All posts by dreamboy

ইরানের সাংস্কৃতিক নীতির লক্ষ্য, মূলনীতি ও ভিত্তি

ইরানে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের দায়িত্বে নিয়োজিত সুপ্রীম কাউন্সিল দ্ইু বছর ধরে আলাপ-আলোচনার পর ইরানের সাংস্কৃতিক নীতি প্রণয়ন ও সংকলন করেছে। সুপ্রীম কাউন্সিল এই বিধিমালাকে লক্ষ্য’, ‘ভিত্তিমূলনীতিএই তিনটি ভাগে বিভক্ত করে অনুমোদন করেছে। এই সাংস্কৃতিক নীতি প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে সুপ্রীম কাউন্সিল একটি বিবৃতি প্রচার করে। নিচে তার সংক্ষিপ্তসার তুলে ধরা হলো :

বিবৃতিতে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের রাহবার আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ীর একটি মন্তব্য উল্লেখ করা হয়। ১৯৯১ সালে সুপ্রীম কাউন্সিলের সদস্যদের সাথে এক বৈঠকে রাহবার খামেনেয়ী দেশের লোক সংস্কৃতির উন্নয়ন ও বিকাশের উপর গুরত্ব আরোপ করে বলেন, দেশের জন্যে একটি সাংস্কৃতিক নীতি প্রণয়ন ও অনুমোদন অত্যন্ত জরুরি।

সুপ্রীম কাউন্সিল অনুমোদিত নীতিমালা নিম্নোক্তভাবে বিভক্ত :

লক্ষ্য

ইসলামী প্রজাতন্ত্র যে সাধারণ সাংস্কৃতিক লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে এবং এ ধরনের বিধিমালা প্রণয়নের পশ্চাতে যে দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করেছে তা হচ্ছে :

ক. ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সাংস্কৃতিক লক্ষ্য

১.         সমগ্র দেশ তথা বিশ্বব্যাপী মানবীয় ও ইসলামী সংস্কৃতির প্রচার এবং ইসলামী বিপ্লবের বাণী ও সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেয়া।

২.         সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা অর্জন, অবক্ষয়ের চিহ্নসমূহ ও বিদেশী সংস্কৃতির ভিত্তিকে নির্মূল করা এবং বিচ্যুত রীতিনীতি ও কুসংস্কার থেকে সমাজকে মুক্ত করা।

৩.         জীবনের সকল ক্ষেত্রে মানুষের উদ্ভাবনী শক্তিকে পরিশুদ্ধ করা এবং আল্লাহ তাআলা মানুষকে যে প্রতিভা ও জ্ঞান দান করেছেন তাকে কাজে লাগানো।

৪.         পরিশুদ্ধি ও পবিত্রতা অর্জনের জন্য মানুষকে নৈতিক শক্তি ও খোদায়ী ঈমানে ভূষিত করা।

৫.         প্রতিটি ব্যক্তি বিশেষ তথা সাধারণ জীবনে ইসলাম ও ইসলামী বিপ্লবের মূল্যবোধ বজায় রাখা এবং সেগুলোকে রক্ষার জন্য পরিপূর্ণভাবে সাংস্কৃতিক বিপ্লব সাধন এবং একটি পরিশুদ্ধ ও খাঁটি জীবনে সমাজ উপনীত না হওয়া পর্যন্ত সাংস্কৃতিক আন্দোলন অব্যাহত রাখা।

৬.         সময়ের চাহিদা পূরণ ও অগ্রগতিকে এগিয়ে নেয়া, অন্যান্য মানব সমাজের সাংস্কৃতিক সাফল্যকে বিশ্লেষণ ও সংশোধন করা এবং সেগুলো থেকে ইসলামী মূল্যবোধ ও মৌলনীতির সাথে সামঞ্জস্যশীল দিকগুলোকে কাজে লাগানো।

 খ. সাংস্কৃতিক নীতির লক্ষ্য

১.         আদর্শগত বিশ্বাস ও মূল্যবোধ এবং দেশের অভ্যন্তর ও বিশ্বজগৎ থেকে আহরিত অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলন পরিচালনার জন্য প্রধান প্রধান নীতি-নির্দেশনা ও অগ্রাধিকার নির্ধারণ ও তা সংকলন করা।

২.         বিভিন্ন সরকারী সংস্থাকে তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে বলা এবং সমাজের সাংস্কৃতিক চাহিদা পূরণের জন্য বিদ্যমান সকল সামর্থ্যকে সংগঠিত করা ও কাজে লাগানো।

৩.         আধ্যাত্মিক চেতনা ও ইসলামী মূল্যবোধের উপর গুরুত্ব প্রদান, সময়ের চাহিদা মোতাবেক জাতীয় সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, সংহত ও শক্তিশালীকরণ এবং দুর্বলতা দূরীকরণ ইত্যাদির মাধ্যমে অগ্রগতির জন্য একটি পূর্ণ মাত্রার প্রস্তুতি গ্রহণ।

৪.         দেশের সাংস্কৃতিক নীতির সাথে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও অন্যান্য পরিকল্পনাকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার পদক্ষেপ গ্রহণ।

৫.         সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের তত্ত্বাবধান ও পর্যবেক্ষণের জন্য সাংস্কৃতিক পরিকল্পনা গ্রহণ, জনসাধারণের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে স্বাধীনতা ও সহায়তা দান, সরকারী-বেসরকারী খাতের মধ্যে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা, জনসাধারণের মধ্যে জ্ঞানের বিস্তার ও সচেতনতা সৃষ্টির জন্য একটি সাংস্কৃতিক জিহাদ পরিচালনা এবং জনসাধারণকে গবেষণা ও উদ্ভাবনের দিকে উদ্বুদ্ধ করে তোলা।

 ভিত্তি

ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সাংস্কৃতিক নীতি বিশ্বজনীনতা ও মানব জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট ইসলামী আদর্শ থেকে উৎসারিত এবং সংবিধান সাংস্কৃতিক নীতির ভিত্তিতে প্রণীত। সাংস্কৃতিক নীতির ভিত্তিসমূহ হলো :

১.         ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনের সকল ক্ষেত্রে একত্ববাদ আদর্শের প্রাধান্য এবং ওহী, নবুওয়াত, ইমামত, ন্যায়বিচার ও আখেরাতের উপর চূড়ান্ত বিশ্বাস।

২.         আত্মার অবিনাশিতা এবং আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে মানুষের সম্মান ও মর্যাদা এবং পরিশুদ্ধির পথে মানুষের সহায়তার জন্য জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার চর্চা।

৩.         মানব জীবনের বিকাশ ও সাফল্যের জন্য খোদায়ী প্রকৃতিকে লালন।

৪.         সৃষ্টির বিবেচনায় সকল মানুষের মধ্যে সমতা, ইসলামের সর্বজনীনতার বাণী মোতাবেক ধর্ম ও বর্ণের মধ্যে কোনরকম পার্থক্য না করা এবং ইসলামের আহ্বান অনুসারে মানবীয় কার্যক্রমের মাধ্যমে সাধারণ্যে সহযোগিতার বিস্তার।

৫.         মানুষের আধ্যাত্মিক ও বস্তুগত প্রকৃতি এবং তার জীবনের ব্যক্তিগত, সামাজিক, বৈষয়িক, আধ্যাত্মিক, দৈহিক, মানবিক ও আবেগ অনুভূতির বিকাশ ও উন্নতি।

৬.         কল্যাণকামিতা ও আদর্শবাদিতার প্রতি মানুষের অনুরাগ বা আগ্রহ, লক্ষ্যের প্রতি নিষ্ঠা এবং জ্ঞান, পরিশুদ্ধি ও নৈতিকতার প্রতি গুরুত্ব প্রদান।

৭.         আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ ও নৈতিক শক্তি সৃষ্টি; মানুষের মধ্যে মুক্তি, স্বাধীনতা ও মর্যাদাবোধ জাগ্রত করা এবং সমাজ ও মানুষের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য ঈমানী বলে বলীয়ান করা।

৮.         ন্যায়বিচার, জিহাদ ও বাস্তবভিত্তিক একটি একত্ববাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষের জানার সামর্থ্য এবং প্রতিভা ও উদ্ভাবনী মানসিকতাকে কাজে লাগানো। বৈজ্ঞানিক গবেষণা পরিচালনা ও ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাও হবে সাংস্কৃতিক চর্চার ভিত্তি।

৯.         মানুষের মর্যাদা ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলামী সমাজে যথার্থ আধ্যাত্মিক শক্তি ও নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা।

১০.       নিজের সামাজিক পরিবেশের প্রতি মানুষের নেতিবাচক ও ইতিবাচক দায়িত্বের আলোকে পরিবেশকে সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচারভিত্তিক করা, জনসাধারণকে সকল ব্যাপারে একটি দিক-নির্দেশনায় পরিচালনা করা এবং অবমাননা, মুনাফেকী, দুর্নীতি, অত্যাচার-নির্যাতন, প্রভুত্ব ও দাম্ভিকতার মূলোৎপাটন করা।

 মূলনীতি

সাংস্কৃতিক বিপ্লবের দায়িত্বে নিয়োজিত সুপ্রীম কাউন্সিল ইরানের সাংস্কৃতিক নীতির যেসব মূলনীতির প্রণয়ন ও অনুমোদন করে তা নিচে উল্লেখ করা হলো :

১.         ইসলামী ও জাতীয় ঐতিহ্য রক্ষা এবং ইরানী ও ইসলামী সভ্যতার পুনরুজ্জীবন ও সংরক্ষণের লক্ষ্যে বিভিন্ন ধর্মীয়, বৈজ্ঞানিক সাহিত্য, লোক-সাহিত্য ও চিত্রকলার ক্ষেত্রে জাতীয় ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের প্রতি স্বীকৃতি ও মূল্যায়ন।

২.         ইসলামের সংস্কৃতি ও সভ্যতার উপর ব্যাপক জ্ঞান অর্জন, ইসলামী নৈতিকতা ও শিক্ষার বিকাশ এবং ইসলামী ও ইরানী ইতিহাসের মহান ব্যক্তিত্ববর্গের পরিচিতি উপস্থাপন।

৩.         দেশ ও জাতিসমূহের সাথে গতিশীল সম্পর্ক এবং বিশ্বের মুসলমান ও অন্যান্য জাতির সাথে সম্পর্ক জোরদার করা।

৪.         মানবীয় সংস্কৃতি ও অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ধারণা অর্জন এবং যথাযথ ও সকল উপায় অবলম্বনে আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক সাফল্য কাজে লাগানো।

৫.         ধর্মীয় মতপার্থক্য ও জাতিগত বিরোধের প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে জাতীয় ও ধর্মীয় সংহতি সৃষ্টি এবং ঐক্যের পথে সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করা।

৬.         সমাজের বৈজ্ঞানিক, সাংস্কৃতিক ও কারিগরি মানকে উন্নত করতে এবং শিক্ষা ও সাক্ষরতা বিস্তারে নিরলস প্রচেষ্টা চালানো।

৭.         ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়ন ও বিকাশে আরো দৃষ্টি দান।

৮.         নবতর আবিষ্কার-উদ্ভাবনে সমর্থন ও সহায়তার জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক ও উদ্ভাবন উপযোগী ক্ষেত্র তৈরি করা।

৯.         মানুষের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, বিচার সংক্রান্ত ও অর্থনৈতিক জীবনের সকল ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা বিধান করা।

১০.       অধ্যয়ন ও গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা এবং বিভিন্ন উদ্দেশ্যে এর ফলাফলকে কাজে লাগানো।

১১.        পরস্পর বিরোধী আদর্শসমূহের মধ্য থেকে একটিকে বাছাইয়ের জন্য মানুষের চিন্তা ও বিশ্লেষণ শক্তিকে জোরদার করা।

১২.       কুসংস্কার, প্রতিক্রিয়াশীল ধারণা, গোঁড়ামি, বহু দর্শনে বিশ্বাসের প্রবণতা ও বিদেশীদের প্রতি আনুগত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম।

১৩.       সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য সংগ্রামের চেতনা বিস্তার।

১৪.        মিতব্যয়িতার নীতি অনুসরণ এবং অপব্যয় ও অপচয়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে স্বাধীনতা ও স্বনির্ভরতা অর্জনের প্রচেষ্টার উপর গুরুত্ব আরোপ।

১৫.       খেলাধুলার উপর সার্বিক গুরুত্ব প্রদানের জন্য শারীরিক ও মানসিক প্রশিক্ষণ দান এবং গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক আবশ্যকতা হিসাবে শরীরচর্চার ব্যবস্থা করা।

১৬.       সকল ক্ষেত্রে ইসলামী শিক্ষা ও চেতনার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যথার্থ ও গঠনমূলক চিত্রকলার উন্নয়ন, পুনরুজ্জীবন ও প্রবর্তন।

১৭.        যুব সমাজকে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিল্পকর্ম ইত্যাদি কাজে আরো সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করার জন্য তাদের ভূমিকা ও সামাজিক মর্যাদাকে স্বীকৃতি দান এবং তাদের অবস্থা পর্যালোচনা করা।

১৮.       মহিলাদের অধিকার ও মর্যাদা সম্পর্কে গবেষণা-পর্যালোচনা করা এবং তাদের ইসলামী চরিত্রকে জোরদার করা। সেই সাথে ভুল রীতিনীতি ও বিশ্বাসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং মহিলাদেরকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, চিত্রকলা ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করা।

১৯.       সরকারী তদারকীর অধীনে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বিস্তার ও উন্নয়নের লক্ষ্যে সংস্কৃতি, চিত্রকলা, বিজ্ঞান ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে জনসাধারণের অংশগ্রহণ ও মতামত গ্রহণের ক্ষেত্র তৈরি এবং সেই সাথে সকল বেসরকারী তৎপরতা ও কার্যব্যবস্থাকে সহায়তা দেয়া।

২০.       সংস্কৃতি, চিত্রকলা ও সামাজিক বিষয়াদির জন্য ইতিবাচক নীতি গ্রহণ এবং ব্যক্তি তথা সমগ্র সমাজের জন্য সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি এবং মিতাচারিতা, কল্যাণকামিতা, একাগ্রতা, শিষ্টাচার ও সৎ চিন্তাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উদ্যোগ গ্রহণ এবং বিশৃঙ্খলা, অস্থিরতা, গোঁড়ামি ও অহংকার পরিহার করে চলা।

২১.       সামাজিক চেতনা তথা ব্যক্তিস্বার্থের উপরে সামষ্টিক স্বার্থকে স্থান দেয়ার মানসিকতা জোরদার করার উদ্দেশ্যে প্রশিক্ষণ ও উৎসাহ দান : আইন-শৃঙ্খলার প্রতি শ্রদ্ধাকে একটি সামাজিক ঐতিহ্য হিসাবে গড়ে তোলা এবং আইন-শৃঙ্খলা ও গণ-অধিকার রক্ষায় সরকারের উদ্যোগ গ্রহণ।

২২.       যথার্থ জাতীয় ও ধর্মীয় পরিচয় জানা ও বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা চালানো, সেগুলো সংরক্ষণ এবং সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।

২৩.       গঠনমূলক সমালোচনার চেতনা বিস্তার, ব্যক্তি ও সামাজিক অধিকারের সমর্থনে সমালোচনার সুযোগ দান, আইনানুগ কাজের পরিবেশকে ব্যাপকতর করা এবং প্রচারে ও পরামর্শের মাধ্যমে পাপ কাজ থেকে বিরত রাখা।

২৪.       নৈতিক গুণাবলির অগ্রগতি ও সংহতকরণে সাংস্কৃতিক প্রচার জোরদার করা।

 (নিউজলেটার, ফেব্রুয়ারি ১৯৯২)

হাদীস বর্ণনা ও বিতর্কিত বিষয় পরিহার

মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াকুব আল-কুলাইনী আবু আবদুল্লাহ (ইমাম জাফর সাদেক আ.) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি বৈষয়িক সুবিধা ও স্বার্থের উদ্দেশ্যে হাদীস শিক্ষা করে, পরকালে সে এর বিনিময়ে কিছুই লাভ করবে না। আর যে ব্যক্তি পরকালের কল্যাণের জন্য হাদীস শিক্ষা করে, আল্লাহ তাআলা এর জন্য ইহকাল ও পরকালে তথা উভয় জগতেই তাকে কল্যাণ দান করবেন।’- উসূলে কাফী : আলেমের বৈশিষ্ট্য অধ্যায়

আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) বলেন, ‘তোমরা বিরোধ ও বিতর্ক থেকে সাবধান থাকবে। কেননা, এ দু’টি বিষয় তোমাদের ভাইদের অন্তরকে শত্রুতা দ্বারা সংক্রমিত করে থাকে। এগুলো কপটতার মূল উৎস। কেননা, এগুলো থেকেই কপটতা উৎপন্ন হয়ে থাকে।’- উসূলে কাফি : ঈমান ও কুফর অধ্যায়

আবু আবদুল্লাহ (ইমাম জাফর সাদেক আ.) বলেন, ‘হে লোকেরা! তোমরা বিতর্কিত বিষয় থেকে সাবধান থাকবে। কারণ, এটা অন্তরকে বিহ্বলিত ও পরাজিত করে এবং কপটতা বৃদ্ধি করে এবং অন্তরে অসদিচ্ছা সৃষ্টি করে।’- উসূলে কাফী : ঈমান ও কুফর অধ্যায়, হাদীস-৮

(নিউজলেটার, মে ১৯৯২)

রোযা ও দান

নবী করীম (সা.) বলেন : ‘রোজাদার ব্যক্তির জন্য দু’টি খুশি রয়েছে- একটি হচ্ছে ইফতারের সময় আর অন্যটি রোজাদার ব্যক্তি যখন আল্লাহর সঙ্গে মিলিত হবে তখন সে লাভ করবে।’- আল কাফী, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৬৫

নবী করীম (সা.) বলেন, ‘খাদ্যের প্রতি আসক্তি থাকা সত্ত্বেও যখন কোন ব্যক্তি রোজা রাখার কারণে খাদ্য গ্রহণ করতে পারে না (অর্থাৎ খাদ্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকে) নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলা এরূপ ব্যক্তির জন্য বেহেশতের খাদ্য সরবরাহ করবেন এবং বেহেশতের পানীয় দ্বারা তাকে পরিতৃপ্ত করবেন। অর্থাৎ রোজা যখন কোন ব্যক্তির পানাহারের জন্য অন্তরায় হয়ে যায় তখন আল্লাহ তাআলা তাকে বেহেশতের খাদ্য ও পানীয় দ্বারা পরিতৃপ্ত করবেন।’- বিহারুল আনওয়ার, ৯৬তম খণ্ড, পৃ. ৩৩১

হযরত আলী (আ.) বলেন, ‘যে খাটো হাতে দেয় (দান করে) তাকে দীর্ঘ হাতে দেওয়া হবে।’- নাহজুল বালাগা, উক্তি নং ২৩২

ভাষ্যকার রাজী বলেন, হযরত আলী (আ.)-এর উক্তির অর্থ হলো, মানুষ তার নিজস্ব সম্পদ হতে পরোপকারের জন্য যে সামান্যতম জিনিস ব্যয় করে তার বিনিময়ে আল্লাহ তাআলা তাকে বিরাট প্রতিদান দিয়ে থাকেন। ‘খাটো’ ও ‘দীর্ঘ’ হাত বলতে এখানে দু’প্রকারের অনুদানকে বুঝানো হয়েছে। হযরত আলী (আ.) বান্দার অনুদান এবং প্রতিপালক আল্লাহ তাআলার অনুদানের মধ্যে পার্থক্য করেছেন। তিনি বান্দার অনুদানকে খাটো হাতের অনুদান’ এবং আল্লাহর অনুদানকে দীর্ঘ হাতের অনুদান বলেছেন। কারণ, আল্লাহর অনুদান সর্বদাই সৃষ্ট জীবের অনুদান অপেক্ষা বিরাট হয়ে থাকে। আল্লাহর দান হচ্ছে যাবতীয় দান-অনুদানের উৎস।

(নিউজলেটার, মার্চ ১৯৯২)

স্মরণীয় বাণী

হযরত আলী (আ.) তাঁর ছেলে হযরত ইমাম হাসান (আ.)-কে বলেন : যুদ্ধের আহ্বান জানাবে না, আর যদি তোমাকে এরূপ আহ্বান জানানো হয় তা হলে তার জবাব দিবে। নিশ্চয়ই আহ্বানকারী সীমালঙ্ঘনকারী হয়ে থাকে। আর সীমালঙ্ঘনকারী ধরাশায়ী হয়।’- নাহাজুল বালাগা, উক্তি নং ২৩৩

হযরত আলী (আ.)-কে বলা হলো, জ্ঞানী কে তা আমাদেরকে খুলে বলুন। অতঃপর তিনি বলেন : ‘সেই জ্ঞানী যে কোন বস্তুকে যথাস্থানে স্থাপন করে।’ তারপর তাঁকে আবার জিজ্ঞাসা করা হলো : ‘জাহেল বা মূর্খের পরিচয় কি তা বলে দিন।’ অতঃপর তিনি বলেন : ‘বললাম তো।’- নাহজুল বালাগা, উক্তি নং ২৩৫

ভাষ্যকার রাজী বলেন, অর্থাৎ মূর্খ তো ঐ বক্তি যে কোন বস্তুকে যথাস্থানে রাখতে জানে না।

ইমাম সাদেক (আ.) বলেন, যে কেউ প্রচণ্ড গরমের সময় এক দিন রোজা রাখে এবং তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়ে, আল্লাহ তাআলা তার জন্য এক হাজার ফেরেশতা মোতায়েন করে দেন যারা তার মুখম-ল বা চেহারা মাসাহ করে দেন এবং তাকে সুসংবাদ দিতে থাকেন। এরপর যে যখন ইফতার করে, আল্লাহ তাআলা বলেন : ‘কতই না উত্তম তোমার (মুখনিঃসৃত) গন্ধ এবং তোমার আত্মা! হে আমার ফেরেশতাগণ! তোমরা সাক্ষী  থাক, আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম।’- কাফী, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৬৫

উন্নত প্রযুক্তির জঙ্গি বিমান তৈরি করছে ইরান

 উন্নত প্রযুক্তির নতুন ধরনের জঙ্গি বিমান তৈরি করছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রযুক্তিতে দেশীয় বিশেষজ্ঞদের উদ্ভাবিত এ বিমানগুলো সামরিক বাহিনীর বিশেষ অর্জন বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।আজ (বুধবার) এ ঘোষণা দিয়েছেন, ইরানের বিমান বাহিনীর শীর্ষস্থানীয় কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আজিজ নাসিরজাদেহ।তিনি বলেন, “সম্প্রতি আমরা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রিজের সহযোগিতায় অত্যাধুনিক জঙ্গি বিমান তৈরি করেছি।”

এ সামরিক বিমানগুলো তৈরি হলে প্রশিক্ষণ বিমানের জন্য বিদেশের ওপর নির্ভরতা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে বলে জানান কমান্ডার। তিনি আরো বলেন, আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার পাশাপাশি ইরানের সামরিক বাহিনী আকাশ যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষেপণাস্ত্র ও দীর্ঘ পাল্লার অস্ত্র তৈরির জন্য জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

ইরানের বিমান বাহিনী ও এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রিজের যৌথ প্রচেষ্টায় আকাশ থেকে আকাশে ও আকাশ থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করছে। এগুলোর মধ্যে বেশ কিছুর সফল পরীক্ষা চালানো হয়েছে। আর বাকিগুলোর পরীক্ষা খুব শিগগিরি চালানো হবে বলে জানান নাসিরজাদেহ।সাম্প্রতিক সময়ে ইরান প্রতিরক্ষা খাতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি লাভ করেছে। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সামরিক যন্ত্রপাতি তৈরির ক্ষেত্রে এক ধরনের স্বনির্ভরতা অর্জন করেছে।

(সূত্র : রেডিও তেহরান ২১ আগস্ট, ২০১৩)

তেহরান : প্রাচীন গ্রাম আধুনিক নগরী

azadiইরানের রাজধানী তেহরানের বয়স দুই শত বছরের বেশি। কিন্তু ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত এর আকৃতি ছিল অপেক্ষাকৃত ছোট এবং তাতে পাশ্চাত্যের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্যও বিদ্যমান ছিল। মোটামুটিভাবে এককালে তেহরানের পরিবেশ ও ভাবধারা ছিল প্রাচ্যের একটি মফম্বল শহরের মতো।

ইতিহাসবিদরা ইরানের বর্তমান রাজধানীকে নবম শতাব্দীকালের একটি ছোট গ্রাম বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু গ্রামটি কালক্রমে তার পার্শ্ববর্তী আলবুর্জ পাহাড়ের দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকণ্ঠের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর- শাহরে রে-এর সাথে একীভূত হয়ে পড়ে। মোঙ্গল শাসকদের ব্যাপক ভাঙাগড়ার মধ্যে তেহরান ক্রমেই সমৃদ্ধ হতে থাকে। তাদের হত্যাযজ্ঞ থেকে যেসব লোক বেঁচে যেতে সক্ষম হয় তারা তেহরানে চলে আসে। প্রকারান্তরে বহু বছর ধরেই তেহরান একটি প্রাদেশিক শহর হিসাবে পরিগণিত হতে থাকে।

street-level-of-tehran-iranবিশ্বের সর্বাধিক বিখ্যাত শহরগুলো সম্পর্কে লেখা ইয়াকুত হামারীর সুপরিচিত গ্রন্থ মুজামুল বুলদানে ইরানের রাজধানী সম্পর্কে বেশ কিছু মজার কথা লেখা রয়েছে। বলা হয়েছে : তেহরান ছিল একটি বৃহৎ গ্রাম, যার কাঠামো নির্মিত হয়েছে ভূগর্ভে এবং বাসিন্দারা অনুমতি না দিলে কেউ ঐ গ্রামে প্রবেশ করতে পারত না।

তেহরান কিভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করল এবং ধীরে ধীরে আজকের এই বড় শহরে রূপ নিল? জানা গেছে, ঐ অঞ্চলের তদানীন্তন শাসক শাহ ইসমাইলের পুত্র শাহ তাহমাসব সাফাভী যখন সিংহাসনে আরোহণ করেন তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র দশ বছর। তিনি প্রায়ই সাফাভী রাজবংশের শাসকদের প্রথম রাজধানী কাজভীন বেড়াতে যেতেন। এছাড়া তাঁর প্রপিতামহ মরহুম সাইয়্যেদ হামজার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রে শহরস্থ শাহ আবদুল আজিমে যেতেন। ফেরার পথে তিনি তেহরান হয়ে যেতেন এবং শিকার করতেন। ধীর ধীরে তিনি সে স্থানটির বিশেষ অনুরাগী হয়ে ওঠেন এবং ঐ শহরের চারদিকে দুর্গ প্রাচীরের মতো বেষ্টনী গড়ে তোলেন। দুর্গ প্রাচীরটির পরিধি ছিল পনের হাজার ফুট।

বাদশাহর ধর্মবিশ্বাস ছিল প্রবল। তিনি পবিত্র কুরআনের সূরা সংখ্যার সাথে সমাঞ্জস্য রেখে নগরীর চারিদিকে ১১৪টি টাওয়ার নির্মাণের আদেশ দেন। নির্মিত প্রতিটি টাওয়ারে পবিত্র কুরআনের এক একটি সূরা লিপিবদ্ধ করা হয় যাতে ঐ শহর এবং শহরের বাসিন্দারা দৈব-দুর্বিপাক থেকে রক্ষা পায়। এছাড়া নির্মাণ করা হয় দুটি তোরণ এবং দুর্গ প্রাচীরের অভ্যন্তরস্থ দুটি জায়গা থেকে মাটি সরিয়ে দুটি গহ্বর সৃষ্টি করা হয়। গহ্বর দুটির একটির নাম দেয়া হয় চালে ময়দান’ (স্কোয়ার গহ্বর) এবং অপরটির নাম দেয়া হয় চালে হেসার’ (দুর্গ গহ্বর)। আজকের দিনে ঐ গহ্বর দুটি ভরাট হয়ে গেলেও ঐ জায়গাগুলোর নাম পূর্ববতই রয়ে গেছে।

Iran_hotel (1)কাজার শাসনামলের বিশিষ্ট লেখক ও রাজনীতিবিদ আবদুল্লাহ মোস্তাফী তাঁর দি স্টোরি অব মাই লাইফগ্রন্থে লিখেছেন, তাহমাসব প্রাচীর ধ্বংস এবং শহরটি বেড়ে উঠলে পর কাজার শাহীবংশের প্রতিষ্ঠাতা আগা মুহাম্মদ খান নগরীর চারিদিকে একটি নতুন দেয়াল নির্মাণ করেন। তিনি তাঁর অভিষেকের দিন ১৭৮৩ সালের ২১ মার্চ তেহরানকে রাজধানী ঘোষণা করেন। তখন তেহরানের লোক সংখ্যা ছিল মাত্র দশ থেকে বিশ হাজার।

১৯২৫ সালে রেজা শাহ ক্ষমতায় আরোহণ করে তেহরানকেই দেশের রাজধানী হিসাবে বহাল রাখে এবং শহরটিকে আধুনিকায়নের প্রচেষ্টা চালায়।

১৯৪৫ সাল থেকে তেহরান শহর উত্তরদিকে সম্প্রসারিত হতে থাকে। আলবুর্জ পাহাড়ের পাদদেশে তেহরান ও শেমিরানের মধ্যবর্তী সমস্ত মরু এলাকায় নতুন নতুন উপশহর সৃষ্টি হতে থাকে।

পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে উপশহর ও বড় বড় দালান-কোঠা গড়ে উঠার মধ্য দিয়ে তেহরান একটি বিভিন্নমুখী আধুনিক মেট্রোপলিটন শহর হিসাবে বেড়ে উঠতে থাকে। দক্ষিণে মরুভূমি ও পতিত জমি অঞ্চলে আবহাওয়া অতি উষ্ণ থাকায় নগরায়ণ বৃদ্ধি পায়নি। তবে ছোট ছোট শিল্প গড়ে উঠেছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে এবং বিশেষ করে দ্রুত নগরায়ণের প্রয়োজনীয় ইট ও অন্যান্য সামগ্রীর কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই অঞ্চলে ব্যাপক শিল্প চুল্লীর দরুন বায়ূ দূষিত হয়ে পড়ে এবং সেখানে স্বাভাবিক ও সুস্থ জীবনযাত্রা খানিকটা অসুবিধাজনক।

এই অবস্থার মধ্যে প্রাদেশিক শহর এবং অন্যান্য মফস্বল এলাকা থেকে হাজার হাজার লোক নির্মাণ কাজে অংশ নিতে এবং অন্যান্য আকর্ষণীয় ব্যবসা ও শিল্পখাতে আকৃষ্ট হয়ে তেহরান শহরের দিকে ঝুঁকতে থাকে।

11111111111নিয়ন্ত্রণহীনভাবে তেহরান শহরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার নগর কর্তৃপক্ষের পক্ষে সকল লোকের গৃহসংস্থান করা কঠিন হয়ে পড়ে। তেহরান শহরের বর্তমান সৌন্দর্য-শোভা, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ভাবধারার সংমিশ্রণ এবং জীবনযাত্রার বহুমুখী সুযোগ-সুবিধার দরুন সকলে সহজেই তেহরানের দিকে আকৃষ্ট হতে থাকে। খুব শীঘ্রই তেহান হয়ে ওঠে একদিকে সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং অপরদিকে ব্যবসা-বাণিজ্যের এক গতিশীল কেন্দ্র। তৈরি হয় আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা। এভাবে তেহরান কেবল দেশের অভ্যন্তরে নয়, গোটা বিশ্বের মাঝে এক গুরুত্বপূর্ণ আসন করে নেয়। ইউরোপীয় শহরগুলোর মতো তেহরানেও সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা হয়।

খোলা হয় বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের জন্য হাজার হাজার ছাত্র আসে মফস্বল এলাকা থেকে। অর্থশালী পরিবারগুলো আরো ভালো ব্যবসা-বাণিজ্য এবং তাদের ছেলেমেয়েদের লেখা পড়ার সুবিধার্থে তেহরানে এসে বসবাস করতে শুরু করে।

বিগত চার দশকে তেহরান বিশ্বের একটি দ্রুত বর্ধমান রাজধানী শহরে পরিণত হয়েছে। এটি এমন একটি শহর যেখানে প্রতিবছরই ব্যাপক হারে লোক আসছে বসবাস করতে এবং এর বাসিন্দাদের যা চাহিদা তা পূরণ করা কর্তৃপক্ষের জন্যে অনেকটা কঠিন হয়ে পড়েছে। এতসবের মধ্যে দ্রুত উন্নয়নের প্রমাণ মিলে প্রায় সর্বত্র। নজরে পড়ে গগনচুম্বী অট্টালিকা, প্রশস্ত জনপথ, বড় বড় হোটেল-রেস্তোরাঁ, দোকান-পাট, সিনেমা হল, বাড়িঘর এবং সেগুলোর সাথে ঘোরানো পেঁচানো রাস্তা আর রাস্তায় রাস্তায় দ্রুত ধাবমান যানবাহন। ত্রিশ বছর আগে এই শহরের আকৃতি যা ছিল তার তুলনায় বর্তমান আকার পাঁচগুণ।

তেহরান শহরে লোকসংখ্যা দ্রুত বেড়ে যাওয়ায় তুলনামূলকভাবে বাড়ি ঘরের সংখ্যা কম। তাই ভাড়া বেড়ে গেছে এবং আশেপাশের জমির দামও বেড়ে গেছে। তাই চাহিদা পূরণের জন্য মূল শহরে নির্মাণ কাজের ব্যাপক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।

শহরের আশে পাশে গড়ে উঠেছে অনেক উপশহর। কিন্তু জনসাধারণ তাদের প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে নতুন নতুন বাড়ি ঘর গড়ে নিয়েছে। বলা হয়ে থাকে যে, জাপানের রাজধানী টোকিওর পর এখন তেহরানই বিশ্বের সর্বাধিক জনবহুল শহর। এখানে রয়েছে বিপুল সংখ্যক মোটরগাড়ি আর বিপুল সংখ্যক কল-কারখানা। পরিস্থিতি এমন যে, যানবাহন চলাচলের ভীড় এড়ানোর জন্য সরকারকে একটি নয়া ট্রাফিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হয়েছে। এই পরিকল্পনা মোতাবেক দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের সাথে যোগাযোগ রক্ষাকারী বাসসমূহের টার্মিনালসমূহ নগরীর কেন্দ্রীয় এলাকা থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে এবং নির্ধারিত ট্রাফিক জোনগুলোতে সকাল সাড়ে ছয়টা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত বেসরকারি যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

তাই আজ তেহরান একটি মেট্রোপলিটন শহর। সরকার এর উন্নয়নে সার্বিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ১৯২২ সাল পর্যন্ত যে শহরে কোন মেয়র ছিল না সেই শহরকে সুশৃঙ্খল করে গড়ে তোলার জন্য গ্রহণ করা হয়েছে সযত্ন পৌর পরিকল্পনা।

পরিবেশ রক্ষার জন্য তেহরান পৌরসভা ইতিমধ্যেই অর্থাৎ ১৯৯১ সালের মার্চ মাসের মধ্যে পূর্বের পনের হাজার হেক্টরের স্থলে ২৫ হাজার হেক্টর জমিকে রাজধানী শহরের গ্রীন-বেল্ট হিসাবে গড়ে তুলেছে।

চলতি পাঁচসালা পরিকল্পনায় প্রাথমিক পর্যায়ের কর্মসূচিতেই রয়েছে তেহরানের পয়ঃনিষ্কাশন উন্নয়ন প্রকল্প। এই প্রকল্পের অধীনে রয়েছে রাজধানীর আট হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকায় পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা চালু এবং উত্তর ও দক্ষিণ তেহরানে দুটি বিশাল আকৃতির পয়ঃনিষ্কাশন লাইন স্থাপন। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে তেহরান, কারাজ, ভারামিন ও শাহরিভারের খামার জমিতে ব্যবহার উপযোগী একশা কোটি ঘনমিটার নিষ্কাশন লাইন প্রতিষ্ঠিত হবে।

বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহের জন্যে ২৫ কোটি ডলার ও ৮০ কোটি রিয়াল ব্যয় সাপেক্ষ একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলা হয়েছে, তেহরানে প্রতি বছর ৬০ কোটি ঘনমিটার পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। জনসংখ্যার ক্রমবৃদ্ধি এবং নগর উন্নয়নের ফলে প্রয়োজনীয় খাবার পানির চাহিদা মেটানোর জন্যে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে আরো ১৫ কোটি ঘন মিটার পানি উত্তোলনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

এছাড়া জনসাধারণের বিনোদন সুবিধা বৃদ্ধির জন্য বর্তমান পার্কগুলোর উন্নতি সাধন নতুন একটি পার্ক প্রতিষ্ঠা এবং একশ লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠাসহ অন্যান্য পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়েছে।

(নিউজলেটার, জানুয়ারি ১৯৯২)

ইসলামী বিপ্লবের সাফল্য

ইসলামের উত্থান ও দাম্ভিক শক্তির পতন

ইরানে আড়াই হাজার বছরের শাসনের সর্বশেষ যোগসূত্র একটি শক্তিশালী শাসককে উৎখাত করে সে স্থলে একটি জনপ্রিয় বিপ্লবের মাধ্যমে ইসলামী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কাহিনী তথা ইসলামী বিপ্লবের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে মুসলমান ও অমুসলমান সবাই সেখান থেকে মূল্যবান অনেক কিছু শিক্ষালাভ করতে পারবে।

এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বেচ্ছাচারী শাহের আমলে ইরানের পরিস্থিতি সংক্ষেপে তুলে ধরা এবং ইসলামী বিপ্লব কিভাবে সফল হয়েছে তা ফুটিয়ে তোলা। ইসলামী বিপ্লবের বিরুদ্ধে বিশ্বের দাম্ভিক শক্তিসমূহের ষড়যন্ত্রের স্বরূপ প্রকাশ করাও এই নিবন্ধনের উদ্দেশ্য।

শাহ আমলের ইরানের সরকার পদ্ধতি সম্পর্কে বলতে গেলে আমরা সংক্ষেপে এ কথাই বলতে পারি যে, ঐ সময় যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সর্ববিষেয়ের উপর আধিপত্য বিস্তার করেছিল। শাহ পুরোপুরিভাবেই তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং একটি পুতুলের মতো তাদের আদেশ-নির্দেশ অনুসরণ করত। সুতরাং ইরান ঐ সময় মারাত্মকভাবে ইসলামবিরোধী নীতি অনুসরণ করছিল। দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৯৯ ভাগ মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও ঐ অন্ধকারাচ্ছন্ন বছরগুলোতে বিভিন্ন পন্থায় তাদেরকে অপমানজনক অবস্থায় ফেলা হয় এবং তাদের উপর নির্যাতন চালানো হয়। এই ধরনের পন্থায় ধর্মীয় নেতাদের উপর অত্যন্ত চাপ প্রয়োগ করা হয়। পাহলভী শাসকগোষ্ঠীর ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করায় ইসলামী আন্দোলনের নেতারা প্রায়ই হামলার শিকার হতেন। অধিকাংশ ধর্মীয় নেতাকে হয় কারাগারে প্রেরণ করা হয় আর না হয় তাঁদের উপর তীক্ষè দৃষ্টি রাখা হয়। এসব ইসলামী নেতাকে স্তব্ধ করে দেয়ার উদ্দেশ্যে শাহের এজেন্টরা ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে পবিত্র কোম নগরীতে প্রায়ই হামলা চালাত। একই কায়দায় তারা বিশ্ববিদ্যালয়সমূহেও থাবা বিস্তার করত। সত্যসন্ধানী ছাত্রদের বিক্ষোভ প্রতিবাদ দমন করাই ছিল এই হামলার লক্ষ্য। ছাত্ররা তাদের প্রিয় নেতা ইমাম খোমেইনী (রহ.)-কে বলপূর্বক নির্বাসনে পাঠানো এবং ইসরাইলের প্রতি শাহের সরকারের সমর্থনসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করত।

ইসলামী বিপ্লবের লাল মশাল জ্বলে ওঠার পূর্বে শাহের শাসনের অন্তিমকালে শাসকগোষ্ঠী ইরানী জাতির মধ্য থেকে সকল ইসলামী প্রবণতা ধ্বংস করা, অন্যান্য মুসলিম দেশ থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করা এবং তাদের সমৃদ্ধ ইসলামী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে সরিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে ইরানের সাম্প্রতিক ইতিহাসে প্রভাব বিস্তারকারী কয়েকটি পদক্ষেপ নেয়ার চেষ্টা করে। স্বৈরাচারী শাহ এসব কৌশল গ্রহণ ছাড়াও হিজাব পরিধানকারী মহিলাদের বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, এমনকি কতিপয় হোটেল ও রেস্তোরাঁয় প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। শাহ যে যুক্তরাষ্ট্রের হাতের পুতুল এবং ইসলাম ও মুসলমানদের প্রকাশ্য শত্রু তা তার এসব প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে এবং এতে তার আসল চেহারা ধরা পড়ে যেত। এই সত্য রোগ-ব্যাধি জর্জরিত সমাজের বিরুদ্ধে সংগ্রামে মুসলমানদেরকে দৃঢ় সংকল্প করেছে। মুসলমান ও ধর্মীয় নেতাদের একশবছরেরও অধিক সময়ের সংগ্রামের মধ্যে ইসলামী বিপ্লবের শিকড় প্রোথিত। ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর নেতৃত্বে ১৯৬৩ সাল থেকে এই বিপ্লব চলতে থাকে এবং ১৯৭৮ সালের পূর্ব পর্যন্ত তা ছিল অনেকটা সুপ্ত অবস্থায়। ঐ বছর ইমাম খোমেইনীর জ্যেষ্ঠ পুত্রের মৃত্যু এবং শাহের তল্পীবাহক একটি পত্রিকায় ইমামের প্রতি চরম অবমাননাকর একটি নিবন্ধ প্রকাশ বিপ্লবের স্ফুলিঙ্গে যেন ঘি ঢেলে দিল। এই বিপ্লবের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে চারদিকে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়লো যে, পাহলভী বংশের ভিত্তিমূলকেই পুড়িয়ে ছারখার করে দিল। ইসলামী বিপ্লবের সাফল্যের পিছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে উপাদানটি কাজ করেছে সেটি হচ্ছে জনগণ এবং ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর বিজ্ঞ নেতৃত্ব। যেসব জাতি নিজেদেরকে বিদেশীদের গোলামি হতে মুক্ত করতে চেষ্টা করছে এবং সত্যিকার স্বাধীনতা লাভ করতে চাইছে তাদের জন্য এটা খুবই ভাল শিক্ষা হতে পারে। তাদের এটা জানা উচিত যে, শত্রুদের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করতে হলে এবং আল-কুদসকে ইহুদিবাদী জবর দখলকারীদের হাত থেকে মুক্ত করতে হলে তাদেরকে অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

এটা প্রত্যক্ষ করা গেছে যে, ইসলামী বিপ্লবে সর্বস্তরের জনগণ অংশ নিয়েছে। বিপ্লবের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপনে কোন কিছুই তাদেরকে বাধা দিতে সক্ষম হয়নি। সর্বস্তরের মানুষ ইসলামের পতাকাতলে সমবেত হয়েছে এবং ইমামের নির্দেশ অনুসরণ করেছে। এভাবেই তারা রেজা শাহ পাহলভীর ইসলামবিরোধী সরকারকে উৎখাতের সংগ্রামে জয়ী হয়েছে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য তাদের অনেককেই শাহাদাত বরণ করতে হয়েছে। ইসলামী বিপ্লবকে সফল করে তোলার লক্ষ্যে তারা জীবন বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠিত হয়নি। ১৭ শাহরিভার ১৩৫৭ (সেপ্টেম্বর ১৯৭৮) কালো শুক্রবারশাহের সৈন্যদের গুলিতে কয়েক হাজার লোক শহীদ হন। এর মধ্যে শত শত সাহসী মহিলা এবং শিশুও ছিল। ঐ দিনের শহীদ এবং আহতদের রক্তের আখরে ইরানের মুসলমানদের সংগ্রামের ইতিহাসের আরেকটি অধ্যায় রচিত হলো।

ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর আস্থা এবং দৃঢ়তা ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। ইমাম (রহ.)-এর সবচেয়ে অনুপ্রেরণাদায়ক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, শাহকে উৎখাত করা সম্ভব- একথা যখন কেউ বিশ্বাসই করতে পারত না ঠিক সেই সময় তাঁর লক্ষ্য অর্জন এবং চূড়ান্তভাবে বিজয়ের ব্যাপারে তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী ছিলেন। ইমামের এই বিশ্বাস ও দৃঢ়সঙ্কল্প আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ রহমতস্বরূপ। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ধর্মের নামে যে কোন শক্তি বিজয় অর্জনের জন্য চেষ্টা করবে তিনি তাকে বিজয়ী করে দেবেন। আল্লাহ তাআলার রহমতের উপর ভিত্তি করে ইমাম খোমেইনী (রহ.) তাঁর দীর্ঘ নিঃসঙ্গ নির্বাসিত জীবনের পূর্ণ সময়টাতেই ইসলামী বিপ্লবের প্রতি সমর্থন যুগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন এবং সংশয় ও বিপদ-আপদের সময়ও ইসলামের বিপ্লবী চেতনাকে ধরে রাখেন।

ইরানে ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ফলে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে তার সবচেয়ে বড় সামরিক ও অর্থনৈতিক ঘাঁটি হারিয়েছে। দীর্ঘ ৩০ বছরের মার্কিন আজ্ঞাবাহী রেজা শাহ দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয় এবং আরেক মার্কিন পুতুল ও আন্তর্জাতিক ইহুদিবাদী চক্রের দোসর মিসরের আনোয়ার সাদাতের আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।

ইরানের ইসলামী বিপ্লবের সাফল্য বিশ্বের বড় শয়তান (যুক্তরাষ্ট্র)-এর প্রতি মারাত্মক হুমকির সৃষ্টি করে। কারণ, বিশ্বের একশকোটি মুসলমানের মধ্যে এই বিপ্লবের ঢেউ লেগেছে। বিশেষ করে মার্কিন অনুগত দেশগুলোর জনগণের মধ্যে এই বিপ্লবের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ায় তাদের স্বার্থহানির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিশ্বের নির্যাতিত মুসলমানদের জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে ইসলামী বিপ্লব একটি বিরাট ভূমিকা পালন করছে। এই বিপ্লবকে ধ্বংস করার জন বড় শয়তান নানা ধরনের ষড়যন্ত্র করে, কিন্তু আল্লাহর রহমতে সকল ষড়যন্ত্রই নস্যাৎ হয়ে যায়।

যখন যক্তরাষ্ট্র ইরানের উপর হামলা চালানোর জন্য সাদ্দামকে প্ররোচিত করেছিল তখন তাদের ধারণা ছিল ইসলামী প্রজাতন্ত্র ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু সে সময় তারা ইরানী মুসলমানদের আত্মবিসর্জনের দৃঢ় মনোভাব, বিপ্লবের প্রতি তাদের অঙ্গীকার এবং আল্লাহর রহমতের বিষয়টি হিসাবে আনতে ব্যর্থ হয়েছিল।

স্বল্পকালের মধ্যেই ইরানের সকল মানুষ বাথপন্থী শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল। সাদ্দাম তার ভুল বুঝতে পেরে নিজের চাপিয়ে দেয়া এই যুদ্ধ বন্ধের জন্য চেষ্টা করে। কিন্তু বিশ্বের পরাশক্তিবর্গের প্ররোচনায় এবং অঞ্চলের শাসকদের সাহায্যে এই যুদ্ধ দীর্ঘ আট বছর স্থায়ী হয়। ইরান যখন নিশ্চিত জয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল ঠিক সে সময়ই যুদ্ধ বন্ধ করা হয়।

আল্লাহর অসীম রহমতে ইসলামী বিপ্লবের শত্রুরা আজ বিপর্যস্ত। চারদিকে আজ ইসলামী বিপ্লবের জয় জয়কার। বিশ্বের নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষ আজ ইসলামী বিপ্লবের পক্ষে আশার আলো দেখতে পেয়েছে।

(নিউজলেটার, ফেব্রুয়ারি ১৯৯২)

অধ্যাপক হেসাবী ‘ইরানের আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞানের জনক’ খেতাবে ভূষিত

ড. মাহমুদ হেসাবী বিশ্বের একজন উচ্চতর যোগ্যতা ও ধীশক্তিসম্পন্ন অধ্যাপক হিসাবে স্বীকৃত ও সুপরিচিত। তিনি ইরানের বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি অঙ্গনের এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। ড. মাহমুদ হেসাবীর বর্তমান বয়স ৮৮ বছর (১৯৯২ সালে)। এই বয়সেও তিনি শিক্ষাদানের কাজে ব্যাপৃত আছেন এবং ইরানের রাজধানী তেহরানস্থ প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সক্রিয় সহযোগিতা করে চলেছেন।

ইরানিয়ান ইনস্টিটিউট অব সাইন্স ড. মাহমুদ হেসাবীকে ফাদার অব ইরানস মডার্ন ফিজিক্স (ইরানের আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞানের জনক) খেতাবে ভূষিত করেছে। ইরান তথা সমগ্র বিশ্বের একজন শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাবিদ ড. হেসাবী অর্ধ শতাব্দীরও বেশি কাল ধরে ছাত্রদের পড়িয়েছেন এবং তাদেরকে বিজ্ঞানের উচ্চতর ও গবেষণামূলক শিক্ষা প্রদান করেছেন। ফারসি ভাষায় তাঁর একুশটি বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

মাহমুদ হেসাবী ১৯০৩ সালে তেহরানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তার শিক্ষা জীবন শুরু করেন সাত বছর বয়সে লেবাননের রাজধানী বৈরুতস্থ ফ্রেন্স ক্রিশ্চিয়ান স্কুলে। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রারম্ভিককালে স্কুলটি বন্ধ হয়ে গেলে তিনি বৈরুতেরই আমেরিকান হাই স্কুলে লেখাপড়া শুরু করেন। উঠতি বয়সেই ভাষার উপর বিশেষত আবরি ও ফরাসি ভাষার উপর তিনি যে দক্ষতা অর্জন করেন তা ছিল তাঁর অসাধারণ ও উল্লেখযোগ্য ধীশক্তি ও প্রতিভার ইঙ্গিতবহ।

বৈরুতের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে মাহমুদ হেসাবীর ভর্তি হওয়ার সুযোগ প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে শিক্ষাদীক্ষায় তাঁর যোগ্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়। সেখান থেকে তিনি বিজ্ঞানে গ্রাজুয়েট হওয়ার পর মাস্টার্স শ্রেণিতে ভর্তি হন। একই সাথে জনাব হেসাবী সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, জ্যোতির্বিজ্ঞান, অংকশাস্ত্র ও জীব বিজ্ঞানের উপরও ডিগ্রি লাভ করেন। ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র পাঁচ বছর অবস্থাকালের মধ্যেই তিনি এসব যোগ্যতা অর্জন করে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন।

বৈরুত থেকে প্যারিসে গিয়ে জনাব মাহমুদ হেসাবী সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের তাঁর প্রতিভা চর্চা শুরু করেন। সেখানে মাত্র দুবছরেরও কম সময়ে তিনি পদার্থ বিজ্ঞানে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। এই সময়ের মধ্যেই তিনি উপার্জনের জন্য ক্যাপিটালস ইলেক্ট্রিক রেলওয়েজ-এ কর্মরত থাকাকালে ইকোল সুপিরিয়র ডী ইলেক্ট্রিসাইট অব প্যারিস থেকে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে অপর একটি ডিগ্রি অর্জন করেন।

ছয়টি ব্যাচেলর ডিগ্রি, একটি মাস্টার ডিগ্রি ও পিএইচডি ডিগ্রিসহ মাহমুদ হেসাবী ১৯২৭ সালে স্বদেশ ইরানে ফিরে আসেন। সে সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র চব্বিশ বছর। স্বদেশ প্রতাবর্তনের পর তিনি তখনকার সময়ের একমাত্র কলেজ দারুল মোয়াল্লেমিন-এ অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন। তিনি বহু বছর যাবৎ তেহরান টিচার্স ট্রেনিং কলেজ ও তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় কারিগরি ও বিজ্ঞান অনুষদের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।

ইরানে অধ্যাপক হেসাবীর কয়েকটি বড় বড় অবদান হচ্ছে : ইরানিয়ান জিওফিজিক্স ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা, অ্যাটমিক এনার্জি অ্যাসোসিয়েশন গঠন, ইনস্টিটিউট ফিজিক্স প্রতিষ্ঠা এবং অপর কয়েকটি বিজ্ঞান সংগঠন গড়ে তোলা। ১৯৭১ সালে তাঁকে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মানসূচক অধ্যাপক পদ দান করা হয়। জনাব মাহমুদ হেসাবী অধ্যয়ন ব্যপদেশে ফ্রান্সে থাকাকালে কমান্ডার ডী লা লেজিয়ন ডী অনারখেতাবে ভূষিত হন। ঐ খেতাবটি ছিল ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মানসূচক খেতাব।

আন্তর্জাতিকভাবে এই ইরানী শিক্ষাবিদ তাঁর অণুর অক্ষয় তত্ত্ব’-এর কারণে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। বৈজ্ঞানিক আলবার্ট আইনস্টাইনই কেবল এই তত্ত্বকে কার্যকর বলে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন এবং সহায়তা করেছিলেন। লেসার প্রযুক্তি ও অন্যান্য মৌলিক বস্তু বিষয়ে বিশ্বের অন্যান্য খ্যাতনামা বিজ্ঞানী ও পদার্থ বিজ্ঞানীদের সাথে অধ্যাপক হেসাবী কাজ করেন। তিনি বিশ্বের ১৫টি শিক্ষা বিষয়ক সংগঠনের সদস্য ছিলেন।

তিনি নিয়মিত তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে সপ্তাহে দুদিন পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক ও অন্যদের জ্ঞানচর্চায় সহায়তা করেন। তাঁর একটি প্রধান আগ্রহব্যঞ্জক কাজ হলো পবিত্র কুরআন এবং ফারসি সাহিত্য, সংগীত ও খেলা বিষয়ক বিভিন্ন অংশ লিপিবদ্ধ করে রাখা। চিত্রকর্মকে তিনি জীবনের প্রধান রুচিকর উপাদান বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি একে বিজ্ঞানেরও অন্তর্ভুক্ত বলে বর্ণনা করেছেন।

(নিউজলেটার, জানুয়ারি ১৯৯২)

ইমাম খোমেইনী (রহ.) ও ইসলামী সরকারের পররাষ্ট্রনীতি

ইমাম খোমেইনী (রহ.) ইরানের মুসলিম জাতিকে শুধু সম্মান, স্বাধীনতা, মুক্তি ও একটি ইসলামী সত্তাই দান করেননি; বরং জীবনদানকারী মতাদর্শ তথা ইসলামকে বর্তমান বিশ্বের সমস্যা সমাধানের একটি বিপ্লবী ও স্বাধীনতাদানকারী মতবাদ হিসাবে উপস্থাপন করেছেন।

এটা নিঃসন্দেহ যে, যদি ইসলামকে বর্তমান আদর্শিক শূন্যস্থান পূরণের পন্থা হিসাবে উল্লেখ করা হয়, যদি মুসলমানরা তাদের সকল শক্তি নিয়ে বৃহৎ শক্তিবর্গের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে এবং বিশ্বের মুসলিম জনতার নীরব সমুদ্র যদি গর্জন শুরু করে দেয় ও এর তরঙ্গমালা বিশ্ব দাম্ভিক শক্তির মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করে ইসলামের আলোকে ও ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর চিন্তাধারার পথ অনুযায়ী এ সকল কিছুই সম্ভব।

আজকে ইমামের অস্তিত্বের ফুল আর আমাদের মাঝে প্রস্ফুটিত হচ্ছে না, কিন্তু তাঁর চিন্তাধারার সুমিষ্ট ঘ্রাণ আমাদের জীবন, আমাদের সমাজ ও বিশ্বকে আমোদিত করছে।

এই নিবন্ধে আমরা ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সংক্ষেপে তুলে ধরব। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ইমামের দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারা নিয়ে যাতে প-িত ও গবেষকরা চিন্তাভাবনা শুরু করেন এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই এই ক্ষুদ্র নিবন্ধের অবতারণা। তিনি যদিও আজ আমাদের মাঝে বেঁচে নেই তবু তাঁর চিন্তাধারা ও কথা আমাদের পথ চলার নির্শেক হিসাবে কাজ করছে। ইসলামী ধারণার উপলব্ধির কাঠামোর মধ্যেই ইমামের দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে পররাষ্ট্র নীতির আদর্শ উপলব্ধি করা সম্ভব। তাঁর দৃষ্টিতে ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং তা জাতীয় স্বার্থের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। যদি জাতীয় স্বার্থ হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ে তা হলেও ইসলামী সরকারকে রক্ষণাবেক্ষণ করা অত্যাবশ্যক বলে ইমাম মনে করেন।

ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর দৃষ্টিতে পররাষ্ট্রনীতির অপরিবর্তনীয় আদর্শ হচ্ছে : পূর্ব নয়, পশ্চিম নয়, আধিপত্য ও অধীনতাকে অস্বীকার করা, ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষণাবেক্ষণ, বিপ্লব রফতানি করা, বিশ্বের মুসলমান ও নির্যাতিতদের প্রতি সমর্থন দান, দাম্ভিক শক্তির মোকাবিলায় মুসলমানদের ঐক্য, আল-কুদস মুক্ত করা ও বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে (কয়েকটি বিশেষ দেশ ছাড়া) সম্পর্ক স্থাপন করা।

এগুলো হচ্ছে স্থায়ী ভিত্তি যেগুলোর উপর ইসলামী সরকারের পররাষ্ট্র নীতি গড়ে উঠবে। কয়েকটি বিষয় পরিবর্তনযোগ্য, যেমন কোন দেশ বা সংস্থার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে। কোন কোন সময় এ রকম ঘটে যে, একটি দেশ বা সংস্থা পরাশক্তির প্রতিনিধি হিসাবে এবং তাদের নীতি অনুসারে কাজ করে থাকে। উদহারণ হিসাবে আমরা মিসরের কথা উল্লেখ করতে পারি। অমর্যাদাকর ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষরের পর ইমাম খোমেইনী (রহ.) মিসরের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য সরকারকে নির্দেশ দেন। বায়তুল্লাহ শরীফের পবিত্রতা ক্ষুণ্ন করার জন্য সউদী সরকারের সঙ্গেও সম্পর্ক ছিন্ন করা হয়। পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে ইমামের দৃষ্টিভঙ্গি নিম্নরূপ :

পূর্ব নয়, পশ্চিম নয়

এটা স্বাভাবিক যে, কোন সরকার যখন তার জাতীয় সীমান্তের কাঠামোর মধ্যে শক্তিশালী হয় এবং বাইরের কোন রাজনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক বা সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত না হয় তাহলে সেই সরকারের পক্ষেই উপরে উল্লিখিত নীতি বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এ জন্যই উপরোল্লিখিত কোন বিষয়ে বাইরের সঙ্গে যোগসূত্র থাকলে জাতীয় শাসনকার্যের স্থায়িত্ব হ্রাস পায়। অতীতে বৃহৎ শক্তি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামরিকসহ সকল ক্ষেত্রে আমাদের দেশের উপর আধিপত্য করেছে। দেশের ভিতরে সাবেক সরকারের কোন শক্তিশালী ভিত্তি ছিল না বলেই এটা হয়েছে। ইমাম এসব বিষয় সম্পর্কে অবগত ছিলেন বলেই পূর্ব নয়, পশ্চিম নয়নীতির উপর ভিত্তি করে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের নীতিমালা গ্রহণ করেছিলেন।

ইমামের দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে এই নীতি পূর্ব ও পশ্চিম উভয় ব্লকের সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ও সাংস্কৃতিকসহ যে কোন ক্ষেত্রে যে কোন ধরনের সংযোগকে প্রত্যাখ্যান করে। এটা নিঃসন্দেহ যে, শুধু জোট নিরপেক্ষতার এই নীতি অনুসরণের মাধ্যমেই একটি দেশ স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে। পূর্ব নয়, পশ্চিম নয়এই কথা বলার মাধ্যমে সম্ভবত এমন একটি প্রশ্নের অবতারণা করা হতে পারে যার অর্থ হচ্ছে পূর্ব ও পশ্চিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা কিংবা এই কথা বলার মাধ্যমে পূর্ব ও পশ্চিমের সঙ্গে যে কোন ধরনের সম্পর্ককে প্রত্যাখ্যান করা বুঝায়। এ প্রসঙ্গে ইমামের দৃষ্টিভঙ্গি যাচাই করলে উপরোক্ত এই উভয় পন্থার চিন্তাধারাই বাতিল হয়ে যায়।

এই নীতি সম্পর্কে ইমাম খোমেইনী (রহ.) অনেক বক্তব্য রেখেছেন। এখানে সেসবের কয়েকটির উদ্ধৃতি দেয়া হলো :

আমরা বিদেশী সরকারসমূহের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করার দাবি করি না, আমরা চাই ইরান বিদেশী সরকারসমূহের বশ্যতা থেকে বেরিয়ে আসুক।

ইসলামের বিধান হচ্ছে, কেউ তোমার উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করবে না, তুমিও কাউকে তোমার উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে দিবে না। আমরা বলি, যুক্তরাষ্ট্রের একটি শক্তি হিসাবে থাকা উচিত নয় এবং রাশিয়া ও তার অন্যান্য মিত্রের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের টিকে থাকা ও স্থায়িত্ব পূর্ব নয়, পশ্চিম নয়নীতির উপর নির্ভরশীল। এই নীতি থেকে বিচ্যুতির অর্থই হবে ইসলাম ও মুসলমানদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। এই বিশ্বাসঘাতকতা দেশ এবং জাতির স্বাধীনতা ও মর্যাদা ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।

ইমাম বিশ্বাস করতেন, জাতি ঐক্যবদ্ধ হলেই কেবল এসব নীতি বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্বের সম্মুখে দাঁড়াতে পারি এবং বলতে পারি, আমরা পূর্ব কিংবা পশ্চিমের দিকে ঝুঁকে পড়ব না এবং সোজ পথ অনুসরণ করব যাতে আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারি।

পবিত্র কুরআনের উপর ভিত্তি করেই এই নীতি গড়ে উঠেছে, যাতে মুসলমানদের উপর অবিশ্বাসীদের যে কোন রূপ আধিপত্যকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।

অন্য দেশের সাথে সম্পর্ক

এ সম্পর্কে ইমাম বলেন, ‘আমরা এমন একটি দেশে বসবাস করতে চাই না, যে দেশটি বাইরের বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন। আজকের বিশ্ব একটি নগরীর মতো। একটি নগরীর বিভিন্ন জনপদ থাকে এবং একটির সঙ্গে আরেকটি সম্পর্কযুক্ত। এ রকম অবস্থায় বিশ্ব থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন থাকা উচিত নয়। যেসব দেশ আমাদের সঙ্গে আছে এবং যারা আমাদের জন্য ক্ষতিকর নয় সেসব দেশের সাথে আমাদের সম্পর্ক স্থাপন করা উচিত। অবশ্য আমরা তাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারি না যারা আমাদের উপর নির্যাতন চালাতে চায়…।

আজকের বিশ্ব হচ্ছে পারস্পরিক সম্পর্ক ও যোগাযোগের বিশ্ব। ইমামের দৃষ্টিভঙ্গিগত দিক থেকে বলা যায়, ইসলাম ও ইসলামী সমাজের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার সদ্ব্যবহার করা অবশ্যই প্রয়োজন। তবে ব্যতিক্রমধর্মী বিষয় হবে তখনই যখন এ ধরনের সম্পর্ক কোন পরাশক্তির আধিপত্য ও অধীনতার দিকে নিয়ে যায় কিংবা বিপ্লবের স্বার্থ হুমকির সম্মুখীন হয়। কয়েকটি মানদণ্ডের ভিত্তিতে অন্যদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। ইমামের দিক নির্দেশনায় আমরা বুঝতে পারি যে, মুসলিম ফিলিস্তিনীদের উপর বেআইনি ও জবর দখল প্রতিষ্ঠার জন্য ইসরাইলের সঙ্গে এবং বর্ণবৈষম্য নীতি অব্যাহত রাখার কারণে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক স্থাপন করা উচিত নয়। একইভাবে আগ্রাসী নীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্র ইমামের বিপ্লবী আক্রমণের লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত হয়। ঐ দেশটি যদি তাদের আগ্রাসনমূলক নীতি পরিহার করে তা হলে আমরা তার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারি। এ ব্যাপারে ইমাম বলেন, ‘যতদিন পর্যন্ত ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নির্যাতিত ও নির্যাতনকারী কিংবা শোষিত ও শোষকের সম্পর্কের অনুরূপ সম্পর্ক থাকবে ততদিন পর্যন্ত ঐ দেশটির সঙ্গে আমাদের কোনরূপ সম্পর্ক স্থাপন করা অসম্ভব।

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সার্বভৌমত্ব রক্ষণাবেক্ষণ

ইমাম খোমেইনী (রহ.) বলেন, ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্রের রক্ষণাবেক্ষণ প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব। এটা অবশ্য কর্তব্য এবং ইসলামের রক্ষণাবেক্ষণের জন্যই এটা এতটা গুরুত্বপূর্ণ।তথাকথিত আমেরিকান ইসলাম ও এর উপাদানসমূহ প্রচারের জন্য পরাশক্তিগুলো যখন চেষ্টার কোন ত্রুটি করছে না সে সময় খাঁটি ইসলামের একটি কেন্দ্র ইসলামী প্রজাতন্ত্রের প্রতি সমর্থন জানানো এবং সকল পন্থায় এর রক্ষণাবেক্ষণ করার দায়িত্ব সকল মুসলমানের উপর বর্তায়। নিম্নলিখিত দুই পন্থায় এই দায়িত্ব পালন করা সম্ভব :

১.         ইরানকে একটি উন্নত দেশে রূপান্তরিত করা যাতে সকল প্রয়োজন নিজের থেকে মেটানো যায়। এটা নিঃসন্দেহে যে, অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে অপরের উপর নির্ভরশীল কোন দেশ অন্যান্য দেশ ও আন্দোলনের জন্য একটি আদর্শ বা মডেলের ভূমিকা পালন করতে পারে না।

২.         বিপ্লবের জাতীয় নিরাপত্তা, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বিশ্ব নিরাপত্তার প্রতি হুমকি সৃষ্টিকারী বিপদসমূহ হ্রাস কিংবা দূর করা।

বিপ্লব রফতানি

বিপ্লব রফতানির অর্থ হচ্ছে বিপ্লবের মহান মূল্যবোধসমূহ দেশের সীমান্তের বাইরে ছড়িয়ে দেয়া। ইসলামী বিপ্লবের ফলে জেগে ওঠা সারাবিশ্বের মুসলমানরা বিপ্লবের কেন্দ্রবিন্দুতে তাদের আশা-আকাক্সক্ষা স্থাপন করেছে। সউদী শাসকবর্গ বিপুল অর্থ ব্যয়ে তথাকথিত আমেরিকান ইসলাম প্রচারের জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। সুতরাং বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠীকে শক্তিশালী ও পথনির্দেশ করা পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারক কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব এবং এই পর্যায়ে বিপ্লব রফতানির মানেও খুঁজে পাওয়া যাবে। ইসলামী সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের হৃদয়বৃত্তি ও চিন্তাধারার উপর কাজ করা।

এ ধরনের উদ্দেশ্য যে সরকারের আছে সে সরকারে কাছে মূল্যবোধ রফতানি করার একটি বিশেষ অর্থ আছে। এটা নিঃসন্দেহে যে, ইমাম খোমেইনী (রহ.) বিপ্লব রফতানির মানে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ কিংবা সীমালঙ্ঘন করে অন্য রাষ্ট্রের ভিতরে অভিযান চালানোকে বুঝাননি, যদিও প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের প্রচার মাধ্যমসমূহ এর অর্থ বিকৃত করার চেষ্টা করেছে। এ সম্পর্কে ইমাম বলেন, ‘আমরা বলি যে, আমরা আমাদের বিপ্লব রফতানি করতে চাই, তবে সেটা আমরা তরবারির মাধ্যমে করতে চাই না, সেটা হবে প্রচার মাধ্যমে। ইসলামের বিরুদ্ধে কম্যুনিস্ট ও অন্যরা যে প্রচারণা চালাচ্ছে আমরা সঠিক প্রচারণার মাধ্যমে সেটাকে ভণ্ডুল করে দিতে চাই এবং আমরা বলতে চাই যে, ইসলামের মধ্যে কোন কিছুর ঘাটতি নেই। বিপ্লব রফতানি মানে সারাবিশ্বে পরাশক্তিবর্গের ঘাঁটিসমূহে বিপ্লবের চিন্তাধারা ও সংস্কৃতির আঘাত। আমরা উপসংহারে বলব, ইসলামী বিপ্লব শুধু ইরানের সীমানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং এই বিপ্লব বিশ্ব ইসলামী বিপ্লবের প্রারম্ভিক স্তর।

মুসলমান, নির্যাতিত ও বঞ্চিতদের প্রতি সমর্থন

ইমাম খোমেইনী (রহ.) প্রমাণ করেছেন, ভৌগোলিক নয়, আদর্শিক সীমানাই হচ্ছে প্রকৃত সীমানা। সারাবিশ্বের মুসলমান যে যেখানেই থাকুক না কেন, একই সমাজের সদস্য। এ সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘মুসলমান ও তাদের দেশসমূহ রক্ষা করা জরুরি আর খোদায়ী লক্ষ্য অর্জন ও মুসলমানদের রক্ষা করার জন্য আমাদের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে।ইমামের সমর্থন শুধু নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের আন্দোলনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি সারাবিশ্বের সকল নির্যাতিত, শোষিত ও পরাধীন জাতির সংগ্রামের প্রতিও সমর্থন জানিয়েছিলেন।

তিনি বলেন, ‘আমরা সকল পরাধীন দেশকে তাদের স্বাধীনতা ও মুক্তি অর্জনে সমর্থন দান করি। আমরা তাদের পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, তাদের অধিকার ফিরে পেতে হবে। আপনারা জেগে উঠুন এবং পরাশক্তিবর্গের হাত থেকে দুনিয়াকে মুক্ত করুন।

মুসলমানদের ঐক্য

মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং একে অন্যের থেকে পৃথক এভাবে নিজেদের চিন্তা করা অনুচিত। তাদের একথা ভাবা উচিত নয় যে, সীমান্ত তাদেরকে পৃথক করার একটি পন্থা। মুসলমানদের হৃদয় একত্র হলে তারা একটি বিরাট শক্তির অধিকারী হবে। মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হলে তাদের হৃদয়ও ঐক্যবদ্ধ হবে।

ইসলাম ও মুসলমানের শত্রুদের বিশ্বাস, মুসলিম জাতি ও সরকারগুলোর অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে তারা ইসলামী দেশগুলোর সম্পদ শোষণ, তাদের উপর আধিপত্য ও আগ্রাসন অব্যাহত রাখতে সক্ষম হবে। তারা মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টির জন্য সব সময় সংকট তৈরির প্রচেষ্টা চালায় এই কারণে যে, এসব দেশ ও সরকারের মধ্যে যদি ঐক্য না থাকে তাহলে তারা স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল হয়ে পড়বে এবং তখন তাদের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা সহজ হবে। এ ছাড়া ইসলামের শত্রুরা ইসলামী আন্দোলন মোকাবিলায় সব সময়ই একই ধরনের অবস্থান গ্রহণ করে। তাদের বিশ্বাস সংগ্রামরত সকল মুসলমান একই চিন্তাধারা ও একই বিপ্লবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।  তাদের কাছে ফিলিস্তিনী, লেবাননী, ইরানী, আফগান, কাশ্মীরী, শিয়া বা সুন্নীর মধ্যে কোন তফাৎ নেই। ইমাম সব সময় মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাতেন এবং বিশ্বাস করতেন যে, মুসলিম বিশ্বের মর্যাদা বাস্তব ঐক্যের উপরই নির্ভরশীল।

আল-কুদস মুক্তকরণ

ইসলামী আন্দোলনের প্রথম থেকেই ইমাম আল-কুদস প্রশ্নে খুবই সংবেদনশীল ছিলেন। ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, ইসলামী বিশ্বের ভূখণ্ডের উপর আগ্রাসন ও দখলদারিত্ব অব্যাহত রাখা নির্যাতিত ফিলিস্তিনী মুসলমান ও ইসলামী সরকারসমূহের জন্য একটি অপমানজনক ব্যাপার। এই অমর্যাদা ও অপমান মোচন এবং মুসলমানদের গৌরব ও শক্তি ফুটিয়ে তোলার লক্ষ্যে ইমাম খোমেইনী (রহ.) রমজানের শেষ শুক্রবারকে কুদস দিবসহিসাবে ঘোষণা করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন সকল বিষয়ের চাবিকাঠি হচ্ছে ঐক্য। ইসরাইলকে মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যে তিনি জোর দিয়ে কয়েকবার বলেছেন, ‘যদি মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হয় এবং প্রত্যেকে এক বালতি করে পানি ইসরাইলের দিকে ছুঁড়ে মারে তাহলে দেশটি তলিয়ে যাবে। কিন্তু তারা সেটা করতে পারছে না।

ইমাম খোমেইনী (রহ.) ইসরাইলকে সব সময়ই এ অঞ্চলের জন্য একটি দুষ্ট ক্ষতবলে বিবেচনা করতেন এবং তাঁর বিশ্বাস ছিল, ‘তারা আরো অগ্রসর হতে চায়, তারা মার্কিন নীতি অনুসরণ করছে, যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য শুধু একটি জায়গায় সীমাবদ্ধ নয়।

উপসংহারে আমরা ইমামের রাজনৈতিক কৌশলের সারমর্ম একটি বাক্যে প্রকাশ করতে পারি এবং তা হচ্ছে আল্লাহর বন্ধুদের সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং আল্লাহর শত্রুদের সঙ্গে বৈরিতা।

ইরানের ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের পর থেকে একটি মুহূর্তের জন্যও ভিতর ও বাইরের ইসলামবিরোধী শক্তির ষড়যন্ত্র ও নাশকতা থেকে মুক্ত থাকেনি। বিপ্লবের ধ্বংস বা এর গতি পরিবর্তনের লক্ষ্যে আমেরিকা এবং তার দোসররা বহুমুখী ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতা অব্যাহত রাখে। কিন্তু আল্লাহ তাআলার অশেষ কৃপায় এবং ইমাম (রহ.)-এর সুচিন্তিত পদক্ষেপে ইসলামী বিপ্লব ও প্রজাতন্ত্র টিকে আছে।

১৯৮৯ সালে ৩ জুন, ইরানী সময় রাত দশটা কুড়ি মিনিটে হযরত ইমাম ইরানী জাতি ও সমগ্র ইসলামী উম্মাহকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে এ ধূলির ধরা ছেড়ে আলামে মালাকুতে পাড়ি দেন (ইন্ন লিল্লাহি ও ইন্না ইলাইহি রাজেউন)।

আজ ইমাম নেই, কিন্তু আছে তাঁর সংগ্রামী আদর্শ। আর সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে আছে লাখো কোটি ভক্ত-অনুসারী। ইমামের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তারা ইসলামী বিপ্লবকে ছড়িয়ে দিবে কাল থেকে কালান্তরে।

(নিউজলেটার, ফেব্রুয়ারি ১৯৯২)

রোজা ও আহার সংক্রান্ত কয়েকটি হাদীস

নবী করিম (সা.) বলেছেন : ‘রোজাদার ব্যক্তি যতক্ষণ অপর কোন মুসলমানের গীবত না করে ততক্ষণ আল্লাহর ইবাদাতে থাকে যদিও সে নিদ্রিত হয়।’- কাফী, চতুর্থ খণ্ড, পৃ. ৬৪।

মহানবী (সা.) বলেন : ‘রোজাদারের নিদ্রা ইবাদত এবং তার শ্বাস-প্রশ্বাস তাসবীহ।’- বিহারুল আনওয়ার : ৯৩তম খণ্ড, পৃ. ২৪৮।

হযরত আলী (আ.) বলেছেন : ‘রোজাদার ব্যক্তির নিদ্রা হচ্ছে ইবাদত, তার নীরবতা হচ্ছে তাসবীহ এবং তার দোয়া আল্লাহর দরবারে মনজুর হয়ে থাকে এবং তার আমল দ্বিগুণ হয়ে থাকে। আর নিশ্চয় রোজাদার ব্যক্তির জন্য ইফতারের সময় এমন একটি দোয়া রয়েছে যা প্রত্যাখ্যাত হয় না।’- বিহারুল আনওয়ার : ৯৩তম খণ্ড, পৃ. ৩৬০।

হযরত ইমাম সাদেক (আ.) বলেছেন : ‘প্রত্যেক জাতির নিকট সর্বাবস্থায় স্বল্প পরিমাণে আহার গ্রহণই পছন্দনীয় কাজ। কেননা, এতে মানুষের জন্য অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক কল্যাণ রয়েছে। আর মুমিনের অন্তরের জন্য অতিরিক্ত আহারের মতো ক্ষতিকর জিনিস আর কিছুই হতে পারে না।’- মিসবাহুশ শারিয়া : পৃ. ২৭।

নবী করিম (সা.) বলেন :  ‘কোন মুসলমানকে ঘৃণা করবে না এবং ছোট করে দেখবে না। কেননা, হতে পারে কোন মুসলমান তোমার দৃষ্টিতে ছোট ও ঘৃণিত, কিন্তু আল্লাহর দৃষ্টিতে সে অনেক বড়।’- মাজমুয়াযে ওররাম ১ম খণ্ড, পৃ. ৩১।

(নিউজলেটার, ফেব্রুয়ারি ১৯৯২)