All posts by pavel

রোযার উপকারিতাসমূহ

তাহমিনা হুসাইন
রোযা মহান আল্লাহর ইবাদতসমূহের অন্যতম। রোযা একটি ফারসি শব্দ। এর আরবি শব্দ হচ্ছে ‘সিয়াম’ যার অর্থ হচ্ছে বিরত থাকা। পারিভাষিক অর্থে রোযা হচ্ছে সুবহে সাদিক থেকে রাত পর্যন্ত নির্দিষ্ট কিছু কাজ থেকে বিরত থাকা। আমরা প্রতি বছর রমযান মাসে রোযা রাখি। আমরা এ কারণে রোযা রাখি যে, মহান রাব্বুল আলামীন আমাদের ওপর তা ওয়াজিব করেছেন। আমাদের জানতে হবে মহান রাব্বুল আলামীন কেন আমাদের উপর রোযা রাখাকে ওয়াজিব করেছেন এবং এর উপকারিতাসমূহ কী কী?
রোযা শারীরিক দিক থেকে সুস্থতা দান করে এবং মানসিক দিক থেকে মানুষকে পশুবৃত্তিক চরিত্র থেকে রক্ষা করে। রোযা একটি সুস্থ ও সুন্দর সমাজ গঠনে অপরিসীম ভূমিকা পালন করে। রোযার উপকারিতাসমূহ নিম্নরূপ :

তাকওয়া অর্জন
রোযা সম্পর্কে মহান রাব্বুল আলামীন পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন :
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ –
‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোযা ফরয করা হয়েছে যেমনভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরয করা হয়েছিল যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।’- সূরা বাকারা : ১৮৩
রোযার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকওয়া অর্জন করা। সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষকে এই পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে মহান রাব্বুল আলামীনের ইবাদতের জন্য এবং তাঁর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের জন্য যাতে মানুষ এ পৃথিবীতে এবং পরকালের অনন্ত জীবনে সফলকাম হতে পারে। মহান রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টি অর্জন ও প্রিয়ভাজন হতে হলে অবশ্যই আমাদেরকে তাকওয়া অর্জন করতে হবে। মহান রাব্বুল আলামীন পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন :
إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِندَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ
‘নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যকার সবচেয়ে তাকওয়াবান ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট সর্বাধিক সম্মানিত।’- সূরা হুজুরাত : ৩
আর রোযার মাধ্যমেই আমরা তাকওয়া অর্জন করে আল্লাহর নিকট সম্মানিত হতে পারি। কারণ, রোযার মূল শিক্ষাই হচ্ছে তাকওয়া অর্জন করা।

গুনাহ থেকে রক্ষা
রোযা আমাদেরকে সকল প্রকার গুনাহ থেকে রক্ষা করে থাকে। রোযা রাখার অর্থ শুধু পানাহার থেকে নিজেকে মুক্ত রাখাই নয়; বরং অন্যান্য অঙ্গকেও হারাম কাজ থেকে দূরে রাখা। এ মাসে মানুষ বেশি বেশি ইবাদত করে এবং আল্লাহকে স্মরণ করে। তাই আল্লাহও তাঁর বান্দাদের প্রতি অন্যান্য মাসের তুলনায় এ মাসে বেশি দয়াশীল হন। এ মাসে মহান রাব্বুল আলামীন শয়তানকে শিকলে আবদ্ধ করেন যাতে সে মানুষকে ধোঁকা দিতে না পারে।
একদা রাসূলুল্লাহ (সা.) রমযান মাস সম্পর্কে মুসলমানদের উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন, এমন সময় হযরত আলী (আ.) জিজ্ঞেস করলেনÑ এ মাসের উত্তম আমল কী? রাসূল (সা) বললেন : ‘আল্লাহ যা হারাম করেছেন তা থেকে দূরে থাকা।’১ অর্থাৎ সকল প্রকার গুনাহ থেকে দূরে থাকা। অন্য এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে : الصوم جنة من النار অর্থাৎ রোযা জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার ঢালস্বরূপ।২
মানবচরিত্রের পরিশুদ্ধি
রোযা মানুষকে সুন্দর চরিত্র গঠনে সহায়তা করে। মানুষ সাধারণত তার নাফ্সের কুপ্ররোচনায় এবং শয়তানের ধোঁকায় বিভিন্ন অপকর্ম করে। রোযা মানুষকে তার নাফ্সের প্রতি বিজয়ী হওয়ার শিক্ষা দেয়। রোযা মানুষকে বিভিন্ন প্রকার অন্যায়, অশ্লীল ও অবৈধ কাজ থেকে বিরত রাখে। এ মর্মে এক রেওয়াত এসেছে : ‘সেই হচ্ছে সর্বোত্তম ব্যক্তি যে তার নাফ্সের সাথে জিহাদ করে এবং সেই হচ্ছে সর্বাধিক শক্তিশালী মানুষ যে তার নাফ্সের ওপর বিজয়ী হয়।’৩
একমাত্র রোযাই আমাদেরকে নাফ্সের ওপর বিজয় হওয়ার শিক্ষা দেয়। রোযা মানুষের চরিত্রকে পরিশুদ্ধ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ধৈর্যের শিক্ষা
আমরা জানি, রোযা হচ্ছে সাধনার মাস। রোযা আমাদেরকে ধৈর্যের শিক্ষা দেয়। আমাদের উপর যে কোন ধরনের বালা, মুসিবত, দুঃখ, কষ্ট, অভাব-অনটন আসলে আমরা ধৈর্যহারা হয়ে পড়ি, আমরা নিরাশ হই। রোযা আমাদের শিক্ষা দেয় কীভাবে আমরা এ সকল বিপদে ধৈর্য ধরতে পারব। এখন আমাদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, রোযা কীভাবে ধৈর্যের শিক্ষা দেয়। রোযা আমাদের ঈমান অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসকে দৃঢ় করে। যার ফলে আমরা যে কোন ধরনের বিপদকে মোকাবেলা করতে সক্ষম হই এবং সকল কাজ ধৈর্যের সঙ্গে করতে পারি। এক রেওয়ায়াতে বলা হয়েছে : ‘রমযান ধৈর্যের মাস আর ধৈর্যের প্রতিদান হচ্ছে বেহেশত।’৪

গীবত করা থেকে বিরত রাখা
গীবত একটি সামাজিক ও আত্মিক ব্যাধি। এর মাধ্যমে সমাজ কলুষিত হয় ও তাতে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। গীবতের ফলে ঈমান দুর্বল হয়ে থাকে। তাই মহানবী (সা.) ও ইমামগণ এটাকে অপছন্দনীয় ও নিন্দনীয় কাজ বলেছেন এবং পবিত্র কোরআনের বক্তব্য অনুসারে গীবতকে মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়ার সাথে তুলনা করে মুমিন ব্যক্তিদেরকে এ কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। রোযা আমাদেরকে একে অপরের গীবত করা থেকে বিরত থাকার শিক্ষা দেয়। এ সম্পর্কে রাসূল (স.) বলেছেন : ‘যদি কেউ তার মুসলমান ভাইয়ের গীবত করে তাহলে তার রোযা বাতিল হয়ে যাবে।’৫
হারাম খাওয়া থেকে বিরত রাখা
খাদ্য মানুষের মন ও শরীরের ওপর প্রভাব ফেলে। যে ব্যক্তি হারাম খাদ্য খেয়ে বড় হয়েছে সে কখনো একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে না। পবিত্রভাবে জীবন-যাপন করতে হলে অবশ্যই আমাদেরকে হালাল ও হারাম খাবারের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। মহান রাব্বুল আলামীন পবিত্র কোরআনে এ সম্পর্কে বলেন :
يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوا مِنَ الطَّيِّبَاتِ
‘হে রাসূলগণ! তোমরা পবিত্র জিনিস থেকে আহার কর…।’- সূরা মুমিনুন : ৫১
রোযা আমাদেরকে হারাম খাওয়া থেকে বিরত থাকার শিক্ষা দেয়। এ সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন : আফসোস ওই ব্যক্তির জন্য যে হারাম খাবার দ্বারা ইফতার করে। কারণ, সত্যিকার রোযা হচ্ছে হালাল খাবার দ্বারা।’৬
অন্য একটি হাদীসে রাসূল (সা.) বলেছেন : ‘যদি কেউ হারাম মালের দ্বারা ইবাদত করে তা কবুল হবে না। হারাম খাদ্য গ্রহণকারী ব্যক্তির রোযার কোন সওয়াব নেই।’৭

মিথ্যা বলা থেকে বিরত রাখা
মিথ্যা হচ্ছে সকল গুনাহের মূল উৎস। মিথ্যা মানুষের ব্যক্তিগত, সাংসারিক ও সামাজিক জীবনে বিপর্যয় ও দুর্যোগ ডেকে আনে। মিথ্যা মানুষের জীবনকে বিষময় করে তোলে। রোযা আমাদেরকে মিথ্যা বলা থেকে দূরে রাখে। এ সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন : ‘যে ব্যক্তি রোযা রাখা অবস্থায় মিথ্যা বলা বন্ধ করে না, তার ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত থাকার কোন প্রয়োজন নেই।’ অন্য একটি হাদীসে রাসূল (সা.) বলেছেন : ‘চারটি জিনিস রোযার ফযিলত নষ্ট করে- মিথ্যা, গীবত, চোখলখুরী ও হারাম দৃষ্টিপাত।’
রোযা মানুষের অন্তরে তাকওয়া সৃষ্টি করে। যার ফলে সে আল্লাহকে ভয় পায় এবং মিথ্যা বলা থেকে দূরে থাকে।

দোয়া ও ইস্তিগফারের শিক্ষা
রমযান মাস রহমত, বরকত, মাগফিরাত ও দোয়া কবুলের মাস। এ মাসে আল্লাহ স্বীয় রহমতের দরজা খুলে দেন ও বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত দয়াশীল হন। বান্দা যতই গুনাহ করুক এই মাসে যদি আন্তরিকতার সাথে তওবা ও ইস্তিগফার করে, আল্লাহ অবশ্যই তা কবুল করবেন।
এ সম্পর্কে রাসূল (স.) বলেছেন : ‘রমযান মাস ইস্তিগফার ও সিয়াম সাধনা এবং দোয়ার মাস।’৮
এ মাসে বেশি বেশি করে দোয়া পাঠ করার প্রতি তাগিদ করা হয়েছে। কারণ, আল্লাহ এ মাসে তাঁর বান্দাদের দোয়াকে কখনো ফিরিয়ে দেন না। এ সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন : ‘রোযাদারের দোয়া কখনো নিষ্ফল হয় না।’৯
বেশি বেশি কোরআন পড়ার শিক্ষা
কোরআন একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। মানবজীবনের সমস্ত প্রয়োজনীয় বিধান এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমরা এই দুনিয়ার প্রেমে গাফিল হয়ে আমাদের জীবনবিধানকে ভুলে যাই। আমরা দুনিয়ার কাজে এতই ব্যস্ত যে, কোরআন পড়ার সময় পর্যন্ত পাই না। রমযান মাস আমাদেরকে বেশি বেশি করে কোরআন পড়ার প্রতি উৎসাহিত করে। কারণ, এই মাসে মানুষ দুনিয়ার কাজে কম ব্যস্ত থাকে এবং খোদামুখী হয়।
রাসূল (স.) বলেছেন : ‘যদি কেউ রমযান মাসে কোরআনের একটি আয়াত তেলাওয়াত করে তার সওয়াব ওই ব্যক্তির মতো যে অন্য মাসে একবার কোরআন খতম করেছে।’১০

নিয়ম শৃঙ্খলা অর্জনের শিক্ষা
রোযা আমাদেরকে নিয়ম-শৃঙ্খলা অর্জনের শিক্ষা দেয়। মানুষের জীবনে উন্নতির জন্য নিয়ম-শৃঙ্খলার অনুসরণ অপরিহার্য। নিয়ম-কানুনের যথাযথ অনুসরণ ছাড়া আমরা জীবনে উন্নতি লাভ করতে পারব না। আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) নাহজুল বালাগায় ইমাম হাসান (আ.)-কে অসিয়ত করতে গিয়ে বলেন : ‘আমি তোমাদেরকে মহান আল্লাহর তাকওয়া অর্জন ও কাজ-কর্মে সুশৃঙ্খল হওয়ার অসিয়ত করছি।’১১
রমযান মাসে আমরা নিয়ম-শৃঙ্খলা অর্জনের শিক্ষা লাভ করি। আমরা যথা সময়ে সেহ্রী ও ইফতার করি। সময়ের কোন ত্রুটি করি না। রমযান মাসে আমরা সব কাজ সুশৃঙ্খলভাবে করে থাকি।

দরিদ্রদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া
রোযা আমাদেরকে দরিদ্রদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার শিক্ষা দেয়। রোযা রাখার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি কীভাবে দরিদ্র ব্যক্তিরা অনাহারে ও ক্ষুধার্ত অবস্থায় জীবন-যাপন করে। তাদের দুঃখ-কষ্টও আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। আর এ কারণেই মানুষ রমযান মাসে বেশি বেশি করে দরিদ্রদেরকে সাহায্য করে। অন্যদিকে বিভিন্ন রেওয়ায়াতে রমযান মাসে বেশি বেশি করে দরিদ্রদের সাহায্যের কথা বলা হয়েছে। রমযানের শেষে ‘যাকাতে ফেতরা’ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে যার মাধ্যমে দরিদ্ররা উপকৃত হতে পারে। ইমাম হাসান আসকারী (আ.)-কে রোযা ফরয হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলেন : ‘যাতে ধনীরা দরিদ্রদের ক্ষুধার্ত অবস্থাকে উপলব্ধি করে এবং তাদের প্রতি গুরুত্ব দেয়।’১২
ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেন : ‘রোযা এ কারণে ওয়াজিব হয়েছে যাতে ধনী ও দরিদ্রদের মাঝে সমতা বজায় থাকে এবং দরিদ্রদের প্রতি ধনীদের যে দায়িত্ব রয়েছে তা পালন করে।’১৩

চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে রোযা
ডাক্তারি মতে রোযার উপাকারিতাসমূহ অনেক। মানুষের শরীর এক ধরনের যন্ত্রবিশেষ। এ যন্ত্রের বিভিন্ন অংশ আপন গতিতে বিরতিহীনভাবে কাজ করছে। পাকস্থলি যার অন্যতম অংশ। এর কাজ হচ্ছে খাদ্যকে হজম করে খাদ্যের প্রয়োজনীয় অংশকে জমা রেখে অপ্রয়োজনীয় অংশকে বের করে দেওয়া। পাকস্থলি ২৪ ঘণ্টা বিরতিহীনভাবে কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় দেখা যায় যে, তা আর ভালোভাবে কাজ করতে পারছে না, তখন মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে। একমাত্র রোযাই হচ্ছে এর উত্তম চিকিৎসা। ইমামগণ থেকে রেওয়ায়াত এসেছে যে, ‘মানুষের পাকস্থলি হচ্ছে অসুস্থতার কেন্দ্রবিন্দু, সংযত পানাহার হচ্ছে তার উত্তম চিকিৎসা।’ ধনী লোকদের অধিকাংশই আজকাল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। যার মূল কারণ হচ্ছে শরীরে অতিরিক্ত চর্বি জমে যাওয়া। এ চর্বির কারণে মানুষ অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। মানুষের শরীরের ওজন বেড়ে যায়। একমাত্র রোযা অর্থাৎ অতিরিক্ত পানাহার থেকে দূরে থাকাই হচ্ছে এর উত্তম চিকিৎসা। বর্তমান বিশ্বে ডায়াবেটিস রুগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এর উত্তম চিকিৎসা হচ্ছে রোযা বা অতিরিক্ত পানাহার থেকে দূরে থাকা। বর্তমান আধুনিক বিশ্বের অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রমাণ করেছেন যে, অতিরিক্ত পানাহার থেকে দূরে থাকাই হচ্ছে অনেক রোগের নিরাময় ও একমাত্র চিকিৎসা যার কোন বিকল্প নেই। ঠিক যেরূপ আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন : ‘রোযা রাখ যাতে সুস্থ থাক।’১৪
রোযা আমাদের সংযমী ও তাকওয়াবান হওয়ার শিক্ষা দেয়। রোযার মাধ্যমে আমরা আমাদের মনকে পরিশুদ্ধ করতে পারি। রোযা আমাদের দেহ ও মনকে প্রফুল্ল রাখে এবং মনের সংকীর্ণতা দূর করে। রোযা মানুষকে হিংসা, বিদ্বেষ, অহংকার ও সকল প্রকার খারাপ কাজ থেকে দূরে রাখে। রোযার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি। রোযা আমাদের পরকালের পাথেয়। তাই আমাদের সবার উচিত রমযানের মাসের মধ্যেই এ ইবাদতকে সীমাবদ্ধ না রেখে অন্যান্য মাসেও বেশি বেশি রোযা রাখা এবং নিজেকে পাপ থেকে মুক্ত করা।

সংকলন : মাহে রমযানের সওগাত, সাংস্কৃতিক বিভাগ, শাহীদাহ বিন্ডুল হুদা মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়, কোম, ইরান।
তথ্যসূত্র
১. ওয়াসায়েলুশ শিয়া, ৭ম খণ্ড, পৃ. ২২৮; ২. বিহারুল আনওয়ার, ৯৬তম খণ্ড, পৃ. ২৫৫; ৩. মুস্তাদরাকুল ওয়াসায়েল, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩০২; ৪. উসূলে কাফী, ৪র্থ খণ্ড, পৃ.৬৩; ৫. বিহারুল আনওয়ার, ৬৯তম খণ্ড, পৃ. ৩৩১; ৬. হুলিয়াতুল আবরার, ১ম খণ্ড; ৭. ওয়াসায়েলুশ শিয়া, ১১তম খণ্ড, পৃ. ১৪৪; ৮. ফাযায়েলু শাহরে ছালেছ, পৃ. ৬৬; ৯. মুসনাদে আহমাদ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৭; ১০. চেহেল হাদীস আয কোরআন (কোরআনের ৪০ হাদীস), পৃ. ৬৪; ১১. নাহজুল বালাগাহ, হিকমত ৪; ১২. কাফী, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৮১; ১৩. তাফসীরে নমুনা, ১ম খণ্ড, পৃ. ৬২৮; ১৪. জামেউল হাদীস, ৯ম খণ্ড, পৃ. ১০৩

স্মরণীয় বাণী

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন : রোযা হচ্ছে আমার জন্য এবং আমি তার পুরস্কার দেব। (ওয়াসায়েলুশ শিয়া, ৭ম খণ্ড, পৃ. ২৯৪, হাদীস ১৫)
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : সৌভাগ্য তাদের (জন্য) যারা আল্লাহ তা‘আলার জন্য ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত হয়েছে; তারা কিয়ামতের দিন পরিতৃপ্ত হবে। (ওয়াসায়েলুশ শিয়া, ৭ম খণ্ড, পৃ. ২৯৯, হাদীস ২)
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : বেহেশতে রিয়ান নামে একটি দরজা আছে। সে দরজা দিয়ে শুধু রোযাদাররা প্রবেশ করবে। (ওয়াসায়েলুশ শিয়া, ৭ম খণ্ড, পৃ. ২৯৫, হাদীস ৩১)
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : প্রতিটি জিনিসের যাকাত রয়েছে আর শরীরের যাকাত হচ্ছে রোযা। (আল কাফি, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৬২, হাদীস ৩)
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : রোযা হচ্ছে আগুনের বিপক্ষে ঢালস্বরূপ। (অর্থাৎ রোযা রাখার কারণে মানুষ জাহান্নামের আগুন থেকে নিরাপদে থাকবে)। (আল কাফি, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৬২)
মহানবী (সা.) বলেন : রোযাদার ব্যক্তি ইবাদতের মধ্যে থাকে, এমনকি যদি স্বীয় বিছানায় ঘুমিয়েও থাকে, যতক্ষণ না সে কোনো মুসলমানের গীবত করে। (তুহাফুল উকুল, পৃ. ৫৪)
ইমাম আলী (আ.) বলেন : আল্লাহ তা‘আলা রোযাকে ওয়াজিব করেছেন যাতে এর মাধ্যমে সৃষ্টির এখলাসকে (ঐকান্তিকতাকে) পরীক্ষা করতে পারেন। (নাহজুল বালাগা, হিকমত ২৫২)
ইমাম আলী (আ.) বলেছেন : নাফ্সের রোযা দুনিয়ার সুখ-শান্তি অপেক্ষা অধিকতর মুনাফাসম্পন্ন। (গুরারুল হিকাম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪১৬, হাদীস ৬৪)
ইমাম আলী (আ.) বলেছেন : কলবের রোযা জিহ্বার রোযা থেকে উত্তম আর জিহ্বার রোযা উদরের রোযা থেকে উত্তম। (গুরারুল হিকাম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪১৭, হাদীস ৮০)
ইমাম আলী (আ.) বলেছেন : যে ব্যক্তির রোযা রাখাটা শুধু তৃষ্ণার্ত ও ক্ষুধার্ত হওয়া ছাড়া অন্য কোন ফলাফল রাখে না, সে নামায পড়ার উদ্দেশ্যে জাগ্রত ব্যক্তির ন্যায়, যে শুধু জেগে থাকা ও কষ্ট করা ব্যতীত অন্য কোন মুনাফা অর্জন করে না। (নাহজুল বালাগা, হিকমত ১৪৫)
হযরত ফাতিমা যাহরা (আ.) বলেছেন : রোযাদার ব্যক্তি যদি রোযা রেখে নিজের জিহ্বা, কর্ণ, চক্ষু ও শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে সংযত না রাখে তবে তার রোযা কী কাজে আসবে? (বিহারুল আনওয়ার, ৯৩তম খণ্ড, পৃ. ২৯৫)
ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেছেন : আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন : ছবর ও নামায থেকে সাহায্য নাও। তিনি বলেন, রোযাই হচ্ছে ছবর। (ওয়াসায়েলুশ শিয়া, ৭ম খণ্ড, পৃ. ২৯৮, হাদীস ৩)
ইমাম মূসা কাযিম (আ.) বলেছেন : রোযাদার ভাইকে ইফতারি করানো মুস্তাহাব রোযা থাকার চেয়েও উত্তম। (আল কাফি, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৬৮, হাদীস ২)
ইমাম আলী রেযা (আ.) বলেছেন : যে ব্যক্তি রমযান মাসে আল্লাহর কিতাব থেকে একটি আয়াত তেলাওয়াত করবে তা অন্য মাসগুলোতে সম্পূর্ণ কোরআন তেলাওয়াত করার অনুরূপ হবে। (বিহারুল আনওয়ার, ৯৩তম খণ্ড, পৃ. ৩৪৬)
সূত্র : সংকলন- রোখসানা আলম, মাহে রমযানের সওগাত, সাংস্কৃতিক বিভাগ, শাহীদাহ, বিণ্ডুল হুদা মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়, কোম, ইরান।

স্মরণীয় দিবস

১ জুলাই : ইরানে হস্তশিল্প দিবস।

২ জুলাই : মহানবী (সা.)-এর দৌহিত্র ও আহলে বাইতের দ্বিতীয় ইমাম হাসান (আ.)-এর জন্মদিবস ও ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর গুপ্তঘাতকের হাতে আয়াতুল্লাহ সাদুকীর শাহাদাত দিবস।
৩ জুলাই : ১৯৮৮ সালের এ দিনে পারস্য উপসাগরে মার্কিন রণতরী থেকে পরিচালিত ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইরানী এয়ারবাসের তিন শতাধিক যাত্রী শহীদ হন।
৬ জুলাই : ইমাম আলী (আ.) কুফার মসজিদে ইবনে মুলযিমের বিষমাখা তরবারিতে আঘাতপ্রাপ্ত হন।
৮ জুলাই : ইমাম আলী (আ.)-এর শাহাদাত দিবস।
৯ জুলাই : ইরানে শিশু-কিশোর সাহিত্য দিবস।
১২ জুলাই : ইরানে হিযাব ও সতিত্ব দিবস।
১৭ জুলাই : বিশ্ব আল-কুদ্স দিবস।
১৮ জুলাই : পবিত্র ঈদুল ফিত্র।
২১ জুলাই : আয়াতুল্লাহ কাশানী স্মরণে দিবস।
৩০ জুলাই : শেখ শাহাবুদ্দিন সোহরাওয়ার্দী স্মরণে দিবস।
৩১ জুলাই : বিশ্ব (স্বেচ্ছায়) রক্তদান দিবস।
১ আগস্ট : আন্তর্জাতিক মাতৃদুগ্ধ দিবস।
২ আগস্ট : শেখ ফাযলুল্লাহ নূরীর শাহাদাত দিবস।
৫ আগস্ট : ইসলামী মানবাধিকার দিবস।
৬ আগস্ট : বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুবার্ষিকী।
*এ দিনে আমেরিকা কর্তৃক জাপানের হিরোসিমায় আণবিক বোমা বর্ষণ করা হয়।
৭ আগস্ট : ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর এ দিনে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ পুনর্গঠন কাজ (সংস্কার) এর সূচনা করা হয়।
৮ আগস্ট : ইরানে সাংবাদিক দিবস।
৩ আগস্ট : ইরানে ‘পাহলোয়ানী সংস্কৃতি দিবস’।
১১ আগস্ট : আহলে বাইতের ষষ্ঠ ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর শাহাদাত দিবস।
১৫ আগস্ট : মহীয়সী নারী হযরত মাসূমা (আ.)-এর জন্মদিবস।
২১ আগস্ট : ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান কর্তৃক ঘোষিত বিশ্ব মসজিদ দিবস।
২৩ আগস্ট : বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক ও বিজ্ঞানী বু-আলী সীনা স্মরণে দিবস, ইরানে এ দিনটি চিকিৎসক দিবস হিসেবে পালিত হয়।
২৬ আগস্ট : আহলে বাইতের অষ্টম ইমাম রেযা (আ.)-এর জন্মদিবস।
২৭ আগস্ট : বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুবার্ষিকী ও বিশ্ববিখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী যাকারিয়া রাযী স্মরণে দিবস। ইরানে এ দিনটি ওষুধ শিল্প দিবস হিসেবে পালিত হয়।
৩০ আগস্ট : ১৯৮১ সালের ৩০ আগস্ট প্রেসিডেন্ট ভবনে গুপ্তঘাতকের পাতা বোমা বিস্ফোরণে শহীদ হন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদ আলী রাজাই ও প্রধানমন্ত্রী হুজ্জাতুল ইসলাম ড. জাভাদ বহোনার। দিবসটি সন্ত্রাসবিরোধী দিবস হিসেবে পালিত হয়।

সাহিত্য

رکاب دادن.
উচ্চারণ : রেকা’ব দা’দান
মর্ম : সম্মত হওয়া, রাজি হয়ে যাওয়া, কারো প্রতি অনুগত হওয়া।
رگ غیرتش جنبید.
উচ্চারণ : রাগে গেইরাতাশ জুম্বীদ
অর্থ : তার আত্মমর্যাদাবোধের রগ লাফিয়ে উঠেছে।
মর্ম : কারো আত্মমর্যাদাবোধ ও বীরত্ব জাগ্রত হয়েছে বুঝাতে এই প্রবাদ ব্যবহৃত হয়।
رنگ به رنگ شدن.
উচ্চারণ : রাং বেরাং শুদান
অর্থ : রং-বেরং হওয়া।
মর্ম : লজ্জা ও অপমানবোধের কারণে চেহারার রং পরিবর্তন হয়ে গেছে- এমন কথা বুঝানোর জন্য এই প্রবাদ ব্যবহৃত হয়।
رو به راه بودن
উচ্চারণ : রূ বেরা’হ বূদান
অর্থ : রাস্তামুখি হওয়া।
মর্ম : সবকিছু ঠিকঠাক আছে, ঠিকমত চলছে- এ কথা বুঝাতে প্রবাদটির ব্যবহার ব্যাপক।
رو برو کردن.
উচ্চারণ : রো বরো কারদান
অর্থ : মুখোমুখি করা।
মর্ম : কোন তথ্য উদ্ঘাটনের জন্য দুই ব্যক্তিকে পরস্পরের মুখোমুখি করা।
روده درازی کردن.
উচ্চারণ : রূদে দারা’যি কারদান
অর্থ : নাড়ি লম্বা করা।
মর্ম : এক নাগাড়ে কথা বলতে থাকা, বকবক করা প্রভৃতি বুঝাতে প্রবাদটি ব্যবহৃত হয়।
روز از نو روزی از نو
উচ্চারণ : রূয আয নো, রূযী আয নো
অর্থ : নতুনভাবে দিন, নতুনভাবে জীবিকা।
মর্ম : প্রত্যেক দিনই নিজের জন্য নিত্য-নতুন চেষ্টা ও সাধনার প্রয়োজন- এ কথা বুঝাতে প্রবাদটির প্রচলন ব্যাপক।

 

বাংলা ভাষায় ফারসি শব্দের ব্যবহার

সংকলন : ড. জহির উদ্দিন মাহমুদ
সম্পাদনা : আব্দুল কুদ্দুস বাদশা

জলদি جلدی জেল্দি
জমা جمع জাম’
জমাদার جمعدار জাম’দর
জনাব جناب জে-নব
জিনিস جنس জেন্্স
জঙ্গ جنگ জাঙ্গ
জঙ্গি جنگی জাঙ্গী
জবাবী جوابی জাভাবী
চাবুক چابک চ-বোক
ছাপ, ছাপা چاپ চপ
চারপায়া چارپاپه চর পয়ে
চাক (টুকরা) چاک চক
চাক চাক چاک چاک চক্ চক্
চাকর چاکر চ-র্কে
চাকরি چاکری চ-কেরী
চালাক چالاک চ-লক্
চালাকী چالاکی চ-লকী
চা چای চই
চেরাগ (বাতি) چراغ চে-রগ্
চর্বি چربی র্চাবী
চর্ম چرم র্চ্ম্্া
চশমা چشمه চেশ্মে
চিল্লা (চল্লিশ দিনের সময়) چله চেল্লে
চাঁদা چنده চান্্দে
চৌপায়া چوچایه চৌ-পয়ে
চৌকি (যেমন সেনাচৌকী) چوکی চৌকী
চেহলাম چهلم চেহেলুম্
চেহারা چهره চেহ্রে

আমাদের শিরাজ ভ্রমণ

মোঃ মফিদুর রহমান

ইরানের রাজধানী তেহরান। কিন্তু আমার মন পড়ে ছিল শিরাজ’এ। তেহরান থেকে শিরাজ বিমানপথে সোয়া এক ঘণ্টার পথ। অথচ মনের দূরত্বে তা কিছুই নয়। বাংলাদেশ থেকে যখন আমরা তেহরান আন্তর্জাতিক বইমেলার উদ্দেশে রওয়ানা হয়েছিলাম তখন বলা হয়েছিল ইরানের আরো একটি শহরে আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু কোন্্ সে শহর? বলা হয়েছিল হয় ইসফাহান নয়তো শিরাজ। শেষ পর্যন্ত আমাদের যাওয়া হলো শিরাজে। মহকবি শেখ সাদী আর হাফিজ এর জন্মভূমি। যে শহর খ্যাত হয়ে আছে এ দুই কবি, সুফিসাধক আর পুণ্যাত্মার নামে।
তেহরান বিমানবন্দর থেকে যে বিমানে চড়ে বসলাম, তার নাম আসমান। কী আশ্চর্য্য এ নামতো আমার কাছে ভীষণ পরিচিত; কারণ, বাংলায় আসমান-জমিন শব্দ দু’টি হরহামেশা ব্যবহৃত হচ্ছে। আসমান শব্দের অর্থ হলো আকাশ। ফারসির বদৌলতে দিব্বি ঢুকে গেছে বাংলায়। কারো আর বোঝার সাধ্যি নেই যে, এ শব্দ বাংলার নয়। এরকম হাজার হাজার ফারসি শব্দ বাংলায় প্রতিনিয়ত ব্যবহৃত হচ্ছে। বলা হয় প্রায় সাড়ে আট হাজার ফারসি শব্দ বাংলা ভায়ায় ঢুকে গেছে। আমরা তার হদিসও রাখি না। মোগল আমলে এদেশের রাজভাষা ছিল ফারসি। এরই সুবাদে ফারসির এমন রমরমা আধিপত্য।
শিরাজ বিমানবন্দরে নামতে না নামতেই অভ্যর্থনার পুষ্পবৃষ্টিতে সিক্ত হলাম। বিমানবন্দরের ভিভিআইপিতে গিয়ে বসলাম প্রথমে। অভ্যর্থনা জানাতে শিরাজ এর গভর্নর মহোদয় স্বয়ং হাজির। বিমান বন্দরেই ছোটখাট একটা সাংবাদিক সম্মেলন হয়ে গেল। তাদের জানবার মূল আগ্রহ হলো, কেন বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের এ সফর? কী কী বিষয় নিয়ে ইরান সরকারের সাথে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বিনিময় চুক্তি হলো। পরবর্তীকালে দু’দেশের সরকারের মধ্যে কাজের পরিকল্পনা কী ইত্যাদি। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী মহোদয় সাংবাদিকদের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরলেন। যে কথাটি তিনি বললেন তা হলো, ইরান ও বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ইতিহাস অনেক পুরনো। দু’দেশের মধ্যে ধর্মীয় দিক ছাড়াও সাংস্কৃতিক অনেক বিষয়ে মিল রয়েছে। আমাদের বাংলা নববর্ষের মতো ইরানিরা নওরোজ পালন করে থাকে। ভবিষ্যতে দু’দেশের মধ্যে চিত্রকলা, নাটক, সেমিনার, সাহিত্য, অনুবাদ ইত্যাদি বিষয়ে বিনিময় কার্যক্রম আরো জোরদার হবে।
শিরাজে এসে প্রথমেই মনে হলো এখানে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসেছিলেন ১৯৩২ সালে। কেমন ছিল শিরাজ তখন? জানা যাক রবীন্দ্রভাষ্যেই: ‘শিরাজ শহরটি যে প্রাচীন তা বলা যায় না। আরবেরা পারস্য জয় করার পরে তবে এই শহরের উদ্ভব। সাফাবি-শাসনকালে শিরাজের যে শ্রীবৃদ্ধি হয়েছিল আফগান আক্রমণে তা ধ্বংস হয়ে যায়। আগে ছিল শহর ঘিরে পাথরের তোরণ, সেটা ভূমিসাৎ হয়ে তার জায়গায় উঠেছে মাটির দেয়াল। নিষ্ঠুর ইতিহাসের হাত থেকে পারস্য যেমন বারবার আঘাত পেয়েছে পৃথিবীতে আর-কোনো দেশ এমন পায় নি, তবু তার জীবনশক্তি বার বার নিজের পুনঃসংস্কার করেছে। বর্তমান যুগে আবার সেই কাজে সে লেগেছে, জেগে উঠেছে আপন মূর্ছিত দশা থেকে।’
শিরাজে আমাদের মূল আকর্ষণ হলো শেখ সাদীর সমাধি-দর্শন। শেখ সাদীর সমাধিদর্শন আমার জীবনে একটি অনন্য ঘটনা। আমরা যখন তাঁর সমাধি কমপ্লেক্সে যাই তখন দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। ইরানের তপ্ত আবহাওয়ায় রোদের তেজ কিছুটা হলেও কমে এসেছে। এ ধরনের শুষ্ক আবহাওয়ার সাথে আমি একদমই অভ্যস্ত ছিলাম না। ইরানে যে ক’দিন থেকেছি আমার শরীর পানিশুষ্ক হয়ে বেশ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। প্রচুর পানি খাওয়া হলেও অবস্থার তেমন একটিা উন্নতি হয়নি। রাতে ক্লান্ত শরীরে হোটেলে ফিরলে লক্ষ করতাম নাক দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। প্রথমদিকে ভীষণ ভয় পেলেও পরে আসল কারণ ধরতে পারায় আর সমস্যা হয়নি। একদিন বাংলাদেশ মিশনের গাড়ির ড্রাইভারকে বললাম, ‘ভাই তুমি আমাকে বাঁচাও।’ সে বাজার থেকে একটি ভেজলিনের ছোট্ট কৌটা এনে দিল; যেটি ব্যবহার করে সে যাত্রায় রক্ষা পেয়েছিলাম।
শেখ সাদীর কবিখ্যাতি দুনিয়াজোড়া। তাঁর জন্মতারিখ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তবু যতটুকু জানা যায়, তিনি ১১৬৪ সালে জন্মগ্রহণ ও ১১৯২ সালে মৃত্যুবরণ করেন। শেখ সাদীর প্রকৃত নাম শরফুদ্দীন। তাঁর ডাক নাম মসলেহউদ্দীন। সাদী ছিল তাঁর উপাধি। বিশ্বের মানুষের কাছে তিনি পরিচিত শেখ সাদী নামে। সাদীর বাবা ছিলেন অত্যন্ত ধর্মভীরু ও নৈতিকতা পরায়ণ মানুষ। সাদীও এসব গুণে গুণান্বিত হয়েছিলেন শৈশব থেকেই। বাল্যকালে তাঁর বাবা মারা গেলে তিনি তাঁর মামা পণ্ডিত আল্লামা কুতুবউদ্দিন শিরাজীর ¯েœহধন্য হন। ছোটবেলা থেকে সাদী শিক্ষানুরাগী ছিলেন। তিনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য বাগদাদ চলে যান এবং সেখানকার বিখ্যাত মাদ্রাসা নিযামিয়ায় ভর্তি হন। সাদী ছিলেন একাধারে একজন কবি-সাহিত্যক-জ্ঞানী ব্যক্তি। তিনি একাধিক ভাষা জানতেন। ভ্রমণ করেছিলেন অনেক দেশ। বলা হয়, তিনি পায়ে হেঁটে চৌদ্দবার হজ করেছিলেন। শেখ সাদীর বিখ্যাত গ্রন্থগুলো হল: গুলিস্তাঁ, বুস্তাঁ, করিমা, সাহাবিয়া, কাসায়েদে ফারসি, কাসায়েদে আরাবিয়া, গযলিয়াত, কুল্লিয়াত ইত্যাদি। গুলিস্তাঁ ও বুস্তাঁ গ্রন্থের অনেক কথা আজ প্রবাদে পরিণত হয়েছে। অনেকে শেখ সাদীকে ইংরেজ লেখক উইলিয়ম শেক্সপীয়রের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। গুলিস্তাঁ উপদেশমূলক গল্পে ভরা। শেখ সাদীর অনেক নৈতিকতাপূর্ণ গল্প শৈশবে আমাদেরকে ভাবিয়ে তুলতো। একটি গল্প তো অত্যন্ত প্রচলিত। শেখ সাদীর পায়ে একবার কোন জুতা ছিল না। এ অবস্থায় তিনি গিয়ে উঠলেন কুফার এক মসজিদে। তাঁর মন বেজায় খারাপ। এমন সময় তিনি দেখলেন, একটি লোক মসজিদে শুয়ে আছে যার একখানি পা-ই নেই। তখন তিনি খোদাকে মনে মনে অনেক ধন্যবাদ দিলেন নিজের সৌভাগ্যের জন্য। শেখ সাদীর পোশাকের গল্পটিও আমাদের অনেক শোনা ও শিক্ষামূলক একটি বিখ্যাত গল্প।
শেখ সাদীর মাজারে প্রচুর পর্যটকের ভিড় দেখলাম। এরা যে সাবাই বিদেশি পর্যটক তা কিন্তু নয়। ইরানের নাগরিকেরাও শিরাজ ভ্রমণে এসেছে। একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম ইরানের মানুষেরা প্রতি সপ্তাহে ছুটির দিনে ছেলেমেয়ে ও পরিবার নিয়ে লং ড্রাইভে বেরিয়ে যায়।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও শেখ সাদীর মাজারে এসেছিলেন ১৯৩২ সালে। তিনি লিখেছেন, ‘১৭ এপ্রেল। আজ অপরাহ্নে সাদীর সমাধিপ্রাঙ্গণে আমার অভ্যর্থনার সভা।… সাদীর সমাধিতে স্থাপত্যের গুণপনা কিছুই নেই।’
রবীন্দ্রনাথের দেখা শেখ সাদীর সমাধি নিয়ে বর্ণনা বর্তমান সময়ের সাথে মেলে না। এখন সাদীর সমাধি ক্ষেত্র অনেক দূর থেকে চোখে পড়ে। সবুজ গম্বুজে ঢাকা কবি-দার্শনিক-পণ্ডিত শেখ সাদীর সমাধি দেখতে খুবই সুন্দর। সবচেয়ে অবাক করে এ জায়গার গাম্ভীর্য ও আধ্যাত্মিকতা। মনে হয় জীবন এখানে বিছিয়ে রেখেছে অপার শান্তি। এ সমাধিতে এসে নিজেকে আত্মআবিষ্কারের সুযোগ পাওয়া যায়। মনে হয় এ অমর জীবন-দার্শনিক হয়তো এখনি জেগে উঠবেন। শোনাবেন তাঁর সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে কোন কাব্য নয়তো নৈতিকতার বা উপদেশমূলক গল্প, যা শুনে জীবন হবে ঋদ্ধ। এভাবেই ভাবের গভীর সাগরে ডুব দিয়ে মহাকবি শেখ সাদীকে সালাম জানিয়ে তাঁর সমাধিপ্রাঙ্গণ ত্যাগ করলাম।
ইরানের আরেক মহাকবি হাফিজ শিরাজী। পুরো নাম খাজা শামসুদ্দীন মুহাম্মাদ হাফিজ শিরাজী। তিনি ৭১০-৭৩০ হিজরি সনের মধ্যে ইরানের শিরাজ নগরে জন্মগ্রহণ হরেন। তাঁর পিতার নাম বাহাউদ্দিন সুলগারী। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, হাফিজের পিতা ইসফাহান হতে ব্যবসার উদ্দেশ্যে শিরাজে আসেন। প্রথমদিকে ব্যবসায়ে প্রচুর উন্নতি করলেও মৃত্যুকালে তাঁর ব্যবসা পতিত হয়ে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়। এতে হাফিজ ও তাঁর মা দারিদ্র্যের করাল গ্রাসে পড়েন। একারণে পিতৃহারা হাফিজকে ছোট বয়সেই বিদ্যালয়ে গমনের পরিবর্তে জীবিকার তাগিদে একটি রুটির দোকানে কাজ করতে হয়। বুলবুল-ই-শিরাজের সঙ্গে এদিক থেকে বাংলাদেশের জাতীয় ও বিদ্রোহী কবি বাংলার বুলবুল কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনের মিল পরিলক্ষিত হয়। তিনিও শৈশবে রুটির দোকানে কাজ করতেন। হাফিজ রুটির দোকানে কাজ করার পাশাপাশি মক্তবে পড়াশুনা করতে থাকেন এবং অল্পদিনেই কুরআন মুখস্থ করে অশেষ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। কথিত আছে তিনি চৌদ্দটি পদ্ধতিতে কুরআন তেলাওয়াত করতে পারতেন।
কাব্যপ্রতিভায় হাফিজ এতটাই উৎকৃষ্টমানের ছিলেন যে, পাশ্চত্যের আরেক মহান কবি গ্যেটে বলেন, ‘হঠাৎ প্রাচ্যের আসমানি খুশবু এবং ইরানের পথ-প্রান্তর হতে প্রবাহিত চিরন্তন প্রাণ সঞ্জীবনী সমীরণের সাথে পরিচিত হলাম। আমি এমন এক ব্যক্তিকে চিনতে পারলাম, যাঁর বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব আমাকে আপাদমস্তক তার জন্য পাগল করেছে।’
শুধু পাশ্চাত্য নয়, হাফিজ প্রাচ্যের, এমনকি বাংলা ভাষার কবি ও চিন্তাশীল ব্যক্তিকে সমানভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩২ সালে হাফিজের মাজারে যান। তাঁর শরীর তখন তেমন একটা ভাল নয়। তথাপি তিনি এ সুফি কবির সমাধি দর্শনের টান উপেক্ষা করতে পারেন নি। শোনা যায় তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও হাফিজের অসম্ভব ভক্ত ছিলেন। শিরাজে কবি হাফিজের সমাধিপাশে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন এভাবে: ‘এই সমাধির পাশে বসে আমার মনের মধ্যে একটা চমক এসে পৌঁছল, এখানকার এই বসন্তপ্রভাতে সূর্যের আলোতে দূরকালের বসন্তদিন থেকে কবির হাস্যোজ্জ্বল চোখের সংকেত। মনে হল আমরা দুজনে একই পানশালার বন্ধু, অনেকবার নানা রসের অনেক পেয়ালা ভরতি করেছি। আমিও তো কতবার দেখেছি আচারনিষ্ঠ ধার্মিকদের কুটিল ভ্রূকুটি। তাদের বচনজালে আমাকে বাঁধতে পারেনি; আমি পলাতক, ছুটি নিয়েছি অবাধপ্রবাহিত আনন্দের হাওয়ায়। নিশ্চিত মনে হল আজ, কত-শত বৎসর পরে জীবনমৃত্যুর ব্যবধান পেরিয়ে এই কবরের পাশে এমন একজন মুসাফির এসেছে যে মানুষ হাফেজের চিরকালের জানা লোক।’ (পারস্যে: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
আমাদের জাতীয় কাজী নজরুল ইসলাম হাফিজের এতটাই অনুরক্ত ছিলেন যে, তিনি ফারসি থেকে ৭৩টি রুবাই সরাসরি বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। তিনি যেদিন অনুবাদ শেষ করেন সেদিন কবির পুত্র বুলবুল মারা যান। কবি তাই বেদনার সাথে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘আমি আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান ও সবচেয়ে প্রিয় সম্পদকে উপঢৌকন দিয়ে শিরাজের বুলবুল কবিকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানিয়েছি। ইরানের কবিস¤্রাট হাফিজ বাংলার সুলতান গিয়াসউদ্দিনের আমন্ত্রণে সাড়া দেননি। কিন্তু আমার আমন্ত্রণে সাড়া না দিয়ে পারতেন না।’
হাফিজ জগদ্বিখ্যাত হয়ে আছেন তাঁর সেই শাশ্বত প্রেমময় উক্তির জন্য: ‘প্রিয়ার গালের একটি তিলের জন্য বিলিয়ে দিতে পারি সমরখন্দ বোখারা।’ কে সেই ভাগ্যবতী তা অবশ্যি আজো জানা যায়নি। তবে প্রত্যেক কালে প্রতিটি প্রেমিক হৃদয় কল্পনায় তার প্রেমিককে নিশ্চয়ই হাফিজ-কথিত প্রেমিকার আসনে স্থান দিয়ে এ কথাটিই ভাবে। এখানে হাফিজের কাব্যের অমরতা ও প্রাসঙ্গিকতা।
হাফিজের সমাধির উদ্দেশে যখন আমরা রওয়ানা হই তখন শিরাজে সন্ধ্যা নামছে। আমার মাথায় একটা প্রশ্ন বিকেল থেকেই ঘুরপাক খাচ্ছিলো, কেন সন্ধ্যারাতে আমরা হাফিজের মাজার-সন্দর্শনে যাচ্ছি? রাতের অন্ধকারে ওখানে আমরা কি দেখব? দিনের আলো মিলিয়ে গেলে তো ভালভাবে কিছুই দেখা যাবে না। শেষ পর্যন্ত আমি বাংলাদেশ মিশনের কর্মকর্তা এবং গাইডকে জিজ্ঞেস করেই বসলাম। প্রতিউত্তরে যা শুনলাম তাহলো, হাফিজভক্তরা সন্ধ্যা থেকেই তাঁর মাজারে ভিড় করতে থাকে। কারণ, হাফিজ হলেন প্রেমের কবি। তাঁর কবিতায় প্রেমের কথকতায় প্রেমিককূল আবেগাপ্লুত হয়ে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে সন্ধ্যার আলোআঁধারিতে তাঁর সমাধিপ্রাঙ্গনে আসে। আমি সত্যিই অবাক হলাম। রাতের আলোআঁধারিতে প্রচুর নারী-পুরুষ, প্রেমিক-প্রেমিকা জুটিকে দেখে। মুগ্ধনয়নে নির্বাক হয়ে কিছুক্ষণের জন্যে আমিও প্রেমিক হৃদয়ে পরিণত হলাম। মনে জাগলো এক আশ্চর্য শিহরণ!
এরই মধ্যে আমাদের গাইড একটি অদ্ভুত কথা বললেন। তিনি হাফিজের একটি কবিতার বই এনে আমাদেরকে বললেন মনে মনে একটি কথা স্মরণ করতে বা ভাবতে। একথা বলে তিনি বললেন যে, ‘তুমি একটি ভাবনা ভাবতে ভাবতে হাফিজের বইয়ের যে পাতাটি মেলে ধরবে দেখা যাবে সেই কবিতার মূল ভাবের সাথে তোমার ভাবনা মিলে যাবে।’ আমরা পরীক্ষা দিলাম এবং যথারীতি কবি হাফিজ সেই পরীক্ষায় দারুণভাবে উত্তীর্ণ হলেন। মনে মনে ভাবলাম, এর রহস্য কী? মনের গহীন থেকে উত্তর এলো, যুগে যুগে প্রেমের তপস্যা এক, প্রেমিক-প্রেমিকার হৃদয়ের ভাষা, চোখের চাহনির মর্ম এক, মনের আকুতি কিংবা বিরহের তপস্যা- সেও তো একই। হাফিজ যদি সে কথাই তাঁর কবিতায় বলেন, তা হলে যুগে যুগে কালে কালে সব প্রেমিক-প্রেমিকা, নর-নারীর হৃদয়ের ভাবনা তো মিলেই যাবে। শত কোটি সালাম সুফি-দরবেশ ও প্রেমিক কবি হাফিজকে।

সংবাদ বিচিত্রা (বিদেশী সংবাদ)

পরমাণু সমঝোতায় সব পক্ষ লাভবান হবে : ফ্যাবিয়াসকে প্রেসিডেন্ট রুহানি
ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি বলেছেন, ছয় জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে ইরানের পরমাণু সমঝোতার ফলে ইউরোপের সঙ্গে তেহরানের স¤পর্ক শক্তিশালী হওয়ার পথ সুগম হয়েছে। তিনি গত ২৯ জুলাই তেহরান সফররত ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী লরা ফ্যাবিয়াসের সঙ্গে বৈঠকে এ মন্তব্য করেন।
হাসান রুহানি বলেন, ভিয়েনা সমঝোতার ভিত্তিতে ইরান-ফ্রান্স সহযোগিতার ফলে দুই দেশের পার¯পরিক স¤পর্ক আরো জোরদার হবে।
গত ১৪ জুলাই ভিয়েনায় স্বাক্ষরিত ইরানের পরমাণু সমঝোতা অনুযায়ী তেহরান তার পরমাণু কর্মসূচিতে সুনির্দিষ্ট কিছু সীমাবদ্ধতা আরোপ করবে। অন্যদিকে পাশ্চাত্য ইরানের ওপর আরোপিত সব নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবে। ছয় জাতিগোষ্ঠীর অন্যতম সদস্য ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফ্যাবিয়াস ওই সমঝোতায় সই করেন।
ফ্যাবিয়াসের সঙ্গে সাক্ষাতে ইরানের প্রেসিডেন্ট আরো বলেন, পরমাণু সমঝোতার মাধ্যমে ছয় জাতিগোষ্ঠী, ইরান এবং আঞ্চলিক দেশগুলো লাভবান হবে। এ সমঝোতা নানা ধরনের হুমকিকে সুযোগে পরিণত করেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি এ সমঝোতা বাস্তবায়নে আন্তরিকতার পরিচয় দিতে সব পক্ষের প্রতি আহ্বান জানান।
সাক্ষাতে ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তাঁর দেশের বহু কো¤পানি ইরানের বাজারে ফিরে এসে এমন কিছু খাতে পুঁজি বিনিয়োগ করতে চায় যেখানে প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থান হয়। তিনি ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদের পক্ষ থেকে ফ্রান্স সফরের একটি আমন্ত্রণপত্র প্রেসিডেন্ট রুহানির হাতে তুলে দেন।

মুসলিম ঐক্য ও সংহতিই শত্রুদের ষড়যন্ত্র রুখতে পারে : আয়াতুল্লাহ কাশানি
শত্রুদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে সব মুসলমানকে ঐক্য ও সংহতি আরও দৃঢ় করার আহ্বান জানিয়েছেন তেহরানের জুমআর নামাযের খতিব। আয়াতুল্লাহ ইমামি কাশানি গত ৩ জুলাই তেহরানের জুমআর নামাযের খোতবায় এ আহ্বান জানান।
বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতিকে খুবই ¯পর্শকাতর বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মুসলমানদের মাঝে যুদ্ধ-সংঘাত বাধিয়ে দিতে শত্রুরা উঠেপড়ে লেগেছে। তিনি বলেন, ইহুদিবাদী ইসরাইলসহ বিশ্বের আধিপত্যবাদী শক্তিগুলো আইএসআইএল, আন-নুসরা ও তালেবানের মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সৃষ্টি করে মুসলিম বিশ্বে বিভেদের আগুন জ্বালানোর পরিকল্পনা করেছে। দুঃখজনকভাবে কয়েকটি আরব দেশ মুসলমানদের ধ্বংস করতে পশ্চিমাদের নির্দেশনায় কাজ করছে।
পরিণতির কথা চিন্তা না করেই মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশ ইসলামের শত্রুদের সাথে একাত্ম হয়েছে। তারা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে নিজেদের তেলের টাকা ব্যয় করে অস্ত্রশস্ত্র, অর্থ ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।
আয়াতুল্লাহ ইমামি কাশানি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর পাশাপাশি ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন মিডিয়ার ইসলামবিরোধী তৎপরতাকে মুসলিম উম্মাহর জন্য মারাত্মক সমস্যা বলে উল্লেখ করেন। তিনি মুসলিম বিশ্বের আলেম ও খতিবসহ ইসলামী চিন্তাবিদদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা যেন নিজ নিজ অবস্থান থেকে ইসলামী মূল্যবোধ সুরক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
তেহরানের জুমআর নামাযের খতিব বলেন, পশ্চিমা কোনো কোনো দেশ ভাবছে সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিয়ে সিরিয়া, ইরাক, লেবাননসহ অন্যান্য মুসলিম দেশে শুধু মুসলমানদেরই ধ্বংস করবে আর তারা শুধু ফায়দা লুটবে। কিন্তু এই সন্ত্রাসের অগ্নিশিখা একদিন সন্ত্রাসের মদদদাতাদেরকেও জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারবে।
তিনি বলেন, মুসলিম বিশ্বের সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ হচ্ছে মুসলমানদের ঐক্য ও সংহতি। রমযানের শেষ জুমআর দিন বিশ্ব কুদ্স দিবস পালনের যে ডাক ইমাম খোমেইনী (রহ.) দিয়েছেন তার মূল লক্ষ্যই হলো বিশ্বের মুসলমানদের ঐক্য ও সংহতি রক্ষা করা।
কুয়েত এবং সৌদি আরবে সংঘটিত সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার প্রতি ইঙ্গিত করে তেহরানের জুমআর নামাযের অস্থায়ী খতিব বলেন, আশা করি শিয়া এবং সুন্নি ভাইয়েরা মুসলমানদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টিকারীদের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে সচেতন হবেন এবং সব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দিয়ে বিজয়ী হবেন।

শিয়া-সুন্নি ঐক্য সম্মেলনের ডাক দিলেন আল-আযহারের গ্রান্ড ইমাম
মিশরের আল-আযহার মসজিদের গ্রান্ড ইমাম রাজধানী কায়রোতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিয়া-সুন্নি ধর্মীয় আলেম ও চিন্তাবিদদের নিয়ে একটি সম্মেলনের ডাক দেন। গত ২২ জুলাই মিশরের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে গ্রান্ড ইমাম আল-তায়িবের এই আহ্বান প্রচার করা হয়।
শিয়া মুসলমানদের হত্যার বিরুদ্ধে ফতোয়া দিতে আল-তায়িব সুন্নি ধর্মীয় আলেমদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। অন্যদিকে, সুন্নি মুসলমানদের হত্যার বিরুদ্ধে একই ধরনের ফতোয়া দিতে তিনি শিয়া ধর্মীয় আলেমদের প্রতিও আহ্বান জানিয়েছেন।
এই অঞ্চলে মুসলমানদের মধ্যে জাতিগত বিদ্বেষ এবং রক্তপাত বন্ধ করার লক্ষ্যেই তিনি এ আহ্বান জানান বলে উল্লেখ করেন আল-তায়িব। মুসলমানদের মধ্যে শান্তি, সম্প্রীতি ও সহাবস্থান বজায় রাখার পাশাপাশি মুসলিম জাতিকে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষার করার ওপরও জোর দিয়েছেন আল-আজহারের এই শেইখ।
মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ ও শত্রুতা সৃষ্টির পাশাপাশি মুসলিম দেশগুলোর ভিতর যেসব নৃশংস এবং বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড চলছে এটি ইহুদিবাদীদের পরিকল্পনার অংশ বলেও অভিযোগ করেন আল-তায়িব।

‘ওবামা নয়, ইরানের প্রতিরোধই পরমাণু সমঝোতার কারণ’
মিশরের প্রখ্যাত সাংবাদিক মুহাম্মাদ হাসনাইন হাইকাল বলেছেন, ৬ বৃহৎ শক্তি ও ইরানের মধ্যে যে পরমাণু সমঝোতা হয়েছে তার বিরোধিতা করার ক্ষমতা সৌদি সরকারসহ পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের আরব সরকারগুলোর নেই, তবে তারা এ বিষয়ে মার্কিন সরকারের কাছে অভিযোগ তোলার ক্ষমতা রাখে।
তিনি ৬ বৃহৎ শক্তির সঙ্গে ইরানের পরমাণু সমঝোতাকে তেহরানের দৃঢ় অবস্থানেরই সুফল বলে মন্তব্য করেন এবং ইরানের প্রতিরোধকে ‘কিংবদন্তীতুল্য’ বলে অভিহিত করেন।
গত ২১ জুলাই লেবাননের দৈনিক আসসাফিরকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে হাইকাল এসব মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ইরানের প্রতিরোধের কারণেই পরমাণু সমঝোতা হয়েছে, ওবামার কারণে নয়।
তিনি বলেন, এ পর্যন্ত আরব আমিরাত ইরানের পরমাণু সমঝোতার ব্যাপারে ইতিবাচক অবস্থান নিয়েছে এবং সৌদি আরবও একই ধরনের নীতি গ্রহণ করতে পারে ভবিষ্যতে।
হাইকাল সিরিয়ার সন্ত্রাসীদের সঙ্গে লেবাননের হিজবুল্লাহর সংঘাত প্রসঙ্গে বলেন, হিজবুল্লাহর এই পদক্ষেপ আত্মরক্ষামূলক। হিজবুল্লাহ সিরিয়াতে তার প্রভাব সৃষ্টির জন্য এই দেশটিতে প্রবেশ করেনি বলে তিনি মন্তব্য করেন।
মিশরের প্রবীণ এই সাংবাদিক আরও বলেন, সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহর রয়েছে বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য যা আমাদের দৃষ্টিতে প্রশংসনীয়। লেবাননে সন্ত্রাসীদের অনুপ্রবেশ ঠেকানোর জন্যই সিরিয়াতে তাকে কিছু পদক্ষেপ নিতে হয়েছে।
তিনি ইয়েমেনে সৌদি হামলা প্রসঙ্গে বলেন, সৌদিরা চোরাবালিতে ডুবে যাবে এবং সৌদিরা কখনও ইয়েমেনে ঢুকতে পারবে না; তারা বাইর থেকেই হামলা চালিয়ে যাবে।

সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে ইরানের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে : বেলায়েতি
মধ্যপ্রাচ্যের বৈধ সরকারগুলোর সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে ইরানের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ীর উপদেষ্টা আলী আকবর বেলায়েতি গত ৪ জুলাই এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, ইরান সন্ত্রাসবাদ প্রতিহত করতে ব্যাপকভাবে সফল হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে নিরাপদ দেশে পরিণত হয়েছে ইরান এবং দেশটিতে পূর্ণ নিরাপত্তা বিরাজ করছে। বেলায়েতি বলেন, ১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের পরই পাশ্চাত্যের মদদপুষ্ট সন্ত্রাসের প্রথম শিকারে পরিণত হয়েছিল ইরান।
মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশে পাশ্চাত্যের মদদপুষ্ট সন্ত্রাসী তৎপরতা চলছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাসবাদ বিস্তারের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, আমেরিকা, ইহুদিবাদী ইসরাইল এবং মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিক্রিয়াশীল শাসক ও দেশগুলো সন্ত্রাসীদের অর্থ ও অস্ত্রের যোগান দিচ্ছে। এ ছাড়া, সন্ত্রাস বিস্তারের প্রশিক্ষণও দেয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
যেসব দেশ সন্ত্রাসবাদের শিকার হয়েছে তাদের মধ্যে সমন্বয় জোরদারের আহ্বান জানান বেলায়েতি। তিনি বলেন, সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের অগ্রভাগে রয়েছে ইরান, সিরিয়া এবং ইরাক। এ তিন দেশ একযোগে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে।

সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াইয়ে নেতৃত্বের ভূমিকায় ইরান : জারিফ
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাওয়াদ জারিফ বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাস এবং উগ্রবাদবিরোধী লড়াইয়ে নেতৃত্বের ভূমিকা রাখছে ইসলামী প্রজাতন্ত্র। তেহরান সফররত সুইজারল্যান্ডের উপ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইভিস রোসিয়ারের সঙ্গে গত ২২ জুলাই ২০১৫ অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ মন্তব্য করেন তিনি।
জারিফ বলেন, সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে আঞ্চলিক দেশ বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে পার¯পরিক সহযোগিতা বাড়াতে প্রস্তুত রয়েছে ইরান। এ ছাড়া, ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা বিশেষ করে অর্থনৈতিক খাতে সহযোগিতা বাড়াতেও ইরান আগ্রহী বলে জানান তিনি।
রোসিয়ার ইরানের সঙ্গে ছয় জাতির পরমাণু সমঝোতাকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ে তেহরান-বার্ন স¤পর্ক উন্নয়ন করা উচিত।

ইরানের আটক অর্থের মোট পরিমাণ ২৯০০ কোটি ডলার
ইরানের আটক অর্থের পরিমাণ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা নাকচ করে দিয়ে গত ২৬ জুলাই ২০১৫ ইরান বলেছে, এর মোট পরিমাণ দুই হাজার নয়শ’ কোটি ডলার। এ অর্থের বেশির ভাগই ইরানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিবিআই-এর স¤পত্তি বলেও জানানো হয়েছে। এর আগে, বিদেশে আটক ইরানের এ অর্থের পরিমাণ ১০ হাজার কোটি ডলার হতে পারে বলে কোনো কোনো মহল জল্পনা-কল্পনা করেছিল।
সিবিআই গভর্নর ওয়ালিউল্লাহ সেইফ ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনকে বলেছেন, আটককৃত অর্থের মধ্যে ২৩০০ কোটি ডলারই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স¤পত্তি। তিনি আরো জানান, ইরানের সঙ্গে ছয় জাতিগোষ্ঠীর পরমাণু সমঝোতার ভিত্তিতে অর্থ অবমুক্ত করা হলে তা সরকারি কোষাগারে জমা হবে।
আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল বিক্রির ৬০০ থেকে ৭০০ কোটি ডলারও আটক করা হয়েছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, অবমুক্ত হওয়া মাত্রই এ অর্থ প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সরকারকে দেয়া হবে।
ঐতিহাসিক পরমাণু সমঝোতার মাধ্যমে ইরানের ১০ থেকে ১৫ হাজার কোটি ডলার সমপরিমাণ অর্থ অবমুক্ত হবে বলে মার্কিন কর্মকর্তারা মন্তব্য করেছিলেন। আর তারই পরিপ্রেক্ষিতে এ বিবৃতি দেন সিবিআই প্রধান।

গান রচনার মাধ্যমে গাজাবাসীরা ইরানের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাল
ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি ইরানের নৈতিক ও বৈষয়িক সমর্থনের জন্য ফিলিস্তিনি সংগীতশিল্পীদের একটি দল ইরানের জনগণকে তাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে একটি গান রচনা করেছে।
‘ইরান তোমাকে ধন্যবাদ’ এই শিরোনামে গানটি গাজায় লেখা ও গাওয়া হয়েছে। গানে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় বসবাসরত অধিবাসীদের জন্য ইরানের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা দেয়ার ব্যাপারে প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়েছে। এছাড়া, আল-কুদ্সকে মুক্ত করার জন্য মুসলিম উম্মাহর ঐক্য প্রতিষ্ঠার ওপরও গানে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০০৭ সাল থেকে ইহুদিবাদী ইসরাইল গাজায় অবরোধ দিয়ে রেখেছে। এই অন্যায় অবরোধের ফলে গাজায় বেকারত্ব ও দারিদ্র্যসহ বিভিন্ন মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।

ইরানে সাদ্দামের রাসায়নিক হামলার কথা জানত ব্রিটেন
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের জনগণ ও ইরাকের কুর্দি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ইরাকের সাবেক স্বৈরশাসক সাদ্দামের রাসায়নিক হামলার কথা জানত ব্রিটেন। কিন্তু ওই হামলা ঠেকাতে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেয় নি ব্রিটিশ সরকার।
ব্রিটেনের অপ্রকাশিত গোপন দলিল থেকে এসব কথা জানা গেছে। এতে বলা হয়েছে, ইরাককে রাসায়নিক অস্ত্র বানানোর প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি দিয়েছিল ব্রিটেনের একটি প্রতিষ্ঠান। এ কারণে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার ইরাককে রাসায়নিক হামলা থেকে বিরত রাখার কোনো ব্যবস্থা নেয় নি। ওই হামলায় হাজার হাজার ইরানী ও কুর্দি নাগরিক নিহত হয়েছিল। রাসায়নিক হামলার শিকার বহু মানুষ বেঁচে থাকলেও দীর্ঘ রোগ ভোগের মুখে পড়েছেন তারা।
‘ইরাকে রাসায়নিক অস্ত্র উৎপাদন’ শীর্ষক ১৯৮৩ সালের ওই গোপন দলিলে ব্রিটেনের কূটনীতিকরা ইরাকের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে ব্রিটিশ সরকারকে সতর্ক করে বলেছিলেন, এতে আন্তর্জাতিক সমালোচনা এড়ানো যাবে না। উত্তর আয়ারল্যান্ডে রাসায়নিক গ্যাস ব্যবহারের বিষয়ে রাশিয়ার কড়া সমালোচনার কথা সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া, ব্রিটিশ কো¤পানি ‘উইয়ার পাম্প’ ইরাকের সামারা রাসায়নিক কারখানায় কীটনাশক তৈরির নামে পা¤প সরবরাহ করেছিল সে কথাও উল্লেখ করা হয়েছে ওই দলিলে।
১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লব সফল হওয়ার পর ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সাদ্দাম সরকার ইরানের ওপর অন্যায়ভাবে যুদ্ধ চাপিয়ে দেয় যা আট বছরের মুসলিম ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে পরিণত হয়।
যুদ্ধে ইরাককে সমর্থন দিয়েছিল আমেরিকা ও ব্রিটেনসহ তাদের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মিত্ররা। এছাড়া, কোনো কোনো দেশ ইরাককে আর্থিক সমর্থন যোগানোর জন্য বিশেষ ঋণ পর্যন্ত দিয়েছিল এবং মার্কিন সরকার সামরিক সরঞ্জাম ও স্যাটেলাইট চিত্র দিয়ে ইরাককে সহায়তা করেছিল।

ইয়েমেনে কোনো ইরানী সামরিক পরামর্শক নেই
ইয়েমেনে কয়েকজন ইরানী সামরিক পরামর্শক নিহত হয়েছেন বলে যে খবর প্রচার করা হয়েছে গত ৪ জুলাই তারিখে তা নাকচ করে দিয়েছেন ইরানের অন্যতম উপ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ান। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, যুদ্ধকবিলত আরব দেশ ইয়েমেনে কোনো ইরানী সামরিক পরামর্শক পাঠানো হয় নি।
তিনি বলেন, ইয়েমেনে শুধু ইরানের দূতাবাস রয়েছে এবং প্রতিষ্ঠানটি সেখানে প্রকাশ্যে সরকারি কাজকর্ম করে থাকে। গত ৪ জুলাই সৌদি আরবের মালিকানাধীন টেলিভিশন চ্যানেল আল-আরাবিয়া দাবি করে, ইয়েমেনের সা’দা প্রদেশে সৌদি বিমান হামলায় ইরানের পাঁচজন সামরিক পরামর্শক ও প্রকৌশলী নিহত হয়েছেন। এ খবরের পর আমির আবদুল্লাহিয়ান ইয়েমেনে সামরিক পরামর্শক থাকার কথা নাকচ করেন।
ইয়েমেনে সৌদি আরবের অব্যাহত আগ্রাসন ও অবরোধের বিরোধিতা করে আরব ও আফ্রিকাবিষয়ক ইরানের উপ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেন, সৌদি আরবের এসব অপরাধের কারণে ইয়েমেনের রাজধানী সানায় ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি হতে চলেছে। ইয়েমেনে সৌদি যুদ্ধাপরাধের কোনো যৌক্তিকতা নেই বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

ইরানে ২০ জার্মান কো¤পানির প্রতিনিধি ও অর্থমন্ত্রীর সফর
ইরানের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়ানোর লক্ষ্যে জার্মানির দশটি বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান ও দশটি ছোট কো¤পানির প্রতিনিধিদল গত ১৯ জুলাই ২০১৫ তেহরান সফর করেন। ইরানের সঙ্গে ৬ জাতির পরমাণু আলোচনাশেষে একটি সমঝোতা অর্জিত হওয়ার পর ইরানী জ্বালানি উপমন্ত্রী হুসাইন ইসমাইলি এই খবর দেন। জার্মানির অর্থনীতি ও জ্বালানিবিষয়ক মন্ত্রী সিগমার গ্যাব্রিয়েল সফরকারী প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন।
বিখ্যাত জার্মান কো¤পানি মার্সিডিস, সিমেন্স, বিএএসএফ, ভক্সওয়াগন, লিন্ডে ও জিআইজেড-এর প্রতিনিধিরা এই সফরে ছিলেন বলে ইসমাইলি জানান। জার্মান মন্ত্রী ইরানের পররাষ্ট্র, জ্বালানি, বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন।
ইরানের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের আগে জার্মানি ছিল ইসলামী এই দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য-অংশীদার।

ইরাক ও চীনের সাথে ইরানের কৃষিবিষয়ক সম্পর্ক সম্প্রসারণের উদ্যোগ
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সরকার ইরাক ও চীনের সাথে কৃষি খাতে পারস্পরিক সহযোগিতা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ইতিপূর্বে স্বাক্ষরিত সমঝোতার বাস্তবায়নের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সরকারের কৃষিমন্ত্রী জনাব মাহ্মূদ্ হুজ্জাতী জানান, ইরান ও ইরাক প্রাণী সম্পদের স্বাস্থোন্নয়ন সম্পর্কে গত ফেব্রুয়ারি মাসে (২০১৫) একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং দু’দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি সমূহ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি কৃষিবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনে সম্মত হয়।
সম্প্রতি ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সফরে আগত ইরাকী কৃষিমন্ত্রী ফাল্লাহ্ হাসান আল-যাইদানের সাথে এক বৈঠকের পর ইরানী কৃষিমন্ত্রী বলেন, কৃষিতে দু’দেশের বেসরকারি খাতের মধ্যে সহযোগিতা গড়ে তোলার বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে এবং এ ব্যাপারে ইরান স্বীয় অভিজ্ঞতা ইরাকি বিশেষজ্ঞ ও কর্মকর্তাদেরকে সরবরাহ করতে পারে। তিনি বলেন, আমাদের অনেক পেশাদার বিশেষজ্ঞ রয়েছেন যাঁরা কৃষি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করে থাকেন; তাঁরা তাঁদের নতুন বৈজ্ঞানিক অর্জনসমূহে ইরাকি বিশেষজ্ঞদেরকে অংশীদার করতে পারেন।
ইরাকি কৃষিমন্ত্রী ফাল্লাহ্ হাসান আল-যাইদান বলেন, ইরাক নতুন সেচপদ্ধতি ব্যবহার করছে এবং মৎস্য চাষের ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, তবে আমাদের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য আমরা ইরানী প্রযুক্তিরও প্রয়োজন অনুভব করছি।
তিনি আরো বলেন, ইরাক গম ও বার্লি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইরানের সহযোগিতা নিতে চায়। তিনি উল্লেখ করেন যে, ইরাকের মোট গম উৎপাদনের শতকরা ৫০ ভাগ ও মোট বার্লি উৎপাদনের শতকরা ২০ ভাগই দেশের উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশসমূহে উৎপাদিত হয়ে থাকে, কিন্তু ঐ অঞ্চল বর্তমানে রণাঙ্গনে পরিণত হয়ে যাওয়ায় দেশের গম ও বার্লি উৎপাদন দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। তিনি বলেন, এ পরিপ্রেক্ষিতে ইরাক সরকার দেশের দক্ষিণাঞ্চলে গম উৎপাদন করতে চাচ্ছে, কিন্তু সেখানে পানির ঘাটতি রয়েছে। তিনি ইরাকের ঐ অঞ্চলে সেচপদ্ধতির উন্নয়নের লক্ষ্যে দু’দেশের মধ্যে একটি যৌথ কমিটি গঠনের জন্য প্রস্তাব দেন।
আলোচনার পর দু’পক্ষ চারাগাছের কোয়ারান্টাইন এবং কৃষি ক্ষেত্রের কীট ও রোগ মোকাবিলার লক্ষ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার উদ্দেশ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে।
এছাড়া চীনের ন্যাশন্যাল পিপল্স্ কংগ্রেস-এর কৃষি ও পল্লি অঞ্চলবিষয়ক কমিটির সভাপতি চেন জিয়াঙ্গু ইরানী কৃষিমন্ত্রীর সাথে এক বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন। তিনি বলেন, কৃষির দিক থেকে ইরান একটি বিশাল দেশ, তাই ইরান চীনকে মূল্যবান কৃষি অভিজ্ঞতা সরবরাহ করে সাহায্য করতে পারে। তিনি ইরান ও চীনের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক কৃষি সহযোগিতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে একটি যৌথ টেকনিক্যাল কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেন।

ইরান থেকে চুরি হয়ে যাওয়া শিল্পকলা সামগ্রী ফেরত দিলো ইতালি
ইতিপূর্বে ১০ বছর ধরে চোরাচালানীদের দ্বারা ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান থেকে চুরি করে ইতালিতে নিয়ে যাওয়া ৩০টি শিল্পকলা সামগ্রী ঐ দেশের সরকার ইরানের কাছে ফেরত দিয়েছে।
বার্তা সংস্থা র্ইনা-র দেয়া খবর অনুযায়ী, ইরানের একটি আইনি প্রতিনিধিদল ইতালির শিল্পকলা কর্তৃপক্ষের সাথে এক দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ে জয়লাভ করে এবং ইতালির উত্তরাঞ্চলীয় শহর মিলানের একটি আপিল আদালতের নির্দেশে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ গত ৩১শে জুলাই (২০১৫) শিল্পকলা সামগ্রীগুলো ফেরত দেয়।
উক্ত শিল্পকলা সামগ্রীসমূহের মধ্যে ইরানের ইসলাম-পূর্ব ও ইসলাম-পরবর্তী উভয় যুগের সামগ্রী রয়েছে। ইতিপূর্বে ইতালি সরকারের শিল্পকলাবিষয়ক পুলিশ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক উদ্ধারকৃত উক্ত শিল্পকলা সামগ্রীগুলো দেশটির রাজধানী রোমে অবস্থিত জাতীয় ন্যাশন্যাল মিউজিয়াম অব ওরিয়েন্টাল আর্টস্-এ অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে ইতালিস্থ ইরান দূতাবাসের একজন প্রতিনিধির কাছে শিল্পকলা ফেরত দেয়া হয়। মিউজিয়ামের প্রশাসকের অফিসের কর্মকর্তা পাওলা পিয়াসেন্তিনী ও ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সংস্থার উপপ্রধান মোহাম্মাদ হাসান ত্বালেবান অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
জনাব ত্বালেবান জানান যে, চুরি যাওয়া বা অবৈধভাবে রপ্তানিকৃত শিল্পকলা সামগ্রী সম্পর্কে ১৯৯৫ সালে রোমে স্বাক্ষরিত আন্তর্জাতিক চুক্তি টঘওউজঙওঞ ঈড়হাবহঃরড়হ অনুযায়ী উক্ত শিল্পকলা সামগ্রীসমূহ ফেরত দেয়া হয়। উক্ত চুক্তিতে শিল্পকলা সামগ্রীর ক্রেতাদের জন্য সংশ্লিষ্ট দ্রব্যাদি বিক্রির আইনগত বৈধতা আছে কিনা তা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়াকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে রোমের ইরান দূতাবাস যে সফল কর্মতৎপরতা চালিয়েছে সে জন্য জনাব ত্বালেবান দূতাবাস কর্মকর্তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি উল্লেখ করেন যে, উদ্ধারকৃত শিল্পকলা সামগ্রীসমূহ আপাতত রোমের ইরান দূতাবাসে থাকবে এবং আগামী সেপ্টেম্বরে (২০১৫) অনুষ্ঠিতব্য একটি অনুষ্ঠানে এগুলো ইরানের জাতীয় জাদুঘরের কাছে হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু হবে।
ইরানী আইনি প্রতিনিধি দলকে সহায়তাকারী রোমের ইরান দূতাবাসের আইনজীবী দুইলিও করতাস্সা জানান, চোরাচালানিরা ইসলাম-পূর্ব ও ইসলাম-পরবর্তী যুগের উক্ত শিল্পকলা সামগ্রীসমূহ ইরান থেকে ইতালির উত্তরাঞ্চলীয় শহর মোন্যা-য় নিয়ে যায় এবং ২০০৭ সালে ইতালির শিল্পকলাবিষয়ক পুলিশ সেগুলো উদ্ধার করে।

ইরানের বিশ্ববিদ্যালয় কারিকুলামে কুর্দি ভাষা
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পশ্চিম অংশের কুর্দি অধ্যুষিত অঞ্চলের ছাত্রছাত্রীরা এখন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ে কুর্দি ভাষা ও সাহিত্যকে প্রধান বিষয় হিসেবে অধ্যয়ন করতে পারবে। এ সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে কুর্দিস্তান বিশ্ববিদ্যালয় আগামী সেপ্টেম্বর থেকে যে শিক্ষা সেসন শুরু হতে যাচ্ছে তাতে কুর্দি ভাষা ও সাহিত্য প্রধান বিষয় হিসেবে অধ্যয়নের জন্য চল্লিশ জন ছাত্রছাত্রীকে ভর্তি করা হবে বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি কুর্দিস্তান প্রদেশে তাঁর দু’দিনব্যাপী সফরের সমাপ্তি পর্যায়ে গত ২৫শে জুলাই (২০১৫) তারিখে প্রাদেশিক কেন্দ্র সানান্দাযে এক অনুষ্ঠানে এ সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেন। তিনি আরো জানান যে, এখন থেকে সরকারি বার্তাসংস্থা র্ইনা কুর্দি ভাষায় সংবাদ ও প্রতিবেদন প্রকাশ করবে।
প্রেসিডেন্ট রুহানি কুর্দিভাষী জনগণকে সাহসী ও ভালো লোক বলে প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সরকার সমগ্র ইরানে যেসব নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী রয়েছে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও পোশাকের সংরক্ষণ করাকে স্বীয় কর্তব্য বলে মনে করে।
উক্ত অনুষ্ঠানে কুর্দিস্তান বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর অধ্যাপক ফারদীন আখলাক্বিয়ান উল্লেখ করেন, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা সংস্থা ইতিমধ্যেই তার প্রকাশিত গাইড্-বুকে ছাত্রছাত্রীদেরকে কুর্দি ভাষা ও সাহিত্যকে প্রধান বিষয় হিসেবে গ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার অনুমতি প্রদান করেছে। তিনি আরো উল্লেখ করেন যে, কুর্দি ভাষা ও সাহিত্য বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অন্যতম প্রধান বিষয় হিসেবে শিক্ষা দানের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণের কাজ ২০০২ সালে শুরু হয়।
উল্লেখ্য, সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের মোট জনসংখ্যা ৭ কোটি ৯৫ লক্ষ এবং এদের মধ্যে প্রায় ৫০ লক্ষ (মোট জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৬.৩ ভাগ) লোকের মাতৃভাষা হচ্ছে কুর্দি যাদের বেশির ভাগই পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ কুর্দিস্তান, পশ্চিম আযারবাইজান, কেরমানশাহ ও ইলাম-এ বসবাস করে।

তুরস্কে ইরানী শিল্পীদের শিল্পকর্ম প্রদর্শনী
তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে ইরানী শিল্পীদের শিল্পকর্মের একটি জমকালো প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো। ‘পৃথিবী থেকে বেহেশ্ত’ শীর্ষক এ প্রদর্শনী গত ৭ই জুলাই (২০১৫) তারিখে শুরু হয় এবং এক মাসব্যাপী চলে।
ইস্তাম্বুলের কামাল রেসিত রেই সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে প্রদর্শনীটির উদ্বোধন করা হয়। তুরস্কে নিয়োজিত ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের কন্সাল জেনারেল জনাব মোহ্সেন মোরাতাযায়ীফার, তুরস্ক সরকারের বেশ কয়েক জন কর্মকর্তা, একদল শিল্পকর্ম সংগ্রাহক ও কয়েক জন গ্যালারির স্বত্বাধিকারী এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
ছয়টি বিভাগে অনুষ্ঠিত এ প্রদর্শনীতে প্রধানত ইরানী ক্যালিগ্রাফিভিত্তিক ও সাফাভী যুগের মটিফ্ প্রতিফলনকারী বিভিন্ন ধরনের শিল্পকর্ম প্রদর্শন করা হয়। প্রদর্শনীর প্রধান ভাগে কাপড়ের ওপর অঙ্কিত কতগুলো অনন্য ও উদ্ভাবনীমূলক মিনিয়েচার চিত্র ও ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শন করা হয়। বায়সোনগে¦ারী ক্যালিগ্রাফি রীতির ওপরে ভিত্তি করে একদল ইরানী শিল্পী এ শিল্পকর্মগুলো তৈরি করেন।
উল্লেখ্য, স্বনামখ্যাত ইরানী ক্যালিগ্রাফি শিল্পী জা‘র্ফা বায়সোনগে¦ারী-র নামে ‘বায়সোনগে¦ারী ক্যালিগ্রাফি রীতি’র নামকরণ করা হয়েছে। তিনি ১৪২৯ খ্রিস্টাব্দে মহাকবি ফেরদৌসির বিশ্বখ্যাত মহাকাব্য ‘শাহ্নামা’র ক্যালিগ্রাফিক পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন।
প্রদর্শনীতে এ ছাড়াও ফিরোযা পাথরের ও ইস্পাতের তৈরি বিভিন্ন হস্তশিল্প, ইরানী কার্পেট এবং কোরআনের আয়াত ও ফারসি কবিতার চিত্ররূপ প্রদর্শন করা হয়। প্রদর্শনীর আরেকটি আকর্ষণীয় অংশ ছিল ইরানের ঐতিহাসিক শহর ইসফাহানের বিখ্যাত চেহেল সোতুন (চল্লিশ স্তম্ভ) প্রাসাদে অঙ্কিত চিত্রসমূহের অনুকরণে চুনা পাথরের মণ্ড দ্বারা তৈরি শিল্পকর্মসমূহ। প্রদর্শনীতে বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে মূল্যবান প্রস্তর খচিত ১৬৩ সেন্টিমিটার উঁচু একটি তামার পাত্র।
এ প্রদর্শনীতে আরো ছিল কাপড়ের চিত্র অঙ্কন, খোদাই চিত্র, এনামেলের কাজ ও দেয়াল চিত্র অঙ্কনের প্রদর্শনীমূলক ওয়ার্কশপ।

ইরান সফরের জন্য ৭ দেশের নাগরিকের ভিসার প্রয়োজন পড়বে না
গত ২৮ জুলাই আবনা জানিয়েছে, ইরান সফরের জন্য সাত দেশের নাগরিকের ভিসার প্রয়োজন পড়বে না। ইরানের পর্যটন শিল্পকে জোরদার করার লক্ষ্যে এসব দেশের নাগরিকের জন্য ভিসার বাধ্যবাধকতা তুলে নেয়া হয়েছে। এ সাতটি দেশ হলো তুরস্ক, লেবানন, আযারবাইজান, জর্জিয়া, বলিভিয়া, মিশর ও সিরিয়া।
নতুন ভিসা বিধি অনুযায়ী এ সাত দেশের নাগরিক ভিসা ছাড়া ইরানে ১৫ থেকে ৯০ দিন অবস্থান করতে পারবেন। এ ছাড়া, ভিসা ব্যবস্থা সহজ করার বিষয়টিও খতিয়ে দেখছে ইরান। নতুন এ ব্যবস্থায় বিশ্বের ৬০টি দেশের নাগরিকের জন্য ভিসা সংক্রান্ত সীমাবদ্ধতা তুলে নেয়া হবে।

মুসলিম চিকিৎসকদের অষ্টম আন্তর্জাতিক সম্মেলন
আহলে বাইত (আ.) বিশ্বসংস্থার উদ্যোগে এবং ইরানের কয়েকটি শহরের বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতায় গত ২৯শে জুলাই থেকে ১০ই আগস্ট পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়েছে মুসলিম চিকিৎসকদের অস্টম আন্তর্জাতিক সম্মেলন। এতে মুসলিম বিশ্বের ৩০০ জন চিকিৎসক অংশগ্রহণ করেন। আলোচনা সভা, প্রশিক্ষণ কর্মশালা, যিয়ারত, সাংস্কৃতিক কেন্দ্রসমূহ পরিদর্শন ইত্যাদি কর্মসূচিতেও তারা অংশ নেন।
ইমামিয়া মেডিক্স ইন্টারন্যাশনাল, ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও মেডিকেল শিক্ষা বিভাগ, ইমাম রেযা (আ.)-এর মাযার পরিচালনা পরিষদ, মাশহাদ সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন সংস্থা এ সম্মেলন আয়োজনে আহলে বাইত (আ.) বিশ্বসংস্থাকে সহযোগিতা করে।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত হতে মুসলিম চিকিৎসকরা এখানে সমবেত হয়ে চিকিৎসা সংক্রান্ত নানা বিষয়ে মত বিনিময় করেন।
চিকিৎসা খাতে ইরানের সাফল্যের কিছু নমুনা ইরানের বিভিন্ন শহরে, বিশেষ করে তেহরান ও মাশহাদে প্রদর্শিত হয়।

ইরানী রসায়নবিদের রজার টেলর পুরস্কার লাভ
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের রসায়নবিদ মান্দানা আমীরী রসায়ন বিজ্ঞানে বিশেষ অবদানের জন্য ব্রিটিশ কার্বন গ্রুপের রজার টেলর পুরস্কার লাভ করেছেন। মান্দানা আমীরী ইরানের মোহাক্বক্বেক্ব আরদেবিলী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকা।
উল্লেখ্য, বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ কেমিস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন, ফিজিক্স ইনস্টিটিউট ও ইসলামিক ওয়ার্ল্ড সায়েন্স সাইটেশন ড্যাটাবেস (আইএসসি) কর্তৃক যৌথভাবে প্রতি বছর রজার টেলর পুরস্কার দেয়া হয়। কার্বনের ওপর মূল্যবান গবেষণা আঞ্জাম দানকারী ব্যক্তিদেরকে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়।
মান্দানা আমীরী জানান যে, তিনি ইতিপূর্বে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবুর্গে অনুষ্ঠিত অ্যাডভান্স্ড্ ন্যানো-স্ট্রাকচার কনফারেন্সে পুরস্কার লাভ করেন। তিনি এ পর্যন্ত আইএসআই-এ ৩২টি গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন এবং ৬০টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করেছেন। এছাড়া তিনি ২০১১ সালে জাপানে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশন্যাল ন্যানো সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করে ইয়ং রিসার্চার অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন।

বিশ্বের শীর্ষ বিজ্ঞানীদের তালিকায় ১৭৩ জন ইরানী বিজ্ঞানী
বিশ্বের বিজ্ঞানীদের মধ্যে সর্বাধিক আলোচিত শতকরা এক ভাগ শীর্ষ বিজ্ঞানীর তালিকায় ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ১৭৩ জন বিজ্ঞানগবেষক স্থান লাভ করেছেন। ইসলামিক ওয়ার্ল্ড সায়েন্স সাইটেশন ড্যাটাবেস (আইএস্সি)-র তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মাদ জাওয়াদ দেহ্ক্বানী গত ১৩ই জুলাই (২০১৫) তারিখে বার্তা সংস্থা আইএসএনএ-কে এ তথ্য জানান।
মোহাম্মাদ জাওয়াদ দেহ্ক্বানী উল্লেখ করেন যে, আইএসসি বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় অনুসন্ধান চালিয়েছে এবং এভাবে উদ্ঘাটন করেছে যে, বিশ্বের বিজ্ঞানীদের মধ্যে সর্বাধিক আলোচিত শতকরা এক ভাগ শীর্ষ বিজ্ঞানীর মধ্যে ১৭৩ জন ইরানী বিজ্ঞানী রয়েছেন। তিনি আরো জানান, আইএসসি ইরানের শীর্ষ বিজ্ঞানীদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকাও প্রস্তুত করেছে।
জনাব দেহ্ক্বানী আরো উল্লেখ করেন যে, বিজ্ঞানীদের মধ্যে শতকরা ৫০.৮ ভাগ ফান্ডামেন্টাল সায়েন্সসমূহে কাজ করছেন এবং শতকরা ২১.৪ ভাগ চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে, শতকরা ২১ ভাগ টেকনিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিজ্ঞানসমূহে, শতকরা ৬.৪ ভাগ কৃষিবিষয়ক বিজ্ঞানসমূহে ও শতকরা ০.৬ ভাগ সামাজিক বিজ্ঞানসমূহে কাজ করছেন।
তিনি আরো উল্লেখ করেন যে, শতকরা ৫০ ভাগ শীর্ষ বিজ্ঞানী সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে কর্মরত আছেন এবং শতকরা ২৩ ভাগ পলিটেকনিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে, শতকরা ২১ ভাগ চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে, শতকরা ৩ ভাগ বিভিন্ন গবেষণা কেন্দ্রে ও শতকরা ৩ ভাগ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে কর্মরত আছেন।

বিশ্বে গোলাপ পানি উৎপাদনে এক নম্বর অবস্থানে রয়েছে ইরান
ইরান প্রতিবছর ২৬ হাজার টন গোলাপ পানি উৎপাদন করে এবং গোলাপ পানি উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশ্বের এক নম্বর দেশে পরিণত হয়েছে ইরান। ইরানের উপ কৃষিমন্ত্রী মিত্রা মাজদজাদেহ গত ১ জুলাই এ কথা জানান। চলতি বছর ইরানের গোলাপ পানি উৎপাদনের পরিমাণ সাড়ে ২৭ হাজার টন হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। তিনি বলেন, লাল গোলাপ থেকে গোলাপ পানি উৎপাদনকারী প্রথম দেশ ইরান। লাল গোলাপকে ইরান থেকে দামেস্কে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং সেখান থেকে এ ফুল ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে বলে ইউরোপে এ ফুল ‘দামেস্ক গোলাপ’ নামে পরিচিত।
সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ২ থেকে ৩ হাজার মিটার উচ্চতায় লাল গোলাপ সবচেয়ে ভালো জন্মায় বলেও জানান তিনি। সমগ্র ইরানে লাল গোলাপ জন্মালেও প্রধানত এ ফুলের চাষ হয় ইরানের ইসফাহান, কেরমান, কেরমানশাহ, র্ফাস এবং পূর্ব আযারবাইজান প্রদেশে। ইরানের উৎপাদিত গোলাপের শুকনো পাপড়ি, কুঁড়ি এবং গোলাপ থেকে তৈরি গোলাপ পানি রপ্তানি করা হয়।
গোলাপ পানি উৎপাদনে বিশ্বে সবচেয়ে খ্যাতিমান দেশ ইরান। এ ছাড়া, হাঙ্গেরি, ফ্রান্স, তুরস্ক, বুলগেরিয়া, মরক্কো, সিরিয়া এবং আফগানিস্তানের গোলাপ পানি উৎপাদনের খ্যাতি রয়েছে।

ইরানী গবেষকদের দস্তা বিশোধনের উন্নততম পদ্ধতি উদ্ভাবন
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের একদল বিজ্ঞানগবেষক দস্তা বিশোধনের উন্নততম পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন যার সাহায্যে দস্তাকে বিশোধন করে এতে মিশ্রিত অন্যান্য ধাতব দূরীভূত করে শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহারের উপযোগী শতকরা ৯৯.৯৯ ভাগ বিশুদ্ধ দস্তা সরবরাহ করা সম্ভবপর হবে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ওস্তানে র্মাকাযী (মধ্য প্রদেশ)-এর বিজ্ঞান পার্কের বিজ্ঞানগবেষকগণ এ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। এ প্রকল্পের পরিচালক জনাব আলী আযীমী জানান যে, তাঁরা খনিজ দস্তা ও শিল্পবর্জ্য থেকে অত্যন্ত উন্নত মানের বিশুদ্ধ দস্তা বহির্গত করার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। এর ফলে, বছরে শিল্পবর্জ্যে যে বিশ হাজার টন দস্তা যুক্ত হয়ে দূষণ ঘটাচ্ছে তা রোধ করা সম্ভব হবে এবং শতকরা ৯৯.৯৯ ভাগ বিশুদ্ধ দস্তা পাওয়া যাবে যা শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহার করা সম্ভব হবে। উল্লেখ্য, এ পর্যন্ত দস্তাকে সর্বোচ্চ শতকরা ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ পর্যন্ত বিশোধন করা সম্ভব হতো, তবে বর্তমানে আর এ ধরনের দস্তা শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় না।
তিনি আরো জানান যে, এ ধরনের উন্নত মানের দস্তা উৎপাদনের লক্ষ্যে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে ইতিমধ্যেই দু’টি কারখানা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। প্রথমে কারখানা দু’টি দুই টন দস্তার উন্নততম বিশোধনের মধ্য দিয়ে কাজ শুরু করবে।

ইরানী গবেষকগণ মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রিত কৃত্রিম হাত তৈরি করেছেন
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের একদল গবেষক এমন এক ধরনের কৃত্রিম হাত তৈরিতে সক্ষম হয়েছেন যা মানবদেহে সংযোজনের পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি স্বাভাবিক হাতের ন্যায়ই স্বীয় মস্তিষ্কের দ্বারা তা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে। ইরানের ইউনিভার্সিটি অব সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন্-এর সাথে সংশ্লিষ্ট একটি গবেষণা কেন্দ্রের গবেষকগণ এ কৃত্রিম হাতটি তৈরি করেছেন।
উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য প্রযুক্তি কেন্দ্র এ কৃত্রিম হাত তৈরি করে। কেন্দ্রের পরিচালক জনাব র্ফাহাদ্ তাবাতাবায়ী জানান, এ কেন্দ্র বেশ কয়েকটি গবেষণা প্রকল্প গ্রহণ করে- যার মধ্যে ব্রেন ওয়েভের দ্বারা পরিচালিত কৃত্রিম হাত তৈরি অন্যতম। তিনি বলেন, যারা নানা দুর্ঘটনায় হাত হারিয়েছে এমন লোকদেরকে সাহায্য করার জন্য এ কৃত্রিম হাত তৈরি করা হয়েছে। তিনি এ কৃত্রিম হাতটি কীভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে ধারণা দিতে গিয়ে বলেন, যখন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার হাতটি দ্বারা কোনো কাজ করার ইচ্ছা করে তখন সে এ বিষয়ে চিন্তা করতে শুরু করে, এর ফলে তার মস্তিষ্কে ব্রেন ওয়েব তৈরি হয় এবং তা তার কৃত্রিম হাতে স্থানান্তরিত হয়, তখন কৃত্রিম হাতটি সংশ্লিষ্ট কাজটি আঞ্জাম দিতে সক্ষম হয়।
জনাব ফারহাদ তাবাতাবায়ী বলেন, এ কৃত্রিম হাতের সিস্টেমটি স্মার্ট টেক্নোলোজির ওপর ভিত্তি করে ডিজাইন করা হয়েছে- যা ব্রেন ওয়েভ গ্রহণ করতে সক্ষম। এতে একটি ব্রেন ওয়েভ প্রসেসর রয়েছে; প্রসেসরটি প্রাপ্ত ব্রেন ওয়েভকে প্রসেস করে তা হাতটির ড্রাইভিং মোটরে পাঠিয়ে দেয় এবং তখন মোটরটি কৃত্রিম হাতটিকে কাজ করতে সাহায্য করে।

ইরানের তেলবাহী সুপার ট্যাংকারের বহর বিশ্বে সবচেয়ে বড়
ইরানের অপরিশোধিত তেলবাহী সুপার ট্যাংকারের বহর বিশ্বে সবচেয়ে বড়। এ বহরে ৪২টি সর্ববৃহৎ তেলবাহী জাহাজ বা ভিএলসিসি রয়েছে এবং এসব জাহাজের প্রতিটি ২০ লাখ ব্যারেল তেল বহন করতে পারে।
ন্যাশনাল ইরানিয়ান ট্যাংকার কো¤পানি বা এনআইটিসি’র বাণিজ্যবিষয়ক পরিচালক নাসরুল্লাহ সারদাশি গত ৩ জুলাই এ কথা জানান। তিনি বলেন, বিশ্বের আর কোনো কো¤পানির এতো বেশি অপরিশোধিত তেলবাহী জাহাজ বা ভিএলসিসি নেই।
তেলবাহী ট্যাংকারের বিষয়ে অভিজ্ঞ লন্ডনভিত্তিক এক বিশ্লেষক দৈনিক ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে বলেন, তিনি মনে করেন, বিশ্বে সর্ববৃহৎ তেলবাহী সুপার ট্যাংকার বহরের মালিক ইরানের এনআইটিসি। এ দৈনিকের প্রতিবেদন অনুযায়ী ইরানী কো¤পানির প্রতিদ্বন্দ্বী জাপানের মিৎসুই ও.এস.কে লাইন্স ও নিপ্পন ইউসেন কাইশা এবং বেলজিয়ামের ইউরোন্যাভ এনভির কাছে অল্প কয়েকটি সুপার ট্যাংকার আছে। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও এনআইটিসি নিজের উন্নয়ন তৎপরতা বন্ধ রাখে নি। এটি আরো ভিএলসিসি নির্মাণের জন্য চীনা কো¤পানিকে অর্ডার দিয়েছে এবং গত আড়াই বছরে ২০ সুপার ট্যাংকার এনআইটিসিকে দেয়া হয়েছে।

ইরান এবার চালু করল ‘গাদির-২’ রাডার ব্যবস্থা
ইরানের ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি গত ৪ জুলাই ২০১৫ দীর্ঘপাল্লার রাডারব্যবস্থা ‘গাদির-২’ চালু করেছে। ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় নগরী আহভাজে এ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে।
গত বছরের জুন মাসে প্রথম ‘গাদির’ রাডারব্যবস্থা চালু করা হয়। এ রাডার ব্যবস্থার পাল্লা ১১০০ কিলোমিটার বা ৬৮০ মাইলের বেশি। অত্যাধুনিক এ রাডারব্যবস্থা আকাশ পথের শত্রুদের শনাক্ত করতে ত্রিমাত্রিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে। এ ছাড়া, স্টিল্থ বিমান, ক্রুজ ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং লো অরবিট বা নি¤œকক্ষপথের কৃত্রিম উপগ্রহ শনাক্ত করতে পারে এ ব্যবস্থা।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরান প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে। দেশটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সরঞ্জাম ও ব্যবস্থা তৈরিতেও সাফল্য পেয়েছে। তবে সামরিক শক্তি অর্জনের বিষয়ে ইরান বলেছে, দেশটির সেনাবাহিনী অন্য কোনো দেশের জন্য হুমকি সৃষ্টি করবে না। কারণ, সামরিক শক্তি অর্জনের প্রধান লক্ষ্য হলো আত্মরক্ষা।

ইরানের স্বর্ণ উৎপাদন ২ বছরে ৭ মেট্রিক টনে পৌঁছবে
ইরানের আহলে বাইত (আ.) বার্তা সংস্থা (আবনা) গত ২৪ জুলাই জানিয়েছে যে, ইরানের স্বর্ণ উৎপাদন ২০১৭ সালের মধ্যে সাত মেট্রিক টনে পৌঁছবে। এতে বিশ্বের স্বর্ণ উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অবস্থানে চলে যাবে ইরান।
মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় স্বর্ণ খনি ইরানের জাশুরান থেকেই এককভাবে ৬ মেট্রিক টন স্বর্ণ উৎপাদন করা হবে। এ ছাড়া, পূর্ব আযারবাইজান প্রদেশে ৭০০ কেজি এবং নিশাবুরের আরগাশ থেকে আরো ৩০০ কেজি স্বর্ণ উৎপাদন হবে।
ইরানের পশ্চিম আযারবাইজান প্রদেশের তাকাব শহরের কাছে অবস্থিত জাশুরান স্বর্ণ খনির উৎপাদন শুরু হয় ২০১৪ সালে। এ খনির প্রতি বছর ৩ মেট্রিক টন স্বর্ণ, ২.৫ টন রৌপ্য এবং ১ টন পারদ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। ২০১৭ সালের মধ্যে এ খনির উৎপাদন দ্বিগুণ করার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। প্রাথমিক হিসাবে বলা হয়েছে, এ খনিতে উত্তোলনযোগ্য ৫৫ টন স্বর্ণের মজুদ রয়েছে। তবে আরো খনন চালিয়ে এ খনি থেকে ১১০ টন পর্যন্ত স্বর্ণ উৎপাদন করা যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
ইরানের শিল্প, খনিজ এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ পর্যন্ত ১৫টি স্বর্ণখনি শনাক্ত করেছে এবং এসব খনি থেকে ৩২০ মেট্রিক টন স্বর্ণ উৎপাদন করা যাবে।

বিশ্ব রোবো-কাপ শিরোপা প্রতিযোগিতায় ইরানের বিরাট সাফল্য
সম্প্রতি চীনের হেফেই শহরে অনুষ্ঠিত ১৯তম বিশ্ব রোবো-কাপ শিরোপা প্রতিযোগিতা ২০১৫-তে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান বিরাট সাফল্য অর্জন করেছে। এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে ইরানের আমীর কাবীর পলিটেকনিক বিশ্ববিদ্যালয় তিনটি বিভাগে যথাক্রমে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান দখল করেছে।
এ প্রতিযোগিতায় আমীর কাবীর পলিটেকনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ধার-রোবোট সংশ্লিষ্ট বিভাগে প্রথম স্থান দখল করে। এছাড়া টেকনিক্যাল সেকশনের প্রতিযোগিতায় ইরানী রোবোট দ্বিতীয় স্থান লাভ করে। অন্যদিকে ইরানী রোবোট টীম মানবিক রোবোট সেকশনের প্রতিযোগিতায় জার্মানিকে পরাজিত করে তৃতীয় স্থান দখল করে।
ইরানী টীমসমূহের পরিচালক জনাব সোরূশ সাদেক-নেযাদ বলেন, প্রতিযোগিতাটি খুবই উন্নততর পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হয় এবং এতে অংশগ্রহণ করার জন্য ইরানী টীমসমূহ যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল।
উল্লেখ্য, গত ১৯শে জুলাই (২০১৫) চীনের হেফেই শহরে পাঁচ দিনব্যাপী ১৯তম বিশ্ব রোবো-কাপ শিরোপা প্রতিযোগিতা শুরু হয় এবং এতে বিশ্বের ৪৭টি দেশ থেকে দুই হাজারেরও বেশি রোবোটিক্স্ পেশাজীবী ও এ বিষয়ে আগ্রহী ব্যক্তিগণ অংশগ্রহণ করেন।
এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী রেবোটসমূহ কোনো রকমের বাইরের নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে এবং সেগুলোকে নিজে নিজেই হাঁটা, দৌড়ানো, লাথি মারা, ভারসাম্য বজায় রাখা, দর্শন ক্ষমতা ও স্বীয় অবস্থান সংক্রান্ত ধারণার প্রোগ্রাম দিয়ে তৈরি করা হয়।
উল্লেখ্য যে, সর্বপ্রথম ১৯৯৩ সালে জাপানি গবেষকগণ রোবো-কাপ প্রবর্তন করেন- যার উদ্দেশ্য ছিল রোবোটিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের লক্ষ্যে ফুটবল প্রতিযোগিতায় রোবোটের ব্যবহার। এ উদ্দেশ্যে চূড়ান্ত লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় যে, ২০৫০ সালের মধ্যে এমন একটি রোবোট ফুটবল টীম তৈরি করা হবে যা ঐ বছর বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতায় মানুষ টীমের সাথে প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম হবে। এ প্রকল্পটি অভাবিতভাবে জাপানের বাইরেও গবেষকদের ব্যাপক দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং এ কারণে তাঁরা আন্তর্জাতিকভাবে রোবো-কাপ প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য অনুরোধ জানান। এর ভিত্তিতে ১৯৯৭ সাল থেকে প্রতি বছর বিশ্ব রোবো-কাপ শিরোপা প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
এ প্রতিযোগিতার উপযোগী রোবোট তৈরি করার ফলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরির ক্ষেত্রেও যথেষ্ট উন্নয়ন সাধিত হয়েছে

ইর্ন্টান্যাশন্যাল্ ফিজিক্স্ অলিম্পিয়াডে ইরানী ছাত্রদের পাঁচটি স্বর্ণ ও রৌপ্যপদক লাভ
গত ১২ই জুলাই (২০১৫) তারিখে সমাপ্ত ৪৬তম ইন্টারন্যাশন্যাল ফিজিক্স অলিম্পিয়াডে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ছাত্র প্রতিযোগীরা পাঁচটি স্বর্ণ ও রৌপ্যপদক লাভ করেছে। ভারতের হোমি ভব সেন্টার ফর সায়েন্স এডুকেশন-এ অনুষ্ঠিত এ অলিম্পিয়াড প্রতিযোগিতায় বিশ্বের ৮৬টি দেশ থেকে চার শতাধিক ছাত্রছাত্রী অংশগ্রহণ করে।
এ প্রতিযোগিতায় জনাব আহমাদ র্শীযাদ ও জনাব আইয়ূব এসমাঈলীপূর-এর নেতৃত্বাধীন ইরানী টীমের সদস্য ছাত্ররা হলো মোহাম্মাদ আলী খাদেম, মোহাম্মাদ হোসেন দারেস্তানী, আলী শীরাযী, মোহাম্মাদ জাওয়াদ তাবাতাবায়ী ও আলী ফাত্হী। এদের মধ্যে মোহাম্মাদ হোসেন দারেস্তানী ও আলী শীরাযী স্বর্ণপদক এবং মোহাম্মাদ জাওয়াদ তাবাতাবায়ী ও আলী ফাত্হী রৌপ্যপদক লাভ করে।

ইরানের সঙ্গে ৫+১ গ্রুপের পরমাণু সমঝোতা: একটি পর্যালোচনা

মিজানুর রহমান মিলন

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে ইরানের সঙ্গে ৫+১ বিশ্বশক্তির ব্যাপকভিত্তিক পরমাণু চুক্তি সই হয়েছে। ইরানের সরকার ও জনগণসহ সারা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ এবং বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রতিষ্ঠানের প্রধানগণও এই চুক্তিতে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এই চুক্তি স¤পর্কে একটি মন্তব্যই যথেষ্ট যে, সারা বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য চুক্তিটি সকলের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
ইরান গত ১৩ বছর ধরে পরমাণু ক্ষেত্রে যেসব অধিকার দাবি করে এসেছিল চুক্তিতে ইরানের সেইসব দাবি মেনে নেয়া হয়েছে। নিজ ভূমিতে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের অধিকার, পরমাণু প্রযুক্তির উন্নয়ন ও গবেষণার অধিকার, এমনকি পরমাণু বাণিজ্যের অধিকারের স্বীকৃতি পেয়েছে ইরান। অর্থাৎ রাশিয়া, আমেরিকা, ফ্রান্সসহ পরাশক্তিরা অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে যেমন পরমাণু চুক্তি করে সে ধরনের পূর্ণ অধিকার পেয়েছে ইরান। কোনো পরমাণু স্থাপনা বন্ধ করতে হয়নি ইরানকে। ইরান আরো পেয়েছে জাতিসংঘে পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি।
হ্যাঁ, ইরান যেহেতু দাবি করে আসছে পরমাণু কর্মসূচির উদ্দেশ্যই শান্তিপূর্ণ সেহেতু ইরানের পরমাণু কার্যক্রম মাত্র ১০ বছরের জন্য জাতিসংঘের পরমাণু তদারকি প্রতিষ্ঠান আইএইএ-র পর্যবেক্ষণে পরিচালিত হবে। যদিও ইরান এনপিটির সদস্য হওয়ায় আগে থেকেই ইরানের পরমাণু কার্যক্রম তদারকি করে আসছে আইএইএ এবং এই ১০ বছর ইরান শান্তিপূর্ণ কাজ বাদে সামরিক ও পরমাণু অস্ত্র উৎপাদনে তার কর্মসুচি পরিচালিত করতে পারবে না। তবে এরপর ইরান পূর্ণ স্বাধীন মাত্রায় তার পরমাণু কর্মসূচি চালাতে পারবে। এর অর্থ এই নয় যে, ইরান ১০ বছর পর পরমাণু অস্ত্র বানাবে। বিনিময়ে ইরানের ওপর থেকে আরোপিত জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের সব ধরনের অবরোধ প্রত্যাহার করা হবে।
ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেয়ী যে রেড লাইন বেঁধে দিয়েছিলেন চুক্তিতে সকল রেড লাইন মেনে নেয়া হয়েছে। পশ্চিমারা দাবি করছিল- ইরানের ফোরদো পরমাণু স্থাপনা বন্ধ করতে হবে। চুক্তিতে সে দাবিও তাদের অর্জিত হয়নি। পশ্চিমারা দাবি করেছিল- ইরানের সামরিক ক্ষেত্রগুলোতেও পরিদর্শনের সুযোগ দিতে হবে, পশ্চিমাদের সে দাবিও অর্জিত হয়নি। পশ্চিমারা দাবি করেছিল- ইরানের সামরিক সক্ষমতা বিশেষ করে ইরানের মিসাইল সক্ষমতা আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, সে দাবিও ইরান বরাবরই নাকচ করেছে। এমনকি পরমাণু বিজ্ঞানীদের সাক্ষাতের নামে জিজ্ঞাসার অনুমতিও দেয়নি ইরান- যা পশ্চিমাদের অন্যতম দাবি ছিল।
মনে রাখা দরকার- ২০০৩ সালে ইরানীরা ইইউ-র সাথে আলোচনায় গবেষণার জন্য মাত্র কয়েকটা সেন্ট্রিফিউজ রাখতে চেয়েছিল, পশ্চিমারা সে অনুমতিও ইরানকে দেয়নি। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামি পশ্চিমাদের দাবি অনুসারে ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম সীমিত করেছিলেন, কিন্তু পশ্চিমাদের সামরিক হুমকি ও তাদের দাবি উপেক্ষা করে পরমাণু কার্যক্রম পুরোদমে শুরু হয় এবং পরমাণু ক্ষেত্রে একের পর এক বিভিন্ন সাফল্য আসতে থাকে। প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিমারা ইরানের ওপর আরোপ করে একের পর এক কঠোর অবরোধ।
ইরানের সঙ্গে আলোচনার জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য ও জার্মানিকে নিয়ে গঠিত হয় ৫+১ গ্রুপ। ইরানের ওপর অরোপিত অবরোধের মাত্রা কেমন ছিল তা বুঝতে শুধু এইটুকুই বলা যথেষ্ট হবে যে, ইরানের ব্যাংকিং লেনদেনও আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। ইরানকে প্রাচীন বিনিময় প্রথা অনুসরণ করতে হয়েছে; তা আবার সবক্ষেত্রেও সম্ভব হয় নি বা হয় না। এরফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইরানের প্রায় তিন হাজার কোটি ডলার আটকা পড়েছিল। এখন চুক্তি অনুযায়ী ইরান তার এই সমুদয় অর্থ বিদেশি ব্যাংক থেকে নিজ দেশে নিয়ে যেতে পারবে এবং বিশ্বের যেকোনো দেশের সাথে কোনো বাধা ছাড়াই স্বাধীনভাবে বাণিজ্য করতে পারবে।
মূলত চুক্তিটা ইরানের জন্য যতটা না জরুরি তার চেয়ে পশ্চিমাদের জন্য অনেক বেশি জরুরি ছিল। আর এই কারণেই চুক্তিটা হয়েছে। ইরানের ওপর সব ধরনের অবরোধ আরোপ করেছে পশ্চিমা বিশ্ব ও জাতিসংঘ। অবরোধের এমন কোনো দিক নেই যা ইরানের ওপর আরোপ করা হয়নি। আমার ধারণা- ইরানের ওপর যেসব অবরোধ আরোপ করা হয়েছে তা ইরান বাদে অন্য কোনো দেশের ওপর অরোপ করা হল সেই দেশটা দেউলিয়া ও তার অর্থনীতি ভেঙে পড়তে বাধ্য হতো, এমনকি তা তেলসমৃদ্ধ দেশ হলেও। ইরান অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পশ্চিমাদের সে আশা পূরণ হয়নি। শুধু পূরণ হয়নি তা নয়, ইরান উল্টো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন করে পশ্চিমাদের তাক লাগিয়ে দেয়। পশ্চিমারা অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ইরানকে দুর্বল করে ইরাকের মতো আক্রমণ করতে চেয়েছিল, কিন্তু ইরান নিজস্ব প্রযুক্তিতেই সকল সমরাস্ত্র তৈরি করা শুরু করে। ট্যাংক, ড্রোন, মিসাইল, ব্যালাস্টিক মিসাইল, সাবমেরিন, ডেস্ট্রয়ার, হেলিকপ্টার, জঙ্গিবিমান, উচ্চক্ষমতাস¤পন্ন রাডারসহ সবধরনের সমরাস্ত্র ইরান নিজেই তৈরি করে। ইরানের গ্যাসোলিন আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে পশ্চিমারা, কিন্তু ইরান নিজেই গ্যাসোলিন উৎপাদন করে রপ্তানিরও ঘোষণা দেয়। তেল শিল্প উন্নয়নের ওপর অবরোধ আরোপ করেছে পশ্চিমারা, কিন্তু তেল শিল্প উন্নয়নের প্রায় সকল ধরনের প্রযুক্তি ইরান নিজেই আবিষ্কার করেছে।
কৃষি, চিকিৎসা, শিল্প, পরমাণু, মহাকাশ গবেষণা, সামরিক, বায়োটেকনোলজি, ন্যানোটেকনোলজিসহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সকল শাখায় ইরান ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। অবরোধের মধ্যেও নিজস্ব প্রযুক্তির স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ ও মহাকাশে বানর প্রেরণ অন্যতম সফলতা ইরানের। এসব বিভিন্ন কারণেই ইরানের ওপর আরোপিত অবরোধ আশানুরূপ মাত্রায় কাজ করেনি। এছাড়াও কোনো দেশ আক্রমণ বা ধ্বংস করতে সরকার ও জনগণকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হ­ যেমনটা ছিল সাদ্দামের সাথে ইরাকি জনগণের ও গাদ্দাফির সাথে লিবিয়ার জনগণের, কিন্তু ইরানের ক্ষেত্রে পশ্চিমারা ১৯৭৯ সালের পর থেকে শত চেষ্টা করেও তা পারেনি। কারণ, জনগণকে সাথে নিয়ে নিজস্ব ধারার গণতান্ত্রিক সিস্টেম চালু করেছে ইরান। প্রেসিডেন্টও নির্বাচিত, পার্লামেন্টের এমপিও নির্বাচিত, এমনকি ইরানী সরকারের সকল স্তরের কর্মকর্তাগণও নির্বাচিত। এমতাবস্থায় সকল ধরনের অবরোধ আরোপ করে পশ্চিমারা তাদের সকল সফ্ট উইপনই নিঃশেষ করেছে। বাকি থাকে থার্ড উইপন অর্থাৎ ইরান আক্রমণ!
ইরানের সামরিক সক্ষমতা, সামরিক অফিসারদের ঐক্য, ইরানের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি এবং বিশ্ব পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন কারণেই ইরানের ওপর সামরিক আগ্রাসন চালানো পশ্চিমাদের জন্য সম্ভব নয়। এই অবস্থায় ইরানের সাথে চুক্তি না করার অর্থ হলো ইরানকে তার পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে স্বাধীনভাবে চলতে দেয়া- যা মেনে নেয়াও পশ্চিমাদের জন্য আপাতভাবে সম্ভব নয়। আর অন্যদিকে ইরানের জন্য জরুরি হয়ে পড়ছে তার ওপর আরোপিত সব ধরনের অবরোধ প্রত্যাহার। পশ্চিমারা ২০১৩ সাল থেকেই ইরানের সাথে পরমাণু চুক্তি করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল।
১৯৭৯ সাল ইরানে ইমাম খোমেইনীর নেতৃত্বে সংঘটিত ইসলামী বিপ্লবে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের অন্যতম সেবাদাস ও মিত্র প্রবল পরাক্রমশারী রেজা শাহ পাহলভির পতনের মাধ্যমে পশ্চিমাদের সাথে বিরোধের সূত্রপাত হয়েছিল। বর্তমান ইরানের অন্যতম চরিত্র হলো- দেশটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র হওয়ার পরেও মার্কিন ও ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অন্যতম শক্তি যা মুসলিম বিশ্বে বিরল! অন্যদিকে বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর সাথে ইরানের বন্ধুত্বপূর্ণ স¤পর্ক রয়েছে। রেজা শাহ পাহলভির পতন যুক্তরাষ্ট্র কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। তারা তাদের ইরানে অবস্থিত দূতাবাসের মাধ্যমে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল এর ফলে তৎকালীন ইরানী ছাত্ররা মার্কিন দূতাবাস দখল করে যুক্তরাষ্ট্রকে উচিত শিক্ষা দিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র কমান্ডো বিমান পাঠিয়েও কুলকিনারা পায়নি! যুক্তরাষ্ট্র এর প্রতিশোধ হিসেবে সৌদি আরব ও অন্যান্য রাজতান্ত্রিক, স্বৈরশাসক আরবদের সহায়তায় ইরাকের সাদ্দামকে লেলিয়ে দিয়েছিল ইরান আক্রমণে। এর ফলাফল সবার জানা আছে।
সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কঠোর অবস্থান নিয়েও সাম্রাজ্যবাদীদেরকে কোনো সম্মানজনক চুক্তি করতে বাধ্য করা যায়- ইরানের সফলতার এটি অন্যতম দিক। চুক্তি হওয়ার পরপরই ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেয়ীর মন্তব্য পড়লেই বিষয়টা ¯পষ্ট হবেÑ
‘তবুও, এর অর্থ এই নয় যে, এই অহংকারী উদ্ধত শক্তির সাথে আমাদের লড়াই-সংগ্রাম সব এখানেই শেষ হয়ে যাচ্ছে বরং, তাদের আঞ্চলিক গোয়েন্দাগিরি ও এ অঞ্চলে তাদের বিভক্তিমূলক রুলিং টেকনিক-এর বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম সবেমাত্র শুরু হলো।
ইরানের সাথে ৫+১ বিশ্বশক্তির পরমাণু চুক্তি বিশ্ব রাজনীতি ও বিশ্ব শান্তির জন্য অন্যতম মাইলফলক! বিশ্ব কূটনীতির অন্যতম সাফল্য। বিশ্বের নানা সংকটেও এ চুক্তি অন্যতম উদাহরণ। ঐতিহাসিক এই চুক্তি উন্নয়নশীল ও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য রোল মডেল হয়ে থাকবে ।

যায়নবাদীদের পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতি দৃষ্টি দেয়ার সময় এসেছে

– হোসাইন মূসাভীয়ান
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পর্কে বিশ্বের বৃহৎ দেশগুলোর সাথে আলোচনাকারী ইরানী টীমের অন্যতম সাবেক সদস্য ও জার্মানিতে নিয়োজিত সাবেক ইরানী রাষ্ট্রদূত বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সাইয়্যেদ হোসাইন মূসাভীয়ান বলেন, ৬ জাতি ও ইরানের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত সমঝোতার বিরুদ্ধে যায়নবাদী ইসরাইল ও সৌদি আরব যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করেছে তার মূল কারণ এই যে, তারা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল না, বরং তারা ইরান ও আমেরিকার সম্পর্কের উন্নয়নে উদ্বিগ্ন। তিনি আরো বলেন, এবার বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলোর জন্য ইসরাইলের পারমাণবিক অস্ত্র ভাণ্ডারের প্রতি দৃষ্টি দেয়ার ও সে সম্পর্কে তদন্ত পরিচালনা করার সময় এসেছে।
বার্তা সংস্থা ইরনা-র প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পর্কে ইরান ও বৃহৎ শক্তিবর্গের মধ্যকার আলোচনায় অংশগ্রহণকারী ইরানী টীমের সাবেক সদস্য হিসেবে বিশেষ অভিজ্ঞতার অধিকারী এবং বর্তমানে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির উড্র উইলসন স্কুলে অ্যাসোসিয়েট রিসার্চ স্কলার হিসেবে কর্মরত জনাব মূসাভীয়ানের কাছ থেকে বিভিন্ন প্রচারমাধ্যম সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে ও তাঁর লেখা প্রবন্ধ প্রকাশ করে। এ সবকিছুতে তিনি উপরিউক্ত মতামত প্রকাশ করেন। যেসব প্রচারমাধ্যম তাঁর সাক্ষাৎকার প্রচার করে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে টিভি-চ্যানেল ‘ডেমোক্র্যাসি নাউ’ ও সিএনএন টেলিভিশন। এছাড়া ডেইলি টেলিগ্রাফ জনাব মূসাভীয়ানের লিখিত একটি কৌশলগত প্রবন্ধ প্রকাশ করে। এসব সাক্ষাৎকার ও উক্ত প্রবন্ধে তিনি ৬ জাতি ও ইরানের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত সমঝোতাকে ইরান ও বিশ্বের বৃহৎ শক্তিবর্গ উভয় পক্ষের জন্যই একটি বিরাট অর্জন বলে অভিহিত করেন এবং অভিমত ব্যক্ত করেন যে, ইসরাইল ও সৌদি আরবের জন্য ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি কোনো উদ্বেগের বিষয় নয়, বরং তাদের উদ্বেগের মূল কারণ ইরান ও আমেরিকার মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন। তিনি আরো বলেন, ইরান ও বৃহৎ শক্তিবর্গের মধ্যে যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হলো মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের সকল দেশ যদি নিজেদের ক্ষেত্রে তা কার্যকর করে তাহলে মধ্যপ্রাচ্যকে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত অঞ্চলে পরিণত করার লক্ষ্য বাস্তবায়িত হবে। তিনি আরো বলেন, এখন ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সংক্রান্ত সমস্যার তো সমাধান হলো, এবার বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলোর উচিত ইসরাইলের পারমাণবিক অস্ত্র ভাণ্ডারের প্রতি দৃষ্টি দেয়া ও সে সম্পর্কে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। তিনি বলেন, তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ একগুঁয়েমি না করলে দশ বছর আগেই এ সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হতে পারতো।
যায়নবাদী সরকারের পারমাণবিক অস্ত্র সম্পর্কে তদন্তের সময় এসেছে
জনাব হোসাইন মূসাভীয়ান সিএনএন টেলিভিশনকে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পর্কিত সমস্যার সমাধানের পর এবার যায়নবাদী ইসরাইল সরকারের পারমাণবিক অস্ত্র ভাণ্ডারের প্রতি দৃষ্টি দেয়ার সময় এসেছে এবং বিশ্বের বৃহৎ শক্তিবর্গের উচিত এ সম্পর্কে তদন্ত করা।
জনাব মূসাভীয়ানকে প্রশ্ন করা হয়, আপনি যখন আলোচক কর্মকর্তা ছিলেন এবং ড. হাসান রুহানি আলোচক টীমের প্রধান ছিলেন তখনকার অবস্থা ও বর্তমান সমঝোতার মধ্যে পার্থক্য কী? জবাবে তিনি বলেন, এবারে সমঝোতার যে মূলনীতিমালা ও কাঠামোতে উপনীত হওয়া সম্ভব হয়েছে তা হুবহু তা-ই ২০০৫ সালে আমরা যা ইউরোপের তিনটি দেশের সাথে আমাদের দেশের পারমাণবিক কর্মসূচি বিষয়ক আলোচনাকালে প্রস্তাব দিয়েছিলাম। আমরা তখন ইউরোপীয়দেরকে বলেছিলাম যে, আমরা আমাদের পারমাণবিক কর্মসূচির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতাকে গ্রহণ করে নিতে প্রস্তুত আছি; ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি যে অস্ত্র তৈরির দিকে মোড় নেবে না তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আমরা আস্থা সৃষ্টিকারী সমস্ত পদক্ষেপ মেনে নিতে প্রস্তুত আছি।
তিনি বলেন, ঐ সময় ইউরোপের সংশ্লিষ্ট তিনটি দেশ সমঝোতার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল, কিন্তু এ ব্যাপারে তারা আমেরিকাকে রাযি করাতে পারে নি। কারণ, আমেরিকা জেদ ধরে বসেছিল যে, ইরান পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণের কাজ মোটেই আঞ্জাম দিতে পারবে না।
জনাব মূসাভীয়ান বলেন, কিন্তু আমেরিকার এ অবস্থান গ্রহণ ছিল পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি)-র সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কারণ, উক্ত চুক্তি অনুযায়ী চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশসমূহের জন্য পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ ও হেভি ওয়াটারের অধিকারী হওয়াসহ শান্তিপূর্ণ লক্ষ্যে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে পারমাণবিক প্রযুক্তির অধিকারী হওয়ার অধিকার রয়েছে। এ কারণেই এনপিটি-তে স্বাক্ষরকারী বেশ কিছু সংখ্যক দেশ এ ধরনের প্রযুক্তির অধিকারী ছিল। তিনি বলেন, দশ বছর আগে আমরা এ ব্যাপারে যে সমঝোতায় উপনীত হয়েছিলাম তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশের নীতির কারণে তা ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল। কারণ, তিনি ইরানের পারমাণবিক সৃমদ্ধকরণের বিরোধিতা করেন। কিন্তু বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা এ সমঝোতার কাজটি আঞ্জাম দিতে সক্ষম হয়েছেন। কারণ, তিনি ইরানের পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ ও হেভিওয়াটারের অধিকারী হওয়ার অধিকার মেনে নিয়েছেন। তিনি বলেন, এখানে মনে রাখতে হবে যে, ওবামার রেড লাইন্ ‘ইরানকে পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ থেকে বিরত রাখা’ ছিল না, বরং ছিল ‘পারমাণবিক বোমা’। আর এ কারণেই মার্কিন প্রেসিডেন্টের এ উদ্যোগকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের রাহ্বার ও প্রেসিডেন্ট স্বাগত জানান। কারণ, ইরান কখনোই পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হবার চেষ্টা করে নি।
জনাব মূসাভীয়ান বলেন, প্রতিষ্ঠিত সমঝোতা প্রেসিডেন্ট ওবামা ও বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলোর জন্য দু’টি বড় ধরনের সাফল্য নিয়ে এসেছে। প্রথমটি হচ্ছে, ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতাকে এবং আন্তর্জাতিক কাঠামোর আওতাধীনে সর্বাধিক পরিদর্শনের বিষয়টি মেনে নিয়েছে এবং দ্বিতীয়টি এই যে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি যে অস্ত্র উৎপাদনের দিকে মোড় নেবে না এটা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থাই এতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
তিনি বলেন, অনুরূপভাবে ইরানও দু’টি বড় ধরনের অর্জনের অধিকারী হয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে, বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলো ইরানের পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণের ও হেভি ওয়াটারের অধিকারী থাকার অধিকার মেনে নিয়েছে। দ্বিতীয় অর্জনটি এই যে, ইরানের ওপর থেকে সকল নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হবে।
জনাব মূসাভীয়ানকে প্রশ্ন করা হয়, বর্তমানে সৌদি আরব ও ইসরাইলসহ মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের অনেক দেশই এ ব্যাপারে ক্রুদ্ধ হয়েছে; আপনার মতে, এ সমস্যার সমাধানের জন্য ইরান কী করতে পারে? জবাবে তিনি বলেন, সৌদি আরব ও যায়নবাদী সরকারের ন্যায় দেশ ও সরকারগুলো ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ব্যাপারে উদ্বিগ্ন নয়, বরং তাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে তেহরান ও ওয়াশিংটনের সম্পর্কের উন্নয়ন। তিনি বলেন, যারা এ সমঝোতার বিরোধী তাদের সকলের উদ্দেশে আমার বক্তব্য হচ্ছে এই যে, মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের সকল দেশই যদি ইরানের সাথে প্রতিষ্ঠিত ১৫৯ পৃষ্ঠার এ সমঝোতাটি বাস্তবায়ন করে তাহলে মধ্যপ্রাচ্যকে পারমাণবিক অস্ত্র মুক্তকরণের আকাক্সক্ষা বাস্তবে রূপায়িত হবে।
জনাব মূসাভীয়ান বলেন, কিন্তু নেতানিয়াহুর অন্য একটি সমস্যা হচ্ছে এই যে, তার প্রত্যাশা ছিল, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সংক্রান্ত সমস্যাটি বৈশ্বিক শক্তিসমূহের কর্মসূচির মধ্যে আগের মতোই থেকে যাবে যাতে আগের মতোই বিশ্ব জনমত আসল বিষয়টি সম্পর্কে অর্থাৎ যায়নবাদী সরকারের পারমাণবিক অস্ত্র সংক্রান্ত বিষয়টি সম্পর্কে উদাসীন থাকে। তিনি বলেন, যায়নবাদী সরকার হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের একমাত্র সরকার যার হাতে পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। আর এখন যেহেতু ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সংক্রান্ত বিষয়টির সমাধান হয়ে গিয়েছে সেহেতু এখন বৈশ্বিক শক্তিসমূহের উচিত যায়নবাদী সরকারের পারমাণবিক বোমাগুলোর প্রতি দৃষ্টি দেয়া।
ভিয়েনার সমঝোতায় উভয় পক্ষই জিতেছে Ñ যা মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ
আমেরিক্যান টিভি চ্যানেল ‘ডেমোক্রাসি নাউ’-কে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে সাইয়্যেদ হোসাইন মূসাভীয়ান বলেন, ৬ জাতি ও ইরানের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত ভিয়েনা সমঝোতায় উভয় পক্ষই জিতেছেÑ যা মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলকে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত করার ক্ষেত্রে একটি অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে পরিগণিত হতে পারে।
জনাব মূসাভীয়ানকে প্রশ্ন করা হয়, আপনি কি মনে করেন যে, ভিয়েনা সমেঝোতা শান্তি অভিমুখী পথ? জবাবে তিনি বলেন, আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে, এ সমঝোতার পথ শান্তি অভিমুখী। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই যে, ওবামা যেমন বলেছেন, সমঝোতা এমন একটি যুদ্ধকে প্রতিহত করবে যে যুদ্ধ আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও বিশ্বের জন্য বিপর্যয়কর হবে। জনাব মূসাভীয়ান আরো বলেন, পাশ্চাত্যের দাবি অনুযায়ী, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির সামরিকায়নের যেসব সম্ভাব্য পথ রয়েছে, এ সমঝোতা তার সবগুলো পথকেই রুদ্ধ করে দেবে।
এ প্রসঙ্গে জনাব মূসাভীয়ান জোর দিয়ে বলেন, ইরান কখনোই পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হবার চেষ্টা করে নি এবং এ কারণে ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচিকে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি হিসেবে বহাল রাখার জন্য প্রয়োজনীয় যে কোনো গ্যারান্টি প্রদানে প্রস্তুত। তিনি ভিয়েনা সমঝোতা অনুযায়ী ইরানের পক্ষ থেকে গৃহীত আস্থা সৃষ্টিকারী পদক্ষেপসমূহের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন যে, ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচির শান্তিপূর্ণ হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার এবং পাশ্চাত্যের দাবিকৃত উদ্বেগসমূহের অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে সম্ভব সমস্ত পদক্ষেপই গ্রহণ করেছে। বস্তুত ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বিশ্বের বুকে স্বচ্ছতম পারমাণবিক কর্মসূচি।
জনাব মূসাভীয়ান আরো বলেন, সমঝোতায় ইরানের রেড লাইনও অনুসরণ করা হয়েছে। ইরানের দাবি ছিল পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি) অনুযায়ী তার বৈধ অধিকারের স্বীকৃতি; আমরা এর চেয়ে বেশি কিছু চাই না। ভিয়েনা সমঝোতায় ইরান তার এ অধিকার লাভ করেছে। তিনি বলেন, আমাদের আরেকটি রেড লাইন ছিল নিষেধাজ্ঞাসমূহের অবসান এবং আমরা তা অর্জন করেছি। এ কারণে ভিয়েনার সমঝোতা হচ্ছে উভয় পক্ষের জিতে যাওয়ার সমঝোতা।
জনাব মূসাভীয়ান বলেন, আমি মনে করি এ সমঝোতা প্রকৃতই একটি অনুকরণীয় আদর্শ হতে পারে। এ সমঝোতা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে অতিক্রম করে আরো বেশি উপকারী প্রমাণিত হতে পারে। কারণ, বৈশ্বিক শক্তিগুলো ও মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে যারা এ সমঝোতার বিরোধিতা করছে তারা যদি সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে ইরানের অনুকরণীয় আদর্শকে কাজে লাগায় তাহলে কেবল এ পথেই মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলকে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত অঞ্চলে পরিণত করার বিষয়টি নিশ্চিত করা যেতে পারে।
জনাব মূসাভীয়ান স্মরণ করিয়ে দেন যে, ইরানের বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচিকে সম্প্রসারিত করেছে। তিনি বলেন, এ থেকে পাশ্চাত্য বুঝতে পারে যে, নিষেধাজ্ঞা বিপরীত ফল দিয়েছে। আর এ বিষয়টি ছিল আলোচনা সফল হওয়ার অন্যতম কারণ। তিনি বলেন, আলোচনায় ইরান সব সময়ই স্থির ও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ করেছে, কিন্তু অতীতে আমেরিকা সব সময়ই ইরানের পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি পুরোপুরি স্থগিত করার দাবি করেছে। তবে পাশ্চাত্যজগৎ নিষেধাজ্ঞার বিপরীত ফল বুঝতে পারায় এবং তার পাশাপাশি ইরানের পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচির ব্যাপারে আমেরিকা তার আগের অবস্থান থেকে সরে আসায় এবার আলোচনা সফল হয়েছে।
মার্কিন সিনেটের রিপাবলিকান দলীয় কতক সদস্যসহ ভিয়েনা সমঝোতার সমালোচকগণ, বিশেষ করে মার্কিন কংগ্রেসে ইরান বিরোধীদের নেতা সিনেটর লিন্ড্সে গ্রাহাম্ যে দাবি করেছেন যে, ইরান সন্ত্রাসবাদকে সাহায্য করে এবং এ সমঝোতার ফলে ইরানের আর্থিক সামর্থ্য বেড়ে যাবে বিধায় ইরানের পক্ষে সন্ত্রাসবাদের জন্য আরো বেশি অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হবে, তাঁদের এ ধরনের দাবির জবাবে জনাব মূসাভীয়ান বলেন, এ ধরনের দাবি পুরোপুরি ভিত্তিহীন এবং এ ধরনের দাবির উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্ব জনমতকে বিভ্রান্ত করা। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, বিগত পাঁচ দশকে ইসরাইল তার প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে ছয় বার সামরিক হামলা চালিয়েছে। এছাড়া সৌদি আরব বিগত পাঁচ বছরে তার প্রতিবেশী দেশ বাহরাইন ও ইয়েমেনের বিরুদ্ধে দুই বার সামরিক হামলা চালিয়েছে। অন্যদিকে আমেরিকাও বিগত ১৫ বছরে আফগানিস্তান ও ইরাকে হামলা চালিয়েছে। আর এ সব হামলার কারণে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চল পুরোপুরি স্থিতিহীন হয়ে পড়েছে; কতক দেশ ধসে পড়েছে ও কতক দেশ ধসে পড়ার দোরগোড়ায় এসে উপনীত হয়েছে এবং সন্ত্রাসবাদীরা সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে, অথচ ইরানকে সন্ত্রাসবাদের জন্য দায়ী করা হচ্ছে।
ভিয়েনা সমঝোতা মধ্যপ্রাচ্যের প্রাকৃতিক সম্পদের ও বৃহৎ শক্তিবর্গের শক্তির অপচয় রোধ করবে
সাইয়্যেদ হোসাইন মূসাভীয়ান ডেইলি টেলিগ্রাফের ১৬ই জুলাই সংখ্যায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে বলেন, ভিয়েনা সমঝোতা আমেরিকার জন্য মধ্যপ্রাচ্যে তার যেসব মিত্র দেশ তার ঘাড়ে চেপে বসে আছে তাদের ওপর নির্ভরতা থেকে মুক্তির এবং ইরানের সাথে মুখোমুখি অবস্থার পরিবর্তে মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা বিধানে ও পারস্পরিক স্বার্থে কাজ করার সুযোগ এনে দেবে, আর সেই সাথে মধ্যপ্রাচ্যের প্রাকৃতিক সম্পদের ও বৃহৎ শক্তিবর্গের শক্তির অপচয় রোধ করবে। বার্তা সংস্থা আযাদ্ নিউজ এজেন্সী (আনা) পরিবেশিত ফারসি অনুবাদের ভিত্তিতে জনাব মূসাভীয়ানের প্রবন্ধের বাংলা অনুবাদ নিম্নে প্রদত্ত হলো :
ইরান ও ৫+১ গোষ্ঠী কাঠামোর আওতাধীন বৈশ্বিক শক্তিবর্গের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিক সমঝোতা ব্যাপক ফলাফল নিয়ে আসবে। আমরা যদি বলি যে, মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে, বরং সমগ্র বিশ্বে, এ ধরনের পরিস্থিতি আর কখনো হবে না তাহলে তা মোটেই অতিশয়োক্তি হবে না। কারণ, এ ক্ষেত্রে এমন একটি সমস্যা সম্পর্কে শান্তিপূর্ণ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভবপর হয়েছে যা আমাদের যুগের সর্বাধিক শ্বাসরুদ্ধকর সঙ্কটসমূহের অন্যতমে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। বস্তুত এ সমঝোতা মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে স্থিতিশীলতা সৃষ্টি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার দৃষ্টিকোণ থেকে একটি বিজয় হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।
অনেক আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকই যেমন উল্লেখ করেছেন, এ সমঝোতা ওবামার রেখে যাওয়া উত্তরাধিকারের একটি প্রধান অংশ হিসেবে পরিগণিত হবে। এর কারণ কেবল এ নয় যে, প্রতিষ্ঠিত সমঝোতাটি কতখানি গুরুত্বপূর্ণ এবং কেবল এ-ও নয় যে, এর ফলে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সংক্রান্ত সঙ্কটের সমাধান হয়েছে। যদিও এটা স্বীয় যথাস্থানে একটি বিরাট সাফল্য ও অর্জন, তবে (ওবামার উত্তরাধিকার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার জন্য) এর চেয়েও বড় কারণ এই যে, এ সমঝোতা মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষেত্রে আমেরিকার সামনে একটি নতুন দিকনির্দেশনার দরজা উন্মুক্ত করে দিয়েছে।
এ সমঝোতা আমেরিকাকে যা দিয়েছে তা হচ্ছে এমন একটি নির্বাচন ক্ষমতা যা এর আগে কখনোই এ দেশটির সামনে ছিল না। আর তা হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে আমেরিকার যে মিত্ররা বহু দশক যাবৎ তার কলার চেপে ধরে বসে ছিল (তথা ঘাড়ে চেপে বসে ছিল) তাদের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে পুরোপুরি মুক্তি লাভ করার সুযোগ। এ সমঝোতা মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের জন্য একটি নতুন নিরাপত্তা কাঠামো তৈরির জন্য দরজা খুলে দিয়েছে যে কাঠামোর আওতায় আমেরিকা ও ইরান পারস্পরিক স্বার্থকে এগিয়ে নেয়ার জন্যÑপরস্পরের মোকাবিলার জন্য নয়Ñপরস্পর সহযোগিতা করতে সক্ষম হবে। সর্বাধিক সম্ভাবনা এই যে, এ ধরনের সহযোগিতা একটি স্থিতিশীল, শান্তি ও স্বস্তিপূর্ণ এবং সফল মধ্যপ্রাচ্য তৈরি করবেÑ যা মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদের ও বৈশ্বিক শক্তিসমূহের শক্তির অপচয় রোধ করবে।
দীর্ঘদিন যাবৎ মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারে আমেরিকা যে সর্বাত্মক কৌশলগত নীতি অনুসরণ করে এসেছে তার ভিত্তিকে সংক্ষেপে ‘নিরাপত্তার বিনিময়ে তেল’ শিরোনামে উল্লেখ করা যেতে পারে। আমেরিকার এ নীতি আমেরিকাকে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চল থেকে নিরাপদে ও স্বাধীনভাবে তেল সরবরাহ লাভের নিশ্চয়তা বিধানের লক্ষ্যে বিশ্বের সর্বাধিক স্বৈরতান্ত্রিক কয়েকটি সরকারের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে বাধ্য করে। আমেরিকার সাবেক নীতিনির্ধারকদের একজন আমাকে বলেছিলেন : ‘আমরা কেবল মুখেই মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে আসছি, কিন্তু কার্যত বিগত কয়েক দশক যাবৎ মধ্যপ্রাচ্যের তেল আমাদের বিশ্বাসে ও ধর্মে পরিণত হয়ে আছে।’
আমেরিকার এ ধরনের নীতির ফল হয়েছে এই যে, মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে আমেরিকার স্বার্থ এবং সেই সাথে এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা সন্দেহাতীতভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে কেবল বিশৃঙ্খলা ও গোলযোগই ছড়িয়ে পড়ে নি এবং একই কারণে আমেরিকা কেবল একটি ব্যাপক বিস্তৃত রেষারেষি ও বিরাট ব্যয়ের মুখোমুখি এসেই দাঁড়ায় নি, বরং এর চেয়েও অধিকতর মন্দ ব্যাপার হলো এই যে, এ রেষারেষির ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের মার্কিন মিত্ররা উস্কানিদাতা হিসেবে একটি প্রধান ও মৌলিক ভূমিকা পালন করেছে, কিন্তু এ সমস্যার সমাধানের জন্য এ পর্যন্ত তারা আমেরিকাকে উল্লেখ করার মতো কোনো সাহায্য করে নি।
প্রকৃতই পরিস্থিতি এই যে, যদিও এ সব সরকার তাদের নিরাপত্তার এক শক্তিশালী অংশীদার আমেরিকার কাছ থেকে অনেক স্বার্থ হাসিল করে নিচ্ছে তবে তারা মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি ও সন্ত্রাসবাদের বিলোপের লক্ষ্যে প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে আমেরিকাকে খুবই অনুল্লেখযোগ্য সহায়তা দিচ্ছেÑ যার পরিমাণকে শূন্য বললেও অত্যুক্তি হবে না।
সারা দুনিয়া যেমন প্রত্যক্ষ করছে, তথাকথিত ইসলামী হুকুমতের (আইএস্) সদস্যরা লিবিয়া, সিরিয়া, ইরাক, লেবানন, ইয়েমেন ও এমনকি জর্দানে পর্যন্ত উপস্থিতির অধিকারী হয়েছে, কিন্তু এদের হুমকির সমাধানের ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের মার্কিন মিত্ররা উল্লেখ করার মতো কোনো সাহায্যই করে নি। আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এ প্রসঙ্গে বলেন : ‘আমাদের আঞ্চলিক মিত্ররা আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা। যে কেউই আসাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে চায় তাকেই এরা কোটি কোটি ডলার অর্থ ও হাজার হাজার টন অস্ত্র দিয়েছে, অথচ যাদেরকে এভাবে অর্থ ও অস্ত্র দেয়া হয়েছে এমন অনেক লোক এখন আন্-নুসরা ফ্রন্ট ও আল-ক্বায়েদা গঠন করেছে অথবা তারা হচ্ছে সেই বাহিনীর অংশবিশেষ যার লোকেরা সারা দুনিয়া থেকে এসে মধ্যপ্রাচ্যে সমবেত হয়েছে।’
বস্তুত আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্যস্থ মিত্রদের সাথে তার সম্পর্ক একটি সমস্যায় পরিণত হয়েছে এবং ক্ল্যাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে হয় যে, এটি একটি নৈতিক বিপদে পর্যবসিত হয়েছে। সংক্ষেপে বলা যেতে পারে যে, মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের মার্কিন মিত্ররা ঐ অঞ্চলে যে কোনো ধরনের শত্রুতামূলক ও উস্কানিমূলক পদক্ষেপেই ভূমিকা পালন করে থাকে এবং তারা এ সম্পর্কে ভালোভাবেই অবগত আছে যে, তাদের যে কোনো পরাজয়ের ও যে কোনো ভ্রান্ত পদক্ষেপের ব্যয়ই আমেরিকা বহন করবে। এ ব্যাপারে ইয়েমেন পরিস্থিতি হচ্ছে সুস্পষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টান্ত। কারণ, ইয়েমেনে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীনে যে হামলা অব্যাহত রয়েছে তা সমগ্র আরব উপদ্বীপে আল্-ক্বায়েদার শক্তির ব্যাপক বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছে। প্রকৃত ব্যাপার যা দৃষ্টিতে আসে তা থেকে সুস্পষ্ট যে, এ ব্যাপারে সৌদি আরবের কর্তাব্যক্তিদের সামান্যতম উদ্বেগও নেই। কারণ, তাঁরা জানেন যে, শেষ পর্যন্ত আমেরিকা, তাঁদের জন্য সৃষ্ট এ উদ্বেগের মূলোৎপাটন করবে।
‘আরব বসন্ত’ প্রমাণ করেছে যে, দুর্নীতিপরায়ণ, স্বৈরাচারী ও দুর্বীনিত সরকারগুলোর পতন হতে বাধ্য এবং আমেরিকা এ গতিধারা রোধ করতে বা পথচ্যুত করতে সক্ষম হবে না। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার এই যে, এ সমস্যাটির মোকাবিলার ক্ষেত্রে এসব আরব হুকুমত ও সরকারের শত্রুতামূলক ও বিদ্বেষপরায়ণ নীতির পরিণামে একদিকে বিভিন্ন চরমপন্থী সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর উদ্ভব ও অন্যদিকে স্বৈরতন্ত্র তীব্রতর হয়ে ওঠা অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞই যেমন বার বার উল্লেখ করেছেন, তা হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের সরকারগুলো যদি তাদের সমাজের উপেক্ষিত জনগণের প্রয়োজন পূরণের প্রতি দৃষ্টি না দেয় এবং আগের চেয়েও বেশি মাত্রায় জবাবদিহিতার পরিচয় না দেয় তাহলে সন্ত্রাসবাদের সমস্যা থেকেই যাবে।
এটি একটি পরিহাসের ব্যাপার এবং চমকপ্রদ ব্যাপারও বটে যে, আজকে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে আমেরিকার সবচেয়ে বড় বিরোধী দেশটি অর্থাৎ ইরান প্রকৃতপক্ষে মধ্যপ্রাচ্যস্থ অনেক মার্কিন মিত্রের তুলনায়ই অধিকতর স্থিতিশীল, অধিকতর শক্তিশালী ও অধিকতর গণতান্ত্রিক এবং ইরান ও আমেরিকার মধ্যে অনেক বেশি মাত্রায় দীর্ঘ মেয়াদি অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে। চরমপন্থী সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে ইরান হচ্ছে অগ্রবর্তী শক্তিসমূহের অন্যতম। এ ক্ষেত্রে সে চরমপন্থী সন্ত্রাসীদের নাম আইএস্ হোক বা আন্-নুসরা হোক, বা আল্-ক্বায়েদা-ই হোক তাতে কোনোই পার্থক্য নেই। অন্যদিকে ইরান ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছে যে, সে এ সমস্যার মোকাবিলার লক্ষ্যে স্বীয় সেনাবাহিনী ব্যবহার করাসহ সর্বশক্তি নিয়োগ করতে এবং এ যুদ্ধে জয়লাভ করতে আগ্রহী। যদিও ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয়টিকে একটি সঙ্কট হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল এবং সম্ভবত কিছুসংখ্যক লোক তা বিশ্বাস করে থাকবে, কিন্তু তার বিপরীতে ইরান সব সময়ই মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলকে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত অঞ্চলে পরিণত করার মূল প্রবক্তা এবং বিগত বিশ বছর যাবৎ ইরান মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলকে গণবিধ্বংসী অস্ত্রমুক্ত অঞ্চলে পরিণত করার পরিকল্পনাকে সমর্থন করে আসছে। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সংক্রান্ত সমঝোতায় ইরান যে অঙ্গীকার করেছে তাতেও এ বিষয়টি প্রমাণ করেছে এবং তাকে সুদৃঢ় করেছে। বস্তুত পারস্য উপসাগরের বুকে নিরাপদে হাইড্রো-কার্বন উপাদান অতিক্রমের বিষয়টির নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে তা আমেরিকার ন্যায় ইরানের জন্যও অনেক সুবিধা নিয়ে আসবে। অন্যদিকে পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের অনেক মার্কিন মিত্রের সামর্থ্যহীনতার বিপরীতে ইরান এ উপসাগরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় উপায়-উপকরণের অধিকারী।

ফারসি থেকে অনুবাদ : নূর হোসেন মজিদী

বৃহৎ শক্তিগুলো ইরানী জনগণের চাওয়ার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে

পররাষ্ট্র মন্ত্রী জাওয়াদ যারীফ-
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব মোহাম্মাদ জাওয়াদ যারীফ বলেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পর্কে ৬ জাতি ও ইরানের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত সমঝোতা ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানকে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের সবচেয়ে বড় শক্তি হিসেবে প্রমাণ করেছে এবং ইরানের নিরাপত্তা বিনাশে যায়নবাদী চক্রান্তকে নস্যাৎ করে দিয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, বিশ্ববাসী এ সমঝোতাকে প্রতিপক্ষের যুদ্ধবায নীতির বিরুদ্ধে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের যৌক্তিক অবস্থানের বিজয় হিসেবে স্বাগত জানিয়েছে।
ইরানী পররাষ্ট্র মন্ত্রী গত ২১শে জুলাই (২০১৫) মজলিসে শূরায়ে ইসলামী (পার্লামেন্ট)-এর উন্মুক্ত অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণে এ কথা বলেন। বার্তা সংস্থা এন্তেখাব-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, জনাব যারীফ বলেন, আপনারা ভুলে যাবেন না যে, কোনো বিষয়ে সমঝোতার মানেই হচ্ছে কিছু দেয়া ও কিছু নেয়া। কিন্তু এ সমঝোতা হচ্ছে এমন একটি সমঝোতা যে সম্পর্কে কেউই বলছে না যে, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান তার প্রতিপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।
জনাব জাওয়াদ যারীফ ৫+১ জাতি ও ইরানের মধ্যে অনুষ্ঠিত আলোচনা ও ১৪ই জুলাই (২০১৫) তারিখে প্রতিষ্ঠিত সমঝোতা সম্পর্কে মজলিস সদস্যদের সামনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে শুরুতেই প্রতিরোধে অটল, সচেতন ও সতর্ক ইরানী জনগণ ও সম্মানিত জনপ্রতিনিধিগণের উদ্দেশে, ইসলামী বিপ্লবের মহান নায়ক হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.), বিপ্লবের শহীদগণ, চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের শহীদগণ ও বিশেষভাবে শহীদ পারমাণবিক বিজ্ঞানিগণের বিদেহী আত্মার প্রতি এবং ইসলামী বিপ্লব ও ইসলামী প্রজাতন্ত্রের জন্য যাঁরা আত্মত্যাগ করেছেন ও বিভিন্ন ধরনের ত্যাগ স্বীকার করেছেন তাঁদের ও শহীদগণের পরিবারবর্গের প্রতি সালাম জানান এবং তাঁদের সকলের জন্য আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে দো‘আ করেন। এছাড়া তিনি ঈদুল ফিতর উপলক্ষে সকলকে মোবারকবাদ জানান, পবিত্র মাহে রমযানে সকলে যে রোযা রেখেছেন ও ইবাদত করেছেন তা কবুল করার জন্য আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে আবেদন জানান, তেমনি পারমাণবিক আলোচনা চলাকালে এ আলোচনায় সাফল্যের জন্য বিগত প্রায় দুই বছর যাবৎ, বিশেষ করে মাহে রমযানে প্রতিটি দিনে ও রাতে সকলে আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে যে দো‘আ করেছেন সে কারণে সকল জনগণের কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।
ইরানের উন্নত শির অবস্থা প্রমাণিত হয়েছে
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, এক সপ্তাহ আগে এই দিনে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান ও বাহ্যত বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী এমন ৬টি দেশের মধ্যে একটি ঐতিহাসিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটি এমন একটি সমঝোতা যা সমগ্র বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং যার পরিণতিতে, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের নিরাপত্তার বিরুদ্ধে যায়নবাদীদের চক্রান্ত নস্যাৎ হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে সমগ্র বিশ্ববাসী এ সমঝোতাকে প্রতিপক্ষের যুদ্ধবায নীতির বিরুদ্ধে ইরানের বিচারবুদ্ধি সম্মত ও যৌক্তিক অবস্থানের বিজয় হিসেবে স্বাগত জানিয়েছে এবং এটিকে বিগত কয়েক দশকের মধ্যে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে গণ্য করেছে। আর বন্ধু ও দুশমন নির্বিশেষে সকলের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী এ থেকে যা প্রমাণিত হয়েছে তা হচ্ছে, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের জনগণ ও ইসলামী বিপ্লবের দূরদর্শী নেতার সম্মান, আত্মবিশ্বাস, শক্তি, উন্নত শির অবস্থা ও প্রজ্ঞা।
জনাব জাওয়াদ যারীফ বলেন, আল্লাহ্ তা‘আলার ওপর তাওয়াক্কুল করে ও দেশের জনগণের পৃষ্ঠপোষকতায় বলীয়ান হয়ে আমরা এ দীর্ঘ ও শ্বাসরুদ্ধকর আলোচনায় যেভাবে অংশগ্রহণ করেছি তা থেকে আলোচনাকালে প্রমাণিত হয় যে, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান বাহ্যত বিশ্বের সর্বাধিক শক্তিশালী এমন ছয়টি দেশের সাথে আলোচনা করছে, কিন্তু তাদের সামনে নতি স্বীকার করছে না। এ আলোচনা আরো প্রমাণ করে যে, ইরান কিছুতেই স্বীয় আশা-আকাক্সক্ষা ও চাওয়া থেকে সরে আসবে না এবং স্বীয় মূল রেড লাইনকে অতিক্রম করে আপোস করবে না।
ইরানী পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, সর্বশেষ পারমাণবিক আলোচনায় প্রমাণিত হয় যে, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান নিষেধাজ্ঞার কঠিনতম পরিস্থিতিতে ও কঠিনতম চাপের মধ্যেও বছরের পর বছর ধরে প্রতিরোধ অব্যাহত রাখতে প্রস্তুত রয়েছে; ইরান দুই বছর ধরে আলোচনা অব্যাহত রাখতে এবং চরম চাপের মুখেও স্বীয় প্রতিরোধ চালিয়ে যেতে প্রস্তুত, কিন্তু কিছুতেই স্বীয় আশা-আকাক্সক্ষা ও চাওয়া থেকে সরে যাবে না এবং এতদসংক্রান্ত স্বীয় রেড লাইন অতিক্রম করবে না। এর ফলে শেষ পর্যন্ত আমেরিকার কাছে আরো একবার ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বারের সেই কথাটিই বাস্তব হিসেবে প্রমাণিত হলোÑ যাতে তিনি বলেছিলেন, তারা যেন ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের আত্মসমর্পণের বিষয়টি কেবল স্বপ্নের ভিতরেই দর্শন করে। জনাব যারীফ বলেন, দৃশ্যত বিশ্বের সর্বাধিক শক্তিশালী ঐ ছয়টি দেশের ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধির সাথে মহান ইরানী জাতির সন্তানগণ যে আলোচনা চালিয়েছেন তা থেকে এটাই প্রমাণিত হয়েছে যে, কেউই কখনোই যেন ইরানী জাতিকে হুমকি প্রদান না করে বা তার জন্য হুমকি সৃষ্টি না করে।
কোনো পারমাণবিক স্থাপনা কখনোই বন্ধ হবে না
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, মহান ইরানী জাতির প্রতিনিধিগণ সেই সাথে এটাও সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, আমরা যে পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ, গবেষণা ও উন্নয়নের কাজ করছি তা কখনোই বন্ধ হবে না, বরং নীতিগতভাবে আমাদের পারমাণবিক স্থাপনা সমূহের কোনো একটিও কখনোই বন্ধ হবে না। তেমনি তাঁরা আরো স্পষ্ট করে দিয়েছেন এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন যে, ইরানের মিসাইল কর্মসূচি একান্তই তার নিজস্ব ব্যাপার; এর সাথে অন্য কারোই কোনো সম্পর্ক নেই যে, এ নিয়ে কথা বলবে, তা তারা নিজেদের দাবি অনুযায়ী যতো বড় শক্তিই হোক না কেন।
মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির জন্য আমেরিকাকে জবাবদিহি করতে হবে
ইরানী পররাষ্ট্র মন্ত্রী আরো বলেন, আলোচনায় আমাদের দেশের প্রতিনিধিগণ আরো স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের অবাঞ্ছিত ঘটনাবলি ও পরিস্থিতির জন্য যদি কাউকে জবাবদিহি করতে হয়ে, তাহলে সে হচ্ছে আমেরিকা ও পাশ্চাত্যজগৎÑ যাদের অস্ত্র দ্বারা ফিলিস্তিনে, ইয়েমেনে ও সিরিয়ায় নিরীহ মানুষদেরকে হত্যা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, ফিলিস্তিনগ্রাসী অবৈধ যায়নবাদী সরকার শুধু নিরীহ ফিলিস্তিনি জনগণকেই হত্যা করছে না, অধিকন্তু তার অস্ত্রের দ্বারা ইয়েমেন ও সিরিয়ার নিরীহ জনগণকেও হত্যা করছে।
এ সমঝোতা যায়নবাদী সরকারের অপূরণীয় ক্ষতি করবে
জনাব জাওয়াদ যারীফ বলেন, এ সমঝোতার কারণে অবৈধ যায়নবাদী সরকারের নেতৃত্বে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের দুশমনরা যে ভীষণভাবে ক্ষিপ্ত হয়েছে তা থেকে বেশ ভালোভাবেই মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে ও বিশ্বের বুকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সুদৃঢ় শক্তিমত্তা প্রমাণিত হয়েছে। তাই এতে আশ্চর্যান্বিত হওয়ার কিছ্ ুনেই যে, আমরা দেখতে পাচ্ছি এ সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় যায়নবাদী সরকারের প্রধান মন্ত্রী হৈচৈ ও শোরগোল শুরু করে দিয়েছেন এবং এ সমঝোতাকে বানচাল করার লক্ষ্যে এর বিরুদ্ধে নেতিবাচক রায় দেয়ার জন্য মার্কিন কংগ্রেসের কাছে ধন্না দিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, এ সমঝোতা অবৈধ যায়নবাদী সরকারের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি ডেকে আনবে বিধায় এ সমঝোতা রোধের জন্য প্রয়োজন হলে তিনি আত্মহত্যা করতেও প্রস্তুত আছেন।
ইরানী পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, যায়নবাদী সরকার এর আগে কখনোই তার মিত্রদের মাঝে এভাবে ও এতোখানি একা হয়ে পড়ে নি। তাই এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই যে, যায়নবাদীদের সর্র্ব বৃহৎ প্রচার লবিটি যায়নবাদীদের জন্য দারুণভাবে ক্ষতিকর এ সমঝোতার অনুমোদন রোধ করার লক্ষ্যে কয়েক মিলিয়ন ডলার ব্যয়সাপেক্ষ প্রচারযুদ্ধ শুরু করেছে।
ইরান স্বীয় মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ কাম্য বিষয়গুলো লাভ করেছে
জনাব জাওয়াদ যারীফ বলেন, পারমাণবিক সমঝোতার বিষয়টিকে বিভিন্ন পেক্ষাপটে মূল্যায়ন করা চলে। এ বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ও অভ্যন্তরীণ প্রেক্ষাপটে মূল্যায়ন করা যেতে পারে। তেমনি নেতৃত্বের দৃষ্টিকোণ থেকেও এর প্রতি দৃষ্টিপাত করা চলে। ইরানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার দৃষ্টিকোণ থেকে এবং দীর্ঘ মেয়াদি পারমাণবিক কর্মসূচির দৃষ্টিকোণ থেকেও এটি নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করা যেতে পারে। তিনি বলেন, কিন্তু আমরা যে কোনো প্রেক্ষাপটেই মূল্যায়ন করি না কেন, আমরা যেন ভুলে না যাই যে, যে কোনো সমঝোতায়ই কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়। প্রত্যেক পক্ষকেই তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চাওয়াগুলোকে পাওয়ার জন্য কতগুলো চাওয়া থেকে হাত গুটিয়ে নিতে হয়। তাই দুই পক্ষের মধ্যকার আলোচনা ততক্ষণ পর্যন্ত অব্যাহত রাখতে হয় যতক্ষণ না দুই পক্ষের দেয়া ও নেয়ার বিষয়গুলোর মধ্যে মোটামুটি ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এমতাবস্থায় স্বভাবতঃই এ প্রশ্ন জাগ্রত হয় যে, ৫+১ জাতির সাথে দীর্ঘ ও শ্বাসরুদ্ধকর আলোচনার পর আমরা যে সমঝোতায় উপনীত হয়েছি তাতে নির্ধারিত এই দেয়া ও নেয়ার বিষয়গুলো কী?
তিনি বলেন, আমরা যে মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো লাভ করার জন্য আলোচনায় অনড় ভূমিকা পালন করেছি এবং শেষ পর্যন্ত ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের যেসব চাওয়ার বিষয় যৌথ পদক্ষেপের সামগ্রিক কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সেগুলো হচ্ছে : ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সম্মানজনক অবস্থান ও শক্তিমত্তার সংরক্ষণ, পারমাণবিক কর্মসূচির স্থিতিশীলতা, বিশেষ করে পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ ও আরাকের হেভি ওয়াটার রিঅ্যাক্টর চালু থাকা ও সেগুলোর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, নিষেধাজ্ঞাসমূহের অবসান এবং সর্বোপরি জাতিসংঘের ঘোষণাপত্রের সপ্তম অধ্যায়ের আওতায় নিরাপত্তা পরিষদে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধে গৃহীত ছয়টি সিদ্ধান্তমূলক প্রস্তাবের অবসান। নিরাপত্তা পরিষদের এ সব প্রস্তাবে ইরানী জাতির বিরুদ্ধে কেবল নিষেধাজ্ঞাই চাপিয়ে দেয়া হয় নি, বরং ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, তেমনি ইরানের প্রতিরক্ষা ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির শক্তিশালী করণ প্রতিহত করাকে একটি আন্তর্জাতিক কর্তব্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, আর এ জন্য প্রয়োজনে যে কোনো ধরনের উপায়-উপকরণ ব্যবহারের কথা বলা হয়েছিল।
প্রতিপক্ষ নতুন কিছুই লাভ করে নি
জনাব জাওয়াদ যারীফ বলেন, আলোচনায় আমাদের প্রতিপক্ষের মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ চাওয়া ছিল এই যে, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান যে পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হবার চেষ্টা করছে না, তারা পারমাণবিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা আরোপ ও নযরদারির মাধ্যমে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চায়। কিন্তু এত সব রণ সংগীত ও রণ ডঙ্কার পরে শেষ পর্যন্ত প্রতিপক্ষ এমন কিছু লাভ করেছে যা আগে থেকেই তাদের হস্তগত ছিল। কারণ, এ ব্যাপারে ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী যে ফত্ওয়া দেনÑযাতে দ্বীনী শিক্ষা ও মানবিক মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটেছেÑতাতে সুস্পষ্টভাবে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি ও ব্যবহার করাকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে এবং এ কারণে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র হস্তগত করার চেষ্টা করে নি এবং এখনো করছে না। সুতরাং সমঝোতায় এ সুস্পষ্ট বিষয়টিতে তাদের জন্য নিশ্চিত হওয়ার যে সুযোগ দেয়া হয়েছে এবং সে লক্ষ্যে যে কতক সীমাবদ্ধতা ও আন্তর্জাতিক নযরদারি মেনে নেয়া হয়েছে তা তাদের জন্য আদৌ কোনো পাওয়া ও সুবিধা হিসেবে পরিগণিত হতে পারে না। বিশেষ করে এ নযরদারি একটি সুনির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য এবং এর সমাপ্তির সুনির্দিষ্ট তারিখ রয়েছে, বিশেষত এর ফলে আমাদের দেশের কোনো ধরনের প্রয়োজন পূরণই বাধাগ্রস্ত হবে না।
ইরানের পারমাণবিক সমৃদ্ধ করণ কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, এ সমঝোতায় এমন কিছু নেই যাতে আমাদের দেশের গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা তথ্যাদি বিজাতীয়দের হাতে পড়তে পারে। তবে প্রশ্ন করা হতে পারে যে, এ সমঝোতায় ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সম্মানের সংরক্ষণ ছাড়া আমরা কার্যত আর কী লাভ করেছি? বস্তুত আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে এই যে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচিকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছেÑ নিরাপত্তা পরিষদের বিগত সত্তর বছরের ইতিহাসে যার আর কোনো নযির নেই। তিনি আরো বলেন, নিরাপত্তা পরিষদ জাতিসংঘের ঘোষণাপত্রের সপ্তম অধ্যায়ের আওতায় ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধে যে ছয়টি প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল তাতে আমাদের পারমাণবিক সমৃদ্ধ করণ কর্মসূচিকে বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করেছিল এবং নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু এখন সেই নিরাপত্তা পরিষদই জাতিসংঘের ঘোষণাপত্রের আওতায় নতুন একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেছে যাতে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে কেবল বৈধ ও আইনসম্মত কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করে নি; বরং বিশ্বের সকল দেশের প্রতি ইরানের সাথে সহযোগিতা সম্প্রসারণের জন্য আহ্বান জানিয়েছে। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এই যে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির বাণিজ্যিক ও শিল্প সংক্রান্ত ভবিষ্যৎ আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করলো।
জনাব জাওয়াদ যারীফ দৃঢ়তার সাথে বলেন, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক সমৃদ্ধ করণ কর্মসূচি এমনকি এক দিনের জন্যও বিরতি ব্যতিরেকেই অব্যাহত থাকবে। সমঝোতায় বর্ণিত ‘যৌথ পদক্ষেপের সামগ্রিক কর্মসূচি’তে যে বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তি পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তাতে প্রথম আট বছরের জন্য যে কতক সীমাবদ্ধতা মেনে নেয়া হয়েছে তার ফলে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি কেবল স্থিতি ও স্থায়িত্বেরই অধিকারী হবে না; বরং তাতে যে কার্যকর ও প্রায়োগিক ক্ষেত্রে উন্নত গবেষণা ও উন্নয়ন কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তা পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ কর্মকাণ্ডকে সামনে এগিয়ে নেয়ার বিষয়টিকে অব্যাহত রাখবে। বিশেষ করে এর ফলে সর্বোত্তম সেন্ট্রিফিউজ ব্যবহার করা যাবে এবং সম্ভাব্য ন্যূনতম ব্যয়ে এর সর্বোত্তম ব্যবহারের বিষয়টি নিশ্চিত হবে।
ইরানী পররাষ্ট্র মন্ত্রী আরো বলেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে যে কেবল সুদক্ষ ইরানী বিজ্ঞানীদেরকে কাজে লাগানো হবে তা নয়; বরং সেই সাথে বিশ্বের উন্নততম বৈজ্ঞানিক অর্জন সমূহও ব্যবহার করা হবে। সবচেয়ে বড় কথা, এর ফলে, এ ক্ষেত্রে পনর বছর মেয়াদি যে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে তা প্রয়োজন পূরণের জন্য এমন সামর্থ্যরে অধিকারী হবেÑ যা পাঁচটি বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট হবে। তিনি বলেন, যে সুবিধা বিশ্বের অনেক দেশের জন্যই অপূরণীয় আকাক্সক্ষার পর্যায়ে রয়েছে ইরানের পক্ষে আজ তা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে।
তিনি বলেন, যদিও আমি ঐসব দেশের নাম উল্লেখ করতে চাই না, তবে বিশ্বের বুকে আমেরিকার সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতার অধিকারী এমন অনেক দেশ রয়েছে যারা এমনকি মাত্র একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচিও গ্রহণ করতে পারে নি; বরং এ থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয়েছে এবং আজকে তারা তাদের আকাক্সক্ষা বুকে চেপে রেখে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বীর জনগণের দৃঢ়তা ও অটলতার শুভ পরিণতির দিকে দৃষ্টিপাত করছে।
সকল নিষেধাজ্ঞার অবসান
ইরানী পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হচ্ছে এই যে, ঘটনা কেবল এখানেই শেষ নয়, বরং ইরানের আরেকটি চাওয়া পূরণ হয়েছে, আর তা হচ্ছে, প্রতিষ্ঠিত সমঝোতা বাস্তবায়নের দিনেই ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ওপর থেকে নিরাপত্তা পরিষদ, আমেরিকা ও ইউরোপের পারমাণবিক নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবে এবং মাত্র কয়েক বছর মেয়াদি সাময়িক সীমাবদ্ধতার কাঠামোর আওতায় অন্যান্য নিষেধাজ্ঞাও উঠে যাবে। অর্থাৎ ইরান এ ক্ষেত্রে কেবল সুবিধাই লাভ করে নি, বরং দ্বিগুণ সুবিধা অর্জন করেছে, আর তা হচ্ছে সমস্ত রকমের অন্যায় নিষেধাজ্ঞার অবসান, যদিও শুরু থেকেই এসব নিষেধাজ্ঞা আইন বহির্ভূত ও অবৈধ ছিল এবং তা আরোপ করাই উচিত ছিল না।
জনাব জাওয়াদ যারীফ বলেন, আমরা কখনো এরূপ দাবি করি নি এবং এখনো করছি না যে, যৌথ পদক্ষেপের সামগ্রিক কর্মসূচি সম্পূর্ণরূপে ইরানের স্বার্থের অনুকূল। কিন্তু এতদসত্ত্বেও আমি আবারো বলছি যে, আলোচনা মানেই হচ্ছে দেয়া ও নেয়া এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না উভয় পক্ষই উল্লেখযোগ্য পরিমাণে তাদের চাওয়ায় উপনীত হয় ততক্ষণ পর্যন্ত সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। সুতরাং অবশ্যই আমাদেরকে আমাদের চাওয়া সমূহের ব্যাপারে স্থিতিস্থাপকতা ও নম্রতার পরিচয় দিতে হবে। তবে এ স্থিতিস্থাপকতা অবশ্যই উদ্দেশ্যমুখি এবং হিসাব-নিকাশের ভিত্তিতে হয়েছে, আমাদের মহান রাহ্বার যেমন উপমা দিয়েছেন, ঠিক যেভাবে একজন কুস্তীগীর প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করার লক্ষ্যে যথোপযুক্ত স্থানে ও কালে কিছু ছোট ছোট সুবিধা হাতছাড়া করে থাকে। কিন্তু সকলেই জানে যে, চূড়ান্ত ফলাফলই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং এ-ও জানে যে, বিজয়ের নিদর্শন সহকারে একজনের হাত উত্তোলিত হয়ে থাকে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী সকলকে স্মরণ করিয়ে দেন, আমেরিকার একজন বিখ্যাত সাংবাদিক এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে প্রশ্ন করেন, ‘ছয়টি বিশ্বশক্তি আলোচনার টেবিলের এক পাশে ছিল এবং অন্যপাশে ইরান ছিল একা; এমতাবস্থায় কেন আমরা এ সুযোগকে এমনভাবে কাজে লাগাতে পারি নি যার ফলে আমরা ইরানের আগামী দশ বছরের মধ্যে পারমাণবিক শক্তির অধিকারী একটি দেশে পরিণত হওয়ার দোরগোড়ায় উপনীত হওয়ার সম্ভাবনাকে দূরীভূত করে দিতে পারতাম? কেন আমরা ইরানের পারমাণবিক সমৃদ্ধ করণ অবকাঠামোকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিতে পারি নি?’ আর এ হচ্ছে এমন একটি প্রশ্ন যা আজ সারা বিশ্বে উত্থাপিত হচ্ছে।
বৃহৎ শক্তিগুলো ইরানী জনগণের চাওয়ার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে
ইরানী পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, আজ বিশ্বে কেউই বলে না যে, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান আত্মসমর্পণ করেছে। বরং আত্মসমর্পণের কথা যদি বলতে হয় তাহলে বলতে হবে যে, বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলো ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের মহান ও বীর জনগণের চাওয়ার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। সেই সাথে নেতানিয়াহুর জন্য এবং আমেরিকার উগ্রপন্থীদের জন্য এক আতঙ্কজনক দুঃস্বপ্ন তৈরি হয়েছে, আর তাতে যে কেবল তাদের তৈরি ইসলাম-আতঙ্ক, শিয়া-আতঙ্ক ও ইরান-আতঙ্ক একবারে ও একত্রে তাদের জন্য কেলেঙ্কারিতে পর্যবসিত হয়েছে শুধু তা-ই নয়, বরং ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির সকল অবকাঠামো সংরক্ষিত থাকছে এবং ইরানের পারমাণবিক কর্মতৎপরতা যুক্তি সঙ্গত গতিতে অব্যাহত থাকছে। আমাদের বৈজ্ঞানিক ও অর্থনৈতিক প্রয়োজন অনুযায়ী আমাদের পারমাণবিক কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে এবং অচিরেই আমাদের দেশ যথাযথ পারমাণবিক প্রযুক্তির অধিকারী একটি দেশে পরিণত হবে। আর লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এই যে, এ পথচলা অব্যাহত রেখেই ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ফাইল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বাইরে চলে আসবে এবং সকল অন্যায় নিষেধাজ্ঞার বিলুপ্তি ঘটবে। সমঝোতার সূচনাতেই কতক নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি উঠে যাবে এবং কতক নিষেধাজ্ঞার কার্যকরিতা স্থগিত হয়ে যাবে।
মজলিসের অধিবেশনে উপস্থিত ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থার প্রধান ড. সালেহীর প্রতি ইঙ্গিত করে জনাব জাওয়াদ যারীফ বলেন, যেহেতু আমি ও আলোচক প্রতিনিধি দলের সদস্যগণের সকলেই আমাদের প্রিয় ও সম্মানিত ভাই ড. সালেহীর চেষ্টা-তৎপরতা, বিশেষজ্ঞত্ব ও মহানত্বের কাছে ঋণীÑ যিনি এ অধিবেশনে উপস্থিত আছেন, তিনি আলোচনার কৌশলগত দিকগুলো সম্বন্ধে বিজ্ঞানী সুলভ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পেশ করবেন, সেহেতু আমি সেদিকে যাচ্ছি না, বরং আমি নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে এবং বিগত কয়েক দিনে যে কয়েকটি অস্পষ্ট বিষয়ের কথা উপস্থাপন করা হয়েছে সে সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু বলব।
বিদেশে আটককৃত অর্থ ফেরত আসবে
ইরানী পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, আমেরিকার অনায় ও বেআইনি নিষেধাজ্ঞার ফলে বিগত কয়েক বছর যাবৎ ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের তেল বিক্রয়লব্ধ ও অন্যান্য আয়ের খাত থেকে অর্জিত বহু বিলিয়ন ডলার অর্থ আটক হয়ে আছে; প্রতিষ্ঠিত সমঝোতার ফলে আমাদের বড় ধরনের অর্জন সমূহের অন্যতম হচ্ছে এই যে, এ অর্থ দেশের কোষাগারে ফেরত আসবে এবং ইরানের তেল বিক্রির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি উঠে যাবে।
সকল প্রকার অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার অবসান
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে বাহানা করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আমেরিকা ইরানের ব্যাঙ্কিং, ফাইন্যান্সিং, তেল, গ্যাস, পেট্রো-রসায়ন শিল্প ও সামগ্রী, বীমা, যোগাযোগ ও পরিবহন ক্ষেত্রের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ও ফাইন্যান্সিং নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে; সমঝোতার শুরুতেই কতক ক্ষেত্রে তা পুরোপুরি তুলে নেয়া হবে এবং কতক ক্ষেত্রে তা স্থগিত হয়ে যাবে। এছাড়া সভ্য সুলভ রীতিনীতি ও আচরণের বরখেলাফে ইরানের ছাত্রছাত্রীদের পারমাণবিক শক্তিসংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহে ঐসব দেশে পড়াশুনার ওপরে যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল তা পুরোপুরি উঠে যাবে। এছাড়া ইরান কর্তৃক যাত্রীবাহী বিমান ক্রয়ের ওপর দীর্ঘ তিন দশক যাবৎ যে অন্যায় নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে রাখা হয়েছিল তা ইতিমধ্যেই উঠে গিয়েছে এবং আমাদের এয়ারশিপগুলোর পুনঃনির্মাণের সম্ভাবনা ও ইরান এয়ারের ফ্লাইটসমূহের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে।
জনাব জাওয়াদ যারীফ বলেন, এ সমঝোতার ফলে ইরানের কার্পেট ও শুকনা ফল পুনরায় বিশ্বের বাজারে রপ্তানি শুরু হবে এবং দেশের যোগাযোগ ও পরিবহন, সাধারণ আর্থিক সেবা, ব্যাংকিং তৎপরতা, বীমা, ফাইন্যান্সিং সেবা, ইরানের সাথে ব্যবসাসংশ্লিষ্ট আর্থিক সেবা, নিঃশর্ত ঋণ, মূল্যবান ধাতব, হীরক, মুদ্রা, জাহায শিল্প, যোগাযোগ ও পরিবহনসংশ্লিষ্ট শিল্প এবং অন্যান্য শিল্প আরোপিত নিষেধাজ্ঞার জোয়াল থেকে মুক্তি লাভ করবে, আর সকল কিছুর ক্ষেত্রেই রপ্তানি ও আমদানির পথ উন্মুক্ত হয়ে যাবে।
জনাব যারীফ আরো বলেন, এ সমঝোতার ফলে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ইসলামী প্রজাতন্ত্র শিপিং কোম্পানি, ইরান জাতীয় তেল কোম্পানি, জাতীয় তেল পরিবহন কোম্পানি, ইরান এয়ার ও তার আওতাধীন কোম্পানিসমূহ, অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, ইরানের ব্যাংকসমূহ, দেশের অন্যান্য সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের ওপর থেকে এবং দেশের যে গুরুত্বপূর্ণ আটশ’ ব্যক্তিত্ব ও পদাধিকারীর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল তাঁদের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবে। সেই সাথে ইরানের পক্ষে অধিকাংশ বাণিজ্যিক, প্রযুক্তিগত ও আর্থিক অঞ্চল ও সংস্থায় ইরানের প্রবেশ ও অংশগ্রহণ সহজ হয়ে যাবে। এছাড়া এই প্রথম বারের মতো আমেরিকা ইরানে আমেরিকান কোম্পানিসমূহের শাখা খোলার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবে। অধিকন্তু আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ ব্যাপারে মতৈক্যে উপনীত হয়েছে যে, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ওপর নতুন কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ হতে বিরত থাকবে এবং নতুন নামে অতীতের নিষেধাজ্ঞা সমূহ কার্যকর করা হতেও বিরত থাকবে। এমনকি তারা যেখানে নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব গ্রহণের মাধ্যমে ইরানের সাথে শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কার্যক্রমে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল এবং এ সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হবার একদিন আগেও এ ধরনের সহযোগিতাকে বেআইনি গণ্য করতো, আজ তারা এ ব্যাপারে ইরানের সাথে সহযোগিতা করার জন্য সকল দেশকে উৎসাহিত করছে এবং ইরানকে সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি সহকারে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও অত্যাধুনিক গবেষণা রিঅ্যাক্টরের অধিকারী হবার ক্ষেত্রে এবং নতুন জ্বালানিসহ পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদনের ক্ষেত্রে তথা গোটা পারমাণবিক ক্ষেত্রে ইরানের সাথে সহযোগিতা করার কথা ঘোষণা করেছে।
অস্ত্র নিষেধাজ্ঞাও উঠে যাবে
ইরানী পররাষ্ট্রমন্ত্রী দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান কখনোই পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হতে চায় নি এবং চাচ্ছে না। এছাড়া এ সমঝোতা আমাদের মিসাইল কর্মসূচির ওপর কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তার করবে না। অন্যদিকে ইরানের বিরুদ্ধে আরোপিত অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবে এবং কতক ক্ষেত্রে তা এমনভাবে পরিবর্তিত হবে যার ফলে প্রতিরক্ষা সামগ্রী আমদানি ও রফতানির পথ উন্মুক্ত হয়ে যাবে। অন্যদিকে যে সব বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা পরিবর্তিত হবে তা মেনে না চললে তার ফলে ‘যৌথ পদক্ষেপের সামগ্রিক কর্মসূচি’র অনুসরণ প্রভাবিত হবে না। অধিকন্তু সংশ্লিষ্ট সীমাবদ্ধতা পাঁচ বছর পর পুরোপুরিভাবে উঠে যাবে। তিনি বলেন, ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার আলোচনার জন্য যে রেড লাইন ও কাঠামো নির্ধারণ করে দিয়েছেন প্রতিষ্ঠিত সমঝোতায় তার সব কিছুই অনুসৃত হয়েছে।
জনাব যারীফ বলেন, বিগত কয়েক মাসে আলোচনা যখন শেষ হওয়ার দিকে এগোচ্ছিল এবং আলোচিত বিষয়গুলো নিখুঁতভাবে পর্যালোচনা করা হচ্ছিল তখন ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের রেড লাইনও অধিকতর নির্দিষ্ট রূপ পরিগ্রহ করছিল এবং আমরা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে ও দৃঢ়তার সাথে কাজ চালিয়ে যাই। আল্লাহ্র রহমতে, আজ আমরা আপনাদের সামনে ঠিক সেভাবে প্রতিবেদন পেশ করতে সক্ষম হচ্ছি যেভাবে ইতিপূর্বে মহান রাহ্বারের খেদমতে পেশ করেছিলাম। তা হচ্ছে, আমরা সম্ভব সর্বোচ্চ মাত্রায় ও এমনভাবে আমাদের রেড লাইন বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছি যে, বলা চলে, তা পুরোপুরি বজায় রাখতে পেরেছি।
জনাব যারীফ উল্লেখ করেন যে, সমস্ত রকমের পারমাণবিক নিষেধাজ্ঞা সমঝোতার দিনে নীতিগতভাবে পুরোপুরি উঠে যাবে এবং সমঝোতার বাস্তবায়নের দিনে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে উঠে যাবে। তিনি বলেন, অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা ও মিসাইল নিষেধাজ্ঞা প্রথমে সীমিত হয়ে যাবে ও একটি সনির্দিষ্ট মেয়াদের পর তা পুরোপুরি তুলে নেয়া হবে। অন্যদিকে এসব নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করা হলে তা সমঝোতা লঙ্ঘন হিসেবে পরিগণিত হবে না। এছাড়া দ্বৈত উদ্দেশ্যে ব্যবহারযোগ্য পণ্যের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা ছিল তা-ও উঠে যাবে।
পারমাণবিক নযরদারিতে সামরিক ও নিরাপত্তা তৎপরতায় হস্তক্ষেপ হবে না
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, সম্প্রতি আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) ও ইরানের মধ্যে অবশিষ্ট সমস্যাগুলোর সমাধানের লক্ষ্যে যে সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়েছে তাতে ইরানের নিরাপত্তা এবং সামরিক স্থানসমূহের ও বিজ্ঞানীদের সংরক্ষিত অবস্থানসহ ইরানের নির্ধারিত রেড লাইন পুরোপুরি মেনে চলা হয়েছে এবং ইরানের সর্বোচ্চ প্রতিরক্ষা পরিষদের সচিবালয়ের নযরদারিতে এ সমঝোতা স্বাক্ষরিত হয়েছে; এর ফলে এতে ইরানের সংশ্লিষ্ট সমস্ত স্বার্থ রক্ষিত হয়েছে। জনাব যারীফ বলেন, আগামীতেও পারমাণবিক স্থাপনাসমূহে আইএইএ-র সকল নযরদারি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রচলিত নিয়ম অনুসরণে ও এতদসংক্রান্ত প্রোটোকলে বর্ণিত পন্থায় অনুষ্ঠিত হবে। ৬ জাতি ও ইরানের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত সমঝোতায় অন্তর্ভুক্ত যৌথ পদক্ষেপের সামগ্রিক কর্মসূচিতে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, নযরদারির আবেদন সমূহ ইরানের সার্বভৌমত্বের অধিকারের প্রতি দৃষ্টি রেখে ও ন্যূনতম প্রয়োজনের ক্ষেত্রে করা হবে এবং এ কাজের মাধ্যমে ইরানের সামরিক তৎপরতায় ও জাতীয় নিরাপত্তার সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য তৎপরতায় হস্তক্ষেপের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করা হবে না।
ইরানী পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, সীমাবদ্ধতার মেয়াদ নির্ধারণ সংক্রান্ত আলোচনার সময় ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বারের নির্ধারিত রেড লাইন অতিক্রম না করার ওপর জোর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। তিনি নির্ধারণ করে দেন যে, সীমাবদ্ধতার মেয়াদ অবশ্যই দশ বছরের নিচে হতে হবে। আর এটি ছিল দু’পক্ষের মধ্যকার মতপার্থক্যের ও বিতর্কের মৌলিকতম বিষয় এবং শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এ বিতর্ক অব্যাহত ছিল। কিন্তু, আপনারা যেমন ‘যৌথ পদক্ষেপের সামগ্রিক কর্মসূচি’তে দেখতে পাচ্ছেন, শেষ পর্যন্ত পারমাণবিক সমৃদ্ধ করণের ওপর সীমাবদ্ধতার মেয়াদ আট বছর বলে সুস্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি স্বাভাবিক গতিতে ও যুক্তিসঙ্গতভাবে বাণিজ্যিক ও শিল্প রূপ পরিগ্রহ করার দিকে এগিয়ে যাবে।
সমৃদ্ধকৃত পারমাণবিক উপাদান ব্যবহার ও বিক্রি করা যাবে
জনাব জাওয়াদ যারীফ বলেন, ইসলামী বিপ্লবের মহান রাহ্বার ও মহান ইরানী জনগণ যে বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন ‘যৌথ পদক্ষেপের সামগ্রিক কর্মসূচি’তে সে উদ্বেগেরও অবসান ঘটেছে; কারণ, সীমাবদ্ধতার এ পুরো মেয়াদে পারমাণবিক গবেষণা ও উন্নয়নের কাজ যথারীতি অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, বরং এ সময়ে যুক্তিসঙ্গত বিভিন্ন ধাপে আমাদের উন্নততম সেন্ট্রিফিউজের গবেষণা ও উন্নয়ন অব্যাহত থাকবে। তিনি আরো বলেন, শুধু তা-ই নয়, আমাদের সঞ্চিত সমৃদ্ধকৃত পারমাণবিক উপাদান সমূহ এ সময় বিনষ্ট হবে না; আমরা তা দেশের ভিতরে ইউরেনিয়ামে পরিণত করতে পারব বা চাইলে প্রাকৃতিক ইউরেনিয়াম লাভের বিনিময়ে বিদেশে বিক্রি করতে পারব। এভাবে ইরান হবে সমৃদ্ধকৃত পারমাণবিক উপাদান বিক্রির একচেটিয়া বাজারে প্রবেশকারী একমাত্র দেশ। সেই সাথে ইরানের কাছে পারমাণবিক উপাদান বিক্রির ওপরে বিগত তেত্রিশ বছর ধরে যে নিষেধাজ্ঞা ছিল জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের নির্দেশে তা-ও তুলে নেয়া হবে।
ইরানী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান স্বীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের হেফাযত, যে কোনো ধরনের আগ্রাসনের মোকাবিলাকরণ এবং সেই সাথে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদী হুমকির মোকাবিলার লক্ষ্যে স্বীয় প্রতিরক্ষা সামর্থ্য শক্তিশালী করার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত রকমের ব্যবস্থা গ্রহণ অব্যাহত রাখবে।
ইরান সম্পর্কে নিরাপত্তা পরিষদের মনোভাবে মৌলিক পরিবর্তন
জনাব যারীফ বলেন, গতকাল (২০শে জুলাই ২০১৫) জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পর্কে একটি নতুন প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। এ প্রস্তাবে অনেক কিছু দেয়া ও নেয়ার কথা বলা হয়েছে, তবে সবচেয়ে বড় কথা, এতে ‘যৌথ পদক্ষেপের সামগ্রিক কর্মসূচি’কে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। আর এর মাধ্যমে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক সমৃদ্ধ করণ কর্মসূচিকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। বস্তুত এ প্রস্তাবটি হচ্ছে নিরাপত্তা পরিষদের ইতিহাসে একটি অনন্য প্রস্তাব। তিনি বলেন, নিরাপত্তা পরিষদের ইতিহাসে এটিই প্রথম যে, একটি দেশ জাতিসংঘের ঘোষণাপত্রের সাত নং অধ্যায়ের আওতায় নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক গৃহীত ছয়টি প্রস্তাবÑযেগুলোর বাস্তায়ন ছিল বাধ্যতামূলকÑবাস্তবায়ন না করেও যুদ্ধ ছাড়াই কেবল আলোচনার মাধ্যমে নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক আরোপিত সকল নিষেধাজ্ঞা থেকে এবং শেষ পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদের নযরদারি থেকেও রেহাই পাচ্ছে। তিনি বলেন, নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক ইতিপূর্বে ইরানের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ ঘোষণাপত্রের সপ্তম অধ্যায়ের আওতায় গৃহীত ছয়টি প্রস্তাবের বরখেলাফে বর্তমান প্রস্তাবটি ৪১ নং ধারার পরিবর্তে ২৫ নং ধারার আওতায় গ্রহণ করা হয়েছে। তবে যেহেতু ইতিপূর্বেকার প্রস্তাবসমূহে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল সেহেতু বর্তমান প্রস্তাবের শেষে ৪১ ধারার আওতায় গৃহীত পূর্ববর্তী প্রস্তাবসমূহ উল্লেখ করে তা তুলে নেয়ার কথা ও তুলে নেয়া সংক্রান্ত বিধি-বিধানসমূহ ৪১ ধারার আওতায় উল্লেখ করা উচিত ছিল। কিন্তু তার মানে এ নয় যে, জাতিসংঘোর ঘোষণাপত্রের সাত নং অধ্যায়ের ও ৪১ নং ধারার অধীনে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। কারণ, এবারে গৃহীত প্রস্তাবের ভূমিকার সাত নং প্যারাগ্রাফে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে, এ প্রস্তাব হচ্ছে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সম্পর্কে নিরাপত্তা পরিষদের মনোভাবের ক্ষেত্রে একটি মৌলিক পরিবর্তনের বহিঃপ্রকাশ।
জনাব জাওয়াদ যারীফ আরো বলেন, এছাড়াও নিরাপত্তা পরিষদের ইতিহাসে এটিই প্রথম যে, নিরাপত্তা পরিষদ যে দেশ সম্পর্কে প্রস্তাব গ্রহণ করেছে সে দেশের সাথে পরামর্শ ও আলোচনা করে প্রস্তাবের বক্তব্য প্রস্তুত করেছে। এ হচ্ছে নিরাপত্তা পরিষদের ইতিহাসে একটি নযির বিহীন পদক্ষেপ। তিনি আরো বলেন, নিরাপত্তা পরিষদ তার এ প্রস্তাবে ‘যৌথ পদক্ষেপের সামগ্রিক কর্মসূচি’কে সংযোজনী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে স্বীয় অতীত প্রস্তাবসমূহের বরখেলাফে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ও পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচিকে আনুষ্ঠানিকভাবে মেনে নিয়েছে ও স্বীকৃতি দিয়েছে এবং এ প্রস্তাবে, এমনকি প্রস্তাবের কোনো সংযোজনীতেও, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা বলতে কোনো কিছুর আর অস্তিত্ব নেই।
ইরানের আঞ্চলিক নীতিতে পরিবর্তন ঘটবে না
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, এর মানে হচ্ছে এই যে, ইসলামী বিপ্লবের মহান রাহ্বার যেভাবে বলেছেন ঠিক সেভাবেই, দেশের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তার সক্ষমতা পুরোপুরি সংরক্ষিত হবে এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের আঞ্চলিক নীতিতে কোনোরূপ পরিবর্তন সাধিত হবে না; মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলার লক্ষ্যে আমরা আমাদের মিত্রদেরকে সহায়তা প্রদানের নীতি অব্যাহত রাখব। তিনি বলেন, মোট কথা, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ২২৩১ নং প্রস্তাবে এমন একটি পূর্ণাঙ্গ পথপরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যাতে এ পথপরিকল্পনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমস্ত পদক্ষেপের, এমনকি তাতে আরোপিত সীমাবদ্ধতার অবসানের কথা এবং এ বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনার সমাপ্তির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। অন্য কথায়, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পর্কে এটি হচ্ছে নিরাপত্তা পরিষদের শেষ প্রস্তাব।
নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাবর্তিত হলে ইরান অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করবে না
জনাব জাওয়াদ যারীফ বলেন, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান যেমন ঘোষণা করেছে তেমনি নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবেও উল্লেখ করা হয়েছে যে, যে কোনো কারণেই হোক না কেন, নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক ইতিপূর্বে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা যদি পুরোপুরি বা অংশত পুনঃপ্রত্যাবর্তন করে সে ক্ষেত্রে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান স্বতঃস্ফূর্তভাবে ‘যৌথ পদক্ষেপের সামগ্রিক কর্মসূচি’তে যেসব অঙ্গীকার করেছে সেগুলো বাস্তবায়ন করবে না। তিনি বলেন, আমরা ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিবৃতির পাঠে আরো যোগ করেছি, এমতাবস্থায় ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ)-র সাথে সহযোগিতার বিষয়টি সম্পর্কে নতুন করে সিদ্ধান্ত নেবে।
ইরান মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় শক্তি
জনাব জাওয়াদ যারীফ উল্লেখ করেন যে, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভাষ্যকারগণের সকলের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ‘যৌথ পদক্ষেপের সামগ্রিক কর্মসূচি’ মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে সবচেয়ে বড় শক্তি হিসেবে ইরানের অবস্থানকে প্রমাণ করেছে এবং স্থিতি দিয়েছে ও সুদৃঢ় করেছে। তিনি বলেন, ইরান এমন একটি শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছে যে স্বীয় মৌলিক নীতিমালার অনুসরণ অব্যাহত রেখে আধিপত্যবাদী শক্তিসমূহের মোকাবিলায় শান্তিপূর্ণ পন্থায় ও কেবল আলোচনার মাধ্যমে বৃহত্তম ও সর্বাধিক দীর্ঘকালীন আন্তর্জাতিক সঙ্কট সমূহের সমাধান করতে সক্ষম। অথচ একই সাথে ইরান স্বীয় পারমাণবিক কর্মসূচির সামর্থ্যরে সংরক্ষণ করেছে এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার অধিকারী হয়ে অধুনাতম আন্তর্জাতিক মানদণ্ডসমূহের ভিত্তিতে বাণিজ্যিক ও শিল্প সামর্থ্যে উপনীত হবার লক্ষ্যে শান্তি ও স্বস্তি সহকারে একটি যৌক্তিক পথে স্বীয় পথচলা অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী ঈদুল ফিত্রের নামাযের খোত্বায় যে বক্তব্য দিয়েছেন তার প্রতি ইঙ্গিত করে জনাব জাওয়াদ যারীফ বলেন, মহান রাহ্বার যেমন বলেছেন, বিগত প্রায় বারো বছর যাবৎ বিশ্বের ছয়টি বৃহৎ দেশ ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানকে তার পারমাণবিক শিল্পের কাজ অব্যাহত রাখা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করে আসছিল এবং অনেকের বক্তব্য অনুযায়ী, ইরানের পারমাণবিক শিল্পের নাট-বল্টুসমূহও খুলে নিতে চাচ্ছিল, আজ তারা কয়েক হাজার সেন্ট্রিফিউজসহ ইরানের পারমাণবিক গবেষণা ও উন্নয়নের কাজ অব্যাহত রাখার বিষয়টি মেনে নিতে ও সহ্য করে নিতে বাধ্য হয়েছেনÑ যার একমাত্র তাৎপর্য হচ্ছে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের শক্তিমত্তা।
অনুবাদ নূর হোসেন মজিদী

ইরান ইতিহাস সৃষ্টিকারী সাফল্য অর্জন করেছে

ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থার প্রধান সালেহী-
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থার প্রধান ড. আলী আকবার সালেহী বলেন, বিশ্বের বৃহৎ শক্তি হিসেবে পরিচিত ৬টি দেশ ও ইরানের মধ্যে যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাতে ইরান এক ইতিহাস সৃষ্টিকারী বিরাট সাফল্য অর্জন করেছে।
জনাব সালেহী গত ২১শে জুলাই (২০১৫) মজলিসে শূরায়ে ইসলামী (পার্লামেন্ট)-এর উন্মুক্ত অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণে এ কথা বলেন।
বার্তা সংস্থা এন্তেখাব্-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, জনাব সালেহী বলেন, আমরা শার‘ঈ দায়িত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে, বিবেকের দৃষ্টিতে, সাধারণ প্রচলিত দৃষ্টিতে ও বিচারবুদ্ধির আলোকে তথা যে কোনো দৃষ্টিকোণ থেকেই ৫+১ জাতি ও ইরানের মধ্যকার সমঝোতার কৌশলগত দিকসমূহের প্রতি দৃষ্টিপাত করি না কেন, আমরা দেখতে পাই যে, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান ইতিহাস সৃষ্টিকারী বিরাট সাফল্য অর্জন করেছে। উল্লেখ্য, জনাব সালেহী পারমাণবিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ও দীর্ঘ ৪৪ বছরের অভিজ্ঞতার অধিকারী।
ড. আলী আকবার সালেহী তাঁর বক্তব্যের শুরুতেই শহীদ পরমাণু বিজ্ঞানীদেরকে তাঁদের নামোল্লেখসহ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন এবং এরপর বলেন, মজলিসের এ অধিবেশনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব জাওয়াদ যারীফ যে বক্তব্য পেশ করেছেন কার্যত তা এ সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন। তাই এ ক্ষেত্রে আমি কেবল আলোচনার কৌশলগত দিক সম্পর্কে কিছুটা ব্যাখ্যা পেশ করব মাত্র। আশা করি এর ফলে এ সমঝোতা সম্পর্কে যে কোনো সংশয়ের অবসান ঘটবে।
জনাব সালেহী বলেন, আলোচনা কোনো সহজ কাজ নয়, বিশেষ করে তা যদি হয় শয়তানকে চ্যালেঞ্জ করে। যারা সব সময়ই ধূর্ততা ও অপকৌশলের আশ্রয় নেয়ার অপচেষ্টা চালায় তাদের সাথে আলোচনা চালানো মোটেই সহজ ও স্বস্তিকর নয়। তবে ইসলামী বিপ্লবের কোলে লালিত ব্যক্তিবর্গÑইরানী প্রতিনিধি দলÑঅবিনশ্বর আল্লাহ্ তা‘আলার ওপর তাওয়াক্কুল করে স্বীয় চিন্তা-বিশ্বাসের আলোকে এবং শার‘ঈ দায়িত্ব হিসেবে ও রাহ্বারের পথনির্দেশের ভিত্তিতে যথাযথভাবে স্বীয় দায়িত্ব পালন করেছেন এবং এর ফলে আমরা যা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি একজন ইরানী নাগরিক হিসেবে সে জন্য আমি গর্বিত।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থার প্রধান বলেন, আমাদের দেশের পারমাণবিক কর্মসূচির ফাইল নিয়ে আলোচনার শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ)-তে ইরানের প্রতিনিধি হিসেবে আমি এতদসংক্রান্ত সকল বিবর্তন প্রত্যক্ষ করেছি। চ্যালেঞ্জপূর্ণ বিগত বারো বছরে ইরানী জাতি সব সময়ই দৃঢ়তা ও প্রতিরোধের পরিচয় দিয়ে আসছে এবং এ ক্ষেত্রে ইসলামী বিপ্লবের মহান রাহ্বার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন। আর এর ফলেই আমরা সম্মান ও উন্নত শির অবস্থাসহ এ ব্যাপারে পথের শেষ প্রান্তে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছি।
জনাব সালেহী বলেন, আমি রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী নই। তবে তা সত্ত্বেও নিশ্চয়তার সাথে বলতে পারি যে, এ সমঝোতার ফলে বৈশ্বিক রাজনৈতিক গতিধারায় এক সর্বাত্মক পরিবর্তন সাধিত হবেÑ যে পরিবর্তনের ঘণ্টা ভিয়েনায় বাজানো হয়েছে। কারণ, যেসব দেশ অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে বিশ্বশক্তি হিসেবে পরিগণিত তাদের সামনে এই প্রথম বারের মতো একটি দেশ দৃঢ়তার সাথে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। ইতিহাসে এটাই প্রথম যে, একটি উন্নয়নশীল দেশ রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জপূর্ণ বিশ্বে আন্তর্জাতিক আন্তঃক্রিয়ার ক্ষেত্রে একটি উন্নত দেশের অবস্থানে আসন গ্রহণ করে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছে। ইসলামী বিপ্লবের বরকতে এবং জাতি ও তার দায়িত্বশীলগণের মনোবলের কারণে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান আজ এমন একটি অবস্থানের অধিকারী হতে পেরেছে। আসুন, আমরা এ অর্জনকে মোবারকবাদ জানাই, এর কদর করি এবং এ জন্য আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করি।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থার প্রধান জনাব সালেহী সমঝোতার কৌশলগত বিষয়াদি নিয়ে বিরাজমান দুশ্চিন্তা প্রসঙ্গে বলেন, ৫+১ জাতি ও ইরানের মধ্যকার আলোচনা বছরের পর বছর ধরে চলে আসছিল। ইতিপূর্বে যে মহান ভাইয়েরা এ আলোচনায় অংশগ্রহণের দায়িত্ব পালন করেন তাঁরা অনেক পরিশ্রম করেছেন। তাঁদের মধ্যে শীর্ষে ছিলেন ড. রুহানি, জনাব লারিজানী এবং এখন আছেন জনাব যারীফ; তাঁদের সকলেই অনেক পরিশ্রম করেছেনÑ যার ফলে এখন আমরা অধিকতর সমুন্নত একটি দিগন্ত প্রত্যক্ষ করছি। কারো পক্ষে এটা মনে করা উচিত হবে না যে, অতীতে যাঁরা পরিশ্রম করেছেন তা কোনো কাজে লাগে নি; বরং আমরা তাঁদের কাজের ধারাবাহিকতায়ই বর্তমান অবস্থায় উপনীত হয়েছি। প্রকৃত অবস্থা হলো এই যে, অতীতে যাঁরা কাজ করেছেন তাঁদের প্রত্যেকেই একটি ইটের ওপর একটি করে ইট গেঁথেছেন এবং সর্বশেষ ইটটি এ ধারাবাহিকতায় সবশেষে অংশগ্রহণকারী মহান ভাইয়েরা গেঁথেছেন।
জনাব সালেহী বলেন, ৫+১ জাতি ও ইরানের মধ্যকার আলোচনা বছরের পর বছর ধরে চলেছিল, কিন্তু কাক্সিক্ষত উপসংহারে উপনীত হওয়া সম্ভব হয় নি। এমতাবস্থায় ইসলামী বিপ্লবের মহান রাহ্বারের খেদমতে একটি প্রস্তাব পেশ করা হয়, আর তিনি স্বীয় দূরদর্শিতার আলোকে প্রস্তাবটি গ্রহণ করেন এবং আরেকটি পথ উন্মুক্ত করতে বলেন। এ দ্বিতীয় পথটি ছিল সরাসরি আমেরিকার সাথে আলোচনা। অবশ্য তিনি একই সাথে সমন্বিতভাবে উভয় পথে অগ্রসর হওয়া অব্যাহত রাখার জন্য আদেশ দেন।
জনাব সালেহী বলেন, সৌভাগ্যবশত এ সুচিন্তিত কর্মধারা বর্তমান সরকারের আমলে অত্যন্ত চমৎকারভাবে অনুসৃত হয়। আর এ ক্ষেত্রে উভয় পথে অগ্রসর হবার দায়িত্ব এমন এক ব্যক্তির ওপর অর্পিত হয় যিনি সুপ্রশিক্ষিত ব্যক্তি ও বিশেষজ্ঞত্বের অধিকারীÑ যাঁর অভিজ্ঞতা খুবই কার্যকর হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। আর এর চূড়ান্ত ফলাফলও অত্যন্ত বরকতময় হয়েছে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থার প্রধান আলোচনার প্রক্রিয়া সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, ফ্রান্সের লুসানে অনুষ্ঠিত আলোচনায় আমরা আলোচ্য বিষয়ের টেকনিক্যাল অক্ষসমূহের ব্যাপারে একটি সমঝোতায় উপনীত হই। এরপর গত সপ্তাহে ভিয়েনায় সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে মধ্যবর্তী কয়েক মাসের আলোচনায় আমরা লুসানের সমঝোতাকে কাজে লাগাই। এ ক্ষেত্রে আমাদেরকে অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে লেগে থাকতে হয় এবং লুসানে যে পথ রচনা করা হয় তাকে ধীরে ধীরে আরো বেশি মসৃণ করা হয়। এর ফলে এমন এক উপসংহারে উপনীত হওয়া সম্ভব হয় ইতিপূর্বে যা চিন্তাও করা যায় নি; ইতিপূর্বে যা হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে বলে মনে করা হয়েছিল তা-ও অর্জন করা সম্ভব হয়।
তিনি বলেন, এ কথা বলা কি আদৌ সম্ভব যে, আমেরিকা তার এতো সব উপায়-উপকরণসহ সহসাই হতভম্ব হয়ে পড়বে? কিন্তু হ্যাঁ, এটাই হয়েছিল। কারণ, এ ক্ষেত্রে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান আমেরিকার তুলনায় মোটেই পিছিয়ে ছিল না। কারণ, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান বিশেষ করে আল্লাহ্ তা‘আলার ওপর তাওয়াক্কুল করে ও আহ্লে বাইতের মাসুম ইমামগণকে (আ.) উসিলা করে স্বীয় পথকে এগিয়ে নেয় এবং এরই বরকতের বদৌলতে নিজেদেরকে যথাযথভাবে ও শক্তিমত্তা সহকারে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়। ফলে প্রতিপক্ষ অনেক চেষ্টা করেও আমাদেরকে টলাতে পারে নি।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থার প্রধান বলেন, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের আলোচক প্রতিনিধিদল লুসানে যে ভূমিকা পালন করেন সে তুলনায় তাঁরা ভিয়েনার আলোচনায় অধিকতর সমুন্নত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। প্রতিপক্ষ বলছিল যে, তারা ইরান কর্তৃক পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদনের পথ বন্ধ করে দেবে। কিন্তু আমরা কি পারমাণবিক অস্ত্র হস্তগত করার জন্য চেষ্টা করছিলাম? আমরা কি এমন কোনো পথে চলছিলাম যে, তারা ঐ পথ বন্ধ করে দেবে? তারা এ পথে যে কোনো বাধাই সৃষ্টি করুক না কেন তাতে আমাদের কিছুই আসে-যায় না। কারণ, ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বারের ফত্ওয়া অনুযায়ী পারমাণবিক অস্ত্রসহ যে কোনো ধরনের গণবিধ্বংসী অস্ত্রের উৎপাদন, সংরক্ষণ ও ব্যবহার পুরোপুরি হারাম। সুতরাং গণবিধ্বংসী অস্ত্র হস্তগত করার জন্য যদি কোনো পথ থেকে থাকে, তাহলে তারা তাদের সাধ্য মতো সে পথ বন্ধ করে দিক। কারণ, আমরা আসলেই সে পথে চলার অভিলাষী নই, যদিও তারা মনে করে যে, তারা আমাদের জন্য এ পথে চলার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা আরোপ করতে পেরেছে এবং বিশ্বজনমতের কাছেও এটা আমাদের জন্য সীমাবদ্ধতা হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।
ড. সালেহী তাঁর বক্তব্যের সমাপ্তিতে বলেন, সমঝোতায় যে সীমাবদ্ধতার কথা বলা হয়েছে, বাহ্যত হয়তো তা সীমাবদ্ধতা হিসেবে পরিগণিত হবে, কিন্তু তা এমন কোনো সীমাবদ্ধতা নয় যা আমাদের পারমাণবিক কর্মসূচির মূল ভিত্তি, অগ্রগতি ও কর্মতৎপরতাকে স্থবির, শ্লথ বা খোদা না করুন, স্থগিত করে দিতে সক্ষম হবে।

অনুবাদ : নূর হোসেন মজিদী