তেহরানে বৈচিত্র্যে প্রাণচঞ্চল ৩৭তম আন্তর্জাতিক ফাজ্র্ চলচ্চিত্র উৎসব অনুষ্ঠিত
পোস্ট হয়েছে: জুলাই ২৫, ২০১৯
বিচিত্র ধরনের বিরাট সংখ্যক দেশী-বিদেশী চলচ্চিত্রের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রাজধানী তেহরানে গত ১৮ থেকে ২৬শে এপ্রিল (২০১৯) ৩৭তম আন্তর্জাতিক ফাজ্র্ চলচ্চিত্র উৎসব (ঋওঋঋ) অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। পুরস্কার বিজয়ী ইরানি চলচ্চিত্র পরিচালক রেযা মীরকারীমীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ইরানের ইসলামি বিপ্লবের চল্লিশতম বিজয় বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এবারের ফাজ্র্ চলচ্চিত্র উৎসবে বিশে^র ৭৫টি দেশের বিচিত্র স্বাদের ১০৯টি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়।
উল্লেখ্য, ইসলামি বিপ্লবের বিজয় বার্ষিকী উপলক্ষে প্রতি বছরই ফাজ্র্ চলচ্চিত্র উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে, তবে গত চার বছর থেকে এ উৎসবের আন্তর্জাতিক বিভাগ এর জাতীয় বিভাগ থেকে স্বতন্ত্রভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে এবং এবারের আন্তর্জাতিক ফাজ্র্ চলচ্চিত্র উৎসব ব্যাপক প্রস্তুতির মাধ্যমে অত্যন্ত জমকালোভাবে অনুষ্ঠিত হলো- যার ফলে যে কেউ স্বীকার করতে বাধ্য যে, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান তার বৃহত্তম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজনের ক্ষেত্রে খুবই অল্প সময়ের ব্যবধানে বহু দূর এগিয়ে এসেছে- যা অবশ্যই গর্ব করার মতো।
আন্তর্জাতিক ফাজ্র্ চলচ্চিত্র উৎসব তার মান, গ্রহণযোগ্যতা ও গৌরবময়তা প্রমাণ করে দিয়েছে। বিশেষ করে এবারের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব প্রমাণ করে দিয়েছে যে, এ উৎসব কেবল ইরানি সিনেমা দর্শকদের জন্য বিভিন্ন ধরনের বিদেশী চলচ্চিত্রের স্বাদ গ্রহণের উৎসবই নয়, বরং এ উৎসবের দর্শক কা’রা সে বিবেচনায়ও এটি যথার্থই একটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। কারণ, নয় দিনব্যাপী এ উৎসবে ইরানি দর্শকদের পাশাপাশি বিশে^র বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত শত শত মেহমান-দর্শকও অংশগ্রহণ করেন। ইরানি ও বিদেশী নির্বিশেষে দর্শকগণ এ উৎসবে বিশে^র বিভিন্ন দেশে তৈরি এমন বিচিত্র ধরনের চলচ্চিত্র উপভোগ করেন যে সব ধরনের চলচ্চিত্র সম্বন্ধে আগে তাঁদের খুব সামান্যই জানা ছিল।
আন্তর্জাতিক ফাজ্র্ চলচ্চিত্র উৎসব দর্শকদের সামনে বিশে^র বিভিন্ন প্রান্তে বিচিত্র সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে তৈরি বহু উন্নত মানের ও অবাণিজ্যিক চলচ্চিত্র পরিবেশন করে যেগুলো তাঁরা ইতিপূর্বে দেখেন নি এবং যে সব জায়গায় তাঁদের যাবার সুযোগ হয়ে ওঠে নি, ফলত ঐ সব দেশ ও জায়গা এবং সংশ্লিষ্ট জনগণ সম্বন্ধে তাঁদের মধ্যে বিশেষ ধরনের বদ্ধমূল ধারণা ছিল বা ক্ষেত্রবিশেষে সম্পূর্ণ ভুল ধারণা ছিল। এবারের চলচ্চিত্র উৎসব তাঁদের সে সব বদ্ধমূল বা ভুল ধারণা দূরীকরণে সহায়ক হয়েছে।
এবারের আন্তর্জাতিক ফাজ্র্ চলচ্চিত্র উৎসবে বিশে^র ৭৫টি দেশের ১০৯টি চলচ্চিত্রকে ১১টি বিভাগে ভাগ করে প্রদর্শন করা হয়। নিকটবর্তী ও দূরবর্তী দেশ ও জায়গার বিবেচনায় এবং সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বিবেচনায় চলচ্চিত্রের বিভাগগুলো বিন্যস্ত করা হয়। এ উৎসবে যে সব দেশের চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয় সে সব দেশের মধ্যে ছিল রাশিয়া, তুরস্ক, চীন, মিসর, ডেনমার্ক, আর্জেন্টিনা ও অন্যান্য দেশ।
এ উৎসবে ‘মুক্তি বিষয়ক চলচ্চিত্র’ (ঈরহবসধ ঝধষাধঃরড়হ) শীর্ষক আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা বিভাগে ১৫টি ফিচার ফিল্ম ও ১৫টি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। এতে বিচারক প্যানেলে ছিলেন চলচ্চিত্র শিল্পের সাতজন স্বনামখ্যাত ব্যক্তিত্ব।
এবারের আন্তর্জাতিক ফাজ্র্ চলচ্চিত্র উৎসবের জন্য যে সব চলচ্চিত্র নির্বাচন করা হয় সেগুলো বৈশিষ্ট্যের দিক থেকেও পূর্ববর্তী উৎসবসমূহে প্রদর্শিত চলচ্চিত্রসমূহের তুলনায় অধিকতর সুচিন্তিতভাবে নির্বাচন করা হয়। এবারের চলচ্চিত্রসমূহ অধিকতর সুসংহত, সুস্পষ্ট তৎপর্য ও বাণীসমৃদ্ধ, পুরস্কার বিজয়ী অভিনয় সম্বলিত, সর্বোপরি চিন্তার উদ্রেককারী ও গতিশীল বিষয়বস্তু সম্বলিত; সব মিলিয়ে এ সব চলচ্চিত্র একদিকে যেমন উৎসবের উপযোগী অন্যদিকে দর্শক আকর্ষণকারী।
এখানে স্মর্তব্য যে, ফাজ্র্ চলচ্চিত্র উৎসব দর্শকদেরকে কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যাভিমুখে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্য সম্বলিত কোনো উৎসব নয়, বরং তার পরিবর্তে এটি হচ্ছে বৈচিত্র্যের প্রতিনিধিত্বশীলতার উৎসব। তাই এবারের চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত চলচ্চিত্রগুলোতে ছিল বিপুল সংখ্যক সাধারণ চরিত্রের ও বিষয়বস্তুর প্রতিফলন- যার মধ্যে ছিল শিশু-কিশোর, দত্তক, ভবিষ্যৎ প্রজন্মসমূহ, পরিবেশ, শক্তিশালী নারী চরিত্র, গতানুগতিকতা প্রত্যাখ্যান, উচ্চতর কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণে অস্বীকৃতি, প্রকৃত ঘটনার ভিত্তিতে নির্মিত গল্প এবং মুক্ত ও সংগ্রামী চেতনার অধিকারী চরিত্র- যারা আশা ছেড়ে দেয় না, বরং চ্যালেঞ্জ ও কঠিন পরিস্থিতির মুখে সমাধানের সন্ধান করে।
এখানে উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মিহা মায্যিনী পরিচালিত সেøাভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া ও সার্বিয়ার যৌথ উদ্যোগে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘মুছিত’ (ঊৎধংবফ) বা ডেনিশ্ চলচ্চিত্র নির্মাতা মিকাইল্ নোর্য়ে নির্মিত ‘তুষারপাতের আগে’ (ইবভড়ৎব ঃযব ঋৎড়ংঃ)-এর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে- যা দেখতে গিয়ে দর্শকগণ তাঁদের আসনে সামান্য নড়াচড়া করতেও ভুলে যান এবং কী ঘটতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে নিজস্ব ধারণার ভিত্তিতে শ^াসরুদ্ধকর উদ্বেগ সহকারে অপেক্ষা করতে থাকেন, আর তাঁদের সামনে একের পর এক ঘটনাবলি উন্মোচিত হতে থাকে এবং একই সময় তাঁদের সামনে বিশে^র একটি বিশেষ অংশের একটি বিশেষ সময়কার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের প্রেক্ষাপটে একেকটি দৃশ্য ভেসে উঠতে থাকে।
‘মুছিত’ (ঊৎধংবফ) চলচ্চিত্রটিতে একজন সেøাভেনিয়ান নারীর গল্প উপস্থাপন করা হয়েছে- ১৯৯১ সালে তৎকালীন যুগোসøাভিয়া থেকে সেøাভেনিয়ার স্বাধীনতা লাভের প্রাক্কালে আরো ছাব্বিশ হাজার মানুষের মতো যার পরিচয় (রফবহঃরঃু) মুছে যায়। কিন্তু সে বিস্মৃত হয়ে যেতে অস্বীকৃতি জানায় এবং তার নিজের ও সেই সাথে তার শিশু সন্তানের স্বকীয় পরিচিতি ফিরে পাবার জন্য সে তার পক্ষে যা কিছু সম্ভব হয় তা-ই করে। এমনকি সে এতদূর পর্যন্ত চেষ্টা করে যে, শেষ পর্যন্ত সে জাতীয় টেলিভিশনে উপস্থিত হয়ে তার নিজের কথা বলে।
বস্তুত ‘মুছিত’ (ঊৎধংবফ) চলচ্চিত্রটি একদিকে যেমন ঐতিহাসিক তথ্যমূলক- যাতে এমন এক ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে যা সম্ভবত বিশে^র অনেক মানুষের কাছেই অজানা রয়ে গিয়েছে এবং একই সাথে এটি একটি শক্তিশালী ইচ্ছাশক্তির অধিকারী চরিত্রের কাহিনী- যা সহিংসতার জোয়ারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে অন্যদেরকে উদ্বুদ্ধ করে।
অন্যদিকে ‘তুষারপাতের আগে’ (ইবভড়ৎব ঃযব ঋৎড়ংঃ) চলচ্চিত্রে ডেনমার্কের একটি প্রত্যন্ত বনাঞ্চলের বিপর্যস্ত অংশের এক সময়কার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এ চলচ্চিত্রটির বিশেষ উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, এতে একজন সৎ বৃদ্ধ পিতার চরিত্র চিত্রায়ণ করা হয়েছে যিনি তাঁর কন্যার সুখের জন্য অনেক কিছু করেন, যদিও তাঁর ব্যক্তিগত লাভের বিষয়টিও দর্শকদের দৃষ্টি থেকে গোপন রাখার চেষ্টা করা হয় নি।
প্রতিযোগিতায় সর্বোত্তম চলচ্চিত্র হিসেবে ‘স্বর্ণ সি-র্মোগ্’ (এড়ষফবহ ঝরসড়ৎময) শীর্ষক গ্রান্ড প্রাইজের জন্য নির্বাচিত হয় আলেকজান্ডার যোলোতুখিন্-এর ‘এক রাশিয়ান কিশোর’ (অ জঁংংরধহ ণড়ঁঃয)। এটি একটি অনন্য চলচ্চিত্র যাতে সাহসী কিন্তু তখনো যার কোনো কাজ নেই এমন একজন বালকের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রথম বিশ^যুদ্ধের ভয়াবহতা তুলে ধরা হয়েছে; সে তার চারদিককার ধ্বংসরত বিশ^কে দৃঢ়তার সাথে আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করছে, যদিও সে প্রাচ্য রণাঙ্গনে তার দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলেছে।
‘এক রাশিয়ান কিশোর’ চলচ্চিত্রটি স্বনামখ্যাত পরিচালক আলেকজান্ডার সোকুরোভ্-এর পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত হয়; তিনি তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠিত অবাণিজ্যিক চলচ্চিত্র তহবিল থেকে এ চলচ্চিত্র নির্মাণের ব্যয় নির্বাহে সহায়তা করেন। উল্লেখ্য, আলেকজান্ডার সোকুরোভ্ ইতিপূর্বে ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত ৩৪তম আন্তর্জাতিক ফাজ্র্ চলচ্চিত্র উৎসবে (ঋওঋঋ) মেহমান হিসেবে অংশগ্রহণ করেন এবং উক্ত উৎসবে তাঁর নির্মিত ঋৎধহপড়ভড়হরধ চলচ্চিত্রটি প্রদর্শিত হয়।
এবারের চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠতম অভিনেতার পুরস্কারটিও ‘তুষারপাতের আগে’ (ইবভড়ৎব ঃযব ঋৎড়ংঃ) লাভ করে; এ পুরস্কারটি দেয়া হয় এর অভিনেতা জের্স্পা ক্রিস্টেনসেন্-কে।
এ উৎসবে শ্রেষ্ঠতম অভিনেত্রীর পুরস্কার লাভ করেছেন বুলগেরিয়ান পরিচালক নাদেজদাকোসেভা পরিচালিত ‘ইরিনা’ চলচ্চিত্রে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয়কারী র্মাতিনা অ্যাপোস্তোলোভা। ‘ইরিনা’ চলচ্চিত্রে খনিজ উত্তোলন করা হয় এমন একটি ছোট শহরের একজন নারীর তার আশেপাশের অস্বস্তিকর পরিবেশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে টিকে থাকার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। তার জীবন সংগ্রামে দেখা যায় যে, সে তার পরিবারকে দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে বাঁচাবার জন্য শেষ পর্যন্ত অর্থের জন্য সারোগেট মাদার হচ্ছে।
এবার শ্রেষ্ঠতম চলচ্চিত্র স্ক্রিপ্টের পুরস্কার লাভ করেন যৌথভাবে জার্মান চলচ্চিত্র ডধপশবৎংফড়ৎভ-এর লেখক র্গেনোত্ক্রায়াা (এবৎহড়ঃকৎধধ) ও অলির্ভা হার্ফ্না (ঙষরাবৎ ঐধভভহবৎ)। এ চলচ্চিত্রটিতেও আরেকটি বিস্ময়কর গল্প পরিবেশন করা হয়েছে; এতে পরিবেশ রক্ষার জন্য জনগণের সরকারের কাছে নতি স্বীকারে অস্বীকৃতি তুলে ধরা হয়েছে। এতে জনগণের শক্তির যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তা একে প্রায় বাস্তব একটি ঘটনায় পরিণত করেছে।
এবারের আন্তর্জাতিক ফাজ্র্ চলচ্চিত্র উৎসবে (ঋওঋঋ) সম্মানিত মেহমান হিসেবে অংশগ্রহণ করেন খ্যাতনামা আমেরিকান স্ক্রিনরাইটার, চলচ্চিত্র পরিচালক ও চলচ্চিত্র সমালোচক পল্ শ্রের্ডা। তিনি এ উৎসব উপলক্ষে চলচ্চিত্র সম্পর্কে একটি অসাধারণ ও ব্যতিক্রমী কর্মশালা পরিচালনা করেন এবং গত ২৪শে এপ্রিল র্চাসন্ সিনেপ্লেক্সে একটি সংবাদ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন।
তিনি আন্তর্জাতিক ফাজ্র্ চলচ্চিত্র উৎসব (ঋওঋঋ)- কে টরোন্টো, ভেনিস্ ও বার্লিনের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের সাথে তুলনা করেন এবং ফাজ্র্ উৎসবের আকার-আয়তনের বিশালতা ও বহুমাত্রিকতায় বিস্ময় প্রকাশ করেন। এছাড়া তিনি ইরানি চলচ্চিত্র সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে র্মহূম আব্বাস কিয়ারুস্তামী ও দুই বার অস্কার বিজয়ী আর্স্গা র্ফাহাদীর চলচ্চিত্রসমূহের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ইরানি চলচ্চিত্রসমূহ একদিকে যেমন স্বাভাবিক বিকাশের পরিচায়ক এবং জীবনের তাৎপর্যে পরিপূর্ণ।
প্রতিবেদক : র্মাজোহ্ন্ শায়খী
সম্পাদনা ও অনুবাদ : নূর হোসেন মজিদী