কাওসারে আপনাকে স্বাগতম Category » Journal » page 13

আল-কুদ্‌স নিয়ে বৃহৎ শক্তির চক্রান্ত

অধ্যাপক সিরাজুল হক

মুসলিম মিল্লাতের প্রাণকেন্দ্র প্রথম কিবলা আজও অভিশপ্ত ইহুদিদের কবলে। শুধু ‘মসজিদে আকসা’ এবং ফিলিস্তিন ভূখণ্ড কুক্ষিগত করাই ইহুদিদের কাম্য নয়। তারা চাচ্ছে এ ভূখণ্ডে তাদের অবস্থান সংহত করার মাধ্যমে আরব জাহান তথা গোটা মুসলিম বিশ্বকে গ্রাস করতে। তাদের এ সর্বগ্রাসী তৎপরতার পশ্চাতে সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করছে বিশ্বের পরাশক্তিগুলো ও তাদের রঙ্গমঞ্চ (Stage) জাতিসংঘ নামক বিশ্ব সংস্থাটি। কারণ, এ সংস্থাটি ইহুদিবাদের নামান্তর মাত্র। ইহুদিরা যে খুঁটির জোরে ফিলিস্তিনে চেপে বসে আছে, তা হলো বৃহৎ শক্তিবর্গ ও তাদের ষড়যন্ত্রের আখড়া এ সংস্থাটি।

১৯৪৮ সালে ‘জাতিসংঘ’ নামক এ সংস্থাটি অন্যায়ভাবে ফিলিস্তিন বিভক্তির প্রস্তাব গ্রহণ করে মধ্যপ্রাচ্য তথা গোটা মুসলিম জাহানে অশান্তির বীজ বপন করে। শুধু তাই নয়, ১৯৪৮ সালে সংঘটিত আরব ইসরাইল যুদ্ধের পর মুসলিম মুজাহিদদের পুনর্বাসন থেকে আজ পর্যন্ত যতগুলো বিপজ্জনক পরিস্থিতি মুসলমানদের ওপর দিয়ে অতিক্রম করেছে, জাতিসংঘ সেসব ব্যাপারে ততটা তৎপর হয়নি, যতটা হয়েছে ইসরাইলের ব্যাপারে।

দেখা গেছে, আরব-ইসরাইলের মধ্যে সংঘটিত বিভিন্ন সংঘর্ষ ও লড়াইয়ের ব্যাপারে জাতিসংঘ ইহুদিদের পক্ষেই কাজ করেছে। কাজেই জাতিসংঘ নামক এই বিশ্ব সংস্থাটিকে ইহুদিবাদের নামান্তর বললে মোটেই অত্যুক্তি হয় না। আমেরিকার বিখ্যাত আইন ব্যবসায়ী হেনরী ক্লিয়েন (Henry Klein) তাঁর ‘Zions rule the world’ নামক গ্রন্থে অনুরূপ মন্তব্যই করেছেন। তিনি বলেন : The United Nations is Zionism. It is the super government mentioned many times in the protocols of the Learned Elders of Zions promulgated between 1597-1905. এর তরজমা করলে এই দাঁড়ায় যে, জাতিসংঘ ইহুদিবাদেরই অন্য নাম। ১৫৯৭ সাল থেকে ১৯০৫ সালের মধ্যে জারিকৃত ইহুদি পণ্ডিত ও মুরব্বিদের প্রণীত দলিলে পুনঃপুনঃ যে উচ্চতর সরকারের কথা বলা হয়েছে এটা তাই।

বনি ইসরাইল বা ইহুদি সম্প্রদায় হযরত ইয়াকুব (আ.)-এর বংশধর হলেও তারা একটি অভিশপ্ত জাতিতে পরিণত হয়েছে। কারণ, তারা একদিকে যেমন খোদাদ্রোহিতায় লিপ্ত হয়েছে, অন্যদিকে তাঁরই প্রেরিত অসংখ্য নবী- রাসূলকে হত্যা করেছে। বহুবার ক্ষমা করার পরেও তারা তাদের সে অবাধ্য আচরণ থেকে প্রত্যাবর্তন করেনি। হযরত মূসা (আ.) দীর্ঘকাল যাবৎ তাদের মুক্তির জন্য ফেরাউনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। কিন্তু এতদসত্ত্বেও তারা তাঁর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এই পৃথিবীর বুকে যেখানেই গিয়েছে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে।

এসব কর্মফলের দরুনই তারা একটি অভিশপ্ত জাতিতে পরিণত হয়েছে। সূরা ফাতেহা থেকে শুরু করে পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন সূরায় বনি ইসরাইলদের এই জঘন্য আচরণ ও চরিত্রের কথা বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে এবং একটি অভিশপ্ত জাতি হিসাবে তাদেরকে  ঘোষণা দেয়া হয়েছে। আল্লাহর সাথে চরম অবাধ্য আচরণ করার কারণে ইহুদিরা যে একটি লাঞ্ছিত জাতিতে পরিণত হয়েছে, ইতিহাসে তার অসংখ্য নজির রয়েছে।

আশুরীয় বাদশা পিয়ার খ্রি.পূ. ৭২৪ সালে ইসরাইলের আবাস ভূমি আক্রমণ করে হাজার হাজার ইহুদিকে গ্রেফতার করে নিয়ে গিয়ে দাসে পরিণত করে। খ্রি.পূ. ৫৬১ সালে ব্যাবিলনের বাদশা বখতে নসর জেরুজালেম আক্রমণ করে এবং ৭০ হাজার ইহুদিকে বন্দি করে নিজ দেশে নিয়ে যায়। অতঃপর ঈসায়ী ৭০ সালে রোমকগণ ইহুদি রাজ্য আক্রমণ করে এবং হাজার হাজার ইহুদিকে হত্যা করে। ঈসায়ী ১৩২ সালে রোমকগণ পুনরায় ফিলিস্তিন আক্রমণ করে এবং ইহুদিদের সেখান থেকে বের করে দেয়। এইভাবে ইহুদি জাতি বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু যেখানেই গিয়েছে সেখানেই তারা ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করেছে। যার ফলে তারা ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ইটালি ও জার্মানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছে, যদিও তারা এখন তাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও মুরব্বি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার তো অসংখ্য ইহুদিকে হত্যা করেছে যা ইতিহাসের পাঠক মাত্র সকলেই অবগত আছেন।

এখন প্রশ্ন ওঠে ইহুদিদের অবস্থা ও অবস্থান যদি এরূপই হয়ে  থাকে তাহলে পৃথিবীর একশ কোটিরও অধিক মুসলমানকে আজ তারা কি করে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতে পারে? প্রকৃতপ্রস্তাবে ইহুদিরা কোন শক্তিই নয়। মুসলিম মিল্লাতের শক্তি ও সামর্থ্যকে খর্ব করার উদ্দেশ্যেই আমেরিকাসহ বৃহৎ শক্তিবর্গ ইহুদিদের ফিলিস্তিনে বসিয়েছে এবং সার্বিকভাবে মদদ যোগাচ্ছে। এর মধ্যে ব্রিটেন ও আমেরিকাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।

১৯৪৮ সালের ১৪ মে রাত ১২টার সময় যখন ফিলিস্তিনে ব্রিটেনের অছিগিরি সমাপ্ত হয় তার ১ মিনিট পরেই ইহুদি নেতা বেন গুরিয়ান স্বাধীন ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেন। আর এর মাত্র ১০ মিনিট পরেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রু ম্যান ইসরাইলকে স্বীকৃতি প্রদান করেন। কাজেই ব্যাপারটা যে তাদেরই সাজানো ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। আর সে খেল-তামাসাই আজও অব্যাহত রয়েছে।

ইহুদিরা আজ মুসলিম মিল্লাতের জন্য হুমকিস্বরূপ। তার একটি বড় কারণ রয়েছে। আর তা হচ্ছে এই যে, আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও নির্ভরশীলতার পরিবর্তে বৃহৎ শক্তিগুলোর মোসাহেবি এবং নিজেদের মধ্যকার দ্বিধাবিভক্তি ও অন্তর্দ্বন্দ্ব মুসলমানদেরকে ইহুদিদের সামনে দুর্বল করে রেখেছে। যার ফলশ্রুতিতে শুধু ইহুদিরাই নয়, বৃহৎ শক্তিগুলো সীমাহীন ফায়দা লুটছে। শুধু তেল সংগ্রহ এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে তাদের নিজস্ব পণ্যের বাজার সৃষ্টি ও কারিগরি দক্ষতা বিক্রি করেই ফায়দা লুটছে না, অধিকন্তু তারা অত্যাধুনিক ভারি অস্ত্র-শস্ত্র সরবরাহ করেও মুসলিম দেশগুলোকে উজাড় ও খতম করে দিচ্ছে। অথচ দেখা গেল ইরাকের পারমাণবিক কেন্দ্র যখন ইসরাইলি বোমার আঘাতে ভস্ম হলো তখন প্রতিবেশী সউদী আরবকে দেয়া মার্কিন রাডার সেট জঙ্গী বিমানগুলো কোন ভূমিকাই পালন করতে পারল না। যদিও সউদী আরব ইরাকের পরম বন্ধু। কাজেই একদিকে ইসরাইলকে কেন্দ্র করে বৃহৎ শক্তিবর্গের পাঁয়তারা, অন্যদিকে আরব তথা মুসলিম মিল্লাতের এহেন নাজুক অবস্থায় আজ ফিলিস্তিন ও আল-কুদ্‌স উদ্ধার তো দূরের কথা, আরব জাহানকে তার অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকাই এক কঠিন ব্যাপার। অথচ ইহুদিদের তুলনায় আরবরা এক বৃহৎ শক্তি।

আর এ অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেই ইরানের ইসলামী বিপ্লবের অবিসংবাদিত নেতা ইমাম আয়াতুল্লাহ খোমেইনী (রহ.) আক্ষেপ করে বলেছেন : ‘আরবরা যদি এক জগ করে পানিও ঢেলে দেয়, তাহলে ইহুদিরা ভূমধ্যসাগরে ভেসে যেতে বাধ্য।’

করণীয় বিষয়

পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিন ও বাইতুল মোকাদ্দাসকে আজ  ইহুদিদের কবলমুক্ত করতে হবে। যে পুণ্যভূমি এবং তার চতুষ্পার্শ্বকে আল্লাহ তাআলা অসীম বরকতময় করেছেন, যে স্থানে মানবতার মুক্তির জন্য অসংখ্য নবীর আগমন হয়েছে, সে স্থান থেকে মহানবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মেরাজ যাত্রা শুরু হয়েছে, যে স্থানে স্মরণাতীত কাল থেকে অসংখ্য মুসলিম নার-নারী আল্লাহর দীনের সংরক্ষণের জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, সেই পুণ্যভূমি আজও ইহুদিদের কবলে- এটা বিশ্বমুসলিমের জন্য একান্তর লজ্জার কারণ। শুধু তাই নয়, তাদেরকে এ জন্য অবশ্যই আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। আজ সেখানকার নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষ অত্যাচারে অতীষ্ঠ হয়ে কুরআনের ভাষায় এই বলে ফরিয়াদ করছে : ‘হে আল্লাহ! এই যালেমদের জনপদ থেকে আমাদেরকে বের করে নিয়ে যাও। হে আল্লাহ! আমাদের জন্য তোমার পক্ষ থেকে একজন অভিভাবক সাহায্যকারী প্রেরণ কর।’

আজ এই দায়িত্ব মুসলিম মিল্লাতের। তাই মুসলিম মিল্লাতকে সে ঈমান আর প্রাণের জোরে দাঁড়াতে হবে ইহুদিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও যুলুমের বিরুদ্ধে। আল-আকসাকে মুক্ত করতে হলে যতটা লড়াই করতে হবে ইহুদিদের  বিরুদ্ধে, তার চেয়েও অধিক মাত্রায় সংগ্রাম করতে হবে মার্কিন তথা বিশ্বসাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। কারণ, ইহুদিদেরকে আমাদের এই পুণ্যভূমিতে যারা বসিয়েছে, তারা হলো এইসব সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। অদ্যাবধি তারাই ইহুদিদের টিকিয়ে রাখার জন্য সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে আসছে। ইহুদিদেরকে যদি একটি দেহের সাথে তুলনা করা হয় তাহলে তার মস্তিষ্ক হচ্ছে ব্রিটেন ও ফ্রান্স। কাজেই এই বৃহৎ শক্তিগুলোই হচ্ছে আমাদের বড় শত্রু। তাদের মুসাহেবি করে অথবা তাদের সাথে সখ্য বজায় রেখে ইহুদিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা যাবে না- আমাদের অতীত ইতিহাস তারই সাক্ষী।

১৯৬৭ সালে রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল হতে গিয়ে মিশর চরম মার খেল, সিনাই ও গোলান উপত্যকা এ ক্ষুদ্র ইসরাইলী শক্তির হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো। অনুরূপভাবে ১৯৭৭ সালে আবার ‘ক্যাম্প ডেভিড’ চুক্তির মাধ্যমে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তথা ইহুদিদের বড় দোসরের জন্য আরো স্থান করে দেয়া হলো। অথচ পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে : তোমরা মুমিন ব্যতীত অন্যদেরকে তোমাদের বন্ধু বা অভিভাবক হিসাবে গণ্য করো না। এটা এজন্য যে, ‘আল-কুফরূ মিল্লাতুন ওয়াহেদাতুন’ অর্থাৎ সমগ্র কুফ্‌র বা খোদাদ্রোহী শক্তি মুসলমানদের মোকাবিলায় এক। এমতাবস্থায় এই কুফ্‌রি শক্তির মোকাবিলায় মুসলমানরা যদি একতাবদ্ধ হতে না পারে তা হলে তাদের এ বিড়ম্বিত ভাগ্যের পরিবর্তন অসম্ভব। আর এ কারণেই আজ মুসলিম মিল্লাতের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন সকল দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে আল্লাহর সমীপে আত্মনিবেদন করা, তাঁর ওপর নির্ভরশীল হওয়া। শিশাঢালা প্রাচীরের ন্যায় নিজেদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি গড়ে তোলা।

মুসলিম মিল্লাতকে একদেহে লীন না হওয়া পর্যন্ত এ সমস্যা সমাধানের জন্য কোন বাস্তব কর্মপন্থা গ্রহণ সম্ভব নয়। আমাদের অতীত ইতিহাস প্রমাণ করে যে, ‘ওয়াতাসিমু বি হাবলিল্লাহি জামিয়া’-এর শিক্ষা গ্রহণ করার ফলেই এই পৃথিবীতে আমরা একটি সোনালি অধ্যায় সৃষ্টি করতে পেরেছিলাম। আজও আমাদের সে অভিন্ন রূপটি ফুটিয়ে তোলা ব্যতীত মুক্তির কোন প্রত্যাশা করতে পারি না। আল্লামা ইকবালের ভাষায় বলব : ‘আমাদের লাভ ও ক্ষতি এক, আমাদের নবী এক, আমাদের দীন ও ঈমান এক, আমাদের কেবলা এক, আমাদের স্রষ্টা এক, আমাদের কিতাবও এক। কিন্তু আমরা মুসলমানরা যদি এক হতে পারতাম তবে কতই না উত্তম হতো!’

এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই বাংলাদেশের মুসলমানরা ইরানসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মুসলমানদের ন্যায় পবিত্র মাহে রমযানের শেষ শুক্রবারকে ‘আল-কুদ্‌স দিবস’ হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে। পবিত্র বাইতুল মোকাদ্দাসকে ইহুদিদের কবল থেকে মুক্ত করার দৃঢ় প্রত্যয় ও সংগ্রামে এই দিবসটি সারা বিশ্বে উজ্জ্বল হয়ে উঠুক- আজকের দিনে এটাই হোক বাংলাদেশের তাওহিদী জনতা তথা বিশ্বমুসলিমের ঐকান্তিক কামনা।


নতুন পদমর্যাদার সন্ধানে ইরানী মহিলা সমাজ

এম বেলালী

ইরানের ইসলামী বিপ্লব হলো একটি অদ্বিতীয় বিপ্লব। এর প্রকৃতি হচ্ছে সম্পূর্ণ ইসলামী। একে অদ্বিতীয় বলার কারণ হচ্ছে এই যে, এই বিপ্লব দীর্ঘকাল থেকে চলে আসা এবং বিরাজমান সাংস্কৃতিক অবকাঠামোর আমূল পরিবর্তনের উদ্দেশ্যেই পরিচালিত হয়েছিল। সমাজে যা কিছু চালু ও বিদ্যমান ছিল, এ বিপ্লব তার সবকিছুকেই প্রত্যাখ্যান করেছিল। এর পর আমাদের চিন্তা-চেতনা, ব্যক্তিত্ব, মনোভাব এবং উচ্চ নৈতিক চিন্তাধারাকে পুনর্গঠিত করা হয়।

যেহেতু ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের সংরক্ষণের ক্ষেত্রে মহিলাদের বিরাট ভূমিকা রয়েছে, তাই বিপ্লবের সাফল্যের ক্ষেত্রে মহিলাদের বিরাট অবদান ছিল। আর যেহেতু মহিলারা এ ধরনের গুণাবলির অধিকারী তাই সমাজের মঙ্গল ও কল্যাণের জন্য স্বাভাবিকভাবেই তাদের নিকট থেকে ত্যাগ-তিতিক্ষা কামনা করা হয়েছিল। অতএব, আমরা দেখতে পাই যে, তাঁরা সকল ক্ষেত্রে এবং সকল ফ্রন্টেই সম্ভাব্য ভূমিকা পালন করেছেন। একই সময়ে তাঁরা একদিকে যেমন বিপ্লবের ময়দানে উপস্থিত থেকে নিজেদের দায়দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করেছেন, দেশের স্বাধীনতার হেফাজত করেছেন, অন্যদিকে তাঁদের ওপর ন্যস্ত মাতৃত্বের দায়িত্বও তাঁরা পালন করেছেন।

সুতরাং বিপ্লবোত্তরকালের সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মহিলাদের সামাজিক, রাজনৈতিক উন্নতি ও বিকাশকল্পে কিছু বাস্তবধর্মী কর্মসূচি নেয়া হয়। তবে এই পরিবর্তন বিশৃঙ্খলভাবে সংঘটিত হয়নি। আমাদের কর্মতৎপর এবং বিপ্লবী মুসলিম বোনদের কর্মপ্রচেষ্টার ফলশ্রুতিতেই সমাজে এই অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। তারা সমাজে মহিলাদের সত্যিকার দাবি ও অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠাকল্পে নিরলসভাবে কাজ করেছেন।

মহিলাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিষদ

এক বছর পূর্বে প্রেসিডেন্ট রাফসানজানী বেগম শাহলা হাবিবীকে তাঁর মহিলা বিষয়ক উপদেষ্টা নিয়োগ করেন। তিনি মহিলাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে প্রেসিডেন্টকে পরামর্শ দেবেন। আসলে এ ধরনের একজন মহিলা উপদেষ্টা নিয়োগের ধারণাটি প্রথম অনুভূত হয় মহিলাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিষদেরপরিম-লে আর এই সংগঠনটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব পরিষদের অধীনে ১৯৮৭ সালে তার প্রথম তৎপরতা শুরু করে। মহিলাদের এই সংগঠনের দায়িত্ব হলো ইরানী মহিলাদের অধিকারগুলো সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে নীতিমালা নির্ধারণ করা এবং তাদের ব্যক্তিগত ও আধ্যাত্মিক বিকাশের ক্ষেত্রসমূহ প্রস্তুত করা। মহিলাদের এই পরিষদের তৎপরতা আঞ্জাম দেয়ার জন্য কর্মতৎপর সাতটি কমিটি রয়েছে। এসব কমিটি মহিলাদের শিক্ষা-দীক্ষা, চাকরিতে নিয়োগের অধিকার, পারিবারিক আইন-কানুন এবং আন্তর্জাতিক বিষয়াদির ব্যাপারে গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে। অতঃপর কমিটি তাদের অনুসন্ধানলব্ধ বিষয়সমূহকে সাংস্কৃতিক বিপ্লব পরিষদের নিকট অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করে। মহিলাদের অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে একটি সমঝোতায় উপনীত হওয়ার নিমিত্ত উক্ত পরিষদ বিভিন্ন সরকারি সংস্থা থেকেও প্রতিনিধি গ্রহণ করে থাকে। গত চার বছরে মহিলা পরিষদ মহিলাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অনেক খসড়া প্রস্তাব সাংস্কৃতিক বিপ্লব পরিষদের নিকট অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছে। যেমন নার্সারি স্কুলের পরিকল্পনা এবং পারিবারিক সহযোগিতা ও পথনির্দেশনার জন্য দেওয়ানি আদালতসমূহে কেন্দ্র বা শাখা খোলা প্রভৃতি। অধিকতর পর্যালোচনার জন্য অধিকাংশ বিল খসড়া প্রস্তাব আকারে ফাইলবন্দি অবস্থায় আছে। এসবের মধ্য থেকে একটি বিল সম্প্রতি আইনে পরিণত হয়েছে। বিলটি হচ্ছে সম-মজুরি বিল। এই আইনের বলে একজন তালাকপ্রাপ্তা মহিলা তালাকদাতা স্বামীর ঘরে থাকাকালীন যে কর্ম সম্পাদন করেছেন তার বিনিময়ে তিনি মজুরি দাবি করতে পারবেন।

মহিলা পরিষদের পরিচালিকা মিসেস যাহরা শুজায়ী বলেন : বিনা মজুরি বা বিনা পারিশ্রমিকে মহিলাদেরকে গৃহকর্ম আঞ্জাম দিতে হবে- ইসলামে এমন কোন কথা নেই। বরং গৃহকর্ম সম্পাদনের জন্য পারিশ্রমিক পাওয়ার অধিকার তাদের রয়েছে।

শুজায়ী বলেন যে, সমাজে  মহিলাদের ব্যাপারে এখনো কিছু কিছু বৈষম্য রয়েছে, যা সত্যিই দুঃখজনক। তিনি বলেন, ভুল বুঝাবুঝির কারণেই এ ধরনের বৈষম্য এবং বে-ইনসাফি বিরাজ করছে। তবে আইনের আশ্রয়ে এগুলো হয়নি, বরং এমনিতেই এগুলো ইরানী সংস্কৃতিতে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে।

মিসেস শুজায়ী আরো বলেন, ইরানী শাসনতন্ত্র হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম প্রগতিশীল ও উন্নত শাসনতন্ত্র, যা ইসলামের নীতিমালার ভিত্তিতে প্রণীত হয়েছে।

তিনি বলেন, ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে পুরুষ  ও মহিলা সমান নয়। প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে যে, পুরুষ ও মহিলা একে অন্যের পরিপূরক। তবে যাই হোক, অধিকারের ক্ষেত্রে তাদের সমান অধিকার রয়েছে। তবে এ অধিকারের ক্ষেত্রে যদি কিছু ভুল-ত্রুটি থেকে থাকে তা হলে বুঝতে হবে যে, আমাদের দেওয়ানি আদালত থেকেই এগুলোর উদ্ভব হয়েছে- যা এখন থেকে ৫০-৬০ বছর পূর্বে লিপিবদ্ধ হয়েছিল।

অনেকেই এই আইনগুলোর বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সংশোধনের পক্ষপাতি। মিসেস শুজায়ী বলেন যে, সমাজে যদি ইসলামী সংস্কৃতি এবং যৌক্তিক মনোবৃত্তি না থাকে তাহলে সকল প্রকার প্রগতিশীল আইন-কানুনও ব্যর্থ হবে। তিনি বলেন, দুঃখজনক যে, আমাদের সমাজে কিছু ভুল ধারণা রয়েছে যা ধমের্র নামে গ্রহণ করা হয়েছে। অনেক লোকই মনে করে যে, একজন মহিলাকে অবশ্যই অনুগত হতে হবে, অথচ তার ব্যক্তিগত এবং পেশাগত উৎকর্ষের কথা ভাবা হয় না। এটা পুরোপুরি ভুল। তিনি বলেন যে, পবিত্র কুরআনের কোথাও এটা বলা হয়নি যে, মহিলাদেরকে শুধু ঘরমুখী হয়েই থাকতে হবে।

একজন রাষ্ট্রনীতিজ্ঞ হিসাবে সুপরিচিত মিসেস শুজায়ী সব সময়ই অত্যন্ত কঠোরভাবে হিজাব পালন করে থাকেন। এতে তিনি কোন সংকটও অনুভব করেন নাতিনি ক্লাস রুমে পাঠদানরত থাকেন অথবা অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকেন।


১৫ শাবান বিশ্ব মুস্তাজআফ দিবস

১৫ শাবান মানবতার মুক্তিদাতা ইমাম মুহাম্মাদ (ইমাম মাহদী) ইবনুল হাসান আল-আসকারী (আ.)-এর গৌরবোজ্জ্বল জন্মদিবস। ১৫ শাবান অত্যাচারিত, বঞ্চিত জনগণের হৃদয়ে আশার আলোক বিচ্ছুরিত হওয়ার দিবস। ১৫ শাবান ইসলামের মহান আনন্দ দিবস।

১৫ শাবান এমন এক মহান ব্যক্তিত্বের পৃথিবীতে আগমন দিবস যাঁর দেহে মহানবী (সা.)-এর রক্ত রয়েছে এবং যিনি আলী (আ.)-এর তরবারি ধারণ করে যালিমদের নিকট থেকে সকল নির্যাতিত ব্যক্তির প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন। যদিও মহানবী (সা.) মহানুভবতা ও দয়ার মাধ্যমে পৃথিবীর প্রত্যন্ত এলাকায় ইসলামের বাণী পৌঁছে দিয়েছেন, কিন্তু মহান প্রতিশোধ গ্রহণকারী আল্লাহ পাকের নির্দেশে অস্ত্র ধারণ করে সমগ্র পৃথিবীব্যাপী ইসলামকে কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠিত করবেন। তিনি অত্যাচারী, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী ও ষড়যন্ত্রকারীদের হস্ত কর্তন করে খোদার সৎ বান্দাদেরকে পিতৃবৎ স্নেহ-মমতায় আশ্রয় দিবেন।

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান এ মহান ব্যক্তিত্বের জন্মদিবসকে ‘বিশ্ব মুস্তাযআফ দিবস’ হিসাবে ঘোষণা করেছে। বিশ্বের বঞ্চিত মুস্তাযআফ জনগণ আশান্বিত হৃদয় নিয়ে এ মহান ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব প্রতীক্ষায় অপেক্ষমাণ। আজকের পৃথিবীতে বঞ্চিত মুস্তাযআফ জনগণ পাহাড়সম সমস্যার তুঙ্গ-তরঙ্গে হাঁপিয়ে উঠেছে। তারা এ উত্তাল তরঙ্গের সাথে পাঞ্জা লড়ে জীবন-যুদ্ধে কোনভাবে টিকে আছে, তবুও তাদের ক্ষত-বিক্ষত এ হৃদয়, অত্যাচারিত, নির্যাতিত মানুষ, শহীদ পরিবারবর্গ, ইয়াতিমগণ সেই উদীয়মান সূর্যের প্রতীক্ষায় নিজেদের চক্ষু সবর্দা উন্মিলিত রেখে কালের প্রহর গুণছে।

কবে এসে পৌঁছবেন?

হ্যাঁ, যদিও সে উজ্জ্বল আলোকবর্তিকার অমিয় জ্যোতি মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের সংগ্রামকে প্রাণবন্ত করেছে এবং ইসলামের মহান সেবকদের হৃদয়ে আলোক আভা উদ্ভাসিত করছে তবুও সবার কামনা এই যে, মহান আল্লাহ তাআলা যেন যত দ্রুত সম্ভব পুঞ্জিভূত মেঘখণ্ডগুলোকে অপসারণ করেন যাতে প্রেমাষ্পদের মুখাবয়ব দর্শনযোগ্য হয় এবং ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়ের অধিকারী প্রেমিক অনুসারীদের আর প্রতীক্ষার আগুনে জ্বলতে না হয়।

বস্তুত আমাদের জন্য এটি একটি অত্যন্ত সৌভাগ্যের ও আনন্দের বিষয় যে, এমন একজন নেতা ও রাহবার আমাদের রয়েছে যিনি আমাদের যুদ্ধক্ষেত্রে সার্বক্ষণিক প্রেরণার উৎস। যদিও আজকে আমরা শত্রুর বহুমুখী ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছি, কিন্তু আমাদের জন্য শুভ বার্তা এই যে, একদা ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে যাবে এবং শত্রুরা অপমানিত ও লাঞ্ছিত হবে এবং অত্যাচার-নিপীড়ন বন্ধ হয়ে যাবে। বঞ্চিত ও মযলুম জনগণের বন্ধু জনতার রাজপথে সম্মিলিত হবেন। এমন এক বন্ধু থাকতে আজকে আর এ সকল অপবিত্র দুশমনকে আমাদের ভয় করার কি কারণ আছে।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে বিশ্বের সকল মুসলমান এ বিষয়ে একমত যে, শেষ যামানায় যখন পৃথিবীতে অত্যাচার, অনাচার, অবিচার, নির্যাতন, রক্তপাত প্রভৃতি চলতে থাকবে তখন মহান আল্লাহর নির্দেশে একজন বিশ্বসংস্কারক আবির্ভূত হবেন এবং পৃথিবীতে শান্তি, ন্যায় বিচার ও সাম্য প্রতিষ্ঠা করবেন।

তবে এ বিষয়ে শিয়া ও সুন্নি ভাইদের মধ্যে যে মতপার্থক্য দেখা যায় তা হলো, শিয়ারা বিশ্বাস করেন যে, এ প্রত্যাশিত ব্যক্তি হচ্ছেন একাদশ ইমাম হাসান আসকারী (আ.)-এর পুত্র আল-মাহদী (আ.)। তিনি বর্তমানে এ পৃথিবীতেই জীবনযাপন করছেন। তিনি এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পর্দার অন্তরালে অবস্থান করবেন অতঃপর খোদার নির্দেশে আবির্ভূত হবেন। কিন্তু সুন্নিদের অভিমত হচ্ছে, এ মহান ব্যক্তি শেষ যামানায় জন্মগ্রহণ করবেন এবং আল্লাহর নির্দেশে বিশ্বব্যাপী ইসলামী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবেন।


১৯৯৩ সালের প্রেক্ষাপটে ইসলামী বিপ্লব ও সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র

অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান

ন্যায় ও শান্তির সমাজ প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষা মানুষের চিরন্তন। একই সাথে মানবজীবনে অন্যায়, অশান্তি, অন্যায্য ও বিপর্যয়ের কারণও মানুষ নিজেই। মানুষের ওপর মানুষের প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষাও প্রয়াশই যাবতীয় অশান্তি ও বিপর্যয়ের মূল কারণ। ব্যক্তি, গোষ্ঠী, রাষ্ট্র কিংবা জাতি ইত্যাকার বিভিন্ন নামে একদল মানুষ বরাবরই এ প্রয়াস চালিয়েছে এবং প্রভুত্ব অব্যাহত রেখেছে।

আল্লাহর মনোনীত একমাত্র দীন আল-ইসলাম। তাই মানবজীবনের এই মূল রোগেরই চিকিৎসা করেছে সর্বাগ্রে। মানুষের কাঁধের ওপর থেকে আল্লাহ ছাড়া আর সবকিছুর আধিপত্য-কর্তৃত্ব সরিয়ে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ব্যক্তি জীবনে এ ঘোষণার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে হয় ‘মুসলিম’ এবং সামষ্টিক জীবনে এ ঘোষণাকে কার্যকরী ও বাস্তবায়ন করার মধ্য দিয়েই কোনো সমাজ কিংবা রাষ্ট্রে সম্পন্ন হয় ইসলামী বিপ্লব। ইসলামী বিপ্লবের অন্তর্নিহিত চেতনা ও প্রেরণা তাই স্বাধীনতা- পূর্ণ স্বাধীনতা। মানুষের দাসত্বের নিগ্রহ থেকে মানবাত্মার মুক্তি ও স্বাধীনতা।

শয়তান ও তাগুতী শক্তির কাছে ইসলাম ও ইসলামী বিপ্লব তাই অসহ্য। নবীদের বেলায় এটি যেমন সত্য ছিল এবং যেমন সত্য ছিল শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জীবনে, তেমনি আজকের যুগেও। ইসলামী বিপ্লবকে যমদূতের মতোই ভয় পায় বিশ্বলুটেরা তথা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। মযলুম ব্যক্তি, গোষ্ঠী কিংবা জাতির ওপর দিয়ে দাম্ভিকতা প্রদর্শন তথা আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অবসান ঘটবে- এটি কিছুতেই মেনে নিতে পারে না শয়তানি শক্তিসমূহ। ইসলামী বিপ্লবের প্রতিরোধে এরা তাই এঁটেই চলে নিত্য নতুন ফন্দি ও ষড়যন্ত্র।

১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর থেকে নব প্রতিষ্ঠিত এ রাষ্ট্রটিকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ষড়যন্ত্র একের পর এক মোকাবিলা করেই পথ চলতে হয়েছে। বস্তুত ইরানে আজ অবধি ইসলামী বিপ্লবের স্থায়িত্ব ও তার অব্যাহত অগ্রযাত্রার ইতিহাস সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অযুত ষড়যন্ত্র মোকাবিলারই ইতিহাস। এ বিপ্লবকে ধ্বংস করার জন্য বিশ্বলুটেরা ও ক্ষমতাদর্পী শক্তিসমূহ তাদের পক্ষে অবলম্বন করার মতো কোনো উপায়ই বাকি রাখেনি। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীদের সকল হিসাব-নিকাশ ভুল প্রমাণ করে ইসলামী বিপ্লব আজো টিকে আছে এবং বিশ্বব্যাপী তার প্রভাব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের মধ্যে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কেন এবং কিভাবে তাদের মরণ সংবাদ প্রত্যক্ষ করে এবং এ বিপ্লবের বিরুদ্ধে তারা এ পর্যন্ত কি ধরনের ষড়যন্ত্র করেছে এবং এখনও ষড়যন্ত্রের জাল বুনেই চলছে, এ প্রবন্ধে এ সম্পর্কেই সামান্য আলোকপাত করা হয়েছে।

ইসলামী বিপ্লব ও নয়া বিশ্ব মানদণ্ড

ইরানের ইসলামী বিপ্লবের বিরুদ্ধে পরিচালিত সকল ষড়যন্ত্রের মূল কারণ এ বিপ্লবের বিশিষ্ট চরিত্র ও অনন্য বৈশিষ্ট্য। অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক সকল দিক থেকেই এর বৈশিষ্ট্য সুপ্রমাণিত। ব্যতিক্রমী কায়দায় এ বিপ্লব জন্মলাভ করে, ব্যতিক্রমী এর নেতৃত্ব এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থা এবং জন্মলগ্ন থেকেই এ বিপ্লব সর্ববৃহৎ পরাশক্তি থেকে শুরু করে বিশ্বের ছোট-বড়, ভৌগোলিক ও আঞ্চলিক সকল দাম্ভিক শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে বসে। ঐশী আদর্শে পুষ্ট ও সুশোভিত এ বিপ্লবের চরিত্র চিত্রণ করতে গিয়ে তাই প্রথমে পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রনীতিবিদ এবং সমাজ বিজ্ঞানীরা মহাসংকটে পড়ে। মার্কিন বিজ্ঞানী রবার্ট ডি. লী তাই তাঁর গবেষণায় উল্লেখ করেন : “The Islamic revolution appears rebellious and mysterious. Egalitarian yet not socialist or democratic, radical but seemingly traditional, xenophobic but scarcely isolationist, it does not mirror the French, the Russian or the American experience. Social scientific theories of modernization, whether Marxist or liberal-capitalist in inspiration, failed to anticipate the upheaval and have yet to explain it satisfactorily.’ (Robert D. Lee: Islamic Revolution and Authenticity) ।

যাই হোক, ইসলামী বিপ্লবের চরিত্র চিত্রণ করতে গিয়ে মার্কিন অ্যাকাডেমিক সার্কেলে মতপার্থক্য থাকলেও তাদের রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ব্যক্তিবর্গের একথা উপলব্ধি করতে বিলম্ব হয়নি যে, এ বিপ্লব কস্মিনকালেও তাদের অনুকূলে যাবে না। বরং এর শুরু ও বিকাশ, আহ্বান ও তৎপরতা এবং প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া সবটাই বিশ্বব্যাপী মার্কিন নীতি ও পরিকল্পনার মুখোমুখি প্রতিবাদ আর প্রতিরোধ। উল্লেখ্য, ১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের পর যুক্তরাষ্ট্র পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র ও শক্তিশালী অবস্থান হারায়। বিপ্লব-পূর্ব ইরানকে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের বৃহত্তম ঘাঁটি হিসাবে মনে করা হতো, কিন্তু ইসলামী বিপ্লবের পর যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলের বঞ্চিত-নিপীড়িতদের এক নম্বর শত্রু হিসাবে চিহ্নিত হয়। বিপ্লবের নেতৃত্ব জনগণকে এ ব্যাপারে সজাগ ও সতর্ক করে তোলে। ফলে আমেরিকান কার্টেল ও ট্রাষ্টগুলোর জাল থেকে বিশ্বের এক গুরুত্বপূর্ণ তেল অঞ্চল বেরিয়ে গেল; মার্কিনীরা হারালো আরো বহু স্বার্থ। এখানেই শেষ নয়। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি অল্প দিনের মধ্যেই টের পেল যে, ইরানের ইসলামী বিপ্লব শুধু ক্ষমতার হাতবদল নয়, অর্থাৎ পাশ্চাত্যশিক্ষিত টাই-স্যুট পরা ব্যক্তির স্থলে নিছক পাগড়ি ও আলখেল্লা পরিহিত ‘সনাতন’ ধর্মীয় মোল্লা শ্রেণির কর্তৃত্ব লাভই নয়; বরং এ বিপ্লবের রয়েছে আধ্যাত্মিক, দার্শনিক, মানবিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উপাদান; রয়েছে জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে নতুন মানদণ্ড ও উপলব্ধি। এ উপলব্ধি একজন ব্যক্তি মানুষকে ইন্দ্রিয়পরায়ণতা, ভোগবাদিতা, দুনিয়াপূজারি দাম্ভিক শক্তিসমূহের পদলেহনের ও সেবাবৃত্তির পরিবর্তে তাকে দান করে জীবন সম্পর্কে উন্নততর মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি, আধ্যাত্মিকতা, পরমুখাপেক্ষাহীনতা, নির্ভীকতা, স্বকীয়তা ও স্বাধীনতা। শয়তানি শক্তিকে ভয় করা কিংবা কুর্নিশ করা নয়, বরং তাকে ও তার সকল পৃষ্ঠপোষককে উৎখাত করার মন্ত্র শিখায় ইসলামী বিপ্লব। এ বিপ্লব আপোস করতে জানে না, প্রতিরোধ করতেই ভালোবাসে, কুফ্র ও কুফ্রি শক্তিকে ছাড় দিতে জানে না, জানে কেবল কুফ্রি শক্তির সাথে সরাসরি লড়াই করতে এবং জেহাদের ঝাণ্ডা সর্বক্ষণ সমুন্নত রাখতে। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের মহান নেতা, বর্তমান দুনিয়ার বিস্ময় ইমাম খোমেইনী (রহ.) শুরু থেকেই সমস্ত মুসলমান এবং বিশ্বের নির্যাতিত জনগণকে আহ্বান জানাতে থাকেন তারা যেন সাম্রাজ্যবাদের অক্টোপাশ থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করার জন্য সচেষ্ট হয় এবং যেসব সরকার ও শাসকগোষ্ঠী জনগণের কষ্টার্জিত পরিশ্রমের ফসল বিশ্বলুটেরার হাতে তুলে দেয় সেসব দুষ্কৃতকারী নাপাক শাসকগোষ্ঠীকে যেন দেশ থেকে বহিষ্কার করে। তিনি বলেন : ‘ইসলামের বিধান হচ্ছে কেউ তোমার ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করবে না, তুমিও কাউকে তোমার ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে দিবে না।’ ইমাম খোমেইনী সবাইকে ইসলামের গৌরবময় পতাকাতলে সমবেত হয়ে ইসলামের দুশমনদের বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়াতে এবং ইসলামী সরকার কায়েম করে দেশে দেশে স্বাধীন সার্বভৌম ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে যাবার আহ্বান জানান। তারপর ‘প্রাচ্য নয়, পাশ্চাত্য নয়- ইসলাম, কেবল ইসলাম’- এর নীতিকে ঘোষণা করেন ইসলামী রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম মূল স্তম্ভ হিসাবে। ফলত ইসলামী বিপ্লব তার এ নয়া বিশ্বমানদণ্ড নিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে পার্শ্ববতী মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোসহ দুনিয়ার বিভিন্ন অংশের রাষ্ট্র ও জনপদকে। শংকিত হয়ে ওঠে সাম্রাজ্যবাদ ও তার তাঁবেদার রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানগণ।

বস্তুত ইসলামী বিপ্লবের এসব বৈশিষ্ট্যের কারণেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাছে তা হয়ে দাঁড়ায় চক্ষুশূল। ইরানের ইসলামী বিপ্লবকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়ার জন্য এ কারণেই শুরু হয় চক্রান্ত। বিপ্লবোত্তর দিনগুলোতে ইসলামী ইরানকে ঘরে ও বাইরে এতসব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হয় যে, এ বিপ্লবের অস্তিত্ব টিকে থাকা সত্যিই এক বিস্ময়কর ব্যাপার। খোদায়ী এ নেয়ামতকে স্বয়ং খোদা তাআলাই হেফাজত করেছেন। পরীক্ষা নিয়েছেন এ বিপ্লবের সংগঠকদের ও এর অনুরক্তদের। ইরানীরা সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষা আর শাহাদাতের নজরানা পেশ করে টিকিয়ে রেখেছেন ইসলামী বিপ্লব নামক চারাগাছটিকে। শাহাদাতের রক্ত থেকে রস সিঞ্চন করেই বিপ্লবের এ চারাগাছটি বেড়ে উঠেছে, সুশোভিত হয়েছে। বিপ্লবোত্তর কালে ইসলামী ইরানের বিরুদ্ধে বিশ্বকুফ্র কী কী ষড়যন্ত্র প্লট তৈরি করে এবং কী কী ষড়যন্ত্র সে বাস্তবায়নের সুযোগ পায় এবারে সেসব নিয়ে আমরা সামান্য আলোচনায় যাব।

বিপ্লবোত্তর ইরান : প্রধান প্রধান ষড়যন্ত্র

বিপ্লবের বিজয়ের পর সাম্রাজ্যবাদী শক্তি প্রথমে চেষ্টা চালায় সন্ত্রাস, অন্তর্ঘাতী তৎপরতা, প্রতিবিপ্লবী শক্তিকে মদদ দান ও গুপ্তহত্যার মাধ্যমে বিপ্লবকে নিশ্চিত করা কিংবা অস্থিতিশীল করে তোলার জন্য। বস্তুত বিপ্লবের বিজয়ের অল্প সময়ের মধ্যেই ইরানের অভ্যন্তরে মার্কিন চররা সন্ত্রাসবাদী কাজ শুরু করে। শহরের রাস্তায় রাতের আঁধারে তারা বহু বিপ্লবী রক্ষী খুন করে। তারপর বিপ্লবের প্রথম সারির নেতাদের খুন করার এক মাস্টার প্লান নিয়ে তারা একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে চলে। ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের মাত্র দু’মাস পরে ইসলামী প্রজাতন্ত্র সশস্ত্র বাহিনীর প্রথম চীফ অব স্টাফ লে. জে. কারানী খুনীদের প্রথম লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন। তাঁর মৃত্যুর পর প্রখ্যাত জ্ঞানবিশারদ আয়াতুল্লাহ মোতাহহারীকে শহীদ করা হয়। শহীদ মোতাহহারী ছিলেন বিপ্লবী পরিষদের প্রধান এবং জ্ঞানরাজ্যের অনন্য দিকপাল। তাঁর হত্যাই প্রমাণ করে দেয়, ইসলামী বিপ্লবী চিন্তাধারা বিপ্লবের শত্রুদেরকে কতটা আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছিল। ড. বেহেশতী, রাজাই, বাহোনার, মোফাত্তেহ, আল্লামা তাবাতাবাঈ- এর মতো প্রত্যেক ব্যক্তিত্বই শাহাদাতপ্রাপ্ত হন কুফ্‌রি শক্তির টার্গেট হয়ে। হাশেমী রাফসানজানী ও আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীর প্রাণনাশেরও চেষ্টা চলে। তাছাড়া নেতৃত্বে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা তথা উপদল সৃষ্টি, নেতৃত্ব সম্পর্কে সন্দেহ সৃষ্টির অপপ্রয়াসও কম চলেনি। এসব চক্রান্ত রূপায়িত হয়ে তা ইসলামী বিপ্লবের জন্য শোচনীয় পরিণতি বয়ে আনতে পারত। বিপ্লবের সেবায় নিয়োজিত নেতাদের বদনাম করার মাধ্যমে নেতৃত্বে ভাঙন ধরলে তা বিপ্লবকে এতই দুর্বল করত যে, বিশ্বনিপীড়কদের ইরানে প্রত্যাবর্তনের পথ হতো প্রশস্ত। কিন্তু জনতার সচেতনতা এবং নেতৃত্বের সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে এসব চক্রান্ত ব্যর্থ হয়।

এখানেই শেষ নয়। ষড়যন্ত্রকারীরা বিভিন্ন সীমান্তবর্তী এলাকায় ষড়যন্ত্র করে, চক্রান্ত করে সরকারি দফতরগুলোতে ও সেনাবাহিনীতে। চরমপন্থী বাম সংগঠনসমূহ ও পূর্বতন শাসকগোষ্ঠীর সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন চক্রের মাধ্যমে সংঘাত বাঁধায়। বিরোধ সৃষ্টি করে বিভিন্ন ধর্ম ও জাতিসত্তার ছদ্মাবরণে। জাতীয় শিল্পব্যবস্থা ভণ্ডুল করার জন্য কল-কারখানায় উসকে দেয় ধর্মঘট। কৃষি উৎপাদন বন্ধ করার উদ্দেশ্যে কৃষি ক্ষেত্রে সৃষ্টি করে বিশৃঙ্খলা। ইরানের বিরুদ্ধে শুরু করে অর্থনৈতিক অবরোধ। অপপ্রচার, গুজব ও মিথ্যাচারের সয়লাব বইয়ে দেয়া হয় দুনিয়াময়। বিশ্ব থেকে ইরানের ইসলামী বিপ্লবকে বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যেই এসব চালিত হয়েছিল।

তারপর ইসলামী বিপ্লবের অন্যতম সহায়ক স্তম্ভ ইমামের অনুসারী বিপ্লবী ছাত্রবৃন্দ যখন তেহরানের মার্কিন দূতাবাস (আসলে গোয়েন্দা আখড়া বা স্পাই সেন্টার) ঘেরাও করল, তখন সাম্রাজ্যবাদী-ইহুদিবাদী প্রচার মাধ্যমসমূহ প্রচারণা শুরু করল যে, ‘গোয়েন্দা আস্তানা’ দখলের বিপ্লবী কাজটি বেআইনি এবং তা সকল আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। কিন্তু তারা একথার জবাব কখনই দেয়নি যে, কোনো দূতাবাসে গুপ্তচরবৃত্তি ও সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের সরঞ্জাম আইনসিদ্ধ কিনা। উল্লেখ্য, তাদের প্রচারণার মুখে ইরানকে নতজানু করতে ব্যর্থ হয়ে আমেরিকা ১৯৭৯ সালের ১২ ডিসেম্বর ইরানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ জারি করে এবং ১৯৮০ সালের ৩০ এপ্রিল আন্তর্জাতিক ব্যাংকসমূহে ইরানী সম্পদ আটক করে। এসব ষড়যন্ত্রেও ইরান নতজানু না হওয়ায় আমেরিকা সরাসরি হস্তক্ষেপের পথ ধরে।

১৯৮০ সালের ২৫ এপ্রিল ৩ হাজার কমান্ডো, মোটর সাইকেল, সামরিক জীপগাড়ি, প্রচুর গ্রেনেড, কামান ও মেশিনগান নিয়ে ১৮টি পরিবহন বিমান ও ২০টি হেলিকপ্টার লুকিয়ে ইরানের আকাশসীমায় প্রবেশ করে এবং খোরাসান প্রদেশের তাবাস শহরের কাছে এক মরুভূমিতে অবতরণ করে। স্পাই সেন্টারে আটক কূটনীতিক নামধারী ক্রিমিন্যালদের উদ্ধার এবং পাহাড়াদার মুজাহিদ ছাত্রদেরকে খুন করাই ছিল এ অভিযানের উদ্দেশ্য। কিন্তু আল্লাহপাকের কী মহিমা! কী তাঁর গায়েবী সাহায্য! এক অপ্রত্যাশিত ঘটনার ফলে মার্কিন ক্রুরা কাজ করতে অক্ষম হয়ে পড়ে এবং বিমান ও হেলিকপ্টারগুলো দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। ফলত তাদেরকে তাবাস মরুভূমিতে ৬টি হেলিকপ্টার, একটি বিমান, কয়েকটি জীপ, ৬টি মোটর সাইকেল, ৩০ হাজার ফাটানো গ্রেনেড এবং কয়েকজন অগ্নিদগ্ধ আমেরিকান কমান্ডোর লাশ ফেলে ইরান ত্যাগ করতে হয়। প্রসঙ্গত সূরা ফীলে কুরআনের ভাষ্যে অনুরূপ এক ঘটনার কথা স্মরণ করা যেতে পারে। ইসলাম আগমনের পূর্ব সময়ের আরবে হস্তিসজ্জিত এক বিশাল বাহিনী পবিত্র কাবা ধ্বংস করতে আসে। তারা মক্কা আক্রমণ করে। কিন্তু ঐ বাহিনীর সকলেই খুব উঁচু থেকে অসংখ্য ছোট ছোট পাখির ফেলা ক্ষুদ্র প্রস্তর খণ্ডে ধ্বংস হয়। ইরানী জাতি দেখল, আল্লাহর ইচ্ছায় তাবাস মরুভূমিতে বালুকণা বাতাসে উড়তে থাকে, এতে অন্ধ হয়ে পড়ে শত্রু ও তার হেলিকপ্টারগুলো।

একদল প্রতারিত সেনা ও পলাতক চরের সাহায্যে ইসলামী সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটানোই ছিল ইরানের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদীদের পরবর্তী চক্রান্ত। এ দায়িত্ব বখতিয়ারের ওপর অর্পণ করে আমেরিকা সরকার। প্রয়োজনীয় সবকিছুর সরবরাহও করা হয়। কিন্তু আল্লাহপাক ইসলামী বিপ্লবকে হেফাজত করেছেন। ইসলামী বিপ্লবী রক্ষীবাহিনী ১৯৮০ সালের ৯ জুলাই রাতে অভ্যুত্থান শুরু হওয়ার কয়েক মিনিট আগে চক্রান্ত সংশ্লিষ্ট চরদের গ্রেফতার করে। এ অভ্যুত্থান পরিকল্পনায় অভ্যুত্থানের উদ্যোক্তারা তেহরান ও কোমে, বিশেষত ইমাম খোমেইনীর বাড়িতে এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে বোমা  বর্ষণের পরিকল্পনা করেছিল। এসব গুরুত্বপূর্ণ স্থানের মধ্যে ছিল মজলিস ও বিপ্লবী রক্ষী কেন্দ্রসমূহের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলো।

এতসব কেলেংকারিজনক প্রচেষ্টা ও পরাজয়ের পর আমেরিকা ইরানে একটি উদারনৈতিক (অন্য কথায় মার্কিনীদের অনুগত) সরকার গঠনের আশা পোষণ করতে থাকে। বনি সদরকে দিয়েই তারা এ লক্ষ্য হাসিল করতে চেয়েছিল। সত্যি বলতে কি Bani Sadar Phenomenon ছিল মার্কিনী Super Conspiracy-এর একটি দৃষ্টান্ত। কত সূক্ষ্ম যে হয় মার্কিনী চাল, কত বহুমুখী তাদের কূটকৌশল- এ ঘটনা থেকেই তার প্রমাণ মেলে। দুনিয়ার দেশে দেশে তারা সরকার ও সরকারবিরোধী উভয় মহলেই লোক নিয়োজিত রাখার চেষ্টা করে। প্রয়োজনমতো উপযুক্ত ব্যক্তিকে ব্যবহার করে উদ্দেশ্য হাসিল করে থাকে। কিন্তু বনি সদর, কুতুবযাদেহকে দিয়ে মার্কিনীরা যা করতে চেয়েছিল তা বেশিদূর এগুতে পারেনি। ইসলামী বিপ্লবকে বিচ্যুত করা ও ইরানের নির্বাহী ব্যবস্থার উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গকে ভর করে ইরানে আমেরিকা সরকারের পুনঃপ্রবেশের সকল পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। তেহরানে আমেরিকান গোয়েন্দা আস্তানা থেকে উদ্ঘাটিত দলিল-দস্তাবেজ থেকে সব ষড়যন্ত্র প্রকাশ হয়ে পড়ে। বনি সদর ও তার সহযোগীদের পদচ্যুতি ঘটে। বিশ্বাসঘাতকতার উপযোগী শাস্তি তাদেরকে পেতে হয় অল্প সময়ের মধ্যেই। মুজাহেদীনে খালক-এর ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করা হয়, কোথাও কোথাও পূর্বাহ্নেই ফাঁস হয়ে পড়ায় প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করা হয়।

১৯৮২ সালের এপ্রিলে ইরানী সেনাবাহিনীর ইসলামী বিপ্লবী আদালত ইসলামী প্রজাতন্ত্রী ব্যবস্থা উৎখাতের লক্ষ্যে পরিচালিত আরেকটি বড় ধরনের ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটন করে। এ ষড়যন্ত্রের প্রধান পরিচালক ছিল সাদেক কুতুবযাদেহ। গ্রেফতারের পরে টেলিভিশনে এক সাক্ষাৎকারে কুতুবযাদেহ স্বীকার করে যে, তার সন্ত্রাসবাদী সাংগঠনিক ব্যবস্থা ইমাম খোমেইনী, সর্বোচ্চ প্রতিরক্ষা পরিষদের সদস্যবর্গকে (প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট ও সর্বোচ্চ প্রতিরক্ষা পরিষদের সভাপতি আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী, ইসলামী মজলিস শুরার স্পীকার ও সর্বোচ্চ প্রতিরক্ষা পরিষদে ইমামের তৎকালীন প্রতিনিধি হুজ্জাতুল ইসলাম হাশেমী রাফসানজানীসহ) হত্যা করার মতলব আঁটে। ইমাম খোমেইনীর বাড়িতে বোমা বিস্ফোরণ ও জামারানে গোলাবর্ষণ করে এটা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সাম্রাজ্যবাদের ঘাপটি মেরে বসে থাকা চররা এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারলে ইমাম খোমেইনী ও সর্বোচ্চ প্রতিরক্ষা পরিষদের সদস্যবর্গ ছাড়াও জামারানের দশ সহস্রাধিক লোক সে সময়ে মারা যেত। আল্লাহ পাকের অসীম রহমতে ষড়যন্ত্র পূর্বাহ্নেই ফাঁস হয়ে যায় তাদেরই লোকের মাধ্যমে।

এভাবে একের পর এক ষড়যন্ত্র ও আঘাতের ধারা অব্যাহত রাখার এক পর্যায়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইরাককে দিয়ে ইসলামী ইরানের ওপর একতরফাভাবে চাপিয়ে দেয় এক আকস্মিক ও সর্বাত্মক যুদ্ধ। যুদ্ধ শুরুর সাথে সাথে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দাম্ভিক পরাশক্তি ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলো অনেকটা প্রকাশ্যেই ইরাককে সমর্থন করে এবং অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করতে থাকে। আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ এ সময় নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। তারা ইরাকের এ হামলা বন্ধের জন্য কোনো প্রচেষ্টাই চালায়নি। ফলে হামলাকারীরা একেবারেই বাঁধাহীন থেকে গেছে। ইরাকের বিরুদ্ধে তখন কোন অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হয়নি এবং ইরানী ভূখণ্ড ও সীমান্ত থেকে ইরাকী বাহিনীর নিঃশর্ত প্রত্যাহার দাবিও কেউ তোলেনি। উপরন্তু বিভিন্ন উপলক্ষে বিভিন্ন মহল থেকে ইরাকী আগ্রাসনের শিকার ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধেই কথা বলা হয়েছে।

উল্লেখ্য, এ ছিল এমন এক সময় যখন ইরানী সশস্ত্র বাহিনী যুদ্ধের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না। ইরানী সৈন্যরা ছিল অসংগঠিত। সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে ধর্মঘট, বিভিন্ন বিষয়ে অস্পষ্টতা, সংঘাত ও নানারকম অস্থিতিশীলতা ছিল, সামরিক শৃঙ্খলার মারাত্মক অবনতি ঘটেছিল। তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত অর্থনৈতিক অবরোধের ফলে সমরাস্ত্রের খুচরা যন্ত্রাংশের ঘাটতি দেখা দেয়। বিদেশী সামরিক বিশেষজ্ঞদের বরখাস্ত করার পাশাপাশি বিরাজিত বিশৃঙ্খলা প্রকৃতপক্ষে সর্বক্ষেত্রে একটি সামগ্রিক স্থবিরতার সৃষ্টি করে। সে সময় ইরানী বাহিনীর পক্ষে প্রকৃত অর্থে কোন প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রদর্শন করা ছিল একেবারেই অকল্পনীয় ও অপ্রত্যাশিত। কুফ্্রি শক্তির মদদপুষ্ট হয়ে সাদ্দাম হোসেন এ সময়টিকেই ইরানের ওপর হামলার জন্য বেছে নেয়।

হামলার সূচনাকালে ইরাকীরা কিছুটা সাফল্য অর্জন করলেও অল্প সময়ের ব্যবধানে এ যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। ইরান ‘আত্মরক্ষার’ (Defensive) পর্যায় থেকে নিজেদেরকে সামনে নিয়ে ‘আক্রমণাত্মক’ (offensive) পর্যায়ে চলে আসে। আর তখনি শত্রুদের অশুভ উদ্দেশ্য আরো পরিষ্কার হয়ে ওঠে। ইহুদি, সোভিয়েত প্রতিক্রিয়াশীলরা সে সময় শান্তি প্রতিষ্ঠার দাবি জানায় এবং একই সাথে ইরানের বিরুদ্ধে ইরাককে সাহায্য জোরদার করে। এ সময় পারস্য উপসাগর দিয়ে উড়ে যাওয়াকালে ইরানী যাত্রীবাহী বিমানের ওপর হামলা করা হয়, ইরানের আবাসিক এলাকায় বোমা বর্ষণ করা হয় এবং ইরানের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করা হয়। ইরাকী বাহিনী এক পর্যায়ে পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন করে এবং পারস্য উপসাগর ও ওমান উপসাগরে বিদেশী সৈন্যের উপস্থিতি দেখা দেয়। এক পর্যায়ে শান্তির স্বার্থেই জাতিসংঘের ৫৯৮ নং প্রস্তাব মেনে নিয়ে ইরান তাতে স্বাক্ষর করে। ১৯৯০ সালের এপ্রিল মাসে ইরাকী প্রেসিডেন্টের তরফ থেকে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের নেতা ও প্রেসিডেন্টকে উদ্দেশ্য করে একটি চিঠি পাঠানো হয়। এ চিঠির প্রেক্ষিত ইরাক ও ইরানের মধ্যে বেশ কিছু পত্র বিনিময় হয়। এক পর্যায়ে ইরাকী প্রেসিডেন্ট একতরফাভাবে ইরানের সাথে বিরোধ অবসানের কথা ঘোষণা করেন।

সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হলো, ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে ইরাকের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও ইরান প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের গোলামি হতে তার বিপ্লব ও স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখতে সক্ষম হয়েছে। ইরানের ইসলামী বিপ্লব এ কারণে আজো বিশ্বের মযলুম মানুষকে মুক্তির হাতছানি দিয়ে ডাকতে সক্ষম হচ্ছে। আমরা আগেই উল্লেখ করেছি যে, ইরানের ইসলামী বিপ্লব নিম্নোক্ত বিষয়সমূহের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ : স্বৈরতন্ত্র, উপনিবেশবাদ ও ইহুদিদের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে এগিয়ে নেয়া; সকল বঞ্চিত ও নিপীড়িত জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা, তাদেরকে আশা দান করা এবং তাদের সকলকে সংগ্রামে সমবেত করা, যুলুম ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে সকলের দায়িত্ব হিসাবে গণ্য করা, এক্ষেত্রে নীরবতা বা নির্লিপ্ততাকে বিশ্বাসঘাতক মনোভাব হিসাবে বিবেচনা করা; জনগণের মধ্যে জিহাদের ও সংগ্রামের উদ্দীপনা সঞ্চার করা, উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে বিশেষ করে সকল জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য দুনিয়া জুড়ে শক্তি সৃষ্টি করা। ইরান ইসলামী বিপ্লবী মতাদর্শ হিসাবে মনে করে যে, নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও বঞ্চিতকে রক্ষা করা ধর্মীয় ও মানবিক দায়িত্ব। তাই এ বিপ্লবের প্রতি দাম্ভিক অপশক্তির ষড়যন্ত্র আর আক্রমণেরও শেষ নেই।

ষড়যন্ত্রের তালিকায় সাম্প্রতিক সংযোজন

সাম্প্রতিককালে সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার মুরুব্বি সোভিয়েত ইউনিয়নে ও তার পক্ষপুটে আশ্রিত পূর্ব ইউরোপীয় দেশসমূহে সমাজতন্ত্রের পতন এবং সোভিয়েত সাম্রাজ্যের বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর স্নায়ুযুদ্ধের ঘটে অবসান। কিন্তু এ প্রেক্ষাপেট মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তার নয়া ‘বিশ্বব্যবস্থার’ ছদ্মাবরণে দুনিয়াময় একক আধিপত্য বিস্তারে সচেষ্ট হয়ে উঠেছে। কমিউনিজমের পতনের পর যুক্তরাষ্ট্র ইসলামী পুনরুজ্জীবন আন্দোলনসমূহকে বিশেষ করে ইরানের ইসলামী বিপ্লবকে টার্গেট করে ষড়যন্ত্রের নতুন জাল বুনে চলছে। উত্তেজনা সৃষ্টি করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের জন্য নতুন নতুন  ইস্যু তৈরি করছে পারস্য উপসাগরীয় এলাকায়। আবিষ্কার করছে আগ্রাসনের নতুন নতুন প্লট।

বস্তুত ইরানের ইসলামী বিপ্লবের অব্যাহত অগ্রযাত্রা, নবতর শক্তি হিসাবে তার অভ্যুদয়ে কুফ্রি শক্তি আরো বেশি বিচলিত হয়েছে। ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ষড়যন্ত্রের তালিকায় তাই নতুন সংযোজন হচ্ছে আবু মুসা দ্বীপ। বিশ্বকুফ্‌রি শক্তি ইরানের সাথে আরব আমীরাত ও অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের বিরোধ উসকে দেয়ার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে। উল্লেখ্য, পারস্য উপসাগরের আবু মুসা দ্বীপটির কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে যথেষ্ট এবং ঐতিহাসিকভাবে এটি ইরানী ভূখণ্ডের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ১৯৭১ সালের একটি চুক্তিতে আবু মুসা দ্বীপের ওপর ইরানের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করা হয় এবং সেখানেকার নিরাপত্তা রক্ষায় ইরানের ওপর দায়িত্ব অর্পিত হয়। চুক্তিতে বলা হয়, কেবল প্রশাসন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও তেল আহরণের কাজ ইরান ও সংযুক্ত আরব আমীরাত যৌথভাবে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করবে। দ্বীপটিতে কারো অনুপ্রবেশজনিত অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার হুমকি মোকাবিলা করার লক্ষ্যে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। অবশ্য ইরানের এ উদ্যোগকে প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রগুলো ভিন্নভাবে দেখছে এবং এ নিয়ে ইরান ও সংযুক্ত আরব আমীরাতের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। এরই সুযোগ নিতে চাচ্ছে পশ্চিমা শক্তিবর্গ যারা প্রতিবেশীদের সাথে ইরানের সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটুক- এটা মেনে নিতে পারে না এবং চায় পারস্য উপসাগরে উত্তেজনা লেগে থাকুক যাতে তাদের নাক গলাবার সুযোগ ঘটে এবং হস্তক্ষেপও করতে পারে। আবু মুসা দ্বীপ প্রসঙ্গে তারা আরব নেতৃবৃন্দকে এ কথা বুঝানোর চেষ্টা করে থাকে যে, ইরান আরব দেশগুলোর জন্য হুমকিস্বরূপ। এ বিরোধের সাথে জড়িত পক্ষগুলোর যেখানে করণীয় হচ্ছে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যাটির শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং নিজেদের সম্পর্কের উন্নয়নে প্রয়াস চালানো, সেখানে আবু মুসা দ্বীপের ওপর ইরানের সার্বভৌমত্ব নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে এবং আরব লীগ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলন ও উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের বৈঠকে সংযুক্ত আরব আমীরাতের দখলিস্বত্বের পক্ষে একতরফা প্রস্তাব উত্থাপন এবং ইরানকে আবু মুসাসহ তিনটি দ্বীপ থেকে সরে পড়ার আহ্বান পরিস্থিতিকে জটিলতর করারই ইঙ্গিতবহ। নিকট অতীতের ইতিহাস যেখানে সুস্পষ্ট সাক্ষী হয়ে রয়েছে, এ অঞ্চলের প্রতিবেশী মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর নিজেদের বিরোধ এদের কারো জন্যই ক্ষতি বই কল্যাণ বয়ে আনে না।  লাভবান হয় কেবল বাইরের ইন্ধনদাতা মতলববাজ পশ্চিমা কুফ্‌রি শক্তি।

সম্প্রতি ইরাকের দক্ষিণাঞ্চলে নিরাপত্তা অঞ্চল গঠনের পেছনেও রয়েছে মার্কিনী দুরভিসন্ধি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে যে, এ এলাকায় ইরাকের বামপন্থী সরকার কর্তৃক পাইকারি হারে শিয়াদের হত্যার পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকা এ পদক্ষেপ গ্রহণে তাড়িত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ব্যাপারটা ভিন্ন। বরং আমেরিকা তার নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির জন্যই এ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। উল্লেখ্য, ১৮ মাসেরও অধিককাল ধরে এ এলাকার জনগণ যখন বুলেট, বোমাসহ বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছিল তখন কিন্তু পশ্চিমা প্রচারমাধ্যমগুলো নীরব ভূমিকা পালন করে আসছিল। সম্প্রতি হঠাৎ করে তাদের মানবাধিকার চেতনা এতটা উপচে পড়ার কারণ কি? বোসনিয়া-হারজেগোভিনায় মুসলমানদের পর সার্বীয়দের দ্বারা নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ব্যাপারে মার্কিনীরা তৎপর হয় না কেন? ভারতে মুসলিম হত্যার ব্যাপারেও তো তাদেরকে কোনো উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায় নি? বরং উল্টো ভারতের সাথে মার্কিনীরা যৌথ সামরিক সহযোগিতা পাততে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। আসলে মার্কিনীদের ইরাকের দক্ষিণাঞ্চলে ‘নো ফ্লাই যোন’ গঠন করা এবং ইরাকের ওপর সাম্প্রতিক সামরিক অ্যাকশনে যাবার পেছনে যেসব মতলব কাজ করছে তা হচ্ছে :

১. ইসরাইলী সরকার কর্তৃক চার শতাধিক ফিলিস্তিনী অন্যায়ভাবে দেশ থেকে বহিষ্কার এবং নো-ম্যানস ল্যান্ডে তাদেরকে মানবেতর অবস্থায় ফেলে রাখা এবং বোসনিয়া-হারজেগোভিনায় মুসলিম হত্যা ও নারী নির্যাতনের পাশবিকতা অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও মার্কিনীদের কোনো কার্যকর ভূমিকা না থাকার ব্যাপারটাকে আড়াল করা।

২. সাদ্দামের পতনের পর সম্ভাব্য ক্ষমতার ভারসাম্য এবং এ এলাকায় আমেরিকা ও তার মিত্রদের স্বার্থ রক্ষার্থে সংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণের মন জয় করার প্রচেষ্টা।

৩. সাদ্দামের পতনকে আমেরিকা তার নিজস্ব স্ট্র্যাটেজির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে করে না এবং বিশ্ববিবেকের চাপের মুখে এবং  পারস্য উপসাগরীয় এলাকার শাসকদের সন্তুষ্টি অর্জন এবং সাদ্দামবিরোধী ইরাকীদের মন জয় করার একটা কৌশল হিসাবে গ্রহণ করেছে।

সত্যি বলতে কি, ঠিক এ মুহূর্তেই সাদ্দামের পতন আমেরিকা নিজেই চায় না। আমেরিকা বর্তমান যা কিছু করছে তা এক ধরনের নাটক। আমেরিকা আসলে যা চাচ্ছে তা হচ্ছে সাদ্দামের একটি বিকল্প ব্যক্তিত্বের সন্ধান। সম্ভবত সে এখনও তেমন ধরনের ব্যক্তিত্বের সন্ধান পায়নি। আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে তার জন্য অনুকূল এমন একটি সময়েই সাদ্দামের পতন হওয়া উচিত যাতে সে বিশ্ববাসীর  দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় যে, সে সাদ্দামের নির্যাতনের হাত থেকে ইরাকী জাতিকে রক্ষা করেছে এবং ভবিষ্যতে এ বিষয়কে সামনে রেখে ফায়দা লুটতে পারে। উত্তর ইরাকের পর দক্ষিণ ইরাকে নিরাপত্তা অঞ্চল গঠন ও সামরিক অ্যাকশনের পেছনে ইরাককে খণ্ডিত করা ও সমগ্র এলাকাকে একটি মারাত্মক পরিণতির সম্মুখীন করার পাঁয়তারা কাজ করছে।

কমিউনিস্ট শাসনের লৌহ প্রাচীর ভেঙে এবং সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক সাম্রাজ্যের পতনের মধ্য দিয়ে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত মুসলিম প্রজাতন্ত্রগুলো নিয়েও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি শুরু করেছে ষড়যন্ত্র। বস্তুত সাম্প্রতিককালে আজারবাইজান, কাজাকিস্তান, উজবেকিস্তান, কিরগিজিস্তান ও তুর্কমেনিস্তান প্রজাতন্ত্রগুলো স্বাধীনতা লাভ করলে এসব প্রজাতন্ত্রের মুসলমানগণ মস্কোর নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়ে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ধর্মীয় নীতি অনুসরণের সুযোগ পায়। উল্লেখ্য যে, এ অবস্থা কেবল মুসলিম প্রজাতন্ত্রগুলোর মধ্যেই সীমাবন্ধ থাকল না, বরং অন্যান্য স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্রও নিজেরা নিজেদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতে চাইল। এসব অঞ্চলে ইসলামী পুনর্জাগণের কিছু সম্ভাবনা সৃষ্টি হওয়ায় এবং ইসলামী বিপ্লবের অনুপ্রেরণায় কোনো কোনো রিপাবলিক কিছুটা এগিয়ে যাওয়ায় মৃতপ্রায় কমিউনিস্টরা সাম্রাজ্যবাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলামী শক্তির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বিশেষ করে তাজিকিস্তানে এ অপশক্তি যে তাণ্ডবলীলা ও অমানবিকতা প্রদর্শন করছে তার তুলনা কেবল বোসনিয়ায় সার্বীয় বাহিনীর পৈশাচিকতার সাথেই করা চলে। এখানে আরো একটি লক্ষণীয় বিষয় হলো যে, যে ইয়েলৎসিন রাশিয়ায় বসে কমিউনিস্টদের মোকাবিলা করেছেন তিনিই কিন্তু তাজিকিস্তানে নিজস্ব বাহিনী পাঠিয়ে কমিউনিস্টদেরকে সাহায্য করছেন মুসলিম হত্যাযজ্ঞে এবং ইসলামী পুনর্জাগরণ ঠেকাতে। ‘আল-কুফ্রু মিল্লাতুন ওয়াহিদাহ’ অর্থাৎ দুনিয়ার সকল কুফ্র আসলে একই মিল্লাত বা সম্প্রদায়- এর আরেক জ্বলন্ত উদাহরণ মুসলমানরা এখানে প্রত্যক্ষ করল। বস্তুত একই কারণে বিশ্বের আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও মধ্য এশিয়ার এ বর্বরতায় নিশ্চুপ। স্ট্যালিনীয় স্টাইলের বর্বরতাও তাদের ‘মানবাধিকার’ চেতনাকে স্পর্শ করে না।

ইসলাম, মুসলিম জাতি ও ইরানের ইসলামী বিপ্লবের বিরুদ্ধে পাশ্চ্যাত্যের আরেকটি ষড়যন্ত্র হচ্ছে ইসলামের মহান নবী (সা.)-এর ওপর অবমাননাকারী বিশ্ব নিন্দিত গ্রন্থ ‘দি স্যাটানিক ভার্সেস’- এর কুখ্যাত লেখক সালমান রুশদীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ রদ করার জন্য ইরানের ওপর চাপ প্রয়োগের ফন্দি-ফিকির। উল্লেখ্য, ইমাম খোমেইনী রুশদীর এ দণ্ড বিশ্বসমক্ষে ঘোষণা করেছিলেন। এ জন্য সাম্রাজ্যবাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এই কুখ্যাত লেখককে ব্রিটেনের বাইরে বিভিন্ন জায়গায় সফর করানো এবং বক্তৃতা দেয়ার ব্যবস্থা করেছে। রুশদীর এসব বক্তৃতার বিষয় একটাই। তা হলো ইরানের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা এবং কিছু মহল তার বক্তৃতা-বিবৃতি এমনভাবে প্রচারের ব্যবস্থা করেছে যাতে আসল বিষয়কে আড়াল করা যায়। শয়তান রুশদীর পক্ষে ওকালতিকারী সংবাদ মাধ্যমসমূহ যে বিষয়টি বেমালুম চেপে যায় তা হচ্ছে বিশ্বের একশ কোটি মুসলমানের বিশ্বাস ও আবেগ-উপলব্ধির ওপর শয়তান রুশদীর আঘাতের বিষয়টি। তারা এটিও উল্লেখ করেন না যে, এ নরাধম কর্তৃক মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসের ওপর  আঘাতের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের বহু মুসলমানকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। সাম্রাজ্যবাদের অনুচররা কেবল ইসলামী আইন অনুযায়ী ইমাম খোমেইনী কর্তৃক রুশদীর মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিষয়টি উল্লেখ করে এবং এহেন অভিমত পেশের চেষ্টা করে যে, এটি আন্তর্জাতিক আইনের সাথে সংগতিহীন। কি অপূর্ব তাদের কৌশল! মোট কথা, সাম্রাজ্যবাদের অনুচররা এবং তাদের প্রচারমাধ্যমসমূহ শয়তান রুশদীর ক্ষমাহীন অপরাধের প্রসঙ্গে না গিয়ে বরং এটিকে ইসলামী ইরানের ওপর চাপ সৃষ্টির কৌশল হিসাবে ব্যবহার করতে চাচ্ছে। তাদের ধারণা এর মাধ্যমেই ইউরোপীয় দেশসমূহের সাথে ইরানের সম্পর্ক সৃষ্টি ঠেকানো যাবে, ইরানকে কিছুটা ‘একঘরে’ করা যাবে। অথচ আজকে পাশ্চাত্যে যারা শয়তান রুশদীকে আদর আপ্যায়ন করছে, তার পক্ষে ওকালতিতে নামছে, তাদের এ কথা স্মরণ রাখা দরকার যে, এ শাস্তি যথোচিত যা এ নরাধমের প্রাপ্য এবং সারা মুসলিম দুনিয়া এ দণ্ডাদেশের পক্ষে রায় ঘোষণা করেছে। কাজেই যে পথে উপরিউক্ত মহল পা বাড়িয়েছে তাতে এ উদ্দেশ্য সফল হবে না যে, মুরতাদ রুশদীর দণ্ড মওকুফ হবে কোনোদিন। তবে পাশ্চাত্য ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অন্য কোনো মতলব হয়তো হাসিল করতে পারে, তা হচ্ছে ইসলামী ইরানের সাথে বিরোধিতাকে নবরূপ দেয়া, চাঙ্গা করা এবং আনুষঙ্গিক কিছু জটিলতা সৃষ্টি করা। এতে আর বিস্মিত হবারই কি আছে। নব্য ক্রুসেড তো ইউরোপীয়রা অনেক জায়গায়ই শুরু করে দিয়েছে, এটি হয়তো তার সাথে নবতর সংযোজন হবে।

সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার আসনে নতুন ব্যক্তি সমাসীন হয়েছেন। তৃতীয় বিশ্বের অতি উৎসাহী এবং সঠিক তথ্য সম্পর্কে অনবগত কিছু ব্যক্তি নির্বাচনের পূর্বে যা-ই আশাবাদ ব্যক্ত করে থাকুন না কেন নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় গিয়ে শুরুতেই জানিয়ে দিয়েছেন যে, “…The Leadership of America changes, but the policies do not.” ‘পলিসি’ বলতে এখানে বিল ক্লিনটন মৌলিক পলিসির কথাই বুঝিয়েছেন। একেবারেই সত্য কথা। তবে হ্যাঁ, পরিবর্তন যদি সামান্য হয়ও তা হবে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকে আরো তীব্রতর করার লক্ষ্যেই। কৌশলগত পদক্ষেপে নতুন নতুন মাত্রা সংযোজন করা হবে হয়ত। তারই পূর্বাভাষ পাওয়া যায় পাশ্চাত্যেরই সংবাদমাধ্যম রয়টার্স পরিবেশিত খবরে। তাতে বলা হয়েছে : ‘বিল ক্লিনটন প্রেসিডেন্ট হবার পর মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিন কৌশলগত অবস্থান ইরাকের থেকে ইরানের দিকে পরিবর্তিত হতে পারে। ইরাকের বিরুদ্ধে মার্কিন পদক্ষেপ অধিকাংশ আরব সন্তুষ্ট নয়। তারা মনে করে আরবের আধুনিকপন্থী ও মার্কিন মিত্রদের (তাঁবেদার) ভবিষ্যতের জন্য ক্রমবর্ধমান সমস্যা হচ্ছে ইরানী ধাঁচের ইসলামী শক্তি।’ এ পর্যবেক্ষণ পরিষ্কার করে দিচ্ছে আমাদের পূর্বের আলোচনার সারবত্তাকে। সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের প্রশাসনের শেষ সময়কার বক্তৃতা-বিবৃতি থেকেও আভাষ পাওয়া যাচ্ছিল মার্কিনীরা ইরানের বিরুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে পড়ার পথ খুঁজছে। ইরান অস্ত্র কিনছে, ইরান পারমাণবিক সরঞ্জামাদি কিনছে ও তৈরি করছে ইত্যাকার অভিযোগ বুশ প্রশাসনের নিত্যদিনকার বুলিতে পরিণত হচ্ছিল। অথচ ইসরাইলের অস্ত্র কেনা ও পারমাণবিক ক্ষমতায় মার্কিনীরা কোনো দোষ খুঁজে পায়  না।

বস্তুত ইরানের ইসলামী বিপ্লব ও তার অব্যাহত অগ্রযাত্রা ইরানের সমৃদ্ধি ও প্রভাব সারা দুনিয়ার সামনে আজকে একটি জ্বলন্ত বাস্তবতা। এ বিপ্লব দুনিয়ার সামনে এমন এক দর্শন উপস্থাপন করেছে, দুনিয়াকে এমন এক পথ দেখিয়েছে যা বিশ্বশোষক ও লুটেরাদের হাত থেকে মযলুম মানবতাকে মুক্তির সন্ধান দিতে পারে। বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে যেখানেই নিপীড়িত মানুষের ক্রন্দন শোনা যায়, সেখানেই ইসলামী বিপ্লবের আহ্বান পৌঁছে, ইসলামী প্রজাতন্ত্র সেখানেই সাহায্যের হাত প্রসারিত করে। এই বিশেষ কারণটির জন্যই বিশ্বসাম্রাজ্যবাদ ইসলামী বিপ্লবের প্রতি খড়গহস্ত। তারা ভালো করেই জানে যে, ইসলামী প্রজাতন্ত্রের অগ্রযাত্রার মধ্যেই নিহিত রয়েছে সাম্রাজ্যবাদী কুফ্‌রি শক্তির মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনি। ইসলামী বিপ্লব সম্প্রসারণের মধ্যেই রয়েছে বিশ্বের সকল যালেম শক্তির প্রতি লেজ গুটিয়ে সরে পড়বার নির্দেশনামা। তাইতো মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগরীয় অঞ্চলের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকচক্রের চোখের ঘুমও উধাও হয়েছে। তাদের মসনদ হাতছাড়া হবার ভয়ে তারা শঙ্কিত এবং সাহায্যের আশায় আরো বেশি করে সাম্রাজ্যবাদের পদযুগল চুম্বন করছে। এ কথা আজ দিবালোকের মতোই পরিষ্কার যে, শুধু মধ্যপাচ্যে নয়, দুনিয়ার দেশে দেশে মুসলমানদের নিদ্রাভঙের জন্য ইরানের ইসলামী বিপ্লব আজানের কাজ করেছে। এ আওয়াজকে স্তব্ধ করে এ শক্তি কারো নেই। এ বিপ্লব মযলুম মানবতার জন্য মুক্তি ও স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনবে- এটি কেবল আজকের প্রত্যাশা নয়, এ আমাদের প্রত্যয়। বিশ্বের তাবৎ যালেমের ওপর আমরা মযলুমদের বিজয়ের প্রহরই গুণছি।

(নিউজলেটার, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৩)


ইসলামী বিপ্লব সম্পর্কে আন্তর্জাতিক ব্যক্তি

হুজ্জাতুল ইসলাম বাকের আনসারী

‘ইসলামী বিপ্লব সফল হওয়ার আগে না মুসলিম আর না বিশ্বদাম্ভিকরা কল্পনা করত যে, আধুনিক বিশ্বে আবার ইসলামের পুনর্জাগরণ হবে। আজ সন্দেহাতীতভাবে এ কথা সত্য যে, এ ইসলামী বিপ্লব বঞ্চিত মানবতার মাঝে ও ইসলামী বিশ্বে এক ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। আর এই বিপ্লবের রয়েছে এক নজিরবিহীন সাংস্কৃতিক ভিত্তি।

ড. হামিদ আলগার

এ বিপ্লব বর্তমান শতাব্দীর অন্যান্য বিপ্লব থেকে স্বতন্ত্র, কেননা, ইতিহাসের গভীরে এর শিকড় প্রোথিত। ইরানীদের আবশ্যকীয় ও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির সাথে সাথে আকস্মিক কোন পরিবর্তন এটা নয়; বরং এ ছিল সুদীর্ঘ বহু বছরের রাজনৈতিক, আধ্যাত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের একটি অব্যাহত প্রয়াসের ফলশ্রুতি।…

আমাদের ঘাড়ে চেপে বসা রাজনৈতিক ভূতের দৃষ্টিভঙ্গিতে আলেম সমাজকে বিচার করা হলে সত্যের অপলাপ হবে। মনে রাখতে হবে যে, আলেমগণ শুধু শিয়া মাযহাব বা ইরানেই নয় বরং সারা দুনিয়াতে ঐতিহ্যবাহী ইসলামী শিক্ষা ও আচারের এক বিশেষ দিকের সংরক্ষণ ও প্রসারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। এটাই শেষ পর্যন্ত সমগ্র সমাজ ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রেরণার উৎসে পরিণত হয়। আমরা যদি ইরানের শিয়া মাযহাবের বিশেষ দিকের প্রতি তাকাই তাহলে দেখতে পাব যে, ষোড়শ শতকের সাফাভী আমল থেকেই আলেমগণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পড়াশুনা ও জ্ঞানচর্চা করেছেন। তাঁদের বিচরণ শুধু কুরআন, হাদীস, তাফসীর, ফিকাহ বা অনুরূপ বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না- ইসলামের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ দর্শন, বিশেষত শিয়া মাযহাবের অধ্যাত্মবাদের ওপরও তাঁদের দখল ছিল। বস্তুত আমরা যদি আয়াতুল্লাহ খোমেইনী এবং তাঁর মহান অবদানের প্রতি তাকাই তাহলে দেখতে পাই যে, ইরানের শিয়া আলেমদের সুদীর্ঘ ঐতিহ্যেরই চূড়ান্ত পরিণতি হচ্ছেন তিনি। শুধু রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যাপারে অসাধারণ, ব্যাপক এবং অবিসংবাদিত ভূমিকা পালন করেছেন বলেই যে তিনি এ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন, তা নয়। শিয়া ঐতিহ্যের খাঁটি ও সার্থক অনুসরণীয় ব্যক্তিত্বের বিকাশও তাঁর মধ্যে ঘটেছে। মোট কথা এ ক্ষেত্রেও তিনি একজন অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব।…

১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি দেশে ফিরে আসলেন। কিন্তু তিনি সাথে করে কোন সম্পদ নিয়ে এলেন না। কোন রাজনৈতিক দলও তিনি গঠন করেননি। কোনো গেরিলা যুদ্ধও পরিচালনা করেননি। কোন বিদেশী শক্তির সাহায্য তিনি নিলেন না। অথচ এর মধ্যেই তিনি ইসলামী বিপ্লবী আন্দোলনের তর্কাতীত নেতৃত্বে সমাসীন হলেন।…

আয়াতুল্লাহ খোমেইনীর ক্ষেত্রে ‘বিপ্লব’ কথাটির অর্থ হচ্ছে এই যে, একজন বিপ্লবী নেতা হিসাবে তিনি নিছক জ্ঞানে ও আবেগে কোন বিশেষ লক্ষ্যের প্রতি শুধু নিবেদিতই নন, বরং তিনি এর সাথে একাত্মও। এক্ষেত্রে ‘বিপ্লব’ শব্দটিকে অবশ্য ইরানী প্রেক্ষাপটেই বুঝতে হবে। তিনি ছিলেন পুরোপুরি আপোসহীন। কিন্তু কেন? কারণ, তিনি নিছক ব্যক্তিগত রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে প্রচলিত অর্থে কোন রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না। পক্ষান্তরে, তিনি কেবল আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.)-এর নির্দেশ বাস্তবায়নের জন্য খোদা নির্ধারিত পথে প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন মাত্র।…

আয়াতুল্লাহ খোমেইনী তাঁর আধ্যাত্মিক ও নৈতিক গুণাবলি দ্বারাই মহান ও অতুলনীয় ভূমিকা পালনে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর গুণাবলি এমনকি ইসলামবিরোধীরাও অস্বীকার করতে পারে না। একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো যে, বিপ্লবের সময় যাঁরা ইসলামের প্রতি নিবেদিত ছিলেন না তাঁরাও বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ইসলাম খুঁজে পেলেন। আয়াতুল্লাহ খোমেইনীর আধ্যাত্মিক ও শক্তিশালী নৈতিক গুণাবলি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁরাও বিপ্লবের তথা ইসলামের প্রতি নিবেদিত হলেন। এটা অনস্বীকার্য যে, তিনি এমনই এক ব্যক্তিত্ব যিনি আত্মকেন্দ্রিকতা ও সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে থেকে কেবল ইরানী জাতির অন্তরের অন্তঃস্থলে নিহিত আশা-আকাক্সক্ষারই প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন।…

আমাদের এ কথা কিছুতেই ভুলে গেলে চলবে না যে, ইরানের ইসলামী বিপ্লব মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদিবাদের জন্য যে মারাত্মক বিপর্যয় এনেছে তা যে কোন যুদ্ধে প্যালেস্টাইনীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রাম কিংবা আরব রাষ্ট্রগুলো কর্তৃক গৃহীত যে কোন সামরিক মাধ্যমে অর্জিত সমস্ত সফলতার চাইতেও বেশি। এটা নিশ্চিতভাবে বলা যাবে যে, সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে, এমনকি সকল মুসলিম দেশের হাতে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা ও ইহুদিবাদ যে প্রাথমিক পরাজয় বরণ করেছে তা সম্ভব হয়েছে একমাত্র ইরানের ইসলামী বিপ্লবের কারণে।

এ বিপ্লবের মধ্যেই এমন শক্তি নিহিত রয়েছে যা সমগ্র মুসলিম মিল্লাতের কল্যাণে আসতে পারে। সুন্নি মুসলিম অধ্যুষিত দেশসমূহ যথা আরব রাষ্ট্রগুলো আফগানিস্তান ও অন্য সব দেশের মুসলমানদের উচিত এ বিপ্লবের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করা এবং একে এগিয়ে নেবার জন্য সব রকমের সমর্থন ও সহযোগিতা প্রদান করা।

ড. কালিম সিদ্দিকী

ইরানের ইসলামী বিপ্লব সম্পর্কে ভালোমন্দ যার যা-ই ধারণা থাক না কেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো এই বিপ্লবের আধ্যাত্মিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক উৎস পুরোপুরিভাবেই ইসলামের গভীরে নিহিত রয়েছে। ঔপনিবেশিক আমলের মুসলিম রাজনৈতিক চিন্তাধারার সাথে জড়িত সকল প্রতিষ্ঠান ও ধ্যান-ধারণা এবং ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ বাইরে এই বিপ্লব অবস্থান করছে। ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের আগ পর্যন্ত এটা বিশ্বাস করা কঠিন ছিল যে, ইরানে (শাহের ইরানে) রীতিমতো ইসলামী নেতৃত্বের উৎস বিরাজ করছে এবং তাঁরা তখন পর্যন্ত পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা দ্বারা সংক্রমিত হননি। সম্পূর্ণ আলাদা এবং স্বতন্ত্রভাবে বিকশিত শিয়া ধর্মতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ববিদ ও তাঁদের প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং উসুলী আলেম সম্প্রদায়ই সমসাময়িক ইস্যুগুলোর ওপর সক্রিয়ভাবে ইজতিহাদে আত্মনিয়োগ করেন। এর ফলে ঔপনিবেশিক আমলের মুসলিম রাজনৈতিক ভাবধারা এবং এর প্রতিষ্ঠানসমূহের আধিপত্যের বিরুদ্ধে স্পষ্টভাবে চ্যালেঞ্জ করার প্রয়োজনীয় ধ্যান-ধারণা এবং নেতৃত্বের উদ্ভব ঘটে।

ইসলামের শক্তির দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ উৎস হলো মুসলিম সর্বসাধারণ বা জনতা। মুসলিম জনতাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উপনিবেশিক আমলের রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা দ্বারা সংক্রমিত ছিল না। জাতীয়তাবাদী আবেগের প্রতি জনতার বিপুল সাড়া পাওয়া যায় যখন ১৯৫১ সালে অ্যাংলো-ইরানিয়ান তেল কোম্পানির মালিকানা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। পৃথিবীর অন্যান্য এলাকায়ও জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ নিজেদের পৃষ্ঠপোষক উপনিবেশিক শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে জনতাকে সাময়িকভাবে সংঘবদ্ধ করতে কম-বেশি সফল হয়েছিল। কিন্তু এর আগে কোন সময় পৃথিবীর কোন অঞ্চলে সর্বসাধারণ মুসলিম রাজতন্ত্র হতে স্বাধীন এবং উপনিবেশিক আমলের রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার বাইরে কোন ইসলামী নেতৃত্বের ছোঁয়া পায়নি। ইরানের মুসলিম জনতার মাঝে উলামা বা ইসলামী শক্তির এক অতলান্ত উৎসের সন্ধান পেয়েছিলেন যা ইতিপূর্বে কোন ইসলামী আন্দোলন আবিষ্কার করতে পারেনি। ইরানে উলামা আর মুসলিম জনতার সম্মিলন (fusion) ইসলামের অনুপম আর অজেয় শক্তির স্ফূরণ ঘটিয়েছিল। এই শক্তির স্ফূরণ প্রতিষ্ঠিত স্বৈরাচারকে পরাজিত করেছে, দেশের অভ্যন্তরীণ বিপ্লববিরোধী উৎসগুলো নির্মূল করেছে, বিদেশী সামরিক ও অর্থনৈতিক মাতব্বরিকে খামোশ করে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক দুশমনদের একটি যৌথ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে এই শক্তি এখন প্রলম্বিত যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। ইসলামের এই অনবদ্য শক্তি একটি নতুন রাষ্ট্রও স্থাপন করেছে। এই রাষ্ট্রের রয়েছে একটি নতুন সংবিধান এবং উপনিবেশিক রাজনৈতিক চিন্তা কাঠামোমুক্ত সম্পূর্ণ নতুন ইসলামী প্রতিষ্ঠানসমূহ। এভাবে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ঔপনিবেশিক শক্তি ও তাদের দোসরদের তিনশ’ বছরের অধিককালের কষ্টার্জিত আধিপত্য ব্যবস্থাকে ইসলামী বিপ্লব নাস্তানাবুদ করে ফেলল।

ইরানে ইসলামী বিপ্লবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবদান হলো শাসক ও শাসিতের মধ্যকার এই চির প্রসারমান ব্যবধানে সুদৃঢ় সেতুবন্ধ রচনা। এই সাফল্য অর্জিত হয়েছে ইসলামের মূল ভূখণ্ডে জনগণ ও উলামাদের মধ্যে স্থিতিশীলতা, শক্তিমত্তা, পারদর্শিতা ও তাকওয়ার নতুন নতুন কেন্দ্র চালু করার মাধ্যমে এবং উপনিবেশবাদ প্রভাবিত জাহেলিয়ার ভূত যা এতদিন পরগাছার মতো ইরানে শেকড় গেঁড়ে বসেছিল তা উপড়ে ফেলার মাধ্যমে।

(নিউজলেটার, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৩)


১৯৯৩ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সংকট মোকাবিলায় ইরানের ভূমিকা

তারেক ফজল

বোসনিয়া-হার্জেগোভিনায় সার্বীয় পৈশাচিকতা আর গণহত্যা বিশ্বের পূর্ববর্তী সকল নিকৃষ্ট নজিরকে স্লান করে দেয়। সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার এই প্রজাতন্ত্রটি স্বাধীণতা ঘোষণা করেছিল, এটিই প্রধান দোষ। আর স্বাধীনতাকামী জনগোষ্ঠী প্রধানত মুসলিম, এই বাস্তবতাটি সেই দোষটিকে অসহনীয় করে তুলেছিল। এজন্যই অব্যাহত নির্যাতন-হত্যাকাণ্ড।

যুগোশ্লাভিয়ার ৬টি প্রজাতন্ত্রের মধ্যে সার্বিয়া ও মন্টিনিগ্রো পূর্বের ফেডারেশনে থেকে যায়। শ্লোভেনিয়া ও ক্রোয়েশিয়া ১৯৯১ এর ২৫ জুন স্বাধীনতা ঘোষণা করে ও  পশ্চিমা স্বীকৃতি পায়। মেসিডোনিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করলেও স্বীকৃতি পায়নি। বোসনিয়া-হার্জেগোভিনা স্বাধীনতা ঘোষণা করলে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয়  গোষ্ঠী এজন্য গণভোটের শর্ত আরোপ করে। সে অনুযায়ী ১৯৯২  সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি ও ১ মার্চ গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। প্রজাতন্ত্রের ৪০ লাখ অধিবাসীর ১২ লাখ সার্ব গণভোট বর্জন করে। বাকি জনগোষ্ঠী গণভোটে অংশ নেয় ও শতকরা ৯৯ জন স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দেয়। এতে প্রজাতন্ত্রটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলেও যুগোশ্লাভ সার্বদেরসামরিক সহায়তায় বোসনীয় সার্বরা তা নস্যাৎ করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। লক্ষাধিক বোসনীয় মুসলিম নিহত হয়। উদ্বাস্তু হয় তিন লাখ। সার্বীয় বন্দি শিবিরে মৃত্যুর মুখোমুখি সোয়া লাখ। বোসনীয় মুসলিম নারীরা নিকৃষ্টতম নির্যাতনের শিকার হয়।

এই বোসনীয় (বোসনিয়া-হার্জেগোভিনা) মুসলিমদের রক্ষা করার জন্য বিশ্বের মানবতাবাদী গোষ্ঠী ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখনো কোনো কার্যকর ভূমিকা নেয়নি। জাতিসংঘের সশস্ত্র ত্রাণদল আর ইউএনইসি মধ্যস্ততাকারীদের তৎপরতার চেয়ে অধিক দ্রততার সাথে চলে সার্বীয় বাহিনীর হত্যাকাণ্ড আর মার্কিন সাময়িকী নিউজউইকের ভাষায় মুসলিম নারীদের ওপর গণধর্ষণ। 

১৯৯২ সালের এপ্রিল থেকে সার্বীয় বাহিনীর নির্যাতন শুরু হয় বোসনীয় মুসলিমদের ওপর। তখন থেকেই ইরান এই গণহত্যা প্রতিরোধে তার প্রচেষ্টা শুরু করে। এই প্রচেষ্টা সার্বিক অর্থেই সামগ্রিক। কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে ইরান সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার কোনো রাষ্ট্রদূত গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়। সার্বীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ইরান সফর বাতিল করা হয়। বেলগ্রেড থেকে ইরানী রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করা হয়। যুগোশ্লাভিয়াকে জাতিসংঘ ও ওআইসিসহ সকল বিশ্ব সংস্থা ও সংগঠন থেকে বহিষ্কারের জন্য ইরান দাবি তোলে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ৭৫৭ নম্বর প্রস্তাব পাশ হবার আগেই ইরান যুগোশ্লাভিয়ার সাথে সকল অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক এবং সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান বাতিল করে। তেহরানে বোসানিয়া-হার্জেগোভিনার রাজনৈতিক প্রতিনিধিবর্গকে গ্রহণ করা হয় এবং পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসার সাথে সাথে সারায়েভোয় কূটনৈতিক মিশন খোলার ঘোষণা দেয়া হয়। ২৯ অক্টোবর ৯২ দ্বিতীয় বারের মতো বোসনীয় প্রেসিডেন্ট আলীজা ইজেতবেগোভিচ তেহরান সফরে গেলে ইরানী প্রেসিডেন্ট আলী আকবর হাশেমী রাফসানজানী তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় স্বাগত জানান।

বোসনীয় জনগোষ্ঠীর (মুসলিম ও ক্রোয়েট) জীবন রক্ষার জন্য কার্যকরী কোনো আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা না দেখে ইরানে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে।  ইরানে এ পর্যায়ে বোসনিয়ায় সামরিক সাহায্য পাঠাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বিষয়টি জানার পর বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বিচলিত হয়ে ওঠে। তারা তড়িঘড়ি করে বোসনিয়া-হার্জেগোভিনার আকাশ সীমাকে জাতিসংঘের প্রস্তাবের মাধ্যমে বিমান উড্ডয়নমুক্ত এলাকা’ (নো ফ্লাইযোন) ঘোষণা করে এবং সেখানে অস্ত্র সরবরাহ নিষিদ্ধ করে। বাহ্যত এই আইনগত বাধার মুখে ইরান বোসনীয় মুসলিমদের জীবন রক্ষায় সরাসরি অংশ গ্রহণে ব্যর্থ হয়। কিন্তু সার্বীয়রা ঠিকই অস্ত্র সাহায্য পায়। যুগোশ্লাভ ফেডারেশনের যে মওজুদ অস্ত্র ছিল, বোসনীয় মুসলিমদেরকে হত্যার জন্য তা-ই যথেষ্ট। এ পর্যায়ে ইরানী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আলী আকবর বেলায়েতী ৪ আগস্ট ও ২৮ অক্টোবর ৯২ ইসলামী সম্মেলন সংস্থার ওআইসি মহাসচিব হামিদ আল-গাবিদের কাছে সংস্থার জরুরি অধিবেশন দাবি করে পত্র পাঠান। বোসনীয় মুসলিমদের সার্বীয় হায়েনাদের হাত থেকে প্রাণে বাঁচাতে দ্রুত ও নিশ্চিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ইরানী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরেকটি পত্র লেখেন ইন্দোনেশীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলী আলতাসের নিকট জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন ন্যাম এর পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের জরুরি সম্মেলন আহ্বানের তাগিদ দিয়ে। ইন্দোনেশিয়া এ সময়ে ন্যাম এর চেয়ারম্যান।

ইরান সরকারিভাবে বোসনীয় মুসলিমদের রক্ষার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। আটা, জ্বালানি তেল, জুতা, কম্বল, টিনজাত মাছ, পোশাক এবং অর্থ সাহায্য ইরান বোসনীয়দের জন্য অব্যাহত রাখে। আহত বোসনীয়দের চিকিৎসা ও এতিম সন্তানদের লালন-পালনের উদ্যোগ নেয়া হয়। বার্তা সংস্থা জানায়, গুরুতর আহত যুদ্ধবিধ্বস্ত ৮৬ জন বোসনীয়কে ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় রেড ক্রিসেন্টের মাধ্যমে গত ৮ ডিসেম্বর তেহরানে নিয়ে আসে। তাদের অবস্থা ভালোর দিক। হাসপাতালের কর্মীরা আন্তরিকতার সাথে তাদের সেবা করে। আহতদের কারো কারো জন্য কৃত্রিম অঙ্গও সরবরাহ করা হয়।

ইরান সরকারিভাবে এই আয়োজনের পাশাপাশি সেদেশের জনগণকেও বোসনীয় নির্যাতিত মুসলিমদের সাহায্যে এগিয়ে আসার ব্যবস্থা করে। জনগণের ব্যক্তিগত সাহায্য-সামগ্রী সংগ্রহ করা হয়। গত ৪-১০ নভেম্বর ইরান সারা দেশে এবং দূতাবাসসমূহের মাধ্যমে সারাবিশ্বে বোসনিয়া-হার্জেগোভিয়া সপ্তাহপালন করে। বোসনিয়ার বিষয়ে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি ও তাদের সাহায্য সংগ্রহ করা ছিল এর লক্ষ্য।

সর্বোপরি ইরান সকল রাষ্ট্রীয় জনশক্তি ও প্রচারমাধ্যমকে সম্ভাব্য সকল প্রক্রিয়ায় বোসনিয়ার স্বাধীনতাকামী মানুষদের কল্যাণে নিয়োজিত করে । বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেয়ী, প্রেসিডেন্ট হজ্জাতুল ইসলাম আলী আকবর রাফসানজানী, পার্লামেন্ট (মজলিস) স্পীকার আলী আকবর নাতেক নূরীসহ মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ ও উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাবৃন্দ বোসনিয়া-হার্জেগোভিনার মুস্তাযআফদের অনুকূলে তাদের ভূমিকা অব্যাহত রাখেন। ২৯ অক্টোবর ৯২ বোসনীয় প্রেসিডেন্ট আলীজা ইজেতবেগোভিচ দুই দিনের সফরে তেহরানে পৌঁছে বলেছিলেন, তাঁর দেশের জনগণের ওপর সার্বীয়দের পরিকল্পিত গণহত্যার (সিসটেমিটক জেনোসাইড) ব্যাপারে মুসলিম দেশসমূহের মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় তিনি অসন্তুষ্ট। ইরানের ভূমিকাকে তিনি উৎসাহব্যঞ্জক অভিহিত করেন।

আলজেরিয়া : ইরানের সাহসী ভূমিকা

আলজেরিয়ার সংগ্রামী জনগণ ১৯৯০  সাল থেকে তাদের উদ্যম ও স্পৃহা প্রদর্শন করে চলেছে। তাদের সেই উদ্যমকে গুঁড়িয়ে দেয়ার জন্য দেশটির সামরিক জান্তা সর্বশক্তি নিয়ে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রেসিডেন্ট শাদলী বেনজাদীদ কিছুটা নমনীয়তা প্রদর্শনের চেষ্টা করলে সামরিক জান্তা এবং নেপথ্যে থেকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তাঁকে মঞ্চথেকে সরিয়ে দেয় এবং দুই যুগের নির্বাসন থেকে অনুগত ও বিশ্বস্ত অনুচরমুহাম্মদ বওদিয়েফকে নিয়োগ করে প্রেসিডেন্ট হিসেবে। ২৯ জুন ৯২ বওদিয়েফ নিরাপত্তা রক্ষীর গুলিতে মারা যান। সামরিক জান্তা  বিপ্লবী কিন্তু নিরস্ত্র জনতাকে অস্ত্রের ভাষায় জব্দ করে রাখতে চেষ্টা করে। কিন্তু তারা কোন উর্দিপরা জেনারেলের শাসন মানবে না। ইসলামিক স্যালভেশন ফ্রন্ট (এফআইএস)-এর নেতৃত্বে এই জনতা ১৯৯০ সালের স্থানীয় পরিষদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ১৯৯১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পার্লামেন্টের প্রথম দফার নির্বাচনে ২০৬ আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে তারা বিজয়ী হয়। ১৯৯২ সালের ১৬ জানুয়ারির নির্দিষ্ট দ্বিতীয় দফায় পার্লামেন্ট নির্বাচনের ৫ দিন আগে ১১ জানুয়ারি দেশটির সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখল করে, পার্লামেন্ট নির্বাচনের ফল বাতিল করে পরবর্তী নির্বাচন বাতিল করে, শাদলি বেনজাদীদকে দৃশ্য থেকে সরিয়ে দেয় ও মুহাম্মদ বওদিয়েফকে প্রবাস থেকে দেশে ফিরিয়ে এনে প্রেসিডেন্ট বানায়। সামরিক জান্তা ইতিমধ্যে হাজার হাজার এফআইএস নেতা-কর্মীকে জেলে ঢুকায়, এফআইএসকে নিষিদ্ধ করে, মসজিদ বন্ধ করে দেয় এবং বেশ কজন নেতাকে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসি দেয়।

ইসলামী বিপ্লবকামী জনতার সাথে সাম্রাজ্যবাদীদের ক্রীড়নক আলজেরীয় জেনারেলদের এই অব্যাহত বৈরী আচরণের বিপরীতে বিশ্বে কার্যত একটি দেশই নৈতিক ভূমিকা নেয় এবং তা হচ্ছে ইরান। প্রচলিত কূটনৈতিক শিষ্টতা রক্ষা করেই ইরান এই ভূমিকা নেয়।

২৩ নভেম্বর জার্মানি থেকে এথেন্সে অবস্থিত ইরনা (আইআরএনএ) অফিসে এফআইএস এর একজন মুখপাত্র ফ্যাক্সযোগে একটি বিবৃতি প্রেরণ করেন। বিবৃতিতে এফআইএস এর মুখপাত্র রাবেহা কবীর বলেন, মিলিটারি সমর্থিত আলজেরীয় ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী পশ্চিমাদের সন্তুষ্ট করতে কিছু মুসলিম রাষ্ট্রকে আক্রমণ করছে। মুখপাত্র বলেন, যারা দুর্নীতি করছে, আলজেরীয় জনতা তাদের থেকে দেশকে মুক্ত করবে।

১৭ জানুয়ারি ৯২ তেহরানে জুমআর ভাষণে আয়াতুল্লাহ মুহাম্মদ ইমামী কাশানী আলজেরীয় সেনাবাহিনীকে জনগণের সাথে সংঘর্ষে যাবার ব্যাপারে সতর্ক করে দেন। তিনি বলেন, ফেরাউনদের জন্য কেবল অনুতপ্ত হওয়াই অপেক্ষা করে। যারা খোদার পথকে বেছে নিয়েছে, বিজয় তাদের জন্যই।

জুমআর নামাযের অন্যতম ইমাম আয়াতুল্লাহ কাশানী বলেন, আলজেরীয় মুসলিম জনতার সাথে সংঘর্ষে যাওয়া সেনাবাহিনীর জন্য কল্যাণকর নয়।

১৪ জানুয়ারি ৯২ ইরানী পার্লামেন্টের (মজলিস) সাবেক স্পীকার হুজ্জাতুল ইসলাম মাহদী কাররুবী এক বাণীতে অন্য মুসলিম দেশসমূহের পার্লামেন্ট প্রধানদের প্রতি আরজেরীয় জনগণের সংগ্রামকে সমর্থনের আহ্বান জানান। তিনি আলজেরীয় জনতাকে ফরাসি উপনিবেশের বিরুদ্ধে বীরহিসাবে উল্লেখ করেন। সাবেক ইরানী স্পীকার বলেন, নির্যাতিত জনতার প্রতি আমরা দয়া অনুভব করি। মানবিক আদর্শ ও মূল্যবোধ বাস্তবায়নের ওপর তিনি জোর দেন।

ইরানী দৈনিকগুলো তাদের সম্পাদকীয় নিবন্ধে দাবি করেন, আলজেরিয়ায় ইসলাম ও ইসলামের অনুরক্ত জনতাই বিজয় লাভ করবে। দৈনিকগুলো আলজেরিয়ার পার্লামেন্ট নির্বাচন ও তার পরবর্তী ঘটনা প্রবাহের ওপর অব্যাহতভাবে লিখে চলে।

আফগানিস্তান : স্থিতিশীলতার প্রচেষ্টায় ইরান

আফগানিস্তানের পুতুল শাসক ড. নজীবুল্লাহ মুজাহিদদের আক্রমণের মুখে জাতিসংঘের ছাত্রছায়ায় ১৯৯২ সালের ২৫ এপ্রিল ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। মুজাহিদরা বিজয়ী হয়। কিন্তু সরকার গঠনে মুজাহিদদের বিভিন্ন সংগঠন গভীর মতানৈক্যে জড়িয়ে পড়ে। এ সময় ইরান পাকিস্তানকে সাথে নিয়ে আফগানিস্তানে একটি ঐকমত্যের সরকার গঠনের উদ্যোগ নেয়।

১৯৮৫ সালে মুজাহিদদের ৭টি সংগঠন পাকিস্তানের পেশোয়ারে একটি ফ্রন্ট গঠন করেছিল। সংগঠনগুলো হলো, জমিয়তে ইসলামী (বুরহান উদ্দীন রব্বানী), হিজব-ই-ইসলামী (গুলবুদ্দীন হিকমতিয়ার), হিজব-ই-ইসলামী (ইউনুস খালিস), ইত্তেহাদ-ই-ইসলামী [ইসলামিক এলায়েন্স (রাসূল সায়েফ)], মিল্লি ইসলামী মাহাজ (আহমদ গিলারু), জাজহা সিহাত-ই-মিল্লি (সিবগাতুল্লাহ মুজাদ্দেদী) ও হারাকাত-ই-ইসলামী (নবী মোহাম্মদ)। ১৯৮৯ সালে এই সংগঠনগুলো একটি অস্থায়ী সরকার গঠন করে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় এই সরকারই মুজাহিদদের প্রতিনিধিত্ব করছিল।

আফগানিস্তানে একটি স্থিতিশীল সরকার গঠনের জন্য ইরান জাতিসংঘের দেয়া পরিকল্পনাকে সমর্থন করে। উক্ত পরিকল্পনায় ১৫ জনের একটি পরিষদের কথা বলা হয়। অধ্যাপক সিবগাতুল্লাহ মুজাদ্দেদী ২৫ এপ্রিল, ১৯৯২ ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন অধ্যাপক রব্বানী। সর্বশেষে অধ্যাপক রব্বানী দুই বছরের জন্য মুজাহিদ নেতৃত্ব পরিষদের ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। গত ৯ নভেম্বর ৯২ অন্তর্বতীকালীন প্রেসিডেন্ট থাকাকালে অধ্যাপক রব্বানীর সাথে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ইরানী প্রতিনিধি দলের নেতা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আলী আকবর বেলায়েতী সাক্ষাৎ করেন। প্রেসিডেন্ট রব্বানী আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রশ্নসমূহে ইরানের শক্তিশালী ভূমিকার কথা বলেন এবং আঞ্চলিক যৌথ সহযোগিতায় যুক্ত হবার জন্য আফগানিস্তানের সম্পূর্ণ প্রস্তুতির কথা বলেন। ইতিমধ্যে প্রেসিডেন্ট রব্বানী গত ২৬ ও ২৭ সেপ্টেম্বর ৯২ ইরান সফর করেন। রাহবার আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেয়ী ও প্রেসিডেন্ট আলী আকবর হাশেমী রাফসানজানীর সাথে আলোচনা করে প্রেসিডেন্ট রব্বানী তাঁর দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরানের সাহায্য কামনা করেন।

মধ্য এশিয়া প্রশ্নে ইরানের ভূমিকা 

মধ্য এশিয়ার ৬টি মুসলিম প্রজাতন্ত্রকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমর্থন ও সাহায্য যুগিয়ে চলেছে ইরান। স্বাধীনতা লাভের পর দেশগুলো ইসলামী ভ্রাতৃত্বের দাবি নিয়ে ইরানের সহযোগিতা আশা করে। ইরানও একে দায়িত্ব পালনের জন্য ভালো সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করে। ইরানী শীর্ষ নেতৃবৃন্দ যেমন মধ্য এশিয়ায় মুসলিম দেশসমূহ সফর করেন, তেমনি সেসব দেশের নেতৃবৃন্দও প্রয়োজনের তাগিদে নিয়মিতভাবে ইরানে যাতায়াত অব্যাহত রাখেন।

৩১ অক্টোবর ৯২ কাজাভস্তানের প্রেসিডেন্ট নূর সুলতান নাজার বায়েখ তেহরানে পৌঁছেন। মেহরাবাদ বিমান বন্দরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, কাজাখস্তান ইরানের সাথে বন্ধুত্ব বাড়াতে চায়। তিনি প্রেসিডেন্ট রাফসানজানীর সাথে আলোচনায় মিলিত হন এবং মধ্য এশিয়ায় বৈরী শক্তি বিস্তৃতির বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।

১৯৯২ সালের ১৪ অক্টোবর ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক উন্নয়ন বিষয়ক পরিচালক যুধিষ্ঠির রাজআইজার ইরানের সংস্কৃতি ও উচ্চ শিক্ষা বিষয়ক মন্ত্রী ড. মোস্তাফা মঈনের সাথে আলোচনা করেন এবং জানান, ১৪-১৮ নভেম্বর ৯২ তেহরানে মধ্য এশিয়ায় সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক সহযোগিতা বিষয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হবে। পরে এই আন্তর্জাতিক কংগ্রেস উদ্বোধন করেন ইরানের প্রথম উপ-রাষ্ট্রপতি হাসান হাবিবী। ৩০টি দেশ থেকে শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক কর্মকর্তা কংগ্রেসে যোগ দেন।

তুর্কমেনিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আতায়েভ ৪ দিনের সফরে ২২ ডিসেম্বর ৯২ তেহরানে পৌঁছলে ইরানী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আলী আকবর বেলায়েতী তাঁকে বিমান বন্দরে স্বাগত জানান। প্রেসিডেন্ট রাফসানজানী তুর্কমেন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সাক্ষাৎদানকালে বলেন, ইরান তাঁর দেশের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক চায়।

আজারবাইজান সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্ট প্যানাহ হোসেইনভ ৪ আগস্ট ৯২ বাকুতে ইরানী রাষ্ট্রদূতের সাথে সাক্ষাৎকালে ইরানের সাথে তাঁর দেশের অব্যাহত বন্ধুত্বের কথা বলেন। এর পর ২৮ ডিসেম্বর ৯২ আজেরী ভাইস প্রেসিডেন্ট প্যানাহ হোসেইনভ একটি প্রতিনিধি দলের নেতা হিসাবে ইরান সফরে আসেন। কারাবাখ ইস্যু ও অন্যকিছু বিষয় নিয়ে ইরানী নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা হয়।

২৩ ডিসেম্বর ৯২ আর্মেনীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট গাজিক আরুতুনিয়ান ইরানী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আলী আকবর বেলায়েতীর সাথে এক বৈঠকে মিলিত হন। ড. বেলায়েতী কারাবাখ বিবাদটি মিটিয়ে ফেলার জন্য আর্মেনীয় নেতার প্রতি আহ্বান জানান। আর্মেনীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট ইরানে দুদেশের যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের বৈঠকে যোগ দিতে আসেন। ইরানী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আলী আকবর বেলায়েতী একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়ে ২৪ নভেম্বর ৯১ মস্কোয় পৌঁছেন। ১০ দিনব্যাপী এই সফরে তিনি ৬টি মধ্য এশীয় মুসলিম প্রজাতন্ত্র সফর করেন।

১৭ নভেম্বর ৯২ ইরান ও উজবেকিস্তানের মধ্যে বিমান যোগাযোগ বিষয়েএকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২৫ নভেম্বর (১৯৯২) উজবেক প্রেসিডেন্ট ইসলাম রহিমভ তেহরানে কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষরের পরে নিজ দেশের উদ্দেশ্যে ফিরে যান। রহিমভ ইরানী নীতিমালাকে বাস্তবসম্মতবলে অভিহিত করেন।

মে ৯২-র প্রথম সপ্তাহে তেহরানে আজারবাইজান, আর্মেনিয়া ও ইরানের প্রেসিডেন্টদের উপস্থিতিতে ত্রিপক্ষীয় এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

লেবানন ও ফিলিস্তিন প্রশ্ন ইরান

১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২ লেবাননের হিজবুল্লাহ দলের সেক্রেটারি জেনারেল হুজ্জাতুল ইসলাম শেখ আব্বাস মুসাভী আলী ইসরাইলী আক্রমণে শহীদ হন। তাঁর সাথে স্ত্রী, এক পুত্র ও চারজন দেহরক্ষীও জীবন হারান।

এ ঘটনার পর ১৭ ফেব্রুয়ারি ইরানী বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী ও প্রেসিডেন্ট আলী আকবর রাফসানজানী পৃথক পৃথক বার্তায় শোক প্রকাশ করেন।

আলী খামেনেয়ী তাঁর বার্তায় বলেন, মুসাভীর শাহাদাত ইহুদি নির্যাতনের বিরুদ্ধে লেবানন ও ফিলিস্তিনীদের ন্যায্য সংগ্রামকে বিস্তৃত মাত্রা প্রদান করবে।

প্রেসিডেন্ট রাফসানজানী বলেন, মুসাভীর হত্যাকাণ্ড লেবানন ও ফিলিস্তিনীদের স্বাধীনতার স্পৃহাকে অবদমিত করতে পারবে না।

২১ ফেব্রুয়ারি (১৯৯২) তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের জুমআর সমাবেশে আয়াতুল্লাহ মোহাম্মদ ইমামী কাশানী বলেন, মুসাভীর হত্যাকাণ্ড মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং তথাকথিত মানবাধিকারের প্রবক্তাদের জন্য আরেকটি লজ্জার বিষয়। তিনি বলেন, মুসাভীর শাহাদাত ইসলামের স্বার্থই রক্ষা করবে।

ইরান ফিলিস্তিনী ও লেবাননী মুসলিমদের সংগ্রাম ও আন্দোলনকে সকল প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে চলে। ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বর ফিলিস্তিনীরা যে ইনতিফাদা বা গণজাগরণ শুরু করেছে, তা ইরানের শাহের আমলের আন্দোলনের পথ ধরেই এগিয়ে চলে। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তিস্থাপনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার দূতিয়ালিতে ৩০ অক্টোবর থেকে ১ নভেম্বর ১৯৯১ যে মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনাস্পেনের মাদ্রিদে শুরু হয়, লেবানন-ফিলিস্তিনের বিপ্লবকামী নেতৃবৃন্দ তা প্রত্যাখ্যান করেন। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান মাদ্রিদ আলোচনাকেসাম্রাজ্যবাদীদের নাটক হিসাবে আখ্যায়িত করে এবং তার আগেই তেহরানে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি স্থাপন বিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করে। সর্বশেষ ৪১৫ জন ফিলিস্তিনী সংগ্রামী যুবককে  ইসরাইল মধ্য ডিসেম্বরে তুষারাবৃত লেবানন সীমান্তের নো-ম্যান্স ল্যান্ডেবহিষ্কার করে। এতে কথিত মধ্যপন্থী নেতা ইয়াসির আরাফাত পশ্চিমাদের মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনা থেকে সরে আসার ঘোষণা দেন।

ইরান লেবানন-ফিলিস্তিনের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের গণজাগরণে সম্ভাব্য নৈতিক সমর্থন অব্যাহত রেখেছে। লন্ডন থেকে নভেম্বরের (৯২) তৃতীয় সপ্তাহে ইরনা জানায়, ইসরাইল অধিকৃত এলাকায় সর্ববৃহৎ ইসলামী শক্তি হামাসের সাথে ইরানের সম্পর্ক শক্তিশালী হয়েছে। বার্তা সংস্থা জানায়, হামাস ফিলিস্তিনকে মুক্ত করার সংগ্রামে ইরানের আনুষ্ঠানিক সমর্থন অর্জন করে।

৪ অক্টোবর (১৯৯২) ইসরাইলের অধিকৃত এলাকায় ঘটনাবলি বিষয়ে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও ফিলিস্তিনী হামাস আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের মধ্যে যৌথ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আলী আকবর বেলায়েতী সভার উদ্বোধন করেন।

৫ অক্টোবর রাহবার আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেয়ী এবং ১১ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট রাফসানজানী লেবাননের হিজবুল্লাহ দলের একটি প্রতিনিধি দলকে সাক্ষাৎ প্রদান করেন। হিজবুল্লাহ নতুন সেক্রেটারী জেনারেল সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ এই দলের নেতৃত্ব দেন।

ইউএন, এনএএম, ওআইসি-তে ইরানের ভূমিকা

ইরান পূর্ববর্তী বছরগুলোর মতো গত বছরটিতেও (১৯৯২) জাতিসংঘ, জোট নিরপক্ষে আন্দোলন ও ইসলামী সম্মেলন সংস্থায় নির্যাতিত জনতা ও মুসলিম জনতার পক্ষে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে।

জাতিসংঘে বোসনিয়া-হার্জেগোভিনা বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে ইরান সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। ইরান বোসনীয় মুসলিম মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সাহায্যের কথা ঘোষণা করলে সাম্রাজ্যবাদীরা বোসনিয়ার ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ইরানের প্রথম উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুহাম্মদ আলী বেশারতী জাতিসংঘের প্রতি বোসনিয়ার ওপর থেকে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবার দাবি করেন। ১ ডিসেম্বর ১৯৯২ তিনি তেহরানে টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এই দাবি তোলেন।

ইরানী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বোসনিয়ায় সার্বীয়দের নারকীয় গণহত্যার বিরুদ্ধে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ২৯ অক্টোবর ৯২ জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক আহ্বানের দাবি তোলেন। এর আগে ১ সেপ্টেম্বর ১৯৯২ ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের দশম শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে ইরানী প্রেসিডেন্ট রাফসানজানী ন্যাম এর একটি পর্যাপ্ত নির্বাহী ক্ষমতাসম্পন্ন মীমাংসা কেন্দ্রস্থাপনের প্রস্তাব করেন যাতে সমঝোতার অভাবে সৃষ্ট আন্দোলনভুক্ত দেশসমূহের অভ্যন্তরীণ বিরোধ নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়। জনাব রাফসানজানী পশ্চিমা মানবাধিকারের দ্বৈত মানদণ্ডের’ (ডাবল স্ট্যান্ডার্ড) কথা উল্লেখ করেন। তিনি বোসনিয়া-হার্জেগোভিনায় নির্বিচার গণহত্যার অবসানের জন্য কার্যকর ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি করেন। কিন্তু ন্যামএ ব্যাপারে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ইরানী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ন্যাম এর জরুরি বৈঠকের দাবি করেন।

মুসলিম দেশসমূহের সংগঠন ইসলামী সম্মেলন সংস্থা মুসলিম বিশ্বের স্বার্থ সংরক্ষণে এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি বোসনিয়া-হার্জেগোভিনায় বর্তমানে অব্যাহত গণহত্যা গণধর্ষণের বিরুদ্ধেও কোনো শক্তিশালী ও উপযুক্ত ভূমিকা গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে। ইরান দুইবার ওআইসির বৈঠকের আয়োজন করে। কিন্তু সংস্থাটি এখনো কোনো উপযুক্ত ভূমিকা নিতে পারেনি।

বাবরী মসজিদ প্রসংগে ইরান

ভারতের অযোধ্যায় ৪৬৪ বছরের প্রাচীন বাবরী মসজিদ ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর উগ্র হিন্দুরা ধ্বংস করে দেয়। ইরান সরকারিভাবে এর জন্য তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে, ভারত সরকারের অক্ষমতার নিন্দা করে এবং মসজিদটি দ্রুত পুনঃনির্মাণের দাবি তোলে।

ভারতের বোম্বেতে অবস্থিত ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটি এ সময় দুষ্কৃতকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত করে। মসজিদ ধ্বংস ও ইরানী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য তেহরানস্থ ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে দুইবার ডেকে পাঠানো হয় এবং কড়া ভাষায় দুটি ঘটনার প্রতিবাদ জানানো হয়।

দিল্লীতে নিযুক্ত ইরানের সাবেক রাষ্ট্রদূত ইবরাহীম রাহিমপুর ৯ ডিসেম্বর (১৯৯২) তেহরানে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, রাও সরকারের বাবরী মসজিদ পুনঃনির্মাণের প্রকৃত ইচ্ছা থাকলে একমিনিটও ক্ষেপণ না করে মসজিদটির নির্মাণ কাজ শুরু করে প্রমাণ দেয়া উচিত।

২২ ডিসেম্বর ১৯৯২ ইরানী পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্ভাব্য সংক্ষিপ্ত সময়ে বাবরী মসজিদ নির্মাণের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন এবং এ জন্য তিনি ভারতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আর এল ভাটিয়ার কাছে একটি পত্র পাঠান।

১৪ ডিসেম্বর ইরানের গ্রান্ড আয়াতুল্লাহ মুহাম্মদ রেজা গুলপায়গানী এক বিবৃতিতে উগ্র হিন্দুদের দ্বারা ভারতের ফয়েজাবাদে অবস্থিত ঐতিহাসিক বাবরী মসজিদ ধ্বংস করাকে বর্বরতা বলে উল্লেখ করেন।

ইরানের বিভিন্ন দৈনিক বাবরী মসজিদ ভাঙার সাথে ভারত সরকারও পরোক্ষভাবে জড়িত বলে দাবি করে। কায়হান ইন্টারন্যাশনাল, জমহুরী ইসলামী, তেহরান টাইম্স এ বিষয়ে সম্পাদকীয় ও নিবন্ধ প্রকাশ করে।

সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী সম্পর্কে ইরানের কঠোর ভূমিকা

ইরান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ মানবতার শত্রু সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি অপরিবর্তিত রেখেছে। বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী ৬ মে ১৯৯২ হজ কর্মকতাদের উদ্দেশ্যে এক ভাষণে বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যতক্ষণ ইসলামী ইরানের প্রতি বৈরী থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত তার সাথে কোন সম্পর্ক স্থাপিত হবে না।

রাহবার খামেনেয়ী ১৮ সেপ্টেম্বর ইসলামী বিপ্লবী রক্ষী দলের কমান্ডারদের উদ্দেশ্যে এক ভাষণে বলেন, ঈমানের শক্তিতে বলীয়ান ও সশস্ত্র বিপ্লবী রক্ষীদের জাতিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনো দিন ক্ষতি করতে পারবে না।

বিপ্লবের নেতা ১ জুলাই তেহরানে একদল দর্শনাথীর উদ্দেশ্যে ভাষণ দানকালে বলেন, মুসলিম জাতিসমূহকে উদ্ধত শক্তিসমূহ, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে। তিনি বলেন, এই শক্তিগুলো ইসলাম, মুসলিম জাতি এবং নির্দিষ্টভাবে ইরানী জাতিকে ভয় করে। কারণ, তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি।

১৮ নভেম্বর ১৯৯২ বিপ্লবের নেতা খামেনেয়ী মিশরীয় অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ইরান মিশরীয় যুবকদের উস্কানি দিচ্ছে এটি একটি মিথ্যা। তিনি বলেন, বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর নীতি হলো উপসাগরীয় ও আরব রাষ্ট্রগুলোকে ইরানের বিরুদ্ধে শত্রুতায় লিপ্ত করা।

তেহরানের অতিরিক্ত জুমার নেতা আয়াতুল্লাহ আহমদ জান্নাতী গত ১৩ নভেম্বর বলেন, মার্কিন নির্বাচন ইহুদিদের দ্বারা আয়োজিত একটি অনুষ্ঠান মাত্র।

নতুন বিজয়ী ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইরানের সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হবে কি-না, এ প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আলী আকবর বেলায়েতী বলেন, ইরান যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক শুরুর ইচ্ছা রাখে না। তিনি বলেন, আমরা বিপ্লবের শুরুতে ডেমোক্র্যাট জিমি কার্টারের শাসন দেখেছি, তারপর এক যুগের রিপাবলিকানদের শাসন দেখেছি রিগ্যান ও বুশের নেতৃত্বে। কিন্তু ইরানের বিষয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি একই থেকে গেছে। ইরনাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ মন্তব্য করেন।

পররাষ্ট্র ও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক

ইরান তার ইসলামী নীতিমালার আলোকে বিশ্বের অন্য দেশগুলোর সাথে সন্তোষজনক সম্পর্ক উন্নয়নের ও দৃঢ় করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে।

প্রেসিডেন্ট রাফসানজানী ইয়েমেন আরব প্রজাতন্ত্রের ইরান সফরকারী পরিকল্পনা ও উন্নয়ন মন্ত্রী ফারাজ বিন গানেমকে ২৮ জানুয়ারি ১৯৯২ সাক্ষাৎ প্রদান করেন। এই সফর কালে ইরান-ইয়েমেনের মধ্যে একটি সাংস্কৃতিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

অস্ট্রিয়ায় সফরকালে ইরানী ভারী শিল্পমন্ত্রী হাদীনাজেদ হুসেইনিয়াম সে দেশের অর্থমন্ত্রী ওলয়গেঙ্গ শ্যুশেলের সাথে ১৯ ফেব্রুয়ারি ৯২ অর্থনৈতিক, বাণিজ্য ও শিল্প ক্ষেত্রে সহযোগিতা জোরদার করার বিষয়ে আলোচনা করেন।

৩ মার্চ ৯২ বাকুতে ইরানের টিএন্ডটি মন্ত্রী মুহাম্মদ কারাজী আজেরী প্রেসিডেন্ট আয়াজ মুতালিভবের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় তারা ৩ শমাইক্রোওয়েভ টেলিফোন চ্যালেন চালুর বিষয়ে আলোচনা করেন।

৩০ জুন (১৯৯২) ইরানের প্রথম উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলী  মুহাম্মদ বেশারতী ইরনার সাথে এক সাক্ষাৎকারে ইরানী প্রেসিডেন্ট আকবর হাশেমী রাফসানজানী ও সৌদি আরবের বাদশাহ ফাহদের শীঘ্রই একে অন্যের দেশ সফর ও সাক্ষাতে মিলিত হবার কথা ঘোষণা করেন।

১ জুলাই প্রেসিডেন্ট রাফসানজানী ও সফররত তাজিক প্রেসিডেন্ট রহমান নবিয়েভ তেহরানে একটি যৌথ ইশতেহার প্রকাশ করেন।

১৯ সেপ্টেম্বর সাবেক সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচভের বিশেষ দূত ইয়েভগেনি প্রিমাকভ একটি আর্থ-রাজনৈতিক প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়ে দুই দিনের সফর শেষ করে তেহরান ত্যাগ করেন।

ইন্দোনেশীয় বাণিজ্যমন্ত্রী আবেরীন এম সেবিগার ১৩ অক্টোবর তেহরান পৌঁছেন।

১০ নভেম্বর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. বেলায়েতী ভারতীয় প্রেসিডেন্ট শংকর দয়াল শর্মা ও প্রধানমন্ত্রী নবসীমা রাওয়ের সাথে পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেন।

ফ্রান্স ইরানের সাথে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরো জোরদার করার আগ্রহ ব্যক্ত করেছে। দেশটির জুনিয়র বাণিজ্যমন্ত্রী ব্রুথো ডুরিয়েক্সাস ৯ ও ১০ অক্টোবর (১৯৯২) ইরান সফর করেন।

২৮ জুন তেহরানে এসকাপের সদস্য রাষ্ট্রসমূহের একটি সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট রাফসানজানী ভাষণ দেন।

১০ নভেম্বর তেহরানে আইডিবি-র ১৭তম বার্ষিক সভা অনুষ্ঠিত হয়।

অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংস্থা (ইকো)’ প্রশ্নে রাফসানজানী

অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংস্থ’ (ইকো) গঠন, সম্প্রসারণ ও একে দৃঢ় ভিত্তির ওপর স্থাপনের জন্য অগ্রণী ও সোচ্চার ভূমিকা রাখে। ১৯ ফেব্রুয়ারি (১৯৯২) ইরানী প্রেসিডেন্ট রাফসানজানী এই সংস্থাটির ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক প্রতিরক্ষা জোটে রূপ লাভের সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেন। তিনি বলেন, বিধান অনুযায়ী এটি একটি অর্থনৈতিক সংস্থা, যার মধ্যে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমও অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু এটি রাজনৈতিক বা নিরাপত্তা জোটের রূপ নিতে পারবে না। তিনি বলেন, তেমনটি করতে চাইলে সংস্থার গঠনতন্ত্রের ধারাগুলো সম্পূর্ণ বদলে দিতে হবে। প্রেসিডেন্ট ইকো-র দুইদিনব্যাপী র্শীষ সম্মেলন শেষে সাংবাদিকদের সাথে আলোচনাকালে এ কথা বলেন। সম্মেলনে ইকোর মূল সদস্য আজারবাইজান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কিরঘিজিস্তান ও তাজিস্তিানের রাষ্ট্রপ্রধান ও উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা অংশ নেন। সম্মেলনে কাজাখস্তান পর্যবেক্ষক হিসাবে অংশ নেয়। কারণ, দেশটি এখনো সদস্য পদের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে দরখাস্ত করেনি।

আইডিবি, ইফাড, ইউনেস্কো, এসকাপ ইরানের ভূমিকাকে প্রশংসা করে।

রমযানের শেষ শুক্রবারকে আল-কুদ্স দিবসঘোষণা করে বায়তুল মুকাদ্দাসকে মুক্ত করার পরিকল্পনা ইরান অব্যাহত রাখে।

সালমান রুশদী : চোরের মতো উপস্থিতি

১৫ জানুয়ারি ৯৩ বার্তা সংস্থা এএফপি একটি সংবাদ প্রচার করে : ব্রিটিশ লেখক সালমান রুশদী (১৫ জানুয়ারি) দিনের শেষে ডাবলিনে তথ্য প্রবাহের স্বাধীনতাসংক্রান্ত এক সম্মেলনে যোগ দেয়। ইরানের হত্যা হুমকির পর থেকে বিতর্কিত এই লেখক লুকিয়ে বেড়াচ্ছে। এই সম্মেলনে তার যোগদান সম্পর্কে কোন ঘোষণা দেয়া হয়নি। চোরের মতো সে সম্মেলনে যোগ দেয়। ভারতীয় বংশোদ্ভূত লেখক সালমান রুশদীর মাথার ওপর ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেইনী (রহ.)-এর ঘোষিত মৃত্যুদণ্ডের আদেশ ঝুলছে। ইসলামের অবমাননা করে দি স্যাটানিক ভার্সেসবই লেখার দায়ে ইমাম খোমেইনী ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাকে হত্যার নির্দেশ দেন। সেই থেকে সালমান রুশদী গোপন জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে।

হজ : সামগ্রিকতার উন্মোচন

বিশ্বমুসলিমের মহান সমাবেশ ঘটে আরাফাতের মাঠে। ইসলামের অন্যতম রুকন বা স্তম্ভ এই হজ অনুষ্ঠান। এই হজের আছে ধর্মীয় তাৎপর্য। আছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক তাৎপর্য এবং সর্বোপরি ও গুরুত্বের সাথে আছে রাজনৈতিক তাৎপর্য। রাসূলে করীম (সা.) বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণে আরাফাতের ময়দানে বিশ্বমুসলিমের জন্য কিছু স্থায়ী নির্দেশনা প্রদান করেছিলেন। এর আগের বছরের হজ তথা নবম হিজরির হজে কাফের-মুশরিকদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ বা বারাআতের ঘোষণা প্রচার করা হয়। এই রাজনৈতিক আচরণ এবং রাসূলের বিদায় হজের ভাষণের আলোকে পবিত্র হজ উদ্যাপন বিগত শত শত বছর থেকে অনুপস্থিতই থেকে গেছে। ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর নির্দেশনা অনুযায়ী ইরানী হাজী ও অন্য দেশের কিছু অংশের হাজীরা হজ পালন করতে গিয়ে কাফের ও মুশরিকদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দিতে শুরু করেন। ইমাম শিখিয়েছেন, আরাফাতের ময়দানে বিশ্বমুসলিমকে সমবেত হয়ে ইসলাম তথা মুসলিমদের শত্রুদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দিতে হবে। বিশ্বমানবতা ও মুসলিমদের শত্রুদের প্রতিরোধ করতে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। নিপীড়িত মানবতা ও মযলুম মুসলিমদের রক্ষার কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। ইমামের এই শিক্ষায় উজ্জীবিত হয়েই হাজীদের, বিশেষত ইরানী হাজীদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ইসরাইলের ধ্বংস কামনা করে স্লোগান দিতে দেখা গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্মান ও স্বার্থহানি ঘটছে দেখে ১৯৮৭ সালে সৌদি সরকার স্লোগানরত আল্লাহর মেহমান হাজীদের গুলি করে শহীদ করে। সেবার চার শতাধিক হাজী শাহাদাত লাভ করেন। মুসলিমদের শত্রু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য দুশমনদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দিতে সৌদি সরকার সম্মত না হওয়ায় ইরান তিন বছর হজ বয়কট করেছিল। পরে সৌদি সরকার হাজীদেরকে নিয়মতান্ত্রিক ও শৃঙ্খলার সাথে বিক্ষোভ প্রদর্শনের অনুমতি দিলে ইরান পুনরায় হজে অংশ নিতে শুরু করে।

২২ অকেটাবর ৯২ ইরানী প্রেসিডেন্ট আলী আকবর হাশেমী রাফসানজানী তেহরানে মহান হজ কংগ্রেসের উদ্বোধন করেন। প্রেসিডেন্ট বলেন, ইরান নিয়মতান্ত্রিকভাবে হজ অনুষ্ঠান পালন করতে চায়- যেখানে রাজনৈতিক ইস্যুগুলো ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতাকে ব্যাঘাত না ঘটিয়েই উত্থাপিত হবে। তিনি বাড়াবাড়ি পরিহার করে হজ উদ্যাপনের আহ্বান জানান।

ইসলামী বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী ২৫ মে ৯২ এক ফতোয়ায় বলেন, মুসলিম হজ যাত্রীদের এমন কোনো আনুষ্ঠানিকতা পালন হারাম, যা মুসলিমদের মধ্যে বিবাদের জন্ম দেয় এবং ইসলামকে দুর্বল করে। বিশ্বাসীদের তেমন কাজ পরিহার করা কর্তব্য।

 (নিউজলেটার, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৩)


ইসলামী সাধারণ বাজার : আবশ্যকতা ও সমস্যা

মুহাম্মদ আলী হাকী

 অধিকাংশ ইসলামী দেশ কৃষিপ্রধান এবং অশিল্পায়িত। এসব দেশের অধিকাংশের অভ্যন্তরীণ আয়ের সিংহভাগ আসে কৃষিখাত থেকে এবং এর সক্রিয় জনসংখ্যার প্রধান অংশ কৃষিকাজের সাথে জড়িত। এসব কিছু বিবেচনায় রেখে বলা যায় যে, ইসলামী দেশগুলো এখনও কৃষি খাতে বিরাট সমস্যার মোকাবিলা করছে এবং অধিকাংশ ইসলামী দেশই খাদ্যশস্য আমদানি করে থাকে। আবাদযোগ্য জমিতে জনসংখ্যার উচ্চহার, কৃষিখাতে প্রাথমিক প্রযুক্তির ব্যবহার, সীমিত বিনিয়োগ এবং উপযুক্ত কৃষি নীতির অভাবের দরুন ইসলামী দেশসমূহে কৃষিখাত থেকে ভালো বা সন্তোষজনক ফল আসছে না এবং সে কারণে তারা জনসংখ্যার প্রয়োজনীয় চাহিদাও পূরণ করতে সক্ষম হচ্ছে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় ইসলামী দেশগুলোর কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির হার খুব আশাব্যঞ্জক নয়। শুধু তাই নয়, বিশ্বের গড় প্রবৃদ্ধিতে সার্বিকভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর হার নিম্ন। কৃষিপণ্য ও খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও ইসলামী দেশগুলোতে কৃষিখাতের কর্মকাণ্ড খুবই দুর্বল। উপরন্তু, কৃষিপদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে থাকায় কৃষি উৎপাদন বলতে গেলে পরিবেশগত বা আবহাওয়া পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল। আর সে কারণে কৃষি উৎপাদনও মারাত্মকভাবে ওঠানামা করে।

শিল্পায়নের দৃষ্টিকোণ থেকেও ইসলামী দেশগুলো কোন অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি। প্রযুক্তি ক্ষেত্রে দুর্বলতার কারণে এসব দেশের বিরাজমান কাঁচামাল অব্যবহৃত থাকে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে অত্যন্ত কম মূল্যে শিল্পোন্নত দেশগুলোর কাছে তা বিক্রি করে দিতে হয়। দেশীয় বাজারের ওপর নানা রকমের বিধি-নিষেধ এবং বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের যোগ্যতাসম্পন্ন জনশক্তির অভাব ইসলামী দেশগুলোর শিল্পোন্নয়নকে কঠিন করে তুলেছে। সর্বোপরি, এসব দেশের শিল্পগত ভিত্তি খুব দুর্বল হওয়ার তাদের বর্তমান শিল্পগুলোর অধিকাংশই হালকা ধরনের, যার কাঁচামালও আমদানি করতে হয়। এ কারণে এসব দেশের বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশের বাজারে ব্যয় করতে হয়। এর ফলে একদিকে এসব দেশের নিজস্ব পুঁজি হ্রাস পাচ্ছে এবং অপরদিকে জাতীয় ও অভ্যন্তরীণ কাঁচামাল বা সম্পদের পরোক্ষ ব্যবহার শিল্প উৎপাদনকে ব্যাহত করছে। সব মিলিয়ে, ইসলামী দেশগুলোর শিল্পখাতে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন শতকরা ১০ ভাগেরও কম। পক্ষান্তরে, এসব দেশের অর্থনীতিতে চাকরি ও বাণিজ্যের অংশ বেশি এবং তা মোট জাতীয় উৎপাদনের শতকরা ৪০ ভাগেরও বেশি।

অধিকাংশ ইসলামী দেশের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ ও জ্বালানি সম্পদ। এসব সম্পদ যদি নিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যবহার করা যায় তাহলে তা দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বিশ্বের তেল সম্পদের এক বিরাট অংশ এবং বিশ্ব কাঁচামালের অধিকাংশ এসব দেশেই পাওয়া যায়। অথচ পর্যাপ্ত তথ্যের অভাব, বিরাজমান খনিসমূহকে উপযুক্তভাবে ব্যবহার করার সামর্থ্যরে অভাব, বিশেষ যোগ্যতাসম্পন্ন জনশক্তি ও সুসংগঠিত প্রতিষ্ঠানের অভাব এবং শিল্প স্থাপনে সামর্থ্যরে অভাব প্রভৃতি কারণে এসব দেশে খনিজ পণ্যের উৎপাদন অত্যন্ত সীমিত, যার কাঁচামালের অধিকাংশই রফতানি করা যায়।

কয়েকটি দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্কের উন্নয়ন নির্ভর করে সেসব দেশের উৎপাদন সুবিধাদির ওপর। অতএব, এ উদ্দেশ্যে কেউ অগ্রসর হলে তাকে অন্যের উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে পরিচিত হতে হবে এবং তাদের চাহিদা জানতে হবে। সত্যি বলতে কি, ইসলামী দেশগুলোর অধিকাংশই একই ধরনের দ্রব্যের উৎপাদক এবং কাঁচা খনিজ সম্পদের রফতানিকারক। তাই এদের মধ্যে সহযোগিতা ও লেনদেন বেশি হতে পারে না। সাধারণভাবে ইসলামী দেশসমূহের একটি বিরাট অংশ তাদের উৎপাদিত পণ্য, খনিজ সম্পদ ও কাঁচামাল রফতানির ওপর খুব বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল।

এক নম্বর ছকে কয়েকটি দেশের কাঁচামালের ওপর রফতানি নির্ভরতার হার প্রদর্শন করা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ইসলামী দেশগুলোর অংশ অত্যন্ত কম। ১৯৮৯ সালের বিশ্বের সমগ্র রফতানির পরিমাণ ছিল শতকরা ৭ ভাগেরও কম। ১৯৮০ সালে এই পরিমাণ দাঁড়ায় শতকরা ১৭ ভাগে। এছাড়া অধিকাংশ ইসলামী দেশের সাথে উন্নত দেশগুলোর লেনদেনের ভারসাম্য নেতিবাচক।

 সাধারণ বাজার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইসলামী  বিশ্বের অবস্থা মূল্যায়ন

১. সদস্য সংখ্যা

বিশ্বে ইসলামী দেশের সংখ্যা প্রায় ৫০টি। বর্তমান বিশ্বে যতগুলো অর্থনৈতিক ইউনিয়ন আছে তাতে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা এসব দেশের মোট সংখ্যার এক চতুর্থাংশ অতিক্রম করেনি। এই সংখ্যা একটি অভিন্ন বা সাধারণ ইসলামী বাজার প্রতিষ্ঠার পথে একটি বাধা। রাষ্ট্র সংখ্যা অধিক হওয়ার কারণে বিভিন্ন বিষয়ে তারা কেউ এদিকে আবার কেউ ওদিকে যেতে চাইবে। সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে সবগুলোর মধ্যে একটি সমন্বয় প্রতিষ্ঠা করা খুব কঠিন হবে। অথচ যে কোন ঐক্যের জন্য তা অপরিহার্য। এ অবস্থা কেবল সাফল্যের ওপরই প্রভাব ফেলবে না, বরং কর্মকাণ্ড ও ব্যয়কেও প্রভাবিত করবে। এ কারণে ইসলামী দেশগুলোর মধ্যে একটি সাধারণ বাজার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে পর্যায়ক্রমিক প্রক্রিয়া গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজন হলে সকল ইসলামী দেশের একটি ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরিবর্তে প্রথমে ছোট ছোট ও সীমিত সংখ্যক ইসলামী দেশ নিয়ে একটি ইউনিয়ন গঠন করা যেতে পারে এবং পরে ক্রমিক পর্যায়ে অর্জিত সাফল্য ও অভিজ্ঞতার আলোকে এই ইউনিয়নকে সম্প্রসারণ এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে সকল ইসলামী দেশকে একটি সাধারণ বাজারের আওতায় এনে তাদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা যায়। এভাবে এসব দেশ এবং তাদের সম্পদ ও জনসংখ্যা একটি শক্তিশালী পর্যায়ে পৌঁছতে এবং নিজেদের গুরুত্ব ও ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সক্ষম হবে।

 ২. ভৌগোলিক বিস্তার

ইসলামী রাষ্ট্র এশিয়া ও আফ্রিকা এই দু’টি মহাদেশের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে রয়েছে। সে কারণে ইসলামী দেশগুলোর এই সাধারণ বাজারকে কোন আঞ্চলিক ঐক্য বলা যাবে না। সচরাচর একটি সাধারণ বাজার প্রতিষ্ঠিত হয় ঐসব দেশকে নিয়ে যেসব দেশ ভৌগোলিক দিক থেকে একে অপর থেকে দূরে নয়। ইসলামী দেশগুলোর এই বিরাট দূরত্ব তাদের মধ্যে একটি সাধারণ বাজার প্রতিষ্ঠার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসাবে দেখা দিতে পারে। বর্তমান অবস্থার বিবেচনায় এই ভৌগোলিক বিস্তৃতি এবং যেখানে অধিকাংশ ইসলামী দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্বল সেখানে এই সমস্যাটি আরো বেশি করে দেখা দেবে। ইসলামী দেশগুলোর মধ্যকার এই বিরাট দূরত্ব তাদের উৎপাদিত পণ্য সামগ্রীকেও ব্যয়বহুল করে তুলবে। মূলত একটি সাধারণ বাজার প্রতিষ্ঠার পক্ষে একটি যুক্তি হচ্ছে রফতানি পণ্যের মূল্য হ্রাসের উদ্দেশ্যে শুল্ক মওকুফ ও পরিবহন ব্যয় কমানো। অতএব, ইসলামী দেশগুলোর মধ্যে রফতানি বৃদ্ধির পথে উচ্চ পরিবহন খরচ স্বয়ং একটি সমস্যা হিসাবে দেখা দেবে।

তাই প্রাথমিক পর্যায়ে এটাই প্রয়োজন হতে পারে যে, একটি বিশেষ অঞ্চলে অবস্থিত ইসলামী দেশগুলো একটি সাধারণ বাজার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালাবে এবং পরিবর্তীকালে পর্যায়ক্রমে এই সাধারণ বাজার অন্যান্য অঞ্চলের দেশগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করবে।

 ৩. অর্থনৈতিক অবস্থার বিভিন্নতা

ইসলামী দেশগুলোর মধ্যে বাজার ব্যবস্থা, উৎপাদন পরিব্যাপ্তি, নাগরিকদের আয় ও প্রাকৃতিক সম্পদের দিক থেকে বিরাট পার্থক্য বিরাজমান। এর দরুন ইসলামী দেশসমূহের সাধারণ বাজার প্রতিষ্ঠা সমস্যার সম্মুখীন হবে। তবে বাজার প্রতিষ্ঠিত হলে সকল দেশ ঐক্যের সমান সুবিধা ভোগ করবে। সদস্য দেশগুলোর মধ্যে অবাধ বাণিজ্য চালু হলে যেসব দেশের উৎপাদন ক্ষমতা বেশি সেসব দেশ বেশি লাভবান হবে। অপরদিকে যেসব দেশের জনসংখ্যা বেশি সেসব দেশ স্বাভাবিকভাবেই বেশি পণ্য ভোগ করবে। তাই দেখা যায়, অর্থনৈতিক অবস্থার দৃষ্টিকোণ থেকে পার্থক্যের দরুন সাধারণ বাজার প্রতিষ্ঠিত হলে ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে আয়ের ব্যবধান বেড়ে যাবে। এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য কিছু নীতি নির্ধারণ করা যেতে পারে। যেমন দরিদ্র দেশগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দান এই সমস্যার সমাধান করতে পারে এবং এর মাধ্যমে ছোট দেশগুলোতে সহযোগিতাও বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু সমস্যা হলো দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের জন্য বর্তমান স্বার্থকে খাটো করে দেখার মতো পর্যায়ে অধিকাংশ ইসলামী দেশই উপনীত হতে পারেনি।

৪. প্রযুক্তিগত দুর্বলতা

কোন ইসলামী দেশকে শিল্পোন্নত দেশ হিসাবে বিবেচনা করা যায় না। সাধারণভাবে এসব দেশের শিল্প উন্নত নয়। শিল্পোন্নত দেশগুলোর উৎপাদিত পণ্য সামগ্রীর ওপর ইসলামী দেশগুলোর এই নির্ভরশীলতা খুব সহজে কাটিয়ে ওঠা যাবে না। বর্তমানে এসব দেশের অধিকাংশই উন্নত দেশগুলো থেকে গুরুত্বপূর্ণ কৃষি উপকরণ পর্যন্ত আমদানি করে থাকে। তাই তাদের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী বিশেষ মান অর্জন করলেও ইউরোপীয় সাধারণ বাজারের মতো স্বল্প সময়ে তারা একটি সাধারণ বাজার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি প্রত্যাশা করতে পারে না। তবে এই সাধারণ বাজার বাণিজ্য প্রতিষ্ঠার বিষয়টি প্রত্যাশা করতে পারে না। তবে এই সাধারণ বাজার বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের ধরনে হতে পারে এবং তা সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে কৃষিপণ্য, তেল ও কাঁচামাল বিনিময় করতে পারে, শিল্পোৎপাদিত পণ্য নয়। অনৈসলামী দেশগুলো থেকে ইসলামী দেশগুলোতে শিল্পোৎপাদিত পণ্য আমদানির পরিমাণ শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ।

৫. অন্যান্য বিষয়

পূর্বোল্লিখিত বিষয়সমূহ ছাড়াও অন্য আরো কতিপয় বিষয় ইসলামী দেশগুলোর মধ্যে একটি সাধারণ বাজার প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে প্রভাবিত করতে পারে। সেসবের মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক কর্মসূচিতে আর্থিক ও মুদ্রা নীতির পার্থক্য, অভিন্ন কৃষিপণ্য উৎপাদন (সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া), শিল্প-কারখানায় কাঁচামালের চাহিদা, সঠিক পরিসংখ্যান ও তথ্য নেটওয়ার্কের অভাব এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতির পার্থক্য।

ইসলামী দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতার প্রধান স্মারক হচ্ছে ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি)। কিন্তু ইসলামী সম্মেলন সংস্থার কাঠামোয় যে অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে তা অত্যন্ত সীমিত। এমনকি এই সংস্থা একটি অভিন্ন বা সাধারণ বাজারের সাধারণ কোন রূপও দান করতে পারেনি। লেনদেনের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহারের মতো বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হওয়া সত্ত্বেও কোন অগ্রগতি হয়নি। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামী দেশসমূহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে গণ্য। অতএব, একটি সাধারণ বাজার প্রতিষ্ঠিত হলে এবং সে বাজার যদি ঐসব দেশের অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা সংক্রান্ত বিশেষ সমস্যাগুলো দূরীভূত করতে পারে তাহলে তারা এই সাধারণ বাজারকে অগ্রাধিকার দিয়ে বিবেচনা করবে। উন্নত কিংবা উন্নয়নশীল, সব ধরনের দেশ নিয়ে গঠিত একটি সাধারণ বাজারের বর্তমান অভিজ্ঞতা থেকে বুঝা যায় যে, এ ধরনের ইউনিয়নের মাধ্যমে সদস্য দেশগুলো তাদের বিশেষ ধরনের উৎপাদিত পণ্যের বাণিজ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি ও বাজার সম্প্রসারণ করতে পারে। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামী দেশগুলো আকার-আকৃতি, বিস্তৃতি, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত দুর্বলতা, আয়-উপার্জনের বিভিন্নতা, কৃষিপণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা, বাজার বিভিন্নতা এবং অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীলতার মতো বড় বড় সমস্যার মোকাবিলা করছে। এসবই তাদের অর্থনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার পথে বাধা।

অবশ্য, এতদসত্ত্বেও ইসলামী দেশসমূহের সম্ভাবনাময় দিকগুলো খাটো করে দেখার মতো নয়। এই দেশগুলো বাস্তববাদী হলে এবং বিশ্বের অর্থনৈতিক গতিধারা বিশেষ করে সাম্প্রতিক কালের অর্থনৈতিক গতিধারার দিকে দৃষ্টিপাত করে একে অপরের সাথে কোন না কোন ধরনের অর্থনৈতিক সহযোগিতামূলক সংগঠন গড়ে তোলে তাদের আর্থিক ক্ষমতা, জনসংখ্যা, উন্নত দেশগুলো থেকে আমদানি ও ভোগের হার, বিপুল পরিমাণের কাচামাল বিশেষতঃ তাদের তেল সম্পদ, অর্থনৈতিক দিক থেকে উন্নত দেশগুলোর সাথে তাদের সম্পর্ক নির্ধারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এমনকি তাদের ওপর নিজেদের মর্যাদাও বৃদ্ধি করতে পারে। পরিশেষে আমরা যদি মনে করি যে, একটি সাধারণ বাজার এ মুহূর্তে কোনভাবেই প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়, তাহলে হয় আঞ্চলিক ভিত্তিতে অথবা অন্য কোনভাবে ক্রমিক পর্যায়ে একটি বাজার প্রতিষ্ঠার দিকে অগ্রসর হয়ে ধীরে ধীরে এ পথের বিরাজমান সমস্যাগুলো কাটিয়ে ওঠা যেতে পারে।

ইসলামী দেশগুলোর একটি সাধারণ বাজার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা, এর সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তোলা এবং এর সকল সদস্য দেশের স্বার্থ নিশ্চিত করার ধারণাটি তাদের রাজনৈতিক অবস্থা ও চিন্তার বিপরীত। কেননা, তারা কেউ অভিন্ন কোন রাজনৈতিক নীতি অনুসরণ করে না। আর যদি তারা অভিন্ন রাজনৈতিক নীতি অনুসরণ না করে, তাহলে একটি অভিন্ন সাধারণ বাজার প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থাও করতে পারবে না। বিভিন্ন অর্থনৈতিক ইউনিয়নের অভিজ্ঞতা থেকে প্রমাণিত হয় যে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আদর্শিক নীতির সমন্বয় সাধনের মাধ্যমেই কেবল একটি সাধারণ বাজার প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হতে পারে।


কৃষি, শিল্প ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে পশ্চাদপদতার কারণেই মুসলিম বিশ্বে অর্থনৈতিক সমস্যা বিরাজ করছে

ভৌগোলিকভাবে হিসাব করতে গেলে ইসলামী দেশগুলোর অধিকাংশই মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর থেকে মধ্য আফ্রিকার মধ্যে অবস্থিত। দীর্ঘদিন থেকেই এই দেশগুলো বিদেশীদের ঔপনিবেশিক শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে আসছে।

আর এ কারণেই ইসলামী দেশসমূহের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কাঠামোর ভিত্তি রচিত হয়েছে ঔপনিবেশিক শাসকদের স্বার্থের অনুকূলে। এটি এমন একটি ব্যাপার যে, মুসলিম দেশগুলোর কতিপয় দেশে এখনো সেই ঔপনিবেশিক রাজনৈতিক কাঠামোই বিরাজ করছে।

মোটের ওপর বিশ্বব্যাংকের প্রদত্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী এই দেশগুলোই হচ্ছে দরিদ্র বা অনুন্নত। আর এগুলোকেই বলা হয় তৃতীয় বিশ্বের দেশ। এই দেশগুলো অসংখ্য সমস্যার সম্মুখীন। এ প্রসঙ্গে আমরা অর্থনৈতিক নির্ভরতা, অর্থনৈতিক দ্বৈতবাদ বা দ্বৈতাবস্থা, সেবামূলক খাতসমূহের বৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় হ্রাস, সম্পদের অসম বণ্টন, জনসংখ্যার হার বৃদ্ধি এবং বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত অসম্পূর্ণভাবে কথা বলতে পারি, এ সবই হচ্ছে এ দেশগুলোর বড় ধরনের সমস্যা।

জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন বিষয়ক সম্মেলন (UNCTAD) কর্তৃক প্রদত্ত ১৯৮৫ সালের পরিসংখ্যান মোতাবেক বিশ্ব জনসংখ্যা খাতে ১৯৮২ সালে ইসলামী দেশগুলোর জনসংখ্যার পরিমাণ ছিল শতকরা ১৫ ভাগ অর্থাৎ ৭০ কোটি। এই সংখ্যা শিল্পোন্নত দেশগুলোর তুলনায় খুবই কম এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর লোক সংখ্যার এক তৃতীয়াংশ। অথচ পৃথিবীতে যে পরিমাণ ভূমি রয়েছে তার শতকরা ১৯ ভাগই রয়েছে উপরিউক্ত জনগোষ্ঠীর হাতে। ১৯৮২ সালের হিসাব অনুযায়ী বিশ্বের মোট উৎপাদনের শতকরা ৬.৬ ভাগ ছিল তাদের হাতে। আর এ সংখ্যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর মোট জাতীয় উৎপাদনের এক তৃতীয়াংশের মতো এবং শিল্পোন্নত দেশগুলোর মোট জাতীয় উৎপাদনের এক দশমাংশ বলা যায়। মুসলিম দেশগুলোর প্রাকৃতিক সম্পদ উল্লেখযোগ্য। এ সম্পদ মুসলিম বিশ্বের শক্তি হিসাবে কাজ করতে পারে। উল্লেখ্য, বিশ্বের অপরিশোধিত তেল এবং গ্যাসের উল্লেখযোগ্য উৎসসমূহ হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায়। এ ছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত মুসলিম দেশগুলোরও রয়েছে পর্যাপ্ত সম্পদ, যেমন অপরিশোধিত তেল, রাবার এবং ধান।

যদিও আফ্রিকা মহাদেশ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ, কিন্তু এই মহাদেশে মুসলিম দেশগুলো শুষ্ক বা খরা অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ার কারণে সেখানে প্রাকৃতিক সম্পদ কম। অন্যদিকে নিরক্ষরেখা এবং ভূমধ্য সাগরের দক্ষিণ উপকূলের মধ্যবর্তী অঞ্চলের দেশগুলোর প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণ সীমাবদ্ধ। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিস্তৃত মুসলিম অঞ্চল মরুভূমি দ্বারা পরিবেষ্টিত। ১৯৮৫ সালে মুসলিম দেশগুলোর এক চতুর্থাংশেরও কম দেশে শিল্প কারখানা, খনি এবং নির্মাণ খাতে জনগণের এক তৃতীয়াংশের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা ছিল। এই দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমীরাত, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া, সিরিয়া, কুয়েত, লিবিয়া এবং ইরান। এই দেশগুলোর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা ছিল যথাক্রমে শতকরা ৩৮, ৩৬, ৩১, ২৯, ৩২, ২৯ ও ৩২ ভাগ। এই দেশগুলোর অর্ধেকের মধ্যে কর্মশক্তির শতকরা ৩০ ভাগ নিয়োজিত হচ্ছে সার্ভিস সেক্টরে। ঠিক একই সালে ইসলামী দেশগুলোর তিন চতুর্থাংশে অন্যান্য সেক্টরের তুলনায় কৃষি ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের হার ছিল সর্বাধিক।

উৎপাদনের পরিসংখ্যানের প্রতি যদি আমরা দৃষ্টি নিবন্ধ করি তাহলে আমরা দেখতে পাব যে, পাঁচটি ইসলামী দেশে কৃষি উৎপাদনই সবচেয়ে বেশি। এছাড়া ২৫টি দেশে সার্ভিস সেক্টরে উৎপাদনের পরিমাণ বেশি এবং ৮টি দেশে সর্বাধিক উৎপাদন হচ্ছে শিল্প ও খনিজ খাতে। আর এই ৮টি দেশের মধ্যে শুধু আলজেরিয়া এবং আরব আমীরাতের মোট জাতীয় উৎপাদনের শতকরা ১০ ভাগেরও বেশি এসেছে শিল্পখাত থেকে। আর অন্যান্য দেশ তাদের উৎপাদনের জন্য তেলের ওপর নির্ভরশীল।

যায়নবাদী ইসরাইল আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনকে এই মর্মে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে যে, আমেরিকা তথা পশ্চিমাদের প্রধান শত্রু হচ্ছে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান। ইসরাইল ক্লিনটনকে ‘এই দেশটি’ (ইরান) সম্পর্কে সদা সতর্ক থাকতে উপদেশ দিয়েছে।

ইসরাইলের মতে ইরাক বা সাদ্দাম নয়, পশ্চিম এশিয়ার নিরাপত্তার সবচেয়ে বড় বিপদ হলো তেহরান। কেননা, প্রত্যেক ব্যাপারেই ইরানের একটি স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি আছে আর আছে আলাদা মনোবল ও তৎপরতা, যা তার জীবনবোধ ও সংস্কৃতি থেকে জাত। ইসরাইল মনে করে, যদি এই মুহূর্তে ইরানের দুর্বার গতি ঠেকানো না যায়, তাহলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সে পরমাণু শক্তির অধিকারী দেশে পরিণত হবে এবং পাশ্চাত্যের বিরোধী শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করবে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক মীযান’ এই খবর পরিবেশন করে।

যদিও ১৯৮৫ সালে এ দেশগুলোতে বিশ্ব আমদানি ও রফতানি বাণিজ্যের যথাক্রমে শতকরা ৮.৫ ভাগ ও ১০ ভাগ সংঘটিত হয়, কিন্তু নিজেদের মধ্যে সংঘটিত হয় তার সামান্য ভগ্নাংশ মাত্র। এই সামান্য বাণিজ্যও হয়েছে আবার তেল এবং তৃতীয় বিশ্বে উৎপাদিত সামগ্রীকে কেন্দ্র করে।

মুসলিম বিশ্বের অর্থনৈতিক কাঠামোর দুর্বলতার হেতু হিসাবে যেসব কারণ প্রধানত দায়ী সেগুলো হলো বিবিধ অর্থনৈতিক কাঠামোর সাংঘর্ষিক বা বিপরীতধর্মী উপস্থিতি, প্রাকৃতিক সম্পদগুলোর যথার্থ ব্যবহারের অযোগ্যতা, উৎপাদন সমস্যা, পণ্য বিনিময় সমস্যা, পুঁজি বিনিয়োগ এবং বন্ধ্যা শিল্পা-কাঠামো প্রভৃতি।

মুসলিম দেশগুলোর বহুবিধ অর্থনৈতিক সমস্যার মধ্যে যে সমস্যাটি সবচেয়ে প্রকট তা হলো খাদ্য-সমস্যা। এই কারণটি তাদেরকে অন্যান্য ক্ষেত্রে বিশ্ববাজার ব্যবস্থার অসহায় শিকারে পরিণত করেছে। উক্ত সমস্যার জন্য কৃষি প্রযুক্তি ও কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট শিল্পক্ষেত্রে কাঠামোগত পশ্চাদপদতাকেই প্রধানত দায়ী করা যায়। কৃষিতে এই পশ্চাদপদতার জন্য বেশির ভাগ মুসলিম দেশে খাদ্যঘাটতি প্রায়ই লেগে থাকে। যেখানে এসব মুসলিম দেশে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির হার ৫% হওয়া দরকার সেখানে তা বৃদ্ধি পাচ্ছে মাত্র ১.৫% হার। ফলশ্রুতিতে ১৯৭৫ সালে এ দেশগুলোর খাদ্য আমদানি যেখানে ছিল ২০ মিলিয়ন টন তা ১৯৮৩ সালে এসে দাঁড়ায় ৩৯ মিলিয়ন টনে।

শিল্প ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে পশ্চাদপদতার কারণে বিশ্ব শিল্প উৎপাদনের ক্ষেত্রেও তাদের ভূমিকা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। এর অবশ্যম্ভাবী ফলাফল যা দাঁড়িয়েছে তা হলো শিল্পজাত সামগ্রীর জন্য এ দেশগুলো অন্যান্য দেশের ওপর ব্যাপকহারে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। শিল্প ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে মুসলিম বিশ্বের এই বিস্ময়কর পশ্চাদপদতার জন্য যে কারণটি বিশেষভাবে দায়ী তা হলো নিরক্ষতার উচ্চহার ও বিশেষজ্ঞের অভাব। চৌদ্দটি মুসলিম দেশে নিরক্ষরতার হার ৮০% এর ওপর এবং অবশিষ্ট ৩২টি মুসলিম দেশের নিরক্ষর মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি। এই বিষয়টি এ দেশগুলোর শিল্প উন্নয়নকে চরমভাবে ব্যাহত করছে।

১৯৮১ সালে উন্নত দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির তুলনায় মুসলিম দেশগুলোর সম্মিলিত প্রবৃদ্ধির হার ২%- যা ব্রাজিলের মত একটি উন্নয়নশীল দেশের প্রবৃদ্ধির চেয়েও কম।

ইসলামী বিশ্বের শিল্প উৎপাদনের ৮৫ ভাগই হয় নয়টি মুসলিম দেশে। বাকি ১৫ ভাগ হয় অবশিষ্ট ৩৭টি মুসলিম দেশে। আর এসব শিল্পের অধিকাংশই হালকাজাতীয় এবং আমদানিনির্ভর।

উপরিউক্ত অধিকাংশ মুসলিম দেশ কাঁচমাল রফতানি করে এবং খাদ্য সামগ্রী ও শিল্পজাত পণ্য আমদানি করে। ১৯৮৫ সালে এসব দেশের রফতানির দুই তৃতীয়াংশই ছিল কাঁচামাল। অর্থনৈতিক কাঠামোতে দুর্বলতা হেতু এ দেশগুলোকে স্বভাবতই বিদেশী সাহায্য ও বিনিয়োগের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। এই নির্ভরশীলতা তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে একটি বড় অন্তরায়। কেননা, যেসব দাতা দেশ এদের ঋণ ও সাহায্য প্রদান করে তারা সাহায্য ও ঋণের ওপর কতিপয় পূর্বশর্ত বসিয়ে দেয় যা প্রায় সময়ই অযৌক্তিক ও অসামঞ্জস্যময় হয়।

(নিউজলেটার, জানুয়ারি ১৯৯৩)


ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে কঠোর ইসলামী পর্দার বিধান

প্রশ্ন : ইরানে ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের পর নারীদেরকে হিজাব পালনে বাধ্য করা হয়েছে। অনেকের ধারণা ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে কঠোর ইসলামী পর্দার বিধান চালু করে নারী সমাজকে আধুনিক জীবনযাপনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে আপনাদের কি ব্যাখ্যা রয়েছে ?

জবাব : আপনার চিঠি ও প্রশ্নের জন্য ধন্যবাদ। জবাবের শুরুতেই একটি বিষয় জেনে রাখা দরকার যে,  ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের পর ইরানে মেয়েদেরকে হিজাব পালনে বাধ্য করা হয়নি; মেয়েরা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ইসলামী বিপ্লবকে সমর্থন করে স্বেচ্ছায় হিজাব পালনে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। জোর করে তাদের ওপর হিজাব চাপিয়ে দেয়া হয়নি। আপনার প্রশ্নের দ্বিতীয়াংশের জবাব প্রসঙ্গে নিম্নলিখিত দিকগুলো প্রণিধানযোগ্য।

  • নারীদের প্রকৃত আনন্দ-উল্লাস ও অবসর-বিনোদনের উপযুক্ত স্থান হলো পারিবারিক পরিবেশ, কোন বাজার বা রাস্তাঘাট নয়। বিশেষ করে ইসলামী ইরানে নারীদের এই আর্দশ মহিমায় উজ্জ্বল। আপনার যদি কখনো সুযোগ হয় ইরানে এসে ঘরোয়া পরিবেশে ইরানী নারীদের অবস্থা দেখে যাবেন। তাহলেই আপনি প্রকৃত অবস্থা উপলব্ধি করতে পারবেন।
  • ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধানে সুস্পষ্টভাবেই নারী-পুরুষের সমান অধিকারকে স্বীকার করা হয়েছে। যেমন সংবিধানের ৩য় পরিচ্ছেদের ১৯ নং ধারায় বলা হয়েছে : ‘জাতি-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল ইরানী নাগরিকের সমান অধিকার রয়েছে। বর্ণ, গোত্র, ভাষা এবং নারী-পুরুষ ভেদে কাউকে পার্থক্য করা হবে না।’

২০ নং ধারায় বলা হয়েছে : ‘নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল নাগরিকই রাষ্ট্রীয় আইনের দ্বারা সমানভাবে সুরক্ষিত এবং ইসলামী মাপকাঠিতে সকল প্রকার মানবিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকার ভোগ করে থাকে।’

২১ নং ধারায় বলা হয়েছে : ‘ইসলামী আদর্শের মাপকাঠিতে নারীদের অধিকার-এর নিশ্চয়তা বিধানের দায়িত্ব রয়েছে সরকারের। সরকারের এই দায়িত্বশীলতার প্রকৃতি হবে নিম্নরূপ :

১. নারীদের ব্যক্তিত্ব বিকাশ এবং তাদের বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক চাহিদা পূরণের নিমিত্ত উপযুক্ত ক্ষেত্র প্রস্তুত করা।

২. মায়েদের, বিশেষ করে তাদের গর্ভাবস্থায় এবং সন্তান লালন-পালনের সময় উত্তম সংরক্ষণ ব্যবস্থা করা ঠিক তেমনি ইয়াতিম সন্তান-সন্ততিকেও রক্ষণাবেক্ষণ করা।

৩. পরিবারের অস্থিত্ব ও মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখার নিমিত্ত যোগ্য পারিবারিক আদালত তৈরি করা।

ইসলামী বিপ্লবের পর নতুন ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে মহিলাদের ভূমিকা নিম্নরূপ :

  • লক্ষ লক্ষ মুসলিম মেয়ে প্রাইমারী স্কুল, হাই স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছে এবং অনেক ক্ষেত্রে ছেলেদের চেয়ে বেশি কৃতিত্ব অর্জন করছে।
  • দেশের ইসলামী পার্লামেন্টে পুরুষের পাশাপাশি মহিলারাও আইন প্রণয়ন কাজে অংশগ্রহণ করছে।
  • হাজার হাজার মহিলা ডাক্তার, প্রফেসর, প্রকৌশলী, অর্থনীতিবিদ, সাংবাদিক, লেখক, বিদূষী, বিজ্ঞানী,আইন পরিষদের সদস্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে পুরুষের পাশাপাশি সমান জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশ সেবায় আত্মনিয়োগ করেছে।
  • বিভিন্ন শ্রেণির মহিলা শিল্পী আগের চেয়ে ভালোভাবে নিজেদের কর্মদক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে।
  • দেশের বিভিন্ন কল-কারখানায়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, মিউনিসিপালিটি এবং রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার কেন্দ্রে অনেক মহিলা পরিচালক হিসাবে বেশ দক্ষতার সাথেই নিজেদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।

মোট কথা উপরিউক্ত দৃষ্টান্ত থেকেই বুঝা যায়, আধুনিক ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বস্তরেই নারীদের স্বর্তঃস্ফূর্ত ভূমিকা রয়েছে। পুরুষের পাশাপাশি সব ক্ষেত্রেই নারীরা দেশ গঠন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করছে। আর এ সবকিছু করছে ইসলামী হিজাবের মধ্যে থেকেই। ইসলামী হিজাব বা পর্দা তাদের মাঝে কোন প্রকার গোঁড়ামি বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি। অধিকন্তু এটা হয়তো অনেকে জানেন না যে, ইসলামী আইন নারীদের পূর্ণ কর্ম-স্বাধীনতা দিয়েছে। তাদের গৃহস্থালি কাজে অবশ্যই আবদ্ধ থাকতে হবে এমন কোন কথা নেই। প্রয়োজনবোধে নারী যদি তার শিশুকে স্তন্যদান করতে না চায় তাহলে স্বামী তাকে সে কাজে বাধ্য করতে পারবে না, অন্য কোন বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। গৃহস্থালি কাজের জন্য চাকর এবং শিশু লালন-পালনের জন্য দাই-মা রাখতে পারবে। এ থেকেই বুঝা যায় যে, ইসলাম নারীকে কত স্বাধীনতা প্রদান করেছে।

এরপরেও যাঁরা ইসলামী হিজাব নিয়ে অযথা দোষ খুঁজে বেড়ান বা পর্দানশীল নারীদের স্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে    মনে করেন তাহলে বলতে হবে তাঁরা প্রকৃত ব্যাপার উপলব্ধি করতে চান না; অপরের ছিদ্রান্বেষণ করাই তাঁদের স্বভাব।


ফিলিস্তিনে ইন্তিফাদার অভ্যুদয় ও তার তৎপরতা

ফিলিস্তিনে দখলদার ইহুদি জান্তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে সোচ্চার এক আন্দোলন ‘ইসলামী জিহাদ’। ’৮০- এর দশকের প্রথম দিকে ফিলিস্তিনে এই ইসলামী জিহাদের কার্যক্রম বেশ দানা বেঁধে উঠে। ইহুদি খ্রিস্টান চক্রের অন্যতম ঘাঁটি জেরুজালেমে তারা ইসলামের স্বাধিকার রক্ষায় আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুসলমানদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পবিত্র ভূমি বায়তুল মোকাদ্দাসে (জেরুজালেম) প্রকৃত ইসলামের চেতনাকে জাগিয়ে তুলে ইহুদি জান্তার মোকাবিলায় ইসলামী জিহাদ এক হুমকি হিসাবে আবির্ভূত হয়।

ফিলিস্তিনী জনগণের মাঝে ইসলামী জিহাদ সাফল্যজনকভাবে নিজেদের কার্যক্রম ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়। বিভিন্ন জনপ্রিয় কাজ, সাংগঠনিক দক্ষতা এবং ইসলামী প্রচার কার্যক্রমের মাধ্যমে ইসলামী জিহাদ দেশের মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন সংগঠন, প্রতিষ্ঠান এবং হাটে-বাজারে নিজেদের আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেয়। ফিলিস্তিনী জনগণের মাঝে ইসলামী বিপ্লবী চেতনা জাগিয়ে তুলতে ইসলামী জিহাদ বেশ সাফল্য অর্র্জন করে। এই আন্দোলনের প্রথম সাফল্যজনক পদক্ষেপ ছিল গাজা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৮১-৮২ শিক্ষাবর্ষের নির্বাচনে বামপন্থী দলগুলো ও ফাতাহ কোয়ালিশনের বিরুদ্ধে ২২ শতাংশ ভোটের ১৬.৫ শতাংশ ভোটেই ইসলামী জিহাদ জয়লাভ করে। এই সময়ে বিভিন্ন প্রচারপত্র, বক্তৃতা-বিবৃতি, পত্রপত্রিকা, গোপন বুলেটিন প্রভৃতির মাধ্যমে তারা আন্দোলনকে আরো ছড়িয়ে দেয়। পত্র-পত্রিকার মধ্যে ‘আল-নূর আল-ইসলাম’ এবং বুলেটিন ‘আল-হাকিকা’ ছিল অন্যতম। এগুলো ইসলামী জিহাদের ছাত্রশাখা ‘ইসলামী ছাত্র আন্দোলন’ কর্তৃক প্রকাশিত হয়। অন্যান্য সাময়িকী হলো ‘সউতুল মুসতাজআফিন’, ‘আল-তালাইয়ে আল-ইসলামিয়া’ এবং বুলেটিন ‘আল-বয়ান’ ও সাপ্তাহিক ‘সাউতুল জামেয়া আল-ইসলামিয়া’। ফিলিস্তিনে ইসলামী আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে এই সাময়িকী ও বুলেটিনগুলোর ভূমিকা ছিল অপরিসীম।

প্রাথমিক পর্যায়ে বিভিন্ন মসজিদ, ঘরোয়া বৈঠক, বিশ্ববিদ্যালয় এবং গোপন কোন আস্তানা থেকে ইসলামী জিহাদের প্রচার কাজ চালানো হতো। এ ব্যাপারে উত্তর গাজার ‘শেখ কারালদিন কাস্সাম মসজিদ’ ছিল ইসলামী জিহাদ আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র। এই মসজিদ থেকে এক জুমআর খুতবায় শেখ আবদুল আজিজ আউদাহ ফিলিস্তিনী জনগণের উদ্দেশ্যে সরাসরি ইসলামী আন্দোলনের ডাক দেন। এই খুতবা প্রদানের কারণে শেখ আউদাহ ইহুদি চক্রের আক্রমণের শিকার হন। তিনি আহত হয়ে হাসপাতালে গেলে জনগণ প্রচ- বিক্ষোভ মিছিল বের করে। গাজা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠে। দলমত নির্বিশেষে সকল ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক এক বাক্যে উচ্চারণ করে ‘আমরা সবাই আবদুল আজিজ আউদাহ’।

এভাবে আঘাত খেয়ে জনগণের মাঝে বর্বর জান্তার বিরুদ্ধে যেমন ঘৃণা এবং আক্রোশ বাড়তে থাকে তেমনি ইসলামী জাগরণ আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ইসলামী জিহাদ জনগণের পূর্ণ সমর্থন নিয়ে নিজেদের কার্যক্রম চালিয়ে যায়।

১৯৮২ সালের এপ্রিল মাসে আল-আকসা মসজিদের ভিতরে এক ইসরাইলী সৈন্য গুলি ছুঁড়ে। এরই প্রতিবাদের ফলশ্রুতিতে ‘ইনতিফাদা’র আবির্ভাব। ‘ইনতিফাদা’ অর্থ জাগরণ তথা দখলদার স্বৈরশক্তির বিরুদ্ধে ইসলামী উত্থান। ইনতিফাদার ডাক সারা ফিলিস্তিনে এক আলোড়ন সৃষ্টি করে। এই জাগরণের চেতনায় নতুনভাবে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে ফিলিস্তিনী জনগণ। ইসলামী জিহাদেরই এক নতুন রূপ হিসাবে ইনতিফাদার আত্মপ্রকাশ। ‘ফিলিস্তিনের ইসলামী ইনতিফাদার সন্তানেরা’ এই নামাঙ্কিত পুস্তিকা বিলি করা হয়। গোপন প্রচারপত্রও বিলি করা হয়। ‘কুরআনের সৈনিকদের আন্দোলন’ এবং ‘আল-আকসার সন্তানেরা’ প্রভৃতি নামেও পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়।

ফিলিস্তিনীদের এই তীব্র আন্দোলনে যায়নবাদীরা বেশিদিন চুপ থাকল না। ১৯৮৩ সালে তারা ইনতিফাদা আন্দোলনের বিরুদ্ধে ব্যাপক ধরপাকড় অভিযান শুরু করে এবং অন্যতম নেতা ফাত্হি ইবরাহীম শাক্কাকী সহ আরো ২৫ জন বিপ্লবী কর্মীকে গ্রেফতার করে। ১৯৬৭ সালের পর পশ্চিম তীর ও গাজা ভূখণ্ডে এটাই ছিল বড় ধরনের গ্রেফতার অভিযান।

এই ধরনের দমনমূলক অভিযান সত্ত্বেও ইহুদি জান্তা ইনতিফাদাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। ইহুদিরা উপায়ন্তর না দেখে ইসলামী জিহাদ আন্দোলনের শেখ আউদাহ সহ কতিপয় নেতৃস্থানীয় কর্মীকে গৃহবন্দি করে রাখে। শেখ আউদার গাজা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। জনসমাগমে তাঁর বক্তব্য রাখার প্রতি কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।

এই ধরনের দমন নিপীড়নে গণ অসন্তোষ আরো বাড়তে থাকে। পরবর্তী বছর এই অসন্তোষ সশস্ত্র আকার ধারণ করে। সশস্ত্র সংগ্রামী নেতা শেখ মিসবাহ আল-সউরী ১৯৮৭ সালের ২ অক্টোবর ইসরাইলী নিরাপত্তা রক্ষীর গুলিতে শহীদ হন। এই সংগ্রামী নেতাকে অনেক দিন আগে গ্রেফতার করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল। পনেরো বছরের দীর্ঘ কারাবাসের পর ১৯৮৫ সালে তাঁকে মুক্তি দেয়া হয়। তিনি ইসলামী জিহাদের তথা ইনতিফাদা আন্দোলনের সাথে সরাসরি জড়িয়ে পড়েন। এক বছর পর তাঁকে আবার গ্রেফতার করা হয়। এর এক বছর পরে শেখ মিসবা আল-সউরী ইসরাইলের কুখ্যাত গাজা বন্দি শিবির থেকে তাঁর পাঁচ সহকারীকে নিয়ে পালিয়ে গিয়ে বিশ্বকে হতবাক করে দেন। জেল থেকে বের হবার পাঁচ মাসের মধ্যে মিসবাহ ও তাঁর সঙ্গীরা গাজা এলাকায় ইসরাইলীদের বিরুদ্ধে এতো প্রচ- অভিযান চালায় যে, কর্তৃপক্ষ গাজা শহর তাদের জন্য দোজখ হয়ে উঠেছে বলে মন্তব্য করতে বাধ্য হয়। মিসবাহ ও তাঁর সাথিরা যুদ্ধ করতে করতেই শাহাদাত বরণ করেন।

মিসবাহর শাহাদাত বরণের কয়েক দিন পরই ৬ অক্টোবর ১৯৮৭ সালে ইসলামী জিহাদের আর একটি দল দখলদার ইহুদি জান্তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। অনেক দুশমনকে খতম করে শেষ পর্যন্ত তারাও ইসরাইলীদের গুলিতে শাহাদাত বরণ করে। অক্টোবরের ৬ তারিখ ফিলিস্তিনীদের ইনতিফাদা আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই সকল ফিলিস্তিনীর পবিত্র রক্তপাতের মধ্য দিয়ে ইসলামী জিহাদের জাগরণ ইতিহাসের এক নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করে।

৬ অক্টোবরের মর্মান্তিক ঘটনার পর থেকে ফিলিস্তিনীদের মধ্যে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। শহীদদের ছবিসম্বলিত হাজার হাজার প্রচারপত্র ফিলিস্তিনের রাস্তায় ছড়িয়ে দেয়া হয়। এসব প্রচারপত্রে দুশমনদের ওপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ফিলিস্তিনী জনগণের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। জুমআর নামাযে শেখ আউদা জনগণের প্রতি শাহাদাতের অনুপ্রেরণামূলক এক অসাধারণ খুতবা প্রদান করেন। যায়নবাদী স্বৈরাচারীদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত জিহাদে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য তিনি জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। শেখের আহ্বানে জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভ মিছিলে ফেটে পড়ে এবং ভাইয়ের রক্তের বদলা নিয়ে তাগুতি শক্তির হাত থেকে স্বদেশভূমি রক্ষার শপথ গ্রহণ করে।

ইসরাইলী কর্তৃপক্ষ শেখ আউদা ও অন্যান্য কতিপয় নেতৃস্থানীয় আন্দোলনকারীকে নির্বাসন দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে দেশবাসী প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। জনগণ বিক্ষোভ ও ধর্মঘটের ডাক দেয়। কাসসাম মসজিদে ইসলামী জিহাদের আহ্বানে উপস্থিত জনতা সম্মিলিতভাবে মরণ শপথ গ্রহণ করে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। জনতার ভয়ে ইহুদি জান্তার পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী সেদিন পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করেছিল। ইসরাইলী ভূখ-ের বিভিন্ন স্থানে ইসলামী জিহাদের ছোট বড় কমান্ডো হামলা সংঘটিত হয়। ১৯৮৭ সালের ৮ ডিসেম্বর ইসরাইলীদের ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে ৪ জন ফিলিস্তিনীর মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। এর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণের নিমিত্তে ইসলামী জিহাদের আহ্বানে এক সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয়। এটা ছিল ইনতিফাদা আন্দোলনের প্রথম সাধারণ ধর্মঘট। হাজার হাজার মানুষ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এবং ‘আল-জিহাদ আল-জিহাদ’ স্লোগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে রাস্তায় মিছিল বের করে। সর্বস্তরের ফিলিস্তিনী জনগণের মাঝে এই চেতনার জোয়ার ছড়িয়ে পড়ে। একটি শরণার্থী শিবির জাবিলায়া (এই ধরনের ক্যাম্পে ফিলিস্তিনীদের স্বদেশেই পরবাসী করে রাখা হয়েছে) সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে এএফপির এক রিপোর্টার বলেন, জাবিলিয়া ক্যাম্পে এখন বিদ্রোহের চেতনা ছড়িয়ে পড়েছে। সব দিকে ওরা পাথর ছুঁড়ে মারছে। ফিলিস্তিনী যুবকরা ‘আল-জিহাদ’ ‘আল-জিহাদ’ বলে চিৎকার করে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। এদের অনতিদূরেই ইসরাইলী সৈনিকরা বলছে, ‘এখনতো রক্তপাত ছাড়া কোন পথ নেই।’ ১২ ডিসেম্বর ১৯৮৭ এর ধর্মঘটে জনতা স্লোগান দিতে দিতে রাস্তায় নেমে পড়েছে। এক সপ্তাহ পরেই ইসলামী জিহাদ তাদের দ্বিতীয় ঘোষণা জারি করেছে, ‘হে পবিত্র জিহাদ, এগিয়ে চল।’

দক্ষিণাঞ্চলীয় ইসরাইলী কমান্ডার ইসহাক মরদেসাই ‘ইনতিফাদা’কে ‘অন্তর্ঘাতী তৎপরতা’ বলে আখ্যায়িত করেন। তাঁর মতে ইনতিফাদার আবির্ভাবের পিছনে দু’টি উপাদান কাজ করেছে। প্রথমত শেখ আউদাহকে নির্বাসন দেয়ার ইসরাইলী সিদ্ধান্ত। দ্বিতীয়ত ইসরাইলী সৈন্য কর্তৃক চারজন ফিলিস্তিনী নিহত হওয়া। কিন্তু ইসরাইলী কর্তৃপক্ষকে অবাক করে দিয়ে এই অন্তর্ঘাতী তৎপরতা সত্যিকারের যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়েছে। ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক শামির তাই বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘এটা হলো (ইনতিফাদা) সত্যিকারের এক যুদ্ধ যার উদ্দেশ্য হলো ইসরাইলকে ধ্বংস করে দেয়া। তারা নিছক গাজা এবং নাবলুস নিয়ে সন্তুষ্ট হবে না, হাইফা এবং জাফার প্রতিও তাদের লক্ষ্য রয়েছে।’

অধিকৃত পশ্চিম তীরের দখলদার ইসরাইলী বাহিনীর অধিনায়ক জেনারেল ওমরাম ইসলামী জিহাদ সম্পর্কে বলেন, ‘দখলদারীদের বিরুদ্ধে এরা হলো অত্যন্ত কার্যকর শক্তি।’

সর্বাধিক প্রচারিত হিব্রু পত্রিকা ‘ইয়েদিয়থ আহরানথ’ লিখেছিল, ‘কুসংস্কারাচ্ছন্ন মুসলমানরা নিঃসন্দেহে একটি বিপদ। দখলদারিত্বের পর থেকে নিরাপত্তা রক্ষীরা আর কখনো এ রকম বাধার সম্মুখীন হয়নি। কেউ যদি কারালদিন কাসসাম মসজিদে মুসল্লিদের ওপর একটি ঢিলও ছুঁড়ে তাহলে ইসলামী জিহাদের কোন সদস্যের গায়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।’

ইসলামী জিহাদই প্রথম দল যারা ১৯৮৮ সালের ২১ জানুয়ারি এক ঘোষণার মাধ্যমে ইসরাইলী পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত সকল আরব পুলিশ অফিসারকে পদত্যাগ করতে আহ্বান জানায় এবং একই ঘোষণায় সকল আরবের প্রতি হুঁশিয়ারি দিয়ে জানিয়ে দেয়া হয় যে,  কোন আরব যদি তার জমি-জমা বা ঘরবাড়ি কোন ইসরাইলীর কাছে বিক্রি করে তাহলে তার পরিণাম খুবই মারাত্মক হবে।

১৯৮৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ইসলামী জিহাদের দুই কমান্ডারের শাহাদাত বরণের পর এই আন্দোলন গোটা ফিলিস্তিনী জাতিকে শাহাদাত কবুলের ডাক দেয়। আন্দোলনের গেরিলারা ফিলিস্তিনের পূর্ণ স্বাধীনতা হাসিল না হওয়া পর্যন্ত জিহাদের ঝাণ্ডা উঁচিয়ে রাখার শপথ গ্রহণ করে। এই শাহাদাতের দু’দিন পরেই সর্বত্র দুশমনদের প্রতি ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে সর্বস্তরের জনসাধারণ প্রতিবাদ জানাতে থাকে। চারদিন পরেই সারাদেশে শহীদদের স্মরণে শোকদিবস ও ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়।

ইনতিফাদার মাধ্যমে ইসলামী জিহাদ আন্দোলন এক নতুন যুগে প্রবেশ করে। ইসলামী জিহাদ গ্রুপ কখনো দাবি করেনি যে, তারাই ইনতিফাদার স্রষ্টা। কারণ, ইনতিফাদা আসলে কোন একক দলের মাধ্যমে রূপলাভ করেনি। এই ইনতিফাদা বা জাগরণ স্বাধীনতাকামী বিভিন্ন ফিলিস্তিনী দলের অবিরাম জিহাদ আন্দোলনের ফসল। তবে এটা সত্যি যে, ইনতিফাদা আন্দোলনে ইসলামী জিহাদ দলের সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রয়েছে। তার মানে এই নয় যে, অন্যান্য ইসলামী দল ইনতিফাদায় কোন ভূমিকা রাখছে না। এখনতো ছোট বড় সব দলই ইনতিফাদাকে তাদের সাধারণ লক্ষ্যে পরিণত করেছে।

যায়নবাদী দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ইনতিফাদা ও সশস্ত্র জিহাদ আন্দোলনই ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার একমাত্র পথ। ফিলিস্তিনের ইসলামী জিহাদের সৈনিকরা দখলদার ইহুদিদের বিরুদ্ধে অভিযান থেকে কখনো বিরত থাকবে না। ইসলামী জিহাদ এবং ইনতিফাদা ফিলিস্তিনের জন্য আল্লাহর এক রহমত বলা যায়। ফিলিস্তিনে এই আন্দোলনকে ইসলামী মুক্তি আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুও বলা যায়। তবে শুধু ফিলিস্তিনের জন্য নয়, গোটা মুসলিম বিশ্বের ইসলামী আন্দোলনের নতুন মাত্রা যোগকারী হিসাবেও এই ইসলামী জিহাদ ও ইনতিফাদা প্রশংসার দাবিদার।