All posts by dreamboy

নজিরবিহীন সাইবার হামলায় বিশ্বজুড়ে ‘গতিহীন’ ইন্টারনেট

নজিরবিহীন সাইবার হামলায় সারা বিশ্বের ইন্টারনেট ব্যবস্থা তছনছ হয়েছে। হামলায় বিশ্বজুড়ে ইন্টারনেটের গতি মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইন্টারনেটের ইতিহাসে এ ধরনের বড় হামলা এর আগে আর হয়নি।

 বাজে বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত মেইল পাঠানো হয়। এ সব মেইলে ক্লিক করলে ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা থাকে বা তথ্য হাতিয়ে নেয়ার কাজে জড়িত এমন সব ওয়েবসাইটের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার আশংকাও থাকে।  এ জাতীয় মেইলকে স্পাম বলা হয়।

 স্পাম-বিরোধী লড়াইয়ে জড়িত একটি গোষ্ঠীর সঙ্গে ওয়েবসাইট হোস্টিং বিবাদের জের ধরে প্রতিশোধমূলক হামলা চালানো হয়। আর এ হামলার প্রভাবই পড়েছে ইন্টারনেটের ওপর। জনপ্রিয় অনেক ওয়েবসাইটে এরইমধ্যে এ হামলার কুপ্রভাব পড়েছে এবং ব্যাংকিং এবং ই-মেইল সিস্টেমেও হামলার প্রভাব পড়তে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে।

 লন্ডন এবং জেনেভাভিত্তিক স্পাম্পহাউস নামে একটি গোষ্ঠী ইন্টারনেটের স্পাম মেইল-বিরোধী ততপরতার সঙ্গে জড়িত রয়েছে। স্পাম মেইলসহ অন্যান্য অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়বস্তু কি করে ফিল্টার করা যাবে সে বিষয়ে ই-মেইল প্রোভাইডারদের সহায়তা করছে স্পাম্পহাউজ।

 এ কাজ করতে গিয়ে এ গোষ্ঠীটি স্পামের সঙ্গে জড়িত সার্ভারগুলোর একটি ডাটাবেজ তৈরি করেছে এবং তাদের ব্লক করে দেয়ার একটি তালিকা রয়েছে স্পামহাউজের হাতে।

 সম্প্রতি সাইবারবাঙ্কার নামের একটি ডাচ ওয়েব হোস্ট পরিচালিত বেশ কয়েকটি সার্ভার ব্লক করে দিয়েছে স্পামহাউজ। শিশু পর্নোগ্রাফি এবং সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত বিষয়বস্তু ছাড়া আর সবই রাখবে অর্থাত হোস্ট করবে বলে ঘোষণা করেছিল সাইবারবাঙ্কার।

 পূর্ব ইউরোপ এবং রাশিয়ার সহযোগিতায় সাইবারবাঙ্কার এ হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করেছে স্পামহাউজ। অবশ্য, এ বিষয়ে সাইবারাবাঙ্কারের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও সাংবাদিকরা তাদের মন্তব্য জানতে পারেননি।

 এ হামলা চালানোর জন্য ডিস্ট্রিবিউটেড ডিনাইয়াল অব সার্ভিস বা ডিডিওএস নামে পরিচিত কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে। এই কৌশলে মিথ্যা চাহিদা সৃষ্টি করা হয় এবং সংশ্লিষ্ট সার্ভার অকেজো হয়ে যায়।

 অবশ্য, এ হামলা সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো বিবরণ এখনো প্রকাশ করেনি স্পামহাউজ।

সূত্র: রেডিও তেহরান, ২৮ মার্চ, ২০১৩

সৌরজগতের বাইরে গ্যাস সমৃদ্ধ নতুন গ্রহ খুঁজে পেলেন জোতির্বিজ্ঞানীরা

আমাদের পরিচিত সৌরজগতের বাইরে বৃহস্পতি গ্রহের মত বিশালাকার গ্রহের সন্ধান পেয়েছেন জোতির্বিজ্ঞানীরা। এ গ্রহটি সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য পাওয়ারও দাবি করেছেন তারা। বিজ্ঞানীরা এ গ্রহটির নাম দিয়েছেন এইচ আর- ৮৭৯৯।

 কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডানলপ ইনস্টিটিউট ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের কুইন কনোপ্যাকি ও একদল জোতির্বিজ্ঞানী এ খবর জানিয়েছেন।  কনোপ্যাকি জানান, “কেক-২ টেলিস্কোপ, ডেটা প্রসেসিং কৌশলসহ অন্যান্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে আমরা গ্রহটি পর্যবেক্ষণ করে নজিরবিহীন তথ্য পেয়েছি। বিশেষ করে গ্রহটির পরিবেশ সম্পর্কে জানতে পেরেছি।”

 বিশ্ববিদ্যালয়ের জোতির্বিজ্ঞান দলের প্রধান হিসেবে কনোপ্যাকি তার গবেষণা পত্র বিখ্যাত জার্নাল সায়েন্সে ২২ মার্চ প্রকাশ করবেন।  জোতির্বিজ্ঞানীদের দলটি হাই রেজুলেশনে ধারণ করা ছবি বিশ্লেষণ করে গ্রহটির পরিবেশে বিভিন্ন রাসায়নিকের উপস্থিতি খুঁজে পেয়েছেন। তারা জানান, গ্রহটির মেঘাচ্ছন্ন পরিবেশের কথা, যেখানে রয়েছে কার্বন মনোক্সাইড ও জলীয় বাষ্প এবং ‘এ ধরনের আরো অনেক বেশি কিছু’।

 কনোপ্যাকির গবেষণা পত্রের সহকারি লেখক জানান, গ্রহটির পরিবেশে কার্বনের পরিমাণ ও অক্সিজেনের উপস্থিতির তুলনা করে এবং রাসায়নিক মিশ্রণের বিশ্লেষণ করে আমরা জানতে পারবো, কিভাবে সম্পূর্ণ গ্রহটির ব্যবস্থাপনা গঠিত হয়েছে।”

বিজ্ঞানীরা জানান, এটি যেন একটি বিশাল গ্যাস দানব।  কার্বন ও অক্সিজেনের পরিমাণ এবং মিশ্রণ হল মহাবিশ্বের গ্রহগুলোর সৃষ্টি ও বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ এক রহস্য।

এইচ আর- ৮৭৯৯ গ্রহটি পৃথিবী থেকে ১৩০ আলোক বর্ষ দূরে। এর আগে বিজ্ঞানীরা এ গ্রহের অন্য তিন সঙ্গীকে খুঁজে পেয়েছিলেন। ওই তিনটি গ্রহই আমাদের সৌরজগতের বৃহত্তম গ্রহটির চেয়েও তিন থেকে সাত গুণ বড়।

 এমনকি ওই গ্রহগুলোর কক্ষপথ আমাদের সৌরজগতের তুলনায় অনেক বেশি বড়। এ থেকে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন দানবাকৃতির গ্রহের সৌরজগতটি অনেক বেশি বড়।

সূত্র: রেডিও তেহরান, ১৭ মার্চ, ২০১৩

সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামে পাঁচ ধরনের নতুন রেডিও ফার্মাসিউটিক্যাল তৈরি করেছে ইরান

ইরানের আণবিক শক্তি সংস্থা পাঁচ ধরনের রেডিওফার্মাসিউটিক্যালস প্রস্তুত করেছে। দেশটির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট নাসরিন সুলতানখাহ এ খবর জানিয়েছেন।

 তিনি আজ (রোববার) বলেন, ইরানের আণবিক শক্তি সংস্থা পাঁচ ধরনের রেডিওফার্মাসিউটিক্যালস তৈরি করেছে যা দিয়ে জটিল রোগের চিকিতসা করা হবে। বিশেষ করে মরণঘাতি ক্যান্সারের চিকিতসায় এসব ব্যবহার করা হবে বলেও জানান তিনি।  ২০ এপ্রিল  রেডিওফার্মাসিউটিক্যালসের তৈরির খবর আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ববাসীকে জানানো হবে বলে জানান নাসরিন।

 রেডিওফার্মাসিউটিক্যালসগুলো তৈরি করতে ২০ মাত্রা সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের প্রয়োজন হয়। ইরানের আণবিক সংস্থা ২০ মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার পর তেজস্ক্রিয় ওষুধগুলো প্রস্তুত করেছে। এছাড়াও, ইরানের প্রায় ১০ লাখ রোগীর জন্য আইসোটোপ থেকে তৈরি করা ওষুধ প্রয়োজন।

তিনি জানান, ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এর আগে আট ধরনের ওষুধ বাইরে থেকে আমদানি করতো। কিন্তু ইরানের ব্যাংক ও অর্থনৈতিক খাতের ওপর মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা গোষ্ঠীর অবৈধ অবরোধের কারণে দেশের ক্যান্সার রোগীদের জন্য এ ওষুধ কেনা সম্ভব হচ্ছিল না।  অবৈধ এ অবরোধের কারণে ক্যান্সারসহ বহু রোগীর জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গিয়েছিল।  মার্কিন অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞায় ইরানে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, কিডনি জটিলতা, থ্যালাসেমিয়া, লিউকেমিয়া, হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত রোগীরা সঠিক চিকিতসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

সূত্র: রেডিও তেহরান, ৭ এপ্রিল ২০১৩

আদা

এই ঠান্ডায় আদা ভীষণ উপকারী। এতে রয়েছে অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল এজেন্ট, যা শরীরের রোগ-জীবাণুকে ধ্বংস করে। জ্বর জ্বর ভাব, গলাব্যথা ও মাথাব্যথা দূর করতে সাহায্য করে।

বমি বমি ভাব দূর করতে এর ভূমিকা অপরিহার্য। তাই বমি বমি ভাব হলে কাঁচা আদা চিবিয়ে খেতে পারেন। এতে মুখের স্বাদ বৃদ্ধি পায়।

অসটিও আর্থ্রাইটিস, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস—এই অসুখগুলোয় সারা শরীরের প্রায় প্রতিটি হাড়ের জয়েন্টে প্রচুর ব্যথা হয়। এই ব্যথা দূর করে আদা। তবে রান্না করার চেয়ে কাঁচা আদার পুষ্টিগুণ বেশি।

মাইগ্রেনের ব্যথা ও ডায়াবেটিসজনিত কিডনির জটিলতা দূর করে আদা। গর্ভবতী মায়েদের সকালবেলা, বিশেষ করে গর্ভধারণের প্রথম দিকে সকালবেলা শরীর খারাপ লাগে। কাঁচা আদা দূর করবে এ সমস্যা।

দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। গবেষণায় দেখা গেছে, আদার রস দাঁতের মাড়িকে শক্ত করে, দাঁতের ফাঁকে জমে থাকা জীবাণুকে ধ্বংস করে।

দেহের কোথাও ক্ষতস্থান থাকলে তা দ্রুত শুকাতে সাহায্য করে আদা। এতে রয়েছে অ্যান্টি ইনফ্ল্যামেটরি এজেন্ট, যা যেকোনো কাটাছেঁড়া, ক্ষতস্থান দ্রুত ভালো করে।

এই ঠান্ডায় টনসিলাইটিস, মাথাব্যথা, টাইফয়েড জ্বর, নাক দিয়ে পানি পড়া, নাক বন্ধ হওয়া, বসন্তকে দূরে ঠেলে দেয় আদা। ওভারির ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াই করে আদা।

গ্রন্থনা: ডা. ফারহানা মোবিন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারি ১৬, ২০১৩

সভা সমাবেশ

পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) ও ইসলামী ঐক্য সপ্তাহ উপলক্ষে আলোচনা সভা

DSC00967পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) ও ইসলামী ঐক্য সপ্তাহ উপলক্ষে গত ২৫ জানুয়ারি ২০১৩ ঢাকাস্থ সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা মিলনায়তনে ‘সমসাময়িক বিশ্বে ইসলামী ঐক্য : ভিত্তি ও প্রতিবন্ধকতা’ শীর্ষক এক সেমিনারের আয়োজন করা হয়। সরকারি আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. এ.কে.এম. ইয়াকুব হোসাইন এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. এম. শমসের আলী। সেমিনারে বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশস্থ ইরান দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত জনাব হোসেইন আমিনিয়ান তূসী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আবদুর রশীদ। এতে আরো বক্তব্য উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ বেতারের কর্মকর্তা জনাব মাওলানা মোহাম্মাদ নজরুল ইসলাম। স্বাগত বক্তব্য রাখেন ইরান কালচারাল সেন্টারের কাউন্সেলর জনাব ড. রেযা দিয়ানাত।

অনুষ্ঠানের সভাপতি ড. এ.কে.এম. ইয়াকুব হোসাইন বলেন, একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য মুসলিম বিশ্বের সামগ্রিক ঐক্য সুদৃঢ় করা সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, আল কুরআন ও আল হাদীসের আদর্শই হতে পারে বিশ্বব্যাপী ইসলামী ঐক্যের মজবুত ভিত্তি। তিনি মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের পথে অন্তরায় প্রসঙ্গে মুসলমানদেরকে মুনাফিকদের ব্যাপারে সতর্ক থাকা এবং সাম্রাজ্যবাদী ও ক্রুশেডার শক্তিগুলোর সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন না করার ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করেন।

প্রফেসর ড. এম. শমসের আলী বলেন, মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ঐক্য বজায় থাকলে আজ মুসলমানদের এ দুরবস্থার সম্মুখীন হতে হতো না। কুরআন বলছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদের জন্য আদর্শ। বিশ্বে অনেক নেতা ছিলেন যাঁরা এক সময়ের নেতা ছিলেন, কিন্তু অন্য সময়ের নন। তিনি এ প্রসঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিলের পরাজয়বরণের দৃষ্টান্ত উত্থাপন করে বলেন, তখন বলা হয়েছিল যে, চার্চিল যুদ্ধকালীন নেতা, কিন্তু শান্তিকালীন নেতা নন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা.) সর্বকালীন নেতা এবং তিনি সর্বক্ষেত্রের নেতা। তিনি বলেন, শুধু আলোচনা নয়, সত্যিকারভাবে রাসূলের অনুসরণেই মহান আল্লাহ সন্তুষ্ট হবেন।

জনাব হোসেইন আমিনিয়ান তূসী বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে আসেন। তিনি মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর সংবিধান ছিল পবিত্র কুরআন। তিনি বলেন, হজে আমরা মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের প্রতিফলন দেখতে পাই যেখানে সকল মুসলিম একই পোশাকে অংশগ্রহণ করে। আমাদের মধ্যে হজের আধ্যাত্মিক চেতনা থাকলে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। তিনি বলেন, শত্রুরা মুসলিম উম্মাহকে বিভক্ত করার চেষ্টা করছে। তাই আমাদেরকে শাখাগত দিক থেকে নয়; বরং উম্মাহ হিসেবে নিজেদের অবস্থানকে বিবেচনা করতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ এ বাক্যই আমাদের ঐক্যের ভিত্তি।

DSC00979প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আবদুর রশীদ বলেন, মহান আল্লাহ সমগ্র সৃষ্টিজগৎ সৃষ্টি করেছেন মহানবী (সা.)-এর ভালবাসায়। পৃথিবীতে এক  লক্ষ অথবা দুই লক্ষ চবিবশ হাজার নবী-রাসূল আগমন করেছেন। কিন্তু মহান আল্লাহ অন্য কোন নবীকে নন, বরং আমাদের রাসূলকে মেরাজের রজনীতে তাঁর অনেক গোপন ভেদ দেখিয়েছেন। তিনি বলেন, আমাদেরকে সকল আদর্শের জন্য রাসূলের শরণাপন্ন হতে হবে। আর রাসূলের জন্মদিন ইসলামী উম্মাহর মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি সুযোগ।

মাওলানা মো. নজরুল ইসলাম বলেন, মহানবী (সা.) ইসলাম ধর্মের দিকে সবাইকে আহবান জানান। তিনি বিশ্বে হানাহানি দূর করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সর্বাবস্থায় মানুষের জন্য আদর্শ ছিলেন। কিন্তু আমরা আজ রাসূলের আদর্শ থেকে দূরে সরে গেছি। আমরা যদি তাঁর আদর্শে আদর্শবান হতে পারি তাহলে আমরাও পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হব।

ড. রেযা দিয়ানাত বলেন, মাজহাব নির্বিশেষে সকলের কাছে মহানবী (সা.) সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ। বর্তমানে মুসলমানরা কুরআন ও রাসূলের সুন্নাহ থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। এ অবস্থায় সকলের জন্যই রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ একান্ত প্রয়োজন।

অনুষ্ঠানে কুরআন তেলাওয়াত করেন জনাব কারী মোহম্মদ হাবিবুর রহমান এবং হাম্দ ও নাত পরিবেশন করেন জনাব মেহেদী হাসান।

 ইরানে ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের ৩৪তম বার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা সভা

DSC01151ইরানের বিপ্লব বিজয়ের ৩৪তম বার্ষিকী উপলক্ষে গত ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের মিলনায়তনে ‘বিশ্বে ইসলামী জাগরণে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের প্রভাব’ শীর্ষক এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। উলূমুল কুরআন ফাউন্ডেশনের সভাপতি জনাব আজিজুল হক মুরাদ এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশস্থ ইরান দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত জনাব হোসেইন আমিনিয়ান তূসী। বিশেষ অতিথি ছিলেন ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ এর সাবেক মহাপরিচালক জনাব এ.জেড.এম. শামসুল আলম। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ইরান কালচারাল সেন্টারের কাউন্সেলর জনাব ড. রেযা দিয়ানাত।

DSC01186জনাব আজিজুল হক মুরাদ বলেন, ইরানে ইসলামী বিপ্লবের সময় বিশ্ব পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক- এ দু’টি ব্লকে বিভক্ত ছিল। এ অবস্থায় ইরানের ধর্মীয় নেতৃত্ব এই দুটি ব্লকের কোনোটি দ্বারা প্রভাবিত না হয়েই নিজেরা একটি সফল বিপ্লব সংঘটন করে। তিনি বলেন, ইরানের ধর্মীয় নেতাদের করণেই মুসলমানদের মধ্যে গতানুগতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়। তাঁরা বুঝিয়ে দেন যে, আলেমদের নেতৃত্ব কেবল ধর্মীয় বিষয়াদির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তাঁরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সময়ের শাসনব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। তিনি আরো বলেন, বিশ্বে বর্তমান ইসলামী আন্দোলনের পেছনে ইরানের বিপ্লবের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। বিশেষ করে লেবানন ও ফিলিস্তিনের আজকের অবস্থানের পেছনে মূল ভূমিকা ইরান পালন করেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বাংলা ভাষায় বক্তব্য রাখার জন্য ড. রেযা দিয়ানাতের প্রশংসা করেন ও তাঁকে ধন্যবাদ জানান।

জনাব হোসেইন আমিনিয়ান তূসীDSC01169 বলেন, মাত্র ৩৪ বছর আগে বিংশ শতাব্দীর একটি অসাধারণ বিপ্লব সংঘটিত হয়। এ বিপ্লব পুঁজিবাদী বিপ্লবও নয়, আবার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবও নয়; বরং তা ছিল এক ভিন্নধর্মী বিপ্লব। কিন্তু এ বিপ্লব বিজয়ের পর থেকেই এর শত্রুরা নানাভাবে চেষ্টা করেছে একে ধ্বংস করার জন্য। কিন্তু তারা এতে সক্ষম হয় নি। তিনি বলেন, বিপ্লবের স্লোগান ছিল : ‘না প্রাচ্য, না পাশ্চাত্য’। আর এ স্লোগানটিই বিশ্বে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। বর্তমানে মুসলিম বিশ্ব ও ল্যাটিন আমেরিকায় এরই প্রতিধ্বনি শোনা যায়। তিনি পাশ্চাত্যের ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ পলিসির ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, তারা আমাদের ঐক্য বিনষ্ট করার জন্য যে চেষ্টা চালাচ্ছে। সে বিষয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে।

জনাব এ.জেড.এম. শামসুল আলম বলেন, ইরানের ইসলামী বিপ্লবের ফলে মুসলিম বিশ্বে যে হীনমন্DSC01164যতা ছিল তা দূর হয়ে যায়। পাশ্চাত্য যেভাবে উন্নতি করতে পারে বা তারা যে পর্যায়ে পৌঁছেছে সে পর্যায়ে পৌঁছা মুসলমানদের পক্ষে সম্ভব নয়- এ ধারণা মুসলমানদের মন থেকে অপসারিত হয়। তিনি বলেন, শাহের সময় ইরান উন্নত ছিল, তবে শাহ চেয়েছিল পাশ্চাত্য ধারায় উন্নয়ন করতে। ধর্মীয় ভাবধারাকে বিসর্জন দিয়ে তাদের খুশি করতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেদেশের জনগণ তা মেনে নেয় নি। তারা বিপ্লবের সময় পাশ্চাত্যকে চ্যালেঞ্জ করে বিজয়ী হয়। আজও তারা পাশ্চাত্যকে চ্যালেঞ্জ করে এগিয়ে চলছে। তিনি বলেন, ইরানীরা নানা দিক থেকে বিপ্লবকে সফল করেছে। তাদের বিপ্লব সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও নানা দিকসমৃদ্ধ। এ বিপ্লব থেকে অনেক কিছু শেখার রয়েছে। তিনি বলেন, আজকে মুসলিম উম্মাহর জন্য প্রয়োজন সত্যিকার নেতা। ইরান একটি মহান জাতি। তারা নিজেদের দেশের DSC01161উন্নয়ন করেছে। কিন্তু ইরানের এখন সময় এসেছে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়ার। তিনি বলেন, শিয়া-সুন্নি পার্থক্য আসলে কোন পার্থক্যই নয়। শিয়ারা ইমাম হোসাইনের জন্য ক্রন্দন করে। বাংলাদেশের মানুষও ইমাম হোসাইনের জন্য ভীষণভাবে ক্রন্দন করে। এদেশের মানুষ তাঁর জন্য যেভাবে ক্রন্দন করে অন্য কারো জন্য তেমন করে না। ইমাম আলী ও ইমাম হোসাইনের বংশধরদের ব্যাপারে মুসলমানদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। হযরত আলীর মর্যাদা ও তাঁর নেতৃত্বের বিষয়টি প্রশ্নাতীত। তিনি বলেন, যদি তাঁদের বংশধররা মুসলমানদের নেতৃত্ব দেন তবে সেই নেতৃত্ব মেনে নিতে আমাদেরও কোনো দ্বিধা নেই।

DSC01153ড. রেযা দিয়ানাত অনুষ্ঠানে সবাইকে স্বাগত জানিয়ে বাংলা ভাষায় বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, ১৯৭৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ইরানের জনগণ ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর নেতৃত্বে আড়াই হাজার বছরের পাহলভি রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রামের পথ ধরে বিজয় অর্জন করে। তিনি বাংলাদেশ ও ইরানের মধ্যকার ঐতিহাসিক সম্পর্কের প্রসঙ্গে বলেন, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক ক্ষেত্রে ইরান-বাংলাদেশ সম্পর্কের বন্ধন প্রায় হাজার বছরের পুরনো। বাংলাদেশে ১২০১-১৮৩৭ সাল পর্যন্ত ফারসি সরকারি ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ও বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুলের ফারসি সাহিত্যচর্চার কথা সকলেই জানেন। সুপ্রাচীন ও সমকালীন কবি, সাহিত্যিক, সুফিদের বাংলাদেশে আগমন ছাড়াও সরকারি পর্যায়েও বাংলাদেশের সাথে ইরানের সম্পর্ক অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ ও আন্তরিক। এ দু’টি ভ্রাতৃপ্রতীম দেশের মধ্যে সম্পর্ক আগের চেয়ে আরো সম্প্রসারিত হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

অনুষ্ঠানে কুরআন তেলাওয়াত করেন জনাব ফখরুল আমীন।

মহানবী (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণের মাধ্যমেই

আজকের বিশ্ব যাবতীয় দ্বন্দ্ব-সংঘাত থেকেমুক্তি পেতে পারে

DSC00990

গত ২৬ জানুয়ারি ২০১৩ জাতীয় প্রেসক্লাব হলরুম মিলনায়তনে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের স্থপতি সংগঠন তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তাগণ বলেছেন, ইসলামের বিশ্বজনীন ধর্মীয় মূল্যবোধ চর্চার অভাবেই আধুনিক বিশ্বে জাতিতে জাতিতে, বর্ণে বর্ণে ও শ্রেণিতে শ্রেণিতে দ্বন্দ্ব- সংঘাত মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। পৃথিবীতে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বজনীন ধর্মীয় আদর্শের কোন বিকল্প নেই। মহানবী (সা.)-এর আদর্শই হচ্ছে বিশ্ব মানব জাতির জন্য সর্বোত্তম আদর্শ। এ আদর্শ অনুসরণের মাধ্যমে মহান প্রভুর নৈকট্য লাভ সম্ভব। একমাত্র বিশ্বনবীর আদর্শ অনুসরণের মাধ্যমেই আজকের বিশ্ব যাবতীয় দ্বন্দ্ব-সংঘাত থেকে মুক্তি পেতে পারে। বক্তারা আরও বলেন, মহানবী (সা.)-এর প্রদর্শিত পথে চললে ইহকালে পরম শান্তিতে থাকা ও পরকালে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

তমদ্দুন মজলিসের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ আবদুস সামাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি (অব.) মোহাম্মদ আবদুর রউফ। বিশেষ অতিথি ছিলেন ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ঢাকাস্থ দূতাবাসের কালচারাল কাউন্সেলর ড. রেযা দিয়ানাত এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের প্রফেসর ড. শাহ কাউসার মোস্তফা আবুলউলায়ী। এছাড়াও আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন প্রখ্যাত ভাষা সৈনিক, প্রবীণ সাংবাদিক অধ্যাপক আবদুল গফুর, ইসলামী চিন্তাবিদ ও সাবেক সচিব আ.জ.ম শামসুল আলম, অধ্যাপক মুহাম্মদ ফরিদউদ্দীন খান, ড. মুহাম্মাদ সিদ্দিক, অধ্যাপক ড. আহমদ আবুল কালাম, জনাব শাহাবুদ্দীন খান, মেজর (অব.) জামিল আহমেদ প্রমুখ।

 ইরানের ইসলামী বিপ্লবের ৩৪তম বার্ষিকী উপলক্ষে চলচ্চিত্র ও ফটোগ্রাফি প্রদর্শনী

DSC01097ইরানের ইসলামী বিপ্লবের ৩৪তম বার্ষিকী উপলক্ষে গত ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউট মিলনায়তনে চার দিনব্যাপী ইরানী চলচ্চিত্র প্রদর্শনী ও ইরানের উন্নয়নের ওপর ফটোগ্রাফি প্রদর্শনী উদ্বোধন করা হয়। এ উপলক্ষে ইরানী চলচ্চিত্রের ওপর একটি আলোচনা অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়। আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউটের পরিচালক জনাব সুলতান আহমেদ এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সেমিনারের প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশস্থ ইরান দূতাবাসের  রাষ্ট্রদূত জনাব হোসেইন আমিনিয়ান তূসী, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রেইনবো ফিল্ম সোসাইটির সভাপতি জনাব আহমদ মুজতাবা জামাল। সেমিনারে আরো বক্তব্য উপস্থাপন করেন ‘ইরানী চলচ্চিত্র’ গ্রন্থের রচয়িতা জনাব অপূর্ব কুমার কুন্ডু। স্বাগতিক বক্তব্য রাখেন ইরান কালচারাল সেন্টারের কাউন্সেলর জনাব ড. রেযা দিয়ানাত ও আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউটের ফারসি বিভাগের প্রধান মিসেস শামীম বানু।

জনাব সুলতান আহমেদ বলেন, প্রায়ই আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউটে চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। আর এর প্রধান উদ্দেশ্যই হলো ভাষা শিক্ষা দেওয়া। তিনি বলেন, ইরানী সাহিত্য অনেক আগে থেকেই পৃথিবীতে বিখ্যাত হয়ে আছে।

জনাব আমিনিয়ান তূসী বলেন, ইরানী চলচ্চিত্র আজ এমন একটি অবস্থানে পৌঁছেছে যে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার অর্জন করছে। তিনি সবাইকে ইরানী চলচ্চিত্র দেখার আহবান জানিয়ে বলেন যে, এ চলচ্চিত্রগুলো ইরানের সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার ব্যাপারে সাহায্য করবে।

জনাব আহমদ মুজতাবা জামাল স্মৃতিচারণ করে বলেন, তিনি ১৯৯২ সালে জামার্নীতে আয়োজিত একটি চলচ্চিত্র প্রদর্শনীতে সর্বপ্রথম একটি ইরানী ছায়াছবি দেখেন এবং সেই ছবি দেখে তিনি ইরানী চলচ্চিত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। তিনি ১৯৯৪ সালে ইরান সফর করেন এবং সেখানে গিয়ে কাছে থেকে ইরানী চলচ্চিত্রের বিষয়গুলো জানতে পারেন।

জনাব অপূর্ব কুমার কুন্ডু বলেন, ইরানী চলচ্চিত্রের এতটা অগ্রসর হওয়ার অন্যতম কারণ হলো ইরান সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা। তিনি বলেন, ইরানী চলচ্চিত্র নির্মাতারা ফ্রান্স ফিল্ম ইন্সটিটিউট ও ভারতের পুনে ফিল্ম ইন্সটিটিউটের অ্যাকাডেমিক ও কারিগরী বিষয়গুলো মূল্যায়ন করে নিজস্ব আঙ্গিকে চলচিত্র নির্মাণ করেছে। তিনি ইরানের চলচ্চিত্রের বিভিন্ন দিক নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করেন।

মিসেস শামীম বানু বলেন, আধুনিক বিশ্বে ইরানী চলচ্চিত্র একটি স্থান করে নিয়েছে। আর সেসব চলচ্চিত্র থেকে সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া কয়েকটি চলচ্চিত্র এখানে দেখানো হবে। সবাই এসব ছায়াছবি দেখে ইরানের বর্তমান চলচ্চিত্রের অবস্থা সম্বন্ধে ধারণা লাভ করতে পারবেন বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

ড. রেযা দিয়ানাত সকলকে ইরানী চলচ্চিত্র দেখার আমন্ত্রণ জানান এবং এ প্রদর্শনীর আয়োজন করার জন্য আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউটকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।

উদ্বোধনী দিনে Family Relation ছায়াছবিটি প্রদর্শিত হয়। ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এ প্রদর্শনীতে মোট সাতটি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারসি বিভাগের নবীনবরণ অনুষ্ঠান

DSC01025গত ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ ঢাকা  বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের নবীনবরণ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ঢাকাস্থ ইরান দূতাবাসের কাউন্সেলর ড. রেযা দিয়ানাত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডীন ড. সদরুল আমীন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইরানী ভিজিটিং প্রফেসর ড. ইরান যাদেহ, ড. আবদুস সবুর, ড. মুহসিন উদ্দিন মিয়া, ড. তারেক সিরাজী, ড. কুলসুম আবুল বাশার, খানম শাহনাজ আরেফীন, ড. আবুল কালাম সরকার ও ড. বাহাউদ্দিন।

বক্তাগণের সকলেই ফারসি কDSC01015বিতার পঙ্ক্তি দিয়ে তাঁদের বক্তব্য শুরু করেন। ড. ইরান যাদেহ বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীমযুক্ত একটি ফারসি কবিতা দিয়ে তাঁর ক্লাসের সূচনা করেন। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন, ফারসি ভাষা আপনাদের নিজেদের ভাষা।

ড. দিয়ানাত বলেন, ফারসি ভাষা এ উপমহাদেশে মজবুত বন্ধনের অধিকারী। এখানে এ ভাষা চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন। আট হাজারেরও বেশি ফারসি শব্দ বাংলা ভাষার ব্যবহৃত হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি ড. ইরান যাদেহ এর নিকট থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি উপদেশ দেন। তিনি ফারসি ভাষার পাশাপাশি ইরানী হস্ত শিল্প ও সংগীতের পরিচিতি তুলে ধরার জন্য সবার প্রতি আহবান জানান।

বিশ্বসভ্যতা ইরানের কাছে ঋণী

বাংলাদেশ আঞ্চলিক সংবাদপত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও দৈনিক অনির্বাণের সম্পাদক অধ্যক্ষ আলী আহমেদ বলেন, ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইরান ৩৪ বছর তাদের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। কোন অপশক্তি তাদের পরাজিত করতে পারেনি। জ্ঞান-বিজ্ঞান, তথ্য-প্রযুক্তি, সাহিত্য-সংস্কৃতিতে বিশ্বসভ্যতা ইরানের কাছে ঋণী। শুক্রবার বিকেল ৪টায় ইরানের ৩৪তম বিপলব বার্ষিকী উপলক্ষে আহলুল বাইত ফাউন্ডেশন খুলনা এর উদ্যোগে এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন। নগরীর আলতাপোল লেনস্থ ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্রের মিলনায়তনে এ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি আরও বলেন, ইসলাম হচ্ছে আত্মসমর্পণ করা এবং বাধ্যতা, আর অস্বীকৃতি ও হটকারিতা ত্যাগ করা।

ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্রের অধ্যক্ষ হুজ্জাতুল ইসলাম সৈয়দ ইব্রাহীম খলিল রাজাভী এর সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথি হিসাবে বক্তৃতা করেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি ও সাপ্তাহিক কোলাহলের সম্পাদক এ্যাডভোকেট ড. মোঃ জাকির হোসেন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন হুজ্জাতুল ইসলাম মোঃ আনিছুর রহমান। অনুষ্ঠানে পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াত ও কবিতা আবৃত্তি করেন ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্রের শিক্ষক মাওলানা মোঃ শহিদুল হক।

অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি এ্যাডভোকেট ড. মোঃ জাকির হোসেন বলেন, আললাহর বন্ধু, শেষ নবী সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জীবনযাপন পদ্ধতিতে যা রয়েছে তাই ইসলাম। তিনি বলেন, ইসলামী বিপলব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল হযরত ইমাম খোমেইনী (র.)-এর নেতৃত্বে। যিনি কারবালার ময়দানে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মহান আত্মত্যাগ থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করেছিলেন। তাই আজ ইরানের ইসলামী বিপলব সমগ্র বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের মুক্তির একমাত্র পাথেয় হিসেবে বিরাজমান।

তিনি মুসলমানদের শিয়া-সুন্নির বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানান।

সমাপনী বক্তব্যে অনুষ্ঠানের সভাপতি ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্রের অধ্যক্ষ হুজ্জাতুল ইসলাম সৈয়দ ইব্রাহীম খলিল রাজাভী বলেন, আজ সময় এসেছে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার। আমাদের আদর্শ ইসলামী আদর্শ। তিনিও শিয়া-সুন্নির বিভেদ ভুলে সকল মুসলমানকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানান।

সাতক্ষীরা আলরাজী পাঠাগারে আলোচনা সভা

ইরানের ৩৪তম ইসলামী বিপ্লব বিজয় বার্ষিকী ও পবিত্র ঈদ-ই মিলাদুন্নবী (স) উদ্যাপন উপলক্ষে আল-রাজী পাঠাগারের নিজস্ব কার্যালয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।

সভায় সভাপতিত্ব করেন আল-রাজী পাঠাগারের পরিচালক আতাহার আলী খান। সভায় বক্তব্য রাখেন এ্যাডভোকেট আব্দুর রাজ্জাক ও সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার (অব.) জনাব আব্দুর রশীদ।

 ইরানীয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে বার্ষিক অনুষ্ঠান ও বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা

DSC00584গত ২৭ ডিসেম্বর, ২০১২ ঢাকাস্থ ইরানীয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে বর্ষসমাপনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ইরানীয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের প্রিন্সিপাল ও ইরান দূতাবাসের কালচারাল কাউন্সেলর ড. রেযা দিয়ানাত, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. এএনএম মেশকাতউদ্দিন, লিট্ল জিনিয়াস স্কুলের সাবেক অধ্যক্ষ জনাব কাজী বাসেত। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের এ মিলনমেলায় ছাত্র-ছাত্রীরা ছড়া-কবিতা আবৃত্তি, বাংলা, ইংরেজি ও ফারসি ভাষায় একক ও সমবেত সংগীত পরিবেশন করে। উদ্বোধনী বক্তব্য প্রদান করেন স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল ড. জহির উদ্দিন মাহমুদ। অভিভাবকদের মধ্য থেকে বক্তব্য প্রদান করেন জনাব ইন্তেখাব আলম, জনাব মীর্জা শাহরিয়ার আলম, জনাব  মোহাম্মদ আশরাফউদ্দিন খান, জনাব মুজিবুর রহমান ও জনাব মোহাম্মদ মাঈনউদ্দিন।

প্রফেসর মেশকাতউদ্দিন তাঁর বক্তৃতায় বলেন, আজকের পৃথিবীতে মুসলমানরা সর্বত্র নিগৃহীত হওয়ার পাশাপাশি পাশ্চাত্যে প্রচুর মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছে। তিনি বলেন, বর্তমান মুসলিম বিশ্বের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতিতে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করছে। তিনি ইরানী স্কুলের মাধ্যমে ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের গঠনমূলক কার্যক্রমের প্রশংসা করেন।

জনাব ড. রেযা দিয়ানাত বলেন, পরিবার ও স্কুলের সমন্বয় ও সহযোগিতার মধ্য দিয়েই আমাদের শিশুদের উত্তমভাবে গড়ে তোলা সম্ভব। পরিবার হলো সমাজের ক্ষুদ্রতম ইউনিট যেটি শিশুদের চরিত্র গঠনের সর্বোত্তম ক্ষেত্র। আর স্কুল হলো শিশুদের দ্বিতীয় বাড়ি যেখানে তারা একটি বড় সময় কাটায়। শিক্ষক ও সহপাঠীদের আচরণ তাদের চরিত্রে প্রভাব ফেলে থাকে। তিনি বলেন, ইসলামের মৌলিক শিক্ষা ছাড়া ছাত্র-ছাত্রীদের উন্নত চরিত্র গঠন সম্ভব নয়। আর এক্ষেত্রে পিতামাতা ও শিক্ষকবৃন্দ বড় ভূমিকা পালন করতে পারেন।

জনাব কাজী বাসেত শিক্ষার্থীদের পাঠ্য বিষয় অনুধাবনে সৃজনশীলতা তৈরি করার আহবান জানান। জনাব ইন্তেখাব আলম শিশুদের জন্য খেলাধুলা ও আনন্দঘন শিক্ষার পরিবেশের ওপর জোর দেন। জনাব মীর্জা শাহরিয়ার আলম বলেন, শিশুকালের স্মৃতিগুলোই সবার জীবনে স্থায়ীভাবে দাগ কাটে। জনাব মোহাম্মদ আশরাফউদ্দিন খান বলেন, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান জ্ঞান-বিজ্ঞানে বর্তমানে এক গৌরবময় অবস্থান গড়ে তুলেছে। তার প্রতিফলন ইরানী স্কুলে ফুটে উঠবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। জনাব মাঈনউদ্দিন ইরানী স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য পরবর্তীকালে ইরানে উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির আহবান জানান।

বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা

গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ইরানীয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার বিতরণী সভার আয়োজন করা হয়। শিক্ষার্থী, শিক্ষকবৃন্দ ও অভিভাবকদের বিভিন্ন ইভেন্টের মধ্য দিয়ে প্রতিযোগিতা সমাপ্ত হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে পুরস্কার বিতরণ করেন ইরানীয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের অধ্যক্ষ ড. রেযা দিয়ানাত। ড. দিয়ানাত তাঁর বক্তৃতায় বলেন, বর্তমানে শিশুদের বিচরণ শুধু ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। অভিভাবক ও স্কুল কর্তৃপক্ষের সুন্দর পরিকল্পনা করে শিশুদের আরো অধিক সময় শরীরচর্চা ও খেলাধুলা করার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।

স্মরণীয় দিবস

৩ জানুয়ারি      :         ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের চল্লিশ দিন পূর্তি (আরবাইন)।

৯ জানুয়ারি       :         মীর্জা তাকীখান আমীর কবিরের শাহাদাতবার্ষিকী।

১১ জানুয়ারি     :         মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর ওফাতবার্ষিকী। ইমাম হাসান (আ.)-এর শাহাদাতবার্ষিকী।

১২ জানুয়ারি     :         আহলে বাইতের অষ্টম ইমাম রেযা (আ.)-এর শাহাদাতবার্ষিকী। ইরানের মাশহাদে তাঁর রওযা অবস্থিত।

১৩ জানুয়ারি     :         মহানবী (সা.)-এর মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের বার্ষিকী।

১৫ জানুয়ারি     : *      ১৯৭৯ সালের এ দিনে ইরান থেকে শাহানশাহ্ রেযা শাহ পাহলভী পলায়ন করেন।

          *        নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহর মৃত্যুবার্ষিকী।

২০ জানুয়ারি     :         আহলে বাইতের এগারতম ইমাম হাসান আসকারী (আ.)-এর শাহাদাত বার্ষিকী।

২৫ জানুয়ারি     : * ১২ রবিউল আউয়াল, মহানবী (সা.)-এর পবিত্র জন্মবার্ষিকী (আহলে সুন্নাতের বর্ণনা অনুযায়ী) ও ইসলামী ঐক্য সপ্তাহের শুরু।

২৬ জানুয়ারি     : * ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়ে আরব বিশ্বের দেশ মিসর সর্বপ্রথম এ দিনে লজ্জাজনক ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষর করে। এর প্রতিবাদে তখন আরব লীগ থেকে মিসরকে বহিষ্কার করা হয়।

          *        বাংলা ভাষার সনেট কাব্যের জনক ও ‘মেঘনাদবধ’ মহাকাব্যের রচয়িতা মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মবার্ষিকী।

২৯ জানুয়ারি     : * আততায়ীর গুলিতে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা মহাত্মা গান্ধী নিহত হন।

৩০ জানুয়ারি     :         ১৭ রবিউল আউয়াল, মহানবী (সা.)-এর পবিত্র জন্মবার্ষিকী (শিয়া মাযহাবের বর্ননা অনুযায়ী) এবং আহলে বাইতের ষষ্ঠ ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-এরও জন্মবার্ষিকী।

১ ফেব্রুয়ারি       :         দীর্ঘ ১৫ বছর নির্বাসনে থাকার পর ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের প্রাক্কালে এ দিনে বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেইনী স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন।

১১ ফেব্রুয়ারি     :         ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিপ্লবের বিজয়বার্ষিকী। ইরানে আড়াই হাজার বছরের রাজতন্ত্রের পতন।

১৪ ফেব্রুয়ারি     :         মহানবী (সা.), বিভিন্ন নবী (আ.) এবং পবিত্র ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কে অবমাননাকর উক্তি করার দায়ে ১৯৮৯ সালের এ দিনে ইমাম খোমেইনী সালমান রুশদীর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেন।

১৯ ফেব্রুয়ারি     :         ইমাম হাসান আসকারী (আ.)-এর জন্মবার্ষিকী।

২১ ফেব্রুয়ারি     :         আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ১৯৫২ সালের এ দিনে বাংলা ভাষা আন্দোলনে শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিক, জাববার, শফিকসহ বেশ কয়েকজন বাঙালি।

২৩ ফেব্রুয়ারি    :         খাজা নাসিরউদ্দিন তূসী স্মরণে দিবস। এটি ইরানে প্রকৌশল দিবস হিসেবেও উদ্যাপিত হয়।

অগ্রগতির পথে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান ও বিশ্বব্যাপী ইসলামী জাগরণ

 

ড. জহির উদ্দিন মাহমুদ

ইতিহাসের এক চরম সন্ধিক্ষণে আইয়ামে জাহেলিয়াতের শত দেবতার নিষ্পেষণ থেকে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) নিপীড়িত মানবতাকে মুক্তি দিয়েছিলেন। মানবজাতি প্রত্যক্ষ করেছিল এক অকৃত্রিম শাশ্বত ভারসাম্যপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। কিন্তু দীর্ঘ পথপরিক্রমায় ইসলামের সে অবিকৃত রূপ থেকে মানুষ দূরে সরে গিয়েছিল। বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের পাশাপাশি নৈতিক চরিত্রের চরম অধঃপতন, সাম্রাজ্যবাদী শোষক শ্রেণির হিংস্র আগ্রাসন, দেশে দেশে মুক্তিকামী মজলুম জনতার করুণ আহাজারি যখন পৃথিবীকে ভারাক্রান্ত করে তুলেছিল তখনই পারস্যের শাহী লৌহপ্রাচীর ভেদ করে মহান নেতা ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর নেতৃত্বে সংঘটিত ইসলামী বিপ্লব মানবজাতির সামনে আবারো সেই চিরন্তন সত্যবাণী ঘোষণা করল – ‘সত্য এসেছে, মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে, মিথ্যা তো বিলুপ্ত হবারই’। (সূরা বনি ইসরাইল : ৮১)

বিশ্ব-যায়নবাদী চক্রের হাতে বন্দি পৃথিবীর মানুষগুলো আবার নতুন করে ভাবতে শিখল। অভ্যন্তরীণ শত্রুদের অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা ও বহিঃশত্রুর কুটনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক আগ্রাসন আর অব্যাহত অপপ্রচারের প্রবল লড়াই মোকাবিলা করে বিগত ৩৩ বছর ধরে ইসলামী বিপ্লব বিশ্ব-মুসলমানের জন্য এক অনুকরণীয় আদর্শ রূপে অটল থেকে ৩৪তম বছরে প্রবেশ করেছে।

সমকালীন বিশ্বে সংঘটিত এত বড় ঘটনার পরবর্তী তিন দশক খুব একটা দীর্ঘ সময় নয়। এ অল্প সময়েই সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব-শয়তানি চক্র এ ইসলামী বিপ্লবের প্রতি নানাভাবে তাদের মাত্রাতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। এর কারণ হিসেবে অনেকে মনে করেন, শত শত বছর ধরে এই শোষক পুঁজিবাদী গোষ্ঠী বিশ্বের তাবৎ জনগোষ্ঠীর চোখে ধুলা দিয়ে বিশ্বকে একচেটিয়াভাবে শোষণ করে আসছিল; ইরানের ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের কারণে যেন তাতে ছেদ পড়ল। বিশেষ করে বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-এর সময়োপযোগী, জাগরণী ও সুনির্দিষ্ট তথ্যবহুল বক্তৃতাসমূহ ধীরে ধীরে যখন মানুষের চোখ খুলে দিচ্ছিল তখনই এই বিশ্বলুটেরা গোষ্ঠী এ বিপ্লব ও তার নেতার প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। বিশ্বব্যাপী তাদের নিয়ন্ত্রিত সকল মিডিয়া ও তাদের দোসরদের মাধ্যমে ইসলামী বিপ্লব ও ইসলামী প্রজাতন্ত্রকে তারা পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার প্রচেষ্টা চালালো। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদীদের সকল হিসাবকে ভুল প্রমাণ করে এ বিপ্লব স্ব মহিমায় এগিয়ে যাচ্ছে।

ইরানে ইসলামী বিপ্লব সংঘটনের পর থেকে যেসব বাধার সম্মুখীন হয় তার মধ্য থেকে কয়েকটি এখানে তুলে ধরা হল :

১. অপপ্রচার : ইসলামী বিপ্লব ও তার নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে অপপ্রচার চালিয়ে বিকৃত চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। যেমন :

ক.      ইসলামী বিপ্লব ইরানকে একটি পশ্চাদপদ দেশে পরিণত করেছে;

খ.       বিপ্লবী ইরান ইসলামের উদারনীতির বিপরীত একটি উগ্র ধারা গড়ে তুলেছে;

গ.       ইরান (রাজা-বাদশাহ শাসিত তথাকথিত আধুনিক) আরব দেশগুলোতে আগ্রাসন চালিয়ে এ দেশগুলোকে দখল করবে;

ঘ. ইরানের পরমাণু সক্ষমতা অর্জন ও মিসাইল প্রযুক্তির অগ্রগতি প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য হুমকি (যদিও ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি কেবল শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে নিবেদিত);

ঙ.       ইরান পুরাতন পারস্য সাম্রাজ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাবে;

চ.       ইরানের বিপ্লব একটি শিয়া বিপ্লব যার লক্ষ্য বিশ্বব্যাপী শিয়া সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা;

ছ.       শিয়ারা মুসলমান নয়; বরং তারা একটি ভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী, একটি বিভ্রান্ত সম্প্রদায়; শিয়ারা ইহুদিদের দোসর;

জ.      এ বিপ্লব নারী অধিকার পদদলিত করছে;

ঝ.      এ বিপ্লব গণতন্ত্র, মানবতা ও বাক-স্বাধীনতার বিরোধী।

২. অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা : ইরানের বিপ্লববিরোধী অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীকে ব্যবহার করে বিপ্লবের প্রতি নিবেদিত অসংখ্য দেশপ্রেমিক নেতাকে গুপ্তহত্যা করা হয়। গুপ্ত হামলায় ১৯৭৯ সালের ১ মে আয়াতুল্লাহ মোতাহ্হারীর শাহাদাত, ১৯৮১ সালের ২৮ জুন ড. বেহেশতী সহ ৭২ জন নেতার শাহাদাত, ১৯৮১ সালের ৩০ আগস্ট প্রেসিডেন্ট রাজাই ও প্রধানমন্ত্রী বাহোনারের শাহাদাত এ ষড়যন্ত্রেরই অংশবিশেষ। বিপ্লবের প্রথম দশকে বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. মোস্তফা চামরান (১৯৮১) ও সাম্প্রতিককালে চারজন পরমাণু বিজ্ঞানী গুপ্তহত্যার শিকার হন। জুন্দুল্লাহ বাহিনীর গুপ্তঘাতকের পেতে রাখা বোমায় শহীদ হন জেনারেল নূর আলী শুশ্তারী। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের পূর্বে ও পরে এ বিপ্লবের সফলতার জন্য প্রাণ দেন লক্ষাধিক মানুষ।

৩. হত্যা ও আগ্রাসন : বাথপন্থী জল্লাদ চরিত্রের সাদ্দামকে দিয়ে ইরানের ওপর আগ্রাসন চালিয়ে আট বছর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ অব্যাহত রাখা হয়। ইরানের বাইরে অনেক ইরানী নেতাকে হত্যা ও গুম করা হয়। এ যুদ্ধে প্রায় দুই লক্ষ ইরানী দেশপ্রেমিক শহীদ হন। ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে পারস্য উপসাগরে ইরানী এয়ারবাস বিধ্বস্তকরণ (১৯৯০) – যে হামলায় ২৯২ জন যাত্রী নিহত হন, মার্কিন গুপ্তচরদের উদ্ধার করার জন্য ইরানের তাবাস মরুভূমিতে অভিযান (২৫ এপ্রিল, ১৯৮০) এবং মক্কায় হারাম এলাকায় তিন শতাধিক হাজীকে শহীদ করা (১৯৮৭) এসব আগ্রাসনেরই অংশ ছিল।

৪. বিপ্লবের নেতৃবৃন্দের মাঝে দ্বন্দ্ব সৃষ্টির প্রয়াস : ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিভিন্ন নেতার মাঝে কাউকে কট্টরপন্থী, কাউকে উদারপন্থী বলে প্রচার করে তাঁদের মাঝে বিরোধ সৃষ্টির চেষ্টা চালানো এবং বহির্বিশ্বে তা ফলাও করে প্রচার করা হয়।

৫. পণ্য আমদানিতে বাধা : বিজ্ঞান ও প্রকৌশলগত গবেষণার জন্য অতীব প্রয়োজনীয় সামগ্রী, বিমান ও অন্যান্য বাহন ও যন্ত্রপাতির স্পেয়ার পার্টস ইত্যাদি (যখন ইরান এসবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয় নি) ইরানে আমদানি করতে বাধা দেয়া হয়। একইভাবে বাণিজ্যিক লেনদেনেও বাধা দেয়া হয়।

৬. শিয়া-সুন্নি বিরোধ উস্কে দেয়া : দেশে দেশে শিয়া-সুন্নি বিষয়টিকে ইস্যু বানানো হয়। এমনকি বিভিন্ন দেশে শিয়াদের ও ইরানী কুটনীতিকদের গুপ্তহত্যা করা হয়। যেসব দেশে ৭০ : ৩০, ৬০ : ৪০, ৮০ : ২০ অনুপাতে শিয়া-সুন্নি জনসংখ্যা বিরাজ করছে সেখানে সুন্নি জনগোষ্ঠী ও নেতৃবৃন্দকে শিয়াদের সাথে শত শত বছর ধরে চলে আসা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও যৌথ ব্যবসায়ে বাধা দেয়া হয়। শিয়াদের সাথে না মিশতে ভীতি প্রদর্শন করা হয়, এমনকি শিয়াদের সাথে যৌথ সরকারে বা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করলে হুমকি প্রদান ও তাদের ওপর হত্যাকাণ্ডও চালানো হয় (ইরাক, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে)।

৭. বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডে বাধা প্রদান : পারমাণবিক ও অন্যান্য বৈজ্ঞানিক সক্ষমতা অর্জনে বাধা দেয়া হয়। এতে সফল না হওয়ায় ‘ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরি করছে’ এই মিথ্যা অভিযোগের ধুয়া তুলে ইরানের প্রতি অব্যাহত অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হয় এবং ইরানে আগ্রাসন চালানোর হুমকি দেয়া হয়। ড্রোন গোয়েন্দা বিমান পাঠিয়ে ইরানের প্রতিরক্ষা ও অন্যান্য সক্ষমতা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য ইরানের সীমানা অতিক্রমের চেষ্টা করা হয়। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) পক্ষ থেকে নিয়মিত পরিদর্শনে আগত পরিদর্শকদলের কাছ থেকে ইরানের বিভিন্ন কৌশলগত স্থানের চিত্র ও তথ্য হস্তগত করার চেষ্টা করা হয়- যে সম্পর্কে ইরান অনেক বার অভিযোগ করেছে।

৮. সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য ইরান ও ইসলামপন্থীদের দায়ী করা : বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন জনপদে সামা্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী তাদের ভাড়াটে লোকদের দিয়ে বোমা হামলা চালিয়ে কাজটি ইরান করেছে বলে প্রচার করে এবং এজন্য ইরানকে অভিযুক্ত করার চেষ্টা চালায়। নাইন-ইলেভেনের ঘটনা এবং এর ধারাবাহিকতায় ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা এর সবচেয়ে বড় ঘটনা।

৯.  বিশ্বে ইসলামকে কদর্য রূপে তুলে ধরা : সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী ও তাদের বাদশাহী দোসরদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে মুসলমানদের স্বল্পজ্ঞানী ও স্বল্প তথ্যজ্ঞানসম্পন্ন মোটা বুদ্ধির মোল্লাদের দিয়ে আল-কায়েদা, তালেবান, সিপাহে সাহাবা ইত্যাদি বিভিন্ন নাম দিয়ে বিভিন্ন জঙ্গীবাদী গ্রুপ তৈরি করা হয়। এসব গ্রুপের নামে বিভিন্ন দেশে (প্রায় সবগুলোই মুসলিম দেশে) নিরীহ মানুষদের হত্যা করা, ঐতিহাসিক নিদর্শন ধ্বংস করা, ইসলাম ও মহানবী (সা.)-এর স্মৃতি বিজড়িত স্থানসমূহের চিহ্ন ধ্বংস করা, নারীশিক্ষা বন্ধ করা, টেলিভিশন দেখা বন্ধ করা ও অনুরূপ কাজ করে ইসলাম ও মুসলমানদের সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী এক বিকৃত চিত্র প্রকাশ করা হয় এবং ভীতি সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়। এসব উদ্দেশ্যমূলক জঙ্গী ঘটনার ডামাডোলে বেছে বেছে মেধাবী ইসলামী ব্যক্তিত্বদের হত্যা করা হয়।

১০. তথ্যের অবাধ প্রবাহে বাধা দান : ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের নেতৃবৃন্দের বাণী, বক্তব্য, বিভিন্ন ডকুমেন্ট অন্যান্য দেশে বিশেষ করে গণমাধ্যমসমূহে প্রচারে বাধা দেয়া হয়। নিতান্তই কিছুটা প্রচার করলেও তা বিকৃতভাবে প্রচার করা হয়।

১১. তথাকথিত নেতৃত্বের প্রচারণা : ইরানের ইসলামী বিপ্লবের নেতৃত্বের আবহ যেন অন্যান্য মুসলিম দেশে না পড়ে সেজন্য সাদ্দাম, গাদ্দাফী, মাহাথির মোহাম্মদ, লাদেন, মোল্লা ওমর, আইমান আল-জাওয়াহিরি প্রমুখ ব্যক্তিদের নিয়ে সারা বছর ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে মিডিয়া কভারেজ দেয়া হয় এবং তাদের বক্তব্য হিসেবে সর্বদা রণহুঙ্কারের তথ্য প্রচার, অন্যান্য ধর্মের লোকদের হত্যা করার ঘোষণা, অন্যান্য দেশের স্থাপনায় হামলার ঘোষণা মিডিয়ায় ফলাও করে আসতে থাকে। অথচ আজ পর্যন্ত ঐসব ব্যক্তির কোনো কর্মসূচি, মেনিফেস্টো, ফলো-আপ বিশ্ববাসী দেখে নি। এরা সবসময়ই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের তথাকথিত ছায়াশত্রু। এদের হুমকি ও আক্রমণের ছুতা দেখিয়ে মুসলমানদের বিভিন্ন স্থান ও সম্পদ দখল করাই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চিরাচরিত কর্মপদ্ধতি।

১২. ইরান-বিরোধী চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা : ইতিমধ্যে হলিউড সহ পাশ্চাত্যের বিভিন্ন চলচ্চিত্রধারায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ চরিত্র চিত্রায়িত করে প্রচুর ইরান-বিরোধী চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে। এর সর্বশেষ উদাহরণ হল হলিউড নির্মিত চলচ্চিত্র অজএঙ। একইভাবে প্রচুর পুস্তক-সাময়িকীর মাধ্যমে, এমনকি উচ্চতর অ্যাকাডেমিক গবেষণা (চয.উ) থিসিসের মাধ্যমেও ইরানের ইসলামী বিপ্লব ও এর নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে বিকৃত ও ভুল তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে।

ইরানের ইসলামী বিপ্লবের বিরুদ্ধে উপরিউক্ত পদ্ধতিতে বাধার প্রাচীর সৃষ্টি করা ছাড়াও আরো বহুমুখী পদ্ধতিতে ইরানের এ বিপ্লবের প্রতি নেতিবাচক আচরণ করা হয়।

এবার আমরা ইসলামী বিপ্লব সংঘটনের পর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বলয়ে যে মৌলিক সাফল্যগুলো অর্জন করেছে সেগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরছি :

১. ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা : ১৯৭৯ সালে মহান আল্লাহর সার্বভৌমত্বের মূলনীতির ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ গণভোটে ৯৮% ভোট পেয়ে ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং গত ৩৩ বছরে বিভিন্ন পর্যায়ে ৩০টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ সহ সব ধরনের Infrastructure-ই আধুনিক ইসলামী প্রজাতন্ত্রে বিদ্যমান। ইরানে বিচার বিভাগ সম্পূর্ণই স্বাধীন। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান কুরআন-সুন্নাহ ও আহলে বাইতের শিক্ষার ওপর প্রতিষ্ঠিত।

২. নাগরিক সুবিধা প্রদান : ইসলামী ইরানে সকল মানুষ সকল মৌলিক নাগরিক সুবিধা – খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, মত প্রকাশের সুবিধাদি ভোগ করছে। বর্তমানে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রত্যেক নাগরিক মাসিক ৪৫,০০০ তুমান করে নিয়মিত ভাতা পাচ্ছে। স্বল্প আয়ের জনগণ কম খরচে ও ঋণসুবিধা পেয়ে গৃহের মালিক হচ্ছে। নববিবাহিতরা গৃহায়ণ ঋণ পাচ্ছে। বিপ্লবের পর পরই প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, পানি, স্কুল-কলেজ ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে তাৎক্ষণিক নাগরিক সুবিধা পৌঁছে দেয়া হয়েছে।

৩. সামাজিক নিরাপত্তা ও ইসলামী পরিবেশ : ইরান বর্তমান বিশ্বে একটি বিরল রাষ্ট্র যেখানে জনগণ বিশেষ সামাজিক নিরাপত্তা ভোগ করছে। দিনে-রাতে সর্বক্ষণ সকল নারী-পুরুষ নিরাপদে রাস্তাঘাটে চলাচল করতে পারে। শালীন পোশাক, নারীর হিজাব মেনে চলা ও প্রচারমাধ্যমে অশ্লীলতার চিহ্ন না থাকায় অপরাধপ্রবণতা সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে।

৪. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অসামান্য সাফল্য : একের পর এক যুদ্ধ, অবরোধ, পাশ্চাত্যের অসহযোগিতা, হুমকি ও সর্বশেষ সাম্প্রতিক বিশেষ অর্থনৈতিক অবরোধের মুখে দেশের সর্বোচ্চ ধর্মীয়-রাজনৈতিক নেতার নির্দেশে ইরানের বিজ্ঞানীরা চরম আত্মত্যাগ ও সাধনার পরিচয় দেয়ায় দেশটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে শনৈ শনৈ উন্নতি করছে (যার সংক্ষিপ্ত খতিয়ান এ নিবন্ধের শেষে সংযুক্ত করা হয়েছে)। বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে ইরানের বিজ্ঞানীদের অগ্রগতি বর্তমানে সমগ্র বিশ্বের বিজ্ঞানীদের গড় অগ্রগতির ১১ গুণ দ্রুততর। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে স্বল্পতম সময়ে তারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বিশ্বের প্রথম ৫টি দেশের মাঝে স্থান করে নেবে। (শান্তিপূর্ণ কাজে ইরানের বিজ্ঞান গবেষণা কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে Iranian Technology for Peace and Human Prosperity সংস্থার রয়েছে ওয়েবসাইট http://diplotech.isti.ir/)

৫. দ্বীনের আলোকে সাংস্কৃতিক বিপ্লব : ইরানের ইসলামী বিপ্লবের পর অনেক ইসলামপন্থী ও সেকুলার জনগণ মনে করেছিল যে, ইরান বোধ হয় ইসলামের প্রথম যুগের উমাইয়্যা ও আববাসী খলিফাদের মতো রাজ্যজয় ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করবে এবং একের পর এক অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন ভূখণ্ডে ইসলামী হুকুমত কায়েম করবে। কিন্তু ইরানীরা, তাদের ভাষায়, প্রকৃত মুহাম্মাদী ইসলাম-তারা মহানবী (সা.)-এর আহলে বাইতের ইমামদের রেওয়াইয়াত ও জীবন থেকে যার শিক্ষা নিয়েছে-সে ধারায় বিশ্বাসী। তারা রাজ্যজয় ধরনের কোনো জবরদস্তিমূলক হুকুমত কায়েমের ধারায় বিশ্বাস করে না। তারা মহানবী (সা.) ও তার আহলে বাইতের শিক্ষা ও কুরআনের সংস্কৃতির বিকাশ করতে চায় এবং প্রকৃত ইমাম ও রাহবারের নেতৃত্বে জীবনকে ঢেলে সাজাতে চায়, আর সে আলোকে একটি সমাজ যদি সত্যিই পরিপুষ্টতা (maturity) লাভ করে তাহলে স্বাভাবিক গতিতে জনগণের মাধ্যমে রাষ্ট্রব্যবস্থায় ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। আর একবার যদি সঠিক যোগ্যতাসম্পন্ন মুজতাহিদের অধীনে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে অভ্যন্তরীণ শত্রু (মুনাফিক) ও বহিঃশত্রুর হাত থেকে তার প্রতিরক্ষা করা তাদের দৃষ্টিতে ফরয হয়ে দাঁড়ায়।

ইরানে ইসামী বিপ্লব সংঘটনের পর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান ধর্মের আলোকে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে গঠন করতে যেসব নিয়মিত কার্যক্রম চালু করে তার কয়েকটি হল-

ক. এ ধারায় ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সারা দেশে ও বহির্বিশ্বে সকল বয়সী ও সকল পেশার মানুষের মাঝে কুরআন শিক্ষা প্রোগ্রাম ছড়িয়ে দিয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে কুরআন তেলাওয়াত ও হিফ্য প্রতিযোগিতার আয়োজন ও অংশগ্রহণ ব্যাপক করেছে। কুরআনের বিভিন্ন কাহিনীনির্ভর চলচ্চিত্র ও সিরিয়াল তৈরি করেছে। যেমন : মারইয়াম মুকাদ্দাসা, মুল্‌কে সুলায়মান, হযরত ইউসুফ, মারদানে আনজালোস (আসহাবে কাহাফ এর ঘটনা অবলম্বনে) ইত্যাদি। ইরান প্রতি রমযানে আন্তর্জাতিক কুরআন প্রদর্শনীর আয়োজন করে যাতে কুরআনবিষয়ক গবেষক, লেখক, ক্যালিগ্রাফি-শিল্পী ও হাফেয-ক্বারীগণের সরব উপস্থিতি থাকে। এছাড়া বিষয়ভিত্তিক, কাহিনীভিত্তিক, শব্দভিত্তিক কুরআনিক সফ্টওয়্যার তৈরি করেছে।

খ. সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ কার্যক্রম : রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে ও প্রতিটি প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি পর্যায়ে এ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এজন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে বাসিজ (গণসংগঠন) রয়েছে – যারা সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রমের পাশাপাশি বিনোদন, চলচ্চিত্র, ডকুমেন্টারী প্রদর্শন ইত্যাদির মাধ্যমে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ কার্যক্রম চালিয়ে থাকে। জাতির ক্রান্তিকালে তারা গণসংযোগের মাধ্যমে নাগরিকদের কর্তব্য নির্ধারণে পরামর্শ দিয়ে থাকে।

গ. হিজাবের সংস্কৃতি : ইরানী নারীদের হিজাবের মডেলটি এখন বিশ্বব্যাপী মুসলিম নারীদের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি অনেক দেশে কিছুসংখ্যক অমুসলিম নারীও আজকাল এ ধরনের হিজাব পরছেন। এটি নারীদের মাঝে এক সাংস্কৃতিক বিপ্লব। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালত, খেলাধুলা – সর্বত্র হিজাব পরে নারীর স্বচ্ছন্দ গতিময় চলাফেরা বিশ্বব্যাপী নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় এক উন্নত মডেল উপস্থাপন করেছে।

ঘ ইরানী চলচ্চিত্র, পেইন্টিং, ফটোগ্রাফি, ভাস্কর্য ইত্যাদি : মানুষের সুকৃতি আচরণকে বিকশিত করার জন্য ইরান সকল শিল্পমাধ্যমকেই ব্যবহার করছে। আর ইরানীরা এসব ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা ও প্রদর্শনীসমূহে অংশগ্রহণ করে শুধু স্বদেশের জন্য সম্মানই বয়ে আনছে না; বরং সকল মুসলমানের পক্ষ থেকে এক শক্তিশালী প্রতিনিধিত্ব করছে। ইসলাম সুস্থ ও মানবিক চিন্তার বিকাশের পথে সাংস্কৃতিক চর্চার বিরোধী তো নয়ই, বরং সংস্কৃতির উন্নত সংস্করণ উপহার দিতে সক্ষম – এটাই প্রমাণ করেছে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান। অশ্লীলতা ও উগ্রতাবর্জিত ইরানী আর্ট ফিল্ম ও অ্যাকশন ফিল্ম আজ বিশ্ববিখ্যাত।

৬. প্রতিরক্ষায় স্বনির্ভরতা ও স্বয়ংসম্পূর্ণতা : ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান অত্যাধুনিক প্রযুক্তির প্রতিরক্ষা সামগ্রী তৈরি করে তার জল, স্থল, আকাশপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আত্মরক্ষামূলক, আক্রমণাত্মক নয়। আজ পর্যন্ত ইরান তার প্রতিবেশী বা দূরবর্তী কোনো দেশে নিজ থেকে আক্রমণ করেছে এমন কোন নজির নেই। ইরানের প্রচলিত ও অপ্রচলিত অনেক যুদ্ধকৌশল রয়েছে যা বহিঃশত্রু আক্রমণ করলেই টের পাবে। ইরানের প্রতিরক্ষা ও সামরিক সক্ষমতা সম্পর্কে পশ্চিমা শক্তির অনেকটা ধারণা রয়েছে। এ কারণেই বিগত ৩৩ বছরে শত বার হুমকি দিয়েও তারা ইরানকে আক্রমণের সাহস করে নি। পাশ্চাত্য ইরানের সাথে অর্থনৈতিক, কৌশলগত, মিডিয়াগত ইত্যাদি এককথায় একটি soft war-এ লিপ্ত রয়েছে।

৭. ইসলাম ও মানবতার বড় শত্রু চিহ্নিত করা : ইসলামী ইরান বিপ্লবের শুরু থেকেই তার নিজস্ব গণমাধ্যম, সাময়িকী ও আন্তর্জাতিক ফোরাম ও আন্তর্জাতিক সম্মেলনসমূহে ইসলাম ও মানবতার অভিন্ন শত্রুকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, সাম্রাজ্যবাদী, পুঁজিবাদী, যায়নবাদী ও বর্ণবাদী আগ্রাসী শক্তিসমূহের অপরাধের খতিয়ান ইরান জাতিসঙ্ঘের অধিবেশনসমূহে ও আন্তর্জাতিক আদালতে (হেগে) লিখিতভাবে ডকুমেন্টেড করেছে। ইরান কোনো আন্তর্জাতিক ফোরাম বর্জন করে নি। বরং জাতিসঙ্ঘ, ওআইসি, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন, ডি-৮ সম্মেলন, ওপেক ও ECO সহ সকল ফোরামে ইরান সক্রিয় ও গঠনমূলক ভূমিকা পালন করে স্বীয় ন্যায্য অধিকার আদায়ের ও মানবতার উন্নয়নের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

৮. বিশ্বে মার্কিন নিয়ন্ত্রিত একমেরু (Unipolar) রাজনীতি রুখে দেয়া : মার্কিন-ব্রিটেন যায়নবাদী গোষ্ঠীর একমেরুভিত্তিক রাজনৈতিক হিসাবকে ইরান ভুল প্রমাণ করেছে। অবশ্য এ অবস্থাটি অর্জন করতে ইরানকে অনেক প্রচেষ্টা চালাতে হয়েছে। মৌলিক আদর্শের বিতর্কে না জড়িয়ে মানবতা, সুস্থ সংস্কৃতি, সমানাধিকার, ন্যায়বিচার ও বাণিজ্যিক লেনদেনের বিষয়গুলোকে ভিত্তি করে ভারত, চীন, রাশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকার বামপন্থী সরকারগুলোর সাথে ইরান ব্যাপক কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তুলেছে যার ফলে ঐ সব দেশ স্ব স্ব অবস্থানে ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফেরামে আমেরিকার একক পরাশক্তি হওয়ার খায়েশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে এবং তার Unipolar প্রভাবকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে।

৯. অন্যান্য দেশের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন : ইরান মধ্যপ্রাচ্যের ও আফ্রিকার আরব দেশসমূহ ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর সাথে ব্যাপক সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। এর ফলে সেসব দেশ আজ আন্তর্জাতিক কোনো ফোরামেই ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বিরোধিতায় অবতীর্ণ  হচ্ছে না। এসব সম্পর্কের ব্যাপক সুফল রয়েছে। সুদান, গাম্বিয়া ও লেবানন সহ বেশ কয়েকটি দেশের সাথে ইরানের রয়েছে ব্যাপক ও দীর্ঘমেয়াদী বাণিজ্যিক, সমাজকল্যাণমূলক ও প্রতিরক্ষা চুক্তি। সুদান ও লেবানন তো হিজাব সহ সামাজিক অনেক বিষয়ে ইসলামী প্রজাতন্ত্রকে অনুসরণ করছে।

১০. ইরাক, ফিলিস্তিন, লেবানন ও আফগানিস্তানের শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদান ও এর সুফল : আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন ও ইরাকে সাদ্দামের নির্যাতনে সব মিলিয়ে প্রায় ৫০ লক্ষ শরণার্থী বছরের পর বছর ধরে ইরানে অবস্থান করেছে। ইসলামের মানবিক সাহায্যের শিক্ষা অনুসরণ করে ইরান তাদের আশ্রয় দিয়েছে। আর তারা অন্যান্য দেশের শরণার্থীদের মতো কোনো শরণার্থী শিবিরে আটক ছিল না; বরং তারা সর্বত্র বিচরণ, শিক্ষা, ব্যবসা, কর্মসংস্থানেরও ব্যাপক সুযোগ পেয়েছে। আর সেই সাথে হয়েছে ইরানের বিপ্লবীদের সাথে তাদের চিন্তাগত বিনিময়। বর্তমানে এদেরই বিরাট অংশ ইরাক ও আফগানিস্তানে ব্যাপক প্রভাবশালী ভূমিকায় রয়েছে। ফিলিস্তিনি ও লেবাননি বহু নেতা দীর্ঘদিন ইরানে থাকাকালে ইরানের ইসলামী বিপ্লব থেকে অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। ইরানের ধর্মীয় আধ্যাত্মিক নেতৃবৃন্দের সাথে তাঁদের সখ্য গড়ে উঠেছে।

১১. আল্-কুদ্‌স ও ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে ইরানের ভূমিকা : ইরানে ইসলামী বিপ্লব সংঘটনের পর এ বিপ্লবের নেতৃবৃন্দ যে আন্তর্জাতিক ও ধর্মীয় ইস্যুতে তাঁদের চিন্তা ও প্রচেষ্টাকে সর্বাধিক পরিমাণে নিয়োজিত করেছেন তা হচ্ছে ফিলিস্তিন ইস্যু। বিপ্লবের পর থেকেই ফিলিস্তিনিদের মানবিক ও অন্যান্য কৌশলগত ক্ষেত্রে ইরানই সর্বাধিক সাহায্য প্রদান করেছে। ইরানের বিপ্লবী নেতাদের অনুপ্রেরণায়ই ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের বিরাট অংশ আপোসের পথ পরিহার করে শক্তিশালী ইন্তিফাদা গড়ে তোলে; গড়ে ওঠে বিপ্লবী সংগঠন হামাস। ফিলিস্তিনীদের পক্ষে ইরানের পাশাপাশি শক্তিশালী সাহায্যে এগিয়ে আসে লেবাননের হিজবুল্লাহ ও সিরিয়ার সরকার। ফিলিস্তিনিরা শক্তি ও সাহস পুনঃসঞ্চয় করে যায়নবাদী ইসরাইলের মোকাবিলায় টিকে আছে ও শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। ২০০৬ সালে ইসরাইল দক্ষিণ লেবানন থেকে হাত গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়। পরবর্তীকালে লেবাননের হিজবুল্লাহর সাথে (২০০৬) ৩৩ দিনের যুদ্ধে, হামাসের সাথে ২২ দিনের (২০০৮-২০০৯)  যুদ্ধে ও সর্বশেষ গাজায় হামলা চালিয়ে ৮ দিনের (২০১২)  বেশি টিকে থাকতে পারে নি। আর এ কথা কে না জানে যে, ফিলিস্তিনি ও লেবাননিরা এক্ষেত্রে ইরান থেকে নৈতিক, আধ্যাত্মিক, মানবিক, রাজনৈতিক ও বস্ত্তগত ব্যাপক সাহায্য লাভ করে থাকে। আর এটি ফিলিস্তিন ও লেবাননের নেতারা অকপটে স্বীকার করেন। ফিলিস্তিন ও আল্-কুদ্‌স মুক্তির জন্য ইমাম খোমেইনী রমযানের শেষ শুক্রবারকে বিশ্ব আল্-কুদ্‌স দিবস ঘোষণা করেছেন এবং কুদ্‌স দিবসের বিশেষ কর্মসূচি দিয়েছেন। এ কথা আজ দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, ইরানের ইসলামী বিপ্লবের সাফল্য ও ফিলিস্তিনিদের জন্য এ বিপ্লবের সর্বাত্মক সাহায্যের জন্যই এ বিপ্লবের পর ইসরাইল তার সীমানা একটুও সম্প্রসারিত করতে পারে নি। অথচ ইসরাইলের নীল থেকে ফোরাত পর্যন্ত সম্প্রসারিত ইহুদিবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা ছিল।

১২. ধর্মের মূলে ফিরে আসার জন্য ইসলামী বিপ্লবের অবদান : ইরানে ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের পর থেকেই বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেইনী (রহ্.) বিশ্ববাসীকে কুরআন, সুন্নাহ ও আহলে বাইতের প্রদর্শিত প্রকৃত ইসলামে ফিরে আসার জন্য উদাত্ত আহবান জানান। ইমাম খোমেইনী তাঁর ইন্তেকালের আগেও তাঁর অসিয়তনামায় এ আবেদন জানান। এ প্রসঙ্গে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ দিবস ও উপলক্ষগুলোকে বিশ্বব্যাপী উদ্‌যাপন কার্যক্রমের উজ্জীবন ঘটান। এ উপলক্ষে ইরানে ও বহির্বিশ্বে আন্তর্জাতিক সম্মেলন, সফর বিনিময়, স্মারক ও সাময়িকী প্রকাশনার আয়োজন করা হয়। যেসব উপলক্ষকে কেন্দ্র করে ইসলামী ইরান ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করে তা হল :

ক.      হজ : হজ বিশ্ব-মুসলিমের সর্ববৃহৎ আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক সম্মেলন। হজের সময় কা‘বায় তাওয়াফ, আরাফাতে অবস্থান, মীনায় কুরবানী, পাথর নিক্ষেপ, মদীনায় মহানবী (সা.)-এর রওজা মুবারক যিয়ারত ইত্যাদি কার্যক্রমকে জীবন্ত করতে, নিছক যিকিরের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রাখতে ও প্রকৃত চেতনার স্ফুরণ ঘটাতে ইসলামী বিপ্লবের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা হাজীদের উদ্দেশে প্রতি বছর সময়োপযোগী গুরুত্বপূর্ণ বাণী প্রদান করেন। ইরানের হজ মিশনের উদ্যোগে আন্তর্জাতিকভাবে মক্কায় বারাআত-এর (মুশরিকদের সাথে সম্পর্কোচ্ছেদ সম্পর্কিত কুরআনের আয়াতের) চেতনা উজ্জীবনের সমাবেশ করা হয়। মহানবী (সা.) কর্তৃক মদীনায় আনসার ও মুহাজিরদের ভ্রাতৃত্ববন্ধনের স্মরণে ওয়াহ্দাত বা ঐক্য সম্মেলন আয়োজন করা হয়। বিশ্বের সব মুসলমানকে সচেতন করতে তাঁরা সুশৃঙ্খলভাবে এসব কার্যক্রম চালিয়ে থাকেন।

খ.       ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদ্‌যাপন উপলক্ষে ১২-১৭ রবিউল আউয়াল সপ্তাহব্যাপী ইসলামী ঐক্য সপ্তাহ উদ্‌যাপন করে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান বিশ্বব্যাপী ইসলামী ঐক্য সুদৃঢ় করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এ উপলক্ষে মহানবী (সা.)-কে কেন্দ্র করে সকল মুসলমানের মাঝে ঐক্য গড়ে তোলার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সম্মেলনেরও আয়োজন করা হয় এবং বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালার মধ্য দিয়ে ঈদে মিলাদুন্নবী উদ্‌যাপন করা হয়।

গ.       আশুরা উদ্‌যাপন : মুসলমানদের প্রকৃত ইসলামী সত্তায় ফিরে আসার চেতনা জাগ্রতকারী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে কারবালায় নবী-দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর সঙ্গীদের শাহাদাত। ইমাম খোমেইনী (রহ.) বলেন : ‘আমাদের যা কিছু অর্জন তার সবই মুহররম ও সফর থেকে।’ ইরানের ইসলামী বিপ্লবে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের চালিকাশক্তিও ছিল এই কারবালার হুসাইনী চেতনা। তাই ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান স্বদেশে ও বিদেশে সর্বত্র মুহররমের ১-১২ তারিখ পর্যন্ত আশুরার শাহাদাতের প্রেক্ষাপট, ঘটনাপ্রবাহ ও শিক্ষা সম্পর্কে আলোচনা ও শোকানুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে।

ঘ.       রমযান মাসে বিশ্বব্যাপী ইরানী ক্বারীগণ সফর করেন ও দেশে দেশে কুরআন প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়।

ঙ.       এসব দিবস ও ধর্মীয় উপলক্ষগুলোকে যথাযথ মর্যাদা সহকারে উদ্যাপনের পাশাপাশি পবিত্র কুরআন, মহানবী (সা.) ও অন্যান্য নবীর মর্যাদায় ও ইসলামের ভিত্তিমূলে আঘাতকারী বইপুস্তক, চলচ্চিত্র ও অন্যান্য ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতার বিরুদ্ধে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সর্বদাই সোচ্চার ভূমিকা পালন করে থাকে। সালমান রুশদীর ‘শয়তানের পদাবলি’ (Satanic Verses) উপন্যাসের জন্য ইমাম খোমেইনী কর্তৃক (১৯৮৯) তাকে মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া বিশ্ব-মুসলিমকে জাগরিত ও ঐক্যবদ্ধ করেছিল।

১৩. ইসলামী জাগরণ বনাম আরব বসন্ত : ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের পর থেকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান এ বিপ্লবের নেতৃবৃন্দ ও বিশ্বব্যাপী এর সমর্থক ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা ইসলামী প্রজাতন্ত্রের আহবানে উপরিউক্ত কর্মসূচিগুলো অব্যাহত রাখেন। ধীরে ধীরে এসব চেতনা বিশ্ব-মুসলমানের চোখ খুলে দেয়, চেতনা জাগ্রত করে, দেশে দেশে গড়ে ওঠে ইসলামের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম। এরই ফলশ্রুতিতে মানুষের মাঝে মূল ইসলামে ফিরে যাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা এবং জালেম, ভণ্ড ও পাশ্চাত্যের সেবাদাস সরকারগুলোর প্রতি ঘৃণা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। মুসলমানরা ইসলামের চেতনায় জেগে ওঠে। কিছু কিছু আরব দেশে যে নামকাওয়াস্তে পার্লামেন্ট রয়েছে সেসব প্রতিকী পার্লামেন্টেও ইসলামপন্থীরা ব্যাপক আসন পায়, কোথাও কোথাও স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান দানা বাঁধে। অবশেষে তিউনিসিয়া, মিসর, ইয়েমেন ও লিবিয়ায় স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে জনগণ মাঠে নামে। পাশ্চাত্য যায়নবাদী পক্ষ ও তাদের প্রচারমাধ্যমসমূহ আরব জনগণের এহেন ইসলামী চেতনাসমৃদ্ধ জাগরণকে তাৎক্ষণিকভাবে ‘আরব বসন্ত’ বলে অভিহিত করে প্রচার চালায় এবং পাশ্চাত্য মাধ্যমগুলো তড়িঘড়ি করে প্রচেষ্টা চালায় যাতে সেসব দেশে তাদের দোসর ব্যক্তিরাই ভোল পাল্টিয়ে বিপ্লবী সেজে নির্বাচনের মাধ্যমে বা জোট গঠনের নামে ক্ষমতা দখল করতে পারে। তবে এ প্রসঙ্গে বলা যায় যে, ভণ্ড স্বৈরশাসকদের প্রতি জনগণের ঘৃণা প্রকাশ, অভ্যুত্থানকারীদের অধিকাংশেরই ইসলামপন্থী হওয়া, স্বৈরাচারীদের ইতিমধ্যে অনেকেরই পতন হওয়া – এসব মিলিয়ে ইসলামী জাগরণ একটি পর্যায় অতিক্রম করেছে। আশা করা যায় যে, পরবর্তী ভণ্ডরাও মুনাফিকী করে বেশিদিন পার পাবে না। তবে অনেক ভাল নেতাকেও ভণ্ড আখ্যায়িত করে কলঙ্কিত করার প্রয়াস চালানো হবে বলে আশঙ্কা রয়েছে। অবশেষে অনেক ধাপ পার হয়ে প্রকৃত ইসলামী জাগরণ পরিণতি পাবে ইনশাআল্লাহ। ইসলামী জাগরণকে ছিনতাই করে আরব জাগরণ আখ্যা দিয়ে তারা বেশিদূর এগুতে পারবে না।

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার আরব দেশগুলোতে ইসলামী জাগরণকে ইতিবাচক ধাপ হিসেবে গ্রহণ করেছে, ইসলামী বিপ্লবের রাহবার হযরত আয়াতুল্লাহ্ ওযমা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী এসব দেশের ইসলামী নেতৃবৃন্দকে ইসলামী নেযাম বা রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করে বিপ্লব ও জাগরণকে সুসংহত রূপদান করার আহবান জানিয়েছেন। ইতিমধ্যে গত দুই বছরে রাহবারের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আলী আকবর বেলায়াতীর আহবানে ইরানে ইসলামী জাগরণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক কবি সম্মেলন, নারী সম্মেলন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষকদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ([email protected] ওয়েবসাইটে এসব সম্মেলনের Proceedings ও গবেষণাপত্রসমূহ পাওয়া যাচ্ছে।)

১৪. সফল ন্যাম সম্মেলন : গত আগস্ট ২০১২ ইরানের রাজধানী তেহরানে সফলভাবে অনুষ্ঠিত হলো জোট নিরপেক্ষ দেশগুলোর  ষোড়শ শীর্ষ সম্মেলন। পাশ্চাত্যের প্রতিক্রিয়াশীল সাম্রাজ্যবাদী কতক দেশের অপপ্রচার ও বাধার মুখেও জাতিসঙ্ঘের মহাসচিবসহ ২৭টি দেশের প্রেসিডেন্ট, ২ জন বাদশাহ, ৮ জন প্রধানমন্ত্রী, ২ জন পার্লামেন্ট স্পীকার, ৯ জন ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ১০টি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধি এ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। এ সম্মেলনের অন্যতম বিষয় ছিল ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি, পরমাণুমুক্ত বিশ্বব্যবস্থা গড়ার আহবান, সন্ত্রাসবাদের শিকড় উপড়ে ফেলা ও ইরানের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কার্যক্রমের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ঘোষণা। যায়নবাদী ইসরাইল ও তার দোসররা এ সম্মেলনের সফলতার বিরুদ্ধে কাজ করেও কিছুই করতে পারে নি।

১৫. ইরানের পরমাণু সক্ষমতা প্রসঙ্গে পাশ্চাত্যের ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা : ২০০৯ সালে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান পারমাণবিক ক্ষেত্রে সক্ষমতা অর্জন করে পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে নিজেদের অবস্থান গড়ে তোলে। এক্ষেত্রে ইরানের বিজ্ঞানীরা আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (IAEA) সকল প্রটোকল মেনেই তাদের কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। ইসফাহান, বুশেহ্র ও কোমের পরমাণু কেন্দ্রগুলোতে IAEA-এর পরিদর্শকদল তাদের রুটিন মাফিক পরিদর্শন অব্যাহত রেখেছেন। উপরন্তু ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (NPT)-তে স্বাক্ষরকারী একটি দেশ। ইরান বিদ্যুৎ উৎপাদন, চিকিৎসা ও কৃষি গবেষণার কাজে এ পারমাণবিক শক্তিকে কাজে লাগাচ্ছে। ইরান শুরু থেকেই বলে আসছে যে, তার এ পারমাণবিক প্রযুক্তির জ্ঞান অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে মুসলিম ও শান্তিপ্রিয় দেশগুলোর সাথে ব্যবহার করতে প্রস্ত্তত। এক্ষেত্রে ইরান পরমাণু প্রযুক্তি কাজে লাগাতে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে একটি ক্লাব গঠনেরও প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু শুরু থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কয়েকটি দেশ ইরানের এ শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে। তারা কল্পিত অভিযোগ এনে প্রচার চালাচ্ছে যে, ইরান পারমাণবিক গবেষণার অন্তরালে পারমাণবিক বোমা বানানোর লক্ষ্যে কাজ করছে। এসব চিৎকারে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হলো NPT-তে স্বাক্ষর করতে অস্বীকারকারী ২ শতাধিক পারমাণবিক বোমার অধিকারী ইসরাইল ও হিরোসিমা-নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপকারী আমেরিকা।

যা-ই হোক, এ কল্পিত অভিযোগের ধুয়া তুলে আমেরিকা ইরানের ওপর একের পর এক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে এবং হামলার হুমকি দিচ্ছে। আমেরিকা তার মিত্র সকল দেশকে ইরানের সাথে বাণিজ্যিক লেনদেনে বাধা দিচ্ছে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ কল্পিত অভিযোগ যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও অন্তঃসারশূন্য তা বিশ্বের অধিকাংশ পর্যবেক্ষক মহলই আজ বুঝতে পারছেন। আবার অনেক অতি উৎসাহী ইসলামপন্থীদের বলতে শোনা যায় যে, প্রতিপক্ষের সাথে শক্তির ভারসাম্য আনার জন্য ইরানের পারমাণবিক বোমা বানানো দরকার। কিন্তু তাদের জবাবে বলতে হয় যে, ইরান তো পারমাণবিক বোমার অধিকারী না হয়েও গত ৩৩ বছর দুশমনের হুমকির মুখে টিকে আছে। আর পারমাণবিক বোমার অধিকারী পাকিস্তানের জনগণ নিজ দেশেই প্রতিদিন মার্কিন ড্রোন হামলার শিকার হচ্ছে। তাই পারমাণবিক বোমার অধিকারী হওয়াই নিরাপত্তার গ্যারান্টি নয়। সর্বোপরি ইসলামী বিপ্লবের সর্বোচ্চ নেতা পারমাণবিক বোমা বানানোর বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছেন। আর ইসলামী প্রজাতন্ত্রের রাহবারের ফতোয়া যে কোনো ফাঁকা বুলি নয় তা সবারই জানা আছে। আরেকটি বিষয় হলো, আমেরিকা ও তার দোসররা এ পর্যন্ত বহু বার চাপ প্রদান করে চেষ্টা করেছে IAEA-এর প্রধানের মাধ্যমে এ মর্মে রিপোর্ট দেয়ার জন্য যে, ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম সন্দেহজনক ও পারমাণবিক বোমা তৈরি করা যেতেও পারে ইত্যাদি। কিন্তু আজ পর্যন্ত তারা সে রকম সুনির্দিষ্ট কোনো বিৃবতি লাভ করতে পারে নি। এদিকে বিগত দুটি জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন সম্মেলন ও ওআইসি সম্মেলনে সদস্যরাষ্ট্রগুলো ইরানের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কার্যক্রমের প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেছে। ইরানের পরমাণু কার্যক্রমের স্লোগান হলো : ‘Nuclear energy for all, Nuclear weapon for none.’ (ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য রয়েছে ইরানের পরমাণু শক্তি কমিশনের ওয়েবসাইট http://www.aeoi.org.ir/Portal/Home/)

১৬. প্রচারযুদ্ধে ইরান : দীর্ঘদিন ধরে সারা বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত সব প্রচারমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল বিশ্ব-যায়নবাদী চক্র নিয়ন্ত্রিত পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদ। তাই স্বাভাবিকভাবেই এসব সংবাদমাধ্যমে ইরানের প্রকৃত সংবাদগুলো ইতিবাচক কভারেজ পায় নি। তাই বিপ্লবের পর থেকেই ইরান এ সংকটে ভুগছিল। ইরানের IRIB-এর বহির্বিশ্ব সম্প্রচার কার্যক্রমে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় রেডিওর সম্প্রচার এর অভাব কিছুটা পূরণ করে। পরবর্তীকালে ইরানের ইংরেজি ভাষায় Press TV, স্পেনিশ ভাষায় হিসপান টিভি ও আরবি ভাষায় আল-‘আলাম টিভি চ্যানেল শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর প্রবল বাধার মুখে গত ৩০ বছরে ইরান তার নিজস্ব প্রচারমাধ্যম ও দেশে দেশে বন্ধুত্বের বিনিময়ে, এ নিবন্ধের শুরুতে ইসলামী ইরান সম্পর্কে বর্ণিত অপপ্রচারগুলো যে মিথ্যা তা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। দিনদিন বিশ্বব্যাপী বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হচ্ছে। মাযহাব নির্বিশেষে মুসলমানগণ ইসলামী ইরানকে তাদের সহযোদ্ধা ও সত্যের পথে নিশানবরদার হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে। এরই ফলশ্রুতিতে বিশ্বের বিভিন্ন জনপদে ইসলামী জাগরণ জোরদার হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদের জন্য এ অবস্থাটি সহ্য করা কঠিন হয়ে উঠেছে। তাই বর্তমানে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতায় যায়নবাদী ইন্ধনে কয়েকটি দেশ ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান পরিচালিত প্রেস টিভিসহ অন্যান্য চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ করলেও বিশ্বের অনেক গণমাধ্যম তাদের ওয়েবসাইট থেকে সংবাদ সংগ্রহ করছে। আজ ইসলামী বিপ্লব দীর্ঘ সংগ্রামের পর এমন একটি নতুন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ইসলামী বিপ্লবের সর্বোচ্চ নেতা ও ইরানের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের কথাগুলো, উন্নয়ন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতির সংবাদগুলো বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম নিজ উদ্যোগেই সংগ্রহ করছে। যেসব ওয়েবসাইট থেকে ইরানের সংবাদগুলো বেশি সংগৃহীত হচ্ছে সেগুলো হলো Iran Supreme Leader : http://www.leader.ir/, President : www.president.ir, Judiciary : www.judiciary.ir; Parliament: www.majlis.ir; Ministry of Culture : www.farhang.gov.ir; Foreign Ministry: www.mfa.gov.ir; Iran Broadcasting: http://www.irib.ir/, Organization of Islamic Culture and Relations: http://www.icro.ir/; Iran Tourism and International Tourism: http://www.ittic.com/; Iran News : http://www.irna.ir/, Iran Students News Agency: http://www.isna.ir/; Other News Agencies: http://www.farsnews.com/, www.presstv.com; Centre for Strategic Studies in Iran: http://www.csr.ir/, Information on Islam: http://www.itf.org.ir, [email protected], www.iqna.ir/bn, www.islamonline.com, www.tebyan.com, www. crescent-online.net, http://islamica.ir; About Imam Khomeini: www.imam-khomeini.com; Women Magazine: www.raihaneh.com; Mahjubah: [email protected]

কয়েকটি ক্ষেত্রে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের অবস্থান

          সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার : প্রত্নতত্ত্ব, ভাস্কর্য, হস্তশিল্প ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক নিদর্শনাদির সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের দিক থেকে UNESCO-এর তালিকাভুক্তিতে ইরানের অবস্থান বিশ্বে সপ্তম।

          কর্মসংস্থান : ২০০৭ সালের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী ইরানের কর্মক্ষম জনসংখ্যার ৯২.২৫% অর্থাৎ ২,১৭,৬৯,০০০ ব্যক্তির কর্মসংস্থান হয়েছে এবং বেকার রয়েছে ৭.৭৫%।

          তেল ও গ্যাসসম্পদ : ভূগর্ভস্থ রিজার্ভ তেলের পরিমাণের দিক থেকে ইরানের অবস্থান বিশ্বে পঞ্চম। রিজার্ভ গ্যাসের পরিমাণের দিক থেকে ইরান বিশ্বে দ্বিতীয় (প্রথম রাশিয়া)।

          দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য গ্যাস সরবরাহ : ১১২৯টি শহরে।

          বিদ্যুৎ উৎপাদন (২০০৬ সাল) : ২০০ মিলিয়ন কিলোওয়াট আওয়ার।

          বাঁধের সংখ্যা : ১৮৬টি সুবৃহৎ ও ৩২০টি ছোট আকারের বাঁধ। ৯১টি বৃহৎ বাঁধের মাধ্যমে ১০ বিলিয়ন কিউব মিটার পানি সরবরাহ হয়। বিশ্বে এর র‌্যাঙ্কিং তৃতীয় (প্রথম চীন, দ্বিতীয় তুরস্ক)।

          রেলপথ : প্রধান রেলপথ ৮,৮৩৭ কিলোমিটার, দ্বিতীয় স্তরে ১,৮৩৩ কিলোমিটার, বাণিজ্যিক রেলপথ (স্বতন্ত্র) ১,০০০ কিলোমিটার।

          ইন্টারনেটের ব্যবহার :  ইন্টারনেট ব্যবহারের দিক থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার মধ্যে ইরানের অবস্থান প্রথম।

          কৃষি উৎপাদন (২০০৭)

          GNP (Gross National Production) : কৃষি থেকে ১৫%।

          তেল-বহির্ভূত রফতানি সামগ্রী : কৃষি থেকে ২২%।

          কৃষিজ দ্রব্য উৎপাদন ৮৫ মিলিয়ন টন (৬২.৫ মিলিয়ন দানাশস্য, ১৩.৫ মিলিয়ন টন ফল, ৮.৬ মিলিয়ন টন গবাদিজাত ও ৪,৫৫,০০০ টন মৎস উৎপাদন।

          বৈচিত্র্যময় বাগানজাত উৎপাদনের দিক থেকে ইরানের অবস্থান বিশ্বে তৃতীয়।

          পেস্তা, জাফরান, খেজুর, ডালিম ও এপ্রিকট উৎপাদনের ক্ষেত্রে ইরানের অবস্থান বিশ্বে প্রথম।

          বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি : বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণায় ইরানের অগ্রগতি বিশ্বে দ্রুততম (Fastest) [Canadia.htmail]। বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষত মহাকাশ গবেষণা, পরমাণু চিকিৎসা ও ন্যানো টেকনোলজি গবেষণায় ইরানের অগ্রগতি ব্যাপক।  [presstv.com, ২১ অক্টোবর, ২০১১]

          ক. ন্যানো টেকনোলজি (Nanotechnology) : পঞ্চাশের অধিক ন্যানো টেকনোলজি কোম্পানি কাজ করছে। Nanotechnology সংশ্লিষ্ট বৈজ্ঞানিক গবেষণা নিবন্ধের ক্ষেত্রে বিশ্বে ইরানের অবস্থান ২৫তম এবং মধ্যপ্রাচ্যে সর্বোচ্চ। সর্বশেষ রিপোর্ট প্রকাশসাপেক্ষে, ২০১২-এর মধ্যে ন্যানো টেকনোলজিতে বিশ্বে ইরানের দশম অবস্থানে আসার সম্ভাবনা। [En.nano.ir.retrieve, 21 Oct, 2011]

          খ. মহাকাশ গবেষণা (Space and Aerospace) : মহাশূন্যে নিজস্ব প্রযুক্তিতে নির্মিত স্যাটেলাইট পাঠানোর ক্ষেত্রে ইরানের অবস্থান বিশ্বে নবম এবং মহাকাশ যানে প্রাণী পাঠানোর ক্ষেত্রে ইরানের অবস্থান ষষ্ঠ। ২০০৮ সালে Iranian Space Agency একটি তিন স্তরের স্যাটেলাইট ‘সাফির’ (Ambassador)-এর পরীক্ষা চালায় এবং ২০০৯ সালে Omid (আশা) নামের ক্যারিয়ার কক্ষপথে উৎক্ষেপণ করে। ২০১৫ সালের মধ্যে ইরান মহাশূন্যে মানুষবাহী স্যাটেলাইট পাঠানোর পরিকল্পনা করেছে।

ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের পর ইরানের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ গবেষকদের প্রতি ইসলাম ও আধুনিক বিজ্ঞানের সমন্বয়ের মাধ্যমে জাতীয় অগ্রগতির ও স্বয়ংসম্পূর্ণতার আহবান জানান। এরই ফলে সাম্প্রতিককালে ইরানে বিজ্ঞান গবেষণায় প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে।

[1. Quarks and the Koran : Iran’s Islamic Embrace of Science- The Daily Beast, 22 May, 2009

2. Science and Technology and the Future Development of Soceities: International Workshop Proceedings. Nap.edu. 11 February, 2007, retrieved 21 Oct, 2011]

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণায় ইরানের দ্রুততম অগ্রগতির রিপোর্ট : এ সম্পর্কে ইরানের সর্বোচ্চ দ্রুত অগ্রগতির স্বীকৃতি (1996-2004) দিয়েছে ISI (Institute of Scientific Information), Canadian Research Firm Science-Matrix and Engineering Indicators: 2010, 2012’, Science Watch Report (2008), International Comperative Performance of UK Research Base (2009), Ges ‘Knowledge, networks and nations’ by Britain Leading Academic Institution, the Royal Society in Collaboration with Elsevier.

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান ৫১,০০০ পৃষ্ঠাসমৃদ্ধ ব্যাপক বিজ্ঞানগবেষণা সংক্রান্ত প্রকল্পপত্রে বর্ণিত ২২৪টি প্রকল্প ২০২৫ সালের মধ্যে সম্পন্ন করতে বদ্ধপরিকর। [Iran Unveils Comprehensive Scientific Plan. payvand.com. 4 Jan, 2011, retrieved 21 Oct, 2011] UNESCO-এর রিপোর্ট অনুযায়ী (২০১০) ইরানের বিজ্ঞান গবেষণার ৭৫% বাজেটই সরকার বহন করে।

          চিকিৎসাবিজ্ঞান গবেষণা : চিকিৎসাবিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে ইরানের অবস্থান বিশ্বে ১৯তম এবং সর্বশেষ রিপোর্ট প্রকাশসাপেক্ষে, ২০১২ সালের মধ্যে ১০ম অবস্থানে আসার কথা। [presstv.ir, 20 Jan, 2012]

          বায়ো টেকনোলজি : স্টেমসেল গবেষণার ক্ষেত্রে ইরান প্রথম সারির ১০টি দেশের মাঝে অবস্থান করছে। স্টেমসেল রিপ্লেস করার ক্ষেত্রে বিশ্বে ইরানের অবস্থান দ্বিতীয়। হাড়, হার্টভাল্ভ ও ট্যানডন রিপ্লেস করা ও Bio-tech drug উৎপাদনের ক্ষেত্রে ইরান প্রথম ১২টি দেশের মাঝে অবস্থান করছে।

          কম্পিউটার সায়েন্স ও রোবোটিক্স : ২০১০ সালে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব প্রযুক্তিতে Sorena-2 নামক রোবট তৈরি করে যা IEEE কর্তৃক বিশ্বের ৫টি সর্বোচ্চ প্রযুক্তির রোবটের মাঝে স্থান পায়। একই ধারাবাহিকতায় ইরানের automotive industry দশটি রোবট তৈরি করে। তেহরানের আমির কাবীর প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ২০০৭ সালে একটি সুপার কম্পিউটার তৈরি করে যার প্রতি সেকেন্ডের কর্মক্ষমতা ৮৬০ বিলিয়ন, যদিও ইরান ২০০১ সালেই প্রথম সুপার কম্পিউটার তৈরি করে। পরবর্তীকালে ইরান তৈরি করেছে RAHYAB-৩০০ যার সক্ষমতা ৪০ Gbit/s। ২০১১ সালে আমির কাবীর ও ইসফাহান বিশ্ববিদ্যালয় ২টি সুপার কম্পিউটার তৈরি করে যার প্রসেসিং ক্ষমতা প্রতি সেকেন্ডে ৩৪০০০ বিলিয়ন – যা বিশ্বের প্রথম সারির ৫০০টি কম্পিউটারের মাঝে রয়েছে।

          এনার্জি (Energy) : ইরান বিশ্বের প্রথম সারির চারটি দেশের মধ্যে রয়েছে যারা V 94.2 গ্যাস টারবাইন তৈরি করার সক্ষমতা অর্জন করেছে। গ্যাস রিফাইনারির সব পার্টসই ইরান নিজেই তৈরি করছে। তরল গ্যাস তৈরির (GTL) প্রযুক্তি অর্জনে ইরান প্রথম তিনটি দেশের মাঝে রয়েছে। ইরান দেশীয়ভাবে রিফাইনারি, তেল-ট্যাংকার, তেলকূপ খনন, Offshore platform এবং তেল উত্তোলনের ৭০ ভাগ সক্ষমতা অর্জন করেছে। গভীর পানিতে তেলকূপ খনন প্রযুক্তিতে ইরান বিশ্বের অল্প কয়েকটি দেশের মাঝে রয়েছে। দেশীয় প্রযুক্তিতে ডিজাইনকৃত ইরানের Darkhovin Nuclear Power Plant কার্যক্ষম হবে ২০১৬ সালে।

          সমরবিজ্ঞান : ইরান সুপারফাস্ট এন্টি সাবমেরিন তৈরি করেছে যা পানির তলদেশ দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে ১০০ মিটার গতিতে চলে; আর এ প্রযুক্তিটি বিশ্বে রয়েছে একমাত্র রাশিযার হাতে। লেজার টার্গেটিং প্রযুক্তিতে অস্ত্রের ক্ষেত্রে ইরান বিশ্বের পাঁচটি দেশের অন্যতম – যাদের চালকবিহীন বিমান (ড্রোন) নির্মাণ সক্ষমতা রয়েছে। ১৯৯২ সাল থেকেই ইরান নিজস্ব প্রযুক্তিতে ট্যাংক, মিসাইল, সাবমেরিন, ফাইটার প্লেন ও যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার্য সামরিক যান তৈরি করছে।

          ইরানের বিজ্ঞান গবেষণার আরো কতক সাফল্য

          কয়েক ধরনের অত্যাধুনিক চালকবিহীন বিমান (ড্রোন) তৈরি;

          সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে সমুদ্রগামী তেল-ট্যাঙ্কার তৈরি;

          মহাশূন্যে ‘পিশগাম’ বা ‘অভিযাত্রী’ নামের বায়ো-ক্যাপসুল প্রেরণ;

          রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম স্টিল্থ ধরনের অত্যাধুনিক জঙ্গী বিমান ‘কাহের-৩১৩’ তৈরি।

          সৌরশক্তিচালিত মোটরগাড়ি তৈরি।

পরিশেষে বলা যায় যে, শক্তিশালী মুজতাহিদ নেতৃত্বের অধীন ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান পুরো জাতির বিভিন্ন পর্যায়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিত্বদের পরিচালনায় সুসংবদ্ধ রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠন করেছে; বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে চরম অগ্রগতি অর্জন করেছে, স্বনির্ভর অর্থনীতির একটি শক্তিশালী ভিত তৈরি করেছে, সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে, স্বীয় ভূখণ্ডের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে, ফিলিস্তিন সহ মুক্তিকামী মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে, বিশ্ব-সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছে, বিশ্বমানবতা ও বিশ্ব-মুসলিমকে ঐক্যের ও উন্নত সংস্কৃতি গ্রহণের আহবান জানিয়েছে। এসবই ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানকে বিশ্ববাসীর সামনে একটি অনন্য মডেল হিসেবে উপস্থাপন করেছে। বিশ্বব্যাপী ইসলামী জাগরণে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান আরো সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাখবে এতে সন্দেহ নেই।

১৯৯৩ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সংকট মোকাবিলায় ইরানের ভূমিকা

তারেক ফজল

বোসনিয়া-হার্জেগোভিনায় সার্বীয় পৈশাচিকতা আর গণহত্যা বিশ্বের পূর্ববর্তী সকল নিকৃষ্ট নজিরকে স্লান করে দেয়। সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার এই প্রজাতন্ত্রটি স্বাধীণতা ঘোষণা করেছিল, এটিই প্রধান দোষ। আর স্বাধীনতাকামী জনগোষ্ঠী প্রধানত মুসলিম, এই বাস্তবতাটি সেই দোষটিকে অসহনীয় করে তুলেছিল। এজন্যই অব্যাহত নির্যাতন-হত্যাকাণ্ড।

যুগোশ্লাভিয়ার ৬টি প্রজাতন্ত্রের মধ্যে সার্বিয়া ও মন্টিনিগ্রো পূর্বের ফেডারেশনে থেকে যায়। শ্লোভেনিয়া ও ক্রোয়েশিয়া ১৯৯১ এর ২৫ জুন স্বাধীনতা ঘোষণা করে ও  পশ্চিমা স্বীকৃতি পায়। মেসিডোনিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করলেও স্বীকৃতি পায়নি। বোসনিয়া-হার্জেগোভিনা স্বাধীনতা ঘোষণা করলে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয়  গোষ্ঠী এজন্য গণভোটের শর্ত আরোপ করে। সে অনুযায়ী ১৯৯২  সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি ও ১ মার্চ গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। প্রজাতন্ত্রের ৪০ লাখ অধিবাসীর ১২ লাখ সার্ব গণভোট বর্জন করে। বাকি জনগোষ্ঠী গণভোটে অংশ নেয় ও শতকরা ৯৯ জন স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দেয়। এতে প্রজাতন্ত্রটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলেও যুগোশ্লাভ সার্বদেরসামরিক সহায়তায় বোসনীয় সার্বরা তা নস্যাৎ করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। লক্ষাধিক বোসনীয় মুসলিম নিহত হয়। উদ্বাস্তু হয় তিন লাখ। সার্বীয় বন্দি শিবিরে মৃত্যুর মুখোমুখি সোয়া লাখ। বোসনীয় মুসলিম নারীরা নিকৃষ্টতম নির্যাতনের শিকার হয়।

এই বোসনীয় (বোসনিয়া-হার্জেগোভিনা) মুসলিমদের রক্ষা করার জন্য বিশ্বের মানবতাবাদী গোষ্ঠী ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখনো কোনো কার্যকর ভূমিকা নেয়নি। জাতিসংঘের সশস্ত্র ত্রাণদল আর ইউএনইসি মধ্যস্ততাকারীদের তৎপরতার চেয়ে অধিক দ্রততার সাথে চলে সার্বীয় বাহিনীর হত্যাকাণ্ড আর মার্কিন সাময়িকী নিউজউইকের ভাষায় মুসলিম নারীদের ওপর গণধর্ষণ। 

১৯৯২ সালের এপ্রিল থেকে সার্বীয় বাহিনীর নির্যাতন শুরু হয় বোসনীয় মুসলিমদের ওপর। তখন থেকেই ইরান এই গণহত্যা প্রতিরোধে তার প্রচেষ্টা শুরু করে। এই প্রচেষ্টা সার্বিক অর্থেই সামগ্রিক। কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে ইরান সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার কোনো রাষ্ট্রদূত গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়। সার্বীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ইরান সফর বাতিল করা হয়। বেলগ্রেড থেকে ইরানী রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করা হয়। যুগোশ্লাভিয়াকে জাতিসংঘ ও ওআইসিসহ সকল বিশ্ব সংস্থা ও সংগঠন থেকে বহিষ্কারের জন্য ইরান দাবি তোলে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ৭৫৭ নম্বর প্রস্তাব পাশ হবার আগেই ইরান যুগোশ্লাভিয়ার সাথে সকল অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক এবং সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান বাতিল করে। তেহরানে বোসানিয়া-হার্জেগোভিনার রাজনৈতিক প্রতিনিধিবর্গকে গ্রহণ করা হয় এবং পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসার সাথে সাথে সারায়েভোয় কূটনৈতিক মিশন খোলার ঘোষণা দেয়া হয়। ২৯ অক্টোবর ৯২ দ্বিতীয় বারের মতো বোসনীয় প্রেসিডেন্ট আলীজা ইজেতবেগোভিচ তেহরান সফরে গেলে ইরানী প্রেসিডেন্ট আলী আকবর হাশেমী রাফসানজানী তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় স্বাগত জানান।

বোসনীয় জনগোষ্ঠীর (মুসলিম ও ক্রোয়েট) জীবন রক্ষার জন্য কার্যকরী কোনো আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা না দেখে ইরানে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে।  ইরানে এ পর্যায়ে বোসনিয়ায় সামরিক সাহায্য পাঠাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বিষয়টি জানার পর বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বিচলিত হয়ে ওঠে। তারা তড়িঘড়ি করে বোসনিয়া-হার্জেগোভিনার আকাশ সীমাকে জাতিসংঘের প্রস্তাবের মাধ্যমে বিমান উড্ডয়নমুক্ত এলাকা’ (নো ফ্লাইযোন) ঘোষণা করে এবং সেখানে অস্ত্র সরবরাহ নিষিদ্ধ করে। বাহ্যত এই আইনগত বাধার মুখে ইরান বোসনীয় মুসলিমদের জীবন রক্ষায় সরাসরি অংশ গ্রহণে ব্যর্থ হয়। কিন্তু সার্বীয়রা ঠিকই অস্ত্র সাহায্য পায়। যুগোশ্লাভ ফেডারেশনের যে মওজুদ অস্ত্র ছিল, বোসনীয় মুসলিমদেরকে হত্যার জন্য তা-ই যথেষ্ট। এ পর্যায়ে ইরানী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আলী আকবর বেলায়েতী ৪ আগস্ট ও ২৮ অক্টোবর ৯২ ইসলামী সম্মেলন সংস্থার ওআইসি মহাসচিব হামিদ আল-গাবিদের কাছে সংস্থার জরুরি অধিবেশন দাবি করে পত্র পাঠান। বোসনীয় মুসলিমদের সার্বীয় হায়েনাদের হাত থেকে প্রাণে বাঁচাতে দ্রুত ও নিশ্চিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ইরানী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরেকটি পত্র লেখেন ইন্দোনেশীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলী আলতাসের নিকট জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন ন্যাম এর পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের জরুরি সম্মেলন আহ্বানের তাগিদ দিয়ে। ইন্দোনেশিয়া এ সময়ে ন্যাম এর চেয়ারম্যান।

ইরান সরকারিভাবে বোসনীয় মুসলিমদের রক্ষার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। আটা, জ্বালানি তেল, জুতা, কম্বল, টিনজাত মাছ, পোশাক এবং অর্থ সাহায্য ইরান বোসনীয়দের জন্য অব্যাহত রাখে। আহত বোসনীয়দের চিকিৎসা ও এতিম সন্তানদের লালন-পালনের উদ্যোগ নেয়া হয়। বার্তা সংস্থা জানায়, গুরুতর আহত যুদ্ধবিধ্বস্ত ৮৬ জন বোসনীয়কে ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় রেড ক্রিসেন্টের মাধ্যমে গত ৮ ডিসেম্বর তেহরানে নিয়ে আসে। তাদের অবস্থা ভালোর দিক। হাসপাতালের কর্মীরা আন্তরিকতার সাথে তাদের সেবা করে। আহতদের কারো কারো জন্য কৃত্রিম অঙ্গও সরবরাহ করা হয়।

ইরান সরকারিভাবে এই আয়োজনের পাশাপাশি সেদেশের জনগণকেও বোসনীয় নির্যাতিত মুসলিমদের সাহায্যে এগিয়ে আসার ব্যবস্থা করে। জনগণের ব্যক্তিগত সাহায্য-সামগ্রী সংগ্রহ করা হয়। গত ৪-১০ নভেম্বর ইরান সারা দেশে এবং দূতাবাসসমূহের মাধ্যমে সারাবিশ্বে বোসনিয়া-হার্জেগোভিয়া সপ্তাহপালন করে। বোসনিয়ার বিষয়ে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি ও তাদের সাহায্য সংগ্রহ করা ছিল এর লক্ষ্য।

সর্বোপরি ইরান সকল রাষ্ট্রীয় জনশক্তি ও প্রচারমাধ্যমকে সম্ভাব্য সকল প্রক্রিয়ায় বোসনিয়ার স্বাধীনতাকামী মানুষদের কল্যাণে নিয়োজিত করে । বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেয়ী, প্রেসিডেন্ট হজ্জাতুল ইসলাম আলী আকবর রাফসানজানী, পার্লামেন্ট (মজলিস) স্পীকার আলী আকবর নাতেক নূরীসহ মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ ও উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাবৃন্দ বোসনিয়া-হার্জেগোভিনার মুস্তাযআফদের অনুকূলে তাদের ভূমিকা অব্যাহত রাখেন। ২৯ অক্টোবর ৯২ বোসনীয় প্রেসিডেন্ট আলীজা ইজেতবেগোভিচ দুই দিনের সফরে তেহরানে পৌঁছে বলেছিলেন, তাঁর দেশের জনগণের ওপর সার্বীয়দের পরিকল্পিত গণহত্যার (সিসটেমিটক জেনোসাইড) ব্যাপারে মুসলিম দেশসমূহের মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় তিনি অসন্তুষ্ট। ইরানের ভূমিকাকে তিনি উৎসাহব্যঞ্জক অভিহিত করেন।

আলজেরিয়া : ইরানের সাহসী ভূমিকা

আলজেরিয়ার সংগ্রামী জনগণ ১৯৯০  সাল থেকে তাদের উদ্যম ও স্পৃহা প্রদর্শন করে চলেছে। তাদের সেই উদ্যমকে গুঁড়িয়ে দেয়ার জন্য দেশটির সামরিক জান্তা সর্বশক্তি নিয়ে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রেসিডেন্ট শাদলী বেনজাদীদ কিছুটা নমনীয়তা প্রদর্শনের চেষ্টা করলে সামরিক জান্তা এবং নেপথ্যে থেকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তাঁকে মঞ্চথেকে সরিয়ে দেয় এবং দুই যুগের নির্বাসন থেকে অনুগত ও বিশ্বস্ত অনুচরমুহাম্মদ বওদিয়েফকে নিয়োগ করে প্রেসিডেন্ট হিসেবে। ২৯ জুন ৯২ বওদিয়েফ নিরাপত্তা রক্ষীর গুলিতে মারা যান। সামরিক জান্তা  বিপ্লবী কিন্তু নিরস্ত্র জনতাকে অস্ত্রের ভাষায় জব্দ করে রাখতে চেষ্টা করে। কিন্তু তারা কোন উর্দিপরা জেনারেলের শাসন মানবে না। ইসলামিক স্যালভেশন ফ্রন্ট (এফআইএস)-এর নেতৃত্বে এই জনতা ১৯৯০ সালের স্থানীয় পরিষদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ১৯৯১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পার্লামেন্টের প্রথম দফার নির্বাচনে ২০৬ আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে তারা বিজয়ী হয়। ১৯৯২ সালের ১৬ জানুয়ারির নির্দিষ্ট দ্বিতীয় দফায় পার্লামেন্ট নির্বাচনের ৫ দিন আগে ১১ জানুয়ারি দেশটির সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখল করে, পার্লামেন্ট নির্বাচনের ফল বাতিল করে পরবর্তী নির্বাচন বাতিল করে, শাদলি বেনজাদীদকে দৃশ্য থেকে সরিয়ে দেয় ও মুহাম্মদ বওদিয়েফকে প্রবাস থেকে দেশে ফিরিয়ে এনে প্রেসিডেন্ট বানায়। সামরিক জান্তা ইতিমধ্যে হাজার হাজার এফআইএস নেতা-কর্মীকে জেলে ঢুকায়, এফআইএসকে নিষিদ্ধ করে, মসজিদ বন্ধ করে দেয় এবং বেশ কজন নেতাকে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসি দেয়।

ইসলামী বিপ্লবকামী জনতার সাথে সাম্রাজ্যবাদীদের ক্রীড়নক আলজেরীয় জেনারেলদের এই অব্যাহত বৈরী আচরণের বিপরীতে বিশ্বে কার্যত একটি দেশই নৈতিক ভূমিকা নেয় এবং তা হচ্ছে ইরান। প্রচলিত কূটনৈতিক শিষ্টতা রক্ষা করেই ইরান এই ভূমিকা নেয়।

২৩ নভেম্বর জার্মানি থেকে এথেন্সে অবস্থিত ইরনা (আইআরএনএ) অফিসে এফআইএস এর একজন মুখপাত্র ফ্যাক্সযোগে একটি বিবৃতি প্রেরণ করেন। বিবৃতিতে এফআইএস এর মুখপাত্র রাবেহা কবীর বলেন, মিলিটারি সমর্থিত আলজেরীয় ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী পশ্চিমাদের সন্তুষ্ট করতে কিছু মুসলিম রাষ্ট্রকে আক্রমণ করছে। মুখপাত্র বলেন, যারা দুর্নীতি করছে, আলজেরীয় জনতা তাদের থেকে দেশকে মুক্ত করবে।

১৭ জানুয়ারি ৯২ তেহরানে জুমআর ভাষণে আয়াতুল্লাহ মুহাম্মদ ইমামী কাশানী আলজেরীয় সেনাবাহিনীকে জনগণের সাথে সংঘর্ষে যাবার ব্যাপারে সতর্ক করে দেন। তিনি বলেন, ফেরাউনদের জন্য কেবল অনুতপ্ত হওয়াই অপেক্ষা করে। যারা খোদার পথকে বেছে নিয়েছে, বিজয় তাদের জন্যই।

জুমআর নামাযের অন্যতম ইমাম আয়াতুল্লাহ কাশানী বলেন, আলজেরীয় মুসলিম জনতার সাথে সংঘর্ষে যাওয়া সেনাবাহিনীর জন্য কল্যাণকর নয়।

১৪ জানুয়ারি ৯২ ইরানী পার্লামেন্টের (মজলিস) সাবেক স্পীকার হুজ্জাতুল ইসলাম মাহদী কাররুবী এক বাণীতে অন্য মুসলিম দেশসমূহের পার্লামেন্ট প্রধানদের প্রতি আরজেরীয় জনগণের সংগ্রামকে সমর্থনের আহ্বান জানান। তিনি আলজেরীয় জনতাকে ফরাসি উপনিবেশের বিরুদ্ধে বীরহিসাবে উল্লেখ করেন। সাবেক ইরানী স্পীকার বলেন, নির্যাতিত জনতার প্রতি আমরা দয়া অনুভব করি। মানবিক আদর্শ ও মূল্যবোধ বাস্তবায়নের ওপর তিনি জোর দেন।

ইরানী দৈনিকগুলো তাদের সম্পাদকীয় নিবন্ধে দাবি করেন, আলজেরিয়ায় ইসলাম ও ইসলামের অনুরক্ত জনতাই বিজয় লাভ করবে। দৈনিকগুলো আলজেরিয়ার পার্লামেন্ট নির্বাচন ও তার পরবর্তী ঘটনা প্রবাহের ওপর অব্যাহতভাবে লিখে চলে।

আফগানিস্তান : স্থিতিশীলতার প্রচেষ্টায় ইরান

আফগানিস্তানের পুতুল শাসক ড. নজীবুল্লাহ মুজাহিদদের আক্রমণের মুখে জাতিসংঘের ছাত্রছায়ায় ১৯৯২ সালের ২৫ এপ্রিল ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। মুজাহিদরা বিজয়ী হয়। কিন্তু সরকার গঠনে মুজাহিদদের বিভিন্ন সংগঠন গভীর মতানৈক্যে জড়িয়ে পড়ে। এ সময় ইরান পাকিস্তানকে সাথে নিয়ে আফগানিস্তানে একটি ঐকমত্যের সরকার গঠনের উদ্যোগ নেয়।

১৯৮৫ সালে মুজাহিদদের ৭টি সংগঠন পাকিস্তানের পেশোয়ারে একটি ফ্রন্ট গঠন করেছিল। সংগঠনগুলো হলো, জমিয়তে ইসলামী (বুরহান উদ্দীন রব্বানী), হিজব-ই-ইসলামী (গুলবুদ্দীন হিকমতিয়ার), হিজব-ই-ইসলামী (ইউনুস খালিস), ইত্তেহাদ-ই-ইসলামী [ইসলামিক এলায়েন্স (রাসূল সায়েফ)], মিল্লি ইসলামী মাহাজ (আহমদ গিলারু), জাজহা সিহাত-ই-মিল্লি (সিবগাতুল্লাহ মুজাদ্দেদী) ও হারাকাত-ই-ইসলামী (নবী মোহাম্মদ)। ১৯৮৯ সালে এই সংগঠনগুলো একটি অস্থায়ী সরকার গঠন করে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় এই সরকারই মুজাহিদদের প্রতিনিধিত্ব করছিল।

আফগানিস্তানে একটি স্থিতিশীল সরকার গঠনের জন্য ইরান জাতিসংঘের দেয়া পরিকল্পনাকে সমর্থন করে। উক্ত পরিকল্পনায় ১৫ জনের একটি পরিষদের কথা বলা হয়। অধ্যাপক সিবগাতুল্লাহ মুজাদ্দেদী ২৫ এপ্রিল, ১৯৯২ ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন অধ্যাপক রব্বানী। সর্বশেষে অধ্যাপক রব্বানী দুই বছরের জন্য মুজাহিদ নেতৃত্ব পরিষদের ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। গত ৯ নভেম্বর ৯২ অন্তর্বতীকালীন প্রেসিডেন্ট থাকাকালে অধ্যাপক রব্বানীর সাথে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ইরানী প্রতিনিধি দলের নেতা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আলী আকবর বেলায়েতী সাক্ষাৎ করেন। প্রেসিডেন্ট রব্বানী আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রশ্নসমূহে ইরানের শক্তিশালী ভূমিকার কথা বলেন এবং আঞ্চলিক যৌথ সহযোগিতায় যুক্ত হবার জন্য আফগানিস্তানের সম্পূর্ণ প্রস্তুতির কথা বলেন। ইতিমধ্যে প্রেসিডেন্ট রব্বানী গত ২৬ ও ২৭ সেপ্টেম্বর ৯২ ইরান সফর করেন। রাহবার আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেয়ী ও প্রেসিডেন্ট আলী আকবর হাশেমী রাফসানজানীর সাথে আলোচনা করে প্রেসিডেন্ট রব্বানী তাঁর দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরানের সাহায্য কামনা করেন।

মধ্য এশিয়া প্রশ্নে ইরানের ভূমিকা 

মধ্য এশিয়ার ৬টি মুসলিম প্রজাতন্ত্রকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমর্থন ও সাহায্য যুগিয়ে চলেছে ইরান। স্বাধীনতা লাভের পর দেশগুলো ইসলামী ভ্রাতৃত্বের দাবি নিয়ে ইরানের সহযোগিতা আশা করে। ইরানও একে দায়িত্ব পালনের জন্য ভালো সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করে। ইরানী শীর্ষ নেতৃবৃন্দ যেমন মধ্য এশিয়ায় মুসলিম দেশসমূহ সফর করেন, তেমনি সেসব দেশের নেতৃবৃন্দও প্রয়োজনের তাগিদে নিয়মিতভাবে ইরানে যাতায়াত অব্যাহত রাখেন।

৩১ অক্টোবর ৯২ কাজাভস্তানের প্রেসিডেন্ট নূর সুলতান নাজার বায়েখ তেহরানে পৌঁছেন। মেহরাবাদ বিমান বন্দরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, কাজাখস্তান ইরানের সাথে বন্ধুত্ব বাড়াতে চায়। তিনি প্রেসিডেন্ট রাফসানজানীর সাথে আলোচনায় মিলিত হন এবং মধ্য এশিয়ায় বৈরী শক্তি বিস্তৃতির বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।

১৯৯২ সালের ১৪ অক্টোবর ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক উন্নয়ন বিষয়ক পরিচালক যুধিষ্ঠির রাজআইজার ইরানের সংস্কৃতি ও উচ্চ শিক্ষা বিষয়ক মন্ত্রী ড. মোস্তাফা মঈনের সাথে আলোচনা করেন এবং জানান, ১৪-১৮ নভেম্বর ৯২ তেহরানে মধ্য এশিয়ায় সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক সহযোগিতা বিষয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হবে। পরে এই আন্তর্জাতিক কংগ্রেস উদ্বোধন করেন ইরানের প্রথম উপ-রাষ্ট্রপতি হাসান হাবিবী। ৩০টি দেশ থেকে শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক কর্মকর্তা কংগ্রেসে যোগ দেন।

তুর্কমেনিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আতায়েভ ৪ দিনের সফরে ২২ ডিসেম্বর ৯২ তেহরানে পৌঁছলে ইরানী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আলী আকবর বেলায়েতী তাঁকে বিমান বন্দরে স্বাগত জানান। প্রেসিডেন্ট রাফসানজানী তুর্কমেন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সাক্ষাৎদানকালে বলেন, ইরান তাঁর দেশের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক চায়।

আজারবাইজান সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্ট প্যানাহ হোসেইনভ ৪ আগস্ট ৯২ বাকুতে ইরানী রাষ্ট্রদূতের সাথে সাক্ষাৎকালে ইরানের সাথে তাঁর দেশের অব্যাহত বন্ধুত্বের কথা বলেন। এর পর ২৮ ডিসেম্বর ৯২ আজেরী ভাইস প্রেসিডেন্ট প্যানাহ হোসেইনভ একটি প্রতিনিধি দলের নেতা হিসাবে ইরান সফরে আসেন। কারাবাখ ইস্যু ও অন্যকিছু বিষয় নিয়ে ইরানী নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা হয়।

২৩ ডিসেম্বর ৯২ আর্মেনীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট গাজিক আরুতুনিয়ান ইরানী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আলী আকবর বেলায়েতীর সাথে এক বৈঠকে মিলিত হন। ড. বেলায়েতী কারাবাখ বিবাদটি মিটিয়ে ফেলার জন্য আর্মেনীয় নেতার প্রতি আহ্বান জানান। আর্মেনীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট ইরানে দুদেশের যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের বৈঠকে যোগ দিতে আসেন। ইরানী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আলী আকবর বেলায়েতী একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়ে ২৪ নভেম্বর ৯১ মস্কোয় পৌঁছেন। ১০ দিনব্যাপী এই সফরে তিনি ৬টি মধ্য এশীয় মুসলিম প্রজাতন্ত্র সফর করেন।

১৭ নভেম্বর ৯২ ইরান ও উজবেকিস্তানের মধ্যে বিমান যোগাযোগ বিষয়েএকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২৫ নভেম্বর (১৯৯২) উজবেক প্রেসিডেন্ট ইসলাম রহিমভ তেহরানে কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষরের পরে নিজ দেশের উদ্দেশ্যে ফিরে যান। রহিমভ ইরানী নীতিমালাকে বাস্তবসম্মতবলে অভিহিত করেন।

মে ৯২-র প্রথম সপ্তাহে তেহরানে আজারবাইজান, আর্মেনিয়া ও ইরানের প্রেসিডেন্টদের উপস্থিতিতে ত্রিপক্ষীয় এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

লেবানন ও ফিলিস্তিন প্রশ্ন ইরান

১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২ লেবাননের হিজবুল্লাহ দলের সেক্রেটারি জেনারেল হুজ্জাতুল ইসলাম শেখ আব্বাস মুসাভী আলী ইসরাইলী আক্রমণে শহীদ হন। তাঁর সাথে স্ত্রী, এক পুত্র ও চারজন দেহরক্ষীও জীবন হারান।

এ ঘটনার পর ১৭ ফেব্রুয়ারি ইরানী বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী ও প্রেসিডেন্ট আলী আকবর রাফসানজানী পৃথক পৃথক বার্তায় শোক প্রকাশ করেন।

আলী খামেনেয়ী তাঁর বার্তায় বলেন, মুসাভীর শাহাদাত ইহুদি নির্যাতনের বিরুদ্ধে লেবানন ও ফিলিস্তিনীদের ন্যায্য সংগ্রামকে বিস্তৃত মাত্রা প্রদান করবে।

প্রেসিডেন্ট রাফসানজানী বলেন, মুসাভীর হত্যাকাণ্ড লেবানন ও ফিলিস্তিনীদের স্বাধীনতার স্পৃহাকে অবদমিত করতে পারবে না।

২১ ফেব্রুয়ারি (১৯৯২) তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের জুমআর সমাবেশে আয়াতুল্লাহ মোহাম্মদ ইমামী কাশানী বলেন, মুসাভীর হত্যাকাণ্ড মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং তথাকথিত মানবাধিকারের প্রবক্তাদের জন্য আরেকটি লজ্জার বিষয়। তিনি বলেন, মুসাভীর শাহাদাত ইসলামের স্বার্থই রক্ষা করবে।

ইরান ফিলিস্তিনী ও লেবাননী মুসলিমদের সংগ্রাম ও আন্দোলনকে সকল প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে চলে। ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বর ফিলিস্তিনীরা যে ইনতিফাদা বা গণজাগরণ শুরু করেছে, তা ইরানের শাহের আমলের আন্দোলনের পথ ধরেই এগিয়ে চলে। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তিস্থাপনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার দূতিয়ালিতে ৩০ অক্টোবর থেকে ১ নভেম্বর ১৯৯১ যে মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনাস্পেনের মাদ্রিদে শুরু হয়, লেবানন-ফিলিস্তিনের বিপ্লবকামী নেতৃবৃন্দ তা প্রত্যাখ্যান করেন। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান মাদ্রিদ আলোচনাকেসাম্রাজ্যবাদীদের নাটক হিসাবে আখ্যায়িত করে এবং তার আগেই তেহরানে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি স্থাপন বিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করে। সর্বশেষ ৪১৫ জন ফিলিস্তিনী সংগ্রামী যুবককে  ইসরাইল মধ্য ডিসেম্বরে তুষারাবৃত লেবানন সীমান্তের নো-ম্যান্স ল্যান্ডেবহিষ্কার করে। এতে কথিত মধ্যপন্থী নেতা ইয়াসির আরাফাত পশ্চিমাদের মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনা থেকে সরে আসার ঘোষণা দেন।

ইরান লেবানন-ফিলিস্তিনের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের গণজাগরণে সম্ভাব্য নৈতিক সমর্থন অব্যাহত রেখেছে। লন্ডন থেকে নভেম্বরের (৯২) তৃতীয় সপ্তাহে ইরনা জানায়, ইসরাইল অধিকৃত এলাকায় সর্ববৃহৎ ইসলামী শক্তি হামাসের সাথে ইরানের সম্পর্ক শক্তিশালী হয়েছে। বার্তা সংস্থা জানায়, হামাস ফিলিস্তিনকে মুক্ত করার সংগ্রামে ইরানের আনুষ্ঠানিক সমর্থন অর্জন করে।

৪ অক্টোবর (১৯৯২) ইসরাইলের অধিকৃত এলাকায় ঘটনাবলি বিষয়ে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও ফিলিস্তিনী হামাস আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের মধ্যে যৌথ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আলী আকবর বেলায়েতী সভার উদ্বোধন করেন।

৫ অক্টোবর রাহবার আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেয়ী এবং ১১ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট রাফসানজানী লেবাননের হিজবুল্লাহ দলের একটি প্রতিনিধি দলকে সাক্ষাৎ প্রদান করেন। হিজবুল্লাহ নতুন সেক্রেটারী জেনারেল সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ এই দলের নেতৃত্ব দেন।

ইউএন, এনএএম, ওআইসি-তে ইরানের ভূমিকা

ইরান পূর্ববর্তী বছরগুলোর মতো গত বছরটিতেও (১৯৯২) জাতিসংঘ, জোট নিরপক্ষে আন্দোলন ও ইসলামী সম্মেলন সংস্থায় নির্যাতিত জনতা ও মুসলিম জনতার পক্ষে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে।

জাতিসংঘে বোসনিয়া-হার্জেগোভিনা বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে ইরান সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। ইরান বোসনীয় মুসলিম মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সাহায্যের কথা ঘোষণা করলে সাম্রাজ্যবাদীরা বোসনিয়ার ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ইরানের প্রথম উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুহাম্মদ আলী বেশারতী জাতিসংঘের প্রতি বোসনিয়ার ওপর থেকে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবার দাবি করেন। ১ ডিসেম্বর ১৯৯২ তিনি তেহরানে টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এই দাবি তোলেন।

ইরানী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বোসনিয়ায় সার্বীয়দের নারকীয় গণহত্যার বিরুদ্ধে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ২৯ অক্টোবর ৯২ জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক আহ্বানের দাবি তোলেন। এর আগে ১ সেপ্টেম্বর ১৯৯২ ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের দশম শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে ইরানী প্রেসিডেন্ট রাফসানজানী ন্যাম এর একটি পর্যাপ্ত নির্বাহী ক্ষমতাসম্পন্ন মীমাংসা কেন্দ্রস্থাপনের প্রস্তাব করেন যাতে সমঝোতার অভাবে সৃষ্ট আন্দোলনভুক্ত দেশসমূহের অভ্যন্তরীণ বিরোধ নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়। জনাব রাফসানজানী পশ্চিমা মানবাধিকারের দ্বৈত মানদণ্ডের’ (ডাবল স্ট্যান্ডার্ড) কথা উল্লেখ করেন। তিনি বোসনিয়া-হার্জেগোভিনায় নির্বিচার গণহত্যার অবসানের জন্য কার্যকর ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি করেন। কিন্তু ন্যামএ ব্যাপারে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ইরানী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ন্যাম এর জরুরি বৈঠকের দাবি করেন।

মুসলিম দেশসমূহের সংগঠন ইসলামী সম্মেলন সংস্থা মুসলিম বিশ্বের স্বার্থ সংরক্ষণে এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি বোসনিয়া-হার্জেগোভিনায় বর্তমানে অব্যাহত গণহত্যা গণধর্ষণের বিরুদ্ধেও কোনো শক্তিশালী ও উপযুক্ত ভূমিকা গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে। ইরান দুইবার ওআইসির বৈঠকের আয়োজন করে। কিন্তু সংস্থাটি এখনো কোনো উপযুক্ত ভূমিকা নিতে পারেনি।

বাবরী মসজিদ প্রসংগে ইরান

ভারতের অযোধ্যায় ৪৬৪ বছরের প্রাচীন বাবরী মসজিদ ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর উগ্র হিন্দুরা ধ্বংস করে দেয়। ইরান সরকারিভাবে এর জন্য তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে, ভারত সরকারের অক্ষমতার নিন্দা করে এবং মসজিদটি দ্রুত পুনঃনির্মাণের দাবি তোলে।

ভারতের বোম্বেতে অবস্থিত ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটি এ সময় দুষ্কৃতকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত করে। মসজিদ ধ্বংস ও ইরানী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য তেহরানস্থ ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে দুইবার ডেকে পাঠানো হয় এবং কড়া ভাষায় দুটি ঘটনার প্রতিবাদ জানানো হয়।

দিল্লীতে নিযুক্ত ইরানের সাবেক রাষ্ট্রদূত ইবরাহীম রাহিমপুর ৯ ডিসেম্বর (১৯৯২) তেহরানে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, রাও সরকারের বাবরী মসজিদ পুনঃনির্মাণের প্রকৃত ইচ্ছা থাকলে একমিনিটও ক্ষেপণ না করে মসজিদটির নির্মাণ কাজ শুরু করে প্রমাণ দেয়া উচিত।

২২ ডিসেম্বর ১৯৯২ ইরানী পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্ভাব্য সংক্ষিপ্ত সময়ে বাবরী মসজিদ নির্মাণের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন এবং এ জন্য তিনি ভারতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আর এল ভাটিয়ার কাছে একটি পত্র পাঠান।

১৪ ডিসেম্বর ইরানের গ্রান্ড আয়াতুল্লাহ মুহাম্মদ রেজা গুলপায়গানী এক বিবৃতিতে উগ্র হিন্দুদের দ্বারা ভারতের ফয়েজাবাদে অবস্থিত ঐতিহাসিক বাবরী মসজিদ ধ্বংস করাকে বর্বরতা বলে উল্লেখ করেন।

ইরানের বিভিন্ন দৈনিক বাবরী মসজিদ ভাঙার সাথে ভারত সরকারও পরোক্ষভাবে জড়িত বলে দাবি করে। কায়হান ইন্টারন্যাশনাল, জমহুরী ইসলামী, তেহরান টাইম্স এ বিষয়ে সম্পাদকীয় ও নিবন্ধ প্রকাশ করে।

সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী সম্পর্কে ইরানের কঠোর ভূমিকা

ইরান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ মানবতার শত্রু সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি অপরিবর্তিত রেখেছে। বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী ৬ মে ১৯৯২ হজ কর্মকতাদের উদ্দেশ্যে এক ভাষণে বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যতক্ষণ ইসলামী ইরানের প্রতি বৈরী থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত তার সাথে কোন সম্পর্ক স্থাপিত হবে না।

রাহবার খামেনেয়ী ১৮ সেপ্টেম্বর ইসলামী বিপ্লবী রক্ষী দলের কমান্ডারদের উদ্দেশ্যে এক ভাষণে বলেন, ঈমানের শক্তিতে বলীয়ান ও সশস্ত্র বিপ্লবী রক্ষীদের জাতিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনো দিন ক্ষতি করতে পারবে না।

বিপ্লবের নেতা ১ জুলাই তেহরানে একদল দর্শনাথীর উদ্দেশ্যে ভাষণ দানকালে বলেন, মুসলিম জাতিসমূহকে উদ্ধত শক্তিসমূহ, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে। তিনি বলেন, এই শক্তিগুলো ইসলাম, মুসলিম জাতি এবং নির্দিষ্টভাবে ইরানী জাতিকে ভয় করে। কারণ, তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি।

১৮ নভেম্বর ১৯৯২ বিপ্লবের নেতা খামেনেয়ী মিশরীয় অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ইরান মিশরীয় যুবকদের উস্কানি দিচ্ছে এটি একটি মিথ্যা। তিনি বলেন, বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর নীতি হলো উপসাগরীয় ও আরব রাষ্ট্রগুলোকে ইরানের বিরুদ্ধে শত্রুতায় লিপ্ত করা।

তেহরানের অতিরিক্ত জুমার নেতা আয়াতুল্লাহ আহমদ জান্নাতী গত ১৩ নভেম্বর বলেন, মার্কিন নির্বাচন ইহুদিদের দ্বারা আয়োজিত একটি অনুষ্ঠান মাত্র।

নতুন বিজয়ী ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইরানের সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হবে কি-না, এ প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আলী আকবর বেলায়েতী বলেন, ইরান যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক শুরুর ইচ্ছা রাখে না। তিনি বলেন, আমরা বিপ্লবের শুরুতে ডেমোক্র্যাট জিমি কার্টারের শাসন দেখেছি, তারপর এক যুগের রিপাবলিকানদের শাসন দেখেছি রিগ্যান ও বুশের নেতৃত্বে। কিন্তু ইরানের বিষয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি একই থেকে গেছে। ইরনাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ মন্তব্য করেন।

পররাষ্ট্র ও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক

ইরান তার ইসলামী নীতিমালার আলোকে বিশ্বের অন্য দেশগুলোর সাথে সন্তোষজনক সম্পর্ক উন্নয়নের ও দৃঢ় করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে।

প্রেসিডেন্ট রাফসানজানী ইয়েমেন আরব প্রজাতন্ত্রের ইরান সফরকারী পরিকল্পনা ও উন্নয়ন মন্ত্রী ফারাজ বিন গানেমকে ২৮ জানুয়ারি ১৯৯২ সাক্ষাৎ প্রদান করেন। এই সফর কালে ইরান-ইয়েমেনের মধ্যে একটি সাংস্কৃতিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

অস্ট্রিয়ায় সফরকালে ইরানী ভারী শিল্পমন্ত্রী হাদীনাজেদ হুসেইনিয়াম সে দেশের অর্থমন্ত্রী ওলয়গেঙ্গ শ্যুশেলের সাথে ১৯ ফেব্রুয়ারি ৯২ অর্থনৈতিক, বাণিজ্য ও শিল্প ক্ষেত্রে সহযোগিতা জোরদার করার বিষয়ে আলোচনা করেন।

৩ মার্চ ৯২ বাকুতে ইরানের টিএন্ডটি মন্ত্রী মুহাম্মদ কারাজী আজেরী প্রেসিডেন্ট আয়াজ মুতালিভবের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় তারা ৩ শমাইক্রোওয়েভ টেলিফোন চ্যালেন চালুর বিষয়ে আলোচনা করেন।

৩০ জুন (১৯৯২) ইরানের প্রথম উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলী  মুহাম্মদ বেশারতী ইরনার সাথে এক সাক্ষাৎকারে ইরানী প্রেসিডেন্ট আকবর হাশেমী রাফসানজানী ও সৌদি আরবের বাদশাহ ফাহদের শীঘ্রই একে অন্যের দেশ সফর ও সাক্ষাতে মিলিত হবার কথা ঘোষণা করেন।

১ জুলাই প্রেসিডেন্ট রাফসানজানী ও সফররত তাজিক প্রেসিডেন্ট রহমান নবিয়েভ তেহরানে একটি যৌথ ইশতেহার প্রকাশ করেন।

১৯ সেপ্টেম্বর সাবেক সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচভের বিশেষ দূত ইয়েভগেনি প্রিমাকভ একটি আর্থ-রাজনৈতিক প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়ে দুই দিনের সফর শেষ করে তেহরান ত্যাগ করেন।

ইন্দোনেশীয় বাণিজ্যমন্ত্রী আবেরীন এম সেবিগার ১৩ অক্টোবর তেহরান পৌঁছেন।

১০ নভেম্বর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. বেলায়েতী ভারতীয় প্রেসিডেন্ট শংকর দয়াল শর্মা ও প্রধানমন্ত্রী নবসীমা রাওয়ের সাথে পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেন।

ফ্রান্স ইরানের সাথে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরো জোরদার করার আগ্রহ ব্যক্ত করেছে। দেশটির জুনিয়র বাণিজ্যমন্ত্রী ব্রুথো ডুরিয়েক্সাস ৯ ও ১০ অক্টোবর (১৯৯২) ইরান সফর করেন।

২৮ জুন তেহরানে এসকাপের সদস্য রাষ্ট্রসমূহের একটি সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট রাফসানজানী ভাষণ দেন।

১০ নভেম্বর তেহরানে আইডিবি-র ১৭তম বার্ষিক সভা অনুষ্ঠিত হয়।

অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংস্থা (ইকো)’ প্রশ্নে রাফসানজানী

অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংস্থ’ (ইকো) গঠন, সম্প্রসারণ ও একে দৃঢ় ভিত্তির ওপর স্থাপনের জন্য অগ্রণী ও সোচ্চার ভূমিকা রাখে। ১৯ ফেব্রুয়ারি (১৯৯২) ইরানী প্রেসিডেন্ট রাফসানজানী এই সংস্থাটির ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক প্রতিরক্ষা জোটে রূপ লাভের সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেন। তিনি বলেন, বিধান অনুযায়ী এটি একটি অর্থনৈতিক সংস্থা, যার মধ্যে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমও অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু এটি রাজনৈতিক বা নিরাপত্তা জোটের রূপ নিতে পারবে না। তিনি বলেন, তেমনটি করতে চাইলে সংস্থার গঠনতন্ত্রের ধারাগুলো সম্পূর্ণ বদলে দিতে হবে। প্রেসিডেন্ট ইকো-র দুইদিনব্যাপী র্শীষ সম্মেলন শেষে সাংবাদিকদের সাথে আলোচনাকালে এ কথা বলেন। সম্মেলনে ইকোর মূল সদস্য আজারবাইজান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কিরঘিজিস্তান ও তাজিস্তিানের রাষ্ট্রপ্রধান ও উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা অংশ নেন। সম্মেলনে কাজাখস্তান পর্যবেক্ষক হিসাবে অংশ নেয়। কারণ, দেশটি এখনো সদস্য পদের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে দরখাস্ত করেনি।

আইডিবি, ইফাড, ইউনেস্কো, এসকাপ ইরানের ভূমিকাকে প্রশংসা করে।

রমযানের শেষ শুক্রবারকে আল-কুদ্স দিবসঘোষণা করে বায়তুল মুকাদ্দাসকে মুক্ত করার পরিকল্পনা ইরান অব্যাহত রাখে।

সালমান রুশদী : চোরের মতো উপস্থিতি

১৫ জানুয়ারি ৯৩ বার্তা সংস্থা এএফপি একটি সংবাদ প্রচার করে : ব্রিটিশ লেখক সালমান রুশদী (১৫ জানুয়ারি) দিনের শেষে ডাবলিনে তথ্য প্রবাহের স্বাধীনতাসংক্রান্ত এক সম্মেলনে যোগ দেয়। ইরানের হত্যা হুমকির পর থেকে বিতর্কিত এই লেখক লুকিয়ে বেড়াচ্ছে। এই সম্মেলনে তার যোগদান সম্পর্কে কোন ঘোষণা দেয়া হয়নি। চোরের মতো সে সম্মেলনে যোগ দেয়। ভারতীয় বংশোদ্ভূত লেখক সালমান রুশদীর মাথার ওপর ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেইনী (রহ.)-এর ঘোষিত মৃত্যুদণ্ডের আদেশ ঝুলছে। ইসলামের অবমাননা করে দি স্যাটানিক ভার্সেসবই লেখার দায়ে ইমাম খোমেইনী ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাকে হত্যার নির্দেশ দেন। সেই থেকে সালমান রুশদী গোপন জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে।

হজ : সামগ্রিকতার উন্মোচন

বিশ্বমুসলিমের মহান সমাবেশ ঘটে আরাফাতের মাঠে। ইসলামের অন্যতম রুকন বা স্তম্ভ এই হজ অনুষ্ঠান। এই হজের আছে ধর্মীয় তাৎপর্য। আছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক তাৎপর্য এবং সর্বোপরি ও গুরুত্বের সাথে আছে রাজনৈতিক তাৎপর্য। রাসূলে করীম (সা.) বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণে আরাফাতের ময়দানে বিশ্বমুসলিমের জন্য কিছু স্থায়ী নির্দেশনা প্রদান করেছিলেন। এর আগের বছরের হজ তথা নবম হিজরির হজে কাফের-মুশরিকদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ বা বারাআতের ঘোষণা প্রচার করা হয়। এই রাজনৈতিক আচরণ এবং রাসূলের বিদায় হজের ভাষণের আলোকে পবিত্র হজ উদ্যাপন বিগত শত শত বছর থেকে অনুপস্থিতই থেকে গেছে। ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর নির্দেশনা অনুযায়ী ইরানী হাজী ও অন্য দেশের কিছু অংশের হাজীরা হজ পালন করতে গিয়ে কাফের ও মুশরিকদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দিতে শুরু করেন। ইমাম শিখিয়েছেন, আরাফাতের ময়দানে বিশ্বমুসলিমকে সমবেত হয়ে ইসলাম তথা মুসলিমদের শত্রুদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দিতে হবে। বিশ্বমানবতা ও মুসলিমদের শত্রুদের প্রতিরোধ করতে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। নিপীড়িত মানবতা ও মযলুম মুসলিমদের রক্ষার কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। ইমামের এই শিক্ষায় উজ্জীবিত হয়েই হাজীদের, বিশেষত ইরানী হাজীদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ইসরাইলের ধ্বংস কামনা করে স্লোগান দিতে দেখা গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্মান ও স্বার্থহানি ঘটছে দেখে ১৯৮৭ সালে সৌদি সরকার স্লোগানরত আল্লাহর মেহমান হাজীদের গুলি করে শহীদ করে। সেবার চার শতাধিক হাজী শাহাদাত লাভ করেন। মুসলিমদের শত্রু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য দুশমনদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দিতে সৌদি সরকার সম্মত না হওয়ায় ইরান তিন বছর হজ বয়কট করেছিল। পরে সৌদি সরকার হাজীদেরকে নিয়মতান্ত্রিক ও শৃঙ্খলার সাথে বিক্ষোভ প্রদর্শনের অনুমতি দিলে ইরান পুনরায় হজে অংশ নিতে শুরু করে।

২২ অকেটাবর ৯২ ইরানী প্রেসিডেন্ট আলী আকবর হাশেমী রাফসানজানী তেহরানে মহান হজ কংগ্রেসের উদ্বোধন করেন। প্রেসিডেন্ট বলেন, ইরান নিয়মতান্ত্রিকভাবে হজ অনুষ্ঠান পালন করতে চায়- যেখানে রাজনৈতিক ইস্যুগুলো ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতাকে ব্যাঘাত না ঘটিয়েই উত্থাপিত হবে। তিনি বাড়াবাড়ি পরিহার করে হজ উদ্যাপনের আহ্বান জানান।

ইসলামী বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী ২৫ মে ৯২ এক ফতোয়ায় বলেন, মুসলিম হজ যাত্রীদের এমন কোনো আনুষ্ঠানিকতা পালন হারাম, যা মুসলিমদের মধ্যে বিবাদের জন্ম দেয় এবং ইসলামকে দুর্বল করে। বিশ্বাসীদের তেমন কাজ পরিহার করা কর্তব্য।

 (নিউজলেটার, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৩)

নওরোযের উৎসব

The-Nowruz-table-is-the-f-001নওরোযের উৎসব ইরানী জনগণের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির প্রধান অংশ এবং প্রাচ্য সভ্যতার অন্যতম নিদর্শন। নওরোয উৎসব প্রচলনের সঠিক সন-তারিখ আজও জানা যায় নি। তবে এর নিদর্শনগুলো কয়েক হাজার বছর পূর্বেকার ইরানের হাখামানেশী রাজবংশের শাসনামলের (খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ থেকে ৩৩০ অব্দ) সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। হাখামানেশী শাসনামল থেকে শুরু করে এ উপলক্ষে যেসব মুদ্রা তৈরি করা হয় তা এখনো মওজূত আছে। প্রাগঐতিহাসিককালের ইরানীরা (প্রকৃতির) জীবনের সমাপ্তি উপলক্ষে ফারসি সালের শেষ এগার দিন (১০ থেকে ২০ মার্চ) শোক পালন করত। নওরোযে প্রকৃতিতে নতুন করে জীবনের আগমনের সাথে সাথে এ শোকের সমাপ্তি ঘটত এবং এ উপলক্ষে আনন্দ উৎসব করা হত। এ কারণে ব্যাপক আগ্রহ-উদ্দীপনা সহকারে এ আনন্দ-উৎসব পালন করা হত।

হাখামানেশী সম্রাটদের যুগে এ উৎসব কীভাবে পালন করা হত সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায় নি। আলেকজান্ডারের ইরান আক্রমণ ও তার ফলে সৃষ্ট ধ্বংস এ ব্যাপারে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণ লাভের পথে বহুলাংশে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যদিও সাসানী রাজবংশের শাসনামলে (২৬২ থেকে ৬৫২ খ্রিস্টাব্দ) নওরোয উৎসব প্রচলিত ছিল বলে বহু তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে।

তাখতে জামশীদে প্রাপ্ত একটি শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, হাখামানেশীদের পূর্ববর্তী মদ্ রাজবংশের শাসনামলে নওরোযের উৎসব পালিত হত। নওরোযের উৎসব পালন হাজার হাজার বছর ধরে এতটাই ব্যাপ্তি ও বিস্তৃতি লাভ করেছে যে, ইরান, তুরস্ক, আরাক, তাজিকিস্তান, উযবেকিস্তান ও আযারবাইজান, ভারত ও পাকিস্তানের কোন কোন অংশে এবং মধ্য এশিয়ায়ও এ উৎসব পালন করা হচ্ছে। একইভাবে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী এ উৎসব পালন করে থাকে।

নওরোয উৎসবের কালগত গুরুত্ব এখানে যে, এ উৎসব এমন এক সময় শুরু হয় তখন প্রকৃতিতে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসতে থাকে; পৃথিবী সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করে আরেকবার প্রদক্ষিণ শুরু করে।

প্রাচীন ইরানের ফার্স এলাকায় যরথুস্ত্রীরা নববর্ষের সূচনায় বিভিন্ন প্রতীকী বস্ত্ত দ্বারা সাতটি ট্রে পূর্ণ করে আহুর্মায্দা (আল্লাহ তা‘আলা)-এর উদ্দেশে উৎসর্গ করত। এই সাতটি ট্রে ছিল সততা, ন্যায়পরায়ণতা, ঈমান, সুদপদেশ, সৎকর্ম, সৌভাগ্য এবং ক্ষমা ও অমরত্বের প্রতীক।

অতীতের এসব আনুষ্ঠানিকতা বর্তমানে যে পরিবর্তিত রূপ নিয়েছে তা হচ্ছে এই যে, এ উপলক্ষে বিশেষ ধরনের দস্তরখান বিছানো হয় এবং তার ওপর বিভিন্ন ধরনের প্রতীকী জিনিস অত্যন্ত সুন্দরভাবে সাজিয়ে রাখা হয়। এ উপকরণসমূহ হতে হবে বিভিন্ন ধরনের সাতটি উপকরণ যেগুলোর নাম ফারসি বর্ণমালার ‘সীন’ হরফ দিয়ে শুরু হয়েছে। এগুলো হলো ‘হাফ্‌ত সীন্’ যা সাধারণত নিম্নোক্ত উপকরণগুলোর মধ্য থেকে বেছে নেয়া হয়।

সাব্যেহ্ (সবুজাভ) : গম বা ডালের কচি চারার গুচ্ছ যা নওরোযের অব্যবহিত পূর্বে গজিয়েছে। একটা ট্রে বা প্লেটের ওপর বসিয়ে হাফ্ত সীন্ দস্তরখানায় রাখা হয় যা নব জীবনের প্রতীক।

সামানূ : কচি গম, বার্লি বা অন্যান্য শাস্যদানার আটা দিয়ে তৈরি বিশেষ ধরনের হালুয়া যা প্রাচুর্য ও নেয়ামতের প্রতীক।

সেনজাদ : এক প্রকার শুষ্ক ফল যা প্রেমের প্রতীক।

সীর (রসুন) : সৌন্দর্য ও সুস্বাস্থ্যের প্রতীক।

সোম্মাগ : মশুরের ডালের চেয়ে সামান্য বড় লাল রঙের টক ফলবিশেষ যা উদীয়মান সূর্যের প্রতীক।

সিরাক : দীর্ঘায়ু ও ধৈর্যের প্রতীক।

সোমবোল : ছোট আকারের পুষ্পময় উদ্ভিদবিশেষ যা বসন্তের আগমন বার্তা বহন করে।

সেক্কেহ্ (কয়েন বা মুদ্রা) : সম্পদ ও সমৃদ্ধির প্রতীক।

ইতিপূর্বে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে, নওরোয উৎসবের উৎপত্তি কবে তা জানা যায় না, কিন্তু সুপ্রাচীন কাল থেকে, এমনকি প্রাগঐতিহাসিক কালেও, ইরান বিভিন্ন সভ্যতা ও সংস্কৃতির মধ্যে যোগাযোগের ট্রানজিট রুট হিসাবে বিবেচিত হত। ইরান এশিয়াকে ইউরোপ ও আফ্রিকার সাথে সংযুক্ত করেছে। এ দেশে বিভিন্ন রসম-রেওয়াজ ও সংস্কৃতির উদ্ভব ও মিলন ঘটে যা অন্য কোন দেশে পাওয়া দুষ্কর।

ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে এবং সুপ্রাচীন কালে ইরানীদের ধর্মবিশ্বাস ও জাতিসত্তায় বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রান্ত হয়। এর অন্যতম দৃষ্টান্ত হচ্ছে এক খোদার ইবাদত এবং শির্ক্ ও বহু দেবদেবীর পূজা প্রতিহতকরণ। যরথুস্ত্রীয় ধর্ম এর অন্যতম দৃষ্টান্ত।

যরথুস্ত্রীয় ধর্মমতে আহুরমায্দার প্রতি বিশ্বাস পোষণ করা হয় যাতে তাওহীদে বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটে।

ইসলামের আবির্ভাব ও অন্যান্য ধর্মের সাথে, বিশেষত ইরানীদের ধর্মবিশ্বাস ও জাতীয় ধ্যান-ধারণার সাথে ইসলামের শন্তিবাদী আচরণের দরুন ইরানীদের ইসলাম গ্রহণ করার পরেও তাদের আগেকার কতক ধ্যান-ধারণা ও রসম-রেওয়াজ অব্যাহত থাকে। অবশ্য ইরান-বিজেতা আরব মুসলমানদের ইরানীদের সাথে সদয় আচরণের কারণেই তারা ইসলামকে সম্পূর্ণরূপে বরণ করে নেয় এবং তাদের আদর্শ ব্যক্তিবর্গ, বীরগণ ও প্রাচীন কাহিনীগুলোকে মহান দীন ইসলামের রঙে রঙিন করে নেয়। প্রাচীন ইরানীদের কিছু কিছু উপলক্ষ ও রেওয়াজ তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও জনগণের ধ্যান-ধারণার সাথে মিশে গিয়েছিল। নওরোয এর অন্যতম। সুদীর্ঘ কয়েক সহস্রাব্দের পুরনো এ ঐতিহ্যটি ইরানের মুসলমানদের মনে একটি স্থায়ী আসন তৈরি করে নিয়েছে এবং ইরানের মনীষিগণ এ ব্যাপারে যথেষ্ট লেখালেখি করেছেন। বিশেষ করে আল-বিরূনী (ওফাত ৪৪০ হি.) তঁর গ্রন্থ ‘আতহারুল বাক্বীয়াহ্’তে প্রাচীন ইরানের ইতিহাস ও ঐতিহ্য তুলে ধরেছেন। এছাড়া অনেক মুসলিম কাবিই নওরোয ও প্রাকৃতির নব জীবন লাভ নিয়ে কবিতা লিখেছেন। এখনও ইরানের অধিকাংশ লোকই পুরাতন বছরের বিদায় ও নতুন বছরের আগমন ক্ষণে নতুন পোশাক পরিধান করে মিষ্টি-মধুর আচরণসহকারে পবিত্র স্থানে বা পরিবারের মুরববীদের সাথে কাটাতে পছন্দ করে। সে মুহূর্তে তারা কুরআন তেলাওয়াত করে ও দু’হাত তুলে মহান আল্লাহ্র কাছে নিজেদের ও পরিবারবর্গের জন্য একটি সুন্দর এবং সুস্থতা ও সমৃদ্ধিপূর্ণ বছর কামনা করে।

নওরোযের পছন্দনীয় অন্যান্য রীতির মধ্যে রয়েছে পরস্পরের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ ও কুশল বিনিময়, কারও প্রতি রাগ বা ক্ষোভ থাকলে পরস্পরকে ক্ষমা করে দেয়া এবং নববর্ষের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করা। এছাড়া এ দিনে তারা এমন সব ব্যক্তির সাথে দেখা করতে যায় যারা পুরাতন বছরে কোন প্রিয়জনকে হারিয়ে শোকে মুহ্যমান হয়ে আছে।

এভাবে নওরোয প্রাচীন ইরান থেকে পর্যায়ক্রমে বর্তমান রূপে এসে দাঁড়িয়েছে এবং ইসলামের পছন্দনীয় রীতি-নীতিগুলোকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তাই ইসলামের মূলনীতির সাথে এর কোন বিরোধ নেই; বরং নওরোয উৎসব ইরানী সমাজের জন্য নৈতিক ও সামগ্রিক শিক্ষার সহায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন করছে।

অনুবাদঃ নূরে আলম মা‘রূফ

নওরোয- নতুন দিনের উৎসব

তিনি হাজার বছর পূর্বে তাহমূরাস-এর ভাই জামশীদ চাইলেন, আপন জাতির জন্য একটি উৎসবের আয়োজন করবেন। সূর্য ‘হামাল’ কক্ষপথে পরিবর্তনের শুভক্ষণে তিনি এক বিশাল মিলনায়তনে তাঁর অলঙ্কৃত সিংহাসনে আরোহণ করলেন। রঙ-বেরঙের মণিমুক্তা খচিত একটি মুকুট মাথায় পরিধান করলেন আর লোকদেরকে তাঁর সাক্ষাতের জন্য সময় দিলেন।

সূর্যের কিরণ মুকুটের রং-বেরঙের মণিমুক্তার ওপর পড়ছিল আর বিজলীর মতো চমকাচ্ছিল। উপস্থিত লোকেরা তখন বিস্ময়ে হতবাক। কারণ, এ পর্যন্ত এত শান-শওকত, এত জৌলুস আর কখনো দেখে নি তারা। তাই বলল, এই দিন নতুন দিন। একে অপরকে মোবারকবাদ জানাল। শুভেচ্ছা বিনিময় করল। জামশীদকে তখন বলা হত ‘জাম্’। কিন্তু এদিনের পর থেকে তাতে যুক্ত করা হল ‘শীদ্’ মানে কিরণ, সূর্যের রশ্মি।

জামশীদ জনগণকে সুন্দর সুদপদেশ দিলেন। সুন্দর অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য পরামর্শ দিলেন। আর সেই দিনটিকে জাতীয় উৎসবের দিন হিসাবে নির্ধারণ করলেন।

নতুন দিন, পরিভাষায় নওরোয। বিশ্বের সকল উৎসবের ওপর নওরোযের চিরায়ত অহংকার আছে। কারণ, কোনো চাপিয়ে দেয়া রাজনৈতিক উৎসবের সাথে এক প্রকার কৃত্রিম সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে এ উৎসবের সৃষ্টি হয় নি। এটি বিশ্ব উৎসব। যমীন, আসমান, সূর্যেরই আনন্দের তিথি। পত্রপল্লবের বিকশিত হওয়া, উদ্গম হওয়া ও যেকোনো সূচনার প্রাণবন্ত উৎসরণের দিন নওরোয।

নওরোয এক বিরাট স্মৃতির রোমন্থন। এ স্মৃতি প্রকৃতির সাথে মানুষের আত্মীয়তার। প্রকৃতির বিস্মৃতি-প্রবণ সন্তান মানুষ দৈনন্দিন কাজে-কর্মে তার মা প্রকৃতিকে ভুল যায়। কিন্তু যখন শিহরণ জাগানো বসন্ত আসে, তখন সে মায়ের আঁচলে ফিরে যায়। এই যে ফিরে যাওয়া, পুনঃসাক্ষাৎ, একে নওরোয উৎসব হিসাবে পালন করা হয়। তখন মায়ের কোলে সন্তান নিজকে ফিরে পায়। আর সন্তানের পাশে মায়ের চেহারা বুকভরা আনন্দে বিকশিত ও প্রস্ফুটিত হয়। আনন্দাশ্রু প্রবাহিত হয়। নতুন জীবন ফিরে পায়, প্রাণবন্ত হয়। উদ্ভিদ ও গাছ-গাছালির এই যে নতুন উদ্গম, আসলে এ মুহূর্তটি ইউসুফকে ফিরে পেয়ে দৃষ্টিলাভ ও জাগ্রত হওয়ার আনন্দঘন তিথি। তাই দিনটি আলোকোজ্জ্বল হয়, আকাশ থাকে মেঘমালাশূন্য।

প্রতি বছর, এমনকি যে বছর আলেকজান্ডার আমাদের জাতির তাজা রক্তে এই মাটির চেহারা রক্তিম করেছিল, সেই বছরও জামশীদের সিংহাসন হতে যখন ভয়াবহ লেলিহান শিখা কুন্ডলী থেকে উত্থিত হচ্ছিল, তখনও সেখানে একই সময়ে আমাদের জনগণ আরো বলিষ্ঠভাবে আরো দৃঢ় প্রত্যয়ে দীপ্ত হয়ে আত্মবিশ্বাস নিয়ে নওরোয পালন করেছিল।

প্রত্যেকে কি একথা অনুভব করে না যে, বসন্তের প্রথম দিনটি সৃষ্টির প্রথম দিন? আল্লাহ্ তা’আলা একদিন বিশ্বকে সৃষ্টি করে থাকলে সেদিনটি ছিল আজকের নওরোয। নিশ্চিতভাবেই বসন্ত সৃষ্টিলোকের প্রথম ঋতু। ফারভারদিন প্রথম মাস ও নওরোয প্রথম দিবস। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ জগৎকে শরৎ, হেমন্ত, শীত বা গ্রীষ্ককাল দিয়ে শুরু করেন নি। নিশ্চিতভাবেই বসন্তের প্রথম দিনেই সবুজের সমারোহ শুরু হয়েছে, খাল-নদীর পথচলা, অংকুরের উদ্গম আর কিশলয়ের পল্লবিত হওয়া আজকের দিনেই শুরু হয়েছে।

ইসলাম জাতীয়তা ও গোষ্ঠীপ্রথার সকল রং দূরিভূত করেছে। সকল প্রথার বিবর্তন সাধন করেছে। ইসলামই নওরোযকে অধিকতর ঔজ্জ্বল্য দান করেছে। তার প্রতিটি পাতা পরস্পরের সাথে ভাঁজ দিয়ে নতুন করে বাঁধাই করেছে আর মজবুত পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে ইরানীদের মুসলমানী জিন্দেগীর অধ্যায়টিতে ধ্বংসের আশঙ্কা হতে নওরোযকে নিরাপদ করেছে।

নওরোয এতকাল জাতীয়তার চেতনায় জীবন্ত ছিল। এবার ধর্মীয় চেতনায় প্রাণবন্ত হয়েছে। জাতীয় ও বংশগত প্রথা, ধর্মীয় ঈমান আর জনগণের মনে সৃষ্ট নতুন প্রেমে সিক্ত হয়ে মজবুত ও অটুট বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। পবিত্রতা অর্জন করেছে, ঈমান ও নিষ্ঠায় আকীর্ণ আর দোয়া ও দরূদে অলংকৃত হয়েছে।

নওরোয শুরু হয়েছিল অগ্নিউপাসক পুরোহিতদের ধর্মীয় গানে, আভেস্তার পাঠ দিয়ে আর আহুরামাযদার আশীর্বাদ নিয়ে; কিন্তু ইসলামের আগমনের পর কুরআন ও আল্লাহর ভাষা দিয়ে আর নামায ও দোয়ার আলোকসজ্জায় সজ্জিত হয়ে নতুন প্রাণ পেয়েছে।

নওরোয কলুষিত কালচক্রের এই অশীতিপর বৃদ্ধ- অনেক শতাব্দীর ধুলোবালি তার চেহারায় এসে বসেছে সত্য, কিন্তু নতুনের প্রাণস্পন্দনে সে নিজেই সকলের চেহারা থেকে কালিমার আঁচড়ে ধুয়েমুছে সাফ করে দেয়। নওরোয তার মহান দায়িত্ব সবসময় প্রচণ্ড শক্তি, প্রেম, বিশ্বস্ততা ও আন্তরিকতার মধ্য দিয়ে আঞ্জাম দিয়েছে। জাতির চেহারা হতে দুঃখ-দুশ্চিন্তা ও ম্রিয়মানতার জং পরিষ্কার করেছে। আর মানুষের প্রাণকে প্রকৃতির আনন্দ-উচ্ছল প্রাণের সাথে যুক্ত, একাত্ম ও একাকার করেছে।

অনুবাদ: ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী