All posts by dreamboy

ইসলাম ও ইমাম খোমেইনী (র.)

আলী আভারসাজী

মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর অস্তিত্ব না থাকলে এই পৃথিবী সৃষ্টি হতো না। যাঁর উসিলায় আমরা সকল কিছু পেয়েছি তাঁর প্রতি ভালোবাসা রাখা, তাঁর আকর্ষণে ক্রন্দন করা আমাদের জন্য বড়ই সৌভাগ্যের বিষয়। ইসলামকে বোঝার জন্য, কুরআনকে বোঝার জন্য ইসলামী সম্মেলন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আলেমগণ এই ধরনের অনুষ্ঠানে কুরআন ও হাদীসের আলোকে ইসলামী জীবনাদর্শ জনগণের সামনে তুলে ধরেন।

আল্লাহর রাসূল (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা রাখলেই একজন মানুষ ঈমানদার হতে পারে, তার হৃদয় জীবন্ত হয়ে ওঠে। মহানবী (সা.) যদিও আমাদের সাথে জীবিত নেই তবুও তাঁর রুহ মোবারক আমাদের মাঝে জাগ্রত। তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা জানাতে হবে, তবেই আমাদের মুক্তি। আল্লাহ পাক কুরআনে ঘোষণা করেছেন, ‘হে রাসূল! আপনি বলে দিন, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও তাহলে আমাকে অনুসরণ কর।’ তাই আল্লাহর ভালোবাসা আমাদের পেতে হলে আমাদের অবশ্যই আশেকে রাসূল হতে হবে।

মহানবী দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রামবহুল জীবনে ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে যে দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেছেন তার বিনিময়ে আল্লাহর কাছে তিনি কী পুরস্কার চান এই প্রশ্ন করা হলে মহানবী বলেছিলেন, তাঁর আদর্শ এবং তাঁর আহলে বাইতকে যেন ভালোবাসা হয়, তাঁদেরকে যেন অনুসরণ করা হয়।

একটি চিরন্তন সত্য ধর্ম হিসেবে ইসলাম এসেছে। ইসলামকে যারা সেকেলে বলে উড়িয়ে দিতে চায় তারা আসলে ভুল ধারাণায় ডুবে আছে। সকল ধর্মের ওর প্রাধান্য দিয়ে আল্লাহ তাআলা এই দীন ইসলামকে কিয়ামত পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত করেছেন। যারা বলে আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে ইসলাম চলতে পারে না তাদের উচিত ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের দিকে লক্ষ্য করা। আধুনিক ইরানে সম্পূর্ণ কুরআনভিত্তিক শাসনব্যবস্থা চালু হয়েছে। সেখানে জনগণের সমর্থনেই আল্লাহর আইন চালু হয়েছে, কুরআন ও সুন্নাহর আদর্শে সবকিছু চলছে।

রাসূলুল্লাহ (সা.) ও খোলাফায়ে রাশেদীনের পর মুসলিম সাম্রাজ্য যুলুম-নির্যাতন ও অত্যাচারে ভরে যায়। ইসলামের নামে রাজতন্ত্র চালু করা হয়, মানুষকে বিভ্রান্তিতে ফেলে দেয়া হয়। ইসলামী বিপ্লবের আগে ইরানের শাসনক্ষমতায় ছিল স্বৈরাচারী ও ইহুদি মার্কিনপন্থী রেযা শাহ পাহলভী। তখন রাষ্ট্রীয় কোনো পর্যায়েই কুরআন-সুন্নাহভিত্তিক শাসন চালু ছিল না। রেযা শাহ ও তার দোসররা ইরানের বুক থেকে ইসলামী মূল্যবোধকে ধ্বংস করে দেয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। দেশব্যাপী মদ, জুয়া ও অশ্লীলতার প্রকোপ মারাত্মকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। ইসলামের কথা যারা বলত তাদেরকে অমানুষিক নির্যাতন করা হতো। দেশের আলেমগণ কারাভোগ করেছেন, অসহ্য নির্যাতন ভোগ করেছেন, তবু স্বৈরাচারের কাছে মাথা নত করেননি।

ইরানকে আমেরিকানরা মধ্যপ্রাচ্যে তাদের অন্যতম ঘাঁটি মনে করত। তাদের ধারণা ছিল ইরান থেকেই তারা গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। এই করুণ পরিস্থিতিতে ইমাম খোমেইনী (র.) একজন মুজাহিদ আলেম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন। তিনি শাহী শাসনের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠে বললেন, আল্লাহর আইন ছাড়া কোনো আইনই চলতে পারে না। তিনি আল্লাহর শাসন কায়েম করার জন্য মানুষকে উতসাহিত করলেন এবং স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানালেন। তাঁর সেই আন্দোলনের চাপে শাহের তখত ভেঙে খান খান হয়ে গেল। এক লক্ষ সত্তর হাজার শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে ইরানে ইসলামী বিপ্লব বিজয় লাভ করল। ইমাম খোমেইনীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ইরানের বুকে প্রতিষ্ঠিত হলো ইসলামী হুকুমত। আত্মপ্রকাশ করল ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান। ইরানে প্রতিষ্ঠিত হলো কুরআনের হুকুমত। শাহের আমলের যে সংবিধান ছিল তা ইমাম খোমেইনী পুড়িয়ে দিয়েছেন। এখন কুরআন ও সুন্নাহভিত্তিক সংবিধান ইরানে চালু হয়েছে। ইরানে মদ বা জুয়ার আড্ডা চালু নেই। কোনো বেপর্দা বেহায়া নারীকে ইরানে এখন দেখা যায় না। সকল নারী ইসলামী পর্দা মেনে চলছে। ইসলামবিরোধী কোনো কিছু ইরানে দেখা যায় না।

ইসলাম আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিরোধী নয়। ইসলামই আসলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের পথ দেখিয়েছে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় মুসলমানরাই ইউরোপকে জ্ঞান-বিজ্ঞান শিখিয়েছে। ইসলামী ইরানে সিনেমা বন্ধ করা হয়নি। সেখানে সিনেমার খারাপ দিকগুলো শুধু বাদ দেয়া হয়েছে। ইরানে চরিত্র গঠনমূলক সিনেমা তৈরি হচ্ছে, সিনেমায় ইসলামী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য, মুসলমানদের বীরত্ব ও গৌরব ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে। এমন গজল ও সংগীত পরিবেশিত হচ্ছে যাতে ইসলামী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, রয়েছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের আধুনিক কেন্দ্রসমূহ। নারী-পুরুষ সকলেই আধুনিক জীবন যাপন করছে। মেয়েরা পর্দার মাধ্যমে পুরুষের পাশাপাশি সমাজ গঠনে কাজে আত্মনিয়োগ করেছে। ইসলামী বিপ্লবের সাফল্যের পেছনে যে জিনিসটি কাজ করেছিল সেটি হলো জনগণের ঐক্য। জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে একজন নেতাকেই মেনে নিয়েছিল। সেই নেতা ছিলেন ইমাম খোমেইনী, যিনি আল্লাহর হুকুম বাস্তবায়নে রাসূলের প্রতিনিধি স্বরূপ ছিলেন। শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে সকলে তাঁকে মেনে নিয়েছিল বলে বিপ্লব সফল হয়েছে। ইমাম খোমেইনীর ইন্তেকালের পরও জনগণ তাঁর প্রতিনিধি রাহবার আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ীর একক নেতৃত্ব মেনে নিয়েছে। মুসলমানদের মাঝে একক নেতৃত্ব না থাকলে ঐক্য বজায় রাখা সম্ভবপর হয় না।

মহানবীর আমলে মক্কা ও মদীনার মসজিদকেন্দ্রিক জুমআর নামাযের বড় জামাআত হতো। ইরানের রাজধানী তেহরান প্রায় ১ কোটির অধিক লোকসংখ্যার একটি শহর। সেখানে একটি মাত্র জুমআর জামাআত অনুষ্ঠিত হয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে এই নামাযে শরীক হন। ইরানের বিভিন্ন বড় বড় শহরে একই দিনে এই জুমআর নামায অনুষ্ঠিত হয়। জুমআর আগের দিন ইমামদের কাছে দেশের ও বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ খবরাখবর পৌঁছে যায়। জুমআর দিন ইমামগণ খুতবার মাধ্যমে দেশবিদেশের পরিস্থিতি জনগণের সামনে তুলে ধরেন, মুসলমানদের করণীয় কী তা বুঝিয়ে দেন এবং সকল মুসলমানকে ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। মুসলমানদের সমস্যাগুলো তুলে ধরে তার সমাধানের পথনির্দেশ দান করেন। এই অবস্থা সৃষ্টির পেছনে কাজ করেছে ইমাম খোমেইনীর সাহস ও নেতৃত্ব এবং কুরআনের ভিত্তিতে জনগণের ঐক্য। আমেরিকা-ইউরোপ আজ ভয় পাচ্ছে যে, মুসলমানরা যদি ঐক্যবদ্ধ হয়েই যায় তাহলে ফিলিস্তিন ও অন্যান্য নির্যাতিত জাতিকে ধরে রাখা যাবে না, ইসরাইলের যায়নবাদী আধিপত্য আর টিকিয়ে রাখা যাবে না। ওরা স্বাধীন হয়ে যাবে।

ইমাম খোমেইনী (রহ.) বলেছেন, মুসলমানরা যারা ইসলামকে মেনে নিয়েছে তারা ঐক্যবদ্ধ থাকবে। শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে সকলের উচিত আজকের বিশ্ব পরিস্থিতিতে কুরআনের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ থাকা। এটা সকলের জন্য ওয়াজিব। বর্তমানে ইরানের রাহবারেরও একই আহ্বান। সকল মুসলমানকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। সকলকে পরস্পরের ভাই ও বন্ধু হতে হবে। আমেরিকা-ইউরোপের বাতিল শক্তির সাথে যেন আমাদের আপোস না হয়। তাদের প্রচারমাধ্যমগুলো ইসলামের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালায়। তা থেকে সতর্ক থাকতে হবে। সকল মুসলমানকে ভাই ভাই হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে বাতিলের মোকাবিলায় এগিয়ে যেতে হবে।

নন্দিত ক্যালিগ্রাফি শিল্পী জালিল রাসূলী

সুমাইয়া সাইকালী

জালিল রাসূলী ইরানের অন্যতম প্রসিদ্ধ চিত্রশিল্পী ও হস্তলিখন শিল্পী। আন্তর্জাতিক উতসব-অনুষ্ঠানাদিতে জালিল রাসূলী বিগত কয়েক দশক ধরে এই ক্ষেত্রে সক্রিয় রয়েছেন এবং অব্যাহতভাবে ভাব প্রকাশের নতুন নতুন পন্থা অনুসন্ধান করে চলেছেন। তাঁর এ শিল্পচর্চার মাধ্যমে ইরানী ক্যালিগ্রাফির প্রাচীন কলাকৌশল আধুনিক প্রেক্ষিতে মূর্ত হয়ে উঠতে থাকে এবং এতে ইরানী চিত্রশিল্প ঐতিহ্যের একটি সত্যিকার প্রকাশও ঘটে।

সৌন্দর্যমণ্ডিত ফারসি হস্তলিখন শিল্পে নিষ্ঠার সাথে আত্মনিয়োগকারী অন্যান্য অগণিত শিল্পীর মাঝে জালিল রাসূলীকে যা বিশিষ্টতা দান করেছে তা হচ্ছে আধুনিক ও সাম্প্রতিক উপাদান-উপকরণসমূহ তুলে ধরার জন্য একজন মানুষের সংকল্প- যা দৃষ্টিপাতকারী মাত্রকেই মোহিত করেছে এবং তাদের সংখ্যাও বৃদ্ধি করে চলেছে।

১৯৪৬ সালে হামেদানে জন্মগ্রহণকারী এই কৃতি শিল্পী তেহরান স্কুল থেকে গ্রাজুয়েট হন। ছেলেবেলা থেকেই তিনি ক্যালিগ্রাফি শেখায় পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করেন। তিনি ছয়টি বছর (মরহুম) উস্তাদ সাইয়্যেদ হাসান মিরখানীর কাছে অধ্যয়ন করেন এবং কাজে এতটা কৃতিত্বের পরিচয় দেন যে, উস্তাদ তাঁকে অধ্যাপকের প্রশংসাপত্র দান করেন। তাঁর একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় ইরানের বিভিন্ন গ্যালারিতে এবং তাঁর তাতপর্যপূর্ণ কর্ম তাঁকে এক মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে যায়। কাতার, সিরিয়া, ইটালি, পাকিস্তান, ব্রিটেনসহ নানা দেশে তাঁর কর্মের প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।

এক একান্ত সাক্ষাতকারে জালিল রাসূলী বলেন, বিপ্লবের পর হস্তলিখন বা ক্যালিগ্রাফি শিল্প অন্যান্য শিল্পকলার তুলনায় বেশি চমতকারভাবে বিকশিত হয়েছে এবং বর্তমানে বিপুল সংখ্যক শিল্পী দক্ষতার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন, দেশ যাঁদের নিয়ে গর্ব করতে পারে। অবশ্য, উল্লেখ করা যেতে পারে যে, চারুশিল্প কারুশিল্প থেকে কিছুটা আলাদা। কেননা, চারুশিল্পে খানিকটা অতিরিক্ত শিল্পবোধ থাকে। এর বিশেষ উপাদান সর্বমহলে সৃজনশীল বলে পরিচিত। তাই কারুশিল্প কেবল একটি কারুকর্ম হয়েই থেকে গেছে এবং যখন এতে কিছুটা সৃষ্টিশীলভাবে উদ্ভাবিত টান দেয়া হয় তখনই তা সকল চারুশিল্পে প্রয়োগ করা যায়। রাসূলী বলেন, ফারসি ক্যালিগ্রাফিতে এই দিকটিই প্রস্ফুটিত।

তিনি বলেন, ‘শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমাদের পূর্ব-পুরুষরা এই ক্ষেত্রে যে নিয়ম ও পদ্ধতি উদ্ভাবন ও প্রণয়ন করেছেন আমরা তা অনুসরণ করে চলেছি। আমাদের ক্যালিগ্রাফির বর্তমান মানদণ্ডে যোগ করার কিছু নেই। কেননা, এ পর্যন্ত এর উন্নয়ন ও অলঙ্করণে যথেষ্ট প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে।’

তিনি মনে করেন কোনো ব্যক্তি যদি স্বাধীনভাবে কারুকর্মের চর্চা করতে চায় এবং একজন প্রকৃত শিল্পী হতে চায় তাহলে তাকে ক্যালিগ্রাফির সকল নিয়ম রপ্ত করার পরেই কেবল নুতন প্রেক্ষাপট তৈরি ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হবে।

জনাব জালিল রাসূলী জানান, ক্যালিগ্রাফি কর্মের সাথে তারমেহ বস্ত্রের সমন্বয় সংক্রান্ত তাঁর কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় চ্যালিপা, ঘোবার, শেশ-ডং অথবা কাতিবেহ স্টাইলে। নিজের আগ্রহ থেকে মনোনীত এই স্টাইলগুলো তাঁর এ সংক্রান্ত চিত্রকর্মের ক্ষেত্র রচনা করে। গ্রাফিক, ডিজাইন ও কম্পোজিশনসমৃদ্ধ এই চিত্রকর্ম ‘তাজহিবে’ একটি নবতর রূপ দান করে।

জালিল রাসূলীর শিল্পকর্ম অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং প্রয়োজনীয়ও বটে। কেননা, তা প্রাচীন পরিবেশের অনুভূতি ধারণ করে। হাতে বোনা তারমেহ সামগ্রী দিয়ে সৃষ্ট এই শিল্পকর্ম অন্তত একশ বছরের পুরানো স্মৃতিকে জাগিয়ে দেয়। আবার একই সাথে তাঁর এই রং ও মিশ্রণ আমাদের আধুনিক যুগের চিত্রশিল্পের এক যথার্থ প্রতিনিধিত্ব করে।

এই জটিল ও ঐতিহ্যবাহী শিল্পে জালিল রাসূলীর পূর্ণ দখন ও সাফল্যের চাবিকাঠি হলো ইরানী ক্যালিগ্রাফি, যাতে তিনি আন্দোলনের অগ্রসেনা হিসেবে কাজ করেছেন এবং এই আন্দোলন তাঁকে আমাদের কালের তথা সাম্প্রতিক কালের শিল্পী জগতের পুরোধা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তিনি কেবল প্রচলিত বা প্রাচীন ধারার শিল্পীদের নিয়ে তাঁর কর্ম সম্পাদন করেছেন বা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছেন তাই নয়, দর্শক সাধারণ ও শিল্পামোদীরা তাঁর অসাধারণ পরিপাটি ও নতুন চিন্তার প্রতিফলন দেখেও আনন্দিত ও মুগ্ধ হয়।

ক্যালিগ্রাফি শিল্পের মাধ্যমেই সাহিত্য সবসময় হাতে হাতে হস্তান্তরিত হয়েছে বিধায় আমরা দেখতে পাই যে, জালিল রাসূলী সাহিত্যকে যথেষ্ট আত্মস্থ করেছেন। হাফিজ ও রুমীর তিনি একজন ভালো সমঝদার। তিনি নিজেই বলেছেন, এই কবিদের উক্তিসমূহ তাঁকে কখনও কখনও পাঠ গ্রহণের দিনগুলোতে নিয়ে যায়। ক্যালিগ্রাফির জন্য নির্বাচনের আগে তাকে আবার সেভাবেই তা পাঠ করতে হয়। জালিল রাসূলী হয়তবা হাজার বার হাফিযের সাহিত্য কর্ম পাঠ করেছেন। তা সত্ত্বেও বার বার তাঁর কাছে তা নতুন ও তরতাজা মনে হয়। তিনি বলেন, ক্যালিগ্রাফির মাধ্যমেই সাহিত্য, ধর্ম ও সুফিতত্ত্ব হস্তান্তরিত হয়েছে।

জালিল রাসূলী বিবাহিত এবং চার সন্তানের জনক। উল্লেখ্য, জালিল রাসূলীর পরিবার কেবল একজন মানুষকে নিয়ে গর্ব করার যোগ্য তাই নয়, ঐ পরিবারে অর্থাত জালিল রাসূলীর আরো দুই ভাই মাহদী ও খলিলও অত্যন্ত সফল ও সক্রিয় শিল্পী। আর তাঁদের মাতাও ছিলেন একজন কার্পেট বয়নকারী ও কারুশিল্পের শিক্ষিকা।

আস্থা ও নির্ভরতার প্রতীক ইরানের ‘ইসলামী গার্ড বাহিনী’

১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লব সফল হওয়ার প্রেক্ষাপটে ইসলামী বিপ্লবী বাহিনী গঠনের পর থেকে ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর কথাগুলোই বার বার প্রমাণিত হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে এই বাহিনী গঠিত হয় ইরানের ইসলামী বিপ্লবকে রক্ষা ও এগিয়ে নেয়ার প্রতি নিষ্ঠাবান ও উৎসর্গীকৃত মুসলিমদের নিয়ে।

মূলত ইসলামী বিপ্লবী গার্ড-এর কাজ শুরু হয় স্থানীয় ভিত্তিতে। বিপ্লবের সূচনায় গঠিত এই বাহিনীর সদস্যরা অত্যন্ত পরিশ্রমের সাথে বিপ্লবকে প্রহরা দিত, দিনের চব্বিশ ঘণ্টাব্যাপী রাস্তায় রাস্তায় টহল দিত এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করত। ইসলামী বিপ্লবের অব্যবহিত পর সুবিধাবাদী দল ও সংগঠনের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য নাশকতা রোধের জন্য ঐ সময় কার্যকর পুলিশ বাহিনী ছিল না। অবশ্য, কোনো দেশে আকস্মিকভাবে কোনো বিপ্লব বা পরিবর্তন সংঘটিত হলে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, লুটপাট ও চরম নিরাপত্তাহীনতাজনিত যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, অবিশ্বাস্যভাবে ইরানের বেলায় তা হয়নি বললেই চলে। প্রকৃতপক্ষে এই ইসলামী বিপ্লব এত বেশি গণভিত্তিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সংঘটিত হয়েছিল যে, সাধারণ নাগরিকরাই সে সময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করেছে।

অনেকটা অনানুষ্ঠানিক হলেও অত্যন্ত অঙ্গীকারাবদ্ধ ইসলামী বিপ্লবী গার্ড আজ অনেক পথ অতিক্রম করে এসেছে। বর্তমানে এই বাহিনী একদল সুসংগঠিত মুসলিম বাহিনী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে এবং এর কর্মততপরতা আরো ব্যাপক ও বিভিন্নমুখী হয়েছে। ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী চাপিয়ে দেয়া ইরাকী যুদ্ধের সময় সম্মুখ সমরে থেকে যুদ্ধ করেছে, দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষা করেছে এবং ব্যাপকতর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপৃত থাকে।

দেশব্যাপী ইসলামী বিপ্লবী গার্ড-এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা এই সংস্থার অনন্য বৈশিষ্ট্য। ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্মদিবসকে ইসলামী বিপ্লবী গার্ড-এর প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবে উদ্‌যাপন করা হয়। এ উপলক্ষে প্রতি বছর এই দিনে ইরানী জনগণ সারিবদ্ধভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ইসলামী বিপ্লবী গার্ড সদস্যদের কুচকাওয়াজকে অভিনন্দন জানায়। এই বাহিনীর ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণ সম্ভবত এই সংস্থার খাঁটি ইসলামী বৈশিষ্ট্য এবং এর সদস্যদের চরিত্র।

ইসলামী বিপ্লবী গার্ড সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি ও পর্যায় থেকে। অবশ্য ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনীতে ভর্তি হওয়ার প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল। এর প্রতিটি সদস্যকে অত্যন্ত যাচাই-বাছাইয়ের ভিত্তিতে নির্বাচন করা হয়। ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা বিবেচনা করে অত্যন্ত আন্তরিকতাসম্পন্ন ও নিষ্ঠাবান লোকদেরকেই এই সংস্থায় ভর্তি করা হয়ে থাকে। যে কেউই ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনীতে ভর্তি হওয়ার জন্য আবেদন জানাতে পারে, তবে ঐসব আবেদনপত্র বিবেচনা করে ও সতর্কতামূলক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। কোনো আবেদনকারীকে ভর্তি করা হলে তাকে ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর কোনো একটি ব্যারাকে রেখে একটি পূর্ণাঙ্গ সামরিক কোর্সের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।

ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনীতে কাজ করতে ইচ্ছুক এমন প্রত্যেক ব্যক্তিকে বাধ্যতামূলকভাবে এই কোর্সে অংশ নিতে হয়। কোর্সে বিশেষ সামরিক প্রশিক্ষণ ও ইসলামী ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে শিক্ষা দেয়া হয়। সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের এই কোর্স শেষে প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার পছন্দ, যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ইউনিটে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী মূলত একটি আধা-সামরিক সংস্থা। ইরাক কর্তৃক চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের সময় রণাঙ্গনে তারা সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাদের ততপরতা ছিল। জনগণকে সংগঠিত করার জন্য দায়িত্বশীল হিসেবে ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী ‘বাসিজ’ নামে আরেকটি সংস্থা গড়ে তোলে এবং এ উদ্দেশ্যে তারা রণাঙ্গনে কাজ করতে ইচ্ছুক লাখ লাখ স্বেচ্ছাসেবীকে ভর্তি, সংগঠিত এবং প্রশিক্ষণ দান করে। বাসিজের সকল সদস্য ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকেই সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে এবং ব্যাপক সামরিক দক্ষতা অর্জন করে। ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর কমান্ডারগণ নিয়মিত সেনাবাহিনীর সহায়তায় রণাঙ্গনে যুদ্ধ ও সামরিক কর্মকাণ্ডে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ইসলামী গার্ড বাহিনীর বিশেষ ও অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানে পদমর্যাদার দিক দিয়ে কোনো পার্থক্য করা হয় না এবং এর কমান্ডারগণ যুদ্ধের সময় সর্বদা সম্মুখ সারিতে অবস্থান করেন। একটি আধা-সামরিক বাহিনীর জন্য এটি একটি সাধারণ নিয়ম হলেও রণাঙ্গনে ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর ভূমিকা ব্যতিক্রমধর্মী।

ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্যরা সমগ্র যুদ্ধের সময় এক উল্লেখযোগ্য যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে। এর একটি অসাধারণ দৃষ্টান্ত হচ্ছে খয়বর সেতু। ‘জিহাদ সাজেন্দেগী’র সহযোগিতায় ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী মাত্র দশ দিনের মধ্যে তেরো কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সেতু নির্মাণ করে। যুদ্ধের ইতিহাসে এটাই ছিল সবচেয়ে বৃহত্তম সেতু। খয়বর সেতু ইরানের জোফেয়ার অঞ্চলের সাথে ইরাকের মজনুন দ্বীপকে সংযুক্ত করে, যা ইরানী যোদ্ধারা ইরাকের কাছ থেকে দখল করে নেয়। খয়বর অভিযানের সময় তুমুল যুদ্ধের মধ্যে ঐ সেতুটি নির্মাণ করা হয়। ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর প্রকৌশল শাখা অন্যান্য রণাঙ্গনেও বেশ সক্রিয় ছিল। দেশের পশ্চিমাঞ্চলের পাহাড়ি এলাকায় তারা সাড়ে তিনশ’ কিলোমিটার সরবরাহ সড়ক ও বহু সেতু নির্মাণ করে। এছাড়া তারা বেশ কিছু ভূগর্ভস্থ টানেল তৈরি ও খাল খনন করে।

মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী সামরিক দক্ষতার ক্ষেত্রে এই পরিমাণ অগ্রগতি অর্জন করে যে, এখন তা একটি উন্নত যোগ্যতাসম্পন্ন ও দক্ষ সামরিক সংগঠনে পরিণত হয়েছে। ইসলাম গার্ড বাহিনীর বিমান বিভাগও যথেষ্ট পরিমাণে অগ্রগতি অর্জন করেছে। এই বিভাগের মাধ্যমে ইরানী লোকদের দ্বারাই বিমান চালনার প্রশিক্ষণ দান করা হয়। শাহের আমলে এ ধরনের কাজ করত কেবল বিদেশীরা। এই বিভাগ অত্যন্ত সাফল্যের সাথে বিমান মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে থাকে এবং যুদ্ধে অভিযান চালায়।

ইসলামী বিপ্লবী গার্ড-এর সদস্যরা তাদের অন্যান্য সহযোদ্ধার মতো অন্যসব ক্ষেত্রে নিষ্ঠা ও সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছে। তারা তাদের নিষ্ঠা ও দক্ষতা দিয়ে সরকারের অন্যান্য সংস্থার কাজেও সহযোগিতা করে থাকে। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী কেবল নিজেদের সদস্যদেরই প্রশিক্ষিত করে তোলেনি বরং দেশের অভ্যন্তরে ও বাইরে ইসলামী বিষয়াদি প্রচারের কাজও আঞ্জাম দিয়ে থাকে। তাদের সাপ্তাহিক রেডিও- টেলিভিশন অনুষ্ঠানগুলো খুবই জনপ্রিয়।

ইসলামী বিপ্লবী গার্ড ছাত্রদের জন্য হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং একটি বিশ্ববিদ্যালয় ধাঁচের সামরিক একাডেমী প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এদের অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে : প্রদর্শনী, খেলাধুলা, সেমিনার ও চলচ্চিত্র। ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর প্রকাশিত বই ও পত্র-পত্রিকা দেশে ও বিদেশে ব্যাপকভাবে পঠিত হয় এবং ফারসি ভাষায় তারা তিনটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করে থাকে। রাজনৈতিক বিষয়ের ওপর আরবি ও ইংরেজি ভাষায়ও বই-পত্রিকা প্রকাশ করা হয়।

গঠনের পর থেকে ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী এত বেশি বিকাশ ও অগ্রগতি অর্জন করতে থাকে যে, এর আর্থিক ও নির্বাহী দিকগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বিষয়ক একটি মন্ত্রণালয় গঠন করতে হয়। প্রকৃতিগতভাবে বিপ্লবী এই অনন্য প্রতিষ্ঠানটি পূর্বের এক অনানুষ্ঠানিক পর্যায় থেকে এখন একটি দক্ষ ও সুসংগঠিত বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। আর এর সদস্যরা সকলেই ঈমানে বলীয়ান মুসলমান। বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণার জন্য ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেছে কয়েকটি গবেষণা কেন্দ্র এবং একটি সুসজ্জিত আধুনিক কম্পিউটার কেন্দ্র। উন্নত পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ জ্ঞান, খাঁটি ইসলামী চরিত্র ও নিষ্ঠায় সমৃদ্ধ ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী ইসলামের পবিত্র লক্ষ্য অর্জনের মধ্য দিয়ে এক ব্যাপকতর কল্যাণের ইঙ্গিত দিয়ে চলেছে।

ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর রচনাবলি এবং জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় তাঁর অবদান

ওস্তাদ রেযা ওস্তাদী

এ যাবত হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর রচনাবলি সম্বন্ধে অজস্র লেখালেখি ও আলোচনা হয়েছে। কিন্তু আমার জানা মতে এখনও তাঁর অসামান্য অবদানগুলো সম্পূর্ণ প্রকাশ পায়নি। এ কারণে আমি চিন্তা করলাম যে, এ প্রসঙ্গে একটি প্রবন্ধ রচনায় হাত দেব। আমি আশা করি, এর দুর্বল দিকগুলো পাঠক-পাঠিকাগণ ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে কয়েকটি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করার চেষ্টা করব।

এক. হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর ১৩৪০ হিজরিতে ঐতিহাসিক ধর্মীয় নগরী কোমে পদার্পণ করা থেকে ১৩৫৫ হিজরি পর্যন্ত অর্থাত মরহুম আলহাজ শেখ আবদুল করিম হায়েরী ইয়াযদীর মৃত্যু পর্যন্ত তিনি যে সকল বিশিষ্ট শিক্ষকের সান্নিধ্যে পড়াশুনা করেন ও ফয়েয লাভ করার সৌভাগ্য অর্জন করেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন :

১. আলহাজ মির্জা জাওয়াদ মালাকী তাবরিযী। ‘আসরারুস সালাত’ (اسرار الصلاة) ও অন্যান্য গ্রন্থ প্রণেতা, মৃত্যু ১৩৪৩ হিজরি।

২. মির্জা সাইয়্যেদ আলী ইয়াসরাবী কাশানী। তিনি ১৩৪১ থেকে ১৩৪৭ হিজরি পর্যন্ত কোমে অবস্থান করেন।

৩. আলহাজ মির্জা আবুল হাসান রাফিঈ কাজভিনী। তিনি হলেন ‘শারহে দোয়ায়ে সাহর’ (شرح دعاء سحر) নামক গ্রন্থের প্রণেতা। তিনি ১৩৪১ থেকে ১৩৪৯ হিজরি পর্যন্ত কোম নগরীতে ছিলেন।

উল্লেখ্য, কোমের বিশিষ্ট শিক্ষক সোবহানী বলেন, হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) ‘হাইআত’  (هيئت) নামক কিতাবও মির্জা আবুল হাসান রাফিঈর কাছে অধ্যয়ন করেন।

৪. জনাব শেখ মুহাম্মাদ রেযা মাসজেদ শাহী। তিনি ‘বেকায়াতুল আযহান’ (وقاية الاذهان) নামক গ্রন্থের প্রণেতা। তিনি ১৩৪৪ থেকে ১৩৪৬ হিজরি পর্যন্ত কোমে ছিলেন।

৫. মির্জা মুহাম্মাদ আলী শাহ আবাদী। তিনি ‘রেশহাতুল বিহার’ (رشحات البحار) নামক কিতাবের রচয়িতা। তিনি ১৩৪৭ থেকে ১৩৫৪ হিজরি পর্যন্ত কোমে জীবনযাপন করেন। হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) সাত বছর এ মহান শিক্ষকের সার্বক্ষণিক সান্নিধ্যে থেকে পরিপূর্ণ ফয়েয লাভে সক্ষম হন।

৬. আলহাজ শেখ আবদুল করিম হায়েরী ইয়াযদী। তিনি হলেন ধর্মীয় নগরী কোমের দীনি মাদরাসার (হাওযায়ে ইলমিয়া কোম) প্রতিষ্ঠাতা এবং বিশিষ্ট কিতাব ‘দুরারুল ফাওয়ায়েদ’ (درر الفوائد) এর প্রণেতা। হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) ১৩৪৫ থেকে ১৩৫৫ হিজরি পর্যন্ত এ মহান শিক্ষকের নিকট ইলমে উসূল ও ফেকাহশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন।

দুই. ১০টি বিষয়ের ওপর ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর লিখিত কিতাবগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে দেওয়া হলো :

১. আধ্যাত্মিকতা (عرفان) : এ বিষয়ের ওপর তাঁর লিখিত বহু কিতাব বিদ্যমান। ১৩৪৭ থেকে ১৩৫৫ হিজরি পর্যন্ত তিনি এসব কিতাব লিপিবদ্ধ করেন।

২. নৈতিকতা (اخلاق) : এ বিষয়ের ওপরও তিনি ফারসি ভাষায় বিভিন্ন কিতাব লিখেছেন এবং তা ১৩৫৫ থেকে ১৩৬০ হিজরির মধ্যে রচনা করেন। এ ছিল এমন একটি সময় যখন তিনি কোমের বিশ্ববিখ্যাত মাদরাসায়ে ফায়যিয়াতে চরিত্র গঠনের উদ্দেশ্যে আধ্যাত্মিকতা ও নৈতিকতার ওপর গুরুত্বপূর্ণ র্দাস পেশ করতেন।

৩. দর্শন (فلسفه) : তিনি দর্শনের বিখ্যাত কিতাব ‘আসফার’ গ্রন্থের ওপর টীকা লেখেন বলে ধারণা করা হয়। কোমের একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সাপ্তাহিক কায়হান পত্রিকার ১১ ও ১৮তম সংখ্যায় এ ধরনের একটি মতামত ব্যক্ত করেছেন।

৪. প্রামাণিক ফেকাহ (فقه استدلالی) : প্রামাণিক ফেকাহ বিষয়ে ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর বিভিন্ন গ্রন্থ আছে যেগুলো তিনি ১৩৬৫ হিজরিতে নাজাফ থেকে ইরানে প্রত্যাবর্তন অর্থাত ১৩৬৫ থেকে প্রায় ১৩৯৭ হিজরির মধ্যে লিখেছেন।

৫. উসূলে ফেকাহ (اصول فقه) : এ বিষয়ের ওপরও ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর লেখা বিভিন্ন কিতাব রয়েছে এবং তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণও বটে, যা তিনি ১৩৭০ থেকে ১৩৭১ হিজরির মধ্যে লেখেন।

৬. ইলমে রেজাল (علم رجال) : ব্যক্তি পরিচয়বিদ্যা। এ বিষয়ের ওপর ইমামের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা ও মন্তব্য তাঁর রচিত ‘তাহারাত’ (طهارت) গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে।

৭. জরুরি মাসায়েল সম্পর্কিত দৈনন্দিন প্রয়োজন পড়ে এমন রেসায়েল। যেমন ‘রেসালাতুল আমালিয়াহ’ (رسالة العملية) : হযরত ইমাম খোমেইনী তাঁর অনুসারীদের জন্য যে সকল রেসালা ও তার হাশিয়াসমূহ লিখেছেন এবং উক্ত রেসালা ও হাশিয়া ইমামের প্রসিদ্ধ কিতাব ‘তাহরীরুল ওয়াসিলা’ (تحرير الوسيله) এর অন্তর্ভুক্ত নয় এবং তা লেখা হয়েছে ১৩৭০ হিজরির আগে।

৮. রাষ্ট্রবিজ্ঞান (حكومت) (সরকার পরিচালনা পদ্ধতি) : এ বিষয়ে ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী কিতাব ‘বেলায়াতে ফকীহ’ এবং সমস্ত ভাষণ, বিবৃতি ও রচনার সমষ্টি যা বিপ্লবের বিজয়ের পর হয়েছে।

৯. ইমামত ও ধর্মীয় নেতৃত্ব  (امامت و روحانيت): এ প্রসঙ্গে আমরা ‘কাশফুল আসরার’ (كشف الاسرار) নামক কিতাবটির কথা উল্লেখ করতে পারি যা ১৩৬৩ হিজরিতে লেখা হয়েছে।

১০. কবিতা (কাব্য)-شعر  : ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর সমস্ত কবিতার সমষ্টি যা ‘দিওয়ান’ (কাব্যসমগ্র) হিসাবে খ্যাতি লাভ করেছে।

তিন. উল্লেখ করা যেতে পারে যে, হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) আয়াতুল্লাহ আল-উযমা বুরুজেরদীর ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত অর্থাত ১৩৭০ হিজরি পর্যন্ত সাধারণ সমাজে তেমন প্রসিদ্ধি লাভ করেননি। বরং তাঁর ইন্তেকালের পর আলেমসমাজের আন্দোলন শুরুর প্রাক্কালে ১৫ খোরদাদের (১৩৪২ সৌরবর্ষের) ঐতিহাসিক ঘটনার পর মানুষ কিছু কিছু করে ইমামের মহান ব্যক্তিত্ব ও কর্মকা-ের সাথে পরিচিত হয়। কথাটা কিছুটা বাস্তব হলেও এমন নয় যে, ১৩৪২ সৌরবর্ষের আগে ইমাম একবারেই সমাজে আত্মগোপন করেছিলেন বা অপরিচিত ছিলেন; বরং কোমের দীনি মাদরাসা (হাউযায়ে ইলমিয়া কোম) ছাড়াও সারা দেশের অসংখ্য আলেম এবং দীনি মাদরাসা তাঁর প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের সাথে পরিচিত ছিল। এমনকি বিপ্লবের পূর্বেই বিভিন্ন বইপত্রে তাঁর রচনাবলি, ব্যক্তিত্ব ও কর্মকা- নিয়ে কমবেশি আলোচনা ও লেখালেখি হতো। এ প্রসঙ্গে লিখিত বইসমূহের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে :

১. নোকাবাউল বাশার  (نقباء البشر)- লেখক আল্লামা আলহাজ আগা বুজুর্গ তেহরানী।

২. আল-জারিয়াহ ইলা তাসানি ফিশশিয়া (الذريعة الى تصانيف في الشيعة)- লেখক : আলহাজ আগা বুজুর্গ তেহরানী।

৩. ফারসি গ্রন্থপঞ্জি : রচনায় মরহুম খান বাবা মাশার।

৪. আরবি গ্রন্থপঞ্জি : মরহুম খান বাবা মাশার।

৫. লেখকের গ্রন্থপঞ্জি : মরহুম খান বাবা মাশার।

৬. আছারুল হুজ্জাত (اثار الحجة) :  ১৩৭৩ হিজরিতে রচনা করা হয়েছে।

৭. রেজালে কোম (رجال قم) : রচনায় সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ মোকাদ্দাস জাদেহ। ১৩৩৫ সৌরবর্ষে প্রকাশিত।

৮. আইনেহ-ই দানেশওয়ারান (آئينه دانشوران) : ১৩৫১-১৩৫৩ হিজরি পর্যন্ত রচনা ও ১৩৫৩ হিজরিতে প্রকাশিত। এই সময় ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর বয়স হয়েছিল ৩২ বছর এবং উল্লেখ করা হয় যে, যে সকল জ্ঞানী ও মর্যাদাশীল ব্যক্তি জনাব শাহ আবাদীর কাছে অধ্যয়ন করার ও দীর্ঘকাল তাঁর আধ্যাত্মিক ও নৈতিক শিক্ষা লাভের সৌভাগ্য অর্জন করেছেন সাইয়্যেদ রুহুল্লাহ ছিলেন তাঁদেরই একজন। এ পরিপ্রেক্ষিতে যেভাবে বর্ণনা করা হয়েছে সামান্য পরিবর্তন করে এভাবে বলব যে, জনাব সাইয়্যেদ রুহুল্লাহ (হযরত ইমাম) জনাব সাইয়্যেদ মোস্তফার সর্বকনিষ্ঠ সন্তান- যিনি খোমেইন শহর ও তার আশপাশের এলাকার জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে ছিলেন এবং ১৩২১ হিজরিতে ওই এলাকার একজন কুখ্যাত খুনীর হাতে তিনি (সাইয়্যেদ মোস্তফা) শাহাদাতবরণ করেন। তাঁর দাদা সাইয়্যেদ আহমদ- প্রসিদ্ধ ‘সাইয়্যেদ হিন্দি’ ছিলেন ভারতের অধিবাসী। একসময় তিনি ভারত থেকে ইরানে এসে কোম থেকে ১৯৫ কি.মি. দূরে জীবনযাপন শুরু করেন।

হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) ১৩২০ হিজরিতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৩৩৯ হিজরি অর্থাত ১৯ বছর বয়স পর্যন্ত ইমাম তাঁর জন্মস্থান থেকে দূরে কোথাও সফর করেননি। যেহেতু জন্মস্থানেই তিনি প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন করেন সেহেতু ফারসি সাহিত্যের ওপর কিছু পড়াশুনা ছাড়া তেমন কোন উল্লেখযোগ্য পড়াশুনা সেখানে করেননি। সে বছরই আরাক শহরের অন্তর্গত সুলতান আবাদে এসে নিয়মিত পড়াশুনা শুরু করেন। হযরত আয়াতুল্লাহ হায়েরী যখন কোম শহরে চলে আসেন (হিজরত করেন) ইমাম খোমেইনীও তাঁর সাথে কোমে চলে আসেন এবং নিজের মূল্যবান সময়কে সারাক্ষণ সাদরুল মুতাআল্লিহীন  (মোল্লা সাদরা)-এর গ্রন্থসমূহ অধ্যয়নে কাজে লাগান। এরপর কয়েক বছর ধরে জনাব মির্জা মুহাম্মাদ আলী শাহ আবাদীর সান্নিধ্যে আধ্যাত্মিক জ্ঞান হাসিল করেন এবং সাথে সাথে কোমের দীনি শিক্ষায় আয়াতুল্লাহ পর্যায়ের অধ্যয়নে জনাব আয়াতুল্লাহ হায়েরীর সান্নিধ্যে থাকেন।

তাঁর রচিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে দোয়ায়ে মাছুরের টীকা- ‘শারহে বার দোয়ায়ে মাছুর সাহর হা’য়ে মাহে রামাযান’ (شرح بر دعاء مأثور، سحر هاء ماه رمضان)- এ বইটি ১৩৪৭ হিজরিতে সমাপ্ত হয়। তাঁর অপর গ্রন্থ হচ্ছে ‘মিসবাহুল হেদায়া ফি হাকিকাতিল খালাকাহ’ (مصباح الهدايه في حقيقة الخلاقة)।

তিনি অন্যান্য যেসব গ্রন্থের টীকা লেখেন সেগুলোর মধ্যে ‘কাজী সায়ীদ কোমীর রেসালা’

(رساله قاضي سعيد قمي) অন্যতম যেটাকে ইমামিয়া মাযহাবের আধ্যাত্মিকতার সনদ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় এবং তা ‘রা’সূল জালূত’ (رأس الجالوت) নামে হাদীস গ্রন্থের شرح (শারহ) বা ব্যাখ্যাগ্রন্থ। তাঁর নিজের বইয়ের শারহ যা ১৩৪৮ হিজরিতে সমাপ্ত হয়। এ বইটি তাঁর আর একটি অবদান যেটি ‘শারহে ফুসুলুল হেকামে কায়সারী’ (شرح فصوص الحكم قسصري) নামে খ্যাত, কিন্তু এ বইটি অসম্পূর্ণ।

‘আইনেয়ে দানেশওয়ারান’ آئينه دانشوران নামক গ্রন্থের লেখক মরহুম আলহাজ সাইয়্যেদ রায়হানুল্লাহ ইয়াযদী ১৩৭৮ হিজরিতে অথবা এর দু’তিন বছর পরে এ বইটির দ্বিতীয় সংস্করণের নতুন পরিশিষ্টে বলেন, ‘আমার এ কিতাবটি লেখার ইতিহাসে হাউযায়ে ইলমিয়া কোম এর ছাত্রদের মধ্যে আধ্যাত্মিকতা ও দর্শন বিষয়ে আগ্রহী, সাদরুল মুতাআল্লেহীনের কিতাব অধ্যয়নকারীদের মধ্যে জনাব আলহাজ রুহুল্লাহ খোমেইনী ছিলেন এমন এক ব্যক্তি যাঁর আধ্যাত্মিকতার ওপর লেখা হৃদয় হরণ করা কবিতাগুলো আমরা- ছাত্রদের জন্য প্রতিদিন আবৃত্তি করা যেন একটি কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাঁর লেখা গযলগুলো এমন ছিল যে, আজও তা আমরা ভুলে যাইনি। আজও তাঁর কবিতাগুলো আমাদের মনে পড়ে। যেমন : তিনি লিখেছেন :

‘আমি আমার বন্ধুর প্রেমে

নিজের হৃদয় অতিক্রম করে চলেছি

আপনজন ও দেশ থেকে

অন্তরকে বিচ্ছিন্ন করেছি।’

দর্শন, আধ্যাত্মিকতা ও চরিত্র গঠনে ইমামের রচনাবলি

১. শারহে দোয়ায়ে সাহ্‌র  (شرح دعاء سحر) : আরবিতে লেখা এ বইটি এই বাক্যগুলো দিয়ে শুরু হয় : হযরত ইমাম রেযা (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, ইমাম বাকের (আ.) এ দোয়াটি রমযান মাসের সেহরীতে পাঠ করতেন। এ দোয়াটির বিভিন্ন টীকা ও ব্যাখ্যা রয়েছে, তার মধ্যে একটি হলো হযরত ইমামের- যা ১৩৪৭ হিজরিতে তাঁর ২৭ বছর বয়সে তিনি লিখেছিলেন।

হযরত ইমামের এ কিতাবটি তাঁর আধ্যাত্মিক কিতাবগুলোর একটি। তাঁর অন্যান্য কিতাব, যেমন ‘মিসবাহুল হেদায়াহ’ (مصباح الهدايه) শুধু তাঁরাই বুঝতে পারবেন দর্শন ও আধ্যাত্মিকতার সাথে যাঁদের পূর্ব পরিচয় আছে।

হযরত মরহুম শাহ আবাদী যে বছর কোমে পদার্পণ করেন, সে বছরই এ বইটি লেখা হয়; বইটির দু’ জায়গায় তাঁর বাণী ও লেখা উল্লেখ করা হয়েছে। এ বইটি জনাব শাহ আবাদীর ছাত্র থাকাকালে প্রথম বছরে লেখা। এর প্রমাণ হলো হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) তাঁর ওস্তাদ জনাব শাহ আবাদীর সাথে প্রথম সাক্ষাতে বলেছিলেন, ‘আমি দর্শন বিষয়ে আগেই অধ্যয়ন করেছি, আধ্যাত্মিকতার ওপর চর্চা করেছি এবং এ বিষয়ে শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়েছি।’ এ বইটির এক স্থানের উদ্ধৃতি একথার সাক্ষ্য বহন করে। তিনি বিভিন্ন স্থানে দলিল আনতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন : ‘আমি এ বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞের কাছে শুনেছি’। এ কথাটা কয়েকবার তিনি বিভিন্নভাবে উল্লেখ করেছেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বুঝতে পারি যে, যাঁর কাছে বা যাঁদের কাছে শুনেছেন বলে তিনি উল্লেখ করেছেন তাঁরা জনাব শাহ আবাদী নন; বরং অন্য কেউ। কারণ, জনাব শাহ আবাদী সম্বন্ধে বলতে গেলে তিনি সব সময় ‘আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক’ শব্দটি ব্যবহার করতেন। উপরিউক্ত কিতাবটি মূলত আরবি ভাষায় লিখিত। বিপ্লবের বিজয়ের পর তা ফারসি ভাষায় অনূদিত ও প্রকাশিত হয়েছে।

২. মিসবাহুল হেদায়া আলে আল খেলাফা ওয়াল বেলায়াহ (مصباح الهدايه آل الخلافه و الولايه) : এ বইটিতে হাকীকতে মুহাম্মাদিয়া (حقيقت محمديه) ও হযরত আলীর বেলায়াত (ولايت علويه) সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এটিও আরবি ভাষায় লিখিত। ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের পর এর ফারসি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। ১৯৭০ সালে (১৩৪৯ ফারসি সালে) বইটি লেখা সমাপ্ত হয়েছিল। এ বইটিও ‘শারহে দোয়ায়ে সাহর’ (شرح دعاء سحر) এর ন্যায়। যাঁরা আধ্যাত্মিকতার সাথে পরিচিত শুধু তাঁদের কাছে এ গ্রন্থটি বোধগম্য হতে পারে।

বইটির শেষের দিকে হযরত ইমাম খোমেইনী আলেম ও রুহানী ব্যক্তিত্বদের উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ এবং নসিহত করেন।

ইমাম খোমেইনী (রহ.) তাঁর অন্যান্য কিতাবের মধ্যে, যেমন ‘সিররুস সালাত’ (سر الصلاة) এবং এ কিতাবটির টীকায় উক্ত কিতাবটির (মিসবাহুল হেদায়া)-এর উদ্ধৃতি দেন।

এ কিতাবটিতে তিনি প্রথমটির ন্যায় বেশ কয়েকটি কিতাবের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। যেমন : কাজী সাঈদ কোমীর ‘শারহে তাওহীদে সাদুক’ (شرح توحيد صدوق), ‘আল বাওয়ারেকুল মালাকুতিয়াহ (البوارق الملكوتية), মোলভীর ‘মিফতাহুল গাইব’ (مفتاح الغيب), কায়ছারির ‘শারহে ফুছুছ’ (شرح فصوص), ইবনে ফারেজ আবদুর রাজ্জাক কাশীর কাসীদার ব্যাখ্যা (شرح قصيده ابن عبد الرزاق كاشى) এবং জনাব মোহাম্মদ রেযা কামশেইর ‘রেসালাহ দার-তাহকীকে আসফারে আরবাআ’ (رساله در تحقيق اسفار اربعه) থেকে এ বইয়ে উদ্ধৃতি এবং বর্ণনা দেয়া হয়েছে এবং তার ওপরে সমালোচনাও করা হয়েছে। এভাবে জনাব মহিউদ্দীন ও তাঁর শ্রদ্ধেয় ওস্তাদ জনাব শাহ আবাদীর কথাও কয়েক স্থানে উল্লেখ করেন।

৩. লিকা আল্লাহ (لقاء الله) : ফারসি ভাষায় সাত পৃষ্ঠার একটি প্রবন্ধ। এর মধ্যে ইমাম তাঁর শ্রদ্ধেয় ওস্তাদ জনাব শাহ আবাদীর স্মৃতি তুলে ধরেন। এ প্রবন্ধটি মরহুম আলহাজ মির্জা জাওয়াদ মালাকীর ‘লিকা আল্লাহ’ (لقاء الله) এর শেষে প্রকাশিত হয়।

৪. সিররুস সালাত : সালাতুল আরেফিন ইয়া মেরাজুস সালেকীন (سر الصلاه: صلاة العارفين يا معراج السالكين) (ফারসি) : এ বইটি বিশেষ করে আধ্যাত্মিকতার সাথে যাঁরা পুরোপুরি সম্পৃক্ত তাঁদের জন্য লেখা হয়েছে। ১৩৫৮ হিজরিতে বইটি লেখা শেষ হয় এবং এ যাবত এর দুটি সংস্কারণ প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম সংস্করণ সরাসরি এবং দ্বিতীয় সংস্করণ শহীদ মোতাহহারী (রহ.)-এর স্মৃতির স্মরণে।

‘আদাবুস সালাত’ (آدب الصلاة) নামে তাঁর অন্য একটি গ্রন্থে তিনি বলেন : ‘কিছুদিন আগে এ গ্রন্থটি সমাপ্ত করি। নামাযের আধ্যাত্মিক বৈশিষ্ট্যের সামান্য কিছু সহজ করে আমি সেখানে উপস্থাপন করেছি। যেহেতু এ বইটির সাথে সাধারণ মানুষের কোনো সম্পর্ক নেই (অর্থাৎ সাধারণের বোধগম্যের বাইরে) সেহেতু এতে আমি আল্লাহ পাকের সাথে একটি আন্তরিক মিলনের সূত্রকে তুলে ধরেছি। হয়তো এতে ঈমানদার ভাইদের অন্তরে একটি অনুভূতি ও প্রতিক্রিয়ার উদ্রেক হতে পারে।

এ বইটিতে ‘শহীদে সানী’ ও মরহুম জনাব শাহ আবাদীর ‘আসরারুস সালাত’ (اسرار الصلاة) থেকে  বর্ণনা দেয়া হয়েছে এবং তাঁর নিজের লেখা ‘শারহে আরবায়ীন’ (شرح اربعين) এর দিকে ইঙ্গিত করা হয়। এ কারণে বোঝা যায় যে, উক্ত বইটি ‘শারহে আরবায়ীন’ (شرح اربعين) এর পরে লেখা হয়েছে। অথবা তা লেখার সময় এ বইটিও তিনি লিখছিলেন। প্রথম সংস্করণের ৬৭ পৃষ্ঠায় তিনি বলেন : ‘যদি আরেফ দরবেশদের কাউকে চিনতে না পার তবে সুফি দরবেশদের মধ্যে উচ্চ স্থানীয় নৈতিক ও আধ্যাত্মিকভাবে যাঁরা স্বীকৃত তাঁদের অনুগত হও, যেমন মাওলানা সাইয়্যেদ ইবনে তাউস (রহ.), শেখ জলিল বাহায়ী (রহ.), শেখ মাওলানা মুহাম্মাদ তাকী মাজলিসী (রহ.) এবং জনাব মাওলানা মাজলিসীর সুযোগ্য পুত্র শাইখুল মুহাদ্দিসীনদের মতো ব্যক্তিদের কিতাব। ‘শারহে ফাকিয়েহ’ জনাব মাওলানা মাজলিসী আউয়াল এর একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী কিতাব যা ফারসি ভাষায় লেখা। কিতাবটি অধ্যয়ন কর; যদি কোনো স্থানে বুঝতে না পার তবে যারা বোঝে তাদের কাছে এসে বুঝে নাও। তার মধ্যে আধ্যাত্মিকতার চাবিকাঠি নিহিত। এভাবে মোল্লা মেহেদী নারাক ও জানাব মোল্লা আহমদ নারাকীর বইসমূহ এবং জনাব আলহাজ মির্জা জাওয়াদ তাবরিযী (রহ.)-এর কিতাবগুলো অধ্যয়ন করবে।’

৫. তা’লিকাতুন আলা শারহে ফুসুলুল হেকাম (تعليقة علي شرح فصوص الحكم) : ফুসুলুল হেকাম (فصوص الحكم) মুহিউদ্দিন আরাবির লেখা একটি গ্রন্থ। আরবি এ গ্রন্থটির ওপর টীকা লিখেছেন জনাব মাহমুদ কায়সারি। যে সাত বছর ইমাম খোমেইনী (রহ.) তাঁর ওস্তাদ জনাব মরহুম শাহ আবাদীর পবিত্র সান্নিধ্যে থাকার সুযোগ পেয়েছেন সে সময়েই ‘শারহে ফুসুস’ নামক কিতাবটি তিনি তাঁর কাছে অধ্যয়ন করেছেন। ‘শারহে ফুসুস’ এর (شرح فصوص) ওপর ইমাম যে টীকা-টিপ্পনি লিখেছেন তাও এ সময়ের মধ্যে। এ বইটিতে ইমাম তাঁর প্রণীত ‘মিসবাহুল হেদায়াহ’ (مصباح الهدايه) নামক বইটির দিকে ইঙ্গিত করেন এবং মরহুম শাহ আবাদীর কথাও স্মরণ করেন। ‘শারহে ফুসুস’ নামক বইটি ৪৯৫ পৃষ্ঠার। ইমাম তার ৩৯৬ পৃষ্ঠা পর্যন্ত টীকা লেখেন।

৬. তা’লিকাতুন আলা মিসবাহুল উন্‌স- تعليقة على مصباح الانس (আরবি)

সদরুদ্দীন মুহাম্মদ বিন ইসহাক কৌনভী সংকলিত গ্রন্থ হচ্ছে ‘মিফতাহুন আয়েবুল জাময়ে ওয়াল উজুদ’ (مفتاح عيب الجمع والوجود) । এর শারহ হচ্ছে ‘মিসবাহুল উন্স’- যা সংকলন করেন মুহাম্মাদ বিন হামযা বিন মুহাম্মাদ উসমানী, যিনি ইবনে কানারী নামে খ্যাত।

ইমাম খোমেইনী (রহ.) ‘মিসবাহুল উন্স’ নামক কিতাবটির ৪৪ পৃষ্ঠা পর্যন্ত (১৩৫০ হিজরি থেকে ১৩৫৪ হিজরি পর্যন্ত) তাঁর সম্মানিত শিক্ষক হযরত শাহ আবাদীর কাছে অধ্যয়ন করেন। এ বইটির প্রথম পৃষ্ঠার টীকায় তিনি উল্লেখ করেন : ‘আমি এর আগেও ইঙ্গিত করেছি যে, এ গ্রন্থটি আমি আমার সুযোগ্য ওস্তাদ শেখ মির্জা মুহাম্মাদ আলী শাহ আবাদী ইসফাহানীর পবিত্র সান্নিধ্যে থেকে অধ্যয়ন করি।’

এরপর তিনি গ্রন্থের ৪৪ পৃষ্ঠায় এভাবে উল্লেখ করেন : ‘এ পর্যন্তই আমি আমার সম্মানিত ওস্তাদ শাহ আবাদীর নিকট অধ্যয়ন করার সৌভাগ্য অর্জন করেছি। তারপর তিনি তেহরানে মৃত্যুবরণ করলে আমি তাঁর কাছে শিক্ষা লাভের সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হই।’

ইমাম খোমেইনী (রহ.) তাঁর এ মূল্যবান লেখাটি সম্ভবত যে রমযান মাসে ‘মিসবাহুল উন্স’ নামক বইটি জনাব শাহ আবাদীর কাছে অধ্যয়ন করেছেন যে রমযানেই লিখেছেন। এরপর তিনি তেহরানে চলে যাওয়ার পরও এর চর্চা অব্যাহত রাখেন। স্মরণ করা যেতে পারে যে, উক্ত বইটি ৩৪৩ পৃষ্ঠাবিশিষ্ট, এটি ১৪০৬ হিজরিতে প্রকাশিত হয়।

৭. তা’লিকাতুন আলা শারহে হাদীসিন রাসূল জালুত (تعليقة على شرح رأس الجالوت)

কাজী সাঈদ মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ মুফীদ কোমী ১১ শতাব্দীর একজন বিশিষ্ট সুফি ও আধ্যাত্মিক নেতা এবং পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর অসংখ্য লেখা ও রচনার মধ্যে উক্ত বই একটি। বইটি সম্বন্ধে হাজী আগা বুজুর্গ এর ‘জারিয়া’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। সম্ভবত ‘শারহে হাদীসে রাসূল জালুত’ রচনার উদ্দেশ্য হচ্ছে হযরত ইমাম রেযা (আ.) বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সাথে বিভিন্ন সময়ে যে সকল বাহাস বা বিতর্ক করেছেন তারই একটি অংশ হবে এবং রাসূল জালুতে ইহুদি গ্রন্থেরও একটি অংশ হবে।

৮. শারহুন হাদীসে রাসূল জালুত (আরবি) شرح حديث رأس الجالوت : উপরিউক্ত গ্রন্থটি ছাড়াও ইমাম খোমেইনী (রহ.) সরাসরি একটি ব্যাখ্যা করেছেন এ নামে। ১৩৪৮ ফারসি সালে এ লেখাটি সমাপ্ত হয়। কিন্তু বইটি এখনও প্রকাশিত হয়নি।

৯. শারহুন হাদীসে রাসূল জালুত (شرح حديث رأس الجالوت) : মরহুম সাইয়্যেদ রায়হান উল্লা ইয়াযদী তাঁর বিখ্যাত বই ‘আয়েনায়ে দানেশইয়ারান’ গ্রন্থে এ গ্রন্থটি যে ইমাম খোমেইনী লিখেছেন তার সত্যতা স্বীকার করেছেন। বইটি ১৩৪৮ (ফারসি) সালে লেখা হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন।

১০. তাফসীরে সূরা হাম্‌দ (ফারসি)- تفسير سوره حمد : এটি একটি আধ্যাত্মিক তাফসীর। ইমাম খোমেইনী (রহ.) সূরা ‘হাম্‌দ’ এর ওপর বিপ্লবের শুরুর বছরগুলোতে ৫টি অনুষ্ঠানে যে বক্তব্য পেশ করেন পর্যায়ক্রমে তা প্রকাশিত হয় এবং তাফসীর হিসেবে সমাদৃত হয়। ইমাম খোমেইনী (রহ.) ‘কিতাবে সিররুস সালাত’ ‘সূরায়ে হাম্‌দ ও তাওহীদ’ নামে অত্যন্ত সংক্ষেপে আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে যান। এ ছাড়াও ‘কিতাবে আদাবুস সালাত’ এ সূরা হাম্‌দ, তাওহীদ ও সূরায়ে কাদরের বিস্তারিত তাফসীর করেছেন। তবে এ তাফসীর সাধারণ মানুষের জন্য করা হলেও আধ্যাত্মিকতায় পূর্ণ থাকার কারণে ইমাম নিজেই এর এক জায়গায় লিখেছেন, ‘আমার ইচ্ছা ছিল এ লেখাগুলো থেকে সর্বসাধারণ উপকৃত হবেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এর মধ্যে আধ্যাত্মিক বিষয়বস্তুর ঊর্ধ্বে উঠতে পারিনি। তাই বিশেষ একটি মহল ছাড়া তা সবার পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়ে উঠবে না। এজন্য আমি ঈমানদার ও আলেমদের কাছে সবিনয়ে অপারগতা প্রকাশ করছি।’

ইমাম একদিন এক অনুষ্ঠানে সূরা আলাক এর ওপর বক্তব্য পেশ করেন যা পরবর্তীকালে ‘তাফসীরে সূরা আলাক’ নামে প্রকাশিত হয়।

১১. আল-হাশিয়াতু আলাল আসফার (আরবি)- الحاشية على الاسفار : মোল্লা সাদরার ‘আসফার’ নামক গ্রন্থটি যাঁরা অধ্যয়ন করেন ও অধ্যাপনার কাজে ব্যবহার করেন তাঁদের মধ্যে ইমাম খোমেইনী (রহ.) ছিলেন একজন এবং সম্ভবত এ গ্রন্থটির ওপর তিনি টীকাও লিখেছেন। ধর্মতাত্ত্বিক শিক্ষাকেন্দ্রের একজন বিশিষ্ট শিক্ষক এর প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন : সাদরুল মুতাআল্লেহীনের (মোল্লা সাদরার) গ্রন্থ ‘আসফার’ এর ষষ্ঠ খণ্ডের ২য় ও ৩য় পৃষ্ঠায় একটি হাদীসের ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে ইমাম খোমেইনী (রহ.) একটি অকাট্য যুক্তি ও দলিল পেশ করে সামনে অগ্রসর হয়েছেন যার ওপর কথা বলার কারো ক্ষমতা হয়নি। দর্শনের ওপর ইমাম খোমেইনীর এ ছাড়া অন্য কোনো লেখা আছে বলে জানা যায়নি।

১২. আদাবুস সালাত (আরবি)- اداب الصلاة : এ গ্রন্থটি ইমাম খোমেইনী (রহ.) তাঁর ‘সিররুস সালাত’ নামক গ্রন্থটি লেখার পর লিখেছেন। ইমাম তাঁর লেখায় এভাবে উল্লেখ করেন : ‘কয়েকদিন আগে এ বইটি সমাপ্ত করি। নামায সম্পর্কিত কিছু আধ্যাত্মিক কথা সেখানে আমি তুলে ধরেছি। যেহেতু এ গ্রন্থটি সাধারণের বোধগম্যতার ঊর্ধ্বে, তাই কিছু আধ্যাত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয় এতে সন্নিবেশিত করার সিদ্ধান্ত নেই।’ এ গ্রন্থটি জনাব ফেহরীর সম্পাদনা ও তত্ত্বাবধানে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়।

১৩. মোবারেজেহ বা’ নাফ্স ইয়া’ জিহাদে আকবার (ফারসি)- مبارزه با نفس يا جهاى اكبر- এটি চরিত্র গঠনের উদ্দেশ্যে লিখিত। আর এটি ইমামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান যা ইমাম ইরাকের নাজাফে থাকাকালীন ছাত্র ও আলেমদের উদ্দেশে রচনা করেন। প্রকৃতপক্ষে এটি তাঁর প্রদত্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ ও নসিহতের একটি সমষ্টি। এ পর্যন্ত এর কয়েকটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে।

১৪. শারহে হাদীসে জুনুদে আক্‌ল ওয়া জাহ্‌ল (ফারসি)- شرح حديث جنود عقل و جهل : ‘উসূলে কাফী’ নামক বিখ্যাত কিতাবে হযরত ইমাম সাদেক (আ.)-এর বর্ণনায় ‘বুদ্ধিমান ও নির্বোধের সেনাবাহিনী’ নামে বিবৃত ঘটনা প্রসঙ্গে কয়েকটি হাদীসের উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে, যার মধ্যে সত্তরটির বেশি শিরোনাম রয়েছে। ইমাম খোমেইনী (রহ.) ফারসি ভাষায় এ সকল হাদীসের ২৫টির মতো ব্যাখ্যা ও টীকা লিখেছেন। নৈতিকতা ও চরিত্র গঠনের জন্য এ গ্রন্থটি অন্যতম। একজন ব্যক্তি ‘আখলাকে ইসলামী’ নামে বইটি তাঁর নামে তিন খণ্ডে প্রকাশ করেন। বইটি ইমামের স্বনামে প্রকাশ না হওয়ার কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে জনৈক ব্যক্তি বলেন : বিপ্লবের পূর্বে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ইমামের সাথে সাক্ষাতের জন্য নাজাফ গমন করেন। তিনি ইমামের বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষিদের একজন ছিলেন। ফেরার পথে ইমাম উক্ত বইটির পাণ্ডুলিপি তাঁর হাতে দিয়ে প্রকাশ করার জন্য অনুমতি দেন। লোকটি শাহের সৈন্যসামন্তের ভয়ের অজুহাত দেখিয়ে কিছু পরিবর্তন করে বইটি তার নামে ছাপিয়ে দেয়। তবে এ কাজের জন্য সে ধিকৃত হয়। তবে গ্রন্থের ২য় খণ্ডের একটি অংশ ইমামের বলে স্বীকার করে। আমরা আশা করব এ বইটির মূল কপি শীঘ্রই খুঁজে পাওয়া যাবে এবং কোনো প্রকারের পরিবর্তন পরিবর্ধন ছাড়াই প্রকাশিত হবে এবং ধর্মতাত্ত্বিক শিক্ষাকেন্দ্রসমূহে (হাউযে ইলমিয়া) নীতিশাস্ত্রের পাঠ্য বই হিসেবে গণ্য হবে।

১৫. আরবাঈন- শারহে আরবাঈন (اربعین- شرح اربعین) : এ গ্রন্থে চল্লিশটি হাদীসের ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তার মধ্যে ৩৩টি হচ্ছে নৈতিকতা সংক্রান্ত এবং অপর ৭টি হচ্ছে আকীদাগত। এর শুরুতে তিনি উল্লেখ করেন : গ্রন্থটিতে সংক্ষিপ্ত সময়ে ইমামদের বর্ণিত চল্লিশটি হাদীস সংকলন করেছি যার মধ্যে সাধারণ মানুষের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো লোকে সামনে রেখে সবাই উপকৃত হতে পারে। হাদীস লেখার শুরুতে যে চারজন বিশেষ সনদপ্রাপ্ত ব্যক্তির অনুমতি নিয়েছেন তাঁদের নাম উল্লেখ করা হলো :

ক. শেখ মুহাম্মাদ রেযা আলে আল্লামা শেখ মুহাম্মাদ তাকী ইসফাহানী বেকায়াতুল আযহান (وقایة الاذهان) গ্রন্থের প্রণেতা, মৃত্যু ১৩৬২ হিজরি।

খ. আলহাজ শেখ আব্বাস কুমী : ওয়াত ১৩৫৯ হিজরি।

গ. আল্লামা সাইয়্যেদ মুহসিন আমীন আমলী, ওফাত ১৩৭১ হিজরি।

ঘ. সাইয়্যেদ আবুল কাশেম দেহকারদী ইসফাহানী, ওফাত ১৩৫৩ হিজরি।

এরপর ইমাম খোমেইনী বর্ণনা করেন যে, এছাড়াও হাদীস বর্ণনার জন্য আমি আরো একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রের অনুমতি পেয়েছি যার সূত্র শেখ আনসারী পর্যন্ত পৌঁছে না। তাই এখানে উল্লেখ করা হলো না।

প্রথম অনুমতি সূত্রের পরম্পরা : মরহুম শেখ মুহাম্মাদ রেযা ও মরহুম আলহাজ শেখ আব্বাস উভয়েই আলহাজ নূরী থেকে, তিনি জনাব শেখ আনসারী এবং মরহুম সাইয়্যেদ মুহসিন আমীন থেকে, তিনি জনাব সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ হিন্দী থেকে, তিনি জনাব শেখ আনসারী এবং মরহুম সাইয়্যেদ আবুল কাশেম দেহকারদী থেকে, তিনি মির্জা হাশেম ইসফাহানী খোনসারী থেকে, তিনি শেখ আনসারী থেকে।

১৩৫৮ হিজরিতে উক্ত গ্রন্থটি লেখা সমাপ্ত হয়। এর মধ্যে চারটি হাদীস জনাব ফেহরী কর্তৃক সম্পাদিত হয়ে এ কিতাবের ২২৪ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়েছে। প্রায় ২০টি হাদীস সাজেমানে তাবলীগাত ইসলামীর মুখপত্র (অধুনালুপ্ত) এতেসামে ছাপা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ১৩৬৬ ফারসি সালে তা-হা প্রকাশনা থেকে সম্পূর্ণ গ্রন্থটি দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়। এরপর মারকাজে নাশরে ফারহাংগে রেযা নামক প্রকাশনী সংস্থা থেকে এক খণ্ডে ৫৫৬ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়।

প্রামাণ্য ফেকাহবিষয়ক কিতাবসমূহ

ইমাম খোমেইনী (রহ.) ৩০ বছরকাল ধরে উক্ত বিষয়ে অধ্যাপনা করেন। তাঁর সমস্ত ক্লাস অথবা এর বেশিরভাগ অংশেরই বক্তব্য সাথে সাথে লিপিবদ্ধ করা হয়ছে। একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো যে, ক্লাসে ইমাম বক্তৃতা দেয়ার পরপরই সে বিষয়টির ওপর গবেষণা হতো। এ প্রসঙ্গে যে সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর ইমাম লিখেছেন তা হলো : طهارت- তাহারাত (পবিত্রতা) এবং মাকাসেবে মুহাররামাহ- (مکاسب محرمه), বাই- بیع, খেয়ারত خیارات ও খালালে সালাত خلل صلاة এবং তাকিয়া تقیه সব বিষয়ই আরবি ভাষায় লিখা হয়। এর বিস্তারিত বর্ণনা নিম্নরূপ :

১৬. কিতাবে তাহারাত (প্রথম খণ্ড)- کتاب طهارت (جلد اول) : অপবিত্রতা (نجاست) সম্পর্কে এ গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩৭৩ হিজরির ১০ জিলহজ, পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৭২। এর প্রথম সংস্করণ কোম থেকে এবং দ্বিতীয় সংস্করণ ১৩৮৯ হিজরিতে নাজাফ থেকে প্রকাশিত হয়, পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩৫৮।

১৭. কিতাবে তাহারাত (২য় খণ্ড)- کتاب طهارت (جلد دوم) : এর বিষয়বস্তু হচ্ছে : পানি তিন প্রকারের। লেখা শেষ হওয়ার তারিখ ২২ রবিউল আউয়াল, ১৩৭৬ হিজরি। এটি কোম থেকে প্রকাশিত হয় এবং এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩১৯।

১৮. কিতাবে তাহারাত (৩য় খণ্ড)- کتاب طهارت (جلد سوم) : বিষয়বস্তু তায়াম্মুম (تیمم); লেখা শেষ হওয়ার তারিখ ১১ শাবান ১৩৭৬ হিজরি। এটিও কোম থেকে প্রকাশিত হয় এবং এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৩৫।

১৯. কিতাবে তাহারাত (৪র্থ খণ্ড)- کتاب طهارت (جلد چهارم) : এ কিতাবটির মূল বিষয় হলো احکام نجاست (অপবিত্রতার বিধান)। কিতাবটির শেষের অংশের বিষয়বস্তু তাহারাত (পবিত্রতা) সংক্রান্ত। ১৩৭৭ হিজরির ২৮ জিলকাদ এটি লেখা শেষ হয় এবং ১৩৮৯ হিজরিতে নাজাফ (ইরাক) থেকে প্রকাশিত হয়। কিতাবটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৯০।

২০. আল-মাকাসেবুল মুহাররামাহ (প্রথম খণ্ড)- المکاسب المحرمة (جلد اول) : শরীয়তের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে এ গ্রন্থে আলোকপাত করা হয়েছে।

২১. আল-মাকাসেবুল মুহাররামাহ (দ্বিতীয় খণ্ড)- المکاسب المحرمة (جلد دوم) : এ খণ্ডে জুয়া, মিথ্যা, অত্যাচারীকে সাহায্য করা যায় কিনা প্রভৃতি বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। ১৩৮০ হিজরির জমাদিউল আউয়াল মাসে এটি লেখা শেষ হয়, ১৩৮১ হিজরিতে কোম থেকে প্রকাশিত হয়। এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৯০।

২২. কিতাবুল বাই (প্রথম খণ্ড)- کتاب البیع (جلد اول) : কেনা-বেচা সংক্রান্ত একটি কিতাব। ১৩৮০ হিজরিতে নাজাফ (ইরাক) থেকে এটি প্রকাশিত হয়। এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪৫৭।

২৩. কিতাবুল বাই (দ্বিতীয় খণ্ড)- کتاب البیع (جلد دوم) : এটিও বেচাকেনা সংক্রান্ত একটি কিতাব। ১৩৯১ হিজরিতে নাজাফ থেকে প্রকাশিত হয়। এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ৫৭৫। এটি ইমামের সাড়াজাগানো ফেকাহ্‌র কিতাব হিসাবে খ্যাত।

২৪. কিতাবুল বাই (তৃতীয় খণ্ড)- کتاب البیع (جلد سوم) : ৪৮৫ পৃষ্ঠার এ কিতাবটি ১৩৯২ হিজরির ১১ জমাদিউল আউয়ালে সমাপ্ত হয় এবং সে বছরই নাজাফ থেকে প্রকাশিত হয়।

ক্রমানুসারে ইমামের ১২ বছরের অধ্যাপনাকালে রচিত কিতাবসমূহের সংখ্যা এ পর্যন্ত দেয়া হলো।

২৫. কিতাবুল বাই (চুতর্থ খণ্ড)- کتاب البیع (جلد چهارم) : এটিও বেচাকেনা সংক্রান্ত একটি গ্রন্থ। ১৩৯৪ হিজরির ২৫ জমাদিউল আউয়াল এটি লেখা সমাপ্ত হয়। এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪৫২। উপরিউক্ত বছরই নাজাফ থেকে এটি প্রকাশিত  হয়।

২৬. কিতাবুল বাই (৫ম খণ্ড)- کتاب البیع (جلد پنجم) : এটিও কেনাবেচা সংক্রান্ত শরীয়তের বিভিন্ন বিধান সম্বলিত একখানা গ্রন্থ। ১৩৯৬ হিজরির ১৫ জমাদিউল আউয়াল এটি রচনা সমাপ্ত হয়। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪০২। ১৩৯৭ হিজরিতে নাজাফ থেকে এটি প্রকাশিত হয়।

২৭. কিতাবুল খালাল  (کتاب الخلل): এ গ্রন্থটির বিষয়বস্তু হচ্ছে নামাযে ত্রুটিবিচ্যুতি সংক্রান্ত। সম্ভবত ১৩৯৭ হিজরির পর থেকে ইমামেরম ইরানে প্রত্যাবর্তনের সময় পর্যন্ত যে সমস্ত বক্তৃতা দেন ও লেখেন তা নিয়েই এ কিতাবটি রচিত হয়। ৩১৪ পৃষ্ঠার কিতাবটি কোম থেকে প্রকাশিত হয়।

২৮. রিসালাতুন ফিত তাকিয়াহ্ (رسالة فی التقیة) : এ প্রবন্ধটি তাকিয়া সম্পর্কিত। ১৩৭৩ হিজরির শাবান মাসে লেখা শেষ হয় এবং ১৩৮৫ হিজরিতে কোম থেকে প্রকাশিত হয়। এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩৫।

২৯. রিসালাতুন ফি কায়েদাতিন মিন মালাক (رسالة فی قاعدة من ملک) : উল্লিখিত গ্রন্থটি সম্পর্কে ‘আসারুল হুজ্জাহ’ নামক কিতাবের ২য় খণ্ডের ৪৫ পৃষ্ঠায় আলোকপাত করা হয়।

৩০. রিসালাতুন ফি তাইনীল ফাজরি ফিল লায়ালী আল-মাকমারাহ  (رسالة فی تعیین الفجر فی اللیالی المقمرة) : ৩২ পৃষ্ঠাবিশিষ্ট এ প্রবন্ধটি ১৯৮৮ ইং সালে প্রকাশিত।

ইমাম খোমেইনীর উসূলে ফেকাহ বিষয়ে যে সকল প্রবন্ধ ও রচনা আরবি ভাষায় রচিত হয় নিম্নে তার বর্ণনা দেয়া হলো :

৩১. রিসালাতুন লা জারার (رسالة لا ضرر) : ইলমে ফেকাহ বিষয়ের একটি পারিভাষিক শব্দ কায়েদায়ে লা-জারার কিন্তু ইলমে উসূলের ‘বারাআত’ প্রসঙ্গেও এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ কারণে আমরা এ প্রবন্ধটাকে ইলমে উসূলের অন্তর্ভুক্ত করেছি। হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) যখন উসূলে ফেকাহ বিষয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন তখন এ প্রবন্ধটি লেখা হয়। ১৩৬৮ হিজরিতে জমাদিউল আউয়াল মাসে লেখা সমাপ্ত হয় এবং কয়েকটি প্রবন্ধ রচনার পর ১৩৮৫ হিজরিতে ‘আর-রিসায়েল’ নামে ৬৮ পৃষ্ঠার পুস্তিকাটি প্রকাশিত হয়।

৩২. রিসালাতুল ইসতিসহাব (رسالة الاستصحاب) : এ গ্রন্থটি ইমামের উসূল বিষয়ে অধ্যাপনার শুরুর দিকে লেখা। এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৯০। ৯ রমযান ১৩৭০ হিজরিতে তিনি এটি সমাপ্ত করেন এবং ১৩৮৫ হিজরিতে কোম থেকে তা প্রকাশিত হয়।

৩৩. রিসালাতুন ফিত তাআদুলে ওয়াত তারাজীহ (رسالة فی التعادل و التراجیح) : এ গ্রন্থটিও ইমামের অধ্যাপনা জীবনের শুরুতে লেখা। ১৩৭০ হিজরির ৯ জমাদিউল আউয়াল তা সমাপ্ত করেন। সে বছরই রমযান মাসে এর সম্পাদনা হয়। ১৩৮৫ হিজরিতে কোম থেকে এটি প্রকাশ করা হয়। এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ৯২।

৩৪. রিসালাতুল ইজতিহাদ ওয়াত তাকলীদ  (رسالة الاجتهاد و التقلید): যেহেতু উসূলে ফেকাহ বিষয়ে ইমামের অধ্যাপনার প্রথম পর্ব ছিল ১৩৭০ হিজরি সেহেতু এ কিতাবটির লেখাও সে বছরই সমাপ্ত হয়। ৭৮ পৃষ্ঠার এ কিতাবটি ১৩৮৫ হিজরিতে কোম থেকে প্রকাশিত হয়।

৩৫. রিসালাতুন ফিত তালাবি ওয়াল ইরাদাহ (رسالة فی الطلب و الارادة) : এ কিতাবটিকে দর্শন ও আধ্যাত্মিক বিষয়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি কিতাব হিসাবে ধরা যেতে পারে। যেহেতু ইমাম তাঁর উসূলে ফেকাহ বিষয়ে পাঠ দান অবস্থায় এর বেশ কয়েকটি অধ্যায় আলোচনা করেছেন সেহেতু আমরাও উসূল বিষয়ে একে শামিল করি। এ কিতাবের শুরুতে ইমামও এ ধরনের উক্তি করেন।

আরবি ভাষায় লিখিত এ গ্রন্থটি ১৩৭১ হিজরির রমযান মাসে হামেদান শহরে অবস্থানকালে লেখা সমাপ্ত হয়। এরপর ফারসি ভাষায় এর অনুবাদও হয়, যার পৃষ্ঠা সংখ্যা হচ্ছে ১৫৭।

৩৬. তালিকাতুন আলা কিফায়াতুল উসূল (تعلیقة علی کفایة الاصول) : মরহুম আলহাজ আগা বুজুর্গ তেহরানী তাঁর কিতাবে আজ-জারিয়াহ এর ২৬তম খণ্ডের ২৮৫ নং পৃষ্ঠায় (মাশহাদ সংস্করণ) জনাব আকন্দে খোরাসানীর কেফায়াতুল উসূলের হাশিয়াতে ইমামের লেখার উদ্ধৃতি দেন।

৩৭. রিসালাহ দার মওজুএ ইলমে উসূল (رسالة در موضع علم اصول) : এ নামেও উসূল বিষয়ে ইমাম (রহ.)-এর কিতাবের সন্ধান পাওয়া যায়।

৩৮. হযরত সোবহানী ইমামের একজন বিশিষ্ট ছাত্র ছিলেন। তিনি কোমের দীনি মাদরাসার একজন সুযোগ্য ওস্তাদ। তিনি বর্ণনা করেন : ইমাম খোমেইনী (রহ.) মরহুম আয়াতুল্লাহ আল উযমা বুরুজেরদীর মোবাহেসে উসূল থেকে হুজ্জিয়্যাত পর্যন্ত টীকা লিখেছেন।

রিসালাহায়ে আমালিয়াহ ইয়া ফেকহে গায়রে ইসতেদলালী  (رساله های عملیه یا فقه غیر استدلالی)

৩৯. তালিকাতুন আলা উরওয়াতুল উসকা (আরবি)- (تعلیقة علی عروة الوثقی) : মরহুম সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ কাযেম ইয়াযদীর উরওয়অতুল উসকা (عروة الوثقی) নামক সম্পূর্ণ গ্রন্থের ওপর ইমামের লেখা হাশিয়া। ১৩৫৭ হিজরির ৭ জমাদিউল আউয়াল এই হাশিয়া লেখা শেষ হয়। এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩৪৫। এটি প্রথম কোম থেকে প্রকাশিত হয়। এর কিছুদিন পর দ্বিতীয় সংস্করণও প্রকাশিত হয়। এভাবে এর কয়েকটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়।

৪০. তালিকাতুন আলা ওয়াসিলাতুন নাজাত (আরবি)- (تعلیقه علی وسیلة النجاة)  : সাইয়্যেদ আবুল হাসান ইসফাহানীর ‘ওয়াসিলাতুন নাজাত’ এর ওপর পরিপূর্ণ হাশিয়া।

৪১. হাশিয়ায়ে তাওজীহুল মাসায়েল (ফারসি)- (حاشیه توضیح المسائل) : আয়াতুল্লাহ বুরুজেরদীর তাওজীহুল মাসায়েলের ওপর ইমামের লেখা হাশিয়া। ১৩৮ পৃষ্ঠার এ গ্রন্থটি আয়াতুল্লাহ বুরুজেরদীর ওফাতের পর কোম থেকে প্রকাশিত হয়।

৪২. রিসালায়ে নাজাতুল ইবাদ (ফারসি)- (رسالة نجاة العباد) : এ গ্রন্থটি সম্ভবত তিন খণ্ডে সমাপ্ত। এ যাবৎ শুধু দুই খণ্ডে মাকাসেবে মুহাররামাহ থেকে তালাক পর্যন্ত কোম থেকে ১৩৭০ ইরানী সালে প্রকাশিত  হয়। এ গ্রন্থটি ইমামের লেখা বলেই ধারণা করা হয়।

৪৩. হাশিয়ায়ে রিসালায়ে এরছ (ফারসি)- (حاشیه رساله ارث) : মুনতাখাবুত তাওয়ারিখ নামক গ্রন্থ প্রণেতা আলহাজ মোল্লা হাশেম খোরাসানী (রহ.) এরছ সংক্রান্ত একটি কিতাব রচনা করেন ফারসি ভাষায়- যার হাশিয়া কয়েকজন বিশিষ্ট আলেম এ যাবত লিপিবদ্ধ করেছেন। ইমাম খোমেইনীও এর ওপর হাশিয়া লেখেন। এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ১২। এটি আয়াতুল্লাহ বুরুজেরদীর ইন্তেকালের পর প্রকাশিত হয়।

৪৪. মানাসেক ইয়া দাসতুরে হজ (ফারসি)- (مناسک یا دستور حج) : ১৮৭ পৃষ্ঠার এ বইটির এ যাবত বেশ কয়েকটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। এর ৩য় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৩৮৪ হিজরিতে।

৪৫-৪৬. তাহরীরুল ওয়াসিলা (আরবি)- (تحریر الوسیلة) : আয়াতুল্লাহ আল উযমা সাইয়্যেদ আবুল হাসান ইসফাহানী প্রণীত ওয়াসিলাতুন নাজাত (الوسیلة النجاة)  ফেকাহশাস্ত্রের একটি বিশেষ গ্রন্থ। এর অধ্যায় সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ কাযেম ইয়াযদীর উরওয়াতুল উসকা নামক গ্রন্থ থেকে বেশি প্রাধান্য পায়; ইমাম খোমেইনী (রহ.) এ বহুল প্রচারিত গ্রন্থটির হাশিয়া (টীকা) লেখেন। ইমামকে যখন তুরস্কে নির্বাসন দেয়া হয় তখন তিনি এ বিষয়ে চিন্তা করেন এবং সিদ্ধান্ত নেন যে, তাঁর লেখা হাশিয়া এবং মূল গ্রন্থের অসমাপ্ত বিষয়গুলোকে পরিপূর্ণ করবেন এবং নির্বাসনে থাকা অবস্থায় এ কাজটি সুচারুরূপে সম্পন্ন করেন এবং এর নাম দেন ‘তাহরীরুল ওয়াসিলা’ (تحریر الوسیلة) । ইমাম নাজাফে থাকাকালীন এ গ্রন্থটি দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়। এরপরও এ যাবৎ বেশ কয়েকবার এর নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। এ গ্রন্থ দুটির পৃষ্ঠা সংখ্যা যথাক্রমে ৬৬২ ও ৬৪৭।

৪৭. যুবদাতুল আহকাম (زبدة الاحکام) :

এ গ্রন্থটি ইমামের প্রখ্যাত গ্রন্থ তাহরীরুল ওয়াসিলা গ্রন্থ অবলম্বনে তাঁর কয়েকজন ছাত্র কর্তৃক রচিত। এ গ্রন্থে জরুরি মাসআলাগুলো আরবি ভাষায় উপস্থাপন করা হয়েছে। গ্রন্থটি বহুবার প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে ১৪০৪ হিজরিতে ইরানের সাজেমানে তাবলীগাতে ইসলামী ২৭৩ পৃষ্ঠার এ গ্রন্থটি প্রকাশ করায় এর জনপ্রিয়তা বেড়েছে। তাহরীরুল ওয়াসিলা গ্রন্থের মূল বিষয়বস্তু অবলম্বনে কয়েক বছর পূর্বে আয়াতুল্লাহ জিলানী এবং আয়াতুল্লাহ আলহাজ সাইয়্যেদ খোনসারীও পৃথক পৃথক গ্রন্থ রচনা করেন।

৪৮. তাওজীহুল মাসায়েল (ফারসি)- (توضیح المسائل)  : ফারসি ভাষায় ইসলামী শরীয়তের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান ও প্রশ্নের উত্তর সন্নিবেশিত হয়েছে এ গ্রন্থে। আয়াতুল্লাহ আল উমযা বুরুজেরদীর সময়ে সাধারণ জনগণের সুবিধার্থে তাঁরই নির্দেশে তেহরানের আলাভী মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা হুজ্জাতুল ইসলাম শেখ আলী আসগর কেরবাচ্ছী এবং প্রখ্যাত লেখক ও গবেষক আলী আসগর ফকিহীর যৌথ প্রচেষ্টায় যে ফতোয়া গ্রন্থ রচিত হয় তারই নাম তাওজীহুল মাসায়েল। এ গ্রন্থের বহু টীকা জাফরী মাযহাবের অনুসারীর জন্য একটি অনন্য সম্পদ হিসাবে পরিগণিত।

৪৯. মুলহিকাতে তাওজীহুল মাসায়েল (ফারসি)- (ملحقات توضیح المسائل) : এ গ্রন্থটিতে সমকালীন পরিস্থিতিতে সৃষ্ট সমস্যা, নব উদ্ভূত প্রশ্নের জবাব ও ফতোয়া ফারসি ভাষায় রচনা করেছেন। তাওজীহুল মাসায়েল গ্রন্থের উপসংহার হিসাবে এ গ্রন্থ বহুবার প্রকাশিত হয়েছে।

৫০. ইসতিফতাআত (ফারসি)-  (استفتائات): ইমাম খোমেইনীর গুরুত্বপূর্ণ ফতোয়া সংকলন। মীরযায়ী কোমীর জামেউশ শিতাব (جامع الشتاب), হুজ্জাতুল ইসলাম শিফতার সাওয়াল জাওয়াব (سوال و جواب), সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ কাযেম ইয়াযদীর সাওয়াল ও জওয়াব এবং আয়াতুল্লাহ গুলপাইগানীর সাওয়াল-জাওয়াব নামক গুরুত্বপূর্ণ ফতোয়া গ্রন্থের মতোই ইমামের ফতোয়াসমূহের সংকলন। এ গ্রন্থে বিশেষ করে ১৯৮১ ও ১৯৮২ সালে প্রদত্ত ফতোয়সমূহ দুই খণ্ডে রচিত হয়েছে। ৫১৯ পৃষ্ঠা সম্বলিত ১ম খণ্ড কোমের জামেয়ায়ে মোদাররেসীন প্রকাশনা হতে প্রকাশিত হয়।

৫১. ইসতিফতাআত (দ্বিতীয় খণ্ড)-  استفتائات (جلد دوم): যা পূর্বোক্ত গ্রন্থেরই অংশবিশেষ।

৫২. হুকুমতে ইসলামী ইয়া বেলায়াতে ফকীহ (ফারসি)-  (حکومت اسلامی یا ولایت فقیه): এ গ্রন্থটি ছিল ইমামের আলোড়ন সৃষ্টিকারী অবদান। ইসলামী নেতৃত্বের স্বরূপ ও ইসলামী হুকুমতের চিন্তাদর্শন এতে অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে স্থান পেয়েছে। ১৩৯১ হিজরিতে ২০৮ পৃষ্ঠার এ গ্রন্থখানি তৃতীয়বারের মতো প্রকাশ পায়।

৫৩. কাশফুল আসরার (ফারসি)- (کشف الاسرار) : এ গ্রন্থটি ছিল আলহাজ শেখ মাহদী পাইন শহরী রচিত আসরারে হেজার সালেহ (اسرار هزار ساله) গ্রন্থের জবাব। শেখ পাইন শহরী তাঁর গ্রন্থে শিয়া মাযহাবের বিরুদ্ধে এবং ওয়াহাবি ফেরকার সমর্থনে অত্যন্ত কড়া বক্তব্য রাখেন। ইরানের রেযা খান তাঁর এ গ্রন্থের পৃষ্ঠপোষকতা করে। রেযা খানের উদ্দেশ্য ছিল ইরানের আলেমদের কোণঠাসা করা। ইমাম খোমেইনী পাইন শহরীর জবাব ও ওয়াহাবি ফেরকার অসারতা প্রমাণ করে রেযা খানের কুকীর্তি অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরেন এ গ্রন্থে।

এ গ্রন্থটি ১৯৪৪ সালে প্রথম মুদ্রিত হয়। ১৯৪৮ সালে ৩৩৪ পৃষ্ঠার এ গ্রন্থ তেহরানের কিতাবফুরুসী ইলমিয়ে ইসলামিয়া প্রকাশনা কেন্দ্র তৃতীয়বারের মতো প্রকাশ করে।

উল্লেখ্য, এ গ্রন্থ রচনার জন্য ইমাম কিছুদিনের জন্য তাঁর নিয়মিত ক্লাস বন্ধ রাখেন। এ গ্রন্থে ওয়াহাবিদের বাতিল আকীদার বিবরণ, তাদের জবাব, শিয়া মাযহাবের অকাট্যতা প্রমাণ করেন। তবে এতে কোনো প্রকার গোঁড়ামি বা একদেশদর্শী বক্তব্য স্থান পায়নি।

৫৪. রেসালা দার রেজাল (আরবি)- (رساله در رجال) : এ পুস্তিকাটিতে হাদীসের সম্বন্ধে উল্লিখিত ব্যক্তিদের গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে ইমামের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত হয়েছে। আরবি ভাষায় লিখিত ২৪ পৃষ্ঠার এ পুস্তিকা কিতাবুত তাহারাত গ্রন্থের ভূমিকাস্বরূপ ছাপা হয়েছে। এ গ্রন্থ ইমামের সুউচ্চ জ্ঞানের স্বাক্ষর বহন করছে।

৫৫. দিওয়ানে শেরে ফারসি (ফারসি)- (دیوان شعر فارسی): এটি ইমামের সাড়াজাগানো কাব্যগ্রন্থ। হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) তাঁর যৌবনকাল থেকে শুরু করে জীবনসায়াহ্ন পর্যন্ত বহু কবিতা লিখেছেন। তাঁর ইন্তেকালের পর বিভিন্ন নামে এসব কবিতার কিছু অংশ প্রকাশিত হয়েছে। সবগুলো কবিতা একত্রে সংকলন করে যে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হতে যাচ্ছে সেটাই দিওয়ানে শেরে ফারসি নামে পাঠকসমাজে উপস্থাপিত হচ্ছে। তবে তাঁর লিখিত বহু কবিতাই হারিয়ে গেছে। যৌবনের শুরুতে লেখা ইমামের কবিতার স্তবকের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে তিনি যে কোন্ পর্যায়ের আরেফ কবি ছিলেন তা সহজেই অনুমান করা যায়। তিনি লিখেছেন:

من در هوای دوست گذشتم زجان خویش

دل از وطن بریدم و از خاندان خویش

‘বন্ধুর প্রেমে সঁপেছি আমি মোর জীবন

ছিন্ন করেছি হৃদয় জন্মভূমি আর পরিবার থেকে।’

তাঁর এ বক্তব্যের নমুনা ছিলেন তিনি নিজেই। পনেরই খোরদাদের রক্তক্ষয়ী ঘটনা, তুরস্কে নির্বাসন, এ জটিল পরিস্থিতিতে কুয়েত ও প্যারিসে হিজরত, অত্যন্ত নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে ইরানে প্রত্যাবর্তন, বিমান হামলা, যুদ্ধের বিভীষিকা সর্ব অবস্থায় তার প্রমাণ রেখেছেন তিনি।

৫৬. রেসালেয়ী মুশতামেল বার ফাওয়ায়েদী দার বাজী মাসায়েলে মুশকিলা (رساله ای مستمل بر فوایدی در بعض مسائل مشکله) কোনো কোনো জটিল সমস্যার সমাধান সম্বলিত পুস্তিকা যা এখনও মুদ্রিত হয়নি।

৫৭. তাহজীবুল উসূল (আরবি) (تهذیب الاصول) : এ গ্রন্থটি শেখ জাফর সোবহানী কর্তৃক ইমামের উসূলে ফিকাহ বিষয়ের ওপর প্রদত্ত বক্তৃতামালার সংকলিত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। এটি চার খণ্ডে বিভক্ত। ইমামের নিজের লেখা বিষয়াদিও এতে স্থান পেয়েছে। ১৩৭৩ হিজরিতে প্রথম খণ্ড, ১৩৭৫ হিজরিতে দ্বিতীয় খণ্ড রচিত হয়েছে। মূল গ্রন্থ তিন খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড বহুবার প্রকাশিত হয়েছে।

৫৮. তাহজীবুল উসূল (আরবি)- (تهذیب الاصول) : এটি উক্ত গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ড। এখনও প্রকাশিত হয়নি। এ গ্রন্থে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ইসলামী আইন প্রণয়নের রূপরেখা কি হবে তা বর্ণিত হয়েছে।

৫৯. রেসালাতু ফি কায়েদাতিন লা জারার ইয়া নাইলুল আওতার (رسالة فی قاعدة لا ضرر یا نیل الاوطار) : ইমামের উসূলে ফিকাহ সম্পর্কিত বক্তৃতামালা। আল্লামা জাফর সোবহানী কর্তৃক ১৩৭৫ হিজরিতে সংকলিত। তাহজীবুল উসূল গ্রন্থের উপসংহার হিসাবে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে।

৬০. রেসালাতুন ফিল ইজতিহাদ ওয়াত তাকলীদ (আরবি)- (رسالة فی الاجتهاد و التقلید)  : আরবি ভাষায় প্রদত্ত ইজতিহাদ ও তাকলীদ (আহকামের ক্ষেত্রে অন্যকে মানা) সম্পর্কিত ইমামের বক্তৃতামালা জনাব সোবহানী কর্তৃক সংকলিত। ১৩৭০ হিজরিতে প্রথম এ সংকলন প্রকাশ পায়। ১৩৭৭ হিজরিতে এ সম্পর্কিত ইমামের পরবর্তী ক্লাসসমূহের বক্তৃতাগুলো সংযোজিত হয়েছে। তাহজীবুল উসূলের সাথেই এটি ছাপানো হয়।

৬১. লুবুবুল আসর ইয়া রিসালাতু ফিত তালাবি ওয়াল এরাদাতি ওয়াল জাবরি ওয়াত তাফবীজ (আরবি) (لب الاثر یا رسالة فی الطلب و الارادة و الجبر و التفویض)  : এ গ্রন্থখানির ৫৭ পৃষ্ঠা পা-ুলিপি কোমের রাহে হক ফাউন্ডেশন লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে। আকায়েদ ও দর্শনশাস্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি ইমামের বক্তৃতামালায় স্থান পেয়েছে। আল্লামা জাফর সোবহানী এগুলোর সংকলন করেন। ইমাম নিজেও এ গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন।

৬২. কিতাবুল বাই (আরবি)- (کتاب البیع)  : ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর বিক্রয় সংক্রান্ত আহকামের ওপর দেয়া বিভিন্ন বক্তব্যের ওপর সুযোগ্য ওস্তাদ জনাব কাদিরীর লেখা এ বইটি সম্প্রতি ইরানের সংস্কৃতি ও ইসলামী নির্দেশনা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। তবে এর মধ্যে ইমাম নিজেও কয়েকটি অধ্যায় লিখেছেন।

৬৩-৮২. সহীফায়ে নূর (ফারসি)- (صحیفه نور) : ১৯৬২ সাল থেকে ইমামের জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি যেসব আদেশ, উপদেশ, বক্তব্য ও সাক্ষাতকার দিয়েছেন তা সংরক্ষণ করে এ নামে প্রকাশ করা হয়েছে। এ গ্রন্থটি সম্ভবত ২০ খণ্ডে সমাপ্ত যার মধ্যে এ যাবত ১৯টি খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে।

৮৩. অসিয়ত নামায়ে সিয়াসী ইলাহী (ফারসি)- (وصیت نامه سیاس الهی)  : ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর লেখা সর্বশেষ অবদান, যা তিনি তাঁর ইন্তেকালের পর সর্বসাধারণের জন্য শেষ নিদর্শন হিসাবে রেখে গেছেন। যার সম্বন্ধে মন্তব্য করতে গেলে বলতে হয়, ইরানী জাতির ইতিহাসে প্রকাশনা জগতে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকাশনা বলে একে স্বীকার করতেই হবে। কেননা, ইমামের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আসার আগেই দশ লাখ কপি প্রকাশিত হয়েছিল।

৮৪. রাহে এশক (ره عشق) : হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর একটি আধ্যাত্মিক চিঠি যা তিনি ১৪০৪ হিজরিতে লেখেন। ইমাম খোমেইনীর অবদান, রচনাবলি ও সংকলন প্রকাশনা বিভাগ থেকে প্রকাশিত।

৮৫. বাদায়ে এশক (باده عشق) : আধ্যাত্মিকতার ওপর লেখা ইমামের আর একটি চিঠি। সুরুশ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত।

এ যাবত ইমামের রচনাবলির সংখ্যা ৮৫ পর্যন্ত এখানে তুলে ধরা সম্ভব হলো। এজন্য যাঁদের কাছ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা পেয়েছি তাঁদের সবার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। যাঁদের নাম স্মরণে আছে কৃতজ্ঞতার নিদর্শন হিসাবে তুলে ধরছি। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন :

১. আলহাজ শেখ আলী আকবর মাসুদী। এক খণ্ড তাহারাত (طهارت) তাঁর সহযোগিতায় ছাপানো হয়েছে।

২. আলহাজ সাইয়্যেদ হাশেম রাসূলী মাহাল্লাতী। তিনি কিতাবে তাহারাত (طهارت) গ্রন্থটির সম্পাদনা করেন।

৩. আলহাজ শেখ মুজতাবা তেহরানী আনসারী (মাকাসেবে মুহাররামাহ ও রেসায়েলের সম্পাদনা করেন)।

৪. আলহাজ শেখ গোলাম রেযা রেযওয়ানী খোমেইনী। কিতাবে বাই তাঁর তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হয়।

৫. আলহাজ সাইয়্যেদ আহমাদ ফেহরী জানজানী। ইমামের অনেক লেখা তাঁর মাধ্যমে অনূদিত ও প্রকাশিত হয়।

৬. আলহাজ শেখ জাফর সোবহানী তাবরিযী, যিনি ইমামের মোবাহেসে উসূল (مباحث اصول)-এর বক্তব্যগুলো লিপিবদ্ধ করেন।

৭. আলহাজ শেখ হাসান কাদিরী ইসফাহানী। ইমামের বাই সংক্রান্ত বক্তব্যের (تقدیرات بیع) লেখক।

৮. আলহাজ শেখ আহমাদ মোতাহারী ছাবেজী। যিনি তাহরীরের শারহ লেখেন (شرح تحریر) ।

৯. আলহাজ শেখ মুহাম্মাদ ফাযেল কাফকাজী (শারহে তাহরীরের লেখক)।

১০. আলহাজ শেখ হাসান রাস্তকাশানী এবং জনাব কাদেরী। ইমামের ইসতিফতাআত (استفتائات) এঁদের তত্ত্বাবধানে সম্পাদন হয়।

১১. আলহাজ সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ বাকের মুসাভী হামেদানী, যিনি তাহরীরুল ওয়াসিলা (تحریر الوسیلة)-এর অনুবাদ করেন।

১২. জনাব কাজী জাহেদ এবং জনাব ইসলামী। উভয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তাহরীরুল ওয়াসিলার পুনঃঅনুবাদ হয়।

 ১৩. আলহাজ শেখ মুহাম্মাদ মুমিন কুমী, যিনি অনেক অনুবাদের সম্পাদনা করেন।

১৪. আলহাজ শেখ হাসান তাহেরী খোররমাবাদী।

১৫. আলহাজ শেখ হাসান ছাকফী, তালিকে ফুসূলের (تعلیقه فصول) অনুবাদক।

১৬. জনাব শেখ মুহাম্মাদ হাসান আহমাদী ইয়াযদী, যিনি ইমামের তায়ীনে ফাজর (تعیین فجر) এবং কিতাবে আরবাঈন (کتاب اربعین) এর প্রকাশক।

সর্বশেষ ইমাম খোমেইনীর রুহের মাগফেরাতের জন্য দোয়া করি এবং দোয়া কামনা করি।

ইমাম খোমেইনী (রহ.) ছিলেন এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব

হাশেমী রাফসানজানী

আমরা আমাদের শরীরের প্রতিটি ইঞ্চি দিয়ে ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর অভাব অনুভব করি। আমরা এক বিরাট দুঃখ ও শোকসাগরে এত গভীরভাবে নিমজ্জিত যে, কেবল আমরাই অনুধাবন করতে পারি যে, আমাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে। কিন্তু আল্লাহর অনুগত বান্দা হিসাবে আমরা সকলেই জানি যে, কোনো মানুষই চিরঞ্জীব নয়। যে দুনিয়ায় আগমন করে, একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর তাকে দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতেই হয়। আমাদের ইমামও এই চিরন্তন সত্যের ব্যতিক্রম ছিলেন না।

আপনাদের সকলেরই জানা আছে যে, ইমাম খোমেইনী (রহ.) এক পবিত্র ও মহিমান্বিত জীবন যাপন করে গেছেন। ইমাম (রহ.) তাঁর জীবনকালে এক বিস্ময়র ও অবিশ্বাস্য কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন। ইমামের এই সাফল্য দেখলে বিশ্বের রাজনৈতিক সমীক্ষকগণ তাঁদের চোখকে খুব কমই বিশ্বাস করতে পারবেন।

সৌভাগ্যের কথা যে, ইমাম তাঁর জীবনের শেষ দশ বছরে বহু বক্তৃতা করে গেছেন এবং বহু ক্ষেত্রে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে গেছেন। আমরা তাঁর বিস্ময়কর ব্যক্তিত্বের বিভিন্ন দিকের বিস্তারিত প্রামাণ্য তথ্য সংরক্ষণ করেছি। আমি জানি না, ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর মতো বিশ্বের আর কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তি এত প্রামাণ্য জিনিস রেখে গেছেন কিনা এটা বিচার করার সময় এখনও আসেনি। তবে আমি নিশ্চিত যে, ইমাম খোমেইনীর কর্মকাণ্ডের মধ্যে আমরা আলোচনা করার মতো অনেক কিছু পেতে পারি। তিনি অসাধারণ কর্ম ও কৃতিত্ব সম্পাদন করে গেছেন। একজন মুসলমান, একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং বিশ্ব রাজনীতির একজন বিশেষজ্ঞের দৃষ্টিকোণ থেকে ইমাম খোমেইনীর অবদান ও ভূমিকাকে পর্যালোচনা করে দেখা যেতে পারে। আমার দৃষ্টিতে ইমাম খোমেইনী (রহ.) ছিলেন অসম্ভবকে সম্ভব করতে সমর্থ এক বিরল ব্যক্তিত্ব।

ইমাম খোমেইনী বিপ্লবের উদ্যোগ গ্রহণের আগে কোমের ধর্মতত্ত্ব স্কুলে বিজ্ঞান, নীতিশাস্ত্র, দর্শন ও সুফিবাদের শিক্ষা সংযুক্ত করে সেখানে এক বিপ্লব সাধন করেন। শিয়া মাজহাবের ইতিহাসে এর আগে এমনটি আর কখনও করা হয়নি। ইমাম খোমেইনীর জীবনের এ একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।

ইমাম খোমেইনী বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থেকে ইসলামের নেতৃত্ব পরিচালনায় সাফল্য অর্জন করেন। ইতিহাসে এটি একটি বিস্ময়কর ঘটনা। মহানবী (সা.)-এর পর এবং ইসলামের আবির্ভাবের পর থেকে এমন আর কখনও হয়নি। সত্যিকার অর্থে ইমাম পাহলভী রাজবংশ ও তাদের রক্তপিপাসু আত্মীয়-স্বজনের অপশাসনকে ধূলিস্যাৎ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ইমামের এই অমর কীর্তি সমাজবিজ্ঞানী ও রাজনীতিবিজ্ঞানীদের জন্য এক বিরাট কর্মক্ষেত্র। বিপ্লবের দিনগুলোতে প্রায়ই বলা হতো, ‘বৃহত শক্তিগুলোকে মোকাবিলা করা অসম্ভব। আমরা যদি কোনো জায়গা থেকে শুরু করি তাহলে আমাদেরকে আবার সেই স্থানে ফিরে আসতে হবে যেখান থেকে আমরা শুরু করেছিলাম। সর্বত্রই বিশ্ব তাগুতের উপস্থিতি অনুভূত হয়।’ হ্যাঁ, ইমাম এই অলীক বিশ্বাসকে ভেঙে দিয়েছেন। জনসাধারণের ওপর ঐ মিথ্যা বিশ্বাস চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল এবং তাদের নৈতিক মনোবল ভেঙে দেয়া হয়েছিল। এর পরিণতিতে জাতির মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল হতাশা।

ইমাম খোমেইনী (রহ.) এই বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। তিনি এই প্রচারণা মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি বৃহত শক্তিগুলোকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেছিলেন। সত্যিকার অর্থেই এ ছিল এক বিরাট কাজ। ইমাম খোমেইনী যদি বৃহত শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে এই জিহাদ শুরু না করতেন তাহলে এই বিশ্বাস সেই উচ্চ অবস্থানেই বিরাজ করত। সত্যি বলতে কি ইমাম খোমেইনী ফিকাহ বা ইসলামী আইশাস্ত্রের ব্যাপারে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির যে দ্বার উন্মোচন করেছিলেন, জাতির মুদিত চক্ষুগুলোকে যেভাবে উন্মীলিত করে দিয়েছেন; মলিনতা মুছে দিয়ে ইসলামের মুখমণ্ডল যেভাবে উজ্জ্বল করে দিয়েছেন, তরুণ ধর্মবেত্তাদের সামনে জ্ঞান-গবেষণার যে পথ বাতলে দিয়েছেন এবং ইসলামী ফিকাহবিদদের সামনে ইজতিহাদের যে নতুন পদ্ধতি উপস্থাপন করেছেন তা সবই এক অতি মূল্যবান মর্যাদা ও কৃতিত্বপূর্ণ কাজ। ইসলামের ওপর গভীরতর অধ্যয়ন গবেষণা এভাবেই সম্ভব।

এটি একটি আশ্চর্যজনক ঘটনা ছিল যে, ইমাম খোমেইনী (রহ.) এককভাবে সকল বিদেশী চক্রান্ত আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিলেন, সেগুলো ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন এবং একটি বিজয় অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এসব এক অনন্য কাহিনী। সাম্প্রতিককালের কোনো বিপ্লবের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, একটি সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর সে বিপ্লব দুর্বল হয়ে পড়েছে। কিন্তু ইরানে ইসলামী বিপ্লবের ক্ষেত্রে এরূপ কল্পনা করা যায় না।

‘প্রাচ্য নয়, পাশ্চাত্য নয়, ইসলামী প্রজাতন্ত্র’ এই নীতি প্রবর্তন করে ইমাম খোমেইনী রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বিশ্বাস করতেন যে, কোনো বিপ্লবকে যদি টিকে থাকতে হয় তাহলে তার সূত্র ও মূল প্রাচ্য বা পাশ্চাত্যের সাথে যুক্ত থাকতে হবে। ইমাম এই ধারণাকে নাকচ করে দিয়েছেন।

আমি ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর চিন্তাধারার সাথে পরিচিতদের একজন। আমি তাঁর আত্মবিশ্বাস ও নৈতিক শক্তি সম্পর্কে জানি। আমি তাঁকে গভীরভাবে দেখেছি। রাজনীতি, ফিকাহশাস্ত্র, বিজ্ঞান ও নৈতিকতা ইত্যাদি সকল বিষয়েই তাঁর সাথে আমার সম্পর্ক ও যোগাযোগ ছিল। তাঁর জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আমাকে মুগ্ধ করে।

ইমাম খোমেইনী (রহ.) ফিকাহশাস্ত্রের একজন বিশেষজ্ঞ ছিলেন। যারা ধর্মীয় রীতি পদ্ধতি সম্পর্কে অধ্যয়ন করতে চায় তাদের ফিকাহশাস্ত্রের সাথে পরিচিতি প্রয়োজন। ফিকাহশাস্ত্রে ইমাম খোমেইনীর এই বিশেষ যোগ্যতা সকলেই স্বীকার করে থাকেন। সাম্প্রতিককালে এমন কোনো ফিকাহবিদ, পণ্ডিত ও আলেম খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি এই মত প্রকাশ করবেন যে, ইমাম অল্প জানতেন। তাঁরা তাঁকে অত্যন্ত মর্যাদাবান ও খ্যাতিমান আলেম বলে বিবেচনা করে থাকেন।

ইমাম খোমেইনী (রহ.) জ্ঞানের যে শাখায় বিশেষজ্ঞ ছিলেন তা হলো দর্শন। কিন্তু তিনি কখনই এমনটি প্রকাশ করেননি যে, তিনি দর্শনের কোনো বিশেষজ্ঞ ছিলেন।

ইমামের আরেকটি বিশেষত্ব ও বৈশিষ্ট্য হলো সুফিবাদ। এক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অনন্য। সুফিবাদ মানবীয় বুদ্ধিমত্তার এমন একটি শাখা যা সাধারণ মানুষের জন্য বোধগম্য নয়। এটি অর্জন করতে হয় কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে। ইমাম খোমেইনী অত্যন্ত খ্যাতনামা একজন পণ্ডিতের কাছ থেকে সুফিতত্ত্বের দীক্ষা নিয়েছিলেন। কিন্তু ইমাম তাঁর ওস্তাদকেও অতিক্রম করে গেছেন। সুফিতত্ত্বের ক্ষেত্রে ইমামের কর্মের ভিত্তিতেই এই দাবি করা যায়।

ফিকাহশাস্ত্র, দর্শনশাস্ত্র ও সুফিতত্ত্বের জ্ঞানে ইমাম ছিলেন অনন্যসাধারণ। এসব ক্ষেত্রে ইমামের অভ্যন্তরীণ যোগ্যতা ছিল অন্য সকলের ওপর।

১৯৬২ সালে ইমামকে গৃহে আটক থাকতে বাধ্য করা হয়। এ ধরনের নিঃসঙ্গ জীবন ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর মতো ব্যক্তিদের আত্মগঠন ও উন্নয়নের উৎস হিসাবে কাজ করে। ঐ সময়টাকে তিনি নীতিশাস্ত্রের ওপর অধ্যয়নে কাজে লাগান। তিনি নীতিশাস্ত্রের ওপরও বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন। কিছুকালের জন্য তিনি এর ওপর শিক্ষকতাও করেন। যাঁরা ইমামের নীতিশাস্ত্রের ক্লাস থেকে পাঠ গ্রহণ করেছিলেন তাঁরা আজও তা থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে চলেছেন।

সুফিতত্ত্বের প্রভাব বিভিন্ন পণ্ডিতের ওপর বিভিন্ন ধরনের। কেউ কেউ মানবজীবন ও পার্থিবজগত থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে সুফিতত্ত্বের অধ্যয়ন করেছেন। তাঁরা খোদার প্রতি এত বেশি লীন হয়ে যান যে, তাঁদের চারিদিকে কী ঘটছে, সে সম্পর্কে তাঁরা অনবহিত থাকেন। মহানবী (সা.) কখনও এমন করতেন না। আমাদের মহান সুফিরাও এমন করতেন না। তাঁরা জনগণের সাথেই বসবাস করতেন, তাদের কল্যাণে সংগ্রাম করতেন এবং তাদের সংহতি রক্ষায় সচেষ্ট থাকতেন। ইমাম খোমেইনী (রহ.) এমনই একজন ছিলেন। এক্ষেত্রে তাঁর দর্শনই তাঁকে সাহায্য করেছে। দর্শন একজন ব্যক্তির সামনে পৃথিবীর একটি প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে। দর্শনের জ্ঞানে সমৃদ্ধ একজন মানুষ আল্লাহকে, তাঁর সৃষ্টিকে এবং সৃষ্টি ও খোদার সম্পর্ক সম্বন্ধে জানতে পারে এবং মানুষ, মানুষের জীবনধারা, তার পরিশুদ্ধতার পথ ও তার সমাজ সম্পর্কে উপলব্ধি করতে পারে।

ইমাম খোমেইনী (রহ.) খোদা ও বিশ্বজনীনতার মধ্যে বিলীন হয়েছিলেন আবার তাঁর জনগণকেও মনে রেখেছেন, ভুলে যাননি। তিনি জানতেন তাঁর কাজ কী।

ইমাম খোমেইনী সম্পর্কে আমি যা উল্লেখ করেছি তা তাঁর প্রতি আমার মনোভাবপ্রসূত। আমি দীর্ঘ পনের বছর  তাঁর কাছে সরাসরি শিক্ষালাভ করেছি। অতীতের শাসকচক্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামকালে আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি যে, ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর কাছ থেকে আমি কী শিখেছি। অনুশীলন তাঁর শিক্ষার সত্যতা আমার কাছে আরো বেশি করে ফুটিয়ে তুলেছে। আল্লাহ তায়ালা যেন মানুষকে দিক নির্দেশনার জন্য এই আলোকবর্তিকা দান করেছিলেন। গোটা বিশ্ব যেন আজ একটি গৃহে রূপ নিয়েছে, আর আল্লাহ তায়ালা যেন পৃথিবীসদৃশ সেই গৃহের সকল মানুষের জন্য সূর্য হিসাবে ইমাম খোমেইনীকে নিযুক্ত করেছিলেন।

এ ধরনের এক একটি সূর্য যেমন সমসাময়িককালের এক একটি সময়ে আবির্ভূত হয়, তেমনি ইমাম খোমেইনীও তাঁর কর্ম সম্পাদন করে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি তাঁর দায়িত্ব যথাসম্ভব পালন করে গেছেন। জীবনে শেষ দিনগুলোতে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, বিপ্লবের পথে কিছু বিপত্তি দেখা দিতে পারে। তাই তিনি সেসব সমস্যা মিটিয়ে দিয়ে গেছেন। তিনি আমাদেরকে সঠিক পথ দেখিয়ে গেছেন। আমরা এখন যে মশাল বয়ে নিয়ে চলেছি তার উৎস রয়েছে পবিত্র কুরআনে, মহানবী (সা.)-এর হাদীসে এবং ইসলামের শিক্ষায়।

[নিবন্ধটি ১৯৮৯ সালের জুলাই মাসে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের মহিলা সমিতি আয়োজিত ‘ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর ব্যক্তিত্বের বিভিন্ন দিক’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে ততকালীন প্রেসিডেন্ট আকবর হাশেমী রাফসানজানী প্রদত্ত ভাষণ থেকে সংকলিত]

ইসলামের পুনরুজ্জীবনে ইমাম খোমেইনী (রহ.)

সাইয়্যেদ কাজেম নূর মুফিদী

পূর্বাভাস

ইমাম খোমেইনীর ন্যায় বিরল ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে কথা বলা মোটেও সহজ ব্যাপার নয়। ইমাম খোমেইনী ছিলেন বহুমুখী ব্যক্তিত্বের অধিকারী এক কালজয়ী পুরুষ। তাঁর ব্যক্তিত্বের সঠিক মূল্যায়ন কেবল বড় বড় চিন্তাবিদ ও মনীষীদের দ্বারা সম্ভব। তাঁরাই নিজেদের শক্তি ও সামর্থ্যরে আওতায় বিভিন্ন আঙ্গিকে ইমামকে নিয়ে পর্যালোচনা করতে পারেন। এক্ষেত্রে আমার মতে ইমাম খোমেইনী (রহ.) সম্পর্কে যে বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব পাওয়ার দাবিদার তা তাঁর জ্ঞানগত আধ্যাত্মিক ও নৈতিক মর্যাদা নয়। (অবশ্য এসব দিক নিয়েও গবেষণা-পর্যালোচনা প্রয়োজন) কেননা, ইসলামের দীর্ঘ ইতিহাসে, শিয়াদের জ্ঞানী ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বদের তালিকায় এ ধরনের অনেক মহান ব্যক্তিত্বের সাক্ষাত আমরা পাই, যাঁরা তাঁদের যোগ্যতা অনুসারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ খেদমত আঞ্জাম দিয়ে গেছেন। এক্ষেত্রে ইমাম খোমেইনীকে যে বৈশিষ্ট্যটি সবার ওপরে বিশ্বজনীন মর্যাদায় উন্নীত করেছে তা হলো ইসলামী বিপ্লব যা এ শতাব্দীর বিস্ময়। তিনি এ বিপ্লবকে সমকালীন ইতিহাসের গতিধারায় এক পূর্ণাঙ্গ সংযোজন হিসাবে বিশ্ববাসীর সামনে পেশ করেছেন। এ দৃষ্টিকোণ থেকেই আমি নিজের সীমিত সাধ্য ও সামর্থ্য অনুসারে ইমাম সম্বন্ধে কিছু কথা তুলে ধরছি। আশা করি জ্ঞানী-মনীষী ও গবেষকগণ এক্ষেত্রে তাঁদের মূল্যবান অবদান রাখবেন।

আম্বিয়ায়ে কেরামের বংশধারার মহান পুরুষ ইমাম খোমেইনী

দীর্ঘ ইতিহাসে বহু আম্বিয়া, সংস্কারক ও খোদায়ী মহাপুরুষের আগমন হয়েছে। যাঁরা নিজ নিজ গ-িতে মানুষের উন্নতি ও পূর্ণতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তবে তাদের মধ্যে এমন অনেকের সাক্ষাত পাবেন যাঁরা বিশেষ ধরনের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য ও ব্যক্তিত্বের অধিকারী হওয়ার কারণে আল্লাহর খাস দয়ায় মানব জীবনে মৌলিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছেন এবং খোদায়ী মানবীয় মূল্যবোধের ভিত্তিতে সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছেন। যার নিরিখে তাঁরা নতুন ইতিহাস ও নতুন সমাজব্যবস্থার জন্ম দিয়েছেন। যেমন হযরত নূহ (আ.), ইবরাহীম (আ.), মূসা (আ.), ঈসা  (আ.) ও হযরত মুহাম্মাদ মুস্তাফা (সা.)। এক্ষেত্রে প্রিয় ইমাম খোমেইনী নিশ্চয় তাঁদের ন্যায় বা তাঁদের সমমানের কোনো ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। তবে বলা যায় যে, তিনি তাঁদের আদলের ও নমুনার একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন।

ইসলামী আন্দোলনের সূচনা, বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম, বিপ্লবের বহু ভয়ানক ঘটনাপ্রবাহ পার হয়ে আসা এবং শেষ পর্যন্ত খোদায়ী আইন-কানুনকে সফলতার স্বর্ণদ্বারে পৌঁছানো আর বিভিন্ন চড়াই-উতরাই পার হওয়ার ক্ষেত্রে সমুন্নত পথযাত্রা সবগুলোর দিকে তাকালে ইমাম খোমেইনীর মাঝে উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যটিই আমরা বিশেষভাবে লক্ষ্য করি। এ ব্যাপারে কারো সন্দেহ নেই যে, এ ধরনের মৌলিক পরিবর্তন সাধন যে কোনো লোকের পক্ষে সম্ভব নয়। বরং এমন লোকের দ্বারাই তা সম্ভব যার মধ্যে বিশেষ ধরনের নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও চারিত্রিক গুণগরিমা বিদ্যমান। ইমাম খোমেইনীর মধ্যে যেসব গুণ ছিল তার মধ্য থেকে কয়েকটি হলো :

১. আল্লাহর সার্বভৌমত্বের প্রতি এবং তা বাস্তবায়নের ব্যাপারে গভীর ও অটল ঈমান আর সুদৃঢ় প্রত্যয়।

২. ধৈর্য, উচ্চতর মনোবল, অবিচলতা এবং ক্লান্তিহীনতা।

৩. আল্লাহর সার্বভৌমত্বের পবিত্র লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার কর্মসূচি প্রণয়নে বিশেষ বিচক্ষণতা।

বিপ্লব শুরু হওয়ার পূর্বে বা বিপ্লব চলাকালে কিংবা বিপ্লব সফল হওয়ার পরবর্তী সময়ে ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর বরকতময় জীবন পর্যালোচনা করলে পরিষ্কার প্রতীয়মান হয় যে, উল্লিখিত তিনটি বৈশিষ্ট্য নবী-রাসূলগণের জীবনে চূড়ান্ত পর্যায়ে বিদ্যমান ছিল আর ইমাম খোমেইনীর জীবনে তার আলোকচ্ছটা পরিস্ফুট ছিল যার কারণে তিনি শতাব্দীর এ বিস্ময়ের জন্ম দিতে পেরেছেন।

খাঁটি মুহাম্মাদী ইসলামের প্রচারক ও ব্যাখ্যাতা

হযরত ইমাম খোমেইনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো যে, তিনি খাঁটি মুহাম্মাদী ইসলাম ও আমেরিকান ইসলামের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করেছেন।

একমাত্র ইমাম খোমেইনীই পরিষ্কার ধারণা দিয়েছেন যে, ইসলামী সমাজ তথা মুসলমানদের মধ্যে বর্তমানে ইসলামকে নিয়ে দু’ধরনের মূল্যায়ন রয়েছে। একটি হলো খাঁটি ও নির্ভেজাল ইসলাম। অপরটি ভেজাল ও জগাখিচুরিপূর্ণ ইসলাম। একটি দুশমনদের চোখের কাঁটাস্বরূপ এবং অপরটি তাদের পছন্দসই। বিষয়টি আরো খোলাসা করার জন্য ঐতিহাসিক মূল্যায়ন প্রয়োজন- যার অবকাশ এ নিবন্ধে নেই। তবে অতি সংক্ষেপে বলা যায় যে, ইসলামের প্রথম যুগ থেকে ইতিহাসের বিভিন্ন গতিধারায় এমন কিছু অবাঞ্ছিত ও ছদ্মবেশী লোকের আবির্ভাব হয়, যারা জাহেলিয়াতের চিন্তা-চেতনা এবং নিজেদের অন্যায় কামনা-বাসনামাফিক চিন্তা ও বিশ্বাস দিয়ে ইসলামের চেহারাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে; তারা ঐগুলোকেই জনগণের মাঝে ইসলামের নামে চালিয়ে দিয়েছে।

এসব চিন্তাধারা যুগের গতিধারায় ক্রমান্বয়ে সকল ইসলামী সমাজে অনুপ্রবেশ করে ইসলাম নামেই চালু হয়েছে। পবিত্র ইমামগণ তাঁদের জীবদ্দশায় যেসব প্রচেষ্টা চালিয়েছেন তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল এসব চিন্তাধারা দূর করা। ইমামগণের জীবনধারাই এর বড় সাক্ষ্য। অতি দুঃখের সাথে স্বীকার করতে হবে যে, সময়ের দীর্ঘ পরিক্রমায় এই বিভ্রান্ত চিন্তাধারা শিয়াদের চিন্তাধারার পরিম-লেও প্রবেশ করেছে। শিয়া চিন্তাধারা এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে এবং সন্দেহাতীত ও গ্রহণযোগ্য বিষয় হিসাবে এগুলো চালু হয়ে গেছে। ইমাম খোমেইনী ঐ বিষয়টি (খাঁটি মুহাম্মাদী ইসলামের কথা) উত্থাপন করে ইতিহাসের রহস্যের এ পর্দাটি উন্মোচন করে দিয়েছেন এবং নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের জন্য দুর্লভ একটি বিষয় হাতের কাছে এনে দিয়ে ইসলামী চিন্তাবিদ ও মনীষীদের জন্য এক কষ্টসাধ্য পথ উন্মুক্ত করেছেন যাতে ইসলামী সমাজ ও ফিকাহর ইতিহাসে ব্যাপক গবেষণার সাহায্যে ধারণা ও অনুমানের পর্দার আড়াল থেকে খাঁটি ইসলামকে উদ্ধার ও দুনিয়ার সামনে তুলে ধরতে পারেন। যদি এ কাজটি সম্পন্ন হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই ইসলামের আকর্ষণ হবে বিশ্বজনীন। ইমাম নিজেই ছিলেন এই খাঁটি ইসলামের প্রচারক ও ব্যাখ্যাতা। তিনি বিভিন্ন ইসলামী বিষয়ের বর্ণনা দানের বেলায় উভয় ইসলামের মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরেছেন। যেমন রাজনীতি হতে ধর্মের অবিচ্ছিন্নতা, ইসলাম শাসনকার্যের ধর্ম, ধনী ও গরীবের সংঘাত প্রভৃতি যেসব বিষয় ইমাম খোমেইনীর ভাষণ ও বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে তা এর মধ্যে শামিল।

ইমাম ও রাষ্ট্রীয় ফিকাহ

আমাদের বিশ্বাসমতে, ফিকাহ হলো জীবনধারণের আইন। যে কোনো যুগেই পরিবেশ ও পরিস্থিতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ আইন-কানুনের মাধ্যমে সমাজ পরিচালিত হওয়ার গুরুত্ব কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। তবে দুঃখজনকভাবে আমাদের ফকীহগণ যেহেতু রাষ্ট্রীয় প্রশাসন থেকে দূরে ছিলেন এবং মালিক শাসকদের কারণে প্রত্যাখ্যাত ও একঘরে হয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন সেহেতু তাঁরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ও ইবাদত-বন্দেগি সম্পর্কিত মাসআলা-মাসায়েল উদ্ঘাটন ও চর্চাতেই ব্যস্ত ছিলেন। সামাজিক বিষয়াদিতে যদি ইজতিহাদ করেও থাকেন তাও ব্যক্তিগত দায়িত্ব হিসাবে করেছেন। রাষ্ট্রীয় আইনচর্চা হিসাবে নয়। যার কারণে আজ ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনায় আমরা বহু কমতি এবং আইনগত শূন্যতার সম্মুখীন। কাজেই আজ দীনি মাদরাসাসমূহের কর্তব্য হলো রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ফিকাহর মাসআলা-মাসায়েলের চর্চা করা এবং সমাজ পরিচালনার নিমিত্তে ইসলামী ফিকাহর ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় সমস্যাবলির সমাধান পেশ করা। ইমাম খোমেইনীর অন্যতম বৈশিষ্ট্যও এটাই। তিনি প্রথমে রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ফিকাহর সামাজিক মাসায়েল ও প্রয়োগ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেন। তিনি এই গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক বিষয়টি উত্থাপন ও এ চিন্তাধারার চর্চা ও প্রসার ঘটান। সম্ভবত ইমাম খোমেইনী বহুবার দীনি মাদরাসাগুলোর কাছে এ অনুযোগ করেছেন এবং স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, বর্তমানে দীনি মাদরাসাগুলোর প্রচলিত ফিকাহশাস্ত্র ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যথেষ্ট নয়। বরং সামাজিক প্রয়োজনের দাবি হলো নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে ফিকাহশাস্ত্রের চর্চা।

তবে একদল লোক, সানাতন ফিকাহর পক্ষপাতি। কতিপয় লোক ফিকাহশাস্ত্রের নতুনত্বের জন্য আগ্রহী। কিন্তু ইমাম যে ফিকাহতে আগ্রহী তা যেমন সনাতন, তেমনি পরিপূরক আধুনিকও। এ কথার অর্থ এই যে, একজন ফকীহর উচিত ইজতিহাদের ক্ষেত্রে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী কাজ করা এবং ফকীহদের কাঠামোর মধ্যে বিচরণ করা। এই নিয়ম-কানুনের বাইরে তিনি যেতে পারেন না। এ অর্থে আমাদের ফিকাহশাস্ত্র সনাতন ধারার। তবে এর অর্থ এ নয় যে, বর্তমানকালের ফকীহগণ বিভিন্ন বিষয় ও মাসআলাকে পূর্ববর্তী ফকীহগণের দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করবেন। বর্তমানে অনেক বিষয়ের ধরন পালটে গেছে। উদাহরণস্বরূপ কাফেরদের সাথে লেনদেনের ব্যাপারটি অতীতে একটি সীমাবদ্ধ গণ্ডিতে ছিল। কেবল দু’জন ব্যক্তির মধ্যকার সম্পর্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। আমাদের ফকীহরাও কিছু কিছু দলিলের ভিত্তিতে সেই সম্পর্ককে বৈধ বলে মনে করতেন। কিন্তু আজ বিষয়টিকে অত সহজভাবে দেখা যাবে না। আজকের দিনে বিশ্বের বুকে বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং বিশ্ব শয়তানি চক্রের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ ও নীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হওয়ায় ধরন পালটে গেছে। কাজেই ফতোয়া দেওয়ার সময় ফকীহকে এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া চিন্তা-ভাবনা করে দেখতে হবে। দেখতে হবে যে, এই সম্পর্ক ও লেনদেনের কারণে বিজাতীয় আধিপত্য চেপে বসছে কিনা? ইমাম খোমেইনী (রহ.) যে ইজতিহাদের ক্ষেত্রে স্থান ও কালের অংশীদারিত্বের কথা উল্লেখ করেছেন এর অন্যতম অর্থও তাই। অর্থাত একটি বিষয় দুই সময়ে ভিন্ন ভিন্ন হুকুম ও সিদ্ধান্ত বহন করে। ইমাম বলেছেন যে, ফকীহকে যে কোনো স্থান ও কালের বাস্তবতাগুলোকে সামনে রেখে ইজতিহাদ করতে হবে যাতে সমসাময়িক সামাজিক সমস্যা ও সংকটগুলোর সমাধান দেয়া সম্ভব হয়। যদি ফকীহ বিদ্যমান বাস্তবতার বাইরে গিয়ে ফতোয়া দেন তাহলে নির্ঘাত ফিকাহ ও মাসআলা জীবনবিচ্ছিন্ন ও একঘরে হয়ে যাবে। তাতে এমন অবস্থার সৃষ্টি হবে যা দুশমনদের একান্ত কাম্য। অর্থাত তারা বলবে যে, আজকের দিনে ফিকাহ সমাজের চাহিদা পূরণে সক্ষম নয়। তবে আমাদের এ বক্তব্যের উদ্দেশ্য, আল্লাহর কোনো হুকুমে পরিবর্তন সাধন নয়। অথবা যুগের তালে তালে কথা বলার জন্যও বলা হচ্ছে না। আসল কথা হলো, আল্লাহর হুকুমে কোনো পরিবর্তন নেই। রদবদলের প্রয়োজনও নেই। বিষয়টি নিয়ে যে কোনো সন্দেহ-সংশয় এড়ানোর জন্য আমি এখানে একটি উদাহরণের শরণাপন্ন হচ্ছি।

ধরে নিন, দু’জন ইঞ্জিনিয়ার জ্ঞান, তথ্য ও অভিজ্ঞতায় একই স্তরের। তাঁদেরকে এলোমেলো আয়তনের একটি জমির ওপর কয়েকটি ভবন নির্মাণের প্লান করার দায়িত্ব দেয়া হলো। তখন একজন ইঞ্জিনিয়ার সরেজমিনে এসে দেখে গেলেন। অপর ইঞ্জিনিয়ার সরেজমিনে আসলেন না; বরং নিজের অনুমান বা আপনার দেয়া ধারণার ভিত্তিতে একটি প্লান তৈরি করলেন। এখন চিন্তা করে বলুন, কার প্লানটি বাস্তবসম্মত হয়েছে। আর কোনটি বাতিল হয়ে যাবে।

বিষয়টি অতি পরিষ্কার। উভয় ইঞ্জিনিয়ার প্লান তৈরির নিয়ম ও মূলনীতি অনুসরণ করেছেন। অথচ কার্যক্ষেত্রে একজন বাস্তবের সাথে পরিচিত হওয়ার কারণে সফলকাম হয়েছেন আর একজন বাস্তবতা থেকে দূরে থাকার কারণে অকৃতকার্য হয়েছেন। বস্তুত ইজতিহাদের ক্ষেত্রে সময় ও স্থানের অংশীদারিত্বকে এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা হয়।

মোটকথা, ফকীহ যদি বছরের পর বছর মাদরাসার চার দেয়ালে বসে কাটান এবং চলমান যুগের সাথে পরিচিত না হন তাহলে তাঁর ইজতিহাদ হবে নীরস এবং স্থান ও কালের প্রয়োজন ও চাহিদা থেকে বিচ্ছিন্ন। সমাজ ও রাষ্ট্রের সাথে জড়িত মাসআলাগুলোর ব্যাপারে তাঁর সিদ্ধান্ত ও ফতোয়াগুলো সেই ইঞ্জিনিয়ারের প্লানের মতো, যিনি সরেজমিনে না দেখে কোনো জায়গার জন্য মাস্টার প্লান তৈরি করেন। এটা কিছুতেই কার্যকর হবে না, হতে পারে না। আমার দৃষ্টিতে এ বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ এবং এর মধ্যেই ইমাম খোমেইনীর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিহিত। আমরা খুব কম ফকীহর কথাই জানি যাঁরা এ ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি যথাযথ মনোযোগ দিয়েছেন। আশা করি ইমামের শিষ্যদের মধ্য থেকে সম্মানিত ফকীহগণ এ বিষয়টির প্রতি যথাযথ গুরুত্বারোপ করবেন।

ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনে ইমাম খোমেইনী

পূর্ববর্তী আসমানী ধর্মগুলো নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করলে আমাদের সামনে একটি সত্য প্রকাশ হয়ে পড়ে, তা হলো ধর্মের অবস্থান ছিল সমাজ ও জীবনের এক প্রান্তে। সমাজের মধ্যখানে নয়। ধর্মের একমাত্র কর্তব্য ছিল ব্যক্তি ও খোদার মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণ করা। মানব জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে এর কোনো ভূমিকা ছিল না। এ বাস্তবতাটি খ্রিস্টধর্মে খুব পরিষ্কারভাবে বিদ্যমান ছিল এবং ইসলামের মধ্যে তা ছিল খুব সূক্ষ্মভাবে। অবশ্য খ্রিস্টধর্ম ও অন্যান্য ধর্মে এবং ইসলামে এ অবস্থা সৃষ্টির পেছনে বিভিন্ন কারণ বিদ্যমান ছিল। আমরা এখন তা নিয়ে আলোচনা করব না। তবে এক্ষেত্রে ইমাম খোমেইনী (রহ.) যে বিস্ময়টি সৃষ্টি করেন তা হলো জীবনের প্রান্তসীমা থেকে তিনি ধর্মকে জীবনের ঠিক মাঝখানে নিয়ে আসেন। এমনকি তিনি পৃথিবীর একটি দেশে এ ধর্মকে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পরিণত করেন। এর ফলে প্রকৃতপ্রস্তাবে মানুষের মনে সকল আসমানী ধর্মের প্রতি একটি শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি হয়। খুব সংক্ষেপে এখানে তার একটি দৃষ্টান্তই উল্লেখ করছি।

ইমামের বরকতময় অবস্থায় ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিনিধি দলে শামিল হয়ে একবার জার্মানিতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক হজ সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছিলাম। এ সেমিনারে সারা বিশ্ব থেকে বিভিন্ন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ও মনীষীরা উপস্থিত ছিলেন। তন্মধ্যে একজন ছিলেন অস্ট্রিয়ার নও মুসলিম প্রফেসর। আমি তাঁর কাছে মুসলমান হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘আমি প্রথমে খ্রিস্টান ছিলাম, কিন্তু যখন দেখলাম যে, খ্রিস্টানদের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মীয় নেতা অর্থাত পোপ বিশ্বের যালিম অত্যাচারীদের হাতে হাত মিলিয়েছেন এবং কথায় ও কাজে তাদের যুলুম ও অন্যায়ের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছেন তখন সবকিছুকে আমি ধর্মের ঘাড়ে নিয়ে ফেলতাম। ফলে ধর্মের নামগন্ধওয়ালা যে কোনো কিছুর প্রতি আমি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। এভাবে ধর্মের প্রতি অবিশ্বাসী হয়ে কিছুকাল বস্তুবাদী চিন্তাধারার সিদ্ধান্তহীন জীবনযাপন করেছিলাম। এহেন পরিস্থিতিতেই একজন ধর্মীয় নেতা হিসাবে ইমাম খোমেইনীর আহ্বান কানে এসে বাজে। তিনি খ্রিস্টধর্মীয় নেতাদের ঠিক বিপরীত অবস্থান থেকে কথা বললেন। ফলে আমি আমার চিন্তা ও বিশ্বাসকে নতুনভাবে মূল্যায়ন করতে লাগলাম। নিজে নিজে বললাম, খ্রিস্টধর্মের অনুসারী প্রথম ব্যক্তিটি যেখানে বিশ্বলুটেরা ও যালেমদের সমর্থনকারী সেখানে ইসলামের হয়ে কথা বলার এ ব্যক্তি বিশ্বব্যাপী লুটেরা সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদের আওয়ায তুলেছেন।’

‘এ কারণে আমি নতুনভাবে ইসলাম নিয়ে অধ্যয়ন শুরু করি। এতে কোনো কোনো বই আমাকে ইসলামের দিকে নিয়ে আসার উসিলা ও সেতুর ভূমিকা পালন করে। তবে যে বইগুলো আমার হৃদয়ে নূরের বাতি প্রজ্বলিত করে তা ছিল আয়াতুল্লাহ শহীদ মোতাহহারীর গ্রন্থাবলি। মোটকথা, আমার মুসলমান হওয়ার পেছনে কারণ ছিলেন ইমাম খোমেইনী।’

ইমাম খোমেইনীর বরকতময় জীবনে এ ধরনের অহরহ ঘটনা খুঁজে পাওয়া বিচিত্র নয়। আমি আশা করি, এক্ষেত্রে উত্তরোত্তর গবেষণা ও পর্যালোচনার পরিধি বিস্তৃত হবে এবং বিশ্বের মযলুম মানুষের জন্য হেদায়াতের এই উৎসের ঝরনাধারায় যেন তাঁরা অবগাহন করতে পারেন। ইমামের রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার তথা ইসলামী বিপ্লব ইনশাআল্লাহ হযরত আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীর সুযোগ্য নেতৃত্বে তার দুর্বার যাত্রা অব্যাহত রাখবে এবং ইমাম মাহদী (আ.)-এর বিপ্লবের সাথে এ বিপ্লব একদিন যুক্ত হবে।

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে নারীর ভূমিকা

ইসলামী সরকারের একটি প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল ব্যক্তিকে জীবনের সকল ক্ষেত্রে তার দক্ষতাপূর্ণ মাত্রায় পৌঁছে দেয়া এবং এসব লক্ষ্য যাতে অর্জিত হতে পারে সে জন্য ইসলামী সরকার প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে একটি চালিকাশক্তি হিসাবে কাজ করে। চূড়ান্ত পর্যায়ে মানুষ ব্যাপকতর মানবীয় অন্তর্দৃষ্টি অর্জনে সক্ষম হয় এবং এই অন্তর্দষ্টি মানুষকে খোদার মহত্ত্বের স্বীকৃতি ও প্রশংসার দিকে নিয়ে যায়। এই পর্যায়ে সমাজ জীবনে সুখ ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত হয়।

ইসলামে মানবীয় মূল্যবোধের ভিত্তি সম্পদ, মর্যাদা-অবস্থান বা নারী-পুরুষ ভেদে নয়। এর ভিত্তি হলো চরিত্র ও সৎকর্ম।

43b5f2e8100f59facbfede10faba888bপবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে : ‘তুমি একনিষ্ঠ হয়ে নিজকে দীনে প্রতিষ্ঠিত কর। আল্লাহর প্রকৃতির অনুসরণ কর, যে প্রকৃতি অনুযায়ী তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন; আল্লাহর  সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই। এটাই সরল দীন; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না।’ (সূরা রূম : ৩০)

ইসলামে জীবনের অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষকে সমানভাবে দেখা হলেও মহিলাদের জীবনকে অগ্রাধিকার দিয়ে কতিপয় প্রতিশ্রুতি দান করা হয়েছে- যার মধ্য দিয়ে নারীর গুরুত্ব ও বিশেষত্ব ফুটে উঠেছে।

এখানে ঐ জাতীয় প্রতিশ্রুতির সারমর্ম তুলে ধরা হলো :

নারীকে মানবীয় প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের দোলনা বলে বিবেচনা করা হয়।

1(110)(1)প্রত্যেক নারীর সহজাত প্রকৃতিতে সেবা ও দয়ার নিরঙ্কুশ উৎস বিদ্যমান। যা তার অন্যান্য সামাজিক কর্তব্য ও দায়িত্বকে ছাপিয়ে যায় এবং তা সামাজিক জীবন ও মূল্যবোধের সূত্রকে পুরোপুরি নিশ্চিত করে।

মাতৃতান্ত্রিক দায়িত্ব পালন করার জন্য তাকে সেবিকার ভূমিকা আত্মস্থ করতে বয়ঃপ্রাপ্তির পূর্ব থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হয়।

মহিলাদের জন্য হিজাবের বিধান করা হয়েছে, যাতে সমাজের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসাবে চিন্তা করতে তাকে ইন্দ্রিয়গত কোন সমস্যায় পড়তে না হয়। কেননা, তাদের অস্তিত্ব কেবল যৌন উদ্দেশ্যে নিবেদিত নয়।

ইসলাম মহিলাদেরকে ঘরের মধ্যে গণ্ডিবদ্ধ করে রাখার পক্ষে উকালতি করে না বা তাদেরকে বাণিজ্যিক যৌন পণ্য হওয়ার অনুমতি দেয় না। ইসলাম মহিলাদের আত্ম-উপলব্ধি ও আত্ম-মর্যাদাবোধ এবং তাদের পূর্ণ মানবীয় যোগ্যতা অর্জনে সহায়ক পরিবেশ সমর্থন করে।

73c409bc44cdbd031bb8928a2d554326দুঃখের বিষয় যে, সৃষ্টিধর্মী পরিকল্পনায় মহিলাদের অবস্থান এখনও পুরোপুরি উপলব্ধি হচ্ছে না। মহিলাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যার অভাবে বিশেষত পশ্চিমা জগতে নারী-পুরুষের মধ্যে স্বাভাবিক প্রতিযোগিতা প্রায়শই সংঘাতে রূপ নিচ্ছে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে সমতার ভিত্তিতে অভিন্ন দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ধারণের অর্থ যৌন ক্ষেত্রে তাদের সমতা প্রকাশ করে না।

ইসলাম নারীদেরকে পরিবারের অভিভাবক এবং স্নেহ-মমতা ও উচ্চতর মূল্যবোধের উৎস বিবেচনা করে তাদের অবস্থান ও মর্যাদাকে সমুন্নত করেছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ইতিহাসে নারীর তুলনামূলক অনুপস্থিতি এবং পুরুষ শাসনে তাদের গৃহবন্দিত্ব নারীর স্বাভাবিক প্রতিভার অপচয় করেছে এবং কেবল সাম্প্রতিককালে পাশ্চাত্যে তারা যখন মুক্ত হলো, তখন আমরা পুনরায় তাদেরকে দেখতে পাই ভোগবাদের বিকাশবাহন হতে এবং পূর্ব নির্ধারিত উদ্দেশ্য মোতাবেক কাজ করার জন্য যৌনতার মাধ্যমে দর্শকদের মনোরঞ্জন করতে। কিন্তু এগুলোই কি তার প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য?

সকল খোদায়ী ধর্মেই মহিলাদেরকে বিশিষ্ট নবীদের পাশাপাশিই দেখতে পাওয়া যায়। যেমন : ফিরআউনের স্ত্রী আসিয়া, হযরত ঈসা (আ.)-এর মাতা মারইয়াম এবং মহানবী (সা.)-এর পত্নী খাদীজা ও কন্যা ফাতিমা (আ.)।

Iranian-Women-Basketball_132464353803আমরা জানি যে, হযরত ঈসা (আ.)-এর মাতা মারইয়ামকে পবিত্র কুরআন একজন মহিমান্বিত মহিলা হিসেবে উপস্থাপন করেছে এবং সে অনুসারে হযরত ঈসা (আ.)-এর নামের সাথে তাঁর নামও পঁচিশ বার কুরআনে উচ্চারিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা হযরত মারইয়ামকে সমগ্র মানবতার জন্য এক আদর্শ নমুনা বা উদাহরণ হিসাবে চিত্রিত করেছেন। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে : ‘ফেরেশতাগণ বলেছিল, হে মারইয়াম! আল্লাহ তোমাকে মনোনীত ও পবিত্র করেছেন এবং বিশ্বের নারীর মধ্যে তোমাকে মনোনীত করেছেন। হে মারইয়াম! তোমার প্রতিপালকের অনুগত হও ও সিজদা কর এবং যারা রুকু করে তাদের সাথে রুকু কর। ’ (সূরা আলে ইমরান : ৪২-৪৩)

images (1)আমরা জানি যে, ইসলাম মহিলাদের প্রতি অবমাননাকর বিশ্বাস ও ব্যবস্থার প্রতি এক চরম মুষ্টাঘাত হেনেছে এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে তার উপস্থিতি অনুমোদন করেছে। প্রাক-ইসলামী আরবে যখন কন্যাশিশুদেরকে প্রায়শই জীবিত কবর দেয়া হতো তখন মহানবী (সা.) একটি কন্যাসন্তান লাভ করলে প্রকাশ্যে গর্ব প্রকাশ করেছেন এবং কন্যা ফাতিমার হাতে চুমু খেয়েছেন। এভাবে তিনি দেখিয়েছেন যে, আল্লাহ তাআলার আদেশ মোতাবেক ইসলামে নারীকে কত উচ্চতর মর্যাদা দান করা হয়েছে!

মহানবী (সা.) নারীদেরকে সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে উৎসাহিত করেছেন।

ইসলামী সরকারে নারীদের অংশগ্রহণ

afkhamইসলামে সরকারের উচ্চতর সোপানে দায়িত্ব পালনে নারীদেরকে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে নারীরা নির্বাহী পর্যায়েও দায়িত্ব পালন করে থাকেন। নিম্নোক্ত ক্ষেত্রসমূহে নারীদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়েছে :

১. মহিলাদের জন্য খণ্ডকালীন চাকুরির ব্যবস্থা। যেসব মহিলা পূর্ণ সময় কাজ করতে পারেন না বা ইচ্ছুক নন এই ব্যবস্থা তাদের জন্য।

২. ২০ বছর চাকরির পর পূর্ণ সুবিধাসহ চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের সুযোগ।

৩. নিয়োগকর্তা কর্তৃক পর্যাপ্ত নার্সারি স্কুলের ব্যবস্থা এবং কর্মস্থলে শিশুদেরকে বুকের দধ পান করানোর সুযোগ দান।

৪. তিন বছরের কম বয়েসী শিশুর মায়েদের এক বছর পর্যন্ত অনুপস্থিত থাকার সুযোগ দানের জন্য ছুটির ব্যবস্থা।

৫. নতুন মায়েদের তিন সন্তান পর্যন্ত তিন মাস সবেতন প্রসূতি ছুটি।

ইরানের ইসলামী সরকারের অধীনে মহিলারা নিম্নোক্ত ক্ষেত্রসমূহে কাজ করে থাকেন :

১. প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চতর শিক্ষা ব্যবস্থার প্রশাসনে, শিক্ষকতায় ও পরামর্শক পদসমূহে।

২. স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থায়। এতে রয়েছে স্বাস্থ্য কার্যক্রমের যাবতীয় দিক ও বিভাগ।

৩. ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্টের দফতরে সম্প্রতি বেশ কয়েকজন মহিলাকে উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়েছে।

৪. শিল্প ও কৃষি খাতের প্রকৌশল ও কারিগরি পর্যায়ে।

সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীদের ভূমিকা

১. ভোটাধিকার

ক. প্রেসিডেন্ট, পার্লামেন্ট সদস্য এবং অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা নির্বাচন।

খ. পার্লামেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া এবং নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর অধিকার।

২. সরকারি সংস্থায় চাকরি

ক. ‘দি সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল কাউন্সিল অব ওম্যান’ ইরানী মহিলাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে থাকে।

খ. মহিলা বিষয়ক দফতরটি পরিচালিত হয় একজন মহিলা নির্বাহী দ্বারা, যিনি প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাও বটে। মহিলা বিষয়ক নীতিমালার পূর্ণ বাস্তবায়ন তদারকীর জন্য তিনি দায়িত্বশীল।

গ. ‘দি কমিশন অব ওম্যান’ দেশের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, পেশাগত ও সামাজিক বিষয়ক রাষ্ট্রীয় নীতি পর্যালোচনা করে এবং সেসবের অবস্থা উন্নয়নে প্রস্তাব পেশ করে। প্রত্যেকটি রাষ্ট্রীয় ও সরকারি সংস্থায় এই কমিশনের প্রতিনিধি আছে এবং তারা কমিশনের কাছে মহিলাদের যুক্তিসংগত দাবি-দাওয়া ও অধিকারের কথা অবহিত করে। কমিশন এসব ব্যাপারে বিকল্প নীতি সুপারিশও করে থাকে।

ঘ. পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরস্থ সংস্থাসমূহ ইরানস্থ ইউনেস্কো সদর দফতর প্রকাশিত প্রস্তাবসমূহ বাস্তবায়ন করে।

ঙ. মহিলাদের শরীরচর্চা শিক্ষা দফতর ও মহিলাদের ক্রীড়া কার্যক্রম বিষয়ক কমিশন পুরোপুরিভাবে মহিলাদের জন্য এবং মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত হয়।

চ. আর্থিক ও সামাজিকভাবে আত্মনির্ভরশীল হতে ইচ্ছুক অদক্ষ বয়স্ক মহিলাদের প্রয়োজন পূরণের জন্য পেশাগত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো সাগ্রহে কাজ করে যাচ্ছে।

৩. বেসরকারি সংস্থাসমূহ

ক. মহিলা বিষয়ক শিক্ষা ও গবেষণা কেন্দ্রসমূহের ব্যবস্থাপনা, পরিচালন ও কর্ম সম্পাদনা মহিলাদের দ্বারাই সম্পন্ন করা হয়।

খ. বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন সারা দেশে মহিলাদের কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

গ. মুনাফাবিহীন শিক্ষা কেন্দ্র। এসব কেন্দ্রের মাধ্যমে বালিকা ও মহিলাদেরকে শিক্ষার সকল পর্যায়ের বিভিন্নমুখি দক্ষতার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।

ঘ. বেসরকারিভাবে প্রদত্ত তহবিল থেকে প্রয়োজনের সময় মহিলাদের সামাজিক ও আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়।

কতিপয় পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে ইরানে ইসলামী বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পরবর্তী বছরগুলোতে মহিলারা তাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা পরিচালনায় বিরাট অগ্রগতি অর্জন করেছে।

১৯৯২ সালে ইরানের ২০টি মন্ত্রণালয়ের ওপর পরিচালিত এক জরিপের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মোট ২০ লাখ ৮১ হাজার ৩৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে ৫ লাখ ৩১ হাজার ৯৩৯ জন মহিলা অর্থাৎ মহিলাদের সংখ্যা শতকরা ২৫ ভাগ।

এ প্রসঙ্গে একটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, মোট সরকারি পদের শতকরা প্রায় ৪০ ভাগই মহিলাদের।

উল্লেখ করা যেতে পারে যে, পশ্চিমা দেশগুলোতে সমান কাজের জন্য পুরুষদের মতো নারীদের সমান পারিশ্রমিক দেয়া হয় না। গবেষণা ও উচ্চতর শিক্ষা ক্ষেত্রে এবং সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ আনুপাতিকহারে কম। অথচ ১৯৪৭ সালের জাতিসংঘ প্রস্তাবে পুরুষ ও মহিলাভেদে বৈষম্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

কয়েকটি পশ্চিমা দেশের কর্মশক্তি সংক্রান্ত একটি জাতিসংঘ পরিসংখ্যানে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, পশ্চিমা জগতে মোট কর্মশক্তির শতকরা ৪৪ থেকে ৪৫ ভাগ মহিলা। সে তুলনায় ইরান মাত্র শতকরা ৭.২ ভাগ পিছনে অর্থাৎ ইরানের মোট কর্মশক্তির শতকরা ৩৬.৮ ভাগ মহিলা। জাতিসংঘ পরিসংখ্যানের আলোকে আমরা যদি সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও নীতিগত প্রেক্ষাপটে গৃহকর্মে মহিলাদের সক্রিয় ভূমিকা পর্যালোচনা করি, তাহলে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পরি যে, ইরানে একটি নতুন ধারা ও নতুন দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, নিঃসন্দেহে যার ভিত্তি ইসলামী শিক্ষা ও মহিলা বিষয়ক কর্মনীতি। এটি নিশ্চিত যে, ইসলাম ছাড়া অন্য কোন চিন্তাধারায় সমাজে মহিলাদের ভূমিকা পালনের প্রতি এত সমর্থন দেয়া হয়নি। এই মর্মে এক আদেশ জারি করে ইমাম খোমেইনী (রহ.) ইরানে ইসলামী বিপ্লবের সূচনাকালে মহিলাদেরকে রাজনৈতিক অঙ্গনে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং সমাজে মহিলাদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। সমাজের একটি বৃহৎ মানবীয় সম্পদ হিসাবে তিনি মহিলাদের গতিশীল ভূমিকা সংহত করার ব্যাপারে অত্যন্ত সজাগ ছিলেন।

 

ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর দৃষ্টিতে ইবাদাত

পৃথিবীর অন্যসব ধর্মে ইবাদাত-বন্দেগিকে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের বিষয়াবলি থেকে বিচ্ছিন্ন বিষয় হিসাবে গণ্য করা হয়ে থাকে। কিন্তু ইসলাম এরূপ কোন ধর্ম নয়। পবিত্র ইসলামে ধর্ম জীবনের সর্ববিধ বিষয়ের সাথে জড়িত এবং সম্পৃক্ত। অর্থাৎ ইসলামে ইবাদাতের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে এই যে, ধর্ম জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

ইসলাম ব্যতিরেকে অন্যান্য ধর্মমতে ইবাদাতের যে দৃষ্টিভঙ্গি তা একান্তই সীমাবদ্ধ ও সংকীর্ণ। এ কথাটাকে আমরা এভাবে বলতে পারি যে, একজন হিন্দু যতক্ষণ পর্যন্ত মন্দিরে দেব-দেবীর পূজা-অর্চনায় লিপ্ত থাকে ততক্ষণ পর্যন্তই সে হিন্দু। আর অন্য সময়ে সে একজন সাধারণ মানুষ। এভাবে একজন খ্রিস্টান যতক্ষণ পর্যন্ত ক্রুশের সম্মুখে অবস্থান করে তখন সে খ্রিস্টান আর অন্য সময় সে একজন সাধারণ মানুষ। এ অবস্থাই চলছে পৃথিবীর অন্যান্য ধর্মের ক্ষেত্রে। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী একজন মুসলমান শুধু মসজিদের চৌহদ্দির মধ্যেই মুসলমান নয়; বরং সে সর্ববস্থায়ই মুসলিম। চিন্তা-চেতনার দিক থেকেই হোক আর ধর্মীয় মূলনীতিগুলোর অনুসরণের দিক থেকেই হোক অথবা কর্মগত দিক থেকেই হোক- একজন মুসলমানের কর্ম ইসলামের আলোকেই সম্পন্ন হয়ে থাকে।

আমাদের সমাজ জীবনে উত্তম বলে গণ্য প্রতিটি মানবীয় কর্ম এবং যেসব কর্মের প্রভাব সমাজ বিন্যাসে ও সমাজ গঠনে সহায়ক তার সবই ইবাদাত। মানব জীবনের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে বন্দেগি, ইসলামের মূল তাৎপর্যই হচ্ছে প্রকৃত ইবাদাত।

কোন কোন জ্ঞানী লোক ইবাদাতের অর্থ বোঝাতে গিয়ে একটি সংকীর্ণতার পরিচয় দিয়ে থাকেন। তাঁরা নামায, রেযা, হজ, যাকাত- বিশেষ করে ধর্মের কতিপয় কাজকেই ইবাদাত বলে মনে করে থাকেন। কিন্তু প্রকৃতপ্রস্তাবে ইবাদাতের ধারণা অত্যন্ত ব্যাপক। আল্লাহ তাআলা বলেন :

و ما خلقت الجنّ و الانس الا ليعبدون

এ আয়াত দ্বারা এটা বোঝানো হয়েছে যে, জ্বীন ও ইনসানের সৃষ্টির উদ্দেশ্যই হচ্ছে আল্লাহর বন্দেগি করা। ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী মানুষের সদিচ্ছাপ্রসূত এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদিত প্রতিটি পুণ্যময় এবং উপকারী কাজই ইবাদাত। আর যখন এটা সাব্যস্ত হলো যে, আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং তাঁর মর্জি মোতাবেক যা কিছু সম্পাদন করা হয় তাই ইবাদাত, এমতাবস্থায় বিদ্যা-শিক্ষা, জ্ঞানার্জন, রুটি-রুজি অন্বেষণ, ধর্মীয় খেদমত, সামাজিক তৎপরতা, অসহায় ও নিঃস্বের সাহায্য, বাতিল শাসন ব্যবস্থা বিলোপ ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম- এ সবকিছুই ইবাদাতের মধ্যে গণ্য। অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে যদি দেখা যায় তাহলে বলব যে, প্রতিটি ইবাদাতের উদ্দেশ্যই হচ্ছে সমাজের পরিশুদ্ধি, পরিবেশ তৈরি, শিশুদের প্রতিপালন ও পরিচর্যা, সমাজ সংশোধন, ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা, আল্লাহ এবং বান্দার মধ্যে সম্পর্ক সৃষ্টি, বিধবা ও ইয়াতিমদের দেখাশোনা এবং ধৈর্য ও তাকওয়ার অনুশীলন।

যদিও ইসলামে এমন কিছু কিছু ইবাদাত-বন্দেগি রয়েছে যা শুধু আনুষ্ঠানিক ইবাদাত হিসাবেই গণ্য, যেমন নামায, হজ ইত্যাদি। আর এগুলো হচ্ছে এমন ইবাদাত যা জামায়াতবদ্ধভাবে আদায় করা হয়ে থাকে। এসব ইবাদাতের উপকারিতা এবং গুরুত্ব সূর্যালোকের মতোই উজ্জ্বল। তবে ইসলাম ব্যক্তিগতভাবে নিষ্পন্ন ইবাদাতগুলোকেও এমনিভাবে নির্ধারণ করেছে যাতে ইবাদাত-বন্দেগির সঙ্গে সঙ্গে জীবনযাপনের প্রয়োজনগুলোও পূরণ হয়ে থাকে। যেমন নামাযের কথা উল্লেখ করা যায় যা আল্লাহ এবং বান্দার মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের একটি পরিপূর্ণ দৃষ্টান্ত। এ নামায যদি কেউ ব্যক্তিগতভাবেও আদায় করে তাহলে সে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক কর্তব্য এবং নৈতিক গুণাবলি অবলম্বন করতে বাধ্য হয়ে থাকে। যথা পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা অর্জন, অন্যের অধিকার সংরক্ষণের অনুভূতি, সময়-জ্ঞান, দিক নির্ণয, চেতনা ও অনুভূতিগুলোর সুনিয়ন্ত্রণ, আল্লাহর সৎ ও খাঁটি বান্দাদের সঙ্গে ভালোবাসা ও সম্প্রীতির ঘোষণা ইত্যাদি।

সার্বিক বিবেচনায় ইবাদাত হচ্ছে আল্লাহ তাআলা নৈকট্যলাভের একটি উপায় যা মানুষের জন্য মেরাজ তুল্য। ইবাদাতের মাধ্যমেই আত্মা সমুন্নত হয়। ইবাদাত হচ্ছে একটি জিনিস যাকে প্রকৃত উপাস্যের নৈকট্য লাভের কেন্দ্রাভিমুখে রূহের উড্ডয়ন, আধ্যাত্মিক দক্ষতা লাভের প্রশিক্ষণ এবং খোদায়ী শক্তি-সামর্থ্য অর্জনের প্রয়াস বলা যেতে পারে। ইবাদাতের মাধ্যমেই শরীরের ওপর রুহ বা আত্মার বিজয় সূচিত হয়ে থাকে। মোট কথা, ইবাদাত হচ্ছে এই বিশ্বলোকের সৃষ্টিকর্তার প্রতি প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি বড় উপায়।

ইবাদাতের মাপকাঠি

ইবাদাত-বন্দেগি একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যেই হওয়া উচিত। ইবাদাতে বিন্দু পরিমাণ প্রদর্শনের (রিয়া) ইচ্ছাও গ্রহণযোগ্য নয়; বরং এটি বান্দাসুলভ বৈশিষ্ট্যের পরিপন্থী। হযরত আলী (আ.) বলেন :

ان قوماً عبدو الله رغبةً فتلك عبادة التّجار، و ان قوماً عبدو الله رهبةً فتلك عبادة العبيد، و ان قوماً عبدو الله شكراً فتلك عبادة الاحرار

‘কোন জাতি যখন বেহেশত লাভের আকাঙ্ক্ষায় আল্লাহর ইবাদাত-বন্দেগি করে, তখন তার ইবাদাত হবে ব্যবসায়ীসুলভ আর যে জাতি জাহান্নামের ভয়ে আল্লাহর ইবাদাত করে তার ইবাদাত হচ্ছে দাসসুলভ আর যে জাতি আল্লাহর করুণা ও নেয়ামতের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর ইবাদাত করে তার ইবাদাত হচ্ছে স্বাধীন ব্যক্তির ইবাদাতের মতো।’ তিনি অন্যত্র বলেছেন :

الهي ما عبدتك خوفاً من نارك و لا طمعاً في جنتك بل وجدتك مستحقاً للعبادة فعبدتك

অর্থাৎ ‘হে আমার প্রভু! আমি জাহান্নামের ভয়ে তোমার ইবাদাত করছি না, জান্নাত লাভের আশায়ও করছি না; বরং আমি তোমাকে উপাস্য হওয়ার উপযুক্ত বিবেচনায়ই তোমার ইবাদাত করছি।’

ইসলামের মহান আলেমদের দৃষ্টিকোণ থেকে ইবাদাত

নবী করিম (সা.) বলেছেন : ‘কোন কোন আলেমের এক ঘণ্টা চিন্তা-ভাবনা একজন আবেদের সত্তর বছরের ইবাদাতের চেয়েও উত্তম।’ এ হাদীসের ভাবধারা সুস্পষ্ট, আর তা হলো এই যে, একজন সাধারণ ইবাদাতকারীর ইবাদাতের সম্পর্ক হচ্ছে শুধু তার ব্যক্তিসত্তার সঙ্গে। অন্যদিকে একজন আলেমের এক ঘণ্টার চিন্তা-ভাবনা সমাজের পরিশুদ্ধি, ধর্ম ও শরীয়তের সংরক্ষণ এবং সমাজের অসহায় ও দুর্বলদের সাথে সম্পর্কযুক্ত। অন্য কথায় একজন (সাধারণ) আবেদ স্বীয় ইবাদাত-বন্দেগিতে ইল্‌ম বা জ্ঞানের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে, কিন্তু একজন আলেম তা হয় না। আলোচ্য হাদীস থেকে এটা প্রমাণিত যে, আলেমের চিন্তা-ভাবনাও ইবাদাতের মধ্যে গণ্য। এভাবে নবী করিম (সা.)-এর একটি প্রসিদ্ধ হাদীস রয়েছে যেখানে বলা হয়েছে :

مداد العلماء افضل من دماء الشهداء

‘আলেমের কলমের কালি শহীদদের রক্তের চেয়ে উত্তম।’ এরূপ কেন হলো? অথচ  আমরা  জানি যে, শাহাদাত হচ্ছে একটি বড় ইবাদাত। এমনকি অন্যান্য ইবাদাত মানুষের জীবন রক্ষা করে সম্ভব, কিন্তু শাহাদাত এমন একটি ইবাদাত যা মানুষের জীবনকে বিলিয়ে দেয়ার মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়ে থাকে। শাহাদাত যখন এরূপ একটি বড় ইবাদাত তখন আলেমদের কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়ে উত্তম কেন? প্রকৃত কথা হচ্ছে এই যে, শহীদের রক্ত হচ্ছে একটি বার্তা বা বাণী সমতুল্য; আর আলেমদের কলমের কালি হচ্ছে বার্তাবহ বা বাণীবহ। আর বাণীবহ ছাড়া কোন বার্তা এবং বাণী মরু সাহারায় ধ্বনি তোলার মতো। এ কারণেই গ্রন্থ রচনা ও সংকলনও ইবাদাত। এ ইবাদাত শহীদদের রক্তের সংরক্ষণকারী হিসাবে গণ্য হবে।

ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর দৃষ্টিতে ধর্মীয় জ্ঞান সাধনার মাধ্যমে ইবাদাত

একটি প্রশ্ন মানুষের মনে স্বভাবতই সৃষ্টি হয়ে থাকে যে, ইমাম তো পর্দার আড়ালে রয়েছেন এবং তাঁর নিকট পৌঁছাও সম্ভব নয়, তাহলে এমতাবস্থায় শরীয়ত সংক্রান্ত জিজ্ঞাসাগুলো এবং সকল প্রকার ধর্মীয় ব্যাপারে কিভাবে অবহিত হওয়া যাবে? এ প্রসঙ্গে ইমাম হাসান আসকারী (আ.)-এর নিম্নোক্ত বক্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন :

من كان من الفقهاء حافظاً لدينه صائناً لنفسه مخالفا لهواه و مطيعاً لامر مولاه فللعوام ان يقلدوه

‘ফকীহদের মধ্যে যে ফকীহ ধর্মের হেফাজতকারী, নিজের নাফ্সকে সংরক্ষণ করে, প্রবৃত্তির কামনা-বাসনাগুলোর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে, স্বীয় প্রভুর প্রতিটি নির্দেশকে মান্য করে- এমতাবস্থায় সাধারণ মানুষের কর্তব্য হচ্ছে তাঁর অনুসরণ করা।’ এখানে ‘সাধারণ মানুষের কর্তব্য হচ্ছে তার (উক্ত ফকীহর) অনুসরণ করা’- ইমামের এ বক্তব্য থেকে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, যে ফকীহ নয় তথা ফিকাহ শাস্ত্রবিদ নয় সে সাধারণ মানুষের মধ্যে গণ্য- ধর্মীয় জ্ঞানের ক্ষেত্রে তার কিছুটা দখল থাকলেও।

বিবেকের বিচারেও ফকীহদের বিদ্যমানতা আবশ্যক। তা হলেই সাধারণ মানুষ তাঁদের মাধ্যমে শরীয়ত সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জন করতে পারবে।

ফকীহগণ যে একটি হুজ্জাত (প্রমাণ) এই ব্যাপারে ইমাম মাহদী (আ.) বর্ণিত একটি হাদীস নিম্নরূপ : ‘তারা (ফকীহগণ) হচ্ছে তোমাদের নিকট আমার পক্ষ থেকে দলিল, আর আমি তাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে দলিল, তাদের নির্দেশ প্রত্যাখ্যানকারী মূলত আমার নির্দেশকে প্রত্যাখ্যানকারীর সমতুল্য, আর আমার নির্দেশ প্রত্যাখ্যানকারী আল্লাহ তাআলার নির্দেশ প্রত্যাখ্যানকারী তুল্য।’ (ওয়াসায়েলুস শিয়া)

ধর্মীয় বিষয়ে জ্ঞানলাভ তথা ইজতিহাদ বা গবেষণা সমস্ত ইবাদাত-বন্দেগির মধ্যে আরেকটি ইবাদাত। একজন ফকীহ কুরআন, সুন্নাত, আকল ও ইজমার আলোকে অনুসন্ধান করে যে ফল দাঁড় করান শরীয়তের পরিভাষায় তাকেই ফতোয়া বলে। তবে ইজতিহাদে ভুলেরও সম্ভাবনা থাকে। কেননা, পবিত্রতা (عصمت) তথা সকল প্রকার ভুলত্রুটি ও পাপ থেকে মুক্ত থাকা মূলত আল্লাহ তাআলার বিশেষ করুণা বলতে হবে- যা তিনি নবী এবং ইমামদের জন্যই নির্ধারিত করে দিয়েছেন। অতএব, যদি কোন ফকীহ বা মুজতাহিদ কোন বিষেয়ে গবেষণা (ইজতিহাদ) করেন এবং তা যদি সঠিক হয়, তা হলে তিনি দ্বিগুণ পুণ্যের অধিকারী হবেন- প্রথমত তাঁর পরিশ্রম ও সাধনার জন্য আর দ্বিতীয়ত তাঁর গবেষণালব্ধ বিষয়ের বিশুদ্ধতার জন্য। কেননা, ফকীহ হচ্ছেন ইমামের প্রতিনিধি।

ইমাম খোমেইনী (রহ.) শুধু যে ইসলামী বিপ্লবের নেতা ছিলেন তাই নয়; তিনি উঁচু স্তরের একজন মুজতাহিদ এবং ফকীহও ছিলেন। তিনি জীবনভর দীনী-জ্ঞান অর্জন বিষয়ক ইবাদাতটি পালন করে গেছেন। ইসলামবিরোধী শক্তিগুলো যখন মুসলিম উম্মাহর ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর একের পর এক আঘাত হানে, ইসলামের দুশমনদের ইঙ্গিতে সালমান রুশদীর মতো একজন কুখ্যাত লেখক মুসলিম উম্মাহর মাতৃতুল্য নবীর স্ত্রীগণ এবং স্বয়ং নবী করিম (সা.)-এর বিরুদ্ধে স্যাটানিক ভার্সেসের মতো অশোভন পুস্তক রচনা করে মুসলিম উম্মাহকে আহত করে তখন ইমাম খোমেইনী (রহ.) সালমান রুশদীর মৃত্যুদণ্ডের মাধ্যমে ইসলামের শত্রুদের একথা বুঝতে বাধ্য করেছিলেন যে, ইসলামের আকীদা-বিশ্বাসের ওপর হামলা এবং তা নিয়ে খেলতামাসা করার অধিকার কারো নেই। সুতরাং ইমামের এই ফতোয়া ঘোষণার পর থেকে ব্রিটিশ সরকার সালমান রুশদীর নিরাপত্তার জন্য প্রতি মাসে হাজার হাজার ডলার খরচ করছে। এই ফতোয়া ঘোষিত হওয়ার পর থেকে ব্রিটিশ সরকার অদ্যাবধি অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে। অন্যদিকে ইমাম (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর সালমান রুশদী এবং তার অনুসারীরা এই ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে, সংকটের নিরসন হয়ে গেছে। কিন্তু রাহবার আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী উক্ত ফতোয়ার সপক্ষে নতুন করে ঘোষণা দিয়ে সালমান রুশদীর জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলেন। আর তার জন্য নিয়োজিত নিরাপত্তা ব্যূহ সত্ত্বেও সে আজ মৃত্যুর প্রহর গুনছে। মনে হচ্ছে যেন সে কিস্তিতে নিহত হচ্ছে। ইমামের এই ফতোয়ার আলোকে সালমান রুশদীকে হত্যা করা একটি বড় ইবাদাত। ইসলামী জ্ঞান-গবেষণার ফলশ্রুতিতে সম্পাদিত ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর ইবাদাতের মাধ্যমে একজন দুর্বিনীত এবং অশিষ্ট লোককে যেভাবে শাস্তি দেয়া হয়েছে তাতে এটা তো সাব্যস্ত হলো যে, ইসলামের কোন দুশমন নবী (সা.)-এর স্ত্রীগণ এবং স্বয়ং পয়গাম্বর (সা.)-এর ব্যাপারে এ ধরনের অশালীন আচরণ করতে সাহস পাবে না। সালমান রুশদীর মৃত্যুদ- ঘোষণা দেয়ার পর অনেকেই ইরানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল; কিন্তু ইমাম তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি। তিনি তো ইবাদাত হিসাবে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যেই এ ফতোয়া জারি করেছিলেন- আর কোন মুফতিই তাঁর ফতোয়া প্রত্যাহার করে নেন না।

ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর দৃষ্টিতে ঐক্যের সংগ্রাম

ইবাদাতসমূহের মধ্যে আরেকটি বড় ইবাদাত হচ্ছে মুসলিম মিল্লাতের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি গড়ে তোলা। সমকালীন বিশ্বে ইমাম খোমেইনী (রহ.) মুসলিম ঐক্যের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি এই ইবাদাতের ওপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। ঐক্য হচ্ছে একটি নেয়ামত। মুসলিম জাতিকে ঐক্যবদ্ধ থাকার জন্য আল্লাহ তাআলা এভাবে নির্দেশ দিয়েছেন :

واعتصموا بحبل الله جميعا و لا تفرقوا

‘আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করো এবং বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’

আরো বলা হয়েছে : ‘মুমিনগণ পরস্পর ভাই।’

ইমাম পরিষ্কার ভাষায় বলে দিয়েছেন, শিয়া-সুন্নি বিরোধ সৃষ্টিকারীরা সুন্নিও নয়, শিয়াও নয়; বরং তারা ইসলামবিরোধী শক্তিগুলোর চর। প্রকৃতপ্রস্তাবে শিয়া এবং সুন্নির উদাহরণ হচ্ছে কাঁচির দুটি ফলার মতো। যতক্ষণ পর্যন্ত এ দুটি বিচ্ছিন্ন থাকবে ততক্ষণ কুফ্‌র ও শির্‌ক বেড়েই চলবে, আর যখন এ দুটি মিলিত তথা অবিচ্ছিন্ন থাকবে তখন কুফ্‌র ও শিরকের প্রাধান্যও হ্রাস পেতে থাকবে। মুমিনদের মধ্যে মতপার্থক্য ও মতদ্বৈধতা সৃষ্টি বড় অপরাধ- যা আল্লাহও ক্ষমা করবেন না।

আল্লাহ তাআলা বলেন : ‘এবং যারা মসজিদ নির্মাণ করেছে ক্ষতিসাধন, কুফ্‌রী ও মুমিনদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে…’ সূরা তাওবা : ১০৭

এ হচ্ছে মসজিদে কুবার বিপরীতে নির্মিত মসজিদ যা ‘মসজিদে জিরার’ নামে অভিহিত। আর এটি নির্মাণের উদ্দেশ্যই ছিল মুসলমানদের ক্ষতিসাধন, কুফ্রীর বিস্তার এবং মুমিনদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি। আল্লাহ তাআলা তাঁর হাবিব মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে এই মসজিদে দাঁড়াবারও অনুমতি দেননি। বরং আল্লাহ তাআলা বলেছেন : لا تقم فيه ابدا ‘হে নবী! তুমি কখনও এতে দাঁড়াবে না।’ অতএব, আল্লাহর নির্দেশেই তিনি এ মসজিদটি নিশ্চিহ্ন করে দেন যাতে এই মসজিদের মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে যে অনৈক্য সূচনা করার চেষ্টা হয়েছিল তা নিঃশেষ হয়ে যায় আর মুমিনদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি গড়ে উঠতে পারে।

প্রকৃতপক্ষে ঐক্য একটি বিশেষ প্রয়োজনীয় বিষয়। মুসলমানরা যদি পরস্পর ঐক্যবদ্ধ হয়, তাহলে বৃহৎ শক্তিগুলো পদানত হতে বাধ্য। ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর বক্তব্য হচ্ছে এই যে, যদি মুসলমানগণ পরস্পর ঐক্যবদ্ধ হয় এবং প্রত্যেক মুসলমান যদি এক বালতি করে পানি ইসরাইলী ভূখণ্ডে ঢেলে দেয় তাহলে এই লুটেরা ও আগ্রাসী ইসরাইল প্লাবনের তোড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে বাধ্য। ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর আহ্বানেই ‘ইসলামী ঐক্য সপ্তাহ’ (১২ রবিউল আউয়াল থেকে ১৭ রবিউল আউয়াল পর্যন্ত) পালিত হচ্ছে। তাঁর এ পদক্ষেপ থেকেই উপলব্ধি করা যায় যে, ঐক্য তাঁর নিকট কতখানি প্রিয় ছিল! তিনি জানতেন ঐক্যের মধ্যে কী পরিমাণ শক্তি নিহিত রয়েছে! প্রকৃতপক্ষে মুসলিম শক্তি ও মুসলমানদের ক্ষমতা লাভের উৎস এ ঐক্যের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। এ ঐক্যের বদৌলতেই মুসলমানরা তাদের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করতে পারে।

ঐক্য প্রসঙ্গে নবী করিম (সা.) বলেন :

لا فخر لعرب على عجم و لا بيض على الاسود

অর্থাৎ ‘একজন অনারবের ওপর কোন আরবের এবং একজন কৃষ্ণাঙ্গের ওপর কোন শ্বেতাঙ্গের কোনই গৌরব নেই।’ মোট কথা, ঐক্য হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত- যে ব্যাপারে প্রতিটি মুসলমানেরই গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করা প্রয়োজন। মুসলিম মিল্লাতের দরদি হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) তাঁর অসিয়তনামায় বলেন :

‘মুসলিম জাতিগুলোর প্রতি আমার অসিয়ত তারা যেন নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছতে তথা ইসলাম ও ইসলামী অনুশাসন বাস্তবায়নে উপায় হিসাবে কখনো বাইরের সাহায্যের প্রত্যাশা না করেন। এই জীবন সঞ্জীবনী কাজে আপনাদের নিজেদেরকেই জেগে ওঠা উচিত, যা আপনাদের স্বাধীনতা ও মুক্তির নিশ্চয়তা বিধান করবে।’

‘সুতরাং মুসলিম দেশসমূহের ওলামা ও ওয়ায়েজগণের কর্তব্য তাঁদের সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো তারা যেন বৈদেশিক শক্তিগুলোর ওপর নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসে এবং দেশের জনগণের সাথে ঐক্যে উপনীত হয়। এর মধ্যেই তাদের জন্য সাফল্য নিহিত রয়েছে। ঐক্য প্রতিষ্ঠা ও ইসলামবিরোধী বর্ণপ্রথার বিলোপ সাধনের জন্য ওলামা ও ওয়ায়েজগণ তাঁদের জাতিকে আহ্বান করুন। তাঁরা যেন বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকল বিশ্বাসী ভাইয়ের সাথে হাত মেলান। কারণ, ইসলামের জন্য তারা সব সময়েই ভাই। যখন ভ্রাতৃত্ববোধের চেতনা একবার সকল মুসলিম সরকার ও জনগণের মাঝে বাস্তবে রূপ লাভ করবে তখন আপনারা দেখবেন মুসলমানরাই দুনিয়ার বুকে সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ইনশা আল্লাহ, একদিন আমরা মুসলিম জাতিগুলোর মধ্যে এই ধরনের ভ্রাতৃত্ববোধ ও সাম্য স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য লাভ করব, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।’

ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর দৃষ্টিতে সামাজিক ইবাদাত

ইমাম খোমেইনী (রহ.) ইসলামের সামগ্রিক ইবাদাত-বন্দেগির ওপরই জোর দিয়েছেন। তবে তিনি সেসব ইবাদাতের ওপরই বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করেছেন যেগুলোর সম্পর্ক রয়েছে ঐক্য-সংহতি, সমাবেশ, ভ্রাতৃত্ব প্রভৃতির সাথে। যেমন জুমআর নামায ও হজের মহাসম্মিলন। জামায়াতবদ্ধভাবে নামায আদায় যা দিনে কয়েকবারই সম্পন্ন হয়ে থাকে তা দ্বারা একটি ইসলামী সমাজে ঐক্যের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। কয়েকবার দেখা-সাক্ষাতের মাধ্যমে পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টি হয়ে থাকে। জামায়াতবদ্ধভাবে নামায হচ্ছে এরূপ একটি ইবাদাত যার জন্য ইমাম খোমেইনী (রহ.) বাস্তবভাবে ইরানে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আর তা হচ্ছে যে, এখানে শিয়াদের জামায়াতে সুন্নিরা শরীক হয়ে থাকেন আর সুন্নিদের জামায়াতে শিয়ারা শরীক হয়ে থাকেন। আর এভাবেই ইসলামী ঐক্যের একটি সুন্দর দৃশ্য ফুটে উঠেছে।

জুমআর নামায

দৈনিক পাঁচবার যে নামায আদায় করা হয় তার মাধ্যমে আশেপাশের লোকজন উপকৃত হয়ে থাকে। কিন্তু জুমআর নামাযের যে সমাবেশ হয় তাতে আরো ব্যাপক উপকার পাওয়া যায়। অপেক্ষাকৃত দূরবর্তী লোকদের ব্যাপারে তথ্য লাভ করার মতো সুযোগও এতে হয়ে থাকে। জুমআর নামায প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য হচ্ছে ইসলামী গণসংযোগকে দৃঢ় করা, মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করা এবং পরস্পরের হাল অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হওয়া। ইমাম খোমেইনী (রহ.) জুমআর নামায প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বিশেষ জোর দিয়েছেন। এটা এজন্য যে, এর মাধ্যমে মুসলিম সমাজ অধিক হারে মৌলিক উপকারগুলো অর্জন করতে সক্ষম হবে। সুতরাং জুমআর নামাযের খুতবা দানের মাধ্যমে ইমামগণ ইরানী জাতির অন্তর জয় করতে সক্ষম হয়েছেন। আর এভাবেই এ সমাবেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ সমাবেশে রূপান্তরিত হয়েছে।

ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর দৃষ্টিতে হজের ইবাদাত

হজ হচ্ছে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত যার অসংখ্য উপকারিতার মধ্যে একটি বড় উপকারিতা হচ্ছে এই যে, এটি আন্তর্জাতিক ভিত্তিতে ইসলামী ঐক্য এবং ভ্রাতৃত্বকে সুসংহত করার গুরুত্বপূর্ণ উপায়। এই ইবাদাতের উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিভিন্ন দেশ থেকে মুসলমানগণ বছরে একবার কাবা ঘরে সমবেত হয়ে নিজেদের ধর্মীয় বিষয়াবলি, অর্থনীতি, রুটি-রুজি সংক্রান্ত বিষয় এবং সমাজ সংশোধনের ব্যাপারে মতবিনিময় করবে এবং তারা এ মর্মে চিন্তা-ভাবনা করে দেখবে যে, তাদের সংকটসমূহ নিরসনের উপায় কী? ইমাম খোমেইনী (রহ.) হজের এই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত প্রসঙ্গে বলেন : ‘হজ হচ্ছে এমন মহান অনুষ্ঠান যা মানবতাকে ধর্মীয়, রাজনৈতিক এবং সামাজিক বিষয়সমূহের ক্ষেত্রে সজাগ করে তোলে।’ হজ এমন একটি মহৎ অনুষ্ঠান যা দ্বারা মানুষ উচ্চ মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়ে থাকে। এ উপলক্ষে ধনী-দরিদ্র, কালো-সাদা, আরব-আজম সবাই একই সারিতে সমবেত হয়। এ প্রসঙ্গে ইমাম খোমেইনী আরো বলেন : ‘এটা অনস্বীকার্য সত্য যে, দুনিয়ার কোন রাষ্ট্রশক্তি অথবা কোন নেতা এ ধরনের একটি মহান অনুষ্ঠান আয়োজনের যোগ্যতা রাখেন না। শুধু মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর অনুগ্রহেই এ বিশাল সমাবেশের ব্যবস্থা হয়ে থাকে।’ ইমাম খোমেইনী (রহ.) পবিত্র কুরআনের সূরা বারাআতের আলোকে হজকে মুশরিকদের সঙ্গে বারাআত বা সম্পর্কচ্ছেদের একটি উত্তম উপায় বলে গণ্য করেন। আর এ কারণেই ইরানী হাজিগণ মক্কায় পৌঁছে ‘আমেরিকা মুর্দাবাদ’ প্রভৃতি স্লোগান দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন। আর এ সূক্ষ্ম অনুভূতির প্রেক্ষিতেই ইমাম বলেছিলেন, মক্কা-মদিনা কারো মালিকানাধীন নয়; বরং এ হচ্ছে বিশ্বের সকল মুসলমানের সম্পত্তি। আর এ কারণেই মক্কা-মদীনার প্রশাসনিক ব্যবস্থা মুসলিম দেশগুলোর ওপরই ন্যস্ত হওয়া প্রয়োজন।

ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর দৃষ্টিতে জিহাদ সংক্রান্ত ইবাদাত

শিয়া মাজহাবের দৃষ্টিকোণ থেকে ইমাম যামান তথা ইমাম মাহদী (আ.)-এর অনুপস্থিতিতে জিহাদ ফরজ হওয়ার বিষয়টি পরিত্যক্ত বা স্থগিত হয়ে থাকে। এটা এজন্য যে, জিহাদ হয় কোন মাসুম ইমামের উপস্থিতিতে সংঘটিত হয়ে থাকে অথবা কোন মাসুম ইমামের নির্দেশে হয়ে থাকে। আর বর্তমান যুগে এ উভয় পদ্ধতিই অসম্ভব। হ্যাঁ, যদি কোন শত্রু আক্রমণ করে তাহলে আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে সে আক্রমণের জবাব দেয়া প্রয়োজন- যাকে বলা হয় ‘প্রতিরক্ষা’। সুতরাং আক্রমণকারী আগ্রাসী ইরাককে প্রতিহত করার লক্ষ্যে যে সব জবাবী হামলা করা হয়েছিল সেগুলোকে ইমাম ‘পবিত্র প্রতিরক্ষা’ হিসাবে অভিহিত করেছেন।

সূরা হজে আল্লাহ বলেন : … ‘এবং জিহাদ করো আল্লাহর পথে যেভাবে জিহাদ করা উচিত।’ সূরা হজ : ৭৮

মহানবী (সা.) বলেছেন যে, বেহেশত হচ্ছে তলোয়ারের নিচে। জিহাদের গুরুত্বকে কেউই অস্বীকার করতে পারে না, এ ইবাদাতকে এজন্যই ফরয বা অবশ্য কর্তব্য করে দেয়া হয়েছে যাতে কাফের এবং মুশরিকরা ইসলামের অগ্রগতির পথে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে। যদি জিহাদ না হতো তাহলে কাফের-মুশরিকদের ইসলামবিরোধী তৎপরতার কারণে ইসলামের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে বিঘ্ন সৃষ্টি হতো। আর প্রতিরক্ষাও আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যেই হওয়া প্রয়োজন। এই ইবাদাতের ক্ষেত্রে যদি ব্যক্তির স্বীয় প্রবৃত্তি শামিল হয়ে যায় তাহলে পুণ্য তার হাতছাড়া হয়ে যাবে। অর্থাৎ সওয়াব থেকে সে বঞ্চিত হবে। এ প্রসঙ্গে আমরা ইসলামের ইতিহাসের একটি ঘটনা উল্লেখ করতে পারি। ঘটনাটি হচ্ছে এই যে, পরিখার যুদ্ধে হযরত আলী (আ.)-এর হাতে আমর ইবনে আবদে উদ পরাভূত হয়। অহংকারী আমরকে ধরাশায়ী করে তিনি তার বুকের ওপর চড়ে বসলেন। দেহ থেকে তার শির বিচ্ছিন্ন করে দেবেন- ঠিক এই মুহূর্তেই আমর তাঁর সঙ্গে একটি অশোভন আচরণ করে। সে হযরত আলীর মুখমণ্ডলে থুথু নিক্ষেপ করে। অতঃপর তিনি তার বুকের ওপর থেকে উঠে দাঁড়ালেন এবং যখন তার রাগ প্রশমিত হলো তখনই তিনি তাকে হত্যা করলেন। জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করল : ‘আপনার এরূপ করার কারণ কী?’ তিনি বলেন : ‘যদি সে অবস্থায় আমি তাকে হত্যা করতাম তাহলে আমি আমার নাফ্স বা প্রবৃত্তির ইচ্ছার সঙ্গে জড়িয়ে পড়তাম।’ হযরত আলী (আ.) একই মুহূর্তে দুটি জিহাদই সম্পন্ন করেছেন- আমরের বুকের ওপর থেকে উঠে আসা যা বড় জিহাদ হিসাবে গণ্য এবং তাকে হত্যা করা- যা ছোট জিহাদ হিসাবে গণ্য। এটা এজন্য যে, মাসুম ইমামদের বর্ণনা অনুসারে প্রবৃত্তির ইচ্ছা ও অভিলাষের ওপর নিয়ন্ত্রণ লাভ হচ্ছে সবচেয়ে বড় জিহাদ। ইমাম খোমেইনীও এই বড় জিহাদের ওপর গুরুত্ব আরো করেছেন এবং কলম চালিয়েছেন। সুতরাং তিনি তাঁর একটি গ্রন্থের নাম রেখেছেন ‘জিহাদে আকবার’। এই গ্রন্থে তিনি প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

পরিখার যুদ্ধে যখন হযরত আলী (আ.) আমর ইবনে আবদে উদকে হত্যা করেন তখন নবী করিম (সা.) বলেন : অর্থৎ পরিখার যুদ্ধের দিন আলীর আক্রমণ সাকালাইনের জিন-ইনসানের ইবাদাতের চেয়ে উত্তম। এ দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তাআলা ইবাদাতের ক্ষেত্রে বান্দার আমলের পরিমাণ দেখেন না; বরং আমলের ওজন বা গুরুত্বকেই দেখে থাকেন। পরিখার যুদ্ধে হযরত আলী (আ.)-এর উক্ত ইবাদাত ছিল একটি মুহূর্তের বিষয়; কিন্তু ওজনের দিক দিয়ে তা ছিল সাকালাইনের ইবাদাতের চেয়েও উত্তম।

ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় ইমাম খোমেইনী (রহ.) ইরানী জনগণকে জিহাদে (প্রতিরক্ষা) উদ্বুদ্ধ করে অনেক বক্তব্য প্রদান করেন। এর প্রভাবে ইরানী জাতি তাদের যুবকদেরকে আল্লাহর পথে উৎসর্গ করাকে নিজেদের জন্য সৌভাগ্যের কারণ বলে মনে করে। জিহাদের ব্যাপারে একটি ভুল ধারণা সমাজে চালু আছে। আর তা হচ্ছে যে, জিহাদ মানে যুদ্ধ। অথচ আরবি ভাষায় যুদ্ধ বলতে ‘হারব’ جرب শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। নিজের আত্মরক্ষার জন্য প্রতিরক্ষামূলক হামলার অধীন শত্রুকে নিধন করা জুলুম নয়; বরং ন্যায়সঙ্গত। কারণ, ইসলামী জিহাদ হচ্ছে ঈমানী তৎপরতা বা কর্মকাণ্ডেরই একটি বহিঃপ্রকাশ। যেভাবে কোন অভিজ্ঞ ডাক্তার জীবন রক্ষার তাগিদে রুগীর দেহে অস্ত্রোপচার করে তার শরীর থেকে ক্যান্সারে আক্রান্ত কোন অংশ কেটে ফেলেন যাতে ঐ দূষিত অংশের কারণে শরীরের বাকি অংশে কোন রোগ সংক্রমিত হতে না পারে তেমনিভাবে সেসব দুষ্ট লোককেও সমাজ থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে জরুরি যারা মানব সমাজ ও শান্তির ধর্মের জন্য ক্যান্সারস্বরূপ।

ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর দৃষ্টিতে সৎকাজের আদেশ দান ও অসৎকাজ থেকে বিরত রাখা

সমুদয় ইবাদাত-বন্দেগির মধ্যে সৎকাজের আদশে দান ও অসৎকাজ থেকে বিরত রাখাও একটি উল্লেখযোগ্য ইবাদাত। কিন্তু এই ইবাদাতটি সম্পন্ন করা যে কোন লোকের পক্ষে সম্ভব নয়; কারণ, এর জন্য কতিপয় সাধারণ শর্তও রয়েছে। প্রথমত শর্ত হচ্ছে এই যে, ব্যক্তির নিজেরই এসব মন্দ আচরণ ও স্বভাব থেকে মুক্ত থাকতে হবে যে ব্যাপারে সে অন্যদের কাছে প্রচার করবে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে : ‘তোমরা কি লোকদেরকে সৎকাজের নির্দেশ দাও আর নিজেদেরকে বিস্মৃত হও?’ (সূরা বাকারা : ৪৪)

এটা একান্তই প্রয়োজন যে, যখন কোন মানুষ কোন বিষয়ে অন্যের নিকট প্রচার করবে, তখন তাকে সে ব্যাপারে যতটুকু সম্ভব সচেতন ও যত্নশীল এবং বাস্তব নমুনা হতে হবে।

কুরআন মজিদে আরো বলা হয়েছে : …‘তোমাদের মধ্যে এমন একদল হোক যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে এবং সৎকাজের নির্দেশ দিবে ও অসৎকাজে নিষেধ করবে; এরাই সফলকাম।’ (সূরা আলে ইমরান : ১০৪)

আরো বলা হয়েছে : …‘তোমরা একটি উত্তম জাতি, বিশ্বমানবের কল্যাণের জন্যই তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে, তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান করো এবং অসৎ কাজে নিষেধ করো… ।’ (সূরা আলে ইমরান : ১১০)

কুরআনের উপরোল্লিখিত বক্তব্যের আলোকে সৎকাজের আদেশ দান এবং অসৎকাজে নিষেধ একটি বড় ইবাদাত। ইমাম খোমেইনী (রহ.) ইবাদাতটি যথাযথ আদায় করার জন্য নিজে যেমন চেষ্টায় থাকতেন, তেমনি অন্যদেরকেও উদ্বুদ্ধ করতেন। শুধু তাই নয়, তিনি লোকদেরকে ইসলামের অধ্যয়ন ও অনুশীলনের জন্য আহ্বান জানাতেন। ১৯৮৯ সালের জানুয়ারিতে ইমাম খোমেইনী (রহ.) তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের সুপ্রিম প্রেসিডিয়ামের প্রেসিডেন্ট মি. মিখাইল গর্বাচেভের উদ্দেশে যে ঐতিহাসিক বাণী প্রেরণ করেন তাতেও তিনি এই ইবাদাতের আহ্বান জানিয়েছিলেন। আমরা ইমাম খোমেইনীর উক্ত বাণী থেকে কিছু উদ্ধৃতি পেশ করা প্রয়োজন বোধ করছি। ইমাম বলেন :

‘জনাব গর্বাচেভ! সবাইকে সত্যের দিকে প্রত্যাবর্তন করা উচিত। ব্যক্তিমালিকানা, অর্থনৈতিক (সমস্যা) ও স্বাধীনতা (হীনতা) আপনাদের প্রধান সমস্যা নয়। এটি হচ্ছে সত্যিকারের খোদা বিশ্বাসের অনুপস্থিতি। সেটাতো এমন এক সমস্যা যেটা পাশ্চাত্যকে নোংরামি ও অচলাবস্থার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে এবং ভবিষ্যতে সে অবস্থাই বিরাজ করবে। সকল সত্তা ও সৃষ্টির উৎস যে খোদা তাঁর বিরুদ্ধে দীর্ঘ ও অর্থহীন সংগ্রামই আপনাদের প্রধান সমস্যা।’

‘জনাব গর্বাচেভ! যখন আপনাদের কোন কোন প্রজাতন্ত্রের মসজিদের মিনারগুলো থেকে আল্লাহু আকবার ও শেষ নবী (সা.)-এর নবুওয়াতের সাক্ষ্যের ধ্বনি শ্রুত হয় তখন এটি খাঁটি মুহাম্মাদী ইসলামের সমর্থকদের মধ্যে আনন্দাশ্রু বয়ে আনে।’

ইমামের প্রেরিত এই বাণী গর্বাচেভের ওপর বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল। যার ফলশ্রতিতে গর্বাচেভ প্রতিনিধিদলের নিকট বলেছিলেন, ‘আমার জন্য এটা বড়ই গৌরবের ব্যাপার যে, আমি পৃথিবীর প্রথম নেতা যার নিকট হযরত ইমাম একটি বাণী প্রেরণ করেছেন।’ অতঃপর সোভিয়েত নেতা ইমামের প্রতিনিধি দলের নিকট ব্যক্ত করেন : ‘আপনারা ইমামের নিকট এ সংবাদ পৌঁছে দিবেন যে, আমরা শীঘ্রই সোভিয়েত ইউনিয়নে ধর্মীয় স্বাধীনতা বহাল করতে যাচ্ছি।’ ইমামের প্রেরিত পত্রের পরিপ্রেক্ষিতেই রাশিয়ার মতো একটি খোদাবিমুখ দেশে তেলাওয়াতে কুরআন, নামাযের আযান এবং রোযা, ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি স্বাধীনভাবে পালনের একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়।

ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর এ কর্মপদ্ধতির মধ্যে মহানবী (সা.)-এর জীবনচরিতের বৈশিষ্ট্যই ফুটে উঠেছে। যেভাবে নবী করিম (সা.) তাঁর সমসাময়িক যুগের রাজা-বাদশাদের নিকট ইসলাম গ্রহণের জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন তেমনিভাবে তিনিও নবীর সুন্নাতের অনুসরণ করতে গিয়ে সত্যের পথে আহ্বান করে এক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত এবং শরীয়তের এমন একটি আবশ্যিক বিষয় পালন করেছেন যার দৃষ্টান্ত বর্তমান যুগে একান্তই বিরল।

ইরানের মহিলা মুজতাহিদ ও মুফাসসির নুসরাত আমীনের জীবন ও কর্ম

সাইয়্যেদা খানুম নুসরাত আমীন ইরানের একজন যশস্বিণী বিদুষী মহিলা আলেমের নাম। আহলে বাইতের মাজহাবের অনুসারীদের মধ্যে একজন শ্রেষ্ঠ মহিলা আলেম হিসাবে তাঁর বিরাট খ্যাতি রয়েছে। ইরানের শীর্ষস্থানীয় আয়াতুল্লাহগণ তাঁকে মহিলা মুজতাহিদ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। অর্থাৎ তিনি কুরআন ও হাদীস গবেষণা করে ধর্মীয় বিধান ও সিদ্ধান্ত দান বা ইজতিহাদ করার অধিকারী একমাত্র মহিলা আলেম। তাঁর সমগ্র জীবন প্রমাণ করে যে, তিনি আল্লাহর একজন বড় অলি ছিলেন।

১৮৮৬ সালে তিনি ইরানের ইসফাহানে এক ধর্মীয় পরিবারের জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ আলী আমীনুত তুজ্জার ইসফাহানী ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ ও দানশীল ব্যক্তি। তাঁর মাতা ছিলেন অতিশয় ধার্মিক ও মানুষের কল্যাণকামী মহিলা। বাবা-মার তিন ছেলের পরে খানুম নুসরাত আমীনের জন্ম হয়।

তখনকার সামাজিক পরিবেশ-পরিস্থিতি এমন ছিল যে, খুব কম পরিবারই কন্যাসন্তানদের মক্তবে বা মাদ্রাসায় পাঠাত। এমতাবস্থায় তাঁর মহীয়সী মা তাঁকে চার বছর বয়সে কুরআন মজীদ পড়া এবং বিদ্যা শিক্ষার জন্য মক্তবে পাঠান। খানুম নুসরাত আমীন শৈশব থেকেই একাকী থাকা এবং চিন্তা-গবেষণার মধ্যে সময় কাটানোতে আগ্রহী ছিলেন। ১৫ বছর বয়সে তিনি চাচাত ভাই হাজী মীর্জা ওরফে মুঈনুত তুজ্জারের সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। তিনি ইসফাহানের একজন নামকরা ব্যবসায়ী ছিলেন। এরপর থেকে তিনি সাংসারিক কাজকর্মে নিয়োজিত হন। কিন্তু সংসার জীবন কিছুতেই তাঁর জ্ঞানচর্চা অব্যাহত রাখার পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি। আর এই জ্ঞানচর্চা তাঁর সাংসারিক কাজেও বিঘ্ন সৃষ্টি করেনি। তিনি সব সময় বলতেন, ‘দাম্পত্য জীবন এক আইনগত ব্যাপার। স্ত্রীর ওপর স্বামীর কর্তব্য রয়েছে। কাজেই এ ব্যাপারে কোনমতেই ত্রুটি করা উচিত নয়।’

খানুম নুসরাত আমীন ৮ সন্তানের মা হন। কিন্তু ৭টি সন্তানই তাঁর জীবদ্দশায় অল্প বয়সে মৃত্যুবরণ করে। কেবল ১টি ছেলেই জীবিত ছিল। সন্তানবিয়োগ সম্পর্কে খানুম নুসরাত আমীনের প্রতিক্রিয়া ছিল : ‘আল্লাহ তাআলা দিয়েছেন, তিনিই নিয়ে গেছেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর বান্দা সে সবকিছুকে আল্লাহর পক্ষ থেকে বলে মনে করে। কাজেই আল্লাহ তাআলা তার জন্য যা পছন্দ করেন, তা-ই তার জন্য মঙ্গলজনক।’

কিন্তু জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে এই বিদুষী মহিলার অধ্যবসায় এত ব্যাপক ছিল যে, তিনি বলতেন, কোন কিছুই তাঁকে ক্লাস ত্যাগে বাধ্য করতে পারবে না, এমনকি সন্তানের মৃত্যুও।

খানুম নুসরাত আমীনের অন্যতম শিক্ষক মরহুম মীর সাইয়্যেদ আলী নাজাফাবাদী বলেন : ‘একদিন শুনলাম যে, তার সন্তান মারা গেছে। মনে করলাম, এবার সে পড়াশুনায় ক্ষান্ত দেবে। কিন্তু হলো তার বিপরীত। দুদিন পর এক লোককে আমার কাছে পাঠালো যাতে পড়ানোর জন্য আমি তার বাসায় যাই। লেখাপড়ার প্রতি তার এ আগ্রহ দেখে আমি সম্পূর্ণ হতবাক হয়ে যাই।’

এই অধ্যবসায়ী বিদুষী মহিলা অক্লান্ত সাধনার মাধ্যমে আরবি ব্যাকরণ, (নাহু-সারফ), বালাগাত, তাফসীর, ইলমে হাদীস, ফিকাহ, উসূল, দর্শন ও ইরফান প্রভৃতি বিষয় অধ্যয়ন করেন। তখনকার দিনে সামাজিক পরিবেশগত সীমাবদ্ধতা, বিশেষ করে মহিলাদের জন্য বিদ্যমান সমস্যাদি ডিঙিয়ে তিনি উচ্চতর স্তর পর্যন্ত পড়াশুনা অব্যাহত রাখেন। এ সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেন : ‘সবসময়ই আল্লাহর দয়া আমার সাথি ছিল এবং পড়াশুনার সময় অনাবিল আনন্দ ও নূরানী অবস্থা আমার নসীব হতো।’

অনতিবিলম্বে খানুম নুসরাত আমীনের আধ্যাত্মিক প্রতিভার বিকাশ ঘটে। এ পর্যায়ে তিনি আধ্যাত্মিক বিষয়াদি উদ্ঘাটন ও প্রত্যক্ষ করতে থাকেন। তিনি আল্লাহর দিকে সফরের বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করেন।

তিনি পাহলভী আমলের দূষিত পরিবেশ এবং পর্দাহীনতা ও অশ্লীলতার ছোঁয়া থেকে আত্মরক্ষার জন্য অধিকাংশ পড়াশুনা নিজ ঘরে এবং আল্লামা আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ আলী নাজাফাবাদী ও শেখ মুর্তাজা মাজাহেরীর সান্নিধ্যে আনজাম দেন। ৪০ বছর বয়সে তাঁর অধ্যবসায় এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় আলেম ও মারজায়ে তাকলীদ, বিশেষত আয়াতুল্লাহ আল উযমা মুহাম্মাদ কাজেম শিরাজী বিভিন্ন পরীক্ষা ও প্রশ্নাদি উত্থাপনের পর তাঁকে শরীয়তের হুকুম-আহকামের ফায়সালা ও সিদ্ধান্ত দেয়ার অনুমতি প্রদান করেন। খানুম নুসরাত আমীন আয়াতুল্লাহ মুহাম্মাদ রেযা নাজাফী ইসফাহানী, হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন মাজাহেরী নাজাফী ইসফাহানী থেকে হাদীস রেওয়ায়াতের অনুমতি লাভ করেন। এছাড়া আয়াতুল্লাহ আল-উযমা মারআশী নাজাফী ও হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন জুহাইর আল হাসনুও তাঁকে হাদীস রেওয়ায়াতের অনুমতি দেন।

খানুম নুসরাত আমীনকে ফিকাহ, উসূল ও হিকমত শিক্ষাদানকারী আয়াতুল্লাহ আগা সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ আলী নাজাফাবাদী বলেছিলেন : ‘আমি এ উদ্দেশ্যে এ নারীকে শিক্ষা দান করছি যেন পরবর্তীকালে তা আমার স্মৃতি হয়ে থাকে।’

যে সময় বিভিন্ন মহলে প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল যে, আসলেই কি নারী পুরুষের সমপর্যায়ের মানুষ? মানবীয় পূর্ণতার জামা কি সবসময় পুরুষদের গায়েই শোভা পাবে, না এই পূর্ণতা মেয়েদের ভাগ্যেও রয়েছে? সে সময়েই এ বিদুষী মহিলার জ্ঞান ও আধ্যাত্মিক পদমর্যাদা এমন স্তরে পৌঁছে যে, শীর্ষস্থানীয় আলেম ও আধ্যাত্মিক সাধকগণ তাঁর দরবারে উপস্থিত হওয়াকে সৌভাগ্য বলে মনে করতেন।

এখানে উল্লেখ করা যায় যে, তাঁর স্বামী আলেম ছিলেন না এবং তাঁর সমকক্ষও ছিলেন না। স্বামীর লেখাপড়া ছিল প্রাথমিক স্তরের। কিন্তু এই বিদুষী মহিলা আলেম কখনো স্বামীর কাছে নিজের বড়াই করেননি। তাঁর বিনয় ও নম্রতা এমন পর্যায়ে ছিল যে, সমসাময়িকদের মাঝে গিয়ে কেউ তাঁকে সহজে চিনতে পারত না।

সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তাঁর অবদান

খানুম নুসরাত আমীন সমকালীন সমাজ ব্যবস্থা দ্বারা প্রভাবিত নারী সমাজের গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেয়ায় খুবই ব্যথিত ছিলেন। তিনি বলতেন : ‘মহিলারা যদি তাদের মর্যাদা বুঝতে পারত, তারা যদি জানত যে, এ বিশ্ব ব্যবস্থায় তাদের কী ভূমিকা রয়েছে এবং আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি কী রহমত করেছেন তাহলে তারা সমাজে এতখানি নিগৃহীত হতো না।’

সমাজ ও ধর্মের প্রতি এই দায়িত্ববোধের কারণেই এ মহীয়সী ‘মক্তবে ফাতেমা’ নামে একটি মহিলা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা নারী সমাজের জন্য এক জ্ঞানগত ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে রূপ নেয়। যার ফলে শিক্ষানুরাগী মহিলারা ফিকাহ, উসূল, হিকমাত, আধ্যাত্মিকতা, দর্শন ও নীতিবিজ্ঞান প্রভৃতি ইসলামী বিষয়ে উচ্চতর জ্ঞানচর্চায় ব্রতী হয়। এই তৎপরতা এখনো অব্যাহত রয়েছে। শিক্ষা বিতরণের ক্ষেত্রে এই মাদ্রাসার ভূমিকা খুবই প্রশংসনীয়। এ মাদ্রাসার সকল ব্যয়ভার খানুম নুসরাত আমীন নিজেই বহন করতেন। তাঁর মৃত্যুর পরও তাঁর গৃহীত ব্যবস্থা অনুযায়ী ব্যয় নির্বাহ হতে থাকে।

যেহেতু অনেক হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক পুরুষ ছিলেন এবং স্কুলে বোরকা পরিধান নিষিদ্ধ ছিল তাই ধর্মীয় পরিবারগুলোই স্কুলে গিয়ে মেয়েদের পড়াশুনা করতে দিত না। এ কারণে তিনি বালিকাদের জন্য একটি পৃথক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।

তিনি বই-পুস্তক ও প্রবন্ধ লিখে, ইসলামী শিক্ষার ক্লাস চালু ও তাফসীর মাহফিলের মাধ্যমে আর শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব ও দিক-নির্দেশনা দিয়ে বিরাট সাংস্কৃতিক অবদান রাখেন। তিনি যদিও ঘরে বসেই পড়াশুনা ও জ্ঞান-গবেষণায় রত ছিলেন, কিন্তু সময়ের দাবিতে ইসলামের জন্য বিপদাশঙ্কা দেখা দিলে তিনি ঘরের বাইরেও পা রাখেন এবং ‘বিশ্ব ইসলামী কেন্দ্র’র আহ্বানে সাড়া দিয়ে সাপ্তাহিক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে নিয়মিত বক্তৃতা প্রদান করতেন।

মহীয়সী নুসরাত আমীনের কয়েকটি উপদেশ

খানুম নুসরাত আমীন সবসময় মহিলাদের উপদেশ দিতেন : ‘আপনারা সর্বক্ষণ জ্ঞান অর্জনে সচেষ্ট হোন।’ বিশেষত তিনি মহিলা সমাজ থেকে বিদগ্ধ আলেম ও মুজতাহিদ তৈরির জন্য বিশেষভাবে তাগিদ দিতেন।

যেসব মহিলা ঘরের বাইরে কর্মজীবনে জড়িত হতে চাইতেন, তাঁদের প্রতি খানুম আমীনের উপদেশ ছিল- ‘ইসলামী হিজাব পুরোপুরি পালন এবং শরীয়তের হুকুম-আহকামগুলো সঠিকভাবে অনুসরণের মাধ্যমে কর্মস্থলে উপস্থিত হবেন। অন্যথায় আপনাদের কাজ ও আমল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের সহায়ক হবে না।’

পড়াশুনায় আগ্রহী মেয়েদের তিনি বলতেন : ‘পাঠ্য জীবনের কষ্টগুলো সহ্য করে যাও। যে কোন কিছুর বিনিময়ে পড়াশুনা অব্যাহত রাখ। কেননা, সমাজ জীবনের বিভিন্ন স্তরে ভালো ও যোগ্য লোকের অভাব প্রচণ্ডভাবে অনুভূত হচ্ছে।’

সাংসারিক কাজকর্মে জড়িত মহিলাদের প্রতি খানুম আমীনের উপদেশ ছিল, যে কোন সুযোগে তাঁরা পড়াশুনা করবেন। যাতে অজ্ঞতার কারণে তাঁদের দ্বারা পরিবারের অধিকার লঙ্ঘন না হয়। অথবা আল্লাহ না করুন তাঁরা এমন ভুল করে না বসেন যার ক্ষতিপূরণ পরবর্তীকালে সম্ভবপর না হয়। তিনি প্রায় সময় বলতেন : ‘নিজের অবস্থার প্রতি নজর রাখ। প্রথমে নিজের সাথেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবে, এরপর প্রতিদিন তার ওপর নজর রাখবে। পরিশেষে আত্মজিজ্ঞাসা করবে। যখন তোমার দ্বারা কোন অন্যায় কাজ হয়ে যায় সাথে সাথে নাফ্‌সকে তিরস্কার করবে।’

নুসরাত আমীনের লেখা গ্রন্থসমূহ

খানুম নুসরাত আমীনের বইগুলো তাঁর সুমহান ব্যক্তিত্ব ও উন্নত হৃদয়ের পরিচায়ক। অনুরূপভাবে এই মহীয়সী নারীকে চেনার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে তাঁর রচনাবলি। তিনি যেহেতু নিজেকে সবসময় গোপন রাখতে চাইতেন সেহেতু তাঁর রচনাবলি বানুয়ে ইসফাহানী অর্থাৎ খানুম ইসফাহানী বা খানুম ইরানী এই ছদ্মনামে লিখতেন। তাঁর কিতাবগুলোর নাম ও সেগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এখানে উল্লেখ করা হলো :

১. আরবাইনুল হাশেমিয়া : এটি আরবি ভাষায় লেখা তাঁর প্রথম গ্রন্থ। এই গ্রন্থে আল্লাহ তাআলার তাওহীদ ও গুণাবলি এবং শরীয়তের হুকুম ও চরিত্র সম্পর্কে দার্শনিক, আধ্যাত্মিক ও ফিকাহগত বিশ্লেষণসহ চল্লিশটি হাদীসের ব্যাখ্যা রয়েছে। কিতাবটি আরবি থেকে ফারসিতে অনুবাদ করেন খানুম হুমায়ুনী। কিতাবটির বিষয়বস্তু এতই সূক্ষ্ম ও গুরুত্বপূর্ণ যে, নাজাফের আলেমগণ এবং কয়েকজন ঘনিষ্ঠ স্থানীয় আয়াতুল্লাহ ‘মারজা’ বিভিন্ন প্রশ্ন ও পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে বাধ্য হন। শেষ পর্যন্ত সব কঠিন পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি মুজতাহিদের পদমর্যাদা লাভ করেন।

২. কিতাবুশ শাত্তাত : এ গ্রন্থটিও আরবি ভাষায় লেখা এবং বিভিন্ন জিজ্ঞাসার জবাব সম্বলিত। অধ্যাপক মুহাম্মাদ আলী কাজী তাবাতাবায়ী এবং অধ্যাপক সাইয়্যেদ হাসান আল হুসাইনীর মতো ব্যক্তিত্বরা তাঁর কাছে যেসব প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন এবং তার জবাবে তিনি যা লিপিবদ্ধ করেন তাই এ বইতে সন্নিবেশিত হয়েছে।

৩. মাআদ ইয়া আখেরীন সেইরে বাশারিয়াত : এটি আখেরাত বা পরকাল সম্পর্কিত একটি উপদেশমূলক কিতাব।

৪. আন নাফাহাতুর রাহমানিয়া ফিল ওয়ারেদাতিল কালবিয়া : এই কিতাবটিতে আল্লাহর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে যা আল্লাহর পথে আধ্যাত্মিক পরিভ্রমণকালে এই আল্লাহ ওয়ালা নারী লাভ করেন। তিনি নিজের অন্তরে যেসব কাশ্ফ প্রত্যক্ষ করেছেন তা আরবি ভাষায় লিপিবদ্ধ করেছেন।

৫. আখলাক : কিতাবটি ইবনে মুসকুভিয়ার طهارة الاعراق কিতাবের একটি সংক্ষিপ্ত অনুবাদ। খানুম আমীন এ কিতাবের বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর মতামতগুলো টীকা আকারে উপস্থাপন করেন। কিতাবটি জ্ঞানগত, বাস্তব কর্মগত ও চরিত্র সম্পর্কিত।

৬. মাখজানুল এরফান : এটি ১৫ খণ্ডে সমাপ্ত পবিত্র কুরআন মজীদের তাফসীর। এই তাফসীর লেখার পর এই বিদুষী নারীই ইসলামের ইতিহাসে একমাত্র মহিলা মুফাসসিরের মর্যাদায় অভিষিক্ত হন- যিনি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কুরআন মজীদের বিশদ তাফসীর সমাপ্ত করেন।

৭. ‘রাভেশে খোশবাখতী ওয়া তাওসীয়ে বে খা’হারানে ঈমানী : গ্রন্থটিতে জীবনে সৌভাগ্যের অর্থ এবং তা লাভের উপায়সমূহ খুব সহজ ও সরল ভাষায় বর্ণনা করার চেষ্টা করা হয়েছে ঈমানদার বোন ও নারীদের উদ্দেশ্যে। এতে সৌভাগ্যের দু’টি প্রধান স্তম্ভ অর্থাৎ দেহের ও মনের সুস্থতা এবং চিন্তা ও আত্মার প্রশান্তি আর এ দুটি মূল স্তম্ভের উৎস যে পরকালে বিশ্বাস এবং সচ্চরিত্রতা তা বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে। গ্রন্থের শেষভাগে ইমামগণকে উসিলা হিসাবে গ্রহণ করা, শাফায়াতের গুরুত্ব এবং কুমন্ত্রণা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, নারীর বৈশিষ্ট্য, বিশেষত তার মর্যাদা, চরিত্র ও চারিত্রিক মূলনীতি প্রভৃতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

৮. মাখজানুল লায়ালী দার মানাকেবে মাওলাল মাওলা আলী আলাইহিস সালাম : একটি ভূমিকা, ১০টি অধ্যায় ও ১টি উপসংহারের সমন্বয়ে লিখিত এই গ্রন্থটি হযরত আলী (আ.)-এর গুণাবলি সম্পর্কিত। তিনি সহজভাবে সবার জন্য বোধগম্য ভাষা ব্যবহার করেছেন এই গ্রন্থে।

৯. সেইর ওয়া সুলুক দার রাভেশে আউলিয়া ওয়া তারিকে সাইরে সুয়াদা : কাশ্‌ফ, শুহুদ ও সাইর ইলাল্লাহ সম্পর্কিত এ গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের এক স্থানে তিনি লিখেন- ‘যতক্ষণ নিজ থেকে বিলীন না হবে ততক্ষণ তার মধ্যে স্থিতি লাভ করবে না। যতক্ষণ নিজের কাছে যা আছে সবই হারিয়ে না ফেলবে ততক্ষণ সেই পবিত্র হেরেমে প্রবেশাধিকার পাবে না। যতক্ষণ আশার প্রদীপ নিয়ে দূর-দূরান্তে সফর না করবে ততক্ষণ নিরাপদে নির্বিঘ্নে আপন ঘরে তোমার স্থায়িত্ব হবে না।’

খানুম নুসরাত আমীন ৯৭ বছর বয়সে ১৯৮৩ সালে ইন্তেকাল করেন।

ঢাকায় আন্তর্জাতিক প্রামাণ্য ও স্বল্পদৈর্ঘ চলচ্চিত্র উৎসব

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আকর্ষণীয় প্রামাণ্য চিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ চলচ্চিত্র প্রদর্শণীর মধ্যদিয়ে ৫ সেপ্টেম্বর শনিবার শেষ হয়েছে দুই দিন ব্যাপী আন্তর্জাতিক প্রামাণ্য ও স্বল্পদৈর্ঘ চলচ্চিত্র উৎসব। বাংলাদেশ, ভারত, ইরান, রাশিয়া, জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এই চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নেয়। রাজধানী ঢাকার শিল্পকলাএকাডেমির আর্ট গ্যালারীতে শুক্রবার থেকে এই চলচ্চিত্র উৎসব শুরু হয়। ঢেকিপ্রযোজনা আয়োজিত এই আন্তর্জাতিক প্রামাণ্য ও স্বল্পদৈর্ঘ চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধন

করেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম এমপি।অনুষ্ঠানে প্রতিমন্ত্রী বলেন, একটি মানসম্পন্ন প্রামাণ্য চিত্র বা একটি স্বল্প দৈর্ঘ চলচ্চিত্রএকজন মানুষ বা একটি সমাজকে বদলে দিতে পারে। যার নজির বাংলাদেশেই
রয়েছে। অনুষ্ঠানের আহবায়ক সাইফুল ইসলাম বাদল বলেন, একটা চলচ্চিত্রের প্রাণহলো দর্শক। হৃদযন্ত্র ছাড়া একজন মানুষ যেমন বাঁচতে পারে না, তেমনি একটিচলচ্চিত্র যদি দর্শকনন্দিত না হয়, তাহলে তার কোন মূল্য থাকতে পারে না। অনুষ্ঠানে ঢাকাস্থ ইরানি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের লচারালকাউন্সেলর সাইয়্যেদ মুসাহুসাইনী বলেন, চলচ্চিত্র হলোএমন একটা শিল্প যা মানুষের
বিনোদন জগতের অন্যতমআকর্ষণীয় দিক এবং সাংস্কৃতিকজগতে এটি দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবফেলতে সক্ষম। দর্শকদেরচাহিদার বিষয়টি মাথায় রেখেযদি পেশাদারিত্বের সঙ্গে চলচ্চিত্রনির্মাণ করা হয় তাহলে তাপ্রামাণ্য চিত্র বা স্বল্পদৈর্ঘ চলচ্চিত্রহলেও এরমাধ্যমে র্শকদের
কাছে সবচেয়ে কার্যকরি ওসুস্পষ্ট বার্তা পৌছে দেয়া সম্ভব। যেমটি একজন কবির ছোট্ট একটি কবিতায় মানব চরিত্রের মূল্যবান বাণি আমাদের স্মৃতিতে স্থায়ীভাবেজায়গা করে নেয়। ইরানে চলচ্চিত্র শিল্পের সফলতার বিভিন্ন দিক তুলে ধরে মুসা হুসাইনী বলেন, ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের পর থেকেবিগত বছরগুলোতে ইরানের চলচ্চিত্র শিল্প চলচ্চিত্র জগতে দর্শকদের কাছে একটা নতুন মাত্রা যোগ করেছে।তিনি বলেন, বিশ্বের অধিকাংশ চলচ্চিত্র নির্মাতারা যখন যৌনতাকে তাদের বাণিজ্যিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে সস্তা বিনোদনেরঅংশ হিসেবে দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে তখন ইরানের চলচ্চিত্র নির্মাতারা তাদের পেশাগত দক্ষতা ও নান্দনিক শিল্পকর্মকেকাজে লাগিয়ে এবং সামাজিক, চারিত্রিক ও মানবিক মূল্যবোধগুলোকে ব্যবহার করে চলচ্চিত্র জগতে দর্শকের কাছে একটা ভিন্ন মাত্রা যোগকরেছে। যে কারণে ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের পর থেকে ইরানের চলচ্চিত্র শিল্প একটা সফল চলচ্চিত্র শিল্প হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেজায়গা করে নিয়েছে। আর এই সফলতার অংশ হিসেবেই অস্কার ও কান পুরস্কার সহ বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কারে সমৃদ্ধ হয়েছে ইরানেরচলচ্চিত্র শিল্প।

সম্প্রতি ইরানসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশে মুক্তি পাওয়া ইরানের বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতামাজিদ মাজিদির নির্মিত চলচ্চিত্র মুহাম্মদ (সা:) প্রসঙ্গে ঢাকাস্থ ইরানের কালচারালকাউন্সেলর বলেন, ইরান ও দক্ষিণ আফ্রিকায় এই ফিল্মের জন্য শ্যুটিং করা হয়।

এইফিল্মটি তৈরি করতে সময় লেগেছে প্রায় ৭ বছর এবং ব্যয় হয়েছে কয়েক মিলিয়নডলার।সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কোন লোক লেখক বিশেষ করে কোন কোন পশ্চিমা শিল্পী যখন রাসুল (সা:)কে নেতিবাচকভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করছিল তখন জনাব মাজিদি এমন একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় যেখানে রাসুল (সা:)এর রহমতপূর্ণব্যক্তিত্বের বাস্তব চিত্র ফুঁটে উঠে। তিনি মানুষের রহমত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন

তা যেন বিশ্বাবসীর কাছে তুলে ধরা যায়। যেমনটি মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,ওয়ামা আরসালনাকা ইল্লা রাহমাতুল্লিল আলামামিন। আমি তোমাকে বিশ্বজগতের জন্যরহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি। আশা করছি এই ফিল্ম ইরান ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশেরপাশাপাশি বাংলাদেশী দর্শকদের হৃদয়ে জায়গা করে নিবে।