All posts by dreamboy

বাংলা সাহিত্য ফারসি রসে ঋদ্ধকরণে কাজী নজরুল ইসলামের অবদান

বাংলা সাহিত্য ফারসি রসে ঋদ্ধকরণে কাজী নজরুল ইসলামের অবদান
মেহেদী হাসান

কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬ খ্রি.) বাংলা সাহিত্যের অভূতপূর্ব প্রতিভা এবং চিরন্তন বাঙালি জাতিসত্তার প্রতিভূ এক স্বভাব-কবি। আজীবন দারিদ্র্যের সাথে মিতালিতে অভ্যস্ত মহান নজরুল সৈনিক হিসেবে বিশ^যুদ্ধের রণাঙ্গনে, নির্ভীক সাংবাদিক হিসেবে ধূমকেতুর মতো প্রকাশনার জগতে এবং সাধারণ বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে রাজনীতির আঙ্গিনায় অবাধ বিচরণের পাশাপাশি কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস ও নাটকসহ সাহিত্যের সকল শাখায় নিজের যে অসামান্য সৃষ্টিশীলতার পরিচয় দিয়েছেন, বিশ^সাহিত্যে তার দৃষ্টান্ত বিরল। বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১ খি.) যুগে জন্মগ্রহণ করেও তিনি কেবল তাঁর প্রভাবমুক্ত হতেই সক্ষম হননি, আধুনিক বাংলা সাহিত্যে সূচনা করতে পেরেছিলেন এক অনন্য ধারার, যে ধারাটি মধ্যযুগে বাঙালি মুসলিম কবিদের প্রচেষ্টায় ‘মুসলমানি রীতি’ বলে স্বীকৃতি লাভ করেছিল। মূলত ‘আধুনিক বাংলা সাহিত্য কেবল হিন্দুদের সাহিত্য নয়, মুসলমানদের সাহিত্যও বটে’Ñ এ বিষয়টিকে যে কেবল প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন, তা-ই নয়, বাংলা সাহিত্য-জগতে রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী শ্রেষ্ঠত্বের স্থানটিকেও তিনি নিজের করে নিতে পেরেছেন। তিনি এ দুরূহ কাজটি করতে সক্ষম হয়েছিলেন কুলীন আধুনিক বাংলা সাহিত্যে অবহেলিত, কিন্তু বাংলার আপামর গণমানুষের মুখে মুখে সাধারণভাবে প্রচলিত ফারসি, আরবি ও উর্দু শব্দরাজিসমৃদ্ধ ‘মুসলমানি ভাষা’ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সাহিত্যকর্মে ব্যবহারের মাধ্যমে। তিনি এতে এতটাই সফল হয়েছিলেন যে, তাঁর জীবদ্দশাতেই এ সাহিত্য-রীতিকে কেন্দ্র করে বাংলা সাহিত্যে এক ব্যতিক্রমী ধারার উদ্ভব ঘটে। তাঁর সম ও উত্তরকালে হিন্দু মুসলমান বহু কবি-সাহিত্যিকই এ ধারায় প্রভাবিত হন। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে নজরুল যে ভাষার শব্দ সবচেয়ে বেশি ঋণ করেছেন, সেটি হচ্ছে ফারসি। শুধু ফারসি শব্দই নয়, বিশ্বখ্যাত ফারসি সাহিত্যের বিভিন্ন সাহিত্য-উপাদানও বাংলা সাহিত্যে প্রয়োগ করে এ সাহিত্যকে তিনি নিয়ে যান এক অনন্য উচ্চতায়। ফারসি সাহিত্যের বিশ^বিশ্রুত কবিদের বিভিন্ন সাহিত্যকর্মের অনুবাদ ও তাঁদের দর্শন ও ভাবধারাকে বাংলা সাহিত্যে প্রবিষ্ট করে তিনি এ সাহিত্যে একটি ভিন্নমাত্রা সংযোজন করেন। তাঁর এ বিস্ময়কর প্রতিভাই বাংলা সাহিত্যে তাঁকে দান করেছে শ্রেষ্ঠত্ব ও চিরন্তনতা; আসীন করেছে বাংলাদেশের ‘জাতীয় কবি’র আসনে।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, আর্য ও অনার্যদের সংমিশ্রণের ফসল হচ্ছে বাঙালি জাতি। এর পরবর্তী পর্যায়ে আরব-ইরান তথা মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম ব্যবসায়ী, ধর্মপ্রচারক ও বিজয়ী শাসকগোষ্ঠী বঙ্গীয় জনপদে ইসলাম প্রচারের ফলে বাঙালি জাতির মধ্যে হিন্দু ও মুসলমানÑ এ দুটি বৃহত্তর স্বতন্ত্র সম্প্রদায় অস্তিত্ব লাভ করে। ফলে অবধারিতভাবে ধর্মকে কেন্দ্র করে একই ভাষার দুটি ধারা সূচিত হয়। সনাতনী বাংলা এবং মুসলমানি বাংলা। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ থেকে এ দুটি ধারায়ই যথাক্রমে হিন্দু লেখকগণ মঙ্গলকাব্য এবং মুসলমান কবি-সাহিত্যিকগণ ফারসি সাহিত্যের অনুবাদ-নির্ভর বাংলা পুঁথিকাব্য, যেমন : ইউসুফ-জুলেখা, লাইলী-মজনু, জঙ্গনামা, নূরনামা প্রভৃতি কাব্য রচনা করতে থাকেন। মুসলমানি বাংলা বলতে আমরা ওই বাংলাকে বুঝি, যে বাংলা সমৃদ্ধ হয়েছিল ফারসি এবং ফারসিভাষী শাসকগোষ্ঠীর ভাষায় ব্যাপকহারে ব্যবহৃত আরবি শব্দাবলির দ্বারা, যেগুলোকে তারা ফারসি ভাষার আবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করত। বলা হয়ে থাকে, ফারসি-আরবি শব্দভা-ারসমৃদ্ধ এ মুসলমানি বাংলা-ই বাংলা ভাষাকে মৃতভাষায় পরিণত হবার হাত থেকে রক্ষা করে। এ ভাষাটি সৃষ্টির পটভূমি হচ্ছে : ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ারুদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খিলজি কর্তৃক বঙ্গদেশ মুসলিম শাসনের আওতায় আসার পর থেকে ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ৬৩৪ বছর বাংলার সরকারি তথা রাজভাষা ছিল ফারসি। চাকুরি পাবার ক্ষেত্রে এখন যেমন প্রতেকের ইংরেজিজ্ঞান থাকা আবশ্যক, ওই সময়কালে তেমনি হিন্দু, মুসলমান কিংবা অন্য যেকোনো ধর্মের অনুসারীকেই সরকারি চাকুরি পেতে হলে ফারসি ভাষা জানতেই হতো। শাসকদের ভাষা হিসেবে এটি ছিল সকল সম্প্রদায়ের অভিজাত শ্রেণির ভাব বিনিময়ের মাধ্যম। ফলে এ ছয় শতাধিক বছরে হাজার হাজার ফারসি এবং ফারসিতে ব্যবহৃত আরবি শব্দ ব্যাপকহারে বাংলা ভাষায় অনুপ্রবেশ করে। উল্লেখ্য, ফারসি ভাষা বাঙালি জাতির উপর এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে, ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ কর্তৃক এ দেশ বিজিত হলেও ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ৮১ বছর তারা তাদের ভাষা ইংরেজি দ্বারা ভারতবর্ষে শাসনকার্য পরিচালনা করতে সক্ষম হয়নি। এ সময়ে তাদেরকেও ফারসি ভাষা শিখেই এদেশ শাসন করতে হয়েছে। এমনকি ১৮৩৮ সালে এক রাজকীয় ফরমানের মাধ্যমে ইংরেজিকে সরকারি ভাষায় রূপান্তরিত করা হলেও বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগ পর্যন্ত ফারসি ভাষার ব্যবহার ও চর্চা এদেশের হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েরই শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে স্ব-মহিমায় বিদ্যমান ছিল।
এ কথা সর্বজনস্বীকৃত যে, ফারসির ভাষাশৈলী সাহিত্যচর্চাÑ বিশেষত কাব্যচর্চার জন্য বিশ্বের যে কোনো ভাষার চেয়ে অনুকূলতর। তবে কেবল ভাষাশৈলীই নয়, এ ভাষায় বিদ্যমান প্রেম, মানবতা ও নৈতিকতার বাণী ও শিক্ষা বাঙালি কবি-সাহিত্যিকদের ভীষণভাবে আকৃষ্ট করত। আর এ কারণেই তাঁরা বাধ্য হয়ে নয়, বরং মনের টানেই এ ভাষায় সাহিত্যচর্চা করতে আগ্রহী হয়েছিলেন। আর সে কারণেই ১৮৩৮ সালে সরকারিভাবে এ ভাষার পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ হয়ে গেলেও এর চর্চা সাধারণের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই তখনও বিদ্যমান ছিল। তবে এটা ঠিক যে, চর্চাটি তখন ক্রমক্ষয়িষ্ণু ছিল।
বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে, বিশেষ করে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে ইসলাম ধর্মের দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে তখনও ফারসি ভাষার চর্চা সমাজে বিদ্যমান ছিল; এমনকি মধ্যযুগে যে বাঙালি হিন্দু কবি-সাহিত্যিকগণ বিদ্বেষপ্রসূতভাবে এ ভাষার শব্দরাজি ব্যবহার থেকে নিজেদের বিরত রেখেছিলেন, তাঁরাও এ যুগে তাঁদের গল্প-কবিতায় ফারসি-আরবি শব্দের ব্যবহার শুরু করেন, এদের মধ্যে রাজা রামমোহন রায়, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ও মোহিতলাল মজুমদারের নাম প্রণিধানযোগ্য। অত্র প্রেক্ষাপটটির এ কারণে অবতারণা করা হলো, যাতে আগ্রহী পাঠকগণ অনুধাবন করতে পারেন যে, ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে জন্ম নেয়া কাজী নজরুল ইসলাম এমন একটা সময়, পরিবেশ ও পরিবারে বেড়ে উঠেছিলেন, যেখানে ফারসি কোনো অপরিচিত ভাষা ছিল না এবং এর চর্চা ক্ষীণভাবে হলেও সেখানে তখনও বিদ্যমান ছিল। তাই এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি গভীর আকর্ষণ জিনগতভাবেই নজরুলের মধ্যে বিরাজমান ছিল। এটা ছিল শত শত বছরের প্রাচীন এমন এক উত্তরাধিকার, যা দ্বারা তিনি বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
ফারসি ভাষাজ্ঞানের সাথে নজরুলের পরিচয়, যখন তিনি চুরুলিয়া গ্রামের মক্তবে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করতে যান। এ কথা স্বতঃসিদ্ধ যে, তৎকালীন মক্তবসমূহে বাংলা, উর্দু ও আরবি শেখানোর পাশাপাশি কবি শেখ সাদির গুলিস্তান, বুস্তান ও পান্দনামা, ফরিদুদ্দিন আত্তারের পান্দনামা ও মানতেকুত্তাইর এবং মৌলানা রুমির মসনভি শরিফের পাঠও দেয়া হতো। তাই মক্তবে পাঠগ্রহণকালীন তিনি ফারসির উপর প্রাথমিক জ্ঞান লাভ তো করেনই, উপরন্তু শিক্ষালাভ শেষে তিনি যখন একই মক্তবে শিক্ষকতা শুরু করেন, তখন হয়ত ওই ফারসি কিতাবাদি তাঁকে পড়াতেও হতো। এছাড়া তাঁর জীবনীগ্রন্থসমূহে দেখা যায়, শৈশবকালে তিনি তাঁর চাচা বজলে করিমের কাছে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের উপর তালিম নেন। এভাবে তাঁর ফারসি ভাষাজ্ঞান ধীরে ধীরে আরো শাণিত হয়ে ওঠে।
ভৌগোলিক দিক বিবেচনা করলে দেখা যায়, পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামের কিছুটা উত্তর থেকেই শুরু হয়েছে উর্দুভাষী বিহারী অধ্যুষিত ভারতের ঝাড়খ- রাজ্য। সে কারণের চুরুলিয়া এলাকার মানুষের মাতৃভাষা বাংলা হলেও তা ছিল ব্যাপক মাত্রায় উর্দু প্রভাবিত। আর যেহেতু ফারসি শব্দভা-ারকে আশ্রয় করে হিন্দি ভাষা থেকে উর্দু ভাষার জন্ম, তাই ভৌগোলিক কারণেও নজরুল উর্দু ও উর্দুর হাত ধরে ফারসি শব্দরাজির সাথে পরিচিতি লাভ করেন সেই ছোটবেলাতেই।
নজরুলের এ ফারসিজ্ঞান পরিপক্বতা লাভ করে যখন তিনি ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ৪৯ নং বাঙালি পল্টনে যোগদান করে বর্তমান পাকিস্তানে অবস্থিত করাচি শহরে গমন করেন। সেখানে তিনি ১৯১৯ সাল পর্যন্ত অবস্থান করেন এবং ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের উপর গভীর জ্ঞান লাভ করেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর অনূদিত ‘রুবাইয়াত-ই-হাফিজ’ গ্রন্থের ‘মুখবন্ধে’ নজরুল নিজেই উল্লে¬খ করেন :
আমি যখন স্কুল পালিয়ে যুদ্ধে গেছি, সে আজ ইংরেজি ১৯১৭ সালের কথা, সেখানেই প্রথম হাফিজের সাথে পরিচয় হয়। আমাদের বাঙালি পল্টনে একজন মৌলভী সাহেব থাকতেন। একদিন তিনি দীওয়ান-ই-হাফিজ থেকে কতগুলি কবিতা আবৃতি করে শোনান, শুনে আমি এমনি মুগ্ধ হয়ে যাই যে, সেদিন থেকেই তাঁর কাছে ফারসি ভাষা শিখতে আরম্ভ করি। তাঁর কাছেই ক্রমে ক্রমে ফারসি কবিদের প্রায় সমস্ত বিখ্যাত কাব্যই পড়ে ফেলি।
তিনি যে ফারসি সাহিত্যের একজন বড় অনুরাগী ছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর প্রিয় বন্ধু মুজাফফর আহমদের ভাষ্যেও। করাচি থেকে ফিরে আসার পর তিনি কবির গাঁঠরির মধ্যে অন্যান্য জিনিসের সাথে ফারসিতে লেখা দিওয়ান-ই-হাফিজের একটি বড় সংস্করণও দেখতে পান বলে জানান। উল্লে¬খ করার মতো বিষয় হলো, কবি নজরুল তাঁর সফল কবিতা রচনা শুরু করেছিলেন হাফিজের কবিতা দিয়েই। কবিতাটির নাম ছিল ‘আশায়’ এবং এটি বাংলা ১৩২৬ সালে প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। হাফিজের একটি গজলের ভাবধারা অবলম্বনে তিনি রচনা করেছিলেন এ কবিতাটি, কবিতার প্রথম দুটি লাইন ছিল এমন :
নাইবা পেল নাগাল, শুধু সৌরভেরই আশে
অবুঝ সবুজ দূর্বা যেমন যুঁই কুঁড়িটার পাশে…
তিনি চেয়েছিলেন এ কবিতার মধ্যমে ইরানি কবি হাফিজের কাব্যে বাংলার সবুজ দূর্বা ঘাস ও যুঁই ফুলের সুবাসকে ছড়িয়ে দিতে। ফারসি কাব্য বাংলা ভাষায় অনুবাদের মাধ্যমে তিনি চেয়েছিলেন পারস্যের প্রেমময় আবহকে বাংলা সাহিত্যে আনয়ন করে একে পরিপূর্ণতায় পৌঁছে দিতে। তিনি ইরানের গোলাব আর নার্গিসের সুবাসকে বাংলার যুঁই-চম্পা-চামেলীর বাগিচায় স্থান দিয়ে একে আরও সমৃদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। তিনি শোনাতে চেয়েছিলেন কোকিলের পাশাপাশি ইরানি বুলবুলির গান, যাতে বাঙালি জাতি এক নবসুরের রসাস্বাদন করে পরিতৃপ্ত হতে পারে। তিনি তাঁর প্রচেষ্টায় শতভাগ সফলতাও লাভ করেছিলেন। তিনি ইরানের দার্শনিক কবি ওমর খৈয়ামের ১৯৭টি রুবায়ি বা চতুষ্পদী কবিতা অনুবাদ করেছিলেন। তবে এতে তিনি এতটাই মুন্সিয়ানা দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, সেগুলো কি অনুবাদ নাকি মৌলিক রচনা, অনুসন্ধিৎসু পাঠকগণও পাঠ করার সময় সে পার্থক্যটি নির্ণয় করতে সত্যিই সংশয়ে পড়ে যান। উদাহরণত খৈয়ামের একটি রুবাই:
گویند کسان که بهشت با حور خوش است
من می گویم آب انگور خوش است
این نقد بگیر و دست از نسیه مدار
که آواز دهل شنیدن از دور خوش است
(رباعیات، شماره: )
গুইয়ান্দ্ কাসা’ন্ কে বেহেশ্ত্ বা’ র্হু খোশ্ আস্ত্
মান্ মী গুইয়াম্ আ’বে আর্ঙ্গূ খোশ্আস্ত্
ঈন্ নাগ্দ্ বেগীরো দাস্ত্ আয্ নাসিয়ে মাদার্’
কে আ’ওয়া’জে দোহ্ল্ শেনীদান্ আয্ র্দূ খোশ্ আস্ত্
নজরুলের অনুবাদ:
করছে ওরা প্রচার-পাবি স্বর্গে গিয়ে হুর-পরী
আমার স্বর্গ এই মদিরা, হাতের কাছের সুন্দরী
নগদা যা পাস তাই ধরে থাক, ধারের পণ্য করিসনে,
দূরের বাদ্য মধুর শোনায়, শূণ্য হাওয়ার সঞ্চারি।
ইরানের বিশ্ববিখ্যাত সুফিকবি মৌলানা জালালুদ্দিন রুমির বিখ্যাত গ্রন্থ মসনভি শরিফের শুরুর অংশটি:
بشنو از نی چون حکایت می کند
از جدایی¬¬ها شکایت می کند
(مثنوی، جلد اول، مقدمه)
বেশ্নু আয্ নেই চূন্ হেকা’ইয়াত্ মী কোনাদ্ আয্ জোদা’ঈহা’ শেকা’ইয়াত্ মী কোনাদ্
কবি নজরুল অনুবাদ করেন ‘বাঁশির ব্যথা’ শিরোনামে এভাবে :
শোন দেখি মন বাঁশের বাঁশির বুক জেগে কী উঠবে সুর,
সুর তো নয় ও কাঁদবে যে রে বাঁশরি বিচ্ছেদ বিধুর।
কিন্তু রুমির দর্শনে অনুপ্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ নজরুল তাঁর খুব বেশি কবিতা অনুবাদ করেননি, যেমনটি করেছেন ইরানের প্রেমিক কবি হাফিজের কবিতার। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, নজরুল সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত ছিলেন হাফিজের দ্বারাই। ইরানের এ অনন্য কবির বহু গজল যেমন তিনি অনুবাদ করেছেন, তেমনি প্রায় ৭৩টি রুবায়ি বা চতুস্পদী কবিতাও সরাসরি মূল ফারসি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন বলে নজরুল নিজেই উল্লে¬খ করেছেন। হাফিজকে গভীরভাবে অধ্যয়নের ফলে নজরুল বাংলার ভাষা-শক্তি, ভাষা-চরিত্র এবং ভাষা-মেজাজের স্টাইল বা ভঙ্গিকে আমূল বদলে দিতে পেরেছিলেন। এর প্রমাণ মেলে নজরুলকৃত হাফিজের ফারসি কাব্য-ছন্দের হুবহু অনুকরণে অনূদিত কয়েকটি গজলের পঙ্ক্তি থেকে। যেমন :
হাফিজের গজল :
الا یا ایها الساقی ادر کأسا و ناولها
که عشق آسان نمود اول ولی افتاد مشکلها
(دیوان حافظ، شمارۀ غزل: ১)
আলা’ ইয়া’ আইয়্যুহাস্ সা’ক্বী আর্দে কা-সান্ ওয়া’ না’ভেল্হা’
কে এশ্ক্ব্ আ’সা’ন্ নেমুদ্ আওয়াল্ ওয়ালী ওফ্তা’দ্ মোশকেল্হা’
সুনিপুণ দক্ষতায় নজরুল এ গজলটিকে ঠিক একই ছন্দে বাংলায় অনুবাদ করেন নি¤œলিখিতভাবে :
হ্যাঁ, এয় সাকি, শরাব ভর লাও, বোলাও পেয়ালী চালাও হরদম
প্রথম প্রেম পথ সহজ সুন্দর, শেষের দিক তার ঢালাও কর্দম!
এছাড়া কবি হাফিজের বিখ্যাত গজল :
اگر آن ترک شیرازی بدست آرد دل مارا
بخال هندویش بخشم سمرقند و بخارارا
(دیوان حافظ، شمارۀ غزل: ২)
আর্গা অ’ন্ র্তোকে শীরা’যী বেদাস্ত অ’রাদ্ দেলে মা’রা’
বেখা’লে হিন্দুইয়াশ্ বাখ্শাম্ সার্মাকান্দো বোখা’রা’রা’
ফারসি ছন্দের পুরোপুরি অনুসরণ করলেও তাঁর বাংলা অনুবাদের ক্ষেত্রে অর্থের কোনো ব্যত্যয়ই এতে ঘটেনি। উদাহরণত নজরুলের অনুবাদ :
যদিই কান্তা শিরাজ সজনি ফেরত দেয় মোর চোরাই দিল ফের
সমরকন্দ আর বোখারায় দিই বদল তার লাল গালের তিলটের।
এভাবে নজরুল কেবল ফারসি কবিতার অনুবাদ দ্বারাই নয়, বরং ফারসি কবিতার ছন্দকেও চমৎকার মুন্সিয়ানার সাথে বাংলা কবিতার জগতে সংযোজন করে বাংলা কাব্যসাহিত্যকে সুসমৃদ্ধ করেছেন।
এছাড়া তিনি কবি হাফিজ ও বাংলার সুলতান গিয়াসুদ্দিন আজম শাহের বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ যে গযলটি বিদ্যমান, সে গযলটিরও দুটি লাইন অত্যন্ত সফলতার সাথে চমৎকার কাব্যানুবাদ করেছেন, যার মধ্যে বিখ্যাত পঙ্ক্তিটি হচ্ছে :
হাফিজ :
شکر شکن شوند همه طوطیان هند
زین قند پارسی که به بنگاله می رود
(دیوان حافظ، شمارۀ غزل: ২২৩)
শের্কা শেকান্ শাভান্দ্হামে তুতীয়া’নে হেন্দ্
যিন্ গান্দে র্ফাসি কে বে বাঙ্গা’লে মী রাভাদ্
নজরুল :
আজকে পাঠাই বাংলায় যে ইরানের এই ইক্ষুশাখা
এতেই হবে ভারতের সব তোতার চঞ্চু মিষ্টি মাখা।
নজরুল দৃশ্যত রুমি, হাফিজ ও খৈয়ামÑ এই তিন ইরানি কবির রচনা অনুবাদ করলেও এর অর্থ এই নয় যে, তিনি কেবল এদের দ্বারাই উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত ছিলেন; বরং তিনি গোটা ফারসি সাহিত্য দ্বারাই প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি যেমন শেখ সাদি’র নৈতিকতা ও মানবতার দ্বারা উদ্বুদ্ধ ছিলেন, তেমনি ফেরদৌসির বীররসও আস্বাদন করেছিলেন। তিনি শেখ সাদির বিখ্যাত নাত ‘বালাগাল উলা বিকামালিহী’ অবলম্বনে রচনা করেছিলেন নাতে রাসুল :
কূল মাখলুক গাহে হযরত বালাগাল উলা বেকামালিহী
আঁধার ধরায় এলে আফতাব কাশাফাদ্দোজা বিজামালিহী
এছাড়া নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাসহ বীররস সমৃদ্ধ কবিতাগুলি আমাদের ফেরদৌসির ‘শাহনামা’র কথাই মনে করিয়ে দেয়। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, নজরুল ইরান, ফারসি ভাষা ও ফারসি সাহিত্যের দ্বারা গভীরভাবে অনুপ্রাণিত ও প্রভাবিত ছিলেন। কবির এমন একটি গান বিদ্যমান রয়েছে, যেটিতে তিনি সরাসরি কয়েকটি ফারসি ছন্দের উল্লেখ করেছেন। গানটির প্রথম পঙ্্ক্তি হলো :
মোফাআলতুন মোফাআলতুন, মোফাআলতুন মোফাআলতুন
কানের তার তুল দোদুল দুল, কোথায় তার তুল কোথায় তার তুল
ফারসি সুরের উপরেও কবি বেশ কিছু গান লিখেছেন। এর মধ্যে ‘শুকনো পাতার নূপুর পায়ে’ এবং নাতে রাসুল ‘ত্রিভূবনের প্রিয় মোহাম্মাদ এলরে দুনিয়ায়’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
তাঁর রচনায় ফারসি শব্দের দেদার ব্যবহার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তিনি এটি করেছেন অবলীলায় এবং স্বভাবগতভাবেই। কারণ তাঁর জন্মস্থান চুরুলিয়ার মাতৃভাষা বাংলার রূপটি ছিল এমনই ফারসি-উর্দু মিশ্রিত। তাই তাঁর পক্ষে এমন সব ফারসি শব্দের ব্যবহার বাংলা সাহিত্যে ঘটানো সম্ভব হয়েছে, যা সেই সময়কার সাধারণ লোকজন তাদের দৈনন্দিন জীবনের কথাবার্তায় ব্যবহার করত। সত্যিকারার্থেই আধুনিক বাংলা সাহিত্যে সেসব শব্দের ব্যবহার ছিল অভূতপূর্ব। তাঁর ব্যবহৃত এ ধরনের কিছু ফারসি শব্দ নিম্নরূপ :
খোদা, নামাজ, রোজা, জায়নামাজ, আসমান, জমিন, বেহেশত, দোজখ, আমদানি, আরাম, আহাজারি, ঈদগাহ, একদম, কম, কমজাত, কমজোর, কমবখত, কামান, কিশতি, খঞ্জর, খাক, খাজা, খামোশ, খাঞ্চা, খোশ আমদেদ, খোশখবর, খোশনসিব…।
এমন অসংখ্য ফারসি শব্দ নজরুল অত্যন্ত সফলতার সাথে নিজ সাহিত্যকর্মে ব্যবহার করেছেন, যা মূলত বাংলা সাহিত্যকেই করেছে সমৃদ্ধ এবং তেজোদ্দীপ্ত। তাঁর এ অবদান অবিস্মরণীয়। আর এ কারণেই নজরুল বাংলা সাহত্যে চির-অম্লান, চির-ভাস্বর হয়ে থাকবেন।

লেখক : নজরুল গবেষক এবং সহকারী অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়।

সহায়ক গ্রন্থ
১. নজরুল রচনাবলী- রফিকুল ইসলাম সম্পাদিত, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
২. নজরুল সাহিত্য বিচার- শাহাবুদ্দীন আহ্মদ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা।
৩. নজরুল সাহিত্যে ফারসি ভাষার প্রভাব- রাশেদুল হাসান শেলী এবং মাহবুব বারী সম্পাদিত, নজরুল গবষেণা ও লোকসংস্কৃতি ইনস্টিটিউট, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।
৪. নজরুলের কাব্যানুবাদ- নজরুল ইনস্টিটিউট, ঢাকা।
৫. যুগ ¯্রষ্টা নজরুল- খান মুহম্মদ মঈনুদ্দীন, আলহামরা প্রকাশনী, ঢাকা।
৬. রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম- কাজী নজরুল ইসলাম, মোহন লাইব্রেরি, কলিকাতা।
৭. دیوان حافظ، شمس الدین محمد حافظ، انتشارات کتاب آبان، تهران
৮. رباعیات عمر خیام، حکیم عمر خیام نیشابوری، امیر کبیر، تهران
৯. مثنوی معنوی، مولانا جلال الدین محمد، کتابخانۀ ملی ایران، تهران

 

শাহনামা কাব্যগ্রন্থ : আধ্যাত্মিকতা, প্রজ্ঞা ও আদর্শের সম্মিলন

শাহনামা কাব্যগ্রন্থ : আধ্যাত্মিকতা, প্রজ্ঞা ও আদর্শের সম্মিলন
ড. তারিক সিরাজী

ফারসি সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ও বরেণ্য কবি হাকিম আবুল কাসেম ফেরদৌসি [৯৪০-১০২০/১০২৫ খ্রি. (আনুমানিক)] ছিলেন ইরানের প্রাচীন ইতিহাস, ঐতিহ্য ও গৌরবগাথার সার্থক রূপকার। ইরানের মহাকবি হিসাবেই তিনি সমধিক পরিচিত। তাঁর মর্যাদার এই বিশালত্বের কারণে তাঁর জীবন-কাহিনী রূপকথার সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে গেছে। বিশ^বিশ্রুত বীরত্বগাথা শাহনামা রচনার মধ্য দিয়ে তিনি মূলত ইরানিদের জাতিসত্তা ও ফারসি ভাষার মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যকে সংরক্ষণ করেছেন। এ কালজয়ী সাহিত্যকর্মটির গুরুত্ব অনুধাবন করে পৃথিবীর অধিকাংশ জীবন্ত ভাষায় এ গ্রন্থটি অনূদিত হয়েছে এবং অসংখ্য সাহিত্যামোদীর কাছে তা হয়েছে সমাদৃত। বর্তমানে গ্রন্থটি বিশ^সাহিত্যে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। যে কারণে এ কাব্যগ্রন্থটিকে কেবল ইরানি ও ফারসি ভাষাভাষীদের সম্পদ হিসাবেই পরিগণিত করা যায় না। কারণ, এর এক বৈশ্বিক আবেদন রয়েছেÑ যা সাহিত্যমোদী, গবেষক ও সাধারণ মানুষের কাছেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বহু গবেষক মানের বিচারে শাহনামা-কে বিশে^ রচিত অনেক মহাকাব্যের চেয়ে উন্নততর বলে অভিহিত করে থাকেন। শুধু তাই নয়, শাহনামার অনুকরণে অনেক বীরত্বগাথাও রচিত হয়েছেÑ যা এ গ্রন্থের ঐতিহাসিকতা ও গুরুত্বের প্রমাণ বহন করে। উল্লেখ্য যে, জার্মান প্রাচ্য ও ভাষাতত্ত্ববিদ থিওডর নোল্ডেক ও হারমান এথি (ঞযবড়ফড়ৎ ঘস্খষফবশব ধহফ ঐবৎসধহহ ঊঃযল্ক) বিস্তর পরিশ্রম ও গবেষণার মাধ্যমে এ অমর কবির নির্ভরযোগ্য জীবনী ও শাহনামার প্রকৃত তথ্য উদ্ঘাটনে সফল হয়েছিলেন।
ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, প্রায় তিনশ বছরকালব্যাপী পারস্য সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ফারসি ভাষা উপযুক্ত মর্যাদা থেকে বঞ্চিত ও অবহেলিত হয়ে উঠেছিল। ফেরদৌসি তাঁর এ রচনার মাধ্যমে লুপ্তপ্রায় পারস্যের প্রাচীন সভ্যতা-সংস্কৃতি ও ফারসি ভাষা পুনরুদ্ধারে এগিয়ে আসেন। তিনি তাঁর শাহনামার শ্লোকে শ্লোকে জাতীয় অনুভূতি, উপলব্ধি ও চেতনার এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন যার দ্বারা ইরানি জনগণ ব্যাপকভাবে জাতীয় মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে শাহনামা হলো ভিনদেশি শাসনশৃঙ্খলের বিরুদ্ধে বহুকালের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ এবং জাতীয়তার মূর্ত প্রতীক।
শাহনামা কাব্যগ্রন্থের তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে মূলত প্রাচীন লোকগাথা, ইতিহাস, ধর্মগ্রন্থসমূহ, গল্প, উপাখ্যান, ও কিংবদন্তি থেকে। এছাড়া এতে বর্ণিত ঘটনাসমূহের ব্যাপ্তিকাল প্রায় তিন হাজার আটশ বছরের অধিক। কবি ফেরদৌসি এ দীর্ঘ সময়কালকে উপাখ্যান আর ইতিহাস এ দু’টি ভাগে বিন্যস্ত করেছেন। এছাড়া ঊনচল্লিশটি রাজবংশের শাসন-বিবরণী এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। উল্লেখ্য যে, শাহনামা গ্রন্থটি সুবিন্যস্ত আকারে উপস্থাপন করার উদ্দেশ্যে ফেরদৌসি তাঁর জনৈক বন্ধু কবি দাকিকির পা-ুলিপির সাহায্য নিয়েছিলেন। শাহনামা রচনায় এটি ছিল ফেরদৌসির সবচেয়ে বড় সূত্র। কারণ, ফেরদৌসির পূর্বে সর্বশেষ শাহনামা রচয়িতা ছিলেন কবি দাকিকি তুসি। মূলত দাকিকি তৎকালীন শাসক নুহ ইবনে মানসুর সামানির নির্দেশে শাহনামা রচনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন এবং এক হাজার পঙ্ক্তি রচনাও করেছিলেন। কিন্তু কবি দাকিকি পুরো রচনার কাজ সম্পন্ন করে যেতে পারেননি। তথ্য ও উপাত্তের প্রমাণস্বরূপ ফেরদৌসি তাঁর শাহনামায় দাকিকির উল্লিখিত এক হাজার বেইত তথা পঙ্ক্তি অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ফেরদৌসির শাহনামায় যে বিষয়গুলোর উল্লেখ রয়েছে তা হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালার আনুগত্য, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা, বীরদের মানসিকতা, প্রচেষ্টা, ন্যায়পরায়ণতা, রাজনীতি, জাতীয় ঐক্য ও সংহতি। এতে শিক্ষণীয় অনেক বিষয়ের উল্লেখের পাশাপাশি রয়েছে বিশ্বদর্শন।
সাহিত্যামোদীদের নিকট কবি ফেরদৌসির গুরুত্ব ও আবেদন কেবল তাঁর ভাষার লালিত্য ও মাধুর্যের মধ্যেই নিহিত নয়; বরং তাঁর ধর্মীয় চেতনা ও জাতীয়তাবাদের মাঝেও বিদ্যমান রয়েছে। তাঁর রচিত শাহনামা গ্রন্থের পরতে পরতে গল্পের কাহিনীগুলো এমনিভাবে বিধৃত রয়েছে যে প্রতিটি চরিত্রই যেন একেক জন পর্যবেক্ষক হিসাবে কাজ করছে। যে কারণে এ মহাকাব্য সাহিত্যের একটি উচ্চমার্গে গিয়ে পৌঁছেছে। ফেরদৌসি তাঁর শৈল্পিক বর্ণনাগুলোতে অলক্সকারশাস্ত্রীয় উপাদানগুলোও অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তুলে ধরেছেন, যা ছিল সে সময়ের বিরল ব্যবহার। এ ছাড়া তিনি প্রচলিত সাহিত্যরীতির বিপরীতে অন্তর্নিহিত বর্ণনার দিকে অগ্রসর হয়েছেন আর এটি ছিল তাঁর নিজস্ব উদ্ভাবিত শৈলী। এ ধরনের সাহিত্যশৈলী ফারসি সাহিত্যে বিরল। তিনি তাঁর শাহনামা কাব্যগ্রন্থকে ধ্বনি, শব্দ চয়ন, এমনকি ব্যাকরণসহ সকল স্তরে একটি সুশৃঙ্খল গঠন কাঠামোর মাধ্যমে বিন্যস্ত করেছেন। যার ফলে এটি ভাষাতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকেও সর্বোচ্চ ও চূড়ান্ত অবস্থানে রয়েছে।
কবি ফেরদৌসি ৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে শাহনামা রচনা শুরু করেন এবং ১০১০ খ্রিস্টাব্দে ৭৫ বছর বয়সে তা সমাপ্ত করেন। তিনি তাঁর যৌবনকালসহ পরবর্তী পুরো জীবনকালটাই এ সাহিত্যকর্ম রচনায় ব্যয় করেছিলেন। দীর্ঘ ত্রিশ বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে তিনি যে শাহনামা কাব্যগ্রন্থটি রচনা করে গোটা পারস্যকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেনÑ তা তাঁর বক্তব্যেই নিহিত রয়েছে। তিনি বলেন :
بسي رنج بردم در اين سال سي عجم زنده كردم بدين پارسي
আমি বহু কষ্ট ভোগ করেছি এই দীর্ঘ ত্রিশটি বছর ধরে
আর এ পারসির (ফারসি) মাধ্যমে পারস্যকে জীবন্ত করেছি।
ফেরদৌসির যুগে আনুষ্ঠানিকভাবে গল্প বলা ও শোনার একটা প্রচলন ছিল। কারণ, সে সময় বেশিরভাগ লোকই পড়তে ও লিখতে জানত না। এ ধরনের গল্প পাঠের আসরে পরিবেশন করা হতো ধর্মীয় ও পৌরাণিক কাহিনী। পুরাণপাঠের এ কাজটিকে বলা হয় নাক্কালি আর যিনি কাহিনীগুলো পাঠ করে শোনান বা উপস্থাপন করেন তাঁকে বলা হয় নাক্কাল বা পুরাণপাঠকারী। তাঁর হাতে থাকত একটি লাঠি যা দিয়ে তিনি চরিত্র চিত্রায়ণ করতেন। বলা যায় ঠিক আমাদের দেশের পুথি পাঠের ন্যায়। অনেকের অভিমত পুরাণপাঠকারীর গল্প বলার কাজটিকে সহজতর ও প্রাণবন্ত করার লক্ষ্যেই ফেরদৌসি সহজ-সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় পৌরাণিক কাহিনীগুলো রচনা করে তা শাহানামা কাব্যগ্রন্থে তুলে ধরেছেন। কবি ফেরদৌসি নিজেই শাহনামা গ্রন্থ রচনার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন :
توانم مگر پايه‌اي ساختن بر شاخ آن سرو سايه فکن
کزين نامور نامةشهريار به گيتي بمانم يکييادگار
تو اين را دروغ و فسانه مدان به رنگ فسون و بهانه مدان
ازو هر چه اندر خورد با خرد دگر بر ره رمز و معني برد
يکي نامه بود از گه باستان فراوان بدو اندرون داستان
پراگنده در دست هر موبدي ازو بهره‌اي نزد هر بخردي
يکي پهلوان بود دهقان نژاد دلير و بزرگ و خردمند و راد
پژوهندةروزگارنخست گذشتهسخنهاهمهبازجست
ز هر کشوري موبدي سالخورد بياورد کاين نامه را ياد کرد
بپرسيدشان از کيان جهان وزان نامداران فرخ مهان
که گيتي به آغاز چون داشتند که ايدون به ما خوار بگذاشتند
چه گونه سرآمد به نيک اختري برايشان همه روز کند آوري
بگفتند پيشش يکايک مهان سخنهاي شاهان و گشت جهان
چو بشنيد ازيشان سپهبد سخن يکي نامور نامه افکند بن
چنين يادگاري شد اندر جهان برو آفرين از کهان و مهان

‘আমি উড়ন্ত জলধর, কিন্তু পদযুগ বিন্যস্ত করেছি
সেই ছায়াচ্ছন্ন দেবদারুর উন্নত শাখায়।
কারণ, যশস্বী নরপতিগণের এই ইতিকথা
দুনিয়ায় আমার স্মারক হয়ে থাকবে।
তুমি এ’কে অলীক কাহিনী বলে মনে করো না,
গণ্য করো না তাকে যুগ-চিত্তের উৎসার মাত্র বলে।
এর কিছু কাহিনীতে রয়েছে বুদ্ধির ও জ্ঞানের দীপ্তি,
অন্যরা নিজেদের মধ্যে বহন করছে রহস্যময় তাৎপর্য।
অতীত কালে ছিল পূরাকীর্তি সম্বলিত এক গাথা,
তার মধ্যে সন্নিবেশিত ছিল অনেক উপাখ্যান।
প্রত্যেক জ্ঞানী ব্যক্তির মুখে মুখে তা ছড়িয়েছিল,
সেগুলি থেকে তারা সংগ্রহ করত প্রজ্ঞা ও তত্ত্বের সম্পদ।
কোন নিভৃত গ্রামাঞ্চলের এক বীর সন্তান
বর্ষীয়ান সাহসী জ্ঞানী ও দানশীলÑ
আদিম যুগের সেই ইতিকথার খোঁজে তৎপর হলো,
কাহিনীগুলোর উদ্ধার মানসে সে ঘুরে বেড়ালো বহুদিন।
ফিরলো সে বহু নগরীর পথে পথে,
ফলে সংগৃহীত হলো এই গাথা।
সবারই কাছে সে জিজ্ঞাস করেছে কেয়ানী বংশের আদিম ইতিহাস,
জেনেছে সে তাদের থেকে যশস্বী সেই নক্ষত্রের পরিচয়।
জেনেছে, সেই আদিম যুগে রাজারা কেমন করে শাসন করতেন পৃথিবী,
আর আজ কেমন করে লুপ্ত হয়েছে সেই কীর্তিকলাপ?
প্রশ্ন করেছে সে, কেমন করে অস্ত গেলো সেই সুভগ নক্ষত্র,
কাল কেমন ছিল সেই বীরবৃন্দের উপর?
দলপতিগণ একে একে বিবৃত করেছেন তার কাছে
রাজ-রাজড়াদের কীর্তিগাথা ও জগতের পরিবর্তনের ইতিহাস।
সেই বীর-জ্ঞানী তাঁদের কাছ থেকে জেনেছে অতীতের সব কীর্তি,
তারপর সেই সংগ্রহ থেকে রচিত হয়েছে এক মহান পুরাণ কথা।
জগতে সেই গাথাই হয়ে আছে অতীতের স্মৃতি,
সর্বত্র জ্ঞানী ও ধর্মবেত্তা জানিয়েছে তাকে স্বাগতম।’(মনিরউদ্দীন ইউসুফ অনূদিত শাহনামা, ১ম খ-, পৃ. ১৩-১৪)

কবি ফেরদৌসি তাঁর এ কাব্যগ্রন্থটি শুরু করেছেন মহান আল্লাহ তায়ালার নামে। তিনি এ সাহিত্যকর্মে দেখাতে চেয়েছেন যে, মানুষ এক আল্লাহর সৃষ্টজীব। সমগ্র বিশ^জগতের একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ও অধিপতি হলেন মহান আল্লাহ। ইসলামের ন্যায় সত্যিকার ও পরম ধর্মের মধ্যেই শান্তি বিরাজমান। আমাদের চিন্তা ও দৃষ্টির সীমারেখার ভিতর ও বাহিরের সকল কিছুই আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি। তিনি তাঁর এ গন্থের শুরু-সূচনাতে সহজ ও সাবলীল ভাষায় আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা ব্যক্ত করেছেন। কবি বলেন :
به نام خداوند جان و خرد کزين برتر انديشه برنگذرد
خداوند نام و خداوند جاي خداوند روزي ده رهنماي
خداوند کيوان و گردان سپهر فروزنده ماه و ناهيد و مهر
ز نام و نشان و گمان برترست نگارندهۀبرشدهپيکرست
به بينندگان آفريننده را نبيني مرنجان دو بيننده را
نيابد بدو نيز انديشه راه که او برتر از نام و از جايگاه
سخن هر چه زين گوهران بگذرد نيابد بدو راه جان و خرد
خرد گر سخن برگزيند همي همان را گزيند که بيند همي

‘প্রাণ ও প্রজ্ঞার প্রভুর নামে শুরু করি,
অতিক্রম করতে পারে না কল্পনা তাঁর নামের সীমা।
প্রভু তিনি নামের, প্রভু তিনি স্থানের,
তিনিই আহার্য দান করেন, তিনিই পথ দেখান।
তিনি প্রভু পৃথিবীর ও ঘূর্ণ্যমান আকাশের,
চন্দ্র-সূর্য ও শুকতারা আলো পায় তাঁর থেকে।
বর্ণনা, ইঙ্গিত ও ধারণার ঊর্ধ্বে তাঁর অবস্থান,
চিত্রকরের সৃষ্টির তিনি মূলতত্ত্ব।
সৃষ্ট জীবের রক্ষণে তিনি সদাতৎপর,
তাঁর অস্তিত্বে সংশয়াপন্ন ব্যক্তির দুঃখও তিনিই দূর করেন।
কল্পনা পথ পায় না তাঁর মধ্যে;
কারণ, নাম ও স্থানের বাইরে তিনি।
কিন্তু বাণী থেকে নাম ও স্থান অন্তর্হিত হলে
প্রাণ ও প্রজ্ঞা দুই-ই স্তব্ধ ও নিশ্চল হয়ে যায়।
তাই, প্রজ্ঞা ভাষাকে নিয়োজিত করে
অমূর্তকে চাক্ষুষ করার জন্যে।’ (মনিরউদ্দীন ইউসুফ অনূদিত শাহনামা, ১ম খ-, পৃ. ১)
ফেরদৌসি তাঁর শাহনামায় প্রজ্ঞা ও যুক্তিনির্ভর একটি আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা করেছেন। সে বিষয়বস্তুর দিকে তাকালে শাহানামা কাব্যগ্রন্থে যে তাঁর আধ্যাত্মিকতার অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছে, তার পরিচয় খুঁজে পাওয়া যায়। কবি বলেন :
حکيم اين جهان را چو دريا نهاد برانگيخته موج ازو تندباد
چو هفتاد کشتي برو ساخته همه بادبانها برافراخته
يکي پهن کشتي بسان عروس بياراسته همچو چشم خروس
محمد بدو اندرون با علي همان اهل بيت نبي و ولي
خردمند کز دور دريا بديد کرانه نه پيدا و بن ناپديد
بدانست کو موج خواهد زدن کس از غرق بيرون نخواهد شدن
‘এই জগৎকে জ্ঞান কর এক সমুদ্র বলে,
যেখানে গর্জন করে ফিরছে প্রবল ঝঞ্ঝা ক্রুদ্ধ ঊর্মিদল;
যেখানে সত্তরটি অর্ণবযান অনুকূল হাওয়ায়
তুলে দিয়েছে তাদের প্রসারিত বাদবান।
তার মধ্যে একটি জলযান সজ্জিত কনের বেশে
রাজহংসের গতিতে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে।
তার মধ্যে রয়েছেন মুহাম্মদ ও আলী
এবং নবী ও আলী পরিবারের সকলে।
দূরে দাঁড়িয়ে জ্ঞানীজন দেখতে পায়Ñ
এই সমুদ্র অসীমÑতার তটরেখা অদৃশ্য।
তারা বুঝতে পারে উত্তাল তরঙ্গ যখন হানবে তার অভিঘাত,
তখন হয়তো নিমজ্জন থেকে কেউই রক্ষা পাবে না।’ (মনিরউদ্দীন ইউসুফ অনূদিত শাহনামা, ১ম খ-,পৃ. ১১)
ধারণা করা হয়ে থাকে যে, উপরে উল্লিখিত পঙ্ক্তিগুলোতে রাসূল (সা.)-এর একটি হাদিসের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। যে হাদিসটির মূল বক্তব্য হলো এই যে, মুহাম্মাদ (সা.)- এর উম্মত খুব শীঘ্রই তিহাত্তরটি দলে বিভক্ত হয়ে পড়বে। যার বাহাত্তরটি দলই যাবে জাহান্নামে এবং একটি দল যাবে জান্নাতে। যদিও কবিতার পঙ্ক্তিতে সত্তরটি কিশ্তি তথা জাহাজের কথা উল্লেখ রয়েছে। এখানে রূপকভাবে গোটা জগতকে সাগর হিসাবে জ্ঞান করার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ দুনিয়াটা হলো সাগরতুল্য। আর এ সাগরে অবস্থানরত সত্তরটি জাহাজ হলো সত্তরটি দল। মহান আল্লাহ তায়ালা এ বিশ্বকে সমুদ্ররূপে সৃষ্টি করেছেন। এ পৃথিবীকে যেহেতু তিনি সমুদ্রের ন্যায় সৃষ্টি করেছেন তাই নানাবিধ ঘটনাপ্রবাহে পূর্ণ রয়েছে এ পৃথিবী। এতে যেমন রয়েছে বিপদ ও বিচ্যুতির আশংকা, তেমনি রয়েছে ধ্বংস ও বিপর্যয়ের সম্ভাবনা। উত্তাল তরঙ্গ মাঝে অস্থির বাতাস, তুফান ও ধ্বংসাত্মক দমকা হাওয়া জগতের এ সমুদ্রকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। এই সংকটময় অবস্থায় যারা অবিচল থেকে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলকে আঁকড়ে ধরবে তারাই তথা সে দলটি সফলতা লাভ করবে। শাহনামায় বর্ণিত এইরূপ অনেক বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ফেরদৌসির আধ্যাত্মিকতার পরিচয় ফুটে উঠেছে।
কবি আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুল (সা.)- এর আনুগত্যের প্রতি জোরালো বক্তব্য তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে মুক্তির পথ অন্বেষণ করা এবং অধঃপতিত জীবন থেকে বাঁচার একমাত্র পথ ও অবলম্বন হলো পয়গম্বরের বাণীকে ধারণ করা। যে বাণী ও আদর্শকে ধারণ করলে হৃদয়ের অন্ধকারকে দূরীভূত করে আলোয় উদ্ভাসিত হওয়া সম্ভব। কবি বলেন :
ترا دانش و دين رهاند درست در رستگاري ببايدت جست
وگر دل نخواهي که باشد نژند نخواهي که دايم بوي مستمند
به گفتار پيغمبرت راه جوي دل از تيرگيها بدين آب شوي
‘তোমার জ্ঞান ও ধর্মকে কর কুসংস্কার থেকে মুক্ত,
মুক্তির পথ অন্বেষণ করাই হলো তোমার কাজ।
অধঃপতিত জীবন থেকে উঠে আসার যদি বাসনা থাকে
যদি বাসনা থাকে চিরদিনের দুঃখ থেকে রেহাই পাওয়ার,Ñ
তবে তোমার পয়গম্বরের বাণী নিয়ে কর পথের অন্বেষণÑ
হৃদয়ের অন্ধকার গুহা সকলকে কর তার আলোয় আলোকিত।’ (মনিরউদ্দীন ইউসুফ অনূদিত শাহনামা, ১ম খ-, পৃ. ১০)
আমরা জানি যে, মহাকাব্যের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে পৌরাণিক কাহিনীগুলোর বিশ্লেষণ, মহান বীরযোদ্ধাদের গুণ, বৈশিষ্ট্য ও কীর্তি বর্ণনা এবং বিভিন্ন জাতির ভাগ্য নির্মাণে সংঘটিত যুদ্ধ-বিগ্রহের ইতিহাস তুলে ধরা। পাশাপাশি সমকালীন রাজনৈতিক, সামাজিক ও আত্মউদ্দীপক বিষয়গুলোও এতে সমভাবে অনুরণিত হয়ে থাকে। এছাড়া মাহাকাব্যে ফেলে আসা অতীত যুগের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, একটি জাতি প্রতিষ্ঠার ঘটনা ও নিজের প্রসিদ্ধ বীরত্বগাথা বিধৃত থাকে।
মহাকাব্যের রচয়িতাগণ এ ধরনের সাহিত্যকর্মে নিজ জাতি ও মানবসভ্যতার আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে থাকেন এবং তাঁদের ভিতরের রহস্যকে নিজদের সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে উন্মোচিত করেন। তাঁরা মনে করেন জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য ও বীরত্ব জানার মধ্য দিয়ে আত্মপরিচয় লাভ করা যায় এবং উৎসাহ-উদ্দীপনা ও জাতীয় আত্মবিশ্বাস প্রতিষ্ঠায় উজ্জীবিত হওয়া যায়। মহাকাব্যে বিধৃত বীরদের কাহিনী থেকে শিক্ষা নিয়ে অত্যাচার ও নীপিড়নের বিরুদ্ধে জাতি ও দেশকে ধ্বংস থেকে রক্ষার উপায় ও অবলম্বন অন্বেষণ করা যায়। বিশ্বে যে কয়টি নির্ভরযোগ্য মহাকাব্য রয়েছে সেগুলোর মূল বক্তব্য ও বিষয় অনেকটা একই বলে প্রতিভাত হয়।
ফেরদৌসি তাঁর শাহনামা কাব্যগ্রন্থে প্রাচীন পারস্যের ইতিহাস-ঐতিহ্য বর্ণনার মাধ্যমে চরিত্র গঠন, বীরত্ব, পা-িত্য, বিচক্ষণতা ও জ্ঞানের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন। জ্ঞানের যে বিশাল শক্তি রয়েছে সে বিষয়ে তিনি বলেন :
توانا بود هر که دانا بود ز دانش دل پير برنا بود
যে জ্ঞানী সেই শক্তিশালী ও সামর্থ্যবান,
আর জ্ঞানসমৃদ্ধ বৃদ্ধের হৃদয় চির যৌবন থাকে।
জ্ঞান ও প্রজ্ঞা যে অমূল্য সম্পদ সে সম্পর্কে কবি ফেরদৌসি অন্যত্র বলেন :
خرد بهتر از هر چه ايزد بداد ستايش خرد را به از راه داد
خرد رهنماي و خرد دلگشاي خرد دست گيرد به هر دو سراي
ازو شادماني وزويت غميست وزويت فزوني وزويت کميست
خرد تيره و مرد روشن روان نباشد همي شادمان يک زمان
چه گفت آن خردمند مرد خرد که دانا ز گفتار از برخورد
کسي کو خرد را ندارد ز پيش دلش گردد از کردۀخويشريش

মহান প্রভুর দানের মধ্যে সবচেয়ে অধিক মূল্যবান হলো জ্ঞান,
জ্ঞানের প্রশংসা করাই বদান্যতার পথে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।
জ্ঞান পথের দিশারী আর জ্ঞানই হলো হৃদয়-মুক্তকারী
জ্ঞানে মাধ্যমেই উভয় জগতকে আঁকড়ে ধরা যায়।
জ্ঞানের মাধ্যমে জানা যায় আনন্দ ও দুঃখকে
এ (জ্ঞান) থেকে অর্জিত হয় উৎকর্ষ আর এর (জ্ঞান) অভাবে আসে খর্বতা।
জ্ঞান অন্ধকার ও জড়ত্বকে দেয় চলমান ঔজ্জ্বল্য
জ্ঞান ছাড়া এক মুহূর্তও প্রফুল্লে ভরে ওঠে না মন।
জ্ঞান সম্পর্কে কতই না সুন্দর বলেছেন জ্ঞানীজনÑ
জ্ঞানীজন বাগ্মিতায় হয়ে ওঠেন অনন্য উচ্চমার্গীয়।
যার রয়েছে জ্ঞানের বিস্তর অভাব
সে নিজেকে দুষ্টক্ষতের ভা-ারে পরিণত করেছে।
ফেরদৌসি শাহনামা রচনা করে ফারসি ভাষাকে নিশ্চিহ্ন হওয়া থেকে রক্ষা করেন। এ গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি প্রতিরোধের মানসিকতা, খোদার আনুগত্য, স্বদেশপ্রেম ও স্বাধীনতার শিক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু শাহনামার বড় পরিচয় হচ্ছে ফারসি ভাষার অস্তিত্বের সনদ হিসাবে।
ফেরদৌসি শাহনামা কাব্যগ্রন্থে যুদ্ধ ও বীরত্বপূর্ণ কাহিনী বর্ণনার পাশাপাশি তথ্যপূর্ণ উপদেশাদি, ন্যায়পরায়ণতা, বদান্যতা, মহত্ত্ব ও নৈতিক কর্তব্যাদি সম্পর্কে বক্তব্য দিতেও সচেষ্ট ছিলেন। শাহনামায় বর্ণিত এমনি উপদেশ সম্পর্কিত কয়েকটি পঙ্ক্তি নিচে তুলে ধরা হলো :
بيا تا جهان را به بد نسپريم به کوشش، همه دست نيکي بريم
نماند همي نيک و بد پايدار همان بِه، که نيکي بود يادگار
نه گنج و نه ديهيم و کاخ بلند نخواهد بدن مر ترا سودمند
فريدون فرخ فرشته نبود ز مُشک و ز عنبر سرشته نبود
بِه داد و دهش يافت اين نيکويي تو داد و دهش کن فريدون تويي
এসো, এ পৃথিবীকে যেনো আমরা অকল্যাণের দিকে ঠেলে না দেই,
প্রচেষ্টার মাধ্যমে একে সামগ্রিক কল্যাণে পরিণত করবো।
ভালো-মন্দ কিছুই স্থায়ী রবে না,
তবে কল্যাণকর স্মৃতি ধরে রাখাই উত্তম।
সুউচ্চ প্রাসাদ, ধন-সম্পদ ও ঐশ্বর্য
তোমার কোনো কল্যাণেই আসবে না
ফরিদুন কোনো ফেরেশতা ছিলো না,
কিংবা কোনো মৃগনাভি বা কস্তুরী দ্বারাও সৃষ্ট নয় সে।
সেতো ন্যায়পরায়ণতা ও বদান্যতা দিয়ে এ মহত্ত্বের অধিকারী হয়েছে,
তুমিও ন্যায়পরায়ণতা ও বদান্যতা অর্জন কর, তবেই তুমি হবে ফরিদুন ।
ফেরদৌসির শাহনামা কাব্যগ্রন্থে তাঁর জ্ঞানের গভীরতার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি মনে করেন এ ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীতে মনুষত্বই শ্রেষ্ঠ আর জ্ঞান ছাড়া সে মনুষত্ব অজির্ত হয় না। সৎ ও সততার দ্বারাই কেবল সকলের মাঝে সাম্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়। কবি বলেন :
دگر گفت روشن روان آن کسي که کوتاه گويد به معني بسي
چو گفتار بيهوده بسيار گشت سخنگوي در مردمي خوار گشت
هنر جوي و تيمار بيشي مخور که گيتي سپنج است و ما برگذر
بگيتي به از مردمي کار نيست بدين با تو دانش به پيکار نيست
ز دانش چو جان ترا مايه نيست بِه از خاموشي هيچ پيرايه نيست

সে (বুজুর্গ মেহের নুশিরওয়ানকে) বললো: সে-ই আলোকিত আত্মার অধিকারী
যে সংক্ষেপে অধিক অর্থ ও তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলে।
যদি বক্তব্য বহুলাংশে অনর্থক হয়ে ওঠে
তবে লোকদের কাছে বক্তা তুচ্ছে পরিণত হয়।
জ্ঞান অন্বেষণ কর আর দুঃখকে প্রশ্রয় দিও না
এ পৃথিবী ক্ষণিকের, আর আমাদের চলে যেতেই হবে।
এ জগতে মনুষ্যত্ব বৈ আর কিছুই শ্রেষ্ঠ নয়
তাই জ্ঞান ব্যতিরেকে তোমার শরীরের কোনো মূল্য নেই।
যদি জ্ঞানসমৃদ্ধ আত্মা তোমার নাই বা থাকে
তবে মৌনতা ছাড়া তোমার আর কোনো ভূষণ নেই।

পুরো শাহনামাই চিত্রকল্পে ভরপুর। যুদ্ধ-বিগ্রহের চিত্র এবং এর চরিত্রগুলো প্রাণবন্তভাবে এ গ্রন্থে অনুরণিত হয়েছে। পাশাপাশি এতে আধ্যাত্মিকতা, প্রজ্ঞা, আদর্শ এবং জীবনঘনিষ্ঠ নানা উপদেশও বাণী এমনিভাবে বিধৃত রয়েছে যে, পাঠক সহসাই তা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন। এছাড়া শাহনামায় বর্ণিত প্রতিটি কাহিনীতে রয়েছে একেকটি উপদেশ ও শিক্ষণীয় বিষয়। কবি অভিযানের কাহিনীতেও পাঠকদের দৈনন্দিন জীবনের ঘটনার প্রতিফলন ঘটিয়েছেনÑ যা সিনেমার পর্দার মতো কাজ করেছে। আর এতেই শাহনামার বিশ^জনীনতার প্রমাণ মেলে। এ গ্রন্থের আবেদন পাঠক হৃদয়ে যুগ যুগ ধরে অক্ষুণœ থাকবে। আর তাঁর প্রদত্ত বাণী নিজ নিজ জাতির জন্য হয়ে থাকবে শিক্ষণীয় ।

তথ্যসূত্র
১. আবদুল মওদুদ (১৯৮০ খ্রি.) : মুসলিম মনীষা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা।
২. আহমাদ তামিমদারি (২০০৭ খ্রি.) : ফার্সী সাহিত্যের ইতিহাস, আলহুদা আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা, ইরান।
৩. আবুল কাসেম ফেরদৌসী (১৯৭৭ খ্রি.) : ফেরদৌসীর শাহনামা (মনিরউদ্দীন ইউসুফ অনূদিত), বাংলা একাডেমী, ঢাকা।
৪. তারিক জিয়াউর রহমান সিরাজী (২০১৪ খ্রি.) : ফারসি সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, বাড পাবলিকেশন্স, ঢাকা।
৫. সাদেক রেযা যাদে শাফাক (১৩৫২ সৌরবর্ষ) : তারিখে আদাবিয়্যাতে ইরান (ইরানি সাহিত্যের ইতিহাস), এনতেশারাতে দানেশগাহে পাহলাভি, ইরান।
৬. হরেন্দ্র চন্দ্র পাল (১৩৬০ বঙ্গাব্দ) : পারস্য সাহিত্যের ইতিহাস, প্রকাশক অজিত চট্ট ঘোষ, শ্রী জগদীশ প্রেস, কলকাতা।
৭. নিউজ লেটার, (ঢাকাস্থ ইরানি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের মুখপত্র), ৩য় সংখ্যা, মে-জুন, ২০১৩।
৮. যঃঃঢ়ং://মধহলড়ড়ৎ.হবঃ/ভবৎফড়ঁংর/ংযধযহধসব

লেখক : অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়

অমর একুশে ও মাতৃভাষা

অমর একুশে ও মাতৃভাষা
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন

সময়ের বিবর্তনে প্রতি বছরই বাঙালির অস্তিত্বের পুরোটা জুড়ে ফিরে আসে অমর একুশে। আমরা আবেগাপ্লুত হই, গ্রন্থমেলার আয়োজন করি, সভা-সমাবেশ, আলোচনা, বক্তৃতা-বিবৃতি, ভাষণ, স্মৃতিচারণ আর কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধাবনত চিত্তে শহিদদের স্মরণ করি। ফেব্রুয়ারি মাস এলেই মাতৃভাষার প্রতি এই অকৃত্রিম দরদবোধে আমরা তাড়িত হই এবং এ মাসের নির্ধারিত কিছু কর্মসূচি সম্পন্নকরণের ভেতর দিয়েই মায়ের ভাষার প্রতি সকল দায়-দায়িত্ব পালন হয়ে যায়Ñ এমনটিও অনেকে ধরে নেন। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে মহান স্রষ্টার অন্যতম সেরা উপহার মায়ের ভাষা বাংলার প্রতি আমাদের দায়িত্ববোধের জায়গাটি অনেকটাই বিস্তৃত, প্রসারিত; খুবই প্রথাসিদ্ধ কিছু আচার-অনুষ্ঠান উদ্যাপনে এ দায়িত্বের হকটুকু আদায় হয়ে যাবে, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। বাঙালির মায়ের ভাষা বাংলা আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি অর্জন করায় ঐতিহাসিক এ ভাষার উন্নয়ন ও বিস্তারে আমাদের দায়িত্ব-পরিসরের দিগন্তটি আরো ব্যাপক আকারে উন্মোচিত হয়ে পড়েছে; যাকে সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচারের বা প্রথাগত আচার-অনুষ্ঠানে শিকলাবদ্ধ করার আর কোনো উপায় নেই। বিশেষ করে অন্তত নিজেদের সমাজ-কাঠামো ও রাষ্ট্রের সর্বত্র মাতৃভাষা বাংলার প্রচলন এখনো হয়ে উঠেনি; যা বায়ান্ন’র ভাষা শহিদদেরই শুধু অবমূল্যায়ন নয়, বরং জাতি হিসেবে আমাদের জন্যে চরম ব্যর্থতা ও লজ্জারও বিষয় বটে।
মাতৃভাষার মর্যাদা ইসলামে স্বীকৃত। মহানবি (সা.)-এর মাতৃভাষা ছিল আরবি। বায়হাক্বি শরিফের একটি হাদিসে তাঁর আরবিপ্রীতির বিরল নজির পাওয়া যায়। তিনি বলেন : ‘তোমরা তিন কারণে আরবদের ভালবাসবে। প্রথমত আমি আরব, দ্বিতীয়ত পবিত্র কুরআনের ভাষা আরবি এবং তৃতীয়ত জান্নাতবাসীদেরও ভাষা হবে আরবি।’ রাসূল (সা.)-এর উল্লিখিত বাণীর পরিপ্রেক্ষিতে মাতৃভাষার প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। একইভাবে এর মাধ্যমে অপরাপর সকল ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর স্ব-স্ব ভাষার গুরুত্বও বৃদ্ধি পেয়েছে। মাতৃভাষার গুরুত্ব আমাদের কাছে আরো বেড়ে যায় যখন দেখি মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন : ‘আমি প্রত্যেক রাসূলকে তাঁর জাতির মাতৃভাষাতেই প্রেরণ করেছি; যাতে তিনি আল্লাহপাকের বাণী সহজেই তাঁদের কাছে ব্যাখ্যা করতে পারেন’ (১৪:৪)। মহান আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রাসূলের বাণীর মাধ্যমে মাতৃভাষার গুরুত্ব, তাৎপর্য ও মর্যাদা সম্পর্কে সম্যক অবহিত হওয়া যায়।
পৃথিবীর সকল জনপদে তাদের নিজ নিজ ভাষা রয়েছে; যা তাদের মায়ের ভাষা, মুখের ভাষা, স্বপ্নের ভাষা এবং প্রাত্যহিক মনের অব্যক্ত বিষয়াবলি প্রকাশের তথা জীবন-যাপনের প্রিয় ভাষা। মমতাময়ী মায়ের কাছ থেকে প্রথম সে ভাষা শিখে বিধায় তার নামকরণ করা হয়েছে মাতৃভাষা হিসেবে। বর্তমান বিশ্বে প্রচলিত ছয় সহ¯্রাধিক ভাষার মধ্যে এক এক জনপদের লোকেরা তাদের সেই প্রিয় মাতৃভাষায় কথা বলে থাকে। এ বিষয়ে মহান আল্লাহর বাণীÑ ‘আমার নিদর্শনসমূহের মাঝে রয়েছে নভোম-ল ও ভূম-ল সৃষ্টি এবং ভাষা ও বর্ণের মধ্যে পার্থক্য; জ্ঞানীদের জন্য এতে সুনিশ্চিত অনেক নিদর্শন রয়েছে’ (৩০:২২)। পৃথিবীর অপরাপর সকল জিনিষের মতো মাতৃভাষার ¯্রষ্টাও স্বয়ং মহামহিম আল্লাহ। তিনি বলেন : ‘তিনিই মানব সম্প্রদায় সৃষ্টি করেছেন এবং তাদেরকে মনের ভাব-বর্ণনা (ভাষা) প্রকাশ করতে শিখিয়েছেন’ (৫৫:৩-৪)।
মানবসমাজে অমানিশার ঘোর তমসাচ্ছন্নতার অবসানে আর অজ্ঞতা-মূর্খতার অন্ধকার দূরীকরণে মহান আল্লাহ সময়ের ব্যবধানে তাঁর নির্বাচিত প্রিয়পাত্রদের প্রতিনিধিত্বের যোগ্যতা ও মর্যাদা দিয়ে প্রেরণ করেছেন। মানুষ ও মানবতার সকল অপ্রাপ্তি পরিপূরণে ও পার্থিব-অপার্থিব সার্বিক সফলতা অর্জনের মানসে নাযিলকৃত সকল আসমানি গ্রন্থ স্ব-স্ব পয়গম্বরের মাতৃভাষাতেই প্রচারিত হয়েছে। আমি সব পয়গম্বরকেই তাঁদের স্বজাতির ভাষাভাষী করেই প্রেরণ করেছি, যাতে তাঁরা তাদেরকে পরিষ্কার বোঝাতে পারেন’ (১৪:৪)। হযরত আবু যার (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূল (সা.) বলেছেন : ‘আল্লাহপাক প্রত্যেক নবিকে তাঁর স্বজাতির ভাষায় প্রেরণ করেছেন (আহমদ)।’ আল্লাহর বাণীবাহক হযরত মূসা (আ.)-এর মাতৃভাষা ছিল ইবরানি, তাই এ ভাষাতেই মহান আল্লাহ তাওরাত কিতাব নাযিল করেছেন। একইভাবে হযরত দাউদ (আ.)-এর মাতৃভাষা ইউনানিতে জাবুর কিতাব, হযরত ঈসা (আ.)-এর মাতৃভাষা সুরিয়ানিতে ইঞ্জিল কিতাব আর সর্বশ্রেষ্ঠ পয়গম্বর হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর মাতৃভাষা আরবিতে মহাগ্রন্থ আল-কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। আল্লাহপাক বলেন : ‘এই কোরআন বিশ্ব-জাহানের পালনকর্তার নিকট থেকে অবতীর্ণ। বিশ্বস্ত ফেরেশতা জিব্রাইল একে নিয়ে অবতরণ করেছে। আপনার অন্তরে, যাতে আপনি ভীতিপ্রদর্শনকারী হতে পারেন। আর এ মহাগ্রন্থ অবতীর্ণ হয়েছে সুস্পষ্ট আরবি ভাষায়। নিশ্চয়ই এর উল্লেখ আছে পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে’ (২৬:১৯২-১৯৬)। মহানবি (সা.) মাতৃভাষাতেই পবিত্র কোরআনের বাণী প্রচার করেছেন। মাতৃভাষার গুরুত্ব তাই অপরিসীম।
আল-কোরআনে রয়েছেÑ ‘হে মানব সম্প্রদায়, আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি; যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হও’ (৪৯:১৩)। পৃথিবীতে নানান জাতির বসবাস এবং তাদের মনোভাব প্রকাশের জন্য মাতৃভাষাও রয়েছে। সেই মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার রক্ষার সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়েছে তুরষ্ক, বুলগেরিয়া, মধ্য এশিয়ার অঞ্চলসমূহ আর ভারতের উত্তর প্রদেশসহ বিশ্বের কিছু জাতিগোষ্ঠীকে। কিন্তু বাঙালি জাতি কেবল আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাংলার মানুষকে জীবনও দিতে হয়েছে। ১৩৫৯ বঙ্গাব্দের ৮ ফাল্গুন মোতাবেক ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালির ইতিহাসে রচিত হয়েছে অমর এক শোকগাথা; যেখানে শাহাদতের সুধা পান করতে হয়েছে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরো অনেককেই। বাংলার দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে মায়ের ভাষাকে মুক্ত করেছে। যা ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্যকে আরো গভীরে নিয়ে গেছে। সেই দায়বদ্ধতা থেকেই আমাদের উচিত বিশুদ্ধ মাতৃভাষা চর্চা করা। বাংলাকে সকল বিকৃতি থেকে রক্ষা করা।
মহান ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক ধারণা থেকে আমরা বলতে পারি, ১৯৫২ সালের বাংলা ভাষার এই আন্দোলনের প্রধানত উদ্দেশ্য ছিল মাতৃভাষা বাংলার অবাধ ব্যবহার ও তার সার্বিক উৎকর্ষ বিধান এবং সর্বস্তরে চর্চার অধিকার আদায় করা। অপর উদ্দেশ্যটি ছিল মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে সরকারি-বেসরকারি সকল অফিস-আদালতসহ রাষ্ট্রীয় সকল প্রতিষ্ঠানে এর যথার্থ ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং জাতীয় স্বাতন্ত্র্য-স্বকীয়তা বজায় রাখা ও সারাবিশ্বে এ ভাষার পরিচিতি আরো উন্নত পরিসরে ছড়িয়ে দেওয়া। আর সেজন্যই আমাদের ভাষা আন্দোলনের মূল সেøাগানই ছিলÑ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। ভাষা আন্দোলনের আরেকটি মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল জাতি হিসেবে বাঙালির সকল গণতান্ত্রিক অধিকার সুরক্ষার সুস্পষ্ট অঙ্গীকার। কেননা, সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির মুখের ভাষার পরিবর্তে সংখ্যালঘিষ্ঠ কোনো জাতির ভাষা এখানে চাপিয়ে দেওয়া কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না; বরং তা সভ্যতা ও মূল্যবোধের চরম পরিপন্থী। এরকম একটি অগণতান্ত্রিক, অন্যায় ও মানবাধিকার পরিপন্থী বিষয়ের তীব্র প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করতে গিয়েই মহান ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছিল; যা পরবর্তীতে বাঙালি জাতির জন্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সকল বৈষম্য দূরীকরণে পর্যায়ক্রমে এক ঐতিহাসিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে রূপ পরিগ্রহ করেছিল। আর এক্ষেত্রে অমর একুশের অকোতভয় বীর শহিদদের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
মহানবি (সা.) ছিলেন আরবের সবচেয়ে সুন্দর ও শুদ্ধভাষী। তিনি কোনোদিন একটি অশুদ্ধ বা বিকৃত শব্দ বা বাক্য উচ্চারণ করেননি। আমাদের মাতৃভাষা বাংলার প্রতি শহিদদের অবদান এবং মহানবি (সা.)-এর মাতৃভাষা প্রীতির অজস্র নজির সামনে রেখে এ বিষয়ে সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। ইতিহাসের আলোকে আমরা দেখতে পাই, আরবের অধিবাসীদের নীতিবিধান, জীবনবোধ ও সামগ্রিক আচার-পদ্ধতি সহজে বোঝাবার জন্যই আরবি ভাষাতে কোরআন নাজিল হয়েছিল। আর তা আল্লাহপাকের এক বাণীতেও পরিষ্কার অনুধাবন করা যায়Ñ ‘আমি একে আরবি ভাষায় কোরআন রূপে অবতীর্ণ করেছি, যাতে তোমরা সহজে বুঝতে পার’ (১২:২)। মহান আল্লাহর এ নির্দেশনার আলোকে আমাদেরও উচিত সর্বস্তরে মাতৃভাষা বাংলার যথার্থ প্রচলন এবং বাংলা ভাষার উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি আনয়ন। বাংলা ভাষার কবি, লেখক, গবেষক, সাংবাদিক, প্রতিবেদকসহ সংশ্লিষ্ট সকলের উচিত তাঁদের রচনায় আমাদের শিশু-কিশোরসহ অল্পশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত মানুষের সহজে বোধগম্য হয় এমন শব্দাবলির ব্যবহার করা। ভিন্ন ভাষায় রচিত গ্রন্থাদি সহজবোধ্য ভাষায় অনুবাদের মাধ্যমে উপস্থাপন বাঞ্ছনীয়। ধর্মীয়, নৈতিক ও শিল্প-সাহিত্য সম্বন্ধীয় সকল রচনা মাতৃভাষায় ভাষান্তর হওয়া প্রয়োজন; যাতে ইসলামকে বুঝতে সহজ হয়, নৈতিক জ্ঞানে মানুষেরা গুণান্বিত হয় এবং বিদেশী রচনাবলির স্বাদ বাংলায় আস্বাদন করতে সক্ষম হয়।
লেখক : চেয়ারম্যান, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়

স্বাধীনতা ও দেশপ্রেম

স্বাধীনতা ও দেশপ্রেম
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন

‘হুব্বুল ওয়াতানে মিনাল ইমান’ অর্থাৎ দেশপ্রেম ইমানের অঙ্গÑ এ অনিবার্য নীতিবাক্যের আওতায় আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাসে এদেশীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ইতিহাস এবং স্বাতন্ত্র্যবোধ নির্মাণে যাঁরা অবদান রেখেছেন তাঁদের সকলের প্রতি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীনতার এই মাসে বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি। বিশেষ করে কবির ভাষায় ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ দেশের মুক্তিসংগ্রামকে যাঁরা সাফল্যের চূড়ায় নিয়ে গেছেন, যাঁদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, আলাদা ভূখ-, ভিন্ন মানচিত্র, পৃথক জাতিসত্তা, লাল-সবুজের পতাকা ও স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠী পেয়েছিÑ তাঁদের সকলের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি। পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের ‘বাংলাদেশ’ নামক নবরাষ্ট্রের অবিসংবাদিত নেতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি, কিংবদন্তির মহানায়ক ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের (১৯২০-১৯৭৫ খ্রি.) মহান স্মৃতির প্রতি অজস্র শ্রদ্ধা নিবেদন করি এজন্যে যে, তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বেই অবহেলিত, বঞ্চিত ও উপেক্ষিত বাঙ্গালি জাতি তার বহুল প্রত্যাশিত স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদন করতে পেরেছে, আমরা জাতি হিসেবে স্বাধীন পরিচয় লাভ করেছি এবং বিশ্বসভায় বাঙ্গালি জাতি তাঁর আত্মমর্যাদাবোধ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমরা ঋণী এ কারণেও যে, সমগ্র বিশ্বে তিনি গর্বভরে পরিচয় দিয়ে বলতেন, আমি বাঙ্গালি, আমি মুসলমান। বঙ্গবন্ধুসহ অসংখ্য শহিদের রক্তে গড়া সেই স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশে আজ বাঙ্গালিত্ব ও মুসলমানিত্ব দুটিই বড় অসহায়ত্ব বরণ করে আছে। দেশপ্রেমে উজ্জীবিত খাঁটি বাঙ্গালির ললাটে আজ নাস্তিক্যবাদের তিলক পরানো হচ্ছে আর মুসলমানিত্ব ধর্মীয় আলখেল্লাধারী তথাকথিত লেবাসধারীদের পার্থিব মোহ ও লালসার প্রকোষ্ঠে জিম্মিদশায় নিপতিত হয়েছে। এহেন পরিস্থিতিতে বিশ্বজনীন, সর্বজনীন ও কালজয়ী মতাদর্শ এবং শান্তি, উদার ও মানবতাবাদী ধর্ম ইসলামের প্রকৃত অনুসারী মাত্রই সকলে ব্যথিত হবে, হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটবে। এমতাবস্থা হতে উত্তরণের নিমিত্তে ইসলামের আলোকে স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত হওয়া এবং ইসলামে দেশপ্রেমের গুরুত্ব ও মর্যাদা সম্বন্ধে অবহিত থাকা একান্ত প্রয়োজন।
ইসলামের মহান পয়গম্বর হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর কাছে তাঁর জন্মভূমির গুরুত্ব ও মর্যাদা ছিল অপরিসীম। ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখি যে, তিনি যখন আরবের অবিশ্বাসীদের ষড়যন্ত্রের মুখে মক্কা হতে মদিনায় হিজরত করতে উদ্যত হলেন তখন মদিনা পানে যাত্রার প্রাক্কালে জন্মভূমি মক্কার জন্য তাঁর হৃদয় বিগলিত হচ্ছিল। বার বার তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে যাচ্ছিলেন এবং খানায়ে কাবার দিকে দৃষ্টিপাত করছিলেন। মক্কার পাহাড়-পর্বত আর বৃক্ষলতার পানে বার বার তাকাচ্ছিলেন। তিনি বলছিলেনÑ হে কাবা, তুমি কতো সুন্দর, তুমি কতো মর্যাদাবান; ওহে মক্কা শহর, তোমায় আমি অনেক ভালোবাসি, কিন্তু আমার জন্মভূমির লোকেরা তোমায় ছেড়ে যেতে আমায় বাধ্য করেছে। জন্মভূমির জন্য হৃদয়ের এই টান ছিল রাসূলের (সা.) স্বভাবজাত। এমনকি মদিনায় যাবার পরেও কখন বা কতদিনে তিনি আবারো বিজয়ীর বেশে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করবেন সেজন্যে সর্বদাই ব্যাকুল থেকেছেন। প্রচ- ক্ষমতা হাতে পেয়েও মক্কা বিজয়ের পর মাতৃভূমির কাউকে অত্যাচার করেননি, কাউকে কষ্ট দেননি, বাড়ি থেকে বের করে দেননি এবং কাউকে কোনো শাস্তি দেননি। এমনকি বড় বড় অপরাধীকেও তিনি কোনো প্রকার শাস্তির আওতায় আনেননি। বরং সবার জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন। গোটা মক্কা জুড়ে যে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল রহমতের আধার নবির মহত্তম এক ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে শান্তি-স্বস্তির সুবাতাস বইতে শুরু করে। রাসূল (সা.) বললেনÑ ‘আজ তোমাদের কারো বিরুদ্ধেই আমার কোনো অভিযোগ নেই, ক্ষোভ নেই, দুঃখবোধ নেই, তোমাদের সবাইকে মাফ করে দিলাম।’ মানবতার ইতিহাসে এমন নিঃশর্ত ক্ষমার ঘোষণা খুবই বিরল। এটি সম্ভব হয়েছিল উদার ও পরমতসহিষ্ণুতার মূর্তপ্রতীক মহানবি (সা.)-এর প্রকৃত দেশপ্রেম আর মানুষের প্রতি অগাধ ভালোবাসার কারণে। সুতরাং দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি এমন দায়বদ্ধতার শিক্ষাই দেয় ইসলাম। ইসলামের পূর্ববর্তী সকল নবি-রাসূলই তাঁদের নিজ নিজ অঞ্চল, এলাকা, প্রতিবেশ, সমাজ আর দেশের প্রতি ভালোবাসায় বিমূর্ত ছিলেন।
বাংলাদেশ বিশ^ মানচিত্রে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম ও আত্মমর্যাদাশীল দেশ। প্রাণাধিক প্রিয় এ দেশকে আমরা মমতাময়ী মায়ের সাথে তুলনা করি। মায়ের স্থান সবার ঊর্ধ্বে। ইসলামে মায়ের মর্যাদা ও অবস্থান সবার ও সবকিছুর উপরে। তাই মায়ের সাথে সাথে মাতৃভূমি, মায়ের ভাষা ও মায়ের দেশের সকল কিছুর প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা পোষণ করাই আমাদের জন্য অবধারিত। মায়ের প্রতি প্রতিটি সন্তানের ভালোবাসা যেমন স্বতঃস্ফূর্ত ঠিক তেমনি দেশের প্রতিও প্রতিটি নাগরিকের ভালোবাসা হবে অকৃত্রিম। যারা দেশকে ভালোবাসবে, দেশের জন্যে কাজ করবে, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব অক্ষুণœ রাখার প্রত্যয়ে ব্রতী হবেÑ ইসলামে তাদের গুরুত্ব অপরিসীম। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে যারা নিজেদের নিয়োজিত রাখবে তাদের জন্য হাদিসে বিশেষ পুরস্কারের ঘোষণা রয়েছে। যারা অকাতরে দেশের জন্য জীবন বিলিয়ে দেবে ইসলাম তাদেরকে শাহাদাতের মর্যাদা দান করেছে।
ইসলামে দেশপ্রেমের তাৎপর্য একটু ভিন্ন ও ব্যতিক্রম। এখানে দেশপ্রেমের অর্থ শুধু দেশকে ভালোবাসার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং দেশ থেকে সকল অন্যায়, দুর্নীতি আর পাপাচারের মূলোৎপাটন করে একটি আদর্শস্থানীয় দেশে রূপান্তরের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে যার যার জায়গা থেকে সাধ্যমতো প্রয়াস অব্যাহত রাখা। দেশের উন্নয়ন, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতি গঠন এবং দেশের সামগ্রিক সমৃদ্ধি ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠায় যথাযোগ্য ভূমিকা পালন করাই একজন ইমানদার নাগরিকের মূল কাজ। দেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র ও দেশকে পেছনের দিকে ঠেলে দেয়া কোনোক্রমেই দেশপ্রেমিকের কাজ হতে পারে না। দেশের উন্নয়ন কর্মকা- ব্যাহত হয় এমন কোনো পদক্ষেপও কোনো দেশপ্রেমিক নিতে পারে না। এসব ইসলামের মৌলিক শিক্ষার পরিপন্থী। ধর্মের নামে দেশের নাগরিকদের মাঝে বিভাজনের সৃষ্টি করাও ইসলামের শিক্ষা নয়। বরং একটি দেশে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সমান নাগরিক অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে বসবাস করবেÑ এটাই ইসলামের মহান শিক্ষা। সংখ্যাগরিষ্ঠ বা সংখ্যালঘু হিসেবে নয়; বরং দেশের নাগরিক হিসেবে এবং ¯্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ হিসেবে সবাইকে মূল্যায়ন করাই একজন দেশপ্রেমিকের দায়িত্ব। ঐক্য, সংহতি, সহনশীলতা, পরমতসহিষ্ণুতা, উদারতা, ন্যায়পরায়ণতা, সংযম, শান্তিকামিতাÑ এগুলো হচ্ছে একজন দেশপ্রেমিক নাগরিকের অনিবার্য গুণ। দেশের ক্রমবর্ধমান উন্নতি ও সমৃদ্ধির স্বার্থে সবাইকে এসব গুণের ধারক হয়ে দেশমাতৃকার কল্যাণে কাজ করতে হবে। স্বদেশের প্রতি শাশ্বত ও চিরন্তন ভালোবাসার দিকনির্দেশনা রয়েছে পবিত্র কোরআন ও হাদিসে। মহান আল্লাহ বলেনÑ ‘তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করো এবং তোমাদের ন্যায়পরায়ণ শাসকের আদেশাবলি মেনে চলো (সূরা নিসা-৫৯)।’ রাসুল (সা.) বলেছেনÑ ‘যে চোখ দেশের সীমান্ত রক্ষার জন্যে জাগ্রত থেকে পাহারা দেয় সে চোখ জাহান্নামের অগ্নি স্পর্শ করবে না।’ ‘দেশের সুরক্ষার জন্য এক দিন ও রাতের পাহারা লাগাতার একমাস সিয়ামব্রত পালন এবং দিবারাত্রি ইবাদতের চাইতেও উত্তম।’
ইসলামের ইতিহাসে ধর্মীয় অনুশাসন পালন ও স্বাধীন মতপ্রকাশের জন্য যেমন মদিনা নামক স্বাধীন ও নিরাপদ ভূখ-ের প্রয়োজন ছিল ঠিক তেমনি মহানবি (সা.)-এর নেতৃত্বে মদিনার সকল অধিবাসী মিলে সেই অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়ন ও নিরাপত্তা বিধানও করেছেন। একইভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্যও প্রয়োজন আমাদের সকলের অংশগ্রহণে দেশটিকে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত করে উন্নত-সমৃদ্ধ এবং আত্মমর্যাদাশীল দেশ হিসেবে একে গড়ে তোলা; স্বাধীনতার এই মহান মাসে এটিই হোক আমাদের দৃপ্ত অঙ্গীকার।

চেয়ারম্যান, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

নারীর ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদা

প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মানবাধিকার সনদের দর্পণে
নারীর ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদা
ড. এম আব্দুল কুদ্দুস বাদশা

[২০শে জমাদিউসসানি নবীনন্দীনি খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতিমা যাহরা (সালামুল্লাহি আলাইহা)’র পবিত্র জন্ম বার্ষিকী এবং ইসলামি নারী দিবস উপলক্ষে প্রবন্ধটি লিখিত]
নর ও নারীতে গঠিত মানবজাতিই সৃষ্টির সেরা। আল-কোরআন যখন মানব জাতির এ শ্রেষ্ঠত্বের বর্ণনা দেয় তখন নর ও নারী উভয়ের স্ব-প্রকৃতির বিচার করেই কথা বলে। এ কারণে আল-কোরআনের নির্দেশাবলি আর প্রকৃতির নির্দেশাবলির মধ্যে পূর্ণ সামঞ্জস্য বিদ্যমান। বাস্তবিকপক্ষে নর আর নারী হচ্ছে মনুষ্যত্বের আকাশে দুইটি আলাদা ধ্রুবতারার নাম, প্রত্যেকে স্ব স্ব কক্ষপথে পরিভ্রমণরত। আল-কোরআনের ভাষায় : ‘সূর্যের জন্য সমীচীন নয় চন্দ্রের নাগাল পাওয়া আর রাত্রের জন্য সমীচীন নয় দিবসকে অতিক্রম করা। প্রত্যেকেই আপন আপন কক্ষপথে সন্তরণরত।’ অতএব, কোরআনের আলোকে মানবসমাজের বাস্তবতায় নর ও নারীর সৌভাগ্যের প্রধান শর্তই হচ্ছে এতদুভয়ের প্রত্যেকেই নিজ কক্ষপথে থেকে পূর্ণতার যাত্রা অব্যাহত রাখা।
নারী পুরুষের স্বাধীনতার কথা বলি আর সমঅধিকারের কথাই বলি, সেটা তখনই সুফল বয়ে আনবে যখন এদের কেউই তার নিজস্ব প্রাকৃতিক কক্ষপথ ও সহজাত গতিপথ থেকে বের হয়ে না যাবে। কারণ, যখনই সে প্রাকৃতিক ও সহজাত নির্দেশাবলির বিরুদ্ধে চলবে তখনই সমাজে অশান্তির কারণ সৃষ্টি হবে। উপরন্তু নারীর এই প্রাকৃতিক ও সহজাত অবস্থার প্রতি বে-খেয়াল হওয়ার ফল হবে তার অধিকার পদদলিত হওয়া। কেননা, যদি নারীর বিপরীতে অধিকারের দাবি নিয়ে পুরুষ দাঁড়িয়ে যায় এবং ঘোষণা করে যে, হে নারী! তুমিও একজন আর আমিও একজন। কাজেই যত কাজকর্ম, দায়-দায়িত্ব, সুযোগ-সুবিধা কিংবা পুরস্কার ও শাস্তি রয়েছে, সবই একরূপ ও একসমান হতে হবে; সেক্ষেত্রে নারীকে সকল কঠিন ও ভারী কাজে পুরুষের সাথে পাল্লা দিতে হবে এবং তার কর্মক্ষমতার উপযুক্ত পারিশ্রমিক গ্রহণ করতে হবে। পুরুষের কোনোই সম্মান ও সমর্থনের প্রত্যাশা সে রাখতে পারবে না। তার নিজের জীবনযাপনের সমুদয় খরচাদি নির্বাহের ভার নিজের কাঁধেই তুলে নিতে হবে এবং সন্তানাদির ভরণ-পোষণের খরচেও পুরুষের সাথে অংশীদার হতে হবে…। এমতাবস্থায় নারী নিশ্চয়ই কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হবে। কেননা, স্বভাবতই নারীর উৎপাদন ক্ষমতা পুরুষের চেয়ে কম, অথচ তার খরচ বেশি।
সুতরাং ইসলাম পুরুষ ও নারী প্রত্যেকের প্রাকৃতিক ও সহজাত অবস্থার কথা বিবেচনায় নিয়ে এবং মানবসত্তা ও মানবাধিকার প্রশ্নে তাদের একসমান ও অভিন্ন হওয়ার প্রতি খেয়াল রেখে নারীকে অত্যন্ত উপযুক্ত এক স্থান দান করেছে, যে স্থানে তার ব্যক্তিত্বকে ক্ষুণœ হতে হয় না, ব্যক্তিত্বও থাকে অটুট। তাই নারী অধিকার পুনরুজ্জীবিতকরণে যে দৃষ্টিভঙ্গি প্রকৃতির পথনির্দেশনাকে অনুসরণ করবে, সেই মতবাদই আক্ষরিক অর্থে নারী অধিকার আন্দোলনে সফলতা লাভ করবে।
প্রখ্যাত চিন্তাবিদ ও দার্শনিক আল্লামা তাকী জা’ফারী নারীর এই প্রাকৃতিক ও সহজাত ব্যক্তিত্বের স্বরূপ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘যদিও ইতিহাসকাল জুড়ে নারীরা দুঃখ-কষ্ট ও কঠিন দুরবস্থার মধ্যে কাটিয়েছে, কিন্তু যে নারীই মানসিক ভারসাম্যতার অধিকারিণী থাকবে, সে তার নারী হয়ে জন্মানোর কারণে কোন দুঃখ ও দোষ অনুভব করবে না। নারীরা সামাজিক চাপসমূহের কথা ব্যতিরেকে কখনই প্রকৃতির কাছে ফরিয়াদ জানায়নি যে, তাদের ব্যক্তিত্বের ব্যাপারে পুনর্বিবেচনা করা হোক কিংবা তাদেরকে অন্য কোনোরূপে সৃষ্টি করা হোক। কারণ, নারীর প্রকৃতিতে এমন অনেক মাহাত্ম্য নিহিত রয়েছে যেগুলো অনুধাবন করার সাধ্য পুরুষের নেই…।’ অবশ্য তিনি নারীর এই মাহাত্ম্যপূর্ণ ব্যক্তিত্ব উপভোগের জন্য একটা শর্ত রেখে বলেছেন : ‘নারীদেরকে তাদের নিজেদের নারীত্বের প্রতি ঈমান থাকা চাই। সে যেন নিজের অস্তিত্বের বহুমাত্রিকতাকে উপেক্ষা না করে এবং অযথাই পুরুষের সঙ্গে নিজের তুলনা না করে। নারী আর পুরুষ উভয়ের উচিত পরিবারের গুরুত্বের প্রতি লক্ষ্য রাখা। তাদের জানতে হবে যে, সমাজ ও জাতির ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয় পরিবার।’
১৯১২ সালে নোবেল বিজয়ী বিখ্যাত ফরাসি শৈল চিকিৎসক ও শরীরতত্ত্ববিদ অষবীরং ঈধৎৎবষ (১৮৭৩-১৯৪৪) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ গধহ, ঃযব টহশহড়হি এর মধ্যে লিখেছেন : ‘প্রাকৃতিক বিধান অনুযায়ী নারী ও পুরুষকে যেমন পরস্পর থেকে পৃথক করে সৃষ্টি করা হয়েছে, তেমনি এ পার্থক্য তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য ও অধিকারেরও পার্থক্য সৃষ্টি করেছে… এই প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির প্রতি লক্ষ্য না রাখার কারণেই নারী আন্দোলনের সমর্থকরা মনে করে যে, নারী ও পুরুষ উভয়ই একই ধরনের শিক্ষা লাভ ও পেশা অবলম্বন এবং অভিন্ন দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারে। নারী অনেক দিক থেকেই পুরুষ থেকে আলাদা ….এ পার্থক্য কেবল তাদের যৌনাঙ্গের সাথে সংশ্লিষ্ট পার্থক্য এবং নারীর ডিম্বাশয় থাকা ও সন্তান জন্মদান করতে পারা, আর এজন্য তাদের বিশেষ ধরনের শিক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়… শরীরবৃত্তিক বিধি-বিধানসমূহ নক্ষত্রীয় জগতের বিধি-বিধানেরই মতোই অলঙ্ঘনীয়। এতে মানুষের ইচ্ছা বা অনিচ্ছার কোনো প্রবেশাধিকার নেই। এগুলোকে যেমন আছে তেমনভাবেই গ্রহণ করা ছাড়া আমাদের কোনো গত্যন্তর নেই। পুরুষদের অন্ধ অনুকরণ না করে প্রকৃতি নারীকে যা দান করেছে তার ভিত্তিতেই তাকে স্বীয়-প্রকৃতি নির্ধারিত পথে চেষ্টা-সাধনা চালিয়ে যেতে হবে। মানবজাতির পূর্ণতার পথে তার দায়িত্ব পুরুষের তুলনায় অনেক বড়। এ দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া কিংবা পরিত্যাগ করা তার সাজে না।’ মি. ক্যারেল এ অধ্যায়ের উপসংহার টেনে বলেন : ‘আমরা যেন যুবতীদের জন্য যুবকদের অনুরূপ চিন্তাপদ্ধতি, একই ধারার জীবন এবং অভিন্ন লক্ষ্য ও আদর্শ নির্ধারণ না করি। শিক্ষাবিষয়ক বিশেষজ্ঞগণকে অবশ্যই নারী ও পুরুষের মধ্যকার দৈহিক ও মনস্তাত্ত্বিক পার্থক্য এবং তাদের প্রাকৃতিক দায়িত্ব-কর্তব্যের কথা মনে রাখতে হবে। এ বিষয়টির প্রতি খেয়াল রাখা আমাদের সভ্যতার ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
প্রাচ্য ও প্রতীচ্য মানবাধিকার প্রশ্নে গবেষণা ও আন্দোলনে পিছিয়ে ছিল না কখনো। ইসলামি সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি) ১৯৯০ সনে কায়রো সম্মেলন থেকে মানবাধিকার সনদ ঘোষণা করে, যা মোটামুটি ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গির ধারক। পক্ষান্তরে জাতিসংঘ কর্তৃক বিশ্ব মানবাধিকার সনদ ঘোষিত হয় ১৯৪৮ সনে, যেখানে পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গির প্রাবল্যই বেশি। আমরা যদি এই দুই বিশ্ব সংস্থার মানবাধিকার সনদে নারীর স্থান অনুসন্ধান করি তাহলে দেখা যাবে নারীর ব্যক্তিত্বের স্বরূপ এবং তার অধিকার সংক্রান্ত প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের দৃষ্টিভঙ্গিতে কিছু সাদৃশ্য যেমন বিদ্যমান, তদ্রƒপ কিছু বৈসাদৃশ্যও দৃষ্টিগোচর হয়। ওআইসি মানবাধিকার সনদের ৬(ধ)- ধারায় বলা হয়েছে : ডড়সধহ রং বয়ঁধষ ঃড় সধহ রহ যঁসধহ ফরমহরঃু, ধহফ যধং ৎরমযঃং ঃড় বহলড়ু ধং বিষষ ধং ফঁঃরবং ঃড় ঢ়বৎভড়ৎস; ংযব যধং যবৎ ড়হি পরারষ বহঃরঃু ধহফ ভরহধহপরধষ রহফবঢ়বহফবহপব, ধহফ ঃযব ৎরমযঃ ঃড় ৎবঃধরহ যবৎ হধসব ধহফ ষরহবধমব. আর ৬(ন)- ধারায় বলা হয়েছে : ঞযব ঐঁংনধহফ রং ৎবংঢ়ড়হংরনষব ভড়ৎ ঃযব ংঁঢ়ঢ়ড়ৎঃ ধহফ বিষভধৎব ড়ভ ঃযব ভধসরষু.
এদিকে ৫(ধ) ধারায় বলা হয়েছে : ঞযব ভধসরষু রং ঃযব ভড়ঁহফধঃরড়হ ড়ভ ংড়পরবঃু, ধহফ সধৎৎরধমব রং ঃযব নধংরং ড়ভ রঃং ভড়ৎসধঃরড়হ. গবহ ধহফ ড়িসবহ যধাব ঃযব ৎরমযঃ ঃড় সধৎৎরধমব, ধহফ হড় ৎবংঃৎরপঃরড়হং ংঃবসসরহম ভৎড়স ৎধপব, পড়ষড়ঁৎ ড়ৎ হধঃরড়হধষরঃু ংযধষষ ঢ়ৎবাবহঃ ঃযবস ভৎড়স বহলড়ুরহম ঃযরং ৎরমযঃ. আর ৫(ন) ধারায় বলা হয়েছে : ঝড়পরবঃু ধহফ ঃযব ঝঃধঃব ংযধষষ ৎবসড়াব ধষষ ড়নংঃধপষবং ঃড় সধৎৎরধমব ধহফ ংযধষষ ভধপরষরঃধঃব সধৎরঃধষ ঢ়ৎড়পবফঁৎব. ঞযবু ংযধষষ বহংঁৎব ভধসরষু ঢ়ৎড়ঃবপঃরড়হ ধহফ বিষভধৎব.
অপরদিকে জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদেও ১৬ নং ধারায় উপস্থাপিত বক্তব্যের তিনটি পয়েন্ট হচ্ছে :
(ধ) গবহ ধহফ ড়িসবহ ড়ভ ভঁষষ ধমব, রিঃযড়ঁঃ ধহু ষরসরঃধঃরড়হ ফঁব ঃড় ৎধপব, হধঃরড়হধষরঃু ড়ৎ ৎবষরমরড়হ, যধাব ঃযব ৎরমযঃ ঃড় সধৎৎু ধহফ ঃড় ভড়ঁহফ ধ ভধসরষু. ঞযবু ধৎব বহঃরঃষবফ ঃড় বয়ঁধষ ৎরমযঃং ধং ঃড় সধৎৎরধমব, ফঁৎরহম সধৎৎরধমব ধহফ ধঃ রঃং ফরংংড়ষঁঃরড়হ.
(ন) গধৎৎরধমব ংযধষষ নব বহঃবৎবফ রহঃড় ড়হষু রিঃয ঃযব ভৎবব ধহফ ভঁষষ পড়হংবহঃ ড়ভ ঃযব রহঃবহফরহম ংঢ়ড়ঁংবং.
(প) ঞযব ভধসরষু রং ঃযব হধঃঁৎধষ ধহফ ভঁহফধসবহঃধষ মৎড়ঁঢ় ঁহরঃ ড়ভ ংড়পরবঃু ধহফ রং বহঃরঃষবফ ঃড় ঢ়ৎড়ঃবপঃরড়হ নু ংড়পরবঃু ধহফ ঃযব ঝঃধঃব.
দেখা যাচ্ছে উভয় সনদে অকপটে স্বীকার করা হয়েছে যে, পরিবারই হচ্ছে সমাজের প্রাকৃতিক ও মৌলিক স্তম্ভ। কাজেই পরিবারের ভিতকে দুর্বলকারী যে কোনো মতাদর্শ ও জীবনাচার মনুষ্য প্রকৃতির বিরুদ্ধ মতবাদ হিসাবে চিহ্নিত ও প্রত্যাখ্যাত হবে। এখানে উভয় সনদের ভাষ্যে অভিন্ন কিছু দিক পাওয়া যায়। যথা :
১- নারী ও পুরুষ মানবীয় ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদার দিক থেকে একসমান। এক্ষেত্রে পরস্পরের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই।
২- নারী সামাজিক ব্যক্তিত্বসম্পন্না এবং পুরুষের মতোই মানবিক ব্যক্তিত্ব সহকারে বাঁচার অধিকার রাখে। পুরুষের মতোই সে সকল জীবনোপকরণ ভোগ এবং সম্মানজনক জীবন যাপন করতে পারবে।
৩- পুরুষের ন্যায় নারী তার নিজের অর্থ-সম্পদ সঞ্চালন ও প্রতিশ্রুতির ক্ষেত্রে স্বাধীন। যদিও পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গির মানবাধিকার সনদে এ বিষয়টা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি, তবে পশ্চিমা বিশ্বে বলবৎ মানবাধিকার সংক্রান্ত অপরাপর সূত্রের বরাতে প্রতিপন্ন হয় যে, সেখানে নারী অর্থ-সম্পদ সংক্রান্ত এই অধিকারটি সুরক্ষিত রয়েছে।
৪- বিবাহ অবশ্যই উভয়পক্ষের (নারী ও পুরুষের) পূর্ণ সম্মতি ও স্বাধীনতা সহকারে সম্পন্ন হতে হবে।
৫- পরিবার হচ্ছে সমাজের প্রাকৃতিক ও ভৌতিক স্তম্ভ। এমর্মে সমাজ ও রাষ্ট্রের পূর্ণ সমর্থন লাভের অধিকার পরিবারের রয়েছে।
এবার প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের দৃষ্টিভঙ্গির বৈসাদৃশ্য নিয়ে পর্যালোচনা করা যাক :
এক : ইসলামের দৃষ্টিতে নারীর জন্য স্বামী নির্বাচনে এবং একইভাবে পুরুষের জন্য স্ত্রী নির্বাচনে ধর্মের বিষয়টি মান্য করে চলা উচিত। এ বিধানটির কারণও খুবই স্পষ্ট। কেননা, ইসলাম হচ্ছে ফিতরাত তথা সহজাতগত ধর্ম। যে কেউ সত্যিকার অর্থে এই ধর্মের ছায়াতলে আসে, সে বাস্তবিকপক্ষে তার নিজের সহজাত প্রবৃত্তিকেই ফলপ্রসূ করে। একারণে এরূপ ব্যক্তির পক্ষে যে মানুষটি ইসলাম ভিন্ন অন্য কোনো পথে তার ফিতরাত ও আকাক্সক্ষাকে চালিত করে তার সাথে মনস্তÍাত্ত্বিক, ব্যক্তিত্বগত ইত্যাদি কোনো দিক থেকেই পূর্ণরূপে সামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। ফলে তার সাথে নিখাঁদ অনুরাগ ও ভালোবাসাও বিনিময় করতে সক্ষম হয় না।
অপরদিকে ইসলাম যেহেতু সঠিক খোদায়ী ধর্ম ব্যতীত জীবনকে ব্যাখ্যাযোগ্য কোনো জীবন বলে মনে করে না। কাজেই যে জীবন ব্যাখ্যার অযোগ্য ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত সেটাকে যুক্তিযুক্ত বলে গ্রহণ করার কোনো কারণ নেই। বিবাহের ক্ষেত্রে যে জিনিসটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হলো সন্তানাদির বিষয়টি। ইসলাম এই দুনিয়াকে একটি ক্ষণস্থায়ী নিবাস বলে মনে করে, যার পশ্চাতে অপেক্ষা করছে এক অনন্তকালীন জীবন। আর সেই জীবনের জন্য মানুষের প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ তথা পক্বতা অর্জন করার স্থান হচ্ছে এই দুনিয়া। অতএব, ইসলাম কোনো মতেই এই দুনিয়ায় আগমনকারী মানুষদেরকে পশুদের ন্যায় দায়-দায়িত্বহীন জীবন পার করার জন্য ছেড়ে দিতে পারে না। বরং ইসলাম মানব সন্তানদেরকে সঠিক আকিদা বিশ্বাস সহকারে একটি মানবিক ও ঐশী আলোয় গড়া জীবনের জন্য যথোপযুক্ত দীক্ষা ও প্রশিক্ষণের জোরালো নির্দেশ প্রদান করে থাকে। এমতাবস্থায় যদি স্বামী-স্ত্রীর কোনো এক পক্ষ মুসলমান না থাকে, তাহলে সন্তানদের ক্ষেত্রে এমন কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয় যার কোনো সমাধান নেই। এরূপ নমুনা চোখের সামনেই রয়েছে অনেক। এ ধরনের বিবাহের কারণে অধিকাংশ সন্তানই ধর্মবোধ ও বিশ্বাস ছাড়াই জীবনযাপনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। যা ক্রমান্বয়ে নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত এক উচ্ছৃঙ্খল বস্তুবাদী ও ভোগবাদী জীবনাচারের সূত্রপাত ঘটায় এবং মানবিক মূল্যবোধগুলো মূল্যহীন হয়ে পড়তে থাকে। আজকের পাশ্চাত্য দুনিয়া যার সাক্ষাৎ প্রমাণ। কারণ, পাশ্চাত্যে ইসলামের ন্যায় নারীর জন্য স্বামী নির্বাচনে এবং একইভাবে পুরুষের জন্য স্ত্রী নির্বাচনে ধর্মের বিষয়টি মান্য করে চলার কোনো তাগিদ নেই।
দুই. জাতিসংঘ সনদে উদ্ধৃত … ঞযবু ধৎব বহঃরঃষবফ ঃড় বয়ঁধষ ৎরমযঃং ধং ঃড় সধৎৎরধমব… ‘অর্থাৎ নারী ও পুরুষ বিবাহ সংক্রান্ত বিষয়ে একসমান অধিকার রাখে’Ñ এই বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, পশ্চিমা মানবাধিকার সনদে বিবাহের মোহরানা, ভরণ-পোষণ ও অন্যান্য জীবনোপকরণের ভার পুরুষের দায়িত্বে নেই। অথচ ইসলাম এ দায়িত্বগুলো পুরুষের উপর ন্যস্ত করেছে। আর নারীদের উপর ন্যস্ত করেছে আবেগ, অনুরাগ, মমতা ও জীবনের পবিত্র অনুভব দিয়ে পরিবার নামক নীড়কে শান্তিতে ভরে তোলার দায়িত্ব। স্বভাবতই এই অফুরান প্রাণশক্তি নিহিত রয়েছে শুধু নারীর কোমল হৃদয়ের নিখাঁদ প্রাণস্পন্দে। তাই পরিবারকে সুখময় করে তোলার ক্ষেত্রে ইসলাম এভাবে পূর্ণ ন্যায্যতার সাথে দায়িত্ব বণ্টন করে দিয়েছে নারী আর পুরুষের মাঝে। পুরুষ জোগান দেবে বৈষয়িক ও বস্তুগত রসদ; আর নারী জোগান দেবে মানবিক ও অবস্তুগত রসদ।
তিন. জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদের উপরিউক্ত একই ধারায় আরও উল্লেখ করা হয়েছে : ঞযবু ধৎব বহঃরঃষবফ ঃড় বয়ঁধষ ৎরমযঃং ধং ঃড় সধৎৎরধমব, ফঁৎরহম সধৎৎরধমব ধহফ ধঃ রঃং ফরংংড়ষঁঃরড়হ অর্থাৎ দাম্পত্য জীবনের গোটা সময়কাল ধরে এবং তা বিলুপ্তির সময়ে নারী ও পুরুষ সর্বব্যাপারে একসমান অধিকার রাখে। এ বক্তব্য থেকে বুঝা যায় যে, পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গিতে তালাকের অধিকারেও নারী এবং পুরুষ দুজনই সমান অধিকার রাখে। অথচ ইসলামে ব্যাপারটা এত সহজ নয়, যতটা সহজ দেখেছেন পশ্চিমা মানবাধিকার বিশেষজ্ঞগণ। কেননা, দাম্পত্য কলহের ক্ষেত্রে নারীরাই সচরাচর দ্রুত প্রতিক্রিয়াশীল হয়। এছাড়া তাদের সাধারণ চাহিদাবলির হাতছানিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদেরকে পুরষদের আগেই তালাক চাইতে অনুপ্রাণিত করে। অথচ তালাকের জন্য যেসব কারণ তারা প্রদর্শন করে থাকে সেগুলোর অধিকাংশই জোরালো কোনো কারণ নয়। ৭/৯/১৯৬৫ তারিখে ইরানের ‘কায়হান’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি রিপোর্ট এই দাবির সপক্ষে প্রমাণ হিসাবে প্রণিধানযোগ্য। উক্ত রিপোর্টে বলা হয় : ‘১৮৯০ সালে ফ্রান্সে আদালতের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনাগুলোর মধ্যে ৯০ শতাংশই ছিল নারীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে।’ তাছাড়া বিবাহ বিচ্ছেদের পরবর্তী যেসব সমস্যা দেখা দেয়, যেমন শিশুদের যতœ ও লালনপালন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীর কাঁধে এসে পড়ে। কিন্তু যদি ঐ শিশুবেলাতেই তাদেরকে শিশুসদন কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তারা মাতৃত্বের মানবীয় আবেগ অনুভব থেকে বঞ্চিত হবে। ফলে কিশোর ও তরুণ বয়সে তারা মানবীয় ব্যক্তিত্ব ও পরিচয়হীন এক অমানবিক জীবনের ধারায় প্রবাহিত হবে। যাদের সম্পর্কে স্বয়ং পশ্চিমা চিন্তাবিদগণেরই মন্তব্য হচ্ছে, এরা শুধু সেনাবাহিনীর কাজে আসতে পারে সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য, কিন্তু মানবতার কোনো কাজে আসবে না যেখানে মানবীয় গুণাবলি ও মাহাত্ম্য প্রয়োজন।
চার. বিবাহের ক্ষেত্রে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। তা হচ্ছে যুবকরা, যতই উন্নত প্রতিপালন ও শিক্ষা-দীক্ষায় বলীয়ান হোক না কেন, তবুও এ বয়সে তারা জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মর্মার্থ সম্পর্কে সম্যক উপলব্ধি অর্জনে সক্ষম থাকে না। তারা জানে না যে, দায়িত্ব ও কর্তব্যহীন জীবন আর নানান দায়-দায়িত্বভরা জীবনÑ এদুয়ের মধ্যে ঢের পার্থক্য রয়েছে। অর্থাৎ অধিকাংশ যুবকের কাছেই বিবাহ বলতে যে বিষয়টা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, সেটা হচ্ছে যৌন কামনার নিবারণ। ফলে এ সময়ে বিবাহ পরবর্তী জীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে তেমন উপলব্ধি তাদের মধ্যে সচরাচর কাজ করে না। আর দৈবাৎ যদি কোনো যুবকের মধ্যে এহেন উপলব্ধির উদ্রেক ঘটেও, তবুও তার যৌবনের তীব্র আকাক্সক্ষার ঢেউ দায়িত্ব ও কর্তব্যের জায়গাগুলোকে ম্লান করে দেয়। ফলে সে সূক্ষ্ম ও সুচারুভাবে তার দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রতি মনোনিবেশ করতে পারে না। তারপর বয়স বাড়ার সাথে সাথে যখন যৌন আবেগে ভাটা পড়ে, তখন তার মধ্যে পারিবারিক ও সামাজিক জীবন সম্পর্কিত বিভিন্ন স্তর ও মাত্রায় দায়িত্ব ও কর্তব্যের অনুভবগুলো জেগে উঠতে থাকে।
অথচ দুঃখজনকভাবে পাশ্চাত্যজগৎ তার সকল সাংস্কৃতিক ও আইনি অঙ্গনে এ সত্যটির ব্যাপারে ঔদাসীন্য প্রদর্শন করে থাকে। অথবা কোনো না কোনো কারণে ইচ্ছাকৃতভাবে জীবনের সকল দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টিকে সরিয়ে রাখে। কিন্তু ইসলাম ব্যাপারটি খুবই গুরুত্বের সাথে দেখে। একারণে ইসলাম বিবাহের ক্ষেত্রে কন্যার অভিভাবকের অনুমতিকে একটি শর্ত হিসাবে গণ্য করে থাকে। অর্থাৎ স্ত্রী নির্বাচনের বিষয়টি যেন একতরফাভাবে কোনো যৌন ভাবাবেগে আপ্লুত যুবকের পছন্দের দ্বারাই চূড়ান্ত না হয়। মেয়েদের পক্ষ থেকে পিতা তথা শারয়ী অভিভাবক যেন এ ব্যাপারে যাচাই বাছাই প্রক্রিয়ায় তৎপর হয় এবং জ্ঞাতসারে অনুমতি প্রদান করে। কেননা, মেয়েদের জন্য সতীত্ব বজায় রাখার আবশ্যকতা সম্পর্কে ইসলামের রক্ষণশীল বিধি-বিধানের কারণে হয়ত তারা ছেলেদের ন্যায় ততটা পরিমাণে বাইরের পৃথিবী ও জীবনাচার সম্পর্কে অবহিত নাও থাকতে পারে। একারণে মেয়েদের পক্ষে তার পিতা কিংবা পিতামহের ন্যায় আপন অভিভাবকের অনুমতি ও সম্মতি লাগে এ ঘাটতি পূরণের জন্য। অবশ্য যখন বিবাহে অনুমতির প্রসঙ্গ আসে তখন উক্ত অনুমতি দাতা অভিভাবককেও যথাযথ যোগ্যতার অধিকারী থাকতে হবে। আর যদি মেয়ের বিবাহে অনুমতি প্রদানের শারয়ী অভিভাবক বলতে কেউ বর্তমান না থাকে, সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র কিংবা সমাজের উপর এ দায়িত্ব ন্যস্ত হয়।
ইসলামে নারী ও পুরুষের অধিকার সম্পর্কে যে পার্থক্য রয়েছে, সে বিষয়ে ইসলাম সম্পর্কে অনভিজ্ঞ ও অবিবেচক ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে অনেক আক্রমণ হানা হয়ে থাকে। তাদের প্রশ্ন একটাইÑ কেন ইসলাম এই দুয়ের মধ্যে পার্থক্য করে থাকে? অথচ এ আপত্তির উত্তরে প্রথমইে যেটা বলতে হয় সেটা হলো নারী ও পুরুষের অধিকারে যে পার্থক্য সেটা তাদের দৈহিক, মানসিক এবং পরিবারে তাদের অত্যাবশ্যকীয় অবস্থানের পার্থক্যপ্রসূত, যে পার্থক্য কোনো বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষে অস্বীকার করার জো নেই। জ্ঞান-গবেষণা যতই অগ্রসর হচ্ছে, নারী পুরুষের এই পার্থক্যের তালিকা ততই দীর্ঘতর হচ্ছে এবং অদ্যাবধি একশ’রও বেশি পার্থক্যের দিক চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে।
পরিশেষে বলা যায়, পশ্চিমা মানবাধিকার সনদে পরিবার সম্পর্কে এবং সামগ্রিকভাবে নারী অধিকার সম্পর্কে যে দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে তা মূলত কতিপয় নারী স্বাধীনতার ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। যে স্বাধীনতাগুলোকে কোনোক্রমেই প্রাকৃতিক ও যুক্তিযুক্ত স্বাধীনতা বলা যায় না। কারণ, যদি সেগুলো প্রাকৃতিক ও যুক্তিযুক্তই হতো তাহলে পাশ্চাত্যে এভাবে পরিবারের ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে পড়ার কথা ছিল না। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হচ্ছে ‘সমতা’ (বয়ঁধষরঃু) আর ‘ন্যায়ন্যায্যতা’ (লঁংঃরপব)- এই দুই অভিধাকে একই অর্থে গ্রহণ করা। নারী-পুরুষের সম অধিকার এক জিনিস। আর নারী-পুরুষের ন্যায়ন্যায্য অধিকার অন্য জিনিস। নারী-পুরুষের সমানাধিকারের দাবি তোলার অর্থই হচ্ছে নারী ও পুরুষের দৈহিক, মানসিক ও আত্মিক পার্থক্যগুলোকে অস্বীকার করা। কেননা, এক্ষেত্রে সমতা ও সমানাধিকারের কথা অবান্তর এবং ভিত্তিহীন। প্রয়োজন হলো ন্যায়ন্যায্যতা, যা নারী ও পুরুষের পার্থক্যগুলোকে মেনে নিয়েই আসে। তাই নারী ও পুরুষের অধিকারের প্রশ্নে পাশ্চাত্য যতদিন ‘সমানাধিকার’ আর ‘ন্যায়ন্যায্য অধিকার’Ñ এদুয়ের মধ্যে পার্থক্যে বিশ্বাস না করবে, ততদিন এতদুভয়ের অধিকার এবং স্বাধীনতার ব্যাপারে তাদের বক্তব্যের সপক্ষে কোনো যুক্তিতর্কই ধোপে টিকবে না।
লেখক : ভাইস প্রিন্সিপাল, ইরানিয়ানি ইন্টারন্যাশনাল স্কুল

 

আন্তর্জাতিক আল-কুদ্্স দিবস উপলক্ষে ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত

আন্তর্জাতিক আল-কুদ্্স দিবস উপলক্ষে আজ ৭ই মে শুক্রবার বিকাল ৩টায় আল-কুদস কমিটি বাংলাদেশ এর উদ্যোগে এক ওয়েবিনারের আয়োজন করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষক ও আল-কুদ্্স কমিটি বাংলাদেশ এর সভাপতি অধ্যাপক ড. শাহ কাওসার মুস্তাফা আবুলউলায়ীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম. শমশের আলী। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রাষ্ট্রদূত মুহাম্মাদ রেজা নাফার। এতে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট এ. কে. এম বদরুদ্দোজা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মাদ সিদ্দিকুর রহমান খান, দৈনিক ইনকিলাবের সহকারী স¤পাদক জামাল উদ্দিন বারী, ফরিদগঞ্জ মজিদিয়া কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ড. মওলানা এ. কে. এম. মাহবুবুর রহমান ও দৈনিক আজকের ভোলার স¤পাদক অধ্যক্ষ মুহাম্মদ শওকাত হোসেন। ওয়েবিনার সঞ্চালনায় ছিলেন আল-কুদ্্স কমিটি বাংলাদেশ এর সেক্রেটারি জেনারেল মোস্তফা তারেকুল হাসান। ক্বারী এ. কে. এম. ফিরোজের সুমধুর কণ্ঠে পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াতের মাধ্যমে ওয়েবিনারটি শুরু হয়।
প্রধান অতিথি ড. এম শমশের আলী বলেন, বাংলাদেশ একটি শান্তিকামী দেশ এবং সবসময় শান্তির পক্ষে কথা বলে আসছে। তিনি যুবকদের জন্য আয়োজিত একটি বিজ্ঞান কনফারেন্সে অংশগ্রহণের কথা উল্লেখ করে বলেন যে, সে কনফারেন্সের আলোচনার একটি বিষয় ছিল পারমাণবিক শক্তির বিধ্বংসী ব্যবহার নয় যেটি হিরোশিমা-নাগাশাকির ক্ষেত্রে ঘটেছিল, বরং পারমাণবিক শক্তির ইতিবাচক ব্যবহার করতে হবে। তিনি হল্যান্ডে আয়োজিত আরেকটি কনফারেন্সের কথা উল্লেখ করে বলেন, সেখানে তিনি লর্ড নোয়েল বেকারের সাক্ষাৎ লাভ করেন যিনি লীগ অব নেশন্স-এর প্রথম সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন, তিনি বলেন, আমি বাদশাহ আবদুল আজিজকে বলেছিলাম যে, ইসরাইলিরা এখানে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। আবদুল আজিজ জবাব দেন, ইহুদিরা যেহেতু জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনেক উন্নত তাই তারা যদি আমাদের পাশে আসে তাহলে আমরা শুধু উপকৃতই হব। কিন্তু তারা এটি চিন্তা করেনি যে, এতে ফিলিস্তিনিরা নিজেদের ভূমিতেই উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে।
বিশেষ অতিথি মোহাম্মদ রেজা নাফার একটি হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে বক্তব্য শুরু করেন। তিনি বলেন, মহানবি (সা.) বলেছেন : ‘যদি কোন মুসলমান অপর কোন মুসলমানকে আহ্বান করে আর সে তার ডাকে সাড়া না দেয় তবে সে মুসলমান নয়।’ এ হাদিস অনুযায়ী ফিলিস্তিনের নির্যাতিত জনগণের আহ্বানের বিষয়টি আমাদের স্মরণ করা উচিত। পৃথিবীব্যাপী করোনা মহামারির মধ্যে ফিলিস্তিনের জনগণের জন্য এই ওয়েবিনারের মাধ্যমে আমরা ফিলিস্তিনের জনগণের কাছে এ বার্তাই পৌঁছাতে চাই যে, ফিলিস্তিন ইস্যু আজও জীবন্ত।
তিনি বলেন, ২০২০ সালে ইসরাইল বিশ্বের ১৬০টি দেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। ২০টি দেশে এখনও ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেনি যাদের মধ্যে বাংলাদেশ ও ইরান রয়েছে। ফিলিস্তিনের জনগণের প্রতি বাংলাদেশের সমর্থনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাই।
আল-কুদ্স হলো মুসলিম বিশ্বের জন্য রেড লাইন। কারণ, এটি অনেক নবি-রাসূলের জন্মভূমি, মহানবির মেরাজ যাত্রার সূচনা ও মুসলমানদের প্রথম কিবলা যেটি যায়নবাদীরা দখল করে আছে। ইমাম খোমেইনী (রহ.) কর্তৃক আল-কুদ্স দিবস ঘোষণা ইসরাইলের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে একটি প্রতীক।
ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের অপরিবর্তনীয় ও অফিসিয়াল সুস্পষ্ট অবস্থান হলো দখলদার যায়নবাদীদের বিরুদ্ধে। ইরান ফিলিস্তিনিদের সর্বব্যাপী স্বাধীনতার সমর্থক। ফিলিস্তিনিদের মুক্তির একমাত্র পথই হলো যায়নবাদীদের বিরুদ্ধে অব্যাহত প্রতিরোধ। ফিলিস্তিনিদের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে, বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেয়া ফিলিস্তিনিদেরকে নিজ দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে, জেরুজালেমকে রাজধানী করে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ঘোষণা করতে হবে।
পরিশেষে তিনি ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীর কথার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন যে, মহান আল্লাহর অনুগ্রহে আগামী ২০ বছর পরে ইসরাইল নামক কোন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব এ অঞ্চলে থাকবে না।
ওয়েবিনারের সভাপতি ড. কাওসার মুস্তাফা আবুলউলায়ী সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ফিলিস্তিনের জনগণ দীর্ঘদিন যাবৎ অত্যাচার, নির্যাতনের মধ্যে অতিবাহিত করছে। অনেকে শহীদ হয়েছেন। শহীদদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না। শিশুহত্যা, দেশ থেকে বিতাড়ন, নির্যাতন সবকিছুরই শেষ রয়েছে।
তিনি বলেন, ইরানের ইসলামি বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেইনী মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য আল-কুদ্্স দিবস ঘোষণা করেন যাতে মাজহাব নির্বিশেষ সকলে ফিলিস্তিন ইস্যুতে একত্র হতে পারে।
ফিলিস্তিনিদের প্রতি অন্যায় করা হয়েছে। কিন্তু কতিপয় আরব দেশ ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক তৈরি করেছে, সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের চেষ্টা করছে যেটি ঠিক নয়। আমাদেরকে শত্রু-মিত্র চিনতে হবে। নিজেদের মধ্যে কিছু মতপার্থক্য থাকলেও অভিন্ন বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমরা বিভক্ত হয়ে পড়লে সেটি ইসলাম ও মানবতার দুশমনদের জন্য ভাল হবে যেটি কাম্য নয়। তাই আমাদের ইমানকে সমুন্নত করতে হবে, জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নতি সাধন করতে হবে, নৈতিকতাকে উন্নত করতে হবে, সর্বোপরি ঐক্যবদ্ধভাবে ফিলিস্তিন মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে হবে।
স্বাগত বক্তব্যে জনাব মোহাম্মাদ শওকাত হোসেন বলেন, বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ঘটনা ছিল ইরানের ইসলামি বিপ্লব। বিপ্লবের বিজয়ের কিছুদিন পরেই ইমাম খোমেইনী (রহ.) ফিলিস্তিনিদের প্রতি ঐক্য ও সহমর্মিতা ঘোষণা করে আল-কুদ্স দিবস ঘোষণা করেন।
তিনি বলেন, ফিলিস্তিনে হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর বংশধর হযরত ইয়াকুব (আ.) বাইতুল মুকাদ্দাস নির্মাণ করেন। পরে হযরত সোলায়মান (আ.) এর পুনঃনির্মাণ করেন। এ স্থান হযরত ইবরাহীম (আ.), মূসা (আ.) সহ অনেক নবীর সমাধিক্ষেত্র।
ব্রিটেন-আমেরিকার ষড়যন্ত্রে এ অঞ্চলে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে। ফিলিস্তিনিরা নিজ দেশে পরবাসী হয়ে গেছে। তারা পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। ১৯৬৭ সালে ইসরাইল বায়তুল মুকাদ্দাস দখল করে নেয়। ফিলিস্তিনিদের সাথে একাত্মতা প্রকাশের জন্যই আমাদের এই ওয়েবিনারের আয়োজন।
আমাদের জন্য আনন্দের বিষয় যে, এ বছর ফিলিস্তিনিরা বায়তুল মুকাদ্দাসে তারাবি নামায পড়তে পেরেছে। আমরা আশা করি আমরা ইসলামের শত্রুদের পরাজিত করে সেখানে আবার নামায পড়তে পারব, সুন্দরভাবে যিয়ারত করতে পারব। সেই দিনটির অপেক্ষায় আমরা রয়েছি।
এই দিনে ইমাম খোমেইনীকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি যে, তিনি ফিলিস্তিন ইস্যুতে মুসলমানদেরকে ঐক্যের দিকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। আমরা আশাবাদী একারণে যে, লেবাননে হিজবুল্লাহ সৃষ্টি হয়েছে, ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামের জন্য সৃষ্টি হয়েছে হামাস। সকলের মধ্যে সংগ্রামী চেতনা আরো শাণিত হয়েছে। সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হবেই।
ড. এ. কে. এম. মাহবুবুর রহমান বলেন, ১৯৮১ সাল থেকে আমরা বাংলাদেশে আল-কুদ্স দিবস পালন করে আসছি। কিন্তু কেন বাংলাদেশের মুসলমানদেরকে ফিলিস্তিন নিয়ে কথা বলতে হবে? আসলে আল-কুদ্স আমাদের ইমানের সাথে জড়িত। এই মসজিদের দিকে ফিরে রাসূলুল্লাহ (সা.) ১৬ মাসের অধিক সময় নামায আদায় করেছে। এই মসজিদে মিরাজের রাতে ১ লক্ষ নবির ইমামতি করেছেন। এই মসজিদে হযরত উমর ইমানের ঝা-া উড়িয়েছেন ও ইমামতি করেছেন। সালাউদ্দিন আইয়ুবী মুসলমানদের একত্র করেছেন ও ইমামতি করেছেন। হাদিসে যে তিনটি মসজিদের দিকে সফর করতে বলা হয়েছে তার অন্যতম বায়তুল মুকাদ্দাস।
ইহুদি জাতিকে সবসময় অপমান ও অসহায়ত্ব বরণ করতে হয়েছিল তাদের জুলুমের কারণে। এরা একটি উচ্ছৃঙ্খল জাতি, এরা মানবতা বোঝে না। তারা মুসলমানদের হাত থেকে পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিন জোর করে নিয়ে যায়। যদি আমরা কেবল ইসরাইলকে দায়ী করি, কিন্তু মূল হোতা হলো ব্রিটেন, আমেরিকা, এরপর রাশিয়া। ব্রিটেন শুরু করে আর আমেরিকা এর সাথে যোগ দেয়। তারা মুসলমানদের কলিজার মধ্যে ইসরাইল নামক ক্যান্সারটিকে বসিয়ে দেয়। তারা এটি পারত না। কিন্তু পেরেছে এজন্য যে, মুসলমানদের মধ্যে আজকে কোনো ঐক্য নেই। আরেকটি হলো ইমানি জোশ নেই। ইমানি জোশ না থাকার কারণে মুসলমানরা পিছিয়ে পড়ছে। ইমাম খোমেইনী (রহ.) বুঝলেন মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার বড় হাতিয়ার হলো আল-কুদ্স। তিনি রমযানের এই দিনটিকে আল-কুদ্স দিবস ঘোষণা করলেন।
১৯৪৮ সালে ১৪ মে যখন বেন গুরিয়ান ইসরাইল রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয় তার ১০ মিনিটের মাথায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়। এই দখলের পর ধীরে ধীরে ইসরাইলিরা ফিলিস্তিনের ৭৮ ভাগ এলাকা দখল নিয়ে নেয়। তারপরও ইহুদিদের নির্যাতন অব্যাহতভাবে চলে আসছে।
১৯৬৪ সালে ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে পিএলও গঠিত হলে মুসলমানরা মনে করে এর মাধ্যমে ফিলিস্তিন মুক্ত হবে। ১৯৯৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর রবিন-আরাফাত চুক্তির পর ফিলিস্তিনিরা জিহাদী চেতনা হারিয়ে ফেলে। এরপর শেখ ইয়াসিন (রহ.)-এর ডাকে হামাস গঠিত হলে আবার সেই জিহাদী চেতনা প্রাণ ফিরে পায়। ইন্তিফাদা আন্দোলন গড়ে ওঠে।
তিনি বলেন, বিভিন্ন দিবস পালন করা হলেও আল-কুদ্স দিবস যা আমাদের ইমানের সাথে জড়িত সে দিবসটিকে যথাযথভাবে পালন করা হচ্ছে না। রাষ্ট্রীয়ভাবে এটি পালন করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের ৪ লক্ষ মসজিদে আল-কুদ্স বিষয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। কিন্তু তা হচ্ছে না। এটি দুঃখজনক। অথচ মুসলমানদেরকে জানানো উচিত যে, আমাদের অপর মুসলিম ভাইবোনরা কোন্্ অবস্থায় রয়েছে।
তিনি বলেন, ইরান, তুরস্ক আর আরব বিশ্বের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে ফিলিস্তিনকে মুক্ত করতে হবে।
জনাব জামাল উদ্দীন বারী বলেন, মুসলমানদের ঐক্যের সাথে যে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সেই প্রেক্ষাপটের সাথে কিছু অস্বচ্ছতা রয়েছে যেগুলো আমরা জানি, কিন্তু বলি না। এখন সময় এসেছে সেই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটগুলো মুসলিম উম্মাহর কাছে যথাযথভাবে তুলে ধরা। যেমন ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের একটি পটভূমি হিসেবে নির্ধারণ করি কিন্তু এর প্রেক্ষাপট আরো ৫০০ বছর আগের। অটোমান সা¤্রাজ্যকে পরভূত করার যে নীল নকশা সেটির সাথে মুসলমানদের যে অংশগ্রহণ এবং প্রথম মহাযুদ্ধের যে পটভূমি সেটির ফলাফল বিবেচনা করলে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, সংকটটা কোথায়। মুসলমানদের বিভাজন ও বায়তুল মুকাদ্দাস দখল একই সূত্রে গাঁথা।
প্রথম মহাযুদ্ধ ছিল ইউরোপের সা¤্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর মধ্যকার দ্বন্দ্ব। এই সময়েই ফ্রান্স ও ব্রিটেন অটোমান সা¤্রাজ্যকে ভাগাভাগি করার ক্ষেত্রে একটি চুক্তি করে। ভার্সাই চুক্তিতে হেজাযের রাজাবাদশারা অংশ নেয় অন্য কোন মুসলিম প্রতিনিধিত্ব নেই। অটোমানদের কোনো প্রতিনিধিত্ব আমরা দেখি না। হেজাযের রাজা ও মক্কার শরীফ হোসনদের ভূমিকা আমরা সেভাবে জানি না। আমাদেরকে ইতিহাসের এই দিকগুলো জানতে হবে। মুসলমানদের বিভাজনের ইতিহাস জানতে হবে।
২০০১ সালে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর আমেরিকার পক্ষ থেকে ক্রুসেড কথাটি উচ্চারিত হয়েছিল। অর্থাৎ তারা ক্রুসেডকে ভুলে যায় নি। এভাবে তারাা যায়নবাদী এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে চলেছে। তারা আরো ২০০ বছর মুসলমানদেরকে পদানত করে রাখার নীল নকশা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে।
আরব রাজা-বাদশারা ডিল অব সেঞ্চুরিকে সমর্থন করছে এবং এটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আমাদের উচিত এ বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা।
জনাব এ কে এম বদরুদ্দোজা বলেন, অনেকে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের পাশাপাশি অবস্থানকে মেনে নিয়েছেন। এটি খুবই বিপজ্জনক। ১৯১৭ সালে বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন যে, মধ্যপ্রাচ্যে একটি ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করব। এটি প্রতিষ্ঠা করা হলো বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা ইহুদিদেরকে এনে। তারা ফিলিস্তিনের ভূমিপুত্র নয়। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিরে ভূমিপুত্র মুসলমানরা নিজেদের দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছে। তারা ছড়িয়ে পড়েছে জর্ডান, লেবানন, তিউনিসিয়া পর্যন্ত। গায়ের জোরে যে কৃত্রিম রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে তাকে কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। তারা প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা দখলে নিচ্ছে।
গত শতাব্দীতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অস্তিত্বের ব্যাপারটি ছিল একটি তামাশা। যে রাষ্ট্রের নিজস্ব কোন সেনাবাহিনী পর্যন্ত ছিল না। এমন রাষ্ট্রের বিষয়টি মেনে নেয়াটিই ভুল ছিল। আর বর্তমানে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের পাশাপাশি অবস্থানের কথা উচ্চারিত হচ্ছে।
আমরা অনেক সময়ই বিশ্বাস করতে চাই নি যে, গোপনের ইসরাইলের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোর সমঝোতার প্রচেষ্টা চলছে। কিন্তু পরবর্তীকালে সেটি স্পষ্ট হয়ে গেছে।
ফিলিস্তিনের সবচেয়ে বড় ভরসা ছিল মুসলিম বিশ্ব। তারা জানত যে, মুসলিম উম্মাহ তার পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু এখন আরব দেশগুলো ইসরাইলকে সমর্থন দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের সংকট গভীরতর হয়েছে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ায় এবং তার সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে নেয়ায়।
১৯৮৫ সালে ইসরাইল পরাজিত হয়েছিল হিজবুল্লাহর কাছে। ২০০৬ সালেও তারা পরাজিত হয়েছে।
আমাদেরকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক সংগ্রাম পরিচালনা করতে হবে। ফিলিস্তিন ইস্যুকে সবসময় আলোচনার মধ্যে রাখতে হবে। সবাইকে জাগ্রত করতে হবে। প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
ড. মোহাম্মাদ সিদ্দিকুর রহমান খান বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে কৃত্রিম ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি বিনষ্ট করা হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সহায়তা দানের বিনিময়ে ফিলিস্তিন ভূখ-ে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার ঘোষণা দেয়া হয়। পরবর্তীকালে এটি ক্রমশ সম্প্রসারিত হয়েছে। তারা ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমি দখল করেছে। প্রতিনিয়ত অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। ফিলিস্তিনের মুক্তি নিশ্চিতকরণে ইমাম খোমেইনী আল-কুদ্স দিবসের ডাক দিয়েছিলেন।
ইসরাইলকে পশ্চিমা শক্তি সহায়তা দিয়ে আসছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ডিল অব সেঞ্চুরি ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী ভাইদের জন্য একটি বড় আঘাত।
মুসলিম বিশ্বের দুর্ভাগ্য আরব বিশ্বের দ্বিধাবিভক্তি। যেসব আরব রাষ্ট্র ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়েছে তারা ভুল করেছে। রাজতান্ত্রিক দেশগুলোর শাসকরা তাদের ক্ষমতা হারানোর চিন্তায় আতঙ্কগ্রস্ত। এজন্যই তারা ফিলিস্তিনের স্বার্থের কথা চিন্তা না করে নিজেদের স্বার্থ চিন্তা করছে।
ইরান সম্পর্কে ভীতি সৃষ্টি করা হচ্ছে। আর পশ্চিমা শক্তি এ ভয়কে তাদের মধ্যে গেঁথে দিয়েছে। কিন্তু আরবদের জন্যও এর ফলাফল ইতিবাচক হবে না। তাদেরকে ভুলের মাশুল দিতে হবে। জালিমদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো রমযানেরও শিক্ষা।
বক্তারা আরো বলেন, যায়নবাদী ইহুদিদের কবল থেকে ফিলিস্তিন ও বাইতুল মুকাদ্দাস মুক্তকরণে বিশ^বাসীকে সচেতন করা ও মুসলমানদেরকে জাগিয়ে তোলাই এ দিবস পালনের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।
উল্লেখ্য, প্রতি বছর রমযান মাসের শেষ শুক্রবারÑ জুমআতুল বিদাকে আন্তর্জাতিক আল-কুদ্স দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের পর বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেইনী (রহ.) জুমআতুল বিদাকে আন্তর্জাতিক কুদ্স দিবস হিসেবে ঘোষণা দেন এবং ফিলিস্তিনের নির্যাতিত মুসলমানদের প্রতি সহমর্মিতা ও তাদের সাথে সংহতি প্রকাশের জন্য এ দিবসটি পালনের জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানান। তারপর থেকে বিশ^ব্যাপী এই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।

আল-কুদস দিবস, ইমাম খোমেইনী ও এবারের যুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের বিজয়

আল-কুদস দিবস, ইমাম খোমেইনী ও এবারের যুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের বিজয়
মুজতাহিদ ফারুকী

মসজিদুল আকসা ও আল কুদস দিবস : এবারের পবিত্র আল কুদস দিবস ছিল ১০ মে তারিখে। প্রতি বছর রমজানের শেষ জুম্মাবারে এই দিবস পালিত হয়ে আসছে গত প্রায় চার দশক ধরে। ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পর বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেইনী এই দিবস ঘোষণা করেন। এ ঘোষণার তাৎপর্য যে কত গভীর ও সুদূরপ্রসারী তা স্পষ্ট হয়, এই দিনে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডে।

প্রতি বছর তারা এই দিনে পবিত্র মসজিদুল আকসায় মুসলমানদের জুমাতুল বিদা পালনে বিঘ্নসৃষ্টি করে সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃতভাবে এবং গায়ে পড়ে সংষর্ষ বাঁধায়। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। তবে ব্যতিক্রম ঘটেছে মুসলমানদের মরণপণ সংগ্রামে, প্রতিরোধে। ইসলামের প্রথম কিবলা পবিত্র বায়তুল মোকাদ্দাস বা আল-কুদ্স আশ-শরিফ। যেটি আল আকসা মসজিদ নামে পরিচিত। হযরত ইয়াকুব (আ.) এ পবিত্র মসজিদের প্রথম নির্মাতা। পরবর্তী সময়ে হযরত দাউদ (আ.) ও তাঁর পুত্র সুলাইমান (আ.) এ মসজিদের পুনঃনির্মাণ করেন। ইসলামের পবিত্র তিনটি মসজিদের এটি একটি। জেরুজালেম, আল-আকসা মসজিদ এবং তার আশপাশের এলাকা ইসলামের বহু নবীর স্মৃতিবিজড়িত। এখানে রয়েছে অসংখ্য নবী-রাসূলের মাজার। ওহি ও ইসলামের অবতরণস্থল এ নগরী নবীদের দ্বীন প্রচারের কেন্দ্রভূমি। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ সা. ‘মসজিদুল হারাম’ অর্থাৎ ক্বাবা শরিফ থেকে ‘মসজিদুল আকসা’ হয়ে ঊর্ধ্বাকাশে পবিত্র মেরাজ শরিফ সম্পন্ন করেন। তাই এ পবিত্র নগরীর প্রতি ভালোবাসা প্রতিটি মোমিনের হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত। এই পবিত্র নাম শুধু একটি স্থানের সঙ্গে জড়িত নয়; বরং তা সব মুসলমানের বিশ্বাস, তাদের অন্তর্গত অনুভূতি ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বিশ্বের সব মুসলমানের মনে এ মসজিদের জন্য ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা রয়েছে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা.) ফিলিস্তিনে বিনা রক্তপাতে ইসলামের পতাকা উড্ডীন করেন। কিন্তু ১০৬৯ সালে খ্রিস্টান ক্রুসেডাররা ফিলিস্তিন দখল করে নেয়। ১১৮৬ সালে কুর্দী বীর গাজী সালাহ উদ্দিন আইয়ুবী খ্রিস্টান শক্তির হাত থেকে বায়তুল মোকাদ্দাসসহ ফিলিস্তিন পুনরুদ্ধার করেন। এর পর থেকেই ইহুদিবাদীরা ও তাদের দোসর খ্রিস্টানরা নানা ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয় এ পবিত্র ভূমি দখল করার জন্য। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ইহুদিরা তুরস্কের খলিফা আবদুল হামিদের কাছে ফিলিস্তিনে জমি কেনার প্রস্তাব দেয়। খলিফা সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় পশ্চিমা মিত্র শক্তিকে গোয়েন্দাগিরিসহ নানাভাবে সহায়তা করে ইহুদিরা ব্রিটিশ সরকারের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশরা ফিলিস্তিন দখল করে এবং একজন ইহুদিকে ফিলিস্তিনের গভর্নর নিয়োগ করলে তাদের নীল নকশা বাস্তবায়নের পথ খুলে যায়। ইহুদিবাদের সাথে গোপন চুক্তি অনুযায়ী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইহুদিদের জন্য একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয় ইঙ্গ-মার্কিন শক্তি। তারা যাদের কাছে বারবার পরাজিত হয়েছে সেই মুসলমানদের দুর্বল করতে তাদের বুকের উপর অর্থাৎ ফিলিস্তিনে ইসরাইল নামের অবৈধ রাষ্ট্র চাপিয়ে দেয়। ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘ ফিলিস্তিনের ৫৪% খাস ভূমির উপর ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে প্রস্তাব পাশ করে। এর সূত্র ধরে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেলফোর ১৯৪৮ সালের ১৫ মে ‘বেলফোর ঘোষণা’র মাধ্যমে অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলের জন্ম দেয়। এর পর থেকে শুরু হয় ফিলিস্তিনের জনগণের উপর নির্মম নির্যাতনের পালা। লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনিকে নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে বিতাড়িত করা হয়। তারা উদ্বাস্তু হিসাবে লেবানন, সিরিয়া জর্ডানসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। অন্যদিকে সারা বিশ্ব থেকে ইহুদিদের এনে মুসলমানদের ঘর-বাড়িতে বসিয়ে দেয় ব্রিটিশ আমেরিকার মদদপুষ্ট ইসরাইল। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরাইল প্রতিবেশী আরব দেশ জর্ডান, সিরিয়া ও মিসরের বিস্তীর্ণ ভূখ- দখল করে। ওদের নির্যাতন-নিপীড়ন বাড়তেই থাকে। প্রতিনিয়ত ওরা হত্যা করে চলেছে ফিলিস্তিনের নারী-শিশু বৃদ্ধ তথা সাধারণ মানুষকে। ১৯৭৩ সালের যুদ্ধেও আরবরা একরকম পরাস্ত হয়। কারণ, আমেরিকার অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্যে ততদিনে ইসরাইল বিপুল শক্তি অর্জন করে। ১৯৮২ সালে ইসরাইল লেবানন দখল করে ২০ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করে। ১৯৬৯ সালে বায়তুল মোকাদ্দাস মসজিদে আগুন ধরিয়ে দেয়। এরই প্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠিত হয় ওআইসি বা ইসলামি সম্মেলন সংস্থা। ১৯৭৪ সালে ইসরাইল আল-আকসা মসজিদে খনন কাজ শুরু করে। ১৯৭৯ সালে ন্যক্কারজনকভাবে মিসরের প্রেসিডেন্ট ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়ে কাম্প ডেভিড চুক্তি করেন। ১৯৬৪ সালের ৮ মে ইসরাইলের বিরুদ্ধে সংগ্রামের লক্ষ্যে পিএলও (প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন) গঠিত হয়। ইয়াসির আরাফাত ছিলেন এর নেতা। তিনিও এক সময় ইসরাইলের সঙ্গে আপোসের পথ ধরেন। ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পর আল-কুদ্স মুক্তির আন্দোলন নতুন দিশা খুঁজে পায়। বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেইনী (র.) আল-কুদস মুক্ত করার জন্য বিশ্বমুসলিমের প্রতি আহ্বান জানান। দিবসের গুরুত্ব সম্পর্কে ইমাম খোমেইনী বলেছিলেন, ‘দিবসটি কেবল কুদসের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। এই দিবস বলদর্পী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে শোষিত-বঞ্চিত-নিপীড়িত জনতার দিবস। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ যেসব দেশের জুলুম অত্যাচারে বিভিন্ন দুর্বল দেশ পিষ্ট হয়েছে তাদের রুখে দাঁড়ানোর দিবস। এই দিবস বলদর্পীদের বিরুদ্ধে নিগৃহীতদের সুসজ্জিত হবার দিবস।’ তাই আল-কুদস দিবস হলো শোষণ, বঞ্চনা, অন্যায়-অবিচার, নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার এক জ্বলন্ত প্রতীক, বিশ্বমানবতার পক্ষে, সত্য, ন্যায় ও মানবাধিকারের পক্ষেও এক অনন্যসাধারণ মানবিক আহ্বান। ইমাম খোমেইনী ফিলিস্তিনিদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং আল-কুদস দিবস পালনের মধ্য দিয়ে বিশ্বের মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধভাবে জেগে ওঠার একটি মঞ্চ তৈরি করে দেন যা অন্য কোনও আরব বা ইসলামি বিশ্বের নেতা কখনও করেননি। এখানেই খোমেইনীর কৃতিত্ব, তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব। এক ভাষণে কুদস দিবসের করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেছেন, বিশ্ব কুদস দিবসে মুসলমানদের কর্তব্য হচ্ছে বিক্ষোভ মিছিল ও সভা-সমাবেশের আয়োজন করে নিজ নিজ দেশের সরকারগুলোর কাছে জোরালো দাবি জানানো যাতে তারা অস্ত্রশক্তি ও তেল অস্ত্র নিয়ে আমেরিকা এবং ইসরাইলের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নামে। যদি তা না করে তবে চাপ প্রয়োগ, ধর্মঘট পালন ও হুমকি প্রদর্শন করে তাদেরকে সে কাজে বাধ্য করতে হবে ৷ কারণ, ইহুদিবাদী ইসরাইল সমগ্র আরব বিশ্ব, এমনকি মক্কা ও মদীনা শরীফ দখলেরও হুমকি দিচ্ছে।
ইমাম খোমেইনী ‘আল-কুদ্স’ দিবসের ঘোষণা দিয়ে এ দিন সারা বিশ্বের মুসলমানদেরকে ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি একাত্মতা ঘোষণার আহ্বান জানান। ফলে আল-কুদ্স মুক্তির লক্ষ্যে সংগ্রাম অব্যাহত থাকে। ফিলিস্তিনের আপোসকামী নেতৃত্বকে উপেক্ষা করে উঠে আসে প্রতিরোধ আন্দোলন ‘হামাস’। ১৯৮৭ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনের সংগ্রামী শিশু-কিশোররা ইসরাইলি সশস্ত্র হানাদার বাহিনীর উপর ইটপাটকেল নিক্ষেপের মাধ্যমে ‘ইন্তিফাদা’ আন্দোলনের জন্ম দেয়। হামাস এবং ইন্তিফাদাহর ফলশ্রুতিতে তিন তিন বার ইসরাইলি পরাশক্তি সংগ্রামী ফিলিস্তিনি জনগণের কাছে পরাজিত হতে বাধ্য হয়। ইমাম খোমেইনীর ঘোষিত দিবসটি আজ মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় এক অনন্য উদাহরণ। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের দৃষ্টিতে, নির্যাতিত ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহমর্মিতা ও সত্য প্রকাশের মাধ্যম হিসাবে এ দিবসটি সব সময়ই বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী। তাই পশ্চিমা ও ইসরাইলি গণমাধ্যম সব সময়ই এ দিবসকে খাটো করে দেখানো এবং এ ব্যাপারে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করে। তারপরও এ দিবস উপলক্ষে আয়োজিত মিছিলে লক্ষ লক্ষ মানুষের উপস্থিতির বিষয়টিকে তারা কখনই জনগণের দৃষ্টি থেকে আড়াল করতে পারেনি।
সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ আমেরিকার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে এবং আর্থিক সুবিধা পাবার লোভে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পর ফিলিস্তিনি ও ওই অঞ্চলের বৃহত্তর আরব জনগণের মধ্যে ইসরাইলের প্রতি বিরূপতা আরও বেড়েছে। ইরান ও তুরস্ক মুসলিম উম্মার ইস্যুতে আরও বেশি সোচ্চার ও কার্যকর ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে। আর এসব দেখে মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে ইসরাইলের। সেই সঙ্গে আছে দেশটির চরম জঙ্গীবাদী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ক্ষমতা হারানো ও কারাবন্দি হবার ভয়। ঘুষ খাওয়া, দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া এবং বিশ্বাস ভঙ্গ করার মতো বেশ কয়েকটি গুরুতর অপরাধের কারণে তাঁর বিরুদ্ধে ইসরাইলের আদালতে একাদিক মামলা রয়েছে। অভিযোগগুলির পেছনে জোরালো তথ্যপ্রমাণ আছে বলে জানা যায় ইসরাইলেরই গণমাধ্যমের খবরে। সুতরাং ক্ষমতা হারালে নেতানিয়াহুকে জেলে পচতে হবে এটা একরকম নিশ্চিতই। আবার ক্ষমতাও যে তাঁর হাতে থাকবেই এমন নিশ্চয়তাও তিনি পাচ্ছিলেন না, জনপ্রিয়তায় ধস নামার কারণে। এখন আগামী দু’বছরের মধ্যে যে নির্বাচন হবে তার আগে জনপ্রিয়তা বাড়ানো বা ভোটব্যাংক নিশ্চিত করার একটি জরুরি এজেন্ডা তাঁর সামনে রয়েছে। ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সেই এজেন্ডার অংশ বলে অনেক আরব বিশ্লেষকই মনে করেন।
এবারের যুদ্ধ : গত ১০ মে জুমাতুল বিদার দিন জেরুসালেমে মসজিদুল আকসায় মুসলমানদের নামাজ পড়তে বাধা দেয় ইসরাইলি পুলিশ। বরাবরের মতোই বাধা দিতে পারে এমন আশঙ্কায় বহু ফিলিস্তিনি সেদিন মসজিদে উপস্থিত ছিলেন। মসজিদে পুলিশ প্রবেশের পথে ব্যারিকেড দিয়ে তারা ভেতরে শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন। আল কুদস দিবসের এই বিক্ষোভও তাদের নিয়মিত কর্মসূচির অংশ। পুলিশ যথারীতি তাতে বাধা দেয় এবং বিপুল শক্তি প্রয়োগ করে। পুলিশের হামলায় প্রায় ৩০০ ফিলিস্তিনি আহত হয় যাদের মধ্যে চারজনের অবস্থা ছিল গুরুতর। গ্রেফতার করা হয় বিপুল সংখ্যককে। এই হামলা এমন সময় চালানো হয় যখন গোটা ফিলিস্তিনি জনগণ ছিল ক্ষুব্ধ ও প্রতিবাদমুখর। ক্ষোভের কারণ, ওই একই সময়ে ইহুদি রাষ্ট্রটি প্রায় সপ্তাহখানের ধরে নগরীর শেখ আল জাররাহ উদ্বাস্তু শিবিরের ফিলিস্তিনিদেরকে তাদের ঘরবাড়ি থেকে জোর করে গণহারে উচ্ছেদ করছিল এবং সেসব ঘরবাড়ি ইহুদি দখলদাররা দখল করে নিচ্ছিল। এই গায়ের জোরে উচ্ছেদের সময় যে নির্যাতন করা হয় তা নজীরবিহীন। প্রতিবাদকারীদের মাটিতে ফেলে মাথা হাঁটু দিয়ে চেপে ধরেছে ইহুদি পুলিশ এমন দৃশ্য আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশ পায়। স্বভাবিকভাবেই পরিস্থিতি ছিল উত্তপ্ত বারুদের মতো দাহ্য। মসজিদে হামলার ঘটনা ও আল জাররায় উচ্ছেদের প্রতিবাদে ফিলিস্তিনি বিভিন্ন গ্রুপ ইসরাইলে রকেট হামলা চালায়। এসব হামলায় কোনও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। কিন্তু জবাবে ইসরাইল দেশের একপ্রান্তে অবস্থিত ছোট্ট একটি অবরুদ্ধ এলাকা গাজায় জঙ্গিবিমান দিয়ে বোমা ফেলতে শুরু করে। সেই বিমান হামলায় প্রথম দিনেই ২০ ফিলিস্তিনি নিহত ও বেশ কিছু ভবন ধ্বংস হয়।
গাজায় ফিলিস্তিনিদের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল হামাস ক্ষমতায়। ইসরাইলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের যে প্রতিরোধ সংগ্রাম তার অন্যতম সেরা শক্তিশালী দল এখন হামাস। তাই ইসরাইল গাজায় হামলা চালিয়েছে হামাসকে ধ্বংস করতে। পরবর্তী ১১ দিন ধরে অব্যাহতভাবে হামলা চালিয়ে গেছে ইসরাইল। বেছে বেছে গাজার সব গুরুত্বপূর্ণ ভবন গুড়িয়ে ধূলিস্মাৎ করে দিয়েছে। ছাড় পায়নি বিশ্বখ্যাত গণমাধ্যম ও টেলিভিশন নেটওয়ার্ক আল জাজিরা ও আমেরিকান বার্তা সংস্থা এপির অফিস ভবনও। ১১ দিনের উপর্যুপরি হামলায় নিহত হয়েছে ২৪৮ জন ফিলিস্তিনি। এর মধ্যে আছে ৬৬টি শিশু ও ৩৯ জন নারী। আহত হয়েছে ১,৯১০ জন। আর বাড়িঘর হারিয়ে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছে ১,৯১০ জন ফিলিস্তিনি। এর বিপরীতে হামাস হাজারে হাজারে মিসাইল ছুঁড়েছে এটি ঠিক। কিন্তু সেগুলোর কার্যকারিতা সামান্যই। ইসরাইলের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করার প্রযুক্তি অনেক শক্তিশালী। ফলে হামাসের হামলায় ইসরাইলের পক্ষে মারা গেছে মাত্র ১২ জন ইসরাইলি। এর মধ্যে দুটি শিশু আর তিনজন বিদেশি শ্রমিক।
তার পরও হামাসের জয়?
রকেট হামলা চালিয়ে ইসরাইলের তেমন কোনও ক্ষতি করতে না পারলেও হামাস এই যুদ্ধে বিজয় দাবি করেছে। কিভাবে এটিকে বিজয় হিসাবে দেখা যেতে পারে? চলুন দেখে নেয়া যাক। ১১ দিনের হামলা শেষে নেতানিয়াহু বা ইসরাইলের মন্ত্রিসভা যখন যুদ্ধবিরতি মেনে নিলো তখন হাজার হাজার ফিলিস্তিনি সেই মধ্যরাতেই রাজপথে ছুটে আসে। তারা রাতভর উল্লাস করে। জঙ্গিবিমানের নির্বিচার হামলা, মৃত্যুর মুখোমুখি ১১টি নিদ্রাহীন রাতের পরও ২১ মে’র সেই রাতটিও নিদ্রাহীন কাটে তাদের। তবে এই নির্ঘুম রাত্রিযাপন ছিল উল্লাসের, আনন্দের। কারণ, সাধারণভাবে সব ফিলিস্তিনিই এটিকে তাদের বিজয় হিসাবেই দেখছিল এজন্যে যে, নেতানিয়াহু একেবারে নিঃশর্তভাবে যুদ্ধবিরতি চুক্তি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। যদিও তিনি দাবি করেছেন, তাঁর বিমান বাহিনী হামাসকে শিক্ষা দিয়েছে, তাদের সুড়ঙ্গপথের নেটওয়ার্ক ও রকেট কারখানা ধ্বংস করেছে এবং ২৫ জন সিনিয়র নেতাসহ ২০০ হামাস যোদ্ধাকে খতম করেছে। অন্যদিকে ফিলিস্তিনি নেতারা বলছেন, তাঁরা দুটি শর্ত মেনে নিতে ইসরাইলকে বাধ্য করেছেন। হামাস নেতা আবদেল লতিফ আল-কানো বলেছেন, দুটি শর্ত হলো, আল আকসায় পুলিশ মোতায়েন করা যাবে না এবং শেখ জাররাহ থেকে কোনও ফিলিস্তিনি পরিবারকে জোর করে উচ্ছেদ করা যাবে না। তবে এই শর্তারোপ করতে পারাই তাঁদের বিজয় দাবির মূল কারণ নয়। যে কারণে তাঁরা বিজয় দাবি করেছেন সেটি হলো, ফিলিস্তিনি জনগণের সুদৃঢ় ঐক্যের প্রতিফলন ঘটেছে এবারের প্রতিরোধে। আর গোটা বিশ্ব ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলি হামলার বিষয়ে অতীতের যে কোনও সময়ের চেয়ে বেশি সোচ্চার হয়েছে।
হামাসের বিজয় দাবির অনুকূলে এটাই সবচেয়ে বড় প্রমাণ যে, নিজেদের বিজয়ের ব্যাপারে ফিলিস্তিনিদের মনে কোনও সন্দেহ নেই। তারা ঈদুল ফিতরের এক সপ্তাহ পর শুক্রবার সকালে সমবেতভাবে ঈদুল ফিতরের দোয়া পাঠ করেছে এবং ঈদের খুৎবা দিয়ে ঈদের নামাজ আদায় করেছে। এরপর সবাই মিষ্টিমুখ করেছে, মিষ্টি বিতরণ করেছে। বিমান হামলার কারণে তারা এবার ঈদের জামাত পড়তে বা উৎসব পালন করতে পারেনি। অন্যদিকে নেতানিয়াহুর পরাজয় এখানেই যে, তাঁর জনগণ এটিকে বিজয় মনে করছে না। বরং নিঃশর্ত যুদ্ধবিরতি মেনে নেওয়ার ঘটনাটি তারা পরাজয় হিসাবেই দেখছে। শুনুন ইহুদি জঙ্গিবাদীদের মন্তব্য। ইসরাইলের নিউ হোপ পার্টির নেতা গিডিওন সা’র যুদ্ধবিরতিকে বলেছেন, ‘বিব্রতকর’। বলেছেন, বিশ্বের সেরা গোয়েন্দা সংস্থা ও বিমান বাহিনী ব্যবহার করেও নেতানিয়াহু হামাসের কাছ থেকে কেবল একটি ‘শর্তহীন যুদ্ধবিরতি’ আদায় করতে পেরেছেন। ইসরাইলের সংসদ বা নেসেটের চরমপন্থী সদস্য ইতামার বেন গবির বলেন, ‘এই বিব্রতকর যুদ্ধবিরতি হলো হামাসের কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ।’
গাজায় পরাজয়ের কথা স্বীকার করে ইসরাইলের অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল আইজ্যাক ব্রিক, একটি রেডিওকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, প্রমাণিত হয়েছে, তেল আবিব কয়েকটি ফ্রন্টে একসঙ্গে যুদ্ধ করতে গেলে মহাবিপর্যয়ের মুখে পড়বে। তিনি বলেন, যখন হিজবুল্লাহও যুদ্ধে নামবে তখন আমরা কীভাবে তা মোকাবেলা করব?
গাজার ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক বিশ্লেষক আদনান আবু আমের বলেন, এবারের যুদ্ধে হামাস সামরিক এবং রাজনৈতিক উভয় দিক দিয়েই বিজয়ী হয়েছে বলে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সাধারণভাবে ঐকমত্য দেখা গেছে। কারণ, ইসরাইলের বস্তুগত ক্ষতি খুব একটা করতে না পারলেও গোটা বিশ্বের সামনে ইসরাইলের ভাবমূর্তিতে মারাত্মকভাবে আঘাত করতে পেরেছে। এবারই ইসলামি, আরব ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের বৃহত্তম অংশ ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং তাঁর সরকার ইসরাইলের সমর্থনে আগের মতোই ন্যক্কারজনক ভূমিকা পালন করেছে যা লজ্জাজনক। কিন্তু মার্কিন কংগ্রেসে এবার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে ইসরাইলকে বাড়তি সামরিক সাহায্য দেওয়ার একটি উদ্যোগ। দুজন সদস্য এই সহায়তা বন্ধের দাবিতে বেসরকারি বিল জমা দিয়েছেন। এতে সাহায্যদান বন্ধ হবে কিনা সেটি পরের কথা, কিন্তু এটি ইসরাইলের প্রতি মার্কিনিদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে ভূমিকা রাখবে তাতে সন্দেহ নেই।
যুদ্ধবিরতির পর স্বাগত জানিয়ে বিশ্বের বহু দেশ শান্তির লক্ষ্যে কাজ করার জন্য উভয় পক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনও শান্তিপ্রক্রিয়া আদৌ নেই। একমাত্র তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে ফিলিস্তিনিদের জীবন ও সম্পদের বিপুল ক্ষতি সাধনের জন্য ইসরাইলকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ও বিচার করতে হবে। ইরানও এ বিষয়ে সোচ্চার শুধু নয়, সর্বতোভাবে সক্রিয়। ইরানের বর্তমান নেতা সম্প্রতি ফিলিস্তিনি নেতাদের চিঠির জবাবে তাদের সংগ্রামে অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করে সব সময় তাদের পাশে থাকার আশ্বাস ও অঙ্গীকার ঘোষণা করেছেন।
ইসরাইলের ফিলিস্তিন দখল বিশ্ব মুসলিমের জন্য সবচেয়ে বেদনাদায়ক একটি ধর্মীয় ক্ষত। এই ঘটনা বিশ্বের প্রতিটি মুসলমানের হৃদয়ে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হাহাকারের মতো প্রতিনিয়ত অনুরণিত হয়। কিন্তু মুসলিম দেশগুলোর শাসকদের অনৈক্য এবং বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্র ও সংগঠনগুলোর অব্যাহত ষড়যন্ত্রের কারণে ফিলিস্তিনিরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত।
বিশ্ববাসীর অজানা নয় যে, সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা, ইসরাইল ও তাদের ইউরোপীয় এবং অন্য সাম্রাজ্যবাদী সহযোগীরাই বিশ্বে যুদ্ধ, সন্ত্রাস ও অশান্তি সৃষ্টির প্রধান হোতা। এটা স্পষ্ট যে, ইহুদিবাদী দখলদারদের নাগপাশ থেকে ফিলিস্তিন ও আল আকসা মুক্ত না করা পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তাই কুদস মুক্তির জন্য সংগ্রামরত ফিলিস্তিনি এবং অন্যান্য সংগ্রামীর নৈতিক সমর্থনসহ সব ধরনের সাহায্য-সমর্থন দিতে হবে। এ ছাড়াও আমেরিকা ও ইসরাইলের মতো যেসব দেশ বিশ্বে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে সামরিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও প্রচারণাগত তথা সর্বাত্মক ক্রুসেড চালিয়ে যাচ্ছে তা মোকাবিলার জন্য মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ নিতে হবে। আশা করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, বিশ্বের মুসলিম দেশ ও আরব বিশ্ব এ বিষয়ে সোচ্চার হলে একদিন সেই সময়ও আসবে যখন ইসরাইলকে সন্ত্রাসী, যুদ্ধাপরাধী ও মানবতার দুশমন হিসাবে হাতেনাতে পাকড়াও করা হবে। আর এভাবেই একটি স্বাধীন সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর অংশীদার ফিলিস্তিনিদের ওপর ইহুদি শাসকগোষ্ঠীর অব্যাহত জুলুম-নিপীড়নের চিরতরে অবসান ঘটবে।

 

করোনাভাইরাস মহামারিতে নওরোজে ভিন্ন আবহ

করোনাভাইরাস মহামারিতে নওরোজে ভিন্ন আবহ
রাশিদুল ইসলাম 

ফারসি ভাষায় নওنو অর্থ নতুন আর রুজ روز অর্থ দিন। বাংলায় আমরা যেমন বছরের প্রথম দিন নববর্ষ উদ্যাপন করি তেমনি ফারসি বছরের প্রথম দিন (২১ মার্চ) ইরান, আফগানিস্তানসহ বিশ্বের অনেক দেশেই এ ফারসি নববর্ষ উদ্যাপন হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। এসেছে নওরোজ চলো এ বসন্ত লগনে/ঘর ছেড়ে বাঁধি ঘর সবুজ জঙ্গলে,বনে। কিন্তু এবারো মহামারির কারণে গত বছরের মতো নওরোজে ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করেছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেয়ী। তিনি নওরোজে কোনো সফর করবেন না বলে ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘গত ফারসি নববর্ষ নওরোজে দেশবাসী করোনা মোকাবেলাবিষয়ক কর্মকর্তাদের দিকনির্দেশনা মেনে চলেছেন, এর ফলে বড় দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়া গেছে। এবারও নওরোজে ব্যাপক ঝুঁকি রয়েছে। এ ক্ষেত্রে করোনা মোকাবেলাবিষয়ক জাতীয় টাস্কফোর্স যা বলবে তা মেনে চলতে হবে। তারা যদি সফরে যেতে মানা করে তাহলে তা মানতে হবে। আমিও নওরোজে কোনো সফরে যাব না।’ এর আগে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা ফারসি নববর্ষ উপলক্ষে প্রতি বছর মাশহাদে যেতেন, সেখানে ইমাম রেযা (আ.)-এর মাযার যিয়ারত করতেন এবং সেখান থেকেই নববর্ষের বাণী দিতেন। মাশহাদ হচ্ছে সর্বোচ্চ নেতার জন্মশহর।
নওরোজে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিবিড় আত্মীয়তার দিনে এই মহামারি কালে উৎফুল্লতা হয়ত থাকবে না প্রকাশ্যে কিন্তু ইরানি মুসলমানরা নওরোজের শুরুতেই দুই হাত তুলে পরোয়ারদিগারের কাছে মুনাজাতে বলবেন, ‘হে অন্তর ও দৃষ্টির পরিবর্তনকারী এবং দিন ও রাতের পরিচালনাকারী এবং অবস্থার পরিবর্তনকারী (মহান আল্লাহ)! আমাদের অবস্থাকে সর্বোত্তম অবস্থায় রূপান্তরিত করুন।’ এ সময় তাঁদের সামনে টেবিলে বা দস্তরখানে থাকে পবিত্র কোরআন, তসবিহ এবং ‘হাফত সিন’ নামে খ্যাত সাতটি বিশেষ সামগ্রীসহ আরো কিছু সামগ্রী।
প্রাচীন ইরানিরা নওরোজকে দু’ভাবে বিভক্ত করে পালন করত। পাঁচদিনব্যাপী পালিত নওরোজ যাতে আপামর জনসাধারণই অংশগ্রহণ করত। বছরের প্রথম দিন পহেলা ফারভারদিন থেকে শুরু হয়ে ৫ ফারভারদিন পর্যন্ত এ উৎসব বিরামহীন চলত। এই পাঁচদিন রাজা-বাদশাহরা জনসাধারণকে বালাখানা বা রাজপ্রাসাদে সাক্ষাৎ দিতেন। তাদেরকে আপ্যায়ন করাতেন। কারাগারের দরজাগুলো খুলে দিয়ে বন্দিদের মুক্তি দিতেন, অভাবী লোকদের অভাব-অনটন দূর করার জন্য চেষ্টা করতেন। মাওলানা রুমীর এক কবিতায় মুক্তির বিষয়টি এসেছে এভাবে- ‘যেহেতু নতুন উৎসবের দিন তাই ফিরে এসেছি কারাগারের তালা ভাঙব বলে, আর এই মানুষখেকো কাল চক্রের থাবা চূর্ণ করব বলে।’
তার মানে নওরোজের মতো উৎসব শুধু বসন্তকালে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়া নয়, দ্রোহের সঙ্গে অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে ঋজু হয়ে দাঁড়ানোর শিক্ষা দেয়। ইরান, আফগানিস্তান ছাড়াও আলবেনিয়া, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, তুরস্ক, বাংলাদেশ, চীন, জর্জিয়া, ভারত, পাকিস্তান, ইরাক, ইসরায়েল, কাশ্মীর, কাজাখস্তান, কিরঘিস্তান, নর্দান সাইপ্রাস, রাশিয়া, সিরিয়া, তাজিকিস্তান, তুরস্ক, তুর্কমেনিস্তান, ইউক্রেইন, উজবেকিস্তানসহ নানা দেশে নওরোজ আসে প্রতি বছরে উৎসব নিয়ে। উচ্চারণে দেশ ও ভাষা পার্থক্যে নওরোজের উচ্চারণও বদলে যায়। কোথাও নোরুজ, নাওরোউজ, নিউরজ, নভরুজ, নওরোউজ, নাওরোউজ, নাউরিজ, নুরুজ, নাওরুজ, নাভরুজ, নেভরুজ এমননিভাবে উচ্চারিত হতে থাকে মানুষের মুখে মুখে। আদতে এ উৎসব ইরানি ও জরাথ্রুষ্টরা প্রথম শুরু করে। যা ৩ হাজার বছর আগেও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে পশ্চিম এশিয়া, মধ্য এশিয়া, ককেশাস, কৃষ্ণ সাগর উপকূল, বলকান ও দক্ষিণ এশিয়ায় উদ্যাপিত হয়ে আসছে।

ইরানের হাখামানেশী সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট দ্বিতীয় সাইরাস বা কুরুশ বাবেল বা ব্যাবিলন জয়ের বছর তথা খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৮ সালে সর্বপ্রথম নওরোজকে জাতীয় উৎসব হিসেবে ঘোষণা ও পালন করেন। পারস্য সম্রাট প্রথম দারিউশের শাসনামলে এ উৎসব পার্সেপলিস প্রাসাদ কমপ্লেক্স বা তাখতে জামশিদে অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা এ উৎসবে উপস্থিত হয়ে ইরান সম্রাটকে নানা উপহার সামগ্রী দিতেন। প্রথম দারিউশ নওরোজ উপলক্ষে খ্রিস্টপূর্ব ৪১৬ সালে স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন করেন। আশকানি ও সাসানি সম্রাটদের যুগেও নওরোজ উৎসব পালিত হতো। সাসানি যুগেই নওরোজ উৎসবের অনুষ্ঠানমালা ও পর্বগুলো তুলনামূলকভাবে বেশি বিস্তৃত হয়েছিল। নওরোজ ইরানি, কুর্দি, তাজিক ও আজেরি জাতিসহ আরো কয়েকটি জাতির বৃহত্তম জাতীয় উৎসব। জাতিসংঘের সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো নওরোজ উৎসবকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। ইসলাম ছাড়াও বিভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসীরাও নওরোজ পালন করে। সেদিক থেকে এ এক ধর্মনিরপেক্ষ উৎসবও বটে। ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক উৎসব হিসেবে একে স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘ। নওরোজ মানে উত্তর গোলার্ধে বসন্তের সূচনা। যে মুহূর্তে সূর্য আকাশের নিরক্ষীয় অঞ্চল অতিক্রম করে এবং রাত ও দিনকে সমান করে প্রতি বছর ঠিক সেই ক্ষণকে গণনা করা হয় আর পরিবারগুলো অনুষ্ঠান পালন করতে একত্রিত হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে নওরোজকে ঘিরে বিভিন্ন দেশে ভিন্ন সময়ে ভিন্ন আঙ্গিকে উৎসবের আয়োজন চলে। যেমন আজারবাইজানে নওরোজের প্রস্তুতি শুরু হয় এক মাস আগে থেকে। নওরোজ উপলক্ষে আজারবাইজানে স্বজনদের গোরস্তানে অনেকে যান দোয়া ও প্রার্থনা করতে। দেশটির মানুষরা পানি, আগুন, মাটি ও বাতাসকে নওরোজের উপকরণ হিসেবে মনে করেন।
আবার অনেকে ইরানি কবিতার সেই ছত্র আবৃত্তি করেন, যেমন ‘আমার দুর্বলতা তোমাকে দিলাম, তোমার শক্তি আমি নিলাম’। (سرخی تو از من‎زردی من از تو، ) উচ্চারণ করলে দাঁড়ায়, ‘জার্দিইয়ে মান আজ তো, শোরখিইয়ে তো আজ মান’। তার মানে নওরোজের উৎসবে মঙ্গল কামনা করে বলা হয় অসুখ-বিসুখ, সংকট যেন অটুট স্বাস্থ্য ও শক্তিমত্তায় রূপান্তরিত হয়। দশম শতাব্দীর পণ্ডিত আল বিরুনি তাঁর বিখ্যাত কিতাব ‘আল-তাফিম লি আওয়াইল সিনাআত আল-তানজিম’-এ বিভিন্ন জাতির নওরোজে অংশগ্রহণের কথা বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। গ্রিক, ইহুদি, আরব, সাবিয়ানসহ বিভিন্ন জাতি নওরোজ উৎসব পালন করত। পারস্য ঐতিহাসিক গারদিজি তাঁর ‘জাইন আল-আখবার’ বইতে জরাথ্রুস্টদের উৎসবপর্বে নওরোজের বিবরণ দিয়েছেন। পার্সেপোলিসেও নওরোজ পালিত হতো শত স্তম্ভের আপাদানা প্রাসাদে। ‘এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা’য় দেখা যায় খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৯ সালে ইহুদিরা ইরানি শাসকদের অধীনে এলে উভয় সাংস্কৃতিক উৎসবের একটা অংশ জুড়ে থাকত নওরোজ। এশারবাইতে পুরিমের গল্পে নওরোজের কাহিনী উঠে এসেছে। এমনকি খ্রিস্টপূর্ব ২৪৮ অব্দ থেকে ২২৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে পার্থিয়ান বা আর্সাসিড রাজত্ব ছিল আর্মানিয়া ও ইবেরিয়া জাতির, সেই সময়ে নওরোজ পালিত হতো। এছাড়া ৫১-৭৮ খ্রিস্টাব্দে ভলোগ্যাসের রাজত্বেও পালিত হতো নওরোজ। সাসানি আমলে নওরোজ বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে উদ্যাপিত হতো। নগদ উপহার থেকে শুরু করে বন্দিদের মুক্তি দেওয়া সেকালে যা আরো নওরোজে অনুসরণ করা হয়।
৬৫০ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানদের পারস্য যুগ শুরু হয়। আব্বাসি শাসনামলে নওরোজ রাজকীয় উৎসবে পরিণত হয়। আবার রাসূল জা’ফারিয়ান তাঁর ‘শিয়া সংস্কৃতিতে নওরোজ’ প্রবন্ধে বলেন, হিজরি ষষ্ঠ শতকের প্রথমার্ধ্বে রচিত দোয়া কবুল সংক্রান্ত ‘যাখীরাতুল আখেরা’ গ্রন্থে পারস্যবাসীর নওরোজ দিবসের আমল সম্পর্কে একটি অধ্যায় রয়েছে যার ব্যাখ্যায় মু’আল্লা ইবনে খুনবাইস-এর হাদিসটি এভাবে বলা হয়েছে : হযরত ইমাম (জাফর) সাদেক (আ.) বলেন : ‘নওরোজে তোমরা রোজা রাখ, গোসল কর, সবচেয়ে পরিষ্কার জামা পরিধান কর, খুশবু ব্যবহার কর, যদি পূর্বের নামাজ ও সুন্নাতগুলো আদায় করে থাক, তাহলে দু’টি সালামের সাথে চার রাকাত নামাজ পড়।’
এ হচ্ছে নওরোজের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্যময় উপলব্ধি। প্রাচীন রীতিনীতি ও পন্থার অনুসরণে এখনো ইরানিরা সেই মূল্যবোধগুলো মেনে চলছেন। তার মানে শুধু সামাজিক রীতিনীতি বা দেশীয় সংস্কৃতিই নয়, নওরোজের সূচনা পর্বে তথা এই দিনের শুরুতে আল্লাহর দরবারে দোয়া করা হয় এইভাবে- ইয়া মুকাল্লিবাল কুলুবি ওয়াল আবসার, ইয়া মুদাব্বিরাল লাইলি ওয়ান্নাহার, ইয়া মুহাভ্ভিলাল হালি ওয়াল আহওয়াল, হাভ্ভিল হালানা ইলা আহসানিল হাল অর্থাৎ হে অন্তরসমূহ ও দৃষ্টিসমূহের বিবর্তনকারী, হে রাত ও দিবসের পরিচালনাকারী, হে বৎসর ও অবস্থাসমূহের পরিবর্তনকারী, আমাদের অবস্থাকে উত্তম অবস্থায় পরিবর্তন করুন।
খিলাফতের পর ইরানি রাজবংশগুলোর উত্থানকালেও নওরোজ আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে বোয়াইদ শাসকরা প্রাচীনকালের সাসানিদের রীতি অনুসরণ করতে থাকে। ইরানে বোয়াইদ শাসক আদুদ আল-দাওলা নওরোজ উৎসবে বিশাল প্রাসাদে রাজকীয় স্বাগত জানাতেন অতিথিদের। সোনা ও রুপার প্লেটভর্তি ফল ও রঙ্গিন ফুলের ফুলদানি সাজিয়ে শাসকরা রাজসিংহাসনে বসতেন। রাজকীয় অতিথিরা নওরোজের এ উৎসবে এসে শাসকদের অভিনন্দন জানাতেন। সংগীতশিল্পীরা গেয়ে উঠতেন আর সুরের মূর্ছণা সৃষ্টি হতো- যার মধ্য দিয়ে উৎসব হয়ে উঠত দুর্দান্ত। পরবর্তীতে তুর্কি ও মঙ্গল আগ্রাসনকারীরা নওরোজকে এড়িয়ে গেছেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন টিকে থাকার সময় সেখানে ও ইরান ও আফগানিস্তানে নওরোজ সরকারিভাবে উদ্যাপিত হতো। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে নওরোজ জাতীয় ছুটির দিনের মর্যাদা পায়। উৎসব শুরু হওয়ার আগে থেকে বাড়ি-ঘর পরিষ্কার, নতুন রংয়ে রাঙ্গিয়ে তোলা, স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ, খাবার দাবার ও বস্ত্র কেনাকাটা, দাওয়াত ও নিমন্ত্রণে ভরপুর হয়ে ওঠে নওরোজ। শিশু থেকে শুরু করে মুরুব্বিদের হাতে তুলে দেওয়া হয় উপহারসামগ্রী।
অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা অঞ্চলে শিয়া মুসলিমরা নিয়মিত নওরোজ উৎসব পালন করে। এটি চলে আসছে মোগল শাসনামল থেকে। তখন ১৯ দিনব্যাপী নওরোজ উদ্যাপিত হতো। ঢাকার নবাব পরিবারও নওরোজ উৎসব পালন করে। বাংলাদেশের জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের কবিতায় উঠে এসেছে নওরোজের শাশ্বত বাণী। এসব কবিতায় তরুণদের শৌর্যের সাথে মানসিক সৌন্দর্যের স্বভাবসুলভ আহ্বান ও হৃদয়গাথার পরিচিতি পাওয়া যায়। ভারতের হায়দ্রাবাদসহ বিভিন্ন প্রদেশে মুসলিমদের মধ্যে নওরোজ উদ্যাপিত হয়ে আসছে মোগল শাসনামল থেকে। কুতুবশাহী আমলেও এ উৎসবের প্রচলন ছিল। সম্রাট হুমায়ূন ভারতের উত্তরাঞ্চলে এই উৎসবটির প্রচলন ঘটান। এরপর স¤্রাট আকবরের রাজত্বের (১৫৫৬-১৬০৫) প্রথম থেকেই নওরোজ উৎসব উদ্যাপিত হতে থাকে। এই উপলক্ষে হেরেমবাসিনী নারীরা শখের বশে দোকান সাজিয়ে মীনা বাজার বসাত।
চীনের উইঘু মুসলমান থেকে শুরু করে তাজিক, সালার ও কাজাখ জাতির মধ্যে নওরোজ উদ্যাপিত হতে দেখা যায়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ সিরিয়া বা ইরাকেও নওরোজের উপস্থিতি রয়েছে। পাকিস্তানের গিলগিট-বালতিস্তান, খাইবার পাখতুনখোয়া বিশেষত দেশটির সঙ্গে আফগান সীমান্ত অঞ্চলের বেলুচিস্তানে নওরোজ উদ্যাপিত হয়ে থাকে। ইসমাইলী সম্প্রদায়েরাও নওরোজে অংশ নিয়ে থাকেন।
শিয়া মুসলিমরা বিশ্বাস করেন তাঁদের সপ্তম ইমাম মূসা আল-কাযিমের বিবৃতি অনুসারে নওরোজের দিন আল্লাহ তাঁর বান্দাদের একমাত্র তাঁরই উপাসনা করার আদেশ দেন, অংশী সাব্যস্ত করতে নিষেধ করেন। তাঁর এ বাণী নিয়ে যখন ফেরেশতা এই দুনিয়ায় আগমন করেন তখন বিশুদ্ধ বায়ু বইতে থাকে এবং ফুলে ফুলে বসন্ত সেজে ওঠে। জিবরাইল (আ.) এদিন নবিজি (সা.)-এর কাছে আসেন। এদিনই ইবরাহিম (আ.) মূর্তি ভেঙ্গে ফেলেন। নওরোজেই নবিজি তাঁর কাঁধে হযরত আলীকে তুলে নেন এবং তিনি কাবা শরীফে রক্ষিত মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেলেন। হযরত আলী এদিনই খিলাফতের দায়িত্ব নেন। শিয়া মুসলমানরা নওরোজে বিশেষ রোজা রাখেন।
নওরোজের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আয়োজেন বিশাল বৈচিত্র্যে ভরপুর হওয়ায় এ উৎসবের ব্যাপ্তি অন্য যেকোনো উৎসবের চেয়ে দীর্ঘ দিনের হয়ে থাকে। জ্যোতির্বিদ্যার বিষয়সমূহ নওরোজকে ঘিরে যেন আবর্তিত হতে থাকে। সূর্যের চতুর্দিকে পৃথিবীর ঘূর্ণন, রাত ও দিনের আবর্তন, বিভিন্ন ঋতুর পরিক্রম, পৃথিবীর চারদিকে চাঁদের পরিক্রম প্রভৃতি মানুষকে দিনক্ষণ, মাস ও বছরের হিসাব-নিকাশে উদ্বুদ্ধ করেছে, প্রকারান্তরে বাধ্যও করেছে। আর এভাবেই বর্ষপঞ্জির জন্ম দিয়েছে। বছরের শেষ দিনগুলো যেমন অন্তিমের সু তোলে মানবজীবনে এবং কিছুটা হলেও বেদনাকর; তেমনি বছরের শুরুটা মূলত এক নতুনত্বের সূচনা- যা মানুষকে নতুন অনুভূতি, নতুন আশা-আকাক্সক্ষা ও প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করে তোলে। সূচনা বা শুরু সব সময়ে আনন্দের হয়ে থাকে। এই খুশি ও আনন্দের অভিব্যক্তির জন্য অর্থাৎ তার প্রকাশ ও বিকাশ ঘটানোর জন্য মানুষ সমাজে বিভিন্ন ধরনের উৎসব ও আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন করে থাকে। প্রাগৈতিহাসিক কালের ইরানিরা নৈসর্গিক জীবনের সমাপ্তি উপলক্ষে ফারসি সনের শেষ ১১ দিন অর্থাৎ খ্রিস্টীয় হিসাবে ১০ থেকে ২০ মার্চ শোক পালন করত। নওরোজ বা নববর্ষ উপলক্ষে বিশ্বপ্রকৃতিতে নতুন করে জীবনের উপস্থিতিতে এই শোকের সমাপ্তি হতো এবং এ উপলক্ষে আনন্দ উৎসব হতো।
ঋতু বৈচিত্র্যের দেশ ইরানে বারো মাসে ৪টি ঋতু, যেমন : বাহার (বসন্ত), তাবিস্তান (গ্রীষ্ম), পায়িয (শরৎ) এবং যেমিস্তান (শীতকাল)। এই চার ঋতুর জন্য হাখামানশীদের চারটি ভিন্ন ভিন্ন আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছিল। পার্সেপোলিস ছিল তাদের বাহার বা বসন্তকালীন আবাসস্থল এবং নববর্ষ উদ্যাপনের কেন্দ্র। প্রাচীন ভাস্কর্য ও নকশাসমূহে পরিদৃষ্ট হয় রাজা (সম্রাট) সিংহাসনে বসে তাঁর প্রজাবর্গ ও রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা এবং আঞ্চলিক প্রতিনিধি বা দূতদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন এবং তাঁরাও সম্রাটের জন্য উপঢৌকনাদি অর্পণ করছেন। তার মানে নওরোজ উৎসব ইরানের জাতিগত ঐক্য ও সংহতি গঠনে বিশেষ সহায়ক ভূমিকা রেখেছে- যার ধারাবাহিকতা আজও বহাল রয়েছে।
কথিত আছে যে, বাদশাহরা এই দিনগুলোতে সিংহাসন ও মুকুট ত্যাগ করতেন এবং জনসাধারণের রায়ের ভিত্তিতে একজন নতুন বাদশাহ নির্বাচন করতেন- যাঁকে বলা হতো মীর-ই-নওরোজী (নওরোজের অধিনায়ক)। এই মনোনীত বাদশাহর শাসন ও আদেশ ৫ দিন পর্যন্ত রাজা-বাদশাহদের আদেশ-নিষেধের ন্যায়ই কার্যকর হতো। তবে এটা ছিল এক প্রতীকী কর্তৃত্বস্বরূপ।
ড. মাহমুদ বাশীরীর মতে, এই প্রাচীন নিয়ম অনুসরণে এখনও কুর্দিস্তান প্রদেশসহ আরও কোনো কোনো প্রদেশ ও অঞ্চলে এ প্রথাটি চালু রয়েছে। এই প্রথাটির সত্যতা কবি হাফিজের কবিতায়ও পাওয়া যায়। হাফিজ বলেন : ‘শোনো, অন্তরলোক থেকে বলছি ফুলের মতো কলি ছেড়ে বেরিয়ে এসো, কারণ, পাঁচদিনের বেশি চলবে না মীরে নওরোজীর ফরমান।’
এই পাঁচদিনকে ইরানি লোকজন ‘নওরোজে সাগীর’বলে থাকে- যার অর্থ হচ্ছে ছোট নওরোজ। এই নামটি বর্তমানে প্রচলিত নেই। তবে সে অতীতকালের অনেক নিয়ম এখনও বিদ্যমান। বর্তমানকালেও সমগ্র ইরানব্যাপী ফারভারদিন মাসের প্রথম পাঁচদিন সাধারণ ছুটি রয়েছে এবং তাঁরা অতীতের মতোই উৎসব আনন্দে মেতে থাকেন। এরপর একটি বিশেষ শ্রেণি ফারভারদিন মাসের ১৩ তারিখ পর্যন্ত আনন্দ উৎসবের আয়োজন করে থাকে। ইরানিরা এই ১৩ তারিখটাকে বিশেষ গুরুত্ব দেন এবং একে বলেন ‘সিযদা বেদার’। ফারসি ভাষায় ‘সিযদাহ মানে তেরো। আর ‘বেদার’ অর্থ ঘরছাড়া। এই দিন ঘরে থাকা তাঁদের জন্য দূষণীয়। সবাই পার্ক, মাঠ-ময়দান বা অনুরূপ বিশেষ স্থানে বেড়াতে যান এবং সন্ধ্যার পর ঘরে ফিরে আসেন। এ দিনটি সর্বজনীন ছুটির দিন।
প্রাচীন ইরানি জাতির বিশ্বাস পহেলা ফারভারদিন আল্লাহ বিশ্বলোক সৃষ্টি করেছেন। এ ছাড়া প্রজ্ঞার প্রতীক সাতটি নক্ষত্রও এইদিন সৃষ্টি হয়েছিল বলে তাঁদের বিশ্বাস- যা ইরানের প্রাচীন মনীষী বা জ্ঞানীদের দৃষ্টিতে সাত আসমানি পিতা নামে অভিহিত। পানি, মৃত্তিকা, অগ্নি ও বাতাস- এই চারটি উপাদানের ওপর উক্ত সাতটি নক্ষত্রের প্রভাবের কারণে যে তিনটি বস্তু সৃষ্টি হয় তা হচ্ছে জড় পদার্থ, বৃক্ষ ও প্রাণীকুল, আর এই চারটিকে বলে ‘উম্মাহাতে আরবা’ বা চার জননী। প্রাচীন ইরানিদের বিশ্বাস মতে প্রথম মানব আদমও বসন্তের এই প্রথম দিনে সৃষ্ট। হাফেজ শিরাজীর একটি গযল যা‘বার-ই-আমানাত’ (আমানাতের বোঝা) নামে খ্যাত, তা এই ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট।
এখনো অতীতের আনুষ্ঠানিকতা অনুসরণ করে নওরোজ উপলক্ষে বিশেষ ধরনের দরস্তরখান বিছানো হয় এবং তার ওপর বিভিন্ন ধরনের প্রতীকী সাতটি উপকরণ যেগুলোর নাম ফারসি বর্ণমালার ‘সীন’ (সাত সীন) নামে বিখ্যাত। হাফ্ত সীন্ সাধারণত এমন হয়ে থাকে। এগুলোহচ্ছে :
সাবযেহ (সবুজাভ) : গম বা ডালের কচি চারার গুচ্ছ যা নওরোজের অব্যবহিত পূর্বে গজিয়েছে একটা ট্রে বা প্লেটের ওপর বসিয়ে হাফ্ত সীন্ দস্তরখানায় রাখা হয় যা নব জীবনের প্রতীক।
সামানু : কচি গম, বার্লি বা অন্যান্য শস্যদানার আটা দিয়ে তৈরি বিশেষ ধরনের হালুয়া যা প্রাচুর্য ও নেয়ামতের প্রতীক।
সেনজাদ : একপ্রকার শুষ্ক ফল যা ভালোবাসা ও প্রেমের প্রতীক।
সীর (রসুন) : সৌন্দর্য ও সুস্বাস্থ্যের প্রতীক।
সোম্মাগ : মসুরের ডালের চেয়ে সামান্য বড় লাল রঙের টক ফলবিশেষ যা উদীয়মান সূর্যের প্রতীক।
সিরকা : দীর্ঘায়ু ও ধৈর্যের প্রতীক।
সোমবোল : ছোট আকারের ফুল ও উদ্ভিদবিশেষ যা বসন্তের আগমনবার্তা বহন করে নিয়ে আসে।
সেক্কেহ্ (কয়েন বা মুদ্রা) : সম্পদ ও সমৃদ্ধির প্রতীক।
ইরানে বিভিন্ন রসম-রেওয়াজ ও সংস্কৃতির উদ্ভব ও মিলন ঘটে যা অন্য কোন দেশে পাওয়া দুষ্কর। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে এবং সুপ্রাচীনকালে ইরানিদের ধর্মবিশ্বাস ও জাতিসত্তার বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রান্ত হয়। এর অন্যতম দৃষ্টান্ত হচ্ছে এক খোদার ইবাদত এবং র্শ্কি ও বহু দেব-দেবীর পূজা প্রতিহতকরণ। জরাথ্রুস্টীয় ধর্ম এর অন্যতম দৃষ্টান্ত। জরাথ্রুস্টীয় ধর্মমতে আহুরমায্দার প্রতি বিশ্বাস পোষণ করা হয় যাতে তাওহীদে বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটে।
ইসলামের আবির্ভাব বিশেষত ইরানিদের ধর্ম ও জাতীয় ধ্যান-ধারণার সাথে ইসলামের শান্তিবাদী আচরণের কারণে ইরানিদের ইসলাম গ্রহণ করার পরেও তাঁদের আগেকার কতক ধ্যান-ধারণা ও রসম-রেওয়াজ অব্যাহত থাকে। অবশ্য ইরানবিজেতা আরব মুসলমানদের ইরানিদের সাথে সদয় আচরণের কারণে তাঁরা ইসলামকে সম্পূর্ণরূপে বরণ করে নেন এবং তাঁদের আদর্শ ব্যক্তিবর্গ, বীরপুরুষ ও প্রাচীন কাহিনীগুলোকে ইসলামের রঙে রঙিন করে নেন।
প্রাচীন ইরানিদের কিছু কিছু উপলক্ষ ও রেওয়াজ তাঁদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও জনগণের ধ্যান-ধারণার সাথে মিশে গিয়েছিল। নওরোজ এর অন্যতম। সুদীর্ঘ কয়েক সহস্রাব্দের পুরনো এ ঐতিহ্যটি ইরানের মুসলমানদের মনে একটা স্থায়ী আসন তৈরি করে নিয়েছে। এখনও ইরানের অধিকাংশ লোকই পুরাতন বছরের বিদায় ও নতুন বছরের আগমনক্ষণে নতুন পোশাক পরিধান করে মিষ্টিমধুর আচরণসহকারে পবিত্র স্থানে বা পরিবারের মুরুব্বিদের সাথে কাটাতে পছন্দ করেন। সে মুহূর্তে তাঁরা কুরআন তেলাওয়াত করে ও দু’হাত তুলে মহান আল্লাহর কাছে নিজেদের ও পরিবারবর্গের জন্য একটি সুন্দর এবং সুস্থতা ও সমৃদ্ধিপূর্ণ বছর কামনা করেন। নওরোজে পরস্পরের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ ও কুশল বিনিময়, কারও প্রতি রাগ বা ক্ষোভ থাকলে পরস্পরকে ক্ষমা করে দেয়া এবং নববর্ষের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করা আরেক রীতি। এছাড়া এ দিনে তাঁরা এমন সব ব্যক্তির সাথে দেখা করতে যান যাঁরা পুরাতন বছরে কোন প্রিয়জনকে হারিয়ে শোকে মুহ্যমাণ হয়ে আছেন। এভাবে নওরোজ প্রাচীন ইরান থেকে পর্যায়ক্রমে বর্তমান রূপে এসে দাঁড়িয়েছে এবং ইসলামের পছন্দনীয় রীতি-নীতিগুলোকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তাই ইসলামের মূলনীতির সাথে এর কোন বিরোধ নেই; বরং নওরোজ উৎসব ইরানি সমাজের জন্য নৈতিক ও সামগ্রিক শিক্ষার সহায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন করছে।

ইসলামি বিপ্লবোত্তর ইরান : পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও অবস্থান

ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান : দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ায় পারস্য উপসাগরের তীরবর্তী দেশ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান মধ্যপ্রাচ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি ইরানের ইতিহাসে ১৯৭৯ সাল একটি মোড় পরিবর্তনকারী সন। এ সনের ১১ ফেব্রুয়ারি প্রখ্যাত মার্জায়ে তাকলিদ বিশ্বব্যাপী ইমাম খোমেইনী নামে সুপরিচিত হযরত আয়াতুল্লাহ্ আল্-উয্মা রুহুল্লাহ্ আল্-মুসাভী (রহ.)-এর প্রাজ্ঞ ও দূরদর্শী নেতৃত্বে ইরানে ইসলামি বিপ্লব সংঘটিত হয়। মানব ইতিহাসের এ নজিরবিহীন ও অভূতপূর্ব বিপ্লবের মাধ্যমে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির তাঁবেদার মুহাম্মদ রেজাশাহ পাহলভী (১৯১৯-৮০ খ্রি.) ও তাঁর সরকার উৎখাত হয়। এতে কেবল পাহলভী রাজবংশ (১৯২৫-৭৯ খ্রি.) নয়; বরং আড়াই হাজার বছর ধরে চলমান রাজতন্ত্রেরও বিলুপ্তি ঘটে। স্বৈরাচারী খোদাদ্রোহী রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বিলুপ্তির পরপরই ইরানি জনগণ প্রায় সর্বসম্মত রায়ে ইরানে ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী সাড়া জাগানো ইসলামি বিপ্লবের ৪২তম বর্ষপূর্তি উদযাপিত হয়েছে। বিপ্লব পরবর্তী এ চার দশকেরও বেশি সময়ে ইরানের পরিবর্তিত পরিস্থিতি এবং আর্থ-সামাজিক ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তিখাতসহ সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে ইরানের বৈশ্বিক অবস্থান সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত লিপিচিত্র অঙ্কন এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অবস্থান ও স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব সুদৃঢ়করণ
বলা হয় যে, ইরানের ইসলামি বিপ্লব ছিল হাজার বছরের সেরা আদর্শিক বিপ্লব। এ বিপ্লবের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ ছিল অভ্যন্তরীণ স্বৈরতন্ত্র থেকে মুক্তি, বহিঃশক্তির তাঁবেদারির নাগপাশ ছিন্ন করে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুনিশ্চিত করা, জনপ্রতিনিধিত্বমূলক ও ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।
এ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ইরানে পাহলভী স্বৈরতন্ত্রের অবাসন ঘটে। পাহলভী স্বৈরশাসকদের উপর নিরঙ্কুশ আধিপত্য ও কৃর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাকারী পশ্চিমা পরাশক্তিসমূহ বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোড়লিপনার অবসান হয়। ফলে ইরানি জনগণের বহুল কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জিত হয়। তবে এ স্বাধীনতা রক্ষা করা ছিল ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানি বিপ্লবী সরকারের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ সুদীর্ঘ কাল ধরে ইরানের উপর যে কায়েমী স্বার্থ প্রতিষ্ঠা করেছিল ইসলামি বিপ্লবের ফলে তা নস্যাৎ হওয়ায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও তার মিত্র পশ্চিমা শক্তিগুলো ইরানকে পদানত ও তাদের তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা ও কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্য বিলিয়ন বিলয়ন ডলার ব্যয় করেছে। ইসলামি বিপ্লব ও ইরানের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিমূলক প্রচারযুদ্ধ চালিয়েছে। ইরানকে অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে দুর্বল করার জন্য অর্থনৈতিক ও সামরিক অবরোধসহ সবধরনের অপচেষ্টা করেছে এবং এখনো করে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের কোনো অপকৌশলই এ যাবৎ কাজে আসেনি। বিপ্লবের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক শত্রুদের সর্বাত্মক অপপ্রচেষ্টা ও ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে ইতোমধ্যে ইরানের জনগণ বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান ও নিজেদের ভাগ্যনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা নিজেদের হাতে গ্রহণের লক্ষ্য পরিপূর্ণভাবে অর্জন করেছে। আগ্রাসী শক্তির কাছে নতজানু না হয়ে তারা নিজেদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সমুন্নত রাখায় অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। মুসলিম দেশগুলোর বেশিরভাগ যখন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের দোসর পশ্চিমা এবং অন্য বৃহৎশক্তির তাঁবেদারে পরিণত হয়েছে, সেখানে ইরান শত প্রতিকূলতার মুখেও স্বাধীনভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বর্তমান পুঁজিবাদী বিশ্বে বস্তুত ঈমানী শক্তি ও দৃঢ় মনোবল নিয়ে ইসলামি বিপ্লবের অনুসারীরা একের পর এক বাধা অতিক্রম করে নিজেদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অটুট রাখতে সক্ষম হয়েছে।
শাসনব্যবস্থা ও সরকার পদ্ধতি
ইসলামি বিপ্লবের অন্যতম লক্ষ্য ছিল রাজতন্ত্রের পরিবর্তে একটি ইসলামি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা- যেখানে সবাই স্বাধীনভাবে মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপন করতে পারবে। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে বিপ্লব সফল হওয়ার পরপরই ঐতিহাসিক গণভোটের মাধ্যমে জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠের সম্মতিতে (৯৮.২%) ইরানকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। রাজতন্ত্রের পরিবর্তে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। তবে একথা স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এক নয়। ১৯৭৯ সালে বিপ্লবী সরকার যে সংবিধান প্রণয়ন করেছিল এর অধীনে ইরানে এমন একটি সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয় যে সরকার ব্যবস্থায় একজন ন্যায়পরায়ণ ইসলামি ধর্মতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ ‘রাহবার’ বা সর্বোচ্চ নেতা সরকার ও প্রশাসনের পথনির্দেশক হিসেবে কাজ করেন। ইসলামি আইনজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত একটি অভিভাবক পরিষদ ইসলামি মানদণ্ডের ভিত্তিতে এবং পার্লামেন্টের অনুমোদিত আইন অনুযায়ী তাঁদের দায়িত্ব পালন করেন। ইরানে প্রেসিডেন্ট শাসিত সরকার চালু আছে।  জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে চার বছরের জন্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সরকার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একটি কেবিনেট সরকার পরিচালনায় প্রেসিডেন্টকে সহায়তা করে। ইরানের আইন পরিষদ- ‘মজলিশে শুরা-ইয়ে-এসলামি’ এক কক্ষবিশিষ্ট এবং এর সদস্য সংখ্যা ২৯০। ইরানের সরকার পরিচালিত হয় ইসলামি শরীয়া আইন ও এর সাথে সঙ্গতি রেখে পার্লামেন্টে প্রণীত আইন দ্বারা।
অর্থনৈতিক অগ্রগতি
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান উদীয়মান অর্থনীতির এক সম্ভাবনাময় দেশ। ইরানি বিপ্লবের পর থেকে সরকারের দীর্ঘস্থায়ী লক্ষ্যসমূহ ছিল অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, পূর্ণ কর্মসংস্থান ও জনসাধারণের আরামদায়ক জীবনযাত্রার মান নিশ্চিতকরণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব, এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের কতিপয় মুসলিম রাষ্ট্র ইরানের উপর নানা রকমের বিধি-নিষেধ ও বাধা-বিপত্তি আরোপ করতে থাকায় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের লক্ষ্য অর্জন অনেক কঠিন এক চ্যালেঞ্জ ছিল। এতদসত্ত্বেও গত চার দশকে অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে ইরান ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে এবং ইতোমধ্যে দেশটি মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলে দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে উন্নীত হয়েছে।
ইরানের অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত হলো খনিজ তেল ও গ্যাস। এ দুটি প্রাকৃতিক সম্পদ ইরানকে energy superpower এর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। তেল (বিশ্বের ১০%) ও খনিজ গ্যাস (বিশ্বের ১৫%) ইরানের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি হলেও বর্তমান বিশ^বাস্তবতা এবং সময়ের দাবি বিবেচনায় ইরান সরকার তেলনির্ভর অর্থনীতির পরিবর্তে নতুন নতুন খাত নির্ধারণ করে অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। ফলে ইরানের অর্থনীতিতে ক্রমশ শিল্প, কৃষি ও সেবা খাতের বিকাশ ঘটায় অর্থনীতির মৌলিক কাঠামো অনেকটাই বদলে গেছে।
তেহরান স্টক এক্সচেঞ্জ বিশ্বের অন্যতম সফল স্টক এক্সচেঞ্জ। বর্তমানে এতে চল্লিশের অধিক শিল্প সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ইরানের জিডিপি বা মোট দেশজ উৎপাদনের পরিমাণ ২ হাজার বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি এবং আর্থিক প্রবৃদ্ধির পরিমাণ ১২ শতাংশের উপরে। মার্কিন অবরোধ ও কোভিড মহামারি সত্ত্বেও ইরানের অর্থনীতির অগ্রগতি অব্যাহত আছে। সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক আউটলুক ‘ম্যানেজিং ডিভারজেন্ট রিকভারিস’ প্রতিবেদনে বলেছে গত বছরের তুলনায় ইরানের প্রবৃদ্ধি আরো এক শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। গত বছর আইএমএফ’র হিসেবে ইরানের প্রবৃদ্ধি ছিল দেড় শতাংশ। এ বছর তা বেড়ে দাঁড়াবে ২.৫ শতাংশে। উল্লেখ্য যে, ইতোমধ্যেই ইরানের প্রবৃদ্ধি পশ্চিম ও সেন্ট্রাল এশিয়ার দেশগুলোর প্রবৃদ্ধিকে ছাড়িয়ে গেছে।
জাতিসংঘের অধীনস্থ বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক কর্তৃপক্ষ আঙ্কটাড ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইরানকে একটি সফল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বিশ্বের সেরা বাণিজ্য সম্পাদনকারী ৪০টি দেশের তালিকায় ইরান ইতোমধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হলো রপ্তানি খাত। এ খাতের সাফল্য একটি দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিরও ইঙ্গিত দেয়। রপ্তানি খাতে ইরানের অর্জন উল্লেখ করার মতো। ইরানের রপ্তানি পণ্যের অন্যতম প্রধান হলো তেল। দেশটির কাস্টমস প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী গত ফারসি অর্থ বছরে দেশটির তেল থেকে অর্জিত রপ্তানি আয় ছিল সাড়ে ৩৪ বিলিয়ন ডলার। একই সময় তেলবহির্ভূত বাণিজ্য আয় ছিল ৭৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। চলতি বছর ইতোমধ্যেই গত বছরের তুলনায় তেলবহির্ভূত রপ্তানি বেড়েছে ৪৬%। তেলবহির্ভূত যেসব পণ্য ইরান রপ্তানি করে থাকে তার মধ্যে রেয়েছে পেট্রোকেমিক্যাল, প্লাস্টিক ও প্লাস্টিকজাত পণ্য, আয়রন ও স্টিল, কপার, রাসায়নিক ও জৈব সার, বিভিন্ন রকমের কৃষি ও খাদ্যপণ্য, খনিজ, অটোশিল্প পণ্য, গালিচা ও ওষধি পণ্য ইত্যাদি। ইরানের প্রযুক্তিভিত্তিক রপ্তানিও বেড়েছে লক্ষ্যণীয় মাত্রায়। অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি বিনিয়োগে বৈচিত্র্য আনার সক্ষমতাও অর্জন করেছে দেশটি। ইতোমধ্যে দেশটির পানি ও বিদ্যুৎ খাতে বড় রকমের বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পেরেছে। দেশটির অভ্যন্তরীণ সুশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি যথেষ্ট স্থিতিশীল বলে ইউরোপ, চীন, আমেরিকা, আফ্রিকা, ভারতসহ লাতিন আমেরিকার দেশগুলো দেশটিতে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছে। ইরানের অর্থনীতির অন্যতম উল্লেখযোগ্য খাত হলো কৃষি। কৃষিখাতে বিপ্লবোত্তর ইরানের অগ্রগতির চিত্রও রীতিমত বিস্ময়কর।
ইসলামি বিপ্লবের পর নানা প্রতিবন্ধকতা জয় করে ইরানের অর্থনীতিতে অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির যে নতুন ধারা সূচিত হয়েছে এতে দেশটি বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির প্রথম ২০টি দেশের মধ্যে নিজের স্থান করে নিয়েছে (২০১৮ সালে ইরানের অবস্থান ছিল ১৮ এবং বর্তমানে সম্ভবত ১৫ তম)। প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি আশা প্রকাশ করেছেন যে, ২০৩০ সালের মধ্যে ইরান বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির প্রধান ১০টি দেশের মধ্যে স্থান করে নেবে। ইতোমধ্যে ইরান মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফিকা অঞ্চলে অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে রূপান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে দেশটি এ ধরনের অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জন করবে বলে গ্লোবাল রিস্ক ইনসাইটস আভাস দিয়েছে। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বা ফাও’র তথ্য মতে, ইরান হচ্ছে বিশ্বের প্রধান পাঁচটি দেশের মধ্যে একটি যে দেশটি কমলা, মাল্টা ও লেবুজাতীয় ফল উৎপাদনে সেরা অবস্থানে রয়েছে। এছাড়া শশা, ক্ষীরা, খেজুর, বেগুন, ডুমুর, পেস্তা, নাশপাতি, আখরোট ও তরমুজ উৎপাদনে বিশ্বের সেরা পাঁচ দেশের মধ্যে রয়েছে ইরান। খাদ্য ও কৃষিপণ্য উৎপাদন মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে অগ্রগামী দেশ ইরান।
শিক্ষা ক্ষেত্রে অগ্রগতি
ইসলামি বিপ্লবোত্তরকালে জ্ঞান-বিজ্ঞানে ধাপে ধাপে এগিয়ে চলেছে ইরান। শিক্ষা এক সময় এলিটদের ভূষণ থাকলেও বিপ্লবোত্তর ইরানে সাধারণ ও প্রান্তিক জনমানুষকে এর আওতায় নিয়ে আসা হয়। শুধু তাই নয়, ইসলামি বিপ্লবপূর্ব সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়ে ইসলামের চেতনায় ঐশী আলোয় আলোকিত হয়। পশ্চিমা বস্তুবাদী শিক্ষার দাপটে প্রায় হারিয়ে যেতে বসা ইবনে সিনা, আল-তুসী, জামী, ওমর খাইয়্যাম ও হাফিজের মতো ক্ষণজন্মা বুদ্ধিজীবীদের সৃষ্টিকর্ম ইসলামি বিপ্লবের পর পুনরুদ্ধারের সর্বাত্মক চেষ্টা গৃহীত হয়। ইরানে বর্তমানে সাক্ষরতার হার ৯৬.৬ শতাংশ।
ইসলামি শিক্ষা দর্শনের ভিত্তিতে দেশের প্রয়োজনের প্রতি দৃষ্টি রেখে এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষার বিষয়বস্তু নির্ধারণ করাসহ কিছু মৌলিক দর্শনের ভিত্তিতে ইরানের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা পরিচালিত হয় Ministry of Education এর তত্ত্বাবধানে। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়, প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের শিক্ষা কার্যক্রম, চিকিৎসা শিক্ষা ও কমিউনিটি কলেজ শিক্ষার সমন্বয়ে গড়া ইরানের উচ্চশিক্ষা পরিচালিত হয় Ministry of Science and Technology I Ministry of Health and Medical Education এর তদারকিতে। তথ্যসূত্র মতে, শিক্ষা ইরান সরকারের অন্যতম প্রাগ্রাধিকার তালিকাভুক্ত। সরকার জিডিপির প্রায় ৫ শতাংশ এবং বার্ষিক সরকারি ব্যয়ের প্রায় ২০ শতাংশ এ খাতে ব্যয় করে। ইরান সরকার শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন ও সুরক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আর এ কারণেই ইরানের শিক্ষাব্যবস্থা বিশ্বদরবারে স্বীকৃতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। ইরানে ১৫৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ৫৮টি পাবলিক মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, ৫৬৭টি বেসরকারি ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় ও ৩৫৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। শাংহাই র‌্যাঙ্কিং প্রকাশিত অ্যাকাডেমিক র‌্যাঙ্কিং অব ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিজ (এআরডাব্লিউইউ) ২০২০-এর তথ্য অনুযায়ী মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চল ও ইসলামি দেশগুলোর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যায় র‌্যাঙ্কিংয়ে প্রথম স্থান দখল করেছে ইরান। টাইমস হায়ার এডুকেশন (টিএইচই) এর ২০২০ সালের বিশ্বের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রকাশিত তালিকায় ইরানের ৪০টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেয়েছে। উচ্চশিক্ষার গুণগত মানের কারণে বর্তমানে ইরানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ১২৯টি দেশের ৪০ হাজারের অধিক শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতের উন্নয়ন
টেকনোলজির উদ্ভাবন, ব্যবহার ও এর যৌক্তিক মাত্রা নির্ণয়ে বর্তমান বিশ্বে মুসলমানদের পশ্চাদপদতা মোটা দাগে চোখে পড়ার মতো। তবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণায় বিপ্লবোত্তর ইরানের অগ্রগতি এককথায় বিস্ময়কর। নানা রকমের বাধা-বিপত্তি, পাশ্চাত্যের অসহযোগিতা ও অর্থনৈতিক অবরোধ সত্ত্বেও দেশপ্রেমে উজ্জীবিত ইরানি বিজ্ঞানীরা চরম আত্মত্যাগ ও সাধনার পরিচয় দেওয়ায় দেশটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে বৈপ্লবিক উন্নতি ও সাফল্য অর্জন করেছে। বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে ইরানের বিজ্ঞানীদের অগ্রগতি সমগ্র বিশ্বের বিজ্ঞানীদের গড় অগ্রগতির চেয়ে ১১ গুণ দ্রুততর। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বে বৈজ্ঞানিক গবেষণার দ্রুত অগ্রগতি বা প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে ইরান শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর একটি। বিশ্বের সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী বৈজ্ঞানিক গবেষকদের তালিকায় ১০ জনের অধিক ইরানি বিজ্ঞানীর নাম রয়েছে। অ্যারোস্পেইস সায়েন্স গবেষণায় ইরান আঞ্চলিক ক্ষেত্রে প্রথম এবং বিশ্বে ১৫তম অবস্থানে রয়েছে। মহাশূন্যে নিজস্ব প্রযুক্তিতে নির্মিত স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে সক্ষম দেশের মধ্যে ইরানের অবস্থান নবম এবং মহাকাশযানে প্রাণী পাঠানোর ক্ষেত্রে ইরানের অবস্থান ষষ্ঠ। ইরানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পার্কের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ২০০২ সালে যেখানে মাত্র ১টি পার্ক ছিল এখন সেখানে রয়েছে ৮০টিরও বেশি।
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এবং এর সাথে সম্পৃক্ত অন্যান্য কৌশল উদ্ভাবনের মাধ্যমে ইরান বিগত দু’দশকে বায়োটেকনোলজি বিষয়ে লক্ষ্যণীয় উন্নতি সাধন করেছে। বর্তমানে ইরানে দেড় শতাধিক সরকারি গবেষণা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং দু’শতাধিক বেসরকারি সেন্টার ও কোম্পানি বায়োটেকনোলজি গবেষণা এবং উৎপাদন খাতে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বায়োটেকনোলজি ব্যবহার করে পণ্য উৎপাদন মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহের মধ্যে ইরানের অবস্থান প্রথম এবং এশিয়ায় ১ম সারির ৫টি দেশের অন্যতম। Bio-tech drug উৎপাদনের ক্ষেত্রে ইরান প্রথম ১২টি দেশের মাঝে অবস্থান করছে।
ন্যানোটেকনোলজি খাতে ইরানের অগ্রগতি বিস্ময়কর। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ন্যানোপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে পাঁচ অগ্রগামী রাষ্ট্রের মধ্যে অদম্য অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে ইরান। তেহরান টাইমস এর সূত্র মতে, বিশ্বের মোট ন্যানোপ্রযুক্তি নিবন্ধে ইরানের ৬ শতাংশ অবদান রয়েছে।। বর্তমানে ইরানে ৩৭০টিরও অধিক কো¤পানি স্বাস্থ্য, নির্মাণ, কৃষি ও প্যাকেজিং, পেট্রোলিয়াম, বস্ত্র এবং যানবাহন নির্মাণ শিল্পে ন্যানোটেকনোলজির প্রয়োগ নিয়ে কাজ করছে। স্বল্প সময়ে ন্যানোটেকনোলজি প্রয়োগ করে এসব খাতে তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেছে।
কম্পিউটার সায়েন্স ও রোবোটিক্স খাতেও ইরানের সাফল্য উল্লেখ করার মতো। ২০১০ সালে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব প্রযুক্তিতে Sorena-2 নামক রোবট তৈরি করে যা  কর্তৃক বিশ্বের ৫টি সর্বোচ্চ প্রযুক্তির রোবটের মাঝে স্থান পায়। একই ধারাবাহিকতায় ইরানের automotive industry দশটি রোবট তৈরি করে। ২০১৫ সালে ইরানের বিজ্ঞানীরা নিজস্ব প্রযুক্তিতে রিমোট বা টেলি সার্জারির কাজে ব্যবহৃত ইবনে সিনা নামের রোবট উন্মোচন করেছেন। ইরান তার নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইতোমধ্যে সুপার কম্পিউটার তৈরিতেও সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছে।
মোটর গাড়ি শিল্প আধুনিক বিশ্বে অর্থনৈতিক অগ্রগতির অন্যতম বড় মাধ্যম। এখাতেও ইরান উল্লেখযোগ্য সফল্য অর্জন করেছে। দেশটি এখন মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বেশি গাড়ি নির্মাণকারী দেশ। ইরানে নির্মিত গাড়ি ইউরোপ ও এশিয়ার নানা দেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি হচ্ছে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে সাফল্য
গত প্রায় চারদশকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে ইরানের অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। বিপ্লবের আগে যে দেশটির অনেক শহরে ইরানি ডাক্তার খুঁজে পাওয়া দুরূহ ব্যাপার ছিল, সে ইরানের নাম এখন চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর তালিকায়। বিশ্বের সেরা ১ ভাগ চিকিৎসা গবেষকদের মধ্যে ৪০ জনের মতো জন ইরানি গবেষক স্থান করে নিয়েছেন। ইরান বিশ্বের শীর্ষ ১০টি ওষুধ উৎপাদনকারী দেশের একটি। দেশটি বর্তমানে জার্মানি ও ইতালিসহ বিশ্বের ৪৪টি দেশে চিকিৎসা সরঞ্জাম রপ্তানি করছে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে অত্যাধুনিক ও জটিল পরমাণু প্রযুক্তির ব্যবহারেও ইরানি বিজ্ঞানীরা দর্শনীয় সাফল্য অর্জন করেছেন। ক্যান্সার চিকিৎসায়ও ইরানি বিজ্ঞানীরা উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছেন। হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রেও ইরানি চিকিৎসকদের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে ইরান হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন ও হৃদরোগ চিকিৎসায় শীর্ষে অবস্থান করছে ইরান। অঙ্গ প্রতিস্থাপন ও কিডনি প্রতিস্থাপনেও ইরানি চিকিৎসকদের দক্ষতা প্রশংসনীয় পর্যায়ের। স্টেমসেল গবেষণার ক্ষেত্রে ইরান প্রথম সারির ১০টি দেশের মাঝে অবস্থান করছে। স্টেমসেল রিপ্লেস করার ক্ষেত্রে বিশ্বে ইরানের অবস্থান দ্বিতীয়। স্বল্প খরচে বিশ্বের আধুনিক ইনফার্টিলিটি ট্রিটমেন্ট মেথড অনুসরণের মাধ্যমে নিঃসন্তান দম্পতিদের সেবা দিচ্ছে। পারস্য উপসাগরের দেশগুলো থেকে অনেক নিঃসন্তান দম্পতি ইরানে চিকিৎসা নিতে আসছেন। ইরানি গবেষকগণ ‘কোভিরান বারেকাত’ নামক করোনাভাইরাসের একটি ভ্যাকসিন আবিস্কার করেছেন। এর মানব পর্যায়ে তৃতীয় ট্রায়াল শুরু হয়েছে।
বর্তমানে এশিয়ার দেশগুলোর মাঝে মেডিক্যাল ট্যুরিজম ক্ষেত্রে কঠোর প্রতিযোগিতা চলছে। এই প্রতিযোগিতায় ইরানের অবস্থান বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দশটি দেশের মধ্যে রয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত
একটি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে বিদ্যুৎ অপরিহার্য। বিদ্যুৎ সভ্যতা ও আধুনিকতার প্রধান নিয়ামক। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের কাক্সিক্ষত উন্নয়ন ও পরিচালনা দক্ষতা বৃদ্ধিও উন্নত গ্রাহক সেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সবিশেষ গুরুত্ব দেয় এবং এরই মধ্যে এ খাতেও ব্যাপক সফলতা লাভ করেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতার দিক থেকে আঞ্চলিক গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর অন্যতম ইরান। বর্তমানে ইরানের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৮০ হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি। ইরানের বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৭৫ ভাগের বেশি হয় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে। বাকি বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে ইরানে কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্লান্ট, হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্লান্ট, জেনারেশন পাওয়ার প্লান্ট ও রিনিউবেল এনার্জি পাওয়ার প্লান্ট থেকে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে ইরানের অবস্থান এক নম্বর। পরিবেশ সংরক্ষণের স্বার্থে পর্যায়ক্রমে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার বাড়ানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে দেশটি। নবায়নযোগ্য জ্বালানির অন্যতম উল্লেখযোগ্য উৎস ফুয়েল সেল বা জ্বালানি কোষের প্রোটন বিনিময় ঝিল্লি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন ইরানি বিজ্ঞানীরা। উল্লেখ্য যে, দেশটি বর্তমানে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ খাতে কেবল পুরোপুরি স্বয়ংস¤পূর্ণতা অর্জন করেছে তাই নয়, একই সাথে দেশটিতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ এখন অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।
জ্বালানি খাতেও ইরানের সাফল্য ঈর্ষণীয়। ইরান কয়েকটি পেট্রোকেমিক্যাল ও শোধনালয় উন্নয়ন প্রকল্প আছে। এসব প্রকল্পে উৎপাদিত পরিশোধিত পেট্রোল বা বেঞ্জিন এখন বিদেশে রপ্তানি করছে। ইরান বিশ্বের প্রথম সারির চারটি দেশের মধ্যে রয়েছে যারা V 94.2 গ্যাস টারবাইন তৈরি করার সক্ষমতা অর্জন করেছে। তরল গ্যাস তৈরির (GTL) প্রযুক্তি অর্জনে ইরান প্রথম তিনটি দেশের মাঝে রয়েছে। ইরান দেশীয়ভাবে রিফাইনারি, তেল-ট্যাংকার, তেলকূপ খনন, Offshore platform এবং তেল উত্তোলনের ৭০ ভাগ সক্ষমতা অর্জন করেছে। গভীর পানিতে তেলকূপ খনন প্রযুক্তিতে ইরান বিশ্বের অল্প কয়েকটি দেশের মাঝে রয়েছে।
শিল্প ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অগ্রগতি
সংস্কৃতি হলো মানুষের জীবনবোধ বিনির্মাণের কলাকৌশল, মানব জীবনের একটি শৈল্পিক প্রকাশ। ইসলাম সুস্থ ও মানবিক চিন্তার বিকাশের পথে সাংস্কৃতিক চর্চার বিরোধী তো নয়ই, বরং সংস্কৃতির উন্নত সংস্করণ উপহার দিতে সক্ষম -এটাই প্রমাণ করেছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। ইরানে বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে নওরোজসহ সকল স্থানীয় সংস্কৃতির পরিচ্ছন্ন ও জোরালো উদযাপন বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
মানুষের সুকৃতি আচরণকে বিকশিত করার জন্য ইরান সকল শিল্পমাধ্যমকেই ব্যবহার করছে। এর মধ্যে ইরানি চলচ্চিত্র অন্যতম। ইরানি চলচ্চিত্র আজ বিশ্বে একটি স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। অস্কারসহ পৃথিবীর সকল ফিল্ম ফেস্টিভালে দাপটের সাথে বিচরণ করছে ইরানি চলচ্চিত্র। বাংলাদেশের সকল ফেস্টিভালে ইরানি চলচ্চিত্রের সাবলীল বিচরণ দেখা যায়। বাংলায় ডাবিংকৃত ইরানি চলচ্চিত্র বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয়। ইরানি চলচ্চিত্রে সচরাচর ধর্মীয় কোনো নির্দেশনা বা ডায়ালগ থাকে না। তবে উপন্যাস ও চরিত্রনির্ভর প্রতিটি ফিল্ম থেকে মানুষ কিছু না কিছু শিক্ষা গ্রহণ করে যা পৃথিবীর অনেক বড় বড় ইন্ডাস্ট্রি বিশ্বকে দিতে পারেনি। শক্তিশালী চিত্রনাট্য, অসাধারণ ও অভূতপূর্ব অভিনয়, কলাকুশলির মনকাড়া আবেদন ছাড়াও বিশ্বমানের কারিগরি কৌশলের কারণে বিশ্বের সর্বত্র আজ ইরানি সিনেমা ব্যাপকভাবে দর্শক সমাদৃত হচ্ছে। সেইসাথে পুরস্কৃত হচ্ছে শীর্ষ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র অঙ্গনে সবচেয়ে আলোচিত ও সম্মানজনক পুরস্কার অস্কার থেকে শুরু করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক পুরস্কার ঘরে তুলে নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশটি।
শুধু চলচ্চিত্র নয়, পেইন্টিংস, ক্যালিগ্রাফি, ফটোগ্রাফি, মিউজিক ইত্যাদি ক্ষেত্রকেও ইরানি বিপ্লব ধারণ করেছে এবং লালন করছে। মুসলিম বিশ্বে আর্ট ও পেইন্টিং-এর যে স্বতন্ত্র ধারা চালু হয়, এর কৃতিত্ব অনেকাংশেই ইরান দাবি করতেই পারে। তাদের এ ধারা বিশেষ কোনো প্রকারে সীমাবদ্ধ নয়; বরং Classical, Traditional, Revolutionary & Modern সকল ক্ষেত্রেই সমানভাবে বিরাজমান। মানুষের সুস্থ বিনোদনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম খেলাধুলা। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি মানুষের সুস্থ বিনোদনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হিসেবে খেলাধুলাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি জনগণের ব্যাপক আগ্রহের কারণে খেলাধুলায় ইরানের খ্যাতি আজ বিশ্বজোড়া। ফুটবল থেকে শুরু করে খেলাধুলার প্রায় সকল ক্ষেত্রেই অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়ে চলেছেন ইরানি খেলোয়াড়রা। আধুনিক ও বিশেষায়িত পার্র্ক ও দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য কীর্তি ইত্যাদির কারণে ইরান এখন পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণস্থল। দেশটি এখন বিভিন্ন ফেস্টিভাল, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, এক্সপো ও আন্তর্জাতিক কার্নিভালের কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।
প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা
ইসলামি বিপ্লবের আগে ইরানের প্রতিরক্ষা বা সমর শিল্প ছিল পুরোপুরি পাশ্চাত্যনির্ভর। ইসলামি বিপ্লবের প্রায় দেড় বছর পর পাশ্চাত্যের ইশারায় ইরানের উপর চাপিয়ে দেয়া দীর্ঘ ৮ বছরের যুদ্ধের সময় বিকশিত হয় ইরানের প্রতিরক্ষা বা সমর শিল্প। ইরানের প্রায় ছয় লাখ সক্রিয় সেনা সদস্য ও তিন লক্ষাধিক রিজার্ভ সেনাসহ দশ লাখেরও বেশি ‘বাসিজ’ নামক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী রয়েছে। প্রচলিত সামরিক সাজ-সরঞ্জাম ও অস্ত্র-শস্ত্রে ইরান এখন পুরোপুরি স্বনির্ভর, এমনকি অপ্রচলিত বা অত্যাধুনিক অনেক সমর-সম্ভারেও প্রায় স্বনির্ভর হয়ে উঠেছে। ইরানের রয়েছে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপক নৌযান ও রাডারসহ অনেক অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় সফ্ট প্রযুক্তির অধিকারী ইরান। ইরান বিমান প্রতিরক্ষা তথা বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ও রাডার সিস্টেম খাতেও ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে। ইতোমধ্যে ইরান সুপারফাস্ট এন্টি সাবমেরিন তৈরি করেছে। লেজার টার্গেটিং প্রযুক্তির অস্ত্রের ক্ষেত্রে ইরান বিশ্বের পাঁচটি দেশের অন্যতম- যাদের চালকবিহীন বিমান (ড্রোন) নির্মাণ সক্ষমতা রয়েছে। সম্প্রতি ইরান বড় আকারের কৌশগত ড্রোন ‘গাজা’ উন্মোচনের মধ্য দিয়ে ড্রোন শক্তিতে আরও এক ধাপ এগোল। এই ড্রোন একটানা ৩৫ ঘণ্টা আকাশে উড়তে পারবে।
ইরানের আক্রমণাত্মক ও প্রতিরক্ষা কৌশলের প্রধান স্তম্ভ হলো অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র। ক্ষেপণাস্ত্র শক্তিতে দেশটির অবস্থান এখন বিশ্বে চতুর্থ। ইরানের হাতে রয়েছে ‘ইমাদ’ ও ‘ফজর’ এর মতো উন্নত প্রযুক্তির ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। সম্প্রতি দেশটি নতুন ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘নাইন দেই’ ও রাডার ব্যবস্থা ‘কুদ্স’ উদ্বোধন করেছে। নাইন দেই শত্রুর ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, বিমান, বিমান থেকে নিক্ষিপ্ত বোমা এবং ড্রোন ধ্বংস করতে সক্ষম। আর কুদ্স রাডার ব্যবস্থা সহজে মোতায়েন ও স্থানান্তরযোগ্য। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে এই রাডার অত্যন্ত কার্যকরী হবে বলে সমর বিশেষজ্ঞরা বলেছেন। রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম স্টিল্থ ধরনের অত্যাধুনিক জঙ্গি বিমান ‘কাহের-৩১৩’ সহ ইরানের নিজেদের তৈরি অনেক যুদ্ধ বিমান রয়েছে। অবরোধ ও নানা প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে গত চার দশকের বেশি সময় ধরে ইরান প্রতিরক্ষা খাতে যে সক্ষমতা অর্জন করেছে সে সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা শক্তির ভালোই ধারণা রয়েছে। এ কারণেই ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে যতই আস্ফালন করুক না কেন তারা ইরানকে সরাসরি আক্রমণ করতে সাহস করেনি।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি
ইরান একটি পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির যাত্রা শুরু হয়। তবে ইসলামি বিপ্লবের পর মার্কিন সহায়তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হলেও প্রজাতন্ত্রী সরকার এ কর্মসূচি অব্যাহত রাখে। ইসলামি সরকারের সম্পূর্ণ শান্তিপুর্ণ পরমাণবিক কর্মসূচির স্লোগান হলো : ‘Neuclear energy for all, Neuclear weapon for none.’ ইরান পরমাণু শক্তি সংস্থা বা আইএই এর সদস্য হিসেবে এবং এনপিটি বা পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশ। জ্বালানি তৈরি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজে দেশটি পারমাণবিক গবেষণা অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ইরান পারমাণবিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণসহ পরমাণু রশ্মি বা শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে উন্নত জাতের বীজ উদ্ভাবন ও সংস্কারের মাধ্যমে কৃষি-উৎপাদন বৃদ্ধি; খাদ্য সামগ্রির স্টেরিয়ালাইজেশান ও স্বাস্থ্যসম্মত করা; পশু টিকা তৈরি, সংকোচনযোগ্য পলিমারের পাইপ নির্মাণ; বিভিন্ন ধরনের লেজার রশ্মি ব্যবহার এবং হাত-পায়ের ছাপ নির্ণয়ের মতো প্রযুক্তি আয়ত্ত করেছে। এ ছাড়াও আলোক-রশ্মি বা তেজস্ক্রিয় রশ্মির মতো বিভিন্ন রশ্মির মাধ্যমে চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি, দেশকে বাইরের সীমান্ত থেকে আসা পারমাণবিক রশ্মির নিঃস্বরণ বা হামলা থেকে রক্ষা ইত্যাদি কাজে পরমাণু শক্তিকে কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছে। পরমাণু ক্ষেত্রে ইরানি বিজ্ঞানীদের একের পর এক নতুন সাফল্যে দিশাহারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের দোসর ইউরোপীয় শক্তিবর্গ দেশটির বিরুদ্ধে নানা ভিত্তিহীন প্রচারণা চালিয়ে এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে প্রভাব খাটিয়ে তেহরানের উপর নানা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে চলছে। তবে এতদসত্ত্বেও ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি থেকে এক চুলও সরে আসেনি; বরং ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ অব্যাহত রাখে এবং ২০ সালা পরিকল্পনায় ২০টির বেশি নতুন পরমাণু চুল্লি নির্মাণ এবং অন্তত ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের টার্গেট নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। ইরান ইতোমধ্যে পারমাণবিক গলনযন্ত্র নির্মাণে সফল হয়েছে। এছাড়া, ইউরেনিয়াম হেক্সাফ্লুরাইড উৎপাদন ও পুরো ‘পরমাণু জ্বালানি চক্র’ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম এলিট ক্লাবের সদস্য দেশ ইরান।
পারমাণবিক কর্মসূচি থেকে ইরানকে নিবৃত করতে ব্যর্থ হয়ে পশ্চিমা মোড়লেরা শেষ পর্যন্ত তার সাথে একটি চুক্তিতে আসতে বাধ্য হয়। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য ও জার্মানিকে নিয়ে গঠিত ৫+১ গ্রুপ ২০১৫ সালে জেনেভায় ইরানের সাথে এক চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য হয়। ২০১৮ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ চুক্তি থেকে বেরিয়ে এসে ইরানের উপর একাধিক নিষেধাজ্ঞা জারি করায় এর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। আর ইরানও নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার না করা হলে চুক্তির শর্ত রক্ষা বা আলোচনায় বসতে অস্বীকৃতি জানায়। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইরানের সাথে পরমাণু বিষয়ে আলোচনায় আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
নারীর ক্ষমতায়ন
বর্তমান বিশ্বকে বলা হয় নারীর ক্ষমতায়নের যুগ। এ যুগে নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নে ইরানের অবস্থান বিশ্বের অগ্রগামী দেশগুলোর মধ্যে প্রথম কাতারে রয়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি, খেলাধুলাসহ সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরানের নারীদের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। ইরানের প্রায় মোট জনসংখ্যার ৯৭ শতাংশ সাক্ষর মানুষের মধ্যে ৪৬ শতাংশ নারী। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারী ইরানিদের প্রায় ৫০ শতাংশই নারী। অথচ বিপ্লবপূর্ব ১৯৭৮ সালে শিক্ষার সর্বক্ষেত্রে নারীর অবস্থান ৫ শতাংশের বেশি ছিল না। উচ্চশিক্ষার গবেষণা ও উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে ইরানি নারীদের অংশগ্রহণ লক্ষ্যণীয় পর্যায়ে বেড়েছে। ২০০০ সালে যেখানে ইরানি নারীদের অংশগ্রহণের হার ছিল ২৭ শতাংশ বর্তমানে এ হার ৪০ শতাংশেরও বেশি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিপক্ষদের বহুদূর ছাড়িয়ে গেছেন দেশটির নারীরা। বিশ্বে সর্বোচ্চ সংখ্যক নারী বিজ্ঞানীর তালিকার শীর্ষে রয়েছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। ইরানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত (সংক্ষেপে এসটিইএম) বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশই নারী। কর্মক্ষেত্রে ইরানি নারীদের সাফল্যও চোখে পড়ার মতো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রশাসন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরনের কর্মক্ষেত্রে ইরানি নারীদের রয়েছে সরব উপস্থিতি। তথ্য সূত্র থেকে জানা যায় যে, ইরানে সকল পর্যায়ে ব্যবস্থাপনা পদে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। তিন বছর আগে ইরানে ব্যবস্থাপনা পদে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ। বর্তমানে তা প্রায় ২০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। সরকারি বেসরকারি চাকরির বাজারেও দেশটির নারীদের চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বিভিন্ন শাখায় নারী কর্মচারীদের সংখ্যাও পূর্বে তুলনায় অনেক বেড়েছে। শিল্প ক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমজীবীদের প্রায় ৫০ শতাংশই নারী। কৃষি পণ্যের প্রায় ৪০ শতাংশই উৎপাদন হয় পল্লি নারীদের শ্রমে। ইসলামি বিপ্লবের পর ইরানি নারীদের গৃহস্থালি কাজেরও মূল্য বেড়েছে। জানা যায় যে, ইরানের বর্তমান মোট দেশীয় উৎপাদন বা জিডিপিতে গৃহিণীদের অবদান ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। উদ্যোক্তা পর্যায়েও নারীরা সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন।
সার্বিক দিক পর্যালোচনায় বলা যায় যে, ইরানি নারীদের জীবনমানের সূচক, জীবন প্রত্যাশা ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের অর্জন প্রমাণ করেছে ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের পর দেশটির নারীদের জীবনমান ব্যাপকভাবে বেড়েছে। নারীর প্রতি সহিংসতা যেখানে আজ উন্নত বিশ্বের দেশগুলোরও এক বড় সমস্যা সেখানে ইরানে নারীর সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি নজির সৃষ্টি করেছে। একজন নারী কিংবা তরুণী যদি একাকী রাতের বেলায় পথে হেঁটে যায় তাকেও আলাদা করে ভাবতে হয় না নিরাপত্তার কথা। এটি নারীর সামগ্রিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে এক বড় সহায়ক হিসেবে কাজ করছে।
সামাজিক সুরক্ষা
গ্লোবালাইজেশনের এ যুগে সামাজিক সুরক্ষা ও নিরাপত্তা একটি বড় ইস্যু। যে কোনো দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধির বিষয়টি অনেকাংশই নির্ভর করে সেই দেশের সামাজিক নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার উপর। ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর দেশটির সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এক্ষেত্রে ইরানের অর্জন দৃষ্টান্তমূলক ও অন্য অনেক দেশের জন্য অনুসরণীয়। যেখানে ইউরোপ ও আমেরিকার মতো উন্নত দেশের মানুষ সারাক্ষণ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, আত্মরক্ষার জন্য বাধ্য হয় অস্ত্র বহন করতে, বর্ণবৈষম্য, সামাজিক বৈষম্য, সংখ্যালঘুদের অধিকার হরণ, খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, চরম নৈতিক অবক্ষয়, গভীর পারিবারিক সংকট প্রভৃতি যেখানে নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার, সেখানে ইরানে বিরাজ করছে উল্টো চিত্র। শিশু ও নারী নির্যাতন, লুটপাট, খুন-খারাবি ও সাইবার ক্রাইম থেকে ইরান অনেকটা মুক্ত। ইরানে বর্তমানে সামাজিক অপরাধ প্রবণতাও অনেক কম। বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধেও ইরান সোচ্চার। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিশ্বের শান্তিপ্রয়াসী জাতিসমূহকে জাগ্রত করতে ইরান সক্রিয় ভূমিকা রাখছে।
শেষ কথা
আধুনিক বিশ্বে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সার্বিক উন্নয়নের এক রোল মডেল। প্রাকৃতিক সম্পদের আধার ও বিশ্বসভ্যতার গৌরবোজ্জ্বল উত্তরাধিকারী ইরান বিশ শতকে পাহলভী রাজবংশের শাসনামলে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত হয়ে এর সম্পদ ও ঐতিহ্য হারাতে বসেছিল, ঠিক তখনই ১৯৭৯ সালে ইমাম আয়াতুলাহ খোমেইনীর নেতৃত্বে ইসলামি বিপ্লব সংঘটিত হয়। এর ফলে ইরানে তাগুতি রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান ঘটে এবং একই সাথে ইরান পশ্চিমা আধিপত্যবাদের হাত থেকে রক্ষা পায়। ইরান পরিণত হয় একটি ইসলামি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে। বিশ শতকের শেষ দিকে ইরানে সংঘটিত ইসলামি বিপ্লব এবং এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ইসলামি প্রজাতান্ত্রিক সরকারের স্থায়িত্ব ও ভবিষ্যৎ নিয়ে কেবল পশ্চিমাদের নয়, মুসলিম বিশ্বেরও সংশয় ছিল। বিপ্লবোত্তর ইরানকে ধ্বংস ও পঙ্গু করে দেওয়ার বিপ্লববিরোধী অভ্যন্তরীণ কুচক্রী মহল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র পশ্চিমাদেশগুলো, এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের একটি প্রভাবশালী রাষ্ট্রের নেতৃত্বে আরব বিশ্বের কোনো কোনো দেশের অব্যাহত অপপ্রয়াস, অবরোধের নামে ইরানকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার অপতৎপরতা সত্ত্বেও ইরান এগিয়ে গেছে। কোনো অপচেষ্টাই ইরানের অব্যাহত অগ্রগতিকে রোধ করতে পারেনি। বর্তমান বিশ্বে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান তার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সুরক্ষা করে সুসংবদ্ধ রাষ্ট্র ও সরকারব্যবস্থা গঠনে কেবল সফল নয়, বিপ্লবোত্তর ৪২ বছরের পথপরিক্রমায় স্বনির্ভর অর্থনীতির বিকাশ, শিক্ষা ও সংস্কৃতি এবং পরমাণু, মহাকাশ গবেষণা, চিকিৎসা, বায়োটেকনোলজি, ন্যানোটেকনোলজিসহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সকল শাখায় ঈর্ষণীয় উন্নতি ও সাফল্য অর্জন করেছে। শুধু তাই নয়, মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের দাবিদার সৌদি আরবসহ মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশ যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নতজানু হয়ে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যস্ত সেক্ষেত্রে ইরানের অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীত। তদুপরি ইরান ফিলিস্তিনসহ বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করে যাচ্ছে। বিশ্বমানবতা ও বিশ্ব-মুসলিমকে ঐক্যবদ্ধ করার অব্যাহত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব বর্তমান অর্জনের মাধ্যমে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান আজ বিশ্ব দরবারে উন্নয়নের অনন্য মডেল রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
লেখক : অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ইসলামি বিপ্লবের তাত্ত্বিক ভিত্তি ও ইসলামি ইরানের রাষ্ট্রব্যবস্থা

ইসলামি বিপ্লবের তাত্ত্বিক ভিত্তি ও ইসলামি ইরানের রাষ্ট্রব্যবস্থা
নূর হোসেন মজিদী
ইরানের ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের পর ৪২ বছর পার হয়ে গিয়েছে, কিন্তু এ সময়ের মধ্যে তৎকালীন বিশ্বের দ্বিতীয় পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তিসহ কমিউনিজম ও সমাজতন্ত্রের বিদায় এবং আরো বহু দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থায় ও শাসনপদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন ঘটা সত্ত্বেও ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান বলদর্পী সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা ও তার বশংবদদের দুশমনি উপেক্ষা করে সগৌরবে মাথা উঁচু করে টিকে আছে এবং সকল ক্ষেত্রে উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছে। তাই অনেকের মনেই সবিস্ময় জিজ্ঞাসা : এটা কীভাবে সম্ভব হলো? এর রহস্য কী?
এক কথায় জবাব দিতে হলে বলতে হয়, এর রহস্য ইসলামি বিপ্লবের তাত্ত্বিক ভিত্তি, এ বিপ্লবের বিজয়প্রক্রিয়া ও ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রাষ্ট্রব্যবস্থার অনন্য বৈশিষ্ট্যের মধ্যে নিহিত – যে বিষয়গুলো সম্পর্কে বহির্বিশ্বে খুব কমই চিন্তা-গবেষণা করা হয়েছে।

ইসলামি হুকুমাতের সংজ্ঞা
হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আত্মপ্রকাশের পূর্বে ইসলামি হুকুমাতের সংজ্ঞা কী? এটা শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে সকল মুসলমানের মধ্যে বিরাজমান অভিন্ন প্রশ্ন। ইতিপূর্বে এ প্রশ্নের কোনো সন্তোষজনক ও বাস্তবসম্মত অভিন্ন জবাব ছিল না। ইসলামের ইতিহাসে প্রথম বারের মতো ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা হযরত ইমাম খোমেইনী (র.) এ প্রশ্নের অকাট্য জবাব প্রদান করেন যার সাথে দ্বিমত করার অবকাশ নেই। তিনি হযরত ইমাম মাহ্দীর আত্মপ্রকাশ-পূর্ব ইসলামি হুকুমাতকে ‘বেলায়াতে ফাক্বীহ্’ (ولايت فقيه) বলে সংজ্ঞায়িত করেন। তবে তিনি প্রথম বারের মতো এ সংজ্ঞা প্রদান করলেও এটি তাঁর স্ব-উদ্ভাবিত কোনো অভিনব তত্ত্ব নয়; বরং এ বিষয়টি ইসলামের অকাট্য জ্ঞানসূত্রে পূর্ব থেকেই নিহিত আছে- যার প্রতি তাঁর পূর্বে কেউ সেভাবে দৃষ্টি প্রদান করেন নি।
এ বিষয়ে মুসলমানদের মধ্যে দ্বিমতের অবকাশ নেই যে, কোনো নবী-রাসূলের (আ.) উপস্থিতিতে তাঁর প্রতি ঈমানদারগণ হুকুমাতের অধিকারী হলে আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ হতে মনোনীত প্রত্যক্ষ প্রতিনিধি হিসেবে তিনিই হবেন তার প্রধান এবং আইনগত মতামত প্রদান ও রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে একচ্ছত্র হকদার; তিনি অন্যদের মতামত গ্রহণ করবেন কার্যত রাষ্ট্রপরিচালনার এখতিয়ারি ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুবিধার্থে, কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণের চূড়ান্ত এখতিয়ার তাঁরই। আল্লাহ্ তা‘আলা হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-কে সম্বোধন করে এরশাদ করেন :
شَاوِرْهُمْ فِي الأمْرِ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ
‘(রাষ্ট্রীয়) কাজকর্মের ব্যাপারে তাদের সাথে পরামর্শ করুন, অতঃপর যখন আপনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন তখন আল্লাহ্র ওপর তাওয়াক্কুল করুন।’ (সূরা আলে ‘ইমরান : ১৫৯)
অধিকন্তু যারা রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ইন্তেকালের পরে তাঁর স্থলাভিষিক্ততার প্রশ্নে আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ হতে মনোনীত মাসুম ইমাম (আ.)-এর ইমামতের আকিদা পোষণ করে তাদের মধ্যে এ বিষয়ে মতৈক্য রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ্র নেতৃত্বাধীন হুকুমাতে তাঁর যে এখতিয়ার মাসুম ইমামের নেতৃত্বে হুকুমাত প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানে মাসুম ইমামের একই এখতিয়ার।
অন্যদিকে শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে মুসলমানরা এ মর্মে অভিন্ন আকিদা পোষণ করে যে, শেষ যামানায় হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.) আত্মপ্রকাশ করবেন ও বিশ^ব্যাপী ইসলামি হুকুমাত প্রতিষ্ঠা করবেন, যদিও তাঁর জন্মকাল সম্বন্ধে মতপার্থক্য আছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যারা ইমামতের আকিদা পোষণ করে না তাদের জন্য রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ইন্তেকালের পরে ও যারা মাসুম ইমামের (আ.) ইমামতের আকিদা পোষণ করে তাদের জন্য হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আত্মগোপনের পরে, তাঁর আত্মপ্রকাশ-পূর্ববর্তী হুকুমাতি ক্ষেত্রে করণীয় কী? এ মেয়াদে মুসলমানরা কি দীনী হুকুমাতবিহীন থাকবে ও হযরত ইমাম মাহ্দীর আত্মপ্রকাশের জন্য অপেক্ষা করবে, নাকি সম্ভব ক্ষেত্রে তারা অন্তর্বতীকালীন ইসলামি হুকুমাত প্রতিষ্ঠা করবে? করলে তার সংজ্ঞা কী হবে তথা তার এখতিয়ার ও সীমারেখা কী হবে?
প্রকৃতপক্ষে এ প্রশ্নের জবাব ইসলামের অকাট্য জ্ঞানসূত্রেই নিহিত রয়েছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা অত্র নিবন্ধের সীমিত পরিসরে সম্ভব নয়; এখানে সংক্ষেপে এতটুকু উল্লেখ করাই যথেষ্ট যে, কোরআন মজীদে আলেমদের প্রশংসা করা হয়েছে, বলা হয়েছে যে, আল্লাহ্র বান্দাদের মধ্যে আলেমগণই তাঁকে যথার্থভাবে ভয় করেন, যার কাছে হেদায়াত আছে তিনিই অর্থাৎ আলেমই অনুসৃত হবার হকদার। প্রশ্ন হচ্ছে সে আলেমের সংজ্ঞা কী?
কোরআন মজীদে মুসলমানদের প্রতিটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে দীনের ব্যাপারে গভীর সমঝের অধিকারী (يَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ) কতক লোক গড়ে ওঠার ওপর এতই গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে যে, তাঁদেরকে, এমনকি দীনী হুকুমাতের প্রতিরক্ষা যুদ্ধে গমনের দায়িত্ব থেকেও রেহাই দেয়া হয়েছে (সূরা আত্-তাওবাহ্ : ১২২) – যার মানে হচ্ছে সমাজে এ ধরনের আলেমের উপস্থিতি ফরযে কেফায়ী। আর ‘দীনের ব্যাপারে গভীর সমঝের অধিকারী’ কথাটি কেবল চিন্তা, কথা ও আচরণে ভারসাম্যের অধিকারী এমন যুগসচেতন দূরদর্শী আলেমদের বেলায়ই প্রযোজ্য- যাঁদেরকে পারিভাষিকভাবে মুজতাহিদ বা ফাক্বীহ্ বলা হয়।
শিয়া-সুন্নি উভয় ধারায় বর্ণিত একটি হাদিস অনুযায়ী আলেমগণ নবী-রাসূলগণের উত্তরাধিকারী। এছাড়া শিয়া সূত্রে বর্ণিত আরেকটি হাদিসে মাসুম ইমামের সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না হলে যে কোনো বিষয়ে আলেমদের দ্বারস্থ হবার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
সবকিছু মিলিয়ে হযরত ইমাম খোমেইনী (র.) এ উপসংহারে উপনীত হন যে, হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর আত্মপ্রকাশের পূর্বে মুসলমানদের পক্ষে দীনী হুকুমাত প্রতিষ্ঠার জন্য যথাযথ পরিবেশ তৈরি হলে তারপরও তারা তা প্রতিষ্ঠা না করে অনৈসলামি হুকুমাত অব্যাহত থাকতে দেবে এবং তাঁর আত্মপ্রকাশের জন্য অপেক্ষা করতে থাকবে- এটা ঠিক নয়; বরং তারা চিন্তা, কথা ও আচরণে ভারসাম্যের অধিকারী যুগসচেতন দূরদর্শী মুজতাহিদগণের নেতৃত্বে দীনী হুকুমাত প্রতিষ্ঠা করবে এবং উক্ত মুজতাহিদগণ তাঁদের এখতিয়ারের হুকুমাতি কর্তৃত্ব প্রতিনিধিত্বমূলকভাবে একজন মুজতাহিদগণের কাছে ন্যস্ত করবেন। এ ধরনের হুকুমাত হবে হযরত ইমাম মাহ্দীর আত্মপ্রকাশের ক্ষেত্র প্রস্তুতকারী। হযরত ইমাম খোমেইনী (র.) এ হুকুমাতের সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞায়ন করেন : বেলায়াতে ফাক্বীহ্ (ولايت فقيه) অর্থাৎ মুজতাহিদের শাসনকর্তৃত্ব।
ইসলামি হুকুমাত প্রতিষ্ঠার পথ
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এ ধরনের হুকুমাত কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে? মুজতাহিদগণ কি কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করে জনগণের মধ্যে প্রচার চালিয়ে তাঁদের হাতে হুকুমাতের ক্ষমতা অর্পণের জন্য আহ্বান জানাবেন এবং ক্ষমতালাভের জন্য অন্যান্য দলের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন?
ইসলামের দৃষ্টিতে রাষ্ট্র্রক্ষমতা কামনা করা জায়েয নেই (সূরা আল্-ক্বাছ¡াছ¡ : ৮৩ ও সূরা আল্-গ¦াশিয়াহ্ : ২১-২২)। নবী-রাসূলগণের মূল দায়িত্ব ছিল মানুষের সামনে আল্লাহ্ তা‘আলার সঠিক পরিচয় তুলে ধরা। আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন : مَا عَلَى الرَّسُولِ إِلا الْبَلاغُ – ‘রাসূলের ওপর পৌঁছে দেয়া ছাড়া কোনো দায়িত্ব নেই।’ (সূরা আল্-মায়েদাহ্ : ৯৯)
দীনী হুকুমাত প্রতিষ্ঠার বিষয়টি পরিস্থিতিনির্ভর; আল্লাহ্ তা‘আলার সঠিক পরিচয় ও দীনের সঠিক রূপ মানুষের কাছে তুলে ধরার ফলে যদি যথেষ্ট সংখ্যক মানুষ তা গ্রহণ করে নিজেদেরকে যথাযথভাবে দীনী আমল ও নৈতিকতায় ভূষিত করে তোলে এবং ভিতর-বাইরের পরিস্থিতি দীনী হুকুমাত প্রতিষ্ঠার জন্য অনুকূল হয় কেবল তখনই দীনী হুকুমাত প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ কারণেই-যথাযথ পরিস্থিতি না পাওয়ায়-সমস্ত নবী-রাসূলের পক্ষ থেকে এবং সমস্ত মাসুম ইমামের পক্ষ থেকে দীনী হুকুমাত প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় নি।
যেভাবে বিপ্লব বিজয়ী হলো
নবী-রাসূলগণ (আ.) ও মাসুম ইমামগণ (আ.) অনুসৃত এ কর্মপদ্ধতি অনুসরণে ইরানি মুজতাহিদগণ, বিশেষত হযরত ইমাম খোমেইনী (র.) ও তাঁর অনুসারী মুজতাহিদগণ সরকারি সংশ্লিষ্টতাবিহীন বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ের দীনী শিক্ষাকেন্দ্রসমূহে দীনী জ্ঞানগবেষণার কাজে এবং রাজনৈতিক লক্ষ্য ও রাজনৈতিক দল ব্যতীত মানুষের মাঝে দীনের সঠিক শিক্ষা বিস্তারে নিয়োজিত ছিলেন। আর যেহেতু যুগজিজ্ঞাসার দীনী জবাব প্রদানের লক্ষ্যে মুজতাহিদের জন্য সমসাময়িক বিশে^র রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিকসহ সকল দিক সম্পর্কে অবগত থাকা অপরিহার্য সেহেতু তাঁরা সার্বিকভাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সদা ওয়াকিফহাল থেকে সকল বিষয়ে জনগণকে সচেতন করতেন ও দিকনির্দেশ প্রদান করতেন। তাঁরা জাতীয় ক্রান্তিকালসমূহে একদিকে যেমন জনগণকে পথনির্দেশ দিতেন অন্যদিকে সরকারকে সংশোধনের জন্য নসিহত করতেন।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ইরানে যে সাংবিধানিক বিপ্লব হয়- যার ফলে নিরঙ্কুশ রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিবর্তে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র ও মজলিসে মিল্লি (ন্যাশনাল পার্লামেন্টে)-এর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়- তাতেও মুজতাহিদগণ নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন। তখন মুজতাহিদগণ শাসনক্ষমতা গ্রহণ করেন নি, তবে মজলিসের সিদ্ধান্তের শার‘ঈ বৈধাবৈধতা নির্ণয়ের জন্য মজলিসে মুজতাহিদগণের জন্য সংরক্ষিত কোটা ছিল। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ তাঁবেদার রেযা খান ক্ষমতা দখল করে সমস্ত ক্ষমতা নিজের হাতে কুক্ষিগত করে এবং কার্যত দেশকে ব্রিটেনের অঘোষিত উপনিবেশে পরিণত করে ও সেই সাথে ইরানি জনগণের ওপর জোর করে ইসলামবিরোধী পশ্চিমা সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ক্ষমতাসীন তার পুত্র মোহাম্মাদ রেযা পাহ্লাভীও একই নীতি অনুসরণ অব্যাহত রাখে। মজলিসে মিল্লি তেল শিল্প জাতীয়করণের মাধ্যমে ইরানের ওপর থেকে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণ খর্ব করার উদ্যোগ নিলে ১৯৫৩ সালে শাহ্ বিদেশে পালিয়ে যায় এবং সিআইএ-র মদদে সংঘটিত সামরিক অভ্যুত্থানের পর পুনরায় দেশে ফিরে আসে। তখন থেকে ইরান আমেরিকার অঘোষিত উপনিবেশে পরিণত হয়।
শাহ্ ১৯৬৩-র শুরুতে আমেরিকার নির্দেশে ইরানি কৃষকদের কৃষি জমির ওপর বাধ্যতামূলক যৌথ খামার পদ্ধতি চাপিয়ে দিয়ে কার্যত শহরবাসী জমিদারদেরকে সকল কৃষি জমির মালিকে পরিণতকরণ ও সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানিগুলো ব্যক্তিমালিকদের কাছে বিক্রিকরণসহ ‘শে^তবিপ্লব’ নাম দিয়ে ছয়-দফাভিত্তিক একটি কর্মসূচি চাপিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নিলে হযরত ইমাম খোমেইনী (র.) তার বিরুদ্ধে কঠোর নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান এবং তাকে ইসলামের দুুশমন হিসেবে অভিহিত করেন। এ বিষয়ে অন্য মুজতাহিদগণও হযরত ইমামের অনুসরণ করেন। এ অবস্থায় ৩রা জুন ইমাম খোমেইনীকে গ্রেফতার করা হলে ৫ই জুন দেশব্যাপী এক স্বতঃস্ফূর্ত গণ-অভ্যুত্থান হয়Ñ যা নির্মমভাবে রক্তপাতের মধ্য দিয়ে দমন করা হয়। পরে ১৯৬৪-র এপ্রিলে ইমামকে মুক্তি দেয়া হয়।
ইতিমধ্যে শাহ্ ইরানে অবস্থানরত আমেরিকান সৈন্যদের কোনো অপরাধের বিচার ইরানি আদালতে করা হবে না মর্মে একটি আইন পাশ করে যা ‘ক্যাপিচুলেশন আইন’ নামে কুখ্যাত। হযরত ইমাম (র.) ২৬শে অক্টোবর ১৯৬৪ তারিখে প্রদত্ত এক ভাষণে এর বিরুদ্ধে কঠোর নিন্দা জানালে তাঁকে ৪ঠা নভেম্বর গ্রেফতার করে তুরস্কে নির্বাসিত করা হয়। তাঁর ওপর নযরদারির সুবিধার্থে প্রায় এক বছর পর তাঁকে সেখান থেকে ইরাকের নাজাফে এনে রাখা হয় এবং সেখানে তিনি আরো তেরো বছর থাকেন। তবে বিভিন্নভাবে ইরানে অবস্থানরত স্বীয় ভক্ত-অনুসারীদের সাথে তাঁর যোগাযোগ অব্যাহত থাকে। নাজাফে থাকাকালেই তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘বেলায়াতে ফাক্বীহ্’ রচনা করেন।
ইরানি জনগণের মধ্যে শাহ্বিরোধী ও ইসলামি চেতনা ক্রমেই শক্তিশালী হতে থাকে। যদিও ইরানে তখন পাশ্চাত্যপন্থী ন্যাশনাল ফ্রন্ট, কমিউনিস্ট তুদেহ্ পার্টি, শাহ্ সমর্থক রাস্তাখীয্ পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সক্রিয় ছিল, কিন্তু মুজতাহিদগণের কোনো দল ছিল না; বরং তাঁদের নেতৃত্বের আসন ছিল জনগণের অন্তঃকরণে এবং তার স্বরূপ ছিল কোনোরূপ আনুষ্ঠানিক অঙ্গীকার ব্যতীতই স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁদের অনুসরণ ও আনুগত্য এবং তাঁদের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা। এ কারণেই ১৯৭৭-এর নভেম্বরে নাজাফে শাহের গোয়েন্দা সংস্থা সাভাক কর্তৃক হযরত ইমামের পুত্র মোস্তাফা খোমেইনী নিহত হওয়ার পর সারা ইরানে লাগাতার গণবিক্ষোভ ও ধর্মঘট তথা বিপ্লব শুরু হলে মুজতাহিদগণের কোনো সংগঠন না থাকায় সিআইএ ও সাভাকের পক্ষে বিপ্লবী জনতার মধ্যে অনুপ্রবেশ তো দূরের কথা, শীর্ষস্থানীয় মুজতাহিদগণকে কারাগারে নিক্ষেপ করেও এ বিপ্লবকে দমন করা সম্ভব হয় নি। কারণ, জনগণের মধ্যে বিভিন্ন স্তরে কারা এ বিপ্লবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাঁদেরকে হাজারো চেষ্টা করেও খুঁজে বের করা সম্ভব হয় নি। দেখা যায় যে, রাজনৈতিক ব্যাক্গ্রাউন্ডবিহীন সাধারণ লোকেরা গণমিছিলসমূহের অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে; তাদেরকে গুলি করে হত্যা করা হলে পরদিন অন্য অখ্যাত লোকেরা নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং এভাবে দিনের পর দিন চলতে থাকায় সিআইএ, সাভাক্, পুলিশ বাহিনী ও সেনাবাহিনীর লোকেরা উপর্যুপরি হত্যা নিষ্ফল প্রত্যক্ষ করে হতাশ হয়ে ময়দান ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এমতাবস্থায় শাহ্ দেশের জনগণের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রধানমন্ত্রী শাপুর বাখতিয়ারের হাতে ক্ষমতা দিয়ে ১৯৭৯-র ১৬ই জানুয়ারি দেশ থেকে পালিয়ে যায়।
অন্যদিকে শাহের অনুরোধে ইরাক সরকার হযরত ইমাম খোমেইনীকে ইরাক থেকে বহিষ্কার করলে তিনি কুয়েতে যাবার চেষ্টা করেন, কুয়েত সরকার তাঁকে সে দেশে প্রবেশ করতে না দিলে তিনি ১১ই অক্টোবর ১৯৭৮ তারিখে প্যারিসে চলে যান এবং সেখান থেকে ১৯৭৯-র ১লা ফেব্রুয়ারি ইরানে ফিরে আসেন।
ইমাম খোমেইনী (র.) ইরানের মাটিতে নেমেই শাহের মনোনীত সরকারকে বরখাস্তের ঘোষণা দিয়ে নতুন সরকার গঠন করেন। এরপর, দীনী চেতনায় উদ্দীপিত গোটা বিমান বাহিনী এবং কতক ব্যতিক্রম বাদে গোটা সামরিক বাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশ বাহিনী ও প্রশাসন নতুন সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে- যার ফলে অনুল্লেখযোগ্য নামমাত্র সংঘর্ষের পর শাহের অনুগত সামরিক বাহিনীর লোকেরা আত্মসমর্পণে বাধ্য হয় এবং ১১ই ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের চূড়ান্ত বিজয় ঘটে।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, মুজতাহিদগণ কর্তৃক যুগজিজ্ঞাসার জবাব দানসহ অরাজনৈতিক পন্থায় দীনী শিক্ষা প্রচারের ফলে তার ঢেউ কেবল ইরানের সর্বস্তরের সাধারণ জনগণের মধ্যেই পৌঁছে নি, প্রশাসন ও সশস্ত্র বাহিনীসমূহেরও রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছিল এবং এ ব্যাপারে শাহের প্রচার কাউকে বিভ্রান্ত করতে পারে নি। অন্যথায় ইসলামি বিপ্লবের বিজয় হয়তো আদৌ সম্ভব হতো না।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রাষ্ট্রব্যবস্থা
৩০ ও ৩১শে মার্চ (১৯৭৯) অনুষ্ঠিত গণভোটে শতকরা ৯৮ ভাগেরও বেশি ভোটার আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের পক্ষে মত দিলে হযরত ইমাম (র.) ১লা এপ্রিল ১৯৭৯ তারিখে ইরানের নাম ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ঘোষণা করেন।
এরপর ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের জন্য বিশেষজ্ঞদের তৈরি সংবিধান গণভোটে অনুমোদিত হয়Ñ যা কেবল ইসলামি সংবিধান হিসেবেই নয়, সাধারণভাবে সমগ্র বিশ^বাসীর জন্য শ্রেষ্ঠতম ভারসাম্যমূলক ও সুবিচারমূলক সংবিধানের দৃষ্টান্তও বটে।
এ সংবিধানে রাহ্বার পদ নির্ধারণের লক্ষ্যে জনগণের ভোটে প্রতি আট বছর পর পর নির্বাচিতব্য মুজ্তাহিদ্ আলেমগণের ৮৪ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ পরিষদ গঠনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এ পরিষদ প্রার্থিতাবিহীনভাবে নিজেদের ভিতর বা বাইরে থেকে যাঁকে উপযুক্ত মনে করবেন এমন কাউকে রাহ্বার মনোনীত করবেন, তাঁর কাজের প্রতি দৃষ্টি রাখবেন এবং প্রয়োজনে তাঁকে অপসারণ করবেন। যেহেতু মুজ্তাহিদ্ আলেমগণ তাত্ত্বিকভাবে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ও মাসুম ইমামগণের (আ.) প্রতিনিধি এবং এ কারণে দীনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পাশাপাশি তাঁদের (আ.) হুকুমাতি এখতিয়ারেরও অধিকারী, সেহেতু এ পরিষদের সদস্যগণ হুকুমাতি এখতিয়ারের অধিকারী এবং তাঁরা স্বীয় হুকুমাতি এখতিয়ার আমানত হিসেবে রাহ্বারের কাছে অর্পণ করেন।
রাহ্বার হুকুমাতের মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে যথাযথ বিশেষজ্ঞ বা জনপ্রতিনিধিদের সাথে পরামর্শ করে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং জনগণের যেসব কাজ আদর্শিক বা রাজনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয় সেসব কাজ সরাসরি জনপ্রতিনিধিগণ আঞ্জাম দেন। তবে রাহ্বার স্বয়ং কোনো প্রকল্পে বা বাজেটে স্বাক্ষর প্রদান করেন না।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, যদিও তাত্ত্বিক বিচারে হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর ও মাসুম ইমামের (আ.) প্রতিনিধি বা স্থলাভিষিক্ত হিসেবে ইসলামি হুকুমাতের সমস্ত ক্ষমতাই রাহ্বারের, কিন্তু যেহেতু তিনি মাসুম নন বিধায় ভুলের ঊর্ধ্বে নন সেহেতু এবং সেই সাথে ইসলামের দুশমনরা যাতে তাঁর ব্যাপারে ভিত্তিহীন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে ও তাঁকে বিতর্কিত করতে না পারে সে লক্ষ্যে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধান-প্রণেতাগণ যথার্থভাবেই তাঁকে সরাসরি আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়োগের ঊর্ধ্বে দিকনির্দেশক হিসেবে রাখাকেই সঙ্গত গণ্য করেছেন। একইভাবে নেতা নির্বাচনী বিশেষজ্ঞ পরিষদকেও একই ধরনের ক্ষমতা প্রয়োগের ঊর্ধ্বে রাখা হয়েছে।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধানে শতকরা একশ ভাগ ক্ষমতার বিভাজন করা হয়েছে এবং প্রশাসন, আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ, সশস্ত্র বাহিনী ও জাতীয় সম্প্রচার বিভাগ (রাষ্ট্রীয় রেডিও-টিভি) পরস্পর থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, ফলে প্রশাসন বা সরকারের পক্ষে স্বৈরাচারী হবার কোনোই সুযোগ নেই।
রাহ্বার ভোটের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দ্বারা নির্বাচিত ব্যক্তিকে প্রেসিডেন্ট পদে মনোনীত করেন এবং তিনি হন প্রশাসনের প্রধান; মন্ত্রিগণ প্রেসিডেন্ট কর্তৃক মনোনীত এবং পার্লামেন্টের অনুমোদনসাপেক্ষ দায়িত্ব লাভ করেন, কিন্তু পার্লামেন্টের সদস্য নন। রাহ্বার সর্বোচ্চ বিচার পরিষদের সাথে পরামর্শ করে বিচার বিভাগের প্রধান ও সর্বোচ্চ বিচারালয়ের বিচারকদের মনোনীত করেন। অনুরূপভাবে তিনি সর্বোচ্চ প্রতিরক্ষা পরিষদের সাথে পরামর্শক্রমে তিন সশস্ত্র বাহিনীর ও ইসলামি বিপ্লবী রক্ষী বাহিনীর তিন বিভাগের প্রধান ও গুরুত্বপুর্ণ উচ্চ পদগুলোতে এবং পুলিশ বাহিনীর প্রধান পদে নিয়োগ দেন। প্রশাসন, আইন ও বিচার বিভাগের প্রতিনিধি সমবায়ে গঠিত জাতীয় সম্প্রচার পরিষদের প্রধান পদেও তিনি নিয়োগ দেন। এছাড়া আইন বিভাগের (মজ্লিসে শূরায়ে ইসলামি/পার্লামেন্ট)-এর অনুমোদিত বিলগুলোতে ইসলামি শারী‘আহ্ ও সংবিধান লঙ্ঘিত না হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিলগুলো পরীক্ষা করে দেখার জন্য গঠিত বারো সদস্যের অভিভাবক পরিষদের ছয়জন আইন-বিশেষজ্ঞ সদস্য বিচার বিভাগ থেকে মনোনয়ন দেয়া হয় ও পার্লামেন্ট কর্তৃক অনুমোদিত হলে তাঁরা দায়িত্ব লাভ করেন এবং ছয় জন মুজ্তাহিদ্ সদস্য রাহ্বার কর্তৃক মনোনীত হন। কোনো বিষয়ে পার্লামেন্ট ও অভিভাবক পরিষদের মধ্যে অচলাবস্থা দেখা দিলে তার নিরসনের লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় কল্যাণ নির্ধারণ পরিষদ গঠিত হয় এবং রাহ্বার সে পরিষদের প্রধানকে ও এক বা একাধিক সদস্যকে মনোনীত করেন। রাহ্বার সর্বোচ্চ প্রতিরক্ষা পরিষদের সাথে পরামর্শক্রমে যুদ্ধ ঘোষণা করবেন ও সন্ধির সিদ্ধান্ত নেবেন। পররাষ্ট্র নীতিতে পরিবর্তন সাধনসহ যে কোনো অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রশাসন ও পার্লামেন্ট রাহ্বারের অনুমোদন ছাড়া কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে না। এছাড়াও রাহ্বার যে কোনো পরামর্শ দিলে তা মেনে চলতে হবে।
এসবের বাইরে অর্থ, শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও উন্নয়নসহ জনজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পার্লামেন্টের অনুমোদনক্রমে প্রশাসন কাজ করে যায় এবং কতক কাজ নির্বাচিত স্থানীয় সরকারগুলো আঞ্জাম দেয়।
এভাবে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধানে রাহ্বার ও জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে কর্মবণ্টনে কোরআন মজীদের নিম্নোক্ত দু’টি আয়াতের প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে :
شَاوِرْهُمْ فِي الأمْرِ فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ
‘কাজকর্মের ব্যাপারে তাদের সাথে পরামর্শ করুন, অতঃপর যখন আপনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন তখন আল্লাহ্র ওপরে ভরসা করুন।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৫৯)
এবং মুসলিম জনগণের অন্যতম বৈশিষ্ট্য :
أَمْرُهُمْ شُورَى بَيْنَهُمْ
‘তাদের কাজ তাদের (নিজেদের) মধ্যে পরামর্শকরণ।’ (সূরা আশ্-শূরা : ৩৮)
প্রথমোক্ত আয়াতটিতে নবী করীম (সা.)-কে তাঁর হুকুমাতি দায়িত্বের ক্ষেত্রে অন্যদের সাথে পরামর্শ করতে বলা হয়েছে, কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে বলা হয়েছে তাঁকেই; পরামর্শদাতাদের সংখ্যাগুরুর, এমনকি তাঁদের সকলের মত অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া তাঁর জন্য বাধ্যতামূলক করা হয় নি। অন্যদিকে যেসব সামষ্টিক কাজ রাসূলের হুকুমাতি দায়িত্বের সাথে সংশ্লিষ্ট নয় সেগুলোতে অধিকতর বান্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নেয়ার ও তা থেকে উপকৃত হবার জন্য স্বভাবতঃই মুসলমানরা পরস্পর পরামর্শ করে থাকে; এসব ক্ষেত্রে রাসূলের হস্তক্ষেপ অপরিহার্য নয়, যদিও এসব ব্যাপারেও তাঁর পরামর্শ লোকদেরকে উপকৃত করতে পারে।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের দল ব্যবস্থা
সমিতি, সংস্থা ও রাজনৈতিক দল গঠনের স্বাধীনতাকে ব্যক্তি স্বাধীনতার অন্যতম প্রধান নিদর্শন হিসেবে গণ্য করা হয়; যদিও রাজনৈতিক দল গঠন করা কারো জন্য অপরিহার্য নয়, তবে তা গঠনের অধিকার বা স্বাধীনতা থাকতে হবে। রাজতান্ত্রিক ও একনায়কতান্ত্রিক দেশ ব্যতীত সকল দেশেই এ স্বাধীনতা আছে। তাই চিন্তা ও মত পোষণ ও প্রকাশের স্বাধীনতার এবং সংঘবদ্ধতার স্বাধীনতার হেফাযতকারী দীনের অনুবর্তী ইসলামি হুকুমাত্ হিসেবে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানেও এ স্বাধীনতা আছে। তবে বিশ্বের অন্যান্য দেশে যেভাবে রাজনৈতিক দলের সাংবিধানিক মর্যাদা আছে- যার দ্বারা জনপ্রতিনিধিদের স্বাধীনতাকে এবং পরোক্ষভাবে কার্যত জনগণের স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয়, ইরানে সেভাবে সংবিধানে দলের জন্য কোনো মর্যাদা সংরক্ষিত নেই। সেখানে যে কেউ দল ও জোট গঠন করতে পারে এবং নির্বাচনগুলোতে যে কোনো দল যে কোনো প্রার্থীকে সমর্থন করতে পারে, কিন্তু সংবিধান ও আইনের দৃষ্টিতে প্রার্থিগণ ব্যক্তিগতভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে থাকেন। ফলে একই প্রার্থীকে একাধিক দল সমর্থন করতে পারে, অন্যদিকে নির্বাচিত পেসিডেন্ট বা পার্লামেন্ট সদস্য স্বীয় কাজকর্মের ব্যাপারে সংবিধান, আইন ও জনগণের কাছে দায়ী থাকেন, কোনো দলের কাছে দায়ী থাকেন না। তাই একজন পার্লামেন্ট সদস্য সরকারের কোনো বিলের বিরোধিতা করার ও কোনো বিলের সমর্থন করার ব্যাপারে এবং যে কোনো বিষয়ে নিজ দলের অবস্থানের বিপরীত অবস্থান গ্রহণের ব্যাপারেও পুরোপুরি স্বাধীন।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধানে দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ধর্ম ও মায্হাবের অধিকারের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার যে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে তা-ও ইসলামি বিপ্লবের স্থায়িত্বের পিছনে একটি বিরাট কারণ হিসেবে কাজ করেছে।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধানে ইহুদি, খ্রিস্টান ও জরাথুস্ত্রীদের জন্য মজ্লিসে শূরায়ে ইসলামিতে (পার্লামেন্টে) জনসংখ্যা অনুপাতে আসন সংরক্ষণ করা হয়েছে। প্রতিটি সংখ্যালঘু ধর্মীয় গোষ্ঠীর লোকেরা ভোট দিয়ে তাদের নিজস্ব প্রতিনিধি নির্বাচন করে থাকে। অন্যদিকে ফৌজদারি অপরাধের বিচার ও সামাজিক নৈতিকতা সম্পর্কে সংবিধানে সুস্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে, সামগ্রিকভাবে ইসলাম রাষ্ট্রীয় আদর্শ এবং গোটা জাতির সামষ্টিক কাজকর্মে তারই প্রতিফলন ঘটবে, তবে প্রত্যেক ধর্মের একান্ত নিজস্ব ব্যাপারে, যেমন : চিন্তা-বিশ্বাস ও ইবাদত্-উপাসনায় তাদের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে, কিন্তু কোনো শহরে ধর্মীয় সংখ্যালঘু কোনো গোষ্ঠী সংখ্যাগুরু হলে সেখানে দুই ধর্মের অনুসারীদের মধ্যকার কোনো বিষয় সংক্রান্ত বিরোধ নিরসনে সেখানকার সংখ্যাগুরু গোষ্ঠীর ধর্মীয় বিধান প্রাধান্য লাভ করবে।
অনুরূপভাবে প্রত্যেক মায্হাবের অনুসারীরা একান্ত নিজস্ব বিষয়াদিতে নিজ নিজ মায্হাবের অনুসরণ করবে, কিন্তু কোনো শহরে দুই মায্হাবের অনুসারীদের মধ্যকার বিরোধ নিরসনে সেখানকার সংখ্যাগুরু মায্হাবের বিধান অনুসৃত হবে।
বৈশ্বিক ইসলামি হুকুমাতের দিকনির্দেশ
বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে যারাই ইসলামি হুকুমাত্ প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষা পোষণ করে তাদের সকলেরই একটি অভিন্ন ধারণা এই যে, শেষ পর্যন্ত বিশ্বে একটিমাত্র ইসলামি হুকুমাত্ প্রতিষ্ঠিত হতে হবে এবং অনেকেই মনে করে যে, একই সময় বিশ্বের বুকে একাধিক ইসলামি হুকুমাতের অস্তিত্ব গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু সেই সাথে একটি প্রশ্ন জাগে যে, নবী বা মাসুম ইমামের (আ.) নেতৃত্ব ব্যতীত এ ধরনের একক ইসলামি হুকুমাতে বিভিন্ন অঞ্চল ও জাতির মধ্যে ইনসাফ বজায় রাখা সম্ভব হবে কিনা।
হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) এ সংশয়ের নিরসন ঘটিয়ে গিয়েছেন। তিনি তাঁর অন্তিম বাণীতে (অসিয়তনামায়) মুসলিম উম্মাহ্র প্রতি এই বলে আহ্বান জানিয়েছেন : ‘স্বাধীন প্রজাতন্ত্রসমূহের সমন্বয়ে একটি ইসলামি সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এগিয়ে যান।’
ইমাম খোমেইনীর এ অতি সংক্ষিপ্ত উক্তিতে এ তাৎপর্যই নিহিত রয়েছে যে, একক ইসলামি হুকুমাতের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মূল কাজ হবে হুকুমাতের আদর্শিক নিয়ন্ত্রণ ও দিকনির্দেশনা এবং প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক বিষয়াদি ‘স্বাধীন প্রজাতন্ত্র’সমূহের হাতে থাকবে, ফলে প্রতিটি জাতি ও জনগোষ্ঠী স্বীয় ন্যায্য পার্থিব স্বার্থের হেফাযত্ করতে সক্ষম হবে এবং কোনো জাতি কোনো জাতির বিরুদ্ধে অন্যায়ের আশ্রয় নিতে ও অপরকে শোষণ করতে পারবে না।
বস্তুত বৈশ্বিক ইসলামি হুকুমাতের জন্য এর চেয়ে অধিকতর ভারসাম্যপূর্ণ ও কার্যোপযোগী বাস্তবানুগ পরিকল্পনার কথা আদৌ চিন্তা করা সম্ভব নয়।