All posts by dreamboy

বিশিষ্টজনদের দৃষ্টিতে ইমাম খোমেইনী (রহ.)

মুসলমান এবং বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের নেতা, ইসলামী ইরানের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর ইন্তেকাল তাঁর কোটি কোটি অনুসারীকে শোকাকূল করে তোলে। যারা ইমামের পথ ও তাঁর আদর্শিক নীতি অনুসরণ করত এবং আন্তরিকভাবে ভালোবাসত তারা তাঁর মৃত্যুতে কান্নায় ভেঙে পড়ে। ইসলামী বিপ্লবের নেতার মৃত্যুতে তাঁর মহান ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পরিচিত বিশ্বে শোকের ছায়া নামে। সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও বৈজ্ঞানিক ব্যক্তিত্বরা তাঁর সম্পর্কে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে মন্তব্য করেন। এমনকি তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর কিছু শত্রুও লজ্জিত হয়। এখানে ইমামের মহান ব্যক্তিত্ব এবং ইসলামী চিন্তাধারার পুনরুজ্জীবন ও বিশ্বব্যাপী ইসলামী বিপ্লবে তাঁর ভূমিকা সম্পর্কে বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের কিছু মতামত তুলে ধরা হলো। এসব মতামতের মধ্যে কোন কোনটি ইমামের মৃত্যুর আগেই করা হয়েছিল।

লেবানন এবং সারা বিশ্বের মুসলমানরা বিশ্বাস করে যে, বিশ্বের দাম্ভিক শক্তিসমূহের আধিপত্য থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ইসলামী ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালাতে হবে এবং ইমাম খোমেইনীর নেতৃত্বকে অনুসরণ করতে হবে। বিশ্বের নির্যাতিত জনগণ ইরানের ইসলামী বিপ্লবের ওপর তাদের আশা-আকাক্সক্ষা ন্যস্ত করেছে।’- আহমদ জাকি তাফাহি, লেবাননী চিন্তাবিদ

ইমাম খোমেইনী শুধু তাঁর জাতির ইতিহাসের ধারাই পরিবর্তন করেননি, তিনি ২০ শতকের শেষার্ধের ইতিহাসে তার প্রত্যক্ষ প্রভাবও রেখেছেন।’- ইরানে নিযুক্ত আরব সাহারা প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রদূত (১৯৯১)

ইমাম খোমেইনী একজন খাঁটি মুসলমান। তিনি আমাদের দ্বীনি ভাই। তিনি আমাদের মতোই ইসলামের পতাকাতলে থেকেই সামনে অগ্রসর হচ্ছেন।’- আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শায়েখ, মিশর।

বর্তমান বিশ্বে একটি মাত্র ইসলামী সরকার আছে এবং সেটা হচ্ছে ইমাম খোমেইনীর সরকার। কারণ, এই একমাত্র সরকারই ইসলামী শরীয়ার প্রতিটি বিধান বাস্তবায়ন করেছে। অবশিষ্ট আর কোন সরকারই ইসলামী সরকার নয়। ফিলিস্তিনী চিন্তাবিদরা বিশ্বাস করেন, ইমাম খোমেইনী একজন বুদ্ধিমান, জ্ঞানী ও সাহসী মুজাহিদ নেতা, যিনি বিশ্বের মুসলমানদের নেতৃত্ব দিতে পারেন।’- শেখ ইউসুফ জিরাইল, ফিলিস্তিনী চিন্তাবিদ

আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেইনী ইসলামী উম্মাহর ইমাম হওয়ার যথেষ্ট দাবি রাখেন। আমার মতে, তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি বর্তমান মুসলিম বিশ্বের সকল নেতার চেহারা থেকে অপমান, সংকীর্ণতা ও অলসতার চিহ্ন মুছে ফেলেছেন। তিনি মুসলিম ও অমুসলিম জাতিসমূহের মধ্যে ইসলামী মূল্যবোধ পুনরুজ্জীবিত করেছেন। নিশ্চয়ই ইতিহাস এসব বিষয় চিরকালের জন্য রেকর্ড করে রাখবে। তিনি ইমাম আলী (আ.)-এর জীবন্ত উদাহরণ।’- আলজেরিয়ার শিক্ষা ও ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রী (১৯৯১)

এটা নিঃসন্দেহ যে, বিপ্লবের নেতা-যিনি একজন আলেম-ইরানী বিপ্লবের বিজয় অর্জনের মূল ব্যক্তি। বিশ্বের সকল মুক্তিকামী ও নির্যাতিত মানুষের হৃদয়ে তিনি আলোড়ন তুলেছেন। তিনি শুধু ইরানের নন, সারা বিশ্বের মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সকল নির্যাতিত মানুষের নেতা। তারা তাঁকে একজন মুক্তিদূতরূপে গণ্য করে।কাপুচি, ফিলিস্তিনী আর্চ বিশপ।

পাকিস্তানের মুসলমানরা ইরানের ইসলামী বিপ্লবের বলিষ্ঠ সমর্থক। পাকিস্তানের সভা সমাবেশগুলোতে ইমাম খোমেইনী ও বিপ্লব আলোচনার দুটি প্রধান বিষয়। বিশ্বের দাম্ভিক শক্তিসমূহ এটা ভালো করে জানে, ইরানের ইসলামী বিপ্লব এবং ইমাম খোমেইনীর প্রতি বিশ্বের নির্যাতিত জাতিসমূহের সমর্থন রয়েছে।’- আল মোন্তাজেরী ধর্মীয় কেন্দ্রের প্রধান, পাকিস্তান

ইরানের ইসলামী বিপ্লব সত্যিকারের মানুষ ও সমাজের একটি নয়া দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছে। ইরানের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্য জগতের শত্রুতার এটাই কারণ। ইমাম খোমেইনী ইরানীদের জীবনকে নতুন করে অর্থবহ করে তুলেছেন।’- রজার গারুদী, ফরাসী বুদ্ধিজীবী

ইমাম খোমেইনীর নেতৃত্বে সংঘটিত ইরানের মহান ইসলামী বিপ্লব আমাদের জন্য মহা শিক্ষা নিয়ে এসেছে। এখনও যদি আমরা ঘুম থেকে না জাগি তাহলে শত্রুরা আমাদের মতবিরোধকে কাজে লাগাবে এবং আমাদের ওপর নির্যাতন চালাবে।’- মাওলানা আতাহারী, কাশ্মীরের একজন সুন্নি মুফতি।

কেবল ইসলাম ও ইমাম খোমেইনীর পথ অনুসরণ করলেই ফিলিস্তিনী বিপ্লব সাফল্য লাভ করবে। ইসলামী বিপ্লব থেকে অনেক দূরে থাকার কারণে এবং অঞ্চলের নতজানু ও প্রতিক্রিয়াশীল নেতাদের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য ফিলিস্তিনী বিপ্লব এখনও সাফল্য লাভ করেনি, যদিও হাজার হাজার শহীদ তাঁদের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন।… আমরা ঘোষণা করছি, ইমাম খোমেইনী হচ্ছেন সারা বিশ্বের মুসলমানদের, বিশেষ করে অধিকৃত অঞ্চলের নেতা… আমরা তাঁর প্রতি আবারো আনুগত্য প্রকাশ করছি। আল-কুদস মুক্ত করা এবং ফিলিস্তিনী জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রচেষ্টারত মুসলমানদের জন্য ইরান হচ্ছে আজ একটি শক্তিশালী ঘাঁটি।’- শেখ ইউসুফ সানি, জুমআর জামায়াতের ইমাম, ফিলিস্তিন।

আমি ইরানীদের অনুরোধ করছি, তারা যেন বিপ্লবের প্রতি সর্বাত্মক যত্নবান থাকেন। ইমাম উপ¯হাপিত এই বিপ্লবের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যাতে সাফল্য লাভ করে সে বিষয়টির প্রতি আপনারা পরিপূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে দৃষ্টি রাখবেন এবং সেগুলোর প্রতি গুরুত্ব দেবেন। এই বিপ্লবকে সংরক্ষণ করা, এমনকি আপনাদের নিজেদের শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করতে হবে। কোন ব্যক্তির জীবনের চেয়েও এই বিপ্লবের গুরুত্ব অনেক বেশি বলে এর প্রতি যত্নবান হতে হবে। কারণ, একজন ব্যক্তির আশা-আকাক্সক্ষা থাকে তার নিজের মাঝেই সীমাবদ্ধ।’- মুনির শফিক, ফিলিস্তিনী ইসলামী চিন্তাবিদ।

ইমাম খোমেইনী এবং ইরানী জাতি একটি মহান ঐতিহাসিক কাজ করেছেন। আমার মতে, একজন পশ্চিমা ও অমুসলিম ব্যক্তি হিসেবে আমি বিশ্বাস করি, আজকের দুনিয়ার এভাবে একটি ধর্মীয় আদর্শভিত্তিক বিপ্লব সংঘটিত হওয়া এক অলৌকিক ঘটনা।’- রবার্ট কালসন, কানাডীয় বিজ্ঞানী

ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার সহায়তায় ও ইমামের নেতৃত্বে ইরানী জাতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে। এই দায়িত্ব পালন করে যদি তারা মানব জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা কায়েমে সফল হয় তা হলে মুসলিম দেশসমূহ তাদের পথ অনুসরণ করবে।’- হামিদ আলগার, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।

আয়াতুল্লাহ খোমেইনীর নীতিবোধ থেকে উৎসারিত আওয়াজের কারণেই ইরানের ইসলামী বিপ্লব মর্যাদার দাবিদার।’- উইলিয়াম ওয়ারসি, মার্কিন লেখক ও সাংবাদিক

ইরানের ইসলামী বিপ্লব বিশ্বের আশ্রয়হীন লোকদের আশ্রয়স্থল এবং ইমাম খোমেইনীই হচ্ছেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি নিপীড়িত ও বঞ্চিতদের পক্ষে। তিনি যালিমদের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় কথা বলেন। ইমামের প্রতি আকর্ষণ এ রকম যে, শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে সকল মুসলমান তাঁর সত্যবাদিতায় বিশ্বাস করেন।’- হায়দার আলী, হায়দরাবাদ জুমআর জামায়াতের ইমাম, পাকিস্তান।

ইমাম খোমেইনী শুধু ইরানের নেতাই নন, তাঁর নাম শুনে দক্ষিণ আফ্রিকার নির্যাতিত জনগণের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। বিশ্বের জেনে রাখা উচিত, ইমাম খোমেইনী দুনিয়ার নিপীড়িত মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক।’- আবদুল্লাহ বিদাত, দক্ষিণ আফ্রিকার মুসলিম যুবনেতা।

বর্তমানে ইমাম খোমেইনীর শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের সুখ্যাতি আমেরিকা, এমনকি শিশুদের মধ্যে সম্ভবত এ কারণে ছড়িয়ে পড়েছে যে, তিনি বিশ্বের সামনে ইসলামের শক্তি এবং পাশ্চাত্যের দুর্বলতা প্রমাণ করেছেন। ইমাম খোমেইনীর নেতৃত্বের বদৌলতে এবং মুসলিম ইরানী জাতির সাহস ও প্রতিরোধের ফলেই ইরানে ইসলামী বিপ্লবের সাফল্য অর্জিত হয়েছে।’- শেখ মুহাম্মাদ জাভেদ আলশারী, জুমআর জামায়াতের ইমাম, ডেট্রয়েট, যুক্তরাষ্ট্র

তাঁর দেশে এবং বিশ্বের বিশাল এলাকায় তিনি (ইমাম খোমেইনী) যে কাজ করেছেন তা অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও গভীর চিন্তায় রেখে তাঁর সম্পর্কে কারো মতামত প্রকাশ করা উচিত।’- পোপ দ্বিতীয় জন পল।

ইমাম খোমেইনী গৌরব নিয়ে এ পৃথিবীতে বেঁচেছিলেন এবং গৌরবের সঙ্গেই এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। তিনি বর্তমানে মুসলিম বিশ্বের সামনে বিশ্বাস, দয়া ও সহজ সরলতার শ্রেষ্ঠতম দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন।’- হাফিজ আল-আসাদ, সিরিয়ার প্রেসিডেণ্ট (১৯৯১)

ইমাম খোমেইনীর নাম ইরানের ইতিহাসে নয়া অধ্যায়ে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে।’- এরিক হোনেকা, জার্মানি

ইমাম খোমেইনীর মৃত্যু বিশ্বের স্বাধীনতাকামী মানুষকে শোকাভিভূত করেছে।’- আর্নেস্টো কার্ডিনাম, নিকারাগুয়ার যুদ্ধবিশারদ

(নিউজলেটার, জুন ১৯৯১)

ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর সংগ্রামী জীবন

প্রতিটি আত্মাকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।মানবতার উদ্দেশ্যে আল্লাহ তাআলার এই বাণী ইসলামী বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর জান্নাত যাত্রার উদ্দেশ্যে পৃথিবী থেকে বিদায়ের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।

ইসলামী বিপ্লবের মহান নেতা ও ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেইনী (রহ.) রাজনীতি ও সংগ্রামের ক্ষেত্রে কেবল একজন অনন্য বিশ্বনেতাই ছিলেন না; বরং আইনবিজ্ঞান, দর্শনশাস্ত্র, সূফিতত্ত্ব ও নীতিশাস্ত্রের বিশেষজ্ঞ হিসাবেও ইসলামী বিশ্বের এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি এসব ক্ষেত্রে পূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন এবং ইসলামী নীতির অনুশীলন ও ধর্মীয় ঐতিহ্য মেনে চলার ব্যাপারে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন।

ইমাম খোমেইনীর জ্ঞান, ঈমান, দৃঢ়তা, অভ্যন্তরীণ চারিত্রিক সৌন্দর্য এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির ওপর ধারণা এতই গভীর ছিল যে, তা সংক্ষিপ্ত কোন নিবন্ধে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। একটি বিখ্যাত কবিতায় যেমন বলা হয়েছে : সমুদ্র থেকে আমরা পানি তুলতে পারি না, কিন্তু তৃষ্ণা তো মেটাতে পারি নিশ্চয়ই।এই নিবন্ধ তেমনই এক প্রচেষ্টা মাত্র।

ইমাম খোমেইনী (রহ.) ১৩২০ হিজরির ২০ জমাদিউস সানী ইরানের খোমেইন শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তারিখটি হযরত ফাতিমা (আ.)-এর জন্মদিন। তিনি ৮৯ বছর বয়সে ১৪০৯ হিজরি মোতাবেক ১৯৮৯ সালের ৩রা জুন ইন্তেকাল করেন।

তাঁর পিতা শহীদ আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ মুস্তফা মুসাভী ছিলেন একজন বিখ্যাত আলেম আল্লামা সাইয়্যেদ আহমদ মুসাভীর পুত্র।

ইমাম খোমেইনীর মাতা হাজেরা একটি ধর্মীয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনিও ইসলামী জ্ঞানের অধিকারী ও ধর্মনিষ্ঠ ছিলেন। মোহতারেমা হাজেরার পিতা ছিলেন মরহুম আয়াতুল্লাহ মির্জা আহমদ। তিনি তদানীন্তন সময়ের একজন বিশিষ্ট আলেম ছিলেন।

অত্যাচার ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রামের দায়ে সাইয়্যেদ মুস্তফা মুসাভীর শাহাদাতের পর তাঁর বোন সাহিবা এই শিশুর অভিভাবক হন। মাত্র পাঁচ মাস বয়স থেকেই ইমাম খোমেইনী তাঁর প্রিয় ফুফু ও মায়ের কাছে লালিত-পালিত হন। এছাড়া খাভের নামে তাঁর একজন ধাত্রী ছিল। তাঁরা তাঁকে সার্বিকভাবে গড়ে তোলেন।

যুগস্রষ্টা মানুষেরা সর্বদাই দুঃখ-কষ্ট, মানসিক চাপ, একাকিত্ব, নির্বাসন ও বিদ্রোহের সম্মুখীন হন এবং এভাবেই তাঁরা অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হওয়ার ভাগ্য লাভ করেন। ইমাম খোমেইনী তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তাঁর ফুফু সাহিবা ইন্তেকাল করেন। এর কিছুদিন পর ১৩৩৬ হিজরিতে তাঁর মাতা হাজেরা ইন্তেকাল করেন। এসব দুঃখ ও শোক ইমাম খোমেইনীকে সহায়হীন ও পিছপা করার পরিবর্তে আরো অভিজ্ঞ ও মহৎ আত্মশক্তির অধিকারী করে তোলে। তিনি সকল পরিস্থিতি সাহসিকতার সাথে মোকাবিলা করেন এবং আত্মবিশ্বাস ও নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে অগ্রগতি, পরিশুদ্ধি, সুশিক্ষা ও জ্ঞান অর্জন করেন।

অত্যন্ত উন্নত প্রতিভার অধিকারী ইমাম খোমেইনী শিশুকালে মির্জা মাহমুদ নামের একজন শিক্ষকের কাছে বাড়িতেই তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু করেন। পরে তিনি মক্তবে ভর্তি হন। মক্তবের প্রধান ছিলেন মোল্লা আবুল কাশেম। পরে তিনি নব প্রতিষ্ঠিত একটি স্কুলে শিক্ষা জীবন শুরু করেন। শেষ পর্যায়ে মাত্র পনের বছর বয়সে তিনি ফারসি ভাষা শেখার কাজ শেষ করেন। এর পর তিনি তাঁর ভাই সাইয়্যেদ মুর্তাজার (আয়াতুল্লাহ পাছান্দিদের) কাছে যুক্তিশাস্ত্র, আরবি ভাষা ও ব্যাকরণসহ ইসলামী বিজ্ঞান শিক্ষা শুরু করেন। ইমাম খোমেইনী আরো অধ্যয়নের জন্য ইসফাহানের ধর্মতত্ত্ব স্কুলে গমন করেন। তিনি খোমেইন অবস্থান করেন ১৬ থেকে ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত। ১৩৩৯ হিজরিতে তিনি আরাক যান। ঐ সময় সেখানে (মরহুম) হাজী শেখ আবদুল করীম হায়েরী বসবাস করতেন। সেখানে তিনি অভিজ্ঞ ও দক্ষ শিক্ষকম-লীর কাছে সাহিত্য শিক্ষা শুরু করেন। ১৩৪০ হিজরিতে আয়াতুল্লাহ হায়েরী আরাক থেকে কোমের ধর্মতাত্ত্বিক মাদরাসায় বদলী হলে ইমাম খোমেইনীও সেখানে যান এবং মুতাওয়াল-এর ওপর (আরবি শিক্ষা গ্রন্থ) অধ্যয়ন ও গবেষণা শুরু করেন।

কোম নগরীতে মুতাওয়াল-এর ওপর ব্যাপক অধ্যয়ন, গবেষণা ও নিরলস সাধনার ফলে ইমাম খোমেইনী ১৩৪৫ হিজরিতে অধিক সাফল্যের সাথে তাতে কৃতকার্য হন।

মরহুম হাজী শেখ আবদুল করীম হায়েরীর ক্লাসসমূহে যোগদানের মধ্য দিয়ে তিনি বিজ্ঞান ও ধর্মীয় জ্ঞানের ভিত্তি রচনায় প্রভূত অগ্রগতি অর্জন ও ইজতিহাদের যোগ্যতা লাভ করেন। ১৩৫৫ হিজরিতে আয়াতুল্লাহ হায়েরী ইন্তেকাল করলে ইমাম খোমেইনী একজন মুজতাহিদ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। কোমের ধর্মতাত্ত্বিক মাদরাসায় তিনি বিশেষজ্ঞ শিক্ষক হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেন।

আইন শাস্ত্রের ওপর উচ্চতর জ্ঞানের পর্যায় অর্জন করা ছাড়াও ইমাম খোমেইনী (রহ.) জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন ও সূফিতত্ত্বেও ব্যাপক জ্ঞান অর্জন করেন।

আধ্যাত্মিক শক্তি অর্জনের জন্য ইমাম খোমেইনী ছেলেবেলা থেকেই ইসলামী শিক্ষাচর্চার মাধ্যমে নিজেকে পরিশুদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালান। স্বল্প সময়ের মধ্যে তিনি উচ্চতর আধ্যাত্মিক পর্যায় অর্জন করেন এবং সে সময়ের খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ববর্গের মধ্যে একজন হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেন। ইজতিহাদের যোগ্যতা অর্জনের পর থেকে তিনি ইমাম হিসাবে নেতৃত্বে সমাসীন হন। তিনি কখনই নিজের মর্যাদার ভাব প্রকাশ করেননি এবং কখনই জনসাধারণের দানের অর্থ নিজের জন্য ব্যয় করেননি। সত্যিকার অর্থে তিনি পদমর্যাদাকে অপছন্দ করতেন এবং সর্বদা এ ধরনের বিষয় থেকে দূরে থাকতেন। এটা এই কারণে যে, তিনি মনে করতেন, ইসলাম, ইসলামী সমাজ বিপদাপন্ন। একে রক্ষা করতে হবে এবং এ উদ্দেশ্যে বিক্ষিপ্ত জনগণকে নেতৃত্ব দিতে হবে।

সকল দিক ও বিষয়ে ইমাম খোমেইনীর জীবন ছিল খুব সুশৃঙ্খল। এমনকি অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির তুলনায়ও সুশৃঙ্খল জীবন যাপনে তিনি ছিলেন অনন্য। সমকালীন যুগে এমন ব্যক্তির কথা না শোনা গেছে, না দেখা  গেছে। তিনি শৃঙ্খলার সাথে তাঁর সকল কাজ সম্পাদন করতেন। ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত ইত্যাদি সকল কাজের ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ্য। তাঁর জীবন এতই সুশৃঙ্খল ও নিয়মানুবর্তী ছিল যে, তাঁর পরিবারের সদস্যরা অনায়াসে বলতে পারত তাঁর কর্মতৎপরতা সম্পর্কে।

এটা বিস্ময়কর যে, ইমাম খোমেইনী তাঁর চলাফেরা বা নড়াচড়ার ক্ষেত্রেও একটি বিশেষ শৃঙ্খলা মেনে চলতেন। উদাহরণস্বরূপ তিনি যখন উঠে দাঁড়াতে চাইতেন তখন বাম হাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াতেন। যখন বাড়ি, স্কুল বা মসজিদে প্রবেশ করতেন তখন ডান পা আগে দিয়ে প্রবেশ করতেন। রাস্তায় তিনি সব সময় ডান পাশ দিয়ে হাঁটতেন। তিনি হাঁটার সময় সৈনিকের মতো মাথা ও ঘাড় সোজা করে অগ্রসর হতেন।

ইমাম খোমেইনী ১৩৪৮ হিজরি পর্যন্ত একাকী জীবন যাপন করেন। ঐ বছরই তাঁর বিবাহের ক্ষেত্র তৈরি হয় এবং তিনি আয়াতুল্লাহ হাজী মির্জা মুহাম্মাদ সাকাফী তেহরানীর কন্যা খাদিজাকে বিবাহ করেন।

ইমাম খোমেইনীর পরিবারে দুই পুত্র ও তিন কন্যা জন্মগ্রহণ করে। তাঁর প্রথম পুত্র হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলেমীন হাজী সাইয়্যেদ মোস্তফা এবং দ্বিতীয় পুত্র হুজ্জাতুল ইসলাম হাজী সাইয়্যেদ আহমদ। তাঁর তিন কন্যা হলেন : সিদ্দিকা, ফরিদা ও ফাতিমা। এদের মধ্যে ড. যাহরা মুস্তফাভী (ফরিদা) তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপিকা এবং ইরানের মহিলা সমিতির প্রধান (১৯৯১ সাল)।

দর্শনশাস্ত্র ও সূফিতত্ত্বের ওপর গবেষণার ক্ষেত্রে ইমাম খোমেইনীর অসাধারণ দক্ষতা তাঁকে কোমের ধর্মতত্ত্ব শিক্ষাকেন্দ্রে একজন অসাধারণ যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকে পরিণত করে। এই কারণে বিপুলসংখ্যক আলেম ও ছাত্র তাঁর কাছে জ্ঞানচর্চা করতে আসেন। এক কথায় বলা  চলে যে, কোমের ধর্মতাত্ত্বিক মাদরাসার অধিকাংশ শিক্ষকই তাঁর ছাত্র ছিলেন।

ইমাম খোমেইনী তাঁর ছাত্রদেরকে আত্মার পরিশুদ্ধি এবং আধ্যাত্মিক ও নৈতিক শক্তি অর্জনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করতেন। এ কারণে তিনি দর্শন ও সূফিতত্ত্বের শিক্ষাদান ছাড়াও ছাত্রদের জন্য হেদায়াতের ক্লাস চালু করেন।

ঐ ক্লাসগুলো এতই আকর্ষণীয় ও গভীর জ্ঞানপূর্ণ ছিল যে, অল্পদিনের মধ্যেই শত শত ধর্মীয় আলেম ও কোমবাসী তাতে অংশগ্রহণ করতে থাকে।

ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা এবং তাঁর ক্লাসসমূহে যোগদানকারীদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা ইরানের তদানীন্তন শাসক শাহ রেজা খান পাহলবী ও তাঁর গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ভীত করে তোলে। সে কারণে তারা তাঁকে বাধা দেয়ার প্রচেষ্টা শুরু করে। কিন্তু তারা সম্মুখীন হয় ইমাম খোমেইনী দৃঢ়তা এবং নজিরবিহীন প্রতিরোধ আন্দোলনের।

ইমাম খোমেইনী কোমের ধর্মতাত্ত্বিক মাদরাসার ছাত্র ও শিক্ষকদের মাঝে বিজ্ঞান শিক্ষার অগ্রগতি বিষয়েও এক তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর নির্বাসন ইরানে ইসলামী ও স্বাধীনতা আন্দোলনের ওপর ছিল আঘাতস্বরূপ। শত শত আলেম তাঁর নির্বাসনের ফলে জ্ঞান আহরণ ও বিজ্ঞানচর্চা থেকে বঞ্চিত হন।

নাজাফের আলেমগণও ইমাম খোমেইনীর বিশাল জ্ঞানভাণ্ডার থেকে আলো গ্রহণ করেছেন এবং তাঁর ক্লাসসমূহে যোগদানের সুযোগ গ্রহণ করেছেন। নাজাফের ধর্মতাত্ত্বিক বিদ্যালয়ের আলেমদের এমন কথা বলতে শোনা যায় : আয়াতুল্লাহ খোমেইনী নাজাফে আসার আগে আমরা বুঝতে পারিনি যে, ইসলামী বিজ্ঞানের জগতে নতুন তথ্য রয়েছে। কিন্তু তিনি যখন নাজাফে আগমন করলেন এবং ক্লাস নেয়া শুরু করলেন, তখন আমরা মূল্যবান বৈজ্ঞানিক প্রমাণাদি সম্পর্কে জানতে পারলাম যা আগে কখনও শুনিনি।

বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে অনন্য মর্যাদা ও পর্যায় অর্জন করা ছাড়াও তিনি আইন, দর্শন ও সূফিতত্ত্বেও বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন। কবিতা রচনায়ও তিনি ছিলেন অনন্য। তিনি নীতিশাস্ত্র, তত্ত্ববিদ্যা ও অন্যান্য বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়ে বেশকিছু গ্রন্থ সংকলন করেছেন। ২৭ বছর বয়সে ইমাম খোমেইনী তাঁর মিসবাহুল হিদায়াতগ্রন্থটি সংকলিত করেন। এ গ্রন্থটি খোদায়ী শিক্ষার এক অনন্য উদাহরণ। ২৯ বছর বয়সে তিনি রমযান মাসের ফজরের নামাযশীর্ষক একটি পুস্তক রচনা করেন। এই পুস্তকে ইমাম খোমেইনীর বুদ্ধিবৃত্তিক উচ্চতার প্রমাণ মেলে। তিনি বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়ের ৭টি হাদীস ও নীতিনৈতিকতা বিষয়ক ৩৩টি হাদিসের ব্যাখ্যা সম্বলিত আরবায়ীন হাদিসনামে আরেকটি গ্রন্থ রচনা করেন। ইমাম খোমেইনী সংকলিত অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে : ইসলামী সরকার বা বেলায়েতে ফকীহএবং নাফসের বিরুদ্ধে জিহাদ বা জিহাদে আকবর

ইমাম খোমেইনীর জনপ্রিয়তায় মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (সিআইএ) এবং ইহুদিবাদী ও ইসলামবিরোধী শাহের সরকার ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। তারা যখন দেখতে পেল যে, তাদের লুণ্ঠন ও ঔপনিবেশিক স্বার্থ বিপন্ন হয়ে পড়ছে তখন তারা ইমামের নেতৃত্ব থেকে ইসলামী জাতিকে বঞ্চিত করার লক্ষ্যে তাঁর কাছ থেকে জনগণকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য নানা পন্থা অবলম্বন করে। ইরানে কেউ যদি ইমামের জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য নিয়ে কথা বলে তাহলে তাকে গ্রেফতার, অত্যাচার, কারাগারে প্রেরণ বা নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া হয়। কেউ তাঁকে অনুসরণ (তাকলিদ) করলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। তাঁর রিসালাহ্ (ধর্মীয় আইনশাস্ত্রের বই) বাজার থেকে তুলে নেয়া হয় এবং নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। শাহের ভাড়াটেরা ইসলামী ও আরব দেশসমূহে ইমাম খোমেইনী সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা জোরদার করে। এসব দেশের জনগণ ইরানের প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না।

ইমাম খোমেইনী ইরানী সমাজের সকল ক্ষেত্রে গবেষণা চালানোর ফলে বুঝতে পেরেছিলেন যে, ইরানের মুসলিম জনগণকে প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাধারা থেকে উদ্ধার ও মুক্ত করার একমাত্র পথ হচ্ছে গণঅভ্যুত্থান কিংবা বিপ্লব আর এটা পরিচালনা করতে হবে মারজায়ে তাকলিদের মাধ্যমে (মারজা হচ্ছেন কোন অনুসরণযোগ্য মুজতাহিদ ব্যক্তিত্ব)। তিনি যখন জানলেন কুরআনের শিক্ষা অনুযায়ী তাঁর দায়িত্ব হচ্ছে সংগ্রাম ও বিপ্লব সৃষ্টি করা এবং তার মধ্যে কাজ করছে একটি বিপ্লবী চেতনা, তখন বিপ্লবের কাজ শুরু করলেন। তিনি বিপ্লবী পদ্ধতি প্রয়োগ করে তাঁর আন্দোলন শুরু করলেন এবং কী হতে যাচ্ছে তা তিনি ছাড়া আর কেউ জানত না।

এই বুদ্ধিবৃত্তিক কৌশল প্রয়োগ এবং বিপ্লবের সাথে তাঁর গোপন সংশ্লিষ্টতা ছিল এক অসাধারণ কর্মপ্রচেষ্টা, যা ইমাম খোমেইনীর মতো একজন মানুষের পক্ষেই চালানো সম্ভব হয়েছে। শাহের সরকার ও তাঁর দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞরা এসব কর্মকাণ্ড দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। এতসবের মধ্যেও ইমাম খোমেইনী জনসাধারণ ও সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে জানতে না দিয়ে তাঁর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন।

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনসুরের পুতুল সরকার ইরানী পার্লামেন্টে ক্যাপিটিউলেশন বিলনামে এক কুখ্যাত আইন পাশ করে। উক্ত আইনে ইরানে বসবাসরত মার্কিন নাগরিকদের এমন কিছু সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়, যা পৃথিবীর কোন দেশে কোন বিদেশী নাগরিক পেতে পারে না। এ আইন পাশের খবর ইমামের কানে পৌঁছলে তিনি এর বিরোধিতা করে বক্তব্য রাখেন। তেহরানে ইমাম খোমেইনীর সমর্থকবৃন্দ দশ মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে ৪০ হাজার ঘোষণাপত্র বিলি করেন। ঘোষণাপত্রটি কুখ্যাত ক্যাপিটিউলেশন আইন সম্পর্কে ইমামের মতামতের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছিল। ঘোষণাপত্রের সারসংক্ষেপ ছিল নিম্নরূপ : আমাদের অভাব-অভিযোগ, দুঃখ-কষ্ট তুলে ধরা মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর দায়িত্ব। এহেন অপমানের প্রতিবাদ করার ভার এখন ইসলামী মুবাল্লিগ ও বক্তাদের ওপরই ন্যস্ত। সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে দেশের স্বাধীনতার জন্য কলম ধরতে হবে, সংগ্রাম করতে হবে। রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়কদের উচিত পার্লামেন্টে গৃহীত সিদ্ধান্তের পিছনে কী রহস্য নিহিত রয়েছে সে সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করা। এ  সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি সর্বসম্মত নীতি গ্রহণ করতে হবে। ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের ইসলাম ও কুরআনের গৌরব বৃদ্ধির জন্য সচেষ্ট হওয়া এবং একই মুসলমানদের সমর্থনে কাজ করা উচিত।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি শাহী সরকারের নতজানু মনোভাব সম্পর্কে মন্তব্য প্রসঙ্গে ইমাম বলেন : আমেরিকার কোন সৈনিকের কুকুর যদি শাহকে কামড়ায় তাহলেও শাহের প্রতিকার চাওয়ার মতো কোন আইনগত ভিত্তি নেই।

এছাড়াও এসময় সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় করার উদ্দেশ্যে শাহ যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দুশ’ মিলিয়ন ডলারের এক চুক্তি করে। ইমাম খোমেইনী সুস্পষ্টভাবে বলেন : শাহের এ চুক্তি অনুমোদন করে মজলিসে যে ভোট প্রদান করা হয়েছে তা অবৈধ ও সুস্পষ্টভাবে কুরআনের নীতিবিরোধী।তিনি ইরানী সেনাবাহিনীর প্রতি এক আবেদনে তাদেরকে জেগে উঠতে বলেন এবং শাহের শাসন উৎখাত করার আহ্বান জানান। তিনি একইভাবে জনগণের প্রতি আহ্বান জানান তারা যেন এ স্বৈরতন্ত্রকে অদৌ বরদাশত না করে, যা ইরানকে পুরোপুরি দাসত্বের শৃঙ্খখলে আবদ্ধ করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। শাহ বুঝতে পারলেন, এ হচ্ছে তাঁর ক্ষমতার প্রতি সারাসরি হুমকি। তিনি চিন্তাভাবনা করে দেখলেন, যতদিন ইমাম খোমেইনী দেশে আছেন ততদিন জনগণের স্বার্থের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করা যাবে না। ধর্মীয় নেতৃত্বের প্রতি জনগণের সমর্থন তাঁর সরকারের কাছে ছিল অসহনীয়। তিনি উপলব্ধি করলেন যে, জনগণের রাজনৈতিক চিন্তাচেতনার বিকাশ ঘটলে তারা বিপ্লবের মাধ্যমে উপনিবেশবাদকে ধুয়ে মুছে সাফ করে দেবে। লক্ষ মানুষের আন্দোলনকে দুর্বল করার জন্য শাহ তাই ইমামকে নির্বাসনে পাঠানোর কথা ভাবলেন।

ইসলামী কর্তব্য পালনের তাগিদে ইমাম খোমেইনী (রহ.) ইরানী জাতির বিরুদ্ধে রেযা খানের কৃত অপরাধ ও বিশ্বাসঘাতকতার কথা প্রকাশ করেন। তিনি ইরানের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে রেযা খানের অমার্জনীয় অপরাধ ও ষড়যন্ত্রের কথা জনসাধারণের কাছে প্রকাশ করেন।

সেসময় ইরানের পরিস্থিতি সম্পর্কে ইমাম খোমেইনীর পরিষ্কার দৃষ্টিভঙ্গি ও সচেতনতা সকলের মনন ও চিন্তাশক্তিকে আলোড়িত করে এবং সকলে পূর্ণভাবে সজাগ হয়।

(নিউজলেটার, জুন ১৯৯১) 

ইমামের সুযোগ্য উত্তরসূরি রাহবার আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী

হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর বেদনাদায়ক ইন্তেকালের পর আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী ১৯৮৯ সালের ৪ জুন ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের নতুন নেতা নির্বাচিত হন। এর আগে তিনি প্রেসিডেণ্ট হিসাবে দীর্ঘ ৮ বছর ইসলামী প্রজাতন্ত্রের খেদমত করেন। প্রেসিডেণ্ট হিসাবে তিনি পাকিস্তান, ভারত, লিবিয়া, সিরিয়া, মোজাম্বিক, অ্যাংগোলা, তানজানিয়া, জিম্বাবে, যুগোশ্লাভিয়া, রোমানিয়া, উত্তর কোরিয়া, চীন প্রভৃতি দেশ সফর করেন। আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী ১৯৩৯ সালের ১৫ জুলাই ইরানের খোরাসান প্রদেশের রাজধানী পবিত্র মাশহাদের এক ধর্মীয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর তিনি কোম-এর ধর্মতাত্ত্বিক কেন্দ্রে গমন করেন এবং হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসেন। ১৯৬২ সালে তিনি ইমামের নেতৃত্বে পরিচালিত ইসলামী আন্দোলনে যোগদান করেন। পরবর্তী বছর তৎকালীন সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করে। আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী ১৯৭৮ সালে মাশহাদে ফিরে আসেন এবং ইসলামী বিপ্লব জয়লাভ না হওয়া পর্যন্ত তিনি তার নেতৃত্ব দেন। বিপ্লবের অব্যবহিত পর ১৯৭৯ সালের মার্চ মাসে তিনি বিপ্লবী পরিষদের একজন সদস্য মনোনীত হন। আগস্ট (৭৯) মাসে তিনি উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী পদে নিযুক্ত হন। অতঃপর ডিসেম্বর মাসে তিনি ইসলামী বিপ্লবী রক্ষিবাহিনীর অধিনায়ক নিযুক্ত হন। ১৯৮০ সালের ১৯ জানুয়ারি ইমাম খোমেইনী (রহ.) তাঁকে তেহরান নগরীর জুমআর নামাযের ইমাম নিযুক্ত করেন। ১৫ মার্চ তিনি মজলিস (পার্লামেন্ট)-এর ডেপুটি নির্বাচিত হন। তার আগে ১১ মার্চ তিনি প্রতিরক্ষা পরিষদের উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। ইরানে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ইমাম খোমেইনী তাঁকে দক্ষিণাঞ্চলীয় রণাঙ্গনে প্রেরণ করেন।

আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী ১৯৮০ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে শতকরা ৯৫ ভাগ ভোট পেয়ে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৮৫ সালের ২০ আগস্ট তিনি পুনরায় দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন।

জনাব আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী ফারসি ছাড়াও আরবি, তুর্কি প্রভৃতি ভাষায় বিশেষ পারদর্শী। তিনি ইসলামী আদর্শ ও ইতিহাসের ওপর বেশ কয়েকটি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছেন। সেগুলোর মধ্যে আয়েন্দাহ দার কালাম রুয়ে ইসলাম’, ‘আদদায়ানামাহ আলাইহে তামাদ্দুনে গারব’, ‘সুলহে ইমাম হাসানপ্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

(নিউজলেটার, জুন ১৯৯১)

চির ভাস্বর ইমাম খোমেইনী (রহ.)

ড. আবদুল করিম সরুশ

ঐতিহাসিক ব্যক্তিবর্গ সাধারণত তাঁদের মৃত্যুর পর খ্যাতি অর্জন করেন। কেননা, সাধারণ্যে বাস্তব অবস্থার উপলব্ধি আসতে সময় লাগে। সাম্প্রতিককালের একজন ইতিহাসবিদ মরহুম আব্বাস ইকবাল আসথিয়ানী বলেছেন : ‘একশ বছর অতিবাহিত না হলে কোন ঘটনাই ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত হয় না বা ঐতিহাসিকভাবে আলোচিত হতে পারে না।’ এর অর্থ এই নয় যে, যখন কোন ঘটনা ঘটে তখনকার শাসক মহল তা নথিভুক্ত করা বা প্রকাশ করার অনুমতি দিতে চায় না; বরং প্রকৃত ব্যাপার হলো যে, ঐতিহাসিক সব ঘটনা একত্রে বা তাৎক্ষণিকভাবে প্রকাশিত হয় না। অর্থাৎ গুটানো বা মুড়ানো কাগজের মতো ধীরে ধীরে মেলে যাওয়ার মতো ঘটনাসমূহ প্রকাশিত হতে সময় লাগে, যাতে ভবিষ্যৎ বংশধরগণ তা ক্রমিক পর্যায়ে অবহিত হতে পারে। এই কারণে আজকে আমরাও ইরানে সংঘটিত মহান ইসলামী বিপ্লব এবং এই বিপ্লবে নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিবর্গের বিরাটত্ব স¤পর্কে সঠিক অনুমান করতে পারি না।

তবে আমরা যদি এই বিপ্লব এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের ব্যাপারে বিস্মৃত হই তাহলে তা হবে ঐ ব্যক্তির মতো যে কোন ঘটনা একেবারে কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করলো এবং একপেশে হয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই বুঝতে পারল না।

ধর্মীয় সংস্কারকগণ ধর্মকে পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা করেন। এই পুনরুজ্জীবনের অর্থ ও ধরন বিভিন্ন। ধর্মকে যিনি পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা করবেন তাঁকে ধর্মীয় মানসিকতাসম্পন্ন ও ধর্মের প্রতি যত্নবান হতে হবে এবং কেবল ধর্মের মধ্যেই যে মানুষের উন্নতি ও সমৃদ্ধি নিহিত সে ব্যাপারে বিশ্বাসী হতে হবে।

ধর্মের প্রতি যত্নবান হওয়া ও বৈজ্ঞানিক বিশ্বাস এবং মানবজীবনের সমৃদ্ধি একেবারে ধর্মের সাথেই জড়িত বিষয় বলে মনকে পুরোপুরি প্রস্তুত করাটাই হলো দীনের তাজদীদ বা ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়। এ ব্যাপারে যথাযথ মান অর্জন ও বাধ্যতামূলক কর্তব্যানুভূতি অর্জন করার আগ পর্যন্ত একাজ শুরুই করা যায় না।

মুজতাহিদগণ তাঁদের সমসাময়িককালে দীনের অবস্থা প্রত্যক্ষ করে দীনকে পুনরুজ্জীবনের ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হন। নবীর মাধ্যমে আল্লাহপ্রেরিত ধর্ম হিসাবে ধর্মের পুনরুজ্জীবন প্রচেষ্টার কোন প্রয়োজন নেই। কিন্তু এই ধর্ম যখন মানুষের কাছে পৌঁছে যায় এবং সময়, স্থান ও ভৌগোলিক-ঐতিহাসিক পর্যায় পেরিয়ে মানুষের দ্বারা প্রচারিত হতে থাকে, তখন তা আস্তে আস্তে ম্লান হয়ে যেতে থাকে। তখনই তাতে পুনরুজ্জীবনের প্রয়োজন দেখা দেয়। তাই বর্তমান পর্যায়ে এক মহান ব্যক্তি তাঁর যুগের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে এবং সীমাবদ্ধতার গণ্ডি পেরিয়ে ধর্ম পুনরুজ্জীবনে সংকল্পবদ্ধ হন এবং অনুসারীদের সাথে নিয়ে পুনরুজ্জীবন ঘটান।

ধর্মের পুনরুজ্জীবন বা দীনের তাজদীদের অর্থ হলো এর সংস্কার ও সংশোধন। কখনও কখনও দীনের সংস্কারক বা মুজাদ্দিদ প্রত্যক্ষ করেন যে, ধর্ম বলতে জনসাধারণ যা অনুসরণ করছে তার মধ্যে ধর্মের সাথে সংগতিহীন কিছু রসম-রেওয়াজ ও বিদেশী রীতিনীতি ঢুকে পড়েছে এবং প্রকৃত ধর্মীয় ভাবধারা ও চেতনা ঢাকা পড়ে গেছে। আর এসব ভুল-ভ্রান্তি ধর্মের সৌন্দর্যকে মলিন করে তুলছে। এমতাবস্থায় ধর্মের সংস্কারক ধর্মকে সঠিক রূপদানের প্রচেষ্টা শুরু করেন। তিনি পূর্ণ সংকল্প নিয়ে দৃশ্যপটে আবির্ভূত হন এবং কোন কোন বিষয় বাদ দিয়ে আর কোন কোন বিষয়কে পূর্ণ করতে পদক্ষেপ নিতে থাকেন।

কখনও কখনও দীনের কিছু কিছু দিক বিস্মৃতির অন্তরালে হারিয়ে যায়। আর জনসাধারণও একটি বিশ্বাস বা ব্যবস্থার সকল দিক বা শিক্ষাকে একভাবে দেখে না বা ধারণা করে না। সামাজিক, মানসিক ও দৃষ্টিভঙ্গির বিভিন্নতার কারণে তারা কোন কোনটিকে বেশি পছন্দ করে এবং কোন কোনটিকে এড়িয়ে যায়। ধর্মের ব্যাপারেও এর ব্যতিক্রম ঘটে না। তাই এর কিছু দিক অজানা হয়ে যায় ও পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। এর ফলে ধর্ম হয়ে যায় অপূর্ণাঙ্গ, অবহেলিত, বিকৃত ও পরিবর্তিত। দীনের সংস্কারক বা মুজাদ্দিদ এই পর্যায়ে ধর্মকে পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা শুরু করেন এবং ধর্মের বিলুপ্ত দিক ও বিষয়গুলো পুনরায় চালু করার চেষ্টা করেন। এক্ষেত্রে এক কাজ হলো ধর্মকে পরিশুদ্ধ করা এবং অপর কাজ হলো এর পূর্ণাঙ্গ প্রবর্তন। ইমাম গাজ্জালী, মোহাম্মাদ আবদুহু, ফয়েজ কাশানী, শরিয়তী প্রমুখ এ উভয় কাজই সম্পাদন করেছেন। তাঁরা সকলেই শরীয়তের বাগানরক্ষক হিসাবে এর শুকনো ডালপালাগুলো কেটে ফেলেছেন এবং জীবন্ত অংশগুলোর লালন করেছেন।

অবশ্য কখনো কখনো উপরিউক্ত কারণসমূহ ছাড়াও দীনের পুনরুজ্জীবন আন্দোলন শুরু হতে পারে। এরকম সময়ে ব্যক্তি মনে করে না যে, দ্বীন বা ধর্ম বিলুপ্ত হয়ে গেছে বা বিকৃত হয়েছে অথবা কোন বিদেশী রীতি-নীতি ধর্মের সৌন্দর্যকে বিনষ্ট করেছে। কিন্তু তিনি একথা মনে করেন যে, সমাজ বা সামগ্রিক জীবনে একটি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে যা ধর্মকে অকার্যকর করে ফেলেছে। ভাসাভাসা ভাবে মনে হতে পারে যে, দীনের কোথাও কোন পবিবর্তন, পরিবর্ধন বা বিকৃতি ঘটেনি, তবে প্রচলিত ব্যবস্থা দীনের কোন কোন চাহিদা পূরণের সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছে। দীনি পরিস্থিতির এই যে অসামর্থ্য ও অসহায়ত্ব কোন মহান মুজাদ্দিদ ব্যক্তির মনকে আলোড়িত করতে পারে এবং তখন তিনি দীনকে তার পূর্ণ ক্ষমতা ও কার্যকারিতায় ফিরিয়ে আনার জন্য প্রচেষ্টা শুরু করতে পারেন। এধরনের পর্যায়ে চিন্তাশীল ও প্রতিভাবান আলেমগণ তাঁদের দীনি জ্ঞান-ভাণ্ডারের ভিত্তিতে দীনের সমসাময়িক বিভিন্ন দিক ও বিভাগ ও রীতিনীতির ওপর গভীর ইজতিহাদ শুরু করেন এবং দীনকে অভ্যন্তরীরণভাবে পুনর্গঠন করেন।

অবশ্য এ প্রচেষ্টায় কেউ কেউ সহজতর পথ অনুসরণ করেন। বিশেষ করে যখন তাঁরা নিজের ধর্মের সামর্থ্য সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে ওঠেন, তখন উপযুক্ত হোক আর না হোক, অন্য বিশ্বাস বা ধর্ম থেকে এনে কিছু বিষয় জুড়ে দিয়ে নিজ ধর্মের অসামর্থ্যকে দূর করে সামর্থ্যবান করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু এই সংক্ষিপ্ত রাস্তায় ধর্মকে পরিশুদ্ধ ও সামর্থ্যবান করার স্বপ্ন পূরণ হবে না। এভাবে তাঁরা কেবল ধর্মে কিছু সংযোজনই করতে পারেন, তা উপযুক্ত হোক আর না হোক এবং মনে করতে থাকেন যে, তাঁরা ধর্মের জন্য অনেক কিছু করে ফেলেছেন। এটাই হলো আমাদের ধর্মীয় ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহ।

তবে কখনও কখনও এমনও ঘটেছে যে, ধর্ম স্বয়ং অকার্যকর হয়ে যায়নি, কিন্তু তার অনুসারীরা অমনোযোগী বা উদ্যমহীন হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় দীনের মুজাদ্দিদ মুজতাহিদগণ ধর্মের অনুসারীদেরকে জাগ্রত ও পরিশুদ্ধ করেন এবং নতুন চেতনা ফিরিয়ে আনেন। এর একটি দৃষ্টান্ত সাইয়্যেদ জামাল উদ্দীন (আসাদাবাদী) আফগানীর আন্দোলন। এমন কখনই হতে পারে না যে, কোন ব্যক্তি দীনের অনুসারীদেরকে জাগ্রত ও সচেতন করার প্রচেষ্টা চালাবেন, অথচ তিনি নিজে দীনের নীতি-আদর্শ সম্পর্কে সম্যক অবহিত হবেন না। এ দুটি বিষয় একটি অপরটির পরিপূরক। তবে কখনও একটিকে এবং কখনও অপরটিকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয়। সাইয়্যেদ জামাল-এর ছাত্রগণ ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনের ব্যাপারে সকল ক্ষেত্রে সমান গুরুত্ব দিয়ে ভেবেছেন, উস্তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ ব্যতিরেকে কেউ রাজনীতির অঙ্গনে ও রাজনৈতিক দৃশ্যপটে আবির্ভূত হতে পারে না।

মরহুম ইমাম খোমেইনী (রহ.)ও দীনি চিন্তাধারার পুনরুজ্জীবন এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়কে জাগ্রত করার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

দীর্ঘদিন থেকে আমাদের ধর্মীয় চিন্তাধারার জগতে কিছু সমস্যা বিরাজ করছে। এক শ্রেণির সূফি সম্প্রদায় প্রধানত এর জন্য দায়ী। এর একটি হলো যে, তাঁরা সকল ইসলামী শিক্ষার ব্যাপারে একটি রহস্যবাদী ব্যাখ্যা উপ¯হাপনের চেষ্টা করেন। দ্বিতীয়ত এসব রহস্যবাদী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আমাদের ইজতিহাদের বিষয়সমূহকে বিঘ্নিত করেছে। ইমাম খোমেইনী এ দুটি দিক সম্পর্কে সদা সচেতন ছিলেন। কুরআন সম্পর্কে সূফিদের লেখা কিছু ব্যাখ্যা ও মন্তব্য পাঠ করলে দেখা যাবে যে, মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ছিলেন একজন দরবেশ এবং তিনি মক্কার খানকায় বসে তাঁর অনুসারীদেরকে কেবল সূফিবাদ বা রহস্যবাদের শিক্ষা দিয়েছেন। অবশ্য একথা সত্য যে, আমাদের সূফি সম্প্রদায় মহানবী (সা.)-কে একটি পবিত্রতার প্রতিচ্ছবি হিসাবেই উপস্থাপন করেছেন। ইসলামী শিক্ষায় কোন পরিবর্তন আনা তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল না। তাঁরা আসলে তাঁদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে ধর্মীয় শিক্ষার সর্বোত্তম ও উৎকৃষ্ট ধারণা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। ইমাম খোমেইনীও কোন কোন ক্ষেত্রে সূফিবাদী চিন্তাধারা অনুসরণ করেছেন এবং এই চিন্তাধারা সম্পর্কে সতর্কতাও অবলম্বন করেছেন। সূফিবাদের ওপরে মহিউদ্দিন আল-আরাবীর লেখা গ্রন্থগুলোর মধ্যে ‘ফুসউস আল-হিকাম’ হচ্ছে একটি কঠিন এবং গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। ইমাম খোমেইনী তাঁর এই বই সম্পর্কে একটি মন্তব্য লেখেন। তাঁর অন্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে ‘সারহে দোয়ায়ে সাহর’, ‘মিসবাহুল হেদায়া’ ও ‘মেরাজুস সালেকীন’। ইমাম (রহ.) মাওলানা রুমীর প্রতি বেশি আকৃষ্ট ছিলেন। ইমাম খোমেইনীর একজন আত্মীয় বলেছেন, ইমাম খোমেইনী তুরস্কে থাকাকালে একবার রুমীর মাজার যিয়ারত করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তুর্কি আইন মোতাবেক ধর্মীয় পোশাক পরিধান করে সেখানে যেতে বাধা থাকায় তিনি মাজার যিয়ারত করতে পারেননি। পরে তিনি সে ব্যাপারে খুবই দুঃখ প্রকাশ করেন। এ থেকে বুঝা যায়, ইমাম খোমেইনী মওলানা রুমীর চিন্তাধারার ওপর কতখানি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। জানা গেছে, সোভিয়েট নেতা মিখাইল গরবাচেভের কাছে তিনি  যে চিঠি লিখেছিলেন, তাতে তাঁকে মহিউদ্দিন আল-আরাবীর মতো সূফি লেখকদের বই পাঠ করতে বলেছিলেন।

এসব ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয় যে, ইমাম খোমেইনী নিঃসন্দেহে একজন সূফিবাদী ছিলেন এবং সে কারণে তিনি সূফিদের জীবন-যাপন প্রণালিকে ঘনিষ্ঠভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন। তবে প্রাচীন সূফিদের চিন্তাধারার সাথে তাঁর চিন্তাধারায় পার্থক্য ছিল। তিনি মনে করতেন যে, সূফি হওয়ার জন্য একজনকে আরেকজন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রয়োজন নেই। প্রাচীন সূফিগণ তাঁদের কার্যকলাপের মাধ্যমে জনমনে যে ধাঁধাঁ সৃষ্টি করেছিলেন তারও তিনি সমাধান করেন।

১৯৭৯ সালে একদল আলেম ও ধর্মীয় নেতার উদ্দেশ্যে এক ভাষণে ইমাম খোমেইনী (রহ.) বলেছিলেন : ‘সূচনাকাল থেকে আজ পর্যন্ত ইসলাম অজানা রয়ে গেছে। এই সমাজের সদস্যদের অনেকেই এর সাথে যথাযথভাবে পরিচিত হয়নি। লোকেরা সব সময়ই এর অংশগুলোকে বাছাই করে নেয় এবং অন্য অংশগুলোকে  উপেক্ষা করে বা চাপা দিয়ে চলে। দীর্ঘকাল যাবৎ আমরা সূফিদের হাতে দুঃখভোগ করছি। ইসলামও তাদের দ্বারা কাঠিন্যের সম্মুখীন হয়েছে। তারা জনসাধারণকে ভালোভাবেই সেবা করেছে, কিন্তু সবকিছুই অন্যদিকে ফিরিয়ে দিয়েছে। মোল্লা আবদুর রাজ্জাক প্রণীত তাফসীরে কুরআন এর একটি উদাহরণ। তিনি একজন বিরাট আলেম ছিলেন বটে, কিন্তু সবকিছুই ব্যাখ্যা করেছেন একটি বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে। আবারো আমরা অপর একটি দলের শিকার হয়েছি, যারা একটি বিপরীত ধাঁচে আমাদের আধ্যাত্মিকতা পরিবর্তন করে দিয়েছে।’

এক্ষেত্রে ইমাম খোমেইনীর চিন্তাধারার এটি একটি সুন্দর উদাহরণ যে, প্রাচীন সূফিদের সব চিন্তাকেই তিনি সত্য বলে মেনে নেননি।

কবি হাফিজের মতো ব্যক্তিত্ববর্গের উদাহরণ সামনে রেখে তাঁদের চিন্তাধারার প্রতি শ্রদ্ধাপোষণ সত্ত্বেও তাঁদের গ্রন্থরাজির ওপর সমালোচনা করেছেন এবং তাঁদের কিছু কিছু সংকীর্ণ মানসিকতার ব্যাপারে দুঃখপ্রকাশ করেছেন। অর্থাৎ তিনি বুঝাতে চেয়েছেন যে, প্রাচীন সূফিদের চিন্তাধারা শতকরা একশ ভাগ সঠিক নয়। বর্তমান সময়ে আমাদের চিন্তা করা আবশ্যক যে, তাঁরা যে পথ ও মূল্যবোধ উপস্থাপন করে গেছেন, তার সাথে কিছু ভালো দিকও রয়েছে। আর এই মূল্যবোধকে সংরক্ষণের মাধ্যমে আমরা নতুন চেতনায় শাণিত একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে পারি। এক কথায়, বিশেষ বিশেষ জামানায় এক ব্যক্তিকে একাধারে সূফি ও আইনজ্ঞ হতে হবে। যাঁরা সূফিবাদী চিন্তা-চেতনার আলোকে জনসাধারণ ও তাদের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেন তাঁরা তাঁদেরকে শাসনও করতে পারেন।  তবে ক্ষমতা ও সম্পদের জন্য তাঁদের ভালোবাসা অর্জন ও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আর এভাবেই দুনিয়া থেকে দোযখের আগুন নিভিয়ে ফেলা যাবে।

ইমাম খোমেইনী (রহ.) তাঁর রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিষয়ের প্রতি আরো সুন্দর আলোকপাত করেছেন। এতে বলা হয়েছে : ‘যা অনুমোদিত নয় তা হলো শয়তানি নির্যাতনমূলক ও স্বৈরাচারী সরকার। সম্পদ কুক্ষিগত করা, ক্ষমতালিপ্সা ও অত্যাচারী কার্যকলাপের প্রতি ঝোঁক অর্থাৎ এক কথায় এসব পার্থিব বিষয় মানুষকে আল্লাহ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়।’

‘যে স্বৈরাচারী পুঁজিবাদ নির্যাতিত ও অবহেলিত মানুষকে বঞ্চিত করে, ইসলাম তা অনুমোদন করে না। উপরন্তু পবিত্র কিতাব ও হাদিসসমূহে এর তীব্র নিন্দা করা হয়েছে এবং পুঁজিবাদ বিরোধিতাকে সমাজিক সুবিচার বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।’

‘ইসলাম ব্যক্তি মালিকানাকে অস্বীকারকারী এবং কঠোর ও স্বৈরাচারী একনায়কতান্ত্রিক শাসনের মাধ্যমে সামষ্টিক মালিকানা প্রতিষ্ঠাকারী মার্কসবাদী ও লেনিনবাদী সরকারবিরোধী।’

পরিশেষে, ইমাম খোমেইনী লিখিত একটি মোনাজাতের উল্লেখ বিষয়টিকে আরো পরিষ্কার করে দেবে। ইমাম খোমেইনী ৩৮ বা ৪০ বছর বয়সে তাঁর ‘মেরাজুস সালেকীন ওয়া সাল্লাতুল আরেফীন’ গ্রন্থের শেষদিকে লিখেছেন : ‘হে আল্লাহ! আমাদেরকে একটি সমৃদ্ধ সমাপ্তি দান কর। আমাদেরকে অন্তর্নিহিত শক্তি ও আল্লাহকে পাওয়ার শিক্ষা দান কর। আমাদের অন্তরে বিরাজমান শয়তানের হাত কেটে দাও। আমাদের অন্তরে তোমার ভালোবাসার অংশ দাও। আমাদের অন্তরে যেন পার্থিব বিষয়ের পরিবর্তে তোমার চিন্তা বিরাজ করে। আমাদের অন্তরকে তোমার ভালোবাসা দিয়ে পূর্ণ করে দাও। আমাদের অবশিষ্ট জীবন দিয়ে অতীত জীবনের ক্ষতি পূরণ করার তৌফিক দাও। তুমিই সকল দানের উৎস।’

(নিউজলেটার, জুন ১৯৯১)

হজের শিক্ষা ও তাৎপর্য সম্পর্কে ইমাম খোমেইনী (র.)

ইসলামী বিপ্লবের নেতা খোমেইনী (রহ.) পবিত্র হজ উপলক্ষে বায়তুল্লাহ আল-হারামে সমবেত হাজী সাহেবদের উদ্দেশে প্রতি বছর নিয়মিত বাণী প্রদান করতেন। এসব বাণীতে হজের সত্যিকার শিক্ষা ও তাৎপর্য এবং বর্তমান সময়ের মুসলিম উম্মাহ ও আলেম সমাজের কর্তব্য সম্পর্কে অত্যন্ত মূল্যবান বক্তব্য রয়েছে। নিম্নে ইমামের এ সম্পর্কিত কয়েকটি বাণীর কিছু উদ্ধৃতি পেশ করা হলো :

মুসলমানদের প্রকৃত খুশির দিন

মুসলমানদের জন্য প্রকৃত আনন্দ ও খুশির দিন হবে সেদিন যেদিন সমগ্র দুনিয়ার মুসলমানরা ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ আলেমদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে জেগে উঠবে এবং বিশ্বগ্রাসী অত্যাচারী ও শোষকদের নিপীড়নমূলক শাসন থেকে নিজেদের মুক্ত করার লক্ষ্যে এক দুর্বার অভিযান শুরু করবে। ইসলামের এই মহত্তম লক্ষ্য অর্জন করা তখনই সম্ভব হবে যেদিন আমাদের আলেমগণ ইসলামী আদর্শের একটি পরিপূর্ণ চিত্র দুনিয়ার নিপীড়িত-নির্যাতিত জনগণের সামনে উপস্থাপন করবেন যা এতদিন তাদের সামনে অনুন্মোচিত ছিল, যেদিন আলেম সমাজ ইসলামের অনুদ্ঘাটিত দিগন্ত দুনিয়ার জাতিসমূহের সামনে তুলে ধরবেন এবং এই অনুপম কর্ম সম্পাদনের মূল্যবান সুযোগ তাদের সামনে পেশ করবেন। বস্তুত মহান হজের সমাবেশই হচ্ছে এর জন্য সবচেয়ে বড় সুযোগ যা মহিমান্বিত ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর নির্দেশে প্রতিপালিত হচ্ছে। কিন্তু এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে, ইসলামী দেশগুলোর শোষক সরকারগুলোর বিভ্রান্তি ও বিচ্যুতি, অবিবেচক ও ধূর্ত দরবারি আলেমদের আচরণ এবং এসব আলেম ও অন্যদের ভুল ব্যাখ্যার কারণে পবিত্র হজের মতো মুসলিম জাতির ভাগ্যনির্ধারণী এই অনুষ্ঠানের প্রকৃত তাৎপর্য ও এর বহুবিধ ফায়দা আজ আমরা হারাতে বসেছি। মূলত এ ধরনের আলেমরাই বিভিন্ন মুসলিম দেশে তাদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধার একটি কল্পিত পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে। এরাই ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করছে; কেননা, এরা মনে করে, ইসলামী রাষ্ট্র খোদাদ্রোহীদের পরিচালিত রাষ্ট্রের চেয়েও খারাপ। এই বিপথগামী ও ভ্রান্ত মানসিকতার কারণে এরা পবিত্র হজ অনুষ্ঠানকে তার প্রকৃত তাৎপর্য থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে এবং হজকে কতকগুলো প্রাণহীন বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রেখেছে। এমনকি এরা যুক্তি দেখাচ্ছে যে, পবিত্র হজের সময় মুসলমানদের সাধারণ্যে কোন আওয়াজ তোলা ইসলামবিরোধী। এভাবে তারা ধর্মীয় সত্যের ওপর একটা ছদ্মাবরণ দেয়ার চেষ্টা করছে।

শোষক ও বিভ্রান্ত সরকারের পোষ্য এসব লোক দুনিয়ার আনাচ-কানাচ থেকে পবিত্র স্থানে সমবেত শোষিত-বঞ্চিত লোকদের শোষণের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলাকে নাস্তিকতাঅনৈসলামিকবলে আখ্যায়িত করছে। এদের মতলব হচ্ছে মুসলমানদের দাবিয়ে রাখা এবং লুটেরা ও ইসলামের ওপর আধিপত্য বিস্তারকামীদের জন্য পথ করে দেয়া। এরা চায় ইসলামকে মসজিদ ও খানকার চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখতে। এরা বলে বেড়াচ্ছে যে, মুসলমানদের দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা বা তাদের কোন সমস্যার ব্যাপারে উচ্চবাচ্য করা ইসলামবিরোধী, এটা মুসলমানদের এবং আলেম সমাজের দায়িত্ব-কর্তব্যের পরিপন্থী।

হজের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য

বিশ্বাসঘাতকরা হজের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যটি ধামাচাপা দেয়া এবং তাকে বিস্মৃতির অন্তরালে মিলিয়ে দেয়ার জন্য অনেক অপচেষ্টা চালিয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরো দীর্ঘ সময় ধরে তারা এই অপচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। কিন্তু অন্য কোন সময় অপেক্ষা মুসলমানরা আজকের এই দিনে-যেদিন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় জংলি যুগের কথা-হজের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যের ওপর বেশি দৃষ্টি নিবদ্ধ করছে এবং তার ওপর সবিশেষ জোর দিচ্ছে কেন? কেননা, আজকের দিনে আন্তর্জাতিক ক্ষমতালিপ্সুরা মুসলমানদের বিভ্রান্ত করার জন্য এবং তাদের উন্নতি-সমৃদ্ধির পথে বাধা সৃষ্টি করার জন্য একটির পর একটি ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত পাকাচ্ছে। আর অন্যদিকে তাদের স্বার্থান্বেষী চর ও ভাড়াটিয়া বাহিনী এবং তাদের সঙ্গে একদল বিভ্রান্ত ব্যক্তি, দরবারি আলেম ও অন্যান্য লোকজন (যারা খাঁটি ঈমানদার, অথচ অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত) মিলে পবিত্র হজের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ দিককে আস্তে আস্তে নিঃশেষ করে দেয়ার জন্য চক্রান্তের জাল বুনে চলেছে।

তাই আজকের দিনে যেসব আল্লাহর রাহে নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তি ও ইসলামের প্রতি সহানুভূতিশীল লোক স্বীয় ঈমানকে বিস্মৃতির অতলে হারাতে রাজি নন, তাঁদের কর্তব্য হয়ে পড়েছে ঈমানের এই বৈশিষ্ট্যের উজ্জীবনে নিজেদের সকল সহায়-সম্পদ কাজে লাগানো এবং বিশেষ করে হজের সময় তাঁদের লেখনি ও বক্তৃতার সর্বাধিক ব্যবহার করা। এতে করে মুসলমানরা পবিত্র হজে আগমন করে হজের এই উজ্জ্বল ও গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করতে পারবে এবং অতঃপর তারা নিজ দেশে ও দুনিয়ার সর্বত্র মুসলমান ও নির্যাতিত জনগণকে জাগ্রত করতে বেরিয়ে পড়বে। তারা বিশ্বশোষক ও অত্যাচারীদের হাত থেকে নির্যাতিত জনগণের মুক্তি আনয়নের জন্য তাদেরকে সংগঠিত করবে।

হজের এ হচ্ছে এমন এক বিরাট ও মহতি সম্মেলন যেখানে দুনিয়ার প্রতিটি দেশ থেকে নিপীড়িত-নির্যাতিত মুসলমানরা এসে সমমেত হয়, যেখানে বিভিন্ন  ভাষাভাষী বিভিন্ন বর্ণের ও গোত্রের লোকেরা একই পোশাক পরে উপস্থিত হয় এবং যেখানে একে অন্যের মধ্যে পার্থক্যের কোন চিহ্নমাত্র থাকে না। এই মহাসম্মেলন যদি মুসলমানদের রাজনৈতিক সমস্যাবলির সমাধানে ব্যর্থ হয়, এটি যদি পৃথিবীর অত্যাচারী ও শোষকদেরকে তাদের প্রাপ্য আঘাত প্রদানে ব্যর্থ হয় তবে একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আঞ্চলিক ভিত্তিতে আয়োজিত সম্মেলনগুলো মুসলমানদের সমস্যা সমাধানে কোন বিশেষ অগ্রগতি সাধন করতে পারবে না।

জনগণের কেন্দ্র

আল্লাহর ঘর (বায়াতুল্লাহ আল-হারাম) হচ্ছে দুনিয়ার সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ স্থান। জনসাধারণের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল। এটা সকল মানুষের জন্য পবিত্র স্থান। কোন এক ব্যক্তি, কোন একটি সরকার বা কোন একদল লোক এই ঘরের সঙ্গে জড়িত থাকার ক্ষেত্রে কোন বিশেষ মর্যাদা ভোগ করতে পারবে না। এই পবিত্র স্থানে যেমন রয়েছেন কাবাঘরের খাদেমগণ, তেমনি রয়েছেন শহরবাসী, গ্রামবাসী, মরুবাসী এবং রাষ্ট্রনেতাগণ। এই পবিত্র স্থান নির্মিত হয়েছে জনগণের জন্য, জনগণের উত্থানের জন্য এবং জনগণের কল্যাণে গণঅভ্যুত্থানের জন্য। কিন্তু জনগণের কল্যাণের জন্য সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে বিশ্বের অত্যাচারিত ও বহিঃশত্রুর আক্রমণের শিকার দেশগুলো থেকে শোষকের হাত কেটে দেয়া। এর ফলে এসব দেশের যে ঐশ্বর্যরাজি রয়েছে তা থেকে এদের হাত গুটিয়ে দেওয়া হবে। তাহলে কেন আমরা এই পবিত্র স্থানে সেইভাবে সমবেত হই না, যে উদ্দেশ্যে এটা নির্মাণ করা হয়েছে? জনগণের কল্যাণে গণঅভ্যুত্থানের মতো সুমহান উদ্দেশ্যে যে পবিত্র স্থানের সৃষ্টি তা অবশ্যই মুসলমানদের গণজাগরণের কেন্দ্রস্থল হতে হবে।

এই মহিমান্বিত ও পবিত্র ঘরের সঙ্গে জড়িত সমগ্র মুসলমান জনগণের স্বার্থ আদায়ের জন্য সংগ্রাম চালাতে হবে এবং সে কথা মনে রেখেই হজের সময় ছোট ও বড় শয়তানের প্রতি পাথর নিক্ষেপের কার্য সম্পাদন করতে হবে।

মসজিদ ও হারামের খাদেমদের বৈশিষ্ট্য

শুধু সীলমোহর সংরক্ষণ, হাজী সাহেবানদের জন্য পানি সরবরাহের ব্যবস্থাকরণ এবং মসজিদুল হারামের দেখাশোনা করার মাধ্যমেই এই পবিত্র স্থানের খাদেমের দায়িত¦ ও তার চূড়ান্ত উদ্দেশ্য পরিপূর্ণ হয় না। অপরপক্ষে যতটুকু প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি অলংকরণ ও সৌষ্ঠবপূর্ণ করার চেয়ে তা না করার মাধ্যমেই এই ঘরের অধিক সেবা করা যায়। পবিত্র স্থানের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে এমন কোন কার্য করার চেয়ে একে যে অবস্থায় আছে সেরূপ রাখা বরং উত্তম এবং এর পরিচালনা হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর আমলে এবং ইসলামের প্রাথমিক যুগে যেমন ছিল সেরূপ রাখাই বাঞ্ছনীয়। মুসলমানদের উচিত ইসলামের এই পবিত্র স্থানে নিজেদের সকল সামাজিক পদ ও মর্যাদা ভুলে গিয়ে শুধু একজন বান্দা হিসেবে সমবেত হওয়া। এই পবিত্র স্থানের অলংকরণ অথবা এর সৌন্দর্য ও অঙ্গসৌষ্ঠব বৃদ্ধি করা অপেক্ষা হযরত ইবরাহীম (আ.) ও ইসলামের প্রাথমিক যুগের মতো পরিচালনা করার মাধ্যমেই এর মর্যাদা ও গুরুত্ব বৃদ্ধি পাবে। আর যদি আল্লাহর ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির দিকেই আমরা মনোযোগ নিবদ্ধ করি তাহলে তা আমাদেরকে আল্লাহর ঘর প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য-লক্ষ্য অর্থাৎ মানবজাতির উত্থানের সাক্ষ্য হওয়া ও মুসলিম জাতির স্বার্থ সংরক্ষণ থেকে বহু দূরে সরিয়ে নিয়ে যাবে।

যারা হাজীদের পানি সরবরাহ করে এবং মসজিদুল হারামের রক্ষণাবেক্ষণ করে, তোমরা কি তাদেরকে তাদের সমজ্ঞান কর যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে এবং আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে? আল্লাহর নিকট তারা সমতুল্য নয় এবং আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়কে সৎপথ প্রদর্শন করেন না।’ (সূরা তাওবা : ১৯)

মনে হচ্ছে, পবিত্র কুরআন মজীদের এ আয়াতটি আমাদের এ যুগেই নাযিল হয়েছে, যে যুগে আমরা বসবাস করছি। মনে হচ্ছে, এ আয়াতের মধ্যে আমাদের যুগের শোচনীয় অবস্থারই প্রকৃত বর্ণনা রয়েছে। আমরাও এমন একটি যুগে বাস করছি যে যুগে হজকে নিয়ে একদল লোক ব্যবসা ফেঁদে বসেছে। তারা হজের সময় হাজী সাহেবদের পার্থিব প্রয়োজন মেটানোর জন্য জাঁকজমকপূর্ণ ব্যবস্থা করছে এবং সেই সঙ্গে মসজিদুল হারামকে এমন জাঁকালোরূপে সাজানো হচ্ছে যাতে খোদায়ী ভাবগাম্ভীর্যের কোন নাম-নিশানা নেই এবং যাতে খোদার রাহে সংগ্রামের বা পরকালের (শেষ বিচারের দিনের) ধারণার কোন পরিচয় মেলে না। পবিত্র কুরআন মজীদের ভাষ্য মোতাবেক এই ধরনের কাজ অন্যায়ের শামিল এবং যারা এই ধরনের কাজ করছে তারা হচ্ছে অত্যাচারী ও শোষক।

মহিমান্বিত ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর ঈমান এবং পরকালে ঈমানই জনগণকে আল্লাহর রাহে সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে এবং ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণঅভ্যুত্থানের অনুপ্রেরণা যোগায়। যারা ভিন্নরূপ কর্ম করে অর্থাৎ আল্লাহ ও পরকালে ঈমান রাখে না আল্লাহ তাদেরকে সৎপথে পরিচালিত করেন না, কেননা, তারা অত্যাচারীর দলভুক্ত।

হজের আধ্যাত্মিক দিক

হজের আধ্যাত্মিক দিক হচ্ছে মানুষের অনন্ত জীবনের চাবিকাঠি এবং তা মানুষকে একত্ববাদের দিকে ধাবিত করে এবং তার জীবনের পবিত্রতাকে করে তোলে অজেয়। হজের ধর্মীয় বিধিনিষেধ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বাস্তবায়িত করা না হলে উপরিউক্ত মহৎ লক্ষ্যসমূহ অর্জন করা সম্ভব নয়। সম্মানিত হাজী সাহেবান এবং হজযাত্রীদলের নেতৃত্বদানকারী আলেম সমাজের এই ব্যাপারে যথাসাধ্য চেষ্টা চালানোর গুরুদায়িত্ব রয়েছে। প্রথম দল অর্থাৎ হাজী সাহেবদের দায়িত্ব হচ্ছে শিক্ষার্জন আর দ্বিতীয় দল অর্থাৎ আলেমদের দায়িত্ব হচ্ছে হজের অনুষ্ঠান সম্পর্কে জ্ঞান দান। ধর্মীয় বিধিবিধান সম্পর্কে পরিজ্ঞাত ব্যক্তির কর্তব্য হচ্ছে তার সঙ্গী-সাথিদের এ ব্যাপারে উপদেশ দেয়া যাতে সে হজের আনুষ্ঠানিক আচার ভঙ না করে। হজের রাজনৈতিক ও সামাজিক বৈশিষ্ট্যগুলো অর্জন করা তখনি সম্ভব হবে যখন এর আধ্যাত্মিক ও খোদায়ী দিকগুলো প্রতিপালিত হবে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর দাওয়াতে সাড়া প্রদান এবং তাঁর দেয়া বিধানগুলো সঠিকভাবে পালন করলেই আমরা সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছতে পারব।

হে হাজী সাহেবগণ! আপনারা দৃঢ় মনোবল ও আত্মপ্রত্যয় নিয়ে প্রস্তুত হোন, সর্বশক্তিমান আল্লাহর নৈকট্যে পৌঁছান এবং আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে যে কোন প্রকার শিরক প্রত্যাখ্যান করুন। আপনারা আপনাদের দৈহিক সত্তাকে বিসর্জন দিয়ে আল্লাহর আত্মিক দিদার লাভ করুন। এই দেহসত্তাই বহুত্ববাদের প্রধান উৎস। আল্লাহ আপনাদের গৌরবান্বিত করুন। যাঁরা এভাবে নিজেদের দেহসত্তা বিসর্জন দিয়ে আল্লাহর সান্নিধ্য চাইবেন তাঁদের পুরস্কার তাঁরা পরকালে আল্লাহর কাছে পাবেন। তাঁদের ইন্তেকালের পূর্বেই তাঁরা পার্থিব দুনিয়া থেকে বিদায় নিচ্ছেন। আর যদি হজের আধ্যাত্মিক দিককে ভুলে যান তাহলে মনে রাখবেন মন্দ আত্মার থাবা থেকে আপনারা কখনোই নিজেদের মুক্ত করতে পারবেন না। আর যতক্ষণ পর্যন্ত আপনারা প্রবৃত্তি ও পাশবিক লালসায় বন্দি হয়ে থাকবেন ততদিন পর্যন্ত আপনারা আল্লাহর রাহে জিহাদের ময়দানে নামতে পারবেন না এবং আল্লাহর সৃষ্ট জগতের রক্ষণাবেক্ষণ করতে সক্ষম হবেন না।

ইরানী হাজীদের প্রতি উপদেশ

হে ইরানী হাজী সাহেবগণ! আপনারা একটি বিজয়ী দেশ (ইরান) থেকে এসেছেন, যে দেশ বহু বছর ধরে রাজতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহর অনুগ্রহ ও দ্বাদশ ইমামের (তাঁর জন্য আমাদের জীবন উৎসর্গীকৃত হোক) কল্যাণকামী দোয়ায় অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে পরাধীনতার জিঞ্জির ভেঙে ফেলেছে এবং ইসলামের জন্য হাজার হাজার লোকের শাহাদাত ও পঙ্গুত্বের বিনিময়ে নিজেদের বিপ্লবী মনজিলে মকসুদে পৌঁছেছে। আপনারা হজের সময় এমন এক জাতির বাণী বহন করছেন যাঁরা তাঁদের বিপ্লবের মাধ্যমে আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণাকারী একটি সরকারকে উৎখাত করেছেন এবং দেশে ইসলামী শাসন কায়েম করেছেন। এভাবে বিপ্লবের মাধ্যমে আপনারা দেশকে চরম ধ্বংসপ্রাপ্তি তথা পাশ্চাত্যের নিকট বিকিয়ে যাওয়া থেকে যা দেশে স্বধর্ম ত্যাগ, দুর্নীতি ও পতিতাবৃত্তির সয়লাব বইয়ে দিয়েছিল রক্ষা করেছেন। এখন আপনারা ইসলামী বিপ্লবের বাণী সর্বত্র ছড়িয়ে দিন এবং শুধু মুসলিম দেশই নয়, দুনিয়ার নির্যাতিত জনগণের সামনে ইসলামের ইনসাফপূর্ণ শাসনের পরিচিতি উপস্থাপন করুন। আপনারা তাঁদেরই প্রতিনিধিত্ব করছেন যাঁরা দুই পরাশক্তি এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ব্লকের চক্রান্ত মোকাবিলা করে এবং তাদের পোষ্য সন্ত্রাসবাদীদের অন্তর্ঘাতী তৎপরতার ফলে সৃষ্ট নানারূপ প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে তাঁদের নতুন ইসলামী বিপ্লবকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। ইসলামের আকর্ষণীয় আদর্শ এবং জনগণের নিরলস প্রচেষ্টার ফলে এই ইসলামী বিপ্লব মুসলিম দেশগুলো এবং দুনিয়ার নির্যাতিত জাতিগুলোর মধ্যে নবজাগরণের সৃষ্টি করতে পেরেছে এবং তাদেরকে ইসলামী আদর্শের দিকে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। ইসলামের মহান বাণীর প্রতিধ্বনি- তা যত কম ক্ষমতাসম্পন্ন বা ক্ষীণ হোক না কেন দুনিয়ার জনগণের দৃষ্টি তার প্রতি আকৃষ্ট হবেই।

হে সম্মানিত ইরানী হজযাত্রীরা! আপনারা এই জাতিরই বাণী বয়ে নিয়ে গিয়েছেন এবং এই দেশেরই প্রতিনিধিত্ব করছেন। সুতরাং আপনারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছেন এবং আপনাদের ঘাড়ে রয়েছে এক গুরু দায়িত্ব। ইনশাআল্লাহ, আপনারা আপনাদের দৃষ্টান্তমূলক ব্যবহার এবং ইসলামী ও বিপ্লবী যুক্তি পেশের মাধ্যমে অন্য সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হবেন। আপনারা দুনিয়ার জাতিগুলোর সামনে ইসলামের সত্যিকারের মডেল পেশ করবেন এবং তার প্রতি তাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করবেন। আপনারা আপনাদের ভ্রাতৃত্বমূলক ও সহানুভূতিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা ইরানের মহান ইসলামী বিপ্লবের প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন এবং প্রচারমাধ্যমগুলোর দুর্নীতিপরায়ণ ও পক্ষপাতমূলক ষড়যন্ত্রের দাঁতভাঙা জবাব দেবেন। তাহলে আল্লাহ আপনাদের হজ কবুল করবেন এবং আপনাদেরকে দ্বিগুণ পুরস্কারে ভূষিত করবেন। আর আল্লাহ না করুন, যদি কোন অজ্ঞ ব্যক্তি প্রদত্ত নির্দেশনাবলির বিপক্ষে কাজ করে তবে সে আল্লাহর সামনে, মুসলমানদের কিবলা বায়তুল্লাহর সামনে এক মস্তবড় পাপ করল। আমি বিশ্বাস করি, এমন কোন ঘটনা ঘটবে না। যদি কেউ এরূপ করে তবে হজ, হযরত (সা.)-এর রওজা মোবারক যিয়ারত, জান্নাতুল বাকীতে মাসুম ইমামদের মাজার যিয়ারত ইত্যাদি সবকিছু থেকে সে বাদ পড়বে এবং পাপের একটি বোঝা পিঠে বহন করে বাড়ি ফিরবে।

মুসলমানদের দুশমন কে?

এই গৌরবান্বিত রওজা মোবারকে যেসব মুসলমান ভাই সমবেত হয়েছেন, তাঁরা যে দেশ থেকেই আসনু না কেন, তাঁদের একটি কথা খুব ভালোভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, ইসলাম মহাসম্মানিত কুরআন মজীদ এবং আমাদের প্রিয় রাসূল (সা.)-এর প্রধান দুশমন হচ্ছে পরাশক্তিগুলো, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার জারজ সন্তান ইসরাইল। ইসলামী দেশগুলোর ওপর তাদের লোলুপ দৃষ্টি রয়েছে এবং এসব দেশে যে বিশাল ঐশ্বর্য রয়েছে তা লুণ্ঠন ও ভোগদখল করার জন্য যত জঘন্য ও লোমহর্ষক ষড়যন্ত্র করা ও অপরাধে লিপ্ত হওয়া দরকার, প্রয়োজন হলে তা করতেও এরা কোনরূপ কুণ্ঠাবোধ করবে না। তাদের এই নাপাক ষড়যন্ত্রে তাদের সাফল্যের চাবিকাঠি হচ্ছে, যে কোন উপায়ে সম্ভব মুসলমানদের মধ্যে সংঘাতের বীজ বপন করা। আশঙ্কা করা হচ্ছে যে, এই হজ সম্মেলনে শিয়া-সুন্নি বিরোধ সৃষ্টি করার জন্য তারা তদের পোষ্য মোল্লাদের লাগিয়ে দিতে পারে। তারা তাদের এই শয়তানি চক্রান্তের জাল হয়ত এমন জায়গায় বিস্তার করবে যেখানে কতিপয় সরলমনা মুসলমান রয়েছে এবং তারা এদের কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে ফেলবে এবং এর ফলে তা থেকে একটা সংঘাত ও দুর্নীতির সূত্রপাত ঘটবে। উভয় মাজহাবের ভাই ও বোনদের অবশ্যই এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে এবং তাদের জানতে হবে এসব ভাড়াটিয়া লোকজনের আসল মতলব হচ্ছে ইসলাম, আল-কুরআন ও সুন্নাহর নাম ভাঙিয়ে মুসলমানদেরকে ইসলাম, আল-কুরআন ও রাসূল (সা.)-এর সুন্নাহ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা অথবা অন্ততঃপক্ষে তাদেরকে সত্যপথ থেকে বিচ্যুত করা। ভাই ও বোনেরা! আপনাদের অবশ্যই জানতে হবে যে, আমেরিকা ও ইসরাইল ইসলামের মূল ভিত্তিরই বিরোধী; কারণ, তারা মনে করে ইসলাম, আল-কুরআন ও সুন্নাহ তাদের পথের কাঁটা; কেননা, এগুলোর অস্তিত্ব তাদের জবরদখল ও আগ্রাসী তৎপরতার পথে বাধা সৃষ্টি করছে। তাছাড়া তারা দেখেছে ইরানের জনগণ আল-কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে একটি বিপ্লব সাধন করেছে এবং বিজয়ী হয়েছে এবং এখন সে তাদের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। বস্তুত ইরান, ইরানের সরকার ও হিজবুল্লাহদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র একটি অজুহাত বৈ কিছু নয়। শাহের আমলে তারা ছিল ইরানের পক্ষে, কেননা, সে আমলের ইরান ছিল তাদের পদপ্রান্তে নিবেদিত। শোষক শাহ তাদের ওপর ইরানকে নির্ভরশীল করে রাখার জন্য সবকিছু করেছে; তখন ইরান থেকে ইসলামকে বিতাড়নের জন্য কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছিল। তারা এখন ইরানের বিরুদ্ধে; কেননা, আমাদের দেশের সম্পদ থেকে তাদের হাত চিরতরে কেটে দেয়া হয়েছে এবং তাদের উপদেষ্টা ও খদ্দেরদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

তাদের প্রকৃত দুশমন হচ্ছে ইসলাম। অবশ্য তাদের সেবাদাস সরকার এবং পদলেহী মোল্লাদের (যারা সরকার থেকেও নিকৃষ্টতর) সৃষ্ট ইসলাম হলে তা তাদের দুশমন নয়। এই তথাকথিত ইসলামকে তারা স্বাগত জানায়, কেননা, এই ইসলাম তাদের সমর্থক ও তাদের স্বার্থের রক্ষক। এই ধরনের তথাকথিত ইসলামের ধারকরাই আজ মুসলিম জাগরণের কেন্দ্রস্থল ও ওহী নাযিলের স্থানে ইরানী হজযাত্রীদের নির্দোষ আওয়াজকে দাবিয়ে রাখছে এবং তাদেরকে ধর্মীয় সত্য আচ্ছাদানকারীদের দলভুক্ত বলে আখ্যায়িত করছে। মহান হজের দিবসে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে মানুষের প্রতি এ একটি ঘোষণা যে, আল্লাহর সাথে মুশরিকদের (অংশীবাদীদের) কোন সম্পর্ক নেই এবং তাঁর রাসূলের সাথেও নয়।’ (সূরা তাওবা : ৩)।  সুতরাং হাজীদের খোদায়ী কর্তব্য হচ্ছে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ ও সংঘাত সৃষ্টির লক্ষ্যে যারা বক্তব্য রাখছে তাদের যে কোন কথাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করা। হাজীদের কর্তব্য হচ্ছে ঐসব পবিত্র স্থানে ধর্মীয় সত্যের আচ্ছাদানকারী ও তাদের নেতাদের থেকে দূরে থাকা, যাতে তাঁদের হজ মিল্লাতের পিতা হযরত ইবরাহীম (আ.) ও হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর হজের তুল্য হয়। তা না হলে অনেকের বিলাপ, কিন্তু স্বল্প লোকের (খাঁটি) হজপ্রবাদ বাক্যটি তাঁদের জন্য প্রযোজ্য হবে।

জাগতে হবে সকলেই

একথা পরিষ্কার, যে জাতির আলেম, বুদ্ধিজীবী, লেখক ও বক্তাগণ যুলুম, শোষণ ও চক্রান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার না হবেন, প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের ষড়যন্ত্রের জাল তাঁদের বিরুদ্ধেই বিস্তারিত হবে বেশি। আজ দুঃখের সাথে বলতে হয়, মুসলিম জাতিগুলো সক্রিয় ও আত্মনির্ভরশীল হওয়ার পরিবর্তে নিজেদের দেশগুলোকে ঐসব শক্তিরই বাজারে পরিণত করেছে। এমনকি পরিতাপের বিষয়, মক্কা-মদীনার মতো মহানবী (সা.), জিবরাঈল এবং আল্লাহর ফেরেশ্তাদের পুণ্য স্মৃতি বহনকারী পবিত্র শহরগুলোকেও আজ শয়তানি শক্তিগুলোর মার্কেটে পরিণত করা হয়েছে। ফলে সেখানে মুসলিম ঐক্যের আহ্বান উচ্চারিত হয় না; বরং অনেক হাজীই আমেরিকান, ইউরোপিয়ান ও জাপানি চমকপ্রদ পণ্য কিনে বেড়ান এবং হজের সম্মানকে ক্ষুণ্ন করেন।

হে বিশ্বের সম্মানিত হাজী এবং আলেমগণ! প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের যুলুমবাজদের প্রত্যাখ্যান করুন, ইরানী জাতির মতো অপমানের পরিবর্তে শাহাদাতকে বেছে নিন এবং রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে ইসলামের দুশমনদের বিতাড়িত করুন।

তোমরা যদি আল্লাহকে সাহায্য কর, তবে তিনি তোমাদের কদম মজবুত করে দেবেন।’ (আল কুরআন)। হে খোদা! স¦ল্পসংখ্যক অধিবাসীর একটি ছোট দেশ থেকে তোমার এক নগণ্য বান্দা আমি আবেদন করছি : তুমি মুসলিম জাতির ওপর তোমার খাস রহমত নাযিল কর এবং পৌত্তলিকতার দাসত্ব থেকে তাদের মুক্ত কর। বিশ্বের নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের, বিশেষ করে মুসলিম জাতির ওপর থেকে অশুভ শক্তিকে বিতাড়িত কর। মুসলমান সরকারগুলোকে এমন সাহস, হিম্মত ও শৌর্যবীর্য দান কর যেন তারা বিদেশীদের দাসত্ব ছেড়ে দিয়ে নিজ সম্পদ ও শক্তিতে বলীয়ান হতে পারে। তাদেরকে শুভবুদ্ধি দানে ধন্য কর।

মুসলমানদের প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে হবে

মুসলিম দেশগুলোর রয়েছে বিপুল মানব সম্পদ এবং অন্যান্য সম্পদের ব্যাপক মজুদ যা পরাশক্তিগুলোর জন্য অতীব জরুরি। এমতাবস্থায় মুসলমানরা ও ইসলামী দেশের সরকারগুলো যদি তাদের শক্তিশালী অবস্থান থেকে বৃহৎ শক্তিগুলোর মোকাবিলা করে, পরাশক্তিবর্গের হুমকিকে ভয় না করে, প্রাসাদচারীদের উচ্ছৃঙ্খলতায় শঙ্কিত না হয়, মিথ্যা প্রচার-প্রপাগান্ডায় কোনরূপ প্রভাবিত না হয় এবং আল্লাহর অসীম শক্তির ওপর নির্ভর করে ও তাঁর অপার করুণার প্রতি শুকরিয়াস¦রূপ পরাশক্তিবর্গের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, তাদের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করার হুমকি দেয় ও তেলসহ তাদেরকে সর্বপ্রকার সম্পদের সরবরাহ বন্ধ করে দেয় তাহলে এটা নিঃসন্দেহ যে, মুসলিম শক্তির সামনে পরাশক্তিবর্গ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে। মুসলমানদের শক্তি যে কত বড়, সে সম্পর্কে আমরা এখনো অনবগত রয়ে গেছি।

হে শক্তিশালী মুসলিম জাতি! আপনারা জাগ্রত হোন, নিজেদের শক্তিকে জানুন। বিশ্ববাসীর সামনে নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করুন। মহান আল্লাহর দেয়া বিধান এবং পবিত্র কুরআন মোতাবেক আপনাদের মাজহাবী ও আঞ্চলিক ভেদাভেদ ভুলে যান। আপনাদের মধ্যকার ভেদাভেদ হচ্ছে অপরাধী পরাশক্তিবর্গ ও তাদের এজেন্টদের চক্রান্তের ফসল। তাদের লক্ষ্য হচ্ছে বিভেদ ও অনৈক্য সৃষ্টির মাধ্যমে আপনাদের সহায়-সম্পদ লুণ্ঠন করা এবং আপনাদের মানবিক ও ইসলামী মান-মর্যাদা ও সম্মান ভূলুণ্ঠিত করা। আপনারা ভাড়াটে মোল্লাদের এবং ইসলামের শক্তি সম্পর্কে অপরিজ্ঞাত জাতীয়তাবাদী (নেতাদের) প্রত্যাখ্যান করুন। তারা ইসলামের যে ক্ষতি করছে তা কোনক্রমেই বিশ্বগ্রাসী পরাশক্তিদের ক্ষতির চেয়ে কম নয়। তারা ইসলামের অপব্যাখ্যা করে এবং এভাবে লুটেরাদের জন্য লুণ্ঠনের পথ খুলে দেয়। আমি আল্লাহর কাছে মুনাজাত করছি, তিনি যেন ইসলাম এবং মুসলিম দেশগুলোকে বিশ্বগ্রাসী শয়তানি পরাশক্তি ও তাদের অনুচরদের ক্ষতি থেকে রক্ষা করেন।

ইসলামের সোনালি যুগে হাজীরা পবিত্র মক্কায় সমবেত হয়ে তাঁদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সমস্যাবলি নিয়ে আলোচনা করতেন এবং এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্তও নিতেন। নবম হিজরির হজের প্রাক্কালে কাফের ও মুশরিকদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের (বারায়াত) নির্দেশ দিয়ে সূরা তাওবার প্রথমাংশ নাযিল হলে রাসূলে করীম (সা.) তা হাজীদের পড়ে শোনাবার জন্য হযরত আলী (আ.)-কে মক্কায় প্রেরণ করেন। অথচ ইরানের হাজীরা ১৯৮৭ সালের হজ উপলক্ষে বর্তমান যুগের কুফরি ও মুশরিকি শক্তির ধ্বজাবাহী আমেরিকা, রাশিয়া ও ইসরাইলের বিরুদ্ধে ধ্বনি উচ্চারণ করলে সৌদি শাসকগোষ্ঠী আল্লাহ সেই মেহমানদের ওপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায় এবং ৪০০ হাজীকে শহীদ করে। শুধু তাই নয়, ইরানী হাজীদের বিরুদ্ধে মক্কা ও মদীনা দখলের মিথ্যা অভিযোগও আনা হয়। এই হৃদয়বিদারক ঘটনার প্রেক্ষিত বর্ণনা করে ইমাম খোমেইনী এক বাণীতে বলেন : আল্লাহর ঘরের হাজীদের হত্যাকা- দাম্ভিক কুফরি চক্রের নীতিসমূহের হেফাজত ও মুহাম্মাদ (সা.)-এর নির্ভেজাল ইসলামের প্রসার ঠেকানোর জন্য একটি ষড়যন্ত্র মাত্র। ইসলামী দেশসমূহের অপদার্থ শাসকদের কলংকজনক ও ঘৃণ্য কার্যকলাপ কেবল অর্ধমৃত ইসলাম ও মুসলমানদের দুঃখ-কষ্ট ও বালা-মুছিবতই বৃদ্ধি করেছে। ইসলামের পয়গাম্বর অভিজাত মসজিদ ও সুরম্য মিনারসমূহের কোন প্রয়োজনই রাখেননি। ইসলামের পয়গাম্বর শুধু তাঁর অনুসারীদের ইজ্জত, সম্মান ও গৌরবের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন যা দুঃখজনকভাবে ভাড়াটে শাসকদের ভ্রান্ত নীতি অবলম্বনের কারণে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। বিশ্বের মুসলমানগণ কি ভুলে যাবেন যে, আলে সৌদের ঘৃণ্য দীর্ঘ শাসনামলে মুসলমানদের সকল মাজহাবের শত শত আলেম, হাজার হাজার নর-নারী এবং আল্লাহর ঘরের হাজীদের পাইকারী হত্যার মতো গর্হিত অপরাধ সংঘটিত হয়েছে? মুসলমানরা কি দেখতে পাচ্ছেন না যে, বিশ্বে ওয়াহাবি ফের্কার কেন্দ্রগুলো ফিতনা ও গুপ্তচরবৃত্তির আখড়ায় পরিণত হয়েছে? একদিকে অভিজাত ধনিক-বণিক শ্রেণির ইসলাম, আবু সুফিয়ানের ইসলাম, ঘৃণ্য দরবারি আলেমদের ইসলাম, দ্বীনী মাদরাসা এবং বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ চেতনাহীন ভণ্ড পীর-মাশায়েখ ও মোল্লাদের ইসলাম, যিল্লতি ও লাঞ্ছনার ইসলাম, অর্থবিত্ত ও জবরদস্তির ইসলাম, প্রতারণা, আপোসরফা ও বন্দিত্ব বরণের ইসলাম এবং মজলুম ও নাঙ্গা পা সর্বহারাদের ওপর পুঁজি ও পুঁজিপতিদের ইসলাম- তথা এক কথায় আমেরিকান ইসলামকে ওরা (ওয়াহাবিরা) প্রচার করছে এবং অন্যদিকে তাদের প্রভু বিশ্বদস্যু আমেরিকার দরবারে সেজদা করছে।…

আজ কি মুসলমানগণ বিশ্বাস করছে যে, ইরানের হাজীরা আল্লাহর ঘর ও পয়গাম্বরের রওজা মুবারক দখল করার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছে এবং কাবাকে লুট করে কোম নিয়ে যেতে চায়? বিশ্বের মুসলমানগণ যদি বিশ্বাস করতে পারতেন যে, তাঁদের রাষ্ট্রপ্রধানগণ আমেরিকা, রাশিয়া ও ইসরাইলের প্রকৃত দুশমন তাহলে হয়তো তাদের প্রচারে বিশ্বাস করতেন। অবশ্য আমরা আমাদের বৈদেশিক ও আন্তর্জাতিক নীতিমালায় বার বার এ বাস্তবতা ও সত্যতাকে ঘোষণা করেছি। আমরা বিশ্বে ইসলামের প্রতিপত্তি বিস্তার ও বিশ্বদস্যুদের আধিপত্য হ্রাস করতে চেয়েছি ও চাচ্ছি। এখন যদি আমেরিকার ভৃত্যেরা এর নাম সম্প্রসারণবাদ’  ও বিশাল সাম্রাজ্য বিস্তারের চিন্তা বলে অভিহিত করে, তাতে আমাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই; বরং আমরা তাকে স্বাগত জানাব। আমরা বিশ্বে ইহুদিবাদ, পুঁজিবাদ ও কমিউনিজমের পচা বিষমূলসমূহকে জ্বালিয়ে দিতে চাই। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, মহামহিম আল্লাহ পাকের অনুগ্রহ ও করুণায় এ তিন স্তম্ভের (ইহুদিবাদ, পুঁজিবাদ ও কমিউনিজমের) ওপর প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থাসমূহকে নাস্তানুবাদ করব এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নেজামে ইসলামকে (ইসলামী সমাজব্যবস্থাকে ) দাম্ভিক কুফরি বিশ্বে ছড়িয়ে দেব। আজ হোক কাল হোক, শিকলবদ্ধ জাতিসমূহ তা প্রত্যক্ষ করবে।

ইনশাআল্লাহ, আমরা এটা মোটেই হতে দেব না যে, মানবতার উচ্চতম শৃঙ্গস্বরূপ কাবা ও হজ- যেখান থেকে মজলুমের ফরিয়াদকে সমগ্র বিশ্বে অবশ্যই পৌঁছাতে হয় এবং তাওহীদের বাণীকে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত করতে হয়, সেখান থেকে আমেরিকা, রাশিয়া ও কুফর-শিরকের সাথে আপোসের আওয়াজ উঠবে। আমরা আল্লাহর কাছে এ শক্তি চাই যাতে শুধু মুসলমানদের কাবা থেকেই নয়; বরং বিশ্বের গির্জাসমূহের চূড়া থেকেও আমেরিকা মুর্দাবাদরাশিয়া মুর্দাবাদেরঘণ্টাধ্বনি বাজাতে পারি। আমাদের ইসলামী বিপ্লব বিশ্বলুটেরাদের জন্য যে কুল-কিনারাহীন বারযাখ’ (কবরদেশ) তৈরি করেছে তাতে বিশ্বের মুসলমানগণ ও সমগ্র বিশ্বের বঞ্চিত সর্বহারাগণ আজাদীর গৌরব অনুভব করুক এবং নিজেদের জীবন ও ভাগ্যে আজাদী ও স্বাধিকারের ডংকা বাজাক আর নিজেদের জখম ও ক্ষতসমূহের ওপর মলম দিক। কেননা, অচলাবস্থা ও হতাশার দিন এবং কুফরের এলাকায় শ্বাস গ্রহণের দিন ফুরিয়ে এসেছে। আর জাতিসমূহের গুলিস্তান (কুসুম কানন) মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আমি আশা করছি যে, সকল মুসলমানই আজাদীর কুঁড়িসমূহ, বসন্তের সৌরভময় পুবাল-হাওয়া, মুহব্বত ও এশকের কুসুমরাজির প্রস্ফুটন এবং নিজেদের ইচ্ছা-বাসনার স্বচ্ছ সলিলের ঝরনাধারা প্রত্যক্ষ করুক। আমেরিকা ও রাশিয়ার কর্মকর্তারা নীরবতা ও নিশ্চয়তার মরাপানি ও গভীর কাদায় মৃত্যু ও বন্দিত্বের যে বীজ ছড়িয়ে দিয়েছে তা থেকে আমাদের সবাইকে অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে এবং সেই দরিয়ার পানে ছুটে যেতে হবে- যেখান থেকে জমজমকুয়ার পানি বের হয়ে এসেছে। আর আমেরিকান নাপাক দুশমনরা ও মার্কিন পোষ্যরা কাবা ও খোদার হেরেমের যে পর্দাকে অপবিত্র করেছে তাকে আমরা নিজেদের চোখের পানি দিয়ে ধৌত করব।…

আমরা মক্কায় থাকি আর না-ই থাকি, আমাদের অন্তর ও রূহসমূহ ইবরাহীম (আ.) ও মক্কার সাথে রয়েছে। রাসূলুল্লাহর মদীনা শরীফের দরজাসমূহকে আমাদের সামনে বন্ধ রাখুক বা খুলে দিক, তাতে রাসূলের সাথে আমাদের মুহব্বতের বন্ধন কখনো ছিন্ন হবে না। আমরা কাবার দিকেই নামাজ পড়ে যাব ও কাবার দিকে মুখ করেই মৃত্যুবরণ করব। আল্লাহর শুকরগুজারি করছি যে, আমরা কাবার খোদার সাথে কৃত আমাদের ওয়াদায় (মিছাক) অটল রয়েছি এবং মুশরিকদের সাথে বারাআতের স্তম্ভসমূহকে হাজার হাজার প্রিয়তম শহীদের খুন দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছি এবং এ অপেক্ষায় থাকিনি যে, ইসলামী ও অনৈসলামী দেশের কোন কোন ব্যক্তিত্বহীন শাসক আামাদের আন্দোলনকে সমর্থন দিক। আমরা সর্ব ইতিহাসের চির মজলুম, মাহরুম (হক থেকে বঞ্চিত) ও নাঙ্গা-পা সর্বহারা দল। আল্লাহ ছাড়া আমাদের আর কেউ নেই। হাজার বারও যদি সবাই টুকরো টুকরো হয়ে যাই তবু যালিমের সাথে সংগ্রাম থেকে হাত-পা গুটাব না। ক্ষমতাসীনদের সৃষ্ট রাজনৈতিক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি সত্ত্বেও বিশ্বের যে সকল স্বাধীনতচেতা মুসলমান কনফারেন্স, সাক্ষাৎকার ও বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে আমেরিকা ও আলে সৌদের অপরাধের রহস্যময় পর্দা উন্মোচন করেছেন এবং দুনিয়াবাসীদের কাছে আমাদের মজলুম অবস্থাকে তুলে ধরেছেন, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে। মুসলমানদের অবশ্যই জানা উচিত যে, যদ্দিন পর্যন্ত বিশ্বের শক্তির ভারসাম্য তাদের সপক্ষে পরিবর্তিত না হবে তদ্দিন তাদের স্বার্থের ওপর বেগানা দুশমনদের স্বার্থসমূহই প্রাধান্য পেতে থাকবে আর প্রতিদিনই শয়তানে বুজুর্গ’ (আমেরিকা) অথবা রাশিয়া নিজ স্বার্থে বিপর্যয় সৃষ্টি করে চলবে। সত্যি, মুসলমানগণ যদি তাদের ইস্যুসমূহের ব্যাপারে বিশ্বলুটেরাদের সাথে শক্তভাবে ফায়সালায় না পৌঁছেন অথবা অন্ততঃপক্ষে নিজেদেরকে বিশ্বের বৃহৎ শক্তিবর্গের সীমান্তে না পৌঁছান তাহলে কি শান্তিতে থাকতে পারবেন? এই মুহূর্তে যদি আমেরিকা একটি ইসলামী দেশকে স্বীয় স্বার্থ সংরক্ষণের বাহানায় মাটির সাথে মিশিয়ে দেয় তাহলে কে তার পথরোধ করে দাঁড়াবে? সুতরাং সংগ্রাম ছাড়া আর কোন পথ নেই। পরাশক্তিবর্গ বিশেষ করে আমেরিকার নখর ও দাঁতগুলোকে অবশ্যই ভেঙে ফেলতে হবে। আমাদের বাধ্যতামূলক দুটির যে কোন একটি বেছে নিতে হবে- হয় শাহাদাত, নয় বিজয়; আর আমাদের আদর্শে দুটিই বিজয়। ইনশাআল্লাহ, আল্লাহ পাক বিশ্বগ্রাসী শাসক ও যালেমদের প্রণীত নীতিমালা ছুঁড়ে ফেলার শক্তি এবং মানবিক মূল্যবোধ ও ইজ্জত-সম্মানের চারপাশ ঘিরে দেয়াল গড়ে তোলার সাহস সকল মুসলমানকে দান করবেন। আর সবাইকে যিল্লতির পাতালপুরী থেকে সম্মান ও শান-শওকতের সুউচ্চ শৃঙ্গে আরোহণ করার সহায়তা দান করবেন।

গত বছর (১৯৮৭) হজের তিক্ত ও মিষ্টঘটনার পূর্ব পর্যন্ত অনেক লোক মুশরিকদের সাথে বারাআত মিছিলের ওপর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের গুরুত্বারোপের যুক্তি-দর্শন উত্তমরূপে উপলব্ধি করতে পারেননি; বরং নিজেদের ও অন্যদের জিজ্ঞেস করতেন হজ সফরে এবং এ গরম হাওয়ায় মিছিল ও সংগ্রামের ফরিয়াদ করার কি আবশ্যকতা রয়েছে? অথবা মুশরিকদের সাথে বারাআতের ফরিয়াদ না হয় করা হলো, কিন্তু তাতে উদ্ধত কুফরি ও শয়তান চক্রের কি ক্ষতি হবে? কত সরলমনা মানুষই না ভাবতেন যে, বিশ্বগ্রাসী দস্যুদের তথাকথিত সভ্য দুনিয়ার পক্ষে এ ধরনের রাজনৈতিক ব্যাপারস্যাপার তো বরদাশত করারই বিষয়, এটা বরং স্বীয় বিরোধীদেরকে বেঁচে থাকার ও মিছিল ও বিক্ষোভের সুযোগ এর চেয়ে বেশি করে দেবে। এ দাবির পিছনে কারণ এটি নয় যে, তথাকথিত মুক্ত পাশ্চাত্যে বিক্ষোভ মিছিলের স্বাধীনতা রয়েছে; বরং এ বিষয় পরিষ্কার হতে হবে যে, এ ধরনের মিছিলসমূহ পরাশক্তিবর্গ ও অন্যান্য শক্তির জন্য কোন প্রকার ক্ষতিকারক নয়। আসলে মক্কা-মদীনার মিছিলের পরিণতিতেই যে সৌদিদের তেলের পাইপ লাইন বন্ধ হয়ে যাবে, মক্কা ও মদীনার মিছিলই যে রাশিয়া ও আমেরিকা দালালদের ধ্বংসযজ্ঞে গিয়ে শেষ হবে। আর ঠিক এ কারণেই স্বাধীন নর-নারীদের পাইকারী হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে তা ঠেকানো হচ্ছে। মুশরিকদের সাথে এ বারাআতের ছায়াতলেই সরলমতি মানুষেরা বুঝতে পারবেন, রাশিয়া ও আমেরিকার দরবারে মাথা ঠেকানো মোটেই ঠিক নয়।…

(নিউজলেটার, জুন ১৯৯১)

হযরত আলী (আ.)-এর বাণী- নাহজুল বালাগা থেকে

হযরত আলী (আ.) দুনিয়ার অসারতা বর্ণনা করে বলেন : ‘আল্লাহর কসম। আমার চোখে তোমাদের এ দুনিয়া কুষ্ঠ রুগীর হাতে ধারণকৃত শুকরের মাংসপিণ্ড অপেক্ষা নিকৃষ্ট বস্তু।’- নাহজুল বালাগা, উক্তি নং ২২৮

হযরত আলী (আ.) বলেছেন : ‘এক শ্রেণির লোক কিছু পাওয়ার আশায় আল্লাহর ইবাদাত করে, তারা হলো ব্যবসায়ী। এক শ্রেণির লোক ভয়ে আল্লাহর ইবাদত করে, এটা হলো কৃতদাসের উপাসনা। এক শ্রেণির লোক কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আল্লাহর ইবাদত করে, এটা হলো স্বাধীন সম্ভ্রমশীলদের ইবাদত।’- নাহজুল বালাগা, উক্তি  নং ২২৯

হযরত আলী (আ.) বলেছেন : ‘যে ব্যক্তি অনীহা দেখায়, সে বঞ্চিত হয়। যে নিন্দুকের কথা শোনে, সে একনিষ্ঠ বন্ধু হারায়।’- নাহজুল বালাগা, উক্তি নং ২৩১

হযরত আলী (আ.) বলেছেন : ‘লুণ্ঠন করে আনা একটি পাথর ঘরে স্থাপন করার অর্থ হচ্ছে ঐ ঘরটিকে ধ্বংসের হাতে বন্ধক রাখা।’- নাহজুল বালাগা, উক্তি নং ২৩২

হযরত আলী (আ.) বলেছেন : ‘নিপীড়নকারীর বিরুদ্ধে নিপীড়িতের বিজয়ের দিনটি নিপীড়িতের ওপর নিপীড়নকারীর দিবস অপেক্ষা কঠিন হয়।’- নাহজুল বালাগা, উক্তি  নং ২৩৩

হযরত আলী (আ.) বলেছেন : ‘যৎকিঞ্চিৎ হলেও আল্লাহকে ভয় কর। আল্লাহ তাআলা এবং তোমার মাঝখানে ক্ষীণ হলেও আবরণ করে রাখ।’- নাহজুল বালাগা, উক্তি নং ২৩৪

হযরত আলী (আ.) বলেছেন : ‘প্রতিটি নিয়ামতের জন্য আল্লাহ তাআলার হক বা প্রাপ্য রয়েছে। যে ব্যক্তি সে হক আদায় করবে, আল্লাহ তার জন্য সেই নিয়ামত বাড়িয়ে দেবেন। আর যে তা আদায়ে ব্যর্থ হবে, সে ঐ নিয়ামত অবলুপ্ত হওয়ার সংকটে পড়বে।’- নাহজুল বালাগা, উক্তি নং ২৩৬

হযরত আলী (আ.) বলেছেন : ‘সংগতি বৃদ্ধি পেলে চাহিদা কমে যায়।’- নাহজুল বালাগা, উক্তি নং ২৩৭

হযযত আলী (আ.) বলেছেন : ‘নিয়ামত হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক হও। কারণ, হারানো বস্তু সবই ফিরে পাওয়া যায় না।’- নাহজুল বালাগা, উক্তি নং ২৩৮

হযরত আলী (আ.) বলেছেন : ‘ভদ্রতা আত্মীয়তা অপেক্ষা অধিক আকর্ষণীয়।’- নাহজুল বালাগা, উক্তি নং ২৩৯

(নিউজলেটার, জুন ১৯৯১)

ডক্টর মুস্তফা চামরান- অকুতোভয় শহীদ

ইসলামের একজন সম্মানিত সিপাহসালার শহীদ ড. মুস্তফা চামরানের শাহাদাত দিবস হচ্ছে ২১ জুন। তিনি ১৯৮১ সালের ২১ জুন দেহলভীতে ইসলামের শত্রুদের হাতে শহীদ হন। ড. মুস্তফা চামরান ছিলেন একজন বিপ্লবী মুসলমান যিনি ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের মহান নেতা ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর নেতৃত্বে ইসলামের দুশমনদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। সম্মানের সঙ্গেই তিনি তাঁর ছাত্রজীবন অতিবাহিত করেছেন এবং ধার্মিকতা ও শিক্ষার দিকটি এমনভাবে সম্পূর্ণ করেছেন যে, ইসলামই আইন ও অন্যান্য বিষয়ে সচেতনতা ও জ্ঞান অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে উচ্চতর ডিগ্রিও লাভ করেছেন।

তিনি আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেকট্রিক্যাল প্লাজমা ফিজিক্সে দুটি পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ড. চামরান ছিলেন উপগ্রহ ও শক্তিশালী রাডার এর একজন বিশিষ্ট গবেষক। তিনি জ্ঞানের বিশালতা ও কর্মকৌশলকে এমনি নিবেদিতচিত্ততার সঙ্গে সমন্বিত করতে পেরেছিলেন যে, তাঁর বন্ধু ও দুশমন সবাই একইভাবে বিস্মিত হত। ইহুদিবাদের এবং কুদসের দখলদার শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বছরের পর বছর ধরে তিনি লেবাননে সংগ্রাম করেছেন।

ইরানে ইসলামী বিপ্লব সফলকাম হওয়ার পর তিনি স¦দেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং তাঁর সকল বাস্তব ও বিপ্লবী অভিজ্ঞতা ইসলাম ও ইসলামী বিপ্লবের স্বার্থে ব্যবহার করেন। তিনি সক্রিয় ও দৃঢ়ভাবে দেশের পুনর্গঠন কর্মের সূচনা করেন। শহীদ চামরানকে তেহরানের জনগণ প্রথম ইসলামী মজলিসের প্রতিনিধি হিসাবে নির্বাচিত করেছিলেন। এক পর্যায়ে ইমাম খোমেইনী ড. চামরানকে তাঁর সামরিক উপদেষ্টা এবং সর্বোচ্চ প্রতিরক্ষা পরিষদে তাঁর প্রতিনিধি হিসাবে নিয়োগ করেন। ইরাকের বামপন্থী সরকারের আগ্রাসন এবং বিশ্ব ক্ষমতাদর্পী আমেরিকার উদ্যোগে একটি অনাহুত যুদ্ধ শুরুর পর শহীদ চামরান যুদ্ধের ময়দানে দায়িত্ব পালন করেন। স্বেচ্ছাসেবক যোদ্ধাদের পাশাপাশি তিনি ‘অনিয়মিত বাহিনী’র একটি প্রধান কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং ইসলাম ও ইসলামী ইরানের সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব আঞ্জাম দেন। তিনি বিরতিহীনভাবে যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত ছিলেন এবং বেশ কয়েকবার আহত হন। কিন্তু প্রতিবারই সুস্থ হলে ফিরে গিয়েছেন যুদ্ধের ময়দানে এবং ইসলামের নিরাপত্তার মহান কর্ম সম্পাদন করেছেন। সুসানগার্দ হোয়াইজেহ ও অন্যান্য ইরানী শহর মার্কিনী ক্রীড়নক সাদ্দামের কবল থেকে মুক্ত হলে ড. চামরান ১৯৮১ সালের ২১ শে জুন দেহলভীতে শাহাদাত বরণ করে তাঁর কাক্সিক্ষত বেহেশতী দুনিয়ায় প্রবেশ করেন। তাঁর শাহাদাত বরণে ইমাম খোমেইনী গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন : ‘তিনি ছিলেন অসাধারণ প্রজ্ঞার অধিকারী, যিনি আল্লাহর ওপর গভীর বিশ্বাস রেখে তাঁর জিহাদ শুরু করেছিলেন। তিনি স্বীয় পথে অবিচল থেকে তাঁর জীবন দান করেছেন।’

(নিউজলেটার, জুন ১৯৯১)

আয়াতুল্লাহ বেহেশতী ও তাঁর ৭২ সাথির শাহাদাত বার্ষিকী

২৮ জুন হচ্ছে আয়াতুল্লাহ ড. সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ হোসাইন বেহেশতী এবং ইমাম খোমেইনীর আরো বাহাত্তর জন নিবেদিতপ্রাণ অনুসারীর শাহাদাত বার্ষিকী। ১৯৮১ সালের এই দিনে ইসলামী বিপ্লবের শত্রুদের পেতে রাখা বোমা বিস্ফোরণে তাঁরা শহীদ হন। ইরানের ইসলামী বিপ্লবকে নস্যাৎ করার জন্য বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিবর্গের দেশীয় এজেন্ট ও মুনাফিকরা প্রথম থেকেই ইমামের বিশ্বস্ত সহকর্মী ও অনুসারীদের ওপর হামলা চালিয়ে আসছিল। ১৯৮১ সালের ২৮ জুন এই মুনাফিকরা তেহরানের ইসলামী রিপাবলিকান পার্টির সদর দফতরে বোমা পেতে রাখে। দুটি শক্তিশালী বোমার বিস্ফোরণে শহীদ হন ইরানের প্রধান বিচারপতি বিপ্লবের অন্যতম দার্শনিক, সংগঠক ও ইমামের প্রিয় ছাত্র আয়াতুল্লাহ ড. সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ হোসাইন বেহেশতী। শাহাদাতপ্রাপ্তদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন হুজ্জাতুল ইসলাম, পিএইচডি ডিগ্রিধারী ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে প্রথম কাতারের নেতা। এর মধ্যে ৩০ জনের অধিক ছিলেন পার্লামেন্ট সদস্য। এই বোমা হামলার প্রধান লক্ষ্য ছিল বিশিষ্ট আয়াতুল্লাহ ড. বেহেশতী, যিনি ছিলেন ইরানের ইসলামী বিপ্লবের গৌরবোজ্জ্বল সাফল্যে অংশগ্রহণকারী এক দৃঢ়চিত্ত ব্যক্তিত্ব। আয়াতুল্লাহ বেহেশতীর শাহাদাত প্রসঙ্গে ইমাম খোমেইনী বলেছেন : ‘শহীদ বেহেশতী মজলুমের জীবনযাপন করেছেন আর মৃত্যুবরণ করলেন মজলুম হয়ে। তিনি ছিলেন ইসলামের দুশমনদের চক্ষুশূল।’ শহীদ বেহেশতী ইসলামিক রিপাবলিকান পার্টিকে দিয়েছিলেন উৎসাহ ও পথনির্দেশনা। এই পার্টি ছিল ইরানের ইসলামবিরোধী চক্রের মোকাবিলায় প্রতিরোধের কেন্দ্রবিন্দু। শহীদ বেহেশতী সম্পর্কে ইরানীরা ইমাম খোমেনীর একটি উক্তি স্মরণ করে : ‘তিনি নিজেই ছিলেন স্বয়ং একটি জাতি।’ আয়াতুল্লাহ বেহেশতী ও তাঁর সঙ্গী বাহাত্তর জনের কোরবানি ইসলামী মূলনীতিকে শক্তিশালী করতে প্রেরণা জুগিয়েছে।

এই বোমাবাজী শুধু সাম্রাজ্যবাদী ও মুনাফিকগোষ্ঠীর শয়তানি পদচারণার একটি পদক্ষেপ মাত্র। শয়তানের উদ্দেশ্য হলো এই ধরনের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের মাধ্যমে খোদায়ী প্রেরণায় জাগ্রত ইরানের বিপ্লবী সরকারকে উৎখাত করা। এই ধরনের ষড়যন্ত্র যদি অন্য কোন দেশে সংঘটিত হতো তাহলে সেই দেশের সরকারই হয়তো উৎখাত হয়ে যেত। কিন্তু নতুন প্রতিষ্ঠিত ইসলামী প্রজাতন্ত্র এই ধরনের ষড়যন্ত্রের মোকাবিলায় অথবা ইরাকের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে নিজ ভূখণ্ডের হাজার হাজার কিলোমিটার সীমান্ত রক্ষার ক্ষেত্রে ছিল যথেষ্ট শক্তিশালী। আল্লাহর অশেষ রহমত, ইমাম খোমেইনীর বিজ্ঞ নেতৃত্ব এবং ইরানী জনগণের ঐক্য ইরানের ইতিহাসে নতুন যুগের সূচনা করেছে।

আয়াতুল্লাহ বেহেশতী ও অন্য বাহাত্তর জন সরকারি কর্মকর্তার শাহাদাত ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি বয়ে আনলেও তাদের স্থান দখল করেছেন অন্য দায়িত্বশীল এবং প্রতিশ্রুতিশীল মুসলিম ভাইয়েরা। শহীদানের জানাযা অনুষ্ঠান ছিল অতিশয় গৌরবোজ্জ্বল। হাজারো মানুষের ভীড়ে তা ছিল অসাধারণ। পাশ্চাত্যের সংবাদমাধ্যমগুলো এই জনসমাগমকে ইচ্ছাকৃতভাবে বর্ণনা করেছে সামান্য এক শবযাত্রা হিসাবে। এই ঐতিহাসিক জানাযা মিছিলে বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল ‘আমেরিকা মুর্দাবাদ’, ‘মুনাফিকরা মুর্দাবাদ’, ‘লাখো বেহেশতী এখনো জাগে ইরানে’ প্রভৃতি স্লোগান।

১৯৮১ সালের ২৮ জুনের ঘটনার পর আরো একটি বিপ্লববিরোধী সন্ত্রাস সংঘটিত হয়। এই ঘটনায় ইসলামী পরামর্শ পরিষদের ২৭ জন প্রতিনিধি শাহাদাত বরণ করেন এবং আরো অনেকে আহত হন। এইসব ঘটনা আসলে ইরানের বিপ্লবী জাতির যুগান্তকারী প্রতিরোধ সংগ্রামেরই সামান্য প্রতিক্রিয়া মাত্র। সন্ত্রাসী তৎপরতার মাধ্যমে মুনাফিকরা চেয়েছিল ইসলামী প্রজাতন্ত্রকে ধ্বংস করতে, কিন্তু এর মাধ্যমে আসলে ওরা ইসলামী প্রজাতন্ত্রের শক্তিকেই বিশদভাবে তুলে ধরেছে এবং নিজেদের কদর্য চেহারারই প্রকাশ ঘটিয়েছে। ইসলামের এই দুশমনরাই মযলুম জনতার সহায় বলে ভান করে।

ইসলামের ইতিহাসে ৬১ হিজরির ১০ মুহররমে সংঘটিত আশুরার ঘটনার মতোই ১৯৮১ সালের ২৮ জুন ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে সংঘটিত ঘটনায়ও শহীদের সংখ্যা সমান। এই ঘটনার ক্ষেত্রেও শহীদদের আত্মোৎসর্গ এবং দৃঢ় মনোবলের পরিচয় ফুটে ওঠে। এটা নিঃসন্দেহ যে, আয়াতুল্লাহ বেহেশতী আর তাঁর বাহাত্তর জন সাথির পবিত্র শাহাদাত, পূর্ববর্তী সময়ের চেয়ে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের জনগণকে অধিকতর বিপ্লবী করে তুলেছে।

এই শাহাদাত প্রকৃতপক্ষে ছিল এক রহমত যা আমাদের বিপ্লবী জাতিকে বিশ্বব্যাপী অত্যাচার আর অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে অধিকতর দৃঢ় মনোবলের অধিকারী করেছে।

(নিউজলেটার, জুন ১৯৯১)

পৈশাচিকতার সাক্ষী খুররম শহর

দুনিয়ায় যুদ্ধ হয়েছে অনেক। অনেক যুদ্ধেই সংঘটিত হয়েছে পৈশাচিক বর্বরতা। কিন্তু ইরানের বিরুদ্ধে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের যুদ্ধ-বর্বরতা ইতিহাসের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। যুদ্ধবন্দিদের প্রতি ইরাকী বাহিনীর ব্যবহার, এক বিরাট সংখ্যক ইরাকী যুদ্ধবন্দির দেশে প্রত্যাবর্তন না করার ইচ্ছা প্রকাশ এবং হালাবজায় ইরাকী রাসায়নিক বোমা বর্ষণের এই পৈশাচিকতার প্রমাণ মিলে। নিউজ লেটারের পাঠকদের অবগতির জন্য এখানে খুররম শহরে ইরাকী বর্বরতার একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হলো। খুররম শহর ইরানের খুজিস্তান প্রদেশের দক্ষিণাঞ্চলের একটি বন্দর। আবাদান শহর থেকে এর দূরত্ব ১৮ কিলোমিটার। ইরাকের বসরা বন্দরের বিপরীত পার্শ্বে আরভান্দ ও কারুন নদীর তীরে এর অবস্থান। বসরা ও খুররম শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে আরভান্দ নদী। ইরান-ইরাক যুদ্ধের পূর্বে এই সীমান্ত শহরের লোকসংখ্যা ছিল ২ লাখ ৩০ হাজার। বেসামরিক এলাকায় হামলা করা যুদ্ধের নীতিবিরোধী হওয়ার সত্ত্বেও ইরানের বিরুদ্ধে ইরাকী আগ্রাসন শুরুর প্রথম দিন থেকেই এ শহরটি ইরাকী হামলার শিকার হয়। দুশমনের কামানের গোলা ও রকেটসমূহ প্রথম দিন থেকেই শহরটিকে ক্ষত-বিক্ষত করে। এরপর ইরাকী বিমান বাহিনীর ছত্রছায়ায় এবং ইরাকী নৌবাহিনীর সহায়তায় ইরাকী ট্যাংকবহর খুররম শহরে পৌঁছে। বলাবাহুল্য, সে সময় ইরানের বড় ধরনের হামলা মোকাবিলার মতো কোন প্রস্তুতি ছিল না। ইরাকী বাহিনী যখন শহরটিতে প্রবেশ করে তখন তারা এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। ইরাকী বাহিনী কেবল তাদের আগ্রাসনে প্রতিরোধ সৃষ্টিকারীদেরই হত্যা করেনি; বরং একই সাথে হত্যা করেছে অসংখ্য অসহায় মানুষকে। ওদের হাত থেকে মসজিদের ইমাম, মোয়াজ্জিন ও মুসল্লি সাধারণ কেউই রেহাই পায়নি। ধ্বংসের জন্য ইঞ্জিনিয়ারিং সাজ-সরঞ্জামও ব্যবহার করে। এই ধ্বংসযজ্ঞ হালাকু খানের বাগদাদ ধ্বংসযজ্ঞকেও হার মানায়।

খুররম শহরের ২৩ হাজার গৃহের মধ্যে ১২০টি মসজিদ ও ধর্মীয় স্থাপনা, ১০০টি স্কুলগৃহ, ২টি কলেজ ভবন, ৪টি বড় বড় হাসপাতাল ও বেশ কিছু স্বাস্থ্য কেন্দ্রসহ আট হাজার ভবন মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছিল। ইরাকীরা ১৫ হাজার ভবন এমনভাবে ধ্বংস করে যে, সেগুলো আর মেরামতযোগ্য নয়। বিরাট সংখ্যক দোকানপাট লুট করা হয় এবং আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। ৫০ থেকে ৬০টি বিদেশী জাহাজ এবং একশটি ইরানী জাহাজ হয় ডুবিয়ে দেয়া হয় অথবা ধ্বংস করা হয়। ইরাকী বাহিনীর ঐ পৈশাচিকতা এত ব্যাপক ছিল যে, একটি গাছও তারা অক্ষত রাখেনি। এই ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয় স্বজ্ঞানে ও স্বেচ্ছায় এবং এজন্য ব্যবহার করা হয় বিস্ফোরক, ধ্বংসাত্মক উপাদান ও ইঞ্জিনিয়ারিং যন্ত্রপাতি। ইরাকী বর্বরতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, আত্মসমর্পণ করা ইরানী স্বেচ্ছাসেবক ও অন্যদের পুড়িয়ে মারা হয়।

অবশেষে পশুশক্তির পতন হয়। ১৯৮২ সালের ২৪ মে ‘বায়তুল মোকাদ্দাস অপারেশন’ চালিয়ে ইরানের বীর মুজাহিদরা খুররম শহর মুক্ত করে। খুররম শহর তখন পরিণত হয়েছিল এক ধ্বংসপুরিতে। অবশ্য ইরানের ইসলামী সরকার ও দেশপ্রেমী জনতার সহায়তায় খুররম শহর আবার তার পূর্ব সৌন্দর্য ফিরে পেয়েছে। ফিরে এসেছে নতুন প্রাণ-প্রবাহ।

(নিউজলেটার, মে ১৯৯১)

হযরত আলী (আ.)-এর বাণী- নাহজুল বালাগা থেকে

হযরত আলী (আ.) বলেছেন : ‘আশাহত ও মুশকিল আছান হওয়ার দ্বারা আমি আল্লাহকে চিনতে পেরেছি।’- নাহজুল বালাগা, উক্তি নং ২৪২

হযরত আলী (আ.) বলেছেন : ‘দুনিয়ার তিক্ততা পরকালে মধুময় হয়। আর দুনিয়ার মাধুর্য পরকালে তিক্ততা আনে।’- নাহজুল বালাগা, উক্তি নং ২৪৩

হযরত আলী (আ.) বলেছেন : ‘শিরক হতে পবিত্র করার জন্য আল্লাহ ঈমান ফরজ করেছেন। নামায ফরয করছেন অহংকার হতে বিমুক্ত করার জন্য। আর যাকাত ফরজ করছেন রিযিক বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য। আর মানুষের মনের ইখলাস পরীক্ষা করার জন্য রোযা ফরজ করেছেন। হজ করা ফরজ করেছেন ইসলামকে শক্তিশালী করে তৈরি করার জন্য। আর জিহাদ ফরজ করেছেন ইসলামের সম্মান ও প্রতিপত্তি বিস্তারের জন্য। জনগণের কল্যাণে ফরজ করেছেন সৎকর্ম নির্দেশ। আর জ্ঞানহীনদেরকে সতর্ক করার জন্য মন্দ কাজে নিষেধ করাকে ফরজ করেছেন। আপনজনের প্রতি সদাচার ফরজ করেছেন সহচরবৃন্দের আধিক্য সৃষ্টির জন্য। আর রক্তপাত বন্ধের জন্য রক্তের বদলে রক্ত-কিসাস ফরজ করেছেন। আর শাস্তিমূলক আইনের বাস্তবায়ন ফরজ করেছেন নিষিদ্ধ কর্মের গুরুত্ব বুঝবার জন্য। আর সুরা পান নিষিদ্ধ করছেন জ্ঞান সংরক্ষণের জন্য। চৌর্যবৃত্তি পরিহার করাকে ফরজ করেছেন সৎ জীবন যাপনকে অপরিহার্য করার জন্য। বংশ পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য ব্যাভিচার পরিত্যাগ করা ফরজ করেছেন। সমকামিতা পরিহার করা ফরজ করেছেন বংশ বৃদ্ধির নিমিত্ত। আর সাক্ষ্যদান ফরজ করেছেন অস্বীকারকৃত বিষয় প্রকাশের জন্য। সত্যকে সম্মানদানের জন্য মিথ্যা পরিহার ফরজ করেছেন। সালাম ফরজ করেছেন আশঙ্কা বিমুক্তির জন্য। ইমামত অবধারিত করেছেন জাতিকে সুশৃঙ্খলে রাখার জন্য। আর আনুগত্য অবধারিত করেছেন ইসলামে রাষ্ট্রীয় বিধানের প্রতি গুরুত্বারোপের জন্য।’- নাহজুল বালাগা, উক্তি নং ২৪৪

হযরত আলী (আ.) বলেছেন : ‘জালিমের কাছ থেকে শপথ নিতে হলে সে আল্লাহর আশ্রয় ও ক্ষমতা হতে বঞ্চিত বলে শপথ নেবে। সে মিছামিছি অনুরূপ কসম করলে ত্বরিত আযাবে নিপতিত হবে। আর যদি- সে আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই- বলে আল্লাহর নামে কসম করে তাহলে সে তাড়াতাড়ি আযাবে নিপতিত হবে না। কারণ, সে এরূপে আল্লাহর একত্ববাদের ঘোষণা দিয়ে থাকে।’- নাহজুল বালাগা, উক্তি নং ২৪৫

(নিউজলেটার, মে ১৯৯১)