সংকলন : আফসানেহ আরযমান্দ
মানবীয় অনুভূতিসমূহের মধ্য থেকে এমন একটি অনুভূতি যা নিয়ন্ত্রণে না থাকলে খুবই ক্ষতিকর এবং পীড়াদায়ক হয়ে ওঠে তা হলো হিংসা। কিন্তু হিংসা কী এবং কীভাবে আমরা এটি দমন করব ও একে আমাদের কল্যাণে ব্যবহার করব ?
হিংসার সংজ্ঞা
হিংসাকে অনেক ভাবেই সংজ্ঞায়িত করা যায় এবং কীভাবে একজন ব্যক্তি এই আবেগকে পরিচালিত করতে পারে সে সম্পর্কে প্রত্যেক বিশেষজ্ঞেরই নিজস্ব মতামত রয়েছে। যদি তুমি একবার একে নিয়ন্ত্রণে আনতে পার, তা হলে তুমি সুখী জীবন যাপন করতে পারবে।
হ্যারল্ড কফিনের অভিমত অনুযায়ী হিংসা হলো ‘যে শিল্পের মাধ্যমে নিজের কল্যাণসমূহের পরিবর্তে অন্যের কল্যাণসমূহ গণনা করা হয়।’
অপরদিকে হিংসা ইতিবাচকও হতে পারে এবং তোমার জীবনে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রেরণাদায়ক হতে পারে। এটি হিংসা সম্পর্কে আরেকটি দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে যার মাধ্যমে তুমি সাফল্য, ব্যক্তিত্ব, শক্তিমত্তা এবং অন্যান্য ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে অন্য ব্যক্তিদের মতো হওয়ার ইচ্ছা পোষণ কর।
এটি তোমাকে তাদের নিকট থেকে শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী করে তোলে এবং তোমার নিজের সুপ্ত গুণাবলি খুঁজে পেতে এবং জীবনে অগ্রসর হতে সাহায্য করে। যখন আমরা অন্যদের সুখে সুখী হতে পারব তখন আমরা নিজেদেরকে অধিকতর সুখী অনুভব করব এবং একই সময়ে আমরা তাদের পথে চলার চেষ্টা করব- যদি আমরা বিশ^াস করি যে, তারা নিজেদের নেয়ামতকে গণণা করেই কোন না কোনভাবে সফল হয়েছে বা জীবনে অগ্রসর হয়েছে।
আমাদের যা নেই, তা নিয়ে বিলাপ করার চেয়ে আমাদের যা আছে, তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকাটাই আমাদেরকে অধিকতর সুখকর জীবনের দিকে পরিচালিত করে। হিংসা তোমার কাঁধে একটি ছোট শয়তানের ন্যায় হতে পারে যা তোমার কানে ফিসফিস করে, তোমার অন্তরে কুমন্ত্রণা দেয় এবং তোমার জীবনকে এমন কিছুতে পরিণত করে যা প্রায়শই ভোগান্তি এবং অধিক মাত্রায় নেতিবাচকতায় পূর্ণ। অথবা হিংসা এমন কিছু হতে পারে যা তোমাকে মাঝে মাঝে ভীষণ বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ করে তোলে।
হিংসা থেকে পরিত্রাণের উপায়
১. যদি হিংসার কারণ হয় তুলনা করা, তবে নিজের প্রতি দৃষ্টি দাও
আসলে সবসময় কেউ না কেউ থাকে যার অবস্থান তোমার থেকে উত্তম- সেটা ক্লাসেই হোক কিংবা বাড়িতে আর তুমি যদি এখানে হিংসার মনোভাব পোষণ কর তবে এটি নিশ্চিত যে, তোমার জন্য এটি সর্বদা তিক্ত অনুভূতি হয়ে থাকবে। এজন্য তোমার নিজের প্রতিভা ও বিশেষ বৈশিষ্ট্যর প্রতি দৃষ্টি দাও এবং সচেতন হও যে, ‘অপর পাশের ঘাসগুলো সর্বদাই বেশি সতেজ হয়।’
তোমার যা আছে সেটির দিকে দৃষ্টি দাও এবং নিরর্থক তুলনার মাধ্যমে নিজেকে কষ্ট দিও না যা তোমাকে প্রকৃত অর্থে কোন অবস্থানে নিয়ে যাবে না।
২. নিজের যা আছে তা নিয়ে কৃতজ্ঞ থাক
এই বিষয়টিকে দৈনন্দিন চর্চার বিষয়ে পরিণত কর, এমনকি অল্প সময়ের জন্য হলেও। দীর্ঘ সময় পর তুমি একটি বিশাল পরিবর্তন লক্ষ্য করতে পারবে। এই সময়ে উত্তম হবে যে, দিনের একটি ঘণ্টা তুমি নির্দিষ্ট করবে তোমাকে প্রদত্ত সকল নেয়ামতের প্রতি দৃষ্টি দেয়ার জন্য; এসকল নেয়ামতের একটি তালিকা তৈরি কর- এটি যত বড় কিংবা ছোট নেয়ামতই হোক না কেন। তাহলে তুমি কৃতজ্ঞ ও আশ্বস্ত হবে এবং সত্যিসত্যিই আশ্চর্যান্বিত হবে।
৩. অভাব-অনটনকে বা কোনো কিছু হারানোকে ভয় পাবে না
যদি তুমি চিন্তা কর যে, অন্য কেউ তোমার স্থান নিয়ে নিয়েছে অথবা তুমি প্রতিনিয়ত কোনো কিছু হারানোর ভয় কর, তাহলে তুমি অন্যের প্রতি তীব্র হিংসাপরায়ণ হয়ে উঠবে। বৃহৎ পরিসরে চিন্তা কর এবং জীবনে নিজের স্থান নিয়ে কখনও চিন্তা করো না। কারণ, শীঘ্রই কিংবা পরবর্তীকালে তুমি তোমার পরিকল্পনা, সততা ও কঠোর কর্মের মাধ্যমে তোমার প্রাপ্য স্থান পেয়ে যাবে। এ ছাড়া তুমি এখনই কেন এসব বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তা করছ?
৪. স্বাভাবিক জীবন যাপন কর
কোনো কিছু না করে বসে থেক না। কারণ, এ ক্ষেত্রে তোমার নেতিবাচক চিন্তা-ভাবনা বৃদ্ধির সম্ভাবনা প্রচ-ভাবে বৃদ্ধি পাবে এবং এত দ্রুত তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে যা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। জীবনকে উপভোগ কর এবং তোমার মধ্যে যে সকল ঘাটতি রয়েছে সেগুলো নিয়ে অধিক সময় ধরে প্রচেষ্টা চালাও।
৫. লোভী হয়ো না
তুমি বুঝে ওঠার আগেই তুমি লোভী হয়ে উঠতে পার এবং তখন হিংসা তার ভয়ানক ছায়ার মাধ্যমে তোমার পশ্চাদ্ধাবন করবে। তুমি ভাল হওয়ার প্রতিযোগিতাকে একটি উপকারী উচ্চাকাক্সক্ষী কারণ হিসেবেও গ্রহণ করতে পার এবং জীবনে কিছু করতে পার। কিন্তু এটি যেন তোমাকে ধ্বংস না করে। আর অনুসরণের জন্য সবচেয়ে উপযোগী ব্যক্তি হলো তারা যারা কাউকে হিংসা করে না; কারণ, তাদের মধ্যে আসলেই বিশেষ কিছু রয়েছে। বরং তাদের প্রতি হিংসা নয়,আমরা তাদেরকে অনুসরণ করতে পারি এবং কীভাবে অন্য ব্যক্তির সাথে নিজেদেরকে তুলনা করেও স্থির ও আরামে থাকা যায় তার শিক্ষা লাভ করতে পারি।
অনুবাদ : সরকার ওয়াসি আহম্মেদ
All posts by dreamboy
ইলশে গল্প
সুমাইয়া বরকতউল্লাহ্ –
টুম্পাদের বাড়িতে আজ যেন উৎসব লেগেছে। আশপাশের সবাই আসছে তাদের বাড়ি। কারণ, একটাই। লন্ডন থেকে টুম্পার ভাইয়া ভাবি এসেছে। আবার তাদের সাথে ছোট্ট একটা মিষ্টি বাবুও এসেছে। পাশের বাড়ির চাচি, চাচাতো ভাই-বোন সবাই এসে বাবুটাকে দেখে যাচ্ছে! আর এদিকে আনন্দে ও গর্বে টুম্পার মুখের হাসিটা কান পর্যন্ত লম্বা হয়ে আছে। তার ছোট্ট ভাগ্নিটাকে তো সে হাতছাড়াই করে না। বাড়ি জুড়ে আনন্দই আনন্দ।
ভাগ্নিটার নাম এলিনা। এলিনাকে ঘিরে সবাই খেতে বসল। টুম্পার মা খুব সখ করে এলিনার পাতে এক টুকরো মাছ দিলেন। সাথে সাথে এলিনা বলে উঠল, ‘এটা কী মাছ? ’টুম্পা বলল, ‘ইলিশ। খাও, খুব মজা। আমাদের খুব প্রিয় মাছ এটি।’
‘এটা তোমাদের প্রিয় কেন?’
এলিনার এই প্রশ্নে হেসে ফেলল সবাই। টুম্পার বাবা এলিনার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘এটা খেলেই বুঝতে পারবে, কেন সবার প্রিয়।’
এলিনা খুব যত্ন করে মাছের কাঁটাগুলো বেছে মাছটা খেলো। তারপর সে হাতের আঙুল চুষতে চুষতে বলল, ‘আরো খাবো।’
তার পাতে আরেক টুকরো মাছ দেওয়া হলো। সে খেয়ে বলল, ‘আমি এত মজার মাছ আর খাই নি।’
টুম্পার বাবা গর্ব করে বললেন, ‘এবার বুঝেছ এটা কেন সবার এত প্রিয় ? এর স্বাদ, গন্ধই আলাদা। আর এটাই হলো আমাদের জাতীয় মাছ ইলিশ!’
এলিনা টুম্পার মার দিকে চোখ রাখল। সে বায়না ধরে ডানে-বামে শরীর ঝাঁকিয়ে বলল, ‘এবার ফিরে যাওয়ার সময় আমরা ইলিশ মাছ নিয়ে যাব কিন্তু!’
আনন্দে সবার মুখ চিকচিক করে উঠলো।
বুদ্ধিমান প্রেমিক
অনুবাদ ঃ কামাল মাহমুদ
সে অনেকদিন আগের কথা। এক দেশে এক রাজা ছিলো আর তার ছিলো এক অতিব সুন্দরী কন্যা। এই রাজকন্যাকে অনেকেই বিয়ে করতে আগ্রহী ছিলো।
কখনো কখনো রাজার এক বন্ধু এ বিষয়টি নানাভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করতো এবং বক্তব্যের উদ্দেশ্য বিয়ে পর্যন্ত নিয়ে শেষ করতো। এমন কারো নাম উল্লেখ করতো যে যুবক যথাযথভাবে রাজকন্যার যোগ্য বলতো তার এই যোগ্যতা আছে ঐ যোগ্যতা আছে এবং সে রাজকন্যার মতো এমন মেয়েকেই বিয়ে করতে চায়। কিন্তু আবার ভয় পেতো সত্যি সত্যি যদি রাজার মেয়েকে সে বিয়ের প্রস্তাব দেয় তাহলে সে হয়তো সেটা ভালোভাবে নাও নিতে পরে, হয়তো এর জবাবে কটু কথা শুনতে হতে পারে। সকলে রাজার কথায় অংশগ্রহণ করে এবং তার কথাবার্তায় সম্মতি জানায়। মনে হয় যেন প্রত্যেকেই জামাই নির্বাচন করার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে নিয়েছে।
রাজা নিজেও বিষয়টি বুঝতো। এ কারণেই সে কারো কথার জবাবে তেমন কোন কথা বলতো না। মেয়েটিও বলতো: ‘আমি এমন স্বামী চাই যে আমাকে মনে প্রাণে চায়, শুধু রাজার জামাই হতে চায় এমন ছেলে আমি চাইনা।’
এভাবে চলতে থাকলো; এক ঈদের দিনে সকল সভাসদ, বন্ধু-বান্ধব ও নিকাটত্মীয়রা রাজার কাছে জমায়েত হলেন। এরপরে কথাবার্তার এক পর্যায়ে আবার এ বিষয়টি আসলো। রাজা বললেন: এ পর্যন্ত এ বিষয়ে অনেক কথা শুনেছি। কিন্তু যে কোন কাজের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় দরকার। এখন আমি এবং আমার কন্যা এ বিষয়ে কথা বলার জন্য প্রস্তুত। আমার মেয়ের প্রেমিকদের মধ্য থেকে একজনকে নির্বাচণ করবো, এ বিষয়ে আর বেশি কথা বলতে চাইনা’। আমি আমার কণ্যাকে আগামীকাল বউ সাজিয়ে এবং কারো হাতে তার হাত রাখার ব্যবস্থা করবো যে তাকে আমার কন্যাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসে। এজন্য যারা আমার কন্যাকে বিয়ে করতে চায় তারা যেন আগামীকাল এখানে উপস্থিত হয়। আমি তাদেরকে আমার মেয়েকে বিয়ে করার জন্য শর্তগুলো বর্ণনা করবো, আমার মেয়ে তার জীবন সঙ্গী দেখবে এবং আগামীকালই বিয়ের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন হবে।’
সকলে ঐ দিনের মতো চলে গেলো এবং যে সকল প্রেমিক রাজকন্যাকে জীবন সঙ্গী হিসেবে পেতে ইচ্ছুক এমন ব্যক্তিদের কাছে খবর পৌঁছে দেয়া হলো এবং বলা হলো: ‘যারা রাজার মেয়েকে বিয়ে করতে চায় তারা যেন আগামীকাল উপস্থিত থাকে যাতে আমরা রাজার জামাইকে দেখতে পারি। কিন্তু রাজার মনে কি খেয়াল তা কে জানে? আমরা এরকম জামাই নির্বাচনের প্রতিযোগিতা ইতোঃপূর্বে আর দেখিনি।’
পরের দিন রাজার বাড়ীর সামনে মাত্র তিনজনকে দেখা গেলো। প্রেমিকরা ভয় পাচ্ছিলো না জানি রাজা তাদেরকে অপমান করেন? তারা প্রচন্ড ভয় পাচ্ছিলো। রাজা ঐ তিনজন প্রেমিককে অভ্যর্থনা জানালেন। তাদের পরিচিতি জানার পরে মেয়েকে তাদের সামনে হাজির করে বললেন: ‘আমার মনে হয় তোমরা তিনজনই আমার মেয়ের সত্যিকারের প্রেমিক’। এই আমার মেয়ে, একে ভালভাবে দেখো, আমার মেয়ে রাজী হলে আজকেই বিয়ের আয়োজন করবো। কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে আমি রাজা, আমার মেয়েকে বিয়ে করতে হলে কিছু শর্তাদি পালন করতে হবে। আমি শর্তাবলী বলার পরে তোমাদেরকে আধা ঘন্টা সময় দেবো, এরপর তোমরা তোমাদের মতামত কাগজে উপর লিখে দেবে এরপর আমি এবং আমার কন্যা সিদ্ধান্ত নেবো এরপর যা ভালো মনে হয় করবো । আমার শর্ত হলো: ‘আমার মেয়ের প্রেমিকদেরকে একটিই পিলারের সাথে বেধে ইচ্ছেমতো আঘাত করবো এরপর যদি বেঁচে থাকে, তারপর আমরা যাকে মনে করবো যে তার সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দেবো। তাকে বিয়ের জন্য প্রস্তুত করা হবে এই শর্তে যে- সে কোনদিন এই বাড়ীতে পা রাখতে পারবেনা। সে জীবনে আমার নামে কোন অভিযোগ করতে পারবেনা। কোন কাজের জন্য আমার কাছে আসতে পারবেনা। সে আমার কাছে কোন কিছু চাইতে পারবেনা। আমার মেয়ে যদি তার সাথে খারাপ আচরণও করে এমনকি যদি তার শরীর থেকে চামড়া তুলে নেয় তবুও। যদি এ রকম কোন অবস্থা তৈরী হয়, যদি কেউ এ শর্ত মেনে নিজেকে প্রস্তুত করতে রাজী না হয় তাহলে তাকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে এ শহর ছেড়ে চলে যেতে হবে আর কোনদিন এ শহরে পা রাখতে পারবেনা। সে আমার এবং আমার কন্যার নাম মুখে নিতে পারবেনা। আর যদি এর ব্যত্যয় ঘটে তাহলে আমি জানিনা যে আমি তার সাথে কি আচরণ করবো’।
‘এই নাও তিনটুকরো কাগজ। হাতে সময় আধা ঘন্টা, এই কাগজের উপর তোমাদের মতামত লিখে সই করবো যাতে আমি বুঝতে পারি কার কাছে আমার মেয়েকে সমর্পন করবো’।
এই বলে রাজা তিনজনের কাছে তিনটুকরো কাগজ দিয়ে তিনজনকে আলাদা আলাদা রুমে রাখলেন এবং দরজা বন্ধ করে দিলেন।
আধা ঘন্টা পরে রাজা, তার মেয়ে, কাজী, মৌলভী এবং বিবাহের রেজিস্টার নিয়ে আসলেন এবং ঐ কাগজগুলো আনার নির্দেশ দিলেন। তাদের মধ্যে একজন যুবক তার লেখা রাজার হাতে দিলেন। রাজা সেটি হাতে নিয়ে বললেন-এতো একটি, পরের জন তার লেখা দিলো রাজা সেটি হাতে নিয়ে বললেন- এতো দুইটি। তৃতীয় লেখাটি নিয়ে বললেন-‘এবার তোমাদের একে একে পরীক্ষা করবো’।
প্রথম যুবক লিখেছে-‘এটা খুবই কঠিন যে, আমি আমার ভালোবাসা ভুলে যাবো, কিন্তু যেহেতু রাজার হুকুম তাই চেষ্টা করবো যাতে ২৪ ঘন্টার মধ্যে শহর ছেড়ে যেতে পারি। আশা করি রাজা এবং তার আত্মীয় স্বজনরা আমার সাথে কোন খারাপ ব্যবহার করবেন না। কেননা আমি তার একমাত্র প্রেমিক ছিলাম এবং এর মধ্যে কোন পাপ ছিলোনা’।
রাজা এবং তার মেয়ে ঐ লেখা দেখে মুচকি হাসলেন। রাজা বললেন-বেশ ভালো! এটা বোঝা গেল যে, সে প্রকৃত প্রেমিক নয়। সে তো ধূর্ত, দুর্বল ও পলায়মান। সে মেয়েকে বিয়ে করে রাজার সান্নিধ্যে আসতে চেয়েছিলো। ভালোবাসার ব্যাপারে তার কোন মাথাব্যথা ছিলোনা। এ ব্যক্তি জানেনা যে, কোন কিছু অর্জন করতে অনেক মসিবত অতিক্রম করতে হয়। সে তার সমস্ত জ্ঞান বুদ্ধি দিয়ে চেষ্টা করে কিছু হাসিল করতে না পারলে মাঝপথে পলায়ন করে। এই যুবক ভীতু এবং বুদ্ধিহীন কেননা সে চিন্তা করে কোন পথ বের করার কোন চিন্তাই করেনি। সব সময় মানুষ নিজেকে সবচেয়ে ভালো চেনে এবং এই পলাতক প্রেমিকে আমাদের কোন কাজ নেই বরং তার চলে যাওয়াই ভালো। সে যেন পিছনের দিকে ফিরে না চায়। আমরা তাকে ভুলে যাবো যাতে সে তার মতো করে ভালো থাকতে পারে’। পলায়নপর প্রেমিককে মুক্ত করে দেওয়া হলো। এবার দ্বিতীয় জনের পালা।
দ্বিতীয় জন লিখেছে- আমি রাজা এবং তার কন্যার সকল শর্ত গ্রহণে রাজি এবং তা বাস্তবায়ন করতেও প্রস্তুত। যদি আমি মারধরের পরে জীবিত থাকি তাহলে আমি আমার লক্ষ্যে পৌছুতে পারবো আর যদি জীবিত না থাকি তাহলে পরজগতে তার জন্য কাঁদবো কেননা আমার জীবনে আমি আর কিছু চাইনা হয় মৃত্যু অথবা এই রাজকন্যা।
রাজা এ লেখা পড়ার পরে কন্যাকে বললেন- এর ব্যাপারে তোমার মতামত কি?
রাজকন্যা বললো- আমি পাগল স্বামী চাইনা।
রাজা বললেন- মাশাআল্লাহ মা, তুমি ঠিকই বলেছো। এই যুবক পিলারের সাথে বাঁধা অবস্থায় মার খেতে রাজি এরপর আমার একজন আদেশের গোলাম হতে চায় এবং সে আমার থেকে দূরে থাকতে চায় সে আমাকে ভয় করে কেননা যদি শেষ পর্যন্ত রাজার তরবারি তার মাথাকে শরীর থেকে আলাদা করে দেয় সেজন্যও সে প্রস্তুত। কিন্তু আমার মেয়ে অন্যান্য মেয়েদের থেকে কত আলাদা? সে প্রেমের বিনিময়ে এই দুই জনের দূর্ভাগ্য কিনতে চায়নি। আমিও এটা বিশ^াস করতে পারছিনা যে, এই লোক এক সময় সুস্থ জ্ঞানবান হবে। এই যুবককে পাগলা গারদে বা মানসিক হাসপাতালে পাঠানো উচিত যাতে সে নিজের চিকিৎসা করতে পারে। আর সে যেন দ্বিতীয়বার আমার মেয়ের নাম নিতে না পারে। এই যুবক প্রেমিক নয়, সে পাগল। পাগল জামাই দিয়ে আমার কাজ নেই। সে খুব দ্রুতই আমাদেরকে ভুলে যাবে তাই আমাদেরও উচিত তাকে ভুলে যাওয়া, যাতে সে শান্তিতে থাকতে পারে।
তৃতীয় যুবকের লেখা পড়বার পালা। সে লিখেছে- আমার একটি চাচাতো বোন আছে যার কোন দোষ আমার চোখে ধরা পড়েনি। তবুও আমি রাজার মেয়েকে অধিক ভালোবাসি এবং স্বপ্ন দেখি যে, আমরা অধিকতর সুখী হবো। আমি শহর থেকে বাইরে যাবোনা, যদি আমাকে বাধ্য করা হয় তাহলে তা হবে আমার উপর জুলুম। কেননা আমি একজন নিরীহ মানুষ। কিন্তু রাজ কন্যাকে বিবাহের জন্য চাবুক খাওয়ার শর্ত এবং পরবর্তীতে বেচে থাকা জীবনে নিপীড়ন সেটাও আমি পছন্দ করিনা, কেননা এতে স্বয়ং রাজকন্যার জীবনেও শান্তি এনে দিবেনা, আমি এমন প্রেমিক ও আগ্রহি যাতে রাজকন্যাও আমাকে পছন্দ করে এবং রাজাও তার শর্ত শিথীল করেন। আর তা যদি না হয় তাহলে আমার চাচাতো বোন কি দোষ করেছে? আমি মনে করি সকল সমস্যা সমাধানের তৃতীয় কোন পথ আছে। আশা করি রাজা আমার এ লেখাকে অক্ষমতা হিসেবে বিবেচনা করবেন না। কেননা আমার কারো সাথে কোন বিবাদ নেই। কিন্তু আমি বিয়ে করতে চাই এবং ভালোভাবে জীবন যাপন করতে চাই এবং সব সময় রাজকন্যাকে খুশী দেখতে চাই।
রাজা কন্যাকে জিজ্ঞেস করলেন- এর ব্যাপারে তোমার কী মতামত?
রাজকন্যা বললো: আপনার যা মর্জি। আর তো কেউ অবশিষ্ট নাই।
রাজা মুচকি হেসে বললেন- ‘খুব ভালো! এই যুবক বুদ্ধিমান। সে জানে যে, তার চাচাতো বোনের সাথে আমার মেয়ের কোন পার্থক্য নাই। কিন্তু আমার মেয়েকে বেশি ভালোবাসে এবং চিন্তা করে যে তোমার জীবন সুন্দর হোক। এই যুবক বুদ্ধিমান এজন্য যে, সে শহর থেকে বের হওয়ার ভয় করেনা এবং সময়ের কাছে সে আত্মসমর্পণ করেনা এবং সে তৃতীয় কোন পদ্ধতিতে সমস্যার সমাধান করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে। আমার শর্তাবলী ছিলো শুধু পরীক্ষার জন্য। আমারও কারো সাথে কোন বিবাদ নেই। আমিও আমার মেয়ের কল্যাণ ও সুখ চাই। এখন এই যুবকের অধিকার আছে আমার মেয়েকে বিয়ে করার। যদি সে রাজি থাকে তবে শর্তহীনভাবে আজকেই বিয়ের অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন করবো। আর যদি সে রাজি না থাকে তবে বুঝবো সে তার চাচাতো বোনের সাথেই ভালো থাকবে। আমরাও তার বিবাহ অনুষ্ঠানে যাবো এবং তাদেরকে শুভেচ্ছা জানাবো। হে যুবক! এখন তোমার শেষ কথা বলো’।
যুবক বললো- ‘আমি এ মেয়ের সাথে বিবাহের জন্যই অধিকতর আগ্রহি’।
রাজকন্যা বললো- ‘আমিও….’
রাজা বললেন- ‘আমিও তোমাদের শুভেচ্ছা জানাই এবং সৌভাগ্য কামনা করি, আশা করি তোমরা সুখী হবে।’
বই পরিচিতি
ছড়াসমগ্র
রচনা : আতিক হেলাল
প্রকাশক : কুষ্টিয়া প্রকাশন
আই/২৫, ব্লক-ই, কাজী নজরুল ইসলাম রোড, মোহাম্মদপুর,
ফোন- ০১৮৩০১০০১০০
প্রচ্ছদ : সাইফ আলী
প্রকাশকাল : আগষ্ট-২০১৮
মূল্য : ৩০০ টাকা।
নব্বই দশকের তুখোর ছড়াকার কবি আতিক হেলাল। বাংলা ছড়া সাহিত্যে স্ব-মহিমায় একজন শক্তিমান ছড়াকার হিসেবে তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত। একাধারে তিনি সাংবাদিক, সম্পাদক এবং গবেষকও। জাতীয় ছড়া সাহিত্যে বিকাশের আন্দোলনে তাঁর যেমন প্রত্যক্ষ পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে তেমনি রয়েছে সাহিত্য সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শুভবুদ্ধির উদয় এবং শুভচিন্তা বিকাশের কল্যাণকর চেতনা। তাঁর ছড়াগুলো নৈতিক ও সামাজিক ন্যয়বিচারের পক্ষে তীব্র ও ক্ষুরধারতারপর তা ছড়িয়ে পড়ে সর্বজনীনতার অবয়ব নিয়ে। দেশ, জাতি, ধর্ম, ইতিহাস, নৈতিক মূল্যবোধ, শিশুতোষ বিষয় সহ আন্তর্জাতিক বিষয় আশয় নিয়েও তিনি ছড়া লিখে থাকেন।
আলোচ্য ছড়াসমগ্রটি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বাছাই করা প্রকাশিত অপ্রকাশিত কিছু ছড়া নিয়ে। জাতীয় কবি নজরুলকে নিয়ে তাঁর একটি ছড়া প্রকাশিত হয়েছে সেটি হলো ‘নজরুল মিশে আছে কবিতাও ছন্দতে/জীবনের বাঁকে বাঁকে ভালো আর মন্দতে// নজরুল মিশে আছে কথা সুর সংগীতে/বিদ্রোহ বিপ্লবে আছে নানা ভঙ্গিতে’। আমাদের জাতীয় জীবনে অমর একুশে ও মাতৃভাষা জড়িয়ে আছে মজবুতভাবে। সেটাই তিনি ছড়ায় বলার চেষ্টা করেছেন, ‘মায়ের ভাষা প্রাণের চেয়ে প্রিয় আমার কাছে/এই ভাষাতে জড়িয়ে আমার ভাইয়ের স্মৃতি আছে//রক্ত দিয়ে কথা বলার এই অধিকার কেনা/বাংলা ভাষার বর্ণ সকল তাইতো বড়ই চেনা’। তেমনি কারাবালা ও ইমাম হোসাইন জড়িয়ে আছে আমাদের ঈমানী চেতনার সাথে। সেটিও স্পর্শ করেছে তাঁর ছড়ায়। ‘আশুরার চেতনা/ইমামের খুন ছাড়া বিস্তার পেত না// নবীজির নাতি/তবু পানি পায় না সে ফেটে যায় ছাতি//এজিদের তোপে/উম্মার জন্য সে দেয় প্রাণ সঁপে//কিন্তু সে কথা/ মুসলিম ভুলে যায় ভাবে যথাতথা// আতিক হেলালের কবিতায় আমাদের জাতীয় জীবনের চিত্র যেমন প্রকাশ পায় তেমনি প্রকাশ পায় আমাদের ধর্মসংস্কৃতির পরিচিতিটিও। আমাদের বৃহত্তর উৎসব ঈদ নিয়ে তাই তিনি লিখেন, ‘ঈদের দিনে তোমরা খাবে মাংস রুটি পোলাও/ওদের তখন জুটবে না যে খাদ্য একতোলাও//তোমরা যখন সাজবে সবাই নুতন জামা কাপড়ে/ওরা তখন থাকবে পথে বস্ত্র কিছুই না পড়ে’ কিংবা ‘বারো মাসে দুইবার দুই খুশির ঈদে/কারো বাড়ে যন্ত্রণা বাড়ে কারো খিদে//দাম বাড়ে ঘাম বাড়ে কেউ থাকে জিদে/খাদ্য মজুত করে কেউ থাকে নিদে’। এভাবেই এগোয় আতিক হেলালের প্রতিবাদের ভাষা।
বাংলাদেশের ছড়া সাহিত্যের ইতিহাসে আতিক হেলাল স্বমহিমায় উৎরে যাবেন একথা আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি। তাঁর ১৬০ পৃষ্ঠার এ ছড়াসমগ্রে রয়েছে তাঁর আরো বিখ্যাত ছড়া। উল্লেখ্য যে, ছড়াকার কবি আতিক হেলাল কঠিন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে দেশের বাইরে যান চিকিৎসার জন্য। তাঁর ওপেন হার্ট সার্জারি হয়। অসুস্থতার এই কঠিন সময়ে তাঁর চিকিৎসা ব্যয়ভার বহনার্থে বইটি প্রকাশিত হয়। আমরা বইটির বহুল প্রচার ও পঠন কামনা করছি।
□ আমিন আল ্আসাদ
ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর ৩০তম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত
ইরানের ইসলামি বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর ৩০তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের উদ্যোগে ২৮ মে, ২০১৯ বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের শহীদ ডা. শামসুল আলম খান মিলন অডিটোরিয়ামে ‘ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর নৈতিক ও আধ্যাত্মিক চিন্তাধারা’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি জনাব আবুল কালাম আজাদ এমপি। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকাস্থ ইরানি রাষ্ট্রদূত জনাব মোহাম্মদ রেযা নাফার। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রফেসর ড. মাইমুল আহসান খান, ব্রিলিয়েন্ট ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের প্রিন্সিপাল হুজ্জাতুল ইসলাম মোহাম্মদ আশরাফ উদ্দিন খান ও প্রখ্যাত চিন্তাবিদ জনাব তানিম নওশাদ। সভাপতি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের প্রফেসর ড. মো. আনিসুজ্জামান।
জনাব আবুল কালাম আজাদ বলেন, ইমাম খোমেইনী ছিলেন সমকালীন বিশে^র অবিসংবাদিত নেতা। তিনি ছিলেন একজন ক্ষণজন্মা পুরুষ। পৃথিবীতে যেসকল নেতা বহুমাত্রিক গুণের অধিকারী ছিলেন ইমাম খোমেইনী তাঁদের অন্যতম। তিনি বিশ্বসভ্যতার অন্যতম লালনভূমি ইরানে আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন রাজতন্ত্রের উত্তরাধিকারী পাহলভী বংশের স্বৈরাচারী শাসনকে উৎখাত করেন। ইমাম খোমেইনী আজীবন সা¤্রাজ্যবাদী পরাশক্তিগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। তিনি ছিলেন একজন আপোসহীন সংগ্রামী পুরুষ, যিনি সকল শোষণ ও অনাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। ইমাম খোমেইনীর বড় পরিচয় হলো তিনি একজন ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক নেতা। তিনি সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন বলেই বিশে^র পরাশক্তিগুলো ইরানের বিপক্ষে ষড়যন্ত্র করেও সফলতা লাভ করতে পারে নি।
তিনি আরো বলেন, ইরানের ইসলামি বিপ্লব দুনিয়ার মুসলমানের কাছে, মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সমগ্র মানবতার কাছে এক নুতন দিগন্ত উন্মোচন করে। ইমাম খোমেইনী (র.)-এর সুযোগ্য নেতৃত্বে ইরানের ইসলামি বিপ্লব ‘ইসলাম’ স¤পর্কে প্রচলিত সংকীর্ণ অনেক ধ্যানধারণাকে বদলে দিয়েছে। দলপূজা, গোষ্ঠীতন্ত্র, খ-িত চিন্তাধারার বেষ্টনীর ঊর্ধ্বে উঠে ঐক্যবদ্ধ ইসলামি উম্মাহর একটি উঁচু ধারণা তিনি উপস্থাপন করেন। তিনি ছিলেন সর্বপ্রকার গোঁড়ামিমুক্ত।
তিনি বলেন, ইমাম খোমেইনী একজন উঁচু মাপের কবিও ছিলেন। তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু ছিল নৈতিকতা, মানবতা, আল্লাহর সাথে বান্দার গভীর সম্পর্ক লাভের শিক্ষা এবং আল্লাহর সৃষ্টির সাথে মানুষের সম্পর্ক লাভের শিক্ষা ও দেশপ্রেম। তাঁর কবিতাগুলো শেখ সাদী (রহ.) ও মাওলানা রুমি (রহ.)-এর ভাবাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত যার গভীরতা অনেক।
প্রফেসর ড. মাইমুল আহসান খান বলেন, একটি সময়ে ইমাম খোমেইনী (রহ.)-কে লেলিন, মাও সেতুং এর মতো বিপ্লবী নেতার মতো মনে করা হতো, কিন্তু অচিরেই ইমাম খোমেইনীর স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব প্রকাশিত হয় এবং তাঁর আধ্যাত্মিকতার দিকটি সকলের সামনে উদ্ভাসিত হতে শুরু করে। তবে এ মহান ব্যক্তিত্বের নানা দিক এখনও উন্মোচিত হয় নি।
হুজ্জাতুল ইসলাম মোহাম্মদ আশরাফ উদ্দিন খান বলেন, ইমাম খোমেইনী এমন একটি নাম যার সাথে কেবল ইসলামি বিপ্লবই নয়, বরং আধ্যাত্মিকতার বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। ইমাম খোমেইনীর বিপ্লব সাড়া বিশ^কে নাড়া দেয়। বিপ্লবের পর এর স্থায়িত্ব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছিল, নানা ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল, কিন্তু সকল ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান দিন দিন অগ্রগতির পানে এগিয়ে চলছে।
জনাব তানিম নওশাদ বলেন, ইমাম খোমেইনী এমন এক সময় বিপ্লবের নেতৃত্ব দেন যখন ইরানের জনগণ রাজনীতি ও অন্যান্য সামাজিক বিষয়াদি সম্পর্কে সচেতন থাকলেও এর সাথে আধ্যাত্মিকতার বিষয়টিতে সেভাবে সচেতন ছিল না। ইমাম খোমেইনী জনগণকে আধ্যাত্মিক রাজনৈতিক চর্চায় উদ্বুদ্ধ করেন।
জনাব মোহাম্মদ রেযা নাফার বলেন, ইমাম খোমেইনীর বহুমুখী ব্যক্তিত্বের কথা বলে শেষ করা যাবে না। তিনি ছিলেন অনন্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী যিনি বস্তবাদী রাজনীতির বিপরীতে পরিচ্ছন্ন রাজনীতিকে আধ্যাত্মিকতার সাথে সংমিশ্রিত করেছেন। তিনি এমন এক বিপ্লবী চিন্তাধারা উপস্থাপন করেন যা আজও ইরানি জনগণকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে।
ড. আনিসুজ্জামান বলেন, ইমাম খোমেইনী ছিলেন সা¤্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার একজন সংগ্রামী মহাপুরুষ। তিনি মহান আল্লাহর ওপর ভরসা করে এমন একটি বিপ্লব সংঘটিত করেন যা আজও সফলভাবে টিকে রয়েছে।
আন্তর্জাতিক আল-কুদ্স দিবস উদ্যাপন
আন্তর্জাতিক আল-কুদ্স দিবস (পবিত্র রমযানের শেষ শুক্রবার) উপলক্ষে আল-কুদ্স কমিটি বাংলাদেশ-এর উদ্যোগে ২৫ রমযান ১৪৪০ হিজরী, শুক্রবার, ৩১ মে, ২০১৯ বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) মিলনায়তনে ‘আল-কুদ্স মুক্তির অন্বেষায়’ শীর্ষক এক সেমিনারের আয়োজন করা হয়।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী জনাব আ.ক.ম মোজাম্মেল হক সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশে নিযুক্ত ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রাষ্ট্রদূত জনাব মোহাম্মদ রেযা নাফার, ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত জনাব ইউসেফ এস ওয়াই রামাদান ও সিটি ইউনিভার্সিটির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. বোরহান উদ্দিন বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান খান, ইস্টার্ণ প্লাস জামে মসজিদের খতিব মওলানা মুহাম্মদ রুহুল আমীন এবং বিশিষ্ট চিন্তাবিদ জনাব আবদুল্লাহ আল ক্বাফি।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন দৈনিক ইনকিলাবের সহকারী সম্পাদক জনাব জামাল উদ্দিন বারী। স্বাগত বক্তব্য রাখেন আল-কুদ্স কমিটি বাংলাদেশ-এর সহ-সভাপতি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী জনাব এ.কে.এম. বদরুদ্দোজা। সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ও আল কুদ্স কমিটি বাংলাদেশ-এর সভাপতি প্রফেসর ড. শাহ কাওসার মুস্তাফা আবুলউলায়ী।
জনাব আ.ক.ম মোজাম্মেল হক বলেন, ইসরাইল কর্তৃক দখলকৃত ফিলিস্তিনের কারণে সকল মুসলমান ব্যথিত, তবে মধ্যপ্রাচ্যের কতিপয় দেশ ছাড়া। বরং তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ইসরাইলকে সমর্থন ও সাহায্য-সহযোগিতা করে চলেছে। আমরা আল-কুদ্স দিবস পালনের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করি। আমরা এই সেমিনারের মাধ্যমে ইসরাইলি বর্বরতার নিন্দা জানাই। বিশে^র সকল মানবতাবাদী মানুষের উচিত ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ সরকার ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবসময় ইসরাইলি নিষ্ঠুরতাকে নিন্দা করেছেন এবং ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছেন।
জনাব রেযা নাফার বলেন, একটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে যে, যদি কোন মুসলমান সাহায্যের আবেদন জানায় এবং অপর মুসলমান তাকে সাহায্য না করে তাহলে সে আসলে মুসলমান নয়। ফিলিস্তিনি মুসলমানরা আমাদেরকে সাহায্যের জন্য আহ্বান জানাচ্ছে, আর আমাদের উচিত তাদেরকে সাহায্য করা। ফিলিস্তিন ও আল-কুদ্স এর মুক্তির লক্ষে আল-কুদ্স দিবস পালন করা হয়ে থাকে। এ দিবস পালনের অর্থ হলো ইসরাইলের অস্তিত্বের বিরোধিতা করা। এটি একটি আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। বিশে^র বিপুল সংখ্যক মানুষ আজ ফিলিস্তিনের সমর্থনে ময়দানে অবতীর্ণ হয়।
জনাব ইউসেফ রামাদান বলেন, ফিলিস্তিনিরা নির্যাতিত অবস্থার মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করছে। পবিত্র ভূমিতে তারা রক্ত দিয়ে যাচ্ছে। জেরুজালেম ছাড়া কোন চুক্তি ফিলিস্তিনিরা মেনে নেবে না। তারা নিজেদের মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন। আর আমাদের উচিত মুসলমানদের মধ্যকার ঐক্য যেন বিনষ্ট না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা।
অধ্যাপক ড. বোরহান উদ্দিন বলেন, ফিলিস্তিনকে নিয়ে শত বছর আগে যে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল তা প্রতিনিয়ত চলছে, নতুন নতুন ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। আমাদের উচিত এসব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সতর্ক হওয়া। মৌখিত প্রতিবাদের সাথে সাথে আমাদেরকে বাস্তব কর্মগত প্রতিবাদের কর্মতৎপরতা চালাতে হবে। ইসরাইলি পণ্য বর্জন করা এরূপ কর্মতৎপরতার একটি দৃষ্টান্ত হতে পারে।
ড. ছিদ্দিকুর রহমান খান বলেন, ফিলিস্তিনকে ঘিরে বর্তমানে যে নতুন নীল নকশা রচনা করা হয়েছে তা বাস্তবায়নের জন্য বাহরাইনে যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে তা হবে প্রথম পদক্ষেপ। আমরা এই নীল নকশা ‘দ্য ডিল অব সেঞ্চুরি’-কে ধিক্কার জানাই। ইসরাইল ও মার্কিন ষড়যন্ত্রের ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের কোন কোন দেশের ভূমিকাও নিন্দনীয়। ইরান ফিলিস্তিন ইস্যুতে প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করায় তারা ইরানের বিরুদ্ধে অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই।
জনাব আবদুল্লাহ আল ক্বাফি বলেন, প্রথম বিশ^যুদ্ধের পর বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ফিলিস্তিনকে নিয়ে যে সংকটের সূত্রপাত হয়েছিল বর্তমানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কারণে সেই সংকট আরো ঘনীভূত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তরের মাধ্যমে নতুন করে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা তৈরি করা হয়েছে। আমরা এ সংকটের মোকাবিলায় ফিলিস্তিনি মুক্তিকামী জনগণের ইন্তিফাদা আন্দোলনের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করছি।
মাওলানা রুহুল আমীন বলেন, ইসরাইলিরা ফিলিস্তিন, জর্ডান, সিরিয়া, মিশর, ইরাক নিয়ে বৃহত্তর ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছে। এদের বিরুদ্ধে মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তবে মধ্যপ্রাচ্যের কতিপয় দেশের কারণে মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেইনীর আল-কুদ্স দিবস পালনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমরা ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে যাব।
স্বাগত বক্তব্যে অ্যাডভোকেট বদরুদ্দোজা বলেন, যায়নাবদী ইসরাইল দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিনের জনগণের ওপর নির্যাতন চালিয়ে আসছে। তারা আল-কুদ্স দখল করে রেখেছে। ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী রাষ্ট্র ইরানকে তারা কোণঠাসা করার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করছে। যদি তারা এতে সফল হয় তবে ফিলিস্তিন মুক্তির সম্ভাবনা অনেক দূরে সরে যাবে। কিন্তু তাদের এ অপচেষ্টা কখনও সফলতা লাভ করবে না।
সেমিনারের সভাপতি প্রফেসর ড. শাহ কাওসার মুস্তাফা আবুলউলায়ী বলেন, ফিলিস্তিন ও আল-কুদ্স প্রসঙ্গে প্রত্যেক মুসলমানকে ঈমানী দায়িত্ব পালন করতে হবে। মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ ও কর্মসূচি হাতে না নিলে আল-কুদ্স মুক্ত হবে না। কেবল ঐক্যবদ্ধ উম্মাহই যায়নবাদী ইসরাইলের হাত থেকে মযলুম ফিলিস্তিনিদেরকে মুক্তি দিতে পারে।
প্রবন্ধকার জনাব জামাল উদ্দিন বারী বলেন, ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লব সফল হওয়ার পর মহান নেতা ইমাম খোমেনী (র) পবিত্র রমজান মাসের শেষ শুক্রবারকে কুদ্স দিবস ঘোষণা করেন। সেই থেকে ইরানসহ বিশ্বের বহু দেশে কুদ্স দিবস পালিত হয়ে আসছে। ফিলিস্তিন ও পবিত্র বায়তুল মোকাদ্দাস দখলদার ইহুদিবাদীদের হাত থেকে মুক্ত করার জন্যে মুসলমানদের জাগিয়ে তোলাই আল-কুদস দিবসের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।
তিনি আরো বলেন, সম্প্রতি ইসলাম ও মানবতার দুশমন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামকে চিরতরে নিঃশেষ করার লক্ষে এক ভয়াবহ ষড়যন্ত্রমূলক চুক্তি (ডিল অফ দা সেঞ্চুরি বা শতাব্দীর সেরা চুক্তি) স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু যায়নবাদী গুরুদের প্রেসক্রিপশনে রচিত কথিত ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি ব্যর্থ হতে বাধ্য। মধ্যপ্রাচ্যের নেতাদের অনেকেই ইতিমধ্যে এই গোপন চুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ফিলিস্তিন ও আল-আকসার বন্দিদশা পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ও সামরিক ধ্বংসযজ্ঞ থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও নিপীড়িত বিশ্বের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্য অর্জনের পথে অন্যতম অন্তরায়। মুসলমানদের ঐক্য এবং মানবতার প্রতি বিশ্বসম্প্রদায়ের কমিটমেন্ট সেই অন্তরায়ের অর্গল ভেঙ্গে দিতে পারে।
সেমিনারের পূর্বে দুপুর ৩টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে নিপীড়িত ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে একটি মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
খুলনায় আল-কুদস দিবস পালিত
আন্তর্জাতিক আল-কুদ্স দিবস উপলক্ষে খুলনা আঞ্জুমান-এ-পাঞ্জাতানী ও আহলে বাইত (আ.) ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে গত ৩১ মে বাদ জুমআ নগরীর আলতাপোল লেনস্থ আঞ্জুমান-এ-পাঞ্জাতানী ইমামবাড়ী হতে এক বিক্ষোভ র্যালী বের হয়ে নগরীর আলতাপোল লেন ও সাউথ সেন্ট্রাল রোড প্রদক্ষিণ করে কেন্দ্রে এসে শেষ হয়।
র্যালী শেষে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্রের অধ্যক্ষ হুজ্জাতুল ইসলাম সৈয়দ ইব্রাহীম খলিল রাজাভী বলেন, সারা বিশ্ব জুড়ে মুসলমানদের ওপরে যে বর্বোরোচিত অত্যাচার-যুলুম নেমে এসেছে সে প্রেক্ষাপটে আজ মুসলমানদের মধ্যে সকল বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। বিশ্ব আল-কুদ্স দিবস পালন করার উদ্দেশ্য হলো ফিলিস্তিনিদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করা এবং এটা বোঝানো যে, আমরাও তাদের সাথে আছি। আমেরিকা ইসরাইলি অপকর্ম আড়াল করার উদ্দেশ্যে মধ্যপ্রাচ্যে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করছে।
কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন হুজ্জাতুল ইসলাম ড. আলী মুর্তজা, হুজ্জাতুল ইসলাম আব্দুল লতিফ, হুজ্জাতুল ইসলাম মোঃ শহীদুল হক এবং আঞ্জুমান-এ-পাঞ্জাতানীর নেতৃবৃন্দ ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।
এটি ১টি ছবি দিয়ে বক্স নিউজ হবে
যশোরে আল-কুদ্স দিবস উদ্যাপন
গত ৩১ মে মাহে রমযানের শেষ শুক্রবার ইনকিলাবে মাহ্দী মিশনের উদ্যোগে আর. এন. রোড যশোর কার্যালয়ে আল-কুদ্স দিবস উদ্যাপিত হয়েছে।
ইনকিলাব-এ-মাহ্দী মিশনের পরিচালক জনাব সিরাজুল ইসলামের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখেন হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা মোঃ মিজানুর রহমান, ঐতিহাসিক দানবীর হাজী মুহাম্মাদ মহ্সীন মুড়লী ইমাম বাড়ি যশোরের পেশ ইমাম জনাব ইকবাল হুসাইন, জনাব আতাহার হুসাইন প্রমুখ।
ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে মহাকবি শেখ সাদীর স্মরণ অনুষ্ঠান
বিশ্বখ্যাত ইরানি কবি শেখ সাদীর স্মরণে গত ২৩ এপ্রিল ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র মিলনায়তনে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। অনুষ্ঠানে প্রধান আলোচক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ইরানি ভিজিটিং প্রফেসর ড. কাযেম কাহদুয়ী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র প্রফেসর ড. কে এম সাইফুল ইসলাম খান।
ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কালচারাল কাউন্সেলর ড. মাহদী হোসেইনী ফায়েকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠোনে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আবুল কালাম সরকার।
অনুষ্ঠানে ড. কাযেম কাহদুয়ী বলেন, এমন এক মহান কবির স্মরণ অনুষ্ঠানে আজ আমরা উপস্থিত হয়েছি যার নাম জানে না উপমহাদেশে এমন মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে। সাদী শিরাজি ছিলেন মানবতার কবি। তাঁর সাহিত্যকর্মে নৈতিকতা, মানবতা ও বিনম্রতার বিষয়টি বিশেষভাবে প্রাধান্য পেয়েছে। তার মতে, ফুলের সং¯পর্শে মাটির ঢেলা যেমনিভাবে সুগন্ধি প্রাপ্ত হয়, অনুরূপ জ্ঞানী-গুণীর সং¯পর্শে থাকলে মানুষের চরিত্রেও এ প্রভাব পড়াটা স্বাভাবিক। সাদী বলেন, তারাই প্রকৃত বড় যাদের মধ্যে কোন দম্ভ বা অহঙ্কার নেই। মানবতা ও বিনম্রতার এক উদাহরণ দিয়ে ড. কাহদূয়ী বলেন, একজন গিটার বাদক কোন কারণে রেগে গিয়ে অপর একজনের মাথায় তার গিটার দিয়ে আঘাত করে গিটারটি ভেঙে ফেলেছে এবং লোকটির মাথা ফেটে গেছে। লোকটি এর প্রতিবাদ না করে যখন উল্টো বলছে আমার মাথা হয়তো ভালো হয়ে যাবে, কিন্তু এই দরিদ্র লোকটার গিটারটা ভেঙে গেল! সে এখন গিটার পাবে কোথায়? এমন মানুষগুলোই যে প্রকৃত বড় মানুষ, মানবতার অগ্রদূত কবি সাদী তার সাহিত্যকর্মে তা চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন।
প্রফেসর ড. কে এম সাইফুল ইসলাম খান বলেন, সাদী ছিলেন অমর কবি। তিনি বিশে^র বিভিন্ন জনপদ ভ্রমণ করে সমাজের মানুষকে কাছে থেকে দেখেছেন এবং সেই অভিজ্ঞতা তিনি লেখনির মাধ্যমে মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন। তাঁর গ্রন্থ ‘গুলিস্তান’ সমাজ কল্যাণের একটি বড় গ্রন্থ। সাদী বলেন, অহঙ্কার পতনের মূল। যারা অহঙ্কার করে তারা কখনো বড় হতে পারে না। তিনি বলেন, সাদী তাঁর সাহিত্যকর্মের মধ্য দিয়ে মানুষের মাঝে বেঁচে আছেন এবং থাকবেন।
ড. মাহদী হোসেইনী ফায়েক বলেন, কবি সাদী কেবল ফারসি ভাষাভাষিদের কবি ছিলেন না। তিনি ছিলেন বিশ্বকবি। তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি বিখ্যাত হয়েছেন। এমন কবি সাহিত্যিকদের স্মরণ অনুষ্ঠান আমাদেরকে সাহিত্য চর্চায় আরো অনুপ্রাণিত করবে।
অধ্যাপক আবব্দুস সবুর খানের সঞ্চালনায় এ অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ছাত্র বাদল মিয়া, নাজমুল ইসলাম ও ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ফারসি ভাষা শিক্ষা কোর্সের ছাত্রী সিফাতে এলাহী।
বাংলাকে সমৃদ্ধ করেছে আরবি, ফারসি : প্রফেসর আব্দুল মান্নান
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর আব্দুল মান্নান বলেছেন, প্রতিটি ভাষাই বিদেশি শব্দ দ্বারা সমৃদ্ধ হয়। বাংলাও তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলায় বিদেশি শব্দের ব্যবহার না থাকলে এই ভাষাটিও সংস্কৃত ভাষার মতোই একটি মৃত ভাষায় পরিণত হতো। বিদেশি ভাষা বিশেষকরে আরবি ও ফারসি এই ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে। গত ২৬ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরসি মজুমদার হলে আঞ্জুমানে ফারসি’র কাউন্সিল অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন।
অধ্যাপক মান্নান বলেন, আমার জন্মস্থান চট্টগ্রাম ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সর্বশেষ অঞ্চল হলেও এটি ছিল বিভিন্ন ভাষাভাষীদের প্রবেশ পথ। যে পথে ব্যবসায়ীদের সাথে বিভিন্ন ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রবেশ ঘটেছে। তিনি বলেন, বঙ্গ ছিল এ অঞ্চলের সবচেয়ে সমৃদ্ধ অঞ্চল। আর এখানে হাজার বছরের প্রাচীন বন্দর থাকায় এ পথ দিয়েই বেশিরভাগ বণিক এ অঞ্চলে প্রবেশ করতো। যে কারণে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় এখনও প্রচুর বিদেশি শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, ফারসি এমন একটি ভাষা যা বিশ্বকে অনেক আন্তর্জাতিক মানের কবি,সাহিত্যিক উপহার দিয়েছে। এই ভাষাটি উপমহাদেশে দীর্ঘ সময় রাষ্ট্রীয় ভাষা ছিল। এ অঞ্চলে ফারসি ভাষার বিস্তারে আঞ্জুমানে ফারসির নব গঠিত কমিটি নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করবে বলে আমার বিশ্বাস।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকাস্থ ইরান দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ রেযা নাফার। তিনি বলেন, এ অঞ্চলে ফারসি ভাষা ও সংস্কৃতি বিস্তারের লক্ষ্যে গঠিত আঞ্জুমানে ফারসির এই কাউন্সিল অনুষ্ঠানে ফারসি ভাষাভাষীদের দেশ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রাষ্ট্রদূত হিসাবে উপস্থিত থেকে নিজেকে ইতিহাসের অংশ করতে পারায় গৌরবান্বিত অনুভব করছি। আশাকরছি নতুন কমিটি আঞ্জুমানে ফারসির পথ চলাকে আরো বেগবান করবে। যাঁরা অতীতে এই আঞ্জুমানের সাথে জড়িত থেকে মেধা ও সময় ব্যয় করেছেন তাঁদেরকে ধন্যবাদ জানানোর পাশাপাশি যাঁরা গত হয়েছেন তাঁদেরকেও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন রাষ্ট্রদূত রেযা নাফার। তিনি কবি শেখ সাদীর স্মরণ দিবসের কথা উল্লেখ করে বলেন, ইরানে যত বড় বড় কবি সাহিত্যিক রয়েছেন সাদী তাঁদের অন্যতম। গত ২১ এপ্রিল ফারসি পহেলা উর্দিবেহেশস্ত ছিল সাদীর স্মরণ দিবস। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো একে সাদী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তাঁর রচিত ফারসির ফুলবাগান খ্যাত ‘গুলিস্তান’ ও ‘বুস্তান’ এখনও সুবাস ছড়াচ্ছে। জাতিসংঘের প্রধান ফটকে লেখা তাঁর কবিতা বিশ্বজুড়ে মানবতার বাণী ছড়াচ্ছে। সাদীর গজলের একটা বিরাট অংশ ইসলামের নবী, ও নবী পরিবারকে কেন্দ্র করে। আরেফদের জন্য মর্তবা, মহব্বত সাদীর কবিতার বিরাট অংশ প্রেমের গাথুনি দিয়ে গ্রথিত। সাদী আমেরিকা ও ইউরোপে খুবই পরিচিত। পুশকিন, হুগো, ইমারসন সাদীর কবিতার প্রশংসা করেছেন।
অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ইরানি ভিজিটিং প্রফেসর ড. কাযেম কাহদুয়ী ফারসি প্রেমিকদের সম্মান ও মর্যাদা কামনা করে বলেন, ইরান ছাড়াও বেশ কয়েকটি দেশে ফারসি ভাষার প্রচলন রয়েছে। তবে ইরানের ফারসি ও আফগানিস্তানে ব্যবহৃত ফারসি দারির মধ্যে কোন পার্থক্য আছে কি না সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দুটি ভাষারই মূল উৎস একই। এই ভাষাটি নতুন নতুন রাষ্ট্রে এসে নতুন নতুন রূপ পায়। তিনি বলেন, ইরানের ফারসি, ফারসি দারি ও ফারসি তাজিকের মধ্যে মৌলিক কোন পার্থক্য নেই। পার্থক্য কেবল উচ্চারণগত।
অনুষ্ঠানে আঞ্জুমানে ফারসির সাবেক সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. কে এম সাইফুল ইসলাম খান বলেন, ইসলামের সূচনা হয়েছে আরবে কিন্তু এ অঞ্চলে ইসলাম এনেছেন পারস্যের সুফি-সাধকরা। প্রায় ৬৩৬ বছর এ অঞ্চলে ফারসি রাষ্ট্রীয় ভাষা ছিল।বাংলা ভাষার গবেষক ড. মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ বলেছেন, বাংলা ভাষায় প্রায় ৮ হাজার ফারসি শব্দ রয়েছে ।
এদেশের মাদ্রাসা শিক্ষায় দীর্ঘকাল ধরে ফারসি ভাষা পড়ানো হলেও পাকিস্তান আমলে এর গুরুত্ব কমে যায়। ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পর ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও বাংলাদেশ সরকারের সহায়তায় ধীরে ধীরে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা বাড়তে থাকে। বর্তমানে দেশের তিনটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত ৩০ জন শিক্ষক ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের প্রসারে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও ত্রিশালে কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ চালু করতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সহায়তা কামনা করেন।
আঞ্জুমানে ফারসির সদ্য বিদায়ী সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আবুল কালাম সরকার বলেন, দীর্ঘদিন পর আঞ্জুমানে ফারসির পুনরুজ্জীবনে সহযোগিতার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ফারসির বিস্তার ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারসি বিভাগ চালু করার ব্যাপারে যে দাবি উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সহায়তায় তা আলোর মুখ দেখবে বলে আমি আশাবাদী।
অনুষ্ঠানে ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কালচারাল কাউন্সেলর ড. মাহদী হোসেইনী ফায়েক বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর এ অঞ্চলে ফারসি চর্চা নতুন মাত্রা পায়। কালচারাল সেন্টারের প্রধান পৃষ্ঠপোষকতায় আঞ্জুমানের নতুন কমিটির র্নির্বাচনকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, ফারসির উন্নয়নের জন্য এ অনুষ্ঠান মাইল ফলক হয়ে থাকবে। অতীতে যারা আঞ্জুমানে ফারসির নেতৃত্ব দিয়েছেন বিশেষকরে অধ্যাপক সিরাজুল হক, ড. কুলসুম আবুল বাসার, ড. এ. কে. এম. মাহবুবুর রহমান, মরহুম ফরিদ উদ্দিন খান, ড. সাইফুল ইসলাম খান, আবুল কালাম সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে ড. মাহদী ফায়েক বলেন ফারসি ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশে ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পক্ষ থেকে অতীতের মতো সাহায্য-সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে ।
আলোচনা পর্ব শেষে নতুন কমিটি গঠন করা হয়। নতুন কমিটির সভাপতি হিসাবে নির্বাচিত হন বিশিষ্ট লেখক, সাহিত্যিক ও ফারসি গবেষক ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী, সহ সভাপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. মহসিন উদ্দিন মিয়া ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন, সাধারণ স¤পাদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউটের ফারসি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শামীম বানু, যুগ্ম স¤পাদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আহসানুল হাদী, কোষাধ্যক্ষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউটের ফারসি বিভাগের শিক্ষক এ্যাডভোকেট কামাল হোসাইন, প্রচার স¤পাদক আহসানিয়া ইন্সটিটিউট অফ সুফিজম এর সহকারী অধ্যাপক শেইখ মোহাম্মদ ওসমান গণি, প্রকাশনা স¤পাদক ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম, অনুবাদ ও গবেষণা স¤পাদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মেহেদি হাসান ও অফিস স¤পাদক মোহাম্মদ ইব্রাহিম।সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হন জামিয়াতুল মোস্তফা বিশ্ববিদ্যালযের শিক্ষক শাহনাজ আরেফিন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আতাউল্ল্যাহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক ড. সিদ্দিকুর রহমান খান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের চেয়ারম্যান ড. নূরে আলম ও ঢাকাস্থ ইরানিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল আব্দুল কুদ্দুস বাদশা। অনুষ্ঠানে নাত পরিবেশন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মেহেদি হাসান।অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুস সবুর খান।
উচ্চারণ : সাঙ্গে মস্তফা কালা’গ হাম মোফ্ত কালাম
سنگ مفت کلاغ هم مفت
অর্থ : বিনামূল্যে পাথর, কাকও বিনামূল্যে।
মর্মার্থ : তোমার তো খরচপাতি কিছুই নাই। যতখানি চাও ব্যবহার কর, কাজে লাগাও। কিসের অপেক্ষায় আছ- এই ভাবার্থ বুঝাতে এই প্রবাদটির প্রচলন ব্যাপক।
سنگی را که دیوانه¬ای در چاه بیندازد صد عاقل نمی تواند در بیاورد
উচ্চারণ : সাঙ্গী রা’ কে দীওয়া’নেঈ দার চা’হ বেয়ান্দা’যাদ সদ আ’কেল নেমী তাওয়া’নাদ দার বিয়া’ওয়ারাদ
অর্থ : যে পাথর কোনো পাগল কুয়ায় নিক্ষেপ করে শত বিদ্বান মানুষও তা উদ্ধার করতে পারে না।
মর্মার্থ : ভালোভাবে চিন্তা-ভাবনা করে কোনো কাজ আঞ্জাম না দিলে যে ক্ষয়ক্ষতি তা বহু জ্ঞানীগুণি লোকের পক্ষেও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয় না।
سوار خر شیطان شدن
উচ্চারণ : সাওয়া’রে খারে শায়তা’ন শোদান
অর্থ : শয়তানের গাধার পিঠে সওয়ার হওয়া।
মর্মার্থ : দুষ্টামি করতে থাকা। অন্যদের ক্ষতি করার পেছনে লেগে থাকা। অসম্ভব রকমের শয়তানি করা।
سوار کسی شدن
উচ্চারণ : সাওয়া’রে কেসী শোদান
অর্থ : কারো ওপর সওয়ার হওয়া।
মর্মার্থ : কারো ওপর নিজের ইচ্ছা চাপিয়ে দেয়া। কাউকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করা।
سوار از پیاده خبر ندارد
উচ্চারণ : সাওয়া’র আয পেয়া’দে খাবার নাদা’রাদ
অর্থ : পদাতিকের খবর আরোহীর নেই।
মর্মার্থ : যারা ধনসম্পদের অধিকারী, গরীবের খবর তাদের কাছে নেই। সম্পদশালীরা গরীবের অবস্থা উপলব্ধি করতে পারে না বুঝাতে এই প্রবাদ ব্যবহৃত হয়।
অনুবাদ : ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
তোমার আগমনে
মুহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন খান :
তোমার আগমনে হে প্রিয়!
কী অবাক করা সাজে রঙিন এ শহর
কতো অনিদ্র রজনী কেটে যায় অধীর
অসহ্য প্রতীক্ষায়
নগরের অলিগলি মাঠঘাট ধুয়ে হয় সাফ
যেনো নিশিথে পতিত সুঁই-ও তোলা যায়
গোলাব পাশ ছড়ায় মাতানো সুঘ্রাণ
কাশানের কামছার থেকে আনীত গোলাপ জল
জমিন থেকে তাই এবার গগন পানে
পবিত্র সুরভী উড়ে
অবশেষে আসে সেই মহালগন
সারা আসমান জুড়ে ছড়ানো
কলেমার মহাপতাকা উড়িয়ে
ঘটে তোমার আগমন
কোটি কোটি হাত জানায় আদরের আবেশ
ক্ষণিকের জন্যেও নীরব নয় দরূদ আর
তকবিরের রেশ
তোমায় দেখে উল্লসিত জনতার মুখ
যেনো সিরাজের ফুটন্ত গোলাপ
অসহায় মজলুমের বুকে আসে দুর্দান্ত প্রতাপ
তোমার আগমন দেখে
খিড়কি পথে এফ্রিত ছুটে পালায়
ফেরেশতার আগমনে যেন দানবের প্রস্থান
জা’য়াল হাক্কু ওয়া যাহাকাল বাতিল
আহা! কি অপূর্ব উল্লাস সর্বহারার মনে
বিজয়ের ঊষালোক ছড়ায়
আড়াই হাজার বছরের অমানিশা শেষে
শহীদদের সুখময় বাগিচা বেহেশতে যাহরায়
সাফ সাফ বলে দিলে তুমি এ ইলহামী ঘোষণা
“শাহী সরকারের মুখ গুঁড়ো করে দেবো
করবো ঐশী সরকার গঠন।”
আহা! কি অবাক উল্লাসে ফেটে পড়ে বঞ্চিত মুস্তাজাফ
অথচ নিয়াভারান শাহী ভবন থেকে শুরু করে
ক্রেমলিন হোয়াইট হাউজে ছড়িয়ে পড়ে
আতংক ও ধসের আঘাত
তাই এমনি অলৌকিক আগমন
হে প্রিয়তম ঘটুক বারবার
ফলুক জালিমের উপর চির অভিসম্পাত
হে প্রিয়তম! অব্যাহত থাকুক তোমার জ্যোতির্ময় পথ
প্রতিশ্রুত মাহদীর আগমন তক।
ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর স্মরণে কবিতা
মোঃ শাহ নওয়াজ তাবিব
দুই দিকে দুই পরাশক্তি
কার প্রতি আজ সব ভক্তি?
তুরবাহ আর তাসবিহ দুহাতে ইমাম তখন বলেন,
এরাই আসল পরাশক্তি এদের সাথেই চলেন।
এক দিকে চলে সবদেশ সারাবিশ্ব
উজান বেয়ে একদিন হবে নিঃস্ব।
বলেন ইমাম- মুসলিম রাখি রোজা
আমাদের সব হিসেব কিতেব সোজা-
পাই-পাবো, না পাই- না খাবো
তবু কি এ হাত পাতবো?
রোজা রেখে ফের ঐশী আশেক
খোদা প্রেমে তবে মাতবো।
এত বড় এক খবর ইমাম! বলুন কেমন লাগছে?
চারদিকে ঐ শয়তানী ভূত কেমন দূরে ভাগছে!
সৌম্যশান্ত ইমাম তাকান দিগন্তপারে দৃষ্টি
খোদার রঙে রঙিন দেখেন রাজ্যির সব সৃষ্টি।
প্রেম পিয়াসে অধীর হৃদয় কেমনে শান্ত হবে,
পার্থিব লোভে লোভী ঐ সব বোদ্ধা বোঝে কবে?
তাবাস মরুতে কী ঘটলো?
যান্ত্রিক ত্রুটি শুধু রটলো!
আসলে তা নয় শোনো হে বন্ধু, শোন পেতে আজ কান
আব্রাহা যার হাতে ধ্বংস সেই সে মহীয়ান
ইমামের ইসলামী বিপ্লব করলেন বেগবান।
নবীজীর নামে কুৎসা রটায় কুপমন্ডুক রুশদী
কুলুপ এঁটেছে রাজা বাদশারা
মনে হয় কষে ঢুস্ দি।
এমন সময় তোমারই কণ্ঠে শাস্তির শুনি ঘোষণা
বন্ধুরা আসো খোলা অন্তরে আর বিদ্বেষ পোষণা।
খোদার হাবীব, আহলে বাইত- তোমার শক্তি ঈমানী
তোমার নেশার এক রতি দাও- চাই বুঁদ হওয়া ঝিমানী।
শেখ সাদী ও ‘বুস্তান’
শাহনাজ আরফিন –
বাংলা ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে ফারসি ভাষার ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। ১৮৩৫ সাল পর্যন্ত ভারত উপমহাদেশে ফারসি ভাষার প্রচলন ছিল। ফারসি ভাষার বিশিষ্ট কবি শেখ সাদী, হাফিজ, ওমর খৈয়াম, মাওলানা রুমী ও ফেরদৌসির নাম জানে না এমন লোক আমাদের সমাজে খুব কমই আছে।
ইরানের কবি শেখ সাদীর অনেক কবিতা এখনও আমাদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান এবং মিলাদ মহফিলের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে।
বালাগাল উলা বি কামালেহি
কাশাফাদ্দুজা বি জামালেহি
হাসুনাত জামিউ খেসালেহি
সাল্লু আলাইহি ওয়া আলেহি।
অর্থ : ‘সমাসীন তিনি সুউচ্চ শিখরে, নিজ মহিমায়
তিমির-তমসা কাটিল তার রূপের প্রভায়
সুন্দর আর সুন্দর তাঁর স্বভাব, চরিত্র তামাম
জানাও তাঁর ও তাঁর বংশের ’পরে দরূদ সালাম।’
মহান কবি শেখ সাদী নবীজীর শানে লেখা তাঁর এ আরবি কবিতায় যে আবেগময়ী ও প্রাঞ্জল ভাষায় রাসূলে খোদার (সা.) ওপর দরূদ ও সালাম পৌঁছে দিয়েছেন তা সত্যিই নজিরবিহীন। এছাড়া পরোপকার এবং দুস্থ মানবতার কল্যাণে তিনি নিজে যেমন ব্রতী ছিলেন তেমনি অন্যকে প্রেরণা যুগিয়েছেন এইভাবে-
‘তরীকত বেজুয খেদমাতে খাল্ক নিস্ত
বে তাসবীহ ও সাজ্জাদে ও দাল্ক নিস্ত।’
তাঁর এ বাণী মুসলিম জাহানে অমর হয়ে আছে।
ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র এই মহান কবির জীবণ ও কর্ম কেবল ফারসি ভাষাভাষী মানুষের জন্যেই নয়, বরং বিশ্বের যে কোন ভাষার সাহিত্যানুরাগীর কাছেই মূল্যবান দিক-নির্দেশনা হিসেবে কাজ করতে পারে।
শেখ সাদীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো ‘গুলিস্তান’, ‘বুস্তান’, ‘কারিমা’, ‘সাহাবিয়া’, ‘কাসায়েদে ফারসি ও আরবি’, ‘গাযালিয়াত’, ‘কুল্লিয়াত’ ইত্যাদি। এসব কাব্যগ্র›েহর মধ্যে ‘গুলিস্তান’ ও ‘বুস্তান’ আজও ভারত উপমহাদেশের বহু মাদ্রাসায় পাঠ্য বই হিসেবে পড়ানো হয়।
সাদীর ‘গুলিস্তান’ বিশ্বসাহিত্যের অমূল্য সেরা স¤পদ হিসাবে স্বীকৃত। এটি পৃথিবীর প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তবে ‘বুস্তান’ গ্রন্থটিও সমমর্যাদার দাবিদার। এই দুটি কালজয়ী গ্রন্থ সেকালে সমগ্র এশিয়ায় বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।এ দুটি গ্রন্থের অনেক পঙ্ক্তি আজ ফারসি সাহিত্যে প্রবাদে পরিণত হয়েছে।
‘গুলিস্তান’ হচ্ছে উপদেশমূলক গদ্যের ফাঁকে ফাঁকে কাব্যে রচিত একটি গ্রন্থ। আর ‘বুস্তান’ পুরোটাই কাব্য। ‘গুলিস্তান’ মানে ফুলের বাগান আর ‘বুস্তান’ মানে বাগান বা সুবাসিত স্থান। ‘গুলিস্তান’ গ্রন্থে শেখ সাদী যেসব কাহিনী দিয়ে মানবমনের চিরন্তন বাগানে ফুল ফুটিয়েছেন তা অনেকটা দৃশ্যমান। কিন্তু ‘বুস্তান’-এর ফুলগুলো দৃশ্যমান নয়, কাছে গেলে অর্থাৎ নিয়মিত চর্চা করলে এর ভেতরের সুবাস মন-প্রাণকে বিমোহিত করে।
ইরানের সাহিত্য জগতে ‘শাহনামা’র রচয়িতা কবি ফেরদৌসির পরই রয়েছে শেখ সাদীর অবস্থান। শেখ সাদীর পুরো নাম হচ্ছে, আবু মোহাম্মাদ মুশরেফ উদ্দীন সাদী। তাঁর জন্ম ঠিক কবে হয়েছিল তা সঠিকভাবে কারো জানা নেই। তবে নিজ কাব্যগ্রন্থ ‘গুলিস্তান’-এ তিনি তাঁর জন্ম তারিখ প্রায় ৬০৬ হিজরি বা খ্রিস্টীয় ১২০৯ সাল বলে উল্লেখ করেছেন।
তিনি শিরাজ নগরীর এক ধর্মীয় পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর ভাষায়, আমি এমন এক পরিবারে জন্ম নিয়েছি ও বড় হয়ে উঠেছি যার প্রত্যেকেই ছিলেন উঁচু স্তরের আলেম।
জন্মস্থান শিরাজে ধর্মীয় ও সাহিত্যের প্রাথমিক ধাপগুলো অতিক্রম করার পর উচ্চ শিক্ষার জন্য তিনি বাগদাদে যান। শেখ সাদীকে নিয়ে গবেষণা করেছেন এমন অনেকের মতে, তাঁর এ বাগদাদ সফরই পরবর্তীকালে আরও অনেক দীর্ঘকালীন সফরের পটভূমি রচনা করেছিল।
তিনি বাগদাদের বিখ্যাত নিজামিয়া মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেন। কেবল বাগদাদে পড়ালেখা করেই তিনি থেমে যান নি , পরবর্তীতে তিনি বিশ্বের আরও বহু দেশ ভ্রমন করেন এবং সেখানকার বিজ্ঞ ও প-িত ব্যক্তিদের সাহচর্যে মূল্যবান জ্ঞান অর্জন করেন।
তিনি বেশ কিছুকাল হিকমাত ও দর্শনশাস্ত্রের বিজ্ঞ মনীষীদের সান্নিধ্যে কাটান। তাঁদের মধ্যে শেখ শাহাবউদ্দীন সোহরাওয়ার্দির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
শেখ সাদী তাঁর জীবনের একটি দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেন বিশ্বের নানা দেশ ঘুরে। এসব ভ্রমণ থেকে তিনি বহু মূল্যবান অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, শেখ সাদীর এসব ভ্রমণকে তাঁর জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যা আহরণের অক্লান্ত প্রয়াসের অংশ ধরা যায়। তিনি বাগদাদের নিজামিয়া মাদ্রাসায় পড়ালেখার পর বিশ্ব ভ্রমণে বের হন। তিনি হেজাজ, লেবানন, সিরিয়া ও রোমসহ বিশ্বের আরো বহু স্থান ঘুরে দেখেন। সাদীর ভাষায় :
در اقصی عالم گیتی بگشم سی
بر بردم ایام با هر کسی
تمتع ز هر گوشه اس یانتم
زهر جرمنی خوشه ای یافتم
অর্থাৎ আমি বিশ্বের বহু দেশ ঘুরে দিখেছি এবং বহু জনের সাথে দিবস যাপন করেছি। প্রত্যেক প্রান্তেই কোন না কোন শিক্ষা লাভ করেছি এবং প্রতিটি শস্যস্তূপ থেকেই শস্যদানা সঞ্চয় করেছি।
এখানে সাদী বুঝাতে চেয়েছেন যে, তিনি বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ করে অনেক মূল্যবান শিক্ষা অর্জন করেছেন এবং এভাবে নিজের জ্ঞান ভা-ার সমৃদ্ধ করেছেন।
শেখ সাদী দীর্ঘ সময় ভ্রমণে কাটাবার পর ৬৫৫ হিজরি বা ১২৫৭ খ্রিস্টাব্দে নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন এবং জীবনের বাকি অংশ শিরাজেই অতিবাহিত করেন। এসময় তিনি কাসিদা, গজল, বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা ও জনগণকে সদুপদেশ দেয়ার কাজে নিজেকে নিয়েজিত করেন। শেখ সাদী ৬৯১ হিজরি পর্যন্ত শিরাজ নগরীর অদূরে একটি নির্জন স্থানে আধ্যাত্মিক চর্চা ও মহান আল্লাহর ইবাদতে সময় কাটান। এসময় তিনি তাঁর মূল্যবান কাব্যগ্রন্থ ‘গুলিস্তান’ ও ‘বুস্তান’ রচনা করেন।
তিনি ফারসি ও আরবি ভাষায় কবিতা ও গজল রচনার পাশাপাশি নানা দেশ ভ্রমণ থেকে যে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, যে সব ঘটনা তিনি প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছেন সে সবকে কাজে লাগিয়ে তিনি ৬৫৫ হিজরিতে ‘বুস্তান’ কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। কথিত আছে, তিনি বিভিন্ন অঞ্চল ও দেশ ভ্রমণকালে ‘বুস্তান’ রচনায় হাত দেন এবং নিজ দেশে ফিরে এসে বন্ধু-বান্ধব ও শুভানুধ্যায়ীদের সামনে এই মূল্যবান রচনা উপস্থাপন করেন। ‘বুস্তান’কে নৈতিক জ্ঞান ও শিক্ষার আধার বলে মনে করা হয়। অবশ্য শেখ সাদী একে ‘সাদী নামা’ বলেও আখ্যায়িত করেছেন।
‘বুস্তান’-এর শুরুতেই রয়েছে মহান স্রষ্টার বন্দনা। অত্যন্ত সহজ-সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় কবি লিখেছেন :
‘কারীমা বে বাখশায়ে বার হা’লে মা’
কে হাস্তাম আসীরে কামান্দে হাওয়া
না দরাম গাইর আজ থো ফরিয়াদ রাছ
তু-য়ী আসীয়ারা খাতা বাখ্শ ও বাস্
নেগাহদার ম রা যে রাহে খাতা’।’
অর্থ : ‘হে দয়াল প্রভু, আমার প্রতি করুণা কর।
আমি কমিনার শিবিরে বন্দি।
তুমি ছাড়া আর কেউ নাই যার কাছে অমার ফরিয়াদ পৌঁছবে।
তুমিই পাপীদের একমাত্র রক্ষাকারী। তুমি পাপ পথ থেকে আমাকে রক্ষা কর।’
সাদীর ‘বুস্তান’ গ্রন্থে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের ওপর দশটি পর্ব রয়েছে। এসব বিষয়ের মধ্যে ইনসাফ বা ন্যায়বিচার, এহসান বা পরোপকার, ইশ্ক বা ভালোবাসা , বিনয়, সন্তুষ্টি আত্মতৃপ্তি, শিক্ষাদান ও প্রতিপালন এবং তওবা উল্লেখযোগ্য বিষয়।
‘বুস্তান’-এর জগৎ শেখ সাদীর আপন চিন্তা ও চেতনা থেকে উৎসারিত। এ বইয়ে তিনি একজন মানুষের কী গুণ-বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত চমৎকার ভাবে তা ফুটিয়ে তুলেছেন।
সাদী মুলত তার এই বইয়ে নিজের কল্পিত স্বর্গরাজ্যের চিত্র নিপুন শিল্পির তুলির আচড়ে চিত্রিত করেছেন।
বর্তমান পৃথিবী পাপ-পঙ্কিলতা, অন্যায়,অসত্য, আর কলুষতায় পরিপূর্ণ। অথচ ‘বুস্তান’-এ চিত্রিত পৃথিবী সত্য, সুন্দর, পবিত্র ও মার্জিত। সেখানে অন্যায় অবিচার, মানবতা ও মনুষ্যত্বের লাঞ্ছনার কোন স্থান নেই।
‘বুস্তান’-এ চিত্রিত সুন্দর ও পবিত্র পৃথিবীই সাদীর একান্ত কাম্য ও প্রত্যাশিত। সাদী তাঁর এ স্বপ্নের জগৎ চিত্রায়নে নিজ অভিজ্ঞতা, বিজ্ঞ ও প-িত ব্যক্তিদের জীবনী ও তাঁদের রেখে যাওয়া শিক্ষাকে ব্যবহার করেছেন। তিনি একজন প্রকৃত মানুষ বা মানুষের মর্যাদা তুলে ধরতে গিয়ে এসব সূত্র ব্যবহার করেছেন। এক চমৎকার বর্ণনায় তিনি দেখিয়েছেন,একজন মানবদরদী ও সাহসী যুবক নিজে হতদরিদ্র ও নিঃস্ব হওয়া সত্ত্বেও একজন অসহায় ও ঋণভারে জর্জরিত ব্যক্তিকে পাওনাদারের বন্দিত্ব থেকে মুক্তি দেবার জন্য কীভাবে নিজে জামিন হয়ে তাকে পালাবার রাস্তা দেখিয়ে দেয় এবং বছরের
পর বছর ধরে তার জায়গায় বন্দিত্বের জীবন বেছে নেয়।
অন্য এক বর্ণনায় তিনি দেখিয়েছেন, এক ব্যক্তি তার পড়শীর বাড়িতে চুরি করতে আসা এক অসহায় চোরকে কিভাবে নির্দিষ্ট বাসায় চুরি করতে বাধা দিয়ে স¤পূর্ণ অপরিচিত লোকের বেশে নিজ বাড়িতে নিয়ে যায় এবং নিজের বিছানাপত্রসহ সব মালামাল তার হাতে তুলে দেয় যাতে সে খালি হাতে বাড়ি না ফিরে।
সাদীর ‘বুস্তান’-এ মানুষ, গাছপালা, পশুপাখি, এমনকি জগতের প্রতিটি বস্তুকে বাকশক্তিস¤পন্ন দেখানো হয়েছে। এই গ্রন্থের প্রতিটি বস্তুই যেন একে অপরের সহমর্মী ও বাকসঙ্গী। তাদের প্রত্যেকের মধ্যে যেন রয়েছে আত্মিক ও সুদৃঢ় বন্ধন।
সাদীর মতে, এ বিশ্বজগতে একমাত্র মানুষই সম্মান, মর্যাদা, দয়া ও ভালোবাসা পাওয়া যোগ্য নয়, বরং প্রতিটি জীবেরই তা প্রাপ্য।
‘বুস্তান’-এর দশটি পর্বে শেখ সাদী যে পৃথিবী চিত্রিত করেছেন তাতে রয়েছে মহান স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস, পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও ভালোবাসা এবং সত্য ও সুন্দরের জয়গান, যা বিদগ্ধ পাঠক মাত্রকেই সুন্দর ও পবিত্র এক পৃথিবী বিনির্মাণে উদ্বুদ্ধ করবে।
আল-কুদস দিবসে এবারের প্রেক্ষাপট এবং আমাদের প্রার্থনা
মুজতাহিদ ফারুকী –
বছর ঘুরে আবার এসেছে পবিত্র মাহে রমযান। সমগ্র মুসলিম উম্মাহর জন্য এক কঠোর প্রশিক্ষণের মাস। দৈহিক ও আত্মিক সংযমের মধ্য দিয়ে আত্মশুদ্ধির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই কেবল জাগতিক ও আধ্যাত্মিক যাবতীয় কল্যাণকর্মে সাফল্যের সোপানে সহজে আরোহণ করা সম্ভব।
বর্তমান ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ বিশ্বে মুসলিম উম্মাহর সামনে এখন বহুমুখী সঙ্কট কেবলই আবর্তিত হচ্ছে। মুসলমানেরা সারা বিশ্বে নানাভাবে নিগৃহীত। বিশ্বের দেশে দেশে তাদের ওপর সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সত্য-মিথ্যা নানা অজুহাতে বিপর্যয়কর, বিধ্বংসী ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। বিশ্বের কোথাও না কোথাও প্রতিদিন অসংখ্য মুসলমানকে হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, আফগানিস্তান, চীন, ভারত, মিয়ানমার সর্বত্র চলছে মুসলিম নিগ্রহ। বাস্তবে তালিকা আরো দীর্ঘ ও সুবিস্তৃত। আসলে প্রশ্নটা বোধহয় এভাবে বলাই ভালো যে, বিশ্বের এমন কোন দেশ আছে যেখানে মুসলমানেরা শান্তিতে বসবাস করছে?
সেই সাথে আছে মুসলমানদের আত্মপরিচয় হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা। আধুনিক বিশ্বের নানামুখী চিন্তাধারার প্রভাব, ইসলাম স¤পর্কে জানার সুযোগ কম থাকা এবং ইসলামবিরোধীদের অব্যাহত চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে মুসলমানেরা এখন নিজের ধর্ম থেকে অনেক দূরে সরে এসেছে। তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে বিভেদ, অনৈক্য ও অজ্ঞানতার অন্ধকার।
এ প্রেক্ষাপটে এবারো পবিত্র মাহে রমযানের শেষ শুক্রবার যথারীতি মুসলিম বিশ্বে পালিত হয় আন্তর্জাতিক আল-কুদ্স দিবস। দীর্ঘ দিন ধরে ইহুদিবাদী ইসরাইলের দখলে থাকা মুসলমানদের প্রথম কিবলা বায়তুল মোকাদ্দাস পুনরুদ্ধারের দাবিতে প্রতি বছর রমজানের শেষ শুক্রবার বিশ্বব্যাপী পালিত হয় দিনটি।
১৯৭৯ সালে ইরানে সংঘটিত সফল ইসলামি বিপ্লবের পর মহান নেতা ইমাম খোমেইনী (রহ.) পবিত্র রমজান মাসের শেষ শুক্রবারকে কুদ্স দিবস ঘোষণা করেন। সেই থেকে ইরানসহ বিশ্বের বহু দেশে কুদ্স দিবস পালিত হয়ে আসছে এবং দিন দিন কুদ্স পালনকারী দেশের সংখ্যা বাড়ছে।
মহানবী (সা.)-এর নবুওয়াতের ঘোষণার পর থেকে মুসলমানদের কাছে বায়তুল মোকাদ্দাস পবিত্র স্থান হিসাবে গণ্য হতে থাকে। কুরআন শরিফে বায়তুল মোকাদ্দাসকে পবিত্র ভূমি বলে উল্লেখ করা হয়েছে- (স্মরণ করো, মূসা তার সম্প্রদায়কে বলেছিল) হে আমার সম্প্রদায়! আল্লাহ তোমাদের জন্য যে পবিত্র ভূমি নির্দিষ্ট করেছেন, এতে তোমরা প্রবেশ করো এবং পশ্চাৎপসারণ করো না, করলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে।’ (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত : ২১)।
ফিলিস্তিন ও পবিত্র বায়তুল মোকাদ্দাস দখলদার ইহুদিবাদীদের হাত থেকে মুসলমানদের প্রথম কিবলা আল-আকসা মসজিদ মুক্ত করার জন্য মুসলমানদের জাগিয়ে তোলাই আল-কুদ্স দিবসের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। এ ছাড়াও মজলুম ফিলিস্তিনি জাতির ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা ইহুদিবাদী শাসন, শোষণ, নিপীড়ন ও তাদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞের অবসান ঘটানো এবং বায়তুল মোকাদ্দাসকে রাজধানী করে ফিলিস্তিনি জাতির নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাও এ দিবসের আরেকটি বড় লক্ষ্য।
মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইহুদি ও খ্রিস্টধর্মের পোশাকধারী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর নব্য ক্রুসেড মোকাবেলার জন্য মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করা এবং মুসলিম উম্মাহর ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম বা প্রচেষ্টার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ইসলামি শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যও এ দিবস কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে- কেন আল-আকসা মসজিদ এবং ফিলিস্তিনকে স্বাধীন করা মুসলমানদের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ?
একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই আমরা বুঝতে পারব কেন বায়তুল মোকাদ্দাস, আল-আকসা মসজিদ এবং ফিলিস্তিন স্বাধীন করা মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে বড় ও সর্বপ্রধান দায়িত্ব। এটা শুধু মুসলিম উম্মাহর হারানো গৌরব বা মান-সম্মান ফিরিয়ে আনার প্রশ্ন নয়, বিশ্বব্যাপী সত্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যও এটা জরুরি। কারণ, বায়তুল মোকাদ্দাস ও ফিলিস্তিন হচ্ছে রাজনৈতিক এবং ভৌগোলিক কৌশলগত দিক থেকে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকা- এ গুরুত্বপূর্ণ তিন মহাদেশের প্রবেশদ্বার। এই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলটি সাম্রাজ্যবাদীদের নিয়ন্ত্রণে থাকার কারণে আজ তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের প্রধান তিন মহাদেশের ওপর কর্তৃত্ব করা সাম্রাজ্যবাদীদের জন্য সহজ হয়েছে।
এরপর রয়েছে পবিত্র বায়তুল মোকাদ্দাস শহর ও আল-আকসার ওপর নিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন। এ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে ওই অঞ্চলের ইতিহাস খুব সংক্ষিপ্তভাবে হলেও জেনে রাখা দরকার।
বায়তুল মোকাদ্দাস শহর নির্মিত হয়েছিল হজরত ইবরাহীম (আ.)-এর মাধ্যমে কাবা শরিফ নির্মাণের ১১০০ বছর পর তথা হজরত ঈসা (আ.)-এর জন্মের ৯৭০ বছর আগে। তাই ইবরাহীম (আ.)-এর বংশধর হজরত দাউদ (আ.)-এর মাধ্যমে নির্মিত আল-আকসা মসজিদ তৌহিদপন্থীদের দ্বিতীয় হারামে পরিণত হয়।
হযরত মূসা (আ.)-এর জীবদ্দশাতেই ইহুদিরা তৌহিদবাদ বা আল্লাহর একত্বের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে মূর্তিপূজা শুরু করেছিল এবং আল্লাহর শাস্তি হিসেবে তারা বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছিল। এরপর ইহুদিরা অনেক নবীকে হত্যা করেছিল।
এরপর মসজিদুল আকসা ছিল বিশ্বনবী (সা.)-এর নবুওয়াতের প্রথম চৌদ্দ বছর পর্যন্ত মুসলমানদের প্রথম কিবলা। ইহুদিদের কিবলার দিকে মুখ করে মুসলমানেরা নামায আদায় করত বলে ইহুদিরা মুসলমানদের উপহাস করত। শেষ নবী (সা.) কেন ইহুদি বংশে জন্ম নিলেন না, এটাই ছিল ইসলামের বিরুদ্ধে ইহুদিদের ক্ষোভের একটা বড় কারণ। এ অবস্থায় হিজরতের দ্বিতীয় বছরে আল্লাহর নির্দেশে মুসলমানরা পবিত্র কাবাকে নামাযের কিবলায় পরিণত করে। দ্বিতীয় খলিফার সময় বা ১৫ হিজরিতে বায়তুল মোকাদ্দাস মুসলমানদের হস্তগত হয়। পরবর্তীকালে এ শহরের বেশির ভাগ বাসিন্দাই ছিল আরব মুসলমান। আর তাদেরই বংশধর হলো আজকের ফিলিস্তিনি মুসলমানেরা। এরপর খ্রিস্টীয় ১০৯৫ সালে ইউরোপীয়রা বায়তুল মোকাদ্দাস দখলের জন্য মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রুসেড শুরু করে। প্রায় ২০০ বছর পর্যন্ত ইউরোপীয় খ্রিস্টানরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে সাত-আটটি ক্রুসেড পরিচালনা করে। সালাহউদ্দিন আইয়ুবির হাতে ক্রুসেডাররা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল।
বায়তুল মোকাদ্দাস মসজিদ এবং তার আশপাশের এলাকা বহু নবীর স্মৃতিবিজড়িত। এই পবিত্র নাম শুধু একটি স্থানের সাথে জড়িত নয়, বরং এই নাম সব মুসলমানের ঈমান ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এখানে রয়েছে অসংখ্য নবী-রাসূলের মাযার। ওহি ও ইসলামের অবতরণস্থল এ নগরী নবিগণের দ্বীন প্রচারের কেন্দ্রভূমি। তাই এ পবিত্র নগরীর প্রতি ভালোবাসা প্রত্যেক মুমিনের হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত।
প্রতি বছর রমজান মাসের শেষ শুক্রবার বা ‘জুমাতুল বিদা’র দিনে সারা বিশ্বের লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান বায়তুল মোকাদ্দাস তথা আল-কুদ্সে ইহুদিদের অবৈধ দখলের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশ করেন এবং ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের কবল থেকে পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে মুক্ত করার জন্য নতুন শপথ গ্রহণ করেন। এটি হলো ইহুদিবাদী ইসরাইলের স্বরূপ তুলে ধরে ঐক্যবদ্ধ বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানানোর দিবস। আল-কুদ্স মুক্তির লক্ষ্যে সমগ্র বিশ্বের মুসলমানদের একতাবদ্ধ হওয়ার দিবস। ইসরাইলের পতন কামনার দিবস।
কিন্তু এবারের আল-কুদ্স দিবস যখন পালিত হতে যাচ্ছে তখন গোটা মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ করে ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক ও কৌশলগত পরিস্থিতি ভিন্ন। ইরানের সম্ভাব্য হুমকির স¤পূর্ণ মিথ্যা অজুহাতে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ যুক্তরাষ্ট্র দেশটির ওপর সামরিক হামলার অজুহাত খুঁজছে। এরই মধ্যে পারস্য উপসাগর এলাকায় জঙ্গিবিমানসহ বিমানবাহী রণতরী মোতায়েন করেছে। বি-৫২ বোমারু বিমান জড়ো করেছে এবং ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছে। ফলে এমনিতেই মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি বেশ উত্তপ্ত।
অবশ্য এ মুহূর্তেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর আক্রমণ চালাবে কি না সে বিষয়ে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের ভিন্নমত রয়েছে। আর মার্কিন কংগ্রেসও ইরানে সামরিক হামলা চালানোর জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রা¤পকে অনুমতি দেয় নি। কিন্তু অভ্যন্তরীণ রাজনীতি অর্থাৎ ভোটের হিসাবে গড়বড় দেখা দিলে ট্রা¤প নিজের নির্বাহী ক্ষমতায় আক্রমণ চালানোর সিদ্ধান্ত নিতে পিছপা হবেন কি না, সেটা সময়েই বোঝা যাবে।
তবে ইরানে সম্ভাব্য মার্কিন হামলার বিষয়টি ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের জন্য আরো বিস্ফোরক পরিস্থিতি অপেক্ষা করে আছে। ইসরাইলের একটি পত্রিকার বরাত দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে, ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সাথে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রা¤প একটি চুক্তি করেছেন। এটিকে বলা হচ্ছে, ‘শতাব্দীর সেরা চুক্তি’। ইসরাইল-ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ-বিষয়ক এই চুক্তিতে বলা হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিন নামে কোনো দেশ থাকবে না।
ফিলিস্তিনের নতুন নাম হবে নিউ প্যালেস্টাইন। চুক্তিটি স্বাক্ষরের আগে ফিলিস্তিনি নেতাদের সাথে কোনো আলোচনাই করেন নি ট্রা¤প; বরং প্রকাশিত চুক্তিতে দেখা যায়, ট্রা¤েপর এই চুক্তি না মানলে প্রয়োজনে ইসরাইল ফিলিস্তিনি নেতাদের হত্যা করতে পারবে। চুক্তিটি বাস্তবায়নে ট্রা¤প সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশকে তার পাশে পেয়েছেন বলে ইসরাইলি পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে। ফিলিস্তিনি নেতারা ট্রা¤েপর এ চুক্তি প্রত্যাখ্যান করেছেন।
চুক্তিতে বলা হয়েছে- ইসরাইল, পিএলও এবং হামাসের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে এবং ফিলিস্তিন নামে কোনো দেশ থাকবে না। চুক্তি অনুযায়ী নতুন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের নাম হবে নিউ প্যালেস্টাইন। গাজা উপত্যকা, জিহুদিয়া পার্বত্য এলাকা এবং পশ্চিম তীরের সামারিয়া এলাকা নিয়ে গঠিত হবে এ রাষ্ট্রটি। তবে পশ্চিম তীরের ইসরাইলি বসতিগুলোর ওপর এ রাষ্ট্রের কোনো কর্তৃত্ব থাকবে না। এসব বসতির সার্বভৌমত্ব থাকবে ইসরাইলের হাতে। নিউ প্যালেস্টাইনের কোনো সামরিক বাহিনীও থাকতে পারবে না।
চুক্তি অনুযায়ী, জেরুসালেম নগরী ভাগ হবে না, এটি হবে উভয় দেশের রাজধানী। নগরীর আরব বাসিন্দারা নিউ প্যালেস্টাইনের নাগরিক হবেন এবং ইহুদিরা ইসরাইলি নাগরিক হিসেবে সেখানে বসবাস করবেন। ইহুদিরা আরবদের এবং আরবরা ইহুদিদের বাড়িঘর কিনতে পারবেন না। জেরুসালেমে নতুন আর কোনো এলাকা দখল করা হবে না। পবিত্র স্থানগুলোর বিদ্যমান অবস্থা বজায় থাকবে। তবে জেরুসালেমের নিয়ন্ত্রণ থাকবে ইসরাইলের জেরুসালেম পৌরসভার হাতে। তবে সেখানকার শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করবে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ। জেরুসালেম পৌরসভার কাছে ট্যাক্স ও পানির বিল প্রদান করবে নিউ প্যালেস্টাইন সরকার।
ভয়াবহ ওই চুক্তি মেনে নেয়া ফিলিস্তিন বা তার প্রতি সহমর্মী ইরান, তুরস্কের পক্ষে সম্ভব নয়- এটা বুঝতে কোনো অসুবিধা কারো হওয়ার নয়। চলতি রমজানের পরই যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল এই চুক্তির ভিত্তিতে তথাকথিত শান্তিপ্রক্রিয়া শুরু করবে বলে খবরে জানানো হয়েছে। চুক্তি যারা মানবে না তাদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ এবং প্রয়োজনে হত্যা করতে পারবে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ। মুসলিম বিশ্বের পবিত্রতম দুই কেন্দ্র কাবা ও রাসূল (সা.)-এর রওজা মোবারকের খাদেম সৌদি আরব ওই চুক্তির পক্ষে থাকার অর্থ হলো, উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের অন্য যেসব সদস্য সৌদি আরবের মিত্র তারাও চুক্তির
পক্ষে থাকছে। এদের মদদ নিয়েই ইসরাইল এখন ফিলিস্তিনিদের নির্বিচার হত্যায় মেতে উঠলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এতে করে আরব তথা সমগ্র মুসলিম বিশ্বে আরেকটি বিভাজনের সূত্রপাত অবশ্যম্ভাবী এবং সেই টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া মুসলিম বিশ্বের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলি ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করার কোনো উপায় থাকবে, এমনটি আশা করা বাতুলতা মাত্র।
এরপরও মুসলমানেরা সব সময় ঈমানের শক্তিতেই নির্ভর করেছে, পরম করুণাময় আল্লাহর রহমতের ওপর আস্থা রেখেছে। এবারের আল-কুদ্স দিবস হয়তো মুসলমানদের সেই ঈমানি শক্তির সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হিসেবে দেখা দিতে যাচ্ছে। আল-কুদ্স দিবসে এবার প্রার্থনা হোক- হে আল্লাহ, তোমার কুদরতের ঝলকানিতে অতীতের মতো এখনো তোমার দ্বীন ও দ্বীনের ধারকদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী ইহুদি-নাসারাদের সব ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের জাল ছিন্ন করে দাও।
তেহরানে বৈচিত্র্যে প্রাণচঞ্চল ৩৭তম আন্তর্জাতিক ফাজ্র্ চলচ্চিত্র উৎসব অনুষ্ঠিত
বিচিত্র ধরনের বিরাট সংখ্যক দেশী-বিদেশী চলচ্চিত্রের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রাজধানী তেহরানে গত ১৮ থেকে ২৬শে এপ্রিল (২০১৯) ৩৭তম আন্তর্জাতিক ফাজ্র্ চলচ্চিত্র উৎসব (ঋওঋঋ) অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। পুরস্কার বিজয়ী ইরানি চলচ্চিত্র পরিচালক রেযা মীরকারীমীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ইরানের ইসলামি বিপ্লবের চল্লিশতম বিজয় বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এবারের ফাজ্র্ চলচ্চিত্র উৎসবে বিশে^র ৭৫টি দেশের বিচিত্র স্বাদের ১০৯টি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়।
উল্লেখ্য, ইসলামি বিপ্লবের বিজয় বার্ষিকী উপলক্ষে প্রতি বছরই ফাজ্র্ চলচ্চিত্র উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে, তবে গত চার বছর থেকে এ উৎসবের আন্তর্জাতিক বিভাগ এর জাতীয় বিভাগ থেকে স্বতন্ত্রভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে এবং এবারের আন্তর্জাতিক ফাজ্র্ চলচ্চিত্র উৎসব ব্যাপক প্রস্তুতির মাধ্যমে অত্যন্ত জমকালোভাবে অনুষ্ঠিত হলো- যার ফলে যে কেউ স্বীকার করতে বাধ্য যে, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান তার বৃহত্তম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজনের ক্ষেত্রে খুবই অল্প সময়ের ব্যবধানে বহু দূর এগিয়ে এসেছে- যা অবশ্যই গর্ব করার মতো।
আন্তর্জাতিক ফাজ্র্ চলচ্চিত্র উৎসব তার মান, গ্রহণযোগ্যতা ও গৌরবময়তা প্রমাণ করে দিয়েছে। বিশেষ করে এবারের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব প্রমাণ করে দিয়েছে যে, এ উৎসব কেবল ইরানি সিনেমা দর্শকদের জন্য বিভিন্ন ধরনের বিদেশী চলচ্চিত্রের স্বাদ গ্রহণের উৎসবই নয়, বরং এ উৎসবের দর্শক কা’রা সে বিবেচনায়ও এটি যথার্থই একটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। কারণ, নয় দিনব্যাপী এ উৎসবে ইরানি দর্শকদের পাশাপাশি বিশে^র বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত শত শত মেহমান-দর্শকও অংশগ্রহণ করেন। ইরানি ও বিদেশী নির্বিশেষে দর্শকগণ এ উৎসবে বিশে^র বিভিন্ন দেশে তৈরি এমন বিচিত্র ধরনের চলচ্চিত্র উপভোগ করেন যে সব ধরনের চলচ্চিত্র সম্বন্ধে আগে তাঁদের খুব সামান্যই জানা ছিল।
আন্তর্জাতিক ফাজ্র্ চলচ্চিত্র উৎসব দর্শকদের সামনে বিশে^র বিভিন্ন প্রান্তে বিচিত্র সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে তৈরি বহু উন্নত মানের ও অবাণিজ্যিক চলচ্চিত্র পরিবেশন করে যেগুলো তাঁরা ইতিপূর্বে দেখেন নি এবং যে সব জায়গায় তাঁদের যাবার সুযোগ হয়ে ওঠে নি, ফলত ঐ সব দেশ ও জায়গা এবং সংশ্লিষ্ট জনগণ সম্বন্ধে তাঁদের মধ্যে বিশেষ ধরনের বদ্ধমূল ধারণা ছিল বা ক্ষেত্রবিশেষে সম্পূর্ণ ভুল ধারণা ছিল। এবারের চলচ্চিত্র উৎসব তাঁদের সে সব বদ্ধমূল বা ভুল ধারণা দূরীকরণে সহায়ক হয়েছে।
এবারের আন্তর্জাতিক ফাজ্র্ চলচ্চিত্র উৎসবে বিশে^র ৭৫টি দেশের ১০৯টি চলচ্চিত্রকে ১১টি বিভাগে ভাগ করে প্রদর্শন করা হয়। নিকটবর্তী ও দূরবর্তী দেশ ও জায়গার বিবেচনায় এবং সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বিবেচনায় চলচ্চিত্রের বিভাগগুলো বিন্যস্ত করা হয়। এ উৎসবে যে সব দেশের চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয় সে সব দেশের মধ্যে ছিল রাশিয়া, তুরস্ক, চীন, মিসর, ডেনমার্ক, আর্জেন্টিনা ও অন্যান্য দেশ।
এ উৎসবে ‘মুক্তি বিষয়ক চলচ্চিত্র’ (ঈরহবসধ ঝধষাধঃরড়হ) শীর্ষক আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা বিভাগে ১৫টি ফিচার ফিল্ম ও ১৫টি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। এতে বিচারক প্যানেলে ছিলেন চলচ্চিত্র শিল্পের সাতজন স্বনামখ্যাত ব্যক্তিত্ব।
এবারের আন্তর্জাতিক ফাজ্র্ চলচ্চিত্র উৎসবের জন্য যে সব চলচ্চিত্র নির্বাচন করা হয় সেগুলো বৈশিষ্ট্যের দিক থেকেও পূর্ববর্তী উৎসবসমূহে প্রদর্শিত চলচ্চিত্রসমূহের তুলনায় অধিকতর সুচিন্তিতভাবে নির্বাচন করা হয়। এবারের চলচ্চিত্রসমূহ অধিকতর সুসংহত, সুস্পষ্ট তৎপর্য ও বাণীসমৃদ্ধ, পুরস্কার বিজয়ী অভিনয় সম্বলিত, সর্বোপরি চিন্তার উদ্রেককারী ও গতিশীল বিষয়বস্তু সম্বলিত; সব মিলিয়ে এ সব চলচ্চিত্র একদিকে যেমন উৎসবের উপযোগী অন্যদিকে দর্শক আকর্ষণকারী।
এখানে স্মর্তব্য যে, ফাজ্র্ চলচ্চিত্র উৎসব দর্শকদেরকে কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যাভিমুখে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্য সম্বলিত কোনো উৎসব নয়, বরং তার পরিবর্তে এটি হচ্ছে বৈচিত্র্যের প্রতিনিধিত্বশীলতার উৎসব। তাই এবারের চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত চলচ্চিত্রগুলোতে ছিল বিপুল সংখ্যক সাধারণ চরিত্রের ও বিষয়বস্তুর প্রতিফলন- যার মধ্যে ছিল শিশু-কিশোর, দত্তক, ভবিষ্যৎ প্রজন্মসমূহ, পরিবেশ, শক্তিশালী নারী চরিত্র, গতানুগতিকতা প্রত্যাখ্যান, উচ্চতর কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণে অস্বীকৃতি, প্রকৃত ঘটনার ভিত্তিতে নির্মিত গল্প এবং মুক্ত ও সংগ্রামী চেতনার অধিকারী চরিত্র- যারা আশা ছেড়ে দেয় না, বরং চ্যালেঞ্জ ও কঠিন পরিস্থিতির মুখে সমাধানের সন্ধান করে।
এখানে উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মিহা মায্যিনী পরিচালিত সেøাভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া ও সার্বিয়ার যৌথ উদ্যোগে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘মুছিত’ (ঊৎধংবফ) বা ডেনিশ্ চলচ্চিত্র নির্মাতা মিকাইল্ নোর্য়ে নির্মিত ‘তুষারপাতের আগে’ (ইবভড়ৎব ঃযব ঋৎড়ংঃ)-এর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে- যা দেখতে গিয়ে দর্শকগণ তাঁদের আসনে সামান্য নড়াচড়া করতেও ভুলে যান এবং কী ঘটতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে নিজস্ব ধারণার ভিত্তিতে শ^াসরুদ্ধকর উদ্বেগ সহকারে অপেক্ষা করতে থাকেন, আর তাঁদের সামনে একের পর এক ঘটনাবলি উন্মোচিত হতে থাকে এবং একই সময় তাঁদের সামনে বিশে^র একটি বিশেষ অংশের একটি বিশেষ সময়কার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের প্রেক্ষাপটে একেকটি দৃশ্য ভেসে উঠতে থাকে।
‘মুছিত’ (ঊৎধংবফ) চলচ্চিত্রটিতে একজন সেøাভেনিয়ান নারীর গল্প উপস্থাপন করা হয়েছে- ১৯৯১ সালে তৎকালীন যুগোসøাভিয়া থেকে সেøাভেনিয়ার স্বাধীনতা লাভের প্রাক্কালে আরো ছাব্বিশ হাজার মানুষের মতো যার পরিচয় (রফবহঃরঃু) মুছে যায়। কিন্তু সে বিস্মৃত হয়ে যেতে অস্বীকৃতি জানায় এবং তার নিজের ও সেই সাথে তার শিশু সন্তানের স্বকীয় পরিচিতি ফিরে পাবার জন্য সে তার পক্ষে যা কিছু সম্ভব হয় তা-ই করে। এমনকি সে এতদূর পর্যন্ত চেষ্টা করে যে, শেষ পর্যন্ত সে জাতীয় টেলিভিশনে উপস্থিত হয়ে তার নিজের কথা বলে।
বস্তুত ‘মুছিত’ (ঊৎধংবফ) চলচ্চিত্রটি একদিকে যেমন ঐতিহাসিক তথ্যমূলক- যাতে এমন এক ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে যা সম্ভবত বিশে^র অনেক মানুষের কাছেই অজানা রয়ে গিয়েছে এবং একই সাথে এটি একটি শক্তিশালী ইচ্ছাশক্তির অধিকারী চরিত্রের কাহিনী- যা সহিংসতার জোয়ারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে অন্যদেরকে উদ্বুদ্ধ করে।
অন্যদিকে ‘তুষারপাতের আগে’ (ইবভড়ৎব ঃযব ঋৎড়ংঃ) চলচ্চিত্রে ডেনমার্কের একটি প্রত্যন্ত বনাঞ্চলের বিপর্যস্ত অংশের এক সময়কার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এ চলচ্চিত্রটির বিশেষ উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, এতে একজন সৎ বৃদ্ধ পিতার চরিত্র চিত্রায়ণ করা হয়েছে যিনি তাঁর কন্যার সুখের জন্য অনেক কিছু করেন, যদিও তাঁর ব্যক্তিগত লাভের বিষয়টিও দর্শকদের দৃষ্টি থেকে গোপন রাখার চেষ্টা করা হয় নি।
প্রতিযোগিতায় সর্বোত্তম চলচ্চিত্র হিসেবে ‘স্বর্ণ সি-র্মোগ্’ (এড়ষফবহ ঝরসড়ৎময) শীর্ষক গ্রান্ড প্রাইজের জন্য নির্বাচিত হয় আলেকজান্ডার যোলোতুখিন্-এর ‘এক রাশিয়ান কিশোর’ (অ জঁংংরধহ ণড়ঁঃয)। এটি একটি অনন্য চলচ্চিত্র যাতে সাহসী কিন্তু তখনো যার কোনো কাজ নেই এমন একজন বালকের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রথম বিশ^যুদ্ধের ভয়াবহতা তুলে ধরা হয়েছে; সে তার চারদিককার ধ্বংসরত বিশ^কে দৃঢ়তার সাথে আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করছে, যদিও সে প্রাচ্য রণাঙ্গনে তার দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলেছে।
‘এক রাশিয়ান কিশোর’ চলচ্চিত্রটি স্বনামখ্যাত পরিচালক আলেকজান্ডার সোকুরোভ্-এর পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত হয়; তিনি তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠিত অবাণিজ্যিক চলচ্চিত্র তহবিল থেকে এ চলচ্চিত্র নির্মাণের ব্যয় নির্বাহে সহায়তা করেন। উল্লেখ্য, আলেকজান্ডার সোকুরোভ্ ইতিপূর্বে ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত ৩৪তম আন্তর্জাতিক ফাজ্র্ চলচ্চিত্র উৎসবে (ঋওঋঋ) মেহমান হিসেবে অংশগ্রহণ করেন এবং উক্ত উৎসবে তাঁর নির্মিত ঋৎধহপড়ভড়হরধ চলচ্চিত্রটি প্রদর্শিত হয়।
এবারের চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠতম অভিনেতার পুরস্কারটিও ‘তুষারপাতের আগে’ (ইবভড়ৎব ঃযব ঋৎড়ংঃ) লাভ করে; এ পুরস্কারটি দেয়া হয় এর অভিনেতা জের্স্পা ক্রিস্টেনসেন্-কে।
এ উৎসবে শ্রেষ্ঠতম অভিনেত্রীর পুরস্কার লাভ করেছেন বুলগেরিয়ান পরিচালক নাদেজদাকোসেভা পরিচালিত ‘ইরিনা’ চলচ্চিত্রে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয়কারী র্মাতিনা অ্যাপোস্তোলোভা। ‘ইরিনা’ চলচ্চিত্রে খনিজ উত্তোলন করা হয় এমন একটি ছোট শহরের একজন নারীর তার আশেপাশের অস্বস্তিকর পরিবেশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে টিকে থাকার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তার জীবন সংগ্রামে দেখা যায় যে, সে তার পরিবারকে দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে বাঁচাবার জন্য শেষ পর্যন্ত অর্থের জন্য সারোগেট মাদার হচ্ছে।
এবার শ্রেষ্ঠতম চলচ্চিত্র স্ক্রিপ্টের পুরস্কার লাভ করেন যৌথভাবে জার্মান চলচ্চিত্র ডধপশবৎংফড়ৎভ-এর লেখক র্গেনোত্ক্রায়াা (এবৎহড়ঃকৎধধ) ও অলির্ভা হার্ফ্না (ঙষরাবৎ ঐধভভহবৎ)। এ চলচ্চিত্রটিতেও আরেকটি বিস্ময়কর গল্প পরিবেশন করা হয়েছে; এতে পরিবেশ রক্ষার জন্য জনগণের সরকারের কাছে নতি স্বীকারে অস্বীকৃতি তুলে ধরা হয়েছে। এতে জনগণের শক্তির যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তা একে প্রায় বাস্তব একটি ঘটনায় পরিণত করেছে।
এবারের আন্তর্জাতিক ফাজ্র্ চলচ্চিত্র উৎসবে (ঋওঋঋ) সম্মানিত মেহমান হিসেবে অংশগ্রহণ করেন খ্যাতনামা আমেরিকান স্ক্রিনরাইটার, চলচ্চিত্র পরিচালক ও চলচ্চিত্র সমালোচক পল্ শ্রের্ডা। তিনি এ উৎসব উপলক্ষে চলচ্চিত্র সম্পর্কে একটি অসাধারণ ও ব্যতিক্রমী কর্মশালা পরিচালনা করেন এবং গত ২৪শে এপ্রিল র্চাসন্ সিনেপ্লেক্সে একটি সংবাদ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন।
তিনি আন্তর্জাতিক ফাজ্র্ চলচ্চিত্র উৎসব (ঋওঋঋ)- কে টরোন্টো, ভেনিস্ ও বার্লিনের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের সাথে তুলনা করেন এবং ফাজ্র্ উৎসবের আকার-আয়তনের বিশালতা ও বহুমাত্রিকতায় বিস্ময় প্রকাশ করেন। এছাড়া তিনি ইরানি চলচ্চিত্র সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে র্মহূম আব্বাস কিয়ারুস্তামী ও দুই বার অস্কার বিজয়ী আর্স্গা র্ফাহাদীর চলচ্চিত্রসমূহের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ইরানি চলচ্চিত্রসমূহ একদিকে যেমন স্বাভাবিক বিকাশের পরিচায়ক এবং জীবনের তাৎপর্যে পরিপূর্ণ।
প্রতিবেদক : র্মাজোহ্ন্ শায়খী
সম্পাদনা ও অনুবাদ : নূর হোসেন মজিদী