সাক্ষাৎকার
শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় আন্তঃসাংস্কৃতিক সংলাপ অপরিহার্য- বিশেষ সাক্ষাৎকারে প্রফেসর মুহিবুল্লাহ সিদ্দিকী
গত ১৩-১৫ জানুয়ারি, ২০১৮ ইরানে আয়োজিত ‘এশিয়ান কালচারাল ডায়ালগ অন কালচারাল ডাইভারসিটি অ্যান্ড কোঅপারেশন’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে অংশগ্রহণ করেন সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. আ ন ম মেশকাত উদ্দিন, ডেফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য প্রফেসর ড. ইউসুফ মাহবুবুল ইসলাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রফেসর ড. মুহিবুল্লাহ সিদ্দিকী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের প্রফেসর ড. শফিকুল আলম। সম্মেলনকে কেন্দ্র করে নিউজলেটারের পক্ষ থেকে প্রফেসর ড. মুহিবুল্লাহ সিদ্দিকী ও প্রফেসর ড. শফিকুল আলম এর সাক্ষাৎকার পাঠকদের উদ্দেশে পত্রস্থ হলো:
প্রশ্ন ১ : অনুগ্রহ করে গত ১৩-১৫ জানুয়ারি, ২০১৮ ইরানে আয়োজিত ‘এশিয়ান কালচারাল ডায়ালগ অন কালচারাল ডাইভারসিটি অ্যান্ড কোঅপারেশন’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের ব্যবস্থাপনা ও অর্জন সম্পর্কে কিছু বলুন।
প্রফেসর ড. মুহিবুল্লাহ সিদ্দিকী : গত ১৩-১৫ জানুয়ারি, ২০১৮ ইরানে আয়োজিত ‘এশিয়ান কালচারাল ডায়ালগ অন কালচারাল ডাইভারসিটি অ্যান্ড কোঅপারেশন’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো থেকে যাত্রা শুরু পর্যন্ত ঢাকাস্থ ইরান দূতাবাস পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। অতঃপর তেহরান পৌঁছলে বিমান বন্দরে ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরা আমাদের অভ্যর্থনা জানান। বিমান বন্দর থেকে তেহরান শহরের মাঝে ফাইভ স্টার মানের হোটেল লালেহ এ নিয়ে যায়। সেখানে প্রাতঃরাশ শেষ করে গুলিস্তান প্যালেস পরিদর্শনে যাই। সেখান থেকে ইরানের ঐতিহ্যবাহী দুপুরের ভোজ গ্রহণের জন্য ফেরদৌসী হোটেলের আন্ডার গ্রাউন্ডে একটি ডাইনিং এ গমন করি। যে ডাইনিং রুমে পারস্যের ঐতিহ্যবাহী গান পরিবেশনসহ খাদ্য গ্রহণের ব্যবস্থা রয়েছে। দুপুরের ভোজের পরে আমরা ইরানের জাতীয় জাদুঘর পরিদর্শন করে হোটেলে ফিরে রাত্রের খাবার গ্রহণ করে ঘুমিয়ে যাই। পরের দিন সকাল ৮টার মধ্যে সকালের নাস্তা সেরে আমরা ইরানের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগদান করি। উক্ত অনুষ্ঠানে ইরানের ৩ জন মন্ত্রী, আফগানিস্তানের ১ জন মন্ত্রী, ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতির দূত, তুরস্কের রাষ্ট্রপতির দূতসহ বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি বক্তৃতা করেন। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী সকল বিশেষজ্ঞ শিক্ষাবিদই শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য সাংস্কৃতিক সংলাপের অপরিহার্যতা স্বীকার করে তাকে এগিয়ে নেয়ার পক্ষে মন্তব্য করেন। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনায় সেখানে এশিয়ার ২১টি দেশের প্রতিনিধিত্বের সাথে দুপুরের খাবার গ্রহণ করি। ইতিমধ্যে কয়েকটি টিভি চ্যানেল আমার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। এ অনুষ্ঠানে শেষে আমরা তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে যাই- Indian Subcontinent বিভাগের অংশগ্রহণকারীরা মাশহাদে চলে যান ও South East Asia বিভাগের অংশগ্রহণকারীরা তেহরানে থেকে যান। আমার কাছে মনে হয়েছে আমরা বেশি ভাগ্যবান। কারণ, মাশহাদ হচ্ছে Holy City। এখানে ইমাম রেযা (আ.)-এর মাযার রয়েছে। তাছাড়া আমাদের অনুষ্ঠান হয় ফেরদৌসী ইউনিভারসিটি অব মাশহাদে। বিকালে আমরা মহান এয়ার লাইন্স এর একটি বিমানে মাসহাদ চলে যাই। যতদিন মাশহাদে ছিলাম ততদিন আবান হোটেলে ছিলাম। আমাদের কার্যক্রম চলে ফেরদৌসী বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাছাড়া ইমাম রেযা ও মহাকবি ফেরদৌসীর মাযার যিয়ারতের সুযোগ হয়েছে। তাঁদের ব্যবস্থাপনা ত্রুটিমুক্ত ছিল। আমার অভিজ্ঞতা রয়েছে দেশ-বিদেশে বহু সম্মেলনে অংশগ্রহণের, প্রবন্ধ উপস্থাপন এবং সেশন সভাপতির দায়িত্ব পালনের। ইরানের অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাঁদের ব্যবস্থাপনায় আমরা সকলে অভিভূত।
প্রফেসর ড. এম শফিকুল আলম : ইরানে আয়োজিত গত ১৩-১৫ জানুয়ারি, ২০১৮ তেহরান ও ফেরদৌসি ইউনিভার্সিটি, মাশহাদ-এ অনুষ্ঠিত ‘এশিয়ান কালচারাল ডায়ালগ অন কালচারাল ডাইভারসিটি অ্যান্ড কোঅপারেশন’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলন ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন। আমাকে উক্ত সম্মেলনে যোগদানের আমন্ত্রণ জানানোর জন্য সম্মানিত আয়োজকম-লীকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। বিশেষ করে ইরানের আতিথেয়তার কথা ভুলবার নয় এবং তা প্রশংসার যোগ্য।
সম্মেলনে ২১টি দেশের প্রথিতযশা অধ্যাপক, শিক্ষক, উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও বিভিন্ন পর্যায়ের স্কলার, উর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা, মন্ত্রী, উপমন্ত্রীরা অংশগ্রহণ করেন। সম্মেলনের সামগ্রিক আয়োজন ও ব্যবস্থাপনা ভালো ছিল। যে লক্ষ্যে এই সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে, আমি মনে করি, তা যথার্থই সফল হয়েছে। তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত ঐ সেমিনারে যে সকল মূল্যবান গবেষণা প্রবন্ধ পঠিত ও আলোচিত হয়েছে তার একটি প্রভাব সম্মেলন শেষে লক্ষ্য করা গেছে। সম্মিলিতভাবে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ পরবর্তীকালে কার্যকর করা গেলে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে একটি সাংস্কৃৃতিক সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবার সম্ভাবনা তৈরি হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
প্রশ্ন ২ : এশিয়ান ডায়ালগ কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করতে সংক্ষিপ্ত ইরান সফরে বর্তমান ইরান সম্পর্কে আপনার ধারণা তুলে ধরবেন কি?
প্রফেসর মুহিবুল্লাহ সিদ্দিকী : ইতিহাসে পারস্য অভিযান পড়েছি এবং পড়িয়েছি। পৃথিবীর বহু দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তার প্রেক্ষিতে বলছি, আজকের ইরান অনেক বেশি এগিয়ে গেছে। আমার মনে হয়েছে, পৃথিবীতে একটি মাত্র মুসলিম দেশ যা সমগ্র বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ করতে সক্ষম হয়েছে। নারীরা সকল পেশায় দক্ষতার সাথে ও পর্দার সাথে কাজ করছে। যাতায়াত ব্যবস্থা খুবই উন্নত। শিক্ষা ব্যবস্থা মানসম্পন্ন। অর্থনৈতিক অবস্থার ভিত খুবই মজবুত। তাই একটি গোষ্ঠীর গাত্রদাহ।
প্রফেসর ড. এম শফিকুল আলম :এশিয়ান ডায়ালগ কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করতে ইরান সফরে আমি দ্বিতীয় বারের মতো সুযোগ পেলাম। ইতঃপূর্বে ১৯৯৯ সালে মোল্লা সাদরা ওয়ার্ল্ড কনফারেন্সে যোগ দেবার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। একই সময়ে সিরাজ পরিভ্রমণের সুযোগ হয়েছিল। সেসময় যে ইরান আমি দেখেছি, এবার ১৮ বছর পরে আমি আরও অনেক বেশি উন্নত এক ইরানকে দেখে অভিভূত হয়েছি। রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, সামাজিক বন্ধন ইত্যাদি উপলব্ধি করে আমি মুগ্ধ হয়েছি। বিশেষ করে সাম্প্রতিককালে তেহরানে স্থাপিত ১৪২ তলা ভবন ছিল অতি আকর্ষণীয়। তাছাড়া প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীসমূহ নিঃসন্দেহে অনবদ্য ও আকর্ষণীয়। আমার কাছে ইরানকে আধুনিক বিশ্বের উন্নত দেশসমূহের মতো সমৃদ্ধশালী উল্লেখযোগ্য একটি দেশ মনে হয়েছে। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় দিক থেকে ইরান অনেক অগ্রগামী এবং অনুসরণীয়।
প্রশ্ন ৩ : বহিঃবিশ্বে ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ডায়ালগ এর পরিবেশ সৃষ্টিতে ইরানের নেতৃবৃন্দের প্রচেষ্টা ও উপস্থাপনা সম্পর্কে আপনার কাছে জানতে চাই।
প্রফেসর মুহিবুল্লাহ সিদ্দিকী : ইরানের নেতৃবৃন্দের প্রচেষ্টায় এশিয়ার ২১টা দেশ হতে প্রায় শতাধিক নেতৃস্থানীয় অধ্যাপক ইরানের সাংস্কৃতিক সংলাপে অংশগ্রহণ করেছেন এটি নিঃসন্দেহে ইরানের বর্তমান নেতৃত্বের প্রতি বুদ্ধিজীবীদের আস্থাজ্ঞাপন।
উন্নত মানের অনুবাদ পদ্ধতি ইংরেজি ও ফারসি ভাষায় সীমানা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে। মারইয়াম নামে একজন গাইড আমাকে সবসময় সহায়তা করেছেন। এত সুন্দর অনুবাদ ব্যবস্থাপনা আমি খুব কম দেশে দেখেছি।
বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানগর্ভ উপস্থাপিত প্রবন্ধসমূহ খুবই মানসম্পন্ন বলে মনে হয়েছে। ইরানের জ্ঞানচর্চার মান সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করেই সিনিয়র অধ্যাপকবৃন্দ এ ধরনের প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়েছে।
সর্বোপরি আন্তর্জাতিক পরিম-লে ডায়ালগ এর পরিবেশ সৃষ্টিতে ইরানি নেতৃত্বের যোগ্যতা, আন্তরিকতা, দক্ষতা, সততা সকলের নিকট প্রশংসিত হয়েছে।
প্রফেসর ড. এম শফিকুল আলম : আমি মনে করি বহিঃবিশ্বে ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ডায়ালগ এর পরিবেশ সৃষ্টিতে ইরানের নেতৃবৃন্দের প্রচেষ্টা ও উপস্থাপনা নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। আমি আশা করব ইরান এ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। ইরান ব্যতীত এশিয়ার অপর কোন দেশ এর নেতৃত্ব দিতে পারবে বলে এই মুহূর্তে আমি বিশ্বাস করতে চাই না। বরং এই ব্যাপারে ইরানের উদ্যোগকে আমি স্বাগত জানাই। সম্মেলনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গের নির্মোহ ও ঐকান্তিক পরিশ্রম সম্মেলনকে সার্থক করেছে। পরবর্তী সম্মেলনগুলোতেও ইরানের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা থাকা প্রয়োজন।
প্রশ্ন ৪ : ইরান ও বাংলাদেশের মাঝে সাংস্কৃতিক মিল বা অভিন্নতা সম্পর্কে আমাদের কিছু বলুন।
প্রফেসর মুহিবুল্লাহ সিদ্দিকী : ফারসি এদেশে (১২০০-১৮৩৭ খ্রি) ছয়শ’ বছরের বেশি রাজকীয় ভাষা ছিল। তাই বাংলা ভাষায় ৮০০০ এর অধিক ফারসি শব্দ রয়েছে যা ভাষায় ক্ষেত্রে এ অসাধারণ মিল বলে গণ্য করা যেতে পারে।
আমাদের দেশে সাদী, রুমী, হাফিজের প্রভাব অকল্পনীয়। কবি সাদীকে সাধারণ লোক শেখ সাদী (রহ.) বলে এবং মহানবী (সা.)-এর শানে তাঁর প্রণীত দরুদ সমগ্র দেশে পঠিত হয়। চট্টগ্রামে আল্লামা রুমী সোসাইটি নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে। হাফিজের সাথে বাংলার সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের সম্পর্ক ইতিহাস স্বীকৃত। ফেরদৌসী প্রণীত ‘শাহনামা’ এক মহাকাব্য যা বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়ে বাংলা একাডেমী হতে প্রকাশিত হয়েছে। ইরান-বাংলাদেশ বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পর্ক এ ক্ষুদ্র পরিসরে আলোচনা সম্ভব নয়।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করতে গেলে খাদ্য ও পানীয় গ্রহণে সমস্যা হয়। কিন্তু সার্বক্ষণিক হালাল খাদ্য পাপ্তিতে ইরানে কোন সমস্যা নেই।
প্রফেসর ড. এম শফিকুল আলম : ইরান ও বাংলাদেশের মাঝে অনেকাংশে সাংস্কৃতিক মিল বা অভিন্নতা বিদ্যমান। তন্মধ্যে পারিবারিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধন উল্লেখযোগ্য। আমাদের দেশে এরূপ বন্ধন জীবনের সুখান্বেষণের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ইরানি সমাজেও তাই লক্ষ্য করলাম। পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন মানুষের মাঝে সাম্য, ঐক্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্ববোধ স্থাপনে সমভাবে সহায়ক হাতিয়ার। আমার কাছে সার্বিক দিক থেকে ইরানকে একটি সুখী, সমৃদ্ধশালী ও শান্তির দেশ মনে হয়েছে।
প্রশ্ন ৫ : ইরানের সাহিত্য ও ধর্মীয় সংস্কৃতির উত্তরাধিকার থেকে শান্তিপ্রত্যাশী অন্যান্য জনগোষ্ঠী কিভাবে উপকৃত হয়েছে সে সম্পর্কে কিছু বলুন।
প্রফেসর মুহিবুল্লাহ সিদ্দিকী : ফারসি সাহিত্যের আরও বেশি অনুবাদ এবং আরো বেশি সাংস্কৃতিক সংলাপ এর মাধ্যমে জাতিতে জাতিতে, গোত্রে-গোত্রে, রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে পরস্পরকে জানার মাধ্যমে আজকের বিশ্বের শান্তি প্রত্যাশী জনগোষ্ঠী উপকৃত হতে পারে। সঠিক জ্ঞান মহাজ্ঞানীর নিকট সংরক্ষিত।
প্রফেসর ড. এম শফিকুল আলম : ইরানের সাহিত্য ও ধর্মীয় সংস্কৃতির উত্তরাধিকার থেকে শান্তিপ্রত্যাশী অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মধ্যে বাংলাদেশ বিশেষত উপকৃত হয়েছে। বাংলাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রীয় চিন্তা-চেতনায় সুফি-দর্শন ও অন্যান্য মরমি-দর্শনের প্রভাব লক্ষণীয়। পারস্য সাহিত্যে সুফিবাদ শ্রেষ্ঠ স¤পদ। ওমর খৈয়াম, ফেরদৌসী, শেখ সাদী, জামী, রূমী- সকলেই এ সত্যের পথিক, সাধক, ভাবুক এবং সুফিবাদের প্রত্যক্ষ অনুশীলনকারী। বাংলাদেশে সুফি-প্রভাব আগমন ঘটে দ্বাদশ শতাব্দীতে। সুফিদের প্রচার কেন্দ্র হিসাবে বরেন্দ্র্র, রাঢ়, বঙ্গ ও চট্টলা খ্যাত। বাংলাদেশের প্রাচীন ভাবধারা পরিবর্তনের মূলে সুফি-প্রভাবই প্রধান। ঐ সকল সুফি বাংলাদেশে সে সময়ে না এলে ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসার এখানে ঘটত না। তাই বাংলাদেশে পারস্যের তথা ইরানের সাহিত্য ও ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রভাব লক্ষণীয়। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য, সংস্কৃতি, গান রচনার ক্ষেত্রে পারস্যের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এ প্রসঙ্গে নজরুলের গান ‘আমি রূপনগরের রাজকন্যা রূপের যাদু এনেছি, ইরান-তুরান পার হয়ে আমি তোমার দেশে এসেছি’ এদেশে ইরান-সংস্কৃতির প্রভাব নির্দেশ করে।
All posts by dreamboy
ইমাম বাকের (আ.)-এর দৃষ্টিতে জ্ঞান অন্বেষণের মূল্য
ইমাম বাকের (আ.)-এর দৃষ্টিতে জ্ঞান অন্বেষণের মূল্য
ফায়েয কারিমী :
আহলে বাইতের পঞ্চম ইমাম মুহাম্মাদ আবু জাফর আল বাকের (আ.) ৫৭ হিজরির রজব মাসের ১ তারিখে তাঁর জন্মের মাধ্যমে বিশ্বকে আলোকিত করেছিলেন। তিনি জ্ঞানের গুরুত্ব সম্পর্কে অনেক মূল্যবান কথা বলেছেন এবং মুসলমানদেরকে জ্ঞান অন্বেষণের আহ্বান জানিয়েছেন যেহেতু এটিই হলো প্রথম স্তম্ভ যার ওপর জাতিসমূহ ও লোকজনের জীবনযাত্রা নির্ভর করে। তিনি জ্ঞানী ও পণ্ডিত ব্যক্তিদেরও প্রশংসা করেছেন, যেহেতু তাঁরা হলেন সমাজের কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও পথনির্দেশনা দানের উৎস। এই বিষয়ে তাঁর থেকে বর্ণিত কয়েকটি বাণী এখানে তুলে ধরা হলো।
১. জ্ঞানের প্রশংসা
ইমাম আবু জাফর আল বাকের (আ.) জ্ঞানের প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেন : ‘জ্ঞান অর্জন কর, যেহেতু জ্ঞান হলো রক্ষক। জ্ঞান অন্বেষণ করা ইবাদত, এর অধ্যয়ন (আল্লাহর) প্রশংসা, এর প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হলো জিহাদ, এটি (অন্যদেরকে) শিক্ষাদান হলো সাদাকাহ এবং উপযুক্ত ব্যক্তিকে তা দান করা হলো (মহান আল্লাহর) নৈকট্য।’
জ্ঞান হলো বাগানের নির্দেশক স্তম্ভ। এটি একাকীত্বের ঘনিষ্ঠজন, নির্বাসিত অবস্থার সাথি, বিরহে বন্ধু, উপশমকারী পথপ্রদর্শক, বিপদে সাহায্য (কারী), বন্ধুদের সাথের ভূষণ এবং শত্রুদের বিরুদ্ধে অস্ত্র। এর দ্বারা আল্লাহ কিছুসংখ্যক ব্যক্তিকে উত্তম ব্যক্তিদের নেতা করেন। সুতরাং (মানুষজন) তাদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে এবং তাদের কর্মসমূহের আলোচনা করে। সকল সিক্ত ও শুষ্ক জিনিস, সাগরের তিমি ও কীটমূষিকাদি এবং জমিনের পশুপাখি তাদের জন্য আল্লাহর রহমত কামনা করে।’ (ইবনে হামাদান, আততাযকিরা, পৃ. ২৬)
এসকল বাণী যেভাবে জ্ঞানকে মহিমান্বিত, জ্ঞানী ও পণ্ডিতদের প্রশংসা এবং জ্ঞানের উপকারিতাসমূহ বর্ণনা করতে পারে তা অন্য কোন বাণীই পারে না। সুতরাং এই কথাগুলো জ্ঞান-গবেষণার স্থান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে লেখার জন্য সবচেয়ে যোগ্য।
২. জ্ঞানী ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের প্রশংসা
ইমাম বাকের (আ.) জ্ঞানী ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের প্রশংসা করেছেন। ইমাম বাকের (আ.) বলেন : ‘যে পণ্ডিত ব্যক্তির জ্ঞান (মানুষজন) ব্যবহার করে সে সত্তর হাজার ইবাদতকারীর চেয়ে উত্তম।’ (জামি বায়ানুল ইল্ম ওয়া ফাযলাহ, ১ম খ-, পৃ. ৩২)
ইমাম বাকের (আ.) বলেন : ‘যে কেউ হেদায়াতের একটি প্রবেশপথের শিক্ষা দেয়, সে যে ব্যক্তি তা বাস্তবায়ন করে তার মতো পুরস্কার পাবে। তাদের (যারা পথনির্দেশের বাস্তবায়ন করে) পুরস্কার থেকে কিছুমাত্র কম করা হবে না। (আর) যে কেউ ভ্রষ্টতার একটি প্রবশেপথের শিক্ষা দেয় তার জন্য রয়েছে যারা তা বাস্তবায়ন করে তাদের মতো বোঝা। তাদের (যারা ভ্রান্ত বিষয়কে বাস্তবায়ন করে) থেকে কিছুমাত্র কম করা হবে না।’ (উসুলে কাফী, ১ম খ-, পৃ. ৩৪)
ইমাম বলেন : ‘যে বান্দা প্রত্যুষে জ্ঞান অন্বেষনে বের হয় সে পুরোপুরিভাবে রহমতের মধ্যে প্রবেশ করে।’ (নাসিখ আত-তাওয়ারিখ, ২য় খ-, পৃ. ২০৫)
৩. প-িত ও ধার্মিক ব্যক্তিবর্গের সাথে সহযোগিতা
ইমাম বাকের (আ.) মুসলমানদেরকে পণ্ডিত ও ধার্মিক ব্যক্তিবর্গের পথনির্দেশ ও আচরণকে কাজে লাগানোর জন্য তাঁদের সাথে সহযোগিতা করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন : ‘নিশ্চয়ই যাকে আমি বিশ্বাস করি তার সাথে সহযোগিতা আমার কাছে এক বছরের কাজের চেয়েও নির্ভরযোগ্য।’ (উসুলে কাফী, ১ম খ-, পৃ. ৩৪)
৪. জ্ঞানের আলোচনা
ইমাম বাকের (আ.) মুসলমানদেরকে পরস্পরের সাথে জ্ঞানের আলোচনা করতে উপদেশ দিয়েছেন। কারণ, তা জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন নতুন দরজা উন্মোচন করে। তিনি বলেন : ‘জ্ঞানের আলোচনা হলো অধ্যয়ন, আর অধ্যয়ন হলো উত্তম ইবাদত।’ (উসুলে কাফী, ১ম খ-, পৃ. ৪১)
৫. ছাত্রদের জন্য উপদেশ
ইমাম বাকের (আ.) ছাত্রদের জন্য চমৎকার নিয়ম-কানুনের পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন : ‘যখন তুমি একজন পণ্ডিতের সাথে বসবে তখন তার সাথে কথা বলার চেয়ে তার কথা অধিক শ্রবণ করবে। ভালোভাবে শ্রবণ করা শিক্ষা কর যাতে তুমি ভালোভাবে বক্তব্য প্রদান করা শিক্ষা করতে পার। যখন সে বক্তব্য দেয় তখন তাকে বাধাগ্রস্ত করো না।’ (নাসিখ আত-তাওয়ারিখ, ২য় খ-, পৃ. ২০৫)
৬. জ্ঞানের প্রচার
ইমাম বাকের (আ.) পণ্ডিতদেরকে জ্ঞানের প্রচার ও বিস্তৃতি ঘটানোর উপদেশ দিয়েছেন, যাতে কেউ অজ্ঞ না থাকে। তিনি বলেন : ‘জ্ঞানের যাকাত হলো তুমি আল্লাহর বান্দাদেরকে তা শিক্ষা দেবে।’ (উসুলে কাফী, ১ম খ-, পৃ. ৪১)
তিনি আরো বলেন : ‘যে জ্ঞান শিক্ষা করে সে তার মতো পুরস্কার পাবে যে তা শিক্ষাদান করে, এবং তার চেয়ে উত্তম হবে। পণ্ডিতদের নিকট থেকে জ্ঞান শিক্ষা কর। অতঃপর তা তোমার ভাইদেরকে শিক্ষা দাও যেভাবে পণ্ডিত ব্যক্তিরা তা তোমাকে শিক্ষা দিয়েছে।’ (নাসিখ আত-তাওয়ারিখ, ২য় খ-, পৃ. ২০৫)
৭. মুসলমানদেরকে জ্ঞান শিক্ষা করার আহ্বান
ইমাম বাকের (আ.) মুসলমানদেরকে জ্ঞান শিক্ষা করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন এবং এ সম্পর্কে জ্ঞানী ব্যক্তিদেরকে জিজ্ঞাসা করতে বলেছেন। তিনি বলেন : ‘জ্ঞান হলো গুপ্তভাণ্ডার এবং এর চাবি হলো প্রশ্ন করা। অতঃপর, আল্লাহ তোমাদের ওপর রহম করুন, জিজ্ঞাসা কর (পণ্ডিতদের)। নিশ্চয়ই চার ব্যক্তি জ্ঞানের কারণে পুরস্কৃত হবে : প্রশ্নকারী, বক্তা, শ্রোতা এবং যে তাদেরকে ভালোবাসে।’ (আল খিসাল, পৃ. ২২৩)
হযরত যায়নাব বিনতে আলী (আ.)
হযরত যায়নাব বিনতে আলী (আ.)
মো. আশিফুর রহমান
হযরত যায়নাব (আ.) ৫ম (মতান্তরে ৬ষ্ঠ) হিজরির ৫ই জমাদিউল আউয়াল পবিত্র মদিনা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন হযরত আলী (আ.) ও হযরত ফাতিমা (আ.)-এর তৃতীয় সন্তান। তাঁর জন্মের সময় তাঁর নানা মহানবী (সা.) মদিনার বাইরে অবস্থান করছিলেন। এজন্য হযরত ফাতিমা (আ.) হযরত আলীকে এই শিশুসন্তানের নাম রাখার জন্য অনুরোধ করেন। হযরত আলী (আ.) তাঁর প্রথম দুই সন্তান ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনের নামকরণের মতোই তাঁর নামকরণের বিষয়টি মহানবী (সা.)-এর জন্য রেখে দেন। মহানবী (সা.) তিন দিন পর মদিনায় প্রত্যাবর্তন করলে হযরত আলী (আ.) তাঁকে কন্যাসন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সুসংবাদ দান করেন এবং তাঁর নাম রাখার জন্য অনুরোধ করেন। মহানবী (সা.) তাঁর নামকরণের ব্যাপারে ওহীর অপেক্ষা করতে থাকেন। হযরত জীবরাইল (আ.) অবতীর্ণ হয়ে বলেন : ‘হে আল্লাহর রাসূল! মহান প্রভু আপনাকে সালাম জানিয়ে বলেছেন : এ শিশুর নাম রাখুন ‘যায়নাব’, কেননা, এ নামকে লওহে মাহফুজে লিপিবদ্ধ করেছি।’ মহান আল্লাহর কাছে এ নামটি এত সম্মানিত কেন তা হযরত যায়নাবের জীবন ও কর্মের দিকে লক্ষ্য করলেই আমরা বুঝতে পারব।
মহানবী (সা.) তাঁর নাতনিকে তাঁর নিকট আনতে বললেন। নবজাতক এ শিশুকে মহানবীর কোলে দিলে তিনি তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং তাঁর নাম রাখলেন ‘যায়নাব’ যার অর্থ হলো ‘পিতার সৌন্দর্য’।
কুনিয়াত ও উপাধি
হযরত যায়নাব (আ.)-এর কুনিয়াত হচ্ছে উম্মুল হাসান, উম্মু কুলসুম। হযরত যায়নাব (আ.)-এর জ্ঞান, ধার্মিকতা ও চরিত্রের বিভিন্ন দিক এমনভাবে প্রকাশিত হয়েছিল যে, মুসলমানরা তাঁকে বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত করেন। তাঁর প্রসিদ্ধ উপাধিগুলো হচ্ছে : সিদ্দিকাহ আস-সোগরা, ওয়ালিয়াতুল্লাহিল উজমা, নামুসুল কোবরা, শারিকাতুল হুসাইন (আলাইহিমাস সালাম), আলেমাহ গায়রু মুয়াল্লিমাহ, ফাদ্বিলাহ, কামিলাহ ইত্যাদি।
শৈশবকাল
হযরত যায়নাবের শৈশবকাল মহানবী (সা.), হযরত আলী, হযরত ফাতেমা ও তাঁর দুই ভাইয়ের সান্নিধ্যে অতিবাহিত হয়। ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সাথে তাঁর ছোট বোন হযরত যায়নাবের অন্যরকম সম্পর্ক ছিল। হয়তো ভবিষ্যতে ইমাম হোসাইনের ওপর যে বিপদ নেমে আসবে সেই বিপদের সাথি হতেই মহান আল্লাহ তাঁদের মধ্যে এই সম্পর্ক তৈরি করে দিয়েছিলেন। বর্ণিত হয়েছে যে, যখন হযরত যায়নাব শিশু অবস্থায় ক্রন্দন করতেন তখন ইমাম হোসাইনের কোলে দেয়া হলেই তিনি শান্ত হয়ে যেতেন। ইমাম হোসাইনের সান্নিধ্যেই যেন তিনি সবচেয়ে বেশি প্রশান্তি লাভ করতেন। আর একারণেই যখন বয়োপ্রাপ্তির পর হযরত যায়নাবের বিবাহের সম্বন্ধ আসতে থাকে তখন তিনি এ শর্তে বিবাহে রাজি হন যে, প্রতিদিন তাঁকে ইমাম হোসাইনের সাথে দেখা করতে যেতে দিতে হবে এবং ইমাম হোসাইন যেখানেই সফর করবেন তাঁকেও সেই সফরে তাঁর সাথে যেতে দিতে হবে। হযরত জাফর তাইয়্যারের সন্তান হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জাফর এ শর্তে রাজি হলে তাঁদের মধ্যে বিবাহ সম্পাদিত হয়। বিয়ের পর প্রতিদিন তিনি সকাল-বিকাল ভাইয়ের সাথে দেখা করতে আসতেন।
মাত্র ছয় বছর বয়সে হযরত যায়নাব তাঁর নানা ও পরম মমতাময়ী মাতাকে হারান। এরপর হযরত আলী তাঁকে সযতেœ প্রতিপালন করেন।
শিক্ষা
হযরত যায়নাব (আ.) রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের সদস্যদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পুণ্যময় জীবন যাপন, ইবাদতে নিষ্ঠা, সাহসী ও নির্ভীকচিত্ত হওয়া, অত্যাচারের মোকাবেলা, ধৈর্যধারণ ইত্যাদি শিক্ষা লাভ করেন নিজ পরিবার হতে। মায়ের ইন্তেকালের পর হযরত আলী (আ.) তাঁকে সকল বিষয়ে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেন। হযরত যায়নাবের শিশুকাল থেকেই হযরত আলী (আ.) তাঁর সাথে ধর্মীয় বিষয়াদি নিয়ে কথা বলতেন। তিনি এমনভাবে তাঁকে শিক্ষা দেন যে, খুব অল্প বয়সেই হযরত যায়নাব (আ.) পা-িত্য অর্জন করেন। ইমাম হোসাইনের সাথে সকাল-বিকাল দেখা করার বিষয়টি কি কেবলই সাক্ষাৎ ছিল? আমরা জানি না, হয়তো তাঁরা ধর্মের কোন বিষয় নিয়ে কথা বলতেন, হয়তো নানা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ইসলাম প্রচার, তাঁর জীবনী ও তাঁর শিক্ষা, নানীর আত্মত্যাগ, বাবা-মায়ের আত্মত্যাগ, ধর্মের গভীর বিষয়, কোরআনের তাফসীর, হাদিসের আলোচনা, ইসলামের খুঁটিনাটি বিষয় আলোচনা করতেন।
যাই হোক একথাটিও বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত যায়নাব (আ.) অন্তর্জ্ঞানের অধিকারিণীও ছিলেন। এজন্য তাঁর অন্যতম উপাধি হলো ‘আলেমাহ গায়রু মুয়াল্লিমাহ’ অর্থাৎ শিক্ষক ব্যতীতই শিক্ষিতা।
হযরত যায়নাব (আ.) মদীনায় তাঁর গৃহে নিয়মিত ধর্মীয় ক্লাস চালু করেন। ঘরে ঘরে গিয়ে তিনি নারীদেরকে তাঁর ক্লাসে অংশগ্রহণের আহ্বান জানাতেন। তিনি বলতেন : ‘তোমাদের মধ্যে কারা কোরআনের সাথে পরিচিত হতে আগ্রহী?’ একদিন তাফসীর, একদিন তাজভীদ, একদিন আকীদা-বিশ্বাস, একদিন আহকাম এভাবে সপ্তাহের দিনগুলোকে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দেয়ার জন্য নির্ধারণ করেন। যখন তিনি তাঁর পিতার সাথে কুফায় চলে যান তখন সেখানেও তিনি একইভাবে ধর্মীয় ক্লাস চালু করেন।
তিনি যেমন অন্যদেরকে জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন তেমনি নিজের সন্তানদেরও একই শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তাঁদেরকে ইসলামের পথে আত্মোৎসর্গী করে গড়ে তুলেছিলেন।
দানশীলতা
হযরত যায়নাব ছিলেন একজন দানশীলা নারী। তাঁর এ দানশীলতার বৈশিষ্ট্য শিশুকাল থেকেই দেখা যায়। একবার হযরত আলী (আ.) ঘরে একজন মেহমান সাথে নিয়ে আসেন। মেহমানকে দেয়ার মতো কোন খাবার ঘরে আছে কিনা তা তিনি হযরত ফাতিমার কাছে জানতে চান। হযরত ফাতিমা বলেন, শুধু একটি রুটি হযরত যায়নাবের জন্য রয়েছে। হযরত যায়নাব একথা শুনে তাঁর মাকে বলেন যেন তিনি মেহমানকে সেই রুটিই খাওয়ার জন্য দিয়ে দেন। তাঁর এ আত্মত্যাগ চরম কষ্টের মধ্যেও দেখা গেছে। যখন দামেশকে ইয়াযীদের কারাগারে তাঁরা বন্দি ছিলেন সে সময় একদিন হযরত যায়নুল আবেদীন (আ.) তাঁর ফুফু হযরত যায়নাবকে বসে ইবাদত করতে দেখে জিজ্ঞেস করেছিলেন : ‘হে ফুফু! আপনাকে সবসময় দাঁড়িয়ে ইবাদতে রত দেখেছি, কিন্তু আজকে আপনি বসে ইবাদত করছেন কেন?’ হযরত যায়নাব জবাবে বলেছিলেন যে তিন দিন ধরে তাঁর জন্য বরাদ্দ রুটিগুলো তিনি বাচ্চাদেরকে দিয়ে দিয়েছেন। আর তাই তাঁর শরীরে দাঁড়িয়ে ইবাদত করার মতো শক্তি ছিল না।
হযরত যায়নাবের কাছে যখনই কেউ কোন কিছু চেয়েছে সে খালি হাতে ফেরে নি। এমনই ছিল হযরত যায়নাবের দানশীলতা।
ইবাদত-বন্দেগি
হযরত যায়নাব ছিলেন ইবাদতে একনিষ্ঠ। তিনি ইবাদতের এই একাগ্রতা শিক্ষা লাভ করেছিলেন তাঁর মা হযরত ফাতিমাতুয যাহরা (আ.)-এর কাছ থেকে। হযরত ফাতিমা সারারাত জেগে জেগে ইবাদত করতেন। হযরত যায়নাব পাশে থেকে তা দেখতেন এবং সেভাবে চেষ্টা করতেন। কোন প্রতিকূলতাই হযরত যায়নাবকে ইবাদত থেকে বিরত রাখতে পারে নি। এমনকি আশুরার রাতেও আমরা তাঁর ইবাদতে একাগ্রচিত্ততার প্রমাণ পাই। ইমাম হোসাইনের মেয়ে ফাতিমা আশুরা রাতে হযরত যায়নাবের অবস্থা বর্ণনা করেছেন যে, আশুরার আগের রাতেও হযরত যায়নাব তাঁর ইবাদতের স্থানে দাঁড়ান এবং আল্লাহর কাছে দোয়ায় মশগুল হন। অথচ সেটি ছিল এমন রাত যে রাতে তাঁদের কেউ ঘুমান নি এবং তাঁদের কান্নার আওয়াজও কখনো থামে নি।
ইবাদত কেবল নামায পড়া ও রোযা রাখা বা তাসবীহ পাঠের মধ্যে সীমিত নয়। বরং মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে যে কোন কর্মকা-ই ইবাদত বলে পরিগণিত। আর এটি হযরত যায়নাবের চরিত্রে দেখা যায়। তিনি সকল কঠিন পরিস্থিতিতে ধৈর্যধারণ করেছেন। দুটি সন্তানকে কোরআন ও আহলে বাইতের জন্য উৎসর্গ করেছেন। নিজে বন্দ্বিত্ব বরণ করেছেন। ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-কে রক্ষা করেছেন, ইমাম হোসাইনের বিপ্লবকে বয়ে নিয়ে গেছেন। ইসলামের শিক্ষা প্রচার করেছেন। এভাবে আমৃত্যু তিনি ইবাদতপূর্ণ একটি মহান জীবন অতিবাহিত করেছেন।
ধৈর্যশীলতা
ধৈর্যশীলতা তাঁর রক্তে মিশে ছিল। ৬ বছর বয়সের সময় নানার ওফাত-পরবর্তী বেদনাদায়ক ঘটনার সাক্ষী ছিলেন, তাঁর মা খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতিমা যাহরার কষ্টকর জীবনকে প্রত্যক্ষ করেছেন। বাবা আলী (আ.)-এর সাথে উম্মতের আচরণে ব্যথিত হয়েছেন। নিজের চোখের সামনে পিতা আসাদুল্লাহকে শহীদ হতে দেখেছেন। বড় ভাই ইমাম হাসানের শরীর বিষে নীল হতে দেখেছেন। কিন্তু ধৈর্যের পরীক্ষার অনেকটাই বাকি ছিল- যে ঘটনার ভবিষদ্বাণী তিনি তাঁর পিতার মুখেই শুনেছিলেন। হযরত আলী (আ.) তাঁকে বলেছিলেন : ‘…আর আমি যেন দেখতে পাচ্ছি তুমি এবং তোমার পরিবারের নারীরা বন্দি অবস্থায় আছ এই শহরে, অসহায় ও ভয়াবহ অবস্থায়, আর আমি ভয় পাচ্ছি- না জানি লোকেরা তোমাদের আঘাত করে। সহ্য কর, সহ্য কর, তাঁর শপথ যিনি বীজ ভেঙ্গে দু’ভাগ করেন এবং মানুষ সৃষ্টি করেন, ঐদিন এ পৃথিবীর ওপর আল্লাহর আর কোন বন্ধু থাকবে না শুধু তোমরা সবাই, তোমাদের বন্ধুরা এবং তোমাদের অনুসারীরা ছাড়া।’
হযরত যায়নাব নিজেকে মানসিকভাবে তৈরি করেছিলেন সেই কষ্টের দিনগুলোকে পার করার জন্য। শুধু মুসলমান নয়; বরং সমগ্র মানবজাতির সামনে হযরত যায়নাব ধৈর্যশীলতার চরম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বিপদে-আপদে ও জীবনের প্রতিটি চড়াই-উৎরাইয়ে নিজেকে কিভাবে স্থির রাখতে হয় তার উজ্জ্বল নমুনা হযরত যায়নাব। কারবালার শহীদদের ক্ষুধা-তৃষ্ণা ছিল তিন দিন। তাঁদের কষ্ট ছিল। কিন্তু হযরত যায়নাব এরপর শারীরিক ও মানসিক কষ্ট সয়েছেন আমৃত্যু। কীভাবে তিনি খাবার মুখে দিতেন, কীভাবে তিনি পানি পান করতেন, যে ভাইকে না দেখে একটি দিনও থাকতে পারতেন না কীভাবে তিনি সেই ভাইয়ের বিরহ সহ্য করতেন, কীভাবে সন্তানদের হারানোর বেদনা সহ্য করতেন- দুটি সন্তান যে ঘরে থাকত সে ঘরে তিনি কী করে প্রবেশ করতেন? কীভাবে নিজেকে সামলে নিতেন?
মহান আল্লাহর প্রতি নিবেদিতপ্রাণ
হযরত যায়নাব ছিলেন মহান আল্লাহর প্রতি উৎসর্গিতপ্রাণ। তিনি ছিলেন সেই মহীয়সী নারী যিনি তাঁর শহীদ ভাইদের, সন্তানদের ও পরিবারের অন্য সদস্যদের শরীর কারবালার ময়দানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতে দেখেও বলেন, ‘আমি সৌন্দর্য ছাড়া আর কিছুই দেখি না।’
দামেশকের রাজপ্রাসাদে হয়তো ইয়াযীদ চেয়েছিল মহানবীর পরিবারের দুর্দশার বর্ণনা শুনতে, কারবালার ঘটনার করুণ বর্ণনা শুনতে। তাই সে হযরত যায়নাবকে জিজ্ঞেস করে যে তিনি কারবালায় কী দেখেছেন। কিন্তু হযরত যায়নাব ইয়াযীদকে চমকে দিয়ে জবাব দেন : ‘আমি সৌন্দর্য ছাড়া কিছুই দেখি নি।’
তিনি ইয়াযীদকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, যে কাজের জন্য আহলে বাইতের সদস্যরা দায়িত্বপ্রাপ্ত সে দায়িত্ব তাঁরা এত সুন্দরভাবে আঞ্জাম দিয়েছেন যার সাথে কোন কিছুর তুলনা হয় না। এমন নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর আনুগত্যই তো সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বসুন্দর।
মহান আল্লাহর প্রতি কতটুকু নিবেদিতপ্রাণ ও আস্থাবান হলে এ কথা বলা যায় তা আমাদের পক্ষে বোঝা প্রায় অসম্ভব। তাঁর কথা যেন ইমাম হোসাইন (আ.)-এর এ কথারই প্রতিধ্বনি- ‘(হে আল্লাহ) আপনার ফায়সালায় আমি সন্তুষ্ট।’
বাগ্মী হযরত যায়নাব
হযরত যায়নাব ছিলেন অত্যন্ত বাগ্মী। কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার পর কুফা ও শামের পথে এবং ইয়াযীদের দরবারে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছিলেন এটি হঠাৎ করেই পরিস্থিতির শিকার হয়ে নয়। তিনি বাগ্মিতার শিক্ষা নিয়েছিলেন তাঁর বাবা আলী মুর্তার্যা থেকে, তাঁর মা হযরত ফাতিমা থেকে। মাত্র ছয় বছর বয়সে তিনি খেলাফত ও ফাদাক ফলের বাগান সম্পর্কিত হযরত ফাতিমার দুটি প্রসিদ্ধ বক্তব্য হুবহু বর্ণনা করেছেন। শুধু বর্ণনা নয়, হযরত ফাতিমা যে ভঙ্গিতে ও ভাষায় বক্তব্য দিয়েছিলেন হযরত যায়নাব সেভাবেই তা প্রকাশ করেছেন। তিনি বাগ্মিতা শিখেছিলেন ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন থেকে।
কুফার বাজারে হযরত যায়নাব যখন ভাষণ দেন তখন সেখানে উবায়দুল্øাহ ইবনে যিয়াদের নিয়োগ করা হাজারেরও বেশি লোক হৈচৈ করছিল যাতে তাঁর কথা কেউ শুনতে না পায়। হযরত যায়নাব ভাষণ দেয়ার আগে শুধু হাত দিয়ে ইশারা করেন। তাঁর প্রবল ব্যক্তিত্বে প্রতিটি মানুষ নিশ্চুপ হয়ে যায়। বলা হয়েছে, তাঁর মধ্যে আল্লাহ প্রদত্ত যে শক্তি ছিল তা দিয়ে তিনি তাঁর শত্রুদেরকে পরাভূত করেন।
হযরত যায়নাব কুফাবাসীকে প্রচ-ভাবে তিরস্কার করেছেন। তিনি বলেন, ‘… হে কুফাবাসী! হে অহংকারী ব্যক্তিরা! হে প্রতারক ব্যক্তিরা! হে পেছনে পলায়নকারীরা! শুনে রাখ, তোমাদের কান্না যেন কখনো না থামে এবং তোমাদের বিলাপ যেন কখনো শেস না হয়। নিশ্চয়ই তোমাদের উদাহরণ হচ্ছে সেই নারীর মতো যে নিজেই তার সুতার প্যাঁচ খুলে ফেলে তা প্যাঁচানোর পর।’
ইমাম হোসাইনকে হত্যার জন্য তিনি কুফাবাসীকে দায়ী করেন, যদিও প্রত্যক্ষভাবে হত্যা করেছিল শিমার। তিনি বলেন, ‘…দুর্ভোগ হোক তোমাদের, তোমরা কি জান তোমরা মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রিয় সন্তানের মাথা কেটে বিচ্ছিন্ন করেছ? এবং কী অঙ্গীকার তোমরা তার সাথে ভঙ্গ করেছ? এবং তার কত প্রিয় পরিবারকে তোমরা রাস্তায় বের করে এনেছ? এবং তাদের মর্যাদার কোন আবরণ তোমরা তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছ? এবং কোন রক্ত তোমরা তার কাছ থেকে ঝরিয়েছ?…’
তিনি আরো বলেন, ‘কী উত্তর দিবে যখন নবী জিজ্ঞেস করবেন, তোমরা ছিলে শেষ উম্মত, কেমন আচরণ করেছ তোমরা আমার বংশ ও আমার সন্তানদের সাথে, যারা ছিল সম্মানিত, যাদের কতককে বন্দি করেছিলে এবং তাদের কতককে রক্তে ভিজিয়েছ?…’
একইভাবে তিনি বাগ্মীতার স্বাক্ষর রাখেন ইয়াযীদের দরবারে। ইয়াযীদ তাঁকে পরিহাস করতে চাচ্ছিল, চাচ্ছিল হযরত যায়নাবকে ব্যথায় জর্জরিত করতে, চাচ্ছিল তাঁর মনোবল ধসিয়ে দিতে। কিন্তু হযরত যায়নাব এত সাহসী প্রতিক্রিয়া দেখান যে, ইয়াযীদ হতভম্ব হয়ে যায়।
সাহসিকতা
যায়নাব কেবল সুবক্তাই ছিলেন না; তিনি প্রভূত মানসিক শক্তির অধিকারী ও সাহসী ছিলেন। তিনি অত্যাচারীদের ভয়ে ভীত হন নি। কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার পর কুফায় উবাযদুল্লাহ ইবনে যিয়াদের প্রাসাদে হযরত যায়নাব অতুলনীয় সাহসিকতা প্রদর্শন করেন। যখন ইবনে যিয়াদ যায়নাবের পরিচয় পায় তখন তাঁকে বলে : ‘সব প্রশংসা আল্লাহর যিনি তোমাদেরকে অপমানিত করেছেন, হত্যা করেছেন এবং তোমাদের মিথ্যাকে প্রকাশ করে দিয়েছেন।’ উত্তরে হযরত যায়নাব বলেন যে, তখন এমন কারণে মৃত্যু অসম্মানের নয়; বরং অসম্মান তাদের ভাগ্যে যারা পাপী।
তিনি বলেন : ‘প্রশংসা আল্লাহর প্রাপ্য যিনি তাঁর রাসূলের মাধ্যমে আমাদেরকে ভালোবেসেছেন এবং আমাদের কাছ থেকে সব অপবিত্রতা দূর করেছেন। নিশ্চয়ই উদ্ধত ব্যক্তি অপমানিত হয় এবং বিকৃতমনা মিথ্যা বলছে, আর এগুলো আমাদের কাছ থেকে বহু দূরে এবং সকল প্রশংসা আল্লাহর।’ ইবনে যিয়াদ বলল : ‘আল্লাহ তোমাদের পরিবারকে কী করেছেন।’ তিনি বললেন : ‘তিনি তাঁদের জন্য শাহাদাত পছন্দ করেছেন এবং তাঁরা দ্রুত তাদের বিশ্রামের জায়গার দিকে এগিয়ে গেছেন, এরপর আল্লাহ তোমাকে মুখোমুখি একত্র করবেন এবং তাঁরা তোমার বিচার করবেন এবং তাঁর সামনে তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করবেন।’
ইবনে যিয়াদ হযরত যায়নুল আবেদীন (আ.)-কে হত্যা করতে চাইলে তিনি বলেন : ‘হে যিয়াদের সন্তান! তুমি আমাদের যথেষ্ট রক্ত ঝরিয়েছ।’ তিনি ইমাম যায়নুল আবেদীনকে আগলে নিয়ে বললেন : ‘আল্লাহর শপথ, আমি তার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হব না। যদি তুমি তাকে হত্যা করতে চাও, তাহলে তার সাথে আমাকেও হত্যা কর।’ (শোকার্তের দীর্ঘশ্বাস, ২য় খ-, পৃ. ৩৪) ইবনে যিয়াদ তার অসদুদ্দেশ্য ত্যাগে বাধ্য হয়।
হযরত যায়নাব একই ভূমিকা পালন করেন। হযরত যায়নাব ইয়াযীদের দরবারে তাকে উদ্দেশ্য করে কঠোর ভাষায় বলেন : ‘তুমি বলপূর্বক শাসক হয়েছ এবং জনগণকে অত্যাচার করতে তুমি তোমার ক্ষমতার অপব্যবহার করছ।’
তিনি আরো বলেন : ‘হে ইয়াযীদ! তুমি এ মহাঅপরাধ করার পর নিজেকে পাপী ও অপরাধী না ভেবে এবং এ অপরাধ কত বড় তা চিন্তা না করে বলছ : ‘হায়! আমার পিতারা যদি এখানে উপস্থিত থাকত!’ তুমি কি মনে কর তারা এ কথা শুনে আনন্দে অভিভূত হয়ে তোমাকে বলত : ‘হে ইয়াযীদ! তোমার হাত পঙ্গু না হোক!’ তুমি এ ধরনের ঔদ্ধত্যমূলক কথা বলছ এবং বেহেশতের যুবকদের সর্দারের দাঁতে আঘাত করছ! তুমি কতটা নির্লজ্জ! হ্যাঁ, এরূপ উদ্ভট ও অসংগত কথা তোমার জন্যই সাজে। কারণ, তুমি হচ্ছ ঐ ব্যক্তি যে পূর্বের ক্ষতকে উন্মুক্ত করেছ এবং যার হাত মুহাম্মাদ (সা.)-এর বংশধরদের রক্তে রঞ্জিত। তুমি আবদুল মুত্তালিবের বংশের তারকাদের হত্যা করেছ এবং আমাদের মূলকে কর্তন করেছ। আর এখন আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে পূর্বপুরুষদের ডাকছ, আর ভাবছ তারা তোমার আহ্বান শুনতে পাচ্ছে। শীঘ্রই তুমিও তাদের সাথে মিলিত হবে এবং এমন শাস্তির সম্মুখীন হবে যে, তখন আকাক্সক্ষা করবে, যদি পূর্বেই তোমার হাতগুলো পঙ্গু আর তোমার জিহ্বা মূক হয়ে যেত।’- ইবনে তাইফুর, বালাগাতুন্নিসা, পৃ. ৩৪।
কারবালার ঘটনা প্রচার ও জনসাধারণকে জাগ্রত করা
যদি প্রশ্ন করা হয়, কে কারবালার ঘটনাকে অমর করেছেন? ইয়াযীদের সেনাবাহিনী কারবালার মাটিতে যে নৃশংসতা চালিয়েছিল তা মানুষের কাছে সবিস্তারে পৌঁছে দিয়েছেন কে? কে কারবালার বিপ্লবের কারণ ও মর্মবাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন? এর উত্তর হলো হযরত যায়নাব (আ.)- ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বোন। যিনি তাঁর সাথি হয়েছিলেন মদীনা থেকে মক্কায়, অতঃপর মক্কা থেকে কারবালায় এবং যিনি নিজের কাঁধে এ ঘোষণা প্রচারের দায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন যে, কোন নীতি ও আদর্শ সমুন্নত রাখতে ইমাম হোসাইন (আ.) জীবন দিয়েছেন!
ইয়াযীদ ইমাম হোসাইন (আ.) সহ কারবালার শহীদদেরকে ‘বিদ্রোহী’ বলে অপপ্রচার চালানোর ও বন্দিদেরকে জিম্মি হিসেবে প্রদর্শন করার যে ষড়যন্ত্র করেছিল তা নস্যাৎ করে দেন হযরত যায়নাব। ইয়াযীদ শহীদদের মাথাগুলো প্রকাশ্যে প্রদর্শন ও পরিবারের সদস্যদেরকে জনসাধারণের সমাগম স্থল দিয়ে হেঁটে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। হযরত যায়নাব এটাকেই সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেন।
হযরত যায়নাব কুফা ও শামের পথে পথে জ্বালামীয় বক্তব্য প্রদান এবং অজ্ঞ মানুষজনকে জাগ্রত করেছেন- যারা ইয়াযীদ ইবনে মুয়াবিয়ার বিষাক্ত অপপ্রচার দ্বারা প্রতারিত হয়েছিল। হযরত যায়নাব (আ.) মহানবীর আহলে বাইতকে মানুষের সামনে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। আহলে বাইতের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের যে স্রােত বয়ে যাচ্ছিল তা তিনি প্রতিহত করেছেন, বরং তিনি স্রােতকে বিপরীত দিকে প্রবাহিত করেছেন। যে মুসলমানরা হযরত আলীর মসজিদে শহীদ হবার ঘটনায় আশ্চর্যান্বিত হয়েছিল সে মুসলমানদের সামনে আহলে বাইতের পরিচয় এত সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছিলেন যে তারা চমকে উঠেছিল। তিনি তাদের সামনে বনু উমাইয়্যার মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছিলেন।
তিনিই সকলের সামনে তুলে ধরেন যে, কারবালার ঘটনা কোন ক্ষমতা দখলের লড়াই ছিল না। এটি ছিল ইসলামের প্রতিরক্ষার সংগ্রাম, মানুষের স্বাধীনতা ও মর্যাদার নীতিকে সমুন্নত করার জন্য একটি বীরত্বগাথা- সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের ঘটনা। তিনি প্রচার করেছেন যে, ইমাম হোসাইন (আ.) স্বৈরাচারী ও উত্তরাধিকারভিত্তিক রাজতন্ত্রের আনুগত্য করাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন- যা খেলাফতের মুখোশ পরিধান করেছিল এবং এভাবে তিনি ইসলামের আত্মাকে রক্ষা করেছিলেন।
হযরত যায়নাব কেবল ঘটনা বর্ণনা করেই ক্ষান্ত হন নি। তিনি জনগণকে তিরস্কার করেছেন। তিনি তাঁদেরকে তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সজাগ করেছেন। তাঁর বক্তব্য কুফা ও শামে ইয়াযীদের বাদশাহীর ভিতে কম্পন ধরিয়ে দিয়েছিল। এমনকি ইয়াযীদের মৃত্যুর পর তার ছেলে বাদশা হতে অস্বীকার করে। সে অত্যাচারী উমাইয়্যা রাজবংশকে তিরস্কার করে শাসনক্ষমতা ছেড়ে দেয়।
নবুওয়াতি মিশনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা
আল্লাহর দ্বীন প্রচার করাই ছিল সকল নবী-রাসূলের মিশন। মহানবী (সা.)-এর মাধ্যমে আল্লাহর দ্বীন পরিপূর্ণভাবে প্রচারিত হয়। সেই দ্বীন রক্ষার দায়িত্ব বর্তেছিল ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ওপর। তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেন এ কাজে এবং এর দায়িত্ব অর্পণ করে যান হযরত যায়নাবের ওপর। হযরত যায়নাব ছাড়া এ মিশনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা সম্ভব ছিল না। আর হযরত যায়নাবও তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন।
ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-কে সান্ত¡না দান
যখন ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) কারবালার শহীদদের জন্য ভীষণভাবে শোকগ্রস্ত হয়ে পড়েন সে সময় হযরত যায়নাব তাঁকে বলেন : ‘হে আমার নানা, বাবা ও ভাইয়ের প্রতিচ্ছবি! কেন তুমি তোমার জীবনকে বিপদাপন্ন করছ?’ ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) জবাবে বলেন : ‘কেন আমি অস্থির হব না, কেন আমি আমার জীবন বিপদাপন্ন করব না, যখন আমি দেখছি আমার মাওলা, আমার ভাইয়েরা, চাচারা, ভাইয়েরা এবং আমার পরিবার রক্ত আর ধুলায় মেখে মাটিতে গড়িয়ে পড়েছে আবরণহীন ও বস্ত্রহীন অবস্থায়, মরুভূমিতে? তাদের কাফনও পড়ানো হয় নি, দাফনও করা হয় নি, কেউ তাদের পাশে নেই, না কোন মানুষ তাদের চারপাশে ঘুরছে, যেন তারা তুর্কি অথবা দায়লামি বংশ।’ তখন হযরত যায়নাব তাঁকে সান্ত¡না দিয়ে বলেন : ‘তুমি যা দেখেছ তার কারণে স্থিরতা হারিও না, আল্লাহর শপথ, তোমার বাবা ও তোমার দাদা, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছ থেকে উপদেশ লাভ করেছেন যেন এ মারাত্মক দুর্যোগের তাপ সহ্য করেন। আর আল্লাহ এ উম্মতের একদলের কাছে অঙ্গীকার নিয়েছেন যাদেরকে এ পৃথিবীর ফিরআউনের মতো ব্যক্তিরা চেনে না, কিন্তু তারা আকাশে বাসিন্দাদের মাঝে সুপরিচিত যে, তারা এ দেহগুলোকে জড়ো করবে এবং দাফন করবে। আর তারা তোমার বাবার কবরের মাথার দিকে একটি নিদর্শন প্রতিষ্ঠা করবে কারবালার ভূমিতে, যা চিরদিন থাকবে এবং কখনোই মুছে ফেলা হবে না। আর যদি কুফরের নেতারা এবং পথভ্রষ্টদের সমর্থকরা তা মুছে ফেলতে চায়, এর নিদর্শন না কমে বরং প্রচুর সংখ্যায় বাড়তেই থাকবে এবং এর বিষয়টি দিনের পর দিন বৃদ্ধি পেতে থাকবে।’- শোকার্তের দীর্ঘশ্বাস, ২য় খ-, পৃ. ১৪
শোক মজলিশের প্রচলনকারী
হযরত যায়নাব (আ.) ইমাম হোসাইনের জন্য শোক মজলিশের প্রচলনকারী। ইয়াযীদের বন্দিশালা থেকে মুক্তি পাবার পর হযরত যায়নাব ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) এর মাধ্যমে ইয়াযীদকে একটি বাড়ি খালি করে দিতে এবং শহীদদের কর্তিত মাথাগুলো সহ তাঁদের জিনিসপত্র ফিরিয়ে দিতে বলেন। তিনি সেই বাড়িতে সাতদিন অবস্থান করেন। সকল বন্দি ও দামেশকের নারীদের নিয়ে তিনি শোকানুষ্ঠান করেন। মদীনায় ফিরে হযরত যায়নাব একইভাবে শোকানুষ্ঠান করতে থাকেন।
ইন্তেকাল
হযরত যায়নাব কারবালার ঘটনার পর প্রায় দু’বছর বেঁচেছিলেন। ৬২ হিজরিতে ৫৭ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর মাযার বর্তমান সিরিয়ায় যায়নাবিয়াতে অবস্থিত।
বাংলা রূপ ফারসি রূপ আধুনিক ফারসি উচ্চারণ
বাংলা রূপ ফারসি রূপ আধুনিক ফারসি উচ্চারণ
সাবান صابون স-বুন
সাহেব صاحب স-হেব
সাফ (পরিষ্কার) صاف স-ফ
সহী صحيح সাহিহ
সদকা صدقه সাদাগে¦
সবর صبر সাবর
স্রেফ صرف সেরফ
সাফাই صفا সা-ফঅ
সোলেনামাহ্(সন্ধিপত্র) صلح نامه সোল-নমেহ্
সিন্দুক صندوق সান্দুগ¦
সুরত (চেহারা) صورت সু-রাত্
সুরতহাল صورت حال সূরাত্ হ-ল্
সুফি صوفى সূ-ফী
আবেদ (ধার্মিক) عابد অ-বেদ
আদত (অভ্যাস) عادت অ-দাত্
আদেল (ন্যায়পরায়ণ) عادل অ-দেল্
আরেফ (আধ্যাত্মিক) عارف অ-রেফ্
আশেক عاشق অ-শেগ¦
আলেম عالم অ-লেম্
আম (সর্বসাধারণ) عام অ-ম্
আমেল (বাস্তবায়নকারী) عامل অ-মেল্
আজব عجب আ-জাব্
আদালত عدالت আদ-লাত্
আযাব عذاب আ-যব্
ওজর عذر ওযর
গাজী (বিজয়ী সৈনিক) غازى গ¦-যী
গাফেল غافل গ¦-ফেল্
গায়েব غايب গ¦-ইব
গায়েবানা غايبانه গ¦-ই-ব-নে
গোবর غبار গে¦ব-র
গাদ্দার غدار গ¦দ্দ-র
গরজ غرض গ¦রায
গরগরা غرغره গ¦র-গ¦রে
গরীব غريب গ¦রীব
গজল غزل গ¦যাল্
গোসল غسل গে¦সল্
ইসলামি বিপ্লব : ইরানের অর্থবহ স্বাধীনতার উৎস
সম্পাদকীয়
ইসলামি বিপ্লব : ইরানের অর্থবহ স্বাধীনতার উৎস
১১ই ফেব্রুয়ারি ইরানের ইসলামি বিপ্লবের ৩৯তম বিজয় বার্ষিকী। ৩৯ বছর আগে এদিনে মহান নেতা হযরত ইমাম খোমেইনীর (রহ্.) নেতৃত্বে ইরানের সংগ্রামী মুসলিম জনগণ আড়াই হাজার বছরের পুরনো স্বৈরাচারী রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা এবং তার ধারক ও বিজাতীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির তাঁবেদার শাহ্কে উৎখাত করে ইরানের বুকে ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠা করেন।
ইসলামি বিপ্লব ইরানে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা, সাংস্কৃতিক, নৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সহ জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইসলামানুগ আমূল পরিবর্তন এনেছে। শুধু তা-ই নয়, এ বিপ্লব ইরানকে একটি অর্থবহ স্বাধীন দেশে পরিণত করেছে যার ওপরে পর্দার সম্মুখে বা অন্তরালে কোনো বিজাতীয় শক্তির নিয়ন্ত্রণ তো দূরের কথা, সামান্যতম প্রভাবও নেই – যার ফলে বিশ্বের ক্ষমতার ভারসাম্যে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।
‘স্বাধীনতা, মুক্তি ও ইসলামি প্রজাতন্ত্র’ স্লোগান দিয়ে ইরানি জনগণ শুধু ঈমানী শক্তির বলে শাহের পতন ঘটাতে ও তার পৃষ্ঠপোষক সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে ইরান থেকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হয়। এ স্লোগানের মূল মর্ম ছিল : বহিঃশক্তির তাঁবেদারি থেকে স্বাধীনতা, অভ্যন্তরীণ স্বৈরতন্ত্র থেকে মুক্তি, নিজেদের ভাগ্যনিয়ন্ত্রণকে নিজেদের হাতে গ্রহণ, জনপ্রতিনিধিত্বমূলক ও ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, স্বকীয় সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ এবং অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা অর্জন। ইরানের জনগণ ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান ও নিজেদের ভাগ্যনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা নিজেদের হাতে গ্রহণের লক্ষ্য পরিপূর্ণভাবে অর্জন করেছে এবং বিগত ৩৯ বছরে অন্যান্য লক্ষ্য-উদ্দেশ্যও উল্লেখযোগ্য মাত্রায় অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের পর মুহূর্ত থেকেই বিপ্লবের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক দুশমনরা এ বিপ্লবকে নস্যাৎ ও পথচ্যুত করার লক্ষ্যে সর্বাত্মক অপচেষ্টা চালিয়ে আসছে। এ লক্ষ্যে তারা তাদের সন্ত্রাসী এজেন্টদের দ্বারা বিপ্লবের অগ্রসেনানী বেশ কয়েক জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বসহ অনেক বিপ্লবী কর্মীকে হত্যা করে, নাশকতামূলক তৎপরতা চালায় এবং আট বছরব্যাপী যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে ও আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এ দেশকে সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে পঙ্গু করে আত্মসমর্পণে বাধ্য করার অপচেষ্টা চালায়। সর্বোপরি তারা বিশ্বের জনগণকে সকল ক্ষেত্রে এ বিপ্লবের ইতিবাচক প্রভাব থেকে বঞ্চিত করার লক্ষ্যে বিপ্লব ও ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও বিভ্রান্তি ছড়াবার উদ্দেশ্যে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয়সাপেক্ষ পরিকল্পিত প্রচারযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আল্লাহ্ তা‘আলার অশেষ রহমতে তাদের সমস্ত ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়ে গিয়েছে; বরং ইসলামি বিপ্লবের দীপ্তি এবং ইসলামি ইরানের শক্তি ও শৌর্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। বিগত ৩৯ বছরে ইরানে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, পারমাণবিক বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি ও ন্যানোটেকনোলজিসহ সকল ধরনের জ্ঞানগবেষণা, সুস্থ সংস্কৃতি ও শিল্পকলা, রুচিশীল চলচ্চিত্র নির্মাণ ইত্যাদি সহ জনজীবনের সকল ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি-অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।
আল্লাহ্ তা‘আলার অনুগ্রহপ্রাপ্ত এ বিপ্লবের দূরদৃষ্টির অধিকারী নেতৃত্ব শুরু থেকেই কূটনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এমন একটি সমন্বিত ও ব্যতিক্রমী কর্মকৌশল গ্রহণ করেন যার ফলে আজ ইরানের ইসলামি বিপ্লবের টিকে থাকার ব্যাপারে আর কারো মনেই কোনো সন্দেহ নেই এবং যে কেউ স্বীকার করতে বাধ্য যে, বিশ্বের কোনো বলদর্পী শক্তিই ইরানের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার জন্য হুমকি সৃষ্টির অপচেষ্টার ন্যায় হঠকারী দুঃসাহস দেখাবে না। বস্তুত ইরানের ইসলামি বিপ্লব মুসলিম উম্মাহ্র জন্য সগৌরবে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার জন্য অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত।
ইরানের ইসলামি বিপ্লবের ৩৯তম বিজয়বার্ষিকী উপলক্ষে আমরা এ বিপ্লবের মহান পথিকৃৎ ও রূপকার হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) এবং বিপ্লবের বিজয় ও প্রতিরক্ষার জন্য যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাঁদেরকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি ও তাঁদের বিদেহী আত্মার মাগ¦ফেরাত কামনা করছি; বিপ্লবের বর্তমান রাহ্বার হযরত আয়াতুল্লাহ্ ‘উয্মা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের জনগণ ও পরিচালকবৃন্দ, বিদেশে অবস্থানরত ইরানি নাগরিকগণ, বিশ্বের তাবত মুসলিম ও মুস্তায্‘আফ্ জনগণ, বিশেষভাবে নিউজলেটারের পাঠক-পাঠিকাগণসহ বাংলাদেশের সকল জনগণের প্রতি অভিনন্দন জানাচ্ছি এবং সকলের জন্য উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করছি।
ভাষা আন্দোলনের শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
ইরানি ও বাংলাভাষী ভূখণ্ডের জনগণের মধ্যে ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বন্ধন সুদীর্ঘকালীন। এ ভাষার নাম ফারসি শব্দ ‘বাংলা’- এটাই এ বন্ধনের অবিচ্ছেদ্যতা নির্দেশের জন্য যথেষ্ট। তাই এ মহান দিবসে আমরা আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে ভাষা আন্দোলনের শহীদদের বিদেহী আত্মার মাগ¦ফেরাত কামনা করছি এবং স্বীয় শিকড়ের সাথে সংযোগ শক্তিশালীকরণসহ এ ভাষার উত্তরোত্তর উন্নয়ন ও প্রসার এবং বিশ্বের ভাষা সমাজে অধিকতর গৌরবময় আসন কামনা করছি।
টোকাই রাজা
বই পরিচিতি
টোকাই রাজা
রচনা : মুহাম্মদ ইসমাইল
প্রকাশক : গিয়াসউদ্দীন খসরু
ঝিঙেফূল, ৩৪ নর্থব্রুক হল রোড
বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০
প্রচ্ছদ : সুখেন দাস
স্বত্ব : গ্রন্থকার
প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০০৩
বর্ণবিন্যাস : ঝিঙেফুল কম্পিউটার্স
মূল্য : ১০০ টাকা।
মুহাম্মদ ইসমাইল একজন কবি, কথাশিল্পী ও শিশুসাহিত্যিক। স্কুল জীবন থেকেই লেখালেখির অভ্যাস হলেও নব্বই দশকের শুরু থেকে তাঁর লেখা কবিতা ও গল্প পত্রপত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশ পেতে থাকে। ফলে তিনি সহসাই নজরে আসেন তাঁর সময়ের লেখক বন্ধুদের। বিভিন্ন সাহিত্য আসরে তাঁর লেখাগুলো আলোচিত হতে থাকে। ইতোমধ্যে তাঁর দুটি বইও প্রকাশিত হয়। তাঁর আলোচ্য বই ‘টোকাই রাজা’ একটি কিশোর গল্পের বই। এখানে রয়েছে মোট আটটি গল্প। তৃতীয় গল্প ‘টোকাই রাজা’র নাম অনুসারে বইটির নামকরণ হয়েছে। প্রথম গল্প ‘ঢেকুর নিয়ে কা-’ ইরানের একটি ছোট কাহিনী। এছাড়া রয়েছে ‘বটগাছ’, ‘নুতন জামা’, ‘আত্মার প্রশান্তি’, ‘এপ্রিল ফুল’, ‘শিউলী’ ও ‘দ্বিতীয় চাকরি’। গল্পগুলোতে রয়েছে হতদরিদ্র, নির্যাতিত, এতিম ও বঞ্চিত শিশুদের জীবনের কথা। রয়েছে উপদেশ। যেমন ‘বটগাছ’ গল্পে এক এতিম শিশুর কথা বলা হয়েছে যার ছিল একটি প্রকৃতিপ্রেমিক মন, যার অভিভাবক ছিলেন তার মামা। মামার মৃত্যু হলে তার জীবনে নেমে দুঃখ-দুর্দশা। ‘টোকাই রাজা’ গল্পে সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত পিতামাতা হারানো এক পথশিশুর হৃদয়বিদারক কাহিনী রয়েছে। ‘নতুন জামা’ গল্পের দুঃখিনী মায়ের সন্তানের ঈদের জামা গায়ে দেয়া হয় নি। টাইফয়েড জ্বরে বিনা চিকিৎসায় মারা যায় শিশুটি। ‘আত্মার প্রশান্তি’ গল্পে আলতাফ নামের কিশোরের মৃত্যু হয় সহপাঠীদের দুষ্টুমী ও খামখেয়ালিপনায় সাঁকো থেকে পড়ে পানিতে ডুবে। তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ধার হলেও হাসপাতালে রোগে ভোগে। যা থেকে অবশ্যই আমাদেরকে শিখতে হবে কেউ যেন স্কুলের সহপাঠীদের সাথে ভয়ঙ্কর মস্করা না করে। ‘এপ্রিল ফুল’ হচ্ছে একটি ইতিহাসের গল্প। গল্প নয় সত্যি ঘটনা। স্পেন মুসলমানদের অধিকারে ছিল। আর গ্রানাডায় ছিল রাজধানী। মুসলমানরা একদিন ক্ষমতা হারালো ভেতরের বিশ্বাসঘাতক ও খ্রিস্টানদের ষড়যন্ত্রের ফলে। খ্রিস্টান রাজা ফার্দিনান্দ-এর হাতে গ্রানাডার পতন হলে সে মুসলমানদেরকে বলেছিল মুসলমানরা যদি মসজিদে অবস্থান করে তবে তাদেরকে হত্যা করা হবে না। কিন্তু বেঈমান রাজা তার কথা রাখে নি; বরং এটা ছিল তার ধোঁকা এবং সরলবিশ্বাসী সব মুসলমানকে এক স্থানে একত্রিত করে সহজে নির্মূল করার ফন্দি। তার আদেশে তার সৈন্যরা মসজিদগুলোতে আক্রমণ করে ও আগুন দিয়ে নির্বিচারে সব মুসলমানকে হত্যা করা হয়। সেদিন ছিল পহেলা এপ্রিল। সেইদিন থেকে খ্রিস্টশক্তি পহেলা এপ্রিলকে এপ্রিল ফুল বা এপ্রিলের বোকা হিসেবে পরস্পর ঠকানো ও হাসি-ঠাট্টার দিবস হিসেবে আনন্দ-ফুর্তি করে মুসলমানদেরকে ঠকানোর ইতিহাসকে স্মরণ করে। কোন কোন দেশের বোকা মুসলমানেরাও এ দিবসটি না বুঝে পালন করত। কিন্তু আজ অনেকে দেশেই এটা কমেছে এবং বিবেকবান খ্রিস্টানরাও এটা ঘৃণা করে। ‘শিউলী’ দরিদ্র ফুলবিক্রেতা পথশিশুর সততার গল্প। ‘দ্বিতীয় চাকরি’ গল্পে ঘুষের মতো মহাপাপের সমালোচনা করে হালাল উপার্জনের শিক্ষা দেয়া হয়েছে।
আমরা মুহাম্মদ ইসমাইলের উক্ত বইটির ব্যাপক প্রচার ও পাঠকপ্রিয়তা কামনা করছি।
□ আমিন আল আসাদ
যেসব মুসলিম মনীষী বদলে দিয়েছেন পৃথিবী
বই পরিচিতি
যেসব মুসলিম মনীষী বদলে দিয়েছেন পৃথিবী
রচনা : মুনীর তৌসিফ
প্রকাশক : সাঈদ বারী
সূচীপত্র, ৩৮/২ ক বাংলাবাজার, ঢাকা
প্রচ্ছদ : সাঈদ বারী
স্বত্ব : গ্রন্থকার
প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০১৫
মূল্য : ১৫০ টাকা।
কবি বলেন, ‘দেখ একবার ইতিহাস খুলি/কত উচ্চে তোরা অধিষ্ঠিত ছিলি।’ সত্যি তাই, সারা দুনিয়ায় জ্ঞান-গরীমায়, সৌর্যে, বীরত্বে একদিন মুসলমানরাই সেরা ছিল। অর্ধ পৃথিবী ছড়িয়ে পড়েছিল তাদের শাসনব্যবস্থা। কিন্তু সেটা কিভাবে? শুধু তলোয়ারের জোরে আর বাহুবলে? তা কি করে হয়? তলোয়ারের জোরে, হত্যার ভয় দেখিয়ে, মানুষকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে কিছুুদিন দুর্বল করে রাখা যায়। মানুষের হৃদয় জয় করা যায় না। মানুষকে প্রভাবিত করা যায় না। যদি তাই হতো তবে হালাকু, তাতার চেঙ্গিস, মঙ্গোলরা ইতিহাসে সুখ্যাত হয়ে থাকতে পারত। কিন্তু তারা ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে আছে অত্যাচারী হিসেবে, মানবতার বন্ধু হিসেবে নয়। আজকের দুনিয়ায়ও যারা মানুষ হত্যা করে, বোমাবাজি করে, আত্মঘাতী হামলা করে, বলপ্রয়োগে কোন আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চায় বা সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বল প্রয়োগে কোন আদর্শকে নির্মূল করতে চায় তারাও অত্যাচারী হিসেবে চিহ্নিত হবে। কিন্তু ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখি প্রকৃত মুসলমানরা দুুনিয়ার যে স্থানেই গিয়েছে সেখানে জ্ঞান, বিজ্ঞান ও মানবতা-মহানুভবতার আলো সাথে করে নিয়ে গেছে ও তা দিয়ে বিশ্বমানবতাকে আলোকিত করেছে। তাদের তলোয়ার মাঝে-মাঝে যদিও উত্তোলিত হয়েছে তবে তা অত্যাচার করতে নয়, অত্যাচারীকে প্রতিহত করতে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের মুসলিম সমাজের অনেকেই আজকে জানে না জ্ঞান- বিজ্ঞানে মুসলমানদের বিরাট অবদানের কথা। সেজন্য তারা হীনমন্যতায় ভোগে এই ভেবে যে, এই বিশ্বসভ্যতা নির্মাণে বোধ হয় মুসলমানদের কোন ভূমিকাই নেই। অপরদিকে এটাও দুঃখের বিষয়, একদা জ্ঞান-বিজ্ঞানে শ্রেষ্ঠ জাতি আজ জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ছেড়ে দিয়েছে। আরেক কবি তাই দুঃখ করে তাঁর কবিতায় বলেছেন, ‘জ্ঞানের বিজয় চাইতে হলে মনের বিজয় চাই/জ্ঞান যেখানে বোবা বধির হৃদয় সেথা নাই//আমরা যে ভাই জ্ঞানের কাঙ্গাল তাই এতো দুঃখ/ঘরে বাইরে তাইতো মোদের সমান দুর্ভিক্ষ’। অথচ একদা মুসলমানরা ছিল আধুনিক রসায়ন, বীজগণিত, আধুনিক সার্জারি, ফলিত প্রকৌশলী, সমাজবিজ্ঞান, দর্শন, সৌরবিজ্ঞান ও মহাকাশবিজ্ঞান, জ্যামিতি, চক্ষুবিজ্ঞান, ত্রিকোণমিতির জনক। শত শত ওষধি গাছের আবিষ্কারক, গণিতের শূন্যের আবিষ্কারক, চিকিৎসাক্ষেত্রে এনেসথেশিয়ার আবিষ্কারক। কবিতা, সাহিত্য, শিল্প, ভাস্কর্য, আঁকিবুকি, নির্মাণশৈলীতেও তারা রেখেছিল বিরাট অবদান। অবদান ছিল তাদের ধর্ম-দর্শনে, আধ্যাত্মিকতায় বা সুফিজমে অর্থাৎ আত্মোন্নয়নে। এই সব মহান জ্ঞানীগুণীর প্রতিনিধিত্বশীল প্রভাবের কারণেই ইসলাম সম্পর্কে মনোযোগী হয় বিশ্বের মানুষ। দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করে। সারা দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে যে এতো মুসলমান তা জ্ঞানী, গুণী, সুফি, দরবেশ, অলি-আল্লাহদের কারণেই। সেজন্যই বলা হয় ‘অসিতে (তলোয়ার) নয়, মসিতে (কলম) বিজয়।’
মুুসলমানরা যে জ্ঞান-বিজ্ঞানে সেরা ছিল তা পৃথিবীর ইতিহাস পাঠ ছাড়াও কিছু কিছু ঘটনা দ্বারাও প্রমাণ মেলে। মূর্খ ডাকু হালাকু খানরা বাগদাদ ধ্বংস করে যখন বড় বড় লাইব্রেরির লক্ষ লক্ষ বই ফেলে দিয়েছিল টাইগ্রিস নদীতে তখন দীর্ঘদিন টাইগ্রিস নদীতে কালিগোরা জল প্রবাহিত হচ্ছিলে। এতেই অনুমান করা যায় বইয়ের সংখ্যা কত ছিল!
জ্ঞান-বিজ্ঞান হচ্ছে মুসলমানদের হারানো সম্পদ। তা যেখানে পাওয়া যায় সেখান থেকেই কুড়িয়ে নিতে হবে। মহামনীষীদের জীবনের গল্প কোন রূপকথা নয়। বাস্তবতাযুক্ত সত্য ঘটনা। মহামানবদের জীবনী শিশু-কিশোরদের চরিত্র গঠনে সহায়ক ভূমিকা রাখে। তাদের জীবনের উজ্জল দিকগুলো শিশু-কিশোরদের চিন্তা চেতনাকেও উজ্জ্বল করে।
লেখক মুনীর তৌসিফ রচিত আলোচ্য বইটিতে মুসলিম জ্ঞানী, বিজ্ঞানী, কবি, সুফি, দার্শনিকদের মোট চব্বিশজনের সংক্ষিপ্ত জীবনী প্রকাশিত হয়েছে। বইটির প্রকাশক জনাব সাইদ বারীও সৃজনশীল মানুষ। বইটির প্রচ্ছদ পরিকল্পনাটিও তাঁরই। বইটি শিশু-কিশোরসহ সব বয়সী পাঠকেরই ভালো লাগবে আশা করি।
□ আমিন আল আসাদ
মিষ্টি মধুর ভাষা
নাসির উদ্দিন সরদার :
আল্লাহ দিলেন সবার কণ্ঠে
মিষ্টি মধুর ভাষা
সেই ভাষাতেই ব্যক্ত করি
মনের সকল আশা।
মাতৃভাষা বাংলা ভাষা
খোদার অপার দান
কথা বলার শক্তি দিলেন
রহিম রহমান।
তাকিয়ে দ্যাখো বধির লোকের
কত কষ্ট-জ্বালা
কথা বলার শক্তি তাদের
দেয়নি খোদাতা’লা।
তোমায় আমায় কথা বলার
শক্তি দিলেন যিনি
সারা জীবন তাঁহার কাছে
আমরা চির ঋণী।
নেয়ামতের শোকর করে
বুঝতে হবে শান
বেশি বেশি করতে হবে
তাঁহার গুণগান।
আমার বর্ণমালা
মিতুল সাইফ
আমার বর্ণমালা
আমার প্রাণ,
মায়ের বোনা
নক্শি কাঁথার ঘ্রাণ।
আমার বর্ণমালা
আমার সুখ,
পাতার ফাঁকে
দোয়েল পাখির মুখ।
আমার বর্ণমালা
প্রাণের দান,
রক্তে লেখা
ফেব্রুয়ারির গান।
কবিতার দেশে বিপ্লবের দেশে : কিছু অনুভূতি
আমিন আল আসাদ :
পারস্য বা ইরান দেশের কথা সর্বপ্রথম জেনেছিলাম ছোটবেলায় স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে। ইরানের কবি শেখ সাদীর জীবনের ঘটনা নিয়ে একটি গল্প ‘পোশাকের গুণে’ পাঠের মাধ্যমেই সর্বপ্রথম ইরানের নাম আমার চেতনায় স্থান লাভ করে। এছাড়া সপ্তম শ্রেণীর সাহিত্য পাঠে ‘সোহরাব রুস্তমের কাহিনী’ নামে একটি গল্প পাঠ করেছিলাম। বিদ্যালয়ের সেলিম স্যার কি দারুণভাবে পড়িয়েছিলেন গল্পটি আজো মনে আছে। গল্পটি ইরানের জাতীয় কবি মহাকবি ফেরদৌসীর শাহানামায় রয়েছে।
আমার মেজচাচা মরহুম জহুরুল করিম চৌধুরী একজন জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন বইপ্রেমিক ও পাঠপ্রিয়। তিনি আমাদেরকে নানা উপলক্ষে বই উপহার দিতেন। বার্ষিক পরিক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর ভালো রেজাল্ট করায় তিনি আমাকে ও তাঁর ছেলে মঞ্জুর-উল করিম চৌধুরীকে যথাক্রমে ‘ফুটলো গোলাপ ইরান দেশে’ এবং ‘শাহনামার গল্প’ নামে দুটি বই উপহার দেন। আমি পেয়েছিলাম মরহুম আখতার ফারুক সাহেবের লেখা ‘ফুটলো গোলাপ ইরান দেশে’ বইটি। দুটি বইই আমরা বিনিময় করে পড়েছিলাম। এভাবে শৈশব কৈশোর কাল থেকেই আমাদের স্বদেশের পাশাপাশি ইরান দেশটিও যেনো কেমন করে আপন হয়ে পড়ে। কিন্তু তখনো ভাবিনি মহান আল্লাহ সেই ভালো লাগা দেশটি ভ্রমণের তওফিক দেবেন।
গিয়েছিলাম ইমাম খোমেনী (র)-এর ১৮ তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে অনুষ্ঠানে ২০০৮ সালে। আমি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্সী ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক লালকুঠি দরবার শরীফের পীর সাহেব জনাব আহসানুল হাদি, বিশিষ্ট লেখক আহমেদুল ইসলাম চৌধুরী, কবি মোহন রায়হান, কবি রোকন জহুর, কবি আহমেদ কায়সার, প্রকাশক মিজানুর রহমান পাটুয়ারী, ব্যবসায়ী সাখাওয়াত হোসেন, মাওলানা সাবির রেজা, জনাব রাশেদুজ্জামান, জনাব আবু সায়িদ প্রমুখ। এর মধ্যে জনাব ্আবু সায়িদ আমাদের সাথে জাননি, তিনি ইরানেই থাকতেন। দেশে এসেছিলেন তাই ফিরছিলেন আমাদের সাথে। তিনিও যোগ দেবেন ইমাম খোমেনী (র)-এর মৃত্যুবাষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে। আমরা গালফ এয়ারে বাহরাইন হয়ে তেহরান যাব। জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ইরানের উদ্দেশে আমাদের বোয়িং আকাশে উড়াল দেয়ার সাথে সাথে এক অভাবনীয় আনন্দের ঢেউ খেলে গেলো দেহমনে। কারণ এটাই ছিলো জীবনে আমার প্রথম বিমান যাত্রা আর যাচ্ছি আমার আদর্শের প্রতিষ্ঠাভূমিতে। কারণ আমি যে সমাজের স্বপ্ন দেখি তা বিংশ শতাব্দিতে ইরানই করে দেখিয়েছে। যেখানে ঘটেছে এক আলোকের বিস্ফোরণ যা আলোকিত করেছে ইরানবাসীকে ও বিশ্ববাসীকে। হ্যাঁ আমরা যাচ্ছি, কবিতার দেশে ও বিপ্লবের দেশে পারস্য সভ্যতার দেশে। সাহাবী সালমান ফার্সী (রা)-এর দেশে। যে দেশ সম্পর্কে আমাদের প্রিয়নবী (সা) ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যখন সুরা মুহাম্মদের শেষ আয়াত নাযিল হয়। ‘যদি তোমরা পেছন ফিরে যাও তবে আল্লাহতাআলা এমন এক জাতিকে বছাই করবেন যারা তোমাদের মতো হবে না। সাহাবীরা রাসূল (সা) কে বললেন ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা)! যদি আমরা পেছন ফিরে যাই তবে আল্লাহপাক কোন জাতিকে বাছাই করবেন?’ সালমান ফারসী (রা) রাসূল (সা)-এর পাশেই বসা ছিলেন। নবীজী (সা) সালমান ফারসী (রা)-এর উরুতে স্পর্শ করে বললেন এই ব্যক্তি ও তার জাতি। শপথ তাঁর, যার হাতে আমার জীবন, ঈমান যদি আকাশের সুরাইয়া তারকাতেও ঝুলে থাকে ফারসের মানুষ সেখান থেকে তা ছিনিয়ে আনবে’। সেদিনকার সেই ফারস-ই আজকের ইরান বা ফারসী বা পারস্য। সপ্তম শতকে মুসলিম বিশ্বে যত জ্ঞানী গুণী জন্মগ্রহণ করেছিলেন এর বেশীরভাগই পড়েছিলো ইরানী ভ’খন্ডে। তখন ইরান আরো বড় ছিলো। ইরাকের একটা বিরাট অংশ আর সমরকন্দ, বুখারা, তাজিকিস্তান, কাজাখিস্তান প্রভৃতি রাশিয়া অধিকৃত প্রদেশগুলোও ইরানের ছিলো। শিয়া ও সুন্নী উভয় মাযহাবের পন্ডিতগণ ইরানে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মগ্রহণ করেন কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, গণিতবিদ, মহাকাশবিদ, ধর্মতত্ত্ববিদ প্রমুখ।
ইরানের কবিদের নাম বিশ্বসাহিত্যের আসরে বিশেষ মর্যাদা নিয়ে অবস্থান করছে। বিশেষ করে ইরানের জাতীয় কবি ফেরদৌসী ছাড়াও শেখ সাদী, হাফিজ, ওমর খৈয়াম, নিযামী, রুদাকী, সুফী কবি মাওলানা রুমী, ফরিদউদ্দীন আত্তারের কথা বিশ্বের কবিদের মুখে মুখে বিরাজমান। মুসলিম দার্শনিক ইমাম গাজ্জালী, চিকিৎসাবিদ ইবনে সীনা, মহাকাশ বিজ্ঞানী ও দার্শনিক আল বিরুনী, পদার্থবিদ আল ফারাবী, প্রমুখ জ্ঞানীগুণীরা ইরানে জন্মেছিলেন। আমাদের দেশে মরহুম সাহিত্য গবেষক মুহাম্মদ মনসুর উদ্দীন ইরানের কবিদের নিয়ে লিখেছিলেন ‘ইরানের কবি’ নামে এক বিশাল বই। আর মুহাম্মদ বরকতুল্লাহ লিখেছিলেন ‘পারস্য প্রতিভা’। আমরা জ্ঞানীদের দেশ কবিদের দেশ এবং মহান ইমাম খোমেনী (র)-এর দেশ, মহান ইসলামী বিপ্লবের দেশ ইরানে যাচ্ছি। আমরা ঢাকা থেকে বাহরাইন এবং বাহরাইন থেকে তেহরান গেলাম।
আমাদের প্রাণপ্রিয় স্বদেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। আমাদের রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস। আমাদের রয়েছে জাতীয় সংস্কৃতি। আমরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করেছি এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পেয়েছি স্বাধীন স্বদেশ। তেমনি ইরানেরও রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস। রয়েছে নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। হাজার বছরের নানা সংগ্রামের ভেতর দিয়ে ১৯৭৯ সালে মহান ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমেই সত্যিকার স্বাধীন দেশে পরিণত হয় ইরান। প্রকৃত স্বাধীনতা মানে কি? প্রকৃত স্বাধীনতা মানে আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে মাথা নত না করা। দুনিয়ার কোন দেশ বা কোন মানুষ আমার প্রভূ নয়; বরং বন্ধু হতে পারে। আমার দেশের সীমানা, আমার দেশের জনগণের ভাল মন্দ, আমাদের আয়-উন্নতি, শিক্ষা দীক্ষা, সংস্কৃতি, ভাষা, ও ধর্মের ব্যাপারে অন্য কেউ নাক গলাতে পারবে না। কেউ কিছু জোর করে আমাদের উপর চাপিয়ে দিতে পারবে না। এটাই হলো আসল স্বাধীনতা। কাজেই আমাদের স্বাধীনতাকে মজবুত করতে হলে আমাদেরকে আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। দৃঢ় শপথ নিতে হবে। কঠোর পরিশ্রমী ও সৎ হতে তবে। এটা ইরানী জাতি থেকে শেখার আছে। কারণ ইরান ও আমাদের বাংলাদেশের মধ্যে অনেক বিষয়ে মিল রয়েছে। যেমন আমরা বলি একুশ মানে মাথা নত না করা। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারীর ভাষা সংগ্রাম আমাদেরকে মাথা নত না করার শিক্ষায় শিক্ষিত করেছে। কারণ একজন দেশপ্রেমিক ও প্রকৃত ঈমানদার কোন আধিপত্যবাদীর কাছে মাথা নত করতে পারে না। আমরা বাংলাদেশিরা যেমন নিজেদের ঐতিহ্য সংস্কৃতি ভাষা ও ইতিহাসের দাঁড়িয়ে সাহসি ও স্বাধীন চেতনার অধিকারী হয়েছি, ইরানীরাও ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে যে ইসলামী বিপ্লব করেছে সেখান থেকে মাথা নত না করার শিক্ষা লাভ করেছে এবং দিনে দিনে উন্নতি লাভ করেছে। ইরানের সাথে বাংলাদেশের রয়েছে জনগণের ধর্মবিশ্বাসের মিল, ইতিহাসের বিভিন্ন সময় আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিতেও ইরানের নানা বিষয় প্রবেশ করেছে। যেমন এদেশে যে সূফিগণ ইসলাম প্রচারে এসেছিলেন তাদের বেশিরভাগ ছিলেন ইরানী ভাবধারার। তারা সবাই ছিলেন নবীবংশের ভক্ত। বাংলা ভাষায় সাড়ে সাত হাজার ফার্সি শব্দ সরাসরি প্রবেশ করেছে নানা পরিভাষায়। আরো অনেক ফার্সী শব্দ এসেছে বাংলায় পরিবর্তন পরিবর্ধন হয়ে।
এদেশের শাসকদের সাথেও ইরানের এবং ইরানের কবিদের সম্পর্ক ছিলো। আমরা জানি সোনারগা থেকে যে সব সুলতান বাংলা শাসন করতেন তাঁদের সাথে ইরানের বন্ধুত্ব ছিলো। সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহ ইরানের কবি হাফিজকে বাংলায় আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
এইসব কথা ভাবতে ভাবতেই মধ্য আকাশ থেকে আমরা ক্রমেই তেহরানের আকাশে এবং তেহরানের মাটির দিকে নেমে আসছিলাম। আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম মধ্যদুপুরের সোনালী রোদে চকচক করছিলো তেহরানের রাস্তাঘাট, গাড়ি, বাড়িঘর, গাছপালা, বিস্তীর্ণ খোলা মাঠ, উঁচু গম্বুজ ইত্যাদি। আমরা অবতরণ করছি ইমাম খোমেনী (র) বিমানবন্দরে। কবিতার দেশ ও বিপ্লবের দেশ আর বিশ্বসেরা গোলাপের দেশ ইরানের মাটি স্পর্শ করতে করতে অপার এক আনন্দে দুলে ওঠলো মন এই ভেবে যে আমরা আমাদের স্পপ্নের ভূমিতে এসে পড়েছি। বিমানের চাকা তেহরানের মাটি স্পর্শ করার সাথে সাথেই সকল যাত্রী সহ একসাথে দরূদ পাঠ করলাম নবীর শানে ‘আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মুহাম্মদ ওয়া আলে মুহাম্মদ’। ইমিগ্রেশনের যাবতীয় কাজ শেষ করে এগিয়ে যেতেই লক্ষ্য করলাম দু’জন যুবক আমাদের জন্যে দাঁড়িয়ে আছেন ইমামের ছবিযুক্ত এক প্লাকার্ড হাতে নিয়ে। তাতে ইংরেজীতে যা লেখা তার অর্থ হচ্ছে ‘আমরা ইমাম খোমেনী (রহ)-এর ঊনিশতম মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপন কমিটির পক্ষ থেকে বিদেশী অতিথিদের আগমনের অপেক্ষা করছি’। আমরা বললাম ‘আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি।’
তাঁরা বললেন ‘হ্যা, আমরা আপনাদের জন্যেই অপেক্ষা করছি।’ তাঁরা তাঁদের অতিথিদের নামের তালিকা বের করে আমাদের সাথে পরিচিত হলেন। যুবক দুজন তেহরান ইউনিভার্সিটির ছাত্র। আমাদের লাগেজগুলো খুঁজে বের করতে সহযোগিতা করলেন তারা। এরপর আমাদেরকে সাথে করে নিয়ে এলেন বিমান বন্দরের বাইরে। এখানে আমাদের জন্যে দাঁড়িয়ে আছে চারটি মূল্যবান মোটর কার। হাত ইশারায় গাড়িতে চড়তে অনুরোধ করে বললেন ‘বেফারমাইদ’ অর্থাৎ দয়া করে ওঠুন। গাড়ী ছুটে চললো ‘কিয়াবানে ইমাম খোমেনী’ অর্থাৎ ইমাম খেমেনী (রহ) সড়কের উপর দিয়ে। সূর্য তখন অস্ত যাচ্ছে। দু’চোখ ভবে দেখলাম ইরানী বিকাল। তেহরান বিশ্বের অন্যতম আধুনিক শহর। চতুর্দিকে পাহাড় আর পাহাড়। পুরো তেহরান শহর ঘিরে আছে আল-বোর্য পর্বতমালা। এর আশ-পাশে ছড়িয়ে আছে ধুসর পাহাড়। পাদদেশে সমতল ভূমিও রয়েছে বিস্তীর্ণ। ছোট বড় পাহাড়ের উপর নির্মিত হয়েছে বড় বড় অট্টালিকা। আমাদের গাড়ি ছুটে চলেছে সত্তর কিলোমিটার গতিতে হু হু করে। অনেক গাড়ি আসছে যাচ্ছে। আমরা ইমাম খোমেনী (রহ.)-এর মাজারের পাশ দিয়েই অতিক্রম করলাম। ড্রাইভার আমাদের হাত ইশারায় দেখালো ইমামের মাজার। এটাই বেহেশত জাহরা। এখানে শুয়ে আছেন সত্তর হাজারেরও অধিক শহীদান। যাঁরা ইসলাম ও ইসলামী প্রজাতন্ত্রের জন্যে অকাতরে তাদের জীবন বিলিয়ে দিয়েছে। তাঁরা মরে নি। তারা জীবিত। ‘আল্লাহর রাস্তায় যারা শহীদ তাদেরকে তোমরা মৃত বলো না বরং তারা জীবিত’। আল কুরআনের বাণী অনুসারে কবিও বলেন সে কথা-
“উদয়ের পথে শুনি কার বাণী ভয় নাই ওরে ভয় নাই/নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই”
আমাদেরকে হোটেল ইস্তেকলাল-এ নিয়ে যাওয়া হবে। ইরানে তিনটি ফাইভস্টার হোটেল খুবই নামকরা। হোটেল ইস্তেকলাল, হোটেল আজাদী, হোটেল লালেহ। হোটেলগুলোর অন্য নাম ছিলো। বিপ্লবের পর এ ধরনের নামকরণ করা হয়েছে। ইস্তেকলাল মানে স্বাধীনতা, আজাদী মানে মুক্তি, আর লালেহ অর্থ লাল টিউলিপ- সংগ্রামের প্রতীক। আমাদের দেশে যেমন সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে পলাশ, শিমুল রক্তজবার কথা উল্লেখ করা হয়। আমরা হোটেল আজাদীর পাশ দিয়েই গেলাম। হোটেল আজাদী পাহাড়ের ঠিক মাঝখানে। চলতি পথে একটি টাওয়ার দেখতে পেলাম। এর নাম বুরজে মিলাদ। বড় অট্টালিকাগুলোর দেয়ালে দেয়ালে ইরানের কৃতি সন্তান যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাঁদের বিরাট ছবি আকা রয়েছে। শহীদ ড. বেহেশতি, শহীদ আয়াতুল্লাহ মোরতাজা মোতাহারী, শহীদ ড. মোস্তাফা চারমান, শহীদ ড. জাভেদ বাহোনার, শহীদ প্রেসিডেন্ট আলী রাজাই প্রমুখ। আরেকটি অট্টালিকার দেয়ালে দেখলাম ফিলিস্তিনের ইসলামী বিপ্লবের (হামাস) নেতা শহীদ শেখ মুহাম্মদ ইয়াসিন এবং সম্প্রতি শহীদ ইমাদ মগনিহ-এর ছবি যার পেছনে আল কুদস বা বায়তুল মুকাদ্দাসের বিশাল আকৃতির ছবি। এসব দেখতে দেখতে যখন হোটেল ইস্তেকলালে আমরা এসে পৌছলাম তখন মাগরিবের আযান হচ্ছে।
বিশ্বসাহিত্যের আসর মাতানো শাহনামার দেশ, মসনবী শরীফের দেশ, গুলিস্তা, বুস্তা আর কারিমায়ে সাদীর দেশ, দীওয়ানে হাফিজ ও রুবাইয়াতে ওমর খৈয়ামের দেশ, আলো ঝলমল ও মোহময় পারস্য উপন্যাসের দেশ- সর্বোপরি ইমাম হোসাইন (আ)-এর বিপ্লবী চেতনার দেশ ইরান যেমন এক স্বপ্নের ভূমি, তেমনি এক আপোষহীন সংগ্রামেরও ভূমি। সেজন্যেই ইরান যেমন কবিতার দেশ তেমনি বিপ্লবের দেশ। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে আড়াই হাজার বছরের রাজতন্ত্র উচ্ছেদ হয়েছিলো একটি ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ায়। ইসলামের ইতিহাসের এক মহান আত্মত্যগের ঘটনা হলো কারবালায় সপরিবারে ইমাম হোসাইন (আ)-এর আত্মত্যাগ। কারবালায় ইমাম হোসাইন (আ)-এর শাহাদত ও কালজয়ী বিপ্লবের চেতনাই সমগ্র ইরানী জাতিকে উদ্দীপ্ত করেছিলো। সেজন্যেই ইরানকে বলা হয় আশুরা সংস্কৃতির লালনভূমি।
মহান ইমাম খেমেনী (রহ) ইরানী জাতির মাঝে আবির্ভূত হয়েছিলেন ভোরের আকাশে সূর্যের মতো। তাঁর আসল নাম সাইয়েদ আয়াতুল্লাহ রুহুল্লা মুসাবী আল খোমেনী। তিনি ছিলেন নবী বংশের সন্তান। ইমাম হোসাইন (আ)-এর বংশধারায় জন্ম নেয়া ৭ম ইমাম মুসা কাজেম (আ)-এর বংশধর। ইরানের জনগণ তাঁর মতো মানুষের নেতৃত্ব পেয়ে বিশ্বের মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়ালো- যেনো কুয়াশা আর বরফে আবৃত শীতের জড়তা ভেঙে জেগে ওঠলো হাজারো পুষ্প কানন। মানুষ তার অধিকার ফিরে পেলো। ইরানের জনগণের উপর চেপে থাকা অত্যাচারী শাহ দেশ ছেড়ে পালালো। ইমাম খোমেনী শুধু ইরানী জাতিকেই ঝাকুনি দিয়ে জাগিয়ে দেননি, গোটা বিশ্বের মুসলমান ও নির্যাতিত মানুষের হৃদয়ে নুতন করে আশা জাগালেন। বিংশ শতাব্দির শেষ প্রান্তে এসে পৃথিবীর দিকে দিকে দেশে দেশে মুসলমানদের জাগরণ আমরা দেখতে পেয়েছি। ইরানের ইসলামী বিপ্লব সেইসব জাগরণকে নুতনভাবে প্রেরণা দিলো। যুগ যুগ ধরে ফিলিস্তিনের মুসলমানদের উপর ইহুদীদের নির্যাতন বর্বরতার সকল সীমানা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ইমাম এসব কঠিন মুহূর্তে মুসলিম জাতিকে ধৈর্য ধারণ করার উপদেশ দিলেন। ইমাম সকল দেশ-ভাষা, বর্ণ ও মাজহাবের মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ হবার উপদেশ দিলেন। মুসলমানদের প্রথম কেবলা আল-কুদস বা বায়তুল মুকাদ্দাস ও ফিলিস্তিনের মুসলমানদের মুক্তির ব্যাপারে সকল মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করার জন্যে প্রতি বছর মাহের রমজানের শেষ শুক্রবার তথা পবিত্র জুমাতুল বিদা-কে আল-কুদস দিবস ঘোষণা করলেন। এখনো প্রতি বছর বিশ্বের সবকটি মুসলিম দেশে আল-কুদস দিবস পালিত হয়। ইমাম বলেছিলেন ‘বিশ্বের সব মুসলমান যদি ঐক্যবদ্ধ হতো আর ইসরাইলের উপর সকলে মিলে একবালতি করে পানিও ঢেলে দিতো তবে ইসরাইল বাণে ভেসে যেতো।’ আমরা দেখেছি সালমান রুশদী নামের এক কুখ্যাত বৃটিশ লেখক মহানবী (সা) সম্পর্কে যখন খারাপ মন্তব্য করে স্যাটানিক ভার্সেস নামে এক বাজে বই লিখে তখন একমাত্র ইমাম খোমেনী (রহ) পরাশক্তির সকল ভয়-ভীতিকে উপেক্ষা করে সালমান রুশদীর মৃত্যুদন্ডের ফতোয়া দিলেন। আমরা দেখেছি ইমামের ফতোয়া ঘোষণার মাধ্যমেই সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সালমান রুশদী ও তার স্যাটানিক ভার্সেস বইয়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়। পৃথিবীতে একই বিষয় নিয়ে একই সাথে সব মানুষের এমন আন্দোলন আর দেখা যায়নি। আমাদের দেশের মুসলমানরাও সালমান রুশদী বিরোধী আন্দোলন করেছিলো।
ইরানের রাজধানী তেহরানের পুরোটাই ইমাম ও ইসলামী বিপ্লবের স্মৃতিতে উজ্জ্বল। তেহরানের রাস্তাঘাট, মেহেরাবাদ বিমান বন্দর, আযাদী স্কোয়ার, ময়দানে ইনকিলাব, তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়, খোনে ইমাম বা ইমামের বাসগৃহ, সর্বোপরি বেহেশত যারা সহ স্মৃতিময় প্রত্যেকটি স্থান যেনো বিপ্লবের এক একটি সৌধ। বাতাসে কান পাতলে আজো যেনো শোনা যায় উত্তাল জনতার আকাশ কাঁপানো স্লোগান যা ফেরাউনরূপী শাহ, হামানরূপী আমেরিকা ও কারূণরূপী ইসরায়িলের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিলো। মাটিতে হৃদয় বিছালে আজো পাওয়া যায় বীর শহীদদের বক্ষ থেকে ছিটকে পড়া রক্তের উত্তাপ। আমি আর হাদী সুযোগ পেলেই বেড়িয়ে পড়তাম রাস্তায়। ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতাম। কল্পনায় খুঁজে বেড়াতাম সেই দৃশ্যগুলো। মনে হতো যেনো এই ফ্লাইওভারের উপরে ও নীচের রাস্তায় লক্ষ জনতার মিছিল। এই সব রাস্তাঘাটেই ইমামের মুক্তির দাবীতে, ইমামের নির্বাসনের বিরুদ্ধে, ইমামকে স্বদেশে ফিরিয়ে আনার জন্যে শিশু-কিশোর, যুবক-বৃদ্ধ সকলেই নেমে এসেছিলো। ‘মোর্গ বর শাহ’ অর্থাৎ শাহের পতন হোক। কিংবা ‘আজাদী,নাজাতি, জমহুরীয়ে ইসলামী’ অর্থাৎ স্বাধীনতা ও ইসলামী প্রজাতন্ত্র। কিংবা ‘আজ মুক্তির দিন’ ‘শহীদদের আত্মাদের ফিরে আসার দিন’ ‘শাহের পতন হোক’ ‘খোমেনী স্বাগতম’ ‘হয় খোমেনী না হয় মৃত্যু’। আমরা পথে পথে হাঁটতে হাঁটতে আর তেহরান ইউনিভার্সিটি ও ময়দানে ইনকিলাবে গিয়ে বিপ্লব চলাকালিন সময়ের ময়দান্ েইনকিলাব ও তেহরান ইউনিভার্সিটির কথা মনে করলাম যা ছিলো জনতার প্রতিরোধ দূর্গ। এই তো সেই জুমার নামাজের স্থান যেখানে আজো জাতীয়ভাবে জুমআর নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। মেহেরাবাদ বিমানবন্দরে গেলাম। মেহেবাবাদ বিমান বন্দর ইসলামী বিপ্লবের ইতিহাসে এক অক্ষয় মনুমেন্ট। এই বিমান বন্দর দিয়েই অত্যাচারি শাহ ইমামকে নির্বাসনে পাঠিয়েছিলো। অদৃষ্টের অবধারিত পরিণামে ইরানী জনগণের ঘৃণা অবজ্ঞার আবর্জনা মাথায় করে শাহ সপরিবারে এই বিমান বন্দর দিয়েই পালিয়েছিলো। এবং এ বিমান বন্দরেই ইমাম অবতরণ করেছিলেন বীরের বেশে। ইমামকে জীবিতাবস্থায় না দেখলেও আমার মনে হলো যেনো আমি দেখছি ওই তো এয়ার ফ্রান্সের সিড়ি বেয়ে ইমাম দৃঢ়তার সাথে বীরের বেশে নামছেন তাঁর প্রাণপ্রিয় স্বদেশের মাটিতে। সারা বিমানবন্দর লোকে লোকারণ্য, ফটোসাংবাদিক, পত্রিকার রিপোর্টার ও টেলিভিশন ক্যামেরাম্যানদের দারুণ ব্যস্ততা। মেহেরাবাদ থেকে আযাদী স্কোয়ার পর্যন্ত লক্ষ মানুষের ভিড়। তিল ধারণের ঠাই নেই। স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরাও এসেছে। প্রত্যেকের হাতে রক্তগোলাপ, লাল টিউলিপ আর কারনেশন। মেহেরাবাদ বিমান বন্দরের অদূরেই আযাদী স্কোয়ার মাথা উচু করে দাড়িয়ে আছে। ওইতো এখানে ইরানী জাতি সম্বর্ধনা জানাচ্ছে ইমামকে। ইমাম জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দিচ্ছেন। জনতা সেøাগান দিচ্ছে। ‘আল্লাহু আকবার, খোমেনী রাহবার’। আযাদী স্কোয়ারের পাদদেশে দাঁড়িয়ে নিরবে অনুভব করা যায় সেদিনের উত্তপ্ত দিনগুলোর কথা।
রাজধানী তেহরানের এক প্রান্তে পাহাড়ের উপর যে মহল্লায় ইমামের বাড়ি তার নাম জামারান। ইমাম এখানে থাকতেন বলে তাঁকে বলা হতো জামারানের পীর। এখানে একটি ছোট্ট ঘরে ইমাম থাকতেন। ইরানের শাহ যেখানে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেছিলো বিশাল রাজপ্রাসাদ। সেই জাতীর নেতৃত্ব দিয়ে ইমাম দিন কাটাতেন গরীবের বেশে। ইমামের ঘরে রয়েছে একটি সাধারণ সোফা সাদা কভারে আচ্ছাদিত, একটি ছাতা, ইমামের ছেলে মোস্তফা খোমেনীর ছবি, একটি ঘড়ি ও সাদাকালো একটি টেলিভিশন। পাশেই রয়েছে মসজিদ। যেখানে উপরে একটি চেয়ার পাতা রয়েছে। এখানে বসে ইমাম ভাষণ দিতেন। আমার মনে হলো আমি তাঁর বয়ান শুনতে পাচ্ছি। ইমামকে সরাসরি না দেখলেও তাঁর স্মৃতিবিজড়িত একেকটি স্থানে গিয়ে গিয়ে তাঁর জীবিতকালের দৃশ্যগুলোই আমি কল্পনার পর্দায় দেখতে লাগলাম। ইমামের বাসস্থানের পাশেই একটি ঘরে ইমামের অন্তিম জীবনের স্মৃতিগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছে যা ইমামের হাসপাতাল জীবনের শেষ দিনগুলোকে মনে করিয়ে দেয়। ওই তো সেই বেড যেখানে অসুস্থাবস্থায় ইমাম শুয়েছিলেন। ওই তো সেই স্যালাইনের বোতল ও পাইপগুলো যা অক্ষত রাখা হয়েছে। এই সেলাইনের বোতল ঝোলানো অবস্থায়ও ইমাম তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করেছেন, রূকু সেজদা দিয়েছেন। পেছন থেকে ডাক্তার ইমামের রূকু সেজদার সাথে সাথে স্যালাইনের বোতলটি সাবধানে উঠাচ্ছিলেন-নামাচ্ছিলেন যাতে ইমাম কষ্ট না পান।
ইমামের বাড়িটি দেখলাম আবার পাশাপাশি আমাদেরকে রেজা শাহ পাহলভীর জৌলুষপূর্ণ জীবন যাপনের প্রমাণ স্বরূপ শাদাবাদ প্যালেস যাদুঘরও দেখানো হলো। সমস্ত ইরানবাসীকে শোষণ করে শাহ কিভাবে বিলাসবহুল জীবনযাপন করতো কিভাবে শাহ ও তার বংশধর সাঙ্গ-পাঙ্গরা ইরানী জাতিকে ভিক্ষুকের জাতিতে পরিণত করছিলো আমেরিকার তাবেদারী করে সেটা না দেখলে বোঝানো যাবে না।
ইমামের মৃত্যু দিবস ৩রা জুনে বেহেশত জাহরায় জড়ো হয়েছে লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ। সারা ইরানের বিভিন্ন শহর থেকে গাড়ী বোঝাই করে জনতা ছুটে এসেছে ইমামের রওজায়। ইমামের মাজারের পশ্চিম পার্শ্বে উপরে স্থাপিত হয়েছে মঞ্চ। আমরা মঞ্চের সামনে ছিলাম। ইরানের নেতৃবৃন্দ ভাষণ দিলেন। আলেমগণ বয়ান রাখলেন। ইমামের নাতি সৈয়দ হাসান খোমেনী ভাষণ দিলেন প্রেসিডেন্ট ভাষণ দিলেন। মুহুর্মুহ দরূদ, দোয়া, আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে এবং কিছুক্ষণ পরপর আমেরিকা ও ইসরাইল বিরোধী সেøাগানে এক অন্যরকম দৃশ্যের সৃষ্টি হলো। অবশেষে রাহাবার ভাষণ দেয়ার জন্যে দাঁড়ালেন তখন জনতার সেøাগানের আওয়াজ আরো বেড়ে গেলো।
এই সেই বেহেশত জাহরা। এখানে আমরা দাঁড়িয়ে। এখানে শুয়ে আছেন দুই লক্ষেরও অধিক শহীদান, যাঁরা আমেরিকার নির্দেশে ইরানের বিরুদ্ধে সাদ্দামের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। যাঁরা ইসলামী প্রজাতন্ত্রের জন্যে অকাতরে তাঁদের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। এতো শাহাদাত, এতো রক্তদান কিন্তু ইরানী জাতিকে ভয় পাইয়ে দেয়নি বরং কারবালায় সত্যের জন্যে ইমাম হোসাইন (আ)-এর আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে এই ত্যাগকে খুব সামন্যই মনে করেছেন তারা। ইমাম হোসাইন (আ)-এর শাহাদতের চেতনায় নুতনভাবে সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েছেন। মনে হলো ওই তো জনতা সেøাগান দিচ্ছে ‘হররোজ আশুরা, হরজমিন কারবালা’।
তেহরানের পথে প্রান্তরে ইমাম খোমেনী (র) ও ইসলামী বিপ্লবের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো যেমন স্পর্শ করার সুযোগ পেয়েছিলাম, সুযোগ পেয়েছিলাম ইমামের বাড়ীঘর ও মাজার যিয়ারতের, তেমন আমরা সৌভাগ্য লাভ করেছিলাম মাশহাদ প্রদেশে গিয়ে নবীবংশের ৮ম ইমাম রেজা (আ)-এর মাজার যিয়ারতের। এই মহান ইমাম ও ওলী-আল্লার রূহানী বরকত ইরানবাসী সবসময় পাচ্ছে। ইমামগণ, ওলী-আল্লাহগন, শহীদগণ অমর এবং তাঁদের আত্না সর্বদা সজীব ও জিন্দা। সেটি পবিত্র কোরানে আছে। ‘আল্লাহর পথে যারা জীবন দিয়েছে তাদেরকে তোমরা মৃত বলো না বরং তারা জীবিত’’। আল্লাহর পথে থেকে তারা ইহকালে যেমন অগণিত মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন, তেমনি মৃত্যুর পরও তাঁরা তা পাচ্ছেন। ইমাম রেজা (আ)-এর মাজারে সবসময় হাজার হাজার লোকের ভিড় লেগেই আছে।ইমাম রেজা (আ)-এর মাজার যিয়ারত করে পেলাম আত্নার প্রশান্তি।
ইমাম রেজা (আ)-এর পূর্বপুরুষ ইমাম মুসা কাজেম (আ)। এ বংশেই জন্মেছিলেন ক্ষণজন্মা মহান ইমাম খোমেনী (র)। তাঁর মতো মানুষ কালে ভদ্রে জন্মায়, যিনি ছিলেন ইসলামী জনতার জন্যে মহান আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। কারণ তিনি ঘুমন্ত জাতিসমূহকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। আজ পৃথিবীর সকল অপশক্তি ও পরাশক্তির বিরুদ্ধে সকল নির্যাতিত মানুষের পক্ষে একা দাঁড়িয়ে আছে ইরান। আল্লাহর প্রতি গঠন বিশ্বাস স্থাপনের সাথে জ্ঞান বিজ্ঞান ও প্রযু্িক্ত সকল ক্ষেত্রে ইরান এগিয়ে গেছে। অজস্র সংগ্রামী মানুষের রক্তে পবিত্র যে দেশের মাটি তা আজ দুনিয়ার মুসলমানদের গর্ব। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের ভরসা ও আশ্রয়স্থল। ইমাম খোমেনী (রহ) আজ আর নেই, কিন্তুু তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছেন।
কথায় আছে যে ছুটি যত লম্বাই হোক না কেনো একদিন তা শেষ হয়। বেড়ানোর দিনগুলোও তাই শেষ হয়ে আসে এক সময়। আমাদের পনর দিনের ভিসাও একদিন শেষ হয়। শেষের দিকে এসে দেশে ফিরে যাবার জন্যে প্রাণ টানছিলো। একদিকে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ ও সেখানে রেখে আসা প্রিয়জনদের টান অন্যদিকে স্বপ্নের ভূমি ইরানের প্রতি গভীর মমতার দোটানার ভেতরেই স্বদেশের উদ্দেশে উড়াল দিলাম আবারো সেই ‘ফুরুতগাহে ইমাম খোমেনী (র)’ বা ‘ইমাম খোমেনী (র) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে। স্মৃতিতে সঙ্গে করে আনলাম ইরান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি।
কবিতার দেশ ও কবিদের দেশ ইরান। বিপ্লবের দেশ ও বিপ্লবীর দেশ ইরান। ওলীদের দেশ, সুফিদের দেশ ইরান। হাজার বছরের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের দেশ ইরান। টিউলিপ আর বিশ্বসেরা গোলাপের দেশ ইরান। গানের দেশ প্রাণের দেশ ইরান। বাস্তবিক ইরান দেশটি খুবই সুন্দর। সুন্দর এর প্রকৃতি, পাহাড় ও মালভূমি। সুন্দর এর শহরের রাস্তাঘাট, ফুটপাথ, বাড়িঘরগুলো। তেমনি সুন্দর ইরানের মানুষের মন। তাদের আতিথেয়তার তুলনা হয় না। পথচারী, দোকানদার, বাসকন্ডাক্টার, ট্যাক্সি ড্রাইভার সবার কাছেই সুন্দর আচার-ব্যাবহার পেয়ে মুগ্ধ হয়েছি। বিদেশি পেয়ে কোথাও ঠকানো তো দূরের কথা যেখানেই গিয়েছি তারা বলেছে, ‘শুমা মেহমানে মা’ আর্থাৎ আপনারা আমাদের মেহমান। তেমনি আতিথেয়তা পেয়েছি বিভিন্ন কাজে ও বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণে আমাদের গাইড হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত আল্লামা তাবাতাবায়ী ও তেহরান উনির্ভাসিটির ছাত্র ছাত্রীদের থেকে। হোটেলের বাইরে ফুটপাথে ও খোলা স্থানে হাঁটতে গিয়ে স্কুলের ছোট দুটি ছেলে-মেয়েও আমাদেরকে হেল্প করেছে পথের পাশে টেলিফোন বুথ থেকে কথা বলার কৌশল শিখিয়ে দিয়ে। আসলে তাদের সঙ্গে আমাদের একপ্রস্থ স্মৃতির কথা কোনদিনই ভুলবো না।
হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর উত্তম শিক্ষামালা হতে
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
তিন বন্ধু :
একদিন রাসূলুল্লাহ হযরত মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর সাহাবিদের সাথে মসজিদে বসে কথা বলছিলেন। এক পর্যায়ে মহানবী (সা.) বললেন যে, তিনি সাহাবিদের সামনে একটি গল্প বলবেন, যেটি থেকে তিনটি প্রশ্ন বের হবে আর সাহাবিদেরকে সেই তিনটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। এই কথাটি সাহাবিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল এবং তাঁরা সকলেই মহানবীর কথা মনোযোগের সাথে শুনতে থাকলেন। মহানবী (সা.) বললেন : “একদা এক ব্যক্তি জানতে পারল যে, তার মৃত্যুক্ষণ ঘনিয়ে এসেছে এবং খুব শীঘ্রই সে মারা যাবে। এটি জানার পর সে কবরে তার একাকীত্ব নিয়ে ভয় পেল এবং সত্যিকারের বন্ধুর সন্ধানে বের হলো- যে বন্ধু তাকে সাহায্য করবে এবং কবরে তার সাথি হবে। সে তার প্রথম বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে তার দরজায় টোকা দিল এবং জিজ্ঞেস করল যে, সে তাকে (একটি বিষয়ে) সাহায্য করবে কিনা। জবাবে বন্ধুটি বলল : ‘অবশ্যই, তা না হলে আমরা কিসের জন্য রয়েছি?’ কিন্তু যখন লোকটি বলতে থাকল যে, তার জীবনের অল্প কয়েকটি দিনই কেবল বাকি আছে আর এরপরেই তার সাহায্যের প্রয়োজন, তখন তার প্রথম বন্ধু বলল : ‘আমি দুঃখিত; যখন মৃত্যু আমাদেরকে পৃথক করে দেবে, তখন তোমাকে কবর দেয়ার জন্য জায়গা এবং কিছু কাপড় যা দ্বারা তোমার শরীরকে ঢাকা যাবে তা কিনে দেয়া ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার নেই।’ মনঃক্ষুণœ অবস্থায়, কিন্তু আশা নিয়ে লোকটি তার পরবর্তী বন্ধুর নিকট গেল।
দ্বিতীয় দরজায় যখন সে তার দ্বিতীয় বন্ধুর মুখোমুখি হলো এবং তার আসন্ন মৃত্যু ও মৃত্যুর পর সাহায্য চাওয়ার ব্যাপারটি বলল তখন সে একই জবাব পেল। দ্বিতীয় বন্ধুটি বলল : ‘আমি তোমার জীবনে সবসময়ই তোমার সাথে ছিলাম এবং এখানে তোমাকে সাহায্য করতে পারব। কিন্তু তোমার মৃত্যুর পর তোমার মরদেহ কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া ও দাফন করা ছাড়া আমি তোমার জন্য কিছুই করতে পারব না।’
হতাশা এবং মনে কষ্ট নিয়ে সে তার তৃতীয় বন্ধুর নিকট গেল। সে খুবই নিশ্চিত ছিল যে, একই রকম জবাব পাবে, কিন্তু সেখানেও কিঞ্চিত পরিমাণ আশা ছিল। সে যখন তার তৃতীয় বন্ধুর মুখোমুখি হলো এবং বলল যে, তার সাহায্যের প্রয়োজন তখন সেই বন্ধু নিজ আগ্রহে তাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এল। কিন্তু লোকটি বলতে লাগল : ‘আমার মৃত্যুর পর সাহায্যের প্রয়োজন।’ তৃতীয় বন্ধু জবাব দিল : ‘তুমি চিন্তা করো না, আমার প্রিয় বন্ধু! আমি তোমার সাথে কবরে যাব এবং যখন ফেরেশতারা (মুনকার এবং নাকির) তোমাকে প্রশ্ন করার জন্য উপস্থিত হবেন তখন তোমার সাথে থাকব। এরপর তোমাকে পুলসিরাত (সেতু) পার হতে সাহায্য করব এবং তোমাকে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাব।’ এই জবাবে সেই ব্যক্তি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল এবং শান্তিতে মৃত্যুবরণ করল।
এরপর মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর সাহাবিদের দিকে ফিরলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন : ‘কেউ কি এই তিন বন্ধুকে এবং এই লোকটিকে চিনতে পারছ?’ সকলেই নিশ্চুপ থাকলে মহানবী (সা.) বলতে শুরু করলেন : ‘এই গল্পের ব্যক্তিটি হচ্ছে মানুষ। প্রথম বন্ধুটি হচ্ছে অর্থ বা সম্পদ- যেসব জিনিস শুধু আমাদেরকে ইহজীবনেই সাহায্য করে, কিন্তু মৃত্যুর পর নয়। দ্বিতীয় বন্ধুটি হচ্ছে আমাদের পরিবার, সন্তান-সন্ততি- ছেলে ও মেয়েরা; আমরা তাদের জন্য সারা জীবন কষ্ট করি এবং তারা শুধু আমাদেরকে কবর পর্যন্ত নিয়ে যায়। আর তৃতীয় ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বন্ধুটি হলো ‘আমল’ (কর্ম)- যে আমাদেরকে সমস্ত পথে সঙ্গ দিয়ে থাকে।’
গল্পের শিক্ষণীয় বিষয় : জড়বাদী বস্তুর জন্য সংগ্রাম করো না যা তোমাকে কিছুই দেবে না এবং কোনোভাবেই তোমার অনন্তকালীন জীবনে সাহায্য করবে না। কিন্তু কঠোর পরিশ্রম কর, নামায পড় এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। সৎকর্ম মানুষকে সাহায্য করে যেখানে অন্য সকল কিছু এ জগতের পর মূল্য হারিয়ে ফেলে।
অনুবাদ : সরকার ওয়াসি আহম্মেদ