All posts by dreamboy

ইউরোপ এবং ইরানের ইসলামী বিপ্লব

ইরানে ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের পর সারা বিশ্বে এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। পৃথিবীর অন্যান্য এলাকার মতো ইউরোপেও ইসলামী বিপ্লবের বিরাট প্রভাব আমরা দেখতে পাই।

খ্রিস্টীয় বিশ্বে ৬০-এর দশকের শেষের দিক এবং ৭০-এর দশককে ধর্মানুরাগের ক্ষেত্রে ‘অন্ধকার যুগ’ বলা হয়। এই সময়ে খ্রিস্টীয় বিশ্বে উল্লেখযোগ্য হারে ধর্মীয় শিক্ষালয় এবং ধর্মযাজকদের সংখ্যা কমতে দেখা যায়। মানুষের মাঝেও ধর্মের প্রতি উৎসাহ কম দেখা যায়। কিন্তু ৮০-এর দশকে এসে এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। এ সময়ে আবার জনগণের মাঝে ধর্মানুরাগ বৃদ্ধি পায়। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে থাকে।

ইসলামী বিপ্লবের পরে কার্ডিনাল র‌্যাটসিং-এর নেতৃত্বে খ্রিস্টবিশ্বের ১২ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ১৯৮৫ সালে এক আন্তর্জাতিক বিৃবতি প্রদান করেন। এ বিবৃতির প্রস্তুতিমূলক কাজ সম্পাদনে চার বছর সময় লাগে। বিবৃতির বিষয়বস্তু ছিল বিশ্বাস, ধর্মীয় অনুশাসন, আদেশ-নিষেধ এবং উপাসনা। বিবৃতিতে সামাজিক ক্ষেত্রে চার্চের ব্যাপক কর্মকাণ্ডের নিশ্চয়তা বিধান করা হয় এবং খ্রিস্টীয় এই প্রশাসন (ক্যাথলিক) নিজেদেরকে মানবজাতির মুক্তিদাতা হিসাবে ঐ বিবৃতিতে উল্লেখ করে।

ধর্মানুরাগকে নিয়ে ইউরোপে এর আগে অনেক বই লেখা হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়। ইতালীয় ভাষায় এরকম একটি  বইয়ের নাম Torento Statement । এই বই সম্পূর্ণ করতে সময় লেগেছিল তিন বছর। তবে এ সকল বই ছিল অঞ্চলভিত্তিক।

ক্যাথলিক পণ্ডিতদের আন্তর্জাতিক বিবৃতিতে চার্চের সামাজিক ভূমিকা রাজনৈতিক পরিমণ্ডল অবধি সম্প্রসারিত হয়। উদাহরণস্বরূপ পোল্যান্ডের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। খ্রিস্টান ধর্মগুরু পোপ পোল্যান্ডের কম্যুনিস্ট প্রশাসনকে উৎখাত করে ধার্মিক প্রশাসনকে ক্ষমতায় বসাবার জন্য তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিগানের সাথে সহযোগিতা করেছিলেন।

ইরান বিপ্লবের পর ইউরোপীয় জনজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধর্মের প্রতি অনুরাগ বৃদ্ধি পায়। ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর পরে অস্ট্রিয়ার প্রেসিডেন্ট কুর্ট ওয়ার্ল্ডহাইম একবার বলেছিলেন, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ধর্মীয় নেতৃত্ব তাঁকে একজন ধার্মিক খ্রিস্টান বলে ভাবতে শিখিয়েছে। এছাড়া সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের পরিপ্রেক্ষিতে অঙ্গ রাষ্ট্রগুলো দীর্ঘ ৭০ বছরের কম্যুনিস্ট শাসনের কবল থেকে মুক্ত হয়ে ধর্মের কাছে ফিরে এসেছে।

ধর্মকে বাদ দিয়ে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের আড়ালে ইউরোপে উৎকট স্বাদেশিকতা আন্দোলন শুরু হয়, যৌন বিকৃতি প্রসার লাভ করে এবং নীতিহীনতা প্রকট হয়ে ওঠে। পাশ্চাত্য সমাজে এসবই ছিল ধর্মকে প্রতিরোধের জন্য ষড়যন্ত্র।

ঐতিহ্যবাহী ধর্মবিশ্বাসে প্রত্যাবর্তনের ফলে জনসমাজে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সকল প্রকার ধর্মীয় চিন্তাধারা বিকাশ লাভ করছে এবং ইউরোপীয় সমাজে পারলৌকিক জীবনের চেতনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, ইউরোপীয় সমাজ পার্থিব লোভ-লালসার বাইরে অন্য এক জগতের প্রতি স্বভাবতই আকৃষ্ট হচ্ছে।

ইউরোপীয় সমাজে ইসলামের প্রতি জনগণের আকর্ষণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

পূর্ব ইউরোপীয় মুসলমানরা প্রধানত স্বল্প আয় শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। এরা বহু শতাব্দী ধরে এ এলাকায় বসবাস করছে। কিন্তু পশ্চিম ইউরোপে বসবাসরত মুসলিম জনগণ প্রধানত উন্নত জীবনের আশায় মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে আগত। এদের বেশির ভাগই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পশ্চিম ইউরোপে অভিবাসী হয়।

পূর্ব ইউরোপের যুগোশ্লাভিয়া, বুলগেরিয়া এবং আলবেনিয়ার মুসলমানদের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং তা প্রাক্তন তুর্কি সাম্রাজ্যের সাথে সম্পর্কিত। তুর্কি মুসলমানদের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত এসব এলাকার মুসলমানরা যুগ যুগ ধরে ওখানে বসবাস করছে। এলাকার অন্যান্য জাতির সাথে ওরাও মিশে আছে। কোন কোন এলাকা, যেমন আলবেনিয়া, বোসনিয়া, হার্জেগোভিনায় মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে থেকেও এখানকার মুসলমানরা তাদের ইসলামী স্বকীয়তা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে।

পশ্চিম ইউরোপের মুসলিম অভিবাসনের ইতিহাস মাত্র ৬০ বছরের পুরোনো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে এই এলাকায় সংখ্যালঘু মুসলমানদের সংখ্যা তেমন উল্লেখযোগ্য ছিল না। কিন্তু বর্তমানে পশ্চিম ইউরোপে অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধার কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এখানে অভিবাসী হয়ে আসে।

যুদ্ধ পরবর্তীকালে ইউরোপে জনশক্তির চাহিদার কারণে অনেক বিদেশী সহজেই ইউরোপে আসার সুযোগ পায়। বর্তমানে অভিবাসী মুসলমানরা ইউরোপীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার পর এখন সামাজিকভাবে বেশ সক্রিয়। নিজ দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি নিয়েও তারা বেশ সজাগ। এ ব্যাপারে ইউরোপীয়দের মাঝেও একটি ভয় ঢুকেছে যে, মুসলমানদের সচেতনতায় ইউরোপে নব্য নাজী ও ফ্যাসিস্ট আন্দোলন বৃদ্ধি পেতে পারে। ইসলাম এবং মুসলমানদের সম্পর্কে ভুল ধারণার কারণে ইউরোপে মুসলমানদের প্রতি এরূপ মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছে।

মাতৃভূমির যে কোন প্রকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ইউরোপের অভিবাসী মুসলমানদের মাঝে বিরাট প্রভাব রাখে। এরকম একটি ঘটনা হলো ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের পর ইউরোপে এর বিরাট প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

ইউরোপীয় মুসলমানদের মাঝে ইসলামী চেতনায় ফিরে যাওয়ার যে প্রবণতা তার সাথে ইউরোপীয় সরকারগুলোর দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এবং ফ্রান্সের স্কুলে ইসলামী পর্দা ও ইসলামী আচার-আচরণের বিরোধীতা শুরু হয়। বিভিন্ন দেশে ইসলামী পুনর্জাগরণ এবং ইউরোপের সংখ্যালঘু মুসলমানদের মাঝে তার প্রভাব এ বিরোধকে আরো জাগিয়ে তোলে। কুখ্যাত ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ গ্রন্থের প্রকাশনা এবং ইসলামী বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেইনী (রহ.) কর্তৃক এ গ্রন্থের লেখক সালমান রুশদীকে মৃত্যুদ- প্রদান প্রভৃতির কারণে ইউরোপীয় মুসলমানদের ইসলামী মানসিকতায় বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়। ইসলামী পুনর্জাগরণের চেতনায় এরা উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে।

ইউরোপে ইসলামী চেতনার উন্মেষ, ইসলামী ছাত্র সংগঠনের প্রতিষ্ঠা, মসজিদ নির্মাণ, ব্রিটেনে মুসলিম পার্লামেন্ট গঠন, মুসলিম রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পাশ্চাত্য বুদ্ধিজীবীর ইসলাম গ্রহণ, যেমন রজার গারোদী (ফ্রান্স), মনসুর মন্টি (ফ্রান্স), আহমদ হোবার (অস্ট্রিয়া) প্রভৃতি; বিভিন্ন ইসলামী সম্মেলনের আয়োজন, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইসলামী সাময়িকী ও দৈনিকের আত্মপ্রকাশ, ইসলামী টিভি এবং রেডিও স্টেশন প্রতিষ্ঠা প্রভৃতিকে ইউরোপে ইসলামী চেতনার বিকাশের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি বলা যায়।

তৃতীয় বিশ্বে ইসলামী আন্দোলনের প্রসারে ইউরোপের উৎকণ্ঠা : ইরানের ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে ধর্মের কাছে ফিরে আসার আহ্বান সারা পৃথিবীতে বিরাট আলোড়নের সৃষ্টি করেছে। খ্রিস্টবিশ্বও এ প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি। ল্যাটিন আমেরিকায় ও আফ্রিকায় ধর্মতাত্ত্বিক স্বাধীনতার উন্মেষ এ প্রভাবেরই ফলশ্রুতি।

ধর্মতাত্ত্বিক স্বাধীনতাকে তৃতীয় বিশ্বের জনগণের সাম্য ও ন্যায়ের জন্য ঐতিহাসিক দাবি হিসাবে আখ্যায়িত করা যায়। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত কতিপয় ধর্মতাত্ত্বিক ব্যক্তিত্বের উদ্ধৃতি প্রণিধানযোগ্য, ‘খরভব‘Life Cannot Exist Only for Me’ গ্রন্থের লেখক নাইরোবীতে অনুষ্ঠিত খ্রিস্টীয় চার্চের এক কনফারেন্সে উল্লেখ করেন, ‘জনগণ এখনও এমন একটি সমাজের প্রত্যাশী যেখানে সকলেই ন্যায়বিচার ভোগ করবে। খোদায়ী মুক্তির এই ঐতিহাসিক পথ ধরেই আমাদের এগিয়ে যাওয়া উচিত।’

‘The History of Church in Latin America’ এবং ‘The Libaration Philosophy’ গ্রন্থের প্রণেতা এটরিক ডে সেল বলেন, ‘মার্কসবাদের আগেও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রতি সমর্থন বজায় ছিল, এর পরেও তা থাকবে।’

‘বেকারত্ব এবং পরিবেশ সংরক্ষণ প্রভৃতির মতো তৃতীয় বিশ্বের ইস্যুগুলোর ব্যাপারে পুঁজিবাদ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এ কারণেই আমার মতে ধর্মতাত্ত্বিক মুক্তির চিন্তা বিকাশ লাভ করেছে।’

এল সালভাদরের জনৈক লেখক জন সুপারনিও থিওলডগ বলেন, ‘স্বাধীনতার সাথে শোষণ-বঞ্চনার একটি সম্পর্ক রয়েছে। তৃতীয় বিশ্বে শোষণ, বঞ্চনা ও অন্যায়-অবিচার দীর্ঘদিন থেকে বিকশিত হয়ে আসছে। ধনী এবং দরিদ্র দেশসমূহের ব্যবধান ক্রমশ বাড়ছে। এখন বঞ্চিতদের আহাজারি আগের চেয়ে বেশি শোনা যাচ্ছে। বর্তমানে ধর্মতাত্ত্বিক পরিমণ্ডলে এর সমাধান খুঁজে বেড়াচ্ছে মানুষ এবং এর অর্থই হলো ধর্মতাত্ত্বিক মুক্তি।’

ধর্মতাত্ত্বিক মুক্ত চিন্তা খ্রিস্টীয় চার্চের কর্তৃপক্ষের মাঝে সাড়া জাগাতে পারেনি। অনেক ক্ষেত্রে এই মুক্ত চিন্তা চার্চের বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছে।

অপরদিকে তৃতীয় বিশ্বে এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামী আন্দোলনের ফলে এ সকল দেশে এবং ইউরোপে গণতন্ত্র, স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার বিষয়ে পাশ্চাত্যের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পরিলক্ষিত হয়। আলজেরিয়ার নির্বাচনে ইসলামপন্থীদের বিজয়ের প্রতি পাশ্চাত্যের অসহযোগিতা, সেখানকার সামরিক জান্তার প্রতি ইউরোপের সমর্থন প্রভৃতি ইসলামী জাগরণের প্রতি ইউরোপের বিরূপ মনোভাবেরই পরিচায়ক।

ইসলামী আন্দোলন ও ইসলামী জাগরণের প্রতি ইউরোপের বিরোধিতা সুস্পষ্ট। নিম্নলিখিত কর্মকাণ্ডগুলোর মাধ্যমে এটা প্রমাণিত হয়। যেমন ইরানের ইসলামী বিপ্লবের বিরোধিতা করে একে ‘সন্ত্রাসবাদী’ আখ্যা দেয়া, বিভিন্নভাবে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ওপর চাপ সৃষ্টি করা, মধ্য এশিয়ার স্বাধীনতার পথে অগ্রসরমান মুসলমানদের মাঝে ধর্মীয় চেতনা যাতে জাগতে না পারে সেজন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া, আফগানিস্তানের শান্তি-শৃঙ্খলা যাতে প্রতিষ্ঠিত হতে না পারে সে উদ্দেশ্যে সেখানকার বিভিন্ন দল-উপদলের মাঝে বিরোধ লাগিয়ে দেয়া। পাকিস্তানে, ভারতে এবং লেবাননে ধর্মান্ধতাকে জাগিয়ে দেয়া, মুসলমানদের মাঝে জাতীয় বিরোধ সৃষ্টি করে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেয়া, ইসলামী আন্দোলনগুলোকে দমন করার জন্য স্থানীয় প্রতিক্রিয়াশীল ও তাঁবেদার দলগুলোকে সাহায্য-সহযোগিতা করা, মুসলমানদের বিরুদ্ধে অন্য ধর্মাবলম্বীদের উসকে দেয়া, যেমন বাবরী মসজিদ ষড়যন্ত্র। পারস্য উপসাগরে এবং আফ্রিকা শৃঙ্গে ন্যাটো ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি, সুদানের ওপর চাপ প্রয়োগ, ফিলিস্তিনে এবং লেবাননে ইহুদি যুলুম-নির্যাতনের প্রতি অব্যাহত সমর্থন প্রদান, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া এবং মিশরের দালাল সরকারগুলোর প্রতি সমর্থন দান প্রভৃতি।

উপরিউক্ত কর্মকাণ্ডগুলো থেকেই প্রমাণিত হয় ইরানে ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের প্রভাবে ইউরোপ ও পাশ্চাত্যে ইসলামের বিরোধিতা কত ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে! সেই সাথে এটাও প্রমাণিত হয় ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের পর সারা বিশ্বে প্রকৃত ইসলামের পুনর্জাগরণের জোয়ার শুরু হয়েছে।

ইসলামী নৈতিকতা পুনরুজ্জীবনে ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর অবদান

ড. এম এ আনজালদুস মোরেলিস

মানব জীবন ও ইতিহাসের ওপর ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর প্রভাব চলতি শতাব্দী এবং এর পূর্বেকার বহু শতাব্দীর যে কোন ব্যক্তিত্বের তুলনায় অধিকতর শক্তিশালী। আমরা দ্বিধাহীন চিত্তে বলতে পারি যে, তাঁর আবির্ভাবের পূর্ব ও পরবর্তীকালে মানব সমাজের অবস্থা বহু দিক বিচারে অভিন্ন নয়।

ইমাম খোমেইনী (রহ.) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, অর্থনীতি, আচরণ, রাজনীতি, নেতৃত্ব ও যুদ্ধবিগ্রহ ইত্যাদিসহ বিভিন্ন দিকে মান নির্ণয় করে গেছেন। অবশ্য এই মান নতুন কিছু নয়। তিনি তা নতুনভাবে আবিষ্কারও করেননি। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের এসব মান মহানবী (সা.) সুস্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত ও নির্দেশিত করে গেছেন। তিনি আল্লাহ তাআলার প্রত্যাদিষ্ট ও কুরআনে প্রকাশিত নির্দেশাবলি মান্য করে চলতেন।

ইদানীং সমগ্র বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম সমাজ ইসলামী মূল্যবোধ, রীতিনীতি ও মানদণ্ড ভুলে গেছে বা সেগুলোর ব্যাপারে অজ্ঞতার মধ্যে নিমজ্জিত রয়েছে। আর এসবের জায়গায় স্থান নিয়েছে উপনিবেশবাদী পশ্চিমাদের চাপিয়ে দেয়া মানদণ্ড। এই পশ্চিমা উপনিবেশবাদীরা ইসলামী বিশ্বকে জবর দখল করেছে, এর সম্পদরাজি লুণ্ঠন করেছে, এর বাসিন্দাদের দাসে পরিণত করেছে এবং এর মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির ধ্বংসসাধন করেছে। আর নির্লজ্জভাবে চার হাতপায়ে নতজানু হয়ে শাসকদের পদচুম্বনকারী, হাদীস বিকৃতকারী এবং প্রভুদের খেয়ালখুশি মোতাবেক কুরআনের ব্যাখ্যা প্রদানকারী দরবারি আলেমদের দ্বারা তাদের এসব কার্যকলাপকে ন্যায়সঙ্গত বলে সমর্থন করিয়ে নিয়েছে।

ইমাম খোমেইনী (রহ.) ইসলামী উম্মাহকে জাগিয়ে তুলেছিলেন, তাদেরকে ইসলামী মূল্যবোধ ও রীতিনীতি শিক্ষা দিয়েছেন এবং পরাশক্তি বলে কথিত পশ্চিমা ও বস্তুবাদীদের প্রাধান্য খর্ব করেছেন। সকল প্রকার ষড়যন্ত্র, সমস্যা ও বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে প্রমাণ করে তিনি দেখিয়ে গেছেন যে, একটি জাতি কিভাবে টিকে থাকতে পারে। কেননা, ইসলামী জীবনযাপনই হচ্ছে আল্লাহ তাআলাকে সন্তুষ্ট করার একমাত্র পন্থা। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে : ‘কেউ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দীন গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনও কবুল করা হবে না এবং সে হবে পরলোকে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সূরা আলে ইমরান ; ৮৫) পবিত্র কুরআনের এই বাণী মোতাবেক কেউ সাফল্য অর্জন করলে শয়তান অসন্তুষ্ট হয়, তাই সবসময় সে বান্দার ধ্বংস সাধনের চেষ্টা করে।

নৈতিকতা একটি সমাজে সুখের জন্য অপরিহার্য। আর মহানবী (সা.) প্রদত্ত শিক্ষা এবং ইমাম খোমেইনী (রহ.) কর্তৃক পুনরুজ্জীবিত ইসলামী নৈতিকতা সঠিক জীবন যাপনের একমাত্র পন্থা। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা যে আদেশ দিয়েছেন, হাদীসের মাধ্যমে মহানবী (সা.) যে বাণী প্রকাশ করে গেছেন এবং আহলে বাইতগণ যে শিক্ষা দিয়ে গেছেন সে মোতাবেক যে জীবন্ত ইসলামী নীতিবিধান তৈরি হয়েছে ইসলামী নৈতিকতা তা ছাড়া আর কিছু নয়।

নৈতিকতা খোদা ও তাগুতের মধ্যে পার্থক্যের সাথে সংশ্লিষ্ট। সততা বা ভালো কর্মের স্বীকৃতি দিতে হবে, তার আনুকূল্য দান করতে হবে এবং তার বিকাশ ঘটাতে হবে। পক্ষান্তরে অসৎ বা মন্দ কর্মকে চিহ্নিত করতে হবে, তার নিন্দা করতে হবে এবং মানব জীবনের সকল কর্মকাণ্ড ও বিষয়াদিতে তা নিষিদ্ধ করতে হবে। আল্লাহ তাআলা হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে সকল নবী-রাসূলের মাধ্যমে মানব সমাজের কাছে এই পার্থক্য তুলে ধরেছেন এবং একটি নৈতিক জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনামূলক নীতি তাদের মনে জাগরুক রেখেছেন। এছাড়া, মহানবী (সা.)-এর পরে যেহেতু আর কোন নবীর আবির্ভাব হবে না তাই আল্লাহ তাআলা জনসাধারণকে নৈতিকতা সম্পর্কে সজাগ রাখার জন্য ইমামদেরকে নিয়োগ করেন।

অবশ্য, ইদানীং মানুষ ধর্মের মৌলিক নীতিমালার প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করছে, সৎকর্মের বিরোধিতা করছে এবং অসৎকর্মের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, মানব জীবনের সকল ক্ষেত্রে নৈতিক উৎকর্ষ উপেক্ষিত হচ্ছে এবং নৈতিকতাসম্পন্ন ও ধর্মপ্রাণ মানুষকে উপহাস ও অবজ্ঞা করা হচ্ছে। অপরদিকে কপট, দুর্নীতিপরায়ণ ও মিথ্যাবাদী লোকেরা প্রশংসিত হচ্ছে এবং নতুন প্রজন্মের আদর্শ নমুনা হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে।

এই নৈতিক অবক্ষয় একান্তভাবে কেবল অমুসলিম দেশে সংঘটিত হচ্ছে তাই নয়, সকল মুসলিম সমাজেই নৈতিক অবক্ষয় ছড়িয়ে পড়ছে এবং এর গতি অমুসলিম দেশসমূহের তুলনায় মুসলিম দেশসমূহেই বেশি। এর কারণ কী? অমুসলিমরা তো সত্যের সকল দিক সম্পর্কে অবগত নয় এবং যেহেতু তাদের সামনে সমগ্র বিষয়টি উদ্ভাসিত করা হয়নি, সেহেতু তারা সকল কিছু প্রত্যাখ্যানও করেনি। অথচ মুসলমানরা তো চৌদ্দশত বছর ধরে চূড়ান্ত সত্যকে জেনে আসছে এবং সে মোতাবেক তাদেরকে জীবন যাপন করতে আদেশ দেয়া হয়েছে। সুতরাং তারা যখন এটি প্রত্যাখ্যান করে তখন তা সচেতনভাবেই করে এবং খোদা ও তাঁর শিক্ষাকে প্রত্যাখ্যান করার মানসেই করে। আর এই নৈতিক অবক্ষয়ের মাধ্যমেই তারা আনয়ন করে খোদার অভিশাপ। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে : তাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে। অতঃপর আল্লাহ তাদের ব্যাধি বৃদ্ধি করেছেন এবং তাদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি; কারণ, তারা মিথ্যাচারী। তাদেরকে যখন বলা হয়, ‘পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করো না’, তারা বলে, ‘আমরাই তো শান্তি স্থাপনকারী।’ সাবধান! এরাই অশান্তি সৃষ্টিকারী, কিন্তু এরা বুঝতে পারে না। যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘যেসব লোক ঈমান এনেছে তোমরাও তাদের মতো ঈমান আন’, তখন তারা বলে, ‘নির্বোধ যে রকম ঈমান এনেছে আমরাও কি সে রকম ঈমান আনব?’ সাবধান! এরাই নির্বোধ, কিন্তু এরা বুঝতে পারে না। যখন তারা মুমিনদের সংস্পর্শে আসে তখন বলে, ‘আমরা বিশ্বাস করেছি’, আর যখন তারা নিভৃতে তাদের শয়তানদের সাথে মিলিত হয় তখন বলে, ‘আমরা তো তোমাদের সাথেই রয়েছি; আমরা শুধু তাদের সাথে ঠাট্টা-তামাশা করে থাকি।’ আল্লাহ তাদের সাথে তামাশা করেন, আর তাদেরকে তাদের অবাধ্যতায় বিভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ানোর অবকাশ দেন। এরাই হেদায়াতের বিনিময়ে ভ্রান্তি ক্রয় করেছে। সুতরাং তাদের ব্যবসা লাভজনক হয়নি, তারা সৎপথেও পরিচালিত নয়।’ (সূরা বাকারা : ১০-১৬)

আমরা যদি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো অনুশীলন করতে মনোযোগী না হই এবং আমাদের যদি বাহ্যিক ও মাঝামাঝি পর্যায়ের চিন্তা থাকে তাহলে আমরা মুসলমান হওয়ার দাবি করতে পারি না। আমরা কি আমাদের প্রতিবেশীদের সম্মান করি? মহানবী (সা.) বলেছেন : ‘যে ব্যক্তি তার প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে ঘুমাতে চায় সে মুমিন নয়।’ জ্ঞান অর্জনের তাকিদ দিয়ে মহানবী (সা.) বলেছেন : ‘দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অনুসন্ধান করো।’

আমরা কোন হারাম বা নিষিদ্ধ কাজ করি না- এটি নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমাদের প্রতিটি কাজকে পর্যালোচনা করে দেখতে হবে। হারাম নয় অথচ হারামের দিকে প্ররোচিত এমন কিছুও আমাদেরকে অবশ্যই পরিহার করতে হবে। যেমন- খারাপ পরিবেশ, খারাপ সংস্পর্শ ও খারাপ উদ্দেশ্য।

প্রতিদিন আমাদের আত্মবিশ্লেষণ করতে হবে এবং অনুসন্ধান করে দেখতে হবে যে, আমরা ছোট মনে করি এমন কোন পাপ সেখানে বিরাজ করছে কিনা। কেননা, এসব ছোট ছোট পাপ বড় বড় পাপের রূপ নিয়ে বিস্তার লাভ করতে পারে, তাই অবশ্যই তা পুরোপুরি পরিহার করা দরকার। ছোট ছোট পাপ আত্মার অসুস্থতা সৃষ্টি করে, বড় বড় পাপের দিকে প্ররোচিত করে এবং ঈমান থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। অহমিকা, ঈর্ষা, পরশ্রীকাতরতা, ক্রোধ, আলস্য, লোভ ও মাত্রাতিরিক্ত পানাহার ইত্যাদি বড় পাপ এবং এসব মানুষকে অসৎকর্মের দিকে প্রলুব্ধ করে। ইসলামের নিম্নোক্ত নৈতিক গুণাবলির মাধ্যমে সেগুলোর মোকাবিলা করা যায়। যেমন- বিনয়, প্রেম, পরোপকার, সুধারণা, ধৈর্য, সৎকর্ম, মিতব্যয় ইত্যাদি।

পবিত্র কুরআন এবং মহানবী (সা.)-এর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা এসব সদগুণ শিক্ষা দিয়েছেন। ইমাম খোমেইনী (রহ.) বিশ্বের সামনে এইসব সদগুণের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন এবং দেখিয়ে গেছেন যে, বর্তমান বিশ্বেও এর প্রয়োজনীয়তা কত তীব্র! তিনি কেবল কথা ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ লেখনী ও সাহিত্যের মাধ্যমেই এ শিক্ষা দেননি; বরং দৃষ্টান্তের মাধ্যমে এ শিক্ষা দিয়ে গেছেন। তাঁর ধৈর্য ছিল দৃষ্টান্তমূলক ও প্রভাব বিস্তারক। সে কারণে ইরানের জনগণ নানা প্রতিকূলতা ও বিপর্যয়ের মধ্যেও অধিকতর ধৈর্যশীল হতে পেরেছে। ইমাম খোমেইনী (রহ.) ও তাঁর ইরানী জাতি কারবালার শহীদদের এক জীবন্ত প্রতীকে পরিণত হয়। ইমাম হোসাইন (আ.) এবং তাঁর পরিবারবর্গ ও অনুসারিগণ যেভাবে ধৈর্য ও সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন সেভাবেই ইমাম খোমেইনী (রহ.) ও তাঁর জনগণ হামলা, আত্মীয়-পরিজন ও বন্ধু-বান্ধবদের জানমালের ক্ষতি, মিথ্যা অপবাদ ও সমালোচনা ইত্যাদির সম্মুখীন হয়।

মানবতার প্রতি ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর ভালোবাসা ছিল প্রচুর। সকল মানুষের জন্যই তিনি ভালো আনয়ন করেন, কেবল ইরানীদের জন্য নয়। ইমাম খোমেইনীর কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের মাধ্যমে প্রতিটি মানুষ উপকৃত হয়েছে। ইরান, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, আফ্রিকা তথা বিশ্বের সকল নির্যাতিত মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধা করে এবং তাঁর থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করে। তিনি সকলের জন্য দোয়া করতেন। গোটা মানবতার জন্য তিনি ছিলেন এক আশীর্বাদ।

ইমাম খোমেইনীর উত্তম চরিত্র ও খোশমেজাজ সম্পর্কে সকলেই ছিলেন সম্যক অবহিত। শিশু ও দরিদ্র কৃষক থেকে শুরু করে সুশিক্ষিত পণ্ডিত ও বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের সকলেই তাঁকে শ্রদ্ধা করত। ইমাম খোমেইনী ছিলেন অত্যন্ত দয়ার্দ্র হৃদয়, কিন্তু দৃঢ়চেতা। তাঁর শত্রু ও আক্রমণকারীদের বেলায়ও তাঁর এই বৈশিষ্ট্যের ব্যত্যয় ঘটতো না।

যে কোন লোকের তুলনায় ইমাম খোমেইনী বেশি পরিশ্রম করতেন। তিনি তাঁর দেশবাসী ও মুসলিম বিশ্বের সমস্যার ব্যাপারে সবসময় মনোযোগী থাকতেন। তিনি কখনই ব্যক্তিগত বৈষয়িক সুবিধা অর্জন করেননি; বরং একটি অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন। তাঁর বাসগৃহ ছিল সাধারণ ইরানীদের বাসগৃহের চেয়েও সাধারণ। তিনি কখনই বিলাস পছন্দ করতেন না এবং সবসময় তোষামোদ ও পার্থিব সম্মান এড়িয়ে চলতেন। তিনি দেখিয়ে গেছেন যে, সকলেরই সুখে থাকার প্রয়োজন রয়েছে এবং ইসলামে তাই বলা হয়েছে। তিনি বস্তুবাদী মানুষদের থেকে সত্যনিষ্ঠ মানুষদের পৃথক করার একটি রেখাচিহ্ন এঁকে গেছেন। তাঁর অনুসারীদেরকেও তাঁর মতো হতে হবে এবং ধনী ও শক্তিশালী লোকদের টেবিল থেকে পতিত হাড় ও রুটির টুকরো নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হওয়া উচিত হবে না।

ইমাম খোমেইনী (রহ.) সবসময় কেবল ইসলামের বাণী প্রচার করে গেছেন তাই নয়, তিনি ইসলামের সত্যকে আন্তরিকভাবে ভালোবাসতেন। ইসলামী সত্যের একজন প্রেমিক হিসাবে তিনি ইসলামের সেবা করতে গিয়ে কোন ত্যাগ স্বীকারে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করেননি। তিনি এই প্রেমে তাঁর সমগ্র জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। যুবক বয়সে ইমাম খোমেইনী (রহ.) তাঁর এক চাচাকে তাঁর জন্য একটি মেয়ের সাথে বিয়ের আয়োজন করতে বলেন। কেননা, কিশোর বয়সেই ইমাম খোমেইনীর পিতৃবিয়োগ ঘটে। মেয়েটিকে যখন বিয়ের প্রস্তাব দেয়া হয়, তখন মেয়েটি এই প্রস্তাব এই বলে অপছন্দ করে যে, তিনি (ইমাম খোমেইনী) ধর্মকে খুব বেশি ভালোবাসেন। তাই সে এই বিয়ের মাধ্যমে সুখী জীবন যাপন করতে পারবে না। সে রাতে স্বপ্ন দেখে যে, মহানবী (সা.) তাঁকে বলছেন : ‘তুমি কেন আমার সন্তানকে অস্বীকার করছ?’ পরের দিন সকালে সে তার পিতামাতাকে বলে : ‘আমি তাঁকে বিয়ে করব।’ এই মহিলাই ছিলেন ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর সারা জীবনের প্রিয় সঙ্গিনী এবং তিনি  সমগ্র জীবন ধরে তাঁর সঙ্গে সত্যের সন্ধানে যাবতীয় কষ্ট ও কাঠিন্য ভোগ করেছেন।

ইমাম খোমেইনী (রহ.) মুসলমানদের মধ্যে ইসলামী মূল্যবোধকে জাগ্রত করে গেছেন এবং সমগ্র বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন যে, কোন ব্যক্তি ইসলাম অনুযায়ী সুখী জীবন যাপন করতে পারে এবং ইসলামই হচ্ছে সকল যুগের সকল মানুষের জন্য সঠিক জীবনপন্থা। তিনি আমাদেরকে সকল নবী-রাসূলের মাধ্যমে প্রেরিত এবং পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে চিরতরে প্রতিষ্ঠিত খোদার শাশ্বত ও সত্য আইন স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেছেন।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর রুহকে রহমত দ্বারা সিক্ত করেন, তাঁর কর্মপ্রচেষ্টা কবুল করে পুরস্কার ও সান্ত্বনা দান করুন, তাঁর অনুসারীদের তাঁর দৃষ্টান্ত অনুসরণ এবং তাঁর উত্তরাধিকারকে রক্ষা ও সাহায্য করার অনুপ্রেরণা দান করুন এবং তাঁর সাধনার ফল ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানকে হেফাজত করুন।

হযরত আয়াতুল্লাহ আল উযমা আরাকী (রহ.)

হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা শায়খুল ফোকাহা মুহাম্মাদ আলী আরাকী ছিলেন ইরানের প্রখ্যাত আয়াতুল্লাহদের অন্যতম। ইল্ম, তাকওয়া, একনিষ্ঠতা ও জ্ঞান সাধনায় তাঁর ন্যায় ব্যক্তি দুর্লভ। ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা ছিল। তিনি বিপ্লবোত্তর তেহরানের জামারান এলাকায় গিয়ে ইমাম খোমেইনীর সাথে দেখা করেন। আর তাঁকে সালাম করতে গিয়ে ভক্তিভরে বলেছিলেন : ‘আসসালামু আলাইকা ইয়া ওয়ালিআল্লাহ’ অর্থাৎ হে আল্লাহর ওয়ালি! আপনার প্রতি সালাম। হযরত আয়াতুল্লাহ আরাকী বয়সে ইমাম খোমেইনী (রহ.) হতে দশ বছর বড় ছিলেন। আর তাঁরা উভয়ে হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা হায়েরী (র.)-এর ছাত্র ছিলেন। তবু তিনি ইমাম খোমেইনীর ব্যক্তিত্ব ও ইসলামী খেদমতের জন্য তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। লোকমুখে শোনা যায় তিনি ইমাম খোমেইনীর হাত চুম্বন করতে চাইলে ইমাম খোমেইনী তা করতে দিতেন না। বলতেন : ‘আপনি হলেন পুণ্যবান লোকদের অবশিষ্ট ব্যক্তি। আপনার অবস্থান পৃথিবীর জন্য কল্যাণের নিদর্শন।’

ইমাম খোমেইনীর ইন্তেকালের পর মরহুম আয়াতুল্লাহ আরাকী তাঁকে এক ‘মহামানব’ বলে আখ্যায়িত করেন। আর তাঁর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী প্রজাতন্ত্রের প্রতি এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্রের নেতার প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখার জন্য বাণী প্রেরণ করেন। তিনি তাঁর বাণীতে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য জোরালো ভাষায় আবেদন জানান। বাণীতে তিনি ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের হিফাযত করাকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বলে বর্ণনা করেন।

আয়াতুল্লাহ উজমা মুহাম্মাদ আলী আরাকী (র.)-এর যোগ্যতা ও গুণাগুণ বর্ণনা করতে গিয়ে ইমাম খোমেইনীর প্রতিনিধি জনাব আয়াতুল্লাহ সানিয়ী বলেন : ইমাম খোমেইনীর ইন্তেকালের পর তাঁর তাকলীদ করা যাবে বলে মরহুম আয়াতুল্লাহিল উজমা আরাকী ফতোয়া দিয়েছিলেন। সাধারণত শিয়া আলেমগণ মুজতাহিদের মৃত্যুর পর তাঁর তাকলীদ করা যাবে না বলে মতপ্রকাশ করেন। কিন্তু ইমাম খোমেইনী (র.) এর ব্যতিক্রম ছিলেন বলে হযরত আয়াতুল্লাহ আরাকী ফতোয়া প্রদান করেন। ইমাম খোমেইনীর ব্যক্তিত্বের চুলচেরা বিশ্লেষণের পর তিনি এ অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন- যা ইরানের অন্যান্য আয়াতুল্লাহ সমর্থন করেছিলেন।

হযরত আয়াতুল্লাহ আরাকী ‘শায়খুল ফোকাহা ওয়াল মুজতাহিদীন’ খেতাবে ভূষিত হন। অর্থাৎ তাঁকে মুজতাহিদ ও ফকীহদের পুরোধা বলা হতো। তিনি পনেরো খোরদাদ থেকে একচল্লিশ বছর পূর্বে ‘আল-উরওয়া’ গ্রন্থের টীকা লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এ কাজ তখন কঠিন ছিল। কারণ, তখনো ‘আল-উরওয়া’ গ্রন্থের সূত্র উল্লেখ করে কোন গ্রন্থ রচিত হয়নি। এমতাবস্থায় সূত্রহীন আল-উরওয়া গ্রন্থের ওপর ইজতিহাদ করে মাসয়ালা-মাসায়েল বের করা কঠিন ব্যাপার ছিল। এ কঠিন কাজ তিনি অনায়াসে সম্পাদন করেন। ফিকাহ শাস্ত্রে আয়াতুল্লাহিল উজমা আরাকীর পাণ্ডিত্যের এটি একটি উৎকৃষ্ট প্রমাণ।

তিনি শুধু ফিকাহ শাস্ত্রের পণ্ডিত ছিলেন না। তিনি ফিকাহ তথা ব্যবহারিক শাস্ত্রের বিধান রচনার মূলনীতি-বিশারদ ব্যক্তি ছিলেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর অনন্য প্রতিভার পরিচয় মেলে। ফিকাহবিদদের মধ্যে তাঁর ন্যায় ব্যক্তি অতি বিরল। তিনি অত্যন্ত পরহেজগার-মুত্তাকী ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর দোয়া কবুল হতো। একবার কোম নগরে অনাবৃষ্টির দরুন ভয়াবহ অবস্থা দেখা দেয়। বৃষ্টির জন্য নামাযের আয়োজন করা হয়। হযরত আয়াতুল্লাহিল উযমা আরাকী বৃষ্টির জন্য নামায পড়ান আর দোয়া করেন। ফলে বৃষ্টি বর্ষিত হয়ে শহরে শান্তি নেমে আসে। আর ফিকাহ শাস্ত্রে তাঁর বুৎপত্তিতে সমসাময়িক আলেমগণ তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। পার্থিব বস্তুতে তাঁর অনাসক্তি ও তাকওয়ার স্বীকৃতি দিয়েছেন সমসাময়িক বিদ্বানগণ। তিনি কোনদিন ‘মারজা’ বলে দাবি করেননি। ধর্মের বিধান জানার জন্য যাঁর প্রতি মুসলমানগণ দৃষ্টি নিবদ্ধ করে তাঁকে ‘মারজা’ বলা হয়। লোকেরা এক বাক্যে মারজার প্রতি অনুগত থাকে। ধর্ম-কর্মের মর্যাদা নিরূপণে এটি একটি উঁচু স্থান। এ পর্যায়ে কদাচই কেউ উপনীত হন। আল্লামা আয়াতুল্লাহিল উযমা বরুজারদী এবং আল্লামা আয়াতুল্লাহিল উযমা  খোনসারী মরহুম মারজা ছিলেন। তাঁদের ওফাতের পরও তিনি মারজা হওয়ার দাবি করেননি। আয়াতুল্লাহিল উযমা খোনসারীর ওফাতের পর তাঁর অনুসারীরা হযরত আয়াতুল্লাহিল উযমা আরাকীর প্রতি আকৃষ্ট হন। তবু তিনি মারজা হওয়ার কল্পনা করেননি। কিন্তু ইসলামের রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও ইসলামের হিফাজতের প্রয়োজন দেখা দিলে তিনি একমাত্র ইসলামের স্বার্থে মারজা পদে অলংকৃত হন। একমাত্র ইসলামের স্বার্থ রক্ষার্থে তিনি এ দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

তাঁর ইলম, তাকওয়া, পরহেজগারী ও বুজর্গীর দরুন তাঁর পেছনে বড় বড় আলেম এক্তেদা করে নামায পড়তেন। তিনি বহুদিন যাবৎ মাদ্রাসা-ই ফায়যিয়ায় নামাযে ইমামতি করেন। কোম নগরে যে কোন পর্যায়ের আলেমের আগমন হয়েছে তাঁরা হযরত আয়াতুল্লাহ আরাকীর পেছনে নামায পড়ার গৌরব অর্জন করেন। হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা শায়খুল ফোকাহা মুহাম্মাদ আলী আরাকী ১৯৯৪ সালের ২৯ নভেম্বর ইন্তেকাল করেন।

ইরানের আল্পস : অশতুরানকোহ- অপরূপ সৌন্দর্যের প্রতীক

মানব সভ্যতার সুপ্রাচীন ঐতিহ্য ও সৌন্দর্যের অন্যতম লীলাভূমি ইরান। বিচিত্র প্রকৃতির বিপুল সম্ভারে পরিপূর্ণ ইরান স্মরণাতীত কাল ধরে পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসছে। ভূপ্রকৃতি ও ঋতু-বৈচিত্র্য এবং মানব সংস্কৃতির বিবিধ ধারায় ইসলামী রীতিনীতি ও ঐতিহ্যের সম্মিলনে ইরান দেশটা হয়ে উঠেছে অপরূপ।

অপরূপ ইরান ভ্রমণের জন্য প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটকের ভীড় হয়। ইরানের বিভিন্ন আকর্ষণীয় স্থানের অন্যতম হলো জাগ্রোস পর্বতমালার নয়নাভিরাম পর্যটন কেন্দ্র ‘আশতুরানকোহ’।

Oshtaran_Mountains,_Lorestan,_Iranজাগ্রোস পর্বতশ্রেণি ইরানের বৃহত্তম পর্বত শ্রেণি। উত্তর পশ্চিম অংশে লোরেস্তান এলাকায় অবস্থিত ‘ইরানের আল্পস’ নামে খ্যাত পার্বত্য ভূমি ‘অশতুরানকোহ’। অশতুরানকোহ এর দুটি বিখ্যাত পর্বতশৃঙ্গ ‘গোলাপ’ এবং ‘সান বোরান’ যথাক্রমে ৪০৫০ মিটার ও ৪১৫০ মিটার উঁচু। আজনা শহরের ১৯ কি.মি. দক্ষিণ পশ্চিমে এ শৃঙ্গ দুটির অবস্থান।

অশতুরানকোহের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান হলো দুটি স্বচ্ছ পানির হ্রদ। এর নাম গহর। এর দুটি অংশ উচ্চ এবং নিম্ন পর্বতের বরফ গলা পানি জমে গহর হ্রদকে রুক্ষ পাহাড়ি পরিবেশে এক টুকরা সুবজাভ পান্নার মতো রূপ দিয়েছে। বিজ্ঞানীরা বলেন, পাহাড়ি ভূমিধসের ফলে এ দুটি হ্রদের সৃষ্টি হয়।

গহর হ্রদের প্রধান অংশের দৈর্ঘ্য ১০৫ কি.মি. এবং প্রস্থ ৬০০ মিটার। উপযুক্ত পর্যটন সুবিধা প্রদান করা গেলে এই হ্রদ শ্রেষ্ঠ বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত হতে পারে।

800px-RudkhanCastleলোরেস্তানের বনভূমি ও চারণভূমির পরিমাণ যথাক্রমে ৭৫০০০ হেক্টর ও ১২৫০০০০ হেক্টর। সামগ্রিকভাবে জাগ্রোস পর্বতমালা হালকা গাছপালায় আচ্ছাদিত। গহর হ্রদের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চল হালকা বনানী আচ্ছাদিত। এ বনাঞ্চলে ওক, তারপিন, কাঠবাদাম, সাভিন প্রভৃতি গাছ জন্মে। লোরেস্তানের বনাঞ্চলে বাদামি ভালুক, নেকড়ে, হায়েনা, শিয়াল, গাজেলী হরিণ, বন্য ছাগল, হরিণ, চিতাবাঘ, বিভিন্ন প্রকার সরীসৃপ, বনমোরগ, ঘুঘু প্রভৃতি জীবজন্তু দেখা যায়। এছাড়া এখানকার হ্রদ এবং নদ-নদীতে রুই-কাতলাজাতীয় মাছও প্রচুর পাওয়া যায়। বসন্তকালের শুরু থেকে গরমকাল অবধি অশতুরানকোহ এর ঢালু উপত্যকাসমূহ বিভিন্ন সবুজের সমারোহে ভরে উঠে। তখন হরেক রকম পাহাড়ি ফুলের গন্ধে চারিদিক মোহিত হয়ে ওঠে। অশতুরানকোহতে এসে পর্যটকরা এর অপরূপ সৌন্দর্য দেখে অভিভূত হয়ে যায়। জনৈক পর্যটক তাঁর ভ্রমণ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘অশতুরানকোহ এর সর্বোচ্চ চূড়ায় আমি আরোহণ করেছি। এটি আমার দীর্ঘ ভ্রমণের শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতা। ক্যাম্প থেকে তাকালে তুষারাবৃত পর্বতচূড়ার নয়নাভিরাম দৃশ্য চোখে পড়ে। নীল আকাশের পটভূমিতে তুষার ঢাকা পর্বতশ্রেণি এক কথায় অপূর্ব। ১৯৭০ মিটার উঁচুতে এই পর্বতশ্রেণি ইউরোপের আল্পস পর্বতমালার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। একমাত্র পার্থক্য হলো এই পাহাড়শ্রেণি লোরেস্তানের গ্রামগুলোকে আড়াল করে রাখে।’

Oshtoran_Kooh‘চূড়া থেকে দেখলে চারিদিকের দৃশ্য আরো চমৎকার। উত্তরদিকে ৩৮০০ মিটার উঁচু তুষারাবৃত সিরাক পর্বত। পশ্চিমে পর্বতচূড়াগুলো ঢালু হয়ে ধীরে ধীরে নেমে গেছে। দক্ষিণ-পশ্চিমে বিশাল এক গিরিখাদের মাঝখানে চোখে পড়ে নীলাভ গহর হ্রদ। আরো দক্ষিণে এক গিরিখাদে শোভা পাচ্ছে প্রধান হ্রদ গহর। পাহাড়ের চূড়া থেকে প্রথম আমি এই হ্রদটি দেখেছি, হঠাৎ দেখলে মনে হবে বিশাল এক টুকরো নীলা যেন মাটিতে পড়ে আছে। টলটলে স্বচ্ছ ঠাণ্ডা পানিতে আকাশের ছায়া পড়ে হ্রদটিকে করে তুলেছে অপরূপ। গহর হ্রদের সৌন্দর্য দেখে আমি অভিভূত না হয়ে পারিনি।…’

800px-Ab_sefid-aligoodarzঅশাতুরানকোহ এর চূড়ায় না উঠে কেউ আসলে এর চারিদিকের শোভা অবলোকন করতে পারবে না। বসন্তকালে এখানে দাঁড়ালে ফুরফুরে হাওয়া আপনার জন্য বয়ে আনবে পাহাড়ি ফুলের মনমাতানো সৌরভ। বিকেলের পড়ন্ত রোদের ঝিকিমিকিতে আপনাকে স্বপ্নিল পরিবেশে নিয়ে যাবে। হ্রদের পানিতে গোধুলির রঙ যখন ছড়িয়ে পড়বে তখন সোনালি পানিতে মাছের জলকেলী দেখে আপনি মুগ্ধ না হয়ে পারবেন না। আপনি ইচ্ছে করলে অশতুরানকোহের উত্তরে আজনার সমভূমিতে রক্তিম টিউলিপের সমারোহ দেখতে পারেন। কিংবা দক্ষিণ-পশ্চিমের খাল পার্বত্যাঞ্চলের পাহাড়ি ঝরনার জলপ্রপাত আপনাকে আরো মুগ্ধ করতে পারে।

 

 

 

ইসফাহানের জামে মসজিদ, ইসলামী স্থাপত্যকলার এক অপূর্ব নিদর্শন

ইসফাহান শহরকে যদি একটি আংটির সাথে তুলনা করা হয় তাহলে জামে মসজিদকে আংটির মাঝখানে মূল্যবান মণি-মুক্তা বলা যায়।

ইরানের অতি প্রাচীন মসজিদগুলোর অন্যতম হলো ইসফাহানের জামে মসজিদ। ঠিক কখন এই মসজিদের প্রতিষ্ঠা সে সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তবে প্রাপ্ত তথ্যাদির ভিত্তিতে অনুমান করা হয়, পঞ্চম হিজরির আগেও এ মসজিদের অস্তিত্ব ছিল।

-جمعه-اصفهان-1392036143ইসফাহান শহরের পুরানো অংশ সাবজে ময়দানে (সবুজ ময়দান) এই ঐতিহাসিক মসজিদটি অবস্থিত। মসজিদটির প্রত্নতাত্ত্বিক খননকালে বেশ কিছু প্রাচীন দলিলের সন্ধান পাওয়া যায়। এ সকল দলিল দায়লামী, সেলজুক, মোঙ্গল এবং সাফাভী আমলের।

মসজিদটি দেখলেই দর্শকের দৃষ্টিতে ভেসে উঠবে ইসলামী ইতিহাসের বিভিন্ন স্মৃতি। মসজিদটিকে ইসলামের বিভিন্ন যুগের স্থাপত্য রীতির সমন্বিত এক অপরূপ নিদর্শন বলা যায়।

মসজিদটির আটটি প্রবেশ পথ রয়েছে। সবেচেয়ে পুরানো প্রবেশ পথটি হাতেফ সড়কের দিকে মুখ করে। এই পথটির স্থাপত্য শৈলীর অসাধারণ কারুকাজ দর্শক মাত্রকেই মুগ্ধ করে। প্রবেশ পথের ডান পাশে ছোট ছোট প্লাটফর্ম রয়েছে। এগুলো চতুর্থ হিজরিতে দায়লামী যুগে তৈরি। বাম পাশের স্তম্ভ শ্রেণি সেলজুক আমলের স্থাপত্য রীতিতে তৈরি। মসজিদের উঠানের দক্ষিণ পাশে যে সুদৃশ্য গম্বুজটি রয়েছে সেটার নাম ‘খাজা নিজামুল মুল্‌ক গম্বুজ’। সেলজুক সুলতান মালিক শাহের উজির নিযামুল মুল্‌ক এটি নির্মাণ করেন পঞ্চম হিজরিতে। এই গম্বুজের পার্শ্ববর্তী যেসব স্তম্ভ রয়েছে সেগুলোও সেলজুক আমলের। তবে দক্ষিণ পশ্চিম পাশের স্তম্ভটি শাহ আব্বাস সাফাভীর আমলে তৈরি।

326011_714মসজিদের দক্ষিণ সিঁড়ির নাম ‘সুফফেহ সাহেব’ যা ৬ষ্ঠ হিজরির স্মৃতি বহন করছে। তবে এর ভেতরে এবং বাইরের যে সুন্দর কারুকাজ তা সাফাভী আমলে সম্পন্ন হয়েছে। এই সিঁড়িসংলগ্ন সুদৃশ্য মিনারগুলো সংযোজন করা হয়েছে ‘হাসান বেগের সময়ে’। উঠানের চারপাশে মসজিদের দেয়ালের কারুকাজ করেন হাসান বেগ তুর্কমান।

মসজিদের পূর্ব সিঁড়ির নাম ‘সুফফেহ শাগেরদ’। এটি ৬ষ্ঠ হিজরিতে সেলজুক আমলে তৈরি। আরেকটি সিঁড়ি ‘সুফফেহ ওমর’ কুতুবউদ্দিন মাহমুদ শাহের আমলে তৈরি। তিনি আল মোজাফফর বংশের নৃপতি ছিলেন। আশরাফ আফগানের শাসনামলে এই সিঁড়িটির সংস্কার করা হয়।

মসজিদের পশ্চিম সিঁড়ির নাম ‘সুফফেহ ওসতাদ’। এটিও ৬ষ্ঠ হিজরিতে নির্মিত। এর সিরামিক টাইলের কাজগুলো সাফাভী বংশের শাহ সুলতান হোসাইনের আমলে সম্পন্ন হয়। পশ্চিম সিঁড়ির উত্তর পাশে একটি ছোট মসজিদ রয়েছে। এটি তৈরি করেছিলেন মোঙ্গল শাসক ওলজাইতু। এ মসজিদের মিম্বর এবং কারুকাজ ৭১০ হিজরিতে সম্পন্ন হয়।

মসজিদের উত্তর পাশের সিঁড়ি ‘সুফফেহ দরবেশ’ও ৬ষ্ঠ হিজরিতে তৈরি। এর অভ্যন্তরে প্লাস্টারের কাজ ও নকশা সাফাভী সুলতান শাহ সুলায়মানের আমলে সম্পন্ন হয়। এর বাইরের টাইলে অলংকরণ হয় অনেক পরে ১৩৩৬/১৩৩৭ হিজরিতে।

উত্তর সিঁড়ির পার্শ্ববর্তী এবং এর উত্তরাংশে যে স্তম্ভগুলো রয়েছে তাও ৬ষ্ঠ হিজরির।

তবে ইসফাহান জামে মসজিদের উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক যে নিদর্শন তা হলো এর সুদৃশ্য তাজউল মূল্‌ক গম্বুজ। সেলজুক আমলের স্থাপত্যকলার অপূর্ব নিদর্শন এই গম্বুজটি। প্রতি বছর ইরানে হাজার হাজার পর্যটক ইসফাহানের জুমআ মসজিদও পরিদর্শনে এসে থাকেন। হাজার বছরের বিবর্তনে এই মসজিদ হয়ে উঠেছে যেমন আকর্ষণীয় তেমনি ইরানের পর্যটন শিল্পের জন্য হয়ে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ। যে কোন পর্যটক ইরান ভ্রমণে গেলে এ রকম আরো অসংখ্য অপূর্ব স্থাপত্যকলার নিদর্শন দেখতে পাবেন এবং মুগ্ধ হবেন।

 

ফারসি কাব্যসাহিত্যে মহানবী (সা.)

ড. মাওলানা এ.কে.এম. মাহবুবুর রহমান

ভাষা ও সাহিত্যজগত কাব্য ও ছন্দ নিয়েই তার যাত্রা শুরু করে। কবিতাই ছিল মানবজাতির সাহিত্য সৃষ্টির প্রাথমিক মাধ্যম। আনুষ্ঠানিক সাহিত্যচর্চা শুরুর পূর্বেই মানুষের মুখে উচ্চারিত হয়েছে ছন্দবদ্ধ বাক্য। অর্থাত মানবমনে সব যুগেই কাব্যসাহিত্য সমাদৃত ছিল। কবিগণ তাঁদের ছন্দবদ্ধ ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন সম্প্রদায়, সমাজ, দেশ ও জাতির গৌরব গাথা। এ ময়দান ছিল প্রতিযোগিতামূলক। যিনি যত বেশি উন্নতমানের কবিতা উপহার দিতে সক্ষম হয়েছেন তিনিই তত বেশি হয়েছেন সমাদৃত।

মহানবী (সা.) যে সময় এ জগতে তাশরীফ আনেন তখন ছিল আরবি কাব্য-সাহিত্যের সোনালি যুগ। বিশ্ববিখ্যাত কবিরা প্রতিযোগিতার ময়দানে অবতীর্ণ হতো আরবের প্রখ্যাত ‘ওকাজ’ মেলায়। যার কবিতা শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হতো তাকে ‘বছরের সেরা মানুষ’ উপাধিতে ভূষিত করা হতো। আর কবিতাকে কাপড়ের ওপর সোনালি রঙের কালি দিয়ে লিখে দুনিয়ার সবচেয়ে মর্যাদাবান স্থান বাইতুল্লাহর সাথে ঝুলিয়ে রাখা হতো। যাকে বলা হতো ‘মুয়াল্লাকাত’ বা ঝুলন্ত কবিতা। বিশ্বসাহিত্যে আজও ‘সাবয়ে মুয়াল্লাকাত’ বা ‘ঝুলন্ত কবিতা সপ্তক’ সবিশেষ প্রসিদ্ধ। কিন্তু আল্লাহর রাসূলের কাছে অবতীর্ণ আল-কুরআনের অপ্রতিদ্বন্দ্বী ভাষা ও সাহিত্য আরবের সকল সাহিত্যকে স্লান করে দেয়। সবার ওপরে স্থান করে নেয় আল-কুরআন। প্রথম দিকে যেসব কবি ইসলাম গ্রহণ করেন তাঁরা কুরআনি সাহিত্যের ভাবগাম্ভীর্য ও রচনাশৈলীতে ছিলেন বিভোর। কবিতা রচনা ও চর্চা করা ছিল তাঁদের কাছে গৌণ বিষয়। আল্লাহর নবী মানুষের জাগতিক ও আধ্যাত্মিক উভয় জগতের জিজ্ঞাসার জবাব নিয়ে এসেছেন। ইসলাম যে মানুষের বাহ্যক ও আত্মিক উভয় অঙ্গনের খোরাক দিতে সক্ষম তার উদাহরণ পেশ করলেন সবক্ষেত্রে। কাব্য-সাহিত্যেও এর উদাহরণ সত্যিই উজ্জ্বল। যে কা’ব বিন জুহাইর ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তার ক্ষুরধার কবিতায় রাসূলের কুৎসা রটনা করে রাসূলের পক্ষ থেকে মৃত্যুর পরওয়ানা পেয়েছিলেন তিনিই আবার ক্ষমার আধার মহানবীর চরণতলে এসে তাঁর প্রশংসায় পেশ করলেন কাসিদায়ে বোরদার মতো বিশ্বনন্দিত গীতিকবিতা। তিনি গাইলেন :

ان الرسول لنور یستضأ به – مهند من سیوف الله مسلول

‘নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূল এমন নূর যাঁর আলোক প্রভা বিচ্ছুরিত হচ্ছে।

আল্লাহর তরবারিসমূহের মাঝে তিনি তীক্ষ্ণ ভারতীয় কোষমুক্ত তরবারি।’

তাঁর ছন্দ, সুর ও উপস্থাপনায় মুগ্ধ হয়ে আল্লাহর নবী তাঁকে উপহার দিলেন নিজের গায়ের বোরদা বা চাদর। রাসূলের পক্ষ থেকে এ সম্মান ছিল মূলত কাব্যসাহিত্যের প্রতিই সম্মান। সবার সামনে প্রতিভাত হয়ে উঠল- ইসলাম কাব্যসাহিত্যকে আড় চোখে দেখে না; বরং উতসাহ দেয়। এর পর রাসূলের সভাকবি হযরত হাস্সান বিন সাবিত (রা.) মসজিদে নববীর মিম্বরে বসে কবিতা আবৃত্তি করেছেন আর রাসূলে খোদা (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে শুনেছেন। এতে কি প্রমাণ হয় না যে, আল্লাহর নবী তথা ইসলাম সদগুণে বিভূষিত কাব্য ও কাব্যসাধনাকে উপেক্ষা করে না; বরং তার লালন ও চর্চার উতসাহ দেয়। আর আল্লাহর নবীর কাছ থেকে প্রেরণা লাভ করে সকল ভাষার মুসলমানই তাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্যকে সমুন্নত করেছেন তাওহীদী চেতনার ভিত্তিতে। ফারসিভাষী মুসলমানদের অবদান বিশ্বসাহিত্যে উল্লেখযোগ্য। ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আসার পূর্বে ফারসি কবিদের কণ্ঠ ও কলম ছিল অগ্নিপূজক, খোদাদ্রোহী রাজ-রাজড়াদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিন্তু ইসলামে এসে তাদের কাব্যসাহিত্য রূপান্তরিত হলো উন্নত রুচিশীল প্রাণজুড়ানো সংগীতে। রচিত হলো শত সহস্র কবিতা, গজল, হামদ, নাত ও মানবতার জয়গান। ফারসি কাব্যসাহিত্য জগতে যাঁরাই উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসাবে উদ্ভাসিত হয়েছেন তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন রাসূলপ্রেমে মাতোয়ারা। রাসূলে খোদার শান, মর্যাদা, জীবন চরিত ও সমাগ্রিক কাজকর্ম স্থান পেয়েছে তাঁদের সাহিত্যে। রাসূলের শানে রচিত তাঁদের কাব্যসমুদ্র থেকে আমরা কয়েক ফোঁটা সিঞ্চন করার প্রয়াস পাব আমাদের আলোচ্য নিবন্ধে। প্রথমেই বিশ্ব বরেণ্য কবি শেখ সাদী (রহ.)-এর কবিতা থেকে উদ্ধৃত করা হলো। কারণ, এ মহান কবির রচিত দু’টি চরণ উচ্চারিত হচ্ছে উপমহাদেশের মুসলমান জনগণের ঘরে ঘরে।

بلغ العلی بکماله – کشف الدجی بجماله

حسنت جمیع خساله – صلوا علیه و آله

‘মানবতার শীর্ষে তুমি হলে উপনীত,

রূপের ছটায় দূর করিলে আঁধার ছিল যত।

সকল গুণের সমাবেশে চরিত্র মহান,

তুমি ও তোমার বংশ পরে হাজারো সালাম।’

রাসূলে খোদার চরিত্র-বৈশিষ্ট্য, শান সম্পর্কে শেখ সাদী আরো বলেন :

کریم السجایا جمیل الشیم – نبی البرایا، شفیع الامم

امام رسل پیشوای سبیل – امین خدا مهیط جبرائیل

شفیع الوری خواجه بعث و نشر – امام الهدی صدر دیوان حشر

کلیمی که چرخ فلک طور اوست – همه نورها پرتر نور اوست

‘মহান স্বভাব চরিত্র মধুর

উম্মতের কাণ্ডারী নবী বিভুর,

রাসূলগণের নেতা, পথের দিশারী

খোদার বিশ্বস্ত জিবরাইলের মনযিল।

সৃষ্টলোকের সুপারিশকারী, পুনরুত্থান দিবসের সরদার

হেদায়াতের ইমাম, বিচার দিনের নেতা।

নভোম-ল যার তুর পাহাড় আল্লাহর সাথে করতে আলাপ,

সকল আলো তারই নূরের বিকিরিত আলোর ছটা।’

আল্লাহর নবীর অস্তিত্ব সম্পর্কে শেখ সাদী বলেন :

تو اصل وجود آمدی از نخست –  دگر هرچه موجود شد فرع تست

‘আপনি সৃষ্টির মূল উতস। অন্যসব সৃষ্টি আপনার শাখা প্রশাখা।’

তাঁর জন্ম প্রসঙ্গে বলেন :

چو صیتش در افواه دنیا فتاد – تزلزل در ایوان کسری فتاد

‘আগমন পরে যে কণ্ঠ ধ্বনিত হলো এ ধরায়

তাতেই কম্পিত কেসরার সিংহাসন।’

আল্লামা জালাল উদ্দীন রুমী (রহ.) ছিলেন ফারসি কাব্যসাহিত্য জগতে বিশ্ববিজয়ী সম্রাট। তাঁর মসনবীকে বলা হয় ফারসি ভাষার কুরআন। রাসূলে আকরাম (সা.)-এর নাম মোবারক যে কত বরকতময় যে সম্পর্কে ইঞ্জিল কিতাবের প্রকৃত অনুসারীদের আচরণ উল্লেখ করে তিনি বলেন :

بود در انجیل نام مصطفی – ان سر پیغمبر ان بحر صفا

طائفه نصرانیان مهر ثواب – چون رسیدندی بدان نام خطاب

بوسه دادندی نام شریف – رو نهادندی بدان وصف لطیف

‘ইঞ্জিলে নাম যার ঘোষিত মুস্তাফা

নবীকুল শিরোমণি পবিত্রতার দরিয়া

সওয়াবের লাগি নাছারা একদল

খুঁজিত তার নাম তাঁর খেতাব

চুমু খেয়ে পড়িত নূয়ে-ভক্তিতে বেতাব।’

ایمن از شرامیران و وزیر – درپناه نام احمد مستجیر

نسل ایشان نیزهم بسیار شد – نام احمد ناصر آمد یار شد

نام احمد چون چنین یاری کند – تاکه نورش چون مددگاری کند

نام احمد چون حصاری شد حصین – تاچه باشد ذات ان روح الامین

‘আহমদ নামের গুণে তারা পেল মুক্তি,

রাজা আর উজিরের ক্ষীণ হল শক্তি,

বাড়িল বংশ সে নামের গুণে-

আহমদ নামই ধ্বনিত তাদের প্রতি বচনে।

আহমদ নাম যদি হয় এতই মদদগার

তার নূর যে কত মহান বলার সাধ্য আছে কার?

আহমদ নামই যদি হয় মজবুত কেল্লা

তার জাত ও মূল সত্তা রুহল আমীন

হেফাজতের কত বড়ই না সুদৃঢ় দুর্গ।’

 ফারসি কাব্যসাহিত্যের অন্যতম দিকপাল আরেফ দার্শনিক কবি ছিলেন হযরত ফরিদুদ্দীন আত্তার নিশাপুরী (রহ.) (মৃত্যু ৬২৭ হি.)। তাঁর বিশ্ববিখ্যাত ১৪টি কাব্যে রাসূলে আকরাম (সা.) সম্পর্কে এতো অধিক কবিতা তিনি রচনা করেছেন যেগুলোর বর্ণনা দিতে গেলে স্বতন্ত্র গ্রন্থের প্রয়োজন। আমরা তাঁর সাগরসম বর্ণনার কয়েকটি চরণ দিয়েই আমাদের তৃষ্ণা মেটানোর প্রয়াস পাব। রাসূলের শানে তিনি বলেন :

چو گویم من؟ ثنای او خدا گفت – که نام اوست بانام خدا جفت

محمد ص صادق القولی امینی – جهان را رحمة للعالمین

محمد بهترین هر دو عالم – نظام دین و دنیا، فخر آدم

‘কি বলব আমি? তার প্রশংসায় আল্লাহই পঞ্চমুখ,

তার নাম তো আল্লাহর সাথেই মিলিত।

মুহাম্মাদ সত্যবাদী আল আমীন,

সমগ্র জগতের জন্যে তিনি রহমত

মুহাম্মাদ দু’জাহানের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব

দীন-দুনিয়ার ব্যবস্থাপক (শৃঙ্খলা রক্ষাকারী) আদমের গর্ব।’ (اسرار نامه)

আল্লাহর নবী হযরত আদম (আ.)-এর আগে নবী ছিলেন এবং সকল সৃষ্টি তাঁর নূর হতেই সৃষ্টি। এ প্রসঙ্গে কবি ফরিদ উদ্দীন আত্তার (রহ.) বলেন :

هنوز آدم میان آب و گل بود – که او شاه جهان جان و دل بود

در آدم بود نوری از وجودش – و گرنه کی ملک کردی سجودش

‘পানি মাটির মাঝে যখন আদম

তখনই তিনি ছিলেন অন্তরসমূহের শাহানশাহ।

আদম অস্তিত্বে ছিল তাঁরই নূরের প্রভা-

তাই ফেরেশতাকুল তাঁকে করেছে সিজদা।’ (আসরার নামা)

আরশ কুরছি এবং উভয় জাহান যে তাঁর নামেই উতসর্গিত এ প্রসঙ্গে আরেফ কবি আত্তার (রহ.) বলেন :

هر دو عالم بسته فتراک او – عرش و کرسی قبله کرده خاک او

هر دو گیتی از وجودش نام یافت – عرش نیز از نام او آرام یافت

انبیاء در وصف او حیران شدند – سرشناسان نیز سرگردان شدند

‘উভয় জগত তাঁরই রশ্মিতে আবদ্ধ,

আরশ কুরছি তাঁর পদধূলিকে করেছে কেবলা।

তার অস্তিত্ব থেকেই উভয় জাহান পেয়েছে নাম,

আরশও তার নামেই লাভ করেছে প্রশান্তি।

নবীগণ তার প্রশংসা করে ক্লান্ত হয়ে গেছেন

বিশেষজ্ঞগণও প্রশংসায় খেই হারিয়েছেন।’ (মানতিকুত তাইর)

আধ্যাত্মিক জগতের নক্ষত্র হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) ছিলেন ইরানের গিলানের অধিবাসী। তাঁর সম্পর্কে উপমহাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর কাছে বেশি কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে আমাদের এদেশে তাঁর কারামতই আলোচনা হয়ে থাকে। তিনি যে ফারসি কাব্যসাহিত্যে অনন্য অবদান রেখে গেছেন তা অনেকেরই জানা নেই। তাঁর ‘কাসিদায়ে গাউছিয়া’য় ৮১টি ফারসি কবিতা স্থান পেয়েছে।

রাসূলে খোদা (সা.)-এর শানে তাঁর কবিতা সত্যই অনুপ্রেরণার উতস। রাসূলে আকরাম (সা.) যে সৃষ্টির সেরা মানব, তাঁকে কেন্দ্র করে যে সমগ্র জাহান সৃষ্টি, এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন :

ای قصر رسالت تو معمور – منشور لطافت از تو مشهور

خدام ترا غلام گشته – کیخسرو و کیقباد و فغفور

در جمله کائنات گویند – صلوات تو تا دمیدن صور

معراج تو تابقاب قوسین – جبریل به ره ماند از دور

روشن ز وجود تست کونین – ای ظاهر و باطنت همه نور

ای سید انبیاء مرسل – وی سرور اولیاء منصور

گل از عرق تو یافته بوی – شد شهد در اندرون زنبور

‘হে মহান, রিসালতের প্রাসাদ তব চির আবাদ,

সৌহার্দ্ররে ঘোষণা তব চির অম্লান।

খসরু, কায়কোবাদ ও ফাগফুর যত

তোমার পায়ে হয়েছে অবনত।

এ বিশ্বলোক গাইবে তব গুণগান

যতদিন না ফুঁকবে শিংগায়।

কাবা কাউসাইন ছিল তব মেরাজ,

জিব্রাইল যার যোজন দূরে।

তব অস্তিত্বের আলোয় আলোকিত উভয় জাহান,

তব জাহের-বাতেন সবই নূর হে মহান।

হে নবীকুল সম্রাট রাসূলদের তাজ,

হে সদা বিজয়ী ওলীদের মুকুট,

তব ঘাম থেকে পেয়েছে ফুল খুশবু,

তব পরশে মৌমাছির মাঝে আসে মধু।’

ফারসি কাব্যসাহিত্যে ‘আশেকে রাসূল’ হিসাবে যিনি সমাধিক পরিচিত, যাঁর আধ্যাত্মিক সাধনা ও রাসূলপ্রেমের বিকাশ বিশ্ববাসীর মাঝে রাসূলপ্রেমের বহ্নিশিখা জ্বালিয়েছে তিনি হলেন মহাকবি হযরত নূরুদ্দিন আবদুর রহমান জামী (রহ.)। রাসূলের প্রেমে রচিত তাঁর বিশাল কাব্যসাহিত্য হতে কয়েকটি চরণ উল্লেখ করতে চাই।

এ বিশ্বলোক যে আল্লাহর রাসূলকে কেন্দ্র করেই সৃষ্টি, এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন :

خلقت عالم برای نوع بشر شد – خلقت نوع بشر برای محمد

گر نبود پرده صفات محمد – خلق بسوزد ز نور ذات محمد

‘মানুষের তরে সৃষ্টি জাহান,

মুহাম্মদের তরে মানুষ।

মুহাম্মদী গুণের পর্দা, সৃষ্টির রক্ষাকবচ,

নচেত তার প্রকৃত সত্তার নূরে সব হতো পুড়ে ছাই।’

রাসূল (সা.) যে সাধারণ মানুষ ছিলেন না, তার প্রমাণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন :

جسمت نداشت سایه و الحق چنین سزد – زیرا که بود جوهر پاک زنور حق

‘তব বদনে ছিল না ছায়া, সত্যই তাইতো হওয়ার

কেননা, পবিত্র অস্তিত্বই তব আল্লাহর নূর।’

ফারসি কাব্যসাহিত্যের অন্যতম খ্যাতনামা কবি নেজামী গাঞ্জভী (রহ.)। তাঁর কাব্যে রাসূলে খোদার যে প্রশংসা করেছেন সত্যিই তা বিস্ময়কর। তাঁর বিরচিত বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ ‘মাখজানুল আসরার’ গ্রন্থের কয়েকটি চরণ এখানে উদ্ধৃত করা গেল। তিনি বলেন :

احمد مرسل که خرد خاک اوست – هر دو جهان بسته فتراک اوست

ای گویا بزبان فصیح – از الف آدم ومیم مسیح

همچو الف راست بعهد ورفا – اول و آخر شده بر انبیاء

‘আহমদ প্রেরিত রাসূল- প্রজ্ঞাই যার সত্তায় গাথা-

যারই বিন্দুতে বাধা উভয় জাহান,

আদম থেকে ঈসা মসীহ

সকলের সেরা বিশুদ্ধ ভাষী;

প্রতিশ্রুত আর অংগীকারে আলিফের প্রত্যয়ী

শুরুতেই নবী আর অন্ত্যেও তিনিই নবী।’

আরেফ কবি সানায়ী গজনভী ফারসি কাব্যসাহিত্যের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর কবিতা যেমন আল্লাহপ্রেমের মনমাতানো বাঁশরি, তেমনি রাসূলপ্রেমের দরিয়ার ঢেউ। কবি সানায়ী আল্লাহর রাসূলকে লক্ষ্য করে বলেন :

کلاه و تخت کسری از تو نابود + سپاه و ملک قیصر از تو درهم

میان اولیاء صدری و بدری + میان انبیاء مهری و خاتم

‘তব পদাঘাতে পারস্য সম্রাটের তাজ ও সিংহাসন নিশ্চিহ্ন

রোমান কায়সরের অপরাজেয় বাহিনী ও রাজত্ব ভূলুণ্ঠিত।

ওলীদের মাঝে তুমি আত্মা ও পূর্ণ শশী

নবীদের মাঝে সীল মোহর তুমি, তুমিই পরিসমাপ্তি।’

বিংশ শতাব্দীর অমর কাব্যপ্রতিভা দার্শনিক কবি ইকবাল (রহ.) ছিলেন সমগ্র বিশ্ব বিশেষ করে উপমহাদেশ ও ইরান তুরানের সংগ্রামী আদর্শের মূর্ত প্রতীক। দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক কবি তাঁর লেখনীতে আল্লাহর নবীর জীবনচরিত অত্যন্ত জোরালো ভাষায় তুলে ধরেছেন। রাসূলে আকরাম (সা.) বিশ্বলোকের আলোকবর্তিকা। এর বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন :

ای ظهور تو شباب زندگی – جلوه است تعبیر خواب زندگی

در جهان شمع حیات افروختی – بندگان راخواجگی اموختی

‘হে মহান, তব প্রকাশ জীবনের যৌবন-

তোমার প্রভা, জীবন স্বপ্নের তাবির,

বিশ্ব মাঝে জীবনের প্রদীপ জ্বালালে তুমি,

আল্লাহর বান্দাদের বিনয় মহত্ত্ব শেখালে তুমি।’

ফারসি কাব্যজগতে অপর খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব হলেন কবি বাহার মালেকুশ্ শোয়ারা খোরাসানী। রাসূলপ্রেমে তিনি ছিলেন বিভোর। তাঁরই কণ্ঠে ধ্বনিতে হয়েছে মহানবীর প্রকৃত স্বরূপ। তিনি বলেন :

با مهر اوست جنت و با حب او نعیم

با قهر اوست دوزخ و با بغض او عذاب

‘তাঁর দয়ায় মিলবে জান্নাত, তাঁর প্রেমেই পাবে নেয়ামত রাশি রাশি।

তাঁর রাগ ও গোস্বায় নির্ঘাত জাহান্নাম, তাঁরই ঘৃণায় শাস্তি।’

با مهر او بود بگناه اند رون نوید – با قهر او بود بصواب اند رون عقاب

‘তাঁর সুদৃষ্টিতে অপরাধীও পাবে আশার আলো

তাঁর অসন্তুষ্টিতে ভালো কাজও হবে শাস্তির।’

অষ্টম শতাব্দীর দার্শনিক কবি রোকনুদ্দীন আওহেদী ছিলেন সে যুগের কাব্যজগতে এক প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব। যাঁর কবিতায় স্থান পেয়েছে রাসূলপ্রেমের এক বাস্তব চিত্র। রাসূলে খোদার প্রশংসায় তিনি যেসব কবিতা রচনা করেছেন তা অত্যন্ত ব্যাপক। দু’একটি চরণেই তাঁর রাসূলপ্রেমের দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে। তিনি বলেন :

بر سر او از نیکنامی تاج – همه شبهای او شب معراج

انکه مه بشکند بنیم انگشت – آفتابش جه باشد اندر مشت

‘তাঁর শিরে রয়েছে চিরদিন সুনামের তাজ

সকল যামিনী তাঁর শবে মেরাজ,

তিনিই তো সে ব্যক্তিত্ব যাঁর ইশরায় চাঁদ খানখান

সূর্য যাঁর মুঠোর মাঝে পায় নিজ প্রাণ।’

আল্লাহর হাবীবকে লক্ষ্য করে তিনি বলেন :

علم نور نصرتت ز عالم نور – یزک لشکرت صبا ودبور

معجزت سنگرا زبان بخشد – بوی خلقت بمرده جان بخشد

‘তব ইল্‌মের বলে আলোকিত আলম,

সকাল সাঁঝের হাওয়া সেপাহী তব হরদম,

তোমার মু’জিযায় বলেছে কথা নিষ্প্রাণ পাথর

তোমার সৃষ্টির সুবাসে মৃত্যু পেয়েছে জীবন।’

রাসূলের প্রেমে পাগল দার্শনিক কবি খাকানী শিরওয়ানী (রহ.) ছিলেন ফারসি কাব্যজগতে এক সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। তাঁর কাব্যে রয়েছে মানবমনের প্রশ্নের জবাব, চেতনার খোরাক আর এশকের ফোয়ারা। তিনি আল্লাহর নবীর উদ্দেশে বলেন :

ما اعظم شانک ای مظفّر؟ – ما اکرم وجهک ای مطهّر؟

ای عشر عطای توبه یکدم – صد ساله خراج هر دو عالم

ای خاک درت مسیح اکبر – جان درده صد هزار عازر

‘হে চির বিজয়ী, তব শান কতই না বড়,

হে মহাপবিত্র, তব অবয়ব কতই না মহান,

হে রাসূল, তব এক শ্বাসের দশমাংশের দাম,

দু’জাহানের শত বছরের খাজনার চেয়েও মূল্যবান।

হে মহান, তব দরজার ধূলিতে ঈসা মসীহ

আযেরের মত লাখ মৃতের দিয়েছে প্রাণ।’

ফারসি কাব্যসাহিত্য জগতে যেসব অমর কবি তাঁদের তেজস্বী লেখার মাধ্যমে মহানবীর শান, মর্যাদা ও জীবন চরিত তুলে ধরেছেন তাঁদের জীবন ছিল রাসূলের আদর্শে অনুপ্রাণিত। আমলের ময়দানে তাঁরা ছিলেন রাসূলের যোগ্য অনুসারী। তাঁদের কবিতা পড়ে আমরা যদি তাঁদের মতোই রাসূলের জীবনকে আমাদের জীবনের আদর্শ হিসাবে গড়ে তুলতে পারি তাহলেই সার্থক হবে আমাদের জীবন।

 

গ্রন্থ সূত্র

১. আরবী সাহিত্যের ইতিহাস- আ. ত. ম. মুছলেহউদ্দিন।

২. কাসিদায়ে বোরদা- হযরত কাব বিন যুহায়ের (রা.)।

৩. দিওয়ানে হাসসান বিন সাবিতের ভূমিকা : মাহমুদ আকন্দ।

৪. গুলিস্তানে সাদী- শেখ সাদী।

৫. বোস্তানে সাদী- শেখ সাদী।

৬. মসনবী শরীফ- মাওলানা জালাল উদ্দীন রুমী (রহ.)।

৭. আসরারনামা- শেখ ফরিদুদ্দীন আত্তার (রহ.)।

৮. মানতিকুত তাইর- শেখ ফরিদুদ্দীন আত্তার (রহ.)।

৯. দিওয়ানে গাউসিয়া- বড় পীর আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)।

১০. মসনবীয়ে জামী- আল্লামা আবদুর রহমান জামী (রহ.)।

১১. মাখজানুল আসরার- কবি নেজামী গাঞ্জভী (রহ.)।

১২. দিওয়ানে সানায়ী- কবি সানায়ী গজনভী (রহ.)।

১৩. কুল্লিয়াতে ইকবাল- আল্লামা ইকবাল (রহ.)।

১৪. দিওয়ানে বাহার- কবি মালেকুশ্ শোয়ারা বাহার।

১৫. জামেজম- কবি আওহেদী মারাগেয়ী (রহ.)।

১৬. না’তে হযরত রাসূলে আকরম দার শেরে ফারসি- সাইয়্যেদ জিয়াউদ্দিন দাহশিরী।

১৭. কুল্লিয়াতে খাকানী- হযরত খাকানী শেরওয়ানী (রহ.)।

ইরাকে বছরে রপ্তানি হচ্ছে অন্তত ৫০ হাজার ইরানি গাড়ি

ইরান থেকে প্রতি বছর অন্তত ৫০ হাজার গাড়ি ইরাকে রপ্তানি করা হচ্ছে। ইরানের অন্যতম প্রধান গাড়ি নির্মাণ কোম্পানি ‘ইরানখোদরু’-র মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক কর্মকর্তা গোলাম রেজা মাহদিজাদেহ এ কথা জানিয়েছেন।

তিনি আরো বলেছেন, ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় মেহরান সীমান্ত দিয়ে প্রতিবেশি ইরাকে এসব গাড়ি রপ্তানি করা হচ্ছে। মেহদিজাদেহ বলেন, ‘সামান্দ’ ও ‘রানা’সহ বিভিন্ন মডেলের গাড়ি সেখানে যাচ্ছে। ইরাকিদের কাছে এসব গাড়ি সমাদৃত হয়েছে বলেও জানান তিনি।

‘ইরানখুদরো’-র কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘সাইপা’ কোম্পানিও ইরাকে গাড়ি রপ্তানি করছে। তারা প্রতি বছর প্রায় ৩০ হাজার গাড়ি ইরাকে পাঠাচ্ছে।

ইরানে ইসলামি বিপ্লব সফল হওয়ার পর দেশটি অন্যান্য অঙ্গনের পাশাপাশি গাড়ি নির্মাণ শিল্পেও ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেছে।

রেডিও তেহরান, ২৫ নভেম্বর, ২০১৪

ইরানি নৌবহরে আসছে নতুন ডেস্ট্রয়ার: থাকবে ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ার ক্ষমতা

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের নৌবহর নতুন একটি ডেস্ট্রয়ার উন্মোচন করবে। নতুন ডেস্ট্রয়ারটির হেলিকপ্টার বহন করার এবং ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ার ক্ষমতা থাকবে।

ইরানের নৌবাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার রিয়ার অ্যাডমিরাল হোসেইন খানজাদে এক অনুষ্ঠানে এ কথা জানিয়েছেন। সামরিক সরঞ্জাম তৈরিতে ইরানি নৌবাহিনীর উল্লেখযোগ্য সাফল্যের কথাও এ সময় তুলে ধরেন তিনি। অ্যাডমিরাল খানজাদে জানান, ইরানি সীমান্তের এক তৃতীয়াংশ জুড়ে রয়েছে সাগর। এ ছাড়া, ইরানের পণ্য যাতায়াতের ৯৩ শতাংশই হয় সাগর পথে।

ইরান সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি ডেস্ট্রয়ার জামারানকে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পারস্য উপসাগরে নামিয়েছে। এ ছাড়া, দেশীয় প্রযুক্তিতে বিভিন্ন ধরনের সাবমেরিন ও উন্নত ধরনের কম্ব্যাট হেলিকপ্টার তৈরি করেছে ইরান। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সামরিক খাতে ইরান চোখা ধাঁধানো উন্নতি করেছে। তবে ইরান সব সময় বলছে, তার এ সামরিক শক্তি প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য কোনো ধরনের হুমকি নয়।

রেডিও তেহরান, ২৯ নভেম্বর, ২০১৪

‘আমেরিকা অবাক দৃষ্টিতে দেখছে আরকিউ-১৭০’র ইরানি ভার্সন’

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রভাবশালী আলেম আয়াতুল্লাহ আলী মোভাহেদি কেরমানি বলেছেন, মার্কিন আরকিউ-১৭০ ড্রোনের ইরানি ভার্সন আমেরিকার সম্মান ও মর্যাদার জন্য একটা বড় আঘাত। আজ রাজধানী তেহরানে জুমার নামাজের খুতবায় তিনি এ কথা বলেন।

জুমার নামাজের খতিব বলেন, অত্যাধুনিক আরকিউ-১৭০ ড্রোনকে রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং করার ক্ষমতা ইরানিদের নেই বলে আমেরিকা দাবি করে আসছিল। কিন্তু ইরান রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং করতে সক্ষম হয়েছে। এ কারণে তারা এখন অবাক দৃষ্টিতে আরকিউ-১৭০’র ইরানি ভার্সন দেখছে।

আগামী বছরই ড্রোনটি ব্যাপক সংখ্যায় তৈরি করা হবে জানান তিনি। আয়াতুল্লাহ কেরমানি বলেন, মার্কিন আরকিউ-১৭০ ড্রোনের রাডার ফাঁকি দেয়ার প্রযুক্তিতে কিছু ত্রুটি ছিল, ইরানি ভার্সন সেই ত্রুটি থেকেও মুক্ত।

কয়েক দিন আগে মার্কিন ড্রোনটির ইরানি ভার্সন প্রথমবারের মতো সফলভাবে আকাশে উড়েছে। ড্রোনটি উড়ার ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করেছে ইরানের সেনাবাহিনী। ওই ফুটেজ বিশ্বের বিভিন্ন টিভি চ্যানেল সম্প্রচার করেছে।

২০১১ সালের ৪ ডিসেম্বর সেনাবাহিনীর ইলেক্ট্রনিক যুদ্ধ ইউনিট ইরানের আকাশে ঢোকার পর রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম মার্কিন আরকিউ-১৭০ ড্রোন সফলভাবে নামিয়ে আনে। মার্কিন লকহিড মার্টিন কোম্পানির তৈরি এ ড্রোনটি আফগান সীমান্ত দিয়ে ইরানের আকাশসীমায় ঢুকেছিল। মার্কিন আরকিউ-১৭০ ড্রোনটি আটকের পর এর কারিগরী বিষয়ক তথ্য উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হন ইরানি বিশেষজ্ঞরা।

তেহরানের জুমার নামাজের খতিব আয়াতুল্লাহ কেরমানি ইসরাইলি হুমকি প্রসঙ্গে বলেছেন, ইহুদিবাদী ইসরাইলের সেনাবাহিনী এবং পরমাণু কেন্দ্রগুলো আমাদের ক্ষেপণাস্ত্রের আওতায় রয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে ইসরাইলের সব কিছু ধ্বংস করে দেয়ার ক্ষমতা রয়েছে এসব ক্ষেপণাস্ত্রের।

রেডিও তেহরান, ১৪ নভেম্বর, ২০১৪

আরকিউ-১৭০’র ইরানি ভার্সনের জন্য নাম চাইল আইআরজিসি

মার্কিন ড্রোন আরকিউ-১৭০’র ইরানি ভার্সনের জন্য উপযুক্ত নাম চেয়েছে ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি। আগামী ৭ ডিসেম্বরের মধ্যে ক্ষুদে বার্তার মাধ্যমে নাম প্রস্তাব করার জন্য ইরানি জনগণের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। ড্রোনের জন্য সর্বোত্তম নামের প্রস্তাবকারীকে বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পুরস্কৃত করা হবে। নাম পাঠানোর জন্য একটি বিশেষ নম্বরও ঘোষণা করেছে আইআরজিসি।

কয়েক দিন আগে মার্কিন ড্রোনটির ইরানি ভার্সন প্রথমবারের মতো সফলভাবে আকাশে উড়েছে। ড্রোনটি উড়ার ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করেছে ইরানের সশস্ত্র বাহিনী। ওই ফুটেজ বিশ্বের বিভিন্ন টিভি চ্যানেল সম্প্রচার করেছে।

২০১১ সালের ৪ ডিসেম্বর আইআরজিসি’র ইলেক্ট্রনিক যুদ্ধ ইউনিট ইরানের আকাশে ঢোকার পর রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম মার্কিন আরকিউ-১৭০ ড্রোন সফলভাবে নামিয়ে আনে। মার্কিন লকহিড মার্টিন কোম্পানির তৈরি এ ড্রোনটি আফগান সীমান্ত দিয়ে ইরানের আকাশসীমায় ঢুকেছিল। মার্কিন আরকিউ-১৭০ ড্রোনটি আটকের পর এর কারিগরী বিষয়ক তথ্য উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হন ইরানি বিশেষজ্ঞরা।

রেডিও তেহরান, ১৫ নভেম্বর, ২০১৪