শেখ সাদীর সুবাসিত ‘বূস্তান’
পোস্ট হয়েছে: জুন ১৩, ২০২০
ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী –
দিনের বেলা আকাশে দেদীপ্যমান সূর্যকিরণ বিলায়। রাতে চাঁদের জোছনা ঘুমন্ত পৃথিবীর উপর শান্তি সুখের শামিয়ানা টানায়। তার সাথে অগণিত গ্রহতারার মিটিমিটি বাতি যদি না থাকে এই পৃথিবী অন্ধকারে ডুবে যাবে, ভুতুড়ে মৃত্যুপুরিতে পরিণত হবে। মানবসভ্যতার আকাশে চাঁদসূর্য তারকারাজির আলোর মেলার সাথে তুলনা করা যায় প্রত্যেক জাতির সাহিত্য সম্ভারকে। কারণ, কবি, সাহিত্যিক, চিন্তাবিদ ও তাঁদের রচনা ও সাহিত্যকর্ম মানব সমাজকে সত্য ও সুন্দরের পথ দেখায়। আকাশের গ্রহ-তারকা হয়ে মানব সভ্যতার সাজানো মঞ্চে আলো বিকিরণ ঘটায়।
বিশ^সভ্যতার আলোকসজ্জা সাহিত্য ভা-ারের একটি হচ্ছে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য। ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের আকাশে রয়েছে অসংখ্য অগণিত গ্রহ-নক্ষত্র দুর্লভ প্রতিভা, যাঁরা মানব জাতিকে সত্য, সুন্দর, প্রেম ও মানবীয় গুণাবলিতে সজ্জিত হওয়ার পথ দেখিয়েছেন, এখনো দিকপালের ভূমিকায় বাতিঘর হয়ে রয়েছেন। এসব মনীষীর অমর সাহিত্যকর্ম বিশ^সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। সেই সম্পদ সম্ভারের একটি হচ্ছে শেখ সাদীর ‘বূস্তান’। ‘গুলিস্তান’ ও ‘বূস্তান’ শেখ সাদীর জগদ্বিখ্যাত রচনা। এ দুটি গ্রন্থ ফারসি ভাষায় রচিত। ‘গুলিস্তান’ গদ্য সাহিত্য, তবে প্রতিটি বাক্যে রয়েছে ভাষার ঝংকার, ছন্দের সমাহার আর মাঝে মাঝে কবিতার পুষ্পমাল্য সাজানো। আর ‘বূস্তান’ একেবারে পদ্য রচনা।
‘গুলিস্তান’ ও ‘বূস্তানকে’ আমরা ফারসির জগতে আঁধার রাতের প্রদীপের সাথে তুলনা করতে পারি। গ্রামীণ জীবনে সন্ধ্যালগ্নে যখন ঘরের বাইরে চেরাগ জ¦ালানো হয়, চারিদিক থেকে প্রেমাসক্ত কীটপতঙ্গ উড়ে উড়ে জড়ো হয়। তারা ঘুরতে থাকে। নীরবে অশ্রু বিসর্জন দেয়। প্রদীপের আলোতে আত্মাহুতি দিয়ে প্রেমের চরম পরাকাষ্ঠা দেখায়। প্রাণটা বিসর্জন দিতে মুখে ‘উহ’ শব্দটিও আনে না প্রেমের অনুরাগে। বস্তুত শেখ সাদী ‘গুলিস্তান’ ও ‘বূস্তান’ রচনার পর থেকে এই দুটি প্রদীপের উপর সাহিত্যের কত প্রেমাক্ত আত্মহারা হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তার পরিসংখ্যান কারো জানা নেই।
শেখ সাদীর পুরো নাম ফারসি উইকিপিডিয়ার মতে আবু মুহাম্মদ মুশাররফ উদ্দীন মুসলেহ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মুশাররাফ সাদী (৬০৬-৬০ হিজরি) । খ্রিস্টীয় পঞ্জিকার হিসেবে জন্ম ১২১০ খ্রিস্টাব্দ আর মৃত্যু ১২৯১ বা ১২৯২ সাল। শেখ সাদী নামটি আমাদের মাঝে এতো পরিচিত স্মরণীয়-বরণীয় হলেও তিনি কিন্তু আমাদের দেশের বা বাংলা ভাষার কবি নন। দুনিয়ার বুকে এসেছিলেন আজ থেকে সাড়ে সাতশ’ বছর আগে প্রাচীন পারস্যের রাজধানী শিরাজে। তিনি কবি-সাহিত্যিকদের স্বপ্নের দেশ ইরানের কবি। সাহিত্যচর্চা করেছেন ফারসি ভাষায়। মাঝে মধ্যে আরবি রচনাও স্থান কাল অতিক্রম করে চিরন্তনতা পেয়েছে তাঁর রচনায়। আমাদের দেশে মসজিদে মাহফিলে একটি না’তে রাসূল (সা.) পাঠ করা হয় পরম ভক্তিতে পবিত্র চেতনায়। নবী করিম (সা.) এর প্রতি উম্মতের ভালোবাসা ও আবেগের সবটুকু উজাড় করা হয় মাত্র চার লাইনের এই কবিতায়। বালাগাল উলা…-এর সাথে আমাদের দেশের ছোট বড় প্রায় সবাই পরিচিত। দুনিয়ার তাবৎ রাসূলপ্রেমিকের জপমালা ‘বালাগাল উলা’র চতুষ্পদি কবিতাটি রয়েছে শেখ সাদীর ‘গুলিস্তান’-এর ভূমিকায়। এ নিয়ে আমার একটি আলাদা পুস্তিকা আছে, তাতে আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম ‘বালাগাল উলা’র যে অসাধারণ অনুবাদ করেছেন তার উপর বিশদ আলোচনা করেছি। তবে বইটি বাজার থেকে উধাও। আবার ছাপানোর তাগাদা পূরণ করতে পারছি না। ‘গুলিস্তান’ ফারসি ভাষায় রচিত হলেও ‘বালাগাল উলা’ রচিত হয়েছে আরবিতে। তাতে প্রমাণিত হয় ‘গুলিস্তান’ বা শেখ সাদীর রচনার ভাবে ও ভাষায় রয়েছে আরবির মিশেল।
জানার বিষয় হলো, শেখ সাদী তাঁর ‘গুলিস্তান’ ও ‘বূস্তান’-এ মানব সভ্যতার জন্য এমন কী উপঢৌকন রেখে গেছেন, যার আবেদন এখনো কালজয়ী। গবেষকরা একমত, মানবতা, মানব প্রেম, মনুষ্যত্বের অলঙ্কার সুন্দর চরিত্র, জীবনাচার আর সদুপদেশের শৈল্পিক উপস্থাপনায় এই দুটি গ্রন্থ ফারসি ভাষায় তো বটেই, বিশ^সাহিত্যে নজিরবিহীন। গুলিস্তানে গুল মানে ফুল স্তান অর্থ অনেকটা বাংলায় স্থানের মতো। মানে যেখানে ফুল পাওয়া যায়। ফুলের কানন। গুলশান মানেও ফুলবাগান। আমাদের রাজধানী ঢাকায় দুটি প্রধান জনবহুল কেন্দ্রের নাম গুলিস্তান ও গুলশান।
ঢাকার গুলিস্তান সাধারণ মানুষের সমাগমে মুখরিত। আশপাশে রয়েছে জাতীয় স্টেডিয়াম, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম, বঙ্গবন্ধু এভিন্যু, অদূরে প্রেসিডেন্ট হাউজ বঙ্গভবন। আগে এটিই ছিল সারা দেশের মূল যোগাযোগ-পরিবহনের প্রাণকেন্দ্র। টেলিযোগাযোগের প্রধান কেন্দ্র এখনো এখানেই অবস্থিত। কমলাপুরে রেল স্টেশন হওয়ার আগে গুলিস্তান ছিল সারা দেশের কেন্দ্রীয় রেল স্টেশন। সত্তরের দশকের শেষ দিকেও এখান থেকে বাসে চেপে দূর পাল্লার গাড়িতে চট্টগ্রাম গিয়েছি। রাজধানীর ভেতরের চলাচলরত বাসগুলো এখনো গুলিস্তান থেকে ছেড়ে যায়। ঢাকার উত্তরাংশের গুলশান ১ ও ২ বিশাল অভিজাত এলাকা ও কূটনৈতিক পাড়া।
শেখ সাদীর ‘গুলিস্তান’ ইরানের প্রাচীন রাজধানী শিরাজে অবস্থিত। ফুল দূর থেকে দেখে চোখ জুড়ায়, মন ভুলায়। কাছে এলে খুশবুতে আমোদিত করে। বূস্তানের বূ মানে খূশবু। তার মানে বূস্তানের কাছে এলে তার সুবাসের মোহ মায়ায় সমঝদার লোকেরা আত্মহারা হয়ে যায়। ইরানি গবেষকরা বলেন, বূস্তান আরবি বোস্তান হতে ফারসিতে রূপান্তরিত। মানে বাগান। বূস্তানের সঠিক পরিচয়ের জন্য আমরা এর রচনার প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আনতে পারি। শেখ সাদী নিজেই এই প্রেক্ষাপট ব্যক্ত করেছেন কবিতায় বূস্তানের ভূমিকায়। কবিতায় তাঁর ভাষার লালিত্য ও মমতা কিছুতেই ভাষান্তর করা সম্ভব নয়। এরপরও আমরা শেখ সাদীর মনের কথাটি বুঝবার চেষ্ট করব।
در اقصای عالم بگشتم بسی
بسر بردم ایام با هرکسی
দার আকসা’য়ে আ’লাম বেগাশতাম বাসী
বসর বোর্দাম আইয়া’ম বা’ হারকেসী
বিশে^র আনাচ কানাচে আমি অনেক ঘুরেছি
দিনকাল কাটিয়েছি সবার সাথে মিলেমিশি।
تمتع به هر گوشه یی یافتم
زهر خرمنی خوشه یی یافتم
তামাত্তু বে হার গূশেয়ী য়া’ফতাম
যে হার খেরমানী খোশেয়ী য়া’ফতাম
যেখানে গিয়েছি পেয়েছি জীবনের পাথেয়
প্রতিটি ফলফুলের এক গুচ্ছ করেছি সংগ্রহ।
چو پاکان شیراز خاکی نهاد
ندیدم که رحمت براین خاک باد
চো পা’কা’নে শীরা’যে খা’কী নেহা’দ
নাদীদাম কে রাহমত বার ইন খা’ক বা’দ
শিরাজের পবিত্র মনের মাটির মানুষ কোথাও
দেখিনি, এই মাটির উপর হোক রহমত অবারিত!
تولای مردان این پاک بوم
برانگیختم خاطر از شام و روم
তাওয়াল্লায়ে মারদা’নে ইন পা’ক বূম
বার আঙ্গীখতাম খা’তের আয শা’ম ও রূম
এই পবিত্র ভূমির মানুষদের ভালোবাসার টানে
মনের আকর্ষণ ছিন্ন করেছি রোম, সিরিয়ার সাথে।
دریغ آمدم زانهمه بوستان
تهی دست رفتن سوی دوستان
দারীগ আ’মাদাম যে আনহামে বূস্তা’ন
তুহী দাস্ত রাফতান সূয়ে দুসতা’ন
খারাপ লাগছিল কীভাবে এসব বূস্তান ছেড়ে
খালি হাতে ফিরে যাই প্রিয়জনদের মাঝে।
শেখ সাদী বলছেন, দুনিয়ার আনাচে কানাচে আমি অনেক ঘুরেছি। পরিস্থিতির চড়াই-উতরাইয়ের সাথে পাল্লা দিয়েছি। নানা জনের সাথে মিশেছি। যেখানে যা পেয়েছি জীবনের পাথেয় সংগ্রহ করেছি। বাস্তবতা হল, শিরাজের বাসিন্দাদের মতো পবিত্র মনের মাটির মানুষ দুনিয়ার কোথাও আমি দেখিনি। শিরাজ ভূমির উপর আল্লাহর রহমত অবারিত হোক! স্বদেশ প্রেম, স্বদেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসার উজ্জ্বল নমুনা সাদীর এই অভিব্যক্তি। তিনি আরো বলেন, পবিত্র ভূমি শিরাজের জনগণের ভালোবাসার টানে যখন রোম-সিরিয়ার মায়ার বাঁধন ছেড়ে স্বদেশে ফিরে আসার মনস্থ করলাম, তখন মনটা ভারী হলো এই ভেবে যে, কীভাবে সুন্দর সুবাসিত এসব বূস্তানের প্রবাস জীবন থেকে খালি হাতে স্বদেশবাসীর মাঝে ফিরে যাব। বস্তুত প্রবাস জীবনের অর্জিত অভিজ্ঞতা ও সঞ্চয়ের সওগাত হলো এই বূস্তান, খুশবুতে আমোদিত ফুলবন। শেখ সাদী অন্যত্র বলেন,
گل آورده سعدی سوی بوستان
بشوخی و فلفل به هندوستان
গোল আ’ওয়ার্দে সাদী সূয়ে বূস্তা’ন
বেশওখী ও ফেলফেল বে হিন্দুস্তা’ন
সাদী ফুলের ডালি নিয়ে এসেছে বূস্তানের পানে
এ যেন মরিচের সওগাত নিয়ে যাওয়া হিন্দুস্তানে।
হিন্দুস্তান মরিচের জন্য বিখ্যাত। কেউ যদি একহালি মরিচ উপহার নিয়ে হিন্দুস্তানে যায় বড় বেমানান হবে। শিরাজও হচ্ছে ফুলের কানন। কাজেই ফুল উপহার নিয়ে ফুলের বনে বেড়াতে যাওয়াও বড্ড বেমানান। আমার জন্যও শিরাজের ফুলের জলসায় ফুলের নজরানা নিয়ে হাজির হওয়া নিশ্চয়ই বেমানান। এখানেও শিরাজের প্রতি মহাকবি শেখ সাদীর বিন¤্র বিনয়ের নিবেদন সত্যিই অভিনব।
দীর্ঘ সফর জীবনের তিতা-মিঠা হরেক রকম অভিজ্ঞতার সঞ্চয় ‘বূস্তান’। কবিতার এই ফুলের ডালি তিনি উপহার দিয়েছেন প্রথমে স্বদেশবাসীর করকমলে। তারপর মানব সভ্যতার বিশাল জলসায়। সেই উপহার বিশ^সমাজ প্রাণ ভরে নিয়েছে। তাই সাড়ে সাতশ’ বছর পরও ভিন দেশের মানুষের কাছেও ‘গুলিস্তান’, ‘বূস্তান’ এর এতো কদর। আর শেখ সাদীর নাম শুনলে সবাই ভাবে একান্ত কাছের প্রাণের প্রিয়জন। সম্পূর্ণ কবিতায় লেখা ‘বূস্তান’-এ দ্বিপদী শ্লোকের সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার। ‘বূস্তান’-এর আলোচ্য বিষয়ের মধ্যমণি মানুষ। মানব জীবনকে সাজানোর নীতিমালা, সুন্দর সহযোগিতাপূর্ণ সমাজ পরিচালনার রূপরেখা, দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন, জুলুমের অবসান ও সুন্দরের পরিচর্যা, রাষ্ট্রপরিচালনার ঐতিহ্যনির্ভর নির্দেশনা আর প্রেমপ্রীতির বন্ধনে পরিবার ও গোটা মানব সমাজকে আত্মীয়তার চেতনায় উজ্জীবিত করার উপদেশমালার বিশাল সম্ভার ‘বূস্তান’। বর্ণনার প্রতিটি স্তরে রয়েছে আধ্যাত্মিক চেতনার স্ফুরণ, মিথ্যা ভ-ামি ও প্রতারণার অবলোপন আর চারিত্রিক অসঙ্গতি দূর করার তীব্র তাগাদা।
‘বূস্তান’-এর রচনাকাল ৬৫৫ হিজরি। তখন শিরাজের শাসনক্ষমতায় ছিলেন আতাবক বংশের রাজা আবু বকর ইবনে সাদ। শেখ সাদী ন্যায়পরায়ন শাসক ইবনে সাদ এর নামানুসারে নিজের কবিনাম গ্রহণ করেন সাদী আর অমূল্য গ্রন্থটি উৎসর্গ করেন আবু বকর ইবনে সাদ এর নামে। এই উৎসর্গ ইবনে সাদ এর হাত হয়ে এখন গোটা মানব সভ্যতার জন্য সওগাত। গবেষকরা বলেছেন, মানব সমাজে সর্বস্তরের মানুষের সামনে পেশ করার উপযোগী একক পূর্ণাঙ্গ সাহিত্যকর্ম ‘বূস্তান’। এর মতো কোনো পূর্ণাঙ্গ সাহিত্যকর্ম জগতের কোনো কবি-সাহিত্যিক বা মনিষী রচনা করতে পারেন নি। এই দাবিটি করেছেন ‘বূস্তান’-এর টীকাকার ইরানের সর্বমহলে সমাদৃত সাহিত্য ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ খাযআলী।
‘বূস্তান’-এর গল্পরীতির ধরন অনুমানের জন্য আমরা একটি গল্পের উপর আলোকপাত করতে পারি। ‘বূস্তান’-এর গল্পের বেশকিছু চরিত্রের নায়ক পশুপাখি। এই রীতি বিশ^খ্যাত সাহিত্যকর্মের আচরিত ও স্বীকৃত রেওয়াজ। এক বুড়ির বাড়িতে একটি আদুরে বিড়াল ছিল। বিড়াল বেশ কিছুদিন ক্ষুধার জ¦ালা সয়ে যাচ্ছিল। একদিন একটি ইঁদুর পেল শিকার হিসেবে। ঠিক সে সময় বিড়ালের কাছে খবর পৌঁছে পাশে আমীরের বাড়িতে যেয়াফতের মহাধুমধাম। ওখানে পেটভরে সুস্বাদু খাবার খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলার বিরাট সুযোগ। বিড়াল তার শিকার ছেড়ে চলে যায় পাশে আমীরের বাড়ির যেয়াফতে। কিন্তু বিধিবাম। সুলতানের চাকররা দেখে ফেলে বিড়ালের লুকিয়ে লুকিয়ে পথ চলা। তারা বিড়ালকে নিশানা বানায় তীর বর্শার। নিষ্ঠুরভাবে তাড়িয়ে দেয় যেয়াফত হতে। খাবারের উপর পাঞ্জা বিস্তারের আগেই শুরু হয় বেচারা বিড়ালের গায়ে রক্তক্ষরণ। বিড়াল বুঝতে পারে তার জীবনের শেষ সময়। তখন করুণ চাহনিতে উপদেশের সুরে লোভী মানুষের উদ্দেশে বলে, ‘ডালভাতে তুষ্ট থাকাই উত্তম। লোভে পড়ে মধু খেতে গেলে হুলের দংশনই তার ভাগ্যে জুটে।’
‘গুলিস্তান’-এর মতো ‘বূস্তান’ও আট অধ্যায়ে বিন্যস্ত। আমরা এখানের শিরোনামগুলোর পরিচয় দেয়ার চেষ্টা করব।
باب اول در عدل و تدبیر ورای বাবে আউয়াল দার আদ্ল ও তাদবীর ও রা’য়
প্রথম অধ্যায় : ন্যায়-ইনসাফ, রাষ্ট্রপরিচালনা, মত ও সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গ
সে যুগে রাজা-বাদশাহদের কোনো কাজের সমালোচনা বা সংশোধনের চেষ্টা করা ছিল মৃত্যুদ-যোগ্য অপরাধ। এ ক্ষেত্রে শেখ সাদী এক অভিনব পন্থা অবলম্বন করেন রাজা-বাদশাহদের সংশোধনের উদ্দেশ্যে। তিনি ‘বূস্তান’-এর প্রথম অধ্যায় রচনা করেন রাজা-বাদশাহদের শাসনকার্য ও ন্যায়-ইনসাফের গুরুত্ব নিয়ে। অতীত-বর্তমানের নানা প্রসঙ্গ টেনে সুশাসনের বিষয়টি তুলে ধরেন এবং রাজ্য রক্ষায় জনগণের শান্তি ও সুখের গুরুত্ব এবং ন্যায়বিচারের ভূমিকার উপর শৈল্পিক ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেন। রাজা-বাদশাহদের চিন্তা, মতামত ও সিদ্ধান্তের গুরুত্ব কতখানি সে ব্যাপারে শাসকবর্গকে সজাগ করেছেন। বলেছেন, দেশের শান্তিসুখের চাবিকাঠি হচ্ছে জনগণ তথা সৃষ্টির সুরক্ষা আর ¯্রষ্টার আদেশ নিষেধের সযতœ পরিপালন।
باب دوم در احسان বাবে দোওওম দার এহসা’ন
দ্বিতীয় অধ্যায় : মাহনুভবতা প্রসঙ্গে
মানবতার সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ ও সর্বশ্রেষ্ঠ সুষমা হচ্ছে মহানুভবতা বা অন্যের প্রতি দয়া, উদারতা ও অনুগ্রহ। শেখ সাদী দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে রাষ্ট্রনীতিকে মহানুভবতার উপর প্রতিষ্ঠিত করা যায়। তিনি প্রমাণ করেছেন মেকিয়াভেলীর রাজনীতির দ্বিমুখিতা ও ভ-ামি চরিত্র কত ঘৃণ্য, কৌশল হিসেবে ব্যর্থ ও পরিত্যাজ্য।
باب سوم در عشق ومستی و شور বাবে সেওওম দার এশকো মাস্তী ও শূর
তৃতীয় অধ্যায় : প্রেম, আসক্তি ও উন্মাদনা প্রসঙ্গে
শেখ সাদী নিজেই প্রেমের শরাবে মাতোয়ারা। তিনি চেয়েছেন বিশ^সভায় প্রেমের বীজ ছড়িয়ে দেবেন। বিশ^ প্রেমের আবহ তৈরির প্রয়োজনে তাঁর লেখুনি ক্ষুরধার অথচ মায়াময়। সৃষ্টির প্রেম থেকে কীভাবে ¯্রষ্টার প্রেমে উত্তরণ ঘটানো যায়, সেই পথ বাৎলে দিয়েছেন তিনি এই অধ্যায়ের কাহিনীগুলোয় কবিতার পসরা সাজিয়ে।
باب چهارم در تواضع বাবে চাহারোম দার তাওয়া’যু
চতুর্থ অধ্যায় : বিনয় প্রসঙ্গ
বিনয়ী জীবন বলতে কী বুঝায়, বিনয় মানুষকে কোন্্ উচ্চতায় নিয়ে যায়, বিনয় কার জন্য শোভন, কার জন্য অশোভন সেসব সূক্ষ্ম তত্ত্ব ব্যক্ত হয়েছে এ অধ্যায়ে। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন মানব জীবনকে সুন্দর সুষমাম-িত করতে হলে চলনে বলনে থাকতে হবে বিনয়।
باب پنجم در رضا বাবে পাঞ্জোম দার রেযা’
পঞ্চম অধ্যায় : সন্তুষ্টি প্রসঙ্গে
মানব জীবনের সৌন্দর্যের প্রধানতম অলঙ্কার তাওয়াজু বা বিনয়। বিনয়ের মধ্য দিয়ে আল্লাহর প্রতি সমর্পিত জীবনের মহিমা প্রকাশ পায়। এই সৌন্দর্যগুলো তিনি গল্প আর গল্পের আসরে আমাদের কাছে বলে গেছেন অসাধারণ কাব্যরসের একেক আসরে।
باب ششم در قناعت বাবে শেশুম দর কানাআত
ষষ্ঠ অধ্যায়: অল্পেতুষ্টি প্রসঙ্গ
ইসলামের আধ্যাত্মিক সাধনায় যে ধরনের জীবন গড়ার তাগিদ দেয়া হয় তাতে থাকে বিনয়, সন্তুষ্টি ও অল্পেতুষ্টি। শেখ সাদী আধ্যাত্মিক অবহে নির্লোভ অল্পেতুষ্টির জীবনে কী সুখ ও শান্তি নিহিত তার মহিমা গেয়েছেন এই অধ্যায়ে।
باب هفتم در عالم تربیت বাবে হাফতোম দার আ’লামে তারবিয়াত
সপ্তম অধ্যায় : শিক্ষার জগৎ
শিক্ষাই মানব জীবনকে উন্নত ও মহিমান্বিত করে, এই সত্যটি দুনিয়ার সবাই বিশ^াস করে। তাই দেশে দেশে জাতিতে জাতিতে এত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু মনুষ্যত্বের উন্নয়ন সাধন করে প্রকৃত সোনার মানুষ বানানোর শিক্ষা কোন্্টি শেখ সাদী গল্পের আসরে তার পথ ও প্রক্রিয়া বাৎলে গেছেন মানব জাতির উদ্দেশে। জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মহিমা নিয়ে দুনিয়ার তাবৎ মনীষি নির্দেশনা দিয়েছেন তাঁদের রচনায়। ইমাম গাযযালী ‘নাসিহাতুল মুল্্ক’ গ্রন্থে দুটি অধ্যায় বরাদ্দ করেছেন শিক্ষা দীক্ষা ও মনীষীদের প্রজ্ঞার আলোচনা নিয়ে। শেখ সাদীর অপর গ্রন্থ ‘গুলিস্তান’ কিতাবের সপ্ত অধ্যায়টির আলোচ্য বিষয়ও হচ্ছে তারবিয়াত বা শিক্ষা ও দীক্ষা। শেখ সাদীর শিক্ষা দর্শনের মূল কথা নিজের ও অন্যের অধিকার চিনতে হবে। ভুলত্রুটি ও দোষখাতা বর্জন করার প্রেরণা থাকতে হবে। এই পথে মানুষ নিজেকে চিনবে আর আত্মপরিচয়ের সূত্র ধরে আপন ¯্রষ্টাকে চিনবে আর ¯্রষ্টার তরফ হতে অর্পিত নিজের দায়িত্ব পালনে যতœবান হবে।
باب هشتم در شکر بر عافیت বাবে হাশতোম দার শোক্্র বার আ’ফিয়াত
অষ্টম অধ্যায় :সুস্থতার শোকরিয়া প্রসঙ্গ
পৃথিবীতে মানুষকে দেয়া আল্লাহর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেয়ামত সুস্থতা। সুস্থ থাকতে হলে এর গুরুত্ব বুঝতে হবে। তখনই মানুষ সুস্থতার পক্ষের বিষয়গুলো অর্জন আর বিপক্ষের বিষয়গুলো বর্জনে যতœবান হবে। কাজেই মানুষ যেন সুস্থতার জন্য নিয়ত আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞ থাকে। তার কথা ও আচরণে সেই শোকরিয়া ও কৃতজ্ঞতা বোধের প্রকাশ ঘটে কবিতার ছন্দে সাদী সেই প্রেরণার সুর তুলেছেন মানুষের হৃদয়তন্ত্রীতে।
باب نهم در توبه و راه صواب বাবে নোহোম দার তাওবা ও রা’হে সাওয়া’ব
নবম অধ্যায় : তওবা ও সঠিক পথ প্রসঙ্গে
তওবা ও আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনার মধ্য দিয়ে মানুষ কীভাবে সঠিক পথের সন্ধান পেতে পারে সেই আবেদন নিয়ে শেখ সাদী তাঁর ‘বূস্তান’-এর নবম অধ্যায় সাজিয়েছেন।
باب دهم در مناجات বাবে দাহোম দার মোনাজাত
দশম অধ্যায় : মোনাজাত প্রসঙ্গে
‘বূস্তান’-এর দশম অধ্যায়ের বিষয়বস্তু আল্লাহর দরবারে হৃদয়কাড়া আর্তি আর্জি।
ختم کتاب খতমে কিতাব
কিতাবের সমাপনীতে শেখ সাদীর অনুভূতি, সৃষ্টিজগতের সবকিছু আল্লাহর। তাঁর রচনার পরতে পরতে আল্লাহরই অনুগ্রহ ও দয়ার প্রকাশ।
আমাদের দেশে আধ্যাত্মিক সাধনা বলতে বুঝায় দুনিয়ার ঝক্কি ঝামেলা দূরে ঠেলে মসজিদে খানকায় বসে তপজপ করা। এক শ্রেণির মানুষের ধারণা দুনিয়াকে বর্জন না করলে আধ্যত্মিক উন্নতি সম্ভব হবে না। এই মতবাদে আক্রান্তরা এতদিনের ঘরসংসার, ব্যবসা-বাণিজ্য, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় দায়িত্ব ত্যাগ করে সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে যায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ধর্মীয় জীবনের জন্য আত্মঘাতি এমন সিদ্ধান্তকে মনে করে প্রচ- ধার্মিকতা আর মোক্ষ লাভের সোপান। শেখ সাদী একটি কবিতায় এই মতবাদ খ-ন করে যে মন্তব্যটি করেছেন তা আমাদের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক মহলের জন্য পথের দিশা। বলেছেনÑ
طریقت به جز خدمت خلق نیست
به تسبیح و سجاده و دلق نیست
তারীকাত বজুয খেদমতে খাল্্ক নীস্ত
বতাসবীহ ও সাজ্জা’দা ও দাল্্ক নীস্ত
‘সৃষ্টির সেবা ছাড়া সিদ্ধি নাই তরিকায়
নহে তসবীহ,জায়নামায ও আলখেল্লায়।’
বুস্তান, ১ম অধ্যায়, ৯ নং হেকায়তের পুরো কবিতাটির অনুবাদ এখানে তুলে ধরছি।
আগেকার দিনের বাদশাহদের কাহিনীতে আছে,
পারস্য-রাজ তাক্লা যখন বসলেন সিংহাসনে।
শান্তিতে জনগণ কারো ক্ষতি কেউ করে না দেশে,
সবাইকে ছাড়িয়ে অগ্রণী তিনি একা এই কীর্তিতে।
এক দরবেশের কাছে গিয়ে একদিন বললেন রাজা,
আমার এ জীবন কেটে গেল হুযুর নিষ্ফল, অযথা।
হতে চাই নিমগ্ন ইবাদত-বন্দেগিতে একাগ্রভাবে,
জীবনের বাকি কয়দিন কাটে যেন সৎভাবে।
এই প্রতিপত্তি, রাজত্ব ও সিংহাসন যখন চলে যাবে
জগতের সম্পদ যাবে না সাথে, নিঃস্বই যেতে হবে।
আলোকিত-হৃদয় দরবেশ শুনে তার কথা
তীব্র প্রতিক্রিয়ায় বললেন, থামো তাক্লা।
‘সৃষ্টির সেবা ছাড়া সিদ্ধি নাই তরিকায়
নহে তসবীহ,জায়নামায ও আলখেল্লায়।’
তুমি সমাসীন থাক তোমার রাজ সিংহাসনে
তবে পূতঃচরিত্রে হও সজ্জিত দরবেশি গুণে।
সততা, নিষ্ঠা ও একাগ্রতায় উদ্যোগী হও,
বড়বড় বুলি, আস্ফালন হতে মুখ সামলাও।
তরিকত সাধনায় বুলি নয়, চেষ্টাই চাই,
বিনা চেষ্টায় এখানে আস্ফালনের মূল্য নাই।
বুযুর্গগণ, যারা সজ্জিত ছিলেন স্বচ্ছতার সম্পদে
এই উত্তরীয় শোভিত ছিল তাদের আচকানের নিচে।
এক শ্রেণির বিভ্রান্ত তাসাউফ বা তরিকতকে ইসলামের বিকল্প হিসেবে দাঁড় করাতে চান। তাঁরা এমনভাবে কথা বলেন যেন তাসাউফ আলাদা একটি ধর্ম। বুঝতে হবে, তাসাউফ ইসলামের বিকল্প হিসেবে সুফিজম বা সুফিবাদ হতে পারে না। ইসলামে আধ্যত্মিকতা একটি আত্মিক চেতনা, ইসলামের সৌন্দর্য। হাদীসে জিব্রাঈলের ভাষ্য মতে যদি ঈমানকে একটি দালানের ভিত্তি বা মাটির নিচের গাঁথুনি পাইলিং এর সাথে তুলনা করি, তাহলে উপরের কাঠামো হলো ইসলামের পাঁচটি মৌলিক বিধান। দালানের মাটির নিচের গাঁথুনি ও উপরের কাঠামো তৈরি হলেও সেখানে বসবাস করা যায় না। বসবাস করতে হলে দালানের দরজা, জানালা, বাথরুমের ফিটিংস লাগবে। যাকে আমরা সাজসজ্জা ডেকোরেশন বলতে পারি।
হাদিসে ‘ইহসান’ শব্দের মধ্যে এর ইঙ্গিত রয়েছে। ইহসান এর মূল ধাতু হাসান। হাসান অর্থ সুন্দর। বাবে ইফআলে গিয়ে ব্যাকরণের রূপান্তরে ইহসান মানে সাজসজ্জা, অলঙ্করণ। ইংরেজিতে বললে ‘ডেকোরেশন’। একথাগুলো চিন্তা না করে কুরআনে বর্ণিত তাযকিয়া ও হাদিসের পরিভাষা ইহসানকে সুফিবাদ নামে ইসলাম থেকে আলাদা একটি মতবাদ হিসেবে যারা দাঁড় করাতে চান তাঁরা নিঃসন্দেহে বিভ্রান্ত। এদের পথ-মত-চিন্তা ভ্রান্ত। শেখ সাদী (র.) এ কথাটি কবিতার ভাষায় ব্যক্ত করেছেন মোহনীয়ভাবে। তার এই উক্তি কাল থেকে কালান্তরে ইসলামের আধ্যাত্মিক সাধনার পথের মাইল ফলক। শেখ সাদীর বলিষ্ঠ উচ্চারণÑ
خلاف پیمبر کسی ره گزید
که هرگز بمنزل نخواهد رسید
খেলা’ফে পায়াম্বার কেসী রাহ গোযীদ
কে হারগেয বেমানযেল না খা’হাদ রেসীদ
পয়গাম্বরের পথ ভিন্ন অন্য পথে যে গেছে
কক্ষণো সে পৌঁছবে না মনজিলে মকসুদে।
সাধনার পথ হতে হবে নবীজির অনুসৃত পথের অনুকীর্তি। এ ছাড়া আর যত পথ মত সব বিভ্রান্তি।
সূত্র : শেখ সা‘দী, বুস্তান, জাভিদান প্রকাশনা সংস্থা, তেহরান, ১৩৬৬ (১৯৮৭ ইংরেজি)