধস কযড়সবরহর সম্পর্কে আমার অভিমত জানানোর সুযোগ পেয়ে খুব ভালো লাগল।
আমার আর আতেনার কথার মাঝেই জানতে পারলাম যে, রেস্টুরেন্ট বন্ধ হবার সময় হয়ে গেছে।
আমি আর আতেনা কড়িডোরের শেষ মাথায় এসে পৌঁছলাম। এতক্ষণে আতেনার ভিডিও ক্যামেরার কথা মনে পড়েছে। ও আমার দিকে ক্যামেরা তাক করে বলল : ‘কিছু বল।’
আমি وحشى بافر এর কবিতা থেকে আবৃত্তি করলাম,
موستان شرح بریشانی من گوش کنید
داستان غم بنهانی من گوش کنید…
ঙ ভৎরবহফং, যবধৎশবহ ঃড় ঃযব ধপপড়ঁহঃ ড়ভ সু ফবংঃৎঁপঃরড়হ. ঐবধৎশবহ ঃড় ঃযব ঃধষব ড়ভ সু যরফফবহ ংড়ৎৎড়.ি তারপর আমরা হাসতে হাসতে আমাদের বগিতে পৌঁছলাম। দেখি, সেখানে অনেকেই দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছে। এলহাম আর শিরিন ছোট্ট করিডোরে শুধু দাঁড়িয়ে আছে। ওদের চোখভর্তি ঘুম। বললাম : ‘কি, ঘুম পাচ্ছে?’ ওরা দু’জনই মাথা নেড়ে বলল : ‘হ্যাঁ।’
এলহাম আর শিরিন ওদের রুমে চলে গেল ঘুমাতে আর আমি আমার রুমের দরজা লক করে দিলাম। এবার সত্যি অন্ধকার হয়ে এল রুম। রাত আর বেশি বাকি নেই। চোখ বুঁজে ভাবতে থাকলাম। অথচ প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত ইরানে কত যে জ্ঞানী আর সুফি সাধক রয়েছেন তার হিসাব নেই। আশ্চর্য দেশ, আর কি বিশাল এর জ্ঞান ভাণ্ডার!
জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম, একটু একটু করে দিনের আলো ফুটছে, পাহাড়ি পথের পাশ দিয়ে ছুটছে ট্রেন। সূর্যের প্রথম আলোয় সোনার মতো রং ফুটে রয়েছে পাহাড়ের গায়ে। তার মাঝে সারি সারি উইন্ডমিলের চাকা। আমি জানালায় গাল রেখে ক্যামেরায় ধারণ করতে থাকলাম এই অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য। দিনের আলো ভালোভাবে ফুটে ওঠার পর আমরা মাশহাদ পৌঁছলাম। মাশহাদ, ঞযব ঐড়ষু ঈরঃু। এখানে আমাদের মহানবী (সা.)-এর বংশের অষ্টম ইমাম রেযা (আ.)-এর মাযার আছে।
মাশহাদের কালচারাল গেস্ট হাউসে পৌঁছে সবাই যখন রেস্ট নিচ্ছে আমি তখন আমার বিশাল রুমে বসে পরবর্তী একদিনের পুরো প্ল্যান করে ফেললাম। কী কী কিনব তার লিস্ট করলাম। বাংলাদেশ থেকে আনা এরভঃ গুলো কাকে কাকে দেব আর আমার টিকিট, টাকা সব ঠিকমত চেক করে ব্যাগ ভালোভাবে গুছিয়ে ফেললাম যেন পরে আমার সময় নষ্ট না হয়। আমাদের মধ্যে থেকে কেউ কেউ তেহরান ফিরে যাবে তারপর সেখান থেকে তাদের দেশে আর কেউ মাশহাদ থেকে দেশে ফিরবে। আমি মাশহাদ থেকে দুবাই হয়ে একই রুটে বাংলাদেশে ফিরব। আমরা দুপুরে লাঞ্চ সারলাম ঘরেই। বিশাল বিশাল নানরুটি, রাইস, ফিশ আর বেগুন দিয়ে বানানো একটা সব্জি। বিকেলে তৈরি হয়ে নিলাম ইমাম রেযার মাযারে যাবার জন্য। তেহরানের মতো মেয়েদের জন্য স্কার্ফ এখানে যথেষ্ট নয়। ওপরে বড় একটা চাদর পড়তে হবে। আমরা প্রস্তুত হয়ে রওয়ানা হলাম।
এত বিশাল মাযার, এত নিঁখুত তার কারুকাজ! আমরা মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এত শিল্পজ্ঞান সত্যি প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। মাশহাদ শব্দের অর্থ অ ঢ়ষধপব যিবৎব ধ সধৎঃুৎ যধং নববহ নঁৎৎরবফ.
৮১৮ খ্রিস্টাব্দে আব্বাসী খলিফা আল মামুন কর্তৃক ইমাম রেযা (ওসধস অষর ধষ-জরফযধ) নিহত হয়ে শহীদের মর্যাদা পেয়েছিলেন। এখানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। এরপর থেকে এই স্থানকে মাশহাদ বলা হয়। তারপর থেকেই শিয়া সুন্নি সকল মুসলমান এখানে যিয়ারত করতে আসেন।
এখানকার মসজিদে প্রায় ৫ লাখ মানুষের নামাযের ব্যবস্থা রয়েছে এবং একে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় কমপ্লেক্স হিসেবে ধরা হয়। ৬,৪৪৩,৮৯০ ঝয়ভঃ-এর মাযার চত্বরে রয়েছে মিউজিয়াম, লাইব্রেরি, সেমিনার হল, কবরস্থান, ঞযব জধুধার টহরাবৎংরঃু, ডাইনিং হল, বিশাল নামায চত্বর এবং অন্যান্য বিল্ডিং।
এক দফায় এই মাযার দেখা শেষ হবে না। ফিরে আসার সময় সিদ্ধান্ত হলো এখানে ফজরের নামাযের সময় আবার আসব। সেই জন্য গেস্ট হাউস থেকে রওয়ানা দিতে হবে রাত দু’টায়। তাই যারা যেতে চায় তারা যেন রাতে না ঘুমায়। আর ঠিক দু’টার সময় যেন নিচে ওয়েটিং রুমে চলে আসে। সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে আমরা সেই রাতেই শপিং-এ গেলাম আর ফেরার পথে চরুুধ চরুুধ ফাস্ট ফুডের দোকানের দারুন পিৎজা খেলাম।
কোনভাবেই যেন বাদ পড়ে না যাই সেই জন্য দু’টা বাজার ১০ মিনিট আগেই নিচে নেমে পড়লাম। তখনও কেউ আসেনি। আমি সিঁড়িতে একা বসে থাকলাম। ল্যাপটপ খুলে আমার কাজ করতে থাকলাম। একে একে কয়েকজন বাদে অন্যরা এলে সেই গভীর রাতে আমরা আমাদের বাসে চড়ে রওয়ানা দিলাম। সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা! গভীর রাত, তবু মাযার চত্বর লোকজনে ভরা। আমরা গিয়ে বসলাম ঠিক সোনার গেটের সামনে যেটা পার হলেই মাযার। ওপরের বড় গম্বুজটিও সোনার। আলোয় চকচক করছে সোনা আর সেই আলো দ্বিগুণ উজ্জ্বল হয়ে ঠিকরে পড়ছে মেঝেতে। খোলা আকাশের নিচে ঠাণ্ডা বাতাসের মধ্যে আমি, এলহাম আর শিরিন তাহাজ্জুদের নামায আদায় করলাম। অন্যরাও আছে আশে-পাশে।
একটা ধূসর রং-এর কবুতর নির্ভয়ে মেঝের কার্পেটের ওপর হাঁটহাঁটি করছে। ওটা হাঁটতে হাঁটতে আমাদের কাছে চলে এল। শিরিন বলল : “এই পাখিকে এখানে বলে ‘ইয়া কারিম’।”
দেখলাম একজন ভদ্রমহিলা ছোট-ছোট দানাজাতীয় খাবার ওকে খেতে দিলেন নামায শেষে। আর পাখিটিও মনের আনন্দে খেতে থাকল।
ফজরের নামায হলো জামায়াতে। এরপরও আমরা অনেকক্ষণ সেখানে বসে থাকলাম। ভালো লাগছিল, তাই বসে থাকা।
সকাল হলে আমরা প্রশান্ত মনে গেস্ট রুমে ফিরে এলাম। কেউ হয়তো ঘুমালো, কিন্তু আমি গোসল আর নাস্তা সেরে সন্ধ্যার প্রস্তুতি নিয়ে নিলাম। কারণ, সন্ধ্যায় আমার ফ্লাইট। আজই রওয়ানা হব বাংলাদেশে। গত রাতে সামান্য কিছু কেনাকাটা করেছি। শেষ পর্যন্ত প্রাচীন হস্তশিল্পের দোকান খুঁজে পেয়েছি। মিনিয়েচার আর্ট সংগ্রহ করতে পারিনি, কিন্তু হাতে তৈরি ছোট কার্পেট পেয়েছি। এর মধ্যে একটি হলো কার্পেটে তৈরি ব্যাগ। অনেক নকশা সেই ব্যাগের মধ্যে। এটি একটি প্রাচীন শিল্প। দোকানদার বললেন : ‘এই ব্যাগের মধ্যে লবণ রাখা হতো। একটি ঊহমষরংয ঃড় চবৎংরধহ ডিকশনারিও পেয়েছি। সব গুছিয়ে রেখে আমরা আবার বেরিয়ে পড়লাম।
এবার আমরা যেখানে যাচ্ছি সেটার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। এটি ৫০ বছর পুরনো একটি ওহংঃরঃঁঃব এখানে কোরআন অনুসারে মেয়েদের শিক্ষা ও ট্রেনিং দেয়া হয়।
সেখানে আসন্ন মুহররমের প্রস্তুতি চলছে। অতি সম্মানে আমাদের স্বাগত জানালেন স্কুল কর্তৃপক্ষ।
অপূর্ব হাতের কাজে সাজানো হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির একেকটা রুম। আমরা একটা হলরুমে এসে দাঁড়ালাম। দূর থেকে ভেসে আসছিল কান্নার সুরে গান। কাছে এসে দেখলাম, একটা বড় হলরুমের মাঝখানে কালো পোশাকে প্রায় ২০/২৫ জন নারী দাঁড়িয়ে ধীর লয়ে মর্সিয়া গাইছেন। তাঁদের ডান হাত হালকা করে বুকের বাম পাশে তালে তালে স্পর্শ করছে। তাদের দু’চোখ বেয়ে পড়ছে অশ্রু।
মুহূর্তেই বুঝে গেলাম কী হচ্ছে। ফারসি গানের প্রতিটা শব্দের অর্থ না বুঝলেও এর সুর আমাদের মন ছুঁয়ে গেল। ‘হোসাইন’ শব্দটাও ঘুরে ঘুরে কানে আসতে থাকল।
আমরা ওদের কাছেই স্টেজে এসে দাঁড়ালাম। ওদের গানে তাল দিয়ে বুকে হাত রাখলাম আর আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম আমাদের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু!
৬৮০ সালে (মুহররম ১০, ৬১ হি.) ঘটে যাওয়া কারবালা প্রান্তরের যুদ্ধ ফুটে উঠল চোখের সামনে। আমন্ত্রণ পেয়ে মদীনা থেকে কুফার পথে চলেছে ইমাম হোসাইনের পরিবারসহ কাফেলা, কিন্তু কুফা পৌঁছানোর আগেই তাঁদেরকে কারবালায় নিয়ে যাওয়া হয়। উমাইয়া খলিফা ইয়াযীদের আনুগত্য স্বীকার না করার জন্য শুরু হয় যুদ্ধ।
মুহররমের ৯ তারিখ রাতে ইমাম হোসাইন তাঁর দলের সকলকে তাঁকে ছেড়ে চলে যাওয়ার অনুমতি দিলেও কেউ তাঁকে ছেড়ে যান নি। ইমাম হোসাইন সারারাত নামায পড়েন। ফজরের নামাযও পড়েন। কারবালার প্রান্তরে ইয়াযীদের নির্দেশে কয়দিনের পানির কষ্টের পাশাপাশি যুদ্ধের এক পর্যায়ে ইমাম হোসাইন একাই রীরত্বের সাথে লড়াই করে শাহাদাত বরণ করেন। তাঁর শিশু সন্তানদেরও হত্যা করা হয়। ইসলামের শেষ নবী ও আল্লাহর প্রেরিত রাসূলের আদরের নাতির এমন হৃদয়বিদারক শাহাদাত ঘটে কারবালা প্রান্তরে।
ঝাপসা চোখে দেখলাম সামনের একটি বড় টেবিলে ইরাকের কারবালায় ইমাম হোসাইনের সমাধি থেকে আনা একটি কারুকাজ খচিত চাদর ধরে অঝোরে কাঁদছে সবাই। আমাদের সঙ্গী পাকিস্তান থেকে আসা তাহমিনা যে সবসময় হাসিখুশি আর দুষ্টুমিতে মেতে থাকে সে কাঁদছে সবচেয়ে বেশি। কী নিঃস্বার্থ সেই অনুভূতি! কী চরম দুঃখবোধ! আমাদের প্রিয় নবীকে যদি আমরা ভালোবাসি তবে তাঁর প্রিয় ও অতি আপন জনের এমন করুণ মৃত্যুতে তো আমরা কাঁদবই। আমরা দুঃখ-ভারাক্রান্ত মনে বিদায় নিয়ে ফিরে এলাম ইমাম রেযার মাযারে। আর সত্যিই অভিভূত হয়ে ভাবছিলাম, কি রকম শান্ত, সংগঠিত ও মার্জিত উপায়ে শোক পালন করছে এরা। সত্যিই খুবই শিক্ষামূলক। ইমাম রেযার মাযারের লাইব্রেরিটা যেমন বিশাল তেমনি প্রাচীন। এখানে ১৯টি ভাষার বই রয়েছে। হাজার বছরের পুরনো এই লাইব্রেরিটি আধুনিক প্রযুক্তির সাথে যুক্ত। এখানে বই খুঁজে আনার জন্য সংযুক্ত দেয়ালের সাথে একটি ছোট বাক্স লাগানো একটি যন্ত্র রয়েছে। যেখানে প্রয়োজনীয় বইয়ের লিস্ট দিলে যন্ত্রটি নিজেই পুরো লাইব্রেরি খুঁজে বই এনে নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছে দেবে। এতে তার সময় লাগে ১০ মিনিট, অথচ একই কাজ অক্সফোর্ড লাইব্রেরির যন্ত্র করে ৫ ঘণ্টায়।
টেকনোলজি সম্পর্কিত ছোট এই উদাহরণ দেখে বুঝতে পারলাম যে, ইসলামী ইরান আধুনিক টেকনোলজিতে অনেক এগিয়ে আছে।
লাইব্রেরি ঘুরে দেখার পর লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে সেমিনার রুমে নিয়ে এলেন। এত বড় হলরুম আর দেয়ালে বিশাল বিশাল প্রাচীন আর্টের নিদর্শন দেখে আমরা যেন থ’ হয়ে গেলাম। উনি আমাদের জানালেন এই আর্টগুলো সব নিখুঁতভাবে হাতে আঁকা। ভদ্রলোক আমাদের একেবারে স্টেজের সামনে এনে ঠিক সামনের সারিতে বসিয়ে বললেন, এই সেমিনার হলে অতি উচ্চ পর্যায়ের সভা হয়। আপনারা যে চেয়ারে বসেছেন সেখানে শুধু বিভিন্ন দেশের আমন্ত্রিত রাষ্ট্রপ্রধানরা বসেন।
দুপুরের খাবার আমরা মাযারের ডাইনিং হলে খেলাম। আর ফিরে আসার সময় ডাইনিং হলের বাইরে গেটের অপর পাশে অনেক অপেক্ষমাণ মানুষ দেখলাম। জিজ্ঞেস করে জানলাম যে, রোগমুক্তির জন্য ইমাম রেযার মাযারের তাবারুকের জন্য তারা অপেক্ষা করছে।
হলের একপাশে চিত্র প্রদর্শনী চলছে। সারা পৃৃথিবীতে মুসলিমদের ওপর যে অত্যাচার চলছে তার স্থির চিত্র। একসাথে এতগুলো করুণ ছবি দেখে আমাদের সত্যিই মন খারাপ হয়ে গেল।
ফিরে আসছি। পথে বাসের মধ্যে একদম অন্য পরিবেশ। সবাই চুপচাপ। অথচ অন্যদিন সারা পথ হৈচৈ, হাসি, আনন্দ করতে করতে আমরা ফিরি। পথও এমন সুন্দর যে, সে দৃশ্য দেখেও মন ভালো হয়ে যায়।
এক সময় হঠাৎ থেমে যায় বাস। কি ব্যাপার? আমরা কেউ জানি না কী হয়েছে। আমাদের গাইড নেমে পড়েন। তারপর সবার জন্য আইসক্রিম নিয়ে আসেন। অমনি হৈচৈ করে ওঠে সবাই। ইরানে এসে আইসক্রিম খাওয়াটাই বাকি ছিল। চলন্ত বাসে চামচ দিয়ে কেটে কেটে কেকের মতো দেখতে দারুন সুস্বাদু আইসক্রিম খেতে খেতে গন্তব্যে পৌঁছলাম। অতিথিপরায়ণতায় জুরি নেই ইরানিদের। সময় নেই হাতে বেশি। তড়িঘড়ি করে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এলাম। এয়ারপোর্ট যেতে হবে। রাত আটটায় ফ্লাইট। আমার সাথে দু’জন পাকিস্তানি সঙ্গী রেজিয়া ও নাদিন। ওরা দুবাই থেকে পাকিস্তান চলে যাবে আর আমি বাংলাদেশ। ভারতীয় ও পাকিস্তানী অন্য সঙ্গীরা পরদিন তেহরান থেকে ফিরবে।
প্লেনে বসে আছি। এবারও এমিরেট। আর একটু পরে ঢাকা পৌঁছবে। অবাক হয়ে ভাবছি আমার সফর শেষ হয়ে গেল! ৬-১৫ অক্টোবর কিভাবে যেন ঘোরের মধ্যে কাটল।
সকাল সাড়ে আটটায় পৌঁছলাম ঢাকায়। সারা রাত প্লেনে একটুও ঘুমাইনি। শুধু ভেবেছি, কিভাবে ইরানে আমার দিনগুলো কেটেছে। আমি এতটাই অভিভূত যে, গত তিন রাত আমি যে ঘুমাইনি অথচ তা আমার শরীরকে এতটুকু কাবু করে নি। ইরান আমাকে এমনই আচ্ছন্ন করে রেখেছে।

স্মরণীয় দিবস

২০ মার্চ : বিশ্ব বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে সচেতনতা দিবস।
২২ মার্চ : নওরোয। ইরানি বর্ষ ১৩৯৫ এর শুরু।
* বিশ্ব পানি দিবস।
২৩ মার্চ : বিশ্ব আবহাওয়া দিবস।
২৪ মার্চ : হযরত ফাতেমা (আ.)-এর শাহাদাত দিবস (একটি রেওয়ায়াত অনুযায়ী)
৩০ মার্চ : নবীকন্যা হযরত ফাতেমা (আ.)-এর পবিত্র জন্মদিবস। বিশ্ব নারী ও মা দিবস।
* হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর জন্মদিবস।
১ এপ্রিল : ইরানে ইসলামি প্রজাতন্ত্র দিবস। এ দিনে ইরানের ৯৮ শতাংশ জনগণ ভোট দিয়ে ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে রায় দেয়।
২ এপ্রিল : বিশ্ব প্রকৃতি বা পরিবেশ দিবস।
৭ এপ্রিল : বিশ্ব স্বাস্থ্য সচেতনতা দিবস।
৮ এপ্রিল : ইরাকের সাবেক বাথ সরকারের হাতে প্রখ্যাত আলেম আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ মোহাম্মদ বাকের সদর ও তাঁর মহিয়সী বোন বিনতুল হুদার শাহাদাতবরণ।
৯ এপ্রিল : পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জনে ইরানের জাতীয় দিবস।
১৪ এপ্রিল : মরমি কবি ও দার্শনিক আত্তার নিশাবুরী স্মরণে দিবস।
* পহেলা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষ।
১৮ এপ্রিল : ইরানের সশস্ত্রবাহিনী ও সেনাবাহিনী দিবস।
২০ এপ্রিল : নবীবংশের পঞ্চম ইমাম বাকের (আ.)-এর পবিত্র জন্মদিবস।
২১ এপ্রিল : বিশ্ববিখ্যাত কবি শেখ সাদী স্মরণে দিবস।
২২ এপ্রিল : নবীবংশের ১০ম ইমাম আলী নাকী (আ.)-এর শাহাদাত দিবস।
* ইসলামি বিপ্লবের পর সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘোষণা দিবস
২৩ এপ্রিল : বিখ্যাত কালামশাস্ত্রবিদ শেখ বাহায়ী স্মরণে দিবস।
* আন্তর্জাতিক পরিচ্ছন্নতা দিবস।
* বিশ্ব গ্রন্থ ও গ্রন্থসংরক্ষণ দিবস।
২৩-২৭ এপ্রিল : আন্তর্জাতিক ‘সবার জন্য শিক্ষা’ সপ্তাহ।
২৫ এপ্রিল : ১৯৮০ সালের এই দিনে ইরানের তাবাস মরুভূমিতে আমেরিকার কমান্ডো বাহিনী অনুপ্রবেশ করে, কিন্তু আল্লাহর অসীম কুদরতে মার্কিন বিমানগুলো মরুঝড়ে বিধ্বস্ত হয়।
২৯ এপ্রিল : নবীবংশের নবম ইমাম তাকী (আ.)-এর পবিত্র জন্মদিবস।
৩০ এপ্রিল : পারস্যোপসাগর দিবস।

সংবাদ বিচিত্রা (বিদেশি সংবাদ)

ইরানে ৩৭তম ইসলামি প্রজাতন্ত্র দিবস পালিত
ইরানে গত ১ এপ্রিল পালিত হয়েছে ৩৭তম ইসলামি প্রজাতন্ত্র দিবস। ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের পর এই দিনে অনুষ্ঠিত গণভোটে ইরানের বেশিরভাগ মানুষ ইসলামি প্রজাতন্ত্রী শাসনব্যবস্থার পক্ষে রায় দিয়েছিল। ১৯৭৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে ইরানে মার্কিন সমর্থিত পাহলভি রাজতন্ত্রের পতন হয়। সেই সঙ্গে ইরানের মাটি থেকে আড়াই হাজার বছরের রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা উৎখাত হয়ে যায়।
১৯৭৯ সালের ৩০ ও ৩১ মার্চ অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক গণভোটে শতকরা ৯৮.২ ভাগ ভোটার ইসলামি শাসনব্যবস্থার পক্ষে ‘হ্যাঁ’ ভোট দিয়েছিল। বিপ্লবের সময় ইরানি জনগণ শাহ সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ এবং বিভিন্ন দাবি-দাওয়া জানিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দিত। এরকম একটি স্লোগান ছিল ‘মুক্তি, স্বাধীনতা এবং ইসলামি প্রজাতন্ত্র।’ বিপ্লব বিজয়ের পর ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রূপকার ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর দৃঢ় সিদ্ধান্তেই মূলত ওই গণভোট অনুষ্ঠিত হয়।
গণভোটে জনগণের এ দাবির পূর্ণ বাস্তবায়ন ঘটে। তখন থেকে প্রতি বছর ১ এপ্রিল ইরানে ইসলামি প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপিত হয়ে আসছে।
এ দিবস উপলক্ষে ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে বলেছেন, ইসলামি প্রজাতন্ত্র দিবস হচ্ছে ইসলামি মূল্যবোধের উপলব্ধির দিবস। তিনি আরো বলেন, বিপ্লব বিজয়ের মাত্র দুই মাসের মাথায় ইমাম খোমেইনী (রহ.) ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে গণভোটে ছেড়ে দেন। এর মাধ্যমে তিনি প্রজাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

প্রেসিডেটে রুহানির পাকিস্তান সফর
ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি পাকিস্তানের সঙ্গে তাঁর দেশের স¤পর্ককে কৌশলগত বলে অভিহিত করেছেন। দু’দিনের পাকিস্তান সফরে ইসলামাবাদের উদ্দেশে তেহরান ত্যাগের প্রাক্কালে গত ২৫ মার্চ ২০১৬ এ মন্তব্য করেন তিনি।
পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে পৌঁছলে পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানান।
পরমাণু সমঝোতার জের ধরে ইরানের ওপর থেকে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর প্রেসিডেন্ট রুহানির এ সফর অনুষ্ঠিত হয়। এ কারণে এ সফরের ফলে প্রতিবেশী দু’টি দেশের স¤পর্কে আরো অনেক শক্তিশালী হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ড. রুহানি তেহরানের মেহরাবাদ বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেন, পাকিস্তান ও ইরানের রয়েছে ধর্মীয়, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক অভিন্নতা এবং এ বিষয়টি তেহরানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
দু’দিনের সফরে প্রেসিডেন্ট রুহানি তাঁর পাকিস্তানি সমকক্ষ মামনুন হুসাইনের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ ও সেনাপ্রধান জেনারেল রাহিল শরীফের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এসব সাক্ষাতে অন্যান্য বিষয়ের মতো থেমে থাকা ইরান-পাকিস্তান গ্যাস পাইপলাইনের কাজ আবার শুরু করার বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। ওয়াশিংটন ওই প্রকল্পের বিরোধিতা করলেও তেহরানের ওপর থেকে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর বিষয়টি নতুন মাত্রা পেয়েছে বলে মনে করছে ইরান।

পাকিস্তানে বিদ্যুৎ রপ্তানি ৪০ শতাংশ বাড়াবে ইরান
গত ৩০ মার্চ ২০১৬ ইরানের জ্বালানিমন্ত্রী হামিদ চিতচিয়ান বলেন, পাকিস্তানে বিদ্যুৎ রপ্তানি ৪০ শতাংশ বাড়াতে প্রস্তুত রয়েছে তেহরান। ইসলামাবাদ ইরান থেকে আরো বিদ্যুৎ নেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, পাকিস্তানের পানি ও বিদ্যুৎমন্ত্রীর পরিকল্পিত তেহরান সফরের সময়ে এ সংক্রান্ত চুক্তি সই হবে।
অবশ্য ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সাম্প্রতিক পাকিস্তান সফরের সময় এ বিষয়ে একটি প্রাথমিক চুক্তি সই হয়েছে। চিতচিয়ান এবং পাকিস্তানের জ্বালানিমন্ত্রী খাজা মোহাম্মদ আসিফ গত ২৬ মার্চ এ চুক্তি সই করেন। এ সময় পাকিস্তানে ৩,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ রপ্তানির বিষয়ে দুই মন্ত্রী আলোচনা করেন।

ইরানের জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী দেশটি থেকে ১০ বিলিয়ন কিলোওয়াট বিদ্যুৎ রপ্তানি করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে প্রায় চার শতাংশ কেনে পাকিস্তান। গত ১৩ বছর যাবৎ পাকিস্তানে বিদ্যুৎ রপ্তানি করছে ইরান। দুই দেশ এখন এর পরিমাণ ৪০ শতাংশ বাড়াতে চায়।
ইসলামাবাদ সফরকালে গত ২৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট রুহানি বলেন, বর্তমানে ইরান পাকিস্তানে ১,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ রপ্তানি করে এবং একে বাড়িয়ে ৩,০০০ মেগাওয়াটে নিতে চায় ইরান।

ইরান-পাকিস্তান দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত
দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ৫০০ কোটি ডলারে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কৌশল গ্রহণে সম্মত হয়েছে ইরান এবং পাকিস্তান। এ লক্ষ্যে দেশ দু’টি নিজেদের সক্ষমতাকে ব্যবহার করবে।
গত ২৭ মার্চ ২০১৬ পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে ইরানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুররেজা রাহমানি ফাযলি এবং পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী ইসহাক দারের মধ্যে বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ ছাড়া, ইরান-পাকিস্তান যৌথ বাণিজ্য কমিটির ২০তম বৈঠক তেহরানে অনুষ্ঠিত হবে বলেও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
ইসহাক দার আশা প্রকাশ করে বলেন, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং ব্যাংকিং খাতের আইনগত বাধা অপসারণের পরিপ্রেক্ষিতে তেহরান ও ইসলামাবাদ বাণিজ্যিক এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা দ্রুততর করবে। ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে তেহরানের বিরুদ্ধে এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল।
প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির প্রতিনিধি দলের অংশ হিসেবে পাকিস্তান সফর করেন রাহমানি ফাযলি।

ছয় জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকে ইরানের প্রশংসা করলেন আমানো
ওয়াশিংটনে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা বা আইএইএ’র প্রধান ইউকিয়া আমানো এবং ছয় জাতিগোষ্ঠীর শীর্ষ নেতা ও প্রতিনিধিরা ইরানের সঙ্গে স¤পাদিত পরমাণু সমঝোতা বাস্তবায়নের বিষয়ে আলোচনা করেছেন। গত ২ এপ্রিল অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী, জার্মানির প্রতিরক্ষামন্ত্রী, ওয়াশিংটনে নিযুক্ত রুশ রাষ্ট্রদূত, আইএইএ’র প্রধান ইউকিয়া আমানো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান উপস্থিত ছিলেন।
আইএইএ’র প্রধান ইউকিয়া আমানো এ বৈঠকে বলেন, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি পুরোপুরি এই সংস্থার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে এবং ইরান ইস্যুতে এই সংস্থার গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণিত হয়েছে। তিনি আরো বলেছেন, চূড়ান্ত পরমাণু সমঝোতা অনুযায়ী যেসব দায়িত্ব পালন করা উচিত তার চেয়ে আরো বেশি দায়িত্ব পালন করেছে ইরান। তিনি বলেন, ইরানের সঙ্গে ছয় জাতিগোষ্ঠীর সই করা চূড়ান্ত পরমাণু চুক্তি পালনে তেহরান অঙ্গীকারাবদ্ধ। আমানো বলেন, আইএইএ’র সঙ্গে নিরাপত্তা চুক্তির পাশাপাশি এনপিটি’র বাড়তি প্রটোকলও বাস্তবায়ন করছে ইরান এবং এতে ইরানের পরমাণু স্থাপনা বিনা ঘোষণায় পরিদর্শন করার অনুমতি দেয়া আছে বলে তিনি জানান ।

ইরানের সাথে রাশিয়ান কোম্পানি সমূহের সম্প্রসারণ
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধে ইতিপূর্বে আরোপিত আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা সম্প্রতি উঠে যাবার পর থেকে রাশিয়ার বিভিন্ন কোম্পানি ইরানের সাথে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছে।
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইম্স্-এর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইরানের বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবার পর বিভিন্ন রাশিয়ান কোম্পানি পুনরায় ইরানে প্রবেশের লক্ষ্যে কাতারবদ্ধ হয়েছে।
এ প্রতিবেদনে বলা হয়, রাশিয়ান বিমান নির্মাণকারী কোম্পানি সুখোই ইরানের পরিবহন বাজারে তার সুপারজেট এয়ারলাইনার বিক্রি করতে চায়, অন্যদিকে দেশটির আভ্তোভায্ কোম্পানি ইরানে তার লাদা গাড়ির সংযোজন কারখানা গড়ে তোলার লক্ষ্যে আলোচনা শুরু করেছে।
উক্ত প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, রাশিয়ার তেল ও গ্যাস কোম্পানি গয্প্রোম্ ও লুকোইল্ পারস্য উপসাগরে অবস্থিত ইরানের একটি গ্যাস তরলীকরণ (এলএনজি) প্রকল্পে ও একটি তেল ক্ষেত্রে পূঁজি বিনিয়োগের লক্ষ্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করছে।
প্রতিবেদনটিতে আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে, তেলক্ষেত্রে সেবা প্রদানকারী অন্যতম রাশিয়ান কোম্পানি দ্য ইউরেশিয়া ড্রিলিং কোম্পানি এবং মস্কোর পূর্বে অবস্থিত রাশিয়ার অন্যতম মুসলিম জনঅধ্যুষিত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল তাতারিস্তানের দ্বিতীয় স্তরের রাশিয়ান কোম্পানি তাত্নেফ্ত্-এর জন্যও ইরানে ব্যবসায়ের ভালো সুযোগ লাভের সম্ভাবনা আছে।

ইউরেশিয়া ইরানকে বাণিজ্যের চেয়েও বেশি কিছু দিতে চাচ্ছে
মধ্য এশীয় মুসলিম সংখ্যাগুরু দেশ কাযাকিস্তানের বিনিয়োগ ও উন্নয়ন মন্ত্রী আস্সেত্ ইস্সেকেশেভ্ বলেন যে, তাঁর দেশ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ইউরেশীয় বাজার করায়ত্ত করার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে। ইরান ও কাযাকিস্তানের মধ্যে নতুন বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলার লক্ষ্যে তাঁর নেতৃত্বে ২৬০ সদস্যের একটি বিরাট বাণিজ্য ও শিল্প প্রতিনিধিদলের সাম্প্রতিক ইরান সফরকালে তিনি তেহরানে এ অভিমত ব্যক্ত করেন।
উভয় দেশের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাগণ দুই দেশের মধ্যে উন্নয়ন সহযোগিতার প্রচুর সম্ভাব্য খাতের কথা উল্লেখ করে বলেন, বর্তমানে কাযাকিস্তান ও ইরানের অর্থনীতি সকল সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়ার জন্য পুরোপুরিভাবে প্রস্তুত।
বার্তা সংস্থা ইএফ্ই জানায়, কাযাকিস্তানের এজেন্সী র্ফ ফরেন ডাইরেক্ট ইন্ভেস্টমেন্ট্-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট আল্মাস্ আইদারোভ্ বলেন, আমরা এ কারণে এখানে এসেছি যে, আমরা আমাদের দেশের কোম্পানিসমূহের জন্য সুযোগ-সুবিধা পেতে চাই।
কাযাকিস্তানের প্রতিনিধিদলের ইরান সফরকালে দুই দেশের কর্মকর্তাগণ পরস্পরের অর্থনীতিকে সহায়তা করার লক্ষ্যে উভয় দেশের জন্য ইউরেশীয় বাজার উন্মুক্তকরণ সম্পর্কে আলোচনা ও মত বিনিময় করেন।
জনাব আইদারোভ্ বলেন, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞার অবসান সহযোগিতার ক্ষেত্রে একটি নতুন দৃশ্যপট তৈরি করে দিয়েছে।
কাযাকিস্তানের প্রতিনিধিদলের সাথে আলোচনাকালে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী মোহাম্মাদ রেযা নে‘মাত্যাদে বলেন, কাস্পিয়ান সাগর, পারস্য উপসাগর ও ওমান সাগরের মাঝখানে ইরানের অবস্থান আঞ্চলিক সংযোগ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বের অধিকারী।
পারস্পরিক আলোচনাকালে কাযাকিস্তানের কর্মকর্তাগণ বলেন যে, কাযাক পূঁজি বিনিয়োগকারিগণ তাঁদের দেশের গম গুদামজাত করার লক্ষ্যে ইরানের বার্ন্দা শাহীদ রাজাই-তে কয়েকটি সাইলো নির্মাণে খুবই আগ্রহীÑ যেখান থেকে এ খাদ্যশস্য জাহাযযোগে অন্যান্য দেশে নিয়ে যাওয়া হবে।

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান বিভিন্ন আফ্রিকান দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন করবে
দেশের নিজস্ব প্রয়োজন পূরণ ও রপ্তানি বাজারে সরবরাহের লক্ষ্যে খাদ্যশস্য, বিশেষ করে গমের উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান বিভিন্ন আফ্রিকান দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন করার চিন্তা-ভাবনা করছে। এ লক্ষ্যে ইরানের বিভিন্ন কোম্পানি আফ্রিকান দেশ কেনিয়া, উগান্ডা ও তান্জানিয়ায় কৃষিজমি লিজ নেয়ার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের কেনিয়াস্থ রাষ্ট্রদূত জনাব হাদী ফারাজ্ভান্দ্ জানান, ইতিমধ্যেই কম পক্ষে দশটি ইরানি কোম্পানি পূর্ব আফ্রিকার দেশসমূহে ধান, ভুট্টা ও গম উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তিনি বলেন, যে সব কোম্পানি দেশের বাইরে বিরাট আয়তনের কৃষিযোগ্য ভূমি লিজ নেবে এবং তাতে আধুনিক কৃষি পদ্ধতি প্রয়োগ করে ইরানে রপ্তানির জন্য খাদ্যশস্য উৎপাদন করবে ইরান সেসব কোম্পানিকে কৃষিকাজে কারিগরী সহায়তা দেবে।
জনাব ফারাজ্ভান্দ্ জানান, উক্ত কোম্পানিগুলো এছাড়াও সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের স্থানীয় বাজারে সরবরাহের ও ইরানে রপ্তানির লক্ষ্যে ঐ অঞ্চলে ম্যানুফ্যাকচারিং কারখানা গড়ে তুলতেও আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তিনি বলেন, এ উদ্যোগের আরেকটি লক্ষ্য হচ্ছে আফ্রিকা শৃঙ্গ অঞ্চলের দেশসমূহের সাথে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের অনুকূলে যে বাণিজ্যিক ব্যবধান রয়েছে তা কমিয়ে আনা।
উল্লেখ্য যে, বর্তমানে পূর্ব আফ্রিকান দেশসমূহের সংস্থা দ্য ইস্ট আফ্রিকান কমিউনিটি (ইএসি) প্রধানত চা, কফি ও গোশ্তের ন্যায় বিভিন্ন পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ছাড়াই ইরানে রপ্তানি করে থাকে এবং ইরান থেকে তেলজাত দ্রব্যাদি, যন্ত্রপাতি ও টেলিযোগাযোগ সরঞ্জামাদি আমদানি করে। স্থানীয় বিশেষজ্ঞগণ বলেন, এ অঞ্চলের দেশসমূহের উচিত চলতি বছরের শুরু থেকেই ইরানে আরো বেশি পরিমাণে প্রক্রিয়াজাতকৃত পণ্য সামগ্রী রপ্তানির চেষ্টা করা।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাগণ জানান যে, বিদেশের কৃষিজমিতে ইরান যেসব পণ্য উৎপাদন করতে চায় তার মধ্যে তেলবীজ এবং পশু পালনের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণাদি অন্যতম। এ প্রসঙ্গে তাঁরা আরো জানান যে, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান দক্ষিণ আমেরিকান দেশ ব্রাজিলে ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে কৃষিদ্রব্যাদি চাষ করার লক্ষ্যে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।

ইরান উচ্চ গতিসম্পন্ন ট্রেনে নেট্ওয়ার্ক সম্প্রসারণ করবে
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সরকারের সড়ক ও নগর পরিকল্পনা মন্ত্রী জনাব আব্বাস আহ্মাদ অখুন্দী ঘোষণা করেছেন, ইরান সরকার কেবল দেশের কয়েকটি সুনির্দিষ্ট অংশে নয়, বরং সারা দেশে উচ্চ গতিসম্পন্ন ট্রেন চলাচলের উপযোগী রেলওয়ে নেট্ওয়ার্ক চালু করবে।
জনাব অখুন্দী ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রেডিও (ওজওই)-কে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে বলেন, এ লক্ষ্যে ইতিমধ্যে তেহরান-কোম-ইসফাহান রুটে উচ্চ গতিসম্পন্ন ট্রেন চালু করার লক্ষ্যে চীনের সাথে চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে এবং সেই সাথে সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে এ প্রকল্পটির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এর বাস্তবায়ন মনিটরিং করার জন্য ইতালির সাথেও চুক্তি সম্পাদন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, দেশে উচ্চ গতিসম্পন্ন ট্রেন চালু করার ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হচ্ছে তেহরান-মাশহাদ রুটের প্রকল্প। এছাড়াও সারা দেশে উচ্চ গতিসম্পন্ন ট্রেন চালু করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অন্যান্য প্রকল্প প্রণয়নের জন্য ইতালির সাথে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে।
ইরান সরকারের সড়ক ও নগর পরিকল্পনা মন্ত্রী দেশের রেলওয়ে সেক্টরের তিনটি অক্ষের কথা উল্লেখ করেন, তা হচ্ছে : পণ্য পরিবহনের প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে দেশের রেলপথের সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ, অন্যান্য দেশের সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে তেহরান ও অন্যান্য বড় শহরের উপশহরসমূহে যাত্রীবাহী ট্রেনের উন্নয়ন এবং আন্তঃনগর ট্রেনের সম্প্রসারণ।

ইরান ও তুরস্কের মধ্যে বাণিজ্য সম্প্রসারণ
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সরকারের শিল্প ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী ওয়ালী উল্লাহ্ আফ্খামী রাদ্ ইরান ও তুরস্কের মধ্যে ইরানি রিয়াল ও তুরস্কের লিরার মাধ্যমে বাণিজ্যিক বিনিময়ের সম্ভাবনা ব্যক্ত করেছেন। গত ৪ এপ্রিল (২০১৬) তুরস্কের রাষ্ট্রদূতকে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এ সম্ভাবনা ব্যক্ত করেন।
জনাব ওয়ালী উল্লাহ্ আফ্খামী রাদ্ বলেন, যদিও দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক সম্প্রসারণের পথে বিরাজমান বাধা হিসেবে আর্থিক ও ব্যাঙ্কিং বিধিনিষেধ রয়েছে, তবে ইরান ও তুরস্ক তাদের নিজ নিজ দেশের মুদ্রা ব্যবহার করে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য করতে পারে।
তিনি বলেন, ইরান ও তুরস্কের মধ্যে সব সময়ই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল এবং বিভিন্ন সময় দুই দেশ পারস্পরিক বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখে এসেছে। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধ ক্রমান্বয়ে উঠে যাওয়ার পাশাপাশি তুরস্কের পুঁজি বিনিয়োগকারিগণ ইরানে আরো বেশি পুঁজি বিনিয়োগে এগিয়ে আসবেন।

জেনেটিক বিজ্ঞানে ইরানের অগ্রগতি
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের জেনেটিক্স্ সোসাইটি-এর সভাপতি মাহ্মূদ তাভাল্লাঈ বলেন যে, ২০ মার্চ ২০১৬ তারিখে সমাপ্ত বিগত ইরানি বছরে ইরান জেনেটিক্স্ বিজ্ঞানে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছেÑ যার মধ্যে মার্কেটিং-এর জন্য দু’টি জেনেটিক্স্ ওষুধের অথোরাইযেশন এবং বিটি কটোন্-এর উন্মোচন অন্যতম।
মাহ্মূদ তাভাল্লাঈ বার্তাসংস্থা মের্হে নিউজ-কে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ইরানের জেনেটিক্স্ সোসাইটি ৬৫ বছরের ইতিহাসে গত বছর সর্বাধিক অগ্রগতি অর্জন করেছে। তিনি বলেন, গত ইরানি বছরে বিশেষ করে প্লান্ট্ জেনেটিক্স্, এনিম্যাল জেনেটিক্স্, এমনকি হিউম্যান জেনেটিক্সে ইরান যথেষ্ট সক্ষমতার অধিকারী হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি জানান যে, বর্তমানে ইরানে জেনেটিক্স্-এর ক্ষেত্রে ৬০টি বৈজ্ঞানিক কেন্দ্র কাজ করে যাচ্ছে।
তিনি আরো উল্লেখ করেন, গত বছর ২৪ থেকে ২৬ মে (২০১৫) পর্যন্ত অনুষ্ঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক ও নবম জাতীয় বায়োটেক্নোলজির পাশাপাশি ইরানের প্রথম জেনেটিক্যালি মডিফাইড্ বিটি কটন্ উন্মোচন করা হয়Ñ যা ইরানের জেনেটিক্স্ সোসাইটির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য। তিনি জানান, এ প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে ইরানে তুলার উৎপাদন পাঁচ থেকে সাত গুণ বৃদ্ধি পাবে।

ক্যান্সার নিরূপণে ইরানি গবেষকদের সাফল্য
ইরানি গবেষকগণ ক্যান্সার নিরূপণে গোল্ড ন্যানোপার্টিক্ল্স্ ব্যবহারে বিরাট সাফল্যের অধিকারী হয়েছেন। তাঁরা ল্যাবরেটরি স্যাম্প্ল্সমূহে কেলরিমেট্রিক পদ্ধতি ব্যবহার করে ক্যান্সারের সেল্ নিরূপণ করেন।
নিউ সায়েন্সেস অ্যান্ড টেক্নোলজিস্ ইউটি-এর প্রকল্প পরিচালক সাইয়্যেদ মোরতাযা হোসেইনী বলেন, এ গবেষণার লক্ষ্য ছিল রোগীর রক্তে ছড়িয়ে থাকা ক্যান্সার সেল গোল্ড ন্যানোপার্টিক্ল্স্-এর কেলরিমেট্রিক প্রপার্টিস্-এর সাহায্যে দ্রুত ও সহজে কার্যকরভাবে নিরূপণের জন্য একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করা।
তিনি এর কার্য ক্ষমতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, আলাদা করা গোল্ড পার্টিক্ল্স্-কে যদি পার্টিক্ল্-এর ডায়ামিটারের চেয়ে দূরে রাখা হয় তাহলে তা একটি লাল রং তৈরি করে, কিন্তু যদি আরো নিকটে রাখা হয় তাহলে ঐ লাল রংটি পার্পল্ রঙে পরিণত হয়ে যাবে। ক্যার্ন্সা সেল্-এর উপস্থিতিতে ন্যানোপার্টিক্ল্স্-এর কার্যক্ষমতা সম্পর্কে তিনি আরো বলেন, ক্যার্ন্সা সেল্-এর উপস্থিতিতে ফাংশনালাইয্ড্ গোল্ড ন্যানোপার্টিক্ল্স্ যোগ করা হলে মুক্ত ন্যানোপার্টিক্ল্সমূহ ঐ পরিবেশে থেকে যাবে এবং তার ফলে এক ধরনের লাল রং দেখা যাবে।
তিনি আরো বলেন, রক্তে যদি ক্যান্সারের সেল না থাকে তাহলে ফাংশনালাইয্ড্ গোল্ড ন্যানোপার্টিক্ল্স্ যোগ করার পরে এক ধরনের পার্পল্ রং দেখা যাবে। তিনি ক্যান্সার নির্ণয়ের জন্য প্রচলিত পদ্ধতির সাথে এর পার্থক্য তথা উদ্ভাবিত পদ্ধতির সুবিধা তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, গোল্ড ন্যানোপার্টিক্ল্স্-এর ব্যবহারের ফলে আর এ কাজে ব্যয়বহুল যন্ত্রপাতি ও সুদক্ষ বিশেষজ্ঞ ব্যবহারের প্রয়োজন থাকবে না। তেমনি এটা ক্যান্সার নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সময়ের ও ব্যয়ের সাশ্রয় ঘটাবে। তিনি বলেন, এ পদ্ধতি যথাসম্ভব দ্রুত স্বাভাবিক সেল্-এর ভেতর থেকে ক্যার্ন্সা সেল্ নির্ণয় নিশ্চিত করবে।
উল্লেখ্য, এ গবেষণার ফলাফল অ্যানালাইটিকা চিমিকা অ্যাক্টা-এর ৯০৪ নং ভলিউমে (২০১৬) ৯২-৯৭ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়েছে।

ইরানে প্রথম থ্রি-ডি প্রিন্টার-এর বাণিজ্যিক ব্যবহার
তাব্রীয্ ইসলামিক আর্ট ইউনিভার্সিটির সফ্ট্ওর্য়্যা টেক্নোলজি ডেভেলপমেন্ট্ সেন্টারের পরিচালক ইবরাহীম ঈমানী এ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক নির্মিত প্রথম থ্রি-ডি প্রির্ন্টা-এর বাণিজ্যিক ব্যবহারের কথা ঘোষণা করেছেন। তিনি প্রচারমাধ্যমসমূহের প্রতিনিধিদের সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে, এ কেন্দ্রটি গত মে মাসে (২০১৫) কাজ শুরু করে এবং ইতিমধ্যেই বিরাট সাফল্যের অধিকারী হয়েছে।
তিনি উল্লেখ করেন, এ কেন্দ্র কর্তৃক তৈরি প্রথম পণ্য হচ্ছে থ্রি-ডি প্রিন্টার এবং তার বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য উৎপাদন। আর ইরানে এটাই এ পণ্যের প্রথম বাণিজ্যিক উৎপাদন। তিনি আরো জানান যে, এ থ্রি-ডি পিন্টার প্রোগ্রামটি ফারসি ভাষার মুদ্রণের কাজেও ব্যবহার করা যাবে।
জনাব ঈমানী আরো উল্লেখ করেন যে, অন্যান্য বিদেশি থ্রি-ডি প্রিন্টারের তুলনায় অধিকতর পূর্ণতার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও ইরানে তৈরি এ থ্রি-ডি প্রিন্টার মূল্যের দিক থেকে অপেক্ষাকৃত সাশ্রয়ী। তাছাড়া এটি শিল্পক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা যাবে। এর মধ্যে রয়েছে অলঙ্কার ও ভাস্কর্যের ডিজাইন্ তৈরি এবং সেই সাথে মেডিকেল, ডেন্টাল, মেকানিক্যাল, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ও স্থাপত্যের ক্ষেত্রে এর ব্যবহার।

নিজের জীবন দিয়ে শিক্ষার্থীদের বাঁচালেন ইরানি শিক্ষক
আত্মোৎসর্গের চরম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে নিজের জীবনের বিনিময়ে তিন শিক্ষার্থীর প্রাণ রক্ষা করেছেন একজন ইরানি শিক্ষক। দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় সিস্তান-বালুচিস্তান প্রদেশের নুকজু গ্রামে অবস্থিত শহীদ রাহিমি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন হামিদরেজা গাঙ্গোযেহি।
গত ৩ এপ্রিল ২০১৬ প্রবল বর্ষণ ও ঝড়ো হাওয়ার মধ্যে তিনি দেখতে পান স্কুলের একটি কক্ষের মধ্যে তিন শিক্ষার্থী আটকা পড়েছে। যেকোনো মুহূর্তে ওই কক্ষের ছাদ ধসে পড়তে পারে দেখে তিনি আরেক শিক্ষককে নিয়ে শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করতে যান। শিক্ষার্থীদের কক্ষটি থেকে বের করে দেয়ার পরপরই ছাদ ধসে পড়লে ঘটনাস্থলেই হামিদরেজার মৃত্যু হয়। উদ্ধার তৎপরতায় অংশগ্রহণকারী দ্বিতীয় শিক্ষকের পা ভেঙে গেছে।
প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি গত ৫ এপ্রিল এক টুইট বার্তায় নিহত শিক্ষকের প্রতি সম্মান জানিয়ে তাঁর পরিবারের প্রতি শোক ও সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। তিনি লিখেন, ‘সাহসিকতা ও আত্মোৎসর্গের দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী শিক্ষক হামিদরেজা গাঙ্গোযেহির নাম ও স্মৃতি আমাদের হৃদয়ে বেঁচে থাকবে চিরকাল।’

আন্তর্জাতিক চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় ইরানি শিশু কিশোরদের সাফল্য
সম্প্রতি জাপানে অনুষ্ঠিত পরিবেশবিষয়ক ষোড়শ আন্তর্জাতিক শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে দু’জন ইরানি কিশোর-কিশোরী বিরাট সাফল্যের অধিকারী হয়েছে। মিলাদ সাদেক্বী (১৬) ও মাশা কাযেমিনী (১১) এ দুই ইরানি কিশোর-কিশোরী যৌথভাবে প্রথম পুরস্কার লাভ করেছে। জাপান কোয়ালিটি অ্যাস্যুর‌্যান্স্ অর্গানাইযেশন (জেকিউএ) ও ইউনিসেফ্-এর পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত সংগঠন দি ইন্টারন্যাশন্যাল সার্টিফিকেশন নেটওয়ার্ক (আইকিউনেট্)-এর যৌথ উদ্যোগে এ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়।
এ প্রতিযোগিতায় ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের শীরাযের ১১ বছর বয়সী মাশা কাযেমিনী তার চিত্রে একটি গমের ক্ষেতের ভিতর দিয়ে বায়ু প্রবাহিত হওয়ার এবং স্থানীয় রঙ-বেরঙের পোশাক পরিহিতা একজন কিসানীর সেখানে কাজ করার দৃশ্য প্রতিফলিত করেছে। ছবিতে উক্ত কিস্থানী এক আঁটি সোনালি গম বুকে জড়িয়ে ধরে থাকতে দেখা যায়। অন্যদিকে ইরানের আর্দেবিলের ১৫ বছর বয়স্ক কিশোর মিলাদ সাদেক্বী তার আঁকা চিত্রে গাছ কেটে ফেলার ভয়ঙ্কর শব্দ প্রতিফলিত করে তার প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এছাড়া সে যে গাছটি কাটা হচ্ছে বলে তার অঙ্কিত চিত্রে দেখিয়েছে তার পাশে আরেকটি গাছের ডালে একজন লোককে এ ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে আতঙ্কিত ও মলিন মুখে বসে থাকতে দেখিয়েছে।
এছাড়া এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী নেগিন্ সাদেক্বীয়ান্ নামক ইরানের ইস্ফাহানের ১১ বছর বয়সী কিশোরীর বিশেষ সম্মাননা লাভের কথা উল্লেখ করা হয়েছে যে তার অঙ্কিত ছবিতে একটি পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত একটি গ্রামের চিত্রায়ণ করেছে যেখানে মাঠের ভিতরে ঐতিহ্যবাহী স্থানীয় পোশাক পরিহিতা মেয়েরা খেলা করছে এবং তাদের মাথার ওপর পাখিরা উড়ে বেড়াচ্ছে।
উল্লেখ্য, উক্ত প্রতিযোগিতায় বিশ্বের ৮৫টি দেশ থেকে শিশু-কিশোরদের আঁকা মোট ১৮ হাজার ২৯৯টি চিত্র পাঠানো হয়। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের শিশু-কিশোরদের আঁকা চিত্রের সংখ্যা ছিল ২৫টি।
উল্লেখ্য, গত বছর অনুষ্ঠিত একই প্রতিযোগিতায় ইরানের র্কেমানের ১০ বছর বযসী বালিকা ফাতেমাহ্ মাহাল্লাতী প্রথম পুরস্কার লাভ করে।

ইরানি গ্রান্ডমাস্টারের এফ্এস্টি খেতাব লাভ
ইরানি গ্রান্ডমাস্টার মোরতাযা মাহ্জুব দাবা খেলার অত্যন্ত সম্মানিত খেতাব এফ্আইডিএ সিনিয়র ট্র্ইেনার (এফ্এস্টি) লাভ করেছেন। উল্লেখ্য, দাবা খেলার ক্ষেত্রে এফএসটি হচ্ছে এমন একটি অতি সম্মানিত খেতাব যা এ পর্যন্ত খুব কম সংখ্যক ব্যক্তি লাভ করেছেন। ইতিপূর্বে তেহরানের আর্মেনিয় দাবা খেলোয়াড় হ্যামলেট্ তুমানিয়ান এবং ইরানি আন্তর্জাতিক দাবা মাস্টার খসরু হারান্দী বিশ্ব দাবা ফেডারেশন (এফ্আইডিই)-তে এ মর্যাদার অধিকারী হন।
র্মোতাযা মাহ্জুব্ হলেন তৃতীয় ইরানি দাবা কোচ যিনি এফ্আইডিই সিনিয়র প্রশিক্ষকের তালিকায় স্থান লাভ করলেন। ৩৬ বছর বয়স্ক এ ইরানি কোচ ইতিপূর্বে ইরানের জুনিয়র ও ক্যাডেট্ ন্যাশনাল টিমের নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং বর্তমানে তিনি হচ্ছেন তরুণতম এফ্এস্টি।
দাবা খেলার গ্রান্ড মাস্টার ইরানি নাগরিক মোরতাযা মাহ্জুব ১৯৮০ সালের ২০ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইতিপূর্বেও বিশ্ব রেকর্ড গড়েন। তিনি ২০০৯ সালের ১৩ আগস্টে যে রেকর্ড করেন তাতে ১৮ ঘণ্টায় ৫০০ গেমে অংশগ্রহণ করেন যার মধ্যে ৩৯৭ গেমে জয়লাভ করেন, ৯০টি ড্র হয় এবং মাত্র ১৩টিতে হেরে যান।

ইরানি চলচ্চিত্রের এন্আইএফ্এফ্ গোল্ডেন ক্যামেরা লাভ
ভারতে অনুষ্ঠিত ৮ম নাশিক ইন্টারন্যাশন্যাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল (এন্আইএফ্এফ্)-এ অংশগ্রহণ করে ইরানি চলচ্চিত্র ‘দো’ (দুই) গোল্ডেন ক্যামেরা পুরস্কার লাভ করেছে। যথাক্রমে সোহেইলা গোলেস্তানী ও র্পাভীয্ পারাস্তুয়ী কর্তৃক পরিচালিত ও প্রযোজিত ‘দো’ চলচ্চিত্রটি একজন চলচ্চিত্র পরিচালক কর্তৃক পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে সর্বোচ্চ সম্মান গোল্ডেন ক্যামেরা লাভ করে।
‘দো’ হচ্ছে বাহ্মানের বাড়িতে কর্মরত একজন কর্মজীবী নারীর স্মৃতিচারণমূলক চলচ্চিত্র, যে বহু বছর ইউরোপে কাটানোর পর স্বীয় বাড়িঘরে ফিরে আসে। এতে দেখা যায় যে, সে তার অতীত পুরোপুরি বিস্মৃত হয়েছে এবং এখন সে তার বাড়িটি বিক্রি করে দিতে চাচ্ছে।
এ চলচ্চিত্রটি এ পর্যন্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার লাভ করেছে। এসব উৎসবের মধ্যে এস্তোনিয়ায় অনুষ্ঠিত ১৯তম টলিন ব্লাক নাইট্স্ ফিল্ম্ ফেস্টিভ্যাল ও ডাব্লিনে অনুষ্ঠিত আইরিশ সিল্ক রোড ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অন্যতম। এ চলচ্চিত্রটি গত ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে আর্ট অ্যান্ড এক্সপেরিয়েন্স সিনেমা গ্রুপ-এর সিনেমা-হলগুলোতে প্রদর্শিত হয়।

ইতালির আন্তর্জাতিক উৎসবে ইরানি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত
ইরানি এনিমেশন চলচ্চিত্র ‘অ্যালার্ম’ ইতালির অন্যতম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ‘কার্টুন্স্ অন্ দ্য বে’-তে প্রদর্শিত হয়। ‘কার্টুন্স্ অন্ দ্য বে’ হচ্ছে ইতালির অন্যতম প্রধান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব।
জালাল না‘ঈমী কর্তৃক পরিচালিত ও ন্যাশন্যাল মিডিয়া সেন্টার কর্তৃক প্রযোজিত এনিমেশন চলচ্চিত্র ‘অ্যালার্ম’ ‘কার্টুন্স্ অন্ দ্য বে’ শীর্ষক ১৯তম ইন্টারন্যাশন্যাল ফেস্টিভ্যাল অব টিভি এনিমেশন অ্যান্ড ক্রস-মিডিয়া-য় প্রদর্শিত হবে।
মাদকদ্রব্যের নেশা ও সংশ্লিষ্ট পরিবারসমূহের ওপর তার ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রামের লক্ষ্যে নিবেদিত ‘অ্যালার্ম’ চলচ্চিত্রের গল্পে দেখানো হয় যে, মাদক দ্রব্যে নেশাগ্রস্ত একজন লোক তার শিশুপুত্রকে সাথে নিয়ে ভিক্ষা করে। সে যত বারই মাদক দ্রব্য গ্রহণ করে বা সিগারেট টানে তত বারই তার শরীরে কতগুলো দাগ পড়ে যায়। সে যত বেশি মাদক দ্রব্য গ্রহণ করে তত বেশি তার শরীরে দাগ পড়ে। ফলে তার সারা শরীরই দাগে ভরে যায় এবং সে পুরোপুরিভাবে শরীরে দাগপড়া একজন লোকে পরিণত হয়ে যায়।
উল্লেখ্য, ‘কার্টুন্স্ অন্ দ্য বে’ হচ্ছে এনিমেশন ফিল্ম, ক্রস-মিডিয়া, ভিডিও-গেম ও শিশুদের টেলিভিশন কর্মসূচির ক্ষেত্রে নিবেদিত অন্যতম প্রধান আন্তর্জাতিক উৎসব। ১৯তম ‘কার্টুন্স্ অন্ দ্য বে’ উৎসব ৭ থেকে ৯ এপ্রিল (২০১৬) ইতালির ভেনিসে অনুষ্ঠিত হয়।

ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানির ভাষণ

بسمالله الرحمن الرحیم
وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعاً وَلَا تَفَرَّقُوا وَاذْکُرُوا نِعْمَة اللَّهِ عَلَيْکُمْ إِذْ کُنْتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِکُمْ فَأَصْبَحْتُمْ بِنِعْمَتِهِ إِخْوَاناً
‘আর তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে ঐক্যবদ্ধভাবে আঁকড়ে ধর, পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। এবং তোমাদের প্রতি আল্লাহর নেয়ামতের কথা স্মরণ কর, যখন তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের অন্তরসমূহের মাঝে সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে দিয়েছেন। অতএব, তার রহমতের বদৌলতে তোমরা পরস্পর ভাই ভাই হয়ে গেছ।’ (সূরা বাকারা : ১০৩)
জনাব এরদোগান! ভ্রাতৃপ্রতীম দেশ তুরস্কের সম্মানিত প্রেসিডেন্ট ও ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার শীর্ষ সম্মেলনের প্রেসিডেন্ট! ইসলামি দেশসমূহের রাষ্ট্রপ্রধানগণ! ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহিলাগণ!
শুরুতে আমি আপনার প্রতি মোবারকবাদ জানিয়ে তুরস্কের সরকার ও জাতির উঞ্চ আতিথেয়তার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি এবং আপনার জন্য সৌভাগ্য ও সাফল্য কামনা করছি।
আমরা যে আজ ‘ইনসাফ ও শান্তির জন্য ঐক্য ও সংহতি’-র স্লোগানে সুন্দর ও ঐতিহাসিক নগরী ইস্তাম্বুলে সমবেত হয়েছি, তাতে সমগ্র জাহানের সকল মুসলমানের অভিন্ন ভাগ্য নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার উপযুক্ত সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
মাত্র কয়েক শতাব্দী আগে ইসলামি সভ্যতা যখন শক্তিমত্তা ও ক্ষমতার চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল তখন কেউ হয়ত চিন্তাও করেনি যে, একদিন ইসলামি জাহান এতখানি দুর্বলতা ও নিস্তব্ধতার সম্মুখীন হবে এবং পশ্চিমা সভ্যতার মোকাবিলায়, যে সভ্যতা চিন্তাদর্শন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে মুসলমানদের কাছে ঋণগ্রস্ত ছিল, তাদের সম্মুখে দুর্বল অবস্থানের শিকার হবে।
অথবা যেদিন ইসলামি সভ্যতা বিভিন্নমুখি চিন্তাধারা, নানা গোত্র ও সম্প্রদায়কে নিজের মধ্যে আত্মস্থ করেছিল এবং তাদের মাঝে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বলবৎ করেছিল, সেদিন হয়ত কেউ কল্পনাও করেনি যে, একদিন মুসলমানদের মধ্যে এমন ফেরকাবাজি ও উগ্রবাদ বিস্তার লাভ করবে এবং তারা মুসলমানের হাতে মুসলমান নিহত হওয়াকে একটি স্বাভাবিক ব্যাপারে রূপান্তরিত করবে।
বাস্তবতা হল, ইসলামি সভ্যতার পতন তখন থেকে শুরু হয়েছে যখন থেকে বৃহৎ ইসলামি শক্তিগুলো পারস্পরিক শক্তি বৃদ্ধির পরিবর্তে পরস্পরের সঙ্গে অনর্থক সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে। আর বিদেশি আগ্রাসনের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিয়েছে।
আর এখন দুঃখজনকভাবে ইতিহাসের পুনরাবৃৃত্তি ঘটছে। ইসলামি জাহানের উপর সর্বতোমুখি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক হামলা বিশেষ করে চিন্তাধারা ও আকিদাগত আগ্রাসন পুনরায় তীব্রতর হয়েছে। তবে এবার নতুন আঙ্গিকে ও ইসলামের বিরুদ্ধে ইসলামকে ব্যবহার করে, মাযহাবের বিরুদ্ধে মযহাবকে লাগিয়ে দিয়ে। উগ্রবাদী ও তাকফিরি গোষ্ঠীগুলোর কথা সবাই জানেন যে, তারা কোথা থেকে ও কীভাবে সংগঠিত হয়েছে, আর কোন স্থান থেকে পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে, তারা সম্ভাব্য সবচেয়ে সহিংস ও নিষ্ঠুর পন্থায় মুসলামান ও অমুসলমানদেরকে নির্বিচারে হত্যা করছে। নিকষ সহিংসতা ইসলামি নৈতিক চরিত্রের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই নৃশংসতা ও হিং¯্রতা ইসলামের নামে ও ইসলামি পতাকা ব্যবহার করে চালানো হচ্ছে আর এর মাঝখানে মূল বলি হচ্ছে ইসলাম আর ইসলামি মূল্যবোধ ও মূলনীতিসমূহ।
এটা কিছুতেই হতে পারে না যে, ইসলামি জাহান নিরাপত্তাহীনতা, সহিংসতা ও সুসংগঠিত সন্ত্রাসের তরঙ্গের মধ্যে হাবুডুবু খাবে আর সর্বতোমুখী পশ্চাদপদতা ও অনগ্রসরতার আষ্টেপৃষ্ঠে বন্দি হয়ে থাকবে। বরং তার উচিত হবে এক উন্নততর অবস্থানে সে বসবে। এর এটা সম্ভব হবে না, যতক্ষণ না আমরা আরো বেশি উৎকণ্ঠা নিয়ে বর্তমান অবস্থা ও পরিস্থিতি এবং নিজের চারপাশের দুনিয়া নিয়ে চিন্তাভাবনা করি।
আসলে আমাদের কাজকর্মই হল সেই মানদ- যার নিক্তিতে ইসলামি জাহানের জনগণ আমাদের আচরণ কতখানি ইসলামি সে বিষয়ে বিচার-ফায়সালা করবে। আমাদের মুখের বুলি, দাবি, উপাধি বা নানা নামধামের ভিত্তিতে বিচার করে দেখবে না।
কোন কোন ইসলামবিরোধী গোষ্ঠীর প্রতি অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য-সহযোগিতা যদি তাদের কাছে সুযোগ এনে দেয়, যাতে তারা ইসলামের নামকে জিম্মি করে নিতে পারে, আর ইসলামের সুন্দর চেহারাকে অপরাধযজ্ঞ ও মানুষ হত্যার কলঙ্ক দ্বারা কলুষিত করতে পারে আর ইসলামোফোবিয়ার ঘৃণ্য চক্রান্তের জন্য অজুহাত ও সাক্ষ্য হিসেবে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়, তাহলে কিভাবে ইসলামের শান্তি ও স্বস্তির প্রতিরক্ষা করা সম্ভব হবে?
ইসলামি উম্মাহর শত শত কোটি ডলার সম্পদ ও পুঁজি যুবকদের উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান খাতে ব্যয়ের পরিবর্তে যদি কাল্পনিক আশঙ্কার অজুহাতে সামরিক বারুদের গুদামে ব্যয় করা হয় আর পরস্পরের বিরুদ্ধে ব্যয়িত হয়, তা হলে কিভাবে ঐক্যের কথা বলা যাবে? কিভাবে যুবকদেরকে ইসলামি মর্যাদা ও বরকতের নীতিমালা মেনে চলতে রাজি করানো সম্ভব হবে?
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান যেদিন থেকে তেহরানে অনুষ্ঠিত ইসলামি সম্মেলন সংস্থার ৮ম অধিবেশনের সভাপতির আসন গ্রহণ করে, ঠিক সেদিন থেকে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ‘বিশ্ব সহিংসতা ও উগ্রবাদের মোকাবিলা’ তত্ত্ব উত্থাপন পর্যন্ত, একটিমাত্র কথার উপর অবিচল ছিল। আর তা হচ্ছে, আলোচনা ও সহযোগিতাই হল যুগের ব্যথা-বেদনা ও সমস্যাদি অনুধাবন এবং তার কার্যকর উপশমের প্রাথমিক উপায়। আমাদের কর্তব্য হল, শান্তি প্রতিষ্ঠা ও সহিংসতার মোকাবিলার জন্য বিশ্ব পর্যায়ের উদ্যোগগুলোতে ইসলামের নামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা। আমরা যেন এতদঞ্চল ও বিশ্বে স্থায়ী নিরাপত্তা, নিরাপদ জীবন ও সর্বতোমুখী মানব অধিকার পুনরায় ফিরিয়ে আনি।
ইসলাম আমাদের শিক্ষা দিয়েছে, অপরাধ যেখানেই হোক এবং যে নামেই হোক তা অপরাধ হিসেবেই গণ্য। তা মযলুম ফিলিস্তিন ভূখ-ে হোক বা লাহোরে অথবা দামেস্কে, ইস্তাম্বুলে কিংবা নিউ ইয়র্ক, প্যারিস কিংবা ব্রাসেলসে সংঘটিত হোক। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আমাদেরকে এর উৎস ও ক্ষেত্রসমূহ সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে হবে এবং সুদৃঢ় প্রত্যয় ও ইস্পাত-কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে তার যত ধরন ও আকার আছে সবগুলোর মোকাবিলায় এগিয়ে আসতে হবে।
অতএব, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য পরিষ্কার ভাষায় ঘোষণা করতে চায় যে,
১. সর্ব প্রকার বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার সদস্য দেশগুলোর মাঝে আলোচনা ও কূটনৈতিক পথ ও পদ্ধতি গ্রহণের নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। যাতে রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক ভুল ধারণাগুলো এবং যায়নবাদ ও বৃহৎ শক্তিগুলোর হস্তক্ষেপ ও দখলদারির প্রতি উদাসীনতা তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত ও বিশেষ রাজনৈতিক বিন্যাসের দ্বারা আলোচনার অগ্রগণ্যতাকে প্রভাবিত করতে না পারে।
২. ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার সমস্যা, সব দেশের স্থায়ী নিরাপত্তা, বৈজ্ঞানিক উন্নতি ও সর্বাত্মক উন্নয়নকে গোটা ইসলামি জাহানের নিরাপত্তা, অগ্রগতি ও উন্নয়ন বলে মূল্যায়ন করতে হবে ও একে স্বাগত জানাতে হবে। কোন মতেই এই সুযোগ দেয়া যাবে না যে, ভীতিপ্রদ পরিস্থিতি সৃষ্টি এবং কাল্পনিক বিপদ ও হুমকির জন্ম দিয়ে এই প্রয়োজনটি বেমালুম ভুলে যাওয়া হবে। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সকল সদস্যের প্রতি জোরালো আহ্বান জানাতে চায় যে, ইরানের বৈজ্ঞানিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষমতাগুলোতে তারা যেন তাদের নিজেদের বলে মূল্যায়ন করে। ইরানের শক্তিকে নিজেদের শক্তি বলে গণ্য করে। যেমন ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সবার ব্যাপারে এ ধরনের মনোভাব পোষণ করে থাকে।
৩. যায়নবাদী ইসরাইল সরকারের বিপদাশঙ্কাকে সবসময় সহিংসতা ও উগ্রবাদ উৎপাদনের আসল উৎস বলে মনে করতে হবে। এ কথা স্বীকার করতে হবে যে, অধিকৃত ভূখ-ে ফিলিস্তিনি নিরপরাধ জনগণের উপর বিশেষ করে শিশু ও নারীদের উপর গণহত্যা এবং অমানবিক হামলা ও আগ্রাসন এবং গাজা অবরোধ এমন এক সরকারের সহিংস চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ, যে সরকার দুঃখজনকভাবে আন্তর্জাতিক সমাজসমূহের অবহেলা বিশেষ করে পশ্চিমা শক্তিগুলোর প্রশ্রয়ে তার নৃশংসতা ও হিং¯্রতা অব্যাহত রেখে চলেছে।
ভদ্রমহোদয়গণ!
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান এতদঞ্চলে সব ধরনের উত্তেজনা ও অস্থিতিশীলতা হতে দূরে থেকে তার পরিচ্ছন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নীতি গ্রহণ করে সব সময় ইসলামি উম্মাহর সংহতি ও ঐক্য সম্প্রসারিত করার লক্ষ্যে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আর ইসলামি দেশগুলোর সাথে সহযোগিতা জোরদার করাকে সত্যিকার অগ্রাধিকারের তালিকায় রেখেছে। ইসলামি ইরান এ কথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, মতবিরোধসমূহ ও ভুল বুঝাবুঝি নিরসনের একমাত্র পথ হচ্ছে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়া গ্রহণ ও আলোচনার মাধ্যমে অগ্রসর হওয়া। এ কারণেই আমরা অন্যান্য দেশের সাথে সম্ভাব্য সমস্যাদি ইসলামি ভ্রাতৃত্ব, সৎ প্রতিবেশীসুলভ মনোভাব এবং ইসলামি উম্মাহর সর্বজনীন কল্যাণ চিন্তার নিরিখে সমাধান করব। আমরা আলোচনা ও বোঝাপড়ার মাধ্যমে গঠনমূলক পরামর্শ, পারস্পরিক যোগাযোগ ও সন্দেহ-সংশয় দূরীকরণ ও বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যাপারে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রস্তুতির কথা ঘোষণা করছি।
ইসলামি দেশসমূহের সম্মানিত নেতৃবৃন্দ!
সবার কাছে এ কথা পরিষ্কার যে, না সৌদি আরব ইরানের জন্য সমস্যা আর না ইরান সৌদি আরবের জন্য সমস্যা। আসল সমস্যা হচ্ছে অজ্ঞতা, গোঁড়ামি ও সহিংসতা। আমাদের সবার জন্য সমস্যা ও সংকটের জট হচ্ছে ইসলামি জাহানে অনৈক্য ও বিরোধ।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সবসময় আগ্রাসন, হুমকি, জবরদখল ও সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলায় ইসলামি ও মুসলিম দেশগুলোর সাহায্যকারী ছিল এবং এখনও আছে।
যেদিন সাদ্দাম কুয়েতে আগ্রাসন চালিয়েছিল সেদিন সবার আগে ইরান এই আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়েছিল আর ইরাকি ও কুয়েতি শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছিল। যে সময় তাকফিরি সন্ত্রাসীরা বাগদাদ ও আরবিলের প্রবেশদ্বারের নিকটবর্তী হয়েছিল তখন এই ইরানই তাদের বর্বরোচিত হামলার মুখে ইরাকের সরকার ও জাতির সাহায্যে এগিয়ে গিয়েছিল। যে সময় দামেস্ক আগ্রাসন ও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল তখন এই ইরানই সিরিয়ার পাশে দাঁড়িয়েছিল। যে সময় গাজা যায়নবাদী ইসরাইল সরকারের আগ্রাসনের শিকার হয়েছিল তখন বীর হিজবুল্লাহ ও ইরান ফিলিস্তিনি জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছিল। আর যে দিন লেবানন তাদের হামলার সম্মুখীন হয়েছিল সেদিনও এই হিজবুল্লাহই লেবাননের জনগণের সম্মুখ সারিতে থেকে যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছিল।
যদি কোন দিন সন্ত্রাসী বা আগ্রাসীরা কোন ইসলামি দেশে আগ্রাসন চালাতে চায় কিংবা কোন পবিত্র ইসলামি স্থানের উপর হুমকি সৃষ্টি করে আর আমাদের কাছ থেকে সাহায্য চাওয়া হয় তাহলে নির্দ্বিধায় আমরা মযলুম মুসলমানদের সাহায্যে এগিয়ে যাব।
ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহিলাগণ!
ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার অধিবেশন থেকে, যা ঐক্যের নামে অনুষ্ঠিত হয়েছে, ইসলামি উম্মাহর মধ্যে অনৈক্যের সৃষ্টি করে এমন কোন বার্তা যেন উত্থাপিত না হয়। আর যে কোন অনৈক্য সৃষ্টিমূলক তৎপরতা, যেহেতু এই সংস্থা ও ইসলামি উম্মাহর ঐকমত্যের সাথে সংগতিশীল নয় এবং এই সংস্থা প্রতিষ্ঠার দর্শনের সাথে সাংঘর্ষিক, সেহেতু তা নিশ্চিতভাবে মূল্যহীন।
ইসলামের দয়াময়তা ও যুক্তি দর্শনের আলোকে আমাদের উপর কর্তব্য হল, দ্বীনের চেহারা থেকে যে কোন ধরনের সহিংসতা, উগ্রবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার ধুলোবালি দূর করা। আমাদেরকে কুরআন মজীদের এই আয়াতের আলোকে ইসলামি জাহানকে ‘মধ্যপন্থা ও ভারসাম্যপূর্ণ’ সমাজের মডেল হিসেবে দুনিয়ার সামনে উপস্থাপন করতে হবে।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
و کَذَلِکَ جَعَلْنَاکُمْ أُمَّهً وَسَطًا لِّتَکُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ وَ يَکُونَ الرَّسُولُ عَلَيْکُمْ شَهِيدًا
‘আর এভাবে আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী জাতিরূপে প্রেরণ করেছি, যাতে তোমরা মানবজাতির সামনে সাক্ষী হও। আর রাসূল তোমাদের ব্যাপারে সাক্ষী হন।’ (সূরা বাকারা : ১৪৩)
ওয়াস্সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ।

নওরোয উপলক্ষে রাহবারের বিবৃতি

নতুন বছরে প্রতিরোধমূলক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে লক্ষ্যে উপনীত হতে হবে
নওরোয নামে বিশ্বের সর্বত্র সুপরিচিত ইরানি নববর্ষের সূচনালগ্নে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল ‘উযমা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী একটি বিবৃতি প্রদান করেন। এ বিবৃতিতে তিনি সকলকে অভিনন্দন জানানোর পর গত হয়ে যাওয়া বছরটিকে তিক্ত-মধুর, উত্থান-পতন এবং হুমকি ও সুযোগের বছর বলে উল্লেখ করেন। তিনি মীনা বিপর্যয়কে তিক্ত এবং বিপ্লব বার্ষিকীর মিছিল ও ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে মধুর অভিজ্ঞতা বলে মন্তব্য করেন। সেই সঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন যে, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি সম্পর্কে প্রতিষ্ঠিত সমঝোতার ফলে বিচিত্র উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পাশাপাশি আশারও সঞ্চার হয়েছে।
সর্বোচ্চ নেতা তাঁর বিবৃতিতে সর্বপ্রকার হুমকিকে সুযোগে পরিণত করার জন্য ব্যাপক প্রচেষ্টা চালানোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
অর্থনীতির ওপর অগ্রাধিকার ও জরুরি ভিত্তিতে সবচেয়ে বেশি জোর দিয়ে তিনি এ ক্ষেত্রে তিনটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বেকারত্ব দূর করা এবং অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবেলার ক্ষেত্রে গতিশীলতা আনাকে দেশের অর্থনৈতিক মূল বিষয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, এসব লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে কেবল প্রতিরোধমূলক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। প্রতিরোধমূলক অর্থনীতির মাধ্যমেই বেকারত্ব ও অচলাবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব, সম্ভব দ্রব্যমূল্যের লাগাম টেনে ধরা, শত্রুদের হুমকি দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবেলা করা এবং দেশের জন্য আরও বহু সুযোগ সৃষ্টি করে সেগুলোকে কাজে লাগানো।
‘প্রতিরোধমূলক অর্থনীতি; পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন’ নববর্ষের এই স্লোগানই সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে লক্ষ্যে পৌঁছার চাবিকাঠি বলে সর্বোচ্চ নেতা উল্লেখ করেন।
সর্বোচ্চ নেতার এ দৃষ্টিভঙ্গি পরমাণু সমঝোতার পর সংকট ও সম্ভাবনাগুলোর সঙ্গে প্রকৃত অর্থেই পরিচিতি ঘটাবে। বিগত দিনের পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে এবং ক্ষুদ্র স্বার্থের পরিবর্তে সামগ্রিক স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে সঠিক পথ খুঁজে পেতেও তাঁর এ বিবৃতি সাহায্য করবে।
এ রকম ভাববার কারণ হলো সকল আশা-আকাক্সক্ষা সত্ত্বেও উদ্বেগকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। সচেতন থাকলে যে কোনো প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করা সম্ভব।
সকল প্রকার হুমকির শেকড় গেল বছরের মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির মাঝে খুঁজে পাওয়া যাবে। ইসলামি প্রজাতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার শত্রুরা বিচিত্র ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে চেষ্টা করেছে ইরানের সরকার ব্যবস্থা স¤পর্কে জনমনে নেতিবাচক ধারণা দিতে এবং ইরানের স্বাধীনতাকে খর্ব করতে। কিন্তু পারে নি।
ইরানকে কোণঠাসা করার জন্য শত চেষ্টা করেও শত্রুরা ইসলামি সরকার ব্যবস্থা কিংবা বিপ্লবের কোনো একটি মূল্যবোধের ওপরও আঘাত হানতে পারে নি। মার্কিন নেতৃত্বাধীন আধিপত্যবাদীদের সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়ে ইরান তার সামগ্রিক সাফল্য অর্জন করেছে।
সর্বোচ্চ নেতার বক্তব্য অনুযায়ী গত বছরের তিক্ত-মধুর সকল অভিজ্ঞতায় আশাবাদী হবার পাশাপাশি সচেতনও হতে হবে। ইরানি জাতিকে শত্রুদের হুমকি মোকাবেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হবার চিন্তা থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে হবে। ভাবতে হবে শুধু ভবিষ্যৎ সমস্যা সমাধানের উপায় নিয়ে। এরকম ভাবা ঠিক হবে না যে, পরমাণু সমঝোতার ফলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে; বরং ভাবতে হবে কী করে হুমকিকে সুযোগে পরিণত করার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে বের করা যায়।
নতুন বছর শুরু হয়েছে অবরোধ, চাপ ও হুমকি মোকাবেলায় ইরানের দৃঢ় অবস্থানের মধ্য দিয়ে। ইরান সেভাবেই দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যাবার ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। নওরোযে দেয়া সর্বোচ্চ নেতার বিবৃতিতে নতুন বছরে বৃহৎ সাফল্যের সেই পথের রূপরেখা সু¯পষ্ট।

ইরান পরিচিতি: কারাজ

-কামাল মাহমুদ
ইরানের আলবোর্য প্রদেশের কেন্দ্রিয় শহর কারাজ। যার পরিধি ৮৫৮ বর্গকিলোমিটার। সমুদ্র উপকূল থেকে এর উচ্চতা ১৩১২ মিটার (৪৩০৪ ফুট)। ২০১১ সালের হিসাব অনুযায়ী মোট জনসংখ্যা ১.৯৬ মিলিয়ন। জনসংখ্যার দিক থেকে এটি ইরানের ৪র্থ জনবহুল শহর। তেহরান, মাশহাদ এবং ইসফাহানের পরেই কারাজের অবস্থান। তেহরান থেকে এর দূরত্ব মাত্র ২০ কিলোমিটার (১২ মাইল)। কারাজ স্কয়ারকে ঘিরেই মূলত কারাজ শহর অবস্থিত। এটি কারাজ সমুদ্র ও কারাজ ব্রীজ থেকে ১০০ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত।
কারাজের নামকরণ সম্পর্কে বিভিন্ন রকম মতামত রয়েছে। কথিত আছে যে, কারাজ নামের একটি বিখ্যাত হ্রদের নাম অনুসারে কারাজের নামকরণ করা হয়েছে।
সাফাভী শাসনামলে এর উন্নতি ঘটতে থাকে এবং কাচার আমলে এর আরো অগ্রগতি হয়। সে সময় এ শহর মূলত গ্রীষ্মকালীন রিসোর্ট হিসেবেই ব্যবহৃত হতো। বর্তমানকালে এটি শিল্প নগরী হিসেবে খ্যাত। যেখানে চিনি, টেক্সটাইল, ক্যাবল, কোমল পানীয় প্রভৃতি তৈরি হয়।
কারাজের ইতিহাস প্রায় ৩০০ বছরের পুরোনো। ২০ শতক পর্যন্ত কারাজ স্টোন ব্রিজের জন্য বিখ্যাত ছিল। সাফাভী আমলে এটি নির্মিত হয়েছিল। এটি শহরের দক্ষিণ দিকে তাওহীদ স্কয়ারের কাছে অবস্থিত। ১৮১০ সালে কেরমান শাহের পুত্র শাহজাদা সোলায়মান (সোলায়মান মির্জা) এখানে গ্রীষ্মকালীন রিসোর্ট নির্মাণ করেন। বর্তমানে এ রিসোর্ট তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের তত্ত্বাবধানে রয়েছে।
আবহাওয়া : কারাজের বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ২৬০ মিলিমিটার। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১০৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট), গড় তাপমাত্রা ২১.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৭০.৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট), গড় নি¤œ তাপমাত্রা ৮.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৪৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট), রেকর্ড নি¤œ তাপমাত্রা -১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট)। এখানে আমীর কবিরদাম সহ বেশ কয়েকটি লেক রয়েছে।
উল্লেখযোগ্য স্থান : কারাজের উল্লেখযোগ্য স্থান হিসেবে রয়েছে মোরওয়ারিদ প্যালেস। পাহলভী আমলে রেযা শাহ পাহলভীর বড় বোন শামস পাহলভী এটি নির্মাণ করেন। এর ডিজাইন করেন ফ্রাঙ্ক লয়েড রাইট ফাউন্ডেশন। এখানকার অধিকাংশ স্থাপনা দেখাশোনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে বাসিজ অর্গানাইজেশন। মোরওয়ারিদ প্যালেসের কিছু অংশ জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে যা পরিচালনা করছে কালচারাল হেরিটেজ অর্গানাইজেশন অব ইরান। অপরাপর দর্শনীয় স্থানের মধ্যে রয়েছে শাহজাদা সোলায়মান মিউজিয়াম, ইমামযাদে মিউজিয়াম, রহমান মিউজিয়াম, ইমাম যাদে জিয়াদ মিউজিয়াম প্রভৃতি। কারাজের বিখ্যাত এলাকার মধ্যে রয়েছে হেসারক, গোওহারদাস্ত, শাহরাক এ আজমীর, গারম দারে, গোলশার ভিলা, মেহেরসার, শাহরাক এ জাহান সার, যিবা দাস্ত, যোবে অহান, মেহের ভিলা, দেহকান ভিলা, মাহদাস্ত, শাহরাক এ বানাফশে, মোহামআদ শহর, ফারদীস, মেহদী আবাদ, মিয়ান যাদে, বাকেস্তান, এসলামাবাদ, হায়দারাবাদ, দৌলাতাবাদ প্রভৃতি। শহরের প্রবেশ পথ হচ্ছে আলবোর্য পর্বতের দক্ষিণ পাদদেশ এবং শেষ সীমানা কাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত।
বিনোদন কেন্দ্রের মধ্যে পার্ক এ যানভাদে, টেনিস পার্ক, পার্কে মাদার, তালেকান গার্ডেন, কোরদান গার্ডেন, জাহানসার গার্ডেন, পারদেশ এ গোলহা, গাকসারের টিউলিপ গার্ডেন প্রভৃতি।
ভাষা : মোট জনসংখ্যার ৬১% ফারসি, ৩৪% আজারবাইজানি, ৭% কুর্দি, ৫% মাজেন্দারানি, ৪% লোর ও অন্যান্য ভাষাভাষি। তবে সবাই ফারসি ভাষায় কথা বলে।
যাতায়াত : তেহরান থেকে ৪০ কিলোমিটার ও কাজভীন থেকে ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত কারাজে রয়েছে সড়ক, রেল ও আকাশ পথ। এছাড়া স্বয়ংক্রিয় পাতাল রেলও রয়েছে। কারাজে ১৯৯০ সালে নগর রেল এর কাজ আরম্ভ হয় এবং ২০০১ সালে তা আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়। এটি কারাজের দক্ষিণে এবং কাজভীন ফ্রি ওয়ের নিকটেই অবস্থিত। সড়ক পথে তেহরান-কারাজ হাইওয়ে, স্পেশাল রোড এবং তেহরানের প্রাচীন রাস্তা (ফাতেহ হাইওয়ে) প্রসিদ্ধ। বাকেরী এক্সপ্রেস ওয়ে কারাজের উত্তর থেকে দক্ষিণ হয়ে তেহরান পর্যন্ত একটি প্রসিদ্ধ সড়ক রুট। যা তেহরান ও কারাজকে যুক্ত করেছে। আকাশ পথে যাতায়াতের জন্য ১৯৯০ সালে নির্মিত পায়াম ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট ১৯৯৭ সালে চালু হয় এবং এ পথে যাত্রী বহন ও মালামাল আমদানি-রপ্তানি করা হয়।
শিল্প : অর্থনৈতিক দিক দিয়ে কারাজ তেহরানের বিকল্প হিসেবে কাজ করছে। তেহরান ও কাস্পিয়ান সাগরের রুট হিসেবেও কারাজ ব্যবহৃত হয়। কেমিক্যাল, সার, কৃষিপণ্য কারাজে তৈরি হয়। অধুনা তেহরান থেকে অনেক ব্যবসায়ী কারাজে এসে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ করেছেন ও আবাস গড়ে তুলেছেন। এখানকার ব্যবসায় পরিবেশ বেশ উন্নত, জীবন যাপন সহজ এবং শ্রমিকও সহজলভ্য। শাহরাক ও জাহানসার কারাজের মূল শিল্প এলাকা। ১৯ শতকের গোড়ার দিকে এখানে শিল্প বিপ্লবের সূচনা হয়। ১৯৬০ সালের দিকে তা আরো বেগবান হয়। এখানে রয়েছে টেক্সটাইল মিল, তেল কারখানা, চা প্রক্রিয়াজাতকরণ মিল ও কোল্ড স্টোরেজ। ইরানের শিল্প খাতের জাতীয় আয়ের ২০% কারাজ থেকে আসে। এখানে ৩৬০০ হেক্টর জুড়ে রয়েছে ‘স্পেশাল ইকোনোমিক জোন’। যা পায়াম ইন্টারন্যাশনাল বিমানবন্দরের নিকটেই অবস্থিত। এখানকার ‘স্পেশাল ইকোনোমিক জোন’ এ রয়েছে নিজস্ব এয়ার লাইন ও কার্গো বিমান ব্যবস্থা।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে কারাজ আযাদ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, পরিবেশ বিশ্ববিদ্যালয়, পায়ামে নূর বিশ্ববিদ্যালয় কারাজ, খারাজমি বিশ্ববিদ্যালয়, তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত ফ্যাকাল্টি, তেহরান চারুকলা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিটেকচার ও নগর পরিকল্পনা অনুষদ, তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ও প্রাকৃতিক সম্পদ অনুষদ, সেন্টার ফর রিসার্চ এগ্রিকালচার অ্যান্ড নিউক্লিয়ার মেডিসিন, আলবোর্য হাইস্কুল ও কলেজ প্রভৃতি।
খেলাধুলা : কারাজের ফুটবল দলসমূহের খেলা ইরান জুড়ে বিখ্যাত। ক্লাবগুলোর মধ্যে সাইপা এফসি খুবই জনপ্রিয়। খেলাধুলার জন্য রয়েছে এনক্বেলাব স্টেডিয়াম যেখানে ১৫০০০ দর্শক একসঙ্গে বসে খেলা উপভোগ করতে পারে। শাহরাক ও জাহানসারে রয়েছে টেনিস কোর্ট। স্কেটিং ও রাইডিং এর জন্য রয়েছে ডিজিন রিসোর্ট যা আলবোর্য পর্বতের কাছেই অবস্থিত। এখানে সাইক্লিং এর কয়েকটি দল রয়েছে। ব্যায়ামের জন্য রয়েছে অনেকগুলো জিমনেসিয়াম ।

শুভ নওরোয ও নতুন ইরানি বছর

ফিরুযে র্মিরাযাভী
ইরানের প্রাচীন ইতিহাসে নওরোয উৎসবের সূচনা ঘটে। আর বর্তমানে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রায় ত্রিশ কোটি মানুষ প্রতি বছর ২১শে মার্চÑযখন সূর্য বিষুব রেখা অতিক্রম করে উত্তর গোলার্ধে প্রবেশ করে এবং এ গোলার্ধে বসন্ত ঋতুর সূচনা ঘটেÑনওরোয উৎসব পালন করে থাকে।
বর্তমানে বিশ্বে চলে আসা প্রাচীন উৎসবগুলোর মধ্যে নওরোয হচ্ছে প্রাচীনতম এবং সর্বাধিক আনন্দ-উৎসবের উপলক্ষÑ জ্ঞাত ইতিহাস অনুযায়ী যা কমপক্ষে বিগত তিন হাজার বছরেরও বেশিকাল যাবত পালিত হয়ে আসছে।
নওরোয হচ্ছে মানবজাতির জন্য শান্তি, বন্ধুত্ব ও মহানুভবতার এবং প্রকৃতিকে ভালোবাসার দূত। আর এটা কেবল ইরানিদের জন্যই নয়, বরং ইরানিরা ছাড়াও আরো কয়েকটি জাতি ও গোষ্ঠী এ সুপ্রাচীন উৎসবটিকে ভালোবাসে এবং বর্ণাঢ্যতার সাথে উদ্যাপন করে থাকে।
বস্তুত নওরোয হচ্ছে নতুন করে চিন্তা করা, নতুন করে সূচনা করা ও নতুন করে গড়ে তোলার একটি সুযোগ।
নওরোয হচ্ছে মানব প্রজাতির আত্মিক ও আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার এবং বিশ্বের জাতিসমূহ যদি এ উত্তরাধিকারকে গ্রহণ করে নেয় এবং এ সুযোগটিকে কাজে লাগায় তাহলে ইরানিরা সর্বাধিক আনন্দিত হবে। কারণ, নওরোয হচ্ছে ইরানিদের পক্ষ থেকে সারা বিশ্বের জন্য শান্তি, সম্প্রীতি ও বন্ধুত্বের বাণী।

নওরোয হচ্ছে ইরানিদের সমৃদ্ধ সভ্যতার, জাতীয় চরিত্র-বৈশিষ্ট্যের ও ইতিহাসের একটি শক্তিশালী সাক্ষ্য। নওরোয এটাই প্রমাণ করেছে যে, কীভাবে একটি জাতি তার অপরাজেয় ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে, এমনকি ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায়ে বিপর্যয়, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, কঠিন পরিস্থিতি ও নির্যাতিত হওয়া সত্ত্বেও স্বীয় দৃঢ়তাকে ধরে রাখতে পারে, শুধু তা-ই নয়, অধিকন্তু বিকাশ লাভ করতে পারে।

ইরানি জনগণ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তার পথে আগত প্রতিটি চ্যালেঞ্জের কালো অধ্যায়কে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে নওরোযের চেতনাকে কাজে লাগিয়েছে। এ চেতনা নওরোয উদ্যাপনকে কেবল একটি নতুন বছরের আগমনকে অভ্যর্থনা জানানোর মধ্যে সীমিত রাখে নি; বরং ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়ে তা ইরানি জাতিকে আরো অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছে।
নওরোয হচ্ছে সুপ্রাচীন কালের যা কিছু এখনো বর্তমান আছে তার অন্যতম। এটি হচ্ছে প্রচীন কালের কাহিনীর, বিশেষত প্রাচীন কালের বীরত্বগাথাসমূহের অন্যতম; প্রকৃতির নব যৌবন প্রাপ্তির ও মানবমনের নতুন সতেজতার পুনরাবৃত্তি।
নওরোযে বসন্তের আগমন ঘটেছে এবং বিগত বছরটি তার ভালো ও মন্দ নির্বিশেষে সমস্ত ঘটনাসহ অতীত হয়ে গিয়েছে। আর নতুন করে জন্ম নেয়া আশা-আকাক্সক্ষা নতুন নতুন সাফল্যের ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে এসেছে।
বস্তুত নওরোযের উৎসব ও অনুষ্ঠান দু’টি সুপ্রাচীন কালের ধারণার প্রতিনিধিত্ব করে থাকে, তা হচ্ছে বিগত বছরের সমাপ্তি ও নতুন বছরের সূচনায় নতুন জীবন।
ফারসি ‘নোওরুয’ কথাটির মানে হচ্ছে ‘নতুন দিন’। এ দিনটি ঐতিহাসিক বৃহত্তর ইরানের অন্তর্ভুক্ত দেশ ও অঞ্চলসমূহের জনগণের অর্থাৎ বর্তমান ইরান, আফগানিস্তান, আযারবাইজান ও মধ্য এশিয়ার প্রজাতন্ত্রগুলোর জনগণের জন্য নতুন বছরের সূচনার দিন। এটি প্রতি বছর বসন্তের প্রথম দিনে-অধিকাংশ বছরই ২১শে মার্চ তারিখে আগমন করে।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী নওরোযের সূচনা ঘটে সুপ্রাচীন কালেÑ এখন থেকে ১৫ হাজার বছর আগে।
অবশ্য এটা পুরোপুরি নির্ভুলভাবে জানা সম্ভব নয় যে, নওরোযের উৎসব ঠিক কখন শুরু হয়েছিল। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন যে, প্রকৃতিতে আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে এ উৎসবের উদ্ভব ঘটেছিল। কিন্তু অনেকে এটিকে একটি জাতীয় উৎসব হিসেবে গণ্য করেছেন, আবার অনেকে এটিকে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান বলেও মনে করেছেন।
যরথুস্ত্রীদের মতে, ইরানি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস ‘র্ফার্ভাদীন’-এর উৎপত্তি ‘ফারাভাশিশ্’ (আত্মা) থেকে। তাঁদের মতে, প্রতি বছর বছরের শেষ দশ দিনে আত্মাসমূহ বস্তু জগতে ফিরে আসে। তাই লোকেরা তাদের মৃত স্বজনদের আত্মাসমূহকে সান্ত¡না দেয়ার উদ্দেশ্যে এ দশ দিনকে সম্মান প্রদর্শন করে থাকে। তবে বর্তমানে ইরানের ব্যাপক মুসলিম জনগণ যরথুস্ত্রীদের ন্যায় বছরের শেষ দশ দিনকে সম্মান প্রদর্শন করে না; বরং বছরের সর্বশেষ বৃহস্পতিবার কবরস্থানসমূহ যিয়ারত করে থাকে। আর তারা বিশেষ দোয়া সহকারে ইসলামসম্মত নিয়মে নওরোযকে তথা নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়ে থাকে।
এ প্রসঙ্গে ইতিহাসে নওরোয অনুষ্ঠানের বিভিন্ন রূপ পরিবর্তনের প্রতি দৃষ্টি দেয়া যেতে পারে।
স্বনামখ্যাত ইরানি অভিধানবিদ মীর্যা আলী আকবার দেহ্খোদার মতে, প্রাচীন কালের ইরানিরা র্ফার্ভাদেগান (বা র্ফার্ভাদিয়ান) নামে ভোজোৎসব সহ একটি উৎসব উদ্যাপন করতো এবং এটা দশ দিন যাবত চলত।
র্ফার্ভাদেগান্ বছরের শেষে পালন করা হতো এবং দৃশ্যত এটি ছিল একটি শোক পালনের অনুষ্ঠান; এটি প্রকৃতির নতুন জীবন লাভকে স্বাগত জানানোর অনুষ্ঠান উদ্যাপন ছিল না। প্রাচীন কালে এ অনুষ্ঠানটি র্ফার্ভাদিন মাসের প্রথম দিনে শুরু হতো, কিন্তু এভাবে কতদিন চলেছিল তা সুস্পষ্ট নয়। তবে শাহী দরবারে এ অনুষ্ঠানটি এক মাসব্যাপী চলত বলে জানা যায়।
কতক ডকুমেন্ট অনুযায়ী এ অনুষ্ঠানটি র্ফার্ভাদিন মাসের পাঁচ তারিখ পর্যন্ত চলত এবং এরপর মাসের শেষ পর্যন্ত বিশেষ উৎসব পালিত হতো। সম্ভবত র্ফার্ভাদিন মাসের প্রথম পাঁচ দিন ছিল সর্বসাধারণের উৎসব এবং তার প্রকৃতি ছিল জাতীয় এবং মাসের বাকি দিনগুলোর উৎসব ছিল ব্যক্তিগত পর্যায়ের, আর তার বৈশিষ্ট্য ছিল রাজকীয়।
এতে সন্দেহের কোনো কারণ নেই যে, নওরোয উৎসব একটি সুপ্রাচীন উৎসব এবং এটি ইরানিদের একটি জাতীয় উৎসব।
কয়েক হাজার বছর গত হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও ইরানিরা এবং আরো নয়টি দেশের জনগণ প্রতি বছর নওরোয উৎসব পালন করে থাকে। তারা তাদের বয়স, ভাষা, গোত্র, জাতীয়তা, সামাজিক অবস্থানের বিভিন্নতা এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এ উৎসবে অংশগ্রহণ করে থাকে। ফলে এ উৎসবটি একটি সীমান্ত অতিক্রমকারী বা বহুজাতিক উৎসবে পরিণত হয়েছে।
নওরোয সম্পর্কিত প্রাচীনতম পুরাতাত্ত্বিক দলিলপত্রাদি যা পাওয়া গিয়েছে তা এখন থেকে আড়াই হাজার বছর আগেকারÑ হাখামানেশী যুগের। তারাই এ অঞ্চলে সর্বপ্রথম একটি বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল; দক্ষিণ ইরানে যে পার্সেপোলিস সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে তা-ও তাদেরই গড়া ছিল। পার্সেপোলিসের সভ্যতার এ নিদর্শনসমূহ, যার মধ্যে বিশালায়তনের শাহী প্রাসাদ ও উপাসনালয়ও অন্তর্ভুক্ত ছিল তা আলেকজান্ডার কর্তৃক ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
পারস্য সভ্যতাকে বিভিন্ন সময়ে বহু ঝড়-ঝঞ্ঝা মোকাবিলা করতে হয়েছে; পারস্যবাসীদেরকে গৃহযুদ্ধ, ধ্বংসযজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলাসহ বহু বার কঠিন সময় পার করতে হয়েছে। কিন্তু সর্বাবস্থায়ই ইরান মানবিক সভ্যতার শীর্ষ অবস্থানে থেকেছে এবং নওরোযের চেতনার ভিতর দিয়ে বহু বৈজ্ঞানিক ও সামরিক সাফল্যের অধিকারী হয়েছে।
নওরোযের এ ধরনের ঐক্যবদ্ধকারী চেতনার কারণে ইরানের পুরো ইতিহাস জুড়েই বিভিন্ন সময় নওরোয বিজাতীয় আগ্রাসনকারীদের ও জাতীয় বিরোধীদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে।
বলা হয় যে, সম্রাট জাম্শীদ্ সর্ব প্রথম নওরোয উৎসবের প্রবর্তন করেন। এর বারো শতাব্দী পরে খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৭ অব্দে হাখামানেশী রাজবংশের মহান সম্রাট দরিউস্ তাঁর নির্মিত পার্সেপোলিস শহরে নওরোয উৎসব পালন করেন। সেদিন দর্শক-শ্রোতায় পরিপূর্ণ বিশালায়তনের শাহী হলঘরের অবজারভেটরি হয়ে সকাল ৬টা ৩০ মিনিটে উদীয়মান সূর্যের প্রথম আলো পতিত হয়েছিল। আর এটা ছিল এমন একটি ঘটনা প্রতি চৌদ্দশ’ বছরে যার পুনরাবৃত্তি ঘটে থাকে।
হাখামানেশী সম্রাটগণ পার্সেপোলিসে নওরোয উপলক্ষে তাঁদের সুবিশাল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত মেহমানদেরকে অভ্যর্থনা জানাতেন। বিশাল প্রাসাদের দেয়ালগুলোতে অঙ্কিত চিত্রসমূহে এ উৎসবের দৃশ্য প্রতিফলিত হয়েছে।
আমরা জানি যে, পার্থিয়ান্ রাজবংশের শাসনামলে ইরানিরা নওরোয উৎসব পালন করত। যদ্দূর জানা যায়, তারা এ উৎসবের ক্ষেত্রেও হাখামানেশী রাজবংশের রীতিনীতিরই অনুসরণ করত। আর সাসানি রাজবংশের শাসনামলে নওরোয উদ্যাপনের জন্য এ দিনের ২৫ দিন আগে থেকে প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু হতো।
এ যুগে বছরের বারো মাসের স্মরণে শাহী দরবারে মাটি ও ইট দ্বারা বারোটি স্তম্ভ নির্মাণ করা হতো। এসব স্তম্ভের মাথায় বিভিন্ন ধরনের শাক-সব্জিজাতীয় উদ্ভিদের বীজ বপন করা হতো। এসব বীজের মধ্যে থাকত গম, বার্লি, মশূরের ডাল, সীমজাতীয় উদ্ভিদ ইত্যাদি। এগুলো এমন সময়ে বপন করা হতো যে, এগুলো থেকে নওরোযের দিনে সবুজ চারা গজাতো এবং এক ধরনের সবুজের উৎসবের পরিবেশ তৈরি হতো।
এ উপলক্ষে সম্রাট জনগণকে অভ্যর্থনা জানাতেন এবং সকলের আগে সাম্রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ যাজক তাঁকে অভিনন্দন জানাতেন। তাঁর পরে সরকারি কর্মকর্তাগণ সম্রাটকে অভিনন্দন জানাতে এগিয়ে আসতেন। প্রত্যেকেই সম্রাটকে একটি উপহার দিতেন এবং সম্রাটের কাছ থেকে উপহার লাভ করতেন।
এভাবে উপহার প্রদান ও উপহার গ্রহণের ধারাবাহিকতা একাধারে পাঁচ দিন যাবত চলত। এ ক্ষেত্রে একেকটি দিন একেক ধরনের পেশার লোকদের জন্য নির্ধারিত থাকত। এরপর আসত ষষ্ঠ দিনÑ যেদিনকে বৃহত্তর নওরোয বলা হতো। এদিনে সম্রাট বিশেষ বিশেষ লোকদেরকে অভ্যর্থনা জানাতেন। এদিনে তিনি শাহী পরিবারের সদস্যদেরকে এবং তাঁর বিশেষ পারিষদবর্গকে অভ্যর্থনা জানাতেন। এছাড়া এ উপলক্ষে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হতো এবং তাতে ছোটখাট অপরাধের জন্য শাস্তিপ্রাপ্তদের দণ্ড মওকুফ করে দেয়া হতো।
নওরোয উপলক্ষে তৈরি করা স্তম্ভগুলো ষোলতম দিনে অপসারণ করা হতো এবং এভাবে নওরোযের অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটত। দেশের সাধারণ জনগণও নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী এ উৎসব উদযাপন করত।
ইরানে ইসলামের আগমনের পর প্রথম দুই শতাব্দী কালে সামাজিক-রাজনৈতিক বিবর্তনের কারণে নওরোয উৎসব তেমন একটা গুরুত্ব পায়নি। পরে উমাইয়াহ্ খলীফারা নওরোয উৎসবকে উপহারাদি গ্রহণের মাধ্যমে তাদের আয় বৃদ্ধির একটা গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হতে পারে মনে করে পুনরায় নওরোয উৎসবের প্রবর্তন করে।
তবে শাসকদের এ ধরনের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও ইরানের সাধারণ জনগণ সব সময়ই, বিশেষ করে বৈদেশিক শাসনে থাকাকালে, তাদের নওরোয উৎসবকে ধরে রাখার চেষ্টা করে।
উমাইয়াহ্ শাসকরা তাদের অন্ধ গোত্রপ্রীতির কারণে কুখ্যাত ছিল। তারা তাদের বিজিত অঞ্চলগুলোর ঐতিহ্য সমূহ ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সমূহ বিলুপ্ত করার জন্য চেষ্টার ক্ষেত্রে কোনোই ত্রুটি করে নি। তাই তারা ইরানিদের নওরোয উৎসব নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে স্বীয় অর্থভাণ্ডারকে সমৃদ্ধতর করার চেষ্টা করে। ঐতিহাসিক জর্জ যেইদান্ লিখেছেন যে, বনি উমাইয়াহ্র শাসনামলে নওরোয উৎসব পালনের অনুমতি লাভের জন্য ইরানিরা প্রতি বছর পাঁচ থেকে দশ হাজার রৌপ্য মুদ্রা সরকারি তহবিলে জমা দিতে বাধ্য হতো। তবে এভাবে মোটা অঙ্কের অর্থ প্রদানে বাধ্য হওয়া সত্ত্বেও ইরানিরা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নওরোয উৎসব পালন করত। উমাইয়াহ্ শাসকরা সব সময়ই তাদের ধনসম্পদের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধতর করার এবং তাদের আধিপত্যকে অধিকতর মজবুত করার চেষ্টা করত, যদিও বাহ্যত তারা তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য ইসলামের আশ্রয় গ্রহণ করত।
বস্তুত অতীতে নওরোয উৎসব ছিল এমনই জমকালো এবং এ উপলক্ষকে এমনই পবিত্র গণ্য করা হতো যে, এমনকি নিষ্ঠুরতম শাসকরাও এ উপলক্ষে বন্দি ও অপরাধীদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করত। যরথুস্ত্রীদের কাছে নওরোযের মর্যাদা যে কত বেশি ছিল তা এ দিনটি সম্পর্কে তাদের ধর্মীয় সূত্রে বিশেষ গুরুত্বের সাথে উল্লেখ থেকেই বুঝা যায়; বলা হয়, নওরোয সম্পর্কে আর্হু মায্দা (স্রষ্টা) বলেন : ‘র্ফার্ভাদিনের (প্রথম) দিনে এমনকি দোযখবাসীরাও এ পার্থিব জগতে ফিরে আসার ও তাদের পরিবারের লোকদের কাছে আসার সুযোগ লাভ করে।’
নওরোয অনুষ্ঠানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, এ উপলক্ষে বিশেষ কতগুলো জিনিস দিয়ে একটি দস্তরখান সাজানো হয়। এতে এমন সাতটি জিনিস রাখা হয় যেগুলোর নামের প্রথম বর্ণ হয় ফারসি ‘সীন্’ হরফ; এ কারণে এটিকে ‘হাফ্ত্ সীন্’ (সাত সীন্) বলা হয়ে থাকে। এতে সাধারণত সাত ধরনের কৃষিজাত দ্রব্য রাখা হতোÑ যেগুলোকে ইসলাম-পূর্ব যুগে প্রাণসঞ্জিবনী সাতটি উপকরণের প্রতিনিধিত্বকারী বলে গণ্য করা হতো। পরবর্তী কালে এতে ধাপে ধাপে পরিবর্তন সাধিত হয়।
বর্তমানেও হাফ্ত্ সীনের দস্তরখান সাজানো হয়, তবে তার উপকরণসমূহে অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে এবং এতে ব্যবহৃত সাত উপকরণের প্রাচীন কালীন উপকরণাদির সাথে তেমন একটা মিল নেই। বর্তমানে হাফ্ত্ সীনের দস্তরখানে প্রাচীন কালের মতোই প্রবৃদ্ধির নিদর্শন হিসেবে গম বা বার্লি রাখা হয়। সেই সাথে যোগ করা হয় কাচের আধারে রক্ষিত মাছÑ যা সহজেই সংগ্রহ করা যায়। তেমনি পানিও রাখা হয়। তাছাড়া আগুনের মতো উপকারী জিনিসের নিদর্শনস্বরূপ মোমবাতি জ্বালানো হয়। বর্তমানে তাতে আয়নাও রাখা হয়, তবে এটা কখন কীভাবে যুক্ত হয় তা জানা যায় নি।
প্রাচীন কালে হাফ্ত্ সীনের দস্তরখানে ব্যয়বহুল দ্রব্যাদি রাখা হতো এবং তার কতক দ্রব্য হতো চকচকে ধাতবের তৈরি। অবশ্য এমনটা মনে করা ঠিক হবে না যে, প্রতিটি পরিবারই তার হাফ্ত্ সীনের দস্তরখানে অভিন্ন জিনিস রাখত। বর্তমানে যরথুস্ত্রীরা তাদের হাফ্ত্ সীনের দস্তরখানে আয়নার সামনে জ্বালানো মোমবাতি রাখে। অতীতে তাদের দস্তরখানে সব সময়ই মদ রাখা হতো। যেহেতু ইসলামে মদ হারাম সেহেতু বর্তমানে তার পরিবর্তে ভিনের্গা রাখা হয়।
হাফ্ত্ সীনের দস্তরখানের অন্যতম উপাদান হচ্ছে ডিম। কারণ, ডিম হচ্ছে পৃথিবীর উর্বরতা ও জন্মদানে সক্ষমতার প্রতীক। রসূন রাখা হয় এতে নিহিত বিবিধ কল্যাণের কারণে। বর্তমানে সামানু নামক এক ধরনের বাদামি রঙের আটাজাতীয় খাদ্যদ্রব্যও রাখা হয়। এটি অত্যন্ত পুষ্টিকর খাদ্যদ্রব্য, এ কারণে এটি ভোজোৎসবেও রাখা হয়। ধন-সম্পদ ও উন্নতি-অগ্রগতির নিদর্শন হিসেবে ধাতব মুদ্রা, ফলমূল ও বিশেষ ধরনের খাদ্য-উপকরণও রাখা হয়।
ইরানের স্বনামখ্যাত বিশ্ববিশ্রুত মহাকবি র্ফেদৌসী তাঁর শাহ্নামা কাব্যগ্রন্থে নওরোয উৎসবের কথা উল্লেখ করেছেন ও এর বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে :
‘জাম্শীদের প্রতি যখন জনগণের মণিমুক্তা-রতœাদি প্রবাহিত হতো/ তারা তাঁকে ফরিয়াদ করে জানাতো যে, নতুন বছর আলোক বিক্ষেপণ করেছে/ র্ফার্ভাদিন্ র্হমূযের এ সমুজ্জ্বল নতুন বছরে/ ব্যথা-বেদনা থেকে শরীরগুলো মুক্ত হতো, হৃদয়গুলো মুক্ত হতো ভয়-ভীতি থেকে?/ নতুন বছরে যেন নতুন বাদশাহ্, তাই পৃথিবী দান করেছে সমুজ্জ্বলতা/ তিনি সমাসীন হয়েছেন সমুজ্জ্বলতা সহকারে সিংহাসনে আলোকিত দিনে।’
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, ইউনেস্কো ২০১০ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি মানবজাতির অন্যতম অবিস্মরণীয় সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার হিসেবে আন্তর্জাতিক নওরোয দিবসকে তালিকাভুক্ত করেছে।
*লেখিকা ইরান রিভিউ ডট্ অর্গ্-এর ডেপুটি এডিটর।

অনুবাদ : নূর হোসেন মজিদী