শুক্রবার, ৬ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২১শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

English

‘মসনবী’তে বাদশাহ বাঁদীর প্রেম কাহিনী মওলানা রূমীর অনন্য জীবন দর্শন

পোস্ট হয়েছে: জানুয়ারি ১৭, ২০২১ 

news-image

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী : গল্পের পর গল্প দিয়ে সাজানো মওলানা রূমী (র)-এর বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ ‘মসনবী’ শরীফের প্রথম গল্প ‘এক দাসীর উপর জনৈক বাদশাহর প্রেমাসক্ত হওয়া’র কাহিনী। এই মনোজ্ঞ রোমান্টিক গল্পে মওলানা ইসলামের সুন্দর জীবনদর্শন ও আধ্যাত্মিক ও নৈতিক শিক্ষার সৌধমালা রচনা করেছেন। আমরা গল্পের ভাঁজে ভাঁজে মওলানা রূমী এসব শিক্ষা ও জীবন দর্শন কীভাবে তুলে ধরেছেন তা মূল্যায়ন করার প্রয়াস পাব।
প্রাচীনকালে এক বাদশাহ ছিলেন জাগতিক ও আধ্যাত্মিক উভয়বিধ ক্ষমতার অধিকারী। দীন ও দুনিয়া, যাহেরী ও বাতেনী উভয় গুণের সমাবেশ ছিল তাঁর চরিত্রে। তিনি একবার শিকারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। যাওয়ার সময় পথের ধারে দেখতে পেলেন এক যুবতী রূপসী দাসী। বাদশাহ সেই দাসীর প্রেমে পড়ে যান। প্রচুর অর্থ দিয়ে খরিদ করেন দাসীকে। মাওলানা রূমী এই রোমাঞ্চকর কাহিনীর শুরুতে এখানে সংসার জীবনের একটি শাশ্বত সত্য তুলে ধরে বলেন, পূর্ণ আনন্দ বলতে যা বুঝায় তা জগতে কারো নসীব হয় না। একদিকে মন আনন্দে ভরে গেলে অন্যদিকে ভেঙে যায়। বাদশাহও সেই অবস্থার সম্মুখীন হন।
দাসীকে রাজপ্রাসাদে আনার পর ঘটনাক্রমে দাসী অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন বাদশাহর অন্তরজ্বালা ভীষণভাবে বেড়ে যায়। তিনি দেশের বড় বড় হেকিম জড়ো করেন বাঁদীর চিকিৎসার জন্য। তাদেরকে মোটা অংকের সম্মানীর ওয়াদা দেন। ডাক্তাররা মাত্রাতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের অহমিকায় আক্রান্ত হন। রোগীর চিকিৎসার ব্যাপারে দর্পভরে তাঁরা বলেন, ‘আমরা অবশ্যই আপনার রোগীকে ভালো করে দেব।’ অহংকারের বশে তাঁরা ‘ইনশাআল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহ যদি চান- একথা বলেননি। মানুষের অক্ষমতা আর আল্লাহর কুদরতের মহিমা তাঁরা বুঝতে পারেননি। এজন্য আল্লাহ মানুষের অক্ষমতা হাতেনাতে প্রমাণ করে দিলেন। তাঁদের চিকিৎসায় উল্টা ফল হতে থাকে। মওলানা রূমী (র) এখানে ‘ইনশাআল্লাহ’ বলার তাৎপর্য তুলে ধরে বলেন : ইনশাআল্লাহ বা ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’ বলার আসল তাৎপর্য মৌখিক উচ্চারণ নয়; বরং অন্তরের উপলব্ধিই মূল কথা।
মওলানা এখানে মৌখিক দু‘আ-দরূদ নিয়ে যারা মনে মনে তুষ্ট, অন্তরের উন্নতি-অগ্রগতির খবর যাদের নেই, তাদের ভুল ধরিয়ে দিতে চান। বাদশাহ তাঁর বাতেনী দৃষ্টিতে বুঝতে পারেন, গলদ কোথায়? হেকিমদের চিকিৎসা কেন উল্টা ফল দিচ্ছে? বাহ্যিক উপায়-অবলম্বন ব্যর্থ দেখে বাদশাহ আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করেন। দৌড়ে চলে যান মসজিদে। মেহরাবের নিকটে গিয়ে সিজদায় লুটিয়ে পড়েন মহান রাব্বুল আলামীনের দরবারে। তিনিই তো নিরাশার আশা, মানুষের একমাত্র ভরসা। বুকফাটা কান্নায় বাদশাহ চোখের পানিতে সিজদার স্থান ভিজিয়ে দেন। আল্লাহ্ তাঁর দু‘আ কবূল করেন।
কঠিন সমস্যা ও সংকট থেকে উদ্ধার পেতে হলে আল্লাহর কাছে পূর্ণ আত্মসমর্পণ এবং বুক ভাসিয়ে কান্নাকাটি করলে আল্লাহর রহমতের দরিয়ায় জোয়ার আসে- এই চিরন্তন সত্যটি এখানে অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী করে তুলে ধরেন মওলানা। মওলানা এ সূক্ষ্ম তত্ত্বটি ব্যক্ত করেন যে, দু‘আ তখনই কবূল হয়, যখন মুখ ও অন্তরের ভাষা এক হয়, যখন ইখলাস ও অসহায়ত্ব মানুষের সমগ্র অস্তিত্বকে আচ্ছন্ন করে ফেলে এবং তার ফলে বুকফাটা কান্না আসে।
বাদশাহ কাঁদতে কাঁদতে ঘুমে তলিয়ে যান। সুফিদের মতে স্বপ্নের জগতে অনেক আধ্যাত্মিক সত্য-তথ্য প্রকাশিত হয়। এখানেও ঘুমের ঘোরে বাদশাহর সমস্যার জট খুলে যায়। এক বৃদ্ধ এসে তাঁকে আশ্বাস দেন আগামীকাল এক আগন্তুক রাজদরবারে আসবেন। যিনি ঐ রোগীর উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন। আনন্দের আতিশয্যে বাদশাহর ঘুম ভেঙ্গে যায়। তিনি ভোর হওয়ার অপেক্ষা করতে থাকেন রাজপ্রাসাদের বৈঠকখানার বারান্দায় সেই আগন্তুক হেকিমের জন্য। হেকিম আসছিলেন। কল্পনায় মনে হচ্ছিল আলো-ছায়ার মাঝখানে নতুন চাঁদ যেন ভেসে ভেসে আসছে। কল্পনা বা ‘খেয়াল’ শব্দটি উচ্চারিত হওয়ায় মওলানার চিন্তা চলে গেল দর্শনের জগতে। মানুষের কল্পনাশক্তি এবং মানব জীবনের সর্বত্র ধারণা ও কল্পনার আধিপত্যের ব্যাখ্যা দেন নানা উপমার সাহায্যে। এখানে আল্লাহর অলিদের কল্পনাশক্তির মহিমা ব্যাখ্যা করে বলেন, আল্লাহ্র গুণাবলির যে বাগান সেই বাগানের সৌন্দর্যের প্রতিচ্ছবি পতিত হয় আউলিয়ায়ে কেরামের কল্পনায়।
বাদশাহ আগন্তুক মেহমান হেকিমকে অভ্যর্থনা জানান। তাঁর প্রতি পূর্ণ আদব প্রদর্শন করেন। মওলানা এখানে ‘আদবের’ সুফল এবং মানব চরিত্রের জন্য ‘আদব’ যে এক মহা ভূষণ ও অলংকার, তার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেন এবং ‘বেয়াদবির’ শোচনীয় পরিণাম ও কুফল বর্ণনায় শয়তান, হযরত আদম (আ.) ও আসমান-যমীনের নানা উপমা পেশ করেন। হযরত মূসা (আ.)-এর কওম বেয়াদবির কারণে আসমানি খাবার থেকে বঞ্চিত হওয়ার কুরআনে বর্ণিত ঘটনাকে তিনি দলিল হিসেবে উল্লেখ করেন। আমাদের সংস্কৃতিতে ‘আদব’ ‘বেয়াদব’ শব্দটি বহুল প্রচলিত এবং এর ভাবার্থ ব্যাপক। খুব সম্ভব মওলানা রূমী (র.)-এর ‘মসনবী’ শরীফের এই আলোচ্য শিক্ষা থেকে এই দুটি পরিভাষা আমাদের সংস্কৃতিকে ঋদ্ধ করেছে।
আগন্তুক হেকিমের সাথে বাদশাহর সাক্ষাতের দৃশ্যটি বড় চমৎকার। বাদশাহ বলছেন যে, আমি যেন আপনার জন্যই পাগল হয়েছিলাম। আমার প্রেমানন্দ দাসী নয়, আপনি। তবে আল্লাহ একটার উসিলায় আরেকটা মিলান। এটিই দুনিয়ার নিয়ম। কাজেই লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টায় কেউ যেন কখনো হতাশ না হয়। হেকিমকে সম্বোধন করে বাদশাহ বলেন, আপনাকে পেয়ে আজ আমি বড়ই ধন্য। এই হেকিম আসলে আল্লাহর অলি, আধ্যাত্মিক কবিরাজ। মওলানা এই সূত্রে অলি-আল্লাহর গুণ ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেন। বলেন যে, তাঁদের দর্শন লাভই মানুষের হাজারো সমস্যার সমাধান।
বাদশাহ হেকিমকে রোগীর কাছে নিয়ে যান। হেকিম বলেন যে, বাড়ির ভেতর বাহির থেকে সব লোককে সরে যেতে হবে। হেকিম বুঝতে পারেন, এই রোগী সাধারণ রোগী নয়; প্রেমের রোগে আক্রান্ত হয়েছে দাসী।
প্রেম ও ‘এশ্ক্’-এর প্রসঙ্গ আসতেই তা মওলানার চিন্তাকে আলোড়িত করে। তিনি প্রেমের পরিচয় বর্ণনায় কয়েকটি বয়েত রচনা করে বলেন, সেটিই আসল প্রেম যা মানুষের আত্মিক পূর্ণতা আনে এবং মানুষকে চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। তবে আল্লাহর রহস্য দর্শনের অনুবীক্ষণযন্ত্ররূপী প্রেম এত ব্যাপক-বিশাল ও অবর্ণনীয় যে, তা ভাষা-বর্ণনা ও লিখনির আয়ত্তে আনা যায় না। কেননা, যে কোনো বর্ণনা ও সংজ্ঞা সেই অর্থ ও আকৃতিকেই প্রকাশ করে, যা মানুষের মনের আয়ত্তাধীন। কারণ, মানব মনে আয়ত্তাধীন না হলে তা ভাষায় ও বর্ণনায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কেউ প্রকাশের চেষ্টা করার অর্থ হবে সেই বিষয়কে আরো অধিক অস্পষ্ট ও আচ্ছন্ন করা। কাজেই প্রেমকে দিয়েই প্রেমকে চেনা উচিত। ঠিক সূর্যের আলোর মতো। আলো দিয়েই সূর্যকে চেনা যায়। অবশ্য ছায়া দিয়েও সূর্যকে চেনা যায়, কিন্তু ছায়া তো সেখানেই থাকে, যেখানে সূর্যের আলো থাকে না।
সূর্যের প্রসঙ্গ আসাতে মাওলানার মন চলে গেল আরেক সূর্যের দিকে। সূর্য ফারসিতে খুরশীদ, আরবিতে শামস। এই শামস আসমানের নয়, মওলানার হৃদয়-আকাশের। শামসে তাবরিযী। তাবরিযের সূর্য। শামসে তাবরিযী হলেন নূরে হক। এখানে এসে মওলানা প্রেমের আতিশয্যে কোনো কথা বলতে অপারগ, নির্বাক। কাজেই সেই প্রেমের আলেখ্য অন্য সময়ে ন্যস্ত করেন। বন্ধুরা বারবার অনুরোধ করেন শামসে তাবরিযীর প্রেমের রহস্য বর্ণনার জন্য। কিন্তু মওলানা ফিতনা ও রক্তপাতের আশংকা করেন। তাই মুখ বন্ধ করে ফিরে আসেন আসল গল্পে।
আগন্তুক হেকিম দক্ষ মনোবিজ্ঞানীর মতো ধীরে ধীরে বিনম্র ভাষায় বাঁদীর সাথে আলাপ জমান। মনে কোনো সন্দেহ জাগার সুযোগ না দিয়ে দাসীর অতীত জীবনের নানা কথা জিজ্ঞেস করেন : কোথায় তার বাড়ি, আত্মীয়-স্বজন, চেনা-জানা কারা? কোথায় কোথায় ছিল? তিনি একেক শহরের নাম নেন আর হাতের শিরার দিকে লক্ষ্য রাখেন। হেকিম যখন সমরকন্দ নামোল্লেখ করলেন লক্ষ্য করলেন, দাসীর শিরার স্পন্দন দ্রুততর হয়েছে। হেকিম তখনই সমস্যার সূত্র ধরতে পারেন। হেকিম এসব প্রশ্ন এমনভাবে করেন, যাতে দাসী হেকিমের গোপন উদ্দেশ্য বুঝতে না পারে।
মওলানা ব্যাপারটিকে পায়ের নিচ থেকে কাঁটা বের করার দক্ষতার সাথে তুলনা করেন। অদক্ষ চিকিৎসকদের তিনি এমন লোকের সাথে তুলনা করেন, যারা গাধার লেজের নিচে কাঁটা গুঁজে দেয়। গাধা কাঁটা বের করবার জন্য যতই লাফায়, কাঁটা ততই আরো শক্তভাবে বিদ্ধ হয়। হেকিম এই পন্থায় এ তথ্য উদঘাটন করেন যে, দাসীর প্রেমাস্পদ হচ্ছে এক স্বর্ণকার। সমরকন্দে তার বসবাস। হেকিম তার ঠিকানা জিজ্ঞেস করে জানতে পারেন, সারপোল মহল্লার গাতফার গলিতে তার বাড়ি। হেকিম দাসীকে নিশ্চয়তা দেন, তার মনের মানুষকে অবশ্যই তার কাছে আনার ব্যবস্থা করবেন। তবে শর্ত হলো, এর গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে।
মওলানা এখানে মনের গোপন কথা গোপন রাখার সুফল বর্ণনা করেন। একটি তত্ত্বকথার উদ্ধৃতি দিয়ে কয়েকটি উপমা ও উদাহরণ পেশ করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি সত্য ওয়াদা ও মিথ্যা ওয়াদার মধ্যকার তফাৎ নির্দেশ করে মানব মনে এর প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, সংক্ষেপে তা ব্যাখ্যা করেন।
হেকিম বাদশাহকে এসে বললেন, দাসীর চিকিৎসার একমাত্র পথ হচ্ছে, প্রথমে সমরকন্দ হতে স্বর্ণকারকে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। বাদশাহ সমরকন্দে কয়েকজন দূত প্রেরণ করেন। রাজকীয় সম্মান ও অঢেল সম্পদের প্রলোভন দেখিয়ে আত্মীয়-স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বর্ণকারকে রাজদরবারে নিয়ে আসা হলো। মওলানা এখানে সম্পদের লোভ কীভাবে মানুষকে মৃত্যুর দুয়ারে টেনে নিয়ে আসে তার হাকীকত বর্ণনা করেন।
স্বর্ণকার আসার পর হেকিমের পরামর্শে দাসীকে তার কাছে ফেরত দেয়া হয়। কিন্তু হেকিম গোপনে শরবতের মাধ্যমে স্বর্ণকারকে বিষপান করান। সেই স্লো-পয়জনে ধীরে ধীরে স্বর্ণকার দুর্বল ও শ্রীহীন হয়ে পড়ে। ওদিকে স্বর্ণকারের প্রতি দাসীর প্রেমেও ভাটা পড়ে। এক পর্যায়ে কৃত্রিম প্রেম নিঃশেষ হয়ে যায়। মাওলানা প্রমাণ করেন যে, যে প্রেম রং রূপ ও আকৃতির জন্য জাগতিক, তার পরিণতি এরূপই হয়।
শেষ পর্যন্ত স্বর্ণকার মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তবে মৃত্যুর আগেই বুঝতে পারে যে, তার প্রাণের শত্রু কে এবং কেন তাকে প্রাণ দিতে হচ্ছে। এ স্তরে এসে মাওলানা মানুষের কর্মের প্রতিফল সম্পর্কে স্বর্ণকারের যবানীতে অভাবনীয় বর্ণনা উপস্থাপন করেন। স্বর্ণকারের প্রতি দাসীর প্রেম লোপ পাওয়াকে মওলানা এ কথার প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেন যে, বস্তু ও দেহগত যে প্রেম, তা ক্ষণস্থায়ী। কেননা, স্বয়ং মানুষেরই তো স্থায়িত্ব নেই; কাজেই মানুষের উচিত সেই চিরঞ্জীব চিরন্তন সত্তার প্রেমে আসক্ত হওয়া। কেননা, সেই প্রেম মানুষকে প্রতিমুহূর্তে নতুন জীবন দান করে। আল্লাহ কারো প্রেমের, আসক্তির আদৌ মুখাপেক্ষী না হলেও তিনি দয়ার্দ্র-দয়ালু বিধায় তাঁর সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলা আমাদের পক্ষে সম্ভবপর। কারণ, দয়ালু দাতার পক্ষে কোনো কাজই অসম্ভব নয়।
স্বর্ণকারকে হত্যার ঘটনায় এক জটিল প্রশ্ন জাগে, কীভাবে দ্বীন ও দুনিয়ার রাজত্বের অধিকারী একজন বাদশাহ একজন লোকের প্রাণহানিতে সন্তুষ্ট হতে পারলেন। এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে মওলানা কামিল (পরিপক্ব) লোক ও নাকেস (অপরিপক্ব) লোকদের কাজের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করেন। এ আলোচনা অনেক দীর্ঘ ও মনোমুগ্ধকর। মাওলানার মতে, কাজের সৌন্দর্য বা কদর্যতা ব্যক্তির নিয়ত ও উদ্দেশ্যের ওপর নির্ভরশীল। যেখানে নিয়ত ও উদ্দেশ্য হয় কোনো কল্যাণ সাধন, সেখানে কাজটি সুন্দর বলে গণ্য হয়। আর যদি উদ্দেশ্য ও নিয়ত খারাপ হয় তাহলে কাজটিও মন্দ হয়ে যায়। এর প্রমাণ হিসেবে খিযির (আ.) কর্তৃক কয়েকজন দরিদ্র মানুষের মালিকানাধীন নৌকা ফুটো করে ডুবিয়ে দেয়া এবং আরেক ঘটনায় এক বালককে হত্যা করার ঘটনা উল্লেখ করেন, যা কুরআন মজীদে সূরা কাহফে (সূরা নং ১৮) বর্ণিত।
প্রথম ঘটনায় নিরীহ ইয়াতীমের সম্পদ ধ্বংস এবং পরের ঘটনায় নিরপরাধ বালকের হত্যাকা- ঘটানো হয়। যা দৃশ্যত খুবই মন্দ। কিন্তু খিযির (আ.)-এর উদ্দেশ্য সৎ, মহৎ ও কল্যাণময় ছিল বিধায় কাজগুলো পছন্দনীয় হয়েছিল। উদাহরণ হিসেবে, তিনি বাচ্চাদের সুন্নতে খাতনার কথা উল্লেখ করেন। হাজাম এসে ধারালো ক্ষুর দিয়ে বাচ্চার খতনা করাচ্ছে, রক্তপাতের আশংকায় বাচ্চা চিৎকার দিয়ে কাঁদছে; কিন্তু বাচ্চার ভবিষ্যৎ কল্যাণ চিন্তা করে মা আনন্দে হাসছে এবং আত্মীয়-স্বজনের সাথে সেই আনন্দ ভাগাভাগি করছে।
মওলানা রূমী (র) বলছেন যে, কামিল লোক আল্লাহর হুকুম ও ওহীর নির্দেশ মোতাবিক কাজ করেন, প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা বা ব্যক্তিগত মতলব নিয়ে কিছু করেন না। তাদের মধ্যে কেউ যদি আল্লাহ্্র নির্দেশে হত্যাকা-ও ঘটায়, তা আল্লাহ্র হুকুমেই ঘটায়। এই হত্যা হয় উন্নততর ও আনন্দময় জীবনের পটভূমি। অনুরূপভাবে পীরের নির্দেশ মতো সাধক যে কৃচ্ছ্রসাধনায় রত হয়, দৃশ্যত তা কারো মৃত্যু ঘটানোর মতো। কারণ, দুনিয়ার সুখ-সম্ভোগ তাকে ত্যাগ করতে হয়। আসলে কিন্তু তা নয়। কারণ, উন্নত চরিত্র ও আত্মিক উন্নতি হচ্ছে সুন্দর-সুখী জীবনের পটভূমি। এই পটভূমি এসব দিক চিন্তা করে ভবিষ্যৎ কল্যাণ বিচার-বিবেচনায় রেখে তিনি স্বর্ণকারকে হত্যার ব্যাপারে সম্মতি দেন।
মওলানা এখন নিজকে দায়মুক্ত করার মানসে বলছেন, বাদশাহ যদি নিজস্ব কুমতলব বা স্বার্থদুষ্ট হয়ে স্বর্ণকারকে হত্যার পরিকল্পনা করতেন, তাহলে তার নামও আমি মুখে আনতাম না, কারণ, আল্লাহ্র বান্দা কোনো পাপিষ্ঠের প্রশংসা করতে পারে না। কাজেই আল্লাহ্র অলি আর নাফসের অনুসারী মানুষকে এক পাল্লায় ওজন করা উচিত নয়। মওলানা বিষয়টি ব্যাখ্যার জন্য অসংখ্য উপমার আশ্রয় নিয়েছেন অপর একটি বিখ্যাত গল্পের সূত্রে। অর্থাৎ মুদির দোকানি ও তোতা পাখির গল্পে।
মনীষীদের গুরুত্বপূর্ণ মূল্যায়ন
‘মসনবী’র ব্যাখ্যাতা মনীষিগণ এ কাহিনীকে রূপক গল্প হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন। তাঁরা কাহিনীর ভিন্ন অর্থ গ্রহণ করেছেন। এ কাহিনীতে বাদশাহ হলেন আক্ল ও রূহের রূপক। বাঁদী হচ্ছে নাফসে আম্মারা। স্বর্ণকারের প্রতি বাঁদীর প্রেম দুনিয়াবি ভোগ-বিলাসের প্রতি নাফসে আম্মারার আসক্তির পরিচায়ক। অদৃশ্য জগতের আধ্যাত্মিক চিকিৎসকই নাফস আম্মারার রোগ ধরতে পারেন এবং তিনিই তার সুচিকিৎসা করতে সক্ষম। তিনি রূহ ও আক্লকে শাহওয়াতে নফসানি বা প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার ফাঁদ থেকে উদ্ধার করেন। প্রফেসর নিকলসন কাহিনীর এরূপ ব্যাখ্যার পক্ষপাতি।
মওলানা আশরফ আলী থানবী (র.) উপরিউক্ত ঘটনার গূঢ়রহস্য বর্ণনা করেছেন এভাবে : ‘এ কাহিনী মূলত আমাদের বাস্তব অবস্থার অনুরূপ। অনুরূপতা এ দিক থেকে যে, কাহিনীতে যেভাবে বাদশাহ বাঁদীর ওপর প্রেমাসক্ত হয়েছেন তদ্রƒপ আমাদের রূহরূপী বাদশাহ, নাফসরূপী দাসীর ওপর প্রেমাসক্ত হয়ে তার অনুগত হয়ে গেছে। বাঁদী যেরূপ স্বর্ণকারের প্রতি আশেক ছিল তেমনি নাফসও দুনিয়াবি ভোগ-বিলাসের প্রতি আশেক হয়ে আছে। বাদশাহ যেভাবে বাঁদীর চিকিৎসার জন্য অদক্ষ হেকিমদের সাহায্য নিয়েছেন, অথচ কোনো ফায়দা হয়নি। তেমনি অপক্ব পীরদের কাছে গিয়ে কোনো ফায়দা হবে না। কাহিনীতে গায়বী হেকিম যেভাবে চিকিৎসা করলেন এবং স্বর্ণকারকে বিষপানে কুৎসিত আকৃতির বানিয়ে দিলেন, যাতে তার প্রতি বাঁদীর মনে ঘৃণার সৃষ্টি হয়, অতঃপর স্বর্ণকারকে মেরে ফেললেন এবং এ পন্থায় বাঁদীর সুচিকিৎসা করলেন, তদ্রুপ কামেল পীর দুনিয়াবি ভোগ বিলাসের আসক্তিকে ক্রমান¦য়ে নাফস থেকে পৃথক করে ফেলেন। এক পর্যায়ে নাফস সেগুলো ত্যাগ করে এবং নফসানি রোগব্যাধি হতে মুক্তি পায়। এরপর বাদশাহ রূহ, নাফসের দ্বারা উপকৃত হন।
মোটকথা এ শিক্ষণীয় বিষয়টি পাওয়া গেল যে, যদি হৃদয়ের মরিচা দূর করতে চাও, তাহলে কামেল পীরের শরণাপন্ন হও। তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চল। তিনি যথাযথ পন্থায় তোমার রোগের চিকিৎসা করবেন।
মওলানা রূমী (র.)-এর বক্তব্যের দুটি প্রধান বিষয় রয়েছে। একটি বিষয়, যা পরম কাম্য তা হলো তাওহীদ। দ্বিতীয়টি হলো তাওহীদে উপনীত হওয়ার কর্মপন্থা অর্থাৎ শেখে কামেল বা কামেল পীরের আনুগত্য।’- (কলীদে মসনবী, প্রথম দপ্তর, পৃ : ১৩)
ড. বদিয়ুযযামান ফরুযানফার এ ধরনের ব্যাখ্যাকে পছন্দ করেননি। তিনি বলেন, ‘এ জাতীয় ব্যাখ্যা মওলানার রুচির সাথে খাপ খায় না। কারণ হচ্ছে, সাধারণত ‘মসনবী’তে গল্প, কাহিনী ও উপমা কোনো বিষয় বা বক্তব্যের ব্যাখ্যা ও বর্ণনার যুক্তি হিসেবে উপস্থাপন করা হয় না; বরং বক্তব্য ও বিষয়গুলোর প্রতি পাঠক ও শ্রোতার মনোযোগ আকর্ষণের মাধ্যম হিসেবে পল্প-কাহিনীর অবতারণা করা হয়। মাওলানা চান না যে, এসব কাহিনী বা গল্পকে নৈতিক বা সামাজিক বিষয়ের আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করা হোক। এ জন্য আমরা দেখতে পাই, ‘মসনবী’তে এমন কতক কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে যেগুলো বাহ্যিক দৃষ্টিতে কুৎসিত ও অপছন্দনীয়। কিন্তু তা দ্বারা যেহেতু কাক্সিক্ষত উদ্দেশ্য বা আসল বক্তব্য পরিষ্কাররূপে তুলে ধরা সম্ভব হয়েছে সেহেতু মওলানা সেসব উপমা বা গল্প বর্ণনা থেকে বিরত থাকেন নি। কারণ, গল্পের কাঠামো বা তার অংশগুলো কী রকম হচ্ছে তার প্রতি মওলানার আদৌ দৃষ্টি নেই। তিনি গল্প ও উপমাকে দাঁড়িপাল্লা বা মাপকযন্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছেন। দৃশ্যত এ গল্পেও তিনি গল্পের আঙ্গিক কাঠামোকে মোটেও গুরুত্ব দেননি; বরং এর ফলাফলই তাঁর লক্ষ্য ছিল।’- (শারহে মসনবী শরীফ, পৃ : ৫০)
আমার ক্ষুদ্র অনুভবে জনাব ফরুযানফারের ব্যাখ্যাই সঠিক। কারণ, মওলানার উদ্দেশ্য কাহিনী বর্ণনা নয়, বরং কাহিনীর ছদ্মাবরণে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা ও গূঢ়-রহস্যগুলো ব্যাখ্যা করাই তাঁর লক্ষ্য। এ জন্য দেখা যায়, তিনি কোনো গল্প কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে নানা ধর্মীয়, নৈতিক ও দার্শনিক বিষয় এমনভাবে তুলে ধরেন, যা পড়তে গিয়ে মনে হবে মওলানা নিজেই কাহিনী শেষ করার কথা ভুলে গেছেন। আবার দেখা যাবে, এক কাহিনী শেষ না করেই আরেক কাহিনীর অবতারণ করেছেন। এভাবে ‘এক গল্পের মাঝে আরেক গল্পের’ আধিক্যে সাধারণত ঐসব পাঠক অস্বস্তি ও বিরক্তি বোধ করবেন যাঁরা মসনবীকে কোনো কাহিনীকাব্য মনে করে এর রস আস্বাদনের চেষ্টা করেন।
মসনবীর কাহিনীগুলোকে কোনো দেশের পর্যটন বিভাগের সুসজ্জিত গাড়ির সাথে তুলনা করা যায়। এ ধরনের গাড়িতে পর্যটকদের নিয়ে কোনো ঐতিহাসিক স্থানে নামানো হয়। গাইড সেখানকার ঐতিহাসিক বিষয় ও নিদর্শনগুলোর বর্ণনা দেন। আবার যাত্রীদের তুলে কোনো পরিত্যক্ত স্থানে নিয়ে নামান, সেখানকার দৃশ্যাবলি দেখানোর পর আবার গাড়িতে ওঠান। এভাবে মনোরম হোক বা দৃশ্যত অপছন্দনীয় হোক, নানা গম্য-অগম্য স্থানে নিয়ে যান। স্থুলদৃষ্টির যাত্রীরা হয়ত বলবে, এত অল্প রাস্তা পাড়ি দিতে এতবার দাঁড়াল কেন, গাইডের এত কথা বলার দরকার কী ছিল? শহরটি এক চক্কর ঘুরিয়ে আনলেই তো হত। শহরের প্রাচীন স্থাপত্যের দুর্গন্ধময় গলিতে নিয়ে গেলেন কেন? কিন্তু সূক্ষ্মদর্শী পর্যটকরা এমন গাইড ও ভ্রমণের জন্য নিজকে ধন্য মনে করবেন। বুঝতে হবে যে, গাইডের উদ্দেশ্য শুধু শহরের কয়েকটি সড়কে বা মোড়ে চক্কর দেয়া নয়, প্রতিটি ঐতিহাসিক স্থান ও নিদর্শন খতিয়ে দেখানোই উদ্দেশ্য। ‘মসনবী’ শরীফকেও সে দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করতে হবে। তাহলেই কোনো বিরক্তির ছোঁয়া লাগবে না। আধ্যাত্মিক তৃপ্তিতে মন ভরে যাবে। অন্যথায় একে সুন্দর সুখপাঠ্য কাহিনী কাব্য মনে করলে সম্পূর্ণ নিরাশ হতে হবে। বাদশাহ ও বাঁদীর প্রেম কাহিনীকেও আমরা এই নিরিখে আধ্যাত্মিক শরাব পানের পেয়ালা অথবা আধ্যাত্মিক জগতের রহস্য দর্শনের উদ্দেশ্যে পর্যটনের গাড়ি মনে করব। তাহলেই স্বর্ণকারকে বিষপ্রয়োগে হত্যার মতো জটিল প্রশ্নের সমাধান মিলবে। মওলানা রূমীর বিশ্লেষণের ধারাভাষ্য বিস্তারিতভাবে সামনে আনলেই এ বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে এবং এ সম্পর্কিত যে কোনো প্রশ্নের জবার পাওয়া যাবে।
গল্পের উপসংহারে মওলানা সতর্ক করে বলেছেন, আল্লাহর কাজ এবং অলি-আল্লাহদের কাজকে নিজের সাথে তুলনা করা মারাত্মক ভুল। নিজের অবস্থা ও অবস্থান ভালো করে চিন্তা করে দেখ, তাহলেই এর হাকীকত বুঝতে পারবে। আমাদের জীবনে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনায় আমরা সে সত্যের সাক্ষাৎ পাই। আমাদের জীবনে এমন অনেক ঘটনা ঘটে, তাৎক্ষণিকভাবে মনে হয় তাতে আমাদের জন্য কোনো কল্যাণ নেই; এমনকি নিজের জন্য ক্ষতিকর মনে করে অস্থির হয়ে উঠি, অধৈর্য হয়ে যাই; কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সময় যাবার পর ঘটনার প্রকৃত কল্যাণ আমাদের সামনে আসে। কাজেই আল্লাহর কাজকে নিজের বুদ্ধি-বিবেচনার মানদণ্ডে বিচার করতে নাই।
একইভাবে আল্লাহর অলিদের কোনো কোনো কাজ সাধারণ দৃষ্টিতে বুঝে আসবে না, আপত্তিকর মনে হতে পারে। এর আসল কারণ, নির্বোধ লোকেরা আল্লাহ্র নবী (আ.) ও অলিদেরকে নিজের সাথে তুলনা করে। তাতে মারাত্মক ভ্রম ও পরিণতির শিকার হয়। মওলানা বলছেন : ‘তোমার মধ্যে আর ঐ শ্রেণির মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। তাঁদের নিকট আল্লাহর আদেশ ও ইলহাম আসে। তাঁরা সেই নির্দেশনা অনুসারেই কাজ করেন। উপরের গল্পে গায়েবী হেকিম সেরূপ ইলহাম যোগেই দাসীর চিকিৎসা করেন। কুরআন মজীদে মূসা (আ.) ও খিজির (আ.)-এর ঘটনাও এর নিরিখে বুঝতে হবে।’
বস্তুত সবকিছুকে নিজের সাথে তুলনা করে বিচার করলে কী ধরনের বিভ্রাট ঘটে এবং গোটা সৃষ্টিতে একই ধরনের বস্তুর পরস্পরের মধ্যে যে তারতম্য বিরাজমান তার ব্যাখ্যায় মওলানা আরেকটি গল্পের অবতারণা করছেন। সেটি হচ্ছে ‘মুদির দোকানি ও তোতা পাখি’র গল্প।

লেখক : ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশিত মসনবী শরীফের বাংলা অনুবাদক ও ব্যাখ্যাতা।