All posts by pavel

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা রাহবার আয়াতুল্লাহ আল উজমা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী প্রদত্ত পবিত্র ঈদুল ফিত্রের খুতবার পূর্ণ বিবরণ

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

মহান আল্লাহর হামদ ও মহানবী (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের প্রতি সালাম জানিয়ে মহামান্য রাহবার তাঁর খুতবা শুরু করেন।

পবিত্র ঈদুল ফিত্র উপলক্ষে উপস্থিত প্রিয় মুসল্লিবৃন্দ! আপনাদের সবার খেদমতে এবং সমগ্র ইরানি জাতি ও মহান ইসলামি উম্মাহর প্রতি শুভেচ্ছা ও মোবারকবাদ জানাচ্ছি। এই ঈদের মাহাত্ম্য হৃদয়ঙ্গম করার জন্য এটুকুই যথেষ্ট যে, ঈদের দিনের নামাযসমূহে যেসব কুনুত (নামাযের ভেতরে দোয়া) পড়া হয়, তাতে এই দিনের শপথ করেই আল্লাহ তা‘আলার কাছে ফরিয়াদ জানানো হয়। বিষয়টি নিঃসন্দেহে এই দিনের সবিশেষ গুরুত্বের প্রমাণ বহন করে।
দীর্ঘ এক মাসব্যাপী ইবাদতের পরিসমাপ্তি, একমাস আল্লাহর দিকে নিবিষ্ট থাকা, আল্লাহর যিকিরে রত থাকা, মুমিন বান্দাদের বিনয়, কাকুতি আর আল্লাহর দরবারে আত্মনিবেদন শেষে আজকের দিনটি সত্যিকার অর্থেই ঈদের দিন। এদিন সকলের জন্য উৎসব ও আনন্দের আর পয়গাম্বরে আকরাম (সা.)-এর জন্য সম্মান ও মর্যাদার।
আজকের খুতবায় আমি আপনাদের সামনে যা পেশ করতে চাই তা হচ্ছে, আলহামদু লিল্লাহ! আমাদের ঈমানদার জনগণ খুব ভালো একটি রমযান মাস অতিবাহিত করেছেন। মাহে রমযান, যার মধ্যে আল্লাহর দিকে আত্মনিবেদন, আধ্যাত্মিকতা, ইবাদত-বন্দেগি, আল্লাহর দরবারে বিনয়-কাতরতা, কান্নাকাটির মধ্য দিয়ে আমাদের জনগণ এই মাসটি অতিবাহিত করেছেন। রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল হিসেবে আমরা যারা আছি, আমাদেরকে আমাদের ঈমানদার জনগণের অবস্থার জন্য তাঁদের নূরানি অন্তরসমূহের দিকে চেয়ে ইর্ষান্বিত হওয়া উচিত। আমাদের উচিত আল্লাহর দরবারে শোকর আদায় করাÑ এই ঈমানদার জাতির পক্ষ হতে আমাদের ওপর যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে তার কারণে। বছরের দীর্ঘতম ও সবচেয়ে উত্তপ্ত দিনগুলোতে সারা দেশের জনগণ রোযা পালন করেছেন। রোযামুখে তাঁরা গ্রীষ্মের প্রচ- খরতাপ সহ্য করেছেন। এমনকি আমাদের যুবসমাজ, আমাদের কিশোর ও তরুণরা প্রবল উৎসাহ-উদ্দীপনায় রোযা রেখেছেন। যেসব চক্রান্তকারী আমাদের তরুণদেরকে রোযা না রাখতে প্ররোচিত করতে চেয়েছিল আল্লাহর রহমতে তারা সফলকাম হয় নি। ভবিষ্যতেও তারা সফলকাম হবে না। কিন্তু দেশের দায়িত্বশীলবর্গ এবং সর্বস্তরের জনগণকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে, বিদ্বেষী ও দুষ্ট-দুরাচারীরা কতদূর কী করছে, কী কী চেয়েছে, কী পরিকল্পনা করেছে, তাদেরকে নখদর্পণে রাখতে হবে। এরা দেশের উদীয়মান তরুণ সমাজকে বিপথগামী করার জন্য, দীন থেকে দূরে সরিয়ে দেয়ার জন্য নানা ধরনের চক্রান্ত এঁটেছে। এরা বসে বসে পরিকল্পনা করে, নীলনকশা আঁকে। তাদের লক্ষ্য আমাদের তরুণরা যেন রোযা না রাখে। আলহামদু লিল্লাহ তারা তাদের চক্রান্তে সফলকাম হয় নি, আমাদের জাতি তাদের মুখে মুষ্টাঘাত হেনেছে। আলহামদু লিল্লাহ।
এই মাস ছিল আল্লাহর মেহমানদারির (যিয়াফতের) মাস। আল্লাহর যিয়াফতে আপ্যায়নের ব্যবস্থা হয় স্বয়ং আল্লাহর তরফ থেকে। আল্লাহর পক্ষ হতে এই মাসে আপ্যায়নের স্বরূপ হচ্ছে, অন্তরসমূহ আলোকিত হওয়া। গুনাহসমূহের মাগফিরাত, বড় বড় নেক কাজের তাওফীক লাভ। এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ নেক কাজ ছিল বিশাল মিছিল, যা রমযানের শেষ শুক্রবারে কুদ্স দিবসে মরহুম মহান ইমামের উপদেশ অনুযায়ী সারা দেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে। অনেক মুসলিম দেশেও এই দিবসের মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। আমাদের দেশের কোনো কোনো শহরে কুদ্স দিবসে তাপমাত্রা এত বেশি ছিল যে, স্বাভাবিক ভাবেই এমন তাপমাত্রার মধ্যে মানুষ রাস্তায় নামে না। কিন্তু এরপরও তাঁরা মিছিলে অংশগ্রহণ করেছেন। দেশের সর্বত্র বিশেষ করে যেসব প্রদেশ অত্যন্ত উঞ্চ ছিল, দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশসমূহ, সত্যিকার অর্থেই তাঁরা কষ্ট স্বীকার করেছেন। রোযা রেখে তাঁরা প্রখর রোদ মাথায় নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফিলিস্তিন ইস্যুতে তাঁদের অবস্থান থেকে সেøাগান দিয়েছেন। এর অর্থ হচ্ছে, যদি কোন কোন মুসলিম রাষ্ট্র ফিলিস্তিনি আশা-আকাক্সক্ষার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেও থাকে, কেউ কেউ যদি নিজেদের দুর্বলতার পরিচয় দিয়ে থাকে, যেমন কোন কোন জাতি তো এ সম্পর্কে কোন খবরই রাখে না; কিন্তু ইরানের জাতি তাঁদের উপস্থিতি ও সেøাগানের মাধ্যমে সকল দুশমনের মোকাবিলায় রুখে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁরা ফিলিস্তিন ইস্যুকে জীবন্ত করেছেন।
এবছর রমযান মাসে দেশের সর্বত্র ছিল প্রদর্শনী। জনগণ যে আধ্যাত্মিকতার দিকে ঝুঁকেছে, আলহামদু লিল্লাহ কুরআনিক ক্লাসগুলোতে খুবই উত্তম পন্থায় কুরআন তেলাওয়াতের যে রেওয়াজ গড়ে উঠেছে, তা আল্লাহর রহমতে মিডিয়ায়ও ভালো কভারেজ পেয়েছে। কুরআন খতমের যে রেওয়াজ মোবারক জায়গাগুলোতে অনুষ্ঠিত হয়েছে তার প্রতি জনগণের ব্যাপক সাড়া পড়েছে। এ বছর বহু শহরে এই কুরআনখানি অনুষ্ঠিত হয়েছে। জনসাধারণের পক্ষ হতে ইফতার মাহফিলের যেসব অনুষ্ঠান হয়েছে বিশেষ করে তেহরানের (কথা বলা যায়)। এখনো অন্যান্য শহরে ইফতার মাহফিলের পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট আমার কাছে এসে পৌঁছায়নি। তবে কোন কোন পবিত্র স্থানে, যেমন পবিত্র মাশহাদে গণভিত্তিক ইফতারের ব্যবস্থা হয়েছিল। মসজিদসমূহে, ইমামবাড়া, হোসাইনিয়াসমূূহে এবং পথেঘাটে, মহল্লায়, মসজিদে গণমানুষের পক্ষ হতে ইফতারির দস্তরখান বিছানো হয়েছিল। তাঁরা পথিকদের মাঝে ইফতারি বিলি করেছেন। লোকেরাও বসে সে ইফতারি গ্রহণ করেছেন। এগুলোর ছবি আমাকে দেখানো হয়েছে। সত্যিই আধ্যাত্মিকতার প্রতি জনগণের এমন আগ্রহ ও উদ্দীপনা, মানুষ মানুষের খেদমত করার দৃশ্যাবলি মানুষকে অভিভূত করে। এগুলো হচ্ছে এমন কতক প্রোগাম যেগুলো এ বছর নতুনভাবে চালু হয়েছে। অবশ্য তা বিগত বছরগুলো থেকে চলে আসছিল। এ বছর অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক বেশি প্রাণবন্ত হয়েছে। তেহরানে তো সর্বব্যাপী ছিল। অন্যান্য অনেক জেলা শহরেও স্বাভাবিকভাবে তা অনুষ্ঠিত হয়েছে। অবশ্য আমার কাছে এর বিস্তারিত রিপোর্র্ট এখন নাই। এগুলো যেসব ইফতার পার্টি অপচয়পূর্ণ ও অভিজাত মহলে হয়, সে ধরনের কিছু নয়। ব্যয়বহুল যেসব ইফতার মাহফিল হয়, তাতে দেখা যায়, ইফতার করার হক যাদের রয়েছে, তাদের জন্য ইফতার মাহফিল হয় না। কোন কোন সময় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে যেসব ইফতার পার্র্টির আয়োজন করা হয় তার পেছনে কোন যুক্তি থাকে না। হোটেলগুলোতে কতক লোক জড়ো করা হয়, তাদের তো এ ধরনের ইফতারের কোনো প্রয়োজন পড়ে না। এদের মোকাবিলায় গণভিত্তিক ইফতার মাহফিলগুলোর কথাই বলছি। একদল লোক নেমে পড়েছিলেন এবং নিজেদের নাম দিয়েছিলেন ‘অলিগলির আশেক’। এটি সত্যিকারের একটি নাম। তাঁরা মানুষের ঘরে ঘরে ইফতার পৌঁছে দিচ্ছিলেন। আমাকে এ সম্পর্কিত বিভিন্ন রিপোর্ট জানানো হয়েছে। ছবি ভিডিও করে আনা হয়েছে। ঘরে ঘরে ইফতার পৌঁছানোÑ এটি এক বিরাট খেদমত। অত্যন্ত সম্মানিত কাজ তাঁরা করেছেন। এছাড়াও দোয়া ও মোনাজাতের মাহফিল, সারা রাতব্যাপী, শেষ রাত অবধি, মসজিদে ও ইমামবাড়ায়, বিভিন্ন মজলিসে ও মহলে বিশেষ করে রাত জাগরণের রজনীগুলোতে, এমনকি শহীদগণের মাযারে উপস্থিত হয়ে, লোকেরা সেখানে জমায়েত হয়েছেন। সেখানে তাঁরা অন্তরসমূহ আল্লাহর দিকেই নিবেদিত করেছেন। এগুলো সবই আল্লাহর রহমত আকর্ষণের উসিলা হয়েছে। রমযানের শেষ দশকের ইতিকাফও ক্রমান্বয়ে একটি সুন্দর রেওয়াজে পরিণত হচ্ছে এবং তা দিনদিন বিস্তার লাভ করছে। ইনশা আল্লাহ এটিও বরকতপূর্ণ। আমি জানতে পেরেছি যে, বেশকিছু সম্মানিত চিকিৎসক মাহে রমযানের কতিপয় দিন ও রাতে ফ্রি চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন। এর অর্থ এটাই হতে পারে যে, এই ত্যাগ ও কুরবানি সর্বস্তরের মানুষের মাঝে অব্যাহত রয়েছে। এ ছিল আমাদের মাহে রমযান, যা আমাদের মাঝ থেকে গত হয়ে গেল। এ ধরনের রমযান মাসের দ্বারাই আল্লাহর রহমত আকর্ষিত হয়। ইনশা আল্লাহ।
আজকেও যে পবিত্র ঈদুল ফিত্র, আজকের দিনটির তাৎপর্য হচ্ছে, মহানবী (সা.)-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্যই এই দিন। جَعَلتَهُ لِلمُسلِمینَ عیدا، وَ لِمُحَمَّدٍ صلّی اللهُ علیهِ وَ آلِه ذُخرًا و شَرَفًا و کرامتًا وَ مَزیدا ‘একে তুমি মুসলমানদের জন্য উৎসবে পরিণত করেছ এবং মুহাম্মাদ (সা.) ও তাঁর বংশধরের জন্য সম্মান, মর্যাদা, ইজ্জত ও সমৃদ্ধির উপলক্ষ করেছ।’ এটি হচ্ছে জনসাধারণের পক্ষ হতে মহানবী (সা.)-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন। মানুষ আর পয়গাম্বর (সা.)-এর সম্পর্ক কী, সে সম্বন্ধে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, মানুষের দুঃখ-কষ্ট তাকে খুবই ব্যথিত করে। (সূরা তাওবা : ১২৮ আয়তাংশ)
প্রভু হে! মুহাম্মাদ (সা.) ও মুহাম্মাদ (সা.)-এর বংশধরের উসিলায় এই রমযানুল মোবারক ও এই ঈদকে ইরানের জাতি ও বিশ্বমুসলিমের জন্য মোবারক কর। (অতঃপর তিনি সূরা আস্র তেলাওয়াত করে প্রথম খুতবা শেষ করেন।)

 

দ্বিতীয় খুতবা

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

সকল ভাইবোনকে তাকওয়ার জীবন অবলম্বনের জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। এ খুতবায় ইসলামি জাহানের চলমান কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাই। এমন বিষয় যেগুলো ইসলামি উম্মাহর সাথে জড়িত। দুঃখজনকভাবে জনগণের আনন্দ-উৎসবের দিন কোন কোন দেশে শোকের দিনে পরিণত হয়েছে। বাগদাদে কয়েকশ’ পরিবার তাঁদের আপনজনদের হারানোর বেদনায় মূহ্যমান। অপরাধী ও সন্ত্রাসীÑযারা তাদের প্রভুদের নির্দেশে একটি জাল ও বানোয়াট ইসলাম মানুষের মাঝে প্রচলিত করতে চায় তাদের হাতে তাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন। অনুরূপভাবে ইস্তাম্বুলে, বাংলাদেশে এবং অন্যান্য আরো কয়েকটি দেশে পবিত্র রমযান মাসে রোযা পালনরত অবস্থায় লোকেরা তাদের সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছেন। এগুলো হচ্ছে বৃহৎ শক্তিবর্গের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর মাধ্যমে সন্ত্রাসের পরিচর্যার ফসল। অবশ্য তারা নিজেরাও এর দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হবে। যেমনটি ক্রমান্বয়ে তারা দেখতে পাচ্ছে। অবশ্য এগুলো তাদেরই পাপ ও অপরাধ । এমন অপরাধ যা কখনো ভুলে যাওয়া হবে না।
দুঃখজনকভাবে পবিত্র মাহে রমযানে কোন কোন ইসলামি দেশ সিরিয়া, ইয়েমেনে, লিবিয়া এবং আরো কয়েকটি স্থানে যুদ্ধের আগুন জ্বলছিল। সত্যিই মানুষ ভীষণ চিন্তায় পড়ে যায় যে, কীভাবে ইসলামি বিশ্ব এ ধরনের একটি পরিস্থিতির শিকার হতে পারে। কেউ কেউ রাজনৈতিক বিবাদকে গৃহযুদ্ধে রূপান্তরিত করেছে। রাজনৈতিক বিরোধ এক বিষয় আর গৃহযুদ্ধ আলাদা বিষয়। বিশ্বশক্তিগুলোর হস্তক্ষেপই সিরিয়ায় ও আরো কয়েকটি স্থানে এ কাজগুলো করছে। ইয়েমেনে আজ এক বছর তিন মাসের বেশিকাল ধরে জনগণ বোমা হামলার শিকার হয়ে আছে। কিন্তু এরপরও ইয়েমেনের জনগণকে আমার সাবাশ দেই যে, কুদ্স দিবসে তাঁরা প্রচ- গরম উপেক্ষা করে বোমা বর্ষণের ভেতরও বিশাল মিছিল বের করেছেন। সাবাশ ইয়েমেনের জনগণ, সাবাশ ইয়েমেনের জনগণের প্রাজ্ঞ নেতৃত্ব। সিরিয়ায়ও মানুষ বিরাট আপদের সম্মুখীন হয়ে আছেন, যা বৃহৎশক্তিগুলো তাদের ওপর আপতিত করেছে।
দুশমনদের চেষ্টা হলো, ফিলিস্তিন সমস্যার কথা যেন ভুলিয়ে দেয়া যায়। তারা ইসলামি জাহানকে তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যার গোলকধাঁধায় বেঁধে রাখতে চায়, যাতে তারা ফিলিস্তিন সমস্যার কথা ভুলে যায়। যায়নবাদী আগ্রাসী সরকারের জন্য যেন সুযোগ সৃষ্টি হয়, যাতে তার দুষ্টু দুরাচারী পরিকল্পনা ও লক্ষ্যসমূহ কার্যকর করতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রাম একটি ইসলামি সংগ্রাম। একটি সর্বাত্মক ও সম্মিলিত সংগ্রাম। নিছক একটি আরব সংগ্রাম নয়। এটি দুনিয়ার সর্বত্র মুসলমানদের একটি কমন দায়িত্ব, যেভাবেই সম্ভব হোক এই আন্দোলন, এই সংগ্রাম, এই সেøাগান অব্যাহত রাখতে হবে। এতবড় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে নিছক আরব বিশ্বের সমস্যা হিসেবে খাটো করে দেখা মারাত্মক ভুল।
(অতঃপর মাননীয় রাহবার খুতবার এ অংশে ইরানের অভ্যন্তরীণ একটি বিষয়ের ওপর আলোকপাত ও প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দান করেন। এরপর সূরা ইখলাস তেলাওয়াতের মাধ্যমে দ্বিতীয় খুতবা শেষ করেন।)

ইমাম আলী ইবনে মূসা আর রেযা (আ.)

সংকলন : আব্দুল কুদ্দুস বাদশা

ভূমিকা
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বংশের সন্তান ও সত্যান্বেষীদের অষ্টম ইমাম হযরত আলী ইবনে মূসা আর-রেযা (আ.) এক জ্যোতির্ময় সারসত্যের নাম। আরব ভূখ-ের বাইরে একমাত্র মাসুম ইমাম, যিনি ইরানের খোরাসানে সমাহিত রয়েছেন, তাঁর অনুপম সুন্দর ব্যক্তিত্ব ও জ্ঞানের উজ্জ্বল দ্যুতি শুধু শিয়া মাযহাবের মধ্যেই নয়, আহলে সুন্নাতের অপরাপর ফেরকা ও মাযহাবের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে, শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে উক্ত ইমামের স্তুতি ও প্রশংসা বর্ণনায় প্রবৃত্ত হয়েছে। আহলে সুন্নাতের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থসমূহে অনুসন্ধান, অধ্যয়ন ও পর্যালোচনার মাধ্যমে একথা সহজে জানা যায়। যদিও এসব গ্রন্থে আলে মুহাম্মাদ (সা.)-এর এ মহামনীষীর সত্যিকার মর্যাদা যথার্থ রূপে বর্ণিত হয়নি, তথাপি প্রত্যেকেই বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি ও ভিন্ন ভিন্ন বিবরণে ইমাম রেযা (আ.)-এর ব্যক্তিত্বের মহিমাকে স্বীকার করেছেন।
একদিকে দূর-দূরান্ত থেকে খোরাসানের মাশহাদ নগরীতে অবস্থিত ইমাম রেযা (আ.)-এর পবিত্র মাযার অভিমুখে বছর জুড়ে অগণিত ভক্তকুলের স্রোতের ঢল, ইমাম রেযা (আ.) সম্পর্কে আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট না থাকা ও তাদের ইতস্তত-বিক্ষিপ্ত মত-অভিমত প্রকাশ এবং পথভ্রষ্ট উগ্রপন্থী চক্র কর্তৃক আহলে বাইত (আ.)-এর ব্যক্তিত্ব হরণ ও তাঁদের মাযারসমূহ বিশেষ করে ইমাম রেযা (আ.)-এর নূরানি মাযার ধ্বংস করার মর্মে ফেতনা সৃষ্টিকারী ফতোয়াবাজি, অপরদিকে এ সম্পর্কিত কোন পূর্ণাঙ্গ ও স্পষ্ট গবেষণা বিদ্যমান না থাকাÑ এ সবকিছু মিলিয়ে আজ এ মহান ইমামকে নতুন করে জানার আবশ্যকতা সৃষ্টি হয়েছে। তাই ইমা রেযা (আ.)-এর পবিত্র জন্মবার্ষিকী স্মরণে প্রস্ততকৃত এ প্রবন্ধে মূলত তিনটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রাখা হয়েছে। যথা: ইমাম রেযা (আ.)-এর ব্যক্তিত্বের বহুমাত্রিকতা সম্পর্কে আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারার প্রকরণের সাথে ব্যাপক ও বাস্তবভাবে পরিচিতি লাভ, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর এ বংশধরকে ঘিরে শিয়া ও সুন্নি উভয় মাযহাবের অনুসারীবৃন্দের মাঝে সহমর্মিতা সৃষ্টি ও যুক্তিসঙ্গত মৈত্রী ও নৈকট্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। আর সবশেষে শিয়া ও সুন্নি- এ দু’মাযহাবের অনুসারীদের মধ্যে গোলযোগ ও নাশকতামূলক কর্মকা-ের প্রতিরোধ ও নিবারণ করা।
উল্লেখ্য যে, আহলে সুন্নাতের বিভিন্ন গ্রন্থের অংশবিশেষে প্রসঙ্গক্রমে ইমাম রেযা (আ.)-এর ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। আহলে সুন্নাতের আলেমগণের মধ্যে যাঁরা তাঁদের গ্রন্থসমূহে ইমাম রেযা (আ.)-এর প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন তাঁদের কয়েকজন হলেন :
১. মুহাম্মাদ ইবনে তালহা শাফেয়ী (৬২৫ হি.) : মাতালিবুছ ছাউল ফি মানাকিবি আলের রাসূল (সা.), ২. ইবনে সাব্বাগ মালেকি (৮৫৫ হি.) : আল ফুসুলুল মুহিম্মাহ ফি মা’রিফাতিল আয়িম্মাহ, ৩. উমর ইবনে শুজাউদ্দীন মুসেলী শাফেয়ী (৬৬০) : আন নায়িমীল মুকিম লি-ইতরাতিন নাবাঈল আযীম (আ.), ৪. মুহাম্মাদ খাজা পারসায়ী বুখারী হানাফি (৮২২ হি.) : ফাসলুল খিতাব লি ওয়াসলিল আহবাব, ৫. নুরুদ্দীন আবদুর রহমান জামী হানাফী (৮৯৮ হি.) : শাওয়াহিদুন নবুওওয়াহ, ৬. মীর খন্দ শাফেয়ী (৯০৩ হি.) : তারিখু রাওদাতুস সাফা, ৭. খুনজি ইসফাহানি হানাফি (৭২৭ হি.) : ওয়াসিলাতুল খাদিমি ইলাল মাখদুম দার শারহে সলাওয়াতে চাহারদাহ্ মাসুম (আ.) ও মেহমান নামা বোখারা, ৮. ইবনে তুলুন দামেশকি হানাফি (৯৫৩ হি.) : আল আয়িম্মাতুল ইছনা আশার (আ.), ৯. খন্দ আমীর শাফেয়ী (৯৪২ হি.) : তারিখু হাবিবিস সিয়ার ফি আখবারি আফরাদি বাশার, ১০. ইবনে হাজার হায়ছামি শাফেয়ী (৯৭৪ হি.) : আস-সাওয়ায়িকুল মুহরিকাহ্, ১১. কারমানি দামেশকি (১০১৯ হি.) : আখবারুদ দুওয়াল ওয়া আছারুল উওয়াল, ১২. শিব্রাওয়ী শাফেয়ী (১১৭২ হি.) : আল ইতহাফ ফি হুব্বিল আশরাফ, ১৩. কুন্দুজি হানাফি (১২৯৪ হি.) : ইয়ানাবিয়্যুল মাওয়াদ্দাহ্ লি যাবিল কুরবা (আ.), ১৪. শাবলাঞ্জি শাফেয়ী (১২৯৮ হি.) : নুরুল আবসার ফি মানাকিবি আলে বাইতিন নাবিয়্যিল মুখতার (আ.), ১৫. সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ তাহের হাশেমী শাফেয়ী (১৪১২ হি.) : মানাকিবি আহলুল বাইত (আ.) আয দিদগাহে আহলুস সুন্নাহ।
এসব প-িত মূলত আহলে সুন্নাতভুক্ত বিভিন্ন মাযহাব, যেমন শাফেয়ী, মালেকি, হাম্বালি, হানাফি ও যাহেরী মাযহাবের আলেম ও অনুসারী ছিলেন, হিজরি দ্বিতীয় শতক থেকে অদ্যাবধি। সুতরাং জাল ও বেদআতমূলক দল, যেমন ওয়াহাবি সম্প্রদায়ের কথা এখানে বলা হয়নি, যারা স্বয়ং আহলে সুন্নাতের ঘোষণা মোতাবেক তাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।
বংশ পরিচয়
শামআনি শাফেয়ী ইমাম রেযা (আ.) এর বংশ পরিচয় এভাবে বর্ণনা করেছেন : ‘আলী ইবনে মূসা ইবনে জাফর ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আলী ইবনে হোসাইন ইবনে আলি ইবনে আবি তালিব (আ.)।

বলা বাহুল্য, ইমাম রেযা (আ.) হলেন মহানবী (সা.)-এর বংশধর। যেমনটা হাকিম নিশাবুরি শাফেয়ী এ প্রসঙ্গে ইশারা করে বলেন : আলী ইবনে মূসা আর-রেযা (আ.)-এর একটি বড় গৌরব ও মর্যাদা হলো এটা যে, তিনি হলেন মহানবী (সা.)-এর বংশধর এবং এ বিষয়টি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকিদা-বিশ্বাসের অংশ। হিজাজের সকল ফকীহ এ ব্যাপারে একমত। যারা এ কথার সাথে ভিন্ন মত পোষণ করে, তারা কোরআন ও সুন্নাহর বিরোধিতায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং সত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে। আর কিয়ামত পর্যন্ত বেহেশতের যুবকদের সম্রাটদ্বয় সম্পর্কে বিদ্বেষ ও শত্রুতা পোষণ করলো।

কুনিয়াত ও লকব
এ মহান ইমামের নাম ‘আলী’ এবং আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিতে তিনি মহানবী (সা.)-এর আহলে বাইতের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি, যাঁর নাম ইমাম আলী (আ.) ও ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর পরে ‘আলী’ রাখা হয়। আর তাঁর কুনিয়াত হলো আবুল হোসাইন। স্বয়ং তাঁর পিতা ইমাম মূসা কাযিম (আ.)ও এ মর্মে বলেন : ‘আমার পুত্রের কুনিয়াত আর আমার কুনিয়াত একই।’
গিয়াসউদ্দীন শাফেয়ী ওরফে খন্দে আমীর বলেন : ‘তিনি অনেক লকবের অধিকারী’। যথা : রেযা, হাশেমী, আলাভী, হোসাইনী, কারাশী, মাদানী , ওয়ালী, হাফী, সাবের, যাকি, কায়িম । এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ লকবটি হলো ‘রেযা’।
‘রেযা’ লকবটি কার দেওয়া?
‘রেযা’ লকবটি কে ইমামকে দেন এবং এর অর্থ কী-
আহলে সুন্নাতের একদল লোক খলিফা মামুনকেই ‘রেযা’ লকবের মূল নামকরণকারী বলে মনে করেন। অর্থাৎ যখন মামুন ২০১ হিজরিতে যুবরাজের পদ ইমামের ওপর চাপিয়ে দেন, তখন ইমামকে ‘রেযা’ লকবটি প্রদান করেন। কিন্তু ইমাম মুহাম্মাদ তাকী (আ.) থেকে বর্ণিত আহমাদ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে নাস্র বাযানতির রেওয়ায়াতে এ বিষয়টি অস্বীকার করা হয়েছে। সেখানে এভাবে বর্ণিত হয়েছে :
ইবনে আবি নাস্র বাযানতি ইমাম মুহাম্মাদ তাকী (আ.)-এর কাছে আরয করেন, আপনাদের কতিপয় বিরোধী লোক ধারণা পোষণ করে যে, মামুন ‘রেযা’ লকবকে যুবরাজের পদ গ্রহণ করার বিপরীতে আপনার পিতাকে প্রদান করেছেন! ইমাম মুহাম্মাদ তাকী (আ.) উত্তরে বলেন : ‘আল্লাহর শপথ! তারা মিথ্যা বলছে। মহান আল্লাহ ‘রেযা’ লকবটি এ কারণে আমার পিতাকে প্রদান করেছেন যে, তাঁর সপক্ষের ও বিপক্ষের সকলেই তাঁর প্রতি রাযি (সন্তুষ্ট) ছিল…।’
আবার, জুওয়াইনী শাফেয়ী এবং আবদুর রহমান জামি হানাফি এর ন্যায় আহলে সুন্নাতের কেউ কেউ এ অর্থই গ্রহণ করেছেন। অন্যরা আবার এ বিষয়টিকে এভাবে কবিতার ছন্দে বেঁধেছেন :
ইমাম আলী নামটি উচ্চ বংশমর্যাদার আজমের আশ্রয় যিনি, আরবের নেতা
তাঁর থেকে সন্তুষ্ট থাকুন জগৎ স্রষ্টা তাই তো তাঁর লকব হয়েছে ‘রেযা’।

পিতামাতা
তাঁর মহান পিতা হলেন হযরত মূসা ইবনে জাফর, ইমাম কাযিম (আ.)। তবে তাঁর প্রিয় মাতার নাম নিয়ে মতপার্থক্য বিদ্যমান।
ইমামের মাতা ছিলেন একজন কানিজ (দাসী), যাঁর বিভিন্ন নাম বর্ণিত হয়েছে। যথা: সাকিনা , আরওয়া , খিযরান মুরাইসিয়াহ নাজমাহ্ । আর তাঁর লকব ‘শাকরাউন নাউবিয়্যাহ’ অথবা ‘উম্মুল বানিন’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, মুহাম্মাদ খাজা পরসায়ে বুখারী হানাফী ইমাম রেযা (আ.)-এর মায়ের প্রশংসায় এবং এ মহীয়ষী নারীর আধ্যাত্মিক মর্যাদার কথা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন : ‘তাঁর (্ইমামের) শ্রদ্ধেয়া মাতা আজমের সম্ভ্রান্তদের মধ্য থেকে ছিলেন এবং বুদ্ধিমত্তা ও ধর্মভীরুতার দিক থেকে তিনি ছিলেন তাঁর যুগের নারীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম।’
ইমাম রেযা (আ.)-এর জন্ম
ইমাম রেযা (আ.) মদীনায় ইমাম সাদিক (আ.)-এর শাহাদাতের এক বছর পরে শুক্রবারে ভূমিষ্ঠ হন। তাঁর জন্মের সন ও মাস সম্পর্কে মতপার্থক্য রয়েছে। কেউ কেউ তাঁর জন্মের সন ১৪৩ হি. ,১৪৮ হি. , ১৫১ হি. , ১৫৩ হি. আবার কেউ কেউ তাঁর জন্মের তারিখ ৬, ৭ অথবা ৮ শাওয়াল বলে উল্লেখ করেছেন।
ইমাম রেযা (আ.)-এর জন্মগ্রহণ সম্পর্কে বিভিন্ন বিস্ময়কর ঘটনাবলি আহলে সুন্নাতের গ্রন্থসমূহে বর্ণিত হয়েছে।
ইমাম (আ.)-এর ওফাত নাকি শাহাদাত?
ইমাম রেযা (আ.)-এর শাহাদাতের তারিখ নিয়ে অনেক মতপার্থক্য রয়েছে। যেমন:
-শনিবার, ২০৩ হিজরির সফর মাসের শেষ ভাগে, আব্বাসী খলিফা মামুনের খেলাফত কালে। (আধিকাংশ আহলে সুন্নাতের মত অনুসারে)
– পহেলা সফর, ২০৩ হিজরি।
– শাবে জুমআ (বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত), রমযান মাস, ২০৩ হিজরি।
– ৫ যিলহজ, ২০৩ হিজরি।
– ১৩ জিলকদ, ২০৩ হিজরি।
– ২০২ হিজরি।

ইমাম রেযা (আ.) আনুমানিক পঞ্চাশ বছর বয়সে শাহাদাতবরণ করেন। অবশ্য, তাঁর শাহাদাতের সময়ে সঠিক বয়স কত ছিল তা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। কেউ কেউ লিখেছেন ৪৪ বছর, আবার কেউ কেউ ৪৭, ৪৯, ৫০ ও ৫৩ বছরই ইমামের শহীদ হওয়ার বয়স বলে উল্লেখ করেছেন।
ইমাম রেযা (আ.) আব্বাসী খলিফা মামুনের আমলে তূস নগরীর নওকন এলাকার অন্তর্গত ‘সানাবাদ’ নামক গ্রামে শাহাদাতবরণ করেন এবং মামুনের নির্দেশে খলিফা হারুনের কবরের পাশে সমাধিস্থ হন।
উল্লেখ্য, ইমাম রেযা (আ.) কীভাবে শহীদ হন এবং এ সম্পর্কে ইমামের ভবিষ্যদ্বাণী এবং তাঁর শাহাদাতের পর যেসব ঘটনা সংঘটিত হয়, সেসব ব্যাপারে বিস্ময়কর বিবরণ এসেছে।
আহলে সুন্নাতের আলেমগণের দৃষ্টিভঙ্গি
ইমাম রেযা (আ.) তাঁর পবিত্র জীবদ্দশায় বিভিন্ন অধ্যায়ে স্পষ্ট ঘোষণা করেছিলেন যে, ‘আমি বিষ প্রয়োগে নিহত ও বিদেশের মাটিতে সমাহিত হব’ এবং খলিফা মামুনকেই তাঁর হত্যাকারী বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন। আর এ কথাটি আহলে সুন্নাতের প-িতবর্গও বর্ণনা করেছেন। ড. কামিল মুস্তাফা শাইবী বলেন : ‘যেমনটা অধিকাংশ ঐতিহাসিকই অভিমত প্রকাশ করেছেন, ইমাম রেযা (আ.) বিষক্রিয়ায় দুনিয়া থেকে বিদায় নেন।’
কিন্তু, এসত্ত্বেও কেউ কেউ এ সত্য ঘটনাকে ধামাচাপা দিয়েছেন এবং অবাঞ্ছিত কিছু কথাবার্তা এ মর্মে বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম (আ.)-এর শাহাদাতের ঘটনাকে বিভিন্ন রূপে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করেছেন।
শাহাদাত পরিভাষাটি
একটি লক্ষণীয় বিষয় হলো হাকেম নিশাবুরি শাফেয়ী, ইবনে সাব্বাগ মালেকি এবং ফায্ল ইবনে রুযবাহান খুঞ্জি ইসফাহানি হানাফি ইমাম রেযা (আ.)-এর ওফাতের প্রসঙ্গে ‘শাহাদাত’ পরিভাষাটি ব্যবহার করেছেন।
হাকেম নিশাবুরি শাফেয়ী বলেন : ‘ইমাম রেযা (আ.) তূস নগরীর অন্তর্গত সানাবাদে শাহাদাতবরণ করেন…’
ইবনে সাব্বাগ মালেকি লিখেছেন : ‘ইমাম রেযা (আ.) শাহাদাতবরণ করেন…’
ফায্ল ইবনে রুযবাহান খুঞ্জি ইসফাহানি হানাফি বলেছেন : ‘অষ্টম ইমাম বিষক্রিয়ায় শাহাদাতবরণ করেন…’
কাজী বাহ্জাত আফেন্দী শাফেয়ী স্পষ্টতই ইমাম রেযা (আ.)-কে শহীদ বলে মনে করেন এবং মামুনকে ইমামের হত্যাকারী বলে ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেন : ‘মামুন ইমাম (আ.)-এর জ্ঞান ও হেদায়াতের আলো বিতরণ করা থেকে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। অবশেষে বিষপ্রয়োগে ইমামকে শহীদ করেন এবং তার এ ধৃষ্টতাপূর্ণ কাজ দ্বারা প্রমাণ করে দেন যে, ন্যায় ও অন্যায়, হক ও বাতিল এবং জ্ঞান ও অজ্ঞতা একত্রিত হবার নয়।’

পবিত্র হজের আধ্যাত্মিক দর্শন

ইসলামের একটি প্রধানতম রোকন হচ্ছে হজ্ব। কিছু নির্দিষ্ট শর্ত ও সামর্থ্য থাকা সাপেক্ষে প্রত্যেক মুসলমানের ওপর যিলহজ্ব মাসের প্রথম দশকে মক্কা শরিফে অবস্থিত মসজিদুল হারামে, আরাফাতের ময়দানে, মুজদালিফা ও মিনায় হাজির হয়ে কিছু আনুষ্ঠানিক ইবাদত-বন্দেগি পালন করতে হয় এবং এর নামই হজ, যা ইসলামের অন্যতম প্রধান ফরয।
হজ সর্বপ্রথম অনুষ্ঠিত হয়েছিল হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর সময়ে, মহানবী (সা.)-এর আগমনের অনেক আগে। তখন থেকেই হজ ও ওমরার বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা, যেমন ইহরাম পরিধান, সাফা ও মারওয়ার মাঝখানে দৌড়ানো, আরাফার ময়দানে উপস্থিত হওয়া, কাবাঘরের চারদিকে প্রদক্ষিণ করা বা তাওয়াফ, কাবাঘরের দেয়ালে স্থাপিত কালো পাথর-হাজরে আসওয়াদে চুমু দেয়া প্রভৃতির প্রচলন ছিল। মহানবী (সা.)-এর আগমনের পর যে হজ পালিত হচ্ছে তাতে আগের বিধানগুলোর সাথে মাত্র কয়েকটি ইসলামি শিক্ষার সংযোজন হয়েছে।

ইসলাম-পূর্ব জাহেলি যুগে আরবরা কাবাঘর তাওয়াফের সময় ‘লাব্বাইকা ইয়া লাত’, ‘লাব্বাইকা ইয়া উজ্জা’ ও ‘লাব্বাইকা ইয়া মানাত’ বলত। লাত, মানাত, ওজ্জা ছিল জাহেলি যুগে আরবদের পূজ্য প্রতীমা। প্রত্যেক গোত্র তাদের নিজস্ব পূজ্য প্রতীমাগুলোকে হজের সময় আহ্বান করত। যেখানে পূর্বে প্রতীমার নাম নিয়ে আহ্বান করা হয়েছে সেখানে ইসলামি যুগে ‘আল্লাহুম্মা’ পরিভাষা প্রতিস্থাপিত হয়েছে। ‘আল্লাহুম্মা’ অর্থ ‘হে আল্লাহ!’ এভাবে হজ্বের সময়কার আগের আহ্বান ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা’ হিসেবে পরিবর্তিত হয়। এর অর্থ ‘আমি হাজির হে আল্লাহ! আমি তোমার দরবারে হাজির।’ আরবরা সম্মানিত হারাম মাসে শিকার করা অবৈধ মনে করত। ইসলামের পয়গাম্বর (সা.) কেবল হজের দিনগুলোতে এবং ইহরাম অবস্থায় শিকার করা হারাম বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। আরবরা কখনো কখনো কাবাঘরের চারপাশে নগ্ন হয়ে তাওয়াফ করত। ইসলাম এই কাজটি হারাম ঘোষণা করে। তার পরিবর্তে হজের সময় ইহরাম অবস্থায় সেলাইবিহীন পোশাক পরিধান বাধ্যতামূলক সাব্যস্ত করে। জাহেলি যুগের আরবরা কুরবানির গোশত খাওয়া অপছন্দ করত, পয়গাম্বর (সা.) তা জায়েয সাব্যস্ত করেন।
মুসলমানরা মক্কা বিজয়ের পর এবং কুরাইশদের স্থাপিত ও পূজ্য মূর্তিগুলো অপসারণের পর সাফা ও মারওয়ার মাঝখানে সাঈ করা বা দৌড়ানো অপছন্দ করত। কেননা, এই দুই পাহাড়ের ওপর ইসলাম-পূর্ব যুগে দু’টি পাথরের মূর্তি স্থাপিত ছিল এবং ঐ যুগের হজ ও বায়তুল্লাহ যিয়ারতকারীরা ঐ দু’টি মূর্তির সান্নিধ্য অর্জন ও সেগুলোকে চুম্বন করার জন্য সাফা ও মারওয়ার মাঝখানে সাঈ করত। তবে হযরত মুহাম্মাদ (সা.) সাফা ও মারওয়ার মাঝখানে সাঈ করা জায়েয সাব্যস্ত করেন এবং কুরআন মজীদের ঘোষণা অনুযায়ী এ কাজ ইসলামের অন্যতম শায়ায়ের (নিদর্শন) বা ‘স্মারক বিধান’ বলে নির্ধারিত হয়।

হাজী কাকে বলা হবে
এমন ব্যক্তিকে হাজী বলা হবে, যিনি হজ সম্পাদন করার মধ্য দিয়ে নিজের ব্যক্তিসত্তার বিকাশে প্রতিবন্ধক আপদগুলো দূর করা এবং নিজের প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা আর সামাজিক নানা আকর্ষণের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সাধনার প্রান্তরে পরিভ্রমণ করেছেন। যিনি মনের স্বচ্ছতা ও শুদ্ধতা, পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব, ত্যাগ ও সৌজন্যবোধ প্রভৃতির পরিচর্যা করেন। যিনি একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যগামী জীবন সামনে নিয়ে চলেন। আল্লাহকেন্দ্রিক জীবন গড়ে তোলার সাধনা করেন। আধ্যাত্মিকতার শত্রু অবাধ্য নাফ্স ও শয়তানকে বর্জন করেন আর যুগের মুশরিক, যালিম ও তাগুতদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দেন এবং তাদের প্রতি ঘৃণা পোষণ ও প্রকাশ করেন। সবশেষে যিনি আল্লাহর রাহে নিজের প্রাণপ্রিয় বস্তু নিজের অস্তিত্ব পর্যন্ত বিসর্জন দেয়ার জন্য প্রস্তুত হন। তিনিই হলেন সত্যিকার অর্থে হাজী, আল্লাহর ঘরের যিয়ারতে জীবন ধন্য করার সাধনায় সফলকাম।

ইসলামে হজের দর্শন
ইসলামের দৃষ্টিতে পবিত্র হজে যে জীবনদর্শন নিহিত রয়েছে তা কুরআন মজীদের এই আয়াতের মধ্যে ফুটে উঠেছে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন : ‘আপনি মানুষের মাঝে হজের ঘোষণা শুনিয়ে দিন, তারা আপনার কাছে আসুক পদাতিকভাবে এবং প্রতিটি কৃষকায় বাহনে সওয়ার হয়ে, তারা আসবে দূর দূরান্ত পাড়ি দিয়ে।’ (সূরা হজ : ২৭)
পবিত্র দ্বীনে ইসলাম হচ্ছে নিখাদ একত্ববাদের ধর্ম। এক অদ্বিতীয় আল্লাহর ইবাদতই এই দ্বীনের বৈশিষ্ট্য। দ্বীন ইসলাম আল্লাহ ও বান্দার মাঝখানে কোনো শরীকের ধারণায় বিশ্বাস করে না। মুমিন মুসলমানরা এমন একজন আল্লাহর ইবাদত করে যিনি মানুষের দেখা বা উপলব্ধির ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন। মুসলমানদের অদ্বিতীয় খোদা কোনো ছবি যেমন নন, তেমনি কোনো প্রতিমাও নন। তিনি ভাস্কর্য নন বা দেহ ও অবয়বধারী নন। কেবল এমন ব্যক্তিই মহান আল্লাহর ইবাদত করতে সক্ষম যিনি সুউচ্চ চিন্তাধারার অধিকারী। যার নিয়্যত বা উদ্দেশ্য-লক্ষ্য ও ইচ্ছাশক্তি মজবুত আর আল্লাহ ছাড়া অন্য সবকিছু থেকে মুক্ত এবং কর্মক্ষেত্রে নিষ্ঠাবান ও নিঃস্বার্থ।
ইসলামের কোলে যারা প্রশিক্ষিত হয়েছে তারা উচ্চতর চিন্তাধারা, বিশ্বাসের স্বচ্ছতা ও কর্মনিষ্ঠায় এমন স্তরে উপনীত হয় যে, অন্য ধর্ম বা দার্শনিক মতবাদ মানুষকে এমনভাবে প্রশিক্ষিত ও দীক্ষা দানে সক্ষম হয় না।

পবিত্র ইসলাম তার অনুসারীদের শিক্ষা, সংশোধন ও দীক্ষা দানের জন্য কতিপয় সুন্দর বিধান ও আনুষ্ঠানিকতা প্রবর্তন করেছে। এর মধ্যে কিছু বিধান ইসলামের শক্তি ও ক্ষমতা এবং মর্যাদার প্রতীক হিসেবে পরিগণিত। এর মধ্যে প্রকৃষ্ট একটি বিধান হচ্ছে পবিত্র বায়তুল্লাহ শরীফের হজ। এটি ইসলামের অন্যতম স্মারক বিধানÑ যার জন্য নির্ধারিত কাজ, আনুষ্ঠানিকতা ও সময়ের সীমাবদ্ধতা আছে। আবার এসব অনুষ্ঠানও এককভাবে ইসলামের স্মারক বিধানের মর্যাদা রাখে। এগুলো এমন বিধান, যা শরীয়তের পরিভাষায় অন্তরের তাকওয়া ও কল্যাণের পরিচয় বাহক। যেমন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর নিদর্শনগুলোকে সম্মান করে তা তার অন্তরের তাকওয়ার পরিচায়ক। (সূরা হজ : ৩২) আল্লাহ পাক আরো ইরশাদ করেন : ‘যে আল্লাহর সম্মানিত নিদর্শনগুলোর প্রতি সম্মান দেখায় তা তার জন্য তার প্রভুর কাছে কল্যাণময়।’ (সূরা হজ : ৩০)

হজ তার সকল আহকাম ও আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে বান্দা ও তার প্রভুর মাঝখানে গভীর ও অকৃত্রিম সম্পর্কের নিদর্শন। আল্লাহ পাক এ ভূপৃষ্ঠের কোন কোন অংশকে বিশেষ মর্যাদা ও পবিত্রতার অধিকারী করেছেন। সেসব স্থানে আল্লাহর রহমত অবারিতভাবে বর্ষিত হয়েছে ও হচ্ছে। আল্লাহর পবিত্র সত্তার জালালিয়াতের প্রকাশ ঘটেছে অবিরত এবং সব মিলিয়ে আল্লাহর পরিচয় ও সান্নিধ্য লাভের নির্দশনস্থলে পরিণত হয়েছে। এসব কারণে এসব স্থানের সাথে মহান স্রষ্টার একান্ত ও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। ফলে মুমিন বান্দা যখন সেখানে যায় বা প্রবেশ করে সাথে সাথে দয়াময় আল্লাহর স্মরণে তাদের অন্তর জেগে ওঠে। সে স্থান দেখার সাথে সাথে তাদের শরীর কাঁপতে থাকে। আল্লাহর জালালিয়াতের তাজাল্লিতে তাদের দেহ-মন শিহরিত হয়।
বস্তুত হজ তার সকল আহকাম-আরকান নিয়ে মহান আল্লাহর নিরঙ্কুুশ আনুগত্য ও তাঁর সম্মুখে শর্তহীন ভাবে আত্মসমর্পণের পরিচয় বহন করে। যার ফলে হজের সময়ে হাজী নিজের কাছে কোন ইখতিয়ার বা স্বাধীনতা কিংবা স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি আছে বলে মনে করেন না। তিনি সর্বক্ষণ মক্কায়, মিনায়, আরাফাতে, মুযদালিফায় দৌড়ের মধ্যে থাকেন। কখনো কোথাও যাত্রাবিরতি করেন, আবার কোথাও আল্লাহর হুকুম পালনে তড়িঘড়ি তৎপর হন, রওয়ানা দেন। যখন মিনা থেকে রওয়ানা হন তখন মুযদালিফায় অবস্থান না করেই সরাসরি আরাফাত ময়দানের উদ্দেশে গমন করেন। আরাফাতে গিয়ে আল্লাহর দরবারে কায়মনোবাক্যে দোয়া ও বিনয়-কাকুতিতে নিরত হন। এভাবেই হজের যাবতীয় আহকাম ক্রমান্বয়ে আঞ্জাম দিয়ে যান।
হজে আল্লাহর সামনে দাসত্বের পরিচয় বাহক একটি সূক্ষ্ম বিষয় হলো আরাফার ময়দানে মাগরিবের সময় মাগরিবের নামায আদায় না করে মুযদালিফায় গিয়ে তা ইশার সময়ে একত্রে আদায় করা। কেননা, মহামহিম আল্লাহ এমনটি হুকুম দিয়েছেন এবং বান্দা তাঁরই হুকুম পালন করে দাসত্বের প্রমাণ রেখেছে। অর্থাৎ যিনি হজ পালন করেন তিনি আল্লাহর বান্দা ও দাস, নামায বা নিজের ইচ্ছানুযায়ী কোনো ইবাদতের দাস নন।

হজের আকর্ষণীয় আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, নিষ্কলুষ অন্তরের লাখো মুমিন-মুসলমানের বিশাল ও প্রাণবন্ত সমাবেশ। সারা দুনিয়া থেকে আগত স্বচ্ছ অন্তর, নিষ্ঠাপূর্ণ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য পোষণকারী লাখো মানুষ একস্থানে সমবেত হয়। তাদের এই জমায়েতের মধ্যে কেয়ামতের দিন সমস্ত মানুষ আল্লাহর দরবারে হাজির হওয়ার একটি ছোট্ট দৃশ্যপট উপস্থাপিত হয়।
হযরত ইমাম আহমদ ইবনে আব্দুর রহীম যিনি শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলাভী নামে পরিচিত তিনি হজের মহাসমাবেশের দর্শন সম্পর্কে বলেন, হজের হাকীকত হচ্ছে ইসলামি উম্মাহর নেককার বান্দাদের একই সময়ে এমন এক স্থানে উপস্থিত হওয়া, যে স্থান আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত ও নিষ্কলুষ হৃদয়ের বান্দাদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তাঁরা ছিলেন আল্লাহর নবী, সিদ্দীক, শহীদ ও সালেহ বান্দাগণ। তাঁরাও আল্লাহর স্মারক বিধানগুলোর প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও মর্যাদা দানের জন্য যুগে যুগে এ স্থানে সমবেত হয়েছিলেন। তাঁরাও একক অদ্বিতীয় আল্লাহর রহমতের আশ্রয় পাওয়া ও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের বাসনায় এখানে ইবাদত-বন্দেগি, কান্নাকাটি ও দোয়ায় রত হয়েছিলেন। এমন এক স্থানে এমন অনুভূতি নিয়ে আল্লাহর সামনে যদি মানুষ হাজির হয় এবং নিজের মিনতি প্রকাশ করে তাহলে আল্লাহর রহমতের সাগরে জোয়ার আসবে না, আল্লাহর অপার রহমতের মধ্যে শামিল হবে না- এমন ধারণা করা নিশ্চয়ই অন্যায় হবে।

হজের মানাসিক ও আনুষ্ঠানিকতা
হজের মানাসিকের মধ্যে শামিল রয়েছে পবিত্র কাবাঘরের তাওয়াফ, সাফা ও মারওয়ার মাঝখানে সাঈ, আরাফাতের ময়দানে অবস্থান, মুযদালিফায় রাত্রি যাপন, জামারায় শয়তানকে পাথর মারা, কুরবানি করা, মাথা কামানো বা চুল ছোট করা, মিনায় রাতে অবস্থান করা। এসব বিধানের প্রতিটির জন্য নির্দিষ্ট দিনক্ষণ, স্থান, পরম্পরা ও পরিমাণ নির্ধারিত আছে।
হজের সকল হুকুম পালনের মধ্য দিয়ে এর এমন মহত্ত্ব ও মহিমা উদ্ভাসিত হয়, যা বর্ণনা করা শব্দ বা বাক্যের আওতায় আসে না, সম্ভব নয়। বরং একে উপলব্ধি করার জন্য সেই নূরানি স্থানে হাজির হতে হবে। এর হুকুম-আহকাম পালনের সঙ্গে একাত্ম হতে হবে। সেসব পবিত্র স্থানে গিয়ে আল্লাহর কাছে বান্দার দাসত্বের কপাল ঠেকাতে হবে। হৃদয় নিংড়ানো কান্না ও চোখের অশ্রু দিয়ে সেসব স্থান ভিজাতে হবে।
হজের আধ্যাত্মিক ও ইরফানি আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে ময়দানে মাহশারে সমবেত হওয়া এবং অদ্বিতীয় আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হওয়ার দৃশ্যপট ফুটে ওঠে। এই আনুষ্ঠানিকতায় রাজা ও প্রজা, ফকির ও আমির, বৃদ্ধ ও তরুণ, আরোহী ও পদাতিক, কালো ও সাদা, আরব ও অনারব সবাই একাকার হয়ে যায়। দুই টুকরা সিলাইবিহীন কাপড়, খালি মাথা, ক্রন্দনরত চোখ নিয়ে এক আসমানের নিচে, একই প্রান্তরে উন্মুক্ত আকাশ পানে দু’হাত তুলে হাজীরা ফরিয়াদ জানান। আপন হাকিকী মাবুদ ও প্রভুর সম্মুখে হাজির হওয়ার তীব্র অনুভূতি ও আনন্দে দোয়া, কান্না ও হৃদয় উজাড় করা প্রার্থনার মাধ্যমে আল্লাহর মাগফিরাত, গুনাহ থেকে মুক্তি ও রহমত লাভের জন্য নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করে দেন। কেউ সিজদায়, কেউ রুকুতে, কেউ দ-ায়মান অবস্থায় আর কেউ নামাযে দীর্ঘ সূরা তেলাওয়াতের মাধ্যমে কিংবা কেউ কুরআন তেলাওয়াতে মনোনিবেশ করে অন্তরের মরিচা ও কালিমা দূর করার সাধনায় নিবেদিত থাকেন। অন্তরের মরিচা মুছে ফেলে অলসতা ও অবহেলা ঝেড়ে ফেলে নিজের আসল সত্তাকে জাগ্রত করেন। তাঁরা আল্লাহর দরবারে সিজদায় লুটে মহান রাব্বুল আলামীনের সান্নিধ্যের চেতনায় বিগলিত হন।

হজের দর্শন ও কতিপয় হিকমত
ইহরামের কাপড় পরিধানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় হজের আনুষ্ঠানিকতা। ইহরামের এই কাপড়ই মানুষের সামনে হজের সবচেয়ে বড় শিক্ষাটি তুলে ধরে। রাজা-বাদশাহ থেকে নিয়ে ফকির-দরিদ্র, শাসক, শাসিত, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, জ্ঞানী-মনীষী, গবেষক, রাজনীতিবিদ, আলেম, জাহেল অর্থাৎ সর্বস্তরের যেকোনো মানুষই পবিত্র হজে যাওয়ার নিয়্যত করবে প্রথম প্রস্তুতিতে তাকে একই ধরনের কাপড় পরিধান করে বের হতে হবে। সেলাইবিহীন দু’টুকরা কাপড়। এখানে কেউ দামী কিংবা বড়ত্ব প্রকাশের পোশাক পরিধান করতে পারবে না। যারা গরীব, যাদের কাপড় জীর্ণশীর্ণ, তাদের সামনে বেশভূষা নিয়ে বাহাদুরি প্রকাশের অনুমতি কারো নেই। এখানে সবাই এক সমান। বাহ্যিকভাবে কারো কোনো ফযিলত বা বিশেষত্বের অবকাশ নেই। এখানে প্রদর্শনী হলো ঈমানের স্তর, তাকওয়া, আল্লাহর ভালোবাসা ও প্রবল ঈমানি উদ্দীপনার, যা প্রতিটি মুমিনের অন্তর্জগতে বিরাজমান।
যে ব্যক্তি যে পরিমাণ বা যে মানে উচ্চতর ঈমান ও তাকওয়ার অধিকারী হবে সে সে পরিমাণেই হজের ফযিলত ও হজের আহকামগুলো পালন করার স্বাদ ও মজা অনুভব করতে পারবে। ঠিক সে পরিমাণেই আল্লাহর মারেফাত ও সান্নিধ্য অর্জনের সৌভাগ্যে আপ্লুত হতে পারবে। এসব দৃশ্য ও বৈশিষ্ট্য মানুষের সামনে বৃহত্তম সেই হজ অর্থাৎ কেয়ামত দিবসের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
আরাফাতের ময়দানের আহাজারি, সেখানে হৃদয় বিগলিত আকুতিতে দোয়া, পৃথিবীর সকল স্থান হতে সমবেত হওয়া, আল্লাহর দরবারে নিজের গুনাহর কথা স্মরণ করে রোনাজারি, আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমা লাভের জন্য একাগ্র প্রার্থনা ও নিবেদনে মানুষ এমনই আত্মমগ্ন হয় যে, নিজের আশেপাশে কে বা কারা আছে সে কথাও ভুলে যায়। এই দৃশ্যপট কেয়ামতের ময়দানের সমাবেশের সাথে খুবই সাদৃশ্যপূর্ণ। কেননা, তখনো মানুষ নিজের কর্মজীবনের হিসাব-নিকাশ নিয়ে আল্লাহর আদালতের সামনে বিচলিত অবস্থায় থাকবে। প্রত্যেকের একমাত্র আহাজারি থাকবে : ইয়া নাফ্সি! ইয়া নাফ্সি! হায় আমার কী অবস্থা হবে, হায়! আমার কোন্ গতি হবে! তখন নিজের হিসাব-কিতাব, ভবিষ্যৎ পরিণতি ছাড়া আর কোনো চিন্তাই কারো মাথায় থাকবে না।

হাশরের দিন কেয়ামতের ময়দানে মানুষ কোনোরূপ দুনিয়াবি সহায়-সম্পদ ব্যতিরেকে খালি হাতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে হাজির হবে। সেদিন যে জিনিসটি মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করবে তা হচ্ছে, কোনো ধরনের র্শিক ও গুনাহ থেকে মুক্ত, পবিত্র, নির্মল ও স্বচ্ছ অন্তর। কুরআন মজীদে এ কথাই ইরশাদ হয়েছে :
‘যেদিন কোনো সম্পদ বা সন্তান-সন্তুতি কোনো উপকারে আসবে না, তবে যে ব্যক্তি স্বচ্ছ অন্তর নিয়ে আল্লাহর সমীপে হাজির হবে সে-ই হবে সফলকাম।’ (সূরা শোয়ারা : ৮৯)
যার অন্তর যতখানি পবিত্র, নির্মল ও কলুষমুক্ত হবে আল্লাহ তা‘আলার দরবারে সে হবে ততই সম্মানিত এবং বেহেশতের সর্বোচ্চ মাকাম হবে তার জন্য নির্ধারিত।

পবিত্র হজের মধ্যে মুসলমানদের জন্য অপর যে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটি রয়েছে তা হলো, প্রাত্যহিক জীবন পরিচালনার শিক্ষা। অর্থাৎ জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ও জীবনকাল কীভাবে অতিবাহিত করতে হবে তার শিক্ষা। হজ হচ্ছে সময়ের নির্দিষ্ট ছকের মধ্যে কতিপয় আমল ও ইবাদত ঠিকভাবে আঞ্জাম দেয়ার নাম। অর্থাৎ প্রত্যেকটি কাজ তার জন্য নির্ধারিত সময়ে ও স্থানে আদায় করতে হবে এবং হজের দিনগুলো থাকতে থাকতেই সমস্ত হুকুম আঞ্জাম দিতে হবে। চিন্তা করলে মানব জীবনের গতিধারাও এটিই। আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে একটি সীমিত ও নির্ধারিত সময় দিয়েছেন। এই সংক্ষিপ্ত সময় সর্বোত্তম পন্থায় ব্যবহার করতে হবে। পরকালীন জীবনের শান্তি, সুখ ও সৌভাগ্যের জন্য ইহকালীন জীবনের সুযোগকে সঠিক খাতে ও সর্বোত্তম পন্থায় কাজে লাগাতে হবে। চিন্তা করলে দেখা যাবে হজের মধ্যে জীবন পরিচালনার এই প্রশিক্ষণ অত্যন্ত সুন্দর ও যতেœর সাথে সম্পন্ন হচ্ছে।

হজের মধ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ও সূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ইসলামের সকল হুকুমের সার-নির্যাস অতি সংক্ষেপে হজে সন্নিবেশিত ও একীভূত পাওয়া যায়। তাওহীদ, নামায, রোযা, যাকাত, জিহাদ, যিক্র ও তাসবীহ হজের মধ্যে সুন্দর বিন্যাসে শামিল রয়েছে। নামাযের ফরয আদায়ের সময় যে কাজটি করতে হয় তা হলো শারীরিক ও আত্মিক তৎপরতা। যাকাতের প্রতীকী রূপ হচ্ছে আল্লাহর রাস্তায় অর্থ ব্যয় করা। ক্ষুধা, তৃঞ্চা, নাফ্সের কামনা-বাসনা থেকে বিরত থাকা প্রভৃতি হচ্ছে রোযার প্রতীকী অনুশীলনের নাম। সাফা-মারওয়ার মাঝখানে যেভাব দৌড়াতে হয় এবং জামারায় শয়তানকে পাথর মারার যে ইবাদত তাকেও জিহাদের প্রতীকী রূপ হিসেবে সাব্যস্ত করা যায়। মোটকথা ইসলামে এমন কোনো ইবাদত ও আনুষ্ঠানিকতা নেই পবিত্র হজের মধ্যে যার নিদর্শন ও অনুশীলন খুঁজে পাওয়া যাবে না।

হজে এভাবে ইসলামের যাবতীয় ইবাদতের প্রতীকী আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে বিরাট শিক্ষা রয়েছে। একটু আগে যেমন আমরা উল্লেখ করেছি, মানুষের জীবন-প্রণালির সঙ্গে হজের সাদৃশ্য প্রচুর। হজের সময় আল্লাহর সকল আদেশ নিষেধ যেমন বিনা বাক্য ব্যয়ে পালন করতে হয়, তেমনি মানুষের গোটা জীবনযাত্রাও আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালনের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করতে হবে। হজের মধ্যে যেভাবে ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা’ আহ্বান অসংখ্যবার বলতে হয়, যার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর তাওহীদের স্বীকৃতি দেয় এবং বিশ্বপালক মহান প্রভুর প্রতি পূর্ণ আনুগত্যের ঘোষণা দেয়, তেমনি প্রতিটি মুসলমানকে তার দীর্ঘ জীবনব্যাপী ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা’ ধ্বনির বাস্তব চিত্র কর্মজীবনের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে হবে।

হজের মানাসিকের আরেকটি অনুষঙ্গ হলো জামারায় পাথর মারা। এই পাথর মারার সময় যদিও মূল লক্ষ্য একটি পাথরের স্তম্ভে পাথর কণা নিক্ষেপ করা; কিন্তু এর মধ্যেও বহু হিকমত ও দর্শন নিহিত রয়েছে। প্রথম হচ্ছে, এই আমলটি একথার প্রমাণ বহন করে যে, মুসলমানরা আল্লাহ তা‘আলা ও আল্লাহর রাসূল সাইয়্যেদুল মুরসালীন (সা.)-এর আদেশের সামনে শর্তহীন আনুগত্য প্রদর্শন করে। দ্বিতীয়ত, এই জামারার তিনটি স্তম্ভ আল্লাহর মহান পয়গাম্বর হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর জীবনের স্পর্শকাতর কয়েকটি মুহূর্তের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। হযরত ইবরাহীম (আ.) আল্লাহর হুকুম পালন করার উদ্দেশ্যে প্রতিশ্রুত স্থানের দিকে যাচ্ছিলেন, তখনই শয়তান তাঁর সামনে আত্মপ্রকাশ করে এবং নানা প্ররোচনা দিয়ে ইবরাহীম (আ.)-কে তাঁর কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা চালায়। কিন্তু হযরত ইবরাহীম (আ.) তার দিকে পাথর নিক্ষেপ এবং মহান শক্তিমান আল্লাহর কাছে শয়তানের অনিষ্ট হতে আশ্রয় প্রার্থনা করে শয়তানের দুরাচার দমন করেন। এই ঘটনা এ কথার সাক্ষ্য বহন করে যে, শয়তান জীবনভর মানুষের পেছনে লেগে আছে এবং মানুষকে গোমরাহ করার জন্য হরদম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। কাজেই প্রত্যেক মানুষকে যেভাবে যে পন্থায়ই হোক শয়তানকে নিজের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে হবে। কোনো অবস্থাতেই শয়তানের ধোঁকার শিকার হওয়া যাবে না। তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে, জামারায় পাথর নিক্ষেপের কাজটি হজের অন্য আমলের চাইতে বেশি মাত্রায় পালন করা হয়। কেননা, এ কাজটি আঞ্জাম দেয়ার জন্য হজযাত্রীকে টানা তিনদিন মিনায় অবস্থান করতে হয় এবং পরপর তিনদিন শয়তানকে পাথর মারতে হয়। বিষয়টি যে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ এ কাজ তার প্রমাণ বহন করে। অর্থাৎ প্রত্যেক মানুষের দীর্ঘ জীবনব্যাপী মানব ও দানব শয়তানের হাত থেকে আত্মরক্ষা করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ এবং এর প্রতি কোনো অবস্থাতেই মানুষের সামান্যতম অবহেলা প্রদর্শন উচিত নয়। এই চেতনাকে জাগরুক রাখা ও শিক্ষা দানের নিমিত্তে আল্লাহর জন্য ইবরাহীম (আ.)-এর সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের ঐতিহাসিক স্থান মিনায় প্রত্যেক হাজীকে জামারায় অর্ধ শতাধিক পাথর নিক্ষেপ করতে হয়।

মোটকথা হচ্ছে হজের প্রতিটি হুকুমের মধ্যে রয়েছে বহুবিধ হিকমত ও জীবন দর্শন। এগুলোর পূর্ণ বিবরণ দেয়া কারো পক্ষে সম্ভব নয়। তবে সংক্ষেপে বলা যায় যে, পবিত্র হজের আনুষ্ঠানিকতা হচ্ছে মানুষের দুনিয়ার জীবন, কবরের জীবন, হাশরের ময়দানে উপস্থিতি, হিসাব-কিতাব ও রোজ কিয়ামতের দৃশ্যপটের ক্ষুদ্র পরিসরে প্রদর্শনী।

সম্পাদকীয়

ইমাম আলী রেযা (আ.) ও হযরত মাসুমা (আ.)-এর জন্ম বার্ষিকী : কারামাতের দশ দিবস
১৪ আগস্ট আহলে বাইতের জ্যোতির্ময় অষ্টম ইমাম আলী রেযা (আ.)-এর পবিত্র জন্মবার্ষিকী। আর ৪ঠা আগস্ট মহানবী (সা.)-এর আহ্লে বাইতের (আ.) বংশধারায় মহিয়সী নারী হযরত ফাতেমা মাসুমা (সালামুল্লাহি আলাইহা)-এর জন্মবার্ষিকী। বিশ্বব্যাপী নবীপ্রেমিক ও আহলে বাইতের অনুসারীরা এ মহান দুই ব্যক্তিত্বের জন্মদিবসের মাঝের দশদিন ‘কারামাতের দশ দিবস’ হিসেবে উদ্যাপন করেন। এছাড়া হযরত মাসুমা (আ.)-এর জন্মদিবসটি কন্যাসন্তানদের প্রতি ইসলাম প্রদত্ত যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা প্রদানের লক্ষে ইসলামি ইরানে কন্যাদিবস হিসেবে পালিত হয়। একই সাথে এ দিনটি ইরানে ইসলামি মানবাধিকার দিবস ও মানবতা দিবস হিসেবেও পালিত হয়ে থাকে।
হযরত মাসুমা ছিলেন নবীবংশের সপ্তম ইমাম হযরত মূসা কাযেম (আ.)-এর কনিষ্ঠতমা কন্যা ও হযরত ইমাম রেযা (আ.)-এর বোন। তিনি শৈশব থেকেই ছিলেন ব্যতিক্রমধর্মী উন্নততর দ্বীনী ও মানবিক গুণাবলির অধিকারিণী এবং দ্বীনী ইল্মে পারদর্শিনী। এ কারণে তিনি মাসুমা (নিষ্পাপ মহিলা) হিসেবে সুপরিচিত হন।
ইসলামের ইতিহাসে আহ্লে বাইতের ধারাবাহিকতায় খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতেমা যাহ্রা (আ.) ও তাঁর বিপ্লবী কন্যা কারবালার নেত্রী হিসেবে খ্যাত হযরত যায়নাব (সা. আ.)-এর পরে তৃতীয় যে মহীয়সী নারী সর্বাধিক খ্যাত ও স্মরণীয় এবং যাঁকে কেন্দ্র করে বিস্তার লাভকৃত ক্বোম নগরীতে গড়ে ওঠা দ্বীনী জ্ঞানগবেষণার আন্দোলন দীর্ঘ বার শ’ বছর পরে এক মহাবিপ্লব সৃষ্টি করে তিনি হলেন হযরত মাসুমা।
হযরত মূসা কাযেম (আ.)-কে স্বৈরাচারী আব্বাসী সরকারের কারাগারে বিষ প্রয়োগে শহীদ করা হলে হযরত ইমাম রেযা (আ.) ইমামতের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ইতিমধ্যে হারূনুর রশীদের মৃত্যুর পর আমীন খলীফা হলে তার সৎভাই মামুন ও তার মধ্যে যুদ্ধ বেধে যায়। এতে আমীন নিহত হয় ও মামুন খলীফা হয়। মামূন তার রাজধানী বাগদাদ থেকে মার্ভে (তৎকালে ইরানের খোরাসানভুক্ত ও বর্তমানে তুর্কমেনিস্তানভুক্ত) স্থানান্তরিত করে। আমীনের সমর্থকদের হাত থেকে নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে মামুন আহ্লে বাইতের অনুসারীদের স্বীয় সমর্থকে পরিণত করার লক্ষ্যে হযরত ইমাম রেযা (আ.)-কে পত্র লিখে তাঁকে মার্ভে গিয়ে খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য দাওআত করে। হযরত ইমাম (আ.) জানতেন যে, একটি স্বৈরাচারী প্রশাসনের শীর্ষপদ গ্রহণ করে ইসলামি হুকুমাত প্রতিষ্ঠা তো সম্ভবই নয়, অধিকন্তু এতে আহ্লে বাইতের পবিত্র চেহারায় মিথ্যা কলঙ্ক লেপন করা হবে। তাই তিনি এ দাওআত প্রত্যাখ্যান করেন। তখন মামুন তাঁকে যুবরাজের পদ গ্রহণের জন্য দাওআত করে এবং তাঁকে ‘নিরাপত্তা দিয়ে’ নিয়ে যাওয়ার জন্য দেহরক্ষীদল পাঠিয়ে দেয়। তাই তিনি বাধ্য হয়ে মার্ভে চলে যান এবং কোনো প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণ না করার শর্তে স্রেফ একটি আনুষ্ঠানিক পদ হিসেবে যুবরাজের পদ গ্রহণে সম্মত হন।
এ ঘটনার ফলে সাময়িকভাবে হলেও বিশেষ করে খোরাসানে আহ্লে বাইতের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরি হয়। তাই ইমাম রেযা (আ.) তাঁর ভাই-বোনদেরকে খোরাসানে চলে আসতে বলেন। এ ছাড়াও আহ্লে বাইতের ভক্ত-অনুরক্তদের অনেকেই খোরাসানের পথে রওয়ানা হন। কিন্তু অচিরেই মামুনের ষড়যন্ত্রে ইমাম রেযাকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হয়; এ খবর পৌঁছলে আহ্লে বাইতের সদস্যগণ ও তাঁদের অনুসারিগণ যে যেখানে পৌঁছেছিলেন সেখানেই স্থায়ীভাবে যাত্রাবিরতি করেন।
হযরত মাসুমা তাঁর কয়েক ভাই সহ মার্ভের উদ্দেশে রওয়ানা হন, কিন্তু ইরানের সভেহ্ নগরীতে পৌঁছে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ক্বোমে যাবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন। তখন ক্বোম থেকে আহ্লে বাইতের কয়েক জন ভক্ত-অনুসারী গিয়ে তাঁদেরকে ক্বোমে নিয়ে আসেন। (সেখানে তিনি ১৭ দিন পর ২০১ হিজরির আটই শা‘বান ইন্তেকাল করেন।)
হযরত মাসুমা ছিলেন ইসলামের ইতিহাসের এক অনন্যসাধারণ মহীয়সী নারী যাঁকে কেন্দ্র করে ক্বোম নগরী একটি ধর্মীয় নগরী ও দ্বীনী জ্ঞানগবেষণার নগরী হিসেবে ব্যাপক বিকাশের অধিকারী হয় এবং তাঁর আগমনের বারো শতাব্দী পরে এ নগরী থেকে সূচিত ইসলামি বিপ্লবের ফলে ইরানের বুকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
আমরা হযরত ইমাম আলী রেযা (আ.) ও হযরত মাসুমা (সা. আ.)-এর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সকলকে, বিশেষত মুসলিম উম্মাহ্কে মোবারকবাদ জানাচ্ছি।
হিজাব ও সতীত্ব দিবস
প্রতি বছর ১১ই আগস্ট ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে হিজাব ও সতীত্ব দিবস পালিত হয়। এ দিনে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে নারী সমাজকে সঠিকভাবে ইসলাম নির্দেশিত হিজাব ও সতীত্ব বজায় রাখার জন্য উৎসাহিত করা হয়।
বস্তুত ইসলামের দৃষ্টিতে হিজাব ও সতীত্ব হচ্ছে নারীর সম্মান, সম্ভ্রম ও মর্যাদার প্রতীক। হিজাব নারীদের স্বাধীনভাবে চলাফেরা ও কর্মতৎপরতার পথে বাধা তো নয়ই, বরং সহায়ক এবং তাদের মর্যাদার প্রতীক সতীত্ব বজায় রাখার জন্য রক্ষাকবচ।
কোরআন মজীদের আলোকে নারীর জন্য ঘরের বাইরে চেহারা, হাতের কব্জির বাইরের অংশ ও পায়ের গিঁটের নিচের অংশ ব্যতীত পুরো শরীর ঢেকে রাখা ফরয। এতে বাধাদান ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ মাত্র এবং তা নিন্দনীয়।
আমরা হিজাব ও সতীত্ব দিবস উপলক্ষে বিশ্বের সকল নারীর প্রতি তাঁদের স্বকীয় সম্মান ও মর্যাদার স্বার্থেই হিজাবসম্মত পোশাক পরিধান করার এবং সমাজে উন্নত নৈতিকতার বিকাশে সক্রিয় ভূমিকা রাখার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।

স্মরণীয় বাণী

মহানবী (সা.) বলেন : আল্লাহ্ তাকে ভালোবাসেন যে তাঁর পথে উদারভাবে দান করে।

মহানবী (সা.) বলেন : দু’টি ব্যাপারে অসংখ্য মানুষ ধোঁকা খেয়ে থাকেÑ সুস্থতা আর অবসর। (অর্থাৎ এগুলোর সদ্ব্যবহার করে না।)

মহানবী (সা.) বলেন : ইবাদতের সাতটি অঙ্গ। তন্মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলো হালাল রুজি অর্জন করা।

মহানবী (সা.) বলেন : যে ব্যক্তি ইচ্ছামতো খায়, ইচ্ছামতো পরিধান করে আর ইচ্ছামতো বাহনে আরোহণ করে, আল্লাহ্ তার ওপর অনুগ্রহের দৃষ্টি ফেলেন না যতক্ষণ না সে তা হারায় কিংবা বর্জন করে (এবং তওবা করে)।

মহানবী (সা.) বলেন : আল্লাহ্ দু’টি স্বরকে ঘৃণা করেন : বিপদের সময় চিৎকার করে কান্নাকাটি করা আর নেয়ামত লাভ ও খুশির সময় বাঁশি বাজানো (গান-বাজনা করা)।

ইমাম আলী (আ.) বলেন : মুমিনের জন্য তিনটি সময় থাকে। একটি সময়ে সে স্বীয় প্রতিপালকের সাথে মনের কথা বলে, আরেকটি সময়ে সে আত্মবিশ্লেষণ করে আর অন্য সময়টিতে সে হালাল এবং উত্তম আনন্দে মাতে। বুদ্ধিমানের তিনটি কাজে উদ্যমী হওয়া সাজে : জীবিকা অর্জন, পরকালের জন্য পদক্ষেপ আর হালাল জিনিস ভোগ করা।

ইমাম আলী (আ.) বলেন : দয়াবান দয়া প্রদর্শনে নমনীয় হয় আর হীন লোক দয়া প্রদর্শনে কঠিন হয়।

ইমাম আলী (আ.) বলেন : তোমার বন্ধুর শত্রুর সাথে বন্ধুত্ব কর না, এতে তোমার বন্ধুর প্রতি শত্রুতা করা হবে।

ইমাম আলী (আ.) বলেন : যে ব্যক্তি দুনিয়ায় তার যতটুকুতে চলে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে, তার জন্য ঐ জিনিসের সামান্যতম যা থাকে তা-ই যথেষ্ট হয়। আর যে ব্যক্তি তার যতটুকুতে চলে তাতে সন্তুষ্ট থাকে না তার জন্য দুনিয়ায় এমন কিছু নেই যে, যথেষ্ট হবে।

ইমাম হাসান (আ.) বলেন : ঘনিষ্ঠ সেই ব্যক্তি, বন্ধুত্ব যাকে নিকটবর্তী করেছে, যদিও তার বংশীয় সম্পর্ক দূরের হয়। আর অচেনা সেই ব্যক্তি, যে বন্ধুত্ব থেকে দূরে থাকে, যতই তার বংশীয় সম্পর্ক নিকটের হোক না কেন।
রোগ থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা এক ব্যক্তিকে ইমাম হাসান (আ.) বললেন : আল্লাহ্্ তোমাকে স্মরণ করেছেন, তাই তুমিও তাঁকে স্মরণ কর। আর তোমাকে মাফ করেছেন, তাই তুমিও তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাও।
জনৈক ব্যক্তি ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কাছে আল্লাহ্্র এ বাণীটির অর্থ জানতে চাইল : ‘আর তোমার প্রতিপালকের নেয়ামত নিয়ে কথা বল।’ ইমাম তাকে বললেন : আল্লাহ্্ তাঁকে দীনের যে নেয়ামত দান করেছেন সে বিষয়ে বর্ণনা করতে নির্দেশ দিয়েছেন।

ইমাম আলী ইবনুল হোসাইন যায়নুল আবেদীন (আ.) বলেন : আর তোমার চোখের অধিকার হলো যা কিছু তোমার জন্য সঙ্গত নয় তা থেকে অবনমিত রাখা এবং এর অশ্লীলতা পরিহার করা, (একে ব্যববহার কর না) কেবল শিক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্র ছাড়া যা দ্বারা তুমি দৃষ্টিবান হতে পার কিংবা কোনো জ্ঞান অর্জন কর। কারণ, চোখ হলো শিক্ষাগ্রহণের উপকরণ।

ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) বলেন : যে ব্যক্তি নিজেকে মর্যাদাবান গণ্য করবে সে দুনিয়াকে তুচ্ছ জ্ঞান করবে।

ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) বলেন : মিথ্যা ছোট হোক আর বড় হোক তা পরিহার করবে, রসিকতার ছলে হোক আর সত্যিকারেই হোক। কারণ, যে ছোট মিথ্যা বলে সে বড় মিথ্যা বলায় সাহসী হয়ে ওঠে।

ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) বলেন : কতই না প্রতারিত ও ঠকে যাওয়া লোক রয়েছে যারা হেসে খেলে পার করছে, খাচ্ছে, পান করছে, অথচ খবর রাখে না যে, হয়তোবা আল্লাহ্্র পক্ষ থেকে তার ওপর ক্রোধ নেমে আসবে যা তাকে দোযখের আগুনে নিপতিত করবে।

ইমাম বাকের (আ.) বলেন : তিনটি জিনিস রয়েছে যা দুনিয়া ও পরকালে সম্মান বয়ে আনে : তোমার প্রতি যে যুলুম করেছে তাকে ক্ষমা করা, তোমার সাথে যে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে তার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা আর তোমার প্রতি যখন মূর্খতা প্রদর্শন করা হয় তখন সহিষ্ণু হওয়া।

ইমাম বাকের (আ.) বলেন : ন্যায়ের পক্ষে উত্থান কর এবং যাতে তোমার কোনো উপকার নেই তা থেকে দূরে থাক। আর তোমার শত্রু থেকে দূরে থাক এবং তোমার বন্ধু যে সম্প্রদায় থেকেই হোক, তার থেকে সতর্ক থাক শুধু এমন বিশ্বস্ত ব্যক্তি ছাড়া যে আল্লাহ্্র ভয় করে। ব্যভিচারীর সাথে ওঠাবসা করবে না এবং তাকে তোমার গোপন কথা অবগত করবে না। আর তাদের সাথেই পরামর্শ করবে যারা আল্লাহ্্র ভয় করে।

(তুহাফুল উকূল থেকে সংকলিত)
অনুবাদ : আব্দুল কুদ্দুস বাদশা

সম্পাদকীয়

হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-এর ওফাত বার্ষিকী
চৌঠা জুন ইরানের ইসলামী বিপ্লবের মহান নেতা ও ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিষ্ঠাতা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-এর ছাব্বিশতম ওফাত বার্ষিকী। দেশে ও বিদেশে অবস্থানরত ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের জনগণ, বিদেশস্থ ইরানী কূটনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মিশনসমূহ এবং বিশ্বব্যাপী হযরত ইমামের ভক্ত ও অনুরক্তগণ এ দিনে বিভিন্ন সভা-সমাবেশ, সেমিনার ও লেখালেখির মাধ্যমে এ মহান ইমামকে স্মরণ করেন এবং তাঁর শিক্ষা অনুসরণের জন্য স্বীয় অঙ্গীকার নবায়ন করেন।
ইরানের ইসলামী বিপ্লবের মহান স্থপতি ও নেতা এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিষ্ঠাতা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) ছিলেন ইরানী জাতির শক্তি ও দৃঢ়তার প্রতীক। তাঁর সুমহান নেতৃত্বে ইরানী জাতি আড়াই হাজার বছরের পুরনো রাজতান্ত্রিক ত্বাগূতী শাসন ব্যবস্থা ও বিজাতীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দাসত্ব হতে মুক্তি লাভ করে মানবিক আত্মমর্যাদা ও স্বাধীন জাতির গৌরবের অধিকারী হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এ মহান নেতার দিকনির্দেশনা অনুসরণের ফলেই ইসলামী ইরান বৈশ্বিক আধিপত্যবাদীদের প্রভাবের বাইরে থেকে ও তাদের বয়কট মোকাবিলা করে বিশ্বের অন্যান্য জাতির সামনে এক অনন্য সফল দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে।
একটি বিপ্লবের নেতা হিসেবে হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-এর অন্যতম অনন্য বৈশিষ্ট্য ও সাফল্য এখানে যে, তিনি বৈপ্লবিক আন্দোলন পরিচালনা কালেই এমন অনেক সুযোগ্য অনুসারী গড়ে তোলেন যাঁরা তাঁর বিদেশে নির্বাসিত জীবন যাপন কালে তাঁর পক্ষ থেকে আন্দোলন পরিচালনা করেন এবং তাঁর ইন্তেকালের পরেও তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে ইরানী জাতিকে তাঁর প্রদর্শিত পথে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) একদল সুযোগ্য উত্তরসূরির পাশাপাশি ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের জন্য একটি নিখুঁত কার্যোপযোগী সংবিধান রেখে গিয়েছিলেন। ফলে তাঁর ইন্তেকালের পরে তাঁর স্থলাভিষিক্ত একজন সুযোগ্য রাহ্বার নির্বাচনের মাধ্যমে ইসলামী ইরানের অগ্রযাত্রা আগের মতোই অব্যাহত থাকে এবং এখনো রয়েছে। ইমামের বিরাট সাফল্য এখানে যে, তিনি ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানকে যে ধারার ওপর প্রতিষ্ঠিত রেখে গিয়েছেন তাঁর ওফাতের সিকি শতাব্দীর বেশিকাল পরেও আজ দেশটি সে ধারার ওপরেই অগ্রসর হচ্ছে এবং সে ধারা থেকে সামান্যতমও বিচ্যুত হয় নি।
হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-এর এ অনন্য সাফল্যের কারণ এই যে, তিনি নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ববর্তী জীবনে যেমন, তেমনি পরবর্তীকালে জনগণকে ও বিপ্লবকে নেতৃত্ব প্রদানকালে এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায়িত্ব পালনকালেও তথা তাঁর গোটা জীবনে সত্যের অন্বেষণ ও অনুসরণ এবং একমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জন ছাড়া অন্য কোনো লক্ষ্যই পোষণ করেন নি। সর্বাবস্থায়ই তাঁর নিঃশর্ত সম্পর্ক ছিল একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলার সাথে এবং অন্য সকলের ও সব কিছুর সাথে তাঁর সম্পর্ক নির্ধারিত হতো আল্লাহ্র সাথে সম্পর্কের মানদ-ের বিচারে। তাই সর্বাবস্থায় আল্লাহ্ তা‘আলাই তাঁকে পথ দেখিয়েছেন, আর আল্লাহ্ যাকে পথ দেখান তাঁর জন্য সাফল্য ছাড়া আর কিছু থাকতে পারে না।
হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) ছিলেন যথাযথ মাত্রায় প্রয়োজনীয় সার্বিক গুণাবলির অধিকারী একজন ওয়ারেছে নবী (সা.) তথা একজন পূর্ণাঙ্গ দ্বীনী নেতা। তাঁর ‘ইল্ম্, আমল ও দূরদর্শিতা সবই ছিল কাক্সিক্ষত মাত্রায়। এ কারণেই তিনি কেবল ইরানী জনগণের নেতা ছিলেন না; বরং তিনি সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্কে সঠিক দ্বীনী দিকনির্দেশনা দিয়ে গিয়েছেন। আজকের দিনে মুসলিম উম্মাহ্র সবচেয়ে বড় সমস্যা ও বিপদ হচ্ছে তাদের বহুধাবিভক্তি যে জন্য তিনি যথার্থভাবেই ইসলামের দুশমনদের ষড়যন্ত্রকে দায়ী হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং এ ব্যাপারে উম্মাহ্কে সতর্ক করে দেন ও তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হবার জন্য পথনির্দেশ দেন। তিনি তাঁর অন্তিম বাণীতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা অঙ্গনে মুসলমানদের মধ্যে শত্রু শিবিরের চরদের অনুপ্রবেশের কথা স্মরণ করিয়ে দেন এবং বিভেদের প্রবক্তাদের নিন্দা করেন। তিনি বলেন যে, যারা শিয়া-সুন্নি বিরোধ সৃষ্টির চেষ্টা করছে তারা শিয়াও নয়, সুন্নিও নয়, বরং তারা সাম্রাজ্যবাদীদের চর। তিনি মাযহাব ও ফিরকা নির্বিশেষে সকল মুসলমানের মধ্যে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার জন্য ইসলামী ঐক্য সপ্তাহ উদ্যাপনের কর্মসূচি প্রদান করেন এবং তা এখনো সমগ্র মুসলিম জাহানে প্রতি বছর উদ্যাপিত হচ্ছে।
হযরত ইমামের (রহ্.) নেতৃত্ব ও ইরানের ইসলামী বিপ্লব সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্কে ইসলামী জাগরণ ও উত্থানের জন্য অনুপ্রাণিত করেছে। এতে কোনোই সন্দেহ নেই যে, ইসলামী আন্দোলনসমূহ সহ বিশ্বের মুসলিম জাতি ও গোষ্ঠীগুলো যদি হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-এর নেতৃত্বের গুণাবলি ও তাঁর অনুসৃত কর্মপদ্ধতি থেকে শিক্ষা গ্রহণ ও তা অনুসরণ করে তাহলে তারাও ইসলামের দুশমনদের সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়ে ইরানের ইসলামী জাতির ন্যায় সকল অঙ্গনে সর্বাত্মক সাফল্যের অধিকারী হতে সক্ষম হবে।

বই পরিচিতি

হযরত শামসে তাবরিযী (র)

রচনা ঃ ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
প্রকাশক ঃ-ছায়াপথ প্রকাশনী
বায়তুশ শরফ, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড.
ফার্মগেট, তেজগাও, ঢাকা-১২১৫
প্রকাশকাল ঃ- ফেব্রুয়ারী-২০১৫
প্রচ্ছদ ও মুদ্রণ ঃ- মাল্টিলিংক
মূল্য ঃ- ১৫০ টাকা ।

শামসে তাবরিযী ছিলেন ইরানে জন্মগস্খহণকারী একজন বড় অলি। তিনি ইরানের তাবরিয নগরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুরো নাম ‘শামস উদ্দীন মুহাম্মদ ইবনে আলী ইবনে মালিকদাদ তাবরিযী। তাঁর মূল নাম মুহাম্মদ, পিতার নাম আলী, দাদার নাম মালিকদাদ। শামস উদ্দীন তার উপাধী। অর্থ দ্বীনের সূর্য। তাবরিয শহরের অধিবাসী হওয়ায় তাঁকে শামস তাবরিযী বা শামসে তাবরিযী ডাকা হয়। তাবরিয শহর ছিলো অলিদের শহর। সেই শহরকে বলা হতো ‘শহরে হাফতাদ বাবা’ বা সত্তর অলির শহর। যেমন আমাদের দেশের চট্টগ্রামকে বলা হয় ‘বার’ আওলিয়ার শহর আর সিলেট জেলাকে বলা হয় ৩৬০ আওলিয়ার জেলা।
শামসে তাবরিযী (র) ফকিরের বেশধারী এক মহান দরবেশ ছিলেন। তাঁর ফকীরি জিন্দেগীর আড়ালে তিনি ছিলেন ইরফানী জগতের এক বড় জ্ঞানী। ইসলামের তাসাউফ বা তাজকিয়া দর্শনের পন্ডিৎ। ছিলেন এক কামেল পুরুষ। ইরফান বা ইলমে মারেফাত হচ্ছে এমন এক জ্ঞান যা খোদার সাথে বান্দার গভীর সম্পর্ক লাভের শিক্ষা দেয়।
শামসে তাবরিযীর জীবনের কিছু ঐশী কারামতের কাহিনীও ইতিহাসে বর্ণিত আছে। যার প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন মাওলানা জালাল উদ্দীন রুমী (র)। মূলতঃ শামসে তাবরিযী (র)-এ সংস্পর্শেই মাওলানা জালাউদ্দিন রুমী (র) বড় অলি ও আধ্যাত্মিক কবি হতে পেরেছিলেন। তিনি তাই তাঁর মসবিতেই স্বীকার করেছেন,‘হতোনা সফল কখনো রুমী পেয়ে প্রকৃত দ্বীন/যদি না থাকতো পীর তাবরিযী মাওলানা শামসুদ্দিন’
মাওলানা জালাউদ্দিন রুমী (র)-এর মসনবীতে বিভিন্নভাবে শামসে তাবরিযীর আধ্যাত্মিক জীবন দর্শন লুক্কায়িত আছে। শামসে তাবরিযীর সংস্পর্শে ্এসে মাওলানা রুমীর মধ্যে যে অসাধারণ রুহানী বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিলো তারই ফসল হচ্ছে মসনবী। যে মসনবী সম্পর্কে বলা হয়,‘মসনবীয়ে মানবিএ মওলভী/হাস্ত কোরান দরজবানে পাহলভী’ অর্থাৎ মসনবী হচ্ছে ফারসী ভাষায় কোরান। কোরানের আসল বক্তব্য বা সারমর্মকে তুলে নেয়া হয়েছে মসনবীতে।
শামসে তাবরিযীর নিজেরও কিছু ইরফানী কবিতা রয়েছে। যা তিনি মুখে মুখে রচনা করেছেন। সেগুলোই হয়তো কোন ভক্ত লিখে রেখেছে। পরবর্তীতে তা দিওয়ানে শামসে তাবরিযী নামে প্রকাশিত হয়েছে। মাওলানা জালালউদ্দিন রুমী (র) ও তার মসনবী সম্পর্কে সারা বিশ্বে ব্যাপক বই পুস্তক লিখিত হলেও তাঁর আধ্যাত্মিক গুরু শামসে তাবরিযী (র) সম্পর্কে পৃথক বই খুব কমই রচিত হয়েছে। তাঁর সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণা হতে পারে। রচিত হতে পারে পিএইচডি বা এমফিল থিসিস। ড. মুহাম্মদ ইসা শাহেদী কর্তৃক রচিত একশত চার পৃষ্ঠার উক্ত বইটি এক্ষেত্রে একটি পদক্ষেপ বলা যেতে পারে। লেখক বইটিতে শামসে তাবরিযীর জীবন দর্শণ বোঝাতে গিয়ে তাসাউফ সম্পর্কেও অল্পবিস্তর ব্যাখা দিয়েছেন। তাসাউফ বা ইলমে মারেফাত যাকে ইরফান শাস্ত্রও বলা হয়, যার প্রধান চালিকাশক্তি হচ্ছে সেই রুহানী জ্ঞান যার উৎপত্তিস্থল ছিলো হযরত আলী (আ)-এর হৃদয়, যিনি ছিলেন রাসুল (সা)-এর সামগ্রিক জীবন দর্শণের প্রকৃত প্রতিনিধি। এবিষয়টিও কিন্তু অধিকাংশ মানুষের কাছে অজানা ।
তাসাউফহীন দ্বীন সবুজ পত্রহীন শাখার মতো। যারা বলেন ইসলামে তাসাউফ নেই তারা দ্বীনের নিগুঢ় তত্ত্ব সম্পর্কে অজ্ঞাত।
বইটি বাংলাভাষী পাঠককে শামসে তাবরিযী, মাওলানা রুমী, মসনবী এবং তাসাউফ বা ইরফানী জ্ঞান সম্পর্কে আরো জানার আগ্রহ সৃষ্টি করবে।

 

ইরানের আধুনিক কবি

মুহাম্মদ হোসাইন শাহরিয়ার
রচনা : মোহাম্মদ আহসানুল হাদী
প্রকাশক : মোহাম্মদ নুরুন নবী এফসিএ
ডেবনার গ্রুপ
পক্ষে ইসলামী দর্শন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান
প্রকাশকাল : মে-২০১৫
প্রচ্ছদ : মোহাম্মদ ওয়ালিয়র রহমান (সুমন)
মূদ্রণ : সুইটি আর্ট প্রেস
মূল্য : ৪৫০ টাকা।

মোহাম্মদ আহসানুল হাদী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং মীরপুরস্থ লালকুটি দরবার শরীফের গদীনশীন পীর। ব্যক্তিগত জীবনে জনাব হাদী বহুগুণের অধিকারী। সাহিত্য, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক আন্দোলনে নানা কর্মকা-ের সাথে তিনি জড়িত। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও সাময়িকীতে অ্যাকাডেমিক লেখালেখি করে থাকেন। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন মাঝে মাঝে।
আলোচ্য বইটি তাঁর এমফিল গবেষণার ওপর ভিত্তি করে রচিত গ্রন্থ। ইরানের আধুনিক কবি মুহাম্মদ হোসাইনের জীবন ও সাহিত্যকর্মের ওপর রচিত তাঁর ব্যক্তিগত অ্যাকাডেমিক বিশ্লেষণের গ্রন্থরূপ।
ইরানের আধুনিক কবি শাহরিয়ারের জীবন ও সাহিত্যের নানা দিক ফুটে উঠেছে বইটিতে, শাহরিয়ারের জন্ম, তাঁর প্রথম কবিতা লেখা, সংসার জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত, প্রেম-প্রণয় ও প্রেমে ব্যর্থতা এবং এক্ষেত্রে প্রাক ইসলামী বিপ্লবকালীন রাজতান্ত্রিক প্রশাসনের মানসিক পীড়ন, ইসলামী বিপ্লবের প্রতি তাঁর সমর্থন, বিপ্লবী সরকার কর্তৃক সম্মাননা প্রদান, ইমাম খোমেইনী (র) কর্তৃক দীর্ঘ ছুটি ও ভাতা প্রদানের ঐতিহাসিক কাহিনী, তাঁর রচিত কবিতার গভীরতম অভিব্যক্তি, তাঁর পিতামাতার মৃত্যু, বেদনা, হাহাকার, রোগাক্রান্ত জীবন ও জীবনাবসান সবকিছু উঠে এসেছে। লেখক প্রয়াস করেছেন বাংলাভাষী পাঠক ও ফারসির ছাত্র-শিক্ষকদের সামনে একজন পূর্ণাঙ্গ ‘শাহরিয়ার’কে তুলে ধরতে। শাহরিয়ারের কাব্য প্রতিভাকে সুধীজনের কাছে তুলে ধরতে গিয়ে লেখক কবির কবিতাকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন। প্রসঙ্গক্রমে ইরানের সমাজব্যবস্থা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, শাহরিয়ারের কাল, প্রকৃতি, পরিবেশ ও সমসাময়িক বিয়য়ও টেনেছেন। ফারসি সাহিত্যের ইতিহাস, ইসলামের নানা প্রসঙ্গ, তাসাউফ, তাযকিয়া ও ইরফান শাস্ত্র, শরীয়ত, মারেফত, কালামশাস্ত্র ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গে কথা বলেছেন। বিভিন্ন জীবন দর্শন ও শাহরিয়ারের কবিতায় যে জীবন দর্শনের কথা বলা হয়েছে এর স্বাতন্ত্র্য এবং শাহরিয়ারের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের মিল অমিলও উঠে এসেছে। কবি শাহরিয়ার ও ব্যক্তি শাহবিয়ার প্রসঙ্গেও কথা বলেছেন তিনি। শাহরিয়ার ছিলেন জীবনবাদী কবি, জীবন সংগ্রামের কবি, আর জীবনের শেষদিকে শাশ্বত জীবন বিধান ইসলামের রুহানী জগৎ দ্বারা প্রভাবিত।
বইটি পাঠক সমালোচককে নানাভাবে স্পর্শ করবে বলে আমি মনে করি। বইটি ফারসি সাহিত্য প্রেমিকদের অবশ্যই কাজে লাগবে।

আমিন আল আসাদ

ভ্রমণ

বাংলাদেশ ও ইরানের সাংস্কৃতিক বিনিময়
মোঃ মফিদুর রহমান*
হঠাৎ করেই সুযোগটা এসে গেল। ভাবিনি এভাবে হঠাৎ করেই যাওয়া হবে। যাওয়া হবে স্বপ্নের মত সুন্দর দেশ ইরানে। তবে ইরান সফরের আগের গল্পটাও বলা দরকার। সরকারি চাকুরি করার সুবাদে প্রশিক্ষণ আর শিক্ষাসফরের আদলে মাঝে মধ্যে বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ ঘটে। এটা যে আবার খুব সহজে পাওয়া যায় তাও নয়। তবে বছরে দু’একবার পাওয়া গেলে তাকে বেশ ভাগ্যের ব্যাপারই বলতে হবে। এক্ষেত্রে আবার ইচ্ছেমত কোন দেশে যাবার সুযোগ নেই। যখন যে দেশে কাজ থাকবে সে দেশেই যাওয়া যাবে।
ছ’মাসের বেশি হবে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেছি। এ মন্ত্রণালয়ে কাজ করতে গিয়ে আমি উপলব্ধি করেছি সংস্কৃতি শুধু সংগীত, নৃত্য, ছবি আঁকা আর নাটকের মতো শিল্পমাধ্যমে সীমাবদ্ধ নয়। এর আরো অনেক মাত্রা রয়েছে। বিশ্বের বহু উন্নত দেশ সেটা উপলব্ধি করতে পারলেও আমরা এখনো পিছিয়ে রয়েছি। আমাদের চেতনায় সে আলো এখনো এসে পড়েনি। তবে খুব শিগগির সে আলোয় আমাদেরও আলোকিত হতে হবে। সারা দুনিয়া এখন মেতে আছে ক্রিয়েটিভ ইন্ডাস্ট্রিজ, কালচারাল হেরিটেজ সংরক্ষণ, কালচারাল ট্যুরিজম, ক্রিয়েটিভ ইকোনমি নিয়ে। তৈরি হচ্ছে ক্রিয়েটিভ সিটি, স্মার্ট সিটি ইত্যাদি ধারণা নিয়ে অভিনব সব নগরপরিকল্পনা। এসবের মূলে কিন্তু রয়েছে সংস্কৃতির অভিনব সব উদ্ভাবনা। অবশ্যই সেসব উদ্ভাবনা অভিনব, সৃজনশীল, পরিবেশবান্ধব আর প্রাণপ্রাচুর্যময় আবিষ্কারে ঋদ্ধ। তবে সে সব আলোচনায় পরে আসছি। এবার ইরান প্রসঙ্গ।
ইরানের সঙ্গে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বিনিময় সমঝোতা স্মারকের নবায়ন স্বাক্ষর কার্যক্রম দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে ছিল। একদিন নিজের দপ্তরে বসে কাজ করছি। হঠাৎ করেই একটি ফোন পেলাম। ফোনের ওপাশ থেকে এক ব্যক্তি তাঁর পরিচয় দিয়ে বললেন যে, তিনি বাংলাদেশে নিযুক্ত ইরানের মান্যবর রাষ্ট্রদূত এর একান্ত সচিব। তাঁর নাম জনাব ইকবাল। তিনি বললেন, ইরানের রাষ্ট্রদূত চাচ্ছেন বাংলাদেশের সঙ্গে ইরানের চুক্তিটি যেন দ্রুত স্বাক্ষর হয় এবং এজন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম শুরু করা হয়। শুরু হলো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে চিঠি চালাচালি। একপর্যায়ে এসে দু’দেশের সরকার সম্মত হলেন চুক্তিটি স্বাক্ষর করতে। এর মধ্যে একটি চমৎকার প্রস্তাব এলো ইরানের কাছ থেকে। তা হলো ৩-১৬ মে ইরানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ২৮তম আন্তর্জাতিক বইমেলা। ইরান সরকার চাচ্ছে বাংলাদেশের সংস্কৃতিমন্ত্রী জনাব আসাদুজ্জামান নূর ঐ মেলা উদ্বোধন কিংবা এর সমাপনী অনুষ্ঠানে থাকুন এবং একইসাথে চুক্তিটি স্বাক্ষর করুন। এভাবেই মাননীয় মন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে আমার ইরানে যাওয়া এবং চমৎকার একটি অভিজ্ঞতা অর্জন করা।
কাতার এয়ারওয়েজ এর ফ্লাইট টাইম ভোর রাতে। আমরা রওয়ানা হলাম ১৩ মে ভোর রাত ৩:২৫ মিনিটে। দোহা হয়ে বিমান যখন ইমাম খোমেইনী আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টে পৌঁছলো ঘড়ির কাটায় তখন স্থানীয় সময় দুপুর ১২:৩০। বিমানবন্দরে আমাদের স্বাগত জানাতে উপস্থিত ইরানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এবং অন্য কর্মকর্তাগণ। এসেছেন ইরানের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা। ভিআইপি রুমে আলাপচারিতায় বুঝতে পারলাম আমাদের ইরান সফর স্মরণীয় হতে চলেছে।
এয়ারপোর্টের বাইরে গাড়ি প্রস্তুত। গাড়ি চলছে দ্রুতবেগে। দু’পাশে বিশালাকৃতির পাহাড়। মনে পড়লো সেই গানের কথা : আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই। এ পাহাড়ের সাথে আমাদের দেশের পাহাড়ের বেশ পার্থক্য চোখে পড়লো। আমাদের দেশের পাহাড়গুলো বেশি উঁচু নয়। আর আমাদের দেশের পাহাড়গুলোয় সবুজের সমারোহ। পাহাড়ের গায়ে জুম চাষ হয়। অন্যদিকে ইরানের পাহাড়গুলো পাথরের। অনেক উঁচু। সবুজ তেমন নয়। তবে রাস্তার ধারে কিছু কিছু পাহাড়ের গায়ে ফুলের চাষ করা হয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে পাহাড়ের গায়ে লতাগুল্ম সুন্দর করে কেটে ছেঁটে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়েছে। রাস্তাঘাট খুব প্রশস্ত আর পরিকল্পিত। হাইওয়েতে সবাই নিয়ম মেনে গাড়ি চালাচ্ছে। পাবলিক বাসের জন্য রয়েছে আলাদা লেন। সেখানে রাস্তায় চলাচলের জন্য সাধারণ মানুষকে দেয়া হয়েছে বেশি গুরুত্ব। যানজট প্রায় চোখেই পড়লো না। যদিও ইরানের সবাই বলাবলি করছিলেন, তেহরান খুব ব্যস্ত শহর; এখানে যানজট আছে। কিন্তু আমাদের কাছে মনে হলো যানজট থাকলেও তার রূপ আমাদের দেশের মত নয়। আমাদের দেশে যেমন ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্থির হয়ে গাড়ি রাস্তায় আটকে থাকে, একচুলও নড়ে না, এখানে তেমন নয়। এখানে গাড়ি ধীর গতিতে চলতে থাকে।
আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো হোটেল আজাদী ইন্টারন্যাশনালে। এটি ইরানের ফাইভ স্টার হোটেল। হোটের রুম থেকে বিশাল বিশাল পাহাড় আর মেঘের বালিকারা মায়াবি ইশারায় যেন ডাক দেয়। মধ্যাহ্নভোজ সেরে হালকা বিশ্রাম। এরপর বিকেলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ সাংস্কৃতিক চুক্তি স্বাক্ষর। আমাদের গাড়ি ছুটে চলছে তেহরানের রাস্তায়। আমার রক্তে কেমন যেন উত্তেজনা আর শিহরণ! জীবনের প্রথম ঐতিহাসিক শহর তেহরানে আসা। ইরানের সংস্কৃতি ও ইসলামিক গাইডেন্স মন্ত্রণালয় প্রস্তুত। আমাদের উষ্ণ স্বাগত জানালেন সংস্কৃতি মন্ত্রী জনাব আলী জান্নাতি। ইরান ও বাংলাদেশের সংস্কৃতি মন্ত্রীর সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা পর্বে দু’দেশের মন্ত্রী এ চুক্তি স্বাক্ষরের প্রয়োজনীয়তা এবং এর ফলে যা অর্জিত হবে তার ওপর গুরুত্বারোপ করলেন। এরপর চুক্তি স্বাক্ষর হলো। ইরানের সরকারি মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা দু’মন্ত্রীকে কিছু প্রশ্নও করলেন। তবে সবই ছিল সৌজন্যমূলক।
ইরানের সাথে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বন্ধুত্ব দীর্ঘদিনের। ১৯৭৭ সালে ইরানের সাথে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক চুক্তি সম্পাদিত হয়। এরপর ২০০৪-২০০৭ মেয়াদে সাংস্কৃতিক বিনিময় কার্যক্রম স্বাক্ষরিত হয়। এটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে নতুন করে আবার সাংস্কৃতিক বিনিময় কার্যক্রম নবায়নকল্পে স্বাক্ষরের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তবে, সাংস্কৃতিক বিনিময় কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষরিত না হলেও ইরানের সাথে বাংলাদেশের নিবিড় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কারণে সাংস্কৃতিক বিনিময় কার্যক্রম অব্যাহত ছিল। যেমন, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে প্রতি দু’বছর অন্তর আয়োজিত দ্বিবার্ষিক এশিয়ান চিত্রকলা প্রদর্শনীতে ইরান নিয়মিত অংশগ্রহণ করে আসছে এবং পুরস্কারও পেয়েছে। ইরানের চলচ্চিত্র বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের কাছে অত্যন্ত প্রশংসনীয় এবং শিক্ষণীয়। বিভিন্ন সময় বাংলা ভাষায় ডাবিং করা চলচ্চিত্র বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রদর্শন করা হয়েছে। সংস্কৃতিচর্চায় ইরান বর্তমান বিশ্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। ইরান সফরে তা আমরা বেশ উপলব্ধি করতে পেরেছি।
এবারে আসা যাক সাংস্কৃতিক বিনিময় কার্যক্রম প্রসঙ্গে। ইরানের সাথে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বিনিময়ের পরিধি বেশ ব্যাপক। এখানে সংস্কৃতির পাশাপাশি বিজ্ঞান ও শিক্ষা কার্যক্রমও স্থান পেয়েছে। বিনিময় কার্যক্রমের মেয়াদ ২০১৫-২০১৮ সাল পর্যন্ত। চুক্তির মধ্যে মোট ৬টি অধ্যায় এবং ৫৬টি আর্টিকেল রয়েছে। প্রথম অধ্যায়েই রয়েছে সংস্কৃতি ও শিল্প। এখানে আর্টিকেল আছে ১৬টি। এখানে বলা হয়েছে, উভয় দেশ নিজেদের মধ্যে সাংস্কৃতিক, শৈল্পিক, ঐতিহাসিক, সাহিত্যিক, ধর্মীয় ও প্রতœতাত্ত্বিক তথ্য, ছবি, সিডি, চলচ্চিত্র, মাইক্রোফিল্ম ইত্যাদি বিনিময় করতে পারবে। তাছাড়া দু’দেশ পারস্পরিক সাংস্কৃতিক সপ্তাহ, বই, হস্তশিল্প, ছবি ও অন্যান্য শিল্পকর্মের মেলা ও প্রদর্শনী করতে পারবে। উভয় দেশ তাদের লেখক, শিল্পী, প্রকাশক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনকে বিভিন্ন সম্মেলন, সভা, ওয়ার্কশপ ইত্যাদিতে অংশগ্রহণের জন্য সহযোগিতা করবে। এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বইমেলায় পরস্পরকে আমন্ত্রণ জানাবে। বাংলাদেশ ও ইরান বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উৎসবে শিল্পী ও সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দল প্রেরণ করবে। একইভাবে সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামের তথ্য আদান প্রদান ও তাতে অংশগ্রহণের জন্যও উভয়দেশ আমন্ত্রণ জানাবে। দু’দেশ নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক স্থাপনা সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানাবে ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করবে। মোটামুটি এই হলো সাংস্কৃতিক বিনিময় কার্যক্রমের মূল বক্তব্য।
আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছি কার্যক্রম শুরু করার। আশা করছি এশিয়ার সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রাচীন ও গুরুত্বপূর্ণ দেশ ইরানের সাথে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বন্ধুত্ব ক্রমাগত সুদৃঢ় হবে।

লেখক : সংস্কৃতি উপদেষ্টা
সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

কবি ফেরদৌসি ও তাঁর প্রজ্ঞা

ড. তারিক সিরাজী

প্রাচ্যের ‘হোমার’ খ্যাত ফারসি সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি আবুল কাসেম ফেরদৌসি ছিলেন ইরানের প্রাচীন ইতিহাস, ঐতিহ্য ও গৌরবগাথার সার্থক রূপকার। যে কারণে তাঁর জীবনকাহিনী রূপকথার ন্যায় ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্ববিখ্যাত বীরত্বগাথা শাহনামা রচনার মাধ্যমে তিনি ইরানিদের জাতিসত্তা ও ফারসি ভাষার মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যকে সংরক্ষণ করেছেন। তাঁর এ কালোত্তীর্ণ বীরত্বগাথা শাহনামা গ্রন্থটি পৃথিবীর প্রসিদ্ধ ভাষাগুলোতে অনূদিত হয়েছে এবং অসংখ্য সাহিত্যামোদীর মনের খোরাক যুগিয়েছে।
আবুল কাসেম ফেরদৌসি ৯৪০ খ্রিস্টাব্দে খোরাসানের তুস নগরীর অন্তর্গত তাবরানের বায নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আর্থিক অবস্থা যাই ছিল না কেনো বস্তুত ত্রিশ বছর ধরে শাহনামা রচনার কারণে তাঁর ধনসম্পদ হাতছাড়া হয়ে যায় এবং বার্ধক্যে এসে তিনি দরিদ্র হয়ে পড়েন। আর এ ত্রিশ বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে তিনি গোটা পারস্যকে পুনরুজ্জীবিত করেন। তিনি নিজেই বলেন:
بسي رنج بردم در اين سال سي عجم زنده كردم بدين پارسي
আমি বহু কষ্ট ভোগ করেছি এই দীর্ঘ ত্রিশটি বছর ধরে
আর এ পারসির (ফারসি) মাধ্যমে পারস্যকে জীবন্ত করেছি।
কবি ফেরদৌসির গুরুত্ব ও আবেদন কেবল তাঁর ভাষার লালিত্য, মাধুর্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও বীরদের কাহিনী বর্ণনার মধ্যেই নিহিত নয়, বরং তাঁর জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় চেতনার মাঝেও বিদ্যমান। তাঁর রচিত শাহনামা গ্রন্থের পরতে পরতে গল্পের কাহিনীগুলো এমনিভাবে বিধৃত রয়েছে যে প্রতিটি চরিত্রই যেন একেক জন পর্যবেক্ষক হিসাবে কাজ করছে। যে কারণে এ মহাকাব্য সাহিত্যের একটি উচ্চমার্গে পৌঁছেছে। তিনি প্রচলিত সাহিত্যরীতির বিপরীতে অন্তর্নিহিত বর্ণনার দিকে অগ্রসর হয়েছেন আর এটি ছিল তাঁর নিজস্ব উদ্ভাবিত শৈলী। এ ধরনের সাহিত্যশৈলী ফারসি সাহিত্যে বিরল। তিনি তাঁর শাহনামা কাব্যগ্রন্থকে ধ্বনি, শব্দ চয়ন, এমনকি ব্যাকরণসহ সকল স্তরে একটি সুশৃঙ্খল গঠন কাঠামোর মাধ্যমে বিন্যস্ত করেছেন। যার ফলে এটি ভাষাতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকেও সর্বোচ্চ ও চূড়ান্ত অবস্থানে রয়েছে।
প্রাচীনকালে তথা শাহনামার রচয়িতা আবুল কাসেম ফেরদৌসির যুগে আনুষ্ঠানিকভাবে গল্প বলা ও শোনার একটা প্রচলন ছিল। কারণ, সে সময় বেশিরভাগ লোকই পড়তে ও লিখতে জানতো না। এ ধরনের গল্প পাঠের আসরে পরিবেশন করা হতো ধর্মীয় ও পৌরাণিক কাহিনী। পুরাণপাঠের এ কাজটিকে বলা হয় নাক্কালি আর যিনি কাহিনীগুলো পাঠ করে শোনান বা উপস্থাপন করেন তাঁকে বলা হয় নাক্কাল বা পুরাণপাঠকারী। তাঁর হাতে থাকত একটি লাঠি যা দিয়ে তিনি চরিত্র চিত্রায়ণ করতেন। বলা যায় ঠিক আমাদের দেশের পুথি পাঠের ন্যায়। পুরাণপাঠকারীর অথবা গল্প বলার কাজটিকে সহজতর ও প্রাণবন্ত করার লক্ষ্যেই ফেরদৌসি সহজ-সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় পৌরাণিক কাহিনীগুলো রচনা করে তা শাহানামা কাব্যগ্রন্থে তুলে ধরেছেন।
আমরা জানি যে, পৌরাণিক কাহিনীগুলোর বিশ্লেষণ, মহান বীর যোদ্ধাদের গুণ, বৈশিষ্ট্য ও কীর্তি বর্ণনা এবং বিভিন্ন জাতির ভাগ্য নির্মাণে সংঘটিত যুদ্ধ-বিগ্রহের ইতিহাস তুলে ধরাই হলো মহাকাব্যের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। পাশাপাশি সমকালীন রাজনৈতিক ও আত্মউদ্দীপক বিষয়গুলোও এতে অনুরণিত হয়ে থাকে। এছাড়া ফেলা আসা অতীত যুগের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, একটি জাতি প্রতিষ্ঠার ঘটনা ও নিজের প্রসিদ্ধ বীরত্বগাথা মাহাকাব্যে বিধৃত থাকে। মহাকাব্যের রচয়িতাগণ এ ধরনের সাহিত্যকর্মে নিজ জাতি ও মানব সভ্যতার আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে থাকেন এবং তাঁদের ভিতরের রহস্যকে নিজদের সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে উন্মোচিত করেন। তাঁরা মনে করেন জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য ও বীরত্ব জানার মধ্য দিয়ে আত্মপরিচয় লাভ করা যায় এবং উৎসাহ-উদ্দীপনা ও জাতীয় আত্মবিশ্বাস প্রতিষ্ঠায় উজ্জীবিত হওয়া যায়। মহাকাব্যে বিধৃত বীরদের কাহিনী থেকে শিক্ষা নিয়ে অত্যাচার ও নীপিড়নের বিরুদ্ধে জাতি ও দেশকে ধ্বংস থেকে রক্ষার উপায় ও অবলম্বন অন্বেষণ করা যায়।
বিশ্বে যে কয়টি নির্ভরযোগ্য মহাকাব্য রয়েছে সেগুলোর মূল বক্তব্য ও বিষয় অনেকটা একই বলে প্রতিভাত হয়। সমৃদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য মহাকাব্যগুলোর মধ্যে রয়েছে:
১. গিলগামেশ (এরষমধসবংয) : এটি প্রায় খ্রিস্টপূর্ব দুই হাজার সালে ব্যাবিলনীয় ভাষায় রচিত হয়েছে এবং যার বিষয়বস্তু ছিল বীরদের জন্য এমন এক মৃতসঞ্জীবনী উদ্ভিদ অন্বেষণ এবং পরাজিত সৈনিকদের কাহিনী বর্ণনা করা। ২. ইলিয়াড (ওষরধফ): এটি খ্রিস্টপূর্ব ৮ম শতকের মধ্যভাগে হোমার কর্তৃক গ্রিক ভাষায় রচিত হয়েছেÑ যার বিষয়বস্তু ছিল ট্রয় নগরীর দশ বছরব্যাপী যুদ্ধকাহিনী। ৩. ইনেইড (অবহবরফ): এটি ভার্জিল কর্তৃক ল্যাটিন ভাষায় রচিত মহাকাব্য। এটি রচনা করতে ভার্জিলের খ্রিস্টর্পূব ২৯ থেকে ১৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময় লেগেছিল। এ মহাকাব্যের বিষয়বস্তু ছিল ট্রয় নগরীর ধ্বংস এবং রোম জাতির প্রতিষ্ঠার পর বন্ধুদের সাথে ইনের ভ্রমণ-বৃত্তান্ত বর্ননা করা। এছাড়া এতে উল্লেখ রয়েছে শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রতীক হিসাবে খ্যাত ট্রয়ের জনগণ এবং শক্তিমত্তার প্রতীক হিসাবে প্রসিদ্ধ ল্যাটিন জনগণের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার বিষয়াবলি। ৪. মহাভারত (গধযধনযধৎধঃধ) খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে সংস্কৃত ভাষায় রচিত হয়েছে। ৫. রামায়ণ (জধসধুধহধ): খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় অথবা চতুর্থ খ্রিস্টাব্দে বাল্মীকি কর্তৃক রামচন্দ্রের জীবনকাহিনী নিয়ে রচিত হয়েছে। ৬. ফেরদৌসির শাহনামা হিজরি চতুর্থ শতকে ফারসি ভাষায় রচিত হয়েছে।
ফেরদৌসি ৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে শাহনামা রচনা শুরু করেন এবং ১০১০ খ্রিস্টাব্দে ৭৫ বছর বয়সে তা সমাপ্ত করেন। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ফেরদৌসির শাহনামায় যে বিষয়গুলো রয়েছে তা হচ্ছে, বীরদের মানসিকতা, প্রচেষ্টা, জ্ঞান ও বিদ্যা, খোদার আনুগত্য, ন্যায়পরায়ণতা, রাজনীতি, জাতীয় ঐক্য ও সংহতি। এতে শিক্ষণীয় অনেক বিষয়ের উল্লেখের পাশাপাশি রয়েছে বিশ্বদর্শন।
হিজরি ষষ্ঠ শতকে শাহনামা মূলত দু’টি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। একটি জর্জিয়ান ভাষায় আর অপরটি হয়েছিল আরবি ভাষায়। কিন্তু পরিতাপের সাথে বলতে হয় যে, উভয়টিই কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। প্রথম আরবি ভাষায় শাহনামা অনুবাদ করেন আসিরুল মামালিক নিশাবুরিÑ যিনি হিজরি পঞ্চম শতকের শেষভাগে এবং ষষ্ঠ শতকের গোড়ার দিক পর্যন্ত জীবিত ছিলেন।
কাওয়াম উদ্দিন ফাতেহ বিন আলি বিন মুহাম্মাদ বুন্দারি ই¯পাহানি কর্তৃক আরবি ভাষায় অনূদিত কপিটিই হচ্ছে শাহনামার সবচেয়ে পুরাতন অনূদিত কপি যা এখনো সংরক্ষিত আছে। অনুবাদক বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক তথ্যগুলোই তুলে ধরেছেন এবং বর্ণনাধর্মী বিষয়গুলো পরিহার করেছেন।
১০৩০ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় যে ভাষায় শাহনামা অনূদিত হয়েছিল তা ছিল ওসমানি তুর্কি ভাষায়। শাহানামা কাব্যগ্রন্থটি ২৭টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। যেমন, আরবি, জার্মানি, উর্দু, ইংরেজি, বাংলা, ইতালি, পশতু, তুর্কি, রুশ, জাপানি, হিন্দি, কুর্দি ইত্যাদি।
উল্লেখ্য যে, শাহানামার প্রথম অনুবাদটি সুলতান ঈসা বিন মুলকে কামেল আবু বকর এর নির্দেশে বুন্দারি সম্পন্ন করেছেন যা ছিল ইতিহাসনির্ভর। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এই যে, জার্মানি ভাষায় যখন শাহানামা অনূদিত হয় তখন চলছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। আবার মনিরউদ্দিন ইউসুফ ১৯৭১ সালে বাংলা ভাষায় যখন শাহনামা অনুবাদ করছিলেন তখন ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়। মহাকাব্য শাহনামা অনুবাদের এ প্রেক্ষাপট পর্যালোচনার দাবি রাখে। তাই বলা যায় যে, মনিরউদ্দিন ইউসুফ বাংলা ভাষায় শাহনামা শীর্ষক মহাকাব্য অনুবাদের মধ্য দিয়ে মূলত কবি ফেরদৌসির আত্মরহস্য উদ্ঘাটন করতে চেয়েছেন।
ফেরদৌসি তাঁর শাহানামা কাব্যগ্রন্থে প্রাচীন পারস্যের ইতিহাস-ঐতিহ্য বর্ণনার মাধ্যমে চরিত্র গঠন, বীরত্ব, পা-িত্য, বিচক্ষণতা ও জ্ঞানের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন। জ্ঞানের যে বিশাল শক্তি রয়েছে সে বিষয়ে তিনি বলেন:
توانا بود هر که دانا بود ز دانش دل پير برنا بود
যে জ্ঞানী সেই শক্তিশালী ও সামর্থ্যবান,
আর জ্ঞানসমৃদ্ধ বৃদ্ধের হৃদয় চির যৌবন থাকে।
ফেরদৌসি শাহনামা রচনা করে ফারসি ভাষাকে নিশ্চিহ্ন হওয়া থেকে রক্ষা করেন। এ গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি প্রতিরোধের মানসিকতা, খোদার আনুগত্য, স্বদেশপ্রেম ও স্বাধীনতার শিক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু শাহনামার বড় পরিচয় হচ্ছে ফারসি ভাষার অস্তিত্বের সনদ হিসাবে।
ফেরদৌসি শাহনামা কাব্যগ্রন্থে যুদ্ধ ও বীরত্বপূর্ণ কাহিনী বর্ণনার পাশাপাশি তথ্যপূর্ণ উপদেশাদি ও নৈতিক কর্তব্যাদি সম্পর্কে বক্তব্য দিতেও সচেষ্ট ছিলেন। শাহনামায় বিধৃত এমনি উপদেশ সম্পর্কিত কয়েকটি পঙ্ক্তি নিচে তুলে ধরা হলো:
بيا تا جهان را به بد نسپريم به کوشش، همه دست نيکي بريم
نماند همي نيک و بد پايدار همان بِه، که نيکي بود يادگار
نه گنج و نه ديهيم و کاخ بلند نخواهد بدن مر ترا سودمند
فريدون فرخ فرشته نبود ز مُشک و ز عنبر سرشته نبود
بِه داد و دهش يافت اين نيکويي تو داد و دهش کن فريدون تويي
এসো, এ পৃথিবীকে আমরা যেন অকল্যাণের দিকে ঠেলে না দেই,
প্রচেষ্টার মাধ্যমে একে সামগ্রিক কল্যাণে পরিণত করব।
ভালো-মন্দ কিছুই স্থায়ী রবে না,
তবে কল্যাণকর স্মৃতি ধরে রাখাই উত্তম।
সুউচ্চ প্রাসাদ, ধন-সম্পদ, ঐশ্বর্য
তোমার কোনো কল্যাণেই আসবে না।
ফরিদুন কোনো ফেরেশতা ছিল না,
কিংবা কোনো মৃগনাভি বা কস্তুরি দ্বারাও সৃষ্ট নয় সে।
সেতো ন্যায়পরায়ণতা ও বদান্যতা দিয়ে এ মহত্ত্বের অধিকারী হয়েছে,
তুমিও ন্যায়পরায়ণতা ও বদান্যতা অর্জন কর, তবেই তুমি ফরিদুন হবে।
শাহনামা কাব্যগ্রন্থে ফেরদৌসির জ্ঞানের গভীরতার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি মনে করেন এ ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীতে মনুষত্বই শ্রেষ্ঠ আর জ্ঞান ছাড়া সে মনুষত্ব অজির্ত হয় না। সৎ ও সততার দ্বারাই কেবল সকলের মাঝে সাম্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়। কবি বলেন:
دگر گفت روشن روان آن کسي که کوتاه گويد به معني بسي
چو گفتار بيهوده بسيار گشت سخنگوي در مردمي خوار گشت
هنر جوي و تيمار بيشي مخور که گيتي سپنج است و ما برگذر
ز دانش چو جان ترا مايه نيست بِه از خاموشي هيچ پيرايه نيست

সে (বুজুর্গ মেহের নুশিরওয়ানকে) বলল: সে-ই আলোকিত আত্মার অধিকারী
যে সংক্ষেপে অধিক অর্থপূর্ণ কথা বলে।
যদি বক্তব্য হয়ে ওঠে অনর্থক
তবে লোকদের কাছে বক্তা তুচ্ছে পরিণত হয়।
জ্ঞান অন্বেষণ করো আর দুঃখকে প্রশ্রয় দিও না
এ পৃথিবী ক্ষণিকের, আমাদের চলে যেতেই হবে।
যদি জ্ঞানসমৃদ্ধ আত্মা তোমার নাই বা থাকে
তবে মৌনতা ছাড়া তোমার আর কোনো ভূষণ নেই।
মোট কথা, গোটা শাহনামাই চিত্রকল্পে ভরপুর। যুদ্ধ-বিগ্রহের চিত্র এবং এর চরিত্রগুলো এতোটাই প্রাণবন্তভাবে এ গ্রন্থে অনুরণিত হয়েছে যে, পাঠক সহসাই তা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন।
ফেরদৌসির শাহনামা কাব্যগ্রন্থ ও এতে বর্ণিত কাহিনীগুলো যুগ যুগ ধরে কাব্যরসিকদের হৃদয় ও মননে এমনি জায়গা করে নিয়েছে যে তা অম্লান হয়ে থাকবে, কখনোই বিনষ্ট হবে না।

তথ্যসূত্র:
১. আহমাদ তামীমদারী (২০০৭ খ্রি.): ফার্সী সাহিত্যের ইতিহাস, আলহুদা আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা, ইরান।
২. হরেন্দ্র চন্দ্র পাল (১৩৬০ বঙ্গাব্দ): পারস্য সাহিত্যের ইতিহাস, প্রকাশক অজিত চন্দ্র ঘোষ, শ্রী জগদীশ প্রেস, কলকাতা।
৩. আবুল কাসেম ফেরদৌসি (১৩৭৪ সৌরবর্ষ): শাহনামেয়ে ফেরদৌসি, এনতেশারাতে তুস, তেহরান, ইরান।
৪. আবুল কাসেম ফেরদৌসি, শাহনামেয়ে ফেরদৌসি, এনতেশারাতে ফ্রাঙ্কলিন, ইরান।
৫. সাদেক রেযা যাদে শাফাক (১৩৫২ সৌরবর্ষ): তারিখে আদাবিয়্যাতে ইরান, এনতেশারাতে দানেশগাহে পাহলাভি, ইরান।
৬. নিউজ লেটার (ঢাকাস্থ ইরানি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের মুখপত্র), ৩য় সংখ্যা, মে-জুন, ২০১৩।

অমর শহীদানের স্মৃতিতে ভাস্বর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান

নূর হোসেন মজিদী
হাজার হাজার শহীদের রক্তের বিনিময়ে ইরানের জনগণ আড়াই হাজার বছরের পুরাতন স্বৈরাচারী রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা এবং ইসলাম ও মুসলমানদের দুশমন, বহিঃশক্তির তাঁবেদার শাহের তাগূতী সরকারকে উৎখাত করে হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-এর নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লবকে বিজয়ী করে এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান প্রতিষ্ঠা করে। এভাবে বিজাতীয় শক্তির অনুগত ইরান আক্ষরিক অর্থে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হয় এবং শত্রুর চাপিয়ে দেয়া আট বছরব্যাপী যুদ্ধ ও দশকের পর দশক ধরে অব্যাহত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাকে মোকাবিলা করে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ হিসেবে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে।
বস্তুত ইসলামী বিপ্লবের বিজয় ও ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আধিপত্যবাদী বৃহৎ শক্তিবর্গের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে স্বাধীনভাবে পথ চলে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান বিশ্বের মযলুম জাতিসমূহের সামনে একটি অনুসরণীয় দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছে। ইসলামী ইরান তার এ গৌরবময় অবস্থান ও মর্যাদার জন্য স্বীয় শহীদানের কাছে ঋণীÑ যাঁরা ইসলামী বিপ্লবকে বিজয়ী করার আন্দোলনে এবং এরপর চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে ও প্রতিবিপ্লবী অন্তর্ঘাতকদের হাতে জীবন বিসর্জন দিয়ে ইসলামী বিপ্লবরূপ চারাগাছের গোড়ায় প্রাণরস সঞ্চারিত করেছেনÑ যার ফলে আজ তা এক বিশাল মহীরুহে পরিণত হতে পেরেছে। তাই ইসলামী ইরানের জনগণ ও সরকার স্বীয় শহীদানকে বিভিন্নভাবে মর্যাদা প্রদান করেছে।
ইরানের ইসলামী বিপ্লবকে বিজয়ী করার আন্দোলনে সর্বস্তরের হাজার হাজার দ্বীনদার মানুষ শহীদ হয়েছেন এবং দীর্ঘ আট বছরব্যাপী চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন আরো কয়েক লক্ষ মানুষ। এছাড়া প্রতিবিপ্লবীদের সন্ত্রাসী তৎপরতার শিকার হয়ে বহু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি শহীদ হয়েছেন। এ শহীদগণের মধ্যে রয়েছেন দেশের জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেণ্ট ও প্রধানমন্ত্রীসহ সর্বস্তরের মানুষ। ইরানী জাতির শহীদগণের মধ্যে সাধারণ মানুষ, দ্বীনী শিক্ষাকেন্দ্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী ও সাধারণ সৈনিকগণ ছাড়াও রয়েছেন বিপুল সংখ্যক আলেম, শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, বিজ্ঞানী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বিচারক, পার্লামেন্টারিয়ান ও সেনানায়ক।
ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের পূর্বে ও পরে যেসব খ্যাতনামা ব্যক্তি শাহাদাত বরণ করেন তাঁদের সকলের নামের তালিকা তৈরি করতে গেলে তা অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে। এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেন স্বনামখ্যাত মনীষী ও মুজতাহিদ শহীদ অধ্যাপক আয়াতুল্লাহ্ মোতাহ্হারী, স্বনামখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ অধ্যাপক ড. আলী শারী‘আতী, প্রেসিডেন্ট মোহাম্মাদ আলী রাজাই, প্রধান মন্ত্রী হুজ্জাতুল ইসলাম ড. জাওয়াদ বহোনার, তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আয়াতুল্লাহ্ মোহাম্মাদ হোসেইন বেহেশতী, আয়াতুল্লাহ্ মোস্তাফা খোমেইনী, আয়াতুল্লাহ্ সাদূক্বী, ড. মোহাম্মাদ মোফাত্তেহ্, ড. মোস্তফা চামরান প্রমুখ। সাম্প্রতিককালে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বেশ কয়েক জন পরমাণুবিজ্ঞানী সাম্রাজ্যবাদী ও যায়নবাদী ইসরাঈলের নিয়োজিত গুপ্ত ঘাতকদের হাতে শাহাদাত বরণ করেন।
এখানে বিপ্লব-পূর্ববর্তী ও বিপ্লবোত্তর ইরানের গুরুত্বপূর্ণ শহীদ ব্যক্তিত্ববর্গের মধ্য থেকে কয়েক জন সম্পর্কে সামান্য আভাস দেয়া যেতে পারে।
অধ্যাপক আয়াতুল্লাহ্ মোতাহ্হারী ছিলেন সাম্প্রতিক ইরানের শীর্ষস্থানীয় ইসলামী চিন্তাবিদগণের অন্যতমÑ যিনি ইসলামের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় অনেক বই-পুস্তক লিখেছেন। তাঁর লেখার বিশেষ বৈশিষ্ট্য এই যে, তিনি ইসলামের জটিলতম বিষয়গুলোকেও সাধারণ পাঠক-পাঠিকাদের বোধগম্য প্রাঞ্জল ভাষায় সাফল্যের সাথে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর বক্তৃতা ও লেখা বিশ্ববিদ্যালয় ও দ্বীনী শিক্ষাকেন্দ্রের ছাত্রছাত্রীদের কাছে সমানভাবে জনপ্রিয় ছিল। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদেরকে ইসলামের পথে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান ছিল খুবই বেশি। ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের কিছুদিন পরে সাম্রাজ্যবাদের দোসর প্রতিবিপ্লবী সন্ত্রাসীদের গুলিতে তিনি শহীদ হন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে ইসলামী ও বৈপ্লবিক চেতনা সৃষ্টিতে বিশেষ অবদান রাখেন এমন আরেক জন ব্যক্তিত্ব ছিলেন অধ্যাপক ড. আলী শারী‘আতী। ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের কিছুদিন আগে তিনি লন্ডনে শাহী সরকারের গুপ্ত ঘাতকের হাতে শাহাদাত বরণ করেন।
বিদেশ বিভূঁইয়ে শাহী সরকারের গুপ্ত ঘাতকের হাতে শাহাদাত বরণ করেন এমন আরেক জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন ইসলামী বিপ্লবের মহান নেতা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-এর জ্যেষ্ঠ পুত্র আয়াতুল্লাহ্ মোস্তাফা খোমেইনী। তিনি বিপ্লব বিজয়ের কিছুদিন আগে ইরাকের নাজাফেÑযেখানে তিনি তাঁর নির্বাসিত পিতার সাথে অবস্থান করছিলেনÑগুপ্ত ঘাতকের হাতে শাহাদাত বরণ করেন।
ইসলামী বিপ্লবের বিজয় ও ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান প্রতিষ্ঠিত হবার পর জনগণের বিপুল ভোটে নির্বাচিত দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট ছিলেন মোহাম্মাদ আলী রাজাই এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের তৎকালীন সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছিলেন স্বনামখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ হুজ্জাতুল ইসলাম ড. জাওয়াদ বহোনার। উভয় নেতা এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে থাকা অবস্থায় প্রতিবিপ্লবী সন্ত্রাসীদের পেতে রাখা এক বোমা বিস্ফোরণের ফলে শহাদাত বরণ করেন।
আয়াতুল্লাহ্ ড. মোহাম্মাদ হোসেইন বেহেশতী ছিলেন ইসলামী বিপ্লবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী আরেক জন মহান ব্যক্তিত্ব। বিশেষ করে বিপ্লবোত্তর ইরানে প্রধান বিচারপতি হিসেবে তিনি যে দৃঢ় ভূমিকা পালন করেন তা বিপ্লবের হেফাযতের ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রেখেছিল। তৎকালীন ইসলামী সরকারের কয়েক জন মন্ত্রী ও মজলিসে শূরায়ে ইসলামী (পার্লামেন্ট)-এর সদস্য এবং বেশ কিছু সংখ্যক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সাথে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে থাকাকালে প্রতিবিপ্লবী সন্ত্রাসীদের পেতে রাখা একটি শক্তিশালী বোমার বিস্ফোরণের ফলে সংশ্লিষ্ট ভবনটি পুরোপুরি ধসে পড়ে। এর ফলে ড. বেহেশতী বাহাত্তর জন সাথিসহ শাহাদাত বরণ করেন।
ইসলামী ইরানের শহীদগণ তাঁদের পবিত্র রক্তের দ্বারা ইসলামী বিপ্লবকে বিজয়ী ও সুরক্ষিত করেছেন এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান রূপ চারাগাছটিতে প্রাণরস সঞ্চারিত করে বিশাল মহীরুহে পরিণত করেছেন। তাঁরা তাঁদের অবদান, ইসলামী বিপ্লব ও ইসলামী প্রজাতন্ত্রের মধ্যে বেঁচে আছেন এবং প্রতি মুহূর্তে সকলকে তাঁদের অবদানের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। তবে ইরানী জনগণ ও ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সরকার স্বীয় শহীদানের স্মরণকে কেবল এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে নি, বরং তাঁদের নাম সরকারি ও বেসরকারি নির্বিশেষে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার সাথে জুড়ে দিয়ে তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে শহীদগণের নামে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানÑ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়, দ্বীনী শিক্ষাকেন্দ্র, মসজিদ, গ্রন্থাগার, গবেষণাগার, বিজ্ঞান সংস্থা, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন, হাসপাতাল এবং বহু সরকারি স্থাপনা। এছাড়া তাঁদের নামে নামকরণ করা হয়েছে অসংখ্য বাজার, ময়দান, মহাসড়ক, সড়ক, গলি ও সেতুর। আর এ নামকরণ কেবল রাজধানী তেহরানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সমগ্র ইরানের অসংখ্য শহর, উপশহর ও গ্রামে এভাবে তাঁদের নামে অনেক কিছুর নামকরণ করা হয়েছে।
অন্যদিকে শীর্ষস্থানীয় শহীদ ব্যক্তিত্ববর্গের নামে যেমন বড় বড় প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নামকরণ করা হয়েছে তেমনি অন্য শহীদগণের নামে স্থানীয়ভাবে অনেক কিছুর নামকরণ করা হয়েছে। এভাবে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বত্র শহীদগণের স্মৃতিকে জীবিত রাখার যত নিদর্শন রয়েছে সে সবের ফিরিস্তি তৈরি করা আক্ষরিক অর্থে অসম্ভব না হলেও খুবই কঠিনÑ প্রায় অসম্ভব; তা করতে গেলে বিশাল এক বিশ্বকোষ রচনা করতে হবে। এখানে উদাহরণ স্বরূপ তেহরানের মাদ্রাসায়ে আলীয়ায়ে শহীদ মোতাহ্হারী, অধ্যাপক মোতাহ্হারী ‘ইল্মী ও সাংস্কৃতিক ফাউন্ডেশন, শহীদ বেহেশতী বিশ্ববিদ্যালয় (সাবেক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়), শহীদ বেহেশতী চিকিৎসাবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়, তেহরানের চামরান হাসপাতাল, আহ্ওয়াযের শহীদ চামরান বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদির নাম উল্লেখ করা যেতে পারে।
এভাবে কেবল শহীদগণের স্মৃতিকে অমর করে রাখার মাধ্যমেই তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনকে যথেষ্ট গণ্য করা হয় নি, বরং শহীদগণের পরিবারবর্গের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে তাঁদের যে কোনো ধরনের প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে বোনিয়াদে শহীদ (শহীদ ফাউন্ডেশন) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
ইরানের ইসলামী বিপ্লব ও ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের অস্তিত্বের সাথে তার শহীদানের অস্তিত্বের সম্পর্ক চিরদিন অবিচ্ছেদ্য হয়ে থাকবে এবং তাঁদের স্মরণ চিরদিন অমর হয়ে থাকবে। সেই সাথে তাঁরা চিরদিন ইরানী জনগণের জন্য উন্নত শির হয়ে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন।