All posts by pavel

ইরানি প্রবাদ

سر به گریبان خود فرو بردن.
উচ্চারণ : সার বে গেরীবা’নে খোদ ফারো বোরদান
অর্থ : মাথা নিজের জামার কলারের ভেতরে ঢুকিয়ে ফেলা।
মর্মার্থ : নিজের জীবনের দুঃখ-কষ্টের চিন্তায় ডুবে যাওয়া। আত্মমগ্ন হয়ে পড়া।
سر به نیست کردن.
উচ্চারণ : সার বে নীস্ত কার্দান
অর্থ : মাথা নাই করা।
মর্মার্থ : নিশ্চিহ্ন করা। হত্যা করা। নাস্তনাবুদ করে দেয়া।
سر پیچی کردن.
উচ্চারণ : সার পীচি কার্দান
অর্থ : মাথা পেঁচানো।
মর্মার্থ : অবাধ্য হওয়া। কারো আদেশ মান্য না করা বা আনুগত্য না করা।
سر توی سرها درآوردن.
উচ্চারণ : সার তূয়ে সারহা’ দারঅ’ওয়ার্দান
অর্থ : মাথাসমূহের মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে দেয়া।
মর্মার্থ : গণ্যমান্য হওয়া। নামী দামী লোকদের মাঝে স্থান করে নেয়া।
سر جای خود نشاندن.
উচ্চারণ : সারেজা’য়ে খোদ নেশা’নদান
অর্থ : নিজের জায়গার উপর বসিয়ে দেয়া।
মর্মার্থ : শাসন করা। অনুগত করে নেয়া। মেনে চলতে বাধ্য করা।
سر جهاز کسی بودن.
উচ্চারণ : সারে জেহা’যে কেসী বূদান
অর্থ : কারো মালপত্রের উপর থাকা।
মর্মার্থ : কারো উপর বোঝা হওয়া। কারো তোলফা হওয়া। পরিবারের পুরনো চাকর- বাকর বুঝাতে এই প্রবাদ ব্যবহার করা হয়।
سر چشمه برود چشمه خشک می شود.
উচ্চারণ : সারে চেশমে বেরাওয়াদ চেশমে খোশ্ক মী শাওয়াদ
অর্থ : ঝর্নার কাছে গেলে ঝর্না শুকিয়ে যায়।
মর্মার্থ : রূপকার্থে বলা হয়, সে যে কাজেই হাত দেয় তা নষ্ট হয়ে যায়। কারো কোনো কাজে সুফল না আসা বুঝাতে এই প্রবাদের ব্যবহার ব্যাপক।
سر حلیم روغن رفتن.
উচ্চারণ : সারে হালীম রোওগান রাফতান
অর্থ : হালিমের উপর তেল ঢালা।
মর্মার্থ : রূপকার্থে, খুব ভোরে তড়িঘড়ি রওয়ানা দেওয়া বুঝাতে প্রবাদটি ব্যবহৃত হয়। সাতসকালে যাত্রা করা।
سر درآوردن.
উচ্চারণ : সার দারঅ’ওয়ার্দান
অর্থ : মাথা বের করে আনা।
মর্মার্থ : কোন বিষয় ভালোভাবে বুঝতে পারা। কোনো বিষয়ের গভীর ও সূক্ষ্ম দিকগুলো উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হওয়া বলতে এ প্রবাদ ব্যবহৃত হয়।

سر در گم بودن.
উচ্চারণ : সার দার গোম বূদান
অর্থ : মাথা গুম হয়ে থাকা।
মর্মার্থ : কাজের আগাগোড়া বুঝতে না পারা। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়া।
سر دستی کاری را کردن (سر دستی گرفتن).
উচ্চারণ : সারে দাস্তী কা’রী রা’ কার্দান (সারে দসতী গেরেফতান)
মর্মার্থ : হাতের মাথায় কোনো কাজ করা (হাতের মাথায় নেওয়া)।
মর্মার্থ : ভাসাভাসাভাবে কোনো কাজ করা। অবহেলা ও অমনোযোগিতায় কোনো কাজ করা বুঝাতে এই প্রবাদটি ব্যবহৃত হয়।
سر دماغ بودن.
উচ্চারণ : সারে দেমা’গ বূদান
অর্থ : দেমাগের মাথার উপর থাকা।
মর্মার্থ : আনন্দিত, উৎফুল্ল এবং বেশ খোশমেজাজে থাকা বলতে প্রবাটি ব্যবহৃত হয়।
سرد و گرم روزگار چشیده بودن.
উচ্চারণ : সার্দো গার্মে রূযেগা’র চাশীদে বূদান
অর্থ : দিনকালের ঠা-া ও গরম এর স্বাদ নিয়েছে এমন হওয়া।
মর্মার্থ : অতীত থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে এবং পুরোপুরি ঝানু ও পাকা হয়েছে এমন।
سر رشته داشتن.
উচ্চারণ : সারে রেশতে দা’শতান
অর্থ : রশির মাথা হাতে থাকা।
মর্মার্থ : খবরাখবর অবহিত থাকা। কোনো একটি বিষয়ে তৎপর হওয়া। কোনো বিষয়ে তথ্যাদি জানা থাকা।
سر رشته را گم کردن.
উচ্চারণ : সারে রেশতে রা’ গোম কার্দান
অর্থ : রশির মাথা হারিয়ে ফেলা।
মর্মার্থ : নিজের কাজে দিশেহারা হয়ে পড়া। কোনো দিকে হদিস না পাওয়া বুঝাতে এর ব্যবহার ব্যাপক।
سر زبانها افتادن.
উচ্চারণ : সারে যাবা’নহা’ ওফতা’দান
অর্থ : মুখেমুখেপড়ে যাওয়া।
মর্মার্থ : বদনাম ছড়িয়ে পড়া। অপমানিত হওয়া।

অনুবাদ : আবু আব্দুল্লাহ

সংবাদ বিচিত্রা (বিদেশী সংবাদ)

মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক বিষয়গুলো এ অঞ্চলের দেশগুলোরই সমাধান করা উচিত : সর্বোচ্চ নেতা

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক বিষয়গুলো এ অঞ্চলের দেশগুলোরই সমাধান করা উচিত। গত ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী স্টিফ্যান লফভেনকে দেয়া সাক্ষাতের সময় সর্বোচ্চ নেতা এ কথা বলেন।
আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী ইরাক পরিস্থিতির উন্নতির কথা তুলে ধরে বলেন, সিরিয়া পরিস্থিতিরও উন্নতি হতে পারে, তবে সবার আগে সন্ত্রাসবাদের প্রতি কয়েকটি দেশের সমর্থন ও যুদ্ধকামী নীতির অবসান হওয়া জরুরি। সর্বোচ্চ নেতা বলেন, সিরিয়ার কথিত বিরোধী গ্রুপে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতিনিধির উপস্থিতি এবং সিরিয়ার চলমান সংকটে সন্ত্রাসীদের জন্য অস্ত্রের যোগান দেয়া- এ ধরনের হস্তক্ষেপের কয়েকটি উদাহরণ।
আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী বলেন, ইরান ও সুইডেনের মধ্যে সহযোগিতা জোরদার করার বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। স্টকহোমের সঙ্গে স¤পর্ক উন্নয়নের পদক্ষেপকে তেহরান স্বাগত জানায় বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, দু’দেশের মধ্যে বর্তমানে যে স¤পর্ক রয়েছে তা প্রকৃত সক্ষমতার চেয়ে অনেক নিচেই। তিনি বলেন, ইরানের জনগণ সুইডেনের বিষয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে যা দু’দেশের মধ্যকার স¤পর্ক জোরদারের ক্ষেত্রে একটি সঠিক ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
এ সময় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী পদে সুইডেনের পক্ষে ইরানের ভোট দেয়ার কথা উল্লেখ করে আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী বলেন, ‘নিরাপত্তা পরিষদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সংস্থাটি কয়েকটি দেশের কাছে বন্দি হয়ে রয়েছে। তারপরও গঠনমূলক ভূমিকা রেখে এ সংস্থাকে দ্বৈতনীতি অনুসরণ করা থেকে বিরত রাখা সম্ভব।’
সাক্ষাৎ অনুষ্ঠানে সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী বলেন, তেহরান সফরে এসে তিনি অর্থনৈতিক ও মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি নিয়ে ইরানের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তিনি জানান, ইরান ও সুইডেন যেসব দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ও সমঝোতা সই করেছে তাঁর দেশ তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, সুইডেন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হয়েছে এ সংস্থায় কার্যকরী ভূমিকা পালনের জন্য।

ইরানকে হুমকি দিয়ে বলদর্পী শক্তিগুলো অনুশোচনা করবে : বিপ্লববার্ষিকীর শোভাযাত্রায় প্রেসিডেন্ট রুহানি
গত ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি রাজধানী তেহরানে বিপ্লব বার্ষিকীর সমাবেশে বলেন, সারা দেশে ইসলামি বিপ্লবের বিজয় বার্ষিকীর শোভাযাত্রায় লাখ লাখ মানুষ অংশ নিয়ে আমেরিকার নয়া প্রশাসনের মিথ্যাচারের জবাব দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, মহান ইরানি জাতিকে হুমকি দেয়ার কারণে বিশ্বের বলদর্পী শক্তিগুলো অনুশোচনা করবে। তিনি বলেন, জনগণের এ সরব উপস্থিতির মাধ্যমে তারা বিশ্বকে এ বার্তাই দিচ্ছে যে, ইরানি জাতির সঙ্গে সম্মান এবং মর্যাদার ভাষায় কথা বলতে হবে, ভয় ও হুমকির ভাষায় নয়। তিনি আরও বলেন, গত ৩৮ বছরে ইরানি জাতি এটা প্রমাণ করেছে যে, যারাই তাদের সঙ্গে হুমকির ভাষায় কথা বলেছে তারাই পরবর্তীকালে অনুশোচনায় ভুগেছে।
ড. রুহানি বলেন, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি গোটা বিশ্ব মেনে নিয়েছে এবং ইরানের পরমাণু পণ্য এখন আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করছে। এ সময় তিনি ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের পর থেকে শত্রুদের অব্যাহত নানা ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতার নিন্দা জানান।
ইরানের সঙ্গে সই হওয়ার পরমাণু সমঝোতা বাতিল করার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রা¤েপর হুমকির মুখে পালিত হয় ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের ৩৮তম বার্ষিকী। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী ইসলামি প্রজাতন্ত্রের সর্বস্তরের জনগণকে এবারের বিজয় সমাবেশ এবং শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণের আহ্বান জানয়েছিলেন। তাঁর এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে খারাপ আবহাওয়াকে উপেক্ষা করে তেহরানের সুবিশাল আজাদি চত্বর এবং তার আশেপাশের এলাকা হয়ে ওঠে ফুঁসে ওঠা মানুষের বিশাল এক মহাসমুদ্র।
ইরানে ফারসি ক্যালেন্ডার অনুসারে ২২ বাহমান বিপ্লব বার্ষিকী উদযাপন করার লক্ষ্যে সারা ইরানে লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে বিজয় মিছিল ও সমাবেশ করেন। ১৯৭৯ সালের ওই দিন ইমাম খোমেইনী (র.)-এর নেতৃত্বে মার্কিন সমর্থিত স্বৈরশাসক রেযা শাহের পতন হয় এবং ইসলামি বিপ্লব চূড়ান্তভাবে বিজয় লাভ করে।

ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আয়াতুল্লাহ রাফসানজানির ইন্তিকাল
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের নীতি নির্ধারণী পরিষদের প্রধান ও সাবেক প্রেসিডেন্ট আয়াতুল্লাহ আলী আকবর হাশেমি রাফসানজানি গত ৮ জানুয়ারি ২০১৭ তেহরানের একটি হাসপাতালে ইন্তিকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। ইরানের প্রেস টিভির খবরে বলা হয়, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি ইন্তিকাল করেন। মৃত্যুর আগে আয়াতুল্লাহ রাফসানজানি ইরানের নীতি নির্ধারণী পরিষদের প্রধানহিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। আয়াতুল্লাহ রাফসানজানি হৃদযন্ত্রে তীব্র ব্যথা অনুভব করলে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে তিনি সেখানে ইন্তিকাল করেন।
১৯৩৪ সালের ২৫ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন ইরানের এই খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ। তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী একজন রাজনীতিবিদ ও লেখক। ১৯৮৯ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত তিনি ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের চতুর্থ প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৭ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন ইরানের বিশেষজ্ঞ পরিষদের চেয়ারম্যান। এছাড়া, ১৯৮০ সালে তিনি ইরানের জাতীয় সংসদের ¯িপকার নির্বাচিত হয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় রাফসানজানি বাংলাদেশ সফর করেছিলেন।

আয়াতুল্লাহ রাফসানজানির জানাযা ও দাফন অনুষ্ঠানে সর্বস্তরের মানুষের ঢল
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও নীতি নির্ধারণী পরিষদের প্রধান আয়াতুল্লাহ আলী আকবর হাশেমি রাফসানজানির নামাযে জানাযা অনুষ্ঠিত হয় গত ৮ জানুয়ারি ২০১৭। নামাযে ইমামতি করেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী।
তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় ক্যা¤পাসে স্থানীয় সময় সকাল দশটায় তাঁর জানাযার নামায অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নেন প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি, মন্ত্রীপরিষদের সদস্যবর্গ ও সরকারের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাবৃন্দ, নীতি নির্ধারণী পরিষদের সদস্যরা, জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. আলী লারিজানি, বহুসংখ্যক সংসদ সদস্য, শীর্ষ পর্যায়ের সামরিক কর্মকর্তাগণ এবং লাখ লাখ সাধারণ মানুষ। জানাযা শেষে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের নেতা মরহুম ইমাম খোমেইনীর মাযার প্রাঙ্গনে তাঁকে দাফন করা হয়।

আয়াতুল্লাহ রাফসানজানির স্মরণে শোক-সভা করলেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা
ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও প্রভাবশালী নেতা আয়াতুল্লাহ হাশেমি রাফসানজানির মৃত্যুতে ইসলামি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ীর উপস্থিতিতে ও তাঁরই উদ্যোগে তেহরানে একটি শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়।
গত ১১ জানুয়ারি ২০১৭ ইমাম খোমেইনী (র.) হোসাইনিয়ার মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় এই শোকসভা। এ সভায় পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত ও বিশ্বনবী (সা.)-এর পবিত্র আহলে বাইতের ওপর দরুদ পাঠ করা হয়। কোরআন পাঠ করেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতাসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
আয়াতুল্লাহ রাফসানজানির পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি, সংসদ স্পিকার আলী লারিজানি, প্রধান বিচারপতি সাদিক আমোলি লারিজানিসহ উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা এই শোকানুষ্ঠানে যোগ দেন। বিদেশি কূটনৈতিক মিশনের কর্মকর্তারাও এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
ইরাকের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইবরাহিম জাফারি ও ইরাকি ইসলামি সুপ্রিম কাউন্সিলের প্রধান আম্মার আল হাকিমও এ শোক অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
ইরানের ইসলামি বিপ্লবের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় নেতা রাফসানজানি ছিলেন দেশটির বিপ্লবোত্তর সংসদের প্রথম ¯িপকার। তিনি পর পর দুই দফায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ ছাড়াও মরহুম রাফসানজানি ছিলেন তেহরানের জুমআ নামাযের অস্থায়ী খতিব। ইরানের নীতি নির্ধারণী পরিষদেরও প্রধান ছিলেন তিনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এই গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে এই ইসলামি রাষ্ট্রের সেবা করেছেন।

আয়াতুল্লাহ রাফসানজানির ইন্তিকালে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের শোক
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের নীতি নির্ধারণী পরিষদের প্রধান ও সাবেক প্রেসিডেন্ট আয়াতুল্লাহ আকবর হাশেমি রাফসানজানির মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্দিরমির পুতিন। তিনি গত ১০ জানুয়ারি ২০১৭ ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানির কাছে পাঠানো এক শোকবার্তায় ইরানের সরকার ও জনগণকে শোক ও সমবেদনা জানান।
মস্কোয় নিযুক্ত ইরানের রাষ্ট্রদূত মেহদি সানায়ি গত ১০ জানুয়ারি এ খবর জানিয়ে বলেন, রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ প্রতিনিধি ইরান দূতাবাসে এসে প্রেসিডেন্ট পুতিনের শোকবার্তা হস্তান্তর করেন। আয়াতুল্লাহ রাফসানজানির মৃত্যুতে মস্কোর ইরান দূতাবাসে খোলা হয়েছে বিশেষ শোকবই। সেখানে পদস্থ রুশ কর্মকর্তাদের পাশাপাশি রাশিয়ায় নিযুক্ত অন্যান্য দেশের কূটনীতিকরা নিজ নিজ দেশের পক্ষে ইরানের সরকার ও জনগণকে সমবেদনা জানিয়েছেন।
এর আগে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ, লেবাননের হিজবুল্লাহ নেতা সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ ও ইয়েমেনের হুথি আনসারুল্লাহ আন্দোলনের নেতা আব্দুল মালেক হুথিসহ বিশ্বের বহু দেশের নেতা আয়াতুল্লাহ রাফসানজানির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে বার্তা পাঠিয়েছেন।

ইউরোপে মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের অধিকতর সক্রিয় ভূমিকা পালনের জন্য রাহ্বারের আহ্বান
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ্ উযমা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী ইউরোপের মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি তাদের চার দিকের বিশ্বে অধিকতর প্রভাব বিস্তারকারী ভূমিকা পালনের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি ইউনিয়ন অব্ ইসলামিক স্টুডেন্ট্স্ অ্যাসোসিয়েশন ইন ইউরোপ (ইউআইএসএই)-এর ৫১তম বার্ষিক সভার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উপলক্ষে গত ২০ জানুয়ারি (২০১৭) প্রেরিত এক বাণীতে এ আহ্বান জানান।
ইরানের ইসলামি বিপ্লবের বর্তমান রাহবার হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী তাঁর এ বাণীতে বলেন, যুবক ও একই সাথে ছাত্র হওয়ার কারণে তারা একটি শক্তিশালী চালিকাশক্তি, এ কারণে তারা স্ব-উদ্যোগে জনগণকে সমুন্নত লক্ষ্য সমূহ অর্জনের দিকে পথপ্রদর্শন করতে পারে।
ইসলামি বিপ্লবের রাহবার বলেন, ছাত্রত্ব ও যুবক হওয়ার দু’টি বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়া ছাড়াও তোমরা ইসলামি সমিতি সমূহের মতো কার্যকর ও প্রভাব বিস্তারকারী প্রক্রিয়ায় উপস্থিতির অধিকারী। তাই এটাই কাম্য যে, তোমরা বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে এবং দ্বীনী ও নৈতিক দিক থেকে নিজেদেরকে অধিকতর উন্নত করে গড়ে তুলবে। তিনি আরো বলেন, তোমাদের কাছ থেকে আরো কাম্য এই যে, তোমরা তোমাদের চার দিকের বিশ্বের ওপর প্রভাব বিস্তার করবে এবং তোমাদের কথা ও কাজের দ্বারা আল্লাহ্র পথে অগ্রসর হবে।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, বর্তমানে ইসলামের সমুন্নত পতাকার বিরুদ্ধে বলদর্পী ও ধর্মদ্রোহী শক্তি যে অসম যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে সে পরিপ্রেক্ষিতে এটা আমাদের সকলেরই কর্তব্য। তিনি এ লক্ষ্যে মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি ইসলামের সঠিক জ্ঞানের উৎসে পরিণত হবার এবং সঠিক ঐশী পথে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আহ্বান জানান।

আরব দেশগুলোর শত্রুরা ইরান-আতঙ্ক ছড়াচ্ছে : রুহানি
ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি বলেছেন, তাঁর দেশ শান্তি প্রতিষ্ঠার অগ্রদূত হওয়া সত্ত্বেও ইসলাম ও আরব দেশগুলোর অভিন্ন শত্রুরা মধ্যপ্রাচ্যে ইরান-আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। মাস্কাত সফররত প্রেসিডেন্ট রুহানি গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ওমানের সুলতান কাবুস বিন সাঈদ আলে সাঈদের সঙ্গে এক বৈঠকে এ মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, ইরান সব সময় সব ধরনের সমস্যা ও মতবিরোধ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করেছে। এ ছাড়া, ইরানের সামরিক শক্তি স¤পূর্ণ আত্মরক্ষামূলক এবং মধ্যপ্রাচ্যের সার্বিক নিরাপত্তা রক্ষার সেবায় নিয়োজিত।
প্রেসিডেন্ট রুহানি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতাই কেবল এ অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। তিনি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে সব ধরনের সহযোগিতা করতে তাঁর দেশের প্রস্তুতির কথা ঘোষণা করেন।
হাসান রুহানি বলেন, এ অঞ্চলের দেশগুলো যখনই কোনো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে তখনই তেহরান তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইরান আঞ্চলিক দেশগুলোকে সহায়তা করতে কার্পণ্য করে নি।
সাক্ষাতে সুলতান কাবুস রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ইরানের সঙ্গে সহযোগিতা শক্তিশালী করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে ইরানের সহযোগিতার ভূয়সী প্রশংসা করেন ওমানের সুলতান। একদিনের ওমান সফর শেষে প্রেসিডেন্ট রুহানি কুয়েতের উদ্দেশে মাস্কাত ত্যাগ করেন।

মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রী ও পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রীর উপদেষ্টার সাথে যারীফের সাক্ষাৎ
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাওয়াদ যারীফ গত ১৯ জানুয়ারি (২০১৭) মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে সে দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব আনিফে আমান ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র্রবিষয়ক উপদেষ্টা সারতাজ আযীযের সাথে সাক্ষাৎ ও পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি সম্পর্কে মত বিনিময় করেন।
মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের সঙ্কট ও ফিলিস্তিনের সর্বশেষ ঘটনাবলি সম্পর্কে আলোচনার উদ্দেশ্যে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত ইসলামি সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি)-র বিশেষ অধিবেশনে যোগদান উপলক্ষে সে দেশে অবস্থানকালে অধিবেশনের অবকাশে জনাব যারীফ ঐ দুই কর্মকর্তার সাথে সাক্ষাৎ করেন।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব জাওয়াদ যারীফ এবং মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব আনিফে আমান ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা সারতাজ আযীযের মধ্যকার এ বৈঠক দু’টিতে গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়াদি সম্পর্কে আলোচনা হয় এবং ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ও সংশ্লিষ্ট দেশ দু’টির মধ্যে সকল ক্ষেত্রে সম্পর্ক সম্প্রসারণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রতি মানবিক সাহায্য প্রদানের জন্য যারীফের আহ্বান
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব জাওয়াদ যারীফ মযলূম রোহিঙ্গা মুসলমানদের মানবিক সাহায্য প্রদানের ও তাদের সপক্ষে যথাযথ ভূমিকা পালনের জন্য বিশ্বের সকল মুসলমানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের সঙ্কট ও ফিলিস্তিনের সর্বশেষ ঘটনাবলী সম্পর্কে আলোচনার উদ্দেশ্যে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত ইসলামি সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি)-র বিশেষ অধিবেশনে গত ১৯শে জানুয়ারী (২০১৭) তারিখে প্রদত্ত ভাষণে এ আহ্বান জানান।
জনাব যারীফ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সে দেশের চরমপন্থী বৌদ্ধদের অপরাধমূলক কর্মকা-ের কঠোর নিন্দা করেন। তিনি বলেন, মিয়ানমারের সরকার অন্যায়ভাবে রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়েছে এবং এরই ধারাবাহিকতায় বৌদ্ধ চরমপন্থীদের দ্বারা তাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত ধর্ষণ ও গণহত্যাকে উপেক্ষা করে চলেছে। তিনি বলেন, এমতাবস্থায় মুসলিম জাতি সমূহকে বৈষম্য ও ধর্মীয় বিদ্বেষের শিকার হওয়া মুসলমানদের পক্ষে সোচ্চার হতে হবে।
জনাব যারীফ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মৃত্যুর হাত থেকে পলায়ন করতে গিয়ে যে মুসলিম সন্তানরা সমুদ্রে ডুবে মারা যাচ্ছে তাদের সে মর্মান্তিক দৃশ্যের প্রতি বিশ্ববাসী চোখ বন্ধ করে আছে ও পুরোপুরি নীরব রয়েছে। তিনি মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলমানদের রক্ষার জন্য জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানান এবং জোর দিয়ে বলেন, মিয়ানমারের সরকার যাতে সে দেশের সংখ্যালঘু মুসলমানদের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে সে লক্ষ্যে তার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে।
জনাব যারীফ আরো বলেন, মিয়ানমারে গণতন্ত্রের যে বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে তার সুফল অবশ্যই সে দেশের মুসলমান ও অন্যান্য সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকেও পেতে হবে। তিনি বলেন, দেশটির গণতন্ত্র অভিমুখে যাত্রা যেমন প্রশংসনীয়, তেমনি সেখানকার জনগণের একটি অংশের বিরুদ্ধে যে নিষ্ঠুরতা ও পৈশাচিকতা চলছে তার প্রতি দেশটির সরকারের অবহেলাও খুবই দুর্ভাগ্যজনক ও গভীর উদ্বেগের বিষয়।

ইরান ও রাশিয়ার মধ্যে দু’টি পারমাণবিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (এইওআই) ও রুশ ফেডারেশনের পারমাণবিক শক্তিবিষয়ক রেগুলেটরি সংস্থা রোসাটম্ স্টেট্ অ্যাটোমিক কর্পোরেশনের মধ্যে পারমাণবিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার লক্ষ্যে দু’টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ইরানি পারমাণবিক প্রতিনিধিদলের রাশিয়া সফরের শেষ দিনে গত ১৯ জানুয়ারি (২০১৭) রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে এইওআই-র মুখপাত্র বেহ্রুয কামালভান্দী ও রোসাটম্-এর প্রধান অ্যালেক্সি লিখাচেভ্ নিজ নিজ দেশের পক্ষ থেকে চুক্তি দু’টিতে স্বাক্ষর করেন।
শান্তিপূর্ণ কাজে ব্যবহারের জন্য ইরানে পারমাণবিক শক্তির উৎপাদনের লক্ষ্যে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প সম্পর্কে গত ২০১৫ সালের ১৪ই জুলাই তারিখে ৫+১ জাতি ও ইরানের মধ্যে স্বাক্ষরিত জয়েন্ট কোঅপারেশন প্লান্ অব্ অ্যাক্শন্ (জেসিপিওএ)-এর সাথে সঙ্গতি রেখে স্টাব্ল্ আইসোটোপ্ উৎপাদনের লক্ষ্যে ইরানের র্ফোদা ফুয়েল এন্রিচ্মেন্ট্ প্লান্টের পুনঃনির্মাণ এবং ইতিপূর্বে ২০১৪ সালে ইরান ও রাশিয়ার মধ্যে সম্পাদিত পারমাণবিক বিষয়ক চুক্তি সমূহের বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে দু’দেশের মধ্যে বর্তমান সহযোগিতা চুক্তি দু’টি স্বাক্ষরিত হয়।

ইরান ও জার্মানির মধ্যে পরিবহন সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ও জার্মানির মধ্যে বিমান, রেলওয়ে, সামুদ্রিক ও সড়ক পরিবহন সহযোগিতা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়েছে। ইরান সরকারের সড়ক ও নগর উন্নয়ন মন্ত্রী আব্বাস আহ্মদ অখুন্দী এবং ইরান সফরে আগত জার্মানির পরিবহন ও ডিজিটাল ইন্ফ্রাস্ট্রাকচার বিষয়ক ফেডারেল মন্ত্রী আলেকজান্ডার ডোব্রিন্ড গত ১৭ জানুয়ারি (২০১৭) তেহরানে এ সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেন। এ সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী দু’দেশের মধ্যে বিশেষভাবে বিমান, রেল, সামুদ্রিক ও সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্র সমূহে পারস্পরিক সহযোগিতার পন্থা উদ্ভাবনসহ যোগাযোগ ও পরিবহনের সকল ক্ষেত্রে সহযোগিতা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে অচিরেই একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হবে।
সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের পর জনাব আব্বাস আহ্মদ অখুন্দী সাংবাদিকদের জানান যে, সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী জার্মানি ইরানে ৫০টি লোকোমোটিভ উৎপাদনের কাজে সহযোগিতা করবে। তিনি জানান, জার্মানির সিমেন্স্ কোম্পানি ইরানের এমএপিএনএ কোম্পানিকে এগুলো উৎপাদনের কাজে সহযোগিতা দেবে।
তিনি আরো জানান যে, এ ছাড়াও দু’পক্ষের মধ্যে সামুদ্রিক পরিবহন, একটি এয়ারক্রাফট মেইনটেন্যান্স সেন্টার নির্মাণ ও সড়ক পরিবহনের স্মার্টিফিকেশন সম্পর্কে আলোচনা হয়েছেÑ যা ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
এ প্রসঙ্গে জনাব অখুন্দী উল্লেখ করেন যে, এয়ারবাস বিমান ক্রয় এবং কয়েকটি ইরানি বন্দরের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহের ব্যাপারে ইরান ও জার্মানির মধ্যে লেনদেন হয়েছে।
জার্মান মন্ত্রী আলেকজান্ডার ডোব্রিন্ড দু’দেশের মধ্যকার আলোচনা ও সমঝোতা স্বারক স্বাক্ষরের ব্যাপারে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ইরান ও জার্মানির মধ্যে পরিবহন খাতে পারস্পরিক সহযোগিতার চমৎকার ক্ষেত্র রয়েছে।
উল্লেখ্য, জনাব আলেকজান্ডার ডোব্রিন্ড তাঁর এ সফরে তাঁর দেশের একটি বড় প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন যাতে মিউনিখ ও ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমান বন্দরের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদ্বয় সহ বিভিন্ন জার্মান কোম্পানির ৩০ জন সিনিয়র পরিচালক অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
আরো উল্লেখ্য যে, জার্মানির পরিবহন ও ডিজিট্যাল ইন্ফ্রাস্ট্রাকচার বিষয়ক ফেডারেল মন্ত্রী আলেকজান্ডার ডোব্রিন্ড এর আগে ২০১৬ সালের অক্টোবরে ইরান সফরে আসেন। ঐ সময় দু’দেশের মধ্যে পরিবহন খাতে সহযোগিতার লক্ষ্যে ছয়টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এবারের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের ফলে ইতিপূর্বে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকসমূহে অন্তর্ভুক্ত সিদ্ধান্তসমূহের বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত ও তার আওতা অধিকতর বিস্তৃত হবে।

ইতালি ইউরোপীয় ইউনিয়নে ইরানি পণ্যের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের কাস্টম্স্ প্রশাসন কর্তৃক প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশসমূহের মধ্যে ইতালি হচ্ছে ইরানি পণ্যের সবচেয়ে বড় আমদানীকারক। চলতি ইরানি বছর (১৩৯৫)-এর প্রথম নয় মাসের (২১ মার্চ Ñ ২০ ডিসেম্বর ২০১৬) রপ্তানির পরিসংখ্যান থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়।
প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, উক্ত নয় মাসে ইতালি ইরান থেকে তেল বহির্ভূত ও স্যুটকেস ব্যবসায়ের মাধ্যমে আমদানিকৃত পণ্যের বাইরে মোট ৫ লাখ ৮৭ হাজার টন পণ্য আমদানি করে যার মূল্য ছিল ৩৮ কোটি ৫০ লক্ষ ডলার। উল্লেখ্য, পূর্ববর্তী বছরে একই সময়ে ইতালি কর্তৃক আমদানিকৃত একই ধরনের পণ্যের মূল্য ছিল ৪৬ কোটি ৪২ লক্ষ ৭৬ হাজার ৫৭৩ ডলার। সে হিসেবে চলতি ইরানি বছরের প্রথম নয় মাসে ইতালি কর্তৃক ইরানি পণ্য আমদানির পরিমাণ গত বছরের একই সময়ের তুলনায় শতকরা ১৭ ভাগ হ্রাস পেয়েছে।
চলতি ইরানি বছরের প্রথম নয় মাসে ইরান থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ইতালির পরের স্থান হচ্ছে ইরানের প্রতিবেশী দেশ আযারবাইজান প্রজাতন্ত্রের; এ সময় আযারবাইজান ইরান থেকে ৩০ কোটি ২১ লক্ষ ২৮ হাজার ৩৫৫ ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করে। এর পর তৃতীয় স্থানে রয়েছে জার্মানি Ñ ঐ সময় ইরান থেকে যার পণ্য আমদানির মূল্য ছিল ২১ কোটি ১০ লক্ষ ৬৫ হাজার ৫৫ ডলার। এর পর চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে ছিল যথাক্রমে স্পেন (১৯ কোটি ৭৩ লক্ষ ৭৪ হাজার ৬৭২ ডলার) ও আর্মেনিয়া (১৬ কোটি ৮ লক্ষ ৭২ হোজার ৭৯২ ডলার)।
চলতি ইরানি বছরের প্রথম নয় মাসে ইউরোপের ৪০টি দেশে ইরান থেকে তেল বহির্ভূত ও স্যুটকেস ব্যবসায়ের মাধ্যমে আমদানিকৃত পণ্যের বাইরে আমদানিকৃত মোট পণ্যের আমদানি মূল্য ছিল ১৮৫ কোটি ৫৪ লক্ষ ৯২ হাজার ১৯৮ ডলার।

৪১০০ কোটি ডলারের তেল রপ্তানি করবে ইরান : জাঙ্গানে
ইরানের তেলমন্ত্রী বিজান জাঙ্গানে আশা প্রকাশ করে বলেছেন, তাঁর দেশ চলতি ফারসি বছরের শেষ নাগাদ ৪১০০ কোটি ডলার মূল্যের তেল ও তেলজাত পণ্য রপ্তানি করতে পারবে। তিনি গত ১৬ জানুয়ারি ২০১৭ তেহরানে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, চলতি বছরের গত নয় মাসে ইরান ২৮৭০ কোটি ডলারের তেল রপ্তানি করেছে। ২০১৬ সালের ২১ মার্চ চলতি ফারসি বছর শুরু হয়েছে এবং আগামী ২০ মার্চ তা শেষ হবে।
তেল রপ্তানি থেকে অর্জিত অর্থ ইরানের চলতি জাতীয় বাজেটে হাতে নেয়া অর্থনৈতিক প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের জন্য যথেষ্ট বলেও তিনি মন্তব্য করেন। জাঙ্গানে বলেন, তেল ও তেলজাত পণ্য রপ্তানির সব অর্থ তেহরান সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে যাচ্ছে এবং কোনো দেশ নিষেধাজ্ঞার সময়ের মতো এই অর্থ আটকে রাখছে না।
ইরানের তেলমন্ত্রী বলেন, পরবর্তী অর্থ-বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট রুহানির সরকার যে বাজেট প্রণয়ন করবে তাতে তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ৫৫ ডলার ধরা হয়েছে।
এর আগে গত ১৫ জানুয়ারি ২০১৭ ইরানের তেলবিষয়ক উপমন্ত্রী আমির হোসেইন জামানিনিয়া জানিয়েছিলেন, চলতি ফারসি বছরের প্রথম নয় মাসে ইরান প্রায় ৩০০০ কোটি ডলার মূল্যের তেল রপ্তানি করেছে। পাশ্চাত্যের সঙ্গে ইরানের পরমাণু সমঝোতা সই হওয়ার পর দেশটির তেল রপ্তানির পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে বলেও তিনি জানিয়েছিলেন।
ইরানে ওয়ার্ল্ড্ ফেডারেশন অব্ ট্যুরিস্ট গাইড্স্ অ্যাসোসিয়েশন-এর সম্মেলন অনুষ্ঠিত
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রাজধানী তেহরানে ওয়ার্ল্ড্ ফেডারেশন অব্ ট্যুরিস্ট গাইড্স্ অ্যাসোসিয়েশন (ডব্লিউএফটিজিএ)-র সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। গত ২৮ জানুয়ারি থেকে ১ ফেব্রুয়ারি (২০১৭) পর্যন্ত অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে বিশ্বের ৪৫টি দেশ থেকে চারশ’ ট্যুরিস্ট্ গাইড্ অংশগ্রহণ করেন। ইরান ফেডারেশন অব্ ট্যুরিস্ট্ গাইড্ অ্যাসোসিয়েশন্ (আইএফটিজিএ) এ সম্মেলনের আয়োজন করে।
উল্লেখ্য, এর আগে ওয়ার্ল্ড্ ফেডারেশন্ অব্ ট্যুরিস্ট গাইড্স্ অ্যাসোসিয়েশন (ডব্লিউএফটিজিএ)-র বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট ও তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রুবী রয়্ ২০১৫ সালে ইরান সফর করেন। ঐ সময় তিনি ওয়ার্ল্ড্ ফেডারেশন অব্ ট্যুরিস্ট গাইড্স্ অ্যাসোসিয়েশন (ডব্লিউএফটিজিএ)-র পরবর্তী সম্মেলন ইরানে অনুষ্ঠানের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
ইরানে ওয়ার্ল্ড্ ফেডারেশন্ অব্ ট্যুরিস্ট গাইড্স্ অ্যাসোসিয়েশন (ডব্লিউএফটিজিএ)-র সম্মেলনের কর্মসূচির অংশ হিসেবে এতে অংশগ্রহণকারী বিদেশি ট্যুরিস্ট গাইড্দেরকে কোনোরূপ প্রবেশমূল্য ছাড়াই বিভিন্ন মিউজিয়াম ও অন্যান্য আকর্ষণীয় স্থান পরিদর্শন করানো হয়। উল্লেখ্য, বিশ্বের অন্যান্য দেশে অনুরূপ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী ইরানি ট্যুরিস্ট গাইডগণকেও অনুরূপ সুবিধা প্রদান করা হয়ে থাকে।

আবাদানে বিশ্বের বৃহত্তম সমুদ্র জাদুঘর নির্মিত হবে
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের পারস্য উপসাগর উপকূলীয় বন্দর নগরী আবাদানে পার্ক আকারে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যারিটাইম মিউজিয়াম (সমুদ্র যাদুঘর) নির্মিত হবে। ইরানের তেল শিল্প মিউজিয়াম অফিসের প্রধান জনাব আকবর নে‘মাতুল্লাহী গত ১২ জানুয়ারি (২০১৭) এ তথ্য প্রকাশ করেন।
তিনি প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করেন যে, বর্তমানে আবাদান শহরে শতাব্দী কালের পুরনো একটি পেট্রোলিয়াম টেকনিক্যাল স্কুল রয়েছেÑ যা তেল শিল্পবিষয়ক পেশাগত প্রশিক্ষণ প্রদানের কেন্দ্র হিসেবে ভূমিকা পালন করে থাকে। তিনি জানান, এ স্কুলের অংশ হিসেবে ১৬০০ বর্গমিটার জায়গা জুড়ে একটি সমুদ্র যাদুঘর নির্মাণ করা হবেÑ যা হবে এ ধরনের দ্বিতীয় কিন্তু বৃহত্তম জাদুঘর।
জনাব আকবর নে‘মাতুল্লাহী বার্তা সংস্থা মেহ্র্ নিউজ-এর সংবাদ প্রতিনিধিকে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বিগত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে দ্রুত বিকাশমান তেল শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে এ স্কুলটি ব্রিটিশ অর্থায়নে নির্মিত হয়। এর আগে অনেক বছর যাবত তেল শিল্পের উঁচু পদগুলোর জন্য কেবল ব্রিটিশদেরকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হতো। আবাদানের পেট্রোলিয়াম টেকনিক্যাল স্কুল প্রতিষ্ঠিত হবার পর ইরানি নাগরিকগণ সেখানে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ লাভ করে তেল শিল্পে উঁচু পদে চাকরি পেতে শুরু করেন।
জনাব আকবর নে‘মাতুল্লাহী জানান, আবাদানে যে সমুদ্র মিউজিয়াম নির্মিত হতে যাচ্ছে তা এ ধরনের পাঁচটি সমুদ্র মিউজিয়াম নির্মাণের লক্ষ্যে গৃহীত উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনারই অংশ। এটি হবে আবাদানের তৃতীয় মিউজিয়াম; ১৬০০ বর্গমিটার আয়তনের এ মিউজিয়াম পার্কে ১১টি ডক্ থাকবে এবং এতে বিভিন্ন বয়স গ্রুপের দর্শকদের জন্য যথেষ্ট জায়গা ও প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ধরনের উপকরণাদি থাকবে।
জনাব আকবর নে‘মাতুল্লাহী বলেন, এ প্রকল্পটি পর্যটন আকর্ষণের বিষয়টি মাথায় রেখে গ্রহণ করা হয়েছে এবং এর সকল উপায়-উপকরণেই তেল শিল্পের প্রতীকী রূপ ফুটিয়ে তোলা হবে। সম্মেলন কেন্দ্রসমূহ নির্মাণ, শিশুদের জন্য খেলার মাঠের ব্যবস্থা রাখা ও অন্যান্য কেন্দ্র নির্বিশেষে সব কিছুরই মূল সুর হবে তেল শিল্প।
তিনি আরো বলেন, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সমুদ্র মিউজিয়াম সমূহের কথা মাথায় রেখে এ সমুদ্র মিউযিয়ামটির প্রকল্প প্রণয়ন করা হয়েছে; এর ডকগুলোতে সকলের হাঁটাচলার জন্য যথেষ্ট জায়গা থাকবে এবং শিশু-কিশোরদের জন্য পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন খেলার মাঠ থাকবে।

ইরানি ওষুধ বিজ্ঞানীরা আল্ঝেইমার চিকিৎসার ভেষজ ওষুধ তৈরি করেছেন
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের ওষুধ বিজ্ঞানিগণ এমন একটি ভেষজ ওষুধ তৈরি করেছেন যা আল্ঝেইমার রোগের নিরাময় করতে সক্ষম হবে। ইরানীয়ান ইনস্টিটিউট্ অব্ মেডিক্যাল প্লান্ট্স্-এর গবেষকগণ ‘মেলিট্রোফিক্’ নামক এ ওষুধটি আবিষ্কার করেছেন।
অতীতে ইরানে মস্তিষ্কের সমস্যাদির চিকিৎসার জন্য যে প্রাচীন ও দেশজ বিজ্ঞানের ব্যবহার করা হতো ইরানিয়ান ইনস্টিটিউট্ অব্ মেডিক্যাল প্লান্ট্স্-এর গবেষকগণ তা কাজে লাগান এবং এ বিষয়ে বিশ্বে যে অধুনাতম গবেষণা পরিচালিত হয়েছে তা অধ্যয়ন ও পর্যালোচনা করেন। এর ফলে তাঁরা প্রথম বারের মতো এমন একটি ওষুধ আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন যা আল্ঝেইমারের চিকিৎসায় সাফল্য এনে দেবে।
ইরানি গবেকগণ এ ওষুধটি উৎপাদনের লক্ষ্যে গবেষণা করতে গিয়ে হাল্কা ও মধ্যম ধরনের আল্ঝেইমারে আক্রান্ত ৬৫ থেকে ৮০ বছর বয়ষ্ক ৪২ জন রোগীর ওপর অনেকগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। এ সব পরীক্ষায় তাঁরা এক্স্পেরিমেন্ট গ্রুপের রোগীদেরকে ড্রাকোসেফালাম্ এবং কন্ট্রোল্ গ্রুপের রোগীদেরকে প্ল্যাসেবোস্ প্রদান করেন। এতে চার মাসের গবেষণায় উল্লেখযোগ্য ফল পাওয়া যায়; দেখা যায় যে, যেসব রোগীকে ড্রাকোসেফালাম্ নির্যাস প্রদান করা হয়েছিল তাদের হাল্কা ও মধ্যম ধরনের আল্ঝেইর্মা নিয়ন্ত্রণে এসেছে এবং এ ছাড়াও সাধারণভাবে এক্সপেরিমেন্ট গ্রুপের রোগীদের ভিতর থেকে উদ্বেগ সমস্যা ও চুলকানির লক্ষণসমূহ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।
ইরানি গবেষকদের দ্বারা তৈরি ‘মেলিট্রোফিক্’ নামক এ ওষুধটি আন্তর্জাতিক বাজারে বাজারজাতকরণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়টি ইতিমধ্যেই বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।

ইরানি গবেষকগণ মধু দূষণ নির্ণয়ক কিট্ তৈরি করেছেন
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের একদল গবেষক একটি মুধু দূষণ নির্ণয়ক কেমিক্যাল কিট্ তৈরি করেছেন, যার সাহায্যে মধু ব্যবহারকারিগণ খুবই কম খরচে খাঁটি মধু ও ভেজাল মধুর মধ্যকার পার্থক্য নির্ণয় করতে সক্ষম হবেন।
‘মধু দূষণ নির্ণয়ক কেমিক্যাল কিট্’ তৈরি প্রকল্পের ব্যবস্থাপক জনাব আব্বাস ইবরাহীমী বলেন, বর্তমান কালে মধু ব্যবহারকারীদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মধুর মান নিশ্চিতকরণ।
উল্লেখ্য, খাদ্য ও পানীয়ের ক্ষেত্রে দূষণ বলতে বুঝায় তাতে অন্য জিনিসের ভেজাল; কতক লোভী লোক অনেক বেশি মুনাফার লোভে মধুতে বিভিন্ন ধরনের কম দামী জিনিস ভেজাল দিয়ে থাকে; এসব জিনিস কেবল যে মধুর চেয়ে নিম্ন মানের তা নয়, ক্ষেত্রবিশেষে তা ক্ষতিকরও বটে।
জনাব আব্বাস ইবরাহীমী বলেন, যেহেতু মধুতে বিভিন্ন ধরনের উপাদান থাকে সেহেতু তার মান নির্ণয়ের জন্য গবেষণাগারে পরীক্ষা করতে হয়Ñ যা খুবই ব্যয় বহুল। এর প্রতি লক্ষ্য রেখেই ইরানি গবেষকগণ মধু দূষণ নির্ণয়ক কিট্ উদ্ভাবন করেছেন যার সাহায্যে খুব সহজে ও স্বল্প সময়ে খাঁটি মধু ও ভেজাল মধুর মধ্যকার পার্থক্য নির্ণয় করা সম্ভব হবে।
তিনি জানান, এ কেমিক্যাল কিট্টি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছেÑ যা মধুতে বিদ্যমান দু’টি প্রধান এন্জাইম্Ñ গ্লুকোজ্ অক্সিডেজ্ ও ডায়াটেস্ট এবং সেই সাথে হাইড্রোক্সাইল্মিথাইর্ল্ফুফুর‌্যাল্ (এইচএমএফ্)-এর মূল্যায়ন করতে পারবে। নকল মধু চিনি জাতীয় উপাদান সমূহের হাইড্রোলাইসিস থেকে তৈরি করা হয় যাতে এসব জিনিস বেশি পরিমাণে থাকে।
উল্লেখ্য, জনাব আব্বাস ইবরাহীমী ও সাইয়্যেদ হোসাইন সাফাভী কর্তৃক পরিচালিত ‘মধু দূষণ নির্ণয়ক কেমিক্যাল কিট্’ প্রকল্পটি অষ্টাদশ খাওয়ারিয্ম্ ইয়ুথ্ ফেস্টিভ্যালে দ্বিতীয় পুরস্কার লাভ করেছে।

ইরানি গবেষকগণ ডিজিট্যাল্ ডেটা-কে ব্রেইল-এ রূপান্তরের ডিভাইস্ আবিষ্কার করেছেন
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের গবেষকগণ এমন একটি ডিভাইস্ উদ্ভাবন করেছেন যা ডিজিট্যাল ডেটা-কে ব্রেইল্-এ রূপান্তরিত করতে সক্ষমÑ যার ফলে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা বর্তমানে তাদের দ্বারা ব্যবহৃত কম্পিউটারের তুলনায় অধিকতর সহজে ডিজিট্যাল্ ডেটা থেকে জ্ঞান আহরণ করতে সক্ষম হবে।
এ ডিভাইস্টি তৈরির প্রকল্প ব্যবস্থাপক জনাব মোসলেম আযামর্ফা বার্তা সংস্থা এমএনএ-র সংবাদ প্রতিনিধিকে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে জানান, এ ডিভাইস্টি ডিজিট্যাল ডেটা-কে লাইন ভিত্তিতে ব্রেইলে রূপান্তরিত করতে সক্ষম এবং তা এমনভাবে বৃত্তাকারে বিন্যস্ত করতে সক্ষম যার ফলে ব্রেইল্ এটি ব্যবহারকারীর হাতের নিচ দিয়ে অতিক্রম করবে এবং সে তার হাত নাড়াচাড়া না করেই এ থেকে জ্ঞান আহরণ করতে সক্ষম হবে।
জনাব মোসলেম আযামর্ফা জানান, ইতিপূর্বে ডিজিট্যাল ডেটা-কে রিফ্রেইশাব্ল্ ব্রেইল ডিস্প্লে-তে রূপান্তরকারী যে সিস্টেম উদ্ভাবিত হয়েছে তার থেকে বর্তমান ডিভাইস্টির সবচেয়ে বড় পার্থক্য হচ্ছে এটির কম ব্যয় সাপেক্ষতা; ব্রেইল কনভার্সনের জন্য প্রচলিত সিস্টেমটি যে ধরনের কম্পিউটারের সাহায্যে ব্যবহার করা হয় তার ব্যয় হচ্ছে চার হাজার ডলার, কিন্তু নব-উদ্ভাবিত এ ডিভাইসটির জন্য ব্যয় হবে মাত্র ৬০০ থেকে ৯০০ ডলার। অন্যদিকে বর্তমানে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের দ্বারা ব্যবহৃত কম্প্উিটারে ডিজিট্যাল ডেটা-কে লাইন ভিত্তিতে ব্রেইলে রূপান্তর করা সম্ভব হয় না, কিন্তু নব-উদ্ভাবিত এ ডিভাইস্টি তা করতে সক্ষম। তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় কথা, এ ডিভাইস্টি দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদেরকে অধিকতর দ্রুত গতিতে ও অনেক বেশি নির্ভুল পাঠের নিশ্চয়তা দেবে।
জনাব মোসলেম আযামর্ফা জানান যে, এ সিস্টেমটি এখনো বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করা হয় নি। তবে তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, এটি বাজারে আসার পরে তা দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের পঠন সুবিধার ক্ষেত্রে একটি বিরাট যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে প্রমাণিত হবে।
উল্লেখ্য, জনাব আযামফারের এ প্রকল্পটি অষ্টাদশ খাওয়ারিযম্ ইয়ুথ ফেস্টিভালে প্রথম পুরস্কার লাভ করে এবং এটি নিবন্ধনের জন্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

তেহরানে চব্বিশতম আন্তর্জাতিক ঝাড় বাতি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রাজধানী তেহরানে ২৪তম আন্তর্জাতিক বাতি, ঝাড়বাতি ও আলোকসজ্জা প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। গত ১৬ ও ১৭ জানুয়ারি তেহরানের স্থায়ী আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী মাঠে এ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের শিল্প, খনিজ সম্পদ ও বাণিজ্যবিষয়ক মন্ত্রী জনাব মোহাম্মাদ রেযা নে‘মাত্যাদে, কয়েক জন উপমন্ত্রী, ইরান চের্ম্বা অব্ কমার্স, ইন্ডা্িট্রজ্ অ্যান্ড্ মাইন্স্-এর চেয়ারম্যান এবং সংশ্লিষ্ট সমিতি সমূহের প্রধানদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত এ প্রদর্শনীতে আড়াইশ’ ইরানি ও অন্যান্য দেশের কোম্পানির নিপুণ কারিগর ও শিল্পী অংশগ্রহণ করেন। এতে ইরানের বাইরের যেসব দেশের কোম্পানি ও প্রতিনিধিগণ অংশগ্রহণ করেন সেসব দেশের মধ্যে রয়েছে চীন, স্পেন, হংকং ও ইতালি। অংশগ্রহণকারী কোম্পানিগুলো তাদের তৈরি বিচিত্র ধরনের ও চমকপ্রদ বাতি, ঝাড়বাতি ও আলোকসজ্জার উপকরণ ও তা ব্যবহারের নমুনা দর্শকদেরকে প্রদর্শন করে।
উল্লেখ্য যে, ইরানে ঝাড়বাতি উৎপাদনের শিল্পের ইতিহাস অনেক পুরনো এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরানে এ শিল্পের ব্যাপক উন্নতি ও প্রসার ঘটেছে। এর ফলে বর্তমানে ইরান ঝাড়বাতি উৎপাদনের ক্ষেত্রে ইতালি, স্পেন ও চেক প্রজাতন্ত্রের সাথে প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম। উল্লেখ্য, ইরানে ব্যবহার্য ঝাড়বাতির শতকরা ৮০ ভাগই এখন স্থানীয়ভাবে ইরানে উৎপাদিত হয়ে থাকে।

তেহরানে ৩৫তম ফাজ্র্ আন্তর্জাতিক থিয়েটার উৎসব অনুষ্ঠিত
ইরানের ইসলামি বিপ্লবের বিজয় বার্ষিকী উৎসবের অংশ হিসেবে গত ২০ থেকে ৩১ জানুয়ারি (২০১৭) পর্যন্ত ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের রাজধানী তেহরানে ৩৫তম ফাজ্র্ আন্তর্জাতিক থিয়েটার উৎসব (এফআইটিএফ্) অনুষ্ঠিত হয়।
এবারের ফাজ্র্ আন্তর্জাতিক থিয়েটার উৎসব (এফআইটিএফ্)-এ প্রতিযোগিতা বিভাগে বিভিন্ন ইরানি মঞ্চনাট্যের পাশাপাশি বিশ্বের আরো এগারোটি দেশের ২০টি মঞ্চনাট্য প্রদর্শিত হয়। ইরানের বাইরের যেসব দেশ এ উৎসবে অংশগ্রহণ করে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ফ্রান্স, জাপান, গ্রিস, স্পেন, ইরাক, তুরস্ক, জর্জিয়া, পোল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড ও বুলগেরিয়া। প্রতিযোগিতায় ইরানের দশটি ও ঐ সব দেশের ১৯টি মঞ্চনাট্য অংশগ্রহণ করে এবং ইরান ও নেদারল্যান্ডের যৌথ উদ্যোগে উপস্থাপিত একটি মঞ্চনাট্যও প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়।
৩৫তম ফাজ্র্ আন্তর্জাতিক থিয়েটার উৎসব (এফআইটিএফ্)-এর আন্তর্জাতিক বিভাগের পরিচালক জনাব মেহ্র্দাদ রায়ানী মাখুস্ জানান যে, এ উৎসবে অংশগ্রহণের জন্য আড়াইশ’টিরও বেশি সংখ্যক আবেদন জমা পড়েছিল।
৩৫তম ফাজ্র্ আন্তর্জাতিক থিয়েটার উৎসব (এফআইটিএফ্)-এর শেষ দিনে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্য থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেরা পারফরম্যান্সের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত ফলাফল হচ্ছে :
শ্রেষ্ঠ মেক-আপ : সারাহ্ এস্কান্দারী (এ মিড্সামার নাইট্স্ ড্রিম), সেরা মিউজিক : র্ফাশাদ্ ফোযুনী (দ্য স্মল্ জয়স্ বিকামিং এ কক্রোচ্), সেরা পোশাক : শীমা র্মীহামীদী (এ মিড্সামার নাইট্স্ ড্রিম), সেরা শব্দ সংযোজন : লিসা র্ভাবেলেন (ওয়ান), সেরা স্টেজ ডিজাইন : আমীর হোসাইন দাভানী (দ্য ট্রাম্পেট্ অব্ ইসরাফীল), সেরা অভিনেতা : র্পসা পিরূর্য্ফা (ম্যাট্রিয়োশ্কা), সেরা অভিনেত্রী : ফাতেমাহ্ নাক্বাভী (‘দ্য ট্রাম্পেট্ অব্ ইসরাফীল্’ ও ‘ডায়াবোলিক্ রোমিও অ্যান্ড্ জুলিয়েট্), সেরা নাট্য রচয়িতা : হোসাইন্ পাক্দেল্ (হিজ্ এক্সেলেন্সীজ্ নাইট্মেয়ার) ও সেরা পরিচালক : জেরি যোন্ (কোরাস্ অব্ র্অফ্যান্স্)। এছাড়া বিশেষ পুরস্কার ক্যাটেগরিতে সিয়ামাক্ আহ্সাএই ও হামীদ র্পুআযারী-কে (দ্য ক্লাউডি হাউজ্) পুরস্কৃত করা হয়।
বিজয়ী নাটকগুলোর মধ্যে ‘ওয়ান’ (নেদারল্যান্ড) ও ‘কোরাস অব্ র্অফ্যান্স্’ বাদে বাকি সবগুলোই ইরানি। উল্লেখ্য, বিদেশি নাটকগুলোর বেশির ভাগই ছিল মূকাভিনয়।

ঢাকার আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে তিন বিভাগে শ্রেষ্ঠ হলো ইরান
ঢাকায় রেইনবো ফিল্ম সোসাইটি আয়োজিত ১৫তম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা ছায়াছবি, সেরা অভিনয় ও শ্রেষ্ঠ পরিচালনা বিভাগে পুরস্কার পেয়েছে ইরান।
ইরানের বার্তা সংস্থা ইসনা জানিয়েছে, ঢাকা চলচ্চিত্র উৎসবের সমাপনী অনুষ্ঠানে রেজা মির কারিমির পরিচালনায় নির্মিত ‘দোখতার’ বা ‘কন্যা’ শীর্ষক ছায়াছবি শ্রেষ্ঠ ছায়াছবি হওয়ার গৌরব অর্জন করে। একই ছায়াছবিতে অভিনয়কারী ফরহাদ আসলানি পেয়েছেন সেরা অভিনয়ের পুরস্কার।
অন্যদিকে ‘ম্যালেরিয়া’ শীর্ষক ছায়াছবি পরিচালনার জন্য সেরা পরিচালক হওয়ার গৌরব অর্জন করেন ইরানের পারভিজ শাহবাজি।
ঢাকার আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব গত ১২ জানুয়ারি ২০১৭ শুরু হয়ে ২০ জানুয়ারি শেষ হয়।
ইরানি চলচ্চিত্রের জেআইএফএফ পুরস্কার লাভ
ইরানি চলচ্চিত্র পরিচালক মেহেরদাদ্ হাসানী পরিচালিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘কেচ্’ ৯ম জয়পুর ইন্টারন্যাশন্যাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল (জেআইএফএফ)-এ অংশগ্রহণ করে ‘শ্রেষ্ঠ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র’ পুরস্কার লাভ করেছে। ভারতের জয়পুর নগরীর গোল্চা সিনেমা হলে গত ৪ থেকে ১১ জানুয়ারি (২০১৭) এ উৎসব অনুষ্ঠত হয়।
রাফসানজান ইয়ং সিনেমা অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক নির্মিত ‘কেচ্’ (বালিকা) চলচ্চিত্রের গল্পে একজন নার্সের কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে যিনি যুদ্ধ এলাকায় একটি শিশুর জীবন রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ হারান।
এ চলচ্চিত্রটিতে যুদ্ধের নির্মমতার বিপরীতে মানুষের অন্তরে মানবতার মূল্যবোধ জাগ্রত করার চেষ্টা করা হয়েছে এবং তুলে ধরা হয়েছে যে, এখনো সমাজে এমন মানুষ আছে যারা অন্যদের জন্য নিজেদের জীবনকে ঝুঁকির কবলে নিক্ষেপ করতে ও প্রাণ হারাতে পারে।
উল্লেখ্য, জয়পুর ইন্টারন্যাশন্যাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল (জেআইএফএফ) প্রথম বারের মতো ২০০৯ সালে শুরু হয় এবং এর পর থেকে প্রতি বছর এ চলচ্চিত্র উৎসবটির ক্ষেত্র দিন দিন প্রসারিত হচ্ছে।

ইরানি শিশুদের আন্তর্জাতিক অ্যাবাকাস্ ও মানসাঙ্ক পুরস্কার লাভ
দক্ষিণ ইরানের শীরায নগরীর দুই ভাই সাঈদ এস্কান্দারী ও সোহেল এস্কান্দারী সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাত্ (ইউইএ)-তে অনুষ্ঠিত ২১তম অন্তর্জাতিক অ্যাবাকাস্ ও মানসাঙ্ক প্রতিযোগিতা (ইউসিএমএএস) ২০১৬-তে অংশগ্রহণ করে প্রথম ও তৃতীয় পুরস্কার লাভ করেছে।
ছয় থেকে তেরো বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে এ প্রতিযোগিতায় অনুষ্ঠিত হয়। এ বছরের প্রতিযোগিতায় বিশ্বের ৫৭টি দেশের আড়াই হাজারেরও বেশি সংখ্যক শিশু অংশগ্রহণ করে।
সাঈদ ও সোহেল মাত্র ৮ মিনিট সময়ের মধ্যে ২০০ প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে সক্ষম হয়। এসব প্রশ্নের মধ্যে ছিল তিন ডিজিটের যোগ-বিয়োগ, তিন ডিজিটের গুণ ও চার ডিজিটের ভাগ অঙ্ক।
উল্লেখ্য, ইউসিএমএএস হচ্ছে ৬ থেকে ১৩ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের মানসাঙ্ক নিপুণতা বিকাশের লক্ষ্যে পরিকল্পিত সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা। ইউসিএমএএস এ পর্যন্ত এ বিষয়ে বিশ্বে দশ লক্ষাধিক শিশুকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
স্মরণ করা যেতে পারে যে, ভারতের নয়া দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ইউসিএমএএস-এর ইতিপূর্বেকার প্রতিযোগিতায় ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর আরদেবিল্-এর দশ বছর বয়সী শিশু মেশকাত্ মোহাম্মাদ বাক্বেরী দ্বিতীয় পুরস্কার জয় করেছিল।

ইরানি কুস্তিগীরদের তাখ্তী কুস্তি কাপ বিজয়
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের গ্রেকো-রোমান ও ফ্রি-স্টাইল্ কুস্তি টীম ৩৭তম তাখ্তী কুস্তি কাপ প্রতিযোগিতায় শিরোপা অর্জন করেছে। গত ১৯ ও ২০ জানুয়ারি (২০১৭) উত্তর-পূর্ব ইরানের মাশহাদ নগরীতে এ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়।
এ প্রতিযোগিতায় ইরানের গ্রেকো-রোমান টীম-‘এ’ জর্জিয়ান টীমকে ৭-১ ব্যবধানে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়নশীপ অর্জন করে। অন্যদিকে ইরানি টীম গ্রেকো-রোমান ‘বি’ তুরস্কের টীমকে ৫-৩ ব্যবধানে পরাজিত করে তৃতীয় স্থান দখল করতে সক্ষম হয়। এছাড়া ইরানের ফ্রিস্টাইল্ কুস্তি টীম-‘এ’ প্রতিযোগিতার ফাইনাল ম্যাচে আর্মেনিয়ান টীমকে ৮-০ ব্যবধানে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়নশীপের অধিকারী হয়। তবে ইরানের ফ্রিস্টাইল্ কুস্তি টীম ‘বি’ কাজাকিস্তানের কাছে ৫-৩ ব্যবধানে পরাজিত হয়ে চতুর্থ স্থান লাভ করে।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের ক্রীড়া ও যুব বিষয়ক মন্ত্রী জনাব সুলতানীর্ফা-এর উপস্থিতিতে উত্তর-পূর্ব ইরানের রাযাভী খোরাসান প্রদেশের কেন্দ্রীয় শহর মাশহাদে অনুষ্ঠিত এ প্রতিযোগিতায় ইরানি কুস্তি টীমগুলোর পাশাপাশি আর্মেনিয়া, বেলারুস, ইউক্রেন, কিরগিজিস্তান, উযবেকিস্তান, মঙ্গোলিয়া, জর্জিয়া ও লাতিন আমেরিকার নির্বাচিত টীমসমূহ এবং কাজাকিস্তানের দু’টি টীম অংশগ্রহণ করে।
এ প্রতিযোগিতায় ইরানের পাঁচটি টীম অংশগ্রহণ করে; এগুলো হচ্ছে : ইরান-এ, ইরান-বি, কোসিহ্, জাভানান্ ও রাযাভী খোরাসান্ টীম।
উল্লেখ্য, তাখতী কুস্তি কাপ প্রতিযোগিতা ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্ষিক কুস্তি প্রতিযোগিতা হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে ইরানের খ্যাতনামা কুস্তিগীর মরহূম্ গোলামরেযা তাখতী-র স্মৃতি স্মরণে যার নামকরণ করা হয়েছে।

রিও ২০১৬ প্রতিযোগিতায় ইরানি মহিলা তীরন্দাযের দ্বিতীয় স্থান অধিকার
রিও ২০১৬ প্যারালিম্পিক্ গেম্স্ প্রতিযোগিতায় বৈশ্বিক তীরন্দাযীর ফাইনাল পর্বে ইরানি মহিলা তীরন্দায যাহ্রা নে‘মাতী বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা তীরন্দায হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছেন।
অলিম্পিক তীরন্দাযী ক্রীড়ার আন্তর্জাতিক ফেযারেশন ‘ওয়ার্ল্ড্ আর্চারী’ রিও ২০১৬ প্যারালিম্পিক্ গেম্স্ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী তীরন্দাযদের ক্রীড়া নৈপুণ্য পর্যালোচনা করে যাহ্রা নেমাতীকে বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা তীরন্দায হিসেবে ঘোষণা করে। এতে প্রথম স্থান লাভ করে গ্রেট্ ব্রিটেন্ প্যারা আর্চারি টীম; এ টীমটি তিনটি স্বর্ণ পদক, দু’টি রৌপ্যপদক ও একটি ব্রোঞ্জপদক লাভ করে।
যাহ্রা নে‘মাতী ইতিপূর্বে ২০১২ সালে লন্ডনে যে টাইটেলের অধিকারী হয়েছিলেন রিও ২০১৬ প্যারালিম্পিক্ গেম্স্ প্রতিযোগিতায় অসাধারণ সাফল্য প্রদর্শন করে তা ফিরিয়ে পান; রিও-র অলিম্পিক্স্ প্রতিযোগিতায় তিনি ওয়ার্ল্ড্ আর্চারি প্যারা চ্যাম্পিয়ন উ চুনিয়ান্কে ৬-৪ ব্যবধানে পরাজিত করে এ সাফল্যের অধিকারী হন।
যাহ্রা নে‘মাতী তাঁর এ ব্যক্তিগত সাফল্য ছাড়াও ইবরাহীম্ রার্ন্জ্বাকিভাজ্-এর সাথে মিশ্র টীমেও অংশগ্রহণ করেন এবং এতে একটি রৌপ্যপদক লাভ করেন। এর ফলে এ প্রতিযোগিতায় ইরানের তীরন্দাযী পদকের সংখ্যা দাঁড়ায় চারটিতে।
উল্লেখ্য, রিও প্রতিযোগিতায় যাহ্রা নে‘মাতী বিরাট জনপ্রিয়তার অধিকারী হন এবং প্রতিযোগিতা চলাকালে দর্শকগণ তাঁর নামে মুহুর্মুহু সেøাগান প্রদান করেন। এছাড়া ২০১৬ সালের জন্য শ্রেষ্ঠ অল্-রাউন্ড্ আর্র্চাদের যে তালিকা প্রণয়ন করা হয় তাতে যাহ্রা নে‘মাতীর নাম ‘সম্মানজনক উল্লেখ’ (ঐড়হড়ৎধনষব গবহঃরড়হং)-এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
উল্লেখ্য, এর আগে ২০১২ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত অলিম্পিক্স্-এ যাহ্রা নে‘মাতী স্বর্ণ জয় করে প্রথম ইরানি কৃতি মহিলা তীরন্দায হিসেবে রেকর্ড গড়েন এবং এরপর রিও-তে অনুষ্ঠিত প্যারালিম্পিক্স্ ২০১৬-তে পুনরায় আরেকটি ব্যক্তিগত স্বর্ণ জয় করে স্বীয় দেশের মুখ উজ্জ্বল করলেন।

আন্তর্জাতিক বেহ্কাপ প্রতিযোগিতায় ইরানের শিরোপা অর্জন
সম্প্রতি ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর ধর্মীয় নগরী মাশহাদে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বেহ্কাপ প্রতিযোগিতা ২০১৭-তে ন্যাশনাল ইরানীয়ান্ বেহ্কাপ টীম ব্যক্তিগত ও টীম্ সেকশনে উভয় ক্ষেত্রেই শিরোপা অর্জন করেছে।
‘পীস্ অ্যান্ড্ ফ্রেন্ড্শিপ্ কাপ্’ শিরোনামে মাশহাদের পায়ামে নূর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ আন্তর্জাতিক বেহ্কাপ প্রতিযোগিতা ২০১৭-তে স্বাগতিক দেশ ইরানের ন্যাশনাল ইরানিয়ান্ বেহ্কাপ টীম ছাড়াও দশটি বিদেশি টীম অংশগ্রহণ করে। এতে অংশগ্রহণকারী বিদেশি টীমগুলো এসেছিল জর্জিয়া, আফগানিস্তান, ভারত, পাকিস্তান, আযারবাইজান প্রজাতন্ত্র, তুর্কমেনিস্তান, ইরাক, উযবেকিস্তান, সিরিয়া ও তাজিকিস্তান থেকে।
এ প্রতিযোগিতায় সার্বিক ফলাফলে ইরান প্রথম স্থান অধিকার করে এবং সিরিয়া দ্বিতীয় স্থান লাভ করে। এছাড়া ইরানি টীম ‘বি’ ও ইরাক যৌথভাবে তৃতীয় স্থানের অধিকারী হয়।
এ প্রতিযোগিতায় ব্যক্তিগত প্রতিযোগিতা বিভাগে ইরানের হোসাইন্ লাতীফী ট্রফি জয় করেন এবং ভারতের আলী মোহাম্মাদ মীর্যা রৌপ্যপদক জয় করে দ্বিতীয় স্থানের অধিকারী হন। অন্যদিকে লাতীফীর দুই সহযোগী দাউদ নিক্বাখ্ত্ ও মাস্‘উদ্ আসাদীয়ান্ যৌথভাবে ব্রোঞ্জপদক লাভ করেন।
প্রতিযোগিতার অবকাশে মাশহাদ পায়ামে নূর বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর মোহাম্মাদ আলী দর্ভাইর্য়া বলেন, আন্তর্জাতিক বেহ্কাপ প্রতিযোগিতা হচ্ছে চলতি ২০১৭ সালে মাশহাদে অনুষ্ঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক ইভেন্ট এবং এ কারণে তা বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী।
উল্লেখ্য, স্বনামখ্যাত ইরানী ক্রীড়াবিদ বেহ্নাম আযাদ অনেকগুলো ক্রীড়ার সমন্বয়ে ‘বেহ্কাপ্’ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পরিকল্পনা করেন এবং ২০১১ সালে তা নিবন্ধিত করেন। অত্যন্ত চমৎকার বিনোদনমূলক এ ক্রীড়া প্রতিযোগিতাটি এমনভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছে যে, এতে নারী-পুরুষ ও শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে সকলের পক্ষেই অংশগ্রহণ করা সম্ভব।
বেহ্কাপ্ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীদের ও রেফারিদের জন্য সুনির্দিষ্ট বিশেষ বিশেষ নিয়মাবলি রয়েছে এবং এ ক্রীড়ার জন্য বিশেষ ধরনের উপকরণাদিও রাখা হয়েছে। বেহ্কাপের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা সিন্থেটিক ঘাসের চত্বরে, প্রাকৃতিক ছোট ঘাসের চত্বরে, বিশেষ ক্রীড়া মেঝেতে, প্রস্তর ভূমিতে, সমুদ্র উপকূলে ও সমতল ভূমিতে তথা যে কোনো ধরনের স্থানে আয়োজনের উপযোগী।
বেহ্কাপ্ ক্রীড়া অনেকটা গল্ফ্ খেলার অনুরূপ, তবে গল্ফ্ খেলায় যেখানে ‘হোল্’-এর মধ্যে বল প্রবেশ করাতে হয় সেখানে বেহ্কাপে ‘গোলপোস্ট’-এর মধ্যে বল প্রবেশ করাতে হয়। এর অন্যান্য নিয়মের মধ্যে রয়েছে : খেলার সময় বলটি অবশ্যই ক্রীড়া-কোর্টের মধ্যে থাকতে হবে, এর বাইরে যেতে পারবে না, বলটি অন্যান্য বলকে স্পর্শ করতে পারবে না, ইত্যাদি। এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে যিনি সর্বোচ্চ সংখ্যক গোল করতে পারবেন তাঁকে বিজয়ী বলে গণ্য করা হবে।

মাশহাদ ইসলামি জাহানের সাংস্কৃতিক রাজধানীর মর্যাদা পেল

অতি সম্প্রতি ইসলামি জাহানে একটি বিরাট সাংস্কৃতিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে; তা হচ্ছে, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর মাশ্হাদকে ইসলামি সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি)-র অঙ্গ সংগঠন ইসলামিক এডুকেশন্যাল, সায়েন্টিফিক্ অ্যান্ড্ কাল্চারাল অর্গানাইযেশন (আইসেস্কো)-র পক্ষ থেকে চলতি ২০১৭ সালের জন্য ইসলামি জাহানের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, মাশ্হাদ হচ্ছে ইরানের অন্যতম ধর্মীয় নগরী- যেখানে হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর পবিত্র আহ্লে বাইতের ধারাবাহিকতার অষ্টম মাসুম ইমাম হযরত আলী ইবনে মূসা র্আ-রেযা (আ.)-এর মাযার মুবারক অবস্থিত- যা বিশ্বের কোটি কোটি দ্বীনদার মুসলমানের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং এ কারণে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ যিয়ারতকারী ও পর্যটক এ শহরে আগমন করছেন।
উল্লেখ্য, ইসলামি সম্মেলন সংস্থা ইসলামি জাহানের সাংস্কৃতিক রাজধানী নির্বাচনের দায়িত্ব স্বীয় অঙ্গ সংগঠন আইসেস্কো-র ওপর অর্পণ করেছে এবং সংগঠনটি মাশ্হাদকে এ বিরল মর্যাদার জন্য উপযুক্ত বিবেচনা করেছে ও এ মর্যাদা প্রদান করেছে। স্মর্তব্য, বিশ্বের মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৭৯ সালে ওআইসি গঠন করা হয় এবং এর সদর দফতর মরোক্কোর রাজধানী রাবাতে অবস্থিত।
ওআইসি কর্তৃক আইসেস্কো গঠনের পেছনে নিহিত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হচ্ছে মুসলিম দেশ সমূহে শিক্ষার বিস্তার সাধন, বিশেষ করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার প্রসার ঘটানো, মুসলিম পণ্ডিত ও মনীষীদের মধ্যে সহযোগিতা সৃষ্টি, পশ্চিমা বিশ্বের ও অন্যান্য অমুসলিম প্রধান দেশের সংখ্যালঘু মুসলমানদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান এবং সর্বোপরি সারা বিশ্বের মুসলমানদের মধ্যে সহযোগিতা সৃষ্টি, বিশেষ করে শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক বিনিময় গড়ে তোলা।
আইসেস্কো তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিশ্বের দেড়শ’ কোটিরও বেশি মুসলমানকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে স্বীয় কর্মতৎপরতার জন্য যেসব ক্ষেত্রকে বেছে নিয়েছে তার অন্যতম হচ্ছে বিশ্বায়নের লাগামহীন সাংস্কৃতিক প্লাবন কর্তৃক চাপিয়ে দেয়া সাংস্কৃতিক মানদ-ের মোকাবিলায় ইসলামি জাহানের জন্য একটি সাংস্কৃতিক কর্মকৌশল উদ্ভাবন ও তার বাস্তবায়ন। এ লক্ষ্যেই আইসেস্কো ইসলামি জাহানের সাংস্কৃতিক রাজধানী নির্বাচনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে- যা নির্ধারণের জন্য বিভিন্ন দিক থেকে ইসলামি উম্মাহ্র উত্তরাধিকারের বিষয়টি দৃষ্টিতে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ দৃষ্টিকোণ থেকে ২০০১ সালে দোহা-য় অনুষ্ঠিত ওআইসি সম্মেলনে ওআইসি-র সদস্য দেশসমূহের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রীদের বৈঠকে প্রথম বারের মতো ইসলামি জাহানের সাংস্কৃতিক রাজধানী নির্বাচনের বিষয়টি কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং এর ভিত্তিতে পবিত্র মক্কা নগরীকে ২০০৫ সালের জন্য ইসলামি জাহানের প্রথম সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ বৈঠকে পরবর্তী বছর সমূহের জন্য ইসলামি জাহানের সাংস্কৃতিক রাজধানী নির্বাচনের দায়িত্ব স্বয়ং আইসেস্কো-র ওপর অর্পণ করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় আইসেস্কো মাশ্হাদকে ২০১৭ সালের জন্য ইসলামি জাহানের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে নির্বাচন করেছে।
আইসেস্কো কর্তৃক মাশ্হাদকে ইসলামি জাহানের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে নির্বাচনের কারণ হচ্ছে এই যে, মাশ্হাদের কতগুলো ব্যতিক্রমী সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
বহু শতাব্দী যাবত মাশ্হাদ বহু বিখ্যাত দ্বীনী, সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের লালনভূমি হিসেবে ভূািমকা পালন করে এসেছে। এসব ব্যক্তিত্বের মধ্যে রয়েছেন মহাকবি ফেরদৌসী, ইসলামি মনীষী শেখ বাহাই ও শেখ তূসী এবং নিযামুল্ মুল্ক্-এর মতো বিরাট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। এছাড়া মাশ্হাদ তার গোটা ইতিহাস জুড়েই বিভিন্ন মতাদর্শের আন্তক্রিয়া এবং বিভিন্ন স্থানীয় নৃতাত্ত্বিক ও মাযহাবী গোত্র এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর সংযোগ স্থল হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে।
গত ২৪ জানুয়ারি (২০১৭) ইসলামি জাহানের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে মাশ্হাদের উদ্বোধন করা হয়। এটি ছিল এক অনবদ্য সাংস্কৃতিক কর্মসূচি। কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে সূচিত এ কর্মসূচির মধ্যে ছিল বিশেষ সংক্ষিপ্ত যিয়ারত তথা হযরত ইমাম রেযা (আ.)-এর মাযার এলাকার জাদুঘরের একটি হলে সমবেত হয়ে তাঁর উদ্দেশে সম্মিলিত কণ্ঠে দরূদ পাঠ।
এ অনুষ্ঠানে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সরকারের সংস্কৃতি ও ইসলামি নির্দেশনাবিষয়ক মন্ত্রী জনাব সালেহী আমীরী, আইসেস্কো-র উপমহাপরিচালিকা ড. আমিনাহ্ আল্-হাজ্রী, ইরানের খোরাসানে রাযাভী প্রদেশের প্রাদেশিক কর্মকর্তাগণ ও এ প্রদেশের কেন্দ্র মাশ্হাদের শহর প্রশাসনের কর্মকর্তাগণ ছাড়াও বিশ্বের ৫১টি মুসলিম প্রধান দেশের আড়াই শতাধিক গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব অংশগ্রহণ করেন। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী বিদেশি মেহমানদের মধ্যে ছিলেন ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে অবস্থিত মুসলিমপ্রধান দেশসমূহের রাষ্ট্রদূতগণ ও সাংস্কৃতিক কর্মকর্তাগণ, বিভিন্ন দেশ থেকে আগত ইসলামি মনীষী ও চিন্তাবিদগণ এবং বহু ইরানি দ্বীনী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।
এ অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ প্রদান করেন ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের খোরাসানে রাযাভী প্রদেশের গভর্নর জনাব আলীরেযা রাশীদীয়ান। তিনি তাঁর ভাষণে বলেন, মাশ্হাদে রয়েছে বড় বড় দ্বীনী শিক্ষাকেন্দ্র, বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা কেন্দ্র এবং এ দিক থেকে আরো বেশি সমৃদ্ধ হবার সুযোগ ও সম্ভাবনাও মাশ্হাদের রয়েছে। এর ফলে ইসলামি জাহানের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে মাশ্হাদের পক্ষে একটি মৌলিক ভূমিকা পালন করা সম্ভব। তাই আজকের দিনে মাশ্হাদ তার সুউচ্চ মিনারসমূহ থেকে সমগ্র বিশ্ববাসীর উদ্দেশে ঐক্য, সংহতি, শান্তি, আন্তরিকতা ও ভ্রাতৃত্বের বাণী পৌঁছে দিতে সক্ষম।
এ অনুষ্ঠানে আইসেস্কোর উপমহাপরিচালিকা ড. আমিনাহ্ আল্-হাজ্রী তাঁর ভাষণে মাশ্হাদের প্রতি ইসলামি জাহানের সাগ্রহ দৃষ্টির কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, মাশ্হাদ সব সময়ই মানবিক সংস্কৃতির অগ্রগতির লক্ষ্যে অনন্য প্রভাবের অধিকারী ছিল এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আর মাশ্হাদের এ ভূমিকা তার মর্যাদাকে আরো বেশি বৃদ্ধি করেছে।
উল্লেখ্য, ড. আমিনাহ্ আল্-হাজ্রী প্রতি বছর একবার মাশ্হাদ সফর করে থাকেন এবং এখানে কীভাবে নিয়মিত যিয়ারতকারী ও পর্যটকদের আগমন ঘটে থাকে তা তিনি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, বছরে দুই কোটিরও বেশি যিয়ারতকারী ও পর্যটক মাশ্হাদ সফর করে থাকেন। তিনি বলেন, মাশহাদের প্রতি মুসলমানদের এ আকর্ষণের কারণ হচ্ছে এই যে, এখানে হযরত ইমাম রেযা (আ.)-এর মাযারের উপস্থিতির ফলে এখানকার পরিবেশ হচ্ছে একটি আধ্যাত্মিক পরিবেশ।
ড. আমিনাহ্ আল্-হাজ্রী আরো বলেন যে, ইসলামি সরকারসমূহের শাসনামলে এ শহরটি যে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে এবং এখানে যেভাবে ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগত সংখ্যালঘুরা পরস্পরের পাশাপাশি শান্তি ও সৌহার্দ্রপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করছে তা এ দেশের শক্তির সংরক্ষণে এবং সংস্কৃতির অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ফলে মাশহাদের পক্ষে সাংস্কৃতিক পরিমার্জন ও উদ্ভাবনীর শীর্ষচূড়ায় উপনীত হওয়া সম্ভব।
আইসেস্কো-র উপমহাপরিচালিকা তাঁর ভাষণে আইসেস্কো কর্তৃক কোনো শহরকে ইসলামি জাহানের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে নির্বাচনের ক্ষেত্রে অনুসৃত শর্তাবলির কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, এ শর্তাবলি হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট শহরের ঐতিহাসিকতা ও সাংস্কৃতিক গ্রহণযোগ্যতার অকাট্য দলিল থাকতে হবে, মানবিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির অগ্রগতিতে সহায়তায় তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকতে হবে, তার গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক নিদর্শনাদি থাকতে হবে, বিভিন্ন সক্রিয় সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান থাকতে হবে এবং এ ধরনের আরো কতগুলো শর্ত রয়েছে। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে ইসেস্কা-র মানদ- বেশ কঠিন এবং আইসেস্কো তার নির্বাচনের ক্ষেত্রে এ মানদ- কঠোরভাবে অনুসরণ করে থাকে, আর মাশ্হাদ্ এ মানদ-ের বিচারে ইসলামি জাহানের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে নির্বাচিত হবার জন্য উপযুক্ত বিবেচিত হয়েছে।
এ অনুষ্ঠানে ইরান সরকারের সংস্কৃতি ও ইসলামি নির্দেশনাবিষয়ক মন্ত্রী জনাব সালেহী আমীরী তাঁর ভাষণে বলেন যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বের সকল ইসলামি সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য ও নৈতিকতার ধ্বনি উচ্চকিত করা অপরিহার্য। তিনি বলেন, রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.) নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে তাঁর মিশনের মূল লক্ষ্য হিসেবে গণ্য করতেন এবং আইসেস্কো কর্তৃক নির্ধারিত ইসলামি জাহানের সাংস্কৃতিক রাজধানী নির্বাচনের শর্তাবলি এর ওপর ভিত্তিশীল।
জনাব সালেহী আমীরী সকল মুসলমানের মূলনীতিমালার অভিন্নতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশ্বের মুসলমানরা একটি মাত্র শত্রুর সাথে মোকাবিলা করছেÑ যে শত্রু ইসলামের একটি সহিংস চিত্র তুলে ধরছে। এ পরিস্থিতিতে ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রুরা চরম পন্থার আশ্রয় নিচ্ছে এবং যায়নবাদীরা ইসলামি জাহানে অনৈক্য ও বিভেদের বীজ বপনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।
ইরান সরকারের ইসলামি নির্দেশনাবিষয়ক মন্ত্রী তাঁর ভাষণে উল্লেখ করেন যে, ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ পালনের কর্মসূচি প্রবর্তন করেন এবং এভাবে তিনি মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি গড়ে তোলার জন্য পতাকাবাহীর ভূমিকা পালন করেন।
জনাব সালেহী আমীরী আরো বলেন, বর্তমানে ইসলামি জাহান দুইটি রণাঙ্গন থেকে হামলার সম্মুখীন; এ কঠিন পরিস্থিতিতে টিকে থাকার লক্ষ্যে ইসলামি উম্মাহ্র জন্য ঐক্য ও পারস্পরিক সহমর্মিতা অপরিহার্য। তিনি বলেন, ইসলামি বিপ্লবের নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী সব সময়ই ঐক্যের ওপরে গুরুত্ব আরোপ করে আসছেন এবং তিনি ঐক্যকে ইসলামি জাহানের সমস্যাবলির একমাত্র সমাধান হিসেবে অভিহিত করে আসছেন।
জনাব সালেহী আমীরী বলেন, বর্তমানে ইসলামি জাহানে অতীতের অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে অনৈক্য, বিভেদ ও সহিংসতার শিকার; আমরা আমাদের আচরণে হযরত ইমাম রেযা (আ.)-এর শিক্ষা অনুসরণ করলে পুনরায় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে ও টিকে থাকতে সক্ষম হব। তিনি আরো বলেন, হযরত ইমাম রেযা (আ.)-এর সংস্কৃতি হচ্ছে সংলাপ ও সহমর্মিতার সংস্কৃতি এবং খোরাসানে রাযাভী প্রদেশের কেন্দ্র মাশ্হাদ হচ্ছে সভ্যতা ও উন্নত যোগাযোগের সংযোগস্থল, নতুন কথা বলার জন্য উপযুক্ত কেন্দ্র এবং অতীতকাল থেকে শুরু করে বর্তমান কালেও এ শহর ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে আন্তঃক্রিয়ার ময়দান।
‘অস্তনে ক্বুদ্সে রাযাভী’ নামে সুপরিচিত হযরত ইমাম রেযা (আ.)-এর মাযার কমপ্লেক্সের মুতাওয়াল্লী হুজ্জাতুল ইসলাম সাইয়েদ ইবরাহীম রাইসী এ অনুষ্ঠানে বলেন, ইসলামি জাহানের ঐক্য, সংহতি ও আত্মপরিচিতির মূল রহস্য হযরত ইমাম রেযা (আ.)-এর শিক্ষায় নিহিত রয়েছে। তিনি বলেন, মাশ্হাদ ইসলামি জাহানের সাংস্কৃতিক রাজধানীÑ এর মানে হচ্ছে এই যে, হযরত ইমাম রেযা (আ.)-এর শিক্ষা ও আচরণের বরকতে আজকে আমরা সারা বিশ্বের মুসলমানদের কাছে ইসলামি সভ্যতাকে পরিচিত করার জন্য তুলে ধরতে পারব।
অনুষ্ঠানের ধারাবাহিকতায় আইসেস্কো-র উপমহাপরিচালিকা ড. আমিনাহ্ আল্-হাজ্রী ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সরকারের সংস্কৃতি ও ইসলামি নির্দেশনাবিষয়ক মন্ত্রী জনাব সালেহী আমীরীর কাছে আইসিস্কো-র একটি ফলক হস্তান্তর করেন। এছাড়া এ উপলক্ষে বহু মহামূল্য সাংস্কৃতিক নিদর্শনের আবরণ উন্মোচন করা হয়। এসবের মধ্যে ছিল স্বনামখ্যাত ক্যালিগ্রাফি শিল্পী মরহুম নাযীরী কর্তৃক স্বহস্তে লিখিত কোরআন মজীদের একটি কপি, চিত্রশিল্পী ওস্তাদ র্ফাশ্চিয়ানের অঙ্কিত কয়েকটি মূল্যবান চিত্র, সা‘ঈদ্ র্আযাকান কর্তৃক অঙ্কিত চিত্র, শাম্স্ আল্-শোমাস্ ক্যালিগ্রাফি চিত্র, ক্লিপ আর্ট, ইসলামি জাহানের সাংস্কৃতিক রাজধানীর বিশেষ জাতীয় সংগীত, মুসলিমপ্রধান দেশ সমূহের পরিচয় সম্বলিত গ্রন্থ ও ক্যালিগ্রাফি স্ক্রোল।
অনুষ্ঠানে মাশ্হাদ শহরের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয় যাতে এ শহরের অতীতের বহু শতাব্দীর বিভিন্ন চিত্র দেখানো হয়Ñ যা এর আগে কখনো দেখানো হয় নি। এছাড়া এ অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে “গধংযযধফ, ঈঁষঃঁৎধষ ঈধঢ়রঃধষ ড়ভ ঃযব ওংষধসরপ ডড়ৎষফ ভড়ৎ ২০১৭” লিখিত একটি স্মারক ডাকটিকেট প্রকাশ করা হয়। এ ছাড়া মাশ্হাদ শহরে পুরো ২০১৭ সালে অনুষ্ঠেয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানÑ যেগুলোর মোট সময়ের পরিমাণ হবে ২৩৮ মিনিটÑ সেগুলোর পরিকল্পনা পত্রের আবরণও উন্মোচন করা হয়। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী অতিথিদেরকে মাশহাদের পবিত্র স্থান সমূহ, জাদুঘর, কোরআন মজীদের ওয়ার্কশপ ও অস্তনে ক্বুদ্সে রাযাভীর লাইব্রেরি পরিদর্শন করানো হয়।
এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ্য যে, যে কোনো ইসলামি শহরকে ইসলামি জাহানের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে নামকরণ করার ক্ষেত্রে ঐসব শহরের যে অভিন্ন বৈশিষ্ট্যকে বিবেচনায় নেয়া হয় তা হচ্ছে, পর্যটন শিল্পের সহায়তায় সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামকে পরিচিত করা। অধিকন্তু, ইসলামের পরিচয় তুলে ধরা ও এর প্রচারের পাশাপাশি এ বিষয়টি বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করা এবং স্থানীয় অর্থনীতিকে সাহায্য করার লক্ষ্যে একটি কর্মকৌশল হিসেবেও ভূমিকা পালন করতে পারে।
এভাবে, এ ক্ষেত্রে গ্রহণীয় সর্বোত্তম পদক্ষেপ হতে পারে পর্যটনের ক্ষেত্রে ধর্মীয় পর্যটনের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপসহ মাশ্হাদের পর্যটন আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্যসমূহের প্রতি দৃষ্টি প্রদান করা।
মাশ্হাদে হযরত ইমাম রেযা (আ.)-এর মাযার অবস্থিত বিধায় এ শহরটি এক অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়েছে। অধিকন্তু এখানে যথাযথ পর্যটন সুবিধা সৃষ্টির লক্ষ্যে ইসলামি জাহানে মাশ্হাদের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ সৃষ্টির জন্য এখানে বিচিত্র ধরনের কর্মসূচি গ্রহণের প্রয়োজন হবে। তাছাড়া হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর পবিত্র আহ্লে বাইতের ধারাবাহিকতার নিষ্পাপ ইমাম হিসেবে হযরত ইমাম রেযা (আ.)-এর মাযারের পরিচয় তুলে ধরা হলে তা মানবজাতিকে তাঁর চিন্তাধারা, আমল ও আচরণের সাথে পরিচিত করবে।
উল্লেখ্য যে, হযরত ইমাম রেযা (আ.)-এর জীবন চরিত থেকে জানা যায় যে, তিনি মুসলমানদের মধ্যকার বিভিন্ন মায্হাব ও ফির্কাহ্র এবং আসমানি কিতাবের অধিকারী অন্যান্য ধর্মের মনীষীদের সাথে অনেক সংলাপ ও বিতর্কে অংশগ্রহণ করেন, এমনকি, ধর্মসম্পর্কহীন (সেক্যুলার)-দের ও নাস্তিকদের সাথে পর্যন্ত তাঁর সংলাপ ও বিতর্ক হয়েছে। এছাড়া তাঁর উপস্থিতিতে তাঁর শিষ্য ও অনুসারীদের সাথে ঐ সব প-িতের অনেক বিস্তারিত আলোচনা ও মত বিনিময় হয়েছে।
হযরত ইমাম রেযা (আ.)-এর জীবনের এ বিশেষ বৈশিষ্ট্যটিকে সারা বিশ্বের ইসলামি মনীষী ও চিন্তাবিদগণের নিজেদের মধ্যকার আলোচনা ও সংলাপের ক্ষেত্রে এবং আসমানি কিতাবের অধিকারী অন্যান্য ধর্মের প-িতদের সাথে চিন্তা ও মত বিনিময়ের লক্ষ্যে একটি অক্ষ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
এছাড়া মুসলিম সংখ্যাগুরু দেশসমূহ ও সেসব দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর উদ্যোগে বিভিন্ন ধরনের প্রদর্শনী অনুষ্ঠান, পর্যটন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আকর্ষণীয় বিষয়ে উৎসব অনুষ্ঠান, তাদের ঐতিহ্য, উত্তরাধিকার ও রীতিনীতি উপস্থাপন, তেমনি হস্তশিল্প ও বিভিন্ন রীতিনীতি সংশ্লিষ্ট শিল্পকলা উপস্থাপন ইত্যাদি মাশ্হাদকে বিপুল সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের কেন্দ্রভূমিতে পরিণত করতে পারে।
এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ্য যে, অনারব দেশগুলোর মধ্য থেকে মাশ্হাদকে ইসলামি জাহানের সাংস্কৃতিক রাজধানী ঘোষণার পাশাপাশি সূদানের সেন্নান্ শহর ও জর্দানের রাজধানী আম্মানকে যৌথভাবে আরব দেশ সমূহের মধ্যে এবং উগান্ডার রাজধানী কাম্পালাকে আফ্রিকা মহাদেশে ইসলামি জাহানের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
অনুবাদ : নূর হোসেন মজিদী

আয়াতুল্লাহ হাশেমি রাফসানজানি ছিলেন ইসলামি বিপ্লবের পরিচয়পত্র

অধ্যাপক মুহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন খান
হযরত আয়াতুল্লাহ আলী আকবর হাশেমি রাফসানজানি যখন গত আট জানুয়ারি (২০১৭) ৮২ বছর বয়সে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করলেন তখন বিশ্ববাসী, বিশেষ করে ইরানের সর্বশ্রেণির জনগণের কাছে সংবাদটি খুবই অপ্রত্যাশিত ও অকালমৃত্যু বলে মনে হলো। হযরত ইমাম খোমেইনী রহমাতুল্লাহি আলাইহির নেতৃত্বে সংগঠিত ইরানের ইসলামি বিপ্লব এবং ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের দ্বিতীয় এ শক্তিমান বিপ্লবী নেতা যেন বিনা সংবাদে পরলোকের অদৃশ্য জগতে পাড়ি জমালেন। তাঁর আচমকা এ তিরোধানে ইরানে তার ঘোর সমর্থক, অনুসারী, সমালোচক, বিরোধী তথা কোটি কোটি মানুষ থ হয়ে গেলেন। ৭ জানুয়ারি শনিবারও যিনি তাঁর প্রতিদিনের ডায়েরিতে তাঁর স্মৃতিকথা ও মূল্যায়ন লিখলেন পরদিন ৮ জানুয়ারি রোববার থেকে সে দায়িত্ব দিয়ে গেলেন অন্যদের ওপর। যেন বলে গেলেন, আমার লেখা শেষ, এবার তোমরা লেখ! তাইতো হাশেমির হয়ে এক ইরানি কবি গেয়ে উঠলেন :
تا هستم¬ای رفیق ندانی که کیستم
روزی سراغ وقت من آیی که نیستم
‘তা হাস্তাম এই রাফিক, না’দানী কে কিস্তাম
রুজি সুরাগে মান আয়ি কে নিস্তাম।’
অর্থাৎ ‘হে বন্ধু! যদ্দিন আছি তোমাদের মাঝে জানলে না যে আমি কে
যেদিন আমার খোঁজে আসবে তখন আর আমি নেই।’
জনাব আয়াতুল্লাহ হাশেমি রাফসানজানি (রহ.) যদিও আমাদের হিসেবে মোটামুটি পরিণত বয়েসে ইন্তেকাল করেছেন তথাপি তাঁর দেদীপ্য ব্যক্তিত্ব, জ্ঞান-প্রজ্ঞার অবিরাম প্রবাহ এবং ইসলামি ইরানের উচ্চতম ক্ষমতা বলয়ে তাঁর সক্রিয় অবস্থান, কর্মচাঞ্চল্য ও জনমনে সদা উপস্থিতিতে তাঁর এ মৃত্যু যেন এক শক্তিশালী নিরোগ যুবকের আচমকা প্রয়াণ। অবশ্য একথাও সত্য, ইসলামি ইরানের আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় নেতাদের জন্য এ বয়েসে মৃত্যুবরণ অকাল মৃত্যুই বটে। ইসলামি বিপ্লবের নেতা হযরত ইমাম খোমেনী যখন প্রায় নব্বই বছর বয়েসে ওফাত গ্রহণ করলেন তখন এই হাশেমি রাফসানজানিই বলেছিলেন, ‘ইমাম খুবই কম বয়েসে ইন্তেকাল করলেন।’ উল্লেখ্য, ইমামের বড় ভাই আয়াতুল্লাহ পাসান্দিদে তখনও জীবিত ছিলেন এবং ১১৫ বছর বয়েসে ইন্তেকাল করেন। যাক, আসল কথা আল্লাহ জাল্লা শানুহু তাঁর বান্দাদের হায়াত-মউতের মালিক। তাঁর পরিকল্পিত ইচ্ছাতেই বান্দাদের আগমন ও প্রস্থান ঘটে থাকে।
জনাব হাশেমি রাফসানজানি মধ্য ইরানের রাফসানজান শহরের নিকটবর্তী বাহ্রামান গ্রামে ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ২৫ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা হাজী মির্জা আলী হাশেমি ছিলেন একজন আলেম, কৃষক ও বাগান মালিক। তাঁর মায়ের নাম মাহ্ বিবি। বাবার পেস্তা বাগানে শৈশবকালেই আলী আকবর হাশেমি কাজ করতেন এবং সকাল-সন্ধ্যায় বাবার কাছে পড়াশুনা করতেন। নয় ভাই-বোনের মধ্যে দ্বিতীয় এ হাশেমি চৌদ্দ বছর বয়েসেই বাহরামানে প্রাথমিক শিক্ষার পাট চুকিয়ে উচ্চ শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে ইরানের প্রখ্যাত ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র কোমের উদ্দেশে রওয়ানা হন। শিশুকাল থেকেই তিনি ছিলেন বুদ্ধিদীপ্ত, যুক্তিবাদী ও প্রগতিমনা এবং ভারসাম্যপূর্ণ বিচার বিবেচনার অধিকারী। তাঁর সৌভাগ্যই বলতে হবে যে, কোমে তিনি তাঁর পরম শিক্ষাগুরু হিসেবে পেয়ে গেলেন আয়াতুল্লাহ উজমা বুরুজের্দী এবং আধ্যাত্মিক-রাজনৈতিক চিন্তা-দর্শনের শিক্ষক আয়াতুল্লাহ উজমা ইমাম খোমেইনীকে। অল্প কিছুকালের মধ্যে কোরআন শরীফ হেফ্জ্ করা ও এর প্রতিযোগিতায় বিশেষ কৃতিত্ব দেখানোর জন্য আয়াতুল্লাহ উজ্মা বুরুজের্দীর হাত থেকে তিনি বিশেষ পুরস্কার লাভ করেন।
অসামান্য প্রতিভাদীপ্ত জনাব হাশেমি রাফসানজানি কোমের প্রথাগত সব ধরনের শিক্ষার পাশাপাশি অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজবিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়াদিতেও ফিকাহের আলোকে জ্ঞানসমৃদ্ধ হয়ে ওঠেন এবং যৌবনের শুরু থেকেই হযরত ইমাম খোমেইনীর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য, চিন্তা-দর্শন ও আধ্যাত্মিকতায় সমৃদ্ধ হতে থাকেন। রাফসানজানের বিশ্বখ্যাত পেস্তা বাগানের ধনাঢ্য পরিবারের এ যুবক আলেম কোমে তাঁর অনেক সহপাঠী আলেমের পড়াশুনার খরচও নিজে বহন এবং তাদেরকে ইমাম খোমেইনীর আধ্যাত্মিক-রাজনৈতিক চিন্তা-দর্শনের দিকে আকর্ষণ করতেন। কোমের বিশ্বখ্যাত দ্বীনী শিক্ষাকেন্দ্র ফেইজিয়া মাদ্রাসায় ইমাম খোমেইনী (রহ.) ও অন্যান্য শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের মাঝে আগা হাশেমি রাফসানজানি ছিলেন অত্যন্ত পরিচিত ও আকর্ষণীয় যুব আলেমে দ্বীন। স্বৈরাচারী শাহানশাহী সরকার এবং উপনিবেশবাদী ও সা¤্রাজ্যবাদীদের শোষণ-শাসন, লুণ্ঠন এবং যাবতীয় ষড়যন্ত্রের বিষয়ে তিনি ও তাঁর সহপাঠীরা সবাই ইমাম খোমেইনীর বিপ্লবী ধ্যান-ধারণার সাথে ছিলেন একাত্ম ও সুতীক্ষ্মভাবে সচেতন। জনাব হাশেমি রাফসানজানি কোম শহরের প্রখ্যাত শিক্ষকগণের কাছে ফেকাহশাস্ত্র অধ্যয়ন ছাড়াও কিছুকাল ধর্মীয় শিক্ষার আরেক বিশ্বখ্যাত কেন্দ্র ইরাকের নাজাফে অধ্যয়ন করেন। সেখানকার একজন সেরা শিক্ষক আয়াতুল্লাহ মির্জা হাসান বুজ্নুর্দী জনাব হাশেমি সম্পর্কে বলেছিলেন : ‘কোম থেকে আগত কম দাড়িসম্পন্ন আলেমের (রাফসানজানির মুখে দাড়ি অত্যন্ত অল্প ছিল) ফেকাহ্শাস্ত্রীয় জ্ঞান-প্রজ্ঞা খুবই প্রশংসনীয়।’
আয়াতুল্লাহ হাশেমি রাফসানজানির কথা ও কলম যেমন তাঁর শিক্ষকবৃন্দ, সহপাঠিগণ ও দীনদার জনগণের কাছে সুপরিচিত ছিল তেমনি তিনি ছিলেন জালেম শাহ সরকারের গুপ্ত পুলিশ সাভাক বাহিনীর কাছে সংবেদনশীল ও আশঙ্কার বিষয়। তাঁকে মোট সাতবারে বহু বছর মেয়াদে কারাগারে আটক রাখা হয়। ছাত্রাবস্থাতেই তাঁকে অন্যান্য তালাবার সাথে বলপূর্বক বাধ্যতামূলক সামরিক সার্ভিসে নেয়া হয় যা দীনী শিক্ষার্থীদের জন্য মাফ ছিল। কিন্তু জনাব হাশেমি ইমাম খোমেইনীর অনুপ্রেরণায় সামরিক পোশাকে সেনা ছাউনির ভেতরেই মাতম-মর্সিয়াসহ বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় অনুষ্ঠান শুরু করেন যা সাধারণ সৈন্যদের মাঝে দীনী উদ্দীপনা ও আকর্ষণ সৃষ্টি করে। শাহী সরকার এতেও প্রমাদ গুণে তাঁর ওপর নির্যাতন চালায়।
ইমাম খোমেইনী যখন শাহ ও আমেরিকাবিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রাম শুরুর কারণে তেহরানে দীর্ঘ কারাবরণের পর দেশের বাইরে ইরাকে নির্বাসিত হন তখন একবার জনাব হাশেমি গোপনে নাজাফে গমন করে ইমামের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এরপর দেশে ফেরার সময় ইমাম তাঁকে সাবধান করলেন যে, শাহী সরকার তাঁকে জেলে পুড়বে। তাই ইরাকে থেকে যেতে পারেন। কিন্তু দুঃসাহসী বীরোত্তম হাশেমি বলেছিলেন, ‘গ্রেফতার করলে করুক। তবুও দেশেই যাব। ওখানে অনেক কাজ করতে হবে।’
শাহের জেলখানাতেও হাশেমি বসে থাকেননি। হাফেজে কোরআন এই হাশেমি শৈশব থেকেই ছিলেন কোরআনের আশেক। জেলে বসেই তিনি বড় বড় ষোল খ-ের তাফসিরে কোরআন ‘রাহ্নামা’ রচনা করেন যা পরবর্তীকালে ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের পর প্রকাশিত হয়। এছাড়াও বন্দি অবস্থায় তাঁর আরেক অনন্য কীর্তি হচ্ছে ৩৩ খ-ের ‘কোরআন বুঝার চাবিকাঠি ও অভিধান’ রচনা করা। জেলখানায় তাঁর বুকে ভারী বোঝা চাপিয়ে শ্বাসরুদ্ধকর নির্যাতন চালিয়ে বলা হতো, ‘খোমেইনীর পক্ষে প্রচার চালাও! তবে এর স্বাদ গ্রহণ কর।’ চরম মাত্রার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর হাশেমি জবাব দিতেন, ‘এ কার্যক্রম চালিয়ে যাব!’ জেলখানায় তাঁর স্ত্রী দেখা করতে গেলে তিনি গোপনে তাঁর কোরআনবিষয়ক পা-ুলিপিগুলো বাইরে চালান করে দিতেন।
জনাব হাশেমি রাফসানজানি ইরানের কাজার বংশীয় শাহের সময়কার দেশপ্রেমিক ও উপনিবেশবাদবিরোধী প্রধানমন্ত্রী আমীর কবির এর অবদান এবং সংগ্রামী ফিলিস্তিনসহ বহু বিষয়ে অনেক গ্রন্থ রচনা করেন যা অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করে। তাঁর ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত তাঁর রচিত তেহরানের জুমআ নামাযের কয়েক হাজার খুতবা সম্বলিত গ্রন্থ, স্মৃতিকথা এবং নানা বিষয়ক কয়েক ডজন অমূল্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তেহরানে হাশেমির খুতবা প্রদান কালে মুহুর্মুহু ধ্বনি উঠতÑ ‘হাশেমি হাশেমিÑ তু রুহে এশ্তেমায়ি।’ অর্থাৎ হে হাশেমি, তুমি আমাদের সমাজের আত্মা।
ইসলামি বিপ্লবের বিজয় অর্জনে তাঁর ভূমিকা ছিল প্রথম সারির কয়েকজন মনীষীর মতোই অনন্য। বিপ্লবের নেতার অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও শক্তিশালী বাহুস্বরূপ আয়াতুল্লাহ আলী আকবর হাশেমি রাফসানজানি ছিলেন প্যারিসে অবস্থানকালে ইমাম যে পাঁচজন সদস্যকে নিয়ে গোপন ‘ইসলামি বিপ্লবী পরিষদ’ গঠন করেন তাঁদের অন্যতম। শহীদ আয়াতুল্লাহ বেহেশতী, শহীদ আয়াতুল্লাহ মুর্তাজা মুতাহ্হারী, আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী ও ড. বাহুনার ছিলেন এ পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট বিপ্লবী পরিষদের সদস্য। তাঁরা সবাই তখন ইরানে অবস্থান করে ইমামের নির্দেশ অনুসারে জনগণের নেতৃত্ব দান করেন। ইরানে ইসলামি বিপ্লব বিজয় লাভের পর দেশব্যাপী জনগণকে সঠিক পথে পরিচালনা করা এবং দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের যাবতীয় লাল-কালো শত্রুকে দমন করার জন্য পাঁচজন আহ্বায়কের নেতৃত্বে ‘ইসলামিক রিপাবলিক পাটি’ নামক সংগঠন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই পাঁচজন ছিলেন জনাব হাশেমি রাফসানজানি, আয়াতুল্লাহ বেহেশতী, আয়াতুল্লাহ মুসাভী আর্দাবিলী, হুজ্জাতুল ইসলাম ড. বাহুনার এবং বর্তমান সর্বোচ্চ নেতা বা রাহবার আয়াতুল্লাহ উজমা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী।
আয়াতুল্লাহ হাশেমি রাফসানজানিকে আমি প্রথম দেখি কোমের মাদ্রাসা ফেইজিয়ায় ১৯৭৯ সনে। আয়াতুল্লাহ মুর্তাজা মুতাহ্হারী ইসলামের নাম ব্যবহারকারী ও সা¤্রাজ্যবাদের সন্ত্রাসী এজেন্ট গ্রুপ ‘ফুরকান’ এর হাতে শাহাদাত বরণ করলে তেহরানের হাজার হাজার শোকার্ত জনতার সাথে আমিও তেহরান থেকে কোমে যাই। ওখানে মাদ্রাসা ফেইজিয়ায় শহীদ মুতাহ্হারীর জানাযা-পরবর্তৗ জনসভায় ইমাম খোমেইনীর সামনে যিনি জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়েছিলেন এবং সন্ত্রাসীদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন তিনিই জনাব হাশেমি রাফসানজানি। জনাব হাশেমি সম্পর্কে এর আগে আমি তেমন কিছু জানতাম না। তেহরান ফিরে আমি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ড. মুহাম্মদ আলী নাকাভী (বর্তমান আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়োলজি বিভাগের চেয়ারম্যান) আমার কাছ থেকে বক্তাদের কথা শুনে জানালেন জনাব হাশেমি কত বড় নেতা ও কতো কি!
দুঃখজনকভাবে এর ক’মাস পরই মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ ও প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের এজেন্ট ‘ফুরকান’ গ্রুপের আততায়ীরা জনাব হাশেমির ওপর তার বাসভবনে ঢুকে ব্রাশ ফায়ার করে। তিনিও তাদের জাপটে ধরেন। ধস্তাধস্তির ভেতরই মিসেস হাশেমি (ইফাত মারাশী) জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্বামীকে আগলে ধরলে সন্ত্রাসীরা এ নেতাকে অকূস্থলে খতম করতে পারে নি। তবে জনাব হাশেমি ও তার স্ত্রী মারাত্মকভাবে গুলিবিদ্ধ হন। হাশেমি রাফসানজানি প্রায় তিন মাস ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণে ছিলেন। হযরত ইমাম খোমেইনী ইরানি জনতা ও হাশেমির উদ্দেশে প্রদত্ত বাণীতে বলেছিলেন, ‘হাশেমি জিন্দা থাকবে যদ্দিন আমাদের সংগ্রাম জিন্দা থাকবে।’ মৃত্যুর নিশ্চিত কূল থেকে হাশেমি পুনরায় পূর্ণশক্তিতে বেঁচে ওঠায় তাঁকে বলা হতো ‘জিন্দা শহীদ’, যেমনটি বলা হয় বর্তমান রাহবারকেও।
ইরানে ইসলামি বিপ্লবের বিজয় ও ইসলামি প্রজাতন্ত্র রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পর থেকে আয়াতুল্লাহ রাফসানজানি তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত শক্তিশালী বাহু হয়ে থাকার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় বহু গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে যান। তাঁর মৃত্যুর পর সঠিকভাবেই দেশের সকল মিডিয়া ও জনগণ তাঁকে খেতাব দিয়েছেÑ ‘ইসলামি বিপ্লবের পরিচয়পত্র’ তথা ‘শেনাসনামে ইনকেলাব’।
ইরানের প্রথম সংবিধান প্রণয়ন পরিষদ ও দেশের আইন প্রণয়নকারী মজলিসে শুরার নির্বাচন অনুষ্ঠান পর্যন্ত তিনি ছিলেন বিপ্লবী পরিষদের নির্বাচিত প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সারাদেশে মসজিদভিত্তিক সংগঠিত বিপ্লবী কমিটিসমূহের অধিনায়ক। এরপর ১৯৮০ সন থেকে নয় বছর পর্যন্ত তিনি ছিলেন মজলিসে শুরা বা ইসলামি সংসদের সফল স্পিকার। তিনি ইরানের ওপর চাপিয়ে দেয়া ইরান-ইরাক যুদ্ধে ছিলেন ইমাম খোমেইনীর নিয়োগকৃত সর্বাধিনায়ক ও যুদ্ধবিষয়ক মুখপাত্র। চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের শেষ ও চূড়ান্ত পর্যায়ে এই সর্বাধিনায়ক নিজে এবং তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান সর্বোচ্চ নেতা স্বয়ং সামরিক পোশাক পড়ে যুদ্ধের সম্মুখ ফ্রন্টে অবস্থান করেন ও যুদ্ধের গতি বদলে দেন বিজয়ের দিকে। তবে আন্তর্জাতিক শয়তানি চক্রের মারাত্মক দুরভিসন্ধি এবং ইরানকে ধ্বংস করার গভীর পারমাণবিক নীল নক্শা টের পেয়ে জনাব হাশেমি যুদ্ধ বিরতি মেনে নেয়ার জন্য ইমামের কাছে অনুরোধ জানান। আধ্যাত্মিক-রাজনৈতিক নেতা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) এক পর্যায়ে যুদ্ধবিরতি মেনে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং হৃদয়গ্রাহী ভাষণে বলেন, ‘আমি ইসলামি বিপ্লবকে ও ইসলামি রাষ্ট্রকে প্রতিরক্ষার জন্যই এ বিষের পেয়ালা পান করলাম।’
যুদ্ধ শেষে হযরত ইমাম খোমেইনীর ইন্তেকালের পর আয়াতুল্লাহ হাশেমি দুই মেয়াদে আট বছরের জন্য দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং ইমাম খোমেইনীর স্থলে নতুন নেতা নির্বাচনের বিশেষজ্ঞ পরিষদে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। পরিষদের মিটিংয়ে তিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামনেয়ীকে সর্বোচ্চ নেতা বা রাহবার হিসেবে নির্বাচনে জোরালো সমর্থন ব্যক্ত করেন। আট বছরের যুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত ইরানকে গড়ে তোলার গুরুভার যথার্থভাবে পালন করলেন রাফসানজানি। শুধু তাই নয়, তিনি ইরানকে একটি পারমাণবিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ এবং অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিধর দেশে পরিণত করার ব্যাপারে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। ইরানের ইসলামি বিপ্লব ও ইসলামি হুকুমতের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের যাবতীয় ভবিষ্যদ্বাণী, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের জবাবে তিনি একবার তেহরানের জুমআ নামাযের খুতবায় বলেছিলেন : ‘পশ্চিমারা গরুর মতো ব্যাখ্যা করে!” তার একথা প্রবাদ বাক্য হয়ে আছে ইরানী জনগণের মুখে মুখে।
জনাব হাশেমি রাফসানজানি একাধারে তেহরানের জুমা নামাযের ইমাম, রাহবার নির্বাচনী বিশেষজ্ঞ পরিষদের নেতা এবং দেশের সর্বোচ্চ কল্যাণ পরিষদেরও চেয়ারম্যান ছিলেন। শেষোক্ত পরিষদের দায়িত্ব ছিল দেশের পার্লামেন্ট, গার্ডিয়ান কাউন্সিল ও সরকারের মাঝে বিরোধ মীমাংসা, সমন্বয় সাধন ও ভারসাম্য বিধান করা। তিনি আগাগোড়াই সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক-রাজনৈতিক নেতা আয়াতুল্লাহ উজমা সাইয়্যেদ আলী খামনেয়ীর ঘনিষ্ঠতম বন্ধ,ু সহযোগী, সহকর্মী ও সমর্থক ছিলেন। জনাব হাশেমির ইন্তেকালের পর রাহবারের প্রদত্ত অমূল্য বাণী ও জানাযা নামাযে ইমামতি করা এবং সকাতর ও সকান্না মুনাজাতেই এর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। তিনি তাঁর পীর ও মুর্শিদ ইমাম খোমেইনীর মাযারেই হযরতের একান্ত ঘনিষ্ঠতায় সমাহিত হয়েছেন। ইরানের রাজনীতির এ বিস্ময়কর সদা হাস্য দুঃসাহসী বীর পুরুষ বেঁচে থাকবেন শতাব্দীর পর শতাব্দী যেমনটি খোদ্ ইমাম খোমেইনী বলে গেছেন, ‘হাশেমি বেঁচে থাকবেন যদ্দিন আমাদের সংগ্রাম বেঁচে থাকবে।’ নারী জাগরণ ও নারী অধিকার প্রদানে তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য ও বৈপ্লবিক।
জনাব হাশেমিসহ ইসলামি বিপ্লব ও প্রজাতন্ত্রের মহামান্য নেতৃবৃন্দের সাথে আমার ও আমার সহধর্মিনীর অনেক ঘনিষ্ঠ ও মধুর স্মৃতি রয়েছে যা কোন প্রবন্ধেই স্থান সংকুলান হওয়ার নয়। শুধু আল্লাহ পাকের অসংখ্য শোকরিয়া জানাই এ তূলনাহীন ঐশী নেয়ামত দানের জন্য। নবীজী ও তাঁর আহলে বাইতপ্রেমী এ বুজুর্গানের দোয়া হোক আমাদের পাথেয়।
লেখক : অধ্যাপক ও পরিচালক, ইউআইটিএস রিসার্চ সেন্টার,
ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেস (ইউআইটিএস)

আয়াতুল্লাহ্ হাশেমি রাফসানজানির রচনাবলির ওপর এক নজর

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের অন্যতম শীর্ষ ব্যক্তিত্ব মরহুম আয়াতুল্লাহ্ আলী আকবার হাশেমি রাফসানজানি (১৯৪৪-২০১৭ খ্রি.) বিপ্লবের বিজয়ের পরে দুই মেয়াদে আট বছর মজলিসে শূরায়ে ইসলামির স্পিকার ও এর পর দুই মেয়াদে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। এ কারণে, তিনি যে বিপ্লবোত্তর ইরানের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বগণের অন্যতম এটা বিশ্বব্যাপী একটি সর্বজনবিদিত বিষয়। কিন্তু তিনি যে একজন উঁচু স্তরের মুজতাহিদ আলেম, ইসলামি চিন্তাবিদ, গবেষক ও বহু গ্রন্থ প্রণেতা তা খুব কম লোকেরই জানা আছে।
মরহুম আয়াতুল্লাহ্ হাশেমি রাফসানজানি একদিকে যেমন অনক মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছেন, অন্যদিকে তিনি ছিলেন একজন সুবক্তাÑ যিনি যে কোনো বিষয়ে আলোচনার সময় অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় ও সুবিন্যস্ত বক্তব্য রাখতেন। ফলে তাঁর বক্তৃতা ও ভাষণসমূহ পরে তেমন একটা সংশোধন বা সম্পাদনা ছাড়াই গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে; এগুলোর মধ্যে তাঁর লিখিত বক্তৃতা-ভাষণ যেমন ছিল যা গ্রন্থকার হিসেবে সরাসরি তাঁর নামেই প্রকাশিত হয়েছে, তেমনি তাঁর অলিখিত বক্তব্য ও ভাষণসমূহ অন্যদের দ্বারা সংকলিত হয়ে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। সব মিলিয়ে তাঁর রচনাবলির আয়তন বিরাট।
মরহুম হাশেমি রাফসানজানির গ্রন্থাবলির বিষয়বস্তুও ব্যাপক; এতে শামিল আছে রাজনীতি, অর্থনীতি, বিশ্ব পরিস্থিতি, সমকালীন সমাজচিন্তা, ইতিহাস এবং ইসলামের বিভিন্ন দিক-বিভাগ, বিশেষ করে কোরআন মজীদের তাফসীর। তবে তাঁর লেখনীর একটি ব্যতিক্রমী ফসল হচ্ছে এই যে, তিনি ‘র্কনমে ও খতেরত্’ (কর্মতৎপরতা ও স্মৃতিচারণ) শিরোনামে স্বীয় সুদীর্ঘ সংগ্রামী ও রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা ও স্মৃতিকথা পাঠক-পাঠিকাদেরকে উপহার দিয়েছেনÑ যা অনেকগুলো খ-ে প্রকাশিত হয়েছে; এগুলোর মধ্য থেকে কোনো কোনো খ- তিনি নিজেই সংকলন করেছেন, কোনো কোনো খ- অন্যদের দ্বারা সংকলিত হয়েছে।
আমরা এখানে অতি সংক্ষেপে আয়াতুল্লাহ্ হাশেমি রাফসানজানির রচনাবলির সাথে পরিচিত হবার চেষ্টা করব।
আলী আকবার হাশেমি রাফসানজানির প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ হচ্ছে ফিলিস্তিনবিষয়ক একটি অনুবাদ গ্রন্থ। তিনি ফিলিস্তিনি লেখক ও সাংবাদিক আকরাম যা‘ঈর্তা (১৯০৯-১৯৯০ খ্রি.)-এর লেখা মাস্আলাতু ফিলিস্তিন্ (ফিলিস্তিন সমস্যা) গ্রন্থটি র্সাগোযাস্তে ফেলেস্তিন (ফিলিস্তিনের অতীত) শিরোনামে ফারসি ভাষায় অনুবাদ করেন। রাফসানজানির এ অনুবাদ গ্রন্থটি ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয় যখন তাঁর বয়স মাত্র বিশ বছর। আর এটি ছিল এমন একটি সময় যখন ইরানের মার্কিন তাঁবেদার রাজতান্ত্রিক পাহ্লাভী সরকার ও ফিলিস্তিনের বুকে জবরদখলের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত যায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরাইলের মধ্যে খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল এবং তা উত্তরোত্তর গভীরতর ও ব্যাপকতর হচ্ছিল। এ কারণে তৎকালে ইরানে যায়নবাদী ইসরাইলের প্রতিষ্ঠার বৈধতা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা ও যায়নবাদীদের সমালোচনা করা ছিল পুরোপুরি একটি নিষিদ্ধ বিষয়। তাই এ গ্রন্থটি প্রকাশিত হবার পর একদিকে এটি ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে, অন্যদিকে তা শাহের সরকারকে ক্ষিপ্ত করে তোলে; শাহী সরকারের গুপ্ত পুলিশ সংস্থা ‘সাভাক্’ তাঁকে গ্রেফতার করে ও তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়।
পরবর্তীকালে তিনি এস্রাঈল্ ভা ফেলেস্তিন (ইসরাইল ও ফিলিস্তিন) এবং এস্রাঈল্ ভা ক্বোদ্সে আযীয্ (ইসরাইল ও প্রিয় ক্বুদ্স্) শিরোনামে আরো দু’টি গ্রন্থ রচনা করেন।
আলী আকবার হাশেমি রাফসানজানির দ্বিতীয় প্রকাশিত গ্রন্থটি ছিল আর্মী কার্বী ইয়া ক্বাহ্রামানে মোবারেযে ব এস্তে‘র্মা (আমীর কাবীর বা উপনিবেশবাদবিরোধী সংগ্রামের নায়ক)। প্রথমবার সাভাকের কারাগার থেকে মুক্তিলাভের কিছুদিনের মধ্যেই তিনি এ গ্রন্থটি রচনা করেন। এ গ্রন্থে তিনি ‘আর্মী কাবীর’ (মহান আমীর) নামে সমধিক পরিচিত মীর্যা তাক্বী খান ফারাহানীর (১৮০৭-১৮৫২) ঘটনাবহুল সংগ্রামী জীবনের ওপর আলোকপাত করেন।
উল্লেখ্য, আমীর কাবীর ইরানের তৎকালীন কাজার বংশীয় বাদশাহ্ নাসিরুদ্দীন শাহের (১৮৩১-১৮৯৬) প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে (১৮৪৮-১৮৫১) ইরানকে রুশ ও ব্রিটিশদের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ থেকে বের করে আনার জন্য সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করেন এবং এ কারণে ব্রিটিশ সরকার ও তাদের পদলেহীদের ষড়যন্ত্রের ফলে বিভ্রান্ত হয়ে নাসিরুদ্দীন শাহ্ তাঁকে পদচ্যুত করেন এবং দুই মাসের মাথায় শাহের নির্দেশে তাঁকে হত্যা করা হয়।
বস্তুত আমীর কাবীর ছিলেন ইরানি জনগণের জন্য স্বাধীনতা ও স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে অভিযাত্রার পথে প্রেরণাস্বরূপ। এ কারণেই রাফসানজানি তাঁর নিজের যুগের ইরানি জনগণকে আমীর কাবীরের সংগ্রামী জীবনের সাথে ব্যাপকতর ও গভীরতরভাবে পরিচিত করানোর লক্ষ্যে এ গ্রন্থ রচনা করেন।
হাশেমি রাফসানজানি তাঁর রচিত যেসব গ্রন্থে সমকালীন সমাজ-পরিস্থিতি ও সমাজচিন্তার ওপরে আলোকপাত করেছেন সেসবের অন্যতম হচ্ছে অযাদ্ আন্দিশিয়ে এস্লামী ভা রাওশান্ফেক্রিয়ে দ্বীনী (ইসলামি মুক্তচিন্তা ও দ্বীনী বুদ্ধিবৃত্তিকতা)। এ গ্রন্থের শিরোনাম থেকেই গ্রন্থটির বিষয়বস্তু ও তার গুরুত্ব সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায়।
স্মর্তব্য যে, তৎকালে ‘প্রতিক্রিয়াশীলতা’ ও ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ ছিল বিশ্বের সর্বত্র, বিশেষ করে মুসলিম জাহানে দ্বীনী চিন্তাধারা ও দ্বীনদারদের বিরুদ্ধে ধর্মসম্পর্কহীনদের (সেক্যুলারদের) দ্বারা বহুল ব্যবহৃত দু’টি পরিভাষা। তাই তিনি এ সম্পর্কে লিখেন তাঁর গ্রন্থ র্এতেজা‘ চিস্ত্ ভা র্মোতাজে‘ কিস্ত্? (প্রতিক্রিয়াশীলতা কী এবং প্রতিক্রিয়াশীল কে?)।
তিনি ইসলামি বিপ্লব ও ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে অনেকগুলো গ্রন্থ রচনা করেন যেগুলোর মধ্যে সরাসরি গ্রন্থ হিসেবে লিখিত গ্রন্থ যেমন রয়েছে, তেমনি বিভিন্ন সভা-সেমিনারে প্রদত্ত তাঁর বক্তৃতা-ভাষণ ও তাঁর দেয়া জুমআ নামাযের খোত্বাকে গ্রন্থের রূপ দেয়া হয়েছে এমন গ্রন্থও রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে : এন্ক্বেলাব্ ইয়া বে‘ছাতে জাদীদ্ (বিপ্লব বা দ্বিতীয় উত্থান্), এন্কেলাব্ ভা দেফাএ মোক্বাদ্দাস্ (বিপ্লব ও পবিত্র প্রতিরক্ষা), ব করাভনে শাহাদাত্ (শাহাদাতের কাফেলার সাথে), তের্রো ভা গোসাস্তান্ আয্ র্মাদোম্ (সন্ত্রাসী হত্যাকা- ও জনবিচ্ছিন্নতা), হেরাসে দুনিয়ায়ে এস্তেক্বারী (বলদর্পী বিশ্বের আতঙ্ক), নাক্ব্শে রূহানীয়াত্ র্দা এন্ক্বেলাব্ (বিপ্লবে আলেমদের ভূমিকা), র্দা রবেতে ব এন্ক্বেলাবে এস্লামী (ইসলামি বিপ্লব প্রসঙ্গে) এবং আরবি ভাষায় ছাওরাতুল্ ইসলামীয়্যাহ্ : ‘উক্বুবাতু কুব্রা ওয়া ইন্তিছ¡ারু ‘আযীম্ (ইসলামি বিপ্লব : বিরাট পরিণাম ও মহান ঐশী সহায়তা), আস্-সিয়াসাতুল্ ইক্ব্তিছ¡াদীয়াতু ফীল্ হুকূমাতিল্ ইস্লামীয়্যাহ্ (ইসলামি রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক নীতি), আল্-মাকাসিবুল্ ইক্ব্তিছ¡াদিয়াতু লিছ্-ছাওরাতিল্ ইসলামীয়্যাহ্ (ইসলামি বিপ্লবের অর্থনৈতিক অর্জনসমূহ) ও আরো কতক গ্রন্থ।
তিনি ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের দুই বছর পরে ভিজ্বেগীহয়ে দো জেব্হেহ্ হাক্ব্ ভা বতেল্ (হক্ব ও বাতিলÑ দুই জোটের বৈশিষ্ট্যসমূহ) শিরোনামে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণাত্মক বক্তৃতা করেনÑ যা পরে একই শিরোনামে তৎকালীন ‘হেয্বে জোম্হুরিয়ে এস্লামী’ (ইসলামিক রিপাবলিক পার্টি)-র দফতর থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
মরহুম রাফসানজানি তাঁর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উপলক্ষে যেসব বক্তৃতা ও ভাষণ প্রদান করেন তাতে স্বাভাবিকভাবেই ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর দ্বীনী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ওপরে আলোকপাত করেনÑ যাতে হযরত ইমাম সম্পর্কিত জ্ঞান-গবেষণার জন্য বহু মূল্যবান উপাদান নিহিত রয়েছে। আবর্দু রায্যাক্ব্ আহ্ভাযী সংকলিত এমম্ খোমেইনী বে রেভইয়াতে আয়াতোল্লাহ্ হশেমী রাফ্সান্জনী (আয়াতুল্লাহ্ হাশেমি রাফ্সান্জানির ভাষায় ইমাম খোমেইনী) গ্রন্থে তাঁর এসব পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা স্থানলাভ করেছে।
এ পর্যায়ে মরহুম রাফসানজানীর লেখা এবং তাঁর বক্তৃতা-ভাষণ থেকে সংকলিত ফারসি ও আরবি ভাষায় আরো অনেক গ্রন্থ রয়েছে।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ রাফসানজানি সুদীর্ঘ ১৬ বছর যাবত ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের মজলিসে শূরায়ে ইসলামি (পার্লামেন্ট)-এর স্পিকার ও দেশের প্রেসিডেন্ট থাকাকালে দেশের ও বিশ্বের পরিস্থিতি ঘনিষ্ঠভাবে ও অপেক্ষাকৃত গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের সুযোগ পেয়েছেন এবং ইরানকে উন্নয়ন ও অগ্রগতির মহাসড়কে অনেক দূর এগিয়ে নেয়ার পাশাপাশি ইসলামি উম্মাহ্র মধ্যে চৈন্তিক ও রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলার জন্য সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করেছেন। তাঁর এ পর্যবেক্ষণের অন্যতম ফসল এবং এ সমুন্নত লক্ষ্যে তাঁর প্রচেষ্টার অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে তাঁর গ্রন্থ হাম্বাস্তেগীয়ে উম্মাতে এসলামী (ইসলামি উম্মাহ্র সংহতি)Ñ যা ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ উপলক্ষে তাঁর প্রদত্ত বিভিন্ন ভাষণের সংকলন।
এবার আমরা মরহুম রাফসানজানির লেখা ইসলামবিষয়ক গ্রন্থাবলির প্রতি সংক্ষিপ্ত দৃষ্টি দেব।
আয়াতুল্লাহ্ হাশেমি রাফসানজানি একজন গবেষক মুজতাহিদ আলেম হিসেবে ইসলামের বিভিন্ন দিকের ওপর প্রচুর লেখালেখি করেছেন। তাঁর ইসলামবিষয়ক একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে জয়গহে মাসাজেদ্ র্দা নেযামে এস্লামী আয্ মান্যারে র্কোআন্ (কোরআনের দৃষ্টিতে ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থায় মসজিদসমূহের অবস্থান)।
নিঃসন্দেহে ইসলামি জ্ঞান-গবেষণার জন্য হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর ওপর ওহী নাযিলকালীন আরব ও বিশ্বের পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপট সম্পর্কে ধারণা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। এ প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে আয়াতুল্লাহ্ হাশেমি রাফসানজানি জাহান্ র্দা আছ¡রে বে‘ছাত্ (নবুওয়াতে অভিষেকের যুগে বিশ্ব) শীর্ষক একটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন।
তাঁর ইসলামি গ্রন্থাবলির মধ্যে র্ফাহাঙ্গে কোরআন্ (কোরআনের অভিধান) অন্যতমÑ যা একটি অনবদ্য গ্রন্থ; এটি হচ্ছে কোরআন মজীদের তাৎপর্য ও বিষয়বস্তুসমূহ সহজে খুঁজে বের করার জন্য একটি সহায়ক গ্রন্থ। এছাড়া তিনি নতুন এক পদ্ধতিতে কোরআন মজীদের তাৎপর্য ও বিষয়বস্তু তুলে ধরার জন্য অপর কয়েক জন ইসলাম গবেষকের সহায়তায় তাফসীরে রাহ্নামা শীর্ষক কোরআন মজীদের একটি তাফসীর গ্রন্থ প্রণয়ন করেন।
ইসলামবিষয়ক তাঁর অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে : তাহ্ক্বীকে কুতাহ্ পিরামুনে মো‘জেযে (মু‘জিযাহ্ সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত গবেষণা), জাহান্বিনিয়ে এস্লামী ঃ বাহাছে মা‘আদ্ (ইসলামি বিশ্বদৃষ্টি : পরকালবিষয়ক আলোচনা), যান্ ভা এদালাতে এজ্তেমায়ী (নারী ও সামাজিক সুবিচার), এদালাতে এজ্তেমায়ী (সামাজিক সুবিচার), যাহ্রা (সালামুল্লাহি ‘আলাইহা) বোযোর্গ্ যানে জাহানে বাশারিয়াত্ [যাহ্রা (সালামুল্লাহি ‘আলাইহা) বিশ্ব মানবতার মহান নারী]। শেষোক্ত গ্রন্থ দু’টিতে তাঁর দু’টি জুমআর খোতবা স্থানলাভ করেছে। এ দু’টি গ্রন্থের মধ্যে এদালাতে এজ্তেমায়ী (সামাজিক সুবিচার) গ্রন্থে তিনি বর্ণবৈষম্যের ওপর বিস্তারিত তথ্যসমৃদ্ধ আলোচনা করেছেন, আর শেষোক্ত গ্রন্থটিতে নারীকুল শিরোমণি খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতেমা (সালামুল্লাহি ‘আলাইহা)-র জীবন ও মর্যাদা তুলে ধরেছেন।
বস্তুত হযরত আয়াতুল্লাহ্ রাফসানজানির রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বহির্বিশ্বে তাঁর ‘ইল্মী ব্যক্তিত্বকে আড়াল করে রেখেছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন এমন একজন উঁচু স্তরের মুজতাহিদ আলেম ও ইসলামি চিন্তাবিদ যাঁর ‘ইল্মী ব্যক্তিত্বের পরিচয় এ সীমিত পরিসর নিবন্ধে তুলে ধরা সম্ভব নয়: তাঁর রচনাবলি ও তাঁর ‘ইল্মের সকল দিক-বিভাগ সম্পর্কে যথাযথ পরিচয় তুলে ধরতে হলে একটি বড় আকারের পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচনা করাই হবে বিধেয়।
তথ্যসূত্র : মাসিক একো অব্ ইসলাম, তেহ্রান, ফেব্রুয়ারি ২০১৭ এবং ইন্টারনেট।
সংকলনে : নূর হোসেন মজিদী

মরহুম আয়াতুল্লাহ আলী আকবর হাশেমি রাফসানজানির সংক্ষিপ্ত জীবনী

ইরানের খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ ও আলেম আয়াতুল্লাহ আলী আকবর হাশেমি রাফসানজানি ১৯৩৪ সালের ২৫ আগস্ট ইরানের রাফসানজান এলাকার বাহরেমান গ্রামের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
স্থানীয় মক্তবে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের পর ১৪ বছর বয়সে তিনি ধর্মীয় উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য পবিত্র কোম নগরীতে যান। সেখানে তিনি আয়াতুল্লাহিল উজমা হোসেইন তাবাতাবায়ি বোরুজেরদি, ইমাম খোমেইনী, সাইয়্যেদ মোহাম্মাদ মোহাক্কেক দামাদ, মোহাম্মাদ রেযা গোলপায়গানি, সাইয়্যেদ মোহাম্মাদ কাজেম শারিয়াতমাদারি, আব্দুলকারিম হায়েরি ইয়াজদি, শাহাবুদ্দিন মারআশি নাজাফি ও মোহাম্মাদ হোসেইন তাবাতাবায়ির মতো প্রখ্যাত আলেমে দ্বীনের সং¯পর্শ লাভ এবং তাঁদের কাছ থেকে মূল্যবান ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করেন।
কোমের ছাত্র থাকা অবস্থায় ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের স্থপতি ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর অনুপ্রেরণায় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন আয়াতুল্লাহ হাশেমি রাফসানজানি। তিনি তৎকালীন স্বৈরাচারী শাহ সরকার ও তার কথিত শ্বেত বিপ্লবের বিরোধিতায় আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এ আন্দোলনে ইরানের আপামর জনতা অংশগ্রহণ করে এবং এর ফলে ১৯৭৯ সালে শাহ সরকারের পতনের মাধ্যমে ইসলামি বিপ্লব চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে।
বিপ্লব বিজয়ের আগে তিনি যেসব গুরুত্বপূর্ণ কাজ আঞ্জাম দেন সেগুলোর মধ্যে রয়েছে শাহের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে বক্তব্য প্রদান, ধর্মীয় ম্যাগাজিন ছাপানো, ফিলিস্তিন বিষয়ক বই-পুস্তকের ফারসি অনুবাদ, স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে লেখালেখি করা, তাফসীর করার ক্ষেত্রে সহায়ক পুস্তক রচনা, নানা ধরনের প্রবন্ধ প্রকাশ করা ইত্যাদি।
সুদীর্ঘ বিপ্লবী ও কর্মময় জীবনে আয়াতুল্লাহ হাশেমি রাফসানজানি ইরানের প্রেসিডেন্ট, পার্লামেন্ট ¯িপকার, নীতি নির্ধারণী পরিষদের প্রধান এবং বিশেষজ্ঞ পরিষদের চেয়ারম্যানসহ অনেক বড় বড় পদে দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি ছিলেন ইসলামি ইরানের পার্লামেন্ট মজলিসে শুরায়ে ইসলামির প্রথম ¯িপকার। এ ছাড়া, ১৯৮৯ সালে তিনি ইরানের চতুর্থ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং ১৯৯৩ সালে পরবর্তী মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও জয়লাভ করে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন।
প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনকালে ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ সফর করেন ইরানের এই প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ।
ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের পর থেকে আমৃত্যু তিনি ইরানের বিশেষজ্ঞ পরিষদে জননির্বাচিত প্রতিনিধি ছিলেন। ২০০৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত তিনি এই পরিষদের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন।
আয়াতুল্লাহ হাশেমি রাফসানজানি জীবদ্দশায় সংক্ষিপ্ত আত্মজীবনী লিখে গেছেন। আমরা সেখান থেকে কিছু অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি :
আমার পিতার নাম : আলহাজ মির্জা আলী হাশেমি বাহরেমানি।
আমার মাতার নাম : মাহ বিবি (সাফারিয়ান)।
আমার প্রপিতামহের নাম ছিল আলহাজ হাশেম। তাঁর নাম থেকেই আমার বংশের নাম হয়েছে হাশেমি। আমাদের এলাকায় আলহাজ হাশেমের অঢেল স¤পত্তি ছিল। এক নামে তাঁকে চিনত সবাই।
আমার পিতা ধর্মীয় লাইনে লেখাপড়া করেছিলেন। আলেম সমাজের ওপর স্বৈরাচারী শাহ সরকারের দমনপীড়নের কারণে আমার পিতা প্রচুর স¤পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও গ্রামে বসবাস করতে বাধ্য হন। এলাকার মানুষের কাছে তিনি ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং সমাজের বিচার-আচারসহ সাধারণ মানুষের ধর্মীয় নানা প্রশ্নের উত্তর ও সমস্যার সমাধান করে দিতেন আমার পিতা।
আমাদের গ্রামের নাম বাহরেমান। বাহরেমান শব্দের অর্থ চুনি পাথর। রাফসানজান এলাকার একটি গ্রাম এটি।
আমার মা ছিলেন একজন গৃহিণী। পাশাপাশি তিনি আমার পিতার কাজেও সাহায্য করতেন। নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও ঔষধী গাছগাছালি স¤পর্কে তাঁর অগাধ জ্ঞান ছিল। তাঁর এই জ্ঞান আমাদের বাড়ির লোকজনের পাশাপাশি গ্রামবাসীর অনেক উপকারে আসত। রোগ-বালাইয়ে পড়লে লোকজন আমার মায়ের শরণাপন্ন হতো। এখনো আমি নানা রোগে আমার মায়ের সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাই।
আমরা পাঁচ ভাই ও চার বোন। গ্রামে বসবাস করলেও আমাদের জীবনমান খারাপ ছিল না। জাতীয় পরিচয়পত্রে আমার জন্ম সাল হচ্ছে ১৯৩৪। পাঁচ বছর বয়সে আমি আমার দুই বছরের বড় ভাই কাসেমের সঙ্গে লেখাপড়া শুরু করি।
আমাদের গ্রামের মক্তবে জাতীয় পাঠ্যক্রমের বই পড়ানোর পাশাপাশি পবিত্র কোরআনসহ অন্যান্য ধর্মীয় বই পড়ানো হতো। ওই মক্তবে আমি শেখ সা’দীর ‘গুলিস্তান’ বইটি পড়তে শিখেছি। সাত বছর বয়সে মক্তবের লেখাপড়ার পাশাপাশি পিতার কাছ থেকেও তালিম নিয়েছি। একটি পর্যায়ে এসে দেখলাম, মক্তব আমাকে নতুন আর কিছু শেখাতে পারছে না। তখন আমার বয়স ১৪ বছর। সে সময় চাচাতো ভাই মোহাম্মাদের পরামর্শে উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে কোম শহরে যাই। কোমের ধর্মতত্ত্ব কেন্দ্রে আমি বিখ্যাত সব আলেমে দ্বীনের কাছ থেকে শিক্ষা অর্জন করি। এসব আলেমের মধ্যে ছিলেন আয়াতুল্লাহিল উজমা বোরুজেরদি, ইমাম খোমেইনী (রহ.), দামাদ, গোলপায়গানি, শারিয়াতমাদারি, হায়েরি ইয়াজদি, মারআশি নাজাফি, আল্লামা তাবাতাবায়ি, জাহেদি ও মোনতাজেরি।
১৯৫৮ সালে আমি হুজ্জাতুল ইসলাম আগা সাইয়্যেদ মোহাম্মাদ সাদেক মারআশির কন্যার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হই। আমার স্ত্রী হচ্ছেন মারআশি নাজাফির আত্মীয়া এবং হযরত আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ কাজেম তাবাতাবায়ি ইয়াজদির নাতনি। আয়াতুল্লাহ তাবাতাবায়ির লেখা বই ইরানের প্রায় সব ধর্মতত্ত্ব কেন্দ্রে আজও রেফারেন্স বই হিসেবে পড়ানো হয়।
আমাদের সুখী দা¤পত্য জীবনে মহান আল্লাহ আমাদেরকে পাঁচটি সন্তান দিয়েছেন। তারা হচ্ছে ফাতেমা, মোহসেন, ফায়েজা, মাহদি এবং ইয়াসির।

আয়াতুল্লাহ রাফসানজানির ইন্তিকালে বিভিন্ন দেশে শোক

ইসলামি ইরানের প্রখ্যাত ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ও রাজনীতিবিদ আয়াতুল্লাহ হাশেমী রাফসানজানি গত ৮ জানুয়ারি ২০১৭ ইরানের রাজধানী তেহরানে ইন্তিকাল করেন। তাঁর ইন্তিকালে ইরানের বাইরে বিভিন্ন দেশে স্মরণানুষ্ঠান পালিত হয় এবং ইরানের বিভিন্ন কূটনৈতিক দফতরে শোকবই খোলা হয়। আয়াতুল্লাহ হাশেমী রাফসানজানি ছিলেন ইসলামি বিপ্লবের নেতা মরহুম ইমাম খোমেইনীর অন্যতম একান্ত সহচর এবং বর্তমান রাহবার আয়াতুল্লাহ উজমা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ীর সুদীর্ঘকালের সাথি ও সহযোদ্ধা। তিনি দুই মেয়াদে ইরানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জাতীয় স্বার্থ ও কল্যাণ নির্ধারণ পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর ইন্তিকালের পরপর বিভিন্ন দেশে ইরানের কূটনৈতিক দফতরে শোকবই খোলা হয়। তাতে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা শোকবাণীতে স্বাক্ষর করে তাঁর মহান ব্যক্তিত্বের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।

তুরস্ক
তুরস্কের প্রখ্যাত ইরানবিশেষজ্ঞ, ইতিহাসবেত্তা ও বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষক আধ্যাপক ইলবার উরতায়ীলী ইরানের কালচারাল কাউন্সেলরের দফতরে উপস্থিত হয়ে আয়াতুল্লাহ রাফসানজানির ইন্তিকাল উপলক্ষে খোলা শোকবইতে স্বাক্ষর করেন এবং এই বিশ^খ্যাত ব্যক্তিত্বের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে তুরস্ক ও ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়নে তাঁর ভূমিকার প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ইরান ঐতিহাসিকভাবেই এতদঞ্চলে উন্নততর অবস্থানে রয়েছে এবং সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কারণে প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করে আসছে। একইভাবে ইস্তাম্বুল বিশ^বিদ্যালয়ের ফারসি বিভাগের সভাপতি আলী গুযাল ইউয ইস্তাম্বুলে ইরানি কনস্যুলেটে উপস্থিত হয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর মুহাম্মদ আক এর পক্ষে শোকবইতে স্বাক্ষর করেন। তিনি আয়াতুল্লাহ হাশেমী রাফসানজানিকে ইরানের বিরাট মহীরুহ বলে আখ্যায়িত করেন, যিনি ইরান ও তুরস্কের মধ্যকার উন্নত সম্পর্ক স্থাপনে প্রচুর চেষ্টা চালান।
অপরদিকে ইস্তাম্বুলের শিয়া ওলামা সমিতির সভাপতি হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলেমীন হাসান কারাহ বুলুত ইস্তাম্বুলে ইরানি কনস্যুলেটে স্থাপিত শোকবইতে স্বাক্ষর করেন। তিনি বলেন, আয়াতুল্লাহ রাফসানজানি বিরাট ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব এবং ইসলামি বিপ্লবের অন্যতম পুরোধা ছিলেন।
ইস্তাম্বুলের ওয়ালেদা খান মসজিদে এ উপলক্ষে এক শোকানুষ্ঠান পালিত হয় এবং তাতে ইরানি সংস্থাগুলোর দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ ও প্রবাসী ইরানিরা অংশগ্রহণ করেন। এ উপলক্ষে ইরানি কনস্যুলেটের পতাকা তিন দিন অর্ধনমিত ছিল এবং স্থানীয় বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের প্রতিনিধিরা শোকবইতে স্বাক্ষর করেন।
শোক পালনের দ্বিতীয় দিনে তুরস্কের আলাভী সম্প্রদায়ের সাথে সংশ্লিষ্ট আহলে বাইত ওয়াক্ফ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ফরমান আলতুন শোকবইতে স্বাক্ষর করেন এবং ইরানের বাইরে ও ভেতরে আয়াতুল্লাহ হাশেমীর ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য ও ভূমিকার কথা উল্লেখ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তিনি মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর উপস্থিতির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, আহলে বাইতের চিন্তাধারা ও শিক্ষাসমূহ আঁকড়ে ধরার মাধ্যমে এর মোকাবিলা করা সম্ভব।

বাংলাদেশ
আয়াতুল্লাহ রাফসানজানির ইন্তিকালে বাংলাদেশে ইরান দূতাবাস ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে ৩ দিনব্যাপী ইরানের পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয় ও ইরান দূতাবাসে শোকবই খোলা হয়। বিভিন্ন দূতাবাসের রাষ্ট্রদূতগণ ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিদ ও আলেমগণ শোকবইতে স্বাক্ষর করেন। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে বিশেষভাবে সংবাদ পরিবেশন এবং ইরানে ও বহির্বিশ্বে তাঁর বিশাল অবদানের কথা উল্লেখ করে নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের প্রধানগণ যথাক্রমে ড. আবদুস সবুর খান, ড. মোহাম্মদ আতাউল্লাহ ও ড. মো. নূরে আলম শোকবাণী প্রদান করেন।

জিম্বাবুয়ে
আয়াতুল্লাহ হাশেমী রাফসানজানির ইন্তিকাল উপলক্ষে জিম্বাবুয়ের রাজধানী হারারেতে শোক অনুষ্ঠান পালিত হয়। তাতে বিভিন্ন খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের লোকজনসহ মুসলিম কম্যুনিটির পক্ষ হতে শোক ও সমবেদনা জ্ঞাপন করা হয়। এসব সংস্থার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, জিম্বাবুয়ে অ্যাপোস্টলিক খ্রিস্টান পরিষদ (এসিসিজেড), জিম্বাবুয়ে খ্রিস্টান পরিষদ (জেডসিসি) উঞ্জেলিক গির্জা, ফিলিস্তিন মুসলিম ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটি, মুসলিম ইয়ুথ অর্গানাইজেশন আল-ইস্তাকামা, বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ, স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, প্রবাসী ইরানী, লেবাননি ও পাকিস্তানি নাগরিক এবং হারারেস্থ ইরান দূতাবাসের কর্মকর্তাবৃন্দ। হারারের আলে মুহাম্মাদ মসজিদের হলরুমে এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ইরানি কালচারাল কাউন্সেলর আয়াতুল্লাহ হাশেমীর বিশ^জনীন ব্যক্তিত্বের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, তাঁর নাম ইরানের ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে থাকবে। জিম্বাবুয়ের অ্যাপোস্টলিক গির্জা পরিচালনা পরিষদের সহ-সভাপতি ১৯৯৬ সালে আয়াতুল্লাহ রাফসানজানির জিম্বাবুই সফরের স্মৃতিচারণ করেন। জিম্বাবুয়ের স্থানীয় নেতা কাম্বা মাকুনা তাঁর বক্তৃতায় আয়াতুল্লাহ রাফসানজানির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে বক্তৃতা করেন।
মদীনা বিশ^বিদ্যালয় ফেরত ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধি তাঁর বক্তৃতায় শোক ও সমবেদনা জানিয়ে বলেন, আয়াতুল্লাহ হাশেমী রাফসানজানি আজকের দুনিয়ার জন্য এক বিরাট উত্তরাধিকার, যার কথা কখনো ভুলে যাওয়া উচিত নয়। আসমানি সংস্কৃতি ও বিশ^শান্তি পরিষদের প্রতিনিধি তাঁর বক্তৃতায় রাফসানজানিকে বিশ^জনীন ব্যক্তিত্ব, বিরাট সংস্কারক ও প্রভাবশালী নেতা বলে আখ্যায়িত করেন।
অনুষ্ঠানে জিম্বাবুয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর হুজ্জাতুল ইসলাম জাহাঙ্গীরীও বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠান শেষে ইরানি কালচারাল কাউন্সেলর জিম্বাবুই টিভির সাথে সাক্ষাৎকার প্রদান করেন। উল্লেখ্য যে, জিম্বাবুইর প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবে দেশের বাইরে অবস্থান করায় তাঁর পক্ষ হতে ভাইস প্রেসিডেন্ট ফলকযলা আম্বাকু কতিপয় রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাসহ ইরান দূতাবাসে উপস্থিত হয়ে শোকবইতে স্বাক্ষর করেন। এ উপলক্ষে হারারের ইরানি দূতাবাসের পতাকা অর্ধনমিত ছিল।

সিরিয়া
লাযেকিয়ায় ইরানি কালচারাল কাউন্সিল ও রাসূলে আযম গ্রেট কমপ্লেক্সের উদ্যোগে কমপ্লেক্সে জুমআ নামায আদায়ের পর এক শোকানুষ্ঠান পালিত হয়। লাযেকিয়া কালচারাল কাউন্সিলের পরিচালক তাঁর বক্তৃতায় আয়াতুল্লাহ হাশেমী রাফসানজানি যেসব রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেন তার বিবরণ দেন। রাসূলে আযম কমপ্লেক্সের সহকারী কালচারাল কর্মকর্তাও এ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। এ উপলক্ষে লাযেকিয়া কালচারাল কাউন্সিলে শোকবইতে বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষকসহ বহু ব্যক্তিত্ব স্বাক্ষর করেন এবং শোক ও সমবেদনা জানান।
সিরিয়ায় ইরানি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ইমাম খোমেইনী মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত শোকানুষ্ঠানে সিরিয়ায় প্রসিদ্ধ আলেম শেখ নাবীল হালবায়ী, তেহরানে নিযুক্ত ইরানে সাবেক রাষ্ট্রদূত তুর্কী সাকার প্রমুখ বক্তৃতা করেন। সিরিয়ায় বসবাসরত ফিলিস্তিনি আলেম শেখ মুহাম্মাদ আল বাহিচী, শেখ মুহাম্মাদ আল উমরী, লাযেকিয়ার সাইয়্যেদ আইমান যায়তুন, আরব রাইটার্স ফোরামের প্রধান নেদাল আস সালেহ প্রমুখও আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন।

চীন
আয়াতুল্লাহ হাশেমী রাফসানজানির ইন্তিকালে পিকিং এ ইরানি দূতাবাসের পক্ষ হতে এক শোকানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তাতে ইরানি রাষ্ট্রদূত আলী আসগর হাজী উপস্থিত ছিলেন। আয়াতুল্লাহ হাশেমী রাফসানজানির ইন্তিকাল উপলক্ষে প্রদত্ত ইরানের মহামান্য রাহবরের শোকবাণী পাঠ করেন ইরানি কালচারাল কাউন্সেলর মুহাম্মাদ রাসূল আলমাসী। ইরানি রাষ্ট্রদূত ইসলামি বিপ্লবের আগে ও পরে আয়াতুল্লাহ হাশেমী রাফসানজানির গৌরবময় ভূমিকার ওপর আলোকপাত করেন।
চীনের সাংহাইতে শোকবই খোলা হয় এবং শোকসভায় ইসলামি বিপ্লবের প্রতিরক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ে আয়াতুল্লাহ রাফসানজানির বলিষ্ঠ ভূমিকা ও অবদানের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে বলা হয় যে, তিনি রাষ্ট্র ও জাতির জন্য আশা ও আস্থার প্রতীক ছিলেন।

ফ্রান্স
আয়াতুল্লাহ হাশেমী রাফসানজানির ইন্তিকাল উপলক্ষে প্যারিসে ইরানি দূতাবাস ও কালচারাল কাউন্সেলরের পক্ষ হতে বায়তুয যাহরায় এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে ইরানি রাষ্ট্রদূত অহানী ও ইউনেস্কোতে ইরানের প্রতিনিধি জালালি এবং ফ্রান্স ইসলামিক সেন্টারের প্রধান হুজ্জাতুল ইসলাম মাক্কী বক্তৃতা করেন। এ উপলক্ষে প্যারিসে ইরান দূতাবাসে শোকবই খোলা রাখা হয়।

আলবেনিয়া
আলবেনিয়ার রাজধানী তিরানায় ইরানি দূতাবাসে শোকবই তিনদিনব্যাপী খোলা রাখা হয়। ৫০ জন রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ব্যক্তিত্ব শোকবইতে স্বাক্ষর করেন এবং ইরানের সরকার ও জনগণের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেন। এ উপলক্ষে জনাব রাফসানজানির জানাযা অনুষ্ঠান সম্পর্কিত সচিত্র প্রতিবেদন প্রচার করা হয়।

ভারত (নয়াদিল্লি)
আয়াতুল্লাহ হাশেমী রাফসানজানির ইন্তিকালে আয়োজিত শোক অনুষ্ঠানে নয়াদিল্লিতে ইরান দূতাবাসের কর্মকর্তাবৃন্দ, প্রবাসী ইরানি ছাত্র ও নাগরিকবৃন্দ, বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি ও তাঁদের পরিবার-পরিজন যোগদান করেন। অনুষ্ঠানে ভারতে নিযুক্ত মহামান্য রাহবারের প্রতিনিধি হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলেমীন মাহদাভীপুর তাঁর বক্তৃতায় আয়াতুল্লাহ হাশেমী রাফসানজানিকে ইরানের রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্যতম স্তম্ভ এবং বিচক্ষণ ও দূরদর্শী ব্যক্তিত্ব বলে আখ্যায়িত করেন, যিনি বিপ্লবের আগে ও পরে বিভিন্ন পর্যায়ে স্মরণীয় অবদান রেখেছেন। অনুষ্ঠানে ইরানি রাষ্ট্রদূত গোলাম রেযা আনসারীও বক্তব্য রাখেন।

ওমান
ওমানের রাজধানী মাস্কাটে ইরান দূতাবাসে শোকবই খোলা হয়। ইরানের পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয় এবং একটি শোকানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তাতে শিয়া, সুন্নি ও আবাযী সম্প্রদায় নির্বিশেষে বিভিন্ন ব্যক্তিত্ব উপস্থিত হয়ে এই নেতার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। এছাড়া টেলিফোনযোগে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সহায়তায়ও বিপুল সংখ্যক ওমানবাসী শোক ও সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।

ফিলিপাইন (ম্যানিলা)
ইরান দূতাবাস, ইরানি কালচারাল কাউন্সিল, জামেয়া আল-মুস্তফা ও ম্যানিলা ইসলামি ছাত্র সংস্থার উদ্যোগে শোকানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ইরানি রাষ্ট্রদূত মুহাম্মাদ তানহায়ী ও কালচারাল কাউন্সেলর জাফরী ও জামেয়া আল-মুস্তফার প্রধান হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলেমীন আকবরী বক্তব্য রাখেন।
কাযাকিস্তান (আস্তানা)
কাযাকিস্তানের রাজধানী আস্তানায় আয়োজিত শোকানুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন ইরানি রাষ্ট্রদূত মুজতবা দামিরচি লু, কালচারাল কাউন্সেলর শেখ যায়ন উদ্দীন, ইরান কূটনৈতিক মিশনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক দফতরের প্রধানগণ, এশিয়ান নিরাপত্তা ও সহযোগিতা পরিষদ সিকা’য় ইরানি প্রতিনিধি ও প্রবাসী ইরানিরা উপস্থিত ছিলেন।

ভেনিজুয়েলা
ভেনিজুয়েলায় ইরানি দফতরসমূহের উদ্যোগে আয়োজিত শোক অনুষ্ঠানে ভেনিজুয়েলায় জামেয়া আল-মুস্তফা আল আলামিয়ার প্রতিনিধি হুজ্জাতুল ইসলাম হুসাইনী নেযাদ বক্তব্য রাখেন। এ উপলক্ষে ইরান দূতাবাসে তিন দিনব্যাপী শোকবই খোলা রাখা হয়।

সুইডেন
স্টকহোমে সুইডেনের ইরান দূতাবাসে তিন দিনব্যাপী শোকবইতে সুইডেনের বিভিন্ন ব্যক্তিত্ব ও রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন দূতাবাস ও কূটনৈতিক দফতরের প্রতিনিধিরা স্বাক্ষর করেন। এ ছাড়া সুইডেনের ইমাম আলী সেন্টারে ঐ দেশে অবস্থানরত ইরানি কর্মকর্তা, আফ্রিকান ও ইসলামি দেশসমূহের প্রতিনিধিবৃন্দ শোকসভায় যোগদান করেন।

থাইল্যান্ড
ব্যাংককে ইরানি দূতাবাসে তিন দিনব্যাপী শোকবই খোলা হয়। ইরানি পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয় এবং ইরানি দফতরসমূহের সদস্যদের অংশগ্রহণে শোকানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে আয়াতুল্লাহ হাশেমী রাফসানজানির রূহের মাগফিরাত কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়।

কিরগিজিস্তান
ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্টের ইন্তিকাল উপলক্ষে কিরগিজিস্তানের প্রেসিডেন্ট এক বাণীতে ইরানের সরকার ও জনগণের প্রতি শোক ও সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। এ উপলক্ষে বিশকেকে স্থাপিত শোকবইতে কিরগিযিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক দফতরের প্রধান, সাবেক স্পিকার, উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বিশকেকে নিযুক্ত পাকিস্তান, আফগানিস্তান, আজারবাইযান, ইউক্রেন, কাতার এর রাষ্ট্রদূতগণ এবং আরো কতিপয় কূটনীতিক স্বাক্ষর করেন। কিরগিজিস্তানের জাতীয় গ্রন্থাগারের প্রধানও এ উপলক্ষে শোকবার্র্তা প্রেরণ করেন। এ ছাড়া বিশকেক ইমাম আলী মসজিদে একটি দোয়ার মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।

লেবানন
লেবাননের রাজধানী বৈরুতে আয়োজিত শোকানুষ্ঠানটি সরাসরি আল মানার চ্যানেল থেকে সম্প্রচার করা হয়। শোক অনুষ্ঠানে হিজবুল্লাহর যুগ্ম সেক্রেটারি জেনারেল, লেবাননে আয়াতুল্লাহ সিসতানীর প্রতিনিধি, সাবেক স্পিকার হুসাইন আল হুসাইনী এবং ব্রিটেন, জাপান, সিরিয়া ও ভ্যাটিকানসহ অন্তত বিশটি দেশের রাষ্ট্রদূতগণ উপস্থিত ছিলেন।

বুলগেরিয়া
বুলগেরিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট সে দেশের তরফে ইরান দূতাবাসে উপস্থিত হয়ে শোকবইতে স্বাক্ষর করেন। এ ছাড়া সে দেশের রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাবৃন্দ, বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষক, সাংবাদিক নেতা, লেখক, অনুবাদক, ফারসি ভাষার ছাত্রবৃন্দ ব্যাপকভাবে স্বাক্ষর করেন এবং তাঁদের সমবেদনা জানান। বুলগেরিয়ার পররাষ্ট্র দফতরের পরিচালকও শোকবাণী প্রদান করেন এবং দুদেশের সম্পর্ক উন্নয়নে জনাব রাফসানজানির বিচক্ষণ নেতৃত্বের প্রশংসা করেন।

পাকিস্তান
এ উপলক্ষে শিয়া ও সুন্নি আলেম ও ব্যক্তিত্বদের অংশগ্রহণে রাওয়ালপিন্ডিতে শোকানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। তাতে আহলে সুন্নাত ওলামা ঐক্যজোটের প্রধান আল্লামা সিরাজ উদ্দীন সিদ্দীকী, হুজ্জাতুল ইসলাম এজায মুসাভী ও আল্লামা হায়দার আলাভী বক্তব্য রাখেন। ইসলামাবাদে ইরানি কালচারাল কাউন্সেলর শাহাবউদ্দীন দারায়ী শোকানুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য রাওয়ালপিন্ডির জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। জাফরী আন্দোলনের কেন্দ্রিয় সেক্রেটারি জেনারেল আল্লামা আরেফ ওয়াহেদী ইরান ও ইসলামি জাহানের জন্য আয়াতুল্লাহ হাশেমী রাফসানজানির নিরলস খেদমতের কথা স্মরণ করে কৃতজ্ঞতা জানান।
পাকিস্তানের লাহোরেও এ উপলক্ষে ইরানি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে পাকিস্তানি ওলামা দল নিয়াযী শাখার সেক্রেটারি জেনারেল ও জামেয়া আল মুন্তাযির বিশ^বিদ্যালয়ের প্রধান হুসাইন নাকাবী আয়াতুল্লাহ হাশেমীর ব্যক্তিত্বের বিভিন্ন দিকের ওপর আলোচনা করেন।

তাজিকিস্তান
তাজিকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জনাব আলী এক শোকবাণীতে গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাজিকিস্তানের রাজধানীতে খোলা শোকবইতে গভীর শোক ও সমবেদনা জানিয়ে স্বাক্ষর করেন। এ ছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও কূটনৈতিক ব্যক্তিত্ব এতে স্বাক্ষর করেন। এ উপলক্ষে প্রবাসী ইরানিদের উদ্যোগে একটি শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়।

তুর্কমেনিস্তান
তুর্কমেনিস্তানের ইশকাবাদে এ উপলক্ষে শোকসভার আয়োজন করা হয়। এতে আয়াতুল্লাহ রাফসানজানি ইরানের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় পদে অধিষ্ঠিত থাকা এবং দুদেশের সম্পর্কোন্নয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকার ওপর আলোকপাত করা হয়।

শ্রীলংকা
শ্রীলংকায় ইরানি দূতাবাসে শোকবই খোলা হয় এবং ইরানি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে দোয়া ও কুরআন তেলাওয়াতের মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। শ্রীলংকা, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের বিভিন্ন সরকারি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শোকবইতে স্বাক্ষর করেন। দোয়া মাহফিলে ইরানের রাষ্ট্রদূত এবং হাশেমী ফাউন্ডেশনের প্রধান বক্তব্য রাখেন।

উগান্ডা
উগান্ডায় খোজা শিয়া মসজিদে অনুষ্ঠিত শোকসভায় ইরানি রাষ্ট্রদূত মুরতাজাবী, কালচারাল কাউন্সেলর আলী বখতেয়ারী, আল মুস্তাফা কলেজের প্রধান হুজ্জাতুল ইসলাম বুকায়ী, স্থানীয় জনগণ ও প্রবাসী ইরানিরা উপস্থিত ছিলেন।

আরমেনিয়া
আরমেনিয়ার রাজধানী ইরাভানায় ইরানি দূতাবাসে শোকবই খোলা হয় এবং কালচারাল কাউন্সেলরের দফতরের পক্ষ হতে স্থানীয় জামে কাবুদ মসজিদে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়।

কাজাকিস্তান (আল মাতা)
কাজাকিস্তানের আল মাতায় অনুষ্ঠিত শোকসভায় ইরানি কালচারাল কাউন্সেলর জালালী কিয়াসরী ও ইরানবিষয়ক গবেষক সফর আব্দুল্লাহ আয়াতুল্লাহ রাফসানজানির ব্যক্তিত্বের বিভিন্ন দিক নিয়ে বক্তব্য রাখেন।

ঘানা
ঘানার আক্রায় ইরানি কালচারাল কাউন্সেলরের উদ্যোগে শোকসভা আয়োজন করা হয়। এতে কুরআন তেলাওয়াত শেষে বক্তাগণ আয়াতুল্লাহ রাফসানজানির ব্যক্তিত্বের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন।

গ্রীস
গ্রীসের এথেন্সে অনুষ্ঠিত শোকসভায় ইরানি রাষ্ট্রদূত মজীদ মাতলবী শাবেস্তরীসহ ইরানি কর্মকর্তা ও বিভিন্ন দেশের মুসলিম প্রতিনিধিগণ অংশগ্রহণ করেন। এতে ইসলামি বিপ্লবের প্রতিষ্ঠা ও বিভিন্ন অঙ্গনে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য আয়াতুল্লাহ রাফসানজানির অবদানের কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়।

মালয়েশিয়া
মালয়েশিয়ায় ইরান দূতাবাসের শোকবইতে স্বাক্ষর করেন সিঙ্গাপুর, ইউক্রেইন ও ঘানাসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতগণ। তাঁরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে, বিশেষ করে ইসলামি জাহানে প্রভাবশালী ভূমিকার জন্য আয়াতুল্লাহ রাফসানজানির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।
কুয়ালালামপুরে ইরানি দূতাবাসে পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। দু’দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে রাফসানজানির ভূমিকার প্রশংসা করে স্থানীয় পত্রিকায় সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়।
শোকসভায় ইরানি রাষ্ট্র্রদূত মারযিয়া আফখাম, কালচারাল কাউন্সেলর আলী মুহাম্মদ সাবেকী ও বিভিন্ন ব্যক্তি বক্তব্য রাখেন। বক্তারা বলেন, বিপ্লবের পর আয়াতুল্লাহ রাফসানজানির মজলিশে স্পিকার হিসেবে ও প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে থাকাকালে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে চড়াই-উৎরাই ছিল। তবে তিনি সবসময় দেশ ও জাতির খেদমতে ও বিপ্লবের প্রতিরক্ষায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রথম সারীতে লড়াই করে গেছেন।

অস্ট্রিয়া
ভিয়েনায় ইরানি দূতাবাস, জাতিসংঘে ইরানি প্রতিনিধি দফতর, ইমাম আলী (আ.) সেন্টার ও কালচারাল সেন্টারের উদ্যোগে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। ভিয়েনা প্রবাসী বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।

শোকবাণী

আয়াতুল্লাহ রাফসানজানির ইন্তিকালে শোকবাণী

ইরানের ইসলামি বিপ্লবের প্রথম কাতারের নেতা, সাবেক স্পিকার ও দুই মেয়াদে সাবেক প্রেসিডেন্ট আয়াতুল্লাহ হাশেমি রাফসানজানি গত ৮ জানুয়ারী ২০১৭ ইন্তিকাল করেন। তাঁর ইন্তিকালে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের মহামান্য রাহবার আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী ও প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি পৃথক দু’টি শোকবাণীতে মরহুমের কর্মময় জীবন ও ইসলামি বিপ্লবে তাঁর অবিস্মরণীয় খেদমত ও ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। আমরা এখানে উভয় বাণীর হুবহু তরজমা পেশ করছি।

মহামান্য রাহবারের শোকবাণী

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম।
ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন (আমরা আল্লাহর জন্য এবং আমরা তাঁর কাছেই ফিরে যাব)
আমার দীর্ঘকালীন বন্ধু, ইসলামি আন্দোলন চলাকালীন অধ্যায়ের সহযোদ্ধা ও সহগামী এবং ইসলামি প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রব্যবস্থার যুগে দীর্ঘ বহু বছরকাল আমার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী জনাব হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন শায়খ আকবর হাশেমি রাফসানজানির আকস্মিক মৃত্যুর সংবাদে অত্যন্ত দুঃখ ও মর্মবেদনা অনুভব করছি। এমন একজন সহগামী ও সহযোদ্ধাকে হারানো, যাঁর সাথে সহকর্মী ও অন্তরঙ্গ হিসেবে কাজ করার ইতিহাস দীর্ঘ ৫৯ বছর পূর্ণ হয়েছে, সত্যিই অত্যন্ত কঠিন ও হৃদয়বিদারক।
বিগত কয়েক দশকের দীর্ঘ সময়ে কত যে কঠিন ও সমস্যাসংকুল অবস্থা আমাদের উপর দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে এবং নানা পরিস্থিতিতে পারস্পরিক সমচিন্তা ও সহমর্মিতার কত ঘটনা আমাদেরকে একই পথে চেষ্টা-সাধনা, ধৈর্যধারণ ও চ্যালেঞ্জ গ্রহণে বাধ্য করেছে তার ইয়ত্তা নেই। তাঁর প্রখর বিচক্ষণতা, নজিরবিহীন আন্তরিকতা সেই বছরগুলোতে তাঁর যারা সহকর্মী, বিশেষ করে আমার জন্য নির্ভরতার স্থলস্বরূপ ছিল। মতপার্থক্য ও ইজতিহাদী বিভিন্নতা এই দীর্ঘ অধ্যায়ে কখনই আমাদের সেই বন্ধুত্বের বন্ধনকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করতে পারে নি, যার সূচনা হয়েছিল কারবালায়ে মুআল্লার বাইনাল হারামাইনে। দুষ্ট দুরাচারীরা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অত্যন্ত জোরালোভাবে এই মতপার্থক্য হতে ফায়দা লোটার জন্য যে চেষ্টা করেছিল, তা এই নগণ্যের প্রতি তাঁর গভীর ব্যক্তিগত ভালোবাসায় কোনোরূপ বি সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় নি।
তিনি ছিলেন যুলুমশাহীর বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রথম প্রজন্মের বিরল দৃষ্টান্ত এবং এই বিপদসংকুল ও বিপজ্জনক পথের অন্যতম কষ্টসহিষ্ণু।
বছরের পর বছর কারাবাস ও সাভাকের নির্যাতন সহ্য করা এবং এসবের মোকাবিলায় প্রতিরোধ, তারপর পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধে বিপজ্জনক সব দায়িত্ব পালন, ইসলামি মজলিসে শুরার স্পিকারের দায়িত্ব এবং নেতানির্বাচনী বিশেষজ্ঞ পরিষদের দায়িত্ব পালন প্রভৃতি হচ্ছে এই অভিজ্ঞ সংগ্রামীর চড়াই উৎরাইপূর্ণ জীবনের একেকটি উজ্জ্বল স্বাক্ষর।
জনাব হাশেমিকে হারানোর পর আমি অন্য কোনো ব্যক্তিত্বকে দেখছি না, যাঁর সাথে এই ঐতিহাসিক অধ্যায়ের চড়াই উৎরাইয়ে এমন যৌথ ও দীর্ঘকালীন সহযোগিতার অভিজ্ঞতা রয়েছে।
এখন এই অভিজ্ঞ সংগ্রামী আল্লাহর হিসাবের আদালতে বিভিন্নমুখী চেষ্টা ও কর্মপ্রয়াসে পরিপূর্ণ আমল নিয়ে হাজির হয়েছেন। আর এটিই আমরা, সকল দায়িত্বশীলদের শেষ পরিণতি।
তাঁর জন্য অন্তরের অন্তস্থল থেকে আল্লাহর কাছে মাগফিরাত, রহমত ও ক্ষমার দরখাস্ত পেশ করছি। তাঁর সম্মানিত স্ত্রী, তাঁর সন্তানগণ ও ভাইগণ এবং অন্যান্য আপনজনের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি।
আল্লাহ আমাদেরকে ও তাঁকে ক্ষমা করে দিন।
সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী
১৯ দেই ১৩৯৫ (৮ জানুয়ারি ২০১৭)

প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানির শোক

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম।
ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
‘এমন কিছুসংখ্যক মানুষ আছে যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের উদ্দেশ্যে নিজের জীবনকে বিক্রি করে দিয়েছে। আর আল্লাহ বান্দাদের প্রতি অতিশয় দয়াপরবশ।’ (আল কুরআন)
হযরত ফাতেমা মাসুমা (আ.)-এর জন্য শোক পালন এবং আমীর কবির মযলুমভাবে শাহাদাত বরণের বার্ষিকীর শোকার্ত দিনগুলোতে ইরান তার যোগ্য অধিনায়কের শোক পালন করছে এবং যুলুম ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জাতীয় বীর আজ মহান প্রভুর দরবারে আত্মসমর্পিত হয়েছেন।
হযরত আয়াতুল্লাহ আকবর হাশেমী রাফসানজানী, যিনি রুহুল্লাহর (ইমাম খোমেইনীর) অবিচল প্রত্যয়ী সন্তান, মহান নেতা রাহবারের দীর্ঘকালীন সঙ্গী ও সহমর্মী, ইসলামি বিপ্লবের উজ্জ্বল অবয়ব ও ইতিহাসের নির্মাতা, জনগণের সত্যিকার দরদি, ত্যাগ-তিতীক্ষা এবং ধৈর্যের পরাকাষ্ঠার দীর্ঘ জীবন শেষে আল্লাহর সাক্ষাতে চলে গেছেন। ইতিহাস কেমন অর্থপূর্ণ দিনক্ষণ নির্ণয় করে রেখেছে। কারণ, ধৈর্য, সহনশীলতা, ঈমান ও ভারসাম্যের এই প্রবাদপুরুষ এমন দিনে আল্লাহর সন্নিধানে চলে গেলেন, যেদিনটি হচ্ছে ইসলামি বিপ্লবের প্রতিষ্ঠাতা মহান খোমেইনীর পক্ষে জাতির জাগরণ ও নব উত্থানের সূচনাপর্ব।
হাশেমির ব্যাপারে কথা বলা- বছরের পর বছর যাঁর পাশে ছিলাম, আমার জন্য অত্যন্ত কঠিন। মহান ইমামের নেতৃত্বে ইরানের জনগণের দীর্ঘ সংগ্রাম চলাকালে তিনি ছিলেন এক সর্বাত্মক বিপ্লবী। বহু বছরকাল নির্যাতন ও কারাভোগ, তাঁকে তাঁর সেই লক্ষ থেকে পৃথক করতে পারে নি। তিনি সবসময়ই ইসলামি বিপ্লবের অন্যতম অগ্রপথিক ছিলেন। তিনিই ছিলেন সেই ব্যক্তি যিনি কোম থেকে নিয়ে নাজাফ এবং প্যারিস থেকে তেহরান কোথাও তাঁর ইমাম ও প্রাণের মানুষটিকে নিঃসঙ্গ রাখেন নি। হাশেমী ইসলামি প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্যতম নির্মাতা। সংবিধান, ইসলামি মজলিসে শুরা (পার্লামেন্ট), নেতা নির্বাচনী বিশেষজ্ঞ পরিষদ মজলিসে খুবরেগান, প্রেসিডেন্ট, রাষ্ট্রের কল্যাণ নির্ধারণী সর্বোচ্চ পরিষদ, হিজবে জমহুরী ইসলামি পার্টি, ইসলামি বিপ্লবী রক্ষীদল সেপাহে পাসদারান, দেশগড়ার জিহাদে সাজেন্দেগী সংস্থা ও ইসলামি বিপ্লবের সকল সংস্থা ও সংগঠন এই ভবিষ্যৎদর্শী বীর পুরুষের দূরদর্শী ও বিজ্ঞ নির্দেশনার কাছে ঋণী।
আজ ইসলাম তার এক মূল্যবান সম্পদ, ইরান তার এক মহান আমীর, ইসলামি বিপ্লব এক সাহসী ঝা-াবাহী ও রাষ্ট্র তার বিরল এক ব্যবস্থাপককে হারিয়েছে।
তিনি ছিলেন ইমামের প্রিয়ভাজন এবং জনগণের সেবক। যখানই তিনি কোনো কিছুর দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, তখনই তা মহান ইমাম, রাহবার ও জনগণের স্বস্তির কারণ ছিল। তিনি ছিলেন এমন শক্তিমান বিশ্লেষক, যিনি বিশ^কে ভালোভাবে চিনতেন। জুমআর নামাযে তাঁর খুতবাসমূহ পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধের দিনগুলোতে সবার মনে মনোবল যোগাত। তিনি মযলুম অবস্থায় তাঁর দীর্ঘকালীন সাথি শহীদ বেহেশতীর মতোই অকৃতজ্ঞতাসমূহকে খুব সহজে সহ্য করতেন।
হাশেমি কখনোই যুদ্ধকে ভয় পান নি। কিন্তু সবসময় শান্তিকে সম্মান করতেন। তিনি জিহাদ ও শাহাদতের ময়দানে যেমন বীর অধিনায়ক ছিলেন, তেমনি যুদ্ধ বন্ধের আলোচনায়ও বীর কেশরী ছিলেন। যে মহান ব্যক্তি সত্যিকার অর্থেই রাষ্ট্রযন্ত্রের পাটাতন ছিলেন, তাঁর সম্পর্কে কথা বলা সহজ বিষয় নয়। তিনি ছিলেন ইমামের একান্ত আপনজন এবং মহান রাহবারের নজিরবিহীন বন্ধুজন। ইরান ও ইরানির জন্য তাঁর আশা-আকাক্সক্ষা ছিল বিশাল। যতদিন প্রাণ ছিল ইসলামি দেশটির উন্নতশির হওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়েছেন। নিজের প্রতি বহু অন্যায় বরদাশত করেছেন এবং নিজের পক্ষ হতে বহু ত্যাগ ও বিশ^স্ততার স্বাক্ষর রেখেছেন। ইসলামের ভারসাম্যপূর্ণ রাস্তা হতে বিচ্যুতির ব্যাপারে মোটেও আপোস করেন নি। রাষ্ট্রের কল্যাণের বিষয়টি অন্য যে কোনো কিছুর ঊর্ধ্বে বলে মনে করতেন। ইরানের সমঝদার জনগণ তাদের সেবকদের মর্যাদা খুব ভালোভাবেই চেনে এবং তাদের দেশগড়ার সর্দারের প্রতি তাদের ঋণ পরিশোধ করবে।
হাশেমির নাম এর অনেক ঊর্ধ্বে, চল্লিশের দশক (ইরানি সাল)-এ সংগ্রামের সূচনা থেকে নিয়ে ইসলামি বিপ্লবের বিজয়কাল পর্যন্ত ইসলামি আন্দোলনের ইতিহাসের পাতায় পাতায় তাঁর প্রভাবশালী ভূমিকা ও কৃতিত্বের স্বাক্ষরসমূহ, পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধের ব্যবস্থাপনা থেকে নিয়ে সকল স্পর্শকাতর সময়গুলোতে তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলো পর্যন্ত তাঁর উজ্জ্বল ও নজিরবিহীন ভূমিকা এবং ইরানের কৃতজ্ঞ জনগণের অন্তরে তাঁর চিরন্তন আসনের কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে। আমাদের সবার পীর ও প্রাণের মানুষ প্রিয় খোমেইনী- আল্লাহ তার পবিত্র আত্মাকে মহিমান্বিত করুন-বলেছেন যে, ‘বিদ্বেষীরা জেনে রাখুক, হাশেমি জীবিত আছে যতদিন প্রেসিডেন্ট দফতরের তথ্য সরবরাহের দফতর জীবিত আছে।’
আমি তিন দিনের শোক এবং এক দিনের সরকারি ছুটি ঘোষণা করে এই জাতীয় বীর, বিরাট ইসলামি চিন্তাবিদ ও ইরানের ইসলামি প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রব্যবস্থার নজিরবিহীন সম্পদকে হারানো উপলক্ষে হযরত বাকিয়াতুল্লাহ (ইমাম মাহদী)- তাঁর জন্য আমার প্রাণ উৎসর্গিত হোক, ইসলামি বিপ্লবের মহান রাহবার, সম্মানিত মারজায়ে তাকলিদবৃন্দ, আলেমগণ, ফোযালা, বিপ্লব ও রাষ্ট্রের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, ইরানের কৃতজ্ঞ জাতি, বিশেষ করে কেরমান প্রদেশ ও রাফসানজান শহরের জনসাধারণ, তাঁর বন্ধুবান্ধব, ভক্তবৃন্দ, বিশেষত তাঁর সম্মানিত পরিবার, তাঁর মুহতারেমা ও ধৈর্যশীলা স্ত্রী এবং এই আদর্শস্থানীয় মুজাহিদের সন্তানগণ ও ভাইগণের প্রতি আন্তরিক শোক ও সমবেদনা জানাচ্ছি। আর আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ জানাচ্ছি, এই মহান ব্যক্তিকে যেন সুউচ্চ মাকাম দান করেন এবং পবিত্র ইমামগণ ও তাঁর প্রাণের মানুষ ইমাম খোমেইনী ও তাঁর সহযোদ্ধা ইসলামি বিপ্লবের শহীদগণের পাশে স্থান দেন। সেই সাথে তাঁর রেখে যাওয়া আপনজনদের সবার প্রতি সবর ও নেকী দানের জন্য আর্জি পেশ করছি।
হাসান রুহানি
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট

এ বছরের বিপ্লববার্ষিকী ইসলামি বিপ্লব ও ইরানের জন্য বিশেষ সম্মান বয়ে এনেছে

ইসলামি বিপ্লবের বিজয়বার্ষিকী সম্পর্কে ইসলামি বিপ্লবের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীর মূল্যায়ন

ইসলামি বিপ্লবের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী বলেন, ২২ বাহমান (১১ ফেব্রুয়ারি) ইরানে ইসলামি বিপ্লবরবিজয় বার্ষিকীর মিছিলে ইসলামি ইরানের সর্বস্তরের জনতা যেভাবে উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে ও প্রাণবন্ত হয়ে রাজপথে নেমেছিল তা এই বিপ্লব ও ইসলামি প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য বিরাট সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ইরানের আযারবাইজান প্রদেশের গণপ্রতিনিধিরা মহামান্য রাহবারের সাথে সাক্ষাৎ করতে আসলে তাদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে এ কথা বলেন। তিনি আরো বলেন, রাষ্ট্রীয় কমকর্তারা জনগণের এই অংশগ্রহণ ও উপস্থিতির অর্থ যেন এটা মনে না করেন যে, তাঁদের প্রতি জনগণের কোনো অভিযোগ বা অনুযোগ নেই। তিনি বলেন, আমেরিকা তার পুরনো ষড়যন্ত্রের পূনরাবৃত্তি ঘটিয়ে এবং নতুন করে যুদ্ধের হুমকি দিয়ে ইরানের রাষ্ট্র্রীয় কর্মকর্তাদের মনোযোগকে আসল লড়াইয়ের ময়দান তথা অর্থনৈতিক লড়াইয়ের ময়দান থেকে অন্যদিকে ফিরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। কাজেই রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীলদের সতর্ক থাকতে হবে এবং বেকারত্ব, অর্থনৈতিক স্থবিরতা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও বৈষম্যের ন্যায় সমস্যাগুলো সমাধানে নিজেদের সকল কর্মপ্রচেষ্টা নিয়োগ করতে হবে।
ইসলামি বিপ্লবের নেতা এ বছর ১১ ফেব্রুয়ারি বিপ্লববার্ষিকীর মিছিলে জনগণের ব্যাপক ও স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতিকে বিপ্লব ও ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য সম্মানজনক বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি দেশবাসীর প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, এ বছর বহু শহরে বিপ্লববার্ষিকীর মিছিলে জনগণের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে কেবল দেশের অভ্যন্তরীণ গণমাধ্যমগুলোই মত প্রকাশ করে নি; বরং বিপ্লবের দুশমনরাও বিগত বছরগুলোর বিপরীতে ‘মিলিয়ন লোকের অংশগ্রহণ’ জাতীয় পরিভাষা ব্যবহার করে ইরানি জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণের বাস্তবতা স্বীকার করেছে। কাজেই জাতির কাছে কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য সত্যিই আমার ভাষা অক্ষম।
মহামান্য রাহবার ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিপ্লবের বিরুদ্ধে পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সিআইএ, মোসাদ, ব্রিটিশ গোয়েন্দা ও তথ্য সংস্থাসমূহের বিরামহীন প্রচেষ্টা এবং কারুণদের তেলখাতে অর্জিত বিপুল ডলার ব্যয়ের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, গেল বছরব্যাপী শত শত উপগ্রহ চ্যানেল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ইরান থেকে পলাতক দেউলিয়ারা ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য, দুর্বল ও অভিযুক্ত করার চেষ্টায় নিয়োজিত ছিল। কিন্তু জনগণের বিপুল উপস্থিতি আল্লাহর রহমতের বৃষ্টি হয়ে ১১ ফেব্রুয়ারির দিন এসব ধুলোবালিতে আচ্ছন্ন আকাশ পরিষ্কার করে দিয়েছে। জনতার জাগরণ ও ¯্রােত বরকতময় ও স্বচ্ছ সলিলের বহমান নদী হয়ে এর ধুলোমলিন আকাশ পরিষ্কার করে দিয়েছে।
ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা বলেন, ১১ ফেব্রুয়ারির মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের বিন্যাস নিয়ে বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন নেহায়েত জরুরি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই বিশাল জনতার অধিকাংশই তাগুতি সরকারের শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির কালো ও তিক্ত অধ্যায়, ইসলামি বিপ্লবের বিজয়কালীন অবস্থা এবং মরহুম ইমাম ও পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধ দেখে নি, তবুও তারা বাস্তব অনুভূতি, সঠিক তথ্য অনুসন্ধান, দূরদৃষ্টি ও আলোকিত মন থেকে রাজপথে নেমেছিলেন।
মহামান্য রাহবার আরো বলেন, ইসলামি বিপ্লব ও রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষায় তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্মের আশাব্যঞ্জক উপস্থিতি ও প্রতিরক্ষার মনোভাব এই বিপ্লবের বিকাশ ও আরো উচ্চতায় আরোহণের প্রমাণ বহন করে। আর এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও লক্ষণীয় একটি বিষয়।
ইসলামি বিপ্লবের নেতা দুশমনরা ইরানের রাষ্ট্রযন্ত্রকে অক্ষম ও অকেজো প্রমাণ করার জন্য যে চেষ্টা চালিয়েছে তা অত্যন্ত ব্যর্থ প্রয়াস বলে উল্লেখ করে বলেন, পৃথিবীর সব জায়গার মতো বেশকিছু অসঙ্গতি আমাদেরও আছে, এগুলোকে আমরা কিছুতেই পাশ কাটিয়ে যেতে রাজি নই। কিন্তু দুশমন চাচ্ছে, বিগত ৩৮ বছরে আমরা যে বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছি ও প্রগতির ক্ষেত্রে বহু অবদান রেখেছি তা তারা অস্বীকার করতে। তাদের লক্ষ হচ্ছে আমাদের জনগণের মাঝে হতাশার বিস্তার ঘটানো।
আয়াতুল্লাহ উজমা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী বাস্তবানুগ রিপোর্টের ভিত্তিতে কোনো কোনো মৌলিক অবকাঠামো ক্ষেত্রে গত ৪ দশকে যেসব কাজ সম্পাদিত হয়েছে তাকে বিস্ময়কর বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, এসব অগ্রগতির কিছুকিছু এমন যে, সাধারণত তা একশৎ বছরের মেয়াদেও অর্জন করা সম্ভবপর হয় না।
তিনি বলেন, তাগুতি শাসনের আমলে ইরানিদের প্রতি যে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ছিল সে তুলনায় ইরানি জাতির মধ্যে যে আত্মমর্যাদা ও সম্মানবোধের উজ্জীবন ঘটেছে, তা বিপ্লবের গৌরবজনক অবদান। তিনি বলেন, আমেরিকা ও ব্রিটেনের সামনে নতশির তাগুত সরকার আমাদের জাতিকে হেয় প্রতিপন্ন করেছিল এবং আমাদের জাতিসত্তা ছিল ভূলুণ্ঠিত। কিন্তু আজ যে কেউ ইরানি জনগণের সম্মান ও শক্তিমত্তা এবং আন্তর্জাতিক ফোরামে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী উপস্থিতির কথা স্বীকার করে। তারা জানে যে, এতদঞ্চলের প্রায় সকল সমস্যায় যদি ইরান উপস্থিত না থাকে বা ইচ্ছা না করে তাহলে কোনো কাজই সম্মুখে অগ্রসর হবে না।
ইসলামি বিপ্লবের নেতা বলেন, ১১ ফেব্রুয়ারি ছিল জাতির আশা-আকাক্সক্ষা ও নীতি-অবস্থান সম্পর্কে জানান দেয়ার জন্য আল্লাহর খাস নেয়ামত এবং এক অমূল্য সুযোগ। তিনি বলেন, এ বছর জাতি দেখিয়ে দিয়েছে যে, তারা দুশমনের মোকাবিলার জন্য রুখে দাঁড়িয়েছে। আর জনগণের মাঝ থেকে উত্থিত ইসলামি চেতনা ও ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার বাস্তবায়ন এবং একে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টায় তারা আপোমহীন। আর যে যে দায়িত্বশীল জনগণের একই সাথে চলবে না এবং রুখে দাঁড়াবে না জাতি নিঃসন্দেহে তাকে প্রত্যাখ্যান করবে।
হযরত আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীলদের উদ্দেশে বলেন, ইরানকে গ্রাস করার জন্য যে দুশমন ওঁত পেতে আছে তার মোকাবিলায় জনগণের বিপুল উপস্থিতিকে আপনারা মনে করবেন না যে, যাঁরা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করছেন, তাঁদের প্রতি জনগণের কোনো অভিযোগ নেই। কেননা, জনগণ বহুবিধ সমস্যায় ভুগছে। যেমন বৈষম্য, কর্মসংস্থানের অপ্রতুলতা, সমস্যাদির প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করা প্রভৃতি ব্যাপারে তাদের অভিযোগ রয়েছে এবং তারা কষ্টের মধ্যে আছে।
মহামান্য রাহবার বলেন, জনগণের মধ্যে বহু অনুযোগ আছে। বেকারত্ব, স্থবিরতা, মুদ্রাস্ফীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দায়িত্বশীলদের বলতে হবে তারা কী করেছেন?
রাহবার স্মরণ করিয়ে দেন যে, প্রতিরোধের অর্থনীতি, একশন ও বাস্তব কর্মের বর্ষ বলে যে বর্ষ ঘোষণা করা হয়েছিল তা এখন শেষ হওয়ার পথে। কাজেই মন্ত্রীসভাএবং অন্যান্য বিভাগের দায়িত্বশীলদের তাঁরা এ ক্ষেত্রে কী কী করেছেন তার প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হবে। দায়িত্বশীলরা জনগণকে বলতে পারবেন না যে, এমনটিই হবার ছিল, হয়েছে (এর বেশি হওয়া সম্ভব ছিল না) । বরং তাঁদের বলতে হবে, এতটুকু হয়েছে।
হযরত আয়াতুল্লাহ খামনেয়ী বলেন, বেকারত্ব, অর্থনৈতিক স্থবিরতা ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এগুলো দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। তিনি বলেন, অবশ্য দায়িত্বশীলবর্গ চেষ্টা করে যাচ্ছেন; কিন্তু দেশের যে শক্তি ও সামর্থ্য আছে তা তো এর চেয়ে অনেক বেশি। আর সমস্যা থেকে উত্তরণের বহুমাত্রিক পথও সুনির্দিষ্ট আছে।
মাননীয় রাহবার অর্থনৈতিক চাপ বৃদ্ধি ও জনগণের মধ্যে হতাশা সৃষ্টির জন্য দুশমন লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে মর্মে ছয় বছর আগে যে বক্তব্য তিনি করেছিলেন, সে কথা উল্লেখ করে বলেন, রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীলদের অবশ্যই অর্থনৈতিক বিষয়াদির প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দিতে হবে। অবশ্য সাংস্কৃতিক ও বিজ্ঞান সংক্রান্ত বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। তবে স্বল্পকালীন দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থনৈতিক বিষয়াদি অগ্রগণ্য।
ইসলামি বিপ্লবের নেতা ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকির ষড়যন্ত্র পুনরাবৃত্তি করার পেছনে আমেরিকার আগের ও বর্তমান প্রশাসনের লক্ষ্য বিশ্লেষণ করে বলেন, আজকেও তারা আগের মতোই টেবিলে বসে সামরিক পদক্ষেপের অপশন নিয়ে কথাবার্তা বলেন, আর সেই ইউরোপীয় কর্মকর্তাও আমাদের কমকর্তাদের বলেন, যদি পারমাণবিক চুক্তি সম্পন্ন না হতো তাহলে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী ছিল। কিন্তু এই কথাটি ডাহা মিথ্যা। তারা চাচ্ছে, আমাদের মনোযোগকে আসল যুদ্ধ অর্থাৎ অর্থনৈতিক যুদ্ধ থেকে বিভ্রান্ত করে সামরিক যুদ্ধের দিকে ধাবিত করতে। যাতে ইরানি জাতির বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের সাংস্কৃতিক যুদ্ধ এবং অর্থনৈতিক কর্মকা-ে অগ্রগতিতে আমাদের কর্মকর্তাদের সমগ্র মনোযোগ কেন্দ্রীভূূত করা থেকে বিরত রাখতে পারে।
হযরত আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী বিভিন্ন পরিকল্পনার ওপর নজরদারি ও বিভিন্ন প্রকল্প এগিয়ে নেয়া একান্ত জরুরি বলে অভিমত ব্যক্ত করেন এবং বলেন, আমি সম্মানিত প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ করেছি, যাতে পরিচালকবর্গকে তিনি স্মরণ করিয়ে দেন যে, তাঁদের তত্ত্বাবধান হতে হবে স্বচ্ছতার সাথে নজরদারি ও সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ সহকারে। নচেৎ যদি যারা কাজ করবে তাদের কেবল বলা হয় যে, এ কাজ ঠিকমত বাস্তবায়িত হতে হবে আর অপরপক্ষ বলে যে, হ্যাঁ, অবশ্যই। তাহলে অগ্রগতি বলতে কিছুই হবে না এবং বাস্তব কাজও সম্পন্ন হবে না।
ইসলামি বিপ্লবের নেতা কোরআন মজীদের আয়াতواعدوا لهم ما استطعتم من قوه (তোমাদের সাধ্যে যত কিছু আছে তা দিয়ে তাদের [দুশমনদের] মোকাবিলা করার প্রস্তুতি গ্রহণ কর) এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, আয়াতের উদ্দেশ্য কেবল সামরিক শক্তির দিকে মনোযোগ দেয়া নয়; বরং এই আয়াতের অর্থ হচ্ছে, তোমারা যতখানি সম্ভব ভেতর থেকে নিজেদেরকে শক্তিশালী কর। আর এটি হচ্ছে অভ্যন্তরীণ অবকাঠামো মজবুত করা- যে কথা আমি বহুবার বলেছি।
ইসলামি বিপ্লবের নেতা বলেন, বিশেষজ্ঞগণ যেমনটি বলেছেন আর যদি দেশের অভ্যন্তরীণ সকল সম্ভাব্য খাতের পূর্ণ ব্যবহার করা হয় তা হলে শতকরা ৮ ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন একান্তই সম্ভবপর। তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধির প্রকৃত অর্থ হচ্ছে, অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি তথা সেই প্রতিরোধমূলক অর্থনীতি। এর মানে কেবল বেশি পরিমাণ তেল বিক্রি করা নয়, অবশ্য তাও উপকারী।
তিনি ঐসব লোকের সমালোচনা করেন, যারা কেবল ঘাটতি ও দুর্বল দিকগুলো নিয়ে চর্চা করে আর সেগুলোকে বড় করে দেখায়। তিনি বলেন, চিন্তা করে দেখার বিষয় হচ্ছে, এসব লোক তো তারাই যারা দুশমনকে অবরোধ আরোপ করার সুযোগ সৃষ্টিতে সহায়তা করেছে।
ইসলামি বিপ্লবের নেতা তাঁর ভাষণের অপরাংশে ১৩৫৬ সালের (১৯৭৭ খ্রি.) ২৯ বাহমান তাবরীযে যে ঘটনা ঘটেছিল তাকে এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ও ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ে জাতিকে সম্মুখে এগিয়ে নেয়ার চালিকা শক্তি বলে আখ্যায়িত করেন। রাহবর বলেন, আযারবাইজানের জনগণ দেশের ১৩০ বছরের ইতিহাসে সকল রাজনৈতিক ও সামাজিক গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন ও পরিস্থিতিতে, যেমন তামাক আন্দোলন, সাংবিধানিক অধিকার আন্দোলন, তেলশিল্প জাতীয়করণ আন্দোলন, ইসলামি বিপ্লব ও পবিত্র প্রতিরক্ষা যুদ্ধ প্রভৃতি সব অঙ্গনেই সংগ্রামের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। এটিই হচ্ছে আযারবাইজানবাসীর গৌরবজনক ইতিহাস ও পরিচয়পত্র।
ইসলামি বিপ্লবের নেতা বিপ্লবের প্রথম দিকের বছরগুলোতে তাবরিযে কতক গোষ্ঠীর বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, আমাদের মহান ইমাম ইংরেজদের প্রাচীন নীতির ফলে সৃষ্ট এসব তৎপরতা সম্পর্কে বলেছিলেন, কেউ যেন উদ্বিগ্ন না হন, কারণ, স্বয়ং তাবরিযের জনগণ তাদের জওয়াব দেবে। আর হয়েছিলও তাই।
রাহবর বলেন, আযারবাইজানের সর্বস্তরের জনগণ, তরুণ সমাজ ও শিক্ষিত শ্রেণি দুশমনের কুমন্ত্রণা ও অনৈক্য সৃষ্টির চেষ্টার জবাবে যে বিচক্ষণতার প্রমাণ দিয়েছে তা প্রশংসনীয়। তিনি বলেন, আযারবাইজান হচ্ছে, ইসলামি বিপ্লব ও রাষ্ট্রব্যবস্থার শক্তির কেন্দ্র আর সেখানকার জনগণ জাতীয় ঐক্যের প্রতিরক্ষায় জান বাজি রেখেছেন, সবার উচিত তাঁদের এই আত্মত্যাগের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো।
হযরত আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী ইরানের জাতি-বৈচিত্র্য, যেমন তুর্কি, ফারসি, লোর, কুর্দি, আরব, বেলুচ প্রভৃতিকে একটি সুবর্ণ সুযোগ বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি সতর্ক করেন যে, দুশমন সবসময় জাতিগত বিরোধ সৃষ্টির দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, যাতে তাদের ধারণা অনুযায়ী যে কোনো ফাঁক ফোকর দিয়ে ঢুকে দেশে বড় ধরনের ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে পারে। অথচ দেশে কোনো ধরনের ফাটল নেই এবং জনগণ একাত্ম হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছে।
জনতার বিশাল মহাসাগর ঐক্যবদ্ধ। যারা আশুরার দিনের প্রতি অবমাননা করেছে তাদের সাথে আপোস করবে না।
ইসলামি বিপ্লবের নেতা ইরানি জাতিসত্তার বিভিন্ন অংশ বিশেষ করে আযারবাইজানের লোকেরা দুশমনের দুরাচারী নীতির মোকাবিলায় যেভাবে বক্ষ পেতে দিয়েছিল তার প্রশংসা করেন এবং বেলুচ সুন্নি আলেম মরহুম মওলভি আব্দুল আজিজ সাদাতী, কুর্দিস্তানের সুন্নি আলেম মরহুম শেইখুল ইসলাম এবং খুজিস্তানের আরব তরুণ নেতা শহীদ আলী হাশেমীকে ইসলাম ও বিপ্লবের প্রতিরক্ষায় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির ঐক্যবদ্ধ ও সমন্বিত তৎপরতার উজ্জ্বল নমুনা বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, ইরানি জাতি ঐক্যবদ্ধ, সুসংহত, সহযাত্রী ও একাত্ম।
রাহবার এ পর্যায়ে ইরানি জনগণের মাঝে সম্প্রতি জাতীয় সম্প্রীতি গড়ে তোলা মর্মে যে কথাটি উত্থাপিত হয়েছে তার দিকে ইঙ্গিত করেন এবং এ জাতীয় প্রবচনকে অর্থহীন বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি এ জাতীয় কথা নিয়ে সংবাদপত্রে ডালপালা বিস্তারের সমালোচনা করে বলেন, জনগণ কি পরস্পরের সাথে রাগ করেছে যে, সম্প্রীতি স্থাপন করতে হবে? এখানে তো পরস্পরের মাঝে কোনো রাগ নেই, ঝগড়া নেই। অবশ্য যারা ৮৮ সালে (২০০৯ খি.) ইমাম হোসাইন স্মরণে আশুরার দিনের অবমাননা করেছে, অত্যন্ত নির্লজ্জতা ও নিষ্ঠুরতা ও ধৃষ্টতার সাথে আমাদের গণযোদ্ধা সদস্যদের প্রকাশ্য রাজপথে উলঙ্গ করেছে, তাদের কিলঘুষি দিয়েছে তাদের প্রতি এই জাতির রাগ আছে এবং তাদের সাথে সম্প্রীতি স্থাপন করবে না।
ইসলামি বিপ্লবের নেতা স্মরণ করিয়ে দেন যে, অবশ্য যারা মূল বিপ্লবের বিরোধী ছিল তারা বলত যে, নির্বাচন উপলক্ষ মাত্র। আমাদের আসল লক্ষ্য রাষ্ট্রব্যবস্থা।’ এরা গুটিকতক মাত্র। ইরানি জাতির মহাসমুদ্র ও প্রাণবন্ত ¯্রােতের মোকাবিলায় এরা খড়কুটোর ন্যায়।
ইসলামি বিপ্লবের নেতা আরো বলেন, যেখানে ইসলাম, ইরান, স্বাধীনতা ও দুশমনের মোকাবিলায় রুখে দাঁড়ানোর প্রশ্ন আসে সেখানে ইরানি জাতি তার গোটা অস্তিত্ব দিয়ে দাঁড়িয়েছে এবং পরস্পর ঐক্যবদ্ধ ও সুসংবদ্ধ। অবশ্য এটা সম্ভব যে, অমুক রাজনৈতিক ইস্যুতে দু’জনের মতপার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু এ তো কোনো মৌলিক ও প্রভাবশালী বিষয় নয়। বরং একেবারে স্বাভাবিক ও সাধারণ একটি বিষয়। হযরত আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী বলেন, জাতির ঐক্যবদ্ধ ও তরঙ্গায়িত মহাসাগর দিনের পর দিন শক্তিশালী, মজবুত ও গতিশীল হতে হবে।
ইসলামি বিপ্লবের নেতা পবিত্র ও খোদায়ী আশা-আকাক্সক্ষার যেসব স্ফুলিঙ্গ সব সময় জাতির মন ও চেতনাকে উষ্ণ ও শাণিত রেখেছে তার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, আমরা বহুক্ষেত্রে অগ্রগতি সত্ত্বেও ইসলাম ও বিপ্লবের আশা-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে একটি ছোট্ট পদক্ষেপ নিতে পেরেছি মাত্র। আমাদেরকে ইনসাফপূর্ণ, প্রাগ্রসর, শক্তিমান, মর্যাদাপূর্ণ ইসলামি সমাজ গড়ে তোলার পথে এগিয়ে যেতে হবে। আল্লাহর দয়া ও মেহেরবানিতে জাতি ও রাষ্ট্রযন্ত্রের সমন্বিত পথ চলায় নিশ্চিতভাবেই বিজয় ও ভবিষ্যৎ ইরানের প্রিয় জাতির পক্ষেই চলে আসবে।
ইসলামি বিপ্লবের নেতার ভাষণের পূর্বে আযারবাইজান প্রদেশে ওলীয়ে ফকিহ এর প্রতিনিধি ও তাবরিযের জুমআ ইমাম আয়াতুল্লাহ মুজাহিদ শাবিস্ত্রী ফাতেমীয় দিবসসমূহ উপলক্ষে শোক প্রকাশ করে বলেন, আযারবাইজানের আত্মমর্যাদাশীল জনগণ ১৩৫৬ সালের ২৯ বাহমান ( ১৮ ফেব্রুয়ারি ৯৭৭ খ্রি.) এক অবিস্মরণীয় ও ঐতিহাসিক বীরত্ব সৃষ্টি করেন। তাঁরা এ বছর ২২ বাহমানেও (১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬) তাঁদের দূরদৃষ্টি ও বিচক্ষণতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁরা রাহবারের সঙ্গে বাইআত নবায়ন করেছেন।

ইরানের ইসলামি বিপ্লব ও নারী

ফাতেমে খাযায়ী

সমাজের জনশক্তির অর্ধেক অংশ হিসেবে প্রতিটি সমাজের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অর্থাৎ শিশুদেরকে শিক্ষিত করার ক্ষেত্রে নারীর বিশেষ অবস্থান রয়েছে এবং এ কারণে নারী সমাজের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে বিবেচিত।
যখন একজন নারী শিশুদেরকে শিক্ষাদান ও তাঁর স্বামীর প্রয়োজন পূরণের পাশাপাশি সামাজিক ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞান অর্জন করেন তখন তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে শিশুর শিক্ষাদান ও প্রতিপালনের ক্ষেত্রে অধিক কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেন। এই কারণে অগ্রসর মানবের সকল প্রয়োজন পূরণে ইসলাম এই ধরনের সমাজ বিনির্মাণের ওপর ব্যাপক গুরুত্ব আরোপ করেছে।
ইরানের ইসলামি বিপ্লবকে নানা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পর্যালোচনা করা যেতে পারে। এই প্রবন্ধে নারীর মর্যাদা বা অবস্থান সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।
ইসলামি বিপ্লবে নারীর অবস্থান সম্পর্কিত যে বিষয়টি সবেচেয়ে মূল্যবান ও অধিক মনোযোগ আকর্ষণ করেছে সেটি হলো ইসলামি বিপ্লব নারীর রাজনৈতিক জীবনের একটি মাইলফলক বলে বিবেচিত। এটি কেবল এ কারণে নয় যে, বিপুল সংখ্যক নারী ইসলামি বিপ্লবের লক্ষ্য (অর্থাৎ ‘স্বাধীনতা, মুক্তি, ইসলামি সরকার’) অর্জনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন, বরং এই দৃষ্টিকোণ থেকেও যে, ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের সময় থেকে শ্রেণিবৈষম্যের বিরুদ্ধে নারীর আত্মসচেতনতা এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক বিপ্লবের ওপর তাদের প্রভাবের বিষয়ে সচেতনতা শুরু হয়।

সমাজে নারী
নারীর রাজনৈতিক অধিকারের বিষয় নির্দেশকারী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস হলো পবিত্র কোরআন। সূরা মুমতাহিনায় কোরআন বলছে : ‘হে নবী! বিশ্বাসী নারীরা যখন তোমার নিকট এ ব্যাপারে বাইআত করতে আসে যে, তারা আল্লাহর সাথে কোন অংশী স্থাপন করবে না…’ (আয়াত : ১২)
আনুগত্য হলো জাতির প্রতি অঙ্গীকার এবং তা মেনে চলার জন্য আত্মনিবেদনÑ তা অমান্য করা নয়। মক্কা বিজয়ের দিন মহানবী (সা.) পুরুষদের নিকট থেকে আনুগত্যের শপথ নেন। এরপর যখন নারীরা তাঁর কাছে আনুগত্যের শপথ নেয়ার জন্য আসেন তখন মহানবী (সা.)-এর ওপর এই আয়াতসমূহ অবতীর্ণ হয় এবং মহান আল্লাহ তাঁকে এ আয়াতের মাধ্যমে নারীদের নিকট থেকে আনুগত্যের শপথ গ্রহণের আদেশ দেন এবং এর শর্তসমূহ ও যোগ্যতাসমূহ বর্ণনা করেন। কিছুসংখ্যক বর্ণনা অনুসারে দেখা যায়, কয়েকজন সাহাবী এসব শর্ত ও যোগ্যতা সম্পর্কে মহানবীকে জিজ্ঞেস করেন। মহানবী (সা.) পূর্ণাঙ্গরূপে তার জবাব দেন। হুদায়বিয়ার শান্তিচুক্তিতে এবং মক্কা বিজয়ের সময় নারীর আনুগত্য এটি নির্দেশ করে যে, ইসলাম ধর্ম অনুসারে নারীর এই অধিকার আছে যে, পুরুষের পাশাপাশি নারীও রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়াদিতে মতামত দেবেন, তাঁর সাধ্যমতো দায়িত্ব ও কর্তব্যের অংশীদার হবেন। [হোসাইন শাফেয়ী, ‘কোরআনে নারীর মর্যাদা সম্পর্কিত কতিপয় আয়াত’, সিরাজ, নং ১, ১৩৭২ ফারসি সাল, পৃ. ৬৪]
পবিত্র কোরআনের সূরা বাকারার ২২৮ নং আয়াত- ‘…এবং (শরীয়ত অনুযায়ী) তাদের (নারী) জন্য (পুরুষের ওপর) ন্যায়সঙ্গত কিছু অধিকার আছে যেমন তাদের ওপর পুরুষের আছে…’-নির্দেশ করে যে, নারীর মূল্যবান অধিকার তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয়।
পবিত্র কোরআনে আরো বলা হয়েছে : ‘অতঃপর তোমার নিকট যখন জ্ঞান (কুরআন) এসে গেছে, এরপরও যদি কেউ (খ্রিস্টান) তোমার সাথে তার (ঈসার) সম্বন্ধে তর্ক-বিতর্ক করে, তবে বল, ‘(আচ্ছা, ময়দানে) এস, আমরা আহ্বান করি আমাদের পুত্রদের এবং তোমাদের পুত্রদের, আমাদের নারীদের এবং তোমাদের নারীদের, এবং আমাদের সত্তাদের এবং তোমাদের সত্তাদের।’ অতঃপর সকলে মিলে (আল্লাহর দরবারে) নিবেদন করি এবং মিথ্যাবাদীদের ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত বর্ষণ করি।- (সূরা আলে ইমরান : ৬১)
সুতরাং পবিত্র কোরআন এবং উপরোল্লিখিত দুটি আয়াত অনুসারে এটি বলা যেতে পারে যে, রাজনৈতিক বিষয়াদিতে নারীর অধিকারকে সম্পূর্ণরূপে সংরক্ষণ করা হয়েছে। [যাহরা মুস্তাফাভী, ‘ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মে নারীর মর্যাদার ওপর এক নজর’, ১৩৬৯ ফারসি সাল, পৃ. ২৪-২৬]
ইসলামের প্রাথমিক ইতিহাসও নারীর রাজনৈতিক ভূমিকাকে নির্দেশ করে; ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠায় হযরত খাদীজা (আ.)-এর প্রত্যক্ষ কর্মকা- এবং কার্যকরী ভূমিকা এবং সেসবের ব্যাপকতা স্ফটিকস্বচ্ছ যে, তিনি ছিলেন মহানবী (সা.)-এর অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক পৃষ্ঠপোষক।
ইসলামি বিপ্লবের দুই দশক পূর্ব থেকে অর্থাৎ ৪০ ও ৫০ এর দশকে নারী সামাজিক, পেশাগত এবং শিক্ষা অঙ্গনে ধীরে ধীরে পদার্পণ করতে থাকে। ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের সময় ইরানি সমাজ কিছুসংখ্যক আধুনিক ভোগবাদীকে প্রত্যক্ষ করে। যদিও সেসময় সামাজিক কর্মকা-ে নারীর উপস্থিতি ছিল, কিন্তু তাঁদের ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্য বিরাজ করছিল। নারীরা ধীরে ধীরে তাঁদের প্রতি কৃত রাজনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের সাথে পরিচিত হচ্ছিলেন।
এসবকিছুই সংঘটিত হয়েছিল স্বৈরাচারী রাজবংশের অধীনে। এমনটি দাবি করার পেছনে কারণ হলো পূর্ববর্তী শাসকরা নারীর সাথে একজন বন্দির মতো আচরণ করত এবং তারা লাম্পট্য ও অনৈতিকতাকে সভ্যতার নিদর্শন বলে গণ্য করত। এর ফলে মানবীয় ও নৈতিক মূল্যবোধ ধসে পড়ে। কিছুসংখ্যক নিবেদিতপ্রাণ বিপ্লবী নারী এসব অনৈতিকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান এবং মানুষের চিন্তাধারাকে আলোকিত করার জন্য চেষ্টা করেন। এর ফলে শাহী সরকারের সময় তাঁদেরকে জেলখানায় বন্দি করা হয়। কিন্তু বিপ্লবের কিরণ ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হতে থাকে। এই সময়ে নারী অতীতের চেয়ে অধিক সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।

ইরানের সামাজিক বিবর্তনে নারীর ঐতিহাসিক পটভূমি
এখানে যেটি উল্লেখ করা প্রয়োজন তা হলো, ইসলামি বিপ্লবের সময় সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্রমবিকাশে নারীর সবচেয়ে বেশি কার্যকরী এবং প্রভাবশালী উপস্থিতির বিষয়টি ছিল তাঁদের ‘বিরোধিতা’র সাথে সম্পর্কিত। এই বিরোধিতা ছিল ইমামের খোমেইনীর নেতৃত্বে এবং তাঁর অনুসারীদের তত্ত্বাবধানে। তাঁরা স্বতস্ফউর্তভাবে এই ‘বিরোধিতাকারী’র ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এবং এটি মানুষের স্বাধীনতা ও ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। বিস্ময়করভাবে, বিপ্লবী বিক্ষোভ মিছিলগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছাত্রী অথবা প্রশাসনে চাকুরিরত নারীর তুলনায় গৃহিণী নারীদের ভূমিকা ছিল অধিক।
বিপ্লবী বিক্ষোভ মিছিল ও অন্যান্য কর্মকাণ্ডে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারীর অংশগ্রহণ ইসলামি বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। কারণ, জনসংখ্যার অর্ধেক ছিলেন নারী এবং তাঁরা বিপ্লবের সময় তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। নারীদের ভূমিকার বিষয়টি এজন্য সংবেদনশীল যে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁদের কর্মকাণ্ডের গভীর প্রভাব রয়েছে।
ইসলামি বিপ্লবের সময়, ইসলামি বিপ্লবের পরে এবং পবিত্র প্রতিরক্ষার যুদ্ধের সময়ও নারীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। ইসলামি বিপ্লবে উপস্থিতির মাধ্যমে ইরানি নারীরা দুটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য অর্জন করেন : অত্যাচারীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং নারীর প্রতি সমাজের মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন সাধন।
ইমাম খোমেইনী সমাজে নারীর ভূমিকা ও উপস্থিতির প্রতি অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। নারীর এই নতুন ভূমিকা ইসলামের কাঠামো এবং হযরত ফাতিমা (আ.)-এর অনুসরণের মধ্যেই রয়েছে। পবিত্র প্রতিরক্ষার যুদ্ধের সময় এটি প্রতিভাত হয়েছে যে, এ যুদ্ধে নারীরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন যা ব্যতীত কোন কিছুই অর্জন করা সম্ভব ছিল না। নারীর কেন্দ্রীয় বা প্রধান ভূমিকার প্রতি নির্দেশ করে ইমাম খোমেইনী বলেছিলেন : ‘আমাদের যা কিছু রয়েছে, তার সবকিছুই নারীর কারণে…’

ইসলামি বিপ্লবে নারীর মৌলিক ভূমিকা
ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের পূর্বে ইরানি নারীরা বিভিন্ন ভূমিকা পালন করেছিলেন। এখানে নারীর দুটি মৌলিক ভূমিকা উল্লেখ করা হয়েছে যা ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর বক্তব্যে বারংবার শোনা যেত।

১. নারী : ইসলামি আন্দোলনের নেতা
ইসলামি বিপ্লবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেইনী, যিনি তাঁর বক্তব্যে কখনই অত্যুক্তি বা অবমূল্যায়ন করতেন না, তিনি ইসলামি বিপ্লবের সময় নারীর ভূমিকা সম্পর্কে বলেন : ‘পুরুষরা নারীদের অনুসরণে বিক্ষোভ মিছিল সংঘটিত করেছিল।’ এবং ‘ ইরানি নারীরাই কোম ও অন্যান্য শহরে বিপ্লবের অগ্রদূত।’
২. ইসলামি বিপ্লবের দিকে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা
ইমাম খোমেইনী প্রায়ই বলতেন : ‘নারী পুরুষদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছে; আমাদের জাতি সাহসী নারীদের আত্মমনোবলের নিকট ঋণী।’ অনেক ক্ষেত্রেই ইমাম খোমেইনী নারীকে বিপ্লবের সংকটময় মুহূর্তগুলোতে পুরুষকে ‘সাহস সঞ্চারকারী’ ও ‘প্রাণশক্তিতে উজ্জীবিতকারী’ হিসেবে পরিচিত করিয়েছেন।
বিপ্লবপূর্ব ইরানি সমাজে বিজাতীয় সংস্কৃতির আধিপত্য এবং একটি বিশেষ সামাজিক শ্রেণি গঠনের কারণে নারী সবধরনের রাজনৈতিক আন্দোলন ও কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। ইরানের বিপ্লবের পূর্বে সমাজে দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে নারীর অবস্থানকে বিবেচনা করা হতো-
একটি দৃষ্টিকোণ থেকে নারীকে নৈতিকতা-বিবর্জিত পুরুষের বিনোদনের কাজে ব্যবহারের একটি সুন্দর ও আকর্ষণীয় উপাদান হিসেবে দেখা হতো। আরেকটি দৃষ্টিকোণ থেকে নারীকে দুর্বল লতার মতো মনে করা হতো যারা কোন শক্তি ও জবরদস্তিকে প্রতিহত করতে পারে না এবং কোন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনেও সক্ষম নয়।
বিপ্লবের সময় যুগপৎভাবে ইরানি নারীরা অপবিত্রতা ও অবক্ষয়ের খাঁচা ভেঙে ফেলতে সক্ষম হন এবং পুরুষের সহযোগী হয়ে তৎকালীন সমাজের বিরুদ্ধে প্রতিমাচূর্ণকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।

বিজয়ে কার্যকরী ভূমিকা পালন
ইরানের ইসলামি বিপ্লব কিছু অনন্য গুণ-বৈশিষ্ট্য ধারণ করে আছে যা একে বিশ্বের অন্যান্য বিপ্লব থেকে পৃথক করেছে। এসব বৈশিষ্ট্যের অন্যতম হলো বিপ্লবে নারীর ভূমিকা। [শহীদ আয়াতুল্লাহ মুর্তাজা মোতাহ্হারী, ইসলামি প্রজাতন্ত্রের ওপর বক্তব্য থেকে, কোম, সেদার ১৩৭৪]

বিপ্লবোত্তর নারী
ইসলামি বিপ্লবের আরেকটি বিশেষ দিক হলো, নারীর উপস্থিতি কেবল বিক্ষোভ মিছিল ও আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং বিপ্লবের লক্ষ্যকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রেও তাঁরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। বিপ্লব বিজয়ের পর ইরানি নারীরা পুরুষের মতোই দেশের প্রতিটি কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেন।
ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেইনী সমাজের অগ্রগতি এবং ইসলামি বিপ্লবের ক্রমোন্নতিতে নারীর অবস্থানের ওপর আলোকপাত করেন। এটিই সত্য এবং প্রকৃতপক্ষে ইসলামি বিপ্লব ইরানি নারীদের ধারাবাহিক প্রচেষ্টা কামনা করছিল যাতে তাঁরা পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন প্রলোভনের নিকট নতি স্বীকার না করেন- যা নারীকে তাদের শয়তানি ও ধ্বংসাত্মক লক্ষ্য পূরণের একটি হাতিয়ার বলে মনে করে। ইসলামি বিপ্লবের সর্বোচ্চ নেতা সবসময়ই সামাজিক ও রাজনৈতিক লক্ষ্যের ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকার ওপর জোর দিয়েছেন।

সংবিধানে নারী
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধান নারীর অধিকার, সামাজিক কর্মকা-ে তাঁদের অংশগ্রহণের সুযোগ এবং আইনের সামনে পুরুষের মতোই সাম্য ও নিরপেক্ষতার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে। সংবিধানের ৩ নং ধারার ১৪ নং অনুচ্ছেদে এটি উল্লেখ করা হয়েছে যে, নারী-পুরুষের সকল অধিকার প্রদান এবং সকলের জন্য আইনগত সুরক্ষার পাশাপাশি সকলের জন্য সমানাধিকার নিশ্চিত করা ইসলামি সরকারের জন্য বাধ্যতামূলক। আইনের ২১ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইসলামি নীতির ভিত্তিতে সকল নারীর অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করতে সরকার বাধ্য। এই আইন অনুসারে সরকারকে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো সম্পাদন করতে হবে :
১. নারীর অর্থনৈতিক ও আধ্যাত্মিক অধিকারের পুনরুজ্জীবনসহ স্বকীয় বৈশিষ্ট্যসমূহের উন্নয়নে যথাযথ ভিত্তি গড়ে তোলা।
২. নারীর প্রতিরক্ষা এবং পরিপোষণ করা, বিশেষ করে গর্ভধারণের সময়কালে এবং এতিমের অভিভাবকত্ব গ্রহণ।
৩. পরিবারের ভিত্তিকে রক্ষার জন্য নিরপেক্ষ আদালত প্রতিষ্ঠা।
৪. বয়স্ক নারীদের জন্য বিশেষ বিমা সুবিধা প্রদান।
৫. আইনগত অভিভাবকের অনুপস্থিতিতে অসহায় মায়েদের অভিভাবকত্ব গ্রহণ।
এ দৃষ্টিকোণে সমাজের নারীরা যাঁরা অনেক সামাজিক ক্ষতি ভোগ করে আসছিলেন এবং ইসলামি ও মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন তাঁদেরকে সত্যিকার ইসলামি সেবা দেয়া হয়। সংবিধান প্রথমত, পরিবারে মা হিসেবে নারীদের যে প্রাথমিক ভূমিকা রয়েছে তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে; দ্বিতীয়ত, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকাকে সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা এবং সমাজের অগ্রগতির জন্য পূর্বশর্ত হিসেবে বিবেচনা করেছে।

সূত্র: ইরানের Islamic Thought Foundation কর্তৃক প্রকাশিত নারী সাময়িকী Mahjuba, January, ২০১৭
অনুবাদ : মো. আশিফুর রহমান