All posts by pavel

ইরান ভ্রমণ বিষয়ক সাক্ষাৎকার

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে গত ২-২৯ আগস্ট, ২০১৬ সাদী ফাউন্ডেশন ও আল্লামা তাবাতাবায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে মাসব্যাপী ৮৩তম ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের মানোন্নয়ন কোর্সের আয়োজন করা হয়। এ কোর্সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মোহাম্মদ ইব্রাহীম খলিল (এম.এ.), এমফিল এর ছাত্রী মেহজাবিন ইসলাম ও নাজমুন্নাহার অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। ৪১টি দেশের দুই শতাধিক শিক্ষার্থীর মাঝে ছেলেদের ক্যাটাগরিতে মোহাম্মদ ইব্রাহীম খলিল প্রথম স্থান, মেয়েদের ক্যাটাগরিতে মেহজাবিন ও নাজমুন্নাহার যথাক্রমে প্রথম ও পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। নিউজলেটারের পক্ষ থেকে মোহাম্মদ ইব্রাহীম খলিল ও মেহজাবিন ইসলামের সাক্ষাৎকার পত্রস্থ করা হল।

প্রশ্ন ১ : ফারসি মানোন্নয়ন যে কোর্সে আপনি অংশগ্রহণ করেছেন তার আয়োজন সম্পর্কে কিছু বলুন।

মোহাম্মদ ইব্রাহীম খলিল : ২০০১ সালে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ভ্রমণের প্রচ- ইচ্ছা ছিল, কিন্তু ছাত্রজীবন অতিক্রম হয়ে গেলেও তা আর হয়ে ওঠে নি। একই বিভাগে চাকুরির বদৌলতে ২০১৪ ও ২০১৫ সালে ভ্রমণের জন্য মনোনীত হলেও নানা কারণে আর যাওয়া হয় নি। ২০১৬ সালে বিভাগীয় চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবদুস সবুর খান ও বিভাগের অন্যান্য শিক্ষক মহোদয়ের অনুপ্রেরণায় এবং ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের মাননীয় কালচারাল কাউন্সেলর জনাব সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনীর আন্তরিক সহযোগিতায় এবছর ইরান সফরের ইচ্ছা পূরণ হয়। এখানে বলে রাখা ভালো যে, এবছর ইরানের ‘সাদী ফাউন্ডেশন’ ও আল্লামা তাবাতাবায়ি বিশ্ববিদ্যালয় ইরানের রাজধানী শহর তেহরানে এ কোর্সের আয়োজন করেছিল। ফারসি ভাষা মানবতার ভাষা। বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিক, যেমন, রুমি, জামি, হাফিজ, সাদীসহ আরো অনেকে এ ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছেন যা বিশ্বব্যাপী বহুল সমাদৃত। বিশ্বের নতুন প্রজন্মের কাছে এ মানবতার ভাষা, ইরানের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য নতুনভাবে পরিচয় করিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে ইরান সরকারের সহায়তায় প্রতি বছরের ন্যায় ইরানের ‘সাদী ফাউন্ডেশন’ ও ‘আল্লামা তাবাতাবায়ি বিশ্ববিদ্যালয়’ ৮৩তম কোর্সটি আল্লামা তাবাতাবায়ি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে আয়োজন করে। অন্যান্য বছরের বছরের তুলনায় এ বছরই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী এ কোর্সে অংশগ্রহণ করে। বিশ্বের ৪২টি দেশের (ইউরোপ, আমেরিকা, লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা মহাদেশসহ) ২১২ জন শিক্ষার্থী এবারের কোর্সে অংশগ্রহণ করে।

মেহজাবিন ইসলাম : আমি মেহজাবিন ইসলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষে এখন এম.ফিল প্রোগ্রামে গবেষক হিসেবে নিয়োজিত আছি। এ বছর ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের ৮৩তম উচ্চতর মানোন্নয়ন কোর্সটি ২ আগস্ট থেকে ২৯ আগস্ট পর্যন্ত অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে ইরানের রাজধানী তেহরানে অনুষ্ঠিত হয়। একমাসব্যাপী বুনিয়াদে সাদী (সাদী ফাউন্ডেশন) ও আল্লামা তাবাতাবায়ি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুষ্ঠিত ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের এ উচ্চতর মানোন্নয়ন কোর্সে বাংলাদেশ থেকে আমরা তিনজন অংশগ্রহণ করি। আমার অপর ২ জন কোর্স সঙ্গী হলেন মোঃ ইব্রাহীম খলিল ও মোছাঃ নাজমুন নাহার। উল্লেখ্য যে, এ বছর ৫টি মহাদেশের ৪২টি দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ., এম.ফিল, পি.এইচ.ডি-এর প্রায় ২১২ জন শিক্ষক, গবেষক ও শিক্ষার্থীর সমন্বয়ে অনুষ্ঠিত হয় এ কোর্স। অংশগ্রহণকারী দেশগুলো হলÑ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মান, অস্ট্রেলিয়া, চীন, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, কলম্বিয়া, আর্মেনিয়া, ইউক্রেন, জর্জিয়া, তুরষ্ক, সিরিয়া, ইরাক, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, তুর্কি, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, বেলজিয়াম, পোল্যান্ড, আলজেরিয়া ও আজারবাইজানসহ অন্যান্য দেশ। আমাকে এমন গুরুত্বপূর্ণ ও আন্তর্জাতিক মানের কোর্সে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়ায় আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মোঃ আব্দুস সবুর খান ও ঢাকাস্থ ইরানিয়ান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সম্মানিত কালচারাল কাউন্সেলর জনাব সাইয়্যেদ মূসা হোসেইনীকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাই।

প্রশ্ন ২ : কোর্সে অন্তর্ভুক্ত বিষয়াবলি, প্রশিক্ষণের ধরন, শিক্ষকদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলুন।
মোহাম্মদ ইব্রাহীম খলিল : এবারের কোর্সে অন্যান্য বছরের কোর্স থেকে একটু ভিন্নধর্মী আয়োজন ছিল। এবারের কোর্সে পড়ালেখার পাশাপাশি গান, কবিতা, কৌতুক, যুব দিবসের আয়োজন, নারী দিবসের আয়োজন, হস্তশিল্প প্রশিক্ষণ, ক্যালিগ্রাফি ও বিখ্যাত নিদর্শনসমূহের স্বচক্ষে পরিদর্শন ও বাস্তব জ্ঞান আহরণ অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইরানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পাঠদানরত বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী শিক্ষকদেরকে এ কোর্সের জন্য মনোনীত করা হয়েছিল। তাঁরা তাঁদের আন্তরিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে তাঁদের দীর্ঘদিনের পরিশ্রমলব্ধ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দ্বারা আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করেছেন। এছাড়াও ইরানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষকগণও এ কোর্সে পাঠদান করেন। এ কোর্সের পাঠদান পদ্ধতি দেখে আমার মনে হয়েছে, যে কোনো ভাষার অন্তঃনির্হিত জ্ঞানার্জনের জন্য সে ভাষার শিক্ষক আবশ্যক।

মেহজাবিন ইসলাম : ৮৩তম ফারসি ভাষার মানোন্নয়ন কোর্সটি আল্লামা তাবাতাবায়ি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা ও হিসাবরক্ষণ অনুষদে সম্পন্ন হয় এবং এ বিশ্ববিদ্যালয়ের (خوابگاہ سلامت شمالی) দক্ষিণ সালামত হলে আমাদের আবাসনের ব্যবস্থা ছিল। কার্যক্রমটি ২টি অংশে বিভক্ত ছিল। প্রথমটি ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক পাঠদান ও অপরটি নানাবিধ সাংস্কৃতিক কর্মসূচি ও প্রতিযোগিতার আয়োজন। এ শিক্ষাকার্যক্রমের প্রথম অর্থাৎ মূল অংশের বিষয়াবলি হচ্ছে ফারসি পদ্য ও গদ্যের বিভিন্ন সময়কাল ও বৈশিষ্ট্য, ইরান স্টাডিজ, ফারসি ভাষার ইতিহাস, ফারসি ব্যাকরণ পদ্ধতি, ফারসি কথপোকথন, ফারসি লিখনপদ্ধতি, ক্যালিগ্রাফি প্রশিক্ষণ, পারস্য স্টাইলের হস্তশিল্প বুনন পদ্ধতি ইত্যাদি। এ শিক্ষাকার্যক্রমের দ্বিতীয় ভাগের অন্তর্ভুক্ত ছিল ফারসি কবিতা আবৃত্তি, কাব্যিক ছন্দের খেলা, গান, কৌতুক, টেলিভিশন লাইভ শো, যুব দিবস বিতর্ক, খেলা, পত্রিকা অফিসে সাক্ষাৎকার প্রদান ও নারী দিবসে গল্প বলার ইভেন্ট। অত্যন্ত আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে, এই দ্বিতীয় অংশটি এবারই প্রথম ফারসি ভাষার মানোন্নয়ন কোর্সে সংযুক্ত করা হয়েছিল এবং আমি প্রায় প্রত্যেকটি ইভেন্টে অংশগ্রহণ করেছিলাম ও কবিতা আবৃত্তির জন্য সর্বমহলে প্রশংসিত ও পুরস্কৃত হই।
একমাসব্যাপী এ কোর্সে প্রতি ক্লাসে ৮ জন করে শিক্ষক মোট ৬০টি ক্লাস নেন যার সময়সীমা ছিল প্রায় ৭২ ঘণ্টা। বুনিয়াদে সাদী এ শিক্ষাকার্যক্রমের জন্য ইরানের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে অত্যন্ত দক্ষ ও জ্ঞানী শিক্ষকবৃন্দকে নির্বাচিত করেন। আর এ শিক্ষকম-লী দক্ষতার সাথে ভিন্ন ভাষাভাষী শিক্ষার্থীদেরকে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষা দেন। উল্লেখ্য যে, ফারসি কথপোকথনের ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছিল। এছাড়াও বুনিয়াদে সাদী প্রতি ২০ জন শিক্ষার্থীর জন্য একজন করে সহযোগী নিযুক্ত করেন। এসব সহযোগী সার্বক্ষণিক আমাদেরকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেন। কখনো কোর্স সম্পর্কিত তথ্য দিয়ে আবার কখনো পাঠদান করে। আমি এ সকল বন্ধুপ্রতিম সহযোগী ও শিক্ষক, যাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমে এ কোর্সটি সফল হয়েছে তাঁদের প্রতি আমার হৃদয় নিংড়ানো ধন্যবাদ জানাচ্ছি ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।

প্রশ্ন ৩ : এই কোর্সে পরিবেশ থেকে ফারসি শিক্ষার কোন কার্যক্রম ছিল কি- যেমন শিক্ষাসফর, স্থান পরিদর্শন, সাংস্কৃতিক প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ ইত্যাদি?

মোহাম্মদ ইব্রাহীম খলিল : এ কোর্সে শিক্ষাসফরও অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইরানের বিখ্যাত ও প্রাচীন শহর ‘ইসফাহান’ ভ্রমণ এ কোর্সের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আমরা সেখানে ৩ দিন অবস্থান করে বিখ্যাত জায়গাগুলো দেখে বাস্তব জ্ঞান লাভ করেছি। ইসফাহানকে ‘নেসফে জাহান’ অর্থাৎ অর্ধেক দুনিয়া বলার কারণ স্বচক্ষে উপলব্ধি করেছি। এছাড়া প্রতিদিন ক্লাসের শেষে এবং ক্লাস ছুটির দিনগুলোতে রাজধানী শহর তেহরান ও এর আশেপাশের বিখ্যাত স্থানগুলো আমরা তাঁদের তত্ত্বাবধানে ভ্রমণ করেছি। আমরা অল্প ক’দিনে ইরানের এতো বিখ্যাত স্থান ভ্রমণ করেছি যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সম্মানিত শিক্ষক জনাব মোঃ মুমিত আল রশিদ- যিনি ইরানের ‘শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয়ে’ পিএইচডি অধ্যয়নরত আছেন তিনি এ স্থানগুলোর বর্ণনা শুনে বলেন, ‘আমি ৪ বছর তেহরান আছি, আমিও এত স্থান ভ্রমণ করিনি।’ আমি আর একটি বিষয় লক্ষ করেছি যে, ইরানিরা খুবই সংস্কৃতিমনা। সুযোগ পেলেই তারা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। যেমন কোর্স শুরুর প্রথম দিনÑঅনেকেই তখনো ইরানে এসে পৌঁছায় নিÑতারা ইরানের নারী দিবস উপলক্ষে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে ফারসি ভাষায় বিভিন্ন পর্ব ছিল। গান, গল্প, কবিতা, অভিনয় ইত্যাদি। আমি সেখানে কৌতুক পর্বে অংশগ্রহণ করে সুনাম অর্জন করি। প্রথম দিনের কৌতুকেই আমি বাংলাদেশকে সবার কাছে পরিচিত করে তুলি।

মেহজাবিন ইসলাম : এই শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে আমরা ফারসি ভাষার জন্মভূমি ইরানের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন, শিক্ষাসফর, সাংস্কৃতিক প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করে বিশেষ করে ফারসি ভাষাভাষী মানুষের সাথে মিশে তাদের কাছ থেকে ফারসি ভাষা শিক্ষার একটা বড় সুযোগ পেয়েছিলাম। আমার কাছে এ পুরো কোর্সটিই একটি শিক্ষাসফর বলে মনে হয়েছে। আমরা তেহরান ও ইসফাহানের প্রায় ৩৮টি দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন করি। তেহরানের দর্শনীয় স্থানগুলোর অন্যতম হল : সুউচ্চ মিলাদ টাওয়ার, ইরানের জাতীয় গ্রন্থাগার, বইয়ের শহর, আজাদী মিউজিয়াম, সা’দ অ’বা’দ রাজপ্রাসাদা, পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধ মিউজিয়াম, সিনেমার উপশহর, জামারানে ইমাম খোমেইনী (র.)-এর বাড়ি, তাজরীশ বাজার, মিউজিক মিউজিয়াম, জাতীয় বোটানিকাল গার্ডেন, তেহরানের আসমাননামা, কাচ ও সিরামিক মিউজিয়াম, গুলিস্তান ও আর্ট গ্যালারি ও নবাব গোসলখানা, জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান, ৩০ তীর সড়ক, জাতীয় জাদুঘর ও হযরত মারইয়াম গির্জা, পা’লা’দিউম শপিং মল, তেহরান নভো থিয়েটার, অলিম্পিক সিনেমা হল।
এ সমস্ত দর্শনীয় স্থান পরিদর্শনের মাধ্যমে আমরা ইরানের ইতিহাস ও ঐতিহ্য, সভ্যতা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ব্যাপক জ্ঞান অর্জন করি, যার জ্ঞান একজন ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষার্থীর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

প্রশ্ন ৪ : আপনার ফারসি ভাষার মান এ কদিনে কেমন উন্নত হলো বলে আপনি মনে করেন? আপনার অর্জন-সাফল্যের অনুভূতি জানতে চাই। এ মানকে অগ্রসরমাণ রাখতে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে বলুন।

মোহাম্মদ ইব্রাহীম খলিল : সত্য বলতে, আমি ফারসির ছাত্র হিসেবে খুব ভালো ছিলাম না। ফারসি ভাষা ও সাহিত্যে আমার জ্ঞান খুবই অপ্রতুল। তবুও এ অল্প ক’দিনে ফারসির দেশে ফারসি ভাষাভাষী জনগণের সাথে থেকে তথা ফারসির মধ্যে থেকে (যেহেতু কোর্সে অংশগ্রহণকারী সবাই ফারসি বলতো) আমার ফারসি জ্ঞান অনেক এগিয়েছে। আমি এখন ইরানিরা কথা বললে সবই বুঝতে পারি, হয়তো পরিপূর্ণভাবে সব কথার উত্তর দিতে পারি না। আসলে কোনো ভাষা শিখতে হলে সেই ভাষার লোকদের সাথে কথা বললে অনেক সুবিধা হয়। আমরা যেহেতু সেখানে অংশগ্রহণ করে বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছি, আলোচিত হয়েছি, টিভিতে সরাসরি প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করেছি, বিভিন্নœ পত্র-পত্রিকায় আমাদের ছবিসহ খবর ছাপানো হয়েছে, আমাদের বাংলাদেশকে উপস্থাপন করে সকলের কাছে পরিচিত করতে পেরেছি এতে আমরা অনেক আনন্দিত ও উৎসাহিত হয়েছি। আমি এ অর্জন থেকে উৎসাহিত হয়ে সামনে ফারসি ভাষার ওপর উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করতে চাই। এছাড়া ইরানে আরো এ ধরনের আরো কোর্সে অংশগ্রহণ করে ফারসি চর্চার এ ধারা অব্যাহত রাখতে চাই।

মেহজাবিন ইসলাম : ফারসি ভাষা পৃথিবীর প্রাচীনতম ভাষা ও সাহিত্যগুলোর অন্যতম। এ ভাষায় রয়েছে সুদীর্ঘকালের ইতিহাস, জ্ঞান, বিজ্ঞান, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির অমূল্য রতœরাজি। জীবন্ত, সাবলীল ও কবিতার ভাষা হিসেবে পরিচিত এ ফারসি ভাষাকে বিশেষ করে এ ভাষার বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকদের প্রতি গভীর অনুরাগের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠিত বিষয় হিসেবে নির্বাচন করেছিলাম। ফারসি ভাষার প্রতি ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে এ ভাষাকে আরো ভালোভাবে জানার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত পড়া-লেখার পাশাপাশি আমি ইরানি কালচারাল সেন্টার থেকে জুনিয়র ও ভাষা ইনস্টিটিউট থেকে সিনিয়র, ডিপ্লোমা ও হায়ার ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করি। উল্লেখ্য যে, স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও ফারসি বিষয়ক এ চারটি কোর্সেই আমি ১ম বিভাগে ১ম স্থান অধিকার করি। এরই স্বীকৃতিস্বরূপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ডিন্স অ্যাওয়ার্ড’ও পাই। এত সাফল্যের পরেও দীর্ঘদিন থেকে মনের গভীরে ইরান দেখার ও ইরানের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ফারসি শোনার একটি বাসনা বিরাজ করছিল। আর আমার এই বাসনা পূর্ণতা পায় এ বছর আগস্টে ইরানের ৮৩তম ফারসি কোর্সে অংশগ্রহণ ও ভালো ফলাফলের মাধ্যমে।
বুনিয়াদে সাদী কর্তৃক আয়োজিত এ কোর্সটি ভিন্ন ভাষাভাষী ফারসি শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর আমার কাছে এ কোর্সের গুরুত্ব অবর্ণনীয়। এ কয়েকদিনে আমার ফারসি কথপোকথনে ও ফারসি সাহিত্যের ব্যাখ্যা প্রদানে এক অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়েছে। ক্লাস, ক্লাস পারফরম্যান্স, সাংস্কৃতিক প্রোগ্রাম, ভ্রমণ, স্থান পরিদর্শন এক কথায় সবকয়টি ইভেন্টে আমার শতভাগ উপস্থিতি ছিল এবং আমি সর্বাধিক পুরস্কারপ্রাপ্ত হই। আমার অর্জন ও সাফল্য সেদিনই পূর্ণতা পেয়েছিল, যেদিন আমার শ্রেণিশিক্ষক জনাব নাভিদী (آقای نویدی) স্যার বলেন, ‘উপমহাদেশে ভিন্ন ভাষাভাষী ফারসি শিক্ষার্থী ও গবেষকদের মধ্যে বাংলাদেশীরা সবচেয়ে বেশি দক্ষ ও পারদর্শী এবং তুমি ফারসিতে আরও অনেক ভালো করবে, তোমাকে আবারও ইরানের মাটিতে দেখতে পাব।’
একথা শোনামাত্র একদিকে যেমন আনন্দে উদ্ভাসিত হয়েছিলাম, অন্যদিকে তেমনি আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করেছি বাংলাদেশী হিসেবে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার যে মহান দায়িত্ব নিয়ে আমি ইরানের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছিলাম, তা সফলতার সঙ্গে পালনে সক্ষম হওয়ায়।
ফারসি ভাষার এ মানকে অগ্রসরমাণ রাখতে আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হল, বেশি বেশি ফারসি বই পড়া, গবেষণার কাজে নিয়োজিত থাকা, ফারসি বিষয়ক বিভিন্ন সেমিনারে অংশগ্রহণ করা, ফারসি থেকে বাংলায় অনুবাদের কাজ করা, কবিতা আবৃত্তি করা, ফারসি সিনেমা দেখা, গান শোনা ও অর্থ বোঝার চেষ্টা করা, বেশি করে ফারসি শব্দভা-ার ও ব্যাকরণ আয়ত্ত করা এবং ফারসি কথপোকথনের চর্চা রাখা। এছাড়া এ কোর্সের বদৌলতে যে সমস্ত ইরানি শিক্ষক ও বন্ধু পেয়েছি তাঁদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা। ফারসির এ উন্নতির ধারা অব্যাহত রাখতে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.ফিল প্রোগ্রাম শেষে ইরানের তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় অথবা আল্লামা তাবাতাবায়ি বিশ্ববিদ্যালয়ে পি.এইচ.ডি পর্যায়ে পড়াশুনা করব ইনশাআল্লাহ।

প্রশ্ন ৫ : এ কদিনে রাষ্ট্র হিসেবে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানকে কেমন দেখলেন কিছুটা খুলে বা বর্ণনা করে বলুন।

মোহাম্মদ ইব্রাহীম খলিল : ইরান একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ। ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে একটি দেশের যে সকল বৈশিষ্ট্য থাকা প্রয়োজন ইরানের আছে বলে আমার মনে হয়েছে। ইরানে নারীদের যেমন চলাফেরার স্বাধীনতা রয়েছে, তেমনি রয়েছে ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা। এখানে নারী-পুরুষ সবাই সবার অধিকার সম্পর্কে সচেতন। এখানে জনগণ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জীবন-যাপনে বিশ্বাসী। সেখানে নিরাপত্তার বিষয়টি লক্ষণীয়। ইরানিরা দিনে-রাতে যেখানে সেখানে গাড়ি পার্কিং করে রাখে। কোনো গাড়িরই কিছু হয় না। রাস্তায় চলতে, বাসায়-বাড়িতে গেলে ইরানিদের আতিথেয়তা লক্ষণীয়। অফিস-আদালত, ব্যাংকে প্রায় প্রতিটি টেবিল বা ডেস্কে চকলেটের ব্যবস্থা রয়েছে। কেউ গেলে প্রথমে তাকে এ চকলেট দ্বারা আপ্যায়ন করা হয়। এছাড়া ইরানিরা খুবই হৃদয়বান। কাউকেই তারা বিপদে ফেলতে চায় না। আবার কেউ বিপদে পড়লেও তাকে উদ্ধারে তারা এগিয়ে আসে। ইতিহাসে দেখা যায় যে, ইরানে যতগুলো হামলা হয়েছে সেগুলোর একটিতেও ইরানিরা আগে কাউকে হামলা করে নি। এ থেকে বুঝা যায় যে, ইরানি একটি ভদ্র জাতি। ইরানিরা খুবই পরিশ্রমী জাতি। এখানে নারী-পুরুষ সবাই খুব পরিশ্রম করেন। এ কারণেই তারা দিনের পর দিন উন্নতির শিখরে পৌঁছার জন্য সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

মেহজাবিন ইসলাম : ইরান দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার পারস্য উপসাগরের তীরে অবস্থিত একটি রাষ্ট্র। উঁচু-নিচু পাহাড়-পর্বত ও মরুভূমি ঘেরা বন্ধুর দেশ ইরান। এখানে হিমালয়ের পরেই এশিয়ার সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ দামাভান্দ অবস্থিত। আধুনিক ফারসি ইরানের সরকারি ভাষা। দেশটির জনগণ জাতিগত ও ভাষাগতভাবে বিচিত্র হলেও এরা প্রায় সবাই মুসলিম। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এ অঞ্চলটি ইসলামের শিয়া মতাবলম্বীদের কেন্দ্র। পারস্য বা ইরান প্রাচীনকাল হতে একটি গৌরবোজ্জ্বল সভ্যতার লীলাভূমি হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান দখল করে আছে। ইরানের জনগণ উন্নত রুচিবোধ ও সংস্কৃতিবহুল জীবনে অভ্যস্ত। ইরানে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের ভা-ার রয়েছে। পারস্য উপসাগরের অন্যান্য তেলসমৃদ্ধ দেশের মতো ইরানেও তেল রপ্তানি বিশ শতক থেকে দেশটির অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। ১৯৭৯ সালে ইরানি বিপ্লব গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের পতন ঘটায় এবং ইরানে একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্র স্থাপন করে। সৌদি আরবের পর ইরান মধ্যপ্রাচ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। ১৬,৪৮,০০০ বর্গকিলোমিটার আয়তন ও ৩০টি প্রদেশে বিভক্ত এ বিশাল দেশটির মাত্র ৩টি প্রদেশ যথাক্রমে- রাজধানী তেহরান, ইসফাহান ও কোম শহর দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। আমি মনে করি, আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা কম হওয়ায় ও আইনের শাসন বলবৎ থাকায় ইরানের লোকজন খুবই স্বাচ্ছন্দে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নভাবে, যানজটমুক্ত পরিবেশে ও নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে জীবন-যাপন করতে সক্ষম হয়েছে। ইরানকে আমার কাছে সুসজ্জিত দেশ বলে মনে হয়েছে। ইরান উন্নয়নশীল দেশ হলেও এ সমস্ত বিবেচনায় উন্নত দেশের মতই।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কয়েকটি খাতে ইরান অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করেছে। যেমন- সামরিক খাত, চিকিৎসা খাত, পারমাণবিক খাত, আধুনিক বিজ্ঞান, খেলাধুলা ও সংবাদমাধ্যম ইত্যাদি। আর এ উন্নতি ও অগ্রগতির ধারা সূচিত হয়েছিল মূলত ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমেই। সাম্প্রতিক সময়ে ইরানের ওপর থেকে আন্তর্জাতিক অবরোধ প্রত্যাহার করায় দেশটি ভবিষ্যতে উন্নয়নশীল আয়ের থেকে উন্নত আয়ের দেশে পরিণত হবে বলে আশা করা যায়।

প্রশ্ন ৬ : ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের জনগণ ও নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?
মোহাম্মদ ইব্রাহীম খলিল : ইরানের জনগণ স্বাধীনতাপ্রিয়। স্বাধীনভাবে চলাফেরায় তারা স্বাচ্ছন্দবোধ করে। তবে তারা অপরের অধিকার সম্পর্কে সচেতন। তারা কারো অধিকারে হস্তক্ষেপ করে না। তবে যদি কেউ তাদের ওপর অন্যায়ভাবে কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে চায় তখন তারা খুবই কঠোর হয়। ইরানের নেতৃবৃন্দ খুবই সহজ-সরল। তাঁরা নিজেদের স্বার্থকে প্রাধ্যান্য দেন না। তাঁরা নিজেদেরকে জনগণের সেবক বলে মনে করেন। তাঁদের মধ্যে কোনো গর্ব-অহংকার নেই। এখানে সবাই নিজের কাজ নিজেই করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। এ কারণেই প্রতিটি পরিবারে একাধিক গাড়ি থাকলেও কোনো ড্রাইভার নেই। এখানে মন্ত্রী বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিও নিজে গাড়ি চালিয়ে অফিসে আসেন। সব মিলিয়ে এই বিশৃঙ্খল পৃথিবীতে ইরান একটি শান্তির দেশের প্রতিচ্ছবি।

মেহজাবিন ইসলাম : ইরানের রাজনীতি একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্র কাঠামোয় পরিচালিত হয়। ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে গৃহীত সংবিধান এবং ১৯৮৯ সালের সংশোধনী ইরানের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সংজ্ঞায়িত করেছে। আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী বর্তমানে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা ও ড. হাসান রুহানি দেশটির নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি। আরও আছে ২৯০জন সদস্যবিশিষ্ট একপাক্ষিক আইনসভা।
এই কোর্সের মাধ্যমে আমার ইরানের নেতৃস্থানীয় দুজন ব্যক্তি সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করার সৌভাগ্য হয়েছে। একজন হলেন ইরানের ইসলামি বিপ্লবের সর্বাধিনায়ক ও ইরানি জাতির পথপ্রদর্শক ইমাম খোমেইনী ও ইরানের সাবেক স্পিকার হাদদাদ আদেল; যিনি বুনিয়াদে সাদীর প্রধান। ইমাম খোমেইনী তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে ইরানি জাতির নিকট চিরজীবন লাভ করেছেন। ইমাম খোমেইনীর বসবাসের জায়গা, ব্যবহৃত আসবাবপত্র দেখে তাঁর অতি সাধারণ জীবন-যাপন আমাকে মুগ্ধ করেছে। জানতে পেরেছি, ইসলামের অনুশাসন ও নিয়ম-শৃঙ্খলায় পরিবেষ্টিত ছিল তাঁর সমগ্র জীবন। হাদদাদ আদেল একজন শিক্ষিত, ভদ্র, রুচিশীল, পরিমার্জিত, দায়িত্বশীল, সাহিত্যপ্রেমি ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের অধিকারী ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। তাঁর স্বরচিত কবিতা ও বক্তৃতা আমাকে ম্গ্ধু করেছে। তিনি আমার গাওয়া হাফিযের গজল শুনে নিম্নোক্ত বেইতটির অবতারণা করেন:
باھر ستارہ ای سرو کارست ھر شبم
از حسرت فروغ رخ ھمچو ماہ تو
শুধু ইরানের নেতৃবৃন্দ নয়, ইরানের সাধারণ জনগণও অত্যন্ত সভ্য ও দায়িত্বশীল, অতিথিপরায়ণ, ধর্মপরায়ণ, কাজের প্রতি নিষ্ঠাবান, আন্তরিক ও সৌজন্যবোধসম্পন্ন।

প্রশ্ন ৭ : এই কোর্স চলাকালীন ইরান অবস্থানকালে আপনার একটি স্মরণীয় স্মৃতি জানতে চাই।

মোহাম্মদ ইব্রাহীম খলিল : ইরানে অবস্থানকালে দিনগুলো খুবই আনন্দে ও কর্মতৎপরতায় কেটেছে। প্রতিদিন সকালে উঠে রেডি হয়ে ক্লাসে যাওয়া, ক্লাস শেষে কোথাও ঘুরতে যাওয়া, রাতে হোস্টেলে ফিরে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া এসবের মধ্যেই বেশি সময় কেটেছে। প্রতিদিন নতুন নতুন স্থান ভ্রমণে নতুন অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে। প্রতিদিনই যেন এক একটি স্মৃতির দিন। এর মধ্যে অনেক বিশেষ স্মৃতিও রয়েছে। যেমন একদিন তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরতে গিয়েছি। সেখানে সবাইকে পরিচয়পত্র দেখিয়ে প্রবেশ করতে হয়। আমাদের গাইড বললেন, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি স্যার আসছেন। আমরা তাকিয়ে আছি। এর মধ্যে একটি গাড়ি আসতে দেখলাম। গাড়িটি গেটে এসে থামলো। দারোয়ান বসে আছে। তারপর গাড়িতে থাকা ভদ্রলোক গাড়ির জানালা খুলে হাত উঁচু করে দারোয়ানকে আইডি কার্ড দেখিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন। আমি গাইডের কাছে জানতে চাইলাম, ভিসি স্যার কোথায়? তিনি বললেন, উনি নিজেই ভিসি। এখানে সবাইকে আইন মানতে হয়। ভিসিও এর বাইরে নয়। তিনি আরো বললেন, কিছুদিন আগে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে দারোয়ানের রিপোর্ট মোতাবেক পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছে।

মেহজাবিন ইসলাম : কোর্স চলাকালীন ইরানি যুবদিবস পালনের জন্য মিলাদ টাওয়ারে এক জমকালো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। উক্ত অনুষ্ঠানে প্রথম ১৫ দিনে ছাত্র-ছাত্রীদের ফারসির মানের উন্নতির ওপর ভিত্তি করে প্রথম ১০ জনকে ক্রেস্ট প্রদান ও পুরস্কৃত করা হয়। নাম ঘোষণার সময় যখন আমি আমার নাম শুনতে পাই, একপ্রকার বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছিলাম; নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কেননা, এ ব্যাপারে আমাকে আগে থেকে কিছুই বলা হয়নি। এ ঘটনাটিই আমার কাছে সবচেয়ে স্মরণীয়, যা কখনো আমার স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাবে না।

প্রশ্ন ৮ : বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরাসি ভাষার শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে ফারসির মানোন্নয়নে করণীয় সম্পর্কে কিছু বলুন।
মোহাম্মদ ইব্রাহীম খলিল : আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশে যখন মুসলিম শাসকগণ ছিলেন তখন প্রায় ছয়শ’ বছর এ অঞ্চলের দাপ্তরিক ভাষা ছিল ফারসি। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনকাল শুরু হওয়ার পর পর্যায়ক্রমে এ ভাষার চর্চা কমে যায়। বর্তমানেও শুধু কয়েকটি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারসি চর্চা অব্যাহত রয়েছে। কয়েক বছর আগেও এ সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারসি ছাত্র ছিল হাতেগোনা। কিন্তু দিনদিন এর পরিসর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন অন্যান্য বিষয়ের মতো ফারসি বিভাগেও অনেক ছাত্রছাত্রী পড়ালেখা করে। তাই ফারসি যাঁরা পড়ান বা পড়েন সকলেরই আন্তরিক হওয়া জরুরি। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলব, যে কোনো ভাষায়ই দক্ষতা থাকলে ভবিষ্যতে সেটা কাজে আসবে। যেহেতু ফারসি বিভাগে তোমরা পড়ালেখা করছ, তাই ফারসির প্রতি আন্তরিক হয়ে ভালোভাবে পড়ালেখা কর, একদিন সফলকাম হবেই। সময় সুযোগ হলে ইরান ঘুরে আসতে পার। তাতে তোমার ফারসি জ্ঞানের উন্নতি হবে।

মেহজাবিন ইসলাম : আমি মনে করি, খুব ধৈর্যসহকারে নিয়মিত অধ্যাবসায়ের মাধ্যমেই যে কোন ভাষাকে আয়ত্ত করা সম্ভব। ফারসি ভাষা শিক্ষা পৃথিবীর যে কোন ভাষা শিক্ষা থেকে সহজ। তাই ফারসি শব্দভা-ার, ব্যাকরণপদ্ধতি ভালোভাবে জানতে হবে এবং কথপোকথনের ওপর জোর দিতে হবে। এজন্য বেশি বেশি ফারসি বই পড়া, সিনেমা দেখা, গান শোনা ও কবিতা আবৃত্তি করা উচিত। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারসি ভাষার শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে আমার একটাই অনুরোধ, তারা যেন অন্তত একবার ইরানে অনুষ্ঠিত এই কোর্সে অংশগ্রহণ করে। এই কোর্সটি একদিকে যেমন তাদেরকে ফারসি শিখতে সাহায্য করবে, অপরদিকে নিজেকে মূল্যায়নের পাশাপাশি আত্মবিশ্বাসী করে তুলবে, যা পরবর্তীকালে তাকে ফারসির মানোন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে সহায়ক হবে।

সংবাদ বিচিত্রা (বিদেশী সংবাদ)

‘তেলের মূল্যহ্রাস স্বাধীনচেতা দেশগুলোর ওপর চাপ তৈরির কৌশল’- রাহবার
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উযমা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী বলেছেন, আমেরিকার তাঁবেদারি করতে নারাজ দেশগুলোর ওপর চাপ তৈরির কৌশল হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমিয়ে রাখা হয়েছে। গত ২২ অক্টোবর ২০১৬ তেহরান সফররত ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সঙ্গে এক বৈঠকে এ মন্তব্য করেন আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী।
তিনি বলেন, ‘চাপের মুখে যৌক্তিক প্রতিরোধ ও বিচক্ষণতার সঙ্গে লক্ষ্য অর্জনে অবিচল থাকার মাধ্যমে বিজয় অর্জন সুনিশ্চিত করা সম্ভব।’
পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোর বিরুদ্ধে আমেরিকার সব পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র এরই মধ্যে ব্যর্থ হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। সর্বোচ্চ নেতা বলেন, কিন্তু তারপরও স্বাধীনচেতা দেশগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টির অপকৌশল হিসেবে তেলের দাম কমিয়ে রাখা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, অতীতে যখন কিছু মুসলিম দেশ ইহুদিবাদী ইসরাইলকে তেল সরবরাহ বন্ধ করে দিত তখন পশ্চিমারা কান্নাকাটি শুরু করে দিত এই বলে যে, এসব দেশ তেলকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সেই দেশগুলোই এখন ওপেকভুক্ত কিছু দেশকে সঙ্গে নিয়ে মার্কিন নীতির সঙ্গে সমন্বয় করে তেলকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।
আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেন, যৌক্তিক নীতি গ্রহণ এবং নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর মাধ্যমে স্বাধীনচেতা দেশগুলো এ ধরনের ষড়যন্ত্র ও বিদ্বেষের ক্ষতিকর প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নীতির ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেন, ‘কেউ কেউ মনে করে আমেরিকাকে পরাজিত করা সম্ভব নয়। অথচ এটি একটি মস্ত বড় ভুল ধারণা।’ তাঁর মতে, গত ১৫ বছরে একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার অবস্থান মারাত্মক নড়বড়ে হয়ে পড়েছে।
আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভেনিজুয়েলার প্রতিরোধকামী নীতির প্রশংসা করে বলেন, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের বর্তমান সভাপতি হিসেবে দেশটি এ সংস্থাকে শক্তিশালী করতে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে পারে। সাক্ষাতে প্রেসিডেন্ট মাদুরো মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে মার্কিন আগ্রাসন সত্ত্বেও ইরানের স্বাধীনচেতা নীতির প্রশংসা করে বলেন, এ অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে যখন যুদ্ধ ও রক্তপাত চলছে তখন ইরানি জনগণ পূর্ণ শান্তি ও নিরাপত্তা ভোগ করছে।
সাক্ষাতে ইরানের প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট ইসহাক জাহাঙ্গিরি উপস্থিত ছিলেন।

উন্নয়নই ইরান সরকারের প্রধান লক্ষ্য: প্রেসিডেন্ট রুহানি
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি দেশের উন্নয়ন প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। গত ২২ অক্টোবর ২০১৬ গ্রাম ও উপজাতি লোকদের জাতীয় দিবসে বক্তৃতা করার সময় তিনি বলেন, বিশেষ করে তরুণীদের বেকারত্ব সমস্যা সমাধানের প্রতি প্রত্যেকের জোর দেয়া উচিত। তিনি বলেন, উন্নয়নই তাঁর সরকারের প্রধান লক্ষ্য। তিনি জানান, তাঁর মন্ত্রিপরিষদ গ্রামাঞ্চলের উন্নয়নে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে যদিও এজন্য এখনো দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। তবে বিষয়টিতে তিনি স¤পূর্ণ সচেতন রয়েছেন বলে মন্তব্য করেন ড. রুহানি।
প্রেসিডেন্ট রুহানি গ্রামের মানুষের জন্য মাটি, পানি, বন, চারণভূমি, নদী ও জলজপ্রাণী রক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরেন। দেশ এখন পানির ঘাটতিতে ভুগছে বিধায় বর্তমান সময়ে জলজস¤পদের যথাযথ ব্যবহারে যতœবান হতে তিনি সবার প্রতি আহ্বান জানান।
পানি স¤পদ ব্যবস্থাপনার জন্য চলমান অনেক পরিকল্পনার প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, এরই মধ্যে চারটি বাঁধ উদ্বোধন করা হয়েছে এবং চলতি বছর সরকার আরো ছয়টি বাঁধ খুলে দেবে।

আফ্রিকান দেশগুলোর সাথে স¤পর্ক বাড়াতে চায় তেহরান : হাসান রুহানি
ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি বলেছেন, আফ্রিকান দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক বাড়ানো ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের অন্যতম নীতি। গত ১৭ অক্টোবর ২০১৬ তেহরান সফররত আইভোরি কোস্টের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদাল্লাহ আলবার্ট তইকেসুর সঙ্গে বৈঠকে এ মন্তব্য করেন তিনি।
প্রেসিডেন্ট রুহানি বলেন, ইয়ামোসুকরোর সঙ্গে সকল ক্ষেত্রে বিশেষ করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সম্পর্ক বাড়ানোর ব্যাপারে তেহরান প্রস্তুত রয়েছে। রুহানি আরো বলেন, দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে তেহরান এবং ইয়ামোসুকরো তাদের সক্ষমতাকে কাজে লাগানো উচিত।
প্রযুক্তি এবং প্রকৌশল ক্ষেত্রে ইরানের অগ্রগতির কথা উল্লেখ করে রুহানি আরো বলেন, পশ্চিম আফ্রিকান দেশগুলোর বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পে সহযোগিতা দিতে তেহরান সবসময় প্রস্তুত রয়েছে।
এছাড়া, বৈঠকে সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে সব দেশের সমন্বিত প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করেছেন প্রেসিডেন্ট রুহানি। সন্ত্রাসবাদকে বিশ্বের প্রধান হুমকি হিসেবে আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, ইসলাম ভালবাসা, শান্তি এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাস করে এবং এর সঙ্গে সন্ত্রাসীদের কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই।
বৈঠকে সন্ত্রাস নির্মূলে সব দেশের সমন্বিত প্রচেষ্টার ওপর জোর দিয়ে মাবরি বলেন, সব দেশের উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধি শান্তি এবং নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার ওপর নির্ভর করছে। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সঙ্গে সকল ক্ষেত্রে বিশেষ করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সম্পর্ক বাড়ানোর ব্যাপারে তার দেশের দৃঢ়তার কথা বৈঠকে উল্লেখ করেন আইভোরি কোস্টের এ কর্মকর্তা।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সফরে ইরানের প্রেসিডেন্ট; সম্পর্ক উন্নয়নই মূল লক্ষ্য
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি গত ৫ অক্টোবর ২০১৬ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার তিনটি দেশ সফরের উদ্দেশে বের হন। এ সফরে তিনি ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড গমন করেন। যাত্রার আগে প্রেসিডেন্ট রুহানি তিন দেশ সফরের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য স¤পর্কে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। এ সময় তিনি এ সফরকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, একুশ শতক হবে এশিয়ার।
এ সফরে প্রেসিডেন্ট রুহানি প্রথমে ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয় যান। পরে তিনি মালয়েশিয়া এবং সবশেষে থাইল্যান্ড যান। ব্যাংককে এশিয়া কো-অপারেশন ডায়ালগ বা এসিডি’র শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেন তিনি। এ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট রুহানি বক্তব্য রাখেন। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ঐক্য, সহযোগিতা এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এশিয়ার ভূমিকা বাড়ানোর লক্ষ্যে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
সম্পর্কের নতুন অধ্যায় রচনা করতে যাচ্ছে ইরান ও থাইল্যান্ড
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ও থাইল্যান্ড সম্পর্কের নতুন অধ্যায় রচনা করার কথা ঘোষণা করেছে। গত ৯ অক্টোবর ২০১৬ থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে দ্বিতীয় এশিয়া কো-অপারেশন ডায়ালগ বা এসিডি সম্মেলনের অবকাশে ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি ও থাই প্রধানমন্ত্রী প্রাইয়ুত চান-ও-চা এক বৈঠকে এ কথা ঘোষণা করেন।
প্রেসিডেন্ট রুহানি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আজ আমরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বাড়ানোর বিষয় নিয়ে কথা বলেছি। তেহরান ও ব্যাংককের মধ্যে এ সম্পর্ক দু দেশের স্বার্থ রক্ষার পাশাপাশি আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে।’
প্রেসিডেন্ট রুহানি বলেন, ইরান ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মাঝে থাইল্যান্ড অর্থনৈতিক সেতু হিসেবে কাজ করতে পারে। তেহরান ও ব্যাংককের মধ্যকার সহযোগিতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে দু’ দেশের বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সক্রিয় ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান। ইরান ও থাইল্যান্ডের মধ্যে অর্থনৈতিক স¤পর্ক জোরদার করার জন্য দু দেশের ব্যাংকিং চ্যানেল চালু করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন প্রেসিডেন্ট রুহানি। তিনি জানান, ইরান এবং থাইল্যান্ড চুক্তি ও প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিগগিরি দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য দ্বিগুণ করবে। বর্তমানে দু দেশের মধ্যে বার্ষিক ৭৯ কোটি ৪৫ লাখ ডলারের বাণিজ্য রয়েছে।
থাই প্রধানমন্ত্রীও তেহরান ও ব্যাংককের মধ্যে সম্পর্কের নতুন অধ্যায় রচনার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, ‘ইরানের সঙ্গে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বৈজ্ঞানিক সম্পর্ক বাড়ানোর বিষয়ে তার সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। একইভাবে জোরদার গতিতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স¤পর্কও বাড়াবে দু’ দেশ।’
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার তিনটি দেশ সফরের শেষ পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট রুহানি থাইল্যান্ড সফর করেন।

ইসলামের শত্রুরা বিভেদের বীজ বপন করছে : প্রেসিডেন্ট রুহানি
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি বলেন, ইসলামের শত্রুরা মুসলমানদের মধ্যে বিভেদের বীজ বপন করছে এবং ইরান ও মালয়েশিয়া এ ব্যাপারে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। গত ৭ অক্টোবর মালয়েশিয়ার প্রশাসনিক রাজধানী পুত্রজয়ায় স্বাগতিক দেশের প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠকের পর এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি। রুহানি বলেন, ইরান ও মালয়েশিয়া মনে করে, ইসলামের সব মাজহাবের লক্ষ্য এক; পাশাপাশি অভিন্ন উৎস থেকে এগুলোর উৎপত্তি হয়েছে। কাজেই মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে স¤পর্কের ক্ষেত্রে মাজহাবগত মতপার্থক্যকে উপেক্ষা করতে হবে।
মধ্যপ্রাচ্যসহ গোটা বিশ্বে চলমান জঙ্গিবাদকে দু’দেশের অভিন্ন উদ্বেগের জায়গা হিসেবে চিহ্নিত করে ইরানের প্রেসিডেন্ট বলেন, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সবগুলো দেশের উচিত সর্বশক্তি প্রয়োগ করা।
এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে স¤পর্ক ও সহযোগিতা শক্তিশালী করার ওপরও জোর দেন প্রেসিডেন্ট রুহানি। তিনি বলেন,ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের পররাষ্ট্রনীতিতে বন্ধু ও ভ্রাতৃপ্রতিম মালয়েশিয়াসহ এশিয়ার সব দেশের বিশেষ স্থান রয়েছে। মালয়েশিয়ায় ইরানি শিল্পপতিদের পুঁজি বিনিয়োগের দারুণ সুযোগ রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন হাসান রুহানি। তিনি বলেন,সেইসঙ্গে ইরানও তার তেল, গ্যাস ও পেট্রোকেমিক্যাল খাতে মালয়েশিয় পুঁজি বিনিয়োগকারীদের স্বাগত জানায়।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার তিন দেশ সফরের দ্বিতীয় পর্যায়ে শুক্রবার সকালে মালয়েশিয়া পৌঁছান প্রেসিডেন্ট রুহানি। এর আগে তিনি ভিয়েতনাম সফর করেন।

পোপের পত্রে মানবতার প্রতি সম্মান প্রদর্শনকারী মূল্যবোধের অংশীদারিত্বের ওপর গুরুত্ব আরোপ
ক্যাথলিক খ্রিস্টান জগতের প্রধান ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় আলেম ও ইসলামি চিন্তাবিদ হযরত আয়াতুল্লাহ্ নাসের মাকারেম শীরাযীর লেখা পত্রের জবাবে আয়াতুল্লাহর সাথে মতৈক্য প্রকাশ করে মানবতার প্রতি সম্মান প্রদর্শনকারী মূল্যবোধের অংশীদারিত্বের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
উল্লেখ্য, হযরত আয়াতুল্লাহ্ নাসের মাকারেম শীরাযী গত আগস্ট মাসে (২০১৬) পোপ ফ্রান্সিস বরাবরে একটি পত্র প্রেরণ করেন এবং এতে ইসলাম সম্পর্কে পোপের অবস্থানের প্রশংসা করেন। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে পোপ এ পত্রের উত্তর দেন।
পোপ তাঁর পত্রে তাঁকে পত্র লেখার জন্য হযরত আয়াতুল্লাহ্ নাসের মাকারেম শীরাযীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ নাসের মাকারেম শীরাযী তাঁর পত্রে ইসলাম সম্পর্কে পোপের অবস্থানের কারণে এবং তিনি যে ইসলাম সন্ত্রাসবাদের সমার্থক নয় বলে উল্লেখ করেছেন সে কারণে পোপকে ধন্যবাদ জানান। তাঁর এ পত্রের জবাবে পোপ ফ্রান্সিস ভ্যাটিকান থেকে একটি আনুষ্ঠানিক পত্র প্রেরণ করেন।
পোপের পত্রে বলা হয়, ‘পোপ ফ্রান্সিস হযরতের পত্র প্রাপ্তির কারণে খুশী হয়েছেন এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন।’ পত্রে আরো বলা হয়, হযরত আয়াতুল্লাহ্ মাকারেম অবশ্যই অবগত আছেন যে, সকল ধর্মের বাণী, বিশেষ করে সকল একেশ্বরবাদী ধর্মের বাণী হচ্ছে প্রথমত মানব প্রজাতি কর্তৃক ঈশ্বরের নিরঙ্কুশ আরাধনা এবং তদসহ আমরা যেসব মানুষের সাথে আন্তঃক্রিয়া করে থাকি তাদের সকলের প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান পোষণ। সুতরাং যখন সহিংসতার আশ্রয় নেয়া হয়, বিশেষ করে যখন তা ঈশ্বর বা ধর্মের নামে করা হয় তখন এ কাজ সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের প্রতি অবমাননা হিসেবে পরিগণিত হয় এবং শুধু তা-ই নয়, বরং তা নিপীড়িত মানুষের বিরুদ্ধে একটি বড় ধরনের যুলুম।’
পোপ তাঁর পত্রের শেষে বলেন, ‘সুতরাং বিশ্বের বর্তমান ধর্মীয় নেতাদের জন্য ইতিপূর্বেকার যে কোনো সময়ের চেয়েও এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গ্রহণ করা এবং প্রতিটি মানুষের সম্মান, মর্যাদা ও বৈধ অধিকারসমূহের সমর্থনে সোচ্চার হওয়া অধিকতর আবশ্যক।’
উল্লেখ্য, পোপ ইতিপূর্বে তাঁর পোল্যান্ড সফরে জোর দিয়ে বলেন যে, সন্ত্রাসবাদ ও সহিংসতার সাথে ইসলামের কোনোই সম্পর্ক নেই এবং কোনো ঐশী ধর্মকেই এসব বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত করে দেখানো উচিত নয়।

ইউনেস্কোর আল-আকসা বিষয়ক প্রস্তাবকে স্বাগত জানালো ইরান
মুসলমানদের প্রথম ক্বিবলা আল-আকসা মসজিদের সঙ্গে ইহুদিবাদী ইসরাইলের কোনো স¤পর্ক নেই বলে জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো যে রায় দিয়েছে তাকে স্বাগত জানিয়েছে ইরান। ইউনেস্কো সম্প্রতি এক প্রস্তাবে বাইতুল মোকাদ্দাস (জেরুজালেম) শহরে অবস্থিত ওই মসজিদ চত্বরে ইসরাইলের সব ধরনের তৎপরতাকে অবৈধ বলেও ঘোষণা করেছে।
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বাহরাম কাসেমি ইউনেস্কোর এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, এর মাধ্যমে আল-আকসা মসজিদের ওপর মুসলমানদের ধর্মীয় অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলো।
ইউনেস্কোর প্রস্তাবে বলা হয়, আল-আকসা মসজিদ এবং এর আঙিনা কেবল মুসলমানদের জন্যই পবিত্র। এছাড়া, এই মসজিদে মুসলমানদের অবাধ প্রবেশাধিকারে ইসরাইলি বাধাদানের তীব্র নিন্দা জানানো হয়। সেইসঙ্গে ‘দখলদার শক্তি’ ইসরাইলকে ঐতিহাসিক বাস্তবতা মেনে নিয়ে আল-আকসা মসজিদের ওপর যেকোনো আগ্রাসী তৎপরতা বন্ধ করার আহ্বান জানানো হয়।
গত ১৩ অক্টোবর ২০১৬ ইউনেস্কোতে আল-আকসা মসজিদ সংক্রান্ত প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয় আলজেরিয়া, ব্রাজিল, চীন, ইরান, রাশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকাসহ ২৪টি দেশ। অন্যদিকে আমেরিকা, ব্রিটেন, জার্মানি, হল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া ও এস্তোনিয়া প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়। এছাড়া, আলবেনিয়া, আলজেরিয়া, ফ্রান্স, গ্রিস, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ¯েপন ও সুইডেনসহ ২৬টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। আর সার্বিয়া এবং তুর্কমেনিস্তান ভোটাভুটিতে উপস্থিতই হয় নি।
এই ভোটাভুটিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করছেন পর্যবেক্ষকরা। কারণ, এর মাধ্যমে আল-আকসা মসজিদের ওপর ইহুদি ধর্মের আধ্যাত্মিক দাবি নস্যাৎ হয়ে গেছে। ইহুদিবাদীরা এই মসজিদকে ‘টে¤পল মাউন্ট’ হিসেবে অভিহিত করলেও ইউনেস্কোর প্রস্তাবে এটিকে আল-আকসা মসজিদ বা আল-হারাম আল-শরীফ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
জাতিসংঘের অঙ্গ সংগঠনের এ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে ইহুদিবাদী ইসরাইল। প্রস্তাবটি পাস হওয়ার পরের দিনই জাতিসংঘের এ সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতা স্থগিত করেছে তেল আবিব।

‘জ্বালানি চাহিদা পূরণে ইরানের সহযোগিতা চায় বাংলাদেশ’
বাংলাদেশের শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেছেন, ভ্রাতৃপ্রতিম দুই মুসলিম দেশ বাংলাদেশ ও ইরানের মধ্যে বাণিজ্যিক স¤পর্ক আরও জোরদার হওয়া উচিত। গত ৪ অক্টোবর ইরানের ইসফাহান প্রদেশের গভর্নর রাসুল জারগারপুরের সঙ্গে বৈঠকে তিনি এ কথা বলেন।
আমির হোসেন আমু বলেন, বিশ্বে গ্যাস মজুদের দিক থেকে ইরান দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। আর বাংলাদেশের রয়েছে ব্যাপক জ্বালানি চাহিদা। ইরান বাংলাদেশকে এ ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে পারে। ইরানের সহযোগিতায় বাংলাদেশের জ্বালানি চাহিদা পূরণ করা তাঁর এ সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য বলে জানান শিল্পমন্ত্রী।
মান যাচাইয়ের পর বাংলাদেশ ইরানের স্টিলজাত পণ্য আমদানির বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেবে বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশের শিল্পমন্ত্রী ইসফাহান শহরের প্রশংসা করে বলেন, তিনি দেশে ফিরে বহু বাংলাদেশি পর্যটককে ইসফাহানে যাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করবেন।
ইসফাহানের গভর্নর এ সময় বলেন, প্রতি বছর বিশ্বের ৮৬টি দেশ থেকে বহু সংখ্যক পর্যটক ইসফাহান সফর করেন। এ শিল্পের উন্নয়নে ইরান সরকার বিশেষ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।

ইরানি শিল্পে অলঙ্কৃত হচ্ছে মালয়েশিয়ার ইসলামি শিল্প জাদুঘর
ইরানি ও ইসলামি শিল্পে আরো সুসজ্জিত ও অলঙ্কৃত হচ্ছে এশিয়ার অন্যতম সেরা জাদুঘর হিসেবে পরিচিতি মালয়েশিয়ার ইসলামি শিল্প জাদুঘর। ইরানের ইসলামি যোগাযোগ ও সংস্কৃতি সংস্থার জনসংযোগ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী মালয়েশিয়ার ইসলামি শিল্প জাদুঘরের প্রধান গম্বুজের পুনর্নির্মাণ এবং এই জাদুঘরের অভ্যন্তরীণ কিছু সংস্কার ও কারুকাজের জন্য ইরানি শিল্পী মোহাম্মদ কভান্দকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। আর মোহাম্মদ কভান্দ ইরানি ও ইসলামি শিল্পের ছোঁয়ায় মালয়েশিয়ার বিখ্যাত এই জাদুঘরকে নতুন ভাবে অলঙ্কৃত করতে কাজ শুরু করেছেন ।
সূত্র জানায়, মালয়েশিয়ার ইসলামি শিল্প জাদুঘরের প্রধান গম্বুজÑ যা এই ভবনটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে তা ইরানি শিল্পী মোহাম্মদ কভান্দের নেতৃত্বে দীর্ঘ ৬ মাসের নিরলস পরিশ্রমে অত্যন্ত চমৎকারভাবে পুনর্নিমিত হওয়ায় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ তাঁকে ইরানি ও ইসলামি নিদর্শনের আদলে একটি পানির ফোয়ারা নির্মাণের দায়িত্ব দেয়। কভান্দ ইরানি-ইসলামি শিল্পের আলোকে জাদুঘরের ভবনের প্রথম তলায় একটি পানির ফোয়ারা নির্মাণের পরিকল্পনা জমা দেন। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী খুব শিগগিরই এই ফোয়ারার কাজ শুরু হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানানো হয়েছে।

মধ্য এশিয়ার চারটি দেশ ইরানের মধ্য দিয়ে ট্রানজিট বৃদ্ধি করবে
মধ্য এশিয়ার চারটি দেশ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের মধ্য দিয়ে পণ্য ট্যানজিট বৃদ্ধি করবে। এ দেশগুলো হচ্ছে তাজিকিস্তান, উযবেকিস্তান, তুর্কোমেনিস্তান ও কাযাকিস্তান। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রেলওয়ে কোম্পানির অপারেশন সংক্রান্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত উপপ্রধান জনাব হোসাইন আশূরী গত ২২ অক্টোবর তেহরানে এ তথ্য প্রকাশ করেন।
জনাব হোসাইন আশূরী জানান যে, এ ব্যাপারে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ও ঐ দেশগুলোর মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী তারা ইরানের মধ্য দিয়ে ছয় ধরনের পণ্যের ট্রানজিট পরিবহন বৃদ্ধি করবে।
তিনি উল্লেখ করেন যে, সাম্প্রতিক কয়েক সপ্তাহে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ও ঐ দেশগুলোর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক ও বহুজাতিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং সেসব বৈঠকে পণ্য পরিবহন সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
জনাব হোসাইন আশূরী আরো জানান, এসব বৈঠকে গন্ধক ও রাসায়নিক সার ট্রানজিট বৃদ্ধির ব্যাপারে তুর্কমেনিস্তানের সাথে, গম ও ইস্পাত ট্রানজিট বৃদ্ধির ব্যাপারে কাযাকিস্তানের সাথে এবং অ্যালুমিনিয়াম রেইল ট্রানজিট বৃদ্ধির ব্যাপারে তাজিকিস্তানের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
তিনি উল্লেখ করেন যে, বর্তমানে ঐ তিনটি দেশের সাথে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের শক্তিশালী সম্পর্ক রয়েছে এবং সাম্প্রতিক কালে এ দেশগুলোর সাথে ইরানের যেসব চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে তাতে শুল্ক হ্রাস ও সফরের সময় শাশ্রয়ের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এবং সেই সাথে অধিক পরিমাণে পণ্য বিনিময়ের লক্ষ্যে পরিবহন সক্ষমতা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
তিনি জানান, এছাড়াও ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ও মধ্য এশীয় দেশ উযবেকিস্তানের মধ্যে কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে যাতে উভয় দেশ উযবেকিস্তান থেকে পারস্য উপসাগরের উপকূলবর্তী দক্ষিণ ইরানের বন্দরগুলোতে বছরে সাড়ে তিন লাখ টন তুলা ট্রানজিটের ব্যাপারে মতৈক্যে উপনীত হয়েছে। উল্লেখ্য, গত বছর এর পরিমাণ ছিল তিন লক্ষ টন।
তিনি আরো উল্লেখ করেন যে, গত ইরানি বছরে কোনো অশোধিত অ্যালুমিনিয়াম ট্রানজিট করা হয় নি, কিন্তু চলতি বছরের (২১ মার্চ ২০১৬ Ñ ২০ মার্চ ২০১৭) বিগত কয়েক মাসে তাজিকিস্তান থেকে দক্ষিণ ইরানে অশোধিত অ্যালুমিনিয়াম ট্রানজিটের পরিমাণ পনর হাজার টনে উপনীত হয়েছে। তিনি জানান, উভয় পক্ষই চলতি বছরের শেষ নাগাদ অশোধিত অ্যালুমিনিয়াম ট্রানজিটের পরিমাণ পঞ্চাশ হাজার টনে উপনীত করতে আগ্রহী।
জনাব আশূরী বলেন, আমদানি, রফতানি ও ট্রানজিট পণ্য স্থানান্তরের লক্ষ্যে ইরান ও ঐ দেশগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি চমৎকার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, সম্পাদিত চুক্তিগুলো যথাসম্ভব অচিরেই বাস্তবায়িত হবে।

ইরানের কোম ও মাশহাদে পাঁচ তারকা ট্রেন চালু
ইরান রেলওয়ে কোম থেকে মাশহাদে পাঁচ তারকা ট্রেন সার্ভিস চালু করেছে। এ ট্রেনের নাম দেয়া হয়েছে ‘ফাদাক’। ইরানের বিখ্যাত এ দুটি শহরের মধ্যে মাযার যিয়ারত ও ধর্মীয় তীর্থযাত্রীদের যাতায়াতে এ ট্রেন সার্ভিস বিশেষ সুবিধা দেবে। ‘ফাদাক’ ট্রেন প্রথমবারের মত কোম থেকে মাশহাদে পাঁচ তারকা মানের ট্রেনসার্ভিস। কোম থেকে মাশহাদে এবং মাশহাদ থেকে কোমে এ ট্রেন যাতায়াতে প্রতিবার সময় লাগবে ৭ ঘণ্টা।
এ ট্রেন সার্ভিসে উন্নত মানের সেবা নিশ্চিত করা হয়েছে। পুরো ট্রেনটিই তৈরি হয়েছে ইরানে। মাশহাদের পর কোম হচ্ছে ইরানের দ্বিতীয় পবিত্র শহর। কোমে হযরত মাসুমা (সা.আ.)-এর ও মাশহাদে হযরত ইমাম রেযা (আ.)-এর পবিত্র মাযার শরীফে লাখ লাখ ইরানি নাগরিক ছাড়াও বিদেশি পর্যটকরা যিয়ারত করতে যান। তাঁদের জন্য এ ট্রেন সার্ভিস চলাচলে সুবিধা এনে দেবে।

ইরান তিন মহাদেশের বিভিন্ন দেশে রেডিও ড্রাগ রফতানি করছে
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান বিশ্বের তিনটি মহাদেশের বিভিন্ন দেশে রেডিও ড্রাগ রফতানি করছে। ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (এইওই)-র প্রধান জনাব আলী আকবার সালেহী ঘোষণা করেন যে, ইরান বর্তমানে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ মহাদেশের বেশ কয়েকটি দেশে ২৫টিরও বেশি রেডিও ড্রাগ রফতানি করছে।
জনাব সালেহী বলেন, বর্তমানে আমরা পঁচিশটিরও বেশি রেডিও ড্রাগ উৎপাদন করছি এবং মিসর, ইরাক ও জার্মানিসহ তিন মহাদেশের আরো কয়েকটি কাছাকাছি দেশে সেগুলো রফতানি করছি। তিনি গত ১৫ সেপ্টেম্বর (২০১৬) তেহরানে এক অনুষ্ঠানের অবকাশে সাংবাদিকদের সাথে সাক্ষাতে এ তথ্য জানান।
তিনি অন্য এক প্রসঙ্গে জানান যে, যেসব রোগীর জন্য পারমাণবিক ডায়াগনোসিস ও চিকিৎসার প্রয়োজন রয়েছে তাদের জন্য তেহরানে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইরান ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদনের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হবার পথে। তিনি বলেন, এ হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠার পূর্বে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ গ্রহণের লক্ষ্যে আমরা একদল ইরানি ডাক্তার ও নার্সকে অস্ট্রিয়ায় পাঠাব।
জনাব সালেহী আরো বলেন, এ হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠার ফলে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধির ডায়াগনোসিস ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হবে। তিনি বলেন, বর্তমানে পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলো এ ধরনের একটি চিকিৎসা কেন্দ্রের অভাব তীব্রভাবে অনুভব করছে।
তিনি আরো উল্লেখ করেন যে, ইরান যেসব রেডিও ড্রাগ রফতানি করছে সেগুলোর সাহায্যে এমন অনেক রোগের চিকিৎসা করা সম্ভব হচ্ছে যেসব রোগকে সুনির্দিষ্ট করে চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি আরো জানান যে, বর্তমানে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে প্রায় দশ লক্ষ লোককে রেডিও ড্রাগের দ্বারা চিকিৎসা করা হচ্ছে।

ইরান ও রাশিয়ার শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের মধ্যে ৩০টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ও রুশ ফেডারেশনের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের মধ্যে ৩০টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়েছে।
সম্প্রতি তেহরানে অনুষ্ঠিত ইরান ও রাশিয়ার শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের চ্যান্সেলরদের শীর্ষ সম্মেলনে এসব সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। দু’পক্ষের মধ্যে এসব সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের উদ্দেশ্য হচ্ছে উভয় দেশের বৈজ্ঞানিক ও শিক্ষা ক্ষেত্রের কর্মতৎপরতা বৃদ্ধি ও তাতে পারস্পরিক সহযোগিতা, ছাত্র ও শিক্ষক বিনিময়, যৌথ কোর্স অনুষ্ঠান ও যৌথ গবেষণা কার্য পরিচালনা।
উল্লেখ্য, এ শীর্ষ সম্মেলনে রাশিয়ার বিভিন্ন শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ জন চ্যান্সেলরসহ মোট ২৩ সদস্যের একটি রুশ প্রতিনিধিদল অংশগ্রহণ করেন। এতে যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর অংশগ্রহণ করেন সেসবের মধ্যে রয়েছে মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি, গুব্কিন্ ইউনিভার্সিটি, লোবাচেভস্কি ইউনিভার্সিটি, কাবার্ডিনো-বালকার স্টেট ইউনিভার্সিটি প্রভৃতি। তাঁরা শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের তেহরান ইউনিভার্সিটি, শহীদ বেহেশতী ইউনিভার্সিটি, শরীফ ইউনিভার্সিটি অব্ টেক্নোলজী, মাশ্হাদের ফেরদৌসী ইউনিভার্সিটি, শীরায ইউনিভার্সিটি এবং ইসফাহান ইউনিভার্সিটির সাথে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেন। বিশেষ করে ইরান ইউনিভার্সিটি অব্ সায়েন্স্ অ্যান্ড টেক্নোলজী এবং সেন্ট পিটার্সবুর্গ স্টেট পলিটেকনিক ইউনিভার্সিটির মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী এ দু’টি বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে পরস্পরের সাথে সহযোগিতা করবে।
উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ও রুশ ফেডারেশনের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের প্রথম যৌথ শীর্ষ সম্মেলন গত ২৮ অক্টোবর ২০১৫ তারিখে লোমোন্সোভ্ মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটির সেন্ট্রাল লাইব্রেরি ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দু’দেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের তৃতীয় শীর্ষ সম্মেলন আগামী বছর মস্কোতে অনুষ্ঠিত হবে- যার তারিখ ও ভেন্যু পরে নির্ধারণ করা হবে।

ইরানের রফতানিকৃত অশোধিত তেলের শতকরা ৬২ ভাগ এশীয় দেশগুলোতে যাচ্ছে
বর্তমানে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রফতানিকৃত অশোধিত তেলের শতকরা ৬২ ভাগ এশীয় দেশগুলোতে যাচ্ছে। ন্যাশনাল ইরানিয়ান অয়েল কোম্পানি (এন্আইওসি)র আন্তর্জাতিক বিষয়াদি সম্পর্কিত নির্বাহী পরিচালক সাইয়্যেদ মোহ্সেন ক্বাসেমী গত ১৬ অক্টোবর (২০১৬) তেহরানে এ তথ্য প্রকাশ করেন।
জনাব মোহ্সেন ক্বাসেমী ছোট আকারের চীনা শোধনাগারগুলোর কাছে ইরানের সাম্প্রতিক অশোধিত তেল বিক্রির কথা উল্লেখ করে আরো বলেন, আমরা যে রফতানির কথা উল্লেখ করেছি তাতে এসব কোম্পানির কাছে বিক্রয়কৃত তেল অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি। কারণ, এসব ছোট ছোট কোম্পানি উপস্থিতভাবে চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে (নগদ মূল্যে) অশোধিত তেল ক্রয় করে থাকে।
জনাব মোহ্সেন ক্বাসেমী আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, চলতি ইরানি বছরের শেষ (২০ মার্চ ২০১৭) নাগাদ ইরানের অশোধিত তেল রফতানির পরিমাণ বর্তমানের তুলনায় দৈনিক আরো দেড় লক্ষ ব্যারেল হতে তিন লক্ষ ব্যারেল পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।
তিনি আরো বলেন, বর্তমানে ইরানের অশোধিত তেলের শতকরা ৬২ ভাগ এশীয় দেশগুলোতে এবং অবশিষ্ট শতকরা ৩৮ ভাগ ইউরোপে যাচ্ছে। তিনি বলেন, এমতাবস্থায় তেল রফতানি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেলেও এ অনুপাতে কোনোরূপ পরিবর্তন ঘটার সম্ভাবনা নেই।
তিনি আরো জানান, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা থাকাকালেও চীন ছিল ইরানি অশোধিত তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। তখন ইরানের রফতানিকৃত অশোধিত তেলের শতকরা ৪০ ভাগই যেত চীনে- যার দৈনিক পরিমাণ ছিল চার লক্ষ ব্যারেল।
জনাব মোহ্সেন ক্বাসেমী এর আগে জানিয়েছিলেন যে, ইরানের অশোধিত তেলের দৈনিক মোট রফতানির পরিমাণ ২২ লক্ষ ব্যারেল, তবে বর্তমানে এর পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে দৈনিক সাড়ে ২৩ লক্ষ ব্যারেলে দাঁড়িয়েছে।
বর্তমানে ইরানের অশোধিত তেল উৎপাদনের মোট পরিমোণ হচ্ছে দৈনিক ৩৮ লক্ষ ৫০ হাজার ব্যারেল। ইরান সরকার চলতি ইরানি বছরের শেষ নাগাদ তার অশোধিত তেল উৎপাদনের পরিমাণ ৪০ লক্ষ ব্যারেলে উন্নীত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।

ইরান তার দৈনিক গ্যাসোলিন আমদানি ছয় মাসে এক তৃতীয়াংশে নামিয়ে এনেছে
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান চলতি ইরানি বছরের প্রথমার্ধের তুলনায় দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে তার দৈনিক গ্যাসোলিন আমদানির পরিমাণ এক তৃতীয়াংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের জাতীয় তেল কোম্পানি ন্যাশনাল ইরানিয়ান অয়েল কোম্পানি (এন্আইওসি)-র আন্তর্জাতিক বিষয়াদি সম্পর্কিত নির্বাহী পরিচালক সাইয়্যেদ মোহ্সেন ক্বাসেমী গত ১৫ অক্টোবর (২০১৬) তেহরানে এ তথ্য প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে ইরানের গ্যাসোলিন আমদানি হ্রাসের এ পরিমাণ হচ্ছে দৈনিক ৮০ লক্ষ লিটার। বর্তমানে ইরানের গ্যাসোলিন আমদানির পরিমাণ হচ্ছে দৈনিক ৪০ লক্ষ লিটার।
তিনি দেশের তেলজাত দ্রব্যাদি আমদানি-রফতানির সর্বশেষ পরিসংখ্যান তুলে ধরতে গিয়ে এ তথ্য প্রকাশ করেন। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, চলতি ইরানি বছরের দ্বিতীয়ার্ধে (২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬-২০ মার্চ ২০১৭) দৈনিক গ্যাসোলিন আমদানির গড় পরিমাণ আরো হ্রাস পাবে।
ইরানি কর্মকর্তা আরো উল্লেখ করেন যে, গ্যাসোলিন আমদানি হ্রাসের পাশাপাশি ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিভিন্ন ধরনের তেলজাত দ্রব্য রফতানির পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি জানান, বর্তমানে ইরান থেকে গড়ে প্রতি মাসে ছয় লক্ষ টন গ্যাস অয়েল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি করা হচ্ছে।
জনাব মোহসেন ক্বাসেমী জানান, বর্তমানে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান থেকে জ্বালানি তেল এবং তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি)ও রফতানি করা হচ্ছে। বর্তমানে জ্বালানি তেল রফতানির পরিমাণ হচ্ছে মাসে বিশ লক্ষ টন।
তিনি উল্লেখ করেন যে, চলতি ইরানি বছরের প্রথমার্ধে (২১ মার্চ থেকে ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৬) ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের গ্যাসোলিন আমদানির পরিমাণ ছিল দৈনিক এক কোটি বিশ লক্ষ লিটারÑ যা অবশ্য এক বছর আগেকার তুলনায় চল্লিশ লক্ষ লিটার বেশি ছিল।
উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে ন্যাশনাল ইরানিয়ান অয়েল রিফাইনারি অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (এন্আইওর্আডিসি)-র ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনাব আব্বাস কাযেমী উল্লেখ করেন যে, বর্তমানে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান গড়ে দৈনিক ৬০ লক্ষ লিটার গ্যাস অয়েল ও ফুয়েল অয়েল রফতানি করছে। তিনি আরো উল্লেখ করেন যে, বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য থেকে যে পরিমাণ তেলজাত দ্রব্যাদি রফতানি করা হচ্ছে তার মধ্যে ইরানের রফতানির পরিমাণ হচ্ছে শতকরা সাড়ে তের ভাগ।

নতুন কিছু নিজস্ব রাডার-সিস্টেম চালু করল ইরান
ইরান তার নিজস্ব প্রযুক্তির নতুন কিছু রাডারের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করেছে। ৫০০ কিলোমিটার পাল্লার এইসব রাডারের মধ্যে রয়েছে ‘মাত্বলায়িল ফাজর-তিন’। ইরানের তাসনিম বার্তা সংস্থার বরাত দিয়ে প্রেসটিভি গত ২২ অক্টোবর জানায়, দেশটির শিরাজ অঞ্চলে এয়ার বা বিমান নেভিগেশন সিস্টেমের চারটি রাডার ও নেভিগেশন প্রকল্প চালু করা হয়েছে। এই প্রকল্পগুলোতে রয়েছে ‘মেরাজ-চার’ ও ‘মাত্বলায়িল ফাজর’ বা ‘ভোরের উদয়-তিন’ নামের দুই রাডার সিস্টেম এবং দুটি ডিএমই সিস্টেম ও এয়ার বা বিমান ন্যাভিগেশন সিস্টেম প্রজাতির লেভেল-পরিমাপক রাডার সিস্টেম।
ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল হোসাইন দেহকান এইসব সিস্টেমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেন, মেরাজ বা ঊর্ধ্বগমন-চার রাডার সিস্টেমে রয়েছে প্রাথমিক সতর্ক বাণী দেয়া, নিয়ন্ত্রণ, দূরপাল্লার বিমান পর্যবেক্ষণ, ভূমিতে ব্যবহারযোগ্যতা ও ত্রিমাত্রিক শনাক্তকরণ ব্যবস্থা।
তিনি আরও বলেন, এই সিস্টেমে রয়েছে ইলেক্ট্রনিক যুদ্ধ মোকাবেলার অত্যাধুনিক নানা টেকনিক ব্যবহারের সুবিধা, ¯পষ্টীকরণের ক্ষমতা ও ২০০টি লক্ষ্যবস্তু বা টার্গেট সনাক্ত করার সুবিধা এবং রয়েছে কন্ট্রোল টাওয়ারের কমান্ডিং ব্যবস্থা।
জেনারেল দেহকান আরও বলেন, ‘মাত্বলায়িল ফাজ্র’ রাডারে রয়েছে দ্বিমাত্রিক টার্গেটগুলো চিহ্নিত করার ব্যবস্থা এবং এর পাল্লা ৫০০ কিলোমিটার।
ডিএমই সিস্টেম প্রসঙ্গে দেহকান বলেন, এটা রেডিও ন্যাভিগেশন সিস্টেমের সহায়ক ব্যবস্থা যা বেসামরিক বিমানবন্দরগুলোতেও পাইলটের সঙ্গে ভূমিতে থাকা কেন্দ্রের যোগাযোগের কাজে ব্যবহার করা হয়।
লেভেল-পরিমাপক রাডার সিস্টেম প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, মিলিমিটার তরঙ্গ ব্যবহার করে এই সিস্টেম তরল বস্তুর লেভেল পরিমাপ করে। এই সিস্টেমের পরিমাপণ ক্ষমতার যথাযথ অবস্থার মাত্রা বা অ্যাকিউরেসি এক থেকে পাঁচ মিলিমিটার।
ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী আরও জানান, অতীতে এ ধরনের রাডার বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো, কিন্তু এখন ইরানি বিশেষজ্ঞদের হাতে এসবের পুরোপুরি স্থানীয়করণ করা হয়েছে। আর এই রাডার সিস্টেমগুলো গুণগত ও পরিমাপগত দিক এবং নৈপুণ্যের দিক থেকে বিশ্বের অত্যাধুনিক রাডার সিস্টেমগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিতে সক্ষম বলে তিনি জানান।

ন্যানো-বিজ্ঞান উৎপাদনে ইরানের চতুর্থ স্থান লাভ
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ২০১৫ সালে ন্যানো-বিজ্ঞান উৎপাদনের ক্ষেত্রে দক্ষিণ কোরিয়াকে পিছনে ফেলে বিশ্বের মধ্যে চতুর্থ স্থান অধিকার করেছে। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিজ্ঞান, গবেষণা ও প্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রী জনাব মোহাম্মাদ ফারহাদী গত ১৬ অক্টোবর (২০১৬) তেহরানে এ খবর জানান।
জনাব ফারহাদী ন্যানো-বিজ্ঞান উৎপাদনে ইরানের অগ্রগতির কথা উল্লেখ করে জানান, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ন্যানো-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ২০১৫ সালে পাঁচ হাজার ১৮৭টি আর্টিকেল প্রস্তুত করে এবং এর ফলে বিজ্ঞান উৎপাদনের ক্ষেত্রে পরিমাণের দিক থেকে বৈশ্বিক র‌্যাঙ্কিং-এ দক্ষিণ কোরিয়াকে পিছনে ফেলে চতুর্থ স্থান অধিকার করতে সক্ষম হয়েছে।
উল্লেখ্য, ন্যানো-বিজ্ঞান উৎপাদনের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক র‌্যাঙ্কিং-এ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যথাক্রমে ২০১২ সালে ৭ম, ২০১৩ সালে ৬ষ্ঠ ও ২০১৪ সালে ৫ম স্থান অধিকার করে।

ইরানি কোম্পানির এএসপিএ পুরস্কার লাভ
বৈজ্ঞানিক উপকরণাদি প্রস্তুতকারী একটি ইরানি কোম্পানি ‘এসিয়ান সায়েন্স্ পার্ক অ্যাসোসিয়েশন (এএসপিএ)’-এর ২০১৬ সালের পুরস্কার লাভ করেছে। গত ১৯ থেকে ২২ অক্টোবর (২০১৬) ভারতের হায়দরাবাদে অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে ইরানি কোম্পানিটি এ পুরস্কার লাভ করে।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের ইসফাহান শহরের সায়েন্স্ এন্ড্ টেক্নোলজী টাউনে ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক উপকরণাদি প্রস্তুতকারী এ কোম্পানিটিকে রিঅ্যাক্টিভ্ এক্স্ট্রুইশন টেক্নোলজী ও পলিমার ন্যানোকম্পোজিট্স্ উপস্থাপনে অসাধারণ সাফল্যের জন্য এ বিরাট পুরস্কার প্রদান করা হয়।
উল্লেখ্য, এএসপিএ-র এ গ্রান্ড প্রাইজ সেই সব কোম্পানিকে দেয়া হয় যেসব কোম্পানির বাস্তবায়নযোগ্য আইডিয়াসমূহ বিভিন্ন টেকনিক্যাল বিজ্ঞান বাণিজ্যিক স্তরে উপনীত হয়েছে এবং এশিয়া মহাদেশে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
এসিয়ান সায়েন্স পার্ক অ্যাসোসিয়েশন (এএসপিএ) একটি আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা যা এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিল্প ও অর্থনীতি ক্ষেত্রে যৌথ উন্নয়নের লক্ষ্যে জাপানে প্রতিষ্ঠিত হয়। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১০টি দেশের ৫১৯টি সংস্থা এএসপিএ-র সদস্য। এসব সংস্থার মধ্যে রয়েছে সায়েন্স্ অ্যান্ড টেক্নোলজী পার্ক (এসটিপি), গবেষণা সংস্থা, বাণিজ্যিক উদ্যোগ সৃষ্টিকারী কেন্দ্র, বিশ্ববিদ্যালয় ও একাডেমিক সংস্থা।
এএসপিএ-এর এ ২০তম সম্মেলনের চিন্তাগত বিষয়বস্তু (থিম্) ছিল ‘এশিয়া মহাদেশ ও এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির ক্ষেত্রে উদ্ভাবনীতে অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতামূয়লক সুযোগ-সুবিধা’।
উল্লেখ্য, এএসপিএ-র পূর্ববর্তী সম্মেলনে ইসফাহানের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি টাউনে অবস্থিত নয়টি কোম্পানি এএসপিএ-র গ্র্যান্ড প্রাইজ লাভ করেছিল।

ভেটের‌্যান্স্ ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ইরানি অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র ‘লিট্ল্ বয়’-এর শ্রেষ্ঠ পুরস্কার লাভ
সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত ভেটের‌্যান্স্ ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে নির্মিত অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র ‘লিট্ল্ বয়’ শ্রেষ্ঠ পুরস্কার ‘রেড্ পপি’ লাভ করে। চলচ্চিত্রটির বিষয়বস্তু হচ্ছে যুদ্ধবিষয়ক গল্প। এছাড়া আরেকটি ইরানি চলচ্চিত্র ‘রেড্ লাইন্’ শ্রেষ্ঠ মিউজিকের ‘রেড্ পপি’ পুরস্কার লাভ করে।
উভয় চলচ্চিত্রেরই লেখক ও পরিচালক ছিলেন মোনা শাহী। ‘রেড্ লাইন্’ চলচ্চিত্রের মিউজিক স্কোর লিখেন হোসাইন জালীলী। মোনা শাহী ‘লিট্ল্ বয়’-এর পুরস্কার ও হোসাইন জালীলী ‘রেড্ লাইন্’-এর পুরস্কার গ্রহণ করেন।
‘লিট্ল্ বয়’ একটি শর্ট অ্যানিমেশন ফিল্ম। এ চলচ্চিত্রের গল্পটি হচ্ছে মোটামুটি এই যে, সামরিক বাহিনীর নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে একটি শহরের সকল অধিবাসী শহর ত্যাগ করে গেলেও একটি ছোট্ট বালক তাদের সাথে শহর ছেড়ে যেতে চায় না, বরং তার নিজস্ব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সে শহরে থেকে যায় এবং এরপর তাকে ও একটি বোমাকে কেন্দ্র করে গল্পটি এগিয়ে যায়।

চেলসিয়া ফিল্ম ফেস্টিভালে ইরানি চলচ্চিত্র ‘প্যারাডাইজ’-এর শীর্ষ পুরস্কার লাভ
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘প্যারাডাইজ’ সম্প্রতি নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত চতুর্দশ চেলসিয়া ফিল্ম ফেস্টিভালে তিনটি শীর্ষ পুরস্কার লাভ করেছে। বার্তা সংস্থা এমএনএ গত ১৭ অক্টোবর (২০১৬) তারিখে এ খবর প্রদান করে। উল্লেখ্য, চেলসিয়া ফিল্ম ফেস্টিভাল হচ্ছে নিউ ইয়র্কের তৃতীয় বৃহৎ চলচ্চিত্র উৎসব।
নিউ ইয়র্কের সিনেপোলিস মুভি থিয়েটারে অনুষ্ঠিত এ চলচ্চিত্র উৎসবে ইরানি ফিচার ফিল্ম ‘প্যারাডাউজ’-এর নির্মাতা আলী আত্শানী শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে, এ চলচ্চিত্রের অভিনেতা জাভাদ এয্যাতী শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে এবং মেহ্রান রাজাবী শ্রেষ্ঠ সাপোর্টিং অ্যাক্টর হিসেবে পুরস্কার লাভ করেন।
‘প্যারাডাইজ’ চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু দু’জন তরুণ ইরানি আলেম যাঁরা জার্মানির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মবিষয়ক একটি সেমিনারে যোগদানের জন্য সিদ্ধান্ত নেন।
এবারের চেলসিয়া ফিল্ম ফেস্টিভালে অংশগ্রহণকারী একমাত্র ইরানি চলচ্চিত্র হিসেবে ‘প্যারাডাইজ’ প্রধান প্রতিযোগিতা ক্যাটেগরিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আরো ২২টি চলচ্চিত্রের সাথে প্রতিযোগিতা করে। চলচ্চিত্রটি দর্শকদের কাছ থেকে উষ্ণ অভ্যর্থনা লাভ করে এবং এর পর পরই এর পরিচালকের সাথে কিউ এন্ড্ এ সেশন অনুষ্ঠিত হয়।
উল্লেখ্য, চেলসিয়া ফিল্ম ফেস্টিভাল হচ্ছে চার দিনব্যাপী একটি চলচ্চিত্র উৎসব যাতে উদীয়মান পরিচালকদের দ্বারা নির্মিত স্বতন্ত্র শর্ট ফিল্ম, ফিচার-লেন্থ ফিল্ম ও প্রামাণ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হয়।
ইরানি চলচ্চিত্র ‘প্যারাডাইজ’, এর পর পরই গত ১৯ অক্টোবর টরোন্টো ফিল্ম ফেস্টিভালে এবং ২৯ অক্টোবর ইরানি ফিল্ম ফেস্টিভালে অংশগ্রহণ করে।

ইরানে উচ্চতর ফারসি ভাষা কোর্সে প্রথম হলেন দুই বাংলাদেশি
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে বিদেশিদের জন্য আয়োজিত ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের উচ্চতর প্রশিক্ষণ কোর্সে দুই বাংলাদেশি শিক্ষার্থী প্রথম হয়েছেন। ছেলেদের মধ্যে প্রথম হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষার্থী ইব্রাহীম খলিল এবং মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী মেহজাবিন ইসলাম।
কোর্স সমাপনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ইরানের সা’দী ফাউন্ডেশন এর প্রধান ও সাবেক সংসদ ¯িপকার গোলাম আলী হাদ্দাদ আদেল। তিনি কৃতি ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন।
ইরানে অনুষ্ঠিত একমাসব্যাপী উচ্চতর প্রশিক্ষণ কোর্সে ৪১টি দেশের দুইশ’র বেশি শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছিল। এর মধ্যে ছেলে ও মেয়ে-এ দুই ক্যাটাগরিতেই বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা প্রথম স্থান অধিকার করেন যা বাংলাদেশিদের জন্য গর্বের বিষয়।
প্রশিক্ষণ কোর্সটি গত ২ আগস্ট শুরু হয়ে ২৮ আগস্ট শেষ হয়। প্রতি বছরই ইরানে এ ধরনের প্রশিক্ষণ কোর্সের আয়োজন করা হলেও এবারের আয়োজন ছিল বেশি জাঁকজমকপূর্ণ।

ইরানের মাইক্রো এয়ার ভেহিক্ল্ টীম চীনের প্রতিযোগিতায় প্রথম হলো
সম্প্রতি গণপ্রজাতন্ত্র চীনের রাজধানী বেইজিং-এ অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক মাইক্রো এর্য়া ভেহিক্ল্ প্রতিযোগিতায় (এমএভি ২০১৬) অংশগ্রহণ করে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের আমীর কাবীর প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রো এর্য়া ভেহিক্ল্ টীম গৃহবহির্ভূত উন্মুক্ত র্পার্ফম্যান্সে সর্বোত্তম দক্ষতা প্রদর্শন করে প্রথম পুরস্কার লাভ করেছে।
এ সেকশনের প্রতিযোগিতায় ১৬টি টীম ইনডোর কম্পিটিশনে এবং অপর ১৬টি টীম আউটডোর কম্পিটিশনে পরস্পরের বিরুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের ৭টি টীম এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে।
আমীর কাবীর প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএভি টীম প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য প্রতিযোগিতার আয়োজকদের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা লাভে সক্ষম হয় এবং ইর্ন্ডো ও আউর্ট্ডো উভয় ক্যাটেগরিতেই অংশগ্রহণের জন্য উপযুক্ত বিবেচিত হয়। এছাড়াও আমীর কাবীর বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএভি টীম এবারের এমএভি সম্মেলনের জন্য দু’টি প্রবন্ধ পেশ করে এবং উভয় প্রবন্ধই সম্মেলনের আয়োজকদের দ্বারা গৃহীত হয়।
প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী আমীর কাবীর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাত সদস্যবিশিষ্ট টীমের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন পিএইচডি, মাস্টার্স ও ¯œাতক পর্যায়ের ছাত্রগণ যারা এয়ারোস্পেস্ ও কম্পিউটার বিজ্ঞানে পড়াশুনা করছেন।
আমীর কাবীর প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এয়ারোস্পেস্ ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ড. নাক্বক্বাশ্-এর নেতৃত্বাধীন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএভি টীম ইনডোর ও আউটর্ডো উভয় প্রতিযোগিতায় বেশ কয়েকটি শীর্ষ র‌্যাঙ্কিং-এর অধিকারী হয়। এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী টীমগুলোর মধ্যে চীন, স্পেন, দক্ষিণ কোরিয়া, রাশিয়া, পোল্যান্ড, ভারত, জার্মানি, ফ্রান্স ও ব্রাজিলের টীম ছিল অন্যতম।
আন্তর্জাতিক মাইক্রো এর্য়া ভেহিক্ল্ সম্মেলন ও প্রতিযোগিতা ২০১৬ (আইএমএভি ২০১৬) গত ১৭ থেকে ২১ অক্টোবর বেইজিং-এ অনুষ্ঠিত হয়। আইএমএভি হচ্ছে একটি বার্ষিক অনুষ্ঠান যাতে মাইক্রো এয়ার ভেহিক্ল্ সংক্রান্ত একটি বৈজ্ঞানিক সম্মেলন ও একটি প্রযুক্তি প্রতিযোগিতা অন্তর্ভুক্ত থাকে।

বৈশ্বিক র‌্যাঙ্কিং-এ ইরানি শিপিং কোম্পানির অবস্থান ১৯তমে উন্নীত
ইরানের সরকারি শিপিং কোম্পানি ইসলামিক রিপাবলিক অব্ ইরান শিপিং লাইন্স্ (আইর্আআইএস্এল্) তার মালিকানাধীন কন্টেইনার শিপের সংখ্যা ও ধারণ ক্ষমতার বিচারে বৈশ্বিক র‌্যাঙ্কিং-এ ১৯তম অবস্থানে উন্নীত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী শিপিং ইন্টারেস্টসমূহের কাছে বাজার সংক্রান্ত তথ্য সরবরাহকারী সংস্থা ক্ল্যার্কসন রিসার্চ সার্ভিসেস এ তথ্য জানিয়েছে।
ক্ল্যার্কসন রিসার্চ সার্ভিসেস তার সাম্প্রতিকতম কন্টেইর্না ইন্টেলিজেন্স্ মান্থলি রিপোর্টে উল্লেখ করেছে যে, ইসলামিক রিপাবলিক অব্ ইরান শিপিং লাইন্স্ (আইর্আআইএস্এল্) কন্টেইনার শিপের মালিক কোম্পানিসমূহের বৈশ্বিক র‌্যাঙ্কিং-এর ক্ষেত্রে এক বছর আগের তুলনায় চার ধাপ এগিয়ে গিয়ে ১৯তম অবস্থানে উন্নীত হয়েছে। উল্লেখ্য, গত বছর একই সময় বৈশ্বিক র‌্যাঙ্কিং-এ আইর্আআইএস্এল্-এর অবস্থান ছিল ২৩তম।
ক্ল্যার্কসন্ রিসার্চ সার্ভিসেস্-এর বিগত দুই মাসের কন্টেইনার ইন্টেলিজেন্স্ মান্থলি রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমানে আইর্আআইএস্এল্-এর মালিকানাধীন কন্টেইনার শিপসমূহের মোট ধারণ ক্ষমতার পরিমাণ হচ্ছে বিশ ফুট সমপরিমাণ ইউনিট (টিইইউ) পরিমাপের হিসাবে ৯২ হাজার ৬৭৪ টিইইউ ইউনিট যার ভিত্তিতে বৈশ্বিক র‌্যাঙ্কিং-এ আইর্আআইএস্এল্-এর অবস্থান দাঁড়িয়েছে ১৯তমে।
পরিবহন সক্ষমতার ক্ষেত্রে সরকারি ইরানি শিপিং কোম্পানি আইর্আআইএস্এল্-এর বৈশ্বিক র‌্যাঙ্কিং-এর এ উন্নতি এটাই নির্দেশ করে যে, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হবার পরে ইরানের সামুদ্রিক পরিবহন বাণিজ্যের ব্যাপক বৃদ্ধি ঘটেছে এবং ইরান মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহের মধ্যে সর্বাধিক পরিমাণে সামুদ্রিক পরিবহন সক্ষমতার অধিকারী হয়েছে।

ইরানের মহিলা তায়কোয়ান্দো টীমের বিশ্ব পুমাসাই খেতাব লাভ
সম্প্রতি পেরুর রাজধানী লিমা-য় অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড্ তায়কোয়ান্দো ফেডারেশন (ডব্লিউটিএফ্) কর্তৃক আয়োজিত ১০ম বৈশ্বিক তায়কোয়ান্দো ফাইনালে ত্রিশোর্ধ বয়সের মহিলা গ্রুপের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে বিরাট সাফল্যের কারণে ইরানি মহিলা তায়কোয়ান্দো প্রতিযোগীদল স্বর্ণপদক বিজয় ছাড়াও ‘বিশ্ব পুমাসাই’ খেতাব লাভ করেছে।
প্রতিযোগিতার দ্বিতীয় দিন ইরানিদের দ্বারা তিনটি পদক বিজয়ের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয়।
আতুসা ফারাহ্মান্দ্, সোনা রায্যাক্বী ও ফারীবা নায্ম্দেহ্কে নিয়ে গঠিত ইরানি মহিলা তায়কোয়ান্দো টীম ৭.৯৭ পয়েন্ট লাভ করে ত্রিশোর্ধ বয়সী মহিলাদের গ্রুপের প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে পডিয়ামের শীর্ষস্থানে দ-ায়মান হবার গৌরব অর্জন করে, অন্যদিকে আমেরিকান টীম রানার্স আপ্ হয় এবং ফিন্ল্যান্ড্ তৃতীয় স্থান অধিকার করে।
এছাড়া এ প্রতিযোগিতায় ৪০ বছরের কম বয়স্ক পুরুষদের একক ব্যক্তিগত প্রতিযোগিতায় ইরানের আলী সালেমী ৮.২ পয়েন্ট লাভ করে রৌপ্যপদক জয় করেন ও দ্বিতীয় স্থানের অধিকারী হন। এ প্রতিযোগিতায় ফিলিপাইনের একজন প্রতিযোগী শীর্ষস্থান অধিকার করেন এবং দক্ষিণ কোরিয়া ও আমেরিকার দু’জন প্রতিযোগী যৌথভাবে তৃতীয় স্থান লাভ করেন।
এছাড়া গ্রুপভিত্তিক ক্যাটেগরির প্রতিযোগিতায় ন্যাশানাল ইরানিয়ান্ মেন্স্ পুমাসাই দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে যৌথভাবে তৃতীয় স্থান অধিকার করে ব্রোঞ্জপদক লাভ করে। অন্যদিকে এ ক্যাটেগরিতে ফিলিপাইন স্বর্ণপদক জয় করে এবং তুরস্ক দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী ইরানি টীমে ছিলেন মোহাম্মাদ তাক্বী হাতামী, আলী সাল্মানী ও মাহ্দী সামাদীয়ান। এ প্রতিযোগিতায় ইরানি টীম ৭.৮৪ পয়েন্ট অর্জন করে।
উল্লেখ্য, ওয়ার্ল্ড্ তায়কোয়ান্দো ফেডারেশন (ডব্লিউটিএফ্) কর্তৃক পেরুর রাজধানী লিমা-য় আয়োজিত ১০ম বৈশ্বিক তায়কোয়ান্দো পুমাসাই চ্যাম্পিয়নশীপ প্রতিযোগিতা গত ২৯ সেপ্টেম্বর (২০১৬) শুরু হয় এবং ২ অক্টোবর সমাপ্ত হয়। এতে বিশ্বের সেরা তায়কোয়ান্দো অ্যাথলেট্গণ পাঁচটি বয়স ক্যাটেগরির সাতটি গ্রুপে স্বর্ণ জয়ের জন্য প্রতিযোগিতা করেন।

ইরানের পুরুষদের জাতীয় ভলিবল টীম-বি কর্তৃক এশিয়ান ভলিবল কনফেডারেশন কাপ অর্জন
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের পুরুষদের জাতীয় ভলিবল টীম-বি ৫ম এশিয়ান ভলিবল্ কনফেডারেশন (এভিসি) কাপ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে ফাইনাল রাউন্ডে তাদের চীনা প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করে তৃতীয় বারের মতো চ্যাম্পিয়নশীপ অর্জন করে এভিসি কাপ লাভ করেছে।
থাইল্যান্ডের কেন্দ্রীয় শহর নাখোন্ পাথম্-এর নাখোন্ পাথম জিমনেসিয়ামে আয়োজিত পুরুষদের ৫ম এশিয়ান ভলিবল্ কনফেডারেশন (এভিসি) কাপ প্রতিযোগিতার শেষ দিনে গত ২৬ সেপ্টেম্বর (২০১৬) ফাইনাল রাউন্ডে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের পুরুষদের জাতীয় ভলিবল টীম-বি তার চীনা প্রতিদ্বন্দ্বীকে ৩-১ ব্যবধানে পরাজিত করে তৃতীয় বারের মতো ইরানের জন্য চ্যাম্পিয়নশীপ নিশ্চিত করে।
এ প্রতিযোগিতা গত ২২ সেপ্টেম্বর (২০১৬) শুরু হয় ও ২৬ সেপ্টেম্বর সমাপ্ত হয়।

বিশ্ব কাপ প্রতিযোগিতায় ইরানের জাতীয় ফুটসাল টীমের তৃতীয় স্থান লাভ
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের জাতীয় ফুটসাল টীম ৮ম ফিফা ফুটসাল ওয়ার্ল্ড কাপ প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান লাভ করেছে। ইরানি টীম পর্তুগালকে ৪-৩ ব্যবধানে পরাজিত করে এ অবস্থানের অধিকারী হয়।
কলোম্বিয়ার ক্যালি-র কোলিসেও এল্ পুয়েব্লো স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত এ আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় ইরানি টীম ছয় রাউন্ড পেনাল্টি শুটআউটের পরে তার প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দিয়ে গত পয়লা অক্টোবর (২০১৬) তৃতীয় স্থান অধিকার করে ও ব্রোঞ্জপদক লাভ করে।
এর আগে ইরানি টীম রাশিয়ার কাছে ৪-৩ ব্যবধানে হেরে যাওয়ায় ফাইনালে ওঠার সুযোগ হারিয়ে ফেলে এবং প্যারাগুয়ের বিরুদ্ধে ৪-৩ ব্যবধানে জয়লাভ করে সেমি-ফাইনালে উন্নীত হয়।
এ প্রতিযোগিতায় পর্তুগালও আর্জেন্টিনার কাছে ৫-২ ব্যবধানে হেরে যাওয়ায় ফাইনালে উঠতে ব্যর্থ হয় এবং তৃতীয় স্থানের জন্য ইরানি টীমের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে।
উল্লেখ্য, ৮ম ফিফা ফুটসাল ওয়ার্ল্ড কাপ প্রতিযোগিতা গত ১০ সেপ্টেম্বর (২০১৬) শুরু হয় এবং পয়লা অক্টোবর আর্জেন্টিনা ও রাশিয়ার মধ্যে চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য লড়াই এবং আর্জেন্টিনা কর্তৃক রাশিয়াকে ৫-২ ব্যবধানে পরাজিত করে শিরোপা লাভের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয়; এটাই হচ্ছে ফিফা ফুটসাল ওয়ার্ল্ড কাপ প্রতিযোগিতায় আর্জেন্টিনার প্রথম শিরোপা বিজয়।

ইরানি বীচ রেসলার টীমের এশিয়া মহাদেশের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার
ফিফ্থ্ এসিয়ান্ বীচ্ গেম্স্ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের ন্যাশনাল বীচ্ রেসলার টীম দু’টি স্বর্ণপদক ও একটি রৌপ্যপদক জয় করে প্রথম স্থানের অধিকারী হয়েছে। ভিয়েতনামের কেন্দ্রীয় এলাকার উপকূলীয় শহর দা নাং-এ গত ৩০ সেপ্টেম্বর (২০১৬) থেকে ২ অক্টোবর পর্যন্ত এ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়।
৮০ কেজির কম ওজনের পুরুষদের ক্যাটেগরিতে ইরানি কুস্তিগীর উমিদ হাসান্তার্বা ১৬তম রাউন্ডে চীনা কুস্তিগীর নাইরিসিগাকে পরাজিত করে কোয়ার্টার ফাইনালে উন্নীত হন এবং কোয়ার্টার ফাইনালে মঙ্গোলিয়ার আঙ্খ্বার্য়ে বাৎচুলুন্কে পরাজিত করে সেমি-ফাইনালে উপনীত হন। সেমি-ফাইনালে তিনি পাকিস্তানি কুস্তিগীর মুহাম্মাদ আসাদ বাট্-এর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং তাঁকে পরাজিত করে ফাইনালে উন্নীত হন। তিনি ফাইনালে উন্নীত হয়ে থাইল্যার্ন্ডে চানউইট্ আউন্জাই-র সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং তাঁকে পরাজিত করে করে শিরোপা লাভ করেন ও পডিয়ামে সর্বোচ্চ স্থানে উপনীত হবার গৌরবের অধিকারী হন।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের জন্য দ্বিতীয় স্বর্ণপদকটি জয় করেন ৭০ কেজি ওজন ক্যাটেগরির ইরানি কুস্তিগীর মোহাম্মাদ নাদেরী। তিনি ক্যাম্বোডিয়ার কুস্তিগীর মাকারা এন্গুয়ান্কে প্রথম দফা প্রতিযোগিতায়ই পরাস্ত করতে সক্ষম হন। এরপর তিনি মঙ্গোলিয়ার বীচ্ রেসর্লা বাৎযোরিগ্ বুইয়ান্জাভ্কে পরাজিত করে সেমি-ফাইনালে উন্নীত হন। তিনি সেমি-ফাইনালে আফগানিস্তানের মালেকজান্ আফ্যাল্যাদাকে পরাজিত করে ফাইনালে উপনীত হন। ফাইনালে তাঁকে পাকিস্তানী কুস্তিগীর নার্যি-এর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয় এবং নার্যিকে পরাজিত করে তিনি ৭০ কেজির উর্ধ্ব ক্যাটেগরিতে চ্যাম্পিয়নশীপের অধিকারী হন।
অন্যদিকে ৯০ কেজির কম ওজন ক্যাটেগরিতে ইরানি কুস্তিগীর সাইয়্যেদ মোহাম্মাদ সাদাতী তাঁর পাকিস্তানি প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে পরাজয় বরণ করে পডিয়ামে তাঁর ক্যাটেগরিতে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। সাইয়্যেদ মোহাম্মাদ সাদাতী এর আগে যথাক্রমে তাঁর কিরগিযিস্তানী, ক্বাতারী, আফগান ও চীনা প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করে ফাইনালে উপনীত হন।
এভাবে ইরানি বীচ্ রের্স্ট্লা টীম্ এ প্রতিযোগিতায় দু’টি স্বর্ণপদক ও একটি ব্রোঞ্জপদকের অধিকারী এশিয়া মহাদেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম বীচ্ রেসর্লা টীমের গৌরবময় মর্যাদার অধিকারী হয়।
ফিফ্থ্ এশিয়ান্ বীচ্ গেম্স্ প্রতিযোগিতায় এশিয়া মহাদেশের ৪৫টি দেশ থেকে সাড়ে তিন হাজার অ্যাথ্লেট্ অংশগ্রহণ করেন। মোট ১৪টি স্পটে এ প্রতিযোগিতার বিভিন্ন ইভেন্ট্ অনুষ্ঠিত হয়।

ইরানের সিয়ামান্দ্ রহমান ভারোত্তোলনে নতুন বিশ্ব রেকর্ড করলেন
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের হেভিওয়েট পাওয়ারলিফটিং চ্যাম্পিয়ন সিয়ামান্দ্ রহমান সম্প্রতি রিও প্যারালিমপিক্স্-এ তাঁর নিজের তিন তিন বারের বিশ্ব রেকর্ড ভঙ্গ করে নতুন রেকর্ড গড়লেন। তিনি এবার ৩১০ কেজি ওজন উত্তোলন করে নতুন রেকর্ড গড়ে স্বর্ণপদক জয় করেন। গত ১৪ সেপ্টেম্বর (২০১৬) রাতে বিশ্বের সর্বাধিক শক্তিশালী এ প্যারা অলিম্পিয়ান ভারোত্তোলনের ইতিহাসে এ নতুন পাতা সংযোজন করেন।
রিওসেন্ট্রো-২ প্যাভিলিয়নে অনুষ্ঠিত রিও-২০১৬ প্যারালিম্পিক্স্-এর দর্শকগণ শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনা সহকারে দেখার জন্য অপেক্ষা করছিলেন যে, ইরানের ২৮ বছর বয়স্ক ভারোত্তোলন চ্যাম্পিয়ন সিয়ামান্দ্ রহমান এ বিষয়ের সর্বোচ্চ রেকর্ড ৩০০ কেজির সীমারেখা অতিক্রমকারী প্রথম ব্যক্তি হতে সক্ষম হন কিনা এবং তিনি দর্শকদেরকে হতাশ করেন নি। বস্তুত ২০১৬-র প্যারা অলিম্পিক্স্-এর এ রেকর্ড হচ্ছে অ্যাথলেটিক্ পারফরম্যান্সের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ঘটনা।
সিয়ামান্দ্ রহমান রিও-র রিওসেন্ট্রো প্যাভিলিয়ন-২-এ প্রথমে ১৭০ কেজি-র উর্ধ্ব গ্রুপে তাঁর প্রথম বারের প্রচেষ্টায় ২৭০ কেজি ওজন উত্তোলন করেন এবং প্যারা অলিম্পিক্স্-এর রেকর্ড ভঙ্গ করেন। এরপর তিনি যথাক্রমে ৩০০ ও ৩০৫ কেজি উত্তোলন করে তাঁর ইতিপূর্বেকার নিজের রেকর্ড ভঙ্গ করেন এবং ইরানের জন্য ষষ্ঠ স্বর্ণপদক জয় করেন। উল্লেখ্য, তিনি ইতিপূর্বে ২৯৬ কেজি উত্তোলন করে এ বিষয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন।
সিয়ামান্দ্ রহমান তিন স্কোরের এ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হবার পর তিনি ৩১০ কেজি ভারোত্তলনের আগ্রহ প্রকাশ করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ জন্য ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানান এবং কর্তৃপক্ষ এতে সম্মতি প্রদান করলে তিনি বিস্মিত দর্শকম-লীর সামনে ৩১০ কেজি ভারোত্তোলন করে চতুর্থ রেকর্ড করে ইতিহাস গড়লেন।

প্যারা অলিম্পিক্স্ সিটিং ভলিবলে ইরানি টীমের স্বর্ণপদক জয় ও নিহত সাইক্লিস্টের স্মৃতির উদ্দেশে উৎসর্গ
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সিটিং ভলিবল টীম ২০১৬ প্যারা অলিম্পিক্স্-এ অংশগ্রহণ করে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার টীমকে পরাজিত করে স্বর্ণপদক লাভ করে এবং এক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে এর চব্বিশ ঘণ্টা আগে নিহত ইরানি সাইক্লিস্ট বাহ্মান্ গোর্ল্বানেযাদের স্মৃতির উদ্দেশে ইরানের সিটিং ভলিবল টীম এ স্বর্ণপদক উৎসর্গ করে।
উল্লেখ্য, স্বর্ণপদক জয়ের এ ম্যাচ শুরু হবার পূর্ব মুহূর্তে প্রতিদ্বন্দ্বী উভয় টীম এবং পুরো ক্রীড়াঙ্গন ইরানি সাইকেল চালক বাহ্মান গোর্ল্বানেযাদের স্মরণে নীরবতা পালন করে। রিও প্যারা অলিম্পিক্স্-এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের খবর অনুযায়ী বাহ্মান গোর্ল্বানেযাদে গত ১৭ সেপ্টেম্বর (২০১৬) তারিখে সাইক্লিস্ট প্রতিযোগিতার সড়কে সংঘটিত এক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মারা যান।
সিটিং ভলিবল প্রতিযোগিতায় ইরানি টীম শুরু থেকেই খুব ভালো পারফর্ম্যান্স করতে থাকেন এবং প্রথম সেটে ২৫-২১ ব্যবধানে জয়লাভ করেন। অবশ্য দ্বিতীয় সেটের প্রতিযোগিতায় বসনীয় টীম যথেষ্ট ভালো করে এবং ফলাফলে টাই করতে সক্ষম হয়। তবে ইরানি টীম তাদেরকে আর বেশি অগ্রসর হবার সুযোগ দেয় নি; তারা পরবর্তী দুই সেটের প্রতিযোগিতায় যথাক্রমে ২৫-১৮ ও ২৫-১৫ ব্যবধানে বসনীয় প্রতিপক্ষকে পরাজিত করে স্বর্ণপদক লাভ করে। ফলে এ রিও-২০১৬ প্রতিযোগিতায় ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সাকুল্যে ৮টি স্বর্ণপদক, ৯টি রৌপ্যপদক ও ৭টি ব্রোঞ্জপদক জয় করে ১৫তম স্থান দখল করতে সক্ষম হয়। এ প্রতিযোগিতায় সিটিং ভলিবল টীমের জয় করা স্বর্ণপদকটি ছিল পুরো প্রতিযোগিতায় ইরানের জয় করা অষ্টম স্বর্ণপদক।
উল্লেখ্য, চার বছর আগে লন্ডনে অনুষ্ঠিত প্যারা অলিম্পিক্স্-এ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ১০টি স্বর্ণপদক, ৭টি রৌপ্য দক ও ৭টি ব্রোঞ্জপদক লাভ করে ১১তম স্থান অধিকার করেছিল।

বিয়ের জন্যে ইরানে বিলিয়ন ডলারের সুদমুক্ত ঋণ
ইরান সরকার সবসময় তরুণ-তরুণীদের বিয়েতে উৎসাহ দিয়ে থাকে। এজন্য তরুণ-তরুণীদের বিয়েতে ঋণ দিয়ে থাকে ইরানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি বছরের প্রথম সাত মাসেই এই ঋণের রেকর্ড করেছে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিয়ের জন্যে ৪ লাখ ৪০ হাজার ৩শ’ আবেদনের বিপরীতে ১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দিয়েছে ইরানের ব্যাংক। এ ঋণ সুদমুক্ত।
২০০৯ সাল থেকে চলতি বছরের ২২ অক্টোবর পর্যন্ত ৭.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সুদবিহীন ক্ষুদ্র ঋণ দিয়েছে ব্যাংকগুলো। বিয়ে করতে ঋণ চেয়ে এই সময়ের মধ্যে ৮০ লাখ ৩০ হাজার আবেদন জমা পড়ে।
ইরানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেখা যায়, তরুণ-তরুণীদের বিয়ের জন্য এর আগে এতো বিপুল পরিমাণে ব্যাংক ঋণ দেওয়া হয়নি। বিয়ে দিতেই এই উদ্যোগ নিয়েছে ইরান কর্তৃপক্ষ।

উন্নত ও মর্যাদাপূর্ণ ইরান গড়ার জন্য সাহসী, শিক্ষিত, বিজ্ঞানমনস্ক ও বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের প্রয়োজন

ইরানের শীর্ষস্থানীয় মেধাবী ও প্রতিভাধর ব্যক্তিদের একটি প্রতিনিধিদলের সাক্ষাতে রাহবার
উন্নত ও মর্যাদাপূর্ণ ইরান গড়ার জন্য সাহসী, শিক্ষিত, বিজ্ঞানমনস্ক ও বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের প্রয়োজন

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী গত ১৯ অক্টোবর ২০১৬ ইরানের সহ¯্রাধিক ব্যতিক্রমী প্রতিভাবান ও শীর্ষস্থানীয় মেধাবী তরুণ ব্যক্তিত্বের সাক্ষাতে বলেন, দেশের প্রতিভাবান তরুণরা রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের হাতে আল্লাহর অতি মূল্যবান উপঢৌকন ও বিরাট আমানত। রাহবার বলেন, রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের উচিত, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ ও প্রতিভাবানদের সমর্থন অব্যাহত রাখা এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দান থেকে মুহূর্তের জন্যও বিরত না থাকা। রাহবার আরো বলেন, প্রতিভাবান ও মেধাবীরা জাতির বিরাট সম্পদ আর কর্মঠ তরুণ প্রজন্ম গড়ে তোলার মাধ্যমে ইসলামি ইরান একটি উন্নত, শক্তিশালী, সম্ভ্রান্ত ও নতুন ইসলামি সভ্যতার ঝা-া উত্তোলনকারী দেশে পরিণত হবে।
ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা মেধাবী ও প্রতিভাবানদের, বিশেষ করে প্রতিভাবান নতুন প্রজন্মকে দেশের জন্য বিরল ও মূল্যবান উপঢৌকন এবং জাতি ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীলদের হাতে আল্লাহর বিশেষ আমানত বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, এই অতি মূল্যবান ঐশী উপঢৌকনের ব্যাপারে দায়িত্বশীলদের কর্তব্য হল, তাদের যতœ নেয়া এবং আরো অধিক প্রতিভাবান ও মেধাবীদেরকে চিহ্নিত করা ও তাদের যথাযথ পরিচর্যার ব্যবস্থা করা।
মাননীয় রাহবার বলেন, এই খোদায়ী নেয়ামতের কারণে প্রতিভাবানদের ওপরও বিরাট দায়িত্ব রয়েছে। তাদেরকে দায়িত্ব চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজ নিজ মেধা, প্রতিভা ও দক্ষতাকে সঠিক পথে নিয়োজিত করে তার কৃতজ্ঞতা আদায় করতে হবে।
ইসলামি বিপ্লবের নেতা তরুণ মেধাবী ও প্রতিভাবানদের প্রতি যতœশীল হওয়া ও তাদের প্রতি সাহায্য সহযোগিতার হাত প্রসারিত করার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন যে, সমাজে ‘আমরা পারব’ এই আত্মবিশ^াসের উজ্জীবন ঘটাতে হবে।
তিনি বলেন, দুঃখজনকভাবে অতীতের কাজার ও পাহলভী শাসনের দীর্ঘ আমলে ‘অক্ষমতা’, ‘আমরা পারব না’ ও ‘পরনির্ভরতা’ এর জিনকোষ জনসাধারণ ও তরুণদের দেহে প্রবিষ্ট করানো হয়েছে। আর এই চিন্তা-চেতনাকে সমাজে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়েছে। এর ফল দাঁড়িয়েছিল, বিরাট জনশক্তি ও বস্তুগত সম্পদে সমৃদ্ধ প্রাচীন ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সভ্যতার লালনভূমি একটি দেশকে অত্যন্ত তুচ্ছতার সাথে পাশ্চাত্যের পরে উল্লেখ করা হতো।
হযরত আয়াতুল্লাহ আল উজমা খামেনেয়ী আরো বলেন, এহেন পরিস্থিতিতে ইসলামি বিপ্লব জাতীয় জীবনে এক বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসে। সত্যিকার অর্থে আত্মবিশ^াস ও স্বনির্ভরতা এখানে পরনির্ভরশীলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।
তিনি আট বছরের প্রতিরক্ষা যুদ্ধকে আত্মবিশ^াস ও স্বনির্ভরতার উন্মুক্ত ও গৌরবময় ময়দান হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, যুদ্ধ যদিও অত্যন্ত তিক্ত, কঠিন ও ক্ষতিকর একটি ব্যাপার; কিন্তু ইরানি তরুণরা প্রমাণ করেছে যে, আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল এবং নিজস্ব যোগ্যতা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে এমন এক শত্রুর ওপর বিজয় লাভ করা যায়, যাকে সকল বৃহৎ শক্তি মিলে সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করেছিল।
হযরত আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী আরো বলেন, যদিও ইসলামি বিপ্লব পরনির্ভরশীলতার চেতনার মোকাবিলায় ‘আমরা পারব’ এই চেতনার পুনরুজ্জীবন ঘটিয়েছে এবং সমাজ জীবনে আত্মবিশ^াসের রেওয়াজ চালু করেছে; তথাপি প্রতিপক্ষ গভীর যুদ্ধÑআজকের দিনে যাকে ‘¯œায়ুযুদ্ধ’ নামে আখ্যায়িত করা হয়Ñতার চাহিদার প্রেক্ষাপটে নতুন আঙ্গিকে ও বাহ্যত আকর্ষণীয় অবয়বে আবারো পরনির্ভরশীলতার সংস্কৃতির বিস্তার ঘটানোর চেষ্টা শুরু করেছে।
মহামান্য রাহবার বিশ্বায়নের সেøাগানে এবং বিশ্বসমাজের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য ইরানের প্রতি আমেরিকান ও ইউরোপীয়দের উপদেশ ও পরামর্শকে পরনির্ভরতার সংস্কৃতি পুন উৎপাদনের প্রকৃষ্ট উদাহরণ বলে উল্লেখ করেন। রাহবার বলেন, পশ্চিমা পক্ষ যাকে বিশ^পরিবার নামে আখ্যায়িত করছে তার বিরোধিতার মানে এ নয় যে, আমরা বাইরের দুনিয়ার সাথে সম্পর্ক রাখার বিরোধী; বরং এর অর্থ হচ্ছে বৃহৎ শক্তিগুলোর পক্ষ হতে দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ও নিরাপত্তার ওপর চাপিয়ে দেয়া সংস্কৃতির বিরোধিতা করা।
ইসলামি বিপ্লবের নেতা প্রতিভাবান ও মেধাবীদের প্রতি রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের বিশেষ ও গভীর মনোযোগ প্রদানের প্রয়োজনীয়তার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ইসলামি রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ লক্ষসমূূহ অর্জনের প্রয়োজনে এ কাজ করতে হবে। রাহবার বলেন, মেধাবীরা হচ্ছে এই মহান লক্ষে উপনীত হওয়ার চালিকা শক্তি। কাজেই রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীলদের কর্তব্য হচ্ছে মেধাবীদের প্রতি গভীর, কার্যকর, দরদি ও অব্যাহত যতেœর মনোভাব নিয়ে দৃষ্টি দেয়া।
হযরত আয়াতুল্লাহ আল ওজমা খামেনেয়ী ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার বড় বড় লক্ষের বিবরণ দিয়ে বলেন, ইসলামি প্রজাতন্ত্রকে এমন এক শক্তিমান, উন্নত, মর্যাদাবান, নতুন বক্তব্যের অধিকারী, আত্মসম্মানবোধের ধারক, নৈতিক আধ্যাত্মিক যোগ্যতাসম্পন্ন এবং নতুন ইসলামি সভ্যতার ঝা-া উত্তোলনকারী দেশে পরিবর্তিত হতে হবে, যার জন্য প্রয়োজন হল, মেধাবীদের প্রতি গুরুত্ব প্রদান, তাদের প্রতিভার মূল্যায়ন ও এই খোদায়ী নেয়ামতের যথাযথ সম্মান ও পরিচর্যা করা।
বিশ^মানবতার বর্তমান দুঃখ-দুর্দশা এবং বস্তুবাদী চিন্তাধারার অচলাবস্থার কথা উল্লেখ করে মহামান্য রাহবার বলেন, মানবতার প্রশ্নে এবং আন্তর্জাতিক বিষয়াদিতে বিশ^ নতুন এক বক্তব্যের মুখাপেক্ষী। তিনি বলেন, আমেরিকায় নির্বাচনী প্রতিযোগিতা ও দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মাঝখানে যেসব বিষয় উত্থাপিত হচ্ছে তা শক্তিমানদের মধ্যে ঈমান ও আধ্যাত্মিকতা না থাকার ফলশ্রুতি।
ইসলামি বিপ্লবের নেতা আরো বলেন, আগামী সপ্তাহগুলোতে বর্তমান প্রার্থীদেরÑ যাদের অবস্থা ও কথাবার্তা আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, তাদের মধ্য হতে যে কোনো একজন এমন একটি দেশের প্রেসিডেন্ট হবেন, যে দেশ দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিধর, সম্পদশালী, সর্বাধিক পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী এবং বিশে^র সর্ববৃহৎ প্রচারমাধ্যমসমূহের নিয়ন্ত্রক।
হযরত আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী তাঁর ভাষণে আরো বলেন, ইসলামি রাষ্ট্রের লক্ষসমূহে উপনীত হতে হলে একটি সাহসী, ঈমানদার, শিক্ষিত, উদ্যোগী, উদ্যমী, অগ্রসরমান, আত্মবিশ^াসী, আত্মমর্যাদায় উজ্জীবিত, প্রাণবন্ত ও জাগ্রত চেতনাসম্পন্ন নতুন প্রজন্মের প্রয়োজন রয়েছে। তিনি বলেন, এই প্রজন্ম হবে ঘোলাটে পরিস্থিতি সৃষ্টির কতক প্রবণতার বিপরীতে সত্যিকার অর্থে বিপ্লবী প্রজন্ম। যারা তাদের সমগ্র অস্তিত্বকে ইরানের উন্নতি-অগ্রগতির জন্য উজাড় করে দেবে। তিনি এই তরুণ প্রজন্মের চিন্তা ও মনন গঠনে মেধাবী ও প্রতিভাধরদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা উল্লেখ করে বলেন, মেধাবী ও প্রতিভাধররা তাদের প্রাণবন্ত প্রচেষ্টার মাধ্যমে চালিকা শক্তি হিসেবে নতুন প্রজন্ম তথা দেশের আসল সম্পদ ও পুঁজিকে পরিশ্রম ও চেষ্টা-সাধনা, গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করতে পারেন।
হযরত আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী বিগত পনের বছর ধরে বিজ্ঞান ও সফ্টওয়ার প্রযুক্তির আন্দোলনের জন্য বারবার যে তাগাদা দিয়েছেন তার কথা উল্লেখ করে বলেন, এই আন্দোলন প্রতিভাবান, বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষক ও ছাত্র সমাজের সহযোগিতায় ভাল ফল বয়ে এনেছে। তবে কিছু প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছে, যা চিহ্নিত হতে হবে এবং তার সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।
ইসলামি বিপ্লবের নেতা দুশমনের প্রতিবন্ধকতাগুলোকে এ লক্ষে পৌঁছার পথে অন্যতম বাধা বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, কিছুসংখ্যক লোক আছে, যারা দুশমন কথাটি উচ্চারণ করার সাথে সাথে মন খারাপ করেন। কিন্তু দুশমনের নাম এভাবে বারবার নেওয়াটা কুরআনে শয়তানের নাম বারবার উল্লেখ করার মতো, এর দ্বারা স্থায়ীভাবে মনের মধ্যে সতর্কতা সৃষ্টি করা হয়। এর আসল উদ্দেশ্য ষড়যন্ত্রকে চিহ্নিত করা, ষড়যন্ত্রের অনুমান করা নয়।
হযরত আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী ইরানের বিজ্ঞান তৎপরতায় স্থবিরতা আনাকে দুশমনের আসল লক্ষ বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, যদি তারা এই লক্ষ অর্জনে সফলকাম না হয়, অন্তত একে বিপথে পরিচালিত করার জন্য চেষ্টা করবে। যদি তাও না হয়, বদনাম রটানো ও একে কলুষিত করার দিকে মনোযোগ দেবে। কাজেই আমাদের সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। তড়িঘড়ি কোনো কাজ করে দুশমনকে এই লক্ষ অর্জনে যেন সহায়তা না করি।
তিনি গবেষণা কর্ম ও থিসিসগুলোকে ইরানের প্রকৃত প্রয়োজন থেকে ভিন্নপথে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতাকে দেশের বিজ্ঞান তৎপরতায় বিচ্যুতি আনা ও বিপথগামী করার ষড়যন্ত্রে সহযোগিতা বলে উল্লেখ করেন। তিনি গবেষণা কর্মের ব্যাপারে দুর্নাম রটানোকে এ ধরনের অপতৎপরতার আরেকটি নমুনা বলে উল্লেখ করেন। রাহবার বলেন, এক ব্যক্তিকে বিজ্ঞানী হিসেবে দেশে দাওয়াত দিয়ে আনা হয়। তিনি ইরানে থিসিস বিক্রি হচ্ছে মর্মে একটি ফলকের ছবি প্রকাশ করে আমাদের মেধাবী ও প্রতিভাবান তরুণদের বদনাম রটায়। আসলেই এ ধরনের লোক কি জ্ঞানী বা বিজ্ঞানী হতে পারে?
ইসলামি বিপ্লবের নেতা বিশ^ পরিসংখ্যান সংস্থাগুলোর তথ্যাবলির কথা উল্লেখ করে বলেন, ইরানে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির দ্রুততা এক পর্যায়ে বিশে^র গড়পড়তা অগ্রগতির হিসেবে ১৩ গুণে দাঁড়ায়। এই দ্রুততা কোনো অবস্থাতেই হ্রাস পেতে দেয়া হবে না; বরং আরো বৃদ্ধি পেতে হবে। কেননা, বিজ্ঞানের অনেক ক্ষেত্রে আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে আছি।
মাননীয় রাহবার আরো বলেন, দেশে বৈজ্ঞানিক উন্নতির গতি মন্থর হওয়ার কারণ সম্পর্কে কতক কর্মকর্তা বলেন যে, ইরানের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির অবস্থান নিচে নামে নি। কিন্তু কথা তো ছিল অন্যরকম। কথা ছিল ইরানের বৈজ্ঞানিক অবস্থান আরো উপরে যাবে। শুধু নিচে নামবে না- এমন তো কাম্য নয়।
মাননীয় রাহবার দেশের বৈজ্ঞানিক উন্নতি-অগ্রগতির তৎপরতায় দুর্বলতার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন যে, মেধাবী ও প্রতিভাবান তরুণদের মনে হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, এই বিরাট ক্ষতি খুব সহজে এবং দ্রুততার সাথে পোষাণো যাবে বলে মনে হয় না। কারণ, এমনটি হলে তা আমাদের প্রতিভা ও মেধাগুলো অন্য দেশে চলে যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
ইসলামি বিপ্লবের নেতা প্রতিভাবান ও মেধাবী তরুণদের চিহ্নিত করা রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বলে উল্লেখ করেন। তিনি সতর্ক করে দেন যে, বিজাতীয়রা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিজ্ঞান মেলাগুলো থেকে বা অন্য কোনো পন্থায় এই বিশাল সম্পদকে চিহ্নিত ও নিজেদের প্রতি আকৃষ্ট করার আগে আপনারাই এই মেধাবী, উদীয়মান তরুণদের খুঁজে বের করুন। তাদের প্রতি সহায়তা প্রদান করুন।
ইসলামি বিপ্লবের নেতা দেশে বিজ্ঞান আন্দোলন গতিশীল হতে পারে এমন কতক বিষয় উল্লেখ করে বলেন, তৃণমূল পর্যায়ের জ্ঞান বিকাশ সংস্থাগুলোর প্রতি সহায়তা বৃদ্ধি, তাদের মান ও কর্মপরিধির উন্নয়ন ও বিস্তার সাধনে সহায়তার হাত সম্প্রসারিত করা এবং তাদেরকে দেশের মূল প্রকল্প ও বিভাগগুলোতে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া এমন কতক জরুরি পদক্ষেপ, যার প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করা উচিত।
মাননীয় রাহবার বুনিয়াদি জ্ঞান সংস্থাগুলোর প্রডাক্ট ব্যবহারের প্রসার ঘটানোকে এসব সংস্থা শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে উল্লেখ করেন। তিনি রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, আপনারা সিদ্ধান্ত নিন যে, রাষ্ট্রযন্ত্রের চাহিদা ও প্রয়োজনগুলো বুনিয়াদি জ্ঞান বিকাশ কেন্দ্রগুলোর পণ্যের মাধ্যমে পূরণ করবেন।
হযরত আয়াতুল্লাহ আল উজমা খামেনেয়ী এ পর্যায়ে আরো দু’টি বিষয় উল্লেখ করেন। যেমনÑ বিশ^বিদ্যালয়সমূহে মেধাবী ও প্রতিভাবান বিষয়ক বিভিন্ন সংস্থা গড়ে তুলতে হবে এবং উদীয়মান প্রতিভা পরিচর্যার জাতীয় সংস্থার সমস্যাগুলো সমাধানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণ বলবৎ রাখতে হবে। তিনি বলেন, এর ফলে দেশের বিজ্ঞান আন্দোলন শক্তিশালী ও গতিশীল হওয়ার ব্যাপারে বিরাট সহায়তা হবে।
ইসলামি বিপ্লবের নেতা মেধা বিকাশ ন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ইরানের ভাইস প্রেসিডেন্ট জনাব সাত্তারীর কর্র্মদক্ষতা এবং সামর্থ্যরে ব্যাপারে গভীর আস্থা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, বর্তমানে বিজ্ঞান বিষয়ক প্রেসিডেন্সি ও মেধা বিকাশ ফাউন্ডেশনের মাঝে বিদ্যমান সমস্যাবলি নিয়ে কিছুটা উদ্বেগ রয়েছে। আমি আাশা করব, ফাউন্ডেশনের একজন যোগ্য ও দক্ষ ডাইরেক্টর নিয়োগ দানের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
হযরত আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী বলেন, দেশের গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে, যেমন মহাশূন্য গবেষণা, ভূউপগ্রহ প্রকল্প, পরমাণু গবেষণা ও আরো কয়েকটি ক্ষেত্রে গবেষণার বিরাট বিরাট প্রকল্পের গতিতে ভাটা সৃষ্টি হওয়া বা স্থবিরতা উদ্বেগের কারণ হতে পারে। তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন যে, রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের গভীর মনোযোগ রাখতে হবে যে, এ ধরনের প্রকল্প কোনো অবস্থাতেই স্থবির, স্থগিত বা গতিহীন হতে পারবে না। কেননা, তার ফলে বৈজ্ঞানিক উন্নতির ক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি নতুন বিজ্ঞানীরা নিরাশ হয়ে পড়বে এবং তা দেশের জন্য বিরাট অশনি সংকেত।
রাহবার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অধিদফতরে সাংস্কৃতিক সেল গঠনের ব্যাপারে সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং বলেন, এই সেলের তৎপরতা বৃদ্ধি এবং মেধাবী ও প্রতিভাবানদের জিহাদী প্রশিক্ষণ শিবির গঠন করা হলে তাতে বিরাট সুফল পাওয়া যাবে।
ইসলামি বিপ্লবের নেতা তাঁর ভাষণের উপসংহার টেনে বলেন, আমাদের আসল লক্ষ হল, এমন এক সমাজ ও দেশ গঠন করা, যা বিজ্ঞান, শক্তি ও সম্পদ প্রভৃতির ন্যায় বিশ^জনীন সূচকগুলোতে উন্নীত হওয়ার পাশাপাশি ঈমান, নৈতিকতা ও মর্যাদাবোধে আমাদেরকে ঋদ্ধ ও পরিপুষ্ট করবে।এর ফলে আমরা জাতিসমূহের অন্তর জয় করে মানবতাকে বর্তমান অজ্ঞতা, গোমরাহী থেকে নাজাত দিতে পারব। আর এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, ইরানের মহান জাতি ও আমাদের প্রিয় তারুণ্যদীপ্ত বিচক্ষণ ও প্রাণবন্ত প্রজন্ম এ ক্ষেত্রে সফলকাম হতে পারবে।
হযরত আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেয়ী যে কোনো বিরোধী তৎপরতার বেলায় শয়তানি শক্তিগুলোর শত্রুতার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, কিছুদিন আগে আমেরিকার জনৈক কর্মকর্তা বললেন যে, ইরান যদি প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রতি সহায়তা অব্যাহত রাখে তাহলে ইরানের ওপর আরোপিত অবরোধগুলোর ব্যাপারে মৌলিকভাবে কোনো হেরফের হবে কিনা জানা নেই। রাহবার বলেন, এই কথা এমন এক বাস্তবতা, যার ব্যাপারে আমি রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের বহুবার বলেছি।
আমেরিকার প্রতি ইসলামি বিপ্লবের রাহবারের খারাপ ধারণা সম্পর্কে ইরানি কর্মকর্তাদের সাক্ষাতে কতিপয় আমেরিকান কর্মকর্তার অভিযোগের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে মহামান্য রাহবার বলেন, আপনাদের এ জাতীয় কথাবার্তার পরেও কি আপনাদের প্রতি ভালো ধারণা পোষণ করতে বলেন।
হযরত আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী ইরানের রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের সাথে ইতঃপূর্বেকার একান্ত ও প্রকাশ্য বৈঠকে তাঁর বক্তব্যগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, আমি বারবার বলেছি যে, যদি আপনারা পরমাণুর প্রশ্নে পেছনে আসেন তাহলে তারা ক্ষেপণাস্ত্রের কথা সামনে আনবে। এ ব্যাপারেও যদি ছাড় দেন তাহলে প্রতিরোধ আন্দোলনে সহায়তার প্রসঙ্গ উত্থাপন করবে। যদি ছাড় দেয়া অব্যাহত রাখেন তাহলে মানবাধিকারের প্রসঙ্গ উত্থাপন করবে। এর পরে যদি তাদের মানদ-গুলো মেনে নেন, তাহলে ইরানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে ধর্মীয় মানদ-গুলো নিয়ে প্রশ্ন তুলবে।
মাননীয় রাহবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাম্প্রতিক বিবৃতির কথা উল্লেখ করে বলেন, এই বিবৃতিতে ইরানে যে বিশাল ক্ষেত্র ও সম্ভাবনা রয়েছে সে তথ্য উঠে এসেছে। তিনি বলেন, আমরা যখন ইরানের বিশাল সম্ভাবনা, জনসম্পদ ও প্রাকৃতিক ঐশ^র্যের কথা বলি তখন কিছুমাত্র আস্ফালন করা হয় বলে মনে করবেন না। বরং এমন বাস্তবতার কথা তুলে ধরা হয়, যা পশ্চিমারাও স্বীকার করে।
ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা বলেন, আমেরিকানরা এহেন সম্ভাবনাময় ও উন্নতি-অগ্রগতির অধিকারী আর ইসলামের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত দেশ ইরানের সাথে সংগ্রাম করছে। এই বিষয়টি যদি আমাদের প্রতিভাবান সন্তানেরা উপলব্ধি করে এবং বিচার-বিশ্লেষণ করে, তাহলে এ উপলব্ধি তাদেরকে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে বিরাটভাবে সাহায্য করবে।
হযরত আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী তাঁর ভাষণে কারবালায় আশুরার ঘটনাকে এমন এক সূর্যের সাথে তুলনা করেন, যা কোনো দিন অস্তমিত হবে না। তিনি বলেন, আশুরার ঘটনা ছিল অন্ধকারের সাথে আলোর সংগ্রাম এবং হীনতা ও নীচতার সাথে মর্যাদার লড়াইয়ের বাস্তব চিত্র। এই পথের পূর্ণতার অনুঘটক ছিলেন হযরত যায়নাব সালামুল্লাহ আলাইহা এবং হযরত ইমাম সাজ্জাদ (যায়নুল আবেদীন) আলাইহিস সালাম।
তিনি আশুরার শোকানুষ্ঠান পরিচালনাকারী সংস্থাগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, তরুণদের ব্যাপকহারে উপস্থিতি, তথ্যপূর্ণ বক্ততাসমূহ, সমৃদ্ধ কতিপয় শোকগাথা ও মাতম মর্সিয়া সামগ্রিকভাবে আশুরার শোকানুষ্ঠানকে সমৃদ্ধ করেছিল।
উল্লেখ্য যে, মাননীয় রাহবারের দিক নির্দেশনামূলক ভাষণের আগে ইরানের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট মেধা বিকাশ ন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট ড. সাত্তারী মেধা বিকাশ ন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে একটি রিপোর্ট উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, মানব সম্পদ হচ্ছে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। তার সৎব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। এই সাক্ষাৎ অনুষ্ঠানে আরো যাঁরা বক্তব্য রাখেন, তাদের অন্যতম হলেন :

  • ডক্টর আলীরেযা বাবাখান, যিনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক পরিকল্পনা প্রণয়নে
  • ডিগ্রিধারী এবং মেধা বিকাশ ফাউন্ডেশনের এ বছরের শিক্ষাবিষয়ক পুরস্কারের জন্য মনোনীত।
  • ডক্টর মুজতবা ফৈয়ায বখ্শ, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র এবং কম্পিউটার বিষয়ে অলম্পিয়াডে পদক জয়ী।
  • ডক্টর আমীর শামলু, বায়ো টেকনোলজি ও ন্যানো টেকনোলজিতে পিএইচডি বিশেষজ্ঞ।
  • ডক্টর আলীরেযা বাজারগান, ক্যামিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিশেষজ্ঞ।
  • ডক্টর সাইয়্যেদ কাজেমী তাবার, যিনি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ^বিদ্যালয় থেকে বিদ্যুৎ ও টেলিযোগাযোগ বিষয়ে অধ্যয়ন করেছেন এবং ইরানের জাতীয় গণিত অলিম্পিয়াডে ব্রোঞ্জ পদক জয় করেছেন।
  • মিসেস আনিসা সাদাত মনসূরী, মেডিক্যাল ছাত্রী এবং অলিম্পিয়াডে ব্রোঞ্জ পদকজয়ী।
  • ডক্টর যাহরা দাওরিনা, পাশ্চাত্য দর্শনে পিএইচডি ডিগ্রিধারী এবং মেধা বিকাশ ফাউন্ডেশনের পুরস্কারের জন্য মনোনীত।
    এ সাক্ষাতে তাঁরা যেসব বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তন্মধ্যে ছিল :
  • দেশের মৌলিক বিষয়াদি সমাধানে ভূমিকা পালনের প্রয়োজনে বিভিন্ন বিজ্ঞান গবেষণা সংস্থার প্রতিভাবানদের নিয়ে একটি ব্যাপকভিত্তিক সংস্থা গঠনের প্রয়োজনীয়তা।
  • মেধা পরিচর্যা ন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের প্রতিরক্ষামূলক অর্থনৈতিক সংস্থা গঠন।
  • ছাত্রদের মাঝ থেকে প্রতিভা বাছাই ও তাদের পরিচর্যার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা।
  • সুস্বাস্থ্য রক্ষার পরিকল্পনা পদ্ধতি বাস্তবায়নের সমালোচনা, স্বাস্থ্য পরিচর্যায় বিশাল অর্থ ব্যয় ও সনাতন চিকিৎসা পদ্ধতির দিকে অবহেলা প্রদর্শনের সমালোচনা।
  • বিভিন্ন সংস্থা ও স্কুল পর্যায়ে সৃজনশীলতার পরিচর্যা এবং তাদেরকে প্রণোদনা ও প্রয়োজনীয় উৎসাহ ভাতা প্রদান।
  • পারিবারিক অর্থব্যবস্থা পরিচালনার মাধ্যমে প্রতিরক্ষামূলক অর্থনীতি গড়ে তোলায় মহিলাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার স্বীকৃতি ও মূল্যায়ন প্রসঙ্গ।
  • মেধা পরিচর্যাকে কেন্দ্রীভূত না রেখে আঞ্চলিক পর্যায়ে সুযোগ-সুবিধা ছড়িয়ে দেয়ার প্রয়োজনীয়তা।

বিদ্যুৎ উৎপাদনে ইরানের সাফল্য

সাইদুল ইসলাম
যে-কোনো দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে বিদ্যুৎ অপরিহার্য। শিল্প, কলকারখানা, কৃষিকাজ, মানব সম্পদ উন্নয়ন, আধুনিক জীবনযাত্রা, চিকিৎসা, যোগাযোগ, কম্পিউটার প্রযুক্তির ব্যবহার থেকে শুরু করে উন্নয়নের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই প্রয়োজন বিদ্যুৎ। একথায় বলতে গেলে বিদ্যুৎ সভ্যতা ও আধুনিকতার প্রধান নিয়ামক। দারিদ্র্য বিমোচন করে একটি দেশকে শিল্পোন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে বিদ্যুতের গুণগত মান ও প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। বাস্তবতার নিরিখে এ সকল উপলব্ধি থেকে বিদ্যুৎ খাতের কাক্সিক্ষত উন্নয়ন ও পরিচালনা দক্ষতা বৃদ্ধি ও উন্নত গ্রাহক সেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান এরই মধ্যে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে।
দেশটি বর্তমানে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ খাতে কেবল পুরোপুরি স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে তাই নয় একই সাথে দেশটিতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ এখন অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।
বর্তমানে ইরানের উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণ ৭৫ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে। ২০১৩ সালে দেশটিতে যেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৬৯ হাজার মেগাওয়াট সেখানে ২০১৫ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ বেড়ে ৭৫ হাজার মেগাওয়াট অতিক্রম করেছে।
অর্থাৎ দুই বছরে দেশটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে ৬ হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি। এর মধ্য দিয়ে ইরান বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিক থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে এক নম্বর স্থানে রয়েছে। আর সারা বিশ্বে দেশটির অবস্থান ১৪ নম্বরে। গত কয়েক বছরে বিদ্যুৎ খাতে ইরানের সফলতা চোখে পড়ার মতো। ২০১৩ সালে যেখানে দেশটিতে বিদ্যুৎ বিতরণজনিত সিস্টেম লসের হার ছিল শতকরা ১৫ দশমিক ৫ ভাগ, ২০১৫ সালে তা হ্রাস পেয়ে শতকরা ১১ ভাগে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে দেশে বিদ্যুৎ বিতরণ থেকে সুবিধা লাভের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং দেশে এনার্জি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিরাট সাশ্রয় হয়েছে।
এই সময়ের মধ্যে দেশের ১৫টি প্রদেশে প্রতিটি ৪০০ কিলোভোল্ট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৪টি বিদ্যুৎ টাওয়ার উদ্বোধন করা হয়েছে ও ব্যবহার করা হচ্ছে- যেগুলোর মোট ক্ষমতা ৭ হাজার ৮৪০ মেগাভোল্ট এমপিআর।
দেশের ১৯টি প্রদেশে প্রতিটি ২৩০ কিলোভোল্ট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৯টি বিদ্যুৎ টাওয়ার উদ্বোধন করা হয়েছে ও ব্যবহার করা হচ্ছে- যেগুলোর মোট ক্ষমতা ৭ হাজার ৮ মেগাভোল্ট এমপিআর।
দেশের ১৩টি প্রদেশে প্রতিটি ১৩২ কিলোভোল্ট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৭টি বিদ্যুৎ টাওয়ার উদ্বোধন করা হয়েছে ও ব্যবহার করা হচ্ছে- যেগুলোর মোট ক্ষমতা ২ হাজার ৫৪৩ মেগাভোল্ট এমপিআর।
দেশের ২৪টি প্রদেশে প্রতিটি ৬৩ থেকে ৬৬ কিলোভোল্ট ক্ষমতাসম্পন্ন ৮৫টি বিদ্যুৎ টাওয়ার উদ্বোধন করা হয়েছে ও ব্যবহার করা হচ্ছে- যেগুলোর মোট ক্ষমতা ৫ হাজার ৬০৪ মেগাভোল্ট এমপিআর।
আর দেশে প্রতিটি ৫৮ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন ৯টি নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উৎপাদন শুরু হয়েছে।
গত ২২ আগস্ট ইরানের বার্তাসংস্থা মেহের নিউজ জানিয়েছে, শিগগিরই ইরানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ৮০ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত হচ্ছে। আরো ১২টি নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে এ সক্ষমতায় পৌঁছতে যাচ্ছে দেশটি।
এধরনের ৫টি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ৫ বিলিয়ন ডলার। তবে এ বছর যে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে তাতে ২০২১ সাল নাগাদ ইরানে প্রতিদিন বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা দাঁড়াবে ১ লাখ মেগাওয়াট।
গত সেপ্টেম্বর মাসে দেশটিতে আরো নতুন তিনটি তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হয়েছে। এর পাশাপাশি ২২টি সৌর ও বায়ুচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প একই সময়ে চালু হয়েছে।
গত জুলাই মাসে ইরানের রিনিউবল এনার্জি অর্গানাইজেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ সাদেকজাদেহ ঘোষণা করেন, আগামী মার্চ নাগাদ চলতি ফারসি বছর শেষে ইরানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়াবে অন্তত ১শ’ মেগাওয়াট।
ইরানের বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং বিতরণ কোম্পানি বা টিএভিএনএসআইআর’র পরিচালক হুমায়ুন হায়েরি বলেছেন, ইরানে সৌর ও বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদন দ্বিগুণ করার পরিকল্পনা করেছে ইসলামি সরকার। একই সঙ্গে তিনি জানান, বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতার দিক থেকে আঞ্চলিক গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর অন্যতম ইরান। অবশ্য ইরানের বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতের দক্ষতা আরো বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে বলেও স্বীকার করেন তিনি।
গত বছরের অক্টোবরে ইরানি কর্মকর্তারা ঘোষণা করেছিলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎস ব্যবহার করে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৫,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
ভৌগোলিক বৈচিত্র্যের কারণে ভূ-তাপ, সৌর ও বায়ু শক্তিসহ নানা নবায়নযোগ্য জ্বালানি শক্তি রয়েছে ইরানের। পরিবেশ সংরক্ষণের স্বার্থে পর্যায়ক্রমে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার বাড়ানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে দেশটি।
১৯৯৫ সালে ইরানের নবায়নযোগ্য জ্বালানি স¤পদের সম্ভাবনা যাচাই, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প (সৌর শক্তি, বায়ু শক্তি, ভূগর্ভস্থ তাপ, হাইড্রোজেন এবং বায়োমাস) বাস্তবায়নের নিমিত্তে ইরানের নবায়নযোগ্য জ্বালানি সংস্থা গঠিত হয়।
ইরানের ভৌগোলিক বৈচিত্র্যের কারণে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস ব্যাপক এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ। যথা: পানি শক্তি, সৌর শক্তি, বায়ু শক্তি, ভূগর্ভস্থ তাপ, বায়োগ্যাস এবং হাইড্রোজেন।
ইরানের গবেষণা ও মানব সম্পদ বিষয়ক উপ জ্বালানিমন্ত্রী আলী আকবর মোহাজেরি বলেছেন, কেবল দেশের ভেতর নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পুরো সক্ষমতা আছে ইরানের। ইরান বিদ্যুৎ-শিল্প সংক্রান্ত প্রযুক্তি অর্জন করেছে ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, আঞ্চলিক দেশগুলোতে এ প্রযুক্তি সরবরাহে প্রস্তুত রয়েছে তেহরান।
জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অন্তর্ভুক্ত দুটি গবেষণা সংস্থা ২৬টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গবেষণা করছে বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ খাতে বিরাজমান সমস্যা নিরসনে এসব গবেষণা চলছে।
এর আগে ইরান বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ কোম্পানি ঘোষণা করেছে ইরানের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৭৫ হাজার মেগাওয়াট অতিক্রম করেছে। এতে মধ্যপ্রাচ্যে বিদ্যুৎ রফতানির কেন্দ্র হয়ে উঠেছে ইরান।

বর্তমানে ইরান যেসব দেশে বিদ্যুৎ রফতানি করছে তার মধ্যে রয়েছে, ইরাক, তুরস্ক, সিরিয়া, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, আর্মেনিয়া ও আযারবাইজান সংযুক্ত আরব আমিরাতেও ইরান থেকে বিদ্যুৎ রপ্তানীর জন্য সাগরের নিচ দিয়ে ঐঠউঈ ক্যাবল টানা হয়েছে।

টিএভিএএনআইআর সূত্র জানিয়েছে, সম্প্রতি ছয়শ’ কোটি ইউরো ব্যয়ে নতুন কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজও শুরু করেছে ইরান। এসব কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ১০ হাজার মেগাওয়াট হবে। অন্যদিকে ইরান আগামী ২০ বছরে ২০ হাজার মেগাওয়াট পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনাও করেছে।
দক্ষিণাঞ্চলীয় বন্দর নগরী বুশহরে ইরানের প্রথম পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হয়েছে। এ কেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুৎ ২০১১ সালে সেপ্টেম্বরে ইরানের জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়।
ইরানের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে সর্ববৃহৎ বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলো দামাভান্দ বিদ্যুৎ কেন্দ্র। জীবাশ্ম জ্বালানির মাধ্যমে পরিচালিত এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ২ হাজার ৮৬৮ মেগাওয়াট। ইরানি ১৩৮৪ সালে এই কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়।এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ধরন কম্বাইন্ড সাইকেল। ইরানে জীবাশ্ম জ্বালানির মাধ্যমে পরিচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর বেশিরভাগই কম্বাইন্ড সাইকেলে রূপান্তরিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এর মাধ্যমে একটি ১০০ মেগাওয়াটের ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রকে একই পরিমাণ জ্বালানি দিয়ে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে আনয়ন করা হয়।
এছাড়া ইরানের অন্যান্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে রয়েছে শহীদ সালিমি নেকা বিদ্যুৎ কেন্দ্র। ইরানের মাজান্দারান প্রদেশে কাস্পিয়ান সাগর উপকূলের নেকা শহরে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি অবস্থিত। ২২১৩.৮ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন এই কেন্দ্রটি ইরানি ১৩৫৮ সালের ২ মেহের প্রতিষ্ঠিত হয়।এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ধরনও কম্বাইন্ড সাইকেল। ইরানি ১৩৮৬ সালের খোরদাদ মাসে ইরানের মারকাজি প্রদেশের জারান্দিয়ে শহরে এই কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়। রোদশোর নামে গ্যাসচালিত এই কেন্দ্রটির উৎপাদন ক্ষমতা ২১৬২ মেগাওয়াট।
ইরানি ১৩৭১ সালের অবন মাসে কাজবিনে প্রতিষ্ঠিত হয় তাপ ও কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্র। শহীদ রেজায়ী নামের এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির উৎপাদন ক্ষমতা ২ হাজার ৪২ মেগাওয়াট।
ইরানি ১৩৮০ সালের তির মাসে প্রতিষ্ঠিত হয় কেরমান কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এই কেন্দ্রটির উৎপাদন ক্ষমতা ১৯১২ মেগাওয়াট। ১৩৮৮ সালে নির্মিত এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ইরানের সেরা বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করে।
ইরানি ১৩৫৮ সালে আহওয়াজ অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয় রমিন আহওয়াজ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র। যার উৎপাদন ক্ষমতা ১৯০৩ মেগাওয়াট। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ইরানের অন্যতম বৃহৎ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র। ইরানের খুজিস্তান অঞ্চলে উৎপাদিত বিদ্যুতের ৪২ শতাংশই এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত হয়ে থাকে।
ইরানি ১৩৬৩ সালে ইসফাহান শহরের উত্তরাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয় শহীদ মোন্তাজেরি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ইরানের অন্যতম বৃহৎ বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং এর উৎপাদন ক্ষমতা ১৬১৬ মেগাওয়াট।
ইরানি ১৩৮৭ সালের ২৮ ইসফান্দ খুররাম শহরের কাছে প্রতিষ্ঠিত হয় খুররাম শহর কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্র। যার উৎপাদন ক্ষমতা ১৪৫২ মেগাওয়াট।
ইরানি ১৩৮৫ সালের ফারভারদিন মাসে প্রতিষ্ঠিত হয় শিরভান কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্র। উত্তর খোরাসান প্রদেশে অবস্থিত এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির উৎপাদন ক্ষমতা ১৪৩৪ মেগাওয়াট।
ইরানের পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে রয়েছে খুজিস্তানের আইজা অঞ্চলে অবস্থিত কারুন-৩। ইরানি ১৩৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির উৎপাদন ক্ষমতা ২২৮০ মেগাওয়াট। খুজিস্তানের আন্দিকা অঞ্চলে ইরানি ১৩৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সাদ শাহীদ আব্বাসপুর (কারুন-১) বিদ্যুৎ কেন্দ্র। যার উৎপাদন ক্ষমতা ২ হাজার মেগাওয়াট।
মসজিদ সোলাইমান এলাকায় ইরানি ১৩৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সাদ্দে মসজিদ সোলাইমান পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। যার উৎপাদন ক্ষমতা ২ হাজার মেগাওয়াট। ইরানি ১৩৯১ সালে খুজিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হয় সাদ্দে গুতভান্দ আলিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্র। যার উৎপাদন ক্ষমতা ২ হাজার মেগাওয়াট। ইরানি ২০১১ সালে মাজান্দারান প্রদেশে নির্মিত হয় তুলুম্বে জাকিরে সিয়বিশে বিুদ্যৎ কেন্দ্র। যার উৎপাদন ক্ষমতা ৯৪০ মেগাওয়াট। চাহর মাহাল ও বাখতিয়রিতে প্রতিষ্ঠিত হয় সাদ্দে কারুন-৪ বিদ্যুৎ কেন্দ্র। যার উৎপাদন ক্ষমতা ১ হাজার মেগাওয়াট।
ইংরেজি ২০১০ সালে ইরানের বুশহর প্রদেশে নির্মিত হয় বুশহর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র। যার উৎপাদন ক্ষমতা ১ হাজার মেগাওয়াট। ২০১১ সালে ইরানের আরাক অঞ্চলে নির্মিত হয় আরাক ভারি পানির বিদ্যুৎ কেন্দ্র। যার উৎপাদন ক্ষমতা ৪০ মেগাওয়াট। ২০১৬ সালে ইরানের দরখুইন অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয় দরখুইন পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। যার উৎপাদন ক্ষমতা ৩৬০ মেগাওয়াট।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পরমাণু জ্বালানি ব্যবহারের একটি বড় কারণ হলো, এটি সম্পূর্ণভাবে নির্মল ও পরিবেশবান্ধব। বিদ্যুৎ উৎপাদনে তেল, গ্যাস ও কয়লার যথেচ্ছ ব্যবহার প্রাকৃতিক পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে খনিজ জ্বালানির ব্যবহার অব্যাহত থাকলে পরিবেশ দূষণ রোধের পদক্ষেপগুলোর সাফল্যের সম্ভাবনাও আরো হ্রাস পাবে। কাজেই বিদ্যুৎ উৎপাদনে নির্মল জ্বালানির ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে ইরান।
ভূতত্ত্ববিদদের মতে, মাটির তলদেশে বর্তমানে বিপুল পরিমাণ ইউরেনিয়াম মজুদ রয়েছে এবং তা বহু বছর ধরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।
ইরানে সৌর বিদ্যুৎ তৈরির সম্ভাবনা অসীম। ইরানের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে সারা বছরব্যাপী তীব্র সূর্যালোক পাওয়া যায়। ইরানের দক্ষিণাঞ্চলে প্রতি বর্গমিটারে দিনে গড়ে ৫.০-৫.৪ কিলোওয়াট ঘণ্টা সূর্যালোক পাওয়া যায়। ফলে প্রতি বর্গমিটারে ০.৫ কিলোওয়াট ঘণ্টা অথবা প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৫০০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে। ইরানে মোট আয়তনের এক চতুর্থাশ মরুভূমি। ইরানে মরু এলাকায় মাত্র ১ শতাংশ সৌর কোষ দ্বারা ঢাকা সম্ভব হলে বর্তমানে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয় তার চেয়ে প্রায় ৫ গুণ বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব।
ইরানি ২০০৯ সালে ইয়াজ্দ অঞ্চলে নির্মিত হয় ইয়াজ্দ সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র। যার উৎপাদন ক্ষমতা ৪৬৭ মেগাওয়াট। একই বছর ইরানের শিরাজে নির্মিত হয় সিরাজ সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র। যারা উৎপাদন ক্ষমতা ৫০০ মেগাওয়াট। এছাড়া ইরানে সম্প্রতি কিছু ছোট ছোট বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। যার মধ্যে রয়েছে ১ মেগাওয়াটের আরাক সৌর বিুদ্যৎ কেন্দ্র। চলতি বছর ইরানের আরাক অঞ্চলে এই সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ইরানে এটাই প্রথম এক মেগাওয়াটের সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
ইরানে বায়ুশক্তি চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মধ্যে রয়েছে ১ হাজার ৮ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন মঞ্জিল বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র। ইরানের গিলান প্রদেশে অবস্থিত এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ১৯৯৪ সালে দেশটির জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়। এটি ইরানের প্রথম বায়ুচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
এছাড়া রয়েছে অনবন আলী বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র। ইরানের তাবরিজে নির্মিত এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ৬৬০ মেগাওয়াট। ইরানি ১৩৮৮ সালের ২৯ বাহমান থেকে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির উৎপাদন শুরু হয়।
২০০৮ সালে খোরাসান রাজাভী প্রদেশে নির্মিত হয়েছে বিনালুদ বায়ু কৃষি খামার বিদ্যুৎ কেন্দ্র। যার উৎপাদন ক্ষমতা ২৮২ মেগাওয়াট।
ভূগর্ভস্থ তাপ শক্তি ব্যবহার করেও বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে ইরান। দেশটির বিভিন্ন স্থানে পর্যাপ্ত পরিমাণ নি¤œ এবং উচ্চ মানস¤পন্ন ভূগর্ভস্থ তাপ শক্তি রয়েছে। উচ্চ মানস¤পন্ন তাপ শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ রয়েছে। অন্যদিকে নি¤œ মানস¤পন্ন তাপ দিয়ে উষ্ণায়ন এবং শীতলীকরণ করা সম্ভব। বোরহোল থারমাল রেসপন্স পরীক্ষার মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ তাপ শক্তি ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। এ পরীক্ষাটি ইরান ব্যতীত বিশ্বের অল্প কয়টি দেশে করা সম্ভব। এ খাতে উল্লেখযোগ্য স্থাপনা হলো ৬০০ কিলোওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাস¤পন্ন মাশহাদ বায়োগ্যাস বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং ১০৬০ কিলোওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাস¤পন্ন সিরাজ বায়োগ্যাস বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
এছাড়া ইরানের কাজভীন প্রদেশে নির্মিত হয়েছে হাইড্রোজেন বিদ্যুৎ কেন্দ্র। ২০০৯ সালে নির্মিত এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির উৎপাদন ক্ষমতা ২০০ কিলোওয়াট।
ইরানের উৎপাদিত বিদ্যুতের মধ্যে ৬১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় জীবাশ্ম জ্বালানির মাধ্যমে পরিচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে।
পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত হয় ১২ হাজার মেগাওয়াট এবং পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত হয় ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র। আর বাকি বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় অন্যান্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে।

সূত্র : Tehran times, vista.ir, Bultannews.com, Iran daily,

বাংলা ভাষায় ফারসি শব্দের ব্যবহার

বাংলা রূপ                                               ফারসি রূপ                          আধুনিক ফারসি উচ্চারণ

 খুব

 خوب

 খোব্

খঞ্জর

خنجر

খান্জার

খোদ (নিজ)

خود

খোদ্

(খোরাকী)

خوراكى

 খোর-কী
খোশ আমদেদ

خوش امديد

 খোশ অ-মাদীদ
খুশ্বু

خوشبو

খোশ-বু
খোশ খবর

خوش خبر

খোশ খাবার
খুন (রক্ত)

خون

খুন
খুনি (হন্তা)

خونى

খু-নী
খেয়াল

خيال

খীয়-ল
খেয়ালি

خيالى

খীয়-লী
খেয়ানত

خيانت

 খীয়-নাত্
খয়রাতি (দাতব্য)

خيراتى

 খেই-রতী
দানা

دانه

দ-নে
দান (কলমদান, ফুলদানি)

دان

 দ-ন্
দায়ের (মামলা দায়ের)

داير

 দ-ইয়ের
দায়রা (দায়রা কোর্ট)

دايره

 দ-ইয়েরে
দাই (নার্স)

دايه

 দ-ইয়ে
দজ্জাল

دجال

 দাজ্জল্
দখল

دخل

 দ-খেল
দখলদার

دخل دار

 দ-খেল্দ-র
দাওয়াত

دعوت

 দাওয়াত্
দাবি

دعوى

 দা-ভী
দাবিদার

دعويدار

 দা-ভীদর্-

 

ইরানি প্রবাদ বাক্য

سال به سال، دریغ از پارسال
উচ্চারণ : সা’ল বে সা’ল, দারীগ আয পা’রসা’ল
অর্থ : বছরে বছরে, গেল বছরের জন্য আফসোস।
মর্মার্থ : এই প্রবাদের ভাবার্থ হল, আফসোস যে, এ বছর যা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে আগামী বছর তার নাগাল পাব না।
سالها گذرد شنبه به نوروز افتد.
উচ্চারণ : সা’লহা’ গুযরদ শাম্বে বে নওরোয ওফতাদ
অর্থ : বহু বছর চলে যায়, শনিবার নওরোযে পড়ে।
মর্মার্থ : বহু বছর গেলে পরে শনিবারে নওরোয হয়। মানে জীবন যাত্রায় অনুকূল পরিবেশ ও পরিস্থিতি খুব কমই হাতে আসে।
سالی که نکوست از بهارش پیداست.
উচ্চারণ : সা’লী কে নেকূস্ত আয বাহা’রশ পয়দা’স্ত
অর্থ : বছরটি যে ভালো যাবে তা তার বসন্ত হতেই বোঝা যাচ্ছে।
মর্মার্থ : যেকোনো কাজের শুরু দেখেই তার শেষ পরিণতি কী হবে তা আন্দায করা যায়।
سایه کسی را با تیر زدن( به خنجر زدن).
উচ্চারণ : সা’য়ে কেসী রা’ বা’ তীর যাদান
অর্থ : কারো ছায়াকে তীর মারা (খঞ্জর দিয়ে মারা)।
মর্মার্থ : কারো সাথে মারাত্মক শত্রুতা করা।
سایه کسی سنگین شدن.
উচ্চারণ : সা’য়েয়ে কেসী সাঙ্গীন শোদান
অর্থ : কারো ছায়া ভারী হওয়া।
মর্মার্থ : কেউ নিজের আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের সাথে শত্রুতা পোষণ করলে এ প্রবাদটি ব্যবহৃত হয়।
سبز کردن حرف خود.
উচ্চারণ : সাব্য কারদানে হারফে খোদ
অর্থ : নিজের কথা সবুজ করা।
মর্মার্থ : নিজের কথা প্রতিষ্ঠা করা। যেভাবেই হোক নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করা অর্থে এই প্রবাদ ব্যবহৃত হয়।
سبک و سنگین کردن.
উচ্চারণ : সাবোক ওয়া সাঙ্গীন কারদান।
অর্থ : হালকা ও ভারী করা।
মর্মার্থ : কাজের সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনায় নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। কোনো বিষয় গ্রহণ করার বেলায় ভালোভাবে পর্যালোচনা করা অর্থে প্রবাদটি প্রচলিত।

অনুবাদ : ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

হাফিজের কবিতায় আধ্যাত্মবাদ

শাহনাজ আরফিন

এরফান বা আধ্যাত্মিকতা ফারসি সাহিত্যের একটি মূল্যবান উপাদান। আরবি ভাষা ও সাহিত্যে ‘এরফানে ইসলামি’ বা আধ্যাত্মিক বিষয়াদি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গদ্যাকারে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু ফারসি ভাষা ও সাহিত্যে এরফানি চিন্তাধারা বিবৃত হয়েছে কাব্যাকারে বা পদ্যছন্দে। ফারসি ভাষায় এরফানে ইসলামি স¤পর্কিত কাব্যগুলোর মধ্যে মাওলানা রুমির মসনবী এবং শেখ মাহমুদ শাবেস্তারীর গুলশানে রায় অন্যতম। ফারসি ভাষী কবিদের দুই তৃতীয়াংশেরও বেশি কবি আরেফ। তবে অনেক কবির লেখায় যেমন এরফান বা আধ্যাত্মিক চিন্তাদর্শন বেশি প্রাধান্য পেয়েছে, আবার অনেকের লেখায় কাব্য ও শিল্পই মুখ্য।
এ ভূমিকার আলোকে এবার আমরা দেখব ফারসি সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল কবি হাফিজের কাব্য এবং চিন্তাদর্শনে এরফানের প্রভাব কতটুকু ছিল। তবে মূল আলোচনায় যাবার আগে এরফান ও সুফিবাদে বহুল আলোচিত ‘পীর’ শব্দটি নিয়ে খানিকটা আলোচনা করা যাক।
ফারসিভাষী বিশিষ্ট কথাশিল্পি আহমাদ আলী রাজায়ী বুখারায়ী পীর শব্দের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লিখেছেন- সুফিবাদী পরিভাষায় পীর হচ্ছেন এমন এক পথনির্দেশক বা রাহবার, যাঁর সাহায্য ছাড়া সালেক বা সত্যের পথযাত্রী মহাসত্যে উপনীত হতে অক্ষম। সুফিবাদীদের মধ্যে প্রচলিত কুতুব, শেখ, মোরাদ, ওলী, গাউস শব্দগুলো পীর শব্দেরই সমার্থক। সুফিবাদে পীর হচ্ছেন এ ইহ জগতের মূল কেন্দ্রবিন্দু। সালেক বা সত্যের পথযাত্রীদের প্রতিপালন ও পরিশুদ্ধকরণ এবং তাকে
মহাসত্যে পৌঁছাবার দায়িত্ব তাঁর। এ জন্য পীরের প্রতিটি আদেশ নির্দেশ নিঃশর্তে মেনে চলেন তাঁর মুরিদ বা অনুসারীরা। একজন প্রকৃত পীর ও আল্লাহর ওলীর তত্ত্বাবধানে মানুষের আত্মা পূর্ণতা লাভ করে এবং ঐশী নূরে আলোকোজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
পীর সাধকদের স¤পর্কে কবি হাফিজের দৃষ্টিভঙ্গি একেবারে সাদামাটা ও সাধারণ লোকদের মত নয়। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি সচরাচর ও প্রচলিত ধারণার চেয়ে ভিন্ন। তিনি সমাজের প্রতিটি বিষয়কে প্রতিটি মূল্যবোধকে নতুন করে দেখার চেষ্টা করেছেন। তাঁর অনুভূতিপ্রবণ ও সংবেদনশীল মন দিয়ে বিচার ও মূল্যায়ন করেছেন প্রতিটি জিনিসকে। তাই হাফিজের কাব্যে পীর সাধকদের সম্পর্কে  স্বতন্ত্র ও খণ্ডিত মূল্যায়ন চোখে পড়ে।
তাঁর কবিতার কিছু কিছু পঙ্ক্তিতে আমরা এক পথহারা যাত্রীকে দেখি, যে উদভ্রান্তের মত একজন নির্দেশককে খুঁজে বেড়াচ্ছে। পরম সত্যকে জানার উন্মাদনায় যার হৃদয় সদা ব্যাকুল। হাফিজের ভাষায়-
দার বিয়াবানে ফানা গুম শুদান অখার ত কেই
রাহ বেপুরছিম মাগার পেই বে মুহেম্মাত বারিম।
অর্থাৎ চির অস্তিত্বহীনতার প্রান্তরে নিঃশেষিত হওয়া আর কত কাল
ঠিকানা জানা নেই, হয়তো বা অভিষ্ট দিশা পাব।
অন্যত্র বলেছেন-
দার ইন শাবে সিয়াহাম গুম গাশত রাহে মাকসুদ
আজ গুশেই বিরুন অই এই কোকাবে হেদায়েত
অর্থাৎ এই তমসাচ্ছন্ন রাত্রিতে, আমার গন্তব্যের ঠিকানা হারিয়ে গেছে
হে ত্রাণকর্তা! পর্দার অন্তরাল থেকে আবির্ভূত হও।
হাফিজের অনেক কবিতায় পীরের প্রয়োজনীয়তার কথা ব্যক্ত হয়েছে। ঐশী সাধকের দিকনির্দেশনা যে মানুষের প্রয়োজন তা উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন-
অনন কে খাকরা বে নাজার কিমিয়া কুনান্দ
আয়া বুদকে গুশেই চেশমি বেমা কুনান্দ?
অর্থাৎ যারা তাদের দৃষ্টির বরকতে মাটিকে খাঁটি সোনায় পরিণত করেন
তাঁরা কি আমাদের দিকে এক পলক তাকাবেন?
হাফিজের কোন কোন গজলে আবার পীর বা আধ্যাত্মিক সাধকদের কঠোর সমালোচনা চোখে পড়ে।
তাঁর ভাষায়-
নেশানে মারদে খোদা আশেকিয়্যাত বা খুদ দর
কে দার মাশায়েখে শাহর ই নিশান নেমিবিনিম
অর্থাৎ এশক বা ঐশী প্রেমই হচ্ছে আল্লাহর বান্দার নিশানা অথচ
আমাদের শহরের শেখ বা পীরদের মধ্যে এ নিশানার অস্তিত্ব নেই।
পীর বা সাধক স¤পর্কে হাফিজের এ ভিন্ন ভিন্ন মূল্যায়ন থেকে আমরা অন্তত এটা পরিষ্কার বুঝতে পারি যে, তিনি পীর বা সুফি সাধকদের মান্য করতেন। তবে প্রচলিত পীর দরবেশদের নয়, তাঁর শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন প্রকৃত ও আদর্শিক পীর ও সুফিসাধকরা।
হাফিজ যেহেতু একজন অসাধারণ কবি, তাই তিনি একজন সুচারু শিল্পীও বটে। তিনি তাঁর শিল্পমনা ও মননশীল হৃদয় দিয়ে কাক্সিক্ষত আদর্শ পীরের চিত্র এঁকেছেন। এই কাক্সিক্ষত পীর বা পীরে মোগান হাফিজের কবিতায় নানা শব্দ ও পরিভাষায় স্থান পেয়েছে। যেমন, পীর, পীরেমা, পীরে মেইকাদে, পীরে মেইখানে, পীরে খারাবাত, পীরে পেইমনে কেশ, পীরে দারদী কেশ ইত্যাদি। তাঁর বিভিন্ন কবিতা থেকে পীরে মোগানের স্বরূপ খানিকটা উপলব্ধি করা যায়। যেমন-
বে মেই সাজ্জাদে রাঙ্গিন কুন গারআত পীরে মোগান গুইয়াদ
অর্থাৎ শরাব বা মেই ঢেলে তোমার জায়নামাজ রঞ্জিত কর যদি তোমার পীরের নির্দেশ মেলে।
অন্যত্র তিনি লিখেছেন-
বান্দে ইয়ে পীরে মোগান আম কে যে জাহলাম বেরাহান্দ
পীরে মা হারচে কুনান্দ এইনে এনাইয়াত বশাদ
অর্থাৎ আমি সেই পীরের আজ্ঞাবহ যিনি আমার অজ্ঞতা দূর করেছেন, আমার পীর যাই করেন
তাতেই স্রষ্টার অনুগ্রহ রয়েছে।
হাফিজের এসব কবিতা থেকে বুঝা যায় যে, তিনি মূলত এরফান বা ঐশী সাধনার পক্ষে ছিলেন এবং নিজেও ছিলেন একই পথের অনুসারী। কাজেই এরফান বা অধ্যত্ম জগতের প্রতিনিধি অর্থাৎ পীর, সুফি-সাধকদের ত্রুটি-বিচ্যুতি তাঁকে দারুনভাবে পীড়া দিত। সুফি-সাধকদের দুনিয়াপ্রীতি, তাদের লোকদেখানো ধর্মাচার, জাগতিক সুখের আশায় ধর্মের লেবাস ধারণ কবির হৃদয়কে বেদনাক্লিষ্ট করে তুলত। হিজরি অষ্টম শতকের প্রথম দিকে পারস্যে তাসাউফ ও সুফিবাদের অধঃপতন ঘটে। এ সময় বাহ্যত সুফিবাদের আচার-অনুষ্ঠান অত্যন্ত জোরালো হয়ে উঠলেও এর অন্তর্নিহিত শিক্ষা ম্লান হতে থাকে। সাধারণ মানুষ পার্থিব ও পারলৌকিক সুখের আশায় তথাকথিত সুফি ও পীরদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাদের খানকা ও দরবার শরীফকে সমৃদ্ধ করে তোলে। অতীতে সুফি এবং তাসাউফপন্থীরা একনিষ্ঠ সাধনা ও খোদায়ী এশকে উদ্দীপ্ত হয়ে মুর্শিদের পদ অলংকৃত করতেন, কিন্তু হিজরি অষ্টম শতকের প্রথম দিকে সুফিবাদের চরম অধঃপতনের যুগে পীর ও সুফি-সাধকরা জাগতিক স্বার্থকে তাঁদের অভিষ্ট লক্ষের সাথে গুলিয়ে ফেলেন, ফলে সুফিবাদ ও তাসাউফ ক্রমেই পারিবারিক সম্পদ ও ঐতিহ্যে পরিণত হয়।
কবি হাফিজের যুগে অধিকাংশ সুফি ও তরীকতপন্থী এ ধরনের ত্রুটি বিচ্যুতিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েন। তাঁরা বাহ্যিকভাবে ধর্মের কথা উচ্চারণ করলেও ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা তাঁদের জীবনে পরিলক্ষিত হতো না। কাজেই কবি, ধর্মের দেহে বিষ ফোঁড়াস্বরূপ এসব তথাকথিত সুফি-সাধকের প্রকৃত চেহারা উন্মোচন করার তাগিদ অনুভব করলেন। তিনি এসব পীর ও সুফির তীব্র সমালোচনা করেই ক্ষান্ত হন নি, ভাষার তীক্ষè ফলায় বার বার তাঁদেরকে ক্ষত-বিক্ষত করেছেন। সমাজ ও জনমানুষকে তাঁদের সং¯পর্শ থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
এখানে আরেকটি বিষয়ের উল্লেখ না করলেই নয়, এরফান ও তাসাউফ এ দুটি পরিভাষা ফারসি ভাষা ও সাহিত্যে অনেক ক্ষেত্রেই সমার্থক শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। অনেকে শব্দ দুটির ব্যুৎপত্তি বিবেচনা করে এই দুইয়ের মধ্যে ব্যাপক ভিন্নতা ও বিস্তর ফারাক দেখানোর চেষ্টা করেছেন। তবে এতে কারো দ্বিমত নেই যে, তাসাউফ মূলত সুফিবাদ থেকে নেয়া হয়েছে এবং এরফান পরিভাষাটি মূলত মারেফাত থেকে উৎসারিত।
আগেই বলা হয়েছে, হিজরি অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত তাসাউফ ও এরফান নিঃষ্কলুষ ও ত্রুটিমুক্ত ছিল। ঐ সময় পবিত্র কোরআনের আধ্যাত্মিক শিক্ষা, আত্মশুদ্ধির আবেদন এবং এবাদত-বন্দেগিই ছিল তাসাউফ ও এরফানের মূলমন্ত্র। তখন শরিয়তি আচার-অনুষ্ঠানের সাথে তাসাউফ ও এরফানের কোন দ্বন্দ্ব বা সংঘাত ছিল না। কালের পরিক্রমায় এসব পরিভাষা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে থাকে এবং ক্রমেই তাতে নানা বিভ্রান্তি অনুপ্রবেশ করে।
পরবর্তীকালে হাল্লাজ,বায়েজীদ বোস্তামী, আবুল হাসান খারকানি ও জুনায়দীর মত বিশিষ্ট সুফি-সাধকদের আবির্ভাব এবং সানায়ী, আত্তার ও মাওলানা রুমীর মত বিশিষ্ট সাধক কবিদের কল্যাণে এরফান ও তাসাউফ ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের অন্যতম আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়। হাফিজের সময়ে তাসাউফ বা সুফিবাদে নানা বিচ্যুতি দেখা দিতে থাকে। তখন নানা মত, তরিকা ও পদ্ধতি সুফিবাদে অনুপ্রবেশ করে।
হাফিজ শুধু একজন কবি ও শিল্পিই ছিলেন না, বরং তিনি একজন সমাজ সংস্কারক ও শ্রেষ্ঠ সমালোচক হিসেবেও সমাদৃত হয়েছেন। ফলে সমাজের এসব বিভ্রান্তি ও বিচ্যুতিকে তিনি অত্যন্ত দক্ষ ও সুনিপুণ ভাষায় কটাক্ষ করেছেন এবং পাশাপাশি সমালোচনা করেছেন খানকা, মসজিদ, পীর-দরবেশ ও সাধকদের। কারণ, বাহ্যত সুফি-দরবেশরাই এসব পবিত্র স্থানকে নিজেদের আখরায় পরিণত করেছিলেন। এসবের বিপরীতে কবি তাঁর মন ও মানসে এমন এক পবিত্র স্থান খুঁজে ফিরেছেন যেখানে লোকদেখানো ধর্মপালন ও পোশাকি ধর্মের কোন অস্তিত্ব থাকবে না। যেখানে শুধু ঐশী সুধা পান করে খোদার প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে তাঁরই মিলন প্রত্যাশা করা হবে।
হাফিজের কবিতায় খারাবাত বা পানশালা, মেইখানা, শুড়িখানা ইত্যাদি শব্দগুলো রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কবির কাক্সিক্ষত ও কল্পনার সেই পবিত্র স্থানকে বোঝাবার জন্যই তিনি এসব শব্দের দারস্থ হয়েছেন।
এ থেকে বোঝা যায় কবি হাফিজ সুফিবাদের তীক্ষè সামালোচক হলেও এরফান বা মারেফাতে বিশ্বাসী ছিলেন।এমনকি তাঁকে একজন আরেফ বা অধ্যাত্মবাদী সাধক বললেও ভুল হবে না। তবে সাধক কবিদের পুরোধা মাওলানা জালালুদ্দীন রুমির সাথে হাফিজের পার্থক্য এখানেই যে কবি হাফিজের কবিতায় এরফান বা আধ্যাত্মিকতা মুখ্য নয়, মুখ্য হচ্ছে তাঁর শৈল্পিক ও কাব্যিক মননশীলতা। এরফান ও এরফানি শব্দমালাকে তিনি তাঁর শিল্প ও কাব্যের সেবায় নিয়োগ করেছেন। অর্থাৎ কবিপ্রতিভা ও সুচারু শিল্পী ও কবি হিসেবেই হাফিজের খ্যাতি জগতময়, আধ্যাত্মিক সাধক হিসেবে নয়।

জালাল উদ্দিন রূমির কাব্য ও দর্শন

ড. মো. কামাল উদ্দিন

ফারসি সাহিত্যাঙ্গনে উদিত নক্ষত্ররাজির মাঝে যাদের আলোকচ্ছটায় বিশ্বসাহিত্য গৌরবান্বিত জালাল উদ্দিন রূমি তাদের অন্যতম। কবি হাকিম সানায়ি ও ফরিদ উদ্দিন তার অগ্রদূত। সানায়ি থেকে সূচিত আধ্যাত্মিক চিন্তাধারা ফরিদ উদ্দিন আত্তারের মাধ্যমে বিকশিত হয়ে জালাল উদ্দিন রূমির দ্বারা তা ফুলে-ফলে সুশোভিত হয়ে ওঠে। শৈশবে উপযুক্ত পরিবেশে লালিত-পালিত হয়ে পরিণত বয়সে শাম্স তাবরিযির সান্নিধ্য তাঁকে আধ্যত্মিকতার পথ পরিভ্রমণে অনুপ্রাণিত করে। কালের আবর্তনে জালাল উদ্দিন রূমিই হয়ে ওঠেন ফারসি সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ সুফিকবি। আলোড়িত করেন বিশ্ববাসীর হৃদয়কে, অনুপ্রাণিত করেন ভাষা, বর্ণ, কালের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের মননকে। আজো পৃথিবীর অসংখ্য ভাষায় অনূদিত হয়ে মানুষের অন্তরে সাড়া জাগিয়ে আসছে তাঁর কবিতা।
ফারসি সাহিত্যের এ মহান কবির জন্ম ইরানের খোরাসান প্রদেশের বাল্খ্ শহরে ৬ রবিউল আউয়াল ৬০৪ হিজরি মোতাবেক ১২০৭ খ্রিস্টাব্দে। মূল নাম মোহাম্মদ, উপাধি জালাল উদ্দিন। পিতার নাম মোহাম্মদ সুলতান বাহা উদ্দিন ওয়ালাদ। পিতা ছিলেন সমকালীন একজন বিখ্যাত জ্ঞানী, ধার্মিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। তৎকালীন অত্যাচারী শাসকদের নির্যাতন থেকে রক্ষা পেতে হাজার হাজার মানুষ বাল্্খ ত্যাগে বাধ্য হন। তাঁর পিতাও তেমনিভাবে মাতৃভূমির মায়া বিসর্জন দিয়ে হেরাত ও তুসের পথ ধরে পথ চলতে চলতে ১২১৯ খ্রিস্টাব্দে নিশাপুরে এসে উপনীত হন। ফরিদ উদ্দিন আত্তারের সাথে সাক্ষাৎ লাভের পর তিনি রূমির পিতাকে ছেলের ব্যাপারে সতর্ক ও যতœশীল হতে পরামর্শ দেন। এছাড়াও তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেন
اين فرزند را گرامی دار، زود باشد که از نفس گرم، آتش در سوختگان عالم زند.
অর্থাৎ ‘এই সন্তানের যতœ নিও, অচিরেই তাঁর উষ্ণ নিঃশ্বাসে উত্থিত প্রেমের আগুনে এই ধরণীর প্রেমিকদের পোড়াবে।’
এছাড়াও আত্তার তাঁর আসরারনামা কাব্যের একটি কপি রূমিকে ¯েœহাশীষ হিসেবে উপহার দেন।
রূমি তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় পশ্চিম তুরস্কের কুনিয়ায় অতিবাহিত করেন। ১২৩০ খ্রিস্টাব্দে পিতার মৃত্যুতে স্বীয় ওস্তাদ সাইয়্যেদ বুরহান উদ্দিনের সংস্পর্শে এসে আধ্যাত্মিকতার পথে ধাবিত হতে থাকেন। আর যে মনীষীর সান্নিধ্য লাভের ফলে রূমির জীবনে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয় তিনি হলেন শাম্স তাবরিযি। অধিকাংশ গবেষকের মতে, তিনি ১২৪৪ খ্রিস্টাব্দে কুনিয়ায় আগমন করেন। তাঁর সাথে রূমির সাক্ষাতের বিষয়ে বিভিন্ন মতভেদ থাকলেও এটি প্রণিধানযোগ্য যে, শাম্স তাবরিযির সান্নিধ্যই রূমিকে আধ্যাত্মিকতার জগতে নব দিগন্ত উন্মোচিত করে দেয়। রূমির জীবনে তাঁর প্রভাব এতই বেশি ছিল যে, তাঁকে ছাড়া তিনি কিছুই কল্পনা করতে পারতেন না। এমনকি তাঁর বিরহে রূমি দিওয়ানে শাম্স তাবরিযি রচনা করেন। ফারসি সাহিত্যের এই শ্রেষ্ঠ কবি মাত্র ৬৮ বছর বয়সে ১২৭৩ খ্রিস্টাব্দে এ ধরণীর মায়া ত্যাগ করে মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে গমন করেন এবং কুনিয়াতেই তাঁকে সমাহিত করা হয়।
জালাল উদ্দিন রূমির কাব্যের মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ তাঁর মসনবি। যা উপমহাদেশে মসনবিয়ে রূমি হিসেবে খ্যাত, যদিও ইরানে তা মসনবিয়ে মওলাভি বা মসনবিয়ে মা‘নাবি নামে সমধিক পরিচিত। এ বিশাল মসনবির পঙ্ক্তি সংখ্যা নিয়ে গবেষকগণের মাঝে ভিন্ন ভিন্ন মত পরিলক্ষিত হয়। অধ্যাপক নিকলসনের মতে, ছয় খণ্ডের পূর্ণাঙ্গ মসনবিতে সর্বমোট ২৫,৬৩২টি পঙ্ক্তি রয়েছে। ড. যবিহ উল্লাহ সাফার মতে, এ গ্রন্থে পঙ্ক্তি সংখ্যা ২৬,০০০টি। আর সমকালীন সাহিত্য সমালোচক ড. তাওফিক হা. সোবহানির মতে, ৬ খ-ের পূর্ণাঙ্গ মসনবিতে সর্বমোট ২৬,০৩২টি পঙ্ক্তি রয়েছে। তন্মধ্যে প্রথম খ-ে ৪,০০৩টি, দ্বিতীয় খ-ে ৩,৮১০টি, তৃতীয় খ-ে ৪,৮১০টি, চতুর্থ খ-ে ৩,৯৫৫টি, পঞ্চম খ-ে ৪৬৩৮টি এবং ষষ্ঠ খ-ে ৪,৯১৬টি পঙ্ক্তি। রূমির অপর এক কাব্য দিওয়ানে শাম্স তাবরিযি। ড. মোহাম্মদ মুঈনের মতে, এ গ্রন্থের পঙ্ক্তি সংখ্যা ৫০,০০০। অপরদিকে ড. তাওফিক হা. সোবহানির মতে, এতে গযল ও তারজিবান্দ পঙ্ক্তির সংখ্যা ৩৬,৩৬০টি, রুবাঈ পঙ্ক্তির সংখ্যা ৩,৬৭৬টি, আর সর্বমোট পঙ্ক্তি সংখ্যা এসে দাঁড়ায় ৪০,০৩৬টি। তাছাড়া তিনি রচনা করেন ফিহ মা ফিহ, মাকাতিব ও মাজালেসে সাব‘আ।
জালাল উদ্দিন রূমির কাব্যপ্রতিভা বিকশিত হবার ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী দু’জন খ্যাতিমান কবি হাকিম সানায়ি ও ফরিদ উদ্দিন আত্তারের প্রভাব অপরিসীম। ফারসি সাহিত্যে সুফিদর্শনের বিকাশে সানায়ি ও আত্তারের ধারা অনুসরণ করেই রূমি কাব্যচর্চা ও সুফিদর্শন পূর্ণতাদানে ভূমিকা রাখেন। স্বীয় জীবনে তাঁদের প্রভাব সম্পর্কে রূমি বলেন,
عطار روح بود و سنائی دو چشم او ما از پی سنائی و عطار آمديم
অর্থাৎ ‘আত্তার ছিল প্রাণ এবং সানাঈ তাঁর দু’টি চক্ষু; আমরা আত্তার ও সানায়ির পদাঙ্ক অনুসরণ করে এসেছি।’
মসনবিয়ে রূমি বিশ্বসাহিত্যের এক অমূল্য রতœভা-ার। মসনবির মূল সূর বা কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয় প্রেম। এ প্রেমেই বিশ্বজাহানের সৃষ্টি। প্রেমের আকর্ষণেই নব নব দিগন্তের উন্মোচন। গতিশীল জীবনের মূলে রয়েছে প্রেম। বিরহ-বিচ্ছেদের যাতনা, মিলনের তীব্র আকাক্সক্ষা প্রেমানুভূতিকে শাণিত করে। পরমাত্মার কাছ থেকে বিরহের অনল হৃদয়-মনকে প্রতিনিয়ত দগ্ধীভূত করে। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড় খাড় করে দেয়। মিলনের তীব্র বাসনা সব সময় মনের গভীরে বেজে ওঠে। বৈষয়িক সকল চাহিদা, ভোগ-বিলাস, লোভ-লালসার ইতি ঘটিয়ে চিরন্তন প্রেমাস্পদের সান্নিধ্যে পৌঁছার বিশেষ অনুভূতি ঝংকৃত হয় হৃদয়ের কর্ণকুহরে। এ হৃদয়ানুভূতি ক্ষণস্থায়ী কোনো ভালোবাসা নয়; যা অতি সহজেই নিঃশ্বেষ হয়ে যাবার মত। বরং ক্রমেই তা বৃদ্ধি পেতে থাকে, অস্থিরতা সৃষ্টি হয় মননের গভীরে। প্রতিকূলতাকে জয়ের আত্মিক শক্তিও বাড়তে থাকে। বৈষয়িক চাহিদা হয়ে ওঠে গৌণ। তাইতো দেখা যায় পার্থিব বিষয়াদির আকর্ষণ কবিকে বিমূখ করতে পারে নি স্বীয় চিন্তাচেতনা থেকে। তিনি একমনে অবিনশ্বর ¯্রষ্টার প্রতি অনুপ্রাণিত করেছেন জগদ্বাসীকে। এমনই অনুভূতিসম্পন্ন হৃদয়ের প্রত্যাশাই ভেসে উঠেছে তাঁর কবিতার ছন্দের তালে তালে। কবির কণ্ঠে ধ্বনিত হয়-
بشنو از نی چون حکايت می کند از جدايی ها شکايت می کند
کز نيستان تا مرا ببريده اند در نفيرم مرد و زن ناليده اند
سينه خواهم شرحه شرحه از فراق تا بگويم شرح درد اشتياق
অর্থাৎ ‘শ্রবণ কর, বাঁশি কী অবস্থা বর্ণনা করছে, বিরহ-বিচ্ছেদের অভিযোগ প্রকাশ করছে। যখন থেকে আমাকে বাঁশবন থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে, আমার কান্না ও আর্তনাদে নারী-পুরুষ সকলেই ক্রন্দন করেছে। বিরহ বেদনায় ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়ের আমি প্রত্যাশী, যেন আমার প্রেম-বেদনার অনুভূতি ব্যক্ত করতে পারি।’
আধ্যাত্মিক প্রেম এক চিরন্তন অনুভূতি। আল্লাহর সাথে রূহের যে সম্পর্ক তা অবিচ্ছেদ্য। ক্ষণিকের তরে তা বিস্মৃত হলেও পরক্ষণেই হৃদয়ের গভীরে বেজে ওঠে সেই সূর। একদিকে যেমন মানুষ এ ধরনীতে এসে চাকচিক্যময় পরিবেশে লাভ করেছে শান্তিময় জীবন, অনুরূপভাবে রূহ বা আত্মাকে প্রতি মুহূর্তে প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে করতে হচ্ছে সংগ্রাম। এ সংগ্রামে কখনো বা নাফ্সের চাহিদা তাকে পরাভূত করে ফেলে আবার কখনো বা রূহ শক্তিশালী হয়ে প্রভাব বিস্তার করে সম্মুখপানে এগিয়ে নিয়ে চলে। জীবনযুদ্ধের এ টানাপোড়েনে আত্মা চায় অতি শীঘ্রই পরমাত্মার সান্নিধ্যে গিয়ে একাকার হয়ে যেতে। পরমাত্মার সাথে আত্মার মিলনের যে অধীর আগ্রহ, দীর্ঘ প্রতীক্ষা সে কল্পনানুভূতির অভিব্যক্তির বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় মসনবির ছন্দে ছন্দে। কবির ভাষায়-
هرکسی کو دور ماند از اصل خويش باز جويد روزگار وصل خويش
سر من از نالهء من دور نيست ليک چشم و گوش را آن نور نيست
অর্থাৎ ‘যে কেউ তার মূল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, পুনরায় সে তার মিলনযুগ অনুসন্ধান করে। আমার গোপন রহস্য আমার ক্রন্দন ও আবেগ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, কিন্তু চক্ষু ও কর্ণের সেই জ্যোতি নেই তা অনুভব করার।’
সুফিকবি রূমির মতে, দেহ, মানবাত্মা ও পরমাত্মার মিলনের ক্ষেত্রে অন্তরায়, দেহের ধ্বংসেই আত্মার মুক্তি। এতে অনায়াসে পৌঁছতে পারে কাক্সিক্ষত পরমাত্মার সান্নিধ্যে। দেহের অভ্যন্তরে যে কামনা-বাসনা, লোভ-লালসা, মোহ মানুষকে সত্যপথ হতে বিচ্যুত করে, রূমির ভাষায় তার নাম নাফ্স। নাফ্সের ধ্বংসই দেহের কর্তৃত্বের অবসান ও আত্মার স্বাধীনতার পূর্ণতা। নাফ্সের বিরুদ্ধে আত্মার এ সংগ্রাম জীবনব্যাপী। এ জন্য প্রয়োজন আত্মিক শক্তি, সামর্থ্যÑ যা দিয়ে নাফ্সকে পরাভূত করে রূহের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবে। এ সংগ্রামের অবসান হবে সেদিন যেদিন নাফ্স সম্পূর্ণরূপে রূহের আজ্ঞাবহ হবে। আত্মার চলার পথে অন্তরায় না হয়ে বাহন হিসেবে পরিগণিত হবে। আর এ অবস্থার নাম ‘ফানা’- বিলয়। এই স্তর অতিক্রম করে যখন আল্লাহতে পূর্ণ সমাপ্তি প্রাপ্ত হওয়া যায় তখন এক নব জীবনের অধিকারী হওয়া যায়। আর এই অবস্থার নাম ‘বাকা’। রূমির আধ্যাত্মিক বিষয়াবলি একান্ত তাঁর নিজস্ব চিন্তাচেতনার বহিঃপ্রকাশ, যা ইতঃপূর্বে এত সুন্দরভাবে কারো কারো কাব্যে দৃশ্যমান হয়নি। অভিনব রচনাশৈলী ও আধ্যাত্মিক পথ পরিক্রমার বর্ণন এতদুভয়ের সার্থক সমাহার ঘটেছে তাঁর মসনবিতে। এ প্রসঙ্গে The New Encyclpaedia Britannica বলা হয়েছে :

“Jalal ad-Din ar-Rumi also called MAWLANA, the greatest Sufi mystic, and poet in the Persian language, famous for his lyrics and for his didactic epic Masnavi-ye Manavi (spiritual couplets) which widely influenced Muslim mystical thought and literature.”

বিশ্বব্যাপী জালাল উদ্দিন রূমির খ্যাতি ও পরিচিতির মূলে হলো তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ মসনবি। এতে রয়েছে সুফিদর্শন ও আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমে মহান ¯্রষ্টার সান্নিধ্য লাভের পথনির্দেশনা। সুফিতত্ত্বের মূলকথা মহান আল্লাহর অস্তিত্ব, রূহ বা আত্মার প্রকৃতি, জীবন-মৃত্যু ও জগতের সাথে সম্পৃক্ত। প্রতিটি বিষয়ের অভিব্যক্তি রয়েছে এ মসনবিতে। বাস্তব ও কল্পিত কাহিনী, উপকথা, নীতিগল্প, রূপক কাহিনী ও গভীর চিন্তাধারার সমাহারে আধ্যাত্মিক ও নৈতিক বিষয়সমূহ হয়ে উঠেছে সহজবোধ্য ও সাবলীল।
সাহিত্যিক ভাবধারার সমাহারে নৈতিক চিন্তাধারার বিশ্লেষণ ও কাব্যিক উপস্থাপনা ইসলামি বিশ্বে বিরল। পার্থিব বিষয়াবলির উপমা প্রদানের মাধ্যমে বৈষয়িক ভোগ-বিলাস, লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ প্রভৃতির অনীহা সৃষ্টি এবং পারলৌকিক জীবনের প্রতি অনুগামী করে তুলতে অনুপ্রেরণার উৎসমূল হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে রূমির এ মসনবি। যা মুসলিম বিশ্বের সাহিত্যসাধনা, ইসলামি সংস্কৃতি ও দর্শনের বিকাশে যুগান্তকারী ভূমিকায় অবতীর্ণ। ফারসি ভাষায় যেন কুরআনীয় নৈতিক শিক্ষার সমাহার ঘটেছে এ মসনবিতে। কবির ভাষায়-
مثنوی معنوی مولوی هست قرآن در زبان پهلوی
অর্থাৎ ‘মৌলভির আধ্যাত্মিক বিষয় সম্বলিত মসনবি পাহলভি (ফারসি) ভাষায় কুরআন (এরই ব্যাখ্যারূপ)।’
দেশ-কাল-জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বমহলে সমাদৃত কবি জালাল উদ্দিন রূমির কবিতা। ভাষা ও ভৌগোলিক সীমারেখা এবং কালের গ-ি এর আবেদনকে সীমায়িত করতে পারে নি। আধ্যাত্মিক চিন্তাধারা, কাব্যিক অনুভূতি, কল্পনার অভিব্যক্তি সাবলীল ভাষায় ছন্দের তালে তালে ঝংকৃত হয় তাঁর কবিতায়। যা পাঠে পরম আনন্দ ও বিশেষ অনুভূতি জেগে ওঠে হৃদয়ের গভীরে। পরম প্রেমের অনাবিল আবেশে স্বীয় সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য লাভের আকাক্সক্ষা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। কাহিনীর বুনন, রূপকালঙ্কার, উপমা-উৎপ্রেক্ষার প্রয়োগ, ভাষার গাঁথুনি এসবই তাঁর কবিতাকে করেছে মহিমান্বিত। সাড়া জাগিয়েছে বিশ্ববাসীর হৃদয়ে। তাঁর কাব্যিক আকর্ষণ ও আধ্যত্মিক তত্ত্ব হাজার বছর ধরে পৃথিবীর মানুষকে আকৃষ্ট করে রেখেছে এবং অনাগত কালেও বিশ্বমানবতাকে পথ প্রদর্শন করবে।
প্রফেসর, ভাষা বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

কারবালায় আবরাইনে সর্ববৃহৎ মানবসমাবেশ

আরবাইন বা হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের চল্লিশতম দিন উপলক্ষে প্রতি বছর কারবালার ময়দান অভিমুখে শোকযাত্রা গত ২০০৯ সাল থেকে ২০১৫ সালের সর্বশেষ আরবাইন পর্যন্ত প্রতি বছরই ‘বিশ্বের বাৎসরিক সর্ববৃহৎ শান্তিপূর্ণ মিলনমেলা’ হিসেবে বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য গণমাধ্যমে স্থান করে নিয়েছে। যেমন, উইকিপিডিয়ার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ইতিহাসের সর্ববৃহৎ মানব-জমায়েতের তালিকায় দু’ নম্বরে রয়েছে ২০১৫ সালের আরবাইনের অবস্থান- যেখানে জঙ্গীহামলার হুমকিকে উপেক্ষা করে অন্তত ২৬ মিলিয়ন মানুষ অংশগ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, মানবেতিহাসের সর্বোচ্চ মানব-জমায়েতের তালিকায় ‘আরবাইন’ দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও বাৎসরিক সর্বোচ্চ মানব-জমায়েতের তালিকায় এর অবস্থান প্রথমে। কেননা, হিন্দু ধর্মাবলম্বিগণের কুম্ভমেলা- যা মানবেতিহাসের সর্বোচ্চ জনসমাগম (২০১৩), সেটি প্রতি তিন বছর অন্তর একবার করে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
উইকিপিডিয়ায় ‘List of Largest peaceful gathering in history’ শীর্ষক নিবন্ধে প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী দেখা যায় যে, ২০০৯ থেকে ২০১৫ (সর্বশেষ) পর্যন্ত বছরগুলোতে কারবালায় আরবাইনে অংশ নেয়া মানুষের সংখ্যা যথাক্রমে ১০-১৪ মিলিয়ন (২০০৯), ১০ মিলিয়ন (২০১০), ১৫ মিলিয়ন (২০১১), ১৫ মিলিয়ন (২০১২), ১৫-১৮ মিলিয়ন (২০১৩), ২০-২২ মিলিয়ন (২০১৪) এবং ২৬ মিলিয়ন (২০১৫)। তাকফিরি জঙ্গিদের হুমকি, হামলা ও আগ্রাসনকে উপেক্ষা করে সারা দুনিয়া থেকে ছুটে আসছেন হযরত ইমাম হোসাইনের প্রেমিকগণ এবং প্রতি বছর তাঁদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। আরো উল্লেখ যে, আরবাইন ও ইমাম হোসাইনের শাহাদাতের ঘটনায় শোকপ্রকাশ শিয়া মুসলমানগণের ঐতিহ্য হিসেবে বিবেচিত হলেও আরবাইন উপলক্ষে কারবালায় ছুটে আসছেন অসংখ্য সুন্নি মুসলমান, খ্রিস্টান, হিন্দু, ইয়াযিদি, যরথুস্ত্র এবং সাবেয়ি ধর্মের অনুসারী ইমাম হোসাইন-প্রেমিকগণ।
হাফিংটনপোস্টে প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ মাহদি আল মুদাররেসি তাঁর নিজ কলামে কারবালার পথে আরবাইনের পদযাত্রায় অংশগ্রহণ করে নিজের অনুভূতি এমনভাবেই প্রকাশ করেছেন, ‘নারী-পুরুষ এবং শিশুদের পদযাত্রা যেন তুষারধসের মত (এগিয়ে চলেছে)। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, কালো চাদরে ঢাকা নারীদের অবস্থানÑ দিগন্তের একমাথা থেকে আরেক মাথা অবধি বিস্তৃত।’
তাঁর আরবাইন শীর্ষক কলাম(World’s Biggest Pilgrimage Now Underway, And Why You’ve

Never Heard of it!) যেটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে, তাতে এটিও জানা যায় যে, বসরা থেকে কারবালা পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৪২৫ মাইল পথ দু’ সপ্তাহের প্রচেষ্টায় পায়ে হেঁটে পার করেন অনেক শোকযাত্রী।
বিনামুল্যে সকাল-দুপুর ও রাতের খাবার এবং অন্যান্য সেবা
মাহদি আল মোদাররেসির কলামে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘তীর্থযাত্রীদের জন্য যাত্রাপথের অন্যতম আকর্ষণ হলো অস্থায়ী রান্নাঘরযুক্ত হাজার হাজার তাঁবু, যেগুলো পার্শ্ববর্তী গ্রামবাসীরা তীর্থযাত্রীগণের খেদমতের জন্য পত্তন করে থাকেন। তাঁবুগুলোতে তীর্থযাত্রীগণ দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় সকল সামগ্রী বিনামূল্যে পেয়ে থাকেন। স্বাস্থ্যকর খাবার থেকে শুরু করে বিশ্রামের স্থান পর্যন্ত সবই। বিদেশে ফোন-যোগাযোগের সুবিধা, বাচ্চাদের ডায়াপারÑ সবই বিনামূল্যে। ৪০০ মাইল যাত্রাপথে তীর্থযাত্রীদের এককথায় কোন কিছুই নিজ থেকে বহন করা লাগে না। এরচেয়েও অভাবনীয় হচ্ছে, যেভাবে তীর্থযাত্রীদের খাদ্যগ্রহণে নিবেদন করা হয় সেটি। রাস্তার মোড়ে মোড়ে যাত্রীকে পথরোধ করেন এলাকাবাসী ইমাম-ভক্তগণ এবং বিনামূল্যে খাদ্যগ্রহণে বাধ্য করেন তাঁরা। যেই খাবার প্রায়ই একজনের জন্য ‘রাজার খাবার’ পরিমাণে হয়ে থাকে। তবে তার আগে ক্লান্ত-শ্রান্ত যাত্রীর পা ম্যাসেজ করে দেবেন স্বেচ্ছাসেবীরা। এরপর তাঁরা পদযাত্রীকে বিশ্রাম নিতে অনুরোধ করবেন- যতক্ষণ তারা (স্বেচ্ছাসেবিগণ) তাঁর (যাত্রীর) জামা-কাপড় ধুয়ে-শুকিয়ে ইস্ত্রী করেন সেই পর্যন্ত (পুরোটাই যাত্রীর সম্মানে বিনামূল্যে)।… একজন স্বেচ্ছাসেবীর ভাষায়, ‘ইসলামের শিক্ষা স¤পর্কে জানতে চাইলে, কতিপয় জঙ্গির দিকে নজর না দিয়ে বরং আরবাইন উপলক্ষে নিঃস্বার্থ ত্যাগের নজিরগুলোর দিকে মনোযোগ দেয়াটাই বাঞ্ছনীয়।’
আরবাইন উপলক্ষে ইমাম হোসাইনের ভক্তগণ কারবালা অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন কেউ বা নাজাফ শহর থেকে যেখান থেকে কারবালার দূরত্ব ৫৫ মাইল আর কেউ বা যাত্রা শুরু করেন বসরা শহর থেকে; কারবালা পৌঁছতে সেক্ষেত্রে অতিক্রম করা লাগে ৪২৫ মাইল। এই বিশাল দূরত্বে পদে পদে পুঁতে রাখা বোমার ভয়, অপহৃত হওয়ার ভয়। সেই ভয়কে জয় করে বিভিন্ন পেশা-শ্রেণীর নারী, পুরুষ, শিশু, যুবক, মৃত্যুপথযাত্রী কিংবা গুরুতর পঙ্গু-বধির-অন্ধ হোসাইন-প্রেমীরা সমস্বরে ¯ে¬াগান তোলেন, ‘যদি তারা দেহ হতে আমাদের পা এবং হাত বিচ্ছিন্ন করে ফেলে, তবুও আমরা এই পবিত্র ভূমির পানে ছুটে আসবই!’
কেনো এই দু’কোটি ষাট লক্ষ মানুষের শান্তিপূর্ণ মিলনমেলা? যেখানে কোন তীর্থব্যবসা নেই। কোন চটকদার দুনিয়াবী আকর্ষণ নেই। নেই সুরম্য অট্টালিকা- শততলা স্কাইস্ক্র্যাপার।
কী উদ্দেশ্যে হুইলচেয়ারে কিংবা ক্রাচে নির্ভর পঙ্গু কিংবা হাতে লাঠি নিয়ে একজন অসহায় অন্ধ ৪০০ মাইল পার হয়ে কারবালায় ছুটে আসেন? কী জন্য একজন বৃদ্ধ পিতা তাঁর প্রতিবন্ধী সন্তানকে কাঁধে করে বসরা থেকে কারবালা অবধি ছুটে আসেন? কী জন্য মিম্বরের সাদা পাগড়ি পরা আলেম স্বেচ্ছাসেবিগণের সাথে রাস্তায় বসে তীর্থযাত্রীদের মাঝে ফল বিতরণ করেন কিংবা তাদের জুতো পালিশ করেন? কেনো ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়া থেকে দুই কোটির অধিক মানুষ কারবালায় ছুটে আসেন! শুধু ইমাম হোসাইনের প্রেমে; যখন এই তীর্থযাত্রা মোটেও কোনো অবশ্যপালনীয় ধর্মীয় আচার নয়!
না! মিডিয়ায় মুহররম বলতে চাকু দিয়ে নিজের পিঠে আঘাত করে যে রক্তপাত দেখানো হয় সেই উদ্দেশ্যে এই তীর্থযাত্রা নয়। শুধু ক্রন্দন কিংবা ‘ইয়া হোসাইন’ বলে বুক চাপড়ানোও উদ্দেশ্য নয়। এই বিপদসংকুল পদযাত্রার পেছনে কোনো ‘বিষাদ সিন্ধু’ শ্রেণির কাহিনী প্রেরণা-দর্শন হিসেবে নিহিত নেই।
‘মানবতাকে জাগ্রত কর; অতঃপর সবাই হোসাইনকে নিজের বলে দাবি করবে।’- ‘পদ্মভূষণপ্রাপ্ত সাহিত্যিক জস মালিহাবাদি

সংকলন : মাহদী মাহমুদ

সম্পাদকীয়

আশুরার মর্মকথা ও শিক্ষা
দশই মুহররম শোকাবহ আশুরা- সাইয়্যেদুশ্ শুহাদা ও বেহেশতে যুবকদের নেতা হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের বার্ষিকী। হিজরি ৬১ সালের এ দিনে ইমাম হোসাইন কারবালায় তাঁর স্বজন ও সহচরগণসহ ইয়াযীদী বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেন।
কারবালার ঘটনা ও তার প্রেক্ষাপট ইতিহাসের বিতর্কাতীত অকাট্য ঘটনাসমূহের অন্যতম।
আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-এর শাহাদাতের ঘটনার পরে হযরত ইমাম হাসান (আ.) খেলাফতের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু মুসলিম উম্মাহ্কে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও সম্ভাব্য রোমান হামলা থেকে রক্ষার লক্ষ্যে তিনি তাঁর বৈধ খেলাফতকে মুআবিয়ার হাতে ছেড়ে দেন। মুআবিয়া হযরত ইমাম হাসান (আ.)-এর সাথে কৃত সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করে মৃত্যুকালে হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)-এর হাতে খেলাফতের দায়িত্ব হস্তান্তরের পরিবর্তে স্বীয় চরিত্রহীন পাপাচারী পুত্র ইয়াযীদকে খেলাফতে অধিষ্ঠিত করে গেলে ইয়াযীদ হযরত ইমাম হুসাইনের কাছ থেকে শক্তিপ্রয়োগে বাই‘আত্ আদায়ের জন্য মদীনার উমাইয়্যাহ্ প্রশাসককে নির্দেশ দেয়। কিন্তু হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)-এর ন্যায় ব্যক্তি ইসলামের সমস্ত সীমারেখা অমান্যকারী ইয়াযীদের আনুগত্য করলে যে কারো জন্য তা ইসলামি মূল্যবোধ বিসর্জনের সপক্ষে দলিল হিসেবে গণ্য হতো। এ কারণে তিনি ইয়াযীদের অনুকূলে বাই‘আত্ করা থেকে বিরত থাকেন এবং রক্তপাত এড়াবার লক্ষ্যে রাতের বেলা মদীনা ত্যাগ করে মক্কায় চলে যান।
মক্কায় তিনি লোকদের মধ্যে মুসলমানদের হুকুমাতের প্রকৃত অবস্থা সম্বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টির কাজে আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু ইয়াযীদ সেখানে তাঁকে হজের ভীড়ে হত্যার জন্য গুপ্তঘাতক পাঠালে হযরত ইমাম পবিত্র স্থানে রক্তপাত এড়াবার লক্ষ্যে মক্কা ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন এবং কুফার জনগণের দাও‘আতে সাড়া দিয়ে সেখানে পৌঁছার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে কারবালায় উপনীত হন। সেখানে ইয়াযীদের নির্দেশে তার বাহিনী হযরত ইমামের ওপরে ইয়াযীদের অনুকূলে বাই‘আত্ করার জন্য কঠোরভাবে চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) কোনো অবস্থায়ই ফাসেক্ব ইয়াযীদের অনুকূলে বাই‘আত্ করাকে জায়েয গণ্য করেন নি বিধায় তাদের এ চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানান। এমতাবস্থায় ইয়াযীদী বাহিনী তাঁকে স্বজন ও সহচরসহ এক অসম যুদ্ধের মধ্য দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। কেবল আল্লাহ্ তা‘আলার বিশেষ ইচ্ছায় হযরত ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) ঐ সময় মরণাপন্ন অসুস্থ থাকায় তিনি এ হত্যাকা- থেকে রেহাই পান; এছাড়া হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সঙ্গী-সাথিদের ও পরিবারের কোনো পুরুষ সদস্যকেই জীবিত রাখা হয় নি।
হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আত্মত্যাগের এ ঘটনা মানুষকে ভাবতে শেখায় এবং মুসলমানদের জন্য বাতিলকে সহ্য করার সীমারেখাকে সুস্পষ্ট করে দেয়। এভাবে কারবালার ঘটনা যুগ যুগান্তর ধরে প্রকৃত ইসলামের অনুসারীদের জন্য প্রেরণার উৎসে পরিণত হয়।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে, কারবালার ঘটনা সম্পর্কে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসা মতৈক্যের বরখেলাফে ইদানিং কিছুসংখ্যক লোক একদিকে কারবালার ঘটনার গুরুত্ব হ্রাস করার লক্ষ্যে অভিনব সব ব্যাখ্যা দিয়ে এমনকি আশুরার এ শোকের দিনকে আনন্দের দিন বলে অভিহিত করার মতো জঘন্য মানসিকতার প্রদর্শন করতে দ্বিধা করছে না। অন্যদিকে কারবালার এ ঘটনাকে তারা হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) ও ইয়াযীদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই হিসেবে চিত্রিত করার এবং ইয়াযীদকে নির্দোষ প্রমাণের ঘৃণ্য অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তারা দাবি করছে যে, ইয়াযীদের অনুমতি ছাড়াই কারবালার ঘটনা ঘটানো হয়েছিল। আমরা এ ব্যাপারে তাদের বিবেকের কাছে একটাই প্রশ্ন করব : যদি তা-ই হয়ে থাকে তাহলে যারা এ জন্য দায়ী ইয়াযীদ তাদেরকে শাস্তি দেয় নি কেন?
আমরা আশুরা উপলক্ষে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্র প্রতি, বিশেষ করে নিউজ লেটারের পাঠক-পাঠিকাদের প্রতি শোক ও সমবেদনা জানাচ্ছি।