All posts by dreamboy

অমর শহীদ- ড. মুহাম্মদ মুফাত্তেহ

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে শহীদদের সারিতে একটি বিশেষ নাম হচ্ছে ড. মুহাম্মদ মুফাত্তেহ (রহ.)। ১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের গুপ্তচরেরা প্রখ্যাত আলেম ইসলামী বিপ্লবের অকুতোভয় সৈনিক হুজ্জাতুল ইসলাম ড. মুহাম্মদ মুফাত্তেহ হামেদানীকে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মতত্ত্ব ও ইসলামী বিজ্ঞান অনুষদের চত্বরে শহীদ করে। ইসলামী বিপ্লব সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। বিশেষত তেহরানের ওলামা সমাজের কেন্দ্রীয় পরিষদের দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে তেহরানের জনণকে তিনি পরিচালিত ও সংগঠিত করার কাজে বিশেষ অবদান রাখেন। শাহের জল্লাদ বাহিনী সাভাক দ্বারা তিনি বহুবারই আক্রান্ত ও বন্দি হয়েছিলেন।

ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের পর শহীদ আয়াতুল্লাহ মোতাহহারীর সুপারিশক্রমে তাঁর ওপর তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মতত্ত্ব ও ইসলামী বিজ্ঞান অনুষদের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন : যখন উক্ত অনুষদের দায়িত্ব গ্রহণ করার ব্যাপারে আমি আপত্তি তুলি তখন আয়াতুল্লাহ মোতাহহারী আমাকে সাহায্যের অঙ্গীকার করেন। তাঁর সাহায্য না পেলে কাজের চাপে আমার শিরদাঁড়া ভেঙে যেত।তাঁর সারল্য, ক্ষমাশীলতা, সাধুতা, দায়িত্ববোধ এবং ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের দক্ষতা তাঁকে অমর করে রেখেছে। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের তিনি একজন স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব।

(নিউজলেটার, ডিসেম্বর ১৯৯১)

ড. মুদাররেস- অমর শহীদ

ইরানে শাহের আমলে যাঁরা অন্যায়, অসত্য, যুলুম, নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন, অকুতোভয় সৈনিকের মতো সাধারণ মানুষের মনে প্রাথমিক পর্যায়ে বিপ্লবের বীজ বপন করেছেন তাঁদের অন্যতম হচ্ছেন শহীদ সাইয়্যেদ হাসান মুদাররেস (রহ.)। তিনি ১৮৭১ সালে ইরানের ইসফাহান প্রদেশের আরদিস্তানের একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ধর্মীয় বিষয়ে প্রগাঢ় জ্ঞানের অধিকারী শহীদ মুদাররেস পরপর বেশ কয়েকবার মজলিসের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। প্রথমবার মজলিসের সদস্য হওয়ার পর মজলিসের সংখ্যাগরিষ্ঠদের নেতা নির্বাচিত হন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি ১৯১৯ সালের চুক্তিটি প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি যুগপৎ দুটি দায়িত্বই পালন করতেন। একদিকে মজলিসের সদস্য হিসেবে রাজনৈতিক দায়িত্ব, অন্যদিকে শিক্ষকতার দায়িত্ব। তিনি মজলিসের প্রতিনিধি হিসেবে সাহসিকতা, দক্ষতা, দূরদর্শিতা ও মনোবলের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন এবং মজলিসকে ইসলামী নীতিমালা অনুযায়ী পরিচালনা করার চেষ্টা করেন। মজলিসে সবসময় অন্যায় ও স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকার কারণে রেযা খান তাঁর কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে চান আর এজন্য চালানো হয় ষড়যন্ত্র। এর ফলে পূর্ববর্তী নিবার্চনগুলোতে তিনি সর্বোচ্চ ভোট পেলেও সর্বশেষ নির্বাচনে তিনি কোন ভোট পাননি। রেযা খান তাঁকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার উদ্দেশ্যে খোরসানে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেন। দীর্ঘ আট বছর নির্বাসনে থাকার পর তাঁকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয় এবং কোমরের বেল্ট দিয়ে ফাঁসিতে লটকিয়ে রেখে আত্মহত্যার কথা প্রচার করা হয়।

শহীদ হাসান মুদাররেসের রাজনীতির একটি বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, তিনি ক্ষমতার ভারসাম্যের ব্যাপারে সচেতন ছিলেন এবং নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর ছিলেন, যাকে বর্তমানে আমরা প্রাচ্যও নয়, পাশ্চাত্য নয়নীতি হিসেবে অভিহিত করে থাকি। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, স্বাভাবিক কারণেই মানুষের জন্য স্বাধীনতা এবং বন্ধনমুক্তি প্রয়োজন। এজন্যই তিনি বলতেন : যে কেউ সাম্রাজ্যবাদীদের নীতির প্রতি ঝুঁকে পড়বে, সে আমাদের জনগণের সমর্থন হারাবে। চাই সে ঝোঁক প্রবণতা রাশিয়া, ব্রিটেন অথবা অবশিষ্ট পৃথিবীর যে কারো প্রতিই হোক। আমরা জোটনিরপেক্ষই থাকতে চাই।তিনি বিশ্বাস করতেন ইসলামী জীবনাদর্শের বাস্তবায়ন ছাড়া জাতির ও দেশের কোন কল্যাণ হতে পারে না। তিনি বলতেন : আমাদের প্রকৃত মূলনীতি হচ্ছে আমাদের ধর্ম। যারা আমাদের বিরোধিতা করবে, আমরাও তাদের বিরোধিতা করব- তারা যারাই হোক না কেন।তাঁর একটি কথা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলতেন : আমাদের রাজনীতি হচ্ছে আমাদের ধর্ম আর আমাদের ধর্মই হচ্ছে আমাদের একমাত্র রাজনীতি।

শহীদ মুদাররেস সম্পর্কে ইমাম খোমেইনী (রহ.) বলেন : রেযা শাহ মুদাররেসকে এত ভয় করত যে, সে বিদ্রোহী তথা সশস্ত্র দস্যুদেরকেও এত ভয় করত না। মুদাররেস রেযা খানকে অনেক বীভৎস ও ঘৃণ্য কাজ থেকে বিরত রেখেছেন, অবশেষে রেযা খান তাঁকে গ্রেফতার করেছে এবং হত্যা করেছে।

(নিউজলেটার, ডিসেম্বর ১৯৯১)

হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনালেখ্য

ইসলামী বিপ্লবের পথিকৃত ও ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিষ্ঠাতা ইমামে উম্মত আয়াতুল্লাহ আল-উজমা খোমেইনী (রহ.) ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে ইরানের খোমেইন শহরে এক প্রসিদ্ধ ধর্মীয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ মোস্তফা মুসাভী একজন ধর্মীয় নেতা ছিলেন। তাঁর মাতাও ছিলেন একজন ধর্মীয় নেতার সন্তান। মহান ইমামের পূর্ব পুরুষগণ কাশ্মীরের অধিবাসী ছিলেন।

হযরত ইমাম (রহ.)-এর আসল নাম রুহুল্লাহ এবং পারিবারিক উপাধি মোস্তফাভী। কিন্তু ধর্মীয় নেতা হিসাবে খ্যাতিলাভের সাথে সাথে তৎকালীন প্রথা অনুযায়ী খোমেইন শহরের অধিবাসী হিসাবে তিনি খোমেইনী হিসাবে সমধিক পরিচিত লাভ করেন। এছাড়া তাঁর নামের দ্বিতীয় অংশ মুসাভীএকথাই নির্দেশ করে যে, তিনি আহলে বাইতের সপ্তম ইমাম হযরত মূসা ইবনে জাফর (আ.)-এর বংশধর। উক্ত ইমামের ডাক নাম ছিল হযরত ইমাম মূসা কাজিম (আ.)। মহান ইমামের পিতামাতা তিন ছেলে এবং তিন মেয়ের অধিকারী ছিলেন। ইমামের বড় ভাইয়ের নাম আয়াতুল্লাহ পাছান্দিদেহ। তিনি একজন মুজতাহিদ ফকীহ। তিনি এখনো জীবিত আছেন। তাঁর ছোট ভাই আয়াতুল্লাহ হিন্দিও একজন মুজতাহিদ ফকীহ।

প্রাথমিক জীবন

শৈশবকালেই ইমামের পিতা দুষ্কৃতকারীদের হাতে শাহাদাত বরণ করেন এবং পনের বছর বয়সে তাঁর মাতাও তাঁকে রেখে ইন্তেকাল করেন। হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) তাঁর বড় ভাইয়ের নিকট প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণ করেন। অতঃপর তিনি আরাক শহরের দীনী শিক্ষাকেন্দ্রে ভর্তি হন। তারপর ধর্মীয় নগরী কোম-এ এসে তিনি জ্ঞানচর্চা অব্যাহত রাখেন। মাত্র ২৭ বছর বয়সে তিনি স্বীকৃতি মুজতাহিদ পর্যায়ে উন্নীত হতে সক্ষম হন। আরবি, ব্যাকরণ, আরবি সাহিত্য, দর্শন, উসূল, হাদীস, ফিকাহ, জ্যোতির্বিদ্যা এবং তাসাউফে তিনি বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন। অতঃপর তিনি কোমের দীনী শিক্ষাকেন্দ্রে অধ্যাপনা শুরু করেন। ১৯৬৪ সনে দেশ থেকে নির্বাসিত হবার পূর্ব পর্যন্ত তিনি সেখানে অধ্যাপনা অব্যাহত রেখেছিলেন।

হযরত ইমাম খোমেইনী ২৭ বছর বয়সে বিবাহ করেন। তাঁর স্ত্রী বেগম বাতুল সাকাফীও এক ধর্মীয় পরিবারের কন্যা। তাঁরা দুই পুত্র এবং তিন কন্যা মোট পাঁচ সন্তানের অধিকারী হন। ইমামের প্রথম পুত্র আয়াতুল্লাহ মোস্তফা খোমেইনী বিপ্লবের প্রায় দেড় বছর পূর্বে সাভাক এজেণ্টদের হাতে ইরাকে শহীদ হন। তাঁর দ্বিতীয় পুত্র হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলেমিন সাইয়্যেদ আহমদ খোমেইনী ইরানে এবং বিশ্বের মাঝে একজন সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। ইমামের প্রথমা কন্যা বেগম যাহরা মোস্তাফাভী ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের মহিলা সমিতির সভানেত্রী।

আন্দোলন ও নেতৃত্ব

ইরানের ওলামায়ে কেরামগণের সংগ্রামী ঐতিহ্য বহুদিনের পুরানো। বিশেষ করে ইরানে দীনী শিক্ষাকেন্দ্রগুলো সর্বদা সহকারী নিয়ন্ত্রণ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকায় এবং ইসলাম সম্পর্কে ওলামাদের ব্যাপক ও পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান থাকায় আলেম সমাজের এক বিরাট অংশ সবসময়েই স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামমুখর ছিলেন। হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) নিজেও জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞানসাধনার পাশাপাশি দেশে সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর দৃষ্টি রাখতেন এবং প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করতেন।

এ সময় ইরানের ব্রিটিশ এজেন্ট রেযা খানের স্বৈরশাসন চলছিল। রেযা খান দেশ থেকে ইসলামী মূল্যবোধ অপসারণ করতে এবং পশ্চিমা ভাবধারা চালু করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। এ কাজে একদল পশ্চিমা এবং তথাকথিত বুদ্ধিজীবী এগিয়ে আসে। এরা আদর্শিক, সাংস্কৃতিক এবং চিন্তাগত দিক থেকে ইসলামের বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করে। বিশেষ করে ওয়াহাবী চিন্তাধারার আশ্রয় নিয়ে তারা ইসলামের বহু মৌলিক বিষয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে থাকে। ইসলামের বিরুদ্ধে এরূপ আদর্শিক আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য হযরত ইমাম (রহ.) কাশফুল আসরার’ (গোপন রহস্যের ফাঁস) নামে একখানি গ্রন্থ রচনা করেন। বইটি ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থ প্রকাশের ফলে পাশ্চাত্যপন্থী বুদ্ধিজীবীদের আদর্শিক, সাংস্কৃতিক আক্রমণ সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়ে যায়। এর ফলে জনগণ যে তাদের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছিল শুধু তাই নয়; বরং জনগণের কাছে এরা ইসলাম ও দেশের দুশমন এবং বহিঃশক্তির তাঁবেদাররূপে চিহ্নিত হয়ে যায়।

ইতিমধ্যে দেশের অভ্যন্তরে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়ে যায়। যেমন : ইংরেজরা রেযা খানকে সরিয়ে তার পুত্র মোহাম্মদ রেযাকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে এবং মোহাম্মদ রেযাকে শাহউপাধিতে ভূষিত করে। এরপর ১৯৫৩ সালে ইরানে শাসনতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয়। ঐ সময়ে পার্লামেণ্টের স্পীকার ছিলেন আয়াতুল্লাহ কাশানী। তখন দেশে তেল সম্পদের ওপর ব্রিটিশ আধিপত্যের বিরুদ্ধে গণ অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছিল এবং প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেক তেল জাতীয়করণের জন্য পার্লামেন্টে বিল উত্থাপন করেন। পার্লামেন্ট কর্তৃক এ বিল গৃহীত হয়। পরিস্থিতির জটিলতায় ভীত হয়ে শাহ দেশ থেকে পলায়ন করেন। এমতাবস্থায় ইংরেজরা ইরানের ওপর নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠার আর কোন সম্ভাবনা না দেখে ইরানকে আমেরিকার কাছে হস্তান্তর করে। এর ফলে সি.আই.এ দ্বারা পরিচালিত এক সামরিক অভ্যুথানে মোসাদ্দেক সরকার উৎখাত হয় এবং শাহ আবার দেশে ফিরে আসেন। তখন থেকে মধ্যপ্রাচ্যে ইরান মার্কিন স্বার্থের পাহারাদারে পরিণত হয়। শুধু তাই নয়, আমেরিকা ইরানের তেল সম্পদ আত্মসাতের পাশাপাশি দেশটিকে মার্কিন ভোগ্যপণ্যের বাজারে পরিণত করে। আর এ লক্ষ্যে আমেরিকা শাহের সরকারের প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে গ্রাম্য জনগণকে শহরে টেনে আনতে শুরু করে। ফলে ইরানের কৃষি ব্যবস্থা প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। এ সময়ে ইরানের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ এবং ওলামায়ে কেরাম এসব অশুভ ষড়যন্ত্র এবং পাশ্চাত্যের আদর্শিক সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জনগণকে সতর্ককরণের দায়িত্ব পালন করে যেতে থাকেন। হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) তাঁদের অন্যতম ছিলেন।

এ সময়ে হযরত আয়াতুল্লাহ বুরুজেরদী (রহ.) ছিলেন কোমের জ্ঞানচর্চা কেন্দ্রের প্রধান। তিনি তখন সারা দেশের ওলামায়ে কেরামেরও নেতা ছিলেন। ১৯৬২ সালে তিনি ইন্তেকাল করলে ওলামায়ে কেরাম হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.)-কে তাঁর স্থলাভিষিক্তরূপে বরণ করে নেন। তখন থেকেই ইমাম খোমেইনী (রহ.) জাতীয় দীনী নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।

ঐ একই বছর মন্ত্রিসভা প্রাদেশিক ও নগর কাউন্সিল বিলনামে একটি বিল তৈরি করে। এতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের জন্য সংবিধানে উল্লিখিত পবিত্র কোরআন নিয়ে শপথ করার শর্ত তুলে দেওয়া হয়। আর তার পরিবর্তে যে কোন ধর্মগ্রন্থ নিয়ে শপথ করার প্রস্তাব করা হয়। এটি ছিল পরিপূর্ণ ধর্মহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি চাতুর্যপূর্ণ পদক্ষেপ। কোমের আলেমগণ সমস্বরে এ বিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালেন। হযরত ইমাম খোমেইনী প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রেরিত এক তারবার্তায় এহেন বিলের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন এবং সেই সাথে জনগণকে এ বিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে আহ্বান জানান। এ ব্যাপারে সাধারণ ধর্মঘটের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী অন্য কোন উপায় না দেখে বিলটি প্রত্যাহার করে নেন।

ইরানকে মার্কিন ভোগ্যপণ্যের বাজারে পরিণত করা এবং সে লক্ষ্যে কৃষি ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে সরকার একটি শহরমুখী সংস্কার পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। এর নাম দেয়া হয়েছিল শ্বেত বিপ্লব’, ‘শাহ এবং জনগণের বিপ্লব। কিন্তু সারাদেশের আলেমগণ এর বিরোধিতা করেন। এ রকম অবস্থায় শাহ এক প্রতারণামূলক ভোটের আয়োজন করে। ১৯৬৩ সালের ২৬ জানুয়ারি গণভোটের দিন ধার্য করা হয়েছিল। ইমাম খোমেইনী এ গণভোট বর্জন করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। ফলে নির্ধারিত দিনে দেখা গেল শাহের গুপ্ত পুলিশ সাভাকের লোকজন এবং সেনাবাহিনী ও পুলিশের সদস্য ব্যতীত সাধারণ জনগণের আর কেউ ভোটকেন্দ্রে যায়নি। ফলে শাহের এ ষড়যন্ত্র ভণ্ডুল হয়ে যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও সরকারি প্রচারমাধ্যমসমূহ সংস্কার পরিকল্পনার সপক্ষে জনগণ কর্তৃক বিপুল ভোটদানের কথা প্রচার করে। এর কয়েকদিন পর ইমাম খোমেইনী (রহ.) ঈদুল ফিতর উপলক্ষে প্রদত্ত এক ভাষণে শাহ সরকারের পাশ্চাত্যের তাঁবেদারি, মার্কিন ও ইসরাইলের প্রতি নতজানু এবং গণবিরোধী নীতির কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য জনগণের কাছে আহ্বান জানান। শাহের আমলে বল্গাহারা আমোদ-প্রমোদের মধ্য দিয়ে তের দিনব্যাপী ইরানী নববর্ষের উৎসব পালন করা হতো। কিন্তু ঘটনাক্রমে ঐ বছর নববর্ষ উৎসবের দ্বিতীয় দিন ছিল ২৫ শাওয়াল। ২৫ শাওয়াল হযরত ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর শাহাদাত লাভের দিন। এ উপলক্ষে ইমাম খোমেইনী (রহ.) নববর্ষ উৎসব বন্ধ রাখার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।

জনগণ ইমামের এ আহ্বানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দিল। এর ফলে শাহের ক্রোধ ভীষণ বেড়ে গেল। উপরন্তু নববর্ষের দিনে (২২ মার্চ, ১৯৬৩) ইমামের আহ্বানে হযরত ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষে কোমে এক বিশাল জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এ সমাবেশকে ভণ্ডুল করার লক্ষ্যে শাহের সাভাক এবং সেনাবাহিনীর লোকেরা কোমের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাদ্রাসা-ই-ফয়াজিয়াতে আলেমদের এবং জনতার ওপর হামলা চালিয়ে বহুসংখ্যক লোককে শহীদ ও আহত করে। ইমাম খোমেইনী তাঁর ভাষণে এ ঘটনার তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি আমেরিকার প্রতি শাহের নতজানু নীতির স্বরূপ ফাঁস করে দেন এবং সরকারবিরোধী আন্দোলনের জন্য জনগণকে ডাক দেন। এছাড়া এ ব্যাপারে জনমত গঠনের জন্য সকল আলেমের প্রতি আহ্বান জানান।

৫ই জুনের গণঅভ্যুত্থান

ইমাম খোমেইনীর আহ্বানে আলেমগণ তাঁদের বক্তৃতা, ভাষণ ও খুতবায় শাহী শাসনের ইসলাম ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী চেহারা জনগণের সামনে তুলে ধরতে শুরু করেন। সেই সাথে ইসলামের বিরুদ্ধে ইসরাইলের ষড়যন্ত্র তুলে ধরলেন তাঁরা। এমতাবস্থায় শাহের সরকার মাদ্রাসা-ই-ফয়জিয়াতে ইমাম খোমেইনীর জন্য বক্তৃতা প্রদান নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু ইমাম এ ঘোষণার প্রতি কর্ণপাত করলেন না। তিনি আশুরার দিন বিকালে মাদ্রাসা-ই-ফয়জিয়াতে এক বিশাল জনসমাবেশ ভাষণ দেন। সে ভাষণে তিনি শাহের ইসলামবিরোধী সরকারকে প্রতিরোধ করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান করেন। সেই রাতেই ইমামকে গ্রেফতার করা হয় এবং কোমে নিয়ে আসা হয়। পরদিন ৫ই জুন শাহী সরকারের বিরুদ্ধে এবং ইমামের মুক্তির দাবিতে কোমে এবং তেহরানে এক গণঅভ্যুত্থান হয়। শাহের সরকার এ ঘটনা মোকাবিলার জন্য সামরিক আইন জারি করে এবং সেনাবাহিনীর সাহায্যে এ বিক্ষোভ দমনের পদক্ষেপ নেয়। কিন্তু জনগণ সামরিক আইনকে উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে আসে। সারাদেশে সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। সেনাবাহিনীর গুলিতে সেদিন কোম ও তেহরানে প্রায় সাড়ে পনের হাজার লোক শহীদ হয়।

শাহী সরকার নিষ্ঠুর পন্থায় গণঅভ্যুত্থানের মোকাবিলায় আপাতত সফল হলেও সর্বত্র বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত বিক্ষোভ এবং চাপা গণ-অসন্তোষ অব্যাহত থাকে। তাই পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য সরকার কয়েক মাসের মধ্যেই ইমামকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ইমাম খোমেইনী আবার কোমে ফিরে আসেন। ইতিমধ্যে ফয়জিয়া মাদ্রাসার হত্যাকা-ের বার্ষিকী উপস্থিত হয়। ইমাম খোমেইনী মাদ্রাসা-ই-ফয়জিয়াতে গণসমাবেশ এক জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়ে শাহের ইসলামবিরোধী নীতি, আমেরিকার নিকট তার তাঁবেদারিত্ব এবং ইসরাইল-প্রীতির বিরুদ্ধে জনগণকে সতর্ক করে দেন।

এরই মধ্যে সরকার মার্কিন নাগরিকদেরকে কতকগুলো বিশেষ সুবিধা প্রদান করে আইন প্রণয়ন করে। এসব দেয় সুবিধার মধ্যে সর্বাধিক ক্ষতিকারক বিষয় ছিল এটা যে, ইরানে বসবাসকারী কোন মার্কিন নাগরিক ইরানের মাটিতে কোন অপরাধ করলে ইরানী আদালতে তার বিচার করা যাবে না। ইমাম খোমেইনী এ আইনের বিরুদ্ধে একটি বিবৃতি প্রদান করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই প্রচারপত্র আকারে বিবৃতিটির হাজার হাজার কপি সারাদেশে বিতরণ করা হয়। ফলে জনগণ এ আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠল।

তুরস্কে নির্বাসন

শাহের সরকার এ সকল ঘটনাপ্রবাহ থেকে এ উপসংহারে উপনীত হলো যে, ইমাম খোমেইনী (রহ.) যতদিন দেশে থাকবেন ততদিন জনগণের মধ্য থেকে সরকারবিরোধী মনোভাব দূর করা সম্ভব হবে না। তাই ১৯৬৪ সালের ৪ঠা নভেম্বর কোম থেকে ইমামকে গ্রেফতার করে সরাসরি তেহরানের মেহেরাবাদ বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। একই সময়ে অন্য নেতৃবৃন্দকেও গ্রেফতার অথবা গৃহবন্দি করা হয়। ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর জ্যেষ্ঠ পুত্র মোস্তফা খোমেইনীকে দুই মাস কারাগারে রাখার পর তাঁকেও তুরস্কে নির্বাসন দেয়া হয়।

কিন্তু ইমাম খোমেইনীকে নির্বাসিত করার পরও ইরানী জনগণের আন্দোলনে মোটেই ভাটা পড়েনি। ইতিমধ্যে ইসলামী আন্দোলনের জনৈক কর্মী প্রধানমন্ত্রী হাসান আলী মনসুরকে হত্যা করেন। অন্যদিকে ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের নিকট চিঠি পাঠিয়ে শাহী সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং ইমামকে বেআইনিভাবে নির্বাসিতকরণের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। এছাড়া তুরস্ক সরকার ইমামের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করলে তাঁরা এ কাজেরও প্রতিবাদ জানান। অতঃপর ইরান ও তুরস্কের সরকারদ্বয়ের পারস্পরিক সম্মতিতে ইমামকে ইরাকে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ঐ সময় ইরাক সরকার এবং ইরান সরকারের মধ্যে সম্পর্ক ভালো ছিল না। তাই ইরাক এ শর্তে তাঁকে গ্রহণ করতে রাজি হয় যে, তিনি ইরাকে অবস্থানকালে তাঁর মর্যাদা ও তৎপরতা সম্পর্কে ইরান সরকারের  কোন বক্তব্য থাকবে না। ইরাকের কারবালা, নাজাফ, সামেরা, কাজেমিন, ও কুফা এ চারটি শহর দীনী জ্ঞানচর্চার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। এছাড়া এ শহরগুলো শিয়া মাজহাবের লোকদের কাছে ধর্মীয় গুরুত্বের অধিকারী। আর তাই ইরাকই ছিল ইমাম খোমেইনীর জন্য সর্বোত্তম জায়গা।

ইরাকে ইমাম খোমেইনী (রহ.)

হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) তুরস্কে বছরখানেক ছিলেন। সেখান থেকে ইরাকে এসে তিনি ইরাকের সবচেয়ে বড় দীনী জ্ঞানকেন্দ্র ধর্মীয় নগরী নাজাফে অবস্থান গ্রহণ করলেন। এখানে থেকেই তিনি জ্ঞানচর্চা, জ্ঞান বিতরণ ও গ্রন্থ রচনা করলেন এবং ইরানী জনগণের আন্দোলনের পথনির্দেশনা প্রদানের কাজ অব্যাহত রাখলেন। নাজাফে অবস্থানকালেই তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ বিলায়াতে ফকিহ’ (ফকিহদের শাসন) রচনা করেন। এ গ্রন্থই ইরানের ইসলামী বিপ্লবের তাত্ত্বিক ভিত্তি রচনা করে। কারণ, বিলায়াতে ফকিহ বা মুজতাহিদ ফকিহর শাসনের অপরিহার্যতার অর্থই হচ্ছে ফকিহ নয় এমন শাসকের শাসনব্যবস্থা অবৈধ এবং অগ্রহণযোগ্য- তা রাজতন্ত্রই হোক অথবা অন্য যে কোন সরকারই হোক।

ইমাম খোমেইনী (রহ.) বাণীবদ্ধ ক্যাসেট প্রেরণের মাধ্যমে ইরানী জনগণকে পথনির্দেশ প্রদান করতেন। বিদেশে অবস্থানরত ইরানী জনগণও একই পদ্ধতিতে পথনির্দেশনা লাভ করতেন। এতে তিনি ইসলামী হুকুমতের প্রয়োজনীয়তার ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করেন। এ বিষয়টিকে তিনি অপরিহার্য দীনী দায়িত্ব হিসাবে উপস্থাপন করেন। ইমাম খোমেইনীর এসব মহান বাণী গোপনে হাজারো কপি হয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ত। এছাড়া ইমামের অনুসারী আলেমগণও দ্বীনী অনুষ্ঠানাদিতে বেলায়েত ফকিহ বা ইসলামী হুকুমত সম্পর্কে আলোচনা করতে থাকেন।

ইমাম খোমেইনী ইসলামী আন্দোলনের সাধারণ পথনির্দেশন প্রদান করা ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতেও জনগণের উদ্দেশ্যে বাণী পাঠাতেন। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় ইরানী রাজতন্ত্রের আড়াই হাজার বার্ষিকী উপলক্ষে শাহ এক বিরাট ব্যয়বহুল অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এ উপলক্ষে শুধু তেহরানেই ৮০ কোটি রিয়াল (তৎকালীন হারে প্রায় তিন কোটি ডলার) ব্যয় করা হয়। জনগণের সম্পদের এহেন অপচয় অপব্যবহারের বিরোধিতায় কঠোর সমালোচনা করে ইমাম এক বাণী প্রেরণ করেন। এছাড়া শাহ তথাকথিত আধুনিক গণতন্ত্রের সাইবোর্ড লাগাবার উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক সুবিধাবাদীদের দ্বারা রাস্তখিজ’ (গণজাগরণ বা পুনরুত্থান) নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করলে ইমাম তাঁর বাণীতে গণবিরোধী এ দলে যোগদান করতে তাদেরকে নিষেধ করেন।

বিপ্লব

শাহের সরকার আন্দোলনের অবসান ঘটাবার লক্ষ্যে তার গুপ্ত পুলিশ বাহিনী সাভাকের মাধ্যমে ইমাম খোমেইনীকে হত্যা করার পরিকল্পনা নেয়। কিন্তু এ পরিকল্পনা কার্যকর করতে শাহ ব্যর্থ হন। তবে  ১৯৭৭ সালের ২৩ অক্টোবর সাভাকের এজেণ্টদের হাতে ইমামের জ্যেষ্ঠ পুত্র আয়াতুল্লাহ মোস্তফা খোমেইনী শাহাদাত বরণ করেন। এতে ইরানী জনগণের মধ্যে ক্ষোভের মাত্রা আরো ধুমায়িত হয়ে উঠল। এর কিছুদিন পর এমন একটি ঘটনা ঘটল যা বারুদের গুদামে জ্বলন্ত দিয়াশলাই নিক্ষেপের সমান ছিল।

১৯৭৮ সালের ৭ জানুয়ারি তেহরানের একটি দৈনিক পত্রিকায় ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর অবমাননা করে প্রবন্ধ প্রকাশিত হলে সারা ইরান বিক্ষোভ ফেটে পড়ে। বিশেষ করে কোম এবং তাবরীজে প্রচ- গণবিক্ষোভ হয়। এসব বিক্ষোভের বিরুদ্ধে দমনমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হলে পরিস্থিতির উত্তপ্ততা স্থায়ীরূপ ধারণ করে। অর্থাৎ বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে নিহতদের জন্য শোক মিছিল হয় এবং মৃত্যুর চল্লিশতম দিনেও প্রথা অনুযায়ী শোকানুষ্ঠান হয়। এসব শোক মিছিল ও শোকানুষ্ঠান সহজেই সরকারবিরোধী বিক্ষোভ-সমাবেশ ও বিক্ষোভ-মিছিলে পরিণত হয়। এর জন্য নতুন দমনমূলক পদক্ষেপ নিলে আবারো নতুন হত্যাকা- হয়। এর ফলে আবারো শোক-বিক্ষোভ হয়। এভাবে একটার পর একটা চলতে থাকে। ১৯৭৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বরে তেহরানের জালেহ স্কয়ারে (বর্তমানে শুহাদা স্কয়ার) এক গণবিক্ষোভে সেনাবাহিনীর গুলিতে প্রায় পাঁচ হাজার লোক শহীদ হয়।

ইরানের রাজনৈতিক পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হলে শাহের সরকার ইমাম খোমেইনী (রহ.)-কে অবাধ তৎপরতার সুযোগ না দেয়ার জন্য ইরাক সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। ইতিমধ্যে ১৯৭৫ সালে ইরানের শাহী সরকার এবং ইরাকের বাথপন্থী সরকারের মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর তাই ইরাক সরকার ইরানকে খুশি করার জন্য নাজাফে হযরত ইমাম খোমেইনীকে গৃহবন্দি করে। এর ফলে ইরানী জনগণ ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ ইরাকী সরকারের এ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। এছাড়া আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকেও আপত্তি ওঠে। অগত্যা ইরাক সরকার ইমামের নজরবন্দির আদেশ তুলে নেয়, কিন্তু নানাভাবে তাঁর তৎপরতায় বাঁধা সৃষ্টি অব্যাহত রাখে। ইরানী জনগণ ইমামকে দেশে ফিরিয়ে আনার দাবি জানাতে থাকে। কিন্তু শাহ সরকার এতে রাজী হয়নি। অগত্যা ইমাম তৃতীয় কোন দেশে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি ১৯৭৮ সালের ৪ অক্টোবর নাজাফ থেকে কুয়েত রওয়ানা হলেন, কিন্তু কুয়েত সরকার তাঁকে সেদেশে প্রবেশের অনুমতি না দিলে তিনি পুনরায় নাজাফ প্রত্যাবর্তন করেন। দুদিন পর তিনি প্যারিস যাত্রা করেন।

ইমামের প্যারিস আগমনের ফলে একদিকে যেমন ইরানী জনগণের আন্দোলনের খবরাখবর আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, অন্যদিকে বিদেশে বসবাসকারী ইরানীরা ইমামের নিকট আসা-যাওয়া করতে থাকে। আর এদিকে ইরানে শাহের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অবসান ও ইমামকে ফিরিয়ে আনার দাবিতে উপর্যুপরি বিক্ষোভ অব্যাহত থাকে।

জনগণকে শান্ত করার লক্ষ্যে শাহ একের পর এক রাজনৈতিক চালবাজির আশ্রয় নিতে থাকেন। তিনি দমননীতি, বহিঃশক্তির তাঁবেদারি এবং ইসলামবিরোধী কার্যকলাপের দায়িত্ব এড়াবার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী হোভেইদাকে পদচ্যুত ও কারাগারে নিক্ষেপ করেন। রাস্তখিজ দল ভেঙে দেন এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত রাজনৈতিক দলসমূহের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। রাজবন্দিদের মুক্তি দেন, মিছিল-সমাবেশের অনুমতি দেন। সাইরাস ক্যালেন্ডার বাতিল করেন এবং বাতিলকৃত হিজরি সৌর-ক্যালেন্ডার পুনঃপ্রবর্তন করেন। শাহ এরকম আরো অনেক চালবাজি করেন। কিন্তু ইমাম খোমেইনী এসব রাজনৈতিক চালবাজিতে না ভুলে শাহের পতন ও ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। ফলে বিক্ষোভ অব্যাহত থাকে।

নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী জাফর শরীফ ইমামী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ায় শাহ তাঁকে সরিয়ে সেনাবাহিনী প্রধান আজহারীকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। আজহারী সামরিক শাসন জারি করেও ব্যর্থ হলে শাহ তাঁকে সরিয়ে আমেরিকাপন্থী শাপুর বখতিয়ারকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। বখতিয়ারও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হন। এমতাবস্থায় ১৬ জানুয়ারি ১৯৭৯ তারিখে শাহ দেশত্যাগ করেন। দেশত্যাগের সময় তিনি সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী, সেনাবাহিনী প্রধান ও প্রধান বিচারপতি সমন্বয়ে একটি রাজ পরিষদ গঠন করে যান। কিন্তু পরিষদের সভাপতি, প্রধান বিচারপতি প্যারিস গিয়ে ইমামের নিকট আনুগত্য ঘোষণা করেন।

ইমামকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য জনগণের বিক্ষোভ অব্যাহত থাকে, কিন্তু বখতিয়ার এ দাবিকে উপেক্ষা করেন। এমতাবস্থায় বখতিয়ারের অনুমতি ছাড়াই ইমাম দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। অতঃপর ১৯৭৯ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। এ উপলক্ষে মেহেরাবাদ বিমানবন্দর থেকে শহীদদের গোরস্তান বেহেশতে যাহরা পর্যন্ত লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। অন্তত পঞ্চাশ লাখ নারী-পুরুষ ইমামকে অভ্যর্থনা জানায়। বিশ্বের ইতিহাসে ইতিপূর্বে অন্য কোন নেতা এতবড় অভ্যর্থনা পাননি।

বেহেশতে যাহরায় জনগণের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে তিনি ঘোষণা করেন যে, তিনি সরকার গঠন করবেন। কয়েকদিন পর তিনি বজারগানকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। বজারগান মন্ত্রিসভা গঠন করেন। এর পাশাপাশি ইমাম একটি বিপ্লবী পরিষদও গঠন করেন। ফলত দেশে দুটি সরকার হলো। বখতিয়ার সরকারের কার্যত দেশের ওপর কোনই নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ছিল না। তবু তিনি সেনাবাহিনীর সহায়তায় ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করলেন, সামরিক আইন জারি করলেন। ইমাম জনগণের ওপর সামরিক আইন অমান্য করার নির্দেশ দিলেন। ফলে দশই ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনী ও জনগণের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হলো। বিমানবাহিনী আগেই ইমামের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেছিল, এবার সেনাবাহিনীও বিভক্ত হয়ে পড়ল। ফলে সেনাবাহিনীর অফিসাররা শীঘ্রই সৈন্যদেরকে ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। এভাবে ১১ই ফেব্রুয়ারির প্রভাতে শাহ নিয়োজিত বখতিয়ার সরকারের পতন ঘটল। ইসলামী বিপ্লব বিজয়ী হলো।

বিপ্লবোত্তর কালে : ইরানের ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের পর থেকে একটি মুহূর্তের জন্যও ভিতর ও বাইরের ইসলামবিরোধী শক্তির ষড়যন্ত্র ও নাশকতা থেকে মুক্ত থাকেনি। বিপ্লবকে ধ্বংস বা এর গতি পরিবর্তনের লক্ষ্যে আমেরিকা এবং তার এজেন্টরা বহুমুখী ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতা অব্যাহত রাখে। বহু শীর্ষস্থানীয় দীনী ব্যক্তিত্বকে তারা হত্যা করে। সুকৌশলে নিজেদের এজেন্টকে প্রেসিডেন্ট পদে পর্যন্ত বসাতে সক্ষম হয়। মহান ইসলামী চিন্তাবিদ আয়াতুল্লাহ মোতাহহারীকে শহীদ করে, ইমামের পরে প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ তালেকানীকে বিষ প্রয়োগে শহীদ করে। বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ইমামের প্রিয় শিষ্য প্রধান বিচারপতি আয়াতুল্লাহ বেহেশতীসহ দেশের ৭৩ জন শ্রেষ্ঠ সন্তানকে শহীদ করে। আরেক বিস্ফোরণের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট রাজায়ী ও প্রধানমন্ত্রী বাহোনারকে শহীদ করে। বর্তমান নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীকে হত্যার ব্যর্থ প্রয়াস পায়। সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা ইরানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে এবং আমেরিকার ব্যাংকসমূহে গচ্ছিত ইরানী সম্পদরাশি আটক করে, ইরাকের মাধ্যমে ইরানের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়, কুর্দিস্তানে বিদ্রোহের সৃষ্টি করে, মাদকদ্রব্য বিস্তারের ষড়যন্ত্রমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এ রকম অসংখ্য সমস্যার মোকাবিলা করতে হয় সদ্যপ্রতিষ্ঠিত ইসলামী প্রজাতন্ত্রকে।

চির বিদায়

ইসলামী বিপ্লবের পর অনেক বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। বিপ্লবের ভাগ্য নির্ধারণী প্রতিটি সমস্যার মোকাবিলা করে এবং সমস্ত ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়ে এ বিপ্লব টিকে গেছে। বিপ্লবের নেতা-কর্মীদের যথেষ্ট অভিজ্ঞতাও হয়েছে। এখন আর এ ভয় নেই যে, এ বিপ্লবকে কেউ ধ্বংস বা পথচ্যুত করতে পারবে। তাই এবার ইমামের জন্য সেই মুর্হূতটি এসে হাজির হলো যে মুহূর্তটির জন্য তিনি দীর্ঘ দিন যাবৎ প্রহর গুণছিলেন। এবার তাঁর প্রিয় সন্নিধান থেকে ডাক এলো। ৩রা জুন ১৯৮৯, রাত দশটা বিশ মিনিটের সময় তিনি এ ধূলির ধরণী ছেড়ে আলমে মালাকুত পানে উড্ডয়ন করেন। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

ইমামের ইন্তেকাল ইরানী জনগণ এবং সারাবিশ্বের ইসলামী বিপ্লবকামী ও মুস্তাযআফ (নির্যাতিত) জনগণ শোকে ভেঙে পড়ে। শুধু তেহরানেই এক কোটি মানুষ ইমামের নামাযে জানাযা ও দাফন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। বিশ্বের ইতিহাসে কোনদিন কোন ব্যক্তির ইন্তেকালে এত মানুষের অশ্রু ঝরেনি। মহান আরেফ হযরত ইমাম খোমেইনীর মাযার এখন দেশ-বিদেশের মুসলমানদের যিয়ারতগাহ। জীবদ্দশায় তিনি ছিলেন বিশ্বের বিপ্লবী মুসলমান ও মুস্তাযআফ জনতার জন্য প্রেরণার উৎস, মৃত্যুর পরে কবরে শায়িত থেকেও তিনি সে ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন- তাঁর মাযারে গিয়ে ইরানের ও বিশ্বের বিপ্লবীরা ইসলামী বিশ্ববিপ্লবের শপথ নিয়ে শয়তানি পরাশক্তিবর্গ ও তাদের তাঁবেদারদের বিরুদ্ধে নবতর উদ্যমে আপোষহীন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।

(নিউজলেটার, ডিসেম্বর ১৯৯১)

ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর চিন্তাধারা ও কমিউনিজমের পতন

পশ্চিমের উদারনৈতিক চিন্তাধারা বিকাশের পবরর্তী বছরগুলোতে পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীরা ভাবতে থাকলেন যে, জ্ঞান ও চিন্তার জগতে তাঁরা এক বিরাট সাফল্য অর্জন করে ফেলেছেন। কিন্তু তার অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁদেরকে ‘কমিউনিজ্ম’ নামে আরেকটি কৃত্রিম মতবাদ উদ্ভাবন করতে হলো। ধারণা করা হয়েছিল, তাঁদের এই নতুন মতাদর্শ মানবসমাজের সমস্যা সমাধান করবে। কিন্তু মাত্র এক শতাব্দী যেতে না যেতেই ঐ মতবাদ ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হলো।

মার্কসবাদ ও লেনিনবাদের অপরিবর্তনীয়  আদর্শের ভিত্তিতে কমিউনিজমের সাম্রাজ্যে বাহাত্তর বছর ধরে একনায়কতান্ত্রিক শাসন ও কট্টর নীতি অনুসরণের পর খোদ এর প্রতিষ্ঠাতারাই একে ছুঁড়ে ফেলে দিল।

স্মরণ করা যেতে পারে যে, সূচনাকাল থেকেই মার্কসবাদ ও লেনিনবাদ মানব ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও ঘটনাপ্রবাহকে বিবেচনায় নেয়নি। ব্যক্তি-মানুষ মার্কসবাদ-লেনিনবাদের বিবেচনায় গৌণ। অতি সম্প্রতি তারা অবশ্য ঐ বিষয়গুলো বিবেচনা করা শুরু করেছে।

একচেটিয়া কমিউনিস্ট শাসনের ফলে সামাজিক গোঁড়ামি ও অস্বাভাবিক নিয়ন্ত্রণ সৃষ্টি হয়। ব্যক্তি-মানুষকে কমিউনিজমে কল-কারখানার খুচরা যন্ত্রাংশ ছাড়া আর কিছুই ভাবা হয় না । মূলত এই কমিউনিস্ট শাসনে কমিউনিস্ট পার্টি এবং তার সদস্যদের স্বার্থই কেবল দেখা হয়।

কমিউনিস্ট সমাজে মানুষ উৎপাদনের সরঞ্জাম বা হাতিয়ার ছাড়া কিছুই নয় এবং যতক্ষণ পর্যন্ত কোন মানুষ উৎপাদন করতে পারে, উৎপাদনের কাজে তাকে ব্যবহার করা চলে, ততক্ষণ পর্যন্তই কেবল সমাজে তার প্রয়োজনীয়তা থাকে। আদর্শগতভাবেই সেখানে সরঞ্জাম ও মানুষের মধ্যে কোন পার্থক্য করা হয় না। ধারণা করা হয়, মানুষ ও সরঞ্জামাদি বস্তুগতভাবেই সৃষ্ট এবং উভয়ই কেবল উৎপাদনের কাজে ব্যবহারের জন্য। যতক্ষণ এগুলো উৎপাদন বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারবে ততক্ষণ এর কার্যকারিতা আছে, অন্যথায় তারা প্রত্যাখ্যানযোগ্য। এই দৃষ্টিভঙ্গি মানুষের স্বাভাবিক আবেগপ্রবণতার পরিপন্থী ও নিবর্তনমূলক। অথচ এটাই কমিউনিজমে নীতি ও আদর্শের ভিত্তি। এই আদর্শের একমাত্র লক্ষ্য হলো উৎপাদন। মানুষের কর্ম তৎপরতা, চিত্রকলা-সাহিত্য , রাষ্ট্র-সরকার ও জ্ঞান তথা সবকিছুই উৎপাদনের জন্য এবং উৎপাদনের পথে কোন বাধা মনে হলে তা পরিত্যাগ করা হয়। শান্তি, সম্প্রীতি, আধ্যাত্মিকতা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা বাদ দিয়ে মানুষকে এখন নিরন্তর সংগ্রাম করতে হয় কেবল বৈষয়িক লক্ষ্যে উপনীত হতে। অথচ ভালোবাসা ও ইবাদত-বন্দেগি দিয়ে মানুষের যে জীবন বিকশিত হওয়ার কথা, অন্য কিছু দিয়ে তা পূরণ হতে পারে না। তাই সত্যিকার মানবীয় চেতনা কমিউনিজমের আদর্শ থেকে দিনের পর দিন বিচ্ছিন্ন হতে থাকে এবং কমিউনিজম ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত এই বেদনাদায়ক অবস্থা চলতেই থাকবে।

এটি আসলে একটি সাংস্কৃতিক অবক্ষয় এবং মুসলিম বিশ্বেও এই অবক্ষয় শুরু হয়েছে। কোন কোন মুসলিম দেশে এর আলামত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিভিন্ন পন্থায় মুসলিম বিশ্বকে কমিউনিজমের এই আদর্শের মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

এই ভুল চিন্তা মুসলিম জাহানে প্রবেশ করেছে তথাকথিত জাতীয়তাবাদী প্রবণতা ও অন্যান্য পন্থার মধ্য দিয়ে। এসব চিন্তা বিস্তার লাভ করেছে ধীরে ধীরে, বিশেষ করে যেসব দেশে স্বৈরাচার ও তাঁবেদার সরকার বিদ্যমান। এদের মাধ্যমে প্রভাবিত হয় সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি, এমনকি ধর্মীয় নেতাদেরও কোন কোন অংশ।

কিন্তু সাম্প্রতিক দিনগুলোতে বিশ্বের জাতিসমূহ এবং ওয়াকিবহাল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মহল অত্যন্ত বিস্ময়কর ও নজিরবিহীন সব ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে। ধর্ম, ঈমান ও পরকালে বিশ্বাসের কুঁড়ি আজ ফুলের মতো বিকশিত হয়েছে এবং সকল বাধার বেড়াজাল ডিঙ্গিয়ে নাস্তিক্যবাদী রুশ সমাজের মোকাবিলা করে চলেছে। বিষাক্ত সাংস্কৃতিক স্বৈরাচারের শৃঙ্খল এবং বস্তুবাদের বেড়ীবাঁধ ভেঙে পড়েছে। আজকে বস্তুতান্ত্রিক সমাজবাদের ভিত্তি কেউ কল্পনাই করতে পারে না।

এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে বস্তুবাদী এই চিন্তাধারার সার্বিক বিপর্যয় এবং এই বিপর্যয়ের বিস্তারিত কারণ তুলে ধরা হচ্ছে না। এই নিবন্ধে আমরা কমিউনিজমের বিপর্যয়ের এবং ইসলাম পুনরুজ্জীবনে ইমাম খোমেইনীর চিন্তাধারা কতখানি প্রভাব ফেলেছে তা সংক্ষেপে পর্যালোচনা করবে।

এই নজিরবিহীন পরিবর্তন এবং নাস্তিক্যবাদী কমিউনিস্ট চিন্তাধারার বিপর্যয়ের মধ্যে আমরা সেই বিশেষ দিকগুলোই দেখব যা সকল মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতির সাথে সংশ্লিষ্ট। প্রকৃতপক্ষে এই কেন্দ্রবিন্দু থেকে ইসলামী বিপ্লব ও ধর্মীয় চিন্তাধারার ঢেউ শুরু হয়েছে এবং ইমাম খোমেইনীর এই চিন্তাধারাই নাস্তিকতার ভিতকে কাঁপিয়ে তুলেছে।

ইমাম খোমেইনীর নেতৃত্বে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের সাফল্য, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সমর্থিত সাবেক সরকারকে উৎখাত করে ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং পরে সেখানেই ইসলামী মূল্যবোধের প্রবর্তন ইরানী জাতিকে ধর্মীয় ও চিন্তাগত দিক থেকে সুরক্ষিত করেছে। এর মধ্য দিয়ে ইসলাম এই অঞ্চলে তথা সমগ্র বিশ্বে এক নতুন চিন্তাধারা বিকাশের ভিত্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এর আগ পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও বিভিন্ন জাতি ইসলামের বিশ্বাস ও ইসলামের প্রতি কিছু কিছু ভালোবাসাও পোষণ করত, এমনকি রাষ্ট্র ও সরকারসমূহও ইসলামের খেদমত করছে বলে দাবি করতো বটে, কিন্তু প্রকৃত অবস্থা ছিল ভিন্নতর। ঐ সময় ইসলামের অনুসরণ ও অনুশীলন হতো আধুনিককালের খ্রিস্টধর্মের মতো। দৈনন্দিন জীবনাচারের সাথে ধর্মের ধর্মের কোন যোগ ছিল না, এমনকি ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব বলে যাঁরা খ্যাত ছিলেন তাঁদেরও অনেকে ঐ দাম্ভিক শাসকগোষ্ঠীরই অংশ।

ইসলামী বিপ্লবের আগে ইরানেও ইসলাম তার পরিচ্ছন্ন রূপ নিয়ে বিরাজমান ছিল না। সেই ইসলাম কেবল তার ওপর নাস্তিক্যবাদের হামলা মোকাবিলায়ই অসমর্থ ছিল না; বরং তার নিজস্ব প্রাধান্য বজায় রাখার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছিল। বিপ্লব পূর্বকালে ইসলাম তার অতীতের মহান গৌরব এবং সত্যানুসন্ধিৎসু বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলেছিল। এই সুযোগে কমিউনিস্ট বস্তুবাদ ধীরে ধীরে সমাজের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করতে থাকে এবং প্রতিদিনই এক আল্লাহর প্রতি আনুগত্য কমতে থাকে।

১৯৭৭-৭৮ সালের দিকে ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর চিন্তাধারার বহিঃপ্রকাশ হিসাবে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের জন্য যে নতুন জাগরণ দেখা দেয় তা ইসলামের ও ইসলামী চিন্তাধারার এক সমৃদ্ধ উৎস হিসাবে পরিগণিত হয়। সত্যি বলতে কী, এই সঠিক ভিত্তিই ইসলামী বিপ্লবকে সাফল্যের স্বর্ণদ্বারে পৌঁছে দিয়েছে। এই বিপ্লবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর মূল্যবোধ। যে মূল্যবোধ ইরানের সমগ্র জনগণকে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত করে। বিপ্লবের পর দেশের ভিতরে-বাইরে উভয় স্থানে এই বিপ্লবী মূল্যবোধের প্রভাব পড়ে। বিপ্লব-পরবর্তী ইরানে ইমাম খোমেইনীর নেতৃত্বে দশ বছরের শাসনামলে মহানবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর সত্যিকার ইসলাম বাস্তবায়নের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

ইরানে তথা সমগ্র বিশ্বে কমিউনিজমের বিপর্যয়ের প্রধান কারণ দুটি। প্রথমত, কমিউজিম মানবতার মুক্তির জন্য যেসব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়েছিল, সময়ের সাথে সাথে সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তা গোলযোগের সম্মুখীন হয় এবং এই পরিস্থিতি জনগণের মৌলিক চাহিদাও পূরণ করতে ব্যর্থ হয়।

দ্বিতীয়ত, ইসলামের ওপর আস্থাশীল জনসাধারণ ইসলামী চিন্তা-চেতনাকেই বেশি করে আঁকড়ে ধরতে শুরু করে। তারা অনুধাবন করে যে, ইসলাম স¤পর্কে অজ্ঞতা তাদেরকে ইসলাম ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। একই সাথে ইসলাম সকল প্রকার অনিয়ম ও বস্তুবাদী চিন্তা-চেতনার বিরুদ্ধে তার ভূমিকা তুলে ধরে। নতুন প্রজন্মের যুবা-তরুণরা ইসলামের কাছে ছুটে আসে সঠিক জ্ঞানের অনুসন্ধানে। আর এ কারণে ইমাম খোমেইনীর কাছে তারা ঋণী।

বিশ্বের দেশে দেশে সমাজজীবনে ইসলামের প্রভাব বাড়ছে এবং যারা ধর্মকে ‘আফিম’ ভাবত, আজ তারা ইসলামের বিজয় দেখে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেছে।

(নিউজলেটার, অক্টোবর ১৯৯১)

হযরত আলী (আ.)-এর বাণী- নাহজুল বালাগা থেকে

হযরত আলী (আ.) বলেছেন : ‘আমি মিথ্যা বলিনি। আমার ওপর মিথ্যা আরোপ করা হয়নি। আর আমি পথভ্রষ্ট হইনি এবং আমার দ্বারা কেউ পথভ্রষ্ট হয়নি।’- নাহজুল বালাগা, উক্তি নং ১৭৬

হযরত আলী (আ.) বলেছেন : ‘অন্যায় সূচনাকারী যালেম আগামী দিন (অর্থাৎ কিয়ামতের দিন) স্বীয় হাত কামড়ে খাবে।’- নাহজুল বালাগা, উক্তি নং ১৭৭

যেমন পবিত্র কুরআনেও বলা হয়েছে : “যালিম ব্যক্তি সেদিন নিজ হস্তদ্বয় দংশন করতে করতে বলবে : ‘হায়! আমি যদি রাসূলের সাথে সৎপথ অবলম্বন করতাম।”- সূরা ফুরকান : ২৭

হযরত আলী (আ.) মৃত্যু সম্পর্কে বলেছেন : ‘প্রস্থান (অর্থাৎ দুনিয়া থেকে চলে যাওয়া) অতি নিকটে। সুতরাং সে ব্যক্তিই জ্ঞানী যে মৃত্যুকালে নিয়ে যাওয়ার মতো পাথেয় সঞ্চয় ও প্রস্তুত করে রাখে।- নাহজুল বালাগা, উক্তি নং ১৭৮

হযরত আলী (আ.) বলেছেন : ‘ধৈর্য যাকে পরিত্রাণ দিল না, অধৈর্য ও অস্থিরতা তাকে ধ্বংস করে দিল।’ (অর্থাৎ ধৈর্য মানুষের জন্য মুক্তি আনে আর অধৈর্য ধ্বংসের কারণ)।- নাহজুল বালাগা, উক্তি নং ১৮০

হযরত আলী (আ.) বলেছেন : ‘মানুষ তো এই পৃথিবীতে লক্ষ্যবস্তুর ন্যায় যাকে লক্ষ্য করে বানের ন্যায় মৃত্যু ছুটে আসে। সে লুণ্ঠিত বস্তুর ন্যায় যাকে লুণ্ঠন করে নেওয়ার জন্য বিপদ-আপদ দ্রুত বেগে তার দিকে ধাবিত হয়। পান করার ক্ষেত্রে প্রতিটি ঢোক গলায় আটকে যাওয়ার মতো এবং প্রতিটি লোকমা (গ্রাস) কষ্টদায়ক। বান্দাকে কোন একটি নিয়ামত লাভ করতে হলে তাকে অন্য একটি নিয়ামত হাতছাড়া করতে হয়। তার জীবনের একটি দিন ভবিষ্যতে করায়ত্ত করতে হলে স্বীয় জীবন থেকে অনুরূপ একটি দিন হাতছাড়া করতে হয়। অতএব, আমরা মৃত্যুর নিত্য সহচর। আর আমাদের জীবনাত্মা সহসা মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার লক্ষ্যবস্তুকে পরিণত হয়েছে। কাজেই আমাদের স্থায়িত্বের আশা কোথায়? এই দিবারাত্রি (অর্থাৎ সময়) যা কিছু উন্নত ও মহান করে তোলে পরক্ষণেই তা ধ্বংস করে দেয়, যা কিছু সৃষ্টি করে তা নষ্ট করে দেয় এবং যা কিছু পুঞ্জিভূত ও একত্র করে তা বিশৃঙ্খল করে দেয়।’- নাহজুল বালাগা, উক্তি নং ১৮২

হযরত আলী (আ.) বলেছেন : ‘হে আদম সন্তান! তুমি তোমার জীবন ধারণের অধিক যা কিছু উপার্জন কর, অন্যের জন্য তুমি তার ভাণ্ডার রক্ষক মাত্র।’ (অর্থাৎ আদম সন্তান তার জীবন ধারণের অধিক যা উপার্জন করে তা তার উওরাধিকারীর অথবা অন্যদের জন্যই হয়ে থাকে, সে শুধু ধন-সম্পদের রক্ষক মাত্র।)- নাহজুল বালাগা, উক্তি নং ১৮৩

(নিউজলেটার, অক্টোবর ১৯৯১)

মৌলকোষ বা স্টেমসেল গবেষণায় বিশ্বে অষ্টম স্থানে ইরান

মৌলকোষ বা স্টেমসেল উতপাদন প্রযুক্তি সংক্রান্ত গবেষণায় ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের অবস্থান বিশ্বে অষ্টম। ইরানের কোম প্রদেশের জিহাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান মুহাম্মাদ ইব্রাহিম ফাকিহজাদেহ এই তথ্য জানিয়েছেন।

মৌল কোষ উতপাদনের মাধ্যমে সম্প্রতি যকৃতের ক্যান্সারে আক্রান্ত ইরানের একটি শিশুকে সম্পূর্ণ সুস্থ করতে সক্ষম হয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্বে এর আগে এই পদ্ধতিতে মাত্র অল্প কয়েকজন ক্যান্সার রোগীকে সুস্থ করতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা।

ইরানের রুইয়ান গবেষণা কেন্দ্র সম্প্রতি অপ্রাকৃতিক পদ্ধতিতে একটি কালো ইঁদুরের ভ্রুণের মৌল কোষ একটি সাদা ইঁদুরের গর্ভে (ব্লাস্টোসিস্টে) ব্যবহার করে ভ্রুণের পরিবর্তন ঘটায় এবং এরপর পরিবর্তিত সেই ভ্রূণ আরেকটি ইঁদুরের গর্ভে প্রয়োগ করে কালো বর্ণের একটি ইঁদুর জন্ম দিয়েছে।
এর আগে ২০০৬ সালে এই একই গবেষণা কেন্দ্র ক্লোনিংয়ের মাধ্যমে দেশটির প্রথম ক্লোন ভেড়া ‘রুইয়ানা’র জন্ম দেয়।

রেডিও তেহরান, ২১ জানুয়ারি, ২০১৪

শিশুর মানস গঠনে পরিবারের ভূমিকা

নৈতিক শিক্ষা

নৈতিক শিক্ষার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, শিশুদের জীবনের প্রথম দিকের বছরগুলোতে নিম্নলিখিত পন্থাসমূহ অবলম্বন করা যেতে পারে। ভালো কাজের জন্য শিশুর প্রশংসা করা, প্রশংসনীয় আচরণের জন্য তাকে পুরস্কার বা উপহার দেয়া, খারাপ কাজের প্রতি অপছন্দের ভাব প্রকাশ করা ইত্যাদি।

অন্যান্য পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে উপকারী ও শিক্ষামূলক গল্প (যা শিশুদের মধ্যে অসাধারণ গঠনমূলক প্রভাব ফেলবে) পাঠ করা বা বলা এবং অন্যদের ভালো কাজের প্রশংসা করা ও তাদের মন্দ কাজের সমালোচনা করা। এই ধরনের প্রশিক্ষণকালে পিতামাতাকে কখনো কখনো তাদের শিশুর ভুল উপেক্ষা করে যেতে হবে, যাতে দুঃসাহসী না হয়ে যায় সেজন্য মাঝে মধ্যে তিরস্কার করতে হবে। তবে তা যেন মাত্রা ছাড়িয়ে না যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে তার মন্দ কাজের কথা ফাঁস করে দেয়ার ভয় দেখাতে হবে এবং কখনো কখনো তাকে সতর্ক করে দিতে হবে।

ইসলামী সমাজব্যবস্থায় গৌরব এই বাস্তবতার ওপর প্রতিষ্ঠিত যে, অতি শুরু থেকেই মহান মানবীয় শক্তিকে ব্যবহার করতে হবে এবং যে কোন ইতিবাচক কর্মকাণ্ড ও বিশুদ্ধ পদ্ধতি, প্রতিটি বক্তব্য ও কাজকে উৎসাহিত করতে এবং সমর্থন যোগাতে হবে।

পিতামাতা তাদের ছেলেমেয়েদের যৌন আবেগ-অনুভূতির ব্যাপারে উদাসীন থাকতে পারেন না। এই বিষয়ে তাদের পূর্ব পরিকল্পিত মনোভাব থাকে না। যৌন বিষয়ে নীতিকথার দ্বারা তাদের পরিচালিত করা সম্ভবত সবচেয়ে কঠিন ও স্পর্শকাতর ব্যাপার। এ বিষয়ে সামান্যতম ভুল বা অবহেলা ছেলেমেয়েদের দুর্নীতি ও ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

বয়ঃপ্রাপ্তির আগে যৌন আবেগ-অনুভূতির আবির্ভাব লক্ষ্যগোচর হয় না, কিন্তু শিশুকাল থেকেই সব মানুষের মধ্যে এর অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকে এবং বিভিন্নরূপে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে। যদিও শৈশবকালে এই প্রবৃত্তি পুরাপুরিভাবেই সক্রিয় থাকে। বয়ঃপ্রাপ্তির আগে তারা জন্মদান কিংবা দৈহিক ও মানসিক দিক থেকে এই প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার জন্য প্রস্তুত হয় না। এজন্যই আল্লাহ তাআলা বয়ঃপ্রাপ্তির আগে ছেলেমেয়েদের মধ্যে এই প্রবৃত্তিকে অবদমিত করে রাখেন। সুতরাং পিতামাতার উচিত ছেলেমেয়েদের মধ্যে উত্তেজনার ভাব জাগাতে পারে এরকম কাজ করা থেকে সত্যিকারভাবেই বিরত রাখা। তাদের উচিত এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি করা যার ফলশ্রুতিতে ছেলেমেয়েদের মধ্যে এই সহজাত প্রবৃত্তির স্বাভাবিক বিকাশ ঘটে।

ইসলাম সঠিক সময়ের পূর্বে যৌন প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার বিরোধী। ইসলামের দাবি হচ্ছে, পিতামাতা তাদের সন্তানদের শিক্ষার এমন একটা ভিত গড়ে তুলবেন যার ওপর ভিত্তি করে এই লক্ষ্য অর্জিত হয়। এজন্য এই নিয়মের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে ওঠা উচিত। পিতামাতার উচিত অন্যদের সঙ্গে তাদের সন্তানদের সম্পর্ক, তাদের ঘুম, বিশ্রাম, গোসল, স্বাস্থ্য এবং শারীরিক ও মানসিক পরিচ্ছন্নতার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা।

পুরুষ ও মহিলাদের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদান এবং তাদের একজন পিতা বা মাতা হিসাবে দায়িত্ব পালন ও দায়িত্বভার গ্রহণের জন্য প্রস্তুত  করে তোলা পিতামাতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এসব ব্যাপারে ছেলেমেয়েদের অবহিত করতে পিতামাতা বিভিন্ন সুযোগকে কাজে লাগাতে পারেন এবং লাগানো উচিত। বয়ঃসন্ধিকাল থেকে ছেলেমেয়েরা যৌন বিষয়সহ সকল ক্ষেত্রে জানার ব্যাপারে উৎসুক হয়ে ওঠে। সুতরাং তারা গুপ্ত বিষয়সম্পর্কে জানতে এবং এ ব্যাপারে তথ্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করে। যদি পিতামাতা এ ব্যাপারে পদক্ষেপ না নেন তাহলে তারা অন্যদের কাছ থেকে এ বিষয়ে অবহিত হবে। এর ফলে তারা বিপদের দিকে পরিচালিত হতে পারে। পিতামাতার উচিত ছেলেমেয়েদের উত্থাপিত প্রশ্নের জবাব তাদের প্রশ্নের কাঠামোর মধ্যেই শিশুসুলভ পন্থায় দেয়ার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা, এর বেশি নয়। পারিবারিক পরিবেশের বাইরেও, যেমন সাহচর্য, সামাজিক পরিবেশ, পঠনীয় বিষয়, শ্রুত কথোপকথন ইত্যাদি বিষয়ও ছেলেমেয়েদের মনে প্রভাব ফেলতে পারে। পিতামাতাকে এসব বিষয় নিয়ন্ত্রণ করতে হবে যাতে সঙ্গ বা সাহচর্য তাদের মধ্যে দুর্নীতি আনয়ন করতে না পারে।

(নিউজলেটার, অক্টোবর ১৯৯১)

ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর ইরাকে নির্বাসিত জীবন

১৯৬৫ সালের অক্টোবরে ইমাম খোমেইনীকে তুরস্ক থেকে ইরাকের নাজাফে পাঠানো হয়। নাজাফ শুধু ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবেই নয়, নির্বাসিত ইরানী ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের আশ্রয়স্থল হিসেবেও খ্যাত। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ইরানের সাংবিধানিক আন্দোলনের সমর্থক আলেমরা কিংবা তামাক আন্দোলনের সময় অথবা তারও আগে তাঁরা ইরাকের শহরগুলোতেই আশ্রয় নিয়েছিলেন। এবার কিন্তু ইমাম খোমেইনীর জন্য নাজাফ কোনক্রমেই বিপদমুক্ত ছিল না। পাশ্চাত্য প্রচারমাধ্যমগুলোর অপপ্রচারের জবাবে একথা উল্লেখ  করা আবশ্যক যে, ইরাকের বাথ সরকারের সাথে সামান্যতম বন্ধুত্ব বা বোঝাপড়ার ফলে ইমাম সেখানে সুদীর্ঘকাল অবস্থান করেননি; বরং বিভিন্ন প্রকার কড়াকড়ি ও বিধিনিষেধ জারি করে বারবার বিভিন্নভাবে তাঁকে অনর্থক হয়রানি করা হতো।

নাজাফে ইমাম জ্ঞানচর্চা, জ্ঞান বিতরণ ও গ্রন্থ রচনার কাজে আত্মনিয়োগ করার সাথে সাথে ইরানী জনগণের আন্দোলনের পথনির্দেশনা প্রদানের কাজও অব্যাহত রাখেন। সেখান থেকে সময় সময় ইরানী জনগণের উদ্দেশে ও ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতে ইরানের সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যাবলি সম্পর্কিত বাণী রেকর্ড করে পাঠাতেন। ইমামের এসব বাণীর হাজার হাজার কপি অল্প সময়ের মধ্যেই গোপনে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ত।

নাজাফে অবস্থানকালেই ইমাম খোমেইনী তাঁর বেলায়াতে ফকীহসংক্রান্ত চিন্তাধারা গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করেন। এ গ্রন্থই ইরানের ইসলামী বিপ্লবের তাত্ত্বিক ভিত্তি রচনা করে। কারণ, বেলায়াতে ফকীহ বা ফকীহর শাসনের অপরিহার্যতা মানেই হচ্ছে ফকীহ নয় এমন ব্যক্তির শাসন অবৈধ এবং অগ্রহণযোগ্য- তা রাজতন্ত্রই হোক কিংবা অন্য কোন ধরনের সরকারই হোক। ইমামের অনুসারী আলেমগণ দ্বীনী অনুষ্ঠানাদিতে বেলায়াতে ফকীহ বা ইসলামী হুকুমত সম্পর্কে আলোচনা করতে থাকেন।

এদিকে কোমের ধর্মতত্ত্ববিদ ও ধর্মীয় শিক্ষকবৃন্দ ইমামকে ফিরিয়ে আনার দাবিতে দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিলেন এবং সর্বত্র ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের ক্লাস মূলতবী ঘোষণা করলেন। কিন্তু তাঁদের সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলো। সরকার ইমামকে ফিরিয়ে আনতে রাজি হলো না।

ইরাকে নির্বাসিত জীবনে ইমাম সবসময়ই চিন্তা করতেন কিভাবে ইরানী জনগণের দুঃখ-কষ্ট দূর করা যায়। ইমাম এ সময় প্রদত্ত তাঁর এক ভাষণে বলেন : যারা ইসলাম ও তার পবিত্র নীতি-আদর্শের মর্যাদা বৃদ্ধি ও মুসলিম জনগণকে বিদেশী শক্তির আধিপত্যের কবল থেকে রক্ষার ব্যাপারে নিজেদের ধর্মীয় কর্তব্য পালন করতে গিয়ে আমর বিল মারুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকার’ (সৎকাজের আদেশ দান ও মন্দ কাজের নিষেধ করা)-এর দায়িত্ব পালন করছেন এবং তা করতে গিয়ে জেল-জীবন অতিবাহিত করছেন বা শহীদ হচ্ছেন তাঁদের পরিবার-পরিজন জীবনের আসল অবলম্বন হারিয়ে ফেলছেন। এদের সাহায্য-সমর্থনে আপনাদের এখলাসের সাথে এগিয়ে আসা উচিত, কিন্তু তাঁদের আত্মসম্মান বা মর্যাদাবোধে যাতে ঘা না লাগে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার ইসলামী ছাত্র সমিতির সদস্যদের কাছে প্রেরিত এক বাণীতে তিনি বলেন : ইসলামী প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থার রূপ কী, মুসলিম জনগণের সাথে শাসকদের সম্পর্ক কেমন হবে এবং জনগণের সম্পদ থেকে তারা কিভাবে অর্থ গ্রহণ করবে, এ সম্পর্কিত নীতিমালা আপনারাই মানবসমাজে পরিচিত করবেন। ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইরানী স্বেচ্ছাচারী শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র ফাঁস করতে কখনো ইতস্তত করবেন না। ইরানে যে পৈশাচিকতা, গণহত্যা এবং বেআইনি কার্যকলাপ চলছে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হোন।

রাজতন্ত্রী সরকারের দুর্নীতির আরেকটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে ইরানে রাজতন্ত্রের ২৫০০তম বার্ষিকী উপলক্ষে পালিত উৎসব। অবশ্য এ অনুষ্ঠানকে পাহলভী রাজবংশের ৫০তম বার্ষিকী উদ্যাপন বা গদীচ্যুত শাহের রাজ্যাভিষেক উৎসবও বলা যেতে পারে। সে অনুষ্ঠানে অন্তঃসারহীন জাঁকজমকের জন্য যে বিপুল পরিমাণ অর্থের অপচয় হয়েছিল তা ছিল জাতির জন্য বিরাট বোঝাস্বরূপ। ইমাম এ প্রসঙ্গে প্রেরিত এক বাণীতে বলেন : যালিম শাসকগোষ্ঠী মনে করে যে, আমি আমার এ জীবন নিয়ে সুখী। মযলুম জনগণের দুঃখ-দুর্দশা দেখার জন্য বাঁচার চেয়ে আমার বরং মৃত্যুবরণ করাই শ্রেয়। আমি মনে করি, যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো আমার কর্তব্য।

আমাদেরকে বার বার বলা হয়েছে, আমরা যেন রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম বা বিষয়াদিতে হস্তক্ষেপ না করি। শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যে কোন আন্দোলন বা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করা আমাদের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু মানবজাতির ইতিহাস সাক্ষী, আল্লাহর মহান নবী-রাসূল ও ধর্মীয় নেতারাই সবসময় স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন।

দেশে আলেমদের সংখ্যা ১৫০০০০ ছাড়িয়ে গেছে। এদের মধ্যে খ্যাতনামা ধর্মতত্ত্ববিদ ও মহান মুজাহিদও রয়েছেন। শাসকগোষ্ঠীর যুলুম-অত্যাচারের কথা তাঁদের জানা আছে। সে সম্পর্কে তাঁরা যদি লিখেন এবং বলেন, তাহলে জয় তাঁদেরই হবে নিঃসন্দেহে।

বঞ্চিত জনগণ উপোস করছে, অথচ শাহী শান-শওকত ও উৎসবের জন্য শুধু তেহরানেই ৮০ কোটি রিয়াল বরাদ্দ করা হয়েছে। তোমরা (সরকার) মৃতদের জন্য উৎসব কর, কিন্তু জীবিতদের অবজ্ঞা কর। শাসকগোষ্ঠী জনগণের তহবিল লুটপাট করছে এবং জাতীয় সম্পদের উৎস বিদেশীদের ভোগ-ব্যবহার করার পূর্ণ সুযোগ দিচ্ছে।

শাহ বুঝতে পারল তার ক্ষমতার মসনদ নড়বড়ে হয়ে উঠেছে। কাজেই সে এমন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করার চিন্তা করল যা হবে সকল রাজনৈতিক দলের একটি একক দল এবং রাজতন্ত্রী আদর্শের প্রচারক। কিন্তু এ শয়তানি পরিকল্পনা চরমভাবে ব্যর্থ হলো।

শাহের নবগঠিত রাজনৈতিক দল রাস্তখিজ পার্টি সম্পর্কে ইমাম জনগণের কাছে প্রেরিত এক বাণীতে বলেন : ইরানের বঞ্চিত জনগণকে জোর-জবরদস্তি করে রাজতান্ত্রিক পদ্ধতি মেনে নিতে বাধ্য করা হচ্ছে। অথচ এটি একটি বাজে ও ক্ষয়িষ্ণু পদ্ধতি, এমন এক পদ্ধতি যা ইসলাম স্বীকার করে না, বরং নিন্দা করে। এ শাসকগোষ্ঠী আল-কুরআনকে নিশ্চিহ্ন করতে চায়। শাহ নিয়মতান্ত্রিকতার কথা বলে, শাসনতান্ত্রিক আইনের কথা বলে, অথচ সে নিজেই এসব কিছু মুছে ফেলতে চেয়েছে। যেহেতু রাস্তখিজ পার্টি ইসলাম ও ইরানী মুসলিম জনগণের প্রকাশ্য বিরোধিতা করছে, সেহেতু এ দলে কারো যোগ দেয়া উচিত নয়। অন্যথায় যোগদানকারী ব্যক্তি যালিমের সাহায্যকারী এবং মযলুমের প্রতি বিশ্বাসঘাতক বলে বিবেচিত হবে।

১৯৬৭ সালের এপ্রিলে ইমাম খোমেইনী তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নিকট একটি খোলাচিঠি পাঠান। এসময় ইরানের প্রধানমন্ত্রী ছিল আমীর আব্বাস হোবায়াদা। ইমাম তাঁর চিঠিতে হোবায়দা এবং শাহকে বারবার ইসলাম ও সংবিধান লঙ্ঘনের জন্য কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি তাঁর চিঠিতে সকল সরকারি নীতির সমালোচনা করেন এবং হোবায়দাকে এই বলে সতর্ক করে দেন যে, একদিন তাঁকে জবাবদিহি করতে হবে। ১৯৬৭ সালের এপ্রিলে তিনি যে সতর্কবাণী দিয়েছিলেন তা কার্যকর হতে দেখা যায় ১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবী আদালত কর্তৃক হোবায়দাকে মৃত্যুদ- প্রদানের মাধ্যমে।

নির্বাসিত জীবনে ইমাম খোমেইনীর ঘোষণার আরো একটি উদাহরণ রয়েছে। ১৯৭০ সালের মে মাসে ইরানী অর্থনীতিতে আমেরিকা অধিকতর অনুপ্রবেশ ও শোষণকে আরো পাকাপোক্ত করে তোলার জন্য বিনিয়োগকারী কনসোর্টিয়াম তেহরানে এক আলোচনায় বসে। ইমাম খোমেইনী এ সময় পর পর অনেকগুলো ঘোষণা জারি করেন। এ উপলক্ষে ইমাম খোমেইনীর অন্যতম অনুসারী আয়াতুল্লাহ সাঈদী তেহরানের এক মসজিদে ঐ আলোচনা সভাকে নিন্দা করে খুতবা দেন এবং শাহের গুপ্ত পুলিশ সাভাকের হাতে নির্যাতিত হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। ইমাম তখন পাহলভী শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য জনগণকে নতুন করে শপথ নেয়ার আহ্বান জানান।

উল্লেখ্য, ইমাম খোমেইনী নির্বাসিত জীবনে দুইবার- একবার ১৯৭১ সালে এবং আরেকবার ১৯৭৯ সালে বিপ্লব চলাকালে মুসলিম বিশ্বের উদ্দেশে বাণী পাঠান এবং তা হজের সময় বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করে বিলি করা হয়। ঐ আবেদনে তিনি মুসলিম উম্মাহর সংহতি এবং পারস্পরিক সমস্যা মোকাবিলায় সমন্বিত প্রচেষ্টা চালানোর আহ্বান জানান।

(নিউজলেটার, অক্টোবর ১৯৯১)

টেলিভিশন ও শিশু

টেলিভিশনের মতো একটি ইলেক্ট্রনিক আবিষ্কারের ইতিবাচক ও ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া কী তা ঘনিষ্ঠভাবে তাকিয়ে দেখার এখনই সময়। টেলিভিশন কি আমাদের শিশুদের জন্য কল্যাণকর?

ঘরের ভিতর শান্তশিষ্ট হয়ে বসে আছে একটি ছোট মেয়ে, রান্নাঘরে কর্মরত তার মায়ের নানা কাজের শব্দ তার কাছে মজা লাগছে। মেয়েটির ছোট ভাই মেঝেতে ঘুমিয়ে আছে আর বড় ভাই চারিদিকে ছড়ানো বইয়ের মধ্যে শুয়ে লেখাপড়া করছে। বাইরে ক্রমবর্ধমান অন্ধকারের মধ্যে নীরবে তুষারপাত হচ্ছে। বাবা এখনও তাঁর কাজ থেকে ঘরে ফিরে আসেননি।

ছোট মেয়েটি টেলিভিশনের আলোকিত পর্দার সামনে মোহাবিষ্ট হয়ে তার বসার জায়গাটির সাথে যেন একেবারে স্থির হয়ে গেছে। তার মন চলে গেছে অনেক দূরে। এমন একস্থানে যা কোনদিন সে দেখেনি। কিন্তু সে বুঝতে পারে সবই। টেলিভিশনের পর্দায় সে দেখছে বরফাবৃত সমতল ভূমির ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে নায়ক আর তাকে অনুসরণ করছে এক ভয়ংকর ভালুক। আজ সকালেই মেয়েটি তার শ্রেণিশিক্ষকের কাছে শুনেছিল দক্ষিণ মেরুর কথা, যে ছবি তার মনের মধ্যে গাঁথা হয়ে ছিল। এখন তা-ই দেখছে টেলিভিশনের পর্দায়। সে দেখছে তুষার আবৃত ভূমিতে বরফের পাহাড় এবং তীব্র ঠাণ্ডা বাতাস। তার কাছে সবই যেন এক একটি বাস্তব ঘটনা। সে সবকিছু যেন গলধঃকরণ করছে আর উদ্বেগের মধ্যে কামনা করছে নায়ক যেন ঘুরে অন্য দিকে চলে যায়। কেননা, তার পিছন দিক থেকে কি যেন আসছে! মেয়েটি কল্পনা করে, এই মুহূর্তে তার কী করা উচিত। হঠাৎ করে ভল্লুকটি গোঁ গোঁ করা শুরু করল আর নায়ক অমনি ঘুরে দাঁড়িয়ে তার রাইফেল তাক করে গুলি ছুঁড়ল। মেয়েটি এখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল এবং চিন্তা করল ভল্লুকটির কী হলো। টিভি পর্দায় যখনই ভল্লুকটির দৃশ্য দেখা গেল তখনই রান্নাঘর থেকে তার মা তাকে ডাক দিলেন। বিরক্তিভরে মেয়েটি মায়ের ডাক উপেক্ষা করতে চেয়েছিল। কিন্তু মা আবার তাকে ডাকলেন, এবার একটু উচ্চৈঃস্বরে। মেয়েটি যেন জোর করে তার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল টেলিভিশনের পর্দা থেকে এবং উঠে গেল রান্নাঘরের দিকে। টেলিভিশন তখনও চলছে। মেয়েটির বড় ভাইয়ের দৃষ্টি তার পড়ার কাজ থেকে টেলিভিশনের পর্দার দিকে পড়তেই সে তাড়াতাড়ি তার লেখার কাজ শেষ করল।

হ্যাঁ। আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু হলো টেলিভিশন। যোগাযোগের একটি ইলেক্ট্রনিক মাধ্যম বা আলোকিত পর্দা, যা আমাদের দৃষ্টিকে আমাদের গৃহকোণ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। সেই একচোখা দানবটি আমাদের অবকাশের সময়কে খেয়ে ফেলে এবং দাবি করে পূর্ণ নীরবতা ও মনোযোগ। টেলিভিশন আমাদের সমাজে বেশিদিন হলো আসেনি। কিন্তু আমরা ইতিমধ্যেই ভুলে যেতে শুরু করেছি, টেলিভিশন ছাড়া বিশ্ব চলতে পারে কিনা। টেলিভিশনের পরিণতি-প্রতিক্রিয়া কী তা আমাদের অনেকেই গুরুত্ব দিয়ে বুঝার চেষ্টা করেন না; বরং অভ্যাসবশত প্রতিরাতেই আমরা টেলিভিশন সেটের সামনে স্থির হয়ে বসে থাকি। গোটা মানববংশই আজ ঐ টেলিভিশন অনুষ্ঠানমালার প্রতি আসক্ত হয়ে উঠছে। খাবার খাওয়া হচ্ছে না, বাড়ির কাজ অসম্পূর্ণ থাকছে এবং ঘুম নষ্ট হচ্ছে।

টেলিভিশন একটি সর্বজনীন সান্ত্বনা দানকারী। মায়েদের জন্য এটি এখন একটি উপযুক্ত মাধ্যম হয়ে উঠেছে তাদের ছেলেমেয়েদের শান্ত রাখার। ছেলেমেয়েদের শোবার ঘরে এনে টেলিভিশন সেট চালু করে দিয়েই মায়েরা অনেকটা খালাস।

কিন্তু আমাদের খুব ঘনিষ্ঠভাবে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা দরকার যে, এই ইলেক্ট্রনিক আবিষ্কারটির ইতিবাচক ও ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া কী? গবেষকরা এ নিয়ে যে ব্যাপক গবেষণা সমীক্ষা চালিয়েছেন এবং তাঁরা যে প্রশ্ন ও জবাব নির্ধারণ করেছেন তা বিভিন্ন  রকম। টেলিভিশন শিশুদের জন্য কল্যাণকর, নাকি কল্যাণকর নয়? টেলিভিশন দেখে ছেলে-মেয়েরা কী পরিমাণ সময় ব্যয় করে? কী ধরনের অনুষ্ঠান শিশুদেরকে আকৃষ্ট করে এবং কেন করে? বয়স্কদের অনুষ্ঠান দেখে শিশুরা কী পরিমাণ সময় ব্যয় করে? টেলিভিশনের অনুষ্ঠান দেখা ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য কতখানি সহায়ক? টেলিভিশন অনুষ্ঠান কি শিশুদের সামনে এক অবাস্তব জীবনধারা উপস্থাপন করে? টেলিভিশন কি একটি বাণিজ্যিক মানসিকতা সৃষ্টি করে?

টেলিভিশন শিশুদের মধ্যে বহুমুখী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। কখনও কখনও টিভি স্টুডিওর দৃশ্য শিশুদের কাছে এতই বাস্তব বলে মনে হয় যে, তারা আশপাশের পরিবেশ সাময়িকভাবে ভুলে যায়। টেলিভিশন যখন শিশুমনকে এতই আলোড়িত করে তখন তা শিশুদের জীবন গঠনেও এক কর্তৃত্বব্যঞ্জক ভূমিকা পালন করতে পারে।

যেসব ছেলেমেয়ে টেলিভিশন দেখে তারা যেসব ছেলেমেয়ে টেলিভিশন দেখে না তাদের তুলনায় বিশ্ব সম্পর্কে অনেক বেশি জানতে পারে। টেলিভিশন দেখে অভ্যস্ত শিশুরা অনেক বেশি কথা শিখতে পারে এবং নায়ক ও ব্যর্থ নায়কদের আবেগ-অনুভূতিতে একাত্ম হয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে। বিশেষত খেলার অনুষ্ঠানে শিশুরা বেশি আগ্রহী হয় এবং নানা প্রশ্ন জবাবের মধ্য দিয়ে যথেষ্ট ধারণা লাভ করে।

কার্টুন ছবি শিশুদের বাস্তব অবস্থা থেকে দূরে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিরাট ভূমিকা পালন করে। আর সেজন্য তারা কার্টুন ছবি পছন্দও করে বেশি।

শালীনতার অভাব দেখা দিলেই কেবল টেলিভিশন ক্ষতিকর বলে বিবেচিত হয় এবং একথা সব জিনিসের বেলায়ই প্রযোজ্য। পিতামাতা এবং টেলিভিশনের অনুষ্ঠানমালা প্রণেতা ও পরিচালকদের দায়িত্ব হলো শিশুদের জন্য উপযোগী শালীন ও ভারসাম্যপূর্ণ অনুষ্ঠান প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনেক সময় এ ব্যাপারটি শিশুদের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়। কোন শিশু যখন চলচ্চিত্র বা অনুরূপ অনুষ্ঠান দেখতে যায় তখন তার সাথে থাকে কোন বয়স্ক ব্যক্তি। কিন্তু টেলিভিশনের বেলায় এমনটি হয় না। পিতামাতারা সাধারণত মনে করে থাকেন যে, টেলিভিশন একটি নিরাপদ বিনোদন মাধ্যম এবং এজন্য বাড়ির অভ্যন্তরে কিছু সময়ের জন্য তাদেরকে স্বাধীনতা দিয়ে থাকেন। কিন্তু শিশুরা যথাযথ নিয়ন্ত্রণ-নির্দেশনা ব্যতিরেকে টেলিভিশন দেখলে তাদের সমস্ত অবকাশের সময় তাতে ব্যয় হয়ে যেতে পারে, পড়ালেখার জন্য খুব সামান্য অথবা একেবারে অল্প সময় পাবে, বাড়ির নির্ধারিত পড়া তৈরি করবে না, শরীরচর্চা বন্ধ হয়ে যাবে, এমনকি অতিরিক্ত টেলিভিশন দর্শনে সামাজিক যোগাযোগ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

টেলিভিশন অবশ্যই একটি চমৎকার যোগাযোগ মাধ্যম। কিন্তু তা অনেক সময় আমাদের পরস্পরের প্রত্যক্ষ যোগযোগের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। টেলিভিশন গবেষকরা অনুষ্ঠানমালা প্রণয়ন এবং শিশুদের গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তার প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে প্রতিদিনই আরো অধিক ধারণা অর্জনের চেষ্টা করছেন। টেলিভিশন এমন একটি মাধ্যম যার অপব্যবহারের সুযোগ থাকলেও ভালোর জন্যও একটি বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে।

একারণে পিতামাতার অবশ্য কর্তব্য হলো শিশুদের প্রয়োজন ও আগ্রহ অনুযায়ী এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনের চাহিদা অনুযায়ী একটি শালীন ও ভারসাম্যপূর্ণ নীতি ও নির্দেশনার আলোকে টেলিভিশন পরিচালনা করা।

(নিউজলেটার, নভেম্বর ১৯৯১)

খাজুয়ে কেরমানী

মুহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন খান

মানবেতিহাসে আধ্যাত্মিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মারেফাত হচ্ছে খোদাপ্রেমিক মহাপুরুষ ও আউলিয়াগণের ঊর্ধ্বজগতে বিচরণের এক বিশাল উৎক্ষেপণ মঞ্চ। এরফান বা আধ্যাত্মিকতার অমিয় সুধার স্বচ্ছ ধারাটি লালিত হয়েছে ইসলামী জাহান, বিশেষ করে ইরান বা পারস্য ভূখণ্ডে। পারস্যবাসীর ভাষা ফারসিকে ইসলামী দুনিয়া তথা বিশ্বসাহিত্য জগতে বলা হয় খোদাপ্রেমের ভাষা, ইশকের ভাষা। মধুর মতো মিষ্ট ফারসি ভাষায় বিশ্বখ্যাত মনীষিগণ তাঁদের মনের কথা, চিন্তা, দর্শন, অধ্যাত্মিকতা, মারেফাত ও দিকনির্দেশনাকে সাহিত্যাকারে স্থায়িত্ব দিয়ে গেছেন।

হিজরি চতুর্থ ও পঞ্চম শতকে যখন বীরত্বগাথায় এবং কাসিদা রচনায় ফেরদৌসী, রোদাকী, আনওয়ারী ও নাসের খসরু সমগ্র সাহিত্যাকাশ দখল করে রাখেন তখন তাঁদের সামনে কাব্যনৈপুণ্য প্রর্দশনের দুঃসাহস কারো হয়নি। কিন্তু হিজরি পঞ্চম শতকের ঠিক ওই সময় ফারসি সাহিত্যের আকাশকে নতুন আলোকে উদ্ভাসিত করে এরফান বা আধ্যাত্মিকতার উজ্জ্বল তারকার আবির্ভাব ঘটল এবং এ গগনে যাঁরা শক্তি প্রদর্শন করলেন তাঁরা হলেন সেনাঈ, শেখ আত্তার, মাওলানা রুমী, শেখ সাদী, খাজুয়ে কেরমানী, হাফেজ শিরাজী প্রমুখ আউলিয়া কেরাম। তাঁরা এরফান ও মারেফাতকে নিজেদের অমিতবিক্রম সাধনাবলে অদৃশ্যজগৎ থেকে নিয়ে এলেন ধরাপৃষ্ঠের অতি কাছাকাছি খোদাপ্রেমিক তাওহিদী জনতার মনমুকুরে। তাঁরা ফারসি ভাষার মধু রসে আপ্লুত করে এরফান ও মারেফাতকে পৌঁছে দিলেন মাটির মানুষের আধ্যাত্মিক রসনায় ও উপভোগের চৌহদ্দিতে। খোদাপ্রেম, ঐশীপ্রেম ফারসি ভাষার অন্যতম চরিত্রবৈশিষ্ট্যে পরিণত হলো। আধ্যাত্মিকতার জান্নাতী সৌরভ ফারসি কাব্যসাহিত্য ও ইরানী মনমনীষায় পূর্ণতা পেয়ে ডালপালা ও শিকড় ছড়িয়ে দেয় বিশ্ব মানব সভ্যতা-সংস্কৃতিতে।

ইসলামের এই ঐশী প্রেমময় সভ্যতা-সংস্কৃতিতে খাজুয়ে কেরমানীর অবদানের কথা সচেতন সাহিত্যামোদীদের অজানা বিষয় নয়। শেখ সাদী ও খাজা হাফেজ শিরাজীর মধ্যবর্তী শতকটি খাজুর কাব্যসুধা ও সৌরভমুখর ছিল। খাজু কেরমানীর কাব্যধারাকে সাদী-প্রভাবিত মনে করা হলেও তা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও ধারায় মণ্ডিত। অবশ্য খাজুর গজলের মধুসুধা, ইঙ্গিতময়তা ও ব্যঞ্জনা স্বয়ং গজরসম্রাট হাফেজের দিওয়ানেও পরিলক্ষিত। খাজুয়ে কেরমানীর গজল প্রেমময়, আধ্যাত্মিক ও মদিরাময়। অবশ্য খাজুর চিন্তাদর্শন অন্যান্য পারস্য সুফি-সাধকের মতোই এতো ভারী ও অর্থবহ যে, কাব্যিক পরিভাষা সে বোঝা বইতে অক্ষম, অপরাগ।

ইসলামী জাহান, বিশেষ করে বুখারা, সমরকন্দ, খোরসান, নিশাবুর, শিরাজ, ইসফাহান ও বাগদাদের ওপর দিয়ে যখন গোবী মালভূমির মঙ্গোলীয় প্রলয় ঝড় বইয়ে যায় এবং সব কিছু ছারখার করে দিয়ে চেঙ্গিজ হালাকুর রণোন্মাদ উত্তরসূরিরা শহরে শহরে ক্ষমতার মসনদ বসায় ঠিক সেই গোলযোগপূর্ণ সময়েই খাজুয়ে কেরমানীর জন্ম। তাঁর নিজের কথামতো ৬৮৯ হিজরিতে ইরানের কেরমান শহরে তিনি ভূমিষ্ঠ হন।

খাজু তৎকালীন সকল শিক্ষাদীক্ষাই লাভ করেন। রওজাতুল আনওয়ারনামক তাঁর এক দ্বিপদী কবিতায় তিনি উল্লেখ করেছেন, বাল্যকালেই স্বপ্নযোগে তিনি এক ফেরেশতাকে দেখেন যে ফেরেশতা তাঁর কাব্যপ্রতিভার ভবিষ্যদ্বাণী করেন এবং অপরূপ কাব্যজগতের দিগন্ত তাঁর চোখের সামনে তুলে ধরেন।

খাজুয়ে কেরমানী অন্যান্য সুফি-সাধকের মতো বহু দেশ ও শহর সফর করেছেন এবং সাক্ষাৎ করেছেন ওই সব জনপদের জ্ঞানী-গুণীদের সাথে এবং তাঁদের কাছ থেকে লাভ করেছেন জীবনদর্শনের পাথেয়।

খাজুয়ে কেরমানী যে সমস্ত কাব্যগ্রন্থ, বিশেষ করে মসনবী রচনা করেছেন সেসবের অন্যতম হলো (১) হুমাই ও হুমায়ূন, (২) গুল ও নওরোজ, (৩) রওজাতুল আনওয়ার, (৪) গওহরনামা, (৫) কামালনামা ও (৬) সামনামা। এছাড়া খাজুর গদ্য রচনার মাঝে মাফাতিহুল কুলুব, রেসালাতুল বাদিয়া, মুনাজারায়ে শামছ্ ও সাহাব, মুনাজারায়ে শামশির ও কলম উল্লেখযোগ্য।

৭৫২ হিজরিতে ৬৪ বছর বয়সে খাজু কেরমানী শিরাজ নগরে ইন্তেকাল করেন। আমরা ফারসি সাহিত্যাকাশের এই উজ্জ্বল নক্ষত্রের একটি আধ্যাত্মিক প্রেমের কবিতা বা গজলের অনুবাদ সম্মানিত পাঠক সমাজের সামনে পেশ করছি।

আক্ষেপ

সাকী! মৌজের সময় হয়ে এলো

নিয়ে এসো শারাবের জাম

সুরাসক্ত আমরা

গোলাপ-রাঙা প্রিয়াকেও বিলাও শারাব,

বকধার্মিকরা জানে না গোপন ভেদ

তাই ঠিক নয় কভু সুরাসক্তদের দোষারোপ করা

প্রেম থেকে ছিলাম বিরত অনেক

কিন্তু কই লাভতো হলো না কিছু!

যারা সেই শুরুতেই ভেবে নিত পরিণতি পিছু।

আর আমি তো তার তিলক কণিকার ঘ্রাণে

পড়ে গেলাম বহ্নিঘেরা ফাঁদে

যদিও বা সুজনেরা মনে করে।

সুকপাল এ ফাঁদেও।

যাক, শুনো

চাঁদ সুন্দরীদের প্রতি যার নেই

তিল পরিমাণ টান

তেমন গবেটের ওপর পশুরও

জেনো ঢের ঢের দাম

আমি তো প্রেমের জ্বালায়

করতে পারি না রাত থেকে প্রভাতের ভেদ,

হয়তো বা সুবহে সাদেকের চেয়েও উজ্জ্বল

ভেবে বসি তিমির আঁধার।

এমন আসক্ত হালতে কেউ যদি মাড়িয়ে

যার চীনের অপরূপ চিত্রশালা,

তবে তো পূজারিরাই অপরূপা প্রতিমা সকল

ভেঙে করবে খান খান।

কাঙ্গালদের মেরে ফেলার

বাদশার হয়তো বা আছে অধিকার,

তবে তার সাধারণ ক্ষমায় রয়েছে ভরসা সবার।

যেদিক থেকেই তাকাও না কেনো সময়ের প্রতি

তার ওপর নেই কোন ভরসা কারো

তাই হে খাজু!

আক্ষেপ বড়ই যদি করো

সময়ের অপচয়।

(নিউজলেটার, নভেম্বর ১৯৯১)