“তাবরিজ, রন্ধন পর্যটনের স্বর্গ”
পোস্ট হয়েছে: ডিসেম্বর ৪, ২০২৫
তেহরান – পুষ্টিকর স্ট্যু থেকে সুগন্ধি নোগাট পর্যন্ত, তাবরিজের স্বাদ ইরানের সমৃদ্ধতম খাদ্যসংস্কৃতির এক উজ্জ্বল দ্বার উন্মোচন করে, যা এই ঐতিহাসিক শহরকে রন্ধন পর্যটনের এক উদীয়মান গন্তব্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে।
বিশ্বজুড়ে পর্যটকরা যখন ক্রমেই খাঁটি খাদ্য অভিজ্ঞতার খোঁজে বেড়াচ্ছেন, তখন তাবরিজ নিজেকে তুলে ধরেছে এমন এক শহর হিসেবে, যেখানে প্রতিটি পদ ধৈর্য, শিল্পকলা ও সাংস্কৃতিক গৌরবের গল্প বলে।
বিশ্বব্যাপী রন্ধন পর্যটন এখন ভ্রমণের দ্রুততম বর্ধনশীল খাতগুলোর একটি। দেশগুলো আজ কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বা আধুনিক স্থাপনাগুলো নিয়েই প্রতিযোগিতা করে না, বরং নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী রান্নাকে সাংস্কৃতিক পরিচয়ের বাহক হিসেবে তুলে ধরে। খাবার এখন এক শক্তিশালী সাংস্কৃতিক দূত — এবং তাবরিজে, সম্ভবত ইরানের অন্য যেকোনো স্থানের তুলনায় বেশি, খাবার একটি জীবন্ত ঐতিহ্য জাদুঘরের মতো কাজ করে।
উত্তর–পশ্চিম ইরানে অবস্থিত তাবরিজ তার সুবিশাল বাজার, ঐতিহাসিক স্থাপত্য, এবং অতুলনীয় কারুশিল্পের জন্য বিখ্যাত। তবে শহরটির যে বিষয়টি ভ্রমণকারীদের সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করে, তা হলো এর বৈচিত্র্যময় রন্ধন ঐতিহ্য — যা ঘর-বাড়ি, বাজারের দোকান এবং শতাব্দী–প্রাচীন চায়ের দোকানে আজও সংরক্ষিত। শহরের পাথুরে গলিপথ ধরে হাঁটলে যে টাটকা রুটি, সুগন্ধি মসলা ও মিষ্টির ঘ্রাণ ভেসে আসে, তা যেন শহরের দীর্ঘ ইতিহাসের স্মৃতি জাগিয়ে তোলে।
তাবরিজের ঐতিহাসিক বাড়িগুলোর ভেতরে রান্নার ঐতিহ্য প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে এসেছে। পুষ্টিকর স্টাফড মিটবল, কোমলভাবে মোড়ানো আঙ্গুরপাতার ডলমা, উৎসবের স্যুপ, উজ্জ্বল রঙের স্ট্যু, আর রঙিন বাদাম ও মিষ্টি — প্রতিটি পদই স্থানীয় রাঁধুনিদের ধৈর্য ও দক্ষতার নিদর্শন। তাবরিজে খাবার কেবল খাবার নয়; এটি এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে বয়ে চলা সাংস্কৃতিক ভাষা।
রন্ধন ঐতিহ্য সংরক্ষণ
তাবরিজের ঐতিহ্যবাহী খাবার, মিষ্টি ও বাদাম শহরের পরিচয়ের কেন্দ্রবিন্দু। প্রতিটি কুফতে, ডলমা, স্যুপ, স্ট্যু, নোগাট বা এক মুঠো বাদাম অতীতের গল্প ধারণ করে। ভ্রমণকারীরা প্রায়ই বলেন, তাবরিজের খাবারের স্বাদ নেওয়া যেন এক ইন্দ্রিয়ভ্রমণ — যা শহরের শিল্পচেতনা ও ঐতিহ্যের প্রতি গভীর সম্মান প্রকাশ করে।
স্থানীয় পর্যটনগাইডরা বলেন, তাবরিজ ভ্রমণ এর ঐতিহ্যবাহী রান্নার স্বাদ ছাড়া অসম্পূর্ণ। তাদের মতে, স্থানীয় খাবারগুলো সাংস্কৃতিক স্মৃতির প্রতীক, যা যত্নসহকারে এবং বহু বছরের অভিজ্ঞতায় তৈরি। “এসব খাবার শুধু খাবার নয়; এগুলো ধৈর্য, সৃজনশীলতা ও গর্বের প্রকাশ।”
তাবরিজের কিছু ঐতিহ্যবাহী খাবার
কুফতে তাবরিজি (তাবরিজের মিটবল)
এ অঞ্চলের রন্ধনশিল্পের প্রধান নিদর্শন। ২০০ বছরেরও বেশি পুরনো এই পদ কাজার যুগের ভ্রমণবৃত্তান্তেও উল্লেখ আছে। কিমা, চানা ডাল, চাল, সুগন্ধি শাক–সবজি, শুকনা বরই, আখরোট—কখনও ডিমসহ — দিয়ে তৈরি এসব বিশাল মিটবল ধীরে ধীরে টমেটো পেস্ট, পেঁয়াজ ও স্থানীয় গুল্মের সসে রান্না করা হয়। মিষ্টি ও ঝাল–নোনার ভারসাম্য, আর নরম বাদামি কেন্দ্রে ভরপুর স্বাদ, এই পদটিকে ইরানের অন্যতম বিখ্যাত খাবারে পরিণত করেছে। এটি শুধুই উৎসবের খাবার নয়; এটি কারুশিল্প ও পারিবারিক ঐতিহ্যের প্রতীক।
ডলমেহ বার্গে মো (আঙ্গুরপাতার ডলমা)
১৫০ বছরেরও পুরনো এই পদটি নিখুঁত র্যাপিং ও ভারসাম্যপূর্ণ স্বাদের জন্য খ্যাত। তাজা আঙ্গুরপাতায় চাল, কিমা, চানা ডাল ও শাকমশলা ভরে টমেটো পেস্ট ও লেবুর রসে ধীরে রান্না করা হয়। উৎসব ও বিশেষ দিনের খাবার হিসেবে এটি তাবরিজের অতিথিপরায়ণতা ও রন্ধনশিল্পের ঐতিহ্য বয়ে আনে।
স্থানীয় স্যুপ (আশ)
আশে মাস্ত ও দুঘাভা—এই দুই জনপ্রিয় স্যুপ শত বছরের বেশি পুরনো। আশে মাস্তে দই, চাল, শাক–সবজি ও কখনও মাংস ব্যবহার হয়। দুঘাভা, যা সাধারণত উৎসবে রান্না হয়, দই, চাল ও শাকের মিশ্রণে তৈরি। এগুলো পুষ্টিকর ও ভারসাম্যপূর্ণ খাবারের প্রতি তাবরিজের ঐতিহ্যকে তুলে ধরে।
গাজরের স্ট্যু (খোরেশ হাভিজ)
পরিবারের প্রিয় এই পদটি তাবরিজে শত বছরেরও বেশি সময় ধরে রান্না হয়। নরম মাংস, গাজর, পেঁয়াজ, টমেটো পেস্ট ও মসলার সমন্বয়ে তৈরি এই স্ট্যুটির স্বাদ মৃদু ও রঙ উজ্জ্বল।
ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্নের ঝলক
নোগাট (নোগা)
শতাব্দী–প্রাচীন এই মিষ্টি ডিমের সাদা অংশ, চিনি, মধু ও বাদাম দিয়ে তৈরি। মসৃণ টেক্সচার ও মৃদু মিষ্টি স্বাদের জন্য এটি উৎসবের প্রিয় খাবার ও জনপ্রিয় সুভেনির।
রিস (আরিস)
৭০–৮০ বছরের পুরনো এই মিষ্টি ময়দা, চিনি, মাখন ও বাদাম দিয়ে তৈরি হয়; কখনও জাফরানও যোগ করা হয়। হালকা শুকনো টেক্সচার ও সুগন্ধি স্বাদ এর বৈশিষ্ট্য।
কোরাবিয়ে
শত বছরেরও বেশি পুরনো, তাবরিজের অন্যতম বিখ্যাত মিষ্টি। বাদাম গুঁড়ো, চিনি, ডিমের সাদা অংশ ও গোলাপজল দিয়ে তৈরি এই নরম ও সুগন্ধি মিষ্টি উৎসবের অপরিহার্য অংশ।
লোজ (বাদাম বা পিস্তাচিও ক্যান্ডি)
এক শতাব্দীরও বেশি ইতিহাসের এই মিষ্টি বাদাম বা পিস্তাচিও ও চিনি দিয়ে তৈরি। ডায়মন্ড বা আয়তাকার আকৃতির এই মিষ্টি উৎসব ও পারিবারিক জমায়েতে সমান জনপ্রিয়।
তাবরিজের বাদাম (আজিল)
আখরোট, কাঠবাদাম, হ্যাজেলনাট, পিস্তাচিও, কিশমিশ ও শুকনা ফলের সমন্বয়ে তৈরি আজিল তাবরিজের অতিথিপরায়ণতার অন্যতম প্রতীক। ঋতুভেদে বিভিন্ন মিশ্রণ পরিবেশন করা হয়।
বিশ্বের সম্ভাব্য রন্ধন গন্তব্য হিসেবে তাবরিজ
রন্ধন পর্যটন যখন বিশ্বব্যাপী ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, তখন যে শহরগুলো তাদের খাদ্য ঐতিহ্য সংরক্ষণ করতে পারে, সেগুলো আন্তর্জাতিক পর্যটকদের কাছে আরও মূল্যবান হয়ে উঠছে। শতাব্দী–প্রাচীন রান্নার ঐতিহ্য ও অতিথিপরায়ণতার সংস্কৃতিসম্পন্ন তাবরিজ সেসব শহরের মধ্যে দ্রুতই এক শীর্ষস্থানীয় গন্তব্য হয়ে উঠছে।
যাঁরা ইরানের খাদ্য ঐতিহ্যকে ঘনিষ্ঠভাবে অনুভব করতে চান, তাঁদের জন্য তাবরিজ সত্যিকারের এক অনন্য অভিজ্ঞতা — এমন একটি শহর, যেখানে প্রতিটি সুগন্ধ, প্রতিটি মসলা, প্রতিটি স্বাদ বহু প্রজন্মের গল্প বহন করে।
তথ্যসূত্র: তেহরান টাইমস