All posts by dreamboy

মরহুম আয়াতুল্লাহ তালেকানী- ইরানে ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ

ইরানে ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ অনলবর্ষী বক্তা, আদর্শ প্রচারক, আপোসহীন সংগ্রামী সংগঠক, তেহরানের জুমআর জামায়াতের প্রথম ইমাম এবং ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর একজন বিশ্বস্ত সহকর্মী আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ মাহমুদ তালেকানীর ১০ সেপ্টেম্বর। ১৯৭৯ সালের এই দিনে ৬৯ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যুতে ইসলামী বিপ্লবের মহান নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেইনী বলেছিলেন : ‘জনাব তালেকানী যাপন করেছেন আলোক ও হেদায়াতপ্রাপ্ত এবং জিহাদী জিন্দেগি। তিনি এমন এক চরিত্রের অধিকারী ছিলেন যে, জেল থেকে জেলে স্থানান্তরিত হয়েছেন এবং একটির পর একটি দুর্ভোগ তাঁকে পোহাতে হয়েছে, কিন্তু কখনই নিজের দৃঢ়তার ক্ষেত্রে এতটুকু শৈথিল্য প্রদর্শন করেননি। বন্ধুরা একের পর এক হারিয়ে যাবেন আর তিনি সেটা দেখার জন্য বেঁচে থাকবেন- এমনটি তাঁর অভিপ্রায় ছিল না। ইসলামের জন্য তিনি ছিলেন এক আবু যার। তাঁর বাচনভঙ্গি ও কণ্ঠস্বরে ছিল মালিক আশতারের তরবারির তীক্ষ্ণ ধার ও আক্রমণ ক্ষমতা।’

ইসলামী বিপ্লবকে চূড়ান্ত সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়ার পিছনে যেসব আলেমের দুঃখ-কষ্ট, সংগ্রাম ও অবদান সবচেয়ে বেশি তাঁদের অন্যতম হলেন আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ মাহমুদ তালেকানী। কোম থেকে ধর্মীয় শিক্ষা সমাপ্ত করে ইজতিহাদী যোগ্যতা অর্জন করার পর তালেকানী তেহরানে তৎপরতা শুরু করেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নির্দেশেই পাহলভী শাসকগোষ্ঠী দেশের যুবক ও বুদ্ধিজীবীদের কুরআনের শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে প্রায় সফল হয়েছিল। আয়াতুল্লাহ তালেকানী যথার্থই উপলব্ধি করেছিলেন যে, কুরআন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিতদের মধ্যে দূরত্ব কমাতে হবে।

১৯৪১ সালে তিনি তেহরানে কানুন-ই-ইসলাম নামে একটি ইসলামী কেন্দ্র স্থাপন করেন। জনগণকে জ্ঞান দানের জন্য নিয়মিত সেখানে বক্তৃতা দানের ব্যবস্থা ছিল। কেন্দ্রটির পক্ষ থেকে ‘দানেশে ইমরুজ’ নামে একটি ম্যাগাজিনও প্রকাশিত হতো। পরে যখন তালেকানী তেহরানের হেদায়াত মসজিদের ইমাম নিযুক্ত হন তখন কুরআন ক্লাস আরো সম্প্রসারিত হয়।

১৯৫৩ সালে সিআইএ পরিকল্পিত সামরিক অভ্যুথানের পর হেদায়াত মসজিদ পাহলভী শাসকগোষ্ঠীর বিরোধীদের মিলনকেন্দ্রে পরিণত হয়। দ্বিতীয়ত জাতীয় মোর্চা যাঁরা গঠন করেছিলেন সেই জাতীয় নেতৃবৃন্দও তাঁদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। শাহের নির্দেশে কেন্দ্রটি বন্ধ করে দেয়া হলে তালেকানী তাঁর বন্ধু ও ভক্ত ছাত্রদের গৃহে অবস্থান করেই স্বীয় সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন।

আয়াতুল্লাহ তালেকানী ১৯৫০ সালে করাচীতে অনুষ্ঠিত মুসলমানদের বিশেষ বৈঠকে এবং ১৯৫৭ ও ১৯৫৯ সালে অনুষ্ঠিত কুদ্স সম্মেলনে ইসলামী দুনিয়ার সামনে ঘোষণা দেন যে, ইরানের জনতা ইহুদিবাদ ও মুসলিম দেশগুলোর তাঁবেদার শাসকগোষ্ঠীর বিরোধী।

১৯৬২ সালে ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর নেতৃত্বে কোম ও তেহরানে জনতার যে অভ্যুথান ঘটে, আয়াতুল্লাহ তালেকানী সেক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রাখায় শাহের গোয়েন্দা সংস্থা সাভাকের লোকেরা তাঁকে গ্রেফতার করে। পরবর্তী বছর মুক্তি পেয়ে তিনি শাহের বিশ্বাসঘাতকতা প্রসঙ্গে জনতাকে সচেতন করতে থাকেন। ১৯৬৩ সালে সাভাকের লোকেরা তাঁকে পুনরায় গ্রেফতার করে। আদালত তাঁকে ১০ বছরের কারাদ- দেয়। প্রহসনমূলক বিচার চলাকালে আদালত ও তাঁর বিচারের বিষয়টিকে ইসলামবিরোধী ঘোষণা দিয়ে তিনি এজলাসে কোন কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। সে ঘোষণার পর তিনি পাক কুরআনের সূরা ফাজ্র তেলাওয়াত করেন এবং আদালতের নিরাপত্তা রক্ষীদের উদ্দেশ্য বলেন : ‘যাও এবং তোমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বল যে, আমরা নই, তোমরাই ধ্বংসপ্রাপ্ত।’  মাত্র ১৬ বছর পরই তাঁর কথা বাস্তবরূপ গ্রহণ করল। তিনি যে সূরা ফাজ্র তেলাওয়াত করেছিলেন, সেটাই ইসলামের বিজয়ের এবং ‘প্রভাতের দশ দিনের’ ভবিষ্যদ্বাণীতে পরিণত হলো।

১৯৬৭ সালে পাহলভী শাসকচক্র চাপে পড়ে এক পর্যায়ে আয়াতুল্লাহ তালেকানীকে মুক্তি দেয়। ১৯৭১ সালে তিনি আবার বন্দি হন এবং কিছুকাল পরে তাঁকে দক্ষিণ ইরানে নির্বাসনে পাঠানো হয়। ১৯৭৫ সালে আয়াতুল্লাহ তালেকানীকে শেষবারের মতো গ্রেফতার করা হয় এবং ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়।

ইসলামী বিপ্লবের চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৭৮ সালে পাহলভী শাসকগোষ্ঠী বাধ্য হয়ে জেলখানার দ্বার খুলে দেয়। আয়াতুল্লাহ তালেকানী অন্যান্য রাজনৈতিক বন্দির সঙ্গে শাহের কারাগার থেকে বের হয়ে আসেন। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত আয়াতুল্লাহ তালেকানীকে যে কোন সময়ের তুলনায় অধিকতর তৎপর দেখা গেছে এবং ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর নেতৃত্বে পরিচালিত ইসলামী বিপ্লবে তিনি তাঁর সকল সময় ব্যয় করেছেন। আয়াতুল্লাহ তালেকানীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, শাহবিরোধী সকল দলই তাঁর প্রশংসা করত। তিনি ছিলেন সবার শ্রদ্ধার পাত্র। ইসলামী বিপ্লবের স্বল্পকাল পূর্বে অনুষ্ঠিত তাসুয়া (মুহররমের নবম দিন) ও আশুরায় তিনি অতুলনীয় যোগ্যতার সাথে তাঁর ভূমিকা পালন করেন।

সামরিক আইন জারি হওয়া সত্ত্বেও আয়াতুল্লাহ তালেকানী আজাদী চত্বরে পৌঁছার লক্ষ্যে শোভাযাত্রা আহ্বান করেছিলেন এবং জনগণকে সে শোভাযাত্রায় অংশ নেয়ার জন্য ডাক দেন। সে আহ্বানে হাজার হাজার মানুষ সাড়া দেয় এবং সকাল বেলায়ই তাঁর ছোট বাড়ির সম্মুখস্থ রাজপথ লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে। সেদিন ছিল ৯ মুহররম, তাসুয়া। পূর্ব ঘোষিত সময় অনুযায়ী তিনি জনতার সামনে হাজির হলেন। এ ঘটনার মধ্যেই তাঁর সে অভূতপূর্ব কৃতিত্বের পরিচয় মিলে।

ইরানী জাতি তাঁকে স্মরণ করবে এজন্য যে, তিনিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি দশ লক্ষাধিক লোকের সম্মুখে দাঁড়িয়ে সেদিন ইরানী জনতার এতদিনের গোপনে ও সাবধানে বলা কথাগুলো ব্যক্ত করেছেন এবং সোচ্চার কণ্ঠ হয়েছেন।

‘বল, শাহ ধ্বংস হোক’- এ কথাটি তালেকানী সেদিন বার বার সোচ্চার কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন। কিছুক্ষণ পরপরই বুলন্দ আওয়াজ তুলে তিনি বলেছেন : ‘বল, শাহ ধ্বংস হোক।’

আয়াতুল্লাহ তালেকানী শাহ ও তার মার্কিনী প্রভুদের বিরুদ্ধে ৪০টি বছর দীর্ঘ ও কঠিন সংগ্রাম চালিয়েছেন। সেদিন ‘শাহ ধ্বংস হোক’ বুলন্দ আওয়াজ তোলার পর সে স্লোগান অধিকতর বুলন্দ আওয়াজে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে শুনে অবশ্যই তিনি আল্লাহর নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকবেন। পরবর্তী পর্যায়ে অবশ্য এটি ‘আমেরিকা ধ্বংস হোক’ যথার্থ এ স্লোগানে রূপান্তরিত হয়।

(নিউজলেটার, সেপ্টেম্বর ১৯৯১)

শহীদ রাজাই- ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল

৩০ আগস্ট হচ্ছে ইরানের শহীদ প্রেসিডেন্ট মোহাম্মাদ আলী রাজাই এর মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৮১ সালের এই দিনে সাম্রাজ্যবাদের এজেন্টদের চক্রান্তে প্রেসিডেণ্ট ভবনে এক বোমা বিস্ফোরণে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।

বিভিন্ন গুণের অধিকারী প্রেসিডেণ্ট রাজাই পার্থিব এবং শয়তানি লোভলালসা থেকে নিজেকে মুক্ত করে তাঁর ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর মধ্যে ছিল আধ্যাত্মিকতা, বিনয়, আন্তরিকতা এবং আল্লাহর প্রতি অগাধ ভালোবাসা। তিনি জনগণের মধ্য থেকে রাজনৈতিক ও সামাজিক দৃশ্যপটে এসেছিলেন। ধৈর্য, সহনশীলতা, অধ্যাবসায়, নিরলস প্রচেষ্টা, দৃঢ় সংকল্প এবং মহান আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাসের কারণে তিনি ফুটপাতের সাধারণ ফেরিওয়ালা থেকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেণ্ট নির্বাচিত হতে পেরেছিলেন। তিনি বহু কষ্ট, সমস্যা এবং বাধার মোকাবিলা করেছেন। তিনি কখনো কোন প্রতিবন্ধকতার মুখে থেমে পড়েননি।

ইসলামের এই মহান সৈনিক শহীদ রাজাই ১৯৩৩ সালে কাজভিনের এক ধর্মীয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বয়স যখন মাত্র ৪ বছর তখন তিনি পিতৃহারা হন। তাঁর মা অনেক কষ্টে তাঁকে লালন-পালন করেন। প্রথমে তিনি বাড়ির নিকটবর্তী একটি স্কুলে ভর্তি হন এবং ইলিমেণ্টারি গ্রেড পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। পরে তাঁর চাচার দোকানে চাকরি নেন এবং এক বছর পর তেহরান চলে যান। সেখানে তিনি একটি হার্ডওয়্যারের দোকানে ফেরিওয়ালার চাকরি নেন। তিনি সেই দোকানের জিনিসপত্র ফেরি করে বিক্রি করতেন। 

এক সময়ে তিনি বিমান বাহিনীতে ভর্তি হন। বিমান বাহিনীতে প্রবেশের কয়েকমাস পরই তিনি ফেদাইনে ইসলামের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতে পেরে এতে যোগ দেন এবং এর গোপন বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন। বাজারে কাজ করার সময় রাজাই নৈশকালীন ইসলামী শিক্ষা ক্যাম্পে অংশগ্রহণ করতেন। তাঁর শিক্ষক ছিলেন শহীদ আমানী। বিমান বাহিনীতে থাকাকালেও তিনি প্রচুর পড়াশুনা করতেন। ১৯৫৫ সালে বিশেষ কারণে তিনি বিমান বাহিনী থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এরপর তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন। পরে তিনি তেহরানের টিচার্স ট্রেনিং কলেজে পরীক্ষা দেন এবং পাস করেন। বিমান বাহিনীতে যোগদান করার সময় মোহাম্মাদ আলী রাজাই আয়াতুল্লাহ তালেকানীর সঙ্গে পরিচিত হন এবং প্রতি বৃহস্পতিবার হেদায়াত মসজিদে সমবেত হতেন এবং প্রতি শুক্রবার তালেকানীর খানে আবাদে বেকার হাউসে একটি প্রশিক্ষণ বৈঠকে বসতেন। যেখানেই মরহুম তালেকানীর কোন ট্রেনিং অধিবেশন থাকত সেখানেই তিনি অংশ নিতেন এবং তা থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতেন। তাঁর কথায় উদ্বুদ্ধ হয়েই তিনি শিক্ষকতা শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন।

এক সময় তিনি পরিসংখ্যান বিষয়ে মাস্টার ডিগ্রি ক্লাসে ভর্তি হন। ১৯৬৩ সালে রাজাইকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়। কিছুদিন পর তিনি মুক্তি পান। তিনি কামাল হাইস্কুলে ৫ বছর শিক্ষকতা করার পর তেহরানের পাহলভী হাই স্কুলে বদলি হন। ১৯৭৪ সালে গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি সেখানে শিক্ষকতা করেন।

১৯৬৭ সালে জনাব রাজাই জালালউদ্দিন ফারসি ও জাভেদ বাহোনারসহ কতিপয় বন্ধুর সঙ্গে মিলিত হয়ে সংযুক্ত গ্রুপনামে একটি দল গঠন করেন। সংযুক্ত গ্রুপের প্রধানদের সমন¦য়ে জুমা নামাযের সদর দফতর গঠন করা হয়। জনাব রাজাই শফিক, জাভেদ বাহোনার এবং তাঁর কতিপয় বন্ধুসহ ইসলামী কল্যাণ এবং পারস্পরিক সাহায্য ফাউন্ডেশন নামে একটি সংস্থার দায়িত্বশীল ছিলেন। জনাব রাজাই ১৯৬২ সালে বিবাহ করেন। তাঁর স্ত্রী ছিলেন ধর্মের ওপর দৃঢ় আস্থাশীল মহিলা।

তিনি রাফাহ স্কুলে এক বছর কাজ করার পর বিদেশে গিয়ে জামালউদ্দিন ফারসির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং এক মাস পর ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে ইরান প্রত্যাবর্তন করেন। ইরানে পৌঁছে তিনি দেখতে পেলেন রাফাহ স্কুলের সকল পুরুষ শিক্ষক বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছেন।

১৯৭৪ সালে ড. আয়াতুল্লাহ বেহেশতীর একটি গোপন ট্রেনিং অধিবেশন থেকে ফেরার পথে সাভাকের এজেন্টরা জনাব রাজাইকে গ্রেফতার করে ও কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে তাঁর ওপর চালানো হয় অকথ্য নির্যাতন। একটানা ১৪ মাস তাঁর ওপর এভাবে নির্যাতন চালানোর পর বিচারের জন্য তাঁকে আদালতে পাঠানো হয়। বিচারে তাঁর ৫ বছরের কারাদ- হয়। বিচারের পর কাউকে নির্যাতন করার নিয়ম না থাকলেও সাভাকের এজেন্টরা রাজাইয়ের মুখ থেকে কথা বের করার জন্য অমানুষিক নির্যাতন চালায়।

মুক্তি পাওয়ার পর তিনি টিচার্স ইসলামিক এসোসিয়েশনে যোগদান করেন। বিপ্লবের সময় বিপ্লবের কেন্দ্র রাফাহ স্কুলের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। বিপ্লবের সাফল্যের পর তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হন। এক পর্যায়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীও নির্বাচিন হন।

প্রেসিডেণ্ট পদ থেকে বনি সদরকে বহিস্কারের পর জনাব রাজাই ৩ সদস্যের প্রেসিডেন্সিয়াল পরিষদের সদস্য হন। ১৯৮১ সালের ২রা আগস্ট তিনি ১ কোটি ৩০ লাখের বেশি ভোট পেয়ে ইরানের দ্বিতীয় প্রেসিডেণ্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। পূর্ববর্তী প্রেসিডেণ্ট সম্পর্কে জনগণের দুঃখজনক অভিজ্ঞতা ছিল। এজন্য তারা এমন একজনকে প্রেসিডেন্ট বানাল যিনি তাদের মধ্য থেকে এসেছেন, আমেরিকা ও শাহ কর্তৃক নির্যাতিত হয়ে অন্ধকার সেলে কারাজীবন কাটিয়েছিলেন। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের এজেন্টরা জনাব রাজাইকে বরদাশত করতে পারেনি। তাই প্রেসিডেণ্ট হিসাবে নির্বাচিত হওয়ার অল্প কিছুদিন পর ১৯৮১ সালের ৩০ আগস্ট প্রেসিডেণ্ট ভবনে এক বোমা বিস্ফোরণের ফলে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।

শহীদ রাজাই ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের জনগণের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

(নিউজলেটার, আগস্ট ১৯৯১)

নাসিবাহ বিনতে কাব- ইসলামের ইতিহাসে স্মরণীয় মহিলা

ইসলামের ইতিহাসের একজন প্রখ্যাত মহিলা নাসিবা বিনতে কাবের দুঃসাহসিকতা ইসলামের প্রাথমিক যুগে নারীদের উদ্দীপ্ত ও মুগ্ধ করত। তারা একসঙ্গে বসে নাসিবাকে ওহুদের যুদ্ধে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর পাশে থেকে তিনি কিভাবে যুদ্ধ করেছেন তা বর্ণনা করার জন্য অনুরোধ করত।

ওহুদের যুদ্ধের কিছু সময় পূর্বে মুসলমানরা প্রথম নাসিবার নাম শুনতে পায়। ইসলাম প্রচার হওয়া সত্ত্বেও তখনো পর্যন্ত অধিকাংশ মহিলা আইয়ামে জাহেলিয়াতের আচার-আচরণের নিগড়ে বন্দি ছিল। ঐ সময় মহিলাদের অস্থাবর সম্পত্তি হিসাবে গণ্য করা হতো এবং তারা নিজেরাও এর বেশি ভাবত না। ঠিক ঐ সময়ে ওহুদের যুদ্ধে অংশ নেয়ার ব্যাপারে মহানবী (সা.)-এর কাছে একদল মানুষের নেএী হিসাবে ওয়াদাবদ্ধ হতে দেখা গেল একজন মহিলাকে। সত্যিই এটা আশ্চর্যজনক ও বিস্ময়কর ব্যাপার। সেই মহিলার নাম নাসিবা। তিনি স্বামী, দুই পুত্র ও আরো কিছুসংখ্যক লোককে নিয়ে মহানবী (সা.)-এর কাছে এলেন এবং তাঁর প্রতি অনুগত্য ঘোষণা করলেন ও যুদ্ধে অংশ গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। দলের মুখপাত্র হিসাবে নাসিবা মহানবী (সা.)-এর কাছে কিছু বললেন এবং তাঁকে দোয়া করার অনুরোধ করলেন যাতে বেহেশতে আল্লাহর রাসূলের পাশে তাঁদের স্থান হয়। একথা শোনার পর মহানবী (সা.) হাত তুললেন এবং তাঁদের বাসনা যাতে পূর্ণ হয় সেজন্য দোয়া করলেন।

ওহুদের ময়দানে যুদ্ধ শুরু হলো। নাসিবা কাঁধে তুলে নিলেন পানিভর্তি চামড়ার একটি বড় ব্যাগ। যুদ্ধের ময়দানে ঘুরে ঘুরে তিনি পিপাসার্ত সৈনিকদের পানি পান করাতে থাকলেন নিরলসভাবে। দুই পক্ষের তুমুল যুদ্ধের মধ্যে তিনি আহতদের পাশে গিয়ে হাজির হলেন অকুতোভয়ে এবং সেবা করতে থাকলেন অবিশ্রান্তভাবে। জিহাদের ময়দানে মুসলমানরা লড়াই করতে থাকলেন সাহসিকতার সঙ্গে। তাঁরা প্রথমদিকে বিজয় লাভও করলেন। কিন্তু আইনান পাহাড়ে মোতায়েন একদল মুসলমানের অবহেলা ও ভুলের কারণে তাঁদের সেই বিজয় ধুলায় লুণ্ঠিত হলো। পাহাড় অরক্ষিত রেখে মুসলমানের দলটি ময়দানে চলে এলো। এতে শত্রুরা পিছন দিয়ে পাল্টা হামলা চালানোর সুযোগ পেল। দুই দিক থেকে আক্রমণের শিকার হয়ে মুসলিম বাহিনী দিশাহারা হয়ে পড়ল। এসময় গুজব ছড়িয়ে পড়ল যে, হযরত মুহাম্মাদ (সা.) নিহত হয়েছেন। এতে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটল। এসময় বিপজ্জনক পরিস্থিতি ও যুদ্ধক্ষেত্রের বিশৃঙ্খল অবস্থা দেখে নাসিবা একটি তারবারি হাতে তুলে নিলেন এবং যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তিনি অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করতে থাকেন এবং শত্রুবাহিনীর ওপর কয়েক দফা প্রচ- আঘাত হানেন। তিনি মুসলিম বাহিনীর অনুপ্রেরণার উৎসে পরিণত হন। এক পর্যায়ে নাসিবা মারাত্মকভাবে আহন হন। তিনি কাঁধে আঘাত পান। তাঁর জখমের স্থান থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে দেখে মহানবী (সা.) নাসিবার এক পুত্রকে ডাকলেন এবং তার মায়ের জখম স্থানে ব্যান্ডেজ করতে বললেন। ইতিমধ্যে তাঁর অপর পুত্রও শত্রুবাহিনীর হাতে আহত হয়। নিজের আহত স্থানের প্রচ- ব্যথা নিয়েও তিনি তাঁর ছেলের জখম স্থানে দ্রুত ব্যান্ডেজ করে দেন এবং তাকে পুনরায় যুদ্ধ করতে পাঠান। মহানবী (সা.) নাসিবার পুত্রের ওপর হামলাকারী শত্রুসৈন্যকে চিহ্নিত করলেন এবং নাসিবা তার ওপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ও মরণ আঘাত হানলেন।

যুদ্ধ শেষ হলে মহানবী (সা.) নাসিবার অবস্থা সম্পর্কে খবর নেয়ার জন্য এক ব্যক্তিকে তাঁর আবাসস্থলে পাঠান। তিনি নাসিবা সম্পর্কে এতই উদ্বিগ্ন ছিলেন যে, নাসিবা বেঁচে আছেন এ খবর শুনেই তিনি খুশি হন। তবে নাসিবার জখম এতই গুরুতর ছিল যে, পরিপূণ সুস্থ হয়ে উঠতে একটি বছর লেগে যায়।

একজন গৃহবধূ ও দুই সন্তানের জননী নাসিবা বিনতে কাব অসীম সাহস ও দৃঢ় বিশ্বাসের জন্য সকলের কাছে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে বিরাজ করছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন, একজন মুসলিম নারীর সত্যিকার কাজ হচ্ছে আরব সংস্কৃতিতে প্রচলিত ভ্রান্ত বিশ্বাসকে নির্মূল করতে সাহায্য করা।

(নিউজলেটার, আগস্ট ১৯৯১)

একটি ফুল আমি হারিয়ে ফেলেছি

(ইমাম খোমেইনী (র.)-এর শোকানুষ্ঠানে যোগদানকারী দশ বছর বয়সের একটি বালকের অনুভূতির আলোকে রচিত)

সকলের পরিধানেই ছিল কালো পোশাক। যেদিকেই তাকাই না কেন বাড়িঘর আর দালানকোঠা সবই যেন কালো কাপড়ে মোড়া। ফুটপাতের থরে থরে সাজানো ফুলের টব পর্যন্ত। মসজিদের ভেতরে মানুষের ভীড়, বাইরেও মানুষ। সবার চোখে-মুখেই শোকের ছায়া। ক্লান্ত-অবসন্ন হয়ে বাড়ি ফিরে এল হুসাইন। মসজিদ পর্যন্ত পৌঁছতে না পারায় সে খুব অসন্তুষ্ট। সে সিদ্ধান্ত নিল যে, তার বাবা বাড়িতে ফিরে না আসা পর্যন্ত সে বাড়িতেই থাকবে এবং বাবা ফিরে আসলে তার সাথে মসজিদে যাবে। যদিও সে জানে না যে, তার বাবা কখন বাড়ি ফিরে আসবে।

আগের দিন রাতে হুসাইনের বাবা গিয়েছিলেন মোসাল্লায় (তেহরানস্থ নামাযের ময়দান) লাখো-কোটি শোকার্ত মানুষের সাথে ইমাম খোমেইনীর জানাযায় শরীক হতে। বাড়ি থেকে রওয়ানা হওয়ার প্রাক্কালে অত্যন্ত দরদমাখা কণ্ঠে হুসাইনের বাবা হুসাইনকে বলেছিলেন : হুসাইন! সম্ভবত আমি আজ রাতে ফিরব না। তুমি তোমার মায়ের কাছে থাকবে এবং আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত কোথাও যেও না।হুসাইনের পিতা খুব শীঘ্রই বাড়ি ফিরে আসবেন এবং সে তাঁর সাথে মসজিদে যাবে একথা চিন্তা করে হুসাইন খুবই আশান্বিত হয়ে থাকল।

অবশেষে পিতা ফিরে এলেন। হুসাইন দৌড়ে তাঁর কাছে গিয়ে বলল : সালাম। হুসাইন তাঁর পিতাকে আগে আর কখনও এ অবস্থায় দেখেনি। হুসাইনের পিতার চোখ ছিল লাল এবং মুখম-লে ছিল শোকের ছায়া।

হুসাইনের বাবা তাঁর কালো জামা থেকে ধুলোবালি ঝেড়ে ফেলে নিজ হাতে তা ভালোভাবে ধুয়ে নিলেন। তাঁকে খুবই ক্লান্ত ও শোকার্ত দেখাচ্ছিল। এমতাবস্থায় হুসাইনের বাবা তাকে মসজিদে নিয়ে যেতে রাজি নয়। একথা জানতে পেরে হুসাইন খুবই অস্বস্তি ও উৎকণ্ঠা বোধ করতে লাগল। ইমাম খোমেইনীর মৃত্যু সংবাদ শোনার পর থেকেই হুসাইন নীরবে ও সকলের আগোচরে বহুবার কেঁদেছে। রেডিওতে এই ঘোষণা এবং পবিত্র কোরআন ও শোকসংগীত শুনে শুনে সে খুবই বিমর্ষ ও মর্মাহত। তার পিতা তখনও কাপড় ধৌত করছিলেন। হুসাইন তাঁকে একটি তোয়ালে এনে দিল। হুসাইন হঠাৎ করে বলল : আব্বা! মসজিদে খুব ভীড়। অন্যান্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশি ভীড়। সেখানে সকলেই ক্রন্দন করছে আর শোক করছে।হুসাইনের পিতা শোকার্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন : আমি জানি বৎস, রাতে খাওয়ার পর আমরা সেখানে যাব।

সমগ্র শহর সেদিন শোক করছিল। হুসাইন ও তার বাবা খুব শান্তভাবে মসজিদের দিকে এগিয়ে গেল। তারা মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করে মেহরাবের কাছে এক কোনায় গিয়ে বসল।

মসজিদ ভর্তি মানুষের সেদিনের ক্রন্দন আর আহাজারির শব্দ দেয়াল আর ছাদে আছাড় খেয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল মসজিদের বাইরে। একটি বালক লোকদের কাছে কুরআন শরীফের কপি পৌঁছে দিচ্ছিল আর তাদের মাথায় গোলাপ পানি ছিটিয়ে দিচ্ছিল। এক শোকার্ত কিশোর মাইকে কবিতা আবৃত্তি করছে আর তার চোখ থেকে পানি ঝরছে। শোকে মুহ্যমান মানুষের মাথা ছিল অবনত আর অতিমাত্রায় কান্নার মধ্যে তাদের ঘাড় কাঁপছিল। এমন সময় একজন বৃদ্ধা হুসাইনকে ডেকে বললেন : খোকা! তুমি এখানে এস।হুসাইন জানত যে, এখানে জবাবের কোন প্রয়োজন নেই। সে নিজে থেকেই সাহায্য করতে আগ্রহী ছিল। লোকটি হুসাইনকে গ্লাসসহ একটি পাত্র আনতে বললেন এবং পানির পাত্র আছে এমন আরেক কিশোরের সাথে মিলিত হয়ে লোকদেরকে পানি পান করাতে বললেন।

হুসাইন আগেও বহুবার শুনেছে যে, মসজিদে কোন কাজে সাহায্য করা সওয়াবের কাজ। তাই সে এই কাজ করার সুযোগ পেয়ে খুব খুশি হলো। সে আরো খুশি এজন্য যে, ইমাম খোমেইনীর জন্য সেও কিছু করছে। অবশেষে শোকানুষ্ঠান শেষ হয়ে গেল এবং শোকার্ত লোকজন ধীরে ধীরে বাড়ি ফিরে গেল। হুসাইন পানির পাত্র ও গ্লাসটি রেখে তার বাবার কাছে ফিরে এল। বাবা হুসাইনকে বললেন : হে পুত্র! তুমি খুব ভালো কাজ করেছ। তুমি ইমামের একজন সৈনিক।এক সময় হুসাইন নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে : কেন এমন হবে? কেন ইমাম আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন?’ তার চোখ থেকে পানি ঝরতে লাগল আর তা তার গণ্ডদেশ ভিজিয়ে দিল। সে বিশ্বাসই করতে চাইছিল না যে, ইমাম খোমেইনী (রহ.) চলে গেছেন। কেউই একথা বিশ্বাস করতে পারে না। হুসাইনের তখন সেই শোকার্ত কিশোরের আবৃত্তি করা একটি কবিতার অংশ বিশেষভাবে মনে পড়ল : আমি একটি ফুলকে হারিয়ে ফেলেছি এবং তা খুঁজছি…

ইমামের মৃত্যুজনিত যন্ত্রণা হুসাইনের অন্তরকে ব্যথিত করেছে। সে তাই খুবই শোকাহত। কী অপ্রিয় ও তিক্ত এক সত্যকে আজ মেনে নিতে হচ্ছে, ইমাম আর ইহধামে নেই, তার এবং সকলের শ্রদ্ধেয় ইমাম সকলকে ছেড়ে চলে গেছেন। পরে হুসাইন তার পিতার সাথে মসজিদ থেকে বাড়ি ফিরে এলো। এটিই শেষ শোক নয়, এ হলো শোকের সূচনামাত্র। কেননা, সারা পৃথিবীতেই যেন শোকের পর্দা উন্মোচিত হয়েছে।

(নিউজলেটার, আগস্ট ১৯৯১)

 

হযরত আলী (আ.)-এর বাণী- নাহজুল বালাগা থেকে

হযরত আলী (আ.)-এর নিকট হারিস ইবনে হুত এসে বলেন : আমার সম্পর্কে আপনার অভিমত কী? আমি উটের যুদ্ধের উদ্যোক্তাদেরকে পথভ্রষ্ট বলে ধারণা করি।উত্তরে হযরত আলী (আ.) বলেন : হে হারিস! নিশ্চয় তুমি নিচের দিকে তাকিয়েছ। তোমার ওপরের দিকে তাকাওনি। তাই হতভম্ব হয়েছে। হককী, তুমি তা অবগত হলে হকপন্থীকে জানতে। তুমিতো হকই জান না। আর বাতিলকী, তা জানলে বাতিলপন্থীকে জানতে পারতে। তুমিতো বাতিল কী, তা-ই জান না। তখন হারিস বললেন : তাহলে সাআদ ইবনে মালিক ও আবদুল্লাহ ইবনে উমরের পথ ধরে স্বতন্ত্র হয়ে থাকি।তখন হযরত আলী (আ.) বললেন : নিশ্চয়ই সাআদ ও আবদুল্লাহ ইবনে উমর ন্যায়ের সহায়তা করেননি। আর বাতিলকেও নিরুৎসাহিত করেননি।’- নাহজুল বালাগা, উক্তি নং ২৫৪

হযরত আলী (আ.) বলেন : বাদশাহর সহচর বাঘের ওপর আরোহণকারীর ন্যায় হয়ে থাকে। লোকেরা তার অব¯হান দেখে ঈর্ষা করে। সে তার অবস্থানের ভয়াবহতা ভালো করেই জানে।’- নাহজুল বালাগা, উক্তি নং ২৫৫

হযরত আলী (আ.) বলেন : অপরের সন্তানের প্রতি করুণা কর। তোমাদের সন্তানদের হিফাজতের ব্যব¯হা তারই ফলে হবে।’- নাহজুল বালাগা, উক্তি নং ২৫৬

হযরত আলী (আ.) বলেন : জ্ঞানীদের উক্তি সঠিক হলে ঔষধের কাজ দেয়। আর তা ভুল হলে রোগ সৃষ্টি করে।’- নাহজুল বালাগা, উক্তি নং ২৫৭

হযরত আলী (আ.) বলেছেন : হে বনী আদম! যে দিনটি আসেনি তার চিন্তায় বিভোর হবে না। যে দিনটি এসেছে তার চিন্তা কর। কারণ, তোমার বয়স অবশিষ্ট থাকলে সেই দিনের জন্য আল্লাহ রিযিকের বন্দোবস্ত করবেন।’- নাহজুল বালাগা, উক্তি নং ২৫৯

হযরত আলী (আ.) বলেছেন : তোমার বন্ধুকে ধীরে ধীরে ভালোবাস। হতে পারে কোন দিন সে তোমার অসন্তোষের পাত্র হয়ে যাবে। আর তোমার নিকট অবাঞ্ছিত ব্যক্তিকে ধীরে ধীরে ঘৃণা কর। হতে পারে সে কোন দিন তোমার প্রিয়পাত্র হয়ে যাবে।’- নাহজুল বালাগা, উক্তি নং ২৬০

(নিউজলেটার, আগস্ট ১৯৯১)

শহীদ জাভেদ বাহোনার- ত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল

শহীদ প্রধানমন্ত্রী হুজ্জাতুল ইসলাম জাভেদ বাহোনার ১৯৩৩ সালে কেরমান শহরে এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পবিত্র কুরআনের ওপর প্রাথমিক কোর্স সম্পন্ন করার পর কেরমানের মাসুমিয়াহ স্কুলে ধর্মতত্ত্ব বিজ্ঞানের ওপর অধ্যয়ন করেন। কোমে ধর্মতত্ত্বের ওপর পড়াশুনা শেষে তিনি তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এখান থেকে তিনি সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি এবং শিক্ষাবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।

ড. বাহোনার সবসময় তাঁর লেখা ও বক্তৃতায় ইসলাম প্রচার করতেন। তিনি ইসলামী তাওহিদী কেন্দ্রনামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন। রাফাহ স্কুল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৬২ সালে তিনি ইমাম খোমেইনীর নেতৃত্বে সক্রিয়ভাবে ইসলামী এবং রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশ নেন।

১৯৬৩ সালে ১৫ই খোরদাদের ঘটনার প্রেক্ষাপটে কয়েকটি স্থানে বক্তৃতা দেয়ার পর তিনি গ্রেফতার হন। ১৯৭৮ সালে ড. বাহোনার ইমাম খোমেইনীর আদেশে আলী খামেনেয়ী, আবদুল করিম মুসাভী আরদেবিলি এবং হাশেমী রাফসানজানীর সহযোগিতায় বিক্ষোভ মিছিল সংগঠিত করার দায়িত্ব পান। তিনি ইসলামী রিপাবলিকান পার্টি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সহযোগিতা করেন।

ইসলামী বিপ্লব সফল হওয়ার পর ড. বাহোনার ইসলামী বিপ্লবী পরিষদের সদস্য, খসড়া শাসনতন্ত্র বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্য, পার্লামেন্টের সদস্য, রাজাই মন্ত্রিসভার শিক্ষামন্ত্রী, ইসলামী রিপাবলিকান পার্টির চেয়ারম্যান ও ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রধানমন্ত্রী প্রভৃতি পদ অলংকৃত করেন।

মোহাম্মদ আলী রাজাই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ১৯৮১ সালের ৫ আগস্ট ড. বাহোনার প্রধানমন্ত্রী হন। এর মাত্র কয়েকদিন পরই ৩০ আগস্ট তিনি প্রেসিডেন্ট ভবনে সাম্রাজ্যবাদের এজেন্টদের পেতে রাখা বোমা বিস্ফোরণে শহীদ হন। তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত কর্মী, কর্মঠ ব্যক্তিত্ব। তিনি আমাদের জন্য নিষ্কলুষ দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন।

(নিউজলেটার, আগস্ট ১৯৯১)

হযরত আলী (আ.)-এর বাণী- নাহজুল বালাগা থেকে

হযরত আলী (আ.)-এর নিকট হারিস ইবনে হুত এসে বলেন : আমার সম্পর্কে আপনার অভিমত কী? আমি উটের যুদ্ধের উদ্যোক্তাদেরকে পথভ্রষ্ট বলে ধারণা করি।উত্তরে হযরত আলী (আ.) বলেন : হে হারিস! নিশ্চয় তুমি নিচের দিকে তাকিয়েছ। তোমার ওপরের দিকে তাকাওনি। তাই হতভম্ব হয়েছে। হককী, তুমি তা অবগত হলে হকপন্থীকে জানতে। তুমিতো হকই জান না। আর বাতিলকী, তা জানলে বাতিলপন্থীকে জানতে পারতে। তুমিতো বাতিল কী, তা-ই জান না। তখন হারিস বললেন : তাহলে সাআদ ইবনে মালিক ও আবদুল্লাহ ইবনে উমরের পথ ধরে স্বতন্ত্র হয়ে থাকি।তখন হযরত আলী (আ.) বললেন : নিশ্চয়ই সাআদ ও আবদুল্লাহ ইবনে উমর ন্যায়ের সহায়তা করেননি। আর বাতিলকেও নিরুৎসাহিত করেননি।’- নাহজুল বালাগা, উক্তি নং ২৫৪

হযরত আলী (আ.) বলেন : বাদশাহর সহচর বাঘের ওপর আরোহণকারীর ন্যায় হয়ে থাকে। লোকেরা তার অব¯হান দেখে ঈর্ষা করে। সে তার অবস্থানের ভয়াবহতা ভালো করেই জানে।’- নাহজুল বালাগা, উক্তি নং ২৫৫

হযরত আলী (আ.) বলেন : অপরের সন্তানের প্রতি করুণা কর। তোমাদের সন্তানদের হিফাজতের ব্যব¯হা তারই ফলে হবে।’- নাহজুল বালাগা, উক্তি নং ২৫৬

হযরত আলী (আ.) বলেন : জ্ঞানীদের উক্তি সঠিক হলে ঔষধের কাজ দেয়। আর তা ভুল হলে রোগ সৃষ্টি করে।’- নাহজুল বালাগা, উক্তি নং ২৫৭

হযরত আলী (আ.) বলেছেন : হে বনী আদম! যে দিনটি আসেনি তার চিন্তায় বিভোর হবে না। যে দিনটি এসেছে তার চিন্তা কর। কারণ, তোমার বয়স অবশিষ্ট থাকলে সেই দিনের জন্য আল্লাহ রিযিকের বন্দোবস্ত করবেন।’- নাহজুল বালাগা, উক্তি নং ২৫৯

হযরত আলী (আ.) বলেছেন : তোমার বন্ধুকে ধীরে ধীরে ভালোবাস। হতে পারে কোন দিন সে তোমার অসন্তোষের পাত্র হয়ে যাবে। আর তোমার নিকট অবাঞ্ছিত ব্যক্তিকে ধীরে ধীরে ঘৃণা কর। হতে পারে সে কোন দিন তোমার প্রিয়পাত্র হয়ে যাবে।’- নাহজুল বালাগা, উক্তি নং ২৬০

(নিউজলেটার, আগস্ট ১৯৯১)

nhiZ Avjx (Av.)-Gi evYxÑ bvnRyj evjvMv †_‡K

 

nhiZ Avjx (Av.)-Gi wbKU nvwim Be‡b ûZ G‡m e‡jb : ÔAvgvi m¤c‡K© Avcbvi AwfgZ Kx? Avwg D‡Ui hy‡×i D‡`¨v³v‡`i‡K c_åó e‡j aviYv Kwi|Õ Dˇi nhiZ Avjx (Av.) e‡jb : Ô†n nvwim! wbðq Zywg wb‡Pi w`‡K ZvwK‡qQ| †Zvgvi Ic‡ii w`‡K ZvKvIwb| ZvB nZf¤^ n‡q‡Q| ÔnKÕ Kx, Zywg Zv AeMZ n‡j nKcš’x‡K Rvb‡Z| Zywg‡Zv ÔnKÕB Rvb bv| Avi ÔevwZjÕ Kx, Zv Rvb‡j evwZjcš’x‡K Rvb‡Z cvi‡Z| Zywg‡Zv evwZj Kx, Zv-B Rvb bv| ZLb nvwim ej‡jb : ÔZvn‡j mvAv` Be‡b gvwjK I Ave`yjøvn Be‡b Dg‡ii c_ a‡i ¯^Zš¿ n‡q _vwK|Õ ZLb nhiZ Avjx (Av.) ej‡jb : ÔwbðqB mvAv` I Ave`yjøvn Be‡b Dgi b¨v‡qi mnvqZv K‡ibwb| Avi evwZj‡KI wbiærmvwnZ K‡ibwb|Õ- bvnRyj evjvMv, Dw³ bs 254

nhiZ Avjx (Av.) e‡jb : Ôev`kvni mnPi ev‡Ni Ici Av‡ivnYKvixi b¨vq n‡q _v‡K| †jv‡Kiv Zvi Ae¯nvb †`‡L Cl©v K‡i| †m Zvi Ae¯’v‡bi fqvenZv fv‡jv K‡iB Rv‡b|Õ- bvnRyj evjvMv, Dw³ bs 255

nhiZ Avjx (Av.) e‡jb : ÔAc‡ii mšÍv‡bi cÖwZ KiæYv Ki| †Zvgv‡`i mšÍvb‡`i wndvR‡Zi e¨e¯nv ZviB d‡j n‡e|Õ- bvnRyj evjvMv, Dw³ bs 256

nhiZ Avjx (Av.) e‡jb : ÔÁvbx‡`i Dw³ mwVK n‡j Jl‡ai KvR †`q| Avi Zv fyj n‡j †ivM m„wó K‡i|Õ- bvnRyj evjvMv, Dw³ bs 257

nhiZ Avjx (Av.) e‡j‡Qb : Ô†n ebx Av`g! †h w`bwU Av‡mwb Zvi wPšÍvq we‡fvi n‡e bv| †h w`bwU G‡m‡Q Zvi wPšÍv Ki| KviY, †Zvgvi eqm Aewkó _vK‡j †mB w`‡bi Rb¨ Avjøvn wiwh‡Ki e‡›`ve¯Í Ki‡eb|Õ- bvnRyj evjvMv, Dw³ bs 259

nhiZ Avjx (Av.) e‡j‡Qb : Ô†Zvgvi eÜz‡K ax‡i ax‡i fv‡jvevm| n‡Z cv‡i †Kvb w`b †m †Zvgvi Am‡šÍv‡li cvÎ n‡q hv‡e| Avi †Zvgvi wbKU AevwÃZ e¨w³‡K ax‡i ax‡i N„Yv Ki| n‡Z cv‡i †m †Kvb w`b †Zvgvi wcÖqcvÎ n‡q hv‡e|Õ- bvnRyj evjvMv, Dw³ bs 260

(wbDR‡jUvi, AvM÷ 1991)

উম্মে সেলিম- ইসলামের ইতিহাসের এক মহীয়সী নারী

ইসলামের প্রাথমিক যুগে ইসলামী চিন্তাধারা, মহানবী (সা.)-এর শিক্ষা ও চিরন্তন খোদায়ী হুকুম-আহকামের অনুসারী মহিলারা যথার্থ অর্থেই ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়েছিলেন। এ ধরনের একজন ধর্মপ্রাণ ও স্বাধীনচেতা মহিলা ছিলেন উম্মে সেলিম। সমসাময়িক মহিলাদের জন্য তিনি এক আদর্শ ও অনুসরণীয় প্রতীক হিসাবে বিবেচিত।

উম্মে সেলিমের নাম ছিল সালেহ। মালহানের কন্যা এই ধর্মপরায়ণা মহিলা আল্লাহর ওপর পূর্ণ ঈমান পোষণ করতেন। উম্মে সেলিম মালেক ইবনে নজরের স্ত্রী ছিলেন। উম্মে সেলিম যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন তাঁর স্বামী দূরবর্তী এক সফরে ছিল। স্বামী বাড়ি ফিরে উম্মে সেলিমের নতুন ধর্ম গ্রহণ বরদাশত করল না। উম্মে সেলিম তাঁর স্বামীকে বললেন : ‘আমি তোমার সাথে বসবাস করতে পারি, যদি তুমি ইসলাম গ্রহণ কর।’ তাঁর স্বামী ইসলাম ধর্ম গ্রহণকে পছন্দ করল না। সে চলে গেল সিরিয়ায় এবং কিছুদিন পর সেখানেই মারা গেল।

আনাস নামে উম্মে সেলিমের মালেকের ঔরসজাত একজন সন্তান ছিল। বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে তিনি মহানবী (সা.)-এর একজন অনুসারী হিসাবে গড়ে ওঠেন। নানা অসুবিধা ও সমস্যার মধ্যেও তিনি ইসলাম, মুসলমান ও মহানবী (সা.)-এর খেদমতে আত্মনিয়োগ করেন। মালেকের মৃত্যুর খবর শুনে উম্মে সেলিম আনাসকে প্রশিক্ষণ ও শিক্ষাদান করেন। ছেলে পূর্ণবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত উম্মে সেলিম বিয়ে করেননি। একদিন আবু তালহা নামে পরিচিত যায়েদ বিন সাহল নামে মদীনার এক বীর পুরুষ তাঁকে বিবাহের প্রস্তাব দেন। কিন্তু উম্মে সেলিম তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেন : ‘আপনি একজন মহান ব্যক্তি বটে। কিন্তু আভাস পেয়েছি যে, আপনি একজন মুশরিক। আপনি যদি মুসলমান হন এবং মানুষের তৈরি পুতুলের পূজা পরিত্যাগ করে আল্লাহর ইবাদত করেন, তাহলে আমি আপনার প্রস্তাব গ্রহণ করব। আমি কোন মোহরানাও চাই না, আপনার মুসলমান হওয়াটাই হবে আমার মোহরানা।’

উম্মে সেলিমের এই যুক্তিপূর্ণ কথা আবু তালহার পছন্দ হলো এবং তাঁর এই ইসলামী চিন্তাধারা প্রত্যক্ষ করে তিনি ইসলামের সত্যতা উপলব্ধি করতে পারলেন এবং মুসলমান হয়ে গেলেন। ইসলামের ইতিহাসে উম্মে সেলিমই প্রথম মহিলা যিনি ইসলামের এই চিন্তাধারা মোতাবেক বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন এবং পাত্রের ইসলাম গ্রহণকেই মোহরানা হিসাবে বিবেচনা করলেন। মুসলিম মহিলাদের জন্য এ এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বিবাহের পর মদীনায় আবু তালহা ও উম্মে সেলিমের জীবন বেশ সুখেই কাটতে থাকে। উম্মে সেলিম তাঁর স্বামীর আধ্যাত্মিক চেতনা বিকাশে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। একদিকে আবু তালহার নিজস্ব প্রতিভা এবং অপরদিকে উম্মে সেলিমের তত্ত্বাবধান তাঁকে একজন ঈমানদার ও বিশ্বাসী মুসলমানে রূপান্তরিত করে। বলা হয়েছে যে, বিভিন্ন যুদ্ধে মুসলমানদের পক্ষে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি আল্লাহর ধর্ম ইসলামকে সর্বাত্মকভাবে ভালোবাসতেন। আবু তালহার তীর নিক্ষেপ কৌশল এত প্রখর ছিল যে, তাঁর প্রতিটি তীরে কোন না কোন কাফের নিহত হতোই।

ওহুদ ও হোনায়নের যুদ্ধে তিনি অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করেন। ঐসব যুদ্ধে তিনি অন্তত বিশজন শত্রুসেনাকে হত্যা করেন এবং বিপুল পরিমাণ যুদ্ধাস্ত্র গনীমত হিসাবে আটক করেন। মহানবী (সা.)-এর ইন্তেকালের পরেও ইসলাম ও পবিত্র কুরআনের পথে তাঁর ত্যাগ ও সংগ্রামী ভূমিকা অব্যাহত থাকে। বার্ধক্যকালেও তাঁর অন্তরে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা এতই গভীর ছিল যে, একদিন আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ সংক্রান্ত পবিত্র কুরআনের একটি আয়াত তেলাওয়াতের সময় তিনি এতই অনুপ্রাণিত হয়ে ওঠেন যে, ছেলে-মেয়েদের বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি তাদেরকে এই বলে দমিয়ে দেন যে, ‘আল্লাহ যুবা-বৃদ্ধ নির্বিশেষে সকলকেই তাঁর পথে জিহাদে যেতে বলেছেন। অতএব, আমি তার ব্যতিক্রম হতে পারি না।’ এ ব্যাপারে সূরা তাওবার ৪১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে : ‘অভিযানে বের হয়ে পড়, হালকা হোক অথবা ভারী অবস্থায় এবং সংগ্রাম কর আল্লাহর পথে তোমাদের সম্পদ ও জীবন দ্বারা, এটাই তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা বুঝ।’

যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার পথে আবু তালহা ইন্তেকাল করেন। হ্যাঁ, উম্মে সেলিম তাঁর সচেতনতা, বিশ্বাস, দৃঢ়তা ও ইসলামী আখলাক দ্বারা এককালের একজন মূর্তিপূজা কাফেরকে একজন জীবনোৎসর্গকারী মুজাহিদে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

আল্লাহর ওপর উম্মে সেলিমের নির্ভরতা ছিল অত্যন্ত প্রবল। আবু তালহার সাথে তাঁর দাম্পত্য জীবনে তিনি একটি পুত্রসন্তান লাভ করেন। পুত্রের নাম রাখা হয়েছিল আবু আমর। সে সর্বদাই তার পিতার কাজে সহায়তা করত। একদিন সকালে দেখা গেল যে, আমরের শরীরে প্রচণ্ড জ্বর উঠেছে এবং সে মারাত্মকভাবে অসুস্থ। আবু তালহা কার্যব্যপদেশে বাড়ির বাইরে যাবার কিছুক্ষণ পরই অসুস্থ আবু আমরের মৃত্যু হয়। এই ঘটনায় উম্মে সেলিম খুব দুঃখ পান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি আল্লাহর ওপর ভরসা করেন এবং তাঁর ইচ্ছাকে মেনে নিয়ে নিজেকে সংযত করেন। এ ব্যাপারে এভাবেই তিনি আল্লাহর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি মানসিক অস্থিরতা বিদূরিত করলেন এবং অজু সম্পাদন করে আবু আমরের লাশ দাফন করলেন। তিনি জনসাধারণকে উদ্দেশ্য করে বললেন : ‘কেউ যেন আবু তালহাকে তাঁর পুত্রের মৃত্যু সংবাদ না জানায়। আমি নিজেই তাঁর সাথে কথা বলব।’

অল্প কিছুদিন পর আবু তালহা বাড়ি ফিরে আসলে উম্মে সেলিম তাঁকে হাসিমুখে স্বাগত জানান। তিনি স্বাভাবিকভাবেই আবু তালহাকে স্বাগত জানান এবং পরে তাঁকে বিশেষ এক ভঙ্গিতে একটি প্রশ্নের মাধ্যমে পুত্রের মৃত্যুর সংবাদ জানান। আবু তালহার কাছে উম্মে সেলিমের প্রশ্ন ছিল : ‘যদি কোন প্রতিবেশী আপনার কাছে কিছু জিম্মা রাখে এবং কিছু সময় পর সে তা ফেরত নিতে আসে তাহলে আপনি কি তা তৎক্ষণাৎ ফেরত দিবেন না?’ আবু তালহা তখন বললেন : ‘হ্যাঁ, অবশ্যই দিব।’ উম্মে সেলিম তখন বললেন : ‘আল্লাহ আমাদের কাছে যে পুত্রকে জিম্মা রেখেছিলেন তা ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন।’ একথা শোনর পর আবু তালহা তাঁর শোক ও মর্মবেদনা সংযত করলেন এবং দোয়া ও মুনাজাতে রত হলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি মহানবী (সা.)-এর কাছে গেলেন এবং তাঁর পুত্রের মৃত্যু ও এ ব্যাপারে তাঁর স্ত্রীর কর্মকাণ্ডের কথা জানালেন। মহানবী (সা.) উম্মে সেলিমের ধৈর্য ও সহনশীলতার প্রশংসা করলেন এবং তাঁর জন্য দোয়া করলেন।

কিছুদিন পর আল্লাহ রাবুল আলামীন উম্মে সেলিম ও আবু তালহার ঘরে আরো একটি পুত্রসন্তান দান করেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর নাম রেখেছিলেন আবদুল্লাহ। বয়ঃবৃদ্ধির সাথে সাথে আবদুল্লাহ ঈমান, ইলম ও তাকওয়ার এক উচ্চতর পর্যায়ে উন্নীত হন এবং মহানবীর একজন বিশ্বস্ত অনুসারী হিসাবে পরিগণিত হন।

উম্মে সেলিম এমনিভাবে ইসলামের শিক্ষা মোতাবেক তাঁর সচেতনতা, ঈমান, ইলম, তাকাওয়া ও সহনশীলতার সাহায্যে ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য এক অনন্যসাধারণ অবদান রেখে গেছেন। আশা করা যায় যে, আধুনিক সমাজের মহিলারাও ইসলামের ইতিহাসের মহীয়সী নারীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাদের সমাজকে গড়ে তোলার লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন এবং একটি খোদাভীরু ও সত্যানুসন্ধিৎসু বংশধর গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করবেন।

(নিউজলেটার, জুলাই ১৯৯১)

হযরত আলী (আ.)-এর বাণী- নাহজুল বালাগা থেকে

হযরত আলী (আ.) কুমায়েল ইবনে যিয়াদকে লক্ষ্য করে বলেন : ‘হে কুমায়েল! নিজ পরিবারবর্গকে হুকুম কর তারা যেন প্রত্যুষে উত্তম গুণাবলি অর্জন করে। আর ঘুমন্ত ব্যক্তির প্রয়োজন পূরণে রাতের অন্ধকারে গমন করে। যে সত্তার কর্ণ আওয়াজসমূহকে আয়ত্তে রাখে তাঁর কসম করে বলছি, কোন ব্যক্তি কারো অন্তরে আনন্দ সঞ্চার করলে অবশ্যই আল্লাহ তাআলা তার কল্যাণে সেই আনন্দের পরিবর্তে করুণা সৃষ্টি করেন। এরূপ ব্যক্তির ওপর কোন বিপদ আপতিত হলে সেই করুণা পানি প্রবাহিত হওয়ার ন্যায় বিপদের প্রতি প্রবাহিত হয়। ফলে অপরিচিত উটকে যেভাবে বিতাড়িত করা হয় সেই করুণাও বিপদকে অনুরূপভাবে তাড়িয়ে দেয়।- নাহজুল বালাগা, উক্তি ২৪৯

হযরত আলী (আ.) বলেছেন : ‘যখন সম্পদ হারিয়ে নিঃস্ব হবে তখন দান-খয়রাত করে আল্লাহর সাথে ব্যবসা করবে।’- নাহজুল বালাগা,  উক্তি নং ২৫০

হযরত আলী (আ.) বলেছেন : ‘বিশ্বাস ভঙ্গকারীর সাথে বিশ্বাস রক্ষা করা আল্লাহ তাআলার নিকট বিশ্বাস ভঙ্গের শামিল। আর বিশ্বাস ভঙ্গকারীর সাথে বিশ্বাস ভঙ্গ করা আল্লাহর নিকট বিশ্বাস রক্ষা করার নামান্তর।’- নাহজুল বালাগা, উক্তি নং ২৫১

হযরত আলী (আ.) বলেছেন : ‘করুণা প্রদর্শন করে অনেককে অবকাশ দেয়া হয়। আবরণ এঁটে অনেককে ধোঁকায় ফেলা হয়। অনেককে উত্তম বাক্য বলে ফিতনায় ফেলা হয়। অন্যায়ে অবকাশ দান করার ন্যায় আর কাউকে আল্লাহ তাআলা পরীক্ষা করেননি।’- নাহজুল বালাগা, উক্তি নং ২৫২

(নিউজলেটার, জুলাই ১৯৯১)

ইমামের স্মরণে- ইমামের পথে

হুশাং আলী মাদাদী

১৯৮৯ সালের ৩রা জুন ইসলামী বিপ্লবের স্থপতি ইমাম খোমেইনী (রহ.) বিশ্বের নির্যাতিত জাতিগুলোকে মুক্তির পথ প্রদর্শন করে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চিরবিদায় গ্রহণ করেছেন।

দুটি বছর চলে গেল… হ্যাঁ, এমন দুটি বছর অতিক্রান্ত হলো যার প্রতিটি দিন ছিল ব্যথা-বেদনায় ভরা। দুঃখ, অনুতাপ, শোক ও মাতমে আকীর্ণ। অশ্রু আর আর্তনাদ ছিল- ছিল অশ্রু আর অশ্রুই…

এখনো আমাদের বিশ্বাস হয় না যে, হযরত ইমাম আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিয়েছেন, আমাদের ইয়াতীম করে ফেলে গেছেন-

দুটি বছর এভাবেই কেটে গেল। আমরা বিশ্বাস করতে পারি না যে, ঈমান, ভালোবাসা, সাধনা ও ইরফানের প্রতিচ্ছবি ও বিপ্লবের মহান নেতার হৃদয়বিদারক ইন্তেকাল ঘটেছে।

দুটি বছর পার হয়ে গেল…

আধ্যাত্মিক অথৈ সাগরের কাণ্ডারি আর মারেফাতের মুর্শিদের ইন্তেকালের পর দুটি বছর পার হলো। এই দুটি বছরের প্রতিটি দিনই ছিল হাজারো দিনের সমান। যেদিন ইমামে উম্মত ইসলামী দেশ ইরানে পদার্পণ করেন, সেদিন জনতার বিশাল তরঙ্গমালা তাঁকে অভিবাদন জানিয়েছিল প্রাণের আকুতি দিয়ে। যেদিকেই দৃষ্টি যেত শুধু লোক আর লোক। জনতার অথৈ সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ আছড়ে পড়েছিল কূলভাঙ্গা জোয়ারে। তাদের নেতা ও ইমাম ফিরে এসেছেন, তাই আনন্দের এত জোয়ার। বসন্তের ছোঁয়ায় আশার বাগানের একমাত্র কিশলয়টি পল্লবিত হাওয়ায় সেদিন আন্দোলিত সুরভিত হয়েছিল বিপ্লবী চেনতায় স্পন্দিত জনতার গোলাপ কানন। তাই তাদের আনন্দের জোয়ার ছিল স্বাভাবিক ও স্বতঃ¯ফূর্ত। আনন্দে বুক ফেটে বেরিয়ে আসছিল স্লোগানের পর স্লোগান…

সেই ঐতিহাসিক দিনে, সেই সমারোহের দিবসে আশার ফল্গুধারায়, বসন্তের সমীরণে বাগানের নতুন সাজের দিনে সবার পরনে ছিল সফেদ পোশাক। তাদের চেহারায় ছিল জগতের সকল আনন্দ, উদ্দীপনা আর খুশির সমারোহ…

তারপর… তারপর দশটি বছর অতিক্রান্ত হবার পর আজ থেকে দুবছর পূর্বে আমাদের ঘর-বাহিরে শহর-পল্লির সর্বত্র আবার জনতার ঢল নেমেছিল। কিন্তু এ ঢল আনন্দের নয়, ছিল অশ্রুর। শোক ও মাতমে মূর্ছা প্রায়, কালো পোশাকে আচ্ছাদিত, বক্ষে ও ললাটে আঘাতরত ব্যথিতপ্রাণ মানুষের ঢল। বেদনায় ভারাক্রান্ত ও বিপন্ন মানুষেরা সেদিন হয়েছিল নিথর, বাকহারা। কান্নার জন্য ছিল না তাদের নয়নে অশ্রুবারি। ইমামকে চিরবিদায় দেয়ার অনুষ্ঠানে, ইমামের জানাযায় শরীক কোটি মানুষের এ ছিল অবস্থা…

হ্যাঁ, ইমামের দেহ আমাদের মাঝ থেকে চলে গেছে। কিন্তু তাঁর চিন্তা-দর্শন ও দিক-নির্দেশনা চিরন্তন হয়ে রয়েছে। তাই প্রিয় ইমামের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে বেদনাতুর হৃদয়ের সমুদ্রসম বিরহগাথার কয়েকটি কথা আপনাদের জন্য ব্যক্ত করতে চাই।

৯১ বছর আগে জমাদিউস সানীর ২০ তারিখে, রাসূলে পাকের প্রাণপ্রিয় কন্যা আমাদের মা সিদ্দিকা কুবরা হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.)-এর জন্মদিনে তাঁরই বংশের এক সন্তান জন্মগ্রহণ করেন ইরানের খোমেইন শহরে। এই নবজাতকই প্রদীপ্ত চন্দ্র আর সমুজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো নবী বংশের (আহলে বাইতের) নিষ্পাপ ইমামগণের উত্তরসূরিরূপে উদ্ভাসিত হন। আর এটাও ছিল হযরত ফাতেমা (আ.)-এর বরকত ও মাহাত্ম্যের আশীর্বাদস্বরূপ। শত শত সালাম ও দরূদ আরজ করছি তাঁর প্রতি। ১৩২০ হিজরির যে দিনটিতে হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.)-এর জন্মদিবস উদযাপিত হচ্ছিল সেদিনই এমন এক সন্তানের জন্ম হয়, যে সন্তান তাঁর সমকালীন ঘটনাপ্রবাহের জটিল ও ভয়াবহ আবর্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান এবং দুশমনদের অপমানিত ও লাঞ্ছিত করেন।

হ্যাঁ, ১৩৩৮ বছর পর সেই দিনটিতে হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.)-এর বংশধারায় এমন শিশুর আগমন হলো, পরবর্তীকালে যিনি হলেন ইতিহাসের ব্যতিক্রম, দ্বীনের উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা, যুগের দেদীপ্যমান সূর্য, স্বাধীন মানুষের সিপাহসালার ও তরিকতের পথিকদের মুর্শিদ। রুহুল্লাহ ঐ দিনই মায়ের কোল উদ্ভাসিত করেন। তাঁর জন্মের মধ্য দিয়ে নতুন এক ইতিহাসের সূচনা হয়।

রুহুল্লাহ কে?

রুহুল্লাহ সেই মহান আরেফ, যাঁর ইরফান ও আধ্যাত্মিকতার সুরাহী  থেকে প্রেমের সুধা পান করে তৃপ্তিলাভের জন্য আরেফ ও প্রেমিকগণ আকুল। রুহুল্লাহ সেই মহাপুরুষ যাঁর অস্তিত্বের ছায়াতলে দুনিয়ার চিন্তাবিদ ও মনীষীরা আশ্রয় চান আর তাঁর মাহাত্ম্য ও জ্ঞানগরিমার অসীম সমুদ্র থেকে এক অঞ্জলি পানি পান করার জন্য অধীর হয়ে থাকেন।

রুহুল্লাহ সেই মহান ব্যক্তিত্ব যাঁর প্রশংসা ও গুণগরিমা বর্ণনায় যুগশ্রেষ্ঠ মনীষীরাও ক্লান্ত; যাঁর সম্মান ও মর্যাদার খ্যাতি আকাশের দিগন্ত ছাড়িয়ে গেছে, মানুষের মন ও সমাজে আশীর্বাদের বৃষ্টির মতো বর্ষিত হয়েছে এবং মানব মুক্তির চিন্তাচেতনার ক্ষেত্রকে ফুল ও ফলে সজ্জিত করেছে।

রুহুল্লাহ সেই মূর্তিনাশী, যিনি ইবরাহীম (আ.)-এর আদর্শ অনুসরণে অজ্ঞতা, শক্তিমদত্ততা, শোষণ ও উপনিবেশবাদের মূর্তিগুলো ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিলেন এবং খোদাপ্রেমের পথে ইসমাঈলদের (বিপ্লবের মহান শহীদদের) কোরবানি করেছেন। যিনি কালেমাতুল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহর বাণীকে মহীয়ান আর আল্লাহর দুশমনদের বাণীকে পদানত করেছেন।

রুহুল্লাহ সেই মহান নিশানবরদার যিনি আপন পূর্বপুরুষদের ন্যায় লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর ঝাণ্ডা কাঁধে নিয়ে খাঁটি মুহাম্মাদী ইসলামের আওয়াজকে সারা বিশ্বে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত করেছেন। যিনি শতাব্দীকাল ধরে অপমানিত, লাঞ্ছিত ও নিপতিত মুসলমানদের হৃত মর্যাদা পুনরুদ্ধার করেছেন আর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের জাহেলিয়াতের পর্দা ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছেন। যিনি ক্ষুরধার তরবারি, ¯পষ্ট ভাষণ, বলিষ্ঠ লেখনি ও সংগ্রাম সাধনার মাধ্যমে স্বীয় পূর্বপুরুষ মহানবী (সা.)-এর দ্বীনের সীমান্তকে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত রক্ষা করেছেন। যিনি বিস্তীর্ণ, কণ্টকাকীর্ণ গোমরাহির অমানিশার মধ্যে ইসলামের সত্যিকার পথকে চিহ্নিত করে মুসলমানদের চিন্তার ভূমিতে খাঁটি ইসলামের পবিত্র বৃক্ষের চারা রোপন করেছেন। যদিও এ পথে তিনি অনেক আঘাত সহ্য করেছেন, অনেক হৃদয়ের রক্ত ঝরতে দেখেছেন এবং বুজুর্গের বেশধারী আহমকদের পক্ষ থেকে আরোপিত অনেক অপবাদ ও দুর্নাম সহ্য করেছেন। কিন্তু সবকিছুকে তিনি অম্লান বদনে একমাত্র আল্লাহর জন্য সহ্য করেছেন; তিনি খাঁটি মুহাম্মাদী ইসলামের দিকে তাক করা যে কোন বিষাক্ত তীরকে বুক পেতে নেয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। তিনি দুর্নাম আর গুজবকে মোটেও ভয় করেননি; বরং অত্যন্ত দৃঢ় ও অবিচলচিত্তে প্রেমের পথে এগিয়ে গেছেন, অবিচল পর্বতের ন্যায় যুগের সকল ভয়াবহতাকে উপেক্ষা করেছেন এবং মুহূর্তের জন্যও সংকুচিত হননি। যদিও তিনি হীন চরিত্রের ধর্ম ব্যবসায়ীদের হাত থেকে সমসাময়িক সকল দায়িত্বপরায়ণ লোকের চাইতে অধিক দুঃখ কষ্ট ও আঘাতের সম্মুখীন হয়েছেন; কিন্তু এ বৈশিষ্ট্য তিনি তাঁর পূর্বপুরুষ রাসূলে পাক (সা.)-এর কাছ থেকে উত্তরাধিকার হিসেবে পেয়েছেন, যিনি বলেছেন, ‘আমাকে যেরূপ কষ্ট দেয়া হয়েছে, সেরূপ কষ্ট আর কোন নবীকেই দেয়া হয়নি।

রুহুল্লাহ সম্মান ও মর্যাদার উচ্চ শৃঙ্গ, দুনিয়ার বঞ্চিত, নির্যাতিত (মুস্তাজয়াফ) মানুষের আশার প্রদীপ। তিনি সেই সুন্দর মানুষ, যিনি ইবাদত-বন্দেগি, সাধনা ও পবিত্রতা, তাকওয়া-পরহেজগারি, খোদাভীতি, ন্যায়নিষ্ঠা, বিনয় ও নম্রতা প্রভৃতি ক্ষেত্রে শুধু সমসাময়িক যুগেই নয়, নিষ্পাপ ইমামদের পর প্রায় সকল যুগের অপ্রতিদ্বন্দ্বী চরিত্রের অধিকারী ছিলেন।

রুহুল্লাহ জ্ঞান ও দূরদর্শিতার প্রতিচ্ছবি, জিহাদ ও শাহাদাতের ময়দানের বীর সেনানী, দুনিয়ার বঞ্চিত, নির্যাতিত মানুষ ও মুসলমানদের অবিসংবাদিত নেতা, হতাশাগ্রস্ত অসহায় মানুষের আশ্রয়স্থল। যিনি যুলুমবাজ, শোষকশ্রেণি, অর্থগৃধনু, ক্ষমতাদর্পী, ছদ্মবেশী আলেম, সাম্রাজ্যবাদের দোসর এবং তাদের সব রকমের অনুসারীর বিরুদ্ধে দৃঢ়চিত্তে সংগ্রামের পতাকা উড্ডীন করেছেন এবং ওহী ও রেসালতের পথ ধরে আসা আমানতকে যুলুম ও অজ্ঞতা পরিহার করে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সাথে বহন করেছেন।

হ্যাঁ, ইমাম তাঁর পার্থিব জীবনের অল্প সময়ে আল্লাহর প্রতি তাঁর দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করেছেন। তিনি তাঁর বরকতময় জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়েছেন এবং ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য সাধ্যমত সর্বোত্তম পন্থায় খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। তিনিই নির্ভীকচিত্তে দুনিয়ার সমস্ত শক্তিমদমত্ত বিশ্বগ্রাসীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দুই পরাশক্তির দম্ভ ও ভাবমূর্তি চূর্ণ করেছেন।

তিনিই ইসলামী বিপ্লবের ভিত্তি মূলকে সুদৃঢ়  করেছেন এবং এ বিপ্লবকে দুশমনদের সব রকমের চক্রান্ত ও নীলনকশা থেকে রক্ষা করেছেন।

তিনিই ছিলেন সেই অসীম সাহসী পুরুষ, যিনি মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন বস্তু বা ব্যক্তিকে ভয় করেননি এবং ভর্ৎসনাকারীদের তিরস্কার তাঁকে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখতে পারেনি। তিনি পশ্চিমা পুঁজিবাদের ফেতনা ও অপকীর্তি এবং প্রাচ্য কম্যুনিজমের আগ্রাসন ও অন্তঃসারশূন্যতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও লড়াই থেকে মুহূর্তের জন্যও বিরত থাকেননি। প্রাচ্য নয়, পাশ্চাত্য নয়স্লোগানকে তিনি ইসলামী বিপ্লবের এক অপরিবর্তনশীল স্লোগানে পরিণত করেছেন এবং এর বরখেলাপ করা অমার্জনীয় অপরাধ বলে ঘোষণা দিয়েছেন। বস্তুত আল্লাহর সেই মহান বান্দা বঞ্চিত নির্যাতিত মানুষের বন্ধু, যালিমদের ত্রাস, আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী, আল্লাহ ও রাসূলের দুশমনদের মৃত্যুদ- দানকারী ব্যক্তিত্ব ইমাম রুহুল্লাহ আল-মুসাভী আল- খোমেইনী ছাড়া আর কে হতে পারেন?

মূলত তিনি একজন ব্যক্তিই ছিলেন না; বরং একাই ছিলেন এক বিরাট জাতি, বীরত্ব, সাহসিকতা, ধৈর্য, অল্পে তুষ্টি, পুতপবিত্রতা এবং সর্বোপরি বঞ্চিত নির্যাতিত মানুষের প্রতি দায়িত্ব সচেতনতা প্রভৃতি মানবীয় গুণের সমষ্টি। এজন্য তিনি কিয়ামত পর্যন্ত তাঁর অনুরক্ত ও প্রেমিকদের হৃদয় জগতে অমর হয়ে থাকবেন। আর আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো- যদি আমরা দুনিয়া ও আখেরাতের সম্মান ও মর্যাদার আকাঙ্ক্ষী হই, তাহলে আল্লাহর প্রেমিকদের এই কাফেলা থেকে যেন কেউ পেছনে পড়ে না থাকি।

আসুন, আজ আমরা এই মহান ব্যক্তিত্বকে হারানোর বার্ষিকীতে ইসলামী বিপ্লবের নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী ও দুনিয়ার সকল মুসলমানের প্রতি শোক ও সমবেদনা জানাই।

মহান ইমাম দৈহিকভাবে আমাদের মাঝে নেই, তবু তাঁর চিন্তাধারা ও উপদেশবাণী আমাদের হৃদয়ের মণিকোঠায় চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। আমাদের একান্ত কামনা আল্লাহ পাক আমাদেরকে সাহায্য করবেন, যাতে তাঁর বরকতময় জীবনের বৈশিষ্ট্যাবলি অনুসরণ করে এগিয়ে যেতে পারি, ইনশাআল্লাহ…।

 (নিউজলেটার, জুন ১৯৯১)