সোমবার, ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

English

ইস্ফাহান জামে মসজিদ: বিশ্বাস ও স্থাপত্যের চিরন্তন সৌন্দর্যের ইতিহাস

পোস্ট হয়েছে: সেপ্টেম্বর ২২, ২০২৫ 

news-image

ইরানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও স্থাপত্য নিদর্শন হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে ইসফাহানের জামে মসজিদ। এটি ইসলামী শিল্প, রাজনৈতিক ইতিহাস এবং আধ্যাত্মিক বিবর্তনের হাজার বছরের বেশি সময়ের সাক্ষ্য বহন করে।

প্রাচীন সূচনা

৮ম শতকে নাজাফাবাদের কাছে তিরান গ্রামের তাইম আরবরা প্রথম এই মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন। এটি গড়ে ওঠে ইয়াহুদিয়া নামের বসতির প্রান্তে, যা ছিল ইসলামি ইস্ফাহানের প্রাথমিক যুগের দুটি প্রধান জনবসতির একটি।

সময়ের সাথে সাথে এটি শহরের সঙ্গে বিকশিত হয়। একটি সাধারণ স্তম্ভনির্ভর (হাইপোস্টাইল) কাঠামো থেকে এটি রূপান্তরিত হয় এক বিশাল চার-ইওয়ান কমপ্লেক্সে, যা পরবর্তীকালে ইরানি মসজিদ স্থাপত্যের আদর্শ রূপ হয়ে ওঠে।

এক সহস্রাব্দের স্থাপত্য বিবর্তন

প্রথমদিকে মসজিদটি ছিল আরবদের প্রচলিত হাইপোস্টাইল ধাঁচের—একটি আয়তাকার নামাজঘর, যেখানে সারি সারি স্তম্ভের উপর সমতল ছাদ দাঁড়িয়ে ছিল। এর সাথে ছিল খোলা প্রাঙ্গণ এবং একটি মাত্র মিনার।

আব্বাসীয় আমলে এটি ইস্ফাহানের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে, এমনকি এখানে হাজার হাজার বইয়ের সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারও ছিল।

খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ইবন আল-আসির একে তার সময়ের সবচেয়ে বড় এবং সুন্দর মসজিদগুলোর একটি বলে বর্ণনা করেছেন। তবে ১১২১ সালে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মসজিদটি ধ্বংস হয়।

সেলজুক আমলের রূপান্তর

১১-১২ শতকে সেলজুকরা ইস্ফাহানকে রাজধানী করার পর মসজিদটির সবচেয়ে বড় রূপান্তর ঘটে। এ সময় নির্মিত হয় দুটি মহৎ গম্বুজ—

দক্ষিণ পাশের গম্বুজটি ‘নিজাম আল-মুলকের গম্বুজ’ (১০৭২–১০৯২), নামে পরিচিত; যা মূল মেহরাব এলাকার স্থলে বিশাল ইটের কক্ষ হিসেবে নির্মিত হয় এবং সাসানীয় ‘চাহারতাক’ ধাঁচকে অনুসরণ করে।

উত্তর পাশের গম্বুজটির নাম ‘তাজ আল-মুলকের গম্বুজ’ (১০৮৮), যা তুলনামূলক ছোট হলেও অত্যন্ত নিপুণভাবে নির্মিত হয়। এতে ছিল জ্যামিতিক ইটের কাজ, দ্বি-স্তর বিশিষ্ট খোলামেলা গম্বুজ এবং স্থাপত্যে ওজন বণ্টনের অসাধারণ প্রযুক্তি।

কুফি ও কারসিভ লিপিতে উৎকীর্ণ কুরআনের আয়াত এই গম্বুজের শৈল্পিক মাহাত্ম্যকে আরও উজ্জ্বল করে তোলে।

চার-ইওয়ান নকশার বিপ্লব

১১২০-এর দশকে সবচেয়ে বিপ্লবী পরিবর্তন আসে—পুরনো স্তম্ভনির্ভর পরিকল্পনার পরিবর্তে মসজিদে চার-ইওয়ান বিশিষ্ট প্রাঙ্গণ নকশা চালু হয়।

চারদিকের প্রাঙ্গণে সুউচ্চ খিলানবিশিষ্ট প্রবেশদ্বার (ইওয়ান) নির্মিত হয়, যা খোলা আকাশের নিচে আধ্যাত্মিক কেন্দ্রবিন্দু তৈরি করে। এই পরিকল্পনা পরবর্তীকালে ইরানি মসজিদের বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয় এবং ইসলামি ও দেশীয় স্থাপত্যের সমন্বয় ঘটায়।


ইস্ফাহান জামে মসজিদ

পরবর্তী যুগের সংযোজন

ইলখানিদ যুগে (১৪শ শতক) পশ্চিম ইওয়ানকে নামাজঘরে রূপান্তর করা হয় এবং ভিজির মোহাম্মদ সাভির অনুরোধে ১৩১০ সালে নির্মিত চমৎকার স্টুকো মেহরাব সংযোজন করা হয়। এতে শিয়া মাজহাবের নিদর্শন ও বারো ইমামের নাম উল্লেখিত আছে।
মুজাফফারিদ আমলে (১৪শ শতকের শেষভাগ) মসজিদের পূর্ব দিকে একটি ছোট মাদ্রাসা নির্মিত হয়।
তিমুরিদ আমলে (১৫শ শতক) বর্ণিল টাইলসের ব্যবহার শুরু হয়, যা সেলজুক যুগের ইটের সরলতাকে প্রাণবন্ত রঙে ভরিয়ে তোলে। ১৪৪৭ সালের একটি শিলালিপি এই পরিবর্তনের নিদর্শন।
সাফাভি শাসকরা ১৬শ শতকে গ্লেজড টাইলস, মুকার্নাস খিলান এবং সরু মিনার যোগ করেন। শাহ তাহমাসপ প্রথমের শিলালিপিতে শিয়া ভক্তির ছাপ ছিল স্পষ্ট।
তবে শাহ আব্বাস প্রথম যখন ১৫৯০-এর দশকে রাজধানী ইস্ফাহানে স্থানান্তর করেন, তিনি নকশে জাহান স্কয়ারে ইমাম মসজিদ নির্মাণ করেন। ফলে জামে মসজিদের ধর্মীয় গুরুত্ব কিছুটা কমে যায়।

উত্তরাধিকার ও স্থাপত্যিক গুরুত্ব

ইস্ফাহান জামে মসজিদ শুধু একটি মসজিদ নয়, বরং এটি ইরানি স্থাপত্যের জীবন্ত জাদুঘর। প্রায় ১৭,০০০ বর্গমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই মসজিদের কেন্দ্রীয় প্রাঙ্গণই প্রায় ২,৫০০ বর্গমিটার।

এর স্তরবিন্যাসে দেখা যায়—৮ম শতকের ভিত্তি, সেলজুক গম্বুজ, ইলখানিদ মেহরাব, তিমুরিদ টাইলস—যা রাজনৈতিক শক্তি, শিল্পীসত্তা ও ধর্মীয় পরিচয়ের মেলবন্ধন ঘটিয়েছে।

এটি ইরানের অন্যতম প্রাচীন জুমার মসজিদ এবং প্রথম যে মসজিদে চার-ইওয়ান পরিকল্পনা প্রয়োগ করা হয়। এর প্রভাব পড়েছে পরবর্তী বহু স্থাপত্যে—যেমন তাবরিজের ব্লু মসজিদ এবং ইস্ফাহানের ইমাম মসজিদ।

এ মসজিদের দ্বি-স্তর বিশিষ্ট গম্বুজ নির্মাণ প্রযুক্তি পশ্চিম, দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার স্থাপত্য বিকাশে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।

২০১২ সালে এটি ‘ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়, ইসলামি স্থাপত্যে এর অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ।

আজও জামে মসজিদ ইস্ফাহানের সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও স্থাপত্য ঐতিহ্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে—যেখানে প্রতিটি ইট বলছে উদ্ভাবন, ভক্তি ও চিরন্তন সৌন্দর্যের গল্প।#

পার্সটুডে/