আবু রায়হান আল-বিরুনি: সাংস্কৃতিক ঐক্যের প্রতীক
পোস্ট হয়েছে: সেপ্টেম্বর ৮, ২০২৫

বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক শাখায় বহুমুখী অবদানের জন্য আবু রায়হান আল-বিরুনিকে এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ঐক্যের আলোকবর্তিকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গেল ৪ সেপ্টেম্বর ইরানের বিখ্যাত এই বহুবিদ্যা বিশারদের স্মরণে পালিত হয়েছে জাতীয় দিবস।
আবু রায়হান আল-বিরুনি বর্তমান উজবেকিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন। এরপর তিনি জ্ঞানের সন্ধানে ইরানের গোরগানে যান, সেখানে তিনি পড়াশোনা ও শিক্ষাদান করেন। এরপর অজানা বিষয়ে জানতে তিনি ভারত ভ্রমণ করেন এবং অবশেষে বর্তমান আফগানিস্তানে তার জীবন অতিবাহিত করেন।
গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসা, ইতিহাস এবং দর্শনসহ বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে তিনি এক অসাধারণ এবং বহুমুখী ব্যক্তিত্ব হিসেবে সমাদৃত।
এক সহস্রাব্দ পরেও তার অবদান ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞান মানবজাতির অমূল্য সম্পদ হিসেবে রয়ে গেছে।
আল-বিরুনিকে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। চতুর্থ এবং পঞ্চম শতাব্দীতে বিজ্ঞানের পদ্ধতির উপর তার শ্রেষ্ঠ কাজগুলো ছাড়াও, তার চিন্তা ও বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা।
আবু রায়হান আল-বিরুনি কেবল জ্ঞানের ভান্ডার ছিলেন না; তিনি জ্ঞান আবিষ্কারের একটি প্রক্রিয়া ছিলেন। সত্যের প্রতি তার প্রতিশ্রুতি, মানব মর্যাদার প্রতি তার শ্রদ্ধা এবং তার সীমাহীন কৌতূহল সংস্কৃতি, ধর্ম এবং মতাদর্শের ব্যবধান জুড়ে সেতুবন্ধন তৈরির জন্য একটি সময়োপযোগী কাঠামো প্রদান করে।
আমরা যখন বিশ্বজুড়ে বিভাজনের মুখোমুখি, তখন তার উত্তরাধিকার আমাদের ভয়কে অনুসন্ধান এবং অনুমানকে প্রমাণ দ্বারা প্রতিস্থাপন করতে উৎসাহিত করে। আল-বিরুনি – বিজ্ঞানী, মানবতাবাদী, বৈশ্বিক নাগরিকের চেতনাকে আলিঙ্গন করার মাধ্যমে আমরা আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, সু- অবহিত এবং শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গড়ে তুলতে পারি। এটি প্রমাণ করে যে জ্ঞানের অন্বেষণ মানবজাতির সবচেয়ে শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ শক্তি।
একাদশ শতাব্দীর এই বহুবিদ্যাবিশারদ যেভাবে একবিংশ শতাব্দীর বৈশ্বিক সংলাপের পথ আলোকিত করেছেন
আজ আমরা কেবল একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বকে স্মরণ করছি না; আমরা এক কালজয়ী বুদ্ধিবৃত্তিক আলোকবর্তিকা উদযাপন করছি।
আবু রায়হান আল-বিরুনির চিন্তাভাবনা এবং পদ্ধতি এতটাই আধুনিক ছিল যে তার কাজ আমাদের থেকে হাজার বছরের দূরত্বকে অতিক্রম করে গেছে। তার প্রতিভার গভীরতা বোঝার জন্য, প্রথমে তার বেড়ে ওঠার সময়কার বুদ্ধিবৃত্তিক স্বর্ণযুগ সম্পর্কে জানতে হবে। চতুর্থ এবং পঞ্চম শতাব্দী ছিল ইসলামিক-ইরানি সভ্যতার মধ্যে অভূতপূর্ব পাণ্ডিত্যপূর্ণ উদ্দীপনার সময়।
এই যুগে আরও অনেক কিংবদন্তী ব্যক্তিত্বের জন্ম হয়েছিল। যেমন – চিকিৎসক এবং আলকেমিস্ট জাকারিয়া আল-রাজি, যার চিকিৎসা সংক্রান্ত রচনাগুলো ইউরোপে শতাব্দী ধরে ব্যবহৃত হয়েছে এবং ইবনে আল-হায়থাম, যার আলোকবিজ্ঞানের যুগান্তকারী কাজ আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ভিত্তি স্থাপন করে।
তবে, এই পণ্ডিতদের মধ্যেও আল-বিরুনি নিজেকে আলাদাভাবে তুলে ধরেছিলেন। অন্যরা যখন একক বিষয়ে গভীরভাবে নিমগ্ন ছিলেন, তখন আল-বিরুনি বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছিলেন।
তিনি ছিলেন একজন সারসংক্ষেপকারী। উদাহরণস্বরূপ, তার জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত গণনাগুলো তার উন্নত গাণিতিক তত্ত্ব দ্বারা পরিমার্জিত হয়েছিল এবং পদার্থবিদ্যা সম্পর্কে তার দার্শনিক ধারণা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল।
তিনি জ্ঞানকে একটি বিশাল, আন্তঃসংযুক্ত জাল হিসেবে দেখেছিলেন। এই সামগ্রিক বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি ছিল তার সবচেয়ে বড় উদ্ভাবন, যা তাকে এমন সব বিষয় এবং সম্পর্ক দেখতে সাহায্য করেছিল যা আরও বিশেষায়িত পণ্ডিতরা হয়তো দেখতে পেতেন না।
আল-বিরুনি কেবল বিশ্ব নিয়ে অধ্যয়ন করেননি; তিনি এর অন্তর্নিহিত ঐক্য বুঝতে চেয়েছিলেন। সম্ভবত আল-বিরুনির সবচেয়ে আধুনিক অর্জন ছিল তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা।
এমন এক সময়ে যখন আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগ প্রায়শই বিজয় এবং বিতর্কের মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত হতো, তখন আল-বিরুনি সহানুভূতিশীল, বস্তুনিষ্ঠ অনুসন্ধানের পথ বেছে নিয়েছিলেন। তার শ্রেষ্ঠ কাজ, “তারেক আল-হিন্দ” (ভারতের ইতিহাস), নৃতত্ত্ব এবং ধর্মীয় অধ্যয়নের একটি যুগান্তকারী নিদর্শন হিসেবে রয়ে গেছে।
তার পদ্ধতি ছিল বৈপ্লবিক এবং আজও গবেষকদের জন্য এটি একটি আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হয়।
একটি শব্দ লেখার আগে, আল-বিরুনি বছরের পর বছর ধরে সংস্কৃত শিখেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, একটি সংস্কৃতির মূল আত্মা বুঝতে হলে, সেই সংস্কৃতির মৌলিক গ্রন্থগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে এবং সেখানকার মানুষের সাথে তাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলতে হবে।
তিনি ভারতীয় প্রধান গ্রন্থগুলো আরবিতে অনুবাদ করেছিলেন, যাতে সেগুলোর জ্ঞান সহজলভ্য হয় এবং তার বিশ্লেষণ যেন সরাসরি প্রমাণভিত্তিক হয়, কেবল শোনা কথা বা কুসংস্কারের উপর ভিত্তি করে না হয়। সূত্রঃ মেহর নিউজ