https://www.iranmirrorbd.com/wp-content/uploads/2019/03/Event-Brochure2.pdf
https://www.iranmirrorbd.com/wp-content/uploads/2019/03/معرفی-نمایشگاه-به-همراه-فرم-.pdf
দেশের শীর্ষস্থানীয় আইসিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান Creative IT Institute তাদের Special Appreciation Award-এর মাধ্যমে দিদারুল আলম-কে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে অসাধারণ অবদান রাখার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মানিত করেছে।
প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও মো. মনির হোসেন স্বাক্ষরিত আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি-পত্রে দিদারুল আলমের দূরদর্শী নেতৃত্ব, অদম্য প্রচেষ্টা এবং আইসিটি খাতে নতুন প্রজন্মকে দক্ষ করে তুলতে তার অসাধারণ ভূমিকার প্রশংসা করা হয়।
চিঠিতে বলা হয়েছে, দিদারুল আলমের উদ্ভাবনী দৃষ্টিভঙ্গি ও নেতৃত্ব দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তিনি শুধুমাত্র প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করেননি, বরং দক্ষতার ঘাটতি পূরণ, টেক প্রতিভা তৈরি এবং ডিজিটাল রূপান্তর ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
তিনি তরুণ প্রজন্মকে প্রযুক্তি শিক্ষায় অনুপ্রাণিত করেছেন, মেন্টরিংয়ের মাধ্যমে তাদের ক্যারিয়ার গঠনে সহায়তা করেছেন এবং প্রযুক্তি খাতে একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের জোয়ার এনেছেন। আজকের অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন তাঁর এই ভূমিকার বাস্তব ফলাফল।
আমিন আল আসাদ –
ভূমিকা : মুহররম তরবারির ওপর রক্তের বিজয়ের মাস। দশই মুহররম কারবালার মরুপ্রান্তরে সংঘটিত বিয়োগান্ত ঘটনা বিশ্বের ইতিহাসে এক ট্র্যাজেডি। এ এক হৃদয়বিদারক ও শোকাবহ ঘটনা। কেবল শোকাবহ ঘটনাই নয়, বরং এর শোক থেকে উত্থিত শক্তি ভস্মীভূত করে দেয় সকল প্রকার যালিমের লৌহ লকার। কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনায় শোককাতর হয় না এমন মুসলমান নেই বললেই চলে। দল-মত, দেশ-ভাষা, বর্ণ, গোত্র, মাযহাব, তরিকা নির্বিশেষে সকল ঈমানদার মুসলমান- যাদের হৃদয়ে আল্লাহর রাসূল (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের প্রতি বিন্দুমাত্র ভালোবাসা রয়েছে, তারা কারবালা প্রান্তরে ঘৃণিত ইয়াযীদ বাহিনীর কাপুরুষোচিত হামলায় নবীর নাতি, বেহেশতে যুবকদের সরদার ইমাম হোসাইন (আ.) এবং তাঁর ৭২ জন সঙ্গী-সাথিসহ নির্মমভাবে শাহাদাত বরণের করুণ ঘটনায় বেদনাহত হয়। শুধু মুসলমানরাই নয়, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বিবেকবান অমুসলিম প-িতরাও লিখেছেন অমূল্য সব শোকবাণী। এদের মধ্যে রয়েছেন ভারতবর্ষের প্রখ্যাত নেতা মহাত্মা গান্ধী, ইংরেজ দার্শনিক ও লেখক টমাস কার্লাইল, ইংরেজ ওপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্স, এডওয়ার্ড ব্রাউন, টমাস মাসরিক, ইতিহাসবিদ পি কে হিট্টি, ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার, ফ্রেডরিক জেমস, দার্শনিক নিকলসন, জার্মান প্রাচ্যবিদ মরবিন, জার্মানির বিখ্যাত কবি গ্যাটে, খ্রিস্টান পুরোহিত অ্যান্টন বারা প্রমুখ।
কারবালার মর্মান্তিক ঘটনায় তাঁরা মর্মাহত হন। কেবল ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কালজয়ী বিপ্লবের প্রতিপক্ষ তদানিন্তন ধিকৃত বর্বর ইয়াযীদ ইবনে মুয়াবিয়া, ইবনে যিয়াদ ও সীমার প্রমুখ মানবতাবিরোধী অপরাধী ও তাদের প্রতিষ্ঠিত রাজবংশীয় স্বৈরশাসকবর্গ এবং তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শের বর্তমান প্রজন্মরা ব্যতীত। সেজন্যই কবি শোকগাথায় গেয়ে উঠেছেন- ‘অমর শহীদ ইমাম হোসেন জন্মেছিলেন মদীনায়/ তাঁর শোকে জগৎ কাঁদে, কাঁদে না যালিমেরাই।’ আশুরার চেতনা ও আন্দোলন মানবতার ইতিহাসে অতীব গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়।
সাহিত্যে কারবালার প্রভাব
ইমাম হোসাইন শুধু একটি নাম নয়। একটি ইতিহাস, একটি চেতনার নাম- যা সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য নিরুপণকারী। কালজয়ী বীর ইমাম হোসাইন ন্যায় ও ইনসাফের পক্ষে এবং অন্যায়, যুলুম ও স্বেচ্ছাচারিতার বিপক্ষে অকুতভয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক মহানায়ক। সত্যান্বেষীদের মন-মগজ জুড়ে থাকা কালোত্তীর্ণ এক অমর ব্যক্তিত্ব। কারবালার শোকাবহ ঘটনা ও আশুরা আন্দোলনের তাৎপর্য নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় বই-পুস্তক লেখা হয়েছে। তবে উর্দু-ফারসি ভাষায়ই এর চর্চা হয়েছে ব্যাপক। হিন্দি ভাষায়ও তা চর্চা হয়েছে। আমাদের মাতৃভাষা বাংলায়ও কম নয়; বরং অনেক।
বাংলা ভাষায় আশুরার শোকাবহ ঘটনা, মুহররমের চেতনা, ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সংগ্রামের দর্শন নিয়ে একদিকে যেমন রচিত হয়েছে তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, সেই সাথে কারবালার শোকাবহ ঘটনা ও আশুরা আন্দোলনের আবেগঘন বিষয়ে রচিত হয়েছে মর্সিয়া সাহিত্যের বিশাল ভা-ার। এসবের মধ্যে রয়েছে কবিতা, ছড়া, গান, জারি, মর্সিয়া, এপিক, কথিকা, নাটিকা, উপাখ্যান, পুঁথিসাহিত্য ইত্যাদি। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অত্যন্ত মর্মস্পর্শী সাহিত্য হিসেবে পরিগণিত হয়ে হয়ে আছে মর্সিয়া সাহিত্য। তাই বাংলা সাহিত্যে কারবালার চেতনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
মর্সিয়া সাহিত্যের বিকাশ ও কিছু কথা
উপমহাদেশে মর্সিয়া সাহিত্যের বিকাশ ঘটে মোঘল আমল থেকেই। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নবাব আলীবর্দী খান ও তদীয় দৌহিত্র নবাব সিরাজউদ্দৌলার সময়ে মুর্শিদাবাদে যে কবিদের সমাগম হয়েছিল তাঁদের অনেকেই ছিলেন শিয়া অথবা নবীবংশের প্রতি মুহব্বত পোষণকারী সুন্নি- যাঁদেরকে বলা হয় আহলে বাইতপন্থী সুন্নি। তাঁরা তরিকতপন্থীও বটে। তাঁদেরই প্রভাবে বাংলা মূলুকে মর্সিয়া সাহিত্যের অনুপ্রবেশ ঘটে এবং সেটা পুঁথি সাহিত্যকে প্রভাবিত করে। ফারসি-উর্দু ভাষার ধর্মীয় বোধ থেকেই বহু বাঙালি মুসলিম কবি মর্সিয়া ও পুঁথি রচনা করেন। তাঁদের মধ্যে রাধারমণ নামে একজন হিন্দু কবিও রয়েছেন।
কারবালা ও মুহররমের ঘটনা নিয়ে মধ্যযুগে ও পরবর্তীকালে যে সব পুঁথি ও বই লেখা হয়েছে সেগুলোর নাম ‘জঙ্গনামা’, ‘মকতুল হুসায়েন’, ‘শহীদ-ই-কারবালা’, ‘সংগ্রাম হুসেন’, ‘এমাম এ্যনের কিচ্ছা’, ‘শাহাদাত নামা’, ‘হানিফার লড়াই’, ‘বড় জঙ্গনামা’, ‘গুলজার-ই-শাহাদাত’, ‘দাস্তানে শহীদ ইকরামালী’, ‘জঙ্গে কারবালা’ ইত্যাদি। পল্লি বাংলার মানুষ কারবালার ঘটনা নিয়ে মুহররম মাসে যে বিষাদময় গীতিকা গেয়ে থাকে তার নাম জারিগান। জারিগান মূলত আশুরার শোকগাথাকে নিয়েই রচিত হয়েছে। তাই বলা যায় জারিগান মুহররমের বেদনাগাথার এক বিশেষ রূপ।
মধ্যযুগের কবিদের থেকে শুরু করে পরবর্তীকালে আবুল মা-আলী, মুহাম্মদ হামিদ আলী, কায়কোবাদ, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, মীর রহমত আলী, কাজী নজরুল ইসলাম, ফররুখ আহমদ পর্যন্ত আশুরা বা কারবালাকেন্দ্রিক কাব্যচর্চা এক বিশেষ রূপ প্রাপ্ত হয়। কারবালা ট্র্যাজেডি নিয়ে বাংলা ভাষায় কে সর্বপ্রথম লিখেছেন তার সঠিক ইতিহাস খুঁজে না পাওয়া গেলেও একথা বলা যায়, আহমদ নগরের কবি আশরাফ প্রথমবারের মতো মর্সিয়া লিখেছিলেন। শায়খ ফয়জুল্লাহ কারবালা সম্বন্ধে ‘জয়গুনে চৌতিশা’ নামে একটি কবিতা রচনা করেন যা এ সম্পর্কিত প্রথম বাংলা কবিতা বলে গণ্য করা হয়। বাহরাম খান নামে এক কবি লিখেন ‘মাকতাল হোসেন’। আরো লিখেন মুহাম্মদ খান নামে আরেক কবি। কারবালা নিয়ে আরো যেসব কবিতা রচিত হয় সেগুলো হলো কবি হায়াত মামুদের ‘কাশেমের লড়াই’, কবি হামিদের ‘সংগ্রাম হুসায়েন’, ফকির গরীবুল্লাহর ‘জঙ্গনামা’, কবি রাধারমণ-এর ‘এমাম এনার কিচ্ছা’, কবি মোহাম্মদ হামিদুল্লাহর ‘গুলজার-ই-শাহাদাত’, কবি মুহাম্মদ হামিদ আলীর ‘জয়নাল উদ্ধার’ ও ‘কাশেম বধ’, কবি মতিউর রহমান খান-এর ‘এজিদ বধ’ (যা অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত), কবি কায়কোবাদের ‘মহররম শহীদ’ (যা তিন খ-ে সমাপ্ত), কবি আবদুল বারীর ‘কারবালা’, ইসমাইল হোসেন সিরাজীর ‘মহাশিখা’, কবি আবদুল মুনায়েমের ‘পঞ্চশহীদ’, কবি মোহাম্মদ ইসমাইলের ‘শহীদের খুন’, কবি আবদুল হাকিমের ‘মরুসেনা’, মীর রহমাত আলীর ‘মর্হরম কাব্য’ ইত্যাদি।
কারবালাকেন্দ্রিক কিছু কবিতার উদ্বৃতি
কারবালাকেন্দ্রিক মর্মস্পর্শী কবিতার কিছু লাইন এখানে উল্লেখযোগ্য। ফকির গরীবুল্লাহর ‘জঙ্গনামা’র দু’একটি লাইন এমন-
‘হোসেন বলেন বিবি কান্দিও না আর
আমা বাদে ভালো হবে তোমা সবাকার
শহর বানু বলে কি যে হবে আর
না রাখিলে মোর বংশ এজিদে কুফ্ফার
আপনি চলিলা ফের করিতে লড়াই
কুফরে সুপিয়া যাও কি হবে ভালাই
এমাম বলেন বিবি না কান্দিও আর
রদ না হইবে কভু কলম আল্লার
ঘিরিয়া রাখিল কুফার পানি বন্ধ করে
পানি পানি করে যত সব গেলো মরে
তোমরা মরিছ সবে পানির লাগিয়া
মেরাও জিও পানি বিনে যায় নেকালিয়া
আজ কাল-ই পানি বিনে মরিব নিশ্চয়
লড়িয়া মরিলে নাম রবে দুনিয়ায়।’
কবি কায়কোবাদ লিখেন,
‘এই কি কারবালা সেই! এই সেই স্থান!
এই সেই মহামরু হেরিলে যাহারে
অশ্রু ঝরে দু’নয়নে কেঁদে ওঠে প্রাণ
যত কথা মনে পড়ে শিরায় শিরায়
প্রচ- অনল শ্রোত হয় প্রবাহিত
প্রাণের নিভৃত কক্ষে হৃদয় কন্দরে
কি যে এক শোক স্মৃতি হয় উচ্ছ্বসিত
এই কি কারবালা সেই এই কি শ্মশান
যাহার বালুকা রাশি সিন্দুরের মতো-
হয়েছিলো সুরঞ্জিত হোসেন-শোণিতে।’
কবি শাহাদাত হোসেন লিখেন,
‘এই সেই মহররম সেদিনের সেই গম
ভুলেছো কি মুসলিম? দ্বীন তব ইসলাম।’
তিনি আরো লিখেন,
‘রুদ্র দুপুর চলে আফতাব শিরে গলে
ছুটে জ্বালা চৌদিকে ইঙ্গিত মৃত্যুর
কোনখানে নাহি চিন পানি এক বিন্দুর
মরু বালু ঝলকায়
উন্মনা ছুটে চলে বাতাসের হল্কায়
নাই পানি, নাই ছায়া জ্বল জ্বল মরুকায়া
কারবালা প্রান্তর ঝাঁ ঝাঁ করে চৌদিক
শান্তির রেখা নাই সান্ত¡না মৌখিক
হাহাকার! হাহাকার!!
আজ বুঝি দুনিয়ায় জাগিয়াছে মহামার
লাও পানি জান যায় ছাতি কাঁপে পাঞ্জায়
কাতরায় পানি বিনে আজি তারা শাহারায়
কলিজার টুকরা সে সন্তান একপাশে
জবে করা কবুতর ছটফটি মরে হায়
ফাটে শোকে মার প্রাণ দাও পানি ছেলে যায়
দিল বুকে জনকের
ফিরো এলো কোলে শিশু বুকে তীর জহরের…’
সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী লিখেন,
‘দুরাত্মা শিমর পাপী সহসা যাইয়া
বসিলেক বক্ষে চাপি নয়ন উন্মীলি
হেরিলা রাজর্ষি বর নির্ম্মম মুরতি
শিমর বসেছে বক্ষে শিরñেদ তরে
কাতরে কহিলা বীর ‘ওরে রে শিমর
আজী পুণ্য জুম্মাবার মধ্যাহ্ন নামাজ
পরিবার অবসর দে রে কিছুক্ষণ।’
পাপিষ্ঠ শিমার যখন ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শির কর্তন করল তখন কী পরিবেশ সৃষ্টি হলো মুহূর্তে ধরায় সেটা বর্ণনা দিচ্ছেন কবি এভাবে-
‘খ-িত হইলো শির! কাঁপিল ধরনী
সহসা জলদ জালে লুকালো তপন
আঁধার হইলো বিশ্ব বিভু সিংহাসন
কাঁপিলেক থর থর নিদারুণ শোকে
প্রকৃতি ছাড়িল শ্বাস, উড়ি রাজোরাশি
আঁধারিল দশ দিশি গগন ম-লে
সহ¯্র সহ¯্র উল্কা জ্বলিয়া উঠিল
রহিল প্রবল বেগে উজানে ফোরাত
বিপ্লবিয়া বেলাভূমি কল্লোলে সমূদ্র
গর্জিল ভীষণ শ^াসে বিষম বিষাদে।’
মুহররম ও কারবালা সংক্রান্ত কাব্য রচনায় আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। কবি আবদুল হাই শিকদার সম্পাদিত, নজরুল ইনিস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত ‘নজরুল কাব্যে আশুরা ও মুহাররম’ শীর্ষক গ্রন্থে নজরুলের মর্সিয়াগুলো একত্রে সংকলিত হয়েছে।
জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের ‘মহররম’ কবিতাটি জাতীয় জাগরণের কবিতা রূপে পঠিত হয়ে থাকে। যা নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কাব্যগ্রন্থে স্থান পেয়েছে।
‘নীল সিয়া আসমান লালে লাল দুনিয়া
আম্মা লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া
কাঁদে কোন ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে
সেকাঁদনে আসু আনে সীমারের ছোড়াতে
রুদ্র-মাতম উঠে দুুনিয়া দামেশকে
জয়নালে পড়ালো এ খুনিয়ারা বেশ কে?
তবে শোন ঐ শোন বাজে কোথা দামামা
শমসের হাতে নাও বাঁধো শিরে আমামা
বেজেছে নাকাড়া হাঁকে নকীবের তূর্য্য
হুশিয়ার ইসলাম ডুবে তব সূর্য।’
‘মহররম’ কবিতায় আরো দুটি লাইন আছে তাৎপর্যপূর্ণ-
‘ফিরে এলো আবার ঐ মহররম মাহিনা
ত্যাগ চাই মর্সিয়া ক্রন্দন চাহিনা।’
প্রশ্ন জাগতে পারে যে, নজরুল কি তাহলে আহলে বাইতের শোকে কিংবা আহলে বাইতের মুহব্বতে কোন মর্সিয়া, কোন শোকানুষ্ঠান বা ক্রন্দন চান না? তিনি কি ইমাম হোসাইনের শাহাদাতের শোকে বেদনাকাতর নন? পৃথিবীতে কত লোক মারা গিয়েছে এবং মারা যায়। তাদেরকে তো মানুষ একসময় ভুলেই যায়। একদিন দুদিন তাদের জন্য কাঁদে। হয়তো কালে-ভদ্রে বা বছরে একদিন স্মরণসভা হয়। কিন্তু আহলে বাইতের শোকে কারবালার শহীদানদের শোকে যুগ যুগ ধরে মানুষের অশ্রু ঝরছে। শোকার্তের কান্নার ভেতর দিয়ে শহীদানে কারবালা বেঁচে আছেন, জেগে আছে কারবালার চেতনা। নজরুল কি এ বিষয়ে অবগত নন?
না, বন্ধু! না। কোন কোন কবিতার কোন কোন বাক্য বা শব্দাবলি জ্ঞাত অর্থের চেয়ে বা বাহ্যিক অর্থের চেয়েও অতিরিক্ত অর্থ প্রকাশ করে। বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদ তাই বলেন : ‘কবিতার শব্দমালা জ্ঞাত অর্থের চেয়েও অধিক বা অতিরিক্ত অর্থ প্রকাশ করে।’ তাই নজরুলের কবিতার উক্ত দুটি লাইনের বাহ্যিক অর্থের চেয়ে অন্তর্নিহিত অর্থের দিকে বেশি মনোযোগ দেয়া দরকার। নজরুল উক্ত দুটি লাইনের মাধ্যমে চাচ্ছেন শোককে শক্তিতে পরিণত করতে। তবেই জাতির আজাদি আসবে। নজরুলের ‘মহররম’ কবিতাটির কাল হচ্ছে পরাধীন বাংলার সময়কাল। যখন ব্রিটিশ ইংরেজ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে জাতি নানাভাবে মুক্তির সংগ্রামে লিপ্ত। ‘মহররম’ কবিতাটির মাধ্যমে নজরুল বাংলার মুসলমানদেরকে জাগাতে চেয়েছেন শোককে শক্তিতে পরিণত করে। যেমনিভাবে শোককে শক্তিতে পরিণত করে সারা বিশ্বের যাবতীয় বিরোধী শক্তির সম্মিলিত ষড়যন্ত্র, রুদ্রচক্ষু ও বিরোধিতার পরও নবীবংশীয় সাইয়্যেদের নেতৃত্বের নিপুণতায় আত্মশক্তিতে দ-ায়মান বর্তমান ইরান। নজরুলও তাঁর জাতির জন্য তেমনটিই চেয়েছিলেন।
আসলে নজরুল তাঁর উক্ত লাইন দুটি দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন কেবল শোক নয়, আশুরা আন্দোলনের চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে সত্য-ন্যায়ের বিজয় ঘটাতে হবে। যে নজরুল লিখেছেন, ‘ত্যাগ চাই মর্সিয়া ক্রন্দন চাহিনা’, সেই নজরুল-ই আবার লিখেছেন মর্মস্পর্শী সব মর্সিয়া।
‘মোহররমের চাঁদ এলো ঐ কাঁদাতে ফের দুনিয়ায়
ওয়া হোসেনা ওয়া হোসেনা তারি মাতম শোনা যায়।’
তিনি লিখেছেন,
‘এলো শোকের সেই মোহররম
কারবালা স্মৃতি বুকে লয়ে
আজি বেতাব বিশ্ব মুসলিম
সেই শোকে রয়ে রয়ে।’
আরো লিখেছেন,
‘ফোরাতের পানিতে নেমে ফাতেমা দুলাল কাঁদে অঝোর নয়নে রে
দুহাতে তুলিয়া পানি ফেলিয়া দিলেন অমনি পড়িল কি মনেরে।’
‘অসীম বেদনায় কাঁদে মদিনাবাসী
নিভিয়া গেল চাঁদের মুখের হাসি
কান্দে তরুলতা বনের পাখি
কোথায় হোসেন ডাকি ডাকি
পড়ছে ঝরে তারার রাশি।’
আরেকটি কবিতার লাইন এ রকম-
‘হায় হোসেন হায় হোসেন বলি
কাঁদে গিরিদরী মরু বনস্থলী
কাঁদে পশু ও পাখি তরুলতার সনে
তারি মর্সিয়া গাহে
বিশ্ব যাবে মুছে। মুছিবে না আসু
চিরকাল কাঁদিবে কালের নয়নে।’
এটাতো আহলে বাইতের বর্ণিত রেওয়ায়াতেরই মর্মার্থ- ‘আমাদের অনুসারীরা যুগ যুগ ধরে আমাদের জন্য কাঁদবে।’
নজরুল আরো লিখেন,
‘ওগো মা ফাতেমা
ছুটে আয়…. ছুটে আয়…
তোর দুলালের বুকে হানে ছুরি
দ্বীনের শেষ বাতি বুঝি নিভিয়া যায় গো
বুঝি আঁধার হলো মদিনাপুরী।’
‘মহররম’ নামে নজরুলের আরো একটি কবি আছে। সেখানে তিনি লিখেছেন,
‘ওরে বাংলার মুসলিম তোরা কাঁদ
এসেছে এজিদী বিদ্বেষ পূনঃ মোহরমের চাঁদ
এক ধর্ম এক জাতি তবু ক্ষুধিত সর্বনেশে
তখতের লোভে এসেছে এজিদ কমবখতের বেশে
এসেছে সীমার এসছে ‘কুফার’ বিশ্বাসঘাতকতা
ত্যাগের ধর্মে এনেছে লোভের প্রবল নির্মমতা
মুসলিমে মুসলিমে আনিয়াছে বিদ্বেষের বিষাদ
কাঁদে আসমান জমিন কাঁদিছে মহররমের চাঁদ
একদিকে মাতা ফাতেমার বীর দুলাল হোসেনী সেনা
আরদিকে যত তখত বিলাসী লোভী এজিদের কেনা
মাঝে বহিতেছে শান্তিপ্রবাহ পূর্ণ ফোরাত নদী
শান্তিবারিতে তৃষাতুর মোরা ওরা থাকে তাহা রোধি
একদিকে নবী পরিবার ওরা কেবলি শান্তিব্রতী
আর একদিকে স্বার্থান্বেষী হিংসুক ক্রোধমতি
এই দুনিয়ার মৃত্তিকা ছিলো তখত যে খলিফার
ভেঙে দিয়েছিলো স্বর্ণসিংহানের যে অধিকার
মদগর্ব্বী ও ভোগী বর্বর এজিদী ধর্ম্মী যত
যুগে যুগে সেই সাম্য ধর্মে করিতে চেয়েছে হত
এই ধূর্ত ও ভোগীরাই তলোয়ারে বেঁধে কোরআন
আলীর সেনারে করেছে সদাই বিব্রত পেরেশান
এই এজিদেও সেনাদল শয়তানের প্ররোচনায়
হাসান হোসেনে গালি দিতে যেতো মক্কা ও মদিনায়
এরাই আত্ম প্রতিষ্ঠা লোভে মসজিদে মসজিদে
বক্তৃতা দিয়ে জাগাত ঈর্ষা হায় স্বজাতির হৃদে
ঐক্য যে ইসলামের লক্ষ্য এরা তাহা দেয় ভেঙে
ফোরাত নদীর কুল যুগে যুগে রক্তে উঠেছে রেঙে-
এই ভোগীদের জুলুমে। ইহারা এজীদী মুসলমান
এরা ইসলামী সাম্যবাদের করিয়াছে খান খান
এক বিন্দুও প্রেম অমৃত নাই ইহাদের বুকে
শিশু আজগরে তীর হেনে হাসে পিশাচের মত সুখে
সার্বজনিন ভ্রাতৃত্ব ইসলামের সাম্যবাদ
যুগে যুগে এই অসুর সেনারা করিয়াছে বরবাদ।’
কবি মনিরউদ্দীন ইউসুফ লিখেছেন,
‘না আমি বিদ্রোহী নই
যুদ্ধ করতে আসিনি আমি
দেখনা আমার কোন সৈন্য নেই, দুর্গ নেই, অস্ত্রাগার নেই
আমার সঙ্গে আমার স্ত্রী-পুত্র-কন্যা
আছে ভাই বেরাদও ও কয়েকজন একনিষ্ঠ অনুগামী বন্ধু
আমি কারবালা পর্যন্ত এগিয়ে এসেছি একটি দায়িত্ববোধের শুভ তাড়নায়
আমার মাতামহ আল্লার রাসুল (সা), শেষনবী
তিনি প্রাচীন যুগের নবুয়তের শেষ ব্যাক্তি
তাঁর পড়ে আর কোন নবী আসবেনা
তিনি আধুনিক যুগে আল্লাহ প্রেরিত নকীব
আামি কারবালায় যিহাদের পতকা উড্ডীন করে গেলাম
শাহাদাতের এ ঐতিহ্য আমাদের থেকেই ছড়িয়ে পড়বে
অনাগত যুগ যুগান্ত ধরে সব দেশে
মনে রেখো আমি যুদ্ধ করতে আসিনি
আমার কোন সৈন্য নেই, দুর্গ নেই, অস্ত্রাগার নেই
আমি প্রতিবাদ করতে এসেছি এবং শাহাদাতের ঝা-া উঁচু করে রেখে গোলাম।’
ইসলামি রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ লিখেছেন,
‘ফোরাতের তীরে তীরে কাঁদে আজো সংখ্যাতীত প্রাণ
উদভ্রান্ত ঘূর্ণির মতো শান্তি চায় মাতমে কান্নায়
যেখানে মৃত্যুর মুখে তৃষ্ণাতপ্ত মরুর হাওয়ায়
জিগরের খুন দিলো কারবালার বীর শহীদান
স্মৃতির পাথর পটে সে কাহিনী রয়েছে অম্লান
উজ্জ্বল রক্তের রঙে, মোছেনি তা মরু শাহারায়।’
এভাবে আশুরা ও মুহররমের প্রেক্ষাপটে অনেকেই লিখেছেন। এখনো তা চলমান আছে। বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে। বিশ শতকের পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর, আশি ও নব্বই দশকের কবিরা অনেকেই আশুরা ও মুহররম নিয়ে কবিতা ও গান লিখেছেন। মর্সিয়া লিখেছেন ও লিখছেন অথবা আশুরা, মোহররম, ইমাম হোসাইন, ফোরাত, কারবালা প্রান্তর, কে হোসাইন-কে ইয়াযীদ, ঘৃণিত সীমার ইত্যাদি মুহররম সম্পর্কিত শব্দাবলিকে উপমা-উৎপ্রেক্ষাতে হলেও বিভিন্ন কবিতার বিভিন্ন লাইন প্রসঙ্গে টেনে এনেছেন। কারবালা সংক্রান্ত স্বতন্ত্র কবিতার রচনা অথবা উপমা-উৎপ্রেক্ষায় মুহররমকেন্দ্রিক শব্দাবলিকে টেনে আনা এই সব কবির তালিকায় রয়েছেন সৈয়দ আলী আহসান, আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান, কআবদুস সাত্তার, আল মুজাহিদী, আসাদ চৌধুরী, শাহাদাত হোসাইন, মাওলানা রুহুল আমিন খান, ফজল শাহাবুদ্দিন, মোহাম্মদ নূরুল হুদা, আ স ম বাবর আলী, মসউদ উশ শহীদ, জহুরুশ শহীদ, আবু নসরত রহমত উল্লাহ, ফারুক মাহমুদ, মতিউর রহমান মল্লিক, আবদুল হাই শিকদার, গোলাম মোহাম্মদ, কবি আসাদ বিন হাফিজ, হোসেন মাহমুদ, মোহসিন হোসাইন, সৈয়দ মুসা রেজা, অধ্যাপক সিরাজুল হক, সোলায়মান আহসান, মুকুল চৌধুরী, আবদুল মুকিত চৌধুরী, মহিউদ্দিন আকবর, আতিক হেলাল, মানসুর মুজাম্মিল প্রমুখ। আমার নিজেরও একটি ছড়া-কবিতা আছে মুহাররমম নিয়ে-
‘আকাশে ওই উঠলো দেখো মোহররমের চাঁদ
ইমাম হোসেনের শোকেতে কাঁদরে তোরা কাঁদ
এই চাদেরি দশ তারিখে ফোরাত নদীর তীরে
কারবালা মাঠ লাল হয়েছে রক্তেরি আবিরে
এজিদ সীমার পাষ-রা ছুড়লো যখন তীর
সেই তীরেতে জীবন দিলেন আল্লাহপ্রেমিক বীর
ইমাম এবং তাঁর সাথিরা জীবন দিলেন হেসে
সত্য পথে লড়াই করে দ্বীনকে ভালবেসে
এজিদ সীমার পাষ-রা আজো লেগেই আছে
বীর মুজাহিদ ইমাম হোসেনের সাথিদের পাছে
ইমাম হোসেনের সাথিরা আজো বিশ্বমাঝে
করছে লড়াই ঢালছে লহু সকাল দুপুর সাঁঝে।’
চলমান সময়েও চোখে পড়ে মুহররমের কবিতা। সকল প্রতিবন্ধকতা, অপপ্রচার এবং নিরুৎসাহিতকরণের জন্য ভ্রান্ত ফতোয়াবাজীর পরও মানুষের হৃদয় থেকে কারবালাকে মুছে দিতে পারে নি এজিদের পক্ষশক্তি ও মানসপুত্ররা। আজো মর্সিয়া রচনা করে চলেছেন অনেক কবি। এদের মধ্যে রয়েছেন মোহাম্মদ আতিয়ার রহমান, ইরফানুল হক, শাহনেওয়াজ তাবীব, নাজীম হোসাইন এবং নুরুল মনির প্রমুখ।
উপসংহার
কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার পর সেদিন নবী পরিবারের সদস্যদের ওপর যে অত্যাচার করা হয়েছিল এবং পরবর্তী সময়ে উমাইয়্যা ও আব্বাসী যালিম শাসকদের আমলে নবীবংশের অনুসারীদের ওপর যে অত্যাচার ও নির্মূল অভিযান চালানো হয়েছিল তা আজও বিদ্যমান। উমাইয়্যা ও আব্বাসী যালিম শাসকদের হাতে পরবর্তীকালে বড় বড় আলেম ও সূফিসাধক নিহত হয়েছিলেন। শহীদ হয়েছিলেন নবী বংশের পরবর্তী ইমামগণ।
সম্প্রতি নানা পুস্তক-পুস্তিকায় একদল চরমপন্থী এই মর্মে ফতোয়াবাজি করছে যে, কারবালার ঘটনা নিয়ে কবিতা, প্রবন্ধ, মর্সিয়া, লেখা যাবে না। কারবালার ইতিহাস চর্চা করা যাবে না। তা নাকি বেদাত। অথচ এই কারবালাই ইসলামকে জিন্দা করেছে। ইসলামকে রক্ষা করেছে। চিনতে সহযোগিতা করেছে কে ইয়াযিদের অনুসারী আর কে হোসাইনের অনুসারী। ইসলামের ইতিহাসে হুদাইবিয়ার সন্ধি যেমন ‘ফাতহুম মুবীন’ বা সুস্পষ্ট বিজয়। ঠিক তদ্রƒপ কারবালার আত্মদানও ইসলামের বিজয়। উর্দু কবি মুহাম্মদ আলী জওহর তাই লিখেন,
‘ক্বাতলে হোসাইন আসল যে মরর্গে ইয়াজিদ হায়
ইসলাম জিন্দা হোতা হায় হার কারবালাকে বাদ।’
অর্থাৎ হোসাইনের মৃত্যু আসলে ইয়াযিদেরই মৃত্যু। ইসলাম কারবালার পর পুনরুজ্জীবিত হয়েছে।
মুহররম তরবারির ওপর রক্তের বিজয়ের মাস। আশুরার চেতনা থেকেই সত্য বিজয় লাভ করে। অত্যাচারী পরাভূত হয়। নিন্দিত হয়, ধিকৃত হয়। আশুরার ইতিহাস চর্চার মাধ্যমেই এর খল চরিত্রগুলো চিহ্নিত হয়। বেরিয়ে আসে তদানিন্তন কারবালা যুদ্ধাপরাধীদের চেহারা ও সমর্থকেদের চেহারা। আশুরা আমাদেরকে শেখায় শক্তির বলে বিজয় লাভ করলেই প্রকৃত বিজয় হয় না। মানুষকে হত্যা করা যায়, কিন্তু তার আত্মাকে কেনা যায় না। কবি বলেন, ‘জেতা শুধু জেতা নয় হারা নয় হারা/সময় যে বলে দেয় বিজয়ী সে কারা।’
কারবালায় ইমাম হোসাইন সপরিবারে শহীদ হয়েও বিজয়ী। আর ইয়াযিদের বিশাল বাহিনী অসম যুদ্ধ করে বিজয়ী হলেও তারা অত্যাচারী যালিম।
হয়রত খাজা মাইনুদ্দিন চিশতি আজমিরি (র.)-এর হাতে এক কোটি ভারতীয় ইসলাম গ্রহণ করেছিল। তিনি বলেছিলেন,
‘শাহ আস্ত হোসাইন। বাদশা আস্ত হোসাইন।
দ্বীন আস্ত হোসাইন। দ্বীন পানাহ আস্ত হোসাইন
সার দাদ, ওয়া না দাদ দাস্ত দার দাস্ত ইয়াযিদ
হাক্কাকে বেনয়ে লা-ইলাহা আস্ত হোসাইন
মান বে গোলামে গোলামান হোসাইন।’
অর্থাৎ হোসাইন হচ্ছেন শাহ, হোসাইন হচ্ছেন বাদশা, হোসাইন দ্বীন, হোসাইন দ্বীনের মুক্তিদাতা, শির দিয়েছেনন কিন্তু ইয়াযিদের হাতে হাত মিলান নি। হোসাইন হচ্ছেন হক ও হকের মুক্তিদাতা, হোসাইন লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর ভিত্তি। আমি হোসাইনের গোলামদেরও গোলাম।
কারবালা এখনো ঘটে যাচ্ছে পৃথিবীতে। নবী বংশের খ্যাতনামা ইমাম ও ফিকাহবিদ ইমাম জাফর সাদেক (আ.) হাজার বছর আগেই বলেছিলেন ‘হার রোজ আশুরা, হার যামিন কারবালা’- প্রতিটি দিনই আশুরা আর প্রতিটি ময়দানই কারবালা। ক্রমবর্ধমান অত্যাচারের প্রেক্ষিতেই তিনি তা বলেছিলেন। তাঁর কথা এই শতাব্দীতেও তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলা ভাষাভাষি লেখক-সাহিত্যিকদের উচিত কারবালার বিয়োগান্তক ঘটনার শোকগাথার সাথে আশুরার আন্দোলনের প্রকৃত তাৎপর্যকে উপলব্ধি করে যুগান্তকারী সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি করা। যা বর্তমান সময় ও আগামী দিনের সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্বে সত্যকে বিজয়ী করার চেতনা সৃষ্টিকারী মাইল ফলক হিসেবে কাজ করবে। আশার কথা আমাদের দেশে ‘একুশের কবিতা’, ‘বিজয়ের কবিতা’, ‘স্বাধীনতার কবিতা’, ‘বৈশাখের পদাবলী’, ‘বৃষ্টির কবিতা’, ‘শীতের কবিতা’র পাশাপাশি যুক্ত হয়ে ‘সীরাতের কবিতা’ বা ‘মিলাদুন্নবী (সা.)-এর কবিতা’ও চর্চা হচ্ছে, পঠিত হচ্ছে। হচ্ছে নানা অনুষ্ঠানমালা। ঈদের কবিতা উৎসবও হচ্ছে বেশ কয়েক বছর যাবৎ। ইসলামের ইতিহাসের প্রাণপ্রদীপ নিহিত যে মহান ও শোকাবহ ঘটনার মধ্যে সেই আশুরা, কারবালা, মুহররমের কবিতার চর্চাও বাড়িয়ে দেয়া হোক ব্যাপকভাবে। এই কামনা করছি।
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) এরশাদ করেন : ‘আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে অন্যদের জ্ঞান শিক্ষাদান অত্যন্ত উত্তম কাজ এবং জ্ঞান শিক্ষা করা ইবাদত। ‘ইলমী বিষয়ে আলোচনা তাসবীহ্ স্বরূপ, জ্ঞান কাজে লাগানো জিহাদ সমতুল্য, যে জানেনা তাকে তা শিক্ষা দেয়া সাদাকাহ্স্বরূপএবং উপযুক্ত ব্যক্তিকে তাশিক্ষা দেয়া আল্লাহ্র নৈকট্যের উপায়। কারণ, জ্ঞান হালাল ও হারামকীতা শিক্ষা দেয়, বেহেশতের পথকে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরে এবং একাকীত্বের অবস্থায় তা সাথি স্বরূপ।’
মহানবী (সা.) এরশাদ করেন :‘চিন্তা ও পর্যালোচনা সহকারে দুই রাক্আ‘ত্ সহজ (নফল) নামায আদায় করা সারা রাত (নফল) নামায আদায়ের চেয়ে উত্তম।’
মহানবী (সা.) আরো এরশাদ করেন : ‘আল্লাহ্ পছন্দ করেন যে, তোমাদের কেউ যখন কোনো কাজ করবে তখন সে যেন কাজটিকে মজবুত্ ও সুদৃঢ়ভাবে আঞ্জাম দেয়।’
রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন : ‘যে ব্যক্তি তার নিজের ও তার পরিবারের রুযী উপার্জনের জন্য সফরে যায় কিয়ামতের দিনে সে ‘র্আশের ছায়ায় অবস্থান করবে।’
রাসূলুল্লাহ্ (সা.) আরো বলেন : ‘যে কেউ তিনটি নে‘আমত সহদিন ও রাত অতিক্রান্ত করে সে দুনিয়ার জীবনের পুরো নে‘আমতের অধিকারী। সেগুলো হচ্ছে : শারীরিক সুস্থতা, নিরাপত্তা ও দৈনন্দিন ব্যয়। আর সে যদি চতুর্থ নে‘আমতটির ও অধিকারী হয় তাহলে সে দুনিয়া ও আখিরাতের সমস্ত নে‘আমতের অধিকারী হলো, সেটি হচ্ছে ইসলাম।’
আমীরুল্ মু‘মিনীন্ হযরত আলী (আ.) এরশাদ করেন : ‘জেনে রেখ, যে ইবাদতের মধ্যে চিন্তা-ভাবনা ও পর্যালোচনা থাকে না তাতে কোনো কল্যাণ নিহিত নেই।’
হযরত আলী (আ.) এরশাদ করেন : মানুষের বিচক্ষণতা ছয় টিজিনিসের দ্বারা পরিমাপ করা হয়, তা হচ্ছে : মেলামেশা, লেনদেন, পদ লাভ, পদ থেকে অপসারণ, আর্থিক সক্ষমতা ও রিক্তহস্ত অবস্থা।
হযরত আলী (আ.) বলেন : ‘নীরবতা আত্মিক স্বস্তির কারণ।’
হযরত আলী (আ.) বলেন : ‘যে ব্যক্তি চিকিৎসকের কাছে তার রোগ গোপন করে সে তার শরীরের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল।’
হযরত আলী (আ.) বলেন : ‘যে ব্যক্তি জ্ঞানীদের উপদেশে কর্ণপাত করা থেকে বিরত থাকে তার ‘আক্লের মৃত্যু ঘটে।’
ইমাম জাফর সাদিক (আ.) এরশাদ করেন :‘আল্লাহ্র কাছে সবচেয়ে ঘৃণ্য বান্দা হচ্ছে সেই ব্যক্তি যে রাতে ঘুমায় আর দিনের বেলা বিনা কাজে কাটায়।’
হযরত ইমাম জা‘ফর সাদেক (আ.) বলেন : ‘তিনটি জিনিস ব্যতীত কোনো কিছু মুসলমানকে উপযুক্ত (বা সংশোধন) করেনা : দ্বীনের জ্ঞান, বিপদাপদে ধৈর্যধারণ এবং যিন্দেগীতে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা।’
হযরত ইমাম মূসা কাযেম্ (আ.) এরশাদ করেন : ‘যেবান্দা অনেক বেশি ঘুমায় ও কাজ করেনা আল্লাহ্্ তা‘আলা তাকে দুশমন গণ্য করেন।’
হযরত ইমাম রেযা (আ.) এরশাদ করেন : ‘লোকেরা যদি কম খাবার খায় তাহলে তাদের শরীর ভারসাম্যপূর্ণ ও শক্তিশালী হয়।’
হযরত ইমাম জাওয়াদ (আ.) এরশাদ করেন : ‘কোনো কিছু সুদৃঢ় হওয়ার আগে সে সংক্রান্ত তথ্য ফাঁশকরণ তা বিনষ্টের কারণ হয়ে থাকে।’
(মাফাতীহুল্হায়াত্গ্রন্থ থেকে সংকলিত)
অনুবাদ :নূর হোসেনমজিদী
ইরানের বিখ্যাত সুফিকবি মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি স্মরণে দিবস পালন উপলক্ষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের উদ্যোগে ‘জালাল উদ্দিন রুমির দর্শনে বিশ্বজগৎ ও মানবসৃষ্টি রহস্য’ শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য প্রফেসর ড. চৌধুরী মো. জাকারিয়া, বিশেষ অতিথি হিসেবে রাবি কলা অনুষদের ডীন প্রফেসর ড. মো. ফজলুল হক ও ঢাকাস্থ ইরানি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কালচারাল কাউন্সেলর জনাব সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনী উপস্থিত ছিলেন। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ভিজিটিং প্রফেসর ড. কাজেম কাহদুয়ি, রাবি ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ভিজিটিং প্রফেসর ড. রেজা সামিযাদে, রাবি ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের প্রফেসর ড. মো. শফিউল্লাহ। সেমিনারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের প্রফেসর মো. নূরুল হুদা। বিভাগীয় সভাপতি প্রফেসর ড. মো. আতাউল্যাহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারে সঞ্চালক ও ভাষান্তরের দায়িত্ব পালন করেন প্রফেসর ড. মো. কামাল উদ্দিন।
ড. মো. ইমতিয়াজ আহমেদের পবিত্র কুরআন মজিদ থেকে তেলাওয়াতের মাধ্যমে সেমিনার শুরু হয়। অতিথিবৃন্দের স্বাগত জানিয়ে স্বরচিত ফারসি গান পরিবেশন করেন বিভাগের পিএইচডি গবেষক মো. মহররম হোসাইন ও তার দল। বিভাগের পক্ষ থেকে অতিথিবৃন্দকে ক্রেস্ট প্রদান করা হয়, বিশেষ করে বিদায়ী কালচারাল কাউন্সেলর জনাব সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনীকে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের পক্ষ থেকে বিদায়ী স্মারক ক্রেস্ট উপহার দেওয়া হয়। উক্ত সেমিনারে বিভিন্ন বিভাগের অর্ধ শতাধিক শিক্ষক ও দুই শতাধিক ফারসি শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রফেসর ড. চৌধুরী মো. জাকারিয়া বলেন, সুফিদর্শনের মাধ্যমে ইরান ও বাংলাদেশের মধ্যে এক প্রাচীন ও ঐতিহাসিক সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমি যখন ঢাকায় টওঞঝ-এর প্রোভিসির দায়িত্বে কর্মরত ছিলাম তখন আল্লামা রুমি সোসাইটির সাথে সবসময় সম্পৃক্ত ছিলাম। বাংলা ভাষায় ফারসি প্রভাব সম্পর্কে বলেন, বাংলা ভাষায় প্রায় আট হাজার ফারসি শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে। নামাজ, রোজা, পর্চা, জায়নামাজ প্রভৃতি ফারসি শব্দ বাংলার ন্যায় আমাদের কাছে পরিচিত। অগণিত ফারসি গ্রন্থ বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ‘গুলিস্তান’, ‘বুস্তান’, ‘শাহনামা’, ‘দিওয়ানে হাফিজ’, ‘রুবাইয়াতে ওমর খৈয়্যাম’ অন্যতম। ইরানিদের আতিথেয়তা বিশ্বজুড়ে খুবই সমাদৃত। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে আগত ইরানি ভিজিটিং প্রফেসর ড. রেজা সামিজাদেকে স্বাগত জানাচ্ছি। তাঁর আগমনে ফারসি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ও অনেক বেশি উপকৃত হবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে রাবি কলা অনুষদের ডীন প্রফেসর ড. মো. ফজলুল হক বলেন, মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি বিশ্বসাহিত্যের এক অমূল্য রতœ। ‘মসনবিয়ে রুমি’ ও ‘দিওয়ানে শামস তাবরিযি’ তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। রুমি ¯্রষ্টা ও সৃষ্টিজগৎ সম্পর্কে দার্শনিক তত্ত্ব উত্থাপন করেন। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ ও ইরানের মধ্যে রয়েছে এক সুদৃঢ় ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক। ঢাকাস্থ ইরান কালচারাল সেন্টারের কাউন্সেলর জনাব সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের উন্নয়নে বিশেষ সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন। এ বিভাগের শিক্ষকগণও একাডেমিক কার্যক্রমে খুবই সক্রিয়। ফলে মাত্র দু’বছরের ব্যবধানে বিভাগ শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক অনেক উন্নয়নমূলক কার্যক্রম সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছে। এ বিভাগ উত্তরোত্তর আরো উন্নতি লাভ করবে বলে প্রত্যাশা করছি। তিনি কালচারাল কাউন্সেলরের নিকট ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের এম এ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষাবৃত্তির প্রদানের মাধ্যমে ইরানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির অনুরোধ জানান।
ইরান কালচারাল সেন্টারের কাউন্সেলর জনাব সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনী তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেন, আমি এবার তৃতীয় বারের মতো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে আগমন করলাম। যখনই আমি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি তখনই এখান থেকে এনার্জি লাভ করেছি। প্রথমবার যখন আসি তখন ফারসি বিষয় ভাষা বিভাগের অধীনে ছিল। তৎকালীন মাননীয় উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. মিজানউদ্দিনের সাথে সাক্ষাৎ করেছি, তিনি ফারসিকে স্বতন্ত্র বিভাগ করার বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া প্রদান করেন। কয়েক মাস পর দ্বিতীয়বার যখন এ বিভাগে এলাম তখন ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ স্বতন্ত্র বিভাগের মর্যাদা লাভ করেছে। মাননীয় উপাচার্য মহোদয়ের উপস্থিতিতে ইরানিয়ান স্টাডিজ রুম উদ্বোধনের পাশাপাশি ফারসি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে ইরানি শিক্ষক দ্বারা ফারসি ভাষা ও সাহিত্য প্রমোশন কোর্স সম্পন্ন করা হয়। এবার তৃতীয়বারের মতো এ বিভাগে যখন এসেছি তখন বিভাগ অনেক উন্নতি লাভ করেছে। ইরানের একজন খ্যাতিমান ফারসি প-িত প্রফেসর ড. রেজা সামিজাদে বিভাগে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে যোগদান করেছেন। আশা করি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ভিজিটিং প্রফেসর ড. কাজেম কাহদুয়ি এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর ড. রেজা সামিযাদের কাছ থেকে বিভাগীয় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীবৃন্দ তাঁদের পঠন-পাঠন ও গবেষণামূলক কাজে অনেক বেশি উপকৃত হবেন। শুরু থেকেই এই বিভাগের শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দ খুবই সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছেন। বিভাগের একাডেমিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। এ বছর ইরানের তেহরানে শেখ সাদি ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ফারসি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কোর্সের আয়োজন করা হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে সর্বমোট চার জন শিক্ষক এ কোর্সে অংশগ্রহণ করেন, তন্মধ্যে তিন জন শিক্ষক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অংশগ্রহণ করেন আর এক জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এটাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি শিক্ষকগণের সক্রিয়তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আশা করি আগামী দিনেও তাঁদের এ তৎপরতা অব্যাহত থাকবে। আগামী বছরের শুরুতে ঢাকাতে ডেফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাযেমানে ফারাহাঙ্গ ওয়া এরতেবাতাতে ইসলামি, মাশহাদ ফেরদৌসি ইউনিভার্সিটির উদ্যোগে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। এতে গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচনার মাধ্যমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকগণ অংশগ্রহণ করতে পারবেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ভিজিটিং প্রফেসর ড. কাজেম কাহদুয়ি তাঁর বক্তব্যে বলেন, আমি ২২ বছর পর দ্বিতীয়বার বাংলাদেশে আগমন করলাম। বিদেশি হিসেবে যাঁরা বাংলাদেশে আসেন তাঁরা দু’বার কান্না করেন। প্রথমবার যখন আসেন তখন জানেন না যে, তাঁরা কোথায় আসছেন? দ্বিতীয়বার যখন তাঁরা নিজ দেশে ফিরে যান তখন বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা, আন্তরিকতা ও আতিথেয়তায় অশ্রুসিক্ত হয়ে বিদায় নিতে হয়। তিনি তাঁর বক্তব্যে রুমির ‘মসনবি’র কাহিনীর আলোকে মানুষের জীবনকে শিশুর জীবনের সাথে তুলনা করেন। তিনি ‘মসনবি’ থেকে সুলতান মাহমুদ ও চোরের কাহিনী উপস্থাপনের মাধ্যমে শিক্ষণীয় বিষয় তুলে ধরেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ভিজিটিং প্রফেসর ড. রেজা সামিযাদে বলেন, রুমির জীবনকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। তাঁর জীবনের শেষাংশ ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যার সূচনা হয়েছিল চল্লিশ বছর বয়সের পর শামস তাবরিযির সাথে সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে। এতে তাঁর জীবনের আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। তিনি আরও বলেন, ফরিদ উদ্দিন আত্তার রুমিকে তাঁর ‘আসরার’ নামে কাব্যগ্রন্থটি উপহার দিয়েছিলেন। রুমির ‘মসনবি’ পৃথিবীর প্রায় ত্রিশটির অধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। রুমি ফারসি সাহিত্যাকাশের এক মহান নক্ষত্র হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
প্রফেসর ড. মো. শফিল্লাহ বলেন, মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমির ‘মসনবি’ বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ের সাথে গেঁথে আছে। বাংলাদেশের যেখানেই ওয়াজ-মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়, প্রায় সর্বত্রই তাঁর ‘মসনবি’ থেকে আলোচনা করা হয়।
সেমিনারে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকগণের মধ্যে যাঁরা আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশগ্রহণ উপলক্ষে ইরান সফর করে এসেছেন তাঁরা বর্তমান ইরানের উন্নয়ন ও অগ্রগতি সম্পর্কে তাঁদের অভিমত তুলে ধরেন। এতে অংশগ্রহণ করেন ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের প্রফেসর ও কলা অনুষদের সাবেক ডীন প্রফেসর ড. এফ এম এ এইচ তাকী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে প্রফেসর ড. মুহিবউল্যাহ সিদ্দিকী ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. আব্দুর রহমান সিদ্দিকী।
সভাপতির বক্তব্যে বিভাগীয় সভাপতি প্রফেসর ড. মো. আতাউল্যাহ অনুষ্ঠানে আগত মাননীয় প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথিবৃন্দ, সম্মানিত আলোচকবৃন্দ, প্রবন্ধকার, বিভিন্ন বিভাগের বিজ্ঞ শিক্ষকম-লী, সুধীম-লী ও উপস্থিত ছাত্র-ছাত্রীদেরকে আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। ছুটির পর পুনরায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় খোলার মাত্র তৃতীয় দিনে বিভাগের পক্ষ থেকে আয়োজিত এ সেমিনারকে সাফল্যম-িত করায় তিনি উপস্থিত সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
পরিশেষে ইরানের আন্তর্জাতিক কুরআন মজিদ প্রদর্শনীমূলক সেমিনারে অংশগ্রহণকারী রাবি আরবি বিভাগের প্রফেসর ড. মতিউর রহমানের মুনাজাতের মাধ্যমে সেমিনারের পরিসমাপ্তি ঘটে।
উপ-উপাচার্য মহোদয়ের সাথে সাক্ষাৎ
ইরান কালচারাল কাউন্সেলর জনাব সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনি ইরানি প্রতিনিধি দল এবং ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষকদের নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য প্রফেসর ড. আনন্দ কুমার সাহার সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা উভয় দেশের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ককে আরো জোরদার করার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন। এক্ষেত্রে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর ড. রেজা সামিযাদে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করবেন। তাঁরা মনে করেন ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ যেভাবে গতিশীলতার সাথে অ্যাকাডেমিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে আগামী দিনে তা আরো উত্তরোত্তর সাফল্যের দিকে নিয়ে যাবে।
ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ পরিদর্শন
জনাব সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনী ও প্রফেসর ড. কাজেম কাহদুয়ি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ পরিদর্শন করেন। এসময় শিক্ষার্থীরা কালচারাল কাউন্সেলরের উদ্দেশে বিদায়ী বক্তব্য প্রদান করেন। বিভাগীয় সকল শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রী বিভাগের উন্নয়নে ও স্বতন্ত্র বিভাগের মর্যাদা লাভের ক্ষেত্রে তাঁর সার্বিক সহযোগিতার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ড. কাহদুয়ি তাঁর বক্তব্যে বলেন, ফারসি আমরা শুধু রুটি রুজির জন্য অধ্যয়ন করি না। কারণ, রিযিকের ফয়সালা আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহপ্রেমে পাগলপারা মানুষ সবাই একই দলভুক্ত। আমরা সবাই একই স্থানে দাঁড়িয়ে নিজেদের ও জাতির উন্নয়নে এগিয়ে যাব।
ঢাবির ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের উদ্যোগে ইরানি কালচারাল কাউন্সেলরকে বিদায় সংবর্ধনা
ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কালচারাল কাউন্সেলর সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনীর বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের হাফিজ প্রাঙ্গনে গত ১৩ আগষ্ট এক বিদায় সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আবুল কালাম সরকার। সূচনা বক্তব্য প্রদান করেন বিভাগের প্রবীন শিক্ষক ড. কুলসুম আবুল বাশার। অনুষ্ঠানে জনাব মূসা হোসেইনীকে বিভাগের পক্ষ থেকে স্মারক ক্রেস্ট প্রদান করেন ড. আবুল কালাম সরকার। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড.এ কে এম সাইফুল ইসলাম খান, প্রফেসর ড. তারেক সিরাজী, প্রফেসর ড. আব্দুস সবুর খান ও সহকারী অধ্যাপক মুমিত আল রশিদ। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জনাব আহসানুল হাদী।
প্রফেসর ড. কুলসুম আবুল বাশার তাঁর বক্তৃতায় বলেন, সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনী বাংলাদেশে দায়িত্ব পালনকালে তাঁর কার্যক্রম ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নে বড় ভূমিকা রেখেছেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইরানি ভিজিটিং প্রফেসরদের আগমন ও অবদানের প্রশংসা করেন।
অনুষ্ঠানে প্রফেসর কে এম সাইফুল ইসলাম খান কয়েকটি কবিতার উদ্ধৃতি থেকে বলেন, ‘গাঞ্জ’ একটি ফারসি শব্দ এবং আমরা ফারসি সাহিত্যের চর্চার মধ্য দিয়ে জ্ঞান, সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিকতার গাঞ্জে মিলিত হয়েছি। এই উপমহাদেশের বিজ্ঞজনেরা একসময় ফারসির রতœভা-ারে বিচরণ করেছেনÑ বর্তমানে এই সাহিত্যচর্চার মধ্য দিয়ে আমরা আবারও সমৃদ্ধ হব।
অনুষ্ঠানে প্রফেসর ড. আব্দুস সবুর খান বলেন, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ ও ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের স¤পর্ক একই পরিবারের মত। তিনি জনাব মূসা হোসেইনীর সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারসি বিভাগে ইরানের সহায়তায় ভাষা শিক্ষা ল্যাব প্রতিষ্ঠা, বিভাগের ১ জন শিক্ষক ও ২ জন ছাত্রের উচ্চশিক্ষার্থে ইরানে অবস্থান, ইরানে বিভিন্ন সেমিনারে শিক্ষকদের ব্যাপক অংশগ্রহণ, ফারসি বিভাগকে সাথে নিয়ে ভিন্ন মাত্রায় নওরোয উৎসব উদ্যাপনসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের কথা তুলে ধরেন।
প্রফেসর ড. তারেক সিরাজী তাঁর বক্তৃতায় বলেন, জনাব মূসা হোসেইনীর কর্মসূচিগুলোর একটি স্থায়ী প্রভাব রয়েছে ও ছাত্র-শিক্ষকরা তা থেকে উপকৃত হবে।
সহকারী অধ্যাপক মুমিত আল রশিদ তাঁর বক্তৃতায় নতুন প্রজন্মকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যময় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ফারসিচর্চাকে ব্যাপকতর করতে ও তাদের কর্মকা-কে বিভাগ ও দেশের গ-ি পেরিয়ে সর্বত্র সম্প্রসারিত করার আহ্বান জানান।
প্রফেসর ড. আবুল কালাম সরকার তাঁর বক্তৃতায় ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নে আবদান রাখার জন্য সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনীকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ছাত্র-শিক্ষকরা সাম্প্রতিক দিনগুলোতে তাদের সাফল্যের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বিশেষভাবে পুরস্কৃত হচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকার ও ইরানভক্ত মানুষের সহযোগিতার কথা স্মরণীয় হয়ে থাকবে : মূসা হোসেইনী
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের বিদায়ী কালচারাল কাউন্সেলর সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনী বলেছেন, তাঁর দায়িত্বকালীন সময়ে বাংলাদেশ সরকার ও সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রনণালয় ও প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং বাংলাদেশের ইরানভক্ত জনগণ যে সহযোগিতা করেছেন তা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। পূর্ণ মেয়াদে দায়িত্ব পালন শেষে ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি একথা বলেন।
গত ৮ সেপ্টেম্বর ঢাকাস্থ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র মিলনায়তনে ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কালচারাল কাউন্সেলর সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনীর বিদায় ও নবনিযুক্ত ভারপ্রাপ্ত কালচারাল কাউন্সেলর সাইয়্যেদ মাহদী হোসেইনীর বরণ উপলক্ষে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল প্রফেসর ড. মুহাম্মদ সিরাজউদ্দিন। অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে ইরানি ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে নিযুক্ত ড. কাজেম কাহদুয়ীকেও সংবর্ধনা দেয়া হয়।
অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণমূলক বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের সাবেক প্রক্টর ও ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. কে এম সাইফুল ইসলাম খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুস সবুর খান, ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কর্মকর্তা ড. জহির উদ্দিন মাহমুদ, বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ হুজ্জাতুল ইসলাম মোহম্মদ আশরাফ উদ্দিন খান, আল কুদস কমিটি বাংলাদেশ-এর সেক্রেটারি জেনারেল মোস্তফা তারেকুল হাসান এবং ইতিহাসবিদ আশরাফুল ইসলাম।
অনুষ্ঠানে বিদায়ী কালচারাল কাউন্সেলর সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনী আরো বলেন, বাংলাদেশকে আমি কখনো বিদেশ ভাবি নি। আর ইরানপ্রেমিক এদেশের মানুষকে পর ভাবি নি। নিজের ভাই-বোনই মনে হয়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করেছি এবং কাজ করার পূর্ণ পরিবেশ এখানে বিদ্যমান ছিল। সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কাজ যেহেতু কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, সাংবাদিক, গবেষক, অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে এমনকি কিছু কিছু বিষয় ছিল ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের সাথে, কাজেই সবার মতামত বা পরামর্শ নিয়ে, সবাইকে সাথে নিয়ে পার¯পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করেছি এবং সবার সহযোগিতা পেয়েছি। বিভিন্ন সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠন, নাট্যসংগঠন, ফিল্ম প্রডিউসার, প্রকাশকের সাথে একাত্ম হয়ে কাজ করতে হয়েছে। তাই বাংলাদেশে দায়িত্ব শেষ করে নিজ দেশে যাওয়ার সময়ও আমার মনে হচ্ছে আমি নিজেই দেশ ছেড়ে যাচ্ছি।
আমি এমন একটি দেশের ও এমন একটি বিপ্লবের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছি যে দেশের জনগণ রক্ত ও জীবন দিয়ে সেই বিপ্লবের বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। এই বিপ্লবের সুশোভিত সুফল ও এর সৌরভকে পৃথিবীময় বিশ্ববাসীর কাছে ছড়িয়ে দেয়ার যে জাতীয় দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে এর অংশ হিসেবেই আমি বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন করেছি।
সভাপতির বক্তব্যে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল প্রফেসর ড. সিরাজুদ্দিন বলেন, ইরানের সাথে বাংলাদেশের স¤পর্ক হাজার বছরের। আর ফারসি ভাষা একটি আধ্যাত্মিক ও প্রেমের ভাষা হিসেবে পরিচিত। এদেশে ফারসি রাজভাষা ছিল দীর্ঘদিন। ইংরেজরা এদেশ দখল করার পরও বহুদিন এদেশে তথা এ উপমহাদেশে ইংরেজরা ফারসি ভাষাতেই শাসনকার্য চলিয়েছে এবং ফারসি ভাষা শেখার জন্য ও ফারসি ভাষাতে রাজকার্য চালানোর জন্য ফারসি জানা আলেমগণের সহযোগিতা নিয়েছে। পরে তারা ধীরে ধীরে ইংরেজি চালু করেছে।
আমরা ইসলাম পেয়েছি ইরানের ভেতর দিয়ে। ফারসি ভাষাভাষী সুফি ও অলি-দরবেশদের মাধ্যমে। ইরানের সাথে এই যে আমাদের ঐতিহাসিক ও ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ঐক্য সে ঐক্য যুগে যুগে জোরদার হয়েছে সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনীদের মতো অভিজ্ঞতাস¤পন্ন ও নিবেদিতপ্রাণ কর্মকতাদের কারণে। আশা করি ভারপ্রাপ্ত নবাগত তরুণ কাউন্সেলরও জনাব মূসা হোসেইনীর মতোই দক্ষ ও প্রাণবন্ত হবেন এবং অভিজ্ঞতার স্বাক্ষর রাখবেন।
দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশে আগত ইরানের ভিজিটিং প্রফেসর ড. কাজেম কাহদুয়ী বলেন, বাংলাদেশ আমার প্রিয় দেশ। এর সবুজ শ্যামল বিস্তৃত ভূখ- আমার প্রিয় জায়গা। সেকারণে আমি চিনে না গিয়ে, হাঙ্গেরীতে না গিয়ে বাংলাদেশেই আবার ফিরে এসেছি। তিনি বলেন, আমি যখন প্রথম মেয়াদে আসি তখন ফারসি বিভাগের ছাত্র সংখ্যা ছিল চারজনের মতো। আর ছাত্রী তো ছিলই না। সেখান থেকে আজ ফারসি শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮০০ ছাড়িয়ে গেছে। এদেশের মানুষের রয়েছে ইরান ও ফারসি ভাষার প্রতি এক গভীর মমতা।
নবনিযুক্ত ভারপ্রাপ্ত কালচারাল কাউন্সেলর জনাব সাইয়্যেদ মাহদী হোসেইনী তাঁর দায়িত্বকালে সকলের সহযোগিতা কামনা করেন।
অধ্যাপক ড. কে এম সাইফুল ইসলাম খান মাওলানা জালালউদ্দীন রুমী (র.)-এর মসনবী থেকে বেশ কিছু লাইন সুর করে পাঠ করেন ও বলেন, মাওলানা রুমীর প্রেম ও মানবিক আওয়াজ ইরানের মাটিতে সীমাবদ্ধ না থেকে তা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়। এই আওয়াজকে আজ বুলন্দ করতে হবে। দল, মত, জাতি, ধর্ম, মাজহাব, তরীকা নির্বিশেষে ঐক্য, প্রেম ও সংহতির সুবাস ছড়িয়ে দিতে হবে সবখানে। বিভেদ-বিদ্বেষের ভয়ংকর আগুন নেভাতে রুমীর আধ্যাত্মিকতার ঝর্নাধারা বইয়ে দিতে হবে এবং এপথেই ফিরে আসতে হবে। ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পর সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের প্রসারে ফারসি চর্চার ব্যাপকতার ফলেই এ উপলব্ধি আমাদের হয়েছে।
অধ্যাপক ড. আবদুস সবুর খান সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনীর অভিজ্ঞতা, দায়িত্ব সচেতনতা, বুদ্ধিদীপ্ততার কথা উল্লেখ করে বলেন যে, তিনি ছিলেন একজন ধীর-স্থির চিন্তার মানুষ। ঠা-া মাথায় নীরবে কাজ করতেন। কালচারাল সেন্টারের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অনেক যৌথ কার্যক্রম রয়েছে। তিনি সবক্ষেত্রে আন্তরিক সহযোগিতা করেছেন।
ড. জহির উদ্দিন মাহমুদ বলেন, সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনী ইরানের ইসলামি বিপ্লবের একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী। তিনি বিপ্লবের সমাবেশ-মিছিলে অংশগ্রহণ করেছেন। রাজপথে তিনি ছিলেন। ইমাম খোমেইনী (র.) প্যারিস থেকে এসে বেহেশত যাহরায় যে ঐতিহাসিক বিপ্লবী ভাষণ দেন সেটিও তিনি কাছে থেকে শুনেছেন ও দেখেছেন। তিনি ইরানের পররাষ্ট্র ও সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর চাকুরি জীবনের শেষ সময়টা তিনি বাংলাদেশে কাটিয়ে গেলেন। তাঁকে কাজ করতে হতো ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সংগঠন, সংস্থা ও ব্যক্তিবর্গের সাথে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন, জাতীয় জাদুঘর, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমী, নজরুল ইনস্টিটিউট সহ বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল, নাট্য গ্রুপ বা ফিল্ম প্রডিউসারের সাথেও। তাঁর সময়ে এসব ক্ষেত্রে যথার্থ সমন্বয় সাধিত হয়েছে।
জনাব আশরাফ উদ্দিন খান বলেন, সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনী একজন জ্ঞানী মানুষ এবং সফল কালচারাল কাউন্সেলর। তিনি বাংলাদেশের মানুষের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থাটা বুঝতেন। শুধু তাই নয়, তিনি উপমহাদেশের মানুষের মনস্তত্ত্বও বোঝেন। তিনি উর্দু সহ বেশ কয়েকটি ভাষা জানেন। তিনি পাকিস্তানেও দায়িত্ব পালন করেছেন। এ অভিজ্ঞতা তাঁকে তাঁর দায়িত্ব পালনের পথকে প্রশস্ত করে দিয়েছে।
তিনি আরো বলেন, ইসলামি বিপ্লবের পর থেকেই ইরান ক্রমাগতভাবে বিশ্বের কায়েমী স্বার্থবাদী পরাশক্তির শত্রুতার সম্মুখীন হয়েছে। পশ্চিমা মিডিয়ার অপপ্রচার ও অর্থনৈতিক অবরোধের ভেতরও ইরান বিশ্ব-মুসলিম ও মানবতার স্বার্থে কাজ করে গেছে ও বর্তমানেও করে চলেছে। ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কাজও থেমে থাকে নি। ইনশাআল্লাহ সামনেও তা থেমে থাকবে না।
আল কুদস কমিটি বাংলাদেশের সেক্রেটারি জেনারেল ও মাল্টিলিংক প্রিন্টার্সের স্বত্বাধিকারী জনাব মোস্তফা তারেকুল হাসান বলেন, মূলত ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত নিউজলেটার ও বই পত্র ছাপা সংক্রান্ত বিষয়ে মূসা হোসেইনী সাহেবের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করেছি। তাঁর সাথে কাজ করে স্বাচ্ছন্দবোধ করেছি, স্বাধীনতা অনুভব করেছি। তিনি নির্দেশ নয়, পরামর্শ দিতেন। নিউজলেটারের ব্যাপারে আমার পূর্ব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বর্তমানের সাথে স্বাধীনভাবে সমন্বয় করে নিতে বলতেন। তিনি বলতেন, বাংলাদেশ ও ইরানের কালচার ও ধর্মানুভূতির সাথে সমন্বয় করে আপনি স্বাধীনভাবে এর প্রচ্ছদ ও গেটআপ, মেকআপ ঠিক করে নিন। স্মিত হাসি ছাড়া তিনি কখনো কথা বলতেন না। আমি তাঁর সর্বাঙ্গীন শুভ কামনা করি।
ইতিহাসবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, বিশ্বে ইসলামি বিপ্লব একমাত্র ইরানই সফলভাবে স¤পন্ন করেছে এবং সকল প্রতিকূলতার ভেতর দিয়েও তারা তা ধরে রেখেছে। মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে একমাত্র ইরান-ই যে কোন দেশে তাদের কূটনৈতিক কর্মে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ক্ষেত্রে বিশেষ দায়িত্ব পালন করে। এবং সে দেশের মাটির সাথে গভীর স¤পর্ক আবিষ্কার করে সমন্বয়ের চেষ্টা করে।
সংস্কৃতির ভাব-হৃদয়ের আদান প্রদান করে। ইরানের সাথে রয়েছে বাংলাদেশের হাজার হাজার বছরের সম্বন্ধ। ফারসি ভাষা ও সংস্কৃতির প্রভাব প্রাচীনকাল থেকেই এখানেসুগভীর। সুফিজম বিকশিত হয়েছে ফারসি ভাষায়। ইরান কালচারাল সেন্টার কর্তৃক ইতিহাসবিদ জনাব আশরাফুল ইসলামের সাতানব্বই বছর বয়স্কা ফারসি ও উর্দু নাগরী ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারা মা মোসাম্মৎ জামিলা খাতুনকে সম্বর্ধনা দেয়ার কথা স্মরণ করে তাঁকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানান।
শেখ সাদী ও নজরুল বিষয়ক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত
‘নজরুলের কবিতা মানব হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করেছে’Ñ ড. কাজেম কাহদুয়ী
গত ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকাস্থ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র মিলনায়তনে ‘নজরুল ফররুখ গবেষণা ফাউন্ডেশন’ ও ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের যৌথ উদ্যোগে ইরানের কবি শেখ সাদী ও বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ও সাহিত্যকর্মের ওপর এক জ্ঞানগর্ভ আলোচনা অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। নজরুল ফররুখ গবেষণা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি লেখক গবেষক এমদাদুল হক চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও সংস্কৃতিসেবী জাহিদুর রহমানের উপস্থাপনায় উক্ত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. কাজেম কাহদুয়ী একথা বলেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইরানি ভিজিটিং প্রফেসর ও নজরুল-গবেষক ড. কাজেম কাহদুয়ী, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কালচারাল কাউন্সেলর সাইয়্যেদ মাহদী হোসেইনী ফায়েক, প্রবীণ সাংবাদিক ও বিশিষ্ট কবি জনাব এরশাদ মজুমদার, নজরুল-গবেষক ও নজরুল ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক কবি আবদুল হাই শিকদার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং লালকুঠি দরবার শরীফের পীর জনাব আহসানুল হাদী। আলোচনায় অংশ নেন নয়া সৈনিক পত্রিকার সম্পাদক ড. মুহাম্মদ একরামুল ইসলাম, কবি ও আবৃত্তিকার আহমদ বাসীর, কবি শাহ সিদ্দিক, জনাব মাহবুব মুকুল প্রমুখ। শেখ সাদীকে নিবেদিত কবিতা পাঠ করেন কবি আমিন আল আসাদ ও কবি রহমান মাজিদ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. কাজেম কাহদুয়ী বলেন, ফেরদৌসী, রুমী, সাদী, হাফিজ ইরানের সবচেয়ে আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ কবি। ইরানের এই চার কবি বাংলাদেশের জনগণের কাছেও প্রিয় ও পরিচিত। বিশেষ করে শেখ সাদী ও রুমী মিশে আছেন বাংলাদেশের ধর্মীয় আবহের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমানে দ্বিতীয় মেয়াদে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব পালনে এসেছি। আজ থেকে ২৫ বছর আগে যখন প্রথমবার বাংলাদেশে আসি তখন ঈদের নামাজ পড়তে গিয়ে দেখলাম ইমাম সাহেব মুনাজাতে দরূদ, দোয়ার সাথে শেখ সাদী (র)-এর বিখ্যাত চার লাইন নাত পাঠ করছেনÑ ‘বালাগাল উলা বি কামালিহি/ কাশাফাত দুজা বি জামালিহি/ হাসুনাত জামিও খিসালিহি/ সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহি’Ñ এটা শুনে আমার খুব প্রশান্তি অনুভব হয়েছে। শেখ সাদী (র) মানবাত্মাকে আল্লাহর রঙ্গে রঙ্গিন করার ও রাসূলপ্রেমের পরম প্রশান্তির পথে ধাবিত হতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। আর বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা প্রবেশ করেছে মানব হৃদয়ের গভীরে। সাদি ও হাফিজ-এর হৃদয়ের ধ্বনিই আমরা বাংলাদেশের নজরুলের কবিতায় পাই। হাফিজের ‘দিওয়ান’ নজরুল অনুবাদ করেছেন। নজরুল হাফিজ-প্রেমিক ছিলেন বলেই তিনি তাঁর ছেলের নাম রেখেছিলেন বুলবুল। এই বুলবুল যখন জন্মগ্রহণ করে তখন নজরুল ‘দিওয়ানে হাফিজ’ অনুবাদের কাজও শুরু করেন একই দিনে। সবচেয়ে বেদনা ও মর্মপীড়ার বিষয় এটা যে, যেদিন এই ‘দিওয়ান’ অনুবাদ শেষ হলো সেই দিন নজরুলের পুত্রসন্তান বুলবুলও অসুস্থতায় ইন্তেকাল করলো।
নজরুল ‘ধুমকেতু’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। নজরুল প্রচুর ফারসি শব্দ তাঁর কবিতায় ব্যবহার করেছেন। তখনকার অনেক কবি-লেখক-সমালোচক নজরুলের এই সব ফারসি শব্দ বাংলায় ব্যবহারের সমালোচনা করেন, বিশেষ করে নজরুল ফারসি ‘খুন’ শব্দটি প্রয়োগ করলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আপত্তি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ফারসি আমার প্রাণের শব্দ, সেগুলো আমার কবিতায় আমি অবশ্যই ব্যবহার করব। সর্বোপরি শেখ সাদী ছিলেন একজন মানবতাবাদী কবি।
নজরুল-গবেষক শেকড়সন্ধানী কবি আবদুল হাই শিকদার বলেন, শেখ সাদীর জ্ঞানের গভীরতা পাশ্চাত্য প-িত ও বিজ্ঞানী পিথাগোরাস এবং টেনিশন থেকেও অনেক ঊর্ধ্বে। শেখ সাদী মানবতাকে সমৃদ্ধ করতে চেয়েছেন আধ্যাত্মিক চেতনা দিয়ে। হাফিজ ও শেখ সাদীর মধ্যে পার্থক্য হলো হাফিজ মানবাত্মার রোদনকে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন পরমলোকে। আর সাদী পরমলোক থেকে আলো এনে মানব জীবনকে সার্থক করতে চেয়েছেন। শেখ সাদী (র) মহানবী (সা.)-এর হাদীসের সেই পরম বাণী ‘সকল বিশ্বাসী মানবম-লী এক দেহের মতো, এর যে কোন অংশে আঘাত লাগলে সমস্ত দেহে এর বেদনা অনুভূত হয়’ অনুযায়ী যে কবিতার লাইন রচনা করেন তা জাতিসংঘের সদর দরজায় লিপিবদ্ধ আছে। শেখ সাদী সহ ইরানি কবিদের রচনার পরিচয় পেতে মোহাম্মদ বরকতুল্লাহর ‘পারস্য প্রতিভা’ ও মুহাম্মদ মনসুর উদ্দিনের ‘ইরানের কবি’ পড়তে হবে। শেখ সাদীর কবিতা বাংলায় প্রথম অনুবাদ করেন কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। শেখ সাদী যেদিন এই ধরাধামে জন্মগ্রহণ করেন সেই দিন দুনিয়া থেকে বিদায় নেন বিখ্যাত অলি আবদুল কাদের জিলানী (র)। এ যেন এক সূর্যের অস্ত গিয়ে একই ভাবাদর্শের আরেক সূর্যের উদয়। শেখ সাদী (র) অত্যাচারের প্রতিবাদে অনেক কবিতা লিখেছেন। তিনি জালিম শাসকদের সম্পর্কে লিখেছেন। তিনি জালিম শাসকদের অত্যাচার প্রত্যক্ষ করেছিলেন। যখন ডাকাত হালাকু-মঙ্গোলরা বাগদাদ নগরী দখল করে লক্ষ লক্ষ লোককে হত্যা করেছিল। তিনি এই হত্যাকা- দেখে প্রচ-ভাবে বেদনাহত হন এবং বাগদাদ ছেড়ে মক্কায় চলে আসেন।
শেখ সাদী অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। ইবনে বতুতার পর শেখ সাদীর মতো ভ্রমণ আর কেউ করেন নি।
কবি আবদুল হাই শিকদার হাফিজ ও শেষ সাদীর ওপর ডকুমেন্টারি ফিল্ম নির্মাণের জন্য ২০০৬ সালে ইরান সফরের স্মৃতি উল্লেখ করে প্রসঙ্গিকভাবে বলেন, ইরান একটি সুন্দর দেশ ও ইরানি জাতি একটি সংস্কৃতিবান ও সুশীল জাতি। ইরানের সাহিত্য অত্যন্ত শক্তিশালী ও শাণিত। ইরানের সাহিত্যের মতো ইরানি জাতির সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনাও শাণিত। এ জাতি ঐক্যবদ্ধ জাতি। ইরান অস্তিত্বহীন হলে মুসলমানদের আর কিছুই থাকবে না। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুলের সাহিত্যেও আমরা পাই ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা। আমরা ইরানি জাতিকে সমর্থন করি। ইরানের সা¤্রজ্যবাদবিরোধী চেতনাকে সালাম জানাই। আমরাও ইহুদি যায়নবাদের প্রতি ধিক্কার জানাই।
প্রবীণ সাংবাদিক এরশাদ মজুমদার বলেন, সাদীর সাহিত্য আমাদেরকে খাঁটি মানুষ ও মুসলমান হতে বলে সেই সাথে মানবতাবাদী মানুষ হতে বলে। কথা প্রসঙ্গে তিনি ধর্মদ্রোহিতা এবং ধর্মীয় গোঁড়ামি ও চিন্তার সীমাবদ্ধতা উভয়ের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, একদল লোক না বুঝেই যেমন ধর্মের বিরোধিতা করে আবার একদল চিন্তাবিদ না বুঝেই ইকবাল, নজরুল, ইবনে সীনা, ওমর খৈয়ামকে কাফের বলেছিল। রোকেয়াকে ফাসেক বলেছিল। ইসলামের বড় বড় সাধককে তাঁদের কথার মর্মার্থ না বুঝতে পেরে তাদের প্রতি মারমুখী হয়েছিল। যেমন মনসুর হাল্লাজের কথা ধরা যায়।
শেখ সাদী যেমন ছিলেন কবি তেমন ছিলেন ওলি। শেখ সাদীর তাসাউফযুক্ত সাহিত্য মানুষকে আল্লাহর রঙ্গে রঙ্গিন করতে চায় ও ইনসানে কামেল হিসেবে গড়ে তুলতে চায়। কিন্তু আজকে মানুষের কথা ও কাজের কোন মিল নেই। সৃষ্টির সেরা মানুষ আজ তাদের স্বভাব-চরিত্রে পশুত্বকে হার মানিয়েছে। মানুষের ভেতর ঢুকে পড়েছে মুনাফেকী ও স্ববিরোধিতা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক অনুষ্ঠানের বক্তাদের বক্তব্যকে বাংলা থেকে ফারসি ভাষায় এবং ইরানি বক্তাদের ফারসি বক্তব্যকে বাংলায় ভাষান্তর করেন। এছাড়া তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন, কবিদের কবিতায় অফুরন্ত এক জীবনী শক্তি লুক্কায়িত থাকে যা যুগ যুগ ধরে আলো বর্ষণ করে। সেই আলোকে গ্রহণ করে মানব সমাজকে পশু সমাজের থেকে পৃথক করা হয়। শেখ সাদীর কবিতা মরিচাযুক্ত ধরা আত্মাকে মরিচামুক্ত করতে সহায়তা করে।
নয়া সৈনিক পত্রিকার সম্পাদক একরামুল ইসলাম বলেন, ধর্মের প্রকৃত রূপ কখনো উগ্রবাদ, জঙ্গীবাদকে সমর্থন করে না। শেখ সাদী তাঁর রচনায় ধর্মের প্রকৃত রূপ তুলে ধরেছেন। ইসলামের জিহাদ আর উগ্রবাদ, জঙ্গীবাদ এক জিনিস নয়। ধর্মের নামে জঙ্গীবাদ, বোমা মেরে অতর্কিতে মানুষ মারা ইহুদি-যায়নবাদীদের ফিলিস্তিনি হত্যা, বর্মী নাসাকা বাহিনী কর্তৃক রোহিঙ্গা হত্যা একই অপরাধ। ইসলামের বিজয় হচ্ছে নৈতিক বিজয়। সেটা শেখ সাদীর মতো আল্লাহর খাঁটি বান্দা ও রাসূলপ্রেমিকদের দ্বারাই হয়েছে।
আবৃত্তি শিল্পী আহমদ বাসির বলেন, হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে ইরানের। আর পৃথিবীর মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র ইরানই সারা বিশ্বে তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রসার ঘটাতে সর্বদা তৎপর। ইরান ইসলামি বিপ্লব করেছে। হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাথে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের চেতনা মিলে মিশে যে আত্মবিশ্বাস ইরানি জাতির মধ্যে তৈরি হয়েছে সেই আত্মবিশ্বাসই তাদের সকল প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে বিজয়ী করেছে। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সব সময়ই ইরান সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।
আমাদের জাতীয় কবি নজরুলের সাথে শেখ সাদীর বড় মিল উভয়ই রাসূল (সা.)-এর শানে নাত লিখেছেন। শেখ সাদী ও রুমির কবিতার ভেতর যে অফুরন্ত শক্তি রয়েছে সেটা আত্মোন্নয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে।
কবি শাহ সিদ্দিক বলেন, শেখ সাদী ও নজরুল উভয়েই মানবতার জয়গান গেয়েছেন। নজরুল মানুষকে অনেক ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। তিনি তাঁর মানুষ কবিতায় মানবের জয়গান গেয়েছেন। বিদ্রোহী কবিতায় কবি বলেছেন, মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি/চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি/ ভুলোক দূলোক গোলাক ভেদিয়া/ খোদার আসন আরশ ছেদিয়া উঠিয়াছি চির বিস্ময়…’ এই কবিতায় তিনি মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর মেরাজের ঘটনার কথাই বলেছেন। রাসূল (সা.)-এর মেরাজে গমন মানে মানবতার প্রতিনিধির মেরাজে গমন। এতো মানবতারই সম্মান। তিনি একই কবিতায় বলেছেন, ‘আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি’Ñ এ লাইনে তিনি নমরুদের অগ্নিকু- থেকে মুসলমান জাতির পিতা ইবরাহীম (আ.)-এর পূর্ণাঙ্গ ফিরে আসার চিত্র এঁকেছেন। নমরুদের আগুনের স্থলে ফুল হয়ে গেল। আর পুষ্পের সাথে ইবরাহীম (আ.)-ও পুষ্পের মতো হাসি হেসেছেন। সেটাই তিনি বুঝিয়েছেন। এখানেও তিনি মানবতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন।
জনাব মাহবুব মুকুল তাঁর আলোচনায় বলেন, শেখ সাদীকে যতটা জানার দরকার ছিল আমাদের দেশে তা মোটেই চর্চা হয় নি। আমরা শুধু সাধারণভাবে শেখ সাদীর পোশাকের গল্পটি ছাড়া আর কিছুই তাঁর সম্পর্কে জানি না। আর তাঁর সেই বিখ্যাত নাত ‘বলাগাল উলা বি…’। কিন্তু ‘গুলিস্তা’, ‘বোস্তা’ ছাড়াও তাঁর অপরাপর সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে আমাদের জানা প্রয়োজন। প্রয়োজন জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সেমিনার বা আলোচনা সভা।
◊ আমিন আল আসাদ
দুরন্ত টিভির বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের প্রতিনিধির অংশগ্রহণ
তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নুরসহ দেশী-বিদেশী বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে ৭ই অক্টোবর রবিবার পালিত হলো দেশের একমাত্র শিশুতোষ টেলিভিশন চ্যানেল দুরন্ত’র প্রথম বর্ষপূর্তি। টেলিভিশন কর্তৃপক্ষকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাতে অনুষ্ঠানে হাজির হন ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের প্রতিনিধি ড. কাজেম কাহদূয়ী। এরপর টেলিভিশনের কর্ণধার ও দেশের বর্তমান পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সাথে সাক্ষাৎ করেন তিনি। এসময় প্রতিমন্ত্রী তার টেলিভিশনে ইরানের শিশুতোষ বিষয়ক অনুষ্ঠানমালা প্রচারে আগ্রহ প্রকাশ করলে ড. কাহদূয়ী এ ব্যাপারে সহযোগিতার আশ্বাস দেন। পরে তিনি বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে শিশু-কিশোরদের জন্য টেলিভিশনের অনুষ্ঠানমালার গুরুত্ব তুলে ধরেন। ড. কাহদূয়ী ইরানের ইসলামি বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেইনী (র.)-এর টেলিভিশনের গুরুত্ব স¤পর্কে এক বক্তব্যের উদ্ধৃত করে বলেন, টেলিভিশন হলো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো।
টেলিভিশনের শিক্ষণীয় ও গঠনমূলক অনুষ্ঠানমালা শিশু কিশোরদের সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। যেমনটি ইমাম খোমেইনী (র.) বলেছেন, আমরা যদি শিশুদের সঠিকভাবে প্রতিপালন করতে পারি তাহলে নতুন প্রজন্ম কম সমস্যার সম্মুখীন হবে। ড. কাহদূয়ী একইভাবে একটি হাদিস উদ্ধৃত করে বলেন, সকল শিশুই একটি পবিত্র ফেতরাত (স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য) নিয়ে দুনিয়ায় আসে এবং বাবা মা তাদের নিজ নিজ ধর্মের দিকে ধাবিত করে। অর্থাৎ দীর্ঘ অতীতকাল থেকে পরিবার শিশুর প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হলেও বর্তমান দুনিয়ার গণমাধ্যম শিশুর প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। কারণ, বর্তমান যুগের গণমাধ্যম শিশুদের বিনোদনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হওয়ায় তারা এর ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। আজ শিশু তার মায়ের কোলে আসার পর থেকেই বলতে গেলে শিশুর সুস্থ বিনোদন ও প্রতিপালনের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের বিশেষ করে ভিডিও মাধ্যমের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। আমি শুনেছি যে দুরন্ত টেলিভিশন তাদের আকর্ষণীয় অনুষ্ঠানমালার জন্য এই অল্প সময়ের মধ্যেই বেশ জনপ্রিয়তা অজর্ন করতে সক্ষম হয়েছে। আজকের শিশুদের আগামী দিনের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষ্যে ও বাংলাদেশকে আগামী দিনে আরো সুন্দর সমাজ উপহার দিতে দুরন্ত টেলিভিশন আরো সুন্দর ও আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান উপহার দিবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে কয়েকজন খুদে অভিনয়শিল্পী তাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে। যাদের বয়স ৬ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। প্রত্যেকেই দুরন্ত টিভির বিভিন্ন ধারাবাহিকে অভিনয় করেছে। অনুভূতি বলতে গিয়ে একজন বলল, ‘আমি স্কুলে গেলে সবাই জানতে চায়, কবে আমার নাটক প্রচার হবে?’ আরেকজন বলল, ‘কোথাও বেড়াতে গেলে অনেকে আমার সঙ্গে ছবি তোলে।’ আরেকজন মাইক্রোফোন হাতে নিয়েই বলল, ‘আমাকে এখন আর কেউ আসল নামে ডাকে না, ডাকে বান্টি নামে।’
উল্লেখ্য বাংলাদেশের একমাত্র শিশুদের টেলিভিশন চ্যানেলটির বর্ষপূর্তির আনন্দ সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে ৭ অক্টোবর বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত এক আনন্দ আড্ডার আয়োজন করে টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে শুরু হয় নতুন কিছু ধারাবাহিক। চ্যানেল কর্তৃপক্ষ জানায়, বৈচিত্র্যপূর্ণ অনুষ্ঠান আয়োজন করতে দুরন্ত টেলিভিশন সব সময় চেষ্টা করে থাকে। আগামীতেও সে ধারা অব্যাহত থাকবে।
ইরান ভ্রমণ স্মৃতিচারণমূলক আলোচনা ও কবিতা পাঠ অনুষ্ঠিত
গত ১৮ আগস্ট ২০১৮ ঢাকাস্থ মিরপুর লালকুঠি দরবার শরীফ মিলনায়তনে লালকুঠি সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে লালকুঠি দরবার শরীফের পীর সাহেব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং লালকুঠি সাহিত্য পরিষদ সভাপতি শাহ সূফি হযরত মাওলানা অধ্যাপক আহসানুল হাদীর মাসব্যাপী ইরান সফর এবং ইতিপূর্বে আরো যাঁরা ইরান সফল করেছেন তাঁদের স্মৃতিচারণমূলক বিষয় নিয়ে ‘কবিতার দেশে বিপ্লবের দেশে পারস্যের পথে প্রান্তরে’ শীর্ষক আলোচনা সভা ও লালকুঠি সাহিত্য পরিষদ-এর নিয়মিত সাহিত্য সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের শেকড় সন্ধানী কবি নজরুল গবেষক সাংবাদিক কবি আবদুল হাই শিকদার। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইতিহাসবিদ আশরাফুল ইসলাম ও চিনাইর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের বাংলার অধ্যাপক কবি মুহিবুর রহিম। আলোচনায় অংশ নেন নজরুল-ফররুখ গবেষণা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি লেখক গবেষক এমদাদুল হক চৌধুরী, ক্বারী আলমগীর হোসেন মোল্লা, রেডিও তেহরানের সাবেক সংবাদ পাঠক, মর্সিয়া লেখক ও ছড়াকার কবি শাহ নওয়াজ তাবীব। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কবি আমিন আল আসাদ। পবিত্র কালামে পাক থেকে তেলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। পবিত্র কালামে পাক থেকে তেলাওয়াত করেন শিল্পী ক্বারী হাবিবুর রহমান। নাতে রাসূল (সা.) পেশ করেন লালকুঠি দরবারের বয়োজ্যেষ্ঠ কবি মুক্তিযোদ্ধা হাজী রফিক মিয়া। কবিতা পাঠে অংশ নেন মুহিবুর রহিম, তাজ ইসলাম, ক্বারী ওবায়দুল্লাহ, আমিন আল আসাদ, শাহ নওয়াজ তাবিব, রহমান মাজিদ, নাসিমা আক্তার নিঝুম, আলমগীর হোসেন জোয়ারদার, হুমায়ূন কবির, জয়নাল আবেদীন প্রমুখ।
অনুষ্ঠানের সভাপতি ও প্রধান আলোচক জনাব আহসানুল হাদী তাঁর সাম্প্রতিক ইরান সফরের স্মৃতিচারণ করে বলেন, বর্তমান সফরটি ছিল একটি অ্যাকাডেমিক সফর যার আয়োজক ছিল ‘বুনিয়াদে সাদী’ নামে একটি সংস্থা যার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সম্প্রসারণের জন্য কাজ করা এবং বিশ্বময় ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের প্রতিনিত্বশীল যোগ্যতাস¤পন্ন লোক তৈরি করা। এই সংস্থাটি ইরানের শিক্ষা ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের আওতাধীন। তারা একটি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কোর্সের আয়োজন করে। আমার সঙ্গে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের ফারসি বিভাগের আরো দু’জন শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন। ঢাকাস্থ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সহায়তায় আমি সেই সফরে অংশগ্রহণ করি। ১৪টি দেশের শিক্ষকবৃন্দ সেখানে অংশগ্রহণ করেন। শুধু মুসলিম দেশ নয়, অমুসলিম দেশের প্রতিনিধিত্বও ছিল সেখানে। আমি সেখানে বিভিন্ন সেমিনারে বক্তব্য রাখি এবং টেলিভিশনের অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করি।
জনাব হাদী ইরানের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক নগরী কোম সফরেরও স্মৃতি বর্ণনা করেন। বর্ণনা দেন বোস্তাম নগরীতে অবস্থিত হয়রত বায়েজিদ বোস্তামীর মাযার যিয়ারতের। ইতিপূর্বে আরো তিনবার তিনি ইরান সফর করেছেন। ২০০৮ সালে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেইনী (র.)-এর ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ থেকে কবি মোহন রায়হান, কবি আহমদ কায়সার, কবি রোকন জহুর, কবি আমিন আল আসাদ, কবি মোস্তাফিজ মামুন সহ ইরান সফরের কথা উল্লেখ করে বলেন, সেই সফরে আমরা ইরানের আরেক আধ্যাত্মিক শহর মাশহাদ গমন করি, যেটি খোরাসান প্রদেশে অবস্থিত। সেখানে নবীবংশের ৮ম ইমাম রেযা (আ.)-এর মাযার যিয়ারত করি। এই প্রদেশের তূস নগরীতে রয়েছে মহাকবি ফেরদৌসির মাযার।
জনাব আহসানুল হাদী বলেন, শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং ধর্মীয়-আধ্যাত্মিক জ্ঞান বিস্তারে ইরানের ইসলামি সরকারের ভূমিকা খুবই প্রশংসনীয়। তিনি বলেন, ইরান যে আসলেই একটি আধ্যাত্মিক চেতনায় পরিপূর্ণ দেশ, আপনি ইরানে গিয়ে স্বচক্ষে অবলোকন করলে সেটির প্রমাণ পাবেন। তাবে সে চোখ আপনার থাকতে হবে। সেদেশের আলেমরা শুধু মসজিদের সাধারণ মোল্লাই নন। তাঁরা আসলেই পূর্ণ যোগ্যতাসম্পন্ন লোক। আমি যতবার ইরানে গিয়েছি ততবারই আমার অন্তর সমৃদ্ধ হয়েছে।
ইরানের ইসলামি বিপ্লব না হলে তাদের জাতীয় চেতনা ও ধর্মীয় অধ্যাত্মবোধকে বিশ্বময় সম্প্রসারণ করা কিছুতেই সম্ভব হতো না। কিন্তু কিছু জনগণকে লক্ষ্যভ্রষ্ট ও ধৈর্য্যচ্যুত করার জন্য বাহির থেকে সা¤্রাজ্যবাদের অনুচররা অপচেষ্টা করে যাচ্ছে। অবরোধের পর অবরোধের ফলে জাগতিকভাবে ইরান একটু সমস্যায় পড়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই। সেকারণে বদর, ওহুদ, খন্দক ও কারবালার চেতনায় জনগণকে ধৈর্য ধরতে হবে ও সেই শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে মনোবল বৃদ্ধি করতে হবে। ভোগবাদী আরব দেশগুলোর মতো তেলসম্পদ বিক্রি আর ভোগবিলাসে জীবন পার করে দেয়ার নাম জীবন নয়। এই তেল সম্পদ ফুড়িয়ে যাবে। কিন্তু জ্ঞানের শক্তি টিকে থাকবে। টিকে থাকবে ঈমানের শক্তি। এই জ্ঞানশক্তির বিকাশ ঘটিয়ে ইরানি জাতি আজ পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন জাতি হয়েছে। স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ ইরান অনেক আগেই এবং অনেকবার উড়িয়েছে। নিজের উদ্যোগে এবং নিজেরই প্রযুক্তির সহায়তায়। ইরানে এখনো দরিদ্র মানুষ নেই এমন নয়, তবে তা শাহের আমল থেকে বেশি নয়। ইরান শিক্ষা-দীক্ষায় ও বিজ্ঞানচর্চায় অনেক দূর এগিয়ে গেছে।
কবি আবদুল হাই শিকদার বলেন, ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বরে পারস্যের কবিদের গুলবাগিচায় ‘ইরান বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে আন্তর্জাতিক নজরুল সম্মেলনে আমি অংশগ্রহণ করি এবং সিরাজ ও ইসফাহান ভ্রমণ করি। কবি হাফিজের ওপর একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি করি। আমার সঙ্গে ছিলেন শিল্পী ও ডকুমেন্টারি প্রডিউসার ফরিদী নূমান। বিটিভিতে আমার পরিচালিত ‘কথামালা’ অনুষ্ঠানে ইরান ভ্রমণের ওপর তিনটি প্রতিবেদন প্রদর্শন করি। সেই ভ্রমণে ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র আমাদেরকে বিশেষভাবে সহযোগিতা করে। বিশেষ করে তৎকালীন কালচারাল কাউন্সেলর জনাব আলী আভারসাজীর সহযোগিতার কথা স্মরণ করতেই হবে। ইরান নিজের সংস্কৃতির বিকাশ ও বিস্তারে এবং অন্যের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে ও আত্মস্থ করতে কতটা আন্তরিক তা উক্ত সম্মেলন থেকেই বোঝা যায়। নজরুলকে ভালো করে আত্মস্থ করেছেন বলেই ইরানের সাংস্কৃতিক মন্ত্রী বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘নজরুল আমাদেরই সম্পদ। প্রচ- ঝড়ো হাওয়া নজরুলকে আমাদের মাঝখান থেকে বাংলাদেশের কাদামটিতে ফেলে দিয়েছে।’
ইরান তার জাতীয় মেধা ও ব্যক্তিত্বগুলোকে সঠিকভাবে দুনিয়ার বুকে পেশ করতে পেরেছে এবং তাদের সংস্কৃতির সঠিক প্রতিনিধিত্ব তাঁরা করছে বলেই জাতিসংঘের সদর দরজায় শেখ সাদী ও রুমীর কবিতা উৎকীর্ণ থাকে। শেখ সাদীর কবিতার একটি বাক্য সেখনে লেখা রয়েছে যে, ‘গোটা মানব সমাজ একটি দেহের মতো/এর যে কোন স্থান আঘাতপ্রাপ্ত হয় সমস্ত দেহে তা অনুভূত হয়’। জার্মান কবি গ্যাটে ইরানের কবি হাফিজের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেছেন, ‘যে হাফিজ পড়ে নি তার জীবনই বৃথা’। হাফিজ এবং ফেরদৌসি দুইজনের পার্থক্য বোঝাতে কবি শিকদার বলেন, ফেরদৌসি ছিলেন বোহেমিয়ান। তিনি দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন। আর হাফিজ ছিলেন ঘরমুখী কবি। তিনি তাঁর প্রিয় নদী রুকনাবাদের তীর ছেড়ে কোথাও যান নি। ইরানি জাতি তাদের সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদেরকে যেভাবে ফোকাস করেছে ও করছে আমরা আমাদের রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ফররুখকে সেভাবে বিশ^ময় ফোকাস করতে পারি নি।
প্রসঙ্গক্রমে কবি শিকদার বলেন, শিয়া-সুন্নি বিভেদ ভুলে যেতে হবে এবং ইরান-তুরান এক হয়ে কাজ করতে হবে। আমাকে ইরানে শিয়া-সুন্নি বিষয়ে প্রশ্ন করলে আমি বলেছিলাম, আমি মুসলমান। আমি শিয়া-সুন্নি ঐক্যের বিষয়ে ইমাম খোমেইনী (র.)-এর সেই বাণী উল্লেখ করে বলেছিলাম, ‘যারা শিয়া ও সুন্নিদের মাঝে বিরোধ তৈরি করে তারা শিয়াও নয়, সুন্নিও নয়, তারা স¤্রাজ্যবাদীদের দালাল।’ আমি বলেছিলাম, যে কোন মূল্যে এ বিভেদ দূর করতে হবে। আহলে বাইতকে শিয়া-সুন্নি উভয়েই মহব্বত করে। কেবল কারবালার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ গ্রুপটি ছাড়া। শিয়া-সুন্নি উভয় মাযহাবের মানুষ মিলেই মোঘলরা ভারতবর্ষ শাসন করেছে। শিয়া-সুন্নিদের মধ্যে আগে বৈবাহিক ও সামাজিক সম্পর্কও ছিল। সে সম্পর্ক আবার গড়ে তুলতে হবে। তিনি বলেন, শিয়া-সুন্নি ঐক্য ভঙ্গের জন্য সা¤্রাজ্যবাদীরা নানা কূটকৌশল হাতে নিয়েছে। তারা পাকিস্তানে শিয়া মসজিদে বোমা হামলা করে পাকিস্তান ও ইরানের সম্পর্কে ফাটল ধরাতে চায়। আবার তুরস্কের সঙ্গে ইরানের বিরোধ তৈরি করার জন্য রাজনৈতিক চাল চালতে থাকে।
তিনি বলেন, ফারসি ভাষা বাংলার সাথে এমনভাবে মিশে গেছে যে, একে আর পৃথক করার সুযোগ নেই। ফারসি শিক্ষার গুরুত্ব উল্লেখ করে তিনি ঢাকাস্থ ইরানের কালচারাল সেন্টারের প্রতি গণমুখী ফারসি অ্যাকাডেমী চালু করার আহ্বান জানান এবং লালকুঠি দরবারে একটি ফারর্সি চর্চা কেন্দ্র গড়ে তোলা যায় কিনা সে ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করা ব্যাপারে দরবারের পীর সাহেবের কাছে আবেদন রাখেন। তিনি বলেন, নবাব সিরাজউদ্দৌলার ওপর ডকুমেন্টারি করতে ভারতে গিয়ে মুর্শিদাবাদে বিশাল লাইব্রেরি দেখতে পাই যার অধিকাংশ বই ফারসি ভাষায় রচিত। ফারসি ভাষা না জানার কারণে এর ভেতরে প্রবেশ করতে পারি নি, বইগুলো হাত দিয়ে স্পর্শ করেছি মাত্র।
ইতিহাসবিদ জনাব আশরাফুল ইসলাম বলেন, আমাদের ইতিহাস, ধর্মীয় আচার-আচরণের সাথে আমাদের জীবন ও সংস্কৃতির সাথে ইরান ও ফারসি ভাষা মিশে গেছে অকৃত্রিমভাবে। আমাদের রক্তে, অস্থি-মজ্জায় তা একাকার হয়ে মিশে গেছে। কারবালা ট্রাজেডির শোকাবহতা এবং নবী-পরিবারের প্রতি ভক্তি আমাদের চেতনার অবিনাশী অংশ। এখানে শিয়া-সুন্নির কোন বিষয় নেই। কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামে বিশাল একটি কারবালার মাঠ আছে। আমাদের দেশের মুহররম মিছিলে শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে অংশগ্রহণ করে। কারবালার ইতিহাস চর্চায় ও কারবালার পুঁথি পাঠে অংশগ্রহণ করে গ্রামে কাঁদে না এমন লোক নেই। আমাদের গ্রামে দশদিনব্যাপী মুহররমের জারি গান হয়। মর্সিয়া পাঠ হয়। হয় ওয়াজ-নসিহতও।
তিনি একটি গ্রাম্যছড়ার দুইটি লাইন আবৃত্তি করে ফারসি ও বাংলার সম্পর্ক বোঝান এভাবে যে, ‘যগাই মাধাই দুইজনে/ মসনবী পড়ে নলবনে’। যগাই মাধাই দুইজন বাঙালি হিন্দু, অথচ তারা নলবনে বসে ‘মসনবী’ পড়ছে। ইরানি সংস্কৃতির কতটা শক্তিশালী প্রভাব থাকলে বাঙালি হিন্দুও মুসলমানী সাহিত্য ‘মসনবী’ পাঠে মনোযোগী হয় তা এই ছড়ায় বোঝা যায়। তিনি বলেন, এটাই আমাদের বাংলাদেশ।
তিনি ফারসি ভাষা ও সংস্কৃতি বিকাশে ও বাংলার সাথে পারস্যের সাংস্কৃতিক আত্মীয়তা জোরদার করতে ইরান দূতাবাস ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রকে আরো গণমুখী হওয়ার আহ্ববান জানান। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্বিবৃত্তিক পরিম-লে এটি সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
বিশেষ অতিথি অধ্যাপক কবি মুহিবুর রহিম স্মৃতিচারণ করে বলেন, ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত ‘নিউজলেটার’-এ একসময় নিয়মিত লিখতাম। রেডিও তেহরানের শুরুর দিকে যখন মরহুম ফরিদ উদ্দিন খান পরিচালক ছিলেন তখন আমার অনেক কথিকা তেহরান বেতারে প্রচারিত হয়েছে। আমাদের সময় রেডিওর খবরের ওপর নির্ভরশীল ছিল গ্রামবাংলার মানুষ। আমি রেডিও তেহরানের নিয়মিত শ্রোতা ছিলাম। ঢাকায় অবস্থানকালে বাংলাদেশে ইরানের ধর্মীয় প্রতিনিধি আয়াতুল্লাহ শাহরুখী খুররমাবাদী (র.)-এর সাথে প্রেসক্লাব ভিআইপি লাউন্সে আমাদের একটি বৈঠক হয়। তাঁর সাথে আমাদের নানা বিষয়ে মতবিনিময় হয়। রেডিও তেহরানের বাংলাদেশী বন্ধুরা একটি সাহিত্য ম্যাগাজিন বের করতেন ‘দীগ্দর্শন’ নামেÑ সেখানে আমার কবিতা ছাপা হয়েছে ‘ইমাম খোমেনী (র)’ নামে। ইরানের সাথে আমাদের বাংলাদেশের বন্ধুত্ব অতীতেও ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। ইরানের ইসলামি বিপ্লবকে বাংলাদেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই সমর্থন করেছে। মাযহাবী বিভেদ নয়, বিশ্ব-মুসলমান এক হয়েই কাজ করতে হবে। সা¤্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রকে রুখতে হবে। ‘ইসলামের আদর্শিক বিপ্লব ও নৈতিক সাংস্কৃতিক বিপ্লব ছাড়া মানবজাতির মুক্তি নেই’Ñ মাওলানা আবদুর রহীম (র.) এ কথাটি অনেক আগেই জাতিকে শুনিয়েছিলেন। তিনি বলেন, আমেরিকার মানুষও যদি মুক্তি চায় তাহলে ইসলামি নৈতিকতার কাছেই তাদেরকে আত্মসমর্পণ করতে হবে।
জনাব এমদাদুল হক চৌধুরী বলেন, নজরুল ও ফররুখ আহমদের কবিতায় অনেক ফারসি শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে। ইরানের সাথে আমাদের শেকড়ের সম্পর্ক আছে, সেটি অস্বীকার করার উপায় নেই। মুসলমান দেশগুলো মিলেমিশে শক্তিশালী উম্মাহ গঠন করতে হবে। কুরবানি তথা ত্যাগের শিক্ষায় মুসলমানদের উদ্দীপ্ত হতে হবে এবং পরস্পর ছাড় দিয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে বলে তিনি মত ব্যক্ত করেন।
ক্বারী আলমগীর হোসেন মোল্লা তাঁর ইরান ভ্রমণের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘শুরায়ে এহইয়ায়ে যাবা’ন ও আদাবিয়া’তে ফারসি’ সংস্থার দাওয়াতে আমরা ইরান যাই। বর্তমানে এই সংস্থার নাম ‘বুনিয়াদে সাদী’Ñ যা অনুষ্ঠানের সভাপতি জনাব আহসানুল হাদী উল্লেখ করেছেন। আমাদের সাথে ছিলেন ড. আবদুস সবুর খান, ড. তারিক সিরাজী ও ড. মুহাম্মদ শাহজালাল প্রমুখ। আমি ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে বহুদিন যাবৎ চাকুরি করছি। এখানে চাকুরি করার আগে এবং ইরান গিয়ে স্বচক্ষে দেখে আসার পূর্বে ইরানের শিয়া মাযহাবের মানুষ সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা ছিল। একটি সমাজে নানা রকমের মানুষ থাকে। কোন সাধারণ মানুষের কোন কাজ বা কথার দ্বারা যেমন আসল ঘটনা না জেনে মূল্যায়ন করা সম্ভব নয় তেমনি স্বচক্ষে দেখার আগে ও বোঝার আগে সকল ধারণা মনে বদ্ধমূল করা ঠিক নয়। আমরা জেনেছিলাম, শিয়ারা হযরত আলীকে নবী মানে ও তাঁকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর থেকে বড় করে দেখে। তারা অন্য কোরআন মানে। অথচ আমি এগুলোর কোন বিষয়েরই সত্যতা পাই নি। বরং আমরা দেখলাম, সালমান রুশদী যখন মহানবী (সা.) ও তাঁর পরিবার-পরিজনকে নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক বই ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ লিখলো তখন ইমাম খোমেইনীই সালমান রুশদীর বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়ে বিশ্বময় আন্দোলন ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, ইরানের মানুষদের থেকে পেয়েছি মায়া-মমতা, আথিতেয়তা। বাসে উঠলেই এমনভাবে ‘সালামুন আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ’ বলে সালাম দেয়, মনে হয় যেন অনেক দিনের চেনা, কিন্তু জীবনে কোনদিনই দেখা হয় নি। মাশহাদে ইমাম রেযা (আ.)-এর মাযার যিয়ারত করেছি। ইবনে সীনার মাযারে গিয়েছি। অনেক আনন্দময় ছিল সেই ভ্রমণ।
জনাব শাহ নওয়াজ তাবিব বলেন, তেহরান রেডিওতে থাকাকালীন ইরানের পথে প্রান্তরে অনেক ঘুরেছি। অনেক স্মৃতি ইরানকে নিয়ে। তাদের আচার-ব্যবহার বদান্যতায় পরিপূর্ণ। কথায় কথায় ‘সালামুন আলাকুম, হালে সোমা’ খুবে’Ñ সালাম, কেমন আছেন। উত্তরে বলবে, ‘খোদা’ রা’ শোক্র’Ñ আল্লাহকে ধন্যবাদ। ‘খুবাম’ অর্থাৎ ভাল আছি। ‘শোমা’ চেতুরে’Ñ তুমি কেমন আছ। কথায় কথায় ‘মুতাশাক্কেরাম’, ‘খেইলী মামনুন’ ইত্যাদি তো আছেই। যার অর্থ ধন্যবাদ। কোন কিছুর সহযোগিত চাইলে আপনি যদি তাকে সহযোগিতা করেন তবে সেই সহযোগিতা নিতে নিতে বলবে, ‘দাস্তে শোমা’ দারদ না কোনে’Ñ তোমার হাতে ব্যথা না হোক! সবজি, ফল ইত্যাদি কিনতে গেলেও কথায় কথায় তারা দোয়া করবে। এই ফল ও সবজি তোমার দেহের উপকার করুক! রোগ মুক্তি দান করুক! শক্তি বৃদ্ধি করুক! ইত্যাদি। কারো সাথে ঝগড়া লাগলে তৃতীয় জন এসে সাথে সাথে দরূদ পড়ে বলবে, ‘আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মুহাম্মাদ ওয়া আলে মুহাম্মাদ। অর্থাৎ ‘রাসূল (সা.)-এর প্রতি এবং তাঁর বংশধরদের প্রতি সালাম। সঙ্গে সঙ্গে ঝগড়া শেষ। ইরানে দেখলাম রাসূল (সা.) ও তাঁর পরিবারের প্রতি অগাধ ভক্তি। কেউ একজন দরূদ পড়লেই সমস্বরে পুরো মজলিশ দরূদ পড়বে। যারা বলে ইরানের শিয়ারা রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে নবী মানে না তাদের কাছে প্রশ্ন হলো তাহলে এত দরূদ কারা পড়ে? আর তারা রাসূলের আহালে বাইতের শানে দরূদ পড়ে আর কান্নাকাটি করে। একটি কথা রয়েছে যে, মুমিনের চোখের জলে জাহান্নামের আগুন নেভে। পাপ দূরীভূত হয় তওবা আর ক্রন্দনের মাঝে। ইরানিদের চোখে যেন পানি এসেই থাকে। যে কোন দোয়া-দরূদ পড়েই তারা আল্লাহর কাছে নাজাত চেয়ে সমস্বরে কাঁদতে থাকে।
জনাব তাবিব ইরানে থাকাকালীন আযাদী স্কোয়ার, ময়দানে ইনকিলাব, বেহেশতে যাহরা, তালেঘানী এভিনিউ, ময়দানে আরজেনটাইন ইত্যাদি স্থানে নিয়মিত যাতায়াতের স্মৃতিচারণ করেন।
কবি আমিন আল আসাদ তাঁর প্রবন্ধে বলেন, আমার রচিত ‘ইমাম খোমেনী (র.) ও ইসলামী বিপ্লব’ শীর্ষক বইয়ের নিমিত্তে ২০০৮ সালে ইরান সফরে যাই। লালকুঠি দরবার শরীফের পীর সাহেব জনাব আহসানুল হাদী, কবি মোহন রায়হান, কবি রোকন জহুর, কবি মুস্তাফিজ মামুন, কবি আহমেদ কায়সার, মাওলানা সাবির রেজা, গবেষক রাশেদুজ্জামান সহ দশ বারোজন। প্রিয় নেতা ইমাম খোমেইনীর ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর মাযার যিয়ারতের সৌভাগ্য হয়। মাশহাদ গিয়েছি এবং ঘুরেছি তেহরানের পথে প্রান্তরে। ময়দানে ইনকিলাব, ময়দানে ফেরদৌসি, বেহশতে যাহরাসহ বেশ কয়েক স্থানে। ইমাম খোমেইনী (র)-এর বাড়িটি দেখেছি। মাশহাদে গিয়েছি ইমাম রেযা (আ.)-এর মাযার যিয়ারতে।
ইরানের ইসলামি বিপ্লব সারা দুুনিয়াকে ঝাঁকুনি দিয়ে জাগিয়ে দেয়া এক আলোকের বিস্ফোরণÑ যা মুসলমানসহ নির্যাতিত জাতিসমূহের ঘুম ভাঙাতে সহায়ক হয়েছিল। এই বিপ্লবের বিরুদ্ধে অঙ্কুরেই একে শেষ করে দেয়ার ষড়যন্ত্র হয়েছে, এখনো সেই ষড়যন্ত্র চলছে। দল-মত-মাযহাব-তরিকা নির্বিশেষে মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
আমিন আল আসাদ
সারা দেশে আশুরা পালিত
গত ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ সারাদেশে ভাবগম্ভীর পরিবেশে ও যথাযোগ্য মর্যাদায় পবিত্র আশুরা পালিত হয়েছে। পবিত্র আশুরা উপলক্ষে বাণী প্রদান করেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ তাঁর বাণীতে উল্লেখ করেন, পবিত্র আশুরা সমগ্র মুসলিম উম্মাহর জন্য এক তাৎপর্যময় ও শোকের দিন। কারবালার শোকাবহ ঘটনা আমাদেরকে অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে উদ্বুদ্ধ করে, সত্য ও সুন্দরের পথে চলার প্রেরণা যোগায়। তিনি আরো বলেন, সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে হিজরি ৬১ সনের ১০ মুহররম হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) তাঁর পরিবারের সম্মানিত সদস্য ও ঘনিষ্ঠ সহচরবৃন্দ বিশ^াসঘাতক ইয়াযীদের সৈন্যদের হাতে কারবালায় শহীদ হন। ইসলামের সুমহান আদর্শ ও ত্যাগের মহিমাকে সমুন্নত রাখার জন্য তাঁদের এই আত্মত্যাগ ইতিহাসে সমুজ্জ্বল হয়ে আছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বাণীতে বলেন, এ দিনটি বিশে^র মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। হিজরি ৬১ সনের ১০ মুহররম মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) ও তাঁর পরিবারবর্গ কারবালা প্রান্তরে শাহাদাতবরণ করেন। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় তাঁদের এ আত্মত্যাগ মুসলিম উম্মাহর জন্য এক উজ্জ্বল ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। প্রধানমন্ত্রী আমাদের জাতীয় জীবনে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় আশুরার মহান শিক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে সবার প্রতি আহ্বান জানান।
ইসলামি ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী বলেন, কারবালার জিহাদ এক শিক্ষণীয় ও অনুসরণীয় ঘটনা। এর একদিকে রয়েছে শোকাবহ অশ্রুসজল কাহিনী, অপরদিকে মহান আত্মত্যাগের অনুপ্রেরণা এবং সেই সাথে ন্যায়, সত্য ও সততা প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রত্যয়। হযরত হোসাইনের অতুলনীয় শাহাদাত কোন পরাজয়ের প্রতিফলন নয়; বরং মুসলিম উম্মাহর জন্য পরম বিজয়ের সংকেত। তিনি আশুরার দিনে ঢাকা মহানগর আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বক্তৃতাকালে এসব কথা বলেন।
বিশ^ সুন্নী আন্দোলনের উদ্যোগে আশুরার দিন সকালে শোভাযাত্রা ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে বিশ^ সুন্নী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম হায়াত্ বলেন, বদর, ওহুদ ও কারবালার ঘটনার শিক্ষা, চেতনা এক ও অভিন্ন।
চট্টগ্রাম মহানগরীর আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ, জমিয়তুল ফালাহ মসজিদ, বায়তুশ শরফ মসজিদ, লালদীঘি মসজিদসহ বিভিন্ন স্থানে ওয়াজ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।
আনজুমান-এ-রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনায় শোহাদায়ে কারবালা মাহফিলে বক্তাগণ বলেন, সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় ইমাম হোসাইন (রা.)-এর আদর্শ অনুসরণের কোন বিকল্প নেই। অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তা ছিলেন জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদরাসার শায়খুল হাদীস মুফতি মুহাম্মদ ওবাইদুল হক নঈমী।
কাগতিয়া দরবার শরীফের পীর আল্লামা অধ্যক্ষ ছৈয়্যদ মুহাম্মদ মুনির উল্লাহ আহমদী গত ২০ সেপ্টেম্বর ‘পবিত্র আশুরার তাৎপর্য’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বলেন, কারবালার ঘটনা সর্বকালের সবচেয়ে মর্মান্তিক। এদিন কারবালা প্রান্তরে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় নবীজির প্রিয় দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (রা.) পরিবারবর্গসহ নিজের জীবন উৎসর্গ করেন, যা মুসলমানদের ইসলামের সত্য, সুন্দর ও ন্যায়ের পথে চলতে আজীবন প্রেরণা যোগাবে।
বিভিন্ন মসজিদ, মাদরাসা, সংগঠন ও খানকা আহলে বাইতে রাসূল (সা.) স্মরণে আলোচনা ও শোকসভার আয়োজন করে। আলোচনা সভায় বক্তাগণ আশুরার ত্যাগের শিক্ষা রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তি জীবনে অনুসরণ করার আহ্বান জানান।
পবিত্র আশুরা উপলক্ষে ২০ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে কোরআনখানি ও ওয়াজ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।
দেশের বিভিন্ন স্থানে শোক র্যালি ও মিছিল বের করা হয়। রেডিও ও টিভি চ্যানেলগুলোতে মুহররম উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। সংবাদপত্রগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে।
ঢাকাস্থ নাখালপাড়া ইমাম বাড়িতে শোকানুষ্ঠান
পবিত্র আশুরা উপলক্ষে নাখালপাড়াস্থ ইমামবাড়িতে ১-১৩ মুহররম ১৩ দিনব্যাপী আলোচনা ও শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। পবিত্র কোরআনের আলোকে প্রকৃত ঈমানদারের পরিচয়, মহানবী (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা ও তাঁদেরকে আনুগত্য করার বিষয়ে ধারাবাহিক বক্তব্য উপস্থাপন করেন হুজ্জাতুল ইসলাম আব্দুল কুদ্দুস বাদশা। তিনি বলেন, শুধু মৌখিক স্বীকারোক্তির মাধ্যমে ঈমানদারকে চেনা যায় না। প্রকৃত ঈমানদারের পরিচয় তার কর্মের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। আর সত্যিকার ঈমানদারদের বৈশিষ্ট্য পবিত্র কোরআনের আয়াতে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্যকে মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে ফরয বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তাই এ বিষয়ে সকল মুসলমানের উচিত আল্লাহর তা‘আলার নির্দেশের প্রতি মনোযোগী হওয়া। মহান আল্লাহর নির্দেশের প্রতি মনোযোগিতার অভাব ও উদাসীনতার কারণেই মুসলিম জাতির ইতিহাসের একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়ে এসে ইমাম হোসাইনকে পরিবার-পরিজন ও বন্ধু-বান্ধবসহ হত্যা করা হয়। আর ইমাম হোসাইন (আ.) অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করে নিজের জীবন উৎসর্গের মাধ্যমে ইসলামকে পুনরুজ্জীবিত করেন।
খুলনায় আশুরা পালিত
খুলনায় পবিত্র মুহররম উপলক্ষে আঞ্জুমান-এ-পাঞ্জাতানী ট্রাষ্ট আয়োজিত ১০ দিনব্যাপী শোক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। ১ হতে ১০ মুহররম পর্যন্ত আলোচনা করেন ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্রের অধ্যক্ষ হুজ্জাতুল ইসলাম সৈয়দ ইব্রাহিম খলিল রাজাভী। সমাপনী দিনে হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)-এর পবিত্র শাহাদাত স্মরণে আশুরার শোক মিছিল নগরীর আলতাপোল লেনস্থ আঞ্জুমান-এ-পাঞ্জাতানী ট্রাষ্ট ইমাম বাড়ি হতে সকাল ৯.৩০ মিনিটে বের হয়।
শোক মিছিলপূর্ব বক্তৃতায় হুজ্জাতুল ইসলাম সৈয়দ ইব্রাহীম খলীল রাজাভী আশুরার শোক সমাবেশে সূরা আলে ইমরানের ৬১নং আয়াত উদ্ধৃত করে বলেন, ধর্ম সম্পর্কে নাজরানের খ্রিস্টানরা রাসূলে করিম (সা.)-এর সাথে বিতর্কে লিপ্ত হলে নবী (সা.) অনেক যুক্তিতর্কের পরও তাদেরকে বোঝাতে যখন সক্ষম হলেন না তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রাসূল (সা.)-কে তাদের সাথে মোবাহিলার নির্দেশ দিলেন এবং মোবাহিলার জন্য তাঁর দুই দৌহিত্র হাসান ও হোসাইন (আ.), কন্যা ফাতিমা (সা. আ.) ও জামাই ও চাচাত ভাই হযরত আলী (আ.)-কে সঙ্গে নিয়ে মোবাহিলার ময়দানের দিকে অগ্রসর হলেন। তাঁদেরকে আসতে দেখে খ্রিস্টান পাদ্রিরা খ্রিস্টানদেরকে মোবাহিলা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিল এবং জিজিরা কর প্রদানে সম্মত হলো।
এ ঘটনা প্রমাণ করে যে, নবী (সা.) ও আহলে বাইতের এ চার সদস্যের বিপক্ষে যারাই অবস্থান নেবে তারাই মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন হবে।
তিনি বলেন, আশুরার শিক্ষাই হলো যালিমদের বিরুদ্ধে ও মযলুমদের পক্ষে অবস্থান নেয়া।
আলোচনা শেষে একটি শোক ও মাতম মিছিল নগরীর প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় ইমামবাড়িতে গিয়ে শেষ হয়।
বেনাপোলে আশুরার শোক মজলিশ ও মিছিল
১০ মুহররম ইমাম হোসাইন (আ.)-এর পবিত্র শাহাদাত উপলক্ষে ইমাম মাহদী (আঃ) ফাউন্ডেশন, শার্শা যশোর এর আয়োজনে বাংলাদেশের বৃহত্তর স্থল বন্দর বেনাপোলে এক বিশাল শোক মজলিশ ও মিছিলের আয়োজন করা হয়। শোক মজলিশে বক্তব্য রাখেন শার্শা উপজেলার প্রাক্তন শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক জনাব মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম, মাষ্টার আয়ুব হোসেন। অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ মোঃ ইকবাল হোসেন (শান্তি)। শোক মজলিশে কাসিদা পাঠ করেন জনাব মোহাম্মাদ আলী।
১ মুহররম থেকে ১০ মুহররম পর্যন্ত ঝিকরগাছা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে শোক মজলিশ অনুষ্ঠিত হয়। শোক মজলিশ শেষে শোক মিছিল বের বেনাপোল বাজার, নোম্যান্স ল্যান্ড প্রদিক্ষণ করে পুনরায় বেনাপোল বলফিল্ডে ফিরে আসে। অনুষ্ঠানের সার্বিক সহযোগিতায় ছিল আলী আকবর (আঃ) যুব সংঘ, শার্শা, যশোর।
মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ঘনিষ্ঠ স¤পর্ক প্রতিষ্ঠাকে বর্তমানে মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেছেন ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা। তিনি বলেছেন, মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ঐক্য ও সহযোগিতা মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সব সমস্যার সমাধান করতে পারে।
আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী গত ৮ সেপ্টেম্বর তেহরান সফররত তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগানের সঙ্গে এক বৈঠকে এ আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আমেরিকার নেতৃত্বাধীন বিশ্বের দাম্ভিক শক্তিগুলো মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ঘনিষ্ঠ স¤পর্ক চায় না এবং তারা একটি সম্ভাব্য মুসলিম শক্তিকে প্রচ- ভয় পায়।
তিনি বলেন, ঠিক এ কারণে শক্তিশালী মুসলিম দেশগুলোর বিরুদ্ধে তীব্র বৈরী আচরণ শুরু করেছে ওয়াশিংটন। আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেন, ইরান ও তুরস্ক এ অঞ্চলের দুটি শক্তিশালী ও সম্ভ্রান্ত রাষ্ট্র এবং মুসলিম বিশ্বের ব্যাপারে তারা একই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। কাজেই পাশ্চাত্যের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করার লক্ষ্যে ইরান ও তুরস্কের উচিত নিজেদের মধ্যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সহযোগিতা অতীতের চেয়ে শক্তিশালী করা।
তুরস্কে ইসলামপন্থিরা ক্ষমতায় আসার পর থেকে তেহরান ও আঙ্কারার স¤পর্কের উন্নতি হয়েছে বলে উল্লেখ করেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা। তিনি বলেন, দুদেশের মধ্যকার ঐক্যের জায়গাগুলোকে চিহ্নিত করে সেগুলোকে জোরদার করতে হবে। আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী মিয়ানমার ইস্যুতে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগানের ভূমিকার প্রশংসা করেন। তিনি ফিলিস্তিন প্রসঙ্গেও তুর্কি সরকারকে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ফিলিস্তিন সংকটের ব্যাপারে মুসলিম বিশ্ব এক মুহূর্ত উদাসীন থাকতে পারে না।
সাক্ষাতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট বলেন, মুসলিম বিশ্বের সব সংকটের মূলে রয়েছে এসব দেশের মধ্যে ঐক্য ও সংহতির অভাব। পাশ্চাত্যের অসদাচরণ পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। এ কারণে তিনি ইরান ও তুরস্কের মধ্যে স¤পর্ক আরো শক্তিশালী করার আহ্বান জানান।
২ ‘ইরান ও রাশিয়ার যৌথ সহযোগিতা একটি অনুকরণীয় আদর্শ’- রাহবার
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ¬াদিমির পুতিনের সঙ্গে এক বৈঠকে গত ৮ সেপ্টেম্বর বলেন, সিরিয়া সংকটকে কেন্দ্র করে ইরান ও রাশিয়ার মধ্যকার সহযোগিতা দ্বিপক্ষীয় স¤পর্ক শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে অনুকরণীয় আদর্শে পরিণত হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য সংকট নিরসনের ক্ষেত্রেও এ সহযোগিতা অব্যাহত থাকতে পারে বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেছেন।
তেহরানে ইরান, তুরস্ক ও রাশিয়ার শীর্ষ নেতাদের সিরিয়া বিষয়ক বৈঠক শেষে রুশ প্রেসিডেন্ট সর্বোচ্চ নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান। এ সময় আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী আরো বলেন, ইরান ও রাশিয়া যৌথভাবে যে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করতে পারে তার অন্যতম হচ্ছে আমেরিকার বলদর্পিতা প্রতিহত করা। কারণ, ওয়াশিংটন বিশ্ব মানবতার জন্য একটি বিপদ এবং তাকে প্রতিহত করা সম্ভব।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেন, মার্কিনীরা সিরিয়ায় সত্যিকার অর্থে পরাজিত হয়েছে এবং তারা তাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারে নি। ইরান, তুরস্ক ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকে এই তিন দেশের মধ্যে সহযোগিতা শক্তিশালী করার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ বলে উল্লেখ করেন।
বৈঠকে পাশ্চাত্যের সঙ্গে ইরানের স্বাক্ষরিত পরমাণু সমঝোতা প্রসঙ্গেও কথা বলেন সর্বোচ্চ নেতা। তিনি বলেন, ইরান পরমাণু সমঝোতায় দেয়া প্রতিটি প্রতিশ্রুতি পূরণ করলেও ইউরোপীয় দেশগুলো তাদের ওয়াদা রক্ষা করে নি। এ বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয় বলে তিনি উল্লেখ করেন।
আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেন, আমেরিকা গত ৪০ বছর ধরে ইরানের ইসলামি শাসনব্যবস্থা উৎখাতের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু এই ৪০ বছরে ইরান অন্তত ৪০ গুণ শক্তিশালী হয়েছে।
সাক্ষাতে ইরানের পরমাণু সমঝোতায় স্বাক্ষরকারী কোনো কোনো দেশের প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘনে দুঃখ প্রকাশ করেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ¬াদিমির পুতিন। তিনি বলেন, মার্কিন সরকার অনুপযুক্ত পদক্ষেপ নিয়ে পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে। পুতিন বলেন, ইউরোপীয়রা মুখে পরমাণু সমঝোতা রক্ষার কথা বললেও তারা আমেরিকার ওপর নির্ভরশীল বলে ওয়াশিংটনের কথা মেনে চলতে বাধ্য।
৩ মুসলিম শক্তির উত্থান ঠেকানো আমেরিকা ও ইসরাইলের প্রধান উদ্দেশ্য : সর্বোচ্চ নেতা
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী নৌবাহিনীর ক্যাডেটদের ¯œাতক ডিগ্রি প্রদান অনুষ্ঠানে পশ্চিম এশিয়া তথা মধ্যপ্রাচ্যকে নিরাপত্তাহীন করে তোলার জন্য পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর নানা ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছেন।
তিনি বলেন, মার্কিন নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো মধ্যপ্রাচ্যে গৃহযুদ্ধ বাঁধানো, সন্ত্রাসবাদের বিস্তার ঘটানো এবং ব্যাপক নিরাপত্তাহীনতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করছে। আরো দুঃখজনক হচ্ছে এ অঞ্চলের কয়েকটি আরব দেশ তাদেরকে সহযোগিতা করছে।
মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম শক্তির উত্থান ঠেকানো আমেরিকা ও দখলদার ইসরাইলের প্রধান উদ্দেশ্য- এ কথা উল্লেখ করে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেন, শত্রুরা ভালো করেই জানে ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা হচ্ছে বঞ্চিত ও নির্যাতিতদের পাশে দাঁড়ানো। এ কারণেই তারা মুসলিম শক্তির উত্থানে ভীত ও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, ইসলামি ইরানের সরকার ও জনগণ ¯পষ্ট ভাষায় এবং কোনো গোপনীয়তা বজায় না রেখে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। আর এটাই ইরানের বিরুদ্ধে জুলুমবাজ সরকারগুলোর শত্রুতার প্রধান কারণ।
যাই হোক, ইরানের নৌবাহিনী বর্তমানে পারস্য উপসাগর, ওমান সাগরসহ আন্তর্জাতিক সমুদ্র সীমায় নিজেদের শক্তিশালী উপস্থিতি বজায় রেখেছে। যেখানেই নিরাপত্তা রক্ষার প্রয়োজন হবে সেখানেই ইরান তার উপস্থিতি বজায় রাখবে। ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমির হাতামি নৌবাহিনী দিবস উপলক্ষে এক বার্তায় বলেন, আইআরজিসি’র নৌবাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় রেখে সেনাবাহিনীর নৌ ইউনিট ইরানের পানিসীমাসহ আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমায় নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত রয়েছে।
গত এক দশকের অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত হয়েছে, সামরিক হস্তক্ষেপ ও প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে এ অঞ্চলে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি ও জাতিগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত বাঁধানো আমেরিকার প্রধান উদ্দেশ্য। এর মাধ্যমে তারা কৌশলগত এ অঞ্চলের ওপর প্রভাব বিস্তার করা, আঞ্চলিক নিরাপত্তাকে বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীল করে তোলা, কোটি কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রি এবং এ অঞ্চলে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করার চেষ্টা করছে। এ অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যে তৎপর প্রতিরোধ শক্তিগুলোর তৎপরতাকে আরো জোরদার করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী প্রমাণ করেছে ইরানসহ এ অঞ্চলে হুমকি ও নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত জবাব দেয়ার ক্ষমতা রাখে। এ ব্যাপারে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা যেমনটি বলেছেন, ইরানের সরকার ও জনগণ সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে প্রমাণ করেছে, ‘জাতিগুলো যদি বলদর্পী বৃহৎ শক্তিগুলোকে ভয় না পেয়ে এবং নিজের শক্তির ওপর নির্ভর করে প্রতিরোধ গড়ে তোলে তাহলে শত্রুরা পিছু হটতে বাধ্য হবে এবং পরাজিত হবে।’ উদাহরণ হিসেবে তিনি সিরিয়া, ইরাক ও লেবাননের কথা উল্লেখ করেন যেখানে মার্কিন সব ষড়যন্ত্রই ব্যর্থ হয়েছে।
যাইহোক, ইসলামি ইরানের সেনাবাহিনীর নৌ ইউনিট ইরানসহ আন্তর্জাতিক পানি সীমায় নিজেদের অবস্থান জোরদার করতে সক্ষম হয়েছে যা এ অঞ্চলের সব দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।
৪ সন্ত্রাসী হামলায় জড়িতদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে : ইরানের সর্বোচ্চ নেতা
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেছেন, আহওয়াজে সামরিক কুচকাওয়াজে সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে জড়িতদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসে পদক অর্জনকারী ক্রীড়াবিদদের সঙ্গে এক বৈঠকে গত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ সর্বোচ্চ নেতা এ কথা বলেন।
গত ২২ সেপ্টেম্বর আহওয়াজে সামরিক কুচকাওয়াজে সন্ত্রাসী হামলায় ২৫ জন শহীদ ও ৬০ জন আহত হয়েছেন। শহীদদের মধ্যে নারী ও শিশু রয়েছে।
তিনি বলেন, এই হামলার মধ্য দিয়ে আবারও প্রমাণিত হয়েছে উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে ইরানের শত্রুর সংখ্যা অনেক।
ইহুদিবাদী ইসরাইলের ক্রীড়াবিদদের সঙ্গে ইরানিদের না খেলার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ইসলামি বিপ্লবের প্রথম থেকেই ইরান ইহুদিবাদী ইসরাইল ও দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক বর্ণবাদী সরকারের বিরোধিতা করেছে। ওই দুই সরকারকে ইসলামি ইরান স্বীকৃতি দেয় নি। অবশ্য দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকারের পতন হয়েছে। মিথ্যাবাদী, দখলদার ও বর্ণবাদী ইহুদিবাদী ইসরাইলেরও পতন হবে।
তিনি বলেন, ইসলামি ইরান, দখলদার ইসরাইলের ক্রীড়াবিদদের সঙ্গে ভবিষ্যতেও খেলবে না এবং গত বছর ইরানি ক্রীড়াবিদ আলী রেজা কারিমি ইসরাইলি প্রতিনিধির সঙ্গে খেলায় অংশ নেন নি। তিনি একজন প্রকৃত চ্যা¤িপয়ন।
এশিয়ান গেমসে ইরানি ক্রীড়াবিদদের সাফল্যের প্রশংসা করে তিনি বলেন, ইরানিরা যে অঙ্গনেই সাফল্য অর্জন করুক না কেন, তাতে ক্ষুব্ধ হয় সাম্রাজ্যবাদীরা। কাজেই ইরানি ক্রীড়াবিদদের বিজয় মানেই হলো ইরানের শত্রুদের পরাজয়। গোটা ইরানি জাতির বিজয়।
৫ আধিপত্যবাদী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ইরানি জাতির বিজয় অবশ্যম্ভাবী : আয়াতুল্লাহ কাশানি
ইরানি জাতি বিশ্ব আধিপত্যবাদ ও ইসলাম বিরোধী শক্তির ষড়যন্ত্র ও সকল নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে বিজয়ী হবেই। তেহরানের জুমার নামাজের অন্যতম খতিব আয়াতুল্লাহ ইমামি কাশানি গত ১২ অক্টোবর ইরানের সক্ষমতা ও সামর্থ্যের কথা তুলে ধরতে গিয়ে আরও বলেন, বিজয় ও সাফল্য ইরানি জাতির জন্য অপেক্ষা করছে।
অপরদিকে ইরানের শত্রুদের স্বপ্ন ও ষড়যন্ত্র কোনোদিনই বাস্তবায়িত হবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ইরানের ওপর শত্রুদের আধিপত্যের স্বপ্নসাধের কবর রচিত হবে।
শত্রুরা চাচ্ছে ইরানের সরকার ও জনগণের মাঝে অসন্তোষ ও অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করতে। কিন্তু ইরানি জাতি সচেতনভাবে শত্রুদের ওই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। শত্রুদের ষড়যন্ত্র তারা ব্যর্থ করে দেবে বলেও দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন বিশিষ্ট এই আলেম।
জুমার খতিব আরও বলেন, আমেরিকা আজকের মতো কখনোই এত নিঃসঙ্গ আর কোণঠাসা হয় নি। আমেরিকাসহ বিশ্ব আধিপত্যবাদ ও ইহুদিবাদের জেনে রাখা উচিত সত্যের জয় সুনিশ্চয়।
৬ ত্রিদেশীয় শীর্ষ বৈঠকে ড. হাসান রুহানি
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি বলেছেন, সিরিয়া সংকট নিরসনে ইরান, তুরস্ক ও রাশিয়া সমনিন্বত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ সিরিয়া বিষয়ক ত্রিদেশীয় শীর্ষ সম্মেলনের সমাপনী ভাষণে তিনি একথা বলেন।
ড. রুহানি আরও বলেন, যারা বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন দেয় তাদের লক্ষ্য পূরণ হবে না। তবে ইরান, রাশিয়া ও তুরস্ক অভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। আর তা হলো সিরিয়া ও গোটা মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। এর আগে বৈঠকের শুরুতে বিস্তারিত বক্তব্য তুলে ধরেন রুহানি। সে সময় তিনি ছয়টি বিষয়ের ওপর কথা বলেন।
তিনি বলেন, সিরিয়া সংকট সমাধানের জন্য যেকোনো রাজনৈতিক আলোচনায় অবশ্যই সিরিয়ার ভৌগোলিক অখ-তা ও স্বাধীনতাকে সম্মান জানাতে হবে। সিরিয়ায় বিশেষ করে ইদলিবে সব সন্ত্রাসী গোষ্ঠী নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত সন্ত্রাসবাদবিরোধী সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সমাজের কর্মসূচিতে শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও দেশ পুনর্গঠনে সহযোগিতার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। সিরিয়ায় আমেরিকার অবৈধ উপস্থিতি ও হস্তক্ষেপ অবিলম্বে বন্ধ করতে
হবে। কারণ, অবৈধ উপস্থিতি ও হস্তক্ষেপ সিরিয়ায় অনিরাপত্তা বজায় রেখেছে।
ইরানের প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, সিরিয়ার জনগণ ও সরকারের বিরুদ্ধে ইহুদিবাদী ইসরাইলের তৎপরতা ও দখলদারিত্ব প্রতিদিনই বাড়ছে। আন্তর্জাতিক সমাজের দায়িত্ব হলো তা মোকাবেলা করা। একই সঙ্গে তিনি সিরিয়া সংকট সমাধানে ইরান, তুরস্ক ও রাশিয়ার চেষ্টা ও অবদানের প্রতি সম্মান জানিয়ে দেশটিতে পরিপূর্ণ শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমন্বয় অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান।
৭ আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেয়ীকে ইউএনএইচসিআর এর অভিনন্দন জ্ঞাপন
জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি ইরানের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আফগান অভিবাসী শিশুদেরকে ইরানে পড়ালেখা করার অনুমতি ও নির্দেশ দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেয়ীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
তেহরানের একটি অভিবাসনকেন্দ্র পরিদর্শনকালে গ্রান্ডি বলেন, আমার মতে আফগান শিশুদের ইরানে পড়ালেখা করার সুযোগ দেয়ার জন্য ইসলামি বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেয়ীর নির্দেশ অভিবাসী ব্যবস্থাপনায় একটি যুগান্তকারী এবং প্রশংসনীয় সিদ্ধান্ত।
তিনি অভিবাসীদের সেবা প্রদানে ইরানের বিশেষ ভূমিকার প্রশংসা করে বলেন, ইরানের শরণার্থী ব্যবস্থাপনায় বিশেষ রকমের পরিকল্পনা রয়েছে এবং অন্যান্য দেশের জন্য তারা রোল মডেলের ভূমিকা রাখতে পারে।
গত মার্চ মাসে ইরানের একজন দায়িত্বশীল সরকারি কর্মকর্তা জানান যে, নয় লক্ষাধিক আফগান শরণার্থী ইরানে বসবাস করছে।
ইরানের অভিবাসীবিষয়ক ব্যুরোর সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আলী সালেহী নাজাফাবাদি আফগানিস্তানকে মুসলমান বিশ্বের অংশ এবং ইরানের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী হিসেবে উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী আফগান শিশুদেরকে বাকি ইরানি শিশুদের সাথে একই শিক্ষায় শিক্ষিত করার আদেশ দিয়েছেন।
সালেহী নাজাফাবাদি আরো বলেন, প্রতিবেশীর নিরাপত্তা যত বেশি নিশ্চিত করা যাবে, ইরানের জন্য সেটা ততই উত্তম। তিনি আরো উল্লেখ করেন, ইরান চেষ্টা করছে আফগানদের এমন একটি প্রজন্ম গড়ে তুলতে যারা নিজেদের দেশে ফিরে গিয়ে দেশের জন্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
তিনি বলেন, একটা সময় ইরানে প্রায় চার লক্ষ পঞ্চাশ হাজার ইরাকি শরণার্থী ছিল, কিন্তু ইরাকের নিরাপত্তা ফিরে আসার পর তাদের অধিকাংশই নিজেদের দেশে ফিরে গিয়েছে। তিনি বলেন, বর্তমানে প্রায় চল্লিশ হাজার ইরাকি ইরানে বসবাস করছে।
৮ পার¯পরিক বাণিজ্যে ডলার পরিহার করবে ইরান, তুরস্ক ও রাশিয়া
ইরান, রাশিয়া ও তুরস্ক পার¯পরিক বাণিজ্যে ডলার পরিহার করাসহ আরো কিছু অর্থনৈতিক কার্যক্রম শুরু করতে সম্মত হয়েছে। তিন দেশের বিরুদ্ধে আমেরিকার অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে তেহরান, মস্কো ও আঙ্কারা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে খবর দিয়েছেন ইরানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুররেজা হেম্মাতি।
তিনি শনিবার তেহরানে বলেছেন, ইরান, রাশিয়া ও তুরস্কের প্রেসিডেন্টদের মধ্যে গত ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮, শুক্রবার তেহরানে সিরিয়া বিষয়ক যে শীর্ষ বৈঠক হয়েছে তার অবকাশে এ সংক্রান্ত চুক্তি সই হয়েছে। হেম্মাতি বলেন, শুক্রবারের শীর্ষ বৈঠকের সময় আমি ও ইরানের তেলমন্ত্রী তিন প্রেসিডেন্টের উপস্থিতিতে রাশিয়া ও তুরস্কের অর্থমন্ত্রীদের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা করেছি।
এসব আলোচনায় তেল ও গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ, মৌলিক পণ্য বিনিময়, ব্যাংকিং খাতে সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং ডলার বাদ দিয়ে পার¯পরিক আর্থিক লেনদেনে নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহারের বিষয়গুলো গুরুত্ব পেয়েছে।
তেহরানে অনুষ্ঠিত এ সংক্রান্ত চুক্তির পরবর্তী ধাপ নিয়ে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে আলোচনা করতে আব্দুররেজা হেম্মাতি অচিরেই মস্কো সফরে যাবেন বলে জানান।
ইরান সরকার এরই মধ্যে ঘোষণা করেছে, দেশটির বিরুদ্ধে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে তেহরান বদ্ধপরিকর এবং এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেয়া হবে।
৯ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পবিত্র আশুরা পালন
কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ মুসলমানের অংশগ্রহণে গত ২০ সেপ্টেম্বর ইরানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পবিত্র আশুরা পালিত হয়। এর আগের দিন পালন করা হয়েছে আশুরার পূর্বদিন তথা তাসুয়া। মহররমের চাঁদ একদিন দেরিতে ওঠায় বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের সব দেশে ২০ সেপ্টেম্বর পালিত হয় তাসুয়া। এসব দেশে শুক্রবার আশুরার শোক পালন করেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা।
রাজধানী তেহরানসহ সারা ইরানের বিভিন্ন শহরে লাখো কোটি জনতা আশুরার শোকমিছিলে যোগ দেন। ইরানের পাশাপাশি বেশিরভাগ আরব দেশে বৃহ¯পতিবার আশুরা উদযাপিত হয়। তাসুয়ার শোকানুষ্ঠানে অংশ নেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী।
৬৮০ খ্রিস্টাব্দের ১০ মহররম খোদাদ্রোহী জালিম শাসক ইয়াযীদের শাসন মেনে নিতে অস্বীকার করায় বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর নাতি হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) এবং তাঁর পরিবার ও সঙ্গীদের ওপর কারবালা ময়দানে চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল এক অসম যুদ্ধ। ইমাম ও তাঁর ৭২ জন সঙ্গী বীরত্বপূর্ণ এবং নীতি-নির্ধারণী ওই লড়াইয়ে শহীদ হয়ে অন্যায় ও
অবিচারের মোকাবেলায় সর্বোচ্চ ত্যাগ বা শাহাদাতের অমর আদর্শ শিখিয়ে গেছেন বিশ্বমানবতাকে।
মহান আশুরার দিনে ইরাকের পবিত্র কারবালা শহরে অন্তত ২৫ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান শোক পালন করেছেন। বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার মুসলমান আশুরার শোক পালন করতে পবিত্র কারবালা শহরে আসেন যেখানে রয়েছে আশুরা বিপ্লবের মহানায়ক হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)-এর পবিত্র মাযার। ভারতীয় উপমহাদেশ, মধ্য-এশিয়া এবং আরব বিশ্বের নানা অঞ্চল থেকেও বিশ্বনবী (সা.)-এর আহলে-বাইত প্রেমিকরা কারবালায় জড়ো হন।
বিশ্বের নানা মহাদেশে, এমনকি পশ্চিমা দেশগুলোতেও ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা আশুরার শোক-মিছিল ও সমাবেশে অংশ নিয়ে শহীদ সম্রাট ইমাম হোসাইন ও তাঁর মহান সঙ্গীদের আত্মত্যাগের আদর্শের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, অঙ্গীকার ও অনুরাগ প্রদর্শন করেন।
১০ আদালতের রায় ইরানের পক্ষে; কোণঠাসা আমেরিকা
হেগের আন্তর্জাতিক আদালত গত ৩ অক্টোবর ২০১৮ এক ঐতিহাসিক রায়ে ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছে।
আদালতের বিচারক আব্দুল কাভি আহমাদ ইউসুফ রায় ঘোষণা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘এই আদালত সর্বসম্মতভাবে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, ওয়াশিংটন গত ৮ মে পরমাণু সমঝোতা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর ইরানের ওপর খাদ্য, ওষুধ, চিকিৎসা সামগ্রী, কৃষিপণ্য ও বিমানের যন্ত্রাংশের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে তা অবশ্যই উঠিয়ে নিতে হবে।’
আদালতের রায়ে ১৯৫৫ সালে ইরান ও আমেরিকার মধ্যকার চুক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলা হয়েছে, ওই চুক্তিতে দু’দেশই বাণিজ্য স্বার্থ রক্ষা করা এবং কূটনীতিকদের অধিকার বিঘিœত হয় এমন কাজ করা থেকে বিরত থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
পরমাণু সমঝোতা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রা¤প ইরানের বিরুদ্ধে ফের নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করেন। এর প্রতিবাদে চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ইরান হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মামলা দায়ের করে। আদালতও ইরানের অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত চালায় এবং শেষ পর্যন্ত পরমাণু সমঝোতা মেনে চলতে আমেরিকার প্রতি আহ্বান জানায়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রা¤প পরমাণু সমঝোতা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়ার আগে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ আমেরিকাকে একঘরে হয়ে পড়ার ব্যাপারে ট্রা¤পকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরও মার্কিন প্রেসিডেন্ট এসব সতর্কবার্তা উপেক্ষা করে এমন এক চুক্তি থেকে বেরিয়ে যান যার প্রতি ইউরোপসহ বিশ্বের অন্য প্রভাবশালী দেশ এমনকি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদেরও সমর্থন রয়েছে।
ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি হেগের আন্তর্জাতিক আদালত আমেরিকার বিরুদ্ধে যে রায় দিয়েছে তা ইরানের জন্য একটি বিশাল বিজয় বলে উল্লেখ করেন। তিনি গত ৩ অক্টোবর এক সমাবেশে বলেন, আন্তর্জাতিক আদালতের রায় আমেরিকার বিরুদ্ধে ইরানের বিশাল রাজনৈতিক ও আইনি বিজয়। তিনি আরো বলেন, তার দেশের বিরুদ্ধে চরম বিদ্বেষী মনোভাব পোষণকারী কিছু লোক বর্তমানে আমেরিকা শাসন করছে। তারা ইরানকে নতজানু করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে কিন্তু এ কাজে সফল হয়নি এবং ভবিষ্যতেও হবে না।
যাইহোক, হেগের আন্তর্জাতিক আদালতের রায় নিঃসন্দেহে প্রমাণ করেছে ইরান সঠিক অবস্থানে রয়েছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা বা আইএইএ’র পরিদর্শকরাও ১২টি প্রতিবেদনে স্বীকার করেছেন ইরান পরমাণু সমঝোতা পুরোপুরি মেনে চলছে। সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট ট্রা¤েপর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকেও অন্যান্য দেশ ইরানের প্রতি সমর্থন জানায় এবং পরমাণু সমঝোতা থেকে ওয়াশিংটনের বেরিয়ে যাওয়ার সমালোচনা করে।
১১ ইরান এবং চীনের মাঝে নতুন রেলপথ চালু
একটি নতুন সিল্করোডের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ইরান এবং চীন নয় হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথ চালু করেছে।
নতুন ইরান-চীন রেলপথটি চীনের মধ্য মঙ্গোলিয়াকে ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত বাম শহরের সাথে যুক্ত করেছে। এ পথ ব্যবহার করছে কার্গো এবং সেবাপ্রদানকারী রেল।
এই রেলপথের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চীনের অন্যতম বাণিজ্য কেন্দ্র মধ্য মঙ্গোলিয়া থেকে আগত একটি কার্গো ট্রেন ইরানের বাম শহরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। এটি পনের দিন পর ইরানের বাম শহরে প্রবেশ করবে। ট্রেনটি ৪১টি কন্টেইনার বহন করছে যেগুলোতে রয়েছে বিভিন্ন উপকরণ, যন্ত্রপাতি এবং গাড়ি তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ যেগুলোর মূল্যমান এক মিলিয়ন ডলার।
অন্যদিকে মধ্য মঙ্গোলিয়ার পশ্চিমের বায়ানুর শহর থেকে ছেড়ে আসা একটি কার্গো ট্রেন ইরানের রাজধানী তেহরান অভিমুখে রওয়ানা দেয়।
এই দুটি রেলপথ আরো বৃহৎ একটি পরিকল্পনার অংশবিশেষ, যার মাধ্যমে চীনকে ইরানের মধ্য দিয়ে ইউরোপের সাথে যুক্ত করা হবে।
১১ (খ) ইরানের সঙ্গে লেনদেন করবে ৭ ইউরোপীয় দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মাদ জাওয়াদ জারিফ বলেছেন, তাঁর দেশের সঙ্গে আর্থিক লেনদেন করতে এখন পর্যন্ত সাত ইউরোপীয় দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রাজি হয়েছে। ইরান যাতে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বহির্বিশ্বের সঙ্গে আর্থিক ও বাণিজ্যিক লেনদেন চালিয়ে যেতে পারে সে লক্ষ্যে ইউরোপীয় দেশগুলো এ পদক্ষেপ নিচ্ছে।
আমেরিকা ছাড়া ইরানের সঙ্গে পরমাণু সমঝোতা স্বাক্ষরকারী বাকি পাঁচ দেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইইউ সম্প্রতি ইরানের সঙ্গে ব্যাংকিং চ্যানেলে আর্থিক লেনদেনের জন্য একটি বিশেষ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সম্মত হয়। সে কাজের অগ্রগতি স¤পর্কে জানাতে গিয়ে গত ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ নিউ ইয়র্কে জাওয়াদ জারিফ এ তথ্য জানান।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে শুধু ইউরোপীয় দেশগুলো নয়; বরং বিশ্বের যেকোনো দেশ ইরানের সঙ্গে লেনদেন করতে পারবে। ইরানের কাছ থেকে তেল আমদানিকারকরা যেমন এই ব্যবস্থার মাধ্যমে তেহরানকে অর্থ সরবরাহ করতে পারবেন তেমনি ইরানে পণ্য রপ্তানিকারকরাও এই ব্যবস্থা ব্যবহার করে তেহরানের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করতে সক্ষম হবেন।
১১ (গ) ইরান ও কিরগিজিস্তানের মধ্যে ১২ শতাংশ বাণিজ্য বৃদ্ধি
ইরানে কিরগিজিস্তানের রাষ্ট্রদূত আভাজবেক আব্দুরজাকোভ বলেছেন, চলতি বছরে তাঁর দেশের সঙ্গে তেহরানের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে অন্তত ১২ শতাংশ। গত ১ অক্টোবর বার্তা সংস্থা ইরনাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, বাণিজ্যের এ পরিমাণ ৬ কোটি ডলার। আব্দুরজাকোভ বলেন, দুটি দেশের মধ্যে সরাসরি বিমান চালু হলে বাণিজ্য আরো বৃদ্ধি পাবে। তিনি ইরানের বিনিয়োগকারীদের তাঁর দেশে আরো বিনিয়োগের আহ্বান জানান। কিরগিজিস্তানের কৃষি, শিল্প ও সংস্কৃতিতে এধরনের বিনিয়োগের সুযোগ বেশ রয়েছে বলে জানান দেশটির রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, তাঁর দেশ ইরানের জন্যে সব ধরনের সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে চায়।
১২ গুরুত্বপূর্ণ পেট্রোক্যামিকাল প্রকল্পের উদ্বোধন করলো ইরান
ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি দক্ষিণ ইরানে অবস্থিত আশালুয়ে অঞ্চলে তিনটি পেট্রোক্যামিকাল প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। এগুলোর নাম মারযান পেট্রোক্যামিকাল প্লান্ট, পারদিস পেট্রোক্যামিকাল প্লান্টের তৃতীয় ধাপ এবং দামাভান্দ পেট্রোক্যামিকাল প্লান্টের প্রথম ধাপ।
এই প্রকল্পের আওতায় দেশের মোট বার্ষিক পেট্রোক্যামিকাল উৎপাদন ক্ষমতার ৩.৪ মিলিয়ন টন উৎপন্ন করা হবে। এই প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ১.৮৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
ইরানের পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী বিজান জাঙ্গানেহ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
পারদিস পেট্রোক্যামিকাল প্লান্টের তৃতীয় ধাপের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১১ সালে এবং এর বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা ১৭ লক্ষ ম্যাট্রিক টন ইউরিয়া এবং অ্যামোনিয়াম।
উল্লেখ্য, এটি উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে এই প্রকল্পটি মধ্যপ্রাচ্য এবং সমগ্র বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বড় ইউরিয়া এবং অ্যামোনিয়া উৎপাদন কেন্দ্রে পরিণত হলো যার বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা ৫২৬৫ মিলিয়ন টন। এই প্রকল্পের মধ্য দিয়ে ৩০০টি নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। এক্ষেত্রে ৫৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে।
মারযান পেট্রোক্যামিকাল প্রকল্পটির কাজ শুরু হয় ২০১১ সালে, যার লক্ষ্যমাত্রা ছিল বার্ষিক ১.৬৫ মিলিয়ন টন মিথানল উৎপাদন।
উল্লেখ্য, এই প্রকল্পটির মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে ২৫০টি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।
দামাভান্দ প্রকল্পের প্রথম ধাপটি গড়ে তোলা হয়েছে পার্শ্ববর্তী ২৪টি পেট্রক্যামিকাল প্লান্টের জন্য বিদ্যুৎ এবং গরম বা®প উৎপাদনের লক্ষ্যে। এটি থেকে ৬৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হবে এবং চারটি গ্যাস টারবাইনের মাধ্যমে চলবে। এই প্রকল্পটি তৈরিতে ৩৬৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে যেখানে ১৬৬ জন মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
১২ (খ) সমুদ্রগামী জাহাজ নির্মাণে ইরানের সাফল্য
ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ম্যারিন ইন্ডাস্ট্রিস অর্গানাইজেশনের প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল আমির রাস্তেগারি বলেন, তাঁর দেশ সমুদ্রগামী জাহাজ নির্মাণে বিশেষ সাফল্য অর্জনের পর এধরনের প্রযুক্তিগত সফলতা উপভোগ করছে। গত ১৪ অক্টোবর তেহরানে তৃতীয় ইন্টারন্যাশনাল ফিশারিজ এক্সিবিশনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি এ বক্তব্য দেন। এসময় তিনি এ শিল্পে ইরানের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা জানান। রিয়ার অ্যাডমিরাল আমির রাস্তেগারি বলেন, প্রতিরোধের অর্থনীতির অংশ হিসেবেই ইরান জাহাজ শিল্পে বিশেষ উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে। এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১৭৬টি জাহাজ তৈরি করা হয়েছে। চারটি শিল্প প্রতিষ্ঠান এসব জাহাজ তৈরি করেছে। একই সঙ্গে ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে আরো ৮০টি জাহাজ তৈরি করা য়েছে। নৌ বাহিনীর উদ্যোগে বেসামরিকভাবে ব্যবহারের জন্যে আরো ১৮০টি নৌযান তৈরি করা হয়েছে।
১৩ আকাশ প্রতিরক্ষায় ইরান এখন একটি বড় শক্তি : জে. হাতামি
আকাশ প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে ইরান এখন একটি বড় শক্তিতে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমির হাতামি একথা বলেন।
তিনি বলেন, আজকে ইরানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে মিলে প্রযুক্তি বিষয়ক অনেক গবেষণা কো¤পানি প্রতিরক্ষা শিল্পে একসঙ্গে কাজ করছে। তাদের সমন্বয়ের ফলে দেশের আকাশ প্রতিরক্ষা খাত এখন অনেক শক্তিশালী হয়েছে।
জেনারেল আমির হাতামি জানান, শিগগিরি দেশীয় প্রযুক্তি ও নকশায় তৈরি হবে কোসার-৮৮ প্রশিক্ষণ বিমান যার প্রস্তুতি চলছে।
তিনি বলেন, বিমান শক্তি দেশের প্রতিরক্ষা খাতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ও জয়পরাজয় নির্ধারণকারী শক্তি। এ ক্ষেত্রে গত ৪০ বছরে ইরান অনেক উন্নতি করেছে এবং নানা রকমের রাডার, ড্রোন, বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং বিমান বাহিনী গড়ে তুলেছে।
ইরান এরই মধ্যে মহাকাশে নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি স্যাটেলাইট পাঠিয়েছে। এছাড়া, আকাশ প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে যে বাব্্র্্ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করেছে তা রাশিয়ার এস-৩০০ ক্ষেপণাস্ত্রের চেয়েও শক্তিশালী বলে জানিয়েছেন ইরানের সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা।
১৪ সেন্ট্রিফিউজ উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জন করল ইরান
বিভিন্ন ধরনের সেন্ট্রিফিউজ উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জন করল ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। দেশটির আণবিক শক্তি কমিশন বা এইওআই-এর বিশেষ উপদেষ্টা আলি আসগার জারিন এ কথা জানিয়েছেন।
পরমাণু কর্মসূচিতে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার যন্ত্রের নাম সেন্ট্রিফিউজ। ওই উপদেষ্টা বলেন, ইরান অত্যাধুনিক সেন্ট্রিফিউজ উৎপাদনে স্বয়ংস¤পূর্ণতা অর্জন করেছে। এই যন্ত্র অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করার আর কোনো প্রয়োজন নেই।
গত ২৫ সেপ্টেম্বর ইরানের কোম প্রদেশে এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেন এইওআই-এর বিশেষ উপদেষ্টা। আট বছরের ইরান-ইরাক যুদ্ধের বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি ওই বক্তৃতা দেন।
এসময় চিকিৎসাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ইরানের অত্যাধুনিক পরমাণু প্রযুক্তি অর্জনের যে সম্ভাবনা ও সক্ষমতা রয়েছে, তা তুলে ধরেন জারিন। তিনি বলেন, দেশের তরুণ বিজ্ঞানীদের বিরতিহীন ও অদম্য প্রচেষ্টায় অত্যাধুনিক সেন্ট্রিফিউজের বিভিন্ন প্রজন্ম আজ দেশীয়ভাবে উৎপাদন হচ্ছে।
ইরানি এই কর্মকর্তা আরও জানান, আরাকের আধুনিক ভারী পানি চুল্লির জন্য যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম উৎপাদনের কাজ আগামী বছর থেকে শুরু হবে।
১৫ বৈশ্বিকভাবে মোবাইল ইন্টারনেটের গড় গতি ছাড়িয়েছে ইরান
বৈশ্বিকভাবে মোবাইল ইন্টারনেটের গড় গতি ছাড়িয়ে উপরে অবস্থান করছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। বর্তমানে মোবাইল ইন্টারনেটের গতিতে দেশটি ১২৪টি দেশের মধ্যে ৫৮তম অবস্থানে রয়েছে। অন্যদিকে, ফিক্সড ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের গতিতে দেশটি ১০৭তম অবস্থানে রয়েছে।
ইন্টারনেট গতি মাপার আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ওকলারের এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। একটি দেশে মোবাইল ও ফিক্সড ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের গতি কেমন, তা নির্ধারণে প্রতি মাসে ‘¯িপডটেস্ট গ্লোবাল ইনডেক্স’ নামের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রতিষ্ঠানটি। এই প্রতিবেদনের সর্বশেষ সংস্করণে ইরানের ইন্টারনেট গতির এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইরানে মোবাইল ইন্টারনেটে ডাউনলোড এখন প্রতি সেকেন্ডে ২৩ দশমিক ৭৯ মেগাবাইট, আপলোড ৯ দশমিক ৩৪ মেগাবাইট। অন্যদিকে, বর্তমানে বৈশ্বিকভাবে মোবাইল ইন্টারনেটে ডাউনলোডের গড় গতি প্রতি সেকেন্ড ২২ দশমিক ৮১ মেগাবাইট ও আপলোড ৯ দশমিক ১৩ মেগাবাইট। অর্থাৎ বৈশ্বিক গড় গতির চেয়ে বেশি গতি পরিলক্ষিত হচ্ছে ইরানে।
তবে মোবাইল ফোনের চেয়ে ইরানের ফিক্সড ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের গতি বেশ কম। ফাইবার অপটিক তারের মাধ্যমে ব্যবহৃত ইন্টারনেটকেই ফিক্সড ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বলা হয়। এখানে ১৩৩টি দেশের মধ্যে দেশটি আছে ১০৭ নম্বরে।
এবার মোবাইল ইন্টারনেটের গতিতে বিশ্বে প্রথম স্থানে রয়েছে কাতার। তাদের ডাউনলোড গতি সেকেন্ডে ৬২ দশমিক ৬৩ মেগাবাইট। ব্রডব্যান্ডে প্রথম অবস্থানে রয়েছে সিঙ্গাপুর। তাদের গড় ডাউনলোড গতি সেকেন্ডে ১৮১ দশমিক ৪৭ মেগাবাইট। এছাড়া মোবাইল ইন্টারনেট গতিতে দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে নরওয়ে ও আরব আমিরাত। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের গতির ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ও তৃতীয় হংকং ও আইসল্যান্ড। বাংলাদেশ মোবাইল ইন্টারনেটের গতিতে ১১২তম ও ব্রডব্যান্ডে ৮১তম অবস্থানে রয়েছে।
১৫ (ক) ইরানে সাক্ষরতার হার বেড়ে ৯৭ ভাগ
ইরানের শিক্ষামন্ত্রী মোহাম্মাদ বাতহায়ি জানিয়েছেন, দেশটির ১০ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নাগরকিদের মধ্যে এখন সাক্ষরতার হার ৯৬ শতাংশ এবং ১০ থেকে ২৯ বয়সী জনসংখ্যার মধ্যে এই হার ৯৭ শতাংশের ওপরে। গত ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৮ বাতহায়ির বক্তব্যকে উদ্ধৃত করে এই তথ্য জানায় ইরানি বার্তা সংস্থা ইরনা।
তিনি আরও জানান, তাঁর দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার বেড়ে প্রায় ৯৮ শতাংশে ঠেকেছে। এই হার শতভাগে গিয়ে পৌঁছবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাতায়ি জানান, দায়বদ্ধ সব সংস্থাগুলোর সব ধরনের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও গত শিক্ষাবর্ষে (সেপ্টেম্বর ২০১৭ থেকে জুন ২০১৮) দেশটির ১ লাখ ৪২ হাজার শিশু স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে। এবছর ঝরে পড়ার হার বাড়বে না বলে আশা করা হচ্ছে।
‘একই সময়ে আমরা স্কুল থেকে ঝরে পড়া ৩১ হাজার ৯১০ জন শিশুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে সক্ষম হয়েছি’, বলছিলেন বাতহায়ি।
উল্লেখ্য, মাঠ পর্যায়ে সাক্ষরতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখার জন্য এবছর ইরানের লিটারেসি মুভমেন্ট অরগানাইজেশন ইউনেস্কো কনফুসিয়াস লিটারেসি অ্যাওয়ার্ড লাভ করে। এ প্রসঙ্গে বাতহায়ি জানান, সংগঠনটির ‘কনসলিডেটেড টিচিং অব লিটারেসি অ্যান্ড আইসিডিএল বেসিক ক¤িপউটার স্কিলস’ শীর্ষক কর্মসূচির জন্য ২০১৮ ইউনেস্কো পুরস্কার দেয়া হয়েছে।
১৫ (খ) বৈজ্ঞানিক সাময়িকী প্রকাশে ১৫তম অবস্থানে ফারসি ভাষা
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘স্কোপাস ডাটাবেইজ’ এর তথ্যমতে, বিগত ২০ বছরে ফারসি ভাষায় বৈজ্ঞানিক সাময়িকী প্রকাশের সংখ্যা বেড়েছে ৪০ গুণ। যার ফলে বৈজ্ঞানিক প্রকাশনার সংখ্যায় বিশ্বে ১৫তম অবস্থানে উঠে এসেছে ইরানের রাষ্ট্রীয় ভাষাটি।
ইসলামিক ওয়ার্ল্ড সাইন্স সিটেশন সেন্টারের (আইএসসি) প্রেসিডেন্ট মোহাম্মাদ জাভাদ দেহগানি এই তথ্য জানিয়েছেন। ইরানের শিরাজে চলমান ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক ১৩তম আন্তর্জাতিক সম্মেলনের অবকাশে গত ১৪ অক্টোবর তিনি এই তথ্য জানান।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ সিটেশন ডাটাবেজ স্কোপাসের তথ্যমতে, ১৯৯৭ সাল থেকে ২০১৭ সালের শেষ অবধি ফারসি ভাষায় বৈজ্ঞানিক সাময়িকী প্রকাশের সংখ্যা বেড়েছে ৪০ গুণ। এই অগ্রগতির মধ্য দিয়ে বৈজ্ঞানিক প্রকাশনার সংখ্যায় বৈশ্বিক র্যাঙ্কিংয়ে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে দেশটির। ৩০তম অবস্থান হতে অগ্রগতি হয়ে বর্তমানে ১৫তম অবস্থানে রয়েছে ইরান।
দেহগানি জানান, ২০১৭ সালে ফারসি বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮৩৪টিতে। গত ২০ বছরে ফারসি বিজ্ঞান সাময়িকী প্রকাশে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪০ গুণেরও বেশি। অর্থাৎ বিজ্ঞান সাময়িকী প্রকাশে ফারসির বছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৫ শতাংশ।
৫৮টি ভাষার বিজ্ঞান সাময়িকী বিশ্লেষণ করে এই সূচক প্রকাশ করেছে স্কোপাস। এতে দেখা যায়, এসব প্রকাশনার প্রায় ৯০ ভাগই ইংরেজি ভাষার। ইংরেজির পরের অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে চীন, জার্মান, ফরাসি ও ¯েপনিশ ভাষা।
১৫ (গ) অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে অবদান : অ্যাওয়ার্ড পেল ইরান
অসংক্রামক রোগ তথা এনসিডি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক জাতিসংঘ আন্তসংস্থা টাস্ক ফোর্স (ইউএনআইএটিএফ) অ্যাওয়ার্ড লাভ করল ইরান। দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এনসিডি কমিটি এই সম্মাননা লাভ করে। অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে অসামান্য অবদান রাখায় কমিটিকে এই অ্যাওয়ার্ড দেয়া হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) প্রোগ্রাম উপ-মহাপরিচালক সোমিয়া স্বামিনাতান ইরানের এনসিডি কমিটির প্রতিনিধির হাতে এই অ্যাওয়ার্ড তুলে দেন। গত ২৭ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে এনসিডি বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ের তৃতীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকের ফাঁকে অনুষ্ঠিত ‘ফ্রেন্ডস অব দ্যা টাস্ক ফোর্স’ মিটিংয়ে এই সম্মাননা প্রদান করে হু।
ইরানি বার্তা সংস্থা ইরনার খবরে বলা হয়, এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে ভিয়েনায় ইউএনআইএটিএফের দশম বৈঠকে ইউএনআইএটিএফ অ্যাওয়ার্ড দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়। যারা অসংক্রামক রোগ (এনসিডি) প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে অসামান্য অবদান রাখবে তাদের সেই অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ অ্যাওয়ার্ডটি চালুর সিদ্ধান্ত হয়।
সোমিয়া বলেন, বিগত ৪০ থেকে ৫০ বছর যাবৎ স্বচ্ছ পানি, রাস্তাঘাট, শিক্ষা, বিদ্যুৎ ও স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধিতে প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। যার ফলে ইরান এখন চোখের সংক্রামক রোগ নির্মূল হওয়া দেশগুলোর অন্যতম।
উল্লেখ্য, হু এর এনসিডি নির্মূল কার্যক্রমের আওতায় ২০১৫ সালে ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাসান কাজিযাদেহ হাশেমিকে প্রধান করে গঠিত কমিটির নাম দেয়া হয় ন্যাশনাল নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ কমিটি।
১৬ দেশীয় তৈরি সাবমেরিন উন্মোচন করছে ইরান
চলতি ইরানি বছরের শেষ নাগাদ (২১ মার্চ ২০১৯) স¤পূর্ণ দেশীয়ভাবে তৈরি সাবমেরিন উন্মোচন করতে যাচ্ছে ইরান। নবনির্মিত ফাতেহ শ্রেণির এই সাবমেরিনটি স¤পূর্ণভাবে ইরানের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি করা হচ্ছে। সাবমেরিনের পাশাপাশি সামুদ্রিক জাহাজের নবনির্মিত সরঞ্জামও উন্মোচন করবে দেশটি।
ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ম্যারিন ইন্ডাস্ট্রিজ অরগানাইজেশনের মহাপরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল আমির রাসতেগারি এই তথ্য জানিয়েছেন। গত ১১ সেপ্টেম্বর তিনি ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সম্প্রচার মাধ্যম আইআরআইবি নিউজ নেটওয়ার্ককে দেয়া এক সাক্ষাতকারে এই তথ্য জানান।
আমির রাসতেগারি বলেন, ইরানের ভাড়া করা জাহাজে পণ্যপরিবহনের পরিবর্তে নিজস্ব জাহাজ নির্মাণের যে নীতি রয়েছে, সে অনুযায়ী সাবমেরিন নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। দেশীয়ভাবে সামুদ্রিক পণ্যবাহী জাহাজ নির্মাণ করা হচ্ছে। গত বছর দেশটির মেরিটাইম ইন্ডাস্ট্রির হাই কাউন্সিলে এ সংক্রান্ত একটি পরিকল্পনা অনুমোদিত হয়। এ পরিকল্পনা মোতাবেক দেশের চারটি সংশ্লিষ্ট শিল্প প্রতিষ্ঠানে দেড় মিলিয়ন ইউরো ব্যয়ে ১৭৬টি নতুন জাহাজ নির্মাণ করা হচ্ছে।
ইরানি এই কর্মকর্তা আরও জানান, পরিকল্পনা অনুযায়ী, ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মেরিন ইন্ডাস্ট্রিজ অরগাইনাইজেশন ৭০টি জাহাজ নির্মাণে কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে সংস্থাটি সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে এসব জাহাজের নকশা ও উৎপাদন প্রক্রিয়া স¤পন্ন করতে কাজ করে যাচ্ছে বলে জানান আমির রাসতেগারি।
১৭ বছরে বিদ্যুৎ রফতানিতে ইরানের আয় ৪ বিলিয়ন ডলার
ইরান তার প্রতিবেশী দেশগুলোতে গত ৫ বছরে ৪২ হাজার ৯২৬ মিলিয়ন কিলোওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুৎ রফতানি করেছে। এক্ষেত্রে দেশটির আয় ৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। আগামীতে দেশগুলোর সঙ্গে ২৫ থেকে ৩০ বিলিয়ন ডলারের বিদ্যুৎ রফতানি চুক্তি করেছে ইরান। এ চুক্তি থেকে ইরান তার প্রযুক্তি ও কারিগরি আয়ের ৭০ভাগ অর্জন করতে সমর্থ হবে। আযারবাইজান, তুরস্ক, আর্মেনিয়া ও ইরাকে বিদ্যুৎ রফতানি করছে ইরান।
নতুন এই চুক্তি অনুযায়ী শীতকালে আর্মেনিয়া ও আযারবাইজানে বিদ্যুৎ রফতানি করবে ইরান এবং গ্রীষ্মকালে এ দুটি দেশ থেকে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ আমদানি করবে। একই সঙ্গে ইরান তার প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে একটি আঞ্চলিক বিদ্যুৎ সংযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছে। আর্মেনিয়ায় ইরান থেকে তৃতীয় একটি বিদ্যুৎ সংযোগ লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। এজন্যে খরচ হবে ১০৭ মিলিয়ন ডলার।
আগামী বছরে ইরান রাশিয়া, আর্মেনিয়া ও জর্জিয়ায় আরেকটি বিদ্যুৎ সংযোগ লাইন নির্মাণ শেষ করছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইরান রফতানি ছাড়াও বিদ্যুৎ আমদানিতেও শীর্ষস্থানে। ৮০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ইরানের। বিশ্বে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ১৪তম স্থানে রয়েছে দেশটি। ২০২৫ সালে ইরান বিদ্যুৎ খাত থেকে ৩০ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে আগাচ্ছে। এরই মধ্যে ইরানের বিদ্যুৎ শিল্প ৪০টি আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য ও কারিগরি সেবা রপ্তানি করছে। ইরাক ও সিরিয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহে বড় ধরনের কাজ শুরু করেছে দেশটি। এছাড়া তুর্কমেনিস্তান, আফগানিস্তান, আযারবাইজান,আর্মেনিয়া, পাকিস্তান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, শ্রীলংকা, উগান্ডা, নাইজেরিয়া, ইথিউপিয়া, ওমান ও ভারতে ৫৮টি বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে ইরান।
১৮ ইরানের হাতে ৩০টি মহাকাশীয় উপগ্রহের স্লট (ড়ৎনরঃধষ ংষড়ঃ)
গত ৩০ সেপ্টেম্বর ইরানের মহাকাশ সংস্থা জানিয়েছে, বর্তমানে তাদের হাতে ৩০টি জিওস্টেশনারী অরবিটাল স্লট রয়েছে এবং এই ফাঁকা স্লটগুলো ইরান নিজে থেকেই প্রয়োজনীয় স্থাপনার মাধ্যমে পরিপূর্ণ করবে।
ইরানের মহাকাশ সংস্থার প্রধান মোরতাযা বারারি মেহের নিউজকে জানান যে, ৩০-এর অধিক অরবিটাল স্লট ইরানের জন্য নিবন্ধিত রয়েছে।
তিনি আরো জানান, এই মহাকাশীয় ফাঁকা স্থানগুলো একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা পর্যন্ত ইরানের হাতে থাকবে। আবেদনের পর থেকে পরবর্তী সাত বছরের মধ্যে যদি ইরান সেগুলো পূর্ণ করতে না পারে তবে সেগুলো অন্য দেশকে দিয়ে দেয়া হবে।
তিনি বৃহদাকার মহাকাশীয় স্থাপনা স্থাপনের জন্য প্রস্তুতিমূলক কর্মসূচির ব্যাপ্তি ত্বরান্বিত করার ওপর জোর দেন যাতে সরকারি সংস্থা এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নির্ধারিত কক্ষপথগুলোতে কৃত্রিম উপগ্রহ স্থাপন করতে পারে।
তিনি আরো জানান যে, মার্কিন অবরোধ মহাকাশের ওপর ইরানের অধিকারের ওপর কোন রকম প্রভাব ফেলতে পারবে না।
বর্তমানে চুল্লিটির পুনঃনকশা ও আধুনিকীকরণের কাজ চলমান রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগামী বছরের শুরুর দিকে আরাক পানি চুল্লির জন্য সংশ্লিষ্ট সব পার্টস ও সরঞ্জাম নির্মাণের কাজ শুরু হবে।
১৯ এবার ইউনেস্কোর কনফুসিয়াস পুরস্কার গেল ইরানে
গ্রাম পর্যায়ে সাক্ষরতা বৃদ্ধি ও দক্ষতা উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখায় এ বছর ‘ইউনেস্কো কনফুসিয়াস লিটারেসি অ্যাওয়ার্ড ২০১৮’ পেল ইরানের সাক্ষরতা আন্দোলন সংস্থা (লিটারেসি মুভমেন্ট অরগানাইজেশন)। ‘কনসলিডেটেড টিচিং অব লিটারেসি’ ও ‘আইসিডিএল’ শীর্ষক দুই কর্মসূচির জন্য এই পুরস্কার লাভ করল সংস্থাটি। প্রতি বছর বিশ্ব সাক্ষরতা দিবস উপলক্ষে এ অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়।
গত ৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ব সাক্ষরতা দিবসের একদিন আগে প্যারিসে ইউনেস্কো’র সদর দফতরে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এ পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। ইউনেস্কোর বিশ্ব সাক্ষরতা দিবসের এই অনুষ্ঠানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ২শ অংশগ্রহণকারী যোগ দেয়। যারা বিশ্বব্যাপী সাক্ষরতা বৃদ্ধি ও দক্ষতা বিকাশ নিয়ে কাজ করে চলেছেন।
এ বছর সাক্ষরতা বৃদ্ধি ও দক্ষতা উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখায় ইরান,আফগানিস্তান, নাইজেরিয়া, ¯েপন ও উরুগুয়ের সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলো এই পুরস্কার লাভ করল। পাঁচ দেশের পাঁচ বিজয়ীর প্রত্যেকেই অ্যাওয়ার্ড হিসেবে একটি ক্রেস্ট,সার্টিফিকেট ও ২০ হাজার মার্কিন ডলার পেয়েছে।
চীন সরকারের সহায়তায় ইউনেস্কোর কনফুসিয়াস সাক্ষরতা পুরস্কার ২০০৫ সালে চালু হয়। এর উদ্দেশ্য হলো নিরক্ষরতা দূরীকরণে লক্ষ্যণীয় কৃতিত্ব অর্জনকারী ব্যক্তি,সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার প্রশংসা করা।
২০ হেগ শহরে ইরানের হস্তশিল্পের প্রদর্শনী
গত ৯ সেপ্টেম্বর নেদারল্যান্ডের হেগ শহরের মিউনিসিপ্যাল জাদুঘরে ইরানের ১০০টি হস্তনির্মিত সামগ্রী প্রদর্শিত হয়েছে। ‘ঐশ্বর্য এবং নান্দনিকতা- ইসলামি বিশ্বের শিল্প’ শীর্ষক প্রদর্শনীটি গত ৮ সেপ্টেম্বর হেগ শহরে শুরু হয় যেখানে উপস্থিত ছিলেন নেদারল্যান্ডে ইরানের রাষ্ট্রদূত আলিরেযা জাহাঙ্গীরী এবং হেগের মেয়র পাউলিনা ক্রিকে। ২০১৯ সালের মার্চ মাসের ৩ তারিখ প্রদর্শনীটি শেষ হবে।
৯০০-১৯০০ খ্রিস্টীয় সময়কালের ৩০০টি বস্তুসামগ্রী এখানে প্রদর্শিত হয় যার মধ্যে ১০০টি ছিল ইরানের।
হেগের পৌর জাদুঘরটি একটি শিল্প জাদুঘর, যেটা তৈরি করেন ডাচ স্থাপত্যশিল্পী বারলার্জ। এখানে রয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম মন্ড্রিয়ান আর্ট (সড়হফৎরধহ) এর সংগ্রহ।
জাদুঘরটির ওয়েবসাইট অনুযায়ী, ‘ঐশ্বর্য এবং নান্দনিকতা’ শীর্ষক প্রদর্শনীটি ইসলামি বিশ্বের বিভিন্ন শিল্পবস্তুকে এক জায়গায় করেছে। প্রদর্শনীটি অত্যন্ত জাঁকজমকের মাঝে নজর দিচ্ছে মুসলিম শিল্প ধারার আলঙ্কারিক সৌন্দর্য এবং এগুলোর পেছনের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং কারুশিল্পের দিকে।
ইসলামি জগতের শিল্পে আলঙ্কারিক সৌন্দর্য খুব বিস্তারিতভাবে ফুটে উঠেছে। এ সমৃদ্ধ শিল্পে একটি ধর্মীয় চেতনাবোধ বিদ্যমান; বিশ্বাসিগণকে মৃত্যুর পরে তাদের জন্য অপেক্ষারত জগতের সৌন্দর্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। ইসলামি জগতের মৌলিক এবং ইতিবাচক প্রতীকগুলোর জট খুলে দেয়। এভাবে প্রদর্শনীটি ইসলামি জগতের কারিগরদের একটি গীতিকাব্যে পরিণত হয়। প্রাচীন শিল্প যেমন কাচ-এর গোলক বানিয়ে সেটাকে অলংকৃত করা, কাঠ খোদাই, ক্যালিগ্রাফি, গালিচার ওপর ডিজাইন ইত্যাদি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং এগুলোর পেছনের পৃষ্ঠপোষকতার ইতিহাস উন্মোচিত করে।
প্রায় ২০০টি ইরানি এন্টিক সামগ্রী ইরানের জাতীয় জাদুঘর থেকে নিয়ে নেদারল্যান্ডের ড্রেন্টস মিউজিয়ামে প্রদর্শিত হচ্ছে। প্রদর্শনীটির নাম দেয়া হয়েছে ‘সভ্যতার জন্মভূমি’। শুরু হয়েছে জুনের সাত তারিখ থেকে এবং চলবে নভেম্বরের ১৮ তারিখ পর্যন্ত।
ইরানের সাস্কৃতিক ঐতিহ্য, হস্তশিল্প এবং পর্যটন বিষয়ক সংস্থার প্রধান আলি আজগার মৌনিসান জানান ৩০০টি ডাচ এন্টিক সামগ্রী নিয়ে তেহরানভিত্তিক জাতীয় জাদুঘরে শীঘ্রই একটি প্রদর্শনী হবে।
২০ (খ) ভিয়েনার আলবার্টিনা জাদুঘরে ইরানের ছবি
অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় আলবার্টিনা জাদুঘরে ইরানের বেশ কয়েকটি ছবি প্রদর্শিত হয়। এ প্রদর্শনী ২ অক্টোবর শুরু হয়ে ৭ অক্টোবর পর্যন্ত চলে। অন্তত ৮০টি ইরানি ছবি দর্শকদের নজর কাড়ে। ইরানের বর্তমান জীবনযাত্রার ওপর ভিত্তি করে তোলা হয়েছে এসব ছবি। ২০১৭ সালে ইরানে বেড়াতে এসেছিলেন ৬৬ বছর বয়স্ক প্রখ্যাত ফটোগ্রাফার আলফ্রেড সেইল্যান্ড। তাঁরই হাতে তোলা এসব ছবি। ইরানের বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থাপনার ছবিও তোলেন তিনি।
ইরানের কেরমান প্রদেশের বাম শহরে আরগ-ই বাম ভবনের ছবি তোলেন আলফ্রেড সেইল্যান্ড। ২০০৩ সালে ভবনটি ভূমিক¤েপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ইউনেস্কো আরগ-এ বামকে আগেই বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে।
আলফ্রেড সেইল্যান্ড এর আগে যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি ও অস্ট্রিয়ার বিভিন্ন শহরের ছবি তুলে বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হন। সেসব ছবিও ভিয়েনার এ প্রদর্শনীতে স্থান পায়।
২১ ইনফরমেটিক্স অলি¤িপয়াড : ৪ মেডেল জিতল ইরানি শিক্ষার্থীরা
জাপানে ক¤িপউটার প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা আন্তর্জাতিক ইনফরমেটিক্স অলি¤িপয়াডে (আইওআই) অংশ নিয়ে ৪টি মেডেল জয় করে ইরানের তরুণ ক¤িপউটার বিজ্ঞানীরা। আইওআই এর এবারের ৩০তম আসর থেকে এসব পদক লাভ করে দেশটির চার শিক্ষার্থী। ২০১৮ আন্তর্জাতিক ইনফরমেটিক্স অলি¤িপয়াড জাপানের সুকুবায় ১ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয়।
এতে বিশ্বের ৮৫টি দেশ থেকে ৯ শতাধিক ক¤িপউটার বিজ্ঞানী অংশ নেয়।
চার সদস্যবিশিষ্ট ইরানি টিম ইনফরমেটিক্স অলি¤িপয়াডে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে চারটি মেডেল জয় লাভ করতে সক্ষম হয়। ইভেন্টে দেশটির পক্ষে স্বর্ণপদক জিতেছে মোহাম্মাদ মাহদাবি। রৌপ্যপদক জিতেছে কেইভান রেজায়ি ও মেহরদাদ সাবেরি। ব্রোঞ্জপদক ঘরে তুলেছে সৈয়দ মাহদি সাদেঘ শোবেইরি।
আন্তর্জাতিক গণিত অলি¤িপয়াডের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম অলি¤িপয়াড হিসেবে বিবেচনা করা হয় আন্তর্জাতিক ইনফরমেটিক্স অলি¤িপয়াডকে (আইওআই)। প্রতি বছর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণে এই ক¤িপউটার প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। ইনফরমেটিক্স অলি¤িপয়াডের আগের আসরের আয়োজক ছিল ইরান। ওই আসরে ১টি স্বর্ণ ও তিনটি রৌপ্যপদক জয় লাভ করে জাপান, চীন ও রাশিয়ার পর চতুর্থ অবস্থান দখল করে দেশটি। আইওআই এর
আগামী আসর বসবে আযারবাইজানে।
২২ বিশ্ব জুনিয়র দাবা প্রতিযোগিতায় ইতিহাস গড়লো ইরানের মাঘসুদলু
গত ১৫ সেপ্টেম্বর ইরানি গ্রান্ডমাস্টার পারহাম মাঘসুদলু ফিদে বিশ্ব জুনিয়র দাবা চ্যা¤িপয়নশিপ ২০১৮-তে বিজয়ী হওয়ার মধ্য দিয়ে নতুন ইতিহাস রচনা করেছেন। প্রতিযোগিতার দশম রাউন্ডে রাশিয়ার ম্যাক্সিম ভাভুলিনকে হারিয়ে দুই রাউন্ড বাকি থাকতেই ট্রফি নিজের করে নেন মাঘসুদলু। তবে তিনি যদি উক্ত রাউন্ডে ড্রও করতেন তারপরেও তা পদক জয়ের জন্য যথেষ্ট ছিল। এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো কোন ইরানি এ সম্মানজনক পদক অর্জন করলেন।
১৮ বছর বয়সী এই দাবাড়– ১০ এর মধ্যে ৯.৫ পয়েন্ট লাভ করেন যা ছিল নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে দু’পয়েন্ট বেশি। ইরানি এই দাবাড়–কে ‘পারস্যের জাদুকর’ আখ্যা দিয়ে প্রতিযোগিতার অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে লেখা হয়, নিঃসন্দেহে আমরা একজন বিরাট প্রতিভাধারীর সম্মুখীন হয়েছি এবং নিশ্চিতভাবে আসন্ন দিনগুলোতে দাবার অভিজাত বৃত্তে সে জায়গা করে নেবে।
ফিদে বিশ্ব জুনিয়র দাবা প্রতিযোগিতা ২০১৮ সেপ্টেম্বরের চার তারিখ তুরস্কের কোকায়েলী প্রদেশের গেবযে শহরে শুরু হয়।
২৩ ইরানের রোলার হকি স্কেটারদের এশিয়া সেরার মর্যাদা অর্জন
গত ১৩ সেপ্টেম্বর জাপানকে ৬-১ গোলে হারিয়ে ইরানের জাতীয় রোলার ইনলাইন হকি দল ১৮তম এশীয়ান ইনলাইন রোলার স্কেটিং প্রতিযোগিতায় বিজয়ীর শিরোপা অর্জন করেছে। ইরানি পুরুষ ইনলাইন হকি দল তাদের জাপানি প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে প্রথমবারের মত স্বর্ণপদক অর্জন করে।
১৮তম এশীয়ান রোলার স্কেটিং প্রতিযোগিতা দক্ষিণ কোরিয়ার নামওন শহরে গত ৭ সেপ্টেম্বর শুরু হয় এবং ১২ সেপ্টেম্বর শেষ হয়।
ফাইনালের আগে ইরানি দল দক্ষিণ কোরিয়া এবং সিঙ্গাপুর দলকে পরাজিত এবং চাইনিজ তাইপের সাথে ড্র করে। ইরানি মহিলা দল ব্রোঞ্জপদক অর্জন করে।
১৯টি দেশ থেকে প্রায় এক হাজার স্কেটার এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেন।
২৪ (ক) এশিয়ান গেমসের ভলিবলে স্বর্ণ জিতল ইরান
ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসের ভলিবলে দক্ষিণ কোরিয়াকে হারিয়ে স্বর্ণপদক লাভ করে ইরানের পুরুষ ভলিবল দল। এশিয়ান গেমসে ইরান ২০টি স্বর্ণ, ২০টি রৌপ্য এবং ২২টি ব্রোঞ্জ জিতে পদক তালিকার ষষ্ঠ স্থান অর্জন করে।
গত ১ সেপ্টেম্বর ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তার জিবিকে স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ভলিবলের ফাইনালে দক্ষিণ কোরিয়ার মুখোমুখি হয় ইরান। ফাইনাল ম্যাচে প্রতিপক্ষকে পরপর তিন সেটে পরাজিত করে স্বর্ণপদক ঘরে তোলে দেশটির ভলিবল খেলোয়াড়রা।
জাকার্তায় ফাইনালে দুর্দান্ত পারফরর্ম করে ইরানি স্কোয়াড। পরপর তিন সেটে যথাক্রমে ২৫-১৭, ২৫-২২ ও ২৫-২১ পয়েন্টের ব্যবধানে দক্ষিণ কোরিয়াকে মাঠ ছাড়া করে। এর মধ্য দিয়ে এশিয়ান গেমস ভলিবল প্রতিযোগিতার দ্বিতীয় স্বর্ণপদক ঘরে তোলে ইরান।
এরআগে এশিয়ান গেমসের ভলিবলের সেমি ফাইনালে কাতারকে পরাজিত করে ইরান। ভলিবলে প্রথম তিন ম্যাচে পাকিস্তান, মঙ্গোলিয়া ও চীনের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয় ঘরে তোলে ইরানি দিল।
২৪ (খ) এশিয়ান প্যারা গেমসে ইতিহাস গড়ল ইরান
২০১৮ এশিয়ান প্যারা গেমসে ইতিহাস গড়ে প্রথমবারের মতো ৫১টি স্বর্ণপদক জেতেন ইরানি অ্যাথলেটরা। এসব পদক জয়ের মধ্য দিয়ে প্যারা গেমসে এই প্রথম তৃতীয় স্থান অর্জন করল দেশটি। ‘উই ক্যান ডু ইট উইথ ট্রাস্ট অ্যান্ড ইফোর্ট’ (আস্থা ও প্রচেষ্টায় এটা করতে পারি আমরা) ¯ে¬াগানে ৬ অক্টোবর শুরু হওয়া গেমসটির পর্দা নামে ১৪ অক্টোবর।
ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় অনুষ্ঠিত এশিয়া প্যারা গেমসে ইরান থেকে ২০৯ জন প্যারা-অ্যাথলেট অংশ নেন। ৫১টি স্বর্ণ, ৪২টি রৌপ্য ও ৪৩টি ব্রোঞ্জপদকসহ তাঁরা মোট ১৩৬টি মেডেল জেতেন। এসব পদক জয়ের মধ্য দিয়ে ইরানি অ্যাথলেটরা জাপান, উজবেকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে ফেলে পদক তালিকায় তৃতীয় স্থান দখল করে।
ইরানের জন্য সবচেয়ে বেশি পদক এনে দিয়েছেন দেশটির প্যারা-অ্যাথলেটরা। তাঁরা জিতেছেন ২৭টি স্বর্ণ, ২৫টি রৌপ্য ও ২৯টি ব্রোঞ্জ মেডেল। টিমের সামগ্রিক পারফরমেন্সে যা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
এবারের প্যারা গেমসের আসর থেকে ইরানের পক্ষে সর্বোচ্চ পদক জিতেছেন সাঁতারু শাহিন ইজাদাইর। তিনি একাই ছয়টি স্বর্ণ ও একটি রৌপ্যপদক জয় করেন। ইভেন্টের সেরা অ্যাথলেট হিসেবে তাঁর নাম ঘোষণা করা হয়।
তবে বরাবরের মতো এবারও এশিয়া প্যারা গেমসের শিরোপা ঘরে তুলেছে চীন। দেশটি ১৭১টি স্বর্ণ, ৮৮টি রৌপ্য ও ৫৯টি ব্রোঞ্জপদক সহ মোট ৩১৯টি পদক জয় লাভ করে। অন্যদিকে, দক্ষিণ কোরিয়া মোট ১৪৫টি পদক জিতে রানার্স-আপ হওয়ার গৌরব অর্জন করে।
২৫ দ্বিতীয়বারের মতো জুনিয়র ওয়ার্ল্ড চ্যা¤িপয়ন ইরান
জুনিয়র ওয়ার্ল্ড চ্যা¤িপয়নশিপের শিরোপা জিতল ইরান। ৪টি স্বর্ণ ও ২টি ব্রোঞ্জপদক এবং সর্বমোট ১৩৬ পয়েন্ট সংগ্রহের মধ্য দিয়ে শিরোপা ঘরে তুলল দেশটির গ্রেকো-রোমান টিম। এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো জুনিয়র ওয়ার্ল্ড চ্যা¤িপয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করল দেশটি।
চ্যা¤িপয়নশিপের ফাইনাল ম্যাচে ৭২ কেজি ওজন শ্রেণিতে জর্জিয়ার প্রতিপক্ষ নিকোলোজ শিকাইদজেকে পরাজিত করেন ইরানের আমিন ইয়াভার কাভিয়ানিনেজাদ। দুর্দান্ত পারফরমেন্সের মাধ্যমে সোনার মেডেল ঘরে তোলেন তিনি। ৬০ কেজি ওজন শ্রেণিতে ব্রোঞ্জপদকের লড়াইয়ে ইউক্রেনের ইহোর কুরোচকিনকে পরাজিত করেন ইরানের আলিরেজা নেজাতি। অন্যদিকে, ভারতের বিজয়কে হারিয়ে স্বর্ণপদক ঘরে তোলেন তুরস্কের কেরেম কামাল।
ইরানের পক্ষে দ্বিতীয় ব্রোঞ্জপদক জয় করেন ইউসেফ হোসেইনভান্দ। তিনি মিশরীয় প্রতিপক্ষ মোহামেদ এলসায়েদকে পরাজিত করে এই পদক জিতেন। এই বিভাগে স্বর্ণপদক জিতেন আরমেনিয়ার মালখাস আমোয়ান। তিনি উজবেকিস্তানের মাখমুদকে পরাজিত করেন।
এর আগে মঙ্গলবার দেশের জন্য তিন-তিনটি স্বর্ণপদক এনে দেন ইরানের পুয়া নাসেরপুর, মোহাম্মাদ সারাভি ও আমিন মিরজাজাদেহ। ফারসি স্কোয়াড মোট ১৩৬ পয়েন্ট সংগ্রহের মধ্য দিয়ে জুনিয়র ওয়ার্ল্ড চ্যা¤িপয়নশিপের গ্রেকো-রোমান ইভেন্টে চ্যা¤িপয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। চ্যা¤িপয়নশিপে রাশিয়া ১৩১ পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয় ও আরমেনিয়া ৮৩ পয়েন্ট নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে।
¯ে¬াভাকিয়ার ত্রানাভায় ১৭ সেপ্টেম্বর জুনিয়র ওয়ার্ল্ড চ্যা¤িপয়নশিপের পর্দা ওঠে। টুর্নামেন্টের পর্দা নামে ২৩ সেপ্টেম্বর।
২৬ ইরান থেকে অস্কারে যাচ্ছে ‘নো ডেট, নো সিগনেচার’
২০১৯ অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড তথা অস্কারের ৯১তম আসরে ইরানের প্রতিনিধিত্ব করবে ‘নো ডেট, নো সিগনেচার’। ভাহিদ জলিলভান্দ পরিচালিত চলচ্চিত্রটি অস্কারের বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে লড়বে। বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এই চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণের জন্য ছবিটিকে নির্বাচিত করেছে ইরানের ফারাবি সিনেমা ফাউন্ডেশন। চলচ্চিত্রটি নিয়ে এবারের অস্কার জয়ের বিষয়ে আশাবাদী দেশটির সিনেমা কর্তৃপক্ষ।
ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন অবরোধের প্রতিবাদে ২০১৯ অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড বয়কটের ঘোষণা দিয়েছিল ফারাবি ফাউন্ডেশন। তা সত্ত্বেও ফাউন্ডেশন কেন এতে অংশ নিচ্ছে জানতে চাইলে কর্তৃপক্ষ বলেন, ‘অ্যাকাডেমিটি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং এটি আমেরিকার সিনেমাজগতের সাথে সংশ্লিষ্ট।’
অস্কারের ৯১তম আসরের বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে ইরানের পাঠানো ছবিটি সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ২০তম ইরান সিনেমা সেলেব্রেশনে অংশ নেয়। চলচ্চিত্রটি এই উৎসবে একাধিক পুরস্কার লাভ করে চমক লাগাতে সক্ষম হয়। ছবিটি একাধারে সেরা পরিচালক, সেরা চলচ্চিত্র, সেরা স্ক্রিপ্ট এবং সেরা সহ-অভিনেত্রী ও সেরা অভিনেতা অ্যাওয়ার্ড লাভ করে।
চলচ্চিত্রটির গল্প এগিয়ে গেছে নারিমান নামের এক ফরেনসিক বিশেষজ্ঞকে নিয়ে যার গাড়ির সঙ্গে সংঘর্ষে এক মোটরসাইকেল আরোহীর আট বছর বয়সী সন্তান আহত হয়। নারিমান তাকে নিকটস্থ হাসপাতালে নিতে চাইলেও শিশুটির পিতা নারিমানের কোন ধরনের সাহায্য নিতে অস্বীকৃতি জানায়।
পরদিন সকালে হাসপাতালে গিয়ে নারিমান আবিষ্কার করেন, সন্দেহজনকভাবে মৃত্যুর পর আগের দিনের দুর্ঘটনায় শিশুটির লাশ আনা হয়েছে ময়না তদন্তের জন্য।
এর আগে ইরান অস্কারের বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে ২০১৭ সালে ‘দ্যা সেলসম্যান’ এবং ২০১২ সালে ‘এ সেপারেশন’ ছবির জন্য অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড লাভ করে। অস্কারজয়ী দুটি ছবিই পরিচালনা করেছেন প্রশংসিত ইরানি চলচ্চিত্র নির্মাতা আসগার ফারহাদি।
২৭ ঢাকায় ইরানি চলচ্চিত্র প্রদর্শনী ৩ নভেম্বর শুরু
রাজধানী ঢাকায় আগামী ৩ নভেম্বর থেকে শুরু হতে যাচ্ছে ৪ দিনব্যাপী ইরানি চলচ্চিত্র উৎসব। ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির যৌথ উদ্যোগে এই চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হচ্ছে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালায় আগামী ৩ নভেম্বর শনিবার বিকেল ৪ টায় এক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এই প্রদর্শনী শুরু হবে এবং এই প্রদর্শনী চলবে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে একটি চলচ্চিত্র দেখানো হলেও ৪ নভেম্বর থেকে ৬
নভেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ১১ টা থেকে ১ টা এবং বিকেল ৩ টা থেকে ৫ টা পর্যন্ত দুটি করে চলচ্চিত্র দেখানো হবে। এই চলচ্চিত্র দেখার জন্য কোন টিকিটের প্রয়োজন হবে না।
এদিকে, ৯ নভেম্বর থেকে দেশের ৩টি বিভাগীয় শহরে শুরু হতে যাচ্ছে ইরানি চলচ্চিত্র প্রদর্শনী। চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা শহরের শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে ৫ দিনব্যাপী এই প্রদর্শনীর আয়োজন করা হচ্ছে। ১৩ই নভেম্বর পর্যন্ত এই প্রদর্শনী চলবে।
ইসলামি বিপ্লবী গণবাহিনীর উদ্দেশে ভাষণে রাহ্বার
যুবকরাই হচ্ছে দেশের সমস্যাবলির সামাধান
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ্ উযমা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী বলেন, ইনশাআল্লাহ্, ইরানি জনগণ নিষেধাজ্ঞা ব্যর্থ করে দিয়ে আমেরিকার গালে আরেকটি চপেটাঘাত হানবেন। তিনি গত ৪ অক্টোবর (২০১৮) ইসলামি বিপ্লবের গণবাহিনী (বাসীজ্)-এর সদস্যদের উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে এ মন্তব্য করেন।
তেহরানের আযাদী স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত বাসিজের এ জমকালো সমাবেশে প্রদত্ত এ ভাষণে ইসলামি বিপ্লবের রাহ্বার প্রথমে যুব সমাজের গুরুত্ব তুলে ধরেন; তিনি বলেন, যুবকরাই হচ্ছে দেশের সমস্যাবলির সমাধান। এরপর তিনি চলমান সংবেদনশীল পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করেন।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, আমেরিকানরা হৈচৈ ও চিৎকার করে এবং হাল্কা কথাবার্তা বলে ও ভিত্তিহীন ধারণা প্রকাশের মাধ্যমে স্বীয় শক্তি ও ক্ষমতা সম্পর্কে এবং ইরানের অবস্থা সম্পর্কে প্রকৃত অবস্থার সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু বিশাল যুব শক্তি সহ মহান ইরানি জনগণ জানেন যে, ইনশাআল্লাহ্, তাঁরা দুশমনের সর্বশেষ অপকৌশল অর্থাৎ নিষেধাজ্ঞা ব্যর্থ করে দিয়ে আমেরিকার গালে আরেকটি চপেটাঘাত হানবেন।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের লক্ষ লক্ষ বাসীজ সদস্যের মধ্য থেকে প্রতিনিধিত্বমূলক অংশগ্রহণকারীদের দ্বারা লক্ষাধিক দর্শক-শ্রোতা ধারণক্ষমতার অধিকারী আযাদী স্টেডিয়াম পরিপূর্ণকারী এ সমাবেশের উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণের শুরুর দিকে ইসলামি বিপ্লবের রাহ্বার কারবালার ঘটনাকে অমর করে রাখার ক্ষেত্রে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর মহান ভগ্নি হযরত যায়নাব (সালামুল্লাহি আলাইহা) ও পুত্র হযরত ইমাম যায়নুল্ আবেদীন (আ.)-এর জ্যোতির্ময় ও গৌরবময় ভূমিকার কথা সংক্ষেপে তুলে ধরেন এবং অচিরেই যে কারবালার ঘটনার চল্লিশতম স্মরণ দিবস (র্আবা‘ঈনে হুসাইনী) পালিত হতে যাচ্ছে সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ইরানি জনগণ, ইরাকি জনগণ ও আরো অনেক দেশের মুসলিম জনগণের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে প্রতি বছর কারবালার যে গৌরবময় ঘটনার চল্লিশতম স্মরণ দিবস পালিত হয়ে থাকে তা একটি অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়- আল্লাহ্ তা‘আলার অনুগ্রহে ও ইসলামি জাহানের বিরাট প্রয়োজনের এ মুহূর্তে তা যথাযথ রূপ লাভ করেছে।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা তাঁর ভাষণে বিশ^ভূক ও বলদর্পী আমেরিকার সরকারি কর্মকর্তাদের হৈচৈ ও চিৎকার, ঈমানদার যুব সমাজের শক্তির প্রদর্শনী, বিভিন্ন অঙ্গনে এ যুবকদের উপর্যুপরি বিজয়, একই সাথে অর্থনৈতিক সমস্যাবলি ও জনগণের বিরাট অংশের জীবন যাপন কঠিন হয়ে পড়া এবং এ ব্যাপারে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ববর্গের সংবেদনশীলতা ও এ সব সমস্যার দ্রুত সমাধান উদ্ভাবনের লক্ষ্যে তাঁদের ব্যাপক প্রচেষ্টাকে দেশের সংবেদনশীল পরিস্থিতির বিভিন্ন দিক বলে অভিহিত করেন ও এ সব দিকের ওপর আলোকপাত করেন ।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী ইরানের বিরাটত্ব ও মহানত্ব, ইসলামি প্রজাতন্ত্রের শক্তিমত্তা ও ইরানি জাতির অপরাজেয়তাকে তিনটি অনস্বীকার্য বাস্তবতা হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, এগুলো কোনো আত্মগৌরবের স্তুতি নয়, বরং এগুলো হচ্ছে এমন সব বাস্তবতা দুশমনরা কামনা করে ইরানি জনগণ যেন এগুলো জানতে না পারেন বা এ ব্যাপারে উদাসীন থাকেন যাতে তাঁরা দেশের পরিস্থিতি ও নিজেদের শক্তি-সামর্থ্য সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার কবলে নিক্ষিপ্ত হন।
ইসলামি বিপ্লবের রাহ্বার এ তিনটি বাস্তবতার ব্যাখ্যা প্রদান করতে গিয়ে ইরানের বিরাটত্ব ও মহানত্বকে একটি ঐতিহাসিক সত্য বলে উল্লেখ করেন এবং বলেন, ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের পূর্ববর্তী দুই শতাব্দী কালের (অর্থাৎ কাজার বংশের শাসনামলের মাঝামাঝি সময় হতে শুরু করে পাহ্লাভী রাজবংশের পতনকাল পর্যন্ত) ব্যতিক্রম বাদে আমাদের প্রিয় দেশ ইরান বিভিন্ন দিক থেকে মুসলিম জাতি সমূহের শীর্ষে ছিল, এমনকি বিভিন্ন সময় বিশে^র সমস্ত জাতির শীর্ষে ছিল।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতা বলেন যে, ইসলামি প্রজাতন্ত্রের শক্তিমত্তা প্রমাণের জন্য ব্রিটেন ও আমেরিকার যুলুম মূলক আধিপত্য থেকে ইরানের মুক্তিলাভই যথেষ্ট। তিনি বলেন, স্বৈরাচারী একনায়কতান্ত্রিক ও উত্তরাধিকারভিত্তিক রাজতান্ত্রিক শাসনের কবল থেকে ইরানি জাতির মুক্তিলাভ বিগত চল্লিশ বছর যাবত সমস্ত ষড়যন্ত্রের মোকাবিলায় রুখে দাঁড়ানো এবং মধ্যপ্রাচ্যে ও বিশ^ অঙ্গনে গ্রহণযোগ্যতা ও সম্মান বৃদ্ধি- এগুলো হচ্ছে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের শক্তিমত্তার অন্যান্য দৃষ্টান্ত।
তিনি আরো উল্লেখ করেন, ইরানের ইসলামি সরকার আট বছরব্যাপী চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে বিশাল রণাঙ্গনে দুশমনদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হয় এবং দেশের ভূখ-ের অখ-তা রক্ষা করতে সক্ষম হয়, আর এভাবে বিগত কয়েক শতাব্দীর মধ্যে প্রথম বারের মতো দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যে, ইরান সরকার হানাদার দুশমনদেরকে আমাদের প্রিয় স্বদেশের ভূখ- থেকে কোনো অংশকে বিচ্ছিন্ন করার সুযোগ দেবে না বা ইরানের বুকে দুশমনদের সামরিক উপস্থিতির মাধ্যমে ইরানি জাতিকে ছোট ও তুচ্ছ করার অনুমতি দেবে না।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী ইরানি জাতির অপরাজেয়তা ইসলামের বরকতে সম্ভব হয়েছিল বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, এ মহান জাতির অপরাজেয়তা ইসলামি বিপ্লবের বিজয়, চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে পবিত্র প্রতিরক্ষা এবং বিগত চল্লিশ বছর যাবত বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মধ্যে প্রত্যক্ষ করা যেতে পারে। কারণ, এ জাতি দুশমনের ষড়যন্ত্র সমূহ ও বিভিন্ন পদক্ষেপের মোকাবিলায় কখনোই দুর্বলতা ও ক্লান্তি অনুভব করে নি এবং পশ্চাদপসরণ করে নি।
ইসলামি বিপ্লবের রাহ্বার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক অঙ্গনে ‘দম্ভ ও অহঙ্কার’কে বিজয়ের জন্য ‘মহামারী’তুল্য বলে অভিহিত করেন এবং তিনি অহঙ্কারী হওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য সকলকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, আমরা যদি অহঙ্কারী হই তাহলে তা আমাদেরকে আমলহীনতা, উদ্ভাবনীহীনতা ও পরিকল্পনা বিহীনতার দিকে টেনে নিয়ে যাবে এবং তাহলে তা দুশমনের বিজয়ের কারণ হবে।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেন, আমরা এখনো পথের শুরুর দিকে আছি, সুতরাং আমাদেরকে পথের সাথে পরিচিতি, চেষ্টা-সাধনা, সাহসিকতা, সুষ্ঠু চিন্তা-ভাবনা ও উপায়-উপকরণের সঠিক ব্যবহার সহকারে পথচলা অব্যাগত রাখতে হবে এবং ইরানি জাতি ও ইসলামি বিপ্লবের অভীষ্ট লক্ষ্যে উপনীত হতে হবে। তিনি বিগত চার দশক কালের বিবর্তনে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের যুব সমাজ যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে তার ওপর আলোকপাত করেন এবং বলেন, প্রিয় যুবকরা! তোমরা জেনে রেখ যে, তোমরা হচ্ছ এ মহান জাতির বিরাট অগ্রযাত্রায় একটি তীরের জন্য তার তীক্ষè ফলা সমতুল্য; তোমাদেরকে পথ উন্মুক্ত করে দিতে হবে। অভিজ্ঞ ও পরীক্ষিত বৃদ্ধরা যদি ক্লান্ত-শ্রান্ত, কিংকর্তব্যবিমূঢ় ও অকর্মণ্য হয়ে না পড়েন তো তাঁরা তোমাদেরকে সঠিক পথনির্দেশ প্রদান করতে সক্ষম হবেন, কিন্তু ট্রেনযাত্রাতুল্য এ অভিযাত্রায় তোমরা হচ্ছ ট্রেনকে সামনে এগিয়ে নেয়ার ইঞ্জিন সমতুল্য।
ইরানি যুব সমাজ ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের পূর্বে খোদাদ্রোহী শক্তি (ত্বাগূত্)-এর বিরুদ্ধে জিহাদে এবং বিপ্লবের বিজয়কালে ও বিপ্লবের বিজয় পরবর্তী প্রথম দিককার কয়েক বছরে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে জিহাদে যে ভূমিকা পালন করে এবং দেশ গড়ার জিহাদে, (ইরানি বর্ষপঞ্জির) ১৩৬০-এর দশকের (১৯৮১-১৯৯০) প্রথম দিককার কয়েক বছরে মুনাফিকদের ও বিশ^াসঘাতক দেশদ্রোহীদের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিহাদে ও শত্রুর চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের পুরো সময়ে, যুদ্ধোত্তর কালে যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যাওয়া সবকিছুর পুনর্নির্মাণের প্রচেষ্টায়, সত্তরের দশকে (১৯৯১-২০০০) দুশমনদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মোকাবিলায় সাংস্কৃতিক জিহাদে ও আশির দশকের (২০০১-২০১০) শুরুর দিককার বিজ্ঞানের উৎকর্ষের জিহাদে ও উল্লম্ফন মূলক প্রচেষ্টায় অংশগ্রহণ করে যে বিরাট খেদমত আঞ্জাম দিয়েছে তার উল্লেখ করে হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী আরো বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতেও তাকফিরি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে জিহাদের ক্ষেত্রেও ইরানি যুব সমাজ অগ্রগামী ছিল। বর্তমানেও যুবকরা মহান লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সহকারে ও কর্তব্যবোধ সহকারে দেশের অর্থনৈতিক সমস্যাবলির সমাধানের লক্ষ্যে চৈন্তিক জিহাদে ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের জিহাদে পরিপক্ব ও সমাধান মূলক বিভিন্ন প্রস্তাব প্রদান করছে।
ইসলামি বিপ্লবের রাহ্বার ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে যুব সমাজের হাজার হাজার সমাজ কল্যাণ মূলক গ্রুপের পক্ষ থেকে দেশের জন্য, বিশেষ করে সমাজের দুর্বল শ্রেণির লোকদের জন্য যে সীমাহীন খেদমত আঞ্জাম দেয়া হচ্ছে তাকে এ জাতির জন্য এক বিরাট পুঁজি হিসেবে উল্লেখ করেন এবং বলেন, এটা আমাদেরকে উন্নততর ভবিষ্যতের সুসংবাদ দিচ্ছে। তিনি যুবসমাজকে দেশের মালিক বলে অভিহিত করেন এবং বলেন, কতক লোক ধারণা করছে যে, আমি কতক যুবকের বিভ্রান্ত ও পথচ্যুত হওয়া সম্পর্কে অবগত নই। কিন্তু এ ধরনের যুবকরা সংখ্যায় খুবই নগণ্য। আর আমি যে যুব সমাজের প্রশংসা করছি তা এ জাতীয় সমস্যাবলি সম্পর্কে যথেষ্ট জেনেশুনেই করছি।
যুবসমাজ যে, দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের ভাগ্য নির্ধারণকারী এ বিষয়টির প্রতি যারা দৃষ্টি দেয় না বা গুরুত্ব দেয় না তাদের সমালোচনা করে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতা বলেন, এ ধরনের লোকেরা এমন ভাব দেখায় যে, যুব সমাজ যেন দেশের জন্য সমস্যা অথবা তারা যুবকদেরকে দেশের জন্য সমস্যায় পরিণত করতে চায়। কিন্তু আমি দৃঢ়তার সাথে বিশ^াস করি যে, যুবকরা হচ্ছে দেশের সমস্যাবলির সমাধান, দেশের জন্য সমস্যা নয়।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী জোর দিয়ে বলেন, দেশের উন্নতি ও অগ্রগতির পথ পুরোপুরি উন্মুক্ত আছে। তবে এ পথে অনেক বাধা-বিঘœ আছে এবং অনেক চড়াই-উৎরাই আছে- যেগুলো অবশ্যই অতিক্রম করতে হবে। তিনি বলেন, উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে অভিযাত্রা অব্যাহত রাখা ও সে পথের ওপর থেকে বাধা-বিঘœ অপসারণের জন্য কতগুলো পূর্বশর্ত আছে এবং এ ক্ষেত্রে প্রথম পূর্বশর্ত হচ্ছে ‘দুশমনের অস্তিত্ব ও উপস্থিতি বুঝতে পারা ও অনুভব করা’। কারণ, মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত দুশমনের অস্তিত্ব অনুভব না করে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা নিজেদের হেফাযতের জন্য পরিখা খনন করে না এবং প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে না।
ইসলামি বিপ্লবের রাহ্বার বলেন, অবশ্য নিজেদেরকে বুদ্ধিজীবী হিসেবে প্রদর্শনকারী আরামপ্রিয় লোকেরা ও মুনাফিকরা- যারা মূলগতভাবেই আমেরিকাকে দুশমন বলে মনে করে না এবং ইরানের সমস্যাবলির সমাধানের জন্য দেশের সরকার ও জনগণের জন্য আমেরিকার কাছে আত্মসমর্পণের প্রেসক্রিপশন লিখছে, তারা যদি আমেরিকার এজেন্ট না-ও হয়ে থাকে তো অন্তত দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ময়দানের লোক নয়।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতা দেশের উন্নতি ও অগ্রগতির পথে বিদ্যমান বাধা-বিঘœ ও চড়াই-উৎরাইসমূহ অতিক্রমের দ্বিতীয় পূর্বশর্ত হিসেবে ‘আত্মবিশ^াস ও রুখে দাঁড়ানোর দৃঢ় প্রত্যয়ের’ কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, নিষ্প্রাণ, ভীরু, হতাশ, আলসে, সুযোগ সন্ধানী, সুবিধাবাদী ও স্বার্থপর লোকেরা যদি অন্যদের জন্য বাধা হয়ে না-ও দাঁড়ায়, তো তারা এ ময়দানে অন্য কোনো যোগ্যতার পরিচয় প্রদান করতেই সক্ষম নয়।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, অবশ্য ইসলামি বিপ্লবের বিজয় পূর্ববর্তী আন্দোলনের যুগে ও বিগত চল্লিশ বছরের বিভিন্ন ক্রান্তিকালে কখনোই ইরানের যুব সমাজ ঐ ধরনের মহামারীতে আক্রান্ত হয় নি, বরং সব সময়ই তারা দ্বিধাদ্বন্দ্ব, ভয়-ভীতি ও কাপুরুষতা থেকে মুক্ত ছিল এবং আত্মবিশ^াস ও সাহসিকতার অধিকারী ছিল।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী ‘দুশমনের হুমকি সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখা ও রণাঙ্গন সম্পর্কে সঠিক পরিচিতির অধিকারী হওয়া’কে বাধা-বিঘœ অতিক্রম করে দেশের উন্নতি ও অগ্রগতির পথে অভিযাত্রা অব্যাহত রাখার জন্য তৃতীয় পূর্বশর্ত হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, প্রথম রণাঙ্গন হচ্ছে ‘ইসলাম ও ইসলামি ঈমান’-এর রণাঙ্গন। কারণ, আমেরিকা ইসলাম ও ইসলামি বিপ্লবের কাছ থেকে চপেটাঘাত খেয়েছে এবং তারা যেখানে ইরানের সমস্ত কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করত সেখানে ইসলামি বিপ্লব ইরানের ওপর থেকে তাদের নিয়ন্ত্রণ খর্ব করে দিয়েছে।
ইসলামি বিপ্লবের রাহ্বার বলেন, কিছুসংখ্যক লোক এই বলে বকবক করে যে, আমেরিকার দোষ প্রচার করা উচিত নয় যাতে তারা ইরানের বিরুদ্ধে দুশমনী না করে। অথচ প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে এই যে, তারা কেবল ইরানি জনগণের ‘আমেরিকা নিপাত যাক’ স্লোগানের কারণে ইরানের বিরুদ্ধে দুশমনী করে না, বরং প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে এই যে, তারা স্বয়ং ইসলাম ও ইসলামি বিপ্লবের বিরোধী। কারণ, মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের বুকে একটি বিরাট ও বিপ্লবী ইসলামি শক্তি মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর কারণে তারা মারাত্মকভাবে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। এ কারণে তারা ইরানের শক্তির উপাদানগুলোকে ধ্বংস করার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, বলদর্পী শক্তির লক্ষ্য হচ্ছে ইসলামি ইরানের শক্তিমত্তার উপাদানগুলোর ওপর আঘাত হানা। তিনি বলেন, সামাজিক স্থিতিশীলতা ও সুদৃঢ়তা, জাতীয় নিরাপত্তা ও ঐক্য, ইসলামি বিপ্লবের মূলনীতিমালা ও ভিত্তিসমূহের ওপর অটল থাকা, বৈজ্ঞানিক উন্নতির পথে অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখা, বৈপ্লবিক ও ইসলামি সংস্কৃতির বিস্তার সাধন ও তাকে গভীরতরকরণ, প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে, বিশেষত ক্ষেপণাস্ত্রের ক্ষেত্রে অগ্রগতি এবং মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে উপস্থিতি- এগুলো হচ্ছে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের শক্তিমত্তার উপাদান এবং দুশমন ইরানের শক্তিমত্তার এ উপাদানগুলোর ওপর আঘাত হানতে চায়।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা ‘ইরানের ও বিশে^র বাস্তবতা সমূহ সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখা এবং ভ্রান্ত চিত্রায়ণের দ্বারা বিভ্রান্ত না হওয়া’ বাধা-বিঘœ অতিক্রম করে দেশের উন্নতি ও অগ্রগতির পথে অভিযাত্রা অব্যাহত রাখার জন্য আরেকটি পূর্বশর্ত বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, যারা ইরানি জাতির অকল্যাণ কামনা করে ও এ জাতির বিরুদ্ধে শত্রুতা পোষণ করে তারা গণমাধ্যমসমূহ, বিশেষ করে নব-উদ্ভূত গণমাধ্যমসমূহ ব্যবহার করে ইরান ও মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্কে এবং সেই সাথে তাদের নিজেদের সম্পর্কে ভ্রান্ত চিত্র তৈরি করার এবং ইরানি জনমতকে প্রকৃত বাস্তবতা থেকে বিচ্যুত করার জন্য অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
ইসলামি বিপ্লবের রাহ্বার বলেন, দুশমনরা যেসব ভ্রান্ত চিত্র তৈরি করছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে আমেরিকাকে শক্তিশালী অবস্থানের অধিকারী হিসেবে তুলে ধরা। তিনি বলেন, আমেরিকানরা ‘শক্ত অস্ত্রশস্ত্রের’ অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও বাস্তবতা হচ্ছে এই যে, তারা আদৌ শক্তিশালী অবস্থানে নেই। কারণ, বৈশি^ক অঙ্গনে মোকাবিলার ক্ষেত্রে প্রকৃত ও ভাগ্য নির্ধারণী শক্তি হচ্ছে ‘নরম অস্ত্রশস্ত্রের শক্তি’ অর্থাৎ যুক্তি, প্রমাণ উপস্থাপন ও নতুন কথা- যে ক্ষেত্রে আমেরিকা খুবই দুর্বল এবং যুক্তি ও প্রমাণ উপস্থাপনে অক্ষমতার কারণে আমেরিকা বলদর্পিতার ভাষায় কথা বলছে।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতা আমেরিকার ‘লিব্যারেল ডেমোক্রাসি’র কলঙ্কিত হয়ে পড়া ও বিশ^ব্যাপী এর সমালোচনা ছড়িয়ে পড়ার কথা উল্লেখ করে বলেন, এ কারণেই আমেরিকা তার পারমাণবিক শক্তি, উন্নত প্রযুক্তি ও প্রচুর আর্থিক সামর্থ্য সত্ত্বেও অনেক অঞ্চলেই, যেমন : ইরাকে, সিরিয়ায়, পাকিস্তানে ও আফগানিস্তানে পরাজয় বরণ করেছে এবং আমেরিকার জন্য আরো অনেক পরাজয় অপেক্ষা করছে।
ইসলামি বিপ্লবের রাহ্বার দুশমনদের দ্বারা ইরান সম্পর্কে প্রতারণামূলক ও অবাস্তব চিত্র তৈরি করার কথা উল্লেখ করে বলেন, তারা ইসলামি ইরান সম্পর্কে বিভিন্ন ভ্রান্ত চিত্র তৈরি করার মাধ্যমে বিশ^বাসীকে ও ইরানি জনগণকে তাদের ভ্রান্ত মতামত বিশ^াস করাবার জন্য অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
তিনি ইরানের অর্থনৈতিক সমস্যাবলির কথা উল্লেখ করে বলেন, আমেরিকানরা ইরানের এ সব সমস্যার ওপরে ভরসা করে তাদের স্বল্প মগযবিশিষ্ট ও প্রজ্ঞাবিহীন মাথায় বিভিন্ন ধরনের কল্পনা লালন করছে। এ কারণেই সম্প্রতি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ইউরোপের কয়েক জন রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানকে বলেন : ‘আপনারা যদি আর দুই-তিন মাস অপেক্ষ করেন তাহলে দেখবেন ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের খেল খতম।’ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বলেছেন : ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের খেল খতম।’ হ্যা, (ফারসি প্রবাদ বাক্যে যেমন বলা হয়েছে 🙂 ‘উট স্বপ্নে দেখে তুলার বীচি।’ (!)
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্টের এ কল্পনা লোকদেরকে চল্লিশ বছর আগেকার কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যখন আমেরিকানরা ও ইরানের ভিতরকার তাদের সেবাদাসরা পরস্পরকে ছয় মাসের মধ্যে ইসলামি প্রজাতন্ত্রের পতনের আগাম সুসংবাদ দিচ্ছিল। কিন্তু বর্তমানে ইসলামি শাসন ব্যবস্থার বয়স চার দশক হয়ে গিয়েছে।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতা ‘বেচারা আমেরিকান প্রেসিডেন্টের’ এ সুখ কল্পনাকে ইসলামি বিপ্লব, ইরানি জাতি এবং ইরানি জনগণের ঈমানী ও বৈপ্লবিক চেতনা সম্পর্কে ধারণা না থাকার ফল বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, এ ধরনের ভ্রান্ত বিশ্লেষণ বিগত চল্লিশ বছর যাবত আমেরিকানদের বিভ্রান্তির কারণ হয়েছে। আল্লাহ্ তা‘আলা যে ইরানি জাতির দুশমনদেরকে অজ্ঞ ও নির্বোধ বানিয়েছেন, এ জন্য অবশ্যই আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে শুকরিয়া আদায় করা উচিত।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, অবশ্য অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমাদের বিভিন্ন সমস্যা ও ত্রুটি রয়েছে, যেমন : অর্থনীতির তেলনির্ভরতা এবং সমাজে সাশ্রয়ী হবার সংস্কৃতির ক্ষেত্রে দুর্বলতা ও অপচয়ের অস্তিত্ব। তবে প্রকৃত ত্রুটি ও দুর্বলতা হচ্ছে অচলাবস্থায় উপনীত হওয়া, কিন্তু দেশে অচলাবস্থার কোনো অস্তিত্ব নেই। তিনি বলেন, কতিপয় লোক যুবকদের মাথায় এ ধারণা প্রবেশ করানোর জন্য অপচেষ্টা চালাচ্ছে যে, দুশমনের কাছে আশ্রয় নেয়া ছাড়া সমাধানের আর কোনো পথই খোলা নেই। আসলে দুশমন ইরানি জাতিকে এ উপসংহারে উপনীত হবার জন্য প্ররোচিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে যে, ইরান অচলাবস্থার শিকার হয়েছে এবং ইরানের জন্য আমেরিকার সামনে নতজানু হওয়া ও আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কোনো পথই খোলা নেই।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, আমি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করছি, ইরানের অভ্যন্তরে যারা দুশমনদের পছন্দনীয় ও কাম্য এ চিন্তার বিস্তার ঘটাচ্ছে কার্যত তারা ইরানি জাতির বিরুদ্ধে বিশ^াসঘাতকতা করে চলেছে।
ইসলামি বিপ্লবের রাহ্বার জোর দিয়ে বলেন, কিন্তু এটা কখনোই ঘটবে না; আল্লাহ্ তা‘আলার মদদের ওপর ভরসা রেখে এবং জনগণকে ও যুবসমাজকে সাথে নিয়ে আমরা যতক্ষণ প্রাণ আছে ততক্ষণ সর্বশক্তিতে চেষ্টা চালিয়ে যাব যাতে ইরানে এ ধরনের অবস্থা সৃষ্টি হতে না পারে।
তিনি ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ও ইরানি জাতির প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে যথাযথ পরিচিতির অধিকারী হওয়া ও সঠিক চিত্র তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, বিশে^র অনেক বড় বড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও রাজনৈতিক নীতিনির্ধারক এবং ভারসাম্যপূর্ণ রাজনৈতিক চিন্তাবিদ দীর্ঘ চল্লিশ বছর যাবত বিভিন্ন চাপের মোকাবিলা করে স্বীয় অবস্থানে অটলভাবে টিকে থাকা এবং একই সাথে উন্নয়ন ও অগ্রগতির অধিকারী হওয়া ও একটি প্রভাবশালী শক্তিতে পরিণত হবার কারণে ইরানি জাতির প্রশংসা করছেন।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী ভৌগোলিক ও আবহাওয়াগত দিক থেকে, জনশক্তির বিচারে এবং ভূগর্ভস্থ ও ভূপৃষ্ঠস্থ প্রাকৃতিক সম্পদের কারণে ইরানের অমিত সম্ভাবনাকে আরেকটি বাস্তবতা বলে উল্লেখ করেন এবং বলেন, আমরা এ সব সম্ভাবনাকে এখনো যথাযথভাবে কাজে লাগাই নি। দেশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের উদ্দেশে আমার সব সময়ের জন্য পরামর্শ এই যে, আপনারা দেশের সম্ভাবনাসমূহকে যথাযথভাবে চিহ্নিত করুন ও কাজে লাগান।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতা ঈমানদার যুবসমাজকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরাজমান গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে উল্লেখ করেন এবং বলেন, দেশের প্রকৃত চিত্র হচ্ছে এই ঈমানদার যুব সমাজ- যারা প্রতিরক্ষা, বৈজ্ঞানিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অঙ্গন সহ জাতীয় জীবনের বিভিন্ন অঙ্গনে স্বীয় শক্তি-সামর্থ্যরে ও যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছে।
ইসলামি বিপ্লবের রাহ্বার ইরানের বিরুদ্ধে আমেরিকার আরোপিত নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে বলেন, নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রকৃত তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, দুশমনের জন্য ইরানের ইসলামি হুকূমাতের বিরুদ্ধে মোকাবিলা করার জন্য অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ ব্যতীত আর কোনো পথই খোলা নেই। কিন্তু এ অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আমাদের জাতীয় অর্থনীতির চেয়ে অধিকতর ভঙ্গুর। তিনি বলেন, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের জাতীয় অর্থনীতি নিষেধাজ্ঞাকে ব্যর্থ করে দিতে সক্ষম এবং আল্লাহ্ তা‘আলার কুদরতের ওপর ভরসা রেখে আমরা নিষেধাজ্ঞাকে ব্যর্থ করে দেব। আর নিষেধাজ্ঞার ব্যর্থতা মানে আমেরিকার পরাজয় এবং এ পরাজয়ের ফলে আমেরিকা ইরানি জাতির কাছ থেকে আরো একটি চপেটাঘাত খাবে।
ইরানের বিশাল গণবাহিনী (বাসীজ) যে আরো কতক জাতির জন্য অনুসরণীয় আদর্শে পরিণত হয়েছে হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী এ বিষয়টিকে ইসলামি ইরানের আরেকটি বাস্তবতা বলে উল্লেখ করে বলেন, বাসীজ হচ্ছে আমাদের দেশের প্রকৃত চিত্রের আরেকটি দৃষ্টিগ্রাহ্য গুরুত্বপূর্ণ অংশ- যে শক্তি কেবল যে দুশমনের হুমকির মোকাবিলায় পশ্চাদপসরণ করে না শুধু তা-ই নয়; বরং এর ফলে তার ঈমান অধিকতর বৃদ্ধি পায়। এ কারণেই দুশমন ও তার এজেন্টরা বাসীজের বিরুদ্ধে খুবই বিরোধিতা করে চলেছে।
ইসলামি বিপ্লবের রাহ্বার হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী তাঁর ভাষণে দেশ গড়ার জিহাদের গ্রুপসমূহ, দেশ গড়ার বাসীজের গ্রুপসমূহ, ‘আলোর পথের পথিকদের শিবির’সমূহ, গণমিছিলসমূহ, মসজিদসমূহে এ‘তেকাফ্, হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাত স্মরণে শোকানুষ্ঠানসমূহ ইত্যাদি সহ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রকৃত চিত্রের আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও গৌরবোজ্জ্বল দিককে ইরানে বিদ্যমান অন্যান্য বাস্তবতা হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ইরানি জাতির সাথে সঠিকভাবে পরিচিত হতে হলে এসব বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে। তিনি বলেন, বাসীজ, দেশ গড়ার জিহাদ সংশ্লিষ্ট গ্রুপসমূহ ও ‘আলোর পথের পথিকদের কাফেলা’সমূহের সাথে সহযোগিতা করা ও তাদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান সরকারের প্রশাসনযন্ত্রের সকল অংশের দায়িত্ব।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের গণবাহিনী (বাসীজ)-এর সদস্যদের এ বিশাল সমাবেশে প্রদত্ত তাঁর এ ভাষণের শেষ পর্যায়ে জনমতকে প্রভাবিত করার জন্য দুশমনদের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমের ব্যাপক ব্যবহারের কথা উল্লেখ করে বলেন, গণমাধ্যম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র সমতুল্য; এ অস্ত্র যদি দুশমনের হাতে থাকে তাহলে তা এতই বিপজ্জনক যে, তাকে সশস্ত্র যুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্রের সাথে তুলনা করা চলে। তিনি উল্লেখ করেন যে, দুশমন ইরানি জাতির জনমতকে বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যে রেডিও, টেলিভিশন, ইন্টারনেট এবং বিভিন্ন সামাজিক নেটওয়ার্ক ও ভার্চুয়াল জগতের ব্যবহার করে চলেছে। তিনি ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সরকারের গণসংযোগ ও গণমাধ্যম বিষয়ক দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, ইতিপূর্বে বিভিন্ন বৈঠকে যেমন স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে, আপনারা এ বিষয়টির প্রতি সঠিকভাবে মনোযোগ দিন এবং গুরুত্ব সহকারে এ বিষয়ে স্বীয় দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করুন যাতে এমন যেন না হয় যে, দুশমন ইরানি জনগণের বিরুদ্ধে সহজে রাসায়নিক অস্ত্রতুল্য এ অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে।
ইসলামি বিপ্লবের রাহ্বার তাঁর ভাষণের এ শেষ পর্যায়ে ঐক্য, দৃঢ় প্রত্যয় ও শক্তি অনুভবকরণের অপরিহার্যতার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন, যুবসমাজ হচ্ছে ইরানের সমস্যাবলির সমাধান এবং তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, তারা তাদের প্রিয় ইরানকে গৌরবের শিখরে উপনীত করবে। তিনি বলেন, গোটা জাতিকে বিশেষ করে ঈমানদার যুবসমাজকে ময়দানের মধ্যখানে উপস্থিত থেকে অভিন্ন লক্ষ্যের দিকে, দেশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সাথে অভিন্নকণ্ঠ হয়ে এবং জনগণ ও কর্মকর্তাদেরকে অভিন্নহৃদয় হয়ে দুশনের কাছে শক্তির বাণী পৌঁছে দিতে হবে। কারণ, ইরানি জনগণের কথা, আচরণ, জীবনযাত্রা ও মনমানসের কারণে দুশমন যদি নিজেকে শক্তিমত্তার অধিকারী একটি জনসমষ্টির মুখোমুখি দেখতে না পায় তাহলে সে ধৃষ্ট ও দুঃসাহসী হয়ে উঠবে।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী দৃঢ়তার সাথে বলেন, ইরানের বাস্তবতা এটাই প্রদর্শন করছে যে, এ দেশের যুব প্রজন্ম সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, তারা কিছুতেই হীনতা, নীচতা ও অপদস্থ হওয়াকে মেনে নেবে না। বিজাতীয় শক্তিসমূহের ও দুশমনদের পিছন পিছন চলবে না এবং তাদের প্রিয় ইরানকে সম্মান ও গৌরবের চূড়ায় উপনীত করবেই এবং আল্লাহ্ তা‘আলার বিশেষ অনুগ্রহে তাদের মধ্যে এ জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি-সামর্থ্য ও দৃঢ় প্রত্যয় রয়েছে।
ইসলামি বিপ্লবের রাহ্বার তেহরানের আযাদী স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত সারা ইরান থেকে আগত নির্বাচিত লক্ষাধিক বাসীজ সদস্যের এ বিরাট সমাবেশ সম্পর্কে বলেন, এ সমাবেশ (ইরানি বর্ষপঞ্জির) ১৩৬০-এর দশকের (১৯৮১-১৯৯০) মাঝামাঝি সময়ে অনুষ্ঠিত বাসীজ সমাবেশের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। তিনি বলেন, সেবারের সে বিশাল বাসীজ সমাবেশ দেশের জন্য একটি বিরাট আন্দোলন ও বিজয়ে পরিণত হয়েছিল; প্রিয় যুবকরা! তোমরাও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ময়দানসমূহে কর্মতৎপরতা, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তৎপরতা, কর্ম সংস্থান তৈরিকরণ, ব্যক্তিগত ও সামাজিক-সামষ্টিক প্রচেষ্টা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নেটওয়ার্ক তৈরি এবং স্বেচ্ছাপ্রণোদিত অন্যান্য তৎপরতার মাধ্যমে সফল ও বিজয়ী হবে, ইনশাআল্লাহ্।
ফারসি থেকে অনুবাদ : নূর হোসেন মজিদী
গত ১৮ আগস্ট ২০১৮ ঢাকাস্থ মিরপুর লালকুঠি দরবার শরীফ মিলনায়তনে লালকুঠি সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে লালকুঠি দরবার শরীফের পীর সাহেব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং লালকুঠি সাহিত্য পরিষদ সভাপতি শাহ সূফি হযরত মাওলানা অধ্যাপক আহসানুল হাদীর মাসব্যাপী ইরান সফর এবং ইতিপূর্বে আরো যাঁরা ইরান সফল করেছেন তাঁদের স্মৃতিচারণমূলক বিষয় নিয়ে ‘কবিতার দেশে বিপ্লবের দেশে পারস্যের পথে প্রান্তরে’ শীর্ষক আলোচনা সভা ও লালকুঠি সাহিত্য পরিষদ-এর নিয়মিত সাহিত্য সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের শেকড় সন্ধানী কবি নজরুল গবেষক সাংবাদিক কবি আবদুল হাই শিকদার। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইতিহাসবিদ আশরাফুল ইসলাম ও চিনাইর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের বাংলার অধ্যাপক কবি মুহিবুর রহিম। আলোচনায় অংশ নেন নজরুল-ফররুখ গবেষণা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি লেখক গবেষক এমদাদুল হক চৌধুরী, ক্বারী আলমগীর হোসেন মোল্লা, রেডিও তেহরানের সাবেক সংবাদ পাঠক, মর্সিয়া লেখক ও ছড়াকার কবি শাহ নওয়াজ তাবীব। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কবি আমিন আল আসাদ। পবিত্র কালামে পাক থেকে তেলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হয়। পবিত্র কালামে পাক থেকে তেলাওয়াত করেন শিল্পী ক্বারী হাবিবুর রহমান। নাতে রাসূল (সা.) পেশ করেন লালকুঠি দরবারের বয়োজ্যেষ্ঠ কবি মুক্তিযোদ্ধা হাজী রফিক মিয়া। কবিতা পাঠে অংশ নেন মুহিবুর রহিম, তাজ ইসলাম, ক্বারী ওবায়দুল্লাহ, আমিন আল আসাদ, শাহ নওয়াজ তাবিব, রহমান মাজিদ, নাসিমা আক্তার নিঝুম, আলমগীর হোসেন জোয়ারদার, হুমায়ূন কবির, জয়নাল আবেদীন প্রমুখ।
অনুষ্ঠানের সভাপতি ও প্রধান আলোচক জনাব আহসানুল হাদী তাঁর সাম্প্রতিক ইরান সফরের স্মৃতিচারণ করে বলেন, বর্তমান সফরটি ছিল একটি অ্যাকাডেমিক সফর যার আয়োজক ছিল ‘বুনিয়াদে সাদী’ নামে একটি সংস্থা যার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সম্প্রসারণের জন্য কাজ করা এবং বিশ্বময় ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের প্রতিনিত্বশীল যোগ্যতাস¤পন্ন লোক তৈরি করা। এই সংস্থাটি ইরানের শিক্ষা ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের আওতাধীন। তারা একটি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কোর্সের আয়োজন করে। আমার সঙ্গে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের ফারসি বিভাগের আরো দু’জন শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন। ঢাকাস্থ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সহায়তায় আমি সেই সফরে অংশগ্রহণ করি। ১৪টি দেশের শিক্ষকবৃন্দ সেখানে অংশগ্রহণ করেন। শুধু মুসলিম দেশ নয়, অমুসলিম দেশের প্রতিনিধিত্বও ছিল সেখানে। আমি সেখানে বিভিন্ন সেমিনারে বক্তব্য রাখি এবং টেলিভিশনের অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করি।
জনাব হাদী ইরানের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক নগরী কোম সফরেরও স্মৃতি বর্ণনা করেন। বর্ণনা দেন বোস্তাম নগরীতে অবস্থিত হয়রত বায়েজিদ বোস্তামীর মাযার যিয়ারতের। ইতিপূর্বে আরো তিনবার তিনি ইরান সফর করেছেন। ২০০৮ সালে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেইনী (র.)-এর ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ থেকে কবি মোহন রায়হান, কবি আহমদ কায়সার, কবি রোকন জহুর, কবি আমিন আল আসাদ, কবি মোস্তাফিজ মামুন সহ ইরান সফরের কথা উল্লেখ করে বলেন, সেই সফরে আমরা ইরানের আরেক আধ্যাত্মিক শহর মাশহাদ গমন করি, যেটি খোরাসান প্রদেশে অবস্থিত। সেখানে নবীবংশের ৮ম ইমাম রেযা (আ.)-এর মাযার যিয়ারত করি। এই প্রদেশের তূস নগরীতে রয়েছে মহাকবি ফেরদৌসির মাযার।
জনাব আহসানুল হাদী বলেন, শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং ধর্মীয়-আধ্যাত্মিক জ্ঞান বিস্তারে ইরানের ইসলামি সরকারের ভূমিকা খুবই প্রশংসনীয়। তিনি বলেন, ইরান যে আসলেই একটি আধ্যাত্মিক চেতনায় পরিপূর্ণ দেশ, আপনি ইরানে গিয়ে স্বচক্ষে অবলোকন করলে সেটির প্রমাণ পাবেন। তাবে সে চোখ আপনার থাকতে হবে। সেদেশের আলেমরা শুধু মসজিদের সাধারণ মোল্লাই নন। তাঁরা আসলেই পূর্ণ যোগ্যতাসম্পন্ন লোক। আমি যতবার ইরানে গিয়েছি ততবারই আমার অন্তর সমৃদ্ধ হয়েছে।
ইরানের ইসলামি বিপ্লব না হলে তাদের জাতীয় চেতনা ও ধর্মীয় অধ্যাত্মবোধকে বিশ্বময় সম্প্রসারণ করা কিছুতেই সম্ভব হতো না। কিন্তু কিছু জনগণকে লক্ষ্যভ্রষ্ট ও ধৈর্য্যচ্যুত করার জন্য বাহির থেকে সা¤্রাজ্যবাদের অনুচররা অপচেষ্টা করে যাচ্ছে। অবরোধের পর অবরোধের ফলে জাগতিকভাবে ইরান একটু সমস্যায় পড়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই। সেকারণে বদর, ওহুদ, খন্দক ও কারবালার চেতনায় জনগণকে ধৈর্য ধরতে হবে ও সেই শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে মনোবল বৃদ্ধি করতে হবে। ভোগবাদী আরব দেশগুলোর মতো তেলসম্পদ বিক্রি আর ভোগবিলাসে জীবন পার করে দেয়ার নাম জীবন নয়। এই তেল সম্পদ ফুড়িয়ে যাবে। কিন্তু জ্ঞানের শক্তি টিকে থাকবে। টিকে থাকবে ঈমানের শক্তি। এই জ্ঞানশক্তির বিকাশ ঘটিয়ে ইরানি জাতি আজ পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন জাতি হয়েছে। স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ ইরান অনেক আগেই এবং অনেকবার উড়িয়েছে। নিজের উদ্যোগে এবং নিজেরই প্রযুক্তির সহায়তায়। ইরানে এখনো দরিদ্র মানুষ নেই এমন নয়, তবে তা শাহের আমল থেকে বেশি নয়। ইরান শিক্ষা-দীক্ষায় ও বিজ্ঞানচর্চায় অনেক দূর এগিয়ে গেছে।
কবি আবদুল হাই শিকদার বলেন, ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বরে পারস্যের কবিদের গুলবাগিচায় ‘ইরান বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে আন্তর্জাতিক নজরুল সম্মেলনে আমি অংশগ্রহণ করি এবং সিরাজ ও ইসফাহান ভ্রমণ করি। কবি হাফিজের ওপর একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি করি। আমার সঙ্গে ছিলেন শিল্পী ও ডকুমেন্টারি প্রডিউসার ফরিদী নূমান। বিটিভিতে আমার পরিচালিত ‘কথামালা’ অনুষ্ঠানে ইরান ভ্রমণের ওপর তিনটি প্রতিবেদন প্রদর্শন করি। সেই ভ্রমণে ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র আমাদেরকে বিশেষভাবে সহযোগিতা করে। বিশেষ করে তৎকালীন কালচারাল কাউন্সেলর জনাব আলী আভারসাজীর সহযোগিতার কথা স্মরণ করতেই হবে। ইরান নিজের সংস্কৃতির বিকাশ ও বিস্তারে এবং অন্যের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে ও আত্মস্থ করতে কতটা আন্তরিক তা উক্ত সম্মেলন থেকেই বোঝা যায়। নজরুলকে ভালো করে আত্মস্থ করেছেন বলেই ইরানের সাংস্কৃতিক মন্ত্রী বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘নজরুল আমাদেরই সম্পদ। প্রচ- ঝড়ো হাওয়া নজরুলকে আমাদের মাঝখান থেকে বাংলাদেশের কাদামটিতে ফেলে দিয়েছে।’
ইরান তার জাতীয় মেধা ও ব্যক্তিত্বগুলোকে সঠিকভাবে দুনিয়ার বুকে পেশ করতে পেরেছে এবং তাদের সংস্কৃতির সঠিক প্রতিনিধিত্ব তাঁরা করছে বলেই জাতিসংঘের সদর দরজায় শেখ সাদী ও রুমীর কবিতা উৎকীর্ণ থাকে। শেখ সাদীর কবিতার একটি বাক্য সেখনে লেখা রয়েছে যে, ‘গোটা মানব সমাজ একটি দেহের মতো/এর যে কোন স্থান আঘাতপ্রাপ্ত হয় সমস্ত দেহে তা অনুভূত হয়’। জার্মান কবি গ্যাটে ইরানের কবি হাফিজের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেছেন, ‘যে হাফিজ পড়ে নি তার জীবনই বৃথা’। হাফিজ এবং ফেরদৌসি দুইজনের পার্থক্য বোঝাতে কবি শিকদার বলেন, ফেরদৌসি ছিলেন বোহেমিয়ান। তিনি দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন। আর হাফিজ ছিলেন ঘরমুখী কবি। তিনি তাঁর প্রিয় নদী রুকনাবাদের তীর ছেড়ে কোথাও যান নি। ইরানি জাতি তাদের সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদেরকে যেভাবে ফোকাস করেছে ও করছে আমরা আমাদের রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ফররুখকে সেভাবে বিশ^ময় ফোকাস করতে পারি নি।
প্রসঙ্গক্রমে কবি শিকদার বলেন, শিয়া-সুন্নি বিভেদ ভুলে যেতে হবে এবং ইরান-তুরান এক হয়ে কাজ করতে হবে। আমাকে ইরানে শিয়া-সুন্নি বিষয়ে প্রশ্ন করলে আমি বলেছিলাম, আমি মুসলমান। আমি শিয়া-সুন্নি ঐক্যের বিষয়ে ইমাম খোমেইনী (র.)-এর সেই বাণী উল্লেখ করে বলেছিলাম, ‘যারা শিয়া ও সুন্নিদের মাঝে বিরোধ তৈরি করে তারা শিয়াও নয়, সুন্নিও নয়, তারা স¤্রাজ্যবাদীদের দালাল।’ আমি বলেছিলাম, যে কোন মূল্যে এ বিভেদ দূর করতে হবে। আহলে বাইতকে শিয়া-সুন্নি উভয়েই মহব্বত করে। কেবল কারবালার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ গ্রুপটি ছাড়া। শিয়া-সুন্নি উভয় মাযহাবের মানুষ মিলেই মোঘলরা ভারতবর্ষ শাসন করেছে। শিয়া-সুন্নিদের মধ্যে আগে বৈবাহিক ও সামাজিক সম্পর্কও ছিল। সে সম্পর্ক আবার গড়ে তুলতে হবে। তিনি বলেন, শিয়া-সুন্নি ঐক্য ভঙ্গের জন্য সা¤্রাজ্যবাদীরা নানা কূটকৌশল হাতে নিয়েছে। তারা পাকিস্তানে শিয়া মসজিদে বোমা হামলা করে পাকিস্তান ও ইরানের সম্পর্কে ফাটল ধরাতে চায়। আবার তুরস্কের সঙ্গে ইরানের বিরোধ তৈরি করার জন্য রাজনৈতিক চাল চালতে থাকে।
তিনি বলেন, ফারসি ভাষা বাংলার সাথে এমনভাবে মিশে গেছে যে, একে আর পৃথক করার সুযোগ নেই। ফারসি শিক্ষার গুরুত্ব উল্লেখ করে তিনি ঢাকাস্থ ইরানের কালচারাল সেন্টারের প্রতি গণমুখী ফারসি অ্যাকাডেমী চালু করার আহ্বান জানান এবং লালকুঠি দরবারে একটি ফারর্সি চর্চা কেন্দ্র গড়ে তোলা যায় কিনা সে ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করা ব্যাপারে দরবারের পীর সাহেবের কাছে আবেদন রাখেন। তিনি বলেন, নবাব সিরাজউদ্দৌলার ওপর ডকুমেন্টারি করতে ভারতে গিয়ে মুর্শিদাবাদে বিশাল লাইব্রেরি দেখতে পাই যার অধিকাংশ বই ফারসি ভাষায় রচিত। ফারসি ভাষা না জানার কারণে এর ভেতরে প্রবেশ করতে পারি নি, বইগুলো হাত দিয়ে স্পর্শ করেছি মাত্র।
ইতিহাসবিদ জনাব আশরাফুল ইসলাম বলেন, আমাদের ইতিহাস, ধর্মীয় আচার-আচরণের সাথে আমাদের জীবন ও সংস্কৃতির সাথে ইরান ও ফারসি ভাষা মিশে গেছে অকৃত্রিমভাবে। আমাদের রক্তে, অস্থি-মজ্জায় তা একাকার হয়ে মিশে গেছে। কারবালা ট্রাজেডির শোকাবহতা এবং নবী-পরিবারের প্রতি ভক্তি আমাদের চেতনার অবিনাশী অংশ। এখানে শিয়া-সুন্নির কোন বিষয় নেই। কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামে বিশাল একটি কারবালার মাঠ আছে। আমাদের দেশের মুহররম মিছিলে শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে অংশগ্রহণ করে। কারবালার ইতিহাস চর্চায় ও কারবালার পুঁথি পাঠে অংশগ্রহণ করে গ্রামে কাঁদে না এমন লোক নেই। আমাদের গ্রামে দশদিনব্যাপী মুহররমের জারি গান হয়। মর্সিয়া পাঠ হয়। হয় ওয়াজ-নসিহতও।
তিনি একটি গ্রাম্যছড়ার দুইটি লাইন আবৃত্তি করে ফারসি ও বাংলার সম্পর্ক বোঝান এভাবে যে, ‘যগাই মাধাই দুইজনে/ মসনবী পড়ে নলবনে’। যগাই মাধাই দুইজন বাঙালি হিন্দু, অথচ তারা নলবনে বসে ‘মসনবী’ পড়ছে। ইরানি সংস্কৃতির কতটা শক্তিশালী প্রভাব থাকলে বাঙালি হিন্দুও মুসলমানী সাহিত্য ‘মসনবী’ পাঠে মনোযোগী হয় তা এই ছড়ায় বোঝা যায়। তিনি বলেন, এটাই আমাদের বাংলাদেশ।
তিনি ফারসি ভাষা ও সংস্কৃতি বিকাশে ও বাংলার সাথে পারস্যের সাংস্কৃতিক আত্মীয়তা জোরদার করতে ইরান দূতাবাস ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রকে আরো গণমুখী হওয়ার আহ্ববান জানান। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্বিবৃত্তিক পরিম-লে এটি সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
বিশেষ অতিথি অধ্যাপক কবি মুহিবুর রহিম স্মৃতিচারণ করে বলেন, ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত ‘নিউজলেটার’-এ একসময় নিয়মিত লিখতাম। রেডিও তেহরানের শুরুর দিকে যখন মরহুম ফরিদ উদ্দিন খান পরিচালক ছিলেন তখন আমার অনেক কথিকা তেহরান বেতারে প্রচারিত হয়েছে। আমাদের সময় রেডিওর খবরের ওপর নির্ভরশীল ছিল গ্রামবাংলার মানুষ। আমি রেডিও তেহরানের নিয়মিত শ্রোতা ছিলাম। ঢাকায় অবস্থানকালে বাংলাদেশে ইরানের ধর্মীয় প্রতিনিধি আয়াতুল্লাহ শাহরুখী খুররমাবাদী (র.)-এর সাথে প্রেসক্লাব ভিআইপি লাউন্সে আমাদের একটি বৈঠক হয়। তাঁর সাথে আমাদের নানা বিষয়ে মতবিনিময় হয়। রেডিও তেহরানের বাংলাদেশী বন্ধুরা একটি সাহিত্য ম্যাগাজিন বের করতেন ‘দীগ্দর্শন’ নামেÑ সেখানে আমার কবিতা ছাপা হয়েছে ‘ইমাম খোমেনী (র)’ নামে। ইরানের সাথে আমাদের বাংলাদেশের বন্ধুত্ব অতীতেও ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। ইরানের ইসলামি বিপ্লবকে বাংলাদেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই সমর্থন করেছে। মাযহাবী বিভেদ নয়, বিশ্ব-মুসলমান এক হয়েই কাজ করতে হবে। সা¤্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রকে রুখতে হবে। ‘ইসলামের আদর্শিক বিপ্লব ও নৈতিক সাংস্কৃতিক বিপ্লব ছাড়া মানবজাতির মুক্তি নেই’Ñ মাওলানা আবদুর রহীম (র.) এ কথাটি অনেক আগেই জাতিকে শুনিয়েছিলেন। তিনি বলেন, আমেরিকার মানুষও যদি মুক্তি চায় তাহলে ইসলামি নৈতিকতার কাছেই তাদেরকে আত্মসমর্পণ করতে হবে।
জনাব এমদাদুল হক চৌধুরী বলেন, নজরুল ও ফররুখ আহমদের কবিতায় অনেক ফারসি শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে। ইরানের সাথে আমাদের শেকড়ের সম্পর্ক আছে, সেটি অস্বীকার করার উপায় নেই। মুসলমান দেশগুলো মিলেমিশে শক্তিশালী উম্মাহ গঠন করতে হবে। কুরবানি তথা ত্যাগের শিক্ষায় মুসলমানদের উদ্দীপ্ত হতে হবে এবং পরস্পর ছাড় দিয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে বলে তিনি মত ব্যক্ত করেন।
ক্বারী আলমগীর হোসেন মোল্লা তাঁর ইরান ভ্রমণের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘শুরায়ে এহইয়ায়ে যাবা’ন ও আদাবিয়া’তে ফারসি’ সংস্থার দাওয়াতে আমরা ইরান যাই। বর্তমানে এই সংস্থার নাম ‘বুনিয়াদে সাদী’Ñ যা অনুষ্ঠানের সভাপতি জনাব আহসানুল হাদী উল্লেখ করেছেন। আমাদের সাথে ছিলেন ড. আবদুস সবুর খান, ড. তারিক সিরাজী ও ড. মুহাম্মদ শাহজালাল প্রমুখ। আমি ইরানের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে বহুদিন যাবৎ চাকুরি করছি। এখানে চাকুরি করার আগে এবং ইরান গিয়ে স্বচক্ষে দেখে আসার পূর্বে ইরানের শিয়া মাযহাবের মানুষ সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা ছিল। একটি সমাজে নানা রকমের মানুষ থাকে। কোন সাধারণ মানুষের কোন কাজ বা কথার দ্বারা যেমন আসল ঘটনা না জেনে মূল্যায়ন করা সম্ভব নয় তেমনি স্বচক্ষে দেখার আগে ও বোঝার আগে সকল ধারণা মনে বদ্ধমূল করা ঠিক নয়। আমরা জেনেছিলাম, শিয়ারা হযরত আলীকে নবী মানে ও তাঁকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর থেকে বড় করে দেখে। তারা অন্য কোরআন মানে। অথচ আমি এগুলোর কোন বিষয়েরই সত্যতা পাই নি। বরং আমরা দেখলাম, সালমান রুশদী যখন মহানবী (সা.) ও তাঁর পরিবার-পরিজনকে নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক বই ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ লিখলো তখন ইমাম খোমেইনীই সালমান রুশদীর বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়ে বিশ্বময় আন্দোলন ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, ইরানের মানুষদের থেকে পেয়েছি মায়া-মমতা, আথিতেয়তা। বাসে উঠলেই এমনভাবে ‘সালামুন আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ’ বলে সালাম দেয়, মনে হয় যেন অনেক দিনের চেনা, কিন্তু জীবনে কোনদিনই দেখা হয় নি। মাশহাদে ইমাম রেযা (আ.)-এর মাযার যিয়ারত করেছি। ইবনে সীনার মাযারে গিয়েছি। অনেক আনন্দময় ছিল সেই ভ্রমণ।
জনাব শাহ নওয়াজ তাবিব বলেন, তেহরান রেডিওতে থাকাকালীন ইরানের পথে প্রান্তরে অনেক ঘুরেছি। অনেক স্মৃতি ইরানকে নিয়ে। তাদের আচার-ব্যবহার বদান্যতায় পরিপূর্ণ। কথায় কথায় ‘সালামুন আলাকুম, হালে সোমা’ খুবে’Ñ সালাম, কেমন আছেন। উত্তরে বলবে, ‘খোদা’ রা’ শোক্র’Ñ আল্লাহকে ধন্যবাদ। ‘খুবাম’ অর্থাৎ ভাল আছি। ‘শোমা’ চেতুরে’Ñ তুমি কেমন আছ। কথায় কথায় ‘মুতাশাক্কেরাম’, ‘খেইলী মামনুন’ ইত্যাদি তো আছেই। যার অর্থ ধন্যবাদ। কোন কিছুর সহযোগিত চাইলে আপনি যদি তাকে সহযোগিতা করেন তবে সেই সহযোগিতা নিতে নিতে বলবে, ‘দাস্তে শোমা’ দারদ না কোনে’Ñ তোমার হাতে ব্যথা না হোক! সবজি, ফল ইত্যাদি কিনতে গেলেও কথায় কথায় তারা দোয়া করবে। এই ফল ও সবজি তোমার দেহের উপকার করুক! রোগ মুক্তি দান করুক! শক্তি বৃদ্ধি করুক! ইত্যাদি। কারো সাথে ঝগড়া লাগলে তৃতীয় জন এসে সাথে সাথে দরূদ পড়ে বলবে, ‘আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা মুহাম্মাদ ওয়া আলে মুহাম্মাদ। অর্থাৎ ‘রাসূল (সা.)-এর প্রতি এবং তাঁর বংশধরদের প্রতি সালাম। সঙ্গে সঙ্গে ঝগড়া শেষ। ইরানে দেখলাম রাসূল (সা.) ও তাঁর পরিবারের প্রতি অগাধ ভক্তি। কেউ একজন দরূদ পড়লেই সমস্বরে পুরো মজলিশ দরূদ পড়বে। যারা বলে ইরানের শিয়ারা রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে নবী মানে না তাদের কাছে প্রশ্ন হলো তাহলে এত দরূদ কারা পড়ে? আর তারা রাসূলের আহালে বাইতের শানে দরূদ পড়ে আর কান্নাকাটি করে। একটি কথা রয়েছে যে, মুমিনের চোখের জলে জাহান্নামের আগুন নেভে। পাপ দূরীভূত হয় তওবা আর ক্রন্দনের মাঝে। ইরানিদের চোখে যেন পানি এসেই থাকে। যে কোন দোয়া-দরূদ পড়েই তারা আল্লাহর কাছে নাজাত চেয়ে সমস্বরে কাঁদতে থাকে।
জনাব তাবিব ইরানে থাকাকালীন আযাদী স্কোয়ার, ময়দানে ইনকিলাব, বেহেশতে যাহরা, তালেঘানী এভিনিউ, ময়দানে আরজেনটাইন ইত্যাদি স্থানে নিয়মিত যাতায়াতের স্মৃতিচারণ করেন।
কবি আমিন আল আসাদ তাঁর প্রবন্ধে বলেন, আমার রচিত ‘ইমাম খোমেনী (র.) ও ইসলামী বিপ্লব’ শীর্ষক বইয়ের নিমিত্তে ২০০৮ সালে ইরান সফরে যাই। লালকুঠি দরবার শরীফের পীর সাহেব জনাব আহসানুল হাদী, কবি মোহন রায়হান, কবি রোকন জহুর, কবি মুস্তাফিজ মামুন, কবি আহমেদ কায়সার, মাওলানা সাবির রেজা, গবেষক রাশেদুজ্জামান সহ দশ বারোজন। প্রিয় নেতা ইমাম খোমেইনীর ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর মাযার যিয়ারতের সৌভাগ্য হয়। মাশহাদ গিয়েছি এবং ঘুরেছি তেহরানের পথে প্রান্তরে। ময়দানে ইনকিলাব, ময়দানে ফেরদৌসি, বেহশতে যাহরাসহ বেশ কয়েক স্থানে। ইমাম খোমেইনী (র)-এর বাড়িটি দেখেছি। মাশহাদে গিয়েছি ইমাম রেযা (আ.)-এর মাযার যিয়ারতে।
ইরানের ইসলামি বিপ্লব সারা দুুনিয়াকে ঝাঁকুনি দিয়ে জাগিয়ে দেয়া এক আলোকের বিস্ফোরণÑ যা মুসলমানসহ নির্যাতিত জাতিসমূহের ঘুম ভাঙাতে সহায়ক হয়েছিল। এই বিপ্লবের বিরুদ্ধে অঙ্কুরেই একে শেষ করে দেয়ার ষড়যন্ত্র হয়েছে, এখনো সেই ষড়যন্ত্র চলছে। দল-মত-মাযহাব-তরিকা নির্বিশেষে মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
আমিন আল আসাদ
سینه پرزور است
উচ্চারণ : সীনে পোর যুর আস্ত
অর্থ : বুক খুব শক্তিশালী।
মর্মার্থ : প্রতিপক্ষের শক্তির মাত্রা অনেক বেশি। সে এমন প্রতিপক্ষ যার সাথে শক্তি পরীক্ষা করা যায় না।
سنگ به در بسته می خورد
উচ্চারণ : সাঙ্গ বে দার বাস্তে মী খুরাদ
অর্থ : দরজা বন্ধ যার, পাথর গিয়ে তার ওপরই পড়ে।
মর্মার্থ : বালা-মুসিবত বেচারা অসহায়দের মাথায় আসে। কঠিন অবস্থা বেশির ভাগ অপেক্ষাকৃত দুর্বল লোকদের ওপরই পতিত হয়।
سنگ بزرگ برداشتن علامت نزدن است
উচ্চারণ : সাঙ্গে বোযোর্গ বারদা’শতান আলা’মাতে নাযাদান আস্ত
অর্থ : বড় পাথর উত্তোলন করা না মারার আলামত।
মর্মার্থ : অবাস্তব ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতি কখনো পূরণ করা হয় না। ধুমধাম বেশি করলে কাজের কাজ কিছুই হয় না। হম্বিতম্বি বেশি করলে বুঝতে হবে যে, কাজের কাজ কিছুই করবে না।
سنگ پیش پای کسی انداختن
উচ্চারণ : সাঙ্গ পীশে পা’য়ে কেসী আন্দা’খতান
অর্থ : কারো পায়ের সামনে পাথর ফেলা।
মর্মার্থ : কারো কোনো কাজের পথে বাধার সৃষ্টি করা বা কারো জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা অর্থে এই প্রবাদ ব্যবহৃত হয়।
سنگ تمام را برایش گذاشت
উচ্চারণ : সাঙ্গে তামা’ম রা’ বারা’য়াশ গোযা’শ্ত
অর্থ : তার জন্য সম্পূর্ণ পাথরটা রেখেছে।
মর্মার্থ : কাউকে ধারণার চেয়ে বেশি সাহায্য করা হয়েছে বুঝাতে এই প্রবাদ ব্যবহৃত হয়। কথায় বলে, তার জন্য যথেষ্ট করেছে। নিজের সাধ্যের চেয়ে বেশি তার উপকার করেছে।
سنگ روی یخ شدن
উচ্চারণ : সাঙ্গে রূয়ে ইয়াখ শোদান
অর্থ : চেহারার পাথর বরফ হয়ে যাওয়া।
মর্মার্থ : কাজে সাফল্য লাভ করতে না পারার কারণে মানুষের সামনে লজ্জিত হওয়া। নিজের মান-সম্মানে আঘাত লাগা, মানুষের চোখে হালকা হয়ে যাওয়া অর্থে এই প্রবাদ ব্যবহৃত হয়।
سنگ کسی رابه سینه زدن
উচ্চারণ : সাঙ্গে কেসী রা’ বে সীনে যাদান
অর্থ : কারো পাথর বুকে মারা।
মর্মার্থ : কারো প্রতি সমর্থন জানানো ও পক্ষপাতিত্ব করা। নিজেকে কারো সমর্থক হিসেবে প্রকাশ করা।
سنگ مفت کلاغ هم مفت
উচ্চারণ : সাঙ্গে মোফ্ত কালা’গ হাম মোফ্ত
অর্থ : পাথর মোফত, কাকও মোফত।
মর্মার্থ : তোমার তো খরচপাতি কিছুই নাই। যতখানি চাও ব্যবহার কর, কাজে লাগাও। কিসের অপেক্ষায় আছ- এই ভাবার্থ বুঝাতে এই প্রবাদটির প্রচলন ব্যাপক।
سنگی را که دیوانه¬ای در چاه بیندازد صد عاقل نمی تواند در بیاورد
উচ্চারণ : সাঙ্গী রা’ কে দীওয়া’নেঈ দার চা’হ বেয়ান্দা’যাদ সদ আ’কেল নেমী তাওয়া’নাদ দার বিয়া’ওয়ারাদ
অর্থ : যে পাথর কোনো পাগল কুয়ায় নিক্ষেপ করে শত বিদ্বান মানুষও তা উদ্ধার করতে পারে না।
মর্মার্থ : ভালোভাবে চিন্তা-ভাবনা করে কোনো কাজ আঞ্জাম না দিলে যে ক্ষয়ক্ষতি তা বহু জ্ঞানীগুণি লোকের পক্ষেও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয় না।
سوار خر شیطان شدن
উচ্চারণ : সাওয়া’রে খারে শায়তা’ন শোদান
অর্থ : শয়তানের গাধার পিঠে সওয়ার হওয়া।
মর্মার্থ : দুষ্টামি করতে থাকা। অন্যদের ক্ষতি করার পেছনে লেগে থাকা। অসম্ভব রকমের শয়তানি করা।
سوار کسی شدن
উচ্চারণ : সাওয়া’রে কেসী শোদান
অর্থ : কারো ওপর সওয়ার হওয়া।
মর্মার্থ : কারো ওপর নিজের ইচ্ছা চাপিয়ে দেয়া। কাউকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করা।
سوار از پیاده خبر ندارد
উচ্চারণ : সাওয়া’র আয পেয়া’দে খাবার নাদা’রাদ
অর্থ : পদাতিকের খবর আরোহীর নেই।
মর্মার্থ : যারা ধনসম্পদের অধিকারী, গরীবের খবর তাদের কাছে নেই। সম্পদশালীরা গরীবের অবস্থা উপলব্ধি করতে পারে না বুঝাতে এই প্রবাদ ব্যবহৃত হয়।
অনুবাদ : ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শাহাদাত এবং মুসলিম উম্মাহর দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা
মো. আশিফুর রহমান
ভূমিকা
যে কোন জাতি বা জনগোষ্ঠীর সফলতার জন্য যেমন শাসকগোষ্ঠীকে যোগ্যতাসম্পন্ন ও দক্ষ হতে হয়ে এবং যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হয়, তেমনি জনসাধারণকেও তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করতে হয়। যে কোন এক পক্ষের দায়িত্ব পালনে অবহেলা বা অমনোযোগিতা সেই জাতির জন্য দুর্ভোগ বয়ে আনে। কোন জনগোষ্ঠী যদি উন্নত বৈশিষ্ট্যের অধিকার হয়, কিন্তু কোনভাবে অপশক্তি ক্ষমতা কুক্ষিগত করে তাহলে সেই জনগোষ্ঠী দুর্গতিতে নিপতিত হয়। কারণ, শাসকের খারাপ বৈশিষ্ট্যের প্রভাব জনগণের মাঝে দ্রুত সংক্রমিত হয়ে পড়ে। অপরদিকে কোন জনগোষ্ঠীর শাসকবর্গ যদি উত্তম হয়, কিন্তু ব্যাপক জনগোষ্ঠী দুরাচারী হয় তাহলেও সেই জাতির ভাগ্যে অকল্যাণ ছাড়া অন্য কিছু জোটে না, যেমনটি ঘটেছিল ইমাম আলী (আ.) খেলাফতকালে।
মানব জাতির ইতিহাসে দেখা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শাসকবর্গ শাসনকার্যে স্বেচ্ছাচারিতা করেছে এবং জনগণের ওপর নানা বিষয় চাপিয়ে দিয়েছে। তবে সকল জাতিতে স্বেচ্ছাচারিতার ক্ষেত্র অভিন্ন বিষয়ে ছিল না; বরং একেক জাতি, একেক জনগোষ্ঠীতে শাসকবর্গের স্বেচ্ছাচারিতা ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে ছিল। কোথাও ক্ষমতার লোভ, কোথাও অর্থ-বিত্ত, কোথাও জাতিগত বিদ্বেষ, কোথাও বর্ণপ্রথা, কোথাও গোঁড়ামি, কোথাও কূপম-ূকতা, কোথাও ধর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান প্রভৃতি বিষয় তাদেরকে স্বেচ্ছাচারী করেছে। যখনই জনগণ এমন শাসকবর্গের বিরোধিতা করেছে, তখনই শাসকবর্গ জনগণের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়েছে, তাদেরকে দমন করেছে।
মুসলিম জাতি ও ইসলাম ধর্ম ব্যতীত যেহেতু অন্যান্য জাতি ও ধর্মের বর্তমান বিধি-বিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্য ও ধরন এবং দায়িত্ব ও কর্তব্যের বণ্টনের অবস্থা সকলের নিকট স্পষ্ট সেহেতু তাদের সম্পর্কে আলোচনা করায় কোন তেমন উপকারিতা নেই। আর তাই আমরা কেবল ইসলামি সমাজ নিয়ে কথা বলতে চাই।
ইসলাম এমন একটি ধর্ম যা মানব জীবনের সাথে সম্পৃক্ত সকল বিষয়ে কথা বলেছে, দিক-নির্দেশনা দিয়েছে। মহানবী (সা.) পবিত্র কোরআন থেকে মানুষকে তাত্ত্বিকভাবে যেমন শিক্ষা দিয়েছেন, তেমনি কোরআনের বিধি-বিধান কীভাবে ব্যবহারিকভাবে পালন করতে হয় সেই শিক্ষাও দিয়েছেন।
ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে শাসনকার্য পরিচালনা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়গুলোর একটি। মহানবী (সা.) মদীনায় হিজরত করার পরই একটি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন এবং দীর্ঘ দশ বছরের অধিককাল সময় তিনি শাসনকার্য পরিচালনার একটি বাস্তব রূপরেখা মুসলিম সমাজের সামনে উপস্থাপন করেন।
শাসকের বৈশিষ্ট্য, শাসকের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন, শাসকের দায়িত্ব-কর্তব্য ও অন্যান্য খুঁটি-নাটি বিষয় ইসলামে সুনির্দিষ্ট ভাষায় উল্লেখ রয়েছে, তেমনি জনগণের ভূমিকারও উল্লেখ রয়েছে। প্রশ্ন হলো মহানবী (সা.)-এর ওফাতের পর সার্বিকভাবে মুসলিম উম্মাহ তাদের ভূমিকা কি যথাযথভাবে পালন করতে পেরেছিল? প্রশ্নটি উত্থাপন করার পেছনে কিছু কারণ রয়েছে। যেমন মহানবী (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর পরিবার-পরিজন (আহলে বাইত) অর্থাৎ ইমাম আলী (আ.), হযরত ফাতিমা (আ.) ও তাঁদের দুই সন্তান বেহেশতের যুবকদের নেতা ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মর্যাদা সম্পর্কে মুসলমানদের সামনে অনেক কথা বলেছেন এবং তাঁদের প্রতি সম্মানজনক আচরণ করা ও তাঁদের প্রতি দায়িত্ব পালনের জন্য তাঁর উম্মতকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু ইসলামের এই চার মহান ব্যক্তিত্বের প্রতি যে আচরণ করা হয়েছে তা ইতিহাসের পাতায় লেখা রয়েছে। এখানে কেবল ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বিয়োগান্ত শাহাদাতের বিষয়ে আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখতে চাই, যেহেতু উম্মতের পূর্ববর্তী সকল অন্যায় আচরণকে তা ছাপিয়ে গিয়েছিল এবং মহানবী (সা.)-এর পরিবারের প্রতি নৃশংসতার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটেছিল।
আমরা জানি, সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (সা.) দীর্ঘ ২৩ বছর কঠোর সংগ্রামের মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে মহান আল্লাহর কাছে মনোনীত একমাত্র ধর্ম ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাতের পর থেকেই ইসলামের ইতিহাসে অনেক অবাঞ্ছিত ঘটনা সংঘটিত হতে থাকে। মুসলিম উম্মাহর মধ্যে অনৈক্য দেখা দেয়, কোন কোন মুসলিম ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে মুরতাদ হয়ে যায়। এমনকি ভ- নবীদেরও আবির্ভাব হয়। আর মুনাফিকদের ষড়যন্ত্র গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে। ২৫ হিজরিতে ষড়যন্ত্রকারীদের চক্রান্তে ইসলামের তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান নিহত হন। বিভ্রান্তি ছড়িয়ে মুসলিম উম্মাহকে কার্যত দুটি প্রধান ভাগে বিভক্ত করে ফেলা হয়। ইমাম আলী (আ.)-এর খেলাফতের সময়কালকে বিশৃঙ্খল করে ফেলা হয়। ষড়যন্ত্রকারী মুনাফিকদের চিনতে মুসলিম উম্মাহর ব্যর্থতা ও তাদের অমনোযোগিতা ও অসচেতনতার ফলে হযরত আলীর পক্ষে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। অবশেষে হযরত আলীকেও হত্যা করা হয়। ইমাম হাসানও তাঁর পক্ষের সেনাদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে কতিপয় শর্তসাপেক্ষে আমীরে মুয়াবিয়ার কাছে শাসনকর্তৃত্বের ভার ছেড়ে দেন। মুয়াবিয়া তাঁর অযোগ্য ও পাপিষ্ঠ পুত্র ইয়াযীদকে তাঁর পরবর্তী খলিফা নিযুক্ত করেন এবং তাঁর জীবদ্দশায়ই তিনি তার পক্ষে মুসলিম উম্মাহর বাইয়াত গ্রহণ করেন। তবে তিনি ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বাইআত আদায়ে ব্যর্থ হন। ৬০ হিজরিতে মুয়াবিয়া মারা গেলে ইয়াযীদ ইমাম হোসাইনের নিকট থেকে বাইআত চায়। কিন্তু ইমাম হোসাইন (আ.) তার বাইয়াত করতে অস্বীকার করেন এবং তার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠভাবে রুখে দাঁড়ান। অবশেষে ইমাম হোসাইনকে কারবালার মরু-প্রান্তরে এক অসম যুদ্ধে বাধ্য করা হয় এবং ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর অবস্থায় সঙ্গী-সাথি ও পরিজনসহ শহীদ করা হয়।
মুসলিম উম্মাহর ব্যর্থতা প্রসঙ্গ
মুসলিম উম্মাহ বলতে ইসলাম ধর্মাবলম্বী সকল ব্যক্তিকে বুঝায়- পৃথিবীর যে স্থানেই সে বসবাস করুক না কেন অথবা সমাজে তার অবস্থান যেটাই হোক না কেন। মুসলিম উম্মাহর ব্যর্থতার প্রসঙ্গটি একটু ভিন্নভাবে অর্থাৎ শাসক ও শাসিতের দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করতে চাই।
যদি শাসনকর্তৃত্বের দিক থেকে চিন্তা করা হয়, তবে মুসলিম উম্মাহর একদল শাসক আর অপর দলটি শাসিত। সাধারণভাবে শাসকশ্রেণির সাথে সম্পৃক্ত লোকজন বলতে নির্বাহী ও প্রশাসনিক কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ, বিচারকার্যের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ, সামরিক ব্যক্তিবর্গ এবং শাসকবর্গের পক্ষ থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অন্যান্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গের কথা বলা যায়। আর শাসিত শ্রেণি বলতে অবশিষ্ট জনগণকে বুঝায়। এই শ্রেণির মধ্যে রয়েছে আলেম, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী, চাকুরিজীবী, শ্রমিক, মজুর, সাধারণ মানুষজন ইত্যাদি। যদিও এদের মধ্য থেকে অনেকেই প্রশাসনের সাথেও জড়িত থাকে।
যদি ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সময়ে মুসলিম উম্মাহর এই দুই শ্রেণির দিকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখব, শাসক শ্রেণি জালিমের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল আর শাসিত শ্রেণি অন্ধ, বধির ও কালায় পরিণত হয়েছিল।
ইমাম আলী (আ.) বলেন : ‘…সৎ শাসক বিনা নাগরিকরা সৎ হয় না। আবার নাগরিকদের অবিচলতা ব্যতীত শাসকরা সংশোধন হয় না। কাজেই যখন জনগণ শাসকের অধিকার পূরণ করে এবং শাসকও জনগণের অধিকার পূরণ করে, তখন তাদের মাঝে অধিকার সমুন্নত হয়, দ্বীনের পথসমূহ প্রতিষ্ঠিত হয়, ন্যায়পরায়ণতার নিদর্শনসমূহ ভারসাম্য লাভ করে এবং সুন্নাহসমূহ আপন ধারায় প্রবাহিত হয়।…’- নাহজুল বালাগা, খুতবা নং ২৭২
যা-হোক, মুসলিম উম্মাহর পরিচালনার যে দায়িত্ব পালন করতেন সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (সা.) সেই অবস্থানে অধিষ্ঠিত করা হয়েছিল ইয়াযীদকে, যে ছিল আকণ্ঠ পাপাচারে নিমজ্জিত; সে প্রকাশ্যে মদ পান ও ব্যাভিচার করত, নামায পরিহার করে চলত, রাজদরবারে বানর নিয়ে খেলা করত। এর কোন্টি মুসলিম শাসকের গুণাবলির অন্তর্ভুক্ত ছিল? এমনকি একজন সাধারণ মুসলমানের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্যগুলো থাকলে তাকে ফাসেক বলে গণ্য করা হতো; তাকে নামাযের ইমাম হওয়ার অযোগ্য ঘোষণা করা হতো। অথচ ইয়াযীদকে এই বৈশিষ্ট্যগুলোসহই উম্মতের কাণ্ডারি বলে মেনে নেয়া হয়!
শাসকবর্গ কি দায়িত্ব পালন করেছিল?
ইমাম আলী (আ.) বলেন : ‘শাসকরাই আল্লাহর জমিনে তাঁর পাহারাদার।’ কিন্তু শাসকরা কেমন ভূমিকা পালন করেছিল? তারা কি তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছিল? নিচে এ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।
প্রশাসনিক কর্মকর্তাবৃন্দ
চল্লিশ হিজরিতে ইমাম আলী (আ.)-এর শাহাদাতের পর থেকে প্রায় ২০ বছর আমীরে মুয়াবিয়া মুসলিম উম্মাহর খলিফা হিসেবে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। এই সময়ে তিনি প্রশাসনের উচ্চতম পদ থেকে শুরু করে নিম্নতম পদ পর্যন্ত বনু উমাইয়্যা ও তাঁর অনুগত লোকদেরকে নিয়োগ দেন। তাঁর নির্দেশে তারা প্রশাসনের বিরোধীদেরকে কঠোরভাবে দমন করে; অনেককে হত্যা করে, অনেককে পঙ্গু করে দেয়, অনেককে জেলে বন্দি করে অথবা নির্বাসনে পাঠায়। অন্যদিকে এই সকল ব্যক্তি জনসাধারণের ওপর ব্যক্তি আক্রোশ মিটানোর জন্য অত্যাচার-নির্যাতন করলেও মুয়াবিয়া তাদেরকে কিছু বলতেন না। আর একারণেই যখন তিনি ইয়াযীদকে তাঁর পরবর্তী উত্তরাধিকারী বলে ঘোষণা দেন ও জনগণের কাছ থেকে বাইআত আদায় করার জন্য বিভিন্ন প্রদেশের গভর্নরদেরকে নির্দেশ দেন তখন তাঁকে তেমন কোন বেগই পেতে হয় নি। প্রায় প্রতিটি অঞ্চলের গভর্নর ও অন্যান্য প্রশাসনিক কর্মকর্তা ইয়াযীদকে মেনে নেয়।
বিচারকার্যের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ যে ভূখণ্ডের শাসনকর্তৃত্বে অত্যাচারীরা অধিষ্ঠিত হয় সেই ভূখণ্ডের বিচারকার্যের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। মুসলিম ভূখণ্ডেও একই রকম ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। বিচারকরা সরকারের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছিল। বিচারকরা শাসকগোষ্ঠীর কৃপাদৃষ্টি অর্জনের জন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের পক্ষে রায় ঘোষণা করত। আর যারা সরকারের বিরোধিতা করত তাদেরকে তৎক্ষণাৎ বহিষ্কার করা হতো।
সেনাবাহিনী
ইমাম আলী (আ.) সৈন্যদের মর্যাদা ও দায়িত্ব সম্পর্কে বলেন : ‘সৈন্যরা আল্লাহ্র অনুমতিক্রমে জনগণের দুর্গস্বরূপ এবং শাসকদের শোভা, দীনের সম্মান এবং শান্তি ও শৃঙ্খলা বিধানকারী।’
কিন্তু আমীরে মুয়াবিয়ার শাসনামলে নবী-পরিবারের প্রতি অপবাদ ও অপপ্রচারের কারণে সিরিয়ার সেনাবাহিনী প্রথম থেকেই নবী-পরিবারের প্রতি বিদ্বেষী ছিল। সেকারণে তারা মুয়াবিয়ার আনুগত্যের ক্ষেত্রে কখনই দ্বিধাদ্বন্দ্বে পতিত হয় নি। কিন্তু মুসলিম বিশ্বের অপরাপর অঞ্চলের সেনাবাহিনীর মধ্যে তাঁর আনুগত্যের ব্যাপারে যে দ্বিধাগ্রস্ততা ছিল মুয়াবিয়া সুকৌশলে তা দূর করেন। তিনি মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলের সেনাবাহিনীকে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে করায়ত্ত করেন। এরপর যখন তিনি ইয়াযীদকে খলিফা বলে ঘোষণা দেন তখন সেনাবাহিনী তাঁর প্রতি নিরঙ্কুশ আনুগত্য প্রকাশ করে। বিভিন্ন স্থানে যে মুষ্টিমেয় সংখ্যক বিরোধিতা করে তাদেরকে প্রথমে ভীতি প্রদর্শন করা হয়, অতঃপর তাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন শুরু হয়।
সাধারণত সেনাপতির সিদ্ধান্তই সৈন্যরা বাস্তবায়ন করে থাকে। আর তাই সেনাপতি নিয়োগে ইসলামের নির্দেশনা হলো সেই ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি সর্বাধিক নিষ্ঠাবান ও নিবেদিতপ্রাণ হবে; সকলের চেয়ে খোদাভীরু, নম্র-ভদ্র, ধৈর্যশীল, জ্ঞানী এবং সুপরিচালক হবে। দুর্বলদের প্রতি দয়ার্দ্র হবে আর শক্তিমানদের প্রতি হবে কঠোর। ক্ষমতা তাকে জিঘাংসাপরায়ণ করবে না, আবার হীনমন্যতা তাকে পর্যুদস্ত করবে না। তারা ক্রোধে শ্লথ এবং ক্ষমায় দ্রুতগতির হবে।
অথচ এ সকল বৈশিষ্ট্যের বিপরীতে ইয়াযীদের সময় উমর ইবনে সাদ, উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদের মতো অধার্মিক, জীঘাংসু মনোবৃত্তিসম্পন্ন ও কঠোর হৃদয়ের অধিকারী লোকদেরকে সেনাপতির পদে নিয়োগ দেয়া হয়। যারা তাদের বিরোধীদের প্রতি সবচেয়ে নির্মম আচরণ প্রদর্শন করে।
সুতরাং বলা যায়, ইয়াযীদের শাসনকালে পুরো শাসনকার্যের সাথে সংশ্লিষষ্ট প্রতিটি বিভাগ চরমভাবে তার আনুগত্য করতে থাকে এবং বিরোধীদের মোকাবিলায় কঠোরতার পরিচয় দেয়।
উম্মতের সাধারণ শ্রেণির ব্যর্থতার প্রসঙ্গ
আলেম শ্রেণি
সাধারণ উম্মাহর ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম যে শ্রেণিটির কথা উল্লেখ করতে হয় তা হচ্ছে আলেম শ্রেণি। আলেমগণের সম্মান প্রসঙ্গে হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) এরশাদ করেন : ‘আবেদের (ইবাদতকারীর) ওপর আলেমের শ্রেষ্ঠত্ব তারকাদের ওপর পূর্ণিমার চাঁদের শ্রেষ্ঠত্বের সমতুল্য।’
‘আল্লাহ্র কাছে আলেমগণ অধিকতর সম্মানিত, নাকি শহীদগণ?’- মহানবী (সা.)-এর এমন এক প্রশ্নের জবাবে জিবরাইল (আ.) বলেন : ‘আল্লাহ্র কাছে একজন আলেম এক হাজার শহীদের তুলনায়ও অধিকতর সম্মানিত। কারণ, আলেমগণ নবী-রাসূলগণের (আ.) অনুসরণ করেন এবং শহীদগণ আলেমগণের অনুসরণ করেন।’
অপর এক প্রসিদ্ধ হাদিসের বক্তব্য অনুসারে আলেমগণ হলেন নবী-রাসূলগণের উত্তরসূরি। তাঁদেরকে মানুষ দুনিয়ার বুকে আল্লাহর বিধান প্রচার ও বলবৎ রাখার ব্যাপারে দায়িত্বশীল মনে করে। জনসাধারণ তাঁদেরকে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে এবং বিভিন্ন বিষয়ে তাঁদের পথনির্দেশনা ও পরামর্শ কামনা করে।
ইয়াযীদের শাসনকালে সেই আলেম সমাজ দায়িত্ব পালনে সবচেয়ে বেশি দুর্বলতার পরিচয় দেয়। ইমাম আলী (আ.)-এর খেলাফতকালেই মুয়াবিয়ার শাসনাধীন অঞ্চলে মসজিদের মিম্বার থেকে হযরত আলী (আ.) ও আহলে বাইতকে গালিগালাজ করা হতো, যেটি অব্যাহত ছিল ৯৯ হিজরিতে উমর ইবনে আবদুল আযীযের খেলাফতে অধিষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত।
ইমাম হোসাইন (আ.) বলেন : ‘… আর (ইয়াযীদের শাসনকালে) প্রত্যেক জনপদে মিম্বারের ওপরে (তাদের মুখপাত্র হিসাবে) একজন বাকপটু খতীব রেখেছে এবং গোটা দেশ তাদের পদতলে এবং তাদের হাত সর্বত্র প্রসারিত। আর জনগণ তাদের নিয়ন্ত্রণে।’…
ইয়াযীদের শাসনকালে সরকার নিযুক্ত আলেমগণ পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াতের অপব্যাখ্যা দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করত। তারা আহলে বাইতের মর্যাদা সম্পর্কিত পবিত্র কোরআনের আয়াতের ভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা দিত; পূর্বকালের ইহুদি ও খ্রিস্টান পণ্ডিতদের মতো নিজেদের বিরুদ্ধে যা যেত তা বর্ণনা করা থেকে বিরত থাকত। অর্থ-বিত্ত ও পদমর্যাদা লাভ তাদের মন-মস্তিষ্ককে আচ্ছন্ন করে ফেলে। অথচ জনগণ তাদের কাছেই হেদায়াত লাভের জন্য যেত।
অপরদিকে আলেমদের আরেকটি দল সামাজিক ও রাজনীতির বিষয়গুলো থেকে নিজেদেরকে গুটিয়ে রেখে শুধু ব্যক্তিগত আমল ও কোরআন-হাদিস বর্ণনা করার মশগুল হয়ে পড়েন। তাঁরা সত্যের সমর্থনে ভূমিকা পালন না করে নির্লিপ্ত থেকে বরং মিথ্যাকেই প্রতিষ্টিত হওয়ার সুযোগ করে দেন।
ব্যবসায়ী শ্রেণি
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাতের পর থেকেই মুসলমানদের মধ্যে একটি ধনিক ও পুঁজিপতি শ্রেণির আবির্ভাব ঘটতে থাকে। তারা যে কোন পন্থায় সম্পদ আহরণের দিকে মনোনিবেশ করে। তারা সরকারি ভাতা ও সুযোগ-সুবিধার পেছনে ছোটে। ব্যবসায়ী শ্রেণি সম্পদ পুঞ্জিভূত করতে থাকে। অধিকাংশ ব্যবসায়ীর কাছে নিজেদের স্বার্থ বড় হয়ে দেখা দেয়। শাসনক্ষমতায় কে অধিষ্ঠিত হলো তা তাদের মাথাব্যথার কারণ ছিল না। এভাবে দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসার কারণে ইসলাম ও মুসলমানদের কল্যাণ তাদের কাছে গৌণ বিষয়ে পরিণত হয়।
সাধারণ জনগোষ্ঠী
সমাজে সাধারণ জনগোষ্ঠীর গুরুত্ব সম্পর্কে ইমাম আলী (আ.) বলেন : ‘সাধারণ প্রজারাই তো দীনের ও মুসলিম সমাজের স্তম্ভ। শত্রুদের মোকাবিলায় প্রধান হাতিয়ারও হলো উম্মাহর মধ্য থেকে সাধারণ জনগণই।’
এর বিপরীতে ইয়াযীদের সময়কালে সাধারণ জনগোষ্ঠী চরমভাবে নিষ্পৃহতার পরিচয় দেয়। অবশ্য সর্বসাধারণ মুসলমানদের মধ্যে পার্থিব জীবনের প্রতি আগ্রহ ও ভোগবাদী প্রবণতা নতুন ছিল বলা যাবে না, এ প্রবণতা আগেও ছিল। এমনকি মহানবী (সা.)-এর যুগে তাবুক অভিযানের ব্যাপারে মহান আল্লাহ রাসূলের একদল অনুসারীর গরিমসির ব্যাপারে আয়াত নাযিল করেছিলেন। একইভাবে আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-এর সময়ও সত্যের পক্ষে সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে অসচেতনতা ও গাফিলতি লক্ষ্য করা যায়। এমনকি তিনি মহান আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেন : ‘আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি অচিরেই যেন তিনি আমাকে এ জনগণ থেকে মুক্তি দেন।’… আর ইমাম হাসানের ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি অভিন্ন ছিল।
সাধারণ জনগণের চরিত্র সম্পর্কে ইমাম আলী (আ.) বলেন, ‘…জনগণ রাজা-বাদশাহদের সাথে, (তারা) দুনিয়ার অনুসারী। আর এই দুনিয়াই তাদের অভীষ্ট যা তারা অন্বেষণ করে, শুধু আল্লাহ্ যাকে রক্ষা করেন সে ব্যতীত।’ এমনকি হযরত আলী (আ.) জনসাধারণের অবস্থা সম্পর্কে এই উক্তিও করেন যে, ‘জনগণ তাদের পিতাদের চেয়ে বেশি তাদের শাসকবর্গের সদৃশ।’
বাস্তব অবস্থা পর্যালোচনা করলে ইমাম আলী (আ.)-এর বক্তব্যের সত্যতা পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। মুসলিম বিশে^র সর্বত্র অধার্মিকতা, অনৈতিকতা, অরাজকতা বিরাজ করলেও জনসাধারণ সেই অবস্থার সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেয়। আর তাই ইমাম হোসাইনের আহ্বান তাদের কাছে মূল্যহীন হয়ে পড়ে। মদীনা থেকে মক্কা ও মক্কা থেকে কুফার পথে যাত্রায় ইমাম হোসাইন ইয়াযীদের হাতে বাইআত না করার কারণ জনগণের সামনে তুলে ধরেন, তাদেরকে তাঁর আন্দোলনে শরীক হওয়ার জন্য আহ্বান জানান, কিন্তু জনগণ নির্লিপ্ততা প্রদর্শন করে। কুফার জনসাধারণ তাঁর প্রতি যে আনুগত্য দেখিয়েছিল তা ছিল নিজেদেরকে একটি কঠিন অবস্থা থেকে মুক্ত করার জন্য তাৎক্ষণিক আবেগের বহিঃপ্রকাশ। এই আনুগত্যে না ছিল বিবেক-বুদ্ধির ব্যবহার, না ছিল কোনরূপ দূরদর্শিতা। একারণেই উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদের কুফায় আগমন তাদেরকে ইমাম হোসাইনের সাথে কৃত অঙ্গীকার পালনে দৃঢ়পদ রাখতে পারে নি।
উম্মাহকে দায়িত্ব সচেতন করার ব্যাপারে ইমাম হোসাইনের প্রচেষ্টা
ইমাম হোসাইন (আ.) তৎকালীন মুসলিম উম্মাহর অবস্থা সম্পর্কে যেমন পূর্ণরূপে অবগত ছিলেন, তেমনি তিনি তাঁর করণীয় সম্পর্কেও সর্বদা সচেতন ছিলেন। একজন ইমাম হিসেবে তিনি পুরো মুসলিম উম্মাহর প্রতি তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর আহ্বান যেমন ছিল শাসকগোষ্ঠীর প্রতি, তেমনি ছিল শাসিত গোষ্ঠীর প্রতি। ইমাম হোসাইনের এই প্রচেষ্টা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করতে চাই।
শাসকগোষ্ঠীর প্রতি দায়িত্ব পালন
ইয়াযীদের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার ব্যাপারে ইমাম হোসাইন (আ.) যে উক্তিটি করেছিলেন তা হলো : ‘উম্মাহ্ যখন ইয়াযীদের ন্যায় শাসকের কবলে পড়েছে তখন ইসলামকে বিদায়!’ অর্থাৎ ইমাম হোসাইন জানতেন যে, ইয়াযীদ এমন এক ব্যক্তি যার উদ্দেশ্যই হচ্ছে ইসলামকে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা। আর তাই তাকে উপদেশ-নসিহত করায় কোন লাভ নেই।
অন্যদিকে ইয়াযীদের অধীন গভর্নরদের অনমনীয়তা সম্পর্কে ইমাম হোসাইন (আ.) খুব ভালোভাবে অবগত ছিলেন। ইমাম হোসাইন (আ.) জানতেন যে, অনৈসলামিক চর্চায় অভ্যস্ত ও পার্থিব বিষয়াদিতে মগ্ন হয়ে যাওয়া শাসকগোষ্ঠীকে কোনভাবে বোঝানো সম্ভব নয়। কোন কোন এলাকার শাসনকর্তা হয়তো তাঁর প্রতি সহানুভূতি দেখাতে পারে-যার উদাহরণ হিসেবে মদীনার গভর্নর ওয়ালীদ ইবনে উতবা ও কুফার গভর্নর নোমান ইবনে বশীরের কথা উল্লেখ করা যায়-কিন্তু তা কোন ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে না। আর তাই তিনি তাদের সাথে তেমন কথা বলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন নি। কিন্তু যখন কারবালায় তিনি উমর ইবনে সাদ ও শিমারের মুখোমুখী হন তখনও তিনি তাদেরকে উপদেশ দেন, তাদেরকে সতর্ক করেন এবং সঠিক দায়িত্ব পালনের জন্য আহ্বান জানান।
উমর ইবনে সাদকে ইমাম হোসাইন বলেন : ‘তুমি আমাকে হত্যা করবে? আমি মনে করি না যে, পিতৃপরিচয়হীনের পুত্র পিতৃপরিচয়হীন (উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদ) রেই ও গোরগানের শাসনক্ষমতা তোমাকে অর্পণ করবে। আল্লাহ্র শপথ, কখনই তা ঘটবে না। আমার এ অঙ্গীকার এমন এক অঙ্গীকার যেন তা বাস্তবায়িত হয়েই আছে। তুমি যা চাও তা করতে পার, কিন্তু জেনে রেখ, আমার (শাহাদাতের) পরে তুমি না দুনিয়ায়, না আখেরাতে- কোথাও আনন্দের মুখ দেখতে পাবে না।…’
পরবর্তী ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, যে পদের লোভে উমর ইবনে সাদ ইমাম হোসাইন (আ.)-কে হত্যা করেছিল সেই পদ তাকে দেয়া হয় নি এবং ইমাম হোসাইনের কথাই সত্যে পরিণত হয়েছিল।
ইমাম হোসাইন শিমারকে প্রশ্ন করেন : ‘তোমার কি এ ব্যাপারেও কোন সন্দেহ আছে যে, আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কন্যার সন্তান? আল্লাহ্র শপথ, এ বিশ্বে পূর্ব ও পশ্চিমের দুই প্রান্তের মধ্যবর্তী ভূখণ্ডে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কন্যার পুত্র আমি ছাড়া আর কেউ নয়। তোমার জন্য পরিতাপ! আমি কি তোমার কাউকে হত্যা করেছি যে, আমার কাছ থেকে তার রক্তের বদলা আদায় করতে চাচ্ছ? আমি কি তোমার কোন সম্পদ বিনষ্ট করেছি, নাকি আমার কাঁধে কারও কেসাসের দায় রয়েছে যা তুমি কার্যকর করতে চাচ্ছ?’
ইমাম হোসাইন শাসকগোষ্ঠীকে সতর্ক করলেও পার্থিব স্বার্থের মোহ তাদেরকে অন্ধ করে ফেলে। তারা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
আলেমগণের প্রতি দায়িত্ব পালন
আমীর মু‘আবিয়ার জীবনের শেষ বছরে তথা কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার এক বছর আগে হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) পবিত্র মক্কা নগরীর পার্শ্ববর্তী মীনায় মদীনার আলেম ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে এক বৈঠকে মিলিত হন। এ বৈঠকে তিনি যে ভাষণ প্রদান করেন তা থেকে কিছুটা এখানে উল্লেখ করা সংগত মনে করছি। তিনি বলেন : ‘হে লোকসকল! আল্লাহ্ তা‘আলা (বনি ইসরাইলের) আলেমদের যে তিরস্কার করেছেন ও উপদেশ দিয়েছেন তা থেকে তোমরা শিক্ষা ও উপদেশ গ্রহণ কর। তিনি এরশাদ করেছেন : ‘কেন (তাদের মধ্যকার) রাব্বানিগণ (আরেফ ও দরবেশগণ) ও আলেমগণ তাদের পাপ-কথা বলতে ও হারাম ভক্ষণ করতে নিষেধ করল না?’
আল্লাহ্ আরও এরশাদ করেছেন : ‘বনি ইসরাইলের মধ্যে যারা কুফরীতে লিপ্ত হয়েছিল তাদেরকে দাউদ ও ঈসা ইবনে মারইয়ামের কণ্ঠে অভিসম্পাত করা হয়। কারণ, তারা নাফরমানী করত ও (আল্লাহ্র নির্ধারিত) সীমা লঙ্ঘন করত। তারা যে সব মন্দ কাজ করত তা থেকে তারা পরস্পরকে নিষেধ করত না; তারা যা করত তা কতই না নিকৃষ্ট কর্ম!’
ইমাম হোসাইন (আ.) এসব আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, মহান আল্লাহ্ তা‘আলা আলেমদেরকে এভাবে তিরস্কার করেছেন এ কারণে যে, তারা যালেম ও পাপাচারীদেরকে যুলুম ও পাপ কাজ করতে এবং ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করতে দেখত, কিন্তু তাদের কাছ থেকে পার্থিব সুযোগ-সুবিধা লাভ ও যুলুমের হাত থেকে নিরাপদ থাকার উদ্দেশ্যে তাদেরকে এসব থেকে নিষেধ করত না।
আলেমদের প্রতি জনসাধারণের আশা-আকাক্সক্ষার কথা তুলে ধরে ইমাম হোসাইন বলেন : ‘…এ সব কি কেবল এ কারণে সম্ভব হচ্ছে না যে, মানুষ তোমাদের ওপর এ মর্মে আশাবাদী যে, তোমরা আল্লাহ্ তা‘আলা কর্তৃক নির্ধারিত অধিকারসমূহ পুনরুদ্ধারের জন্য রুখে দাঁড়াবে? কিন্তু বেশির ভাগ বিষয়েই তোমরা আল্লাহ্ তা‘আলা কর্তৃক নির্ধারিত দায়িত্ব পালনে শৈথিল্য প্রদর্শন করেছ এবং ইমামগণের অধিকারসমূহকে খুব হাল্কাভাবে নিয়েছ, আর দুর্বলদের অধিকারকে পয়মাল করেছ।’
পবিত্র কোরআনের বক্তব্য অনুসারে যেহেতু ‘আল্লাহ্র বান্দাদের মধ্যে কেবল আলেমগণই তাঁকে ভয় করে চলে’ সেজন্য তিনি আলেমদেরকে সম্বোধন করে বলেন : ‘…তোমরা আল্লাহ্ তা‘আলার সাথে কৃত অঙ্গীকারসমূহ ভঙ্গ হতে দেখছ, কিন্তু এ ব্যাপারে টু-শব্দটিও করছ না এবং এ ব্যাপারে তোমাদের মধ্যে আল্লাহ্ তা‘আলার ভয়ও সৃষ্টি হচ্ছে না। তোমাদের পূর্বপুরুষদের কতক অঙ্গীকার বিপর্যস্ত হয়ে যাওয়ায় তোমরা বিলাপ করছ, অথচ রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সাথে কৃত অঙ্গীকার ও চুক্তিসমূহকে উপেক্ষা করছ।… বরং তোমরা কেবল নিজেদের স্বার্থ ও আরাম-আয়েশের জন্য যালেম-অত্যাচারীদের তোষামোদ করছ।
আলেমসমাজ ইমাম হোসাইনের বক্তব্যের প্রতি ইতিবাচক সাড়া প্রদান করা থেকে বিরত থাকে। তারা অত্যাচারী ও ধর্মহীন শাসনব্যবস্থার মোকাবিলায় হীনতাকে বেছে নেয়। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, ষাট হিজরিতে যখন ইমাম হোসাইন (আ.) ইয়াযীদের বিরুদ্ধে সতর্ককারী প্রচারণার আন্দোলন শুরু করেন তখন ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ বা ফতোয়া দেয়ার কর্তৃত্বশীল (বিচারকশ্রেণি) তিনশ’র অধিক মুফতি ইয়াযীদের অনুকূলে ইমাম হোসাইনকে হত্যা করা জায়েয বলে ফতোয়া প্রদান করে।
জনসাধারণের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য
যে কোন আন্দোলন-সংগ্রামের জন্য জনসাধারণের অংশগ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জনসাধারণের অংশগ্রহণ ছাড়া কোন আন্দোলন সফল হতে পারে না। ইমাম হোসাইনও চেয়েছিলেন মুসলিম জনগণকে সেই আন্দোলনে শামিল করতে। কিন্তু জনগণ যেমন শাসকবর্গের অধীনতা মেনে নিয়েছিল তেমনি কোন বিচার-বিবেচনা ছাড়াই শাসকের অনুগত আলেমগণের অনুসরণ করত। অথচ হযরত ঈসা (আ.) এমন আলেমদের ব্যাপারে বলেন : ‘নিকৃষ্টতম মানুষ হচ্ছে সেই আলেম যে তার দুনিয়াকে তার দ্বীনের ওপর অগ্রাধিকার দিয়েছে, দুনিয়াকে ভালোবেসেছে, দুনিয়া লাভের জন্য চেষ্টা-সাধনা চালিয়েছে এবং এক্ষেত্রে তার চেষ্টা-সাধনা এমনই যে, তা মানুষকে বিস্মিত করে…।’
আলেমগণের অনুসরণ প্রসঙ্গে হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর একটি হাদিসের প্রতি দৃষ্টি দেয়া যেতে পারে। তিনি (সা.) বলেন : ‘ফকীহ্গণ নবী-রাসূলগণের আমানতদার, যতক্ষণ না তারা দুনিয়ায় প্রবেশ করে।’ প্রশ্ন করা হলো : ‘হে আল্লাহ্র রাসূল! দুনিয়ায় প্রবেশের মানে কী?’ জবাবে তিনি এরশাদ করেন : ‘আধিপত্যের (রাজা-বাদশাহ্, সরকার ও শক্তিমানদের) অনুসরণ। তারা যখন এরূপ করবে তখন তোমরা স্বীয় দ্বীনের ব্যাপারে তাদের থেকে সতর্ক থেক।’
যখন জনগণ আলেমদের শোচনীয় অবস্থা লক্ষ্য করেছিল, তখন তাদের উচিত ছিল রাসূলের এই হাদিসের নির্দেশনা অনুযায়ী সেই আলেমদেরকে পরিত্যাগ করা। কিন্তু তারা তা করে নি।
ইমাম হোসাইন (আ.) জনসাধারণকে অত্যাচারী ও ধর্মহীন শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। তিনি আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে জনগণকে সচেতন করার চেষ্টা করেছেন। তিনি জনগণকে সম্বোধন করে বলেন : ‘তোমরা কি দেখতে পাচ্ছ না যে, সত্যের ভিত্তিতে কাজ করা হয় না এবং বাতিল থেকে বিরত থাকা হচ্ছে না? অতএব, (এহেন পরিস্থিতিতে) যথার্থভাবেই মু’মিনের উচিত তার রবের সাথে সাক্ষাতের জন্য আগ্রহী হওয়া।’
তিনি তাদেরকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন : ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ্র কৃত হারামকে হালালকারী, তাঁর (আল্লাহ্র গৃহীত) অঙ্গীকার ভঙ্গকারী ও রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সুন্নাতের বিরোধিতাকারী কোন নিপীড়ক শাসককে আল্লাহ্র বান্দাহ্দের মধ্যে পাপাচার ও দুর্বৃত্তপনা করতে দেখে, সে যদি তার কাজ বা কথার মাধ্যমে তাকে প্রতিহত না করে, তাহলে আল্লাহ্র জন্য দায়িত্ব হয়ে যায় যে, তাকে (প্রতিহতকরণে বিরত ব্যক্তিকে) তার (নিপীড়ক শাসকের) প্রবেশদ্বার দিয়ে (জাহান্নামে) প্রবেশ করাবেন।’
এমনকি যারা কুফা থেকে চিঠি লিখে ইমাম হোসাইনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিল, কিন্তু পরে ইয়াযীদের দলে যোগ দিয়েছিল তাদেরকে উদ্দেশ্য করে আশুরার দিন ইমাম হোসাইন বলেন : ‘হে কুফাবাসী! তোমাদের মায়েরা তোমাদের শোকে ক্রন্দন করুক। তোমরা আল্লাহ্ তা‘আলার এ নেক বান্দাহ্কে দাওয়াত করেছিলে এবং বলেছিলে : আমরা আপনার পথে জীবন বিলিয়ে দেব। কিন্তু এখন তোমরা তার বিরুদ্ধে তোমাদের তলোয়ারগুলোকে উন্মুক্ত করেছ এবং তাকে সকল দিক থেকে অবরুদ্ধ করে ফেলেছ। তোমরা তাকে এ বিশাল পৃথিবীর যেখানে ইচ্ছা চলে যাবার জন্য সুযোগ দিচ্ছ না। এখন সে বন্দির মত তোমাদের হাতে আটকা পড়ে আছে। তোমরা তাকে এবং তার পরিবারের নারী ও কন্যাদের ফোরাতের পানি পান করতে বাধা দিয়েছ, অথচ ইহুদি ও খ্রিস্টান গোত্রসমূহের লোকেরাও সেখান থেকে পানি পান করছে। এমনকি পিপাসায় আমাদের পশুগুলোর প্রাণও ওষ্ঠাগত হয়েছে এবং সেগুলো ছটফট করছে ও গড়াগড়ি দিচ্ছে। তোমরা রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর বংশধরদের ব্যাপারে তাঁর বর্ণিত মর্যাদার সীমারেখাকেও রক্ষা কর নি। মহাপিপাসার দিনে আল্লাহ্ তোমাদের পরিতৃপ্ত না করুন।’
তিনি আরো বলেন : ‘হে লোকসকল! …আমি বলছি, তোমরা আল্লাহ্কে ভয় কর এবং আমাকে হত্যা কর না। কারণ, আমাকে হত্যা করা বা অবমাননা করা তোমাদের জন্য জায়েয নয়। আমি তোমাদের রাসূলের কন্যার সন্তান, আর আমার নানী খাদীজাহ্ তোমাদের রাসূলের স্ত্রী। হয়ত রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর সেই কথা তোমাদের কাছে পৌঁছে থাকবে যে, তিনি এরশাদ করেছেন : ‘হাসান ও হোসাইন হচ্ছে বেহেশতবাসী যুবকদের দুই নেতা।’…
প্রকৃতপক্ষে যখন কোন জাতি তার বিবেক-বুদ্ধি হারিয়ে ফেলে ধর্মহীন পার্থিব বিষয়কে আঁকড়ে ধরতে চায় তখন কোন উপদেশ-নসিহত কাজে লাগে না। তেমনি তৎকালীন মুসলিম সমাজ বিবেক-বুদ্ধিহীন একটি সমাজে পরিণত হয়েছিল যেখানে বেহেশতের যুবকদের নেতা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর উপদেশ, নসিহত ও সতর্ক বাণীও সাধারণ মানুষের চৈতন্য ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়।
উপসংহার : অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠী যত শক্তিশালীই হোক না কেন, যদি জনসাধারণ সেই শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় তাহলে তাদের পতন অবশ্যম্ভাবী- যার বহু নজির বিশ্বে রয়েছে। আর এ রুখে দাঁড়ানোর জন্য প্রয়োজন লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের ব্যাপারে জনগণের সচেতনতা, লক্ষ্যে পৌঁছানোর ব্যাপারে দৃঢ় মনোভাব ও অঙ্গীকারাবদ্ধতা, জনগণের একতাবদ্ধতা, সর্বোপরি বৃহত্তর কল্যাণের লক্ষে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত হওয়া। কিন্তু অবৈধ ও ইসলামবিরোধী শাসকের বিরুদ্ধে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আন্দোলন ও সংগ্রামে তৎকালীন আলেম সমাজ, বুদ্ধিজীবী শ্রেণি, ব্যবসায়ী, সাধারণ মুসলমান নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেয়।
মুসলিম উম্মাহ ব্যর্থ হলেও ইমাম হোসাইন (আ.) তাঁর দায়িত্ব সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম পন্থায় আঞ্জাম দেন। তিনি অত্যাচারী ও অবৈধ শাসনব্যবস্থার সামনে আনুগত্য প্রদর্শন করেন নি এবং অপমান ও হীনতাকে মেনে নেন নি। তিনি বলেছিলেন : ‘দূর হোক লাঞ্ছনা আমা থেকে; আমি কখনই লাঞ্ছনা মেনে নেব না।’…
ইমাম হোসাইন (আ.) ইসলামের পুনরুজ্জীবনের জন্য তাঁর পরিবার-পরিজন ও সাথিদের নিয়ে দায়িত্ব পালন ও আত্মত্যাগের সর্বোচ্চ আদর্শ স্থাপন করেন। ইমাম হোসাইনের শাহাদাত বরণের পরই মানুষ তাঁর শাহাদাতের কারণ উদ্ঘাটনে তৎপর হলো, শাসকবর্গের চরিত্র অনুসন্ধানের ফলে তাদের চরিত্র প্রকাশিত হতে লাগল। শুরু হলো একের পর বিদ্রোহ। মদীনা, কুফা, মক্কাসহ ইসলামি বিশ্বের নানা অঞ্চলে বিদ্রোহ দেখা দিল। অল্প সময়ের ব্যবধানে কুফায় স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন হয়। ইমাম হোসাইনের হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতদেরকে শাস্তি দেয়া হয়। এভাবে প্রতিরোধ ও বিদ্রোহের এক পর্যায়ে কুখ্যাত বনু উমাইয়্যার শাসনব্যবস্থার পতন হয়। মওলানা মোহাম্মদ আলী জওহার যথার্থই বলেছেন :
‘কাতলে হোসাইন আসলে মে মার্গে ইয়াযীদ হ্যায়,
ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হার কারবালাকে বাদ।’
অর্থাৎ হোসাইনের হত্যাকাণ্ডের মধ্যেই ইয়াযীদের মৃত্যু নিহিত ছিল। প্রতিটি কারবালার পর এভাবেই ইসলামের উত্থান ঘটে।
ইমাম হুসাইন (আ.) কারবালায় তাঁর সাথিদের শাহাদাতবরণের পর আহ্বান করেছিলেন : ‘আমাকে সাহায্য করার জন্য কেউ আছ কি?’ এ আহ্বান কেবল সে সময়ের মানুষের প্রতি ছিল না। এ আহ্বান ছিল কিয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীতে আগমনকারী সকল মানবের প্রতি। আর তাঁর এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে অতীতে যেমন সত্যের পক্ষে মানুষ সংগ্রাম করেছে, বর্তমানেও তেমনি সংগ্রাম করে চলেছে এবং বিজয় লাভ করছে। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ইরানের ইসলামি বিপ্লব। কারবালায় ইমাম হোসাইনের অনুসারী ছিলেন মাত্র ৭২ জন, আর বর্তমান বিশ্বে কোটি কোটি অনুসারী আজ ইমাম হোসাইনের সত্যের পতাকাকে উচ্চে তুলে ধরেছে। ইমাম হোসাইনের আন্দোলন ও আত্মত্যাগের সফলতা এখানেই।