নারীকুলের আদর্শ হযরত ফাতেমা যাহরা (সা. আ.)
পোস্ট হয়েছে: ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৯
ড. মোহ্সেন রেযা: একটি ইসলামি সমাজে একজন নারী বিভিন্ন ধরনের ভূমিকা পালন করতে পারে। এসব ভূমিকার মধ্যে কতোগুলো ভূমিকা এমন ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী যেগুলো তার জন্য বাধ্যতামূলক নয়, তবে সে স্বীয় মেধা-প্রতিভা ও যোগ্যতা অনুযায়ী এবং ঈমানের দাবি ও দায়িত্ববোধের ভিত্তিতে সেগুলো আঞ্জাম দিতে পারে।
এখানে স্মর্তব্য যে, রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর যুগের তুলনায় বর্তমান যুগে সাধারণভাবে মানুষের জীবনযাত্রা অপেক্ষাকৃত সহজতর, ফলে গড়পরতা নারীদের জীবনও অপেক্ষাকৃত সহজ। ইসলামের অভ্যুদয়ের যুগে সমাজে বিদ্যমান র্শিকী চিন্তাধারার প্রভাবে নারীরা কঠিন চাপের মধ্যে ছিল এবং এ অবস্থায় ইসলাম একটি নতুন জীবন ব্যবস্থা নিয়ে আবির্ভূত হয় ও নারীর জন্য একটি গতিশীল ভূমিকা উপস্থাপন করে।
এছাড়াও ইসলামের অভ্যুদয়ের পর থেকেই মুসলমানদেরকে বিভিন্নভাবে যুলুম-নির্যাতনের শিকার হতে হয়, তাঁরা দেশত্যাগে বাধ্য হন, এরপর তাঁদেরকে বহু যুদ্ধ মোকাবিলা করতে হয় এবং আরো বহু ধরনের কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। এ কঠিন পরিস্থিতি হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর পরবর্তী ইসলামের ইতিহাসের অন্য কোনো অধ্যায়ের কঠিন পরিস্থিতির সাথেই তুলনীয় ছিল না। এহেন পরিস্থিতিতে হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর কন্যা হযরত ফাতেমা (সালামুল্লাহি আলাইহা) ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে বিভিন্ন ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন একই সাথে একজন আদর্শ কন্যা, স্ত্রী, মাতা, শিক্ষয়িত্রী, পথনির্দেশক, সমাজকর্মী, অভাবীদের সাহায্যকারী ও পৃষ্ঠপোষক, গৃহকর্ত্রী, রাত জেগে ইবাদতকারিণী, ইসলামি শালীন পোশাকের সক্রিয় প্রবর্তক, নারীদের মধ্যে আদর্শিক মূল্যবোধের বিস্তারকারী, আর্থিক ব্যবস্থাপনাকারিণী, মুজাহিদাহ, এক কথায়, ইসলামের সত্যিকারের ও একনিষ্ঠ অনুসরণকারিণী।
হযরত ফাতেমা (সা. আ.)-এর এসব ভূমিকা তাঁর বহুমুখী ব্যক্তিত্বেরই পরিচায়ক। আর তাঁর পক্ষে এসব উন্নত ভূমিকা পালন করা সম্ভব হয়েছিল একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলের সাথে তাঁর আন্তরিক ও একনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে। তাই হযরত ফাতেমা (সা. আ.)-কে অনুসরণীয় আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে নিলে বর্তমান যুগের মুসলিম নারীদের পক্ষে স্বীয় ব্যক্তিগত জীবনের সকল ক্ষেত্রে এবং একই সাথে সমাজ জীবনে যথাযথ ভূমিকা পালন করা সম্ভব।
বস্তুত যারা নারীর কর্মক্ষেত্রকে কেবল গৃহের চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ মনে করেন তাঁরা এ বিষয়ে সঠিক ধারণা পোষণ করেন না; বরং সমাজে নারীর জন্য পালনীয় বহু ভূমিকা রয়েছে। একটি ইসলামি সমাজে একজন নারী বিভিন্ন পর্যায়ে ও বিভিন্ন অবস্থায় বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তিগত ও সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে পারে। অবশ্য এসব ভূমিকা ও দায়িত্বের মধ্যে কতগুলো পালন করা তার জন্য ইসলামের দৃষ্টিতে বাধ্যতামূলক এবং কতগুলো বাধ্যতামূলক নয়, তবে অনেক ক্ষেত্রে সেগুলোতে নারীর ব্যক্তিগত চেষ্টাসাধনা, গুণাবলি ও মেধা-প্রতিভার প্রতিফলন ঘটে থাকে। এ বিষয়টি মাথায় রেখে ইসলামের অভ্যুদয়-পরবর্তী ইতিহাসের বিভিন্ন যুগে মুসলিম নারীরা যেসব ভূমিকা পালন করেছেন সে সম্বন্ধে গবেষণা করা যেতে পারে।
বর্তমান যুগ হচ্ছে উন্নততর প্রযুক্তির যুগ; বর্তমান যুগের উন্নত প্রযুক্তি, অত্যুন্নত যন্ত্রপাতি ও জীবন যাপন সহজ করার লক্ষ্যে উৎপাদিত বিবিধ উপায়-উপকরণ এবং উচ্চ গতিসম্পন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা একদিকে যেমন জ্ঞানার্জনকে সহজতর করে দিয়েছে, অন্যদিকে জীবনকে করে দিয়েছে অধিকতর আরামদায়ক। তাই বর্তমান যুগের অবস্থাকে কোনো দিক দিয়েই হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর সময়কার পরিবেশের রূঢ়তা ও জীবনযাত্রার কঠিনতার সাথে তুলনা করা চলে না। একই কারণে বর্তমান যুগের মানুষের অবস্থা এবং আরব উপদ্বীপের তৎকালীন সেই রূঢ় সমাজ পরিবেশ ও কঠিন জীবনযাত্রায় জীবন যাপনকারী মানুষের অবস্থার সাথে তুলনা করা সম্ভব নয়। তাই এটা যে কেউ স্বীকার করতে বাধ্য যে, ঐ ধরনের পরিস্থিতিতে একজন নারীর পক্ষে বিভিন্ন ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালন করা, যেমন : জ্ঞানার্জন করা, অন্যদেরকে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা, যোগাযোগ ও প্রচারের কাজ আঞ্জাম দেয়া, এমনকি স্বাভাবিক জীবন যাপন করা, কোনো দিক থেকেই আজকের দিনে ঐসব দায়িত্ব পালনের সাথে তুলনীয় ছিল না। অধিকন্তু ইসলামের অভ্যুদয়ের ফলে মুশরিক, ইহুদি ও ইসলামবিরোধী অন্যান্য মহলের বিরোধিতাজনিত কারণে ঐ সময়টি ছিল দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও যুদ্ধ-বিগ্রহের সময়।
ইসলামের অভ্যুদয়কালে জাহেলীয়াত যুগের আরব সমাজে নারীকে পুরুষের তুলনায় নিম্নমানের মানুষ বা দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষ মনে করা হতো, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে তাদেরকে আদৌ মানুষ বলে স্বীকার করা হতো না। এ ধরনের সমাজ-পরিবেশে একটি নতুন ও অভিনব ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে, অন্য কথায়, ইসলাম এমন একটি সর্বাত্মক জীবন ব্যবস্থা হিসেবে আবির্ভূত হয় যা নারীকে আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে তাদের জন্য নির্ধারিত নারীত্বের মর্যাদা ও অধিকারসমূহ প্রত্যর্পণের জন্য সংগ্রাম করে। তৎকালে জনমনে নারীদের সম্পর্কে যে জাহেলীয়াত্ যুগের চিন্তা-চেতনা বিদ্যমান ছিল সে পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন মুসলিম নারীদের জন্য অনেক বেশি দায়িত্ব পালন করা প্রয়োজন ছিল। তখন একজন মুসলিম নারীর জন্য ইসলামি আদর্শের অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিগণিত হবার লক্ষ্যে অনেক অতিরিক্ত দায়িত্বের বোঝা বহন করা অপরিহার্য ছিল।
তৎকালীন আরব সমাজে যে সংঘাতময় ও সহিংস পরিবেশ-পরিস্থিতি বিদ্যমান ছিল সে কারণে ইসলামের প্রথম যুগের পরিস্থিতি কোনো দিক থেকেই পরবর্তীকালীন কোনো যুগের পরিস্থিতির সাথেই তুলনীয় ছিল না। এ কারণে ইসলামের প্রথম যুগে যেসব নারী প্রকৃত অর্থেই ইসলামি মূল্যবোধের সপক্ষে দাঁড়ান এবং স্বীয় যথাযথ ভূমিকা ও দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করেন তাঁদেরকে অবশ্যই পরবর্তীকালীন মুসলিম নারীদের জন্য, এমনকি বর্তমান কালের মুসলিম নারীদের জন্য অনুসরণীয় আদর্শ হিসেবে গণ্য করতে হবে।
এটা কোনো অনুমানভিত্তিক অভিমত নয়; বরং এ হচ্ছে ইসলামের ইতিহাসের প্রাথমিক অধ্যায়ের অবস্থার পর্যালোচনা থেকে প্রাপ্ত উপসংহার। রাসূলে আকরাম (সা.)-এর যুগে আরব সমাজে ইসলামকে যেভাবে বিরোধিতা মোকাবিলা করতে হয় এবং মুসলমানদেরকে যেভাবে যুলুম-নির্যাতন, নিপীড়ন ও শারীরিকভাবে আক্রমণের শিকার হতে হয়, যেভাবে দুঃখ-কষ্ট স্বীকার করতে হয়, এমনকি স্বীয় জন্মভূমি থেকে হিজরত করতে হয় এবং শেষ পর্যন্ত মদীনায় ইসলামি হুকূমাত প্রতিষ্ঠিত হবার পর অনবরত আগ্রাসন ও যুদ্ধের মোকাবিলা করতে হয়, তার ফলে তৎকালে মুসলমানদেরকে, বিশেষ করে মুসলিম নারীদেরকে অনেক শারীরিক, মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিক চাপের ভিতর দিয়ে জীবন যাপন করতে হয়।
এ প্রসঙ্গে এখানে এসে আমরা আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে বিভিন্ন দিক থেকে নারী ও পুরুষের মধ্যে যেসব পার্থক্য রয়েছে তার ওপরে সংক্ষেপে দৃষ্টিপাত করতে চাই।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, শারীরিক, মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে এবং বিশেষ করে আবেগজনিত চাপ মোকাবিলার ক্ষেত্রে নারীরা পুরুষদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত দুর্বল। অন্যদিকে মায়ের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে একজন নারীকে অতিরিক্ত ব্যথা-বেদনা, যন্ত্রণা এবং দীর্ঘ সময়ের জন্য শারীরিক কষ্ট সহ্য করতে হয়। এছাড়া নারী স্বীয় সন্তান-সন্ততি ও প্রিয়জনদের ব্যাপারে তাদের পুরুষ সমপক্ষের তুলনায় অধিকতর আবেগপ্রবণ। এসব বিষয় এবং এ ধরনের আরো কতক বিষয় রয়েছে যা ব্যক্তিগতভাবে ও সামষ্টিকভাবে উভয় দিক থেকেই সমাজে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নারীকে একটি বিশেষ অবস্থানে অধিষ্ঠিত করেছে।
এ পরিপ্রেক্ষিত মাথায় রেখে আমরা, হযরত ফাতেমা যাহ্রা (সা. আ.) স্বীয় সংক্ষিপ্ত জীবন কালে তৎকালীন আরব সমাজে, বিশেষত ইসলামের প্রথম যুগের কঠিন সময়ে যে ভূমিকা পালন করেন তার ওপরে সংক্ষেপে আলোকপাত করতে চাই- যাতে যে কারো পক্ষে তাঁর ভূমিকা ও তাঁর সময়কার অন্যান্য মুসলিম নারীর ভূমিকার মধ্যে তুলনা করা সম্ভব হতে পারে। আর তাহলেই তাঁরা হযরত ফাতেমা (সা. আ.)-এর অত্যুন্নত গুণাবলি ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসমূহের পছন্দনীয়তা অনুভব করতে পারবেন।
আমাদের এ অভিমতের যথার্থতা প্রমাণের জন্য হযরত ফাতেমা সম্পর্কে হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) থেকে বর্ণিত বিভিন্ন হাদিসের প্রতি ও তাঁর সম্পর্কে কোরআন মজীদের যেসব আয়াত নাযিল হয়েছে সেগুলোর প্রতি দৃষ্টি দেয়াই যথেষ্ট। তবে এখানে আমরা আমাদের অভিমতের সমর্থনের জন্য এসব হাদিস ও আয়াতের আশ্রয়গ্রহণ করছি না; বরং আমরা তাঁর বাস্তব জীবনের প্রতি দৃষ্টি দিতে চাই। কারণ, তাহলে আমরা বুঝতে পারব যে, তিনি পারিবারিক সূত্রে কী ধরনের চরিত্র-বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ব্যক্তিত্ববর্গের সাথে সম্পর্কিত ছিলেন, তেমনি সামাজিক ও ধর্মীয় কারণে ইসলামের অনুসারী যেসব ব্যক্তির সাথে তাঁর যোগাযোগ ছিল তাঁদের অবস্থাই বা কেমন ছিল। তেমনি একজন মুসলমান হবার কারণে তিনি যে প্রতিকূল পরিবেশে জীবন যাপন করতে বাধ্য হন তা-ও আমরা জানতে পারব। অতঃপর আমরা সেসব বিষয় নিয়ে পর্যালোচনা করলে আমাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে যাবে যে, তিনি যে ধরনের কঠিন পরিস্থিতিতে তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবন কালে বিভিন্ন ধরনের গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন তা আমাদের আধুনিক যুগের লোকদের পক্ষে এমনকি কল্পনা করাও সম্ভবপর নয়।
পারিবারিক জীবন
হযরত ফাতেমা যাহ্রা (সা. আ.) তাঁর বিবাহের পূর্বে অত্যন্ত প্রতিকূল ইসলামবিরোধী সামাজিক পরিবেশে তাঁর পিতা রাসূলে আকরাম (সা.)-এর প্রতি স্বীয় দায়িত্বসমূহ পরিপূর্ণ নিষ্ঠা সহকারে পালন করেন। এর অন্যতম দৃষ্টান্ত হচ্ছে এই যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) মক্কায় অবস্থান কালে কা‘বা গৃহে নামায আদায়ের সময় সিজদায় গেলে কাফেররা তাঁর ওপরে আবর্জনা চাপিয়ে দেয়; যেহেতু বালিকা হযরত ফাতেমা সব সময় তাঁর পিতার কাছাকাছি থাকতেন সেহেতু তিনি এ দৃশ্য দেখার পর উপস্থিত দুশমনদের তোয়াক্কা না করে সাথে সাথে ছুটে গিয়ে রাসূলুল্লাহ্র ওপর থেকে সে আবর্জনা সরিয়ে দেন।
অন্যদিকে হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) হযরত ফাতেমার প্রতি খুবই সম্মান প্রদর্শন করতেন। হযরত ফাতেমা তাঁর সামনে উপস্থিত হলে তিনি নিজে দাঁড়িয়ে গিয়ে তাঁর আসনে হযরত ফাতেমা যাহরাকে বসতে দিতেন- যা ছিল ইসলামি সমাজ ও সংস্কৃৃতিতে কন্যাসন্তানের অবস্থান ও মর্যাদার প্রকৃষ্টতম দৃষ্টান্ত।
একজন স্ত্রী হিসেবে হযরত ফাতেমা যাহরার ভূমিকার প্রতি দৃষ্টি দিলে দেখা যায় যে, তিনি অত্যন্ত সুন্দরভাবে তাঁর সংসার পরিচালনা করেন এবং তাঁর স্বামী ইমাম আলী (আ.)-কে প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেন। আর হযরত আলী ছিলেন হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর সাহাবিগণের মধ্যে ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতিরক্ষায় সর্বাধিক ভূমিকা পালনকারী। তিনি যুদ্ধের সময় ও রাসূলে আকরাম (সা.) কর্তৃক বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের জন্য বিভিন্ন স্থানে গমনের সময় স্বীয় গৃহ হতে দূরে থাকতে বাধ্য হতেন। এ সময়গুলোতে হযরত ফাতেমা যাহরা (সা. আ.)-কে পরিবারের সকল দায়িত্বই পালন করতে হতো। বস্তুত তিনি তাঁর স্বামীকে সকল দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেই একজন অন্তরঙ্গ বন্ধুর ন্যায় সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করতেন।
শুধু তা-ই নয়, হযরত ফাতেমা যাহরা (সা. আ.) তাঁর স্বামী হযরত আলীরই ন্যায় দরিদ্র ও অভাবীদের প্রয়োজন পূরণের ব্যাপারেও খুবই যত্নবান ছিলেন। এ ধরনের ঘটনাও ঘটেছে যে, নিজেদের জন্য প্রস্তুত খানা একজন অভাবী লোককে দান করে তাঁরা দু’জনই না খেয়ে রাত কাটিয়েছেন।
হযরত ফাতেমা যাহরা একজন মাতা হিসেবেও ছিলেন অনুসরণীয় আদর্শ। একজন মাতা হিসেবে তাঁর ভূমিকাকে তাঁর সন্তান হযরত ইমাম হাসান (আ.), হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) ও হযরত যায়নাব (সা. আ.)-কে লালন-পালনের ভিত্তিতে বুঝা যেতে পারে। তিনি তাঁর এ সন্তানদেরকে এমনভাবে লালন-পালন করেন ও গড়ে তোলেন যার ফলে তাঁরা সমুন্নত নৈতিকতা, বুদ্ধিবৃত্তিকতা ও আধ্যাত্মিকতার অধিকারী হতে পেরেছিলেন। এ তিনজন ব্যক্তিত্বের জীবন চরিত, ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব, অনুপম চরিত্র-বৈশিষ্ট্য ও ইসলামের ইতিহাসের চরম সঙ্কট কালসমূহে তাঁরা যেসব দিকনির্দেশক ও যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেন তা থেকেই প্রমাণিত হয় যে, তাঁদের মাতা তাঁদেরকে কী ধরনের সন্তান হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। বাস্তবিকই হযরত ফাতেমা যাহরা (সা. আ.) তাঁর সন্তানদের জন্য একজন মহান শিক্ষয়িত্রীর ভূমিকা পালন করেছিলেন।
শিক্ষিকা ও পথপ্রদর্শক হিসেবে ভূমিকা
হযরত ফাতেমা যাহরা (সা. আ.) সরাসরি হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর নিকট থেকে ইসলামের জ্ঞান লাভ করেন এবং এ কারণে তিনি ইসলামি জ্ঞানের সকল শাখায়ই পূর্ণ দক্ষতার অধিকারী ছিলেন। ফলত তিনি কেবল নারীকেই দ্বীনী শিক্ষা দিতেন না, অনেক পুরুষ সাহাবিও দ্বীনী বিষয়াদি জানার জন্য তাঁর কাছে আসতেন।
তিনি একজন ব্যতিক্রমী ও বহুদর্শী সফল ও সুদক্ষ শিক্ষিকা ও দ্বীনী পথপ্রদর্শক হিসেবে যে ভূমিকা পালন করেন তার প্রমাণ তাঁর দ্বারা স্বীয় সন্তানদেরকে সামাজিক ও দ্বীনী উভয় দিক থেকেই প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার মধ্যে পাওয়া যায়। তাঁর সন্তান হযরত ইমাম হাসান (আ.), হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) ও হযরত যায়নাব (সা. আ.) যে মানব জাতির ইতিহাসে তিনজন অনন্য সাধারণ সমুন্নত ও সমুজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব ছিলেন এ বিষয়টি নতুন করে ব্যাখ্যা করে বলার প্রয়োজন নেই। ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন কীভাবে সামাজিক সৌজন্য, আদব-কায়দা ও মানব মনস্তত্ত্বের প্রতি দৃষ্টি রেখে লোকদেরকে দ্বীনী শিক্ষা প্রদান করতেন তা তাঁদের দ্বারা রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর জনৈক প্রবীণ সাহাবির ভুল নিয়মে ওযূ করাকে তাঁর আত্মসম্মান বিনষ্ট না করে সুকৌশলে ও পরোক্ষভাবে শুধরে দেয়ার ঘটনা থেকেই বুঝা যেতে পারে।
বস্তুত হযরত ফাতেমা যাহরা (সা. আ.) কেবল ফিক্বাহ্ ও নীতিশাস্ত্র সহ দ্বীনী জ্ঞানের সকল শাখায়ই সুদক্ষ ছিলেন না, বরং তার বাস্তব প্রয়োগ এবং সামাজিক ও ব্যক্তিক মনস্তত্ত্বের জ্ঞানেও সুদক্ষ ছিলেন- যা তিনি স্বীয় সন্তানদেরকে শিক্ষা দিয়ে যান।
আদর্শ মনিব হিসেবে
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) হযরত ফাতেমার কাজকর্মে সাহায্য করার জন্য তাঁকে ফিযযাহ নামক যে ক্রীতদাসীটি দান করেছিলেন তাঁর সাথে হযরত ফাতেমার আচরণ থেকে তাঁর বহুমুখী অনুসরণীয় আদর্শ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যকার আরেকটি বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যায়।
হযরত ফাতেমা (সা. আ.) ফিযযাহর সাথে এভাবে গৃহকর্মের পালা নির্ধারণ করে নেন যে, একদিন ফিযযাহ ঘরের কাজকর্ম করবেন ও তিনি বিশ্রাম নেবেন এবং আরেক দিন তিনি গৃহকর্ম করবেন ও ফিযযাহ বিশ্রাম নেবেন। বস্তুত মানব জাতির ইতিহাসে এ ধরনের দ্বিতীয় আরেকটি দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না।
স্মর্তব্য যে, তৎকালীন জীবনযাত্রা বর্তমান যান্ত্রিক জীবযাত্রার ন্যায় সহজসাধ্য ছিল না। কারণ, বর্তমানে যেসব গার্হস্থ্য কর্ম যন্ত্রের সাহায্যে সম্পাদন করা হয় তখন সেসব কাজও হাতেই করতে হতো। অধিকন্তু মুসলমানদের মদীনার জীবনটা ছিল যুদ্ধবিগ্রহের যুগ; মুসলমানদের ওপর কাফের-মুশরিক ও ইহুদিদের পক্ষ থেকে একের পর এক যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হচ্ছিল। রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর মদীনার দশ বছরের যিন্দেগীতে এ ধরনের ২৭টি যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং হযরত ইমাম আলী (আ.) এসব যুদ্ধের বেশির ভাগেই অংশগ্রহণ করেন, ফলে তাঁকে অনেক সময়ই স্বীয় গৃহ থেকে দূরে অবস্থান করতে হতো। এ সময় হযরত ফাতেমা যাহরা (সা. আ.)-কে পরিবারের জন্য দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় ঘরের বাইরের কাজও আঞ্জাম দিতে হতো। এহেন পরিস্থিতিতে ক্রীতদাসীর সাথে কাজকর্ম সম্পাদনের বিষয়টি পালা করে আঞ্জাম দেয়া ও তাঁকে পালাক্রমে বিশ্রামের সুযোগ দেয়া অন্য যে কারো জন্যই অকল্পনীয় ছিল এবং এ বিষয়টি কেবল তাঁর পক্ষেই সম্ভবপর ছিল। কারণ, তিনি ছিলেন সর্বোচ্চ স্তরের মানবিক মূল্যবোধের অধিকারী এবং তিনি মানবাধিকারের প্রতি সর্বোচ্চ পর্যায়ের সম্মান পোষণ করতেন, আর এ কারণেই তিনি তাঁর অধীনস্থকে মানুষ হিসেবে তাঁর নিজের সমতুল্য গণ্য করে তদ্রুপ আচরণ করতেন।
জাতীয় ও সামাজিক জীবনে তাঁর ভূমিকা
হযরত ফাতেমা যাহ্রা (সা. আ.) যে সমাজে বসবাস করতেন সে সমাজের সামাজিক দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রেও তিনি নিস্পৃহ ছিলেন না; বরং ইসলামের সীমারেখার মধ্যে অবস্থান করে এ দায়িত্বও তিনি যথাযথভাবে পালন করেন। এ বিষয়ে ইতিহাসের পাতায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে যে কারো পক্ষেই বিস্তারিত জানা সম্ভব।
হযরত ফাতেমা যাহ্রা দরিদ্র ও অভাবী লোকদের প্রয়োজন পূরণকে, এমনকি নিজের ন্যূনতম মৌলিক প্রয়োজন পূরণের ওপরেও অগ্রাধিকার প্রদান করতেন। তিনি তাঁর সমস্ত সম্পদ, এমনকি তাঁর বিবাহের পোশাক ও অলঙ্কার পর্যন্ত দান করে দেন। শুধু তা-ই নয়, তিনি সারা দিন রোযা রেখে ইফতারের সময় তাঁর পুরো খাবার অভাবী লোককে দান করে দেন। শুধু মুসলমানদেরকেই নয়, তিনি প্রয়োজনবোধে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী লোকদেরকেও সাধ্যানুযায়ী সাহায্য করতেন। আর তিনি কোনোরূপ ধন্যবাদ লাভ বা অন্য কোনো পার্থিব লক্ষ্যে এ কাজ করতেন না; বরং একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলাকে সন্তুষ্ট করার ও দ্বীনী দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে এ কাজ করতেন। আর তিনি এ সামাজিক দায়িত্ব পালনের প্রতি এতই যতœবান ছিলেন যে, এ কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় তাঁর নিজেকে ও সেই সাথে তাঁর পরিবারের সদস্যদেরকে না খেয়ে থাকতে হতো এবং প্রয়োজনীয় বিভিন্ন উপায়-উপকরণের ক্ষেত্রে কষ্ট স্বীকার করতে হতো। মানব জাতির ইতিহাসে এমন অন্য কোনো নারীর কথা জানা যায় কি যিনি কেবল আল্লাহ্ তা‘আলার প্রতি ভালোবাসার কারণে পর পর তিন দিন নিজের ও স্বীয় স্বামী-সন্তানদের খাবার ক্ষুধার্তকে দান করে দিয়েছিলেন?
আল্লাহ্ তা‘আলার প্রতি ভালোবাসার কারণে হযরত ফাতেমা যাহরা (সা. আ.)-এর সামাজিক দায়িত্ববোধ ও মানুষের প্রতি এ ভালোবাসা কেবল খাদ্য ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী দান করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এমনকি তিনি যখন আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট দো‘আ করতেন তখনও অন্যদেরকে নিজেদের ওপর অগ্রাধিকার দিতেন। তিনি সারা রাত জেগে নফল ইবাদত করতেন ও দো‘আ করতেন, আর তাতে অভাবী লোকদের ও প্রতিবেশীদের দুঃখ-কষ্ট দূর করে দেয়ার জন্য ও তাদের প্রয়োজন পূরণের জন্য আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে আবেদন-নিবেদন ও অনুনয়-বিনয় করতেন। সামাজিক দায়িত্বানুভূতির ক্ষেত্রে এ ধরনের সমুন্নত চিন্তা-চেতনা ও তদনুযায়ী আচরণের দৃষ্টান্ত মানব জাতির ইতিহাসে একান্তই বিরল ব্যতিক্রম।
স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে ভূমিকা
যে কোনো সমাজ জীবনে স্বেচ্ছাসেবীর ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তবে অপরিহার্য বা বাধ্যতামূলক নয় এমন ধরনের সামাজিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সাধারণত পুরুষদেরকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। কিন্তু প্রয়োজন বোধে নারীর জন্যও স্বেচ্ছাসেবীর ভূমিকা পালন ইসলামের দৃষ্টিতে অপছন্দনীয় তো নয়ই, বরং খুবই পছন্দনীয়। আর বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে ভূমিকা পালন করে হযরত ফাতেমা যাহরা এরই সমুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
হযরত ফাতেমা (সা. আ.) বিভিন্ন সময় রণাঙ্গনে গমন করে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে ভূমিকা পালন করেন; তিনি রণাঙ্গনে মুসলিম বাহিনীকে বিভিন্ন ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করেন, বিশেষ করে আহত সৈনিকদের সেবা-শুশ্রƒষা করেন। অন্যদিকে যুদ্ধের পরে তিনি শহীদগণের পরিবার-পরিজনের কাছে গিয়ে তাঁদেরকে সান্ত¡না প্রদান করতেন। এছাড়া তিনি স্বীয় পরিবারের অভাব ও দারিদ্র্য সত্ত্বেও ইয়াতীম, অভাবী ও দরিদ্রদের প্রয়োজন পূরণের চেষ্টা করতেন। তাঁর গৃহের দরজা সব সময়ই যে কোনো অভাবী ও দরিদ্রের জন্য উন্মুক্ত থাকতো।
উল্লেখ্য যে, হযরত ফাতেমা যাহরা তাঁর ব্যাপক সমাজকল্যাণমূলক কর্মতৎপরতার কারণে সমাজসেবা ব্যবস্থাপনায় বিশেষ দক্ষতার অধিকারী হন, অন্যদিকে অভাবী ও দরিদ্র লোকেরা নিয়মিত তাঁর দ্বারস্থ হতো। কিন্তু তাদের প্রয়োজন পূরণের জন্য তাঁর সামর্থ্য ছিল খুবই সীমিত। এ কারণে হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) তাঁকে বাগানসমৃদ্ধ ফাদাক ভূখণ্ড প্রদান করেন এবং তিনি ফাদাক থেকে প্রাপ্ত আয় ও রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বিভিন্ন সময় তাঁকে আরো যা কিছু দিতেন তা ইসলামের বিধান অনুযায়ী ইয়াতীম, শহীদদের বিধবা স্ত্রীগণ, অভাবী ও দরিদ্রদের সাহায্যার্থে ব্যয় করতেন। এ ক্ষেত্রে মূলত তাঁর ভূমিকা ছিল একজন সুদক্ষ ব্যবস্থাপকের ভূমিকা।
হিজাব প্রচলনে তাঁর ভূমিকা
মুসলিম নারীদের মধ্যে ইসলামি হিজাবসম্মত শালীন পোশাক পরিধানের প্রবণতা তৈরি ও তার বিস্তার সাধনের ক্ষেত্রেও হযরত যাহ্রা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বিভিন্ন উপলক্ষে তিনি মুসলিম নারীদের উদ্দেশে হিজাবের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে বক্তব্য রাখেন এবং তাদেরকে হিজাবসম্মত পোশাক পরিধানের জন্য নসিহত করেন। ইতিহাসে এসব ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে।
এখানে মনে রাখার বিষয় হচ্ছে এই যে, ইসলাম নারীকে যে হিজাবসম্মত শালীন পোশাক পরিধান করার জন্য বিধান দিয়েছে তা পরিধান করে তারা ঘরের বাইরে তাদের সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে পারে। তেমনি ঘরের বাইরে গ¦ায়রে মাহ্রাম পুরুষদের সাথে তাদের আচরণ কী ধরনের হবে সে শিক্ষাও ইসলাম দিয়েছে। আর হযরত ফাতেমা যাহ্রা স্বীয় জীবনে কর্ম ও আচরণের দ্বারা এ শিক্ষার বাস্তব প্রদর্শনী করেছেন এবং এ ব্যাপারে মুসলিম নারীদের জন্য অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে গিয়েছেন।
আত্মিক, আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক দিক সহ হযরত ফাতেমা যাহরা (সা. আ.)-এর সমুন্নত জীবনচরিতের আরো কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় দিক রয়েছে- অত্র নিবন্ধের সীমিত পরিসরের প্রতি দৃষ্টি রেখে সেসব সম্বন্ধে আলোচনা হতে আমরা বিরত থাকছি।
একটি ভাবনার বিষয়
অত্র আলোচনার উপসংহার টানার আগে একটি বিস্ময় উদ্রেককারী ভাবনার বিষয়ের উল্লেখ না করে পারছি না।
ইতিহাসে হযরত ফাতেমা যাহ্রা (সা. আ.)-এর বহুমুখী ব্যক্তিত্বে¡র পরিচয়জ্ঞাপক ও ব্যাপক কর্মতৎপরতার কথা উল্লেখ পাওয়া যায়; প্রশ্ন হচ্ছে, তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনকালে তাঁর পক্ষে তা কীভাবে সম্ভব হয়েছিল?!!! আর নিঃসন্দেহে তাঁর জীবনের প্রতিটি ঘটনা ও তাঁর পালিত প্রতিটি দায়িত্বের কথা উল্লেখ করা ইতিহাসবিদদের পক্ষে সম্ভবপর হয় নি। মানব সভ্যতার তৎকালীন স্তরের জীবন যাত্রা ও আরবের রুক্ষ পরিবেশে এবং বিভিন্ন কারণে বহুবিধ বস্তুগত, মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিক চাপ ও কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে থেকে কী করে একজন মুসলিম নারীর পক্ষে স্বীয় পারিবারিক দায়িত্বসমূহ যথাযথভাবে আঞ্জাম দেয়ার পাশাপাশি এত সামাজিক দায়িত্ব পালন করা সম্ভবপর হলো?!!! অভ্যন্তরীণ ও বাইরের দুশমনদের দুশমনী, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, হিজরতের কষ্ট ও কঠিন পরিবেশ-পরিস্থিতি সহ্য করে, জীবন ধারণের জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় উপায়-উপকরণ ও আর্থিক সামর্থ্যরে অভাব হাসিমুখে মেনে নিয়ে এবং যুদ্ধবিগ্রহ ও আরো অনেক বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যে কীভাবে তাঁর পক্ষে এটা সম্ভব হয়েছিল?!!!
এসব প্রশ্নের একটাই জবাব হতে পারে, তা হচ্ছে, একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলের সাথে তাঁর সুগভীর ও শক্তিশালী আত্মিক সম্পর্কের কারণে, ইসলামের জন্য তাঁর পরিপূর্ণরূপে নিবেদিতপ্রাণ হওয়ার কারণে এবং আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে তাঁর পরিপূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ, আত্মিকভাবে আল্লাহ্ তা‘আলার সান্নিধ্যে উপনীত হওয়া ও আল্লাহ্র জন্য আত্মবিলয়ের কারণে তাঁর পক্ষে এটা সম্ভবপর হয়েছিল। আমরা আল্লাহ্ তা‘আলার সাথে হযরত ফাতেমা যাহ্রা (সা. আ.)-এর এ বিশেষ সম্পর্কের প্রতিফলন দেখতে পাই তাঁর দো‘আয়ে নূরে এবং ইতিহাস গ্রন্থাবলিতে উদ্ধৃত তাঁর বিভিন্ন বক্তব্যে ও তাঁর ইবাদতের বর্ণনাসমূহে।
অন্যদিকে হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর সাথে হযরত ফাতেমা যাহ্রা (সা. আ.)-এর যে সম্পর্ক ছিল তা কেবল পিতা ও কন্যার মধ্যকার আবেগের সম্পর্ক তথা রক্তসম্পর্কজনিত ভালোবাসা, স্নেহ-মমতা ও ভক্তিশ্রদ্ধার সম্পর্ক মাত্র ছিল না; বরং তাঁদের সম্পর্ক ছিল অধিকতর সমুন্নত দ্বীনী সম্পর্ক, আল্লাহর রাসূলের সাথে তাঁর একনিষ্ঠ অনুসারীর শক্তিশালী আত্মিক ও আধ্যাত্মিক সম্পর্ক।
উপসংহার
আজকের দিনে হযরত ফাতেমা যাহ্রা (সা. আ.)-এর বহুমুখী ব্যক্তিত্ব আল্লাহ্ তা‘আলার ভালোবাসায় আত্মনিবেদিত হয়ে দো‘আ ও ইবাদতে রাত্রি জাগরণকারিণী একজন সমুন্নত আত্মিক ও আধ্যাত্মিক দ্বীনী ব্যক্তিত্ব এবং হিজাবসম্মত শালীন পোশাক পরিধান করে সামাজিক দায়িত্ব পালনের দৃষ্টান্ত স্থাপনকারিনী ও রণাঙ্গনে মুসলিম বাহিনীকে সহায়তাকারিণী হিসেবে কেবল মুসলিম নারীদের জন্যই অনুসরণীয় আদর্শ নয়; বরং একজন আদর্শ কন্যা, একজন আদর্শ স্ত্রী, একজন আদর্শ মাতা ও সন্তান লালন-পালনকারিনী, একজন আদর্শ গৃহকর্ত্রী, একজন আদর্শ মনিব, একজন আদর্শ শিক্ষিকা ও পথপ্রদর্শক, একজন আদর্শ সমাজসেবিকা ও দানশীলা এবং অসহায়দের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তিনি যে কোনো সমাজের যে কোনো নারীর জন্যই অনুসরণীয় আদর্শ। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে কঠিন অবস্থা মোকাবিলা করে এবং শত্রু পরিবেষ্টিত, যুদ্ধ ও শান্তিকালীন নির্বিশেষে যে কোনো পরিবেশে ও যে কোনো কঠিন পরিস্থিতিতে প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে স্বীয় সকল দায়িত্ব পালনকারিণী একজন পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ আদর্শ নারীর দৃষ্টান্ত হযরত ফাতেমা যাহরা (সা.‘আ.)। সর্বোপরি, যখন একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলার সাহায্যের আশা ব্যতীত সকল আশার আলো নির্বাপিত হয়ে যায় তখনো কী করে ঈমান ও আদর্শের ওপর অটল থেকে স্বীয় সকল দায়িত্ব যথাযথভাবে আঞ্জাম দিতে হয় মুসলিম নারীর জন্য তার চিরকালীন অনন্যসাধারণ দৃষ্টান্ত তিনি।
(ইন্টারনেট থেকে গৃহীত)
অনুবাদ ও সম্পাদনা : নূর হোসেন মজিদী