নন্দিত ক্যালিগ্রাফি শিল্পী জালিল রাসূলী
পোস্ট হয়েছে: সেপ্টেম্বর ৮, ২০১৫
সুমাইয়া সাইকালী
জালিল রাসূলী ইরানের অন্যতম প্রসিদ্ধ চিত্রশিল্পী ও হস্তলিখন শিল্পী। আন্তর্জাতিক উতসব-অনুষ্ঠানাদিতে জালিল রাসূলী বিগত কয়েক দশক ধরে এই ক্ষেত্রে সক্রিয় রয়েছেন এবং অব্যাহতভাবে ভাব প্রকাশের নতুন নতুন পন্থা অনুসন্ধান করে চলেছেন। তাঁর এ শিল্পচর্চার মাধ্যমে ইরানী ক্যালিগ্রাফির প্রাচীন কলাকৌশল আধুনিক প্রেক্ষিতে মূর্ত হয়ে উঠতে থাকে এবং এতে ইরানী চিত্রশিল্প ঐতিহ্যের একটি সত্যিকার প্রকাশও ঘটে।
সৌন্দর্যমণ্ডিত ফারসি হস্তলিখন শিল্পে নিষ্ঠার সাথে আত্মনিয়োগকারী অন্যান্য অগণিত শিল্পীর মাঝে জালিল রাসূলীকে যা বিশিষ্টতা দান করেছে তা হচ্ছে আধুনিক ও সাম্প্রতিক উপাদান-উপকরণসমূহ তুলে ধরার জন্য একজন মানুষের সংকল্প- যা দৃষ্টিপাতকারী মাত্রকেই মোহিত করেছে এবং তাদের সংখ্যাও বৃদ্ধি করে চলেছে।
১৯৪৬ সালে হামেদানে জন্মগ্রহণকারী এই কৃতি শিল্পী তেহরান স্কুল থেকে গ্রাজুয়েট হন। ছেলেবেলা থেকেই তিনি ক্যালিগ্রাফি শেখায় পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করেন। তিনি ছয়টি বছর (মরহুম) উস্তাদ সাইয়্যেদ হাসান মিরখানীর কাছে অধ্যয়ন করেন এবং কাজে এতটা কৃতিত্বের পরিচয় দেন যে, উস্তাদ তাঁকে অধ্যাপকের প্রশংসাপত্র দান করেন। তাঁর একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় ইরানের বিভিন্ন গ্যালারিতে এবং তাঁর তাতপর্যপূর্ণ কর্ম তাঁকে এক মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে যায়। কাতার, সিরিয়া, ইটালি, পাকিস্তান, ব্রিটেনসহ নানা দেশে তাঁর কর্মের প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।
এক একান্ত সাক্ষাতকারে জালিল রাসূলী বলেন, বিপ্লবের পর হস্তলিখন বা ক্যালিগ্রাফি শিল্প অন্যান্য শিল্পকলার তুলনায় বেশি চমতকারভাবে বিকশিত হয়েছে এবং বর্তমানে বিপুল সংখ্যক শিল্পী দক্ষতার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন, দেশ যাঁদের নিয়ে গর্ব করতে পারে। অবশ্য, উল্লেখ করা যেতে পারে যে, চারুশিল্প কারুশিল্প থেকে কিছুটা আলাদা। কেননা, চারুশিল্পে খানিকটা অতিরিক্ত শিল্পবোধ থাকে। এর বিশেষ উপাদান সর্বমহলে সৃজনশীল বলে পরিচিত। তাই কারুশিল্প কেবল একটি কারুকর্ম হয়েই থেকে গেছে এবং যখন এতে কিছুটা সৃষ্টিশীলভাবে উদ্ভাবিত টান দেয়া হয় তখনই তা সকল চারুশিল্পে প্রয়োগ করা যায়। রাসূলী বলেন, ফারসি ক্যালিগ্রাফিতে এই দিকটিই প্রস্ফুটিত।
তিনি বলেন, ‘শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমাদের পূর্ব-পুরুষরা এই ক্ষেত্রে যে নিয়ম ও পদ্ধতি উদ্ভাবন ও প্রণয়ন করেছেন আমরা তা অনুসরণ করে চলেছি। আমাদের ক্যালিগ্রাফির বর্তমান মানদণ্ডে যোগ করার কিছু নেই। কেননা, এ পর্যন্ত এর উন্নয়ন ও অলঙ্করণে যথেষ্ট প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে।’
তিনি মনে করেন কোনো ব্যক্তি যদি স্বাধীনভাবে কারুকর্মের চর্চা করতে চায় এবং একজন প্রকৃত শিল্পী হতে চায় তাহলে তাকে ক্যালিগ্রাফির সকল নিয়ম রপ্ত করার পরেই কেবল নুতন প্রেক্ষাপট তৈরি ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হবে।
জনাব জালিল রাসূলী জানান, ক্যালিগ্রাফি কর্মের সাথে তারমেহ বস্ত্রের সমন্বয় সংক্রান্ত তাঁর কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় চ্যালিপা, ঘোবার, শেশ-ডং অথবা কাতিবেহ স্টাইলে। নিজের আগ্রহ থেকে মনোনীত এই স্টাইলগুলো তাঁর এ সংক্রান্ত চিত্রকর্মের ক্ষেত্র রচনা করে। গ্রাফিক, ডিজাইন ও কম্পোজিশনসমৃদ্ধ এই চিত্রকর্ম ‘তাজহিবে’ একটি নবতর রূপ দান করে।
জালিল রাসূলীর শিল্পকর্ম অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং প্রয়োজনীয়ও বটে। কেননা, তা প্রাচীন পরিবেশের অনুভূতি ধারণ করে। হাতে বোনা তারমেহ সামগ্রী দিয়ে সৃষ্ট এই শিল্পকর্ম অন্তত একশ বছরের পুরানো স্মৃতিকে জাগিয়ে দেয়। আবার একই সাথে তাঁর এই রং ও মিশ্রণ আমাদের আধুনিক যুগের চিত্রশিল্পের এক যথার্থ প্রতিনিধিত্ব করে।
এই জটিল ও ঐতিহ্যবাহী শিল্পে জালিল রাসূলীর পূর্ণ দখন ও সাফল্যের চাবিকাঠি হলো ইরানী ক্যালিগ্রাফি, যাতে তিনি আন্দোলনের অগ্রসেনা হিসেবে কাজ করেছেন এবং এই আন্দোলন তাঁকে আমাদের কালের তথা সাম্প্রতিক কালের শিল্পী জগতের পুরোধা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তিনি কেবল প্রচলিত বা প্রাচীন ধারার শিল্পীদের নিয়ে তাঁর কর্ম সম্পাদন করেছেন বা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছেন তাই নয়, দর্শক সাধারণ ও শিল্পামোদীরা তাঁর অসাধারণ পরিপাটি ও নতুন চিন্তার প্রতিফলন দেখেও আনন্দিত ও মুগ্ধ হয়।
ক্যালিগ্রাফি শিল্পের মাধ্যমেই সাহিত্য সবসময় হাতে হাতে হস্তান্তরিত হয়েছে বিধায় আমরা দেখতে পাই যে, জালিল রাসূলী সাহিত্যকে যথেষ্ট আত্মস্থ করেছেন। হাফিজ ও রুমীর তিনি একজন ভালো সমঝদার। তিনি নিজেই বলেছেন, এই কবিদের উক্তিসমূহ তাঁকে কখনও কখনও পাঠ গ্রহণের দিনগুলোতে নিয়ে যায়। ক্যালিগ্রাফির জন্য নির্বাচনের আগে তাকে আবার সেভাবেই তা পাঠ করতে হয়। জালিল রাসূলী হয়তবা হাজার বার হাফিযের সাহিত্য কর্ম পাঠ করেছেন। তা সত্ত্বেও বার বার তাঁর কাছে তা নতুন ও তরতাজা মনে হয়। তিনি বলেন, ক্যালিগ্রাফির মাধ্যমেই সাহিত্য, ধর্ম ও সুফিতত্ত্ব হস্তান্তরিত হয়েছে।
জালিল রাসূলী বিবাহিত এবং চার সন্তানের জনক। উল্লেখ্য, জালিল রাসূলীর পরিবার কেবল একজন মানুষকে নিয়ে গর্ব করার যোগ্য তাই নয়, ঐ পরিবারে অর্থাত জালিল রাসূলীর আরো দুই ভাই মাহদী ও খলিলও অত্যন্ত সফল ও সক্রিয় শিল্পী। আর তাঁদের মাতাও ছিলেন একজন কার্পেট বয়নকারী ও কারুশিল্পের শিক্ষিকা।