All posts by pavel

স্মরণীয় বাণী

মহানবী (সা.) বলেন : জ্ঞান হলো গুপ্ত ভাণ্ডারতুল্য। আর তার চাবিকাঠি হলো প্রশ্ন। অতএব, প্রশ্ন কর, আল্লাহ্ তোমাদের অনুগ্রহ করবেন। কারণ, চার ব্যক্তির জন্য পুরস্কার ও পারিশ্রমিক রয়েছে : প্রশ্নকারী, বক্তা, শ্রোতা আর তাদের ভক্তিকারী।

মহানবী (সা.) বলেন : আমার প্রতিপালক আমাকে নয়টি জিনিসের উপদেশ দিয়েছেন : প্রকাশ্য ও গোপনে নিষ্ঠা অবলম্বন করা, সন্তুষ্টি আর ক্রোধের অবস্থায় ন্যায়পরায়ণ থাকা, অভাব ও প্রাচুর্যের সময় মধ্যপন্থা অবলম্বন করা, আর যে আমার প্রতি অত্যাচার করে তাকে যেন ক্ষমা করি, আর আমার প্রতি যে কৃপণতা করে তাকে প্রদান করা, আর যে আমার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে তার সাথে যেন সম্পর্ক গড়ি, আর আমার নীরবতা যেন হয় চিন্তা-গবেষণা, আর আমার কথা যেন হয় যিকির আর আমার তাকানো যেন হয় শিক্ষাগ্রহণ।

মহানবী (সা.) বলেন : চারটি জিনিস যার মধ্যে থাকে সে আল্লাহর মহিমাময় জ্যোতিসমৃদ্ধ হয় : যার সকল কাজের আশ্রয়স্থল হয় আল্লাহর একত্ববাদ এবং আমি তাঁর প্রেরিত হওয়ার সাক্ষ্য প্রদান, তার ওপর বিপদ আপতিত হলে বলে ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’। আর ভালো কিছু লাভ করলে বলে ‘আলহামদুুলিল্লাহ্’। আর অপরাধ করলে বলে ‘আসতাগফিরুল্লাহ্ ওয়া আতুবু ইলাইহি’।

মহানবী (সা.) বলেন : সৃষ্টির প্রতি আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষণ হলো তাদের (দ্রব্যসমূহের) মূল্য সস্তা হওয়া এবং তাদের শাসকের ন্যায়বিচারক হওয়া। আর সৃষ্টির প্রতি আল্লাহর ক্রোধের লক্ষণ হলো তাদের শাসকদের অবিচারক হওয়া এবং তাদের (পণ্যদ্রব্যসমূহের) মূল্য চড়া হওয়া।

ইমাম (আ.) বলেন : দুনিয়ায় নিরাসক্ত হলো সেই ব্যক্তি, হারাম যার ধৈর্যকে লুটে নিতে পারে না আর হালাল তাকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ থেকে বিরত রাখতে পারে না।

ইমাম আলী (আ.) বলেন : বেহেশতের গুপ্তধনসমূহের অন্যতম হলো পুণ্যকাজ করা, পুণ্যকাজকে গোপন করা, বিপদ-আপদে ধৈর্যধারণ করা আর দুঃখ-কষ্টকে আড়াল করা।

ইমাম আলী (আ.) বলেন : আমি তোমাদের ব্যাপারে দুটি জিনিসের ভয় পাই : প্রলম্বিত আশা আর প্রবৃত্তির অনুসরণ। প্রলম্বিত আশা পরকালকে ভুলিয়ে দেয়। আর প্রবৃত্তির আনুগত্য সত্য থেকে বিরত রাখে।

ইমাম আলী (আ.) বলেন : যাকে চাও (তার) উপকার কর, যাতে তোমার (ভালোবাসায়) বন্দি হয়ে পড়ে।

ইমাম আলী (আ.) বলেন : জিহ্বা হলো একটি দাঁড়িপাল্লা, অজ্ঞতা একে হালকা করে আর বুদ্ধি একে ভারী করে।

ইমাম হাসান (আ.)-কে প্রশ্ন প্রশ্ন করা হয় : আত্মসংযম কী? তিনি বলেন : তাকওয়ার প্রতি আকর্ষণ এবং দুনিয়া থেকে অনাসক্তি। প্রশ্ন করা হয় : সহিষ্ণুতা কী? তিনি বলেন : ক্রোধ সংবরণ করা ও প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা।

ইমাম হাসান (আ.) বলেন : নিকৃষ্টতা হলো এটা যে, নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে না।

ইমাম আলী ইবনুল হোসাইন যায়নুল আবেদীন (আ.) বলেন : তাকওয়ার সাথে কোনো কাজই কম নয়। কীভাবে তা কম বলে গণ্য হবে যখন তা আল্লাহর কাছে গৃহীত হয়েছে!

ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) বলেন : মহত ও বিনয়ী হওয়া ব্যতীত শুধু কুরাইশ বংশীয় বা আরব হওয়ার মধ্যে কোনো মর্যাদা নেই, তাকওয়ার অধিকারী হওয়া ব্যতীত কোনো সম্মান নেই, আর (সঠিক) নিয়ত ব্যতীত কোনো কর্মেরই মূল্য নেই, আর নিগুঢ় জ্ঞান ব্যতীত কোনো ইবাদত নেই। সাবধান! আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বিরাগভাজন ব্যক্তি হলো সেই ব্যক্তি যে নিজেকে কোনো ইমামের অনুসারী বলে মনে করে, অথচ তাঁর কর্মের অনুসরণ করে না।

ইমাম আলী ইবনে মুহাম্মাদ আন-নাকী (আ.) বলেন : কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনকারী যে নেয়ামতের কারণে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে তার চেয়ে স্বয়ং কৃতজ্ঞতা দ্বারা বেশি সৌভাগ্যবান হয়। কারণ, নেয়ামত হলো দুনিয়ার সামগ্রী। আর কৃতজ্ঞতা দুনিয়া ও পরকালের নেয়ামত।

ইমাম নাকী (আ.) বলেন : যে ব্যক্তি নিজের মূল্য বোঝে না তার অনিষ্ট থেকে নিশ্চিন্ত থেক না।

ইমাম নাকী (আ.) বলেন : দুনিয়া হলো একটি বাজার যেখান থেকে কিছুসংখ্যক লোক লাভবান হয় আর কিছুসংখ্যক লোক লোকসান করে।

ইমাম হাসান আল আসকারী (আ.) বলেন : কোমর ভেঙে দেওয়া বিপদগুলোর মধ্যে একটি হলো সেই প্রতিবেশী, যে ভালো কাজ দেখলে তা গোপন করে আর মন্দ কাজ দেখলে তা ফাঁস করে দেয়।

ইমাম হাসান আল আসকারী (আ.) বলেন : যে ব্যক্তি নিজ ভাইকে গোপনে উপদেশ দেয় সে তাকে অলঙ্কৃত করল। আর যে তাকে অপরের সামনে উপদেশ দেয় সে তাকে কলঙ্কিত করল।

(তুহাফুল উকূল থেকে সংকলিত)
অনুবাদ : আব্দুল কুদ্দুস বাদশা

সংবাদ বিচিত্রা (বিদেশী সংবাদ)

‘সাম্রাজ্যবাদী ও ইহুদিবাদীরা তাকফিরিদের লেলিয়ে দিয়েছে’- রাহবার
শিয়া-সুন্নি মতভেদ উস্কে দেয়ার যেকোনো পদক্ষেপ আমেরিকা, ব্রিটেন ও ইহুদিবাদী ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষা করবে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুাল্লহিল উজমা খামেনেয়ী। তিনি বলেন, এই তিন শক্তি মধ্যপ্রাচ্যে উগ্র ও মূর্খ তাকফিরি সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিয়েছে।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা গত ১৩ অক্টোবর পবিত্র ঈদে গাদীরে খুম উপলক্ষে সর্বস্তরের জনগণের এক সমাবেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন। রাজনীতি থেকে ধর্মকে আলাদা করে শুধু ব্যক্তিগত জীবনে ইসলামকে সীমাবদ্ধ করে ফেলার প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেক্যুলারদের এ দৃষ্টিভঙ্গির অসারতা প্রমাণের জন্য গাদীরে খুমের ঘটনাই যথেষ্ট; কারণ, ওই দিন শাসনকাজ পরিচালনায় ইসলামের সুস্পষ্ট নীতিমালা ঘোষণা করা হয়।
ইরানের ইসলামী শাসনব্যবস্থাকে প্রতিহত করার জন্য শত্রুরা মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ উস্কে দিচ্ছে বলে উল্লেখ করেন আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী। তিনি বলেন, ইরানের ইসলামী বিপ্লবের পর আমেরিকা, ইহুদিবাদী ইসরাইল এবং ‘ডিভাইড এন্ড রুল’-এর প্রবক্তা ব্রিটেন শিয়া-সুন্নি বিভেদ উস্কে দিয়ে মুসলমানদের আসল শত্রু থেকে তাদের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করেছে।
ঠিক এ লক্ষ্যেই সাম্রাজ্যবাদী ও ইহুদিবাদীরা ইরাক ও সিরিয়াসহ আরো কিছু দেশে তাকফিরি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেন, ওরা ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানকে প্রতিহত করার জন্য আল-কায়েদা ও আইএসআইএল সৃষ্টি করেছে, কিন্তু এখন এসব গোষ্ঠী তাদের জন্য বুমেরাং হয়ে গেছে।
আইএসআইএল বিরোধী কথিত বিমান হামলাকে ভণ্ডামি হিসেবে আখ্যায়িত করে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেন, ইসলামের শত্রুরা এই হামলাকেও মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ উস্কে দেয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। তিনি বলেন,  ইসলাম ও কুরআনের শাসনে বিশ্বাসী প্রতিটি মুসলমানের উচিত তাদের প্রকৃত শত্রু আমেরিকা, ইহুদিবাদী ইসরাইল ও ব্রিটেনের অপরাধী কার্যকলাপ স¤পর্কে সচেতন থাকা।

বিশ্বের সঙ্গে গঠনমূলক সম্পর্ক চায় ইরান- প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি বলেছেন, পুরো বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক চায় তাঁর দেশ। গঠনমূলক যোগাযোগ নীতির ভিত্তিতে তেহরান এ সম্পর্ক গড়ে তুলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে তিনি উল্লেখ করেন। আমেরিকায় বসবাসরত ইরানী নাগরিকদের এক সভায় প্রেসিডেন্ট রুহানি গত ২৫ সেপ্টেম্বর এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, দেশের বাইরে এখন এ বিষয়ে এক ধরনের ঐকমত্য তৈরি হয়েছে যে, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নানা ইস্যুতে ইরানের অনুপস্থিতি পরিস্থিতি জটিল কিংবা অসম্ভব করে তুলছে। তিনি আরো বলেন, সমস্যাসঙ্কুল মধ্যপ্রাচ্যে একটি স্থিতিশীল ও নিরাপদ দেশ হিসেবে বিভিন্ন ইস্যুতে যেকোনো দেশের আগে ইরান বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নিয়েছে।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশনে যোগ দেয়ার পর প্রেসিডেন্ট রুহানি ইরানী নাগরিকদের সভায় বক্তৃতা করেন।

‘সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে সমর্থন দিচ্ছে ইরান’- ড. হাসান রুহানি
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি বলেছেন, সন্ত্রাস-বিরোধী লড়াইয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে সমর্থন দিচ্ছে তেহরান। গত ২২ সেপ্টেম্বর পবিত্র প্রতিরক্ষা সপ্তাহ উপলক্ষে এক সেনা সমাবেশে ড. রুহানি বলেন, কৌশলগত মধ্যপ্রাচ্যে ইরান হচ্ছে স্থিতিশীলতার নোঙর এবং সবসময় নিপীড়িত জাতিগুলোর পাশে দাঁড়াবে। তিনি আরো বলেন, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে অবশ্যই রুখে দাঁড়াতে হবে; এক্ষেত্রে ইরানের সরকার ও সামরিক বাহিনী তাদেরকে সহযোগিতা করবে। শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিরোধ শক্তিগুলোর ভূমিকারও প্রশংসা করেন তিনি।

ইরানের উদ্যোগে পবিত্র মক্কা নগরীতে ইসলামী ঐক্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত
পবিত্র হজ উপলক্ষে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের হজ মিশনের উদ্যোগে গত ৩০শে সেপ্টেম্বর (২০১৪) পবিত্র মক্কা নগরীতে ইসলামী ঐক্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। পবিত্র হজ পালনের লক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত বিরাট সংখ্যক হজযাত্রী ও ইসলামী মনীষী এ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন।
সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বক্তাগণ ইসলাম ও মুসলিম ঐক্যের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে, বিশেষ করে নব উদ্ভূত তাকফিরি গোষ্ঠীসমূহ এবং তাদের পক্ষ থেকে ইসলামের নামে মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হামলা সম্পর্কে আলোচনা করেন।
এ সম্মেলনে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের হজ মিশনের প্রধান হুজ্জাতুল ইসলাম আলী গাযী আসগার তাঁর বক্তব্যে বলেন : ‘মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে তাকফিরি গোষ্ঠীগুলোকে গড়ে তোলার পিছনে উদ্দেশ্য হচ্ছে বর্তমানে ইসলামী জাহান যেসব গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সম্মুখীন সেগুলো থেকে, বিশেষ করে ফিলিস্তিন সমস্যা থেকে বিশ্বের মুসলমানদের দৃষ্টি ফেরানো।’
সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বক্তাগণ অভিমত ব্যক্ত করেন যে, প্রকৃতপক্ষে পাশ্চাত্যের অবৈধ স্বার্থের হেফাযতের লক্ষ্যে মুসলিম জাহানে যে চরমপন্থী ধ্যানধারণার বিস্তার ঘটানো হচ্ছে তার মূলোচ্ছেদ করতে হলে অবশ্যই ইসলামী ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।

ওলামা সম্মেলনে লারিজানি : ‘ইসলামী জাগরণ সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করছে ইরান’
ইরান গোটা মুসলিম বিশ্বে ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও ইসলামী জাগরণ সৃষ্টির চেষ্টা করছে বলে জানান ইরানের সংসদের স্পিকার ড. আলী লারিজানি। গত ৯ সেপ্টেম্বর রাজধানী তেহরানে আন্তর্জাতিক ওলামা সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ সংগ্রামের সমর্থনে এ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
ড. লারিজানি আরও বলেন, ইরানের ইসলামী বিপ্লব মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ করেছে এবং মুসলমানদের সম্মান ও মর্যাদা বাড়াতে ঐক্যের বিকল্প নেই। তিনি বলেন, ইসলামী বিপ্লবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর ভাষণ-বিবৃতিতে মুসলিম ঐক্যের বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। আর কোনো শব্দ এতো বেশি উচ্চারিত হয়নি।
সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের সাম্প্রতিক এক বক্তব্য উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, ‘মুসলমানেরা যাতে পাশ্চাত্যের কাছে ধোঁকা না খায়, সেজন্য তাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে তেহরান। কিন্তু আমরা কখনোই সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চাই না, এমনকি আমরা কোনো পুতুল সরকারও চাই না।’ ইসলামী জাগরণ সৃষ্টির অংশ হিসেবেই ইরান ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ সংগঠনগুলোকে সহযোগিতা দিচ্ছে বলে তিনি জানান।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি হেনরি কিসিঞ্জার বলেন, বিশ্বে ইরানের প্রভাব ক্রমেই বেড়ে চলেছে।

ইরান-রাশিয়া ৭,০০০ কোটি ইউরোর বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর
ইরান ও রাশিয়ার মধ্যকার বাণিজ্য এবং অথনৈতিক স¤পর্ক আরো শক্তিশালী করার জন্য ৭,০০০ কোটি ইউরোর চুক্তি সই হয়েছে। রাশিয়ার বাণিজ্যমন্ত্রী আলেকজান্ডার নোভাক ৯ সেপ্টেম্বর ইরানের রাজধানী তেহরানে এ তথ্য জানান। ইরান-রাশিয়া বাণিজ্য সহযোগিতা কমিশনের ১১তম বৈঠক অনুষ্ঠানের পর তিনি এ ঘোষণা দেন। আলেকজান্ডার নোভাক জানান, যৌথ এ বৈঠকে রাশিয়ার ৪০টি কো¤পানির প্রতিনিধি যোগ দেয়। তবে, কোন কোন ক্ষেত্রে এ চুক্তি বলবৎ হবে তা ¯পষ্ট করেননি তিনি।
নোভাক বলেন, ইরানে বিভিন্ন ধরনের পণ্য ও সেবা রপ্তানি করতে প্রস্তুত রয়েছে রাশিয়া এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান থেকে প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবা আমদানি করতেও প্রস্তুত তারা। নোভাক আরো জানান, তেহরানের ওপর মার্কিন নেতৃত্বাধীন একতরফা পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর রাশিয়া ইরানের তেল ও গ্যাসের বাজার নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। তিনি জানান, ইরানের বাণিজ্য সহযোগিতা বিষয়ে কিছু নিয়ম-কানুন রদবদল করলে রাশিয়া ইরানের তেল শিল্পে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে। রুশ বাণিজ্যমন্ত্রী জানান, খুব শিগগিরি ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ¬াদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করবেন।

ইরানের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক বাড়াতে চায় চীন
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেন, ইরানের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক আরো বাড়ানোর বিষয়ে তার দেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তাজিকস্তানের রাজধানী দোশাম্বেতে গত ১২ সেপ্টেম্বর ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সঙ্গে বৈঠকে এ কথা বলেন প্রেসিডেন্ট জিনপিং। মধ্যপ্রাচ্য এবং বিশ্বে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, তেহরানের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক বাড়াতে চায় বেইজিং। এছাড়া, আগামী বছর সরকারি সফরে ইরানে যাবেন বলেও ঘোষণা করেন তিনি।
প্রেসিডেন্ট রুহানি এ বৈঠকে তেহরান-বেইজিং সম্পর্ককে শক্তিশালী উল্লেখ করে বলেন, আগের সব চুক্তি বাস্তবায়নে ইরান ও চীনের তৎপরতা চালানো উচিত।
এছাড়া এ বৈঠকে আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ে মত বিনিময় করেন এ দুই নেতা। সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা বা এসিও’র শীর্ষ বৈঠকের অবকাশে দু’নেতার মধ্যে এ বৈঠক হয়।

ইরান ও স্পেনের মধ্যে পর্যটন সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত
এবারের বিশ্ব পর্যটন দিবস উপলক্ষে স্পেনের শিল্প, জ্বালানি ও পর্যটন বিষয়ক মন্ত্রী ম্যানুয়েল সোরিয়া লোপেয ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সফর করেন এবং এ উপলক্ষে তেহরানে আয়োজিত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।
উক্ত অনুষ্ঠানের আগে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান ও স্পেনের মধ্যে একটি পর্যটন সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সরকারের পক্ষ থেকে দেশের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার, পর্যটন ও হস্তশিল্প সংস্থার প্রধান মাসউদ সুলত্বানীফার এবং স্পেনের পক্ষ থেকে দেশটির শিল্প, জ্বালানি ও পর্যটন বিষয়ক মন্ত্রী ম্যানুয়েল সোরিয়া লোপেয।
উক্ত চুক্তি অনুযায়ী স্পেন হোটেল নির্মাণ ও ঐতিহাসিক ভবনসমূহকে গেস্টহাউসে রূপান্তর ক্ষেত্রে স্বীয় অভিজ্ঞতা ইরানের সাথে বিনিময় করবে এবং এছাড়াও স্পেনীয় শেয়ারহোল্ডারদেরকে ইরানের হোটেল শিল্পে বিনিয়োগ করার জন্য উৎসাহিত করবে।

ইরানে বিশ্ব পর্যটন দিবস উদ্যাপিত
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সরকারের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার, পর্যটন ও হস্তশিল্প সংস্থার উদ্যোগে গত ২৭শে সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবস উদ্যাপিত হয়।
এ উপলক্ষে রাজধানী তেহরানে একটি অনুষ্ঠানের আযোজন করা হয় যাতে পর্যটন খাতে কর্মরত বিভিন্ন ইরানী সংস্থার প্রতিনিধিবর্গ এবং অনেক সরকারী কর্মকর্তা অংশগ্রহণ করেন। অনুষ্ঠানে ইরানী পর্যটন শিল্পে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখার জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থাকে পুরস্কৃত করা হয়।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের আকাশ সীমা হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নিরাপদ আকাশ সীমা। এছাড়া ইরানের অত্যন্ত চমৎকার আবহাওয়া বৈচিত্র্য ও দায়িত্বশীল সেবা কার্যক্রমের পরিপ্রেক্ষিতে উক্ত আন্তর্জাতিক সংস্থা ইরানকে বিশ্বের সেরা ১০টি পর্যটন আকর্ষণীয় দেশের অন্যতম হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।
এছাড়াও ইসলামী ও হালাল পর্যটন গড়ে তোলার লক্ষ্যে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সরকার প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। ইরান তার সমৃদ্ধ ইতিহাস ও সংস্কৃতির কারণে বিশ্বের পর্যটকদেরকে ব্যাপকভাবে আকর্ষণ করতে সক্ষম হচ্ছে এবং অধিকতর ব্যাপকভাবে পর্যটকদেরকে আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এ লক্ষ্যে সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাগণ এ বিষয়টির প্রতি অধিকতর দৃষ্টি প্রদান করছেন।
উল্লেখ্য, ইরানী সমাজ হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের সর্বাধিক প্রাণচঞ্চল ও বৈচিত্র্যময় সমাজ- যা ইতিহাসপ্রেমিক ও নৃতাত্ত্বিক বৈচিত্র্যের প্রতি আগ্রহী লোকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়।
বস্তুত পর্যটকদের জন্যে আকর্ষণীয় ঐতিহাসিক নিদর্শনের দিক থেকে ইরান হচ্ছে বিশ্বের সমৃদ্ধতম দেশ। এখানকার নাকশে জাহান চত্বর, আর্মেনীয় মঠ ও গির্জা, বাম্ ও তার মনোরম সাংস্কৃতিক দৃশ্য, বিস্তূন্, পাসারগাদ, পার্সেপোলিস, শায়খ ছ¡াফীউদ্দীনের মাযারের সৌধ, শুশ্তারের ঐতিহাসিক পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, সুলত্বানীয়াহ্, ঐতিহাসিক তাবরীয বাজার কমúেøক্স, তাখ্তে সোলায়মান, চোগ¦া জাম্বিল, পারস্য বাগান ইত্যাদি হচ্ছে ইরানের ঐতিহাসিক নিদর্শনাদির অন্যতম যা ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, প্রতি বছর ২৭শে সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবস উদ্যাপিত হয়। বিশ্বের সকল দেশেই বহু মানুষ এ দিবসের অনুষ্ঠানাদিতে অংশগ্রহণ করে থাকে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে পর্যটনের গুরুত্ব বৃদ্ধি এবং এর সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মূল্য সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টিই হচ্ছে এ দিবসটি পালনের উদ্দেশ্য।

রাহ্বারের পক্ষ থেকে ইরানী কুস্তিগীরদের প্রতি অভিনন্দন
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের কুস্তিগীরগণ দেশের জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুনাম অর্জন করায় রাহ্বার হযরত আয়াতুল্লাহ্ উয্মা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী তাঁদেরকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। ন্যাশনাল ইরানীয়ান গ্রেকো-রোমান রেসলিং টীম চলতি ২০১৪ সালের রেসলিং ওয়ার্ল্ড্ চ্যাম্পিয়নশীপ অর্জন করায় তিনি এ অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী এক বাণীতে এ বিজয়ের জন্য জাতীয় কুস্তিগীর টীমের সদস্যদেরকে এবং এ টীমের টেকনিক্যাল স্কোয়াডকে অভিনন্দন জানান। তিনি দেশের জন্য বিরাট সম্মান নিয়ে আসার কারণে এ টীমকে ধন্যবাদ জানান এবং এ বিজয় উপলক্ষে ইরানী জনগণকেও অভিনন্দন জানান।
উল্লেখ্য, উযবেকিস্তানের তাসখন্দে অনুষ্ঠিত রেসলিং ওয়ার্ল্ড্ চ্যাম্পিয়নশীপ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে ন্যাশনাল ইরানীয়ান গ্রেকো-রোমান রেসলিং টীম প্রথম বারের মতো ৪২ পয়েন্ট অর্জন করে।
উযবেকিস্তানের জিমন্যাস্টিক প্যালেসে অনুষ্ঠিত এ প্রতিযোগিতায় ৫৯ কেজি ক্যাটেগরিতে ইরানী কুস্তিগীর হামীদ সুরীয়ান তাঁর রুশ প্রতিদ্বন্দ্বী মিন্গিয়ান সেমেনোভকে ২-১ পয়েন্টে হারিয়ে দ্বিতীয় স্থানে ঠেলে দিয়ে চ্যাম্পিয়নশীপ অর্জন করেন। উল্লেখ্য, হামীদ সুরীয়ান ইতিপূর্বে ২০১২ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত অলিম্পিক গেম্স্-এ কুস্তি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে স্বর্ণ পদক জয় করেছিলেন। ঐ সময় পর্যন্ত তিনি মোট ছয়টি স্বর্ণ পদকের অধিকারী হন এবং এবারে স্বর্ণ পদক জয়ের মধ্য দিয়ে তিনি সাতটি স্বর্ণ পদক বিজয়ী একমাত্র ইরানী কুস্তিগীরের মর্যাদায় অধিষ্ঠত হলেন।

আবারো বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষ হলেন ইরানের সালিমি
দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠানরত এশিয়ান গেমসে ভারোত্তোলন প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ইরান। দেশটির ভারোত্তোলক বেহদাদ সালিমি গত ২৬ সেপ্টেম্বর চীন ও তাইওয়ানের প্রতিদ্বন্দ্বীদেরকে হারিয়ে এ বিজয় ছিনিয়ে নেন। এর ফলে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হচ্ছেন। তাঁর এই শক্তিমত্তার জন্য তাঁকে বলা হয় ইরানের ‘হারকিউলিস’।
সালিমি এশিয়ান গেমসে ওজন তুলেছেন ২৫৫ কেজি। ২৪৫ কেজি ওজন তুলতে ব্যর্থ হয়েও দ্বিতীয় হন চীনা প্রতিদ্বন্দ্বী।
এদিকে, সালিমি ২৫৫ কেজি ওজন তুললেও বিশ্ব রেকর্ড ভাঙতে পারেন নি। এ রেকর্ডের মালিক হচ্ছেন তাঁর নিজ দেশের ক্রীড়াবিদ হোসেইন রেজাজাদেহ। তিনি ২০০০ সালের সিডনি অলিম্পিকে তুলেছিলেন ২৬৩ কেজি। সালিমি এবারের এশিয়ান গেমসে ইরানের পক্ষে পতাকা বহনের দায়িত্ব পালন করেন।

এশিয়ান গেম্স্-এ ইরানী ফ্রি-স্টাইল কুস্তিগীরের স্বর্ণ পদক জয়
দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেম্স্ ২০১৪-এ ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ফ্রি-স্টাইল কুস্তিগীর মাসউদ ইসমাঈল-র্পু চমৎকার নৈপুণ্য প্রদর্শন করে দেশের জন্য একটি স্বর্ণপদক জয় করেন।
মাসউদ ইসমাঈল-র্পু এ প্রতিযোগিতায় সেমি-ফাইনালে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কাযাকিস্তানের কুস্তিগীর দাউলাত নিয়ায্বেকোভকে ৮-৩ পয়েন্টে হারিয়ে ফাইনালে উন্নীত হন। ফাইনালে তিনি তাঁর ভারতীয় প্রতিদ্বন্দ্বী বজ্রং বজ্রংকে ৬-৪ পয়েন্টে পরাজিত করে স্বর্ণপদকের অধিকারী হন।
এশিয়ান গেম্স্ ২০১৪-এ এছাড়াও ইরানী কুস্তিগীর রেযা ইয়ায্দানী পুরুষদের ৯৭ কেজি ক্যাটেগরিতে ফ্রি-স্টাঈল কুস্তি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে তাঁর কিরগিযিস্তানি প্রতিদ্বন্দ্বী মাহ্মূদ মূসায়েভকে ১৪-৪ পয়েন্টে পরাজিত করে স্বর্ণপদক লাভ করেন।

ভেনিসের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ইরানী চলচ্চিত্র নির্মাতা রাখ্শান্ বানী এ‘তেমাদের বিরাট সাফল্য
সম্প্রতি ইতালীর ভেনিস্-এ অনুষ্ঠিত একাত্তরতম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় মহিলা চলচ্চিত্র নির্মাতা রাখ্শান্ বানী এ‘তেমাদ্ পুরস্কৃত হয়েছেন।
এ উৎসবে রাখ্শান্ বানী এ‘তেমাদ্-এর নির্মিত ঞধষবং (গল্পসমূহ) চলচ্চিত্রটি সেরা স্ক্রিন্প্লে হিসেবে নির্বাচিত হয় এবং উৎসবের সমাপ্তি দিবস গত ৬ই সেপ্টেম্বর (২০১৪) তারিখে ভেনিস্ লিদো-তে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানে তাঁকে পুরস্কার প্রদান করা হয়। এ চলচ্চিত্রটি আরো ১৮টি চলচ্চিত্রের সাথে উৎসবের মূল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে গোল্ডেন লায়ন অ্যাওয়ার্ড লাভ করে।
রাখ্শান্ বানী এ‘তেমাদ্ তাঁর Tales চলচ্চিত্রটিতে সাতটি সংক্ষিপ্ত কাহিনী পরিবেশন করেছেন। এতে তিনি তাঁর ইতিপূর্বে নির্মিত চলচ্চিত্র The Blue-Veiled, Under the Skin of the City ও Mainline চলচ্চিত্রের কয়েকটি প্রধান চরিত্রের পরিণতিকে তুলে ধরেছেন।
উল্লেখ্য, রাখ্শান্ বানী এ‘তেমাদ্ তাঁর চলচ্চিত্রসমূহে সামাজিক সমস্যাবলির সমাধান নির্দেশের জন্য সুপরিচিত। তিনি এ পর্যন্ত অনেকগুলো ফিচার- পূর্ণদৈর্ঘ্য ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ছাড়াও বিভিন্ন প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। তাঁর নির্মিত এসব চলচ্চিত্র অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেছে।
রাখ্শান্ বানী এ‘তেমাদ্ এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমার চলচ্চিত্রসমূহের চরিত্রগুলো বাস্তব- যাদের মধ্য থেকে অনেকের সাথে আমার প্রতিদিনই দেখা হয়।’
উল্লেখ্য, ভেনিস্-এ অনুষ্ঠিত একাত্তরতম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে আরেক জন ইরানী চলচ্চিত্র নির্মাতা নীমা জাভীদী-র নির্মিত প্রথম ফিচার পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র Melbourne চলচ্চিত্র সমালোচকদের সর্বাধিক দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়। এ চলচ্চিত্রটি প্রদর্শনের মাধ্যমে উৎসবের ক্রিটিক্স্ উইক সেকশনের উদ্বোধন করা হয়।
এ বছরের ভেনিস্ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের প্রধান ছিলেন ফরাসি চলচ্চিত্র নির্মাতা আলেকজান্দার দেস্প্লাত্। এ উৎসবটি গত ২৭শে আগস্ট (২০১৪) তারিখে শুরু হয় এবং ৬ই সেপ্টেম্বর সমাপ্ত হয়।

বাগদাদ চলচ্চিত্র  উৎসবে বিরাট সংখ্যক ইরানী চলচ্চিত্রের অংশগ্রহণ
১৫ থেকে ১৯শে অক্টোবর (২০১৪) পর্যন্ত ইরাকের রাজধানী বাগদাদে আয়োজিত ষষ্ঠ বাগদাদ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের প্রধান আকর্ষণ ছিল বিপুল সংখ্যক ইরানী চলচ্চিত্র প্রদর্শন। এ উৎসবে বিভিন্ন ক্যাটেগরিতে প্রদর্শনের জন্য মোট ৬১টি ইরানী চলচ্চিত্র বাছাই করা হয় এবং এগুলোর মধ্য থেকে পুরস্কারের জন্য প্রতিযোগিতা বিভাগে অংশগ্রহণের জন্য বাছাইকৃত চলচ্চিত্রের সংখ্যা দশটি।
উল্লেখ্য, ষষ্ঠ বাগদাদ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শনের জন্য নির্বাচিত চলচ্চিত্র সমূহ দীর্ঘ গল্প, প্রামাণ্য, স্বল্পদৈর্ঘ্য নাটক, মানবিক ভাবমূর্তি (মানবাধিকারের ওপর আলোকপাতকারী চলচ্চিত্র), আরব নারী চলচ্চিত্র নির্মাতা বিভাগ ইত্যাদি বিভিন্ন বিভাগে বিভক্ত করা হয়।
এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ্য যে, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সম্প্রতি বাগদাদে একটি সিনেমাটিক ট্রেনিং সেন্টার খুলেছে। এ সেন্টারে বিভিন্ন ক্যাটেগরির চলচ্চিত্র নির্মাণ, অভিনয় ও স্ক্রিন্-প্লে লেখার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সেন্টারটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বহু সংখ্যক ইরানী ও ইরাকী সাংস্কৃতিক কর্মকর্তা অংশগ্রহণ করেন।
উল্লেখ্য যে, গত বছর বাগদাদে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের বিভিন্ন বিভাগে বেশ কিছু সংখ্যক ইরানী চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয় এবং এতে পুরস্কারের জন্য প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে তিনটি ইরানী চলচ্চিত্র পুরস্কৃত হয়।

ইরান চিকিৎসাবিজ্ঞানে ১৮তম স্থান অর্জন করল
ইরানের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের কঠোর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও দেশটি জ্ঞান-বিজ্ঞানে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করে চলেছে। বিশেষ করে ওষুধ উৎপাদনে ইরানের সাফল্য উল্লেখ করার মতো।
চলতি ২০১৪ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চিকিৎসা সংক্রান্ত জ্ঞান উৎপাদনে ইরান বিশ্বে ১৮তম স্থানে রয়েছে। কয়েকটি আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক কেন্দ্রের পরিসংখ্যানে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের শিক্ষা বিষয়ক উপ-ব্যবস্থাপক আমির মোহসেন জিয়ায়ি বলেন, বিশ্বের ২৩৮টি দেশের মধ্যে ইরান ১৮তম স্থান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এর আগে ২০১১ সালে চিকিৎসা সংক্রান্ত জ্ঞান তথা উঁচু মানের গবেষণাপত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে বিশ্বে ইরান ২৩তম স্থান অধিকার করেছিল। ২০০০ সালে এ ক্ষেত্রে ইরানের অবস্থান ছিল ৫৩।
গত কয়েক বছরে ইরান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি সাধন করেছে। মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘থমসন রয়টার্স’ এর সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী চলতি বছর বৈজ্ঞানিক জ্ঞান উৎপাদন ও গবেষণায় ইরান বিশ্বে ২০তম স্থান অধিকার করেছে। ইন্সটিটিউট অব সায়েন্টিফিক ইনফরমেশন- আইএসআই জানিয়েছে, ১৯৯৯ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক জার্নালগুলোতে ইরান ৬০,৯৭৯টি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ প্রকাশ করেছে।
বৈজ্ঞানিক জ্ঞান উৎপাদনে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে ইরানের অবস্থান সবার শীর্ষে। এছাড়া এর আগে ন্যানোটেকনোলজি বিষয়ক গবেষণা কাজে মধ্যপ্রাচ্যে প্রথম ও বিশ্বে অষ্টম স্থান অর্জন করে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান।

দুটি অত্যাধুনিক রাডার ব্যবস্থা উদ্বোধন করল ইরান
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দেশে তৈরি দু’টি অত্যাধুনিক রাডার ব্যবস্থার উদ্বোধন করেছে। দু’টি রাডারই স্টিলথ বিমান ও দূরবর্তী লক্ষ্যবস্তুকে শনাক্ত করতে সক্ষম। গত ১ সেপ্টেম্বর জাতীয় বিমান প্রতিরক্ষা দিবস উপলক্ষে শীর্ষ সামরিক কমান্ডারদের উপস্থিতিতে এসব রাডার উদ্বোধন করা হয়।
রাডার ব্যবস্থা দু’টির নাম দেয়া হয়েছে অরাশ-২ এবং কেইহান। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে খাতামুল আম্বিয়া বিমান প্রতিরক্ষা ঘাঁটির কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফারজাদ ইসমাইলি উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, কেইহান হচ্ছে দ্বিমাত্রিক রাডার ব্যবস্থা। এটি প্রচলিত জঙ্গি বিমানের পাশাপাশি স্টিল্থ বিমান শনাক্ত করতে পারে। স্টিল্থ বিমানগুলো অনেক উঁচু দিয়ে উড়তে পারে। অরাশ-২ রাডার ব্যবস্থাও এক লাখ ফুট উঁচুতে অবস্থানকারী বিমানকেও শনাক্ত করতে পারে।

রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম হেলিকপ্টার তৈরি করছে ইরান
স¤পূর্ণ নিজস্ব প্রযুক্তিতে রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম হেলিকপ্টার তৈরি করছে ইরান। ইরানের হেলিকপ্টার্স লজিস্টিক্স অ্যান্ড রিনোভেশন অর্গানাইজেশন বা আইএইচএলআরও’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মাদ আলী আহমাদাবাদি গত ৫ সেপ্টেম্বর এ খবর জানিয়ে বলেন, প্রতিরক্ষা শিল্পে উত্তরোত্তর সাফল্যের ধারাবাহিকতায় এ হেলিকপ্টার নির্মাণ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, পুরনো হেলিকপ্টারগুলো সংস্কারের পাশাপাশি প্রতিরক্ষা খাতে আগামী দিনের প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করে নতুন তিন মডেলের হেলিকপ্টারের ডিজাইন স¤পন্ন করেছে আইএইচএলআরও। এই তিন মডেলের মধ্যে একটি হেলিকপ্টার শত্রুর রাডার ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিতে পারবে।
জেনারেল আহমাদাবাদি বলেন, ১৪ আসনের মাঝারি-ভারী ‘হোমা’ হেলিকপ্টারটি রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম এবং এতে অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র বহন ও নিক্ষেপ করার ব্যবস্থা রয়েছে। সেই সঙ্গে দুই ইঞ্জিনবিশিষ্ট ৮ আসনের ‘সাবা’ হেলিকপ্টার নৌবাহিনীর জন্য তৈরি করা হলেও এটি দিয়ে দুর্যোগের মুহূর্তে ত্রাণ ও উদ্ধার তৎপরতা চালানো যাবে। স¤পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি তৃতীয় হেলিকপ্টারটি সামরিক প্রশিক্ষণের কাজে ব্যবহৃত হবে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদনের ক্ষেত্রে ইরান স্বয়ংস¤পূর্ণতা অর্জন করেছে। নিজের প্রয়োজন মিটিয়ে বিশ্বের বহু দেশের কাছে সমরাস্ত্র রপ্তানি করছে তেহরান। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান বহুবার বলেছে, তার প্রতিরক্ষা সক্ষমতা প্রতিবেশী দেশগুলোর পাশাপাশি মুসলিম বিশ্বের জন্য কোনো হুমকি সৃষ্টি করছে না বরং নিছক আত্মরক্ষার স্বার্থে প্রতিরক্ষা ক্ষমতা শক্তিশালী করছে তেহরান।

আকাশে যুদ্ধের উপযোগী ক্ষেপণাস্ত্রসজ্জিত ড্রোন উন্মোচন করল ইরান
ইরান ক্ষেপণাস্ত্রসজ্জিত প্রথম ড্রোন উন্মোচন করেছে। আকাশ যুদ্ধের উপযোগী চালকবিহীন এ বিমান নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি করেছে ইরান। গত ২৪ সেপ্টেম্বর এটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ইরানের উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমির হাতামি বলেন, যুদ্ধে ব্যবহারের উপযুক্ত এ ড্রোন এরই মধ্যে পরিচালনা সংক্রান্ত যাবতীয় পরীক্ষায় উতরে গেছে। পরীক্ষা চালানোর সময় এ ড্রোন দিয়ে পূর্ব নির্ধারিত লক্ষ্যবস্তুতে সফলভাবে আঘাত হানা হয়েছে। আকাশ যুদ্ধের উপযোগী ড্রোনটি ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর কাছে হস্তান্তরের জন্য প্রস্তুত বলে জানানো হয়েছে।
জেনারেল হাতামি জানান, সশস্ত্র বাহিনীর অভিযান চালানোর পরিধি আরো বাড়াতে সহায়তা করবে এ ড্রোন। এতে আগ্রাসী শত্রুর বিমানকে তাড়া করা, প্রতিহত করা এবং ধ্বংস করার সক্ষমতা বাড়বে ইরানের। তিনি বলেন, উড়ন্ত নানা ধরনের বিমানসহ জঙ্গি বিমান, হেলিকপ্টার, চালকহীন বিমান ধ্বংস করতে সক্ষম নতুন এ ড্রোন।

বিশ্বে ন্যানো প্রযুক্তি সংক্রান্ত জ্ঞান উৎপাদনে ৭ম স্থানে ইরান
গত ৬ অক্টোবর ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ন্যানো টেকনোলজি ইনিশিয়েটিভ কাউন্সিল বা আইএনআইসি’র সচিব সায়িদ সারকর বলেছেন, ন্যানো প্রযুক্তি সংক্রান্ত জ্ঞান উৎপাদনে ইরান বিশ্বে সপ্তম স্থান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এর আগে ইরান অষ্টম স্থানে ছিল। একই সঙ্গে মুসলিম বিশ্বে এখনো ইরান শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। তেহরানে সপ্তম আন্তর্জাতিক ন্যানোপ্রযুক্তি উৎসবের অবকাশে এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন। তিনি আরো বলেন, ইরানের ন্যানো প্রযুক্তি গোটা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং অনেক দেশই এ বিষয়ে ইরানের সহযোগিতা চাইছে। বর্তমানে ২০ হাজার বিশেষজ্ঞ ও গবেষক ন্যানো প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে বলে তিনি জানান।

ইরানী গবেষকদের স্ট্রেস ক্যালকুলেটর তৈরি
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের গবেষকগণ ব্রেসলেট আকারের একটি যন্ত্র তৈরি করেছেন যা মানুষের স্ট্রেস (মানসিক চাপ) পরিমাপ ও রেকর্ড করার কাজে ব্যবহার করা যাবে।
উক্ত যন্ত্রটি তৈরির প্রকল্প বাস্তবায়নকারী গবেষকদের অন্যতম ড. হোসাইন হাসানপুর বলেন, এ যন্ত্রটিতে একটি কম্পিউটার  গেম দেয়া হবে যা লোকদের মানসিক চাপ কমানোতে সাহায্য করবে।
তিনি জানান যে, এ যন্ত্রটি পেশাদার ক্রীড়াবিদরাও ব্যবহার করতে পারবেন। তিনি বলেন, জাতীয় টীমসমূহের ক্যাম্পগুলোতে পেশাদার ক্রীড়াবিদদের অন্যতম প্রধান সমস্যা হচ্ছে এমন ধরনের মানসিক চাপ যে সম্পর্কে এমনকি তাঁরা নিজেরাও সচেতন থাকেন না। অথচ অনেক সময় একজন ক্রীড়াবিদের এমনকি সামান্যতম মানসিক চাপও গেম্-এর ফলাফলকে পাল্টে দিতে পারে।
ড. হাসানপুর বলেন, মানসিক চাপ মানুষের হৃদপিণ্ডের স্পন্দন বৃদ্ধি করে এবং তার চামড়ার প্রতিরোধক্ষমতাকে কমিয়ে দেয়। তিনি বলেন, সুতরাং আঙ্গুলসমূহের সাথে লাগানো সেন্সরের সাহায্যে চামড়ার প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্যালকুলেট করে একজন লোকের পক্ষে এমন সঙ্কেত তৈরি করা সম্ভব যা মানসিক চাপের ১৬টি নিদর্শন নির্দেশ করে।
তিনি বলেন, ব্রেসলেটটি ব্লুটুথ-এর সাহায্যে কম্পিউটারের সাথে যুক্ত করা হয়- যা তার মধ্যে সৃষ্ট মানসিক চাপের মাত্রাকে শব্দ, ছবি বা চার্টের আকারে প্রদর্শন করে ।

ইরান পরিচিতি : তাবরীয

– কামাল মাহমুদ
ইরানের একটি জনবহুল শহরের নাম তাবরীয। ইরানের পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের রাজধানী তাবরীয। এ নগরীর ইতিহাস ৪৫০০ বছরেরও বেশি। ইরানের অন্যতম পরিচ্ছন্ন নগরীর সুনাম কুড়িয়েছে তাবরীয। এর অবস্থান তেহরান থেকে ৬১৯ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে; সমুদ্র সমতল থেকে ১৩৫০ মিটার উচ্চতায় এবং শাহান্দ পর্বতের উপত্যকায় অবস্থিত। এর পূর্ব দিকে তুরস্কের সাথে ৩১০ কিলোমিটার সীমান্ত এবং দক্ষিণে ১৫৯ কিলোমিটার আজারবাইজান সীমান্ত। সড়ক পথে তুরস্ক, ইউরোপ ও মস্কোর সাথে যাতায়াত রয়েছে। তেহরান, ইস্তাম্বুল ও অন্যান্য শহর থেকে আকাশ পথে তাবরীযের সাথে যোগাযোগ রয়েছে।
১২৬৫ খ্রিস্টাব্দে ইলখানী আমলে তাবরীয রাজধানী হবার গৌরব লাভ করে। ১২৯৫ খ্রিস্টাব্দে গাযান খানের সময় রাজধানী হিসেবে তাবরীয এর সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কারা কায়ানলু (১৩৭৫-১৪৬৮ খ্রি.) এবং পরবর্তীকালে এ কে কায়ানলু (১৪৬৮-১৫০১ খ্রি.) এর সময়কাল পর্যন্ত তাবরীয ইরানের রাজধানী হিসেবে পরিগণিত ছিল। সর্বশেষ সাফাভী আমলে পারস্য শাসকদের রাজধানী ছিল তাবরীয। যার সময়কাল ছিল ১৫০১ থেকে ১৫৫৫ খ্রি. পর্যন্ত। বর্তমানে এটি ইরানের একটি বিখ্যাত শহর হিসেবেই বিশ্ববাসীর কাছে সুপরিচিত।

এক নজরে তাবরীয
দেশ : ইরান
প্রদেশ : পূর্ব আজারবাইজান
নগর এলাকা : ১৯০ বর্গকিলোমিটার
শহর এলাকা : ২৩৫৬ বর্গকিলোমিটার
পর্বতমালা : ১৩৫১ মিটার (৪৪৩৩ ফুট)
জনসংখ্যা : ৩০৫০২৪১ (২০১৩ সালের হিসাব অনুযায়ী)
ঘনবসতি : ইরানে ৫ম স্থান
উপনাম : তাবরিযীয়ান, তাবরিযী, তাবরিযলী
পোস্ট কোড : ৫১৩৬৮
এরিয়া কোড : ০৪১

আবহাওয়া : তাবরীয এর আবহাওয়া বিভিন্ন প্রকৃতির। গরমে এখানকার আবহাওয়া সহনীয়। শীতের তীব্রতা অনেক বেশি। শীতকালে প্রচুর পরিমাণে বরফ পড়ে। এখানকার বার্ষিক বৃষ্টিপাতের গড় ৩৮০ মি.মি.। এখানে চারটি ঋতু দৃশ্যমান। গ্রীষ্ম, শরৎ, বসন্ত ও শীতকাল। বসন্তকালে এখানকার আবহাওয়া অত্যন্ত চমৎকার। বার্ষিক গড় তাপমাত্রা ১২০ সে.। সাধারণভাবে তাবরীযের আবহাওয়া সম্পর্কে প্রচলিত কথা হলো এখানে ছয়মাস গরম ও ছয়মাস ঠাণ্ডা।

বায়ু দূষণ : সাম্প্রতিক সময়ে শহরে যানবাহন নিঃসৃত গ্যাস ও ধোঁয়া, কেমিক্যাল ও তৈল শোধনাগারসহ অন্যান্য কল-কারখানার কারণে তাররিজের বাতাস দূষিত হচ্ছে। বিশেষ করে বিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগ থেকে এর সূচনা হয়েছে। যদিও এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সরকার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

ভাষা : তাবরীযের লোকজন মূলত আজারবাইজানী ‘আজারী’ ভাষায় কথা বলে, যা কয়েক শতাব্দী ধরে প্রচলিত। ফারসিতে প্রচুর আজারি শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে। ১৯৯৯ সালে তাবরীয বিশ্ববিদ্যালয় ফারসির পাশাপাশি ‘আজারি’ ভাষায় পাঠদান কার্যক্রম শুরু করে। এখানকার অধিকাংশ অধিবাসী ফারসি ভাষার সাথে সুপরিচিত। অফিসিয়াল ও পড়াশোনার মাধ্যম ফারসি ভাষা। ত্রয়োদশ শতকের একটি কাব্যগ্রন্থের পাণ্ডুলিপির সন্ধান পাওয়া যায় যার নাম ছিল ‘সাফিনায়ে তাবরিযী’। এর ভাষা আজারি। এ ভাষার প্রসারে আব্দ আল-কাদির মারাগীকে প্রবাদ পুরুষ মনে করা হয়ে থাকে। এ ভাষায় গ্রন্থ প্রণেতাদের অন্যতম হলেন বাবা ফারজী, হুমাম তাবরিযী, মামা ইসমত তাবরিযী, মাগরেবি তাবরিযী প্রমুখ।

শিল্প-সংস্কৃতি : তাবরীয শিল্প-সংস্কৃতির উর্বর ভূমি। এখানকার সংগীতে মিশ্রভাব লক্ষণীয়। তবে ক্ল্যাসিক সংগীত দু’ভাগে বিভক্ত। প্রথমত : আসুগ এবং দ্বিতীয়ত : মুগাম। যদিও পারস্যের ক্ল্যাসিক সংগীতের সাথে মুগাম এর যথেষ্ট মিল রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে মুগাম মধ্যবিত্ত যুব সমাজের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
আসুগ সংগীতের রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। মূলত আজারি ভাষাভাষিরা এ সংগীতকে খুবই পছন্দ করেন। সাম্প্রতিক সময়ে এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এ সংগীত শেখানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।  প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতা হচ্ছে এ সংগীতকে কেন্দ্র করে।

চিত্রশিল্প : ইরানী চিত্রশিল্পের একটি ধরনকে বলা হয় তাবরিযী স্টাইল- যা ইলখানী যুগ থেকে আজ পর্যন্ত ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়। চতুর্দশ শতকের গোড়ার দিকে তাবরীযে এর উৎপত্তি।  তাবরীযে মিনিয়েচার পেইন্টিং এর জন্য আলাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

খাবার : স্যুপ তাবরীযের বেশ জনপ্রিয় খাবার- যা বিভিন্ন প্রকার সব্জি, গাজর ও মসলা দিয়ে তৈরি করা হয়। তাবরীযের সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবারের নাম অ’বগুশত- যা মূলত ভেড়ার মাংস দিয়ে তৈরি। সেই প্রাচীনকাল থেকে আজো তাবরীযের মানুষের প্রধান খাবার এটি। চেলো কাবাব ও ভাত তাবরীযের অধিবাসীদের অন্যতম খাবার। ইরানে তাবরীযের চেলো কাবাব খুবই বিখ্যাত। আজারবাইজানী ঐতিহ্যবাহী খাবার দোলমা- যার উপাদান হলো ডিম, ক্যাপসিকাম, টমেটো, জুচিনি, মাংসের টুকরো, পিয়াজ ও বিভিন্ন মসলা। গার্নিয়াক এক প্রকার দোলমা যা মাংস, রসুন ও অন্যান্য মসলা দিয়ে প্রস্তুত করা হয়। তাবরীযের কোপ্তা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। সারা ইরানে এর সুনাম রয়েছে। এ স্পেশাল রেসিপি তৈরি করা হয় মাংস, চাল, পিয়াজ ও আরো অনেক উপাদান দিয়ে। অন্যান্য খাবারের মধ্যে রয়েছে গোবারিয়া, তাবরিযী লোভাজ, এরিস, নুগা, তাসবিহী, লতিফে, আহরি, লোভাদিয়া, লোকুম প্রভৃতি। তাবরীযের বিস্কুট ও কুকিজ খুবই উন্নতমানের।

দর্শনীয় স্থান : ৮৫৮ খ্রি., ১০৪১ খ্রি. এবং ১৭২১ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত বড় বড় ভূমিকম্পসহ অনেকগুলো ভূমিকম্পে তাবরীযের অনেক দর্শনীয় স্থাপনা ধ্বংস হয়ে গেছে। কোনটির ধ্বংসাবশেষ কালের সাক্ষী হয়ে এখনো অবশিষ্ট আছে। তাবরীয দৃষ্টিনন্দন এলাকা। এখানকার দর্শনীয় স্থানের মধ্যে রয়েছে আলীচেহ ব্রীজ, আমীর নেজাম হাউজ, কাচার মিউজিয়াম, আজারবাইজান মিউজিয়াম, বাগমা শাহ গেট, বিশ্বখ্যাত তাবরীয বাজার (যা ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে), বেহনাম হাউজ, ব্লু মসজিদ, জামে মসজিদ, বলুয়ার চিন হাউজ, তাবরীয ক্যাথলিক চার্চ, সাংবিধানিক আন্দোলন হাউজ (মাশরুতে মিউজিয়াম), আয়রন গেট মিউজিয়াম, পাহলভী ডকুমেন্ট মিউজিয়াম, পূর্ব আজারবাইজান রাজভবন, ফেরদৌসী সড়ক, গাদাকী হাউজ, ঘড়ি ব্রীজ, হায়দার যাদে হাউজ, মাদরাসায়ে আকবারিয়া, মাকবারাতুশ শোয়ারা (কবিদের মাযার), মনসুর ব্রীজ, কেরাস মিউজিয়াম, সেন্ট মেরি চার্চ, মোজার মিউজিয়াম, সৈয়দ হামযার মাযার, শাহরিয়ার সাহিত্য মিউজিয়াম, শোহাদা মসজিদ, তাবরীয ফায়ার ফিটিং টাওয়ার প্রভৃতি।

পার্ক ও বাগান : তাবরীযে ১৩২টি পার্ক আছে। ২০০৬ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী পার্কের আয়তন ২৫৯৫ বর্গকিলোমিটার এবং সবুজ ভূমি রয়েছে ৮৫৪৮ বর্গকিলোমিটার যা জনপ্রতি প্রায় ৫.৬ মিটার। তাবরীযের সবচেয়ে প্রাচীন পার্কের নাম ‘গোলেস্তানে বাগী’। পাহলভী আমলে এর গোড়াপত্তন হয়। বিখ্যাত পার্কসমূহের মধ্যে রয়েছে খাকানী পার্ক, গীম মাগাম, গোলেস্তান পার্ক, মাশরুতে পার্ক, সায়েব তাবরিযী পার্ক, শাম্স তাবরিযী গার্ডেন, ইনালী স্টেট ফরেস্ট পার্ক, বাগমে শাহ পার্ক প্রভৃতি।

অর্থনীতি : তাবরীয ইরানের আধুনিকতম নগরী। এখানে রয়েছে প্রচুর কল-কারখানা, মেশিন ফ্যাক্টরী, কেমিক্যাল, পেট্রেকেমিক্যাল, তেল শোধনাগার, সিমেন্ট কারখানা, আসবাবপত্র তৈরির কারখানা, টেক্সটাইল, ট্যানারি, ফার্নিচারসহ নানা রকমের শিল্প প্রতিষ্ঠান। এগুলো দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে প্রতিনিয়ত রপ্তানি হচ্ছে। তাবরীযের ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকাতে রয়েছে শত শত ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স। ইরান ট্রাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি তাবরীযে অবস্থিত। এছাড়া মাঝারি ও ক্ষুদ্র কল-কারখানা তো সারা শহর জুড়ে রয়েছেই। প্রাচীনকাল থেকেই তাবরীয হস্তশিল্পের জন্য বিখ্যাত। তাবরীযের হাতে বোনা কার্পেটের খ্যাতি বিশ্বময়। এছাড়া কাঠ খোদাই, সিরামিক, মোজাইক প্রভৃতির জন্য তাবরীযের সুনাম রয়েছে।

কেনাকাটা : তাবরীযের কেনাকাটার প্রধান কেন্দ্র হচ্ছে সিটি সেন্টার  ও তাবরীয ট্র্যাডিশনাল বাজার, পিডেস্ট্রেইন মল, শাহনাজ স্ট্রীট এবং ফেরদৌসী স্ট্রীট প্রভৃতি। এছাড়া ছোট ও মাঝারি ধরনের শপিং মল শহরের সর্বত্রই রয়েছে। তাবরীযের অভিজাত বুটিক, জুয়েলারি প্রভৃতি খুবই জনপ্রিয়। তাবরীযে রয়েছে ‘ইন্টারন্যাশনাল এক্সিবিশন সেন্টার’। যেখানে নানা ধরনের নতুন নতুন পণ্যের প্রদর্শনী সারা বছর ধরে চলতে থাকে। এর মধ্যে বিখ্যাত মেলা হচ্ছে ‘টেক্সপো’- যা ১৯৯২ সাল থেকে চালু হয়েছে।

হোটেল : তাবরীযের খ্যাতনামা হোটেলের মধ্যে তাবরীয গোলী র্পাস হোটেল, শাহরিয়ার হোটেল, হোটেল ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল আজারবাইজান, মাশহাদ গেস্ট হাউজ, র্আক হোটেল, সিনা হোটেল প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

শিক্ষা ও গবেষণা : ইরানের প্রধান ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাবরীযে অবস্থিত। ১৯৪৭ সালে তাবরীয বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে শাহান্দ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, আজারবাইজান তারবিয়াত মোয়াল্লেম বিশ্ববিদ্যালয়, তাবরীয আর্টস বিশ্ববিদ্যালয়, তাবরীয পায়ামে নূর বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামিক আযাদ বিশ্ববিদ্যালয় (তাবরীয শাখা), দারভিশান হায়ার এডুকেশন ইন্সটিটিউট, নবী আকরাম ইউনিভার্সিটি কলেজ, খাজা রশিদ ইউনিভার্সিটি, তাবরীয এলমী কারবোরদি ইউনিভার্সিটি, তাবরীয টেকনোলজি কলেজ, ইমাম হোসাইন বিশ্ববিদ্যালয় (তাবরীয শাখা), শহীদ বেহেশতী শিক্ষক প্রশিক্ষণ সেন্টার প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
এখানকার শিক্ষা পদ্ধতি হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা ৫ বছর, মাধ্যমিক শিক্ষা ৩ বছর, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা ৩ বছর এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য এক বছর অধ্যয়ন করে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ।
শত শত স্কুল ও কলেজ রয়েছে তাবরীযে। তাবরীযের বিখ্যাত স্কুলসমূহের মধ্যে রয়েছে মেমোরিয়াল স্কুল অব তাবরীয যা ১৮৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত। ইসলামী বিপ্লবের পরে এ স্কুলের নামকরণ করা হয় পারভীন হাই স্কুল। বর্তমানে এটি ৩টি আলাদা স্কুল হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে। তাবরীযের রাশিদিয়া স্কুল হচ্ছে ইরানের প্রথম স্কুল। এর প্রতিষ্ঠাতা হাজী মির্জা হোসাইন রাশিদি। বর্তমানে এটি ইরানের জাতীয় ডকুমেন্ট ও লাইব্রেরির তাবরীয শাখা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ফেরদৌসী হাই স্কুল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে প্রতিষ্ঠিত। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ওয়ালী আস্র ইসলামিক স্কুল, তালেবিয়া ইসলামিক স্কুল প্রভৃতি।
বিখ্যাত লাইব্রেরিসমূহের মধ্যে তাবরীয কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি। এখানে হাতে লিখিত প্রচুর পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত আছে। এছাড়া পাবলিক লাইব্রেরির মধ্যে রয়েছে তারবিয়াত লাইব্রেরি, হেলাল আহমার লাইব্রেরি, শহীদ মোতাহ্হারী লাইব্রেরি, শাহরিয়ার লাইব্রেরি, যাকারিয়া লাইব্রেরি, ফারহাঙ্গ সারা লাইব্রেরিসহ আরো অনেক পাবলিক ও প্রাইভেট লাইব্রেরি।

যাতায়াত : তাবরীযের অধিবাসীরা সড়ক পথেই বেশি যাতায়াত করে থাকে। সড়ক পথে চলাচলের জন্য সর্বসাধারণের জন্য এখানে রয়েছে বাস-ট্যাক্সি। তাছাড়া প্রাইভেট গাড়ি, ফোনো ট্যাক্সিও রয়েছে। তেহরানের পর তাবরীয হচ্ছে দ্বিতীয় শহর যেখানে র‌্যাপিড বাস ট্রানজিট চালু আছে- যার ব্যাপ্তি ১৮ কিলোমিটার। ব্যাসেজ স্কয়ার থেকে কেন্দ্রীয় রেল স্টেশন পর্যন্ত এর ৫০টি স্টেশন রয়েছে। তাবরীয-তুরস্ক-ইউরোপ রেল ব্যবস্থা চালু আছে। এটি ইরানের জাতীয় রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত। তাবরীয হলো ইরানের প্রথম শহর যেখানে ১৯৯২ সাল থেকে আন্তর্জাতিক রুটে ট্রেন চলাচল শুরু হয়। রেল স্টেশন শহরের পশ্চিম দিকে খোমেইনী স্ট্রীটের শেষ প্রান্তে অবস্থিত। তাবরীয ইন্টারন্যাশনার এয়ারপোর্ট ১৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত।

খেলাধুলা : তাবরীযে রয়েছে অনেকগুলো ক্রীড়া কমপ্লেক্স। সবচেয়ে বড় কমপ্লেক্সের নাম ‘বাগে শোমাল’ কমপ্লেক্স। যেখানে রয়েছে ফুটবল স্টেডিয়াম, সুইমিং পুল, বাস্কেটবল স্টেডিয়াম ও ভলিবল স্টেডিয়াম। অলিম্পিক ভিলেজ নামে অপর একটি বৃহদাকার দৃষ্টিনন্দন কমপ্লেক্সও চোখে পড়ার মতো। ফুটবল তাবরীযের প্রধান খেলা। ইরানের নামকরা ৫টি ফুটবল টীম তাবরীযের। এগুলো হলো ট্রাক্টর সাযী এফসি, মেশিন সাযী এফসি, তাবরীয এফসি, শহরদারী তাবরীয এফসি এবং গোলেস্তান ফোলাদ। সাইক্লিংয়ে তাবরীযের যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। ১৯৮৬ সাল থেকে এখানে নিয়মিত সাইক্লিং প্রতিযোগিতা হয়ে এসেছে। সবচেয়ে বিখ্যাত সাইক্লিং টিমের নাম ‘তাবরীয পেট্রোকেমিক্যাল সাইক্লিং টীম’। এই টীম এশিয়ান গেমসে অংশগ্রহণ করে থাকে।

মিডিয়া : তাবরীযের অন্যতম জনপ্রিয় টিভি চ্যানেলের নাম শাহান্দ টিভি। এখান থেকে ফারসি ও আজার ভাষায় অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়। এছাড়া কয়েকটি কমিউনিটি টিভি চ্যানেল রয়েছে। এখানে সরকার পরিচালিত স্বতন্ত্র একটি রেডিও স্টেশন রয়েছে। এটিও ফারসি ও আজার ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচার করে। তাবরীয থেকে ১৪টি সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন এবং ৮টি দৈনিক পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে থাকে।

বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ : ইরানের আধুনিকায়ন ও মুক্তির আন্দোলনে তাবরীযবাসীর অবদান অবিস্মরণীয়। এখানে শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ব্যক্তিদের সম্মিলন ঘটেছে। বিখ্যাত শিল্পীদের মধ্যে রয়েছেন আহাদ হোসাইনী, গোলাম হোসাইন বিগজে খানী, ফারহাদ ফাখরুদ্দিনী, ইব্রাহিম হাতামিকিয়া, তাহমিনে মিলানী, কামাল তাবরিযী।
ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের মধ্যে রয়েছেন আল্লামা তাবাতাবায়ী, আল্লামা জাফারী, জাওয়াদ তাবরিযী প্রমুখ। কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে যাঁদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তাঁরা হলেন সায়েব তাবরিযী, শাম্স তাবরিযী, গোলাম হোসাইন সাঈদী, রেযা বাহরানী, আহমাদ কাসরাভী, শাহরিয়ার, মোহাম্মাদ মোসলেমী, পারভীন এতেসামী, ইরাজ মির্জা, নায়ার তাবরিযী প্রমুখ। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে যাঁদের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য তাঁরা হলেন বাগের খান (মাশরুতিয়াত আন্দোলনের অন্যতম নেতা), মোহাম্মাদ খিয়াবানী, মোহাম্মাদ শাহ কাচার, নাসের আল দীন কাচার, আহমদ শাহ কাচার। খ্যাতনামা বিজ্ঞানীদের মধ্যে যাঁদের নাম সর্বাগ্রে উচ্চারিত হয় তাঁরা হলেন জাভান আলী (গ্যাস লেজারের আবিষ্কারক), মোহসেন হাসরুদী (গণিতজ্ঞ), লোতফি যাদে (গণিতজ্ঞ)
তাবরীয ইরানের ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্রস্থল। এখানকার কলকারখানা বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন করে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিশ্ব বাজারে রপ্তানি করে থাকে। খেলাধুলায় তাবরীয অনন্য। তাবরীযের পার্ক ইরানের অধিবাসী, এমনকি বিদেশীদের কাছেও অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে বিবেচিত। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের দিক থেকে তাবরীযের সুনাম বিশ্বব্যাপী। অবকাঠামোগত উন্নয়ন, স্বাস্থ্য সেবা, যাতায়াত ব্যবস্থায় তাবরীয অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধন করেছে।

ইবনে সীনা ও তাঁর জ্ঞান-মঞ্জুষা

ড. তারিক সিরাজী*
বিশ্ববিশ্রুত মনীষী হুসাইন বিন আবদুল্লাহ বিন হাসান বিন আলি ইবনে সীনা ৯৮০ খ্রিস্টাব্দে বুখারার অন্তর্গত আফ্সানা নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আবদুল্লাহ ও মাতা সেতারা বিবি উভয়েই ছিলেন ইরানী। তাঁর পিতা সামানি রাজবংশের অধীন বুখারার একজন শাসনকর্তা ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর তিনি বুখারা ত্যাগ করেন এবং প্রথমে কিছুকাল গুরগান এরপর যথাক্রমে কাযভিন, হামেদান ও ইস্ফাহানে বসবাস করেন। তাঁর বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে শেইখুর রাইস (প্রধান প্রাজ্ঞনেতা), হুজ্জাতুল হক (সত্যের দলিল), শারফুল মুল্ক (রাজ্যের মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি) ও ইমামুল হুকামা (মনীষীদের নেতা) প্রভৃতি উপাধিতে ভূষিত করা হয়ে থাকে। পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানীদের নিকট তিনি আভিসীনা (আরপবহহধ) নামে অধিক পরিচিত। তিনি ১০৩৭ খ্রিস্টাব্দে ৫৭ বছর বয়সে হামেদান শহরের নিকটবর্তী এলাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
ইবনে সীনাকে বেশিরভাগ লোকই চিকিৎসাবিজ্ঞানী হিসাবে জানেন। কিন্তু তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞান ছাড়াও পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, জ্যামিতি, গণিত ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে সমান পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন এবং এসকল বিষয়কে ঘিরে তিনি শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর চিন্তা-দর্শনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল অ্যারিস্টটলীয় বুদ্ধিবৃত্তিক ও ইসলাম ধর্মশাস্ত্রীয় চিন্তা-দর্শনÑ যার সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল একটি মতবাদ। এ মতবাদ মূলত ইসলামী চিন্তাধারার আলোকে প্রকাশিত হয়েছিল। যে কারণে ইবনে সীনার গভীর চিন্তা-দর্শনের প্রতি আমরা সহজেই মোহাবিষ্ট হয়ে থাকি। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে এই যে, ইবনে সীনা হিকমাতে মাশ্শায়ী মতবাদ তথা অ্যারিস্টটলীয় মতবাদকে সুসংবদ্ধ করে তাঁর চিন্তাধারায় আল্লাহ ও তাঁর সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের মধ্যকার শূন্যতাকে বৈজ্ঞানিক ধারণাশক্তি দিয়ে পূরণ করেন। ইবনে সীনা মুসলিম বিশ্বে অ্যারিস্টটলীয় বুদ্ধিবৃত্তিক ও যুক্তিভিত্তিক মতবাদের প্রবর্তক আল-কিন্দি (মৃ. ৮৬৬ খ্রি.) এবং তাঁর স্থলাভিষিক্ত আবু নাস্র আল-ফারাবি (৮৭২-৯৫০ খ্রি.)-এর ন্যায় দার্শনিকগণের মতবাদের ব্যাখ্যাতাই ছিলেন না; বরং গ্রীসের সকল চিন্তা-দর্শনকে নিজস্ব জ্ঞানের আলোকে সুশৃঙ্খল ও সুবিন্যস্ত করে দর্শনশাস্ত্রের পাঠকদের সামনে তা তুলে ধরেন। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক হিট্টির ভাষায় বলা যায় যে, ধর্মশাস্ত্রীয় মতবাদের (ইলমুল কালাম) সাথে অ্যারিস্টটলীয় (হেকমতে মাশ্শায়ী) বা গ্রীক দর্শনের সাযুজ্য বিধানের যে সূচনা আল-কিন্দি করেছিলেন, ইবনে সীনা দক্ষতার সাথে তা উচ্চমার্গে নিয়ে যান। তবে তিনি অ্যারিস্টটলকে অন্ধভাবে অনুসরণ করেননি; বরং তাঁর উদ্ভাবিত নতুন ধারাগুলোকে প্রকাশ করতে গিয়ে অ্যারিস্টটলীয় মতবাদের অস্পষ্ট দিকগুলো প্লেটোনিক ও নিউপ্লেটোনিক চিন্তাধারার উপাদানের সহায়তায় প্রকাশ করেন- যা একটি নতুন দার্শনিক রীতি হিসাবে পরিগণিত হয়েছে। অতএব, ইবনে সীনাকে হেকমাতে মাশ্শায়ীর সাথে ইসলামী ভাবধারার মিলনকারী ভাষ্যকার হিসাবে গণ্য করা যায়। তিনি ছিলেন জ্ঞান ও মুক্তবুদ্ধিসঞ্জাত একত্ববাদে বিশ্বাসী মুসলমান। উদাহরণ হিসাবে তাঁর একটি প্রসিদ্ধ মতবাদের উল্লেখ করা যেতে পারেÑ
‘প্রত্যেকটি বস্তুর হাকীকত তার সত্তার সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত। এ কারণে চূড়ান্ত বিবেচনায় কোনো কিছুকে জানা মানে তার সত্তাকে এবং সাধারণভাবে অস্তিত্বলোকে তার অবস্থানকে জানা, আর তার এই অবস্থানই তার গুণ-বৈশিষ্ট্যসমূহ ও ধরন-ধারণ নির্ধারণ করে। সমগ্র বিশ্বলোকে যে সকল জিনিস আছে, যেহেতু আছে সেহেতু সেগুলো অস্তিত্বশীল। কিন্তু বস্তুগত অর্থে শূন্যতা বা নিরঙ্কুশ অস্তিত্ব, যা সমস্ত কিছুর সূচনাস্থল তথা ¯্রষ্টা। এ কারণে সত্তার মূল সুর বা তাঁর গুণাবলি কোনো কিছুর বিচারেই সেই নিরঙ্কুশ অস্তিত্বের সাথে ধারাবাহিকতার দ্বারা যুক্ত নন; বরং আল্লাহ তাআলা এ বিশ্বজগতের তুলনায় অগ্রবর্তী অর্থাৎ যখন এ বিশ্বজগৎ ছিল না তখনো তিনি ছিলেন এবং এদের তুলনায় তিনি সব সময়ই সমুন্নত।’
ইবনে সীনার দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক বিষয়াবলির প্রতি আলোকপাত করা যেতে পারেÑ যা ধারণ করেই তাঁর মতবাদ আবর্তিত হয়েছে। এ মতবাদগুলোর বেশিরভাগই গ্রীক দার্শনিকদের কাছ থেকে গৃহীত হয়েছে এবং এগুলো ইসলামী চিন্তাধারার আলোকে প্রকাশিত হয়েছে। ইবনে সীনার চিন্তা-দর্শনের মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলি হচ্ছে :
১. অস্তিত্বের স্বরূপবিষয়ক সুনির্দিষ্ট তত্ত্ব ও ধর্মতত্ত্ব।
২. প্রকৃতি ও অস্তিত্বের মধ্যে পার্থক্য।
৩. সৃষ্টিজগতের স্তরসমূহ এবং মূল সত্তা ও তার সংঘটিত হওয়ার বিষয়ে আলোচনা।
৪. অপরিহার্য ও সম্ভব।
৫. ইল্মে ওয়াজেবুল ওয়াজুদ (অপরিহার্য সত্তা তথা আল্লাহ তাআলা সম্বন্ধীয় জ্ঞান)।
৬. ফেইয ওয়া সুদুর তথা অনুগ্রহ ও উদ্ভব মতবাদ।
৭. মারেফাত (আল্লাহ পরিচিতি) সম্পর্কিত মতবাদ।
৮. মাআদ (পারলৌকিক জীবন) সম্পর্কিত মতবাদ।
৯. উকূল (বিবেকসমূহ) সম্পর্কিত মতবাদ।
ইবনে সীনার রচনাসমগ্র ছিল বিশাল ও বিক্ষিপ্ত। পিতামাতা ইরানী হওয়ার ফলে তাঁর মাতৃভাষা ছিল ফারসি। কিন্তু তিনি আরবি ভাষাকে তাঁর চিন্তাধারা প্রকাশের মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। ফলে, তিনি তাঁর অধিকাংশ গ্রন্থই আরবি ভাষায় রচনা করেছেন। তাঁর রচিত বহু পাণ্ডুলিপি তাঁর জীবদ্দশাতেই হারিয়ে গেছে। বর্তমানে তাঁর যে রচনাসমগ্র বিদ্যমান তাও অপূর্ণাঙ্গ ও অপ্রতুল। ইবনে সীনা রচিত গ্রন্থগুলোকে মোটামুটি তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়।
প্রথম ভাগেই রয়েছে তাঁর দর্শনশাস্ত্রীয় গ্রন্থসমূহ :
১. ফারসি ভাষায় রচিত প্রথম দর্শন বিষয়ক গ্রন্থ দানেশ নামে আলায়ি।
২. নাজাত (মুক্তি)-এটি তাঁর রচিত শেফা গ্রন্থের সংক্ষিপ্তসার।
৩. অয়ুনুল হিক্মা (জ্ঞানের ঝর্না)
৪. কিতাবে শেফা
৫. আল-ইশারাত ওয়াত্ তাম্বিহাত (নির্দেশিকা ও মন্তব্যবিষয়ক গ্রন্থ)
৬. এছাড়াও যুক্তিবিদ্যা, মনোবিজ্ঞান, বিশ্বতত্ত্ব ও অধিবিদ্যা সম্পর্কে তাঁর আরো বহু গবেষণা প্রবন্ধ রয়েছে।
দ্বিতীয় ভাগে যেসকল গ্রন্থ রয়েছে তা মূলত প্রকৃতিবিজ্ঞান নিয়ে রচিত।
১. চিকিৎসাবিজ্ঞানের খ্যাতনামা গ্রন্থ কানুন ফিত্ তিব্। কানুন গ্রন্থে তাঁর সমসাময়িক চিকিৎসাবিজ্ঞানের সকল বিষয়ের তথ্যাবলি বিধৃত হয়েছে। এটি হলো একটি বিশাল গ্রন্থ যা চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিপ্লব সৃষ্টি করেছিল। বইটি বিভিন্ন ভাষায়, যেমন ল্যাটিন, ইংরেজি, হিব্রু ইত্যাদি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এটি ইউরোপীয় মেডিকেল কলেজগুলোতে পুরোদমে পড়ানো হয়। এটি পাঁচ খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খণ্ডে রয়েছে মানুষের দেহ, রোগ, সুস্থতা, সামগ্রীক ও সর্বজনীন চিকিৎসা সম্পর্কে মৌলিক নীতিমালা ও চিকিৎসাবিদ্যা (ঞযবৎধঢ়বঁঃরপং) সম্পর্কে আলোচনা। দ্বিতীয় খণ্ডে রয়েছে আরোগ্যদায়ক ওষুধপত্র ও ভেষজবিদ্যা (চযধৎসধপড়ষড়মু)। গ্রন্থের একটি অংশে ওষুধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা সংক্রান্ত অভিজ্ঞতার বর্ণনা রয়েছে। তৃতীয় খণ্ডে হচ্ছে প্যাথলজি (চধঃযড়ষড়মু) সম্পর্কিত যা দেহের অঙ্গ বা তন্ত্রীর (ঙৎমধহ ধহফ ংুংঃবসং) সাহায্যে পরীক্ষিত হয়। চতুর্থ খণ্ড বিভিন্ন রকম জ্বর সম্পর্কিত আলোচনা দিয়ে শুরু হয়েছে। এরপর রোগের লক্ষণ, রোগ চিহ্নিতকরণ, রোগ সম্পর্কে আগাম সংবাদ দান, ছোটখাট অস্ত্রোপচার, ফোঁড়া, ক্ষত, কাটাছেঁড়া ও নানা রকম বিষ সম্পর্কিত আলোচনা রয়েছে। পঞ্চম খণ্ডে বিভিন্ন রকম ওষুধ প্রস্তুত প্রণালি (চযধৎসধপড়ঢ়ড়বরধ) সম্পর্কে বিশদ আলোচনা স্থান পেয়েছে।
২. আল্ উরজুযাহ ফিত্ তিব্ নামক চিকিৎসাবিষয়ক গবেষণা প্রবন্ধ।
৩. বিশ্বজগতের অস্তিত্বের প্রকৃতি দর্শনের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলি নিয়ে রচিত আশ্ শেফা গ্রন্থ। মূলত বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় ও অধিবিদ্যা তথা গবঃধ-চযুংরপং দর্শন নিয়ে রচিত হয়েছে। এটি দর্শনশাস্ত্রের অমূল্য গ্রন্থ। গ্রন্থটি ২০ খণ্ডে বিভক্ত। এ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রাণীতত্ত্ব, উদ্ভিদতত্ত্বসহ যাবতীয় বিষয়।
তৃতীয় ভাগে রয়েছে তাঁর রচিত রহস্যপূর্ণ ও বাতেনি (আধ্যাত্মিক) রচনাসমূহ- যা তাঁর জীবনের শেষ দিকে রচিত হয়েছে।
১. রেসালেয়ে হাই বিন ইয়াক্যান (সতর্ক জগতের জীবন্ত পুত্র) শীর্ষক পুস্তিকা।
২. রেসালাতুত্ তায়ের (পাখি সম্বন্ধীয় প্রবন্ধ)।
৩. সালমান ও আবসাল
৪. ‘মানতেকুল মাশরেকিন’ শিরোনামে ইশারাত গ্রন্থের শেষ তিনটি অধ্যায়।
৫. ‘আল-কাসিদাতুল আইনিয়্যাহ’ শীর্ষক আত্মা সম্পর্কিত কবিতাগুচ্ছ।
৬. কুরআনে কারিমের সূরাগুলোর সংক্ষিপ্ত তাফসীর।
ইবনে সীনার রচনাবলি নিয়ে বিভিন্ন গবেষণাকর্ম রচিত হয়েছে এবং এর ধারাবাহিকতা আজও অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া তাঁর রচনাসমগ্রের ওপর অনেক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থও প্রণীত হয়েছে। ইরানের খ্যাতনামা মনীষী সাঈদ নাফিসি ও ড. ইয়াহইয়া মাহ্দাভির প্রচেষ্টায় ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে তেহরান থেকে ইবনে সীনার রচনাবলির ওপর একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থে ইবনে সীনার রচনাবলির নানা দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়।
ইবনে সীনা মনে করতেন মানুষের প্রতি আল্লাহর শ্রেষ্ঠ দান হচ্ছে তার বিশ্বাস ও যুক্তিবাদিতা। তিনি কোনো একটি বিশিষ্ট ধর্মীয় মতবাদ বা চিন্তা-দর্শনে আস্থা রাখতেন না। তাঁর মতে ধার্মিকতার শ্রেষ্ঠ পুরস্কার হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত মানসিক ও বুদ্ধিসুলভ উপলব্ধি। তিনি এক আল্লাহতে এবং হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর রেসালাত ও অহিতেও একইভাবে বিশ্বাস করতেন এবং ধর্মীয় কাজকর্মগুলো যথারীতি নিজে পালন করতেন এবং তা পালনে সমর্থন করতেন।
অস্তিত্ব সম্পর্কে ইবনে সীনার মতবাদ দু’টি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করেই এগিয়ে গেছে। প্রথমটি হচ্ছে যে কোনো বস্তুর প্রকৃতিকে তার অস্তিত্ব থেকে পৃথক্করণ আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে অস্তিত্বের অপরিহার্যতা, অস্তিত্বের সম্ভবতা ও অসম্ভবতার মধ্যকার পারস্পরিক পৃথক্করণ। এ মতবাদের আলোকে বলা যায় যে, এ বিশ্বজগতে যা কিছু আছে তার সবই হচ্ছে সম্ভব অস্তিত্ব এবং তা অপরিহার্য অস্তিত্বের পুরোপুরি মুখাপেক্ষী।
ইবনে সীনা নৃতত্ত্বকে ফেরেশতাতত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই বর্ণনা করেছেন। ফেরেশতাতত্ত্বে বিশ্বতত্ত্বের যে ভিত্তি রয়েছে তা এবং নৃতত্ত্বের মর্যাদা ও অবস্থান সম্পর্কেও তিনি সম্যক অবগত ছিলেন। তাই ইবনে সীনার দর্শনে সৃষ্টিতত্ত্বও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ফেরেশতাতত্ত্বের সাথে। ফেরেশতার স্বাভাবিক কার্যক্রমের অন্যতম হলো সৃষ্টির কার্যক্রম প্রকাশের প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকা। কারণ, ফেরেশতা হচ্ছে সেই সত্তা যার মাধ্যমে সম্পন্ন হয় আল্লাহর নির্দেশিত সৃষ্টির কার্যাবলি।
আল্লাহ এবং বিশ্বজগতের মধ্যকার সম্পর্ক সম্বন্ধে ইবনে সীনা পরিপূর্ণ জ্ঞাত ছিলেন। তিনি সবসময় ¯্রষ্টার সামনে সমস্ত সৃষ্ট বস্তুর সম্ভাব্য প্রকৃতিকে প্রদর্শন করার চেষ্টা করেছেন। আর এভাবে তিনি সেই আদর্শে বিশ্বস্ত ছিলেন যা ইসলামী চিন্তা-দর্শনের মূল ও আদি নীতি।
ইবনে সীনা আধ্যাত্মিকতা প্রকাশের ক্ষেত্রে বিখ্যাত সুফি কবি ফরিদউদ্দিন আত্তারের ন্যায় কাব্যকলার প্রতিও বিশেষ মনোযোগী হয়েছিলেন। প্রমাণস্বরূপ তিনি রেসালাতুত্ তায়ের শীর্ষক প্রতীকাশ্রয়ী আধ্যাত্মিক সৃষ্টিকর্ম রেখে গেছেন। এ গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি মানব আত্মার রহস্য উদ্ঘাটনে প্রয়াসী হয়েছেন এবং জীবনের ঘটে যাওয়া অন্তর্নিহিত বিষয়গুলোকে প্রতীকীরূপে তুলে ধরেছেন।
মূলত ইবনে সীনা মনুষ্যসমাজকে সুস্থ করতে চেয়েছেন মূল সত্তার প্রতি তাদের উদাসীনতার ব্যাধি থেকে। তাদের এ ব্যাধি তাদের আত্মার মাঝেই বিদ্যমান। তাই তিনি মানুষকে নিরাময় করতে আত্মা সম্পর্কিত গান গেয়েছেন এবং এর গূঢ় রহস্য সকলের সম্মুখে তুলে ধরেছেন। ফলে ইসলামের অনেক ধ্যানশীল মনীষী যুগ যুগ ধরে ইবনে সীনার বহুমুখী প্রতিভা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন এবং তাঁরা তাঁর চিন্তা-দর্শন ও কর্মের আলোকে মানুষের মুক্তির জন্য ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে আলো বিস্তার করছেন।

তথ্যসূত্র
১.    সৈয়দ হোসেন নসর (২০০৫ খ্রি.), তিনজন মুসলিম মনীষী, (অনুবাদ : মহীউদ্দীন), দিব্যপ্রকাশ, ঢাকা।
২.     আহমাদ তামীমদারী (২০০৭ খ্রি.), ফার্সী সাহিত্যের ইতিহাস (তারিক জিয়াউর রহমান সিরাজী ও মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী অনূদিত), আলহুদা আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা, ইরান।
৩.     আবদুল মওদুদ (১৯৮০ খ্রি.), মুসলিম মনীষা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা।
৪.     মুজাফফর সারবাজী (১৯৯৯ খ্রি.), চিকিৎসা বিজ্ঞানী ইবনে সীনা (অনুবাদ : তারিক সিরাজী), গ্রন্থ মালঞ্চ, ঢাকা।
৫.     মো. ফজলুর রহমান মুনশী (১৯৯৭ খ্রি.), বিশ্বের মুসলিম মনীষীদের কথা, বার্ড পাবলিকেশন্স, ঢাকা।
৬.     নিউজ লেটার (১৯৯৯ খ্রি.), ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, ঢাকার মুখপাত্র।

* অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান
ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

হাজিদের উদ্দেশে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার হজবাণী

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
ওয়ালহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন ওয়া সাল্লাল্লাহু আলা মুহাম্মাদিউ ওয়া আলিহিত ত্বাহিরীন

আপনারা যারা কুরআনের আহ্বানে লাব্বায়িক বলার মতো এবং আল্লাহর ঘরের আতিথ্য বরণ করার মতো সৌভাগ্য অর্জন করেছেন তাঁদের প্রতি রইলো আন্তরিক সালাম ও দরুদ। সবকিছুর আগে বলব, আপনারা এই মহান নিয়ামতের গুরুত্বটা উপলব্ধি করবেন। হজের মতো অনন্য একটি বিধানের আন্তর্জাতিক, আধ্যাত্মিক, সামাজিক এবং ব্যক্তিগত দিকগুলো নিয়ে ভালোভাবে চিন্তাভাবনা করবেন এবং হজের মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্যগুলো বাস্তবায়নের চেষ্টা করবেন। এজন্য এই হজের আয়োজক সর্বশক্তিমান এবং মহাদয়ালু আল্লাহর কাছে সাহায্য কামনা করবেন।
আমিও আপনাদের সুরে সুর মিলিয়ে, আপনাদের অন্তরের সাথে অন্তর মিলিয়ে সেই গাফুর ও মান্নান আল্লাহর কাছে বিনীত আবেদন জানাচ্ছি তিনি যেন তাঁর পূর্ণ নিয়ামত আপনাদের দান করেন। তিনি যেহেতু আপনাদের হজ করার মতো যোগ্যতা দিয়েছেন সেই হজ পরিপূর্ণভাবে আদায় করার তৌফিকও তিনি দান করুন। আল্লাহ আপনাদের হজ কবুল করুন এবং আপনারা আল্লাহর পক্ষ থেকে পরিপূর্ণ ক্ষমা লাভ করে ভরা হাতে নিজ নিজ এলাকায় যেন ফিরে যেতে পারেন ইনশাআল্লাহ, সেই দোয়া করছি।
নজিরবিহীন এবং জ্ঞানগর্ভ এই হজ অনুষ্ঠানের মৌলিকতম ও শ্রেষ্ঠ অর্জন যদিও আত্মিক এবং আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধি লাভ করা, তবু তার পাশাপাশি হজের এই সুবর্ণ সুযোগে মুসলিম বিশ্বের সমস্যাগুলোর দিকেও মনোযোগ দিতে হবে। মুসলিম উম্মাহর সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়-আশয়গুলোর ওপর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এবং সবচেয়ে বেশি গুরুত্বের সাথে দৃষ্টি দেওয়াও হজপালনকারীদের অন্যতম দায়িত্ব।
আজকের দিনে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারযোগ্য বিষয়টি হলো মুসলমানদের ঐক্য এবং মুসলিম উম্মাহর মাঝে বিভেদ সৃষ্টির গ্রন্থিগুলো উন্মোচন করা। হজ হলো ঐক্য, সংহতি, ভ্রাতৃত্ব এবং পার¯পরিক সহযোগিতার অনন্য প্রতীক। হজে সবার উচিত অভিন্ন বিষয়গুলোর ওপর দৃষ্টি দেওয়া এবং নিজেদের মধ্যকার বিভেদ ও মতপার্থক্য মুছে ফেলা।
ঔপনিবেশিক রাজনীতির ধারকরা সেই প্রাচীনকাল থেকেই তাদের ঘৃণ্য লক্ষ্য হাসিল করার জন্য বিচ্ছিন্নতা ও বিভেদের মতো নোংরামিপূর্ণ কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু আজ ইসলামী জাগরণের বরকতে মুসলিম দেশগুলো ইহুদিবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদী শত্রুগুলোকে ভালোভাবে শনাক্ত করতে পেরেছে এবং তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। মুসলমানদের মাঝে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টির নীতি এখন ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে।
ধূর্ত শত্রুরা মুসলমানদের মাঝে যুদ্ধের আগুন ছড়িয়ে দিয়ে প্রতিরোধ ও জিহাদের ¯পৃহাকে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করতে চাইছে যাতে মুসলমানদের প্রকৃত শত্রু ইহুদিবাদী ইসরাইল ও সাম্রাজ্যবাদীরা নিরাপদ থাকতে পারে। এই গাদ্দারি নীতির আলোকেই পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোতে তাকফিরি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীসহ বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর জন্ম দিয়েছে। এটি আমাদের সবার জন্য সতর্কবার্তা। মুসলিম ঐক্যকে আমাদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সব দায়িত্বের শীর্ষে স্থান দিতে হবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- ফিলিস্তিন ইস্যু। দখলদার ইসরাইল প্রতিষ্ঠার ৬৫ বছর পার হয়ে গেছে। গুরুত্বপূর্ণ ও ¯পর্শকাতর এ ইস্যুতে নানা চড়াই-উতরাই শেষে বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোর রক্তাক্ত ঘটনাবলির পর দু’টি বিষয় এখন সবার সামনে পরিষ্কার হয়ে গেছে :
এক- ইহুদিবাদী ইসরাইল ও তার পৃষ্ঠপোষকরা নৃশংসতা, নিষ্ঠুরতা এবং নৈতিকতা ও মানবিকতা পদদলিত করার ক্ষেত্রে কোন ধরনের সীমা-পরিসীমা মেনে চলে না। তারা সব ধরনের অন্যায়-অনাচার, জাতিগত নিধনযজ্ঞ, ধ্বংসযজ্ঞ, নারী-শিশু ও আশ্রয়হীনদের হত্যাসহ সব ধরনের নৃশংসতা ও জুলুমকে নিজেদের জন্য জায়েয বলে মনে করে এবং তারা এ জন্য গর্ব করে। ৫০ দিনের সাম্প্রতিক গাজা যুদ্ধের কান্না উদ্রেককারী নৃশংস দৃশ্যগুলো তাদের ঐতিহাসিক অপরাধযজ্ঞের সর্বশেষ উদাহরণ। অবশ্য গত অর্ধ শতাব্দীতে তারা এ ধরনের ঘটনা বারবারই ঘটিয়েছে।
দ্বিতীয় বাস্তবতা হচ্ছে- চরম পাশবিকতা ও নৃশংসতার মাধ্যমেও দখলদার ইসরাইল ও তার পৃষ্ঠপোষকরা তাদের অশুভ লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে পারেনি; বরং দুষ্টু রাজনৈতিক খেলোয়াড়দের নির্বুদ্ধিতামূলক কর্তৃত্বকামী প্রত্যাশার বিপরীতে দখলদার ইসরাইল প্রতিদিনই ক্রমেই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে।
ইহুদিবাদী ইসরাইলের সর্বশক্তির মোকাবিলায় অবরুদ্ধ ও আশ্রয়হীন গাজাবাসীর ৫০ দিনের প্রতিরোধ, গাজার অধিবাসীদের কাছে দখলদারদের পরাজয় ও পশ্চাদপসরণ এবং প্রতিরোধ সংগ্রামীদের শর্তগুলোর কাছে দখলদার শক্তির নতি স্বীকারের মধ্য দিয়ে তাদের দুর্বলতা ও ব্যর্থতার প্রকাশ্য প্রদর্শনী হয়ে গেছে। এর অর্থ দাঁড়ায়- ফিলিস্তিনী জাতিকে এখন অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি আশাবাদী হতে হবে, ইসলামিক জিহাদ ও হামাসের যোদ্ধাদেরকে চেষ্টা-প্রচেষ্টা, উদ্যম ও দৃঢ়তা জোরদার করতে হবে এবং পশ্চিম তীরকে তাদের সদা গৌরবোজ্জ্বল পথ আরো শক্তি ও দৃঢ়তার সঙ্গে পাড়ি দেয়া অব্যাহত রাখতে হবে। আর সরকারগুলো যাতে ফিলিস্তিনের প্রতি আন্তরিক ও প্রকৃত সমর্থন দেয়, সে জন্য মুসলিম জনগণের পক্ষ থেকে জোর দাবি তুলতে হবে এবং মুসলিম সরকারগুলোর পক্ষ থেকেও এ ক্ষেত্রে দ্ব্যর্থহীন পদক্ষেপ নিতে হবে।
তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে মুহাম্মাদি ইসলামের সঙ্গে আমেরিকান ইসলামের পার্থক্যের দিকে মুসলিম বিশ্বকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। এ দুই ইসলামের পার্থক্য যেমন তাদের নিজেদের বুঝতে হবে তেমনি অন্যদের বোঝাতে হবে যে, এই দু’টিতে আকাশ-পাতাল ব্যবধান রয়েছে। আমাদের মরহুম ও মহান ইমাম প্রথমবারের মতো এ দুই ইসলামের পার্থক্য তুলে ধরার সাহসিকতা দেখান এবং বিষয়টিকে মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক অভিধানে অন্তর্ভুক্ত করেন। মুহাম্মাদি ইসলাম হচ্ছে আধ্যাত্মিকতা ও প্রশান্তিদায়ক ইসলাম, খোদাভীরু ও জনগণের শাসনের ইসলাম এবং ‘আশিদ্দাউ আলাল কুফ্ফার ও রুহামাউ বাইনাহুম’ অর্থাৎ কাফেরদের বিরুদ্ধে কঠোরতা ও নিজেদের মধ্যে আন্তরিকতার ইসলাম। অন্যদিকে আমেরিকান ইসলাম হচ্ছে বিজাতীয়দের হীন অনুচরবৃত্তির গায়ে ইসলামের লেবাস পরিয়ে মুসলিম উম্মাহর সঙ্গে শত্রুতা করা।
যে ইসলাম মুসলমানদের মধ্যে মতবিরোধ উস্কে দেয়, যে ইসলাম আল্লাহর দেয়া প্রতিশ্রুতির প্রতি ভরসা না করে আল্লাহর শত্রুদের ওপর নির্ভর করতে শেখায়, যে ইসলাম সাম্রাজ্যবাদী ও ইহুদিবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করার পরিবর্তে ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ করতে উদ্বুদ্ধ করে এবং যে ইসলাম নিজ জাতি বা অন্যান্য জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আমেরিকার সঙ্গে জোট গঠন করতে শেখায় তা আসলে ইসলামই নয়। এটি এমন এক বিপজ্জনক ও মারাত্মক ভণ্ডামি যার বিরুদ্ধে প্রতিটি নিষ্ঠাবান মুসলমানের লড়াই করা উচিত।
যে কোনো সত্য অনুসন্ধানী ব্যক্তি দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞা নিয়ে মুসলিম বিশ্বের এ গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতার দিকে তাকালে সঠিক পথের সন্ধান পেয়ে যাবেন এবং দ্বিধাহীন চিত্তে নিজের কর্তব্য নির্ধারণ করতে পারবেন।
পবিত্র হজ, এর আনুষ্ঠানিকতা ও দোয়াগুলো আমাদেরকে সেই দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞা অর্জনের চমৎকার সুযোগ এনে দেয়। আশা করছি, আপনারা, সম্মানিত হাজিগণ আল্লাহর দেয়া এই নেয়ামতের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করবেন। আপনাদের সবাইকে মহান আল্লাহর হাতে সমর্পণ করছি এবং আল্লাহর দরবারে আপনাদের হজ কবুলের জন্য দোয়া করছি।
ওয়াসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ

সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী
৫ই যিলহজ ১৪৩৫ হিজরি মোতাবেক ৮ই মেহর ১৩৯৩ ফারসি সাল।

হোসাইনী আত্মত্যাগ : প্রয়োজন সঠিক মূল্যায়ন

আব্দুল কুদ্দুস বাদশা
প্রত্যেক ঘটনা ও বীরত্বগাথা যতই মৌলিক ও সত্য ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকুক না কেন, যদি তা বিকৃতি ও বিদআতের কবলে পড়ে এবং কুসংস্কৃতি দ্বারা আক্রান্ত হয় তাহলে কালক্রমে তার মৌলিকতা হারিয়ে ফেলে। আবার তার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করার বিষয়েও যদি যথাযথ পন্থা অবলম্বন করা না হয় সেক্ষেত্রেও একই পরিণতি হতে বাধ্য। ফলে উক্ত বীরত্বগাথা কালক্রমে যে প্রভাব রাখার কথা, তা তো রাখেই না, উপরন্তু কখনো বা তা এতটা বিকৃত রূপ পরিগ্রহ করে থাকে যে, ক্রমান্বয়ে তা বিপরীত চেহারা ধারণ করে। অর্থাৎ বিপরীত ভূমিকা রাখতে থাকে। ৬১ হিজরির ১০ মুহররম তথা আশুরার দিনে কারবালার ফোরাত-কূলে নবীবংশের যে রক্তধারা ঝরেছে তা মরুভূমি শুষে নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু প্রকৃত দ্বীন ইসলামকে যে কীভাবে পানি সিঞ্চন করেছে তা স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ‘হোসাইন আমা হতে ও আমি হোসাইন হতে’- এ অমর বাণীর মধ্যে প্রতিফলিত হয়। তাই আজ যদি বিশ্বের যে কোন প্রান্তে যে কেউ নিজেকে মুসলমান বলে পরিচয় দেয় এবং হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে তার নবী বলে মানে তবে তাকে এটাও স্বীকার করতে হবে যে, ‘হোসাইন আমা হতে আর আমি হোসাইন হতে।’ কিন্তু কোন মুসলমান যদি নিজের মুসলমান হওয়া কিংবা ইসলামের টিকে থাকার ক্ষেত্রে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর কোন ভূমিকাই মানতে না চায়, বরং ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য শোক পালনকে তার মুসলমানিত্ব বা ইসলামের জন্য ক্ষতিকারক বলে মনে করে তাহলে বুঝতে হবে যে, সমস্যা হোসাইনী আশুরার মধ্যে নয়; বরং অন্য কোথাও সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে- উপরের কথাগুলো দ্বারা যার প্রতি ইশারা করা হয়েছে। তাছাড়া কারবালার শহীদদের বীরত্বগাথায় যে সত্য তাওহীদি আত্মা নিহিত- যা সকল স্বেচ্ছাচারিতা, খোদাদ্রোহিতা ও অধার্মিক অত্যাচারী শাসককে উৎখাত করার এক বজ্রকঠিন শপথ, একারণে যুগে যুগে স্বৈরাচারী ও খোদাদ্রোহী শাসকরা নিজেদের অবৈধ স্বার্থকে অটুট রাখতে এ মহাবীরত্বগাথার মর্মকথাকে বিকৃত করার সর্বপ্রকার চেষ্টা চালিয়েছে। ইসলামকে বাঁচাবার জন্য মরু কারবালার বুকে নবী-দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (আ.)-এর এ মহান আত্মত্যাগকে ঘিরে তাই তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় নানা প্রশ্নের অবতারণা করা হয়েছে। অর্থাৎ ইমাম হোসাইনকে বাস্তবিকপক্ষে দু’বার মযলুম করা হয়েছে। দু’বারই তাঁর নানার উম্মত মুসলমানদের পক্ষ থেকে। একবার কারবালার ময়দানে। আরেকবার তাঁর মহান আত্মত্যাগকে ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য ক্ষতিকর বলে ব্যাখ্যা দাঁড় করাবার মাধ্যমে। এরূপ এক নির্মম বাস্তবতার মধ্য দিয়ে প্রতি বছর মুহররম মাস ও আশুরা আসে। তাই ইসলামের জন্য ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মহান আত্মত্যাগকে স্মরণ করে দু’টি কথা বলতে চাই।

“এক’’
ইমাম হোসাইন (আ.) নিজেকে কেন মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিলেন? পবিত্র কোরআনে তো নিষেধ করা হয়েছে : لا تُلقُوا بأيديکم إلي التَّهلُکهِ : ‘তোমরা  নিজ হাতে নিজেদেরকে ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ করো না।’ (সূরা বাকারা : ১৯৫)
মূলত এরূপ একটি প্রশ্নের অবতারণা করে ইমাম হোসাইনকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হয়েছে। তবে ইমাম হোসাইন কি আদৌ জানতেন, তিনি যে পথে অগ্রসর হচ্ছেন তার শেষ প্রান্তে মৃত্যু অপেক্ষমাণ! এটাও একটি প্রশ্ন। যদিও এ ব্যাপারে মুসলিম প-িতগণের দু’টি মত রয়েছে। একটি মত এসেছে ইবনে খালদুন ও আরো কতিপয় খ্যাতনামা ঐতিহাসিক ও প-িতগণের পক্ষ থেকে। তাঁদের মতে, ইমাম হোসাইন (আ.) জানতেনই না যে, তাঁর এই বিপ্লব ও আন্দোলনের শেষ পরিণতি মৃত্যু ও শাহাদাত। সেক্ষেত্রে উপরিউক্ত অভিযোগেরও কোন অবকাশ থাকে না যে, তিনি কেন নিজেকে ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ করলেন। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এ অভিমত নিতান্তই দুর্বল ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। কারণ, স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা.) যেমন জিবরাইল (আ.) মারফত অবগত হয়ে এ খবর দিয়ে গিয়েছিলেন, তেমনি ইমাম হোসাইনও ছিলেন মাসুম ইমাম এবং নবীজির ঐশী ইলমের আকর।
অন্য মতটি হলো, ইমাম হোসাইন (আ.) তাঁর শাহাদাতের কথা অবগত ছিলেন। অনেকগুলো সূত্রে এটা প্রমাণিত। আর সেটাই যদি হয়ে থাকে তাহলে মূল প্রশ্নটি জোরদার হয়ে সামনে আসে যে, তিনি জানা সত্ত্বেও কেন নিজেকে মৃত্যুর মধ্যে নিক্ষেপ করলেন!
খুব তত্ত্বকথায় না গিয়ে বলা যায় যে, এ সংশয়টি ঐ সমস্ত লোকই উত্থাপন করে থাকে যারা বলে : জগতে ‘জীবন’ই হচ্ছে নিরঙ্কুশভাবে কাক্সিক্ষত বস্তু। স্বাভাবিক মৃত্যু আর আধ্যাত্মিকতা ও আদর্শিক মূল্যবোধকে রক্ষার জন্য জীবনকে উৎসর্গ করার মধ্যে কোন পার্থক্য এরূপ লোকদের চোখে পড়ে না। একারণেই তারা মনে করে যে, মৃত্যুর কথা জেনেও সে পথে অগ্রসর হওয়াটা আক্ল (বুদ্ধিবৃত্তি) ও শার (ধর্মীয় বিধান) উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে নিষিদ্ধ।
যারা এরূপ সংশয় সৃষ্টি করে তাদের উদ্দেশে বক্তব্য হলো-
প্রথমত, আপনারা ‘জীবন’ (ইসলামের পরিভাষায় যার নাম হায়াত) এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভুল পথে পা বাড়িয়েছেন। আপনাদের কথা সঠিক হতো তখনই যখন ‘জীবন’ এর অর্থ হতো শুধুই খাওয়া ও পান করা আর (যৌন) কামনার নিবৃত্তি। যেখানে একটি পশুর জীবনের সাথে পার্থক্য করার মতো কোন দিক খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথচ কোরআনের অভিধানে ও দ্বীনের বিশ্বকোষে হায়াত তথা জীবনের অর্থ অন্য কিছু লিপিবদ্ধ রয়েছে। সেখানে حيات معقول  তথা বুদ্ধিবৃত্তিক ও যুক্তিগ্রাহ্য জীবন এবং حيات طيبه  তথা শুচিময় পবিত্র জীবনের যে আভাস রয়েছে তার অর্থ হচ্ছে যথাযথ যুক্তিপ্রমাণ ও কারণনির্ভর এমন একটি জীবন যার মালিক আল্লাহ এবং সে জীবনটাও তাঁরই জন্য [ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন]। এক্ষেত্রে পশুসুলভ জীবন যে শুধু কাক্সিক্ষতই হতে পারে না, তা নয়; বরং বুদ্ধিবৃত্তিক ও যুক্তিগ্রাহ্য জীবনের পথে তা প্রতিবন্ধকও বটে। মোটকথা, জীবনকে একমাত্র সেই ব্যক্তিই বুদ্ধিবৃত্তিক ও যুক্তিগ্রাহ্য এবং পবিত্র অর্থে গ্রহণ করতে পারবে, যে এটাকে শাশ্বত ঐশী প্রজ্ঞা থেকে উৎসারিত বলে জানবে। আর তখন তার কাছে প্রাকৃতিক জীবনটা ঐ পবিত্র জীবনে উপনীত হওয়ার একটি মাধ্যম হিসাবে গণ্য হবেÑ যে জীবন পাওয়ার জন্য উক্ত ব্যক্তি দ্বীনি বিচক্ষণতা দ্বারা এরূপ হাজারটা প্রাকৃতিক জীবনকে উৎসর্গ করতেও কুণ্ঠিত নয়। আর এই জীবনবোধ আশুরার রাতে ইমাম হোসাইনের আত্মত্যাগী সৈনিকদের মাঝে পূর্ণরূপে প্রত্যক্ষ করা যায়।
দ্বিতীয়ত, যে জিহাদ ও শাহাদাত দ্বীনকে বাঁচানো এবং মুসলমানদের রক্ষা করার জন্য হয়, সেটা আল্লাহর রাহে সবচেয়ে বড় আত্মত্যাগী পদক্ষেপ। পক্ষান্তরে নিজেকে ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ করা অন্য বিষয়। কথাটা এভাবে বলা যায় যে, মানবজাতির হেদায়াত তথা সুপথপ্রাপ্তির জন্য একদিকে যেমন হেদায়াতের ‘উৎপত্তি তথা সৃষ্টি কারণ’ আবশ্যক, অপরদিকে তেমনি হেদায়াত ‘বজায় থাকা কারণ’ও আবশ্যক। প্রথম কারণটি বাস্তবায়ন হয় আম্বিয়াগণের নবুওয়াত ঘোষণার মাধ্যমে। আর দ্বিতীয় কারণটি বাস্তবায়িত হয় ‘বেলায়াতে কোবরা’র মাধ্যমে। ইমাম হোসাইন (আ.) হলেন আম্বিয়াগণের সেই দাওয়াতের স্থায়িত্ব বজায় থাকার কারণ ও রহস্যকথা। ইমাম হোসাইন (আ.) তাঁর ইমামতের জ্ঞানের স্থান থেকে যেমন অবগত ছিলেন যে, শাহাদাত বরণ করবেন, একইভাবে এটাও জানতেন যে, তাঁর শাহাদাত বরণের মাধ্যমে ইসলাম ও মুসলমানরা রক্ষা পাবে। তাই তো তিনি বলেছিলেন : إن کانَ دينُ محمد (صلّي الله عليه و آله ) لم يستَقم إلاّ بقَتلي فيا سيوف خُذيني ‘আমার কতল ব্যতীত যদি মুহাম্মাদের দ্বীন রক্ষা না পায় তাহলে এসো হে তরবারিসমূহ! আমাকে গ্রহণ কর।’ (নাসেখুত তাওয়ারিখ : ৩/১১৯) এভাবেই তিনি ইসলামের জীবনকে নিজ জীবনের ওপর অগ্রগণ্য করেছিলেন। অন্যত্র ইমাম বলেন : ليس الموت في سبيل العزِّ إلاّ حياهً خالدهً و ليست الحياهُ مع الذّلِّ إلاّ الموته الذي لا حياهَ معه ‘সম্মানের পথে মৃত্যু আসলে চিরন্তন জীবন বৈ নয় আর অপমানের সাথে বেঁচে থাকা সেই মৃত্যু বৈ নয় যার সাথে কোন জীবনই নেই।’  (মাওসুআতু কালিমাতিল ইমাম আল-হোসাইন : ৩৫৬)
অর্থাৎ ইমাম হোসাইন (আ.)-এর দ্বীনি দৃষ্টিকোণ ও শিক্ষায় জীবনের যৌক্তিকতা নিহিত রয়েছে সম্মান আর ইসলাম ও মুসলমানদের রক্ষা পাওয়ার মধ্যেই এবং এটাই শেষ কথা। একজন ইমাম ও দ্বীনের নেতা হিসাবে তাঁর ভূমিকা কেবল দ্বীন ও ইসলামী আদর্শকে রক্ষা ছাড়া আর কী হতে পারে? আশুরার রক্তরঞ্জিত স্মৃতিকথা এই সত্যেরই প্রতিরূপ মাত্র যে, দ্বীনের অস্তিত্ব ও ভবিষ্যৎ বিপদের সম্মুখীন হলে দ্বীনের নেতা প্রয়োজনে শুধু নিজের জীবনই নয়, গোটা পরিবারের জীবনকে উৎসর্গ করে হলেও দ্বীন রক্ষায় এগিয়ে আসবেন এবং যে কোন মূল্যে দ্বীনের প্রদীপকে নিভে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচাবেন।
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়। তা হলো, দ্বীন রক্ষার বিষয়টি নির্দিষ্ট কোন সীমায় সীমাবদ্ধ নয়। দ্বীন ও ইসলামী আদর্শকে রক্ষা করা- সেটা যে কোন উপায়েই হোক না কেন, সকলের ওপর অবশ্য কর্তব্য। শেষ অবধি যদি এ গুরু দায়িত্ব পালন করতে জীবন ও সম্পদ উৎসর্গ করার প্রয়োজন পড়ে তবুও পিছপা হওয়া চলবে না।
জ্বি, তাই বলে যদি সাধারণ দ্বীনদাররা তাদের এ কর্তব্য পালনে শৈথিল্য দেখায়, দ্বীনের নেতা যিনি, তিনি তো নিজেকে দায়িত্বমুক্ত করতে পারেন না। অন্যরা দাঁড়ালে হয়তো তাঁকে এভাবে সপরিবারে, এমনকি ছয় মাসের শিশুকে নিয়ে শাহাদাত বরণ করত হতো না। এ থেকে বোঝা যায়, সেদিন ইসলাম ধর্ম কত বড় বিপদের সম্মুখীন হয়েছিল আর দ্বীনের নেতা ইমাম হোসাইন (আ.) কত বেশি অসহায় ও মযলুম হয়ে পড়েছিলেন! তাই আজ যে ইসলামেরই বদৌলতে পরের অনুগ্রহে নিজে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গৃহে পরম আয়েশে বসে ইমাম হোসাইন (আ.)-কে ‘নিজ হাতে নিজেকে ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপে’র দায়ে অভিযুক্ত করে তাঁকে আরো মযলুম করার চেয়ে বরং এ বাক্যটির সারকথা উপলব্ধির চেষ্টাই শ্রেয় হবে : الإسلامه محمدي الحدوث و حسيني البقاء ‘ইসলামের গোড়াপত্তন মুহাম্মাদ কর্তৃক আর বেঁচে থাকা হোসাইন কর্তৃক।’

“দুই”
ঐশী নিয়ম-পদ্ধতি হতে শাহী-সুলতানী নিয়ম-পদ্ধতিকে পৃথক করতে হবে। হোসাইনী আন্দোলন ও কারবালার রক্তস্নাত শিক্ষার মধ্যে এটি অন্যতম শিক্ষা। অবশ্যই খোদায়ী ও দ্বীনি শাসনব্যবস্থাকে শাহী-সুলতানী ও পরিবারতান্ত্রিক একনায়ক শাসনব্যবস্থা হতে আলাদা করে দেখতে হবে। ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়া যখন মদীনার গভর্নর ওয়ালিদকে ইমাম হোসাইন (আ.) হতে বাইআত আদায়ের নির্দেশ পাঠাল এবং তিনি উক্ত বাইআতে অস্বীকৃতি জানালেন তখন ওয়ালিদকে উদ্দেশ্য করে ইমাম বলেন : ايها الامير ! انّا اهل بيت النبوه و معدن الرساله و مختلف الملائکه، بنا فتح الله و بنا ختم الله و يزيد رجل فاسق شارب الخمر، قاتل النفس المحرّمه، معلن بالفسق و مثلي لا يبايع مثله و لکن نصبه و تصبحون و ننظر و تنظرون اينا احقّ بالخلافه و البيعه؟ ‘হে আমীর! আমরা হলাম নবুওয়াতের পরিবার ও রেসালাতের খনি। আর ফেরেশতাদলের গমনাগমনের ঠিকানা। আল্লাহ আমাদের (খান্দানের) মাধ্যমেই (ইসলামের) শুভ সূচনা করেছেন এবং শেষ অবধি আমাদের মাধ্যমেই এর পরিসমাপ্তি ঘটাবেন। কিন্তু ইয়াযিদ-যার জন্য আপনি আমার নিকট থেকে বাইআত আদায়ের অপেক্ষা করছেন-একজন ফাসেক ও মদ্যপ ব্যক্তি। যার হাত নিরপরাধ মানুষদের রক্তে রঞ্জিত। সে আল্লাহর হুকুম বিধানের সীমাকে চুরমার করে দিয়েছে এবং প্রকাশ্যে জনসম্মুখে অনাচার-ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। তাই আমার মতো কেউ তার মতো কারো কাছে বাইআত হতে পারে না। তবুও আপনি রাতটা অতিবাহিত করুন, আমরাও রাতটা অতিবাহিত করি। সকাল হোক। আমাদের ও আপনাদের ধৈর্য ধারণ করতে হবে এবং ভবিষ্যতকে বিবেচনা করতে হবে। তাহলে দেখবেন আমাদের মধ্যে কে খেলাফত ও ইসলামী উম্মাহর নেতৃত্ব দানে অধিকতর যোগ্যতাসম্পন্ন আর কে জনগণের বাইআতের উপযুক্ত।’  (আল লুহুফ, পৃ. ২৩)
ইমাম হোসাইন (আ.)-এর যুক্তিপূর্ণ এ সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের উপসংহারে এসে যে সিদ্ধান্তমূলক কথাটি বলেছেন, তা আর তাঁর মহান বিপ্লবের বার্তাকে দেশ-কালের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে নি। অনাগত কালের সত্যাগ্রহী মানুষদের জন্য তিনি এমনি এক মাপকাঠি হাতে তুলে দিয়ে গেছেন যা ইসলামকে রক্ষার যেমন অটুট ঢাল হয়ে থাকবে, সত্যাগ্রহী প্রতিটি মানুষকেও তেমনি স্বীয় পথ খুঁজে পেতে এবং স্বীয় কর্তব্য পালনের জন্য চির অনুপ্রেরণা দিয়ে যাবে। কারণ, তিনি বলেছেন : و مثلي لايبايع مثله ‘আমার মতো কেউ তার (ইয়াযিদের) মতো কারো কাছে বাইআত হতে পারে না।’ একজন পবিত্রতা ও ধার্মিকতার প্রতীক। অন্যজন পাপাচার ও খোদাদ্রোহিতার প্রতীক। একজন দ্বীনদার ও দ্বীনরক্ষায় প্রাণোৎসর্গকারী। আরেকজন দ্বীন ধ্বংসকারী ও দ্বীনদারের প্রাণহন্তা। এখন আমাদের কর্তব্য ঠিক করে নিতে হবে। হয় হোসাইনী পথ ধরে বেহেশতের সরদারের নেতৃত্বে বেহেশতবাসী হওয়া। নয়তো ইয়াযিদের পথ ধরে জাহান্নামের পথকে পরিষ্কার করা- যা ইসলামের শিক্ষা ছিল না। ইমাম মূসা কাযিম (আ.) হিশামের উদ্দেশে এক অসিয়তে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন : لیس لانفسکم ثمن الا الجنة فلا تبیعوها بغیرها  ‘তোমাদের জীবনের মূল্য জান্নাত ছাড়া কিছু নয়। সুতরাং ঐ মূল্যে ছাড়া তা বিক্রি করবে না।’ (আল আনওয়ারুল বাহিয়্যাহ ফি তাওয়ারিখিল হুজাজিল ইলাহিয়্যাহ, পৃ. ৪৫)

সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ সম্পর্কে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বক্তব্য থেকে

মদীনার আলেম ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের উদ্দেশে
হে জনগণ! আল্লাহ্্ যা দ্বারা স্বীয় বন্ধুদের উপদেশ দেন, তা থেকে উপদেশ গ্রহণ কর, যেমন ইহুদি পর্ণ্ডিতদের সম্পর্কে তাঁর নিন্দাবাণী থেকে।
ইরশাদ হচ্ছে : ‘কেন রব্বানী আলেম ও পণ্ডিতবৃন্দ তাদেরকে অন্যায় কথা থেকে বিরত রাখেনি?’ (সূরা মায়েদা : ৬৫)
অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে : ‘অভিসম্পাতপ্রাপ্ত হয়েছে বনি ইসরাইলের যারা অবিশ্বাসী হয়েছে… কতই না মন্দ যা তারা করে।’ (সূরা মায়েদা : ৭৮-৭৯)
আর নিশ্চয় আল্লাহ্্ তাদেরকে এ কারণে ভর্ৎসনা করেছেন যে, তারা তাদের মধ্যে যারা যালিম ছিল তাদের নোংরা ও জঘন্য কাজ প্রত্যক্ষ করত, কিন্তু তাদেরকে তা থেকে নিষেধ করত নাÑ তাদের হাতে যা ছিল তার লোভে এবং কোণঠাসা হয়ে পড়ার ভয়ে। অথচ মহান আল্লাহ্্ বলেন : ‘মানুষকে ভয় কর না, ভয় কর আমাকে।’ (সূরা মায়েদা : ৪৪) আরো বলেন : ‘মুমিন নর ও নারীরা একে অপরের বন্ধু এবং তারা সৎকাজে আদেশ করে ও অসৎকাজে নিষেধ কর।’ (সূরা তওবা : ৭১)
আল্লাহ্্ সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধকে তাঁর একটি ফরয কাজ হিসাবে কথার সূত্রপাত করেছেন। কারণ, তিনি জানতেন, যদি এই ফরযটি পালন করা হয় অথবা প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে সহজ-কঠিন সব ফরযই পালন করা হবে। আর এটা এজন্য যে, সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজের নিষেধ হলো অন্যায়ভাবে হৃত অধিকার প্রত্যার্পণ, যালিমের বিরোধিতা, বাইতুল মাল ও গনীমত বণ্টন, যাকাতের জায়গা থেকে যাকাত গ্রহণ এবং যথার্থ খাতে তা ব্যয় করা সহকারে ইসলামের প্রতি আহ্বান জানানো।
অতঃপর তোমরা, হে শক্তিমান সম্প্রদায়! যারা জ্ঞানে বিখ্যাত এবং ভালো কর্ম ও মঙ্গলকামিতায় স্বনামধন্য ও প্রসিদ্ধ আর আল্লাহ্্র মাধ্যমে মানুষের অন্তরে এতটা মর্যাদার অধিকারী হয়েছ যে, মর্যাদাবান ব্যক্তিও তোমাদের মূল্যায়ন করে আর দুর্বল ব্যক্তি তোমাদের শ্রদ্ধা করে চলে। আর যারা তোমাদের সমতুল্য এবং যাদের ওপর কোনো নেয়ামতের অধিকারী নও, তারা তোমাদেরকে নিজেদের ওপরে প্রাধান্য দেয়। যখন কামনাকারীরা তাদের মনষ্কামনায় পৌঁছতে ব্যর্থ হয় তখন তোমাদেরকে সেসব পাওয়ার মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করে। আর তোমরা সম্রাটদের শান সহকারে আর বুজুর্গদের সম্মান সহকারে রাস্তায় পথ চল। এসবই কি এজন্য নয় যে, জনগণ তোমাদের প্রতি আশা রাখে যে, তোমরা আল্লাহ্্র অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলন করবে? আর যদি তাঁর অধিকাংশ অধিকার থেকে পিছু হটে যাও তাহলে ইমামগণের অধিকারে অবজ্ঞা করলে। আর দুর্বলদের অধিকারকে এড়িয়ে গেলে, অথচ তোমাদের ধারণায় যা স্বীয় অধিকার বলে গণ্য কর, তা ঠিকই প্রাপ্ত হয়েছ, এ অবস্থায় যে, তোমরা এ পথে কোন অর্থও খরচ করনি, নিজ জীবনও সেই আল্লাহ্্র জন্য বিপদাপন্ন করনি যিনি ঐ জীবনের স্রষ্টা। আর আল্লাহ্্র সন্তুষ্টির জন্য কোনো স্বজনের সাথেও দ্বন্দ্বে লিপ্ত হওনি। তোমরা আল্লাহ্্র দরবারে তাঁর বেহেশতের আকাক্সক্ষা পোষণ কর, তদ্রƒপ তাঁর রাসূলগণের পাশে থাকা ও তাঁর আযাব থেকে নিরাপদে থাকার আশা রাখ। হে ঐ ব্যক্তিবর্গ! যারা আল্লাহ্্র থেকে এরূপ আশা কর, তোমাদের ব্যাপারে আমার আশঙ্কা হয় যে, ঐশী কোনো প্রতিশোধ তোমাদের ওপর নেমে আসবে। কারণ, তোমরা আল্লাহ্্র সম্মানের ছায়ায় এমন এক মর্যাদায় পেঁৗঁছেছ যেখানে অন্যদের ওপরে তোমাদের শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে। আল্লাহ্্র প্রতি ঈমানদার বান্দা সংখ্যায় অনেক, কিন্তু জনগণ তাদেরকে শ্রদ্ধা করে না। আর তোমরা আল্লাহ্্র (সাথে বাহ্যিক সম্পৃক্ততার) কারণে জনগণের মাঝে সম্মানের পাত্র। এখন তোমরা স্বচক্ষে আল্লাহ্্র অঙ্গীকারসমূহ ভঙ্গ হতে দেখেও ভয় করছ না, অথচ নিজেদের পিতাদের একটি অঙ্গীকার ভঙ্গ করতে তোমরা ভীত হয়ে পড়ছ, কিন্তু রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর অঙ্গীকার ভঙ্গ হওয়াকে তুচ্ছ জ্ঞান করছ।
সকল জনপদে অন্ধ, বোবা আর অচলরা অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে এবং তাদের ওপর দয়া করা হয় না। এক্ষেত্রে তোমরা তোমাদের পদ অনুযায়ী ও দায়িত্ব মোতাবেক কাজ করছ না। আর যে ঐ কাজ করে তাকেও সাহায্য করছ না। আর যালিমদের সাথে আঁতাত ও আপোষ করে নিজেদেরকে ঝামেলামুক্ত রাখছ। এসবই হলো সেই জিনিস যেগুলোকে সংঘবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করার জন্য আল্লাহ্্ তোমাদের নির্দেশ দিয়েছেন। আর তোমরা তা থেকে উদাসীন। তোমাদের ওপর দুর্দশা অন্যদের চেয়েও বড়। কারণ, তোমরা পণ্ডিত ও বিদ্বানদের মহান জ্ঞান-মর্যাদাকে রক্ষার দায়িত্ব পালনে অক্ষম হয়েছ। হায়! যদি তোমরা তোমাদের চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগাতে! এটা ঐ জন্য যে, নির্দেশাবলি ও বিধি-বিধানের বাস্তবায়ন আল্লাহ্্র জ্ঞানে পণ্ডিত ও বিদ্বানের ওপর ন্যস্ত যারা তাঁর হালাল ও হারামের ওপরে আমীন (বা বিশ্বস্ত রক্ষক) এবং শাসনকর্তৃত্ব তাদের হাতেই থাকতে হবে। সুতরাং তোমরা হলে তারাই যাদের থেকে এই পদ ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। আর যে কারণে তা তোমাদের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে সেটা হলো তোমরা সত্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছ এবং যথেষ্ট প্রমাণ বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ্্ (সা.)-এর নীতিপন্থা সম্পর্কে মতপার্থক্য করেছ। তোমরা যদি নিপীড়নে ধৈর্যধারণ কর এবং আল্লাহ্্র রাহে সহনশীল হও তাহলে আল্লাহ্্র শাসনকর্তৃত্ব তোমাদের কাছে ফিরে আসবে এবং তোমাদের পক্ষ থেকেই বাস্তবায়ন হবে এবং তোমরাই জনগণের বিষয়াদির সমাধান স্থলে পরিণত হবে। কিন্তু তোমরা নিজেরাই অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়েছ এবং খোদায়ী শাসনকর্তৃত্বকে তাদের হাতে সোপর্দ করেছ যাতে তারা সংশয় প্রণোদিত কাজ করে এবং স্বীয় প্রবৃত্তি ও কামনার বশীভূত হয়ে চলে। তোমাদের মৃত্যুভয় এবং দুনিয়ার জীবন- যা তোমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হবে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকাই তাদেরকে এই পদে আসীন করেছে। এরূপ মানসিকতা ও জীবনপদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমেই তোমরা অক্ষমদেরকে তাদের অধীন করেছ। ফলে অক্ষমদের একদল তাদের অনুদাস ও আজ্ঞাবহ হয়েছে আর আরেক দল এক লোকমা খাবারের অন্বেষণে নিরুপায় হয়ে পড়েছে। আর এসকল শাসক নিজেদের (প্রবৃত্তিপ্রসূত অবিবেচক) মত দ্বারা রাষ্ট্রকে ওলট-পালট করে দেয় এবং পরাক্রমশালী আল্লাহর প্রতি ধৃষ্টতা প্রদর্শন ও কুজনদের অনুসরণের মাধ্যমে প্রবৃত্তি পূজারির লাঞ্ছনাকে নিজেদের ওপরে ডেকে আনে। আর প্রত্যেক জনপদে মিম্বারের ওপরে (তাদের মুখপাত্র হিসাবে) একজন বাকপটু খতীব রেখেছে এবং গোটা দেশ তাদের পদতলে এবং তাদের হাত সর্বত্র প্রসারিত। আর জনগণ তাদের নিয়ন্ত্রণে। তাদের ওপরে যা-ই চাপিয়ে দিক তা থেকে আত্মরক্ষা করতে অপারগ। কিছু আছে জোরজবরকারী ও শত্রুতাকারী এবং অক্ষমদের ওপরে কঠিন আক্রমণকারী। আর কিছু আছে শাসনকারী। তারা আল্লাহ্্ ও কিয়ামতের প্রতি বিশ্বাস করে না। অদ্ভুত! আর কেনই বা অবাক হব না, যখন পৃথিবী এমন এক ব্যক্তির হস্তগত যে ঠগবাজ ও যালিম, আর যাকাত আদায়ের দায়িত্ব এমন ব্যক্তির ওপর ন্যস্ত যে আত্মসাৎকারী এবং মুমিনদের শাসনের ভার এমন একজনের হাতে রয়েছে যে তাদের প্রতি কোনো দয়া করে না। তাই আল্লাহ্্ যা নিয়ে আমাদের বিরোধ সে বিষয়ে বিচার করুন। নিশ্চয় তিনি স্বীয় নির্দেশ অনুযায়ী আমাদের দ্বন্দ্বের মীমাংসা করবেন।
হে আল্লাহ্্! তুমি জান যে, আমাদের থেকে যা কিছু প্রকাশ পেয়েছে তা শাসনকর্তৃত্বের প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য নয় এবং দুনিয়ার পণ্যের লোভে নয়। তবে এজন্য যে, তোমার দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত দেখব এবং তোমার রাজ্যে সংস্কার করব আর তোমার নিপীড়িত বান্দাদের চিন্তÍামুক্ত করব এবং তোমার ওয়াজিব ও সুন্নাত এবং বিধি বিধান পালন করব। তোমাদের উচিত আমাদের সহায়তা করা এবং আমাদের প্রতি ইনসাফ করা। যালিমদের শক্তি তোমাদের ওপরে রয়েছে। তারা তোমাদের নবীর নূরকে নিভিয়ে দিতে চেষ্টা করছে। আর আল্লাহ্্ই আমাদের জন্য যথেষ্ট। তাঁর ওপরে ভরসা করি এবং তাঁর দরবারে প্রত্যাবর্তন করব। শেষ পরিণতি সব তাঁরই অভিমুখে।
একটি উপদেশ
আমি তোমাদের আল্লাহ্্কে ভয় করে চলার উপদেশ দান করছি আর তাঁর (শাস্তির) দিনসমূহ থেকে সতর্ক করছি এবং তাঁর প্রতীক ও নিদর্শনসমূহকে তোমাদের জন্য সমুন্নত করছি এমনভাবে যে, যেন যা ভীতিকর; তা তার ভয়ানক আগমন, অচেনা পদার্পণ এবং তিক্তকর স্বাদসহ তোমাদের অন্তরে প্রবেশ করেছে আর তোমাদের ও তোমাদের আমলের মাঝে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তোমরা সুস্থ শরীরে তোমাদের আয়ুষ্কালের মধ্যেই আমলে ধাবিত হও, যেন অকস্মাৎই মৃত্যু হানা দিবে আর তোমাদেরকে মাটির ওপর থেকে মাটির মধ্যে টেনে নিবে এবং মাটির টিলা থেকে গর্তের মধ্যে নিক্ষেপ করবে এবং সঙ্গী-সাথি ও প্রশান্তি থেকে ভয় ও নিঃসঙ্গতায় নিয়ে যাবে এবং খোলা আকাশ ও আলো থেকে অন্ধকারে নিয়ে যাবে। আর প্রশস্ত জায়গা থেকে সংকীর্ণতার মধ্যে ঠেলে দিবে যেখানে আত্মীয়-স্বজনদের দেখতে যাওয়া হয় না, অসুস্থকেও দেখতে যাওয়া হয় না আর না কোনো ফরিয়াদে সাড়া দেওয়া হয়। আল্লাহ্্ আমাদের এই দিনের ভয় থেকে সাহায্য করুন আর আমাদের ও তোমাদের তাঁর শাস্তি থেকে নাজাত দিন এবং আমাদের ও তোমাদের জন্য তাঁর সমুচিত সওয়াব আবশ্যক করুন।
আল্লাহ্্র বান্দারা, যদি এই দুনিয়াই তোমাদের জীবনের শেষ হতো ও চূড়ান্ত আবাস হতো, তাহলে উচিত ছিল মানুষ এমন কোনো কাজ করবে যা দুনিয়া থেকে তার দুঃখ-কষ্টকে সরিয়ে নেয় ও দুনিয়ার বিপত্তি থেকে মুক্তি দেয়। আর কেনই বা এমনটা হবে না যখন মানুষ এই দুনিয়ার পরে তার কৃতকর্মের দায়ে বাঁধা। তাকে হিসাব-নিকাশের মুখোমুখি করা হবে, কোনো সাহায্যকারী নেই যে তাকে বাঁচাবে আর কোনো পৃষ্ঠপোষক নেই যে তাকে রক্ষা করবে। এই দিনে ঈমান এনে কারো কোনো লাভ হবে না যদি না দুনিয়ায় ঈমান এনে থাকে কিংবা ঈমান অবস্থায় সৎকর্ম করে থাকে। বলুন, তোমরা অপেক্ষা কর, আমরা তোমাদের সাথেই অপেক্ষমাণ। আমি তোমাদেরকে আল্লাহ্্কে ভয় করে চলার উপদেশ দিচ্ছি। কারণ, যে ব্যক্তি তাকওয়াবান হয় আল্লাহ্্ তাঁর জন্য জামিনদার হন; তার খারাপ অবস্থা থেকে তাকে ভালো অবস্থায় নিয়ে যাবেন এবং যে পথ দিয়ে সে ধারণাও করেনি সেখান থেকে তার রুজির ব্যবস্থা করবেন। আর এমন না হয় যে, তুমি তাদের অন্তÍর্ভুক্ত হবে যে আল্লাহ্্র অন্যান্য বান্দার পাপে উৎকণ্ঠিত থাকবে, অথচ নিজের পাপ থেকে নির্ভাবনায় থাকবে। কারণ, আল্লাহ্্ তাঁর বেহেশতের ব্যাপারে ধোঁকার শিকার হবেন না। আর তাঁর নিকটে যা আছে সেটা আনুগত্য ব্যতীত অর্জন করা যায় না। ইনশাআল্লাহ্্।

কারবালা অভিমুখে সফরের সময়:
নিশ্চয় এই দুনিয়া পরিবর্তিত হয়ে গেছে এবং অচেনা হয়ে গেছে। তার কল্যাণ চলে গেছে। আর তার থেকে শুধু বাটির অবশিষ্ট তলানির মতো ছাড়া কিছুই বাকি নেই। আর কেবল ক্লান্তিকর জীবন ছাড়া। তোমরা কি তাকিয়ে দেখ না যে, সত্যানুগ কাজ করা হচ্ছে না আর মিথ্যা থেকে বিরত থাকছে না। ফলে অবস্থা এমন হয়েছে যে, মুমিনের জন্য মৃত্যু ও আল্লাহ্্র সাক্ষাতে অনুরাগী হওয়াই বাঞ্ছনীয়। আমি তো সত্যিই মৃত্যুকে সৌভাগ্যকর আর যালিমদের সাথে বেঁচে থাকাকে অপমানজনক ছাড়া কিছুই দেখি না। নিশ্চয় জনগণ সকলেই দুনিয়াপূজারি, দীন কেবল তাদের জিহ্বার বুলি। দীনকে তারা ততক্ষণ চায় যতক্ষণ তা তাদের জীবনের প্রয়োজন মেটায়। আর যখন বিপদে পরীক্ষার সম্মুখীন হয় তখন ধার্মিক সামান্যই।

সম্পাদকীয়

হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাত স্মরণে
বছর ঘুরে আবার বিশ্ব মুসলিমের দ্বারে এসেছে দশই মুর্হারাম বা আশুরা- সাইয়্যেদুশ শুহাদা হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের তথা মানবজাতির ইতিহাসের সর্বাধিক হৃদয়বিদারক ঘটনার বার্ষিকী। এখন থেকে প্রায় চৌদ্দ শতাব্দী কাল পূর্বে কারবালার মরু প্রান্তরে তিনি তাঁর ৭২ জন সঙ্গী-সাথিসহ ইয়াযীদী বাহিনীর হাতে শাহাদাত বরণ করেন।
হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) হচ্ছেন হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর দৌহিত্র ও খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতেমা যাহ্রা (সালামুল্লাহি আলাইহা)-এর পুত্র এবং আহ্লে বাইতের সদস্য পূতপবিত্রতম ব্যক্তিত্ববর্গের অন্যতম। এছাড়া সর্বসম্মত মত অনুযায়ী হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হুসাইন (আলাইহিমাস সালাম) হবেন বেহেশতে যুবকদের নেতা।
আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-এর শাহাদাতের পর হযরত ইমাম হাসান (আ.) তাঁর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে ইসলামী খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, কিন্তু আমীরে মুআবিয়া খেলাফত দখলের চেষ্টা থেকে বিরত না হওয়ায় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহ্র ধ্বংস অনিবার্য হয়ে উঠলে উম্মাহ্কে ধ্বংসের কবল থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি খেলাফতের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান। মুআবিয়া তাঁর মৃত্যুর পরে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) খলীফা হবেন এ শর্তে সন্ধি করে খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু তিনি তাঁর ওয়াদা ভঙ্গ করে স্বীয় পাপাচারী পুত্র ইয়াযীদকে খলীফার দায়িত্ব দিয়ে যান। আর হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) পাপাচারী শাসকের বিরুদ্ধে জনগণকে সতর্ককরণরূপ আম্র্ বিল-মারূফ ওয়া নাহি আনিল মুন্কার-এর দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে উত্থান করেন, ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে নয়। কিন্তু বর্তমান যুগে বিশ্বের অনেক অমুসলিম শাসিত দেশেও মত প্রকাশের এবং শাসকের দুর্নীতি ও অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবার যে স্বাধীনতা রয়েছে মুসলিম উম্মাহ্র খলীফা হওয়ার দাবিদার স্বৈরশাসক ইয়াযীদের শাসনে সে ন্যূনতম অধিকারটুকুও স্বীকৃত ছিল না। এ কারণেই সৃষ্টিকুলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানুষ হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-কে সঙ্গীসাথিসহ প্রায় নিরস্ত্র অবস্থায় নির্মমভাবে শহীদ হতে হয়।
হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) আম্র্ বিল-মারূফ ওয়া নাহি আনিল মুর্ন্কা-এর দায়িত্ব পালন তথা জনগণকে তাগূতী শাসনের অশুভ পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করতে গিয়ে যে কোনো ধরনের রক্তপাত এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন। এ কারণেই ইয়াযীদ খেলাফতের আসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কাছ থেকে জোর করে বাইআত আদায়ের জন্য মদীনার উমাইয়্যা প্রশাসককে নির্দেশ দিলে হযরত ইমাম (আ.) রক্তপাত এড়ানোর লক্ষ্যে রাতের বেলা মদীনা ত্যাগ করেন এবং মক্কায় এসে আল্লাহ্র গৃহের পাশে মসজিদুল হারামে অবস্থান করে জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন। কিন্তু ইয়াযীদ তাঁকে হজের মওসুমে তাওয়াফ্কারীদের ভীড়ের মধ্যে হত্যা করার জন্য গুপ্তঘাতক পাঠায় এবং এটা জানতে পেরে ইমাম হুসাইন (আ.) মসজিদুল হারামে রক্তপাত এড়ানোর লক্ষ্যে মক্কা ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। ইতিমধ্যে কুফার জনগণ সেখানে গিয়ে জনগণকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য আহ্বান জানিয়ে ইমামের কাছে শত শত পত্র পাঠালে জনগণের ডাকে সাড়া দেয়ার লক্ষ্যে তিনি হজের আগের দিন আটই জিলহজ মক্কা ত্যাগ করে কুফার পথে রওয়ানা হন। কিন্তু তিনি কারবালা পৌঁছলে ইয়াযীদের অনুগত বাহিনী তাঁকে অবরুদ্ধ করে ফেলে। ইতিমধ্যে কুফায় ইয়াযিদের নিয়োজিত গভর্নর ওবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদ নৃশংসপন্থায় জন রেশকে স্তব্ধ করে, ইমাম হোসাইনের ২ জন ক্বায়েস ইবনে মুসাহহার ও মুসলিম বিন আকিল ও কতিপয় বিশ্বস্ত অনুসারীদের নির্মমভাবে হত্যা করে। আর কুফার বিরাট অংশ জনগণ ইবনে যিয়াদের ভয়ে ইমামের প্রতি তাদের অঙ্গীকার থেকে সরে যায়। ইয়াযীদের নির্দেশে তার বাহিনী ইমাম হোসাইনকে ইয়াযীদের অনুকূলে বাইআত্ বা মৃত্যুকে বরণ করে নেয়া এই দু’টি পথের যে কোনো একটিকে বেছে নিতে বলে এবং তৃতীয় কোনো প্রস্তাব মেনে নিতে অস্বীকার করে। কিন্তু যেহেতু ইমাম হুসাইনের মতো ব্যক্তি ইয়াযীদের ন্যায় যালেম ও পাপাচারী শাসকের অনুকূলে বাইআত করতে পাবেন না। ইয়াযিদের উদ্দেশ্য ছিল ইমাম হোসাইনকে বাইয়াতে বাধ্য করে মুসলিম উম্মাহকে তার জুলুমবাজ ও পাপচারী সরকারের বৈধতার দাবী করে অনুকুলে রাখা। ইমাম হোসাইন ইয়াজিদের অনুকূলে বাইআতের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং প্রায় নিরস্ত্র অবস্থায় অসম যুদ্ধে স্বীয় সঙ্গী-সাথিদের সহ শাহাদাত বরণ করেন। এভাবে তিনি কিয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষের জন্য সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রয়োজনে চূড়ান্ত আত্মত্যাগের অনুপ্রেরণাদায়ক দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠা করে যান।
আল্লাহ্ তাআলা আমাদেরকে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সত্যের পতাকা বুলন্দ রাখার জন্য প্রয়োজনে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের তাওফীক দিন। আমীন।

স্মরণীয় বাণী

মহানবী (সা.) বলেন : হে আলী! সত্যিই আল্লাহ্ খুশি হন তাঁর বান্দার ওপর যখন সে বলে : ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে ক্ষমা কর। তুমি ছাড়া পাপ মার্জনা করার আর কেউ নেই।’ আল্লাহ্ বলেন : ‘হে আমার ফেরেশতারা! আমার এ বান্দা জেনেছে যে, আমি ছাড়া পাপ মার্জনা করার কেউ নেই। তোমরা সাক্ষী থাক, আমি তাকে মার্জনা করে দিলাম।’

মহানবী (সা.) বলেন : প্রতিটি জিনিসেরই মর্যাদা থাকে। আর সভার মর্যাদা হলো কিবলামুখী হওয়া। যে ব্যক্তি সকলের চেয়ে প্রিয় হতে চায়, তার উচিত আল্লাহ্কে ভয় করা। যে ব্যক্তি চায় সবচেয়ে শক্তিমান হতে, তার উচিত আল্লাহ্র ওপর ভরসা করা। আর যে ব্যক্তি চায় সবচেয়ে ক্ষমতাবান হতে, তার উচিত নিজের কাছে যা আছে তার চেয়ে আল্লাহ্র কাছে যা আছে তার ওপর বেশি নির্ভর করা।…

মহানবী (সা.) বলেন : যে ব্যক্তি আল্লাহ্কে রাগান্বিত করার মাধ্যমে শাসককে সন্তুষ্ট করে সে আল্লাহর দীনের বহির্ভূত।

মহানবী (সা.) বলেন : কল্যাণের চেয়ে কল্যাণকারী হলো উত্তম আর মন্দের চেয়েও মন্দকারী ব্যক্তি নিকৃষ্টতর।

ইমাম আলী (আ.) বলেন : হে লোকসকল! নিশ্চয় আল্লাহর দেওয়া প্রত্যেক নেয়ামতে তাঁর হক রয়েছে। যে তা আদায় করবে, তিনি তার নেয়ামতকে বৃদ্ধি করে দেবেন। আর যে অবহেলা করবে, সে নিজেকে নেয়ামত হারানো এবং আল্লাহর শাস্তি দ্রুত ডেকে আনার বিপদের মুখে নিক্ষেপ করবে। আল্লাহর তোমাদের যেন নেয়ামতের ব্যাপারেও ভীত দেখেন, যেমন পাপের ব্যাপারে ভীত দেখেন।

ইমাম আলী (আ.) বলেন : যে ব্যক্তি অভাবে পড়ল এবং এটাকে আল্লাহরই একটি দয়া বলে মনে করল না, সে একটি আশাকে নষ্ট করল। আর যে ব্যক্তি সম্পদে প্রসার লাভ করল এবং এটাকে তার প্রতি আল্লাহর একটি ফাঁদ বলে মনে করল না, সে একটি বিপজ্জনক জায়গায় নিজেকে নিরাপদ মনে করল।

ইমাম আলী (আ.) বলেন : যাকে চাও (তার) উপকার কর, যাতে তোমার (ভালোবাসায়) বন্দি হয়ে পড়ে।

ইমাম হাসান (আ.) বলেন : যে ব্যক্তি নিয়মিত মসজিদে যায় সে আট উপকারের যে কোনোটি লাভ করে- সুদৃঢ় নিদর্শন, কল্যাণকারী বন্ধু, নতুন জ্ঞান, প্রতীক্ষিত অনুগ্রহ, যে কথা তাকে সঠিক পথে চালিত করে কিংবা তাকে ধ্বংস থেকে বাঁচায়, জনগণের লজ্জায় পাপ ত্যাগ করা আর আল্লাহর ভয়।

ইমাম হাসান (আ.) বলেন : ঘনিষ্ঠ সেই ব্যক্তি, বন্ধুত্ব যাকে নিকটবর্তী করেছে, যদিও তার বংশীয় সম্পর্ক দূরের হয়। আর অচেনা সেই ব্যক্তি, যে বন্ধুত্ব থেকে দূরে থাকে, যতই তার বংশীয় সম্পর্ক নিকটের হোক না কেন। হাতের চেয়ে কোনো কিছুই দেহের নিকটবর্তী নয়। আর নিশ্চয় এ হাতই কখনও কখনও ভেঙে যায় এবং পচে নষ্ট হয়ে যায় ফলে তা কেটে ফেলতে এবং বিচ্ছিন্ন করতে হয়।

ইমাম হোসাইন (আ.) বলেন : স্বনামধন্য ও সর্বমান্য হওয়ার চিহ্নাবলির নির্দেশকসমূহের মধ্যে একটি হলো বুদ্ধিমানদের সাথে ওঠাবসা। আর মূর্খতার কারণসমূহের একটি চিহ্ন হলো মুসলমানদের সাথে বিবাদ করা। আর বিজ্ঞতার একটি চিহ্ন হলো নিজের বক্তব্যের পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করা এবং তত্ত্ববিদ্যাসমূহের (চিন্তার বিভিন্ন পদ্ধতির) সারসত্য জানা।

ইমাম আলী ইবনুল হোসাইন যায়নুল আবেদীন (আ.) বলেন : তোমার প্রতি আল্লাহর এই সাহায্যই যথেষ্ট যে, দেখবে, তোমার শত্রু তোমার ব্যাপারে আল্লাহর অবাধ্যতা করছে।

ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) বলেন : আল্লাহর নিকট তাঁর মারেফাত অর্জনের পরে পেট ও লজ্জাস্থানের পবিত্রতা রক্ষার চেয়ে প্রিয়তর আর কিছু নেই। আর আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়ার চেয়ে তাঁর নিকট প্রিয়তর আর কিছুই নেই।

ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে আলী আল-বাকির (আ.) বলেন : একজন জ্ঞানী যার জ্ঞান কাজে লাগানো হয়, তিনি সত্তর হাজার আবেদ ব্যক্তির চেয়ে শ্রেয়।

ইমাম বাকির (আ.) বলেন :  ঈমান হলো (আল্লাহর বন্ধুদের প্রতি) ভালোবাসা আর (তাঁর শত্রুদের প্রতি) ঘৃণার নাম।

ইমাম বাকির (আ.) বলেন : লজ্জা আর ঈমান একই সুতায় বাঁধা। একটি চলে গেলে অন্যটিও তার পিছে চলে যায়।

স্মরণীয় দিবস

৬ নভেম্বর     :    বাংলাদেশের বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক শাহেদ আলীর মৃত্যুবার্ষিকী।
১১ নভেম্বর    :    ইতিহাসখ্যাত সাহিত্যিক ‘বিষাদ সিন্ধু’র রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেনের জন্মদিবস।
১৪ নভেম্বর    :     বিশ্ব ডায়াবেটিক রোগীদের সহায়তা দিবস।
১৫ নভেম্বর    :    বিশ্ব পুস্তক ও পুস্তক পাঠ দিবস, বিশ্ব গণমাধ্যম দিবস।
১৭ নভেম্বর    :    বাংলাদেশের মযলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যুবার্ষিকী।
১৯ নভেম্বর    :    আহলে বাইতের ধারার চতুর্থ ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর শাহাদাত বার্ষিকী।
*অবিভক্ত ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অমর শহীদ মীর নিসার আলী তিতুমীরের শাহাদাত বার্ষিকী।
* আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস।
২০ নভেম্বর    :    বাংলাদেশের প্রখ্যাত মহিলা কবি সুফিয়া কামালের মৃত্যুবার্ষিকী।
১ ডিসেম্বর     :    বিশ্ব এইড্স প্রতিরোধ দিবস।
২ ডিসেম্বর     :    শিল্পী কামরুল হাসানের জন্মদিন।
৩ ডিসেম্বর     :    ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর প্রথম সংবিধান গৃহীত হওয়ার দিবস।
* বাংলাদেশের কচিকাঁচার আসরের প্রতিষ্ঠাতা রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাইয়ের মৃত্যুবার্ষিকী।
* বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস।
৫ ডিসেম্বর     :    অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী।
১০ ডিসেম্বর   :    আহলে বাইতের ধারার অস্টম ইমাম আলী ইবনে মূসা আর-রেযা (আ.)-এর শাহাদাত বার্ষিকী।
১৩ ডিসেম্বর   :    ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের চল্লিশতম দিবস (আরবাইন)।
১৬ ডিসেম্বর   :    বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবস। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর এই দিনে বাংলাদেশ বিজয় লাভ করে।
* বিশ্ব গবেষণা দিবস।
১৮ ডিসেম্বর   :    ড. মুহাম্মাদ মুফাত্তেহ্র শাহাদাত দিবস। এ দিবসটি ইরানে ‘ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (হাওযা) ও বিশ্ববিদ্যালয় এর মধ্যে ঐক্য দিবস’ হিসাবে পালিত হয়।
২০ ডিসেম্বর   :    সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর ওফাত দিবস।
*আহলে বাইতের ধারার দ্বিতীয় ইমাম ও বেহেশতের যুবকদের নেতৃদ্বয়ের প্রথম ব্যক্তিত্ব ইমাম হাসান (আ.)-এর শাহাদাত বার্ষিকী। ।
২১ ডিসেম্বর    :    ইরানে বছরের সবচেয়ে দীর্ঘতম রাত (শাবে ইয়ালদা)
২৫ ডিসেম্বর    :    হযরত ঈসা (আ.)-এর পবিত্র জন্মদিবস।
২৭ ডিসেম্বর    :    প্রলয়ংকরী সুনামীর বার্ষিকী। এ দিনে ভয়াবহ সুনামীতে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপসহ এ অঞ্চলের দেশগুলোর কয়েক লাখ লোক মৃত্যুবরণ করে।
৩০ ডিসেম্বর    :    ইমাম আল-হাসান ইবনে আলী আল-আসকারী (আ.)-এর শাহাদাত দিবস।