All posts by pavel

ইরানের ৩৮তম ইসলামি বিপ্লববার্ষিকী ও প্রায়োগিক দিকসমূহ

রাশিদ রিয়াজ

এমন এক সময় ইরানের ইসলামি বিপ্লব বার্ষিকী অতিক্রান্ত হচ্ছে যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সাতটি দেশের অভিবাসী নিষিদ্ধ করে রণহুঙ্কার দিচ্ছেন। তাঁর হাত ধরে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে আহ্বান জানিয়েছেন একাট্টা হতে যাতে দুটি দেশ পুরো বিশ্বকে একচেটিয়া শাসন করতে পারে। আর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন একই অভিপ্রায়ে। যে সাতটি দেশের অভিবাসী যুক্তরাষ্ট্র প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন ট্রাম্প, তার অন্যতম দেশ ইরান প্রতিরক্ষাজনিত নিরাপত্তার দিক বিবেচনা করে কয়েকটি দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করায় প্রবল গোস্বা হচ্ছেন কারা এবং খেয়াল রাখুন তার মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের কোন কোন দেশ সিরিয়া ও ইয়েমেনে সামরিক আগ্রাসন চালাচ্ছে পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে মিলে। বিশ্বে ইসরাইলের অস্ত্র, ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে কারো কোনো প্রশ্ন নেই কেন?
একারণেই বিশ্বে ইরানের ইসলামি বিপ্লব প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে এবং তার প্রায়োগিক বিষয়টি জানান দেয়। দিন কয়েক আগে ইরান তার সমুদ্রসম্পদ জরিপে নিজেদের তৈরি জাহাজ ভাসিয়েছে। এমন এক জাহাজ তৈরির প্রেরণা দিয়েছিলেন বিপ্লবের মহান ইমাম আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেইনী। ৩ লাখ ঘণ্টা ব্যয় করে প্রযুক্তিবিদ, প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী মিলে জাহাজটি তৈরি করেছেন। এমন নবযাত্রার অনেক কাহিনীর জন্ম দিয়ে চলেছে নিরন্তর ইরানের ইসলামি বিপ্লব। সাম্রাজ্যবাদের এককেন্দ্রিক রাজনীতি তাই ক্রমশ বিবর্ণ হয়ে উঠছে। ইউরোপ, চীন, ভারত, রাশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকার দেশসহ অনেক রাষ্ট্রই বিলম্বে হলেও ইরানের ইসলামি বিপ্লবের গ্রহণযোগ্যতা অনুধাবন করে অবরোধ কিংবা নিষেধাজ্ঞাকে পায়ে মাড়িয়ে সহাবস্থানে নতুন দিগন্ত সৃষ্টি করেছে। শোষক ও স্বৈরাচারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইরানের ইসলামি বিপ্লব এখন গবেষণার বিষয়। এ গবেষণা প্রয়োজন বৈষম্যহীন বিশ্ব সৃষ্টির জন্য। কিউবা, ভেনিজুয়েলা, বলিভিয়া, ইকুয়েডর, ব্রাজিল, আর্জেন্টনা, নিকারাগুয়ার গণমিছিলের সঙ্গে একদিন হয়ত বাংলাদেশের মানুষও যাত্রা শুরু করবে অভিন্ন গন্তব্যে। এ যাত্রায় ইসলামভীতি বা ইসলামকে জঙ্গি হিসেবে উপস্থাপন করে যারা অস্ত্র ও অর্থ জুগিয়ে চলছে ¯্রফে ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত ও শোষণের হাতিয়ার যুগ যুগ টিকিয়ে রাখতে তার বিপরীতে ইরানের ইসলামি বিপ্লব ও সংস্কৃতি মানুষের জন্য বেঁচে থাকার অনন্য সৃষ্টি। কিন্তু ইরানের বিপ্লব খোদায়ী প্রেমের এমন এক নজির স্থাপন করেছে যা পরাশক্তিকে তুচ্ছ ভেবে মাথা উঁচু করে সাহসের সঙ্গে দাঁড়াতে সাহায্য করে।
২০১৫ সালে বিশ্বের ৬টি পরাশক্তির সাথে যে পারমাণবিক চুক্তিতে তেহরান সম্মত হয়, সে অনুযায়ী আরো অন্তত আট বছর তারা ক্ষেপণাস্ত্র উন্নয়নের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের নিয়ম মেনে চলবে। ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হোসেইন দেহগান বলেছেন, তাঁরা পূর্বঘোষিত পরিকল্পনা অনুযায়ী জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম তৈরি করবেন। এতে কোনো হস্তক্ষেপ বা প্রভাব গ্রহণযোগ্য নয়।
একই সঙ্গে ইরান নিজেদের তৈরি চারটি উপগ্রহ নিক্ষেপ করেছে। এও বলে দেওয়া হয়েছে, ইরান একদিনের জন্যও ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি থেকে সরে দাঁড়াবে না। সাতটি দেশের অন্যতম ইরানের কোনো নাগরিককে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর দেশটি অনুরূপ পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছে। ঠিক ওই সময় ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইরান এসে বলেছেন, এ বছর ইরানের নাগরিকদের জন্য তাঁর দেশ ভিসা দ্বিগুণ করবে। ইরান আরো বলছে, আন্তর্জাতিক লেনদেনে ডলারের পরিচয় উল্লেখ করবে না। রাশিয়া, আযারবাইজান, তুরস্ক, ইরাক সহ নানা দেশ ইরানের সঙ্গে নিজেদের মুদ্রায় লেনদেন শুরু করেছে। অথচ অন্য ৬টি দেশ সোমালিয়া, ইরাক, লিবিয়া, সুদান, সিরিয়া, ইয়েমেন ইরানের মতো যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছে না কেন? কারণ, ওই ৬টি দেশে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মতো কোনো বিপ্লব সংঘটিত হয় নি। মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ২২০ বিলিয়ন ডলার বাণিজ্য হয় এবং এ সাতটি দেশের মুসলিম অভিবাসীদের নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় বছরে যুক্তরাষ্ট্রকে ৬৬ বিলিয়ন ডলার মাশুল গুণতে হবে বলছে এক জরিপে। ইরানে বোয়িং বিমান বিক্রির জন্য যে সাড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি হয়েছে তা বাতিল হলে বছরে যুক্তরাষ্ট্র অন্তত ১ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হারাবে। আগামী ১০ বছর ধরে বোয়িং কোম্পানির এসব বিমান ইরানে সরবরাহ দেওয়ার কথা।

মধ্যপ্রাচ্যের ১৪টি দেশে বিদেশি বিনিয়োগের তুলনায় ইরান ১২তম অবস্থানে ছিল। কিন্তু অবরোধ প্রত্যাহারের ৬ মাসের মাথায় ইরান এখন সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের পরেই অবস্থান করছে। ন্যাটো বা কোনো প্রভাবশালী রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা প্রমাণ দিতে পারে নি ইরান গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র বানাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্পাই স্যাটেলাইটগুলো অনুরূপ কোনো প্রমাণ দিতে পারে নি।
ইরান যা করছে তা হচ্ছে বাণিজ্য ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধি। গত বছর ২২টি বিদেশি বিনিয়োগ চুক্তি করতে সমর্থ হয় ইরান। বোয়িং এর সঙ্গে চুক্তির পাশাপাশি ১১৮টি বিমান কিনতে ইরান এয়ারবাসের সঙ্গে ২৭ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেছে। এসব চুক্তি স্মরণকালের সবচেয়ে কম দামে বিমান কেনার ক্ষেত্রে দরকষাকষি করে সফলতা পেয়েছে ইরান। ইরান তার প্রতিবেশি দেশ ইরাক, তুরস্ক, পাকিস্তান ও ভারত, এমনকি চীনের সঙ্গে জ্বালানি রপ্তানি বৃদ্ধির পাশাপাশি রেল যোগাযোগ উন্নয়নে অনেক দূর এগিয়েছে। ইরাকে রপ্তানি হচ্ছে ইরানের বিদ্যুৎ। আইএস জঙ্গি দমনে সিরিয়া ও ইরাকে রাশিয়ার সঙ্গে ইরানের সহযোগিতায় এধরনের সন্ত্রাস প্রতিরোধে অভাবিত সফলতা মিলেছে। অথচ ২০১৪ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র একা সাড়ে ৮ বিলিয়ন ডলার খরচ করেও আইএস জঙ্গি দমনে সামান্যই এগুতে পেরেছে।
তুর্কমেনিস্তানের সঙ্গে আগামী দশ বছরে গ্যাসের বিনিময়ে পণ্য কিনবে ইরান এবং এধরনের পণ্য বিনিময়ের পরিমাণ ৩০ বিলিয়ন ডলার। ইরানের জাতীয় নেতৃত্ব যদি স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা না করে দুর্নীতির অতলে তলিয়ে যেত তাহলে অবরোধ মোকাবেলা করে অর্থনৈতিকভাবে এভাবে এগিয়ে যাওয়া দেশটির পক্ষে সম্ভব ছিল না।
ইরান ছাড়া বাকি ৬টি দেশে সন্ত্রাস দমনে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে তার জন্য পশ্চিমা দেশ ও মিত্র আরব দেশগুলো দায়ী। লিবিয়া, ইয়েমেন, সোমালিয়া, সিরিয়া, ইরাক, সুদানে আজকের পরিস্থিতির জন্য পশ্চিমা দেশগুলো পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ইসলামের নামে সন্ত্রাসী চক্র সৃষ্টি করেছে। তাকে দমনের নামে এসব দেশে অভিযান চালাচ্ছে। আর এসব দেশের মানুষ অভিবাসী হিসেবে মানবেতর জীবন যাপন ও সস্তা শ্রম দিতে বাধ্য হচ্ছে। ইরানের নেতারা এসব বিষয় খুব ভালো বুঝেন বলেই নিজেদের উন্নয়ন কৌশল নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক গতিধারা বিনির্মাণ করেছেন যার নির্দেশনা দিয়েছে ইসলামি বিপ্লব। অবরোধ উঠে যাওয়ার পর এজন্য আগামী মার্চের মধ্যে ইরান ৪১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তেল রপ্তানি করতে সমর্থ হচ্ছে। এর পেছনে রয়েছে ইরানের সঠিক কর্মপন্থা।
যুক্তরাষ্ট্রের অনলাইন মিডিয়া মিলিটারি টাইম্স বলছে, ২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি থেকে এ বছরের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত শুধু ইরাক ও সিরিয়ায় বিমান হামলা হয়েছে ১৭ হাজার ৮৬১ বার। এসব হামলার ১৩ হাজার ৯৮৯টি যুক্তরাষ্ট্র একাই করেছে। বাকিগুলো করেছে মিত্র দেশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়া, বাহরাইন, কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জর্ডান, নেদারল্যান্ড, সৌদি আরব, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত। এসব হামলায় দেশগুলোর জঙ্গি বিমান উড়েছে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬৯ বার। এরপরও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এক টুইটার বার্তায় বলেছেন, ইরাক দ্রুত দখল করে নিচ্ছে ইরান। তার দেশ ইরাকে ৩ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার জন্য ইরানকে সতর্কবার্তা দেন ট্রাম্প। কিন্তু ইরান তো কোনো দেশ আক্রমণ করছে না। অন্যদেশের মতো তারও নিরাপত্তা ও নিজেকে রক্ষা করার অধিকার রয়েছে। ইসলামি বিপ্লবের নেতাদের সঠিক নেতৃত্বে ইরান তাই করছে। হুমকির জবাবে ইরানের সংসদে জাতীয় নিরাপত্তা, ফরেন পলিসি কমিশনের সদস্য ও বিপ্লবী গার্ড রেজিমেন্টের সাবেক নেতা মুজতাবা জোনুর ফার্স নিউজকে যথার্থই বলেছেন, ইরান থেকে তেলআবিবে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পৌঁছতে মাত্র ৭ মিনিট সময় লাগবে। ইসরাইলের জেরুজালেম পোস্ট তা ফলাও করেই ছেপেছে।
ট্রাম্প একদিকে ইরানকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের জন্য হুমকি দিচ্ছেন, অন্যদিকে ইসরাইলকে সামরিক উন্নয়নে ২০২৮ সালের মধ্যে ৩৮ বিলিয়ন ডলারের অনুদান যোগান দিতে সম্মত হয়েছেন। ফিলিস্তিনে নতুন করে আরো ৩ হাজার ইহুদি বসতি স্থাপনে নেতানিয়াহুকে সমর্থন দিয়েছেন। ইরানের ‘শিহাব’ ক্ষেপণাস্ত্র মোকাবেলায় ইসরাইল যে অ্যারো-থ্রি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন করেছে সে সম্পর্কে ট্রাম্প কেন কোনো কথা বলছেন না? কারণ, এ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে মার্কিন বোয়িং কোম্পানি ও ইসরাইলের যৌথ উদ্যোগে। যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল উইলিয়াম কুলে জানান, এধরনের অ্যারো-থ্রি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মার্কিন কংগ্রেস ও প্রশাসনের সহায়তায় ১০ বছর ধরে গড়ে তোলা হয়েছে। সর্বশেষ ইসরাইলের পাঁচ বছর সামরিক পরিকল্পনায় ২০২০ সালের মধ্যে ৭৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যয় করার কথা বলা হয়েছে। দেশটির সামরিক কর্মকর্তা ডাবড গিডিয়ন বলছেন, লেবানন, সিরিয়া, গাজা, ইরানের পশ্চিম উপকূল থেকে সম্ভাব্য আক্রমণ ঠেকানো ছাড়াও ইরানের সামরিক সক্ষমতা বিবেচনা করেই এধরনের বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। কই, ট্রাম্পতো ইসরাইলকে কোনো হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন না। যে পরিমাণ অস্ত্র রপ্তানি করে ইসরাইল তাতে দেখা গেছে প্রতি ১০ জন ইসরাইলি নাগরিকের ১ জন এধরনের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।
বরং রাশিয়া ও তুরস্ককে নিয়ে ইরান আপ্রাণ চেষ্টা করছে সিরিয়া সংকট সমাধানের। ইরাকে গ্যাস ও বিদ্যুৎ রপ্তানি করে দেশটির উন্নয়নে অবদান রাখছে। মার্কিন আদালত ইরানের ২ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ আটক করার যে নির্দেশ দিয়েছে তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করেছে দেশটি। ইরানে সামুদ্রিক মাছ রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে ৪শ’ মিলিয়ন ডলারে। অস্কার স্বীকৃতি পেয়েছে যেমন ইরানের চলচ্চিত্র ‘দি সেলসম্যান’ তেমনি ইরানি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘হার্ন্টি’ ও ‘সাইলেন্স’ যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে অ্যাটলাস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। ইরান ফারা বোর্সের প্রধান নির্বাহী আমির হামোনি বার্তা সংস্থা ইরনাকে জানিয়েছেন, অবরোধ উঠে যাওয়ার পর দেশটির শেয়ার বাজারে ১২৫ মিলিয়ন ডলার বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। বিপ্লব সফল হওয়ার শুরুতে ইরানে মাথাপিছু আয় ছিল ৪ হাজার ২৬৭ ডলার আর ২০১৫ সালে তা উন্নীত হয়েছে ১৬ হাজার ৯১৮ ডলারে। একই সময়ে দেশটির জনসংখ্যা ৩৮ থেকে ৭৯ মিলিয়নে বৃদ্ধি পেয়েছে। আর্থিক খাতে ব্যাপক সংস্কার হয়েছে। জ্বালানি ব্যবহারে ইরানের নাগরিকরা বিশ্বমানের চেয়ে ৩ গুণ এগিয়ে আছেন।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো ছাড় দেওয়া হয় না এর একটি উদাহরণ হচ্ছে ২ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক ঘাপলায় অভিযুক্ত কোটিপতি ব্যবসায়ী বাবাক জানজানিকে মৃত্যুদণ্ডিত হতে হয়েছে। ফলে অবরোধের মধ্যে নিজেদের টিকে থাকার লড়াই ইরানকে নিয়ে গেছে অন্য এক উচ্চতায়। ইরানের বিরুদ্ধে অবরোধে যোগ দিয়ে ইউরোপ প্রবল অর্থনৈতিক মন্দায় পড়ে। কারণ, ইউরোপ জ্বালানি তেলের জন্য ইরানের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল ছিল। দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানের মতো দেশও ইরান থেকে তেল আমদানি বন্ধের পর ক্ষতির মুখে পড়ে। কর্মসংস্থানের গতি হ্রাস পায়। অবরোধ প্রত্যাহারের পর স্বাভাবিকভাবে ইউরোপসহ এসব দেশ ইরান থেকে তেল আমদানি বৃদ্ধি করছে।
মধ্যপ্রাচ্যে ইরান, রাশিয়া ও তুরস্ক এখন এক কৌশলগত ভিত্তি রচনা করে আইএস জঙ্গিদের হটিয়ে দিয়েছে। একই সঙ্গে পূর্ব ও পশ্চিমে ভারতের সঙ্গে ইরানের কৌশলগত রণকৌশল অনেককে মুগ্ধ করছে। ইরানের বিরুদ্ধে অবরোধ না মেনেই চীন ও ভারত দেশটি থেকে তেল আমদানি করে এবং এখন নতুন গ্যাস পাইপলাইন, রেলপথ ও নৌপথ তৈরি করে বিশ্বায়ন ব্যবস্থায় নতুন এক বিকল্প অবস্থান তৈরি করছে ইরান। তেল ও অন্যান্য পণ্য ক্রয় বাবদ ভারতকে ৫৫ ভাগ মূল্য ইরানের কাছে মার্কিন ডলারে নয়, মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে ইউরো’তে এবং বাকি ৪৫ ভাগ পরিশোধের সুযোগ মিলেছে রুপিতে। ভারত ইরানের চবাহার সমুদ্র বন্দরে ২০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে। চবাহার বন্দরটি অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে ভারতের কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
কার্যত ইরানের ওপর অবরোধ চীন, আমিরাতসহ অনেক দেশকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে যারা দেশটিতে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য বৃদ্ধি করছিল। এই অবরোধ ইরান প্রশ্নে পুরো বিশ্বকে দুই ভাগে বিভক্ত করে। অবরোধ এখন অচল বিষয়। ইউরোপ, চীন, ভারত, ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলো নিজেদের বাণিজ্য স্বার্থেই ইরানের বিরুদ্ধে অবরোধ দেওয়া হলে ভবিষ্যতেও তা মানবে বলে মনে হয় না। রাশিয়া ইরানের বিরুদ্ধে যে কোনো অবরোধের বিরুদ্ধে আইনগত সহায়তাসহ রাজনৈতিক চাপ মোকাবেলায় ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়ে কাজ করবে।
বিশেষ করে নতুন সিল্ক মহাসড়ক নির্মাণ পরিকল্পনায় ইরান যে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে তা দেশটিকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দৃঢ় ভিত্তিমূলের ওপর দাঁড় করিয়েছে। সিল্ক মহাসড়ক চীন, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপকে শুধু যুক্তই করবে না একই সঙ্গে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় এক বিশাল মুক্তবাণিজ্য এলাকার সৃষ্টি করবে। সিল্ক মহাসড়ক বাস্তবায়ন হলে এ অঞ্চলে একচেটিয়া মার্কিন বাণিজ্য নীতি অকার্যকর হয়ে পড়বে। অবরোধ নিয়ে চিন্তা করার সময় নেই ইরানের। ইরানের মনোযোগ চীন, কাজাখাস্তান, তুর্কমেনিস্তান হয়ে রেল সংযোগের মতো অসংখ্য প্রকল্প কতটা বাস্তবায়িত হলো তার ওপর। অবরোধে ক্ষতিগ্রস্ত তেল খাতকে চাঙ্গা করতে কীভাবে ২শ’ বিলিয়ন ডলার বিদেশি বিনিয়োগ সম্ভব হয়ে ওঠে তার ওপর।
পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় ইরানের রাজনৈতিক নেতৃত্বের বোঝাপড়ার ক্ষমতা আন্তর্জাতিক বিশ্বের নজর কেড়েছে। ইরানের সমুদ্রসীমায় ভুল করে মার্কিন নৌ সেনারা ঢুকে পড়লে তাদের আটকের পর ছেড়ে দেয় ইরান। আবার যেদিন ইরানের ৪শ’ মিলিয়ন ডলার পাওনা ফেরত দিল ওয়াশিংটন সেদিন তেহরান কারাগার থেকে বেশ কয়েকজন মার্কিন নাগরিককে মুক্তি দেওয়া হয়। হেগ ট্রাইবুনালের নির্দেশে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওই পাওনা ফেরত দিতে বাধ্য হয়। এরপর পরই যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর অবরোধের সময়সীমা বৃদ্ধি করে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জারিফ চুক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, সকল পক্ষকে তা মেনে চলা উচিত, না হলে এর বিকল্প ব্যবহার করবে তেহরান। বিশেষ করে গত বছর তেহরানে চীনের প্রেসিডেন্ট ঝি জিনপিংএর সফর ছিল এক বড় চমক। দুটি দেশের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধি ৪০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে ১৮টি চুক্তি হয়। আগামী ২৫ বছরে তা ৬শ’ বিলিয়নে পৌঁছাবে বলে আশা করছে দুটি দেশ। চীন এখন ইরান থেকে সবচেয়ে বেশি তেল আমদানি করছে।
এদিকে রাশিয়ার সঙ্গে ইরান সম্পর্ককে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। অবরোধ সত্ত্বেও পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে রাশিয়া ইরানকে নীরবে সহায়তা করে গেছে। রাশিয়ার তেল কোম্পানিগুলো একের পর এক ইরানে বিনিয়োগ করছে। দুটি দেশের আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে এধরনের বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ইরান ও ইউরোশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়ন মিলে মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে। তার আগেই দুটি দেশের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে ৮০ ভাগ। বিশ্ব রাজনীতিতে এ দুটি দেশ এখন বড় ধরনের ভূমিকা রাখছে।
আরো একটি বড় চমক দেখাতে যাচ্ছে ইরান, আর তা হচ্ছে পারসিয়ান ক্যানেল নির্মাণ করে ইউরোএশিয়াকে যুক্ত করা। ইরানের এ পরিকল্পনা হচ্ছে বিকল্প সুয়েজ খাল নির্মাণ। দশ বছরের মধ্যে কাস্পিয়ান সাগর থেকে পারস্য উপসাগরে তৈরি ওই খাল দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার পথ নির্মাণ কবে শেষ হবে সেদিকে চেয়ে আছে চীন ও রাশিয়া। কারণ, এমন খাল নির্মাণ হলে শুধু ইরান নয়, ওই বৃহৎ দুটি দেশও উপকৃত হবে। আর এ খালটির সামরিক গুরুত্ব হবে আরো বেশি। বসফরাস প্রণালি দিয়ে রাশিয়া পণ্যভর্তি কিংবা যুদ্ধজাহাজ যেটাই এখন পাঠিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকে, পারসিয়ান ক্যানেল দিয়ে যেতে পারলে সে দুশ্চিন্তা আর থাকবে না। ভূমধ্যসাগরের বন্দর হয়ে সুয়েজ খাল পাড়ি না দিয়ে পারসিয়ান ক্যানেলের বিকল্প পথ ধরবে অনেক দেশের জাহাজ। বিশ্বে পরাশক্তির একচেটিয়া বাণিজ্য কিংবা অবরোধের হুঙ্কার অবশিষ্ট থাকবে না। তথাকথিত ‘হার্ডলাইনার’দের দিনও শেষ হয়ে যাবে।
আরব বসন্তে ৮৩ হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহতের স্মৃতি নিয়ে সংঘাতের চিহ্ন বহন করছে মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকার যেসব দেশ, তাদের জন্য ইরান বরং নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে দিয়েছে। এজন্য ইরান পোল ডটকমের এক জরিপে দেখা গেছে ৮৪ ভাগ উত্তরদাতা মনে করছেন মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা রক্ষায় বরং ইরানের প্রভাব বৃদ্ধি হওয়া দরকার। ৮০ ভাগ মনে করছেন সিরিয়া পরিস্থিতি সামাল দেওয়া না গেলে তা আরো বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি করবে। ৭৭ ভাগ মনে করেন মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের নীতির পাল্টা বিকল্প থাকা উচিত। ইরাক যখন ইরানে আক্রমণ করে তখন যুক্তরাষ্ট্র দেশটির ওপর অবরোধ আরো জোরদার করে। আর সেই ইরাককে পুনর্গঠনে ইরান সহায়তা করে যাচ্ছে। আমেরিকান গণতন্ত্র সম্পর্কে ইরানের যথেষ্ট ধারণা আছে বৈকি। নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক লরা সেকর তাই ইরানের এগিয়ে যাওয়াকে বিপ্লব ও কাজের অগ্রগতি হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেছেন, সংগ্রামই ইরানের আত্মা এবং তা এক বাস্তবতা।
অন্যদিকে ইরান, চীন, ইরাক ও পাকিস্তান মিলে যে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করে যাচ্ছে তা শুধু ভূ-কৌশলগত অবস্থানকে পরিবর্তন করে দিচ্ছে না, একই সঙ্গে অন্তত ৩ বিলিয়ন মানুষের জন্য নতুন ভাগ্য গড়ে দিচ্ছে। এরাই হচ্ছে বিশ্বের অর্ধেক মানুষ। যাদের সম্পদ কুক্ষিগত করে নয়, যুদ্ধ বাঁধিয়ে সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে নয়, বোমারু বিমান উড়িয়ে নয়, বরং প্রেম ও ত্যাগের মহিমায়, সহায়তার হাত বাড়িয়ে ইরান, চীন ও রাশিয়ার বিশ্বমানের বিজ্ঞানীরা এক অভিন্ন লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন। আর এধরনের একাধিক কাজে প্রেরণা যুগিয়ে যাচ্ছে ইরানের ইসলামি বিপ্লব। কিন্তু ওয়াশিংটন বরাররের মতোই ইরানকে বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছে।
আর তাই ইরানের সামনে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে একদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ইসরাইল ও তার মিত্র আরব দেশগুলোর পক্ষ থেকে ইয়েমেন, সিরিয়া, বাহরাইন সহ মধ্যপ্রাচ্যে আগ্রাসনের মোকাবেলা করে স্থিতিশীলতা টিকিয়ে রাখার মধ্য দিয়ে নিজের শক্তিকে জানান দেওয়া এবং অন্য চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থাকে মাটি চাপা দেওয়া। হযরত আলী (রা) এর দুধারি তরবারির মতো ইরানকে নানা ধরনের যুদ্ধের ময়দানে লড়তে হচ্ছে। আশার কথা, পেট্রোডলারের সেই দাপট আর নেই। তেলনির্ভর অর্থনীতির দিনও শেষ। ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক শক্তির ব্যবহার এখন বিশ্বে পাত্তাও পাচ্ছে না। খুব কম সময়ের মধ্যেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু একে অপরের সঙ্গে মিলিত হচ্ছেন, অথচ তাঁদের দেশের নাগরিকরা এধরনের হম্বিতম্বি পছন্দ করছেন না। এদিক থেকে ইরান স্বতন্ত্র ও ভিন্ন। দেশটির নাগরিকদের জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতিতে যুক্ত করে প্রযুক্তি ও পুঁজির ব্যবহারে ইরানের নেতারা বাস্তবিকই ইসলামি বিপ্লবের এক মহান নজরানা উপস্থাপন করছেন। যা টিকে থাকার জন্য এসেছে, ফুরিয়ে যাবার জন্য নয়।

ইরানের ইসলামি বিপ্লবের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ

ড. মোহাম্মদ ইকবাল হোছাইন
অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

সংস্কৃতি আসলে একটি দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। একটি জীবনবোধ বিনির্মাণের কলাকৌশল। এটি মানুষের জীবনের একটি শৈল্পিক প্রকাশ, সমাজ জীবনের স্বচ্ছ দর্পণ যা ধীরে ধীরে জাতি গঠনের উপাদান তৈরি করে। এ সকল অর্থের বিবেচনায় ইরানের ইসলামি বিপ্লবকে সত্যিকার অর্থে সাংস্কৃতিক না সামাজিক বিপ্লব বলে অভিহিত করা হবে এ নিয়ে গবেষকদের বিতর্ক থাকলেও আত্মম্ভরিতা, স্বেচ্ছাচারিতা ও ইন্ডিভিজ্যুয়ালিজমের বিপরীতে ¯্রষ্টা ও সৃষ্টির সম্পর্কের মূল্যমানের উপর এটি এক সার্থক (আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সংস্কৃতি) গণবিপ্লব তাতে সন্দেহ নেই। বিপ্লবের মহানায়ক আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেইনী এমন এক খোদায়ী সংস্কৃতির ছায়াতলে আবদ্ধ হয়ে ইরানি জাতির মণিকোঠায় স্থান করে নিয়েছেন যেখানে ব্যক্তির খেয়াল-খুশি ছিল নিয়ন্ত্রিত। একদিকে শাহানশাহ উপাধি নিয়ে সারা শরীর স্বর্ণখচিত অহংবোধের পরিচ্ছদে মুড়ানো অত্যাচারী শাসক রেজা শাহ, অপরদিকে খোদার প্রতি অনুগত আত্মত্যাগী এক বান্দা, যিনি সারাদিন মানবতার কল্যাণে জীবন বিলাতে ব্যস্ত, অপরদিকে সারারাত ইবাদাতে মাশগুল থেকে রাব্বুল ইজ্জতের করুণাপ্রার্থী। জনগণ নিশ্চয়ই আত্মত্যাগীকেই বেছে নিবে। তাই হয়েছে রুহুল্লাহর ক্ষেত্রে। তিনি তো ক্ষমতা চাননি, নেনওনি। চেয়েছেন খোদাভীরু ইরানি এক মহান জাতি। এ জন্যই পৃথিবীর ইতিহাসে তিনি ইমাম, আবেদ ও রূপকথার তুল্য ব্যক্তিত্ব। আর ইরানি জাতির কাছে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর প্রত্যয়ী এক মহান নেতা। প্রখ্যাত ফরাসি দার্শনিক ও চিন্তাবিদ ফুকো ইমাম খোমেইনীর নেতৃত্ব ও জীবনবোধে বিমোহিত হয়েছেন। বলেছেন, ‘আয়াতুল্লাহ খোমেইনীর ব্যক্তিত্ব কিংবদন্তি ও রূপকথার তুল্য।… পৃথিবীর অনেক ব্যক্তিত্ব আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে ক্ষমতায় পৌঁছতে পেরেছেন বৈকি, কিন্তু জনগণের সাথে এত গভীর ও শক্তিশালী সম্পর্ক রাখার দাবি করতে পারেন না।’ তাঁর দার্শনিক তত্ত্বের সার্থকতা এখানেই যে, বিপ্লবের ৩৮ বছর পরেও তিনি জাতির হৃদয়ের মণিকোঠায় আধ্যাত্মিক উস্তাদ হিসেবে নির্দেশনা দিচ্ছেন। পৃথিবীর আধিপত্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের দর্প চূর্ণকারী রাসূলের মহান এ অনুসারীকে নির্মোহ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে পৃথিবীর লক্ষ-কোটি ভক্ত ও অনুসারী। সমসাময়িক পৃথিবীর বাস্তবতায় তাঁর ত্যাগী ও নির্মোহ আদর্শ শুভ্রতা ছড়াচ্ছে প্রতি মুহূর্তে আর অপরদিকে তাঁর সমালোচনাকারী বিদ্বেষীরা ইতিহাসের বিপরীত পাতায় নাম লেখাচ্ছে আর হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
ইসলাম চেতনাগতভাবে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করেছে। রাসূল মুহাম্মাদ (সা.) ‘উম্মাতে ওয়াসাত’ চেতনায় দ্বীনের দাওয়াত থেকে শুরু করে সকল কর্মকাণ্ডে সাবলীল মানবতাবাদী পরিবার ও সমাজ নির্মাণে মগ্ন হয়েছিলেন। মক্কায় ইবাদতের সময় অত্যাচার, তায়েফের আক্রমণ, মদীনা সনদ, চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে ডিফেন্সিভ অবস্থান, হুদায়বিয়ার সন্ধি অথবা বিভিন্ন দেশের শাসকদেরকে চিঠির মাধ্যমে ইসলামের আমন্ত্রণ মধ্যমপন্থা ও সহাবস্থানের বিষয়কে নির্দেশ করে। রাসূল (সা.) এর সুমহান সিরাতের সংস্কৃতির প্রভাব ছিল আয়াতুল্লাহর উপর। সাম্রাজ্যবাদী যখন সারাবিশ্বে দখলস্বত্ব নিয়ে লড়ছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ন্যায় মানবতাবিধ্বংসী সংস্কৃতির নোংরামিতে ব্যস্ত তখন তিনি মানবতাকে সাজানোর কাজে ব্যস্ত হলেন, লেখলেন ‘কাশ্ফ আল-আসরার’ (Uncovering Secrets)। পৃথিবীর ভাঙা-গড়ার সংস্কৃতির বিপরীতে তিনি দক্ষ খোদাভীরু মানুষ তৈরির সংস্কৃতি গড়ে তুললেন। তাঁর ‘স্বপ্নিল সমাজ’ ভঙ্গুর ইরানি সমাজে কাদের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা পাবে এ প্রশ্নের জবাব তিনি ষাটের দশকের শিশুদের দিকে ইশারা করে বলেছিলেন, ‘এরা আমার প্রাণশক্তি। সম্ভাব্য বিপ্লবের সিপাহসালার’। মজার ব্যাপার হলো, এরা যখন সত্যিকার তারুণ্যদীপ্ত তখন এল মাহেন্দ্রক্ষণ। ১৯৭৯ সাল, এল বিপ্লবের ডাক। আর তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল এ তরুণরাই। হিলাল হাফিজের প্রত্যয়ী কথা সত্যিই সুন্দর- ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়’। শ্রেষ্ঠ যুব সমাজকে ইসলাম সর্বদাই স্বাগত জানায়। আর এ স্বাগতের মধ্যে আছে নিজ ও ধরীত্রিকে গড়ার এক সম্মোহনী শক্তি। এজন্য ইসলামি বিপ্লব ও আয়াতুল্লাহর ত্যাগ, তাকওয়ার জিন্দেগি একই সুতোয় গাঁথা। মালাতেই যেন মালীর পরিচয়।
নীতিভ্রষ্ট পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী ও কতিপয় ভ্রান্ত মানুষের কবলে পড়া সাম্যবাদী পৃথিবী ভাবতেই পারেনি হাজার বছরের সভ্যতার ইরান ‘শ্বেত বিপ্লবের’ স্লোগানে পশ্চিমা দাসত্ব মেনে নেবে না। কেননা, তৃতীয় বিশ্বের ক্ষমতা পরিবর্তনে পশ্চিমাদের আশীর্বাদ অঘোষিত বিধানে রূপ নিয়েছিল। দীর্ঘ পাঁচ হাজার বছরের ধারাবাহিক সভ্যতার ধারক ও বাহক পারস্য- আজকের ইরান ইসলামকে স্বাগত জানিয়ে যে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিল, বিপ্লবোত্তর বিশ্ব পরিস্থিতিকে মানিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রেও ইরান বিজ্ঞোচিত সিদ্ধান্তের পরিচয় দিয়েছে। বিপ্লবের পরপরই পার্লামেন্ট ভবনে হামলা, ইরাক-ইরান যুদ্ধে সাদ্দামকে পশ্চিমাদের অব্যাহত কাপুরোষিত উস্কানিমূলক সমর্থন, কোন কিছুই ইরানকে আদর্শচ্যুত করতে পারেনি। একটি প্রবাদ আছে- ‘রাগলেন তো হেরে গেলেন’, এ কাজটি ইরানের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক কোন ক্ষেত্রেই বিপ্লবী সরকার প্রয়োগ করেনি। বিপ্লব ও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে সুযোগের ব্যবহার করে বিপ্লবকে ধ্বংস করতে বারবার ইরানে সরাসরি আক্রমণের অনুরোধ সত্ত্বেও সাম্রাজ্যবাদী এবং তার দোসররা তা করেনি। কারণ, তারা ভিয়েতনাম যুদ্ধে যে শিক্ষা পেয়েছে তা ভুলে যায়নি। আর ইরানের বিপ্লবতো ছিল খোদায়ী চেতনার। এখানে সরাসরি সংযুক্তি কেবল আরো ধ্বংসই ডেকে আনবে, এটা তাদের গবেষকদের কাছে দিবালোকের মত স্পষ্ট ছিল। কিন্তু মুসলিম বিশ্বের জন্যে দুঃখের হল ইরানকে ধ্বংস করার জন্যে ভাড়া করা হয়েছিল কিছুসংখ্যক মুসলমানকে, নিজেদের রক্ত নিয়ে নিজেরা হোলি খেলেছে। অত্যন্ত ধৈর্যের সংস্কৃতির কারণে এ পরীক্ষায়ও ইরান উৎরে গিয়েছিল। আর লজ্জায় ডুবেছিল সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাভিলাসী ও তাদের দোসর নামধারী কিছু মুসলমান। পশ্চিমাদের এ ষড়যন্ত্র দূর থেকে অবলোকন ও নীরব সমর্থনের জন্যে বিপ্লবের সিপাহসালার আয়াতুল্লাহ সাম্যবাদী সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি খুশি ছিলেন না। তবে বৈশ্বিক সম্পর্কে এর কোন প্রভাব পড়তে দেননি। সত্যকে সত্য বলে মেনে না নেওয়ায় সমাজতন্ত্র তখন অনেকটা অসার হয়েছিল বলেই আয়াতুল্লাহ তৎকালীন সোভিয়েত প্রেসিডেন্টকে ইসলাম সম্পর্কে পড়াশুনার জন্য বিশেষ দূতের মাধ্যমে আমন্ত্রণ পাঠিয়েছিলেন। কূটনৈতিক শিষ্টাচার ও ইসলামি আদর্শের গ-ির মধ্যে থেকে এ আহ্বান করে তিনি পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। এ তাক লাগানোর সংস্কৃতি কেবল ইরানি বিপ্লবই বর্তমান পৃথিবীকে উপহার দিতে পেরেছে। সমাজতন্ত্রের প্রতি দুর্বল বলে যারা ইরানি বিপ্লবকে অভিযুক্ত করতেন, বিশ্ব মুসলিম ও মানবতার স্বার্থে একই সাথে সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ ও সমাজবাদের বিপরীতে ইরানের অবস্থান তাদের ধারণায় চপেটাঘাত করেছে বৈকি!
স্যামুয়ের হান্টিংটনের ‘ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশনের’ পৃথিবী অনেক বেশি জটিল ও অনেকটাই মানবতার বিপরীতে অবস্থান করছে। বর্তমানে অনেকের মুখে মানবতার কথা শুনলেও তাদের অস্ত্রের বাজেট দেখলে এর বিপরীতে রাক্ষুসে চরিত্র ফুটে ওঠে। পৃথিবীর প্রথম সারির ১০টি দেশের এক বছরের প্রতিরক্ষা বাজেট দিয়ে জাতিসংঘের ৭৫০ বছরের বাজেট তৈরি করা যায়। কেবল ভিয়েতনাম যুদ্ধে যে অস্ত্র ও বিলিয়ন টন বোমা ফেলা হয়েছে তাতে দেশটির করুণ কথা না হয় বাদই দিলাম, আক্রমণকারীদের অর্ধলক্ষ সৈন্যের মৃত্যু, হাজার হাজার লোকের পঙ্গুত্ব তাদেরকে কী দিয়েছে? একবার কি তারা ভেবেছে? ভাবার তো সুযোগ নেই। কারণ, মানবতার নাম করে এরা মানুষের গ্রাস কেড়ে অস্ত্রের রসদ যোগায়। এরা ক্ষুধার্তকে অন্ন যোগানোর পরিবর্তে জঙ্গিদের অস্ত্র দিতে বেশি পছন্দ করে। বর্তমান সিরিয়া পরিস্থিতির জন্যে আইরিশ বংশোদ্ভূত ককবার্ণ স্পষ্টতই পশ্চিমাদের অদূরদর্শী নীতি ও অস্ত্র রাজনীতিকে দায়ী করেছেন। বিপ্লবোত্তর ইরানকে সন্ত্রাসের সাথে মেলানোর অনেক প্রচেষ্টা খোদায়ী গায়েবি মদদ ও ইরানের ধৈর্যের সংস্কৃতিই সাফল্যের সাথে মোকাবিলা করার প্রেরণা যুগিয়েছে। উপসাগরীয় যুদ্ধে সা¤্রাজ্যবাদীদের একসময়ের দোসরদের কাউকে ধ্বংস করে অস্ত্র তাক করা হয় ইরানের দিকে। তাদের নাকি পারমাণবিক অস্ত্র আছে! সুতরাং এবার যায় কোথায়? খাঁচায় বন্দি হল পাখি। তাদের শায়েস্তা করার নামে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাংকিং লেনদেন বন্ধ করে দেওয়া হল, অবরোধ আরোপ করা হল। আরো কত কী? কিন্তু ঐশী চেতনায় ভাস্বর ইরানকে কি তাতে টলানো যায়? পশ্চিমাদের ‘স্ট্র ইনদা উইন্ড’ পলিসি এখানেও মার খেল। ইরান ধৈর্যের পরিচয় দিল। সকল হুমকি ধমকি ব্যর্থ হওয়ায় ছয় জাতি কনসোর্টিয়াম চুক্তিতে আসতে বাধ্য হয়। কেননা, তারা জানে ইরানকে কাবু করার মত আত্মিক ও বৈষয়িক শক্তি এখন আর তাদের নেই। এখানেও ধৈর্যের সংস্কৃতির কল্যাণে পাশ করল ইরানের সফল কূটনীতি। ইরানের পারমানবিক কর্মসূচী একেবারেই শান্তিপুর্ণ। তাদের পারমাণবিক শক্তি সম্পর্কে স্লোগান হল: ‘Neuclear energy fo all, Neuclear weapon for none.’ তাদের শান্তিপূর্ণ এ কর্মসূচীতে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন ও ওআইসিও সমর্থন জানিয়েছে। ঠিক একইভাবে বিপ্লবোত্তর ইরানে সফল হয়েছিল বিপ্লবী নেতৃত্ব। যারা ইসলামি বিপ্লবীদের উপর সীমাহীন অত্যাচার করেছিল, বিপ্লবের পর ইমাম আয়াতুল্লাহ খোমেইনী কম্বোডিয়ার পলপটের ন্যায় তাদের উপর প্রতিশোধ নিতে পারতেন। মেকং নদীর ন্যায় রক্তগঙ্গা বইয়ে পারস্য উপসাগর লাল করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে সবাইকে কাছে টেনে নেন এবং বিপ্লবোত্তর ইরানে গণভোটের মাধ্যমে ৯৮% লোকের সমর্থন নিয়ে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করেন। সুতরাং পশ্চিমা কোন কোন সোসিওলজিস্টের বিপ্লব হাইজ্যাক করার অভিযোগ একেবারেই অগ্রহণযোগ্য ও প্রত্যাখ্যাত।
বিপ্লবোত্তর অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সহজ কাজ ছিল না। বিপ্লবকে যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে নিতে কেবল বিপ্লবের বন্দনায় সাধারণ মানুষকে সন্তুষ্ট রাখা যাবে না, নেতৃবৃন্দ তা বুঝতে বেশি দেরী করেন নি। এজন্য বিপ্লব-পরবর্তী নেতৃত্ব কর্মমুখী স্বাবলম্বী ও সক্ষমতার নতুন বিপ্লবের ডাক দিলেন। সাড়াও পেলেন আশাতীত। যুদ্ধ ও শত প্রতিকূলতার মধ্যেও দেশের কল্যাণমূলক কাজ প্রত্যন্ত ও নিভৃত অঞ্চল পর্যন্ত নাড়া দিয়ে ওঠে। শিক্ষা একসময় এলিটদের ভূষণ থাকলেও বিপ্লবোত্তর ইরানে সাধারণ ও প্রান্তিক জনমানুষকে এর আওতায় নিয়ে আসা হয়। বর্তমানে ইরানে শিক্ষার হার শতভাগ। ইসলামপূর্ব পারস্যে পনডারে নিক (Correct Thought) গুফতারে নিক (Correct Talk) ও রাফতারে নিকের (Correct Behavior) ব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়ে ইসলামের চেতনায় ঐশী আলোয় আলোকিত হয়। ইসলামি ইরানের শিক্ষা একসময় ইবন সিনা, আল-তুসী, জামী, ওমর খাইয়্যাম ও হাফিজের মত ক্ষণজন্মা বুদ্ধিজীবীদের জন্ম দিয়েছে যার প্রভাব পশ্চিমা বস্তুবাদী শিক্ষায় হারিয়ে যাচ্ছিল। বিপ্লবের পরপরই ঐশী আলোয় শিক্ষাধারা শুরু করার নিমিত্তে সাংস্কৃতিক বিপ্লব ও শিক্ষা সংস্কার কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি আয়াতুল্লাহর পরামর্শে এমন এক ধারা চালু করে যে, তা ইরানকে তো বটেই বরং সারা পৃথিবীর সচেতন ও আলো প্রত্যাশিত মানুষকে আরো সুন্দরের দিকে নিয়ে যায়। চেতনা ও সংস্কৃতির এ বৈশ্বিক প্রভাব ইরান ও ইসলামকে জানার ও বুঝার নতুন নতুন দিক উন্মুক্ত করছে প্রতিনিয়ত।
ইরানে বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে নওরোজসহ সকল স্থানীয় সংস্কৃতির পরিচ্ছন্ন ও জোরালো উদ্যাপন বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। পরিচ্ছন্ন নওরোজ উদ্যাপন এটাই প্রমাণ করে, অপসংস্কৃতির বেড়াজালমুক্ত কোন স্থানীয় সংস্কৃতি ইসলামবিরোধী নয়। শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ সমাজের সকল স্তরে নারীর সরব উপস্থিতি প্রসঙ্গে ইসলাম ও ইরান সম্পর্কে বৈশ্বিক বিরোধীরাও নমনীয়। ২০১২ সালের ইউনেস্কোর এক হিসেবে ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষায় ইরানের মেয়েরা পৃথিবীর যে কোন দেশের চেয়ে এগিয়ে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা বহুলাংশে নারীদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় কাজে নারীর অবস্থানে যে কোন মুসলিম দেশের চেয়ে অপেক্ষাকৃত এগিয়ে। ইরানি নারীদের শালীন পোশাক আর হিজাব তো এখন প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সংস্কৃতির অংশ। হিজাবের এ সফ্ট উদ্ভাবন বিশ্বের অসংখ্য নারীকে এ শালীন পোশাকে উদ্বুদ্ধ করেছে। অনেক অমুসলিমও নিজেদের নিরাপত্তায় এ পোষাককে সমর্থন জানিয়েছে।
ইরানি নাটক, সিরিয়াল, আর্টফিল্ম, সিনেমা আজ একটি স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত। পৃথিবীর সকল ফিল্ম ফেস্টিভালে দাপটের সাথে বিচরণকারী ইরানি চলচ্চিত্রকে অস্ট্রেলিয়ান ফিল্মমেকার মিশেল হেনেক ও জার্মান ফিল্মমেকার ওয়ার্নার হারজক One of the world most important artist Cinema হিসেবে অভিহিত করেছেন। ১৯৯২ সালে চীনে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয়েছিল ইরানি চলচ্চিত্র। বাংলাদেশের সকল ফেস্টিভালে ইরানি চলচ্চিত্রের সাবলীল বিচরণ এবং বাংলায় ডাবিংকৃত ইরানি চলচ্চিত্র মানেই টিভি সেটের সামনে পুরো পরিবারের উপস্থিতি যা সুস্থ সংস্কৃতির প্রতি সমর্থনেরই পরিচায়ক। এসব কিছু কিন্তু বিপ্লবের দর্শনে বিশেষ কোড মেনেই হচ্ছে। এতে সিনেমার শিল্পমান ও ইমোশান ক্ষুন্ন হয়নি। নৈতিকতা, মানবিকতা, প্রকৃতি ও শিশুদের ব্যাপক উপস্থিতি ইরানি চলচ্চিত্রে লক্ষ করা যায়। Sex ও Violence এর স্থানকে তারা বিভিন্ন উপাদান দিয়ে পূরণ করেছে। আরেকটি দিক এখানে বলতেই হবে, এসব চলচ্চিত্রে ধর্মীয় কোন নির্দেশনা বা ডায়ালগ আমার চোখে পড়েনি। তবে উপন্যাস ও চরিত্রনির্ভর প্রতিটি ফিল্ম থেকে মানুষ কিছু না কিছু শিক্ষা গ্রহণ করে যা পৃথিবীর অনেক বড় বড় ইন্ডাস্ট্রি বিশ্বকে দিতে পারে নি। পেইন্টিংস, কালিগ্রাফি, ফটোগ্রাফি, মিউজিক ইত্যাদি ক্ষেত্রকে বিপ্লব ধারণ করেছে এবং লালন করছে। মুসলিম বিশ্বে আর্ট ও পেইন্টিং-এর যে স্বতন্ত্র ধারা চালু হয়, এর অনেকটার কৃতিত্ব ইরান দাবি করতেই পারে। তাদের এ ধারা বিশেষ কোন প্রকারে সীমাবদ্ধ নয় বরং Classical, Traditional, Revolutionary & Modern সকল ক্ষেত্রেই সমানভাবে বিরাজমান।
আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে ক্রীড়া ও বিনোদনের ক্ষেত্রেও। অলিম্পিকসহ ক্রীড়ার সকল ক্ষেত্রে শারয়ী কোড মেনে অগ্রসর হচ্ছে দেশটি। ইসলামিক গেম্স্ আয়োজন করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল ইরান। আমার ইরান যাওয়া হয়নি, তবে যাঁরা ভ্রমণ করেছেন এবং পত্র-পত্রিকার বিভিন্ন রিপোর্ট অনুযায়ী সারাদেশে হাজার হাজার পরিচ্ছন্ন ও আধুনিক পার্ক ও ব্যায়াম কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, বিশেষায়িত পার্ক, ওয়াটার পার্ক, জীববৈচিত্র পার্ক, ফুলের পার্ক, প্রাণি পার্কসহ অসংখ্য বিশেষায়িত পার্ক ও দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা কোন কোন ক্ষেত্রে অনেক ট্যুরিস্ট ফ্রেন্ডলি দেশকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। যে কারণে দেশটিতে ভ্রমণকারীর সংখ্যা প্রতিদিনই ঊর্ধ্বমুখী। আন্তর্জাতিক আকর্ষণের কারণেই দেশটি এখন বিভিন্ন ফেস্টিভাল, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, এক্সপো ও আন্তর্জাতিক কার্নিভালের কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।
টেকনলজির উদ্ভাবন, ব্যবহার ও এর যৌক্তিক মাত্রা নির্ণয়ে স্বর্ণযুগের পর থেকে মুসলমানদের পশ্চাদপদতা মোটা দাগে চোখে পড়ার মত। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গতিপথ নির্ণয়ের ধারণায় মক্কা ও মদীনা শরীফের পর, কখনো দামেশক, কর্ডোভা, বাগদাদ ও কায়রোর দিকে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য বারবার ফিরে যায়। তেহরান কেন্দ্রীক মধ্য-এশিয়ার অবদানও কম নয়। তবে বিজ্ঞান গবেষণায় বিপ্লবোত্তর ইরানের অগ্রগতি এককথায় বিস্ময়কর। একের পর এক যুদ্ধ, অবরোধ, পাশ্চাত্যের অসহযোগিতা, হুমকি ও সর্বশেষ সাম্প্রতিক বিশেষ অর্থনৈতিক অবরোধের মুখে দেশের সর্বোচ্চ ধর্মীয়-রাজনৈতিক নেতার নির্দেশে ইরানের বিজ্ঞানীরা চরম আত্মত্যাগ ও সাধনার পরিচয় দেয়ায় দেশটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে শনৈ শনৈ উন্নতি করছে । বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে ইরানের বিজ্ঞানীদের অগ্রগতি বর্তমানে সমগ্র বিশ্বের বিজ্ঞানীদের গড় অগ্রগতির ১১ গুণ দ্রুততর (Fastest)। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে স্বল্পতম সময়ে তারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বিশ্বের প্রথম ৫টি দেশের মাঝে স্থান করে নেবে। বিজ্ঞান জার্ণাল প্রকাশে দেশটি মুসলিম বিশ্বে শীর্ষে অবস্থান করছে। দু:খজনক হলেও সত্য এসব পজিটিভ সংবাদ ইহুদী ও সা¤্রাজ্যবাদ নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ায় স্থান পায় না। সত্যের বিপরীতে ইরানকে তারা অন্যভাবে পোট্রেইট করতে চায়। অবশ্য এখন তা আর সম্ভব নয় কেননা তথ্য-প্রযুক্তি এবং মিডিয়ার ক্ষেত্রে ইরান যে কোন সময়ের চেয়ে শক্তিশালী।
আইন মান্য করার সংস্কৃতি বিপ্লবোত্তর ইরানের একটি বড় অর্জন। একথাটি এখানে এজন্য সংযুক্ত করেছি দু’একটি দেশ বাদে কেন জানি মুসলিম বিশ্বে আইন মানার সংস্কৃতি গড়ে উঠছে না। অথচ কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের জন্যে তা খুবই প্রয়োজন। এটা বললে অত্যুক্তি হবে না, সা¤্রাজ্যবাদীরা কেউ কেউ এ কাজটি নিজেদের জনগণের জন্যে করতে পেরেছে। মুসলিম বিশ্বে ইরান এক্ষেত্রে মডেল হতে পারে। গ্লোবালাইজেশনের এ যুগে সামাজিক নিরাপত্তা একটি বড় ইস্যু। সাইবার ক্রাইম, নৈতিকতার অবক্ষয়ের কবলে পতিত জাতিগুলো জেনে অবাক হবেন, শিশু নির্যাতন, নারী নির্যাতন, লুটপাট, খুন-খারাবি ও সাইবার ক্রাইম থেকে ইরান অনেকটা মুক্ত। নারী ও পুরুষদের বৈবাহিক বন্ধনকে উৎসাহদান, উচ্চশিক্ষার পর্যায়ে নৈতিকতার সংরক্ষণসহ সকল কার্যক্রমে ইরানের ইনডেক্স সত্যিই অনুপ্রেরণার জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে। স্বল্প সংখ্যক সংখ্যালঘুর অধিকার সংরক্ষণে ইরান সচেষ্ট। আমেরিকার রিলিজিয়াস রিপোর্টেও তা ফুটে উঠেছে। মাইনরিটিদের মধ্য থেকে এমপি আছেন এবং তাদের বিশেষায়িত হাসপাতালসহ চাহিদা মাফিক প্রয়োজনীয় সকল কিছুর আঞ্জাম দেওয়া হচ্ছে। বিপ্লবের পর কিছু ইহুদি কমে যাওয়ার ব্যাপারে অভিযোগ উঠলে ইহুদিদের মধ্য থেকেই এর প্রতিবাদ উঠেছে এবং কম-বৃদ্ধি আসলে গতানুগতিক প্রক্রিয়ার অংশ বলে তাঁরা উল্লেখ করেছেন। এতে বিপ্লবের কোন ভূমিকা নেই। ইরানের সংবিধানের ১৩ ও ১৪ নং আর্টিকেলে তাদের অধিকারের ব্যাপারে স্পষ্ট নির্দেশনা আছে।
বিশ্বে ইরানি সংস্কৃতির প্রভাবের কথা বলতে গেলে শিয়া-সুন্নি সম্পর্কের কথা এড়িয়ে গেলে আলোচনা অপূর্ণাঙ্গ থেকে যাবে। মৌলিক আকীদার প্রশ্নে কাছাকাছি এ দুটি ধারার বর্তমান বিপরীত অবস্থান অনেকটাই পীড়াদায়ক। মাসয়ালার বৈপরীত্য ইসলামের অনন্য সৌন্দর্য ও মতামত প্রকাশের মৌলিক স্বীকৃতি। এ স্বীকৃতিকে ইরানের ইসলামি বিপ্লব ধারণ করে। আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেইনী ভিন্নতার মধ্যে ঐক্য খুঁজেছেন এবং বিশ্বমুসলিমের সমর্থন পেয়েছেন। এখানে শিয়া-সুন্নি ভেদাভেদ বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি। আল-কুদস্ দিবস ও সালমান রুশদীর ব্যাপারে ইমাম খোমেইনীর ঘোষণা মুসলিম বিশ্বে যে প্রভাব ফেলেছে তাতে কি শিয়া-সুন্নি বিভেদ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে? সুতরাং বর্তমানে এ বিরোধকে কারা উস্কে দিচ্ছে তা সন্তর্পণে বিশ্লেষণ করতে হবে এবং উভয় দিকের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্বকে সমস্যা সমাধানে অগ্রসর হতেই হবে। পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে এর বিকল্প নেই।
গ্লোবাল সন্ত্রাস বর্তমান বিশ্বের এক মূর্তিমান আতংক। একসময় ইরানকে সন্ত্রাসের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হত। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় তা ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে। বর্তমানে ধর্মের নামে যে সন্ত্রাস মুসলিম বিশ্বসহ সমগ্র সভ্যতাকে গ্রাস করতে চাচ্ছে তার সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরান তার স্পষ্ট উদাহরণ। বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ এজন্য যে, ইসলামের সাথে সন্ত্রাসবাদের কোন সম্পর্ক নেই বিষয়টি স্পষ্টভাবে তাঁরা বিশ্বাস করেন। যে ধর্ম অন্যায়ভাবে একজন মানুষ হত্যাকে সমগ্র মানবতার হত্যার সাথে তুলনা করেছে সে ধর্ম কি খেয়ালখুশির হত্যাকে সমর্থন করতে পারে? অবশ্যই না। এ বিষয়ে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি সমর্থিত, তবে এতে আরো বেশি করে ধর্মীয় ব্যক্তিত্বকে সংশ্লিষ্ট করলে ফলাফল আরো দ্রুত পাওয়া যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি। এ বিষয়ে বিশ্বের শান্তিপ্রয়াসী জাতিসমূহকে জাগ্রত করতে ইরান সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুুযায়ী ইরান ইতোমধ্যে সন্ত্রাসবিরোধী বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করেছে এবং সর্বশেষ সম্মেলনে বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বাইতুল মুকাররমের মাননীয় খতিবসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বগণ অংশগ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশ ও ইরানের সাংস্কৃতির সম্পর্কের গভীরতা ভবিষ্যতে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে, সর্বোপরি আধ্যাত্মিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করবে বলে প্রত্যাশা রাখি। পরিশেষে আল্লামা রুমীর একটি কথা দিয়ে শেষ করতে চাই। ‘লাইট কেমন বা কোন ধরনের তা বিবেচ্য নয়; বরং কেমন আলো ছড়াচ্ছে তাই বিবেচ্য।’
সকলকে ধন্যবাদ।

সম্পাদকীয়

ইসলামি বিপ্লব : উত্তরোত্তর দেদীপ্যমান
১১ই ফেব্রুয়ারি ইরানের ইসলামি বিপ্লবের ৩৮তম বিজয় বার্ষিকী। ৩৮ বছর আগে এদিনে মহান নেতা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-এর নেতৃত্বে ইরানের দ্বীনদার সংগ্রামী জনগণ স্বৈরাচারী খোদাদ্রোহী রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা এবং বিজাতীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির তাঁবেদার শাহ্ ও তার সরকারকে উৎখাত করে ইরানের বুকে ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠা করেন।
ইরানের ইসলামি বিপ্লব কেবল একটি সরকারের পরিবর্তন ছিল না; বরং ছিল সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও নৈতিকসহ জীবনের সকল ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন- যা শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সমগ্র বিশ্ববাসীকে প্রভাবিত করে।
‘স্বাধীনতা, মুক্তি ও ইসলামি প্রজাতন্ত্র’- স্লোগানের মাধ্যমে ইরানি জনগণ তাদের ঈমানী শক্তির বদৌলতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত শাহী সরকারের পতন ঘটায়। এ স্লোগানে বিধৃত বিপ্লবের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যসমূহ ছিল : বহিঃশক্তির তাঁবেদারি থেকে স্বাধীনতা, অভ্যন্তরীণ স্বৈরতন্ত্র থেকে মুক্তি, নিজেদের ভাগ্যনিয়ন্ত্রণকে নিজেদের হাতে গ্রহণ, জনপ্রতিনিধিত্বমূলক ও ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, স্বকীয় সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ এবং অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা অর্জন। ইরানের জনগণ ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান ও নিজেদের ভাগ্যনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা নিজেদের হাতে গ্রহণের লক্ষ্য পরিপূর্ণভাবে অর্জন করে এবং বিগত ৩৮ বছরে অন্যান্য লক্ষ্য-উদ্দেশ্যও উল্লেখযোগ্য মাত্রায় অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের পর মুহূর্ত থেকেই বিপ্লবের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক দুশমনরা এ বিপ্লবকে নস্যাৎ ও পথচ্যুত করার লক্ষ্যে সর্বাত্মক অপচেষ্টা চালিয়ে আসছে। এ লক্ষ্যে তারা তাদের সন্ত্রাসী এজেন্টদের দ্বারা বিপ্লবের অগ্রসেনানী অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতা, ইসলামি চিন্তাবিদ, আলেম ও বিপ্লবী কর্মীকে হত্যা করে এবং আট বছরব্যাপী যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে ও আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এ দেশকে সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে পঙ্গু করে আত্মসমর্পণে বাধ্য করার অপচেষ্টা চালায়। সর্বোপরি তারা বিশ্বের জনগণকে সকল ক্ষেত্রে এ বিপ্লবের ইতিবাচক প্রভাব থেকে বঞ্চিত করার লক্ষ্যে বিপ্লব ও ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও বিভ্রান্তি ছড়াবার উদ্দেশ্যে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয়সাপেক্ষ পরিকল্পিত প্রচারযুদ্ধ চালিয়েছে- যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু আল্লাহ্ তা‘আলার অশেষ রহমতে তাদের সমস্ত ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়ে গিয়েছে, বরং ইসলামি বিপ্লবের দীপ্তি এবং ইসলামি ইরানের শক্তি ও শৌর্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। বিগত ৩৮ বছরে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, পারমাণবিক বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি ও ন্যানোটেকনোলজিসহ সকল ধরনের জ্ঞানগবেষণা, সুস্থ সংস্কৃতি ও শিল্পকলা, রুচিশীল চলচ্চিত্র নির্মাণ ইত্যাদিসহ জনজীবনের সকল ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি-অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।
ঐশী অনুগ্রহপ্রাপ্ত এ বিপ্লবের দূরদৃষ্টির অধিকারী নেতৃত্ব শুরু থেকেই কূটনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এমন একটি সমন্বিত ও ব্যতিক্রমী কর্মকৌশল গ্রহণ করেন যার ফলে আজ ইরানের ইসলামি বিপ্লবের টিকে থাকার ব্যাপারে আর কারো মনেই কোনো সন্দেহ নেই এবং যে কেউ স্বীকার করতে বাধ্য যে, বিশ্বের কোনো বলদর্পী শক্তিই ইরানের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার জন্য হুমকি সৃষ্টির অপচেষ্টার ন্যায় হঠকারী দুঃসাহস দেখাবে না। তাই আজ নি:সন্দেহে বলা যায় যে, ইরানের ইসলামি বিপ্লব মুসলিম উম্মাহর জন্য সগৌরবে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার পথ নির্মাণ করে দিয়েছে।
ইরানের ইসলামি বিপ্লবের ৩৮তম বিজয়বার্ষিকী উপলক্ষে আমরা এ বিপ্লবের মহান রূপকার হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) এবং বিপ্লবের বিজয় ও প্রতিরক্ষার জন্য যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাঁদেরকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি ও তাঁদের বিদেহী নাফ্সের মাগফেরাত কামনা করছি; বিপ্লবের বর্তমান রাহ্বার হযরত আয়াতুল্লাহ্ ‘উয্মা সাইয়্যেদ্ আলী খামেনেয়ী, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের জনগণ ও পরিচালকবৃন্দ, বিদেশে অবস্থানরত ইরানি নাগরিকগণ, বিশ্বের তাবত মুক্তিকামী ও নির্যাতিত জনগণ, বিশেষভাবে নিউজলেটারের পাঠক-পাঠিকাগণসহ বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের প্রতি অভিনন্দন জানাচ্ছি এবং সকলের জন্য সুস্থতা ও উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করছি।

ভাষা আন্দোলনের শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
ইরানি ও বাংলাভাষী ভূখণ্ডের জনগণের মধ্যে ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বন্ধন সুদীর্ঘকালীন। বিশেষ করে এ ভূখণ্ডের জনগণ যে ফারসি শব্দ ‘বাংলা’কে তাঁদের মাতৃভাষার নামকরণের জন্য বেছে নিয়েছেন তা-ই এ বন্ধনের অবিচ্ছেদ্যতা প্রমাণ করে।
এ মহান দিবসে আমরা আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে ভাষা আন্দোলনের শহীদদের বিদেহী নাফ্সের মাগফেরাত কামনা করছি এবং স্বীয় শিকড়ের সাথে সংযোগ শক্তিশালীকরণসহ এ ভাষার উত্তরোত্তর উন্নয়ন ও প্রসার এবং বিশ্বের ভাষা সমাজে এ ভাষার জন্য অধিকতর গৌরবময় অবস্থান ও আসন কামনা করছি।

স্মরণীয় বাণী

মহানবী (সা.) বলেন : আল্লাহর প্রতি ঈমানের পর সবচেয়ে বড় বুদ্ধিমত্তার কাজ হলো মানুষের সাথে মানিয়ে চলা যতক্ষণ না কোনো অধিকার ত্যাগ করা হয়।

মহানবী (সা.) বলেন : আমি মূর্তিপূজা থেকে বিরত থাকার নির্দেশের পরে মানুষের সাথে বিবাদ থেকে দূরে থাকার মতো আর কোন বিষয়ে এত অধিক নির্দেশিত হই নি।

মহানবী (সা.) বলেন : যে ব্যক্তি মুসলমানকে ফাঁকি দেয় কিংবা তার ক্ষতি করে অথবা তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে সে আমাদের থেকে নয়।

মহানবী (সা.) বলেন : …তিনটি জিনিস রয়েছে যেগুলোর বিষয়ে কোনো মুসলমানের অন্তরে বিদ্বেষ থাকতে পারে না : আল্লাহর জন্য কাজে একনিষ্ঠতা, মুসলমানদের নেতৃবর্গের জন্য কল্যাণকামিতা এবং তাদের একতাবদ্ধের অপরিহার্যতা। সকল মুমিনই ভাই ভাই। তাদের রক্ত (মর্যাদার দিক থেকে) পরস্পর সমান। অন্যদের বিপরীতে তারা সকলে ঐক্যবদ্ধ থাকবে আর তাদের অঙ্গীকার পালনে প্রচেষ্টা চালাবে, এমনকি যদি তাদের নিম্ন শ্রেণির কোনো লোকও (তাদের ভিন্ন অন্যের সাথে) কোনো বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়।

ইমাম আলী (আ.) বলেন : নিজে রাগান্বিত হয়ো না এবং কাউকে রাগান্বিত কর না। প্রকাশ্যে সালাম প্রদান করবে এবং মিষ্টি ভাষায় কথা বলবে।

ইমাম আলী (আ.) বলেন : নিছক সন্দেহের বশে তোমার ভাইয়ের সাথে সম্পর্কোচ্ছেদ কর না। আর বিনা অভিযোগে তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ো না।

ইমাম আলী (আ.) বলেন : (পৃথিবীতে) তোমরা এমন এক অবকাশ লাভ করেছ যার পশ্চাতে আছে মৃত্যু। আর তোমাদের সাথে রয়েছে মনোবাসনা যা পরকালের কাজের পথে বাধা। তাই এই অবকাশকে গনীমত গণ্য কর এবং মৃত্যুর দিকে ধাবিত হও। আর মনোবাসনাকে দূরে ঠেলে দাও এবং পরকালের কাজে প্রবৃত্ত হও। মৃত্যুর থেকে কি কোনো নিস্তার রয়েছে? কোনো আশ্রয় কি রয়েছে? কিংবা পলায়নের কি কোনো পথ রয়েছে? কিংবা কোনো পারাপার, কোনো অজুহাত কি আছে? আর কত মিথ্যাচার করবে?!

ইমাম আলী (আ.) বলেন : বিবেক হলো মুমিনের বন্ধু আর সহিষ্ণুতা হলো তার উপদেষ্টা আর নমনীয়তা হলো তার পিতা আর সুস্বভাব তার ভাই। বিবেকবানের জন্য তিনটি জিনিস আবশ্যক : তার নিজের মূল্য বুঝবে, তার জিহ্বাকে সংযত রাখবে আর তার যুগকে চিনবে। সাবধান! অভাব হলো একটি বিপদ এবং এর চেয়ে কঠিন বিপদ আর নেই। আর দেহের রোগের চেয়ে মনের রোগ বেশি কঠিন। জেনে রেখ, সম্পদের প্রাচুর্য হলো একটি নেয়ামত। আর এর চেয়ে উত্তম হলো শারীরিক সুস্থতা। আর শারীরিক সুস্থতার চেয়ে উত্তম হলো অন্তরের তাকওয়া।

ইমাম হোসাইন (আ.) বলেন : আর নিশ্চয় আল্লাহ তাদেরকে (বনি ইসরাইলকে) এ কারণে ভর্ৎসনা করেছেন যে, তারা তাদের মধ্যে যারা যালিম ছিল তাদের নোংরা ও জঘন্য কাজ প্রত্যক্ষ করত, কিন্তু তাদেরকে তা থেকে নিষেধ করত না- তাদের হাতে যা ছিল তার লোভে এবং কোণঠাসা হয়ে পড়ার ভয়ে।

ইমাম হোসাইন (আ.) বলেন : আল্লাহ সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধকে তাঁর একটি ফরয কাজ হিসাবে কথার সূত্রপাত করেছেন। কারণ, তিনি জানতেন, যদি এই ফরযটি পালন করা হয় অথবা প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে সহজ-কঠিন সব ফরযই পালন করা হবে। আর এটা এজন্য যে, সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজের নিষেধ হলো অন্যায়ভাবে হৃত অধিকার প্রত্যার্পণ, জালিমের বিরোধিতা, বাইতুল মাল ও গনীমত বণ্টন, যাকাতের জায়গা থেকে যাকাত গ্রহণ এবং যথার্থ খাতে তা ব্যয় করা সহকারে ইসলামের প্রতি আহ্বান জানানো।

ইমাম আলী ইবনুল হোসাইন যায়নুল আবেদীন (আ.) বলেন : আল্লাহর নিকট তাঁর মারেফাত অর্জনের পরে পেট ও লজ্জাস্থানের পবিত্রতা রক্ষার চেয়ে প্রিয়তর আর কিছু নেই। আর আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়ার চেয়ে তাঁর নিকট প্রিয়তর আর কিছুই নেই।

ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) বলেন : নিশ্চয় দুনিয়া প্রস্থান করেছে এবং পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেছে আর পরকাল রওয়ানা হয়েছে এবং এগিয়ে আসছে। প্রত্যেকেরই সন্তানাদি রয়েছে। তোমরা পরকালের সন্তান হও। দুনিয়ার সন্তান হয়ো না। দুনিয়া থেকে আত্মসংযমী হবে এবং পরকাল অভিমুখী হবে। কারণ, পরহেযগাররা আল্লাহর পৃথিবীকে জীবনের ময়দান আর মাটিকে বিছানা বানায়। আর মাটির ঢিলাকে মাথার বালিশ এবং পানিকে সুগন্ধী হিসাবে গ্রহণ করেছে। আর পৃথিবীতে নির্বিঘ্ন জীবন কাটানোর চিন্তা ত্যাগ করেছে।

(তুহাফুল উকূল থেকে সংকলিত)
অনুবাদ : আব্দুল কুদ্দুস বাদশা

ইরানি প্রবাদ

سبیل بودن چیزی
উচ্চারণ : সাবীল বূদানে চীযী
অর্থ : সস্তা হওয়া কোনো জিনিস, কোনো জিনিস পাওয়া যাওয়া।
মর্মার্থ : কোনো জিনিস সহজলভ্য হওয়া বা প্রচুর পরিমাণে মজুদ থাকা অর্থে প্রবাদটি ব্যবহৃত হয়।
سبیلش آویزان شد.
উচ্চারণ : সিবিলাশ আ’বিযা’ন শোদ
অর্থ : তাঁর গোঁফ লটকে গেছে।
মর্মার্থ : সে সফলকাম হয় নি, নিরাশ হয়ে গেছে। তার চেষ্টা ভালো ফল বয়ে আনেনি বুঝাতে এ প্রবাদটি ব্যবহৃত হয়।
سبیلکسی را چرب کردن (سبیلش را چرب کرد).
উচ্চারণ : সিবিলে কেসী রা’ চার্ব কারদান (সিবীলাশ রা’ চার্ব র্ক্দা)
অর্থ : কারো গোঁফ তৈলাক্ত করা। (তার গোঁফে তেল মেখে দিয়েছে)।
মর্মার্থ : টাকা কড়ি দিয়ে কাউকে সন্তুষ্ট করা বা কারো সম্মতি আদায় করা। ঘুষ দেয়া।
ستاره را بالای سرش نمی تواند بیند.
উচ্চারণ : সেতা’রে রা’ বা’লা’য়ে সারাশ নেমী তাওয়া’নাদ বীনাদ
অর্থ : নিজের মাথার উপর তারা দেখতে পায় না।
মর্মার্থ : আত্মম্ভরী ও সংকীর্ণমনা লোক এবং নিজেকে ছাড়া আর কাউকে দেখার চোখ নেইÑ এ কথা বুঝাতে এর ব্যবহার হয়।
ستاره زحل است.
উচ্চারণ : সেতা’রে যুহল আস্ত
অর্থ : তারাটি শণি
মর্মার্থ : অলক্ষুণে এবং মন্দ স্বভাবের লোক বুঝাতে প্রবাদটি ব্যবহৃত হয়।
ستاره سهیل است.
উচ্চারণ : সেতা’রে সুহাইল আস্ত
অর্থ : এটি শুকতারা।
মর্মার্থ : বছরের পর বছর যায় তার দেখা নাই, সে নিজেকে খুুব কমই দিনের আলোতে আনে বুঝাতে প্রবাদটি ব্যবহৃত হয়। আমরা যেমন বলি, কালেভাদ্রে তার দেখা পাওয়া যায়। সুখের পায়রা।
سحر خیز باش تا کامروا گردی
উচ্চারণ : সাহার খিয বা’শ তা’ কা’মরওয়া’ গার্দী
অর্থ : প্রত্যুষে জাগায় অভ্যস্ত হও তবেই সফলকাম হবে?
মর্মার্থ : অলসতা ও আরামপ্রিয়তার ফলে দেহ মনে জড়তা আসে বুঝাতে প্রবাদটি ব্যবহৃত হয়। বলা হয়েছে, অলসতা ঝেড়ে ফেল, প্রত্যুষে ঘুম ছেড়ে ওঠ। তাহলে সফলকাম হতে পারবে।
سخن حق تلخ است.
উচ্চারণ : সুখানে হাক্ব তাল্খ আস্ত
অর্থ : সত্যকথা তিতা।
মর্মার্থ : সাধারণত সত্য ও যথার্থ কথা কারো শুনতে ভালো লাগে না বুঝাতে এ প্রবাদটি ব্যবহৃত হয়।
سراپا گوش شدن (بودن).
উচ্চারণ : সরা’পা’ গূশ শোদান
অর্থ : মাথা থেকে পা পর্যন্ত কান হওয়া।
মর্মার্থ : পূর্ণ মনোযোগের সাথে কারো কথা শ্রবণ করা। যে কথা বলছে তার ছোট্ট কোনো বিষয়ের প্রতিও অমনোযোগী না হওয়া।
سر به جهنم زدن.
উচ্চারণ : সার বে জাহান্নাম যাদান
অর্থ : মাথা জাহান্নামে দেয়া।
মর্মার্থ : এমন ক্ষতি যার শেষ নেই, ক্ষতির পর ক্ষতি আসছেই এমন ভাবার্থ বুঝাতে প্রবাদটি ব্যবহৃত হয়।
سر به سر کسی گذاشتن.
উচ্চারণ : সার বে সারে কেসী গুযা’শতান
মর্মার্থ : মাথা কারো মাথার উপর রাখা।
মর্মার্থ : মজা করার জন্য কাউকে কোনো কষ্টকর কাজে লাগিয়ে দেয়া।

অনুবাদ : আবু আব্দুল্লাহ

স্মরণীয় দিবস

৩ নভেম্বর : ইরানে ছাত্রদিবস হিসেবে পালিত হয়। ১৯৭৯ সালের এই দিনে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তৎকালীন মার্কিন দূতাবাস অবরোধ করে কূটনীতিকের ছদ্মাবরণে থাকা গোয়েন্দাদের আটক করে।
৪ নভেম্বর : ইরানে গণসংস্কৃতি দিবস।
৬ নভেম্বর : বাংলাদেশের বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক শাহেদ আলীর মৃত্যুবার্ষিকী।
৭ নভেম্বর : মহানবী (সা.)-এর বিশিষ্ট সাহাবী হযরত সালমান ফারসি স্মরণে দিবস।
১১ নভেম্বর : ইতিহাসখ্যাত সাহিত্যিক ‘বিষাদ সিন্ধু’র রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেনের জন্মদিবস।
১৪ নভেম্বর : দার্শনিক, তাফসিরকারক আয়াতুল্লাহ তাবাতাবায়ী স্মরণে দিবস
* বিশ্ব পুস্তক ও পুস্তক পাঠ দিবস, বিশ্বগণমাধ্যম দিবস।
১৭ নভেম্বর : বাংলাদেশের মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যুবার্ষিকী।
১৯ নভেম্বর : * অভিভক্ত ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অমর শহীদ মীর নিসার আলী তিতুমীরের শাহাদাত বার্ষিকী।
* আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস।
২০ নভেম্বর : ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের আরবাঈন (৪০তম দিবস) বার্ষিকী।
*বাংলাদেশের প্রখ্যাত মহিলা কবি সুফিয়া কামালের মৃত্যুবার্ষিকী।
২৭ নভেম্বর : ইরানে এই দিবসটি সতীত্ব দিবস হিসেবে পালিত হয়।
২৮ নভেম্বর : মহানবী (সা.)-এর পবিত্র ওফাত দিবস ও হযরত ইমাম হাসান (আ.)-এর শাহাদাত দিবস।
২৯ নভেম্বর : শেখ মুফিদ স্মরণে দিবস।
৩০ নভেম্বর : আহলে বাইতের অষ্টম ইমাম আলী রেযা (আ.)-এর শাহাদাত দিবস।
*ইরানে পার্লামেন্ট দিবস। *বিশ্ব এইড্স প্রতিরোধ দিবস।
১ ডিসেম্বর : মহানবী (সা.)-এর মক্কা থেকে মদীনায় হিযরত দিবস।
৩ ডিসেম্বর : ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর প্রথম সংবিধান গৃহীত হওয়ার দিবস।
*বাংলাদেশের কচিকাঁচার আসরের প্রতিষ্ঠাতা রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাইয়ের মৃত্যুবার্ষিকী।
*বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস।
৫ ডিসেম্বর : অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী।
৬ ডিসেম্বর : ইরানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদিবস।
৮ ডিসেম্বর : আহলে বাইতের ১১তম ইমাম হাসান আসকারী (আ.)-এর শাহাদাত দিবস।
৯ ডিসেম্বর : বাংলাদেশে নারী জাগরণের অগ্রপথিক বেগম রোকেয়া স্মরণে দিবস।
*ইমাম খোমেইনীর নির্দেশে এই দিনে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কমিটি গঠন করা হয়।
১০ ডিসেম্বর : দুশমনের পাতা বোমায় আয়াতুল্লাহ দাস্তগায়েব এর শাহাদাত দিবস।
১২ ডিসেম্বর : মহানবী (সা.)-এর পবিত্র জন্মদিবস (আহলে সুন্নাতের রেওয়ায়েত অনুযায়ী) ও ইসলামি ঐক্য সপ্তাহের শুরু।
১৬ ডিসেম্বর : বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবস। *বিশ্ব গবেষণা দিবস।
১৮ ডিসেম্বর : * মহানবী (সা.)-এর পবিত্র জন্মদিবস (আহলে বাইতের রেওয়ায়েত অনুযায়ী)
* আহলে বাইতের ৬ষ্ঠ ইমাম ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর জন্মদিবস।
২৫ ডিসেম্বর : হযরত ঈসা (আ.)-এর জন্মদিবস
২৭ ডিসেম্বর : প্রলয়ংকরী সুনামীর বার্ষিকী। এ দিনে ভয়াবহ সুনামীতে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত, শ্রীলংকা, মালদ্বীপসহ এ অঞ্চলের দেশগুলোর কয়েক লাখ লোক মৃত্যুবরণ করে।

বাংলা রূপ ফারসি রূপ আধুনিক ফারসি উচ্চারণ

দলিল دليل দা-লী-ল
দেমাগ دماغ দে-ম-ক্ব
দামামা دمامه দাম-মে
দুনিয়া دنيا দুনইয়া
দুনিয়াদার دنيادار দুন্ ইয়া-দ-র
দুনিয়াদারি دنيادارى দুনইয়া-দ-রী
দুনিয়াবিী دنيوى দুনইয়াভী
দু (দুই) دو দো
দাওয়াখানা (ঔষধালয়) دواخانه দাভা-খ-নেহ্
দোয়াত دوات দো-ভ-ত্
দোতার دوتار দো-তর্-
দোজাহান دوجهان দোজা-হ-ন্
দূর دور দূ-র
দূরবীন دوربين দূর-বী-ন্
দোযখ دوزخ দূ-যাখ্
দোস্ত
রৌশনি روشنى রৌ-শ-নী
রওযা روضه রৌ-যেহ্
দালাল دلاّل দাল্লা-ল
দিল دل দেল
রিফু (সেলাই জাতীয়) رفو রিফূ
রকম رقم রাগ¦াম
রগ رگا রাগ্
রঙ رنگ রান্গ্
রঙিন رنگين রান্গীন
রেওয়াজ رواج রেভ-য্
রওয়ানা روانه রাভ-নেহ্
রোজ (দিন) روز রুয্
রোজগার روزكار রুযের্গ
রোযা روزه রুযেহ্
রুযী (আয়) روزى রুযী
রুমাল رومال রুম-ল
রেহাই رهايى রিহায়ী

ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের মানোন্নয়ন কোর্স : ফারসি শিক্ষার্থীদের মিলনমেলা

নাজমুল নাহার*

বুনিয়াদে সাদী বা সাদী ফাউন্ডেশন কর্তৃক আয়োজিত ৮৩তম ফারসি ভাষা ও সাহিত্যবিষয়ক মানোন্নয়ন কোর্স ইরানের রাজধানী তেহরানে অবস্থিত আল্লামা তাবাতাবায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। বুনিয়াদে সাদী ফারসি ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে কাজ করে এবং ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের সাথে জড়িত অ-ইরানি ফারসিপ্রেমীদের নিয়ে এ কোর্সের আয়োজন করে থাকে। এর মাধ্যমে ইরান ফারসির স্থানীয় ভাষাভাষীদের সাথে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ফারসির সাথে জড়িত শিক্ষার্থীর এক মিলনক্ষেত্র রূপে কাজ করে। এই কোর্সটি ২ আগস্ট ২০১৬ সালে শুরু হয়ে ২৯ আগস্ট কৃতি শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা প্রদান ও সনদ বিতরণের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয়। এ মানোন্নয়ন কোর্সে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, আজারবাইজান, চীন, রাশিয়া, ফ্রান্স, ইতালি, জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, তিউনিশিয়াসহ বিশ্বের ৪১ দেশের মোট ২১২ জন ছাত্রছাত্রী অংশগ্রহণ করে। এক মাসব্যাপী চলা এ কোর্স বুনিয়াদে সাদী ও আল্লামা তাবাতাবায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অক্লান্ত পরিশ্রম ও আন্তরিকতায় ফারসির মিলনমেলার সফল পরিসমাপ্তি ঘটে। যা আপাত দৃষ্টিতে সমাপ্ত হলেও আমার হৃদয়ের ফারসির প্রেমবাগিচায় অম্লান ও অক্ষয় হয়ে প্রেরণা যোগাবে সব সময়। এর মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ইত্যাদি কাছ থেকে জানার সুযোগ ঘটায় ইরান সরকারকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
আমাদের প্রশিক্ষণ কোর্সে ফারসি সাহিত্যের বিভিন্ন প্রকার কবিতা, ছোট গল্প পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কবিতা ও ঃবীঃ এ অন্তর্ভুক্ত শব্দ ও বাক্যের মধ্যে যেগুলো অপরিচিত সেগুলো ছাত্র-ছাত্রীদের চিহ্নিত করার জন্য শিক্ষকরা প্রথমে পড়তে বলতেন এবং পরে সেগুলো ব্যাখ্যা দিতেন। সেই বিষয়গুলোর ওপর নিজ মতামত, বিষয়টির সারমর্ম ফারসিতে ব্যাখ্যা করার জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের বাড়ির কাজ দেয়া হতো। এভাবে এক মাসব্যাপী ফারসি কবিতা ও গল্প এবং এতে ব্যবহৃত শব্দ ও বাক্যের শাব্দিক, পারিভাষিক, আভিধানিক ও আলংকারিক অর্থের সাথে পরিচিতি এবং এগুলোর ব্যবহারের মাধ্যমে অনেক কার্যকরী শিক্ষাদান পদ্ধতিতে আমাদের পাঠদান করা হয়েছে।
আমাদের পাঠ্যসূচিতে ইরানের বিভিন্ন স্থান, গম্বুজ, অনুষ্ঠান, ভাস্কর্য, কারুকাজ ইত্যাদি পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এসব বিষয়ের সাথে প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীর নিজ দেশের কী কী বিষয় সাদৃশ্যপূর্ণ ও কী কী বিষয় আলাদা সেসব বিষয় শিক্ষক মহোদয় ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে জানতে চাইতেন। পাঠদানের শুরুতেই ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ার দক্ষতা যাচাই করতেন। এরপর তিনি সঠিক উচ্চারণগুলো ধরিয়ে দিতেন। বাড়ির কাজের মধ্যে ছিল যেসব বিষয় শ্রেণিতে পড়া হতো সেগুলো হলে ফিরে বিনংরঃব এ ঝবধৎপয করা এবং সেসব বিষয় নিজের মতো করে লেখা এবং পরে শ্রেণিকক্ষে গিয়ে ব্যাখ্যা দেয়া। প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীকে নিজ দেশের দর্শনীয় স্থান ও মানচিত্র পরিচিতিও এ ক্লাসের আলোচ্য বিষয় ছিল। প্রতিটি ক্লাসেই শিক্ষকম-লী ও ছাত্র-ছাত্রী দুই দিক থেকেই আন্তরিকতাপূর্ণ অংশগ্রহণ ছিল।
প্রত্যেক শিক্ষকই ছিলেন অত্যন্ত আন্তরিক ও নিবেদিতপ্রাণ। তাঁরা সবাই প্রতিটি বিষয় বুঝানোর পর একাধিকবার জিজ্ঞেস করতেন, ‘তোমরা বুঝেছ কিনা; না বুঝলে একাধিক বার বলবে; লজ্জা পাবে না। কারণ, তোমরা শিখতে এসেছ।’ প্রশ্ন করার পাশাপাশি তাঁরা নিজেরাও ছাত্র-ছাত্রীদের বোঝার দক্ষতা পর্যবেক্ষণ করতেন যে, তারা আসলেই বুঝেছে কিনা। শিক্ষকরা একই বিষয় বিভিন্ন উদাহরণ প্রয়োগ করে বুঝাতেন। প্রয়োজনে ছবি এঁকে, অভিনয় করে হলেও বিষয়টি পরিষ্কারভাবে না বুঝতে পারা পর্যন্ত চেষ্টা অব্যাহত রাখতেন।
তাছাড়া, অন্যান্য শিক্ষক ক্লাসে উপস্থিত থেকে পর্যবেক্ষণ করতেন যে, সংশ্লিষ্ট শিক্ষক ক্লাস কতটা আন্তরিক ও ছাত্র-ছাত্রীদের অংশগ্রহণের জন্য কতটা সুযোগ দেন। মূল্যায়নের ব্যাপারে ছাত্র-ছাত্রীদের পক্ষ থেকে শিক্ষককে মার্কস দেয়ার ব্যবস্থা থাকত যা খুবই চমৎকার একটি পদ্ধতি।
পরিবেশ থেকে শিক্ষাগ্রহণের বিষয়ের মধ্যে ছিল শিক্ষাসফর। শিক্ষাসফরের স্থান ছিল ইসফাহানÑ যাকে পৃথিবীর অর্ধেক বা ‘নেসফে জাহান’ বলা হয়। ইসফাহানে তিন দিনের শিক্ষাসফরে ছিলাম। ইসফাহানে শেখ লুৎফুল্লাহ মসজিদ, নাকশে জাহান, জাদুঘর, ময়দানে ইমাম খোমেইনী, মিনার ইত্যাদি ছিল অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন।
এছাড়া রাজধানী তেহরানের মোট ২৮টি দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন করেছি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ বোর্যে মিলাদ (ইরানে অবস্থিত পৃথিবীর ৬ষ্ঠ উচ্চতম টাওয়ার), আযাদী টাওয়ার, দেফায়ে মুকাদ্দাস (প্রতিরক্ষা যুদ্ধের স্মৃতিজড়িত বিষয়ে নির্মিত) জাদুঘর, আসেমান নামা (নভোথিয়েটার), ইমাম খোমেইনীর বাড়ি, পারসিয়ান গালফ (কৃত্রিম), পোলে তাবীয়াত (ব্রিজ), কাখে গুলিস্তা (জাদুঘর), তাজরিশ বাজারসহ আরো অনেক দর্শনীয় স্থান।
আমাদের শিক্ষক ড. রেজা সাহরায়ী বলেন যে, এটা একমাসে রেকর্ড পরিমাণ দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন।
ইরান রাষ্ট্র হিসেবে অনেক উন্নত, বিশেষ করে আমি যা দেখলাম সেগুলো সম্পর্কে এভাবেই বলব যে, ইরানের উন্নতি অগ্রগতি, জনগণের রুচি, সংস্কৃতি, পরিষ্কার-পরিছন্নতা ইত্যাদির ব্যাপকতা ফারসির অমিয় সুধা ও প্রেমের কারণেই সম্ভব হয়েছে। কারণ, ফারসি প্রেমের ভাষা। আর তাই ফারসির প্রেমিকদের ফারসি কবি রুমি, সাদী, জামীর স্বপ্নভূমি ইরান। তাই এই ইরানকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে এবং ফারসি প্রেমিকদের ইরানের সাহিত্য-সংস্কৃতিকে কাছ থেকে বোঝার সুযোগস্বরূপ বুনিয়াদে সাদী কর্তৃক এ আয়োজন। ফারসি প্রেমিকদের পরিচ্ছন্ন ও যানজটমুক্ত রাস্তা-ঘাট এবং যানবাহনের শব্দমুক্ত পরিবেশ উপহার না দিলে কী করে চলে! তাই তো দেখি ইরানের রাস্তাগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। যানজটমুক্ত, দূষণমুক্ত, হর্নের কোন শব্দ পাইনি। ফারসি প্রেমিকদের জন্য কোন কষ্টই অনুভূত হতে দিতে চায় না যেন ইরান, তাই এমন ব্যবস্থা করেছে তারা। যাতে ফারসির প্রতি, ইরানের প্রতি ভালোবাসার বৃদ্ধি না ঘটে আর উপায় না থাকে।
নিরাপত্তার বিষয়টি চোখে পড়ার মতো ছিল। কোথাও কোন দাঙ্গা-হাঙ্গামা, কোন্দল দেখি নি। এক শান্ত-নিবিড় নির্মল প্রশান্তির জায়গা যেখানে নিশ্চিন্ত না হয়ে পারে না কেউ। কাউকে রাগ করতে দেখি নি। অসৌজন্যমূলক আচরণ করতে। এমনকি কাউকে দেখিনি ভ্রু জুগলকে কুঞ্চিত করতে পর্যন্ত। তবুও পুলিশি নিরাপত্তা সার্বক্ষণিক আমাদের সঙ্গী ছিল। জনগণের রুচি ও সংস্কৃতির পরিচয় তো এখানেই পাওয়া যায়। কারণ, সংস্কৃতি তো সেটাই যা মানুষের জীবনের দৈনন্দিন বিষয়াবলি পর্যবেক্ষণে ধরা পড়ে। ইরানের অগ্রগতি-উন্নতি বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় হতে খুব বেশি দিন দেরি হবে না বলেই আমার মনে হয়।
ইরানের নেতৃবৃন্দ অত্যন্ত জনদরদি যাঁরা তাঁদের দেশের ঐতিহ্য, আতিথেয়তা ও নিরাপত্তা বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর বলেই আমার মনে হয়েছে। বুনিয়াদে সাদীর প্রধান ড. হাদ্দাদ আদেল সমাপনী অনুষ্ঠানে সবার উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা এই একমাস ইরানে ছিলেন। কোথাও কি কখনো কাউকে দেখেছেন কারো সাথে কোন্দল করতে? বা কারো সাথে কাউকে খারাপ আচরণ করতে?’ উত্তর আসল, ‘না।’ তিনি বললেন, ‘ইরান কখনোই কাউকে আক্রমণ করে নি। ইরান আক্রান্ত হয়েছে। ইরান শুধু বন্ধুত্বই করতে জানে, শত্রুতা নয়। অথচ পরাশক্তির পক্ষ থেকে কিছুদিন পর পর বলা হয় আমরা নাকি বিশ্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। যার কোন প্রমাণ ও নজির নেই।’
ইরানের জনগণ এক কথায় আন্তরিক, সৌহার্দ্র্যপূর্ণ আচরণসম্পন্ন ও বন্ধুভাবাপন্ন। এই জাতির মূল উদ্দেশ্য হল প্রেমের মাধ্যমে বিশ্বে শান্তি স্থাপন। আমার ঠিক এটাই মনে হয়েছে।
এই এক মাসে আমার ফারসি ভাষার মান অনেক উন্নত হয়েছে। ভাষার চর্চার পরিবেশ পুরোটাই ছিল। পারস্পরিক বক্তব্য, ভাবের আদান-প্রদান, মত বিনিময়, ইত্যাদি শত ভাগ ফারসিতে করার একটা ভাল পরিবেশ ছিল। বিভিন্ন জিনিস চারপাশে যা দেখি বা ব্যবহার করি তার সবকিছুই ফারসিতেই ব্যবহার করতে করতে এবং দেখতে দেখতে ও শুনতে শুনতেই আত্মস্থ হবার সুযোগ ব্যাপক থাকায় কথ্য ভাষাগত উন্নতির বিষয়টি প্রত্যাশার চেয়ে বেশি পেয়েছি।
একমাস ইরানে অবস্থানকালে আমার একটি স্মরণীয় স্মৃতি জানাতে চাই তা হল ইরানি শিক্ষকদের আন্তরিকতা সম্পর্কিত। ইরানের সব শিক্ষকই অত্যন্ত আন্তরিক। আমার প্রিয় সম্মানিত একজন শিক্ষক আব্বাস নাজী। তাঁর শিক্ষাদানের ধরন আমাকে মুগ্ধ করেছে।
একদিন আমার শিক্ষককে আমি বললাম, আমার ভালো ফারসি বলতে সমস্যা হয়। কারণ, আমি অ-ইরানি আর তাই শোনার দক্ষতা দুর্বল। তাই আমি যখন কোন কিছু শুনি তখন দ্রুত বলার কারণে শব্দগুলো বুঝি না। আমার কাছে এটা খুবই কঠিন মনে হয়।
তখন তিনি আমাকে বললেন, তুমি বেশি বেশি শুনবে। মনে রাখবে, ভাষা শেখার ও বোঝার সবচেয়ে প্রথম এবং কার্যকরী উপায় হলো শোনা। প্রথমে শুনবে; তারপর যা শুনলে তা বলবে, তারপর পড়বে এবং সবশেষে তা লিখবে। ইরানি ফিল্ম যেগুলোর সাবটাইটেল রয়েছে, মূল ফারসি ডাবিং নয়, সেগুলো দেখবে এবং শুনবে। আরো মনে রাখবে, ভাষা শেখা কঠিন কিছুই নয়। কোন শিশুকে দেখে এটার প্রমাণ পেতে পার। একটা শিশু জন্মের প্রথম দুই বছর শুধু শোনে। তারপর ২ বছর ধরে যা শুনেছে সেগুলো আস্তে আস্তে বলার চেষ্টা করে। তারপর সে পড়ে তারপর তা লেখে। আমি অত্যন্ত অবাক হয়ে গেলাম। ভাবলাম, তাই তো! এভাবে তো কোন দিন ভাবি নি। সত্যিই তো তাই। ওস্তাদ নাজী একটি বিষয়কে অনেকবার বুঝানোর পর তা বাস্তবে বুঝানো ও দেখানোর জন্য ময়লার ঝুড়ি নিজ হাতে ক্লাসে এনে পরিষ্কার করলেন। আমি খুবই অবাক হয়ে গেলাম। একজন শিক্ষক ফারসির পাঠদানে কতটা আন্তরিক হলে একটা ঝুড়ি নিজ হাতে এনে ছাত্রছাত্রীদের বুঝাতে পারেন।
আমরা যেদিন ইসফাহানে গিয়েছিলাম আমার মনে পড়ছে, ওস্তাদ নাজী শিক্ষার্থীদের খাবারের বড় বক্স নিজে বহন করে নিয়ে যাচ্ছেন। ইরানের রাস্তা তো ঢালু আর উঁচু-নিচু। একজন শিক্ষক কতটা নিরহংকার ও শিক্ষার্থীদের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হলে এটা করতে পারেন। স্যালুট ইরানকে ও ফারসি ভাষাকে যারা এমন শিক্ষক তৈরি করে।
ইরানে অবস্থানকালে আমাদের খাবারের অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গে বলতে হয় যে, ইরানের জনগণের খাদ্যাভ্যাস এবং বাংলাদেশের খাদ্যাভ্যাস সম্পূর্ণ আলাদা। তাই এটা অনেক অসুবিধাজনক ছিল। যেমন : আমরা মরিচ ও ঝাল খাই; ইরানিরা ঝাল খায় না। আমরা সবজি জাতীয় তরকারি বেশি খাই, ওরা নানা রকম কাঁচা সবজি সালাদ হিসেবে প্রচুর পরিমাণে খায়। ইরানিরা তরকারিতে ঝোল কম খায়, আমরা ঝোল বেশি খাই। তাই শুকনো খেতে অনেক কষ্ট হতো।
ইরানের আবহাওয়া অত্যন্ত শুষ্ক। আমরা তো বুঝতে পারি নি এতটা শুষ্ক। আমাদের দেশে শীতকালে আবহাওয়া যতটা শুষ্ক থাকে তার চেয়ে বহুগুণ শুষ্ক। এতে আমাদের খাপ খাওয়াতে খুবই সমস্যার পড়তে হয়েছে। শরীর শুষ্ক ও রুক্ষ হয়েছে পড়েছিল। আমি ও আমাদর ডিপার্টমেন্টের মেহজাবিনসহ ইব্রাহিম ভাই সবাই অপ্রস্তুত হয়েছে পড়েছিলাম। মুমিত আল-রশিদ স্যারকে ধন্যবাদ যে, তিনি কষ্ট করে লোশন ও ভ্যাসলিন আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। এছাড়াও অন্যান্য অনেক বিষয়ে তিনি আমাদেরকে অনেক সাহায্য করেছেন ও পরামর্শ দিয়েছেন। এজন্য স্যারের কাছে আমরা অত্যন্ত কৃতজ্ঞ।

*এমফিল স্টুডেন্ট
ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সাক্ষাৎকার

প্রশ্ন ১ : এ বছর আপনার ইরান সফর সম্পর্কে আমাদের কিছু বলুন?
উত্তর : ২০১৬ সালে আমি দুই দুই বার আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করার জন্য ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সফরে যাই। আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দাওয়াত পেয়ে তেহরান ও কোমে অনুষ্ঠিত দুইটি সেমিনারে অংশগ্রহণ করি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক আয়োজিত মানবাধিকার সম্পর্কিত সেমিনারে বিশ্বব্যাপী সংখ্যালঘুদের অধিকারের ওপর একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ উপস্থাপন করি। সেখানে মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সবার মানবাধিকার রক্ষায় মুসলিম দেশগুলোর ভূমিকা নিয়েও কথা বলি। আমার বক্তব্যের মৌলিক বিষয় ছিল কীভাবে আমরা পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের দেশগুলোর মাঝে এ ব্যাপারে সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে পারি। মধ্যপ্রাচ্যসহ বহু দেশেই সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। এই সেমিনারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে ইরানের বেশ কয়েকজন প্রসিদ্ধ আয়াতুল্লাহ অংশগ্রহণ করেন।
এই সফরে আমার অংশগ্রহণকৃত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সেমিনারটি অনুষ্ঠিত হয় ইরানের আধ্যাত্মিক নগরী কোমে। এটি যৌথভাবে আয়োজন করে জেনেভা ভিত্তিক ওঈজঈ এর হেডকোয়ার্টার এবং ইরান রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। এই সেমিনারটিতে কোমের সবগুলো বড় বিশ্ববিদ্যালয় ও হাওযার (নয়টি ধর্মীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের) বড় বড় আলেম, পঁচিশটি দেশের ত্রিশজন প্রতিনিধি এবং প্রায় এক হাজারেরও বেশি ইরানি ছাত্র-ছাত্রী অংশগ্রহণ করে। দুই দিনব্যাপী (৭ ও ৮ ডিসেম্বর) এই সেমিনারের কার্যক্রম চলে। পূর্বেরটির মত এই সেমিনারেও বাংলাদেশ থেকে আমি একাই অংশগ্রহণ করি। দ্বিতীয় এই সেমিনারে আমাকে কোন প্রবন্ধ উপস্থাপন না করে ইরানি ও বিদেশিদের উপস্থাপিত প্রবন্ধসমূহের অনানুষ্ঠানিক সমালোচক হিসাবে দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়। উল্লেখ্য, এই সেমিনারের অন্যতম আলোচ্য বিষয় ছিল বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যুদ্ধ ও সকল প্রকার বিরোধ ও সংঘর্ষ বন্ধ করে কীভাবে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা যায়।
প্রশ্ন ২ : ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সফরের ইতিবাচক দিক সম্পর্কে বলুন?
উত্তর : বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক ও গবেষক হিসেবে আমি উল্লিখিত দুটি আন্তর্জাতিক সেমিনার থেকে নানাভাবে উপকৃত হয়েছি। গত ৩৫ বছরে শিক্ষা-দীক্ষা ও গবেষণায় ইরানি আলেম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের অভূতপূর্ব উন্নতি প্রত্যক্ষ করেছি। বিশেষ করে ইরানের মহিলা শিক্ষক ও গবেষকদের উন্নতি ও অগ্রগতি প্রত্যক্ষ করে আমি উপলব্ধি করেছি যে, আমরা আরব-অনারবসহ সব মুসলিম জাতি আসলেই ইরানবিরোধী প্রচারণার শিকার। আমি মনে করি এই দুটি আন্তর্জাতিক সেমিনার বা সম্মেলন আমার মনোজগৎ ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকে সমৃদ্ধ করেছে। আমার বিশ্বাস, এইবার আমি আরও অধিক নিরপেক্ষভাবে দক্ষিণ এশিয়া বা পুরো এশিয়াতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দেশসমূহে ইরানের শিক্ষা-দীক্ষা ও গবেষণার বিভিন্ন দিক তুলে ধরতে পারব।
উল্লেখ্য, ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক পরিম-লে আমার বেশ কিছু গবেষণামূলক লেখা প্রকাশিত হয়েছে। যেযখানে ইরানের ইসলামি সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিভিন্ন দিক বিধৃত হয়েছে।
প্রশ্ন ৩ : ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের তথ্য প্রবাহ ও ন্যায় বিচার এবং শান্তি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় তার ভূমিকা সম্পর্কে আপনার পর্যবেক্ষণ থেকে দয়া করে আমাদেরকে জানান।
উত্তর : প্রাচীন পারস্য ও বর্তমান ইরান সমৃদ্ধ সভ্যতার ধারক। একটি বিপ্লবী দেশ হিসেবে আমরা ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানকে খুবই পছন্দ করি। মুসলিম উম্মাহ্র মধ্যকার বিবিধ চড়াই-উৎরাই, বিশেষত বিভিন্ন ধরনের ঐতিহাসিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাবলি ও সংঘাতের ঊর্ধ্বে থেকে ইরান সব সময়ই তার মানবাধিকারের উত্তরাধিকার সংরক্ষণ করে আসছে, বরং তা গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে।
একটি জাতি হিসেবে ইরানিরা রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক ক্ষেত্রে বহুত্ববাদের গঠন ও লালনে সব সময়ই বিরাট অবদান রেখেছে। এমনকি এর আগেÑগ্রীক ও রোমান সভ্যতার আগেওÑইরানি জাতি মানবাধিকারের, বিশেষ করে নারী জাতির ও সংখ্যালঘুদের অধিকারের হেফাযতে সব সময়ই যতœবান ছিল। পরবর্তীকালে মুসলিম শাসনাকমলে, যেমন : ফাতেমী, সেলজুক ও মোগল শাসনামলে মানবাধিকার সংক্রান্ত বিভিন্ন ইসলামি ধ্যান-ধারণা বর্তমান ইরানের মূল ভূখ-সহ তৎকালীন পারস্যের সর্বত্র এবং আশেপাশের ভূখ- সমূহে বিস্তার লাভ করে।
এরপর ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের যুগে ইরানিরা উপনিবেশবাদী শক্তিগুলোকে তাদের দেশে প্রবেশ করতে দেয় নি, বরং তাদেরকে পারস্য উপসাগরের উপকূল থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে এবং স্বীয় রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের হেফাযত করার ক্ষেত্রে পুরোপুরি সফল হয়। অবশ্য ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি ও তাদের উদ্যোগে গড়ে ওঠা কোম্পানিগুলো অর্থনৈতিক, আর্থিক ও মনস্তাত্ত্বিক সম্পদসূত্র সমূহের ওপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক চেষ্টা চালায়। কিন্তু ইরানের দ্বীনী ও বুদ্ধিজীবী নেতৃবৃন্দের প্রতিরোধের ফলে ঔপনিবেশিক শক্তি তাতে সফল হয় নি। শুধু তা-ই নয়, ইরানের দ্বীনী ও বুদ্ধিজীবী নেতৃবৃন্দ দেশের সকল জনগণের সাংবিধানিক অধিকার ও মৌলিক মানবাধিকার সুসংহতকরণের লক্ষে সংগ্রামেও পুরোপুরি সফল হন। আমরা দেখতে পাই, এর ফলে ইরানে এমন একটি গতিশীল ও টেকসই আইনী, নৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে যা ইরানি জনগণের জীবন ও সংস্কৃতির প্রতিটি পর্যায়ে অত্যন্ত সাফল্যের সাথে কাজ করছে। বিশেষ করে মুস্তায‘আফীন্ (দরিদ্র শ্রেণি) তত্ত্বের মর্মবাণী ও তার বিশ্বদৃষ্টি ইসলামি ইরানকে এমন একটি দেশের মর্যাদায় ভূষিত করেছে যা ধর্ম, সংস্কৃতি, জাতিগত গোষ্ঠী ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য আইনগত অধিকার ঘোষণা ও তার বাস্তব প্রয়োগের দৃষ্টিতে মুক্তি, মানবিক মর্যাদা ও উন্নয়নের দেশে পরিণত হয়েছে।
প্রশ্ন ৪ : ইসলামের মানবিক বিধান সমূহের বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ইরান যে নীতি অনুসরণ করেছে সে সম্পর্কে আপনার ধারণা আমাদেরকে জানালে খুশি হব।
উত্তর : এ প্রসঙ্গে আমি ইসলামি বিপ্লবী ইরানের ওপর চাপিয়ে দেয়া আট বছরব্যাপী যুদ্ধের সময়কার অবস্থার দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে চাই। এ সময় আমরা দেখতে পাই যে, শত্রুর সামরিক হামলাজনিত ধ্বংসযজ্ঞের দ্বারা প্রতিটি ইরানি পরিবারই কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ঐ সময় এবং এর পরেও ইরান বিশ্বের সর্ববৃহৎ সামরিক শক্তিবর্গের আরোপিত এক সর্বাত্মক নিষেধাজ্ঞার শিকার হয় এবং তারা গোটা ইরানি জাতিকে লাঞ্ছিত করার লক্ষ্যে ইসলামি ইরানের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাকেও ব্যবহার করে। তবে দীর্ঘ তিন দশকব্যাপী সফল কূটনৈতিক তৎপরতার ফলে ইরান এ কঠিন অবস্থা মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে। ইসলামি ইরান এখন পুরোপুরিভাবে তার নিজের পায়ে ভর করে দাঁড়াতে এবং স্বয়ং স্বীয় অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক ও মানবিক প্রয়োজন সমূহ পূরণ করত সক্ষম হয়েছে।
আমরা লক্ষ্য করেছি, ‘আরব বসন্ত’ নামক রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রভাবে সমগ্র আরব জাহান অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাত, চরম রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও ধ্বংসাত্মক গৃহযুদ্ধের কবলে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে স্বীয় অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য সংগ্রামরত অনেক আরব দেশের জন্যই কোনো আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে, সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তথাকথিত ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ বা দা‘এশ্-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধকে এর সমাপ্তি পর্যন্ত এগিয়ে নেয়া এবং সিরিয়া, ইরাক, মিসর, লিবিয়া ও অন্যান্য গৃহযুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশগুলোর মানবিক প্রয়োজন সমূহ পূরণ সবচেয়ে বেশি জরুরি। এ ক্ষেত্রে, গোষ্ঠীগত, জাতীয়, ধর্মীয় ও মাযহাবি পরিচিতি নির্বিশেষে এসব দেশের জনগণের জন্য, বিশেষ করে ইরাকি ও সিরীয় জনগণের জন্য সম্ভবত ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানই হচ্ছে একমাত্র আশার আলো।

প্রশ্ন ৫ : ইরানের শিক্ষা-দীক্ষা ও সংস্কৃতিচর্চায় কী ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন?
উত্তর : গত ৩৫ বছরে আরও তিনবার ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিভিন্ন অঞ্চল ও শহর ঘুরে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। ১৯৮১ সালে আমি প্রথম বিপ্লবোত্তর ইরান দেখতে যাই। ঘটনাচক্রে আমি তখন ইরানি মজলিশের তৎকালীন স্পিকার হুজ্জাতুল ইসলাম আলি আকবর রাফসানজানীর মেহমান হই। ব্যক্তিগতভাবে খুব কাছ থেকে ইমাম খোমেইনীকে দেখার সৌভাগ্য হয় আমার। ইমাম খোমেইনীর ছেলে আহমাদ খোমেইনীর সাথে আমার সরাসরি কথা হয়। ইরানের বিভিন্ন শহর, যেমন : ইসফাহান, আবাদান, খোররাম শাহ্র, সিরাজ, আহ্ওয়াজসহ তেহরান ও কোম তো অবশ্যই, অনেক শহর পরিদর্শন ও প্রসিদ্ধ আয়াতুল্লাহদের বক্তব্যে আমি দারুণভাবে মুগ্ধ হই। কিন্তু সাদ্দামের সেনাবাহিনী দ্বারা বহুলাংশে যুদ্ধবিধ্বস্ত শহর ও জনপদ দেখে আমি কখনোই ভাবি নি যে, বিপ্লবোত্তর ইরান একা বড় বড় এত সব শক্তির সংগঠিত যুদ্ধের বিরুদ্ধে এককভাবে লড়ে বিজয়ী হতে পারবে। আজও যেন আমার সামনে ইরানের সে সকল যুদ্ধ বিধ্বস্ত জনপদের ছবি ভাসমান। গত কয়েক বছর পূর্বে আমি কাযভীন শহরে অবস্থিত ইমাম খোমেইনী আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে গিয়েছিলাম ভিজিটিং প্রফেসর হিসাবে। পৃথিবীর বহু দেশের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ও পড়ানোর সুযোগ আমার হয়েছে। কিন্তু কাযভীনের ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর অভিজ্ঞতা ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। অনুবাদকদের সাহায্যে আমার পড়ানোর সে চেষ্টা বেশি দূর অগ্রসর হতে পারে নি। ফারসি ভাষা না জানার গ্লানি নিয়ে তুরষ্ক ও আফগানিস্তাান হয়ে পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যাবর্তন করি। উল্লেখ্য, আমাদের পূর্বপুরুষদের একটি আপ্তবাক্য তখন আমার বার বার মনে পড়ছিলÑ ‘আরবি বা ফারসি না জানলে নিজেকে পরিপূর্ণ শিক্ষিত বলে ধরে নেয়া বাতুলতা মাত্র।’ বলে রাখা ভালো যে, আমি রুশ ভাষার মত কঠিন মাধ্যম ব্যবহার করে মধ্যপ্রাচ্য, ইসলাম ও আইনশাস্ত্রীয় বহু জটিল বিষয়ে দীর্ঘদিন সফলভাবেই গবেষণা কর্ম চালিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছিলাম। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, কয়েক দশক পূর্বেও আমি উজবেক, তাজিক, আফগানদের মাঝে থেকেও উপলব্ধি করি নি যে, আরবি ও ফারসি জানা বর্তমানেও এতটা জরুরি। ফারসি শুধু একটি অসাধারণ সাহিত্যসমৃদ্ধ ভাষা নয়। এটি আজ রুশ ও ফরাসি বা চাইনিজ ভাষার মত একটি বিপ্লবী ভাষা। ফেরদৌসী, শেখ সা’দী, ওমর খৈয়াম ও গালিবদের কথা না হয় বাদই দিলাম, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম একাই আরবি-ফারসি থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার শব্দ উপহার দিয়েছেন আমার প্রাণপ্রিয় বাংলা ভাষাকে। পৃথিবীর ইতিহাসে একক কোন ব্যক্তির পক্ষে বিদেশি ভাষা থেকে নিজের ভাষায় এত বিপুল শব্দ ভা-ারের সংযোজনের ইতিহাস নেই। উল্লেখ্য, সৈন্য থাকাকালীন করাচির নৌবন্দরে সৈনিকের জীবন অতিবাহিত করার সময় আমাদের জাতীয় কবি এক বছরে ফারসি ভাষায় গভীর বুৎপত্তি অর্জন করেন। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, নেহেরু কর্তৃক রচিত ঞযব এষরসঢ়ংবং ড়ভ ঃযব ডড়ৎষফ ঐরংঃড়ৎু ফারসি ভাষাতেই রচিত হয়। একসময়ের পারস্য আর আজকের বিপ্লবী ইসলামি প্রজাতন্ত্র সমগ্র মুসলিম বিশ্বের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের মাধ্যম হয়ে উঠছে। এটি প্রত্যক্ষ করে আমি যার পর নাই খুশি হয়েছি। তবে নিজেকে আজ মুসলিম ও ইসলামি সভ্যতাসহ সমগ্র মানবসভ্যতার কাছে অনেক বেশি দায়বদ্ধ মনে হয়।
প্রশ্ন ৬ : ইসলামের আন্তর্জাতিকতাবাদের কোন্ দিকটির পরিচর্যা আজকের ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে বেশি?
উত্তর : আজ আমরা বিশ্বায়িত সমাজের নাগরিক। ইরানকে বা ইরানিদেরকে অনেক বাইরের পর্যবেক্ষকই ভুল প্রচারনার শিকার হয়ে মনে করেন আধুনিক বিশ্বের একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। অথচ জ্ঞান-বিজ্ঞানের আধুনিক শাখাসমূহের সাথে ভাষা ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্যময় জ্ঞানের উৎসসমূহের ওপর ইরানিদের গবেষণা প্রমাণ করে যে, ইরানিরা জাতি হিসেবে এবং ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান রাষ্ট্র হিসেবে আধুনিক বিশ্বের একটি আন্তর্জাতিকতাবাদের অনুঘটক (পধঃধষুংঃ)। বাংলাসহ ভারতীয় উপমহাদেশে বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চা আজ এক নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। কবিগুরুকে জীবদ্দশায় দাওয়াত করে এবং সমগ্র আধুনিক ইরানের সাথে প্রত্যক্ষ পরিচয় করিয়ে দিয়ে ইরানিরা বুঝিয়েছিল যে, আমরা প্রাচ্যের একটি অতি বুনিয়াদি ও ঐতিহ্যম-িত সভ্যতার ধারক। কবিগুরুও নানা ভাবে ইঙ্গিত করেছেন পারস্য সভ্যতার অতীত যশগাঁথার বিভিন্ন দিকে। উল্লেখ্য, ইংরেজরা যখন লিখতে বা পড়তে পারত না বা ইংরেজদের ভাষাই যখন সৃষ্টি হয় নি, তখন পারস্যের অধিবাসীরা বর্ণমালার চারুলৌকিক গাঁথুনীকে সৌন্দর্যম-িত ও যুক্তিযুক্ত করার কাজে নিরলস প্রচেষ্টায় লিপ্ত ছিল। আধুনিক ইসলামি ইরানিদের জ্ঞানচর্চা, সাহিত্যসাধনা, সংগীতচর্চা ও চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে সাফল্যগুলো আজ বিশ্বনন্দিত। আমার মনে হয় বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের উচিত হবে আরবি, ফারসিসহ প্রাচ্যের সম্মিলিত সমৃদ্ধ ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানভা-ার থেকে নুড়ি খুঁজে নিয়ে আমাদের জাতীয় ভাষা ও সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধির কাজে ব্যবহার করা। ভুলবশত মনে করা হয় যে, বিপ্লবোত্তর ইরান কেবল শিয়া দর্শনকে লালন করে এবং শিয়া-সুন্নি মতপার্থক্য ও দ্বন্দ্বে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করে। অথচ বিশ্ব ও আঞ্চলিক ঘটনাপ্রবাহে ইরানের গঠনমূলক ভূমিকা বড়ই স্পষ্ট এবং তা জ্ঞানী লোকদের কাছে সহজেই দৃশ্যমান।

দর্শকনন্দিত ইরানি সিরিয়াল ইউসুফ জুলেখা

আমিন আল আসাদ
‘আলিফ-লাম-রা- এগুলো হচ্ছে একটি সুস্পস্ট গ্রন্থের আয়াত। নিঃসন্দেহে আমি একে আরবি কোরআন হিসেবে নাযিল করেছি। যেন তোমরা তা অনুধাবন করতে পার। হে নবী (সা.)! আমি তোমাকে কোরআনের মাধ্যমে একটি সুন্দর কাহিনী শোনাতে চাচ্ছি যা তোমার কাছে ওহি হিসেবে পাঠিয়েছি। অথচ এর আগ পর্যন্ত তুমি এ কাহিনী সম্পর্কে ছিলে বেখবর।এটা হচ্ছে সে সময়ের কথা যখন ইউসুফ তার পিতাকে বলল : ‘হে আমার পিতা! আমি স্বপ্নে দেখেছি এগারোটি তারা ও চাঁদ-সূর্য আমার প্রতি সেজদাবনত।’ শুনে তার পিতা তাকে বলল : ‘হে আমার পুত্র! তোমার স্বপ্নের কথা তোমার ভাইদের কাছে বলে দিও না। তারা তোমার প্রতি ষড়যন্ত্র ও বিদ্বেষে লিপ্ত হবে। কারণ, শয়তান মানুষের প্রকাশ্য দুশমন।’
সূরা ইউসুফের এই আয়াতগুলো দ্বারাই আরম্ভ হয় দর্শকনন্দিত ইরানি সিরিয়াল ‘ইউসুফ জুলেখা’র প্রতিটি পর্ব। বাংলায় ডাবিংকৃত এ সিরিয়ালটি গত ২৭ নভেম্বর ২০১৬ থেকে বাংলাদেশের বেসরকারি টিভি চ্যানেল এস এ টিভিতে প্রতি রবিবার থেকে বৃহস্পতিবারে রাত ৮.৪০ মিনিটে প্রদর্শিত হচ্ছে। পুনঃপ্রচার করা হয় রাত ১২.৩০ মিনিটে। এছাড়াও প্রতি শনিবার দুপুর ২.৩০ মিনিটে গত সপ্তাহের প্রদর্শিত পাঁচ দিনের পর্বগুলো পুনঃপ্রদর্শিত হয়। বাংলায় ডাবিংকৃত এ সিরিয়ালটি পবিত্র কোরআনে বর্ণিত মুসলমানদের নবী ইয়াকুব (আ.) ও তাঁর পুত্র ইউসুফ (আ.)-এর জীবনের ঘটনাবলিকে কেন্দ্র করে নির্মিত।
জ্ঞানের মাধ্যম হিসেবে প্রিন্ট মিডিয়া, প্রকাশনা, বই-পুস্তক তো রয়েছেই এবং তা থাকবে। কিন্তু বিজ্ঞানের এ যুগে সবচেয়ে শক্তিশালী মিডিয়া হচ্ছে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া। মানুষের চিন্তা-চেতনা, বোধ-বিশ্বাস, ধর্মানুভূতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিষয়আসয় এ মিডিয়ার মাধ্যমে জনমনে প্রসারিত করা যায় সবচেয়ে দ্রুত। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার এ যুগে একটি শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যম হচ্ছে চলচ্চিত্র। প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ মরহুম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী একবার এক বক্তৃতায় বলেছিলেন : ‘আমি সারাদেশ ঘুরে ঘুরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বক্তৃতা দিয়ে যে জিনিস মানুষকে বোঝাতে পারি না তা এক ঘণ্টার একটি সিনেমা মানুষকে বোঝাতে সক্ষম। মনে হয় আমাকে চলচ্চিত্রই নির্মাণ করতে হবে।’
ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার এই গুরুত্বের কথা ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ভালোভাবেই ওয়াকেবহাল। তাই ইরানের আলেম ও জ্ঞানীগুণী চিন্তাবিদগণ ইসলামের রাজনৈতিক, সামাজিক, তাত্ত্বিক ও আধ্যাত্মিক বিপ্লবের সাথে সাথে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও বিপ্লব সম্পন্ন করেছেন সফলতার সাথে। ইরানের সিনেমাগুলো সবসময়ই দর্শকনন্দিত ও আন্তর্জাতিক নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়। ইরানের সামাজিক সিনেমাগুলো যেমনিভাবে শিল্পমানে উত্তীর্ণ, তেমনি সেখানে থাকে নানা মানবিক ও আদর্শিক আবেদন। ইরান বিভিন্ন সময়ে ইসলাম ও জাতীয় ইতিহাসভিত্তিক সাড়া জাগানো চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছে। ইতিপূর্বে কারবালার ইতিহাসনির্ভর ‘দূত’ ও ‘পতাকাবাহী’, জীবনভিত্তিক সিনেমা ‘হযরত আলী’, ‘ইবনে সীনা’, কোরআনের ঘটনানির্ভর সিনেমা ‘আসহাবে কাহ্ফ’, ‘মারইয়াম মোকাদ্দাস’ দর্শকনন্দিত হয়েছে। দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমরের জীবনভিত্তিক একটি ফারসি সিনেমাও আমরা লক্ষ্য করেছি যা ইরানের একটি চলচ্চিত্র কোম্পানি কর্তৃক নির্মিত হয়েছে। আর কিছুদিন পূর্বে ইরানের বিখ্যাত ও বিশ্বনন্দিত চলচ্চিত্র নির্মাতা মাজিদ মাজিদি সর্বকালের সবশ্রেষ্ঠ মানুষ মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে নিয়ে যে অসাধারণ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন তা সারা বিশ্বে আলোচিত হয়েছে।
আমাদের আলোচ্য সিরিয়াল ইউসুল জুলেখা সিরিয়ালটি সাসানি যুগের বিখ্যাত সুন্নি আলেম ও ফেকাহ শাস্ত্রবিদ মুহাম্মাদ ইবনে জারির তাবারীর বিখ্যাত তাফসির গ্রন্থ ‘তাফসীরে তাবারী’ ও খ্যাতনামা তাফসিরকার ইবনে কাসিরের ‘তাফসিরে ইবনে কাসির’ গ্রন্থে বর্ণিত নবী হযরত ইউসুফ (আ.)-এর বিস্তারিত জীবনী থেকে ধারাবাহিক রূপ দেয়া হয়েছে। এছাড়াও সহযোগিতা নেয়া হয়েছে হযরত ইউসুফ (আ.) ও জুলেখার স্বতন্ত্র কাহিনী গ্রন্থগুলোর। হযরত ইউসুফ (আ.)-এর জীবনের এই ঘটনা পবিত্র কোরআনে বর্ণিত রয়েছে। এছাড়া এটি তাওরাত গ্রন্থেও আছে।
হযরত ইউসুফ (আ.) ছিলেন আল্লাহর নবী। তিনি ছিলেন হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর পুত্র ইসমাইল (আ.)-এর বংশধর ইয়াকুব (আ.)-এর সন্তান। তিনি ও তাঁর ছোটভাই বেনিয়ামিন হযরত ইয়াকুব (আ.)-এর দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আরো দশ ভাই ছিল যারা অন্য মাতার সন্তান। হযরত ইউসুফ ছিলেন অপূর্ব সুন্দর এক যুবক এবং পূতঃপবিত্র চরিত্রের অধিকারী। কিশোর বয়সে তিনি স্বপ্ন দেখেন, এগারোটি তারা ও চাঁদ-সূর্য তাঁর প্রতি মাথা ঝুকিয়ে দিয়েছে। সেই স্বপ্ন তাঁর নবী ও শাসক হওয়ার ইঙ্গিত বহন করে। পিতা তাঁকে সেই স্বপ্নের কথা কাউকে বলতে নিষেধ করলেও পিতার কাছে তা ব্যক্ত করার সময় আড়াল থেকে শ্রোতার মাধ্যমে তা জানাজানি হয়ে যায়। তাঁর ভাইয়েরা তাঁর প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে তাঁকে হত্যার নিমিত্তে প্রহার করে ও এক পর্যায়ে একটি কুয়ায় নিক্ষেপ করে। বাঘ ইউসুফকে খেয়ে ফেলেছে বলে তারা তাদের পিতাকে মিথ্যা সংবাদ দেয়। একটি কাফেলা বালক ইউসুফকে সেই কুয়া থেকে উদ্ধার করে মিশরের প্রভাবশালী উযির পুতিফারের কাছে বিক্রয় করে দেয়। ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে থাকেন ইউসুফ। তাঁর রূপ, গুণ ও আচার-ব্যবহারের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে রাজ্যজুড়ে। উজিরের স্ত্রী ইউসুফের রূপ, গুণ ও যৌবনে মুগ্ধ হয়ে তাঁর প্রেমে পড়েন। প্রাসাদজুড়ে সেই কাহিনী ছড়িয়ে পড়লে উযিরের স্ত্রী সমালোচনায় পড়েন। তিনি রাজ্যের অভিজাত নারীদেরকে দাওয়াত করে প্রত্যেকের হাতে একটি ফল ও ছুড়ি দিয়ে ফল কাটার আহ্বান করেন। ঘরের একপাশ থেকে ইউসুফকে ঘরের ভেতর প্রবেশ করার হুকুম দিলে ইউসুফ সেই ঘরে প্রবেশ করেন। ইউসুফকে দেখে সেই সম্ভ্রান্ত নারীরা ফলের পরিবর্তে নিজ নিজ আঙ্গুল কেটে ফেলেন।
পরবর্তীকালে ইউসুফকে সেই নারী অনৈতিকভাবে কামনা করলে আল্লাহর নবী পূতঃপবিত্র চরিত্রের ইউসুফ তা প্রত্যাখ্যান করেন। এতে তিনি তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে কারাগারে পাঠান। ইউসুফ (আ.) সত্য ও ন্যায়ের পথে থেকে নির্দ্বিধায় জেলযুলুম সহ্য করতে থাকেন। ইউসুফকে একটিবারের জন্যও জুলেখার প্রতি অনৈতিক আকাক্সক্ষায় মনোনিবেশ করতে দেখা যায় না। কারণ, তিনি ছিলেন আল্লাহর নবী। তিনি বরং জুলেখা ও তার বান্ধবীদেরকে তওবা করে এক খোদায় বিশ্বাস স্থাপন ও খোদার প্রেমে আকৃষ্ট হতে বলতেন। জেলখানায় অবস্থান করে ইউসুফ রাজার দেখা একটি বিশেষ স্বপ্নের ব্যাখ্যা দেয়ায় তাকে কারাগার থেকে মুক্ত করে প্রধান উযিরের পদ দেয়া হয়। এভাবেই ঘটনা গড়াতে থাকে। এক পর্যায়ে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে ইউসুফের ভাইয়েরা মিশর দেশের রাজ-দরবারে খাদ্যসামগ্রী নিতে আসে। ই্উসুফ তাঁর ভাইদেরকে চিনতে পারেন। পরবর্তীতে নাটকীয়ভাবে ইউসুফ তাঁর ভাইদের কাছে পরিচয় ব্যক্ত করেন। বাবা ইয়াকুব (আ.)-এর সাথেও তাঁর দেখা হয়। এভাবেই সুখ-দুঃখ, ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এগুতে থাকে ইরানের বিখ্যাত টিভি সিরিয়াল ইউসুফ নবীর কাহিনী। সিরিয়ালটির পরিচালক ফারাজুল্লাহ সালাহশুরী আত্ তাবারী তাফসির গ্রন্থের হুবহু কাহিনী তাঁর সিরিয়ালটিতে তুলে ধরেছেন। সিরিয়ালটি ইতিমধ্যে ইরানের বাইরে ইরাক, সিরিয়া, তুরস্ক, মিশর, লেবানন, পাকিস্তান, আফগানিস্থানে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। জনপ্রিয় এই টিভি সিরিয়ালটির বাংলায় অনুবাদ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জনাব মুমিত আল রশিদ। যিনি বর্তমানে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জনের জন্য ইরানে অবস্থান করছেন। তিনি ইরানের তারবিয়াত মোদাররেস বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
৪৫ পর্বের এই ধারাবাহিকটিতে দর্শক পাবেন নবীযুগের সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা। দেখতে পাবেন ইসলাম-বহির্ভূত পৌত্তলিক ধর্মের নানা কাল্পনিক বিশ্বাস যা তাওহিদী বিশ্বাসের কাছে পড়াভূত হয়েছে। পাবেন বাবেল, কেনান, শাম, মিশরের নানা ঐতিহাসিক ও প্রতœতাত্ত্বিক আবহ যা দর্শককে ইতিহাসের আনাচে কানাচে নিয়ে যাবে। প্রাচীন যুগের দাস প্রথা, খাবার, বাণিজ্যিক ভ্রমণের দৃশ্য। প্রাচীন আরবের রাজ্যব্যবস্থা, জীবনব্যবস্থা, রীতিনীতি, ধু ধু মরুভূমি, মরুভূমিতে ভেড়া চড়ানোর দৃশ্য, মমি, পিরামিডের ইতিহাস ইত্যাদি। পোশাক-পবিচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জায় ইসলামি নৈতিকতা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বজায় রাখা হয়েছে যা বাংলাদেশে প্রচলিত সিরিয়ালগুলো থেকে ভিন্নমাত্রা পেয়েছে। সিরিয়ালটিতে কোন ধর্মমতকে আঘাত করা হয় নি। যৌক্তিকভাবে তাওহীদবাদকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
বড় ইউসুফের ভূমিকায় অভিনয় করছেন মোস্তফা যামানি, ছোট ইউসুফের ভূমিকায় অভিনয় করেন হোসাইন জাফারি, জুলেখার ভূমিকায় কাতায়ুন রিয়াহি, ইয়াকুব (আ.)-এর ভূমিকায় মোহাম্মাদ পাক নিয়্যাত, পুতিফারের ভূমিকায় জাফর দেহকান, অনেখ মহেুর ভূমিকায় আব্বাস আমিরি ও অখন অতুনের ভূমিকায় করছেন রাহিম নওরোযি।
সিরিয়ালটির পা-ুলিপি তৈরি করেন পরিচালক ফারাজুল্লাহ সালাহসুরী স্বয়ং। এছাড়া পা-ুলিপি উপদেষ্টা ওস্তাদ মানসুর বেরাহিমী, মঞ্চ পরিচালক রহিম মানসুরী, সাজসজ্জা সমন্বয়কারী : কাজেম ফারি বুরুজী, ভাস্কর্য নির্মাতা : দারিউস মির্জায়ী, সংগ্রহকারী পরিচালক : নাদের কানবারী, আলোকচিত্র গ্রাহক : মোহাম্মদ হাসান নমি, টেকনিক্যাল সাপোর্ট : বাহমান দাদাসি, ক্যামেরাম্যান : নাসের কাভুসি, সহকারী ক্যামেরাম্যান : আহমেদ কাভাসি, ভিজুয়াল ইফেক্টস : সাইয়্যেদ আমির রেযা মোতামেদী, স্পেশাল ইফেক্ট : মোহসেন রুজ বাহানি, মঞ্চসজ্জা ও দৃশ্যপট চিত্রক : ফরহাদ আলী যাদেহ, পোশাক ডিজাইনার : যাদেহ জাকি যাদেহ, সহকারী পরিচালক : আতাউল্লাহ সালমানিয়ান, পরিচালকের পরামর্শক : জামাল সুরুজে প্রমুখ। প্রত্যেকের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকা সিরিয়ালটিকে আলোর মুখ দেখিয়েছে।
ইতিপূর্বে আমাদের দেশে প্রচারিত ‘দি সোর্ড অব টিপু সুলতান’, ‘আকবর দি গ্রেট’ মুসলিম ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে নির্মিত। ‘হাতেম তাই’, ‘আলেফ লায়লা’, ‘সিন্দবাদ’কেও আমরা এই বলে নিন্দা জানাচ্ছি না যে, সেগুলো কেবল কাল্পনিক ঘটনার ওপর নির্মিত। সেসব কাল্পনিক ঘটনার ভেতরেও সত্য মিশ্রিত আছে। আছে ইশারা-ইঙ্গিতে নানা ভঙ্গিতে কোন না কোন নৈতিক আবহ। কিন্ত ইউসুফ জুলেখা সিরিয়ালটি সম্পূর্ণ সত্য ঘটনার ওপর নির্মিত। কোন কাল্পনিক গল্পের সংযোগ নেই এখানে। উল্লেখ্য, দৈনিক পত্রিকার কোন কোন পর্যালোচনামূলক নিবন্ধে এই সিরিয়ালটিকে মধ্যযুগের বাংলাসাহিত্যের ইউসুফ-জুলেখা উপাখ্যাননির্ভর বলে বর্ণনা করেছেনÑ যা আদৌ ঠিক নয়। সাহিত্যধর্মী ইউসুফ-জুলেখা উপাখ্যানে অনেক কাল্পনিক চিন্তার সংমিশ্রণ ঘটেছে যার সাথে ইউসুফ-জুলেখা সিরিয়ালের কোন সম্পর্ক নেই। কেউ কেউ আবার নবীজীবনের কাহিনীর প্রেমনির্ভর চলচ্চিত্রের বিরুদ্ধে কাল্পনিক কথাবার্তার ডালপালা ছড়াচ্ছেন। অথচ প্রকৃত ব্যাপার হলো হযরত ইউসুফ (আ.) জুলেখার সাথে প্রেম করেন নি এবং এই সিরিয়ালে এধরনের কিছুই নেই। যেটা প্রতিষ্ঠিত সত্য তা হলো জুলেখা হযরত ইউসুফের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল এবং তাঁকে অনৈতিকভাবে কাছে পেতে চেয়েছিল। কিন্তু হযরত ইউসুফ তার ডাকে সাড়া দেন নি, যার জন্য তাঁকে জেলে যেতে হয়েছিল। সিরিয়ালটিতে এই সত্যের বাইরে কিছুই ফুটিয়ে তোলা হয় নি। বরং পুরো সিরিয়ালটিতে সত্যধর্ম, খোদাপরিচিতিকে উন্নত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তথা নৈতিকতা ইত্যাদি বিষয়গুলোই দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ও ঘটনাপ্রবাহের ভেতর দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তাই সকলের প্রতি আহ্বান সিরিয়ালটি নিজে দেখে তারপর মূল্যায়ন করুন। আর একটি বিষয় হলোÑ ইরানি সিরিয়ালটির নাম হলো ‘নবী ইউসুফ (আ.)’; এসএ টিভি এটিকে বাংলায় ডাবিং করে নাম দিয়েছে ‘ইউসুফ-জুলেখা’। এই নামকরণটিও কতিপয় মূল্যায়নকারীকে প্রেমকেন্দ্রিকতার আবহ সৃষ্টি করেছে। আমাদের মতে নামকরণটি হুবহু ‘নবী ইউসুফ (আ.)’ রাখলেই ভালো হতো।
এদিকে শিল্প বোদ্ধাদের মতে, ‘আলেফ লায়লা’র মতো ‘শাহনামা’ নিয়েও মেগা সিরিয়াল নির্মিত হওয়া দরকার। ‘মসনবী’র ছোট ছোট গল্প নিয়েও নাটক, নাটিকা বা চলচ্চিত্র নির্মাণ করা যেতে পারে। কিংবা শেখ সাদীর ‘গুলিস্তাঁ’, ‘বোস্তাঁ’র গল্পগুলো থেকে অথবা ফরিদ উদ্দিন আত্তার রচিত ‘তাজকেরাতুল আওলিয়া’, ‘পান্দনামা’, ‘মানতেকুত তাইয়্যার’ গ্রন্থগুলোর কাহিনী নিয়ে। আমরাও রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অমূল্য চরিত্র ইশা খাঁ, সুলতান গিয়াস্্্্্্্্্উদ্দিন আজম শাহ, তিতুমীর, ফকির মজনু শাহ প্রমুখকে নিয়ে সিরিয়াল তৈরি করতে পারি।