All posts by dreamboy

দূরপাল্লার রাডার ব্যবস্থার সফল পরীক্ষা করল ইরান

ইরান দূরপাল্লার সেপেয়ার রাডার ব্যবস্থার সফল পরীক্ষা চালিয়েছে। এ রাডার ব্যবস্থা ২,৫০০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে যে কোনো লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত করতে পারে।

মঙ্গলবার এ রাডার ব্যবস্থার প্রথম পর্যায়ের পরীক্ষা সফলভাবে সম্পন্ন হয়। পরে এ নতুন এ রাডার ব্যবস্থাকে ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। ইরানের খাতামুল আম্বিয়া বিমান প্রতিরক্ষা ঘাঁটির কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফারজাদ ইসমাইলি এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

ডেপুটি কমান্ডার এবং এ ঘাঁটির মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহরুখ শাহরাম জানান, এই প্রথম নয়া রাডার ব্যবস্থা থেকে পাওয়া তথ্য ইরানের রাডার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কাজে লাগানো গেছে।

রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম লক্ষ্যবস্তুসহ ব্যালিস্টিক, সেমি ব্যালিস্টিক এবং ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র নির্ণয় করতে পারে নতুন এ রাডার ব্যবস্থা। শাহরাম বলেন, ইরানের সীমান্তের বাইরে অনেক দূরে অবস্থিত সম্ভাব্য হুমকিও শনাক্ত করতে পারে এ ব্যবস্থা। গত কয়েক বছরে ইরান নতুন নতুন রাডার ব্যবস্থা নির্মাণ এবং ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় সেগুলো ব্যবহারও করেছে বলে জানান তিনি।

রেডিও তেহরান, ১২  নভেম্বর, ২০১৪

‘বিশ্বে ন্যানো প্রযুক্তি সংক্রান্ত জ্ঞান উৎপাদনে ৭ম স্থানে ইরান’

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের ন্যানো টেকনোলজি ইনিশিয়েটিভ কাউন্সিল বা আইএনআইসি’র সচিব সায়িদ সারকর বলেছেন, ন্যানো প্রযুক্তি সংক্রান্ত জ্ঞান উৎপাদনে ইরান বিশ্বে সপ্তম স্থান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এর আগে ইরান অষ্টম স্থানে ছিল। একইসঙ্গে মুসলিম বিশ্বে এখনো ইরান শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। তেহরানে সপ্তম আন্তর্জাতিক ন্যানোপ্রযুক্তি উৎসবের অবকাশে এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন।

সায়িদ সারকর আরো বলেছেন, ন্যানো প্রযুক্তির জ্ঞান উৎপাদনের ক্ষেত্রে ইরান গত বছরের চেয়ে আরো এক ধাপ এগিয়েছে। ইরানের ন্যানো প্রযুক্তি গোটা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং অনেক দেশই এ বিষয়ে ইরানের সহযোগিতা চাইছে। বর্তমানে ২০ হাজার বিশেষজ্ঞ ও গবেষক ন্যানো প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে বলে তিনি জানান।

আজ (সোমবার) তেহরানের আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী কেন্দ্রে সপ্তম আন্তর্জাতিক ন্যানো প্রযুক্তি উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে।

তেহরান রেডিও, ৬ অক্টোবর, ২০১৪

আল্লামা ইকবাল- ইসলামী বিশ্বের এক মহান সংস্কারক

মাহমুদ বায়াত

‘বর্তমান যুগ ইকবালের বৈশিষ্ট্যে পরিপূর্ণ,

তিনি ছিলেন এমন এক ব্যক্তিত্ব

যিনি লক্ষ জনকে অতিক্রম করেছেন,

কবিকুল পরাজিত সৈন্য বাহনীর মতো দিগি¦দিক ছুটেছে,

আর তিনি তো শত অশ্বারোহীতুল্য যোদ্ধা।’

(মালেকুশ শোয়ারা বাহার)

ইকবালের জীবন ও কর্মের বর্ণনা তথা প্রাচ্যের এই দার্শনিকের চিন্তা ও কর্মের যথাযথ মূল্যায়ন এক দুরূহ বিষয়। সৌভাগ্যের বিষয় যে, পৃথিবী তাঁকে উত্তমরূপেই জানে। তিনি ছিলেন এক বিশাল ও মহান ব্যক্তিত্বের অধিকারী। মানবিক ও আত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে এবং একজন মুসলমান হিসাবে তিনি বিশেষ কোন ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে নিজেকে সংশ্লিষ্ট রাখেননি। ইকবালের চিন্তাধারা হচ্ছে সমগ্র ইসলামী চিন্তাদর্শ বিকাশের দর্পণস্বরূপ যা ধীরে ধীরে সমগ্র ইসলামী বিশ্বে বিস্তার লাভ করেছে। তিনি কেবল এক বিশাল ব্যক্তিই নন; বরং তিনি ছিলেন মানুষের জন্য একটি দৃষ্টান্ত ও আদর্শ।

বস্তুত ইকবালকে ইসলামী বিশ্বের বিশেষত উপমহাদেশের সংস্কারক হিসাবে মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। তাঁর সংস্কারধর্মী চিন্তাধারা নিজ দেশের সীমা অতিক্রম করেছে। তাঁরই সাহসী প্রেরণায় একটি ইসলামী দেশ হিসাবে পাকিস্তান সৃষ্টির ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল।

তিনি বলেন

قلب ما از هند و روم و شام نیست

مرز و بوم ما بجز اسلام نیست

‘আমাদের আত্মা শাম (সিরিয়া), রোম ও

ভারতে সীমাবদ্ধ নয়,

একমাত্র ইসলামই আমাদের সীমান্ত।’

ইকবালকে অনুধাবন কোন ব্যক্তি বিশেষের অনুধাবন নয় বরং একটি সংগঠন ও একটি আদর্শের অনুধাবন এবং সর্বোপরি আমাদের অবস্থা, পরিবেশেরও অনুধাবনস্বরূপ।

ইকবাল সে প্রথম পর্যায়ের ব্যক্তিদেরই একজন যিনি সমাজ ও দার্শনিক চিন্তাধারার পুনর্গঠন করে এটিকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দান করেন- যা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা-দর্শন ও আইনগত বিশেষ প্রক্রিয়ায় সুবিন্যস্ত। ইকবাল তাঁর দর্শন ও চিন্তাধারাকে তাওহীদের ভিত্তির ওপরে বিন্যস্ত করেন। ইকবালের দৃষ্টিতে তাওহীদ হলো এক আল্লাহর প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন- যা নির্ভর করে মানুষের ঐক্য ও দৃশ্যমান জগতের প্রতিটি উপকরণের ঐক্যের ওপর। আর এর মধ্যেই মানুষ তার প্রাকৃতিক পর্যায়ে পূর্ণতা লাভ করে থাকে। ইকবালের চিন্তাধারার গভীর উপলব্ধি ব্যতীত উপমহাদেশের সাম্প্রতিক বিবর্তন ও ঘটনা প্রবাহের অনুধাবন অসম্ভব।

ইকবাল কেবল চিন্তা-ভাবনা করেই ক্ষান্ত হননি; বরং তিনি ছিলেন এক সংগ্রামী পুরুষ। কার্যত তিনি ছিলেন একজন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লোক। নিজস্ব চিন্তাধারাকে কাব্যের আঙ্গিকে প্রকাশ করাই হচ্ছে ইকবালের বিশেষত্বসমূহের একটি। তবে তাঁর চিন্তা, দর্শন ও কাব্য প্রতিভা ইসলামের সেবায়ই নিয়োজিত ছিল।

ইকবালের কবিতা কেবল কবিতা নয়; বরং এগুলো হলো দর্শন, চিন্তা এবং একটি নতুন দেশ ও জাতি গঠনের উদাত্ত আহ্বান ও পরিকল্পনায় পূর্ণ।

ইকবাল পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি উত্তমরূপে জানতে পেরেছিলেন এবং এর পারিপার্শ্বিকতাকে গভীরভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। যার ফলে পাশ্চাত্যও তাঁকে দার্শনিক হিসাবেই অভিহিত করেছিল।

ইকবাল তাঁর সমস্ত জ্ঞান ও বিচারবুদ্ধির আলোকে পাশ্চাত্য সমাজ ও সংস্কৃতিকে বিচার-বিশ্লেষণ করার প্রয়াস পান এবং পরিপূর্ণ আদর্শের ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকে অন্তঃসারশূন্য হিসাবে দেখতে পান।

কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি মুসলমানদেরকে পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান অর্জনের জন্য আহ্বান জানান। তবে সাথে সাথে তাদেরকে পাশ্চাত্যের অনুকরণ ও পাশ্চাত্য প্রীতি হতে দূরে থাকতে বলেছেন।

তিনি বলেন :

ای اسیر رنگ پاک از رنگ شو

مؤمن خوب کافر افرنگ شو

رشته سود و زبان در دست توست

آبروی خاوران در دست توست

‘হে পবিত্র রঙের বন্দী, রঙের আলোকেই মু’মিন হও,

পাশ্চাত্যকে প্রত্যাখ্যান করো,

লাভ-ক্ষতির বিষয় তো তোমার হাতেই,

প্রাচ্যের মান-সম্ভ্রম তো তোমার হাতেই নিবদ্ধ।’

ইকবাল গভীর অভিনিবেশ সহকারে কুরআন অধ্যয়ন করেন। তিনি তাঁর জীবনের কোন পর্যায়েই কুরআন অধ্যয়ন থেকে দূরে সরে যাননি।

তিনি বলেন :

گر تومی خواهی مسلمان زیستن

نیست ممکن جز به قرآن زیستن

پیش قرآن بنده و مولا یکی است

بوریا و مسند و دیبایکی است

‘যদি তুমি মুসলমান হিসাবে বেঁচে থাকতে চাও-

তবে কুরআন অবলম্বন ছাড়া তা সম্ভব নয়;

কুরআনের নিকট রাজা প্রজা সবাই সমান,

চাটাই, সিংহাসন ও রেশম একই।’

 

ইকবাল মহানবী (সা.) ও তাঁর আহলে বাইত-এর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রকাশ করেন। তিনি তাঁদের উদ্দেশ্যে শিক্ষামূলক ও বিপ্লবী কবিতা রচনা করেন যা ছিল ইকবালের কাব্য দর্শন ও কাব্য-চিন্তার মূল উৎস।

তিনি বলেন :

هر که عشق مصطفی سامان او است

بحر و بر تر گوشه دامان اوست

در دل مسلم مقام مصطفی است

آبروی مازنام مصطفی است

‘মোস্তফার প্রেমই যার সম্বল

সাগর ও ভূমি তার করতলে,

মুসলমানের হৃদয়ে রয়েছে,

মোস্তফার আসন,

আর আমাদের সম্ভ্রম মোস্তফার নাম থেকেই উৎসারিত।’

আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-এর প্রশংসায় তিনি বলেন :

مسلم اول شه مردان علی

عشق را سرمایه ایمان علی است

از ولای دودمانش زنده ام

در جهان مثل گهرتا بنده ام

‘বীর শ্রেষ্ঠ আলীই হচ্ছেন প্রথম মুসলমান,

ইশ্কই হচ্ছে আলীর ঈমানের পুঁজি,

তাঁর পরিবারের ভালোবাসার বন্ধনেই আমি বেঁচে আছি,

আর আমি বিশ্বে আলোক বিচ্ছুরণকারী মণি-মুক্তাস্বরূপ।’

মহানবীর আদরের দুলালী হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.)-এর প্রসঙ্গে তিনি বলেন : ‘তিনটি কারণে ফাতেমা যাহরা মর্যাদার অধিকারী। প্রথমত, রাসূলের কন্যা, দ্বিতীয়ত, হযরত আলী (আ.)-এর স্ত্রী, তৃতীয়ত, কারবালার মহান শহীদ ইমাম হোসাইনের মা।’ এছাড়াও তিনি এই মহীয়সী মহিলার অনুসরণ করার জন্য মহিলাদেরকে উপদেশ দিয়েছেন।

ইকবাল শহীদদের নেতার প্রশংসায় বলেন :

رمز قرآن از حسین آموختیم

زآتش او شعله ها اندوختیم

‘কুরআনের রহস্য হোসাইন থেকে শিখেছি,

তাঁর অগ্নি থেকেই শিখাসমূহ সংগ্রহ করেছি।’

ইকবালের দৃষ্টিতে মানবিক পরিশুদ্ধির মাধ্যমেই কেবল সামাজিক পরিশুদ্ধি অর্জন সম্ভব। আর এভাবেই সৃষ্টির উন্নতি এবং যথাযথ বিকাশ সম্ভব। সমস্ত অস্তিত্ব ও অনস্তিত্ব মানুষ এবং তার উপলব্ধি থেকেই উৎসারিত হয়ে থাকে।

ইকবালের দর্শন হচ্ছে আত্মোপলব্ধির দর্শন। অর্থাৎ আত্মার স্বাধীনতা ও আত্মনির্ভরশীলতা। তাঁর দৃষ্টিতে যদি কেউ আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার লাভে সমর্থ হয় এবং আত্মাকে চিনতে সক্ষম হয়, তাহলে তিনি তার ভিতরে এমন একটি জগৎ সৃষ্টি করতে সক্ষম হন যা বাহ্যিক জগতের সমস্ত অপরিপূর্ণতাকে দূর করতে সক্ষম।

ইকবাল মানুষকে সচেতন, স্বাধীন, চিন্তাশীল, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হিসাবে মূল্যায়ন করেছেন। তাঁর মতে পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রতি আসক্তিই হচ্ছে মানুষের বড় শত্রু। তিনি পাশ্চাত্য সভ্যতার উপকরণগুলোকে বস্তুবাদী এবং এর প্রকৃতিকে সাম্রাজ্যবাদী হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন।

তিনি বলেন :

آدمیت زار نالید از فرنگ

زندگی هنگامه برچید از فرنگ

پس چه باید کردای اقوام شوق

یاز روشن می شود ایام شرق

در ضمیرش انقلاب آمد پدید

شب گذشت و آفتاب آمد پدید

مشکلات حضرت انسان از اوست

آدمیت را غم پههان از اوست

 

‘পাশ্চাত্যের যাঁতাকলে (পিষ্ট হয়ে) মানবতা ক্রন্দন করছে,

পাশ্চাত্যের অভিশাপে মানব জীবন বিপর্যস্ত;

হে, প্রাচ্যের জাতিসমূহ! তোমরা কি জান আজ আমাদের করণীয় কি?

প্রাচ্যের দিনগুলো পুনরায় আলোকিত হতে যাচ্ছে,

এর (প্রাচ্যের) হৃদয়ে বিপ্লব দানা বেঁধে উঠছে,

রাত্রি অতিক্রান্ত হয়েছে এবং সূর্য উদ্ভাসিত হয়েছে।

তার (পাশ্চাত্য) কারণেই মানুষের যাবতীয় সমস্যা,

আর তার কারণেই মানবতার যত ভোগান্তি।’

ইকবাল বিশ্বাস করেন যে, ইসলামী প্রাচ্য তার প্রকৃত সত্তাকে হারিয়ে ফেলেছে এবং তাকে অবশ্যই এর পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হতে হবে।

তাঁর মতে বর্তমান অবস্থায় ইসলামী সমাজ পাশ্চাত্য সভ্যতার সংস্পর্শে আসার কারণে একদিকে যেমন তার স্বকীয় জাতিসত্তাকে হারিয়ে ফেলেছে তেমনি ব্যক্তিবর্গের ওপরও অশুভ প্রভাব বিস্তার করেছে। ইকবাল আরো বলেন যে, তাদের অভ্যন্তরীণ স্বকীয় বৈশিষ্ট্য যা ঈমান ও আধ্যাত্মিকতার আলোকে আলোকিত- সে দিকেই তাদের প্রত্যাবর্তন করতে হবে।

ইকবাল বলেন :

ای غنچه خرا بیده چونرگس، نگران خیز

کاشانه ما رفت به تاراج، غمان خیز

از ناله مرغ چمن ازبانگ اذان خیز

ازگرمی هنگامه آتش نفسان خیز

از خواب گران، خواب گران، خواب گران خیز

از خواب گران خیز

‘হে ঘুমন্ত পুষ্প কলি ! নার্গিসের মতো জেগে উঠো,

আমাদের আবাসগুলো লুণ্ঠিত হয়েছে,

পরিতাপ নিয়ে জেগে উঠো,

বাগানের বুলবুলের ক্রন্দন এবং আজানের সুমধুর

ধ্বনিতে জেগে উঠো,

শৌর্য বীর্য বিপ্লবী চেতনায় জেগে উঠো,

তোমার দীর্ঘ নিদ্রা, দীর্ঘ নিদ্রা, দীর্ঘ নিদ্রা হতে জেগে উঠো,

তোমাদের দীর্ঘ নিদ্রা থেকে জেগে উঠো।”

ইকবাল যেমন ছিলেন একজন চিন্তাশীল দার্শনিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তি তেমনি তিনি শিল্প ও সাহিত্য বিশেষত ফারসি কবিতায়ও অসামান্য প্রতিভার অধিকারী। তিনি আসরার ও রামুজ, পায়ামে মাশারেক, জাবুরে আজম, জাভিদ নামেহ, পাস চে বায়াদ কারদ ও আরমুগানে হেজাজ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে ৯ হাজারেরও অধিক ফারসি শ্লোক রচনা করেন যা হচ্ছে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য এবং ইরানের কবিদের প্রতি এ বিপ্লবী কবির গভীর আগ্রহের বহিঃপ্রকাশ। বিভিন্ন কবিতায় তিনি এ বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছেন।

তিনি বলেন :

پارسی بین تاببینی نقش های رنگ رنگ

بگذر از مجموعه اردو که بیرنگ منست

گرچه هندی درعذوبت شکّر است

طرز گفتار دری شیرین تر است

‘ফারসির প্রতি লক্ষ্য করো যাতে করে তুমি বৈচিত্র্যময় বক্তব্য দেখতে পাবে,

আমার বৈচিত্র্যহীন উর্দু রচনাবলি ত্যাগ করো,

যদিও মাধুর্যের দিক থেকে হিন্দি সুমিষ্ট,

(কিন্তু) ফারসি ভাষার বর্ণনারীতি অধিকতর সুমিষ্ট।’

যদিও ফারসি ভাষার এ উন্নত মর্যাদার কবি কখনো ইরান সফর করেননি, তথাপি তিনি ইরানকে স্মরণ করে বলেন :

محرم رازیم باما راز گوی

آنچه میدانی از ایران بازگوی

‘আমরা গোপন কথার রক্ষক

আমাদের কাছে গোপন কথা বলতে পারো,

ইরান সম্পর্কে তুমি যা কিছু জানো আবার বলো।’

ইকবাল আরো বলেন :

تهران هوگر عالم مشرق کا جنیوا

شاید کره ارض کی تقدیر بدل جائی گا

‘তেহরান যদি প্রাচ্যের জেনেভা হয়,

তাহলে বিশ্বের ভাগ্য পরিবর্তিত হয়ে যাবে।’

ইকবালের বিশ্বদর্শনই হচ্ছে ইকবাল দর্শনের প্রকৃত স্বরূপ যা বিশ্বমানবতার সাথে সংশ্লিষ্ট। তাঁর বাণী হচ্ছে মানবতার প্রতি দরদ ও ভালোবাসার বাণী- স্বাধীনতার বাণী। নিঃসন্দেহে সৎকর্মশীল ব্যক্তিরা কখনো মৃত্যুবরণ করেন না। ইকবালের তেজোদ্দীপ্ত আত্ম-অনির্বাণ অনুভূতিসমূহ তরঙ্গের ন্যায় গর্জন করছে। আর বিশ্বমানবতা বিশেষ করে মুসলমানদেরকে ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও স্বাধীনতার দিকে আহ্বান করছে।

ইকবাল বলেন :

نه ترکیم ونه افغان وتتاریم

چمن زادیم واز یک شاخساریم

تمیزرنگ وبو بر ما حرام است

که ما پرورده یک شاخساریم

‘আমরা তুর্কী নই, আফগানী নই, তাতার নই,

এ শ্যামল সবুজ মাঠেই আমাদের জন্ম,

আমরা একই শাখা-প্রশাখা হতে সৃষ্ট।

আমাদের জন্য রং ও ঘ্রাণের পার্থক্যকরণ অবৈধ।

কেননা আমরা একই শাখা-প্রশাখা থেকে প্রতিপালিত হয়ে এসেছি।’

(অনুবাদ : আরিফ বিল্লাহ)

শিল্পকলায় ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ভূমিকা

ইরানে শিল্পকলার উদ্ভব কবে যে প্রথম ঘটেছিল তা সুস্পষ্টভাবে বলা কঠিন। কেননা, ইরান মানব সভ্যতার একটি প্রাচীনতম দেশ। অতীত অনুসন্ধান করে প্রাচীন সভ্যতার যে সমস্ত ভগ্নাংশ মানুষের দৃষ্টিতে পড়েছে তাতে দেখা যায় গুহাগাত্রে এবং প্রস্তর ও মৃৎপাত্রের গায়ে এক সময়কার মানুষ রেখাঙ্কনের চিহ্ন রেখে গিয়েছিল। এসব চিহ্ন পৃথিবীর অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতার শিল্প নিদর্শনের মতোই।

0.249915001320310678_taknaz_irপারসিক শিল্পে, বিশেষ করে পারসিক চিত্রকলার মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অনবদ্য সৌন্দর্য সৃষ্টি। এ সৌন্দর্য সৃষ্টি তাঁরা করেছেন অত্যন্ত দীপ্ত উজ্জ্বল রংয়ের সাহায্যে এবং পেলব দ্রুতগতি রেখাঙ্কনের সাহায্যে। এভাবে শিল্পীরা তাঁদের অনুভূতিকে অত্যন্ত তীক্ষ্ণ দক্ষতায় প্রকাশ করেছেন। বহুদিনের পরিচর্যা এবং অনুশীলনের ফলে শিল্পীরা তাদের হাতের ব্যবহার এবং করাঙ্গুলির প্রয়োগকে একটি দক্ষ ভঙ্গিতে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছেন।

ইসলাম পারসিক শিল্পের সর্ববৃহৎ চালিকা শক্তি। আল্লাহ তাআলা পৃথিবীকে নানা অপূর্ব সাজে সজ্জিত করেছেন। ঘাস-লতাপাতা, বৃক্ষের শাখা, বনাঞ্চলের প্রাণী এবং আকাশের পাখি সবকিছু সৃষ্টিতে বিধাতার অনন্যসাধারণ পরিপূর্ণতা আমরা লক্ষ্য করি। পারস্যের শিল্পিগণ বিধাতার এ রূপ দক্ষতাকে অত্যন্ত অভিনিবেশ এবং আন্তরিকতার সঙ্গে প্রকাশ করবার চেষ্টা করেছেন। যে কোন একটি পারসিক মিনিয়েচার ছবির দিকে তাকালে আমরা শিল্পীর এই অভিনিবেশ লক্ষ্য করব। আমরা লক্ষ্য করব যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, বিশেষ করে প্রস্ফুটিত পুষ্প এবং সবুজ লতাপাতা অত্যন্ত সুন্দর বর্ণ বিভায় প্রকাশ পেয়েছে। এসব শিল্প মূলত অলঙ্করণের বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। যার রেখা-রংয়ের পুনরাবৃত্তির সাহায্যে সুন্দর ভারসাম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। তাঁরা প্রাকৃতিক বস্তু, প্রাণী এবং বৃক্ষলতার যথার্থ স্বভাব রং ও রেখায় তুলে ধরবার চেষ্টা করেছেন। এ কারণে সমালোচকরা বলে থাকেন যে, পারসিক শিল্পীরা যখন হাতে তুলি ধরেন তখন সে তুলিকে পরিচালিত করেন যুক্তির সাহায্যে, কিন্তু সে যুক্তির পিছনে আবার আবেগ থাকে।

downloadএই শিল্পকর্মে ফর্ম বা আকৃতি এবং বিষয় উভয়ই একই সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শুধু আকৃতি নিয়ে শিল্পীরা কখনও ব্যতিব্যস্ত থাকেন না। আকৃতি বিষয়কে অবলম্বন করে রূপলাভ করে। ভারতবর্ষের সম্রাট হুমায়ুন শের শাহের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পারস্যে এক সময় আশ্রয় নিয়েছিলেন। পারস্যে অবস্থানকালে তিনি বিশ্রামে এবং অবকাশে সময় কাটাননি। তিনি পারসিকদের কাছে বিস্ময়কর চিত্রকর্মের রীতি প্রকরণ শিখেছিলেন এবং স্থাপত্যের নতুন নির্দেশনা পেয়েছিলেন। তিনি যখন পুনরায় ভারতবর্ষে ফিরে গেলেন তখন এদেশে নতুন শিল্প প্রক্রিয়ার জন্ম হয় যাকে আমরা ‘মোঘল চিত্রকলা’ বলে থাকি। মূলত পারসিক চিত্রকলার ওপর ভিত্তি করেই ভারতে মোঘল চিত্রকলার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে।

images (2)পারসিক চিত্রকলায় রংয়ের ব্যবহারটি বিশেষভাবে লক্ষ্যযোগ্য। শিল্পীরা দুই বা ততোধিক রংয়ের মিশ্রণ ঘটিয়ে নতুন বিভা নির্মাণ করে থাকেন। আবার কখনও পরস্পর বিরোধী দু’টি রংয়ের সংঘর্ষ সৃষ্টি করে একটি নতুন তাৎপর্যের জন্ম দেন। লক্ষ্য করা যায় যে, তাঁরা সচরাচর এমন রং বেছে নিয়ে থাকেন যা দৃষ্টিতে খুব স্নিগ্ধ মনে হয়। এই রংগুলো হচ্ছে লাল, হলুদ, নীল ও সবুজ। এই সব ক’টি রং-ই অত্যন্ত উজ্জ্বল এবং দৃষ্টিমুগ্ধকর। প্রথম থেকেই পারসিকরা গাছ থেকে, মাটি থেকে এবং পাথর থেকে রং সন্ধান করেছেন। এগুলো বিচূর্ণিত করে ভিন্ন ভিন্ন রংয়ের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। এর ফলে শিল্পীদের ব্যবহৃত রংগুলো স্থায়িত্ব পেয়েছে।

Farnet-Alighapu-02এটা বলা হয়ে থাকে যে, পারসিক শিল্পীরা তাঁদের চিত্রকলার সাহায্যে আল্লাহর অনন্ত শক্তিকে অনুভব করবার চেষ্টা করেছেন এবং কৌশলগতভাবে এ অনুভবকে তাঁরা প্রকাশ করেছেন রং ও রেখার সাহায্যে। প্রাচীন চীন অথবা জাপানের চিত্রকলায় যেখানে চিত্রকর্মের পরিপূর্ণ রেখাঙ্কনটি একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, পারসিক চিত্রকলায় সেখানে সেই রেখাঙ্কনকে যেন অতিক্রম করবার চেষ্টা করা হয়েছে।

Untitled3আধুনিককালে ইরানের শিল্পীরা তাঁদের ঐতিহ্যকে অবলম্বন করেই নতুন নতুন শিল্পভঙ্গিতে হাত দিচ্ছেন। পাশ্চাত্যের ছাপচিত্র, তৈল চিত্র, জল চিত্র এগুলো সবই বর্তমানে ইরানের শিল্পীদের আয়ত্তে। তাঁরা তাঁদের এই আধুনিক জ্ঞানকে বর্তমান সময়ের উপযোগী করবার চেষ্টা করছেন। দীর্ঘকাল শাহের আমলে এক প্রকার নির্যাতনের মধ্যে শিল্পীরা ছিলেন। সেসব শিল্পীই পাহলভী শাসনের আনুকূল্য পেয়েছে যাঁদের কাছে চিত্রকলা ছিল এক প্রকার অর্থহীন কারুকার্য মাত্র। ইরানে ইসলামী বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পীরা নতুন একটি প্রেরণা লাভ করেন। এই প্রেরণাকে ‘ইসলামী জীবন প্রেরণা’ বলা যেতে পারে। এই নতুন প্রেরণায় শিল্পীরা একতাকে, ত্যাগকে, সাহসিকতাকে এবং আল্লাহর পথে আত্মসমর্পণকে শিল্পের বিষয়বস্তু করেছেন। শিল্প তাঁদের কাছে হয়েছে ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার একটি উপায়। ইসলামী বিপ্লব ইরানের শিল্পকলায় একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। শিল্পীরা বিপ্লবের অংশীদার হবার চেষ্টা করছেন এবং অংশীদারিত্বের জন্য যে শিল্পকর্মের জন্ম দিচ্ছেন তা পাশ্চাত্যের দৃষ্টিতে প্রচারমুখীন মনে হলেও এগুলো বর্তমান ইরানের বিশ্বাসের প্রতিবিম্বস্বরূপ এবং মৌলিক জীবন-সত্য। বর্তমানে পাশ্চাত্যের বিষয়বস্তুকে শিল্পীরা অস্বীকার করবার চেষ্টা করেছেন, যার ফলে শিল্পীদের শিল্প চেতনায় একটি প্রতিবাদের ভাব প্রকাশ পাচ্ছে। প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে একদিন ইরানে একটি নতুন শিল্প প্রক্রিয়ার জন্ম হবে।

 

অমর কবি ফররুখ আহমদ

মাসুদ মজুমদার

 বাংলা কাব্য সাহিত্যের অনন্য দিকপাল কবি ফররুখ আহমদ। নজরুল যুগের পর দিগন্ত উন্মোচন করে এ কবির আবির্ভাব। যুগ বিচারে ফররুখ যুগের সৃষ্টি নয়, স্রষ্টা। কাব্য ক্ষেত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, নতুন ভাবধারার সন্ধান এবং সর্বপ্লাবী সাহিত্যচর্চায় কালোত্তীর্ণ ধারা সৃষ্টিতে তিনিই তাঁর উপমা। জীবন সত্য এবং কাব্য সত্যের আশ্চর্য সমন্বয় ঘটেছিল একমাত্র ফররুখ এর জীবনেই। যে আদর্শ এবং চেতনায় তিনি অবগাহন করেছিলেন কাব্য সৃষ্টির দিগন্ত উন্মোচনে সেই চৈতন্যই ছিল তাঁর উপলব্ধির সহজাত প্রেরণা। তাই তিনি রেনেসাঁর চেতনাদীপ্ত কবি। তুলনাহীন মানবতাবাদী।

কাব্যে তিনি সন্ধান করেছেন সৃষ্টি সুন্দরকে। স্রষ্টার মহত্ত্বকে। জাতিসত্তার তর্কাতীত উৎস মূল এবং সতত প্রবহমান মূল স্রোতধারাকে। সঙ্গত কারণেই তাঁর কাব্যে ভর করেছে মানবতার আকুতি, স্বপ্ন এবং কাঙ্ক্ষিত প্রগতি। সাহিত্যের প্রতিযোগী তিনি ছিলেন না। স্বকীয় বৈশিষ্ট্য, স্বতন্ত্রধারা তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করেছে তাঁর যোগ্য আসনে। তাঁর কাব্যলক্ষী নদী, ফুল, নারী কিম্বা প্রকৃতির মাঝেই শুধু বিচরণ করেনি। সিন্দাবাদ, নৌফেল হাতেমের হাত ধরে সাত সাগর পাড়ি দিয়েছে। দুর্ভিক্ষের সাথে লড়েছে, লাশের মিছিলে হেঁটেছে, জড় সভ্যতাকে জ্ঞঞ্জালের মতো ঠেলেছে। সামনে এগিয়ে যাবার কোরাসে নব উত্থানের জয়গান গেয়েছে।

ঈগল চোখে সমাজ-সভ্যতা, যুগ, কাল এবং সময় পর্যবেক্ষণ করার এমন আশ্চর্য শক্তি আর কার ছিল। স্থবিরতাকে ভেঙে চুরমার করে জাগরণের গান গেয়ে হেরার রাজতোরণ প্রদর্শনের অঙ্গীকার শুধুই ভর করছিল ফররুখের কাব্যে, ব্যক্তিসত্তায়, কাব্যসত্তায়। স্বপ্ন রাজ্যের দুঃসাহসী নায়ক সিন্দাবাদকে দিয়ে তিনি জাগরণের ঢেউ তুলেছেন। যুগ প্রবর্তক এ কবি অসাধারণ দক্ষতায় আকাশের মুক্তবিহঙ্গ শাহীনকে উড়িয়েছেন- সেই সাথে মর্যাদাবোধের প্রতীক হয়ে অনমনীয় ফররুখ আপোষহীন থেকে এক বিস্ময়কর কবি আসনকে তর্কাতীতভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। আধুনিক কবিতার ব্যতিক্রমী এ শিল্পী ন্যায়ের পথে তাৎক্ষণিক হয়তো এক নিঃসঙ্গ কবি। কিন্তু যাঁরা তাঁকে নিয়ে হেঁয়ালি প্রদর্শন করেছেন তাঁরা কেউ বিষয়, ছন্দ, সমীক্ষা, কবিতার শরীর নির্মাণ এবং অভিনবত্বে তাঁকে অতিক্রম করতে পারেননি। তাই তাঁর শত্রুদের পক্ষেও তাঁকে অস্বীকার করা অসম্ভব। অনেকের ধারণা কবি ফররুখ তাঁর স্বপ্নরাজ্যে নিঃসঙ্গ এবং একা। তাদের ধারণা কতটা স্ববিরোধী এবং রাজনৈতিক ভেদবুদ্ধিতাড়িত, বাংলা সাহিত্যের আজকের সমৃদ্ধ অবয়ব দেখেই তা অনুভব করা সম্ভব।

তাঁর ডাহুক এখনও ডাকছে। তাঁর সমুদ্র-নাবিক এখনও পাল তুলছে। তাঁর হাতেম এখনও মানবতার জয়গান গায়। কিন্তু নিন্দুকেরা সাহিত্যের আসরে ঠাঁই পায়নি, কাব্যের জগতে টিকেনি, স্থায়ী আসন সৃষ্টিতো দূরের কথা, সমকালীন আসন থেকেও ছিটকে পড়েছে। ঐতিহ্যের রূপকার ফররুখ এখনো নারঙ্গীবনের সবুজ পাতায় কাঁপন তুলছেন।

ফররুখ মানস মানে কাব্য সচেতন, স্ববিরোধহীন, সচেতন এক কাব্যসম্রাট, কাব্যনাট্যের দিকপাল, অমূল্য সনেটের স্রষ্টা, আধুনিক কাব্য-সাহিত্যের বিস্ময়কর প্রতিভা।

যে সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যা লালন করেছেন, সাহিত্যের স্মৃতিতে তা অশেষ। তাঁর কবি কৃতি, জীবন বোধ, জাতীয় চেতনা আমাদের চেতনার উচ্চারণে এতটা ভাস্বর যে, ফররুখের আকাঙ্ক্ষা মানে আজকের জাতিসত্তার আকাঙ্ক্ষা, তাঁর অকৃত্রিম বিশ্বাস আজকের নব জাগৃতির সিপাহসালারদের বিশ্বাস। তাঁর স্বপ্ন একজন প্রগতিশীল সমাজকর্মীর স্বপ্ন। জীবনবোধের উজ্জীবিত লড়াকু বিপ্লবীর স্বপ্ন। বাংলা কাব্যে ফররুখের অবস্থান হুইটম্যান, গ্যাটে, মিল্টন, এলিয়ট, কীটস, শেলীর সাথে তুল্য মনে করা হয়। শব্দ, উপমা, ইমেজ এবং রূপকল্প সৃষ্টিতে কুশলতায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার। নজরুল আরবি-ফারসি শব্দ তুলে এনেছেন কাব্যের শরীরে, ফররুখ সে ধারাকে করেছেন ঐশ্বর্যমণ্ডিত।

ছন্দে তিনি যাদুকর ছিলেন না, ছিলেন বিপ্লবী। মধু কবি, রবিঠাকুর, জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে, বুদ্ধ দেব এর কাব্যের সাথে মিলিয়ে দেখলে এ সত্য আবিষ্কার করা যাবে না।

প্রভাবমুক্ত স্বতন্ত্র পথ রচনায় অন্যদের কৃতিত্ব যেখানে গৌণ, ফররুখ সেখানে সমুজ্জুল। বিষয় ও ছন্দ-সমীক্ষায় বিশেষত কাব্যনাট্যের জগতে ফররুখের উপস্থিতি সমসাময়িক সকল কবিকেই ঈর্ষাকাতর করেছে। সুনির্দিষ্ট মাত্রা, যতি, পর্ব, প্রয়োগে নিয়মরীতির অধীনে ছন্দবদ্ধ কবিতা ও গদ্য ছন্দের কবিতা রচনায়ও ফররুখের সাফল্য প্রচুর।

ফররুখ কাব্যে আঙ্গিক-বৈচিত্র্য, ভাব-ভাষা নিয়ে যে অবলম্বন তাতে কবি আধুনিকতার মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছেন।

কালজয়ী ঐতিহ্য সচেতন আধুনিক মানসের যুগ প্রবর্তক এ কবির জন্ম উনিশ শআঠারো সালের দশ জুন। যশোহর জেলার মাঝ আইলে তাঁর পৈত্রিক নিবাস। বাবা খান সাহেব সৈয়দ হাতেম আলী, মা বেগম রওশন আখতার। কবির পুরো নাম সৈয়দ ফররুখ আহমদ। মা-বাবার দ্বিতীয় পুত্র ফররুখ নিজের নামের সাথে সাধারণত সৈয়দশব্দটি ব্যবহার করতেন না। শৈশবে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে, কৈশোরে কলকাতার তালতলা মডেল স্কুলে, বালিগঞ্জ হাইস্কুল ও পরে খুলনা জেলা স্কুলে লেখাপড়া করেন। খুলনা জেলা স্কুল থেকেই তিনি প্রবেশিকা পাস করেন। উনিশ শউনচল্লিশ সালে রিপন কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। স্কটিশ চার্চ কলেজ ও সিটি কলেজেও তিনি পড়াশোনা করেছেন। আইএ পাস করার পর প্রথমে তিনি দর্শন এবং পরে ইংরেজিতে অনার্স পড়ার জন্য বিএ-তে ভর্তি হন। কিন্তু তাঁর অনার্স পরীক্ষা দেয়া হয়নি। অনেকেই মনে করেন, সম্ভবত কাব্যচর্চায় মাত্রাতিরিক্ত ঝোঁক প্রবণতা তাঁকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার জগতে টিকে থাকতে দেয়নি।

বিয়াল্লিশ সালে আপন খালাতো বোন সৈয়দা তৈয়বা খাতুনের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। তেতাল্লিশ সালে কর্মজীবনে প্রবেশ করে প্রথমে আইজি প্রিজন অফিস এবং সিভিল সাপ্লাইতে চাকুরী করেন। স্বল্প কালের এ চাকরি ছেড়ে পয়ঁতাল্লিশ সালে স্বল্প সময়ের জন্য মাসিক মোহাম্মদীর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। পরে জলপাইগুড়িতে সামান্য কিছুদিন চাকরি করেন। দেশ বিভাগের পর প্রথমে খণ্ডকালীন এবং পরে নিয়মিত শিল্পী হিসাবে রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা কেন্দ্রে কাজ করেন। একাত্তর সালে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ বেতারের নিজস্ব শিল্পী হিসাবে উনিশ শচুয়াত্তর সালের উনিশ অক্টোবর মৃত্যু পর্যন্ত এ চাকরিতে বহাল ছিলেন।

বিস্ময়কর এ প্রতিভার প্রথম আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি আসে ষাট সালে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার’-এর মাধ্যমে। একই সালে তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন। ছেষট্টি সালে হাতেম তায়ীগ্রন্থটির জন্য তিনি আদমজী পুরস্কার, একই সালে পাখির বাসাগ্রন্থটির জন্য ইউনেস্কো পুরস্কার লাভ করেন। জীবদ্দশায় একষট্টি সালে তৎকালীন ঢাকা হলে সর্বস্তরের সংস্কৃতি সেবীদের পক্ষ থেকে সম্বর্ধিত হন।

মৃত্যুর পর এ যুগস্রষ্টা কবিকে সাতাত্তর সালে মরণোত্তর একুশের পদক, আশি সালে স্বাধীনতা পুরস্কার এবং চুরাশি সালে ইসালিমক ফাউন্ডেশন পুরস্কার প্রদান করা হয়।

চুয়াল্লিশ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়ে কবির প্রথম অমর কাব্য সাত সাগরের মাঝিপঁচাত্তর সাল নাগাদ তিনবার প্রকাশিত হয়েছে। তারপর একে একে প্রকাশ পায় আজাদ করো পাকিস্তান, সিরাজাম মুনীরা, নৌফেল ও হাতেম, মুহূর্তের কবিতা, হাতেমতায়ী, পাখির বাসা, হরফের ছড়া, নতুন লেখা, ছড়ার আসর (এক), শ্রেষ্ঠ কবিতা, হে বন্য স্বপ্নেরা, নয়া জামাত (চার খণ্ড), ফররুখ রচনাবলী (প্রথম খণ্ড), ইকবালের নির্বাচিত কবিতা, চিড়িয়াখানা, কাফেলা, হাবেদা মরুর কাহিনী, সিন্দাবাদ-নামে চুরাশি সাল নাগাদ বিশটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তখন পর্যন্ত ছাপার অপেক্ষায় ছিল দিলরুবা, ফুলের জলসা, সাঁঝ সকালের কিস্সা ও কিস্সা কাহিনী নামক চারটি গ্রন্থ। শিশু-কিশোরদের জন্য প্রকাশের অপেক্ষায় পাণ্ডুলিপির সংখ্যা ছিল সাতটি, ছড়ার আসর (দুই, তিন), অলোকলতা, খুশীর ছড়া, ছড়াছবির দেশে, মজার ছড়া, পাখির ছড়া, রং মশলা। ব্যঙ্গ কবিতা, গান ও অনুবাদের সমাহার নিয়ে আরো দশটি পাণ্ডুলিপির সন্ধান মিলেছে। অনুস্বার বিসর্গ, ঐতিহাসিক অনৈতিহাসিক হাল্কা লেখা, তসবির নামা, রসরঙ্গ, রাজ রাজড়া, কাব্যগীতি, রক্ত গোলাব, মাহফিল, কোরান মঞ্জুষা। পারিবারিক সূত্রে যদ্দুর জানা যায়, সময়ান্তে কবির আরো কিছু পাণ্ডুলিপির সন্ধান মিলে যেতে পারে।

ফররুখের অন্য এক পরিচয় রোমান্টিক হিসাবে। বিশ্বাসের কবি হিসাবে অন্য পরিচয়টি তাঁকে নতুন প্রজন্মের কাছে স্বতন্ত্রধারার পথিকৃৎ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

খ্যাতিমান ও প্রতিষ্ঠিত অন্য কোন কবি শিশু-কিশোরদের জন্য এতবেশি লেখালেখি করেননি। সাহিত্য বিচারে, শিল্পমান, নৈতিক ভিত্তি তাঁর সৃষ্ট শিশু সাহিত্যকে বিশেষত্ব দিয়েছে। অনুসন্ধিৎসু শিশু মনে তাঁর পাখির বাসা, চিড়িয়াখানা প্রভৃতি দোলা দিবে অমর সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য নিয়ে।

ফররুখের কবি মানস এবং ব্যক্তি মানস ছিল বিরোধহীন, অভিন্ন। কবিতার বিভিন্ন বাঁকে কবির উপস্থিতি এতটা বলিষ্ঠ ও বক্তব্য প্রধান হয়েও আধুনিক এ কবির কাব্যচর্চার পরিধি এতটা বিস্তৃত হতে পেরেছে শুধুই বড় মাপের স্বভাবকবি হবার সুবাদে। কবির কবিতা সমালোচনা এবং কাব্য মান বিচার করার সামর্থ্য আমার নেই, কিন্তু ভালো লাগা কবিতা থেকে কিছু উদ্ধৃতির অধিকার নিশ্চয়ই আছে।

 হেরার তোরণ মিলাবে সম্মুখে জানি!

তবে নোঙ্গর তোলো,        

তবে তুমি পাল খোলো,

তবে তুমি পাল খোলো।

**

সওদাগরের দল মাঝে মোরা ওঠায়েছি আহাজারী,

ঘরে ঘরে উঠে ক্রন্দন ধ্বনি আওয়াজ শুনেছি তারি,

ওকি বাতাসের হাহাকার, ওকি রোনাজারি ক্ষুধিতের।

ওকি দরিয়ার গর্জন, ওকি বেদনা মজলুমের

ওকি ক্ষুধাতুর পাঁজরায় বাজে মৃত্যুর জয় ভেরী!

পাঞ্জেরী!

**

জাগো! বন্দরে কৈফিয়তের তীব্র ভ্রুকুটি হেরি,

জাগো! অগনন ক্ষুধিত মুখের নীরব ভ্রুকুটি হেরি;

দেখ চেয়ে দেখ সূর্য ওঠার কত দেরী, কত দেরী!!

**

কত যে আঁধার পর্দা পারায়ে ভোর হল জানি না তা,

নারঙ্গী বনে কাঁপছে সবুজ পাতা,

দুয়ারে তোমার সাত সাগরের জোয়ার এনেছে ফেনা,

তবু জাগালে না? তবু তুমি জাগালে না?

**

কেটেছে রঙিন মখমল দিন, নতুন সফর আজ,

শুনছি আবার নোনা দরিয়ার ডাক,

ভাসে জোরওয়ার মউজের শিরে সফেদ তাদির তাজ,

পাহাড়-বুলন্দ ঢেউ বয়ে আনে নোনা দরিয়ার ডাক;

**

হ জড় সভ্যতা

মৃত সভ্যতার দাস স্ফীত মেদ শোষক সমাজ,

মানুষের অভিশাপ নিয়ে যাও আজ।

তার পর আসিলে সময়

বিশ্বময়

তোমার শৃংখলগত মাংসপি-ে পদাঘাত হানি,

নিয়ে যাব জাহান্নাম দ্বার-প্রান্তে টানি,

আজ এই উৎপীড়িত মৃত্যুদীন নিখিলের অভিশাপ বও

ধ্বংস হও

তুমি ধ্বংস হও।

**

জানি না মানুষের লাশ মুখ গুঁজে পড়ে আছে জমিনের পর

সন্ধ্যার জনতা জানি কোন দিন রাখে না সে মৃত্যুর খবর।

**

রাত্রিভর ডাহুকের ডাক…

এখানে ঘুমের পাড়া স্তব্ধ নিবিড় সুপ্তির

দীর্ঘ রাত্রি একা জেগে আছি।

ছলনার পাশাখেলা আজ পড়ে থাক;

ঘুমাক বিশ্রান্ত শাখে দিনের মৌমাছি,

কান পেতে শোন আজ ডাহুকের ডাক।

***

খঞ্জরে ভাঙো জিঞ্জির ভীতি

কাঁপুক দুনিয়া টালমাটাল।

***

তীব্র ব্যথায় ঢেকে ফেলে মুখ দিনের সূর্য অস্তাচলে,

ডোবে ইসলাম রবি এজিদের আঘাতে অতল তিমির তলে,

কলিজা কাঁপায়ে কারবালা মাঠে ওঠে ক্রন্দন লোহুসফেন

ওঠে আসমান জমিনে মাতম কাঁদে মানবতা হায় হোসেন।

***

আজ সংগ্রাম নিজেকে চেনার,

মানবতা নিয়ে বেচা কেনার

হাটের ভীড়ে,

সময় এসেছে সকল দেনার

সকল হিসাবে মেটাতে ফিরে।

ঋণ শুধবার দিন

আজ সংগ্রাম নিজের সংগে

নিজেকে চেনার দিন।

যতই উদ্ধৃতি দেয়া যাবে শক্তিশালী এ শিল্পীর কাব্যলক্ষীকে ততই ধরা যাবে, ছোঁয়া যাবে, অনুভব করা যাবে। অনুভবের অলিন্দে এমন হৃদয় ছোঁয়া ধ্বনি শুধুই আপ্লুত করে, হৃদয় তন্ত্রিতে সুর তোলে। এ অনুভব গানে, শিশু সাহিত্যে, সনেটে, প্রতিটি কাব্যের পঙ্‌ক্তিতে।

অনেকেই মনে করেন ফররুখ অভিমান করে চলে গেছেন। নির্দয়, নিষ্ঠুর, পাষাণ সমাজের ওপর ছিল তাঁর সীমাহীন ও নিদারুণ অভিমান। ফররুখের মৃত্যু নিছক মৃত্যু নয়। অবজ্ঞা, অবহেলা, অবমূল্যায়ন তাঁকে জীবনের শেষ দিনগুলোতে অর্ধাহার, অনাহার ও দুশ্চিন্তায় ফেলেছিল। এক রকম চিকিৎসাহীন অবস্থায় এ অমর কবি পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিয়েছেন। এ এক নিষ্ঠুর যন্ত্রণায় আমরা নতুন প্রজন্ম দায়বোধে আবদ্ধ।

ক্ষমতার দাপটে মিথ্যা অহমিকার একদল মানুষ তাঁর বিশ্বাসকে খণ্ডিত করতে চেয়েছিল, সাম্প্রদায়িকতার মিথ্যা অভিযোগে দায়ী করার হীন মানসিকতা ছিল। তাদের সাথে অনন্যসাধারণ এ প্রতিভা সামান্যতমও আপোষ করেননি। বিশ্বাসকে অহংকার ভেবে মৃত্যুকে শ্রেয় মনে করেছেন। ব্যথাতুর হৃদয়ে আজ ভাবতে অবাক লাগে, জাতির এ অহংকার, কবি ফররুখ এর কবরের জন্য সাড়ে তিন হাত জায়গা মিলেনি। জ্ঞানতাপস ড. শহিদুল্লাহর মাজারের পাশে একটুকরো জায়গার আকুতি একশ্রেণির মানুষ মঞ্জুর করেনি। বাধ্য হয়ে কবি বেনজীর আহমদ তাঁর কাব্য সতীর্থের লাশ আগলে বলেছিলেন, ‘আমার ভাইকে আমি আমার ডেরায় নিয়ে যাই।শাহজাহানপুরে কবি বেনজীরের আম্রকাননে চির নিদ্রায় শায়িত হলেন যুগশ্রেষ্ঠ, ঐতিহ্য সচেতন, সময়ের শ্রেষ্ঠ কবি ফররুখ আহমদ। অপরাজেয় কবি মরেও হলেন অমর।

কবি নিজেই লিখেছিলেন,

তোরা চাসনে কিছু কারো কাছে খোদার মদদ ছাড়া,

 তোরা পরের উপর ভরসা ছেড়ে নিজের পায়ে দাঁড়া।

জীবনের শেষ মুহূর্তের লেখায় এবং বিশ্বাসে তিনি ছিলেন এক অভিন্ন। তাঁর আহ্বান ছিল শাশ্বত সত্যের আহ্বান। হে কবি! আমাদের সামনে আজও তোমার স্বপ্নের হেরার রাজ তোরণ, তোমার সামনে চিরন্তন শান্তির আবাস জান্নাত। তুমি বিজয়ী, অপরাজেয়। নাবিকের প্রতি তোমার মিনতি, জড় সভ্যতাকে জাহান্নামের দারপ্রান্তে টেনে নেবার আকুতি, আমাদেরও অঙ্গীকার। তুমি বলেছিলে, ‘জান্নাতে ফিরদৌসের সব মুক্ত দরজা তোমাকে ডাকে।সত্যি তোমাকে ডাকছে জান্নাত। তুমি পরিশ্রান্ত, ক্লান্ত, এবার ঘুমাও। তোমার শান্তির ঘুমে সন্বিত ফিরিয়ে দিক আমাদের মুক্তির কোরাস, তোমার প্রিয় আবেহায়াত।

ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)-এর গুরুত্ব ও শিক্ষা

এ. কে. এম. মাহবুবুর রহমান

ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) কেন পালন করতে হবে

সৃষ্টির প্রথম থেকেই মানুষের ফিতরাত বা স্বভাব হচ্ছে এই যে, মানুষ সুন্দর, আনন্দদায়ক, কল্যাণকর কোন বস্তু, ব্যক্তি ও ঘটনায় আনন্দিত হয়, আর অসুন্দর, দুঃখজনক ও অকল্যাণকর অবস্থায় ব্যথিত হয়। স্বভাব এমন যে, দুঃখের জীবন থেকে বের হয়ে আসতে সে প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে। ইতিহাসের পাতা উল্টালে অসংখ্য ঘটনা পাওয়া যাবে যখনই মানুষ অন্যায়, অসত্য ও জুলুম-নির্যাতনের স্টীম রোলারে নিষ্পেষিত হয়েছে তখনই মুক্তি পাওয়ার জন্য প্রাণপণে খুঁজেছে একজন মুক্তিদাতা, ত্রাণকর্তা যাকে কেন্দ্র করে এবং যার নেতৃত্বে ঘটাবে সকল দুঃখের অবসান, চিরতরে বিলীন করবে সকল অশুভ শক্তিকে।

মানুষ যখনই এ দুরবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেয়ে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলেছে তখনই স্বধর্মীয়, স্বগোত্রীয় লোকদের নিয়ে করেছে আনন্দানুষ্ঠান। এ আনন্দানুষ্ঠানকে মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের ভাষায় বলা হয়েছে ঈদ (عيد)। অভিধানে ঈদ বলতে বুঝায় :  কোন মর্যাদাবান ব্যক্তি অথবা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সমবেত হওয়ার দিন বা স্মৃতিচারণের দিবসই ঈদ। কেউ কেউ বলেছেন, ঈদকে এজন্যই ঈদ বলা হয় যে, প্রতিবছর নব আনন্দ নিয়ে তা ফিরে আসে।’ (আল-মুন্জিদ, পৃ. ৫৩৯)

আর মিলাদ ميلاد শব্দের অর্থ وقت الولادة জন্ম সময়। (আল-মুনজিদ, পৃ. ৯১৮)। পারিভাষিক অর্থে মিলাদ বলতে জন্ম সময়, জন্ম বৃত্তান্ত তথা কারো জন্ম তারিখে তার জীবন চরিত আলোচনা ও তার জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণের অঙ্গীকার করা। মিলাদ শব্দটি যদিও আরবি, কিন্তু আমাদের দেশে এর প্রচলন ফারসি ভাষা থেকে হয়েছে। অনেকে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট না জেনে এ শব্দটি আরবি ভাষার আঙ্গিকে তুলে ধরে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি করেন। ফারসিতে মিলাদ অর্থ زمان تولد জন্ম সময়। (ফারহাঙ্গে জবানে ফারসি, পৃ. ১০৬৭)

কোন নেয়ামত ও রহমত লাভ করলেই আনন্দোৎসব করা যেরূপ মানুষের স্বভাবজাত কাজ তদ্রূপ আল্লাহ তাআলার নির্দেশও তাই। যেমন কুরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে : ‘(হে রাসূল!) বল : আল্লাহর অনুগ্রহে ও তাঁর দয়ায়। সুতরাং এতে তারা আনন্দিত হোক।’ (সূরা ইউনুছ : ৫৮)

এ আয়াতে বর্ণিত আল্লাহর অনুগ্রহ فضل الله এবং তাঁর রহমত رحمة বলতে কী বুঝানো হয়েছে সে সম্পর্কে ইবনে জারির তাবারী (রহ.) তাঁর তাফসীরে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণনা করেছেন : হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন : অনুগ্রহ (فضل الله) বলতে ইসলাম আর রহমত (رحمة) দ্বারা আল-কুরআনে বুঝানো হয়েছে।

আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ূতী (রহ.) আদ্দুররুল মানসুর তাফসীরে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেছেন : হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) এ আয়াতের তাফসীরে বলেন : এখানে আল্লাহর অনুগ্রহবলতে ইল্ম বুঝানো হয়েছে। আর রহমতদ্বারা বুঝানো হয়েছে মুহাম্মাদ (সা.)-কে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন : আমিতো তোমাকে বিশ্বজগতের প্রতি কেবল রহমতরূপেই প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আম্বিয়া : ১০৭)

অর্থাৎ তোমরা মহামূল্যবান সম্পদ আল-কুরআন ও ইসলাম বা রাসূলে খোদা (সা.)-কে পেয়েছ, এর জন্য আনন্দ করা তোমাদের অন্যতম কাজ। যদি কুরআন মজীদ ও দীন ইসলাম পাওয়ার কারণে আনন্দ করতে হয় তাহলে যার মাধ্যমে কুরআন ও দীন পেয়েছি, যিনি ছিলেন সমগ্র জগতের রহমত, তাঁর আগমন যে কত বড় নেয়ামত ও রহমত তা বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না।

আবদুল হক মুহাদ্দেসে দেহলভী (রহ.) তাইতো তাঁর রচিত মা সাবাতা মিনাসসুন্নাহগ্রন্থে লিখেছেন : হাজার মাসের চেয়ে উত্তম লাইলাতুল কাদর, ফজিলতের রাত্রি শবে বরাত, শবে মেরাজ, দুই ঈদের রাত এ সবই রাহমাতুল্লিল আলামীনকে দান করা হয়েছে। যাঁকে দান করা রাত হাজার মাসের চেয়ে উত্তম, স্বয়ং তাঁর আগমন দিবস যে কত লক্ষ-কোটি দিবস-রজনীর চেয়ে উত্তম তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।

সামান্য জাগতিক নেয়ামত লাভ করলেও তার জন্য ঈদ উৎসব করার সরাসরি উদাহরণ আমরা আল-কুরআনে দেখতে পাই। যেমন আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ কামনা করে হযরত ঈসা (আ.) যে দোয়া করেছিলেন তা প্রণিধানযোগ্য। এরশাদ হয়েছে :

ঈসা ইবনে মারইয়াম বলল : হে আল্লাহ! আমাদের প্রভু! আমাদের জন্য ঊর্ধজগৎ হতে খাদ্যপূর্ণ খাঞ্চা প্রেরণ করুন। এ হবে আমাদের ও আমাদের পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সকলের জন্য ঈদস্বরূপ, আর আপনার অন্যতম নিদর্শন।’ (সূরা মায়িদা : ১১৪)

মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে খাঞ্চা ভরা খাওয়া পেলে তা যদি হযরত ঈসা (আ.)-এর ভাষায় সৃষ্টির আদি হতে অন্ত পর্যন্ত আনন্দোৎসবের কারণ ও আল্লাহ তাআলার নিদর্শন হয় তাহলে সৃষ্টির সেরা মানব, রহমতের ভাণ্ডার রাসূলে পাক (সা.)-এর মতো এ মহান নেয়ামতের আগমন দিবস কতই না মর্যাদাবান, গুরুত্ববহ, কতই না আনন্দের তা সহজেই অনুমেয়।

হযরত ইমাম বুখারী (রহ.) বর্ণনা করেন : আবু লাহাবের মৃত্যুর পর তার বংশের একজন স্বপ্নে তাকে খুবই খারাপ অবস্থায় দেখে জিজ্ঞেস করল, আপনার অবস্থা কি? সে জবাবে বলল, তোমাদেরকে ছেড়ে আসার পর আমার কল্যাণজনক কিছুই হয়নি, হ্যাঁ, এই আঙ্গুল (শাহাদাত অঙ্গুলি) দ্বারা পানি পাই। কারণ, এ আঙ্গুলের ইশারায় আমি দাসী সুয়াইবাকে মুক্তি দিয়েছিলাম।

এই হাদীসের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) তাঁর বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ ফাতহুল বারী এবং আল্লামা বদরুদ্দিন আইনী (রহ.) তাঁর রচিত আইনীগ্রন্থে বর্ণনা করেন : ইমাম সুহাইলী (রহ.) উল্লেখ করেন যে, হযরত আব্বাস (রা.) বলেন, ‘আবু লাহাবের মৃত্যুর এক বছর পর তাকে স্বপ্নে দেখি যে, অত্যন্ত দুরবস্থার মাঝে পতিত রয়েছে। সে বলল, ‘তোমাদের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার পর আমি শান্তির মুখ দেখিনি। তবে প্রতি সোমবার আমার আযাব লাঘব করা হয়।হযরত আব্বাস (রা.) বলেন : তার এ আযাব লাঘবের কারণ হলো রাসূলে পাক (সা.)-এর জন্মদিন ছিল সোমবার। তাঁর জন্মের সুসংবাদ নিয়ে আসায় দাসী সুয়াইবাকে সে খুশিতে মুক্তি দেয়। (ফাতহুল বারী, ৯ম খ-, পৃ. ১১৮; আইনী, ২০/৯৫)

যে কাফের সম্পর্কে কুরআন মজীদে সরাসরি নাযিল হয়েছে :

 ‘ধ্বংস হয়েছে আবু লাহাবের দুহাত এবং সে নিজেও।সে যদি একজন কাফের হওয়া সত্ত্বেও ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)-এর খুশির কারণে তার প্রতি সোমবার আযাব লাঘব হয়, শাহাদাত অঙ্গুলি দিয়ে পানি বের হয়- যা খেয়ে সে তৃপ্ত হয়, একজন মুসলমান ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদযাপন ও আনন্দানুষ্ঠান করলে তাতে রহমত, বরকত লাভ এবং আযাব থেকে মুক্তিলাভের এক বিরাট সুযোগ তা যে কোন বিবেকবান ব্যক্তি সহজেই অনুধাবন করতে পারে। কবি শেখ সাদী (রহ.)-এর ভাষায় :

دوستان را کجا کنی محروم

تو که با دشمانان نظرداری

বন্ধুদের বঞ্চিত করার প্রশ্নই আসে না, তুমি তো এমন সত্তা যে, দুশমনের দিকেও লক্ষ্য রাখ।

মিলাদুন্নবী উদযাপন দিবসকে কেন্দ্র করে রাসূলের পুরো জীবনকে আয়নার মতো নিজের জীবনের সামনে তুলে ধরা এবং সে অনুযায়ী ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ জীবন গড়ে তোলার সংকল্প গ্রহণের মতো উত্তম ও বরকতময় কাজ আর কী হতে পারে? রাসূলের মর্যাদা বর্ণনা করার সাথে সাথে তাঁর দাওয়াত ও হেদায়াত গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। অতীতে মনীষিগণ রাসূলের প্রশংসা বর্ণনার সাথে সাথে রাসূলের সুন্নাতকে তাঁদের জীবনে বাস্তবায়নের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন। হযরত আলী (রা.) যেমন ছিলেন রাসূলের সুন্নাতের ধারক তদ্রূপ প্রশংসায় ছিলেন পঞ্চমুখ। তিনি বলেন :

اختاره من شجرة النبياء و نشكاة الضياء و ذوابة العلياء و سرّة التئحاء و مصباح الظلمة و ينابيع الحكمة

নবুওয়াত বৃক্ষের মাঝে তিনি বাছাইকৃত আলোকের আধার, সম্মানের সর্বোচ্চ চূড়ায় অধিষ্ঠিত, বাতহা তথা মক্কা মুয়াজ্জমার মূলকেন্দ্র, অন্ধকারের বাতি, হেকমত ও প্রজ্ঞার উৎস-প্রস্রবণ।’ (নাহজুল বালাগা, খুতবা ১০৭)

হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) তাইতো বলেছিলেন :

روشن زوجود تست کونین

ای ظاهر و باطنت همه نور

আপনার অস্তিত্বের আলোয় উভয় জাহান আলোকিত, হে মহান! আপনার জাহের ও বাতেন সবই নূর।’ (কাসিদায়ে গাউসুল আজম)

তাইতো আল্লামা বুছিরী (রহ.) বলেছেন :

لو لاه ما خلق الافلاک خالقها

لو لاه ما خرج الانسان من عدم

তিনি না হলে আসমান স্রষ্টা তা সৃষ্টি করতেন না, তিনি না হলে মানবজাতি অনস্তিত্বের গ-ি হতে বের হয়ে আসত না।

তাঁর মহান সত্তা সম্পর্কে শেখ সাদী (রহ.) বলেছেন :

بلغ العلی بکماله

کشف الدجی بجماله

حسنت جمیع خصاله

صلوا علیه و آله

মানবতার শীর্ষে তুমি হলে উপনীত,

রূপের ছটায় দূর করলে আঁধার ছিল যত-

সকল গুণের সমাবেশে চরিত্রে মহান,

তুমি ও তোমার বংশ পরে হাজারো সালাম।

কবি ফররুখ বলেন :

হারা সম্বিত ফিরে দিতে বুকে তুমি

আনো প্রিয় আবহায়াত

জানি সিরাজাম মুনীরা তোমার রশ্মিতে

জাগে কোটি প্রভাত।

 কবি আল মাহমুদ বলেন :

এই নামে ফোটে হৃদয়ে গোলাপ কলি

যেন অদৃশ্য গন্ধে মাতাল মন,

যেন ঘনঘোর আঁধারে আলোর কলি

অকুল পাথারে আল্লার আয়োজন।

মোটকথা, সকল লেখক, কবি-সাহিত্যিকই রাসূলের শানে কিছু না কিছু লিখতে চেষ্টা করেছেন। অধুনা বিশ্বে কলমের সাথে আমলের দিক থেকে রাসূলের আদর্শের রূপায়নই হবে সবচেয়ে বড় কাজ।

আল্লাহর নবী কোন সময় এলেন

যে সময় আল্লাহর ঘরে স্থান পেয়েছে তিন শতাধিক মূর্তি। আইন, বিচার ও প্রশাসন সবক্ষেত্রে চলছে তাগুতী শাসন, মানুষে মানুষে হানাহানি, উটকে পানি খাওয়ানোর মতো তুচ্ছ বিষয় নিয়ে চলছিল যুগের পর যুগ যুদ্ধ। জীবন্ত কবর দিচ্ছিল বাবা নিজ কন্যাকে, সুদ ছিল দুনিয়ার অর্থনৈতিক ভিত্তি, ব্যভিচার, মদ ও জুয়া ছিল সমাজের ওপর তলার লোকদের নিত্যদিনের কাজ। অসহায়, ইয়াতিম, অনাথ বঞ্চিত মানবতা যখন করছিল গগনবিদারি ফরিয়াদ, নারী জাতি ছিল মর্যাদাহীন খেলনার বস্তু। আদর্শিক, নৈতিক অবস্থা বলতে কিছুই ছিল না। এ সময় ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ১২ই রবিউল আউয়াল সুখময় বসন্তকাল হিসাবে যিনি আগমন করেছিলেন তিনিই হলেন রাহমাতুল্লিল আলামীন। বিশ্ববিখ্যাত হাদীস বিশারদ মোল্লা আলী কারীর ভাষায় :

ربیع فی ربیع فی ربیع

ولکن فوق نور فوق نور

তিনি ছিলেন বসন্তকাল, যার আগমনে যেমন আগমন করেছে প্রাকৃতিক বসন্ত, তেমনি নৈতিকতা ও আদর্শের ভুবনেও আগমন করেছে নববসন্তের জোয়ার। তিনি ছিলেন জাগতিক বসন্তের চেয়ে লাখ-কোটি গুণ অধিক আলোদানকারী নূর।’ (মেরকাতুল মাফাতিহ)

কী নিয়ে এলেন এ শিশু

এ শিশুর শুভাগমন সারা দুনিয়াকে নাড়া দেয়। একদিকে মা আমেনার জীর্ণ কুটির স্বর্গীয় আলোতে ঝলমল, প্রকৃতির বস্তু নিচয় আনন্দাপ্লুত। আজ ইবরাহীমের তাওহিদী হুংকার, মূসার অলৌকিক অসি, ঈসা মসীহর আলৌকিকত্ব সবই নয়া সাজে সজ্জিত আর তাগুত, শয়তান জালেমের গায়ে লেগেছে আগুন। এ রাতে কিসরার প্রাসাদের ১৪টি গম্বুজ ভেঙে পড়েছে, পারস্যের হাজার হাজার বছরের অগ্নি নিভে গেছে, শাতিল নদী শুকিয়ে গেছে, কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি শুধু কিসরার গম্বুজই নয় বরং আজমীদের শান-শওকত, রোমানদের আড়ম্বর, চীনের প্রাচীরের মতো গগনচুম্বী মহলরাজি ভেঙে পড়েছিল। শুধু পারস্যের অগ্নিই নয় বরং অবিশ্বাসের গভীর ঘন অন্ধকার এবং পথভ্রষ্টতার বেড়াজাল ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। তাফসীরে সোরাবাদীরভাষ্য অনুযায়ী ২৫টিরও অধিক অলৌকিক ঘটনার সমাহার নিয়ে তিনি আগমন করলেন এ ধরায়। তাই তো কবি বলেছেন :

তাঁর গুণবৈশিষ্ট্য লেখার সাধ্য কারো আছে কি? তিনি তো আপাদমস্তক অলৌকিকত্ব নিয়েই এসেছেন।

 ‘মুহাম্মাদকতই না সুন্দর নাম!

কী চমৎকার শিশু! যার দুনিয়ায় আগমনের সময় মা আমেনার প্রসব বেদনা হয়নি, নাভি মায়ের নাভির সাথে সংযুক্ত নয়, যার খতনা মায়ের পেটেই সম্পন্ন, পুত-পবিত্র গোসল করা ও সেজদারত অবস্থায় তাশরিফ এনেছেন। বাংলার বুলবুল কবি নজরুল বলেন :

দেখ আমেনা মায়ের কোলে

দোলে শিশু ইসলাম দোলে

কচি মুখে শাহাদাতের

বাণী সে শুনায়।

যার আগমনের সাথে আকাশ, বাতাস মুখরিত হচ্ছে সালাম আর সওগাতে। তাঁর নাম যে কত তাৎপর্যবহ হবে তা তো সহজেই অনুমেয়।

পিতৃহীন স্বর্গীয় নাতিকে প্রথমবারের মতো কোলে নিয়ে আবদুল মুত্তালিব পুত্রবধূ আমেনাকে জিজ্ঞেস করলেন : এ চাঁদের নাম কী রাখা যায়?’ জবাবে আমেনা বললেন : স্বপ্নে আমাকে কে যেন বলেছে, শিশুর নাম হবে মুহাম্মদদাদা এ নাম শুনে খুশি হয়ে এ নামেই ডাকতে লাগলেন। (সিরাতে ইবনে হিশাম, নেহায়াতুল আরব) যার অর্থ চরম প্রশংসিত। অভিধানের দৃষ্টিতে মুহাম্মাদ অর্থ যার প্রশংসা অতীতে চলেছে, বর্তমানে চলছে এবং ভবিষ্যতেও চলবে, তিনিই হলেন মুহাম্মাদ।

মুহাম্মাদ তাকেই বলে যার মাঝে প্রশংসনীয় চরিত্রের সমাহার ঘটেছে।

কবি হাসসান বিন ছাবিত তাইতো মসজিদে নববীর মিম্বারে বসে আল্লাহর রাসূলকে সামনে নিয়ে গেয়েছেন :

وشق له اسمه لیجله- فذو العرش محمود و هذا محمد

আল্লাহ (আদর ও সোহাগ করে) নিজের নাম হতে তাঁর নামকে বের করেছেন। অধিকন্তু মহান আরশের অধিপতি হচ্ছেন মাহমুদ (প্রশংসিত) আর হযরতের নাম হলো মুহাম্মাদ (চরম প্রশংসিত)।

শিশু-কিশোরের আদর্শ মুহাম্মাদ (সা.)

আমেনার আদরের দুলাল মুহাম্মাদ (সা.) তো প্রশংসা পাবারই পাত্র। যে হযরত হালিমার দুধপান করতে গিয়েও একটি স্তনের দুধ পান করছেন আরেকটি রেখে দিচ্ছেন দুধ ভাই আবদুল্লাহর জন্য। ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের দরদ, সাম্যের এরূপ নিদর্শন দুনিয়ার ইতিহাসে আরেকটি কি খুঁজে পাওয়া যাবে? শিশু মুহাম্মাদ (সা.)-এর আচার-আচরণ দেখে হালিমার আশপাশের নারীরা হিংসায় জ্বলে যেত। সবাই ভাবত, এরূপ একটি শিশুর লালন যদি আমার ভাগ্যে জুটত। দুধ ভাইয়ের এ আদর্শ দেখেই দুধবোন সায়মা কোলে নিয়ে বলছেন :

বেঁচে থাকুক মুহাম্মদ- সে দীর্ঘজীবী হোক

চির তরুণ চির কিশোর চির মধুর রোক।

হয় যেন সে সরদার আর পায় যেন সে মান

শত্রু তাহার ধ্বংস হোক ঘুচুক অকল্যাণ।

মুহাম্মদের পানে খোদা করুন চোখে চাও

চিরস্থায়ী গৌরব যা-তাই তাহারে দাও।

(অনুবাদ-কবি গোলাম মোস্তফা)

আল-আমীন মুহাম্মাদ (সা.)

শৈশবের ঘটনাবহুল দিনগুলো পেরিয়ে কৈশোরে প্রতিষ্ঠিত হলেন কিশোর মুহাম্মাদ (সা.) আল-আমীনমুহাম্মাদ রূপে। যার অর্থ শান্তিপ্রিয়, সম্প্রীতির আধার, চরম সত্যবাদী ও পরম বিশ্বস্ত। মক্কার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ল মুহাম্মাদ’ (সা.) এমন এক কিশোর যে মিথ্যা কথা বলে না, আমানতের খেয়ানত করে না, অন্যের উপকার করা যার কাজ, বড়দের সম্মান ছোটদের স্নেহ করা যার চরিত্র। গোটা মক্কার জনগোষ্ঠীর মনের মাঝে এ কিশোরের স্থান ছিল অনন্য। সবার সাথে সুসম্পর্ক রয়েছে, অথচ সে অন্যায়, অশ্লীলতার ধারে কাছেও যায় না। কটুবাক্য সে বলেনি যা অন্যের মনে কষ্ট হতে পারে। আজকের কিশোর সমাজ আদর্শ কিশোর হতে হলে যে জীবন্ত প্রতীকের অনুসরণ করবে তিনি হলেন কিশোর মুহাম্মাদ (সা.)।

আদর্শ যুবক মুহাম্মাদ (সা.)

যে কিশোর সকলের আদরের, সবার স্নেহের যৌবনে পদার্পণ করার পর মক্কার যুব সমাজে তাঁর কদর হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু চরিত্র যতই ভালো হোক সমাজ সংস্কারের জন্য যে যুবক উদ্যোগ নেয় না, যথাসাধ্য চেষ্টা চালায় না, সে যুবক সমাজের সর্বত্র প্রভাব বিস্তার ও সমাজ সংস্কারের কাজে কোন ভূমিকা নিতে পারে না। যৌবনে পদার্পণ করেই যুবক মুহাম্মাদ (সা.) দেশের সামাজিক, চারিত্রিক ও রাজনৈতিক করুণ অবস্থা দেখে সমবয়সী যুবকদের সমন্বয়ে গঠন করলেন হিলফুল ফুজুলনামক শান্তি সংঘ। দুনিয়ার ইতিহাসে এটাই ছিল যুবকদের সর্বপ্রথম শান্তি সংঘ। এর ফলে অসহায় ও দুর্গত মানবতার সেবা, ইয়াতীম-বিধবা ও দুর্বলগণকে অত্যাচার থেকে মুক্তি, পথিক-ভিনদেশীর নিরাপত্তা বিধান, অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার মাধ্যমে সাম্য-মৈত্রীর এক বন্ধন হার গড়ে তুলতে সক্ষম হন।

রাসূল হিসাবে আবির্ভাব

যুবক মুহাম্মাদ (সা.) মক্কার যুব সমাজকে নিয়ে যদিও সমাজ সংস্কারের পদক্ষেপ নিয়েছেন, কাবা ঘরে পাথর বসানো নিয়ে বিভিন্ন গোত্রের বিবাদ শান্তিপূর্ণভাবে মিমাংসা করতে সক্ষম হয়েছিলেন; কিন্তু মক্কা তথা গোটা দুনিয়ার মানুষ র্শিকে নিমজ্জিত ছিল। র্শিক থেকে মুক্ত করার জন্য প্রয়োজন ছিল এক মহা শক্তির প্রত্যক্ষ মদদ যা সকল তাগুতী শক্তিকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। যতদিন যেতে লাগল মুহাম্মাদ (সা.)-এর মনে ততই চিন্তার পাহাড় জমতে থাকে। হেরা পর্বতের গুহায় বসে ভাবছিলেন কি করে এ বিশ্বকে র্শিকমুক্ত করা যায়। খোদায়ী ওহী ধারণ করার জন্য যেসব মানবীয় গুণ ও নৈতিক চরিত্র দরকার, জনমনে যে আসন লাভ করা প্রয়োজন সে চারিত্রিক ও গুণগত বৈশিষ্ট্য ফুলে-ফলে সুশোভিত হওয়ার পরই নাযিল হলো লওহ মাহফুজে লেখা আল্লাহর বাণী আল-কুরআন। ঘোষিত হলো :

পড় তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।’ (সূরা আলাক : ১)

এ খোদায়ী নূরানি কুরআনকে যারা ধারণ করতে চায় তাদেরকেও রাসূল চরিত্রের অনুকরণীয় চরিত্র অর্জন করতে হবে।

শুরু হলো হক-বাতিলের লড়াই

কুরআনের নূরানি ঝলক, পুত-পবিত্র ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বের মুখে লা শারিক’-এর ঘোষণা সকল স্বার্থান্বেষী, সুবিধাভোগী আমলা ও দুর্নীতিবাজ শোষক শ্রেণির মাথায় হানলো এক বজ্রাঘাত। অত্যাচার, নিপীড়ন, অর্থনৈতিক অবরোধ, সামাজিক বয়কট, হত্যার হুমকি, কুৎসা রটনা এবং পাগল-যাদুকর, দেশদ্রোহী, ধর্মবিরোধীরূপে আখ্যাসহ সকল প্রকার প্রচার অর্থাৎ শয়তানি শক্তির সকল বাধা বিপত্তির মুখে দৃঢ় চিত্ত ঈমান নিয়ে আল্লাহর নবী নিজেকে ও সাহাবায়ে কেরামগণকে গড়ে তোলেন কুরআনি আদর্শে। কায়েম হলো আল্লাহর রাজ। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সংবিধানে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, আদল-ইনসাফভিত্তিক বিচার ব্যবস্থা এবং দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিমুক্ত প্রশাসন উপহার দেয়ার জন্য শারীরিক নির্যাতন, অর্থনৈতিক দৈন্য সবকিছু সহ্য করেছেন, প্রয়োজনে পেটে পাথর বেঁধেছেন, গাছের পাতা খেয়েছেন; কিন্তু অন্যায়ের সাথে, র্শিকের সাথে, হারামের সাথে, দুর্নীতির সাথে আপোষ করেননি। মানুষের তৈরি খোদাবিমুখ আইন-কানুন, সংবিধান, সম্পূর্ণ উল্টিয়ে আল-কুরআনকে বসিয়েছেন সবার ঊর্ধ্বে। সুদভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থা পরিবর্তন করে প্রতিষ্ঠা করেছেন বাস্তবসম্মত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। মোটকথা, মাত্র তেইশ বছরের মধ্যে আল্লাহর রাসূলের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে এক আদর্শ সভ্যতা, উন্নত সংস্কৃতি ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থা।

ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদযাপন ও কিছু কথা

রাসূলে খোদা (সা.)-এর জীবন চরিত্র-সুন্নাহ হলো আল্লাহর কুরআনের বাস্তব দিক। যারা এ সুন্নাহর পুরোপুরি অনুসরণ করবেন, এ সুন্নাহকে বাস্তবায়ন করার কাজে ব্রতী হবেন তাঁদের জন্যই হবে রাসূলের জন্ম দিবস আনন্দের। যারা প্রতিবছর ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)-কে কেন্দ্র করে নিজের, পরিবারের, সমাজ ও রাষ্ট্রের সার্বিক কাজ-কর্মকে রাসূলের জীবনের সাথে মিলাবেন, সে আয়নায় নিজেদেরকে দেখবেন, নিজেদের দোষ-ত্রুটি চিহ্নিত করে পরবর্তী বছরের জন্য প্রস্তুতি নেবেন তাঁদের জন্য হবে এ দিবস ঈদের দিন।

কিন্তু যে দেশের সংবিধান র্শিকমিশ্রিত, যেখানে আল্লাহকে বাদ দিয়ে মানুষকেই ক্ষমতার উৎস বলা হয়- সে দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে ঈদে মিলাদুন্নবী পালন আল্লাহর রাসূলের সাথে উপহাস ছাড়া আর কিছুই নয়।

যে ব্যক্তি সুদ খায়, সুদ দেয়, সুদী কারবার করে, ঘুষ খায়, ঘুষ দেয়, ঘুষের লেনদেনে জড়িত, যে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে প্রশাসনে দুর্নীতি ঢুকায়, যে ব্যবসা-বাণিজ্যে পরকে ঠকানোর ব্যবস্থা করে, যে মালিক অন্যায়ভাবে তার শ্রমিকদের ঠকায় ও শ্রমের মর্যাদা দেয় না, যে শ্রমিক কাজে ফাঁকি দেয় তার জন্য রাসূলে খোদার জন্মদিন হবে ভয়ের দিন, দুঃখের দিন। তার জন্য এ দিবস কিছুতেই ঈদ বা খুশির হতে পারে না। যে মিলাদ মাহফিলে রাসূলের জীবন চরিত্র আলোচনা হয় না, সুদ ঘুষ ও চোরাচালানির পয়সা দিয়ে যেখানে মিষ্টি হালুয়া ক্রয় করা হয়, তাদের এ মাহফিল ও পয়সা ব্যয় রাসূলে পাকের গলায় ছুরি চালানোর মতো। যে আলেম সামান্য কিছু পয়সার বিনিময়ে রাসূলের নির্দেশিত সত্যকে গোপন রাখে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলে না, সামান্য দাওয়াতের জন্য সুদখোর, মদখোর, জুয়াড়ি, বেনামাযী খোদাদ্রোহীর সাথে সম্পর্ক রাখে, তাদের ঈদে মিলাদুন্নবী পালন হবে বনি ইসরাইলের স্বার্থান্বেষী দরবারি আলেমদের মতো যাদেরকে কুরআনে কুকুর বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। এরশাদ হয়েছে :

তাদেরকে ঐ ব্যক্তির বৃত্তান্ত পড়ে শুনাও যাকে আমি দিয়েছিলাম নিদর্শন। সে তা বর্জন করে (তাকে নিদর্শন মুক্ত পেয়ে) শয়তান তার পেছনে লাগে, আর সে বিপথগামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়। আমি ইচ্ছা করলে এ সব (নিদর্শন) দ্বারা তাকে উচ্চ মর্যাদায় ভূষিত করতাম। কিন্তু সে দুনিয়ার প্রতি ঝুঁকে পড়ে ও তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করে- তার অবস্থা কুকুরের ন্যায়। তার ওপর তুমি বোঝা চাপালেও সে হাঁপাতে থাকে আর বোঝা না চাপালেও সে হাঁপায়। যে সম্প্রদায় আমার নিদর্শনকে প্রত্যাখ্যান করে তাদের অবস্থাও এইরূপ। তুমি ঘটনা বলে দাও যাতে তারা চিন্তা করে।’ (সূরা আরাফ : ১৭৫-১৭৬)

তাই আজকের সমাজে বিদ্যমান সকল অন্যায়, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও জুলুম থেকে মুক্তি পাওয়ার এবং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে র্শিক থেকে মুক্ত করার জন্য মুসলিম বিশ্বের ঐক্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এক মাত্র পথ হলো আল-কুরআনকে আঁকড়ে ধরা, রাসূলে খোদা (সা.)-এর সুন্নাহকে বাস্তবায়নের সর্বাত্মক চেষ্টা করা। ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) রাসূলের এ চিরন্তন দাওয়াত পৌঁছানোর এবং তাঁর সাথে ভালোবাসা গড়ে তোলার মোক্ষম সময়। আমরা রাসূলের সাথে যত বেশি মহব্বতের সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারব, যত বেশি দরুদ ও  সালাম পাঠাব ততই বাতিল, তাগুত আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাবে। আসুন ঘরে ঘরে রাসূলের জীবন চরিত্র আলোচনা ও বাস্তবে তা পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করি। ঈদে মিলাদুন্নবী সবার জন্য হোক মুবারক এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

যেসব গ্রন্থ অবলম্বনে লিখিত

  ১. কুরআন মজীদ

  ২. বুখারী শরীফ- ইমাম বুখারী

  ৩. উমদাতুল কারী ফি শারহিল বুখারী- বদরুদ্দিন আইনী

  ৪. ফাতহুল বারী ফি শারহিল বুখারী- ইবনে হাজার আসকালানী

  ৫. মিশতাকুল মাছাবিহ- ওলীউদ্দিন খতিব

  ৬. মিরকাতুল মাফাতিহ- মোল্লা আলী কারী

  ৭. বুখারী শরীফ- অনুবাদ : শাইখুল হাদীস আজিজুল হক

  ৮. তাফসীরে ইবনু জারির তাবারী- ইবনে জারীর তাবারী

  ৯. তাফসীরে দুররুল মানসুরজালালুদ্দীন সুয়ূতী

  ১০. মা সাবাতা মিনাস্ সুন্নাহ- আবদুল হক মুহাদ্দেসে দেহলভী

  ১১. সিরাতে ইবনে হিশামইবনে হিশাম কোরেশী

  ১২. সিরাতুন্নবীশিবলী নোমানী

  ১৩. বিশ্বনবীকবি গোলাম মোস্তফা

  ১৪. গুলিস্তানে সাদী- শেখ সাদী

  ১৫. কুল্লিয়াতে ইকবাল- ড. ইকবাল

  ১৬. নজরুলের ইসলামী সংগীত- নজরুল ইসলাম

  ১৭. সিরাজাম মুনীরাকবি ফররুখ আহমদ

  ১৮. আল মাহমুদের কবিতা- কবি আল মাহমুদ

  ১৯. দিওয়ানে হাসসান বিন সাবিত- কবি হাসসান বিন সাবিত

  ২০. নাহজুল বালাগাহযরত আলী (রা.)

  ২১. মুফরাদাতে ইমাম রাগেব- ইমাম রাগেব

  ২২. আল মুনজিদ

  ২৩. গিয়াসুল লোগাত

  ২৪. লোগাতে কিশওয়ারী

  ২৫. ফারহাঙ্গে জবানে ফারসিমুশীদ মুসাইয়েরী

  ২৬. কাসিদায়ে গাউসুল আজম- বড় পীর আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.)

  ২৭. কাসিদায়ে বোরদাআল্লামা বুছিরী

  ২৮. শরহে বুখারী যোরকানী- আল্লামা যুরকানী

  ২৯. নেহায়াতুল আরবআল্লামা নুবাইরী

 [লেখক: অধ্যক্ষ, মজিদিয়া কামিল মাদরাসা, চাঁদপুর]

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান পরিচিতি- (কর্মঘণ্টা, বর্ষপঞ্জি ইত্যাদি)

চাষাবাদ

অতীতের শাসকগোষ্ঠী নিজেদেরকে বিশ্ব পরিমণ্ডলে একটি প্রগতিশীল সরকার হিসাবে চিত্রিত করার জন্য অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে গ্রামাঞ্চলকে অবহেলিত রেখে ইরানের শহর ও নগরাঞ্চলকে রঙিন ও জাঁকালো করে তোলার চেষ্টা করে।

সে কারণে কৃষিখাত সেই আদিম অবস্থায় রয়ে যায়। চাষাবাদে মানুষ ও পশুর ক্ষমতাই থাকে প্রধান অবলম্বন এবং কৃষি উৎপাদনও বৃদ্ধি পায়নি। ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সরকার অর্থনীতিতে কৃষির অবদান গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে এই খাতে আধুনিক ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রবর্তনের জন্য ব্যাপক প্রচারাভিযান শুরু করে এবং মানব ও পশুশ্রমের স্থলে যান্ত্রিক শক্তি স্থাপন করে। এই প্রচেষ্টায় সন্দেহাতীতভাবে অসাধারণ উৎপাদন-সাফল্য অর্জিত হয়। তখন থেকে বীজ ও চারা উন্নয়ন সংস্থা এবং কৃষি যন্ত্রপাতি উন্নয়ন সংস্থার মতো বিভিন্ন সংস্থা গড়ে তোলা হয়। এসবের মাধ্যমে কৃষকদেরকে প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা প্রদান করা হয় এবং উন্নততর যন্ত্র-সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়। এ ধরনের প্রচেষ্টার একটি দিক হলো যৌথ চাষাবাদ। সমবায় সংগঠন, গ্রামীণ সমাজ কল্যাণ ও ঋণদান প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মতো রাষ্ট্রীয় সহায়তা কর্মসূচির মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং পল্লিবাসীর জীবন যাত্রার মান উন্নয়নের জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

বিপ্লব পরবর্তীকালের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, ইরানের মোট জাতীয় আয়ের শতকরা ১৬.৩ ভাগ আসে কৃষিখাত থেকে এবং এতে দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ২৪.৪ ভাগ লোকের কর্মসংস্থান ছিল। সেই সময় থেকে লাখ লাখ একর আবাদযোগ্য জমি দরিদ্র কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। ইসলামী বিপ্লব সফল হওয়ার পূর্বে এসব জমি সামন্তবাদী ব্যবস্থার অধীনে কর্তৃত্বশালীদের অধীনে ছিল। ইরানের ঊর্বর অঞ্চলবিশিষ্ট চারটি প্রদেশ যুদ্ধাঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও এসব সুষ্ঠু পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে দেশের কৃষি উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পায়।

গম, বার্লি ও চাউলের মতো খাদ্যশস্য এবং তুলা, তামাক ও চিনিবীট উৎপাদনযোগ্য জমির পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য আরো প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জয়তুন, তরমুজ, খরমুজ ও কমলার মতো নানা জাতের ফল এবং বাদাম, চা, মশলা ও ওষুধ তৈরির গাছ-গাছড়া ইত্যাদিকেও বাণিজ্যিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে এ সবের উৎপাদনের দিকে বিশেষ নজর দিচ্ছে। কৃষিখাতে আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ এবং উন্নততর সুযোগ-সুবিধার প্রবর্তন এই খাতের উন্নয়নকে দর্শনীয় করে তুলেছে।

 বনায়ন

ইরানে বনায়ন কৃষিখাতের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় এক কোটি ৮৮ লাখ হেক্টর জমি বনভূমি। এই বনভূমি কেবল গুরুত্বপূর্ণ কাঠ-উৎসই নয়; বরং শিল্প ও শহরাঞ্চলের বাসিন্দাদের জন্য আকর্ষণীয় বিনোদন এলাকাও বটে। উপরন্তু, পানির প্রবাহ হ্রাস, বাতাসের প্রকোপকে দুর্বল, বাতাসকে পরিচ্ছন্ন এবং ভূমিধস ও হিমবাহ রোধ করে এই বনাঞ্চল মাটি, বায়ু ও পরিবেশের ওপর এক কল্যাণকর প্রভাব বজায় রাখে। এসব সুবিধার কথা বিবেচনা করে কর্তৃপক্ষ বেপরোয়া বৃক্ষ কর্তন নিয়ন্ত্রণ করেছে। ইতিপূর্বে এসব বৃক্ষ বা কাঠ কয়লার আকারে বিকল্প জ্বালানি উৎস হিসাবে ব্যবহৃত হতো।

তাই ব্যাপক আকারের নতুন বনায়ন নীতি গ্রহণের পাশাপাশি কাঠ বিক্রয় ও রফতানি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে এবং একটি সুষ্ঠু বন ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে।

 মৎস্য শিকার

ইরানে মৎস্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ খাত এবং অভ্যন্তরীণ ভোগ ও রফতানি উভয় প্রয়োজনেই মৎস্য শিকার করা হয়। ইরানের মৎস্য শিল্প পরিচালিত হয় ফিশারি অব ইরাননামক একটি সংস্থার মাধ্যমে। দেশের দক্ষিণাঞ্চল থেকে মৎস্য শিকার করে ফিশারি অব সাউথ। বছরে শরৎ ও শীত এই দুই মৌসুমে সাধারণত মৎস্য শিকার করা হয়। সবচেয়ে বেশি মাছ ধরা হয় কাস্পিয়ান সাগর থেকে। এখানকার মাছের শতকরা ৭ ভাগই কেভিয়ার। কাস্পিয়ান সাগরে এ ছাড়াও আছে স্টারজিয়ান, ব্রীম, রুপালি মাছ, স্যামন, মুলেট, পোনা মাছ, মাগুর ও শিং মাছ, পার্চ ও রোচ। পারস্য উপসাগরে আড়াইশরও বেশি প্রজাতির মাছ আছে। এর মধ্যে দেড়শপ্রজাতির মাছ খাওয়ার যোগ্য।

 ব্যবহারিক তথ্য

 সময়ের পার্থক্য

তেহরানের সময় গ্রীনিচ মান সময়ের চেয়ে সাড়ে তিন ঘণ্টা অগ্রবর্তী। অর্থাৎ পশ্চিম ইউরোপীয় পরিব্রাজকদেরকে অবশ্যই তাঁদের ঘড়ির কাঁটাকে সাড়ে তিন ঘণ্টা এগিয়ে নিতে হবে, ব্রিটিশ সামার (গ্রীষ্ম) সময় (বিএসটি) মোতাবেক তাঁদের সময় যাই হোক না কেন।

 কর্ম ঘণ্টা

সরকারি অফিস, ব্যাংক ও সরকারি সংস্থাসমূহে কাজের সময় সকাল ৭টা থেকে বেলা ২টা অথবা সকাল সাড়ে ৭টা থেকে বেলা আড়াইটা। তবে যাদুঘর ইত্যাদির মতো প্রতিষ্ঠান কখনও কখনও বিকাল ৪টা থেকে ৭টা পর্যন্ত পুনরায় খোলা রাখা হয়। এ ছাড়া দোকান-পাট, বাজার ও বিক্রয় কেন্দ্রসমূহ খোলা রাখার সময় সকাল ৭টা থেকে রাত ৮টা।

বর্ষপঞ্জি

সমগ্র মুসলিম বিশ্বে স্বীকৃত ইসলামী বর্ষপঞ্জি গণনা করা হয় [৬২২ খ্রিস্টাব্দে] মহানবী (সা.)-এর হিজরতের সময় থেকে। ইরানে দুই ধরনের বর্ষপঞ্জি গণনা করা হয়। প্রায় ৩৫৪ দিনে ১২ মাসের চান্দ্রবর্ষ আর ৩৬৫ দিনে ১২ মাসে সৌরবর্ষ। উভয় বর্ষপঞ্জিরই সূচনা ধরা হয়েছে হিজরতের (মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর মক্কা থেকে মদীনায় গমন) সময় থেকে। তাই ইরানে প্রচলিত উভয় বর্ষপঞ্জির (চান্দ্র ও সৌর) প্রথম বছরের প্রথম মাসের প্রথম দিন ছিল ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জুলাই।

চান্দ্রবর্ষের মাসসমূহ নিম্নরূপ : ১. মুহররম, ২. সফর, ৩. রবিউল আউয়াল, ৪. রবিউস সানী, ৫. জমাদিউল উলা, ৬. জমাদিউস সানী, ৭. রজব, ৮. শাবান, ৯. রমযান, ১০. শাওয়াল, ১১. জিলকদ ও ১২. জিলহজ।

সচরাচর ৩০ দিনে এক মাস এবং পরবর্তী মাস ২৯ দিনে গণনা করা হয়।

ধর্মীয় উৎসবসমূহ চান্দ্রবর্ষ অনুসারে উদযাপিত হয়।

সৌর বর্ষের মাসগুলো নিম্নরূপ :

১. ফারভারদিন : ২১ মার্চ –২০ এপ্রিল,

২. উর্দিবেহেশত : ২১ এপ্রিল –২১ মে,

৩. খোরদাদ : ২২ মে ২১ জুন,

৪. তীর : ২২ জুন ২২ জুলাই,

৫. মোরদাদ : ২৩ জুলাই ২২ আগস্ট,

৬. শাহরিভার : ২৩ আগস্ট –২২ সেপ্টেম্বর,

৭. মেহের : ২৩ সেপ্টেম্বর ২২ অক্টোবর,

৮. আবান : ২৩ অক্টোবর –২১ নভেম্বর,

৯. আজার : ২২ নভেম্বর ২১ ডিসেম্বর,

১০. দে : ২২ ডিসেম্বর ২০ জানুয়ারি,

১১. বাহ্মান : ২১ জানুয়ারি –১৯ ফেব্রুয়ারি এবং

১২. ইসফান্দ : ২০ ফেব্রুয়ারি –২০ মার্চ।

এই সৌরবর্ষের প্রথম ছয় মাসের প্রতি মাস ৩১ দিন করে, পরবর্তী পাঁচ মাসের প্রতিমাস ৩০ দিন করে এবং শেষ মাস ২৯ দিনে। সরকারী ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হয় সৌর তারিখ মোতাবেক।

ইরানে চারটি ঋতু। প্রথম তিন মাস বসন্ত ঋতু ও শেষ তিনমাস শীত ঋতু। বসন্তের পরবর্তী মাস গ্রীষ্মকাল এবং গ্রীষ্মের পরবর্তী তিন মাস শরৎ-হেমন্ত।

সপ্তাহের দিন

শনিবার শাম্বে

রবিবার –এক শাম্বে

সোমবার –দো শাম্বে

মঙ্গলবার –ছে শাম্বে

বুধবার চার শাম্বে

বৃহস্পতিবার –পাঞ্জ শাম্বে

শুক্রবার জোময়ে

ছুটি

জাতীয় ছুটি : ১২ ফারভারদিন (১ এপ্রিল) ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রশ্নে গণভোট দিবস, ১৫ খোরদাদ (৫ জুন) ইমাম খোমেনী (রহ.)-এর গ্রেফতার দিবস, ২২ বাহবান (১১ ফেব্রুয়ারি), ইরানে ইসলামী বিপ্লবের বিজয় দিবস।

ধর্মীয় ছুটি

১৩ রজব, হযরত আলী (আ.)-এর জন্ম দিবস।

২৭ রজব, মহানবী (সা.)-এর মাবাস (নবী হিসাবে মনোনয়ন প্রাপ্তি) দিবস।

১৫ শাবান, দ্বাদশ ইমামের জন্ম দিবস।

২১ রমযান, ইমাম আলী (আ.)-এর শাহাদাত দিবস।

১ শাওয়াল, ঈদুল ফিতর।

১২ শাওয়াল, ইমাম সাদিক (আ.)-এর শাহাদাত দিবস।

১১ জিলকদ, ইমাম রেযা (আ.)-এর জন্মদিবস।

১০ জিলহজ, ঈদুল আযহা।

১৮ জিলকদ, ঈদে গাদীর।

৯ মুহররম, তাসূয়া।

১০ মুহররম, আশুরা।

২০ সফর, আরবাইনে হোসাইন (আ.)।

২৮ সফর, মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর ওফাত এবং ইমাম হাসান (আ.)-এর শাহাদাত দিবস।

১৭ রবিউল আউয়াল, মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জন্ম দিবস।

প্রতি রমযান মাষের শেষ শুক্রবার : কুদ্স দিবস।

সরকারি ছুটি

১-৩ ফারভারদিন (২১-২৩ মার্চ) নওরোজ (নববর্ষ)।

১৩ ফারভারদিন (২ এপ্রিল) সিজদাহে নওরোজ।

৪ জুন : ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর মৃত্যু দিবস।

শুক্রবার, সাপ্তাহিক ছুটি।

ফারসি ভাষায় ব্যবহৃত সংখ্যাসমূহ হচ্ছে :

۱- ১, ۲ – ২, ۳ – ৩, ۴ – ৪, ۵ – ৫, ۶ – ৬, ۷ – ৭, ۸ – ৮, ۹ – ৯

ভ্রমণকাল

ইরানে ভ্রমণের সর্বোত্তম মওসুম হচ্ছে শরৎ ও বসন্তকাল। এই ঋতুগুলোতে দিনের বেলা সূর্য সব সময় মেঘমুক্ত থাকে এবং তাপমাত্রাও থাকে সবচেয়ে ভালো : দিনের বেলা উষ্ণ আর রাতের বেলা মৃদু ঠাণ্ডা। শরৎকালে লম্বা লম্বা গাছের গুচ্ছগুলোকে পাখির সোনালি পালকের মতো মনে হয়। বসন্তকালে সেগুলো থাকে খুব কচি ও নরম। সর্বত্র ফুল প্রষ্ফুটিত হয় এবং পাহাড়ের চূড়ায় বরফ জমে থাকে। শীত মওসুমে দেশের দক্ষিণাঞ্চল ছাড়া সর্বত্র তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচে নেমে আসে।

গ্রীষ্মকালে অতিশয় গরম পড়ে, তবে সহনীয়। এই মওসুমে জীবনযাত্রাকে পূর্ণভাবে আরামদায়ক করার জন্য জন প্রতিষ্ঠান ও উন্নতমানের হোটেলগুলোতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হয়। পারস্য উপসাগরের উপকূল পথে ভ্রমণ করার উপযুক্ত সময় অক্টোবর থেকে এপ্রিল মাস। গ্রীষ্মকালের ভ্যাপসা গরম খুব অসহনীয়। কাস্পিয়ান সাগরের উপকূল অঞ্চলের আবহাওয়া তুলনামূলকভাবে উন্নত। সারা বছর এখানকার আবহাওয়া থাকে মৃদুমন্দ, এর সাথে থাকে এক মনোরম শুষ্কতা। এ এলাকা মালভূমির সড়কপথে মাত্র কয়েক ঘণ্টার পথ। এ অঞ্চলে প্রায়শঃই বৃষ্টিপাত হয়। গাছপালাসমৃদ্ধ এ অঞ্চলে সর্বদা সামুদ্রিক বাতাস প্রবাহিত হয়। সকল মওসুমে এখানে দু’টি প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া যায় : পশমি পুলওভার এবং সানগ্লাস।

সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও সাংস্কৃতিক বিনিময় এ দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়

আয়াতুল্লাহ আল-উযমা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী

সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আর সাংস্কৃতিক বিনিময় ভিন্ন বিষয়। সাংস্কৃতিক বিনিময়ের প্রয়োজন রয়েছে। কোন জাতিই সংস্কৃতি ও সংস্কৃতি হিসাবে স্বীকৃত বিষয়াদিসহ সকল ক্ষেত্রের জ্ঞান ভিন্ন জাতি থেকে শিক্ষা লাভের গণ্ডিমুক্ত নয়। ইতিহাসের ধারা সব সময় এরূপই ছিল। জাতিসমূহ পরস্পরের আগমন প্রত্যাগমনের মাধ্যমে জীবন চলার রীতিনীতি, চরিত্র, জ্ঞান, পোশাক পরিধানের ধরন, লেনদেনের রীতিনীতি, ভাষা জ্ঞান, মনীষা ও ধর্ম শিক্ষা লাভ করেছে। জাতিতে জাতিতে এই বিনিময় এতই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যা অর্থনৈতিক ও পণ্য বিনিময় থেকেও অধিক গুরুত্বের অধিকারী। এমন বহু ঘটনাও ঘটেছে যাতে এ সাংস্কৃতিক বিনিময় একটি দেশের ধর্মকেও পাল্টিয়ে দিয়েছে। যেমন পূর্ব এশিয়া তথা পূর্বাঞ্চলীয় ইসলামী ভূখণ্ড। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, এমনকি উপমহাদেশের গুরত্বপূর্ণ অংশে ইসলামের আগমন শুধু মুবাল্লিগদের দাওয়াতের ফলেই হয়নি; বরং এর বেশির ভাগই ছিল ইরানী জনগণের আচরণ। ইরানী ব্যবসায়ী ও পর্যটকগণ এসব অঞ্চলে গমন করেন। আগমন-প্রত্যাগমনের মাধ্যমেই এশিয়ার বৃহত্তম মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়ার জনগণ ইসলামের ছায়াতলে স্থান পেয়েছে। সেখানে ইসলামের সূচনা মুবাল্লিগদের (ধর্ম প্রচারক) দ্বারা বা তরবারির জোরে যুদ্ধের মাধ্যমে হয়নি বরং আগমন-প্রত্যাগমনের মাধ্যমেই এর সূচনা হয়েছে। আমাদের জনগণও দীর্ঘকাল ধরে অন্যান্য জাতি থেকে বহু বিষয় শিখেছে। এই পারস্পরিক শিক্ষা সমগ্র বিশ্বে সাংস্কৃতিক জ্ঞান ও জীবনে টিকে থাকার জন্য একটি প্রয়োজনীয় ধারা হিসাবে স্বীকৃত। এটাই হলো সাংস্কৃতিক বিনিময় যা উত্তম বা বাঞ্ছিত।

সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের অর্থ হলো একটি রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক গোষ্ঠী তাদের ইপ্সিত লক্ষ্য অর্জনের এবং একটি জাতির সংস্কৃতির ভিত্তিসমূহকে বন্দিশালায় আবদ্ধ করার জন্য সে জাতির ওপর আগ্রাসন চালায়, তারা এসব দেশে ও জনগণের কাছে নতুন কিছুর আমদানি করে। ঐ জাতির জাতীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের স্থলে নিজেদের সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়ার জন্য যে শক্তি প্রয়োগ করে তার নামই সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। আর সাংস্কৃতিক বিনিময়ের লক্ষ্য হলো জাতীয় সংস্কৃতিকে ফলপ্রসূ ও পূর্ণতা বিধান করা। অথচ সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের লক্ষ্য হলো জাতীয় সংস্কৃতির মূলোৎপাটন ও সম্পূর্ণ ধ্বংস করা।

সাংস্কৃতিক বিনিময়ে জনগণ সংস্কৃতির স্বভাবজাত, হৃদযগ্রাহী, উত্তম ও ইপ্সিত বস্তুসমূহ ধারণ করে। যেমন ইরানী জনগণ দেখছে ইউরোপীয়রা পরিশ্রমী এবং আত্মপ্রত্যয়ী মানসিকতাসম্পন্ন। আমাদের জনগণ যদি তাদের এ বৈশিষ্ট্য অর্জন করে তাহলে ভালো। অথবা আমাদের জনগণ পূর্ণ এশিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে দেখতে পায় সেখানে জনগোষ্ঠী কার্যকরী বিবেক কর্মস্পৃহাসম্পন্ন, সময়ের মূল্যদানে সক্ষম, শৃঙ্খলা ও সংহতিতে বিশ্বস্ত, পারস্পরিক বন্ধুত্ব, উত্তম শিষ্টাচার ও সম্মানবোধের অধিকারী। তাদের কাছ থেকে যদি আমাদের জাতি এসব গুণ অর্জন করে তাহলে অনেক উত্তম কাজই বটে।

সাংস্কৃতিক বিনিময়ে একটি জাতি সঠিক ও সংস্কৃতির পূর্ণতা বিধানকারী দিকগুলোই শিখে। এর উদাহরণ  হলো সেই দুর্বল লোকের মতো যে সুস্থতার জন্য খাদ্য বা উপযোগী ঔষধের সন্ধান করে।

সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে জাতির ওপর যেসব বস্তু চাপিয়ে দেয়া হয় সেগুলো ভালো নয়- সেগুলো খারাপ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ইউরোপীয়রা যখন আমাদের দেশে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন শুরু করে তখন তারা সময়ের মূল্য, বীরত্ব, সমস্যাদির প্রতি মনোনিবেশ, জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অনুসন্ধান- এসব বিষয আমাদের জন্য নিয়ে আসেনি। শিক্ষা, প্রচার ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ইরানী জাতিকে একটি সক্রিয় কর্মক্ষম ও জ্ঞানগত ঐতিহ্যসম্পন্ন জাতিতে পরিণত করার চেষ্টাও তারা করেনি। তারা শুধু লাগামহীনভাবে আমাদের দেশে যৌন উস্কানিমূলক বিষয়াদি আমদানি করেছে। আমাদের জাতি ইসলামী অধ্যায়ের হাজার বছরাধিককাল ধরে যৌন বিনিময় তথা নারী-পুরুষের সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়মমাফিক লালন করে আসছে। তবে এর মর্ম এই নয় যে, কেউ ভুল বা আইনবিরোধী কাজ করেনি। ভুল সবসময়ই সকল যুগে ও সকল ক্ষেত্রে হয়ে এসেছে এবং এখনও হচ্ছে। মানবজাতি সবসময় ভুল করে থাকে। অন্যায় করার অর্থ এই নয় যে, একটি অন্যায় সমাজ ও জাতির মধ্যে প্রচলন ঘটবে। আমাদের জাতি ব্যাপকহারে বাহুল্য, বিলাসিতা, বিনোদন ও হাসি-তামাশায় মত্ত ছিল। আমাদের সমাজে এসব কাজের হোতা ছিল সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গ, রাজরাজড়া, শাহজাদা, জমিদার তথা অভিজাত শ্রেণি যারা পুরো রাত জাগ্রত থেকে বিলাসিতায় কাটিয়ে দিত। মদের আড্ডা ও অশ্লীলতার আখড়ায় সদামত্ত ইউরোপীয়রা এসব অশ্লীলতা ও বিপর্যয়পূর্ণ অভ্যাস আমাদের সমাজে আমদানি করার কাজে লিপ্ত ছিল। আপনার ইউরোপের ইতিহাস পড়ে দেখুন- ফ্যাসাদ বা বিপর্যয় সবসময় সকল যুগে এবং তাদের সভ্যতার দীর্ঘ ইতিহাসের পরতে পরতে বিদ্যমান ছিল। তারা এসব বিপর্যয় আমাদের দেশে অনুপ্রবেশ ঘটাতে চাইল এবং যতটুকু সম্ভব অনুপ্রবেশ ঘটালো।

সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে দুশমন তার সংস্কৃতির কিছু দিক এ জাতিকে অর্পণ করে এ দেশে তাদেরই মনমতো সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটায়। এটা জানা কথা- দুশমন তো কত কিছুই চায়। সাংস্কৃতিক বিনিময়ের আলোচনায় অন্যের সংস্কৃতি ধারণ করাকে এমন এক ব্যক্তির সাথে উপমা দিয়েছিলাম যে অলিতে-গলিতে, হাঁটে-বাজারে খাদ্য ও উপযোগী ঔষধ যোগাড় করে সেগুলো ব্যবহার করার কাজে নিয়োজিত। আর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে আক্রান্ত জাতিকে এমন এক রোগীর সাথে উপমা দিচ্ছি যে ভূমিতে লুটিয়ে পড়েছে, নড়াচড়া করার ক্ষমতা নেই। তখন তার দুশমন এসে তাকে একটি ইনজেকশন ঢুকিয়ে দিচ্ছে। এটা তো জানা কথা, দুশমন যে ইনজেকশন দিচ্ছে তা কী জিনিস। যে ঔষধ বা চিকিৎসার জন্য আপনি নিজে গিয়েছেন, নিজেই নির্বাচন করেছেন এবং নিজের আগ্রহে সে ঔষধ সেবন করেছেন তার সাথে ঐ ইনজেকশনের অনেক পার্থক্য রয়েছে। সাংস্কৃতিক বিনিময় আমাদের পক্ষ থেকে হয়ে থাকে আর সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আমাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক মূলোৎপাটনের উদ্দেশ্যেই দুশমনদের দ্বারা সম্পাদিত হয়। সাংস্কৃতিক বিনিময় ভালো, তবে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন খুবই খারাপ। সংস্কৃতির বিনিময় একটি জাতির শক্তি ও ক্ষমতা থাকাকালেই হয়ে থাকে, আর সাংস্কৃতিক আগ্রাসন একটি জাতির দুর্বল সময়ে হয়ে থাকে। তাই ইতিহাসে দেখতে পাচ্ছেন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যখন এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় প্রবেশ করে তখন তাদের রাজনৈতিক সেনাবাহিনী ও বিশেষ এজেন্টদের উক্ত অঞ্চলে প্রবেশ করানোর পূর্বেই খ্রিস্টান মিশনারী এবং খ্রিস্টান ধর্মীয় গুরুদের প্রতিনিধিদল সেখানে ঢুকিয়ে দেয়। রেড ইন্ডিয়ান ও কৃষ্ণাঙ্গদের প্রথমে খ্রিস্টান করে এবং এর পর সাম্রাজ্যবাদী রশি তাদের ঘাড়ে তুলে দেয়। এরপরও তাদেরকে তাদের ঘড়বাড়ি থেকে বিতাড়িত করে। আপনারা যদি অনুরূপভাবে ইরানের কাজার শাসনের শেষদিকের ইতিহাস অধ্যয়ন করেন তাহলে দেখতে পাবেন, এ দেশের জনগণকে খ্রিস্টান করার উদ্দেশ্যে ইউরোপ থেকে কত বিপুল সংখ্যক পাদ্রীই না এসেছেন! অবশ্য নতুন চোরের মতো কোথায় খ্রিস্টধর্মের প্রচলন ঘটাতে চায় সে স্থান সম্পর্কে না বুঝার কারণে ব্যর্থ হয়। তবে পুঁজিপতি কোম্পানি ও আন্তর্জাতিক লুটেরা শ্রেণিকে হযরত ঈসা (আ.)-এর অনুসারী বলা যায় না। তারা কোথায় হযরত ঈসাকে (আ.) চিনে? যাই হোক যে পরিবেশে একটি জাতির সংস্কৃতি ও নিজস্ব মানসম্ভ্রম প্রতিরক্ষার সুযোগ রয়েছে তাদের প্রথম কাজ হলো সে সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরা। যেমন একদল সৈন্য যদি একটি সুদৃঢ় দুর্গে হামলা চালাতে চায় তাদের প্রথম কাজ হবে দুর্গের ভিত্তিসমূহে আঘাত হানা। আর তা করতে পারলেই দুর্গের প্রাচীর ধসে পড়বে। দুর্গের প্রাচীরকে দুর্বল করার জন্য সম্ভাব্য সকল প্রচেষ্টা চালানো, এমনকি প্রথম কাজ হিসেবে প্রয়োজনে দুর্গবাসীদেরকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে হবে।

শেখ সাদী ‘গুলিস্তান’ গ্রন্থে একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তাতে বলা হয়- একদল লোকের কাছে কয়েকজন চোর উপস্থিত হয়ে দেখতে পেল তারা ঘুমাচ্ছে। সাদী বলেন, তাদের ওপর প্রথম দুশমনের হামলা ছিল এই ঘুম। প্রথমে এই অভ্যন্তরীণ দুশমন তাদের চোখ বন্ধ করে দেয়, তাদের হাতকে কর্মহীন করে ফেলে। এরপর বহিরাগত দুশমন এসে তাদের হাত বেঁধে ফেলে, তাদের সম্পদ অপহরণ করে। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বেলায় দুশমন অনুরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। প্রথমত, জনগণকে নিদ্রাভিভূত করে এবং এরপরই তাদের সকল সম্পদ নিয়ে যায়। আমাদের জাতির ওপর সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বিশেষভাবে রেযা খানের যুগ থেকেই শুরু হয়। অবশ্য এর পূর্বে এ আগ্রাসনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল। তার পূর্বেও এ ক্ষেত্রে ব্যাপক তৎপরতা চালানো হয়। আমাদের দেশের ভেতরেই পরনির্ভশীল বুদ্ধিজীবী লালন করা হয়েছে। আমার জানা নেই বিপ্লবের বংশধর যুব শ্রেণি গত দেড়-দু’শতাব্দীর ইতিহাস ভালোভাবে অধ্যয়ন করেছেন কিনা। আমার মানসিক পীড়া এখানেই যে, বিপ্লবী যুবকরা আজ জানে না কী ধরনের অধ্যয়গুলো অতিক্রম করে আমরা আজ ইরানে এই মহান আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি। ইরানের জনগণের উচিত বিগত দেড়-দুই শতাব্দী তথা কাজার শাসনের মধ্য যুগ থেকে ইরান-রুশ যুদ্ধের পরবর্তী যুগের ইতিহাস অধ্যয়ন করা। দেখা উচিত কত ঘটনা এ দেশে সংঘটিত হয়েছে! এসব ঘটনাপ্রবাহের অন্যতম দিক হলো তল্পীবাহক বুদ্ধিজীবী লালনের ধারা সৃষ্টি করা। আমরা এ কথা বলছি না যে, ইরানের ইতিহাসে বুদ্ধিজীবী ছিল না। সর্বদাই সকল যুগে সকল অধ্যায়ে এমনসব বুদ্ধিজীবী ছিলেন যাঁরা অনাগত ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতেন, তৎপরতা চালাতেন। তবে প্রযুক্তি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের অধিকারী পাশ্চাত্য যখনই ইরানে তার আধিপত্যের ঘাঁটিকে সুদৃঢ় করার উদ্যোগ গ্রহণ করে তখন বুদ্ধিজীবীদের পথেই প্রবেশ করে। ‘মীর্জা মালকম খান’ ও ‘তাকীযাদের’ মতো আত্মবিকৃত এজেন্টদের মাধ্যমে অনুপ্রবেশ করে। কাজার যুগ থেকে নিয়ে পরবর্তীকালে ইরানের বুদ্ধিজীবী ধারা অসুস্থতা ও পরনির্ভরশীলতার জন্ম দেয়। দুঃখজনকভাবে হাতে গোনা যে ক’জন সুস্থ ও নিষ্ঠাবান ছিলেন তাঁরা অসুস্থদের মাঝে হারিয়ে যান। এ ধারা শুরু থেকেই তল্পীবাহক ছিল। তাদের কেউ ছিল রুশদের এজেন্ট। যেমন মীর্জা ফতেহ আলী আখন্দযাদেহ, আর কেউ ছিল ইউরোপ ও পাশ্চাত্যের পোষা গোলাম। যেমন মীর্জা মালকম খান ও তাদের দোসররা। এ কাজ পূর্বে ইরানের অভ্যন্তরেই হয়েছিল, তবে ততটা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়নি। এ সময় ইরানে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির স্বার্থে এবং বস্তুত পাশ্চাত্য ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে যে ব্যক্তিটি সবচেয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে সে ছিল রেযা খান। আপনারা লক্ষ্য করুন, এ সময়ের অবস্থা কতই না লজ্জাকর যে, এক রাজতন্ত্রী সরকার একেবারে একটি দেশের জাতীয় পোশাক পরিবর্তন করেছে। আপনারা বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চল বিশেষ করে ভারতে গমন করুন। দেখুন জনগণের জাতীয় পোশাক রয়েছে। এতে তারা গৌরববোধ করছে, তাতে তারা হীনমন্য মনোভাবও পোষণ করছে না। কিন্তু এরা এসে একবারেই এ জাতির জাতীয় পোশাক নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। (তাদের প্রতি প্রশ্ন হলো) কেন? (এ নিষিদ্ধ ঘোষণার) জবাবে বলল, যেহেতু এ পোশাকে জ্ঞানী হওয়া যায় না। কি আশ্চর্য!

যেসব ইরানী মনীষীর রচিত গ্রন্থাবলি এখনও ইউরোপে শিক্ষা দেয়া হয় তাঁরা এই সংস্কৃতি এবং এই পরিবেশেই লালিত হয়েছিলেন। পোশাকে কি কোন প্রভাব আছে? এ কোন ধরনের হাস্যকর কথা ও যুক্তি যা তারা উত্থাপন করছে। তারা একটি জাতির পোশাক পরিবর্তন করেছে। নারীদের মাথা থেকে চাদর (হিযাব) সরিয়ে নিয়েছে। তারা বলেছে, হিযাব পরিহিতা নারী জ্ঞানী ও চিন্তাবিদ হতে পারে না। সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারে না।

আমার প্রশ্ন হলো আমাদের দেশে হিযাব তুলে নিয়ে নারিগণ সামাজিক কর্মকাণ্ডে কতটুকু অংশগ্রহণ করেছে? রেযাখান ও তার ছেলের শাসনামলে আমাদের নারীদেরকে সামাজিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের সুযোগ কি দেয়া হয়েছিল? তাদের শাসন আমলে সামাজিক কার্যক্রমে না পুরুষদেরকে সুযোগ দেয়া হয়েছিল, না নারীকে? ইরানের নারিগণ যে সময় সামাজিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন, তাঁদের শক্তিশালী হাতসমূহ দেশকে পরিবর্তন করে, হিযাব পরা অবস্থায় এদেশের পুরুষদেরকে নিজেদের পেছনে সংগ্রামের ময়দানে টেনে নিয়ে আসেন এবং নিজেরাও ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েন এ সময় হিযাব ও পোশাক নারী-পুরুষের নিষ্ক্রিয় হওয়ার পথে কি কোন প্রভাব রেখেছে? উত্তম কথা হলো, এ নারী বা পুরুষের অন্তর কিরূপ? কি চিন্তাই বা তারা করে। তার ঈমান কতটুকু, তার মনমানসিকতা কী ধরনের, সামাজিক বা শিক্ষা ক্ষেত্রে তৎপরতা চালানোর কী দৃষ্টিভঙ্গিই বা পোষণ করে। এই গোঁয়ার মোড়ল, অজ্ঞ-মূর্খ তথা রেযা খান এসে নিজেকে দুশমনের হাতে সঁপে দেয়। একবারেই দেশের পোশাক পরিবর্তন করে। জনগণের বহু সনাতন রীতিনীতির পরিবর্তন করে ধর্মকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। মোড়ল হিসাবে যেসব কাজ করেছে এবং পাশ্চাত্যের প্রিয় পাত্রে পরিণত হয়েছে এর সবই আপনারা অবগত আছেন। তাও পাশ্চাত্যের জনগণ ও জনমতের সাথে সম্পৃক্ত ছিল না; বরং তার সখ্য ছিল পশ্চিমা আধিপত্যবাদী রাজনীতিকদের সাথে।

ইসলাম ও জনগণের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এখান থেকেই শুরু হয়। এর বিভিন্ন রূপও পরিগ্রহ করে। এ আগ্রাসন নতুন অধ্যায়ে ধিকৃত পাহলভী বংশের শাসনামলের সর্বশেষ বিশ-ত্রিশ বছরে যে বিপজ্জনক পর্যায়ে উপনীত হয় তার বর্ণনা দেয়া এখন সম্ভব নয়। ইসলামী বিপ্লব এসে মজবুত মুষ্টির মতো আগ্রাসীর বক্ষে আঘাত হানে, তাকে পিছু হটিয়ে দেয়। আগ্রাসনকে থামিয়ে দেয়। আপনারা বিপ্লবের সূচনা লগ্নেই হঠাৎ দেখতে পেয়েছেন, অতি স্বল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের জনগণ চারিত্রিক ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন অনুভব করেছে। জনগণের মাঝে হারানো মানসিকতা পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। লোভ-লালসা কমে গেছে। সহযোগিতার অনুভূতি বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের যুব সমাজ কর্মমুখর ও তৎপর হয়ে উঠেছেন। শহরে বসবাসে অভ্যস্ত বহুলোক গ্রামে-গঞ্জে গমন করেছেন। তাঁরা বলেছেন, আমরা (গ্রামে) যাব, কাজ করব, উৎপাদন করব। জনগণের অর্থনৈতিক জীবনে শূন্যতার মতো যেসব ভিত্তিহীন কাজ বিস্তৃত হয়েছিল তা কমে যায়।

বিপ্লবের প্রারম্ভিক কয়েক বছরেই এ সাংস্কৃতিক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়, যে সময় দুশমনদের অপসংস্কৃতি ও অশ্লীল চারিত্রিক বীজ বপনের ধারা বন্ধ হয়ে যায়, এসময় আমাদের জনগণের অন্তরে বিদ্যমান ইসলামী সংস্কৃতি, চরিত্র, শিষ্টাচার ও ইসলামের প্রতি এক ধরনের চেতনা পুনরুজ্জীবিত হয়। অবশ্য এ চেতনা গভীর ছিল না। কয়েক বছর এ ক্ষেত্রে কাজ চালিয়ে গেলে এ প্রবণতা গভীরে পৌঁছত। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এ কাজের সুযোগ আসেনি। আগ্রাসন ক্রমান্বয়ে শুরু হয়। যুদ্ধ চলাকালীনও প্রচারযন্ত্র, ভুল ও বিকৃত বক্তব্যের মাধ্যমে (যার অশুভ প্রতিক্রিয়া জনগণের মনমানসিকতায় প্রভাবশালী ছিল) এ আগ্রাসন চলতে থাকে। কিন্তু যুদ্ধের তীব্রতা এ আগ্রাসনের মোকাবিলায় এক ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছিল। যুদ্ধোত্তর সময়ে এ নয়া ফ্রন্ট নতুন আঙ্গিকে কাজ শুরু করে। দুশমন এক হিসাব-নিকাশে বুঝতে পারে যে, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানকে সামরিক আগ্রাসনের মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করা যাবে না। তাদের পূর্বের হিসাব-নিকাশ যে সম্পূর্ণ ভুল ছিল তাই প্রমাণিত হয়। অনুরূপভাবে তারা দেখল অর্থনৈতিক অবরোধের মাধ্যমেও কিছুই করা যাবে না। কেননা, একটা জাতি যখন স্বল্পে তুষ্ট, ধৈর্যশীল, আত্মপ্রত্যয়ী, আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল হয়, কখনও পরাভূত হয় না। আমরা এসব পরীক্ষা দিয়েই এসেছি। অন্যান্য জাতিও এ ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। তাই তারা বুঝল যে, আমাদের মুক্তির গিরিপথে বোমা বর্ষণ করতে হবে। একদল সৈন্য যখন রণাঙ্গনে যুদ্ধে লিপ্ত, তাদের খাদ্য যদি পেছন থেকে আসে, নতুন সৈন্য প্রেরিত  হয়, প্রয়োজনীয় সামগ্রী পাঠানো হয়, রণাঙ্গনের পশ্চাৎ থেকে বন্ধু-বান্ধব, মাতা-পিতার পত্রাবলি তাদের হাতে পৌঁছতে থাকে, পশ্চাৎ থেকে রণাঙ্গনে তাদের মানসিকতা আরো শক্তিশালী করা হয়, আর এ গিরিপথ যদি সুগম থাকে, অগ্রবর্তী বাহিনী তখনই যুদ্ধ করতে সক্ষম হয়, কিন্তু দুশমন যদি মুক্তির গিরিপথে বোমা বর্ষণ করে, খাদ্য, রসদপত্র, নতুন সৈন্য সম্মুখ ফ্রন্টে পৌঁছতে না পারে, বন্ধু-বান্ধব, মাতা-পিতার পক্ষ থেকে প্রশংসা, ধন্যবাদ ও ভালোবাসাপূর্ণ পত্র পাঠানো না হয় তাহলে যারা রণাঙ্গনে রয়েছে তারা কি করে যুদ্ধ অব্যাহত রাখার শক্তি পাবে? এ অবস্থায় বীরসেনারা রণাঙ্গনে কয়েকদিন চেষ্টা চালিয়ে শেষ পর্যন্ত নিশ্চিহ্ন হতে বাধ্য।

বিশ্ব শয়তানি চক্রের দাপটের বিরুদ্ধে ইরানী জাতির সংগ্রামে আমাদের মুক্তির গিরিপথ বলতে যা বুঝায় তা হলো আমাদের সংস্কৃতি। আমাদের গিরিপথের আওতায় রয়েছে ইসলামী চরিত্র, আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল, ঈমান এবং ইসলামের প্রতি আগ্রহ। যে মায়ের চারটি সন্তান শহীদ হওয়ার পর সে বলছে, ‘আমি ইসলামের জন্যই তাদেরকে দিয়েছি; আর তাদের শাহাদাতে সন্তুষ্ট’, আমি নিজে সেসব পরিবারকে অতি কাছ থেকে দেখেছি, তাদের ঘরে গিয়েছি। মাতা-পিতার সাথে কথা বলেছি। অন্যের কাছ থেকে শুনে বলছি না, আমি নিজেই বর্ণনা করছি যে, অতি নিকট থেকে তাদের দেখেছি। এক পরিবারে দুটি ছেলে ছিল, তাদের উভয়েই শহীদ হয়েছে। অন্য পরিবারে তিন ছেলে ছিল, তাদের তিন ছেলেই শহীদ হয়েছে। এসব হাস্য-কৌতুকের বিষয় নয়।

এই বিপদ কি সহ্য করার মতো? এই পিতা ও মাতা দুঃখে পাগল হয়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু দেখলাম মা (অবশ্য আবেগ থাকা তো স্বাভাবিক) পূর্ণ স্থিরতা নিয়ে বলছেন, জনাব! আমরা আমাদের সন্তানকে ইসলামের পথে দিয়েছি, আমাদের কোন অভিযোগ নেই। দুশমনও বুঝল, ইসলাম ও আল্লাহর ওপর ঈমানের প্রভাব এটাই। যে যুবককে মাতা-পিতা বলছে, ‘তুমি ষোল-সতের বছরের যুবক, লেখাপড়া কর, খেলাধুলা কর, আনন্দ-উল্লাস কর। তোমার ভাই রণাঙ্গনে শহীদ হয়েছে।’ কিন্তু এ যুবক বলছে, ‘না, আমার শক্তিকে ইসলামের পথে উৎসর্গ করব।’ শহীদগণের অসিয়তনামায় এ মানসিকতার পরিচয় আমরা প্রত্যক্ষ করছি।

আমি নিজে শহীদগণের পিতা-মাতা ও পরিবারের কাছে এসব কথা শুনেছি। ইসলামের প্রভাব এটাই। একদিন হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) বলেছেন, ‘আজ ইসলাম তোমাদের- যুবকদের সাহায্যের মুখাপেক্ষী।’ আমি বিকাল বেলায় একটি কাজে যাচ্ছিলাম, দেখলাম সড়কগুলো বিপ্লবের প্রথমদিকের মতো সরগরম। ইমাম ‘পাবেহ’ নামক স্থানে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। সে দিকে জনগণ দলে দলে যাচ্ছে। এ ঘটনা এবং এ ধরনের দৃশ্য যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত বহুবারই ঘটেছিল। যখনই ইসলামের নামে ইমামের নির্দেশ আসত (ইমামের নির্দেশও ইসলামেরই নির্দেশ ছিল। জনগণ ইসলামের জন্যই ইমামের নির্দেশকে গুরুত্ব দিত), দেখা গেছে জনগণ আনন্দ-উচ্ছাস নিয়ে সেদিকে ধাবিত হচ্ছে। যুবকরা শহর, গ্রাম, বিশ্ববিদ্যালয়, বাজার, কর্মক্ষেত্র, স্টেডিয়ামের ফুটবল খেলা এবং সকল প্রকার কাজকর্ম ছেড়ে রণাঙ্গনে ছুটে চলেছে, নিজের জীবনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে। এগুলো কৌতুক নয়। দুশমনও অন্ধ ছিল না। এদেরকে দেখেছে। মূল্যায়ন করেছে। বুঝতে পেরেছে এ জাতির মুক্তির গিরিপথ রয়েছে। যতদিন এই মুক্তির গিরিপথ থাকবে এ জাতিকে অর্থনৈতিক, সামরিক অবরোধসহ কোন প্রকার অবরোধ পরাস্ত করতে পারবে না। (তাই তারা (সিদ্ধান্ত নিল) এই মুক্তির গিরিপথকে বোমা দিয়ে উড়িয়ে দিতে হবে। তার সংস্কৃতি, চরিত্র, ঈমান, আত্মত্যাগ, দীনের প্রতি আস্থা, নেতৃত্বের প্রতি আস্থা, কুরআন, জেহাদ ও শাহাদাতের প্রতি দৃঢ়বিশ্বাসকে ধ্বংস করে দিতে হবে। কেননা, যুদ্ধের উত্তপ্ত অগ্নিকুণ্ডে যুবকদেরকে ব্যস্ত ও আকৃষ্ট করে রেখেছিল, তাদের কানে দুশমনের কথার কোন প্রতিক্রিয়া ছিল না। কিন্তু যখন এ অগ্নিকুণ্ড নিভে যায়, পরিস্থিতি তাদের অনুকূলে আসে, তখন তারা ব্যাপক আকারে তৎপরতা শুরু করে। তারা বিভিন্ন উপায়-উপকরণ ব্যবহার করে। আমি যখন দুশমনের উপকরণের ব্যাপকতার প্রতি লক্ষ্য করি তখন বুঝি তাদের কাছে এ কাজটি কতটুকু গুরুত্ববহ। তাদের অন্যতম কাজ ছিল দেশের বিপ্লবী সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতিকে হেয় প্রতিপন্ন ও কোণঠাসা করা। বিপ্লবের গুরুত্বপূর্ণ কাজসমূহের মধ্যে একটি হলো এ বিপ্লব একদল সাংস্কৃতিক ক্ষমতাসম্পন্ন লোক তৈরি করেছে। আমাদের হাতে এসব লোক রয়েছে। আল্লাহর শোকর বর্তমানে এসব শ্রেণির লোক কম নয়। কবি ও গল্পকারের সংখ্যাও অনেক। সিদ্ধহস্ত ফারসি ভাষী দক্ষ প্রতিবেদক ও লেখক সৃষ্টি হয়েছে।

…রাজতান্ত্রিক অধ্যায়ের শেষ দিকে প্রতিভাসমূহ অচলাবস্থা ও বন্ধ্যাত্বের শিকার হয়। এ অধ্যায়ে মূলত মহান ব্যক্তি, প্রতিথযশা লেখক ও শিল্পীদেরকে বিশেষত শিল্পের কোন কোন বিভাগে তৈরি করা হয়নি। আমরা আজকে আমাদের দেশে প্রত্যক্ষ করছি আমাদের যুবকদের মাঝে উত্তম চলচ্চিত্র শিল্পী, গল্পকার প্রশিক্ষণ পেয়েছে। বিপ্লবই এসব শক্তিকে স্বাধীন করেছে।

…ঈমানদার জনশক্তিকে কোণঠাসা অবস্থায় ফেলে দেয়ার জন্য যেসব পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় (আমিও অনুভব করেছি ঐসব দুঃখ যা লুক্কায়িত আছে এসব দুঃখ সবিস্তারে প্রকাশ করাই মানুষ পছন্দ করে), এর অন্যতম দিক হলো যখন ইরানী চলচ্চিত্র অথবা শিল্পক্ষেত্রে সাফল্যের নিদর্শনাবলি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উত্থাপিত হয়, যেসব অবদানে বিপ্লবী মানসিকতার আমেজ রয়েছে সেগুলোই অবজ্ঞার শিকার হয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের শিশুদের চলচ্চিত্র, প্রদর্শনী ও কর্মতৎপরতা সবগুলো একই অবস্থায় পতিত হয়। কিভাবে কেউ স্বচক্ষে এগুলো দেখে বলতে পারে এসব সংস্থা অরাজনৈতিক। এরা যেসব অবদানের জন্য পুরস্কার দিয়ে থাকেন কেন সেগুলোতে একটি বিপ্লবী নিদর্শনেরও অস্তিত্ব নেই? আমাদের কি বিপ্লবী চলচ্চিত্র নেই? আমাদের কি বিপ্লবী কবিতা নেই? এগুলোর কি শিল্পমূল্য নেই? আমার ধারণা, এসব সংস্থা এমনকি নোবেল পুরস্কারও এমন সব পক্ষকে দেয় যারা ইসলাম ও বিপ্লববিরোধী তথাকথিত সংস্কৃতিকে বিশ্বে বড় করে এবং বিপ্লবী শক্তিকে কোণঠাসা করার অপচেষ্টায় লিপ্ত। এ কাজ কি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন নয়?

বর্তমানে এসব কাজ হচ্ছে। আমি বহুবার উল্লেখ করেছি, একদল লোক রাস্তায় পর্দাবিহীন কয়েকজন মহিলাকে দেখে তার মনে এক ধরনের অনুভূতি জাগল। অবশ্য এ কাজও মন্দকাজ। তবে এ কাজই একমাত্র মন্দ কাজ নয়- মৌলিক মন্দকাজ এমন যা আপনারা রাস্তাঘাটে প্রত্যক্ষ করছেন না। কেউ একজনকে বলল : ‘কি করছ?’ জবাব দিল : ‘ঢোল বাজাই।’ বলল : ‘এর আওয়াজ আসছে না কেন?’ উত্তরে বলল : ‘আগামীকাল তার আওয়াজ আসবে।’ আপনারা জনগণ ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী যদি জাগ্রত না হন, খোদা না করুন, দুশমনের গোপন ও  চালাকিপূর্ণ আগ্রাসনের ফলে আধ্যাত্মিক মূল্যবোধসমূহ খসে পড়ার আওয়াজ যখন শোনা যাবে তখন তা আর চিকিৎসার যোগ্য থাকবে না।

রণাঙ্গনে আমাদের কোন যুবককে যদি আটক করত তাকে প্রথমে একটি ভিডিও দেয়া হতো। এরপর যৌন অশ্লীল ফিল্ম তাদের দেখানো হতো, তার কামভাবকে উত্তেজিত করা হতো, তারপরও তাকে বিভিন্ন ধরনের বৈঠকে নিয়ে যাওয়া হতো। ঐ সময় আমাদের কি করা উচিত? যে কেউ তার যৌবনকে তার চূড়ান্ত তাড়নায় অশ্লীল করা কোন সমস্যার কথা নয়, এরপর বিশেষ করে বিপর্যয়কারীদের সকল হাতিয়ার যদি বিদ্যমান থাকে তাতে আর কথাই থাকে না। বর্তমানে দুশমনরা এ কাজই করছে। আমি দেশের বিভিন্ন শহরের খবর রাখি, এ ধরনের সংবাদ আমার কাছে পৌঁছে। এমন কোন দিন নেই যেদিন বা রাতে এ ধরনের সংবাদ কর্ণগোচর হয় না। দুশমন ছাড়া আর কে এসব কাজ করে?…

ইসলামী শাসনব্যবস্থাকে এই বলে অভিযুক্ত করা হয় এই শাসনব্যবস্থা স্বাধীনতা দেয় না। কিভাবে আমরা স্বাধীনতা দেই না? আপনাদের কাছে এমন কোন দেশের সন্ধান আছে যেখানে প্রকাশিত সকল ম্যাগাজিন, পত্র-পত্রিকায় যা ইচ্ছে তাই লিখতে পারে? দেশের সরকারি সংবাদপত্রগুলো প্রকাশ্যে ও সুস্পষ্টভাবে সরকারের নীতিমালাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করছে, দেদার সমালোচনা করে যাচ্ছে। সরকারও পূর্ণ মহানুভবতার সাথে এসব প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন।…

…দুশমনরা চায় সাংস্কৃতিক অঙ্গনের লেখকরা যেন শয়তানি চক্রের এজেন্ট হয়, তারা চায় যা ইচ্ছে তা-ই লিখুক। ইসলামী শাসন ব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত এবং ইসলামী পক্ষ ও শক্তি এ সবের জবাব না দিক। যদি জবাব দেয় তখনই বলে, স্বাধীনতা নেই। আমাদেরকে ভয় দেখাচ্ছে। দেখুন দুশমনরা এ ধরনের পরিবেশই সৃষ্টি করে। একদল সরল সহজ লোক অতি সহজেই ধোঁকায় পতিত হয়। অবশ্য দুশমনের খপ্পরে পড়ে যায়। তারা বোঝে না কী বলছে এবং কী করছে।

কোন দেশে দুশমন সামরিক হামলা চালালে কারা দুশমনের বিরুদ্ধে রখে দাঁড়ায়? যারা সবচেয়ে দেশ ও জাতির জন্য দরদি, দুনিয়ার সম্পদ ভাণ্ডারের প্রতি অধিকতর ভ্রুক্ষেপহীন, প্রবল দায়িত্বানুভূতিসম্পন্ন এবং দ্বীনদার- ঐসব মানুষই অগ্রসর হয়, প্রতিরক্ষা করে। আপনারা যুদ্ধ অধ্যায়ে দেখেছেন কারা গিয়েছে এবং প্রতিরক্ষা করেছে। আমাদের যুদ্ধের ময়দানে প্রধান অংশই ছিল বাসিজ বা গণবাহিনী। বাসিজ তথা সেই ঈমানদার, বিপ্লবী দেশপ্রেমিক, আত্মত্যাগী জনগোষ্ঠীই যুদ্ধের ময়দানের মধ্যখানে গিয়ে আত্মত্যাগের মাধ্যমে শত্রুকে পরাভূত করেছেন। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও অনুরূপ।…

তারাই ইসলামী সংস্কৃতি এবং এ জাতির মান-মর্যাদা ও অস্তিত্ব প্রতিরক্ষায় এগিয়ে আসবে, দুশমনদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে, যাদের অন্তর ইসলামের জন্য উচ্চকিত, ইসলাম ও ইরানকে ভালবাসে।

…এ জাতির মান-মর্যাদা, সত্যিকার মানবিক, ইসলামী বিপ্লবী ও জাতীয় সংস্কৃতিকে স্থায়ীভাবে রক্ষা করতে হলে চাই সাধনা, প্রতিরোধ, দুশমনের আগ্রাসনের মোকাবিলার জন্য রুখে দাঁড়ানোর ক্ষমতা। দুশমন দুর্বল দিক দিয়েই আগ্রাসন চালায়। আর এ প্রতিরোধ আমাদের নিজস্ব লোকেরাই করতে পারে। আমার কথা এতটুকুই।

আমি বলব, আপনারা যদি চান এদেশের শিল্পের প্রবৃদ্ধিও বিকাশ হোক তাহলে ঈমানদার যুবক শিল্পীদের ওপর নির্ভর করুন। সেই পারবে বিপ্লব ও দেশকে প্রতিরক্ষা করতে।…

হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এবং আমার জীবনে তাঁর প্রভাব

মরিয়ম জামিলা

ছোটবেলা থেকেই আমি কড়া ধর্মীয় শাসনে বন্দি ছিলাম। আমার বয়ঃসন্ধিকাল এবং যৌবনের প্রথম দিকের সময়টাও সেই অবস্থায় কেটেছে। তখন থেকেই প্রতিষ্ঠিত ইয়াহুদী ধর্মালয় (সাইনাগগ) ও খ্রিস্টীয় চার্চের ধারণা থেকে আমার মোহমুক্তি ঘটে। আমি তখন নাস্তিক্যবাদকেই স্বীকার করে নিয়েছিলাম। কিন্তু তাতেও সন্তুষ্ট না হয়ে পরম সত্যের সন্ধানে নিজেকে উৎসর্গ করি যে সত্যের মাধ্যমে জীবনের অর্থ, দিক-নির্দেশনা ও লক্ষ্য অর্জন করা যায়।

যাই হোক, সুস্থ কোন ধর্মীয় পরিবেশে আমি বড় হয়ে উঠিনি। আমার পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবরা ছিল নামমাত্র ইয়াহুদী। আমেরিকান জীবনধারায় তাঁরা ছিলেন সরাসরি সম্পৃক্ত। তাঁরা সর্বাংশেই ছিলেন ভদ্র, নম্র, উদারমনা, সংস্কৃতিবান এবং বুদ্ধিমান। নৈতিক যেসব মৌলিক আইন-কানুন রয়েছে তাতে তাঁরা বিশ্বাসী ছিলেন এবং নিষ্ঠার সাথে তা মেনেও চলতেন। তথাপি তাঁরা নৈতিক আচার-আচরণ ধর্মতত্ত্বের ওপর নির্ভরশীল- একথা অস্বীকার করতেন। বস্তুত পক্ষে তাঁরা এই দুই বিষয়ের মধ্যকার প্রাসঙ্গিকতাও বুঝতে পারেননি। মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে শাস্তি ও পুরস্কার সম্পর্কিত যে কোন ধারণাকেই তাঁরা পুরানো দিনের কুসংস্কারপূর্ণ সেকেলে ধ্যান-ধারণা বলে মনে করতেন। ঠিক একই কারণে নবুওয়াত, ঐশী প্রত্যাদেশ, মানবীয় বিষয়াদি সরাসরি হস্তক্ষেপেকারী এবং ভক্তদের প্রার্থনা প্রশ্নকারী ব্যক্তিগত কোন উপাস্য সম্পর্কিত যে কোন ধারণাও বাতিল বলে গণ্য করেন। এই সমাজের মূল লক্ষ্য হলো সুখ-সমৃদ্ধি, আনন্দ আর ফুর্তি। যখনই আমি চিন্তা করতে সক্ষম হলাম এবং উপলব্ধি করলাম, তখন দেখতে পেলাম প্রচলিত মূল্যবোধের কারণে আমি সমাজ থেকে দূরে সরে পড়েছি। সর্বোপরি আমার একটি কামনা ছিল চিরস্থায়ীভাবে প্রয়োজনীয় কিছু অর্জন করা। যেহেতু এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে চূড়ান্ত কোন জবাব পাওয়া যাবে না তাই এই সব চিন্তা বাদ দিয়ে যে কেউ অন্তর্বর্তীকালীন এই জীবনের আনন্দ যতটুকু পারা যায় ভোগ করাকে বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করবে। যেমন সুস্বাস্থ্য, সুস্বাদু খাবার, আরামদায়ক জীবন যাপন, পারিবারিক ভালোবাসা, অন্তরঙ্গ বন্ধুদের সাহচর্য এবং বিবিধ প্রকারের আমোদ-প্রমোদ যা আধুনিক আমরিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে রয়েছে। কেন আমরা জন্মগ্রহণ করেছি, কে আমাদের সৃষ্টি করেছে। আমাদের জীবনের উদ্দেশ্যই বা কি, কেন আমাদের মরতে হবে কিংবা মৃত্যুর পরে আমাদের কি হবে ইত্যাকার প্রশ্নাবলি কেউ করে না, পাছে সে হীনমন্যতা, দুঃখবাদ ও নৈরাশ্যে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। বিদেশীরা প্রায়ই আমেরিকানদের প্রশংসা করে স্থবির নয় বলে। এই প্রগতিবাদীদের মতে আমেরিকা আর প্রগতি একার্থবোধক। কারণ, তাদের ধারণা মতে, এটাই একমাত্র দেশ যেটা সামাজিক ও ধর্মীয় সব জটিল ও সেকেলে দর্শনের দ্বারা গতিশীল, অবাধ স্বাধীনতার দেশ, তাই সৃষ্টিশীল পরিবর্তনে সক্ষম।

আমি এই কারণে কখনো এই পরিবর্তনে স্বীকৃতি দেইনি। আমি মনে করি কোন জিনিসের সুস্থিতি ও স্থায়িত্ব না থাকার অর্থই হলো এর মূল্যহীনতা এবং এতে জীবন অর্থহীন ও হালকা হয়ে উঠে। তাই সব সময়েই আমার অনুসন্ধান ছিল পরম সত্যের জন্য।

ইয়াহুদীবাদ বা খ্রিস্টবাদ কোনটাই আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। সিনাগগের নীচ ও সংকীর্ণমনার কারণে আমি তাড়িত হয়ে ফিরেছি এবং ফিলিস্তিনী আরবদের প্রতি ইয়াহুদীবাদের নিষ্ঠুর বর্বরতা দেখে আমি আতঙ্কিত হয়েছি। খ্রিস্টানদের জটিল ও অবোধ্য ধর্মতত্ত্বের প্রতি এবং নৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুষ্কৃতির সাথে চার্চের অন্তহীন আপোষের সাথে আমি নিজেকে কখনো খাপ খাওয়াতে পারিনি। আমার দেখা সিনাগগ এবং চার্চ উভয়টিই ছিল দুর্নীতি আর কপটতায় পরিপূর্ণ। আমার ইয়াহুদী প্রশিক্ষণের প্রাক্কালে স্বাভাবিকভাবেই ইসলাম ধর্মের প্রতি আমার কৌতুহল জাগ্রত হয়। কারণ, ঐতিহাসিকভাবে ইয়াহুদী ধর্মের সাথে ইসলাম ধর্মের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। আমি বুঝতে পারলাম, ইসলাম ও ইসলামী সভ্যতা সম্পর্কে ভালো রকম জ্ঞান না থাকলে আরবদের সম্পর্কে জানতে পারব না। আর যখন আমি জানতে পারলাম যে, আরবদের দ্বারাই ইসলাম বড় হয়ে উঠেনি। অন্য কোনভাবে তার মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে তখন থেকেই আমি যথাসম্ভব ইসলামকে জানার জন্য সচেষ্ট হয়ে উঠি। ইয়াহুদী ধর্মের সংকীর্ণ ও জটিল জাতীয়তাবাদ এবং বাইবেলের ওপর আল-কুরআনের প্রাধান্য আমার কাছে সর্বাত্মক বিশ্বজনীন বলেই প্রতীয়মান হয়েছে। এই বিশ্বজনীনতাই ক্রমে উচ্চতর নৈতিকতায় পর্যবসিত হয়ে এসব ধর্ম ও এসব ধর্মভিত্তিক সভ্যতাগুলোর ওপর এক প্রচ- চাপ প্রয়োগ করল। ইসলামের পরম মূল্যবোধের সন্ধানে এসে আমি সন্তুষ্ট। ইসলামে এসে আমি সবকিছুই সত্য, সুন্দর এবং ভালো দেখতে পেয়েছি যাতে জীবন ও মৃত্যুর উপলব্ধি রয়েছে এবং দিক নির্দেশনা রয়েছে। অপরদিকে অন্যান্য ধর্মে সত্যকে দেখেছি বিকৃত, পঙ্গু, সীমাবদ্ধ ও বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। যদি কেউ আমাকে জিজ্ঞাসা করে কীভাবে আমি জানতে পারলাম, তাহলে আমি শুধু বলতে পারি, আমার ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতাই আমার মাঝে দৃঢ়-প্রত্যয় উৎপাদন করার জন্য যথেষ্ট। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা-ভাবনা করে এবং গভীর আত্মপ্রত্যয় সহকারে আমি ইসলামের সংস্পর্শে এসেছি। অন্যান্য নও মুসলিমের ন্যায় আমি কখনো নবী (সা.)-কে স্বপ্নে দেখিনি; কিংবা ইসলাম ধর্ম গ্রহণের প্রাক্কালে কোন রকম অলৌকিক বা নাটকীয় কিছুর অভিজ্ঞতাও আমার হয়নি। আমি মনে করি ইসলাম নামের কোন বিষয় যে আছে তা-ও জানার আগে আমি আসলে মন-মেজাজে মুসলমানই ছিলাম। আমার ধর্মান্তর ছিল একটা আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। কারণ, ধর্ম বদলের পর তেমন কোন মৌলিক পরিবর্তন আমার মাঝে আসেনি; বরং অনেক দিন ধরে যে চিন্তা-ভাবনা আমার মাঝে বিরাজমান ছিল তারই একটা আনুষ্ঠানিক রূপ লাভ হয়েছে মাত্র।

কুরআন অধ্যয়ন শুরু করার অব্যবহিত পর আমি বুঝতে পারলাম প্রাসঙ্গিক হাদীসের জ্ঞান অর্জন ছাড়া কুরআন মজীদকে সম্যকরূপে অনুধাবন করা যাবে না। কারণ, পাক কুরআন যাঁর কাছে নাযিল হয়েছে তিনিই তো এর শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাদাতা। আল-কুরআন আমাদেরকে ইসলামী জীবনের মৌলিক রূপরেখা প্রদান করেছে, আর আল-হাদীস তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা তুলে ধরেছে।

যখন নবীপত্নী হযরত আয়েশা-এর কাছে নবী (সা.)-এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য জানতে চাওয়া হলো তখন হযরত আয়েশা জবাবে বলেছিলেন, আল-কুরআনই হলো তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ নবী (সা.)-এর দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল-কুরআনের শিক্ষারই প্রতিফলন ঘটেছে। কুরআন কর্তৃক যে সকল গুণ বিবৃত হয়েছে তিনি ছিলেন সেসবেরই মূর্ত প্রকাশ। তাঁর জীবনচিত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায় একজন শিশু হিসাবে, একজন প্রতিবেশী হিসাবে, একজন ব্যবসায়ী হিসাবে, একজন ধর্মপ্রচারক, একজন নির্বাসিত ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, একজন বন্ধু, একজন যোদ্ধা, একজন সেনাপতি, একজন রাজ্যবিজেতা এবং বিচারক হিসাবে, একজন আইন প্রণেতা, একজন শাসক হিসাবে এবং সর্বোপরি একজন আল্লাহপ্রেমিক হিসাবে নবী (সা.)-এর সার্বিক আচার-আচরণই ছিল আল্লাহর কিতাব আল-কুরআনেরই প্রতিফলন। তাঁর দৈনন্দিন রুটিনে পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠত তাঁর ধার্মিক জীবন যাপনের আন্তরিকতা এবং বিশুদ্ধতা। তিনি দৈনন্দিন জীবনে অত্যন্ত কঠোর নিয়মানুবর্তী ছিলেন। ফজরের নামাযের পর তিনি লোকজনদের সাথে কথাবার্তা বলতেন তাদেরকে শিক্ষা দেয়ার জন্য। এ সময় তিনি অনেক মামলা-মোকাদ্দমারও নিষ্পত্তি করতেন এবং সুবিচার কায়েম করতেন। বাইরের কোন দূত বা প্রতিনিধি এলে তাদের সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং কোথাও কোন দূত বা প্রতিনিধি পাঠানোর প্রয়োজন থাকলে সে কাজ সম্পন্ন করতেন। এভাবে তাঁর সকালের বৈঠক শেষ হতো। এরপর তিনি বাড়ি রওয়ানা হতেন এবং যে কোন একজন স্ত্রীর খেদমতে হাজির হয়ে তাঁর কোন প্রয়োজন থাকলে তিনি সেটা পূরণ করতেন। প্রয়োজনবোধে তিনি বাজার করতে যেতেন, বাজার থেকে এসে নামায পড়ে রোগী ও গরীবদের খোঁজ-খবর নিতেন এবং বন্ধু-বান্ধবদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করে যোহরের নামায আদায় করতেন। যোহরের নামাযের পর তিনি বাড়ি এসে আহার গ্রহণ করতেন (যদি থাকত) এবং আহার শেষে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতেন। তারপর মসজিদে গিয়ে আসরের নামায পড়ে বাড়ি ফিরে এসে নিজের স্ত্রীদের এবং সন্তান-সন্ততিদের সাথে কিছু সময় অতিবাহিত করতেন। এরপর মাগরিবের নামাযের পর বাড়ি ফিরে রাতের খাবার খেয়ে কিছুক্ষণ নির্জনে ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থেকে পরে বিশ্রাম নিতেন। তিনি কয়েক ঘণ্টা মাত্র ঘুমিয়ে আবার শেষরাতে উঠে ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল হয়ে যেতেন এবং এরপর শুয়ে পড়তেন। অল্প কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে ফজরের নামাযের আগেই আবার ঘুম থেকে উঠে পড়তেন এবং নামায শেষে রীতিমত তাঁর আর এক নতুন দিনের কাজ শুরু হতো। তাঁর কর্মদক্ষতা ছিল অসাধারণ। খুব কমই তিনি ক্লান্তি বোধ করতেন।

এখন দেখা যাক নবী (সা.)-এর ধর্মীয় জীবন-যাপনের প্রভাব তাঁর পরিবারের মহিলাদের মাঝে কতটা ফেলেছিল! নবীদুহিতা হযরত ফাতেমা (আ.) সম্পর্কে বলতে গিয়ে হযরত আলী (আ.) বলেছিলেন : “ফাতেমা নিজ হাতে গম পিষত, যার ফলে তার হাতে ফোস্কা পড়ে গিয়েছিল। একটি চামড়ার থলিতে করে বাড়ির জন্য সে পানি বয়ে আনত। এতে তার বুকে দাগ পড়ে গিয়েছিল। সে নিজে তার ঘরদোর পরিষ্কার করত, এতে তার কাপড়-চোপড় ময়লা হয়ে যেত। একবার মদীনায় কিছু যুদ্ধবন্দি আনা হয়েছিল। তা দেখে আমি হযরত ফাতেমাকে বললাম : ‘তুমি নবীজির কাছে গিয়ে তোমার গৃহস্থালি কাজের সাহায্যের জন্য একজন চাকর প্রার্থনা কর। আমার কথামতো হযরত ফাতেমা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট গিয়ে দেখতে পেলে তার চারপাশে অনেক লোকজনের জমায়েত। অন্য লোকজনের সামনে তিনি নবীজীকে কিছু বলতে সংকোচ বোধ করলেন। পরদিন নবী (সা.) নিজে আমাদের বাড়ি এসে জানতে চাইলেন : ‘ফাতেমা! গতকাল তুমি আমার কাছে কি জন্য গিয়েছিলে?’ ফাতেমা লজ্জাবশত কোন জবাব দিতে পারল না, চুপ করে রইল। তখন আমি নবী (সা.)-কে ব্যাপারটি খুলে বললাম। এ শুনে হযরত বললেন : ‘ফাতেমা আল্লাহকে ভয় করো, তাকওয়া হাসিল করো এবং শোবার সময় ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ ও ৩৪ বার আল্লাহু আকবার তাসবিহগুলো পাঠ করবে। একজন চাকরের চেয়ে এগুলোই তোমার জন্য বেশি উপকারী হবে।’ একথা শুনে হযরত ফাতেমা খুশি হয়ে বললেন : ‘আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি সন্তুষ্ট’।”

নবী (সা.)-এর পবিত্র স্ত্রীগণ কিভাবে জীবন-যাপন করতেন? এ সম্পর্কে হযরত আয়েশা বলেন : ‘হযরত মায়মুনা ছিলেন নবীপত্মিগণের মাঝে সবচেয়ে পুণ্যবতী মহিলা। তাঁকে প্রায়ই হয় নামাযে, না হয় গৃহস্থালি কাজে মশগুল দেখা যেত। যদি কোন কাজ না থাকত তাহলে তিনি গাছের ডাল দিয়ে মিসওয়াকে ব্যস্ত থাকতেন।’

এই উদাহরণ তথাকথিত ‘নারী স্বাধীনতার’ আধুনিক আন্দোলনের সপক্ষে কোন আবেদন রাখবে না; বরং এতে আধুনিক নারীরা আতঙ্কিত বোধ করবেন। তাঁরা নিশ্চয়ই আমার কাছে জানতে চাইবেন বিংশ শতাব্দীর আমেরিকায় জন্মগ্রহণকারী একজন আধুনিক মহিলা হয়েও আমি কি করে এ ধরনের সংকীর্ণ দরিদ্র, সীমিত এবং সঙ্কুচিত এক জীবনকে অনুমোদন করলাম? আমার জবাব হলো যে, মহানবী (সা.)-এর কাছে ব্যাপক বিস্তৃতির চেয়ে অভিজ্ঞতার গভীরতাই ছিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতা দ্রুত এগিয়ে চলেছে। এর সাথে তাল মিলিয়ে চলাকেই আজকাল উন্নত গুণাবলি হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কিন্তু আধুনিক নারী-পুরুষের বিবিধ ও বিস্তারিত কর্ম অভিজ্ঞতা থাকতে পারে, তবুও তাদের অন্তঃকরণ অগভীর, ভাসাভাসা ও নড়বড়েই থেকে যায়। মহানবী (সা.)-এর কাছে জীবনের উদ্দেশ্যই ছিল অর্জন করা, উপভোগ করা নয়। নিজের বিবেক-বুদ্ধি মতো কাজ করে যে সন্তুষ্টি পাওয়া যায় তারই স্বাভাবিক প্রকাশ হলো সুখ, আনন্দ প্রভৃতি। বস্তুবাদী জগতে কোন কীর্তি বা অবদান বলতে কোন কিছুতে পূর্ণতা হাসিল, যেমন শিল্পে, বিজ্ঞানে অথবা কোন ব্যাপারে যশ, খ্যাতি অর্জন কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভূত সাফল্য লাভ ইত্যাদিকেই বুঝিয়ে থাকে। ইসলামে কীর্তি বা অবদান বলতে প্রয়োজনীয়, উপকারী এবং সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে স্থায়ী কার্যকরী কিছু হাসিল করা এবং সেই সাথে আত্ম প্রশংসায় অযথা সময় নষ্ট করা থেকে বিরত থাকা এবং যথাসম্ভব দুষণীয় কার্যকলাপ থেকে দূরে থাকা। প্রকৃতপক্ষে কুরআন ও সুন্নাহর মাধ্যমে যে শ্রেষ্ঠ কীর্তি বা অবদান আমাদের রাখতে হবে তা হলো পরকালের চিরন্তন ক্ষমা বা নাজাত।

এই ছিল নবী (সা.)-এর সকল শিক্ষার মূল বিষয়বস্তু। হিজরি প্রথম বছরে মদীনার মসজিদে নবী (সা.) কর্তৃক প্রদত্ত নিম্নলিখিত ভাষণে এই শিক্ষারই প্রতিফলন ঘটেছে : “হে লোকসকল! আগে থেকেই তোমরা প্রস্তুতি গ্রহণ করো। তোমাদের জেনে রাখা উচিত তোমরা প্রত্যেকেই দিশেহারা হয়ে পড়বে (কেয়ামতের দিন) যেন রাখালবিহীন ভেড়ার পাল। যখন কোন পথপ্রদর্শকও থাকবে না বা কোন আশ্রয়স্থলও থাকবে না। তবে প্রভু তাকে বলবেন : ‘আমার রাসূল কি তোমার কাছে আমার বাণী প্রকাশ করেনি? তোমাকে আমি সহায়-সম্পদ দান করেছিলাম। এর পর নিজের জন্য তুমি কি প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলে?’ এই কথা শুনে সে ডানে তাকাবে, বামে তাকাবে, কিন্তু কোন সাহায্যকারী দেখতে পাবে না। তারপর সে তার সামনে লক্ষ্য করবে এবং তখন দোযখের আগুনই শুধু সে দেখতে পাবে। সুতরাং এক টুকরা খেজুর খরচ করেও যদি কেউ দোযখের আগুন থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারে তাহলে সে যেন তাই করে আর যে তাও পারে না সে যেন একটি ভালো কথা দিয়ে হলেও তাই করে। সৎ কাজকে পুরস্কৃত করা হবে এবং তা দশ থেকে সাতশ গুণ বৃদ্ধি করা হবে।”

নবম হিজরিতে সিরিয়ার তাবুকে নবী (সা.) ঘোষণা করেন : ‘নিশ্চয়ই সবচেয়ে সত্যাপরায়ণ রচনা হলো আল্লাহর কেতাব। সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপদেশ বাণী হলো ধর্মীয় উপদেশ। ধর্মের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম হলো হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর ধর্ম (অর্থাৎ) ইসলাম)। শ্রেষ্ঠ নজির বা উদাহরণ হলো মুহাম্মাদের উদাহরণ। সবচেয়ে মহত্তম উক্তি হলো আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা। সুন্দরতম বর্ণনা হলো আল-কুরআন। শ্রেষ্ঠ বিষয় হলো যা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। ধর্মে সবচেয়ে খারাপ জিনিস হলো নতুন কিছু উদ্ভাবন (বিদআত)। সর্বশ্রেষ্ঠ পথ হলো নবী-রাসূলদের পথ। সবচেয়ে মহান মৃত্যু হলো শাহাদাতের মৃত্যু। সবচেয়ে বড় অন্ধত্ব হলো সঠিক পথ পাওয়ার পরও বিপথগামী হওয়া। শ্রেষ্ঠ কাজ যাতে উপকার রয়েছে। শ্রেষ্ঠ পথনিদর্শন হলো যা বাস্তবে অনুসরণ করা হয়। নিকৃষ্টতম অন্ধত্ব হলো হৃদয়ের অন্ধত্ব। প্রলুব্ধকর প্রাচুর্যের চেয়ে অল্পে তুষ্টি অনেক ভালো। মৃত্যুর আগমন মুহূর্তে যে ক্ষমা চাওয়া হয় তা হলো নিকৃষ্টতম ক্ষমা প্রার্থনা এবং সবচেয়ে বড় অনুশোচনা যা শেষ বিচারের দিন অনুভূত হবে।’

আর এভাবে নবী করিম (সা.) আমার কাছে তথা স্থান-কাল নির্বিশেষে সকল সময়ের জন্য সমগ্র মানবজাতির কাছে মানব জীবনের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য এবং কোনটা গুরুত্বপূর্ণ ও কোনটা গুরুত্বপূর্ণ নয় তা বিশদভাবে তুলে ধরেছেন। আধ্যাত্মিক জীবনে হিন্দু ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম ও খ্রিস্ট ধর্মের বৈরাগ্যবাদ ও সন্ন্যাস জীবনের গুরুত্বকে দূরে ছুঁড়ে দিয়ে মহানবী (সা.) বাস্তব জীবনের কথাই বলেছেন। চমৎকার ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থায় তিনি পার্থিব জীবনের বৈধ আমোদ-প্রমোদের সমর্থনও দিয়েছেন। তিনি নির্মল হাস্যরসেও কোন বাধা দেননি। অনেক সময় শিশুদের সাথেও তাঁকে আনন্দ হাসি করতে দেখা গেছে। তবে পরকালের একমাত্র জীবনের তুলনায় যাতে এই পার্থিব জগতের স্বার্থ চিন্তা বেশি হয়ে না যায় সে ব্যাপারে তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন। অনেক সময় সাহাবীদের উদ্দেশে তিনি বলতেন : ‘আমি যা দেখেছি (পরকালের জীবন সম্পর্কে) তোমরা যদি তা দেখতে তাহলে অবশ্যই তোমরা হাসতে কম, কাঁদতে বেশি।’

মহানবী (সা.)-এর ইবাদত-বন্দেগি ছিল অনন্যসাধারণ, দুনিয়ার সমস্ত কিছু ছাড়িয়ে উঠেছিল তাঁর আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রতি গভীর প্রেম ও ভালোবাসা। প্রতি রাতে ঘুমাবার আগে তিনি এই মুনাজাতটি করতে ভুলতেন না : ‘হে আল্লাহ! শেষ বিচারের দিনের দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে আমাকে রক্ষা কর। হে প্রভু! আমি তোমার নামেই বাঁচি আর তোমার নামেই মরি।’

 গ্রন্থপঞ্জি

1.   The Life of Muhammad, Abdul Hamid Siddiqi, Islamic Publications, Lahore. p. 389.

2.   The Stories of Sahabah, Maulana Muhammad Zakaria; Malik Bros Lyallpur Pn. dh. p. 157-158.

3.   Ibid. p. 197.

4.   The Oration of Muhammad, Maulana Muhammad Ubaidul Akbar, Shaykh Muhammad Ashraf, Lahore, 1954. p. 30-31.

5.   Idid. p. 197.

6.   Prayers of the Prophet. Abdul Hamid Siddiqi. Shaykh Muhammad Ashraf, Lahore. p. 13.

ঐতিহ্যবাহী ফারসি শিল্পকলার একটি হস্তলিপি বিদ্যা

ইরানের প্রাচীন ঐতিহ্যময় শিল্পকলাগুলোর অন্যতম হলো হস্তলিপিবিদ্যা বা ক্যালিগ্রাফি। যান্ত্রিক মুদ্রণব্যবস্থা আবিষ্কারের পূর্বে কোনো খবর জনগণকে লিখিতভাবে জানানোর জন্য হস্তলিপিবিদদের সাহায্য নেয়া হতো। হস্তলিপিবিদগণ তাঁদের মনের মাধুর্য মিশিয়ে মনোযোগকে কেন্দ্রীভূত করে সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা তৈরি করতেন। ক্যালিগ্র্যাফি বা হস্তলিপিবিদ্যা তখন ইরানের জনপ্রিয় শিল্পকলাগুলোরও অন্যতম ছিল।

আধুনিককালে বিশেষ করে মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের পরে হস্তলিপিবিদগণের কাজের ক্ষেত্রের সঙ্কোচন ঘটে। কিন্তু তারপরও প্রচারমাধ্যমের সৌন্দর্যের উপাদানগুলো তাঁদের দখলে রয়ে গেছে। বিভিন্ন ধরনের হস্তলিপি লিখনপদ্ধতি, যেমন : নাস্‌খ, নাসতালিক এবং সেকাশতেহ এখনো ব্যবহার করা হচ্ছে। ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পরে এসব লিখনপদ্ধতির উন্নয়নে যথেষ্ট পরিমাণে ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। হস্তলিপিবিদ্যা ব্যবহার করে অনেকে ধর্মীয় পুস্তক (বিশেষ করে কুরআন) এবং সাহিত্যবিষয়ক পুস্তক (যার মধ্যে কবিদের বাছাই করা কবিতার সংকলনও রয়েছে) লেখা হচ্ছে। ইসলামী বিপ্লবোত্তর এক দশকে অনেক ঐতিহ্যবাহী বিষয়ের মধ্যে হস্তলিপিবিদ্যা নিজ গুণে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে এবং হাজার হাজার ছাত্রের মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে।

অন্য যে কোন ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলার তুলনায় হস্তলিপিবিদ্যাকে জাতীয় এবং ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধের সংরক্ষণ ও প্রচারের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে।

গণশিক্ষা এবং পাঠ্যপুস্তকে হস্তলিপিবিদ্যাকে আগের চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্ব সহকারে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ থেকে প্রমাণিত হয়, সমাজে এর চাহিদা এবং কদর দুই-ই রয়েছে। এই শাখার উত্তরোত্তর উন্নয়নের জন্য হস্তলিপিবিদ্যাবিষয়ক বিদ্যালয়গুলোর প্রয়োজন শিল্পকলার অপরাপর শাখার সাথে যোগসূত্র স্থাপন করা। হস্তলিপিবিদ্যার দক্ষ শিক্ষক ও পরিশ্রমী ছাত্রদের মেধা ও মননের সাথে শিল্পের অন্যান্য শাখার সম্মিলন ঘটলে হস্তলিপিবিদ্যা নামক প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী শিল্পটির ব্যাপক উন্নয়ন ঘটবে।

ইসলাম এবং ইরানের প্রাচীন শিল্প হস্তলিপিবিদ্যার বিভিন্ন দিক তুলে ধরে এর উন্নয়নে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে সে সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের কয়েকজন প্রসিদ্ধ ব্যক্তির মতামত সম্প্রতি ‘নামে ফারহাঙ্গ’ নামের একটি সংস্কৃতিবিষয়ক সাময়িকিতে প্রকাশ করা হয়েছে।

নামে ফারহাঙ্গ-এ প্রকাশিত হস্তলিপি শিল্পের বিদগ্ধজনদের মন্তব্য ও মতামত কায়হান ইন্টারন্যাশনাল পত্রিকার এক সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে এভাবে :

পণ্ডিত সালাহশূর : অনেকে আছেন যাঁরা শিল্পের বিভিন্ন শাখা, যেমন লেখালেখি, ভাস্কর্য, নাটক, কবিতা, চলচ্চিত্র, সংগীত, চিত্রকলা ইত্যাদি নিয়ে গর্ব প্রকাশ করেন। তাঁদের জানার জন্য বলছি, একটি বিষয় শিল্প হিসাবে পরিগণিত হতে হলে যে সকল চারিত্রিক গুণ থাকতে হয়, হস্তলিপিবিদ্যা শিল্পের তা পূর্ণমাত্রায় রয়েছে। চিত্রকলার সাথে হস্তলিপিবিদ্যা শিল্পের এক অদ্ভুত ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। কারণ, উভয় ক্ষেত্রেই কলমের ব্যবহার হয়।

মাস্টার জলির রাসুলী : ‘হস্তলিপিবিদ্যার বর্তমান আকারকে কোনভাবেই শিল্প হিসাবে গণ্য করা যায় না। অতীতে এই শিল্পের উন্নতি এবং বিকাশের জন্য বিভিন্ন রকম গবেষণা করা হয়েছে। বর্তমানে এই বিদ্যা চর্চার ক্ষেত্রে যা হচ্ছে তা পূর্বসূরিদের গবেষণালব্ধ ফলের ব্যবহার মাত্র। এই বিদ্যাকে তখনই শিল্প হিসেবে গণ্য করা যাবে যখন হস্তশিল্পবিদ্যা বিশারদরা তাঁদের মেধা ও মননের ব্যবহারের মাধ্যমে এই ক্ষেত্রটির জন্য নতুন কিছু করবেন।

এইভাবে কি আমরা গতিশীল ও বৈচিত্র্যময় নতুন কোনো কাজের ধারা তৈরি করতে পারব? অভিজ্ঞতা থেকে একটা বিষয় প্রমাণিত যে, একজন কখনোই এ সকল নিযম মেনে কোন কিছু করতে পারেন না। মীর এমাদ লিখেছেন সর্বাপেক্ষা নির্ভুল পালা (cross)। মানোত্তীর্ণ সর্বোত্তম বইগুলো লিখেছেন কালহর। সুন্দরতম লেখাগুলো রুচিসম্পন্ন করেছেন গোলাম রেযা এবং মীর হুসাইন তৈরি করেছেন শ্রদ্ধা জাগানো কাজগুলো। বর্তমানের হস্তলিপিবিদগণ ঐ শ্রেষ্ঠ কর্মগুলোর সাথে নতুন কি যোগ করতে পেরেছে? আধুনিককালের হস্তলিপিবিদদের ব্যক্তিগত মেধা-মন ও উদ্যোগের কতটুকু যোগ হয়েছে পুরনো একজনের সাথে? যদি আমরা বর্তমান প্রজন্মের নতুন কিছু পুরাতন প্রজন্মের কাজের সাথে যোগ করি তবেই হস্তলিপিবিদ্যাকে শিল্প বলা যাবে।

নিঃসন্দেহে হস্তলিপিবিদ্যা এক নতুন দিগন্তে প্রবেশের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। এটি শিল্পের বিস্ময়কর জগতে প্রতিষ্ঠিত হবে কিনা তা নির্ভর করে শিল্পীর ব্যক্তিগত বোধশক্তি ও রুচিবোধ এবং সৃষ্টিশীলতার ওপর। কিভাবে একজন শিল্পী সম্ভাবনা ও ক্ষমতাময় শিল্পটিকে ব্যবহার করবেন তার ওপর নির্ভর করে এর ভবিষ্যৎ।

মাস্টার আত্তারিয়ান : শিল্পকে যদি সংজ্ঞায়িত করা হয় আদর্শ ও ইচ্ছার প্রকাশ মাধ্যমরূপে তবে আমরা সকল শিল্প, যেমন : সংগীত, চিত্রকলা এবং কবিতাকে এগুলোর নিজস্ব সাধারণ সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করতে পারি। উদাহরণ হিসাবে ফারসি কবিতার কথা বলা যায়। ফারসি গীতি-কবিতা, লোকগাথা ও শোকগাথায় চতুস্পদী শ্লোক ব্যবহৃত হয়েছে।

সকল শিল্পের নিজস্ব নির্মাণশৈলী ও উপাদান রয়েছে। সঠিক নির্মাণ কৌশল ব্যবহার করে শিল্পের যাবতীয় উপাদানকে ব্যবহারের মাধ্যমে মানোত্তীর্ণ শিল্পকর্ম তৈরি করা সম্ভব। শিল্পের উপাদান বলতে এখানে সামঞ্জস্য, সাদৃশ্য বা তুল্যতা, ভারসাম্যপূর্ণ গঠন, আরোহণ ও অবরোহণ ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে।

প্রতিটি শিল্পের নিজস্ব উপাদান বলতে ঐ সকল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উপাদানকে বোঝানো হচ্ছে যার প্রতি যথাযথ মনোযোগ সম্পাদিত কর্মটিকে শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছে দেয়। যেমন : কবিতার বেলায় শব্দ, সংগীতের বেলায় সুর, চিত্রকলার বেলায় আলো এবং রং ও হস্তশিল্পের বেলায় ডট বা বিন্দুর ব্যবহার।

এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, উপাদান কখনো নিজের গতিতে শিল্প হয়ে উঠতে পারে না। একটি শিল্পের উপাদানগুলো তখনই শিল্প বলে স্বীকৃত হয় যখন শিল্পকলার ঐ ক্ষেত্রে শিল্পী তাঁর অনুভূতিকে নির্দিষ্ট শিল্পের যাবতীয় উপাদান ও কলাকৌশল দ্বারা গ্রহণযোগ্য ও বোধগম্য করে গড়ে তোলেন। এই অর্থে হস্তলিপিবিদ্যা একাধারে একটি শিল্প ও একটি কৌশল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

মুদ্রণ শিল্পের বিকাশ হস্তলিপিবিদ্যা শিল্পের ওপর কী মাত্রায় প্রভাব বিস্তার করেছে, এই সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে হস্তলিপিবিদ্যা বিশেষজ্ঞ ফুরাদি বলেন : এক সময়ে হস্তলিপিবিদ্যা শিল্প হিসাবে স্বীকৃত ছিল। তাই একে কোনভাবেই চিত্রকলা কিংবা হাতের লেখার সাথে তুলনা করা উচিত নয়। এ সকল শিল্পের সবগুলোই নকশা বা চিত্রময় যোগাযোগ শিল্পের অন্তর্ভুক্ত।

এটি হস্তলিপিবিদ্যাকে সহযোগিতা করেছে, কিন্তু এর শিল্পমাধুর্যের মানের অবনতিও ঘটিয়েছে। এটি মিথ্যার আবরণ চড়িয়ে অতিপ্রাকৃতভাবে হস্তলিপিবিদ্যাকে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। অন্যদিকে এর বস্তুনিষ্ঠ সুন্দর ও শৈল্পিক ভাবমূর্তিকে বিপথে পরিচালিত করেছে। হস্তলিপিবিদ্যার মূল্যায়ন ও উন্নয়ন অনেকাংশে ঘটেছে পবিত্র কুরআনের ওপর ভিত্তি করে। এক্ষেত্রে অন্য উপাদানগুলো হলো পুস্তক লিখন, উৎকীর্ণলিপি, সে সাথে এই অকৃত্রিম শিল্পের নিবেদিত শিল্পীদের কর্তব্য ও দায়িত্ববোধর কথা উল্লেখ করতে হয়।

হস্তলিপিবিদ্যা শিল্প শুধু ইসলামী ইরানের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের সংরক্ষণ ও উন্নয়নে অবদান রাখেনি। এর পাশাপাশি শিল্পটি বহির্বিশ্বেও শিল্প হিসেবে নিজের অবস্থানকে পাকাপোক্ত করেছে। হস্তলিপিবিদ্যা তাইমুর আমলে সাফল্যের শিখরে ওঠে, কিন্তু সাফাভী রাজবংশের শাসনামলে এর জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়। শিল্পটি আরো একবার সাফল্যের মুখ দেখেছিল শাহ আব্বাসের শাসনামলে। কিন্তু পুনরায় যেন্দ, আফসার এবং কাজার রাজবংশের শাসনামলে এ শিল্পটিকে অবহেলা করা হয়। নাসির উদ্দিন শাহের আমলে শিল্পটি পুনরায় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। আবার এর ক্রান্তিকাল শুরু হয় রেযা শাহ এবং মোহাম্মদ রেযার আমলে। ইসলামী বিপ্লবের পরে এ শিল্পটি সর্বকালের সর্বোচ্চ পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে।

ইসলামী বিপ্লবের আগে হস্তলিপিবিদ্যা শিল্পটি বিভিন্ন ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে পথ চলছিল। যন্ত্রের বহুল ব্যবহারে সকল ধরনের হস্তশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এর মধ্যে হস্তলিপিবিদ্যা বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী শিল্পটির অস্তিত্বের বিষয়টি হুমকির সম্মুখীন হয়। দেশে ইসলামী বিপ্লবের পর এ অবস্থায় পরিবর্তন ঘটে। বর্তমানে হস্তলিপিবিদ্যা শিল্পের অনেক উন্নতি ঘটেছে। এক্ষেত্রের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে এবং প্রচুর সংখ্যক লোক হস্তলিপিবিদ্যা শিল্পের ওপর লেখাপড়া করছে।