All posts by dreamboy

তিন হাজার বছরের ইরানী স্থাপত্য শিল্প

অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান

প্রাচীন পারস্যের শিল্প ঐতিহ্য

প্রাচীন সভ্যতার মধ্যে মিশরীয়, গ্রীক এবং রোমান সভ্যতা যেমন উল্লেখযোগ্য, তেমনি উল্লেখযোগ্য হচ্ছে প্রাচীন পারসিক সাম্রাজ্য। পুরাতন পৃথিবীতে ইরানীয় মালভূমিতে যে পারসিকরা বসতি করত তারা অনন্যসাধারণ স্থাপত্যকর্মের নিদর্শন রেখে গেছে। এক সময় সভ্যতার রঙ্গমঞ্চে ফেরাউনের প্রতাপ ছিল। তারপরে এল নিনেভা এবং ব্যাবিলনের রাজাদের প্রতাপ। এরপরই আমরা ইরানে একিমিনীয় সাম্রাজ্যের সন্ধান পাই। একিমিনীয় সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব ছিল দীর্ঘকাল পর্যন্ত। এই সাম্রাজ্য যে বলিষ্ঠ সংস্কৃতিকে বহন করত সেই সংস্কৃতির নিদর্শনস্বরূপ আমরা প্রাচীন পারস্যে অনেক দুর্গ ও প্রাসাদের নিদর্শন পাই। এই দুর্গ ও প্রাসাদের নিদর্শন থেকে নির্ণয় করতে অসুবিধা হয় না যে, প্রাচীন পারস্যের এই সভ্যতায় বিত্তের অধিকার এবং প্রতাপ ছিল প্রচণ্ড। এর প্রমাণ আমরা পাই বহু বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে তাদের ধ্বংসাবশেষের চিহ্নের মধ্যে।

22272499901350544039ইরানের অভ্যুদয় কখন হয় তা আমরা সুস্পষ্টভাবে জানি না। গবেষকগণ অনুমান করেন যে, ‘জেন্দাবেস্তা’য় উল্লিখিত ‘আরিয়ান’ শব্দটি থেকেই ইরান শব্দের উদ্ভব ঘটেছে। ‘জেন্দাবেস্তা’য় উল্লিখিত নামের অর্থ হচ্ছে আর্য জাতির বসতভূমি। ‘পারস্য’ শব্দটিও প্রাচীন। এ শব্দটি এসেছে গ্রীক ‘পারসিস’ শব্দ থেকে। ‘পারসিস’ শব্দের অর্থ ফারস প্রদেশ। প্রাচীন যে একিমিনীয় রাজশক্তির উদ্ভব ইরানে ঘটেছিল তাদের উদ্ভব হয়েছিল ফারস্ প্রদেশ থেকেই। একিমিনীয় রাজ্যের রাজধানী ফারস্ প্রদেশে বলেই বর্তমান পারস্য শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহার হয়। প্রাচীন পারস্যে মিদ এবং  পারসিক- এ দু’টি সম্প্রদায় ছিল আর্য সম্প্রদায়। মিদ সভ্যতাও একটি প্রাচীন সভ্যতা যা পরে পারসিস সভ্যতার সঙ্গে মিশে যায়। মিদ সভ্যতার সঙ্গে অ্যাসিরিয় এবং সিথীয় সভ্যতার সম্পর্ক ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ১১০০ অব্দের অ্যাসিরীয় শিলালিপিতে মিদ সম্প্রদায়ের উল্লেখ আছে। এরা ছিল পারস্যের পশ্চিমাঞ্চলের অধিবাসী এবং দীর্ঘকাল এরা অ্যাসিরীয়দের শাসনাধীনে ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ অব্দে এরা স্বাধীনতা অর্জন করে। দক্ষিণ পারস্যের অধিপতি কাইরাস খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ অব্দে মিদ সম্প্রদায়কে পরাভূত করে নিজের সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটান। তিনি লিদিয়ার রাজা ক্রিসাসকেও পরাজিত করেন এবং সর্বশেষ পর্যায়ে ব্যাবিলনও তার বশ্যতা স্বীকার করে। এ ঘটনাটি ঘটে খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৮ অব্দে। এভাবে ব্যাবিলন এবং মিদীয় সাম্রাজ্য অধিকার করে কাইরাস যে বিরাট সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন তা বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসে একিমিনীয় সাম্রাজ্য নামে চিহ্নিত। যেহেতু এই সাম্রাজ্যের সম্রাটদের পূর্বপুরুষদের একজনের নাম ছিল একিমিনীয় সেই কারণে কাইরাসের সাম্রাজ্য একিমিনীয় সাম্রাজ্য বলে খ্যাতি পেয়েছে। কাইরাসের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্রের রাজত্বকালে একিমিনীয় সাম্রাজ্য মিশর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। কিন্তু এই সাম্রাজ্য চূড়ান্তভাবে বিস্তৃতি লাভ করে দারিয়ুসের সাম্রাজ্যকালে। সময়কাল হচ্ছে ৫২১ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ৪৮৬ খ্রিস্টপূর্ব পর্যন্ত। এভাবে যে সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে সে সাম্রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত হয় সমগ্র এশিয়া মাইনর, সিরিয়া, অ্যাসিরীয় ও ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্য। ককেশাস ও কাস্পিয়ান অঞ্চল, মিদিয়া, পারস্য ও ভারতবর্ষের সিন্ধু দেশ। এই সাম্রাজ্য খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ অব্দ পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল এবং ৩৩০ অব্দেই আলেকজান্ডারের আক্রমণে তা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।

63739505569014036238 এভাবেই ক্রমশ বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড অধিকারের ফলে সামগ্রিকভাবে একিমিনীয় শিল্পকর্মের যে বিকাশ ঘটে তা এককভাবে একিমিনীয় শিল্পরূপ নয়, তার মধ্যে মিশ্রণ ঘটে মিশরীয় শিল্পের, অ্যাসিরীয় এবং গ্রীক শিল্পের। কিন্তু এই শিল্পের সকল প্রকার নিদর্শন আমরা পাই না। আমরা শুধু রাজসিক শিল্পের নিদর্শনস্বরূপ পুরাতন রাজপ্রাসাদগুলোর প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ পাই। তবে এই ধ্বংসাবশেষও একটি অসাধারণ স্থাপত্য শিল্পের অধিকারকে প্রমাণ করে। যখন ৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে কাইরাস ব্যাবিলন দখল করেন তখন ব্যাবিলনের শাসনের চূড়ান্ত পতন ঘটে এবং টাইগ্রিস এবং ইউফ্রেতিসের নিকটবর্তী শহরগুলো মূল্যহীন হয় এবং নতুন শহর সমৃদ্ধি পায় সুসায়, পার্সিপোলিসে এবং পাসারগাদে। আমরা জানি যে, যে কোন শিল্প দু’টি অবস্থাকে আত্মস্থ করে গড়ে ওঠে অথবা বলা যেতে পারে, নির্ভর করে গড়ে ওঠে। এদের মধ্যে একটি বাস্তব অবস্থা এবং অপরটি হচ্ছে বোধ এবং বিশ্বাসের অবস্থা। প্রাথমিক অবস্থার ক্ষেত্রে আবহাওয়া এবং প্রাপ্য উপকরণের গুরুত্ব অসীম। দ্বিতীয় অবস্থার জন্য ধর্মবিশ্বাস এবং সামাজিক রীতিনীতির গুরুত্ব অপরিহার্য। একটি দেশের কি ধরনের শিল্প গড়ে উঠবে তা নির্ভর করে সে দেশের অবস্থান এবং প্রাকৃতিক বিন্যাসের ওপর। মহেন-জো-দারোয় পাথর ছিল না। সেখানে সবকিছু ছিল মাটির। তেমনি সুমার দেশেও পাথর ছিল না, কাঠও ছিল না। তাই তারাও তাদের অট্টালিকা মাটি দিয়ে তৈরি করেছিল। কিন্তু পারস্যের অবস্থা ছিল ভিন্ন। পারস্যে পাথর ছিল প্রচুর। তাই সেখানে মাটির তৈরি অট্টালিকার কথা চিন্তাও করা যায় না।

images (4)একিমিনীয় শিল্প-সম্ভারের একমাত্র নিদর্শন হচ্ছে তাদের প্রাচীন স্থাপত্যের ভগ্নাবশেষগুলো। যেমন অ্যাসিরীয় রাজারা নিজেদের সৌভাগ্য এবং প্রতাপ চিহ্নিত করার জন্য রাজপ্রাসাদ এবং দুর্গ নিমার্ণ করেছিলেন, তেমনি একিমিনীয়রা রাজার প্রতাপ এবং প্রতিপত্তি চিহ্নিত করার জন্য বিরাট মহিমাময় এবং আড়ম্বরপূর্ণ রাজপ্রাসাদ নিমার্ণ করেছিলেন। যেহেতু একিমিনীয় সাম্রাজ্য বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এবং যাকে আমরা সেকালীন সভ্যতার সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্য বলে আখ্যায়িত করতে পারি, তাই  বিরাট সাম্রাজ্যের উপযোগী স্থাপত্য নির্মাণের প্রয়োজন তারা অনুভব করেছিল। এই প্রাসাদগুলোর মধ্যে সর্বাপেক্ষা বিরাট ছিল পার্সিপোলিসের প্রাসাদ। যার ধ্বংসাবশেষ আজো আমাদের বিস্ময়ের উদ্রেক করে। পার্সিপোলিসের প্রাসাদের যে দীর্ঘ স্তম্ভগুলো আজো বিদ্যমান রয়েছে সেগুলোর উচ্চতা ছিল ৭০ ফুটের মতো। প্রাসাদের ভিত্তিভূমি-সিঁড়ি, বিভিন্ন দেয়াল, প্রবেশদ্বার এবং উচ্চ কলামগুলো প্রমাণ করে যে, সেকালের শিল্পীরা এমন একটা কিছু করতে চেয়েছিলেন তা দেব-দুর্লভ এবং অনন্যসাধারণ। পার্সিপোলিসের দীর্ঘ কলামগুলোর পাশে মানুষ যদি দাঁড়ায় তাহলে মানুষগুলোকে ক্ষুদ্রাকায় বামনের মতো দেখাবে। এই প্রাসাদ ছিল মানুষের স্বাভাবিক পরিমাপবোধের বাইরে। পৃথিবীর কোন সভ্যতায়ই এত বিরাট এবং বিপুলায়তনের চিহ্ন আমরা খুঁজে পাই না। এই রাজপ্রাসাদটি নির্মাণ করা হয়েছিল পাহাড়ের সানুদেশে এবং সে যুগের স্থপতিরা পাহাড়ের মহিমাময় এবং বলিষ্ঠ ব্যঞ্জনার প্রেক্ষাপটে রাজপ্রাসাদটি নির্মাণ করেছিলেন একটি অপরূপ দৃশ্যমান সঙ্গতিতে। আমরা দেখেছি যে, স্থাপত্যশিল্পে কলাম বা স্তম্ভ প্রাচীনকালে প্রাধান্য পেয়েছিল। এই প্রাধান্যের সূত্রপাত গ্রীকযুগ থেকে। গ্রীক শিল্পীরাই প্রথম মনোরম, বলিষ্ঠ, সুদৃশ্য কলাম নির্মাণ করেছিলেন। একিমিনীয়রা গ্রীকদের কাছ থেকেই এই কলামের ব্যবহার পায়। কিন্তু একিমিনীয়রা এই কলামকে একটি চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যায়। পার্সিপোলিসের যে সমস্ত কক্ষ এবং প্রকোষ্ঠ নির্মিত হয়েছিল সেগুলোকে ধারণ করার জন্য মোট ৫৫০টি কলাম নির্মিত হয়েছিল। এটি এক ধরনের অবিশ্বাস্য অতিরিক্ততা বলা যায়। এত বেশি কলামের শৈল্পিক দিক থেকে কোন প্রকার প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু পারসিকরা এক প্রকার মহিমা সৃষ্টির জন্যই হয়ত এগুলো নির্মাণ করেছিলেন। শৈল্পিক দিক থেকে স্থাপত্য শিল্পে কলামকে একটা মোটিফ বলতে পারি। একটি মোটিফের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে পার্সিপোলিসের স্থপতিরা একটি  অলংকরণের ব্যবস্থা ঘটিয়েছিলেন।পার্সিপোলিসের দেয়ালগাত্রে অথবা অধিরোহণীর পার্শ্বে উৎকীর্ণ মূর্তিগুলো দর্শককে অভিভূত করে। প্রাচীন পারসিকদের ধর্মবিশ্বাসে ন্যায়-অন্যায়ের মধ্যে সংগ্রামটি  সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সৎবুদ্ধি, ন্যায় এবং সৌন্দর্যের প্রতীক হচ্ছে ‘আহুর মাজদা’ এবং পাপ ও অসত্যের প্রতীক হচ্ছে ‘আহরিমান’। বিভিন্ন চিত্রে আহরিমানের পরাজয় এবং বিনাশ দেখানো হয়েছে এবং এর মাধ্যমে বুঝাবার চেষ্টা করা হয়েছে যে, পৃথিবীতে কল্যাণ কর্মে ন্যায়ের জয় হবেই এবং যথার্থ সংগ্রামে অন্যায় এবং পাপ বিমূঢ় হবে এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। একটি চিত্রে দেখানো হয়েছে যে, ড্রাগনকে হত্যা করা হয়েছে। ড্রাগন সেখানে হিংস্রতা এবং ধ্বংসের প্রতীক। পারসিকদের শিল্পে আমরা প্রথম ঘোড়সওয়ারের মূর্তি দেখি। পরবর্তীকালে খ্রিস্টজগতের বিভিন্ন আইকনে ঘোড়সওয়ারের মূর্তি আমরা দেখতে পাই। এটা পারসিকদেরই দান। পাপ এবং পুণ্যের মধ্যে এভাবে ঘোড়সওয়ার মূর্তিকে ব্যবহার করা হয়েছে। ঘোড়সওয়ার বর্শার সাহায্যে বিরোধী শক্তিকে দমন করছে এই দৃশ্য পার্সিপোলিসে দেখা যায়। শিল্পসৌকর্য এবং দক্ষতার বিচারে আক্রমণরত ঘোড়সওয়ারের মূর্তিটি বিশিষ্ট শিল্প কৌশলের প্রমাণ বহন করে। ঘোড়ার গ্রীবাভক্তি এবং অশ্বপৃষ্ঠে অশ্বারোহীর আনত ভঙ্গি দু’টির মধ্য দিয়েই দক্ষ শিল্প কুশলতার পরিচয় পাওয়া যায়।

পারসিকদের ধর্মবিশ্বাসে পাপ এবং পুণ্যের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা এবং বিভেদ চূড়ান্ত পর্যায়ে আনা হয়েছে। এই দুইয়ের মধ্যে চূড়ান্ত বৈপরীত্য বিদ্যমান ছিল। ইংরেজিতে যাকে বলে পোলারিটি, পারসিক ধর্মে পাপ এবং পুণ্যকে দুই বিপরীত মেরুতে অবস্থিত বলে গণ্য করা হতো। আর্যদের দেবতা ছিল আলো। আলোর অধিকার হচ্ছে অন্ধকারকে দূর করা। এই আলোর  অভিষেকের উদ্দেশে পারসিকরা বহু দেবতার কল্পনা করেছিল। অথবা সত্যের রক্ষক হিসাবে জ্বীনদের কথা কল্পনা করেছিল। পার্সিপোলিসের দেয়ালগাত্রে এই সমস্ত দেবতা এবং জ্বীনের মূর্তি উৎকীর্ণ দেখা যায়। এ সমস্ত উৎকীর্ণ মূর্তির বাহুল্য পার্সিপোলিসে স্থাপত্যগত অলংকরণের একটি বৈশিষ্ট্য নির্মাণ করেছিল। সিংহ একটি ষাঁড়কে পরাভূত করছে- এ রকম দৃশ্য পার্সিপোলিসে আছে। এই দৃশ্যের অর্থ হচ্ছে সূর্য দেবতা ‘মিথরা’ অশুভ শক্তিকে পরাজিত করছেন।

একিমিনীয়দের শৈল্পিক নিদর্শনের মধ্যে সমাধি মন্দিরটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সমাধি মন্দিরগুলো তারা একটি সুস্পষ্ট স্থাপত্যগত উচ্চারণে বিমণ্ডিত করেছে। পাসারগাদের অঞ্চলে কাইরুসের সমাধি মন্দির একটি দর্শনীয় স্থাপত্য নিদর্শন। নাসখ-ই-রুস্তমে এবং পার্সিপোলিসে যে সমস্ত সমাধি মন্দির আবিষ্কৃত হয়েছে সেগুলোর কারুকর্ম বিশেষভাবে লক্ষণীয়। নাসখ-ই-রোস্তমে সম্রাট প্রথম দারায়ুসের সমাধি মন্দিরটি পাহাড় খনন করে নির্মাণ করা হয়েছে। সমাধিগাত্রে উৎকীর্ণ কিছু রিলিফ মূর্তি আছে যা সে যুগের শিল্প কুশলতার পরিচয় বহন করে। এ সমস্ত সমাধি মন্দিরে মিশরীয়দের মতো অনেক দামি তৈজসপত্র, মূল্যবান দ্রব্যাদি এবং অলংকার মৃতের সঙ্গে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। এই মন্দিরগুলো অতীতে লুণ্ঠিত হয়েছে বহুবার। মনে হয় পারসিকরা মৃত্যুর পরের একটি জীবনে বিশ্বাস করত। অর্থাৎ তাদের বিশ্বাস ছিল যে, মৃত্যুর পর একটি বিশেষ সময় অতিক্রান্ত হলে মৃত ব্যক্তি পুনর্জাগরিত হবে। এই কারণেই প্রাচীন পারসিকরা বিশ্বাস করত যে, মানুষ যদি জীবিতকালে সৎগুণের চর্চা করে তাহলে পরবর্তী জীবনে তার মূল্য পাবে। এই কারণে পরবর্তী জীবনের অবস্থান এবং সাফল্যকে নির্মাণ করার উদ্দেশ্যে সমাধি মন্দিরগুলোকে মহার্ঘ করে তারা নির্মাণ করত। নাসখ-ই-রুস্তম এবং পার্সিপোলিসের সমাধি মন্দিরগুলো প্রমাণ করে যে, পারসিকরা মনে করত যে, মৃত্যুর পরেও একটা জীবন আছে এবং সে জীবনের জন্য মৃতের সঙ্গে জীবন-যাপনের উপকরণ দিয়ে দেয়া প্রয়োজন। নাসখ-ই-রুস্তমের একটি সমাধিতে দেখা যায় যে, সম্রাট একটু উচ্চস্থানে দণ্ডায়মান রয়েছেন যেন তিনি পৃথিবীতে তাঁর অধিকারের দিকে দৃষ্টিপাত করে  আছেন। আরো মজাদার হলো যে সমস্ত উৎকীর্ণ শিলাচিত্র আমরা পাই তাতে দেখা যায় তাঁর সমগ্র মুখাবয়বের চতুর্দিকে একটা বৃত্তের বেষ্টনী আছে। এই বৃত্তটি অনন্তকালীনতার প্রতীক বহন করছে। মনে হয় প্রাচীন মিশরীয়দের দ্বারা একিমিনীয় পারসিকরা প্রভাবিত হয়েছিল। মিশরেও যেটা ছিল পাখাসংযুক্ত গোলাকার বৃত্ত, একিমিনীয়দের কাছে সেই বৃত্তটাই এসেছিল। কিন্তু পাখা দু’টি আসেনি।

যে যুগের কথা বলেছি সে যুগে পারসিক সাম্রাজ্য ছিল বিপুল বিস্তার এবং  সমৃদ্ধির সাম্রাজ্য। এই বিপুল বিস্তার এবং সমৃদ্ধিকে চিহ্নিত করার জন্য পার্সিপোলিসের দেয়ালগাত্রের বাস-রিলিফ-এ অজস্র মানুষের মূর্তি উৎকীর্ণ আছে। এই মূর্তিগুলো দেখে মনে হয় এগুলো যেন পটভূমির মধ্যে প্রায় প্রোথিতভাবে নির্মিত। এটাকে আমরা উঁচু উৎকীর্ণতা বলতে পারি। সম্রাট জীবিতকালে যে সমারোহের মধ্যে এবং অত্যুজ্জ¦ল দীপ্তির মধ্যে সিংহাসনে বসে রাজকার্য পরিচালনা করতেন শিল্পীরা এ সমস্ত উৎকীর্ণ মূর্তির সাহায্যে তারই একটা পরিচয় দেবার চেষ্টা করেছেন। অ্যাসিরীয়দের উৎকীর্ণ শিল্পচিত্রে আমরা একটি বীভৎসতা এবং নিষ্ঠুরতার পরিচয় পাই। সেখানে সম্রাটকে দেখা যায় ভোজসভায় আহার করছেন এবং তার সামনে শত্রুদের মৃতদেহ পড়ে রয়েছে। পারসিকদের বাস-রিফিল-এ কোন প্রকার বীভৎসতার চিহ্ন নেই। সেখানে দেখা যায় যে, অলংকৃত ফ্রিজগুলোতে রাজার অমাত্যগণ রাজাকে উপঢৌকন দেবার জন্য বহুবিধ সামগ্রী বহন করে নিয়ে চলেছে। এই ফ্রিজগুলোতে টেবলোর যে দৃশ্যগুলো আমরা পাই তাতে দেখা যায় যে, মূর্তিগুলো একে অন্যের হাত ধরে আছে, কেউ যেন ঘাড় ফিরিয়ে পিছনের লোকের সঙ্গে কথা বলছে অথবা কেউ সামনের মানুষের ঘাড়ে হাত রেখেছে। এই দৃশ্যগুলো অপরূপ দক্ষতায় উৎকীর্ণ করা হয়েছে। প্রাচীনকালে এর সমতুল্য উৎকীর্ণ আর কোন সভ্যতার শিল্পসাধনায় আমরা পাই না। ফ্রিজের সব মূর্তি পার্শ্ব-অবস্থানে উৎকীর্ণ। কোন মূর্তির সম্মুখীন অথবা পশ্চাদের চিত্র আমরা পাই না। তবে এ সমস্ত দেয়ালগাত্রে নতুন নতুন দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে।

পারসিকদের অন্য একটি প্রাচীন নগরী হচ্ছে সূসা। সূসা নগরীর অবস্থিতি এমন একটি পটভূমিতে ছিল যেখানে কোন পাথর ছিল না। এর ফলে সেখানকার বাড়িঘর ছিল পোড়ামাটির ইটের এবং উৎকীর্ণ মূর্তিও ছিল পোড়ামাটির। এখানে আমরা রং এর ব্যবহার পাই। রং এর সাহায্যে মূর্তিতে চকচকে ভাব আনা হয়েছে। নানাবিধ রং এর ব্যবহার তারা করেছিল। তাদের উৎকীর্ণ মূর্তিতে আমরা অদ্ভুত আকৃতির নানা ধরনের জীবজন্তুকে পাই এবং তীর নিক্ষেপরত ধনুকধারীকে পাই। তাছাড়া নানা আকৃতির পাখাযুক্ত মূর্তিকে পাই। এ সমস্ত কিছুই যেন স্বপ্নের জগৎ থেকে বাস্তবে রেখাঙ্কিত হয়েছে। উৎকীর্ণ মূর্তিগুলো ছাড়াও সূসায় পূর্ণকায় বিভিন্ন মূর্তিও পাওয়া গিয়েছে, যেমন ব্রোঞ্জনির্মিত সিংহ অথবা স্ফিংক্স? পার্সিপোলিসের মতো সূসাতেও  বহু রাজকীয় প্রহরীর উৎকীর্ণ মূর্তিও আমরা পাই। পার্সিপোলিসে এগেুলো ছিল পাথরের ওপর উৎকীর্ণ। কিন্তু সূসাতে এগুলোকে পাচ্ছি পোড়ামাটির ইটের গায়ে। যে সমস্ত রং আমরা সূসায় পাই, সেগুলো হচ্ছে উজ্জ্বল নীল গিরি মাটির রসুন এবং হলুদ। এগুলো এখনও এত উজ্জ্বল যে, রৌদ্রের আলোতে জ্বলজ্বল করে ওঠে। পরবর্তীকালে পারস্যের ইসফাহানে মসজিদের উজ্জ্বল নীল টালির সঙ্গে প্রাচীন যুগের নীল রং-এর সঙ্গতি পাওয়া যায়। এই নীল রংটি পারসিক স্থাপত্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

প্রাচীন পারসিক সভ্যতার শিল্পসম্ভার আজও আমাদের বিস্ময়ের উদ্রেক করে। মহিমময়তায়, ঔজ্জ্বল্যে, সূক্ষ্ম কারুকার্যে বিবিধ রং-এর বৈশিষ্ট্যময় ব্যবহারে প্রাচীন পারস্যে স্থাপত্য এবং ভাস্কর্য অনন্যসাধারণতার চিহ্ন বহন করছে। প্রাচীন বিভিন্ন সভ্যতার শিল্পচাতুর্যকে নিজস্ব প্রক্রিয়ায় আপন শিল্পসত্তার অঙ্গীভূত করে তাঁরা যে নিদর্শনগুলো রেখে গেছেন, মহাকালের প্রেক্ষাপটে তা চির উজ্জ্বল থাকবে। সুমেরীয় রাজারা ছিলেন দেবতাদের প্রতিনিধি। ব্যাবলনীয় রাজারা ছিলেন সকল বস্তুর অধিকর্তা, কিন্তু প্রাচীন পারস্যে রাজারা ছিলেন রাজাদের রাজা। প্রাচীন পারসিকদের কল্পনায় রাজাকে রাজত্ব করার অধিকার দিয়েছিলেন আহুর মাজদা। যিনি রাজাদের রাজা হতেন তিনি হতেন বিরাট সাম্রাজ্যের অধিপতি, যাঁর থাকত প্রচুর সৈন্য-সামন্ত এবং প্রচুর অশ্ব। রাজার রাজা ছিলেন ন্যায়াধি। তার রাজত্বে অগ্নি ছিল সমস্ত কিছু শুদ্ধিকরণের উজ্জ্বল উপাদান। সর্বাংশে না হলেও সেই প্রাচীন সাম্রাজ্যো ভগ্নাবশেষের মধ্যেই আমরা অভূতপূর্ব মহিমার নিদর্শন পাই।

ইসলামী শিল্পকলা

‘ইরান সর্বদাই চেষ্টা করেছে তার জাতীয় স্বকীয়তা নির্মাণকর্মের মধ্যে প্রস্ফুটিত করতে। এই স্বকীয়তাএসেছে তার অতীত থেকে। যে অতীতের ধর্মীয় চেতনাকে সে অস্বীকার করেছে, কিন্তু তার নির্মাণশিল্পকে গ্রহণ করেছে এবং সম্মান করেছে।’

৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে আরব অশ্বারোহীরা পূর্ণ বিক্রমে সাসানীয় সাম্রাজ্য আক্রমণ করল এবং ইরানের সমগ্র মালভূমি তাদের অধিকারে আনল। এক সময় মহামতি আলেকজান্ডরের হাতে একিমিনীয় সাম্রাজ্য পরাভূত হয়েছিল, তেমনি আরবদের  হাতে সাসানীয় শক্তি নিশ্চিহ্ন হলো। দেশের দখল বিদেশীদের হাতে চলে গেল, কিন্তু তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে ধ্বংস হতে দিল না। ইসলাম ধর্ম তারা গ্রহণ করল। কিন্তু আরবদের ভাষাকে গ্রহণ করল না, তারা ফারসি ভাষাকেই তাদের জীবনে প্রচলিত রাখল।

ইসলামের বিজয়ের প্রাথমিক দিকে আরবরা ইরানে মসজিদ শিল্পের প্রতিষ্ঠা ঘটায়। উমাইয়াদের সময় যে ধরনের মসজিদ তৈরি হতো অবিকল সেই ধরনের মসজিদ ইরানে তৈরি হতে লাগল। উমাইয়া মসজিদের বিশেষত্ব ছিল যে, সেখানে একটি বিরাট অঙ্গনের চতুর্দিকে পোর্টিকোর ব্যবস্থা ছিল এবং নামাজের জন্য একটি আবরিত কক্ষের ব্যবস্থা ছিল। নবম শতকে আব্বাসী আমলে যে সমস্ত মসজিদ তৈরি হয়েছিল, সেগুলো সবই এ ধরনের ছিল। প্রথম প্রথম ইরানের দামগানে এবং নাঈনে এ ধরনের মসজিদ তৈরি হয়েছিল, কিন্তু অতি অল্প সময়ের মধ্যে তারা নিজস্ব পদ্ধতিতে মসজিদ নির্মাণের সূত্রপাত ঘটাতে লাগল। ইরান তার অতীতের স্থাপত্যের নিদর্শন থেকে অনেক উপমা এবং ভাষা গ্রহণ করল। স্থাপত্যের ভাষায় যাকে ‘কীয়স্ক’ বলে প্রাচীন অগ্নিপূজার বেদীর থেকে তার নির্মাণকৌশল গ্রহণ করল এবং সাসানীয় যুগের অর্ডিয়েন্স হলকে ইসলামের প্রয়োজনে রূপান্তরিত করল। এই সংযোগটি রাজপ্রাসাদ-মসজিদ এবং মাদ্রাসার মধ্যে একটি সেতু-বন্ধন নির্মাণ করল। ইরানীয় রাজপ্রাসাদের এবং পরবর্তীকালে মাদ্রাসার মাঝখানে একটি চতুষ্কৌণিক কোড থাকত যার চতুর্দিকের অভ্যন্তরীণ দেয়ালে আইভান বা অর্ডিয়েন্স হলগুলো থাকত। একে অনেকটা ক্রুশাকার বা ‘ক্রুশিফর্ম প্ল্যান’ বলা হয়ে থাকে। ইরানীয়রা অতীতের পদ্ধতিতে একটি নতুন মাত্রা যোগ করতে সমর্থ হয়। মসজিদের মধ্যে কেবলা নির্দিষ্ট হয় এবং একটি ‘নিশ’ এর আকারে মেহরাব সংযুক্ত হয়। এক প্রকার বক্র খিলানের মধ্যে মেহরাব প্রতিষ্ঠিত হয়। ইরানীয় মসজিদ-স্থাপত্যে ভোল্ট এর ব্যবহার অনন্যসাধারণ। অনেক প্রকার খিলানের পারস্পরিক সংযোগে বিরাট খিলানের ভোল্ট-এর সৃষ্টি তারা করেছিল।

ইরান সর্বদাই চেষ্টা করেছে তার জাতীয় স্বকীয়তা নির্মাণকর্মের মধ্যে প্রস্ফুটিত করতে। এই স্বকীয়তা এসেছে তার অতীত থেকে। যে অতীতের ধর্মীয় চেতনাকে যে অস্বীকার করেছে, কিন্তু তার নির্মাণশিল্পকে গ্রহণ করেছে এবং সম্মান করেছে। অতীতের এই নির্মাণশৈলীর বৈশিষ্ট্য ছিল তার অগ্নিপূজার বেদীভূমির কৌশলগত নির্মাণ, সাসানীয় সাম্রাজ্যের অর্ডিয়েন্স হল এবং গম্বুজ শিল্প। ইরান ইসলামী শিল্পকলার ক্ষেত্রে নতুন ভঙ্গিতে এবং নতুন ভাষায় প্রাচীনকালের নির্মাণ পদ্ধতিকে গ্রহণ করেছে। আমরা লক্ষ্য করি যে, ইসলামী স্থাপত্যের ক্ষেত্রে ইরান গম্বুজকে নানাভাবে ব্যবহার করেছে এবং বহু খিলানের সমন্বিতরূপে ভোল্টের ব্যবহারকে প্রবল করেছে। ইরানকে অন্য কোন দেশ থেকে গম্বুজের কলাকৌশল গ্রহণ করতে হয়নি। ইটের তৈরি গম্বুজ ইরানে পূর্বেও ছিল, এমনকি বাসগৃহেও ছিল। ইতিহাস বলে, প্রার্থীয় এবং সাসানীয় সাম্রাজ্যের সময় গম্বুজের ব্যবহার নানাভাবে বিস্তৃত হয়। রাজপ্রাসাদ এবং মন্দিরের চূড়ায় গম্বুজের ব্যবহার ছিল। ইসলামের আগমনের পর ইরানের মুসলমান স্থপতিরা গম্বুজ এবং ভোল্টের ব্যবহার নতুনভাবে বিশুদ্ধ করেছে এবং এসব ক্ষেত্রে অসাধারণ উৎকর্ষ লাভ করেছে। পূর্বেকার গম্বুজগুলো চতুষ্কৌণিক ভিত্তির ওপর নির্মিত হতো। ইসলামের আগমনের পরে এই চতুষ্কৌণিক ভিত্তি বৃত্তাকারে পরিবর্তিত হয়। এই পরিবর্তন সাধনের ফলে গম্বুজের যেমন দৃশ্যগত পরিবর্তন সাধিত হয়, তেমনি নির্মাণগত পরিবর্তন সাধিত হয়। ইরানের শিল্পীরা জ্যামিতিক সূক্ষ্ম বিচারের সাহায্যে তাদের গম্বুজ, খিলান এবং ভোল্টের উৎকর্ষ সাধন করেছিলেন। আমরা জানি, তাঁরা জ্যামিতিক কৌশলে বৃত্ত, অর্ধ বৃত্ত, চতুষ্কোণ এবং বহুবিধ কৌণিক ব্যঞ্জনা অট্টালিকার নির্মিতির মধ্যে অসাধারণ বৈচিত্র্য সম্পাদন করেন। প্রাচীন গ্রীকরাও জ্যামিতিকে গ্রহণ করেছিল, কিন্তু তারা জ্যামিতির সাহায্যে বৈচিত্র্য সৃষ্টিতে সক্ষম হয়নি। তারা ত্রিভুজের ব্যবহার করেছে এবং লম্ব রেখার ব্যবহার করেছে। ইরানের মুসলমান শিল্পীরা এ দু’টি ব্যবহারে সন্তুষ্ট থাকেননি। তাঁরা সমান্তরাল রেখা, লম্বরেখা, বৃত্ত, অর্ধবৃত্ত, বক্ররেখা এবং নানাবিধ আকৃতি নিয়ে বিস্ময়কর পরীক্ষা করেছেন। এসব পরীক্ষার ফলস্বরূপ যে শিল্পস্বভাবের পরিস্ফুটন দেখি তা অতুলনীয়।

এভাবে ডোম এবং ভোল্ট নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজিতে যাকে বলে ‘পেনডেনটিভ’ এবং ‘স্ট্যালাকটাইট’- সেই সমস্ত সূক্ষ্ম কারুকার্যের সম্মোহনী বিন্যাস ঘটিয়ে ইরান যে অসাধারণ শিল্প চাতুর্যের নিদর্শন সৃষ্টি করেছে তা আজও পরিশীলিত স্থপতি-বিজ্ঞানীদের কাছে অসাধারণ নির্মাণ-কৃতি হিসাবে পরিগণিত হয়। প্রাচীন গুহায় ছাদ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়ে শুকিয়ে যেভাবে ঝুলন্ত দণ্ডের সৃষ্টি হয় তাকেই ‘স্ট্যালাকটাইট’ বলা হয়। ইরান তার মসজিদ এবং অন্যান্য ভবন নির্মাণ কাজের মধ্যে নানা রকম ‘স্ট্যালাকটাইট’ সৃষ্টি করেছিল। তাছাড়া মৌমাছির মধুচক্র বা চাকের মতো ছিদ্রবহুল ছোট ছোট খোপের সাহায্যে অদ্ভুত সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছিল। এগুলো ছিল নিছক সৌন্দর্যের জন্য, ব্যবহারের প্রয়োজনে নয়।

ইরানের ইসলামী শিল্পকে যদি আমাদের পরীক্ষা করতে হয়, তাহলে ইসফাহান শহরের দিকে আমাদের দৃষ্টিপাত করতে হবে। ইসফাহান শহরটি একটি পরিকল্পিত শহর ছিল এবং এ শহরের মসজিদ পরিকল্পনাকে কেন্দ্র করে নগরের চতুর্দিকে বিস্তৃতি ঘটেছিল। একাদশ শতক থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত ইসফাহান নগরের স্থাপত্যগত বিকাশ ঘটে। সেলজুকদের আমলে এবং সাফাভীদের আমলে ইসফাহান ছিল ইরানের রাজধানী। ইসফাহানের প্রধান মসজিদই হচ্ছে ‘মসজিদ-ই-জামি’। সেলজুকদের আমলে এই মসজিদটি নির্মিত হয়। মালিক যখন সম্রাট, তখন ১০৭৩ থেকে ১০৯২ সালের মধ্যে এই মসজিদটি নির্মিত হয়। যথার্থ ইরানীয় পদ্ধতিতে এই মসজিদটি নির্মিত হয়। সাফাভীদের আমলে ১৫৫৮ খ্রিস্টাব্দে ইসফাহান যখন পুনরায় ইরানের রাজধানীতে পরিণত হয় তখন সম্রাট শাহ আব্বাস ইসফাহানকে স্থাপত্যকলার দিক থেকে নতুন করে পুনর্গঠিত করেন। তিনি ‘মায়দান-ই-শাহ’ নামক একটি বিরাট রাজকীয় কমপ্লেক্স নির্মাণ করেন। উক্ত কমপ্লেক্সে চল্লিশটি কলাম বা পিলারের ওপর একটি প্রাসাদ নির্মিত হয় এবং ‘আলী কাপু’ নামক অন্য একটি প্রাসাদ ময়দানের নিকটে নির্মিত হয়। এই কমপ্লেক্সে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ছিল শেখ লুৎফুতউল্লাহ মসজিদ। অন্য একটি মসজিদ ছিল যাকে ‘শাহের মসজিদ’ বলা হতো। এই ‘শাহের মসজিদ’ হচ্ছে ইরানের একটি অনন্যসাধারণ স্থাপত্য কীর্তি। এই মসজিদের মধ্যে একটি চতুষ্কৌণিক আয়তক্ষেত্র ছিল যার চারপাশে ভোল্ট আকৃতির ৪টি মেহরাবের মতো নির্মিতি ছিল। এই নির্মিতিগুলো অত্যন্ত সূক্ষ্ম কারুকার্যমণ্ডিত। মসজিদ এলাকার অভ্যন্তরে মাদ্রাসার জন্য দু’টি স্থান নির্দিষ্ট ছিল। শিল্পকলার দক্ষ এবং কৌশলগত অভিনিবেশ এই মসজিদকে শুধু ইরানের কেন, সমগ্র বিশ্বের একটি অলোকসামান্য কীর্তি হিসাবে গণ্য করা যায়। ময়দানে শাহের অভ্যন্তরে মসজিদ-ই-শাহ একটি অনন্যসাধারণ স্থাপত্য কীর্তি। ১৬১৩ খ্রিস্টাব্দে এই মসজিদের নির্মাণ কাজ আরম্ভ হয় ইরানের নিজস্ব স্থাপত্য ভাষায়। মাঝখানে একটি আয়ত ক্ষেত্র যাকে ইংরেজিতে ‘কোর্ট’ বলে এবং চারপাশে ‘পোর্টিকো’। পোর্টিকোগুলোর ভারসাম্য রক্ষা করা হয়েছে ৪টি আইভানের দ্বারা। এই পদ্ধতিটা ইরানের নিজস্ব পদ্ধতি। এই পদ্ধতিটি বহাল রেখে বহুবিধ কারুকার্য সম্পাদন করা হয়েছে। এসব কারুকার্যের দ্বারা বুঝা যায় যে, সাফাভীরা স্থাপত্যে অলংকরণের ক্ষেত্রে সকল কুশল প্রয়োগ করেছিল। এই মসজিদের সমগ্র নির্মাণকর্মটি এমনভাবে সম্পূর্ণ করা হয়েছে যাতে একটা পরিপূর্ণ সামঞ্জস্য অনুভব করা যায়। নির্মিতিটি সকল দিক থেকেই সমভাবে এবং সুসমঞ্জস পূর্ব ও পশ্চিম দিকের দুই আইভান অবিকল এক রকম এবং প্রতিটি আইভান দিয়ে অগ্রসর হয়ে আমরা একটি  করে গম্বুজের ছাদবিশিষ্ট একটি করে কক্ষ পাই। দক্ষিণ দিকের আইভানটি অন্য দু’টি আইভানের চেয়ে বড় এবং এই আইভান দিয়ে আমরা উপাসনা-গৃহের পবিত্রতম অংশে প্রবেশ করি। এই অংশেই মেহরাব অবস্থিত এবং এই অংশের গম্বুজটি তার বেইজ থেকে ক্রমশ প্রসারিত হয়ে ওপরে মিলিত হয়েছে কিছুটা ঘোড়ার খুরের নালের মতো। উপাসনা কক্ষের দু’টি উন্মুক্ত কক্ষ রয়েছে। প্রধান আইভানের দু’পাশে দু’টি মিনার উঠে গেছে। সামগ্রিকভাবে নির্মাণ কৌশলের দিক থেকে এ মসজিদটি একটি সমগ্রতা, একটি সম্পন্নতা, ভারসাম্য এবং দক্ষ বিভাজনে একটি অপূর্ব মহত্ত্বব্যঞ্জক সৃষ্টি। এই মসজিদের ভিতরকার মিনা করা কারুকার্যগুলো আলোকসম্পাতে অসাধারণ দীপ্তিমান হয়ে দেখা দেয়। মিনা কারুকার্যের মধ্যে উজ্জ্বল নীল, ফিরোজা এবং হলুদের ব্যবহার খুবই সুন্দর। লতানো কারুকার্যগুলো বিচিত্র শোভার সৃষ্টি করেছে। গম্বুজের বেষ্টনীতে ‘কুফী’ হরফে কুরআন শরীফের আয়াত লিখিত হয়েছে। মসজিদের মূল গম্বুজের ওপরের বেষ্টনীতে নীল, হলুদ লতাপাতাগুলো পরস্পর সংলগ্ন হয়ে একটি চমৎকার দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে। গম্বুজের মধ্যভাগের সামগ্রিক বেষ্টনীতে নীলের ওপর সাদা ব্যবহার করে কুরআন শরীফের আয়াত খচিত আছে। গম্বুজের সর্বনিম্নভাগ কয়েকটা খণ্ড খণ্ড অংশে বিভক্ত করে আল্লাহর বিভিন্ন নামে অলংকরণ নির্মাণ করা হয়েছে। গম্বুজের বহির্বিভাগটি যেমন সুন্দর, অভ্যন্তরীণ কারুকার্যও তেমনি সুন্দর। অভ্যন্তরভাগে একবারে ওপরের ছাদে চক্রাকারে একটি ফুলের পুনরাবৃত্তি তৈরি করা হয়েছে এবং তার নিম্নে মৌমাছির ঝুলন্ত কারুকার্য আমাদের অভিভূত করে। ইটের সাহায্যে অসাধারণ অভিনিবেশের সাহায্যে মৌচাক সদৃশ আকৃতিগুলো বিন্যস্ত করা হয়েছে।

এই মসজিদের ভোল্টগুলো অনেকগুলো খিলানের সাহায্যে এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে যাতে মনে হয় যে, একটি আটমুখী তারা ভোল্টের ৮টি দিকে তার আলো ছড়িয়েছে। ভোল্টের জ্যামিতিক বিন্যাস এবং বিস্তার নিয়ে আমি এখানে আলোচনা করব না। শুধু এ কথা বললেই যথেষ্ট হবে যে, এই ভোল্টগুলো একই সঙ্গে স্থাপত্যগত দক্ষতা এবং শিল্পগত মনোজ্ঞ বিন্যাসের পরিণতি। যেভাবে খিলানগুলো পরস্পরের সংলগ্ন হয়ে একটি আচ্ছাদন নির্মাণ করেছে তাতে একই সঙ্গে ভারসাম্য এবং দক্ষ নির্মিতি-কৌশলের পরিচয় দেয়। ভোল্টের অভ্যন্তরে আলোর বিকিরণের ব্যবস্থাও বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। আইভানের শেষের দিকে যে অর্ধ গম্বুজের ভোল্টিং রয়েছে তা পারস্যের স্থপতিদের সুচারু দক্ষতার পরিচয় দেয়। একটি গম্বুজকে মাঝখানে কেটে দু’খ- করলে যে অর্ধবলয় নির্মিত হয় সে আইভানটি এমনভাবে গঠিত যে, দর্শকের জন্য তা বিস্ময়-বিমূঢ়তার সৃষ্টি করে। এই অর্ধগম্বুজ নির্মাণের ক্ষেত্রে পারস্যের স্থপতিরা বহুবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন এবং এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে তাদের সামনে অজস্ত্র বিকল্প ছিল- এই প্রমাণ আমরা পাই নানাবিধ আইভানের মধ্যে। আইভানগুলো সবই এক রকমের নয়।

শাহ আব্বাস যে সমস্ত স্থপতি নিযুক্ত করেছিলেন, এক কথায় তাদের বলা যায় ‘মাস্টার বিল্ডার্স’, সাধারণ ভাষায় অসাধারণ দক্ষ নির্মাণকারী। নির্মাণের ক্ষেত্রে যে সমস্ত জটিল সমস্যার সম্মুখীন তাঁরা হয়েছিলেন সেগুলোর সমাধান তাঁরা করেছিলেন বিচিত্রভাবে। এ সমস্ত নির্মাণগত সমস্যা ছিল অত্যন্ত জটিল। তাঁরা এই সমস্ত জটিল সমস্যার সমাধান করে নির্মাণগত ‘ভার্চুয়াসিটি’ অর্থাৎ আঙ্গিকগত দক্ষতার যে পরিচিতি দিয়েছেন তা আজকের বৈজ্ঞানিক যুগের নির্মাতাদের কাছেও অভূতপূর্ব মনে হয়। খিলানের সভঙ্গ আকৃতিগুলো যে জটিল যুক্তি বিচারে একে অন্যের সঙ্গে সমন্বিত হয়ে ওপরের ছাদ নির্মাণ করেছে তা অসাধারণ তাৎপর্যপূর্ণ।

গম্বুজ আকৃতির নির্মিতি আমরা অনেক দেখেছি বাইজানটাইন শিল্পে। গম্বুজের আকৃতি অসাধারণ শোভনতা এককালে প্রকাশিত হয়েছিল আমরা জানি। ওসমানীয় তুর্কীরা বাইজানটাইন শিল্প প্রকৃতি অবলম্বন করে গম্বুজধারী বহু মসজিদ নির্মাণ করে গেছেন। সে সমস্ত গম্বুজ নির্মাণগত দিক থেকে অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় বহন করে। ইরানের গম্বুজ কিন্তু কোনক্রমেই তুর্কী গম্বুজের দ্বারা প্রভাবিত নয়। বহুকাল ধরে ইরানের মানুষ তাদের বাসগৃহে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের জন্য একপ্রকার গম্বুজ ব্যবহার করে এসেছে। সুতরাং গম্বুজটা ইরানের নিজস্ব ভার্নকুলার বা শিল্পভাষার অন্তর্গত। ইরান নিজস্ব ঐতিহ্য থেকেই গম্বুজের ধারণা পেয়েছে এবং তাদের মসজিদে সেই গম্বুজ তারা ব্যবহার করেছে। দৃশ্যত বাইজানটাইন গম্বুজ এবং ইরানী গম্বুজের মধ্যে পার্থক্য আছে। নির্মাণ পদ্ধতিতে এদের উভয়ের জটিলতা ব্যাখ্যা না করে বলা যায় যে, এই দুই গম্বুজ রীতিগতভাবে ভিন্ন প্রকৃতির।

ইরানে মসজিদের অলংকরণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন মিনার কাজ অত্যন্ত সুন্দর। এই  মিনার কাজের সাহায্যে যে সমস্ত আকৃতি গঠিত হয়েছে সেগুলো উজ্জ্বল চাকচিক্যে অসাধারণ কুশলতার পরিচয় বহন করে। পাকা ইটের ওপর মিনার কাজ করা হয়েছিল। সেলজুক যুগে রং এর ব্যবহার তেমন প্রবল ছিল না। কিন্তু আব্বাস তাঁর শিল্প সচেতনতার সাহায্যে অট্টালিকায় মিনার চাকচিক্যের বৈচিত্র্যে আনলেন। আইভানের খিলানগুলো এবং গম্বুজগুলো নানা রং-এর মোজাইকে তিনি অলংকৃত করলেন ঘন নীল, ওকার বা হালকা হলুদ এবং হলুদ। এই রং এর কাজগুলোর ওপর কালো এবং সাদা রং-এর আরবি অক্ষরগুলো লেখা হয়েছিল। ‘পলিক্রম’ বা বহুবর্ণের ব্যবহার সাফাভী আমলে মসজিদগুলোতে এত সম্পন্ন এবং সম্পূর্ণভাবে করা হয়েছে যে, মসজিদের দেয়াল, মেঝে, গম্বুজের অভ্যন্তর, আইভানের অভ্যন্তর এবং পোর্টিকোতে কোথাও রংবিহীন খালি জায়গা নেই। এক্ষেত্রেও বাইজানটাইন এবং রোমের মোজাইক থেকে তা ভিন্নতর। রোম এবং বাইজানটাইনে রং-এর ব্যবহার ছিল অসম্ভব সীমাবদ্ধ, কিন্তু সাফাভীদের রং-এর ব্যবহার এত সমগ্র এবং সম্পূর্ণ যে, দর্শকের মনে এক প্রকার মোহগ্রস্ততা এবং তন্ময়তা সৃষ্টি করে। সাফাভীদের আমলে তৈরি ইসফাহানের ইটের অট্টালিকাগুলো সামগ্রিকভাবে বহুবর্ণের পরিমার্জনীয় উজ্জ্বল। পৃথিবীতে কোন যুগে কোন দেশে স্থাপত্যকর্মের ইতিহাসে পলিক্রমের এমন সামগ্রিক ব্যবহার আর নেই। স্থাপত্যের  নিদর্শনের দিক থেকে ইসফাহান লালিত্যে, মাধুর্যে এবং মহার্ঘতায় একটি চিরকালীনতার স্বাক্ষর রেখেছে যা অতুলনীয় এবং অনন্যসাধারণ।

ইসফাহানের এই গৌরব দীর্ঘকাল পর্যন্ত ছিল এবং এখনও আছে। এখন ইসফাহান বিখ্যাত তার কার্পেট শিল্পে, হস্তশিল্পে এবং ছাপ-চিত্রে। ইসফাহানের এই সমস্ত ছাপ-চিত্রশিল্পীকে ‘কলমকর’ বলা হয়। এই ‘কলমকরগণ’ তাঁদের সুনিপুণ হস্তশিল্পের কারুকার্যে বিশ্ববিখ্যাত। সেজন্যই সৌন্দর্য-পিপাসু শিল্প-রসিকরা ইসফাহানেরকে ‘অর্ধ পৃথিবী’ বলে থাকেন। ইসফাহানের অট্টালিকায় রৌপ্যধাতুর অভ্যন্তরীণ সজ্জায় প্রস্তরগুলো বিভূষিত এবং বিচিত্রিত হয়েছে।

পারস্য শিল্প বিশেষ করে স্থাপত্য শিল্প আজও তার প্রাচীন ঐতিহ্য বজায় রেখেছে। আধুনিক সময়ের একটি দাবি হচ্ছে, নির্মিত গৃহকে বাসযোগ্য করা অর্থাৎ প্রয়োজন সিদ্ধতাই বর্তমানে স্থাপত্য শিল্পে আদর্শ। এর ফলে আধুনিককালে সকল দেশেই একটা চেষ্টা চলছে। বর্তমানকালের ব্যবহারিক জীবন এবং দ্রুতগতি সময়ক্ষেপণের সঙ্গে সমন্বিত করা। কিন্তু ইরানই একমাত্র দেশ যে তার ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করছে এবং আধুনিককালেও তার প্রবাহকে বিদ্যমান রাখছে। দু’টি ক্ষেত্রে ইরান তার প্রাচীন সংস্কার এবং কৌশলকে পূর্ণ মর্যাদায় সংরক্ষিত রাখছে। এ দু’টি ক্ষেত্র হচ্ছে সমাধি মন্দির এবং মসজিদ। আচ্ছাদিত গম্বুজধারী অলংকৃত সমাধি-মন্দির আজও ইরানে তৈরি হচ্ছে। ইমাম খোমেইনীর মুসলিয়ামটি এর একটি প্রকৃষ্ট নিদর্শন। তবে অতীতের মতো সম্ভ্রান্ত এবং মহার্ঘ বিপুলায়তনে মসজিদ নির্মাণ এখন আর হচ্ছে না। সেটা আর সম্ভবপর নয়। মসজিদের নির্মাণ কৌশলের মধ্যে একটি সহজতা এসেছে এবং ‘মিনার’ কাজ থাকলেও তা ব্যাপক নয়। তবে ইরান তার সকল পুরানো মসজিদ এবং মুসলিয়ামগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে যাচ্ছে এবং লক্ষ্য করে যাচ্ছে যাতে তাদের পুরানো সৃষ্টির গৌরব এবং ঔজ্জ্বল্যের অবক্ষয় না ঘটে।

ফিলিস্তিন- কবিতা

আমিন ইবনে করিম

ফিলিস্তিন! হে ফিলিস্তিন!

সবর কর আসবে সুদিন।

আসবে ফিরে স্বপ্ন ঘিরে

তোমার নীড়ে লাল আবিরে,

একটি যুবক মুক্ত স্বাধীন

ফিলিস্তিন! হে ফিলিস্তিন!

 

ফিলিস্তিন! হে ফিলিস্তিন!

সবর কর আর ক’টা দিন।

যায়নবাদের ধারক যারা

ডাকাত তারা দেশ লুটেরা,

ফুরিয়ে যাবে ওদের দিন

ওই দেখ ওই আসছে নবীন।

 

ফিলিস্তিন! হে ফিলিস্তিন!

সবর কর আর ক’টা দিন।

এক জামাতে সকল মুমিন

এক সাথে হাত রাখবে যেদিন।

শাহাদাতের নেশায় পাগল

খালিদ তারিক মুসার বেশে,

আসবে ছুটে ভাঙতে আগল

ফৌজে খোদা মরুর দেশে।

স্বাধীনতা আসবে ওদিন

রইবে না আর ওদের অধীন,

আসবে ফিরে আসবে সুদিন,

ফিলিস্তিন! হে ফিলিস্তিন!

সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ

এরভিন চ্যারগাফ

 (এরভিন চ্যারগাফ একজন আধুনিক জার্মান দার্শনিক। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন। সাধারণত জার্মান ভাষাতেই তিনি লিখেন। কিন্তু ইংরেজি ভাষাতেও তাঁর চর্চা বেশ প্রশংসিত। চ্যারগাফ ইংরেজি ভাষায় ‘সিরিয়াস ম্যাটারস’ (Serious Matters) নামক একটি প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশ করেন। এই বইয়েরই একটি রচনার সার সংক্ষেপ আমরা এখানে তুলে ধরলাম)।

কিছুদিন আগে ফরাসি সংস্কৃতি মন্ত্রীর একটি বক্তৃতা পড়েছিলাম। সেখানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ‘সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ’ এর জন্য অভিযুক্ত করেছেন। আমি জানি না, এই ধরনের কোন কিছুর অস্তিত্ব আছে কি নেই। তবে গ্রেশামস’ ল (Gresham’s Law)-এর কথা আমি জানি। গ্রেশামের আইন মতে কালো টাকা বাজারে এসে সাদা টাকাকে অচল করে দেবে। এটা একটি সত্য যে, মানুষ আর ঘোড়ার মধ্যে তফাৎ রয়েছে, আগেকার মানব প্রজ্ঞা বর্তমান আমি’র চেয়ে অনেক বেশি অভিজ্ঞ ছিল। তা থেকে আমার উপলব্ধি হয়েছে, মানুষ ঘোড়াকে পানির কাছে নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু জোর করে পানি খাওয়াতে পারে না। কিন্তু আমার স্থির বিশ্বাস, মানুষের বেলায় এই দু’টি কাজই সম্ভব। আমাদের রয়েছে প্রচার-প্রপাগান্ডার প্রভূত হাতিয়ার এবং উত্তেজনাকর বিবিধ শিল্পকলা। মিষ্টি-মধুর গানবাদ্য ছাড়াও এ ক্ষেত্রে যদি পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করা হয়, তাহলে মানুষকে মূত্রপান করতেও বাধ্য করা যেতে পারে। এটা কিভাবে সম্ভব? অর্থাৎ যদি দুই বা একজন চলচ্চিত্র তারকা মঞ্চে দাঁড়িয়ে এ কাজটির (মূত্রপান) ভান করে, তাহলেই লোকেরা তা করবে। তবে আমার মনে হয় না, এই ধরনের ব্যবসায়িক ফন্দি-ফিকিরে কেউ টাকা কামাতে পারবে। তাই যদি হতো তাহলে এতদিন আমরা একটি ‘আমেরিকান মূত্র কোম্পানির’ American Urine Company-A.U.C মুখ দেখতে পেতাম।

লর্ড রোজবেরী (১৮৯৯) একবার মন্তব্য করেছিলেন, ‘যৌক্তিক সাম্রাজ্যবাদ বৃহত্তর ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদে রূপ লাভ করে।’

‘যৌক্তিক’ বা ‘বিজ্ঞতাপূর্ণ’ এমন একটি বিষয়, যা নিকৃষ্টতম বর্বরতার বেলায়ও প্রযোজ্য হতে পারে।

উপনিবেশিত জনগণের প্রতি উপনিবেশবাদী প্রভুরা পশুর ন্যায় আচরণ করত। কারণ, ব্রিটিশ জাতীয়তাবাদ এবং ‘বিজ্ঞতা’র অভাবে এসব স্থানীয় লোক দুর্ব্যবহার পাওয়ারই যোগ্য ছিল। তাই প্রভুদের মতে উপনিবেশিত জনগণকে ফায়ারিং স্কোয়াডে নিয়ে যাওয়াতে অন্যায় কিছু হয় না।

সাম্রাজ্যবাদই শুধু নয়, প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার আরো একটি শব্দ তাদের রয়েছে। তা হলো মোড়লিপনা বা hegemony;  ইদানীংকালে চীন দেশে এর বেশ ব্যবহার দেখা যায়। যাদের সাথে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের ভালো সম্পর্ক নেই তাদেরকে চীন এই বিশেষণে আখ্যায়িত করে থাকে।

সাম্রাজ্যবাদ বা আধিপত্যবাদের ওপর ব্যাপক রচনা সম্ভার রয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে লেনিন এবং অটো বাভের (Ott Baver) এর মতো কম্যুনিস্ট চিন্তানায়করা আধিপত্যবাদকে পুঁজিবাদেরই অস্ত্রসজ্জিত একটি শাখা হিসাবে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। সমাজতন্ত্রীদের ক্ষমতা লাভের পর আধিপত্যবাদের এই কঠোর সংস্থার রূপ পাল্টে যায়। আমি মনে করি, মানুষ যখন কোন কিছু করতে অক্ষম বোধ করে তখন মান-মর্যাদার দিকেই ফিরে তাকায়। মানুষের মধ্যে একদল আছে যারা সাম্রাজ্যবাদী কার্যকলাপেই লিপ্ত থাকে। আর একটি দল সেই কার্যকলাপকে লেখনির মাধ্যমে তুলে ধরে। এভাবে ইতিহাসে শিক্ষণীয় বিষয়গুলো পাওয়া যায়। কিছুকাল আগের ফকল্যান্ড দ্বীপমালার ঘটনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, প্রাক্তন রাজতন্ত্রের মিথ্যা স্বপ্নগরিমা ধীরে ধীরে বিস্মৃতির গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে। এই ঘটনা কার্ল মার্কস এর সেই উক্তিরও সত্যতা বিধান করে যখন কার্ল মার্কস বলেছিলেন : ‘হেগেল বলেছেন, ‘সকল ঐতিহাসিক ঘটনার দ্বিতীয়বার পুনরাবৃত্তি ঘটে’। কিন্তু তিনি এটা বলতে ভুলে গেছেন যে, এ সকল ঘটনা একবার বিয়োগান্ত রূপ লাভ করে এবং তারপর হাস্যকর রূপে পর্যবসিত হয়।’

অবস্থার যখন পরিবর্তন ঘটে এবং প্রচলিত কোন শব্দ যখন উপযুক্ততা হারিয়েছে বলে আমরা মনে করি তখন সেই শব্দের প্রারম্ভে সাধারণত আমরা একটি উপসর্গ জুড়ে দেই, যেমন ‘নতুন’ বা ‘পরবর্তী’ ইত্যাদি। আধিপত্যবাদের এ রকম এক নতুন রূপ হলো নয়া উপনিবেশবাদ (New Colonialism)। এর আভিধানিক অর্থ খুঁজলে পাওয়া যায়, অন্য দেশ ও জনগণের ওপর পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে বৃহৎ শক্তিগুলোর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পদ্ধতি।

এই সূত্রে আমেরিকার সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের উদ্দেশ্যে হলো অন্য দেশে পরোক্ষভাবে তার সংস্কৃতির চালান দেয়া। তবে এই ‘সংস্কৃতি’ শব্দটার অর্থ কী তা আমাদের জানা উচিত। Raymond Williams এর বিশ্ববিখ্যাত আভিধানিক গ্রন্থ KEY WORDS-এ বলা হয়েছে ইংরেজি ভাষায় ‘Culture’ অর্থাৎ সংস্কৃতি শব্দটার ব্যাখ্যা করা খুবই জটিল। এই সংস্কৃতির আওতায় অনেক বিষয়ই আসতে পারে, যেমন সাহিত্য, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, সংগীত, নাটক, সিনেমা ইত্যাদি। কিন্তু আমাদের যুগে এই সংখ্যাকেও খুব সংক্ষিপ্ত মনে হয়। আমার মতে উচ্চতর শিক্ষা, অধ্যয়ন, গবেষণা প্রভৃতিও সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। তা ছাড়া জাতীয় ভাষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়াও সংস্কৃতির অঙ্গ। শিশুসন্তান এবং গাছপালার যে রকম যত্ন নেয়া হয় তেমনি ভাষারও যত্ন নেয়া উচিত। তবে সংস্কৃতির সংজ্ঞায়িতকরণে আমি অবশ্যই গণমাধ্যম ও অন্যান্য ভাবপ্রবণতা জাগানো উপাদানকে বাদ দেব। কারণ, এগুলো জনমতকে বিকৃত ও বিভ্রান্ত করায় ওস্তাদ। চিত্তবিনোদন শিল্পগুলোকেও আমি সাংস্কৃতিক অভিধায় আখ্যায়িত করতে চাই না।

রফতানি করতে হলে রফতানি করার মতো কিছু আপনার থাকতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের আদৌ কি তেমন কোন সংস্কৃতি রয়েছে যা সে অন্যদের ওপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে চাপাতে পারে? আমি বলব, নেই। বস্তুসামগ্রীর উৎকৃষ্ট মানের কারণে রফতানি করা হয়, তা ভাবা হাস্যকর হবে। সাম্রাজ্যবাদীরা প্রায়ই কোন গুণাগুণ বিচার ছাড়াই তাদের দ্রব্যসামগ্রী রফতানি করে থাকে। তবে তাদের মারণাস্ত্রগুলো বেশ উন্নতমানের হয়।

ফরাসি সংস্কৃতি মন্ত্রী যদি প্যারিস নগরীর দেয়ালগুলোর দিকে লক্ষ্য করেন, তাহলে কী দেখতে পাবেন? যদি কান পেতে দেন, তাহলে কী শুনতে পাবেন? তিনি দেখতে পাবেন আমেরিকান ধাঁচের ড্রাগ স্টোর, তিনি দেখতে পাবেন প্যারিসের যুবকেরা আমেরিকান ব্লু জীন্‌স পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আমেরিকান সংগীতের তালে তালে নাচছে এবং আমেরিকান কোকাকোলায় চুমুক দিচ্ছে। তিনি আরো দেখতে পান প্যারিস নগরীর সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে গেছে কুৎসিত সব গগনচুম্বী অট্টালিকার কারণে। তিনি দেখতে পান সিনেমা হলগুলোয় হলিউডি মারদাঙ্গা সিনেমার দৌরাত্ম্য, টিভিতে একই রকম এক ঘেঁয়েমিপূর্ণ সিরিয়ালের আধিপত্য। তিনি যখন রেস্তোরাঁয় ঢোকেন তখন টেবিলে টেবিলে খাবারের আমেরিকান নামের বহর দেখে অবাক হয়ে যান। এসব কিছুই আধিপত্যবাদের নমুনা। তবে এসবকে কালচার অর্থাৎ সংস্কৃতি বলা যাবে কিনা- এ ব্যাপারে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

শিশুবেলায় ভিয়েনায় থাকতে আমি দেখেছি ফ্রান্স বা ব্রিটেন থেকে যা কিছুই আসত তা প্রশংসনীয় ছিল। যদিও হাঙ্গেরী, রোমানিয়া, পোল্যান্ডে ভিয়েনার জিনিসপত্র প্রশংসনীয় ছিল। ঠিক তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চল সকলের কাছে আকর্ষণীয় ছিল। কিন্তু আমি মনে করি গত ৩০ বছর এই সুনাম সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে গেছে।

আধিপত্যবাদ বা অ-আধিপত্যবাদ যাই হোক, আমি মনে করি, সংস্কৃতি হিসাবে তুলে ধরার মতো যুক্তরাষ্ট্রের কিছুই নেই। যতদূর জানি, যুক্তরাষ্ট্রে লেখকদের লেখার মান অত্যন্ত নীচু প্রকৃতির, সংগীত এবং  সুকুমার কলার অবস্থাও তথৈবচ। শুধু সিনেমা এবং সম্ভবত নৃত্যশিল্পকে কিছুটা উন্নতমানের বলা যায়। অথচ ৭০ বছর পিছনে ১৯২২ সালে যদি আমরা ফিরে যাই, তাহলে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র আমাদের সামনে ফুটে উঠবে। তখন আমেরিকান সমাজে বড় বড় ঔষধ, কবি, সাহিত্যিক, চিত্রকর, ভাস্কর এবং সংগীত বিশারদের প্রাচুর্য…। অথচ সেই সময়েও কালচার হিসাবে উপস্থাপন করার মতো যুক্তরাষ্ট্রের তেমন চমকদার কিছু ছিল না, তবে একটা জিনিস ছাড়া- তা ছিল জ্যাজ সংগীত। তাও আবার ছিল নিগ্রোদের অবদান।

এর পরে সাংস্কৃতিক আধিপত্যের আওতায় বাকি থাকে শুধু গবেষণা এবং বিজ্ঞান। বর্তমানে এই দু’টি বিষয় সম্পূর্ণভাবে কতিপয় বিশেষজ্ঞের হাতে কুক্ষিগত হয়ে আছে। কল-কারখানায় উৎপাদিত বস্তুসামগ্রীর মধ্যেই বিজ্ঞান ও গবেষণাকে তারা আবদ্ধ করে রেখেছে। অর্থাৎ সাধারণ জনগণের কাছ থেকে তা বিচ্ছিন্ন। এই গবেষণা ও বিজ্ঞানের আমেরিকান ব্রান্ডকে অপপ্রচারকারীরা সাংস্কৃতিক আধিপত্যের অন্যতম উপাদান হিসাবে জাহির করে।

নিজেদের অনিচ্ছা বা অক্ষমতার কারণে আমেরিকানরা অন্য কোন ভাষা শিখতে পারে না। এ জন্য নিজেদের ভাষাকে গোটা পৃথিবীর ঘাড়ে জোর করে চাপিয়ে দেয়ার বদ মতলব তাদের স্পষ্ট। এ ক্ষেত্রেও গ্রেশামের নীতি কাজ করে।

স্লোগান হলো আধিপত্যবাদের একটি বড় হাতিয়ার। তবে এই স্লোগানকে সংস্কৃতি বলা যাবে কিনা আমার সন্দেহ। ইদানিং আমেরিকান জীবনধারা একটি প্রভাবশালী স্লোগান। আমি মনে করি এই জীবনধারা ‘রিয়েল এস্টেট’ ব্যবসার রঙিন পুস্তিকা এবং টিভি পর্দাতেই নিহিত। নিউইয়র্কে আমি অনেকদিন কাটিয়েছি। ওখানকার অধঃপতিত অবস্থা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ আমার হয়েছে। এখনো আমি বুঝতে পারি না, প্রাচ্য দেশগুলোর প্রচার সংস্থা ও গণমাধ্যমগুলো কেন তাদের লোকজনদের নিউইয়র্কের অলিগলি, ব্রংস-এর দক্ষিণভাগ এবং ব্রুকলিনের মহল্লাগুলোকে পরিদর্শনের জন্য পাঠায় না? তাহলে প্রকৃত অবস্থাটা তাদের চোখে পড়ত। কিন্তু আমি জানি, এই প্রশ্নটা একেবারে সাদামাটা গুরুত্বহীন একটা প্রশ্ন। কেননা, অধিকাংশ এশিয়াবাসীই যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় লাভের জন্য লালায়িত। আমার কাছে যা বাজে কুঁড়ে ঘর, তাদের কাছে তা স্বাধীনতার সোনার রথ।

‘মুক্তি’ শব্দটা ব্যবহার করে খুব শক্তিশালী স্লোগান বানানো যায়। এই শব্দটার উচ্চমূল্য রয়েছে। মুক্তি শব্দের বিচার করতে গেলে স্বাধীনতা শব্দটাও এসে যায়। এ দু’টি শব্দ যেমন সমার্থক, তেমনি আবার ভিন্নার্থকও হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার যখন তাঁর নাগরিক স্বাধীনতার বেলুন উড়িয়েছিলেন তখন সেগুলো নিউইয়র্কেও গগনচুম্বী অট্টালিকাগুলোকেও ছাড়িয়ে ওপরে উঠে গিয়েছিল। নাগরিকদের মুক্তির নামে কি তিনি সেই কাজ করতে পারতেন? আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আমার মতে মুক্তি হলো স্বাধীনতার চূড়ান্ত রূপ। মুক্তির পরিসংখ্যানগত দিক থাকতে পারে, কিন্তু স্বাধীনতা এমন জিনিস যা হতাশ হয়ে মানুষ খুঁজে বেড়ায়।

কিংবদন্তী সৃষ্টির মহান প্রক্রিয়াতেই এসব স্লোগানের শক্তি নিহিত। স্লোগান অবাস্তব স্বপ্ন কল্পনারই প্রতিফলন। নিজের অর্ধমুক্ত ভাগ্যের জন্য যুক্তরাষ্ট্র এসব স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে সচেষ্ট। এ ধরনের আধিপত্যবাদের সবচেয়ে বড় বিপদ হলো এর বহির্মুখী রূপকে বিশ্বাস করা। আমাদের সময়ের কোটি কোটি নির্যাতিত অবহেলিত জনগণের কানে রাতদিন ঢোল পিটিয়ে এই অবাস্তবতা ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। তারা যদি শেষ পর্যন্ত এসবের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে তাহলে এই বিশ্ব ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই সময় থাকতেই আমাদের সাবধান হয়ে যাওয়া উচিত।

১৯৯৩ সালের প্রেক্ষাপটে ইসলামী বিপ্লব ও সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র

অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান

ন্যায় ও শান্তির সমাজ প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষা মানুষের চিরন্তন। একই সাথে মানবজীবনে অন্যায়, অশান্তি, অন্যায্য ও বিপর্যয়ের কারণও মানুষ নিজেই। মানুষের ওপর মানুষের প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষাও প্রয়াশই যাবতীয় অশান্তি ও বিপর্যয়ের মূল কারণ। ব্যক্তি, গোষ্ঠী, রাষ্ট্র কিংবা জাতি ইত্যাকার বিভিন্ন নামে একদল মানুষ বরাবরই এ প্রয়াস চালিয়েছে এবং প্রভুত্ব অব্যাহত রেখেছে।

আল্লাহর মনোনীত একমাত্র দীন আল-ইসলাম। তাই মানবজীবনের এই মূল রোগেরই চিকিৎসা করেছে সর্বাগ্রে। মানুষের কাঁধের ওপর থেকে আল্লাহ ছাড়া আর সবকিছুর আধিপত্য-কর্তৃত্ব সরিয়ে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ব্যক্তি জীবনে এ ঘোষণার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে হয় ‘মুসলিম’ এবং সামষ্টিক জীবনে এ ঘোষণাকে কার্যকরী ও বাস্তবায়ন করার মধ্য দিয়েই কোনো সমাজ কিংবা রাষ্ট্রে সম্পন্ন হয় ইসলামী বিপ্লব। ইসলামী বিপ্লবের অন্তর্নিহিত চেতনা ও প্রেরণা তাই স্বাধীনতা- পূর্ণ স্বাধীনতা। মানুষের দাসত্বের নিগ্রহ থেকে মানবাত্মার মুক্তি ও স্বাধীনতা।

শয়তান ও তাগুতী শক্তির কাছে ইসলাম ও ইসলামী বিপ্লব তাই অসহ্য। নবীদের বেলায় এটি যেমন সত্য ছিল এবং যেমন সত্য ছিল শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জীবনে, তেমনি আজকের যুগেও। ইসলামী বিপ্লবকে যমদূতের মতোই ভয় পায় বিশ্বলুটেরা তথা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। মযলুম ব্যক্তি, গোষ্ঠী কিংবা জাতির ওপর দিয়ে দাম্ভিকতা প্রদর্শন তথা আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অবসান ঘটবে- এটি কিছুতেই মেনে নিতে পারে না শয়তানি শক্তিসমূহ। ইসলামী বিপ্লবের প্রতিরোধে এরা তাই এঁটেই চলে নিত্য নতুন ফন্দি ও ষড়যন্ত্র।

১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর থেকে নব প্রতিষ্ঠিত এ রাষ্ট্রটিকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ষড়যন্ত্র একের পর এক মোকাবিলা করেই পথ চলতে হয়েছে। বস্তুত ইরানে আজ অবধি ইসলামী বিপ্লবের স্থায়িত্ব ও তার অব্যাহত অগ্রযাত্রার ইতিহাস সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অযুত ষড়যন্ত্র মোকাবিলারই ইতিহাস। এ বিপ্লবকে ধ্বংস করার জন্য বিশ্বলুটেরা ও ক্ষমতাদর্পী শক্তিসমূহ তাদের পক্ষে অবলম্বন করার মতো কোনো উপায়ই বাকি রাখেনি। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীদের সকল হিসাব-নিকাশ ভুল প্রমাণ করে ইসলামী বিপ্লব আজো টিকে আছে এবং বিশ্বব্যাপী তার প্রভাব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের মধ্যে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কেন এবং কিভাবে তাদের মরণ সংবাদ প্রত্যক্ষ করে এবং এ বিপ্লবের বিরুদ্ধে তারা এ পর্যন্ত কি ধরনের ষড়যন্ত্র করেছে এবং এখনও ষড়যন্ত্রের জাল বুনেই চলছে, এ প্রবন্ধে এ সম্পর্কেই সামান্য আলোকপাত করা হয়েছে।

ইসলামী বিপ্লব ও নয়া বিশ্ব মানদণ্ড

ইরানের ইসলামী বিপ্লবের বিরুদ্ধে পরিচালিত সকল ষড়যন্ত্রের মূল কারণ এ বিপ্লবের বিশিষ্ট চরিত্র ও অনন্য বৈশিষ্ট্য। অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক সকল দিক থেকেই এর বৈশিষ্ট্য সুপ্রমাণিত। ব্যতিক্রমী কায়দায় এ বিপ্লব জন্মলাভ করে, ব্যতিক্রমী এর নেতৃত্ব এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থা এবং জন্মলগ্ন থেকেই এ বিপ্লব সর্ববৃহৎ পরাশক্তি থেকে শুরু করে বিশ্বের ছোট-বড়, ভৌগোলিক ও আঞ্চলিক সকল দাম্ভিক শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে বসে। ঐশী আদর্শে পুষ্ট ও সুশোভিত এ বিপ্লবের চরিত্র চিত্রণ করতে গিয়ে তাই প্রথমে পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রনীতিবিদ এবং সমাজ বিজ্ঞানীরা মহাসংকটে পড়ে। মার্কিন বিজ্ঞানী রবার্ট ডি. লী তাই তাঁর গবেষণায় উল্লেখ করেন : “The Islamic revolution appears rebellious and mysterious. Egalitarian yet not socialist or democratic, radical but seemingly traditional, xenophobic but scarcely isolationist, it does not mirror the French, the Russian or the American experience. Social scientific theories of modernization, whether Marxist or liberal-capitalist in inspiration, failed to anticipate the upheaval and have yet to explain it satisfactorily.’ (Robert D. Lee: Islamic Revolution and Authenticity) ।

যাই হোক, ইসলামী বিপ্লবের চরিত্র চিত্রণ করতে গিয়ে মার্কিন অ্যাকাডেমিক সার্কেলে মতপার্থক্য থাকলেও তাদের রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ব্যক্তিবর্গের একথা উপলব্ধি করতে বিলম্ব হয়নি যে, এ বিপ্লব কস্মিনকালেও তাদের অনুকূলে যাবে না। বরং এর শুরু ও বিকাশ, আহ্বান ও তৎপরতা এবং প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া সবটাই বিশ্বব্যাপী মার্কিন নীতি ও পরিকল্পনার মুখোমুখি প্রতিবাদ আর প্রতিরোধ। উল্লেখ্য, ১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের পর যুক্তরাষ্ট্র পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র ও শক্তিশালী অবস্থান হারায়। বিপ্লব-পূর্ব ইরানকে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের বৃহত্তম ঘাঁটি হিসাবে মনে করা হতো, কিন্তু ইসলামী বিপ্লবের পর যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলের বঞ্চিত-নিপীড়িতদের এক নম্বর শত্রু হিসাবে চিহ্নিত হয়। বিপ্লবের নেতৃত্ব জনগণকে এ ব্যাপারে সজাগ ও সতর্ক করে তোলে। ফলে আমেরিকান কার্টেল ও ট্রাষ্টগুলোর জাল থেকে বিশ্বের এক গুরুত্বপূর্ণ তেল অঞ্চল বেরিয়ে গেল; মার্কিনীরা হারালো আরো বহু স্বার্থ। এখানেই শেষ নয়। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি অল্প দিনের মধ্যেই টের পেল যে, ইরানের ইসলামী বিপ্লব শুধু ক্ষমতার হাতবদল নয়, অর্থাৎ পাশ্চাত্যশিক্ষিত টাই-স্যুট পরা ব্যক্তির স্থলে নিছক পাগড়ি ও আলখেল্লা পরিহিত ‘সনাতন’ ধর্মীয় মোল্লা শ্রেণির কর্তৃত্ব লাভই নয়; বরং এ বিপ্লবের রয়েছে আধ্যাত্মিক, দার্শনিক, মানবিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উপাদান; রয়েছে জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে নতুন মানদণ্ড ও উপলব্ধি। এ উপলব্ধি একজন ব্যক্তি মানুষকে ইন্দ্রিয়পরায়ণতা, ভোগবাদিতা, দুনিয়াপূজারি দাম্ভিক শক্তিসমূহের পদলেহনের ও সেবাবৃত্তির পরিবর্তে তাকে দান করে জীবন সম্পর্কে উন্নততর মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি, আধ্যাত্মিকতা, পরমুখাপেক্ষাহীনতা, নির্ভীকতা, স্বকীয়তা ও স্বাধীনতা। শয়তানি শক্তিকে ভয় করা কিংবা কুর্নিশ করা নয়, বরং তাকে ও তার সকল পৃষ্ঠপোষককে উৎখাত করার মন্ত্র শিখায় ইসলামী বিপ্লব। এ বিপ্লব আপোস করতে জানে না, প্রতিরোধ করতেই ভালোবাসে, কুফ্র ও কুফ্রি শক্তিকে ছাড় দিতে জানে না, জানে কেবল কুফ্রি শক্তির সাথে সরাসরি লড়াই করতে এবং জেহাদের ঝাণ্ডা সর্বক্ষণ সমুন্নত রাখতে। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের মহান নেতা, বর্তমান দুনিয়ার বিস্ময় ইমাম খোমেইনী (রহ.) শুরু থেকেই সমস্ত মুসলমান এবং বিশ্বের নির্যাতিত জনগণকে আহ্বান জানাতে থাকেন তারা যেন সাম্রাজ্যবাদের অক্টোপাশ থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করার জন্য সচেষ্ট হয় এবং যেসব সরকার ও শাসকগোষ্ঠী জনগণের কষ্টার্জিত পরিশ্রমের ফসল বিশ্বলুটেরার হাতে তুলে দেয় সেসব দুষ্কৃতকারী নাপাক শাসকগোষ্ঠীকে যেন দেশ থেকে বহিষ্কার করে। তিনি বলেন : ‘ইসলামের বিধান হচ্ছে কেউ তোমার ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করবে না, তুমিও কাউকে তোমার ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে দিবে না।’ ইমাম খোমেইনী সবাইকে ইসলামের গৌরবময় পতাকাতলে সমবেত হয়ে ইসলামের দুশমনদের বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়াতে এবং ইসলামী সরকার কায়েম করে দেশে দেশে স্বাধীন সার্বভৌম ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে যাবার আহ্বান জানান। তারপর ‘প্রাচ্য নয়, পাশ্চাত্য নয়- ইসলাম, কেবল ইসলাম’- এর নীতিকে ঘোষণা করেন ইসলামী রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম মূল স্তম্ভ হিসাবে। ফলত ইসলামী বিপ্লব তার এ নয়া বিশ্বমানদণ্ড নিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে পার্শ্ববতী মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোসহ দুনিয়ার বিভিন্ন অংশের রাষ্ট্র ও জনপদকে। শংকিত হয়ে ওঠে সাম্রাজ্যবাদ ও তার তাঁবেদার রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানগণ।

বস্তুত ইসলামী বিপ্লবের এসব বৈশিষ্ট্যের কারণেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাছে তা হয়ে দাঁড়ায় চক্ষুশূল। ইরানের ইসলামী বিপ্লবকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়ার জন্য এ কারণেই শুরু হয় চক্রান্ত। বিপ্লবোত্তর দিনগুলোতে ইসলামী ইরানকে ঘরে ও বাইরে এতসব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হয় যে, এ বিপ্লবের অস্তিত্ব টিকে থাকা সত্যিই এক বিস্ময়কর ব্যাপার। খোদায়ী এ নেয়ামতকে স্বয়ং খোদা তাআলাই হেফাজত করেছেন। পরীক্ষা নিয়েছেন এ বিপ্লবের সংগঠকদের ও এর অনুরক্তদের। ইরানীরা সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষা আর শাহাদাতের নজরানা পেশ করে টিকিয়ে রেখেছেন ইসলামী বিপ্লব নামক চারাগাছটিকে। শাহাদাতের রক্ত থেকে রস সিঞ্চন করেই বিপ্লবের এ চারাগাছটি বেড়ে উঠেছে, সুশোভিত হয়েছে। বিপ্লবোত্তর কালে ইসলামী ইরানের বিরুদ্ধে বিশ্বকুফ্র কী কী ষড়যন্ত্র প্লট তৈরি করে এবং কী কী ষড়যন্ত্র সে বাস্তবায়নের সুযোগ পায় এবারে সেসব নিয়ে আমরা সামান্য আলোচনায় যাব।

বিপ্লবোত্তর ইরান : প্রধান প্রধান ষড়যন্ত্র

বিপ্লবের বিজয়ের পর সাম্রাজ্যবাদী শক্তি প্রথমে চেষ্টা চালায় সন্ত্রাস, অন্তর্ঘাতী তৎপরতা, প্রতিবিপ্লবী শক্তিকে মদদ দান ও গুপ্তহত্যার মাধ্যমে বিপ্লবকে নিশ্চিত করা কিংবা অস্থিতিশীল করে তোলার জন্য। বস্তুত বিপ্লবের বিজয়ের অল্প সময়ের মধ্যেই ইরানের অভ্যন্তরে মার্কিন চররা সন্ত্রাসবাদী কাজ শুরু করে। শহরের রাস্তায় রাতের আঁধারে তারা বহু বিপ্লবী রক্ষী খুন করে। তারপর বিপ্লবের প্রথম সারির নেতাদের খুন করার এক মাস্টার প্লান নিয়ে তারা একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে চলে। ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের মাত্র দু’মাস পরে ইসলামী প্রজাতন্ত্র সশস্ত্র বাহিনীর প্রথম চীফ অব স্টাফ লে. জে. কারানী খুনীদের প্রথম লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন। তাঁর মৃত্যুর পর প্রখ্যাত জ্ঞানবিশারদ আয়াতুল্লাহ মোতাহহারীকে শহীদ করা হয়। শহীদ মোতাহহারী ছিলেন বিপ্লবী পরিষদের প্রধান এবং জ্ঞানরাজ্যের অনন্য দিকপাল। তাঁর হত্যাই প্রমাণ করে দেয়, ইসলামী বিপ্লবী চিন্তাধারা বিপ্লবের শত্রুদেরকে কতটা আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছিল। ড. বেহেশতী, রাজাই, বাহোনার, মোফাত্তেহ, আল্লামা তাবাতাবাঈ- এর মতো প্রত্যেক ব্যক্তিত্বই শাহাদাতপ্রাপ্ত হন কুফ্‌রি শক্তির টার্গেট হয়ে। হাশেমী রাফসানজানী ও আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীর প্রাণনাশেরও চেষ্টা চলে। তাছাড়া নেতৃত্বে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা তথা উপদল সৃষ্টি, নেতৃত্ব সম্পর্কে সন্দেহ সৃষ্টির অপপ্রয়াসও কম চলেনি। এসব চক্রান্ত রূপায়িত হয়ে তা ইসলামী বিপ্লবের জন্য শোচনীয় পরিণতি বয়ে আনতে পারত। বিপ্লবের সেবায় নিয়োজিত নেতাদের বদনাম করার মাধ্যমে নেতৃত্বে ভাঙন ধরলে তা বিপ্লবকে এতই দুর্বল করত যে, বিশ্বনিপীড়কদের ইরানে প্রত্যাবর্তনের পথ হতো প্রশস্ত। কিন্তু জনতার সচেতনতা এবং নেতৃত্বের সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে এসব চক্রান্ত ব্যর্থ হয়।

এখানেই শেষ নয়। ষড়যন্ত্রকারীরা বিভিন্ন সীমান্তবর্তী এলাকায় ষড়যন্ত্র করে, চক্রান্ত করে সরকারি দফতরগুলোতে ও সেনাবাহিনীতে। চরমপন্থী বাম সংগঠনসমূহ ও পূর্বতন শাসকগোষ্ঠীর সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন চক্রের মাধ্যমে সংঘাত বাঁধায়। বিরোধ সৃষ্টি করে বিভিন্ন ধর্ম ও জাতিসত্তার ছদ্মাবরণে। জাতীয় শিল্পব্যবস্থা ভণ্ডুল করার জন্য কল-কারখানায় উসকে দেয় ধর্মঘট। কৃষি উৎপাদন বন্ধ করার উদ্দেশ্যে কৃষি ক্ষেত্রে সৃষ্টি করে বিশৃঙ্খলা। ইরানের বিরুদ্ধে শুরু করে অর্থনৈতিক অবরোধ। অপপ্রচার, গুজব ও মিথ্যাচারের সয়লাব বইয়ে দেয়া হয় দুনিয়াময়। বিশ্ব থেকে ইরানের ইসলামী বিপ্লবকে বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যেই এসব চালিত হয়েছিল।

তারপর ইসলামী বিপ্লবের অন্যতম সহায়ক স্তম্ভ ইমামের অনুসারী বিপ্লবী ছাত্রবৃন্দ যখন তেহরানের মার্কিন দূতাবাস (আসলে গোয়েন্দা আখড়া বা স্পাই সেন্টার) ঘেরাও করল, তখন সাম্রাজ্যবাদী-ইহুদিবাদী প্রচার মাধ্যমসমূহ প্রচারণা শুরু করল যে, ‘গোয়েন্দা আস্তানা’ দখলের বিপ্লবী কাজটি বেআইনি এবং তা সকল আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। কিন্তু তারা একথার জবাব কখনই দেয়নি যে, কোনো দূতাবাসে গুপ্তচরবৃত্তি ও সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের সরঞ্জাম আইনসিদ্ধ কিনা। উল্লেখ্য, তাদের প্রচারণার মুখে ইরানকে নতজানু করতে ব্যর্থ হয়ে আমেরিকা ১৯৭৯ সালের ১২ ডিসেম্বর ইরানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ জারি করে এবং ১৯৮০ সালের ৩০ এপ্রিল আন্তর্জাতিক ব্যাংকসমূহে ইরানী সম্পদ আটক করে। এসব ষড়যন্ত্রেও ইরান নতজানু না হওয়ায় আমেরিকা সরাসরি হস্তক্ষেপের পথ ধরে।

১৯৮০ সালের ২৫ এপ্রিল ৩ হাজার কমান্ডো, মোটর সাইকেল, সামরিক জীপগাড়ি, প্রচুর গ্রেনেড, কামান ও মেশিনগান নিয়ে ১৮টি পরিবহন বিমান ও ২০টি হেলিকপ্টার লুকিয়ে ইরানের আকাশসীমায় প্রবেশ করে এবং খোরাসান প্রদেশের তাবাস শহরের কাছে এক মরুভূমিতে অবতরণ করে। স্পাই সেন্টারে আটক কূটনীতিক নামধারী ক্রিমিন্যালদের উদ্ধার এবং পাহাড়াদার মুজাহিদ ছাত্রদেরকে খুন করাই ছিল এ অভিযানের উদ্দেশ্য। কিন্তু আল্লাহপাকের কী মহিমা! কী তাঁর গায়েবী সাহায্য! এক অপ্রত্যাশিত ঘটনার ফলে মার্কিন ক্রুরা কাজ করতে অক্ষম হয়ে পড়ে এবং বিমান ও হেলিকপ্টারগুলো দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। ফলত তাদেরকে তাবাস মরুভূমিতে ৬টি হেলিকপ্টার, একটি বিমান, কয়েকটি জীপ, ৬টি মোটর সাইকেল, ৩০ হাজার ফাটানো গ্রেনেড এবং কয়েকজন অগ্নিদগ্ধ আমেরিকান কমান্ডোর লাশ ফেলে ইরান ত্যাগ করতে হয়। প্রসঙ্গত সূরা ফীলে কুরআনের ভাষ্যে অনুরূপ এক ঘটনার কথা স্মরণ করা যেতে পারে। ইসলাম আগমনের পূর্ব সময়ের আরবে হস্তিসজ্জিত এক বিশাল বাহিনী পবিত্র কাবা ধ্বংস করতে আসে। তারা মক্কা আক্রমণ করে। কিন্তু ঐ বাহিনীর সকলেই খুব উঁচু থেকে অসংখ্য ছোট ছোট পাখির ফেলা ক্ষুদ্র প্রস্তর খণ্ডে ধ্বংস হয়। ইরানী জাতি দেখল, আল্লাহর ইচ্ছায় তাবাস মরুভূমিতে বালুকণা বাতাসে উড়তে থাকে, এতে অন্ধ হয়ে পড়ে শত্রু ও তার হেলিকপ্টারগুলো।

একদল প্রতারিত সেনা ও পলাতক চরের সাহায্যে ইসলামী সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটানোই ছিল ইরানের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদীদের পরবর্তী চক্রান্ত। এ দায়িত্ব বখতিয়ারের ওপর অর্পণ করে আমেরিকা সরকার। প্রয়োজনীয় সবকিছুর সরবরাহও করা হয়। কিন্তু আল্লাহপাক ইসলামী বিপ্লবকে হেফাজত করেছেন। ইসলামী বিপ্লবী রক্ষীবাহিনী ১৯৮০ সালের ৯ জুলাই রাতে অভ্যুত্থান শুরু হওয়ার কয়েক মিনিট আগে চক্রান্ত সংশ্লিষ্ট চরদের গ্রেফতার করে। এ অভ্যুত্থান পরিকল্পনায় অভ্যুত্থানের উদ্যোক্তারা তেহরান ও কোমে, বিশেষত ইমাম খোমেইনীর বাড়িতে এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে বোমা  বর্ষণের পরিকল্পনা করেছিল। এসব গুরুত্বপূর্ণ স্থানের মধ্যে ছিল মজলিস ও বিপ্লবী রক্ষী কেন্দ্রসমূহের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলো।

এতসব কেলেংকারিজনক প্রচেষ্টা ও পরাজয়ের পর আমেরিকা ইরানে একটি উদারনৈতিক (অন্য কথায় মার্কিনীদের অনুগত) সরকার গঠনের আশা পোষণ করতে থাকে। বনি সদরকে দিয়েই তারা এ লক্ষ্য হাসিল করতে চেয়েছিল। সত্যি বলতে কি Bani Sadar Phenomenon ছিল মার্কিনী Super Conspiracy-এর একটি দৃষ্টান্ত। কত সূক্ষ্ম যে হয় মার্কিনী চাল, কত বহুমুখী তাদের কূটকৌশল- এ ঘটনা থেকেই তার প্রমাণ মেলে। দুনিয়ার দেশে দেশে তারা সরকার ও সরকারবিরোধী উভয় মহলেই লোক নিয়োজিত রাখার চেষ্টা করে। প্রয়োজনমতো উপযুক্ত ব্যক্তিকে ব্যবহার করে উদ্দেশ্য হাসিল করে থাকে। কিন্তু বনি সদর, কুতুবযাদেহকে দিয়ে মার্কিনীরা যা করতে চেয়েছিল তা বেশিদূর এগুতে পারেনি। ইসলামী বিপ্লবকে বিচ্যুত করা ও ইরানের নির্বাহী ব্যবস্থার উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গকে ভর করে ইরানে আমেরিকা সরকারের পুনঃপ্রবেশের সকল পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। তেহরানে আমেরিকান গোয়েন্দা আস্তানা থেকে উদ্ঘাটিত দলিল-দস্তাবেজ থেকে সব ষড়যন্ত্র প্রকাশ হয়ে পড়ে। বনি সদর ও তার সহযোগীদের পদচ্যুতি ঘটে। বিশ্বাসঘাতকতার উপযোগী শাস্তি তাদেরকে পেতে হয় অল্প সময়ের মধ্যেই। মুজাহেদীনে খালক-এর ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করা হয়, কোথাও কোথাও পূর্বাহ্নেই ফাঁস হয়ে পড়ায় প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করা হয়।

১৯৮২ সালের এপ্রিলে ইরানী সেনাবাহিনীর ইসলামী বিপ্লবী আদালত ইসলামী প্রজাতন্ত্রী ব্যবস্থা উৎখাতের লক্ষ্যে পরিচালিত আরেকটি বড় ধরনের ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটন করে। এ ষড়যন্ত্রের প্রধান পরিচালক ছিল সাদেক কুতুবযাদেহ। গ্রেফতারের পরে টেলিভিশনে এক সাক্ষাৎকারে কুতুবযাদেহ স্বীকার করে যে, তার সন্ত্রাসবাদী সাংগঠনিক ব্যবস্থা ইমাম খোমেইনী, সর্বোচ্চ প্রতিরক্ষা পরিষদের সদস্যবর্গকে (প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট ও সর্বোচ্চ প্রতিরক্ষা পরিষদের সভাপতি আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী, ইসলামী মজলিস শুরার স্পীকার ও সর্বোচ্চ প্রতিরক্ষা পরিষদে ইমামের তৎকালীন প্রতিনিধি হুজ্জাতুল ইসলাম হাশেমী রাফসানজানীসহ) হত্যা করার মতলব আঁটে। ইমাম খোমেইনীর বাড়িতে বোমা বিস্ফোরণ ও জামারানে গোলাবর্ষণ করে এটা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সাম্রাজ্যবাদের ঘাপটি মেরে বসে থাকা চররা এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারলে ইমাম খোমেইনী ও সর্বোচ্চ প্রতিরক্ষা পরিষদের সদস্যবর্গ ছাড়াও জামারানের দশ সহস্রাধিক লোক সে সময়ে মারা যেত। আল্লাহ পাকের অসীম রহমতে ষড়যন্ত্র পূর্বাহ্নেই ফাঁস হয়ে যায় তাদেরই লোকের মাধ্যমে।

এভাবে একের পর এক ষড়যন্ত্র ও আঘাতের ধারা অব্যাহত রাখার এক পর্যায়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইরাককে দিয়ে ইসলামী ইরানের ওপর একতরফাভাবে চাপিয়ে দেয় এক আকস্মিক ও সর্বাত্মক যুদ্ধ। যুদ্ধ শুরুর সাথে সাথে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দাম্ভিক পরাশক্তি ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলো অনেকটা প্রকাশ্যেই ইরাককে সমর্থন করে এবং অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করতে থাকে। আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ এ সময় নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। তারা ইরাকের এ হামলা বন্ধের জন্য কোনো প্রচেষ্টাই চালায়নি। ফলে হামলাকারীরা একেবারেই বাঁধাহীন থেকে গেছে। ইরাকের বিরুদ্ধে তখন কোন অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হয়নি এবং ইরানী ভূখণ্ড ও সীমান্ত থেকে ইরাকী বাহিনীর নিঃশর্ত প্রত্যাহার দাবিও কেউ তোলেনি। উপরন্তু বিভিন্ন উপলক্ষে বিভিন্ন মহল থেকে ইরাকী আগ্রাসনের শিকার ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধেই কথা বলা হয়েছে।

উল্লেখ্য, এ ছিল এমন এক সময় যখন ইরানী সশস্ত্র বাহিনী যুদ্ধের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না। ইরানী সৈন্যরা ছিল অসংগঠিত। সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে ধর্মঘট, বিভিন্ন বিষয়ে অস্পষ্টতা, সংঘাত ও নানারকম অস্থিতিশীলতা ছিল, সামরিক শৃঙ্খলার মারাত্মক অবনতি ঘটেছিল। তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত অর্থনৈতিক অবরোধের ফলে সমরাস্ত্রের খুচরা যন্ত্রাংশের ঘাটতি দেখা দেয়। বিদেশী সামরিক বিশেষজ্ঞদের বরখাস্ত করার পাশাপাশি বিরাজিত বিশৃঙ্খলা প্রকৃতপক্ষে সর্বক্ষেত্রে একটি সামগ্রিক স্থবিরতার সৃষ্টি করে। সে সময় ইরানী বাহিনীর পক্ষে প্রকৃত অর্থে কোন প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রদর্শন করা ছিল একেবারেই অকল্পনীয় ও অপ্রত্যাশিত। কুফ্্রি শক্তির মদদপুষ্ট হয়ে সাদ্দাম হোসেন এ সময়টিকেই ইরানের ওপর হামলার জন্য বেছে নেয়।

হামলার সূচনাকালে ইরাকীরা কিছুটা সাফল্য অর্জন করলেও অল্প সময়ের ব্যবধানে এ যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। ইরান ‘আত্মরক্ষার’ (Defensive) পর্যায় থেকে নিজেদেরকে সামনে নিয়ে ‘আক্রমণাত্মক’ (offensive) পর্যায়ে চলে আসে। আর তখনি শত্রুদের অশুভ উদ্দেশ্য আরো পরিষ্কার হয়ে ওঠে। ইহুদি, সোভিয়েত প্রতিক্রিয়াশীলরা সে সময় শান্তি প্রতিষ্ঠার দাবি জানায় এবং একই সাথে ইরানের বিরুদ্ধে ইরাককে সাহায্য জোরদার করে। এ সময় পারস্য উপসাগর দিয়ে উড়ে যাওয়াকালে ইরানী যাত্রীবাহী বিমানের ওপর হামলা করা হয়, ইরানের আবাসিক এলাকায় বোমা বর্ষণ করা হয় এবং ইরানের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করা হয়। ইরাকী বাহিনী এক পর্যায়ে পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন করে এবং পারস্য উপসাগর ও ওমান উপসাগরে বিদেশী সৈন্যের উপস্থিতি দেখা দেয়। এক পর্যায়ে শান্তির স্বার্থেই জাতিসংঘের ৫৯৮ নং প্রস্তাব মেনে নিয়ে ইরান তাতে স্বাক্ষর করে। ১৯৯০ সালের এপ্রিল মাসে ইরাকী প্রেসিডেন্টের তরফ থেকে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের নেতা ও প্রেসিডেন্টকে উদ্দেশ্য করে একটি চিঠি পাঠানো হয়। এ চিঠির প্রেক্ষিত ইরাক ও ইরানের মধ্যে বেশ কিছু পত্র বিনিময় হয়। এক পর্যায়ে ইরাকী প্রেসিডেন্ট একতরফাভাবে ইরানের সাথে বিরোধ অবসানের কথা ঘোষণা করেন।

সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হলো, ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে ইরাকের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও ইরান প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের গোলামি হতে তার বিপ্লব ও স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখতে সক্ষম হয়েছে। ইরানের ইসলামী বিপ্লব এ কারণে আজো বিশ্বের মযলুম মানুষকে মুক্তির হাতছানি দিয়ে ডাকতে সক্ষম হচ্ছে। আমরা আগেই উল্লেখ করেছি যে, ইরানের ইসলামী বিপ্লব নিম্নোক্ত বিষয়সমূহের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ : স্বৈরতন্ত্র, উপনিবেশবাদ ও ইহুদিদের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে এগিয়ে নেয়া; সকল বঞ্চিত ও নিপীড়িত জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা, তাদেরকে আশা দান করা এবং তাদের সকলকে সংগ্রামে সমবেত করা, যুলুম ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে সকলের দায়িত্ব হিসাবে গণ্য করা, এক্ষেত্রে নীরবতা বা নির্লিপ্ততাকে বিশ্বাসঘাতক মনোভাব হিসাবে বিবেচনা করা; জনগণের মধ্যে জিহাদের ও সংগ্রামের উদ্দীপনা সঞ্চার করা, উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে বিশেষ করে সকল জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য দুনিয়া জুড়ে শক্তি সৃষ্টি করা। ইরান ইসলামী বিপ্লবী মতাদর্শ হিসাবে মনে করে যে, নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও বঞ্চিতকে রক্ষা করা ধর্মীয় ও মানবিক দায়িত্ব। তাই এ বিপ্লবের প্রতি দাম্ভিক অপশক্তির ষড়যন্ত্র আর আক্রমণেরও শেষ নেই।

ষড়যন্ত্রের তালিকায় সাম্প্রতিক সংযোজন

সাম্প্রতিককালে সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার মুরুব্বি সোভিয়েত ইউনিয়নে ও তার পক্ষপুটে আশ্রিত পূর্ব ইউরোপীয় দেশসমূহে সমাজতন্ত্রের পতন এবং সোভিয়েত সাম্রাজ্যের বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর স্নায়ুযুদ্ধের ঘটে অবসান। কিন্তু এ প্রেক্ষাপেট মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তার নয়া ‘বিশ্বব্যবস্থার’ ছদ্মাবরণে দুনিয়াময় একক আধিপত্য বিস্তারে সচেষ্ট হয়ে উঠেছে। কমিউনিজমের পতনের পর যুক্তরাষ্ট্র ইসলামী পুনরুজ্জীবন আন্দোলনসমূহকে বিশেষ করে ইরানের ইসলামী বিপ্লবকে টার্গেট করে ষড়যন্ত্রের নতুন জাল বুনে চলছে। উত্তেজনা সৃষ্টি করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের জন্য নতুন নতুন  ইস্যু তৈরি করছে পারস্য উপসাগরীয় এলাকায়। আবিষ্কার করছে আগ্রাসনের নতুন নতুন প্লট।

বস্তুত ইরানের ইসলামী বিপ্লবের অব্যাহত অগ্রযাত্রা, নবতর শক্তি হিসাবে তার অভ্যুদয়ে কুফ্রি শক্তি আরো বেশি বিচলিত হয়েছে। ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ষড়যন্ত্রের তালিকায় তাই নতুন সংযোজন হচ্ছে আবু মুসা দ্বীপ। বিশ্বকুফ্‌রি শক্তি ইরানের সাথে আরব আমীরাত ও অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের বিরোধ উসকে দেয়ার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে। উল্লেখ্য, পারস্য উপসাগরের আবু মুসা দ্বীপটির কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে যথেষ্ট এবং ঐতিহাসিকভাবে এটি ইরানী ভূখণ্ডের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ১৯৭১ সালের একটি চুক্তিতে আবু মুসা দ্বীপের ওপর ইরানের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করা হয় এবং সেখানেকার নিরাপত্তা রক্ষায় ইরানের ওপর দায়িত্ব অর্পিত হয়। চুক্তিতে বলা হয়, কেবল প্রশাসন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও তেল আহরণের কাজ ইরান ও সংযুক্ত আরব আমীরাত যৌথভাবে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করবে। দ্বীপটিতে কারো অনুপ্রবেশজনিত অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার হুমকি মোকাবিলা করার লক্ষ্যে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। অবশ্য ইরানের এ উদ্যোগকে প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রগুলো ভিন্নভাবে দেখছে এবং এ নিয়ে ইরান ও সংযুক্ত আরব আমীরাতের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। এরই সুযোগ নিতে চাচ্ছে পশ্চিমা শক্তিবর্গ যারা প্রতিবেশীদের সাথে ইরানের সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটুক- এটা মেনে নিতে পারে না এবং চায় পারস্য উপসাগরে উত্তেজনা লেগে থাকুক যাতে তাদের নাক গলাবার সুযোগ ঘটে এবং হস্তক্ষেপও করতে পারে। আবু মুসা দ্বীপ প্রসঙ্গে তারা আরব নেতৃবৃন্দকে এ কথা বুঝানোর চেষ্টা করে থাকে যে, ইরান আরব দেশগুলোর জন্য হুমকিস্বরূপ। এ বিরোধের সাথে জড়িত পক্ষগুলোর যেখানে করণীয় হচ্ছে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যাটির শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং নিজেদের সম্পর্কের উন্নয়নে প্রয়াস চালানো, সেখানে আবু মুসা দ্বীপের ওপর ইরানের সার্বভৌমত্ব নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে এবং আরব লীগ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলন ও উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের বৈঠকে সংযুক্ত আরব আমীরাতের দখলিস্বত্বের পক্ষে একতরফা প্রস্তাব উত্থাপন এবং ইরানকে আবু মুসাসহ তিনটি দ্বীপ থেকে সরে পড়ার আহ্বান পরিস্থিতিকে জটিলতর করারই ইঙ্গিতবহ। নিকট অতীতের ইতিহাস যেখানে সুস্পষ্ট সাক্ষী হয়ে রয়েছে, এ অঞ্চলের প্রতিবেশী মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর নিজেদের বিরোধ এদের কারো জন্যই ক্ষতি বই কল্যাণ বয়ে আনে না।  লাভবান হয় কেবল বাইরের ইন্ধনদাতা মতলববাজ পশ্চিমা কুফ্‌রি শক্তি।

সম্প্রতি ইরাকের দক্ষিণাঞ্চলে নিরাপত্তা অঞ্চল গঠনের পেছনেও রয়েছে মার্কিনী দুরভিসন্ধি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে যে, এ এলাকায় ইরাকের বামপন্থী সরকার কর্তৃক পাইকারি হারে শিয়াদের হত্যার পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকা এ পদক্ষেপ গ্রহণে তাড়িত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ব্যাপারটা ভিন্ন। বরং আমেরিকা তার নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির জন্যই এ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। উল্লেখ্য, ১৮ মাসেরও অধিককাল ধরে এ এলাকার জনগণ যখন বুলেট, বোমাসহ বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছিল তখন কিন্তু পশ্চিমা প্রচারমাধ্যমগুলো নীরব ভূমিকা পালন করে আসছিল। সম্প্রতি হঠাৎ করে তাদের মানবাধিকার চেতনা এতটা উপচে পড়ার কারণ কি? বোসনিয়া-হারজেগোভিনায় মুসলমানদের পর সার্বীয়দের দ্বারা নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ব্যাপারে মার্কিনীরা তৎপর হয় না কেন? ভারতে মুসলিম হত্যার ব্যাপারেও তো তাদেরকে কোনো উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায় নি? বরং উল্টো ভারতের সাথে মার্কিনীরা যৌথ সামরিক সহযোগিতা পাততে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। আসলে মার্কিনীদের ইরাকের দক্ষিণাঞ্চলে ‘নো ফ্লাই যোন’ গঠন করা এবং ইরাকের ওপর সাম্প্রতিক সামরিক অ্যাকশনে যাবার পেছনে যেসব মতলব কাজ করছে তা হচ্ছে :

১. ইসরাইলী সরকার কর্তৃক চার শতাধিক ফিলিস্তিনী অন্যায়ভাবে দেশ থেকে বহিষ্কার এবং নো-ম্যানস ল্যান্ডে তাদেরকে মানবেতর অবস্থায় ফেলে রাখা এবং বোসনিয়া-হারজেগোভিনায় মুসলিম হত্যা ও নারী নির্যাতনের পাশবিকতা অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও মার্কিনীদের কোনো কার্যকর ভূমিকা না থাকার ব্যাপারটাকে আড়াল করা।

২. সাদ্দামের পতনের পর সম্ভাব্য ক্ষমতার ভারসাম্য এবং এ এলাকায় আমেরিকা ও তার মিত্রদের স্বার্থ রক্ষার্থে সংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণের মন জয় করার প্রচেষ্টা।

৩. সাদ্দামের পতনকে আমেরিকা তার নিজস্ব স্ট্র্যাটেজির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে করে না এবং বিশ্ববিবেকের চাপের মুখে এবং  পারস্য উপসাগরীয় এলাকার শাসকদের সন্তুষ্টি অর্জন এবং সাদ্দামবিরোধী ইরাকীদের মন জয় করার একটা কৌশল হিসাবে গ্রহণ করেছে।

সত্যি বলতে কি, ঠিক এ মুহূর্তেই সাদ্দামের পতন আমেরিকা নিজেই চায় না। আমেরিকা বর্তমান যা কিছু করছে তা এক ধরনের নাটক। আমেরিকা আসলে যা চাচ্ছে তা হচ্ছে সাদ্দামের একটি বিকল্প ব্যক্তিত্বের সন্ধান। সম্ভবত সে এখনও তেমন ধরনের ব্যক্তিত্বের সন্ধান পায়নি। আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে তার জন্য অনুকূল এমন একটি সময়েই সাদ্দামের পতন হওয়া উচিত যাতে সে বিশ্ববাসীর  দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় যে, সে সাদ্দামের নির্যাতনের হাত থেকে ইরাকী জাতিকে রক্ষা করেছে এবং ভবিষ্যতে এ বিষয়কে সামনে রেখে ফায়দা লুটতে পারে। উত্তর ইরাকের পর দক্ষিণ ইরাকে নিরাপত্তা অঞ্চল গঠন ও সামরিক অ্যাকশনের পেছনে ইরাককে খণ্ডিত করা ও সমগ্র এলাকাকে একটি মারাত্মক পরিণতির সম্মুখীন করার পাঁয়তারা কাজ করছে।

কমিউনিস্ট শাসনের লৌহ প্রাচীর ভেঙে এবং সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক সাম্রাজ্যের পতনের মধ্য দিয়ে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত মুসলিম প্রজাতন্ত্রগুলো নিয়েও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি শুরু করেছে ষড়যন্ত্র। বস্তুত সাম্প্রতিককালে আজারবাইজান, কাজাকিস্তান, উজবেকিস্তান, কিরগিজিস্তান ও তুর্কমেনিস্তান প্রজাতন্ত্রগুলো স্বাধীনতা লাভ করলে এসব প্রজাতন্ত্রের মুসলমানগণ মস্কোর নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়ে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ধর্মীয় নীতি অনুসরণের সুযোগ পায়। উল্লেখ্য যে, এ অবস্থা কেবল মুসলিম প্রজাতন্ত্রগুলোর মধ্যেই সীমাবন্ধ থাকল না, বরং অন্যান্য স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্রও নিজেরা নিজেদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতে চাইল। এসব অঞ্চলে ইসলামী পুনর্জাগণের কিছু সম্ভাবনা সৃষ্টি হওয়ায় এবং ইসলামী বিপ্লবের অনুপ্রেরণায় কোনো কোনো রিপাবলিক কিছুটা এগিয়ে যাওয়ায় মৃতপ্রায় কমিউনিস্টরা সাম্রাজ্যবাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলামী শক্তির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বিশেষ করে তাজিকিস্তানে এ অপশক্তি যে তাণ্ডবলীলা ও অমানবিকতা প্রদর্শন করছে তার তুলনা কেবল বোসনিয়ায় সার্বীয় বাহিনীর পৈশাচিকতার সাথেই করা চলে। এখানে আরো একটি লক্ষণীয় বিষয় হলো যে, যে ইয়েলৎসিন রাশিয়ায় বসে কমিউনিস্টদের মোকাবিলা করেছেন তিনিই কিন্তু তাজিকিস্তানে নিজস্ব বাহিনী পাঠিয়ে কমিউনিস্টদেরকে সাহায্য করছেন মুসলিম হত্যাযজ্ঞে এবং ইসলামী পুনর্জাগরণ ঠেকাতে। ‘আল-কুফ্রু মিল্লাতুন ওয়াহিদাহ’ অর্থাৎ দুনিয়ার সকল কুফ্র আসলে একই মিল্লাত বা সম্প্রদায়- এর আরেক জ্বলন্ত উদাহরণ মুসলমানরা এখানে প্রত্যক্ষ করল। বস্তুত একই কারণে বিশ্বের আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও মধ্য এশিয়ার এ বর্বরতায় নিশ্চুপ। স্ট্যালিনীয় স্টাইলের বর্বরতাও তাদের ‘মানবাধিকার’ চেতনাকে স্পর্শ করে না।

ইসলাম, মুসলিম জাতি ও ইরানের ইসলামী বিপ্লবের বিরুদ্ধে পাশ্চ্যাত্যের আরেকটি ষড়যন্ত্র হচ্ছে ইসলামের মহান নবী (সা.)-এর ওপর অবমাননাকারী বিশ্ব নিন্দিত গ্রন্থ ‘দি স্যাটানিক ভার্সেস’- এর কুখ্যাত লেখক সালমান রুশদীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ রদ করার জন্য ইরানের ওপর চাপ প্রয়োগের ফন্দি-ফিকির। উল্লেখ্য, ইমাম খোমেইনী রুশদীর এ দণ্ড বিশ্বসমক্ষে ঘোষণা করেছিলেন। এ জন্য সাম্রাজ্যবাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এই কুখ্যাত লেখককে ব্রিটেনের বাইরে বিভিন্ন জায়গায় সফর করানো এবং বক্তৃতা দেয়ার ব্যবস্থা করেছে। রুশদীর এসব বক্তৃতার বিষয় একটাই। তা হলো ইরানের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা এবং কিছু মহল তার বক্তৃতা-বিবৃতি এমনভাবে প্রচারের ব্যবস্থা করেছে যাতে আসল বিষয়কে আড়াল করা যায়। শয়তান রুশদীর পক্ষে ওকালতিকারী সংবাদ মাধ্যমসমূহ যে বিষয়টি বেমালুম চেপে যায় তা হচ্ছে বিশ্বের একশ কোটি মুসলমানের বিশ্বাস ও আবেগ-উপলব্ধির ওপর শয়তান রুশদীর আঘাতের বিষয়টি। তারা এটিও উল্লেখ করেন না যে, এ নরাধম কর্তৃক মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসের ওপর  আঘাতের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের বহু মুসলমানকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। সাম্রাজ্যবাদের অনুচররা কেবল ইসলামী আইন অনুযায়ী ইমাম খোমেইনী কর্তৃক রুশদীর মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিষয়টি উল্লেখ করে এবং এহেন অভিমত পেশের চেষ্টা করে যে, এটি আন্তর্জাতিক আইনের সাথে সংগতিহীন। কি অপূর্ব তাদের কৌশল! মোট কথা, সাম্রাজ্যবাদের অনুচররা এবং তাদের প্রচারমাধ্যমসমূহ শয়তান রুশদীর ক্ষমাহীন অপরাধের প্রসঙ্গে না গিয়ে বরং এটিকে ইসলামী ইরানের ওপর চাপ সৃষ্টির কৌশল হিসাবে ব্যবহার করতে চাচ্ছে। তাদের ধারণা এর মাধ্যমেই ইউরোপীয় দেশসমূহের সাথে ইরানের সম্পর্ক সৃষ্টি ঠেকানো যাবে, ইরানকে কিছুটা ‘একঘরে’ করা যাবে। অথচ আজকে পাশ্চাত্যে যারা শয়তান রুশদীকে আদর আপ্যায়ন করছে, তার পক্ষে ওকালতিতে নামছে, তাদের এ কথা স্মরণ রাখা দরকার যে, এ শাস্তি যথোচিত যা এ নরাধমের প্রাপ্য এবং সারা মুসলিম দুনিয়া এ দণ্ডাদেশের পক্ষে রায় ঘোষণা করেছে। কাজেই যে পথে উপরিউক্ত মহল পা বাড়িয়েছে তাতে এ উদ্দেশ্য সফল হবে না যে, মুরতাদ রুশদীর দণ্ড মওকুফ হবে কোনোদিন। তবে পাশ্চাত্য ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অন্য কোনো মতলব হয়তো হাসিল করতে পারে, তা হচ্ছে ইসলামী ইরানের সাথে বিরোধিতাকে নবরূপ দেয়া, চাঙ্গা করা এবং আনুষঙ্গিক কিছু জটিলতা সৃষ্টি করা। এতে আর বিস্মিত হবারই কি আছে। নব্য ক্রুসেড তো ইউরোপীয়রা অনেক জায়গায়ই শুরু করে দিয়েছে, এটি হয়তো তার সাথে নবতর সংযোজন হবে।

সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার আসনে নতুন ব্যক্তি সমাসীন হয়েছেন। তৃতীয় বিশ্বের অতি উৎসাহী এবং সঠিক তথ্য সম্পর্কে অনবগত কিছু ব্যক্তি নির্বাচনের পূর্বে যা-ই আশাবাদ ব্যক্ত করে থাকুন না কেন নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় গিয়ে শুরুতেই জানিয়ে দিয়েছেন যে, “…The Leadership of America changes, but the policies do not.” ‘পলিসি’ বলতে এখানে বিল ক্লিনটন মৌলিক পলিসির কথাই বুঝিয়েছেন। একেবারেই সত্য কথা। তবে হ্যাঁ, পরিবর্তন যদি সামান্য হয়ও তা হবে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকে আরো তীব্রতর করার লক্ষ্যেই। কৌশলগত পদক্ষেপে নতুন নতুন মাত্রা সংযোজন করা হবে হয়ত। তারই পূর্বাভাষ পাওয়া যায় পাশ্চাত্যেরই সংবাদমাধ্যম রয়টার্স পরিবেশিত খবরে। তাতে বলা হয়েছে : ‘বিল ক্লিনটন প্রেসিডেন্ট হবার পর মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিন কৌশলগত অবস্থান ইরাকের থেকে ইরানের দিকে পরিবর্তিত হতে পারে। ইরাকের বিরুদ্ধে মার্কিন পদক্ষেপ অধিকাংশ আরব সন্তুষ্ট নয়। তারা মনে করে আরবের আধুনিকপন্থী ও মার্কিন মিত্রদের (তাঁবেদার) ভবিষ্যতের জন্য ক্রমবর্ধমান সমস্যা হচ্ছে ইরানী ধাঁচের ইসলামী শক্তি।’ এ পর্যবেক্ষণ পরিষ্কার করে দিচ্ছে আমাদের পূর্বের আলোচনার সারবত্তাকে। সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের প্রশাসনের শেষ সময়কার বক্তৃতা-বিবৃতি থেকেও আভাষ পাওয়া যাচ্ছিল মার্কিনীরা ইরানের বিরুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে পড়ার পথ খুঁজছে। ইরান অস্ত্র কিনছে, ইরান পারমাণবিক সরঞ্জামাদি কিনছে ও তৈরি করছে ইত্যাকার অভিযোগ বুশ প্রশাসনের নিত্যদিনকার বুলিতে পরিণত হচ্ছিল। অথচ ইসরাইলের অস্ত্র কেনা ও পারমাণবিক ক্ষমতায় মার্কিনীরা কোনো দোষ খুঁজে পায়  না।

বস্তুত ইরানের ইসলামী বিপ্লব ও তার অব্যাহত অগ্রযাত্রা ইরানের সমৃদ্ধি ও প্রভাব সারা দুনিয়ার সামনে আজকে একটি জ্বলন্ত বাস্তবতা। এ বিপ্লব দুনিয়ার সামনে এমন এক দর্শন উপস্থাপন করেছে, দুনিয়াকে এমন এক পথ দেখিয়েছে যা বিশ্বশোষক ও লুটেরাদের হাত থেকে মযলুম মানবতাকে মুক্তির সন্ধান দিতে পারে। বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে যেখানেই নিপীড়িত মানুষের ক্রন্দন শোনা যায়, সেখানেই ইসলামী বিপ্লবের আহ্বান পৌঁছে, ইসলামী প্রজাতন্ত্র সেখানেই সাহায্যের হাত প্রসারিত করে। এই বিশেষ কারণটির জন্যই বিশ্বসাম্রাজ্যবাদ ইসলামী বিপ্লবের প্রতি খড়গহস্ত। তারা ভালো করেই জানে যে, ইসলামী প্রজাতন্ত্রের অগ্রযাত্রার মধ্যেই নিহিত রয়েছে সাম্রাজ্যবাদী কুফ্‌রি শক্তির মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনি। ইসলামী বিপ্লব সম্প্রসারণের মধ্যেই রয়েছে বিশ্বের সকল যালেম শক্তির প্রতি লেজ গুটিয়ে সরে পড়বার নির্দেশনামা। তাইতো মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগরীয় অঞ্চলের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকচক্রের চোখের ঘুমও উধাও হয়েছে। তাদের মসনদ হাতছাড়া হবার ভয়ে তারা শঙ্কিত এবং সাহায্যের আশায় আরো বেশি করে সাম্রাজ্যবাদের পদযুগল চুম্বন করছে। এ কথা আজ দিবালোকের মতোই পরিষ্কার যে, শুধু মধ্যপাচ্যে নয়, দুনিয়ার দেশে দেশে মুসলমানদের নিদ্রাভঙের জন্য ইরানের ইসলামী বিপ্লব আজানের কাজ করেছে। এ আওয়াজকে স্তব্ধ করে এ শক্তি কারো নেই। এ বিপ্লব মযলুম মানবতার জন্য মুক্তি ও স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনবে- এটি কেবল আজকের প্রত্যাশা নয়, এ আমাদের প্রত্যয়। বিশ্বের তাবৎ যালেমের ওপর আমরা মযলুমদের বিজয়ের প্রহরই গুণছি।

(নিউজলেটার, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৩)

বিশিষ্টজনদের দৃষ্টিতে ইরানের ইসলামী বিপ্লব

হুজ্জাতুল ইসলাম বাকের আনসারী

‘ইসলামী বিপ্লব সফল হওয়ার আগে না মুসলিম আর না বিশ্বদাম্ভিকরা কল্পনা করত যে, আধুনিক বিশ্বে আবার ইসলামের পুনর্জাগরণ হবে। আজ সন্দেহাতীতভাবে এ কথা সত্য যে, এ ইসলামী বিপ্লব বঞ্চিত মানবতার মাঝে ও ইসলামী বিশ্বে এক ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। আর এই বিপ্লবের রয়েছে এক নজিরবিহীন সাংস্কৃতিক ভিত্তি।

ড. হামিদ আলগার

এ বিপ্লব বর্তমান শতাব্দীর অন্যান্য বিপ্লব থেকে স্বতন্ত্র, কেননা, ইতিহাসের গভীরে এর শিকড় প্রোথিত। ইরানীদের আবশ্যকীয় ও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির সাথে সাথে আকস্মিক কোন পরিবর্তন এটা নয়; বরং এ ছিল সুদীর্ঘ বহু বছরের রাজনৈতিক, আধ্যাত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের একটি অব্যাহত প্রয়াসের ফলশ্রুতি।…

আমাদের ঘাড়ে চেপে বসা রাজনৈতিক ভূতের দৃষ্টিভঙ্গিতে আলেম সমাজকে বিচার করা হলে সত্যের অপলাপ হবে। মনে রাখতে হবে যে, আলেমগণ শুধু শিয়া মাযহাব বা ইরানেই নয় বরং সারা দুনিয়াতে ঐতিহ্যবাহী ইসলামী শিক্ষা ও আচারের এক বিশেষ দিকের সংরক্ষণ ও প্রসারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। এটাই শেষ পর্যন্ত সমগ্র সমাজ ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রেরণার উৎসে পরিণত হয়। আমরা যদি ইরানের শিয়া মাযহাবের বিশেষ দিকের প্রতি তাকাই তাহলে দেখতে পাব যে, ষোড়শ শতকের সাফাভী আমল থেকেই আলেমগণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পড়াশুনা ও জ্ঞানচর্চা করেছেন। তাঁদের বিচরণ শুধু কুরআন, হাদীস, তাফসীর, ফিকাহ বা অনুরূপ বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না- ইসলামের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ দর্শন, বিশেষত শিয়া মাযহাবের অধ্যাত্মবাদের ওপরও তাঁদের দখল ছিল। বস্তুত আমরা যদি আয়াতুল্লাহ খোমেইনী এবং তাঁর মহান অবদানের প্রতি তাকাই তাহলে দেখতে পাই যে, ইরানের শিয়া আলেমদের সুদীর্ঘ ঐতিহ্যেরই চূড়ান্ত পরিণতি হচ্ছেন তিনি। শুধু রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যাপারে অসাধারণ, ব্যাপক এবং অবিসংবাদিত ভূমিকা পালন করেছেন বলেই যে তিনি এ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন, তা নয়। শিয়া ঐতিহ্যের খাঁটি ও সার্থক অনুসরণীয় ব্যক্তিত্বের বিকাশও তাঁর মধ্যে ঘটেছে। মোট কথা এ ক্ষেত্রেও তিনি একজন অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব।…

১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি দেশে ফিরে আসলেন। কিন্তু তিনি সাথে করে কোন সম্পদ নিয়ে এলেন না। কোন রাজনৈতিক দলও তিনি গঠন করেননি। কোনো গেরিলা যুদ্ধও পরিচালনা করেননি। কোন বিদেশী শক্তির সাহায্য তিনি নিলেন না। অথচ এর মধ্যেই তিনি ইসলামী বিপ্লবী আন্দোলনের তর্কাতীত নেতৃত্বে সমাসীন হলেন।…

আয়াতুল্লাহ খোমেইনীর ক্ষেত্রে ‘বিপ্লব’ কথাটির অর্থ হচ্ছে এই যে, একজন বিপ্লবী নেতা হিসাবে তিনি নিছক জ্ঞানে ও আবেগে কোন বিশেষ লক্ষ্যের প্রতি শুধু নিবেদিতই নন, বরং তিনি এর সাথে একাত্মও। এক্ষেত্রে ‘বিপ্লব’ শব্দটিকে অবশ্য ইরানী প্রেক্ষাপটেই বুঝতে হবে। তিনি ছিলেন পুরোপুরি আপোসহীন। কিন্তু কেন? কারণ, তিনি নিছক ব্যক্তিগত রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে প্রচলিত অর্থে কোন রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না। পক্ষান্তরে, তিনি কেবল আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.)-এর নির্দেশ বাস্তবায়নের জন্য খোদা নির্ধারিত পথে প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন মাত্র।…

আয়াতুল্লাহ খোমেইনী তাঁর আধ্যাত্মিক ও নৈতিক গুণাবলি দ্বারাই মহান ও অতুলনীয় ভূমিকা পালনে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর গুণাবলি এমনকি ইসলামবিরোধীরাও অস্বীকার করতে পারে না। একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো যে, বিপ্লবের সময় যাঁরা ইসলামের প্রতি নিবেদিত ছিলেন না তাঁরাও বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ইসলাম খুঁজে পেলেন। আয়াতুল্লাহ খোমেইনীর আধ্যাত্মিক ও শক্তিশালী নৈতিক গুণাবলি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁরাও বিপ্লবের তথা ইসলামের প্রতি নিবেদিত হলেন। এটা অনস্বীকার্য যে, তিনি এমনই এক ব্যক্তিত্ব যিনি আত্মকেন্দ্রিকতা ও সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে থেকে কেবল ইরানী জাতির অন্তরের অন্তঃস্থলে নিহিত আশা-আকাক্সক্ষারই প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন।…

আমাদের এ কথা কিছুতেই ভুলে গেলে চলবে না যে, ইরানের ইসলামী বিপ্লব মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদিবাদের জন্য যে মারাত্মক বিপর্যয় এনেছে তা যে কোন যুদ্ধে প্যালেস্টাইনীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রাম কিংবা আরব রাষ্ট্রগুলো কর্তৃক গৃহীত যে কোন সামরিক মাধ্যমে অর্জিত সমস্ত সফলতার চাইতেও বেশি। এটা নিশ্চিতভাবে বলা যাবে যে, সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে, এমনকি সকল মুসলিম দেশের হাতে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা ও ইহুদিবাদ যে প্রাথমিক পরাজয় বরণ করেছে তা সম্ভব হয়েছে একমাত্র ইরানের ইসলামী বিপ্লবের কারণে।

এ বিপ্লবের মধ্যেই এমন শক্তি নিহিত রয়েছে যা সমগ্র মুসলিম মিল্লাতের কল্যাণে আসতে পারে। সুন্নি মুসলিম অধ্যুষিত দেশসমূহ যথা আরব রাষ্ট্রগুলো আফগানিস্তান ও অন্য সব দেশের মুসলমানদের উচিত এ বিপ্লবের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করা এবং একে এগিয়ে নেবার জন্য সব রকমের সমর্থন ও সহযোগিতা প্রদান করা।

ড. কালিম সিদ্দিকী

ইরানের ইসলামী বিপ্লব সম্পর্কে ভালোমন্দ যার যা-ই ধারণা থাক না কেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো এই বিপ্লবের আধ্যাত্মিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক উৎস পুরোপুরিভাবেই ইসলামের গভীরে নিহিত রয়েছে। ঔপনিবেশিক আমলের মুসলিম রাজনৈতিক চিন্তাধারার সাথে জড়িত সকল প্রতিষ্ঠান ও ধ্যান-ধারণা এবং ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ বাইরে এই বিপ্লব অবস্থান করছে। ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের আগ পর্যন্ত এটা বিশ্বাস করা কঠিন ছিল যে, ইরানে (শাহের ইরানে) রীতিমতো ইসলামী নেতৃত্বের উৎস বিরাজ করছে এবং তাঁরা তখন পর্যন্ত পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা দ্বারা সংক্রমিত হননি। সম্পূর্ণ আলাদা এবং স্বতন্ত্রভাবে বিকশিত শিয়া ধর্মতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ববিদ ও তাঁদের প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং উসুলী আলেম সম্প্রদায়ই সমসাময়িক ইস্যুগুলোর ওপর সক্রিয়ভাবে ইজতিহাদে আত্মনিয়োগ করেন। এর ফলে ঔপনিবেশিক আমলের মুসলিম রাজনৈতিক ভাবধারা এবং এর প্রতিষ্ঠানসমূহের আধিপত্যের বিরুদ্ধে স্পষ্টভাবে চ্যালেঞ্জ করার প্রয়োজনীয় ধ্যান-ধারণা এবং নেতৃত্বের উদ্ভব ঘটে।

ইসলামের শক্তির দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ উৎস হলো মুসলিম সর্বসাধারণ বা জনতা। মুসলিম জনতাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উপনিবেশিক আমলের রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা দ্বারা সংক্রমিত ছিল না। জাতীয়তাবাদী আবেগের প্রতি জনতার বিপুল সাড়া পাওয়া যায় যখন ১৯৫১ সালে অ্যাংলো-ইরানিয়ান তেল কোম্পানির মালিকানা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। পৃথিবীর অন্যান্য এলাকায়ও জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ নিজেদের পৃষ্ঠপোষক উপনিবেশিক শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে জনতাকে সাময়িকভাবে সংঘবদ্ধ করতে কম-বেশি সফল হয়েছিল। কিন্তু এর আগে কোন সময় পৃথিবীর কোন অঞ্চলে সর্বসাধারণ মুসলিম রাজতন্ত্র হতে স্বাধীন এবং উপনিবেশিক আমলের রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার বাইরে কোন ইসলামী নেতৃত্বের ছোঁয়া পায়নি। ইরানের মুসলিম জনতার মাঝে উলামা বা ইসলামী শক্তির এক অতলান্ত উৎসের সন্ধান পেয়েছিলেন যা ইতিপূর্বে কোন ইসলামী আন্দোলন আবিষ্কার করতে পারেনি। ইরানে উলামা আর মুসলিম জনতার সম্মিলন (fusion) ইসলামের অনুপম আর অজেয় শক্তির স্ফূরণ ঘটিয়েছিল। এই শক্তির স্ফূরণ প্রতিষ্ঠিত স্বৈরাচারকে পরাজিত করেছে, দেশের অভ্যন্তরীণ বিপ্লববিরোধী উৎসগুলো নির্মূল করেছে, বিদেশী সামরিক ও অর্থনৈতিক মাতব্বরিকে খামোশ করে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক দুশমনদের একটি যৌথ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে এই শক্তি এখন প্রলম্বিত যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। ইসলামের এই অনবদ্য শক্তি একটি নতুন রাষ্ট্রও স্থাপন করেছে। এই রাষ্ট্রের রয়েছে একটি নতুন সংবিধান এবং উপনিবেশিক রাজনৈতিক চিন্তা কাঠামোমুক্ত সম্পূর্ণ নতুন ইসলামী প্রতিষ্ঠানসমূহ। এভাবে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ঔপনিবেশিক শক্তি ও তাদের দোসরদের তিনশ’ বছরের অধিককালের কষ্টার্জিত আধিপত্য ব্যবস্থাকে ইসলামী বিপ্লব নাস্তানাবুদ করে ফেলল।

ইরানে ইসলামী বিপ্লবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবদান হলো শাসক ও শাসিতের মধ্যকার এই চির প্রসারমান ব্যবধানে সুদৃঢ় সেতুবন্ধ রচনা। এই সাফল্য অর্জিত হয়েছে ইসলামের মূল ভূখণ্ডে জনগণ ও উলামাদের মধ্যে স্থিতিশীলতা, শক্তিমত্তা, পারদর্শিতা ও তাকওয়ার নতুন নতুন কেন্দ্র চালু করার মাধ্যমে এবং উপনিবেশবাদ প্রভাবিত জাহেলিয়ার ভূত যা এতদিন পরগাছার মতো ইরানে শেকড় গেঁড়ে বসেছিল তা উপড়ে ফেলার মাধ্যমে।

(নিউজলেটার, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৩)

সাংস্কৃতিক বিনিময় বনাম সাংস্কৃতিক আধিপত্য

সংস্কৃতি হলো একটি গতিশীল বিষয়। মানবজাতির সমগ্র ইতিহাসই সংস্কৃতির এই চিরন্তন পরিবর্তনশীল বা গতিশীলতার অনড় সাক্ষী। সংস্কৃতির এই আবহমান পরিবর্তনশীল প্রকৃতির কারণেই একটি সংস্কৃতির মৃত্যু এবং আর একটি সংস্কৃতির জন্ম হয়। তবে সবসময় যে এই পরিবর্তনগুলো একটি নতুন সংস্কৃতির জন্ম দেবে, এমন কথা নয় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা হয়ও না। ইসলামী সংস্কৃতিও এর ব্যতিক্রম নয়। ইসলাম তার চৌদ্দশ বছরের ইতিহাসে এরূপ অনেক জোয়ার-ভাটা প্রত্যক্ষ করেছে। তবে একথাও সত্য যে, নানা ঘাত-প্রতিঘাত ও প্রতিকূলতার পরও ইসলামী সংস্কৃতি তার স্বকীয়তায় বিদ্যমান থেকে নিজস্ব গতিতে এগিয়েও চলছে।

বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীতে বর্তমান সংস্কৃতি ও সভ্যতাগুলোও কম-বেশি এই বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে। এগুলো বিভিন্ন চড়াই-উৎরাই পেরিয়েই বর্তমান অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। এগুলোর মধ্যে যেগুলো এসব ধকল বা প্রতিকূলতা সামলিয়ে উঠতে পারেনি, সেগুলো কালের গহ্বরে হারিয়ে গেছে।

যে তিক্ত বিষয়টি বর্তমান বিশ্বের সবাইকে কম-বেশি ভাবিয়ে তুলেছে তা হলো ‘পশ্চিমা মার্কিন সাংস্কৃতিক আগ্রাসন’, বিশেষ করে ‘মার্কিন সাংস্কৃতিক আগ্রাসন’। পশ্চিমা ঔপনিবেশিক আধিপত্যবাদের মাধ্যমেই পশ্চিমা সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ গড়ে উঠেছে। তারা তাদের চাপিয়ে দেওয়া অপসংস্কৃতির ফাঁদে ফেলে অন্যান্য জাতির বিশ্বাস ও মূল্যবোধে ধস নামানোর হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এক্ষেত্রে তারা তাদের প্রচারণামূলক কাজে বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমগুলোকে একচেটিয়াভাবে ব্যবহার করছে।

পশ্চিমাদের এরূপ আধিপত্যবাদী সাংস্কৃতিক নীতির কারণেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ব্যবধান ও দ্বন্দ্ব শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সীমিত না থেকে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও বিস্তৃত হয়েছে। কেননা, বিশ্বের মানুষ এখন বুঝতে পেরেছে অন্যান্য সংস্কৃতি ও সভ্যতার প্রতি পশ্চিমা সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাবোধ নেই এবং অন্যান্য সংস্কৃতি ও সভ্যতার উপর একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করাই তার মূল উদ্দেশ্য। সে জন্য অন্যান্য সংস্কৃতির সাথে পশ্চিমা সংস্কৃতির বিনিময় দ্বি-পাক্ষিক না বলে বরং এক তরফা বলা চলে। পারস্পরিক সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে বিভিন্ন সংস্কৃতি ও সভ্যতার সমৃদ্ধি ঘটে। কিন্তু পশ্চিমা সংস্কৃতি ও প্রাচ্যের সংস্কৃতির বিনিময়ের বেলায় এই দর্শন অকার্যকর; বরং সেখানে বিনিময়টা হয় একপেশে বিনিময় নীতির ভিত্তিতে।

ইতিহাসের আলোকে বলা যায়, পৃথিবীর অন্যান্য সংস্কৃতি থেকে একটি বিশেষ সংস্কৃতির বিচ্ছিন্নতা তাকে লাঞ্ছনা ও ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। এটাকে আমরা মূল থেকে বিচ্ছিন্ন একটি গাছের সাথে গণ্য করতে পারি।

কাজেই কোন সংস্কৃতি যদি তার স্বকীয়তা নিয়ে টিকে থাকতে চায় এবং যথাযথ মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠা পেতে চায়, তাহলে তাকে যথাযথ অর্থে ‘সাংস্কৃতিক বিনিময়’ দর্শনে বিশ্বাসী হতে হবে এবং কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। এ ‘সাংস্কৃতিক বিনিময়’ হতে হবে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে এবং সৌহার্দমূলক পরিবেশে। অন্যথায় এই ‘সাংস্কৃতিক সম্পর্ক’ উন্নয়নের বিষয়টি কেবল একটি ‘স্বগতোক্তি’র মতোই হয়ে থাকবে। বাস্তবতায় এর কোন প্রতিফলন থাকবে না। উপরন্তু তা কিছু বাড়তি সমস্যার সৃষ্টি করবে যা জাতিসমূহের সাংস্কৃতিক সত্তার জন্য বয়ে আনবে ভীতিকর দুর্দশা।

বর্তমান বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলো যদি ‘নতুন বিশ্বব্যবস্থা’ কিংবা ‘যোগাযোগ বিপ্লব’ প্রভৃতি স্লোগানের আলোকে সবকিছু চিন্তা-ভাবনা করে, তবে এটা দিবালোকের মতো সত্য যে, তারা বলতে চায়, ‘সাংস্কৃতিক বিনিময়’ প্রতিষ্ঠিত আছে এবং তা এই বৃহৎ শক্তিগুলো বনাম অন্যান্য দেশের মধ্যে। কিন্তু ইতিমধ্যে বাস্তবে আমরা যা দেখতে পেয়েছি তা হলো এই তথাকথিত বিনিময়ের নামে এই ‘সাংস্কৃতিক বিনিময়’ একপেশে এবং এক তরফা বিনিময়ে পরিণত হয়েছে। এই বিনিময় ব্যবস্থায় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো ঐসব তথাকথিত বৃহৎ শক্তির কাছ থেকে সংবাদ, তথ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি প্রভৃতি গ্রহণ করবে, কিন্তু তারা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর কাছ থেকে কিছুই গ্রহণ করবে না। কাজেই এই একতরফা ‘সংস্কৃতি-বিনিময়কে’ আমরা আর যা কিছু বলতে পারি অন্তত একে ‘সাংস্কৃতিক বিনিময়’ বলতে পারি না।

এই প্রেক্ষিতে ঐসব তথাকথিত বৃহৎ শক্তির সর্তক হওয়া উচিত। কেননা, তারা যদি মনে করে যে, তারা তাদের সংস্কৃতি ও সভ্যতা দিয়ে বিশ্বের সব মানুষের চিন্তা-চেতনাকে প্রভাবিত করে তাদের স্বমতে নিয়ে আসতে পারবে, তবে তা হবে একটি বিরাট ভুল চিন্তা। কেননা, অতীতেও অনেক স্বৈরাচারী শক্তি এরূপ চিন্তা করেছিল এবং তা বাস্তবায়নে সম্ভাব্য সব ধরনের পন্থাও অবলম্বন করেছিল; কিন্তু তাদের সব চিন্তা-চেতনা ও প্রয়াস ভেস্তে গিয়েছিল। কোন সংস্কৃতিই তার স্বকীয়তা পুরোপুরি হারায় না এবং কালের ¯্রােতে নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে ফিরে আসে। এই একই কারণে এই নব্য শক্তিরাও তাদের অপসংস্কৃতি দ্বারা অন্যান্য বিশুদ্ধ সংস্কৃতির মূলোৎপাটন করতে সক্ষম হবে না।

এসব তথাকথিত শক্তিকে সর্তক করা এই লেখার মূল উদ্দেশ্য নয়; বরং এই প্রেক্ষিতে মুসলমানদের করণীয় কী তাই স্মরণ করিয়ে দেওয়াই আমাদের এই আলোচনার মূল উদ্দেশ্য। মুসলমানদের উচিত ইসলামের সমৃদ্ধ সংস্কৃতিকে যথাযথভাবে অনুধাবন করে তা বিশ্ববাসীর কাছে প্রচার করা। কেননা, পবিত্র কুরআনের মতে, পশ্চিমা সংস্কৃতিকে সাগরের ঢেউয়ের চূড়ায় যে ফেনা থাকে তার সাথে তুলনা করা যায় যা ঢেউ সরে গেলে সাগরের বুকে বিলীন হয়ে যায়। পক্ষান্তরে ইসলাম ও ইসলামী সংস্কৃতিকে একটি প্রশান্ত সাগরের স্থির পানির সাথে তুলনা করা যায় যা অনন্ত ও স্থায়ী।

স্মার্ট ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র উদ্বোধন করল ইরান: বাড়বে যুদ্ধ ক্ষমতা

অত্যাধুনিক স্মার্ট ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার উদ্বোধন করেছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান।সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে এ ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করা হয়েছে এবং ব্যালিস্টিক এ ক্ষেপণাস্ত্র অত্যন্ত নিখুঁতভাবে তার লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পারে। ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞরা এ ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করেছেন। এর পাশাপাশি নতুন ধরনের সাঁজোয়াযান উদ্বোধন করা হয়েছে।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হোসেইন দেহকান, সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অব স্টাফের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল হাসান ফিরোজাবাদি এবং অন্য শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা।স্মার্ট ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির ফলে নৌ ও স্থলযুদ্ধে ইরানের নির্ভুল হামলার সক্ষমতা অনেক বেড়ে যাবে। একইসঙ্গে ইরানের সশস্ত্র বাহিনী অনেক বেশি শক্তি সঞ্চয় করবে।

এ ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে সফলতার পর ইরান এখন হাতে গোণা কয়েকটি দেশের তালিকায় স্থান করে নিল যারা কৌশলগত অস্ত্রের ক্ষেত্রে এই বিশেষ প্রযুক্তির অধিকারি।এছাড়া, নতুন যে সাঁজোয়াযান তৈরি করা হয়েছে তা স্টিল কোর এন্টি আর্মর বুলেট প্রতিরোধ করতে সক্ষম। আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে এ যান তৈরি করা হয়েছে।

রেডিও তেহরান, ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪

ব্যালিস্টিক ও লেসার গাইডেড মিসাইলের পরীক্ষা চালালো ইরান

নতুন প্রজন্মের ব্যালিস্টিক ও লেসার গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালিয়েছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান।ইরানের ইসলামি বিপ্লবের ৩৫তম বিজয় বার্ষিকী উদযাপনের প্রাক্কালে এসব পরীক্ষা চালানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হোসেইন দেহকান।

তিনি জানান, ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য দূরপাল্লার নতুন ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র একইসঙ্গে বহুসংখ্যক ওয়ারহেড বহন করতে পারবে। আর লেসার গাইডেড মিসাইল হচ্ছে বিমান থেকে ভূমিতে আবার ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপ করা যাবে। দু’টি ক্ষেপণাস্ত্রেরই পরীক্ষা সফল হয়েছে বলে জানান তিনি। লেসার গাইডেড মিসাইলের ফার্সি নাম দেয়া হয়েছে বিনা।

হোসেইন দেহকান জানান, সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি নতুন দু’ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র শত্রুর ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করতে এবং একইসঙ্গে বহুসংখ্যক লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করতে পারবে। তিনি জানান, লেসার গাইডেড মিসাইল ভূমি থেকে আবার আকাশ থেকে নিক্ষেপ করা যাবে।

ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, এ ক্ষেপণাস্ত্র অত্যন্ত নিখুঁতভাবে সেতু, ট্যাংক এবং শত্রুর কমান্ড সেন্টার ধ্বংস করতে সক্ষম। তিনি বলেন, ইরানের এসব অর্জন থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইসলামি বিপ্লব সঠিক পথে এগিয়ে যাচ্ছে।

রেডিও তেহরান, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪

নিজস্ব ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা সিমুলেটর উদ্বোধন করল ইরান

নিজস্ব প্রযুক্তিতে আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা উদ্বোধন করল ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সেনাবাহিনী। এর মধ্যে রয়েছে শাহীন ও অন্যান্য আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা।সিমুলেটরগুলো তৈরি করছে খাতামুল আম্বিয়া বিমান ঘাঁটির প্রকৌশলী ও বিশেষজ্ঞরা। তরুণ বিমানসেনাদের প্রশিক্ষণে এসব সিমুলেটর ব্যবহার করা হবে।

গতকাল (মঙ্গলবার) এক বিবৃতিতে খাতামুল আম্বিয়ার কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফারজাদ ইসমাইলি তেহরানে বলেন, ইরানের তৈরি এসব সিমুলেটর অনেক বেশি আধুনিক, দ্রুত গতির ও মূল ব্যবস্থার চেয়েও অনেক নিখুঁত।

তিনি  বলেন, “এসব সিমুলেটরের নকশা প্রণয়ন ও তৈরির আগে আমাদের সম্পূর্ণ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাপনা স্থাপন করতে হত। এমনকি, প্রায় দেড়শ’ কর্মী মোতায়েন করতে হত যেন অন্যরা প্রশিক্ষণের কাজে তা ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু, এখন এসব সিমুলেটরের মাধ্যমে আমরা অনেক বাস্তবসম্মতভাবে প্রশিক্ষণ দিতে পারব।”

এসব সিমুলেটর আকাশ প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে কর্মীদের দক্ষতা আরো বাড়াবে। সেই সঙ্গে প্রশিক্ষকরা আকাশের বিভিন্ন এলাকায় ক্ষেপণাস্ত্র, বিমান, হেলিকপ্টার ও ড্রোনকে টার্গেট হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন বলেও জানান কমান্ডার।

রেডিও তেহরান, ২৯ জানুয়ারি, ২০১৪

হযরত আলী (আ.)-এর বাণী- নাহজুল বালাগা থেকে

একদিন হযরত আলী (আ.) এক আস্তাকুঁড়ের পাশ দিয়ে পথ অতিক্রম করার সময় বলেন : ‘এ হচ্ছে সে জিনিস যা নিয়ে কৃপণগণ কার্পণ্য করত।’

আর অন্য একটি বর্ণনা মতে তিনি বলেন : ‘এ হচ্ছে জিনিস যার ভালোবাসা ও লিপ্সায় গতকাল পর্যন্ত তোমরা প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিলে।’- নাহজুল বালাগা, উক্তি নং ১৮৬

হযরত আলী (আ.) বলেছেন : ‘যে সম্পদ তোমার জন্য উপদেশ রেখে গিয়েছে, তা বিনষ্ট হয়নি।’- নাহজুল বালাগা, উক্তি নং ১৮৭

হযরত আলী (আ.) বলেছেন : ‘মানুষের দেহ যেমন অবসন্ন বা ক্লান্ত হয়। অতএব, অন্তরের অবসন্নতা দূর করার জন্য জ্ঞানের বিষয়সমূহ অন্বেষণ কর।’- নাহজুল বালাগা, উক্তি নং ১৮৮

হযরত আলী (আ.) বলেন : ‘প্রত্যেক লোকের সাথে দু’জন ফেরেশতা রয়েছেন তাঁরা তাকে হেফাজত করে থাকেন। আর যখন অলঙ্ঘনীয় তাকদীর এসে পড়ে তখন ফেরেশতাগণ তাকে ছেড়ে চলে যান। আর মানুষ তথা কোন প্রাণীর জন্য ‘নির্ধারিত সময়কাল’ হচ্ছে একটি সুরক্ষিত বর্ম।’ (অর্থাৎ মানুষের যখন অন্তিমকাল এসে যায় তখন তার সঙ্গের ফেরেশতাদ্বয় তাকে ছেড়ে চলে যান এবং তাকদীর অনুযায়ী তার জীবনের অবসান ঘটে।)- নাহজুল বালাগা, উক্তি নং ১৯২

হযরত আলী (আ.) লোকদের উদ্দেশ্যে বলেন : ‘হে লোক সকল! আল্লাহকে ভয় কর যিনি শোনেন যখন তোমরা কথা বল আর তোমার কোন কিছু গোপন করলে তিনি তা জানেন। আর মৃত্যুর পূর্বে নেক কাজে অগ্রসর হও। মৃত্যুর নিকট থেকে পলায়ন করলে মৃত্যু তোমাদেরকে ধরে ফেলবে। আর দাঁড়িয়ে থাকলেও মৃত্যু তোমাদের ধরে ফেলবে। তোমরা মৃত্যুকে ভুলে গেলে মৃত্যু তোমাদের স্মরণ করবে।’- নাহজুল বালাগা, উক্তি নং ১৯৪

(নিউজলেটার, ডিসেম্বর ১৯৯১)