রাশিদ রিয়াজ –
ইরান দীর্ঘদিন থেকে শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে আসছে যা কৃষি, শিল্প, জ¦ালানি, চিকিৎসা প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন খাতে ব্যাপক অবদান রাখার ফলে তেহরানের সক্ষমতা বাড়ছে। এর ফলে বিশ^ব্যাপী পশ্চিমা মিডিয়া ও পরাশক্তি দেশগুলো এ কর্মসূচির বিরুদ্ধে শুধু অপপ্রচারই চালাচ্ছে না, বরং রাজনৈতিক কারণে এ কর্মসূচি থেকে ইরানকে বিরত রেখে অর্থনৈতিকভাবে পর্যুদস্ত ও নির্ভরশীল করে তোলার ব্যর্থ অপপ্রয়াস অব্যাহত রেখেছে। এধরনের অপপ্রচারের কারণে ইরানের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে অনেকে বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যান এবং মনে করেন ইরান সত্যি সত্যি পারমাণবিক বোমা তৈরি করছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি মুসলিম দেশ এধরনের অপপ্রচার ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে গেলেও ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী রীতিমত ফতোয়া জারি করে পারমাণবিক বোমা তৈরি ইসলামের যুদ্ধ নীতি অনুসারে সম্পূর্ণ হারাম ঘোষণা করেছেন। কারণ, ব্যাপক ধংসযজ্ঞ, গণহত্যা ছাড়াও ফসলের মাঠ ও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি করে বলে পারমাণবিক বোমা তৈরি ইরান নিষিদ্ধ করেছে।
বস্তুত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাবৎ বিশে^ একাধিপত্য চাপিয়ে দিচ্ছে যার কাছে ইরান কখনো আত্মসমর্পণ করে নি। কাতারের রাজধানী দোহায় ‘এশিয়া সহযোগিতা সংলাপ’-এর মন্ত্রী পর্যায়ের ষোড়শ সম্মেলনের অবকাশে ‘আশ-শার্ক’ পত্রিকাকে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ বলেছেন, আমরা ঠিকই পথ খুঁজে নেব। গত ৪০ বছর আমরা এটাই করেছি এবং এখনো তাই করব। মার্কিন চাপ উপেক্ষা করা সহজ কাজ নয়, তবু আমরা আমাদের জনগণের বিরুদ্ধে কোনো চাপকে কখনো মেনে নেব না।
পঞ্চাশের দশক থেকে ইরান পারমাণবিক কর্মসূচি শুরু করে। তখন থেকে আজ পর্যন্ত ইরান শান্তিপূর্ণভাবে এ কর্মসূচি চালিয়ে আসছে। তাই আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা আইএইএ অব্যাহতভাবে ইরানের এ কর্মসূচির দিকে নজর রাখছে এবং বলতে বাধ্য হচ্ছে যে, ঘোষিত নীতি অনুসরণ করেই ইরান এ ধরনের কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে। তাই এ নিয়ে যে বিতর্ক রয়েছে তা আলোচনার মাধ্যমে সহজেই সমাধান সম্ভব। একই কারণে বিষয়টি নিয়ে কোনো আলোচনায় যেতে চায় না পরাশক্তি দেশগুলো। এর আগে প্রায় এক যুগ ধরে আলোচনার টেবিলে ইরানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ প্রজ্ঞার সঙ্গে আলোচনার পর পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার নিয়ে যে ঐতিহাসিক সমঝোতায় পৌঁছান তা থেকে শুধু যুক্তরাষ্ট্র সরে এসেছে। জাতিসংঘসহ এ চুক্তিতে অংশগ্রহণকারী অন্য একটি দেশও সরে আসে নি এবং তা বহাল রেখে চলছে।
ইরান সরকার নিজেদের ও আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ; কৌশলগত অবস্থান, আধ্যাত্মিক ও আদর্শিক মতবাদের অনুসারী। এজন্য শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক চুক্তির অখ-তা ও কর্তৃত্ব বৃদ্ধিতে ইরানের দৃঢ় আগ্রহ রয়েছে। এ ধরনের আগ্রহ অপ্রতিরোধ্য শাসনভিত্তিক। সেখানে মার্কিন রেজিম চেঞ্জ ফর্মুলা কখনোই কার্যকর হতে পারে না। জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি ব্যাপক ধ্বংসযোগ্য অস্ত্র তৈরি না করার ব্যাপারে ইরান আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগরীয় অঞ্চলে স্থিতিশীলতার ব্যাপারে ইরান সজাগ বলেই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে উৎসাহী নয়। রাসায়নিক অস্ত্র তো নয়ই। গত আড়াই শ’ বছরে ইরান কোনো দেশকে আক্রমণ করে নি।
একই সঙ্গে ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি তদারকি ও পর্যবেক্ষণে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা আইএইএ’কে সবসময় সহযোগিতা করে যাচ্ছে। ২০০৩ সাল থেকে ১৭শ’ দিবসে ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পর্কে তদারকিতে সহযোগিতা করেছে। ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ, ভারী পানি তৈরিতে গবেষণা, সেন্ট্রিফিউজ পদ্ধতি উন্নীতকরণসহ যেকোনো বিষয়ে ইরান আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতা মেনে চলছে। বহুবার আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার ইন্সপেক্টররা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ও দেশটির পরিবেশের ওপর এর কী প্রভাব পড়ছে তার নমুনা সংগ্রহ করেছেন এবং কোনো ব্যত্যয় ঘটতে দেখেন নি। কারণ, এসব নমুনায় কোনো পারমাণবিক উপাদান পাওয়া যায় নি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কোনো কর্মসূচিও দেখতে পায় নি আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা। এক্ষেত্রে সংস্থার সকল দিকনির্দেশনা মেনে চলছে ইরান। আর এসব দিকনির্দেশনা সঠিকভাবে মেনে চলতে ব্যয়বহুল অবকাঠামো নির্মাণ ছাড়াও নিজস্ব তদারকি ব্যবস্থাও গড়ে তুলেছে দেশটি। এজন্য প্রয়োজনীয় আইন সংস্কারে সহায়তা দিয়েছে দেশটির সংসদ। স্থায়ী আইন করা হয়েছে যাতে ইরান থেকে কোনো পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি, মজুদ বা রপ্তানি না হতে পারে। প্লুটোনিয়াম উৎপাদনও বন্ধ রেখেছে ইরান। পারমাণবিক উপাদানগুলো একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় উৎপাদন সীমাবদ্ধ রেখেছে যাতে তা কোনো মারণাস্ত্রের কাজে ব্যবহৃত না হয়। ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ করতে যে বিপুল অংকের টাকা খরচ করে অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছিল তাও জ¦ালানিতে রূপান্তর করা হয়েছে, বিনষ্ট করা হয়েছে অবকাঠামো। আন্তর্জাতিক বিশ^, আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থাকে আস্থায় রেখেই ইরান তার শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচি এভাবে চালিয়ে যাচ্ছেÑ যা উন্নয়নের কাজে লাগে মাত্র, ধংসাত্মক নয়। এমনকি পারমাণবিক কর্মসূচির নিরাপত্তায় ইরান একটি আঞ্চলিক কনসোর্টিয়াম প্রতিষ্ঠার তাগিদ দিয়ে আসছে। অন্যান্য দেশের সরকার বিশেষ করে রাশিয়া ফেডারেশন ইরানের এধরনের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচির প্রতি আস্থা রেখে বলছে, এধরনের কর্মসূচি নিরাপত্তার স্বার্থেই এমন হওয়া উচিত। তবে ইরান বারবার বলে আসছে তার পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে কোনো রাষ্ট্রের চাপ বা হুমকিকে সে পাত্তা দেবে না। খোলা মন নিয়ে রাজনৈতিক সদিচ্ছায় কোনো দেশ যদি আলোচনা করতে চায় তাহলে ইরান তাকে স্বাগত জানায়।
২০১৫ সালে ‘ইরান নিউক্লিয়ার ডিল’ নামে যে চুক্তি হয় তা জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্লান অব অ্যাকশন বা সংক্ষেপে জেসিপিওএ নামে অভিহিত। বিশে^র ৬ পরাশক্তি ব্রিটেন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ফ্রান্স ও জার্মানি এবং জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে এ চুক্তি হলেও তা থেকে একতরফা বের হয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্র। এর ফলে আন্তর্জাতিক কোনো চুক্তির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে চরম আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রসহ কোনো দেশই প্রমাণ করতে পারে নি যে, ইরান চুক্তির কোনো শর্ত ভঙ্গ করেছে। বরং যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সরকারের পক্ষ থেকে এ চুক্তিকে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি বলে উল্লেখ করা হয়। সেদিক থেকে আগের সরকারের কোনো ধারাবাহিকতা বজায় রাখে নি ট্রাম্প প্রশাসন। ফলে মার্কিন সরকারের সঙ্গে কোনো চুক্তির গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। একদিকে চুক্তি ভঙ্গ অন্যদিকে একতরফা অর্থনৈতিক অবরোধ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর যে চাপ সৃষ্টি করছে তা মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে অস্থিতিশীল পরিবেশ, এমনকি যুদ্ধের হুমকি সৃষ্টি করছে। ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি কার্যকর হওয়ার আগেই তা ভঙ্গ করায় মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির চরম ব্যর্থতা শুধু আন্তর্জাতিক বিশে^ উন্মোচিত হয় নি; বরং এটি ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইরানের বিরুদ্ধে ভবিষ্যতের একটি যুদ্ধকে ন্যায্য করার এক নৃশংস পরিকল্পনা বলে অভিহিত করছে আন্তর্জাতিক মহল। মধ্যএশিয়ায় ও মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য যখন দেশগুলোর সঙ্গে ইরান প্রয়োজনে একে অপরকে আক্রমণ না করার নীতিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে চুক্তির আহ্বান জানিয়েছে তখন ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র চাইছে না ইরান পাল্টা এক ভারসাম্যপূর্ণ এক আঞ্চলিক শক্তিশালী দেশ হিসেবে গড়ে উঠুক। একারণেই দশকের পর দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন ধরনের অবরোধ আরোপ করছে তেহরানের ওপর।
একই সঙ্গে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে নিয়ে চলছে পশ্চিমা মিডিয়ার টানা অপপ্রচার। এধরনের মিডিয়া প্রচার করছে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের দিকেই মোড় নেবে। তবে এর কোনো পরিষ্কার ব্যাখ্যা বা প্রমাণ তারা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। এধরনের প্রপাগান্ডার অংশ হিসেবে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গত বছর ৩০ এপ্রিল বলেই বসেন, তাঁর গোয়েন্দারা তেহরান থেকে পারমাণবিক বোমা তৈরির গোপন কাগজপত্র উদ্ধার করেছে। এ বিষয়ে বিরাট এক বয়ান দেন। এরপর আল-জাজিরা তাঁকে লাইভ টেলিফোনে জিজ্ঞাস করে ইসরাইলের কাছে কয়টি পারমাণবিক বোমা আছে। এ প্রশ্নের কোনো উত্তর নেতানিয়াহু দেন নি এবং তাঁর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় আল-জাজিরার। এর পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক সমঝোতা চুক্তি করে তা ভঙ্গের মতো বিশ^াসঘাতকতার পর উল্টো ধারাবাহিক অবরোধ আরোপ করে বসে আছে।
কিন্ত বসে নেই ইরান। পরমাণু সমঝোতা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়া এবং নিজেদের প্রতিশ্রুতি পালনে ইউরোপীয় দেশগুলোর ব্যর্থতার বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে অতিরিক্ত সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম ও ভারী পানি বিক্রি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইরান। দেশটি পরমাণু সমঝোতা বা জেসিপিওএ’র কিছু শর্ত বাস্তবায়ন স্থগিতের ঘোষণা দিয়ে বলেছে, এখন থেকে উৎপাদিত অতিরিক্ত সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম ও ভারী পানি বিক্রি করা হবে না যদি না চুক্তির সাথে জড়িত সংশ্লিষ্ট দেশগুলো এব্যাপারে কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করে। একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় ইউরেনিয়াম ও ভারী পানি উৎপাদন পারমাণবিক সমঝোতা চুক্তি অনুযায়ী বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু গত বছর ৮ মে যুক্তরাষ্ট্র এ সমঝোতা থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেওয়ার পর ইউরোপীয় দেশগুলো এব্যাপারে ইরানের স্বার্থ রক্ষায় তেমন কোনো অঙ্গীকার করতে না পারায় তেহরান এ সিদ্ধান্ত নিল। এক রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ভাষণে ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি এ ঘোষণা দিয়ে এ ব্যাপারে ৬০ দিনের সময় সীমা বেঁধে দিয়েছেন। ৬ জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে এ সমঝোতা ২০১৫ সালে সই করেছিল ইরান।
তেহরানে নিযুক্ত ফ্রান্স, ব্রিটেন, জার্মানি, রাশিয়া এবং চীনের রাষ্ট্রদূতদের ওই দিনই এ বিষয় অবহিত করে ইরান। প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সই করা একটি চিঠির মাধ্যমে এ সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। চিঠিতে ইরানকে দেয়া প্রতিশ্রুতি বিশেষ করে তেল এবং ব্যাংকিং খাতের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য পরমাণু সমঝোতায় সই করা দেশগুলোকে ৬০ দিনের সময় সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে।
এদিকে ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল এক বিবৃতিতে বলেছে, দেশটির সঙ্গে ৬ জাতিগোষ্ঠীর পারমাণবিক সমঝোতা চুক্তি পরিবর্তন করা হয়েছে এ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার পর এধরনের পরিবর্তন করতে হয়েছে। ইরানের পক্ষ থেকে সতর্ক করে দিয়ে এ বিবৃতিতে বলা হয়, পারমাণবিক সমঝোতা চুক্তি অনুসারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো যদি কোনো ব্যবস্থা না নেয় তাহলে ইরান তার উৎপাদিত সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম ও ভারী পানি উৎপাদন, মজুদ ও বিক্রির ব্যাপারে কোনো শর্ত মানবে না।
গত বছরের মে মাসে ইরানের পরমাণু সমঝোতা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়ার পর নভেম্বরে তেহরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল করে ট্রাম্প প্রশাসন। অন্যদিকে ইউরোপীয় দেশগুলো এ সমঝোতা বাস্তবায়নের কথা মুখে বললেও কার্যত তারা কোনো পদক্ষেপ নেয় নি। ইরান এতদিন বলে আসছিল, তার ধৈর্যের সীমা আছে এবং পশ্চিমারা যেন তেহরানের কাছ থেকে ধৈর্যের পরীক্ষা না নেয়। সাইয়্যেদ আব্বাস আরাকচি গত ৭ মে তেহরানে বলেন, পরমাণু সমঝোতা থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে যাওয়ার অধিকার ইরানেরও রয়েছে। এটির ২৬ ও ৩৬ নম্বর ধারা অনুযায়ী কিছু প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন স্থগিত রাখবে তেহরান। যেখানে বলা আছে, ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল করা হলে তেহরান কিছু কিছু ধারা বাস্তবায়ন থেকে সরে আসতে পারবে। বিষয়টি নিয়ে ইরানের পার্লামেন্টে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়।
তবে পরমাণু সমঝোতা লঙ্ঘন হয় এমন কিছু করবে না ইরান এমন আশ^াস দিয়ে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মাদ জাওয়াদ জারিফ বলেন, পরমাণু সমঝোতা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়ার পর পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে তেহরান যে পদক্ষেপ নিয়েছে তার সবই ২০১৫ সালে সই হওয়া পরমাণু সমঝোতার আওতায় করা হচ্ছে। কোনোভাবেই ইরান পরমাণু সমঝোতা লঙ্ঘন করবে না।
এপ্রসঙ্গে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ বলেন, গত বছর মার্কিন সরকার পরমাণু সমঝোতা লঙ্ঘন করলে ইরানের ‘কৌশলগত ধৈর্য’ শেষ হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যায় পদক্ষেপের বিপরীতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রুখে দাঁড়াতে সক্ষম নয়। এ কারণে ইরান পরমাণু সমঝোতার আওতায় স্বেচ্ছায় নতুন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে।
কিন্তু আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, ইরানের বিরুদ্ধে পারমাণবিক সমঝোতা চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের এক গভীর ষড়যন্ত্র কাজ করছে। প্রথমত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির প্রধান বিবেচ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে এটি। কিন্তু চীন, রাশিয়া, ইউরোপসহ বিশে^র অধিকাংশ দেশ ইরানের তেল রপ্তানিকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার জন্য পারমাণবিক সমঝোতা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসাকে সমর্থন দেয় নি। ইউরোপের দেশগুলো জানে আরব বিশে^ যেভাবে আইএস জঙ্গিদের পেছনে অর্থ ও অস্ত্র যুগিয়ে সন্ত্রাস ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে তা ওসব দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এবং এধরনের বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী হামলায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছে ইউরোপ। সিরিয়া ও ইরাকে আইএস নিয়ন্ত্রণে আনতে ইরান এক বিশাল ভূমিকা রেখেছে। কারণ, ইরান জানে সিরিয়া আইএস জঙ্গিদের কাছে হাতছাড়া হয়ে গেলে সেখান থেকে জঙ্গিরা তেহরান পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ার প্রচেষ্টা শুরু করবে। তাই ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি যতই শান্তিপূর্ণ হোক না কেন যুক্তরাষ্ট্র তাকে অজুহাত হিসেবেই তার পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেছে। ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণার অন্যতম প্রধান অংশ ছিল এটি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাস দমনের নামে আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়াসহ বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ শুরু করে, কিন্তু তারা শেষ করতে জানে না।
অথচ ইরানকে পঞ্চাশের দশকে পারমাণবিক কর্মসূচি নিতে প্রথমে তেহরান নিউক্লিায়ার রিসার্চ সেন্টারকে ৫ মেগাওয়াটের একটি গবেষণা চুল্লি দিয়ে সহায়তা করে যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৬৭ সালে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ করে ইরান। ১৯৭৩ সালে দেশটি ২৩ হাজার মেগাওয়াট পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সে অনুযায়ী যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে লোকবল তৈরি করা হয়। ফ্রান্স ও নামিবিয়ার সাথে পারমাণবিক কর্মসূচির অংশীদারিত্বে যায় ইরান। এজন্য বিলিয়ন ডলার খরচ করে। এরপর ৭শ’ মিলিয়ন ডলার দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ইউরেনিয়াম ইয়েলো চক কেনে ইরান। ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর পারমাণবিক কর্মসূচি স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়। দীর্ঘমেয়াদে চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে পারমাণবিক শক্তি গবেষণায় সহযোগিতা চুক্তি করে ইরান। এ সহায়তায় যুক্ত হয় রাশিয়া। আর্জেন্টিনার সঙ্গে ইরান যে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সহায়তা গড়ে তোলে তাতে বাধা সৃষ্টি করে যুক্তরাষ্ট্র। বাধা সৃষ্টি করে ভারী পানি উৎপাদন সহযোগিতায়। এরই মধ্যে ১৯৯৫ সালে রাশিয়া ইরানে বুশেহর-১ পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণে সহায়তা করতে রাজি হলে যুক্তরাষ্ট্র এর বিরোধিতা করে। এধরনের বিরোধিতা নাকচ করে ইরানের আরাকে ৪০ মেগাওয়াট ভারী পানি উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। ২০০২ সালে দি ন্যাশনাল কাউন্সিল অব রেজিস্টেন্স অব ইরান নাতাঞ্জ এনরিচমেন্ট কমপ্লেক্স উন্নয়নের সিদ্ধান্ত নেয়। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা আইএইএ’র তদারকিকে স্বাগত জানায় ইরান। অব্যাহত আলোচনার মধ্য দিয়ে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচিকে সীমাবদ্ধ ও ভারী পানি উৎপাদনের ক্ষেত্রে একই ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ইরান। এক্ষেত্রে ইরান কূটনৈতিক আলোচনাকে প্রাধান্য দেয়। আলোচনায় দরকষাকষিতে ইরানের আলোচকরা সবসময় প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়ে দীর্ঘমেয়াদী একটি চুক্তিতে উপনীত হতে চাইলেও জাতীয় স্বার্থকে কখনো বিসর্জন দেন নি। ২০০৫ সালে ইউরোপের সঙ্গে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা থেকে সরে দাঁড়ায় এবং চুক্তি করতে অস্বীকৃতি জানায়। এজন্য যুক্তরাষ্ট্র ধারাবাহিকভাবে বিদেশে ইরানের অর্থ সম্পদ আটকের ঘোষণা দেয়। ২০০৬ সালে ইরান নাতাঞ্জে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি পুনরায় শুরু করে। এর পরের বছরেই ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে একটি সমঝোতা চুক্তিতে যেতে ৬ জাতি আলোচনা শুরু হয়। তেহরানে ২০০৮ সালের ১৪ জুন ইইউ’এর পররাষ্ট্রনীতি প্রধান জাভিয়ার সোলানা ও ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মানোচেহের মোত্তাকির সঙ্গে আলাপের পর ৬ জাতি আলোচনা শুরুর ঘোষণা দেয়া হয়। ইরানের পক্ষে প্রধান মধ্যস্থতাকারী ছিলেন সাইদ জালিলি। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে এধরনের আলোচনার পাশাপাশি ইরানের বিরুদ্ধে একের পর এক অবরোধ দেয়া হয়। তারপরও ইরান আলোচনা থেকে পিছু হটে নি। এমনকি তুরস্কে চিকিৎসা গবেষণা চুল্লির জন্য ইরানের পাঠানো সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম নিয়েও অভিযোগ তোলা হয়। শর্ত মেনে চলার মধ্য দিয়ে রাশিয়া ইরানের ওপর থেকে ধারাবাহিকভাবে অবরোধ তুলে নেয়ার প্রস্তাব দিলেও যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্সসহ অনেক দেশ তাতে রাজি হয় নি। ২০১১ সালে নভেম্বরে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক কমিশনের দেয়া রিপোর্টের ভিত্তিতে ইরানের ওপর ফের অবরোধ দেয়ার ব্যাপারে চীন ও রাশিয়া প্রতিবাদ জানায়। এই প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ব্যাংক ও সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আন্তর্জাতিক লেনদেনে অবরোধ আরোপ করে। ইরানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের ওপর অবরোধ আরোপ করা হয়। চীন, তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, শ্রীলংকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, তাইওয়ান, ভারত ও মালয়েশিয়া ছাড়াও ১০টি ইউরোপীয় দেশের ওপর ইরান থেকে তেল আমদানি বন্ধের জন্য চাপ সৃষ্টি করে। একই সঙ্গে বিভিন্ন দেশে ইরানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্পদ আটকের নির্দেশ দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এধরনের ধারাবাহিক অবরোধের মধ্যে ইরান পারমাণবিক সমঝোতায় পৌঁছতে আলোচনা অব্যাহত রাখে এবং শেষ পর্যন্ত ২০১৫ সালের ১৪ জুলাই একটি চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হয়। ২০ জুলাই ইরান পার্লামেন্টে এটি অনুমোদিত হয়। ২০১৩ সালে হাসান রুহানি নির্বাচনে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার পর পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে আলোচনায় একটি গতি আসে। এই চুক্তিতে উপনীত হবার জন্য ইরানকে বেশ কিছু ছাড় দিতে হয়। প্রথমত ২০২৫ সাল পর্যন্ত নাতাঞ্জ পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রে সেন্ট্রিফিউজিং ১৯ হাজার থেকে ৫ হাজার ৬০টিতে নামিয়ে স্থির রাখতে হবে। চুক্তির প্রতি আস্থা রেখে এক্ষেত্রে অবকাঠামো পর্যন্ত বিনষ্ট করে ইরান। এরপর আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার দিকনির্দেশনা অনুসরণ করে চলে ইরান। কিন্তু ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক সমঝোতা চুক্তি হওয়ার বিষয়টি সৌদি আরব, ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র মেনে নিতে পারে নি বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর এ চুক্তির বিরুদ্ধে তিনি তাঁর অন্যতম নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নে কথা বলতে শুরু করেন এবং শেষ পর্যন্ত এ সমঝোতা থেকে বের হয়ে যান।
তবে সর্বশেষ ইরান নির্দিষ্ট মাত্রায় ভারী পানি ও ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার ব্যাপারে দুই মাসের আল্টিমেটাম দেয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র তেহরানের ওপর লৌহ, ইস্পাতসহ ধাতব পণ্য রপ্তানির ওপর নতুন করে অবরোধ দিয়ে বসে। এখাতটি ইরানের চতুর্থ রপ্তানি খাত। একই সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইরানের এ আল্টিমেটামকে নাকচ করে বলেছে, ইউরোপীয় জোট এখনো পরমাণু সমঝোতায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক প্রধান ফেডেরিকা মোগেরিনি এবং ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক যৌথ বিবৃতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এ সম্পর্কে মোগেরিনি বলেন, যেকোনো ধরনের সময়সীমা আমরা প্রত্যাখ্যান করছি। পরমাণু সংক্রান্ত ইরানের প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ইরানের সহযোগিতা সম্পর্কে আমরা পর্যালোচনা করে দেখব। এর পাশাপাশি মার্কিন ডলার এড়িয়ে ইরানের সঙ্গে বৈধ চ্যানেলে লেনদেন করার জন্য ইনসটেক্স চালুর প্রচেষ্টা জোরদার করা হবে বলেও জানান তিনি।
একই সঙ্গে ইউরোপের ২২ জন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি থেকে বের হয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত ক্ষতিকর। এতে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন ইরান নতুন করে বেশি মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করলে তা পর্যবেক্ষণ করা কঠিন হবে। এছাড়া, কোনো কোনো দেশ বিশেষ করে সৌদি আরব আঞ্চলিকভাবে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে পারে।
তার মানে ইরানের প্রেসিডেন্ট পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে আল্টিমেটাম দিয়ে যথার্থই বলেছেন যে, এই চুক্তিতে একটি অস্ত্রোপচার দরকার। কারণ, এক বছর ধরে যে ঘুমের ওষুধ আমাদের দেওয়া হচ্ছিল, তাতে ফল হয় নি। আর এই অস্ত্রোপচার চুক্তিটিকে বাঁচানোর জন্য প্রয়োজন। সেটাকে ধ্বংস করতে নয়।
আন্তর্জাতিক রীতিনীতি উপেক্ষা করে ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের ওপর একের পর এক অবরোধ জারি করেই ক্ষান্ত নয়। উপসাগরীয় অঞ্চলে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ এবং বি-৫২ বোমারু বিমান পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র যা সুয়েজ খাল অতিক্রম করেছে। আচমকা মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ইরাক সফরেও যান। তবে তাঁকে শুনতে হয়েছে প্রতিবেশী দেশ ইরানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে না বাগদাদ। একই কথা বলেছে ইসলামাবাদ। যদিও ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, তেহরানকে কোন মতেই পরমাণু অস্ত্র বানাতে দেওয়া যাবে না। ইরানের বিরুদ্ধে আমাদের এ যুদ্ধ অব্যাহত থাকবে। তবে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বলেছেন, আমাদের মনে হয় এখন সমাধানের সময়। আর তার জন্য ইউরোপের বাকি দেশগুলোর উচিত চুক্তির বাধ্যবাধকতাগুলো মেনে চলা। মার্কিন মুসলিম আইন প্রণেতা ইলহান ওমর বলেছেন, ট্রাম্প প্রশাসন মিথ্যা গোয়েন্দা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ইরানের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে যাওয়ার পাঁয়তারা করছে। টুইট বার্তায় তিনি বলেন, ২০০৩ সালে ইরাকে আগ্রাসন চালানোর আগে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যে ধরনের অজুহাত সৃষ্টি করেছিল চরম ইরানবিদ্বেষী নীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে তারা একই পন্থা অবলম্বন করছে।
এরপরও ইরানের আণবিক শক্তি সংস্থার মুখপাত্র বেহরুজ কামালবান্দি বলেছেন, পরমাণু স্থাপনাগুলোতে সমৃদ্ধ ৩০০ কেজি অতিরিক্ত ইউরেনিয়াম ও ১৩০ টন ভারী পানি বিদেশে রপ্তানি করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তেহরান। কিন্তু পাঁচ জাতিগোষ্ঠী দুই মাসের মধ্যে তাদের প্রতিশ্রুতি পালন না করলে ইরান আর কখনো সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম ও ভারী পানি রপ্তানি করবে না। অন্যদিকে ইরানের উপ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধান পরমাণু আলোচক সাইয়্যেদ আব্বাস আরাকচি বলেছেন, তাঁর দেশ ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত পরমাণু সমঝোতা থেকে ‘ধাপে ধাপে’ বেরিয়ে আসার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এর ফলে ইরান কেন পরমাণু সমঝোতা ত্যাগ করলো সে অভিযোগে বিশ্বের কোনো দেশ তেহরানকে অভিযুক্ত করতে পারবে না। ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি বলেছেন, পরমাণু সমঝোতায় শর্ত ছিল ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ৩.৬৭ মাত্রায় সীমাবদ্ধ রাখবে ইরান। বেঁধে দেয়া সময়সীমা শেষ হলে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মাত্রা আর সীমাবদ্ধ রাখা হবে না। আরাক হেভি ওয়াটার রিঅ্যাক্টরকে পরিপূর্ণতা দেওয়ার কাজ শুরু করব। ইরানের এ পদক্ষেপকে অজুহাত হিসেবে বিষয়টিকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে পাঠালে তেহরান অত্যন্ত কঠিন পদক্ষেপ নেবে। তিনি বলেন, ইরান কখনোই যুদ্ধের সূচনা করে নি, ভবিষ্যতেও যুদ্ধের সূচনা করবে না। তবে কারো তর্জন-গর্জনের কাছেও তেহরান কখনোই মাথানত করবে না। সঙ্গত কারণে জাতিসংঘে নিযুক্ত ইরানের স্থায়ী প্রতিনিধি মাজিদ তাখতে রাভাঞ্চি বলেছেন, গত এক বছর ধরে ইউরোপ ইরানের ব্যাপারে পারমাণবিক সমঝোতা নিয়ে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিতে যে ব্যর্থ হয়েছে তার অন্যতম কারণ ছিল রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব।
এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানি নেতাদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করলেন এমন এক সময়ে যখন দুটি দেশের মধ্যে চরম বাকযুদ্ধ চলছে। ইরানের প্রতি ট্রাম্প প্রশাসনের ধারাবাহিক অবরোধ আরোপ ও দেশটির তেল রপ্তানি শূন্যে নামিয়ে আনার হুমকির মুখে ট্রাম্পকে নির্ভরযোগ্য বলে মনে করছে না তেহরান। ট্রাম্পের কথা বলতে চাওয়ার ব্যাপারে জাতিসংঘে নিযুক্ত ইরানের স্থায়ী প্রতিনিধি মাজিদ তাখতে রাভাঞ্চি বলেছেন, আলোচনার জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি নন এবং তাঁর ওপর আস্থা রাখা যায় না।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হোয়াইট হাউজে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, আমি ইরানের ব্যাপারে যা দেখতে চাই তা হলো তারা (আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য) আমাকে টেলিফোন করছে। তিনি বলেন, আমি চাই ইরানি কর্মকর্তারা একটি ভালো চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য আলোচনা করতে আমাকে টেলিফোন করুক। এ ধরনের চুক্তি ইরানকে চলমান অর্থনৈতিক সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে সহযোগিতা করবে। ট্রাম্প দাবি করেন, তিনি ইরানিদের কাছ থেকে বেশি কিছু চান না, শুধু চান ইরানিরা পরমাণু অস্ত্র তৈরি না করুক।
মার্কিন নিউজ চ্যানেল এনবিসি’কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জাতিসংঘে নিযুক্ত ইরানের স্থায়ী প্রতিনিধি মাজিদ তাখতে রাভাঞ্চি বলেন, আগে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এই ব্যাখ্যা দিতে হবে তিনি কেন আলোচনার টেবিল থেকে উঠে গেলেন? তিনি বলেন, ট্রাম্প এমন সময় আলোচনার টেবিল থেকে উঠে গিয়েছিলেন যখন বিশ্ব শক্তিগুলোর পাশাপাশি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ওই টেবিলে বসে ছিল।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এমন এক সময় ইরানের সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন যখন পশ্চিমাদের ভাষায় ইরানকে পরমাণু অস্ত্র তৈরিতে বাধা দেয়ার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রসহ ছয় বিশ্বশক্তি ২০১৫ সালে তেহরানের সঙ্গে পরমাণু সমঝোতা সই করে। কিন্তু ট্রাম্প গত বছরের মে মাসে গোটা বিশ্বের বিরোধিতা উপেক্ষা করে সেই সমঝোতা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেন।
হোয়াইট হাউজে সাংবাদিক সম্মেলনে ট্রাম্প আলোচনার আগ্রহ প্রকাশ করার পাশাপাশি ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নেয়ারও হুমকি দেন। পাশাপাশি সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে ট্রাম্প বলেন, তিনি ইরানের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রক্ষা করছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, তাঁর প্রশাসনের ইরান নীতি প্রত্যাখ্যান করে জন কেরি ইরানি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে ‘লোগান আইন’ লঙ্ঘন করছেন এবং এজন্য তাঁর বিচার হতে পারে।
ট্রাম্প বলেন, জন কেরি (টেলিফোনে) তাদের (ইরানিদের) সঙ্গে অনেক বেশি কথা বলছেন এবং তিনি তাদেরকে বলছেন তারা যেন আমাকে ফোন না করে। এটি লোগান আইনের লঙ্ঘন এবং অকপটে বলতে গেলে এজন্য তাঁর বিচার হওয়া উচিত। ট্রাম্পের এ বক্তব্যের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জন কেরির একজন মুখপাত্র সিএনএন’কে বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আজ যা কিছু বলেছেন তার সব ভুল এবং কল্পকাহিনী। তিনি বাস্তবতা বুঝতে পারেন নি, আইন বোঝেন নি এবং সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে কীভাবে নিরাপদ রাখতে হয় সেই কূটনীতি তিনি রপ্ত করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
জন কেরি গত বছর এক বক্তব্যে বলেন, তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার পর ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মাদ জাওয়াদ জারিফের সঙ্গে ‘তিন থেকে চারবার’ সাক্ষাৎ করেছেন এবং এসব সাক্ষাতে পরমাণু সমঝোতাসহ অন্যান্য বিষয়ে কথা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৭৯৯ সালে অনুমোদিত লোগান আইনে যুক্তরাষ্ট্রের শত্রুভাবাপন্ন কোনো দেশের সঙ্গে ওয়াশিংটনের অনুমতি ছাড়া আলোচনা করাকে অপরাধ বলে গণ্য করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ১৮০২ এবং ১৮৫২ সালে মাত্র দুই ব্যক্তি এই আইন লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসনের বিরোধীদের পাশাপাশি কোনো কোনো মার্কিন গণমাধ্যম বলছে, ট্রাম্পের সাবেক নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইকেল ফ্লিন ক্ষমতা গ্রহণের আগে ওয়াশিংটনে নিযুক্ত তৎকালীন রুশ রাষ্ট্রদূত সের্গেই কিসলিয়াকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে লোগান চুক্তি লঙ্ঘন করেছিলেন।
এদিকে জাতিসংঘে নিযুক্ত ইরানের স্থায়ী প্রতিনিধি বলেছেন, আবার আলোচনায় বসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে উঠে যাবেন না তার নিশ্চয়তা কোথায়; বিশেষ করে তিনি যখন একের পর এক আন্তর্জাতিক আইন ও চুক্তি লঙ্ঘন করে যাচ্ছেন। ইরানকে তাঁর ভাষায় পরমাণু অস্ত্র তৈরি থেকে বিরত রাখার জন্য আলোচনায় বসতে চান বলে ট্রাম্প যে দাবি করেছেন তার জবাবে তাখতে রাভাঞ্চি বলেন, ইরান যে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে চায় না তা বোধ হয় ট্রাম্পের জানা নেই। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা ১৪টি ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে বলেছে, ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে না। এছাড়া, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা এই অস্ত্র নিষিদ্ধ করে ফতোয়া জারি করেছেন।
ওদিকে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মাদ জাওয়াদ জারিফ এক টুইট বার্তায় বলেছেন, ইরানকে একতরফাভাবে পরমাণু সমঝোতা মেনে চলার পরামর্শ না দিয়ে ইউরোপের নিজের উচিত এ সমঝোতা মেনে চলা। জারিফ বলেন, পরমাণু সমঝোতা সম্পর্কে ইইউ’র বিবৃতি দেখে মনে হয়, ইরান কেন এর কিছু ধারা স্থগিত রাখল সেজন্য তারা বিস্মিত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র এক বছর ধরে ইউরোপসহ গোটা বিশ্বকে ভয় দেখিয়ে পরমাণু সমঝোতা লঙ্ঘন করে পায়ের তলায় পিষে ফেললেও ইইউ ‘দুঃখ প্রকাশ’ ছাড়া আর কিছুই করতে পারে নি। ইইউ’র নিজের উচিত ইরানের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করাসহ পরমাণু সমঝোতায় দেয়া প্রতিশ্রুতি মেনে চলা।
All posts by dreamboy
ইসলামি বিপ্লবের ৪০ বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরানের বিস্ময়কর উন্নয়ন
সাইদুল ইসলাম –
দুনিয়া-কাঁপানো ইসলামি বিপ্লবের গৌরবময় ৪০ বছর পূর্তি হলো গত ১১ ফেব্রুয়ারি। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দিবসটি পালিত হয়েছে। এই বিপ্লব ইরানে যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করেছিল।বলা হয় এটি ছিল মানব ইতিহাসের এক নজিরবিহীন বিপ্লব। যার মাধ্যমে পতন ঘটে আড়াই হাজার বছরের শক্তিশালী ও স্বৈরাচারী রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার। অবসান হয় মার্কিন কর্তৃত্বসহ পরাশক্তিগুলোর মোড়লিপনার। বহু বিশ্লেষকের মতে এ বিপ্লব বিগত এক হাজার বছরের সেরা আদর্শিক বিপ্লব, যা ইরানি জাতির জন্য ফিরিয়ে আনে প্রকৃত স্বাধীনতা, সম্মান ও উন্নয়নের বিরতিহীন অগ্রযাত্রার সেই গৌরবের ধারা।
কিন্তু এ বিপ্লবের ফলে দিশেহারা হয়ে পড়া মার্কিন পরাশক্তি ও তার মিত্ররা গত প্রায় চার দশক ধরে একের পর এক বিছিয়ে যাচ্ছে নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের জাল। এইসব ষড়যন্ত্র অনুযায়ী তারা কখনও পরোক্ষ যুদ্ধ আবার কখনও কঠোর অর্থনৈতিক অবরোধসহ নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং এখনও করে যাচ্ছে। কিন্তু মার্কিন নেতৃত্বাধীন ওইসব দাম্ভিক পরাশক্তির চাপিয়ে দেয়া এসব অবরোধ ও কূটকৌশলের কাছে নতজানু হওয়া দূরের কথা, বরং খাঁটি ইসলামের অদম্য শক্তির বলে দিনকে দিন ভেতরে ও বাইরে এবং বিশ্ব-অঙ্গনে শক্তিশালী হচ্ছে ইসলামি বিপ্লবের দেশ ইরান। বিশেষ করে উন্নয়নের অনেক মৌলিক ক্ষেত্রে দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দেয়ার মতো বহু সাফল্য অর্জন করেছে দেশটি। কৃষি, শিক্ষা, শিল্প, পর্যটন, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য-চিকিৎসা, মহাকাশ গবেষণা ও সামরিক খাতে ইরানের উন্নয়ন বিশ্ববাসীকে বিস্মিত করে চলেছে। সম্প্রতি ইরান মহাশূন্যে পাঠিয়েছে নিজস্ব প্রযুক্তির দু’টি কৃত্রিম উপগ্রহ। ইরানের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র এবং ক্রুজ ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো এখন লক্ষ্যবস্তুর মাত্র কয়েক মিটারের মধ্যে নিখুঁতভাবে আঘাত হানতে সক্ষম। বিজ্ঞান-গবেষণায় ইসলামি ইরান এখন বিশ্বের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকটি দেশের অন্যতম। এই নিবন্ধে ইসলামি বিপ্লবের পর গত ৪০ বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরানের সার্বিক উন্নয়নের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরা হলো:
শিল্প, বিজ্ঞান ও প্র্রযুক্তি খাতে উন্নয়ন
একটি দেশ তথা জাতির উন্নয়নের প্রধান চালিকাশক্তি হচ্ছে জ্ঞান-বিজ্ঞান। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে যে জাতি যত বেশি এগিয়ে সে জাতি তত উন্নত। বলা হয়ে থাকে, জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ কোন জাতি যেকোন সময় যে কোন কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে সক্ষম। আর এ বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দিয়েই ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার নির্দেশে দেশটির বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদরা চরম আত্মত্যাগ ও সাধনার মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে ইরানের বিজ্ঞানীদের অগ্রগতি সমগ্র বিশ্বের বিজ্ঞানীদের গড় অগ্রগতির চেয়ে ১১ গুণ দ্রুততর (ঋধংঃবংঃ)। ইরানের বিজ্ঞান, গবেষণা ও প্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রী বলেছেন, সর্ব-সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বে বৈজ্ঞানিক গবেষণার দ্রুত অগ্রগতি বা প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে ইরান শীর্ষ স্থানে রয়েছে। মন্ত্রী বলেন, বৈজ্ঞানিক প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রেখেছে এমন ২৫টি দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ইরান ১৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে এক্ষেত্রে শীর্ষ স্থানে রয়েছে। আর এক্ষেত্রে রাশিয়া দ্বিতীয় ও চীন রয়েছে তৃতীয় স্থানে।২০০৫ সালে মধ্যপ্রাচ্যে বৈজ্ঞানিক প্রকাশনায় ইরানের অবদান ছিল ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১৪-১৫ সালে অবদান বেড়ে দাঁড়ায় ২৮ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০০৫ সালে বৈজ্ঞানিক প্রকাশনায় মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের অবস্থান ছিল তৃতীয়, সেখানে ২০১৪-১৫ সালে একেবারে শীর্ষ স্থান দখল করেছে দেশটি। ইরানে ২০১৪ সালে জ্ঞানভিত্তিক ফার্ম ছিল ৫২টি, ২০১৭ সালের মে পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩০৩২টিতে। এসব কোম্পানিতে ৯০ হাজার ব্যক্তির কর্মসংস্থান হয়েছে, রাজস্ব আদায় হয়েছে ৯ দশমিক ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ইরানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পার্কের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ২০০২ সালে যেখানে মাত্র ১টি পার্ক ছিল এখন সেখানে রয়েছে ৩৯টি।
এক কথায় বলতে গেলে ইসলামি বিপ্লবের গত ৪০ বছরে ইরান বায়োপ্রযুক্তি, ন্যানোপ্রযুক্তি, ওষুধ শিল্পসহ বিজ্ঞানের প্রায় সব ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করেছে। দেশটি এখন মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বেশি গাড়ি নির্মাণকারী দেশ। পরিবহন খাতে বিরাট উন্নতি ঘটিয়েছে। এছাড়া, মধ্যপ্রাচ্যের ভেতরে ইরান হচ্ছে নির্মাণ, গৃহস্থালিতে ব্যবহার্য জিনিসপত্র, খাদ্য ও কৃষিপণ্য উৎপাদন, অস্ত্র ও তথ্যপ্রযুক্তি, বিদ্যুৎ এবং পেট্রোকেমিক্যাল উৎপাদনে সবচেয়ে অগ্রগামী দেশ। ২০০৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ‘সাফির’ নামে একটি রকেট উৎক্ষেপণের মাধ্যমে ইরান সর্বপ্রথম কক্ষপথে তার কৃত্রিম উপগ্রহ স্থাপনে সাফল্য অর্জন করে। নিজস্ব প্র্রযুক্তিতে তৈরি স্যাটেলাইট ও দেশে নির্মিত লাঞ্চারের মাধ্যমে রকেট উৎক্ষেপণে বিশ্বে যে সাতটি দেশ সক্ষম ইরান এখন তার একটি। এছাড়া, ইউরেনিয়াম হেক্সাফ্লুরাইড উৎপাদন ও পুরো ‘পরমাণু জ্বালানি চক্র’ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম এলিট ক্লাবের সদস্য দেশ ইরান। অ্যারোস্পেইস সায়েন্সেও আঞ্চলিক ক্ষেত্রে প্রথম এবং বিশ্বে ১৫তম অবস্থানে রয়েছে। এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে মহাকাশ বিজ্ঞান গবেষণা র্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে রয়েছে ইরান। মহাশূন্যে নিজস্ব প্র্রযুক্তিতে নির্মিত স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে সক্ষম দেশের মধ্যে ইরানের অবস্থান নবম এবং মহাকাশযানে প্রাণী পাঠানোর ক্ষেত্রে ইরানের অবস্থান ষষ্ঠ। স্টেমসেল গবেষণার ক্ষেত্রে ইরান প্রথম সারির ১০টি দেশের মাঝে অবস্থান করছে। স্টেমসেল রিপ্লেস করার ক্ষেত্রে বিশ্বে ইরানের অবস্থান দ্বিতীয়।
ন্যানো প্র্রযুক্তির ব্যবহার
কারিগরি ও প্র্রযুক্তিক্ষেত্রে এখন ন্যানোপ্র্রযুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। বিজ্ঞান ও প্র্রযুক্তির প্রায় সকল বিভাগেই এই ন্যানো প্র্রযুক্তি এখন গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিয়েছে। এই প্র্রযুক্তিতে বিশ্বে ইরানের অবস্থান চতুর্থ। মেডিসিন, ইঞ্জিনিয়ারিং, ফার্মাসিউটিক্যালস, পশু চিকিৎসা, পরিবেশ বিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান, মলিকিউল এমনকি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়েও এই প্র্রযুক্তির ব্যবহার লক্ষণীয়। ন্যানো প্র্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ইরানে এখন অন্তত ৩০০টি পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে। এসব পণ্য ইরানের বাইরে ১৭টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। গবেষণাগারের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, শিল্প সরঞ্জাম, টেক্সটাইল সরঞ্জাম, লন্ড্রি বা ডিজারজেন্ট পণ্য সামগ্রী, কৃষি ও ভবন নির্মাণ সরঞ্জাম ইত্যাদি ন্যানো প্র্রযুক্তিজাত পণ্যের অন্তর্ভুক্ত। টেক্সটাইল শিল্প পণ্যের ক্ষেত্রে হাসপাতালে ব্যবহৃত বেডশিটের কথা বলা যেতে পারে। ন্যানো প্র্রযুক্তির ব্যবহার করে নির্মিত এইসব বেডশিট অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল মানে কোনোরকম ব্যাকটেরিয়া এসব চাদরে আক্রমণ করতে পারবে না। শিশুদের জামা-কাপড়ও এই ন্যানো প্র্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি করা হয়। স্যাটেলাইট-রশ্মি, মাইক্রোওয়েভ রশ্মি প্রতিরোধক কাপড়ও ন্যানো প্র্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি করা হয়। বায়ুম-লীয় ঠা-া প্লাজমা শিল্প মেশিনের কথা না বললেই নয়। এই শিল্পে এখন তাঁত শিল্পসহ খাবার, চিকিৎসা, প্যাকেজিং এবং স্টেরিলাইজ করা হয়। এমনকি পরিবেশবিজ্ঞানেও এই প্র্রযুক্তির ব্যবহার ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
শিক্ষা
ইসলামি বিপ্লবের গত ৪০ বছরে ইরানে শিক্ষা খাতে ইরানে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। বর্তমানে দেশটির শতকরা ৯৭ ভাগ মানুষ শিক্ষিত। ইসলামি শিক্ষা-দর্শনের ভিত্তিতে দেশের প্রয়োজনের প্রতি দৃষ্টি রেখে এবং বিজ্ঞান ও প্র্রযুক্তি ক্ষেত্রে অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হয়েছে।বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে দেশটির অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। সম্প্রতি ‘সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইন ইরান : এ ব্রিফ রিভিউ’নামক বইতে এক নজরে ইরানের বিজ্ঞান, প্র্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে অর্জনগুলো তুলে ধরা হয়েছে। এতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দেশটিতে অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রী, স্নাতক ও পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের তালিকা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, ২০০৫-৬ শিক্ষাবর্ষে ইরানে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ছাত্র-ছাত্রী ছিল ২৩ লাখ ৮৯ হাজার ৮৬৭ জন। ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে এটা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৪ লাখ ১১ হাজার ৫৮১ জনে। ২০০৫-৬ শিক্ষাবর্ষে স্নাতকধারীর সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৪০ হাজার ২৪৬ জন, ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭ লাখ ৩৮ হাজার ২৬০ জনে। এসময়ে পিএইচডি ছাত্রছাত্রী ১৯ হাজার ২৩৭ জন থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৩২৪ জনে।
ইরানের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ১৫৪টি, পাবলিক মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ৫৮টি, বেসরকারি ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় ৫৬৭টি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ৩৫৪টি। এরমধ্যে বিশ্ব সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে ইরানের ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয়। ইনফরমেশন সায়েন্স ইনস্টিটিউটের (আইএসআই) এক জরিপে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বিশ্বের সবচেয়ে কার্যকর শিক্ষাকেন্দ্র ও প্রতিষ্ঠানের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে ইরানের ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে তেহরান মেডিকেল সায়েন্স ইউনিভার্সিটি, ইরান পলিমার অ্যান্ড পেট্রোকেমিকেল ইনস্টিটিউট, তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় ও আমির কবির ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি অন্যতম।
চিকিৎসা
ইসলামি বিপ্লবের গত ৪০ বছরে চিকিৎসাখাতে ইরানের উন্নয়ন যেকারো দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাধ্য। বিপ্লবের আগে যে দেশটির অনেক শহরে ইরানি ডাক্তার খুঁজে পাওয়া দুরূহ ব্যাপার ছিল সে ইরানের নাম এখন চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর তালিকায়। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত থমসন রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের সেরা ১ ভাগ চিকিৎসা গবেষকদের মধ্যে অন্তত ৩৬ জন ইরানি গবেষক স্থান করে নিয়েছেন। থমসন রয়টার্স প্রতিনিয়ত বিশ্বের চিকিৎসা গবেষকদের একটি তালিকা আপডেট করে থাকে। গত ১০ বছরের চিকিৎসা গবেষণার কর্ম থেকে গবেষকদের এ ধরনের তালিকা করা হয়েছে। বার্তা সংস্থা ইরনার এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইরান বিশ্বের শীর্ষ ১০টি ওষুধ উৎপাদনকারী দেশের একটি। দেশটি বর্তমানে বিশ্বের ৪৪টি দেশে চিকিৎসা সরঞ্জাম রপ্তানি করছে। সম্প্রতি ইরানের চিকিৎসা সরঞ্জাম রপ্তানিকারকদের ইউনিয়নের সচিব মোহাম্মাদ রেযা জানিয়েছেন, প্রতি বছর বিশ্বের ৪৪টি দেশে তিন কোটি ডলারের চিকিৎসা সরঞ্জাম ইরান থেকে রপ্তানি হয়। রপ্তানির পরিমাণ আরও বাড়ানোর ইচ্ছে রয়েছে বলে তিনি জানান। তিনি আরও বলেন, ইরানের চিকিৎসা সরঞ্জাম জার্মানি ও ইতালিসহ ইউরোপের দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয়। এসব সরঞ্জাম ইউরোপীয় মান নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিই-র অনুমোদনপ্রাপ্ত।
এদিকে, ইরানের চিকিৎসা খাতে ব্যবহৃত জৈব পণ্য উৎপাদন এবং রপ্তানি সংস্থার পরিচালক আমির হোসেইন কারাগাহ্ জানিয়েছেন, ইরান কেবল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে তা-ই নয়, একই সাথে দেশটি জৈব ওষুধ প্রস্তুত সংক্রান্ত প্র্রযুক্তি এবং অভিজ্ঞতাও রপ্তানি করছে। তিনি বলেন, এ জাতীয় প্র্রযুক্তি রপ্তানির মধ্য দিয়ে ইরানের জৈব ওষুধ উৎপাদনের উচ্চ সক্ষমতাই ফুটে উঠেছে। বর্তমানে ইরান এ জাতীয় ওষুধ নির্মাণের প্র্রযুক্তি তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ইরাক, আর্মেনিয়া, কাযাকস্তান এবং রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ রপ্তানি করছে। গত কয়েক বছরে ইরান প্রায় এক ডজনের বেশি জৈব ওষুধ উৎপাদন করেছে। এতে ইরান প্রায় ৭০ কোটি ডলারের বেশি পরিমাণে অর্থ বিদেশে যাওয়া থেকে সাশ্রয় করতে পেরেছে।
এ ছাড়াও ইরানি বিজ্ঞানীরা শক্তিশালী মৌলিক কোষ তৈরি করতে সক্ষম হওয়ায় ইরান এ ক্ষেত্রে বিশ্বের সেরা ৫টি দেশের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। বিশ্বের খ্যাতনামা বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী মৌলিক কোষ নির্মাণে ইরানের সাফল্যের কথা স্বীকার করেছে। ফলে ইরান এক্ষেত্রে বিশ্ব অঙ্গনে জার্মানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও চীনের পরই নিজের বিজয় পতাকা উড্ডীন করতে সক্ষম হয়।
ক্যান্সার চিকিৎসায়ও ইরানি বিজ্ঞানীরা উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছেন। তেহরানের কে এন তূসি প্র্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা ন্যানো প্র্রযুক্তি ব্যবহার করে এমন একটি যৌগ আবিষ্কার করেছেন যার সাহায্যে মানবদেহে ক্যান্সার চিহ্নিত করা যাবে। এধরনের যৌগ উৎপাদন করা যাবে বেশ সস্তায় এবং এতে অপেক্ষাকৃত কম খরচে ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসা সম্পন্ন করা যাবে।
হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রেও ইরানি চিকিৎসকদের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। ইরান বছরে প্রায় ১০০ হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন অস্ত্রোপচার করে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে ইরান হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন ও হৃদরোগ চিকিৎসায় শীর্ষে অবস্থান করছে। এছাড়া অঙ্গ ও কিডনি প্রতিস্থাপনে ইরানি চিকিৎসকদের খ্যাতি এখন বিশ্বজুড়ে।২০১৬ সালের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ২০১৫ সালে আড়াই হাজার মানুষের কিডনি ও ৩৩শ’ মানুষের অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। ইরানে বর্তমানে ২৯টি কিডনি প্রতিস্থাপন কেন্দ্র, যকৃত প্রতিস্থাপনে ৭টি কেন্দ্র, ৮টি হৃদযন্ত্র ও ২টি ফুসফুস প্রতিস্থাপন কেন্দ্র কাজ করছে।
মেডিক্যাল ট্যুরিজম
মেডিক্যাল ট্যুরিজম শিল্পে ইরান এখন উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাতারে রয়েছে। এখন সারা বছর জুড়েই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বহু মানুষ চিকিৎসার জন্য ইরানে আসছেন। বেশিরভাগ রোগী হলেন ব্রিটেন, সুইডেনসহ পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর। ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য নীতিতে চিকিৎসা ব্যয় কমানোর ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এ কারণে ইরানে যেকোনো অপারেশনের ব্যয় তুরস্ক, ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক চতুর্থাংশের মতো। তবে চিকিৎসার গুণগত অবস্থা বিশ্বমানের। সেজন্যই বিদেশী রোগীরা ইরানের চিকিৎসার মানের ব্যাপারে সন্তুষ্ট। এছাড়া ইরানি অস্ত্রোপচারকারী চিকিৎসক এবং সাধারণ চিকিৎসকগণ বেশ দক্ষ। বিদেশী সহযোগীরা সবসময়ই তাঁদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এশিয়ার দেশগুলোর মাঝে মেডিক্যাল ট্যুরিজম ক্ষেত্রে কঠোর প্রতিযোগিতা চলছে। এই প্রতিযোগিতায় ইরানের অবস্থান বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দশটি দেশের মধ্যে রয়েছে। ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মেডিক্যাল ট্যুরিজম ক্ষেত্রে এশীয় দেশগুলোর সাথে সহযোগিতা বৃদ্ধি সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষরও করেছে। বর্তমানে বছরে প্রায় ২ লাখ রোগী মেডিক্যাল ট্যুরিজমের লক্ষ্যে ইরান সফরে আসে এবং ইরানের উন্নত চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করে উপকৃত হচ্ছে। ইরানের অন্তত ষাটটি হার্ট অপারেশন কেন্দ্রে ওপেন হার্ট সার্জারি হচ্ছে। ইরানের এই চিকিৎসা সেবা বিশ্বের চিকিৎসকগণকে আকৃষ্ট করছে। কেবল ওপেন হার্ট সার্জারিই নয়, আরো বহু জটিল ও মারাত্মক রোগের চিকিৎসা এখন বেশ উন্নত প্র্রযুক্তির মাধ্যমে করা হচ্ছে।
রপ্তানি খাত
একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হলো রপ্তানি খাত। এই খাতে যে দেশ যত বেশি শক্তিশালী সেই দেশ অর্থনৈতিকভাবে তত বেশি সমৃদ্ধ। আর এক্ষেত্রে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান উদীয়মান অর্থনীতির সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে যাচ্ছে সমৃদ্ধির ইতিবাচক গতিধারায়। তেলের ওপর নির্ভরতাই ছিল এক সময় দেশটির অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি। কিন্তু সেই তেলনির্ভর অর্থনীতি থেকে ক্রমশ বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে দেশটি। ইসলামি বিপ্লবের পর বিগত ৪০ বছরে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তিগুলোও পাল্টে যাচ্ছে। ক্রমশ শিল্প, কৃষি ও সেবা খাতের বিকাশ ঘটছে। এর ফলে দেশটির অর্থনীতির মৌলিক কাঠামো অনেকটাই বদলে যাচ্ছে। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান চলতি ফারসি বছরের প্রথম দশ মাসে কেবল(২১ মার্চ ২০১৮ থেকে ২১ জানুয়ারি ২০১৯) প্রতিবেশী ১৫টি দেশে ৫৭ দশমিক ২৮ মিলিয়ন টনের তেলবহির্ভূত পণ্য রপ্তানি করেছে। এই রপ্তানি থেকে দেশটির আয় হয়েছে প্রায় ৩০বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ওজনের দিক দিয়ে ৩৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ কম এবং মূল্যের দিক দিয়ে ৩ দশমিক ৪৯ শতাংশ বেশি। ইরানের সাথে বাণিজ্য করা ওই ১৫ প্রতিবেশী দেশ হচ্ছে ইরাক, তুরস্ক, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, রাশিয়া, ওমান, আযারবাইজান, তুর্কমেনিস্তান, কুয়েত, কাতার, কাজাখস্তান, আরমেনিয়া, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের শুল্ক প্রশাসন প্রকাশিত সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি বছরের প্রথম দশ মাসে ইরান সর্বমোট ৫০ দশমিক ৪৬ মিলিয়ন টন পণ্যসামগ্রী রপ্তানি করেছে। এই রপ্তানি থেকে দেশটির আয় হয়েছে ২০ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ওজনের দিক দিয়ে ১৬ দশমিক ১২ শতাংশ এবং মূল্যের দিক দিয়ে ২১ দশমিক ৯৬ শতাংশ বেশি।
ইরানের প্র্রযুক্তিভিত্তিক রপ্তানিও বেড়েছে। ২০০৪ সালে দেড় বিলিয়ন ডলার প্র্রযুক্তিভিত্তিক রপ্তানি হয়েছে দেশটির, ২০০৯ সালে সেখানে হয়েছে ৭ বিলিয়ন ডলার ও ২০১৪ সালে হয়েছে ১২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার।বিজ্ঞান ও প্র্রযুক্তি পার্কের মাধ্যমে জ্ঞানভিত্তিক পণ্য সামগ্রীর রপ্তানি বেড়েছে। ২০১৩ সালে যেখানে ৪৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের এসব পণ্য রপ্তানি হয়েছে, ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫০ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারে।
ইরানে তেলবহির্ভূত পণ্য রপ্তানির তালিকায় প্রথম স্থানে রয়েছে প্লাস্টিক ও প্লাস্টিকের জিনিসপত্র, দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে জৈব রাসায়নিক পণ্যসামগ্রী, তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে আকরিকসহ ধাতব দ্রব্যসমূহ, চতুর্থ স্থানে রয়েছে ফলমূল ও বাদাম। এছাড়া ইরানের রপ্তানিযোগ্য পণ্যের মধ্যে আয়রন ও স্টিল, কপার, সার, লবণ, সালফার, পাথর ও সিমেন্ট, পেট্রোকেমিক্যাল, কৃষিপণ্য, খাদ্যপণ্য, খনিজ ও ওষধি পণ্য উল্লেখযোগ্য।
বিশ্বে উদ্যোক্তা বৃদ্ধিতে শীর্ষ পাঁচে ইরান
বিশ্বে উদ্যোক্তার সংখ্যা বৃদ্ধিতে শীর্ষ পাঁচ দেশের তালিকায় রয়েছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। দেশটির বিজ্ঞান, প্র্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের সূচকের অবস্থা পর্যবেক্ষণে এই চিত্র উঠে এসেছে। ইরানের বিজ্ঞান, প্র্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের সূচকের অবস্থা পর্যবেক্ষণের একটি প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে ২০১৮ সালের জন্য এই র্যাঙ্কিং প্রকাশ করা হয়।ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, উদ্যোক্তা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিশ্বে শীর্ষ পাঁচ দেশের অন্যতম ইরান।
কৃষি উন্নয়ন
ইসলামি বিপ্লবের গত ৪০ বছরে কৃষিখাতে ইরানের অগ্রগতির চিত্র রীতিমত বিস্ময়কর। ২০১৭ সালে বিশ্বে কৃষি পণ্যের বৈচিত্র্যের দিক দিয়ে তৃতীয় অবস্থান দখল করতে সক্ষম হয়েছে ইরান। এছাড়া ইরানের তুলনামূলক রপ্তানি সম্ভাবনাময় খাতগুলোর তালিকায় শীর্ষে উঠে এসেছে দেশটির কৃষি খাত। ইরানের বাণিজ্য উন্নয়ন সংস্থা (টিপিও) প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে এই চিত্র পাওয়া গেছে। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বা ফাও’র তথ্য মতে, ইরান হচ্ছে বিশ্বের প্রধান পাঁচটি দেশের মধ্যে একটি যে দেশটি কমলা, মাল্টা ও লেবুজাতীয় ফল উৎপাদনে সেরা অবস্থানে রয়েছে। এছাড়া শশা, ক্ষীরা, খেজুর, বেগুন, ডুমুর, পেস্তা, নাশপাতি, আখরোট ও তরমুজ উৎপাদনে বিশ্বের সেরা পাঁচ দেশের মধ্যে রয়েছে ইরান।
বিশ্ব র্যাংকিংয়ে ইরানি কৃষিপণ্য
পৃথিবীর অন্যতম মূল্যবান কৃষিপণ্যের একটি জাফরান। যাকে ইরানের ‘লাল স্বর্ণ’ বলা হয়ে থাকে। বিশ্বের মোট উৎপাদিত জাফরানের প্রায় ৯০ শতাংশই উৎপাদিত হয় মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটিতে। বিশ্বের সবচেয়ে দামি খাবার ক্যাভিয়ার যাকে ‘কৃষ্ণ সোনা’ হিসেবেও অভিহিত করা হয়ে থাকে সেটি উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষ স্থানে রয়েছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। বিশ্বে উটপাখির মাংস উৎপাদনে ইরান দ্বিতীয়। বৈশ্বিকভাবে ডিম উৎপাদনের র্যাঙ্কিংয়ে ১২তম অবস্থানে রয়েছে ইরান। মধু উৎপাদনে ইরানের অবস্থান বিশ্বে তৃতীয়। খেজুর উৎপাদনে বিশ্বে ইরানের অবস্থান দ্বিতীয় এবং বিশ্বের বৃহত্তম খেজুর রপ্তানিকারক দেশ ইরান। বিশ্বে বর্তমানে তৃতীয় বৃহত্তম কিসমিস রপ্তানিকারক দেশ ইরান। বিশ্বের শীর্ষ আঙ্গুর উৎপাদনকারী দেশের তালিকায় ৮ম স্থান অধিকার করেছে ইরান। পৃথিবীতে যত দামী ফল বিশেষ করে বাদামজাতীয় ফল রয়েছে তার মধ্যে পেস্তা অন্যতম। এই ফলটির নাম উঠলেই যে দেশটির কথা সবার আগে উচ্চারিত হয় তার নাম ইরান। আখরোট উৎপাদনে ইরান বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে।
সামরিক শক্তি
ইরান সারা বিশ্বে এখন যেসব কারণে বিশেষ আলোচিত তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে এর সামরিক শক্তি। সামরিক শক্তি নিয়ে পূর্ণাঙ্গ আলোচনায় না গিয়েও বলা যায় ইরানের রয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ সক্রিয় সেনা সদস্য। এছাড়া আছে সাড়ে তিন লাখ রিজার্ভ সেনা। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী বাসিজ, যার সদস্য সংখ্যা দশ লাখের বেশি। এতে পুরুষের পাশাপাশি নারী সদস্যও রয়েছে। সব মিলিয়ে ইরান যেকোনো সময় দশ লাখের বেশি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনা মোবিলাইজ করতে পারে এবং এ সুবিধা বিশ্বের হাতেগোনা কয়েকটি দেশের রয়েছে। ইরানের হাতে রয়েছে নিজস্ব সামরিক শিল্প-কারখানা যেখানে ট্যাংক, আর্মার্ড পারসোনেল ক্যারিয়ার, গাইডেড মিসাইল, সাবমেরিন, সামরিক নৌযান, গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার, রাডার সিস্টেম, হেলিকপ্টার এবং জঙ্গিবিমান তৈরি করা হয়। এছাড়া ইরানের কারখানায় তৈরি করা হচ্ছে হুত, কাউসার, জেলযাল, ফতেহ-১১০, শাহাব-৩ ও সিজ্জিল ক্ষেপণাস্ত্র এবং নানা ধরনের ড্রোন।
ক্ষেপণাস্ত্র শক্তি
ইরানের আক্রমণাত্মক ও প্রতিরক্ষা কৌশলের প্রধান স্তম্ভ হলো অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র। ক্ষেপণাস্ত্র শক্তিতে দেশটির অবস্থান এখন বিশ্বে চতুর্থ। ইরান বিশ্বের যত বড় পরাশক্তির হাতেই আক্রান্ত হোক না কেন দেশটির ব্যালিস্টিক ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্টা আঘাতগুলো প্রতিপক্ষের জন্য হজম করা হবে খুবই কঠিন এবং অসহনীয়। তাই ইরানের শত্রুরা এ দিকটি বিশেষ বিবেচনায় রেখে সামরিক হামলার কথা খুব কমই ভাবতে বাধ্য। উল্লেখ্য, ইরান এরআগে নিজস্ব প্র্রযুক্তিতে তৈরি করেছে ‘ইমাদ’ ও ‘ফজর’ এর মতো উন্নত প্র্রযুক্তির ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র।
বিদেশী হুমকি মোকাবিলায় ইরানের প্রস্তুতি
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমির হাতামি বলেছেন, শত্রুর যেকোনো হুমকি মোকাবিলায় তাঁর দেশের সামরিক প্রস্তুতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে।তিনি আরো বলেন, মার্কিন একতরফা নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইরান সর্বোচ্চ পর্যায়ের সামরিক প্রস্তুতি নিতে সক্ষম হয়েছে; এর মাধ্যমে একথা পরিষ্কার হয় যে, শত্রুর নিষেধাজ্ঞা ইরানের সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে কোনো রকমের বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি। এমনকি এখন আমেরিকা ও তার আঞ্চলিক পুতুল সরকারগুলো ইরানের সামরিক শক্তিকে স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে।
পর্যটন শিল্প
আনন্দ, ভালোলাগা আর রূপময় স্বপ্নীল পৃথিবীর অজানা কোন সৌন্দর্যের হাতছানিতে ক্ষণিকের জন্য হারিয়ে যেতে মন ছুটে চলে পাহাড়, নদী, সাগর ও অরণ্যে। কখনও মন চায় কোন শিল্পকর্মেরসুনিপুণ কারুকার্যে মন রাঙাতে। আর সে মনের খোরাক জোগাতেই দূর থেকে দূরে ছুটে চলা। সে চলার পথের গন্তব্য যদি হয় ইতিহাস, ঐত্যিহ্যে সমৃদ্ধ কোন দেশ তাহলে যে একজন ভ্রমণপিপাসুর মনের ষোলকলা পূর্ণ হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। ঠিক এমনই এক দেশের নাম হলো ইরান। বলা হয়ে থাকে, পৃথিবীর অর্ধেক সৌন্দর্যের দেশ এটি।যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী মিডিয়া সিএনএন এর সিনিয়র প্রডিউসার ব্যারি নিল্ড ইরানের পর্যটন সম্পর্কে তাঁর প্রতিবেদনের শিরোনাম করেছেন, ‘থার্টি ফোর ইনক্রেডিবল বিউটিফুল রিজন্স টু ভিজিট ইরান’।অর্থাৎ ইরান সফরের ৩৪টি অবিশ্বাস্য সুন্দর কারণ।ইরানের ৩৪টি আকর্ষণীয় নিদর্শনের বর্ণনা দিয়ে এই প্রতিবেদনটি লেখা হয়। এমন একটি দেশে ইসলামি বিপ্লবের গত ৪০ বছরে সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ দেশটিকে বিশ্বপর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রে পরিণত করেছে। বর্তমানে ইরান বিশ্বের সেরা ১০ পর্যটন গন্তব্যের অন্যতম। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় রয়েছে ইরানের ২১টি নিদর্শন। ইরানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, পর্যটন ও হস্তশিল্প সংস্থার (সিএইচটিএইচও) প্রধান আলি আসকার মুনেসান একথা জানান। গত ফারসি বছরে (২১ মার্চ ২০১৮ থেকে ২০ মার্চ ২০১৯) ইরান ভ্রমণ করেছেন প্রায় ৭৮ লাখ বিদেশী পর্যটক। আগের বছর যেখানে দেশটিতে ভ্রমণে আসা বিদেশী পর্যটকের সংখ্যা ছিল ৫১ লাখ। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় গত বছর বিদেশী পর্যটক বেড়েছে ৫২ দশমিক ৫ শতাংশ।
গ্রামীণ উন্নয়ন
আট কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত ইরানের ৭৪ শতাংশ মানুষ শহরে এবং ২৬ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে। তবে, শহরের মতো গ্রামের মানুষও সকল মৌলিক নাগরিক সুবিধা ভোগ করছে। স্বল্প আয়ের জনগণ কম খরচে ও ঋণসুবিধা পেয়ে বাড়ির মালিক হচ্ছে। ইসলামি বিপ্লবের পর পরই প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, পানি, স্কুল-কলেজ ও হাসপাতাল-ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করে তাৎক্ষণিক নাগরিক সুবিধা পৌঁছে দেয়া হয়েছে। এখন ইরানের গ্রামের মানুষও স্বাস্থ্যবিমার আওতায় চলে এসেছে।তিন বছর আগে অর্থাৎ ফারসি ১৩৯৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ইরানের গ্রামাঞ্চলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৫৫ হাজার, বিপ্লবের আগে ছিল ২২ হাজার ২৪৬টি। গত চার দশকে ডে-নাইট স্কুল ৯টি থেকে বেড়ে হয়েছে ১৩৮৭টি। শাহ সরকারের আমলে গ্রামে খেলার মাঠ ছিল মাত্র ১২টি, বর্তমানে ২ হাজার ১৮২টি। বিপ্লবের আগে গ্রামে পাকা রাস্তা ছিল মাত্র ২০০ কিলোমিটার, বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৩ হাজার কিলোমিটার। আধাপাকা রাস্তা ছিল ৮ হাজার ২০০ কিলোমিটার আর এখন ১ লাখ ২৯ হাজার কিলোমিটার। বিপ্লবের আগে ইরানের গ্রামাঞ্চলের জন্য কোনো ফায়ার সার্ভিস কেন্দ্র ছিল না, বর্তমানে ৩৮০টি গ্রামে ফায়ার সার্ভিস সেবা চালু আছে। সেসময় ইরানের ৩১২টি গ্রামে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল। বর্তমানে ইরানের ৫ হাজার ৩১২টি গ্রামের মানুষ টেলিফোন ব্যবহার করে। দেশটিতে গত ৪০ বছরে ৩৩ হাজার ৫০০ পল্লি উন্নয়ন পরিষদ গড়ে তোলা হয়েছে। এভাবে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ইরানের গ্রামীণ জীবনে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে।
সামাজিক নিরাপত্তা
যে কোনো দেশের শান্তি ও সমৃদ্ধির বিষয়টি অনেকাংশই নির্ভর করে সেই দেশের সামাজিক নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার ওপর। ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর দেশটির সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। তাই তো সারা বিশ্বের নজর আজ শান্ত ও স্থিতিশীল ইরানের দিকে, দেশটির সামাজিক নিরাপত্তার দিকে। যেখানে ইউরোপ ও আমেরিকার মতো উন্নত দেশের মানুষ সারাক্ষণ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, আত্মরক্ষার জন্য বাধ্য হয় অস্ত্র বহন করতে, বর্ণবৈষম্য, সামাজিক বৈষম্য, সংখ্যালঘুদের অধিকার হরণ, খুন, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, চরম নৈতিক অবক্ষয়, গভীর পারিবারিক সংকট, তালাক প্রভৃতি যেখানে নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার সেখানে ইরানে বিরাজ করছে উল্টো চিত্র। এখানে নেই কোন মারামারি, নেই চুরি-ছিনতাই, গোলাগুলি-অস্ত্রবাজি। প্রতিদিনের পত্রিকায় কিংবা টেলিভিশনের খবরে খুন-হত্যাকা-ের খবর ‘মাস্ট আইটেম’ হিসেবে থাকে না- যা অনেক উন্নত দেশেও কল্পনা করা যায় না। এখানে মানুষ অনেক বেশি নিরাপদে পথ চলে। সেই নিরাপত্তা দিনে-রাতে একই রকম। রাতের আঁধার নামার সঙ্গে সঙ্গে এখানে ভয় নেমে আসে না। নিশ্চিন্তে পথ চলা যায় একাকী। ভাবতেও হয় না- ‘কেউ জানতে চাইবে কাছে কী আছে!’বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে এই নিরাপত্তা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার ক্ষেত্রেই সমান। একজন নারী কিংবা তরুণী যদি একাকী রাতের বেলায় পথে হেঁটে যায় তাকেও আলাদা করে ভাবতে হয় না নিরাপত্তার কথা। পথ চলতে গেলে ডাকাত-ছিনতাইকারীর সামনে পড়ার ভয় নেই। রাস্তায় নেই কোন উটকো মাস্তানি। কেউ পথ আগলে দাঁড়াবে না, কেউ অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করবে না বা শিস দেবে না। এ এক অন্যরকম সমাজ; সামাজিক নিরাপত্তাই যার বড় বৈশিষ্ট্য। সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি আসলে ইরানকে নিয়ে গেছে অন্যরকম উচ্চতায়।
চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়ন
চলচ্চিত্র একটি সৃজনশীল গণমাধ্যম। এর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উপাদান। যে দেশে তা নির্মিত হয় সে দেশেরই জাতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করে চলচ্চিত্রটি। শিল্পকলার প্রভাবশালী মাধ্যম, শক্তিশালী বিনোদন মাধ্যম এবং শিক্ষার অন্যতম সেরা উপকরণ হিসেবেও খ্যাতি রয়েছে চলচ্চিত্রের। গণযোগাযোগ বা সাধারণ মানুষের কাছাকাছি খুব সহজে পৌঁছার ক্ষেত্রেও চলচ্চিত্রের ভূমিকা অপরিসীম। আবার সৃষ্টিশীল মানুষ ও আলোকিত সমাজ উপহার দেয়ার ক্ষেত্রেও এর রয়েছে জাদুকরি প্রভাব। আর এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই ইতিহাস, ঐতিহ্য ও শিল্প-সাহিত্যে সমৃদ্ধ দেশ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। দেশটির চলচ্চিত্র এখন বিশ্বমানের। অসংখ্য আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ইরানি সিনেমার হৃদয়স্পর্শী ও প্রভাবশালী উপস্থিতি বিশ্বে ইরানি সংস্কৃতি ও শিল্পের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি তুলে ধরেছে। ১৯০০ সালে শুরু হয় ইরানি চলচ্চিত্রের পথচলা। বর্তমানে দেশটিতে প্রতি বছর প্রায় ২০০টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। শক্তিশালী চিত্রনাট্য, অসাধারণ ও অভূতপূর্ব অভিনয়, কলাকুশলির মনকাড়া আবেদন ছাড়াও বিশ্বমানের কারিগরি কৌশলের কারণে বিশ্বের সর্বত্র আজ ইরানি সিনেমা ব্যাপকভাবে দর্শক সমাদৃত হচ্ছে। সেইসাথে পুরস্কৃত হচ্ছে শীর্ষ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে।
আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র অঙ্গনে সবচেয়ে আলোচিত ও সম্মানজনক পুরস্কার অস্কার থেকে শুরু করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক পুরস্কার ঘরে তুলে নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশটি। অস্কারের ৮৯তম আসরে সেরা বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র হিসেবে পুরস্কার জিতে নেয় ইরানি ছবি ‘দ্য সেল্সম্যান’। এ নিয়ে দ্বিতীয়বার অস্কার জিতলেন ছবিটির পরিচালক আসগর ফারহাদি। এর আগে ‘অ্যা সেপারেশন’ তাঁকে এনে দেয় এই সম্মাননা।
পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এবং প্রভাবশালী চলচ্চিত্র উৎসব কান চলচ্চিত্র এই উৎসবের ৭০তম আসরে সিনেফন্ডেশন পুরস্কার জিতেছে ইরানি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি ‘অ্যানিমল’। গত কান চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনও হয়েছে ইরানি চলচ্চিত্র দিয়ে এবং এই উৎসবের শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকারের পুরস্কারও জিতে নিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটি।
ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবের ৭৪তম আসরে দুই অ্যাওয়ার্ড জয় করে ইরানি চলচ্চিত্র ‘নো ডেট, নো সিগনেচার’। ছবিটির জন্য সেরা পরিচালকের অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন এর পরিচালক চলচ্চিত্রকার ভাহিদ জলিলভান্দ এবং সেরা অভিনেতার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন নাভিদ মোহাম্মাদজাদেহ।
ভারতে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় কার্গিল আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অ্যাওয়ার্ড জেতে ইরানের চারটি ছবি।পঞ্চদশ ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে তিন বিভাগে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেয়েছে ইরান। সেরা ছায়াছবি, সেরা অভিনয় ও শ্রেষ্ঠ পরিচালনা বিভাগে পুরস্কার জিতে নেয় ইসলামি প্রজাতন্ত্রের এই দেশটি।এক কথায় বলতে গেলে প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যে সর্বত্র ইরানি চলচ্চিত্রের জয়জয়কার।
আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরানি নারীদের সাফল্য
নারীর উন্নয়নে বিশ্বের যে দেশগুলো এগিয়ে রয়েছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান তাদের অন্যতম। জ্ঞান-বিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি, খেলাধুলাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরানের নারীদের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। ফারসি ১৩৯৫ সালের হিসাব অনুযায়ী ৮ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত ইরানে সাক্ষরতার হার ৯৭ শতাংশ। এর মধ্যে ৪৬ শতাংশ নারী। দেশটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী মানুষের সংখ্যা ১১ মিলিয়ন। যার ৫০ শতাংশই নারী। বিশ্বে সর্বোচ্চ সংখ্যক নারী বিজ্ঞানীর তালিকার শীর্ষে রয়েছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। বিজ্ঞান ও প্র্রযুক্তিতে পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিপক্ষদের বহুদূর ছাড়িয়ে গেছেন দেশটির নারীরা। এক হিসাব মতে, বিজ্ঞানে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন ইরানের অর্ধেকেরও বেশি নারী। ইরানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান, প্র্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত (সংক্ষেপে এসটিইএম) বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশই নারী। যা বিশ্বের যে কোনো দেশের তুলনায় শতাংশে অনেক বেশি। লেখিকা সাদিয়া জাহিদি তাঁর নতুন বই ‘ফিফটি মিলিয়ন রাইজিং’-এ এসব তথ্য তুলে ধরেন।
কর্মক্ষেত্রে ইরানি নারীদের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রশাসন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরনের কর্মক্ষেত্রে ইরানি নারীদের রয়েছে সরব উপস্থিতি। বর্তমানে ইরানের রাষ্ট্রীয় এয়ারলাইন্স ইরান এয়ারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন একজন নারী।
কর্মক্ষেত্রে নারীর এমন সফলতার কারণে চাকরির বাজারে দেশটির নারীদের চাহিদা বাড়ছে। ইরানের চাকরির বাজারে বিগত তিন বছরে নারীদের উপস্থিতির সংখ্যা বেড়েছে ৪০ ভাগ। ইরান ট্যালেন্ট ডটকমের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ফারসি বছরে আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর বিভিন্ন শাখায় নারী কর্মচারীদের সংখ্যা বেড়েছে ২৯ ভাগ। অন্যদিকে, বেসরকারি মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোতে বেড়েছে ৩২ শতাংশ এবং রাষ্ট্রীয় পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে নারীর সংখ্যা বেড়েছে ২০ শতাংশ। প্রতিবেদন মতে, ইরানে মধ্যম সারির ব্যবস্থাপক পর্যায়ে ২৫ শতাংশ নারী কর্মরত রয়েছেন এবং উচ্চ পর্যায়ের ব্যবস্থাপনা পদে রয়েছেন ১৯ শতাংশ নারী। এছাড়া দেশটিতে প্রায় ৬০ শতাংশ নারী কার্যনির্বাহী ও প্রশাসনিক কর্মী হিসেবে সক্রিয় রয়েছেন। বিদেশী ভাষা থেকে অনুবাদের কাজে কর্মরত রয়েছেন ৫০ শতাংশ নারী।
ইরান ট্যালেন্ট ডটকমের অপর আরেকটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রায় ৫০ শতাংশ ইরানি নারী শিল্প ক্ষেত্রে কাজ করছেন। দেশজুড়ে ২৮টি ভিন্ন ভিন্ন চাকরি ক্ষেত্রের ১ লাখ কর্মচারীর ওপর জরিপ পরিচালনা করে এই তথ্য দেয়া হয়।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে ইরানের সাফল্য
যে-কোনো দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে বিদ্যুৎ অপরিহার্য। শিল্প, কলকারখানা, কৃষিকাজ, মানব সম্পদ উন্নয়ন, আধুনিক জীবনযাত্রা, চিকিৎসা, যোগাযোগ, কম্পিউটার প্র্রযুক্তির ব্যবহার থেকে শুরু করে উন্নয়নের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই প্রয়োজন বিদ্যুৎ। বাস্তবতার নিরিখে এ সকল উপলব্ধি থেকে বিদ্যুৎ খাতের কাক্সিক্ষত উন্নয়ন ও পরিচালনা দক্ষতা বৃদ্ধি ও উন্নত গ্রাহক সেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান এরই মধ্যে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে। দেশটি বর্তমানে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ খাতে কেবল পুরোপুরি স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে তাই নয় একই সাথে দেশটিতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ এখন অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। বর্তমানে ইরানের উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণ ৮০ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে। ২০১৫ সালে দেশটিতে যেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৭৫ হাজার মেগাওয়াট সেখানে ২০১৮ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ বেড়ে ৮০ হাজার মেগাওয়াট অতিক্রম করেছে। এর মধ্য দিয়ে ইরান বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিক থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে এক নম্বর স্থানে রয়েছে। আর সারা বিশ্বে দেশটির অবস্থান ১৪ নম্বরে।এছাড়া আরও অনেক ক্ষেত্রেই ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন যা এই সীমিত পরিসরে তুলে ধরা প্রায় অসম্ভব। তবে যেকথা না বললেই নয় তা হচ্ছে, শত বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও ইসলামিবিপ্লবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেইনী (র.)-এর সুযোগ্য উত্তরসূরি ও ইসলামি বিপ্লবের বর্তমান নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ উজমা খামেনেয়ীর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ ইরানি জাতি কোন অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করে উন্নয়নের ধারায় যেভাবে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে তাতে দেশটি একদিন বিশ্বের নেতৃত্বের আসনে অবস্থান করবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
ইসলামি বিপ্লবের নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীর প্রদত্ত ভাষণের পূর্ণ বিবরণ
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেইনী (র)-এর ত্রিশতম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তেহরানের উপকণ্ঠে ইমাম খোমেইনীর মাযার এলাকায় অনুষ্ঠিত বিশাল সমাবেশে ইসলামি বিপ্লবের নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীর প্রদত্ত ভাষণের পূর্ণ বিবরণ
بسم الله الرّحمن الرّحیم
الحمدلله ربّ العالمین و الصّلاة و السّلام علی سیّدنا و نبیّنا ابیالقاسم المصطفی محمّد و علی آله الاطیبین الاطهرین المنتجبین المعصومین الهداة المهدیّین سیّما بقیّةالله فی الارضین.
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য। আর দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক আমাদের সর্দার ও আমাদের নবী আবুল কাসেম মুহাম্মদ এর প্রতি এবং তাঁর পবিত্র নির্বাচিত ও নিষ্পাপ বংশধরগণের ওপর, যাঁরা হোদায়াতের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং হেদায়তের ঝা-াবাহী, বিশেষ করে পৃথিবীতে আল্লাহর আমানত বাকিয়্যাতুল্লাহ (ইমাম মাহদী আ.) এর প্রতি।
আজকের দিনে সেই তিক্ত ইতিহাসের ঠিক ত্রিশটি বছর অতিক্রান্ত হচ্ছে, আমাদের প্রিয়তম ও মহান ইমামের সাথে বিরহের ত্রিশ বছর। ঐতিহাসিক চিরবিদায় এবং জনগণ তাদের ইমাম ও নজিরবিহীন মহান নেতাকে অত্যন্ত প্রাণঢালা হৃদয়ের আবেগ উজাড় করা চিরবিদায় দানের ত্রিশটি বছর।
এই ত্রিশ বছরে অনেক চেষ্টা তদবীর করা হয়েছে, যাতে ইমামের স্মরণ, ইমামের নাম ও ইমামের সুনাম-সুখ্যাতিকে খাটো করা যায়। ইমামের অনুসৃত মূলনীতি, ইমামের চিন্তা ও আদর্শ এবং ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানকে পরিচালনার ক্ষেত্রে ইমামের অনুসৃত পথকে উপেক্ষা করা যায়। আমাদের মহান ইমামের বিশাল আকর্ষণ শক্তিকে ¤্রয়িমাণ করা ও দুর্বল করার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করা হয়েছে। ত্রিশটি বছর ধরে বিভিন্ন জাতের শত্রু ও কতক উদাসীন লোকের পক্ষ হতে এ ধরনের চেষ্টা ও তদবীর চলে আসছে। কিন্তু বাস্তবতা পুরোপুরিই বিরোধী ও দুশমনদের চাওয়া ও কামনার সম্পূর্ণ বিপরীত ধারা অনুসরণ করে চলেছে। বাস্তবতা হচ্ছে, ইমামের আকর্ষণশক্তি আজকে যে কোনোরূপ হ্রাস পায় নি শুধু তাই নয়, বরং তার পরিধি আরো অধিক প্রলম্বিত হয়েছে। তার একটি চিহ্ন হচ্ছে আজকের এই বিশাল সমাবেশ। মহান ইমামের ইন্তিকালের ত্রিশ বছর পর এই পবিত্র মাহে রমযানে, মাহে রমযানের সন্ধ্যায় এই বিশাল স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি তীব্র গরমের মধ্যে এত প্রাণচাঞ্চল্য ও উৎসাহ-উদ্দীপনা এই সমাবেশকে আলোকিত করেছে। দুনিয়ার কোথাও কি এমন নজির আছে?
ইমামের আকর্ষণশক্তি কয়দিন আগেও কুদ্স দিবসের মিছিলে আপনারা প্রত্যক্ষ করেছেন। সমগ্র দুনিয়া তা দেখেছে। চল্লিশ বছর আগে মহান ইমাম গুরুত্বপূর্ণ ফিলিস্তিন সমস্যার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে কুদ্স দিবস প্রবর্তন করেন। সেই থেকে চল্লিশ বছর অতিক্রান্ত হচ্ছে। অথচ কুদ্স দিবস পুরোনো হয় নি। এ বছর একশ’টির বেশি দেশে মহান ইমামের স্মরণে কুদ্স দিবসে মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। অথচ আমেরিকা ও আমেরিকার সাঙ্গপাঙ্গ ও লেজুড়বৃত্তিকারীদের শক্তিমদমত্ত নীতির প্রচেষ্টা ছিল তারা ফিলিস্তিন সমস্যাকে বিস্মৃতিতে তলিয়ে দেবে- সমস্যাটির অস্তিত্বই যাতে বিদ্যমান না থাকে। যেমন এ সম্পর্কে আপনারা আমেরিকানদের এসব দুষ্টামি ও কোনো কোনো আরব নেতার বিশ^াসঘাতকতা সম্পর্কিত খবরাখবর শুনতে পাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের মহান ইমামের প্রভাবের কারণে একশ’টির বেশি দেশে কুদ্স দিবস নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এই আলোচনা ক্ষমতাসীন বা রাজনৈতিক পক্ষগুলোর মুখপাত্রের মাধ্যমে নয়; বরং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর পক্ষ হতে, বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠীর পক্ষ হতে এই দিবস উদ্যাপিত হচ্ছে। এটি ইমামের আকর্ষণশক্তির প্রমাণ যে, তাঁর ইন্তিকালের ত্রিশ বছর পরে এই আকর্ষণশক্তি এখনো বিদ্যমান রয়েছে। বর্তমান দুনিয়াতে অন্য কোনো আকর্ষণ এর সমকক্ষ হতে পারে না। অবশ্য আমি এখানে সুযোগ নিতে চাই এবং আমাদের জনগণের প্রতি অন্তরের অন্তস্থল থেকে কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই যে, তাঁরা রমযানের শেষ শুক্রবারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ব্যাপক ভিত্তিতে সারা দেশে কুদ্স দিবসের মিছিল ও সমাবেশগুলোতে অংশ নিয়ে মাঠে ময়দানের তাঁদের উপস্থিতি প্রমাণ করেছেন এবং জনসাধারণ সত্যিকার অর্থেই ইমামের উপদেশ পালনে ত্রুটি করেন নি এবং করবেনও না।
এই আকর্ষণের রহস্যটা কী? ইমামের নজিরবিহীন আকর্ষণ শক্তি কোন্ জিনিস থেকে উৎসারিত হয়েছে? আমি বিষয়টির ছোট্ট একটি দিক এখানে উল্লেখ করব। এর জন্য অত্যন্ত ব্যাপক আলোচনার প্রয়োজন। ইমামের ছিল বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্য, ব্যক্তিত্ব ও খোদাপ্রদত্ত যোগ্যতা। আল্লাহ তা‘আলাই এসব বৈশিষ্ট্য ও যোগ্যতা দিয়েছিলেন। খুব কম মানুষের জীবনেই এ ধরনের বৈশিষ্ট্য ও যোগ্যতার সমাবেশ দেখা যায়। ইমামের বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে ছিল : তিনি ছিলেন একজন সাহসী মানুষ। তিনি ছিলেন দূরদর্শী ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন পূত চরিত্রের এবং পরহেযগার। মহান আল্লাহর সাথে ছিল তাঁর আত্মার সম্পর্ক। আল্লাহর যিকিরের প্রতি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। ইমাম ছিলেন যুলুমবিনাশী মহান ব্যক্তি। যুলুমের সাথে তিনি আপোস করেন নি। যুলুমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। মযলুমের সাহায্যকারী ছিলেন। শক্তিমদমত্তদের বিরুদ্ধে ছিলেন খড়গহস্ত। ইমাম ছিলেন ইনসাফকামী একজন মানুষ। মযলুমদের সাহায্যকারী ও সমর্থক। সততার পক্ষে ছিল তাঁর অবস্থান। জনগণের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল সততার ভিত্তিতে। মানুষের সাথে সেই ভাষায় কথা বলতেন, যা তাঁর অন্তরের মধ্যে ছিল। মানুষের প্রতি অন্তরের দরদ ছিল। মানুষের সাথে আচরণ করতেন সততার ভিত্তিতে। আল্লাহর রাস্তায় কৃচ্ছ্রতা সাধন করতেন। রেয়াযতকারী ছিলেন। তিনি ছিলেন বিশ্রামহীন। অবিরাম চেষ্টা ও সাধনায় নিরত ছিলেন। তিনি ছিলেন এই আয়াতের প্রতিপাদ্য :
فَاِذا فَرَغتَ فَانصَب * وَ اِلیٰ رَبِّکَ فَارغَب
‘যখন আপনি অবসর হবেন দ-ায়মান হবেন এবং আপন প্রভুর দিকে প্রবল আগ্রহী হয়ে রুজু হবেন।’ (সূরা ইনশিরাহ, আয়াত-৭ ও ৮)
তিনি একটি বড় কাজ থেকে অবসর হওয়ার সাথে সাথে আরেকটি বড় কাজের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেন। সেই কাজের পেছনে সময় ব্যয় করতেন। আল্লাহর রাস্তায় মুজাহাদা ও কৃচ্ছ্রসাধনায় নিরত থাকতেন। এগুলো ছিল ইমামের আকর্ষণশক্তির উপাদান। এসব বৈশিষ্ট্য ইমামের মধ্যে সমাবিষ্ট হয়েছিল। যার মধ্যেই এসব বৈশিষ্ট্য থাকে অন্তরসমূহ তার দিকে আকৃষ্ট হবেই। এগুলো হচ্ছে সেই আমলে সালেহ, সৎকর্ম, যে সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اِنَّ الَّذینَ ءامَنوا وَ عَمِلُوا الصّالِحاتِ سَیَجعَلُ لَهُمُ الرَّحمانُ وُدًّا؛
‘নিশ্চয়ই যারা ঈমান এনেছে ও নেক আমল করেছে, শীঘ্রই আল্লাহ তাদের জন্য (মানুষের অন্তরে অন্তরে) ভালোবাসা সৃষ্টি করবেন।’ (সূরা মারইয়াম : ৯৭)
এ হচ্ছে আল্লাহর ওয়াদা। এসব ভালোবাসাও হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ হতে ভালোবাসা। প্রচার নির্ভর, চাপিয়ে দেয়া বা শিখিয়ে দেয়া মহব্বত নয়। আল্লাহর কাজ, এখানে আল্লাহর হাত সক্রিয়।
হ্যাঁ, হযরত ইমামের অনেকগুলো বৈশিষ্ট্যের মাঝে একটি বৈশিষ্ট্য আছে, যে ব্যাপারে আমি আজকে বিস্তারিত আলোচনা করতে চাই। সেই বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মুকাবেমাত বা প্রতিরোধ। প্রতিরোধ, রুখে দাঁড়ানো। এটি এমন এক বৈশিষ্ট্য, যা ইমামকে একটি প্রতিষ্ঠান, একটি আদর্শ, একটি স্বতন্ত্র চিন্তাধারা ও একটি চলার পথ হিসেবে তাঁর সময়ে এবং ইতিহাসের পাতায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। রুখে দাঁড়ানো, প্রতিরোধ করার বৈশিষ্ট্য মানে সমস্যাবলির মোকাবিলায় আত্মসমর্পণ না করা। তাগুতদের মোকাবিলায় কীভাবে রুখে দাঁড়াতে হয় ইমাম তা দুনিয়ার সামনে দেখিয়ে দিয়েছেন। সেই তাগুত দেশের অভ্যন্তরে হোক, যেমন বিপ্লবী আন্দোলন চলাকালে অনেকেই ক্লান্ত হয়ে গেছেন। অনেকেই সম্পূর্ণ নিরাশ হতাশ হয়ে গেছেন। কিন্তু ইমাম অবিচল রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। ইমাম বিন্দু পরিমাণ পশ্চাদপসরণ না করে সংগ্রামের পথে অবিচল ছিলেন। এই অবস্থাটা ছিল ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের পূর্বেকার অধ্যায়ে। ইসলামি বিপ্লব বিজয় লাভের পরও একের পর এক চাপ ভিন্নভাবে এবং আরো বেশি সর্বাত্মকভাবে ইমামের সামনে উপস্থিত হয়। কিন্তু ইমাম তারপরও প্রতিরোধের মূলনীতি, রুখে দাঁড়ানোর কর্মপন্থা হাতছাড়া করেন নি। তিনি প্রতিরোধ করে গেছেন। এই অধম যখন ইমামের চরিত্রের এই বৈশিষ্ট্যটির দিকে তাকাই এবং কুরআন মজীদের আয়াতগুলো সামনে আনি তখন দেখি যে, সত্যিকার অর্থেই কুরআনের বহু আয়াতের, তিনি তাঁর এই অবিচলতা ও রুখে দাঁড়ানোর বাস্তব পদক্ষেপ দিয়ে অর্থ করেছেন। ধরুন যে, কুরআন বলছে,
فَلِذالِکَ فَادعُ وَاستَقِم کَما اُمِرتَ وَ لا تَتَّبِع اَهواءَهُم
‘অতএব আপনি দাওয়াত দিতে থাকুন। আর যেভাবে আদেশ দেয়া হয়েছে অবিচলতা প্রদর্শন করুন। আর তাদের কামনা বাসনার অনুসরণ অনুগমন করবেন না।’ (সূরা শূরা : আয়াত-১৫ এর অংশবিশেষ)
ইমামের ওপর হুমকি বা প্রলোভন কোনো প্রভাব ফেলতে পারে নি। এমন নয় যে, ইমামকে হুমকি দেয়া হয় নি বা প্রলোভন দেখানো হয় নি। কিংবা ধোঁকা প্রতারণার আশ্রয় নেয়া হয় নি। কেন? কিন্তু ইমামের ওপর এসবের মোটেও প্রভাব পড়ে নি। তাঁর প্রতিরোধকে বিক্ষত করে নি। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে দুশমনের চেষ্টা, দুশমনের হুমকি ধমকি ইমামের হিসাব কিতাবের যন্ত্রকে বিকল করতে পারে নি। যেহেতু দুশমনদের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ এটাই। দুশমন যখন তোমার মুখোমুখি হয়, তোমার উদ্দেশ্য তো তার জানা আছে, তোমার সিদ্ধান্ত কী তার হিসাব তো তার কাছে আছে, তাই এমন কোনো কাজ করার পদক্ষেপ নেয়, যা তোমার হিসাব নিকাশ উল্টে দিতে পারে। তোমার হিসাব নিকাশের যন্ত্রটি বিকল করে দেয়াই তার লক্ষ্য হয়। বিভিন্ন আঙ্গিনায় দুশমনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ এটিই হয়ে থাকে। কাজেই দুশমন ইমামের হিসাব নিকাশের যন্ত্র, যা পবিত্র ইসলামের সাক্ষ্য-প্রমাণের ওপর নির্ভরশীল ছিল, তার মধ্যে কোনো গোলযোগ ঘটাতে পারে নি।
প্রতিরোধ বলতে কী বুঝায়? প্রতিরোধ বলতে বুঝায়, মানুষকে এমন একটি পথ বেছে নিতে হবে যে পথকে সে সত্য বলে জানে। সঠিক পথ বলে বিশ^াস করে। আর এই পথে পথচলা শুরু করে। এই পথে তাকে কোনো বাধাই তার গতিরোধ করতে পারে না। ধরুন, কেউ কোনো এক সময় কোনো রাস্তায় কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়, একটি বিরাট গর্ত দেখে। বিরাট কোনো পাথর পথরোধ করেছে দেখতে পায় যখন এই পাথর বা প্রতিবন্ধকতা কিংবা চোর বা নেকড়ের সামনে পড়ে যায় ফিরে আসে, পথচলা ক্ষান্ত দেয়। এক শ্রেণির মানুষ এমন আছে। কিন্তু কিছুসংখ্যক লোক আছে, না। তারা দেখে বিরাট পাথর ডিঙ্গিয়ে পার হওয়ার কোনো বিকল্প রাস্তা আছে কিনা। এই বাধার মোকাবিলা করার উপায় আছে কিনা। সেই পথ তারা খুঁজে নেয়। হয়ত বাধা দূর করে কিংবা বুদ্ধিমত্তার সাথে তা অতিক্রম করার উপায় বের করে। সেভাবে অগ্রসর হয়। প্রতিরোধ বলতে এটিই বুঝায়। ইমাম (খোমেইনী) এ রকমই ছিলেন। তিনি একটি চলার পথ বেছে নিয়েছিলেন। সে পথ ধরে অগ্রসর হয়েছেন। সেই পথ কী ছিল? আসলে ইমামের বক্তব্য কী ছিল যে, তার জন্য তিনি প্রতিরোধ করেছেন, রুখে দাঁড়িয়েছেন এবং জোরালো চেষ্টা চালিয়েছেন। ইমামের কথা ছিল মুসলমানদের সমাজে সর্বস্তরের মানুষের মাঝে আল্লাহর দ্বীন ও আদর্শের শাসন। এটিই ছিল ইমামের বক্তব্য। তিনি যখন প্রতিবন্ধকতাসমূহ জয় করার এবং ইসলামি প্রজাতন্ত্রী ব্যবস্থা বলবৎ করার সামর্থ্য অর্জন করলেন তখন তিনি ঘোষণা দিলেন যে, আমরা যুলুম যেমন করব না, তেমনি কারো যুলুম সহ্যও করব না। যুলুম করব না, যুলুমের বোঝাও বহন করব না। যালিমের সাথে আপোস করব না। মযলুমদের সমর্থন ও সহায়তা দিয়ে যাব। এটিই ছিল ইমামের কথা।
হ্যাঁ, এই কথা তাঁর নিজের নয়, দ্বীনের বিরাট পাঠশালা থেকে তা চয়ন করেছেন। কুরআনের ভাষা থেকে তা পেয়েছেন। কুরআন মজিদে এ কথা বর্ণিত হওয়া ছাড়াও মানুষের সুস্থ বুদ্ধিও এ কথা সমর্থন করে। যুলুমের মোকাবিলা করার কথা বলে। মযলুমদেরকে সহায়তা দানের কথা বলে। যুলুমের সাথে সহযোগিতা না করা বা আপোস না করা এমন একটি বিষয়, দুনিয়ার সকল জ্ঞানী ব্যক্তিই তা পছন্দ করেন। ইমাম এ কথার ওপর অবিচল ছিলেন। হ্যাঁ, এ কথাও পরিষ্কার যে, এই বক্তব্য এবং এই চলার পথের জন্য বিশে^ বড় বড় দুশমনও আছে। বিশে^র শক্তিমদমত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো যালিম। ইমাম যখন এই বিশাল আন্দোলন শুরু করেন, তার আগে দুইশ’ বছরেরও অধিক কাল ধরে দুনিয়ার আনাচে কানাচে, এশিয়ায় আফ্রিকায় বিভিন্ন দেশে পশ্চিমা দেশগুলো বিভিন্ন জাতির ওপর বহুমুখি যুলুম চাপিয়ে দিয়েছিল। ইংরেজরা ভারত এবং এখানকার অন্যান্য দেশে, ফরাসিরা আফ্রিকায়, আলজেরিয়ায় ও আরো অনেক দেশে, এ ছাড়া কতিপয় ইউরোপীয় দেশ বিভিন্ন দেশে প্রকাশ্যে রাখঢাক না রেখে যুলুমের স্টীমরোলার চালাচ্ছিল। কাজেই এটাই পরিষ্কার যে, এরা ইমামের এই সেøাগানে অসন্তুষ্ট হবে। এই যে একটি সরকার এশিয়ার বক্ষস্থলে এমন একটি স্পর্শকাতর অঞ্চলে ইরানে আত্মপ্রকাশ করবে, যার সেøাগান হবে ‘যুলুমের সাথে আপোস করব না, যুলুম মেনে নেব না, যালেমের সাথে সহযোগিতা করব না, মযলুমদের সাহায্য করব’, এটা জানা কথা যে, এদের জন্য তা খুবই কঠিন এবং অসহনীয় ছিল। এ কারণে সেই প্রথম দিন থেকে একের পর এক দুশমনি শুরু করে।
তারাই দুশমনি শুরু করে, যারা ছিল যালেম। যারা ছিল আগ্রাসী। এরা জিম্মি করে পণ আদায়ের পক্ষপাতি ছিল। এরা ইমাম খোমেইনীর বার্তার যে আবেদন অর্থাৎ ইসলামি প্রজাতন্ত্রী ব্যবস্থা, স্বভাবতই এর সাথে তারা খাপ খাওয়াতে পারে নি। ফলে সেই প্রথম দিন থেকেই শত্রুতা শুরু করেছিল। বিপ্লবের প্রথম দশকে- ইমামের মোবারক জীবনকালে একভাবে, ইমামের ইন্তিকালের পরেও- গত দুই তিন দশকে আরেকভাবে। ইমাম এসব কাপুরুষোচিত ও দুরাচারপূর্ণ আগ্রাসনের মোকাবিলায় প্রথম থেকেই প্রতিরোধের চিন্তা, রুখে দাঁড়ানোর চিন্তা ও পথ না হারানোর চিন্তার ভিত্তি রচনা করেন। তিনি একটি সবক, পথের একটি শিরোনাম হিসেবে আমাদের জন্য, ইরানি জাতির জন্য, সংগ্রামীদের জন্য, দেশের রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীলবর্গের জন্য এই পথটি পরিষ্কার করে দেখিয়ে দিয়েছেন। আর আমাদেরকে সেই পথ ধরে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন।
এই প্রতিরোধ ক্রমান্বয়ে ইরানের সীমানার বাইরে চলে যায়। এর অর্থ এটা নয় যে, আমরা প্রতিরোধের চিন্তা বা প্রতিরোধকে ইরানের বাইরে রপ্তানি করতে চাই। যেটি কোনো কোনো রাজনীতিবিদ বা অন্যরা দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আপত্তি করে থাকে যে, তোমরা কেন বিপ্লব রপ্তানি করতে চাও। আমরা বিপ্লব রপ্তানি করছি না। বিপ্লব হলো একটি চিন্তা, একটি চিন্তাধারা, একটি পথ, কোনো জাতির কাছে যদি এটিই পছন্দনীয় হয়, তাহলে সে জাতি নিজে থেকে তা গ্রহণ করবে। আমরা কি এ বছর এসব দেশকে বলেছি যে, আপনারা আসুন, মিছিল করুন? তাঁরা নিজেরাই করেছেন। তাঁরা নিজেরাই চেয়েছেন। প্রতিরোধের চিন্তাধারাটিও বিভিন্ন জাতি নিজ থেকে গ্রহণ করেছে। বর্তমানে আমাদের অঞ্চলে, পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলে বিভিন্ন জাতির একটি অভিন্ন ভাষা হচ্ছে প্রতিরোধ। সবাই প্রতিরোধের ধারণাটি গ্রহণ করেছেন। তবে কেউ কেউ সাহস করে যে, প্রতিরোধের ময়দানে অবতীর্ণ হবে, কেউ কেউ সেই সাহস করে না। তবে যারা সাহস করে তাদের সংখ্যাও একেবারে কম নয়। এই যে পরাজয়গুলো গেল কয় বছরে আমেরিকানরা ইরাক, সিরিয়া ও লেবানন, ফিলিস্তিন এবং আরো অন্যান্য অঞ্চলে বরণ করেছে, তা প্রতিরোধ গ্রুপগুলোর প্রতিরোধেরই ফলশ্রুতি। প্রতিরোধ ফ্রন্ট বর্তমানে একটি শক্তিশালী ফ্রন্ট।
অবশ্য আমরা এ কথা অস্বীকার করি না যে, যেহেতু আমরা ইরানি জাতি প্রতিরোধকে সুদৃঢ় হাতে ধারণ করেছি, অগ্রসর হয়েছি ও সফলকাম হয়েছি সেহেতু অন্যরাও প্রতিরোধে উৎসাহিত হয়েছেন। এ কথাটি ইরানের বাইরের তথ্যাভিজ্ঞ মহল, আন্তর্জাতিক অঙ্গনের অভিজ্ঞজনেরা বলেছেন, ব্যাখ্যা করেছেন। আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত একজন বিশ্লেষক, যিনি আমেরিকানও বটেন, সবাই তাঁর নাম শুনেছেন, তিনি বলেছেন যে, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাথে আমেরিকার দুশমনির অন্যতম কারণ হচ্ছে, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান প্রতিরোধের পথ ধরে অগ্রসর হয়েছে এবং সফলকামও হয়েছে। প্রতিবন্ধকতাগুলো অতিক্রম করতে সমর্থ হয়েছে। এটিই হচ্ছে শত্রুতার অন্যতম কারণ। তারা চায়, আমরা যেন পরাজিত হই। তারা চায়, আমরা ফিরে আসি। তারা চায়, আত্মসমর্পণের প্রমাণস্বরূপ আমরা দুই হাত উঁচু করি। যেহেতু তা করি না, তাই শত্রুতা করে।
লক্ষ্য করুন। আমি একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় কথা এখানে বলতে চাই। বস্তুত ইমাম প্রতিরোধের পথ বাছাই করে নেন। গুরুত্বপূর্ণ কথাটি হচ্ছে, ইমাম প্রতিরোধের নীতিটি উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে গ্রহণ করেন নি। ক্ষণস্থায়ী আবেগ দ্বারা চালিত হয়ে করেন নি। আমাদের মহান ইমামের পক্ষ হতে প্রতিরোধের নীতি গ্রহণের প্রেক্ষাপটটি একটি যুক্তিপূর্ণ প্রেক্ষাপট। একটি বুদ্ধিবৃত্তিক প্রেক্ষাপট। জ্ঞানগত প্রেক্ষিত। ইমামের রুখে দাঁড়ানো, ইমামের প্রতিরোধ এর পশ্চাতে অবশ্যই ধর্মীয় ও যৌক্তিক প্রেক্ষাপট বিদ্যমান রয়েছে। আমি এখানে এর কয়েকটি দিক তুলে ধরতে চাই।
এই যুক্তিদর্শনের একটি অংশ হচ্ছে, শক্তির দাপট ও চাপ প্রয়োগের মোকাবিলায় প্রতিরোধ করা হচ্ছে যে কোনো স্বাধীনচেতা, মর্যাদা সচেতন জাতির স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। এর জন্য অন্য কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণের প্রয়োজন হয় না। যে কোনো জাতি নিজের মর্যাদার জন্য, নিজের আত্মপরিচয়ের জন্য, নিজের মানবতার জন্য মূল্যমান স্বীকার করবে, সে জাতি যখন দেখে যে, কোনো একটি জিনিস তার ওপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে, তখন সে প্রতিরোধ করে, তাতে বাধা দেয়। তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। এটিই একটি স্বতন্ত্র ও সন্তোষজনক প্রমাণ। এ গেল একটি।
দ্বিতীয় হলো, প্রতিরোধ করা হলে তা দুশমনের পশ্চাদপসরণের কারণ হয়। এটি আত্মসমর্পণের বিপরীত। যখন দুশমন তোমার সাথে শক্তির দাপট দেখায়, তখন যদি আপনি এক পা পেছনে সরে যান সে সামনে আসবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। দুশমন যাতে সামনে না আসে তার জন্য পথ হলো তোমাকে প্রতিরোধ করতে হবে। দুশমনের বাড়তি দাবি, দুশমনের শক্তির দাপট, দুশমনের মুক্তিপণ দাবির মোকাবিলায় সে যাতে সামনে এগিয়ে না আসে তার জন্য আগাম ব্যবস্থা হল প্রতিরোধ করা। কাজেই প্রতিরোধের মধ্যেই লাভের অঙ্ক বেশি। আমরা নিজেরাও এ রকমই। ইসলামি প্রজাতন্ত্রে আমাদের অভিজ্ঞতাও এ কথাই বলে। আমার অবশ্য এ মুহূর্তে অনেক বিষয় মনের মধ্যে আছে। সব খুলে বলতে চাই না। উদাহরণ দিয়ে বলতে চাই। সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলছি। যেখানেই আমরা প্রতিরোধ করেছি, রুখে দাঁড়িয়েছি, সেখানেই আমরা অগ্রসর হতে পেরেছি। যেখানে আত্মসমর্পণ করেছি, প্রতিপক্ষের মর্জি মতো তৎপরতা চালিয়েছি সেখানে আঘাত খেয়েছি। এর পক্ষে অনেক পরিষ্কার উদাহরণ দেয়ার মতো আছে। যারা বিচক্ষণ ও অভিজ্ঞ তারা ইসলামি প্রজাতন্ত্রের চল্লিশ বছরের ইতিহাস থেকে তার উদাহরণ সহজে খুঁজে নিতে পারেন। এটিও হচ্ছে ঐ যুক্তির আরেকটি অংশ।
প্রতিরোধের যুক্তিদর্শনের তৃতীয় অংশটি হচ্ছে, যা আমি দুই তিন বছর আগে এই সভায় (ইমাম খোমেইনীর আটাশতম ওফাত বার্ষিকীতে) বলেছিলাম। তা হচ্ছে প্রতিরোধ করতে হলে অবশ্যই খরচ আছে। খরচবিহীন নয়। তবে দুশমনের সামনে প্রতিরোধ যে মাশুল দিতে হবে তার অংক প্রতিরোধের খরচের চেয়ে বেশি। আপনি যখন দুশমনের মোকাবিলায় আত্মসমর্পণ করবেন তখনও আপনাকে খরচ দিতে হবে। পাহলভী সরকার আমেরিকার সামনে নতজানু ছিল। অনেক সময় অশান্তিতেও ছিল। রাজি ছিল না। কিন্তু আমেরিকার সামনে আত্মসমর্পিত ছিল। তেল দিচ্ছিল। অর্থও দিচ্ছিল। ডলারও দিচ্ছিল। মাথায় মুষ্ঠাঘাতও খাচ্ছিল। আজকের দিনে সৌদি সরকারের অবস্থাও এরূপ। অর্থও দেয়। তেলও দেয়। আমেরিকার ইচ্ছানুযায়ী নীতি অবস্থানও গ্রহণ করে। তার সম্পর্কে বলা হয় যে, দুধেল গাভী। আপোস করার খরচ, আত্মসমর্পণের খরচ, প্রতিরোধ না করার খরচের পরিমাণ প্রতিরোধের খরচের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি। বৈষয়িক খরচ যেমন আছে তেমনি নৈতিক খরচও আছে। (জনতার সেøাগান : আপোস নয়, আত্মসমর্পণ নয়, আমেরিকার সাথে লড়াই)
দেখুন, আপনার আমার দিকে লক্ষ্য রাখুন। আমি এখন যুদ্ধের কোনো আলোচনা করছি না। প্রতিরোধের কথা আলোচনা করছি। লড়াইয়ের বিষয়ে কথা আলাদা। আমি রুখে দাঁড়ানো, প্রতিরোধ ও পশ্চাদপদ না হওয়ার বিষয়ে বলছি। ভালোভাবে বুঝবার চেষ্টা করুন।
মহান ইমাম ইসলামি প্রজাতন্ত্রী ব্যবস্থায় যে প্রতিরোধ দর্শনের গোড়া পত্তন করেছেন তার চতুর্থ অংশ ও চার নম্বর উপাদান হচ্ছে, কুরআন মজীদের ঘোষণা ও আল্লাহর ওয়াদার কথা। আল্লাহ পাক কুরআন মজীদের আয়াতসমূহে বহুবার এই ঘোষণা দিয়েছেন যে, সত্যপন্থী, যারা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে থাকবে তারা চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করবে। কুরআন মজীদের বহু আয়াত হতে এই ভাবধারা প্রতীয়মান হয়। হয়ত কুরবানি দিতে হবে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরাজয় বরণ করতে হবে না। এরাই এই ময়দানে বিজয়ী, সফলকাম। কুরবানি তাঁরা দেন; কিন্তু ব্যর্থতা তাঁদের নেই। কুরআন মজীদের বিভিন্ন উদাহরণের মধ্য হতে আমি এখানে দু’তিনটি উল্লেখ করছি। আমাদের যুবকরা যারা কুরআন নিয়ে আছে তোমরা এ বিষয়গুলো মিলিয়ে দেখবে। এগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে। আল্লাহ পাক বলেন, اَم یُریدونَ کَیدًا فَالَّذینَ کَفَروا هُمُ المَکیدون ‘অথবা তারা চায় যে, প্রতারণার কূটকৌশল করবে; কিন্তু যারা কাফের তারাই প্রতারণার শিকার হয়েছে।’ (সূরা তূর : ৪২) তারা মনে করে যে, তারা ক্ষেত্র প্রস্তুত করে, হকের ফ্রণ্টের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের বিপক্ষে ষড়যন্ত্র পাকায়। কিন্তু বুঝতে পারে না যে, তাদের নিজেদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। এটি হয় আল্লাহর শাশ^ত নীতি ও প্রাকৃতিক নিয়মে। আরেকটি আয়াত হচ্ছে ্রوَ نُریدُ اَن نَمُنَّ عَلَی الَّذینَ استُضعِفوا فِی الاَرضِ ‘আমি ইচ্ছা করলাম যারা এই পৃথিবীতে হীনবল ছিল তাদের ওপর অনুগ্রহ করতে।’ (সূরা কাসাস : আয়াত-৫ এর অংশবিশেষ) আয়াতের শেষ পর্যন্ত। আরো একটি আয়াত اِن تَنصُرُوا اللهَ یَنصُرکُم وَ یُثَبِّت اَقدامَکُم (যদি আল্লাহকে সাহায্য কর তবে তিনি তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পদক্ষেপসমূহকে সুদৃঢ় করবেন।’ (সূরা মুহাম্মাদ : আয়াত-৭ এর অংশবিশেষ) وَ لَیَنصُرَنَّ اللهُ مَن یَنصُرُه. (নিশ্চয়ই আল্লাহ সেই ব্যক্তিকে সাহায্য করবেন যে তার দ্বীনকে সাহায্য করবে।’ (সূরা হজ : আয়াত-৪০ এর অংশবিশেষ) কুরআনের প্রচুর আয়াত একই পরিণতির সুসংবাদ দেয় যারা প্রতিরোধের পথে আছে তাদেরকে। ইমামের যৌক্তিক ও শক্ত প্রমাণ ও জীবন দর্শনের একটি অংশ এসব আয়াত। অসংখ্য আয়াত আছে কুরআন মজীদের। এখানে মাত্র তিন চারটি আয়াত তেলাওয়াত করেছি।
প্রতিরোধ দর্শনের পক্ষে পাঁচ নম্বর সূক্ষ্ম বিষয়টি হলো, একটি বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে এবং ইমামও বিবেচনায় রাখতেন, আর আমরাও তা জানি এবং বুঝি ও হিসাব নিকাশ করে দেখেছি যে, প্রতিরোধ কাজটা কিন্তু করা সম্ভব। এটি সেই চিন্তাধারার ঠিক বিপরীত যে চিন্তাধারা কিছুসংখ্যক লোক পোষণ করেন ও প্রচার করেন যে, না জনাব। লাভ নেই। কীভাবে প্রতিরোধ করতে চান? প্রতিপক্ষ তো ঘাড় মোটা। প্রতিপক্ষ অনেক শক্তিশালী। বড় ভুলটা কিন্তু এখানেই। বড় রকমের ভুল হচ্ছে, কেউ এই চিন্তা করা যে, দুনিয়ার ঘাড় মোটাদেরকে মোকাবিলা করা বা (তাদের বিরুদ্ধে) রুখে দাঁড়ানো যায় না। আমি এ বিষয়টি এখানে আরো একটু বিশদভাবে ব্যাখ্যা দিতে চাই। কারণ, বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, চালু ও পরীক্ষার সম্মুখীন। এখনও আমাদের মাঝে এমন লোক আছে যারা বুদ্ধিজীবীর পোশাক গায়ে; এ জাতীয় চিন্তাবিদগণ পত্রপত্রিকায়, বইপুস্তকে, বক্তৃতাবিবৃতিতে এখানে ওখানে এ কথাই বলতে চান যে, জনাব, লাভ হবে না। এদের সাথে জড়িয়ে পড়া ঠিক হবে না। এদের মোকাবিলায় দাঁড়ানো যাবে না। মেনে নেয়া ছাড়া উপায় নেই। মোটকথা তাঁরা বলতে চান যে, ঠিক আছে পথ ছেড়ে দেন। আমরা দুশ্চিন্তা হতে মুক্ত হই। আমি বলতে চাই যে, এই দৃষ্টিভঙ্গি যে বলা হয়, ‘আমরা পারব না’। এটিই সেই হিসাব নিকাশের ভুল থেকে সৃষ্টি হচ্ছে, যার দিকে আমরা ইতিপূর্বে ইঙ্গিত করেছি। (ইতিপূর্বে কোমের সর্বস্তরের জনগণের একটি প্রতিনিধিদলের সাক্ষাতে দেয়া রাহবারের ভাষণের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে)। এটি হিসাব নিকাশের ভুল, আর কিছু নয়।
যে কোনো ইস্যুতে হিসাব নিকাশের ভুলের কারণ হচ্ছে, আমরা ইস্যুটির বিভিন্ন উপাদানকে ঠিকভাবে দেখি না। যেখানে একটি মোকাবিলার প্রসঙ্গ, দুটি ফ্রন্টের মুখোমুখি সংঘাতের প্রশ্ন যেখানে, সেখানে হিসাব নিকাশের ভুলটার উৎপত্তি হয় যখন আমরা নিজেদের পক্ষকে ভালোভাবে না চিনি। প্রতিপক্ষ ফ্রন্টকেও যখন ভালোভাবে চিনতে পারি না। হ্যাঁ যখন চিনতে পারি না তখন হিসাব নিকাশে ভুল করি। আমরা যদি সঠিকভাবে চিনতে পারতাম তাহলে আমাদের হিসাব নিকাশ অন্যরকম হতো। আমি বলতে চাই যে, বিশে^র শক্তিমদমত্তদের মোকাবিলায় প্রতিরোধের বেলায় যে হিসাব নিকাশ করব তাতে এসব শক্তিমদমত্ত সম্পর্কিত বাস্তবতাগুলোকে বিবেচনায় নিতে হবে। আমাদের নিজেদের প্রকৃত অবস্থাও ভালোভাবে জানা থাকতে হবে। এসব বাস্তবতার একটি হচ্ছে প্রতিরোধের ক্ষমতা।
লক্ষ করুন! আন্তর্জাতিক রাজনীতির সাহিত্যে ‘ইমাম খোমেইনীর স্টাইলে প্রতিরোধ’, এটি একটি শিরোণাম। ফিরিঙ্গিদের পরিভাষায় যেটির প্রকাশ ঘটেছে এবং খুররম শহর মুক্ত করার ঘটনার পর এই পরিভাষাটির ব্যাপক প্রচলন হয়েছে তা হলো ইমাম খোমেইনীর প্রতিরোধের ডক্ট্রিন। তাঁরা এ বিষয়টি উত্থাপন করেছেন। বহু প্রবন্ধ রচনা করেছেন। এখন আমি এখানে একটি বাক্য নোট করেছি, বাক্যটি বিশে^র একজন প্রসিদ্ধ রাজনৈতিক ব্যক্তির। নাম বললে সবাই চিনবেন। তিনি কথাটি বলেছেন একটি প্রবন্ধে। তিনি লিখেছেন যে, বিশ^ আধিপত্য ক্ষেত্রে সামরিক ও অর্থনৈতিক একচেটিয়া ভূমিকার যুগ অস্তমিত হচ্ছে। এই যে, কোনো একটা দেশ অধিক সামরিক ক্ষমতার অধিকারী হবে, অর্থনৈতিক অতিরিক্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখবে এবং এ ক্ষেত্রে নিজের আধিপত্য বলবৎ রাখবে, এ অবস্থা এখন গত হতে চলেছে। দুনিয়া এখন পাল্টে গেছে। তিনি আরো লিখেছেন, অনতিদূরে আমরা এমন ওভারসিজ শক্তির উদ্বোধন দেখত পাব যারা যুদ্ধাস্ত্র, যেমন অ্যাটম বোমা কিংবা বিশ^ শিল্প জগতে উৎপাদনে অংশীদারত্বে তেমন জোরালো ক্ষমতার অধিকারী নয়। কিন্তু কোটি কোটি মানুষের ওপর প্রভাব রাখার শক্তির জোরে পাশ্চাত্যের সামরিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করবে। এ কথাটি বলেছেন একজন পশ্চিমা ও আমেরিকান রাজনীতিবিদ। তিনি আরো বলেন, খোমেইনীর প্রতিরোধ ডক্ট্রিন সর্বশক্তি দিয়ে আমেরিকা ও পাশ্চাত্যের আধিপত্যের ধমনীগুলোকে টার্গেট করেছে। ইসলামি প্রজাতন্ত্রের স্থায়িত্বের রহস্য এগুলোর মধ্যেই নিহিত। এটি এমন এক নীতি, যা এই মহান ব্যক্তি, আল্লাহর এই নেক বান্দা আমাদের মাঝে অবশিষ্ট রেখে গেছেন। এটিই প্রতিরোধের নীতি, অবিচলতার নীতি এবং আমাদের যা আছে তার প্রতি সম্মান দেখানোর মূলনীতি।
আমি আজকে এ কথা আরয করতে চাই যে, বর্তমানে প্রতিরোধ ফ্রন্ট গত চল্লিশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে সুসংগঠিত অবস্থায় রয়েছে। এই অবস্থা এতদঞ্চলে, এমনকি এতদঞ্চলের বাইরের কেন্দ্রগুলোতেও বিরাজ করছে। এটি একটি বাস্তবতা। এটি বিশ^শক্তিমদমত্তদের ঠিক বিপরীত মেরু। বিশ^শক্তিমদমত্ত তথা আমেরিকার দাম্ভিক শক্তি এবং যায়নবাদী সরকারের বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ও দুরাচারপূর্ণ শক্তির চল্লিশ বছরের পর থেকে নিয়ে এদিকে তুলনামূূলকভাবে অবনতি হয়েছে। তুলনামূলকভাবে নিচে নেমে গেছে। আমাদেরকে এ বিষয়গুলো নিজেদের হিসাব নিকাশের বেলায় বিবেচনা করতে হবে। এই যে আমেরিকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি অথবা আমেরিকার সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে কী ঘটেছে ও ঘটে চলেছে এগুলো আমাদের হিসাব নিকাশের মধ্যে আনতে হবে। এই কথাগুলো স্বয়ং কতিপয় আমেরিকানই বলেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, উই পোকার মতো অস্তায়মানতা। এ কথাটি জনৈক আমেরিকান লেখক বলেছেন। আমেরিকার শক্তিমত্তার অস্তায়মানতা সম্পর্কে বলেছেন যে, উই পোকার মতো পতন। অর্থাৎ উই পোকায় খাওয়া কাঠের মতো ভেতর দিক থেকে ফোকলা হয়ে গেছে। আমেরিকার ভেতরকার প্রতিষ্ঠানগুলোই এ কথা বলছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যেমন এই অবস্থা, সামাজিক ক্ষেত্রেও অবস্থা তা-ই। রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। পরিষ্কার পরিসংখ্যানসমূহ বিদ্যমান রয়েছে যে, আমেরিকার অর্থনৈতিক ক্ষমতা এবং বিশ^ অর্থনীতিতে আমেরিকার অর্থনৈতিক প্রভাবের বিস্ময়করভাবে পতন ঘটেছে। তার পরিসংখ্যান এখন আছে। এ সম্পর্কে আমার কাছে নোটও আছে। তবে এ মুহূর্তে এসব নোটের খুঁটিনাটি বলার প্রয়োজন মনে করছি না। রাজনৈতিক অঙ্গনেও আমেরিকার ক্ষমতার অধঃপতন ঘটেছে।
প্রিয় ভাইয়েরা ও বোনেরা! আমি আপনাদের সামনে একটি কথা বলতে চাই। আমেরিকার রাজনৈতিক অধঃপতনের একটি প্রমাণ আমি আপনাদের বলছি, যদি অধিকতর প্রমাণ না-ও থাকে, এই একটি প্রমাণই যথেষ্ট। সেই প্রমাণটি হচ্ছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো চরিত্র-বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন একজন লোক দেশটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়া। স্বয়ং এই নির্বাচনই আমেরিকার রাজনৈতিক অস্তগামিতার প্রমাণ। তিনশ’ মিলিয়নের চেয়ে আরো বেশি জনগণের ভাগ্য এই চরিত্রের একজন লোকের হাতে ন্যস্ত হওয়া আমেরিকার রাজনৈতিক অস্তগামিতার নিদর্শন। যাঁর মানসিক ভারসাম্য, তাঁর চিন্তাগত ভারসাম্য ও চারিত্রিক ভারসাম্যের ব্যাপারে স্বয়ং আমেরিকাতেই এত কথা বলা হচ্ছে। এ ধরনের একটি লোক যখন কোনো একটি দেশের প্রেসিডেন্ট হয়, তখন সেই দেশের অস্তগামিতার প্রমাণ দেয়। রাজনৈতিক অস্তগামিতা, চারিত্রিক অস্তগামিতা। এরা যায়নবাদী সরকারের মানুষ হত্যা ও অপরাধযজ্ঞের প্রতি বরাবর সমর্থন জুুগিয়েছে, পক্ষ নিয়েছে। কয়েকটি সরকারের জোট ইয়েমেনে এবং ইয়ামেনের জনগণের ওপর যে গণহত্যা চালাচ্ছে তাকে এরা সমর্থন দিয়েছে। অপরাধের প্রতি এরা সমর্থন জ্ঞাপন করে। এর চেয়ে জঘন্য চারিত্রিক স্খলন আর কী হতে পারে?
আমেরিকার অভ্যন্তরেই সমস্যার অন্ত নেই। সেদিন আমার মনে হয় একটি সাক্ষাৎ অনুষ্ঠানে এ রমযানের শুরুতে আমি এ সম্পর্কে কথা বলেছি। (প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণের প্রতি ইঙ্গিত) আমেরিকার কৃষি মন্ত্রণালয় সরকারিভাবে ঘোষণা করেছে যে, আমেরিকায় ৪১ মিলিয়ন লোক ক্ষুধার সমস্যায় জর্জরিত। আমেরিকার অবস্থা এরূপ। আমেরিকার অর্থনীতির অবস্থা এটিই। মার্কিন সরকার ২২০০ শত কোটি ডলারের ঋণের বোঝা টানছে- ২/২ ট্রিলিয়ন- এ তো রূপকথার মতো। আসলেই এসব পরিসংখ্যান অকল্পনীয়। এসব হচ্ছে তাদের সমস্যা ও সংকট। তারপর এই ভদ্রজন এসে ইরানের জনগণের জন্য মায়া দেখান। বলেন যে, আমরা ইরানের জনগণের সুখ চাই, সৌভাগ্য চাই, তাদের কর্মসংস্থান চাই। যাও, তুমি নিজেকে শোধরাও। যদি পার নিজেদের অবস্থার উন্নয়ন ঘটাও। আমেরিকা সহিংস অপরাধের দৃষ্টিতে পৃথিবীতে এক নম্বরে আছে। মাদক দ্রব্য সেবনে বিশে^ আমেরিকার অবস্থান এক নম্বরে। স্বয়ং দেশের লোকদের হত্যার ব্যাপারে এক নম্বরে আছে। আমেকিার পুলিশের হাতে মানুষ হত্যার পরিসংখ্যানে সে এক নম্বরে আছে। যেসব পরিসংখ্যান আছে তা প্রমাণ করে যে, এই গত ৮ মাসে ৮৩০ জন মার্কিন নাগরিক রাস্তাঘাটে পুলিশের হাতে নিহত হয়েছে। ইরানি জাতির জন্য যে সরকারটির কুম্ভিরাশ্রু ঝরানোর অন্ত নেই তার নিজের অবস্থা এমনই।
হিসাব নিকাশের একদিকে স্বয়ং আমরা নিজেরা আছি। আমাদের অবশ্যই সমস্যা আছে। আমাদের অর্থনৈতিক সমস্যা আছে। বহুবার আমি তা বলেছি। রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তারাও তাঁদের সাধ্য অনুযায়ী এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছেন। আমাদের সমস্যা আছে। তবে অচলাবস্থায় আমরা নেই। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আমরা দেশে অচলাবস্থার সম্মুখীন নই। অর্থনৈতিক বিষয়ে যেমন, তেমনি সামাজিক বিষয়ে, রাজনৈতিক বিষয়েও না। এমন সমস্যাদি আছে, তার বিভিন্ন কারণ আছে। কিন্তু দেশে অচলাবস্থা নেই। তার বিপরীতে আমাদের অগ্রগতি আছে। আমাদের দেশের বড় জিনিসের মধ্যে রয়েছে এই সম্মানিত ইরানি জাতি। এই প্রাণ উচ্ছ্বল জাতি। এই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন জাতি। আমাদের জাতির যদি দূরদৃষ্টি না থাকত তাহলে যেসব অঙ্গনে তাদের উপস্থিতির প্রয়োজন, সেসব অঙ্গনে তারা উপস্থিতি প্রমাণ করত না। জনতার উপস্থিতি ৯৭ ফারসি সাল (২০১৯ সালের) ২২ বাহমান (১১ ফেব্রুয়ারি) অর্থাৎ এই চার-পাঁচ মাস আগে জনতার মাঠে ময়দানে উপস্থিতি দেশের সর্বত্র সড়কগুলোতে বিশাল আকারের যেসব জনসমাবেশ হয়েছে, এর জন্য দূরদৃষ্টির প্রয়োজন। এর পেছনে মনোবল থাকতে হয়। প্রস্তুতি থাকতে হয়। কোমর বেঁধে প্রস্তুত থাকার প্রয়োজন আছে। ইরানি জাতির তা আছে। সচেতনতা আছে। দূরদৃষ্টি আছে। রুখে দাঁড়ানোর শক্তি আছে। সুদৃঢ় ইচ্ছাশক্তি আছে। এটিই হচ্ছে আমাদের দেশের শক্তিমত্তার সবচেয়ে বড় দিক। শক্তিমত্তার আরো কয়েকটি দিকও আছে। কাজেই প্রতিরোধের যে আদর্শের কথা বললাম, তা এগুলোই। ইমাম এ ধরনের একটি যৌক্তিক প্রেক্ষাপট ও পৃষ্ঠপোষকতার ভিত্তিতেই প্রতিরোধের ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছেন।
আমি কয়েকটি বিষয় নোট করে এনেছি। সময় যেহেতু অনেকখানি হয়ে গেছে তাই খুব দ্রুত বলছি। হে আমার প্রিয়জনরা! একটি বিষয় হচ্ছে, প্রতিরোধের লক্ষ্য বলতে বুঝায় প্রতিরোধ করা যায় এমন একটি পর্যায়ে উপনীত হওয়া, অর্থনীতিতে যেমন, তেমনি দেশের রাজনৈতিক বিষয়াদিতেও। সামাজিক বিষয়াদিতে যেমন, তেমনি সামরিক বিষয়াদিতেও আমাদের এমন এক পর্যায়ে পৌঁছতে হবে, যে পর্যায়টি প্রতিরোধবাচক হবে। অর্থাৎ নিজেকে এমনভাবে প্রদর্শন করতে হবে যা দুশমনকে সব ব্যাপারে ইরানি জাতির ওপর হস্তক্ষেপ থেকে বারণ করবে। দুশমন দেখবে যে, কোনো লাভ নেই। ইরানি জাতিকে কিছুই করা যাবে না। আমরা বর্তমানে সামরিক খাতে বেশ খানিকটা এই প্রতিরোধমূলক অবস্থায় উপনীত হয়েছি। এই যে দেখছেন, ক্ষেপণাস্ত্রের বিষয়ে ও অন্যান্য বিষয়ে ওরা এত বাড়াবাড়ি করছে তার কারণ এটাই। তারা জানে যে, আমরা প্রতিরোধ করার মতো অবস্থায় উপনীত হয়েছি। স্থিতিশীল একটি অবস্থায় পৌঁছে গেছি। তারা আমাদের দেশকে এগুলো থেকে বঞ্চিত করতে চায়। অবশ্য কোনো দিনই তারা করতে পারবে না।
আমাদের সমস্যাদি ও আমাদের দুশমনদের সাথে আমাদের মোকাবিলা প্রথমেই সাহসিকতাপূর্ণ হতে হবে। প্রভাব বিস্তার ও ভয় সৃষ্টির মতো হতে হবে। দ্বিতীয়ত, তা হতে হবে আশাব্যঞ্জক। নিরাশাবাদী হবে না। তৃতীয়ত, বিজ্ঞতাপূর্ণ ও বুদ্ধিমত্তার সাথে হতে হবে। ভাসাভাসা, আবেগি ও উত্তেজনাব্যঞ্জক হবে না। চতুর্থত, তা হতে হবে সৃজনশীল। প্রতিক্রিয়াশীলতার বশবর্তী হয়ে হবে না। আমাদেরকে সৃজনশীল হতে হবে। যদি এইভাবে অগ্রসর হই, জেনে রাখবেন যে, ইরানি জাতি সকল বৃহৎ শক্তির মোকাবিলা করতে সফলকাম হবে এবং সম্মুখে এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে।
সাফল্য লাভের জন্য আরেকটি শর্ত হলো, আমাদের প্রতিরোধী চিন্তা-চেতনাকে দুর্বল করার জন্য দুশমনের চক্রান্ত সম্পর্কে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। লক্ষ্য করুন আমার প্রিয়জনরা! প্রতিরোধের চিন্তা হলো একটি জাতির সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। কাজেই স্বাভাবিকভাবে দুশমন আমাদের হাত থেকে এই অস্ত্র কেড়ে নিতে চায়। অতএব, প্রতিরোধ চিন্তার ওপর কুমন্ত্রণা দিতে আরম্ভ করে, সন্দেহ-সংশয় ঢুকিয়ে দিতে চায় যে, ‘জনাব কী লাভ হবে। হবে না।’ প্রতিরোধের চিন্তাধারাকে দুশমনের ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করতে হবে। দুশমনের চক্রান্তে যেন এই চিন্তা ও মনোবল দুর্বল না হয়।
দুশমনের প্রতারণাও বিভিন্ন ধরন ও প্রকরণ আছে। কখনো হুমকি দেয়। কখনো প্রলোভন দেখায়। যেমন ইদানিংকার এই পাগলা বেটা, আমেরিকার এই সম্মানিত প্রেসিডেন্ট, যিনি সম্প্রতি বয়ান দিয়েছেন যে, ইরান বর্তমান নেতৃত্ব থাকা অবস্থায়ই বড় রকমের অগ্রগতির অধিকারী হতে পারবে। এর অর্থ হলো, হে ইরানের বর্তমান নেতৃবৃন্দ! আমরা আপনাদেরকে উৎখাত করতে চাই না। আপনারা মন খারাপ করবেন না। আপনাদেরকে উৎখাত করার মতলব আমাদের নেই। আমরা আপনাদেরকেও মেনে নিতে রাজি আছি। এটি ইরানের নেতৃবৃন্দকে উদ্দেশ্য করে এক ধরনের তথাকথিত রাজনৈতিক ধাপ্পাবাজি। অবশ্য এ কথা সত্য। যদি ইরানের বর্তমান নেতৃবৃন্দ, ইরানের বর্তমান দায়িত্বশীলবর্গ মনোবলকে চাঙ্গা করেন, হাতের আস্তিন ওপরে উঠান, দিনরাত যদি তফাৎ না থাকে, সাধনা করেন, সমচিন্তা ও এক মন এক ধ্যানের হন, যথাযথভাবে জনগণের সুযোগ-সুবিধার সদ্ব্যবহার করেন, তাহলে নিশ্চিতভাবেই অনেক বেশি অগ্রগতি অর্জিত হবে। এতে কোনো ধরনের সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে শর্ত হলো, আমেরিকানদের কাছে আসতে দেয়া যাবে না। অগ্রগতির শর্ত হলো, আমেরিকানরা কাছে আসতে পারবে না। এই ভদ্রলোকের রাজনৈতিক প্রতারণা ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের প্রতারিত করবে না। জাতিকে প্রতারিত করতে সক্ষম হবে না। আমেরিকানদের কাছে আসতে দেয়া হবে না। যেখানেই আমেরিকানরা পা ঢুকিয়েছে সেখানে হয়ত যুদ্ধ হয়েছে নচেত ভ্রাতৃহত্যা হয়েছে। হয়ত গোলযোগ দেখা দিয়েছে নতুবা শোষণ হয়েছে। উপনিবেশে পরিণত হয়েছে বা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হয়েছে। আমেরিকানদের পদার্পণ অশুভ, অশুভ পদার্পণ। যদি কাছে না আসে তাহলে আমরা নিজেরাই জানি কীভাবে কী করতে হবে। আমাদের কী করতে হবে তা আমরা জানি। আল্লাহ তা‘আলাও আমাদেরকে ইনশাআল্লাহ তাওফীক দান করবেন।
জাতি মাঠে ময়দানে উপস্থিত আছে। এই উপস্থিতি অব্যাহত রাখতে হবে। আমার প্রিয় ভাইয়েরা ও আমার প্রিয় বোনেরা! আমি আপনাদের বলতে চাই যে, মনে রাখবেন, এই যে মাহে রমযানের শেষ শুক্রবারে মাঠে ময়দানে নেমে পড়েন তা দুশমনের সব হিসাব নিকাশ ভ-ুল করে দেয়। গোলযোগ বাধিয়ে দেয়। (জনতার সেøাগান ‘হে স্বাধীনচেতা রাহবার! আমরা প্রস্তুত আছি, প্রস্তুত।) আল্লাহ তা‘আলা ইনশাআল্লাহ তাঁর বরকত, তাঁর রহমত আপনাদের ওপর নাযিল করবেন। ইরানি জাতি সত্যিকার অর্থেই প্রস্তুত আছে।
দেশের রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের উদ্দেশেও একটি উপদেশ দিতে চাই। আসল সমস্যার ওপর কেন্দ্রীভূত গুরুত্ব দেয়া যেকোনো পরিস্থিতিতে দেশের জন্য মৌলিক গুরুত্বের দাবি রাখে। কাজেই অবশ্যই এর ওপর কেন্দ্রীয় গুরুত্ব দিতে হবে। বিপ্লব বিজয়ের পূর্বে আসল সমস্যা ছিল ‘তাগুতি সরকার’। ইমাম এ বিষয়টির ওপরই কেন্দ্রীভূত গুরুত্বারোপ করতে থাকেন, তাতে তিনি সফল হন। বিপ্লব বিজয়ের পর একটি পরিস্থিতিতে প্রজাতন্ত্রের স্থিতিশীলতার প্রশ্ন ছিল সবচেয়ে বড়। এক পরিস্থিতিতে দেশের ওপর সাদ্দামের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। গোটা দেশ যুদ্ধের প্রশ্নে কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। আলহামদুলিল্লাহ সাফল্য অর্জিত হয়েছে। আজকে আসল ও নগদ সমস্যা হচ্ছে অর্থনৈতিক সমস্যা। অবশ্য সাংস্কৃতিক সমস্যাদিও আছে এবং তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিরাপত্তার প্রশ্নও সে রকমই। তবে এসব সমস্যা ও বিষয়ের মধ্যে সবচেয়ে নগদ হলো অর্থনৈতিক বিষয়াদি, যা জনগণের জীবনযাত্রার সাথে সম্পর্কিত। দেশের সাংস্কৃতিক ও নিরাপত্তা বিষয়ের ওপরও তা প্রভাব ফেলে।
অর্থনীতির বিষয়ে মৌলিক বিষয়াদি রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ শিরোনামসমূহ আছে। আমি এর মধ্যে কয়েকটির কথা বলছি। একটি হচ্ছে উৎপাদনে ঔজ্জ্বল্য। একটি হচ্ছে জাতীয় মুদ্রার মূল্যমান। একটি হচ্ছে আয়-উপার্জন ও শ্রমের পরিবেশ উন্নত করা। একটি হলো অপরিশোধিত তেল বিক্রি থেকে দেশের অর্থনীতি আলাদা করার বিষয়। অপরিশোধিত তেল, অপরিশোধিত তেল বিক্রি ও অপরিশোধিত তেলের ব্যবসার সাথে দেশের বাজেট ও অর্থনীতির নাড়ির বন্ধন ছিন্ন করতে হবে। এটি আমাদের অন্যতম আসল সমস্যা ও বিষয়। অর্থনীতিতে সরকারের হস্তক্ষেপকে সরকারের নির্দেশনা ও তদারকিতে পরিবর্তন করাও দেশের অন্যতম মৌলিক ইস্যু। অর্থনৈতিক দুর্নীতিবাজ অর্থাৎ চোরচাট্টা, অর্থনৈতিক সন্ত্রাসী ও নিষ্ঠুর চোরাকারবারীদের হাতকে অর্থনৈতিক অঙ্গন থেকে কর্তন করতে হবে। দেখুন, এগুলো হচ্ছে দেশের মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যা। রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাগণ প্রধানত প্রশাসন আর তার পাশে আইন বিভাগ এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিচার বিভাগকে ঐক্যবদ্ধভাবে এসব বিষয়ে কাজ করতে হবে। এসব সমস্যার সমাধান বের করতে হবে। এগুলো আমাদের মৌলিক সমস্যা। এগুলোর প্রতি আমাদের কেন্দ্রীভূত হতে হবে। শাখাগত সমস্যাবলি ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত হলে চলবে না। খামোখা ছুতা বের করব না। জাতীয় সংহতি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাজনৈতিক ও গোষ্ঠীগত ঝগড়া এক পাশে ঠেলে রাখা বড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আরেকটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মহান আল্লাহর সাথে আমাদের হৃদয়ের বন্ধন মজবুত করা।
এ বছরের রমযান মাস ছিল অত্যন্ত সুন্দর মাস। আমার যতটুকু জানা আছে এবং আমার কাছে নিকট যেসব রিপোর্ট দেয়া হয়েছে তাতে জানতে পেরেছি যে, এ বছর রমযান মাসে দোয়া, যিকির, মোনাজাত ও ওয়াজের মজলিস ছিল, ইসলামি জ্ঞানচর্চার ব্যাপক আয়োজন খুবই প্রাণবন্ত ছিল। এই তেহরান শহরে বিভিন্ন মহল্লায় বিরাট বিরাট সমাবেশে প্রধানত তরুণরা সমবেত হয়েছে। দোয়া মোনাজাতে অংশ নিয়েছে। কেঁদেছে। অশ্রুপাত করেছে। আহাজারি করেছে। ওসিলা দিয়ে দোয়া করেছে। এগুলো অত্যন্ত মূল্যবান জিনিস। এগুলো হচ্ছে আল্লাহর রহমত ও হেদায়াতের ক্ষেত্র প্রস্তুতকারী। এগুলোর মূল্য অনুধাবন করবেন। তরুণ সম্প্রদায়! তোমাদের পবিত্র অন্তরগুলো, তোমাদের নূরানি হৃদয়গুলো বড় বড় জটিলতা সমাধানের চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করতে পারে। এগুলোই আল্লাহর রহমত আকর্ষণ করবে। আমি আশা করি, ইনশাআল্লাহ আল্লাহ তা‘আলা এই মহান ও গুরুত্বপূর্ণ রমযান মাসকে জনগণ এ বছর যেভাবে অতিবাহিত করেছে, তা আমাদের জাতির জন্য বরকতময় হোক। আজকেও হচ্ছে মাহে রমযানের শেষ দিন। এখন আমরা মাহে রমযানের শেষ মুহূর্তে অবস্থান করছি। এ মুহূর্তে কয়েকটি দোয়া করা ভালো মনে করছি।
نسئلک اللّهمّ و ندعوک باسمک العظیم الاعظم الاعزّ الاجلّ الاکرم و بحرمة محمّدٍ و آله یا الله … یا رحمان یا رحیم یا مقلّب القلوب ثبّت قلوبنا علی دینک
হে আল্লাহ! তোমার কাছে প্রার্থনা জানাই। তোমাকে ডাকছি তোমার মহান, অতি মহান অতি মর্যাদাবান, অতি সম্মানিত ও অতিশয় ইজ্জতের নাম ধরে, মুহাম্মাদ (সা.) ও তাঁর বংশধরের সম্মানের উসিলা দিয়ে। ইয়া আল্লাহ, ইয়া আল্লাহ, ইয়া রাহমান, ইয়া রাহীম, হে অন্তরসমূহ পরিবর্তনকারী আমাদের অন্তরসমূহকে তোমার দ্বীনের ওপর স্থায়িত্ব দান কর।
হে পরওয়ারদেগার! আমাদেরকে তোমার রাস্তায় অবিচলতা দান কর। ওহে পরওয়ারদেগার! ইমামের পবিত্র রূহকে, যিনি আমাদেরকে প্রতিরোধ শিক্ষা দিয়েছেন তাঁর বন্ধুদের সাথে হাশর কর। ওহে পরওয়ারদেগার! ইমামের স্মরণ ও শহীদানের স্মরণ এর ছায়া এই জাতির মাথার ওপর থেকে সংকীর্ণ ও হ্রাস করো না। ওহে পরওয়ারদেগার! তোমার সাহায্য ইরানি জাতির ওপর অবতীর্ণ করো। ওহে পরওয়ারদেগার! মুসলিম উম্মাহর ওপর তোমার সাহায্য অবতীর্ণ কর। ওহে পরওয়ারদেগার! ইসলামি জাহানে যারা ফিতনা সৃষ্টি করছে তাদেরকে অপদস্থ, ঘৃণিত ও অপমানিত করো। ওহে পরওয়ারদেগার! মুহাম্মাদ (সা.) ও আলে মুহাম্মাদ (সা.) এর উসিলায় এই মানুষের প্রয়োজনসমূহ, যারা এই জলসাসমূহে যিকির ও দোয়া করেছে তা কবুল করো। ইরানি জাতির জন্য, উম্মতে ইসলামির জন্য পবিত্র মাহে রমযানকে মোবারক কর। ওহে পরওয়ারদেগার! আমাদেরকে তোমার দয়া, মেহেরবানি ও মাগফেরাত হতে বঞ্চিত করো না। আমাদের গুনাহসমূহ মাফ করে দাও। আমাদের ভুলত্রুটি, আমাদের বাড়াবাড়ি মাফ করে দাও। আমাদের মধ্যে যাঁরা বিদায় হয়ে গেছেন আমাদের মাতাপিতাকে মাফ করে দাও। ওহে পরওয়ারদেগার! মুহাম্মাদ ও আলে মুহাম্মাদের উসিলায় তোমার ওলী (ইমাম মাহদী) এর মকবুল দোয়া আমাদের অবস্থার সাথে সঙ্গতিশীল কর। আমাদেরকে তাঁর সৈনিক হিসেবে গ্রহণ করো। আমাদের মৃত্যুকে এ পথে শাহাদাত হিসেবে কবুল কর। মুহাম্মাদ ও আলে মুহাম্মাদের উসিলায় যা বললাম, যা শুনলাম, যা আঞ্জাম দেব, তোমার জন্য এবং তোমার পথে হিসেবে গ্রহণ কর। তোমার দয়ার উসিলায় আমাদের দোয়া কবুল কর।
ওয়াস সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ।
ইমাম খোমেইনী (র.) ও বেলায়েতে ফকিহ
মোহাম্মদ আশরাফ উদ্দিন খান-
বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে (১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে) ইরানের বুকে সংঘটিত হয় মহান ইসলামি বিপ্লব। ইমাম খোমেইনী (র.)-এর নেতৃত্বে পরিচালিত কালজয়ী এ বিপ্লব প্রকৃতপক্ষে সহস্রাব্দের সবচেয়ে বড় ও বিস্ময়কর ঘটনা। ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে যতই দিন অতিবাহিত হচ্ছে ততই আমরা মধ্যপ্রাচ্যসহ সারাবিশ্বে এ বিপ্লবের ধারার গভীরতা ও এর ক্রমবর্ধমান বিস্তৃতি লক্ষ্য করছি। এ বিপ্লবের বিজয়ের মাধ্যমেই ‘বেলায়েতে ফকিহ’ তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। ইসলামের ইতিহাসে প্রথমবারের মত বেলায়েতে ফকিহ বাস্তবরূপ লাভ করে। যার রূপরেখাও স্বয়ং ইমাম খোমেইনী (র.) পবিত্র কোরআন-সুন্নাহর আলোকে ইতিপূর্বেই প্রদান করেছেন। ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত চার দশক অতিক্রান্ত হয়েছে। বেলায়েতে ফকিহ দর্শনের কার্যকারিতা ও গতিময়তা ইতোমধ্যেই বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক চিন্তাধারার ওপর ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। এ প্রভাব এতটাই গভীর যে, বিশ্বের যেখানেই ইসলামি রাষ্ট্র বা ইসলামি বিপ্লবের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয় সেখানেই সকলের দৃষ্টি বেলায়েতে ফকিহ্ দর্শনের দিকে নিবদ্ধ হয়। কারণ, ইরানে ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইমাম খোমেইনী (র.) একটি প্রগতিশীল ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। যেখানে ইসলাম ও গণতান্ত্রিক মূলবোধের একটি চমৎকার সমন্বয় ঘটেছে।
বেলায়েতে ফকিহ কী?
বেলায়েত শব্দের অর্থ কর্তৃত্ব বা শাসনক্ষমতা, আর ফকিহ শব্দের অর্থ ফিকাহবিদ অর্থাৎ যিনি ইসলামের বিধিবিধান সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখেন। বেলায়েতে ‘ফকিহ’ বা ‘ফকিহর শাসনক্ষমতা’ মূলত ‘বেলায়েতে রাসূল (সা.)-এর ধারণা থেকে উৎসারিত। সত্যিকার অর্থে এ বেলায়েত বা শাসনক্ষমতা হচ্ছে মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব, যার অধিকারী ছিলেন স্বয়ং মহানবী (সা.) ও তাঁর ন্যায়পরায়ণ খলীফাগণ। আর পরবর্তীকালে বা বর্তমানে তাঁদের অনুপস্থিতিতে এ কর্তৃত্বের অধিকারী ওয়ালী এ ফকিহ। ফকিহদের মধ্যে যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ আর মৌলিক মানবীয় গুণাবলি, যেমন প্রশাসনিক যোগ্যতা, নেতৃত্বের গুণাবলি ও ন্যায়পরায়ণতা ইত্যাদির দিক থেকেও যিনি অগ্রগণ্য, এরূপ ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব মুসলিম উম্মাহকে সঠিকভাবে নেতৃত্ব প্রদান করা। মুসলিম বিশ্বের ঐক্য ও সংহতি জোরদার করা এবং স্বার্থ সংরক্ষণ করা সহ উম্মতের সকল বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক বিষয়ের নেতৃত্ব সুচারুরূপে প্রদান করার দায়িত্ব ওয়ালী-এ ফকিহর ওপরই ন্যস্ত।
বেলায়েতে ফকিহ দর্শনের পুনরুজ্জীবন
ফুকাহা বা ফিকাহবিদ আলেমগণ যুগ যুগ ধরে ফিকাহর বিভিন্ন অধ্যায়ে বেলায়েতে ফকিহগণ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। ফিকাহশাস্ত্রের উৎপত্তিকাল থেকেই জিহাদ, গণিমত, খুমস, আনফাল, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ ইত্যাদি সহ বিভিন্ন অধ্যায়ে বেলায়েতে ফকিহ সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। কিন্তু পুরাতন যুগের ফকিহদের মধ্যে কেউই এ বিষয়ে একটি সুবিন্যস্ত ও পরিপূর্ণ আলোচনা করেন নি। তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার দিকে দৃষ্টি দিলেই এর প্রকৃত কারণ খুঁজে পাওয়া যায়।
নির্ভরযোগ্য সূত্র অনুযায়ী কাজার বংশীয় বাদশাহদের আমলের ফকিহদের মরহুম মোল্লা আহমাদ নারাকী (ওফাত ১২৪৫ হিজরি) প্রথম বেলায়েতে ফকিহ সম্পর্কে বিস্তারিত ও পরিপূর্ণ একটা ধারণা উপস্থাপন করেন। তিনি হাদীসের ভিত্তিতে প্রমাণ করেন যে, যেসব বিষয়ে রাসূল (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের ইমামগণ কর্তৃত্ব প্রাপ্ত ছিলেন সেসব বিষয়ে ফকিহগণও পরিপূর্ণভাবে বেলায়েতপ্রাপ্ত। তবে এক্ষেত্রে শুধু সেসব বিষয় বাদ যাবে যেগুলো একান্তভাবে মাসুমদের (নিষ্পাপ ব্যক্তিবর্গ) জন্য নির্ধারিত। তাঁর এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সুস্পষ্ট যে, তিনি সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকে বেলায়েতে ফকিহর অন্তর্ভুক্ত মনে করতেন।
মোল্লা আহমাদ নারাকীর পরে ইমাম খোমেইনীই আধুনিক যুগের একমাত্র ফকিহ যিনি বেলায়েতে ফকিহ সম্পর্কে বিস্তারিত ও পরিপূর্ণ আলোচনা করেছেন। প্রকৃত প্রস্তাবে তিনি এ ব্যাপারে একটি সুস্পষ্ট রূপরেখা প্রদান করেছেন। তিনি তাঁর ঐতিহাসিক বেলায়েতে ফকিহ গ্রন্থে কোরআান, হাদীস ও বুদ্ধিবৃত্তিক দলিল উপস্থাপন করে প্রমাণ করেছেন, সবধরনের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কর্ম বেলায়েতে ফকিহর অন্তর্ভুক্ত। যদিও পবিত্র কোরআনে এ প্রসঙ্গে সরাসরি ফকিহ্ শব্দটি ব্যবহৃত হয় নি, কিন্তু বেলায়েতে ফকিহর প্রমাণ্য দলিল হিসাবে কয়েকটি আয়াত প্রণিধানযোগ্য। এগুলোর মধ্যে সুস্পষ্ট ও অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি আয়াত এক বা একাধিকবার কোরআনে উল্লিখিত হয়েছে-
‘হে তোমরা যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছ! আনুগত্য কর আল্লাহর, আনুগত্য কর রাসূলের এবং তাদের যারা তোমাদের মধ্যে কর্তৃত্বের অধিকারী।’- সূরা নিসা : ৫৯
ইমাম খোমেইনী (র.) যেসব বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়কে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অপরিহার্যতার দলিল হিসাবে উল্লেখ করেছেন সেগুলো নি¤œরূপ :
১. মহানবী (সা.) স্বয়ং ইসলামি রাষ্ট্্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং নিজেই তার কর্ণধার ছিলেন।
২. ইসলামি বিধি-বিধান বা আইন-কানুন অব্যাহত থাকার প্রয়োজনীয়তা অর্থাৎ ইসলামি আইন-কানুনের প্রয়োগ শুধু রাসূল (সা.) ও তাঁর ন্যায়পরায়ণ খলীফাবৃন্দের যুগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা কিয়ামত পর্যন্ত সব যুগের জন্যই প্রযোজ্য।
৩. ইসলামি আইন-কানুনের স্বরূপ ও ধরণ প্রমাণ করে যে, একমাত্র ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার অধীনেই এসব আইনের পরিপূর্ণ প্রয়োগ সম্ভব।
ইমাম খোমেইনী (র.) তাঁর উপস্থাপিত বেলায়েতে ফকিহ তত্ত্বের ধারাবাহিকতায় ইসলামি নেতৃত্বের অপরিহার্য শর্তাবলির কথা উল্লেখ পূর্বক বলেন, ইসলামি নেতৃত্বের জন্য বুদ্ধিবৃত্তিক প্রজ্ঞা ও প্রশাসনিক যোগ্যতার মতো সাধারণ বৈশিষ্ট্যাবলি ছাড়াও আরো অন্তত দুটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য অপরিহার্য। আর সেগুলো হচ্ছে : ইসলামি আইন-কানুনের ওপর ব্যুৎপত্তি ও ন্যায়পরায়ণতা। বেলায়েতে ফকিহর ক্ষমতার পরিসর কতটুকু হবে সে সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি আরো বলেন, সবদিক থেকে যোগ্যতাসম্পন্ন এবং উপরিউক্ত দুটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যেরও অধিকারী এরূপ কোন ব্যক্তি যদি কিয়াম করে এবং ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে, তাহলে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার ক্ষেত্রে কোন তারতম্য সৃষ্টি করে না।
বেলায়েতে ফকিহ ব্যবস্থার স্বরূপ
কালের প্রবাহে আজ এটা সবার সামনে সুস্পষ্ট যে, ইমাম খোমেইনী (র.) বেলায়েতে ফকিহ্ দর্শনকে শুধু বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করেই ক্ষান্ত হন নি; বরং তৎকালীন খোদাদ্রোহী স্বৈরাচারী, জালিম রাজতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মাধ্যমে ইরানি জনগণের সর্বাত্মক সহযোগিতায় ইসলামি বিপ্লব ঘটিয়েছেন। আর বেলায়েতে ফকিহ তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে ইরানের ভূমিতে প্রতিষ্ঠা করেন ইসলামি প্রজাতন্ত্র। ইতোমধ্যে আমরা ইমাম খোমেইনী (র.) কর্তৃক প্রণীত বেলায়েতে ফকিহ দর্শনের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি উপস্থাপন করেছি। এ পর্যায়ে আমরা এ ঐশী দর্শনের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বরূপ নিয়ে আলোচনা করব।
১. আল্লাহর সার্বভৌমত্ব
বেলায়েতে ফকিহ্ দর্শন অনুসারে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব মহান আল্লাহর। মহাবিশ্বের সকল শক্তির উৎস মহাপ্রভু আল্লাহ। ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে মানব জাতিসহ সমগ্র মহাবিশ্বের একমাত্র মালিক সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী। আল্লাহ্র অনুমতি ছাড়া কারো পক্ষে কোন কিছুর ওপর ক্ষমতা প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। সুতরাং মানুষের ওপর শাসনক্ষমতা প্রয়োগ করার অধিকারও একমাত্র আল্লাহর নিকট সংরক্ষিত। তাঁর অনুমোদন ছাড়া শাসনক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার কারো নেই।
সুতরাং প্রথমত ও মৌলিকভাবে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও সকল রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস মহান আল্লাহ। তাই এক্ষেত্রে শুধু তাঁরাই শাসনক্ষমতার অধিকারী হবেন, যাঁরা আল্লাহর পক্ষ থেকে অধিষ্ঠিত হবেন। মহানবী (সা.)-এর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রও এ পথেই বৈধতা লাভ করেছে অর্থাৎ তিনি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অধিষ্ঠিত ছিলেন। বেলায়েতে ফকিহর বৈধতাও এই একই সূত্রে গাঁথা।
২. জনগণের সম্মতি ও অংশগ্রহণ
বেলায়েতে ফকিহ্ ব্যবস্থার অধীনে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রে ফকিহ্র শাসন ক্ষমতা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব থেকে উৎসারিত। কিন্তু এ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জনগণের ভূমিকাই মুখ্য। কারণ, সমাজে বা রাষ্ট্রে বেলায়েতে ফকিহ্ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য শুধু জনগণের আকাক্সক্ষাই যথেষ্ট নয়; বরং ন্যায়ভিত্তিক এরূপ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন। প্রথমত এ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাকল্পে ফকিহর শাসনক্ষমতাকে মেনে নেওয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসাবে আল্লাহর দ্বীনকে মেনে নেয়া। আর দ্বিতীয়ত ফকিহর শাসনক্ষমতাধীনে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অব্যাহত সক্রিয় অংশগ্রহণ। মোটকথা জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বা তাদের অংশগ্রহণ ছাড়া বেলায়েতে ফকিহ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। বরং জনগণের ইচ্ছায় প্রতিষ্ঠিত ফকিহর শাসনাধীন রাষ্ট্রে জনগণের অংশগ্রহণ, ইসলামি চেতনার প্রসার ও পারস্পরিক ঐক্য ও সংহতি যত বেশি হবে, এ রাষ্ট্রব্যবস্থা ততই সফল ও শক্তিশালী হবে।
৩. জনমতের প্রতিফলন
বেলায়েতে ফকিহ ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান ভিত্তি হচ্ছে সকল রাষ্ট্রীয় কর্মকা-ে জনমতের প্রতিফলন। পবিত্র কোরআনে মুমিনদের বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে বলা হয়েছে :
‘আর তাদের কর্মকা- হচ্ছে পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে।’- সূরা শূরা : ৩৮
তা ছাড়া কোরআনের অন্যত্র মহানবী (সা.) সরাসরি এ ব্যাপারে নির্দেশিত হয়েছেন :
‘আর কর্মের ব্যাপারে তাদের সাথে পরামর্শ করুন, আর যখন সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন তখন আল্লাহর ওপর ভরসা করুন।’- সূরা আলে ইমরান : ১৫৯
সুতরাং বেলায়েতে ফকিহ্ ব্যবস্থার অধীনে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের বিভিন্ন পদে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ তাঁদের সকল রাষ্ট্রীয় কর্মকা-ের ব্যাপারে জনগণের সাথে পরামর্শ করেন এবং সবক্ষেত্রে তাদের মতামতের প্রতিফলন ঘটান। তবে পরামর্শের এ ধরন কী হবে এ ব্যাপারে ইসলামে কোন সীমাবদ্ধতা নেই। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধান অনুযায়ী মজলিশে শূরায়ে ইসলামি বা সে দেশের পার্লামেন্ট- যার সদস্যরা জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন, এ ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। তাছাড়া প্রতিটি গ্রাম, জেলা ও শহর পর্যায়েও শূরা বা পরিষদ রয়েছে, যেগুলো সার্বিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা জন্য জনমতের প্রতিফলন ঘটাবার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তবে সংগত কারণেই বেলায়েতে ফকিহ ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠিত ইসলামি রাষ্ট্রের এই পরামর্শ প্রক্রিয়া সার্বিকভাবে ইসলামি শরীয়তের বিধি-বিধানের আলোকেই পরিচালিত হয়।
৪. সকল নাগরিকের সমঅধিকার
বেলায়েতে ফকিহ্ ব্যবস্থার অধীনে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রে ক্ষমতাসীন ফকিহ্ কোন অতিরিক্ত নাগরিক অধিকার ভোগ করেন না। এমনকি নেতৃত্বের আসনে সমাসীন হওয়ার কারণে যেসব হুকুম বা ফতোয়া তিনি জারি করেন, সেগুলো তাঁদের নিজের জন্যও অবশ্য পালনীয়। উল্লেখ্য যে, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধানের ১০৭ নং ধারায় বলা হয়েছে, আইনের দৃষ্টিতে রাহবারের (ওয়ালীয়ে ফকিহ্) ব্যক্তিগত অধিকার দেশের অন্যান্য নাগরিকের সমান।
তা ছাড়া যে ইসলামি বিশেষজ্ঞ পরিষদ কর্তৃক ওয়ালীয়ে ফকিহ বা ক্ষমতাসীন ফকিহ নির্বাচিত হন তাঁদেরই সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের মধ্যে থাকেন তিনি। এক্ষেত্রে সামান্যতম বিচ্যুতি বা অনধিকার চর্চা তাঁর পদচ্যুতির জন্য যথেষ্ট।
৫. আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা
বেলায়েতে ফকিহ ব্যবস্থার অধীনে প্রকৃত প্রস্তাবে ফকিহর নয়; রবং ফিকাহ বা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এমনকি মহানবী (সা.)-ও যে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেখানে তিনি নিজের ইচ্ছা মতো কোন রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপ পরিচালনা করতেন না; বরং আল্লাহ প্রেরিত বাণী অনুসারেই দেশ পরিচালনা করতেন। কারণ, প্রকৃতপক্ষে বেলায়েত বা শাসনক্ষমতার অধিকারী হচ্ছে স্বয়ং মহান আল্লাহ। আর রাসূলের নিকট এ ক্ষমতা আল্লাহর পক্ষ থেকে অর্পিত হয়েছে। একইভাবে রাসূলের সত্যিকারের উত্তরাধিকারী হিসাবে ফকিহগণের কাছে শাসনক্ষমতা অর্পিত হয়েছে মাত্র। তাই রাসূলের মতো ফকিহগণও আল্লাহর কিতাব বা ইসলামের বিধি-বিধান অনুসারে দেশ পরিচালনা করতে নির্দেশিত হয়েছেন।
৬. ফকিহ্র সর্বময় ও চূড়ান্ত ক্ষমতা
ইতিপূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে যে, মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব প্রদানকারী হিসাবে প্রয়োগিক ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন ফকিহ্ আর রাসূল (সা.) ও তাঁর ন্যায়পরায়ণ খলীফাবৃন্দের ক্ষমতার মধ্যে কোন তারতম্য নেই। সুতরাং মুসলিম সমাজকে সুচারুরূপে পরিচালনার জন্য যত রকমের ক্ষমতা ও এখতিয়ারের প্রয়োজন, তার সবটাই ওয়ালী-এ-ফকিহ্র রয়েছে। আর জনগণের ওপর এটা অবশ্য কর্তব্য যে, ওয়ালীয়ে ফকিহ্র নির্দেশনাকে পুরোপুরি মেনে চলবে।
বেলায়েতে ফকিহ ব্যবস্থায় ওয়ালীয়ে ফকিহ্ নিজে সরাসরি কোন নির্বাহী দায়িত্ব পালন করেন না। তবে নির্বাহী দায়িত্ব পালনকারী যে কোন ব্যক্তির সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মের ওপর তিনি হস্তক্ষেপ করতে পারেন, আর সেক্ষেত্রে তাঁর সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত। তবে এসব কিছু তিনি করেন শরীয়তের বিধি-বিধানের আলোকেই। ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক বা ইসলামের চৌহদ্দির বাইরের কোন আইন জারি করার কোন অধিকার ফকিহ্র নেই। সুতরাং ফকিহ্র সর্বময় ক্ষমতা সত্ত্বেও বেলায়েতে ফকিহ্ ব্যবস্থায় স্বেচ্ছাচারিতা বা একনায়কতান্ত্রিকতার কোন অবকাশ নেই।
পরিশেষে বলা যায়, বেলায়েতে ফকিহ ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠিত ইসলামি রাষ্ট্রে আসলে চূড়ান্তভাবে আল্লাহর যমিনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এক্ষেত্রে কোন ভাবেই ব্যক্তি ফকিহ্’র শাসন বিষয়বস্তু নয়। এমনকি ইসলামি শাসনব্যবস্থায় স্বয়ং মহানবীও শুধু তাঁর মহান প্রভুর বিধান অনুসারে রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনা করেছেন। প্রকারান্তরে যা আল্লাহর শাসন প্রতিষ্ঠারই নামান্তর। প্রকৃতপ্রস্তাবে মহানবী (সা.)-এর শাসনক্ষমতা, তাঁর ন্যায়পরায়ণ খলীফাদের শাসনক্ষমতা ও ফকীহর শাসনক্ষমতা বেলায়েতে ফকিহ্ এসবই মহান আল্লাহর শাসনক্ষমতা থেকেই উৎসারিত। আসলে প্রকৃত ইসলামি রাষ্ট্রে মানুষ আল্লাহর বান্দা হিসেবে আল্লাহর শাসনক্ষমতা বা সার্বভৌমত্বের অধীনেই পরিচালিত হয়। তাই বেলায়েতে ফকিহর অধীনে প্রতিষ্ঠিত ইসলামি রাষ্ট্র প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত একটি কল্যাণ রাষ্ট্র। কারণ, ফকিহ্ সেখানে শুধু মহান আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে সমাজকে আল্লাহর বিধি-বিধান অনুসারে, ন্যায়পরায়ণতার ভিত্তিতে পরিচালনা করেন মাত্র।
হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-এর বহুমুখী ব্যক্তিত্বের ওপর এক নযর
নূর হোসেন মজিদী
ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ও ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিষ্ঠাতা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) মানব জাতির ইতিহাসে অন্যতম বিরল ব্যক্তিত্ব; তাঁর পূর্ণ পরিচয়ের ব্যাপ্তি ও গভীরতা মহাসাগরতুল্য। তাঁর জীবন ও আচরণের অনেক দিকের মধ্য থেকে এখানে আমরা মাত্র কয়েকটি দিক অতি সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
যুগসচেতন মুজতাহিদ : হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) ছিলেন চিন্তা, কথা ও আমল-আচরণে ভারসাম্যের (عدالة) অধিকারী একজন যুগসচেতন দূরদর্শী মুজতাহিদ তথা একজন প্রকৃত দ্বীনী আলেম- কোরআন মজীদে যে ধরনের ব্যক্তিদের সম্পর্কে يَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ (সূরা আত্-তাওবাহ্ : ১২২) ব্যবহৃত হয়েছে। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই ওয়ারেছে আম্বিয়া।
তিনি ছিলেন যুগজিজ্ঞাসার জবাব দানে সক্ষম গতিশীল ইজতিহাদের পথিকৃৎ এবং এ ক্ষেত্রে তিনি কতগুলো মৌলিক বিষয়ে নতুন দিকনির্দেশনা প্রদান করেন; এগুলোর মধ্যে মুজতাহিদের শাসন (বেলায়াতে ফকীহ্) তত্ত্ব প্রদান ও এর ‘আক্বায়েদী ভিত্তি নির্ধারণ এবং ‘নামের অভিন্নতা সত্ত্বেও বিষয়বস্তুর প্রকৃতিতে পরিবর্তনের ফলে হুকূমে পরিবর্তন’ মূলনীতি ও প্রাথমিক বিধান (হুক্মে আইয়ালীয়াহ্) কার্যকরকরণের শর্তাবলির অনুপস্থিতিতে দ্বিতীয় স্তরের বিধান (হুক্মে ছানাভীয়াহ্) কার্যকরকরণ মূলনীতি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। [এ সব বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা স্বতন্ত্র পরিসরের দাবিদার।] এছাড়া তিনি কোরআন মজীদের আলোকে সৃষ্টির ভবিষ্যৎ নির্ধারণে আল্লাহ্ তা‘আলার একক ইচ্ছা, আল্লাহ্র ইচ্ছার ভিত্তিতে বান্দার ইচ্ছা ও বান্দাহ্র স্বাধীন ইচ্ছা-র যে সমন্বয় তুলে ধরেন (ত্বালাব্ ও ইরাদাহ্ গ্রন্থে) তা মুসলিম উম্মাহ্র মধ্যকার হাজার বছরেরও বেশিকালের অদৃষ্টবাদ বনাম কর্মবাদ বিতর্কের অবসানের পথনির্দেশক হয়েছে।
তিনি ছিলেন একজন পূর্ণাঙ্গ ও সার্বিক মুজতাহিদ (ফাক্বীহে জামে‘); তিনি দ্বীনী ‘ইল্মের সকল দিকের ওপরই সমান দক্ষতার অধিকারী ছিলেন। তাঁর র্দাস্সমূহ কেবল ফিকাহ্, উছূলে ফিকাহ্ ইত্যাদি দ্বীনী শিক্ষাকেন্দ্রসমূহে বহুলপ্রচলিত বিষয়সমূহের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত না, বরং পাশ্চাত্য দর্শন, ইসলামি দর্শন, আধ্যাত্মিকতা (‘র্ইফান/মা‘রেফাত), তাফসীর ইত্যাদি অনেক বিষয়েই তিনি র্দাস্ দিতেন। বিভ্রান্ত চিন্তাধারার অধিকারীদের সৃষ্ট বিভ্রান্তি ও সংশয়সমূহের জবাব দানেও তিনি ছিলেন উপযুক্ত ব্যক্তি।
আজীবন দ্বীনী শিক্ষক : তিনি ছিলেন আজীবন আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক দ্বীনী শিক্ষক- যাঁর কাছে দ্বীনী শিক্ষাপ্রাপ্তদের মধ্যে অনেক সুযোগ্য মুজতাহিদ গড়ে ওঠেন। তিনি কোমের দ্বীনী শিক্ষাকেন্দ্রে শিক্ষাদানরত অবস্থায়ই (১৯৬১) বিশ^ব্যাপী শিয়া ওলামায়ে কেরামের নেতৃত্বে বরিত হন। তাঁকে দেশ থেকে নির্বাসিত করে তুরস্কে পাঠানোর (১৯৬৪) এক বছর পর ইরাকের নাজাফে স্থানান্তরিত করা হলে তিনি সেখানকার দ্বীনী জ্ঞানচর্চা কেন্দ্রে পাঠদান করতে শুরু করেন ও দীর্ঘ ১৪ বছর সেখানে দ্বীনী জ্ঞানের আলো বিতরণ করেন। দেশে ফিরে (১৯৭৯) জাতীয় নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হবার পরেও ইন্তেকালের (১৯৮৯) পূর্ব পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সব সময়ই তিনি ‘ইল্মী বিষয়াদিতে শিক্ষক ও গবেষকসুলভ দিকনির্দেশ প্রদান অব্যাহত রাখেন।
মনীষী গ্রন্থকার : হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-এর প্রণীত গ্রন্থাবলি, বিশেষ করে ফিক্বাহ্ শাস্ত্রীয় গ্রন্থাবলি দ্বীনী ‘ইলমের জগতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থানের অধিকারী হয়ে আছে। তিনি তাঁর ক্লাসসমূহে যে বক্তব্য রাখতেন তাঁর ছাত্রগণ তা লিখে রাখতেন এবং পরে মুদ্রিত আকারে প্রকাশ করতেন।
পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসেবে দ্বীনের উপস্থাপন : তিনি ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসেবে উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন : ‘ইসলামে সকল কিছুই শামিল রয়েছে- এ দৃষ্টিকোণ থেকে গভীরভাবে দেখলে দেখা যাবে ইসলাম সকল সমস্যার সামাধান প্রদান করেছে।’
সসম্মান সমালোচনা : তিনি যখন তাঁর র্দাসে মনীষীদের মতামতের সমালোচনা করতেন তখন তাঁদের সম্মান ও মর্যাদা বজায় রেখে করতেন। এছাড়া তিনি ‘ইল্মী আলোচনায় কখনোই কারো অন্ধ অনুসরণ ও বা অন্ধ বিরোধিতা করতেন না, বরং গবেষণামূলক দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করতেন।
সুন্নাতী ধারার দ্বীনী নেতৃত্ব : বিংশ শতাব্দীতে মুসলিম বিশে^ ইসলামি রাজনৈতিক নেতৃত্বের যে ধারণা গড়ে ওঠে ও বহুলপ্রচলিত হয়ে পড়ে হযরত ইমাম সে ধরনের কোনো ইসলামি রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না এবং তিনি কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠনও প্রতিষ্ঠা করেন নি। তিনি কেবল নবী-রাসূলগণের (আ.) ও মা‘ছ¡ূম্ ইমামগণের (আ.) তাত্ত্বিক প্রতিনিধি বা উত্তরাধিকারী হিসেবে দ্বীনের শিক্ষা প্রদান এবং জনগণকে দেশের ও বিশে^র প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন করার নৈতিক দায়িত্ব পালন করেন। আর ইরানি জনগণ গণবিরোধী ও ধর্মদ্রোহী পাহলাভী শাহীতন্ত্রের বিরুদ্ধে এবং তাদের সহযোগী বিশ্বগ্রাসী আমেরিকা ও ফিলিস্তিনগ্রাসী যায়নবাদী ইসরাঈলের বিরুদ্ধে সংগ্রামে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁকে নেতৃত্বে বরণ করে নেয়।
দায়িত্ব পালনের অনুভূতি : হযরত ইমাম কোনোরূপ ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতি বা সাফল্য-ব্যর্থতার প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে একজন ওয়ারেছে আম্বিয়া’ হিসেবে সব সময়ই কেবল দায়িত্ব পালনের অনুভূতি সহকারে সত্য প্রকাশ ও জনগণকে দিকনির্দেশ প্রদান করতেন। ১৯৬৪ সালের ২৬শে অক্টোবর ক্যাপিচুলেশন আইন সম্পর্কে ভাষণ দেয়ার পর তিনি বলেন : ‘আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি; এবার স্বস্তি পেলাম।’ এর পর পরই তাঁকে তুরস্কে নির্বাসিত করা হয়।
উঁচু স্তরের রাষ্ট্রনায়ক : হযরত ইমাম ছিলেন একজন উঁচু স্তরের রাষ্ট্রনায়ক। তিনি রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে সুপরিচালনা, সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ, শৃঙ্খলা, আইন, জনগণ ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। তিনি দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের প্রতি ছিলেন আন্তরিক ও নিজেকে তাঁদের সহযোগী মনে করতেন; বিনা কারণে দায়িত্বশীলদের পরিবর্তন করাকে সমর্থন করতেন না।
নিয়োগ, বরখাস্ত, স্থগিতকরণ, সমালোচনা ও প্রতিবাদ ইত্যাদি ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বেলায় তিনি দেখতেন কর্তব্য ও করণীয় কী এবং তদনুযায়ী কাজ হয়েছে কিনা। এ সব ক্ষেত্রে কারো প্রতি ব্যক্তিগত স্নেহ ও বিরাগকে তিনি মোটেই স্থান দিতেন না। তিনি সংবিধান ও আইনের সীমারেখা এবং জনগণের রায় মেনে চলতেন, নিজস্ব মত আন্তরিকতার সাথে পেশ করতেন এবং তিনি দায়িত্বশীলদের উদ্দেশে উপদেশের ভঙ্গিতে কথা বলতেন।
পরিপূর্ণ ভারসাম্যের অধিকারী : চিন্তা, কথা ও আচরণে তিনি ছিলেন পরিপূর্ণ ভারসাম্যের অধিকারী। নিজের ওপর তাঁর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল। তিনি কারো প্রতিই এমন নিঃশর্ত ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের মনোভাব পোষণ করতেন না যে, ভালো-মন্দ সর্বাবস্থায় ও অন্ধভাবে তাকে সমর্থন করবেন, অন্যদিকে কাউকে বৈধ সাহায্য-সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে মোটেই দ্বিধা করতেন না।
সাহসী ও বিনয়ী ব্যক্তিত্ব : হযরত ইমাম ছিলেন একই সাথে সাহসী ও বিনয়ী। সাহসিকতা, স্পষ্টবাদিতা, দৃঢ় প্রতিরোধ ও স্থৈর্য সহ একজন প্রকৃত বীর পুরুষের সবগুলো বৈশিষ্ট্যই তাঁর মাঝে ছিল এবং তাঁর বক্তৃতা-ভাষণ, বিবৃতি ও লেখায় তা ফুটে উঠত। অন্যদিকে তাঁর কথা, মৃদু হাসি, স্নেহশীলতার হস্ত উত্তোলন ইত্যাদিতে স্নেহাস্পদদের ও জনগণের প্রতি বিনয় ফুটে উঠত।
১৯৬৩ সালে কোমের মাদ্রাসায়ে ফায়যিয়ায় শাহের ভাড়াটে এজেন্টদের হামলা কালে, ১৯৬৪-র ২৬শে অক্টোবর তাঁকে গ্রেফতারের সময় এবং দীর্ঘ ১৪ বছরের নির্বাসনশেষে ১৯৭৯-র পয়লা ফেব্রুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর তেহরানের বেহেশ্তে যাহ্রায় প্রদত্ত ভাষণে তাঁর মধ্যে সমভাবেই বীরত্ব ও সাহসিকতার পরিচয় ফুটে ওঠে।
তিনি শাহের ও শাহানশাহী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, আমেরিকা ও ইসরাঈলের বিরুদ্ধে, সাদ্দামের বিরুদ্ধে ও ইতিহাসের রাজা-বাদশাহ্দের সম্পর্কে আগুনঝরা শব্দ ও পরিভাষা ব্যবহার করতেন, এরপর তিনি স্নেহ-মমতামাখা শব্দাবলি ও হিতোপদেশের ভঙ্গিতে উপদেশ দিতেন। এমনকি তিনি বানী ছাদ্রকে বরখাস্তের সময় তার ভুলের কথা একই সাথে অত্যন্ত বিনয় ও দৃঢ়তা সহকারে উল্লেখ করেন।
সিদ্ধহস্ত লেখক ও সুবক্তা : হযরত ইমাম ছিলেন একই সাথে একজন অত্যন্ত সিদ্ধহস্ত লেখক ও সুবক্তা। কেবল দ্বীনী জ্ঞানগর্ভ বিষয়াদিতে লেখার ক্ষেত্রেই নয়, বরং তাঁর নিজের দায়িত্বের সাথে সংশ্লিষ্ট সরকারি দাফতরিক কাজকর্মের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় লেখাগুলোতেও তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন; এ সব লেখার ক্ষেত্রেও তিনি কারো মুসাবিদার ওপর নির্ভর করতেন না। তিনি কাউকে কোনো দায়িত্ব প্রদান করলে তার হুকুমনামা ও প্রেসিডেন্টের নিয়োগপত্র নিজের হাতেই লিখতেন। তিনি ইন্তেকালের আগে বিশ্ববাসীর উদ্দেশে, বিশেষ করে বিশ্বের মুসলিম ও মুস্তায্‘আফ্ জনগণের উদ্দেশে এবং আরো বিশেষভাবে ইরানি জাতির উদ্দেশে স্বহস্তে দ্বীনী ও রাজনৈতিক পথনির্দেশমূলক ওয়াছ¡ীয়াতনামা (অন্তিম বাণী) লিখে রেখে যান।
তিনি যখনই যা কিছু লিখতেন কদাচিৎ তাতে কাটাকাটি থাকতো। তিনি সংস্কৃতি, দর্শন, চিন্তামূলক ও রাজনৈতিক নির্বিশেষে বিভিন্ন বিষয়ে যা কিছু লিখেছেন তাতেই সহজ-সরল, গতিশীল, সুখপাঠ্য, পরিপূর্ণ অর্থজ্ঞাপক, সুস্পষ্ট, ওজস্বী, আবেগময় ও জ্ঞানপূর্ণ শব্দাবলি ও বাক্যাবলি ব্যবহার করেছেন। এর ফলে তা পাঠকদের মধ্যে বিস্ময়কর প্রভাব বিস্তার করে এবং লোকদের অন্তঃকরণে প্রবেশ করে তাদের জান-প্রাণের সাথে সংমিশ্রিত হয়ে যায়।
তিনি যে বিষয়ে লিখতেন এবং যখন কোনো লিখিত বক্তব্য বা বাণী প্রদান করতেন তখন সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ছোটখাট ও সূক্ষ্ম দিকসমূহের প্রতিও দৃষ্টি রাখতেন। তিনি তাঁর লেখায় প্রকৃত ও নিগূঢ় সত্যসমূহ তুলে ধরতেন।
পেশাদার ওয়াযেয, খতীব বা বাক্যবাগীশদের বরখেলাফে তিনি ছিলেন একজন শিক্ষক, কিন্তু তিনি যখন চরিত্রনীতি থেকে শুরু করে পাশ্চাত্য দর্শন, ইসলামি দর্শন, ফিকাহ্ বা উছূলে ফিকাহ্র যে কোনো বিষয়ে বক্তব্য রাখতেন, বা কোরআন মজীদের তাফসীর করতেন, অথবা সাধারণ মানুষ বা সরকারি কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখতেন সর্বাবস্থায়ই এমনভাবে কথা বলতেন যাতে তা সংশ্লিষ্ট সকলের পক্ষে বুঝতে পারা সম্ভব হয়।
হযরত ইমামের কথা শ্রোতাদের হৃদয়ে গেঁথে যেত এবং গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করত- লোকদের অন্তঃকরণে বিপ্লব সৃষ্টি করত। ইমামের ইন্তেকালের এত বছর পরেও এখনো তাঁর কথার প্রভাব মোটেই হ্রাস পায় নি। এখনো তাঁর বক্তৃতা ও ভাষণ রেডিও-টেলিভিশন থেকে প্রচার করা হলে অথবা রেকর্ড বা সিডি থেকে শোনা হলে মনে হয় যেন তিনি এখন কথা বলছেন এবং তা শ্রোতাকে আনন্দিত করে ও তার ওপর বিরাট প্রভাব বিস্তার করে।
ইমাম অত্যন্ত সংক্ষেপে অথচ জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য রাখতেন। অনেক সময় তিনি একই বক্তৃতায় কয়েকটি মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ও একই সাথে চারিত্রিক নীতিমালা সম্পর্কে কথা বলতেন এবং লোকদেরকে বিভিন্ন বিষয়ে দিকনির্দেশ দিতেন।
সাক্ষাৎকারীদের প্রতি আন্তরিকতা : রাষ্ট্রীয় বা জ্ঞানমূলক বিষয়ে আলোচনা বা বন্ধুসুলভ দেখাসাক্ষাতের জন্য, এমনকি চিকিৎসা বিষয়ক আলোচনার জন্য হলেও, তাঁর সাথে দেখাসাক্ষাৎ করতে আসা ও উপস্থিত ব্যক্তিদের সাথে তাঁর আচরণ ও কথাবার্তা হতো খুবই অন্তরিকতাপূর্ণ।
বন্ধুদের সাথে আজীবন সুসম্পর্ক : সহপাঠী ও জ্ঞানমূলক আলোচনার বন্ধুগণ সহ হযরত ইমাম তাঁর ছাত্রজীবনের ও যৌবন কালের বন্ধুদের সাথে পরবর্তী জীবনেও সম্পর্ক রক্ষা করেছেন এবং সব সময়ই তাঁদের খোঁজখবর নিতেন। যুগজিজ্ঞাসার জবাব নিয়ে আলোচনাকারিগণের ও ধর্মীয় স্থানসমূহ যিয়ারতের সময় একত্রে সফরকারীদের সাথেও তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। অনেকের সাথে তাঁর পারিবারিকভাবে ওঠাবসা ছিল। দ্বীনী শিক্ষাকেন্দ্রের দায়িত্ব পালন ব্যপদেশে অনেক প্রতিষ্ঠিত মনীষীর সাথেও তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ইমাম সব সময়ই বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ ও সম্পর্ক রাখতেন। হাজারো কর্মব্যস্ততা সত্ত্বেও তিনি তাঁদের খোঁজখবর নিতেন।
আধ্যাত্মিকতার পথের পথিক : হযরত ইমাম ছিলেন আধ্যাত্মিকতার পথপরিক্রমারত পথিক। তিনি কোরআন মজীদ ও আহলে বাইতের সাথে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রাখতেন এবং সম্ভব হলেই ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহ নিয়মিত যিয়ারত করতেন। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক দায়িত্ব পালন সহ হাজারো ব্যস্ততা সত্ত্বেও দো‘আ-দরূদ ছিল তাঁর নিয়মিত করণীয়। জীবনের শেষ দিকে তিনি তেলাওয়াত ও দো‘আ-দরূদে অনেক বেশি সময় দেন।
দীর্ঘ চৌদ্দ বছর নাজাফে নির্বাসিত জীবনে তিনি প্রতিদিনই হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর মাযার যিয়ারত করতেন এবং প্রতিদিনই এক পারা বা তার বেশি পরিমাণ কোরআন তেলাওয়াত করতেন। তিনি নিয়মিত তাহাজ্জুদ নামায আদায় করতেন, এমনকি ইন্তেকালের অব্যবহিত পূর্বে যে রাতে তাঁর শরীরে অস্ত্রোপচার করা হয় সে রাতেও তিনি তাহাজ্জুদ নামায আদায় করেন।
তিনি ফ্রান্স থেকে ইরানে ফিরে আসার পথে বিমানে হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য যে ভালোবাসার অশ্রুপাত করেন তা ছিল এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।
জাতীয় ও বিশ^পরিস্থিতির দূরদর্শী পর্যবেক্ষক : তিনি ছিলেন জাতীয় ও বিশ^পরিস্থিতির দূরদর্শী পর্যবেক্ষক; বিভিন্ন ঘটনায় এর দৃষ্টান্ত রয়েছে। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্ক্সবাদের আশু ধসে পড়ার বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভকে লেখা তাঁর ঐতিহাসিক পত্রে তা উল্লেখ করেছিলেন। এছাড়া তিনি আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের পরাজয় ও সাদ্দামের চপেটাঘাত খাওয়ার (অভাবিতভাবে আঘাতের সম্মুখীন হওয়ার) ব্যাপারেও ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, সাদ্দামের বন্ধুরা ও প্রভুরা তার প্রতি বিমুখ হয়ে যাবে।
তিনি ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের অনেক আগেই বলেছিলেন যে, ইরানে অদূর ভবিষ্যতে পাহ্লাভী রাজবংশের পতন ঘটবে। এর ভিত্তিতে তিনি নাজাফে থাকাকালেই ইসলামি রাষ্ট্রের রূপরেখা তৈরি করেন এবং স্বীয় শিষ্য ও অনুসারীদের ইসলামি রাষ্ট্রের পরিচালনার ব্যাপারে শিক্ষা প্রদান করেন।
এছাড়া হযরত ইমাম ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, তাঁর অবর্তমানেও ইসলামি বিপ্লব ও ইরানের ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা টিকে থাকবে- যার যথার্থতা সকলেই দেখতে পাচ্ছে।
জনমনস্তত্ত্ব পর্যবেক্ষণে দক্ষতা : তিনি ইরানি জনগণ সম্পর্কে পুরোপুরি ও যথাযথ ধারণা রাখতেন এবং তাদের ওপর আস্থা পোষণ করতেন। ইরানি জনগণও তাঁর প্রতি ভালোবাসা ও আস্থা পোষণ করত এবং তিনি সে সম্বন্ধে পুরোপুরি অবহিত ছিলেন। এ কারণেই তিনি বিশ্বগ্রাসী আমেরিকার পক্ষপুটাশ্রিত শাহের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থানের ডাক দিয়েছিলেন এবং জনগণের সাথে তাঁর বিশেষ সম্পর্কের কারণে ইসলামি বিপ্লবের বিজয় সম্ভব হয়েছিল।
দুশমনদেরকে চেনা : হযরত ইমাম ইসলামের দুশমনদেরকে সঠিকভাবে চিনতেন এবং তাদের ভবিষ্যৎ অবস্থা সম্বন্ধেও যথাযথ ধারণা রাখতেন। এ কারণেই অনকূল ও প্রতিকূল অবস্থা নির্বিশেষে তিনি দুশমনদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করতে, বিশ্বের বলদর্পী শক্তিবর্গ ও তাদের তাঁবেদারদের সাথে আপোসহীন থাকতে এবং বিশ্বের জনমনে বিরাজমান বলদর্পী শক্তিগুলোর দেবমূর্তিতুল্য অপরাজেয়তার ধারণাকে চূর্ণ করতে সক্ষম হন।
ইসলামি উম্মাহ্র ঐক্য : তিনি দেশ-জাতি, বংশ-গোত্র, দল-মত ও মাযহাব-ফির্কাহ্ নির্বিশেষে বিশ্বের সকল মুসলমানের প্রতি ঐক্যের আহ্বান জানান। এ লক্ষ্যে তিনি ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ্ উদযাপনের প্রচলন করেন।
আত্মবিশ্বাসী : হযরত ইমাম আল্লাহ্ তা‘আলার বিশেষ অনুগ্রহের ওপর আস্থার ছায়াতলে দারুণ আত্মবিশ্বাসের অধিকারী ছিলেন। ইরানি জনগণ যাতে বিজাতীয় শক্তির ও বিশ্ববলদর্পীদের ভয়ে ভীত না হয় এবং তাদের কাছে পরাভূত না হয় সে লক্ষ্যে তিনি সর্বাত্মক চেষ্টা চালান। তাঁর ভূমিকা গোটা সংগ্রামী অধ্যায়ে ইরানি জনগণের মধ্যে আস্থা, দৃঢ়তা, আশা ও সাহস সৃষ্টি করে। এ কারণেই তাদের পক্ষে খালি হাতে ষড়যন্ত্র ও ফিতনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং ইরানের ওপর সাদ্দামের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে শত্রুর বিরুদ্ধে বীরত্বব্যঞ্জকভাবে আপোসহীন প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভবপর হয়েছিল।
অনন্য জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব : হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) দীর্ঘ নির্বাসিত জীবন থেকে যেদিন (পয়লা ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯) ইরানে ফিরে আসেন এবং যেদিন তিনি এ ধরাধাম থেকে চির বিদায় গ্রহণ করলে তাঁর নামাযে জানাযা ও দাফন অনুষ্ঠিত হয় (৪ঠা জুন ১৯৮৯)- এ দু’টি দিন মানব জাতির ইতিহাসের দু’টি অতুলনীয় অবিস্মরণীয় দিন। এ উভয় দিনে ইমামের প্রেমে উদ্বেলিত জনগণ যেভাবে আক্ষরিক অর্থেই জনসমুদ্রের সৃষ্টি করেছিল মানব জাতির ইতিহাসে বিরল। অনন্য উচ্চতায় তাঁর এই জনপ্রিয়তার কথা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে তখন উচ্চকিত হয়েছিল। এমনকি তাঁর ইন্তেকালের পর তিন দশক অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও এখনো তাঁর জনপ্রিয়তা, গ্রহণযোগ্যতা ও দ্বীনী গুরুত্ব কেবল যে টিকে আছে তা নয়, বরং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে।
* * *
স্মরণীয় দিবস
১ এপ্রিল : ইরানে ইসলামি প্রজাতন্ত্র দিবস। এ দিনে ৯৮ শতাংশ জনগণের ভোটের মধ্য দিয়ে ইরান ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
২ এপ্রিল : বিশ্ব প্রকৃতি বা পরিবেশ দিবস।
৩ এপ্রিল : মহানবী (সা.)-এর নবুওয়াত ঘোষণা (মাবআছ) দিবস।
৭ এপ্রিল : বিশ্ব স্বাস্থ্য সচেতনতা দিবস।
৮ এপ্রিল : ইরাকের সাবেক বাথ সরকারের হাতে প্রখ্যাত আলেম আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ মোহাম্মদ বাকের ও তাঁর মহিয়সি বোন বিনতুল হুদার শাহাদাত দিবস।
৯ এপ্রিল : আহলে বাইতের তৃতীয় ইমাম নবীদৌহিত্র ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্মদিবস।
*পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জনে ইরানের জাতীয় দিবস।
১০ এপ্রিল : আহলে বাইতের চতুর্থ ইমাম হযরত যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর জন্মদিবস।
১৪ এপ্রিল : মরমি কবি ও দার্শনিক আত্তার নিশাবুরী স্মরণে দিবস।
* পহেলা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষ।
১৮ এপ্রিল : ইরানের সশস্ত্রবাহিনী ও সেনাবাহিনী দিবস।
২১ এপ্রিল : বিশ্ববিখ্যাত কবি শেখ সাদী স্মরণে দিবস।
২৩ এপ্রিল : বিখ্যাত কালামশাস্ত্রবিদ শেখ বাহায়ী স্মরণে দিবস।
২৩-২৭ এপ্রিল : আন্তর্জাতিক সবার জন্য শিক্ষা সপ্তাহ।
২৫ এপ্রিল : ১৯৮০ সালের এই দিনে ইরানের তাবাস মরুভূমিতে আমেরিকার কমান্ডো বাহিনী অনুপ্রবেশ করে, কিন্তু আল্লাহর অসীম কুদরতে বিমানগুলো মরুঝড়ে বিধ্বস্ত হয়।
৩০ এপ্রিল : পারস্যোপসাগর দিবস।
১ মে : আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস।
২ মে : আধুনিক বিশ্বে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের অন্যতম প্রধান তাত্ত্বিক ও বিশ্লেষক অধ্যাপক আয়াতুল্লাহ মোর্তজা মোতাহহারীর শাহাদাত দিবস। এটি ইরানে শিক্ষক দিবস হিসেবে পালিত হয়।
৫ মে : শেখ সাদুক (রহ.) স্মরণে দিবস।
৮ মে : আন্তর্জাতিক রেডক্রস ও রেডক্রিসেন্ট দিবস। ইরানে ১৯৪৯ সালের এ দিনে আজকের রেডক্রিসেন্টের ভিত্তি স্থাপন করা হয়।
১৫ মে : উম্মুল মুমিনীন হযরত খাদীজাতুল কুবরা (আ.)-এর ওফাত দিবস।
*মহাকবি ফেরদৌসি স্মরণে দিবস। আবুল কাসেম ফেরদৌসি ৩২৯ হিজরিতে ইরানের তূস নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। ইরানে ফারসি ভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়।
১৮ মে : দার্শনিক ও কবি ওমর খৈয়াম স্মরণে দিবস। হাকিম আবুল ফাতাহ ওমর বিন ইবরাহীম খৈয়াম নিশাবুরী ছিলেন পঞ্চম শতাব্দীর শেষ ও ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথম দিকের দার্শনিক, গণিতবিদ ও কবি।
২০ মে : আহলে বাইতের দ্বিতীয় ইমাম নবীদৌহিত্র ইমাম হাসান মুজতবা (আ.)-এর জন্মদিবস।
২২ মে : প্রখ্যাত দার্শনিক মোল্লা সাদরা স্মরণে দিবস।
২৫ মে : (১১ জ্যৈষ্ঠ) বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী।
২৬ মে : আহলে বাইতের প্রথম ইমাম আমীরুল মুমিনীন ইমাম আলী (আ.)-এর শাহাদাত দিবস।
৩১ মে : আন্তর্জাতিক আল-কুদ্স দিবস।
৪ জুন : ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ও ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিষ্ঠাতা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর মৃত্যুবার্ষিকী এবং আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ীর নেতৃত্ব (রাহবারি) শুরু হয়।
৫ জুন : ঈদুল ফিত্্র।
১০ জুন : ইরানে হস্তশিল্প দিবস হিসেবে পালিত হয়।
১৯ জুন : আধুনিক ইরানের প্রখ্যাত চিন্তাবিদ ড. আলী শরীয়তী ১৩১২ ফারসি সালে খোরাসান শহরে জন্মগ্রহণ করেন।
২১ জুন : ইরানের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ড. মোস্তফা চামরানের শাহাদাত দিবস।
২৬ জুন : আন্তর্জাতিক মাদক নিয়ন্ত্রণ ও মাদক চোরাচালান প্রতিরোধ দিবস।
২৮ জুন : আয়াতুল্লাহ বেহেশতীসহ ইসলামি বিপ্লবের নেতৃস্থানীয় আরো ৭২ ব্যক্তির শাহাদাত দিবস। বিপ্লববিরোধী মুজাহেদীনে খাল্ক কর্তৃক বোমা হামলায় তাঁরা শহীদ হন।
২৯ জুন : আহলে বাইতের ষষ্ঠ ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-এর শাহাদাত দিবস।
বরকতময় মাসসমূহ ও মহানবীর পরিবার
মো. আশিফুর রহমান –
রজব, শাবান ও রমযান- এ তিনটি মাস এমন বরকতময় ও ফযিলতের মাস যে সম্পর্কে হাদিসে অনেক বর্ণনা এসেছে। হাদিসে রজব মাসকে ‘আল্লাহর মাস’, শাবান মাসকে ‘মহানবীর মাস’ ও রমযান মাসকে ‘উম্মতের মাস’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ তিনটি মাস মহানবী (সা.)-এর আহলে বাইতের সাথেও সম্পৃক্ত, কেননা, এ মাসগুলোতে মহানবীর পরিবারের বেশ কিছু সংখ্যক সদস্য জন্মগ্রহণ করেন। সেসব মহান ব্যক্তির মধ্য হতে কয়েকজন সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা উপস্থাপন করা হলো।
ইমাম হাসান (আ.)
ইমাম হাসান (আ.) তৃতীয় হিজরির ১৫ রমজানে পবিত্র নগরী মদিনাতে জন্মগ্রহণ করেন। ইমাম আলী (আ.) ও হযরত ফাতিমা যাহরা (সা. আ.)-এর প্রথম সন্তান। ইমাম হাসান (আ.)-এর উপনাম হচ্ছে ‘আবু মুহাম্মাদ’। ইমাম হাসান (আ.)-এর উপাধিগুলো হলো ত্যাইয়েব, ত্বাকী, সিবত, জাকী, সাইয়্যেদ, ওলী ও মুজতাবা।
ইমাম হাসান (আ.) দেখতে হুবহু মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর মতো ছিলেন এবং তাঁর সুন্দর ও অপরূপ চেহারা দেখে জনগণের হৃদয় শান্ত হতো এবং তাঁরা সকলেই মহানবীর কথা স্মরণ করতেন।আনাস বিন মালেক বলেন :‘হাসান ইবনে আলী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর সবচেয়ে বেশি সদৃশ ছিলেন।’- কাশফুল গুম্মাহ ফি মা’রেফাতিল আইম্মাহ, ১ম খ-, পৃ. ৫২২
খুব ছোটবেলা থেকে হাসান ইবনে আলী (আ.) মহানবী (সা.)-এর মজলিশে অংশগ্রহণ করতেন এবং ওহীর বিষয়বস্তুসমূহ মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করতেন এবং সেগুলো মুখস্থ করতেন। পরে তাঁর মায়ের নিকট এসে সেগুলো বর্ণনা করতেন। যখন হযরত আলী (আ.) ঘরে ফিরতেন, তখন দেখতেন যে, মসজিদে মহানবী (সা.) যে বিষয়গুলো বলেছেন সে সম্পর্কে হযরত ফাতিমা (সা. আ.) অবগত রয়েছেন এবং সকল খুঁটিনাটি বিষয় জানতেন; আলী (আ.) তাঁর নিকট জিজ্ঞাসা করতেন : ‘এগুলো তুমি কীভাবে জেনেছ?’ ফাতিমা (সা. আ.) উত্তরে বলতেন : ‘আপনার সন্তান হাসানের মাধ্যমে আমি অবগত হয়েছি।’
পবিত্র কুরআনের সাথে ইমাম হাসানের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। বিশেষ করে সূরা কাহ্ফের প্রতি তাঁর অন্যরকম আকর্ষণ ছিল। যাহাবী হতে বর্ণিত হয়েছে, ইমাম হাসান (আ.) ঘুমানোর জন্য যখনই বিছানায় যেতেন, তখনই সূরা কাহ্ফতিলাওয়াত করতেন।- ইহকাকুল হাক্ক, ১১ নং খ-, (মালহাক্কাত) পৃ. ১১৪, সিরা আয়লামুল নাবলায় গ্রন্থ হতে।
হযরত ইমাম হাসান ইবনে আলী (আ.) একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ তাআলার ইবাদত করতেন।
ইমাম হাসান যখনই আজানের ধ্বনি শুনতেন, তখনই তাঁর চেহারা পরিবর্তন হয়ে যেত এবং তাঁর রং হলুদ বর্ণ হয়ে যেত। এ বিশেষ পরিবর্তনের বিষয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন : ‘নিঃসন্দেহে মহান আল্লাহ তাঁর বার্তা বাহককে আমার নিকট প্রেরণ করেন এবং আমাকে তাঁর বিশেষ সেবার (নামাযের) জন্য আহ্বান জানান। আমি জানি না, মহান আল্লাহ এ সেবাকে (নামায) গ্রহণ করবেন, কি করবেন না। তাহলে কেন আমার চেহারার রং পরিবর্তন হবে না?’- সারহে রিসালাতুল হুকুক, ইমাম যাইনুল আবেদীন (আ.), কাবাঞ্চি রচিত, ২য় খ-, পৃ. ৮৪
ওযূ করার সময়ও ইমাম হাসানের চেহারার রং পরিবর্তন হয়ে যেত। এ বিষয়ে তিনি বলতেন : ‘‘আরশের মালিক আল্লাহর নিকট যে ব্যক্তি প্রবেশের সিদ্ধান্ত নেয়, তার চেহারার রং পরিবর্তন হওয়াই উত্তম।’- ইদ্দাতুদ দায়ী, ইবনে ফাহাদ হিল্লী, পৃ. ১৩৯
ইমাম হাসানের ইবাদতসমূহের অন্যতম হচ্ছে আল্লাহর ঘর যিয়ারত ও হজ পালন। রেওয়ায়েত অনুযায়ী ইমাম হাসান পঁচিশ বার পায়ে হেঁটে আল্লাহর ঘর (ক্বাবা শরিফ) যিয়ারত করেছেন।
ইমাম হাসান (আ.) ছিলেন অত্যধিক দানশীল, তিনি অভাবীদেরকে কখনই খালি হাতে ফিরিয়ে দিতেন না। কোন ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি তাঁর শরণাপন্ন হলে তিনি সেই ঋণ শোধ করে দিতেন, তিনি অসুস্থদেরকে দেখতে যেতেন, উত্তম কাজের প্রতিদান হিসেবে দাস মুক্ত করে দিতেন। তাঁর বিরোধীদের প্রতিও তিনি দয়া প্রদর্শন করতেন। তাদের অত্যাচারের মোকাবেলায় ধৈর্য ধারণ করতেন ও তাদের জন্য মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতেন। তিনি সৎকর্মশীলদের কর্মের প্রশংসা করতেন।
ইমাম হাসান (আ.) একজন সাহসী ও বীর যোদ্ধা ছিলেন। ইমাম আলী (আ.)-এর খেলাফতকালে জঙ্গে জামালে তাঁর সাহসিকতা ও বীরত্বের কারণেই যুদ্ধ দ্রুত শেষ হয়ে যায়; তিনি জঙ্গে সিফফিন ও জঙ্গে নাহরাওয়ানেও সাহসিকতা ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন।
নিজ খেলাফতকালে ইমাম হাসান (আ.) নানা সমস্যার মোকাবিলা করেন। আমীরে মুয়াবিয়া তাঁর খেলাফত মেনে নিতে অস্বীকার করে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হলে ইমাম হাসানও যুদ্ধের জন্য বের হন। কিন্তু নিজ সেনাপতি ও সৈন্যদের বিশ^াসঘাতকতা ও মুয়াবিয়ার চক্রান্তের ফলে তিনি তার সাথে সন্ধি করেন। সন্ধি চুক্তি করার মাধ্যমে ইমাম হাসান (আ.) সামাজিক ও রাজনৈতিক সফলতা অর্জন করেছেন। এ সন্ধির মাধ্যমে তিনি মুসলমানদেরকে নিশ্চিহ্ন হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেন। অপরদিকে মুয়াবিয়ার প্রকৃত রূপ সকলের নিকট স্পষ্ট হয়ে যায়।
ইমাম হাসান (আ.)-এর মাযার মদিনার জান্নাতুল বাকীতে অবস্থিত।
ইমাম হোসাইন (আ.)
ইমাম হোসাইন (আ.) ৪র্থ হিজরির ৩ শাবান পবিত্র মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন। মহানবী (সা.)-এর মুখম-লের সাথে ইমাম হাসানের মুখম-ল এবং তাঁর দৈহিক গঠনের সাথে ইমাম হোসাইনের দৈহিক গঠনের সাদৃশ্য ছিল। এজন্য হযরত আলী বলেছেন :‘কেউ যদি মহানবীকে দেখে খুশি হতে চায় তাহলে তার উচিত হাসান ও হোসাইনকে দেখা। কারণ, মহানবীর সাথে এ দু’জনেরই সবচেয়ে বেশি দৈহিক ও আকৃতিগত সাদৃশ্য রয়েছে।’
ইমাম হোসাইনের উপনাম ছিল আবু আবদিল্লাহ। মহানবী তাঁকে ‘বেহেশতের যুবকদের নেতা’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।
ইমাম হোসাইন (আ.) বাল্যকালেই ইসলামি কর্মকা-ে আত্মনিয়োগ এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি তাঁর পিতা ইমাম আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)-এর সাথে তিনটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।যখন তাঁর ভাই ইমাম হাসান (আ.) ইমাম হন তখন তিনি সর্বাবস্থায় তাঁকে মান্য করেন ও তাঁর অনুসরণ করেন। ইমাম হাসানের শাহাদাতের পর তাঁর ভূমিকা একটি নতুন পর্যায়ে উপনীত হয়।
ইমাম হাসান কর্তৃক মুয়াবিয়ার সাথে কৃত সন্ধির শর্ত মোতাবেক ইমাম হোসাইন (আ.) মুয়াবিয়ার শাসনামলে তার বিরোধিতা করেন নি। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বেই মুয়াবিয়া তার ফাসেক পুত্র ইয়াযীদকে খলিফা হিসেবে ঘোষণা ও তার পক্ষে বাইআত দাবি করলে ইমাম হোসাইন তা অস্বীকার করেন। ইয়াযীদ খলিফা হওয়ার পর প্রকাশ্যে ইসলামবিরোধী কর্মকা- অব্যাহত রাখলে এবং ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আনুগত্য দাবি করলে ইমাম হোসাইন (আ.) তাঁর আন্দোলন শুরু করেন। আন্দোলনের এক পর্যায়ে কুফাবাসীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি কুফার দিকে যাত্রা করেন। পথিমধ্যে ইয়াযীদের বাহিনী কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হয়ে কারবালায় উপনীত হন। অবশেষে ইসলামকে পুনরুজ্জীবিত করতে ৬১ হিজরির ১০ মুহররম কারবালায় একটি অসম যুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবংপরিবার-পরিজন ও বন্ধু-বান্ধবসহ তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেন।
ইমাম হোসাইন (আ.) ছিলেন সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার অবিসংবাদিত নেতা। তিনি ছিলেন মহানুভবতার প্রতীক- অন্যের দুঃখ-কষ্ট লাঘবে নিবেদিতপ্রাণ। যিনি মানুষের সাথে কোমল আচরণ করতেন, আত্মীয়দের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন, দুর্বলদেরকে সহায়তা করতেন, ঋণগ্রস্তদের ঋণ মওকুফ করে দিতেন। যিনি ছিলেন অভাবীদের প্রতি দয়ালু ও ইয়াতীমদের প্রতি সচেতন। সর্বোপরি ইমাম হোসাইন (আ.) ছিলেন ধৈর্য, অবিচলতা, সাহসিকতা ও বীরত্বের অতুলনীয় দৃষ্টান্ত।
হযরত যায়নাব বিনতে আলী (আ.)
হযরত যায়নাব (আ.) ৫ম (মতান্তরে ৬ষ্ঠ) হিজরির ৫ শাবান পবিত্র মদিনা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন হযরত আলী (আ.) ও হযরত ফাতিমা (আ.)-এর তৃতীয় সন্তান। মহানবী (সা.) তাঁর নাম রাখলেন ‘যায়নাব’ যার অর্থ হলো ‘পিতার সৌন্দর্য’। হযরত যায়নাব (আ.)-এর প্রসিদ্ধ উপাধিগুলো আলেমাহ গায়রু মুয়াল্লিমাহ, ফাদ্বিলাহ, কামিলাহ ইত্যাদি।
হযরত যায়নাবের শৈশবকাল মহানবী (সা.), হযরত আলী, হযরত ফাতেমা ও তাঁর দুই ভাইয়ের সান্নিধ্যে অতিবাহিত হয়। মাত্র ছয় বছর বয়সে হযরত যায়নাব তাঁর নানা ও পরম মমতাময়ী মাতাকে হারান। এরপর হযরত আলী তাঁকে সযতেœ প্রতিপালন করেন। হযরত যায়নাব (আ.) রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের সদস্যদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পুণ্যময় জীবন যাপন, ইবাদতে নিষ্ঠা, সাহসী ও নির্ভীকচিত্ত হওয়া, অত্যাচারের মোকাবেলা, ধৈর্যধারণ ইত্যাদি শিক্ষা লাভ করেন নিজ পরিবার হতে। খুব অল্প বয়সেই হযরত যায়নাব (আ.) বিভিন্ন বিষয়ে পা-িত্য অর্জন করেন।
হযরত যায়নাব (আ.) মদীনায় তাঁর গৃহে নিয়মিত ধর্মীয় ক্লাস চালু করেন। যখন তিনি তাঁর পিতার সাথে কুফায় চলে যান তখন সেখানেও তিনি একইভাবে ধর্মীয় ক্লাস চালু করেন।
হযরত যায়নাব ছিলেন একজন দানশীলা নারী। হযরত যায়নাবের কাছে যখনই কেউ কোন কিছু চেয়েছে সে খালি হাতে ফেরে নি। এমনই ছিল হযরত যায়নাবের দানশীলতা।
হযরত যায়নাব ছিলেন ইবাদতে একনিষ্ঠ। তিনি ইবাদতের এই একাগ্রতা শিক্ষা লাভ করেছিলেন তাঁর মা হযরত ফাতিমাতুয যাহরা (আ.)-এর কাছ থেকে। ধৈর্যশীলতা তাঁর রক্তে মিশে ছিল। নানা মহানবী (সা.), মা হযরত ফাতিমা যাহরা, পিতা ইমাম আলী, বড় ভাই ইমাম হাসানের মৃত্যু তিনি কাছে থেকে দেখেছেন। আর তিনি ছিলেন সেই মহীয়সী নারী যিনি তাঁর শহীদ ভাইদের, সন্তানদের ও পরিবারের অন্য সদস্যদের শরীর কারবালার ময়দানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতে দেখেও বলেন, ‘আমি সৌন্দর্য ছাড়া আর কিছুই দেখি না।’
হযরতযায়নাব একজন সুবক্তা ছিলেন; একই সাথে তিনি প্রভূত মানসিক শক্তির অধিকারী ও সাহসী ছিলেন। তিনি অত্যাচারীদের ভয়ে কখনই ভীত হন নি। কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার পর কুফায় উবাযদুল্লাহ ইবনে যিয়াদের দরবারে ও শামে ইয়াযীদের প্রাসাদে হযরত যায়নাব অতুলনীয় সাহসিকতা প্রদর্শন করেন।
হযরত যায়নাব (আ.) মহানবীর আহলে বাইতকে মানুষের সামনে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। তিনি মুসলমানদের সামনে বনু উমাইয়্যার মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছিলেন। তিনিই সকলের সামনে তুলে ধরেন যে, কারবালার ঘটনা কোন ক্ষমতা দখলের লড়াই ছিল না। এটি ছিল ইসলামের প্রতিরক্ষার সংগ্রাম, মানুষের স্বাধীনতা ও মর্যাদার নীতিকে সমুন্নত করার জন্য একটি বীরত্বগাথা, সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের নমুনা।
হযরত যায়নাব ৬২ হিজরিতে ৫৭ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর মাযার বর্তমান সিরিয়ায় যায়নাবিয়াতে অবস্থিত।
ইমাম আলী ইবনুল হুসাইন যায়নুল আবেদীন (আ.)
ইমাম আলী ইবনুল হুসাইন (আ.) ৩৮ হিজরির ৫ শাবান পবিত্র মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন। হযরত আলী (আ.)এই নবজাতকের নাম রাখেন ‘আলী’। ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর কুনিয়াত বা ডাক নাম হলো আবু মুহাম্মাদ।
ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) শৈশবের প্রথম কয়েক বছর অতিবাহিত করেন পিতামহ আলী ইবনে আবু তালিবের ¯েœহক্রোড়ে এবং পরবর্তীকালে চাচা ইমাম হাসান ও পিতা ইমাম হুসাইনের কাছে লালিত-পালিত হন। তাঁদের কাছ থেকেই তিনি লাভ করেন ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা।
কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার সময় ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) সেখানে উপস্থিত ছিলেন। অসুস্থতার কারণে তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। সেই কারণে নিহতহওয়া থেকে রেহাই পান।কারবালার ঘটনার পর ইয়াযীদের বর্বর বাহিনীর হাতে ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) বন্দি হন। নারীদের সাথে তাঁকেও বন্দি করে দামেশকে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে ইয়াযীদের রাজপ্রাসাদে হযরত যায়নাব (আ.) ও হযরত যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর ভাষণের প্রতিক্রিয়ায় জনমত বিগড়ে যাবার ভয়ে ইয়াযীদ তাঁদেরকে মদিনায় পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হয়।
মদিনায় ফিরেও ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) চরম নির্যাতনের মধ্যে দিন অতিবাহিত করেন। তাঁর চলাফেরার ওপর আরোপ করা হয় কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং কোন ব্যক্তির সাথে তাঁর সাক্ষাৎ স¤পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। ইমাম যায়নুল আবেদীনকে তাঁদের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন : ‘আমাদের অবস্থা ফিরআউন বংশীয়দের মাঝে বনু ইসরাইলের ন্যায়- তারা তাদের শিশুদেরকে হত্যা করত এবং তাদের নারীদেরকে ছেড়ে দিত।’
মুসলিম লেখকগণ প্রতিভা, জ্ঞান এবং ধার্মিকতার জন্য ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
ইবনে হাজার আসকালানী তাঁর ‘সাওয়ায়েকে মুহরিকাহ’ গ্রন্থে বলেন : ‘যায়নুল আবেদীন হলেন এমন ব্যক্তি যিনি তাঁর পিতার জ্ঞান, দুনিয়াবিমুখতা ও ইবাদত উত্তরাধিকার হিসাবে পেয়েছিলেন।’
ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) তাঁর পিতার শাহাদাতের পর প্রায় ৩৪ বছর পর্যন্ত জীবিত ছিলেন এবং সমগ্র জীবনকাল নিবেদিতচিত্তে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি ও শহীদ পিতার স্মরণের মধ্যে অতিবাহিত করেন। তিনি অধিক পরিমাণ সময় নামায পড়তেন ও সেজদারত থাকতেন বিধায় ‘সাজ্জাদ’ হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন।
ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর দানশীলতা ছিল অসাধারণ। তিনি রাতের বেলা ঘুরে ঘুরে গরীর-দুঃখীদের খোঁজ-খবর নিতেন এবং নিজের পিঠে করে আটার বস্তা ও অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী নিয়ে তাদেরকে সাহায্য করতেন। তিনি নিজের শত্রুদেরও প্রয়োজনের মুহূর্তে সাহায্য করতে দ্বিধাবোধ করতেন না; শত্রুদের সদুপদেশ দানে কখনো বিরত হতেন না।
ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর ওপর অধিক কঠোরতা আরোপ করা হলে তিনি বনু উমাইয়্যার বিরুদ্ধে আন্দোলনের বিকল্প পন্থা বেছে নিয়েছিলেন। আর সেটা হলো আল্লাহর কাছে নিবেদন পেশ করার জন্য মোনাজাত করা। ‘আস-সাহীফা আল-কামিলাহ’ বা ‘আস-সাহীফা আস-সাজ্জাদীয়া’ বলে খ্যাত তাঁর মোনাজাতের এসব মূল্যবান সংগ্রহ ‘আলে মুহাম্মাদের যাবুর’ বলেও পরিচিত। ‘আস-সহীফা আস-সাজ্জাদীয়া’ গ্রন্থে ৫৭টি দোয়া রয়েছে। এসব দোয়ার মধ্যে রয়েছে মহান আল্লাহর প্রশংসা, মহানবী (সা.) ও তাঁর পরিবারবর্গের ওপর দরুদ, ফেরেশতাদের প্রতি দরুদ, নবিগণের অনুসারীদের জন্য আল্লাহর অনুগ্রহ চাওয়া, আল্লাহ তাআলার কাছে আশ্রয় চাওয়া, অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা, শত্রুদের শত্রুতাকে প্রতিহত করার দোয়া ইত্যাদি। এসব মোনাজাতের মাধ্যমে ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) মুসলমান ও বিশ্ববাসীর জন্য প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন।
ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর অন্যতম প্রসিদ্ধ গ্রন্থের নাম হলো ‘রিসালাতুল হুকুক’ (অধিকার পত্র)। এটি অধিকার সংক্রান্ত একটি গ্রন্থ। এই গ্রন্থে মহান আল্লাহর অধিকার, নিজের প্রতি অধিকার, নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অধিকার, আত্মীয়-স্বজনের অধিকার, প্রতিবেশীর প্রতি অধিকার এভাবে ৫০টি অধিকারের প্রসঙ্গ বর্ণিত হয়েছে।
হযরত আব্বাস ইবনে আলী (আ.)
ইমাম আলী (আ.)-এর পুত্র ও ‘বনি হাশিমের চাঁদ’ নামে পরিচিত হযরত আব্বাস ইবনে আলী ২৬ হিজরির ৪ শাবান পবিত্র মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল ফাতিমা বিনতে হিযাম, যিনি ‘উম্মুল বানীন’ নামে ইতিহাসে প্রসিদ্ধ। উম্মুল বানীন পবিত্র আহলে বাইতের জন্য উৎসর্গকৃত প্রাণ ছিলেন, অন্যদিকে আহলে বাইতও এই মহিয়সী নারীকে অত্যন্ত উচ্চতর মর্যাদার অধিকারী বলে মনে করতেন।
ইমাম আলী (আ.)তাঁর নাম রাখেন আব্বাস। এর অর্থ সাহসী ও বীর। হযরত আব্বাস ‘আবুল ফযল’ নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তিনি ‘আব্বাস আলমদার’ বা আব্বাস পতাকাবাহী নামেও প্রসিদ্ধ। কেননা, তিনি কারবালার ময়দানে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সেনাদলের পতাকা বহন করেছিলেন। তিনি ছিলেন ইমাম হোসাইনের একনিষ্ঠ অনুসারীদের অন্যতম।
ইমাম আলী (আ.) তাঁর এ পুত্র সম্পর্কে বলেন : ‘আমার সন্তান আব্বাস শিশু থাকা অবস্থায়ই জ্ঞান রপ্ত করত। কবুতরের ছানা যেভাবে মায়ের কাছ থেকে পানি ও খাদ্য নেয়, তেমনি আব্বাসও আমার কাছ থেকে জ্ঞান রপ্ত করত।’
স্বয়ং হযরত আলী (আ.) নিজের শাহাদাতের সময় প্রিয় পুত্র আব্বাসকে কাছে ডেকে এনে তাঁকে নিজের বুকের মধ্যে টেনে নেন এবং তাঁর মর্যাদা প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘শিগগিরই কিয়ামত বা পুনরুত্থানের দিনে আমার চোখ তোমার মাধ্যমে উজ্জ্বল হবে।’
হযরত আব্বাস যেমন সুদর্শন ছিলেন তেমনি ছিলেন সাহসিকতা, বীরত্ব, শক্তিমত্তা ও যোদ্ধা হিসেবে ক্ষিপ্রতার অধিকারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ইবনে মানযার তাঁর ‘আল-আয়ানে বর্ণনা করেন যে, আব্বাস ছিলেন সিংহ যাকে অন্যান্য সিংহ ভয় পায়- যা যোদ্ধা হিসেবে তাঁর পরিচিতি তুলে ধরে।
আব্বাস তাঁর পিতার সাথে সিফফিন যুদ্ধে প্রথম যোদ্ধা হিসেবে যোগদান করেন। তিনি এই যুদ্ধে তাঁর পিতার পোশাক পরিধান করে যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হন। তিনি এই যুদ্ধে অনেক শত্রুসেনাকে হত্যা করেন। মুয়াবিয়ার সৈন্যরা তাঁকেই হযরত আলী মনে করে ভুলে নিপতিত হয়। পরে যখন ইমাম আলী স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন তখন মুয়াবিয়ার সৈন্যরা অপর সৈন্য সম্পর্কে আশ্চর্যান্বিত হয়ে যায়। ইমাম আলী তাঁর পরিচয় শত্রুসেনাদের সামনে তুলে ধরে বলেন : ‘ সে হলো আব্বাস, বনি হাশিমের চাঁদ।’
কারবালায় হযরত আব্বাস ইমাম হোসাইনের প্রতি আনুগত্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন। ইয়াযীদ খলিফা হয়ে ইমাম হোসাইনের আনুগত্য দাবি করে। ইমাম হোসাইন একজন পাপিষ্ঠের আনুগত্য করতে অস্বীকার করেন। ইমাম হোসাইন মদিনা থেকে মক্কা, মক্কা থেকে কুফা যাবার পথে ইয়াযীদের সেনাবাহিনী কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হয়ে কারবালায় উপনীত হন। সেখানে তাঁকে তাঁর সঙ্গী-সাথিসহ অবরোধ করা হয়। অবশেষে ১০ মুহররম ইমাম হোসাইন এক অসম যুদ্ধে অবতীর্ণ হন।
ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি ও পতাকাবাহক হওয়া সত্ত্বেও ইমাম হোসাইন (আ.) হযরত আব্বাসকে তাঁর পরিবারের তৃষ্ণার্ত শিশুদের জন্য পানি আনার দায়িত্ব দেন। ফোরাতের কূল ইয়াযীদের সেনাবাহিনী অবরোধ করে রেখেছিল এবং তারা ইমাম হোসাইনের লোকদেরকে পানি আনতে বাধা দিচ্ছিল। হযরত আব্বাস একমাত্র ব্যক্তি যাঁকে ইমাম হোসাইন যুদ্ধে প্রেরণ করেন নি; বরং তাঁকে পানি আনতে পাঠিয়েছিলেন।
হযরত আব্বাস একাকী বীরত্বের সাথে ইয়াযীদের বাহিনীকে সরিয়ে দিয়ে ফোরাতের পানিতে নেমে যান এবং এক মশক পানি ভর্তি করেন। যখন তিনি ফোরাতে নেমে মশকে পানি ভর্তি করছিলেন, তখনও তিনি ইমাম হোসাইনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। যদিও তিনি নিজেও খুব তৃষ্ণার্ত ছিলেন, কিন্তু তারপরও ইমাম হোসাইন ও তাঁর পরিবারের শিশুদের তৃষ্ণার্ত অবস্থা স্মরণ করে তিনি পানি পান করেন নি। ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে যে, কীভাবে তিনি ফোরাত অধিকার করেছিলেন, তারপরও পানি পান করেন নি। আব্বাসের সাথে ছিল একটি বর্শা এবং পানিভর্তি একটি মশক। অপরদিকে তাঁকে পতাকা বহনের দায়িত্বও দেয়া হয়েছিল। পানিভর্তি মশক নিয়ে তাঁবুতে ফেরার পথে তাঁকে পিছন থেকে আঘাত করা হয়। তাঁর একটি হাত কেটে পড়ে যায়। পরে পিছন থেকে আরেকটি আঘাতে তাঁর অপর হাত কেটে ফেলা হয়। আব্বাস তাঁর দাঁতে চেপে মশক আনতে থাকেন। ইয়াযীদের সেনারা হযরত আব্বাসের চেহারা ও মশকে তীর নিক্ষেপ করতে থাকে। মশক ফেটে পানি পড়ে যায়। একটি তীর এসে আব্বাসের চোখে বিঁধে। একজন সেনা আব্বাসের মাথায় আঘাত করে। আব্বাস মাটিতে পড়ে যান। এরপর তীর ও বর্শা নিক্ষেপ করে হযরত আব্বাসকে শহীদ করা হয়। হযরত আব্বাসের মাযার কারবালায় ফোরাতের তীরে অবস্থিত।
হযরত আব্বাসের পাঁচ জন ছেলে ও দুই জন মেয়ে ছিল।
এই মহামানবের জন্মদিন ইসলামি ইরানে ‘রুযই জানবজান’ বা যুদ্ধাহতদের দিবস হিসেবে পালিত হয়।
হযরত আলী আকবর (আ.)
আলী আকবর (আ.) ৩৩ হিজরির ১১ শাবান পবিত্র মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল লায়লা বিনতে আবি মুররা।আলী আকবরইমাম হোসাইন (আ.)-এর জ্যেষ্ঠ সন্তান ছিলেন। অবশ্য কেউ কেউ বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বয়সে আলী ইবনু হোসাইন যায়নুল আবেদীন (আ.) অপেক্ষা ছোট ছিলেন।
বর্ণিত হয়েছে যে, চেহারা ও ব্যক্তিত্বের দিক থেকে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর হযরত আলী আকবরেরসাদৃশ্য ছিল। আলী আকবর কারবালার ময়দানে সাহসিকতা ও আত্মত্যাগের মহান নজির স্থাপন করেন এবং ইয়াযীদের বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে শাহাদাত বরণ করেন। ইতিহাসবিদদের মতে, আশুরার দিনে তিনি ছিলেন রাসূলের বংশধারা বনু হাশিমের প্রথম শহীদ। তাঁকে কারবালায় তাঁর পিতার কবরের পাশে সমাহিত করা হয়।
যাঁরা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মহান পিতা ইমাম আলী (আ.)-এর নাম পৃথিবীর বুক থেকে মুছে দিতে চেয়েছিল তাদের বিপরীত পদক্ষেপ হিসেবে ইমাম হোসাইন (আ.) তাঁর এ সন্তানের নাম রেখেছিলেন আলী। শুধু তাই নয়, ইমাম হোসাইন (আ.) তাঁর প্রত্যেক সন্তানের নাম রেখেছিলেন ‘আলী’। হযরত আলী আকবরের উপনাম ছিল ‘আবুল হাসান’।- আবুল ফারাজ ইসফাহানি, মাকতালুত তালিবিয়্যীন, পৃ. ৮৬।
হযরত আলী আকবরের চেহারা ছিল সম্ভ্রান্ত এবং তা চাঁদের মতো উজ্জ্বল ছিল। তিনি সৌন্দর্য ও পরিচ্ছন্নতার কারণে সম্মানিত ছিলেন। তাঁর শরীরের রং ছিল গোলাপি-সাদা। তার চোখ ছিল কালো এবং দীর্ঘ ভ্রুবিশিষ্ট। তিনি বিস্তৃত কাঁধবিশিষ্ট মধ্যম গড়নের শরীরের অধিকারী ছিলেন।উচ্চতায়ও তিনি মধ্যম ধরনের ছিলেন।-মাহাল্লাতী, ফারসান আল হাইযা, পৃ. ৪০৯-৪১০
তিনি এমনভাবে হাঁটতেন যেন মনে হতো তিনি কোন উঁচু জায়গা থেকে নেমে আসছেন। যখন কারো দিকে ফিরতেন তখন পুরো শরীরকে ফেরাতেন। তিনি অধিকাংশ সময় নিচের দিকে দৃষ্টিপাত করে থাকতেন। তাঁর দেহ থেকে মেশকের গন্ধ পাওয়া যেত।
ইমাম হোসাইন তাঁকে লোকদের মধ্যে সৃষ্টি ও আচরণগত বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে মহানবী (সা.)-এর সাথে সবচেয়ে সাদৃশ্যপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন।- খারেজমী, মাকতালুল হুসাইন, ২য় খ-, পৃ. ৩৪
ইমাম হোসাইন (আ.) বলতেন : ‘হে আল্লাহ! যখন আমরা তোমার নবীকে দেখতে পছন্দ করতাম তখন আমরা তার (আলী আকবার) দিকে তাকাতাম।’- ইবনে তাউস, আল লুহূফ, পৃ. ১৩৯; খারেজমী, মাকতালুল হুসাইন, ২য় খ-, পৃ. ৩৫
হযরত আলী আকবর (আ.) সত্যপথের নির্ভীক সৈনিক ছিলেন। পাপিষ্ঠ ইয়াযীদ ক্ষমতা হাতে পেয়েই ইমাম হোসাইন (আ.)-এর নিকট থেকে আনুগত্য দাবি করে। ইমাম হোসাইন তাঁর মহান সংগ্রাম শুরু করেন। তিনি মক্কার উদ্দেশে মদিনা থেকে বের হয়ে পড়েন। হযরত আলী আকবর তাঁর পিতার সাথে যাত্রা শুরু করেন।
ইমাম হোসাইন তাঁর যাত্রাপথে একটি স্থানে যাত্রাবিরতি করেন। সেখানে একটি স্বপ্ন দেখে তাঁর ঘুম ভেঙে যায় এবং তিনি ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন’ পড়েন। আলী আকবার তাঁকে এর কারণ জানতে চাইতে তিনি বলেন, তিনি একটি স্বপ্ন দেখেছেন যে, এই কাফেলা এগিয়ে যাচ্ছে আর মৃত্যু এ কাফেলাকে অনুসরণ করছে। তখন আলী আকবর ইমাম হোসাইনকে প্রশ্ন করেন : ‘আমরা কি সত্যপথে নই?’ ইমাম হোসাইন ইতিবাচক জবাব দিলে তিনি বলেন : ‘ হে পিতা! যখন আমরা সত্যপথে রয়েছি, তখন আমরা মৃত্যুকে ভয় পাই না।’- মুফিদ আল ইরশাদ, ২য় খ-, পৃ. ৮২। ইমাম হোসাইন আলী আকবরের জন্য দোয়া করেন : ‘আল্লাহ যেন তোমাকে সর্বোচ্চ পুরস্কার প্রদান করেন যা একজন সন্তান তার পিতার নিকট থেকে পেতে পারে।’- আবু মিখনাফ, ওয়াকাত আল তাফ, পৃ. ২৭৬; তাবারী, তারিখুল উমাম ওয়াল মুলূক, ৩য় খ-, পৃ. ৩০৯
আশুরার দিনে আলী আকবর যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে শত্রুপক্ষের একজন তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলে : ‘হে আলী! তুমি তো আমীরুল মুমিনীন (ইয়াযীদ)-এর আত্মীয়, আর আমরা একে মূল্যায়ন করতে চাই, তুমি চাইলে আমরা তোমাকে নিরাপত্তা দেব।’ আলী আকবার প্রত্যুত্তরে বলেন : ‘মহানবী (সা.)-এর সাথে আত্মীয়তার সম্পর্কই মূল্যায়িত হওয়ার জন্য অধিক গুরুত্বপূর্ণ।’
আলী আকবার আশুরার দিনে বনু হাশিমের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে শাহাদাত বরণ করেন- যা যিয়ারাতে শুহাদা’য় উল্লেখ করা হয়েছে : ‘আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক, সর্বোত্তম বংশধারার মধ্য থেকে যিনি প্রথম নিহত হয়েছেন।’
হযরত আলী আকবারের জন্মদিনটিকে ইরানে ‘যুবদিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।
ইমাম মাহদী (আ.)
ইমাম মাহদী (আ.)-এর আবির্ভাব সম্বন্ধে শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে সকলেই একমত। এ সংক্রান্ত হাদীস ও বর্ণনাগুলো তাওয়াতুরের (অকাট্য) পর্যায়ে পৌঁছেছে। আল ইমামুল মাহদী গ্রন্থের লেখক আলী মুহাম্মদ আলী দাখিল ৫০ জন সাহাবী ও ৫০ জন তাবেয়ীর নাম উল্লেখ করেছেন যাঁরা ইমাম মাহদী স¤পর্কে হাদীস লিপিবদ্ধ করেছেন। এ সংক্রান্ত ৬০০০ হাদীসের কথা তিনি বলেছেন।
ইমাম মাহদী (আ.)-এর জন্মগ্রহণের বিষয়ে মতভেদ লক্ষ্য করা যায়। আহলে সুন্নাত ওয়ালা জামায়াতের অধিকাংশ আলেমের মতে ইমাম মাহদী (আ.) কিয়ামতের আগে জন্মগ্রহণ করবেন। অন্যদিকে আহলে বাইতের মাযহাবের অনুসারী আলেমগণের মতে, ইমাম মাহদী ২৫৫ হিজরীর ১৫ শাবান শুক্রবার ফজরের ওয়াক্তের আগে ইরাকের সার্মারা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন।ইমাম মাহদী (আ.)-এর পিতা হলেন আহলে বাইতের একাদশ ইমাম হাসান আল আসকারী (আ.)। তাঁর মায়ের নাম নারজীস।
ইমাম মাহদী (আ.)-এর কুনিয়াত আবুল কাসেম। তাঁর অনেক উপাধি আছে। যেমন-কায়েম,মুনতাযার, সাহেবুজ্জামান, বাকিয়াতুল্লাহ্, হুজ্জাতুল্লাহ্ ইত্যাদি।
পবিত্র কোরআনের অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে :‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে আল্লাহ্ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে, তিনি তাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধিত্ব দান করবেন, যেমন তিনি প্রতিনিধিত্ব দান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তিগণকে এবং তিনি অবশ্যই তাদের জন্য সুদৃঢ় করবেন তাদের দীনকে যা তিনি তাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং ভয়-ভীতির পরিবর্তে তাদেরকে অবশ্যই নিরাপত্তা দান করবেন। তারা আমার ইবাদত করবে, আমার কোন শরীক করবে না, অতঃপর যারা অকৃতজ্ঞ হবে তারা তো সত্যত্যাগী।’- সূরা নূর : ৫৫
আর হাদীসে এসেছে যে, এ প্রতিশ্রুতির পরিপূর্ণ দৃষ্টান্ত বাস্তবরূপ লাভ করবে ইমাম মাহদী (আ.)-এর আবির্ভাবের পর।
রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন : ‘যদি পৃথিবীর আয়ুষ্কাল একদিনের বেশি অবশিষ্ট না থাকে, তবু মহান আল্লাহ্ ঐ দিনকে এমন সুদীর্ঘ করবেন, যাতে আমার আহলে বাইতের মধ্য থেকে আমার নামের অনুরূপ নামধারী কোন ব্যক্তি হুকুমত করতে পারে।’- তিরমিযী ২য় খ-, পৃ.৪৬, আবু দাউদ,মুসনাদ
কিয়ামতের আগে পৃথিবী যখন অন্যায়, অত্যাচার ও অবিচারে পূর্ণ হয়ে যাবে তখন এক মহান ব্যক্তি মানবের মাঝে আবির্ভূত হবেন। তিনি সকল অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবেন। তিনি সকল অপশক্তিকে পরাজিত করে পৃথিবীতে একটি তাওহীদবাদী ন্যায়পরায়ণ শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবেন। এই সংক্রান্ত বিশ্বাসই মাহদাভীয়াত।
যেহেতু এসকল কর্ম সম্পাদনকারী মহান ব্যক্তির উপাধি ‘মাহদী’, সেহেতু এই সংক্রান্ত বিশ্বাস ‘মাহদাভীয়াত’ নামে অভিহিত হয়েছে।
মুসলিম উম্মাহ্ ঐকমত্য পোষণ করে যে, মহানবী (সা.)-এর বংশধারার সর্বশেষ ইমাম হচ্ছেন ইমাম মুহাম্মদ আল মাহ্দী (আ.), যিনি শেষ যামানায় আবির্ভূত হয়ে বিশ্বব্যাপী ইসলামি হুকুমত এবং ন্যায়বিচার কায়েম করবেন এবং পৃথিবীর বুক থেকে অন্যায়-অত্যাচার ও শোষণের পরিসমাপ্তি ঘটাবেন।
মাহদাভীয়াতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ইমাম মাহদীর জন্য প্রতীক্ষা। প্রতীক্ষা অর্থ অবশ্যম্ভাবী কোন ঘটনার জন্য অপেক্ষা। এই রকম প্রতীক্ষা মানুষের কাঁধে দায়িত্ব অর্পণ করে।যখন একজন নিশ্চিত হয় যে, তার সামনে এমন একটি ভবিষ্যৎ রয়েছে, তখন সে এর জন্য প্রস্তুত হবে। যেমনটি পবিত্র কোরআন বলছে : ‘আমি উপদেশের (তাওরাতের) পর যাবুরে লিখে দিয়েছি যে, আমার সৎকর্মপরায়ণ বান্দারাই অবশেষে পৃথিবীর উত্তরাধিকারী হবে।’- সূরা আম্বিয়া : ১০৫
আল্লাহর সৎকর্মশীল বান্দাগণ এই আয়াতের মর্মার্থ বুঝতে পারে। তারা এ আয়াতকে বুকে ধারণ করে প্রস্তুতি নেয়। প্রতীক্ষা মানেই নিজেদেরকে প্রস্তুত করা। যারা প্রতীক্ষা করছে তাদেরকে ইমাম মাহদী (আ.)-এর আগমনকালে যেসব বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে সেগুলোর নিকটবর্তী হতে হবে। সত্যপন্থী, সাহসী, ইবাদতগুজার, আত্মিক পরিশুদ্ধতা- যা যা প্রয়োজন প্রতীক্ষারতদেরকে তা অর্জন করতে হবে। আমাদেরকে প্রতিনিয়ত অধিকতর অগ্রগতি অর্জন করতে হবে এবং আধ্যাত্মিক চরিত্র অর্জন করতে হবে।
১৫ শাবানকে ইরানে ‘অসহায় ও নির্যাতিত-নিপীড়িতদের দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।
সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
ইমাম খোমেইনী (রহ্.) : ওফাতের পরে অধিকতর ভাস্বর আত্মিক নেতৃত্ব
৪ঠা জুন ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-এর ৩০তম ওফাত বার্ষিকী।
হযরত ইমাম খোমেইনীর নেতৃত্বে বিজয়ী ইসলামি বিপ্লব ইরানি জাতিকে আড়াই হাজার বছরের রাজতান্ত্রিক জাহেলিয়াতের নাগপাশ থেকে ও একই সাথে বিজাতীয় বলদর্পী শক্তির তাঁবেদারি থেকে মুক্ত করে ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য পথ তৈরি করে দেয়। হযরত ইমামের (রহ্.) সুযোগ্য নেতৃত্বে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান আধিপত্যবাদী বলদর্পী শক্তির রক্তচক্ষু ও নিষেধাজ্ঞাজনিত কঠিন চাপকে উপেক্ষা করে এবং তাদের তাঁবেদারদের চাপিয়ে দেয়া আট বছরব্যাপী যুদ্ধ সফলভাবে মোকাবিলা করেও স্বীয় ইসলামি চরিত্র বজায় রেখে বলয়মুক্ত প্রকৃত স্বাধীন পথে চলার এবং সেই সাথে অর্থনৈতিক, প্রতিরক্ষা, বিজ্ঞানগবেষণা ও সমাজকল্যাণের ক্ষেত্রে নযীরবিহীন উন্নতির অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে- যা বিশ্বের মুসলিম ও মুস্তায্‘আফ্ জনগণের জন্য প্রেরণাদায়ক দৃষ্টান্তে পরিণত হয় এবং তাদের জন্য বিরাট আশাবাদ সৃষ্টি করে।
এভাবেই তিনি ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত এক দশক কাল সফল নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানকে বিশ^সমাজে এক অনন্য মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেন- যা বিশ্বের পর্যবেক্ষক মহলকে বিস্মিত করে।
হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) ছিলেন এমন এক ব্যতিক্রমী নেতৃত্ব যিনি শুরু থেকেই কেবল ইরানি জাতির ভবিষ্যৎ নিয়েই চিন্তা করতেন না, বরং বিশে^র সমস্ত মুস্তায্‘আফ্ জনগণের এবং আরো বিশেষভাবে ইসলামি উম্মাহ্র ভবিষ্যৎ ও ইসলামের প্রথম কিবলা কুদ্স্ (বায়তুল্ মুকাদ্দাস)-এর মুক্তির পথ নিয়ে চিন্তা করতেন। এ কারণে তিনি বিপ্লব বিজয়ের দেড় যুগ পূর্ব থেকে ইসলামি উম্মাহ্কে যায়নবাদী ইসরাঈলের বিরুদ্ধে সতর্ক করে আসছিলেন। আর বিপ্লব বিজয়ের পর তাঁর নির্দেশে ইসরাঈলের প্রতি ইরানের স্বীকৃতি প্রত্যাহার করা হয় এবং তিনি ১২ থেকে ১৭ই রবিউল আউয়ালকে ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ ও মাহে রমযানের শেষ শুক্রবারকে কুদ্স্ দিবস ঘোষণা করেন- যার ফলে ইতিমধ্যেই ইসলামি উম্মাহ্র মধ্যে তৃণমূল পর্যায়ে ঐক্য প্রক্রিয়ার সূচনা হয়েছে এবং কুদ্সের মুক্তিসংগ্রামে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়েছে- যায়নবাদী ইসরাঈলের বিরুদ্ধে হযরত ইমামের প্রেরণায় গড়ে ওঠা হিযবুল্লাহ্ ও হামাসের প্রতিরোধে নযীরবিহীন সাফল্যে যা বিশ^বাসীর কাছে সুস্পষ্ট প্রতিভাত।
হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) ফিলিস্তিন সমস্যাকে মুসলিম উম্মাহ্র এক নম্বর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং এর একমাত্র সমাধান নির্দেশ করেন অবৈধ যায়নবাদী ইসরাঈলকে উৎখাত করে সমগ্র ফিলিস্তিন ভূখ- জুড়ে অখ- ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা- যেখানে মুসলিম, খৃস্টান ও ইয়াহূদী নির্বিশেষে ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত সকল জনগণ সমান অধিকার লাভ করবে। প্রথমে অনেকেই এটাকে উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য ও ইসরাঈলকে এক অপরাজেয় শক্তি মনে করলেও হিযবুল্লাহ্ ও হামাস প্রমাণ করেছে যে, হযরত ইমামের (রহ্.) এ স্বপ্ন বাস্তবসম্মত; ইতিমধ্যেই এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে মুসলিম উম্মাহ্র মধ্যে মেরুকরণ শুরু হয়েছে।
হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) ছিলেন একজন প্রকৃত ওয়ারেছে আম্বিয়া হিসেবে একজন দ্বীনী শিক্ষক এবং এ কারণেই তাঁর নেতৃত্বে সংঘটিত ইসলামি বিপ্লব একটি ঘটনামাত্র নয়, বরং একটি অব্যাহত প্রক্রিয়া- যার ধারাবাহিকতা তাঁর গড়ে তোলা সুযোগ্য শিষ্য ও উত্তরসূরি ইসলামি বিপ্লবের বর্তমান রাহ্বার হযরত আয়াতুরøাহ্ খামেনেয়ীর নেতৃত্বে অব্যাহত রয়েছে। তাঁর নেতৃত্বে বিগত তিন দশক কাল যাবত সার্বিক ক্ষেত্রে নযীরবিহীন উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, বিশেষ করে ইসলামি ইরানের নযীরবিহীন সামরিক স্ট্রাটেজী বলদর্পী শক্তিকে যেভাবে অক্ষম করে দিয়েছে তা বিশ^বাসীর কাছে সুস্পষ্ট।
হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) সূচিত প্রক্রিয়ার উত্তরোত্তর সাফল্য ইন্তেকালের পরেও তাঁকে বিশে^র মুসলিম ও মুস্তায্‘আফ্ জনগণের, বিশেষ করে ইরানি জনগণের হৃদয়ে অধিকতর জনপ্রিয় করে তুলেছে; বরং তিনি আত্মিকভাবে এখনো তাদেরকে নেতৃত্ব প্রদান করে চলেছেন এবং তাঁর আত্মিক উপস্থিতি তাঁর দৈহিক উপস্থিতিকালের তুলনায় অধিকতর ভাস্বর প্রতিভাত হচ্ছে।
আমরা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-এর ওফাত বার্ষিকী উপলক্ষে ইরানি জনগণ ও নিউজলেটারের পাঠক-পাঠিকাগণ সহ সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্ ও বিশে^র মুস্তায্‘আফ্ জনগণের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি এবং তাঁর বিদেহী আত্মার সমুন্নত মর্যাদার জন্য আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে দো‘আ করছি।
ঈদুল ফিত্রের অভিনন্দন
পবিত্র ঈদুল ফিত্র্ উপলক্ষে আমরা বাংলাদেশের জনগণ সহ সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্কে এবং বিশেষভাবে নিউজলেটারের পাঠক-পাঠিকাদেরকে মোবারকবাদ জানাচ্ছি। আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে আবেদন, ঈদুল ফিত্র্ উপলক্ষে মুসলিম উম্মাহ্ ও বিশ্বের মুস্তায্‘আফ্ জনগণের ওপর থেকে সকল অপশক্তির অপচ্ছায়া বিদূরিত করে দিন এবং ঈদের আনন্দে ভরে উঠুক সকলের মন-প্রাণ-গৃহ-পরিবেশ।
স্মরণীয় বাণী
স্মরণীয় বাণী
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) এরশাদ করেন : ‘মনে রেখ, তোমাদের সকলেই দায়িত্বের অধিকারী এবং তোমাদের সকলেই স্বীয় দায়িত্ব সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব, শাসক ও দায়িত্বশীল ব্যক্তি লোকদের ওপরে যে দায়িত্বের অধিকারী সে ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে।’
রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন : ‘যে কেউ কোনো জনগোষ্ঠীর ওপরে নেতৃত্বের অধিকারী, কিয়ামতের দিন সে এমনভাবে উপস্থিত হবে যে, তার হস্তদ্বয় তার ঘাড়ের সাথে বাঁধা থাকবে। এমতাবস্থায়, সে যদি লোকদের মধ্যে মহান ও মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী আচরণ করে থাকে তাহলে আল্লাহ্ তাকে মুক্ত করে দেবেন, আর সে যদি যালেম হয়ে থাকে তাহলে তাকে দোযখে নিক্ষেপ করা হবে, আর তা কতই না নিকৃষ্ট প্রত্যাবর্তনস্থল!’
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) এরশাদ করেন : ‘সুবিচারক ইমামের একটি মুহূর্ত (অন্যদের) সত্তর বছরের (নফল) ইবাদতের চেয়ে উত্তম।’
আমীরুল্ মু‘মিনীন হযরত আলী (আ.) রাসূলে আকরাম (সা.)-এর গুণ-বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে গিয়ে এরশাদ করেন : ‘…আল্লাহ্ রাসূলুল্লাহকে প্রেরণের মাধ্যমে লোকদেরকে মূর্খতা, গোমরাহী ও দিশাহারা অবস্থা থেকে মুক্তি দান করেছেন।’
তিনি আরো এরশাদ করেন : ‘…তিনি ছিলেন এমন একজন চিকিৎসক (সমতুল্য) যিনি সবসময় লোকদের নিরাময়ের জন্য ঘুরে বেড়াতেন। তাঁর মলম শক্তিসৃষ্টিকারক ছিল এবং তাঁর চিকিৎসা উপকরণ সবসময় প্রস্তুত ছিল যাতে যেখানেই প্রয়োজন তা ব্যবহার করতে পারেন-দিশাহারা ও গাফলাতের মুহূর্তগুলোতে অন্ধ চক্ষুগুলোকে দৃষ্টি’ দান করতে পারেন, বধির কর্ণগুলোকে শ্রবণশক্তি দিতে পারেন এবং বোবাদেরকে কথা বলার শক্তি দান করতে পারেন।’
ইমাম আলী (আ.) এরশাদ করেন : ‘তিনটি বিষয়ে শৈথিল্য দেখানো শাসকদের জন্য কোনোভাবেই উচিত নয়, তা হচ্ছে : সীমান্ত প্রহরা, বিনষ্ট হয়ে যাওয়া অধিকারগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং বিভিন্ন দায়িত্বে যথোপযুক্ত লোকদেরকে নিয়োগ দান।’
ইমাম আলী (আ.) বলেন : ‘শ্রেষ্ঠতম শাসক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীল হচ্ছে তারা যাদের মধ্যে তিনটি গুণ-বৈশিষ্ট্য রয়েছে, তা হচ্ছে : মেহেরবানী, দানশীলতা ও সুবিচার।’
ইমাম আলী (আ.) এরশাদ করেন : ‘যে কেউ জনগণের নেতৃত্ব গ্রহণ করবে সে যেন অন্যদেরকে শিক্ষাদানের আগে নিজের শিক্ষার জন্য চেষ্টাসাধনা করে। আর তার মৌখিক শিক্ষার (অন্যদেরকে শিক্ষাদানের) আগে তার আমলের শিক্ষা হতে হবে (তার আমল শিক্ষার দৃষ্টান্ত হতে হবে)। যে ব্যক্তি তার নিজের শিক্ষক ও শাসক সে অন্যদের শিক্ষক ও শাসকের তুলনায় অধিকতর সম্মানার্হ হওয়ার উপযুক্ত।’
ইমাম সাজ্জাদ্ (আ.) শাসকের দায়িত্ব¡-কর্তব্য সম্বন্ধে এরশাদ করেন : ‘জনগণের প্রতি তোমার কর্তব্য হচ্ছে এই যে, জনগণের মধ্যে সুবিচারের ভিত্তিতে আচরণ করবে এবং তাদের সাথে মেহেরবান পিতার মতো হবে, অজ্ঞদের দোষত্রুটি উপেক্ষা করবে, তাদেরকে শাস্তিদানের ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া করবে না এবং আল্লাহ্ তোমাকে যে নে‘আমত দিয়েছেন ও তোমাকে যে তাদের ওপর শাসনকর্তৃত্বে অধিষ্ঠিত করেছেন সেজন্য শোকরগুযারী করবে (আর উভয় গোষ্ঠীই সুবিচার লাভের ও যুলুম থেকে বেঁচে থাকার হকদার)।’
ইমাম জা‘ফর সাদেক (আ.) এরশাদ করেন : ‘…লোকদের জন্য শহরে তিনটি জিনিসের অপরিহার্য প্রয়োজন যার কাছে তারা তাদের দুনিয়া ও আখিরাতের ব্যাপারে আশ্রয় নিতে পারে। এ তিনটি জিনিস না থাকলে তাদের যিন্দেগীতে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। এগুলো হচ্ছে : পরহেযগার জ্ঞানী ফকীহ্, এমন নেককার শাসক- জনগণ যার অনুসরণ করবে এবং নির্ভরযোগ্য সুবিজ্ঞ চিকিৎসক।’
(মাফাতীহুল্ হায়াত্ গ্রন্থ থেকে সংকলিত)
অনুবাদ : নূর হোসেন মজিদী
ইরানের থিয়েটার ফেস্টিভালে আবেদনপত্র আহ্বান
ইরানে অনুষ্ঠিতব্য ইন্টারন্যাশনাল স্ট্রিট থিয়েটার ফেস্টিভাল-২০১৯ এ অংশগ্রহণের জন্য আবেদনপত্র আহ্বান করা হয়েছে। নাট্যোৎসবে অংশগ্রহণে আগ্রহীদের ১০ জুলাইয়ের মধ্যে দরখাস্ত পাঠানোর অনুরোধ জানিয়েছে আয়োজক প্রতিষ্ঠান ড্রামাটিক আর্টস সেন্টার অব ইরান (ডিএসি)। স্ট্রিট থিয়েটার ফেস্টিভালের এবারের ১৪তম আসর ইরানের মারিভানে ২৩ আগস্ট শুরু হয়ে শেষ হবে ২৭ আগস্ট।
আবেদনপত্র ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদি ড্রামাটিক আর্টস সেন্টারের ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স অফিস (ভাহদাত হল, ওস্তাদ শাহরিয়ার স্ট্রিট, হাফিজ অ্যাভিনিউ, তেহরান) বরাবর পাঠাতে অথবা এই নাম্বারেdramatic.artcenter.iran@gmail মেইল করতে বলা হয়েছে। ওয়েবসাইটের ঠিকানা, থিয়েটার ডটআইআর, টেলিফোন- +৯৮২১৬৬৭০৮৮৬১।
একই সাথে পৃথক আরও দুই আন্তর্জাতিক থিয়েটার ফেস্টিভালে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছে ড্রামাটিক আর্টস সেন্টার। এরমধ্যে ২৬তম আন্তর্জাতিক শিশু-কিশোর থিয়েটার ফেস্টিভাল অনুষ্ঠিত হবে ১০ থেকে ১৫ নভেম্বর ইরানের হামেদানে। এরপরেই ৩৮তম ফজর আন্তর্জাতিক থিয়েটার ফেস্টিভাল অনুষ্ঠিত হবে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে। রাজধানী তেহরানে পহেলা ফেব্রুয়ারি উৎসব শুরু হয়ে চলবে ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এটি দেশটির সবচেয়ে বড় ও প্রধান নাট্যোৎসব।
শিশু-কিশোর ও ফজর আন্তর্জাতিক থিয়েটার ফেস্টিভালে অংশগ্রহণে আগ্রহীদেরও উল্লিখিত ঠিকানায় আবেদনপত্র, থিয়েটার কর্মের ওয়েব লিংক ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদি পাঠাতে বলা হয়েছে। শিল্পকর্ম মূল্যায়ন ও নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্নের জন্য আগ্রহীদের আবেদনপত্র পূর্ণাঙ্গভাবে পূরণ করে জমা দিতে বলা হয়েছে।
Application Form for Theater fest