All posts by pavel

ভ্রমণ (ইরানে পাঁচ দিনের সফর)

এ, কে, এম, বদরুদ্দোজা
নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ড. জহিরউদ্দিন মাহমুদ জানালেন ইরানের ধর্মীয় নগরী কোমে ২৩-২৪ নভেম্বর, ২০১৪ চরমপন্থী ও তাকফিরি আন্দোলন সম্পর্কে একটি বিশ্ব কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হবে। এতে বাংলাদেশ থেকে তিনজনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সেই তিনজনের মধ্যে আমিও আছি। বাকি দু’জন নিজ নিজ অঙ্গনে স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর আনোয়ারুল আজিম এবং জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব প্রফেসর মাওলানা মোহাম্মাদ সালাহউদ্দিন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র অসন্তোষের কারণে প্রফেসর আনোয়ারুল আজিমের যাওয়া হয়নি।
আমাদের সফরসূচি ছিল ২১ থেকে ২৬ নভেম্বর। ২১ নভেম্বর সকালে আমি এবং প্রফেসর মাওলানা সালাহউদ্দিন ধানমন্ডিস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কালচারাল কাউন্সেলর জনাব আসগার খসরুয়াবাদীর সাথে সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হই। তিনি জানান ইরানের দুই বর্ষীয়ান ও নেতৃস্থানীয় ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ মাকারেম সিরাজী এবং আয়াতুল্লাহ জাফর সোবহানী মুসলিম বিশ্বে চলমান চরমপন্থী ও তাকফিরি আন্দোলনের বিপদ ও মুসলিম উম্মাহর করণীয় সম্পর্কে আলোচনার জন্য ইরানের ধর্মীয় নগরী কোমে একটি ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসের আয়োজন করেছেন। এতে মুসলিম বিশ্বের প্রতিনিধিত্বশীল ধর্মীয় নেতা, ইসলামী চিন্তাবিদ ও শিক্ষাবিদরা অংশ নেবেন। কালচারাল কাউন্সেলর ফিলিস্তিনকে কেন্দ্র করে যায়নবাদের বিরুদ্ধে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নস্যাৎ করতে বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রে মুসলিম উম্মাহর পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবার অশুভ পরিণতি সম্পর্কে আলোকপাত করেন।
আমাদের ফ্লাইট রাত ৭টায়। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনালে ঢুকে দেখলাম মাওলানা সালাহউদ্দিন নিয়ে ট্রলি এগুচ্ছেন। আমাকে পেয়ে তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করলেন। আমিও স্বস্তি পেলাম। বোর্ডিং কার্ড নিয়ে ইমিগ্রেশন সেরে ইত্তিহাদ এয়ার ওয়েজের আবুধাবীগামী ফ্লাইটে চেপে বসলাম। সহযাত্রীদের অধিকাংশই সংযুক্ত আরব আমীরাতে কর্মরত বাংলাদেশী শ্রমিক। বয়সে তরুণদের সংখ্যা বেশি। তাদের অনেকেই মাওলানা মোহাম্মদ সালাহউদ্দিনকে চিনে। সেই সুবাদে চলতে থাকে কুশল বিনিময়ের পালা। ৫ ঘণ্টার লম্বা প্লেন জার্নি শেষে গভীর রাতে পৌঁছলাম আবুধাবী বিমানবন্দরে। বিমানবন্দর তো না, যেন বিমানের হাট। বড় মাঝারি ছোট অসংখ্য বিমানের সমারোহ। আবুধাবী বিমানবন্দরও বিশালায়তনের। আমি ও মাওলানা একের পর এক অনেকগুলো চলন্ত পথ পেরিয়ে ইত্তিহাদের ইরানগামী ফ্লাইটের যাত্রী লাউঞ্জে এসে বসলাম। ইত্তিহাদের মাঝারি ধরনের একটা বিমানে চেপে দু’ঘণ্টার পথ পেরিয়ে ইরানের ইমাম খোমেইনী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছলাম স্থানীয় সময় রাত ৩টায়। টার্মিনালের ভেতরে দু’জন পাশাপাশি হাঁটছি। বেশিদূর এগুতে হলো না। ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসের এক তরুণ অভ্যর্থনা কর্মী আমাদের পরিচয় জেনে নিয়ে গেলেন ভিআইপি কক্ষে। সেখানে চা বিস্কুট খেলাম। উদ্যোক্তাদের অনেকেই এসে স্বাগত জানালেন। কুশলাদি বিনিময় হলো। আমাদের সাথে একই ফ্লাইটে ইরানে এসেছেন ইন্দোনেশিয়ার ৭জন প্রতিনিধি। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা সেরে তাদের সাথে একত্রে একটি মাইক্রোবাসে করে রওয়ানা হলাম কোমের পথে। উজ্জ্বল সোডিয়াম বাতির আলোয় উদ্ভাসিত পথ ধরে আমরা যাচ্ছি কোমে। ফজরের নামাযের আযান শুনতে শুনতে গাড়ি থেকে নামলাম। আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে কোমের ইসতিকলাল হোটেলে। রুমে ঢুকে নামায সেরে নাস্তার জন্য রেস্টুরেন্টে নামলাম। মেলা আয়োজন। ডালের সাথে ছোলা ও বাদামের তৈরি দু’রকম স্যুপ। ইরানী রুটির সাথে জেলি, বাটার, সব্জি, হালুয়া। সাথে কফি, চা, দুধ এবং রকমারি ফলমূল। সেদিন ছিল শুক্রবার। হোটেলের নামায কক্ষে নামায পড়ে লাঞ্চ করতে গেলাম। স্যুপের সাথে ইরানের ঐতিহ্যবাহী কাবাব, সুস্বাদু ভাত, ফ্রায়েড মাছসহ রকমারি খাবার। ডেজার্টও বৈচিত্র্যময়। পুডিং ফিরনি পায়েশ। সেদিন বিকেলে ও রাতে দেখা করতে এলেন কোমের দুই বাংলাদেশী উচ্চতর শিক্ষার্থী মুনীর হোসেন খান ও আনোয়ারুল কবীর আরিফ। তাঁদের কাছ থেকে ইসলামের নামে চরমপন্থী ও তাকফিরি আন্দোলন সম্পর্কে ভালো ধারণা পাওয়া গেল।
শনিবার বেলা ১১টার দিকে কোমের আরেক বাংলাদেশী ছাত্র রাকীবকে নিয়ে নগরীর প্রাণকেন্দ্রে ‘হারাম’ খ্যাত বিশিষ্ট ধর্মীয় নেতাদের ও এক তাপসীর কবরস্থান দেখতে গেলাম। এখানেই পর পর শুয়ে আছেন বড় বড় আলেম ও ইমাম রেযার বোন তাপসী ফাতেমা মাসুমা। বিশাল কমপ্লেক্স। বাহারি সিরামিকের তৈরি দেয়াল পরিষ্কার তকতকে। অবিরাম সমাগত হচ্ছেন বিপুল নরনারী। তেলাওয়াত, বয়ান ও দরুদ হচ্ছে। বিশাল কবরস্থান, দশটি কম্পাউন্ডে বিভক্ত। কোথাও নেই জটাধারীদের ভীড়, ন্যূনতম অস্বচ্ছতা। হারাম কমপ্লেক্সের একাধিক চেম্বারে বসেন একদল আলেম- পুরুষ ও মহিলা। দর্শনার্থীরা তাঁদের নিকট থেকে নানা বিষয়ে উপদেশ-পরামর্শ নেন।
শনিবার বিকেলে আবারও আসেন মুনীর। তাঁর মাধ্যমে যোগাযোগ হয় রেডিও তেহরানের বাংলা বিভাগের সৈয়দ মুসা রেযা ও নাছির মাহমুদের সাথে। শুক্র ও শনিবার দু’দিনসহ বেশির ভাগ সময় কাটাই ইসতিকলাল হোটেলে। লবিতে রেস্টুরেন্টে কথা হয় ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া, মিয়ানমার, জাপান, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশের প্রতিনিধিদের সাথে। জেহাদের নামে চরমপন্থা ও তাকফিরি আন্দোলনের বিপদ নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন। সিরিয়া ও ইরাকে আইএস-র নামে আত্মঘাতী যুদ্ধ নিয়ে উৎকণ্ঠাই বেশি। পাশাপাশি পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর সাথে তালেবানদের লড়াই নিয়েও আছে উদ্বেগ। সাম্রাজ্যবাদী পাশ্চাত্য শক্তি বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রাম থেকে ফোকাস সরিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে মধ্যপ্রাচ্যে ভাতৃঘাতী যুদ্ধে মুখোমুখি করছে মুসলিম জনতাকে। তাতে মদদ দিচ্ছে ওয়াহাবী মতবাদপুষ্ট আরব রাজন্যবর্গ। এরা প্রথমে সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদ সরকারকে উৎখাতের জন্য আইএসকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে বলীয়ান করে। এখন সেই আইএসকে নির্মূল করার নামে এ অঞ্চলে ড্রোন হামলা চালাচ্ছে। পাকিস্তানে তালেবান নির্মূলের নামে বিভিন্ন জনপদে চলছে ড্রোন হামলা। অথচ একদিন যুক্তরাষ্ট্রই পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় তালেবান তৈরি করে। বহুল আলোচিত আল-কায়দা নেটওয়ার্কও তাদের মদদে সৃষ্ট। ইসলামে জবরদস্তির স্থান নেই। এটি সৌন্দর্য ও মানবকল্যাণের ধর্ম। অথচ আইএসের মতো তাকফিরি আন্দোলনের দৃষ্টিতে তাদের মুসলিম প্রতিপক্ষ কাফেরদের চেয়েও ঘৃণা ও প্রতিহিংসার পাত্র। তারা সিরিয়া ও ইরাকে এবং হালে লিবিয়ায় মুসলিম ভাইদের রক্তে হাত রঞ্জিত করছে। মহান ধর্ম  ইসলামকে অপমানিত করছে তাদের নৃশংসতা । আইএস যেভাবে ধৃত ব্যক্তিদের নির্মম হত্যার পর তার ভিডিও চিত্র প্রচার করছে তা বিভীষিকাময়। এটা ইসলামসম্মত নয়। আবু জেহেলের স্ত্রী হিন্দা হযরত আমীর হামযা (রা.)-এর কলিজা চিবিয়ে খেয়েছিল। এখন আইএস-ও তাই করছে।
২৩ মার্চ রোববার কোমের একটি সুবিশাল ধর্মীয় স্থাপনায় উদ্বোধন হয় চরমপন্থী ও তাকফিরি আন্দোলনবিরোধী ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসের। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বর্ষীয়ান ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ মাকারেম সিরাজী চরমপন্থী ও তাকফিরি আন্দোলনের উত্থান ও বিপদ সম্পর্কে তথ্যবহুল বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তিনি মুসলিম উম্মাহকে বিভক্ত করার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নীল নকশায় তাকফিরি আন্দোলনের উত্থান হয়েছে বলে জানান। রোববার বিকেলে সম্মেলনে ৮৩টি দেশ থেকে আগত ৩১৮ জন প্রতিনিধি ৪টি কমিশনে বিভক্ত হয়ে কংগ্রেসের প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করে নানা রকম প্রস্তাব গ্রহণ করেন। ৪ নম্বর কমিশনে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ জাতীয় মসজিদের খতিব প্রফেসর মাওলানা সালাহউদ্দিন। তিনি সূচনা বক্তব্যে ধর্মে কোন বাড়াবাড়ি ও জোরজবরদস্তির স্থান নেই বলে উল্লেখ করে প্রাসঙ্গিক কোরআনের আয়াত ও হাদীস থেকে উদ্ধৃতি দেন।  এই কমিশনে আমিও সংক্ষেপে বক্তৃতা দেই। বক্তৃতায় আমি বলি যে, বুলেট দিয়ে কোন আদর্শ কায়েম করা যায় না। একটি বুলেট একজন মানুষের প্রাণ হরণ করতে পারে, কিন্তু একটি আইডিয়া  বা আদর্শ দিয়ে লাখো মানুষের হৃদয় জয় করা যায়। বিশ্বে কোন আদর্শ গায়ের জোরে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তেমন হলে তায়েফে কাফেরদের হাতে প্রহৃত হবার পর আল্লাহর নবী মুহাম্মাদ (সা.) তাদের জন্য আল্লাহর গজব চাইতে পারতেন। তিনি তা না করে ভবিষ্যতে তাদের হেদায়াতের জন্য প্রার্থনা করেন। আমি ইসলামের নামে চরমপন্থা ও তাকফিরি আন্দোলনের বিপদ সম্পর্কে যুব সমাজকে সচেতন করার এবং তাদের সাথে নিরন্তর সংলাপের আহ্বান জানাই। সম্মেলনে চারটি ভাষায় বক্তব্য অনুবাদের ব্যবস্থা থাকায় অনেকে আমার বক্তব্যের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন। সম্মেলন স্থলটির কথা না বললেই নয়। বিশাল গম্বুজের নিচে মূল মিলনায়তনের ধারণক্ষমতা এক হাজার। মিলনায়তনের বিভিন্ন স্থানে খচিত আল্লাহর পবিত্র কালাম। মূল মিলনায়তন ছাড়াও আছে আরো অনেকগুলো সভাকক্ষ, লাইব্রেরি, আইটি রুম এবং সুপরিসর মসজিদ। সম্মেলন চলাকালে আমরা এই মসজিদেই আছর ও মাগরিবের নামায আদায় করি। ইরানে মাগরিবের নামায শেষে স্বল্প বিরতির পর এশার নামায অনুষ্ঠিত হয়। নামাযের আঙ্গিকও আমাদের মতোই। কেবল চার রাকাতের নামাযে দু’রাকাত শেষে রুকুতে যাওয়ার আগে ক্ষণিকের জন্য দু’হাত তুলে প্রার্থনাটাই আলাদা।
কংগ্রেসের দ্বিতীয় দিন ২৪ মার্চ সোমবার বিভিন্ন দেশের অর্ধ শতাধিক প্রতিনিধি বক্তব্য রাখেন। ইরাকের একজন ধর্মীয় নেতা মর্মস্পর্শী ভাষায় আইএসের নির্মমতার বিবরণ দেন। বিকেলের অধিবেশনে সঞ্চালকের দায়িত্ব নেন ইরানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আলী আকবর বেলায়েতী। তাঁর সাবলীল উপস্থাপনায় উপভোগ্য হয়ে ওঠে জটিল ও সারগর্ভ আলোচনা। সমাপনী অধিবেশনে আরেক প্রবীণ ইরানী ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ জাফর সোবহানী মুসলিম বিশ্বে চরমপন্থী ও তাকফিরি আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রবল জনমত গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তিনি কংগ্রেস উপলক্ষে প্রকাশিত বিভিন্ন গ্রন্থ ও স্মারকের মোড়ক উন্মোচন করেন। সম্মেলন চলাকালে একটি বিষয় আমাকে বিস্মিত করে। সাধারণভাবে একটি প্রচারণা আছে যে, শিয়া অধ্যুষিত ইরানে রাসূলে পাক (সা.)-এর বিষয়ে যথেষ্ট গুরুত্ব ও মর্যাদা দেওয়া হয় না? অথচ সম্মেলনে যখনই কোন বক্তা নবী করিম (সা.)-এর নাম নিয়েছেন তখনই গোটা মিলনায়তন প্রকম্পিত করে ধ্বনি ওঠে ‘আল্লাহুমা সাল্লি আলা মুহাম্মাদ ওয়া আলে মুহাম্মাদ’। আরেকটি বিষয় না বললেই নয়। কংগ্রেসের প্রতিটি অধিবেশনের শুরুতে পবিত্র কোরআনের সুললিত তেলাওয়াত মন কেড়ে নিত। সমাপনী অনুষ্ঠানের শেষ উপস্থাপনাও ছিল তেলাওয়াত। আল কোরআনের দোয়া সম্বলিত একাধিক আয়াতের মর্মস্পর্শী তেলাওয়াতে মিলনায়তন জুড়ে পিনপতন নীরবতার মধ্যে ক্রন্দনের রোল ওঠে।

২৪ নভেম্বর গভীর রাতে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় রাজধানী তেহরানের আলীশান হোটেল আজাদীতে। একুশ তলায় একটি কক্ষ বরাদ্দ ছিল আমাদের জন্য। ভোরে নামায ও গোসল সেরে জানালার পর্দা টেনে সরালাম। কী অপূর্ব দৃশ্য! অদূরে দাঁড়িয়ে আছে সুউচ্চ আলবোর্য পর্বতমালা। সবুজ পাহাড়ের মাথায় সাদা বরফের টুপি। ছিমছাম পরিচ্ছন্ন তেহরানের রাস্তাঘাট চওড়া, ভবনগুলো নির্মিত হয়েছে মেটাল বার দিয়ে। নির্মাণাধীন বেশকিছু বহুতল ভবন চোখে পড়ল। সেগুলো লোহার ফ্রেমে তৈরি  হচ্ছে। আমাদের মতো রড সিমেন্টের বালাই নেই। কোমে প্রাচীন জনপদে বহু ইট-সুরকির বাড়ি দেখেছি। তেহরান তেমনটি নয়।
২৫ নভেম্বর আমাদের নেওয়া হলো ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা তথা রাহবার আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ীর দফতরে। আমরা বসে আছি কনফারেন্স রুমে। সামনে ছোট একটি মঞ্চ, তার ওপর একটি চেয়ার, সাইড টেবিলে একটি মাইক্রোফোন। কানে হেডফোন লাগিয়ে অপেক্ষা করছি। বেলা ১১টায়  রাহবার এসে মঞ্চে দাঁড়িয়ে অভ্যাগতদের হাত তুলে স্বাগত জানালেন। তারপর তেলাওয়াত ও কংগ্রেস সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন উপস্থাপিত হলো। রাহবার আমাদের উদ্দেশে নাতিদীর্ঘ বক্তব্য রাখলেন। মনে হলো তাঁর বক্তব্য না শুনলে কংগ্রেসে যোগদান অসম্পূর্ণই থাকত। তিনি ইসলাম ও জেহাদের নামে চরমপন্থী ও তাকফিরি আন্দোলনের বিপদ সম্পর্কে বলেই ক্ষান্ত হলেন না। আশাবাদের কথাও শোনালেন। বললেন যুক্তরাষ্ট্র সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও ইরানকে পদানত করতে পারেনি। তারা ২০০৬ সালে দক্ষিণ লেবাননে হিজবুল্লাহকে হারাতে পারেনি। ২০১৪ সালে গাজায় হামাসকে নির্মূল করতে পারেনি। ইনশা আল্লাহ আগামীতেও আমরা গালিব বা বিজয়ী হব। রাহবারের বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়ে হোটেলে ফিরলাম।
বিকেলে রেডিও তেহরানের পক্ষে আমার সাক্ষাৎকার নিলেন নাছির মাহমুদ। তিনি তাকফিরি আন্দোলন, আইএস ও ওয়াহাবী আন্দোলন সম্পর্কে নানা প্রশ্ন করলেন। আমি বলার চেষ্টা করি যে, ইসলাম কেবল অনুশাসন ও বিধিনিষেধের ধর্ম নয়। ওয়াহাবী মতবাদ ইসলামের রুহানী ও উন্নত সংস্কৃতির সৌন্দর্যের পরিবর্তে নিছক বিধিনিষেধের ওপর জোর দেয়। তারা নারীর জন্য নানা রকম নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল তৈরি করে। একজনকে খলিফা ঘোষণার মাধ্যমে খেলাফতের মতো মহান প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে তামাশা করা হচ্ছে।
২৫ নভেম্বর দিনশেষে মধ্যরাতে বাক্সপেটরা গুছিয়ে আবার ফিরতি পথে যাত্রা। ২৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকায় পা রাখি। ৫ দিন ইরান সফরকালে একটি সুশৃঙ্খল জাতির চেহারা দেখেছি। দেখেছি এক পরিকল্পিত রাষ্ট্র। ইরানে ধর্ম রাষ্ট্র ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন কোন ব্রতমালা নয়। এখানে ইসলাম প্রোথিত হয়েছে সমাজ ও রাষ্ট্রের গভীরে। গোটা দেশকে দৃঢ় ও সুসংহত করেছে ধর্মীয় আবেগ আর সংস্কৃতি। কী আশ্চর্য ব্যাপার! ৩৬ বছরেও একটু খানি মরিচা ধরেনি ইসলামী বিপ্লবে।

এডভোকেট
বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট

চলো জীবন গড়ার লক্ষ্যপানে

আকরাম আব্বাসী
আজ আমাদের  বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার উন্নয়ন সম্পর্কে কিছু কথা বলতে চাই। আমার জানি, আমাদের প্রত্যেকের মনে কতক সুপ্ত ইচ্ছা বা স্বপ্ন আছে। সেই ইচ্ছা পূরণ ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য নিশ্চয়ই একটা লক্ষ্যও হয়তো স্থির করা আছে।
এ ব্যাপারে আমি সর্বপ্রথম যে কথাটা বলতে পারি তা হচ্ছে, আমার মনের এই  ইচ্ছা বা স্বপ্নটি বাস্তবায়ন হওয়া একান্তই সম্ভব। তবে আমরা তো জানি যে, জীবন বলতে যা বুঝায় তার গতি পরিবর্তন মোটেও সহজ ব্যাপার নয়; বরং অত্যন্ত  কঠিন কাজ। কারণ, জীবনের আশা-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের জন্য নানা ধরনের কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়। বহু ব্যর্থতা, কষ্টের পর কষ্টের পারাবার পার হতে হয়। জীবন চলার পথে এমন এমন মুহূর্ত আসে যখন আমার নিজের মধ্যেই সন্দেহ জাগে যে, আচ্ছা, আমি কি সফলকাম হতে পারব, নাকি পারব না।
এমন সময়ও আসে যখন আমি বলতে বাধ্য হই যে, হায় আল্লাহ! আমার জীবনে এমন দিনটি কেন আসল? আমি তো কেবল নিজেকে নিয়ে আর নিজের পরিবার-পরিজনের সুখ-শান্তি ও  জীবন-জীবিকা নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। কারো সাথে ঝামেলায় জড়াই নি, জড়াতে চাই নি। আমি তো কখনো কারো পকেটের টাকা মারতে চাই নি! আমি সরলভাবে জীবন যাপন করছিলাম। এরপরও কেন আমার সামনে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব  হলো।
যাঁরা জীবনে কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হয়েছেন তাঁদের সাথে আমার কিছু কথা আছে।
প্রথম কথা হলো, আপনি মনে যে ইচ্ছা বা স্বপ্ন কিংবা আশা-আকাক্সক্ষা লালন করছেন তা কোনো অবস্থাতেই ত্যাগ করবেন না।
মনে রাখবেন, জীবনে দুঃখ-কষ্ট, কঠিন পরিস্থিতি আসে, আসবে, আসতে পারে; তবে এই আসাটা স্থায়ী থাকার জন্য নয়। চলে যাওয়ার জন্যই এই আগমন। একদিন অবশ্যই চলে যাবে। আর যখন চলে যাবে তখন পেছন ফিরে দেখতে পাবেন যে, এসব দুঃখ-কষ্ট, কঠিন পরিস্থিতি আমাদেরকে অনেক অভিজ্ঞতা উপহার দিয়েছে। আমাদের পথ চলাকে অবিচল, শক্ত ও মজবুত করে দিয়ে গেছে। কাজেই নিশ্চিত জেনে রাখুন যে, যদি ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেন, তাহলে আপনার সাফল্যের বিস্ময়কর দৃশ্যপট একের পর এক সম্মুখে হাজির হবে। জেনে রাখুন, ধৈর্যের বিনিময়ে সাফল্যের এই বরমাল্য খুব কম সংখ্যক লোকের ভাগ্যেই জোটে। আর সেই নগণ্য লোকের মধ্যে আপনিও একজন। মনে রাখবেন, আল্লাহ পাক আপনাকে খাসভাবে সৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ আপনার আকৃতি-অবয়ব যেমন আলাদা তেমনি আপনার মধ্যে যে বৈশিষ্ট্য দান করেছেন তাও আলাদা ও বৈশিষ্ট্যম-িত।
সাধারণত সব মানুষের পরিবার-পরিজন আছে। তাদের  আয়-উপার্জনের পথও আছে। তারা জীবন-যাপন করে এবং পরিশেষে  মৃত্যুবরণ করে। এই শ্রেণির লোকেরা জীবনকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার সাধনা করে না। তারা তাদের  লালিত স্বপ্ন পূরণ বা জীবনের চরম লক্ষ্যে উপনীত হবার কথা ভুলে যায়। এ পথে চেষ্টা-সাধনার প্রয়োজন অনুভব করে না। আসলে তাদের জীবনের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই। আগে থাকলেও তা বিস্মৃত হয়ে গেছে। কোনো মতে জীবনকে তরিয়ে নেয়া, হায়াতের দিনগুলো পার করাই তাদের জীবনের লক্ষ্য। তারা নিজের ইচ্ছা বা স্বপ্নের কথা ভুলে গেছে। তাই সেদিকে অগ্রসর হওয়ার মনোবল পায় না।
কারণ কী?
অনেকেই আছে, শুধু অভিযোগ করতে ভালোবাসে। নিজের সাফল্যের জন্য কোনো কাজ করার মনোবৃত্তি তাদের নেই। এর প্রথম কারণ হচ্ছে তারা ভীতু। যদি লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হই তাহলে কী হবে- এই ভয় তাদেরকে পেছন দিকে টানতে থাকে।
এসব লোক ঝুঁকি নিতে চায় না। সে সাহস তাদের নেই।
লক্ষ্য করুন, আপনারা জীবনের বহু মূল্যবান সময় মানুষের সাথে মেলামেশায় ব্যয় করেন। এর পেছনে উদ্দেশ্য থাকে মানুষ যাতে আপনাকে ভালো বলে। আপনি নিজেকে যতখানি চেনেন, তার চেয়ে অন্যদেরকে ভালো করে চেনেন; অথচ আপনার কর্তব্য ছিল নিজেকে, নিজের ভেতরটাকে ভালো করে চেনা। আত্মপরিচয় নিয়ে গবেষণা করা।
আপনি অন্যদের  সম্পর্কে অনেক কিছুই জানেন। আপনিও চান যে, তাদের মতোই সময় অতিবাহিত করবেন। অথবা ঠিক তাদের মতোই হয়ে যাবেন। আসল ব্যাপারটা কী তা কি আপনি জানেন? আসল ব্যাপার হচ্ছে, আপনি নিজেকে চেনার জন্য যথেষ্ট সময় ব্যয় করেন না; বরং অন্যের চর্চা নিয়েই ব্যস্ত থাকন।
আপনি ওদের জন্য অনেক সময় ব্যয় করছেন। অথচ আপনি নিজে কে, সেটা জানেন না। আপনার কাছে আমার একান্ত অনুরোধ থাকবে, দয়া করে আপনার সময়টা নিজের জন্য ব্যয় করুন।
আপনি যদি চান যে, আপনার জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ বাস্তবায়িত হোক, যদি আগ্রহী হন যে, আপনার ইচ্ছা ও আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ হোক, তাহলে অনাকাক্সিক্ষত লোকদের তালিকা আপনার জীবনের খাতা থেকে কেটে দিন।
যেসব লোক জীবনের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যপথে অগ্রসরমাণ তাদের কাছে জীবন বিরাট অর্থবহ ও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
আপনি যখন সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অভিসারী একজন মানুষ হবেন, তখন যে কাজটি করতে হবে তা হলো, নিজের ভেতরকার ইতিবাচক দিকগুলোকে চিহ্নিত করুন। নিজেকে অন্যদের থেকে আলাদা করে নিতে তৎপর হোন। অর্থাৎ নিজের যোগ্যতা ও কর্মক্ষমতাগুলো চিহ্নিত করুন। তখন দেখবেন যে, আপনি ঠিকই নিজের ইতিবাচক দিকগুলোকে খুঁজে পেয়েছেন। এখন দায়িত্ব হলো, ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
নিজের লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় মনোবল নিয়ে অগ্রসর হোন। পরবর্তী পদক্ষেপে সেই লক্ষ্যগুলোকে আরো স্পষ্ট করুন। অর্থাৎ মনের কাছে বলুন যে, যেমন আমি এমপি হতে চাই কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হতে চাই অথবা ডাক্তার হওয়া আমার লক্ষ্য।
একটা কথা মনে রাখবেন, আপনি নিজের লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবেন না যদি বিষয়টিকে আপনার বিশ্বাসের মধ্যে নিয়ে না আসেন। অর্থাৎ আপনার চিন্তাকে বিশ্বাস করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা নিজের ওপর আস্থাশীল হতে হবে।
আপনি অনেক বই-পুস্তক পড়েন। পড়াশুনার মধ্যে আপনার দিনরাত কেটে যায়; কিন্তু একটি কথা কি চিন্তা করে দেখেছেন যে, আপনি নিজেকে বিশ্বাস করেন না। আপনার মধ্যে যে যোগ্যতা ও প্রতিভা আছে তার ব্যাপারে মনে সাহস সঞ্চয় করুন। একাকী থাকার জন্যও সাহসের প্রয়োজন হয়। সেই সাহস আপনাকে অর্জন করতে হবে। নিজকে চেনা, নিজের যোগ্যতা ও প্রতিভার পরিচয় লাভ, নিজের আশা-আকাক্সক্ষার বিচার-বিশ্লেষণ ইত্যাদির  জন্য কিছু সময় বরাদ্দ করুন। ছোট থেকে  বড় লক্ষ্যে কীভাবে পৌঁছা যাবে তার একটি ছক তৈরি করুন।
এ পর্যায়ে এসে আপনি এক মানুষে পরিণত হবেন, আপনি যেন নতুন সৃষ্টি হয়েছেন, সবেমাত্র পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়েছেন।  চেষ্টা করুন, নিজে যেন উপকারী মানুষ হতে পারেন। এর জন্য নিজেই নিজের একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করুন।
যখন একাকী হবেন, তখন নিজের যোগ্যতা ও সক্ষমতাকে নির্মাণ করতে তৎপর হোন। নিজের প্রতি বিশ্বাসী হোন। যে কোনো কাজের ঝুঁকি নিতে সাহসী হোন। প্রতিদিন মনে মনে বলুন : আমি আছি, আমার অস্তিত্ব আছে। কাজেই আমার কাজে অবশ্যই আমি সফল হব।
আপনি নিজের চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগান। জীবনের লক্ষ্যগুলো খতিয়ে দেখুন। কতদূর এসেছেন আর কতদূর যেতে হবে, ভেবে দেখুন। নিজেকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যান যাতে মানুষ আপনাকে কষ্ট না দেয়। মানুষের সাথে হানাহানি, রেষারেষির পরিবর্তে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে ভাবুন।
কখনো আত্মতৃপ্ত হয়ে বলবেন না যে, আমার আর কোনো আশা-আকাক্সক্ষা নেই। না। আপনার অনেক ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষা এখনো অপূরণ রয়ে গেছে।
আপনাকে এমন হতে হবে যাতে আপনার পিতামাতা আপনাকে নিয়ে গর্ব করে। আপনার বন্ধুমহলে প্রিয়পাত্র হওয়া চাই। লক্ষ-কোটি মানুষকে মুগ্ধ করার মতো ব্যক্তিত্বের অধিকারী আপনাকে হতে হবে।
এই দুনিয়া নদীর পানির মতো বয়ে চলেছে। জগৎ-সংসার যেভাবে চলে যাচ্ছে তা পুনরায় ফিরে আসবে না। আপনি তো এমন পথ ধরে অগ্রসর হচ্ছেন যে পথে চলার পূর্ব অভিজ্ঞতা আপনার নেই।
কাজেই সতর্ক থাকবেন অন্যরা যাতে আপনাকে উপহাসের পাত্র বানাতে না পারে। আপনার ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষার গুড়ে বালি দেয়ার সুযোগ যেন কেউ না পায়। এজন্য মনের কথাগুলো কোনো অবস্থাতেই বলে বেড়াবেন না। কোনো অবস্থাতেই মন খারাপ করবেন না। হয়তো এমন লোকদের মাঝে বিচরণ করছেন যারা কথা দিয়ে কথা রাখে না। তখন তাদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার পরিবর্র্তে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে- এই দর্শনে বিশ্বাসী হোন। অন্যের অবহেলা বা অবজ্ঞাকে অবহেলা করুন। একমাত্র আল্লাহর কাছেই সাহায্যপ্রার্থী হোন।
আমি জানি, জীবন চলার পথে আপনি বার বার হোঁচট খেয়েছেন। কিন্তু এরপরও আপনার সামনে আশার নতুন দিগন্ত হাতছানি দিয়েছে। ফলে প্রতিদিনই নতুন নতুন আশা বুকে বেঁধে এগিয়ে গেছেন। দেখুন, কতখানি এগিয়ে এসেছেন। কাজেই মনে মনে বলুন : এখনই আমার সব কাজ শেষ হয়ে যায় নি। আমার জীবনে পূর্ণ সাফল্যের পথে এগিয়ে যাওয়ার সংকল্প নিয়ে অদম্য মনোবল নিয়ে চেষ্টা ও সাধনা চালাতে হবে। তখনই বিজয় ও সাফল্য আপনার পদচুম্বন করবে। জীবনে যেটি চেয়েছিলেন তা হয়তো পান নি; কিন্তু এখন যা পেয়েছেন তা সেই চাওয়ার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়; বরং অধিকতর উত্তম, আরো বেশি উন্নত। বুঝতে পারবেন যে, জীবনের দুর্গম পথ পাড়ি দিতে আল্লাহ তাআলা আপনাকে পদে পদে সাহায্য করছেন। কথায় বলে ‘হিম্মতে মর্দ মদদে খোদা’- ‘মানুষের সাহস মনোবল যেখানে, আল্লাহর সাহায্য সেখানে।’
অনুবাদ : ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

বাংলা ভাষায় ফারসি শব্দের ব্যবহার

সংকলন : ড. জহির উদ্দিন মাহমুদ
সম্পাদনা : আব্দুল কুদ্দুস বাদশা

বাংলা রূপ    ফারসি রূপ    আধুনিক ফারসি উচ্চারণ
তাবাররুক    تبرّک    তাবাররোক
তাবলীগ    تبلیغ    তাবলীগ
তেজারত    تجارت    তে-জ-রাত
তহসিলদার    تحصیل دار    তাহ্সীলদর
তহবিল    تحویل    তাহ্ভীল
তদবির    تدبیر    তাদবীর
তসবিহ    تسبیح    তাসবীহ
তশরিফ    تشریف    তাশরীফ
তারিফ    تعریف    তা’রীফ
তাজিম    تعظیم    তা’যীম
তালুক/তাল্লুক    تعلق    তাআল্লোক্
তালিম    تعلیم    তা’লীম
তফসিল    تفصیل    তাফসীল
তালাশ    تلاش    তা-লশ্
তামাদী    تمادی/تمدیر    তা-মদী
তামাশা    تماشا    তা-ম-শ
তামাম    تمام    তা-মম
তামাদ্দুন    تمدّن    তামাদ্দুন
তওফীক    توفیق    তাওফীক
তহবন্দ (লুঙ্গি)    ته بند    তাহবান্দ
তোহমত (অপবাদ)    تهمت    তোহমাত্
তৈয়ার    تیّار    তেইঅর
তীরন্দায    تیرانداز    তীর আন্দয
তেজী    تیزی    তী-যী
শালিস    ثالث     সলেস্
ছওয়াব    ثواب    সা-ভব
জাদুকর    جادوگر    জদুগার
জাগীরদার    جاگیر دار    জগীরদর
জামা    جامه    জ-মে
জান    جان    জন
জানবাজ    جانباز    জনবয
জায়নামায    جانماز    জ-না-ময
জানোয়ার    جانور    জনভার
জাহেল    جاهل    জ-হেল
জুব্বা    جبّه    জোব্বে
জযবা    جذبه    জায্বে
জরিমানা    جریمه    জারীমে
জলসা    جلسه    জালাসে
জামাত    جماعت    জা-মআত

ইরানী প্রবাদ বাক্য

ذکر خیرش درمیان بود.
উচ্চারণ : যেক্রে খেইরাশ দারমিয়া’ন বূদ
অর্থ : তার সুনাম মাঝখানে ছিল।
মর্ম : কারো অনুপস্থিতিতে তার সুনাম-সুখ্যাতি নিয়ে আলোচনা করা। কারো সুনাম করা।
راه پس و پیش نداشتن.
উচ্চারণ : রা’হে পাস ও পীশ না দা’শতান
অর্থ : পেছনের সামনের রাস্তা না থাকা।
মর্ম : কিংকর্তব্যবিমূঢ় হওয়া। কোনো কাজ বা পরিস্থিতি মেনে নিতে বাধ্য হওয়া।
راه پیش پای گذاشتن.
উচ্চারণ : রা’হ পীশে পা’য় গোযা’শতান
অর্থ : রাস্তা সম্মুখে রাখা।
মর্ম : কারো জন্য উপায়ান্তর খুঁজে বের করা। কারো কল্যাণ চিন্তা করা ও সৎ পরামর্শ দেওয়া।
رآی کسی را زدن.
উচ্চারণ : রা-য়ে কেসি রা’ যাদান
অর্থ : কারো মতামতকে খ-ন করা।
মর্ম : কারো মতামত বা সিদ্ধান্ত পাল্টে দেওয়া। কাউকে কোনো কাজ করা থেকে ফিরিয়ে দেওয়া।
رخت بر بستن.
উচ্চারণ : রাখ্ত বার বাস্তান
অর্থ : বিছানাপত্র গুটিয়ে নেয়া।
মর্ম : সফরের বিছানাপত্র গুটিয়ে নেয়া। চিরবিদায় গ্রহণ করা। মৃত্যুবরণ করা।
رد احسان غلط است.
উচ্চারণ : রদ্দে এহসান গালাত আস্ত
অর্থ : অনুগ্রহ রদ করা ভুল।
মর্ম : কারো হাদিয়া বা উপহার গ্রহণ না করা তাকে অসম্মান করার শামিল।
رد و بدل کردن.
উচ্চারণ : রাদ্দো বাদাল কারদান
অর্থ : আদান-প্রদান করা।
মর্ম : উভয় পক্ষের লেনদেন পরিষ্কার হয়ে যাওয়া। পারস্পরিক লেনদেনের হিসাব চুকিয়ে ফেলা।
راست آمدن کار.
উচ্চারণ : রা’স্ত অ’মাদানে কা’র
অর্থ : কাজ ঠিকঠাক হওয়া।
মর্ম : কাজ আঞ্জাম দেয়ার সাজ-সরঞ্জাম জোগাড় হওয়া। সবকিছু ঠিকঠাক থাকা।
راست و دروغش به گردن راوی.
উচ্চারণ : রা’স্ত ও দোরুগাশ বে গার্দানে রাভী
অর্থ : সত্য মিথ্যা বর্ণনাকারীর কাঁধের ওপর।
মর্ম : আমার কথায় কোনো হেরফের নেই, যা শুনেছি হুবহু তাই বলেছি।

অনুবাদ : ড. মাওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

রুদাকি ও তাঁর কাব্য ভাবনা

ড. মোঃ মুহসীন উদ্দীন মিয়া*

ফারসি সাহিত্যাকাশে যে কয়েকজন উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক স্বীয় কর্মদক্ষতা ও কাব্য-সাধনার গুণে খ্যাতির শীর্ষে আরোহণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন তাঁদের অন্যতম হলেন অন্ধ কবি রুদাকি। হিজরি চতুর্থ ও পঞ্চম শতকের সন্ধিক্ষণ ও দশম শতাব্দীর সামানী যুগের বহুল আলোচিত রুদাকিকে বলা হয় ‘ফারসি কবিতার জনক’ ও ‘প্রথম শ্রেষ্ঠ কবি’। তাঁর কাব্যগুণে মুগ্ধ হয়ে সামানী শাসক নাসর বিন আহমাদ (৯১৪-৯৪৩) তাঁকে সভাকবি নিয়োগ করেন এবং কাব্যক্ষেত্রে অসাধারণ পা-িত্যের কারণে তাঁকে ‘কবিগুরু’ উপাধি দেন।
পরিচিতি : ফারসি সাহিত্যের প্রাচীনতম ইতিহাস গ্রন্থ সেমনানী রচিত ‘এনসাব’ এর ভাষ্যমতে তাঁর পুরো নাম আবু আবদুল্লাহ জাফর ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে হাকীম ইবনে আবদুর রহমান ইবনে আদাম, যিনি রুদাকি নামে সর্বাধিক পরিচিতি পান। রুদাকি নামটি তৎকালীন সমরকন্দের রুদাক অঞ্চলের সাথে সম্পর্কিত। সেময়ানী বলেন, রুদাক কেন্দ্রভূমির নাম ছিল بنج বানোজ। রুদাকি সমরকন্দের পাহাড়ঘেরা রুদাক অঞ্চলের বানোজ বা বান্জ নামক নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। বানোজ শব্দটি মূলত ‘পানোজদেহ’ শব্দের বিকৃত রূপÑ যা আজো বোখারার সমরকন্দে স্বনামে বহাল আছে।১
তাঁর জন্ম সন ও তারিখ স্পষ্ট নয়, তবে হিজরি ৩য় শতকে মধ্যভাগে যে তিনি জন্ম নিয়েছিলেন তা সহজেই অনুমান করা যায়। কেননা, বিভিন্ন ‘তাযকিরা’ গ্রন্থে তাঁর মৃত্যুসাল ৩২৯ বলে উল্লেখ রয়েছে, আরো বলা হয়েছে, তিনি দীর্ঘ ৭০ বৎসর জীবিত ছিলেন। যেমন তিনি লিখেন-
من موی خویش را نه از آن می کنم سیاه
تا باز نوجوان شوم ونو کنم گناه
چون جامها بوقت مصیبت کنند
من موی از مصیبت پیوی کنم سیاه২
অর্থ : আমার শুভ্র চুলকে কালো করার অর্থ এই নয় যে, আমি যৌবনে ফিরে গুনাহে লিপ্ত হব; বরং এ রং শোক প্রকাশের কালো পোশাকের ন্যায় বার্ধক্যে শোক প্রকাশের নামান্তর।
এ কারণেই তাঁর মৃত্যুসাল অনুপাত হিসাব করলে তাঁর জন্মসাল হয় হিজরি ৩য় শতকের মধ্যভাগ। তাই সম্ভবত তিনি হিজরি ২৫০ সাল থেকে ২৬০ মোতাবেক ৮৬০ হতে ৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের ভেতর জন্ম নিয়ে থাকবেন।৩ ইরানের চিকিৎসাশাস্ত্রের পুবোধা মুহাম্মাদ বিন জাকারিয়া রাযী, সামানীয় ওস্তাদ অভিধায় ভূষিত বিখ্যাত দার্শনিক আবু নাসর ফারাবিও এ সময়েই জন্ম নিয়েছিলেন। মুহাম্মাদ বিন তাবারি তখন ৩৪ বছর বয়সী ছিলেন এবং তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থরাজি সংকলনে ব্যস্ত ছিলেন।৪
রুদাকির কবিতায় উল্লিখিত সূত্র, সমসাময়িক এবং পরবর্তী কবি-সাহিত্যিক লেখকগণের বর্ণনা মতে, জন্মস্থান রুদাক অঞ্চলের নামানুসারেই উপাধি হিসেবে তিনি রুদাকি নামটি গ্রহণ করেছেন। তবে কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে রুদাকি শব্দটি رود نیک ‘পবিত্র নদী’ হতে উদ্ভূত বলে উল্লেখ করা হলেও এর পক্ষে তেমন কোন জোড়ালো সমর্থন মেলেনি। আবার দৌলত শাহ সমরকান্দির মতে তিনি ‘রুদ’ নামক বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন বলে রুদাকি নামে পরিচিতি পান। এ মতের খ-নে যাবিহুল্লাহু সাফা বলেন, রুদ হতে রুদাকি হয় না; বরং রুদী হওয়ারই কথা।
তবে সেমনানী رسمنانی ‘এনসাব’ নামক গ্রন্থে বলিষ্ঠতার সাথে উল্লেখ করেছেন, রুদাকি নামটি বোখারা ও সমরকন্দের রুদাক গ্রামের নাম থেকেই উদ্ভূত। কেননা, আবু আবদুল্লাহ বানোজ গ্রামের রুদাক এলাকার লোক ছিলেন এবং আঞ্চলিকভাবে সাক্ষ্য হিসেবে তিনি এ কবিতা নামটি গ্রহণ করেছেন।৫
শৈশব ও যৌবনকাল : তাঁর জীবন ও প্রাথমিক শিক্ষা লাভ সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। তবে মুহাম্মাদ উফিতার ‘লোবাবুল আলবাব’ গ্রন্থে তাঁর মেধা ও মনন সম্পর্কে চমৎকার মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, রুদাকি এতটাই ধীশক্তির অধিকারী ছিলেন যে, মাত্র আট বৎসর বয়সে পবিত্র কুরআন হেফ্য করেন। একই সাথে ইল্মে কিরআত তথা কুরআন পাঠ পদ্ধতি (তাজবীদ বিদ্যা)ও আয়ত্ব করেন। এ সময় থেকেই তিনি কাব্যচর্চা করতেন। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে তিনি এতে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন।
অসমর্থিত কয়েকটি সূত্রমতে তিনি শৈশবে সমরকন্দের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে শিক্ষাগ্রহণ করেছেন। তাঁর কবিতা প্রমাণ করে তিনি শিক্ষিত কবি ছিলেন। ফারসি শব্দ চয়নে তিনি এতটাই পারঙ্গম ছিলেন যে, এখনো প্রায় প্রতিটি অভিধান গ্রন্থে কবিতার নমুনা হিসেবে তাঁর কবিতার উদ্ধৃতি থাকে। সাধারণ মানুষও তাঁকে যথেষ্ট সম্মান করত এবং তাঁকে উস্তাদ বা শিক্ষক বলে সম্বোধন করত।
যৌবনে রুদাকি ছিলেন সুগায়ক, বেহালাবাদক। বেহালা সংযোগে তিনি কবিতা গাইতেন চমৎকার। তৎকালীন শ্রেষ্ঠ সংগীতজ্ঞ আবুল আমাক বাখতিয়ারীর কাছ থেকে সংগীতে দীক্ষা নিয়ে গুরু কর্তৃক প্রশংসিত হন। তাঁর সংগীত সাধনার স্বীকৃতি হিসেবে উস্তাদ বাখতিয়ারী শেষ জীবনে তাঁর চাঙ্গ (বেহালার মতো বাদ্যযন্ত্রবিশেষ) রুদাকিকে দান করে সম্মানিত করেন।৬
তিনি কবিতাও লিখতেন অসাধারণ। ছন্দবদ্ধ কবিতার পঙ্ক্তিমালার সাথে সুরঝংকারের ঐকতান, হিজরি চতুর্থ-পঞ্চম শতক ও ইরানে ইসলাম আগমনের পূর্বের দিনগুলোতে মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। সুরের মূর্ছনাবিহীন কবিতা, আর কবিতা ছাড়া সুর যেন বড়ই বেমানান ছিল।
তখনকার দিনে তিনিই বড় মাপের কবি হিসেবে বিবেচিত হতেন যিনি কবিতার মাধ্যমে সুরের মায়াজাল সৃষ্টিতে পারঙ্গম হতেন। রুদাকি ছিলেন তেমনি একজন কবি যিনি (ক) সুর সৃষ্টি ও গান গাইতে পারতেন। (খ) যন্ত্র সংগীতে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন (গ) কবিতা লিখতেন ও তাতে সুরারোপ করতেন (ঘ) সুকণ্ঠের অধিকারী ছিলেন। এ কারণেই তিনি হিজরি চতুর্থ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের শ্রেষ্ঠ কবির স্বীকৃতি পান। তাঁর পরে ফরুরুখি (৪২৯ হি.) শ্রেষ্ঠ সংগীতজ্ঞ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
সুরদানে অপারগ কবিগণ তাঁদের কবিতা কাক্সিক্ষত ব্যক্তিবর্গকে সুর সহযোগে শোনাতে রুদাকির দারস্থ হতেন। রুদাকি খুনইয়া গারগণের (বিশেষ গায়ক ও বাদক দলের) শীর্ষস্থানীয় ছিলেন বিধায় অল্প দিনে তাঁর সুখ্যাতি দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পরলে সামানী সম্রাট নাসর বিন আহমাদ (৩০১-৩৩১ হি., ৯১৪-৯৪৩ খ্রি.) তাঁকে শ্রেষ্ঠ সভাকবির মর্যাদা দান করেন।৭
সে সময়ে ফারসি গজলের সাথে সুরের মিশ্রণ ও জনপ্রিয় করতে রুদাকির কৃতিত্ব অনস্বীকার্য। তাঁর গজলগুলো শুধু সুরের মায়াজালে আচ্ছন্নই ছিল না। ভাবার্থের বিচারেও ছিল মূল্যবান মুক্তোখ-ের মতো। তাঁর গজলের কয়েকটি পঙ্ক্তিÑ
زمانه پندی ازاد وارمرا- زمانه راچو نکو بنگری همه پند است
برو زنیک کسان گفت تاتوغم نخوری – بساکساکه روزتو آرزومنداست৮
অনুবাদ : সময় আমায় দিয়েছে ঢের শিক্ষা
কালের উপদেশে জীবন নিলো মোর দীক্ষা,
অপরের সুখে হয়ো না তুমি দুঃখী
তোমাতে আসিতে অনেকে হয় সুখী।
সামানী সম্রাট নাসর বিন আহমাদের দরবারে রুদাকির কবিতার প্রভাব ছিল অপরিসীম। সম্রাটকে হেরাত থেকে বোখারাতে ফিরিয়ে আনার জন্য তাঁর গাওয়া ‘বোখারা’ নামক কবিতাটি এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। নিযামী আরুজী সমরকান্দি তাঁর ‘চাহার মাকালা’ গ্রন্থে এ ঘটনার প্রেক্ষাপট বর্ণনায় বলেন, সম্রাট নাসর বিন আহমাদের প্রচলিত নিয়ম ছিল তিনি সভাসদবর্গসহ শীত ঋতুতে বোখারায় এবং গ্রীষ্মকালে সমরকন্দে অবস্থান করতেন। কোন এক গ্রীষ্মে তিনি হেরাতে অবকাশ যাপনে গেলে প্রসিদ্ধ প্রমোদ বাগান বাদ-ই-গীসের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে বাদশা বোখারায় আর না ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়ে একাধারে চার বছর সেখানেই অবস্থান করতে থাকেন।
এতে সম্রাটের প্রত্যাবর্তন কামনায় অস্থির বোখারাবাসী নিরুপায় হয়ে রুদাকির শরণাপন্ন হন। রুদাকিও ‘বোখারা’ নামক কবিতা লিখে সুরারোপের মাধ্যমে সংগীতে রূপ দিয়ে কোন এক নির্মল সকালে বাদশার দরবারে গিয়ে চাঙ্গা নামক বাদ্যযন্ত্রের সহযোগে ‘ওশ্শাক’ রাগ সংগীতের সুরে গাইতে শুরু করেন। রুদাকির সুরের মূর্ছনায় সম্রাট এতটাই আচ্ছন্ন হন যে, সেই মুহূর্তে সভাসদবর্গসহ রাতের পোশাকেই বোখারা পানে যাত্রা করেন। বোখারার আকর্ষণ সম্রাটের ভিতর এতটাই তীব্র ছিল যে, কথিত আছে তিনি পায়ের মোজা পরতে ভুলে গিয়েছিলেন।’৯
কবিতার পঙ্ক্তি ছিল নিম্নরূপÑ
بوی جوی مولیان آیدهی – یاد یار مهربان آیدهی
ریگ آموی در رشتیهای او – زیر پایم پرتیان آید هم و….. الخ১০
মুলিয়া নদীর জলরাশির সুগন্ধ ভেসে আসছে
মহানুভব বন্ধুর স্মৃতিকথা থেকে থেকে মনে পড়ছে
ককেশাস নদীর কর্কষ বেলাভূমির বালুকারাশি
পদতলে মোর সুকোমল রেশমতুল্য অনুভূত হচ্ছে
বোখারা প্রশান্তির দেশ, শান্তিময়ই থাক চিরদিন
সম্রাট আসবে ফিরে এখানে অতিথি হয়ে ফের।
বোখারা আকাশ তুমি, সম্রাট সে আকাশের চাঁদ,
বোখারা তুমি বাগান, সম্রাট সে বাগানের সার্ভবৃক্ষ
বৃক্ষ বাগানে, চাঁদ আকাশের ফিরে আসছে আবার।
রুদাকি তাঁর সংগীত চর্চার কথা নিজেই বলেন এভাবেÑ
بحسن صوت چو بلبل مقید نظم
بجرم حسن چو یوسف اسیر زندنی
সুমিষ্ট সুরের কারণে বুলবুলির ন্যায় আমি খাঁচায় আছি।
যেমন ইউসুফ তাঁর সৌন্দর্যের অপরাধে কারারুদ্ধ ছিলেন।
অন্ধ কবি : ইংরেজ কবি হোমার, আরব কবি আবুল আলা আল-মাআরবি এবং ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর মিশরীয় প-িত ড. তহা হোসেনের মতো রুদাকিও ছিলেন জন্মান্ধ। হিজরি চতুর্থ শতকের ইরানের শ্রেষ্ঠ প-িত আবু হাইয়্যান তাওহীদী তাঁর ‘আল হাওযামিলু ওয়াশ্ শাওযামিল’ গ্রন্থে রুদাকিকে জন্মান্ধ উল্লেখ করেছেন।১১
বিশিষ্ট ঐতিহাসিক আবু মনসুর দাকিকি ও নাসের খসরু উপরিউক্ত মতকে সমর্থন করে যথাক্রমে বলেনÑ
(ক) استاد شهید زنده بایستی – وآن شاعر تیره چشم روشن بین
تا شاه مرا مدیح گفتندی – با الفاظ خوش زمعلنی رنگین
(دقیقی)
শহীদ ওস্তাদ সেই দৃষ্টিহীন আলোকদ্রষ্টা কবি যদি আজও বেঁচে থাকতেন
তবে সুন্দরতম শব্দ চয়নে ও রঙিন অর্থায়নে আমাদের বাদশাহের প্রশংসা বর্ণনা করতেন।
(খ) ১২اشعار زهد وپند بسی گفتست آن تیره چشم شاعر روشن بین (ناصرخسرو)
আলোকিত হৃদয়ের অধিকারী সেই অন্ধ কবি
বহু তপসীসুলভ ও উপদেশপূর্ণ কাব্য রচনা করেছেন।
এছাড়াও রুদাকির সমসাময়িক কয়েক জন কবি-সাহিত্যিক, যেমন আবু যারা মামারী জুনজানী বলেন, একবার খোরাসানের আমির তাঁর কবিতা রুদাকির মতো হয়েছে বললে জবাবে তিনি বলেছিলেনÑ
اگر به دولت با رودکی نمی مانم – عجب مکن سخن ز رودکی نه کم دانم
اگر به کوری چشم او بیافت گیتی را- ز بهر گیتی من کور بود نتوانستم১৩
প্রাচুর্যের ক্ষেত্রে যদিও রুদাকির সমকক্ষ নই, কিন্তু অবাক হবেন না
বক্তব্য প্রকাশে রুদাকির চাইতে কোন অংশে কম যাই না,
যদিও তাঁর অন্ধচোখ সমগ্র পৃথিবী অর্জন করেছে,
কিন্তু অর্জনের ক্ষেত্রে অন্ধত্ব (অপারগতা) আমি সফলতা পাইনি।
উপরিউক্ত তিনটি বেইতে ‘আলোকিত দৃষ্টির অন্ধ কবি’ বলতে সকলেই রুদাকিকে বুঝিয়েছেন।
তবে রুদাকি গবেষকগণের অপর একটি অংশে মনে করেন তিনি জন্মান্ধ ছিলেন না; বরং জীবনের শেষ প্রান্তে এসে কোন কারণে অন্ধ হয়েছিলেন। এ মতের ধারকগণের অন্যতম ছিলেন ওস্তাদ সাঈদ নাফিসি, বাদিউজ্জামান ফরুজানফার।১৪
তাঁরা তাঁর কবিতায় ব্যবহৃত উপমা, উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্প ও ইঙ্গিতধর্মী বক্তব্যকে দলিল হিসেবে উপস্থাপন করে বলেন, চাক্ষুস দর্শন ভিন্ন কারো দ্বারাই কবিতায় এ ধরনের বিষয়াবলির ব্যবহার সম্ভব নয়।
রাশিয়ার বিশেষজ্ঞ গবেষক অধ্যাপক গ্রাসিমভের গবেষণাকর্মও শেষোক্ত মতকে সমর্থন করে। ১৯৭০ সালে গ্রাসিমভ রুদাকির কবর খুঁড়ে মাথায় খুলি ও হাড় উত্তোলন করে পরীক্ষার মাধ্যমে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, রুদাকি ৮০ বছর জীবন পেয়েছিলেন এবং জন্মান্ধ ছিলেন না; বরং শেষ জীবনে এসে অন্ধ হয়েছিলেন। তাঁর শরীরের কিছু কিছু হাড় ভাঙা ছিল।১৫
সাহিত্য সাধনা : কবিতার সকল শাখায় রুদাকির বিচরণ ছিল অত্যন্ত সাবলীল। কাসিদা (স্বার্থপ্রণোদিত প্রশংসাগীতি), রুবায়ী (চতুষ্পদী কবিতা), মাসনভী (দ্বিপদী কবিতা), কেত্য়া (পদ্যাংশ) এবং গজল (প্রেমগীতি) লিখে তিনি স্বনামধন্য হন। ফারসি ভাষায় গজলকে তিনি ভিন্ন মাত্রা দান করেন। উনসুরীর মতো বিখ্যাত কবিও তাঁর গজলের প্রশংসায় বলেন,
غزل رودکی وار نیکو بود – غزلهاد من رودکی وار نیست
اگر چه بکوشم به باریک وهم – بدین پرده اندر مرا بار نیست১৬
অতি উন্নত ছিল রুদাকির গজলÑ আমার গজল রুদাকির মতো নয়।
যত চেষ্টা করি না কেন ভাবার্থের গভীরতা আনয়নের জন্যÑ তথাপি এ আবরণ আমার নিকট উন্মোচিত হবার নয়।
তবে কাসিদা রচনায় তাঁর কৃতিত্ব ছিল অতুলনীয় এবং সকল কবির অনুপ্রেরণার উৎস। তিনি দৃষ্টিহীন হলেও দিনের পর দিন স্বরচিত কবিতা জনসম্মুখে মুখস্থ আওরাতেন। গবেষকগণের মতে তাঁর কাসিদা, মাসনভী, খ-কবিতা, গীতিকবিতা ইত্যাদির সংখ্যা ছিল প্রায় ১৩ লক্ষের মতো। কবিতার এ সংখ্যা কল্পকথা মনে হলেও তিনি যে স্পেনীয় কবি লোপেদ্য ভেগার মতো কয়েক লক্ষ কবিতা রচনা করেছিলেন তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। কেননা, হিজরি ৬ষ্ঠ শতকের বিখ্যাত সাহিত্যগবেষক ও কবি রাশিদী সমরকন্দি যথার্থই বলেছেনÑ
گرسری یابد به عالم کس به نیکو شاعری – رودکی را بر سر آن شاعران زیبد سری
شعر او را بر شمردم سیزده ره صدهزار – هم فزون آید اگر چو نانکه باید بشمری১৭
কাব্যজগতের শ্রেষ্ঠত্বের আসনে যদি কেউ সমাসীন হয়ে থাকেন
রুদাকির নামটিই সর্বাগ্রে খুঁজে পাবেন।
তাঁর কবিতার সংখ্যা গণনা করেছি তেরবার শত হাজার
আপনি গণনা করলেও পাবেন এর চাইতে বেশি আবার।
সকল গবেষক ও জীবনীকার এর ব্যাখ্যায় বলেনÑ ‘শত হাজার ১৩ বার গুণেছি’ অর্থাৎ যার সংখ্যা দাঁড়ায় এক মিলিয়ন ও তিন শত হাজার বেইত। মুহাম্মাদ উফি বলেন, রুদাকির কবিতা শত খ-ে সংকলন হয়েছিল।১৮ হামদুল্লাহ মাসতুফীও তাঁর কবিতার সংখ্যা ৭ লক্ষ বলে উল্লেখ করেছেন।১৯ কবিতার এ সংখ্যা অকল্পনীয় মনে হলেও অসম্ভব নয়। কেননা, তাঁর কয়েকটি কাসিদা, মাসনভী ও কালিলা-দিমনা গ্রন্থের অনুবাদকৃত বেইতের সংখ্যাটি ছিল দশ হাজার। এছাড়াও তাঁর অসংখ্য কাসিদা, মাসনভী, গজল, কেতয়া ও অন্যান্য কবিতা তো ছিলই।
কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো বর্তমানে এই কবিতা সম্ভারের অতি অল্প সংখ্যক (মাত্র এক হাজার বেইত) অবশিষ্ট রয়েছে। বিশিষ্ট রুদাকি-গবেষক সাঈদ নাফিসি তাঁর সকল কবিতা সংগ্রহ করে তিন খ-ে সংকলন করে ‘আহভাল ওয়া আশয়ারে রুদাকি’ নামে ১৩১৯ ইরানী বর্ষে প্রকাশ করেন।২০
রাশিদী, নিযামী আরুযী, হামদুল্লাহ মাসতুফীর মতে হিজরি ৬ষ্ঠ শতক থেকে ৮ম শতকের ভেতর তাঁর এ কবিতাসম্ভার কালের অতলে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায়।২১
কাব্যশৈলী ও বৈশিষ্ট্য : প্রচলিত ও সহজ-সরল শব্দের ব্যবহার। বিষয় বিন্যাস, বাক্য সংযোজন, উপমা-উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্প ও প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলির সৌন্দর্য বর্ণনা, মানবস্বভাব-প্রকৃতি ও আবেগানুভূতি ফুটিয়ে তোলা এবং চিন্তা-দর্শনের সফল প্রয়োগে তাঁর কবিতা সুধী সমাজে সমাদৃত হয়। কবিতা রচনায় রুদাকি ‘সাক্কে খোরাসানী’ বা ‘খোরাসানী কাব্যশৈলী’র অনুসরণ করেছেন। তাঁর রচনাপদ্ধতিই খোরাসানী কাব্যশৈলীর সর্বোৎকৃষ্ট নমুনা হিসেবে গণ্য করা হয়। বলা হয়ে থাকে, তাঁর রচনাসম্ভার খোরাসানী কাব্যশৈলীর সমৃদ্ধকরণে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে।
রুদাকিই প্রথম আরবির অনুকরণে ফারসি সাহিত্যে قصیده কাসিদার (প্রশাস্তিমূলক কবিতা) প্রচলন করে কাসিদাকে বিভিন্ন অংশে বিভক্ত করে নতুন আঙ্গিক দান করেন। যেমন কাসিদার শুরুতেই مطلع (ঙঢ়বহরহম াবৎংব) বা প্রারম্ভিকা দিয়ে সূচনা করেন। এরপরে তাশবিব تشبیب আনেন যেখানে প্রকৃতি, বসন্ত, মিলন ও বিচ্ছেদ, আনন্দমুখরতা, যৌবনের গুণগান ও প্রেমিক-প্রেমিকার অবস্থা বর্ণনা করা হয়। এরপরে আসে مدیحه বা ঊপড়সরধংঃরপ াবৎংব যেখানে প্রশংসিত ব্যক্তির গুণ-মহানুভবতা, ন্যায়পরায়ণতা, সাহসিকতা, বীরত্বগাথা তুলে ধরা হয়। এরপরেই আসে নিজের প্রয়োজন বর্ণনা বা احسن طلب (জবয়ঁবংঃ, ঈষধরস), পরিশেষে নিজের ভণিতানাম ব্যবহারে মাধ্যমে শেষ করার পদ্ধতি مقطع বা (ঈষড়ংরহম াবৎংব) ব্যবহার হয়। এতদভিন্ন তিনি প্রেম ও প্রেয়সীর বন্দনায় গজল রচনার বিশেষ ধারার প্রবর্তন করেন যা পরবর্তীকালে শেখ সাদী ও হাফিজের রচনায় পরিদৃষ্ট হয়।
রুদাকির কবিতায় তাঁর নিজস্ব চিন্তা-চেতনাও ফুটে উঠেছে। তিনিই প্রথম ফারসি কবিতায় দার্শনিক অভিব্যক্তি তুলে ধরেন। যেমন তাঁর বিখ্যাত কাসিদা نونیه নূনিয়েতে প্রতিটি ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সফলতা কামনা করে বলেনÑ
گرتو فصیحی همه مناقب او گویی – ورتو دبیری همه مدایح او خوان
ورتو حکیمی و راه حکمت جویی – اینک سقراط وهم فلاطون یونان
ورتو فقیهی وه سوی سرع گرایی – شافعی اینک وبوحنیفه وسفیان২২
যদি হও বাগ্মী তুমি কাক্সিক্ষত পুরুষের কর গুণ বর্ণনা
যদি দাবির (সচিব) হতে চাও তুমি গাও আমীরের প্রশংসাগীতি,
যদি হতে চাও প্রজ্ঞাবান কাক্সিক্ষত জ্ঞানের পথিক
হও তার গ্রীক প-িত সক্রেটিস বা অ্যারিস্টটলের মতো,
আর যদি হও আইনবেত্তা ফকীহ্, শরীয়তের নীতিমালার পথে হাঁট
তবে অবশ্যই তুমি শাফেয়ী, আবু হানিফা এবং সুফিয়ানের মতো হও।
রুদাকির বাকি কবিতামালা পর্যালোচনা করলে তাঁর দর্শনের বিভিন্ন দিক আমরা দেখতে পাই। যেমন خردگرائی জধঃরড়হধঃরংস বা যুক্তিবাদ, علم گرائی ঝপরবহঃরংস বা প্রজ্ঞাবাদ, بی اعتنایی جهان وعشق لزت جوئی ঊঢ়বপঁৎবধহরংস ইন্দ্রিয় সুখানুভূতি বা ভোগবাদ, اندیشه سعادت চবষরপরঃড়ষড়মবব বা সুখবাদ।২৩
خردگرائی বা যুক্তিবাদ : রুদাকি ছিলেন যুক্তিবাদের প্রবজ্ঞা। আবেগের চেয়ে জীবনের সকল ক্ষেত্রে তিনি যুক্তিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তাঁর আচরিত সেই আদর্শ তাঁর কবিতার ছত্রে প্রতিফলিত হয়েছে। যেমন ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীতে ভঙ্গুর জীবনের চিরন্তন সত্যকে মেনে নিয়ে উপদেশ দিয়ে তিনি বলেনÑ
این جهان پاک خواب کردار است – آن شناسد که دلش بیدار است
نیکی او بجایگاه بدیست – شادی او بجای تیمارست২৪
এই পৃথিবী এক স্বপ্নলোক ভিন্ন কিছু নয়,
সেজন জানে তা হৃদয় যার সদা জাগ্রত রয়।
মন্দ লোকও হেথা কল্যাণকর্মে ব্রতী হবে
হতাশাগ্রস্তগণও সেথায় আনন্দে মেতে রবে।
রুদাকি ছিলেন ইন্দ্রিয় সুখানুভূতি বা ভোগবাদে বিশ্বাসী। ক্ষণস্থায়ী দুনিয়াত অযথা সময় ব্যয় না করে ইন্দ্রিয় সুখ ভোগে ব্যস্ত থাকার কথা বলেছেনÑ
شاد زی باسیاه جشمان شاد – که جهان نیست جزفسانه وبار
زآمد شادمان نباید بود – وزگزشته نکرد باید یاد২৫
সদানন্দে রত রও কালো চোখের হুরীদের সাথে সর্বক্ষণ
কেননা, কল্পলোকের এই দুনিয়া টিকবে না বেশিক্ষণ
ক্ষণিকের এই সুখানুভূতি থাকবে না চিরন্তন,
অযথা তাই অতীত গ্লানিকে খুঁজো না নিরন্তর।
তিনি নিজের প্রাপ্তিযোগে যেন কেউ অপরকে ভুলে না যায়, ক্ষণস্থায়ী সুখানুভূতিতে বঞ্চিতের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে যাতে কেউ পিছু না হটে সে শুভ কামনায় বলেনÑ
نیک بخت آن کسی که داد وبخورد – شوربخت آن که نخورد ونداد২৬
সৌভাগ্যবান সেই যে নিজের তৃপ্ত হলে অপরকেও সুযোগ দিল
হতভাগা সেজন যে নিজে ভোগ করল না অপরকেও দিল না।
রুদাকি নিজ ভাগ্য বিনির্মাণে প্রচেষ্টার মাধ্যমে বিশেষ গুণাবলি অর্জনের পক্ষপাতি। এক্ষেত্রে চারটি বিশেষ গুণকে সৌভাগ্যের আকড় মনে করে বলেনÑ
چهار چیز مرآ زاده رازغم بخرد – تن درست وخوئی نیک ونام نیک وفردا
هرآنکه ایزدش این چهار روزی کرد – سرد که شاید زید جاویدان وغم نخور-
মহান হতে হলে প্রত্যেকের চারটি গুণ থাকা অবশ্যক,
সুস্থ শরীর, সুস্থ চিন্তা, জ্ঞানান্বেষণ এবং খ্যাতির প্রত্যাশা,
এই চার গুণের অধিকারীর কোন চিন্তা নেই।
রুদাকির মতে মানুষ পৃথিবীতে খালি হাতে আসে আবার শূন্য হাতেই ফিরে যায়। তাই পার্থিব এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে সুস্থ সমাজ বিনির্মাণে নিজ দায়িত্ববোধের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখা এবং জনকল্যাণকর কার্যাবলি পরিচালনা করা একান্ত কাম্য।
তিনি বলেনÑ
مهتران جهان همه مردند – مرگ را سرفروهمی گردند
زیر خاک اندون شدند آنان – که همه گوشکها بر آورند
از هزارا هزار نعمت و ناز – نه به آخر به جزکفن مردند২৭
মৃত্যুস্বাদ চেখেছেন জগতের মহাপ্রাণ আছে যত
স্বাগত জানিয়েছে, মরণ তাঁদের হৃদয়ে দিয়ে বড় ক্ষত
মাটি হয়েছে আসল ঠিকানা মুছে রঙিন পরিচয়
নাজ-নেয়ামতের মহা সমুদ্রে তাঁরা, যদিও ডুবে রয়।
মরণে তাদের কাফন খ-ই পথের সঙ্গী হয়।
পরিশেষে বলা যায়, রুদাকি তাঁর সমসাময়িক কালের সকল কবি-সাহিত্যিকের নিকট যুগের শ্রেষ্ঠ কবি হিসাবে বিবেচিত হয়েছেন, পরবর্তীকালে ফারসি সাহিত্যের প্রথিতযশা কবিগণ, যেমন- দাকিকি, কাসায়ি, ফেরদৌসী, ফররুখি, উনসুরী রাশিদি সমরকন্দি, নেযামি আরুযি ও অন্য কবি-সাহিত্যিকগণ তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তাঁকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন এবং তাঁকে ‘কবিগুরু’, ‘কবিসম্রাট’ বিভিন্ন অভিধায় সম্বোধন করেন। ফারসি সাহিত্যের এই কৃতিমান পুরুষ সেময়ানীর বর্ণনায় ২২৯ হিজরিতে এ ধরাধাম ত্যাগ করেন এবং নিজ জন্মভূমি বানোজে সমাহিত হন।
*অধ্যাপক ফারসি ভাষা সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

তথ্যসূত্র
১. যাবিহুল্লাহ সাফা, তারিখে আদাবিয়াতে ইরান, পৃ. ১০০
২. মির্জা মাকবুল বেগ বাদাখশানী, তারিখে আদাবিয়াতে ইরান, পৃ. ৮১
৩. আল্লামা জালাল উদ্দিন হুমায়ী, তারিখে মোখতাছারে ইরান, পৃ. ৭৩
৪. জাফর শায়ার, হাসান আবভারী, খোযিদে আশয়ারে রুদাকি, পৃ. ৭৩
৫. আল্লামা জালাল উদ্দিন হুমায়ী, তারিখে মোখতাসার ইরান, পৃ. ৭৩
৬. হাসান আনুশে, দানেশনামে আদাবে ফারসি, ১ম ও ২য় খ-; ওযারাতে ফারহাঙ্গ ও এরশাদে ইসলামী, তেহরান, পৃ. ৪৬
৭. প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৬১
৮. ড. খলিল খাতিব রাহবার, ‘রুদাকি’, সফি আলী শাহ প্রকাশনী, তেহরান, পৃ. ৫
৯. হরেন্দ্র চন্দ্রপাল, পারস্য সাহিত্যের ইতিহাস
১০. আব্দুস সাত্তার, ফারসি সাহিত্যের কালক্রম, পৃ. ৬
১১. আবুল আলা আল মাআরবি, আওয়ামিলুশ্ শাওয়ামিল, কায়রো প্রকাশনী, ১৯৫১, পৃ. ৮০
১২. মোঃ উফি, লোবালুল আলবাব, ২য় খ-, পৃ. ৬
১৩. প্রাগুক্ত
১৪. আহভাল ও আসারে রুদাকি, ২য় খ-, পৃ. ৫৫৪
১৫. মিরজায়েফ, আঃ গনি, আবু আব্দুল্লাহ রুদাকি, তাজিকিস্তান, ১৯৫৮, পৃ. ২২২
১৬. ড. জাফর শোয়ার, ড. হাসান আনভারী, গোযিদেহ আশাআ’রে রুদাকি, আমির কাবির, তেহরান, ১৩৮৭, পৃ. ২০৬
১৭. লোবাবুল আলবাব, ২য় খ-, পৃ. ৭
১৮. লোবাবুল আলবাব, ২য় খ-, পৃ. ৭
১৯. সাঈদ নাফিসি, আহভাল ওয়া আশয়ারে রুদাকি, ২য় খ-, পৃ. ৫৭৪
২০. প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৭৪, মিটায়েভ, পৃ. ২৩০
২১. প্রাগুক্ত ও যাবিহুল্লাহ সাফা, তারিখে আদাবিয়াতে ইরান, ১ম খ-, পৃ. ৩৭৮
২২. আহভাল ও আসারে রুদাকি, ১৫ পাঠ, ২১-২৩ নং পঙ্ক্তি
২৩. ড. জাফর শায়ার, ড. হাসান আনওয়ারী, গোযিদেহ আ’শয়ারে রুদাকি, আমীর কাবির প্রকাশনী, তেহরান, ১৩৮৭, ইরানী সাল, পৃ. ২৬
২৪. বাহাউদ্দিন খুররমশাহী, দারদে জাভেদানেসী, ১৫ অধ্যায়, পঙ্ক্তি নং ২৫, ২৮
২৫. ড. জাফর শোয়ার, ড. হাসান আনভারী, গোযিদেহ আশাআ’রে রুদাকি, আমীর কাবির, তেহরান, ১৩৮৭, পৃ. ২৮
২৬. প্রাগুক্ত, পৃ. ২৮
২৭. প্রাগুক্ত, পৃ. ২৮

বিশেষ নিবন্ধ (ইরানী নারী রেইহানার মৃত্যুদণ্ড এবং বাস্তবতা)

সিরাজুল ইসলাম
ইরানের রেইহানা জাব্বারি নামে এক মহিলার মৃত্যুদণ্ড নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে সারা বিশ্বে ব্যাপক অপপ্রচার চলছে; এর বাইরে নেই বাংলাদেশও। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে ঝড় উঠেছে ওই নারীর পক্ষে, তবে নিতান্তই অসত্যের পক্ষে। বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য লেখাটি লিখলাম। যাঁরা সত্য অনুসন্ধান করতে চান আশা করি তাঁরা সত্যের সন্ধান পাবেন।
প্রথমেই বলে নিই- বাংলাদেশের বেশিরভাগ গণমাধ্যমের সীমাবদ্ধতা হলো বিদেশী খবর যাচাই বাছাই করার সুযোগ নেই। সে কারণে পশ্চিমা গণমাধ্যম বিশেষ করে এএফপি, রয়টার্স, এপি, ভোয়া বা বিবিসি যা দেয় তাই যেন চোখ বন্ধ করে গিলতে হয়।
পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোতে বলা হচ্ছে রেইহানাকে অন্যায়ভাবে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। আরো বলা হচ্ছে, ধর্ষণ থেকে আত্মরক্ষা করতে গিয়ে মহিলাটি ওই লোকটিকে খুন করেছেন। অর্থাৎ নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে, ধর্ষণ প্রতিরোধ করতে গিয়ে খুনের ঘটনাটি ঘটেছে। তারপরও তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে! তার মানে হচ্ছে নারীর এই প্রতিরোধকে স্বীকার করা হলো না, নারীর অধিকারকে স্বীকার করা হলো না। কেউ কেউ বলছেন, এই বিচারের মাধ্যমে ধর্ষণকে উৎসাহ দেয়া হলো।
অথচ প্রকৃত ব্যাপার হলো রেইহানা ধর্ষণ প্রতিরোধ করতে গিয়ে খুন করেন নি। ঘটনাটিকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। ইরানের বিচার বিভাগ আদৌ নারীবিদ্বেষী নয় যে, অন্যায়ভাবে একজন নারীকে ফাঁসি দেবে। হত্যাকাণ্ডটি ওই মহিলা উক্ত খুনের কথা স্বীকার করেছেন আদালতে পূর্বপরিকল্পিত ছিল। আর সার্বিক তদন্তের সাপেক্ষে রেইহানা নিজেকে নির্দোষ প্রমাণেও ব্যর্থ হয়েছেন।
ঘটনাটি হচ্ছে, দু’জনের অবৈধ সম্পর্কের জের ধরে এক পর্যায়ে তাঁদের মধ্যে টানাপড়েন সৃষ্টি হয় এবং এই খুনের ঘটনা ঘটে। সে ক্ষেত্রে পুরুষ লোকটি যে ভালো মানুষ ছিলেন তা বলার সুযোগ নেই। টানাপড়েনের এক পর্যায়ে বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে যার কারণে রেইহানা লোকটিকে খুনের সিদ্ধান্ত নেন। খুনের দুই দিন আগে রেইহানা নতুন ছুরি কিনেছিলেন এবং তাঁর এক বান্ধবীকে এসএমএস করেছিলেন যে, খুনের ঘটনাটি ঘটতে যাচ্ছে। এখানে একটি কথা মনে রাখা দরকার, তা হলো- এই মহিলার সঙ্গে ইরানের আদালতের এমন কোনো ঘটনা ঘটে নি যে, তাঁকে ফাঁসি দিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় দিয়ে দেবে। অথবা এই মহিলা ইরানের জন্য কোনো হুমকি ছিলেন সে কারণে তাঁর ফাঁসি কার্যকর করা হলো। বরং যদি এমন হতো যে, খুন হয় নি বরং অবৈধ সম্পর্ক বা ধর্ষণের ঘটনার বিচার হচ্ছে তাহলে ওই পুরুষ লোকটিও মৃত্যুদণ্ডের মুখে পড়তেন। আর এ ক্ষেত্রেও ইরানের আইন অনুসরণ করা হতো- দেখা হতো না কে পুরুষ আর কে নারী; যেমনটি দেখা হয় নি রেইহানার ক্ষেত্রে।
৭ বছর আগের ঘটনা এটি; এমন নয় যে, তাড়াহুড়ো করে একজন নারীকে ফাঁসি দিয়ে আদালত একটি বিরাট কিছু করে ফেলছে। বাস্তবতা হচ্ছে- এটা নিতান্তই পশ্চিমা গণমাধ্যম ও কথিত মানবাধিকার কর্মীদের প্রচারণা। আমি তো ইরানে থাকি, এখানকার নারীরা যে কতটা স্বাধীনতা ভোগ করেন তা বেশ কাছ থেকে দেখার সুযোগ হচ্ছে… এবং ইরানের সমাজে নারীর যে কত মূল্যায়ন তা অনেকের জানা নেই এবং জানলেও তা প্রকাশ করবেন না; বরং বলার চেষ্টা করবেন ইসলামী সরকার এতটা বর্বর এবং এ কারণে একজন নারীকে ফাঁসি দিল ইত্যাদি ইত্যাদি। কল্পনা করা যাক- যদি ঘটনাটা পুরুষের বেলায় ঘটত তাহলে কি পুরুষ লোকটি বেঁচে যেতেন ফাঁসির হাত থেকে। নিশ্চয় নয়। ইরানের আইনের মূল ভিত্তি হচ্ছে ইসলামী বিধান। যে অন্যায় ঘটেছে তার জন্য নারী-পুরুষ মুখ্য বিষয় নয়; মুখ্য বিষয় হচ্ছে আইন এবং তার বাস্তব প্রয়োগ। ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর বহু খুনের ঘটনার বিচার হয়েছে এবং মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে দোষীদেরকে; সেখানে নারী-পুরুষ কখনো বিবেচ্য বিষয় হয়ে ওঠে নি; বিচার হয়েছে অপরাধের।
২০০৭ সালে সংঘটিত হয় আলোচ্য হত্যাকাণ্ডটি। ঘটনাটি সাত বছর ধরে পুঙ্খানুপঙ্খ বিচার বিশ্লেষণ করে তারপর ইরানের আদালত রায় দিয়েছে। এ নিয়ে উচ্চ আদালতে পরে আবার বিচার হয়েছে এবং উচ্চ আদালত রায় বহাল রাখে। তারপরও এক মাস দেরী করা হয়েছে যে, ভিক্টিম পরিবার যদি মাফ করে দেয় তাহলে ফাঁসিটি কার্যকর করা হবে না। কিন্তু ওই পরিবার মাফ করে নি। ইরানের বিচার ব্যবস্থায় খুনের ঘটনায় কারো মৃত্যুদণ্ড হলে ভিক্টিম পরিবার ছাড়া কারো পক্ষে সে রায় পরিবর্তনের সুযোগ নেই, এমনকি প্রেসিডেন্ট বা সর্বোচ্চ নেতাও পারেন না। এটা ইসলামের বিধান- তা কারো ভালো লাগুক আর না লাগুক। মনে রাখতে হবে, ইরান সম্পূর্ণ স্বাধীন-সার্বভৌম ইসলামী বিপ্লবের দেশ। ইসলামী আইন হচ্ছে এখানকার বিচার ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। কারো কথায় তার বিচারবিভাগ প্রভাবিত হবে না; কারো কথায় আদালতের রায় পাল্টায়ও না।
যাই হোক, নারীবাদী অ্যাঙ্গেল থেকে জাব্বারির মৃত্যুদণ্ডের ঘটনাটি দেখলে সত্য এড়িয়ে যাওয়া হবে। ইরানে নারীবাদ বা পুরুষবাদ বলে কিছু নেই। পরিশেষে বলব, সবারই তো, বিশেষ করে সংবাদকর্মীদের জানা থাকার কথা যে, পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো কেমন করে খবর বিকৃত করে এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তা ব্যবহার করে! আর মানবাধিকার যেন তাদের একান্ত নিজস্ব; এটি তারা ছাড়া রক্ষা করার আর কেউ নেই! ইরাক-আফগানিস্তানে লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে এরা, কিন্তু ভাবখানা এমন যে, তা কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় পড়বে না… ইরানে এক নারীকে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে সেটা বিরাট বড় ঘটনা! মানবাধিকার ইস্যুকে তারা এভাবেই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে যাচ্ছে যুগের পর যুগ।

লেখক : সাংবাদিক, রেডিও তেহরান

সংবাদ বিচিত্রা (বিদেশী সংবাদ)

খাঁটি ইসলাম ঠেকাতে ভীতি ছড়ানো হচ্ছে : সর্বোচ্চ নেতা
ইসলামভীতি ছড়ানোর ষড়যন্ত্রের বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী। গত ১৭ নভেম্বর তেহরানে ইমাম আলী (আ.) মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে পদক বিতরণী অনুষ্ঠানে তিনি এ আহ্বান জানান।
সর্বোচ্চ নেতা বলেন, খাঁটি ইসলামের বার্তা যাতে বিশ্ববাসীর কানে পৌঁছতে না পারে সে লক্ষ্যে বলদর্পী শক্তিগুলো শিল্প, রাজনীতি ও সামরিক উপায়সহ সব ধরনের পন্থা অবলম্বন করছে। কিন্তু এরপরও খাঁটি ইসলামের বার্তা পৌঁছে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে একটি প্রমাণ হলো আধিপত্যবাদী শক্তিগুলোর মধ্যে আতঙ্ক ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
তিনি বলেন, শত্রুরা ইসলামভীতি ছড়িয়ে দেয়ার জন্য বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী তৈরি করছে যারা আল্লাহর নামে বেসামরিক লোকদের ওপর গণহত্যা চালাচ্ছে। সর্বোচ্চ নেতা বলেন, সাম্রাজ্যবাদীরা এখন ইসলামের শক্তির বিষয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এ কারণে তারা বিশ্বব্যাপী ইসলামভীতি ছড়িয়ে দেয়ার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে।
তিনি আরো বলেন, ইসলাম ধর্ম মানবজাতির মর্যাদা, কল্যাণ ও শান্তির কথা বলে। ইসলামের এ প্রকৃত বার্তা যাতে অন্য জাতির কাছে পৌঁছতে না পারে সেজন্যই শত্রুরা নানা ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে।
তাকফিরি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএসআইএল যখন ইসলামের নামে ইরাক ও সিরিয়ায় নানা অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে ঠিক তখনি এসব মন্তব্য করলেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা। আমেরিকা ও তার মিত্র দেশগুলোই ইসলাম ধর্মের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন করতে আইএসআইএল-এর মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সৃষ্টি করেছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।

চাপের কাছে ইরান নতি স্বীকার করবে না : রুহানি
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি বলেন, তাঁর দেশের জনগণ নিষেধাজ্ঞা ও কোনো চাপের কাছে নতি স্বীকার করবে না। এছাড়া, যেকোনো চুক্তিই হোক না কেন ইরান তার পরমাণু স্থাপনা চালু রাখবে।
ইরান ও ছয় জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে পরমাণু আলোচনার মেয়াদ আরো সাত মাসের জন্য বাড়ানোর পর গত ২৫ নভেম্বর এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। প্রেসিডেন্ট রুহানির ওই সাক্ষাৎকার ইরানী টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
ড. রুহানি বলেন, আলোচনার বিপরীত পক্ষ এটা বুঝে গেছে যে, চাপ ও নিষেধাজ্ঞা কোনো ফল বয়ে আনবে না। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ইরান কখনো তার পরমাণু অধিকার ছাড়বে না। এছাড়া, দেশের পরমাণু স্থাপনাগুলো অবশ্যই চালু থাকবে এবং ইরান কখনো তার সেন্ট্রিফিউজও বন্ধ করবে না।
প্রেসিডেন্ট রুহানি বলেন, ইরান দু’টি প্রধান লক্ষ্যকে সামনে রেখে আলোচনা করছে আর তা হলো পরমাণু কর্মসূচি অব্যাহত রাখা এবং ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার। এ প্রেক্ষাপটে তিনি বলেন, এমুহূর্তে বিশ্বের কারো কোনো সন্দেহ নেই যে, ইরানের কাছে অবশ্যই পরমাণু প্রযুক্তি রয়েছে এবং ইরানের অভ্যন্তরেই ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ করা হচ্ছে। এর পাশাপাশি ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে হবে এ নিয়েও কারো কোনো সন্দেহ নেই। তিনি আশা করেন, পরমাণু ইস্যুতে ইরানের জনগণই চূড়ান্তভাবে বিজয়ী হবে।
চূড়ান্ত চুক্তিতে পৌঁছানোর লক্ষ্যে সব পক্ষ আলোচনা চালানোর বিষয়ে একমত হয়েছে উল্লেখ করে ড. রুহানি বলেন, আলোচনার পথ ধরেই একটি চূড়ান্ত ও পূর্ণাঙ্গ চুক্তি সই হবে। ইরানের প্রেসিডেন্ট বলেন, দু’পক্ষই আলোচনাকে এগিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করেছে এবং পরিস্থিতি তিন বা ছয় মাস আগের মতো নেই। যুক্তিগুলো কাছাকাছি এসে গেছে এবং মতপার্থক্যও সম্ভবত কমে আসছে। দু’পক্ষ সমঝোতা ও চুক্তির জন্য পদক্ষেপ নিয়েছিল, কিন্তু একটি লিখিত ও চূড়ান্ত চুক্তিতে পৌঁছার জন্য সময়ের প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন প্রেসিডেন্ট রুহানি।

মার্কিন সরকারের ওপর আস্থা রাখা যায় না : আহমাদ খাতামি
গত ৭ নভেম্বর তেহরানের জুমআর নামাযের খুতবায় ইরানের বিশিষ্ট আলেম সাইয়্যেদ আহমাদ খাতামি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বক্তব্যের জবাবে বলেন, পরমাণু বিষয়ে ছয় জাতিগোষ্ঠীর সাথে ইরানের আলোচনা প্রমাণ করে মার্কিন সরকারের ওপর কোনোরকম আস্থা রাখা যায় না। সম্প্রতি বারাক ওবামা বলেছিলেন, অবরোধের কারণেই নাকি ইরান আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য হয়েছে। তিনি বলেন, পরমাণু সমস্যার সমাধান হলেও আমেরিকার সাথে ইরানের মতপার্থক্যের অবসান হবে না। বিশ্ববাসী ইহুদিবাদী ইসরাইলের প্রতি মার্কিন সমর্থনের কথা, আইএসআইএল সৃষ্টির কথা এবং সিরিয়ায় সন্ত্রাসীদের অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করার কথা কখনোই ভুলবে না বলেও মন্তব্য করেন এই বিশিষ্ট আলেম।
আয়াতুল্লাহ খাতামি মাসজিদুল আকসায় ইসরাইলি হামলার ঘটনায় এ অঞ্চলের কোনো কোনো দেশের নীরবতার নিন্দা জানান। তিনি ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর মন্তব্য উদ্ধৃত করে বলেন, ইহুদিবাদী ইসরাইলের অপরাধী কর্মকাণ্ড মোকাবেলার একমাত্র উপায় হলো মধ্যপ্রাচ্যের এই ক্যান্সারকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে ফেলা।
সৌদি আরবের পূর্বাঞ্চলীয় শহর আলআহসায় মুহররমের শোক মিছিলে হামলার নিন্দা করে জনাব খাতামি বলেন, এই হামলার ঘটনা সেই ওয়াহাবি মতাদর্শে বিশ্বাসীদের কাজ যারা মানুষ হত্যা করে আর সন্ত্রাসীদের লালন করে। বাহরাইনেও মুহররমের শোক পালনকারীদের ওপর হামলার কথা উল্লেখ করে জনাব খাতামি বলেন, বাহরাইনে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য শোক পালনের রীতি অনেক পুরোনো। আলে খলিফা সরকারের কর্মকর্তাদের প্রতি ইয়েমেনের ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বাহরাইনের মুসলিম জনতার ওপর চাপ প্রয়োগের ঘটনা অব্যাহত রাখলে তাদের পতন ত্বরান্বিত হবে।

সমস্ত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আহ্বান জানালেন ইরানের সংসদ সদস্যরা
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ওপর থেকে সমস্ত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার আহ্বান জানিয়েছেন দেশটির সংসদ সদস্যরা। ইরানী সংসদের বেশিরভাগ সদস্য এক বিবৃতিতে বলেন, ইরান ও ছয় জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে পূর্ণাঙ্গ চুক্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তেহরানের ওপর থেকে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে হবে।
গত ৯ নভেম্বর প্রকাশিত এ বিবৃতিতে ২০০ এর বেশি সংসদ সদস্য ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের ওপর কোনো ধরনের বাধা এবং জ্বালানি চক্র সম্পর্কিত কোনো সীমাবদ্ধতা না মানতে ইরানী পরমাণু আলোচকদের প্রতি আহ্বান জানান। ইরানের পরমাণু স্থাপনা পরিদর্শনের জন্য আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা এবং পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চুক্তিতে যে রক্ষাকবচ ঘোষণা করা হয়েছে তার বাইরে কোনো ধরনের পরিদর্শনের বিষয়ে রাজি না হতে ইরানী আলোচকদের প্রতি আহ্বান জানান সংসদ সদস্যরা।
তাঁরা জোর দিয়ে বলেন, তেহরান গবেষণা চুল্লির জন্য আরাক ও ফোরদো স্থাপনার পরমাণু কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে; এ নিয়ে কোনো বিধিনিষেধ মানা যাবে না।

‘শান্তিপূর্ণ লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়নি ইরানের পরমাণু কর্মসূচি’- আইএইএ
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পরমাণু কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়নি বলে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা বা আইএইএ’র সর্বশেষ প্রতিবেদনে স্বীকার করা হয়েছে। আইএইএতে নিযুক্ত ইরানের রাষ্ট্রদূত রেযা নাজাফি গত ৮ নভেম্বর এ তথ্য জানান।
তিনি আরো বলেন, নাতাঞ্জ, ফোরদো, আরাক, ইসফাহান, তেহরান ও বুশেহরসহ ইরানের সব পরমাণু কেন্দ্রের কার্যক্রম শান্তিপূর্ণ লক্ষ্যে পরিচালিত হচ্ছে বলে স্বীকার করেছে আইএইএ। সংস্থাটির প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ছয় জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে স্বাক্ষরিত অন্তবর্তীকালীন পরমাণু চুক্তির ভিত্তিতে সব পদক্ষেপ নিয়েছে ইরান। নাজাফি আরো বলেন, আইএইএ’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ইরানের পরমাণু কর্মসূচির গোপন কোনো লক্ষ্য নেই।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ২০ নভেম্বরে ছয় জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে অন্তর্বর্তী পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষর করে ইরান। এ অন্তর্বর্তী পরমাণু চুক্তির বর্ধিত মেয়াদ ২৪ নভেম্বর শেষ হয়। বর্তমানে একটি চূড়ান্ত পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষর করতে দু’পক্ষই চেষ্টা চালিয়ে আসছে।

পরমাণু চুক্তি ইস্যুতে ইরানের ভূমিকার প্রশংসা করলেন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী
ছয় জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে পরমাণু চুক্তিতে পৌঁছতে ইরানের আন্তরিকতার প্রশংসা করেছেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। গত ১৭ নভেম্বর ইরানী পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাওয়াদ জারিফের সঙ্গে টেলিফোন সংলাপে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ মন্তব্য করেন। পরমাণু আলোচনায় ইরান ও ছয় জাতিগোষ্ঠী মিলে একটি আশাব্যঞ্জক ফলাফল বের করে আনতে সক্ষম হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ  করেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাওয়াদ জারিফ চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে পরমাণু চুক্তির বিষয়ে ইরানের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন এবং চীনের সহযোগিতামূলক ভূমিকার প্রশংসা করেন।

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান ফিলিস্তিনীদের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছে
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সরকার ফিলিস্তিনী জনগণের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছে। গত ২৯ নভেম্বর ফিলিস্তিনীদের সাথে বৈশ্বিক সংহতি দিবস উপলক্ষে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে ইরান সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুনরায় জোর দিয়ে বলে যে, ইসলামী প্রজাতান্ত্রিক সরকার ফিলিস্তিনী জাতির প্রতি স্বীয় সমর্থন অব্যাহত রাখবে।
ইরানী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উক্ত বিবৃতিতে বলা হয়, ২৯ নভেম্বর হচ্ছে এমন একটি দিন প্রতি বছর যে দিনটিতে সারা বিশ্ব নির্যাতিত ফিলিস্তিনী জাতির প্রতি সংহতি পুনর্ব্যক্ত করে থাকে। যায়নবাদী সরকার কর্তৃক ফিলিস্তিনে জবর দখল প্রতিষ্ঠা এবং এ পবিত্র ভূখণ্ডের অধিবাসীদের বিরুদ্ধে অমানবিক ও পৈশাচিক অপরাধ সংঘটন অব্যাহত রাখার বিষয়টি বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘস্থায়ী সঙ্কট সৃষ্টি ও অব্যাহত রাখার জন্য দায়ী বলে এ বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
উক্ত বিবৃতিতে বলা হয়, ফিলিস্তিন সঙ্কট হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের বুকে ও ইসলামী জাহানে আরো বহু সমস্যা ও সঙ্কটের মূল। তেমনি এটি বৈশ্বিক অঙ্গনে অশান্তি ও নিরাপত্তাহীনতারও উৎস।
ইরানী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার এ বিবৃতিতে ফিলিস্তিনী জনগণের মানবিক ও স্বাধীনতাকামী লক্ষ্যসমূহের প্রতি স্বীয় সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে এবং ইসরাঈলী দখলদারীর বিরুদ্ধে তাদের দৃঢ় প্রতিরোধের প্রশংসা করে।
এছাড়াও এ বিবৃৃতিতে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সরকারের পক্ষ হতে দীর্ঘস্থায়ী ফিলিস্তিনী সঙ্কটের প্রতি দৃষ্টি দেয়ার এবং সেখানে দখলদারীর অবসান ঘটানোর জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
উক্ত বিবৃতিতে বলা হয়, ফিলিস্তিনী ভূখণ্ডের ওপর থেকে যায়নবাদী সরকারের অবৈধ দখলের এবং সেখানকার অধিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অনস্বীকার্য অধিকার লঙ্ঘনের অবসান ঘটানো ও স্বীয় ভিটামাটি থেকে উৎখাতকৃত ফিলিস্তিনীদেরকে স্বীয় ভূখণ্ডে প্রত্যাবর্তনের অধিকার প্রত্যর্পণই হচ্ছে উক্ত সঙ্কটের একমাত্র সমাধান।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সরকার উক্ত বিবৃতিতে অবিলম্বে গাযার নির্মম অবরোধের নিঃশর্ত অবসানে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য মুসলিম সংখ্যাগুরু দেশসমূহের প্রতি পুনরায় আহ্বান জানায়।

সৌদি আরবসহ সব প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করতে চায় ইরান
সৌদি আরবসহ প্রতিবেশী সব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করা ইরানের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। একথা জানিয়েছেন  সৌদি আরবে নিযুক্ত ইরানের রাষ্ট্রদূত হোসেইন সাদেকি। গত ২৮ নভেম্বর সৌদি আরবের রিয়াদ প্রদেশের আমির প্রিন্স তুর্কি বিন আবদুল্লাহ আলে সৌদের সঙ্গে এক সাক্ষাতে তিনি একথা জানান।
সাদেকি বলেন, সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য দু’দেশকেই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তেহরান ও রিয়াদের মধ্যে দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য তিনি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রসহ সব খাতে বিদ্যমান সুযোগগুলোকে কাজে লাগানোর আহ্বান জানান।
সাক্ষাতে প্রিন্স তুর্কি বিন আবদুল্লাহ বলেন, তাঁর দেশও ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সঙ্গে সুসম্পর্ক চায়। তেহরান ও রিয়াদের মধ্যে সম্পর্ক শক্তিশালী হলে মধ্যপ্রাচ্যসহ গোটা মুসলিম বিশ্বের জনগণ উপকৃত হবে বলে তিনি জানান। চলতি বছরের গোড়ার দিকে ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি বলেছিলেন, আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে শক্তিশালী সম্পর্ক জরুরি।

আইএসএইএল’র সমর্থকদের খুঁজে বের করুন : জাতিসংঘকে ইরান
গত ১ ডিসেম্বর মধ্যপ্রাচ্যে তৎপর তাকফিরি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএসএইএল’র সমর্থক কারা তা খুঁজে বের করতে জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতার পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আলী আকবর বেলায়েতি।
ইরাকে নিযুক্ত জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি নিকোলা ম্লাদেনভের সঙ্গে তেহরানে এক বৈঠকে তিনি বলেন, ইরাকের ঘটনাবলি নিয়ে বিশ্বসংস্থাকে সঠিকভাবে কাজ করতে হবে। ড. বেলায়েতি বলেন, আইএসআইএল’র মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে কারা সমর্থন করছে তা খুঁজে বের করা জাতিসংঘের দায়িত্ব; কারণ, এ গোষ্ঠীকে বাইরে থেকে যদি সমর্থন না দেয়া হতো তাহলে ইরাকের সেনা ও জনগণই তাদেরকে পরাজিত করতে সক্ষম হতো।
তিনি বলেন, আঞ্চলিক ও পশ্চিমা কিছু দেশ আইএসআইএল-সহ আরো কিছু সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে তৈরি করেছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, আইএসআইএল’র বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জাতিসংঘকে আন্তরিক ভূমিকা পালন করতে হবে।
ইরানের এ শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা বলেন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আইএসআইএলসহ তাকফিরি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যোগ দিতে ইরান প্রস্তুত রয়েছে। একইসঙ্গে তিনি বলেন, ইরাকের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কারোরই হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়।

কোমে ‘তাকফিরি চিন্তাধারার বিপদ’ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত
গত ২৩ ও ২৪ নভেম্বর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ধর্মীয় নগরী কোমে ‘মুসলিম চিন্তাবিদদের দৃষ্টিতে তাকফিরি চিন্তাধারার বিপদ’ শীর্ষক দুই দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। গত ২৩ নভেম্বর ইরানের প্রখ্যাত আলেম আয়াতুল্লাহ মাকারেম শিরাজির বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এ সম্মেলন শুরু হয়।
ইরাক ও সিরিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তৎপর উগ্র তাকফিরি জঙ্গিদের স্বরূপ উন্মোচন এবং তাদের ইসলাম ও মানবতাবিরোধী অপরাধযজ্ঞ সম্পর্কে মুসলিম বিশ্বকে সচেতন করার লক্ষ্যে ইরানের উদ্যোগে এ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সম্মেলনে বিশ্বের ৮৩টি দেশ থেকে ৩১৮ জন মুসলিম চিন্তাবিদ, আলেম ও রাজনীতিবিদ অংশগ্রহণ করেন।

‘সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধে আমেরিকার সঙ্গে ইরানের দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য রয়েছে’
মধ্যপ্রাচ্যের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান।
আরব ও আফ্রিকা বিষয়ক ইরানের উপ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ান তেহরানে জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র তিসুকাসা উইমুরার সঙ্গে গত ২ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে ওই আহ্বান জানান।
আবদুল্লাহিয়ান বলেন, সিরিয়া সংকট ও সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধের বিষয়ে আমেরিকা ও তার মিত্রদের নীতির সঙ্গে ইরানের দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য রয়েছে। তিনি বলেন, সিরিয়া সংকট নিরসনে সহায়তার জন্য ইরানের দরজা সবসময় খোলা রয়েছে। তবে সিরিয়া সংকট নিরসনে দেশটির বর্তমান বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিতে হবে। বৈঠকে ইরাক ইস্যু নিয়েও দুই কর্মকর্তা আলোচনা করেন।
তিসুকাসা উইমুরা ইরাক সম্পর্কে বলেন, ইরাকের কেন্দ্রীয় সরকার ও দেশটির সশস্ত্র বাহিনীকে শক্তিশালী করার জন্য কাজ করতে হবে। তিনি জানান, সিরিয়ায় মানবিক ত্রাণ সহায়তা পাঠাতে জাপান সরকার প্রস্তুত রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান অস্থিতিশীলতা বিশ্ব সম্প্রদায়ের জন্য হুমকি সৃষ্টি করেছে বলেও উল্লেখ করেন জাপানের এ কর্মকর্তা।

আইআরআইবি’র প্রধান হলেন ড. মোহাম্মাদ সারাফরাজ
বিশ্ব কার্যক্রমের প্রধান ড. মোহাম্মাদ সারাফরাজকে ইরানের জাতীয় সম্প্রচার সংস্থা- আইআরআইবি’র প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী। গত ৮ নভেম্বর এক ডিক্রি জারি করে তিনি এ নিয়োগ দেন। গত ১০ বছর আইআরআইবি’র প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন ইজ্জাতুল্লাহ জারগামি।
আইআরআইবি’র প্রধানের দায়িত্ব পাওয়ার আগে মোহাম্মাদ সারাফরাজ গত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে এ সংস্থার বিশ্ব কার্যক্রমের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। রেডিও তেহরানের বাংলা বিভাগসহ প্রায় ৪০টি ভাষায় রেডিও অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয় এই বিশ্ব কার্যক্রম থেকে।
এ ছাড়া, ইংরেজি ভাষার নিউজ চ্যানেল প্রেস টিভি, আরবি ভাষার নিউজ চ্যানেল আল-আলম এবং স্প্যানিশ ভাষার টিভি চ্যানেল হিস্পান টিভি চালু হয় ড. সারাফরাজেরই তত্ত্বাবধানে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাড়া ফেলে দেয়া এই তিন টিভি চ্যানেলকে তাঁর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য হিসেবে দেখা হয়। পাশ্চাত্যের প্রথম সারির নিউজ চ্যানেলগুলোতে সাধারণত সাম্রাজ্যবাদবিরোধী খবর গুরুত্ব পায় না। কিন্তু আরবি, ইংরেজি ও স্প্যানিশ ভাষার ইরানী তিনটি চ্যানেল পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর সেই একচ্ছত্র আধিপত্যের সামনে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।
ড. সারাফরাজের তত্ত্বাবধানে আইআরআইবি’র ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের আরেকটি উল্লেখযোগ্য অর্জন হচ্ছে ‘আইফিল্ম’ চ্যানেল। এ চ্যানেল থেকে ফারসি ভাষার পাশাপাশি ইংরেজি ও আরবি ভাষায় ইরানী সিনেমা ও বিখ্যাত টিভি সিরিয়াল প্রচারিত হয়।

বাংলাদেশের সঙ্গে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক জোরদার করতে চায় ইরান : জান্নাতি
ইরানের ইসলামী দিকনির্দেশনা ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আলী জান্নাতি বলেছেন, বিরোধ মিটিয়ে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠায় গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। গত ৩ ডিসেম্বর তেহরানে বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে বৈঠকে তিনি এ কথা বলেন।
ইরানী মন্ত্রী আরো বলেন, উগ্র গোষ্ঠীগুলোর অপরাধযজ্ঞ ফাঁস করার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
ইরানী সংস্কৃতিমন্ত্রী আরো বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সিনেমা, থিয়েটার, মিউজিক, ভাস্কর্য শিল্প, সাহিত্য, বই এবং গণমাধ্যমসহ সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্পর্ক জোরদার করতে প্রস্তুত রয়েছে ইরান।
এ সময় বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর মোকাবেলায় অভিন্ন অবস্থান গ্রহণের ওপর জোর দিয়ে বলেন, বাংলাদেশ সরকার বিশ্বাস করে এসব গোষ্ঠী ইসলাম ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করে না। কারণ, ইসলাম কখনোই নিরস্ত্র ও নিরপরাধ মানুষ  হত্যাকে সমর্থন করে না; বরং এটাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করা জরুরি বলেও তিনি জানান।
উল্লেখ্য, ইরানের রাজধানী তেহরানে গত ২-৪ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি)-র তথ্যমন্ত্রীদের সম্মেলনে বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু অংশ নেন।

ঘনিষ্ঠ মিডিয়া সহযোগিতার আহ্বান জানালেন ওআইসি’র তথ্যমন্ত্রীরা
গত ৩ ডিসেম্বর ঘনিষ্ঠ মিডিয়া সহযোগিতার আহ্বান জানানোর মধ্য দিয়ে তেহরানে ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা-ওআইসির তথ্যমন্ত্রীদের তিনদিনব্যাপী সম্মেলন শেষ হয়। বিশ্বব্যাপী ইসলামের সঠিক ভাবমর্যাদা তুলে ধরার লক্ষ্যে ওআইসি’র সদস্য দেশগুলোর মধ্যে এ সহযোগিতা প্রতিষ্ঠিত হবে।
ওআইসি’র তথ্যমন্ত্রীদের সংগঠন আইসিআইএম-এর ১০ম সম্মেলন গত ১ ডিসেম্বর তেহরানে শুরু হয়। বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন।
ওআইসি’র তথ্যমন্ত্রীরা তাঁদের সমাপনী প্রস্তাবে ফিলিস্তিনী ভূখণ্ডের ওপর ইসরাইলি দখলদারিত্ব অবসানের আহ্বান জানান। তাঁরা বলেন, মুসলমানদের প্রথম কিবলাসমৃদ্ধ নগরী বাইতুল মোকাদ্দাসকে ইহুদিকরণের চেষ্টা এবং নির্যাতিত ফিলিস্তিনী জনগণের ওপর ইসরাইলি বাহিনীর বর্বরতার খবর মুসলিম দেশগুলোর গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করতে হবে।
ওআইসি’র তথ্যমন্ত্রীরা মুসলিম বিশ্বে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় গণমাধ্যমের ভূমিকার কথা জোর দিয়ে উল্লেখ করেন। তাঁরা বলেন, সব ধরনের সহিংসতা, উগ্রবাদ ও বর্ণবাদ রুখতে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। মন্ত্রীরা ইরাক ও সিরিয়ায় তাকফিরি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএসআইএল-র বর্বরতা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের নিন্দা জানান। তাঁরা বলেন, মুসলিম নামধারী সন্ত্রাসীরা যেসব অপরাধযজ্ঞ চালাচ্ছে তার সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই।

আইএসআইএল-বিরোধী লড়াইয়ে ইরাকের পাশেই থাকবে ইরান
তাকফিরি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএসআইএল’র বিরুদ্ধে লড়াই শেষ না হওয়া পর্যন্ত ইরাকের জনগণের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান।
গত ৮ ডিসেম্বর তেহরানে ইরাকের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইবরাহীম আল-জাফারির সঙ্গে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মাদ জাওয়াদ জারিফ এ ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ইরাকের জনগণ একটি অভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করছে।
জাওয়াদ জারিফ বলেন, তাকফিরি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিপদ সম্পর্কে ইরান শুরু থেকেই বুঝতে পেরেছে এবং তখন হতে ইরাকের জনগণের পাশে রয়েছে; চরমপন্থিদের বিরুদ্ধে এ লড়াই শেষ না হওয়া পর্যন্ত তেহরান ইরাকের শিয়া, সুন্নি, কুর্দি ও আরব জনগোষ্ঠীর পাশেই থাকবে। তিনি বলেন, আঞ্চলিক দেশগুলোর মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখার বিষয়ে ইরান আহ্বান জানিয়ে আসছে; একই সঙ্গে ইরান বিশ্বাস করে যে, চরমপন্থি ও উগ্রবাদী আইএসআইএল গোষ্ঠী পুরো মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের জন্য হুমকি।
ইরাকের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আইএসআইএল গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আরো সহায়তা দেয়ার জন্য ইরানের প্রতি আহ্বান জানান। এছাড়া, তাকফিরি এ গোষ্ঠীর ছড়িয়ে পড়ার বিপদ থেকে সতর্ক থাকার জন্যও তিনি আঞ্চলিক দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান।
চরমপন্থা ও সহিংসতাবিরোধী একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে ইবরাহীম আল-জাফারি একটি প্রতিনিধিদল সহ গত ৭ ডিসেম্বর তেহরান সফর করেন।

পর্যটকদের অভিমত : ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বাস্তবতার সাথে পশ্চিমা অপপ্রচারের কোনোই মিল নেই
বিদেশী পর্যটকগণ ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান ভ্রমণ করার পর অভিমত ব্যক্ত করেন যে, ইসলামী ইরানের বাস্তবতা ও ইরান সম্পর্কে পশ্চিমা অপপ্রচারের মধ্যে আদৌ কোনো মিল নেই; বরং এখানকার বাস্তব অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
পশ্চিমা বার্তাসংস্থা এএফপি সম্প্রতি ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রচীন নিদর্শনাদির অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র পার্সেপোলিস পরিদর্শনকারী পোলিশ পর্যটক পিওতর চওল্বা-র অভিমত উদ্ধৃত করে এ কথা জানায়। চওল্বা বলেন, ইরানের মতো একটি জায়গার দু’টি চিত্র রয়েছে; এর একটি চিত্র হচ্ছে পশ্চিমা প্রচারমাধ্যম কর্তৃক অঙ্কিত চিত্র, অপরটি হচ্ছে সত্য- যে চিত্রে দেখা যাবে যে, আপনি ইরান ভ্রমণে গেলে সেখানে প্রত্যেকেই আপনাকে সাহায্য করছে এবং হাসিমুখে আপনাকে বরণ করছে।
উল্লেখ্য, মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে ইরান হচ্ছে সর্বাধিক প্রাণচঞ্চল ও পর্যটন আকর্ষণের দেশ যা ইতিহাস-প্রেমিকদেরকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করে থাকে।
জার্মানীর স্টুটগার্দ থেকে ইরান ভ্রমণে আগত ইঞ্জিনিয়ার টমাস বলেন যে, তিনি তাঁর নিজের দেশে থাকাকালে ইরান সম্বন্ধে একমাত্র যা শুনেছেন তা হচ্ছে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সরকারের পারমাণবিক প্রকল্প এবং এ বিষয়ে পাশ্চাত্যের ও এ দেশটির মধ্যকার বিরোধ। তিনি বলেন, কিন্তু এখানে আমি যা দেখতে পাচ্ছি তা ইরানের বাইরে থেকে ইরান সম্পর্কে যা কিছু শুনেছি তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি আরো বলেন, ইরানীরা খুবই অতিথিপরায়ণ এবং তাদের মধ্যে সমস্ত বিষয়ে জানার আগ্রহ খুবই প্রবল।
২৯ বছর বয়স্ক এ জার্মান নাগরিক বলেন, এ দেশটি খুবই নিরাপদ; সম্ভবত কতক ইউরোপীয় দেশের তুলনায় এ দেশটিতে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা অনেক বেশি।
উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থার মতে, মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের আকাশসীমা সর্বাধিক নিরাপদ। সম্প্রতি ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানকে এর আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য এবং যুক্তিসঙ্গত সেবার কারণে বিশ্বের সর্বাধিক পর্যটক আকর্ষণকারী দশটি দেশের অন্যতম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।

ছয় হাজার আমেরিকান নাগরিক ইরান ভ্রমণে আগ্রহী
আগামী ২০১৫ সালে গোল্ডেন ঈগল দাম্বু এক্সপ্রেসেস-এর ট্রেনের নয়টি ট্রিপে ইরান ভ্রমণে আসার জন্য ছয় হাজার আমেরিকান নাগরিক অপেক্ষা করছেন। উল্লেখ্য, পর্যটক বহনকারী উক্ত ট্রেনটি ইতিমধ্যেই দুই বার ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে ট্রিপ দিয়েছে এবং আরো নয় বার ইরানে ট্রিপ দেয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। গোল্ডেন ঈগল কোম্পানির ম্যানেজার বলেন যে, ট্রেনটির ইরানগামী যাত্রীদের জন্য বরাদ্দকৃত সবগুলো টিকেট বিক্রি হয়ে গিয়েছে এবং এর প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে শতকরা ৪৫ ভাগই হচ্ছেন আমেরিকান নাগরিক।
উক্ত ট্রেনটি হাঙ্গেরীর বুদাপেস্ট নগরী থেকে ১৪ দিনব্যাপী যাত্রা শুরু করবে এবং এরপর রোমানিয়া, বুলগেরিয়া ও তুরস্ক হয়ে ইরানে প্রবেশ করবে। ইরানে প্রবেশ করার পর পর্যটকবাহী এ ট্রেনটি এক সপ্তাহ সময়ের মধ্যে পর্যায়ক্রমে যান্জন, ইয়ায্দ, শীরায, কেরমান ও মাশহাদ সফর করবে।
১৯৫০-এর দশকের ডিজাইনে নির্মিত এ ট্রেনটিতে বাথরুম ও গরম পানির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রয়েছে এবং এটি জ্বালানি হিসেবে কয়লা ব্যবহার করবে। উল্লেখ্য, ট্রেনযোগে ইরান ভ্রমণে একেক জন পর্যটকের ৯ হাজার থেকে ১৫ হাজার ডলার পর্যন্ত ব্যয় হতে পারে।
উক্ত ট্রেনটিতে বর্তমানে নয়টি ওয়াগন আছে এবং এটি ১০২ জন লোক বহনে সক্ষম। এদের মধ্যে ৬৭ জন যাত্রী ও ৩৫ জন ক্রু থাকবে।

ইরানী চলচ্চিত্রে সামী ইউসুফের যন্ত্রসংগীত
বিশ্ববিখ্যাত যন্ত্রসংগীত তারকা সামী ইসলাম ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে নির্মিত ইসলামী চলচ্চিত্র ‘মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ্ (সা.)’-এ যন্ত্রসংগীতে অবদান রেখেছেন।
উল্লেখ্য, ইরানে জন্মগ্রহণকারী সামী ইউসুফ একাধারে সংগীত ও যন্ত্রসংগীত শিল্পী। তিনি বিশেষভাবে আরব জাহানে ব্যাপক জনপ্রিয়। ব্রিটিশ নাগরিক এ শিল্পী তাঁর একান্ত নিজস্ব যন্ত্রসংগীত রীতির জন্য বিশ্বব্যাপী বিশেষভাবে খ্যাতির অধিকারী। তিনি তাঁর যন্ত্রীসংগীতকে আধ্যাত্মিক বোধে উদ্দীপ্ত হিসেবে উল্লেখ করেন।
অস্কার পুরস্কারের জন্য মনোনীত ইরানী চলচ্চিত্র নির্মাতা মাজীদ মাজীদী কর্তৃক পরিচালিত ‘মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ্ (সা.)’ শীর্ষক চলচ্চিত্রটি একটি বিরাট সিনেম্যাটিক প্রকল্প। এ চলচ্চিত্রটি নির্মাণে সময় লেগেছে চার বছর। এতে রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর শৈশবকাল থেকে শুরু করে নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনে অভিষিক্ত হওয়া পর্যন্ত জীবনকাল প্রতিফলিত হয়েছে। এ চলচ্চিত্রটি নির্মাণের জন্য ঐতিহাসিক দলিলপত্র সংগ্রহের ক্ষেত্রে ইরান, মরোক্কো, তিউনিসিয়া, লেবানন, ইরাক ও আলজেরিয়া সহ বিভিন্ন দেশের পণ্ডিত ব্যক্তিগণ, ইতিহাসবিদগণ ও ইসলামী মনীষিগণের কাছ থেকে সাহায্য নেয়া হয় এবং কেবল এ কাজেই এক বছর সময় ব্যয়িত হয়। এভাবে সংগৃহীত দলিলপত্রাদির ভিত্তিতে এ চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট তৈরি করা হয়।
মোহাম্মাদ হায়দারীয়ান কর্তৃক নির্মিত এ চলচ্চিত্রটি একই সাথে ফারসি, আরবি ও ইংরেজি ভাষায় (২০১৫ সালে মুক্তি পাবার কথা।

বিশ্বে প্রথম বারের মতো ইরান ন্যানো-টেক্ সফ্ট্ ন্যাচারাল ডিটারজেন্ট উৎপাদন করছে
বিশ্বে প্রথম বারের মতো ইরানী বিজ্ঞানিগণ ন্যানো-টেকনোলজি ব্যবহার করে সফ্ট ন্যাচারাল ডিটারজেন্ট তৈরি করেছেন। এটি উৎপাদনকারী কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মের্হতাশ হেদায়াতী-মানেশ বলেন, এ নতুন ডিটারজেন্ট কম্পোজিশনটি হচ্ছে বিশ্বের বুকে ইনিসিয়েটিভ ফরমুলেশন্স ও মেথোড প্রয়োগ করে উৎপাদিত প্রথম সফ্ট ডিটারজেন্ট।
এটি অত্যন্ত উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পরিষ্কারক এবং এর দ্বারা এলসিডি, এলইডি, কাচ, বস্ত্র, সিরামিক ও সমস্ত ধরনের বাহ্যিক ময়লা পরিষ্কার করা সম্ভব হচ্ছে। অত্যন্ত শক্তিশালী এন্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদানের দ্বারা তৈরি এ ডিটারজেন্ট ব্যবহারে কোনো ধরনের এলার্জি হয় না এবং যেসব জিনিস পরিষ্কার করা হবে এ ডিটারজেনের দ্বারা তার বা পরিবেশের কোনোরূপ ক্ষতি হয় না।
উল্লেখ্য, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ন্যানো-টেকনোলোজিতে দৃষ্টিগ্রাহ্য উন্নতি সাধন করেছে এবং বর্তমানে বহু রকমের ন্যানো দ্রব্য উৎপাদন করছে।
আরো উল্লেখ্য যে, ন্যানো-টেকনোলোজি ব্যাপকভাবে ব্যবহারযোগ্য অনেক নতুন নতুন দ্রব্য ও ডিভাইস তৈরি করতে সক্ষম বলে মনে করা হয়- যা ব্যাপক ক্ষেত্রে ব্যবহার করা সম্ভব হবে। এসব দ্রব্যের মধ্যে ওষুধ, ইলেকট্রনিক দ্রব্যাদি ও এনার্জি সামগ্রী অন্যতম।

ইরান পুরুষদের বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসার জন্য অর্গানিক মেডিসিন উৎপাদন করছে
দক্ষিণ ইরানের হোরমোযগান প্রদেশের মেডিক্যাল সায়েন্সেস ইউনিভার্সিটির একটি হেল্থ সেন্টারের গবেষকগণ পুরুষদের বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসার জন্য ভেষজ ওষুধ তৈরি করেছেন।
এ ভেষজ ওষুধটি কয়েকটি উদ্ভিদের সমন্বয়ে ক্যাপসুল আকারে তৈরি করা হয়েছে। এসব ক্যাপসুলে ঐ এলাকায় সহজলভ্য এমন কয়েক ধরনের উদ্ভিদ থেকে তৈরিকৃত বিভিন্ন ওষুধ একত্রে ব্যবহার করা হয়।
উক্ত ওষুধ তৈরির প্রকল্প পরিচালক ড. সোগরা ফাল্লাহী বলেন, এ ভেষজ ওষুধটি একাধারে ৭২ দিন সেবন করা হলে পুরুষদের বীর্যে শুক্রকীটের সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পায়, তেমনি সেগুলোর গতিও বৃদ্ধি পায়। তিনি জানান, দক্ষিণ ইরানের বন্দর নগরী বান্দার আব্বাসের একটি মলিক্যুলার মেডিসিন ল্যাবরেটরিতে এ ওষুধটির প্রাথমিক পর্যায়ের ও মলিক্যুলার গবেষণা অব্যাহত আছে। গবেষকগণ ওষুধটির ড্রাগ ইম্প্যাক্টসমূহের মেকানিজ্ম ও পারফরম্যান্স মেকানিজ্ম চিহ্নিত করার জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।
ড. ফাল্লাহী জানান, ওষুধটি ব্যাপক ভিত্তিতে উৎপাদন করা হবে এবং এর উচ্চ মানের কারণে এটি বিদেশে রপ্তানি করা যাবে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সরকারের গবেষণা ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপমন্ত্রী রেযা মালেকযাদেহ্ জানান, বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসা ও গবেষণার ক্ষেত্রে ইসলামী ইরান মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের মধ্যে প্রথম অবস্থানে এবং বিশ্বের মধ্যে ১৬তম বা ১৭তম স্থানে রয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে রাজধানী তেহরানে রয়্যান মেডিক্যাল ইনস্টিটিউট ও ইরানের রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি যৌথ উদ্যোগে অধুনাতম প্রযুক্তি সজ্জিত একটি উচ্চ মানসম্পন্ন বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসা ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করেছে। এ ক্লিনিকটি ইন ভিট্রো ফার্টিলাইযেশন (আইভিএফ)-এর সর্বাধিক উন্নত যন্ত্রপাতি সরবরাহ করছে এবং বন্ধ্যাত্ব রোগীদেরকে এসিস্টেড রিপ্রোডাকটিভ টেকনোলোজী (এআরটি) ব্যবহার করতে দিচ্ছে। উল্লেখ্য, এআরটি হচ্ছে কৃত্রিমভাবে বা অংশত কৃত্রিমভাবে গর্ভসঞ্চারের পদ্ধতি।
সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী এখানে যেসব দম্পতি চিকিৎসা সেবা গ্রহণের জন্য আসছে তাদের মধ্যে শতকরা ৪০ ভাগের বেলায় স্বামী, শতকরা ৪০ ভাগের বেলায় স্ত্রী ও শতকরা ২০ ভাগের ক্ষেত্রে উভয়ই বন্ধ্যাত্বে ভুগছে।

ইরানী বিজ্ঞানী মস্তিষ্কের সুরক্ষাকারী জীবাণু আবিষ্কার করেছেন
সুইডিশ ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটে কর্মরত ইরানী বিজ্ঞানী আফরূয আব্বাসপুর তাঁর সহকর্মীদের সাথে নিয়ে গবেষণা করে মানবদেহে এমন এক ধরনের জীবাণু আবিষ্কার করেছেন যা রোগ প্রতিষেধক থেকে শুরু করে খাদ্য হজম করা পর্যন্ত মানবদেহের সব কিছুর সংরক্ষণে ভূমিকা পালন করে এবং দেহের সকল কাজে সহায়তা করে। এটা বিশেষ করে মানুষের মস্তিষ্ককে ক্ষতিকর প্যাথোজিন থেকে রক্ষা করে। এ জীবাণুগুলো ব্লাড-ব্রেন ব্যারিয়ার নামে কথিত এক ধরনের জীবাণু-বেড়া তৈরি করে মস্তিষ্ককে প্যাথোজিন সহ অন্যান্য ক্ষতিকর জীবাণু থেকে রক্ষা করে।
এর আগে এক গবেষণায় আবিষ্কৃত হয় যে, মানবদেহের অভ্যন্তরে জীবাণু চলাচলের পথসমূহে এক ধরনের জিন তৈরি হয়ে থাকে যা ক্যাপ জাঙ্কশন প্রোটিন নামে অভিহিত কোডিং তৈরি করে- যা এক ধরনের দেয়াল তৈরি করে-যা রক্তের ভিতরে প্যাথোজিন প্রবেশে ও সম্ভাব্য রোগ-ব্যাধি সৃষ্টিতে বাধা দেয়।
সুইডেনের ক্যারোলিন্স্কা ইনস্টিটিউটে কর্মরত বিজ্ঞানিগণ তাঁদের এ নতুন গবেষণায় ব্লাড-ব্রেন ব্যারিয়ার নিয়ে-যাতে প্রোটিনও পাওয়া যায়-গবেষণা করেন। এ গবেষণায় তাঁরা গবেষণাগারে ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। তাঁরা কিছু সংখ্যক এমন ইঁদুরকে রাখেন যেগুলোর প্রজনন ক্ষমতা ছিল এবং সেগুলোর শরীরে কোনো রোগজীবাণু চিহ্নিত করা যায় নি এবং অপর কতগুলো ইঁদুরের শরীরে স্বাভাবিকভাবেই রোগজীবাণু ছিল। গবেষকগণ এই শেষোক্ত ইঁদুরগুলোর শরীরে এন্টিবডি ইনজেক্ট করে দেন যাতে সেগুলোর মধ্যকার ব্লাড-ব্রেন ব্যারিয়ার ভেঙে যায় এবং রোগজীবাণুমুক্ত সাধারণ মাদী ইঁদুরের গর্ভে ভ্রুণের সৃষ্টি হয়।
স্বাভাবিকভাবে মোটামুটি ১৭ দিনের মধ্যে ব্যারিয়ার বন্ধ হয়ে যায় ও ভ্রুণের সৃষ্টি করে, অন্যদিকে ইনজেক্টকৃত এন্টিবডি ১৭ দিনের কম সময় পার হয়ে যাওয়া সবগুলো ভ্রুণের মস্তিষ্কে কাক্সিক্ষতভাবে ক্রিয়া করে এবং তা জীবাণুমুক্ত মা-ইঁদুরগুলোর গর্ভস্থ ভ্রুণগুলোর মস্তিষ্কে ১৭ দিনের পরেও প্রবেশ অব্যাহত রাখে। সায়েন্স ট্রান্সলেশন্যাল মেডিসিন সাময়িকীতে এসব তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।

রোমানিয়ায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় ইরানী শিশু-কিশোরদের পুরস্কার লাভ
সম্প্রতি রোমানিয়ায় অনুষ্ঠিত ৯ম আন্তর্জাতিক শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে ১৫ জন ইরানী শিশু-কিশোর পুরস্কার লাভ করেছে।
‘রংধনু’ শীর্ষক এ প্রতিযোগিতায় ইরানী শিশু-কিশোররা মোট ৮৫৭টি চিত্র নিয়ে অংশগ্রহণ করে। এ প্রতিযোগিতায় বিশ্বের মোট ২৭টি দেশের সর্বমোট ৩ হাজার ২৯৪টি চিত্র উপস্থাপন করা হয়।
এ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী ইরানী শিশু-কিশোরদের মধ্যে ১০ বছর বয়স্ক সেপিদেহ্ তাহেরী ও ১২ বছর বয়স্ক মেইসাম্ আবদুল্লাহী যৌথভাবে প্রথম পুরস্কারের পদক লাভ করে এবং দ্বিতীয় পুরস্কারের পদক অর্জন করে ১২ বছর বয়সী আমীর হোসাইন ওয়ালীযাদেহ্, আর তৃতীয় পুরস্কার বিজয়ী হয় ৯ বছরের বিনইয়ামীন কেরামাতিনীয়া।
এ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী ইরানী শিশু-কিশোরদের সকলেই ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের শিশু-কিশোর মনন বিকাশ ইনস্টিটিউটের সদস্য।
এ বছরের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী শিশু-কিশোরদেরকে তাদের চিত্রে ‘পৃথিবীর প্রতি ভালোবাসা’ তাৎপর্য প্রতিফলিত করতে বলা হয়।

আন্তর্জাতিক পানি সীমায় ১,৮০০ জাহাজের নিরাপত্তা দিয়েছে ইরানী নৌবহর
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ৩২তম নৌবহর ভারত মহাসাগর ও এডেন উপসাগরে প্রায় এক হাজার আটশ’ জাহাজকে নিরাপত্তা দিয়েছে। এ নৌবহরের কমান্ডার সাইয়্যেদ হোসেইন শারিফি নাস্ব ১৫ নভেম্বর বার্তাসংস্থা ইরনাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক পানি সীমায় ইরানী নৌবহর তৎপরতা শুরু করার পর থেকে এ পর্যন্ত মোট এক হাজার ৭৪৫টি জাহাজকে নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৮০৭টি বাণিজ্যিক জাহাজ ও ৯৩৮টি তেল ট্যাঙ্কার রয়েছে। এসব জাহাজকে সরাসরি স্কর্ট করে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিয়েছে তারা। নৌ কমান্ডার শারিফি আরো বলেন, ইরানী নৌবহর এডেন উপসাগর, লোহিত সাগর ও ভারত মহাসাগরের উত্তরাঞ্চলে জলদস্যুদের সঙ্গে এ পর্যন্ত দেড়শ’র মতো সংঘর্ষে জড়িয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরান আন্তর্জাতিক পানি সীমায় নিজের উপস্থিতি জোরদার করেছে। ২০০৮ সালের নভেম্বর থেকে এডেন উপসাগরে টহল দিতে শুরু করে ইরানী নৌবাহিনী। বর্তমানে ইরানের ৩২তম নৌবহর এডেন উপসাগরে টহল দিচ্ছে।
এদিকে ইরানের সংসদ মজলিশে শুরার স্পিকার আলী লারিজানি গত ২২ নভেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকার দেশ জিবুতির একটি বন্দরে নোঙ্গর করে থাকা ইরানী ডেস্ট্রয়ার জামারান এবং যোগাযোগ যান বুশেহর পরিদর্শনকালে বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের শান্তিপ্রিয় দেশ হিসেবে এ অঞ্চলের সামুদ্রিক নিরাপত্তা জোরদার করেছে ইরান।
লারিজানি বলেন, জলদস্যুদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য এডেন উপসাগর এবং আঞ্চলিক পানিসীমায় ইরানের নৌ বাহিনী মোতায়েন রয়েছে; এতে ইরানসহ সমগ্র অঞ্চলের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ইরানের পার্লামেন্ট স্পিকার আরো বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে এ অঞ্চলে নিরাপত্তাহীনতা দেখা গেছে যা বিভিন্ন দেশের ক্ষতি করেছে। কিন্তু ইরানের নৌ বাহিনীর উপস্থিতি এ অঞ্চল দিয়ে যাতায়াতকারী বাণিজ্যিক জাহাজগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। ইরান এ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার যে নীতি গ্রহণ করেছে এসব তৎপরতার মাধ্যমে তাই ফুটে উঠেছে বলেও জানান তিনি।

ইরাকে চালু হলো ইরানের তৈরি ১৬২ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্র
ইরাকের নাজাফের অদূরে হেইদারিয়া এলাকায় ইরানের তৈরি একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করা হয়েছে। এ কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা হচ্ছে ১৬২ মেগাওয়াট।
গত ১৩ নভেম্বর ইরাক ও ইরানের জ্বালানিমন্ত্রীর উপস্থিতিতে এটি উদ্বোধন করা হয়। এ কেন্দ্র থেকে নাজাফে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। ইরানের ‘মাপনা’ গ্রুপ এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সার্বিক দায়িত্ব পালন করে এবং এটি নির্মাণে সময় লেগেছে তিন বছর।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ইরানের জ্বালানিমন্ত্রী হামিদ চিতচিয়ান বলেন, বাগদাদের সঙ্গে সব ক্ষেত্রে বিশেষ করে বিদ্যুৎ খাতে সম্পর্ক জোরদারে তেহরান প্রস্তুত রয়েছে। ইরাকে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করে দেয়ার পাশাপাশি দেশটিতে এক হাজার ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ রপ্তানি করে ইরান। ইরাক ছাড়াও লেবানন, সিরিয়া, তুরস্ক ও পাকিস্তানে বিদ্যুৎ রপ্তানি করে আসছে ইরান।

ইরাকে বছরে রপ্তানি হচ্ছে অন্তত ৫০ হাজার ইরানী গাড়ি
ইরান থেকে প্রতি বছর অন্তত ৫০ হাজার গাড়ি ইরাকে রপ্তানি করা হচ্ছে। ইরানের অন্যতম প্রধান গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি ‘ইরানখোদরু’-র মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক কর্মকর্তা গোলাম রেযা মাহদিযাদে গত ২৫ নভেম্বর এ কথা জানান।
তিনি আরো বলেন, ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় মেহরান সীমান্ত দিয়ে প্রতিবেশী ইরাকে এসব গাড়ি রপ্তানি করা হচ্ছে। মেহদিযাদে বলেন, ‘সামান্দ’ ও ‘রানা’সহ বিভিন্ন মডেলের গাড়ি সেখানে যাচ্ছে। ইরাকীদের কাছে এসব গাড়ি সমাদৃত হয়েছে বলেও জানান তিনি। তিনি আরো বলেন, ‘সাইপা’ কোম্পানিও ইরাকে গাড়ি রপ্তানি করছে। তারা প্রতি বছর প্রায় ৩০ হাজার গাড়ি ইরাকে পাঠাচ্ছে।
ইরানে ইসলামী বিপ্লব সফল হওয়ার পর দেশটি অন্যান্য অঙ্গনের পাশাপাশি গাড়ি নির্মাণ শিল্পেও ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেছে।

আকাশে উড়ল মার্কিন আরকিউ-১৭০ ড্রোনের ইরানী ভার্শন
মার্কিন আরকিউ-১৭০’র অনুকরণে তৈরি ইরানী ড্রোন প্রথমবারের মতো আকাশে উড়েছে। ইরানের ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর অ্যারোস্পেস ডিভিশনের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমির আলী হাজিযাদেহ গত ১০ নভেম্বর এ কথা জানান। তিনি বলেন, মার্কিন পাইলটবিহীন বিমান আরকিউ-১৭০’র ইরানী ভার্শনের সফল উড্ডয়ন সম্পন্ন হয়েছে।
২০১১ সালের ৪ ডিসেম্বর ইরানী সেনাবাহিনীর ইলেক্ট্রনিক যুদ্ধ ইউনিট ইরানের আকাশে ঢোকার পর রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম মার্কিন আরকিউ-১৭০ ড্রোন সফলভাবে নামিয়ে আনে। মার্কিন লকহিড মার্টিন কোম্পানির তৈরি ড্রোনটি আফগান সীমান্ত দিয়ে ইরানের আকাশসীমায় ঢুকেছিল।
এরপরই ইরানী বিশেষজ্ঞরা মার্কিন আরকিউ-১৭০ ড্রোনের কারিগরি বিষয়ক নতুন তথ্য উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হন। ওই প্রযুক্তির ভিত্তিতেই ইরান আরকিউ-১৭০’র স্থানীয় ভার্শন তৈরি করল। আটক মার্কিন ড্রোনটির হুবহু তৈরি করেছে ইরানী বিশেষজ্ঞরা। এটি প্রযুক্তিগত দিকের পাশাপাশি কার্যকারিতায়ও মার্কিন ড্রোনটির অনুরূপ।

‘আমেরিকা অবাক দৃষ্টিতে দেখছে আরকিউ-১৭০’র ইরানী ভার্শন’
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রভাবশালী আলেম আয়াতুল্লাহ আলী মোভাহেদি কেরমানি বলেন, মার্কিন আরকিউ-১৭০ ড্রোনের ইরানী ভার্শন আমেরিকার সম্মান ও মর্যাদার জন্য একটা বড় আঘাত। গত ১৪ নভেম্বর রাজধানী তেহরানে জুমআর নামাযের খুতবায় তিনি এ কথা বলেন।
জুমার নামাজের খতিব বলেন, অত্যাধুনিক আরকিউ-১৭০ ড্রোনকে রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং করার ক্ষমতা ইরানীদের নেই বলে আমেরিকা দাবি করে আসছিল। কিন্তু ইরান রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং করতে সক্ষম হয়েছে। এ কারণে তারা এখন অবাক দৃষ্টিতে আরকিউ-১৭০’র ইরানী ভার্শন দেখছে। আয়াতুল্লাহ কেরমানি বলেন, মার্কিন আরকিউ-১৭০ ড্রোনের রাডার ফাঁকি দেয়ার প্রযুক্তিতে কিছু ত্রুটি ছিল, ইরানী ভার্শন সেই ত্রুটি থেকেও মুক্ত। আগামী বছরই ড্রোনটি ব্যাপক সংখ্যায় তৈরি করা হবে বলে তিনি জানান।

দূরপাল্লার রাডার ব্যবস্থার সফল পরীক্ষা করল ইরান
ইরান দূরপাল্লার ‘সেপেয়ার’ রাডার ব্যবস্থার সফল পরীক্ষা চালিয়েছে। এ রাডার ব্যবস্থা ২,৫০০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে যে কোনো লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত করতে পারে।
গত ১১ নভেম্বর এ রাডার ব্যবস্থার প্রথম পর্যায়ের পরীক্ষা সফলভাবে সম্পন্ন হয়। পরে এ নতুন এ রাডার ব্যবস্থাকে ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। ইরানের খাতামুল আম্বিয়া বিমান প্রতিরক্ষা ঘাঁটির কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফারজাদ ইসমাইলি এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম ব্যালিস্টিক, সেমি ব্যালিস্টিক এবং ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র নির্ণয় করতে পারে নতুন এ রাডার ব্যবস্থা। ইরান সীমান্তের বাইরে অনেক দূরে অবস্থিত সম্ভাব্য হুমকিও শনাক্ত করতে সক্ষম এ ব্যবস্থা।

ইরানে রাডার ফাঁকি দেয়ার প্রযুক্তি অকার্যকর
রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম মার্কিন স্টিল্থ জঙ্গি বিমানগুলোকেও শনাক্ত করতে পারবে ইরান। জাতীয় সম্প্রচার সংস্থা আইআরআইবি’র সঙ্গে গত ১২ নভেম্বর এক সাক্ষাৎকারে এ তথ্য দেন ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি’র আকাশ প্রতিরক্ষা বিভাগের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমির আলী হাজিযাদেহ।
তিনি বলেন, বর্তমানে ইরানের হাতে এ সংক্রান্ত যেসব প্রযুক্তি রয়েছে তা দিয়ে ইরাক ও পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম মার্কিন এফ-টুয়েন্টি টু জঙ্গি বিমানকে সহজেই শনাক্ত করা যাবে।
ইরানী কমান্ডার বলেন, আড়াই মাস আগে ইহুদিবাদী ইসরাইলের রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম হারমেস ড্রোন ভূপাতিত করতে সক্ষম হয় আইআরজিসি। আর এ থেকেই প্রমাণ হয় আইআরজিসি’র পদক্ষেপ কতটা নিখুঁত! তিনি আরো বলেন, ইরানের হাতে মার্কিন ড্রোন আরকিউ-১৭০ আটক হওয়ার বিষয়টিও এ ক্ষেত্রে প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। এর মধ্য দিয়ে এ বাস্তবতাই ফুটে উঠেছে যে, ইরান বি-টু এবং এফ-থার্টি ফাইভসহ রাডার ফাঁকি দেয়ার প্রযুক্তিসম্পন্ন সব ধরনের বিমান শনাক্ত করতে পারে।

সন্ত্রাসবাদ কবলিত মুসলিম বিশ্ব শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের অতিথিদের উদ্দেশে

রাহবার আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী
রাহবার আয়াতুল্লাহ আল-উযমা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী গতকাল ২৫ নভেম্বর ২০০৪ তারিখে সন্ত্রাসবাদ কবলিত মুসলিম বিশ্ব শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আলেম ও চিন্তাবিদদের উদ্দেশে বলেন : সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাকফিরি ধারাগুলোর পুনর্জীবিত হওয়া মুসলিম বিশ্বের ওপর সাম্রাজ্যবাদীদের কর্তৃক গড়ে তোলা ও চাপিয়ে দেওয়া একটি সমস্যা। রাহবার বিগত দিনগুলোতে তাকফিরি গোষ্ঠীগুলো যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল ও সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কীভাবে জঘন্য নৃশংসতা ও বর্বরতা চালিয়েছে সে দিকে ইঙ্গিত করেন। ফিলিস্তিন ও মসজিদুল আকসার প্রসঙ্গকে বিস্মৃতির মধ্যে ঠেলে দেওয়ার জন্য কতই না চেষ্টা করা হয়েছে! রাহবার তাগিদ দিয়ে বলেন : বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ইসলামী জাহানের আলেমবৃন্দের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও অগ্রাধিকারপূর্ণ বিষয় হচ্ছে তাকফিরি ধারাগুলোর মূলোৎপাটন ও এ ধারাকে পুনরুজ্জীবিত করতে সাম্রাজ্যবাদী নীতিকৌশলের ভূমিকা সম্পর্কে সবাইকে স্পষ্ট করে দেওয়ার লক্ষ্যে একটি জ্ঞান ও যুক্তিভিত্তিক এবং সর্বব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলা।
আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী তাঁর বক্তব্যের শুরুতে আয়াতুল্লাহ আল উযমা মাকারিম শিরাজী, আয়াতুল্লাহ জাফর সুবহানি সহ কোম নগরীর শীর্ষ আলেমবৃন্দকে এরূপ একটি সম্মেলন আয়োজন এবং তাকফিরি গোষ্ঠীগুলোর মোকাবিলার লক্ষ্যে ইসলামী জাহানের প-িতবর্গ ও চিন্তাবিদদের মাঝে একটি ব্যাপক ইলমি ধারার রূপরেখা তৈরিতে আন্তরিক প্রয়াস চালানোর জন্য কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। তিনি বলেন : এ বিপজ্জনক গোষ্ঠী সম্পর্কে বিশ্লেষণের সময় এ দিকটির প্রতি খেয়াল রাখতে হবে যে, মূল বিষয় হল নতুন করে জেগে ওঠা তাকফিরি গোষ্ঠীকে সর্বাত্মক মোকাবিলা করা। এ ধারাটি আইএসআইএল নামে খ্যাত গোষ্ঠীটির চেয়েও বড় ও ব্যাপক। প্রকৃতপক্ষে আইএসআইএল হচ্ছে এ বিষবৃক্ষের একটি শাখা মাত্র।
রাহবার অতঃপর একটি অনস্বীকার্য বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন : তাকফিরি গ্রুপগুলো এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দানকারী রাষ্ট্রসমূহ সম্পূর্ণরূপে সাম্রাজ্যবাদীদের অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল ও অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী দেশের লক্ষ্যপথেই হাঁটছে। তারা বাইরে ইসলামের বেশ ধারণ করে কার্যত তাদেরই সেবাদাসে নিয়োজিত। এ মর্মে তিনি তাদের কিছু কার্যকলাপের নমুনাও উল্লেখ করেন।
আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামী জাগরণের জোয়ারকে বিপথে পরিচালিত করা তাদের এরূপ কার্যকলাপের প্রথম নমুনা বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন : ইসলামী জাগরণ ছিল মার্কিনবিরোধী, স্বৈরাচারবিরোধী ও আমেরিকার পুতুল সরকারগুলোর বিরোধী একটি গণজাগরণ। কিন্তু তাকফিরি গ্রুপগুলো এই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মহান উত্থানকে একটি গৃহযুদ্ধ ও মুসলমানদের ভাই ভাই হত্যাযজ্ঞে পরিণত করেছে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেন : এতদঞ্চলে মুসলমানদের সংগ্রামের ফ্রন্ট লাইন ছিল অধিকৃত ফিলিস্তিনী ভূখণ্ড। কিন্তু তাকফিরি গ্রুপগুলো এ ফ্রন্ট লাইনকে পাল্টে দিয়ে ইরাক, সিরিয়া, পাকিস্তান ও লিবিয়ার সড়ক ও জনপদগুলোর মধ্যে টেনে এনেছে। এটা হল তাকফিরি গ্রুপগুলোর এমন এক জঘন্য অপরাধ যা ভোলা যায় না।
আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী ইসলামী জাগরণকে বিপথে পরিচালিত করাকে আমেরিকা, ইসলাইল, ইংল্যান্ড ও যায়নবাদী সরকারের এবং তাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রতি খেদমত বলে অভিহিত করে বলেন : তাকফিরি গ্রুপগুলো যে সাম্রাজ্যবাদীদের লক্ষ্যের পথেই হাঁটছে তার আরেকটি নমুনা হল যারা এদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে তারা যায়নবাদী জান্তার বিরুদ্ধে ‘টু’ শব্দটিও করে না। এমনকি মুসলমানদের মোকাবিলা করার জন্য এই জান্তার সাথে তারা সহযোগিতা করে। অথচ মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য তারা আদাজল খেয়ে লেগে আছে।
আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী তাকফিরি সন্ত্রাসীদের হাতে ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর মূল্যবান ভৌতিক অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে যাওয়াকে মুসলমানদের শত্রুদের স্বার্থে আরেকটি বড় খেদমতের নমুনা হিসাবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন : তাকফিরি গ্রুপগুলোর আরেকটি অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক কাজ হচ্ছে ইসলামের দয়াশীল, বুদ্ধিগ্রাহ্য ও যৌক্তিক চেহারাকে খর্ব করা। তারা তাদের পৈশাচিক কার্যকলাপ, যেমন নিরপরাধ মানুষদের ওপর তলোয়ার চালানো, কিংবা একজন মুসলমানের হৃৎপি- বের করে এনে দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরা ইত্যাদি কাজগুলো তারা ইসলামের নামেই ভিডিও চিত্রের মাধ্যমে প্রদর্শন করেছে।
হযরত আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী তাকফিরিদের কর্তৃক সা¤্রাজ্যবাদীদের স্বার্থে সেবাদাসের আরেকটি নমুনা হিসাবে ৫০ দিনব্যাপী গাযা যুদ্ধে প্রতিরোধ ফ্রন্টকে নিঃসঙ্গ ফেলে রাখা বলে মনে করেন। তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন যে, এরূপ আরেকটি নমুনা হল ইসলামী জাগরণের জোয়ারে মুসলিম যুবশ্রেণির মধ্যে যে উচ্ছ্বাস ও বীরত্ববোধ জন্ম নিয়েছিল সেটাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা। পরিতাপের কথা হল ঐ উচ্ছ্বাসকে অপর নিরপরাধ মুসলমানদের হত্যার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে।
ইসলামী বিপ্লবের নেতা এরূপ আরেকটি নমুনা হিসাবে ইরাকে সাম্প্রতিক মার্কিন ত্রাণবাহী বিমান থেকে আইএসআইএল নামের সন্ত্রাসীদের জন্য পুনঃপুন অস্ত্র ফেলার ঘটনার কথা উল্লেখ করেন। তিনি গুরুত্বারোপ করে বলেন : মার্কিনীরা এসব কর্মকা- সত্ত্বেও বাহ্যত আইএসআইএল বিরোধী জোট গঠনের দাবি করে আসছে। যা একটি নির্জলা মিথ্যা বৈ কী। কারণ, এ জোটের মূল উদ্দেশ্য হল যুদ্ধের ফিতনা ও মুসলমানদের মাঝে সংঘাতকে জিইয়ে রাখা। অবশ্য তারা তাদের সে উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারবে না।
ওয়ালীয়ে আমরে মুসলিমীন হযরত আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী অতঃপর বর্তমান পরিস্থিতিতে ইসলামী জাহানের আলেমবৃন্দের মহান কর্তব্য সম্পর্কে বলেন : বর্তমান সময়ে ইসলামী মাযহাবসমূহের আলেমবৃন্দের অন্যতম কর্তব্য হল তাকফিরি ধারার মূলোৎপাটন করার নিমিত্তে একটি জ্ঞান ও যুক্তিভিত্তিক ও সর্বব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলা। তিনি বলেন : তাকফিরিরা সালাফে সালেহগণের নামে মিথ্যা স্লোগান তুলে এ অপকর্মে নেমেছে। তাই তাদেরকে দ্বীন, ইল্ম ও মানতিকের (যুক্তির) ভাষায় জবাব দিতে হবে এবং তাদের এহেন গর্হিত কার্যকলাপের প্রতি সালাফে সালেহীনদের অসন্তুষ্টির কথা তুলে ধরতে হবে। তিনি আরও বলেন : এ জ্ঞান ও যুক্তিভিত্তিক আন্দোলনের মাধ্যমে যেসব নিরপরাধ যুবক তাদের জঘন্য ফাঁদে আটকা পড়েছে তাদেরকে মুক্ত করতে হবে। এ দায়িত্ব আলেমবৃন্দের ওপর ন্যস্ত।
হযরত আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী তাকফিরি ধারাকে পুনরুজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড ও যায়নবাদী জান্তার ভূমিকাকে স্পষ্ট করে তুলে ধরা মুসলিম দেশগুলোর আলেমবৃন্দের আরেকটি গুরুদায়িত্ব হিসাবে উল্লেখ করেন। রাহবার বলেন : আলেমবৃন্দের ওপর তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি হচ্ছে ফিলিস্তিন ও মসজিদুল আকসা ইস্যুর প্রতি যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করা। যেন ইসলামী জাহানের এ আসল বিষয়টি অবহেলা ও বিস্মৃতির কবলে না পড়ে। তিনি অতিসম্প্রতি যায়নবাদী সরকারের মন্ত্রীসভায় অধিকৃত ফিলিস্তিনকে ইয়াহুদিকরণের যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে তার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন : যায়নবাদী জান্তা বায়তুল মুকাদ্দাস ও মসজিদুল আকসাকে দখল করার এবং ফিলিস্তিনীদের যতটা দুর্বল করতে পারা যায় সেই পাঁয়তারা করছে। তাই প্রত্যেকটি মুসলিম জাতি এবং আলেমবৃন্দকে স্ব স্ব সরকারের কাছে দাবি জানাতে হবে যেন ফিলিস্তিনের ব্যাপারে সোচ্চার থাকে।
ইসলামী বিপ্লবের নেতা মরহুম ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর ‘ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন ও যায়নবাদী জান্তার বিরুদ্ধে শত্রুতা’র নীতি ঘোষণার প্রতি ইঙ্গিত করে জোর দিয়ে বলেন : আমরা আল্লাহকে শুকরিয়া জানাই যে, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে সরকার ও জনগণ ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন আর যায়নবাদী জান্তার বিরুদ্ধে শত্রুতার প্রশ্নে এক কণ্ঠ ও এক তান রয়েছে। ইমাম খোমেইনী (রহ.) যে পথ এঁকে দিয়ে গিয়েছিলেন, বিগত ৩৫ বছরে তারা সে পথ থেকে বিচ্যুত হয়নি।
আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী জোর দিয়ে বলেন যে, ইরানের জাতি ও যুবসমাজ পূর্ণ আগ্রহ সহকারে ফিলিস্তিনের জনগণের পক্ষে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে এবং যায়নবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে তারা মনেপ্রাণে আসক্তি পোষণ করে। তিনি আরও বলেন : ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান খোদায়ী অনুগ্রহ ও কৃপা গুণে মাযহাবী সংকীর্ণতা ও ভেদাভেদের মধ্যে বন্দি হয়নি। তারা লেবাননের শিয়া হিজবুল্লাহদেরকে যেমন সাহায্য করে থাকে, ফিলিস্তিনে হামাস ও ইসলামী জিহাদসহ অন্যান্য আহলে সুন্নাত গ্রুপগুলোকেও তদ্রুপ সাহায্য ও সহযোগিতা করে থাকে। ভবিষ্যতেও এরূপ সাহায্য-সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে। তিনি গাযায় ফিলিস্তিনী ভাইদের শক্তিশালী করাকে ফিলিস্তিনী জনগণের প্রতি ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সাহায্যের একটি নমুনা হিসাবে গণ্য করেন এবং বলেন : আগেও যেমনটা বলা হয়েছে, পশ্চিম তীরকেও সশস্ত্র হতে হবে এবং প্রতিরক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। আর এ কাজ নির্ঘাত সম্পন্ন করা হবে।
ইসলামী বিপ্লবের নেতা ইসলামী জাহানের শত্রুদের শক্তি ও অবস্থা অতীতের চাইতে কয়েক গুণে দুর্বলতর বলে মূল্যায়ন করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমূহের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাগত সমস্যাবলির প্রতি ইঙ্গিত করেন। একইভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরো করুণতর নৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যাবলি, বিশেষ করে তাদের মুদ্রা ও আর্থিক সমস্যা এবং পরাশক্তি হিসাবে ভাবমূর্তি দুর্বল হওয়ার কথাও ইঙ্গিত করেন। তিনি বলেন : যায়নবাদী ইসরাইলও অতীতের তুলনায় প্রচ-ভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এ হল সেই জান্তা যারা কিছুকাল আগে ‘নীল হতে ফোরাত পর্যন্ত’ বলে স্লোগান দিয়ে বেড়াত। কিন্তু আজ ৫০ দিনের যুদ্ধে সর্ব শক্তি ক্ষয় করেও হামাস ও ইসলামী জিহাদের আন্ডারগ্রাউন্ড টানেলগুলোকে ধ্বংস করতে ব্যর্থ হয়েছে।
আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী এতদঞ্চলে বিশেষ করে ইরাক, লেবানন ও সিরিয়ায় ইসলামের শত্রুদের সমস্যাবলি ও ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন : দুশমনের দুর্বলতার আরেকটি নমুনা হচ্ছে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো একত্রে জড়ো হয়েছে পরমাণু ইস্যুতে ইরানকে নতজানু করতে। কিন্তু তারা সক্ষম হয়নি। ভবিষ্যতেও সক্ষম হবে না।

সূত্র : ইসলামিক স্টুডেন্টস নিউজ এজেন্সি (ইস্না)

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ইরানের অগ্রগতি

ভূমিকা
বিগত কয়েক দশক যাবৎ ইরানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে যার ফলাফল আশাব্যঞ্জক। ইরানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের জন্য ‘ভিশন ২০২৫’ নামক একটি কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে, এর উদ্দেশ্য হলো গবেষণা খাতে জিডিপির ২.৫ শতাংশ বিনিয়োগ নিশ্চিত করা। বিগত ৩০ বছর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সকল শাখা, যেমন- ন্যানো-টেকনোলজি, বায়োটেকনোলজি, মহাকাশবিজ্ঞান, পরমাণু প্রযুক্তি, চিকিৎসাবিজ্ঞান, স্টেম সেল গবেষণা এবং ক্লোনিং প্রযুক্তির প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে।
১.  বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পরিচিতি
দেশের সার্বিক উন্নয়নে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অনন্য অবদানের কথা বিবেচনা করে ইরানে সর্বাধুনিক এবং উচ্চ প্রযুক্তির উদ্ভাবন, উন্নয়ন ও প্রসারের ওপর ব্যাপক গুরুত্বারোপ করা হয়। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক এবং প্রযুক্তিগত অবস্থানকে জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীতকরণের মাধ্যমে আগামী ২০ বছরের মধ্যে উন্নত দেশের সারিতে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে ‘ভিশন ২০২৫’ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।
২. ইরানের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পরিসংখ্যান
শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গবেষণার সকল ক্ষেত্রে ইরান বিগত ৩০ বছরে ব্যাপক উন্নতি সাধন করেছে। বিজ্ঞানে উন্নতির হারের দিক থেকে ইরান বর্তমান বিশ্বে অগ্রণী। ইরানের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ছাত্রসংখ্যা ১৯৭৯ সালে ১০০০০০ থেকে ২০১২ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪০৪৬১৪। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায় সর্বাধিক সংখ্যক ছাত্র (প্রায় ৪৫%) মানবিক বিষয়সমূহ অধ্যয়ন করছে। ইঞ্জিনিয়ারিং ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে অধ্যয়ন করছে যথাক্রমে ৩২.৫% এবং ৪.৩%।
উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ : ইরানে সরকারি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ বিজ্ঞান, গবেষণা এবং প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীন। অন্যদিকে বেসরকারি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ ইসলামী আজাদ বিশ্বদ্যিালয় নামক অলাভজনক সংস্থার অধীন (সারণী-১)।

সারণী-১ : সরকারি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং কেন্দ্রসমূহ

 সরকারি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (বিজ্ঞান, গবেষণা ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীন)
 বিশ্ববিদ্যালয়   ১০৫
 সায়ত্বশাসিত বিদ্যালয়    ১৬
 উচ্চ শিক্ষাকেন্দ্র     ৯
 ইনস্টিটিউট   ১৩৫
 পায়াম-ই-নূর বিশ্ববিদ্যালয় স্থানীয় শিক্ষাকেন্দ্র এবং ক্যাম্পাস (উন্মুক্ত  বিশ্ববিদ্যালয়)   ৫০০
 প্রায়োগিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়   ১৬৯
 বেসরকারি উচ্চ শিক্ষাকেন্দ্র
 অলাভজনক প্রতিষ্ঠানসমূহ   ২৮৫
 ইসলামিক আজাদ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা (উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় : দেশীয় ও বৈদেশিক)   ৪০৬
 মোট    ১৬২৫

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পার্ক : বর্তমানে ইরানে ৩৩টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পার্ক রয়েছে যার মধ্যে ৮৭.১% বিজ্ঞান, গবেষণা এবং প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীন। চিত্র-১.২-এ ২০০৫ হতে ২০১২ সালের মধ্যে ইরানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পার্কের ব্যাপক বৃদ্ধি দেখানো হয়েছে।

ইরান পরিচিতি : নিশাপুর

-কামাল মাহমুদ
ইরানের অন্যতম প্রসিদ্ধ শহর নিশাপুর। রাজাভী খোরাসান প্রদেশে এর অবস্থান। খ্রিস্টিয় ৩য় শতকে প্রথম শা’পুর এ শহরের গোড়াপত্তন করেন, যা ১৯৩১ সালে মিউনিসিপ্যালিটিতে রূপান্তরিত হয়। ২০১১ সালের হিসাব অনুসারে এ শহরের লোকসংখ্যা ২৭০৩০১ জন। নিশাপুরকে স্থানীয়ভাবে নিশাবুর বা নেইশাবুর নামে উচ্চারণ করা হয়। নিশাপুর নামের উৎপত্তি নিয়ে নানা মতভেদ থাকলেও নিউশা’পুর বা নিউ সিটি অব শা’পুর বা শা’পুরের নতুন শহর এ নামকরণটিই সমধিক প্রসিদ্ধ। এটি প্রাচীন খোরাসানের রাজধানী। কয়েকটি সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল এই নিশাপুর। দক্ষিণ ইরানে এর অবস্থান।
প্রথম শা’পুর একে সাসানী সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলেন। পরবর্তীকালে তাহেরীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবেও এটি পরিগণিত হয়। ৮৩০ সালে আবদুল্লাহ তাহির এর সংস্কার করেন। ১০৩৭ সালে সালজুক সা¤্রাজ্যকালেও এটি রাজধানীর মর্যাদা লাভ করে। আব্বাসী আমলে নিশাপুর সংস্কৃতি, বাণিজ্য এবং ইসলামী বিশ্বের একটি উল্লেখযোগ্য শহর হিসেবে পরিগণিত হয়। নাসের খসরুর সফরনামাসহ প্রাচীন অনেক গ্রন্থে নিশাপুরের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার চমৎকার বর্ণনা রয়েছে। টেক্সাস, চীন, ইরাক ও মিশরের সাথে ইরানের বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক যোগাযোগের রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয় নিশাপুর। ইরানের ব্যবসায়িক রুট হিসেবে নিশাপুরের গুরুত্ব অপরীসীম।
দশম শতাব্দীতে সামানী সা¤্রাজ্যকালে নিশাপুরের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। কিন্তু ১২১১ সালে মোঙ্গলদের আক্রমণের ফলে নিশাপুর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে নিশাপুরে ‘মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্টস’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩৫ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত এটি সাজানো হয়; কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এ মিউজিয়াম লুটতরজের শিকার হয় এবং দর্শনীয় সামগ্রী লণ্ডভণ্ড করা হয়। এ মিউজিয়ামটি প্রাক-ইসলামী যুগের নিদর্শনের জন্য আজো বিশ্বখ্যাত। সা’দ ইয়াখ (প্রশান্তির প্রাসাদ) নবম শতাব্দীতে প্রাচীন নিদর্শনাবলির অন্যতম। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে এটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
সিল্ক রোডের কারণে নিশাপুর যাতায়াতের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ কানেক্টিং পয়েন্ট হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। আনাতোলিয়া থেকে চীন পর্যন্ত সিল্ক রোড সংযোগ স্থাপন করেছে। নিশাপুর ইরানের মালভূমি ও মধ্য এশিয়ার সীমানাবর্তী এলাকা হিসেবেও আলাদাভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বাস ট্রেন উভয় পথেই নিশাপুরে যাতায়াত করা যায়। সড়কপথে ৪৪টি হাইওয়ে রয়েছে যা তেহরান, মাশহাদসহ ইরানের বিভিন্ন শহরের সাথে সংযুক্ত। পর্যটনের জন্য রয়েছে নানা মনোরম দর্শনীয় স্থান।
চেঙ্গিস খানের জামাতা ১২১১ সালে নিশাপুরে নিহত হন এবং চেঙ্গিস খান নিশাপুরের সবাইকে হত্যার নির্দেশ দেন। নারী-পুরুষ, যুবক-বৃদ্ধ, শিশু-কিশোরদের লাশ দিয়ে মোঙ্গলরা নিশাপুরে পিরামিড তৈরি করেছিল।
২০১১ সালের ১৪ এপ্রিল থেকে নিশাপুরে স্বতন্ত্র্য জাতীয় সংগীত চালু করা হয়। নিশাপুরে স্থানীয়ভাবে অনেকগুলো দিবস পালিত হয়ে থাকে। যথা : ১৩ ফারাভারদিন- প্রকৃতি দিবস, ২৫ ফারাভারদিন- আত্তার দিবস, ২৮ উর্দিবেহেশত- খৈয়াম দিবস, ১০ তির- ইমাম আলী রেযা (আ.) দিবস, ২ মোরদাদ- রাজান বন্যা স্মরণ দিবস, ৩০ অযার- ইয়ালদা রাত, ২৯ বাহমান- নিশাপুর ট্রেন দুর্ঘটনা দিবস, ২৫ রজব- মূসা আল কাযিম (আ.)-এর শাহাদাত দিবস প্রভৃতি।
সালজুক আমলে শিল্পের দিক থেকে নিশাপুর বাগদাদ, কায়রো ও তুঘরিলের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচিত হতো। ১০৩৭ সালে এখানে অনেক বসতি ছিল। সে সময়ে নিশাপুর পৃথিবীর দশটি সমৃদ্ধ নগরীর অন্যতম হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছিল। ইসলামী স্বর্ণযুগে বিশেষত নবম ও দশম শতাব্দীতে মৃৎশিল্প সহ অন্যান্য শিল্পের অন্যতম কেন্দ্রস্থল ছিল নিশাপুর। অধিকাংশ সিরামিক দ্রব্য নিশাপুরেই তৈরি হতো- যার নিদর্শন তেহরান, মাশহাদ ও নিশাপুরের মিউজিয়ামে কিয়দংশ সংরক্ষিত আছে। বর্তমানে নিশাপুরে চারটি মৃৎশিল্প কারখানা রয়েছে। নিশাপুরের প্রায় ৪৭০টি গ্রামে কার্পেট বোনা হয়। তন্মধ্যে শাফী আবাদ, গারীনে দারুদ, বোযগান, সৈয়দাবাদ, সারচাহ, সুলতান আবাদ প্রভৃতি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। বিশ্বের বৃহৎ আকৃতির কার্পেটের অনেকগুলোই নিশাপুরের তৈরী। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, শেখ যায়েদ মসজিদ, সুলতান কাবুস মসজিদ, আর্মেনিয়ার রাজপ্রাসাদ, তেহরানস্থ ফিনল্যান্ড এম্বেসী, ওমানের আল আমিন মসজিদ সহ বিভিন্ন বৃহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নিশাপুরের বৃহৎ কার্পেট ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
নিশাপুরে বেশ কতগুলো শিল্পকারখানা রয়েছে। এখানে রয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। কৃষিক্ষেত্রে নিশাপুরের অবদান উল্লেখ করার মতো। নিশাপুরের তুলার খ্যাতি বিশ্বজোড়া। যার বেশিরভাগ কার্পেট তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
নিশাপুরের সিরামিক আজো বিশ্বখ্যাত; বিশেষত পশ্চিমা বিশ্বের কাছে। এখানকার অন্যতম শিল্প হলো টাইল্স ও মোজাইক। এখানে প্রাচীনকাল থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভবনের গায়ে নানা রংয়ের টাইল্স খোদাই করা হয়ে থাকে। বিশেষত নীল রংয়ের টাইল্স; কেননা, এই রঙ-কে ‘কালার অব হ্যাভেন’ বা ‘স্বর্গীয় রঙ’ মনে করা হয়ে থাকে। কাঠ খোদাই, হাতে বোনা কাপড়, পশমি কাপড়, পেইন্টিং, ক্যালিগ্রাফি, ভাস্কর্য, দেয়াল পেইন্টিং প্রভৃতিতে নিশাপুরের ঐতিহ্য সুপ্রাচীন।
নিশাপুরে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে আরবি ও ফারসি প্রচলিত রয়েছে। কোন কোন প্রতিষ্ঠানে ইংরেজির প্রচলন রয়েছে। তবে নিশাপুরের অধিকাংশ লোক ফারসি ভাষায় কথা বলে। অধিকাংশই ইসলাম ধর্মের অনুসারী এবং বারো ইমামী শিয়া মাযহাবে বিশ্বাসী। উল্লেখযোগ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ইসলামিক আযাদ ইউনিভার্সিটির মূল শাখা- যার অনেকগুলো শাখা ইরানের বিভিন্ন প্রদেশে রয়েছে।
নিশাপুরের বিখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যে আবু সাঈদ আবুল খায়ের, ওমর খৈয়াম, ফরিদ উদ্দিন আত্তার, সা’দাত আলী খান, হোসেন ওয়ালীদ খোরাসানী, যারতুশতীয়ান ধর্মমতের প্রবক্তা মাযদাক, ইসহাক ইবনে রাওয়াহ, ইবনে খুজামা, মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ, আল জুয়াইনী, সালিম নিশাপুরী, মুহাম্মাদ রেযা শাফেয়ী কাদকানী, আবুল হাসান দাউদী, হোসাইন সায়েদী প্রমুখ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
খেলাধুলায় নিশাপুর বেশ অগ্রসর। এখানকার পেশাদার ফুটবল দলের নাম হচ্ছে ‘জাহান ইলেট্রিক নিশাপুর’। ইনডোর খেলাধুলার জন্য ‘ইনকিলাব স্পোর্টস কমপ্লেক্স’- যেখানে বাস্কেটবল, ভলিবলসহ নানা প্রকার ইনডোর খেলার ব্যবস্থা রয়েছে।
ভৌগোলিক দিক দিয়ে ১২১৩ স্কয়ার মিটার উর্বর সমভূমি রয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে রয়েছে মাউন্ট বিনালুদ। নিশাপুরের আবহাওয়া ভূমধ্যসাগরীয়। বসন্ত ও শীত এখানকার দৃশ্যমান প্রধান ঋতু। মাঝে মধ্যে বৃষ্টিপাতও হয়ে থাকে। নিশাপুর ভূকম্পনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ভূকম্পনে নিশাপুর মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ১৯৮৭ সালে বোজন গ্রামে বন্যায় ১০০০ লোক নিহত ও বহু লোক আহতসহ নানা প্রকার ক্ষয়ক্ষতি হয়।
নিশাপুরে মাসিক ও সাপ্তাহিক অনেকগুলো পত্রিকা প্রকাশিত হয়। খোরাসান অঞ্চলের প্রথম পত্রিকা ‘মর্নিং অব নিশাপুর’ ১৯৮৯ সাল থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছে। অন্যান্য পত্রিকার মধ্যে ২০০২ সাল থেকে ‘সাদিকেহ’, ২০০৪ সাল থেকে খৈয়াম, ২০০৬ সাল থেকে নাসিম, ২০১০ সাল থেকে সী র্মোগ প্রভৃতি নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছে।
পৃথিবীর প্রাচীন নগরীগুলোর অন্যতম নিশাপুর প্রাকৃতিক নৈসর্গে ভরা এক ভূমি। নিশাপুরে জন্ম নিয়েছেন সেসব বিখ্যাত মানুষ যাঁরা জগৎমাঝে চিরস্মরণীয় থাকবেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন কবি, সাহিত্যক, দার্শনিক, চিকিৎসক, ধর্মবেত্তা, ধর্মমতের প্রবক্তা প্রমুখ। ফারসি কবিতার শিরোমনি আত্তার, খৈয়াম, আবু সাঈদ আবুল খায়ের শাফেয়ী কাদকানীসহ অনেক কবি এ নিশাপুরের সন্তান। নিশাপুর ইরানের অন্যতম সংস্কৃতি নগরী হিসেবে খ্যাত। ভ্রমণপিপাসু মানুষের কাছে নিশাপুর অনন্য নাম। নান উত্থান-পতন আর ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে নিশাপুর আজো পৃথিবীর বিখ্যাত নগরী হিসেবে স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে আছে।