All posts by pavel

সংবাদ বিচিত্রা (বিদেশী সংবাদ)

মিয়ানমার থেকে আফ্রিকা পর্যন্ত আজ মুসলমানেরা হত্যাকাণ্ডের শিকার : ইরানের সর্বোচ্চ নেতা
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেছেন, আজকের দিনে মুসলিম বিশ্ব যে মহা বিপদের মোকাবেলা করছে তার থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র উপায় হচ্ছে ঐক্য।
তিনি বলেন, মিয়ানমার থেকে আফ্রিকা পর্যন্ত আজ মুসলমানরা হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে। এর মধ্যে কেউ মারা যাচ্ছে বোকো হারামের হাতে, কেউ উগ্র বৌদ্ধদের হাতে।
সর্বোচ্চ নেতা আরও বলেন, ‘আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ হতে পারি এবং ইসলামি লক্ষ্যের দিকে এগুতে পরি তাহলে ক্ষতিকর সাম্রাজ্যবাদী ও ইহুদিবাদী শক্তি বিভিন্ন দেশকে তাদের কব্জায় রাখতে পারবে না।’
মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর পবিত্র জন্মবার্ষিকী ও ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ উপলক্ষে গত ১৭ ডিসেম্বর ২০১৬ তেহরানে আয়োজিত আন্তর্জাতিক ইসলামি সম্মেলনে অংশ নেয়া রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা, কূটনীতিক প্রতিনিধি এবং বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সাক্ষাৎ অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, শিয়া ইসলামের ব্রিটিশ ভার্সন এবং সুন্নি ইসলামের মার্কিন ভার্সন তৈরি করে মুসলমানদের একে অপরের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে এবং এ দুটি হচ্ছে একই ছুরির দুই ধার।
সর্বোচ্চ নেতা জোর দিয়ে বলেন, ‘বিভক্ত কর ও শাসন কর’-ব্রিটিশ এই নীতি ইসলামের শত্রুরা মারাত্মকভাবে অনুসরণ করে চলেছে। আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী বলেন, ফিলিস্তিনি সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রেও মুসলিম ঐক্য একইভাবে জরুরি।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে’র সাম্প্রতিক ইরানবিরোধী বক্তব্য স¤পর্কে সর্বোচ্চ নেতা বলেন, ‘এই ব্রিটিশ সরকার বিগত ২০০ বছর আমাদের অঞ্চলের দেশগুলোর জন্য খুবই জঘন্য ও নোংরা নীতি অনুসরণ করে চলেছে। ব্রিটিশ সরকার ভারত, পাকিস্তান, ইরান, ইরাক এসব দেশকে বিভক্ত করেছে এবং ব্রিটিশ কর্মকর্তারা এখন বলছেন, ইরান মধ্যপ্রাচ্যের জন্য হুমকি।’

শত্রুরা ইরানের তরুণ সমাজকে বিভ্রান্ত করতে চায় : সর্বোচ্চ নেতা
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, তাঁর দেশের কিশোর ও তরুণ সমাজকে বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যে শত্রুরা ইরানের ওপর অথনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালাতে চায়।
তিনি আরো বলেছেন, আজকের কিশোররাই আগামী দিনে দেশের নেতৃত্ব দেবে। কাজেই তাদেরকে শত্রুর সব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করার যোগ্যতা অর্জন করার পাশাপাশি সব সময় সতর্ক থাকতে হবে।
ইসলামি শরিয়তের বিধান ফরজ হওয়া উপলক্ষে প্রায় দুই হাজার কিশোর গত ১৪ ডিসেম্বর সর্বোচ্চ নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি তাদের সমাবেশে দেয়া ভাষণে এ আহ্বান জানান।
ইরানে শিশুদের ‘বালেগপ্রাপ্তি’ বা ইসলামি বিধিবিধান পালনের মতো পূর্ণ বয়সে উপনীত হওয়ার সময়টিতে নানা সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। প্রতিটি স্কুলে প্রতি বছর এ ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বালেগপ্রাপ্তদের জানিয়ে দেয়া হয় আজ থেকে তাদেরকে নামায ও রোযার মতো প্রতিটি ইসলামি ফরয দায়িত্ব পালন করতে হবে।
বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনও এ ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতাও প্রতি বছর এরকম একদল কিশোরের সমাবেশে ভাষণ দিয়ে তাদের ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্তব্য স¤পর্কে সচেতন করে তোলেন।
সর্বোচ্চ নেতা ধর্মীয় বিধিবিধান পালনে উপযুক্ত হওয়ায় কিশোরদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, এজন্য তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে হবে। আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেন, মহান স্রষ্টার সঙ্গে গভীর স¤পর্ক প্রতিষ্ঠা ছাড়া কোনো মানুষ ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে উন্নতি লাভ করতে পারে না। এ স¤পর্ক ছিন্ন হওয়ার কারণে আজ পশ্চিমা সমাজে নৈতিক স্খলন চরম আকার ধারণ করেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের ঊর্ধ্বে সুবিচার নিশ্চিত করতে হবে- প্রেসিডেন্ট রুহানি
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি মন্ত্রণালয়সমূহ, সরকারি ও আধা সরকারি সংস্থাসমূহ ও স্থানীয় সরকারসমূহের কার্যক্রম তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের সাথে সভায় তাঁদের দায়িত্বের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন, তদারকি সংস্থাসমূহের দায়িত্ব কেবল তদারকির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং সামাজিক পুঁজি পুনর্গঠন ও জনগণের মধ্যে আস্থা গড়ে তোলা তাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট ইসলামি ন্যায়নীতির আলোকে ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য সুবিচার নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
প্রেসিডেন্ট তাঁর ভাষণে বিচার বিভাগের প্রশংসা করে বলেন, বিচার বিভাগের সততা ও ন্যায়বিচারের কারণে এ বিভাগের প্রতি জনগণের পরিপূর্ণ আস্থা থাকা উচিত। এ প্রসঙ্গে তিনি কতক লোকের দ্বারা আইন লঙ্ঘনের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, কোনো ব্যক্তি কর্তৃক আইন লঙ্ঘনের তুলনায় একটি গোষ্ঠী কর্তৃক আইন লঙ্ঘন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
ড. রুহানি সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যক্রম তত্ত্বাবধান ও তদারকের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, ইসলামি প্রজাতন্ত্রে এ বিষয়টি অনেক বেশি গুরুত্বের অধিকারী।
প্রেসিডেন্ট রুহানি বলেন, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সবচেয়ে বড় সম্পদ হচ্ছে তার সামাজিক পুঁজি এবং শক্তির উৎস হচ্ছে জনগণের শক্তি। তিনি বলেন, এমন কতক বিশাল বাজেটের প্রকল্প রয়েছে যেগুলো সম্পর্কে জনগণের যে কোনো প্রশ্নের জবাব দেয়া জরুরি। অন্যথায় জনগণের আস্থা ও সামাজিক পুঁজি নস্যাৎ হয়ে যাবে।
তিনি তত্ত্বাবধান ও তদারকির প্রক্রিয়া সম্পর্কে দিকনির্দেশ প্রদান করেন। তত্ত্বাবধান ও তদারকির দায়িত্বে নিয়েজিত বিভিন্ন সংস্থা থাকা সত্ত্বেও ইতিপূর্বে যেসব আর্থিক অনিয়ম হয়েছে সে ব্যাপারে তদন্ত সম্পর্কে তিনি বলেন, এতদসংক্রান্ত তদন্ত রিপোর্ট বিচার বিভাগের কাছে হস্তান্তরের আগে সে সম্পর্কে গোয়েন্দা বিভাগ কর্তৃকও তদন্ত হতে হবে যাতে তদন্ত রিপোর্ট পুরোপুরি স্বচ্ছতার অধিকারী হয়।
তিনি বলেন, কোনো ব্যক্তি কর্তৃক আইন অমান্য করার তুলনায় কোনো গোষ্ঠী কর্তৃক আইন অমান্য করা অধিকতর গুরুতরÑ এ বিষয়টি জনগণের কাছে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা অপরিহার্য। তিনি বলেন, যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের তদন্ত এমনভাবে হওয়া উচিত যাতে সেসবে প্রদত্ত সুপারিশ আইন সংস্কারে ও তা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার উন্নয়নে সহায়ক হয়। তিনি বলেন, তদন্তে সংশ্লিষ্ট অনিয়মের বিষয়টির প্রতি যতখানি দৃষ্টি দিতে হবে তার চেয়েও বেশি দৃষ্টি দিতে হবে অনিয়মের পেছনে নিহিত মূল কারণের প্রতিÑ যাতে আইনের ও তার প্রয়োগের প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করা সম্ভব হয়।
কোনো অপরাধ সম্পর্কে তদন্তের পরে ঐ ধরনের অপরাধের পেছনে নিহিত কারণ ও তা প্রতিরোধের পন্থা নির্দেশের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে প্রেসিডেন্ট রুহানি বলেন, এর পরিপ্রেক্ষিতে এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি যাতে ঐ ধরনের অপরাধ পুনরায় সংঘটিত হতে না পারে। আর অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রেও বিচার বিভাগের এমন পদক্ষেপ নেয়া উচিত যার ফলে অপরাধের পুনরাবৃত্তি প্রতিহত হয়। তিনি বলেন, সুবিচারের স্থান ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের ঊর্ধ্বে।
তিনি কতক প্রচারমাধ্যম কর্তৃক মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে মিথ্যা অভিযোগ প্রচারের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, কেন তারা এ ধরনের কর্মনীতি অনুসরণ করছে? তিনি বলেন, সমাজে যখন কিছুসংখ্যক লোক পাপাচার ও মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে সুখী হয় তখন স্বভাবতঃই সে সমাজের নৈতিক মানের অবনতি ঘটে।
প্রেসিডেন্ট রুহানি তদন্তকারী সংস্থা ও ব্যক্তির কাজের ওপর গুরুত্ব আরোপের পাশাপাশি জনগণের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বজায় রাখার ওপরও বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন, একান্ত ব্যক্তিগত পর্যায়ের দোষ ধরা পড়লে তা প্রকাশ করা কিছুতেই উচিত হবে না।
তিনি বলেন, অর্থনৈতিক ও নৈতিক উন্নয়ন এবং জনগণের ঐক্যের স্বার্থে কোনো রকম বৈষম্য ব্যতিরেকেই দুর্নীতি ও অনাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম অপরিহার্য। জনগণের অধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে প্রতিটি আইন অমান্যকারী ব্যক্তির সাথে সমানভাবে আচরণ করতে হবে।
প্রেসিডেন্ট রুহানি সরকারি সংস্থাসমূহের কাজকর্মের ওপর জনগণের দৃষ্টি রাখার ওপরে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, জনগণকে আরো বেশি দৃষ্টি রাখতে হবে, আরো বেশি তত্ত্বাবধান করতে হবে। কারণ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামের ক্ষেত্রে জনগণের তত্ত্বাবধানই হচ্ছে সবচেয়ে বড় শক্তি।
তিনি মতপার্থক্য পরিহারের জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আসুন, আমরা পরস্পরের হাতে হাত রেখে জনগণের সমস্যাবলির সমাধানের লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যাই।
ড. রুহানি তাঁর ভাষণের শেষে সকলকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, জনগণের অধিকারকে সমুন্নত রাখা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তিনি বলেন, নাগরিক অধিকার ঘোষণার মূল লক্ষ্য ছিল এই যে, জনগণ যেন রাষ্ট্র ব্যবস্থার সকল শাখা ও সকল সংস্থার কাছ থেকে তাদের সংশ্লিষ্ট অধিকার দাবি করতে পারে এবং আদায় করতে সক্ষম হয়।

মন্ত্রী সভার বৈঠকে সরকারের স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পর্যালোচনা
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন ড. হাসান রুহানি ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের ঊর্ধ্বে সকলের জন্য সুবিচার নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি গত ২৮ ডিসেম্বর (২০১৬) তাঁর সরকারের বিগত সময়কার স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পর্যালোচনার লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত মন্ত্রী পরিষদের বৈঠকে প্রদত্ত ভাষণে এ বিষয়টির ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেন।
এ বৈঠকে স্বাস্থ্যসেবা খাতে সরকারের বিগত সময়কার সফল কার্যক্রম, বিশেষত এ ক্ষেত্রে সাধিত সংস্কারের ওপর বিস্তারিত প্রতিবেদন পেশ করা হয় এবং সেই সাথে এ ক্ষেত্রে বিরাজমান চ্যালেঞ্জসমূহ তুলে ধরে তা মোকাবিলার সম্ভাব্য পন্থাসমূহ সুপারিশ করা হয়।

তেহরানে ইসলামি ঐক্য সম্মেলনের বিবৃতি প্রকাশ : ‘নয়া মুসলিম সভ্যতা’ গড়ে তোলার অঙ্গিকার
তেহরানে অনুষ্ঠিত ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ উপলক্ষে আয়োজিত ৩০তম আন্তর্জাতিক সম্মেলন বিবৃতি প্রকাশের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় আরো সতর্কতা এবং মুসলিম ঐক্য জোরদারের ওপর গুরুত্বারোপ করে গত ১৮ ডিসেম্বর ২০১৬ আন্তর্জাতিক ইসলামি ঐক্য সম্মেলন শেষ হয়।
২৭টি ধারায় প্রণীত ওই বিবৃতিতে মুসলিম দেশগুলোর সর্বশেষ অবস্থা খতিয়ে দেখা এবং মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে বিভেদ রোধে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের আহ্বান জানানো হয়েছে সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধিদের ওপর। এছাড়া, তাকফিরি সন্ত্রাসীদের অপরাধযজ্ঞ মোকাবেলায় মুসলিম ঐক্য জোরদার করার উপায় খুঁজে বের করার বিষয়টি তিনদিনের এই আলোচনায় বেশ গুরুত্ব পেয়েছে। তাকফিরি চিন্তাভাবনা ও তার কুফল এবং নয়া মুসলিম সভ্যতা গড়ে তুলতে মুসলিম উম্মাহর লক্ষ্য বাস্তবায়নের নানা দিক নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক ইসলামি ঐক্য সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধিরা মুসলিম ঐক্য ধ্বংস এবং মুসলমানদের বিভিন্ন মাযহাবের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি, বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়া ও রক্তপাত ঘটানোর পেছনে উগ্র তাকফিরিদের ভূমিকার বিষয়টি আরো ভালোভাবে পর্যালোচনার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
তাঁদের মতে, উগ্র তাকফিরি চিন্তা-চেতনা মুসলিম ঐক্যের পথে সবচেয়ে বড় বাধা। এ অবস্থায় যারা ঐক্যে বিশ্বাসী তাদের উচিত হবে তাকফিরিদের মোকাবেলার বিষয়টিকে সবচেয়ে অগ্রাধিকার দেয়া।
আন্তর্জাতিক মুসলিম ঐক্য সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধিরা তাঁদের বিবৃতিতে মুসলিম উম্মাহকে পিছিয়ে রাখা ও দুর্বল করার জন্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর ষড়যন্ত্র চিহ্নিত করা এবং তাদের মোকাবেলায় মুসলিম উম্মাহর সতর্কতা ও জাগরণের আহ্বান জানান।
এ ছাড়া, বিবৃতিতে ইরাক ও সিরিয়ায় সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সেদেশের জনগণের বিজয়কেও শুভেচ্ছা জানিয়ে ওই দেশ দুটিতে দ্রুত শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসার ব্যাপারেও আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। তাঁরা ইয়েমেনে গণহত্যা বন্ধেরও দাবি জানিয়েছেন।

আয়াতুল্লাহ শাহরুখির ইন্তিকালে সর্বোচ্চ নেতার শোকবার্তা
গত ২৯ নভেম্বর ২০১৬ বিশিষ্ট আলেম, ইসলামি ইরানের সর্বোচ্চ নেতার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের প্রতিনিধি আয়াতুল্লাহ শাহরুখি খোররাম আবাদির ইন্তিকালে ওই শোকবার্তায় সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন ইসলামি বিপ্লবের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আল-উজমা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী। সর্বোচ্চ নেতার শোকবার্তা এখানে তুলে ধরা হলো:
পরম করুণাময় আল্লাহর নামে
বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্য এবং প্রয়াত ইমামের (খোমেইনীর) ছাত্র ও কয়েকটি দেশে তাঁর প্রতিনিধি, সক্রিয় আলেম মরহুম ও মাগফুর (ক্ষমাপ্রাপ্ত) হুজ্জাতুল ইসলাম আলহাজ সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ নাকি শাহরুখিরÑআল্লাহর রহমত তাঁর ওপর বর্ষিত হোকÑইন্তিকালে তাঁর পরিবার ও শুভাকাক্সিক্ষ এবং খোররাম আবাদের বিপ্লবী জনতার প্রতি সমবেদনা জানাই। মহান আল্লাহর দরবারে তাঁর জন্য মাগফিরাত ও রহমত কামনা করি। মহান এ সাইয়্যেদ তাঁর নি®পাপ [ইমামগণ] পূর্বপুরুষদের সাথে হাশরে উত্তোলিত হবেন, ইনশা আল্লাহ।
সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী
৯ আযার, ১৩৯৫
(২৯ নভেম্বর, ২০১৬)
উল্লেখ্য, ইসলামি ইরানের সর্বোচ্চ নেতার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের প্রতিনিধি, ইসলামি ইরানের বিশেষজ্ঞ পরিষদ ও মজলিশে শুরায়ে ইসলামির সাবেক সদস্য আহলে বাইত (আ.) বিশ্বসংস্থার সদস্য আয়াতুল্লাহ শাহরুখি খোররাম আবাদি গত ২৭ নভেম্বর ইরানের কোম শহরের একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

আয়াতুল্লাহ ওয়ায়েযযাদেহ খোরাসানীর ইন্তেকাল
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিশিষ্ট আলেম ও গবেষক হযরত আয়াতুল্লাহ ওয়ায়েযযাদেহ খোরাসানী গত ১৮ ডিসেম্বর ২০১৬ ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন)। তিনি মুসলিম উম্মাহর মাঝে ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠায় আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। মুসলিম মাযহাবসমূহের মাঝে ঐক্য ও সংহতি সৃষ্টিকারী বিশ্ব সংস্থার সর্ব প্রথম মহাসচিব ছিলেন তিনি।
হযরত আয়াতুল্লাহ ওয়ায়েযযাদেহ খোরাসানী ১৩০৪ ফারসি সনে ইরানের মাশহাদ নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইরাকের নাজাফ ও ইরানের কোম নগরস্থ ধর্মতত্ত্বের সর্বোচ্চ শিক্ষালয় থেকে ধর্মতত্ত্বের ওপর সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেন।
তিনি ইরানের ইসলামি বিপ্লবের স্থপতি ইমাম খোমেইনী, হযরত আয়াতুল্লাহ মুহাম্মাদ হুসাইন বুরুজের্দী এবং হযরত আয়াতুল্লাহ মুহাম্মাদ হোসাইন তাবাতাবায়ির সান্নিধ্যে ধর্মতত্ত্বের ওপর গভীর গবেষণা করেন।
মরহুম আয়াতুল্লাহ ওয়ায়েযযাদেহ খোরাসানীকে ১৯ ডিসেম্বর ইরানের পবিত্র নগরী মাশহাদে আহলে বাইত (আ.)-এর অষ্টম নক্ষত্র ইমাম রেযা (আ.)-এর পবিত্র মাযারের সান্নিধ্যে দাফন করা হয়।

ইরান পরমাণু সমঝোতা পুরোপুরি মেনে চলছে: ইউকিয়া আমানো
তেহরানের শান্তিপূর্ণ পরমাণু ইস্যুতে গত বছর ছয় জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে সই হওয়া পরমাণু সমঝোতার সব ধারা ইরান পুরোপুরি মেনে চলছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা বা আইএইএ’র প্রধান ইউকিয়া আমানো।
গত ১৮ ডিসেম্বর ২০১৬ তেহরানে ইরানের পরমাণু শক্তি সংস্থার প্রধান আলী আকবর সালেহির সঙ্গে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এ মন্তব্য করেন তিনি। আইএইএ’র প্রধান আমানো বলেন, ইরান পরমাণু সমঝোতার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।
পরমাণু সমঝোতার কারিগরি দিক পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে জাতিসংঘের এ সংস্থাটি। গত জানুয়ারি থেকে পরমাণু সমঝোতা পত্র বা জেসিপিওএ বাস্তবায়ন শুরু হওয়ার পর থেকে এ সংস্থাটি বার বার বলে আসছে যে, ইরান এ চুক্তি পুরোপুরি মেনে চলছে। ইরানের পরমাণু সংস্থার প্রধান সালেহির আমন্ত্রণে একদিনের সফরে তেহরানে আসা আমানো আরো বলেন, পরমাণু সমঝোতা ধারা যেভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে তাতে আমরা সন্তুষ্ট এবং এ ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আমরা আশা করছি। বৈঠকে হেভি ওয়াটার, ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ, ইরানে ইউরোনিয়ামের মজুদের পরিমাণ, পরমাণু শক্তির গবেষণা এবং উন্নয়নের ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে বলে জানান সালেহি।

নিষেধাজ্ঞা নবায়ন : ৬ জাতিগোষ্ঠীর বৈঠক ডাকার আহ্বান জানালো ইরান
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধে আরো ১০ বছরের জন্য মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নবায়নের সব ব্যবস্থা পাকা করার পর তেহরান ও ছয় জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে নতুন করে বৈঠকের আহ্বান জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মাদ জাওয়াদ জারিফ। গত ১৮ ডিসেম্বর ২০১৬ ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক প্রধান ফেডেরিকা মোগেরিনির কাছে লেখা এক চিঠিতে তিনি এ আহ্বান জানান।
জারিফ বলেছেন, ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা নবায়নের উদ্যোগ নিয়ে আমেরিকা পরমাণু সমঝোতা লঙ্ঘন করেছে এবং বিষয়টি নিয়ে যৌথ কমিশনের বৈঠকে বসা দরকার।
গত ১ ডিসেম্বর মার্কিন সিনেট ৯৯-০ ভোটে ইরানের বিরুদ্ধে আরো ১০ বছরের জন্য নিষেধাজ্ঞা নবায়ন করতে একটি বিল পাস করেছে এবং প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যদিও তাতে সই করেন নি, তবে নাকচও করেন নি। ফলে বিলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে আইনে পরিণত হবে।
এ প্রসঙ্গে জাওয়াদ জারিফ বলেন, সব পক্ষকে পরমাণু সমঝোতা বাস্তবায়নের বিষয়ে তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হবে। পরমাণু সমঝোতার বিষয়ে আমেরিকা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এখন সে প্রতিশ্রুতি পালন করছে না বলে তিনি মন্তব্য করেন। এ কারণে নতুন করে ইরান ও ছয় জাতিগোষ্ঠীর যৌথ কমিশনের বৈঠক ডাকার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে তিনি মোগেরিনির প্রতি আহ্বান জানান। মোগেরিনি হচ্ছেন ছয় জাতিগোষ্ঠীর পক্ষের প্রধান আলোচক।

তুরস্কে রুশ রাষ্ট্রদূত হত্যাকা-ের তীব্র নিন্দা জানালো ইরান
তুরস্কে নিযুক্ত রুশ রাষ্ট্রদূতের হত্যাকা-কে ‘বর্বরোচিত’ বলে অভিহিত করে এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ইরান। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বাহরাম কাসেমি গত ২০ ডিসেম্বর ২০১৬ বলেন, এই অপরাধী পদক্ষেপ প্রমাণ করে উগ্র তাকফিরি জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো কোনো ধরনের আন্তর্জাতিক আইন বা রীতিনীতিকে তোয়াক্কা করে না।
সোমবার শেষ বেলায় তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় একটি চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেয়ার সময় রুশ রাষ্ট্রদূত আন্দ্রে কার্লভকে প্রকাশ্যে উপস্থিত দর্শকদের সামনে গুলি করে হত্যা করে এক যুবক। পরে ঘাতক ব্যক্তি নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়।
এ স¤পর্কে কাসেমি আরো বলেন, জঙ্গিরা এ ধরনের নির্মম হত্যাকা- চালিয়ে বিভিন্ন দেশের মধ্যে সংঘাত বাধিয়ে দেয় এবং অস্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করে। তিনি সন্ত্রাসবাদকে বর্তমান শতাব্দীর সবচেয়ে ‘অশুভ ও জঘন্য’ বিষয় হিসেবে অভিহিত করে বলেন, বিশ্বের সব দেশকে ঐক্যবদ্ধ ও সমন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমে জঙ্গিবাদ নির্মূল করতে হবে এবং এখানে দ্বৈত নীতি গ্রহণ করা যাবে না।
সন্ত্রাসবাদ সমূলে বিনাশ না হওয়া পর্যন্ত ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান মধ্যপ্রাচ্যসহ সারাবিশ্বের সব দেশের পাশে থাকবে বলেও জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বাহরাম কাসেমি।

সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য সকল ধর্মের প্রতি ইরানের আহ্বান
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সরকার সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রামের জন্য সকল ধর্মের অনুসারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। ইরান সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জনাব বাহ্রাম ক্বাসেমী কায়রোর খ্রিস্টান গির্জায় সংঘটিত সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার বিরুদ্ধে তাঁর সরকারের পক্ষ থেকে তীব্র নিন্দা ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ঐক্যের এ আহ্বান জানান।
উল্লেখ্য, মিসরের সরকারি টেলিভিশন প্রদত্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, কায়রোর কপটিক খ্রিস্টানদের প্রধান ক্যাথেড্রালের নিকটস্থ গির্জার অভ্যন্তরে পরিচালিত সন্ত্রাসী বোমা হামলার ফলে সেখানে প্রার্থনারত নিরীহ খ্রিস্টানদের মধ্য থেকে ২৫ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন।
জনাব বাহ্রাম ক্বাসেমী তাঁর এ বিবৃতিতে বলেন, ধর্মীয় কেন্দ্র ও পবিত্র স্থানসমূহকে হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করার ন্যায় জঘন্য কাজ সমস্ত ধর্মেরই শিক্ষার বিরোধী। এ পরিপ্রেক্ষিতে তিনি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের লক্ষ্যে সকল ধর্মের অনুসারিগণের ও সকল দেশের প্রতি ঐক্যবদ্ধ হবার জন্য আহ্বান জানান।
উল্লেখ্য, মিসরীয় সরকারি টেলিভিশনের প্রতিবেদনে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে জানানো হয় যে, সেন্ট্ পিটার্স চার্চে পরিচালিত উক্ত সন্ত্রাসী হামলায় আরো ৪৯ জন লোক আহত হয়েছেন।

পর্যটকদের জন্য ইরান মধ্যপ্রাচ্যে সর্বাধিক নিরাপদ দেশ : ডব্লিউসিও
বিশ্ব নগর সংস্থা (ডব্লিউসিও)-এর প্রেসিডেন্ট ইয়ং হুন্কক্ বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে ইরান হচ্ছে পর্যটকদের জন্য সর্বাধিক নিরাপদ দেশ। তিনি গত পয়লা নভেম্বর (২০১৬) ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সেমনান শহরের সিটি কর্পোরেশন মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণে এ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, স্বীয় শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী, জনগণ ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতির কারণে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান মধ্যপ্রাচ্যে বিদেশি পর্যটকদের জন্য সর্বাধিক নিরাপদ দেশে পরিণত হয়েছে।
মি. হুন্কক্ আরো বলেন, আগামী ২০১৯ সালে সিল্ক রোডে অবস্থিত নগরী সমূহের মেয়রদের সম্মেলনের ভেন্যু নির্বাচনের জন্য যেসব শহরের নাম প্রস্তাব করা হয়েছে সেমনান নগরী সেসবের অন্যতম।

পঞ্চম বার্তা সংস্থা বিশ্ব সম্মেলনে ইরানের অংশগ্রহণ
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান আযারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠিত ৫ম বার্তা সংস্থা বিশ্ব সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছে।
গত ১৬ নভেম্বর (২০১৬) এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। একই দিনে বাকুতে এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বার্তা সংস্থাসমূহের সংস্থা (ওআনা)-এর ১৬তম সাধারণ অধিবেশনও অনুষ্ঠিত হয়। আযারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইল্হাম্ ‘আলীয়েভ্ উভয় কর্মসূচির উদ্বোধন করেন।
উক্ত দুই কর্মসূচির পাশাপাশি একই দিনে বাকুতে কাউন্সিল অব্ সিআইএস্ নিউজ এজেন্সিজ-এর প্রধানদের ২২তম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের পক্ষ থেকে মেহ্র্ নিউজ এজেন্সী (এমএনএ) ও ইসলামিক রিপাবলিক নিউজ এজেন্সী (র্ইনা) এ আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে।
এবার অনুষ্ঠিত ৫ম বার্তা সংস্থা বিশ্ব সম্মেলনের স্লোগান ছিল ‘বার্তা সংস্থাগুলোর জন্য নতুন চ্যালেঞ্জসমূহ’। এ সম্মেলনের বিভিন্ন অধিবেশনের শিরোনাম সমূহের মধ্যে ছিল ‘সংবাদ গ্রহণের ভবিষ্যৎ’, ‘বার্তা সংস্থা : নতুন প্রযুক্তি ও সামাজিক মাধ্যমের জন্য চ্যালেঞ্জ ও সুযোগসমূহ’, ‘বার্তা সংস্থার সংস্কার’, ‘মাল্টি-মিডিয়ার জন্য সাংবাদিক প্রশিক্ষণ’, ‘সাংবাদিকদের মিশনের সুরক্ষা, স্বাধীনতা, সংবাদ সংগ্রহের সুযোগ, নিরাপত্তা ও সংঘাতের ক্ষেত্র সমূহ’।
উক্ত সম্মেলনে এ ছাড়াও এমন কতক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হয় সাংবাদিকগণ যেগুলোর মুখোমুখী হয়ে থাকেন। এছাড়াও এর মধ্যে রয়েছে বার্তা সংস্থাসমূহ ও বিভিন্ন সামাজিক মিডিয়া প্লাটফর্মের মধ্যকার পারস্পরিক সহযোগিতার ধরনসমূহ।

স্লোভেনিয়ার মহিলা চ্যারিটি বাজারে ইরানের অংশগ্রহণ
সম্প্রতি ইউরোপীয় দেশ স্লোভেনিয়ায় অনুষ্ঠিত ২৩তম সিলা অ্যানুয়্যাল্ ইন্টারন্যাশন্যাল চ্যারিটি বাজারে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান গুরুত্বপূর্ণ উপস্থিতি সহকারে অংশগ্রহণ করে। গত ৪ ডিসেম্বর (২০১৬) এ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।
স্লোভেনিয়ান ইন্টারন্যাশন্যাল লেইডিজ্ অ্যাসোসিয়েশন (সিলা) কর্তৃক আয়োজিত ও সেখানকার গ্র্যান্ড্ হোটেল ইউনিয়নে অনুষ্ঠিত এ প্রদর্শনীতে ইরান ছাড়াও বিশ্বের আরো বারোটি দেশ তাদের পণ্য পরিবেশন সহ অংশগ্রহণ করে।
স্লোভেনিয়াস্থ বিদেশি সমিতি ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান সমূহের প্রতিনিধিগণ এবং সেখানে অবস্থিত বিশ্বের ৩২টি দেশের দূতাবাস ও কূটনৈতিক মিশনের বেশ কিছু সংখ্যক প্রতিনিধি এ প্রদর্শনী পরিদর্শন করেন।
ইরানের সংস্কৃতি, ইতিহাস, সভ্যতা ও রীতিনীতি তুলে ধরার লক্ষ্যে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান এ প্রদর্শনীতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে এবং এতে ইরানের বেশ কিছু ব্যতিক্রমধর্মী সাংস্কৃতিক পণ্য ও হস্তশিল্প উপস্থাপন করে। এগুলো দর্শকদের কাছ থেকে আশাব্যঞ্জক প্রশংসা লাভ করে।
এ প্রদর্শনীতে স্বাগতিক দেশ স্লোভেনিয়ার পাশাপাশি ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ছাড়াও আরো যেসব দেশের স্টল ছিল সেসব দেশ হচ্ছে : পাকিস্তান, হাঙ্গেরী, পোল্যান্ড্, গ্রীস, নেদারল্যান্ড্স্, রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, কেনিয়া ও ইতালি। প্রতিটি দেশের স্টলেই স্ব স্ব দেশের সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ পণ্য উপস্থাপন করা হয়।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান এবার দ্বিতীয় বারের মতো সিলা চ্যারিটি বাজারে অংশগ্রহণ করলো।
উল্লেখ্য, সিলা চ্যারিটি বাজার থেকে অর্জিত আয় স্থানীয় পাঁচটি চ্যারিটি অর্গানাইজেশনকে দান করা হয়। এ চ্যারিটি অর্গানাইজেশনগুলো সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুদের সাহায্য করে থাকে। সিলা ও আইডব্লিউসিএল্ বাজার বিগত দুই দশকে স্লোভেনিয়ার বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তিকে দশ লাখ ইউরোরও বেশি পরিমাণ অর্থ দান করেছে।

ইরান ও জাপানের মধ্যে প্রেট্রো-রসায়ন চুক্তি স্বাক্ষরিত
সম্প্রতি ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ও জাপানের মধ্যে বিভিন্ন পেট্রো-রসায়ন প্রকল্পে পারস্পরিক সহযোগিতার লক্ষ্যে৩২ কোটি ডলার ব্যয়সাপেক্ষ একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ইরানের পার্সিয়ান্ গাল্ফ্ পেট্রোকেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ্ কোম্পানি (পিজিপিআইসি) ও জাপানের জেনারেল ট্র্রেডিং ফার্ম আইটিওসিএইচ্ইউ-এর দু’জন শীর্ষ কর্মকর্তা বিভিন্ন পেট্রো-রসায়ন প্রকল্পে পারস্পরিক সহযোগিতার এ চুক্তিতে নিজ নিজ দেশের পক্ষ থেকে স্বাক্ষর করেন।
চুক্তি সম্পাদন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আইটিওসিএইচ্ইউ-এর প্রতিনিধি ইরান ও জাপানের মধ্যকার পারস্পরিক সহযোগিতার প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ইরান প্রেট্রো-রসায়ন সামগ্রীর জন্য একটি অত্যন্ত শক্তিশালী বাজার। তিনি আরো উল্লেখ করেন যে, এ ধরনের বিভিন্ন সামগ্রীÑউদাহরণস্বরূপ, পলিথাইলিনÑবাজারজাতকরণের জন্য ইরান ও জাপানের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সরকারের প্রেট্রো-রসায়ন বিভাগের কর্মকর্তাগণ জানান যে, প্রেট্রো-রসায়ন ক্ষেত্রে ইসলামি ইরানের সাথে যে কেবল জাপানের সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তা নয়, বরং জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি, নের্দাল্যান্ড্স্, দক্ষিণ কোরিয়া, এমনকি আমেরিকার বিভিন্ন কোম্পানি এবং জাপানেরও আরো অনেক কোম্পানি ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিভিন্ন পেট্রো-রসায়ন প্রকল্পে অংশগ্রহণের জন্য স্বীয় প্রস্তুতির আভাস দিয়েছে।

ইরান ও আর্মেনিয়ার বিদ্যুৎ বিনিময় সহযোগিতা বৃদ্ধির প্রস্তুতি
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ও প্রতিবেশী দেশ আর্মেনিয়া বিদ্যুৎ বিনিময়ের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছে। ইরান সরকারের জ্বালানিবিষয়ক মন্ত্রী জনাব হামীদ চিত্চিয়ান্ বলেন, দুই দেশ পারস্পরিক বিদ্যুৎ বিনিময়ের সক্ষমতা চার গুণ বৃদ্ধি করর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।
জনাব হামীদ চিত্চিয়ান্ ইরান-আর্মেনিয়া যৌথ কমিশনের ১৪তম বৈঠকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভাষণ প্রদান করেন এবং এরপর সাংবাদিকদের কাছে এ তথ্য প্রকাশ করেন। এ অনুষ্ঠানে দুই দেশের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্মকর্তা ছাড়াও আর্মেনিয়ার জ্বালানি অবকাঠামো ও প্রাকৃতিক সম্পদবিষয়ক মন্ত্রী আশোত্ মানুকিয়ান্ অংশগ্রহণ করেন।
জনাব হামীদ চিত্চিয়ান্ জানান যে, ইরান ও আর্মেনিয়া পারস্পরিক বিদ্যুৎ বিনিময়ের পরিমাণ বর্তমান তিনশ’ মেগাওয়াট থেকে বৃদ্ধি করে ১২০০ মেগাওয়াটে উন্নীত করবে। তিনি আরো জানান, উভয় পক্ষ অদূর ভবিষ্যতে গ্যাস স্থানান্তর সম্পর্কেও আলোচনা করেছে।
জবান হামীদ চিত্চিয়ান্ উক্ত বৈঠকে আর্মেনিয়ার সাথে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির ব্যাপারে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের আগ্রহ ও প্রস্তুতির কথা ঘোষণা করেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, উভয় দেশেরই পারস্পরিক সর্বাত্মক সহযোগিতা সম্প্রসারণের জন্য প্রয়োজনীয় সক্ষমতা রয়েছে।
১৫. ইরানি চলচ্চিত্র ‘যেন্দেগী ভা ইয়াক্ রুয্’ টাউস্ এক্রান্স্-এর শ্রেষ্ঠ পুরস্কার লাভ করেছে
সম্প্রতি জেনেভায় অনুষ্ঠিত ২২তম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব টাউস্ এক্রান্স্-এ ইরানি চলচ্চিত্র ‘যেন্দেগী ভা ইয়াক্ রুয্’ (জীবন ও এক দিন) শ্রেষ্ঠ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। সাঈদ্ রোস্তামী পরিচালিত এ চলচ্চিত্রটি উক্ত উৎসবে ৩০ হাজার দর্শকের সামনে প্রদর্শিত হয়।
উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে অনুষ্ঠিত ফাজ্র্ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ফ্রান্স, ডেন্মার্ক, আর্জেন্টিনা ও হংকং-এর বিভিন্ন চলচ্চিত্রের সাথে প্রতিযোগিতায় যেন্দেগী ভা ইয়াক্ রুয্’ চলচ্চিত্র বেশ কয়েকটি পুরস্কার অর্জন করে। এ চলচ্চিত্রটির গল্পে দেখানো হয় যে, একটি পরিবার একটি বিবাহ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে, কিন্তু কতগুলো ঘটনার ফলে তাদের জন্য পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে ও উক্ত অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ কঠিন হয়ে পড়ে।
উল্লেখ্য, জেনেভা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব টাউস্ এক্রান্স্ হচ্ছে এমন একটি উৎসব যেখানে চলচ্চিত্র জগতের সকল প্রজন্মের ও পর্যায়ের নির্মাতাদের মিলন ঘটে এবং এখানে উদ্যাপনী ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার চেতনা গড়ে তোলা হয়। এতে চলচ্চিত্রসমূহ পাঁচটি প্রতিযোগিতামূলক বিভাগে অংশগ্রহণ করেÑ যার মধ্য দিয়ে নতুন নতুন প্রতিভার উদ্ঘাটন করা হয় এবং এর ফলে নতুন চলচ্চিত্র নির্মাতাগণ অগ্রগতির অধিকারী হন।

কেরালার আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ১৩টি ইরানি চলচ্চিত্র প্রদর্শন
ভারতের কেরালায় অনুষ্ঠিত ২১তম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে (আইএফএফকে) ১৩টি ইরানি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। গত ৯ থেকে ১৬ ডিসেম্বর (২০১৬) এ চলচ্চিত্র উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
ভারত সরকারের আইন, সংস্কৃতি ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী, কতক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং বহু ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পীর পাশাপাশি ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত চলচ্চিত্র শিল্পীদের উপস্থিতিতে ভারতের কেরালা রাজ্য চলচ্চিত্র অ্যাকাডেমিতে এ উৎসবের উদ্বোধন করা হয়।
উৎসবের প্রথম দিনে এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ইরানি চলচ্চিত্র পরিচালক নাভীদ মাহ্মূদী পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘রাফ্তান্’ (যাওয়া) প্রদর্শিত হয়। এ চলচ্চিত্রে বিদেশে গমনের পর এক ইরানি দম্পতির পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার ঘটনা চিত্রিত করা হয়েছে।
এছাড়াও এ চলচ্চিত্র উৎসবে ‘বৈশ্বিক চলচ্চিত্র’ বিভাগে ইরানি পরিচালক রেযা মীর কারীমী পরিচালিত ‘দোর্খ্তা’ (কন্যা), নাভীদ দানেশ্ পরিচালিত ‘ডুয়েট্’, ইবরাহীম ইবরাহীমীয়ান পরিচালিত ‘অদাত্ নেমিকোনিম্’ (আমরা অভ্যস্ত হব না), বেহ্নাম্ বেহ্যাদ্ পরিচালিত ‘ভরুনেগী’ (উল্টে যাওয়া), র্মাজান্ আশ্রাফীযাদে পরিচালিত ‘অব্জী’ (আপু), আসর্গা র্ফাহাদ্ পরিচালিত ‘ফোরুশান্দে’ (বিক্রেতা) ও বাব্রাক্ আনোয়ার পরিচালিত ‘যিরে সইয়ে’ (ছায়ার নিচে) প্রদর্শিত হয়।
এ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ইরানি চলচ্চিত্রাভিনেত্রী বরন কাওছারী জুরি বোর্ডের অন্যতম সদস্য হিসেবে অংশগ্রহণ করেন।

বাগদাদের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ইরানি চলচ্চিত্র ‘বডিগার্ড’-এর প্রথম পুরস্কার লাভ
সম্প্রতি বাগদাদে অনুষ্ঠিত ৮ম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ইরানি চলচ্চিত্র পরিচালক ইবরাহীম হাতামীকিয়া পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘বডিগার্ড’ প্রথম পুরস্কার লাভ করেছে।
গত ৩ সেপ্টেম্বর (২০১৬) অনুষ্ঠিত এ চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগতিক দেশ ইরাকের বিভিন্ন সরকারি দায়িত্বশীল ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ববর্গ ছাড়াও ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড্স্ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাগদাদস্থ দূতাবাসের প্রতিনিধিবর্গের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বহু সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তা ও সাংস্কৃতিক সংস্থা অংশগ্রহণ করেন।
উক্ত চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণকারী ইরাকি ও বিদেশি চলচ্চিত্র সমূহের মান বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক জুরির বিচারে ইরানি চলচ্চিত্র পরিচালক ইবরাহীম হাতামীকিয়া পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘বডিগার্ড’ পূর্ণ দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতা বিভাগে অংশগ্রহণকারী চলচ্চিত্র সমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে বিবেচিত হয় এবং প্রথম পুরস্কার লাভ করে।
উল্লেখ্য, ‘বডিগার্ড’ চলচ্চিত্রটি নির্মিত হবার পর ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে অনুষ্ঠিত ৩৪তম আন্তর্জাতিক ফাজ্র্ চলচ্চিত্র উৎসবে প্রথম বারের মতো প্রদর্শন করা হয়। এ চলচ্চিত্রে এমন একজন মধ্য বয়স্ক লোকের কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে যে ব্যক্তি উচ্চপদস্থ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ববর্গের দেহরক্ষী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকে। গল্পে দেখানো হয় যে, একজন আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী বিস্ফোরকপূর্ণ একটি জ্যাকেট পরিধান করে দেশের ভাইস প্রেসিডেন্টের দিকে এগিয়ে গেলে সে ঝামেলায় পড়ে যায়।
উক্ত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন পারভীয পারাস্তুরী, বাবাক্ হামীদীয়ান, মেরিলা যারেঈ, মাহ্মূদ আযীয, আমীর অগ¦ায়ী, র্ফাহাদ ক্বায়েমীয়ান ও কামরান নাজাফীযাদে।
উল্লেখ্য, বাগদাদ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব সর্ব প্রথম ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হয়। ইরাকে নিবন্ধিত স্বাধীন বেসরকারি সংস্থা ইরাকি অ্যাসোসিয়েশন র্ফ কালচার অ্যান্ড্ সিনেমা ডেভেলপমেন্ট্ প্রতি বছর এ উৎসবের আয়োজন করে থাকে।

বেলজিয়ামের থ্রি-ডি স্টেরিও মিডিয়া ফেস্টিভালে ইরানি চলচ্চিত্র ‘যান্জল্ র্দা আরূসী’ প্রদর্শন
সম্প্রতি বেলজিয়ামে অনুষ্ঠিত অষ্টম থ্রি-ডি স্টেরিও মিডিয়া ফেস্টিভালে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘যান্জল্ র্দা আরূসী’ (বিবাহ অনুষ্ঠানে হাঙ্গামা) প্রদর্শিত হয়। গত ১২ থেকে ১৫ ডিসেম্বর (২০১৭) এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান এই দ্বিতীয় বারের মতো বেলজিয়ামে অনুষ্ঠিত থ্রি-ডি স্টেরিও মিডিয়া ফেস্টিভালের প্রতিযোগিতা বিভাগে অংশগ্রহণ করল।
সাইয়্যেদ রেযা খাতীবী পরিচালিত ও ফারাবী সিনেম্যাটিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক নির্মিত ‘যান্জল্ র্দা আরূসী’ চলচ্চিত্রের গল্পে দেখানো হয় যে, একটি বিবাহ অনুষ্ঠানে শিশু-কিশোরদেরকে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হচ্ছে না, বরং তাদেরকে বাগানের শেষ প্রান্তে অবস্থিত একটি কুটিরে পাঠানো হয়। কিন্তু এ বিবাহ অনুষ্ঠান চলাকালে উক্ত শিশু-কিশোররা বুঝতে পারে যে, উক্ত বিবাহ অনুষ্ঠানের আয়োজকরা আসলে মাদক দ্রব্য চোরাচালানীর সাথে জড়িত। তখন তারা উক্ত বিবাহ অনুষ্ঠান রূপ নাটক বানচাল করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
উল্লেখ্য, বিশ্বের মাত্র অল্প কয়েকটি জায়গায় থ্রি-ডি স্টেরিও মিডিয়া স্বীকৃতির অধিকারীÑ যেসব জায়গায় থ্রি-ডি বিশেষজ্ঞগণ বৈঠকে মিলিত হবার, মতামত বিনিময়ের, প্রকল্প গ্রহণের ও চুক্তি সম্পাদনের অনুমতি পেয়েছেন।
বেলজিয়ামে অনুষ্ঠিত অষ্টম থ্রি-ডি স্টেরিও মিডিয়া ফেস্টিভাল ছিল বিশ্বব্যাপী থ্রি-ডি গবেষণা ও চর্চা এগিয়ে নেয়ার এবং এ ব্যাপারে থ্রি-ডি গোষ্ঠীকে সহায়তা করার লক্ষ্যে এ পর্যন্ত সর্বোত্তম ও সর্বাধিক পূর্ণাঙ্গ উৎসবÑ যাতে দৃঢ়তা সহকারে যে কোনো পরিস্থিতিতে এগিয়ে যাবার চেতনা প্রতিফলিত হয়।

ইরানি ফটোগ্রাফি শিল্পীর সেরা প্যারালিম্পিক ফটোগ্রাফি পুরস্কার লাভ
ইরানি ফটোগ্রাফি শিল্পী আবুল্ ফায্ল্ আমানুল্লাহ্ এশিয়ান্ প্যারালিম্পিক কমিটি (এপিসি) কর্তৃক ‘সর্বোত্তম ফটোগ্রাফি’ বিভাগের পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন। গত পয়লা ডিসেম্বর (২০১৬) থাইল্যা-ের রাজধানী ব্যাঙ্ককে অনুষ্ঠিত এপিসি-র অনুষ্ঠানে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়।
এছাড়াও এ অনুষ্ঠানে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সিটিং ভলিবল্ ন্যাশন্যাল স্কোয়াড্ বেস্ট্ এশিয়ান্ টীম্ র্পাফর্ম্যান্স্ পুরস্কার লাভ করে।
উল্লেখ্য, জনাব আবুল্ ফায্ল্ আমানুল্লাহ্ হচ্ছেন এ পর্যন্ত উক্ত পুরস্কার লাভকারী প্রথম ইরানি ফটোগ্রাফি শিল্পী। তিনি তাঁর তোলা যে ফটোর জন্য এ পুরস্কার লাভ করেন তাতে রিও-তে অনুষ্ঠিত ‘প্যারালিম্পিক ফুটবল ৫-এ-সাইড্Ñ ২০১৬’র ইরান-ব্রাজিল ম্যাচের একটি অনবদ্য দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করেছেন। তাঁর তোলা এ ফটোগ্রাফটি উক্ত পুরস্কার লাভের জন্য এশিয়ান্ প্যারালিম্পিক কমিটি (এপিসি)-র অপর ৪৪ সদস্যের ফটোর সাথে প্রতিযোগিতার জন্য উপস্থাপন করা হয়েছিল।
উল্লেখ্য, ‘দ্য এশিয়ান্ প্যারালিম্পিক্ অর্র্ডা’ হচ্ছে এশিয়ান্ প্যারালিম্পিক কমিটি কর্তৃক দেয় সর্বোচ্চ পুরস্কারÑ যা এমন এক ব্যক্তিকে বা ব্যক্তিবর্গকে প্রদান করা হয় যিনি বা যাঁরা স্বীয় কাজের মাধ্যমে এপিসি-র আদর্শকে সর্বোত্তমভাবে তুলে ধরেন বা ক্রীড়াক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেন অথবা এপিসি-র লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের পথে অসাধারণ ও সুদীর্ঘকালীন খেদমত আঞ্জাম দেন।

ইরান ন্যাশন্যাল বীচ্ সর্কা টীমের বিশ্বের মধ্যে ৫ম স্থান লাভ
বীচ্ সর্কা ওয়ার্ল্ডওয়াইড্ (বিএস্ডব্লিউডব্লিউ) ও ফেডারেশন অব্ ইন্টারন্যাশন্যাল ফুটবল্ অ্যাসোসিয়েশনস (ফিফা)-এর পক্ষ থেকে নতুন যৌথ র‌্যাঙ্কিং-এ ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের ন্যাশন্যাল বীচ্ সর্কা টীমকে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় অসাধারণ সাফল্যের কারণে বিশ্বের মধ্যে ৫ম স্থান প্রদান করা হয়েছে।
সংযুক্ত আরব আমীরাত (ইউইএ)-এর দুবাই-এ অনুষ্ঠিত বীচ সর্কা ইন্টারন্যাশন্যাল্ কাপ প্রতিযোগিতায় সুইজারল্যান্ড, তাহিতি, জাপান, স্পেন ও ওমানকে পিছনে ফেলে ইরানি টীম্ ১৭৮৫ পয়েন্ট লাভ করে পঞ্চম স্থান অধিকার করে। এ তালিকার শীর্ষে রয়েছে পর্তুগীজ টীমÑ যে মোট ৩৫০০ পয়েন্ট অর্জন করেছে। এর পরে রাশিয়ান, ব্রাজিলিয়ান ও ইতালিয়ান টীম যথাক্রমে ৩২০৪, ২৫২৫ ও ২১৪৩ পয়েন্ট লাভ করে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ স্থান অধিকার করে।
সুইজারল্যান্ড, তাহিতি, জাপান, স্পেন ও ওমান যথাক্রমে ১৬৯১, ১৬৫৯, ১২৬৭, ১১৫৪ ও ১০৩৭ পয়েন্ট লাভ করে বিশ্বের মধ্যে ষষ্ঠ থেকে দশম স্থান লাভ করে।

এইউটি কাপ ২০১৬-তে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা
তেহরানের আমীর কাবীর প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (এইউটি) কর্তৃক আয়োজিত ৬ষ্ঠ আন্তর্জাতিক রোবোটিক কাপ্ টুর্নামেন্ট (এইউটি কাপ ২০১৬) এবং প্রথম হিউম্যানয়েড্ অলিম্পিক প্রতিযোগিতায় পুরস্কার বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেছে।
গত ১ থেকে ৫ ডিসেম্বর (২০১৬) এ প্রতিযোগিতা দু’টি অনুষ্ঠিত হয় এবং ৬ ডিসেম্বর প্রতিযোগিতার ফলাফল ঘোষণা করা হয়। এ প্রতিযোগিতা দু’টিতে ৮০টি ইরানি ও ৬৫টি বিদেশি টীম অংশগ্রহগণ করে। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বাইরের যেসব দেশের টীম এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য উপযুক্ত বিবেচিত হয় সে দেশগুলো হচ্ছে কানাডা, জার্মানি, আফগানিস্তান, লেবানন, ইরাক ও সিরিয়া। ইরানি ও বিদেশি মিলিয়ে এ ১৪৫টি টীম্ ৮টি প্রধান ইভেন্টে ও জুনিয়র লীগে অংশগ্রহণের সুযোগ লাভ করে; জুনিয়র লীগের ইভেন্ট্গুলোর মধ্যে ছিল এম্এডব্লিউ রোবোট, ট্রান্স্পোর্র্টা, ডিমাইর্না রোবোট্, হিউম্যানয়েড্ রোবোট্ অলিম্পিক্স্ ও ‘ওয়ার্ক’।
এ প্রতিযোগিতায় অ্যাড্ভান্স্ড্ ট্রান্স্পোর্র্টা লীগে স্বাধীন টীম্ আল্ট্রা বট্, ইরানের ভারামীনের ইসলামি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও ইরানের ইসলাম্শাহ্র্স্থ ইসলামি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের র্আমেনা ট্রান্স্পোর্র্টা যথাক্রমে প্রথম থেকে তৃতীয় স্থান লাভ করে।
‘ট্রান্স্পোর্র্টা-এ নন্-ইরানীয়ান্ জুনিয়র লীগ্’-এ যেসব টীম্ প্রথম থেকে তৃতীয় স্থান লাভ করে সেগুলো হচ্ছে যথাক্রমে র্টবো (ইরাক), অরিয়ানা রোবোট্ (ইরাক) ও র্আমেনা জুনিয়র।
এতে এমএভি রোবোট্স্ প্রতিযোগিতায় নেইশাহ্র্-এর ইসলামি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের খাইয়াম্ টীম্, ইসলামশাহ্র্-এর ইসলামি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিআইএমএজি ও খোমেইন্শাহ্র্-এর ইসলামি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের র্পাসিস্ যথাক্রমে প্রথম থেকে তৃতীয় স্থান লাভ করে।
উল্লেখ্য, এই প্রথম বারের মতো হিউম্যানরয়েড্ অলিম্পিক্স্ বিভিন্ন লীগে অনুষ্ঠিত হয়; এ সব লীগের মধ্যে ছিল : ফুটবল, ভারোত্তোলন, বাস্কেট বল, শুটিং, জিম্ন্যাস্টিক্স্, রাগ্বী, ট্র্যাক্, ফিল্ড্, কারাতে ইত্যাদি।
এ প্রতিযোগিতায় আমীর কাবীর বিশ্ববিদ্যালয়ের এইউটিম্যান্ এন্এও রাগ্বী, ভারোত্তোলন ও শট্পুট্-এ তিনটি স্বর্ণপদক এবং এছাড়াও কারাতে ও স্প্রিন্টিং-এ দু’টি রৌপ্যপদক জয় করে প্রথম স্থান অধিকার করে। অন্যদিকে আমীর কাবীর বিশ্ববিদ্যালয়ের এইউটিম্যান্ কিড্ কারাতে, জিম্ন্যাস্টিক্স্ ও শুটিং-এ তিনটি স্বর্ণপদক এবং রেস্ ও স্প্রিন্টিং-এ দু’টি রৌপ্যপদক জয় করে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে।
এ প্রতিযোগিতায় স্প্রিন্টিং-এ একটি স্বর্ণপদক, রাগ্বী, রিলিফ্ রেস্ ও ভারোত্তোলনে তিনিট রৌপ্যপদক এবং কারাতে ও শট্ পুট্-এ দু’টি ব্রোঞ্জপদক জয় করে রোবোমেক্ তৃতীয় স্থান অধিকার করে।
প্রতিযোগিতার জুরি প্যানেলের বিচারে তাইওয়ানের তাইপে সুর্পা হিউম্যানয়েড্ রোবোট্ অলিম্পিক্স্-এ প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জের ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী মূলক কর্মতৎপরতার জন্য সর্বশীর্ষ টীম্ হিসেবে বিবেচিত হয়।
উল্লেখ্য, ইন্টারন্যাশন্যাল ফেডারেশন্ অব্ রোবোটিক্স্ ফেইরা (এফ্আইর্আএ)-এর সহযোগিতায় পর পর দ্বিতীয় বারের মতো এইউটিকাপ্ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হল। বর্তমানে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানসহ ১০টি এশীয়, ১৫টি ইউরোপীয়, ৩টি আফ্রিকান ও ৬টি আমেরিকান দেশ ইন্টারন্যাশন্যাল ফেডারেশন্ অব্ রোবোটিক্স্ ফেইরা (এফ্আইর্আএ)-এর সদস্য পদের অধিকারী।

ইরানি বিজ্ঞানীর ব্রেকথ্রো ফাউন্ডেশন রেগুলার প্রাইয্ লাভ
বস্তুবিজ্ঞানে ও গণিত শাস্ত্রে বিশেষ অবদান রাখার কারণে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী জনাব কম্রন্ ওয়াফা অপর দু’জন বিজ্ঞানীর সাথে যৌথভাবে ব্রেক্থ্রো ফাউন্ডেশন প্রাইয্ লাভ করেছেন।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান বার্তা সংস্থা (র্ইনা) নিউ ইয়র্ক টাইম্স্-এর উদ্ধৃতি দিয়ে জানায়, স্ট্রিং থিওরির ক্ষেত্রে বিরাট ধরনের অগ্রগতি সাধনের কারণে তিনজন তাত্ত্বিক বিজ্ঞানীকে যৌথভাবে ব্রেকথ্রো ফাউন্ডেশন পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে। উল্লেখ্য, স্ট্রিং থিওরি এখন পর্যন্ত পরিপূর্ণ ও অকাট্য রূপে প্রমাণিত হয় নি। এ থিওরি পুরোপুরি ও অকাট্যভাবে প্রমাণিত হলে এর সাহায্যে ব্লাক্হোলসহ এ বিশ্বলোকের সকল কিছু সম্পর্কে ব্যাখ্যা প্রদান করা সম্ভব হবে বলে মনে করা হয়।
আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ইরানি বিজ্ঞানী কম্রন্ ওয়াফার সাথে অপর যে দু’জন বিজ্ঞানীকে ব্রেক্থ্রো ফাউন্ডেশন পুরস্কারের জন্য যৌথভাবে মনোনীত করা হয়েছে তাঁরা হলেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অপর একজন বিজ্ঞানী অ্যান্ড্রু স্ট্রোমিঙ্গার এবং সান্তা র্বাবারা-স্থ ইউনিভার্সিটি অব্ ক্যালিফোর্নিয়ার ক্যাভ্লি ইনস্টিটিউট্ র্ফ থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স্-এ কর্মরত বিজ্ঞানী জোসেফ্ পোল্চিন্স্কি।
নিউ ইয়র্ক টাইম্স্ উল্লেখ করে যে, স্ট্রিং থিওরি অনুযায়ী প্রকৃতিতে নিহিত সমস্ত শক্তি ও বস্তুকণা অনেক অতি ক্ষুদ্র ও সদাকম্পমান সুতা সদৃশ উপাদান দ্বারা গঠিত।
নিউ ইয়র্ক টাইম্স্ আরো জানায়, ইরানি বিজ্ঞানী ওয়াফা বিগত ত্রিশ বছরেরও বেশিকাল যাবত আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান গবেষণা ও শিক্ষকতায় কর্মরত আছেন।
উল্লেখ্য, পুরস্কার হিসেবে দেয় অর্থের অঙ্কের বিবেচনায় ব্রেক্থ্রো ফাউন্ডেশন্ প্রাইয্ হচ্ছে বিজ্ঞান বিষয়ক সবচেয়ে বড় পুরস্কার। গত ৪ ডিসেম্বর (২০১৬) ব্রেক্থ্রো ফাউন্ডেশন পদার্থ বিজ্ঞানে বিশেষ অবদানের জন্য এক হাজারেরও বেশি সংখ্যক পদার্থ বিজ্ঞানী, জীব বিজ্ঞানী ও গণিতবিদকে তার এবারের বার্ষিক পুরস্কার প্রদান করেÑ যার মোট পরিমাণ ছিল আড়াই কোটি ডলার।
উল্লেখ্য, গুগ্ল্-এর সের্গেই ব্রিন্, ২৩ অ্যান্ড্মি-এর অ্যানি ওয্সিস্কি, আলীবাবা-র জ্যাক্ ম্যা, তাঁর স্ত্রী ক্যাথি ঝ্যাং, ইন্টারনেট ব্যবসায়ী ইউরি মির্ল্না, তাঁর স্ত্রী জুলিয়া মির্ল্না এবং ফেস্বুকের যুর্কাবার্গ ও তাঁর স্ত্রী প্রিসিলা চ্যান্ ব্রেক্থ্রো ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন।

পর্যটকদের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্র ইরান

সাইদুল ইসলাম
আনন্দ, ভালোলাগা আর রূপময় স্বপ্নীল পৃথিবীর অজানা কোন সৌন্দর্যের হাতছানিতে ক্ষণিকের জন্য হারিয়ে যেতে মন ছুটে চলে পাহাড়, নদী, সাগর ও অরণ্যে। কখনও মন চায় কোনও শিল্পকর্মের সুনিপুণ কারুকার্যে মন রাঙাতে। আর সে মনের খোরাক জোগাতেই দূর থেকে দূরে ছুটে চলা। সে চলার পথের গন্তব্য যদি হয় ইতিহাস, ঐত্যিহ্যে সমৃদ্ধ কোন দেশ তাহলে যে একজন ভ্রমণপিপাসুর মনের ষোলকলা পূর্ণ হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। ঠিক এমনই এক দেশের নাম হলো ইরান। বলা হয়ে থাকে, পৃথিবীর অর্ধেক সৌন্দর্যের দেশ এটি। অনেকে আবার বলে থাকেন ইরানের ইসফাহান শহর দেখলেই যেন পৃথিবীর অর্ধেক সৌন্দর্য দেখা হয়ে যায়। যেমনটি ফারসিতে বলা হয়ে থাকে ‘শাহরে ইসফাহান, নেসফে জাহান’।
সত্যিই তাই, পৃথিবীর অর্ধেক সৌন্দর্য নিয়ে এক ঘোরলাগা প্রাকৃতিক মহুয়া বন, জনশূন্য বিরান মরুভূমি আর এবড়ো-থেবড়ো সুউচ্চ পাহাড়ের কোল ঘেষে অবস্থান করছে ইসফাহান প্রদেশ। এখানকার উঁচু পাহাড়গুলোর মধ্যে রয়েছে বিদকান এবং সিমানসাফে। সাফাভি শাসনামলের ইরানের রাজধানী ইসফাহানের সৌন্দর্যের নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলি আর ইমাম স্কয়ারে ইমাম মসজিদের কারুকার্যময় দেয়ালচিত্র ও চোখধাঁধানো রং-বেরঙের হাজারও বাতির আলোর নাচন কিংবা ‘নাকশে জাহান’-এর স্ফটিকশুভ্র আলোগুলো যেকোন পর্যটককে মুগ্ধ করবে।
ইসফাহান শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে যায়াইন্দে রুদ নদী। নদীটি শহরটিকে দু’ভাগে ভাগ করে দিয়েছে। নদীটি পূর্ব-পশ্চিমে প্রবাহিত হওয়ায় শহরটি উত্তর-দক্ষিণে বিভক্ত হয়েছে। কেন্দ্রীয় ইরানের মধ্যে সবচেয়ে জলটৈটুম্বুর নদী হলো এই যায়াইন্দে রুদ। এ নদীর ওপর তৈরি করা হয়েছে খাজু ব্রিজ বা সেতু, আল্লাভারদিখান সেতু বা সি ও সেহ সেতু ও শাহরেস্তান সেতুÑ যা সত্যি দেখার মতো। সি ও সেহ পুল বা তেত্রিশ দ্বার বা গেইটবিশিষ্ট সেতুটি দৈর্ঘ্যে তিনশ’ মিটার আর প্রস্থে চৌদ্দ মিটার। যাইয়ান্দে রুদের ওপরে যতগুলো সেতু আছে সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে লম্বা সেতু এটা। ইসফাহান শহরে নদীটির ওপর অসংখ্য সেতু ও নদীর দুই পাড় বাধাই করার পাশাপাশি পানির ফোয়ারা ও ফুলের বাগান দিয়ে নদীর দুই ধার এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যেখানে কোন পর্যটক এলে নিঃসন্দেহে তার হৃদয়-মন প্রশান্তিতে ভরে যাবে। এছাড়া এই শহরে রয়েছে বিখ্যাত ফ্লাওয়ার ও বার্ড গার্ডেন। কেউ ইসফাহানের এ দুটি গার্ডেন পরিদর্শন করেছেন, অথচ তা তাঁর স্মৃতির মণিকোঠায় চিরদিনের জন্য ঠাঁই করে নেয় নি তা যেন একেবারেই অবিশ্বাস্য ব্যাপার। কারণ, পৃথিবীর এমন কোন প্রজাতির ফুল নেই যা ইসফাহানের ফ্লাওয়ার গার্ডেনে পাওয়া যাবে না। একইসাথে আপনি যদি ইসফাহানের বার্ড গার্ডেন পরিদর্শন করেন তাও যে আপনার হৃদয়-মন ভরিয়ে দেবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বার্ড গার্ডেন পরিদর্শনকারীর চারপাশে বিচিত্র রকমের পাখি উন্মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্য যে কোন পর্যটকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাধ্য।
একইভাবে ইরানের আরেকটি আকর্ষণীয় নগরী শিরাজের কথা না বললেই নয়। ইতিহাস, ঐতিহ্য ও কাব্য-সাহিত্যের ডানায় ভর করে সম্ভবত পৃথিবীর আর কোনো স্থান এত জনপ্রিয় হয় নি কখনও।
শিরাজ ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিমে ফার্স প্রদেশে অবস্থিত। যাকে বলা হয় গোলাপ, বাগান ও বুলবুলের শহর। যদিও বিশ্ব জনমানসে শিরাজের বেশি পরিচিতি কবি ও কবিতার শহর হিসেবে। কবিরাই হচ্ছে ইরানের বুলবুল, যাদের গান পৃথিবীর কবিরা আজও ফেরি করে ফেরে। বলা হয়, ইরানেরই আরেক নগরী নিশাপুর (ওমর খৈয়ামের জন্মভূমি) ছাড়া আর কোনো শহর বিশ্বজোড়া এত খ্যাতি লাভ করে নি। শিরাজের যেসব কবি-সাহিত্যিকের কাব্যকৃতী আজো পৃথিবীতে অম্লান, তাঁদের একজন সা’দী শিরাজী এবং অপর জন ‘বুলবুল-ই-শিরাজ’ বা ‘শিরাজের বুলবুল’ বলে খ্যাত মহাকবি হাফিজ।
ইরানের দর্শনীয় ঐতিহাসিক স্থানগুলোর অন্যতম হলো ‘তাখ্তে জামশীদ’। পাশ্চাত্যে একে ‘পার্সেপোলিশ’ নামেও অভিহিত করা হয়, যা এই ফার্স প্রদেশেই অবস্থিত। ‘তাখ্তে জামশীদ’ একটি প্রাচীন রাজপ্রাসাদ। ইরানের হাখামানশী বংশের বাদশাহদের এই নগরী প্রাচ্য সভ্যতার এক উজ্জ্বল নিদর্শন হিসেবে আজো টিকে রয়েছে। কালের বিবর্তনে এই নগরীর জৌলুশ আর নেই। তবে এর ধ্বংসাবশেষ আজো বিশ্ববাসীকে প্রাচীন পারস্য সভ্যতার শৌর্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের হাজার হাজার পর্যটক এই তাখ্তে জামশীদের নিদর্শন দেখার জন্য ইরানে এসে ভিড় করেন।
ইরানের শিরাজ নগরীর উত্তর-পূর্বে ৭৫ কিলোমিটার দূরে বিশাল এক সমভূমির মাঝে প্রায় আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাখ্তে জামশীদের স্তম্ভশ্রেণি।
প্রাচীন ইরানের হাখামানশী রাজবংশ ছিল খুবই বিখ্যাত। এই বংশের বিখ্যাত রাজা ছিলেন প্রথম দারিয়ুস। রাজা প্রথম দারিয়ুসের আমলে হাখামানশী সাম্রাজ্য সমৃদ্ধির সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করে। তিনি ৫২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৪৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত শাসন করেন। দারিয়ুসই প্রথম তাখ্তে জামশীদ নির্মাণ শুরু করেন।
দেশটিতে এমন আরো অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে যা একটি লেখার মধ্যে বর্ণনা দিয়ে শেষ করা সম্ভব নয়।
দেশটিতে রয়েছে অসংখ্য বাগান। যেগুলো পরিদর্শনে যেকোন পর্যটকের মন সত্যি ছুঁয়ে যাবে। এ পর্যন্ত দেশটির ৯টি বাগান বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ইউনেস্কোর প্রতিবেদনে ইরানের বাগিচাগুলো সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘এই বাগিচাগুলোর ডিজাইন চারটি আলাদা আলাদা ভাগে বিভক্ত। এগুলোর মাঝখানে রয়েছে পানির ব্যবস্থা যা একদিকে দৃশ্য নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে অপরদিকে বাগানের সজ্জাকৌশল ও স্থাপত্যশৈলীর দিক থেকেও এই পানির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।’ ওই প্রতিবেদনে আরো এসেছে, ইরানের বাগিচাগুলো কাল্পনিকভাবে বেহেশতের বাগানের অনুসরণে তৈরি করা হয়েছে। এই বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, ইরানের বাগিচা নির্মাণ পদ্ধতি ও সজ্জা কৌশলের প্রভাব সুস্পষ্টভাবে ভারত এবং স্পেনের মতো দেশগুলোর বাগিচা তৈরির স্টাইলের ওপর ব্যাপকভাবে পড়েছে।
ইউনেস্কো তালিকাভুক্ত ইরানের নয়টি বাগিচা হলো : বাগে পাসারগাড, বাগে এরাম, বাগে চেহেল সুতুন, বাগে ফিন, বাগে আব্বাসাবাদ, বাগে শাযদেহ মহন, বাগে দৌলাতাবাদ, বাগে পাহলাভনপুর এবং বাগে আকবারিয়া। মজার ব্যাপার হলো, এইসব বাগিচা ইরানের বিভিন্ন অঞ্চলে বিচিত্র আবহাওয়াময় পরিবেশে নির্মাণ করা হয়েছে।
তবে ইউনেস্কোর বিশেষজ্ঞগণ স্বীকার করেছেন, অঞ্চলগত বৈচিত্র্য, পরিকল্পনা ও ডিজাইন এবং ইরানের ঐতিহাসিক রীতি ও সাংস্কৃতিক শেকড়গুলো এই মনোনয়নের ক্ষেত্রে যে কাজ করে নি তা নয়। এই বাগিচাগুলো ইতিহাসের বিভিন্ন যুগে গড়ে উঠেছে। সেই হাখামানশীয় যুগ অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দী থেকে দুই শতাব্দী আগের কাজার শাসনামল পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে বাগিচাগুলো তৈরি করা হয়েছে। ইরানিদের বিশ্বাস ও মূল্যবোধের মাঝে বাগিচা সবসময়ই বেহেশতের মতোই একটি পবিত্র স্থান হিসেবে সম্মানিত ও মর্যাদাময়।
প্রাকৃতিক পরিবেশের দিক থেকে বলতে গেলে দেশটিতে যেমন রয়েছে পাহাড় আর সাগর, তেমনি রয়েছে বিশাল মরুভূমি, কোথাও নদ-নদী, আবার কোথাও সুবিস্তৃত সমতল ভূমি। ভূমি-বৈচিত্র্যের মতো এখানকার আবহাওয়াতেও রয়েছে বেশ বৈচিত্র্য। সারা ইরানে বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ ও শীত- এই চারটি ঋতু রয়েছে। রাজধানী তেহরানসহ বিশাল এলাকাজুড়ে যখন প্রচ- শীত কিংবা তুষারাবৃত তখন দক্ষিণে (পারস্য উপসাগর সংলগ্ন) দিব্যি বসন্তের হাওয়া। পাহাড়, সাগর, নদ-নদী আর জঙ্গলাকীর্ণ বৈচিত্র্যময় ভূমি এবং আবহাওয়ার কারণে ইরানে পর্যটকের ভিড়ও লেগে থাকে সারা বছর। শুধু পারস্য উপসাগরের কিশ দ্বীপ ভ্রমণ করেন প্রতি বছর ১০ লাখের বেশি বিদেশি পর্যটক। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ইরানে বিদেশি পর্যটক এসেছেন ৫০ লাখের বেশি। এশিয়ার বহু দেশ, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা থেকেই আসেন বেশি পর্যটক। ইউনেস্কোর হিসাব মতে, ইরান বিশ্বের ১০ম প্রধান পর্যটনের দেশ।
ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এই দেশটিকে আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিশ্বের পর্যটকদের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে ইরান সরকার এরই মধ্যে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
ইরানের নাগরিক ছাড়াও বিদেশি পর্যটকদের নজর কাড়তে দেশটিতে একাধিক নিত্য নতুন ধরনের ওয়াটার পার্ক চালু হচ্ছে। সর্বশেষ ওয়াটার পার্ক চালু হয়েছে ধর্মীয় নগরী কোমে। আধুনিক বিনোদন ব্যবস্থা ছাড়াও সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে এসব ওয়াটার পার্কে। ইরানের পৌর সরকার এধরনের বিনোদন কেন্দ্রে সবাইকে বিনোদন পেতে যোগ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। বিশেষ করে শিশু ও তরুণদের কাছে ওয়াটার পার্কগুলো অত্যন্ত আকর্ষণীয়। গরমে প্রশান্তি এনে দেয় এসব আয়োজন।
ওয়াটার পার্কগুলোতে বিভিন্ন রংয়ের ব্যবহার নজর কাড়ে সহজেই। সাঁতার কাটা ছাড়াও বিভিন্ন ওয়াটার রাইড বেশ রোমাঞ্চকর। রয়েছে ঝরনা। সুইমিং পুলের পাশাপাশি ধীর কিংবা দ্রুত গতির রাইড রাখা হয়েছে। এধরনের ওয়াটার পার্কে নারীরা অংশগ্রহণ করতে পারবেন ভিন্ন স্থানে যা তাঁদের জন্যে সংরক্ষিত। ইসলামি বিধি মেনে এব্যবস্থা করা হয়েছে। মাশহাদ শহরে ‘ওয়াটার ওয়েভ্স ল্যান্ড’ নামে একটি ওয়াটার পার্কে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য প্রবেশ মূল্য ধরা হয়েছে ১৭ মার্কিন ডলার। এটি মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বড় ওয়াটার পার্ক।
মাশহাদ শহরেই আরেকটি ওয়াটার পার্ক হচ্ছে আফতাব কোস্ট পার্ক। এটি এ শহরের দ্বিতীয় বৃহত্তম ওয়াটার পার্ক। চার হাজার বর্গফুট এলাকায় ১৫ হাজার বর্গফুটের অবকাঠামো স্থাপন করা হয়েছে। সাত তলার একটি কমপ্লেক্স রয়েছে। এ কমপ্লেক্সের একেকটি তলায় ভিন্ন ধরনের আয়োজনের ব্যবস্থা রয়েছে। স্পিড স্লাইস ছাড়াও রয়েছে ১৮ মিটার উঁচু ওয়াটারফল। পাশাপাশি জোড়াস্লাইড রয়েছে। স্পেস হোল ছাড়াও রয়েছে খোলা স্লাইড, শরীরচর্চা ছাড়াও বালির স্টিমবাথসহ রয়েছে বিভিন্ন ধরনের আয়োজন।
ইরানে বিদেশি পর্যটকদের জন্য আতিথেয়তার কথা চিন্তা করে ইরানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, হস্তশিল্প ও পর্যটন সংস্থা নতুন করে ১২৫টি চার তারকা ও পাঁচ তারকা মানের হোটেল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। যার মাধ্যমে আতিথেয়তার দিক দিয়ে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করতে যাচ্ছে ইরান। দেশটিতে বর্তমানে ২৪টি পাঁচ তারকা, ৪৫টি চার তারকা এবং ২৫টি তিন তরাকা হোটেল রয়েছে।
ইরানের এই উদ্যোগে উল্লসিত হয়েছে আন্তর্জাতিক হোটেল মালিকপক্ষ। বিশেষ করে পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের আরব দেশগুলো এরই মধ্যে ইরানে তাদের হোটেল নির্মাণ কার্যক্রম জোরদার করার পরিকল্পনা নিয়েছে। এসব দেশ ইরানের পর্যটন খাতকে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় ও লাভজনক খাত হিসেবে বিবেচনা করছে।
ইরানের সরকারি সূত্রের খবর অনুযায়ী, এরই মধ্যে জার্মানি, গ্রিস, দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন হোটেল গ্রুপ আলোচনার জন্য তেহরান সফর করেছে। সম্প্রতি ইউরোপের হোটেল নির্মাণকারী সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান ‘অ্যাকর’ (অপপড়ৎ) তেহরানের ইমাম খোমেইনী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে দুটি চার তারকা হোটেল নির্মাণ করেছে। এছাড়া, সংযুক্ত আরব আমিরাতের রোতানা কোম্পানি ইরানের রাজধানী তেহরানে ৬০০ কক্ষবিশিষ্ট একটি পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণ করছে।
দেশটির যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই উন্নত। রয়েছে ৩১৯টি এয়ারপোর্ট ও ১৪টি নিজস্ব এয়ারলাইন্স। রাজধানী শহরে রয়েছে আধুনিক পাতাল রেল। রয়েছে উন্নতমানের বাস ও ট্রেন সার্ভিস। দেশটির যোগাযোগ ব্যবস্থাকেও আরো আকর্ষণীয় করতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে ইরান সরকার। সম্প্রতি ইরান রেলওয়ে কোম থেকে মাশহাদে পাঁচ তারকা ট্রেন সার্ভিস চালু করেছে। এ ট্রেনের নাম দেয়া হয়েছে ‘ফাদাক’। ইরানের বিখ্যাত এ দুটি শহরের মধ্যে মাযার যিয়ারত ও ধর্মীয় তীর্থযাত্রীদের যাতায়াতে এ ট্রেন সার্ভিস বিশেষ সুবিধা দেবে। ‘ফাদাক’ ট্রেন প্রথমবারের মতো কোম থেকে মাশহাদে পাঁচ তারকা মানের ট্রেনসার্ভিস। কোম থেকে মাশহাদে এবং মাশহাদ থেকে কোমে এ ট্রেন যাতায়াতে প্রতিবার সময় লাগবে ৭ ঘণ্টা।
এ ট্রেন সার্ভিসে উন্নত মানের সেবা নিশ্চিত করা হয়েছে। পুরো ট্রেনটিই তৈরি হয়েছে ইরানে। মাশহাদের পর কোম হচ্ছে ইরানের দ্বিতীয় পবিত্র শহর। কোমে হযরত মাসুমা (আ.) এবং মাশহাদে হযরত ইমাম রেযা (আ.)-এর পবিত্র মাযার শরীফে লাখ লাখ ইরানি নাগরিক ছাড়াও বিদেশি পর্যটকরা যিয়ারত করতে আসেন।
আজকাল হালাল ট্যুরিজম নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। মুসলিম বিশ্বের গণ্ডি পেরিয়ে বিষয়টি নিয়ে পাশ্চাত্যেও আলোচনা হচ্ছে। এই রকম একটা প্রেক্ষাপটে মুসলিম বিশ্বে হালাল ট্যুরিজমের ক্ষেত্রে ইরান হয়ে উঠতে পারে মূল কেন্দ্র। এমন আশার কথাও সম্প্রতি বলেছেন ইরানের কালচারাল হেরিটেজ, ট্যুরিজম অ্যান্ড হ্যান্ডিক্র্যাফ্ট অর্গানাইজেশনের প্রধান মাসুদ সোলতানিফার।
তিনি বলছেন, হালাল ট্যুরিজমে ইরান সবার আগে যে জিনিস উপহার দিতে পারে তা হচ্ছে হ্যান্ডিক্র্যাফ্ট বা হস্তশিল্প। সোলতানিফারের মতে বিশ্বের পর্যটকদের জন্য ইরানের হস্তশিল্প হতে পারে আকর্ষণের অন্যতম প্রধান বস্তু। তাদের হাতে রয়েছে বিখ্যাত আকিক পাথর, নানা রঙের ক্রিস্টাল পাথর, রয়েছে ভুবনবিখ্যাত কার্পেট, মাটির পাত্র; রয়েছে আকর্ষণীয় সব ক্যালিগ্রাফির চর্চা। এসবকে কেন্দ্র করে হালাল ট্যুরিজমের জন্য নতুন পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে চাইছে ইরান।
সময়ের পরিবর্তনে মানুষের মন বদলায়, রুচি বদলায়। সময় ও দূরত্ব অতিক্রম করে মানুষ ছুটে যায় দূরে কোথাও। একটু অবসর কাটানোর জন্য; জীবনের ক্লান্তি ঝেড়ে একটু ভালো সময় কাটানোর জন্য। কালের পরিক্রমায় মানুষ এখন দিন দিন হালাল ট্যুরিজমের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। বিশ্বের মুসলমানরা নিরাপদ পর্যটনের সন্ধান করছেন। এদিকটা মাথায় রেখে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান পর্যটন শিল্পকে জোরদার করছে।
দেশটি এমন পর্যটন শিল্প গড়ে তুলতে আগ্রহী যেখানে পাঁচ তারকা হোটেলে মদের যোগান, নাচগানের আসর কিংবা খোলামেলা পরিবেশে সমুদ্রতটে সূর্যস্নানের বিপরীতে ধর্মের গ-ি না পেরিয়েই মানুষ বিশুদ্ধ বিনোদনের সুযোগ পেতে পারে।
আর বিশ্বের বহু মানুষ রয়েছেন যাঁরা ধর্মের গ-ি না পেরিয়েই পর্যটনের সুযোগ নিতে চান। তাঁদের জন্য ইরান হয়ে উঠতে পারে হালাল ট্যুরিজমের কেন্দ্রবিন্দু।
ইরানের দুই পাশে রয়েছে দুই সাগর অর্থাৎ পারস্য উপসাগর ও কাস্পিয়ান সাগর। রয়েছে বিশাল মরুভূমি, পাহাড়-পর্বত, জঙ্গলাকীর্ণ জনপদ; প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন। রয়েছে জাতিসংঘ ঘোষিত বহু ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ। এর বাইরে রয়েছে বহু অলি, আউলিয়া, ইমাম ও সাহাবির মাযার। ইরানের মাশহাদ শহরে ইমাম রেযার যে মাযার রয়েছে তাতেই তো প্রতিদিন দেশ-বিদেশের লাখো মানুষের আগমন ঘটে। এছাড়া, আরো বহু মাযার রয়েছে। আছে কোমের মতো ধর্মীয় নগরী।
এদিকে, পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে বিশ্বের ২৮টি দেশের ওপর থেকে ভিসাপ্রথা তুলে নিচ্ছে ইরান। পর্যটন শিল্প জোরদারের পদক্ষেপ হিসেবে ইরান এ পরিকল্পনা নিচ্ছে। ইরানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, হস্তশিল্প ও পর্যটন সংস্থার পরিচালক মাসুদ সুলতানিফার এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘পর্যটক আকর্ষণের জন্য আমরা ৪০টি দেশকে তালিকার শীর্ষে রেখেছি। এর মধ্যে ২৮টি দেশের ভিসাপ্রথা তুলে নেয়ার ব্যাপারে প্রক্রিয়া চলছে।’ তবে কোন কোন দেশ এর আওতায় পড়বে তা জানা যায় নি।
সুলতানিফার জানান, ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইলেক্ট্রনিক ভিসা চালুর কাজ করছে যা ‘ই-ভিসা’ নামে পরিচিত। এ ব্যবস্থা চালু হলে ভিসাপ্রথায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে এবং সবাই নিজ নিজ দেশ থেকে পর্যটক ভিসার জন্য আবেদন করতে পারবেন। এছাড়া, অন অ্যারাইভাল ভিসার মেয়াদ ১৫ দিন থেকে বাড়িয়ে ৩০ দিন করার অনুমোদন দিয়েছে সরকার।
মাসুদ সুলতানিফার বলেন, যেসব দেশ ইরানি নাগরিকদের জন্য সন্তোষজনকভাবে তাদের দেশে যাওয়ার ব্যবস্থা করবে সেসব দেশের জন্য ভিসাপ্রথা বাতিল করা হবে।
ছয় জাতি গোষ্ঠীর সঙ্গে চূড়ান্ত পরমাণু চুক্তি সইয়ের পর ইরান পর্যটন খাতে বিশেষ নজর দিয়েছে। তেহরান বিদেশি পর্যটক আকর্ষণের মাত্রা পাঁচ গুণ বাড়াতে চাইছে। প্রতি বছর দুই কোটি বিদেশি পর্যটক আকর্ষণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে তেহরান। এর ফলে এ খাতে বার্ষিক আয় বেড়ে দাঁড়াবে তিন হাজার কোটি ডলার।
ইরান মধ্যপ্রাচ্যের একটি বিশাল ভূখ-ের দেশ। এর মোট আয়তন হচ্ছে ১৬ লাখ ৪৮ হাজার ১৯৫ বর্গ কিলোমিটার। রাজধানী তেহরান। ২০১৩ সালের হিসাব অনুযায়ী ইরানের মোট জনসংখ্যা সাত কোটি ৮৫ লাখ। জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৮ জন। মোট জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৯৫ ভাগ শিয়া মুসলমান, ৪ ভাগ সুন্নি এবং বাকি এক ভাগ খ্রিস্টান, ইহুদি, জয়থ্রুস্ট ও বাহাই। দেশটির মাথাপিছু আয় ১২,৮৩৩ মার্কিন ডলার, তবে কোনো কোনো হিসাব মতে মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ ১৫,০০০ ডলার। সে কারণে ইরানকে বলা হয় উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ। মুদ্রার সরকারি নাম রিয়াল, তবে স্থানীয়ভাবে রিয়ালকে তুমান বলা হয়। দেশটিতে শিক্ষার হার শতকরা ৯৫ ভাগের বেশি।
ইরান হচ্ছে বিশ্বের সবেচয়ে বড় আয়তনের দেশগুলোর তালিকায় ১৮তম যা ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি ও স্পেনের মোট আয়তনের সমান। ইরানের পূর্বে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান, উত্তর-পূর্বে তুর্কমেনিস্তান, উত্তরে কাস্পিয়ান সাগর, উত্তর-পশ্চিমে আযারবাইজান ও আর্মেনিয়া এবং পশ্চিমে তুরস্ক ও ইরাক। উত্তরে কাস্পিয়ান সাগরের অপর পাড়ে রয়েছে কাজাখস্তান ও রাশিয়ার মতো বৃহৎ দেশ। আর দক্ষিণে রয়েছে পারস্য উপসাগর। সাগরের ওপারেই আছে কুয়েত, সৌদি আরব, বাহরাইন, কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, আমরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোর পর্যটকরা ইরানে আসার জন্য দারুণ আগ্রহী। বিশেষ করে ইরানের বহু ঐতিহাসিক স্থাপনা, পর্যটনকেন্দ্র, পাহাড়, সাগর এবং প্রকৃতিক সৌন্দর্যম-িত জায়গা বিদেশি পর্যটকদের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। ইরান ভ্রমণের বিষয়ে মার্কিন পর্যটকদের আগ্রহ নিয়ে আমেরিকার পত্র-পত্রিকাতেও খবর বের হচ্ছে।
ইরান হচ্ছে বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সম্ভাবনাময় পর্যটনের দেশ যেখানে বহু প্রাচীন ও প্রাকৃতিক নিদর্শন রয়েছে। ইতোমধ্যে ইরানের ১৯টি নিদর্শনকে জাতিসংঘের ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেব ঘোষণা করেছে।

তেহরানে ইসলামি ঐক্য সপ্তাহে আগত মেহমানদের উদ্দেশে রাহবারের ভাষণ

পয়গাম্বরে আকরাম (সা.) ও ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-এর পবিত্র জন্মদিন উদ্যাপন উপলক্ষে আয়োজিত ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী মেহমান ও ইরানের রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের উদ্দেশে প্রদত্ত ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের মহামান্য রাহবার সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ীর ভাষণের পূর্ণ বিবরণ :
بسم‌الله‌الرّحمن‌الرّحیم
والحمدلله ربّ العالمین والصّلاة والسّلام علی سیّدنا محمّد و آله الطّاهرین و علی صحبه المنتجبین و علی من تابعهم باحسان الی یوم الدّین.
(বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য, যিনি সমগ্র জাহানের প্রতিপালক। সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক আমাদের নেতা হযরত মুহাম্মাদ (সা.), তাঁর পবিত্র বংশধর, তাঁর সুশীল সাহাবিগণ এবং কিয়ামত পর্যন্ত যাঁরা আন্তরিকভাবে তাঁদের অনুসরণ করবে তাদের প্রতি।)
অস্তিত্ব জগতের সকল মাখলুকের সরদার ও সৃষ্টিলোকের শিরোমণি মহান পয়গাম্বর হযরত মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ (সা.)-এর জন্মদিন, একইভাবে ইমামতের যুগে পৃথিবীতে আল্লাহর দলিল ও হুজ্জাত পয়গাম্বর (আ.)-এর সন্তান হযরত আবি আবদিল্লাহ আস সাদেক (আ.)-এর জন্মদিবস উপলক্ষে আমি আপনাদের মোবারকবাদ জানাচ্ছি। আশা করছি যে, আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সবাইকে সকল মুসলমানের, বিশ্বের সকল আলোকিত চিন্তার লোককে তাওফীক দেবেন, যাতে আমরা সবাই এই নেয়ামতের কদর বুঝি। এতবড় অনুগ্রহের গুরুত্ব যেন উপলব্ধি করতে সক্ষম হই। তাঁরা বিশাল অস্তিত্বজগতের খুঁটি। তাঁরা আমাদেরকে যে সিরাতুল মুস্তাকীমের পথ দেখিয়ে গেছেন সে পথ যেন আমরা চিনি এবং সে পথ ধরে অগ্রসর হই।
মহান পয়গাম্বর (আ.)-এর পবিত্র অস্তিত্বের বিদ্যমানতার গুরুত্ব এত অধিক যে, আল্লাহ তা‘আলা মানবজাতিকে এই বিরাট নেয়ামত প্রদান করার কারণে মানুষের প্রতি আপন অনুগ্রহের খোঁটা দিয়েছেন। বলেছেন : لَقَد مَنَّ اللّهُ عَلَی المُؤمِنینَ اِذ بَعَثَ فیهِم رَسولًا مِن اَنفُسِهِم. ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করেছেন যে, তিনি তাদের নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে রাসূল করে তাদের কাছে প্রেরণ করেছেন।’ (সূরা বাকারা : ১৬৪)
ইমাম সাজ্জাদ আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম ‘সাহীফায়ে সাজ্জাদিয়া’য় মহান আল্লাহর দরবারে এভাবে আরয করেন, اَلحَمدُلِلّهِ الَّذی مَنَّ عَلَینا بِمُحَمَّدٍ نَبیِّه دونَ الاُمَمِ الماضیَة وَ القُرونِ السّالِفَة ‘সেই আল্লাহর জন্য সমস্ত প্রশংসা, যিনি মুহাম্মাদ (সা.)-কে প্রেরণ করে আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, যা বিগত উম্মতদের এবং অতীতের জাতিসমূহের প্রতি প্রদান করেন নি। (সাহীফায়ে সাজ্জাদিয়া, দ্বিতীয় দোয়া)
মানবজাতির প্রতি আল্লাহর এমন বিরাট দানের ব্যাপারে কুরআন মজীদে এবং ইমামগণের বাণীতে যে বর্ণনা এসেছে তা সত্যিই বিরাট বিষয়। এক বিরাট অনুদান। আল্লাহ তা‘আলা পয়গাম্বর (আ.)-কে জগৎবাসীর জন্য রহমত হিসেবে অভিহিত করেছেন। এই রহমত জগতের কোন একটি মানবগোষ্ঠীর জন্য নয়, অথবা জগতের একটি বিশেষ সমষ্টির জন্য নয়; বরং রাহমাতাল লিল আলামীন رَحمَةً لِلعٰلَمین ‘সমগ্র জগতের জন্য রহমতস্বরূপ।’ (সূরা আম্বিয়া : ১০৭) । তিনি আল্লাহর কাছ থেকে যে পয়গাম মানবজাতির জন্য নিয়ে এসেছেন তা মানবজাতিকে তিনি উপহার দিয়েছেন। তিনি এই তীক্ষè দৃষ্টিশক্তি, এই উজ্জ্বল চলার পথ মানবসমাজের প্রতিটি মানুষের জন্য উৎসর্গ করেছেন।
অবশ্য এমনও অনেকে আছেন, যারা ক্ষমতার মালিক, যাদের হাতে অর্থবিত্ত আছে, ক্ষমতা ও প্রতাপ আছে, তারা চায় না আল্লাহর বিশাল বিস্তৃত রহমত সর্বস্তরের মানুষের জন্য অবারিত হোক। তারা শক্তিমত্তা দেখিয়ে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তারা আল্লাহমুখী এই তৎপরতা রুখে দাঁড়ায়। এই পরিস্থিতিতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, یٰاَیُّهَا النَّبِیُّ اتَّقِ اللّهَ وَ لا تُطِعِ الکٰفِرینَ وَ المُنٰفِقین ‘হে নবী! আপনি আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করুন এবং কাফের ও মুনাফিকদের আনুগত্য করবেন না।’ (সূরা আহযাব : ১) অপর এক আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বিষয়টি পরিষ্কার করে দিয়ে বলেন, یٰاَیُّهَا النَّبِیُّ جٰهِدِ الکُفّارَ وَ المُنٰفِقینَ وَ اغلُظ عَلَیْهِم‌ ‘হে নবী! আপনি কাফেরদের দল এবং মুনাফিকদের সাথে জিহাদ করুন এবং তাদের প্রতি কঠোর হোন।’ (সূরা তওবা : ৭৩ নং আয়াতের অংশবিশেষ।)
এখানে বলা হচ্ছে جاهِد ‘জিহাদ করো’। বলা হয় নি যে قاتِل ‘লড়াই কর’ বা قاتِلِ الکُفّارَ وَ المُنافِقین ‘কাফের ও মুনাফিকদের সাথে লড়াই কর।’ কারণ, লড়াই সব সময় প্রয়োজন নেই্। তবে জিহাদ সমসময় আবশ্যক। কখনো জিহাদ হয় রাজনৈতিক জিহাদ, কখনো জিহাদ সাংস্কৃতিক হয়ে থাকে। কখনো জিহাদ ন¤্র হয়ে থাকে, কখনো হয় শক্ত ও মজবুত। কখনো সশস্ত্র হয়ে থাকে, কখনো জ্ঞান দিয়ে হয়। সবগুলোই জিহাদ। কিন্ত সব কিছুতেই মনে রাখতে হবে যে, এই জিহাদ হবে দুশমনের বিরুদ্ধে। মানবতার শত্রুর বিরুদ্ধে। ঐসব দুশমনের বিরুদ্ধে যারা নিজের ক্ষমতা, অর্থ, দাপট ও শক্তিমত্তার ওপর নির্ভর করে নিজেদের স্বার্থ ও কর্তৃত্ব মানবতার ওপর চাপিয়ে দেয়। এদের সাথে আপস করার কোন অর্থ হয় না। اِتَّقِ اللّهَ وَ لا تُطِعِ الکٰفِرینَ وَ المُنٰفِقین. ‘আল্লাহকে ভয় কর এবং কাফের ও মুনাফিকদের অনুসরণ করো না।’
পয়গাম্বর (আ.) সম্পর্কে এবং তিনি যেসব শিক্ষা মানবজাতিকে দিয়েছেন, নব প্রতিষ্ঠিত ইসলামি সমাজকে পায়ে পায়ে, এক বাক্য দুই বাক্য করে এগিয়ে নেয়ার বিষয়ে কোরআন মজীদের আয়াতের সংখ্যা বহু। আমাদের নিজেদের প্রতি, নিজেদের তরুণ সমাজের প্রতি, ধর্মীয় প্রচারক মহলের প্রতি এবং মানুষের চিন্তার নাটাই যাদের হাতে নিয়ন্ত্রিত, তাদের সবার প্রতি আমার পরামর্শ হচ্ছে, কোরআন মজীদের এ সকল আয়াত অধ্যয়ন করবেন। এসকল ভাবধারা কোরআন মজীদ থেকে আহরণ করবেন। এটি এক জ্ঞানসমগ্র। একটি পূর্ণাঙ্গ সমগ্র। আমাদের কাজের গলদটা হচ্ছে, পয়গাম্বর (সা.)-কে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ তা‘আলা যেসব শিক্ষা দিয়েছেন এবং পয়গাম্বরের যে পরিচয় ব্যক্ত করেছেন তার প্রতি আমরা অবহেলা প্রদর্শন করেছি। এই উপদেশ-সমষ্টি যদি আমরা পূর্ণাঙ্গরূপে আমাদের চোখের সামনে রাখি তাহলে আমাদের সামনে যে সিরাতুল মুস্তাকীমের ওপর নবী করিম (সা.) চলেছেন, সেই পথ আমাদের সামনে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। اِنَّکَ عَلیٰ صِراطٍ مُستَقیم ‘নিশ্চয়ই আপনি সিরাতুল মুস্তাকীমের ওপর প্রতিষ্ঠিত।’ (সূরা যুখরুফ : ৪৩)
যেহেতু আমার ভাইয়েরা, আমাদের দেশের ও অন্যান্য দেশ থেকে আগত, ঐক্য সম্মেলনের সম্মানিত মেহমানবৃন্দ, ইসলামি দেশসমূহের রাষ্ট্রদূতগণ, শিয়া-সুন্নি বিভিন্ন মাযহাবের লোকজন, নানা চিন্তাধারা ও মতাদর্শের অনুসারীরা এ সমাবেশে উপস্থিত হয়েছেন, পরেও এসব কথা শোনা হবে, সেহেতু আমি প্রয়োজন মনে করেছি যে, আজকের এই সমাবেশে যে কথাটি আরয করতে চাই তা হলে আমার প্রিয় ভাইয়েরা ও বোনেরা! আজ ইসলামি জাহানের বড় রকমের সমস্যাদির সম্মুখীন হয়েছে। এসব সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ হচ্ছে ইসলামি ঐক্য। একতা, সহমত পোষণ, একে অপরকে সাহায্য করা এবং মাযহাবি ও চিন্তাগত অনৈক্যকে অতিক্রম করে যাওয়া।
বিশ^ক্ষমতাধর ও সা¤্রাজ্যবাদী চক্র ইসলামি জাহানের প্রতি যে দৃষ্টিতে তাকায় তা হচ্ছে, ইসলামি জাহানকে যতদূর পারা যায় ঐক্যের বাঁধন থেকে দূরে সরিয়ে দিতে হবে। এই ঐক্য তাদের জন্য হুমকিস্বরূপ। দেড়শ’ কোটি মুসলমান, এতগুলো ইসলামি দেশ, এত বিপুল সম্পদ সম্ভার, এই যে অসাধারণ জনশক্তি- যদি এসব সমষ্টি একত্রিত হয়, যদি ঐক্যবদ্ধভাবে ইসলামি লক্ষ্যসমূহের দিকে এগিয়ে যায়, তাহলে শক্তিমানরা বিশে^ তাদের ক্ষমতার ঘণ্টা বাজাতে পারবে না। আমেরিকা আর বিভিন্ন দেশের ওপর, বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সরকারের ওপর নিজের ইচ্ছা চাপিয়ে দিতে পারবে না। যায়নবাদী দুষ্টচক্র বিভিন্ন দেশ ও সরকারের ওপর তার চক্রান্তজাল বিস্তার করতে পারবে না। সে তখন তার অশুভ পাঁয়তারা সফল করতে ও স্বার্থ চরিতার্থ করতে সক্ষম হবে না। মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে এমনটিই হবে।
মুসলমানরা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকে তাহলে আজ ফিলিস্তিনের অবস্থা যেভাবে দেখছি সেভাবে থাকবে না। আজ ফিলিস্তিনের অবস্থা খুবই কঠিন ও নাজুক। গাজার অবস্থা এক রকম। পশ্চিম তীরের পরিস্থিতি অন্য রকম। ফিলিস্তিন জাতি আজ দৈনন্দিন প্রচণ্ড চাপের মধ্যে রয়েছে। তারা চাচ্ছে ফিলিস্তিনি ইস্যু মানুষের মন থেকে মুছে ফেলতে। একেবারে ভুলিয়ে দিতে চায়। তারা পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলকে- যার মধ্যে আমাদের দেশগুলো রয়েছে, যে অঞ্চলটি একেবারেই স্পর্শকাতর, আমাদেরকে আমাদের নিয়ে ব্যস্ত করে দিতে চায়। মুসলমানরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে, আরবরা আরবদের বিরুদ্ধে যেন রুখে দাঁড়ায়. একে অন্যকে যেন লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে, একে অন্যের যেন নিপাত সাধন করে। যেন মুসলিম দেশগুলোর সেনাবাহিনী বিশেষ করে যেসব সেনাবাহিনী যায়নবাদী ইসরাইলের প্রতিবেশিত্বে অবস্থান করছে দিন দিন দুর্বল হয়ে যায়। তাদের লক্ষ্য এটিই।
আজকের দিনে এতদঞ্চলে দু’টি ইচ্ছা পরস্পরের সাথে সাংঘর্ষিক। একটি ইচ্ছা ঐক্যের ইচ্ছা। আরেকটি ইচ্ছা বিচ্ছিন্নতা ও অনৈক্যের ইচ্ছা। ঐক্যের যে ইচ্ছা তা মুমিনদের সাথে সংশ্লিষ্ট। ইখলাসের কণ্ঠস্বর হতে ঐক্য ও একতার আহ্বান ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত। তাতে মুসলমানদের আহ্বান জানানো হচ্ছে, আপনারা আপনাদের মধ্যে যেসব অভিন্ন বিষয় রয়েছে সেগুলোর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করুন। যদি এমনটি হয়, যদি এই ঐক্য সম্পন্ন হয় তাহলে মুসলমানদের যে অবস্থা বর্তমানে বিরাজ করছে তা ভবিষ্যতে তেমনটি থাকবে না। মুসলমানরা মর্যাদাপূর্ণ অবস্থা লাভ করবে। আজকের দিনে আপনারা লক্ষ করুন, পূর্ব এশিয়ার শেষ প্রান্ত থেকেÑযেখানে মায়ানমারে মুসলমান নিধন চলছে- পশ্চিম আফ্রিকা পর্যন্ত নাইজেরিয়ায় মুসলিম হত্যা চলছে। কোথাও বৌদ্ধদের হাতে নিহত হচ্ছে। কোথাও বোকো হারাম ও আইএস বা এ জাতীয় গোষ্ঠীগুলোর হাতে নিহত হচ্ছে। ব্রিটিশ শিয়া ও আমেরিকান সুন্নি একই রকম। সবাই একটি কাঁচির দুই ফলার ন্যায়। তাদের চেষ্টা হলো, মুসলমানদের পরস্পরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া। এটিই হচ্ছে বিচ্ছিন্নতার ইচ্ছার বার্তা। এই ইচ্ছা হচ্ছে শয়তানি ইচ্ছা। তবে ঐক্যের বার্তাটি হলো : এই অনৈক্য থেকে অতিক্রম করতে হবে। পরস্পরের কাছে অবস্থান করবে। এক সঙ্গে কাজ করতে হবে।
আজ বিশে^র ক্ষমতাদর্পী ও জাতিসমূূহের অতীব গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলো দখলকারীদের বক্তব্যের দিকে আপনারা যদি লক্ষ করেন দেখবেন যে, সবখানেই অনৈক্যের আহ্বান। প্রাচীনকাল থেকেই ইংরেজদের পলিসি সম্পর্কে বলা হত যে, ‘অনৈক্য সৃষ্টি কর আর শাসন কর।’ ডিভাইড অ্যান্ড রুল অর্থাৎ অনৈক্যের সুযোগ নিয়েই কর্তৃত্ব চালাও। ইংরেজদের হাতে যতদিন ক্ষমতা ছিল এটি ছিল তাদের নীতি। আজকেও এই পলিসি আজকের বস্তুগত দুনিয়ার ক্ষমতাধররা চালিয়ে যাচ্ছে। তা আমেরিকা হোক বা আবারো সাম্প্রতিক ইংরেজরা হোক।
ইংরেজরা আমাদের এ অঞ্চলে সবসময় মন্দের উৎস ছিল। সর্বদা জাতিসমূহের দুর্দশা-দুর্গতির কারণ ছিল। এরা এতদঞ্চলের জাতিসমূহের জীবনের ওপর যেসব আঘাত হেনেছে তা দুনিয়ার কোন অংশেই কোন শক্তির দ্বারা হানা হয়েছে কিনা তার নজির নেই। ভারতীয় উপমহাদেশে- যা বর্তমানে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ- এমন আঘাত হেনেছে, সেখানকার জনগণের ওপর এতখানি যুলুম চালিয়েছে, আফগানিস্তানের ওপর এক রকম যুলুম, ইরানের ওপর অন্যভাবে, ইরাক অঞ্চলে একভাবে, অবশেষে ফিলিস্তিনেও এমন খবিসিপূর্ণ তৎপরতা চালিয়েছে, তাতে মুসলমানদেরকে এবং প্রকৃতপক্ষে একটি জাতিকে উদ্বাস্তুতে পরিণত করেছে। তাদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করেছে। কয়েক হাজার বছর থেকে ইতিহাসে ‘ফিলিস্তিন’ নামে রেকর্ড আছে এমন একটি দেশ ইংরেজদের পলিসির কারণে অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে। এতদঞ্চলে দুই শতক থেকে এ দিকে, দুই শতাব্দী ও আরো কিছুকাল হবে, প্রায় ১৮০০ সাল থেকে নিয়ে এদিকে ইংরেজদের দ্বারা যা কিছু সংঘটিত হয়েছে সবই ছিল মন্দ, বিপর্যয় ও হুমকি। এ সময় এই ইংরেজ গভর্নর (ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বাহরাইনে অনুষ্ঠিত পরস্য উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের বৈঠকে এ কথা বলেন) এখানে এসে বলেন যে, ইরান এতদঞ্চলের জন্য হুমকি। ইরান কি এতদঞ্চলের জন্য হুমকি? এটা বলার জন্য বড় ধরনের নির্লজ্জতার দরকার। যারা বছরের পর বছর, দীর্ঘকাল ধরে এতদঞ্চলের জন্য হুমকি, দুর্দশা-দুর্গতি ও বিপদ ডেকে এনেছে তারা এসে আমাদের প্রিয় মযলুম দেশটিকে অভিযুক্ত করছে! এদের চরিত্রটাই আসলে এমন।
[লাল কালি এই অংশ হাইলাইট হবে
যখন থেকে এতদঞ্চলে ইসলামি জাগরণের আলামত দেখা গেছে, তখন থেকে অনৈক্য সৃষ্টির তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এরা জাতিসমূহের ঘাড়ে সওয়ার হওয়ার জন্য অনৈক্যকে একটি মাধ্যম হিসেবেই জানে। যে সময় থেকে তারা অনুভব করেছে যে, এতদঞ্চলে নতুন বক্তব্য, নতুন ইসলামি চিন্তাধারা, জাতিসমূহের উত্থান, জাতিসমূহ পুনরুজ্জীবিত ও শির উন্নত করার তৎপরতা শুরু হয়েছে তখন থেকেই দুশমনের অনৈক্য সৃষ্টির প্রয়াস ও প্রচেষ্টা জোরদার হয়েছে। ইরানে যখন থেকে ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে, ইসলামের ঝা-া উড্ডীন করেছে, কোরআন মজীদকে হস্তে ধারণ করেছে এবং গর্বের সাথে ঘোষণা দিয়েছে যে, আমরা ইসলাম অনুযায়ী আমল করছি আর রাষ্ট্রক্ষমতা, রাজনীতি, সেনাবাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী ও সবকিছুই সাথে রয়েছে আর দিনের পর দিন তা আরো জোরদার করেছে তখন তারা এই অনৈক্য সৃষ্টির তৎপরতা অধিকতর জোরদার করেছে। উদ্দেশ্য হলো এই ইসলামি গণজাগরণ ও ইসলামের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার মোকাবিলা করা।
ইসলাম তাদের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ, কেননা, ইসলাম মুসলমানদের জাগ্রত করেছে। তবে যে ইসলামের কাছে সরকার নেই, সেনাবাহিনী নেই, রাজনৈতিক কাঠামো নেই, সম্পদ নেই, জিহাদি জযবায় উজ্জীবিত একটি মহান জাতি নেই, এমন ইসলামের সাথে তার অনেক তফাত আছে। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান বিশাল বিস্তৃত দেশ, জিহাদি প্রেরণায় উজ্জীবিত জাতি, তরুণ জনগোষ্ঠী মুমিন ও প্রাণচঞ্চল জনশক্তি, প্রচুর খনিজ সম্পদ, বিশে^র মাঝারি মানের চেয়ে উন্নত যোগ্যতা ও ক্ষমতা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের দিকে এগিয়ে যাওয়ার তৎপরতা এগুলো ইরানের রয়েছে। এ ধরনের ইরান তাদের জন্য অবশ্যই বিপজ্জনক। কেননা, যদি বিশে^র মুসলমানদের সামনে একটি মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তারা এটার সাথে শত্রুতা পোষণ করে। কোন কোন সময় যদি নম্রতা ভদ্রতা দেখিয়েও থাকে তা তাদের মিথ্যাচার। তাদের ভেতরে আছে সহিংসতা। তাদের কাজের আসল চরিত্র সহিংসতা। এ ধরনের একটি দুশমনের মোকাবিলার জন্য- যে দুশমনের না চরিত্র আছে, না আছে ধর্ম, আর না আছে ন্যায়বিচারÑ এদের বাইরের সাজগোছটা পরিপাটি; কিন্তু ভেতরে পুরোদমে একটি বন্যপশু, এ অবস্থায় জাতিসমূহকে সতর্ক ও প্রস্তুত থাকতে হবে।
আমাদের মতে আজকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তুতি হচ্ছে, মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলা। মুসলমানদেরকে অনৈক্য সৃষ্টির ব্যাপারে সজাগ সতর্ক থাকতে হবে। সব দলমতের লোকদেরই তা দরকার। এখানে শিয়া বা সুন্নি তফাত নেই। সকল ইসলামি দলের চেষ্টা করতে হবে, যাতে পরস্পরের মধ্যে যেসব অভিন্ন বিষয় রয়েছে সেগুলোর মধ্যে তাদের চিন্তাগত অনৈক্যগুলো লুকিয়ে যায়। অনৈক্যের বিষয়গুলোর প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করতে হবে।
[লাল কালি এই অংশ হাইলাইট হবে
পয়গাম্বর (আ.)-এর পবিত্র সত্তা সর্বস্তরের মুসলমানদের ভালোবাসা ও প্রবল আগ্রহের মধ্যমণি। সবাই নবীজিকে ভালোবাসে। এটিই মূলকেন্দ্রবিন্দু। কোরআন মজীদ সর্বস্তরের সব মুসলমানের প্রাণের আকর্ষণ। কাবা শরীফও সেরূপই। মুসলমানদের মধ্যে অভিন্ন সূত্র কতই না বেশি! এসব অভিন্ন সূত্রের দিকে অধিক মনোযোগ নিবদ্ধ করতে হবে।
এতদঞ্চলে দুশমনদের অনুচর কারা, বিশে^র দাম্ভিক শক্তিগুলোর অনুচর কারা তাদেরকে চিনে নিন। দুঃখজনক হলো, সেই সরাসরি দুশমনটি এসে বলছে যে, তোমরা পরস্পর শত্রু। এই দেশটি তোমাদের জন্য হুমকি। অর্থাৎ তোমরা তাদের শত্রু। আর তারাও তোমাদের শত্রু। সে তো দুশমন বলেই এসব কথা বলছে। তাতে বুঝাই যায় যে, এমন কথা কেন বলছে। যারা তার কথা শুনছে, তারা তো বাহ্যত ইসলামি এবং ইসলামের নামেই জীবন যাপন করছে, দেশ শাসন করছে। তারা কেন ওর কথা মেনে নেবে? তার কথা কেন সত্য জ্ঞান করবে? কেন এতদঞ্চলের কতিপয় সরকারের চলার পথ আর দুঃখজনকভাবে ইসলামের প্রকাশ্য শত্রু ও ইসলামি উম্মাহর জঘন্য শত্রুদের চলার পথ এক হবে?
আমি যে কথাটি আমাদের স্বজাতির উদ্দেশে আরয করব, ইরানের যে প্রিয় জাতি ইসলামি প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পরের বছরগুলোতে এবং একইভাবে সংগ্রাম চলাকালীন বছরগুলোতে, যার পরিণতিতে শেষ পর্যন্ত ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হয়েছে সেই উত্তুঙ্গ সংগ্রামের বছরগুলোতেও বহু পরীক্ষা দিয়েছে ও কৃতকার্য হয়েছে। তাদের প্রতি আমার আরয হলো, এই রাস্তাটি যা বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেইনীর চলার পথ এবং বিপ্লবের পথ এই পথ আপনারা ছেড়ে যাবেন না। এই পথ ধরে চলবেন। দুনিয়ার সম্মান ও ঊর্ধ্বলোকের জগতের সম্মান এই পথ ধরে চলার ওপরই নির্ভরশীল। এই পথ কোরআনকে আঁকড়ে ধরার পথ। আহলে বাইতকে আঁকড়ে ধরার পথ। আল্লাহর হুকুম আহকাম আঁকড়ে ধরার পথ। দুশমনের মোকাবিলায় রুখে দাঁড়াবার পথ। সত্য প্রকাশে কাউকে সমীহ না করা এবং সত্যের পক্ষে সাহসের সাথে দাঁড়ানোর পথ। এটি সেই পথ যা আমাদের জাতি যদি অনুসরণ করে- আলহামদু লিল্লাহ এ পর্যন্ত তারা এ পথ ধরে অগ্রসর হয়েছে, রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের অনুসরণ করে তারা অগ্রসর হয়েছে এবং এই গৌরবময় পথ ধরে চলেছে, যদি এই পথ ধরে চলা অব্যাহত রাখে, এই সংগ্রাম চালাতে থাকে তাহলে এই জাতির দুনিয়া ও আখেরাতের চাহিদা পূরণ হয়ে যাবে। দুনিয়ার অন্য মুসলমানরাও উপকৃত হতে পারবে।
আমরা সকল ইসলামি দেশ ও মুসলিম সরকারের প্রতি পারস্পরিক সহযোগিতা, সাহায্য ও সহমর্মিতা পোষণের জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। আর এটি এমন এক আহ্বান যার মধ্যে সবার জন্য উপকার ও কল্যাণ রয়েছে।
আশা করি মহান আল্লাহ তা‘আলা তার অপার রহমত বরকত ও কল্যাণ ইসলামি উম্মাহর সবার প্রতি অবারিত করবেন। সকল ইসলামি দেশ ও জনগণের ওপর নাযিল করবেন। আর দুশমনের অনিষ্ট এতদঞ্চল থেকে ইনশাআল্লাহ দূরীভূত করবেন।
ওয়াসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ।
উল্লেখ্য যে, মহামান্য রাহবারের ভাষণের শুরুতে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট হুজ্জাতুল ইসলাম রুহানি সংক্ষিপ্ত আলোচনা পেশ করেন।
এবারের ৩০তম ইসলামি ঐক্য সম্মেলন ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬ থেকে তিনদিন ব্যাপী ইরানের রাজধানী তেহরানে অনুষ্ঠিত হয়।

জ্যোতির্ময় মহামানব : ইমাম আলী বিন মূসা রেযা (আ.)

খন্দকার মোঃ মাহফুজুল হক

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষ সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জন্য উত্তম জীবন বিধান নির্ধারণ করে দিয়েছেন, সেই ঐশী জীবন বিধান বা আল্লাহর বাণী বহন করে যুগে যুগে একদল নিষ্কলুষ, আলোকময় পুরুষ দুনিয়াতে আবির্ভূত হয়েছেন। তাঁরা আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত, প্রেরিত। আল্লাহর বাণীবাহক এই আলোকিত মহামানবগণ নবী বা রাসূল নামে আখ্যায়িত হয়েছেন। হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে হযরত মুহাম্মাদ (সা.) পর্যন্ত আলোক অভিযাত্রিগণের এ যেন এক সুদীর্ঘ কাফেলা। তাঁরা সমকালের মানবগোষ্ঠীর মাঝে আবির্ভূত হয়েছেন পর্যায়ক্রমে। একজনের কাজ
সমাপ্ত হতেই অন্যজনের হাতে কাজের দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছে। এ দীর্ঘ কাফেলার সর্বশেষ মহামানব হলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এই ইহধাম ত্যাগ করার পর সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতির কাছে আর কোন পয়গম্বর আসবে না। নবী বা রাসূল প্রেরণের পরিসমাপ্তি ঘটেছে শেষ পয়গম্বর আবির্ভূত হওয়ার মধ্য দিয়ে। তাই বলে ঐশী জ্ঞান বিতরণের কাজ বন্ধ হয়ে যায় নি। কোন দিন তা বন্ধও হবে না। কারণ, সর্বশেষ পয়গম্বরের মাধ্যমে মানবজাতির কাছে যে জীবন বিধান পাঠানো হয়েছে তা চিরন্তন। মহাপ্রলয় পর্যন্ত এই জীবন বিধান কার্যকর থাকবে। অতএব,এই জীবন বিধান বুকে বহন করে নির্ভুলভাবে তা ব্যাখ্যার মহান দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে বিশ্বনবীর সুযোগ্য ও জ্যোতির্ময় উত্তর পুরুষের একটি ক্ষুদ্র দলের ওপর। তাঁরা আহলে বাইতের পবিত্র ইমাম হিসেবে পরিচিত হয়েছেন। তাঁদেরই একজন হলেন ইমাম আবুল হাসান আলী বিন মূসা রেযা (আ.)। তিনি পবিত্র নবীবংশ বা আহলে বাইতের অষ্টম ইমাম। ১৪৮ হিজরির ১১ জিলকদ মদীনা শরীফে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
ইসলামের ইতিহাস গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হয় যে, পবিত্র আহলে বাইতের মনোনীত বারো জন ইমাম পবিত্র কোরআন ও রাসূল (সা.)-এর সুন্নাহর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের একমাত্র অনুমোদিত ব্যক্তি। তাঁরা এই মহান কাজের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে। বিশ্বনবীর মাধ্যমে মানবম-লীর কাছে যে জীবন বিধান পাঠানো হয়েছে তা সর্বকালীন। কেয়ামত পর্যন্ত নতুন কোন ঐশী বিধান মানুষের কাছে পাঠানো হবে না। পবিত্র কোরআনের চিরন্তনতা এবং খতমে নবুয়্যত বা নবী-রাসূল প্রেরণের পরিসমাপ্তির এই দর্শন সু¯পষ্টভাবে এটাই ইঙ্গিত করে যে, রাসূলে পাক (সা.)-এর ইহধাম ত্যাগের পর এমন নেতৃত্বের প্রয়োজন যাঁরা নি®পাপ ও পূতপবিত্রতার জায়গা থেকে কোরআন ও সুন্নাহর সঠিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করবেন।
তাছাড়া নবীজির ওফাতকালীন কিছু ঘটনা পর্যালোচনা করলে তাঁর ওফাত-পরবর্তীকালে আধ্যাত্মিক নেতৃত্বের অপরিহার্যতার যৌক্তিক কারণ উপলব্ধি করা যায়। ঐ সময়ে মুসলমানদের সাথে তৎকালীন প্রবল পরাক্রমশালী রোমান সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রত্যক্ষ যুদ্ধ (মুতার যুদ্ধ) যেমন চলছিল তেমনি অপর প্রবল পরাক্রমশালী পারস্য সম্রাটও নবীজির ইসলামি দাওয়াতের প্রত্যুত্তরে চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেছিল। অন্যদিকে কিছু ভ- নবীর উত্থানের পাঁয়তারা চলছিল। যে কারণে অন্তিম সময়ে নবীজি ফেতনা-ফ্যাসাদ চতুর্দিক থেকে ধেয়ে আসছে বলে আক্ষেপও করেছেন! একইভাবে ঐ সময় মুহাজির ও আনসারগণের মধ্যেও প্রচুর পক্ষ পরিবর্তনকারীর অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। অতএব, একজন বিচক্ষণ সত্যদ্রষ্টা, সর্বশ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হিসেবে শেষনবী তাঁর অনুসারীদের পথপ্রদর্শন, ঐক্যবদ্ধ রাখা এবং আসন্ন চরম বিশৃঙ্খলা মোকাবেলা করার জন্য কোনো সুযোগ্য নেতা নির্বাচনের গুরুত্বকে অবহেলা করবেন, বা এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি উম্মতের হাতে ছেড়ে দিয়ে যাবেন, এমন বক্তব্য ইসলামের মৌলিক দর্শনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হয় না।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে ¯পষ্টই উপলব্ধি করা যায় যে, নবী করিম (সা.)-এর ওফাতের পর মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্বের বিষয়টি বিদায় হজ্বের অব্যবহিত পরে গাদীর খুম নামক স্থানেই সুরাহা হয়েছিল। এ বিষয়ে আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ প্রত্যাদেশ বাণীতে বলা হয়, ‘হে রাসূল! পৌঁছে দিন আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে। আর যদি আপনি এরূপ না করেন, তবে আপনি তাঁর পয়গাম কিছুই পৌঁছালেন না।’ (মায়েদা : ৬৭)
আদিষ্ট হওয়ার পর নবীজি সমবেত মুসলমানদের উদ্দেশে হযরত আলীকে মুসলমানদের নেতা এবং কোরআন ও সুন্নাহর ব্যাখ্যাতা হিসেবে ঘোষণা দেন। কিন্তু নবীজীর ওফাতের অব্যবহিত পর মুহাজির ও আনসারগণের একাংশের একটি সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে খলিফা নির্বাচনের কাজ স¤পন্ন হয়ে যায়, ফলে মুসলিম সাম্রাজ্যে আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব এবং প্রধান নির্বাহীর পদে বিভক্তির ধারা সূচিত হয়।
যাই হোক, গাদীরে খুমে আল্লাহর রাসূলের ঘোষণা থেকে উৎসারিত আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব কোটি কোটি মুসলমানের জন্য আলোকবর্তিকা হয়ে আছে। পবিত্র নবীবংশের অষ্টম পুরুষ ইমাম রেযা (আ.) ঐ আধ্যাত্মিক নেতৃত্বেরই অন্যতম প্রাণ পুরুষ। তিনি ১৮৩ হিজরিতে স্বীয় পিতা নবীবংশের সপ্তম পুরুষ ইমাম মূসা কাযেম (আ.)-এর শাহাদাতের পর পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে মুসলিম উম্মাহর ইমামতের ঐশী দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
তিনি মানুষকে সত্য, ন্যায় ও কোরআন সুন্নাহর পথে চলার আহ্বান জানাতেন। তাঁর বক্তৃতা এবং উপদেশ বাক্যে পবিত্র কোরআনের উদ্ধৃতি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ব্যবহৃত হতো। জীবনের সর্বক্ষেত্রে কোরআনের দিকনির্দেশনা গ্রহণ করার জন্য তিনি মানুষকে নসিহত করতেন। এ স¤পর্কে তিনি বলেছেন, ‘কোরআন হচ্ছে আল্লাহর বাণী, কোনক্রমেই তা উপেক্ষা করো না, কোরআন ব্যতীত অন্য কোন কিছু থেকে দিকনির্দেশনা গ্রহণ করার চেষ্টা করো না, কারণ, তা তোমার জন্য বিচ্যুতি ও বিভ্রান্তি ডেকে আনবে।’ তিনি বেশির ভাগ সময় কোরআন অধ্যয়ন ও গবেষণায় ব্যয় করতেন, প্রতি তিন দিনে একবার কোরআন খতম করা তাঁর অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল।
নবীবংশের প্রত্যেক ইমামের জীবন মহৎ গুণ, জ্ঞান, আর কল্যাণের নানা ঐশ্বর্যের মহিমায় সমুজ্জ্বল। ইরানের সর্বোচ্চ নেতার ভাষ্য অনুযায়ী ইমামদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো সামাজিক-রাজনৈতিক সংগ্রাম। ইসলামের মধ্যে নানা বিকৃতি চাপিয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই সোচ্চার ছিলেন বিশ্বনবী (সা.)-এর পবিত্র আহলে বাইতের ইমামগণ। হিজরি প্রথম শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ইসলামি খেলাফত যখন সু¯পষ্টভাবেই রাজতন্ত্রের রূপ নেয় এবং ইসলামি নেতৃত্ব জাঁকজমকপূর্ণ বাদশাহিতে রূপান্তরিত হয়, তখন থেকেই আহলে বাইতের সম্মানিত ইমামগণ সকল অব্যবস্থা বা
অসঙ্গতির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রাম চালাতে থাকেন। তাঁদের সংগ্রামের বৃহত্তর লক্ষ্য ছিল প্রকৃত ইসলাম এবং ইমামতের ভিত্তিতে হুকুমাত প্রতিষ্ঠা করা।
ইমাম রেযা (আ.)-এর ইমামতির সময়কাল ছিল বিশ বছর। এই বিশ বছরে আব্বাসী তিনজন শাসক যথাক্রমে বাদশাহ হারুন এবং তার দুই পুত্র আমিন ও মামুনের শাসনকাল তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই ইমাম রেযা (আ.) তাঁর পিতা ইমাম মূসা কাযেম (আ.)-এর নীতি-আদর্শকে অনুসরণ করেই এগিয়ে গেছেন। ফলে ইমাম মূসা কাযেম (আ.)-এর শাহাদাতের পেছনে যে উপাদানগুলো সক্রিয় ছিল, ইমাম রেযাও সেসবের মুখোমুখী হন। অর্থাৎ কায়েমি স্বার্থবাদী মহলের নেপথ্য রোষের মুখে পড়েন তিনি। আব্বাসী রাজবংশে বাদশা হারূন এবং মামুনই ছিল দোর্দ- প্রতাপশালী। তাঁরা প্রকাশ্যে আহলে বাইতের ইমামদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভক্তি প্রদর্শন করতেন, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ইমামদেরকে হত্যার চক্রান্ত করতেন।
ইমাম কাযেমের শাহাদাতের পর মদীনা শরীফের প্রভাবশালী ও জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা ইমাম রেযার প্রতি ঝুঁকে পড়েন। ইমামের প্রতি ইমানদার মুসলমানদের এই আগ্রহ আব্বাসী খলিফা মামুনকে বিচলিত করে তুলে। নবীবংশের এই ইমামের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তাকে খলিফা মামুন তাঁর ক্ষমতার জন্য বড় হুমকি হিসেবে ধরে নেন। ফলে ধূর্ত মামুন ইমাম রেযাকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার নীতি গ্রহণ করেন। অবশ্য উমাইয়া এবং আব্বাসী সব শাসকই নবীবংশের সকল ইমামকে গণবিচ্ছিন্ন করে রাখার কৌশল গ্রহণ করেছিল। মামুন যখন দেখল যে, ইমাম রেযার ক্ষেত্রে এই পুরানো কৌশল খুব একটা কার্যকরী হচ্ছে না, তখন তিনি ইমামকে মদীনা শরীফ থেকে তাঁর রাজধানী ইরানের অন্তর্গত খোরাসানে আসার আমন্ত্রণ জানান। ইমাম প্রথমত রাজি হন নি, কিন্তু পরবর্তীকালে তাঁকে আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়। এরপর খলিফা নানা নাটকীয়তার আশ্রয় নেন। শেষ পর্যন্ত ইমামকে বিষ প্রয়োগে শহীদ করা হয়। তখন ইমামের বয়স ছিল মাত্র পঞ্চান্ন বছর। এভাবে ২০৩ হিজরির সফর মাসের ১৭ তারিখ ইসলামের ইতিহাসে আরেকটি কালো দিবস হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়।
বিষ প্রয়োগে ইমামকে শহীদ করা হলেও আসল মৃত্যু ঘটেছিল মামুনেরই। পক্ষান্তরে ইমাম শাহাদাতের পেয়ালা পান করে অমর হয়ে গেলেন চিরকালের জন্য। তার প্রমাণ মেলে মাশহাদে তাঁর পবিত্র সমাধিস্থলে গেলে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ যিয়ারতের উদ্দেশ্যে তাঁর মাযারে উপস্থিত হয়। ইমামের জন্মদিনে তাঁর মাযার প্রাঙ্গনে লাখো মানুষের ঢল নামে। সোনালি রঙ্গের সমাধি-ভবনের চারপাশ জাঁকজমক আর অপূর্ব ঐশ্বর্যে কোলাহল-মুখর হয়ে ওঠে। যুগ যুগ ধরে মানুষের নেক বাসনা পূরণের উসিলা হিসেবে কিংবদন্তিতুল্য খ্যাতি রয়েছে নবীবংশের ইমামগণের।
ইমাম রেযা (আ.) ও তাঁর পবিত্র মাযারও এর ব্যতিক্রম নয়। শুধু মাযার প্রঙ্গনই নয়, ইমামের সমাধিকে বুকে ঠাঁই দিয়ে পবিত্রতার সম্মানে সিক্ত হয়েছে গোটা খোরাসান প্রদেশ। ভক্তি ও আনত শ্রদ্ধায় খোরাসানবাসী মহান এই ইমামকে ‘শাহে খোরাসান’ খেতাবে সম্বোধন করে থাকে।
ইমাম রেযার অসংখ্য বক্তব্য এবং অগণিত উক্তি মানবজাতির জন্য অমূল্য স¤পদ ও পথ চলার উত্তম পাথেয় হয়ে আছে। এখানে তাঁর মহামূল্যবান কয়েকটি বাণী তুলে ধরা হলো।
‘জ্ঞান ও প্রজ্ঞা হচ্ছে এমন এক গচ্ছিত স¤পদের মতো যার চাবি হলো, প্রশ্ন। আল্লাহর রহমত তোমাদের ওপর বর্ষিত হোক, কারণ, প্রশ্নের মাধ্যমে চার ধরনের মানুষ অর্থাৎ প্রশ্নকারী, শিক্ষার্থী, শ্রবণকারী ও প্রশ্নের উত্তরদাতা সাওয়াব বা পুণ্য অর্জন করে।’
‘মুমিন ক্রোধান্বিত হলেও, ক্রোধ তাকে অপরের অধিকার সংরক্ষণ থেকে বিরত করে না।’
‘কিয়ামতের দিনে সেই ব্যক্তি আমাদের সর্বাধিক নিকটবর্তী হবে, যে সদাচরণ করে এবং তার পরিবারের সাথে সদ্ব্যবহার করে।’
‘যদি কেউ কোন মুসলমানের সাথে প্রতারণা করে, তবে সে আমাদের কেউ নয়।’
‘তিনটি কাজ সবচেয়ে কঠিন : এক. ন্যায়পরায়ণতা ও সত্যবাদিতা। দুই. সর্বাবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করা। তিন. ঈমানদার ভাইকে নিজ স¤পদের অংশীদার করা।’
লেখক : গবেষক ও লেখক

মহানবী (সা.)-এর আদর্শ ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবনের শিক্ষা

মাহদী মাহমুদ

আমাদের নবী একজন মানুষ। ইসলামের মহানতম ব্যক্তিত্ব! সারা জগতের সেরা সৃষ্টি। অন্যদিকে, গৌতম বুদ্ধ, মহাত্মা গান্ধী, কনফুসিয়াস, শ্রী বিবেকানন্দ, লালন ফকির প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ ছিলেন সমাজের আর দশজন থেকে একেবারেই অন্যরকম।
যেখানে আমাদের নবী ছিলেন গৃহি সেখানে অন্য অনেক মহাপুরুষ ছিলেন সন্ন্যাসী। তাঁদের কেউ কেউ বিয়ে-শাদী করেন নি। কেউ বিয়ে করলেও পরে কঠোর ব্রহ্মাচার্য গ্রহণ করেছিলেন! কেউবা সংসারত্যাগী। কেউবা ধ্যানী ছিলেন। কেউবা নির্জন সাধনার মাধ্যমে আত্মবিলয় লাভ করেছিলেন! কেউবা আধ্যাত্মিক আনন্দে আবিষ্ট হয়ে জগৎ-সংসারকে ভুলে ছিলেন।
আমাদের নবী ১১টি বিয়ে করেছিলেন। তাঁর একজন পালক সন্তান ছিল। তিনি আমাদের মতই সমাজে বসবাস করতেন। তিনি ঘুমাতেন। খাদ্য গ্রহণ করতেন। স্ত্রীদের সাথে সময় অতিবাহিত করতেন। নিজ স্ত্রী-সন্তানের মৃত্যুতে কাঁদতেন। হাসি-মজাও করতেন মাঝে মাঝে। তিনি ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। ছিলেন সামাজিক কার্যকলাপের কেন্দ্রবিন্দুতে। খেটে খুটে নিজের খাদ্য জোটাতেন।
সত্যি বলতে এই পারিবারিকতা-সামাজিকতা-গৃহিত্বই আমাদের নবীর এক বড় বৈশিষ্ট্য। আমাদের গর্ব আর শিক্ষার ক্ষেত্র। প্রয়োজন শুধু বস্তুবাদী-নাস্তিক্যবাদের চশমা ত্যাগ করে ইসলামের নবীকে ধর্মের প্রকৃত দর্শনের ক্ষেত্র থেকে মূল্যায়ন করা। তবেই নবীর ওপর আরোপিত ভুল ধারণাগুলো আমরা অপনোদন করতে সক্ষম হব এবং নবীর জীবন থেকে প্রকৃত নূর বা আলোকের উৎস খুঁজে পাব।
বস্তুবাদী ব্যাখ্যা অনুযায়ী ধর্ম মানবজীবনের নিছক একটি অংশ। মানুষ একরকমের জৈব যন্ত্র। কাজ-কর্ম-দুঃখ-কষ্টের দোলাচলে মানুষ ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে যায়। কখনো নিরাশ হয়ে পড়ে। স্থবিরতা দেখা দেয়। সেই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কিছু অবস্তুগত মোটিভেশনের দরকার হয়, ধর্ম হলো মোটিভেশন।
আর ধর্মের প্রকৃত দর্শন অনুযায়ী ধর্ম জীবনের নিছক একটি অংশ নয়; বরং এই ক্ষণস্থায়ী অথচ সার্বিক জীবনাচার ও ও ব্যবস্থাপনার অপরিহার্য অঙ্গ বা চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রক! আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপে ধর্মের যৌক্তিক প্রয়োগ আছে।
ইসলাম অনুযায়ী পলিটিক্স মানেই ম্যাকিয়াভেলিক ধোঁকাবাজি নয়। কৌটিল্যের কূটচাল নয়! ইসলামে পলিটিক্স, ইকোনমিক্স কিংবা জার্নালিজম সবই এথিক্সের সাথে জড়িত। আর এথিক্স এর ভিত্তি এখানে ধর্ম।
যাহোক, কথা হচ্ছে, মুহাম্মাদ (সা.) যে বিকশিত একত্ববাদী ধর্ম নিয়ে এসেছেন, সেটা একটি ব্যবহারিক বিজ্ঞান। নেহায়াত কোন থিওরিটিকাল সায়েন্স নয় (অর্থাৎ শুধু একটি উচ্চ-মানস শ্রেণির বোধগম্য আধ্যাত্মিক শ্লোক এর সমস্টি নয়)।
ইসলামের আবেদন রয়েছে জ্ঞানী-মূর্খ, ধনী-দরিদ্র, পাপী-নিষ্পাপ, নারী-পুরুষ, আরব-অনারব, রাজা-প্রজা, রোগী-নিরোগ সবার প্রতিই।
অর্থাৎ একবিংশ শতাব্দীতে সারা দুনিয়া যখন একটি সর্বজনীন জীবন ব্যবস্থার মুখাপেক্ষিতা অনুভব করছে, ইসলাম সেখানে একটি পূর্ণাঙ্গ সমাধান; শুধু সাপ্তাহিক ‘ঝঢ়রৎরঃঁধষ জবভৎবংযবৎ’ নয়।
আমাদের নবী একটি গণমুখী জীবনব্যবস্থা নিয়ে এসেছেন। আর তাঁর মাঝে রয়েছে সেই জীবনব্যবস্থার বাস্তব ও জীবন্ত রূপ। প্রতিটি শ্রেণির মানুষের জীবনের প্রতি পদক্ষেপের প্রতিটি জীবনঘনিষ্ঠ প্রশ্নের জন্য নবী করিম (সা.)-এর জীবনে রয়েছে উত্তর। আমাদের জন্য নবী (সা.)-এর জীবনের কোন প্রেক্ষাপটই অপরিচিত নয়।
আমাদের নবী সমস্যা-দুঃখ-কষ্ট থেকে পালিয়ে গিয়ে জীবনের পরীক্ষার সমাধান করেন নি। তিনি মানব-পরিবার-সমাজ-রাজনৈতিক-রাষ্ট্রীয় জীবনের সমস্যাসঙ্কুল ঘূর্ণিপাক আর জটের মধ্যে থেকে যুদ্ধ করেই জীবনে জয়ী হয়েছেন। তিনি পারিবারিক কিংবা সামাজিক সমস্যার মোকাবেলা করেছেন। দারিদ্রের কষ্টকে মোকাবেলা করেছেন। তিনি আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন, সমস্যা থেকে পালিয়ে যাওয়া কোন সমাধান নয়, সমস্যার মধ্যে থেকে সেগুলোর স্থায়ী সমাধান করাই মানবীয় দায়িত্ব। বস্তুজগতের মধ্যেই অধ্যাত্ম-জগতের সন্ধান দিয়েছেন রাসূলুল্লাহ (সা.)। এখানেই তাঁর স্বাতন্ত্র্য।
উপমহাদেশের একজন আলেমের একটি উক্তি এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য, ‘রাসূল (সা.) মিরাজে গিয়ে আল্লাহর দিদার লাভ করার পরেও আল্লাহর সান্নিধ্য ছেড়ে আবার বস্তুগত পৃথিবীতে ফিরে এসেছিলেন। আমি হলে কখনোই ফিরে আসতে সক্ষম হতাম না। আর এখানেই রাসূল (সা.)-এর শ্রেষ্ঠত্ব।’
এখানেই সাধারণ আধ্যাত্মিক পুরুষগণের সাথে রাসূল পাকের পার্থক্য। অপরদিকে অনেক মহাপুরুষই জীবনের কাঠিন্য আর বাস্তবতাকে বরদাস্ত করতে পারেন নি। তাঁদের চোখে ঈশ্বরের দুনিয়া শুধুই তাঁদের মনমতই রোমান্টিক হবে! যখন তাঁদের মোহমুক্তি ঘটে তখন তাঁরা ‘নিষ্ঠুর’ বাস্তবতা থেকে পলায়ন করেছেন। বনবাসে গিয়েছেন। নিজ পরিবার ত্যাগ করেছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাঁরা অন্যদের ফেলে রেখে নিজেরা শান্তি খুঁজেছেন আর অত্যাচারী শাসকদের হাতে নিষ্পেষিত মযলুমদের জন্য কিয়াম করেন নি! কেউ কেউ বিষয়টিকে এভাবে বলেছেনÑ ‘ক্ষুধার্ত মানুষের হাতে পুষ্টিবিজ্ঞানের তত্ত্বকথা তুলে ধরা!’
তাঁদের জীবনে নেই যুলুম-পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আবেদন। কিংবা তা থাকলেও নেই মযলুমদের সমতাভিত্তিক সমাজ-রাষ্ট্র-অর্থনীতি গড়ে তোলার মূলমন্ত্র ও বিধিবিধান। অর্থাৎ তাঁদের জীবন বাস্তব সমাজের প্রেক্ষাপটে একপেশে, অপূর্ণাঙ্গ। কিন্তু ইসলামের নবীর জীবন সাধারণ মানুষকে এক্ষেত্রে আশার আলো দিতে পারে।
এতিমদের জন্য তিনি প্রেরণা; কেননা, বিশ্বের সবচেয়ে বড় মহাপুরুষ হিসেবে তিনি নিজেই এতিমদের প্রতিনিধি। সাধারণ গণমানুষের মতই একজন তিনি।
আবার তিনি দরিদ্রপল্লির সন্তানও নন; বরং বিচিত্র, কিন্তু আমাদের পরিচিত এক পরিবেশে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। কাবাঘরের খাদেমের বংশে জন্ম নিয়েও কখনো তিনি মেষ চড়িয়েছেন। কখনো দাদা মুত্তালিবের সাথে শান-শওকত-মর্যাদা উপলব্ধি করেছেন। আবার চাচা আবু তালিবের পরিবারের দারিদ্র দেখেছেন খুব কাছ থেকে। মরুর দুরন্ত ছেলেদের মাঝে বেড়ে উঠেছেন। দুধ মায়ের সাথে ভিন্ন পরিবেশে শৈশব কাটিয়েছেন আর দশ জন আরবের মতই! ব্যবসা করেছেন চাচার সাথে সাথে। যুদ্ধ দেখেছেন। কষ্ট দেখেছেন। দারিদ্র অনুভব করেছেন। আবার নিজে হেরা গুহায় আত্মমগ্ন হয়েছেন (নিজ দায়িত্বকে দূরে সরিয়ে দিয়ে নয়!)।
সমাজের মানুষের সাথেই তিনি জীবনযাপন করেছেন! তাঁর জীবন আমাদের থেকে ভিন্ন অক্ষে ছিল না। তিনি জীবনে বাস্তব পরিস্থিতির পেক্ষাপটে কম-বেশি ৭০ এর মত যুদ্ধ করেছেন। কখনো ভালোবেসেছেন। কখনো কঠোরতা দেখিয়েছেন। শাস্তি দিয়েছেন। কখনো ক্ষমা করেছেন। কারণ, এসব বৈপরীত্ব নিয়েই এ জীবন। কেউ যদি ভালোকে ভালোবাসতে চায় তবে মন্দকে অবশ্যই ঘৃণা করতে হবে! পরম ভালোবাসা সম্ভব নয় এই আপেক্ষিকতার দুনিয়ায়।
‘অপরাধকে ঘৃণা করো, অপরাধীকে না!’ এটি একটি থিওরিটিকাল কথা। কিন্তু এতে মানব-সমাজে অশান্তির কোন সমাধান নেই। অপরাধ একটি ক্রিয়ার নাম। ক্রিয়া নিজে ঘটে না। একজন মানুষকে তার ফ্রি উইল দিয়েই ঘটাতে হয়। তাই, শুধু অপরাধকে ঘৃণা করাই যথেষ্ট নয়, অপরাধীকে করুণা আর ক্ষেত্রবিশেষে অপরাধীকে ঘৃণা করতে হবে। তা না হলে সমাজে ন্যায়-অন্যায়ের কোন কার্যকরী পার্থক্য থাকবে না। এই ভিত্তিতে ছাড়া আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করে সামাজিক শান্তিও প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
‘অহিংসা পরম ধর্ম!’Ñ এটিও একটি থিওরিটিকাল সত্য। কিন্তু এর বাস্তবসম্মত ব্যাখ্যা প্রয়োজন।
আবার ‘আমরা শান্তি চাই। যুদ্ধ চাই না।’Ñ এটি একটি খোড়া একপেশে বাক্য। ক্ষেত্রবিশেষে যুদ্ধ, হিংসা, হিংস্রতা, অশান্তিকে দূর করতে যুদ্ধবাজ, হিংস্র, অশান্তিকামী নিপীড়কের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হতে হয়!
মহাত্মা গান্ধীর অহিংস বাণীকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করলেও বলতেই হবে, তিনি নিজেও ক্ষেত্রবিশেষে অপরাধীকে শাস্তি দিয়েছেন, কঠোর হয়েছেন এবং এর যৌক্তিকতাও উপলব্ধি করেছেন।
কিন্তু ইসলামের নবী তাঁর সমগ্র জীবনে যুদ্ধ করেছেন অন্ধ-বিশ্বাসের বিরুদ্ধে। বিশ্বাসের পরাধীনতার বিরুদ্ধে। চিন্তার স্বাধীনতার জন্য। পৌরহিত্যবাদের বিরুদ্ধে। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। যালেমের বিরুদ্ধে। শোষকের বিরুদ্ধে। তিনি সাধারণ মানুষ আর তাঁর নিজের মাঝে উপস্থিত সকল বস্তুগত ও অবস্তুগত বাধাকে সরিয়ে দিয়েছেন।
তিনি যে কোরআন নিয়ে এসেছেন তা যেকোন সংস্কারমুক্ত স্বাধীন চিন্তাধারার মানুষকেই পথ দেখাবে। মানুষের সাধারণ পথ প্রদর্শনে কোরআনের বাণী খুবই সহজ-সরল। আর জটিল সমস্যা সমাধানের জন্য নবীর জীবন, তাঁর বাণী, তাঁর বংশধর এবং আলেমগণ রয়েছেন।
কোরআন থেকে যেমন সাধারণ মূর্খ কৃষক আলোকপ্রাপ্ত হবেন, তেমনিভাবে ইবনে সিনা, ইবনে রুশ্দ, ফারাবি, মোল্লা সাদরার মত চিন্তাবিদ-দার্শনিকগণ গভীর চিন্তার খোরাক পাবেন। একজন অধ্যাত্মবাদী, অতীন্দ্রিয়বাদীও আত্মার খাদ্য পাবেন। বিপ্লবী পাবে বিপ্লবের চেতনা। আবার খারাপ নিয়্যতের মানুষ কোরআন পাঠ করে অন্ধকারের আরো গভীরেই প্রবেশ করবে! (কোরআনের আয়াত : এই কোরআন মুমিনদের জন্য পাথেয় আর কাফেরদের জন্য ক্ষতির কারণ)। প্রত্যেকে তার যোগ্যতা, জ্ঞান ও চিন্তার স্তর, নিয়্যত অনুযায়ী কোরআন থেকে ফলাফল লাভ করবে।
অন্য মহাপুরুষদের সাথে ইসলামের নবীর আরেকটা তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য পরিদৃষ্ট হয়। অন্য ধর্মের মহাপুরুষেরা বিশেষ বিশেষ প্রেক্ষাপটে তাঁদের ‘আধ্যাত্মিক’ জীবনধারা গ্রহণ করেছেন। যেমন, সম্রাট অশোক প্রথম জীবনে যুদ্ধে প্রচুর মানুষকে হত্যা করেন। পরে তাঁর মনে হিংস্রতার বিরুদ্ধে, জীব হত্যার বিরুদ্ধে একটি চেতনা সৃষ্টি হয় এবং তিনি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন।
ইসলাম খোদামুখী ধ্যান, সাধনা, কঠোর আত্মসংযম ইত্যাদির বিরোধী নয়। বরং ইসলাম এগুলোর জেনারালাইজেশনের বিরোধী। কারণ, ইসলাম এগুলোর মাধ্যমে সাধারণ্যে মূল্যায়িত হলে আমজনতা ঐ ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হতো না বরং ভীত হয়ে যেত। তাই নবী (সা.)-এর শিক্ষা হচ্ছে মধ্যপন্থার জীবন, যেটা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের জন্য হেদায়াতের পথ।
কিন্তু, নবীর জীবনের সাথে এবং ইসলামের ইতিহাসে বিশেষ ধরনের কতক আধ্যাত্মিক সাধকের ঘটনাও জড়িত, যাঁদেরকে নবী (সা.) নিজেই গড়ে তুলেছিলেন তাঁদের যোগ্যতা, তাঁদের ক্ষমতা আর ইচ্ছার ওপর ভিত্তি করে।
ইসলামের ইতিহাসে সাহাবিগণ অত্যন্ত সম্মানিত। তাঁদের জীবনেতিহাস আর জীবন শিক্ষা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
উসমান বিন মাজউন (রা.) ছিলেন একজন সন্ন্যাসী-প্রায় মানুষ। তিনি এতটাই আত্মসংযম চর্চা করতেন যে, তিনি তাঁর স্ত্রীকে বলতে গেলে ত্যাগ করেছিলেন। তিনি মাংস খেতেন না। এমনকি ইসলাম-পূর্ব জাহেলি যুগেও তিনি মদপান করেন নি। যদিও মহানবী (সা.) তাঁর মাত্রাতিরিক্ত আত্মসংযমের জন্য তাঁকে সতর্ক করতেন, তবুও উসমান বিন মাজউন আল্লাহ, তাঁর নবী ও নবীর আহলে বাইতের নিকট অত্যন্ত প্রিয়ভাজন ছিলেন। হযরত আলী (আ.) তাঁর এক পুত্রের নাম উসমান বিন মাজউনের প্রতি ভালোবাসাবশত রাখেন উসমান।
হযরত আবু যার গিফারি ছিলেন মরুদস্যু গোত্রের লোক। অথচ সত্যান্বেষী এই সাহাবী কঠোর আত্মসংযমী জীবন ধারা অনুসরণ করতেন। তিনি মহানবীর মৃত্যুর পর সমাজের ভোগবাদী জীবন ও অনিয়মের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন।
হযরত আলী (আ.) ছিলেন ন্যায়বিচারের প্রতিমূর্তি। তাঁর প্রতি এমনকি তাঁর যামানার ইহুদি, খ্রিস্টানগণও মুগ্ধ ছিল। তিনি সকল ধর্মের সবার প্রতি সাম্যের ভিত্তিতে বিচার করতেন। প্রবলতম শত্রুকেও গালি দিতে কঠোর নিষেধ ছিল তাঁর অনুসারীদের প্রতি! সবাইকে যথাযোগ্য সম্মান দিতেন এই মহাপুরুষ। তাঁর সম্প্রীতিবোধের বাণী প্রবাদতুল্য। জনগণের প্রতি ন্যায়শাসনের জন্য তিনি তাঁর প্রতিনিধি মালিক আশতারকে যে চিঠি লিখেছিলেন সেটি জাতিসংঘের প্রধান কার্যালয়ের বাইরের দেয়ালে ইংরেজি অনুবাদে টানানো রয়েছে!
এই সাহাবিগণের অনেকেই নবীর হাতে প্রশিক্ষিত। এভাবে নবীর সাহাবীদের জীবনে রয়েছে ভিন্নমাত্রার শিক্ষা।
নবীর পারিবারিক জীবন আমাদের পারিবারিক জীবনের জন্য শিক্ষার উৎস। তাঁর পারিবারিক জীবনে কখনো স্ত্রী খাদিজা, উম্মে সালামা কিংবা কন্যা ফাতেমার সাহচার্য তাঁকে শান্তি দিয়েছে। আবার কখনো পারিবারিক সমস্যাগুলোকে সামাল দিতে হয়েছে ধৈর্য আর প্রজ্ঞার সাথে। কিন্তু তিনি পালিয়ে যান নি। তিনি তাঁর পুত্রের মৃত্যুতে বিচলিত হলেও আত্মসমর্পণ করেন নি জীবনযুদ্ধে।
আমাদের নবী আর যেকোন মহাপুরুষের চেয়ে অনেক বেশি মযলুম-নির্যাতিত ছিলেন। সত্য সাধনার পথে মুনাফিকের কূটচক্রের শিকার হতে হয়েছে তাঁকে। সাম্রাজ্যবাদী, মূর্তিপূজারি পুরোহিত সমাজ তাঁকে বয়কট করেছিল। সেই অন্ধকূপ থেকেই তিনি মুক্তি দিয়েছিলেন মানবতাকে। বাস্তবসম্মতভাবে। সহজ-সরল ও বোধগম্য ভাবে। মানুষের সাথে, সমাজের সাথে, রাজনীতি আর অর্থনীতির মধ্যে থেকে তিনি কূটজাল ছিন্ন করে সমস্যার সমাধান করেছেন। তিনি ছিলেন নিষ্পাপ, কিন্তু তিনি কোন রোবোট ছিলেন না। তিনি ছিলেন মানুষ। যিনি তাঁর মনো-দৈহিক চাহিদা পূরণ করেছেন সুন্দরতম স্বাভাবিক উপায়ে এবং আমাদেরকেও তেমনটাই শিক্ষা দিয়েছেন। যে যতটুক ধারণক্ষমতাস¤পন্ন, নবীর শিক্ষা তাকে ততটাই হেদায়াত দেবে। যার অন্তর যত গভীর তার অন্তরে ততদূর পর্যন্ত আলো প্রবেশ করবে। যার অন্তর যতটা পরিষ্কার তার অন্তর ততটাই আলোক প্রতিফলন করবে। নবীর হেদায়াত সাধারণতম মানুষ থেকে অসাধারণতম মানুষ পর্যন্ত! শেষকথা, ইসলাম শুধু ব্যক্তিকেন্দ্রিক বা আত্মকেন্দ্রিক আত্মার সাধনার ধর্ম নয়। আবার নিজের প্রতি উদাসীন থেকে শুধু সমাজ-রাষ্ট্রমুখী সংশোধনের ধর্মও নয়; বরং ইসলাম হলো একই সময়ে ব্যক্তি ও সমস্টির আত্মিক-মনোদৈহিক-পারিবারিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাষ্ট্রীয়-জাগতিক উন্নয়নের মধ্যপন্থি ধর্ম, যেখানে ব্যক্তির ধর্ম আত্ম উন্নয়নের মাধ্যমে সমাজের উন্নয়নের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা আর সমাজের ধর্ম সামাজিক-রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের মাধ্যমে ব্যক্তির সকল প্রকার বিকাশের পথ সুগম করা।
অবিশ্বাসী কিংবা বস্তুবাদী সমাজব্যবস্থা এরকম সর্বব্যাপী ধর্ম চায় না। তারা চায় আংশিক এবং পঙ্গু ধর্ম যেগুলো তাদের শোষণব্যবস্থার ওপর বাধার সৃষ্টি করবে না। কিন্তু ইসলামের ক্ষেত্র তেমন আংশিক ক্ষেত্র বিশেষের জন্য নয়। ইসলামের নবীও আংশিক বা নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে প্রেরিত হন নি।
পরিশেষে আমরা নবী করিম (সা.)-এর সেই অমিয় হাদিসের কথা স্মরণ করব। মহানবী (সা.) বলেছেন : ‘স্ত্রী, সন্তান এবং বন্ধুদের প্রতি তোমার দায়িত্ব রয়েছে। তোমার উচিত সেগুলো পালন করা।’

ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদযাপনের তাৎপর্য

রাশিদ রিয়াজ

প্রতি বছর যথাযোগ্য মর্যাদায় আমরা উদ্যাপন করি পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)। যদিও ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন নিয়ে আমরা দুর্ভাগ্যবশত বিতর্ক ও বিভ্রান্তির বেড়াজালে আটকে গেছি। রাহমাতুল্লিল আলামীন নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর আগমনে দূরীভূত হয়েছিল অন্ধকার, নির্যাতন-নিপীড়ন-নিষ্পেষণের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছিল মানবতা। তার রেখে যাওয়া আদর্শ থেকে আমরা হয় অনেকটাই বিচ্যুত হয়ে গেছি বা সঠিকভাবে অনুসরণ করতে না পারায় আমাদের ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে ঘোর অমানিশার অন্ধকারের সৃষ্টি হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে প্রতিবছর ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদযাপনের তাৎপর্য কোথায়? আসলে আমরা নবী জীবন ও তার আদর্শ সঠিকভাবে উপলব্ধি করার পাশাপাশি তা আমাদের জীবনে কার্যকর করে তুলতে পারি নি। বিভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তি আমাদের মধ্যে এক ধরনের অনৈক্য সৃষ্টি করেছে যা চিন্তা ও মননে যেমন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে তেমনি লক্ষ্যভ্রষ্ট করে দিচ্ছে।

আল্লাহ মুসলমানদের বিশ্বে অনন্য জাতি হিসেবে তৈরি করেছেন। বিভিন্ন ইস্যুতে চিন্তাগত মতপার্থক্য থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু ধর্মের মৌলিক বিষয়গুলোতে পার্থক্য না থাকা সত্ত্বেও আমরা গোষ্ঠীগত স্বার্থের কারণে নিজেদের মধ্যে এত বিভেদ তৈরি করেছি যা আমাদেরকে পারস্পরিক বোঝাপড়ায় দূরত্ব তৈরি করছে। আল্লাহর রজ্জুকে যেখানে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরার কথা বলা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে খোদার রঙে নিজেকে রাঙাও সেখানে লম্বা টুপি না গোল টুপি, দাড়ি কতটুকু লম্বা হবে না ছোট হবে কিংবা বিভিন্ন দিবস উদযাপন জায়েজ কি নাজায়েয এধরনের বিষয় যা মৌলিক বিশ্বাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় তা নিয়ে আমরা এতটাই সময় ব্যয় করেছি এবং এভাবে অনৈক্যের আবর্তে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছি সেদিকে কোনো খেয়াল নেই।
একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের উচিত মহানবী (সা.)-এর আদর্শকে পুরোপুরি অনুসরণ করা। আর তা করতে পারলে আমাদের বর্তমান দৈন্য দশায় নিপতিত হয়ে থাকার কথা নয়। বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশের দিকে তাকিয়ে দেখুন, প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে শুরু করে ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া, সোমালিয়া, বাহরাইনসহ বিভিন্ন দেশের দিকে তাকিয়ে দেখুন মুসলমানদের কী অবস্থা! কি অর্থনৈতিক, কি সামাজিক, কি রাজনৈতিক, কি সামরিক সর্বক্ষেত্রেই মুসলমানরা মার খাচ্ছে। একই সঙ্গে ইসলামোফোবিয়া বা পশ্চিমা দেশগুলো সন্ত্রাসকে ইসলামের নামে ছড়িয়ে দিয়ে মুসলমান মাত্রই সন্ত্রাসী এমন একটি অপপ্রচার চালিয়ে আসছে। পশ্চিমা মিডিয়া এধরনের অপপ্রচারের প্রধান ধারক ও বাহক হয়ে উঠেছে। আর পশ্চিমা এই মিডিয়া কবলিত বিশ্বের বাকি দেশগুলোর মিডিয়া তাদের আবহেই খবরগুলো পরিবেশন করছে।
এমনি প্রেক্ষাপটে ঈদে মিলাদুন্নবী প্রতিবছর আমাদের দরজায় কড়া নাড়িয়ে জানিয়ে যাচ্ছে, আমরা কতটা নবীজীর আদর্শ সম্পর্কে জেনে বুঝে এবং সে অনুযায়ী জীবনের সকল ক্ষেত্রে অনুসরণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। দিবস উদযাপন আমাদেরকে সেই দিবসের তাৎপর্য সম্পর্কে আরো গভীরে যাওয়ার অনুপ্রেরণা যোগায়। এটা শিশু থেকে তরুণ-তরুণী, এমনকি বয়স্কদের পর্যন্ত জীবনের বিভিন্ন ধাপে বিভিন্নভাবে বিষয়টি অনুধাবনের উপাদান যোগায়। ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপনে একটি শিশু সহজেই জানতে চাইবে নবীজী (সা.) শিশুদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতেন, তিনি শিশুদের কী বলতেন, কতটা আদর করতেন, তেমনি তরুণদের সবচেয়ে সোনালি জীবনের অংশে তাদের প্রতি নবীজীর কী আহ্বান ছিল, বয়স্কদের প্রতি কী কী বিষয়ে নবীজী (সা.) হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন ইত্যাদি।
এখন দিবস উদযাপনের সঙ্গে সঙ্গেই যেমন বিষয়টি শেষ হয়ে যায় না তেমনি ঈদে মিলাদুন্নবী আমাদের প্রতিনিয়ত নবীজী (সা.)-এর আদর্শ থেকে আমরা আসলে কতটা দূরে কিংবা কতটা কাছে অবস্থান করছি সেই সম্পর্কে আত্মসমালোচনার তাগিদ সৃষ্টি করে। মনে রাখতে হবে যাঁর কারণে আমরা ইসলাম পেলাম তাঁর আগমনের দিনটি আমাদের কাছে স্বাভাবিকভাবেই অনেক গুরুত্ব বহন করে। কোন পরিস্থিতিতে, কোন প্রেক্ষাপটে তাঁর আগমন, আরবে তখন সার্বিক আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট কেমন ছিল আর আজকেই বা আমাদের জীবন যাত্রা কেমন চলছে তার মধ্যে একটা পার্থক্য যাচাই বাছাই করে নেয়ার এক মহাসুযোগ আমরা যে কোনো সময় পেতে পারি একথা যেমন সত্যি তেমনি দিবসের তাৎপর্য আমাদের মনে তা আরো বদ্ধমূল করে দিয়ে যায়।
আমরা অনেক সময় শিশুদের অযথা বকা দেই। গায়ে হাত তুলি। বাচ্চারা মসজিদে নামাযে গেলে অনেক সময় স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে সে হয়ত হেসে ওঠে, দুষ্টুমি করে, কিন্তু আমরা এমনভাবে চোখ রাঙ্গাই বা গালমন্দ করি তাতে মসজিদের সঙ্গে তার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অথচ আমরা জানি যে, নবীজীর নামায পড়া অবস্থায় অনেক সময় তাঁর দৌহিত্র ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন শিশুকালে তার কাঁধে উঠে যেতেন, নবীজী (সা.) তাঁদেরকে হাত দিয়ে সামলিয়ে সেজদায় অবনত হতেন। এমনকি সেজদায় যদি শিশু হাসান ও হোসাইন নবীজীর পিঠে চড়ে বসতেন, যতক্ষণ না তাঁরা নামতেন, নবীজী সেজদা থেকে উঠতেন না। ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে বাচ্চারা স্কুলে ছুটি পায়। নবীজী সম্পর্কে বিশেষ ক্লাস নেওয়া বা রচনা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে শিক্ষকরা শিশুদের কচি মনে চমৎকার ধারণা সৃষ্টি করতে পারেন।
অপসংস্কৃতি, প্রযুক্তির অপব্যবহার না করা, খেলার মাঠের অভাবে অতিরিক্ত টিভি না দেখা, মাদকাসক্ত হয়ে না পড়া, অসৎ সংসর্গে না যাওয়া, মসজিদে নামায পড়তে যাওয়া, পিতামাতা ও গুরুজনদের মেনে চলা, ছোটদের স্নেহ করা সহ হরেক রকম প্রায়োগিক শিক্ষা শিশু যদি পেয়ে থাকে এবং তার অনুশীলনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে তাহলে বাকি জীবনে তার পথভ্রষ্ট হওয়ার সুযোগ খুব কমই থাকে।
এবার আসা যাক তরুণ-তরুণীদের বিষয়ে। প্রচ- অভিমানী এ জীবনে ভালোবাসার কাঙ্গাল মন নিয়ে কিশোর-কিশোরীরা তরুণ ও তরুণীর বৃত্তে ঘুরপাক খেতে থাকে। তাদের উপযোগী করে নবীজী (সা.)-এর আদর্শের পূর্ণ পরিচয় জানান দেয়ার এক বিশাল দায়িত্ব আমাদের সকলের। একটি দেশের জনসংখ্যার ৩ থেকে ৪ কোটি তরুণ-তরুণী আগামী দিনের নেতৃত্বের দায়িত্ব কাঁধে নেবে। অপসংস্কৃতির জোয়ারের জোয়াল তার কাঁধে চেপে বসলে সে না পারে নিজেকে আলোকিত করতে, না পারে সমাজকে আলোকিত করতে। আগামী দিনের জন্য তার ব্যক্তিত্ব নির্মাণে ঈদে মিলাদুন্নবী তাই তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
এরপর বয়স্কদের কথা না বললেই নয়। জীবনের অনেক ত্রুটি নিজের কাছে ধরা পড়তে থাকে বলে মন অনেকটা থিতু হয়ে আসে। আর ভুল বুঝতে পেরে অন্য কেউ যাতে একই ভুলের ফাঁদে পা না দেয় সেজন্য নিজে শুধরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অন্যকে নতুন পথের সন্ধান দেয়া জরুরি হয়ে ওঠে মাঝ বয়সী থেকে শুরু করে মুরুব্বিদের মাঝে। ঈদে মিলাদুন্নবী তাঁদের কাছেও এক নতুন জীবনের হাতছানি দিয়ে উঠতে পারে।
কিন্তু আমরা যদি ঈদে মিলাদুন্নবী নিয়ে নিজেরাই বিপথগামী হয়ে তর্কে বিতর্কে লিপ্ত হয়ে থাকি তাহলে নিজে ও চারপাশ পরিবর্তনের সুযোগ পাব কিভাবে? নানা বিতর্কের আবর্তে পড়ে ঈদে মিলাদুন্নবীর মূল তাৎপর্য খুঁজে ফেরার পথই আমরা হারিয়ে ফেলছি। এটাতো সত্য, নবীজী আমাদের জীবনকে সহজ সরল সুন্দর করে তুলতে তাঁর আদর্শ রেখে গেছেন। কবে, কখন, কোথায় এসব নিয়ে বিস্তর বিতর্কে লিপ্ত না হয়ে আসুন আমরা নিজেদের উপলব্ধি করার প্রস্তুতি নেই। তাঁর আদর্শ এখনো আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যায়নি। কিন্তু যে ফেতনা-ফ্যাসাদ আমাদের পেয়ে বসেছে তা নিশ্চিত নবীজীর কাছ থেকে আমাদেরকে অনেক দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। বরং প্রতি বছর ঈদে মিলাদুন্নবীতে আমাদের শপথ আরো অনেক দৃঢ় হয়ে উঠতে পারে ধাপে ধাপে ধারাবাহিকভাবে নবীজীর আদর্শ অনুসরণের মধ্য দিয়ে।
ঘরে যথেষ্ট সময় দিতেন নবীজী (সা.)। বিবিদের রান্নার কাজে সহায়তা করতেন। নারীকে আজকের সমাজে পণ্যের বিজ্ঞাপন করে তোলার মধ্য দিয়ে আমরা প্রদর্শন বস্তু করে তুলে ফেলেছি। ফ্যাশন সংস্কৃতিতে যেটি প্রকট হয়ে দেখা যায়। এরপর নারীর প্রতি সহিংস আচরণ পত্রিকা খুললেই আমাদের মনকে কেন প্রভাবিত করে না বুঝি না। প্রবঞ্চনা, নারীকে ঘরের যাবতীয় কাজের মধ্যে ফেলে রেখে তাকে যেন কলুর বলদ করে ফেলেছে। সমাজ গঠনে নারীর অংশগ্রহণে নবীজী (সা.) কী বলেছেন আমরা তা ভুলেই গেছি। নারীর সম্ভ্রম ও মর্যাদা যদি মুসলমান হয়ে নিশ্চিত করতে না পারি তাহলে অন্য সমাজে নারীর প্রতি আচরণ আমাদের পরিবারকে ভাঙ্গনের মুখে নিয়ে যাবে। আমাদের সন্তানরা দিশেহারা, হতাশার ছোবলে পড়ে নিজেকে ধংসের পথে নিয়ে যেতে পারে। একবার নবীজী (সা.) মসজিদে সাহাবাদের সাথে মজলিসে ছিলেন। সেখানে মা ফাতেমা এলে তিনি দাঁড়িয়ে তাঁকে সম্মান জানিয়েছিলেন। একজন নবী হয়েও নারীর প্রতি এতটা সম্মান দেখানোর জন্য সাহাবারা তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, কেন তিনি এটা করলেন। নবীজী তাঁদেরকেও নারীর প্রতি সম্মানজনক আচরণ করার কথা বলেছিলেন। নারী শুধু জায়া, জননী, কন্যা নয়, সমাজ, ঘর, সংসার থেকে রাষ্ট্র গঠনের কারিগর সে।
ইরান ১২ রবিউল আউয়াল থেকে ১৭ রবিউল আউয়াল ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ পালন করে আসছে। এ ঐক্য সপ্তাহে মুসলিম দেশগুলো আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেদের নবীজীর আদর্শ অনুসরণে পিছিয়ে থাকা বা কোনো কোন ক্ষেত্রে অগসর হওয়া সম্ভব হয়েছে তা নিয়ে বিস্তর চিন্তা করে নিজেদের মধ্যে মতপার্থক্যকে কমিয়ে আনার একটা উপায় খুঁজে পেতে পারে। মুসলমানদের যে একক জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং এথেকে বিচ্ছিন্ন না হওয়ার মধ্যেই ঐক্যের মূলভিত্তি নিহিত রয়েছে তা উপলব্ধি করতে না পারলে পরাশক্তি কর্তৃক উম্মাহর মাঝে ছড়িয়ে দেয়া দ্বন্দ্বের মধ্যে থেকে আমরা উদ্ধার পাব না। আমাদের তেলসম্পদ, মানবসম্পদ, মেধাশক্তি ব্যবহার করে অন্যরা লাভবান হবে আর আমরা চিরকাল বিভেদে খাঁচার পাখির মতো কেবল ডানা ঝাপটিয়ে মুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকব তা কখনো হতে পারে না। এভাবে বিভ্রান্তিতে থাকলে আমরা শুধু নিজেদেরকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন করে ফেলব। পরাশক্তির কাছ থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনে নিজের ভাইদের ওপর তা নিক্ষেপ করতে থাকব এবং পরাশক্তি আড়ালে ও প্রকাশ্যে আমাদের দেখে হাসবে আর আমাদের পিঠ চাপড়ে দেবে।
এজন্য শুধু নবীজী (সা.)-কে বুঝতে হবে, জানতে হবে। ঈদে মিলাদুন্নবী উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে যদি তার সামান্য সুযোগ আমরা পাই তাহলে তা থেকে বিরত থাকব কেনো? বিদাত নিয়ে বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে আমরা যেন নবীজীকে বুঝে ওঠার সুযোগ থেকে দূরে না থাকি। সেই সঙ্গে বিশ্বব্যবস্থা বুঝে ওঠার কৌশল আয়ত্তে আনতে হবে। যেখানেই পরাশক্তির কূটনীতি মার খাচ্ছে সেখানেই বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোতে ধর্মের নামে সন্ত্রাস ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। কখনো তা আইএস, কখনো তা আল কায়েদা ইত্যাদি নামে। এতে সারাবিশ্বে মুসলমানদের ওপর ঘৃণা ছড়িয়ে দিয়ে কারা ইসলাম থেকে মানুষকে আরো দূরে সরিয়ে রাখছে তা উপলব্ধি করতে হবে। নবীজী (সা.) দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অর্জন ও সুদূর চীনে গিয়ে হলেও জ্ঞান অর্জনের কথা বলে গেছেন। আজকাল প্রযুক্তি জ্ঞান অর্জন অনেকটা সহজ করে দিয়েছে। আপনার হাতে যে মোবাইল ফোনটি তা দিয়েও আপনি বিশ্বের সমসাময়িক প্রসঙ্গ জানতে পারেন। উপলব্ধি করতে পারেন মুসলমান বলেই কি আমরা শুধু নিগৃহিত হচ্ছি, কিন্তু কেন, জ্ঞানই শক্তি তা কি আমরা ভুলে গেছি? আল্লাহর নবীজী একবার নামায পড়তে যাবার সময় দেখেন তাঁর প্রিয় বিড়ালটি চাদরের ওপর ঘুমাচ্ছে। বিড়ালটির ঘুম নষ্ট না করে তিনি কাঁচি দিয়ে আস্তে করে চাদরটির এক অংশ কেটে তা পড়ে নামাযে গেলেন। একটি বিড়ালের প্রতি তাঁর আচরণ মুসলমান হিসেবে আমাদের স্বভাবে রয়েছে। তাই মুসলমানরা কখনো বোমা ব্যবহার করে জিহাদের নামে সমাজে সন্ত্রাস করতে পারে না। তার ধর্ম কিভাবে জঙ্গি তৎপরতাকে সমর্থন করবে? কখনোই না। নিরপরাধ মানুষকে হত্যা কখনো কোনো ধর্মই সমর্থন করে না। অস্ত্র দিয়ে, প্রশিক্ষণ দিয়ে গোপনে কারা এসব ছড়িয়ে দিয়েছে তাও বুঝে উঠতে না পারলে আমাদের সন্তানরা বিভ্রান্ত হবে। জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও পবিত্র, একথা নবীজী (সা.) কেন বলেছেন, তাও বুঝতে হবে।
ধর্মকে শুধু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে রেখে অর্থনীতি, রাজনীতিসহ সবধরনের জ্ঞান বিমুখ হয়ে আমাদের ভাগ্য সুবিধাবাদীদের হাতে বন্ধক রেখে ভাগ্যের ওপর দোষ দিয়ে লাভ নেই। শোষণের হাতিয়ার ও অত্যাচারীর খড়গ কিভাবে আমাদের ওপর নেমে আসে তা যদি বুঝতেই না পারি, পুঁজিবাদ ও সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থা কিভাবে আমাদেরকে পুঁজিপতিদের দাস বানিয়ে রেখেছে তার গোমর যদি ধরতেই না পারি তাহলে এক আল্লাহর জীবন ব্যবস্থা তাঁর দেয়া এ জীবনে আমরা কিভাবে আয়ত্ত করতে পারব? ঈদে মিলাদুন্নবীতে সেই মেধার আবাদ শুরু করতে হবে। যে জরাজীর্ণ ব্যবস্থা আমাদের ধ্বংস করছে তার সমাধান বা ব্যবস্থাপনায় ইসলাম কি দিয়ে গেছে তা আঁকড়ে ধরতে শিখতে হবে। নবীজী (সা.) বলেছেন, আগুন যেমন লাকড়িকে খেয়ে ফেলে, দারিদ্র্য তেমনি ঈমানকে খেয়ে ফেলে। আপনি যদি দরিদ্র হন তাহলে অপরের কাছে হাত পাততে হয়। যে মুহূর্তে আপনি হাত পাতলেন, অন্যের সাহায্যের মুখাপেক্ষী হলেন তখন তার প্রতি আপনাকে অনুগত হতে হয়। আপনি আপনার মেরুদ- সোজা করে সহজে উঠতে পারবেন না। প্রযুক্তি, পুঁজি ও ভালো জীবনের জন্য বশ্যতা স্বীকার করতে হয়। এটা যদি না করতে হয় সে জন্য আপনাকে ইসলাম কী অনুসরণ করতে বলেছে, ঈদে মিলাদুন্নবীতে আসুন তার তালাশ করি। এটা করতে পারলে আমরা আমাদের নিজেদের স্বাবলম্বী করার মধ্য দিয়ে সমাজে সাম্য সৃষ্টি করতে পারব। বৈষম্যহীন সমাজ তৈরি করতে পারব। ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে, নিজের স্বার্থকেই শুধু প্রাধান্য দিয়ে সুন্দর সমাজ গড়তে পারব না। আমাদের বড় বিচ্যুতি হলো জ্ঞান থেকে নিজেকে বিমুখ করে রাখা। আর যাচাই না করে কোন তথ্যকে মেনে নেওয়া। আর মেনে নিচ্ছি বলেই আমাদের নিয়ে পরাশক্তির পাতা ফাঁদ ও চক্রান্ত তার উপাদান চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও আমরা সচেতন হতে পারছি না। একবার ভাবুন যে সম্পদ আল্লাহ তা‘আলা আমাদের মুসলিম দেশগুলোকে দিয়েছেন তার সঠিক ব্যবহার না করে, তার চেষ্টা অন্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে শুধু ভাগ্যকে দোষারোপ করে না আমরা ইহকালে লাভবান হচ্ছি না পরকালে লাভবান হব?
এজন্যই ঈদে মিলাদুন্নবীর প্রকৃত শিক্ষা হতে পারে মুসলমানদের মধ্যে ছোটখাট মতভেদ ভুলে যাওয়া। কে কালো, কে সাদা, কে ধনী, কে গরীব তা এক কাতারে নামাযে দাঁড়ালে যদি আমাদের খেয়াল না থাকে তাহলে সার্বিক জীবনযাত্রায় তা কেন বাধা হয়ে দাঁড়ায়? আর এ বাধা থাকলে আমরা কি কখনো আমাদের মেধার সঠিক ব্যবহার করতে পারব? কখনো কি নিজেদের কৌশলগত অবস্থান টের পাব। দুর্ভিক্ষ নয়, গোলা ভরা ধান, হীনমন্যতা নয়, ভ্রাতৃত্ববোধ নিয়ে বুকে আঁকড়ে ধরে, ‘পুঁজিবাদ ও ভোগবাদ নয়, সম্পদের মালিকানা আল্লাহর’- এ বিশ্বাসের কার্যকর নজির উপস্থাপন করে বৈষম্যহীন আর্থসামাজিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মতো নবীজীর অসংখ্য শিক্ষা প্রতিবছর ঈদে মিলাদুন্নবীতে আমাদের ডাক দিয়ে যায়। যা অনুসরণ করে আমরা প্রথমে আমাদের জীবন এবং সার্বিকভাবে পুরো বিশ্বকে পাল্টে দিতে পারি।

ইমাম খোমেইনী (র.)-এর দৃষ্টিতে ইসলামি ঐক্য

বিজ্ঞ মনীষিগণের কল্যাণচিন্তায় সবসময়ই ইসলামি ঐক্যের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হয়েছে। ইমাম খোমেইনী (র.) মুসলিম জগতের কল্যাণকামী এবং ঐক্যের আহ্বানকারীদের অন্যতম ব্যক্তিত্ব। মুসলিম ফেরকাগুলোর মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তাঁর সু¯পষ্ট কিছু পরিকল্পনা ছিল। বিপ্লবের আগে এবং পরেও ইমাম তাঁর ঐ পরিকল্পনা অনুযায়ী মুসলমানদের ঐক্যের আহ্বান জানান এবং এ বিষয়টির ওপর গুরুত্বারোপ করে ঐক্যের পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করার চেষ্টা চালান। তাঁর এই চেষ্টার ক্ষেত্রে দুটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। একটি হলো সাংস্কৃতিক ও মননশীল
আন্দোলন এবং দ্বিতীয়টি হলো রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টি।
ইমাম খোমেইনীর চিন্তাধারা অনুযায়ী ইসলামি সমাজে পরিবর্তন আনা এবং বিচ্ছিন্নতা থেকে জাতিকে মুক্তি দেয়া এমন সহজ কোনো বিষয় নয় যে, সুচিন্তিত এবং মৌলিক কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই তা সম্ভব হয়ে যাবে। কেননা, মুসলিম বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতির পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। মুসলমানদের সাংস্কৃতিক ও চিন্তাদর্শনগত অবক্ষয় এবং মুসলিম দেশগুলোতে উপনিবেশবাদী এবং স্বৈরাচারী শক্তিগুলোর শাসনব্যবস্থার মতো বিষয়গুলো এক্ষেত্রে দায়ী। এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে হলে মুসলিম দেশ ও সরকারগুলোর সামগ্রিক তৎপরতা এবং সুনির্দিষ্ট কৌশল অবলম্বন করা উচিত। যেহেতু মুসলিম দেশগুলোর অভিন্ন ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ইতিহাস রয়েছে, সেহেতু তাদের উচিত তাদের সেই সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ও মৌলিক সাংস্কৃতিক ইতিহাসের দিকে প্রত্যাবর্তন করা, সেইসাথে ধর্মীয় পরিচিতির স্মারক বই-পুস্তকগুলোর সাথে ভালোভাবে পরিচিত হওয়া। এ কারণেই ইমাম খোমেইনী ইসলামের মৌলিক সংস্কৃতির দিকে প্রত্যাবর্তন করার ব্যাপারে বলেছেন : ‘আমাদের মুসলমানদের খুবই সমৃদ্ধ সংস্কৃতি রয়েছে। মুসলমানদের উচিত নিজেদের পরিচয় স¤পর্কে
সচেতন হওয়া। অর্থাৎ বুঝতে হবে যে, তারা একই সংস্কৃতির অধিকারী… অসহায় এবং দুর্বল জাতিগুলো পরাশক্তিগুলোর সাথে যে স¤পর্ক সৃষ্টি করেছে, অভ্যন্তরীণ এবং চিন্তাগত স¤পর্ক তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কেননা, অন্যসব নির্ভরতামূলক স¤পর্ক তা থেকেই প্রেরণা লাভ করে। চিন্তার স্বাধীনতা লাভ করতে হলে নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে উপলব্ধি করতে হবে।’
ইমাম খোমেইনী (র.) মুসলমানদের মাঝে অভিন্ন বিশ্বাস ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় ইসলামি চিন্তাদর্শনগুলোর ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। এ বিষয়টিকে তিনি ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী বলে উল্লেখ করেছেন। ইমামের দৃষ্টিতে ইসলাম হচ্ছে মানুষের চিন্তাদর্শন ও ব্যবহারিক জীবনের জন্য একটি পূর্ণ ও সামগ্রিক বিধান। মানুষের সামগ্রিক জীবনের জন্য তাই ইসলামের রয়েছে সামগ্রিক কর্মসূচি। মুসলিম সমাজে বিশ্বাসগত গভীরতার কারণে এবং মুসলমান জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগত দিক থেকেও তাদের যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। যদি এ বিষয়গুলোকে যথার্থভাবে কাজে
লাগানো সম্ভব হয় তাহলে মুসলিম বিশ্বের সম্মান পুনরায় ফিরে আসতে পারে। ইমাম খোমেইনীর মতে, ইসলাম এ বিশ্বাস ও বোধকে কাজে লাগিয়ে মুসলমানদের ভৌগোলিক সীমারেখা মুছে ফেলতে পারে, পারে ব্যক্তিগত স্বার্থের সীমা পেরিয়ে গোত্র বর্ণভেদে সকল মুসলমানকে একটি কেন্দ্রে সমবেত করতে।
ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য ইমাম খোমেইনী (র.) যেসব কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়েছেন, সেগুলো ছিল মুসলিম বিশ্বে বিচ্ছিন্নতার মূল কারণকেন্দ্রিক। এই বিচ্ছিন্নতার মূল কারণ হিসেবে ইমাম খোমেইনী বিদেশি শক্তির কথা উল্লেখ করেছেন যারা মুসলমানদের মাঝে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টির জন্য মুসলমানদেরই অভ্যন্তরীণ উপাদান বা বিষয়গুলোকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে মুসলমানদের ঐক্য বিনষ্টের কাজে লিপ্ত রয়েছে। মুসলিম সমাজের ওপর বিদেশিদের এই চক্রান্তের উদ্দেশ্য হিসেবে ইমাম বলেন, মুসলমানদের স¤পদ লুট করাই তাদের উদ্দেশ্য। তিনি এ স¤পর্কে আরো বলেন : ‘যারা মুসলমানদের ভূখ- থেকে স্বার্থ উদ্ধার করতে চায়, যারা মুসলমানদের স¤পদগুলোকে আত্মসাৎ করতে চায় এবং মুসলিম সরকারগুলোকে তাদের তাঁবেদার বানাতে চায়, তারাই মুসলমানদের মাঝে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টির চেষ্টা চালায়। শিয়া ও সুন্নির নামে তারাই এই মতপার্থক্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়।’
ইমাম খোমেইনী (র.) অপর এক ভাষণে মুসলমানদেরকে নিজেদের ভেতরে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টির জন্য শত্রুদের মূল হাতিয়ার মাযহাবগত মতপার্থক্যের ফাঁদে পা দিতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন, ইসলামি মাযহাবগুলোর মাঝে মতানৈক্য সৃষ্টির পরিকল্পনা একটি মারাত্মক অপরাধ, আর এই অপরাধের স্রষ্টা হলো সেসব পরাশক্তি যারা ওই মতপার্থক্য থেকে ফায়দা হাসিল করে। তারাই এই মতানৈক্যের বীজ মুসলমানদের মাঝে বপন করেছে এবং নিয়মিত তার গোড়ায় পানি ঢেলে পরিচর্যা করে যাচ্ছে। যারা এই বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করতে চায় তারা না আহলে সুন্নাতের, না আহলে শিয়ার অন্তর্ভুক্ত। তারা হলো পরাশক্তিগুলোর মদদপুষ্ট সরকারের কর্মকর্তা। মাযহাব এবং গোত্রগত সবধরনের মতপার্থক্যকে অসমীচীন ও অবৈধ বলে উল্লেখ করেছেন, কেননা, এগুলো মুসলমানদের সংহতির পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। তিনি ইসলামের মানদ- ও কোরআনকে ঐক্যের মূল মাপকাঠি বলে মনে করেন। সে জন্য ইসলামি মাযহাবগুলোর মাঝে যেসব বিষয়ে অভিন্নতা রয়েছে যেমন আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, নবী এবং কোরআনের প্রতি বিশ্বাস ইত্যাদির মতো বিষয়গুলোর প্রতি ইঙ্গিত করে ইমাম হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন : ‘শিয়া এবং সুন্নিদেরকে দুটি পক্ষে দাঁড় করানোর মতো সমস্যাটির মূল নিহিত রয়েছে বিদেশিদের অজ্ঞতা এবং প্রচারণার মধ্যে। এখন সময় এসেছে সকল মুসলমান পর¯পরে ঐক্যবদ্ধ হবার।’
ইমাম অসহায় বঞ্চিতদের একটি দল গঠনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন, এই দলে সকল বঞ্চিত জনগোষ্ঠী যোগ দেবে এবং পরাশক্তিগুলোর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। এ প্রসঙ্গে তিনি মুসলিম জাতিগুলোর প্রতি উপদেশ দিয়ে বলেছেন, তারা যেন ইরানের মুজাহিদ জাতির আদর্শ অনুসরণে এগিয়ে আসে।
একইভাবে তিনি ইসলামি ঐক্য বাস্তবায়নের পন্থা হিসেবে মুসলিম দেশগুলোর কর্মকর্তাদের পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলেছেন। কারণটা হলো মুসলিম দেশগুলোর প্রধানদের হাতে ইসলামি ঐক্যের পক্ষে সরকার গঠন করার জন্য প্রয়োজনীয় সকল সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। তাই তাঁরা যদি সত্যিকার অর্থেই ইসলামি ঐক্য বাস্তবায়নের চেষ্টা চালান তাহলে তা অর্জন করা খুব একটা কঠিন হবে না।
তিনি বিশ্বাস করেন, মুসলিম দেশগুলোর স¤পদ বা অর্থনৈতিক বৃহৎ উৎসগুলোকে কাজে লাগালে পরাশক্তিগুলোর মোকাবেলায় তা মুসলমানদের বৃহৎ এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি চালিকাশক্তি হতে পারে। ইমাম খোমেইনীর মতে খনিজ স¤পদের দিক থেকে সমৃদ্ধ মুসলিম দেশগুলোর মাঝে যদি ঐক্য গড়ে ওঠে তাহলে কোনো দেশ বা কোনো শক্তির কাছেই মুসলমানদের ধন্না দেয়ার প্রয়োজন হবে না। কিন্তু মূল সমস্যাটা হলো অধিকাংশ মুসলিম দেশই পরাশক্তির নীতির অনুসারী এবং ইসলামি ঐক্য গড়ে তোলার ব্যাপারে আন্তরিক নয়। এ অবস্থার অবসান ঘটুক, মুসলমানদের মধ্যকার সকল বিভেদ দূর হয়ে যাক, প্রতিষ্ঠিত হোক শিসাঢালা প্রাচীরের মতো দৃঢ় ঐক্য।

সম্পাদকীয়

ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) ও ইসলামি ঐক্য সপ্তাহের উদাত্ত আহ্বান
রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর পবিত্র জন্মবার্ষিকী ঈদে মিলাদুন্নবী সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্র জন্য আনন্দ ও উৎসবের একটি বিরাট উপলক্ষ।
হযরত মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহ্ তা‘আলার প্রেরিত সর্বশেষ নবী ও রাসূল। তাঁর মাধ্যমে মানব প্রজাতির উদ্দেশে আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর পরিপূর্ণ বাণী পৌঁছে দিয়েছেন এবং এ বাণীকে যে কোনো বিকৃতি ও পরিবর্তন থেকে সংরক্ষিত রেখেছেন।
কোরআন মজীদ হচ্ছে মানব জাতির মুুক্তির পথপ্রদর্শক। তাই এ মহাগ্রন্থ কিয়ামত পর্যন্ত সমগ্র মানব জাতির জন্য আল্লাহ্ তা‘আলার শ্রেষ্ঠতম নে‘আমত। আর রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ছিলেন কোরআন মজীদের মূর্ত প্রতীক; তিনি স্বীয় চরিত্র, আচরণ ও শিক্ষার মাধ্যমে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কোরআন মজীদের শিক্ষা ও পথনির্দেশের বাস্তব প্রদর্শনী করেছেন- যা প্রমাণ করে যে, কোরআন মজীদ মানুষের জন্য পুরোপুরি অনুসরণ ও বাস্তবায়নযোগ্য। এ কারণে আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁকে রাহ্মাতুল্লিল্ ‘আলামীন (সমগ্র জগৎসমূহের জন্য অনুগ্রহ) হিসেবে অভিহিত করেছেন।
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর জীবনাদর্শ ও শিক্ষা স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে এসেছে বিধায় তা সম্পূর্ণরূপে ভারসাম্যপূর্ণ ও সুবিচারের পতাকাবাহী। তাই এ দ্বীন গ্রহণের ব্যাপারে যেমন কোনোরূপ জোর-জবরদস্তির অবকাশ নেই, তেমনি এর বিস্তারের পন্থা সুস্থ বিচারবুদ্ধির কাছে আবেদন এবং এর প্রতিষ্ঠার পথ শান্তিপূর্ণ। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ দ্বীনের সাথে লোকদের সঠিক ও যথাযথ পরিচিতির অভাবের সুযোগ নিয়ে ইসলামের দুশমনরা তাদের অসদুদ্দেশ্য চরিতার্থ করার লক্ষ্যে এ দ্বীনের ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টা চালিয়ে আসছে। তাই এ দ্বীন ও হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর জীবন ও শিক্ষার সাথে সঠিকভাবে পরিচিত হওয়া এবং তা অন্যদের কাছে পৌঁছে দেয়া মুসলমানদের জন্য অপরিহার্য।
আল্লাহ্ তা‘আলা যেসব উদ্দেশ্যে এ দ্বীন পাঠিয়েছেন তার অন্যতম হচ্ছে মানবতার ঐক্য গড়ে তোলা এবং এ লক্ষ্যে তিনি ইসলামি উম্মাহ্র ঐক্যের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কোরআন মজীদে ন্যূনতম অভিন্ন ‘আক্বায়েদী সূত্র তাওহীদ ও আখেরাতের ভিত্তিতে নাজাতের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে এবং এর ভিত্তিতে আহ্লে কিতাবের প্রতি ঐক্যের আহ্বান জানানোর জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এমতাবস্থায় মুসলমানদের ঐক্য ফরয হওয়া সম্পর্কে সামান্যতম সন্দেহও থাকতে পারে না। কিন্তু ইসলামের দুশমনদের ও মুসলিম নামধারী মুনাফিকদের ষড়যন্ত্রের ফলে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ, অনৈক্য ও হানাহানি চলে আসছে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের পর এ বিপ্লবের মহান নায়ক হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)-কে ইসলামি ঐক্য গড়ে তোলার চালিকাশক্তিতে পরিণত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। যেহেতু রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জন্মতারিখ নিয়ে কিছুটা মতপার্থক্য আছে এবং বেশির ভাগ মুসলমানই ১২ বা ১৭ই রবিউল্ আউয়াল্কে তাঁর জন্মবার্ষিকী হিসেবে গণ্য করে থাকে সেহেতু ইসলামি ঐক্য গড়ে তোলার প্রয়াসকে অধিকতর শক্তিশালী করার লক্ষ্যে তিনি উভয় তারিখকে সমন্বিত করে ১২ থেকে ১৭ই রবিউল্ আউয়াল্কে ‘ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ’ হিসেবে ঘোষণা করেন এবং ইসলামি ঐক্য গড়ে তোলার লক্ষ্যে যথাযথ মর্যাদায় এ সপ্তাহ উদ্যাপনের জন্য সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্র প্রতি আহ্বান জানান। তখন থেকে সারা বিশ্বের মুসলমানগণ, বিশেষ করে ইরানি মুসলমানগণ প্রতি বছর যথাযথ মর্যাদা সহকারে এ সপ্তাহটি উদ্যাপন করে আসছে।
মুসলিম উম্মাহ্র জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে, বিগত কয়েক দশক যাবত ইসলাম ও মানবতার দুশমন বলদর্পী শক্তিবর্গের সামরিক, রাজনৈতিক, প্রচার, ষড়যন্ত্র ও কৌশলগত সহযোগিতায় ইসলামের নামে গড়ে ওঠা কতগুলো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বিভ্রান্তিকর প্রচার ও সশস্ত্র তৎপরতার মাধ্যমে ইসলামের ওপর সহিংসতা ও সন্ত্রাসবাদের কলঙ্ক লেপনের পাশাপাশি মুসলমানদের হত্যার কাজে মেতে উঠেছে এবং এদের সন্ত্রাসী তৎপরতা বিশেষভাবে আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া ও ইয়েমেনের মুসলমানদের ওপর বিরাট বিপর্যয় চাপিয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে পাশ্চাত্য জগতের জনগণের মধ্যে যখন ইসলামের সাথে সঠিকভাবে পরিচিত হওয়ার প্রবণতা ও ইসলাম গ্রহণের হার বৃদ্ধি পেয়েছে তখন এই ষড়যন্ত্রের বলি হয়ে সেখানকার অনেক তরুণ মুসলমান ঐ সব সন্ত্রাসী দলে যোগদান করায় এবং মাঝে মাঝে পাশ্চাত্য জগতে কিছু সন্ত্রাসী কর্মকা- সংঘটিত করায় ইতিমধ্যেই পাশ্চাত্যে মুসলমানদের প্রতি সন্দেহ ও চাপ সৃষ্টি বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সেখানে ইসলামের প্রচার-প্রসারের কাজও চাপের মুখোমুখী হয়ে পড়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববাসীকে, বিশেষত মুসলমানদেরকে ইসলামের সঠিক রূপের সাথে পরিচিত করার প্রয়োজনীয়তা পূর্বাপেক্ষা বহুগুণ বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।
পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জনগণসহ সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্কে, বিশেষ করে নিউজ লেটারের পাঠক-পাঠিকাগণকে অভিনন্দন ও মোবারকবাদ জানাচ্ছি এবং আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে কামনা করছি, ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) ও ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ্ ইসলামি উম্মাহ্ ঐক্য ও সংহতির চালিকা শক্তিতে পরিণত হোক।

স্মরণীয় বাণী

মহানবী (সা.) বলেন : মানুষের সাথে মানিয়ে চলা ঈমানের অর্ধাংশ। আর তাদের প্রতি নরম ব্যবহার হলো সুখী জীবনের অর্ধাংশ।

মহানবী (সা.) বলেন : হে আলী! কিয়ামতের দিন প্রত্যেক চোখই ক্রন্দনরত থাকবে তিনটি চোখ ব্যতীত : যে চোখ আল্লাহ্র রাস্তায় বিনিদ্র রাত কাটায়, যে চোখ আল্লাহর নিষিদ্ধ হারাম থেকে অবনত থাকে, আর যে চোখ আল্লাহর ভয়ে অশ্রু ঝরায়।

মহানবী (সা.) বলেন : হে আলী! ধন্য সেই মুখমণ্ডল যার দিকে আল্লাহ্ তাকিয়ে দেখেন যে, এমন পাপের জন্য সে ক্রন্দনরত যে সম্পর্কে আল্লাহ্ ব্যতীত আর কেউ জানে না।

মহানবী (সা.) বলেন : …আর ফরয নামাযকে ইচ্ছাকৃতভাবে ত্যাগ কর না। কারণ, যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে একটি ফরয নামাযকে ত্যাগ করে সে আল্লাহর আশ্রয় থেকে বিতাড়িত। আর মদ ও অন্য কোনো নেশাদ্রব্য পান কর না, কারণ, এ দু’টি হলো সকল অনিষ্টের চাবিকাঠি।

ইমাম আলী (আ.) বলেন : বুদ্ধির মতো কোনো সম্পদ নেই আর অজ্ঞতার চেয়ে কোনো দারিদ্র্য নেই।

ইমাম আলী (আ.) বলেন : ভীতি নিরাশা নিয়ে আসে আর লজ্জা বঞ্চনা নিয়ে আসে। প্রজ্ঞা হলো মুসলমানদের হারানো সম্পদ। তাকে খুঁজে ফের যদিও তা দুষ্টদের হাতে থাকে।

ইমাম আলী (আ.) বলেন : যদি জ্ঞানের বাহকরা সঠিকভাবে তা বহন করে তাহলে আল্লাহ্, তাঁর ফেরেশতাকুল এবং তাঁর সৃষ্টির মধ্য থেকে তাঁর আনুগত্যকারীরা তাকে ভালবাসে। কিন্তু তারা জ্ঞানকে দুনিয়া লাভের আশায় চেয়েছে। তাই আল্লাহ্ তাদেরকে শত্রু গণ্য করেছেন এবং মানুষের সামনে তারা হীন হয়েছে।

ইমাম আলী ইবনুল হোসাইন যায়নুল আবেদীন (আ.) বলেন : নিশ্চয় মুসলমান ব্যক্তির জ্ঞান ও দীনের পূর্ণতা হলো যে বিষয়ে তার কোনো উপকার নেই সে ব্যাপারে কথা না বলা, ঝগড়া কম করা, ধৈর্য ও সংযমের পরিচয় দেওয়া এবং সদাচারী হওয়া।

ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) বলেন : নিশ্চয় মুমিনের অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলো আর্থিক সংকটে আয়ের স্বল্পতার পরিমাণে দান করে আর আয়ের বিস্তৃতির সময় সে অনুপাতে দান করে। আর মানুষের সাথে ন্যায্য আচরণ করা এবং তাদের সালাম দেওয়া।

ইমাম মূসা কাযিম (আ.) যে কবরের নিকটে ছিলেন তা দেখিয়ে বললেন : যার শেষ পরিণতি এটা, তার শুরু থেকেই পরহেযগার হওয়া উচিত। আর যার শুরু এটা, তার শেষ পরিণতি থেকে ভয় করা উচিত।

ইমাম মূসা কাযিম (আ.) বলেন : কিয়ামতের দিন একজন চিৎকারকারী চিৎকার করে বলবে : যদি আল্লাহর কাছে কারো কোনো পারিশ্রমিক প্রাপ্য থাকে তাহলে উঠে দাঁড়াও। তখন কেউ উঠে দাঁড়াবে না কেবল যে ক্ষমা করেছে এবং সংশোধিত হয়েছে সে ব্যতীত। তার পুরস্কার আল্লাহর ওপরে।

ইমাম মূসা কাযিম (আ.) বলেন : দানশীল সচ্চরিত্রবান ব্যক্তি আল্লাহর আশ্রয়ে থাকে। আল্লাহ্ তাকে ত্যাগ করেন না যতক্ষণ না তাকে বেহেশতে প্রবেশ করান। আল্লাহ্ কোনো নবীকেই প্রেরণ করেননি উদারতা ও দানশীলতার বৈশিষ্ট্য ব্যতীত। আর আমার পিতা সর্বদা আমাকে উদারতা ও সচ্চরিত্রের উপদেশ দিতেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।

ইমাম মূসা কাযিম (আ.) তাঁর এক অনুসারীকে বললেন : হে অমুক! আল্লাহ্কে ভয় কর এবং সত্য বলবে, এতে যদি তোমার মৃত্যুও হয়। কারণ, তোমার মুক্তি তার মধ্যেই। হে অমুক! আল্লাহ্কে ভয় কর এবং বাতিলকে ত্যাগ কর যদিও (তোমার কাছে মনে হয়) তার মধ্যেই তোমার মুক্তি থাকে। কেননা, নিশ্চয় তোমার ধ্বংস তার মধ্যে।

(তুহাফুল উকূল থেকে সংকলিত)
অনুবাদ : আব্দুল কুদ্দুস বাদশা

স্মরণীয় দিবস

২ সেপ্টেম্বর : নবীবংশের নবম ইমাম তাকী (আ.)-এর শাহাদাত দিবস।

৩ সেপ্টেম্বর : আহলে বাইতের প্রথম ইমাম আলী (আ.) এবং নবীকন্যা হযরত ফাতিমা (আ.)-এর বিবাহ বার্ষিকী। ইরানে দিবসটি বিবাহ দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়।
*বিজ্ঞানী ও দার্শনিক আবু রায়হান বিরুনী স্মরণে দিবস।
*নবীবংশের দশম ইমাম আলী নাকী (আ.)-এর জন্মদিবস।

৮ সেপ্টেম্বর : নবীবংশের পঞ্চম ইমাম বাকের (আ.)-এর শাহাদাত দিবস।

৯ সেপ্টেম্বর : আরাফাত দিবস (৯ যিলহজ)।

১০ সেপ্টেম্বর : ঈদুল আযহা বা কোরবানির ঈদ।

১৭ সেপ্টেম্বর : ইরানে কবিতা ও ফারসি সাহিত্য দিবস হিসেবে পালিত হয়। কবি সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ হোসাইন শাহরিয়ার স্মরণে দিবস।

২০ সেপ্টেম্বর : বাংলা ভাষার প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক আবুল খায়ের মুসলেহ উদ্দিনের মৃত্যুবার্ষিকী।
ঈদ-ই গাদীর দিবস। বিদায় হজ থেকে ফেরার সময় মহানবী (সা.) ১৮ যিলহজ হাজীদের সমাবেশে ইমাম আলীকে মহানবীর ওফাত পরবর্তীকালে উম্মতের মাওলা ঘোষণা করেন।

২২ সেপ্টেম্বর : ইরাকের সাদ্দাম সরকার এদিনে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। ইরানের পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধের শুরু।
*নবীবংশের অষ্টম ইমাম মূসা কাযেম (আ.)-এর জন্মদিবস।

২৬ সেপ্টেম্বর : মহানবী (সা.)-এর সাথে খ্রিস্টান পাদ্রিদের মুবাহিলা দিবস। *বিশ্ব শিশু দিবস।

২৭ সেপ্টেম্বর : বিশ্ব পর্যটন দিবস।

২৯ সেপ্টেম্বর : বিশ্ববিখ্যাত মরমি কবি মওলানা জালালউদ্দিন রূমির (মৌলভী রূমি) জন্মবার্ষিকী।

৩০ সেপ্টেম্বর : ফিলিস্তিনের শিশু-কিশোরদের সাথে সংহতি প্রকাশের জন্য দিবসটি পালিত হয়।

১ অক্টোবর : বাংলাদেশের প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ ও বহু গ্রন্থ প্রণেতা মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রহ.)-এর মৃত্যুবার্ষিকী।

৩ অক্টোবর : হিজরি ১৪৩৮ সাল শুরু।

৪ অক্টোবর : হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) ইরাক থেকে ফ্রান্সে হিজরত করেন (১৯৭৮)।

১১ অক্টোবর : বিশ্ববিখ্যাত কবি হাফিজ স্মরণে দিবস।

১২ অক্টোবর : পবিত্র আশুরা। ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শাহাদাত দিবস।

১৫ অক্টোবর : * বিশ্ব সাদা ছড়ি দিবস (অন্ধদের কল্যাণে)।

১৭ অক্টোবর : বাংলাদেশের মরমি বাউল সংগীতের জনক লালন শাহের মৃত্যুবার্ষিকী।

১৯ অক্টোবর : বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ফররুখ আহমদের মৃত্যুবার্ষিকী।

২৩ অক্টোবর : ইমাম খোমেইনীর সুযোগ্য পুত্র আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ মুস্তাফা খোমেইনীর শাহাদাত দিবস। *মুহররম মাসের নবম দিবস।

২৪ অক্টোবর : উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম, সাহিত্যিক, সাংবাদিক মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর মৃত্যুবার্ষিকী।

২৭ অক্টোবর : নবীবংশের চতুর্থ ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর শাহাদাত দিবস।

২৬ অক্টোবর : অবিভক্ত বাংলার নেতা প্রজাতিহৈষী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের জন্মবার্ষিকী।

২৯ অক্টোবর : কবি বেনজীর আহমদের জন্মবার্ষিকী। *কবি তালিম হোসেনের জন্মবার্ষিকী।
*কিশোর (১৩ বছর) মুহাম্মাদ হুসাইন ফাহমিদেহ এর শাহাদাত দিবস। ইরানে এটি কিশোর স্বেচ্ছাসেবী দিবস হিসেবে পালিত হয়।