All posts by dreamboy

চালু হলো ‘গাদির’ রাডার ব্যবস্থা; সনাক্ত করা যাবে উপগ্রহও

ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী-আইআরজিসি আনুষ্ঠানিকভাবে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন রাডার ব্যবস্থা ‘গাদির’ চালু করেছে। এই ব্যবস্থা স্টিলথ বিমান সনাক্ত করতে সক্ষম।

আজ (সোমবার) তেহরানে খাতামুল আম্বিয়া বিমান প্রতিরক্ষা ঘাঁটির কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফারজাদ ইসমাঈলসহ পদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে এটি চালু করা হয়। অত্যাধুনিক এ রাডার ব্যবস্থা আকাশ পথের শত্রুদের সনাক্ত করতে ত্রিমাত্রিক প্রযুক্তি ব্যবহার করবে। এ রাডার ব্যবস্থা স্টিলথ বিমান, ক্রুজ ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং লো অরবিট বা প্রাথমিক কক্ষ পথের কৃত্রিম উপগ্রহ সনাক্ত করতে হবে।

২০১১ সালে মহানবী (সা.) নামের সামরিক মহড়ার সময় প্রথম বারের মতো এই রাডার ব্যবস্থাটি জনসমক্ষে উন্মোচন করা হয়। পরে এই ব্যবস্থাটি ব্যপক সংখ্যায় উৎপাদন করা হয়। আজ সেই রাডার ব্যবস্থাটিই আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করা হলো। আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করার আগে বেশ কয়েক দফায় এর পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়েছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরান প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে। দেশটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সরঞ্জাম ও ব্যবস্থা তৈরিতেও সাফল্য পেয়েছে। তবে সামরিক শক্তি অর্জনের বিষয়ে ইরান বলেছে, দেশটির সেনাবাহিনী অন্য কোনো দেশের জন্য হুমকি সৃষ্টি করবে না, কারণ সামরিক শক্তি অর্জনের প্রধান লক্ষ্য হলো-আত্মরক্ষা।

তেহরান রেডিও, ২ জুন, ২০১৪

ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র: চলমান লক্ষ্যবস্তুতে নিখুঁত আঘাতের ক্ষমতা বাড়ল

ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি’র ডেপুটি কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হোসেইন সালামি বলেছেন, চলমান লক্ষ্যবস্তুতে নিখুঁতভাবে আঘাতের জন্য ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে যে কোনো চলমান লক্ষ্যবস্তুতে নিখুঁতভাবে আঘাত হানতে পারবে এসব ক্ষেপণাস্ত্র।

তিনি বলেন, বৈজ্ঞানিক দিক থেকেও এটাকে অসম্ভব মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো- ইরান এ প্রযুক্তি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। তিনি বলেন, আমেরিকার কাছেও এ প্রযুক্তি নেই। ইরানের বাইরে একমাত্র রাশিয়া এ প্রযুক্তির অধিকারী বলে তিনি ঘোষণা করেন। সালামি বলেন, ‘আমরা বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থারও উন্নয়ন ঘটিয়েছি।’ স্পর্শকাতর হওয়ার কারণে এ বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছু জানাতে রাজি হননি তিনি।

গত শুক্রবারও আইআরজিসি’র ডেপুটি কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হোসেইন সালামি বলেছেন, বিশ্বের যেকোনো স্থানে শত্রুর অবস্থানে হামলা চালাতে সক্ষম ইরান। জেনারেল সালামি বলেন, ইসলামি ইরানের বিরুদ্ধে কেউ যদি কোনো ধরনের আগ্রাসন চালাতে চায় তাহলে তেহরান বিশ্বের যেকোনো স্থানে শত্রুর কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থে আঘাত হানবে; সে ক্ষমতা ইরানের আছে।

রেডিও তেহরান, ১ জুন, ২০১৪

‘এস-২০০ ব্যবস্থায় নিজস্ব ক্ষেপণাস্ত্র বসিয়েছে ইরান’

এস-২০০ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থায় নিজস্ব প্রযুক্তির ক্ষেপণাস্ত্র বসিয়েছে ইরান। সাইয়্যাদ বা হান্টার-৩ নামের এ ক্ষেপণাস্ত্র ইরানের বিজ্ঞানীরা তৈরি করেছেন এবং এটা অত্যন্ত নিখুঁতভাবে দ্রুতগতিতে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে।S-200, saiyed missle

ইরান ২০১০ সালের নভেম্বর মাসে দেশে তৈরি এস-২০০ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার সফল পরীক্ষা চালায়।

খাতামুল আম্বিয়া বিমান ঘাঁটির ডেপুটি কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহরুখ শাহরাম আজ (শনিবার) জানিয়েছেন, সাইয়্যাদ-৩ ক্ষেপণাস্ত্রকে এস-২০০ ব্যবস্থার উপযোগী করে উন্নয়ন ঘটানো হয়েছে। এ ক্ষেপণাস্ত্র মধ্য আকাশের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারবে। মধ্যম পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সাইয়্যাদ-২ এর উন্নত সংস্করণ হচ্ছে সাইয়্যাদ-৩।

জেনারেল শাহরাম আরো জানান, দেশে তৈরি মেরসাদ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থায় আগে শালামচেহ ক্ষেপণাস্ত্র যোগ করা হয়েছিল কিন্তু এখন খাতামুল আম্বিয়া ঘাঁটির বিশেষজ্ঞরা মেরসাদ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থায় সাইয়্যাদ-২ ক্ষেপণাস্ত্র বসিয়েছেন। সাইয়্যাদ-২ হচ্ছে ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ৩৫০ কিলোমিটার পাল্লার একটি ক্ষেপণাস্ত্র যা আকাশে শত্রুর ক্ষেপণাস্ত্রসহ বিভিন্ন ধরনের হেলিকপ্টার, ড্রোন ও ছোট আকারের রাডার ধ্বংস করতে পারে।

রেডিও তেহরান, ২৬ এপ্রিল, ২০১৪

তেহরান পরমাণু চুল্লির সর্বাধুনিক কন্ট্রোল রুম উদ্বোধন

জাতীয় পরমাণু প্রযুক্তি দিবস উপলক্ষে ‘তেহরান পরমাণু চুল্লি’র সর্বাধুনিক কন্ট্রোল রুম উদ্বোধন করা হয়েছে। এটাকে ইরানের পরমাণু প্রযুক্তির ক্ষেত্রে একটি বড় অগ্রগতি হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে।

পরমাণু চুল্লির সর্বাধুনিক কন্ট্রোল রুমটি ইরানেই নির্মাণ করা হয়েছে এবং এটি নির্মাণে প্রায় চার বছর সময় লেগেছে। জাতীয় পারমাণবিক শক্তি সংস্থার প্রধান আলী আকবর সালেহি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, তেহরান পরমাণু চুল্লির কন্ট্রোল রুমের উদ্বোধন পরমাণু কর্মসূচির ক্ষেত্রে আরেক ধাপ অগ্রগতি।

তিনি বলেন, তেহরান পরমাণু চুল্লির কন্ট্রোল রুমে ব্যবহৃত প্রযুক্তিটি ছিল প্রায় ৫০ বছর আগের। এখানে অ্যানালগ সিস্টেমে তথ্য সংগ্রহ করা হতো। কিন্তু এখন এনালগ ও ডিজিটাল সিস্টেমের সমন্বয়ে সর্বাধুনিক কন্ট্রোল রুম তৈরি করা হয়েছে। পরমাণু ক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্য বিভিন্ন অঙ্গনে কাজে লাগানো হবে বলেও তিনি জানান।

রেডিও তেহরান, ১০ এপ্রিল, ২০১৪

সম্পাদকীয়

ইসলামী বিপ্লবের সফল অভিযাত্রার পঁয়ত্রিশ বছর
ইরানের ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের পর পঁয়ত্রিশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। ইরানী বর্ষপঞ্জির ১৩৫৭ সালের ২২শে বাহ্মান মোতাবেক খৃস্টীয় ১৯৭৯ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি মহান দ্বীনী নেতা ওলীয়ে কামেল হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর প্রাজ্ঞ ও দূরদর্শী নেতৃত্বে ইরানের ইসলাম-প্রিয় জনগণ আড়াই হাজার বছরের তাগূতী রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ও বহিঃশক্তির পদলেহী তৎকালীন শাহের ইসলাম-বিরোধী গণ-দুশমন সরকারকে উৎখাত করে মহান ইসলামী বিপ্লবকে- যা ছিল বিংশ শতাব্দীর, বরং হাজার বছরেরও বেশি কালের বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম গণবিপ্লব- বিজয়ী করেন। এ বিজয়ের অব্যবহিত পরেই ইরানী জনগণ হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর আহ্বানে সাড়া দিয়ে একটি গণভোটে অংশগ্রহণ করে প্রায় সর্বসম্মত রায়ে আল্লাহ্ তা‘আলার আইন এবং হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) ও মাসুম ইমামগণের (আ.) দিকনির্দেশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে ইরানের বুকে একটি পুতপবিত্র আদর্শ দ্বীনী সমাজ ও জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন।
যেহেতু ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা- যা মানুষের ইহ ও পরকালীন উভয় জীবনের সকল ক্ষেত্রের সর্বোত্তম কল্যাণ ও সাফল্য নিশ্চিত করে এবং এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের দায়িত্ব ইসলামী রাষ্ট্রের ওপর অর্পিত সেহেতু ইসলামী প্রজাতন্ত্র কেবল ইরানী জনগণের দ্বীনী ও চারিত্রিক উন্নয়নই নিশ্চিত করে নি, বরং দুর্নীতিমুক্ত দ্বীনী সমাজ ও প্রশাসনের বদৌলতে এবং সর্বোপরি আল্লাহ্ তা‘আলার বিশেষ অনুগ্রহে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের পক্ষে আন্তরিকতা ও দৃঢ়তা সহকারে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে স্বনির্ভরতা অর্জন সহ সর্বাত্মক পার্থিব উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে নযিরবিহীন সাফল্যের অধিকারী হয়েছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ ও নিষেধাজ্ঞা সহ ইসলাম ও ইসলামী হুকুমতের দুশমনদের শত্রুতামূলক সর্বাত্মক অপতৎপরতার বাধাবিঘেœর পাহাড় অতিক্রম করে- যা শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সমগ্র বিশ্ববাসীর বিস্ময়ের কারণ হয়েছে।
বিগত পঁয়ত্রিশ বছরে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান কূটনৈতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সহ সার্বিক ক্ষেত্রে যে বিস্ময়কর উন্নতি ও অগ্রগতি হাসিল করেছে তার সবগুলো শিরোনাম উল্লেখ করাও অত্র সীমিত পরিসরে সম্ভব নয়। এখানে কেবল এতোটুকু উল্লেখ করাই যথেষ্ট যে, বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি হবার দাবিদার বলদর্পী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন যায়নবাদী ও পাশ্চাত্য বিশ্বের রক্তচক্ষু হুমকি উপেক্ষা করে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান বিশ্বের অন্য সকল রাষ্ট্রের সাথে, বিশেষ করে বিভিন্ন মুসলিম সংখ্যাগুরু দেশের সাথে বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক শুধু বজায় রেখেই চলছে না, বরং এ সম্পর্ক দিন দিন অধিকতর শক্তিশালী ও গভীরতর করতে সক্ষম হচ্ছে। এছাড়া ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান বিগত সাড়ে তিন দশক কালে জাতিসংঘ, ন্যাম, ওআইসি, ইসিও ইত্যাদি সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ফোরামে স্বীয় দৃষ্টিগ্রাহ্য উপস্থিতি বজায় রেখেছে এবং এখনো রেখে চলেছে, বিশেষ করে ন্যামের ইতিহাসের সফলতম সম্মেলনের স্বাগতিক দেশের ভূমিকা পালন করে শত্রু শিবিরকে হতবিহ্বল করে দিয়েছে। ইসলামী ইরান আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শান্তিপ্রচেষ্টার ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে।
অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সাক্ষরতা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, টেলিফোন ও মোবাইল, বিজ্ঞান গবেষণা, বিশেষতঃ আইটি, পরমাণু বিজ্ঞান ও ন্যানো-টেকনোলজি, সড়ক, রেল ও বিমান যোগাযোগ, কৃষি, শিল্প, বৈদেশিক বাণিজ্য ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি করেছে এবং এগুলোর মধ্য থেকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উন্নতির গতি বা হারের দিক থেকে বিশ্বে বা মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে শীর্ষস্থান বা তার কাছাকাছি স্থান দখল করতে সক্ষম হয়েছে।
এমনকি সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও ইসলামী ইরান অবিশ্বাস্য সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সংস্কৃতির নামে অনৈতিক কার্যকলাপ এবং নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ও প্রকাশ্য ঘনিষ্ঠতা কঠোরভাবে পরিহার করা সত্ত্বেও ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে নির্মিত বহু চলচ্চিত্র সারা বিশ্বে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে এবং সার্বিক মানের বিচারে প্রতিযোগিতায় শীর্ষস্থানীয় বিবেচিত হওয়ায় এমনকি পাশ্চাত্য জগতেও বহু পুরস্কার লাভ করেছে- যা প্রমাণ করে যে, ইসলামী মানদ- তথা পরিশীলিত রুচিবোধ বজায় রেখেও সর্বোত্তম শিল্প সৃষ্টি করা সম্ভব।
ইরানের ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের পঁয়ত্রিশতম বার্ষিকীতে আমরা দেশে-বিদেশে অবস্থানরত সকল ইরানী জনগণ, বিশ্বের সকল মুক্তিকামী মুস্তায্‘আফ জনগণ, ইসলামী বিপ্লব ও ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সকল শুভানুধ্যায়ী এবং নিউজলেটারের সকল পাঠক-পাঠিকার প্রতি গভীর আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি এবং এ বিপ্লবের স্থায়িত্ব ও ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সার্বিক উন্নয়ন তৎপরতায় অধিকতর গতি সঞ্চারের জন্য সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে একনিষ্ঠভাবে প্রার্থনা করছি।

লস অ্যাঞ্জেলেসে বিশ্ব কুস্তি প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন ইরান

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে অনুষ্ঠিত বিশ্ব কুস্তি প্রতিযোগিতায় টানা তৃতীয়বারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ইরান। আমেরিকার স্থানীয় সময় রোববার রাতে (ইরান সময় সোমবার ভোর ৫টায়) অনুষ্ঠিত ফাইনাল রাউন্ডে রুশ দলকে ৪-২ পয়েন্টে পরাজিত করে এ গৌরব অর্জন করে ইরান।

শনিবার থেকে শুরু হওয়া বিশ্ব ফ্রিস্টাইল কুস্তি প্রতিযোগিতা রোববার শেষ হয়। শনিবার প্রতিযোগিতার আগের কয়েকটি রাউন্ডে আর্মেনিয়াকে ৮-০ পয়েন্টে, তুরস্ককে ৭-১ পয়েন্টে, যুক্তরাষ্ট্রকে ৫-৩ পয়েন্টে এবং ভারতকে ৮-০ পয়েন্টে পরাজিত করে ইরানি কুস্তি দল।

ফাইনাল রাউন্ডের একক প্রতিযোগিতায় ৫৭ কেজি ওজন বিভাগে ইরানের হাসান রাহিমি রাশিয়ার কুস্তিগির ভিক্টর লেবেদেভের কাছে পরাজিত হন। এরপর ৬১ কেজি ওজন বিভাগে রাশিয়ার মুরাদ নুখকাদিয়েভকে পরাজিত করে ইরানের পক্ষে প্রথম জয় এনে দেন মাসুদ ইমাইলিপুর।

এরপর ৬৫ কেজি ওজন বিভাগে ইরানের পক্ষে পরপর দ্বিতীয় বিজয় ছিনিয়ে আনেন সাইয়্যেদ আহমাদ মোহাম্মাদি। তিনি দারুণ কুস্তিনৈপূণ্য দেখিয়ে তার রুশ প্রতিপক্ষ আলিবেঘাদঝি এমিভকে ঘায়েল করেন। ৭০ কেজি বিভাগে ইরানের মোস্তফা হোসেইনখানি রাশিয়ার খেতিক সাবোলোভকে পরাজিত করেন। এরপর ৭৪ কেজি ওজন বিভাগে রুশ কুস্তিগির আখমেদ গাদঝিমাগোমেদোভ তার ইরানি প্রতিপক্ষ ইজ্জাতুল্লাহ আকবারিকে হারিয়ে দেন।

পরবর্তীতে অনুষ্ঠিত হয় ৮৬ কেজি ওজন বিভাগের প্রতিযোগিতা। এতে ইরানি কুস্তিগির এহসান লাশকারি তার রুশ প্রতিপক্ষ আনযোর ইউরিশেভকে ধরাশায়ী করেন। এরপর ৯৭ কেজি ওজন বিভাগে ইরানি ফ্রিস্টাইল কুস্তিগির রেজা ইয়াজদানি রাশিয়ার ইউরি বেলোনভস্কিকে পরাজিত করেন। সবশেষে অনুষ্ঠিত হয় ১২৫ কেজি ওজন বিভাগের কুস্তি। এতে ইরানি প্রতিযোগী কোমেইল কাসেমি তার রুশ প্রতিপক্ষ আনযোর খেযরিয়েভকে হারিয়ে দেন। ফলে সার্বিকভাবে রাশিয়া ইরানের কাছে ৪-২ পয়েন্টে হেরে যায়। চ্যাম্পিয়ন হয় ইরান।

এর আগে ২০১৩ সালে তেহরানের আজাদি স্পোর্টস কমপ্লেক্সে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ফ্রিস্টাইল কুস্তি প্রতিযোগিতায় ইরান চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। গত বছরের ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতায় রাশিয়া রানার্স আপ ও যুক্তরাষ্ট্র তৃতীয় স্থান অধিকার করেছিল।

রেডিও তেহরান, ১৭ মার্চ, ২০১৪

তাওহীদ ও আল্লাহপ্রেমের প্রেরণাই মসনবী কাব্যের মূল সুর

প্রিন্সিপ্যাল এ. এ. রেজাউল করিম চৌধুরী

 রুমীর মসনবী আমাদের দেশে একটি জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থ। আমাদের মাদ্রাসাসমূহে এই মহাকাব্যের পঠন-পাঠন হয়ে থাকে। আমাদের আলেমসমাজ, পীর-মশায়েখ মসনবী থেকে উদ্ধৃতি পেশ করে ওয়াজ-নসীহত করেন। মসনবীর অনেক ছত্র আমাদের ভাষায় প্রবাদ বাক্যে পরিণত হয়েছে। মসনবী আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনকে সঞ্জীবিত করে রেখেছে।

ছয়শ’ বছরেরও অধিক কাল ফারসি আমাদের রাষ্ট্রভাষা ছিল। আরবি ও ফারসিমিশ্রিত বাংলাভাষাই আমাদের মাতৃভাষা। মসনবী ফারসি ভাষায় লিখিত অনন্য মহাকাব্য। এই মহাকাব্যকে অনুবাদ এবং এর দর্শনকে অবলম্বন করে আমাদের আত্মার জাগৃতিকে আমরা অব্যাহত রাখতে পারব।

আল্লাহর প্রেমের ওপর এত বড় মহাকাব্য পৃথিবীর অন্য কোন ভাষায় ও সাহিত্যে নেই। কাব্যকলার যত রূপ-আঙ্গিক আছে সবগুলোর সমাহার রুমীর মসনবী, Epic, lyric, ode, elegy, তথা কাব্যের যত রূপ এবং ঋড়ৎস আছে সবই সন্নিবেশিত হয়েছে মসনবীতে। মওলানার ভাষা, ছন্দ, শব্দ চয়ন, উপমা, রূপকল্প, প্রতীক তথা অলংকারশাস্ত্র প্রয়োগ ও ছন্দ প্রকরণে যে নৈপুণ্য দেখা যায় তা আর কোথাও পাওয়া যায় না। তাই সারা বিশ্ব মসনবীর শ্রেষ্ঠত্বে এবং মাহাত্ম্যে এত মুগ্ধ, অভিভূত।

মানবাত্মার ইতিকথা বর্ণনার মধ্য দিয়ে রুমী আমাদের অনন্ত জীবনের সন্ধান দিয়েছেন। তাঁর কাব্যের ছত্রে ছত্রে আমাদের আত্মা জেগে ওঠে, অনন্তের অন্বেষায় আমাদের সত্তা উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। রুমীর কাব্যপ্রেরণা তাওহীদ এবং রেসালাতভিত্তিক। তাই তাঁর কাব্যে সত্যিকার কাশ্ফ, এলকার আভাস পাওয়া যায়। এর সাথে খান্নাস ও শয়তানের প্রেরণালব্ধ কবিতার তুলনা হয় না। তিনি ঈমানদার, নেক আমলের কবি। হেদায়াতের পথকে তিনি সুপ্রশস্ত করেছেন।

আমরা আনন্দিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, প্রতিষ্ঠানে রুমীচর্চা ব্যাপকতা লাভ করেছে। রুমীর মসনবীসঞ্জাত খোদাপ্রেম, বিশ্বপ্রেম এবং মানবপ্রেম যতই জাগ্রত হবে ততই এই হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীর জন্য কল্যাণকর হবে। রুমী আমাদের মত পার্থক্য পরিহার করে তাওহীদের মন্ত্রে উজ্জীবিত হবার প্রেরণা দিয়েছেন।

কাব্যকলায় যে Art অবলম্বন করেছেন তা গভীরভাবে প্রণিধানযোগ্য। আল্লাহর প্রতি আমাদের প্রেমকে প্রকাশ করার জন্য তিনি যে পন্থা অবলম্বন করেছেন তা হলো : প্রেমাস্পদের গোপন কথা লুকানো থাকা ভালো, বিভিন্ন গল্পের মাধ্যমে তা বলা যাবে, এসব গোপন রহস্য অন্যের কথাবার্তায় বলা যাবে। তুচ্ছ ঘাসের ওপর পাহাড় রাখা যাবে না, সূর্যকে কাছে আনলে অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। তাই রুমী আল্লাহপ্রেমের এই মহাকাব্যে অসংখ্য বাস্তব, কাল্পনিক কাহিনী, উপকথা, নীতিগল্প, রূপক কাহিনীর সাথে সংযোজিত করেছেন গভীর চিন্তা-চেতনার ¯্রােত যাতে আল্লাহপ্রেমের ঝংকার মানুষ অনুভব করতে পারে।

মসনবীর শুরুতে বাঁশীর রূপকে খোদা থেকে মানবাত্মার বিচ্ছেদ বিরহ যন্ত্রণার সুরকে উচ্চকিত করে মওলানা খোদাপ্রেমের মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন। এই প্রেমের পথে অন্তরায় নাফ্্সকে চিহ্নিত করে সেই নাফ্্সকে দমনের উপায় শিখেয়েছেন বাদশা বাঁদীর গল্পে।

তোতা এবং সবজি বিক্রেতার গল্পে তিনি আমাদের আল্লাহর ওলীদের নিজের অবস্থায় কেয়াস না করার জন্য সাবধান করে দিচ্ছেন। ইয়াহুদী রাজার খ্রিস্টান নিধন গল্প থেকে আমরা এই শিক্ষা পাই যে আল্লাহ যালেমদের অবশ্যই ধ্বংস করে দেবেন যদি ঈমানদারগণ ঈমানের ওপর মজবুত থাকে। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে এই গল্প থেকে আমাদের শিক্ষণীয় অনেক কিছু আছে। সিংহ ও খরগোশের গল্পে আমরা তাকদীর-তদবীর সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, আখেরাত ভুলে গিয়ে দম্ভের সাথে দুনিয়ায় বাহাদুরি করতে থাকলে সিংহের মতো কুয়ায় পতিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যাব। অতি ক্ষুদ্র প্রাণীও বড় প্রাণীকে ধ্বংস করতে পারে যদি তা দাম্ভিক হয়।

ক্ষুদ্র ও দুর্বলকে আল্লাহ পাক এমন হেকমত, কৌশল দান করেন যা সবল এবং বিশাল আকৃতির মধ্যে দেখা যায় না। মৌমাছিকে, রেশম পোকাকে যে হেকমত দেয়া হয়েছে তাতো হাতিকে দেয়া হয়নি। মাটির তৈরি আদমকে ফেরেশতাদের ওপর প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। বাহ্যিক বস্তুর বিজ্ঞানীরা অনেক কিছু আবিষ্কার করেন, কিন্তু আসল জ্ঞান তাঁদের নেই। মানুষের ছোট অন্তরে যে খোদার প্রেম আছে তা সাগরে-আকাশে নেই। বিজ্ঞানের বস্তুগত সাফল্য অনেক, কিন্তু বিজ্ঞান প্রেম কাকে বলে, জানে না। বিজ্ঞানের কোন প্রক্রিয়ায় প্রেমের বিশ্লেষণ নেই, অথচ খোদার প্রেম ছাড়া জীবনটাই নিষ্ফল।

রুমীর কাহিনীর মাধ্যমে খোদাপ্রেমের বর্ণনায় কেউ অসঙ্গতি দেখলেও তা ভিত্তিহীন। এ সম্পর্কে নিকলসন এবং Gustar বলেন : “To say that ‘The stories follow each other in no order’, is entirely wrong. They are bound together by subtle links and transitions arising from the poets’ development of his theme and each book forms an artistic whole.”

কবি মানবাত্মার খোদাপ্রেমের জাগতিক পরিবেশে বিকাশের ক্ষেত্রে যেসব অন্তরায় এবং সহায় আছে সেগুলোকে গল্পকারে মূর্ত করে এক সূক্ষ্ম চিন্তার সূত্রে অচ্ছেদ্যভাব গ্রথিত করে যে অপূর্ব কাব্যিক সুষমা সৃষ্টি করেছেন, বিশ্বের কাব্যসাহিত্যে তার তুলনা নেই।

মওলানা রুমীর মূল্যায়ন করে Nicholson যে মন্তব্য করেছেন, তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন : “Today, the words I applied to the author of the Mathnabi thirty five years ago- ‘the greatest mystical poet of any age’ seem to me no more than just.

Where else shall we find such a panorama of Universal existence unrolling itself through time into eternity? And apart from the supreme mystical quality of the poem, what a wealth of satire, humour and pathos what masterly pictures drawn by a hand that touches nothing without revealing essential character.”

আমাদের বিশ্বজনীন অস্তিত্ব, কাল থেকে মহাকালে উত্তরণের যে অপূর্ব চিত্র সমাহার মসনবীতে বিদ্যমান তা পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই।

রুমীর সেই প্রসিদ্ধ উক্তি : ‘আমি প্রস্তররূপ ছিলাম, সেখান থেকে উদ্ভিদ রূপে জন্ম নিলাম, উদ্ভিদরূপ থেকে প্রাণী রূপে জন্ম নিলাম, প্রাণীরূপ থেকে মানুষ হিসাবে জন্ম নিলাম, মানুষ হিসাবে মৃত্যুর পর ফেরেশতা হব, তারপর আমি অনন্তে বিলীন হয়ে যাব।’ Universal Existence -এর কথা মওলানা বলেছেন : ‘আমি সূর্য কিরণের কণা, আমি সূর্যের গোলক, আমি প্রভাতের আলোক, আমি সন্ধ্যার বায়ু।’

মহাকবির মাজারে

আশ্‌রাফ সিদ্দিকী

হজরত ইমাম রেজার পুণ্য নগরী মাশহাদ থেকে

আমরা চলেছি তুস্ নগরীর পথে

হাইওয়ের শুরুতেই শাহনামার অমর কবি ফেরদৌসীর

বিরাট ভাস্কর্য মূর্তি-

প্রশস্ত রাস্তার দুইপাশে সবুজ থেকে সবুজ চিনাব্ তরুর সারি-

দুইদিকে আংগুর, আপেল, কমলা, পেস্তা এবং জাফরানের বাগান

বাতাসে মধুর মধুর গন্ধ…।

 

চাষীরা কাজ করছেন খেতে খামারে

বোরকায় আবৃত তাদের গৃহিণী এবং কন্যারাও আছেন

কখনো বিশ্রাম করছেন গাছের ছায়ায়

হাতে কফি অথবা চায়ের পেয়ালা

অথবা দু’একটি আপেল বা আংগুরের থোকা।

মাত্র ত তিরিশ কিলোমিটার পথ-

আমাদের গাইড চলন্ত বিশ্বকোশ মোহাম্মদ আমেরী-

ব্যাখ্যা করে চলেছে ইরানের ইতিহাস…।

 

সামনে ডাইনে বাঁক নিতেই তুস্ নগরী

এই কি সেই নদী- যার অকাল বন্যা থেকে দেশবাসীকে বাঁচাতে

ছিল তরুণ ফেরদৌসীর শাহনামা রচনার অমর সাধনা

আর সেই একমাত্র আদরিনী কন্যা-

অর্থ প্রয়োজন ছিল যার শুভ বিবাহের জন্য

গাইড আমেরী বলে চলেছে…।

 

জুন মাসের এই সকালে

শত শত দর্শনার্থীতে উপচে পড়ছে স্মৃতিসৌধের প্রান্তর

সামনেই সাতটি বিচিত্র ফোয়ারা

তাতে রামধনুকের সাতটি রঙ

ডাইনেই মহাকবির বিরাট ভাস্কর্য

মুখে মৃদু হাসি দেখছেন ফোয়ারার রঙধনু…।

 

তাঁর সামনেই মাজার

ঘুমিয়ে আছেন তিনি

দেয়ালে দেয়ালে উৎকীর্ণ শাহনামার বিচিত্র সব ভাস্কর্য।

 

সুলতান মাহমুদ গজনী রক্ষা করেন নাই

ষাট হাজার স্বর্ণ মুদ্রার প্রতিশ্রুতি

কিন্তু তিনি কোথায় আজ? কোথায় তার মাজার?

গাইড বলছে সে মাজারে দর্শকদের নেই যাতায়াত।

কে বড়?- কবি না সম্রাট?

কবির স্পর্ধা- না সম্রাটের অহঙ্কার?

 

চিনাব গাছের তলায় মহাকালের প্রতীক এক মহাকবি

আমাদের এসব আলাপ শুনে

দেখি মৃদু মৃদু হাসছেন,

 

চোখে তাঁর মহাকালের ভ্রুকুটি !!

ইসলামের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ

শের কাভান্দ

‘নিশ্চয়ই আমি আমার রাসূলগণকে প্রেরণ করেছি স্পষ্ট প্রমাণ সহকারে এবং তাঁদের সঙ্গে দিয়েছি কিতাব ও ন্যায়নীতি, যাতে মানুষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে।’ (সূরা হাদীদ : ২৫)

ঐতিহাসিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিভিন্ন পর্যায়ে মানবতা নির্দিষ্ট কিছু ভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিকশিত হয়েছে। সংস্কৃতি এই মানবতা থেকেই উৎসারিত। এমন কোন জাতি নেই যাদের কোন সংস্কৃতি নেই। বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গির আলোকে এই সকল সংস্কৃতি বেড়ে ওঠে ঠিক যেমন শেকড় থেকে খাদ্য নিয়ে একটি গাছ বড় হয়ে ওঠে।

ইরান দেশটা অনেক সংস্কৃতি, সভ্যতা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের সূতিকাগার। তবে ইরানে সভ্যতার চরম উৎকর্ষ সাধিত হয় ইসলাম আসার পর। ইসলাম আসে ইরানে মুক্তির বার্তা নিয়ে। ইসলামের আদর্শে প্লাবিত হয়ে ইরান থেকে শ্রেণিবৈষম্য দূর হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের দ্বার উন্মুক্ত হয় এবং মানবতার উৎকর্ষ সাধিত হয়। তৎকালীন ইরানে ইসলামের আবির্ভাব ছিল শুষ্ক মরুভূমিতে বৃষ্টিপাতের ন্যায়।

সৃষ্টির ঐক্য এবং জাতিসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সহমর্মিতা এবং সৌজন্যবোধের আলোকে ইসলাম দৃপ্ত কণ্ঠে এই ঘোষণা দেয়ার প্রয়াস পায় যে, জাতীয়তাবাদ, সংকীর্ণ দেশাত্মবোধ এবং বর্ণবাদ দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে জাতিসমূহের মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। ইসলাম এই সকল বাধা অপসারণ করে মানবজাতির মাঝে একাত্মতা ঘোষণা করে এবং পরস্পরকে আরো গভীরভাবে জানার ও বুঝার জন্য আহ্বান জানায়।

পাক কুরআনে বলা হচ্ছে : ‘হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে। পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পার…।’ (সূরা হুজুরাত : ১৩)

ইসলামের এই উদারতা মানব সংস্কৃতির সকল জড়তাকে অপসারিত করে নব সৌরভে প্রস্ফুটিত হয়েছে। তাই আমরা দেখতে পাই, এক ইরানী মুসলিমের হাতে আরবি ব্যাকরণের উন্নয়ন ঘটেছে।

আমরা দেখেছি, মুসলিম স্পেন বা মুসলিম আফ্রিকার বিজ্ঞানীরা জ্ঞান সাধনা এবং জ্ঞান আহরণের জন্য পৃথিবীর দূর-দূরান্তে ছুটে গেছেন। মোটের ওপর আমরা দেখতে পাই, ইসলামের স্বর্ণযুগে সকল মুসলিম দার্শনিক, বিজ্ঞানী ও পণ্ডিত জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় গবেষণা করেছেন এবং মানব সভ্যতার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তাঁদের এই সকল প্রচেষ্টার মূলে ছিল ইসলামের মহানবী (সা.)-এর অনুপ্রেরণা। কেননা, তিনিই বলেছেন, ‘জ্ঞান অর্জন করা সকল মুসলিম নর-নারীর ওপর ফরজ বা অবশ্য কর্তব্য।’

আরবি ব্যাকরণের উৎকর্ষ সাধনে সিবোইয়েহ (Sibooyeh), সমাজ বিজ্ঞানের ফয়েজ কাশানী, গাজ্জালী, তূসী, ভেষজ এবং চিকিৎসাবিদ্যায় ইবনে সীনা, রাযী, রাজনীতি ও নীতিবিদ্যায় নাসিরুদ্দীন তূসী, ইতিহাসে ইবনে খালদুন, নৃতত্ত্ব এবং ভূগোলবিদ্যায় যাকারিয়া কাযভিনী, সাহিত্যে ইবনুল আমিদ, হস্তলিপিবিদ্যায় ইবনুল বাভবার, চারুকলায় আবুল ফারাজ ইসফাহানী ও এরমাভী, কাব্যে ফেরদৌসী, সাদী, হাফেজ, রুদাকী, খাকানী এবং আবদুল ফাত্তাহ বাস্তী, দর্শনশাস্ত্রে ফারাজী, আল-কিন্দী, ইবনে সীনা, বিরুনী, সোহরাওয়ার্দী, মোল্লাহ সাদরা এবং আল্লামা তাবাতাবাঈ, স্বৈরতন্ত্র ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামশীল সাইয়্যেদ জামালুদ্দীন আফগানী, আবদুহু কাওকাবী, ইকবাল, শরিয়তী, ইমাম খোমেইনী (রহ.) প্রমুখ এবং বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় আরো অনেক বিশ্ববিখ্যাত বরেণ্য ব্যক্তিত্ব ইসলামের কালজয়ী চিন্তাধারায় গঠিত এবং প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। বিশ্বজনীন ইসলামী আদর্শই এই সকল প্রতিভাকে মানবজাতির কাছে উপহার দিয়েছে। ইসলামের মহান শিক্ষা মুসলমানদের চিন্তা, চেতনা ও কর্মপন্থায় প্রকাশ পেয়েছে। ইসলামী সংস্কৃতি মানব প্রকৃতির সাথে এতই সামঞ্জস্যপূর্ণ যে, মানবতার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ইসলাম মিশে আছে। সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ নিজেই এর সমন্বয় সাধন করেছেন।

কোন সংস্কৃতিই পৃথিবীর বুকে বিকাশ লাভ করতে পারে না যদি না মানব প্রকৃতির সাথে তার সংগতি থাকে। সংস্কৃতি যতই মানব প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যশীল হবে ততই এটি গুতশীল হয়ে সমকালীন পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াতে পারবে এবং মানব সম্পর্কের শ্রীবৃদ্ধি ঘটাতে সক্ষম হবে। এখানেই ইসলামী সংস্কৃতি আর অন্যান্য সংস্কৃতির মাঝে পার্থক্য বিদ্যমান।

ইসলামী নীতিমালা, মূল্যবোধ, অন্তর্দৃষ্টি এবং অনুশাসনসমূহ সুস্পষ্টভাবে মানুষের মুক্তির কথাই বলেছে, জ্ঞানচর্চার বিশাল দিগন্ত পানে মানুষকে আহবান জানিয়েছে, মানুষের দৃষ্টিপাতের সকল বাধা অপসারিত করেছে যেন মানুষ এই বিশ্ব রহস্যের উদ্যোগ ও বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে পারে।

ইসলামের আদর্শে স্নাত হয়ে মুক্ত মানুষের মধ্য থেকে জ্ঞানের ফল্গুধারা প্রবাহিত হয়। তার মাঝে সৃষ্টিশীল প্রেরণা উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। নতুন নতুন শিল্প-সাহিত্য এবং বিজ্ঞানের উদ্ভাবনে সে ব্রতী হয়। তার সৃষ্টিকর্মে এই পৃথিবী সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।

জ্ঞানের মূল্যবোধ, তাকওয়া, জিহাদ, আনুগত্য, আত্মোৎসর্গ এবং সহিষ্ণুতা মানুষকে একটি শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলতে সাহায্য করে, যে আন্দোলনের মাধ্যমে সে নতুন মানব সভ্যতার ভিত্তি স্থাপন করে, স্রষ্টার সৃষ্টিকে সুশোভিত করে তোলে। এর ফলে মানুষের প্রার্থনা, তীর্থযাত্রা, শিক্ষা, জ্ঞানচর্চা এবং শৈল্পিক সৃষ্টিশীলতা স্রোতস্বিনীর মতোই প্রবাহিত হয়। তাওহীদের আশ্রয়ে এটি প্রবহমান হয়ে মানবতা ও মানব পরিচিতির বিকাশ সাধন করে এবং পারস্পরিক বৈষম্য ও হিংসা-বিদ্বেষের সীমারেখাকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়।

ইসলামী সংস্কৃতি উঁচুমানের অর্থাৎ ক্লাসিকধর্মী এই কারণে যে, এতে রয়েছে সংহতি, সুদৃঢ়তা, মানব-শৌর্যের প্রকাশ, জীবনক্ষেত্রে মানুষের কার্যকর ভূমিকা এবং তার অদৃষ্ট সম্পর্কে দৃঢ় আত্মবিশ্বাস।

ইসলামী সংস্কৃতি রোমান্টিক এই অর্থে যে, এটি বিশ্বাসী জনগণের হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা এবং বিশ্বাস দ্বারা তা বিমণ্ডিত।

ইসলামী সংস্কৃতি বাস্তবধর্মী। অর্থাৎ বাস্তবতা ও প্রকৃতিবিবর্জিত সকল বিপথগামী মূল্যবোধের বিরোধী এই সংস্কৃতি। স্বৈরাচার আর নাস্তিক্যবাদের বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান ইসলামী সংস্কৃতি সকল দুষ্কর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার। সেটা সামাজিক আনাচারই হোক বা শ্রেণিবৈষম্যই হোক কিংবা বর্ণবৈষম্যই হোক।

ইসলামী সংস্কৃতি সকল প্রকার বিভ্রান্তি ও বিকৃতির বিরোধী। মানুষকে দেবতা জ্ঞান করা, আত্মম্ভরিতা ও স্বার্থপরতা- সকল প্রকার মানসিক, আধ্যত্মিক ও নৈতিক বিকৃতি ইসলামী সংস্কৃতির পরিপন্থী।

বিশ্বজনীন ইসলামী সংস্কৃতির অবকাঠামো দৃঢ় প্রত্যয়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এতে রয়েছে মানবতার সুপ্রকাশ, বিশ্বাস, একত্ববাদ এবং নৈতিকতা। ইসলামী বিপ্লব এই সকল মূল্যবোধ, নীতিমালা ও সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ।

ইসলামী সংস্কৃতি মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে আনার প্রয়াস পায়। মানুষ এবং এই বিশ্বজগৎ সম্পর্কে এর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। এর মাধ্যমে ভয়-ভীতি অপসারিত হয়ে মানুষের মনে মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়। মানুষের আত্ম, মন এবং জীবনের পরিশুদ্ধিতে ইসলামী সংস্কৃতির ভূমিকা ব্যাপক। এর মাঝে ধ্বনিত হয় আশার বাণী। এই সংস্কৃতি জাতিসমূহের ওপর চাপিয়ে দেয়া হীনমন্যতা অপসারণে বদ্ধপরিকর। মানুষের সত্যিকারের ব্যক্তিত্বকে তুলে ধরে ভক্তিশ্রদ্ধা, আত্মোৎসর্গ, স্নেহ-মমতা এবং আধ্যাত্মিক প্রেরণা জাগ্রত করে। যার ফলে বিভ্রান্ত ও বিপথগামী মানুষ সঠিক পথে ফিরে আসার সুযোগ পায়।

মোট কথা ইসলামী সংস্কৃতি মানব জীবনের সকল দিকের ওপর আলোকপাত করে। এই সংস্কৃতি প্রাধান্য লাভ করলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি সাধিত হবে। গ্রন্থাগারগুলো জ্ঞান সাধকদের দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে ওঠবে। লেখকরা সৃষ্টিশীল লেখায় এগিয়ে আসবে। তরুণ প্রজন্ম তাকওয়ার পরিপূর্ণ একটি নতুন উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করবে। সমাজে তারা যথাযোগ্য মর্যাদায় আসীন হয়ে দর্শন, শিল্প ও সাহিত্যে তারা মূল্যবান অবদান রাখবে। প্রচুর গ্রন্থ প্রকাশিত হয়ে জ্ঞানচর্চার পরিধি বৃদ্ধি পাবে। তখন এই কিংবদন্তীর অপনোদন হবে যে, ‘প্রাচ্যের লোকেরা বই পড়ে না।’

এমনকি ইসলামী সংস্কৃতি পরিচালিত সমাজে নারীদের মর্যাদাও সমুন্নত হবে। লেখাপড়া শিখে পুরুষের পাশাপাশি সমান অধিকার নিয়ে সামাজিক কর্মকাণ্ডে তারাও এগিয়ে আসবে।

ইসলামী সরকার : একটি পর্যালোচনা

হুজ্জাতুল ইসলাম মুহাম্মদ ইয়াজদী

মানুষের মনে করা উচিত আইন হলো মহান আল্লাহর অধিকার। কেননা, আল্লাহ হলেন সর্বজ্ঞ এবং কেবল তিনিই তাঁর অমান্যকারীদের যে কোন ধরনের শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। এই একই কথা ইমামত দর্শনের ভিত্তিতেও বলা যেতে পারে।

নবী-রাসূলগণ খোদায়ী আইন-কানুন দুনিয়ার বুকে প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর নির্বাচিত প্রতিনিধি। এখন এসব আইন-কানুন দুনিয়ার বুকে বাস্তবায়ন এবং তার বিরুদ্ধাচরণকারীদের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা নেয়ার জন্য একজন নেতা বা ইমাম থাকা আবশ্যক। অর্থাৎ কোন অবস্থাতেই নবুওয়াতের নীতিমালাকে ইমামতের নীতিমালা থেকে পৃথক করা সম্ভব নয়। এই কারণেই নবী-রাসূলগণ একই সময়ে নবুওয়াত ও ইমামত প্রাপ্ত ছিলেন অর্থাৎ খোদায়ী আইন-কানুন প্রতিষ্ঠা ও বাস্তবায়ন- এ উভয় ক্ষমতাই তাঁদের হাতে ছিল।

হযরত ইবরাহীম (আ.) ছিলেন এরূপ একজন নবী-ইমাম। পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারার ১২৪ নং আয়াতে তাঁর ইমামত সম্বন্ধে বলা হয়েছে :

‘এবং স্মরণ কর যখন ইবরাহীমকে তার প্রতিপালক কয়েকটি কথা দ্বারা পরীক্ষা করেছিলেন এবং সেগুলো সে পূর্ণ করেছিল; আল্লাহ বললেন, ‘আমি তোমাকে মানবজাতির নেতা করছি।’ সে বলল, ‘আমার বংশধরদের মধ্য থেকেও’? আল্লাহ বললেন, ‘আমার প্রতিশ্রুতি জালিমদের প্রতি প্রযোজ্য নয়’।’

উপরোক্ত আয়াত থেকে এটা সুস্পষ্ট হয় যে, ইমামত (শাসনের অধিকার) অত্যাচারী শাসকদের কাছে যেতে পারে না।

ইসলামের পবিত্র নবীও একই সাথে ইমামত ও নবুওয়াতপ্রাপ্ত ছিলেন। মহান আল্লাহ তাঁকে একই সময়ে আল্লাহর পক্ষ হতে মানবজাতির জন্য দূত ও শাসক হিসাবে মনোনীত করেছিলেন। রাসূল হিসেবে ইসলামে পবিত্র নবীর পদমর্যাদা সম্পর্কিত কুরআনে অনেক আয়াত আছে। ঐসব আয়াতের কয়েকটি এখানে তুলে ধরা হলো :

‘মুহাম্মাদ তোমাদের মধ্যে পুরুষের পিতা নন, বরং সে আল্লাহর রাসূল এবং শেষ নবী। আল্লাহ সর্ব বিষয়ে সর্বজ্ঞ।’ (সূরা আহযাব : ৪০)

‘মুহাম্মাদ একজন রাসূল মাত্র; তার পূর্বে বহু রাসূল গত হয়েছে। সুতরাং যদি সে মারা যায় অথবা সে নিহত হয়, তবে তোমরা কি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে? এবং কেউ পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলে সে কখনও আল্লাহর ক্ষতি করবে না; বরং আল্লাহ শীঘ্রই কৃতজ্ঞদেরকে পুরস্কৃত করবেন।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৪৪)

‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। তার সহচরগণ কাফেরদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল।’ (সূরা মুহাম্মাদ : ২৯)

এরূপ আরো আয়াত আছে যেগুলোতে আল্লাহর রাসূল হিসেবে নবীর পদমর্যাদা তুলে ধরা হয়েছে :

‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে নির্দেশ দিলে কোন মুমিন পুরুষ কিংবা মুমিন নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্তের অধিকার থাকবে না। কেউ আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলকে অমান্য করলে সে তা স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে।’ (সূরা আহযাব : ৩৬)

‘নবী মুমিনদের নিকট তাদের নিজদের অপেক্ষা ঘনিষ্ঠতর এবং তার পত্নীগণ তাদের মাতা। আল্লাহর বিধান অনুসারে মুমিন ও মুহাজিরদের চেয়ে যারা আত্মীয়, তারা পরস্পরের নিকটতর।’ (সূরা আহযাব : ৬)

‘তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর ও রাসূলের আনুগত্য কর এবং সতর্ক হও; যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও তবে জেনে রেখ যে, স্পষ্ট প্রচারই আমার রাসূলের কর্তব্য।’ (সূরা মায়েদা : ৯২)

‘তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর যাতে তোমরা কৃপা লাভ করতে পার।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৩২)

‘হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস কর, তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আনুগত্য কর রাসূলের এবং তাদের যারা তোমাদের মধ্যে ক্ষমতার অধিকারী, কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ হলে তা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নিকট উপস্থাপন কর। এটাই উত্তম ও পরিণামে শ্রেয়।’ (সূরা নিসা : ৫৯)

‘লোকে তোমাকে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সম্পর্কে প্রশ্ন করে; বল, ‘যুদ্ধলব্ধ সম্পদ আল্লাহ এবং রাসূলের; সুতরাং আল্লাহকে ভয় কর এবং নিজেদের মধ্যে সদ্ভাব স্থাপন কর এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর, যদি তোমরা মুমিন হও।’ (৮ : ১)

‘হে মুমিনগণ! আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর এবং যখন তোমরা তার কথা শ্রবণ করছ তখন তা হতে মুখ ফিরিও না।’ (৮ : ২০)

‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে ও নিজেদের মধ্যে বিবাদ করবে না, করলে তোমরা সাহস হারাবে এবং তোমাদের শক্তি বিলুপ্ত হবে; ধৈর্যশীল হবে। আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন।’ (৮ : ৪৬)

‘আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর।’ অতঃপর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে তার ওপর অর্পিত দায়িত্বের জন্য সে দায়ী এবং তোমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্বের জন্য তোমরা দায়ী; এবং তোমরা তার আনুগত্য করলে সৎপথ পাবে, রাসূলের কাজ তো কেবল স্পষ্টভাবে পৌঁছে দেওয়া।’

‘সালাত কায়েম কর, যাকাত দাও এবং রাসূলের আনুগত্য কর, যাতে তোমরা অনুগ্রহভাজন হতে পার।’ (২৪ : ৫৬)

‘হে মুমিনগণ! আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের আনুগত্য কর এবং তোমাদের কর্ম বিনষ্ট করো না।’

‘তোমরা কি চুপে চুপে কথা বলার পূর্বে সাদাকা প্রদানকে কষ্টকর মনে কর, যখন তোমরা সাদাকা দিতে পারলে না, আর আল্লাহ তোমাদিগকে ক্ষমা করে দিলেন; অতএব, তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত প্রদান কর এবং  আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর। তোমরা যা কর, আল্লাহ তা সম্যক অবগত।’ (৫৮ : ১৩)

‘আল্লাহর আনুগত্য কর, যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে আমার রাসূলের দায়িত্ব কেবল স্পষ্টভাবে প্রচার করা।’ (৬৪ : ১২)

রাসূল (সা.)-এর ইমামতের বিষয় নিয়ে বিশদ আলোচনা এ প্রবন্ধে করা হচ্ছে না। তবে পবিত্র হাদীস ও রাসূলের জীবন চরিত থেকে জানা যায় যে, যুদ্ধ, সন্ধি স্থাপন এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ, শত্রুর বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরির জন্য লোক নিয়োগ, ঐ সময়কার পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানের ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ কিংবা যুদ্ধের জন্য তৈরি হওয়ার হুঁশিয়ারি জানিয়ে পত্র লিখন, উসামার সেনাবাহিনী গঠন এবং এরূপ আরো অনেক বিষয়েই রাসূলের আদেশ বস্তুত সরকারি আদেশ ছিল।

রাসূল (সা.) একই সময় নবুওয়াত ও ইমামত প্রাপ্ত হন। মক্কাতে ১০ বছর গোপনে ও প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের পর মদীনায় হিজরত করেন। মদীনায় পৌঁছার পর সেখানে তিনি ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। এভাবে মদীনা প্রথম ইসলামী সরকারের কেন্দ্রে পরিণত হয় এবং মদীনায় বসবাসরত ইহুদি ও অন্যান্য কাফের গোত্র একটি চুক্তিনামায় স্বাক্ষর করে ইসলামী শাসনকে মেনে নেয়।

অতঃপর রাসূলকে মদীনার বাইরে বসবাসরত কাফের ও মুশরেকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়। মক্কা বিজয় ও পরিশেষে সমগ্র আরব-ভূভাগে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা হওয়া পর্যন্ত এরূপ যুদ্ধ চলে। কাজেই পবিত্র নবীর মক্কা আগমনের পরই প্রথম ইসলামী সরকার তার কাঠামোগত ভিত্তি পায়।

নবী করিম (সা.)-এর আমলের পরবর্তীকালে ইসলামী শক্তি রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক, ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক, সকল অঙ্গনেই তার দৃপ্ত পদচারণার স্বাক্ষর রাখে। হযরত আলী (আ.) তাঁর চার বছরের শাসনামলে ইসলামী সরকারের স্বরূপকে আরো বিস্তৃত পরিসরে ব্যাখ্যা করেন। হযরত আলী (আ.) তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সেনাপতি ও রাজনীতিক মালিক আশতারের কাছে রাজ্য শাসনের ওপর যে ঐতিহাসিক সনদ লিখে পাঠান তাতে তিনি একটি ইসলামী সরকারের স্বরাষ্ট্রনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, সমরনীতি ও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কিত নীতিমালা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন- খুব কম মুসলমান আছে যারা এই ঐতিহাসিক সনদ সম্পর্কে জানেন না।

এটা এমন এক সনদ যাতে ইসলামী সরকারের রূপরেখাকে যথাযথ ও বিস্তৃত পরিসরে তুলে ধরা হয়েছে। এটা এমন এক সনদ যার মর্ম উপলব্ধি করে জ্ঞানীরা লাভবান হতে পারেন।

ইসলামী সরকারের নীতিমালা

ইসলামী সরকার দর্শনে মানুষ হলো এক উন্নত চরিত্রসম্পন্ন মর্যাদাশীল প্রাণী। জগতের সবকিছুই মানুষের কল্যাণকে কেন্দ্র করে। কাজেই সমস্ত পরিকল্পনা কর্মসূচি হবে মানুষের এই উন্নত চরিত্র ও নৈতিকতাবোধকেন্দ্রিক। এভাবেই মানুষ খোদায়ী পরিচিতি এবং তাকে সৃষ্টির উদ্দেশ্যের মর্ম উপলব্ধি করে তার ওপর আরোপিত ঐশী কর্তব্যগুলো সম্পাদন করতে পারে।

এমনকি ইসলামী সরকারাধীন অমুসলিমদের সাথেও এমন ব্যবহার করতে হবে যাতে তাদের মানবীয় মূল্যবোধগুলো চাঙ্গা হয় এবং এক সময় ইসলামের একত্ববাদের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নেয়। নাস্তিক্যবাদী মুশরিক, এমনকি আহলে কিতাবদের সাথে ইসলামী সরকারের আচরণ সম্পর্কে ইসলামে বিস্তৃত আলোচনা আছে। এ বিষয়ে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের গঠনতন্ত্রের আর্র্টিকেল-১-এ আলোকপাত করা হয়েছে।

(ক) ইসলামী সরকারের ভিত্তি দেশের ইসলামী জনতার ওপর নির্ভরশীল। রাসূলের নবুওয়াত ও ইমামতের প্রতি মুসলিম জনতার বিশ্বাসের ওপরই ইসলামী সরকারের ভিত্তি নিহিত। কেননা, রাসূলের কাছে আসা খোদায়ী বিধানের ভিত্তিতেই ইসলামের পরিচিতি। ইসলামী প্রজাতন্ত্রে সরকার কাঠামো জনতার পছন্দের ধর্মীয় নেতার ওপর নির্ভর করে। এই নেতা আবার ধর্মীয় মাপকাঠির ভিত্তিতে নির্বাচিত হন।

ইসলামী প্রজাতন্ত্রে বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্য নির্বাচন, পরামর্শ পরিষদের সদস্য নির্বাচন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এবং সবধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ইসলামী শরীয়তের ভিত্তিতে হয়। গঠনতন্ত্রের চতুর্থ অনুচ্ছেদে এই বিষয়ে উল্লেখ আছে। যেখানে বলা আছে যে, ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সকল আইন-কানুন ইসলামের নীতিমালার সাথে সামঞ্জস্যশীল হতে হবে।

(খ) ইসলামী সরকার খোদায়ী বিধান বাস্তবায়নে আপোষহীন। ইসলামী সরকার কোন অবস্থাতেই কোন ইসলামী বিষয়ে ইসলামের শত্রুদের চাপের মুখে নতি স্বীকার করবে না। ইসলাম ও ইসলামী প্রজাতন্ত্রের মর্যাদা রক্ষার্থে, তার উন্নতিকল্পে এবং তা ধরে রাখতে ইসলামী সরকার আত্মরক্ষা, জিহাদ, তাবলীগ (ইসলামের প্রচার), ন্যায়ের পক্ষ অবলম্বন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধাচরণ প্রভৃতি নীতিতে বিশ্বাসী।

বিভিন্ন ইসলামী রচনাবলিতে এসব নীতির বিশদ ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

(গ) ইসলামী সরকারের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ন্যায়পরায়ণতা এবং এই ন্যায়পরায়ণতা হবে যথার্থ অর্থে। এ প্রেক্ষিতে ইসলামী সরকার দেশের সকল প্রাণী ও বস্তুর ন্যায্য প্রাপ্যের প্রতি বিশেষ মনোযোগী হয়। নিশ্চিত সরকারি সুযোগ-সুবিধাগুলো যাতে সকল নাগরিক সমভাবে ভোগ করতে পারে তা নিশ্চিত করে। এরূপ সরকার সর্বদা জনতাকে খোদায়ী পথে পরিচালনায় নিবেদিত থাকে।

ইসলামী সরকারের উদ্দেশ্যাবলি

খোদার নবীর রেখে যাওয়া পথ ও মত অনুসরণই ইসলামী সরকারের মূল উদ্দেশ্য। ইসলামী সরকারের মহান উদ্দেশ্যাবলির কতিপয় উদ্দেশ্য নিচে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হলো :

-মানুষকে খোদায়ী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা যাতে সে এক উন্নত মানবীয় জীবনযাপন করতে পারে।

-প্রকৃতিকে মানবসেবায় ব্যবহার করা যাতে মানুষ প্রাকৃতিক সম্পদাদি ব্যবহার করে অধিকতর সমৃদ্ধ জীবনযাপন করতে পারে।

-রক্তপাত, ঝগড়া-ফ্যাসাদ, হঠকারিতা ব্যাভিচার, বিদ্রোহ এবং এ জাতীয় যাবতীয় পাপকাজের বিরোধিতা করা এবং যে পর্যন্ত এসব পাপাচার ও অনাচার দুনিয়ার বুক থেকে তিরোহিত না হয় সে পর্যন্ত এগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া।

এ পর্যন্ত আমরা যা আলোকপাত করেছি, তা হলো একটি ইসলামী সরকারের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। আমরা এখন সংক্ষেপে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সরকার কাঠামোর ওপর সংক্ষেপে আলোকপাত করব।

ইরানের সরকার হলো একটি ইসলামী সরকার। অধিকাংশ জনমতের ভিত্তিতে এরূপ সরকার গঠন করা হয়। ৯৮.২ ভাগ প্রাপ্তবয়স্ক লোক ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে ভোট দেয়। এই একচেটিয়া রায় থেকে এটাই সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, ইরানের জনতা ইসলামী শাসনব্যবস্থা ছাড়া অন্য কোন শাসনব্যবস্থার অধীনে যেতে রাজি নয়।

এটা দিবালোকের মতোই পরিষ্কার যে, এই প্রজাতন্ত্রের সিংহভাগ জনতা পবিত্র নবীর রেখে যাওয়া সত্যিকার ইসলামকে গ্রহণ করেছে। তারা পবিত্র কুরআনে বর্ণিত ও পবিত্র আহলে বাইত কর্তৃক বিবৃত ইসলামকেই গ্রহণ করেছে। কাজেই এ ইসলাম কোন বিশেষ গোষ্ঠীর মনগড়া ব্যাখ্যার সংকীর্ণতার বেড়াজালে বন্দি নয়। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের গঠনতন্ত্রে এরূপ ইসলামের কথাই বলা হয়েছে।

ইসলামী প্রজাতন্ত্রের গঠনতন্ত্রে সরকারের ভিত্তির প্রকৃতি, এর বৈশিষ্ট্যাবলি, উদ্দেশ্যাবলির সারসংক্ষেপ আলোকপাত করা হয়েছে।

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান ১৯৭৯ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারিতে প্রতিষ্ঠা পায়। ১৯৭৯ সালের ২রা এপ্রিলের গণভোটে প্রজাতন্ত্রের সরকার কাঠামো নির্ধারিত হয়। এই সরকারের মূল ভিত্তি হলো তাওহীদ বা আল্লাহর একত্ববাদ (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ- আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই)। এই সরকার কাঠামোর মুখ্য উদ্দেশ্য হলো নবুওয়াত, পুনরুত্থান, ইমামত, ইজতিহাদ, (কুরআন-হাদীসের ভিত্তিতে মুজতাহিদ কর্তৃক কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান), বিজ্ঞানের অগ্রগতি থেকে লাভবান হওয়া এবং সব ধরনের অত্যাচারী শাসন, অন্যায়, অনাচার, বিদেশী প্রভাব ইত্যাদির বিরোধিতা করা।

এ সরকার ন্যায়বিচার, সমঅধিকার এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বজায় রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও নিবেদিত। প্রজাতন্ত্রের সকল আইন-কানুন ইসলামী নীতিমালার সাথে সামঞ্জস্যশীল।