All posts by pavel

সংবাদ বিচিত্রা (বিদেশী সংবাদ)

ইরানের সর্বোচ্চ নেতার সঙ্গে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাক্ষাৎ
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী মার্কিন ষড়যন্ত্র স¤পর্কে সতর্ক থাকতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ব্লাদিমির পুতিনের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, পশ্চিম এশিয়া নিয়ে আমেরিকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা রয়েছে যা এ অঞ্চলের সব দেশ বিশেষ করে ইরান ও রাশিয়ার স্বার্থের পরিপন্থি।
ইরানে অনুষ্ঠিত গ্যাস রপ্তানিকারক দেশগুলোর ফোরাম জিইসিএফ’র তৃতীয় শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে পুতিন গত ২৩ নভেম্বর ২০১৫ তেহরান পৌঁছেই সর্বোচ্চ নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ওই সাক্ষাৎ অনুষ্ঠানে আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, মার্কিন ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিতে হলে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে এবং দু’দেশের মধ্যে যোগাযোগ রাখতে হবে।
প্রায় দু’ঘণ্টাব্যাপী এ সাক্ষাতে আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী বলেন, পুরো পশ্চিম এশিয়ার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে আমেরিকার এবং এ জন্য তারা সিরিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এরপর মার্কিনিরা পুরো পশ্চিম এশিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পরিকল্পনা করছে। এ ষড়যন্ত্র আঞ্চলিক সব দেশ বিশেষ করে ইরান ও রাশিয়ার জন্য মারাত্মক হুমকি।
আঞ্চলিক ইস্যুতে বিশেষ করে সিরিয়ার চলমান দ্বন্দ্বে রাশিয়ার ভূমিকার প্রশংসা করে সর্বোচ্চ নেতা বলেন, এতে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মস্কোর তথা প্রেসিডেন্ট পুতিনের অবস্থান অনেক উন্নত হয়েছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, সিরিয়ার যেকোনো সমাধান হতে হবে দেশটির জনগণ ও কর্মকর্তাদের মতামতের ভিত্তিতে।
রাহবার তাঁর বক্তব্যের এক পর্যায়ে দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে ইরান ও রাশিয়ার মধ্যকার স¤পর্ককে স্বাগত জানিয়ে তা আরো উন্নত করার কথা বলেন। পরমাণু ইস্যুতে তিনি বলেন, বিষয়টির যদিও এক ধরনের সমাপ্তি এসেছে তবে এ বিষয়ে তেহরান চোখ-কান খোলা রেখেছে। ইরানের বিষয়ে রাশিয়ার অবস্থানেরও প্রশংসা করেন আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী।
সাক্ষাৎ অনুষ্ঠানে পুতিন বলেন, সিরিয়া ইস্যুতে তেহরান ও মস্কো খুবই ঘনিষ্ঠ অবস্থান নিয়েছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, তাঁর দেশ মনে করে সিরিয়া সমস্যার সমাধান হবে শুধু রাজনৈতিক উপায়ে এবং দেশটির জনগণের চাহিদার ভিত্তিতে।
তিনি পরিষ্কার করে বলেন, সিরিয়া ইস্যুতে নিজের ইচ্ছা দামেস্কের ওপর চাপিয়ে দেয়ার অধিকার কোনো দেশের নেই। এছাড়া, সিরিয়ার সরকারের কাঠামো এবং কে প্রেসিডেন্ট হবেন তা ঠিক করে দেয়ারও এখতিয়ার কারো নেই। এ সময় পুতিন বলেন সিরিয়া সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের ক্ষেত্রে তেহরান-মস্কো সহযোগিতা জোরদার করতে হবে। নিরাপত্তা, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ইরানের সঙ্গে সক্রিয় সহযোগিতার বিষয়ে পুতিন তাঁর দেশের অবস্থানের কথাও তুলে ধরেন।
আলোচনা শেষে রুশ প্রেসিডেন্ট ইরানের সর্বোচ্চ নেতাকে একখানা কুরআন শরীফ উপহার দেন। এটি হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো কুরআনগুলোর একটি।একটি চমৎকার বাক্সে করে রাশিয়া থেকে কুরআনটি সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট। সর্বোচ্চ নেতা কুরআন শরিফটি পড়ে দেখেন এবং মূলব্যান এ উপহারের জন্য পুতিনকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।

নিষেধাজ্ঞায় স্বয়ংস¤পূর্ণ হয়েছেন ইরানী বিজ্ঞানীরা : রাহবার
গত ১১ নভেম্বর ২০১৫ ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের রাহবার বলেন, পশ্চিমা দেশগুলো তেহরানকে পরমাণু জ্বালানি সরবরাহ করতে গড়িমসি করায় ইরানের তরুণ বিজ্ঞানীরা নিজেদের মাটিতে এই জ্বালানি উৎপাদন করেছেন। ইরানের বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর ও শিক্ষকদের এক সমাবেশে এ মন্তব্য করেন আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী।
তিনি বলেন, ‘ইরানকে ২০ মাত্রায় সমৃদ্ধ পরমাণু জ্বালানি সরবরাহ করার ক্ষেত্রে পশ্চিমা দেশগুলো তেহরানকে অবমাননাকর শর্ত দিয়েছিল। তবে এতে লাভ হয়েছে আমাদের এবং আমাদের তরুণরা দেশের ভেতরেই তা উৎপাদন করতে পেরেছে।’ তিনি বলেন, ইরানি তরুণ বিজ্ঞানীদের এ সাফল্য পশ্চিমা দেশগুলোর পিঠ দেয়ালে ঠেকিয়ে দেয় এবং তারা তেহরানের সঙ্গে পরমাণু আলোচনায় বসতে বাধ্য হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের চেয়ে ১৪০ বছর আগে বৈজ্ঞানিক উন্নতি শুরু করেছে উল্লেখ করে আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেন, ‘বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির দিক দিয়ে আমাদের দ্রুতগতিতে বিশ্ব হতবাক হয়ে গেছে। তারা বলছে, বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির দিক দিয়ে ইরান অন্যান্য দেশের তুলনায় ১৩ গুণ বেশি গতিতে এগুচ্ছে।’ তবে একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির দিক দিয়ে ইরান এখনও দুই ধাপ নিচে অবস্থান করায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন সর্বোচ্চ নেতা।

আত্মোৎসর্গকারী সেনা পরিবারের সঙ্গে বড়দিনে সর্বোচ্চ নেতার সাক্ষাৎ
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী আত্মোৎসর্গকারী ইরানী খ্রিস্টান সেনা পরিবারগুলোর সঙ্গে বড়দিনে সাক্ষাৎ করেন। এ জন্য গত ২৭ ডিসেম্বর ২০১৫ আত্মোৎসর্গকারী সেনা পারিবারগুলোর বাড়ি যান ইরানের সর্বোচ্চ নেতা। এসব সেনা আট বছরের ইরান-ইরাক যুদ্ধে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করেছেন।
টুইটার অ্যাকাউন্টে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, আত্মোৎসর্গকারী এক খ্রিস্টান সেনার মায়ের সঙ্গে বৈঠক করছেন আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী। ইরানের সর্বোচ্চ নেতার টুইটার অ্যাকাউন্টে দেয়া বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে এ ধরনের আরো ছবি প্রকাশ করা হবে।
এদিকে, বড়দিনে সর্বোচ্চ নেতার টুইটার বার্তায় বলা হয়, পুরো খ্রিস্টানজগতের চোখে হযরত ঈসা (আ.)-এর যে অবস্থান রয়েছে মুসলমানরা তাঁকে তার চেয়ে কম শ্রদ্ধা করেন না।

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা ও মুসলমানদের ঐক্য চায় : প্রেসিডেন্ট রুহানি
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি বলেন, ইরান মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে স্থিতিশীলতা আনয়নে ও উন্নয়নে অবদান রাখতে এবং মুসলিম জাহানে ঐক্য ও সংহতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চায়।
প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি গত ৫ই ডিসেম্বর (২০১৫) তেহরানে সেনেগাল, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, বেলজিয়াম, পাকিস্তান, ডেনমার্ক, গ্রীস, শ্রীলঙ্কা ও মালয়েশিয়ায় নব নিযুক্ত ইরানী রাষ্ট্রদূতগণের সাথে এক বৈঠকে এ কথা বলেন।
প্রেসিডেন্ট রুহানি এ বৈঠকে বলেন, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বৈদেশিক নীতিতে মুসলিম জাহানে ঐক্য, সংহতি ও ভ্রাতৃত্ব গড়ে তোলাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ইরান সরকার মুসলিম দেশসমূহের সাথে সম্পর্কের উন্নয়নের ওপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করছে।
গত জুলাই মাসে (২০১৫) ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান ও ছয়টি বৈশ্বিক শক্তির মধ্যে যে চুক্তি সম্পাদিত হয়Ñ যা যৌথ সমন্বিত কর্ম পরিকল্পনা (জেসিপিওএ) হিসেবে পরিচিতÑ তার ফলে ইরান যেসব সুযোগ-সুবিধা পাবে প্রেসিডেন্ট রুহানি দেশের স্বার্থে অন্যান্য দেশের সাথে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য সেসব সুবিধার সর্বোচ্চ ব্যবহারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন।
প্রেসিডেন্ট রুহানি বলেন, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান অন্যান্য দেশের সাথে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে অগ্রগতি ও টেকসই উন্নয়নের অধিকারী হতে সক্ষম। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে ইরানী কূটনীতিকগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট আরো বলেন যে, যৌথ সমন্বিত কর্ম পরিকল্পনা (জেসিপিওএ) ইরান ও অন্যান্য দেশের মধ্যে সহযোগিতা ও সমঝোতা বৃদ্ধির জন্য একটি বিরাট সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। তিনি আরো বলেন, বর্তমান বিশ্বে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যথাযথ প্রচার চালানোর ক্ষেত্রে পতাকাবাহী হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।
উল্লেখ্য, গত ১৪ই জুলাই (২০১৫) তারিখে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান এবং ৫+১ জাতি হিসেবে পরিচিত ছয়টি বৈশ্বিক শক্তিÑ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন ও জার্মানিÑ ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সংক্রান্ত বিরোধ নিরসনে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে সক্ষম হয়। ইতিপূর্বে এ বিরোধকে কেন্দ্র করে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধে যেসব অর্থনৈতিক ও আর্থিক নিষেধাজ্ঞা এবং আরো কতগুলো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে ইরান সরকার স্বীয় পারমাণবিক কর্মসূচিতে কতক সীমাবদ্ধতা মেনে নেয়ায় তার বিনিময়ে এসব নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

২৯তম আন্তর্জাতিক ইসলামী ঐক্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর পবিত্র জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ইরানসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলামী ঐক্য সপ্তাহ পালিত হয়।
ইসলামী ঐক্য সপ্তাহ উপলক্ষে গত ২৭ থেকে ২৯ ডিসেম্বর ২০১৫ ইরানের রাজধানী তেহরানে অনুষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক ইসলামী ঐক্য সম্মেলন। ২৯তম এ সম্মেলনে বিশ্বের ৭০টি দেশের ৩০০জন ইসলামী চিন্তাবিদ ও আলেম যোগ দেন। এতে ইরানেরও ৩০০ জন প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব অংশ নেন। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি এ সম্মেলনের উদ্বোধন করেন।
উল্লেখ্য, গত তিন দশকেরও বেশি সময়ের ধরে এই পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে ইমাম খোমেইনী (রহ.) ঘোষিত ঐক্য সপ্তাহ উদযাপন বিশ্ব মুসলমানের ঐক্য জোরদারে সহায়ক ভূমিকা পালন করে আসছে।

‘সর্বোচ্চ নেতার চিঠি দায়েশের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়েছে : তিজিয়ানা চিভারদিনি
গত ৭ ডিসেম্বর ২০১৫ ইতালির বিশিষ্ট সাংবাদিক তিজিয়ানা চিভারদিনি বলেন, ‘তাকফিরি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএসআইএল বা দায়েশ ইসলাম ও মুসলমানদের ওপর আঘাত হানার জন্য ইসলামের নামেই নানা সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাচ্ছে, কিন্তু ইরানের সর্বোচ্চ নেতার চিঠি তাদের এ ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে দিয়েছে।’
পশ্চিমা যুবসমাজকে উদ্দেশ্য করে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা তাঁর দ্বিতীয় চিঠিতে লেখেন, তাকফিরি সন্ত্রাসবাদের প্রকাশ্য ও নিশ্চিত পৃষ্ঠপোষকরা সবচেয়ে পশ্চাৎপদ রাজনৈতিক ব্যবস্থার অধিকারী হওয়ার পরও সব সময় পাশ্চাত্যের মিত্র হিসেবে স্থান পেয়েছে। তাঁর এ মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ইতালির সাংবাদিক চিভারদিনি আরও বলেন, ইউরোপ ও ইতালির জনগণ তাকফিরি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দায়েশ বা আইএসআইএল এবং ইসলামের মধ্যে পার্থক্য কী তা বোঝে না। তাঁর মতে সন্ত্রাসবাদের বিষয়ে পাশ্চাত্যের আসল ভূমিকা এ চিঠিতে উঠে এসেছে বলেই পশ্চিমা মিডিয়াগুলো এই চিঠি প্রচারের ক্ষেত্রে হাস্যকর সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছে।
তিনি বলেন, ইরানের সর্বোচ্চ নেতার এই চিঠি এতই আন্তরিক যেন একজন পিতা তাঁর সন্তানের সঙ্গে কথা বলছেন। সাংবাদিক চিভারদিনি মনে করেন, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী পশ্চিমা যুব সমাজকে দেয়া বার্তায় পশ্চিমা সমাজের চলমান আতঙ্কের কারণ খুব সহজ ভাষায় তুলে ধরেছেন। এই চিঠি পড়লে ইউরোপের বর্তমান সংকটগুলোর কারণ জানা যাবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
ইতালির আরেক সাংবাদিক লুকা পিনাসকো বলেন, পশ্চিমা যুবসমাজের কাছে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার এই বাণী অত্যন্ত সময়োচিত ও সচেতন পদক্ষেপ। কারণ, পশ্চিমারা মুসলিম ও আরব বিশ্বের ঘটনাবলিকে উপেক্ষা করছে; অন্যদিকে নিজেদের বিরুদ্ধে নানা সহিংসতায় মুসলমানদেরকেই অপব্যবহার করছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা ইহুদিবাদী ইসরাইলের অপরাধযজ্ঞকেও তুলে ধরেছেন বলে লুকা পিনাসকো মন্তব্য করেন।

ইরানে সংসদ নির্বাচন, প্রার্থী বাছাই শুরু
ইরানের ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য সাড়ে ১১ হাজারের বেশি প্রার্থী নাম নিবন্ধন করিয়েছেন। এদের মধ্যে ১১ শতাংশই নারী। ২০১২ সালের সংসদ নির্বাচনের তুলনায় এবারের নির্বাচনে নিবন্ধিত প্রার্থীর সংখ্যা ৭০ ভাগ বেড়েছে।
১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লব সফল হওয়ার পর এবারই ইরানে নির্বাচনের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রার্থী নাম নিবন্ধন করেছেন। ইরানের সংবিধান অনুযায়ী, নিবন্ধিত প্রার্থীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের যোগ্যতার বিষয়টি যাচাই করবে অভিভাবক পরিষদ। আগামী ৯ ফেরুয়ারি চূড়ান্তভাবে নির্বাচনের জন্য যোগ্য প্রার্থীদের নাম প্রকাশ করবে এ পরিষদ।
২৬ ফেব্রুয়ারি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ইরানের সংসদ মজলিশে শূরার ২৯০টি আসনের জন্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন প্রার্থীরা।
এদিকে, একইদিনে ইরানের বিশেষজ্ঞ পরিষদের ৫ম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ পরিষদ ইরানের সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচন করে থাকে। প্রতি আট বছর অন্তর বিশেষজ্ঞ পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং চলতি বছরেই প্রথমবারের মতো সংসদ নির্বাচনের দিনে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

ইসলামী জাহানে আন্তঃক্রিয়ার সন্ধানরত মুহম্মদ মুস্তাফা (সা.) বিজ্ঞান পুরস্কার আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সমাজে স্থান করে নেবে
জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেস্কো)-এর তেহরানস্থ ক্লার্স্টা অফিসের পরিচালক ও প্রতিনিধি এর্স্থা কুনিসেহ্ লারোচে বলেছেন, যেহেতু মুহম্মদ মুস্তাফা (সা.) বিজ্ঞান পুরস্কার ইসলামী জাহানে বৈজ্ঞানিক আন্তঃক্রিয়ার সন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে সেহেতু এ পুরস্কার আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সমাজে স্থান করে নিতে সক্ষম হবে। গত ৬ই ডিসেম্বর (২০১৫) তেহরানে মুস্তাফা (সা.) বিজ্ঞান পুরস্কার-এর গণসংযোগ বিভাগের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য প্রদান করা হয়।
উক্ত বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় যে, এর্স্থা কুনিসেহ্ লারোচে একটি সুনির্দিষ্ট সময়ে মুসলিম দেশ সমূহে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে সীমিত উন্নতি হওয়ার কথা উল্লেখ করে বলেন, ৫৭ সদস্য বিশিষ্ট ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা তার মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিএনপি) মাত্র ০.৮১ শতাংশ বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও উৎপাদনের কাজে বিনিয়োগ করে থাকে যা অন্যান্য দেশে এ খাতে বাজেট বরাদ্দের শতকরা হারের তুলনায় মাত্র এক তৃতীয়াংশ।
এর্স্থা কুনিসেহ্ লারোচে বলেন, তবে অসংখ্য বৈজ্ঞানিক মনে করেন যে, মুসলিম জাহানে বৈজ্ঞানিক সচেতনতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এসব দেশে অত্যন্ত উঁচু মানের প্রচুর বৈজ্ঞানিক গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে।
তিনি বর্তমানে বিজ্ঞান গবেষণায় ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে বলেন যে, বিজ্ঞানের প্রধান প্রধান ক্ষেত্রে গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচনার দিক থেকে ইরান শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। তিনি বলেন, উদাহরণ স্বরূপ, ইরান বিজ্ঞান ক্ষেত্রে, বিশেষত অঙ্কশাস্ত্রে যেসব গবেষণামূলক প্রবন্ধ উৎপাদন করেছে প্রকৃতপক্ষে সেগুলোর মান এ ক্ষেত্রে গড় আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় বেশি।
এর্স্থা কুনিসেহ্ লারোচে আরো বলেন, ন্যানোটেকনোলোজি বা বায়োটেকনোলোজি সহ কয়েকটি প্রধান বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সর্বাধিক উন্নত দেশ সমূহের অন্যতম হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে। তিনি বলেন, এ কারণে আমি আশা করি যে, ইরান ও মুসলিম জাহান অতীতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে স্বর্ণ যুগের অধিকারী ছিল পুনরায় সে গৌরব ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে।
তিনি মুসলিম জাহানে মুস্তাফা (সা.) বিজ্ঞান পুরস্কার-এর ইতিবাচক ও প্রভাবশালী ভূমিকার কথা উল্লেখ করে বলেন, আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সম্প্রদায়ের কাছে একটি সুনামের অধিকারী পুরস্কার হিসেবে পরিগণিত মুস্তাফা (সা.) বিজ্ঞান পুরস্কার অবশ্যই যথাযথ মূল্যায়ন ও অবস্থানের অধিকারী হবে। এ পুরস্কারটি প্রদানের জন্য বিজ্ঞানের ছয়টি বিভাগে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হবে এবং চার জন বিজ্ঞানীকে স্বর্ণপদক প্রদান করা হবে। এছাড়া বিজয়ী বিজ্ঞানীদেরকে পাঁচ লাখ মার্কিন ডলার পরিমাণ নগদ অর্থও প্রদান করা হবেÑ যা বিজ্ঞানী ও গবেষকগণকে তাঁদের কাজে উৎসাহিত করার জন্য একটি খুবই ভালো উদ্যোগ।
এর্স্থা কুনিসেহ্ লারোচে মুস্তাফা (সা.) বিজ্ঞান পুরস্কার ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক পুরস্কারের মধ্যকার পার্থক্য তুলে ধরেন এবং এ পুরস্কারটির ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন, বিশ্বে অনেকগুলো আন্তর্জাতিক পুরস্কার রয়েছে, তবে এগুলোর মধ্যে খুব কম সংখ্যক পুরস্কারই বিশেষভাবে বিজ্ঞানের বিষয়ের ওপরে অথবা স্কুল ছাত্র-ছাত্রী গ্রুপ বা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-ছাত্রী গ্রুপের ন্যায় বিশেষ গ্রুপের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে থাকে। তিনি বলেন, আমি মনে করি যে, মুস্তাফা (সা.) বিজ্ঞান পুরস্কার বিশেষভাবে আকর্ষণীয় একটি পুরস্কার।
উল্লেখ্য, ২৪ থেকে ২৯ ডিসেম্বর (২০১৫) তেহরানে অনুষ্ঠিত এক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রথমবারের মত মুহম্মদ মুস্তাফা (সা.) বিজ্ঞান পুরস্কার প্রদান করা হয়।

ভিয়েনায় বিদেশি শিক্ষাবিদদের কাছে ইরানী শিল্প ও সংস্কৃতির পরিচয় উপস্থাপন
অস্ট্রিয়াস্থ ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দূতাবাসের সাংস্কৃতিক অ্যাটাচের দফতরের পক্ষ থেকে দেশটির রাজধানী ভিয়েনায় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বিদেশি শিক্ষাবিদদের কাছে ইরানের শিল্প ও সংস্কৃতির পরিচয় তুলে ধরা হয়। গত ১৯শে নভেম্বর (২০১৫) আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষক ও ছাত্র অংশগ্রহণ করেন।
এতে অংশগ্রহণকারীদেরকে বিশেষভাবে ইরানের উদ্যান পরিকল্পনা এবং বিশ্ববিশ্রুত স্বনামখ্যাত কবি, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও গণিতবিশারদ ওমার খাইয়ামের রুবাঈ‘আতের সাথে অধিকতর পরিচিত করার লক্ষ্যে এ অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়।
এ অনুষ্ঠানে বিশেষভাবে ওমার খাইয়ামের বিশ্ববিখ্যাত শিল্পকলাসমৃদ্ধ সাহিত্যকর্ম ‘রুবা‘ঈয়াত্’ উপস্থাপন করা হয় ও তার পরিচিতি তুলে ধরা হয় এবং সেই সাথে এ গ্রন্থের ইংরেজি, জার্মান, ফ্রেঞ্চ ও আরবি অনুবাদও প্রদর্শন করা হয়। এছাড়া এ অনুষ্ঠানে ইরানী ক্যালিগ্রাফি ও মিনিয়েচার প্রদর্শন করা হয় এবং সেগুলোর পরিচিতি তুলে ধরা হয়।
এ অনুষ্ঠানে ইরানের উদ্যান পরিকল্পনার পরিচিতি উপস্থাপন প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় যে, সুপ্রাচীন কাল থেকেই ইরানে বিশেষভাবে আবহাওয়া বৈচিত্র্যের সাথে খাপ খাইয়ে সুপরিকল্পিতভাবে বাগান গড়ে তোলা হয় এবং এ কারণে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (ইউনেস্কো) তার বৈশ্বিক উত্তরাধিকার তালিকায় ডিজাইন বৈচিত্র্যের দৃষ্টিকোণ থেকে অনন্য হিসেবে ইরানী উদ্যানকে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
উল্লেখ্য যে, প্রাচীন কাল থেকেই ইরানে উদ্যান পরিকল্পনার ক্ষেত্রে বেহেশতের বাগান কেমন সে সম্পর্কিত ধারণা ও কল্পনার অনুসরণের চেষ্টা করা হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে বাগানসমূহে আকাশ, মাটি, পানি ও গাছপালার সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করা হয়েছে। আর তাদের এ ধারণা বিশ্বের সর্বত্র উদ্যান পরিকল্পনাকে প্রভাবিত করেছে, আর তা পরবর্তীকালে মুসলমানদের উদ্যান পরিকল্পনার ভিত্তি তৈরি করেছে এবং আরো পরবর্তীকালে ইউরোপীয় উদ্যান ঐতিহ্যের মূল হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। ইরানী উদ্যান পরিকল্পনা অনুসরণের অনেক দৃষ্টান্ত ভারত উপমহাদেশে দেখা যায়, বিশেষ করে বিখ্যাত তাজমহল এ উদ্যান পরিকল্পনার ভিত্তিতেই নির্মিত হয়েছে।
আর ওমর খাইয়াম্ নেইশাবূরী (বাংলায় উচ্চারণ ‘নিশাপুরী’) হচ্ছেন বিশ্ববিশ্রুত শ্রেষ্ঠতম ইরানী কবিগণের অন্যতম। একই সাথে তিনি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী, বিশেষত জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসেবে সুপরিচিত। স্বনামখ্যাত ব্রিটিশ কবি ও লেখক এড্ওয়ার্ড ফিট্যেরাল্ড্ (১৮০৯ – ১৮৮৩) ওমর খাইয়ামের রুবা‘ঈয়াত্-এর যে ইংরেজি অনুবাদ করেন তার মাধ্যমে খাইয়াম পাশ্চাত্য জগতে ব্যাপক খ্যাতির অধিকারী হন এবং এরপর বিশ্বের সর্বত্র তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।

ইরানে জালাল আলে আহ্মাদ সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ীদের নাম ঘোষণা
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ সাহিত্য পুরস্কার- জালাল আলে আহ্মাদ্ সাহিত্য পুরস্কার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যকার বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। স্বনামখ্যাত ফারসি সাহিত্যিক, ছোট গল্পকার ও লেখক মরহূম জালাল আলে আহ্মাদ-এর নামে প্রবর্তিত এ পুরস্কারের জন্য অংশগ্রহণকারী গ্রন্থাবলির মধ্যে উপন্যাস বিভাগের প্রতিযোগিতায় দু’টি উপন্যাসকে যৌথভাবে প্রথম পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে।
গত ২১শে নভেম্বর (২০১৫) তেহরানের ওয়াহ্দাত্ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে এ সাহিত্য প্রতিযোগিতা সংক্রান্ত বিচারকম-লী তাঁদের রায় ঘোষণা করেন।
বিচারক ম-লীর রায়ে নাসীম র্মা‘আশী-র লিখিত ‘শরৎ হচ্ছে বছরের শেষ ঋতু’ এবং শাহ্রিয়ার আব্বাসীর লেখা ‘মহানুভব বালিকা’ যৌথভাবে শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের পুরস্কার লাভ করে। এছাড়া আরো কয়েকটি গ্রন্থকে উদ্ভাবনী ও সৃজনশীলতার জন্য প্রশংসাপত্র প্রদান করা হয়।
এ প্রতিযোগিতায় ছোটগল্প সংকলন বিভাগে মাহ্দী আসাদ্যদেহ্র ‘ধনভাণ্ডারের শিশুরা কি সফলকাম হয়?’ এবং মাজীদ ক্বেইছ¡ারী-র ‘অন্ধকারের প্রহরী’ প্রশংসাপত্র লাভ করে। অন্যদিকে সাহিত্য সমালোচনা বিভাগে আলী আব্বাসীর ‘ফলিত বর্ণনা পরিচিতি’ ও আবূল্ ফায্ল্ হোরীর ‘কল্পনার ভেলা’ প্রশংসা পত্র লাভ করে।
এছাড়া প্রামাণ্য রচনার ক্ষেত্রে বিচারক মণ্ডলীর রায়ে হামীদ্ হেস্সাম্-এর ‘পানি কখনো মরে না’ এবং শিল্পকলা ও ফুটবল বিষয়ক জনপ্রিয় ইরানী টিভি আলোচক হামীদ্ রেযা ছ¡াদ্র্-এর ‘তুমি ক্বায়রোতে মারা যাবে’ প্রশংসা পত্র লাভ করে।
উল্লেখ্য, মরহূম জালাল আলে আহ্মাদ (১৯২৩ – ১৯৬৯)-এর নামে ২০০৭ সালে রাষ্ট্রীয়ভাবে এ সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়। এবারের জালাল আলে আহ্মাদ সাহিত্য পুরস্কার প্রতিযোগিতা ছিল এ পর্যায়ের অষ্টম সাহিত্য পুরস্কার প্রতিযোগিতা। এতে বিজয়ীদেরকে ৩০ হাজার ডলার নগদ অর্থ পুরস্কার দেয়া হয়।

ইরান পেট্রো-রসায়ন প্রকল্পসমূহে ব্যপক বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারে : উড্ ম্যাকেঞ্জি
বৈশ্বিক এনার্জি, ধাতব পদার্থ ও খনিজ দ্রব্য সংক্রান্ত গবেষণা ও কন্সালট্যান্সি গ্রুপ উড্ ম্যাকেঞ্জি মন্তব্য করেছে যে, বর্তমানে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান স্বীয় পেট্রো-রসায়ন প্রকল্পসমূহে ৭০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে সক্ষম।
ব্রিটেনের স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গভিত্তিক এ গবেষণা ও কন্সালট্যান্সি গ্রুপটি- বিশ্বের আরো পঁচিশটি জায়গায় যার শাখা রয়েছেÑগত ৬ই ডিসেম্বর (২০১৫) ইস্যুকৃত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করে। উড্ ম্যাকেঞ্জির মতে, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান স্বীয় পেট্রো-রসায়ন প্রকল্পসমূহের আরো উন্নয়ন করতে চায় এবং সে লক্ষ্যে দেশটির কয়েকটি প্রধান পরিকল্পনা রয়েছে- যাতে দেশটি তার পেট্রো-রসায়ন খাতের সম্প্রসারণের লক্ষ্যে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।
উড্ ম্যাকেঞ্জি-র ইএমইএআরসি রিফাইনিং অ্যান্ড কেমিক্যাল্স্ রিসার্চ টীম্- যা ওলেফিন্স্ ও পলিওলেফিন্স্ স্পেশালাইজেশনের ক্ষেত্রে কাজ করে থাকে, তার অন্যতম বিশেষজ্ঞ জনাব আফসার হুসাইন বার্তা সংস্থা ট্রেন্ড-এর কাছে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে, স্বীয় পেট্রো-রসায়ন শিল্পের সম্প্রসারণের ব্যাপারে ইরানীদের খুবই উচ্চাভিলাষী বিভিন্ন পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া তাদের বিভিন্ন পরিকল্পনার আওতায় বিভিন্ন ফেস্-এর অনেকগুলো প্রকল্প রয়েছে।
আফসার হুসাইন আরো বলেন যে, কম ব্যয়সাপেক্ষ গ্যাস জ্বালানিভিত্তিক পেট্রো-রসায়ন ফীড্স্টক্ হিসেবে সুস্পষ্টতঃই ইরান একটি টেকসই লোকেশন। কারণ, মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রো-রসায়ন খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী আরব দেশসমূহের মধ্যে একমাত্র কাতার বাদে অন্যান্য দেশে কম ব্যয়সাপেক্ষ ইথেন্ সরবরাহের পরিমাণ খুবই সীমিত।
উল্লেখ্য, গত ১৩ ও ১৪ই ডিসেম্বর (২০১৫) তেহরানে ইরানের পেট্রো-রসায়ন শিল্পে বিনিয়োগ সম্পর্কে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ১৩৭টি খ্যাতনামা আন্তর্জাতিক কোম্পানি এ সম্মেলনে প্রতিনিধি প্রেরণ করে অংশগ্রহণ করে। বার্তা সংস্থা সিন্হুয়ার প্রতিবেদন অনুায়ী, এ সম্মেলনের প্রথম দিনে ইরান সরকারের তেলমন্ত্রী জনাব বিজন্ নামর্দা যাঙ্গানে বলেন যে, তাঁর দেশ আগামী বছরগুলোতে বার্ষিক পেট্রো-রসায়ন উৎপাদনের পরিমাণ ৭০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে চায় এবং এ লক্ষ্যে উপনীত হবার জন্য ইরানের এ খাতে ব্যাপকভিত্তিক বিনিয়োগ, এ দেশে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি স্থানান্তর এবং বিপণনের প্রয়োজন।
এর আগে গত এপ্রিল মাসে (২০১৫) ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পেট্রো-রসায়ন শিল্প সংস্থাসমূহের সমিতির সেক্রেটারি জনাব আহ্মাদ মাহ্দাভী আব্হারী বলেন যে, তাঁর দেশের পেট্রো-রসায়ন শিল্প ৭০ বিলিয়ন ডলার পরিমাণ অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে সক্ষম। তিনি আরো জানান যে, বর্তমানে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পেট্রো-রসায়ন খাতে যেসব অর্ধসমাপ্ত প্রকল্প রয়েছে সেগুলোর মূল্য প্রায় ৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারÑ যা প্রমাণ করে যে, ইরানের এ খাতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে।

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান কর্তৃক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-এর বিসিজি ভ্যাকসিন রফতানি সার্টিফিকেট লাভের সম্ভাবনা
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান আগামী বছর (২০১৬ সাল)-এর শেষ নাগাদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-এর কাছ থেকে বিসিজি ভ্যাকসিন রফতানির সার্টিফিকেট লাভ করবে বলে আশা করা যাচ্ছে। পাস্তুর ইন্স্টিটিউট অব ইরান (আইপিআই)-এর প্রধান জনাব হুমান কগাযীয়ান গত ১ ডিসেম্বর (২০১৫) এ কথা বলেন।
জনাব হুমান কগাযীয়ান বার্তা সংস্থা মেহ্র্ নিউজ-এর প্রতিনিধিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান, পাস্তুর ইন্স্টিটিউট অব ইরান (আইপিআই) বিগত বহু বছর যাবত যক্ষার প্রতিষেধক বিসিজি ভ্যাকসিন উৎপাদন করে আসছে। তিনি বলেন, আমরা আমাদের বিসিজি ভ্যাকসিন উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি করেছি এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) ইরানের বিসিজি ভ্যাকসিন সম্বন্ধে পর্যালোচনা করছে। তিনি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে ইরানকে বিসিজি ভ্যাকসিন রফতানির সার্টিফিকেট দেয়া হলে ইরান তার এ ওষুধটি বিশ্বের যে কোনো দেশে রফতানি করতে পারবে। তিনি আরো বলেন, আমরা আমাদের বিসিজি ভ্যাকসিন উৎপাদন সংক্রান্ত তথ্যাবলি সম্বলিত ফাইল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে পেশ করেছি এবং বর্তমানে হু কর্তৃক এতদসংক্রান্ত পর্যালোচনা সমাপ্ত করার অপেক্ষায় আছি।
জনাব হুমান কগাযীয়ান জানান, পাস্তুর ইন্স্টিটিউট অব ইরান (আইপিআই) বিগত অর্ধ শতাব্দী কাল যাবত বিসিজি ভ্যাকসিন উৎপাদন করে আসছে এবং অতি সম্প্রতি এর মান অধিকতর উন্নত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।

ইরান ও দক্ষিণ কোরিয়া যৌথ উদ্যোগে জাহাজ নির্মাণ শিল্প প্রতিষ্ঠা করবে
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান ও দক্ষিণ কোরিয়া যৌথ উদ্যোগে উভয় দেশেই জাহাজ নির্মাণ শিল্প প্রতিষ্ঠা করবে। গত ৫ই ডিসেম্বর (২০১৫) ইরান সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয় যে, এ ব্যাপারে দু’দেশের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ইরান শীপ বিল্ডিং অ্যান্ড অফর্শো ইন্ডাস্ট্রিজ কমপ্লেক্স কোম্পানি (আইএসওআইসিও) ও দক্ষিণ কোরিয়ার হাইইয়ুন্দাই কোম্পানি যৌথভাবে উভয় দেশে জাহাজ নির্মাণ শিল্প প্রতিষ্ঠা করবে।
বার্তা সংস্থা র্ইনা-র প্রতিবেদন অনুযায়ী, আইএসওআইসিও-র ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনাব হামীদ রেযায়ীয়ান জানিয়েছেন যে, এ ব্যাপারে ইতিমধ্যেই প্রয়োজনীয় কন্সাল্টেশন কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি সমূহ স্বাক্ষরিত হয়েছে।
জনাব রেযায়ীয়ান্ বলেন যে, তাঁর কোম্পানি সপ্তম প্রজন্মের জাহাজ নির্মাণের লক্ষ্যে হাইইয়ুন্দাই কোম্পানির সাথে যৌথভাবে কাজ করবে। তিনি আরো জানান যে, এ ক্ষেত্রে বিপণন ও যৌথ বাজার সুবিধা কাজে লাগানোই উভয় কোম্পানির প্রধান লক্ষ্য।
তিনি বলেন, যেহেতু আইএসওআইসিও হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় জাহাজ নির্মাতা কোম্পানি সেহেতু এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য আইএসওআইসিও হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে হাইইয়ুন্দাই-র যথোপযুক্ত বাণিজ্যিক অংশীদার। তিনি আরো বলেন যে, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ওপরে আরোপিত বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাসমূহ পুরোপুরি উঠে যাওয়ার পর উভয় কোম্পানিই বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ সুবিধা আকর্ষণে সক্ষম হবে।
উল্লেখ্য, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সুসমৃদ্ধ এবং প্রয়োজনীয় সকল উপকরণে সুসজ্জিত জাহাজ নির্মাণ শিল্পের অধিকারী। ইরানী জাহাজ নির্মাণ শিল্পসমূহ প্রধানত তেলবহনকারী ট্যাঙ্কার ও কন্টেইনার শীপ নির্মাণ করে থাকে, এছাড়া অন্যান্য অর্ফ্শো স্ট্রাকচারও নির্মাণ করে থাকে।
আরো উল্লেখ্য যে, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান বিশ্বের বৃহত্তম তেলবহনকারী সুপারট্যাঙ্কার বহরের অধিকারীÑ যার রয়েছে ৪২টি ভিএলসিসি সুপারট্যাঙ্কার; এগুলোর প্রতিটির তেল বহন ক্ষমতা হচ্ছে বিশ লক্ষ ব্যারেল।

ইরানের সাম্প্রতিক রোবট মানব সুরেনা-৩ এর আবরণ উন্মোচন
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে তৈরি সাম্প্রতিক রোবট মানব সুরেনা-৩ মানুষের মতোই হাঁটাচলা করতে ও কথা বলতে পারে এবং বিশেষভাবে ইঞ্জিনিয়ারিং মার্বেল পাথর চিহ্নিতকরণের কাজ সুষ্ঠুভাবে আঞ্জাম দিতে পারে। গত ১৭ই নভেম্বর (২০১৫) তারিখে তেহরানে এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে এ রোবট মানবের আবরণ উন্মোচন করা হয় এবং উপস্থিত মেহমানদের সামনে এর কর্মক্ষমতা প্রদর্শন করা হয়। উল্লেখ্য, এটি তৈরির আগেই রোবট মানব তৈরির ক্ষেত্রে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান বিশ্বের মধ্যে পঞ্চম স্থান অধিকার করে; ইন্স্টিটিউট্ অব ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং (আই.ই.ই.ই.) এ তথ্য প্রদান করেছে।
উল্লেখ্য, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে তৃতীয় প্রজন্মের এ মানব রোবট তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকগণ কর্তৃক তৈরি ও প্রদর্শন করা হয়। ১৯০ সেন্টিমিটার দীর্ঘ এ মানব রোবটটি বিল্ট্-ইন্ অডিটরি ও ভিসুয়াল সেন্সরসমূহের সহায়তায় স্বীয় পারিপার্শ্বিকতার সাথে আন্তঃক্রিয়া করতে সক্ষম। এছাড়া এটি চেহারা ও বাহ্যিক দৃশ্য দেখে ব্যক্তি ও বস্তু নিচয়কে চিনতে পারে এবং বিভিন্ন ধরনের শারীরিক হস্তক্ষেপের মোকাবিলায় প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করতে পারে।
মানব রোবট সুরেনা-৩ ঘণ্টায় ০.৭ কিলোমিটার গতিতে হাঁটাচলা করতে পারে। এটির এ গতি ইতিপূর্বে ২০১০ সালে তৈরি ইরানী রোবটের চলাফেরার গতির তুলনায় সাত গুণ। এছাড়া সুরেনা-৩ সিঁড়ি দিয়ে অত্যন্ত ভালোভাবে ওঠানামা করতে পারে এবং অমসৃণ জায়গায় অধিকতর দ্রুততা ও দক্ষতার সাথে চলাফেরা করতে পারে।

ইরানী গবেষকদের দ্রুত পানি দূষণ পরিমাপক ব্যয় সাশ্রয়ী সেন্সর তৈরি
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের গবেষকগণ সহজে ও দ্রুত পানি দূষণ পরিমাপণের উপযোগী ব্যয়সাশ্রয়ী সেন্সর তৈরি করেছেন। এটির সাহায্যে শিল্পজাত পানি দূষণকারী আর্সেনিক আয়োন-এর ঘনত্ব পরিমাপ করা যাবে।
ইরান ন্যানোটেকনোলোজী ইনিশিয়েটিভ কাউন্সিল (আইএনআইসি) জানায়, এ সেন্সরটি ব্যবহার করা হলে স্যাম্পল পরীক্ষার মাধ্যমে বিভিন্ন দ্রব্যের দূষণ, বিশেষত আর্সেনিক, কম খরচে চিহ্নিত করা সম্ভব হবে। এছাড়াও এ সেন্সরটি বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদানের বৈশিষ্ট্যসমূহ প্রচলিত পদ্ধতিসমূহের তুলনায় অধিকতর দ্রুত বিশ্লেষণ করতে সক্ষম।
এ পটেনশিওমেট্রিক সেন্সরটি তৈরিতে আর্সেনিক আয়োন-এর সাথে কাস্ট্কৃত পলিমার ব্যবহার করা হয়েছেÑ যার ফলে হাই সিলেক্টিভিটি সম্বলিত সেন্সর উৎপাদন করা এবং আর্সেনিক চিহ্নিত করণের লক্ষ্যে তাতে যথাযথ ডিটেকশন লিমিট সংযোগ করা সম্ভব হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, এ ক্ষেত্রে প্রচলিত সেন্সরগুলো ব্যবহারের সময় সবচেয়ে বড় যে সমস্যাটি মোকাবিলা করতে হয় তা হচ্ছে, এগুলোর মেম্ব্রেন স্ট্রাকচার-এর মধ্য দিয়ে সবেগে পানি প্রবেশ করানোর ফলে মেম্ব্রেন স্ট্রাক্্চার সহজেই বিনষ্ট হয়ে যায়, ফলে মেম্ব্রেন ইলেকট্রোড্-এর আয়ুষ্কাল হয় খুবই অল্প। এ কারণে নব উদ্ভাবিত এ সেন্সর তৈরি সম্পর্কে গবেষণা কালে উক্ত সমস্যাটি মোকাবিলা করার চেষ্টা চালানো হয়।
এ ক্ষেত্রে মেম্ব্রেন ইলেকট্রোড্-এর আয়ুষ্কাল বৃদ্ধির লক্ষ্যে আর্সেনিক আয়োন্-এর জন্য কাস্টিং পলিমারকে ন্যানোমেট্রিক ডাইমেনশনসমূহে সংবেদনশীল করা হয়েছে। ফলে, ন্যানোপার্টিক্ল্সমূহের সারফেস-এর অ্যালকাইল চেইন্স্ সংযোগ করে এগুলোর হাইড্রোফিলিক প্রপার্টিস হ্রাস করা হয়েছে। এরপর চূড়ান্ত পর্যায়ের সেন্সর-এর কার্যক্ষমতা প্রকৃত স্যাম্পলসমূহে আরসেনিক আয়োনসমূহের সেন্সিং-এর মূল্যায়ন করা হয়েছে।
এর ফলে দেখা যায় যে, চূড়ান্ত সেন্সর ডিটেকশন লিমিটকে নামিয়ে এনেছে, কিন্তু ইতিপূর্বে ব্যবহৃত সেন্সরসমূহের তুলনায় লাইনিয়ার রেস্পন্স্ রেঞ্জকে প্রশস্ততর করেছে। এছাড়াও, কাস্টিং পলিমারিক ন্যানোপার্টিক্ল্ ব্যবহারের ফলে উচ্চতর মানসম্পন্ন অধিকতর সামঞ্জস্যশীল মেম্ব্রেন ইলেকট্রোড উৎপাদন করা সম্ভবপর হয়েছেÑ যা সন্দেহাতীতভাবে চূড়ান্ত সেন্সরের কার্য সম্পাদনের ক্ষেত্রে অধিকতর দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছে।
এ গবেষণার ফলাফল ঊষবপঃৎড়পযরসরপধ অপঃধ-এর ১৭৮তম ভলিউমে (২০১৫, পৃ. ৮৭৭ – ৮৮৫) প্রকাশিত হয়েছে।

ইরানে সোলার সিস্টেমের জন্য ন্যানোস্ট্রাকচারড্ লাইট সর্পশন্ সারফেস উৎপাদন
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ইসফাহান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকগণ সোলার থার্মাল সিস্টেমসমূহে ব্যবহারের উপযোগী ন্যানোস্ট্রাকচারড্ লাইট সর্পশন্ সারফেস নিজস্ব গবেষণাগারে উৎপাদনে সাফল্যের অধিকারী হয়েছেন। ইরান ন্যানোটেকনোলজি ইনিশিয়েটিভ কাউন্সিল (আইএনআইসি)-র পক্ষ থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
উল্লেখ্য, সাধারণভাবে ব্যবহৃত অন্যান্য সর্পশন সারফেসসমূহের তুলনায় এ সারফেসগুলোর সর্পশন সক্ষমতা অনেক বেশি এবং ডিচ্প্যাচ্-এর পরিমাণ অপেক্ষাকৃত কম। এর ফলে সোলার সিস্টেমসমূহে এ সারফেসসমূহের কার্যক্ষমতা অনেক বেশি।
এতদসংক্রান্ত গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল সোলার কালেক্টরসমূহে ব্যবহারের লক্ষ্যে কাম্য প্রপার্টিজ ব্যবহার করে একটি ব্ল্যাক্ সর্পশন উৎপাদন করা। এ গবেষণার ফলে ধাতব তল সমূহের ওপর ন্যানোস্ট্রাকচারড্ ফিল্ম স্থাপনের মাধ্যমে সারফেসটি উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে।
ইতিপূর্বেকার গবেষণা সমূহ থেকে যে ফলাফল পাওয়া গিয়েছিল তার ভিত্তিতে ইলেকট্রোলেস্ নিকেল ব্লাক ফর্স্ফ কোটিং থেকে কাক্সিক্ষত অপটিক্যাল প্রপার্টিজ পাওয়া যায় এবং অপটিক্যাল কালেক্টরসমূহে সেগুলো ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। সুতরাং, বর্তমান গবেষণার লক্ষ্য ছিল এসব কোটিং-এর মানকে কাক্সিক্ষত পর্যায়ে উন্নীতকরণ। সর্পশন-এর পরিমাণ বৃদ্ধি করে এবং ডিস্প্যাচ্-এর পরিমাণ কমিয়ে সোলার সিস্টেমসমূহের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ন্যানোস্ট্রার্ক্চাড্ সারফেসসমূহকে সিন্থেসাইজ করা হয়। এ ক্ষেত্রে কালেক্টরসমূহের কার্য ক্ষমতা কাক্সিক্ষত মানে উন্নীত করার জন্য সর্পশন শীটসমূহের স্পেকট্রাম সিলেক্টেড্ হওয়া প্রয়োজন। তাই অত্র গবেষণায় কাক্সিক্ষত প্রপার্টিজ লাভ করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের পর ইলেকট্রোলেস্ নিকেল ব্লাক ফর্স্ফ কোটিং ও ব্লাক অ্যাডোনাইয্ড্ কোটিংকে অ্যালুমিনিয়াম সারফেস-এর ওপর স্থাপন করা হয়। অতঃপর অ্যাডোনাইযিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অ্যালুমিনা ও নিকেল্ ফর্স্ফ-এর ন্যানোস্ট্রাকচারড্ লেয়ার-এর কোটিংকে কাক্সিক্ষত মানে উন্নীত করার লক্ষ্যে স্যাম্পলসমূহের সারফেস-এর ওপরে বিভিন্ন মাত্রার পুরুত্ব সহকারে অ্যালুমিনা ন্যানোপোরাস্ লের্য়া তৈরি করা হয়।
উক্ত গবেষণার ফলাফলসমূহ ঞযরহ ঝড়ষরফ ঋরষসং-এ (ভলিউম নং ৫৯২, পার্ট এ, ২০১৫, পৃ. ৮৮ – ৯৩) প্রকাশিত হয়েছে।

ইরানী কোম্পানি কর্তৃক দেশীয় প্রযুক্তিতে কম ব্যয় সাপেক্ষ প্রোফাইলার কিট্ তৈরি
বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ও উপকরণাদি উৎপাদনকারী একটি ইরানী কোম্পানি সম্পূর্ণরূপে দেশীয় প্রযুক্তির ভিত্তিতে একটি হিউম্যান আইডেনটিফিকেশন কিট্-এর ডিজাইনিং ও উৎপাদনে সক্ষম হয়েছে যা এ পণ্যের বৈদেশিক মডেলসমূহের তুলনায় কম ব্যয় সাপেক্ষ।
উক্ত বিজ্ঞান কোম্পানির অন্যতম গবেষক মোহাম্মাদ এহ্সান্ আমীনী বার্তা সংস্থা মেহ্র্ নিউজ-এর সংবাদ প্রতিনিধিকে বলেন যে, তাঁদের কোম্পানিটি আইডেনটিফিকেশন কাজে ব্যবহারের লক্ষ্যে নিজস্ব প্রযুক্তিতে হিউম্যান প্রোফাইলার কিট্-এর ডিজাইনিং ও উৎপাদনের কাজে সফল হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের দেশে তৈরি এ কিট্-এর দ্বারা খুব সহজেই এর বৈদেশিক মডেলগুলোর প্রতিস্থাপন করা যাবে এবং এ ক্ষেত্রে ইতিপূর্বে প্রাপ্ত ফলাফল সমূহ বিশ্লেষণে কোনো পরিবর্তন সাধিত হবে না।
দেশের অভ্যন্তরে এ ধরনের কিট্ উৎপাদনের কারণ সম্পর্কে জনাব আমীনী বলেন যে, ইতিপূর্বে ইরানীয়ান লিগ্যাল মেডিসিন্ অর্গানাইজেশনের আওতাভুক্ত জেনেটিক গবেষণাগারসমূহ ও পুলিশ বাহিনী কর্তৃক বিদেশে তৈরি ১৬ ধরনের হিউম্যান প্রোফাইলার কিট্ ব্যবহার করা হতো। তিনি বলেন, দেশের মেডিক্যাল কোয়ালিটির মানোন্নয়নের লক্ষ্যে দেশের অভ্যন্তরে এ ধরনের কিট্ উৎপাদনের উদ্যাগ নেয়া হয়েছে, আর এ কিট্গুলো পুরোপুরিভাবেই এ ইরানী কোম্পানির নিজস্ব গবেষকগণ কর্তৃক তৈরি হয়েছে।
জনাব আমীনী জানান, কোম্পানিটি এ ব্যপারে দুই বছরব্যাপী গবেষণা পরিচালনা করে এ কিট্ তৈরিতে সক্ষম হয় এবং গত এপ্রিল মাস (২০১৫) থেকে তা উৎপাদন পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। তিনি জানান, ইরানী গবেষকগণ কর্তৃক তৈরিকৃত এ প্রোফাইলার কিট্ ১৭টি লোকেশনে নির্ভুলভাবে ও অত্যন্ত দ্রুত গতিতে ব্যক্তিদের প্রোফাইল তৈরি করতে এবং দুই ব্যক্তির মধ্যে পিতা-পুত্র, পিতা-কন্যা, মাতা-পুত্র বা মাতা-কন্যা সম্পর্ক থাকলে তা চিহ্নিত করতে সক্ষম।
এ কিট্ রক্ত, চুল, থুথু ও অন্যান্য জৈবিক স্যাম্পলের ভিত্তিতে ব্যক্তিকে চিহ্নিত করতে সক্ষম। এতে সঞ্চিত প্রোফাইল অপরাধীদেরকে শনাক্ত করণে, দুর্ঘটনা বা অপরাধের শিকার হয়ে চেহারা শনাক্ত করণের অনুপযোগী হয়ে পড়া লোকদের শনাক্ত করণে এবং পারিবারিক সম্পর্ক শনাক্ত করণে ব্যবহার করা যেতে পারে।

ইরানকে ৩০০ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করবে শেল কোম্পানি
অ্যাংলো-ডাচ জ্বালানি কো¤পানি শেল শিগগিরি ইরানকে ৩০০ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করার পরিকল্পনা নিয়েছে। গত ২৭ ডিসেম্বর ইরানের সংবাদ মাধ্যম এ কথা জানায়।
খবরে বলা হয়, ব্রিটিশ অর্থ বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের সময় শেল কো¤পানির ঋণের বিষয়টি তুলেছিলেন ইরানের উপ অর্থমন্ত্রী এবং ইরানের অর্থনৈতিক বিনিয়োগ ও কারিগরি সহায়তা সংস্থার প্রধান মোহাম্মদ খাজায়ি। তাঁর উদ্ধৃতি দিয়ে ফারসি ভাষার সংবাদপত্র ইরান জানিয়েছে, ব্রিটিশ অর্থ বিভাগের কর্মকর্তাদের বক্তব্যের জের ধরে শেল দ্রুত ইরানের এ ঋণ পরিশোধ করবে।
ইরানের বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পরই এ ঋণ পরিশোধ করা হবে। এছাড়া, নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর ইরানের জ্বালানি খাতে বিনিয়োগের কথাও ভাবছে শেল। কো¤পানিটি ইরানের কাছ থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল নিয়েছিল এবং সেই বাবদ ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩০০ কোটি ডলার। পরে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে শেলের পক্ষে ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হয় নি।

আন্তর্জাতিক ইসলামী ঐক্য সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ড. রুহানির ভাষণ

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের মাননীয় প্রেসিডেন্ট ড. রুহানি এ কথার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন যে, ইসলাম হচ্ছে দয়া-রহমত, শান্তি, স্বস্তি ও ভ্রাতৃত্বের ধর্ম। তিনি বলেন, সন্ত্রাস প্রতিরোধের জন্য আমাদেরকে চিন্তাগত উগ্রতা ও তার প্রপাগান্ডার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। আজকের দিনে সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন ও লিবিয়ার জনগণের বিরুদ্ধেই কেবল বড় ধরনের যুলুম হচ্ছে না; বরং দয়া ও মেহেরবানির যে ইসলাম সে ইসলামের ওপরই সবচেয়ে বড় যুলুমটি হচ্ছে।
ইরানের সরকারি তথ্য দফতরের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রেসিডেন্টের ভাষণের পূর্ণ বিবরণ নি¤œরূপ :
بسم الله الرحمن الرحیم الحمد لله رب العالمین و صلی الله علی سیدنا و نبینا محمد و آله الطاهرین و صحبه المنتجبین
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল ‘আলামীন। ওয়া সাল্লাল্লাহু ‘আলা সাইয়্যিদিনা ওয়া নাবিয়্যিনা মুহাম্মাদ ওয়া আলিহীত তাহিরীনা ওয়া সাহবিহিল মুন্তাজাবীন।
إِنَّ هَذِهِ أُمَّتُكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَأَنَا رَبُّكُمْ فَاعْبُدُونِ ‘নিশ্চয়ই তোমাদের এই জাতি অভিন্ন এক জাতি আর আমি তোমাদের প্রভু, অতএব, তোমরা আমারই ইবাদত কর।’ সর্বশেষ রাসূল ইসলামের মহান পয়গাম্বর হযরত মুহাম্মাদ মুস্তাফা (সা.) এবং তাঁর সত্যনিষ্ঠ সন্তান ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-এর পবিত্র জন্মদিন উপলক্ষে বিশ্বের সকল মুসলমান, মহান ইরানী জাতি, সম্মানিত হাজেরানে মজলিস, সুধিবৃন্দ এবং যেসব চিন্তাবিদ সমগ্র বিশ্ব থেকে এখানে সমবেত হয়েছেন, আপনাদের সবার প্রতি মোবারকবাদ ও অভিনন্দন জানাচ্ছি। আর সম্মানিত মেহমানদের জানাচ্ছি সুস্বাগতম।
আমি আশা করি, এই সমাবেশ এবং এই মোবারক ও উচ্চ পর্যায়ের সমাবেশে যা কিছু উপস্থাপিত হবে তার ফলশ্রুতি হবে মুসলমানদের এবং ইসলামী জাতিসমূহের চিন্তাধারা পরস্পরের অধিকতর নিকটবর্তী ও ঘনিষ্ঠ হওয়া। আমরা এমন এক পরিস্থিতিতে ইসলামের মহান পয়গাম্বরের জন্মদিনের উৎসব পালন করছি, যে পরিস্থিতিতে আমরা নিজেদের জীবন, সভ্যতা, ঐক্য, শক্তিমত্তা এবং একইভাবে উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে অধিকহারে হযরত (সা.)-এর দেখানো পথ তথা তাঁর সীরাত ও চরিত্র-আদর্শের মুখাপেক্ষী। অন্যদিকে যে কোন সময়ের চাইতে এবং অতীতের বছরগুলোর তুলনায় বিশ্বজনমতের কাছে পয়গাম্বর (সা.)-এর পরিচিতি অনেক বেশি মযলুম ও অসহায়।
যদি কোনদিন আমাদের চিন্তা ও ক্ষোভ এই বিষয়ে ছিল যে, সীমা লঙ্ঘনকারী, বিদেশি শক্তিসমূহ এবং ইসলামের দুশমনরা মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে এবং কোন একটি ইসলামী দেশকে জবরদখল করেছে আর মুসলমানদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। দুঃখজনকভাবে আজ আমরা এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি যে, ইসলামী দেশগুলোর মাঝে এক দেশ আরেক দেশের ওপর হামলা করছে। অসহায় নিরপরাধ মযলুম মানুষের মাথার ওপর বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র ফেলছে। অথবা ইসলামী দুনিয়ার অভ্যন্তরে দীন, ইসলাম ও জিহাদের দোহাই দিয়ে বিভিন্ন দল উপদল মুসলমানদের বুকে ছুরি চালাচ্ছে। এভাবে তারা ইসলামের পয়গাম্বরকে সংশয়াবিষ্টভাবে দুনিয়ার সামনে উপস্থাপন করছে।
হয়ত কখনো আমরা চিন্তা করি নি যে, ইসলামী জাহানে আসল আগ্রাসী ও প্রকৃত সীমা লঙ্ঘনকারী অর্থাৎ জবরদখলকারী যায়নবাদী সরকারের প্রসঙ্গ, এমনকি ইসলামী জাহানের সংবাদের পাতা থেকেও ভুলে যাওয়া হবে। কিন্তু আজ যা আলোচিত হচ্ছে, তা হলো, মুসলমানদের হাতে মুসলমান নিধন অথবা কমপক্ষে যারা ইসলামের দাবিদার এবং এমন পতাকা হাতে মানুষের ওপর হামলা চালাচ্ছে, যে পতাকায় আল্লাহ তা‘আলা এবং ইসলামের মহান পয়গাম্বরের পবিত্র নাম অঙ্কিত হয়েছে।
আমরা কি চিন্তা করেছিলাম যে, দুশমন, আগ্রাসীরা এবং বিশ্বের শক্তিমদমত্তরা ইসলামকে সহিংসতা, রক্ত ও রক্তপাতের ধর্ম হিসেবে চিহ্নিত করার পরিবর্তে ইসলামী জাহানের অভ্যন্তরে মুষ্টিমেয় লোক কথায় ও কাজে ইসলামকে হত্যাযজ্ঞ, সহিংসতা, বেত্রাঘাত ও সমাজে যুলুম-অত্যাচার চালানোর ধর্ম হিসেবে চিত্রিত করবে?
এতদঞ্চলের ও ইসলামী জাহানের এহেন স্পর্শকাতর পরিস্থিতিতে আমরা সবাই যেন নিজের ওপর এক বিরাট দায়িত্বের ভার অনুভব করি। বিগত দুই বছরের বেশিকাল হল, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান জাতিসংঘে উপস্থাপন করেছে যে, আজকের দুনিয়ায় যে জিনিসটি আমাদেরকে হুমকির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে তা হচ্ছে সহিংসতা ও উগ্রবাদ। বিশ্ব যদি শান্তি ও স্বস্তি পেতে চায় তা হলে আমদের সবাইকে হাতে হাত মিলাতে হবে এবং সহিংসতা ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। যদিও মৌখিক ও বাহ্যিকভাবে সকল ইসলামী, অনৈসলামী ও বিশ্বের সকল দেশের পক্ষ হতে এই প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন ও তা অনুমোদিত হয়েছিল, কিন্তু দুঃখজনকভাবে বাস্তব ক্ষেত্রে সদুদ্দেশ্য প্রমাণ করে এমন কোন পদক্ষেপ কমই দেখা গেছে।
কেন এত সহিংসতা ও রক্তপাত? আমরা কোন লক্ষ্য অর্জন করতে চাই? এই সহিংসতার উৎপত্তি কোত্থেকে হয়েছে? নিঃসন্দেহে সহিংসতার সূচনা হয় একটি জনগোষ্ঠীর চিন্তা ও মনোগত সহিংসতা থেকে। সূচনাতেই চিন্তা ও চেতনা ভারসাম্য হারিয়ে বেরিয়ে যায় তখন ইসলামী রচনাবলি থেকে যা উপলব্ধি করে তা দুঃখজনকভাবে সঠিক নয় এবং সে বুঝ ও উপলব্ধি সঠিক নয়। যদি চিন্তা থেকে সহিংসতার উৎপত্তি হয়ে থাকে এই সহিংসতা কথাবার্তা এবং পরে সংলাপে পরিবর্তিত হয়। আর তার বিপদাশঙ্কা সেদিনই দেখা দেয়, যেদিন ইসলামী বা অনৈসলামিক সমাজে সহিংসতা ও সন্ত্রাসের সংলাপে রূপান্তরিত হয়।
আলোচনা-পর্যালোচনা যে পর্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ, ইনসাফপূর্ণ ও বাড়াবাড়ি ও কড়াকড়িমুক্ত না হবে তার ফলশ্রুতি বাস্তব সহিংসতায় রূপ নেবে। বড়ই আফসোসের বিষয় যে, কতিপয় মাদ্রাসা যেগুলো ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেগুলোতে ইসলাম, কুরআন মজীদ এবং রাসূল (সা.)-এর সীরাতের যে পাঠ গ্রহণ করা হয় সে পাঠ হচ্ছে সহিংসতা ও উগ্রবাদের।
প্রথম দিন থেকেই বৈশিষ্ট্যগত যে প্রতিপক্ষ দাঁড় করানো হয়েছে, তা অনৈসলামের মোকাবিলায় ইসলাম বা কুফ্রির মোকাবিলায় ধার্মিকতা নয়। সকল আসমানি ধর্মের মূল কথাটি হচ্ছে, আল্লাহর আদেশের প্রতি শর্তহীন আনুগত্য আর আল্লাহবিহীন বা খোদাবিরোধী শক্তিসমূহ হতে দূরে থাকা। কীভাবে হতে পারেÑ আমাদের মূল ভিত্তিÑ যা আল্লাহর দাসত্ব ও কুফ্রি ও নাস্তিকতার মোকাবিলায় আল্লাহর একত্ববাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা, তা সূচনাতেই এই মযহাবের বিরুদ্ধে ঐ মাযহাবের স্বরূপ নির্ণয়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে? কুফ্রি ফতোয়া উৎসারিত হয় চিন্তাগত সহিংসতা হতে। কূপমণ্ডূকতা ও ভারসাম্যহীনতা হতেই সৃষ্টি হয় তাক্ফির। আমাদের সমাজ, মাদ্রাসা ও র্দাসগুলো কেন তাওহীদ ও পরকালের স্বরূপ পরিচিতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হবে না? ইসলামে কি তাহলে ঈমানের স্বাক্ষ্যের ভিত্তি হিসেবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ও মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)’ ছাড়া আর কিছু আছে? যদি মতপার্থক্য থাকে এবং ব্যাখ্যা ও তাফসীর এক না হয়, তা তো মানুষের স্বভাবের প্রতিফলন। পার্থক্য তো গ্রহণযোগ্য। কিন্তু ঝগড়া কেন? পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়াবে কেন? কেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণকে কম গুরুত্বপূর্ণের জন্য বিসর্জন দেব? যেসব মূলনীতির ইসলামী জাহানে ঐক্যের ভিত্তি রচনার কথা ছিল, তা কেন ভুলে গেলাম? যে কিতাব ও কথাবার্তা বিগত শতাব্দীগুলোর সাথে সম্পর্কিত তা কেন এখনও আঁকড়ে ধরব, অথচ এসব কথার মধ্যে সমালোচনা ও পর্যালোচনার অনেক কিছুই আছে। আমাদের তো মানদণ্ড আছে। আর তা হলো, আল্লাহর কিতাব। এই কিতাবই আমাদের বিশ্বাস তথা ঈমান আকীদার মূল ভিত্তি হতে পারে।
সৌভাগ্যজনকভাবে পয়গাম্বর (সা.)-এর বহু উক্তি ও সীরাতের ব্যাপারে আমাদের মধ্যে ঐকমত্য রয়েছে। পয়গাম্বরের সীরাত বা জীবনচরিত ও তাঁর বাণীর যেসব বিষয় অকাট্য ও প্রমাণিত সেগুলোকে মূলসূত্র ও বিবেচ্য হিসেবে গ্রহণ আর বাদবাকি বর্ণনাগুলোকে অনির্ভরযোগ্য ও সমালোচনাযোগ্য হিসেবে গ্রহণ করা হোক।
বহুযুগ আগের একজন আলেম, যে আলেমের চিন্তাধারাকে সেই মাযহাবের চিন্তাশীল, গবেষক ও শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিত্বরাই সমালোচনা করে থাকেন, তাঁর কথা ও মতামতকে কেন আমরা মূল ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করব? তা নিয়ে কেন প্রচার প্রপাগান্ডা চালানো হবে? এ অবস্থায় কুফ্র ও নাস্তিকতার স্বরূপের মোকাবিলায় ইসলামের স্বরূপ তুলে ধরার পরিবর্তে সুন্নির মোকাবিলায় শিয়া স্বরূপ অথবা শাফেয়ী পরিচিতির মোকাবিলায় হানাফী পরিচিতি, কিংবা হাম্বালীর মোকাবিলায় মালেকী বা যায়দী ও আলাভী পরিচিতি কেন তুলে ধরা হবে। আমাদের একটি মাত্র পরিচিতিই আছে আর তা হল ইসলামী পরিচিতি।
কিছুসংখ্যক লোক যে ‘শিয়া নয়া চাঁদ’ নামে প্রচার চালায়, এ ধরনের প্রচারণা রোগগ্রস্ত এবং ভুল। আমাদের ‘শিয়া নতুন চাঁদ’ বা ‘সুন্নি নতুন চাঁদ’ নামে কিছু নেই। আমাদের একটি পূর্ণিমা চাঁদ আছে। আমরা সকল মুসলমান যে দুনিয়াতে বাস করছি, এখানে আমাদেরকে পরস্পরের সাথে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
আপনারা চিন্তাশীল, অভিজ্ঞ এবং ইসলামী দেশসমূহের সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদের কাছে আমি জানতে চাই যে, সিরিয়ার ধ্বংসযজ্ঞ কার স্বার্থে? আমরা যদি সিরিয়ার রাস্তঘাট ও ভবন ধ্বংস করে থাকি, যদি সিরিয়ার প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন ধ্বংস করে থাকি, যদি সিরিয়ার তেল চুরি করে থাকি এবং অন্যদের কাছে বিক্রি করি আর যদি এমন একটি দেশকে দুর্র্বল করে থাকি, যে দেশ বছরের পর বছর ধরে যায়নবাদী ইসরাইলের মোকাবিলায় প্রতিরোধ করেছে, তাতে লাভটা কার? সিরিয়াকে দুর্বল করা কি ইসলামী জাহানের জন্য লাভজনক? সিরিয়াকে দুর্বল করার মধ্যে কি প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য কোন উপকার আছে? সিরিয়াকে ধ্বংস করার মধ্যে কি তুরস্ক, জর্দান, সৌদি আরব, কাতার, আরব আমিরাত ও অন্যান্য দেশের নির্মাণ অর্জিত হবে। সিরিয়ার ধ্বংসের মধ্যে যায়নবাদী ইসরাইল ছাড়া আনন্দিত আর কে হয়? ইরাকে যুদ্ধের কারণে আনন্দিত কে হয়? যায়নবাদী ইসরাইল ও মুসলমানদের শত্রুরা ছাড়া আর কে খুশি?
বর্তমানে বিশ্বে সহিংসতা, গুপ্তহত্যার শতকরা ৮৪ ভাগ দুঃখজনকভাবে আফ্রিকার ইসলামী অঞ্চলে, উত্তর আফ্রিকায়, ম্যধপ্রাচ্যে ও পশ্চিম এশিয়ায় সংঘটিত হচ্ছে। আমরা মুসলমান। মুসলমানের রক্ত ঝরার ব্যাপারে কি মুসলমানদের কোন দায়িত্ব নেই? এর জন্য কি আমাদেরকে জবাবদিহি করতে হবে না? এটা কি গ্রহণযোগ্য হবে যে, মুসলমানদের তেলের পয়সা আমেরিকার হাতে তুলে দেব? আর বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র খরিদ করব? আর তা নিয়ে ইয়েমেনের জনগণের মাথার ওপর ঢালব? এটা কি গ্রহণযোগ্য যে, আমেরিকার কাছ থেকে ট্যাংকবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র খরিদ করব আর তা আইএস, আল-নুস্রা ফ্রন্ট ও অন্যান্য ইসলামবিরোধী সন্ত্রাসী গ্রুপের কাছে সরবরাহ করব?
সত্যিই মুসলমানদের কি জবাব আছে? ইসলামের মহান পয়গাম্বর (সা.)-এর পবিত্র রূহ, যিনি আমাদেরকে পারস্পরিক দয়া ও ভ্রাতৃত্বের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন, যিনি আমাদেরকে কুরআনের এই বাণী শুনিয়েছেন انما المؤمنون إِخوة ‘নিশ্চয়ই মুসলমানরা পরস্পর ভাই ভাই।’ কুরআনের এই বাণীর আবেদন কী? আল্লাহর রাসূল (সা.) যে কুরআনের এ বাণী মানুষকে শুনিয়েছেন وَالمُؤمِنونَ وَالمُؤمِناتُ بَعضُهُم أَولِیاءُ بَعض ‘মুমিন নারী ও মুমিন পুরুষরা তারা পরস্পরের বন্ধু।’ এই বন্ধুত্ব কোথায়? আমরা আজ মুসলমান ও মুমিনদের মধ্যে কোন্ ধরনের বন্ধুত্ব প্রত্যক্ষ করছি? আমাদের কি হয়েছে যে, এত হত্যা, রক্তপাত ও ধ্বংসযজ্ঞের মোকাবিলায় আমরা চুপ করে রয়েছি? নাকি যারা এই রক্তপাতের মূল অনুঘটক তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছি? এটা কি ইসলামী জাহানের জন্য লজ্জার বিষয় নয় যে, মুসলমানরা ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে, নারীদের নিয়ে প্রচণ্ড শীতের মধ্যে পানি, নদী, সাগর, হ্রদ নৌকা যোগে পাড়ি দিচ্ছে আর কোন অনৈসলামিক দেশে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে। আর সেই অনৈসলামিক দেশ তাদেরকে সীমান্তে আটকে রাখছে। যদি আজ পয়গাম্বর ও পয়গাম্বরের সাহাবিগণ আমাদের মাঝে থাকতেন তা হলে কি তাঁরা এতবড় বিপর্যয় সহ্য করতেন?
আমাদের উচিত হবে চিন্তাগত ও সংলাপভিত্তিক সহিংসতা থেকে কাজ শুরু করা। চিন্তা ও তাত্ত্বিক সহিংসতার মোকাবিলায় আমাদেরকে রুখে দাঁড়াতে হবে। আমাদেরকে আজকের দুনিয়ার কৃত্রিম ও প্রকৃত আঙ্গিনায় ইসলামকে নেতিবাচকভাবে চিত্রিত করার মোকাবিলায় রুখে দাঁড়াতে হবে। আজকে বড় ধরনের যুলুম শুধু মুসলমানদের ওপর হচ্ছে না। বড় যুলুম কেবল লিবিয়া, সিরিয়া, ইরাক ও ইয়েমেনের মুসলমানদের ওপর হচ্ছে না। দয়া ও ভালোবাসায় পূর্ণ ইসলামের পরিচিতির ওপরই সবচেয়ে বড় যুলুম হচ্ছে। وَما اَرْسَلْناکَ اِلّا رَحْمَةً لِلعالَمینَ ‘আমি আপনাকে জগৎবাসীর জন্য রহমতরূপে প্রেরণ করেছি।’ ইসলামের নবী রহমতের নবী। এই দীন রহমতের দীন। এটি এমন দীন, যে দীনের প্রত্যেক নামাযের কেরাআত শুরু হয় দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নাম নিয়ে। আর এই নামাযের সমাপ্তি হয় সালাম, শান্তি কামনা ও বন্ধুত্বের পয়গাম নিয়ে। এই ধর্ম ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্বের ধর্ম, যে ধর্মের পয়গাম্বরকে মানুষের ব্যাপারে হুকুম দেয়া হয়েছে যে, তাদেরকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখুন, তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাদের সাথে পরামর্শ করুন। এই দীনে মহান পয়গাম্বর (সা.)-কে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে মানুষকে ক্ষমা করার জন্য। মানুষের জন্য ক্ষমা প্রার্থনার জন্য এবং মানুষের সাথে পরামর্শের জন্য। তিনি তো ওহীর সাথে যুক্ত ছিলেন, তিনি তো ছিলেন সৃষ্টিলোকের সবার সেরা, তাঁর সমগ্র জীবন ছিল সুন্দর চরিত্রাদর্শের প্রতীক। তিনি আমাদের কাছে এমন ইসলাম নিয়ে এসেছেন, যেখানে তিনি বলেছেন যে, সুন্দর চরিত্রের নামই হল ইসলাম। আসলে সুন্দর চরিত্রের নামই তো ইসলাম। তিনি ঘোষণা করেছেন, إِنَّمَا بُعِثْتُ لِأُتَمِّمَ مَکَارِمَ الْأَخْلَاقِ সুন্দর চরিত্রের পূর্ণতা বিধানের জন্যই আমি আবির্ভূত হয়েছি।
আজকের এই ধরনের বিশ্বে আমাদের সামনে এ ছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই যে, আমরা মুসলমানরা পরস্পরের হাতে হাত মিলাব।
আমি এতদঞ্চলের এবং এতদঞ্চলের বাইরের সকল ইসলামী দেশের প্রতি, এমনকি যারা আজকেও তাদের প্রতিবেশীদের মাথার ওপর বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র ফেলছে তাদেরকেও আহ্বান জানাচ্ছি, আসুন, আমরা বিরত হয়ে যাই এবং সঠিক রাস্তাটি অনুসরণ করি।
আমরা যেন দেখি যে, মুসলমানরা কোন্ অবস্থায় আছে। আপনারা গত এক বছরে আমেরিকার কাছ থেকে কী পরিমাণ বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র খরিদ করেছেন? যদি এগুলোকে গরীবদের মাঝে বণ্টন করতেন, তাহলে ক্ষুধার্ত অবস্থায় কাউকে রাতে বিছানায় যেতে হতো না। যদি আইএস এর মতো গ্রুপগুলো সৈন্য ভাড়া করেেত পারে তাহলে তার পেছনে অনুঘটক হচ্ছে বস্তুগত ও সাংস্কৃতিক দীনতা।
আসুন, ইসলামী সমাজ থেকে সাংস্কৃতিক ও বস্তুগত দীনতা দূর করি। বছরের পর বছর আমরা ইসলামী ঐক্যের কথা বলেছি। ইসলামী জাহানের ঐক্য কি ইসলামী দুনিয়ার অর্থনৈতিক সংযোগ ব্যতিরেকে সম্ভবপর হতে পারে? আমাদের অর্থনীতি অনৈসলামিক দুনিয়ার সাথে যুক্ত থাকবে, আমাদের শিক্ষা-সংস্কৃতি, বিশ্ববিদ্যালয়, জ্ঞান- বিজ্ঞান অনৈসলামিক বিশ্বের সাথে যুক্ত থাকবে আর ঐক্য, একতা ও ভ্রাতৃত্বের দোহাই দেব? মুখের কথা দিয়ে কি ঐক্য প্রতিষ্ঠা হয়? পয়গাম্বর (সা.) কি মদীনায় কথা দিয়ে সরকার চালিয়েছিলেন? ইসলামের প্রথম যুগের মুসলমানরা যে বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞান ও উন্নয়নের ঝাণ্ডা উড়িয়েছেন, তাঁরা কী ধরনের কথা বলতেন?
ধর্মীয় আলেমÑ যাঁরা ওয়ায-নসিহত করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ, মাদ্রাসা অঙ্গন, বক্তৃতার মঞ্চ সব জায়গা থেকেই কথা, সংলাপ ও প্রচারণার মাধ্যমে আসুন আমরা এমন উদ্যোগ নিই যাতে সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলায় একটি বাঁধ তৈরি করতে পারি।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, সন্ত্রাসবাদ ও মানুষ হত্যা বোমা মেরে বন্ধ করা যাবে না। আমাদেরকে সংলাপের ধারা পাল্টিয়ে সন্ত্রাসবাদের গতিধারা পরিবর্তন করতে হবে। আপনারা জানেন যে, আমাদের এই ইরানেই এক সময় মোঙ্গল বংশ নামে একটি শাসকগোষ্ঠী দেশের কর্তৃত্ব দখল করেছিল। তারা আলেমদের হত্যা করেছিল। মসজিদসমূহ ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল।
কিন্তু যে সময় ইরানের আলোচনার সংস্কৃতি আলেম, গবেষক, বিশেষজ্ঞ, ফকীহ ও আরেফদের মাধ্যমে উপস্থাপিত হল এবং মোঙ্গল দরবারে আলেম, আরেফ ও ফকীহগণ সমবেত হলেন তখন এই মোঙ্গলরাই ইসলামের রহমতের বিধিবিধানের প্রবর্তক হল। তারা মসজিদ নির্মাতায় পরিণত হল।
আমাদেরকে আজকের দুনিয়ার তরুণদের চিন্তাকে দখল করতে হবে। আজকে আমাদের কাঁধে সবচেয়ে বড় যে দায়িত্বটি রয়েছে তা হল, বিশ্ব জনমতের সামনে ইসলামের চিত্রটি সংশোধিত আকারে উপস্থাপন করা। মরহুম ইমাম খোমেইনীর ভাষায় বলতে গেলে, তিনি বলেছেন, বিশ্বজনমতের সম্মুখে কোন শক্তি দাঁড়াতে পারবে না। আমরা যদি বিশ্ব জনমতকে সত্যিকার ইসলাম, সত্যিকার রহমতের দিকে আকৃষ্ট করতে পারি এবং তার প্রচার-প্রসার করতে পারি! আর আল্লাহ না করুন, যদি আজকের দুনিয়ায় সাধারণ জনমত ইসলামকে সহিংসতার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে, যেটি বর্তমানে এতদঞ্চলে বলবৎ রয়েছে, তা হলে কিভাবে সাধারণ জনমতকে পয়গাম্বর (সা.)-এর জীবন পদ্ধতি ও সুন্নাতের ওপর আনা সম্ভব হবেÑ যে জীবন পদ্ধতি ও দিক্ষা তিনি আমাদের সামনে পেশ করেছিলেন। আমরা সেই প্রথম দিন থেকেই বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছি যে, আমাদের চলার পথ হচ্ছে সহিংসতামুক্ত বিশ্ব। আমরা বলেছি যে, এই সরকারের কাছে যে কোন সমস্যা যত জটিলই হোক না কেন, আলোচনার টেবিল ও সংলাপের মাধ্যমে তার সমাধান করা সম্ভব। আমরা বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলোর মোকাবিলায় আলোচনা ও যুক্তির মাধ্যমে আমাদের ও তাদের মধ্যে বহু বছর ধরে যে মতভেদ ক্রমান্বয়ে জটিলতর হচ্ছিল তার সমাধান করতে সক্ষম হয়েছি। আমরা আলোচনার টেবিলে সবচেয়ে জটিল রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে পেরেছি, যা এতদঞ্চল ও বিশ্বের সকল পক্ষের জন্যই কল্যাণকর এবং তা দুনিয়ার সামনে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। দীর্ঘ বার বছর আলোচনা হয়েছে এবং আমাদের ওপর অপবাদ দেয়া হয়েছিল এবং আমাদের প্রতিবেশীদেরকে আমাদের ব্যাপারে ভয় দেখানো হয়েছিল এবং বলছিল যে, ইরান গোপন স্থানে আণবিক বোমা বানানোর কাজে ব্যস্ত আছে। এই বলে আমাদের বন্ধু ও প্রতিবেশীদের ভয় দেখানো হচ্ছিল। আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের ভয় দেখিয়েছিল। আর আমাদের দুশমনদের উস্কানি দেয়া হয়েছিল। ১২ বছর পর জানা গেল যে, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান কারো সাথে মিথ্যা কথা বলে না এবং এ পর্যন্ত যা কিছু বলেছে সবই সত্য। ১২ বছর পর আন্তর্জাতিক আণবিক সংস্থা ঘোষণা করেছে যে, ইরানে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার জন্য কোন গোপন কেন্দ্র নেই। আর ইরানের পারমাণবিক দ্রব্য সামরিক লক্ষ্যে বিচ্যুত হয়ে যায় নি। আমরা এর পর থেকে শুধু সামনের দিকেই তাকাব।
কাজেই প্রমাণিত হল যে, আজকের মহা বিশ্বকে যুক্তি ও প্রমাণের সাহায্যে যুক্তি, সত্যপথ ও সঠিক ধারায় নিয়ে আসা সম্ভব। বস্তুত আজকের দুনিয়ায় বিরাট জটিল সমস্যাকে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব। আমরা যদি ছয় বৃহৎ শক্তির সাথে ‘বরজাম’ সৃষ্টি করতে পারি তাহলে কেন নিজেদের সমস্যা ও জটিলতাগুলো সমাধানের ক্ষেত্রে এই মডেলটি প্রয়োগ করতে পারব না। আলোচনার টেবিলে পরস্পর কথা বলা, পারস্পরিক আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তার অনুশীলন। আমরা যেন চিন্তা না করি যে, সন্ত্রাসী দলগুলো কোন ব্যক্তি বা দেশের জন্য কল্যাণকর। আমরা যেন চিন্তা না করি যে, যদি কোন দেশের নেতার আমরা বিরোধী হই তা হলে বোমা মেরে, ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ে সেই নেতাকে বদলাতে পারব। আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, দেশসমূহের ভবিষ্যৎ সে দেশের জনগণের হাতে। কোন বিদেশি বা বৈদেশিক শক্তি কোন জাতির সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারে না। আসুন, সবাই জনগণের শক্তির সম্মুখে বিনয়ের মাথা নত করি। আসুন, আমরা জনগণকে সাহায্য করি। এটা কি সম্ভব যে, কোন একটি দেশে শাসনকেন্দ্রকে দুর্বল করব আর দাবি করব যে, আমরা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করছি? এমন কিছু কি হওয়া আদৌ সম্ভবপর হবে?
আজ যদি আমরা পয়গাম্বর (সা.)-এর আহ্বানে অনুকূল সাড়া দিতে চাই, তা হলে আমাদের প্রত্যেককে নিজেদের অবস্থা অনুযায়ী, আলেমরা, সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ, শিক্ষিত সমাজ সবাইকে এই পরিস্থিতিতে বিশ্ববাসীর সামনে ঐক্য ও একতার সেøাগান, সহিংসতার অবসান, রহমতপূর্ণ ইসলামকে তুলে ধরার পদক্ষেপ নিতে হবে। পরিশেষে চূড়ান্ত পর্যায়ে আমাদেরকে সুউচ্চ কণ্ঠে ঘোষণা দিতে হবে যে, আমাদেরকে পরস্পরের নিকটবর্তী হতে হবে। এটি ইসলামী জাহানের ভবিষ্যতের জন্যই প্রয়োজন এবং তাতে সকল মুসলমানের জন্যই কল্যাণ নিহিত।
অন্যদের আগেই আমাদেরকে আমাদের বৈজ্ঞানিক অভিজ্ঞতাগুলো পরস্পরের কাছে উপস্থাপন করতে হবে। ইসলামী জাহানের সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ইসলামী জাহানের গরীবদের নিয়ে চিন্তা করতে হবে। ইসলামের প্রকৃত চিত্র বাস্তব দৃষ্টান্ত, কথা ও কাজ এবং সংলাপের মাধ্যমে দুনিয়াবাসীর সামনে উপস্থাপন করতে হবে। এ কাজ যদিও কঠিন, কিন্তু তা হওয়া সম্ভব এবং তা আমাদের দায়িত্বও বটে।
মরহুম ইমাম আমাদেরকে ঐক্যের দিকে আহ্বান জানিয়েছেন আর এই সপ্তাহকে ‘ঐক্য সপ্তাহ’ বলে ঘোষণা দিয়েছেন। যে সপ্তাহটি সকল ইসলামী মযহাব ও গোষ্ঠীকে শেষ নবী পয়গাম্বরে আকরাম (সা.)-এর নাম, ঝাণ্ডা ও সীরাতের ছায়াতলে কাছে আনতে ও অধিকতর ঘনিষ্ঠ করতে সক্ষম। এই সপ্তাহে মহামান্য রাহবার ইসলামী জাহানের ঐক্য, সংহতি, ঘনিষ্ঠতা ও ভ্রাতৃত্বের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। শুধু ঐক্য সপ্তাহ নয়, আমাদের সব দিন, সব মাস যেন ঐক্যের দিন ও ঐক্যের মাস হয়। ঐক্য ও একতার মাধ্যমেই ইসলামের দুশমনরা তাদের লক্ষ্য থেকে দূরে সরে যেতে বাধ্য হবে। আর তখনই আমরা অভিন্ন ঐক্যবদ্ধ মুসলিম উম্মাহ গঠন করতে সক্ষম হব। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন : إِنَّ هَذِهِ أُمَّتُكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَأَنَا رَبُّكُمْ فَاعْبُدُونِ ‘নিশ্চয়ই তোমাদের এই জাতি হচ্ছে অভিন্ন জাতি। আর আমি তোমাদের প্রতিপালক। অতএব, তোমরা আমারই ইবাদত কর।’
ওয়াস্সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।

আন্তর্জাতিক ইসলামী ঐক্য সম্মেলনে মেহমানদের উদ্দেশ্যে রাহবারের বক্তব্য

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা এবং ইসলামী বিপ্লবের বর্তমান রাহ্বার হযরত আয়াতুল্লাহ্ ‘উয্মা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী বর্তমান যুলুম-অবিচার, বৈষম্য ও সহিংসতায় বিক্ষুব্ধ বিশ্বের মানুষের কাছে সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠাকামী ইসলামের সঠিক চেতনা ও আধ্যাত্মিকতা তুলে ধরার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি ইসলামী ঐক্য সপ্তাহ উপলক্ষে তেহরানে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ইসলামী ঐক্য সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের প্রদত্ত সাক্ষাতে গত ১৭ই রবিউল আউয়াল মোতাবেক ২৯শে ডিসেম্বর (২০১৫) এ আহ্বান জানান।

ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী প্রথমেই রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ও হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.)-এর জন্ম বার্ষিকী উপলক্ষে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্কে এবং বিশেষভাবে ইরানী জনগণকে ও সমাবেশে উপস্থিত সকলকে মোবারকবাদ জানান।

হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী উল্লেখ করেন যে, রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জন্ম ও নবুওয়াতের দায়িত্বে অভিষিক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে জীবনের যথার্থ তাৎপর্য ও প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং অতীতের বিষদুষ্ট পৌত্তলিক বিশ্বের মৃত্যুঘণ্টা বেজে যায়। তিনি বলেন, আজকের দিনে মুসলিম জাহানের কাঁধে, বিশেষ করে ইসলামী পণ্ডিত, চিন্তাবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের কাঁধে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে তা হচ্ছে, তাঁদেরকে যুলুম, অন্যায়, অবিচার, বৈষম্য ও সহিংসতায় নিমজ্জিত এ বিশ্বের জনগণের কাছে ইসলামের সঠিক চেতনা ও আধ্যাত্মিকতাকে তুলে ধরার জন্য দৃঢ়তা ও সাহসিকতার সাথে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার বলেন, আজ মুসলিম জাহানের জন্য বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও বৈশ্বিক উপকরণাদি ব্যবহার করে এবং সেই সাথে যুক্তি, বিচারবুদ্ধি, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও অন্তর্দৃষ্টি কাজে লাগিয়ে একটি আধুনিক ইসলামী সভ্যতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণের পালা এসেছে।

হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর জন্ম বার্ষিকী উদ্যাপন বিশ্বের মুসলমানদের কাছ থেকে একটি ন্যূনতম প্রত্যাশিত বিষয়, কিন্তু আজকের দিনে ইসলামী উম্মাহ্র দায়িত্ব কেবল রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর জন্মবার্ষিকী ও তাঁর নবুওয়াতে অভিষিক্ত হওয়ার উপলক্ষ উদ্যাপনের মধ্যেই সীমিত নয়। বরং মুসলিম জাহানকে অবশ্যই একটি আধুনিক ইসলামী সভ্যতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে উপনীত হবার জন্য চেষ্টা চালাতে হবে। তিনি বলেন, একটি আধুনিক ইসলামী সভ্যতার মানে পাশ্চ্যত্য সভ্যতা যা করেছে সেভাবে বিভিন্ন ভূখণ্ডে আগ্রাসন চালানো, লোকদের অধিকার পদদলিত করণ এবং জাতি সমূহের ওপর স্বীয় চরিত্র, আচরণ ও সংস্কৃতি জোর করে চাপিয়ে দেয়া নয়; বরং এর মানে হচ্ছে মানব প্রজাতিকে ঐশী মর্যাদা উপহার প্রদান এবং তারা যাতে নিজেরাই মানবতার মাধ্যমে সঠিক পথ চিনে নিতে পারে সে জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষেত্র প্রস্তুত করা।

ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার স্মরণ করিয়ে দেন যে, পাশ্চাত্য জগৎ স্বীয় সভ্যতার ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে ইসলামী জাহানের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শনকে কাজে লাগিয়েছিল। তিনি বলেন, যদিও পাশ্চাত্য সভ্যতা প্রযুক্তিজাত সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ, গতির দ্রুততা, সহজতা ও মানুষের জীবন যাপনে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের উপকরণ প্রদর্শন করেছে এবং মানুষের জীবন যাত্রাকে সহজ করে দিয়েছে, কিন্তু এ সভ্যতা মানবজাতিকে শান্তি, স্বস্তি, সৌভাগ্য ও সুবিচার উপহার দিতে পারে নি; বরং এ সভ্যতা স্বীয় অভ্যন্তরীণ স্ববিরোধিতার কবলে নিপতিত হয়েছে।

হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, পাশ্চাত্য সভ্যতা তার বাহ্যিক জাঁকজমক ও চাকচিক্য সত্ত্বেও বর্তমানে এমনভাবে নৈতিক ও চারিত্রিক দিক থেকে দুর্নীতি, অনাচার ও পঙ্কিলতার আবর্তে নিমজ্জিত হয়েছে এবং চিন্তাগত ও মানসিক দিক থেকে এমনভাবে অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়েছে যে, স্বয়ং পশ্চিমা জগতের লোকেরাই তা অনুভব করতে পেরেছে।

ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী জোর দিয়ে বলেন যে, ইসলামী জাহানের জন্য এখন আধুনিক ইসলামী সভ্যতার মজবুত ভিত্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণের পালা এসেছে। তিনি বলেন, এ লক্ষ্যে উপনীত হবার জন্য ইসলামী জাহানের রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক নীতি নির্ধারকদের ওপরে আশা করার কোনো কারণ নেই; বরং এ লক্ষ্যে সেই সব ওলামায়ে দীন এবং সত্যপন্থী চিন্তাবিদ ও বুদ্ধি বৃত্তিকদেরকে এগিয়ে আসতে হবে যাঁরা পাশ্চাত্যকে তাঁদের কিবলা হিসেবে গ্রহণ করে নেন নি; তাঁদের পক্ষ থেকে ইসলামী উম্মাহ্র মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী উল্লেখ করেন যে, ইসলামী জাহান অত্যন্ত উন্নত মানের ভূখণ্ড, সুবিধা জনক ভৌগোলিক অবস্থান, প্রভূত প্রাকৃতিক সম্পদ এবং প্রতিভা ও দক্ষতার অধিকারী জনশক্তি সহ বিরাট সম্ভাবনা ও সামর্থ্যরে অধিকারী। তিনি বলেন, এ সামর্থ্য ও সম্ভাবনাকে যদি প্রকৃত ইসলামী শিক্ষার সাথে সংমিশ্রিত করা হয় তাহলে ইসলামী উম্মাহ্র পক্ষে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, কারিগরি, রাজনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রসমূহে দক্ষতার সাথে স্বীয় সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো সম্ভব হবে।

হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানকে এ মহান লক্ষ্যসমূহে উপনীত হওয়া সম্ভব হওয়ার বাস্তব দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের আগে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, রাজনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে ইরান ছিল পশ্চাদপদ, অন্যদিকে কূটনৈতিক দিক ছিল কোণঠাসা, আর জাতীয় মর্যাদার বিচারে এ দেশটি ছিল পুরোপুরি অন্যের তাঁবেদার। কিন্তু ইসলামের বদৌলতে আজ ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান স্বীয় স্বাতন্ত্র্য প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছে; এ দেশ আজ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও অন্যান্য আধুনিক জ্ঞানে খুবই উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে এবং এসব ক্ষেত্রে মাত্র অল্প কয়েকটি দেশ বাদে বিশ্বের অন্যান্য দেশের ওপর শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হয়েছে। তিনি বলেন যে, ইসলামী জাহানের সকল দেশের পক্ষেই এ ধরনের উন্নতি ও অগ্রগতির অধিকারী হওয়া সম্ভবপর। তিনি বলেন, তবে এ ধরনের অবস্থানে উপনীত হবার জন্য একটি শর্ত পূরণ করা অপরিহার্য। আর সে শর্ত হচ্ছে, মুসলিম জাতি সমূহের ওপর থেকে পরাশক্তিসমূহের ভারী ও অন্ধকার অপছায়া অপসারণ করতে হবে। অবশ্য তা করতে হলে যথেষ্ট মূল্য দিতে হবে। কারণ, মূল্য প্রদান করা ছাড়া কোনো বিরাট লক্ষ্যই অর্জিত হতে পারে না।

ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার বলেন, পাশ্চাত্য সভ্যতার বিপরীতে ইসলামী সভ্যতা কোনো দেশকেই শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে স্বীয় আধিপত্যের অধীনে নিয়ে আসে না।

তিনি বলেন, আধুনিক ইসলামী সভ্যতার ভিত্তি স্থাপন করতে গিয়ে আমাদেরকে কোনোভাবেই পশ্চিমাদের প্রতি দৃষ্টি দিলে চলবে না এবং আমরা যেন তাদের মৃদু হাসি ও মুখ ভার করাকে গুরুত্ব না দেই। বরং আমাদেরকে আমাদের নিজেদের শক্তি, সামর্থ্য ও সম্ভাবনার ওপরে নির্ভর করতে হবে।

হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী স্মরণ করিয়ে দেন যে, আধুনিক ইসলামী সভ্যতার ভিত্তি প্রতিষ্ঠাকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে ইসলামের দুশমনরা যেসব হাতিয়ার ব্যবহার করছে তার অন্যতম হচ্ছে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ ও অনৈক্য সৃষ্টি করা। তিনি বলেন, আমেরিকান সরকারের নীতি নির্ধারকদের অভিধানে যখন ‘শিয়া ও সুন্নি’ বিষয়টি স্থান লাভ করে তখনই চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ ও বিশ্লেষকগণ উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। কারণ, তখনই এটা সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, তারা একটি নতুন এবং আগেরটির চেয়েও অধিকতর বিপজ্জনক একটি ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, আমেরিকানরা সামগ্রিকভাবে ইসলামের বিরোধী, সুতরাং তারা যে মুসলমানদের মধ্যকার কতক র্ফিকার প্রতি সমর্থন ঘোষণা করে তখন তা দেখে কারোরই প্রতারিত হওয়া উচিত নয়।

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা বলেন, এর আগে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এগারোই সেপ্টেম্বরের ঘটনার পরে ক্রুসেড যুদ্ধের কথা বলেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তাঁর সে উক্তি ছিল ইসলামের বিরুদ্ধে বলদর্পী বিশ্বের যুদ্ধেরই নিদর্শন। আর মার্কিন সরকারের বর্তমান কর্মকর্তারা যে মুখে মুখে ইসলামের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করছেন প্রকৃত পরিস্থিতির সাথে তার কোনোই মিল নেই; বরং তাঁদের এ ধরনের উক্তি সমূহ তাঁদের মুনাফেকির নিদর্শন মাত্র। তিনি বলেন, আমেরিকার বর্তমান প্রতিরোধ প্রকৃতপক্ষে ইসলামের বিরুদ্ধে; তারা মুখে যা বলছে তার বরখেলাফে কার্যত মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ ও অনৈক্য সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর দৃষ্টান্ত হচ্ছে, আমেরিকার তাঁবেদারদের অর্থে ও তাদের নীতির ফলে ইসলামের নামে দায়েশ (আইএস্) ও একই ধরনের অন্যান্য ফিরকার আত্মপ্রকাশ ঘটেছে এবং তারা বর্তমানে ইসলামী জাহানে বিরাট বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে।

হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, আমেরিকান সরকারের কর্তাব্যক্তিরা যে সুন্নিদের সমর্থন ও শিয়াদের বিরোধিতা করছে বলে দাবি করছে তা মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি বলেন, গাযার যে জনগণ এভাবে আগ্রাসন ও সীমা লঙ্ঘনের শিকার হয়েছে তারা কি সুন্নি নয়? তেমনি পশ্চিম তীরের যে জনগণ এভাবে চাপের মুখে আছে তারাও কি সুন্নি নয়?

আমেরিকান সরকারের জনৈক নীতি নির্ধারক যে বলেছেন, ‘আমেরিকার দুশমন হচ্ছে ইসলাম-প্রবণতা’Ñ এর উল্লেখ করে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেন, আমেরিকানদের কাছে শিয়া ও সুন্নিতে কোনো পার্থক্য নেই; যে কোনো মুসলমানই ইসলামের আহ্কাম ও আইন-বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করতে চাইবে তার বিরুদ্ধেই তারা লড়াই করবে, তারা তারই বিরোধিতা করবে। তিনি বলেন, মুসলমানদের সাথে আমেরিকানদের আসল সমস্যা হচ্ছে এই যে, মুসলমানরা ইসলামের আহ্কাম ও বিধি-বিধানের অনুসরণ করার চেষ্টা করছে এবং ইসলামী সভ্যতার ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে। হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, এ কারণেই যখন ইসলামী জাগরণ শুরু হয় তখন তারা উদ্বিগ্ন ও দিশাহারা হয়ে পড়ে এবং তা রোধ করার জন্য চেষ্টা করে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে তারা কতগুলো দেশে সফল হয়, কিন্তু ইসলামী জাগরণ ধ্বংস হবার নয়; বরং আল্লাহ্ তা‘আলার অনুগ্রহে এ জাগরণ তার লক্ষ্যে উপনীত হবে।
আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, বিশ্বের বলদর্পী শক্তিবর্গের জোটের আসল লক্ষ্য হচ্ছে মুসলমানদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেয়া এবং সিরিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া প্রভৃতি দেশের অবকাঠামোসমূহ ধ্বংস করে দেয়া। তিনি বলেন, এ ষড়যন্ত্রের মোকাবিলায় নীরব হয়ে বসে থাকা ও আত্মসমর্পণ করা ঠিক হবে না; বরং দূরদৃষ্টির অধিকারী হয়ে এবং প্রতিরোধের হেফাযত করে এসব ষড়যন্ত্রের মোকাবিলায় রুখে দাঁড়াতে হবে।

হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বাহরাইনের মুসলমানদের ওপর যে চাপ সৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে এবং প্রায় এক বছর যাবত যে ইয়েমেনের মুসলিম জনগণের ওপর দিন-রাত বোমা বর্ষণ করা হচ্ছে তার মোকাবিলায় ইসলামী জাহানের নীরবতার সমালোচনা করেন। এছাড়া তিনি সিরিয়া ও ইরাকের বর্তমান পরিস্থিতি এবং নাইজেরিয়ার সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের প্রতি ইঙ্গিত করেন। তিনি স্বনামখ্যাত শিয়া আলেম শায়খ্ ইবরাহীম আল-যাক্যাকী-র আটকের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টির লক্ষ্যে নিবেদিতপ্রাণ একজন সুযোগ্য ও খাঁটি মুমিন আলেমের ওপর কেন এভাবে বিপর্যয় চাপিয়ে দেয়া হলো? এতে প্রায় এক হাজার লোক নিহত হলো ও তাঁর সন্তানরা শহীদ হলেন, অথচ এ ধরনের একটি বিপর্যয়কর ঘটনার মোকাবিলায় মুসলিম জাহান নীরবতা অবলম্বন করল!

ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার বলেন, ইসলামের দুশমনদের লক্ষ্য সমূহ অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। তাই তার মোকাবিলায় দূরদৃষ্টির পরিচয় দেয়া ও সচেতন থাকা সকল মুসলমানেরই দায়িত্ব এবং বিশেষ করে ওলামায়ে ইসলাম এবং সত্যপন্থী চিন্তাবিদ ও বুদ্ধিবৃত্তিকদের দায়িত্ব সাধারণ জনগণের সাথে ও জাগ্রতবিবেক রাজনীতিবিদ ও নীতি নির্ধারকদের সাথে আলোচনা করে তাঁদের সকলের সামনে প্রকৃত বিষয়গুলো তুলে ধরা।

হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, ধনী ও শক্তিমত্তার অধিকারী বিশ্ব যখন তার সমস্ত সামর্থ্য সহকারে ইসলামী জাহানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে তখন কারো জন্যই ঘুমিয়ে থাকার ও প্রকৃত পরিস্থিতির প্রতি মনোযোগী না হওয়ার অধিকার নেই।

অনুবাদ: নূর হোসেন মজিদী

পশ্চিমা যুবসমাজের উদ্দেশে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতার দ্বিতীয় খোলা চিঠি

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

হে পশ্চিমা যুবসমাজ,
ফ্রান্সে সংঘটিত তিক্ত সন্ত্রাসী ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তোমাদের সঙ্গে আবারও কথা বলার প্রয়োজন অনুভব করছি।
আমার জন্য এটা খুবই দুঃখজনক যে, এ ধরনের একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কথা বলতে হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এ ধরনের একটি ঘটনার পরেও যদি এর সমাধান অনুসন্ধান ও এ লক্ষ্যে আলাপ-আলোচনার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা না হয় তাহলে ক্ষতির পরিমাণ আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের যেকোনো মানুষের দুঃখ-কষ্টই অপর মানুষের জন্য কষ্টকর। স্বজনদের চোখের সামনে শিশুর মৃত্যু, মায়ের পারিবারিক আনন্দ শোকে পরিণত হওয়া এবং স্ত্রীর নিথর মৃতদেহ নিয়ে স্বামীর ছুটে চলার মতো দৃশ্যগুলো মানুষকে আবেগাপ্লুত না করে পারে না। যাদের মধ্যেই মমত্ব ও মানবতাবোধ রয়েছে, তারাই এ ধরনের দৃশ্য দেখে ব্যথিত ও দুঃখিত হতে বাধ্য। এ ধরনের ঘটনা ফ্রান্সেই ঘটুক অথবা ফিলিস্তিন, ইরাক, লেবানন বা সিরিয়াতেই ঘটুক, মানুষ ব্যথিত ও দুঃখিত হবেই।
নিশ্চিতভাবেই বিশ্বের দেড়শ’ কোটি মুসলমানের মনে এই একই ধরনের অনুভূতি কাজ করছে এবং মুসলমানরা সন্ত্রাসী ঘটনার হোতাদের ওপর ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত।
কিন্তু সমস্যা হলো, আজকের দিনের দুঃখ-কষ্ট যদি আরও সুন্দর ও নিরাপদ ভবিষ্যৎ গড়ার উৎস না হয়ে ওঠে তাহলে কেবল তিক্ত ও নিষ্ফল অভিজ্ঞতার ভা-ারই বাড়তে থাকবে।
আমি বিশ্বাস করি, তোমরা তরুণরাই কেবল আজকের দুর্ভোগ থেকে শিক্ষা নিয়ে সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে পারবে এবং পাশ্চাত্যের ভুলপথ পরিক্রমণের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করতে পারবে।
এতে সন্দেহ নেই যে, বর্তমানে সন্ত্রাসবাদ আমাদের ও তোমাদের অভিন্ন সমস্যা, কিন্তু তোমাদের জানা প্রয়োজন যে, সাম্প্রতিক ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে তোমরা যে অনিরাপত্তা ও উৎকণ্ঠার মধ্যে পড়েছ, তার সঙ্গে ইরাক, ইয়েমেন, সিরিয়া ও আফগানিস্তানের মানুষের কষ্টের দু’টি বড় পার্থক্য রয়েছে। এসব দেশ বছরের পর বছর ধরে এ পরিস্থিতির মোকাবেলা করছে। প্রথমত, মুসলিম বিশ্ব দীর্ঘ মেয়াদে আরও ব্যাপক মাত্রায় বড় ধরনের হিংস্রতা ও সহিংসতার শিকার। দ্বিতীয়ত, দুঃখজনকভাবে বিশ্বের বিভিন্ন বৃহৎ শক্তি নানা কৌশলে ও কার্যকর পন্থায় এসব সহিংসতার পেছনে সমর্থন দিয়েছে।
আজ খুব কম লোকই আছে যারা আল-কায়েদা, তালেবান ও এ ধরনের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর সৃষ্টি ও বিস্তার এবং তাদেরকে অস্ত্রে সজ্জিত করার পেছনে আমেরিকার ভূমিকার কথা জানে না।
এছাড়া, তাকফিরি সন্ত্রাসবাদের প্রকাশ্য ও নিশ্চিত পৃষ্ঠপোষকরা সবচেয়ে পশ্চাৎপদ রাজনৈতিক ব্যবস্থার অধিকারী হওয়ার পরও সব সময় পাশ্চাত্যের মিত্র হিসেবে স্থান পেয়েছে। কিন্তু একই সময়ে জনপ্রতিনিধিত্বভিত্তিক গতিশীল শাসনব্যবস্থার অধিকারী অগ্রগামী ও সু¯পষ্ট চিন্তা-দর্শনকে কঠোরভাবে দমন করা হয়েছে। মুসলিম বিশ্বে ইসলামী জাগরণের বিষয়ে পাশ্চাত্যের দ্বিমুখী আচরণ পাশ্চাত্যের নীতিতে স্ববিরোধিতার প্রমাণ বহন করছে। তাদের স্ববিরোধী আচরণের আরেকটি প্রমাণ হলো, যায়নবাদী ইসরাঈলের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের প্রতি সমর্থন। ফিলিস্তিনের নির্যাতিত জনগণ ৬০ বছরের বেশি সময় ধরে সবচেয়ে ঘৃণ্য সন্ত্রাসবাদের মোকাবেলা করছে।
ইউরোপের জনগণ এখন যদি কয়েক দিনের জন্য নিজেদের ঘরে আশ্রয় নিয়ে থাকে এবং জনবহুল কেন্দ্র বা স্থানগুলো পরিহার করে থাকে তাহলে ফিলিস্তিনের পরিবারগুলো তো বছরের পর বছর ধরে, এমনকি নিজেদের ঘরেও নিরাপদ নেই এবং কখনোই ছিল না। তাদের ঘরেই তারা ইসরাঈলী বুলডোজারে পিষ্ট হয়ে আসছে। ইসরাঈলীরা যে ফিলিস্তিন ভূখ-ে জোর করে ইয়াহূদী বসতি নির্মাণ করে যাচ্ছে ঐ জঘন্য কাজটিকে কি কোনো ধরনের নৃশংসতার সঙ্গে তুলনা করা যায়? যায়নবাদী ইসরাঈল কোনো আন্তর্জাতিক রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে তাদের এ পাশবিকতা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের মিত্রদের প্রশ্রয়ে তারা প্রতিদিনই ফিলিস্তিনীদের ঘরবাড়ি বিরান করেই যাচ্ছে, ধ্বংস করে যাচ্ছে তাদের ক্ষেত-খামার, বাগ-বাগিচা। এতো জঘন্যভাবে এ নৃশংসতা চালানো হয় যে, ঘরের ভেতরে থাকা ফিলিস্তিনীরা তাদের ঘরের জিনিসপত্র কিংবা কৃষিকাজের সরঞ্জামাদি পর্যন্ত গুছিয়ে নেয়ার সুযোগ পায় না। ঘরের ভেতরে থাকা শিশু ও মহিলাদের জন্য শুধু ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। এই নারী ও শিশুরা অশ্রুসজল দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে তাদের পরিবারের লোকজনকে কীভাবে নির্যাতন করা হচ্ছ, কীভাবে তাদের কাউকে কাউকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ভয়ঙ্কর নির্যাতনকেন্দ্রের দিকে। এ ধরনের নির্দয় নিষ্ঠুরতার উদাহরণ কি বর্তমান পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি আছে? আপাদমস্তক সশস্ত্র ইসরাঈলী সেনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর কারণে একজন ফিলিস্তিনী মহিলা তাকে রাস্তার মাঝখানে নিয়ে গুলি করে মেরে ফেলার ঘটনা যদি সন্ত্রাসবাদ না হয় তাহলে কোন্টা সন্ত্রাসবাদ?
এই নৃশংস বর্বরতা একটি দখলদার সরকারের সেনারা ঘটিয়ে যাচ্ছে বলে তাকে উগ্রতা বলা যাবে না? নাকি ষাট বছর ধরে এই নৃশংসতার চিত্র টেলিভিশনের পর্দায় দেখতে দেখতে এখন আর তা আমাদের বিবেককে নাড়া দেয় না?
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মুসলিম দেশগুলোতে সৈন্যসমাবেশ ঘটানোÑযার ফলে নিজেদেরও অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছেÑপাশ্চাত্যের আরেকটি বৈষম্যমূলক ও স্ববিরোধী যুক্তির প্রমাণ। যেসব দেশে আগ্রাসন চালানো হয়েছে সেসব দেশে প্রাণহানি তো ঘটেছেই, তদুপরি অর্থনৈতিক এবং শিল্পখাতগুলোর ভিত্তি ভেঙেচুরে খানখান হয়ে গেছে। যার ফলে সেসব দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির প্রবাহ ধীরগতি হয়ে গেছে কিংবা একেবারেই থেমে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই ঐ দেশগুলো বহু বছরের জন্য পিছিয়ে গেছে। অথচ নির্লজ্জভাবে তাদেরকে বলা হয় তারা যেন নিজেদেরকে অত্যাচারিত কিংবা মযলূম মনে না করে। এটা কি করে সম্ভব যে, একটা দেশকে পুরোপুরি বিরানভূমিতে পরিণত করে, তাদের শহর-নগর-গ্রামগুলোকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে তারপর তাদের বলা হচ্ছে : দয়া করে তোমরা নিজেদেরকে মযলূম ভেব না? এভাবে বাস্তবতাকে উপেক্ষা করার আহ্বান না জানিয়ে নিষ্ঠার সাথে ক্ষমা প্রার্থনা করাটা কি উত্তম নয়?
আগ্রাসী বর্ণচোরাদের কারণে মুসলিম বিশ্ব সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যে ধরনের দুঃখ-কষ্টের শিকার হয়েছে তা বস্তুগত ক্ষতির চেয়ে কোনোভাবেই কম নয়।
প্রিয় তরুণ সমাজ!
আমি আশা করি বর্তমানে কিংবা ভবিষ্যতে তোমরা সেই কপট ও দূষিত মানসিকতায় পরিবর্তন আনবে যে মানসিকতার অপকৌশল হচ্ছে তার সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য গোপন করা এবং ধোঁকাবাজি ও দুরভিসন্ধিকে রঙিন অলঙ্কারে সজ্জিত করা।
আমি মনে করি শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য সবার আগে এই আগ্রাসী ও নৃশংস মানসিকতায় পরিবর্তন বা সংস্কার আনা উচিত। পাশ্চাত্যের চিন্তাধারায় যতদিন এই দ্বৈত মানদ- বজায় থাকবে, যতদিন সন্ত্রাসবাদ তার শক্তিশালী পৃষ্ঠপোষকদের দৃষ্টিতে ভালো ও মন্দ এই দুই ভাগে বিভক্ত থাকবে, যতদিন বলদর্পী সরকারগুলোর স্বার্থকে মানবীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের ওপর স্থান দেয়া হবে ততদিন নৃশংসতার শেকড় অন্য কোথাও খুঁজে লাভ নেই।
দুঃখজনকভাবে এই শেকড়গুলো বছরের পর বছর ধরে পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক নীতির গভীরে ধীরে ধীরে প্রোথিত হয়ে গেছে এবং একটি নীরব ও নরম যুদ্ধের ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছে। পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশই তাদের নিজস্ব ও জাতীয় সংস্কৃতির জন্য গর্ব করে। সেসব সংস্কৃতি জন্ম থেকে বিকশিত হয়ে শত শত বছর ধরে তাদের সমাজের সাংস্কৃতিক চাহিদা বা খোরাক মিটিয়েছে। মুসলিম বিশ্বও এ ধরনের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য থেকে ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব এখন উন্নত মাধ্যম ও সরঞ্জাম ব্যবহার করে সমগ্র বিশ্বের ওপর তাদের সংস্কৃতি চাপিয়ে দিয়ে অভিন্ন সাংস্কৃতিক রূপ দেয়ার জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমি পশ্চিমা সংস্কৃতিকে এভাবে অন্যান্য দেশের ওপর চাপিয়ে দেয়াকে এবং মুক্ত ও স্বাধীন সংস্কৃতিগুলোকে হেয় প্রতিপন্ন করাকে একটি নীরব ও ক্ষতিকর সহিংসতা বলে মনে করি।
এমন সময় সমৃদ্ধ সংস্কৃতিগুলোর পাশাপাশি এসব সংস্কৃতির সর্বাধিক সম্মানার্হ উপকরণগুলোর অবমাননা করা হচ্ছে যখন অন্য কোনো কিছু দিয়েই একটি সংস্কৃতির স্থান পূরণ করা সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বর্তমান যুগে ‘সহিংসতা’ ও ‘নৈতিক স্খলন’ পশ্চিমা সংস্কৃতির দু’টি প্রধান অনুষঙ্গে পরিণত হলেও পাশ্চাত্যের মানুষই এখন এ দু’টি বিষয় থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা যদি একটি সহিংস, অশ্লীল ও নিরর্থক সংস্কৃতি গ্রহণ করতে না চাই, তাহলে তা কি আমাদের অপরাধ? নানা ধরনের কথিত শিল্পপণ্যের আদলে আমাদের তরুণদের উদ্দেশ্যে যে ধ্বংসাত্মক ঢল নামিয়ে দেয়া হয়েছে তা প্রতিহত করার কারণেই কি আমরা অপরাধী? সংস্কৃতিগুলোর মধ্যে সংযোগের গুরুত্ব ও মর্যাদাকে আমি অস্বীকার করছি না। যখন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এবং সম্মানের সঙ্গে কোনো সমাজে এই সংযোগ ঘটে তখন সে সমাজের উন্নতি ও সমৃদ্ধি ঘটে। কিন্তু জোর করে সাংস্কৃতিক সংযোগ ঘটানোর চেষ্টা সব সময়ই ক্ষতিকর ও ধ্বংসাত্মক। আমি চরম পরিতাপের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, আমদানি করা সংস্কৃতিগুলোর সঙ্গে এ ধরনের ব্যর্থ সংযোগ ঘটানোর চেষ্টার ফসল হিসেবে আইএসআইএল বা দায়েশের মতো হীন প্রকৃতির গোষ্ঠীগুলোর সৃষ্টি হয়েছে। ইসলামী চিন্তাধারায় যদি দৈন্য থাকতো তাহলে সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদী যুগ শুরু হওয়ার আগেও মুসলিম বিশ্বে এ ধরনের গোষ্ঠী দেখা যেত। অথচ ইতিহাস তার উল্টো চিত্রই তুলে ধরছে। অকাট্য ঐতিহাসিক দলিল একথা দিবালোকের মতো ¯পষ্ট করে দেয় যে, একটি বেদুঈন গোত্রের একটি উগ্র ও জঘন্য চিন্তাধারার সঙ্গে উপনিবেশবাদের মিলনের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে চরমপন্থার বীজ বপন করা হয়েছে। তা না হলে, বিশ্বের সবচেয়ে মানবিক ও নীতিনৈতিকতাপূর্ণ ধর্মÑ যাতে একজন মানুষের হত্যাকা-কে গোটা মানবতাকে হত্যার সমান বলে অভিহিত করা হয়েছেÑ সেখান থেকে কীভাবে দায়েশের মতো আবর্জনা বেরিয়ে আসতে পারে?
পাশাপাশি এ প্রশ্নও করতে হবে যে, যারা ইউরোপে জন্মগ্রহণ করেছে এবং ইউরোপীয় পরিবেশ ও সংস্কৃতিতে যাদের চিন্তাধারার বিকাশ ঘটেছে তারা কিভাবে এ ধরনের গোষ্ঠীতে যোগ দেয়? এটা কি বিশ্বাসযোগ্য যে, একদল মানুষ যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকাগুলোতে একবার বা দু’বার সফর করার পর হঠাৎ করে এতটা চরমপন্থী হয়ে যায় যে, নিজের দেশের নাগরিকদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে? এখানে যে বিষয়টি উপেক্ষা করা হচ্ছে সেটি হলো, এসব জঙ্গি একটি অসুস্থ ও সহিংস সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠেছে এবং জীবনের বড় অংশ কাটিয়েছে। এ বিষয়টিকে অবশ্যই পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করতে হবেÑ যে বিশ্লেষণের ফলে সমাজের প্রকাশ্য ও গোপন দূষণগুলো বেরিয়ে আসবে। পাশ্চাত্যে শিল্প ও অর্থনৈতিক বিকাশের বছরগুলোতে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে আইনি প্রক্রিয়ায় যে অসাম্য ও বৈষম্যের বীজ বপন করা হয়েছে কিছুদিন পর পর অসুস্থ প্রকৃতিতে হয়তো তার ফলে সৃষ্ট চাপা ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটছে।
সে যাই হোক, তোমাদেরকেই নিজেদের সমাজের বাহ্যিক আবরণগুলো ভেঙে ফেলে এই ক্ষোভ ও জটগুলোকে খুঁজে বের করে তা ঝেড়ে ফেলতে হবে। ফাটলগুলোকে গভীর করার পরিবর্তে ভরাট করতে হবে। সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে তড়িঘড়ি প্রতিক্রিয়া দেখানো হবে মস্তবড় ভুলÑ যা বিদ্যমান ফাটলগুলোকে আরো বড় করে তুলবে। বর্তমানে ইউরোপ ও আমেরিকায় বসবাস করছে কোটি কোটি মুসলমান যারা সেখানকার সমাজের নানা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছে। যেসব হঠকারী ও ত্বরিৎ পদক্ষেপ এই মুসলিম সমাজে ভীতি ও শঙ্কা তৈরি করে ও অতীতের চেয়ে আরো বেশি করে তাদের অধিকার লঙ্ঘিত হয় এবং সমাজের মূলধারা থেকে তাদেরকে সরিয়ে দেয় সেসব পদক্ষেপের ফলে সমস্যার সমাধান তো হবেই না বরং উল্টো সেই ফাটল ও বিদ্বেষকে আরো গভীর করে তুলবে।
যে কোনো প্রতিক্রিয়াশীল পদক্ষেপ, বিশেষ করে সেটিকে যদি আইনি রূপ দেয়া হয় তাহলে তাতে বিদ্যমান শ্রেণিবিভাগকে উস্কে দেয়া এবং নতুন নতুন সংকটের পথ উন্মুক্ত করে দেয়া ছাড়া অন্য কোনো ফল পাওয়া যাবে না। প্রাপ্ত খবরে জানা যাচ্ছে, কোনো কোনো ইউরোপীয় দেশে এমন আইন করা হয়েছে যার ফলে কিছু নাগরিককে মুসলমানদের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তিতে বাধ্য করা হচ্ছে। এ আচরণগুলো অত্যন্ত অন্যায় এবং আমরা সবাই জানি, অন্যের প্রতি অন্যায় আচরণ কোনো না কোনোভাবে নিজের প্রতি ফিরে আসে। বস্তুত মুসলমানদের সাথে এমন অকৃতজ্ঞ আচরণের পিছনে কোনো সঙ্গত কারণ নেই।
পশ্চিমা দুনিয়া বহু শতাব্দী ধরে মুসলমানদের সঙ্গে ওঠাবসা করেছে। এক সময় তারা মুসলিম দেশগুলোতে উপনিবেশ স্থাপন করে স্বাগতিক দেশগুলোর স¤পদ লুণ্ঠন করেছে এবং বর্তমানে মুসলমানদেরকে তাদের নিজেদের দেশে আপ্যায়ন করে বিভিন্নভাবে তাদের সেবা গ্রহণ করছে। দু’টি ক্ষেত্রেই মুসলমানরা পশ্চিমাদের সঙ্গে অত্যন্ত সদয় আচরণ করেছে এবং ধৈর্যের চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছে। কাজেই আমি তোমাদের কাছে প্রত্যাশা করব, তোমরা গভীর দৃষ্টি দিয়ে ইসলাম স¤পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা লাভ করার পাশাপাশি অতীত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে মুসলিম বিশ্বের ব্যাপারে একটি সঠিক ও সম্মানজনক পন্থা অবলম্বন করবে। তখন দেখবে, অচিরেই এ ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত ভবনটি তার নির্মাতাদের ওপর বিশ্বাস ও আস্থা সৃষ্টিকারী ছায়া বিস্তার করবে, তাদেরকে শান্তি ও নিরাপত্তা উপহার দেবে এবং বিশ্ব অঙ্গনে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রতি আশার আলোর সঞ্চার করবে।

সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী
২৯ নভেম্বর, ২০১৫

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিপুল সম্ভাবনাময় খনিজ সম্পদ

প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী মধ্যপ্রাচ্যের তেল সম্পদ সমৃদ্ধ অন্যান্য দেশের ন্যায় ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানও পুরোপুরিভাবে তেল রফতানিনির্ভর একটি দেশ। কিন্তু এ ধারণা মোটেই ঠিক নয়। অবশ্য এখন পর্যন্ত ইরানের প্রধান রফতানি পণ্য খনিজ জ্বালানি তেল, বিশেষত অশোধিত তেল বটে, তবে অন্য অনেক পণ্য, বিশেষত পেট্রো-রসায়ন শিল্পজাত সামগ্রী, খনিজ সম্পদ, কার্পেট ও কৃষিজাত দ্রব্যাদি ইরানের রফতানি খাতে উল্লেখযোগ্য অবস্থানের অধিকারী। বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, ২০১৩ সালে ইরানের রফতানি খাতে অশোধিত তেল ও ইথাইলিন পলির্মা-এর পরে খনিজ লৌহ (আয়রন র্ও)-এর অবস্থান ছিল তৃতীয়। ঐ বছর ইরানের মোট ৪৮.৯ বিলিয়ন ডলার রফতানির মধ্যে আয়রন র্ও রফতানিজাত আয়ের পরিমাণ ছিল ২.০২ বিলিয়ন ডলার (৪.১৩%)।
কিন্তু ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের তেল-বহির্ভূূত খনিজ সম্পদ বলতে কেবল আয়রন র্ও-কেই বুঝায় না, বরং ইরান বিভিন্ন ধরনের খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ একটি দেশ। সম্প্রতি ইষড়ড়সনবৎম ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয় যে, ইরানের ভূগর্ভে যেসব খনিজ সম্পদের রিজার্ভ রয়েছে তার উন্নয়ন ও উত্তোলনের লক্ষ্যে যদি যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় তাহলে দেশটি এ খাত থেকে অশোধিত জ্বালানি তেল রফতানি থেকে লব্ধ আয়ের তুলনায়ও অনেক বেশি আয় করতে পারে।
উক্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, বর্তমানে তেল রফতানিকারক দেশসমূহের সংস্থা (ওপেক)-এর সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ইরান হচ্ছে পঞ্চম বৃহত্তম অশোধিত তেল উৎপাদনকারী দেশ। কিন্তু দেশটি এমন এক সম্ভাবনার অধিকারী যে, দেশটির সরকার যদি তার ধাতব খনিজ সম্পদের উন্নয়ন ও উত্তোলনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে তাহলে দেশটি অশোধিত তেলের তুলনায় খনিজ সম্পদ থেকে অনেক বেশি আয় করতে সক্ষম।
উক্ত প্রতিবেদনে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সরকারের শিল্প, খনিজ দ্রব্য ও বাণিজ্য বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী জনাব মুজতাবা খসরুতাজ-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয় যে, ইরানে তামা, দস্তা ও উচ্চ মূল্যের বিভিন্ন ধরনের খনিজ সম্পদ রয়েছে যেগুলো থেকে ইরানের তেল শিল্প থেকে লব্ধ আয়ের চেয়েও বেশি আয় করা যেতে পারে।
উল্লেখ্য, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত বিরোধের প্রেক্ষিতে ২০১২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইরানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল, তা সত্ত্বেও ২০১৩ সালে ইরানের মোট রফতানি আয়ের পরিমাণ ছিল ৪৮.৯ বিলিয়ন ডলার এবং এর মধ্যে অশোধিত তেল রফতানি থেকে আয় হয়েছিল ৩৩.১ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ মোট রফতানি আয়ের ৬৭.৬৯% ভাগ।
ইষড়ড়সনবৎম-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে ইরান দৈনিক গড়ে ২০ লক্ষ ব্যারেল অশোধিত তেল রফতানি করে থাকে, তবে দেশটির ওপর আরোপিত আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি তুলে নেয়া হলে দেশটি তার তেল ও অন্যান্য রফতানি বৃদ্ধির জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি উঠে যাবার পর ইরান ৩০ বিলিয়ন ডলার ব্যয়সাপেক্ষ এনার্জি প্রকল্পসমূহ ও ২৯ বিলিয়ন ডলার ব্যয় সাপেক্ষ খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ও উত্তোলন প্রকল্পসমূহ বিনিয়োগকারীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেবে।
ইষড়ড়সনবৎম-এর প্রতিবেদনে ইউএস জিওলোজিক্যাল্ সার্ভে-র উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয় যে, ইরানে বর্তমানে তিন হাজারেরও বেশি এমন খনি রয়েছে যেগুলো থেকে নিয়মিত খনিজ সম্পদ উত্তোলন করা হচ্ছেÑ যেগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই বেসরকারি মালিকানাধীন।
উপমন্ত্রী জনাব মুজতাবা খসরুতাজ জানান, ইরানের খনিজ সম্পদ খাতে এখনো ১৫ থেকে ২০ বছর আগেকার যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়। কারণ, পাশ্চাত্যের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা থেকে উদ্ভূত বিনিয়োগ সমস্যার কারণে এগুলোর পরিবর্তে সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি উঠে যাবার পর ইরানের খনিজ সম্পদ খাতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা সম্ভব হবে।
ইউএসজিএস্-এর দেয়া তথ্য অনুযায়ী মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহের মধ্যে যদিও অশোধিত তেল উৎপাদনের দিক থেকে সৌদি আরব, ইরাক, সংযুক্ত আরব আমীরাত (ইউএই) ও কুয়েতের পরে ইরানের অবস্থান পঞ্চম, কিন্তু ধাতব পদার্থ উৎপাদনের ক্ষেত্রে, বিশেষত আয়রন র্ও, অশোধিত ইস্পাত, ম্যাঙ্গানিজ, দস্তা, সিমেন্ট, জিপসাম ও তামা উৎপাদনের ক্ষেত্রে ইরান হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে সবচেয়ে বড় উৎপাদনকারী দেশ।
উপমন্ত্রী জনাব মুজতাবা খসরুতাজ বলেন, ইরানের খনিজ সম্পদ খাতের উন্নয়ন ও খনিজ সম্পদ উত্তোলনের জন্য দেশি ও বিদেশি কোম্পানিগুলোকে উৎসাহিত করতে হবে। তিনি বলেন, ভবিষ্যৎ ইরান হচ্ছে এমন একটি দেশ যেখানে অর্থনীতির প্রধান খাত হিসেবে খনিজ সম্পদ খাত ক্রমান্বয়ে তেল খাতের স্থলাভিষিক্ত হতে সক্ষম হবে। তিনি বলেন, তাই আমরা সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের প্রতি আমাদের খনিজ সম্পদ খাতের প্রতি মনোযোগ দেয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছি।
এ পর্যন্ত ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের মোট আয়তনের মাত্র শতকরা ৭ ভাগ এলাকায় খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান চালানো হয়েছে এবং ভূগর্ভের ৫০ মিটার (১৬৪ ফুট) গভীর পর্যন্ত খনিজ দ্রব্যাদি অনুসন্ধান চালানোর ফলে ৩৭ বিলিয়ন টন খনিজ সম্পদ আবিষ্কৃত হয়েছেÑ যার মূল্য ৭০০ বিলিয়ন ডলার। নতুন আবিষ্কারের ফলে এর পরিমাণ কম পক্ষে দ্বিগুণে দাঁড়াবে বলে আশা করা যাচ্ছে। অবশ্য এখনো ইরানের খনিজ সম্পদ খাতে কাম্য পর্যায়ে উন্নয়ন সাধন করা হয় নি এবং বর্তমানে দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে (জিডিপিতে) খনিজ সম্পদ খাতের অবদান মাত্র শতকরা এক ভাগেরও কম। আরো ব্যাপক ভিত্তিতে ও ভূগর্ভের অধিকতর গভীরে অনুসন্ধান চালানো হলে খনিজ সম্পদের এ রিজার্ভের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায়।
ইরানের মোট খনিজ সম্পদ রিজার্ভের পরিমাণ ৬০ বিলিয়ন মেট্রিক টন প্রাক্কলিত হয়েছে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সরকার স্বীয় খনিজ সম্পদ খাতে যে ২৯ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেছে তাতে বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের অংশ ১৫ বিলিয়ন রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ইস্পাত থেকে শুরু করে এলুমিনিয়াম, তামা ও স্বর্ণের খনি, কয়লা এবং বিরল ধরনের বিভিন্ন মৃত্তিকা উপাদানসহ আরো অনেক খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ও উত্তোলনের জন্য এসব বিনিয়োগ ব্যবহার করা হবে বলে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে।
জনাব মুজতাবা খসরুতাজ বলেন, ইরানে যে পরিমাণ তামা, আয়রন র্ও ও বিভিন্ন ধরনের ভারী মৃত্তিকা উপদান রয়েছে তার মূল্য দেশের মোট অশোধিত তেল রিজার্ভের মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি হবে।
টাইটানিয়াম উত্তোলনে বিনিয়োগ আকর্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের খনিজ সম্পদ বিভাগের কর্মকর্তাগণ জানান যে, দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় সিস্তান-বেলুচিস্তান প্রদেশের ফানুজ্ নামক স্থানে টাইটানিয়ামের বিরাট রিজার্ভ আবিষ্কৃত হয়েছে এবং এ খনিজ সম্পদের উন্নয়ন ও উত্তোলনের জন্য বিনিয়োগ আকর্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তাঁরা বলেন, এ খাতে আগামী পাঁচ বছরে ৪.২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে।
মাক্রান্ স্টীল্ কোম্পানির পরিচালনা বোর্ডের প্রধান জনাব জামশীদ জাহানবাখ্শ্ তেহ্রানী বলেন, ফানুজ্ থেকে বছরে তিন কোটি টন টাইটানিয়াম্ র্ও উত্তোলন করা হলে চারশ’ থেকে পাঁচশ’ বছর পর্যন্ত এ খনি থেকে টাইটানিয়াম উত্তোলন করা যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
ফানুজে ৩.৬ বিলিয়ন টন টাইটানিয়ামের নিশ্চিত রিজার্ভ রয়েছে বলে প্রাক্কলিত হয়েছে। এখানে টাইটানিয়ামের ত্রিশটি গুচ্ছ রিজার্ভ রয়েছে যেগুলোর প্রতিটি থেকে বছরে দশ লাখ টন টাইটানিয়াম র্ও উত্তোলন করা যাবে।
উল্লেখ্য, টাইটানিয়াম হচ্ছে শতাব্দীর কৌশলগত ধাতব পদার্থ। শক্তি, কম ওজন ও ক্ষয়রোধ ক্ষমতার বিচারে এ ধাতব পদার্থটির মূল্য অনেক বেশি এবং এটি বিমান নির্মাণের কাজে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া এটি সামরিক শিল্প, এয়ারোস্পেস্ শিল্প, মেরিন ইন্ডাস্ট্রিজ, ডেন্টাল ইমপ্লান্ট ও আরো বহু শিল্প প্রক্রিয়ার কাজেও ব্যবহৃত হয়।
জনাব তেহরানী আরো জানান, বিগত পাঁচ বছরে ফানুজে আশিটিরও বেশি টাইটানিয়াম, আয়রন র্ও ও তামার খনি আবিষ্কৃত হয়েছে। তিনি বলেন, ঐ অঞ্চল থেকে যে খনিজ টাইটানিয়াম উৎপাদন করা হবে তা প্রক্রিয়াজাতকরণের লক্ষ্যে দুই হাজার ৪০০ ভারী ট্রাকের সাহায্যে ওমান সাগরের তীরবর্তী ইরানী সামুদ্রিক বন্দর চ-বাহারে পাঠানো হবে এবং এরপর সেখান থেকে জাহাজ যোগে এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাঠানো হবে। তিনি জানান, প্রাক্কলন অনুযায়ী, উত্তোলনের কাজে ফানুজের টাইটানিয়াম রিজার্ভ এলাকায় চার হাজারেরও বেশি জনশক্তি নিয়োগের প্রয়োজন হবে, এছাড়া চ-বাহার বন্দর এলাকায় প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজে আরো নয় হাজার লোকের প্রয়োজন হবে।
উল্লেখ্য, ফানুজের টাইটানিয়াম রিজার্ভ এলাকা ইরানের একমাত্র টাইটানিয়াম রিজার্ভ এলাকা নয়। এছাড়াও কেরমান প্রদেশের কাহ্নূজ এলাকায় চল্লিশ কোটি টন টাইটানিয়াম রিজার্ভ আছে বলে প্রাক্কলিত হয়েছে। আর উরূমীয়ার নিকটবর্তী ক্বারা আগ¦ায হার্ড রক্ রিজার্ভ এলাকায় এর ঘন সংবদ্ধ রিজার্ভ রয়েছেÑ যার রিজার্ভের পরিমাণ আনুমানিক ২০ কোটি টন।
এ পর্যন্ত জাপানের ইস্পাত উৎপাদনকারী বিভিন্ন কোম্পানি ইরানে টাইটানিয়াম উৎপাদনের কাজে বিনিয়োগের জন্য আগ্রহ প্রদর্শন করেছে। গত আগস্ট মাসে (২০১৫) জাপানের কোবে স্টীল লি. এবং সে দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠান জাপান অয়েল, গ্যাস অ্যান্ড মেটাল্স্ ন্যাশনাল কর্পোরেশন (জেওজিএমইসি)-এর নির্বাহী কর্মকর্তাগণ তেহরান সফরে আসেন এবং এ ব্যাপারে সহযোগিতা পরিকল্পনা নিয়ে ইরান সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনায় মিলিত হন।
নূর হোসেন মজিদী

ইরান পরিচিতি: হামাদান

কামাল মাহমুদ

ইরান তথা পৃথিবীর প্রাচীনতম নগরীগুলোর অন্যতম হলো হামাদান। গ্রীক ঐতিহাসিক হিরোডোটাসের মতে খ্রিস্টপূর্ব ৭ম শতাব্দীতে এ শহরের উৎপত্তি এবং তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ শতকে এটি মেডেস এর রাজধানী ছিল। পরবর্তীকালেও এটি রাজধানী শহরের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিল। বাইবেলের ‘ইজরা’ নামক গ্রন্থে হামাদান ও এর প্রাচীন নাম ইকোবানা শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। দারিউশ জেরুজালেমে একটি উপসানালয় পুনঃনির্মাণ করতে গিয়ে একটি মুদ্রার সন্ধান পান যে মুদ্রায় ‘হামাদান’ শব্দটি মুদ্রিত ছিল। হামাদানের প্রাচীন নাম ইকবাতানা, হ্যামাংতানা অর্থ হলো মিলিত হবার স্থান। পার্থিয়ান যুগে হামাদান ছিল তাদের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী। সাসানী স¤্রাটরাও হামাদানে গ্রীষ্মকালে অবস্থানের জন্য তাঁদের আবাসস্থল নির্মাণ করেছিলেন। ৬৬৩ খ্রিস্টাব্দে নহবন্দের যুদ্ধে আরব মুসলমানদের আওতাধীনে চলে যায় হামাদান। বুয়াহিদ সা¤্রাজ্যকালে এ নগরী ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয়। ১১ শতকে সেলজুক স¤্রাটরা হামাদান থেকে রাজধানী বাগদাদে স্থানান্তর করেন। সময়ের বিবর্তনে হামাদানের অনেক উত্থান-পতন ঘটেছে। তৈমুরীয় শাসনামলে এ শহরে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ হয়, কিন্তু সাফাভী আমলে এ শহর ব্যাপক উন্নতি লাভ করে। ১৮ শতকে হামাদান অটোমানদের নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু নাদির শাহ আফসার এর সময়কালে ইরান ও অটোমান সা¤্রাজ্যের মধ্যে চুক্তির ফলে হামাদান ইরানের অংশ হিসেবে পরিগণিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এটি রাশিয়া ও তুর্ক-জার্মান বাহিনীর দখলে চলে যায় এবং পরবর্তীকালে ১৯১৮ সালে যুদ্ধ অবসানের পরে হামাদান আবার ইরানের অধীনে চলে আসে।
অবস্থান ও জনসংখ্যা : হামাদানের আয়তন ১৯৫৪৬ বর্গকিলোমিটার। ইরানের মধ্য-পশ্চিম দিকে এবং সমুদ্র উপকূল থেকে ১৮৫০ মিটার উচ্চতায় জাগরোস পর্বতের নিকটে হামাদানের অবস্থান। শহরটি সিল্ক রোডের পাশে অবস্থিত। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী লোকসংখ্যা ২০,৫৮,২৬৮ জন। পরিবার সংখ্যা ২,৫৪,৪১২টি। জনসংখ্যার দিক থেকে এটি ইরানের ১৪তম নগরী। এটি তেহরান থেকে ৩৬০ কিলোমিটার বা ২২৪ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত।
আবহাওয়া : হামাদানের আবহাওয়া বিভিন্ন প্রকৃতির। উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে গ্রীষ্ম, বসন্ত ও শীত ঋতু পরিলক্ষিত হয়। কখনো কখনো প্রচুর বৃষ্টিপাতও হয়। পশ্চিম ও পূর্র্ব দিকে বছরের অধিকাংশ সময় গ্রীষ্ম ও শরৎ ঋতু থাকে। বার্ষিক সর্বোচ্চ তাপমাত্র ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট)। গড় তাপমাত্রা ১৯.২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সর্বনি¤œ তাপমাত্রা মাইনাস ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বছরে গড়ে ৮৫ দিন বৃষ্টিপাত হয়, বরফ পড়ে বছরে গড়ে ২৯ দিন (১৯৬১-১৯৯০ পর্যন্ত গড় হিসেব অনুযায়ী)। এটি ইরানের অন্যতম শীতপ্রধান শহর। এ শহরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখতে সারা বছর পর্যটকদের পদচারণায় মুখর থাকে এ শহর, বিশেষত গ্রীষ্ম ও বসন্তকালে। এ শহরের প্রতীক হলো পাথরে খোদাই করা অভিলিখন যা ‘গাঞ্জনামে’ হিসেবে প্রসিদ্ধ।
ভাষা : এ অঞ্চলের অধিবাসীদের অধিকাংশই ফারসি ভাষায় কথা বলে। তবে কিছুসংখ্যক অধিবাসী কুর্দি, লোরী, আযারবাইজানী ভাষায় কথা বলে।
পেশা ও শিল্প : এখানকার অধিকাংশ মানুষের পেশা কৃষি, ব্যবসা ও চাকুরি। সাম্প্রতিককালে হামাদান ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থলে পরিগণিত হয়েছে। হামাদান হ্যান্ডিক্রাফট, চামড়া শিল্প, সিরামিক ও কার্পেটের জন্য বিখ্যাত।
দর্শনীয় স্থান : হামাদানে ২০৭টি ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে। বাবেলিক চসমার ও তার ভাই মোরদেচাই এর সমাধিক্ষেত্র, বিখ্যাত গণিতজ্ঞ আবু আলী সীনার সমাধিক্ষেত্র, মাকামাত এর লেখক বদিউজ্জমান হামাদানীর মাযার রয়েছে এখানে। দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে বাবা তাহের মিউজিয়ামে রক্ষিত কানুন অব মেডিসিন এর হস্তলিখিত কপি, ইমামযাদে আবদুল্লাহ মসজিদ, কোরবান টাওয়ার, আলী সদর গুহা, হামাদানের পাথরের সিংহ, দারাউশের সময়কার লেখা গাঞ্জনামে, আব্বাসাবাদ জঙ্গল, এরাম পার্ক, ইমাম স্কয়ার, আবু আলী সীনার মনুমেন্ট, হাফ্ত বেসার (সাত দেয়াল)- যেখানে এক হাজারের মত কক্ষ রয়েছে। এটিকে হামাদানের ব্যবিলন টাওয়ার হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে।
খেলাধুলা : হামাদানে খেলাধুলার জন্য রয়েছে কুদ্স স্টেডিয়াম, শহীদ মোফাত্তেহ স্টেডিয়াম, তাকী ক্রীড়া কমপ্লেক্স, হামাদান জাতীয় স্টেডিয়াম প্রভৃতি। ফুটবল ক্লাবের মধ্যে রয়েছে বিখ্যাত পাস হামাদান এফসি ও আলীতাজ হামাদান এফসি।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : হামাদান দীঘকাল ধরে ধর্মীয় শিক্ষার জন্য খ্যাত হয়ে আছে। এখানে আধুনিক স্কুল-কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়গুলোর প্রতিষ্ঠার ইতিহাস খুব বেশিদিনের নয়। হামাদানের প্রথম আধুনিক স্কুলের নাম মোজাফফারীয়ে স্কুল। এছাড়া দেশি-বিদেশিদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত অনেক স্কুল-কলেজ রয়েছে। বিশ^বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে রয়েছে হামাদান প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়, হামাদান মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়, ইসলামিক আযাদ ইউনিভার্সিটি হামাদান, পায়ামে নূর বিশ^বিদ্যালয় হামাদান, মালায়ের বিশ^বিদ্যালয় প্রভৃতি।
ব্যক্তিত্ব : হামাদানের বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে রয়েছেন ২০০৩ সালে নোবেল পুরস্কার জয়ী শিরিন এবাদী, ফজলুল্লাহ জাহেদী, বিখ্যাত কবি মীর সাইয়্যেদ আলী হামাদানী, ফখরুদ্দিন এরাকী, বাবা তাহের উরিয়ানী, মীর যাদে এশকী, বিপ্লবের পর প্রথম প্রেসিডেন্ট আব্দুল হাসান বনি সদর, আমীর নুসরাতুল্লাহ বালাখান লু, আমীর সাহান বাজারীয়ান, আল কোজাত হামাদানী, এনসাইক্লোপিডিয়া অব ইরানিকার সংকলক এহসান ইয়ার প্রমুখ।

মুসলমানদের মধ্যে চরমপন্থী চিন্তাধারার বিস্তার

সংকলন : সেলিনা পারভীন

ইসলামী দুনিয়া আজ তার ইতিহাসের সবচেয়ে জটিলতম সময় অতিক্রম করছে। একদিকে ইসলামী জাগরণের ঢেউ বহমান, অন্যদিকে এই প্রাণ-সঞ্জীবনী ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়োজিত করে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে ইসলামের চরমতম শত্রুমহল। তারা ইসলামের শান্তিকামী চেহারা ও সৌন্দর্যকে ধ্বংস করার জন্য বিভিন্নমুখী প্রয়াসে লিপ্ত। এ সময় আমরা এমনসব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছি যে সম্পর্কে আমাদের চিন্তাশক্তি বা কল্পনাশক্তিও হার মেনে যায়। সারাবিশ্বে বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বে যা ঘটছে তা অবিশ্বাস্য, মানুষের সাধ্য নেই তা অনুধাবন করার। কারণ, ঘটনাগুলো ঘটছে অতি দ্রুত। বাস্তবতা হচ্ছে বিভিন্ন উগ্র গোষ্ঠীর উত্থান ঘটিয়ে, ইসলামের নামে ভ্রান্ত বিশ্বাসের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে মুসলমানদের মধ্যে তারা বিভেদের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে।
ইসলামের শত্রুরা বুঝতে পেরেছে ইসলামের প্রকৃত ও মহান শিক্ষা মুসলমানদের মধ্যে বিস্তার লাভ করলে উপনিবেশবাদ বা সাম্রাজ্যবাদের অস্তিত্ব বরবাদ হয়ে যাবে। মুসলমানরা ইসলামের এ বিশেষত্ব অনুধাবনের সাথে সাথে ইসলাম বৈশ্বিক রূপ ধারণ করবে, গ্লোবালাইজ্ড হয়ে যাবে। ইসলামের এ জাগরণকে কোনক্রমেই রুখে দেয়া যাবে না।
ইসলামী জাগরণের বিরুদ্ধে শত্রুদের কার্যক্রমের পাশাপাশি যে বিষয়টি ইসলামী সমাজের অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তা হলো ‘তাকফিরি ফেতনা’ (কথায় কথায় মুসলমানদেরকে কাফির ঘোষণা দেয়া)। বিভ্রান্তিকর মিথ্যা ফতোয়ার ভিত্তিতে এই তাকফিরি গোষ্ঠী খারেজীদের অনুরূপ মুসলমানদের রক্ত ঝরাচ্ছে, তাদের সম্পদসমূহ নষ্ট করছে, মুসলমানদের ধর্মীয় ও পবিত্র স্থাপনাগুলো ধ্বংস করছে। দেশে দেশে বিভিন্ন নামে মুসলমানদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে প্রতিদিন। এমন একটি দিনও অতিবাহিত হচ্ছে না যেদিন এই চরমপন্থী গোষ্ঠী মুসলমানদের রক্তপাত ঘটাচ্ছে না। বিপজ্জনক বিষয় হলো দেশগুলোর রাজনৈতিক মতপার্থক্যে অহেতুকভাবে ধর্মকে জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। এই অন্যায় প্রবণতার কারণে অধিকাংশ সংঘাত ঘটছে। সমস্যা হলো তাদের এসব কর্মকাণ্ডকে তারা যুক্তিসিদ্ধ করছে আল-কোরআনের শিক্ষাকে বিভ্রান্তিমূলকভাবে ব্যাখ্যা করে।
দুঃখজনকভাবে দেখা যায়, তাকফিরি গোষ্ঠী হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। আর পাশ্চাত্য মিডিয়া এগুলোকে ইসলামী কর্মকাণ্ড হিসেবে চালিয়ে দিয়ে মানুষকে প্রকৃত ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। এই গোষ্ঠীর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সম্পর্কে পাশ্চাত্য মিডিয়াসমূহ ওয়াকেবহাল হলেও তারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এই গোষ্ঠীগুলোকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে। এই সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোকে কাজে লাগিয়ে ইসলামের শত্রুরা নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। এভাবে এই সমস্ত গোষ্ঠীর কার্যকলাপ ইসলাম ও ইসলামী সমাজের জন্য অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়ে উঠেছে।
ইতিহাসের নিরিখে চরমপন্থী ধারা
চরমপন্থী গোষ্ঠীসমূহের এই সমস্ত কর্মকাণ্ড আমাদেরকে খারিজীদের কথা মনে করিয়ে দেয়। খারিজীরা ছিল কঠোরহৃদয় এবং স্বেচ্ছাচারী চিন্তার একটা জনগোষ্ঠী। সিফফিন যুদ্ধে সালিশীর বিষয়টি আসলে তাদের গোঁয়ার্তুমি ও আমিত্বের নিকৃষ্ট স্বেচ্ছাচারিতা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। খারেজীরা ঈমান ও কর্মের ক্ষেত্রে সদা দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকত। ইসলামের ইতিহাসের ঐ খারিজী গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ডই নতুনভাবে মনে করিয়ে দেয় আজকের তাকফিরিদের কর্মকাণ্ড। তৎকালীন তাকফিরিরা নিরীহ মুসলমানদের নৃশংসভাবে হত্যা করত, তাদের সহায়সম্পদ লুট করত। তাদের এ সমস্ত নৃশংসতাকে ইসলাম ও কোরআনের রেফারেন্সে যুক্তি সিদ্ধ করার চেষ্টা করত। ইমাম আলী (আ.) এই অজ্ঞ তাকফিরি গোষ্ঠীর ব্যাপারে বলেছেন, ‘তারা সত্য সন্ধান করে, কিন্তু কোন না কোন কারণে তা ভ্রান্ত পথে চলে যায়। তারা মিথ্যাকে সত্যের মতো করে উপস্থাপন করে।’ ধর্মীয় শিক্ষার বিষয়াদির ক্ষেত্রে তারা নিজেদের বিভ্রান্তিকর ও নব উদ্ভাবিত ব্যাখ্যার মাধ্যমে ইসলামের সুষুমামণ্ডিত জীবন বিধানকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে এবং বিকৃত অবস্থাকে বৈধতা দান করে। খারিজীরা মুসলমানদের মূূল ¯্রােতের সাথে অসমীহ ও অবাধ্যচারিতার প্রকাশ ঘটায়। রাসূলুল্লাহ (সা.) এই দলটি সম্পর্কে বলেছেন, ‘ধনুক থেকে তীর যেভাবে নিক্ষিপ্ত হয় তদ্রƒপ তারা দ্বীন থেকে নিক্ষিপ্ত হবে।’(১) খারিজী গোষ্ঠীটি তাদের বক্র উপলব্ধি ও বিচ্যুত বোধের কারণে দ্বীনের মূল ¯্রােত থেকে দূরে চলে যায়। ইসলামের বুনিয়াদি শিক্ষা সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার কারণে নিজেদের ধ্বংসের বিনিময়ে হলেও তারা ঐশী হেদায়াতের আলো নিভিয়ে দিতে চাইত। ইতিহাসের ক্রমধারায় খারেজী গোষ্ঠীগুলো বিভিন্ন ধারা উপধারায় বিভক্ত হয়ে তাদের এ জঘন্য কাজগুলো চালিয়ে যায়। তাদের একটা দল গুনাহের কাজ থেকে মানুষকে দূরে রাখার জন্য তাদের ঘরে আক্রমণ করত। নারীদের সাথে একত্রে কোন পুরুষকে দেখলেই তারা তাদের জিজ্ঞাসা করার জন্য দাঁড় করিয়ে রাখত; যদি তারা পরস্পরের আত্মীয় না হতো তবে তাদেরকে বন্দি করত। এইভাবে এই তাকফিরি গোষ্ঠীগুলো সাধারণ মুসলমানদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। খলিফাদের হস্তক্ষেপের কারণে আপতত নির্মূল হলেও ভিন্ন নামে ঐ চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলো আবার সক্রিয় হয়ে উঠে।
তাকফিরি চিন্তা পুনরায় ফিরে আসে ইবনে তাইমিয়ার মাধ্যমে। তিনি মনে করতেন, ইসলামী আকিদা-বিশ্বাস একমাত্র কোরআন ও হাদীসের আক্ষরিক অর্থের অনুগামী হবে। বিকৃত এ চিন্তাধারার গোষ্ঠীগুলো অন্য মুসলমানদের ব্যাপক হারে হত্যা করেছে। এমনকি নামাযরত অবস্থায় মুসল্লিদের হত্যা করেছে। নির্দোষ অসহায় নারী-শিশুদের তারা অত্যন্ত নৃশংসভাবে হত্যা করছে। নিজেদের ভ্রান্ত বিশ্বাস দ্বারা তারা অন্যা মুসলমানদের কাফির-মুশরিক ঘোষণা দিয়ে তাদের সহায়-সম্পদ, এমনকি নারীদেরকে নিজেদের জন্য হালাল ঘোষণা করেছে। ইবনে তাইমিয়ার চিন্তাধারার অনুসারীরা আজকের মুসলিম বিশ্বে চরমপন্থী কর্মকাণ্ডের নীলনকশা বাস্তবায়নকারী।
ইসলামের আলোকে পর্যালোচনা
ক. মানবিক মূল্যবোধের প্রতি ইসলামের সম্মান : ইসলাম মানবিক মূল্যবোধকে সম্মান করে। পবিত্র কোরআন ঘোষণা করছে, ‘এই কারণেই বনী ইসরাঈলের প্রতি এই বিধান দিলাম যে, নর হত্যা অথবা দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কার্য করা হেতু ব্যতীত কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যে দুনিয়ার সকল মানুষকে হত্যা করল, আর কেউ কারো প্রাণ রক্ষা করল সে যেন সকল মানুষের প্রাণ রক্ষা করল।’Ñ সূরা মায়িদা : ৩২।
উপরিউক্ত আয়াতে মহান আল্লাহ্ মানুষের জীবন ও সম্পদের হেফাজতকে পবিত্র কর্তব্য হিসেবে মুসলমানদের জন্য নির্ধারণ করেছেন। মানুষের জান-মালের সুরক্ষা ইসলামী শিক্ষার অপরিহার্য অংশ। অকারণে কোন মুসলমান অন্য মানুষের জান-মালের কোন ক্ষতি করতে পারবে না।
খ. মুসলমানদের মর্যাদা : পবিত্র কোরআন ইরশাদ করছে : ‘কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোন মুমিনকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম; সেখানে সে স্থায়ী হবে এবং আল্লাহ তার প্রতি রুষ্ট হবেন; তাকে লা’নত করবেন এবং তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত রাখবেন।’Ñ সূরা নিসা : ৯৩
এই আয়াতের মাধ্যমে মহান আল্লাহ মুমিনের জীবন ও সম্মানকে এক অনন্য সুরক্ষা দান করেছেন। কোন মানুষের এ অধিকার নেই যে সে স্বীয় ইচ্ছা বিবেচনায় কোন মুমিনের প্রাণ সংহার করবে। উপরন্তু ভিন্ন গোত্রের বা গোষ্ঠীর কেউ যদি মুসলমানদের সালাম প্রদান করে তবে সেই ব্যক্তির জান ও মাল মুসলমানদের হাতে নিরাপদ থাকবে। ইসলামের শিক্ষা হলো সালাম দেয়াটাই ঐ ব্যক্তির জন্য যথেষ্ট। অযথা তাকে হয়রানি করা যাবে না। অন্যান্য মুসলমানে মতো সমাজে সেও নিরাপত্তা লাভ করবে। সম্পদের লোভে অথবা অন্য কোন কারণে তাকে হত্যা করা মুসলমানদের জন্য নিন্দনীয় অপরাধ। ইরশাদ হচ্ছে : “হে মুমিনগণ! তোমরা যখন আল্লাহর পথে যাত্রা করবে তখন পরীক্ষা করে নেবে এবং কেউ তোমাদেরকে সালাম করলে ইহ জীবনের সম্পদের আকাক্সক্ষায় তাকে বল না, ‘তুমি মুমিন নও’, কারণ, অনায়াসলভ্য সম্পদ আল্লাহ নিকট প্রচুর রয়েছে।”Ñ সূরা নিসা : ৯৪। এই আয়াতের প্রেক্ষাপট হলো : খায়বর যুদ্ধ শেষে নবীজি উসামা বিন যাইদকে কিছু সংখ্যক সঙ্গীসহ এক ইহুদি গোত্রের কাছে ইসলাম প্রচারের জন্য প্রেরণ করেন। ইহুদি গোত্রটি ফাদাক বাগানের পাশেই বসবাস করত। মারদাস বিন নাহিদ নামের একজন ইহুদি উসামার আগমন বুঝতে পেরে তার সহায়-সম্পদ ও পরিবারের সদস্যদেরকে কাছাকাছি একটা পাহাড়ে লুকিয়ে রাখে। অতঃপর সে উসামার কাছে আসে এবং ঘোষণা করেÑ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’। এ ঘোষণা শোনার পরও উসামা ঐ ব্যক্তিকে হত্যা করে এবং রাসূল (সা.)-এর কাছে এসে ঐ ঘটনার বর্ণনা দেয়। নবীজি উসামাকে জিজ্ঞেস করেন : ‘সত্যিই কি তুমি ঐ ব্যক্তিকে হত্যা করেছ, যে তোমার কাছে মহান আল্লাহর একত্ববাদ ও তাঁর রাসূলের ব্যাপারে সাক্ষ্য দিয়েছে?’ উসামা উত্তর দিলেন : ‘হে আল্লাহর রাসূল! সে নিজেকে রক্ষা করার জন্য উক্ত সাক্ষ্য প্রদান করেছে।’ উত্তরে রাসূল (সা.) বললেন : ‘তুমি কি তার অন্তরের খবর নিয়ে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছ?’২
এ রকম অনেক হাদীস আছে যেখানে নবীজি কাউকে মুসলমানদের সমাজ থেকে বহিষ্কার করার ব্যাপারে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। এমনকি তিনি বিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসীদের মাঝে সীমারেখা টেনে দিয়েছেন। আর তাদের সাথে কেমন ব্যবহার করতে হবে সে ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন : ‘আমি আল্লাহর নির্দেশে ইসলাম প্রচারের জন্য কোন মিশন প্রেরণকালে তাদেরকে এইভাবে নির্দেশ দিতামÑ তারা যদি বলে, ‘আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই’, অতঃপর তারা নামায আদায় করে এবং কেবলা মেনে চলে, তাদের পশুগুলোকে আমাদের মতো জবাই করে তবে তাদের জান ও মাল সুরক্ষিত থাকবে।”৩
অন্য আর একটি ঘটনা হলো : রাসূলুল্লাহ (সা.) ইমাম আলী (আ.)-কে খায়বরের যুদ্ধে সেনাপতি নিযুক্ত করেন। তিনি খায়বরের সুরক্ষিত দুর্গ জয় করার নির্দেশ দেন। ইমাম আলী রাসূল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করেন : ‘আমি কতক্ষণ পর্যন্ত তাদের সাথে যুদ্ধ করব?’ উত্তরে রাসূল (সা.) বললেন : ‘তুমি তাদের সাথে ঠিক ততক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধ করবে যতক্ষণ না তারা মুখে মহান আল্লাহর একত্ববাদের ঘোষণা দেয় এবং আমাকে আল্লাহর প্রেরিত নবী হিসেবে মেনে না নেয়। তারা এ ঘোষণা দিলে তুমি তাদের জান-মালের উপর আর আক্রমণ করবে না। এতদসত্ত্বেও তারা যদি কোন মন্দ কাজ করে তবে সে ভার মহান আল্লাহ উপর ন্যস্ত করবে।’৪
একই রকম আর একটি হাদীসে রাসূল (সা.) বলেন : ‘তাদেরকে ক্ষমা করে দাও যারা মহান আল্লাহর একত্ববাদ ও তাঁর প্রেরিত রাসূলের সপক্ষে সাক্ষ্য দেয়। কখনও তাদেরকে কাফের বল নাÑ তারা পাপ কাজে লিপ্ত হলেও। যে আল্লাহর একত্ববাদের সাক্ষ্য দেয় কেউ তাকে মুসলমান সমাজ থেকে বহিষ্কার করলে প্রকৃতপক্ষে ঐ ব্যক্তি নিজেই অবিশ্বাসীদের মধ্যে গণ্য হবে।’
সামাহ বিন মেহরান ইমাম জাফর সাদেক (আ.) থেকে বর্ণনা করেন। ইমাম বলেছেন : ‘ইসলাম এই ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিতÑ যে মহান আল্লাহর একত্ববাদ ও তাঁর প্রেরিত রাসূলের (সা.) ব্যাপারে সাক্ষ্য দেবে তার জীবন সুরক্ষিত থাকবে, বিয়ে-শাদী ও উত্তরাধিকারের ব্যাপারে সকল মুসলমানের মতো সমান অধিকার ভোগ করবে।’৫
গ অন্য মুসলমানদের কাফের আখ্যায়িত করার ব্যাপারে মুসলিম পণ্ডিতগণের দৃষ্টিভঙ্গি : মুসলমানদের কাউকে কাফের হিসেবে আখ্যায়িত করার ব্যাপারে মুসলিম পণ্ডিতগণ সদা সতর্ক ছিলেন। তাঁদের সর্বসম্মত রায় হলো একাজ পবিত্র কোরআন ও হাদীসের পরিপন্থী এবং তা মুসলিম সমাজে অহেতুক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে। শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে আলেমগণ কাফের ফতোয়া দেওয়ার ব্যাপারে বিরোধী ভূমিকা পালন করেন। শিয়া আলেমদের মধ্যে শেখ সাদুক, শেখ হাসান নাজাদী, গ্রান্ড আয়াতুল্লাহ হাকিম, গ্রান্ড আয়াতুল্লাহ জাওয়াদী আমোলী প্রমুখ এসব ফতোয়া দেওয়ার ঘোর বিরোধী। অন্যদিকে সুন্নি আলেমগণও এ ব্যাপারে সোচ্চার।
শেখ সাদুক এ ব্যাপারে বলেন : “ইসলাম ঘোষণা করেÑ ‘আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং হযরত মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর প্রেরিত রাসূল’; যে কেউ এ সাক্ষ্য প্রদান করলে তার জীবন ও সম্পদের উপর কেউ আক্রমণ করতে পারবে না। এই সাক্ষ্য দ্বারা তার জীবন ও সম্মান সুরক্ষিত হয়ে যায়।”৬
সুন্নি আলেমদের মধ্যে ইবনে হাজ্ম তাকফিরি বিশ্বাসসমূহ পৃথক পৃথকভাবে চিহ্নিত করে গ্রন্থবদ্ধ করেছেন। তাঁর গ্রন্থে ‘আল-কালাম ফি মান ইউকাফ্ফির ওয়া লা ইয়াকাফ্্ফার’ শীর্ষক অধ্যায়ে তিনি বলেন : ‘এ ব্যাপারে জনসাধারণের মাঝে মতপার্থক্য রয়েছে :
প্রথমত, কেউ কেউ তাদের আদর্শিক ও ফতোয়াগত পার্থক্যের কারণে অন্যকে কাফের হিসেবে আখ্যায়িত করে;
দ্বিতীয়ত, কেউ কেউ তাদের বিপরীত চিন্তাধারার কোন একটি অংশকে এবং কেউ কেউ অপর অংশকে নিজেদের বিশ্বাসের আলোকে মূল্যায়ন করে অশ্রদ্ধাভরে প্রত্যাখান করেছে;
তৃতীয় দলটি হলো তারা যারা ফতোয়া ও আমলের ক্ষেত্রে তাদের থেকে ভিন্ন মতাদর্শ অনুসরণ করলেও তাদেরকে কাফের বা পাúী গণ্য করে না, বরং তাদেরকে সেই মুজতাহিদের ন্যায় বিবেচনা করে যিনি তাঁর কাজে ভুল করলেও নিয়তের কারণে ক্ষমার্হ;
চতুর্থত, সর্বশেষ দল হলো তারা যারা তৃতীয় দলের মতাদর্শ ধর্মীয় আমলের দিক থেকে গ্রহণযোগ্য গণ্য করে। কিন্তু আকিদাগতভাবে তাদের বক্তব্য হলো, ঐশী বিষয়ে মতভিন্নতার পরিণাম হলো কুফ্র এবং অন্যান্য বিষয়ে ত্রুটিপূর্ণ চিন্তাধারা হলো ফাসেকী কাজ।’৭
আবুল হাসান আশআরীর শিষ্য যাহের সারাখ্শি বলেন : “আবুল হাসান আশআরী আমার বাড়িতে মৃত্যুশয্যায় শায়িত ছিলেন। মৃত্যু ঘনিয়ে এলে তিনি তাঁর সকল ভক্ত ও সঙ্গীকে কাছে ডাকার নির্দেশ দিলেন। সবাই তাঁর সামনে এলে তিনি ঘোষণা করেন : ‘তোমরা সকলে সাক্ষী থেক, আমি কখনও কোন মুসলমানকে কাফের ঘোষণা করিনি, যদিও তারা পাপ কাজ করেছে। কারণ, তারা ইসলামী ইবাদত-বন্দেগি করেছে ও মহান আল্লাহর প্রতি ঈমান পোষণ করেছে। ইসলাম তাদের সবাইকে নিজের মধ্যে একীভূত করে রেখেছে।”৮
একই রকম মনোভাব পোষণ করেন শাফেয়ী মাযহাবের ইমাম শাফেয়ী। তাঁর বিশ্বাসÑ ‘বাতিকগ্রস্ত মানুষের পাপের কারণে আমি তাদেরকে কাফের আখ্যায়িত করি না। যারা পবিত্র কেবলা মেনে চলে তারা কোন কাজ করলেও আমি তাদেরকে মুসলমান হিসাবে গণ্য করিÑ কিতাবিয়াদের ছাড়া।’৯
‘আকিদায়ে তাহাভীয়্যা’ নামক গ্রন্থে এ সংক্রান্ত বহু সংখ্যক টীকা সংযোজিত হয়েছে সুন্নি মনীষিগণের দ্বারা। তন্মধ্যে আবু জাফর তাহাভী বলেন : ‘আমরা তাদেরকে মুমিন হিসেবে জানি যারা কেবলা (কেবলার দিকে মুখ করে নামায পড়ে) মেনে চলে। আমরা ততক্ষণ তাকে মুসলিম হিসেবে মেনে চলব যতক্ষণ তারা ইসলামের মহান নবীর শিক্ষাকে মেনে চলবে। আমরা মুসলমানদের কাউকে অমুসলিম বলি না, যদিও সে গোনাহের কাজ করে, কিন্তু ঐ গোনাহের কাজকে নাজায়েয মনে করি।’
কাজী আয়াজ ছিলেন ১৬ হিজরির মালেকী মাযহাবের একজন প্রখ্যাত পণ্ডিত। তিনি বলেন : ‘যদি কেউ আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও পবিত্রতার বিপক্ষে এমন কোন উক্তি করে যা মহান আল্লাহর প্রতি কটাক্ষপূর্ণ নয় তবে তারা ব্যক্তিগতভাবে অবিশ্বাসীদের মতো কার্যকলাপে লিপ্ত বলা যাবে। এবং তারা বিদআত সৃষ্টিকারী হিসেবে বিবেচিত হবে। এসব বিষয়ে ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের মাঝে মতবিরোধ রয়েছে। অতীতের মতো বর্তমানেও তাদের ব্যাপারে দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে যে, এই সমস্ত কার্যসম্পাদনকারীকে অবিশ্বাসী বলা হবে কি না?’১০
১১ হিজরির প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব হানাফী মাযহাবের অনুসারী মোল্লা কারি ইবনে হাজার সম্পর্কে বলেন : ‘এ কথা সত্য যে, বর্তমান এবং অতীতের আমাদের প্রখ্যাত পণ্ডিতগণ সর্বসম্মতভাবে একমত হয়েছেন যে, তাঁরা কাউকে কাফের আখ্যায়িত করবেন নাÑ যারা সমাজে নতুন কিছু প্রচলন করে (বিদআত সৃষ্টি) বা গোনাহের কাজ করে। এদের কথা বা কাজগুলোকে ধর্ম বিষয়ে প্রচলিত মতের বিপক্ষে সাদামাটা হিসেবে গণ্য করা হয়, যতক্ষণ না তারা তাদের চিন্তাধারাকে প্রায়োগিকভাবে অনুশীলন করে। সেই কারণে মুসলমানগণ তাদের সাথে সকল সম্পর্ক রক্ষা করে চলবে। তাদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক থাকবে, সাধারণ মুসলমানদের জানাযায় তারা শরীক হবে, একই রীতি অনুযায়ী গোরস্তানে সমাহিত হবে। এটা এ কারণে যে, ভুল পথে চালিত হওয়ার কারণে তারা খারাপ ও পাপ কাজগুলো করেছে। তারা ধর্ম সম্পর্কিত যে কথাগুলো বলেছে তা উদ্দেশ্যমূলক ছিল না।’১১
তাকি আলদীন সুবুকি (শাফয়ী মাযহাবের মনীষী) কাউকে কাফের ফতোয়া দেওয়ার ব্যাপারে বলেন : “ভাই সকল! কাউকে কাফের সাব্যস্ত করা খুবই কঠিন কাজ। কারো অন্তরে মহান আল্লাহর ব্যাপারে বিশ্বাস থাকলে তাকে কাফের বলা গোনাহের কাজ, বিপজ্জনক বিদআতী কাজ। কেননা, যারা মুখে স্বীকার করে ‘আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর প্রেরিত রাসূল’, এমন ব্যক্তিকে কাফের বলা ভয়ঙ্কর অন্যায়।”১২
সুন্নি মাজহাবের পণ্ডিতগণ কাউকে কাফের আখ্যায়িত করার ব্যাপারে আরও সতর্কতা ব্যক্ত করেছেন। খারেজীদের কাফের ফতোয়া দেওয়ার ব্যাপারে তাঁরা বিরত থেকেছেন। উদাহরণ হিসেবে সহীহ মুসলিমের টীকা লেখক নাহওয়ায়ীর কথা বলা যায়। তিনি বলেছেন : ‘এটা এক ধরনের বিশ্বাস যে, যারা সত্যপথ অনুসরণ করে এমন মুসলমান যদি কখনও পাপ, খারাপ কাজ বা বিদআতে লিপ্ত হয় তবে তাকে কাফের বলা যাবে না। যেমন খারিজী ও মুতাযিলী সম্প্রদায়। তাদেরকেই শুধু কাফের বলা যাবে যারা ইসলামের বুনিয়াদি বিষয়কে অস্বীকার করবে।’১৩
মহান আল্লাহ ইসলামকে মানুষের ইহকাল ও পরকালের সার্বিক কল্যাণের জন্য প্রেরণ করেছেন। ইসলামের সুষমা তখনই সৌরভ ছড়াবে যখন তা পূর্ণাঙ্গভাবে মেনে চলা হবে। খাদ্য এবং ওষুধ মানুষের জীবন বাঁচায় এবং জীবনকে বিকশিত করে। খাদ্য ও ওষুধে ভেজাল মিশিয়ে যারা বিক্রি করে তাদেরকে শাস্তি দানের ব্যাপারে যেমন কেউ সন্দেহ পোষণ করে না, তদ্রƒপ যারা মুসলমানদের আকিদা-বিশ্বাস হরণ করে বিভ্রান্তিকর ও ধ্বংসাত্মক আকিদা-বিশ্বাসের প্রচার ও প্রসার করে তাদের শাস্তি দানের ব্যাপারে কারো দ্বিধাদ্বন্দ্ব করা উচিত না। সমাজের সকল মানুষের পার্থিব, পারলৌকিক ও আধ্যাত্মিক কল্যাণ ও সৌভাগ্যকে কেউ যেন হুমকিতে ফেলে না দেয় সে ব্যাপারে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। ইসলাম আকিদা-বিশ্বাস ব্যক্ত ও প্রচার করার স্বাধীনতা ততটুকুই অনুমোদন করে।
ইসলামী ঐক্যের অনন্য আহ্বান
ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী ২০০৯ সালে (১২ মে) কুর্দিস্থান প্রদেশে সফরকালে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য সম্পর্কে অত্যন্ত মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তিনি এ বক্তব্যের মাধ্যমে অন্য মাযহারের নিকট পবিত্র বিষয়াদি সম্পর্কে অসম্মানজনক মন্তব্যকে গর্হিত বলে চিহ্নিত করেন। ইরানের রাহবার বলেন : ‘আল্লাহর কসম! যারা শিয়াদের অন্তরে সুন্নিদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারের বীজ বপন করে এবং অপরপক্ষে যারা শিয়াদের বিরুদ্ধে সুন্নিদের অন্তরে ঘৃণার উন্মেষ ঘটায় তারা আসলে কেউই শিয়া অথবা সুন্নি নয়। তারা প্রকৃতপক্ষে ইসলামের শত্রু। অবশ্যই তাদের অধিকাংশই অজ্ঞ। তারা বুঝতে পারে না তাদের এ কর্মকাণ্ডের পরিণতি কী হবে? এদের জন্য দুঃখ হয়।’
‘এধরনের ভুল ধারণার উদ্ভব কিভাবে হলো? সারা বিশ্বের শিয়া, উত্তর আফ্রিকার শাফেয়ী জনগোষ্ঠী এবং মধ্য আফ্রিকার মালেকী মাযহাবের লোকজন সকলেই নবীর আহলে বাইতকে ভালোবাসেন। তাঁরা কি সবাই কাফের যাঁরা কায়রোর ইমাম হোসাইনের মাযার অথবা তাঁর নামে উৎসর্গিত মসজিদকে পবিত্র মনে করেন? শুধু একারণেই তাঁরা কাফের আখ্যায়িত হবেন! শিয়ারা কাফের হলে সুন্নিদের মধ্যে যারা কাদেরিয়া বা নক্শবন্দী সম্প্রদায়ের অথবা যারা সাগেজ, সান্দাজ ও মারভিয়ান এলাকার অধিবাসী তারা সবাই কি কাফের? এভাবে ভ্রান্ত আকিদার মাধ্যমে মুসলমানদের পর¯পরের সম্প্রীতি নষ্ট করা হচ্ছে কেন?’
‘শিয়া মাযহাবের অজ্ঞ ও বিদ্বেষপরায়ণ কিছু লোক শিয়া-সুন্নি জনগোষ্ঠীর মাঝে বিভেদের কারণ হয়েছে, যারা সুন্নিদের পবিত্র বিষয়কে অপমানের চোখে দেখে। আমি সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চাই, এই ধরনের আচরণ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অথবা যৌক্তিকতার নিরিখে দুভাবেই অন্যায় (শরীয়ত পরিপন্থী)।’
ইসলামী ইরানের রাহবার ঐক্য সম্মেলনে প্রদত্ত অন্য একটি খুতবায় বলেন : ‘ইসলামী উম্মাহর জন্য আজ ঐক্য ও অভিন্ন হৃদয়ের বড় প্রয়োজন।’ তিনি ঐক্য সৃষ্টিকারী দায়িত্ব পালনের জন্য মুসলিম দেশসমূহের সরকার, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্বের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। তিনি বলেন : ‘ইসলামী জাগরণ যদি ব্যাপকতর ও গভীর হয় এবং মুসলমানদের হৃদয়গুলো পরস্পর ঘনিষ্ঠতর হয় তাহলে আন্তঃসম্পর্ক, সহযোগিতা ও সর্বজনীন অগ্রগ্রতির দরজা উন্মুক্ত হয়ে যাবে…।’
ইরাকের গ্রান্ড আয়তুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী সিস্তানী ও গ্রান্ড আয়াতুল্লাহ মুহাম্মাদ সা’য়িদ আল-হাকিমকে ঐক্য প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হয় । প্রশ্নটি হলো কেউ যদি মহান আল্লাহর একত্ববাদ এবং মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ (সা.)-এর নবুওয়াতে বিশ্বাসী হয়, কেবলামুখী হয়ে নামায আদায় করে, আটটি মাযহাবের (হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী, হাম্বলী, জাফরী, যায়েদী, ইবাদী ও যাহেরী) কোন একটিতে বিশ্বাসী হয় তাহলে তারা কি মুসলিম হিসেবে গণ্য হবে? তাদের সম্মান-মর্যাদা, সম্পদ কি সুরক্ষিত থাকবে?
গ্রান্ড আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী সিস্তানী জবাব দেন : বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম। কেউ যখন এ দুটি ব্যাপারে সাক্ষ্য দেবে (শাহাদাতাইন) এবং এই সাক্ষ্যের বিপরীতে কোন কথা সে বলবে না এবং মহান নবী (সা.)-এর আহলে বাইতের প্রতি ঘৃণা বা শত্রুতামূলক কোন কথা বলবে না, তাহলে সে মুসলমান হিসেবে গণ্য হবে।
গ্র্যান্ড আয়তুল্লাহ সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ সা’য়িদ আল-হাকিম এ ব্যাপারে বলেন : সাহাবীদের গালাগাল করা বা অন্য কোন মুসলমানÑ তা তিনি যে মাযহাবেরই হোন না কেন তাঁকে কাফের বা রাফেজী বলা শিয়াদের আকিদা নয়। এটা ইসলামের মৌল নীতি ও চেতনার পরিপন্থী কাজ।
তিনি বলেন : যে মহান আল্লাহর একত্ববাদ এবং নবী মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ (সা.)-এর নবুওয়াতের ঘোষণা দেয়, ধর্মীয় অনুশাসন, যেমন নামায, রোযা ইত্যাদি আবশ্যকীয় বিষয় মেনে চলে, কারো মুসলমান হিসেবে বিবেচিত হবার জন্য এগুলোই যথেষ্ট। এভাবে তার জীবন, সম্পদ ইত্যাদি সম্পর্কিত সকল ধর্মীয় অনুশাসন তার জন্য প্রয়োগযোগ্য হবে।
২০১৫ সালের জুলাই মাসে মিশরের আল-আযহার মসজিদের গ্রান্ড ইমাম আল-তায়িব রাজধানী কায়রোতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিয়া-সুন্নি ধর্মীয় আলেম ও চিন্তাবিদদের নিয়ে একটি সম্মেলনের ডাক দেন। শিয়া মুসলমানদের হত্যার বিরুদ্ধে ফতোয়া দিতে আল-তায়িব সুন্নি ধর্মীয় আলেমদের প্রতি আহ্বান জানান। অন্যদিকে, সুন্নি মুসলমানদের হত্যার বিরুদ্ধে একই ধরনের ফতোয়া দিতে তিনি শিয়া ধর্মীয় আলেমদের প্রতিও আহ্বান জানান। মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ ও শত্রুতা সৃষ্টির পাশাপাশি মুসলিম দেশগুলোর ভিতর যেসব নৃশংস এবং বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড চলছে এটি ইহুদিবাদীদের পরিকল্পনার অংশ বলেও অভিযোগ করেন আল-তায়িব।
উপসংহার
চরমপন্থীদের ভয়াবহ কর্মকাণ্ড থেকে সাধারণ মুসলমানদের হেফাজত করা দরকার। সকল মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ছাড়া সেটা কখনও সম্ভব নয়। তাই সবার আগে দরকার পারস্পরিক দূরত্ব পরিহার করে ইসলামের মূলনীতির আলোকে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। ইসলাম ধর্মের মৌলিক বিষয়ের সঠিক জ্ঞান এক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে। মাযহাবসমূহের পণ্ডিতদের এ ব্যাপারে আরও আন্তরিক ও তৎপর হতে হবে। আর যত তাড়াতাড়ি একাজ সম্পন্ন করা যাবে ততই মুসলিম উম্মাহ্র মুক্তি ত্বরান্বিত হবে।
সূত্র
(১) আল-শাহরেস্তানী, আল-মিলাল ওয়ান নিহাল, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৩৪।
(২) মাজলিশী, বিহারুল আনওয়ার, ২২তম খণ্ড, পৃ. ৯২।
(৩) সহীহ আল-বুখারী, নামায অধ্যায়, অধ্যায় ২৮, পৃ. ১০৮, নম্বর ৩৯২।
(৪) নিশাবুরী, সহীহ মুসলিম, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ১৮৭২, ‘ফাজায়েল সাহাবা’, নম্বর ৩৩।
(৫) কুলাইনী, উসূলে কাফী, বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী অধ্যায়, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৯।
(৬) শেখ সাদুক, আল হেদায়া, পৃ. ৪৭।
(৭) ইবনে হাজাম, আল-ফাসাহ ফি আল-মিলাল ওয়াল-আহওয়া ওয়া নিহাল, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৯১, আল-কালাম-ফি মান ইয়া কাফির ওয়ালা ইয়া কাফির।
(৮) শারাফউদ্দিন, আল-ফাযল আল-মুহিম্মা ফি তাঅলিফ আল-উম্মাহ, পৃ. ৩৮।
(৯) ঐ, পৃ. ৩২।
(১০) আল-হিয়াসী, আল-শিফা বিতাআরিফ হুকুক আল-মুস্তাফা, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৭২।
(১১) আল-গওহারী, বিন সুলতান, মানাহ আল-রাওয়া আল-আজহার ফি শারহে আল-ফিকাহ আল-আকবার, পৃ. ৪২৫।
(১২) শারাফউদ্দিন, আল-ফাযল আল-মুহিম্মা ফি তাঅলিফ আল উম্মাহ, পৃ. ২৮।
(১৩) আল-নাহওয়ায়ী, শারহে সহীহ মুসলিম, ১ম খণ্ড, পৃ. ২১৩।

মহানবী (সা.)-এর সিরাতে বিশ্বশান্তি ও সুবিচার

শান্তি ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা ইসলামের অন্যতম লক্ষ্য। ইসলামের এ লক্ষ্য কেবল মুসলমানদের জন্য নয়, বরং সমস্ত মানুষই এ লক্ষ্যের আওতাধীন।
আজ থেকে চৌদ্দশ’ বছর আগে যখন মহানবী (সা.)-এর জামাতা ও উওরাধিকারী হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) মালিক আশতারকে মিসরের গভর্নর নিয়োগ করেন তখন তাঁর কাছে শাসনব্যবস্থার মূলনীতিসমূহের রূপরেখা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করে একটি পত্র প্রেরণ করেন।
তখন মিসর ছিল ইসলামী খেলাফতের অন্তর্গত একটি প্রদেশ যেখানে বহু ধর্মের অনুসারী লোকেরা বসবাস করতো। ইমাম আলী (আ.) তাঁর এ পত্রে মালিক আশতারকে নিম্নরূপ নির্দেশনা প্রদান করেন : ‘তোমার মনে জনগণের প্রতি দয়া ও ভালোবাসা লালন করো আর তাদের প্রতি মমতা ও হৃদ্যতা পোষণ করো। হিংস্র পশুর মতো হয়ো না যে, তাদের ভক্ষণ করাকে গনীমত মনে করবে। কারণ, মানুষ দুই শ্রেণির : হয় তারা তোমার ঈমানী ভাই, না হয় তোমার সমপ্রজাতির (মানুষ)।’
মানুষ হিসেবে অমুসলমানদের প্রতি এ মমত্ববোধ ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশÑ যার বার্তা নিয়ে আসেন রাসূলুল্লাহ্ (সা.)। আর এজন্যই এ মহান ব্যক্তিত্ব ও তাঁর সহগামীদের সম্পর্কে জানার প্রয়োজন রয়েছে।
নবী-রাসূলগণের মিশন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা
আল্লাহ তা‘আলা মানবজাতির হেদায়াতের জন্য যুগে যুগে নবী-রাসূলগণকে প্রেরণ করেন; তাঁদের মধ্যে সর্বশেষ হচ্ছেন মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)। আর সকল নবী-রাসূলই মানবসমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে প্রেরিত হয়েছিলেন। আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা কোরআন মজীদে এরশাদ করেন :

‘নিঃসন্দেহে আমি আমার রাসূলদেরকে সুস্পষ্ট প্রমাণসহ প্রেরণ করেছি এবং তাদের সাথে গ্রন্থ ও ন্যায়দণ্ড (নিক্তি) অবতীর্ণ করেছি, যাতে মানুষ সুবিচার সহকারে দণ্ডায়মান থাকে।’ (সূরা আল্-হাদীদ : ২৫)
বস্তুত সকল মানুষই এ দুনিয়ায় শান্তি কামনা করে। কিন্তু শান্তি এমন নয় যে, তা শূন্যতা থেকে হঠাৎ আবির্ভূত হবে, বরং এটি ন্যায়বিচারের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য অবশ্যই ন্যায়বিচার সমাজব্যবস্থার অংশ হতে হবে, নতুবা টেকসই শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব হবে না।
প্রশ্ন হচ্ছে, ন্যায়বিচার কী? ন্যায়বিচার হচ্ছে সবকিছুকে তার যথাযথ অবস্থানে স্থান দেয়া। যখন কেউ কোন কিছুকে তার যথাযথ স্থান ব্যতীত অন্য কোথাও স্থান দেয় তখন সামাজিক সুস্থিতি ও শান্তির ব্যাঘাত ঘটে।
আর সামাজিক শান্তি নির্ভর করে ব্যক্তির আত্মিক প্রশান্তির ওপর। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এরশাদ করেন, সেই ব্যক্তিই ন্যায়বান যে তার রাগ ও ক্রোধকে আক্্ল দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে। তিনি আক্্ল প্রয়োগ করে অযাচিত ভাবাবেগ, লোভ, ক্রোধ ইত্যাদি দমন করাকে ‘বৃহত্তর জিহাদ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
একবার মুসলিম সেনাবাহিনী সফল যুদ্ধ শেষে মদীনায় ফিরে এলে নবী করীম (সা.) তাঁদেরকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘অভিনন্দন তাদের জন্য যারা একটি ছোট জিহাদ (জিহাদে আসগার) শেষে ফিরে এসেছে এবং এখনো বড় জিহাদ (জিহাদে আক্বার) বাকি রয়েছে।’ সৈন্যরা জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহ্র রাসূল! কোন্টি বড় জিহাদ?’ তিনি বললেন, ‘আত্মার পরিশুদ্ধির জিহাদ।’
আত্মিক জিহাদ কোনো সহজ জিহাদ নয়, বরং এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিকে তার প্রচণ্ডতম ভাবাবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে আক্ল ও সচেতনতার দাবি মেনে জীবনযাপন করতে হয়। আর যারা নিজেদের আমিত্বকে বর্জন করতে পারে কেবল তারাই সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়।
আল্লাহ্র রাসূল হিসেবে হযরত মুহাম্মাদ (সা.) সমাজে শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় বিরাট ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি যুদ্ধের সময়ে অমুসলমান শত্রুদের সাথে কী রকম আচরণ করেছিলেন তার ওপর দৃষ্টিপাত করলেই তা সহজে বুঝা যাব। কারণ, বিরূপ পরিবেশেই কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রকৃত স্বভাব উন্মোচিত হয়।
নবী করীম (সা.) ও তাঁর অনুসারিগণ মক্কায় সমাজের নিপীড়িত সংখ্যালঘু শ্রেণিভুক্ত ছিলেন। নির্যাতন সীমা অতিক্রম করে গেলে তিনি মদীনায় হিজরত করেনÑ যার অধিকাংশ অধিবাসী এর আগেই ইসলাম গ্রহণ করেছিল। মদীনায় গমনের পর নবী করীম (সা.) লক্ষ্য করলেন যে, সেখানকার ইহুদি সম্প্রদায়ের ইসলাম গ্রহণের আগ্রহ নেই। তাই তিনি তাদের সাথে যোগাযোগ করলেন এবং তাদেরকে একটি পারস্পরিক সম্মতি চুক্তিতে আবদ্ধ হতে আহ্বান জানালেন যাতে মদীনার প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায় সমাজে তাদের অধিকার ও কর্তব্য স¤পর্কে নিশ্চিত থাকে। এ চুক্তির কয়েকটি অনুচ্ছেদ ছিল সংক্ষেপে এরূপ :
ইহুদিদের মধ্যে যেসব গোষ্ঠী এ চুক্তিতে আবদ্ধ থাকবে তারা যে কোনো প্রকার অপমান ও নিপীড়ন থেকে নিরাপদ থাকবে। সমাজে তারা যে কোন ভালো কাজ ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে মুসলমানদের সমান ভাগীদার হবে। মদীনার ইহুদি এবং অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায় মুসলমানদের সাথে মিলে একটি একক জাতির অন্তর্ভুক্ত হবে। ইহুদিরা মুসলমানদের মতোই ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করবে। ইহুদিদের মিত্ররাও ইহুদিদের মতোই নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা ভোগ করবে। মদীনা শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হলে ইহুদিরা মুসলমানদের সাথে মিলিত হয়ে শত্রুকে প্রতিহত করবে। যারাই এ চুক্তি মেনে নেবে তাদের জন্য মদীনা পবিত্র গণ্য হবে। ইহুদি ও মুসলমানদের মিত্ররাও চুক্তির মূল সম্প্রদায়দ্বয়ের (ইহুদি ও মুসলমান) মতোই একইরূপ সম্মানিত গণ্য হবে।
মুসলমান ও ইহুদিদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর উদ্যোগে বাস্তবায়িত এ চুক্তি সংখ্যালঘুদের প্রতি তাঁর চরিত্রের ন্যায়-চেতনারই বহিঃপ্রকাশ। আর তিনি যে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে মদীনায় ইসলামের ভিত্তি গড়ে তোলেন নি; বরং ভিন্ন ধর্মানুসারীদের সাথে নিয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন এটি তারই প্রমাণ।
ইবরাহীমী ধর্মত্রয়ের মধ্যে একমাত্র ইসলামই অপর দুই ধর্ম তথা ইহুদি ও খ্রিস্টধর্মকে ধর্মতত্ত্বীয় দৃষ্টিকোণ থেকে স্বীকৃতি দিয়েছিল (অর্থাৎ উক্ত ধর্মদ্বয়ের সম্মানিত চরিত্রসমূহ ইসলামেও সম্মানিত এবং একটা সময় ইহুদি ও খ্রিস্ট ধর্মদ্বয় যে হকের পথে ছিল তার স্বীকৃতি দেয়) এবং এ দুই সম্প্রদায়কে ‘আহ্লে কিতাব’ বা ঐশী গ্রন্থধারী হিসেবে আখ্যায়িত করে।
অমুসলিম আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের সাথে আচরণ
প্রতিবেশীদেরকে ভালোবাসা এবং যতœ করার ইসলামী নির্দেশনা সব মতের, সকল প্রকার প্রতিবেশীর প্রতিই প্রযোজ্য। কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে :

‘আর তোমরা আল্লাহরই ইবাদত করো এবং তাঁর সাথে কোনো কিছুকেই অংশীদার গণ্য করো না এবং পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতিম, দরিদ্র, আত্মীয় প্রতিবেশী ও অনাত্মীয় প্রতিবেশী, সহচর, অসহায় পথিক ও ক্রীতদাসদের সাথে সদাচরণ করো; নিশ্চয় আল্লাহ দাম্ভিক-অহঙ্কারীদেরকে ভালোবাসেন না।’ (সূরা আন্-নিসা : ৩৬)
এমনকি যদি কোন মুসলমানের পিতা-মাতা মূর্তিপূজক হয়, তবুও একত্ববাদের ধর্ম ইসলাম তাদের প্রতি যথাযথ সম্মান ও দয়া প্রদর্শনের নির্দেশ দেয়। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন :

‘তারা (তোমার পিতা-মাতা) যদি আমার সাথে কোনো কিছুকে অংশীদার করার জন্য তোমাকে পীড়াপীড়ি করে অথচ সে সম্বন্ধে তোমার জ্ঞান নেই (তুমি জান যে, তা ঠিক নয়), সে ক্ষেত্রে তাদের আনুগত্য করো না এবং পার্থিব জীবনে তাদেরকে উত্তমভাবে সাহচর্য প্রদান করো…।’ (সূরা লুকমান : ১৫)
যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর প্রতি ন্যায় ও শান্তির নীতি
ইসলাম তার অনুসারীদের প্রতি নির্দেশ দেয় যে, তারা যেন ন্যায়বিচার করে, এমনকি শত্রুদের সাথে আচরণের ক্ষেত্রেও। এরশাদ হয়েছে :

‘হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর খাতিরে ন্যায়ের ভিত্তিতে সাক্ষ্যদানকারী হও এবং (সাবধান!) কোন সম্প্রদায়ের প্রতি বৈরিতা যেন তোমাদেরকে কখনো সুবিচার না করার জন্য প্ররোচিত না করে; বরং সুবিচার করো, এটাই তাক্বওয়ার নিকটতর এবং আল্লাহকে ভয় করতে থাক, কারণ, আল্লাহ তোমাদের কৃতকর্মের ব্যাপারে সবিশেষ অবহিত।’ (সূরা আল্-মায়েদা : ৮)
ইসলামের ইতিহাসের প্রথম যুদ্ধটি ছিল অতীব তাৎপর্যপূর্ণ। এ যুদ্ধটি মুসলিম ও মক্কার মুশরিকদের মধ্যে হিজরি দ্বিতীয় সনে সংঘটিত হয়। অতি অল্প পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সংখ্যালঘু মুসলমানেরা মক্কার মুশরিকদের বিরুদ্ধে জয়ী হন এবং তাদের অনেককে আটক করা হয়।
সে সময় সকল জাতিগোষ্ঠীর রীতি ছিল আটককৃত যুদ্ধবন্দিদেরকে হত্যা করা কিংবা দাস হিসেবে ব্যবহার করা। কিন্তু রাসূলুল্লাহ্ (সা.) মুসলমানদেরকে যুদ্ধবন্দিদের সাথে মানবিক আচরণ করার জন্য নির্দেশ দিলেন। তাই মুসলমানরা যুদ্ধবন্দিদের নিরাপত্তা প্রদান করে মদীনায় নিয়ে এলেন এবং যে মুসলমান যাকে বন্দি করেছিলেন তাকে নিজের বাড়িতে সসম্মানে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন।
পাশ্চাত্যের অন্যতম খ্যাতনামা মনীষী স্যার উইলিয়াম মূর-এর বর্ণনায় : “মুহাম্মাদের নির্দেশনা অনুসরণ করে… মদীনার জনগণ যুদ্ধবন্দিদেরকে শ্রদ্ধার সাথে গ্রহণ করে নেন। ‘মদীনার জনগণের ওপর আশীর্বাদ বর্ষিত হোক! তাঁরা আমাদেরকে তাঁদের বাহনগুলোতে সওয়ার করিয়েছিলেন যখন নিজেরা পায়ে হেঁটে চলেছিলেন, তাঁরা আমাদেরকে গমের রুটি খেতে দিয়েছিলেন যখন সেটির অপ্রতুলতা ছিল এবং আমাদেরকে খেজুরের মাধ্যমে পরিতৃপ্ত করেছিলেন’Ñ এভাবেই পরবর্তীকালে একজন যুদ্ধবন্দি মদীনাবাসী মুসলমানদেরকে স্মরণ করেন।”

রাসূলুল্লাহ্ (সা.) যুদ্ধবন্দিদের সাথে যেরূপ আচরণ করেছিলেন তা ছিল নজিরবিহীন। তিনি দরিদ্র বন্দিদেরকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন এবং ধনাঢ্য বন্দিদের নিকট থেকে সুনির্দিষ্ট মুক্তিপণ গ্রহণ করে তাদের ছেড়ে দিয়েছিলেন। কারণ, কোরআন মজীদে বন্দিদেরকে মুক্তিপণ গ্রহণ করে বা না করে মুক্তি দেয়ার জন্য মুসলমানদেরকে এখতিয়ার দেয়া হয়েছে (সূরা মুহাম্মাদ : ৪)। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় মুক্তিপণ ছিল শিক্ষিত যুদ্ধবন্দিদের বেলায়; রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাদের সাথে এ মর্মে চুক্তি করেছিলেন যে, দশজন মুসলিম শিশুকে লিখতে-পড়তে শেখানোর বিনিময়ে একজন শিক্ষিত যুদ্ধবন্দিকে মুক্তি দেয়া হবে।

মুসলমানদের জন্য যুদ্ধকালে রণাঙ্গন বহির্ভূত সাধারণ লোকদের, এমনকি পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারেও মহানবী (সা.)-এর পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। যেমন :
-চুক্তি লঙ্ঘন করবে না।
-বৃদ্ধ, শিশু ও নারীদের হত্যা করবে না।
-গাছপালা ও বনজঙ্গল কাটবে না বা জলমগ্ন করবে না।
-খেজুর গাছ পুড়িয়ে ফেলা ও জলমগ্ন করা থেকে বিরত থাকবে।
-ফলবান গাছ কাটা থেকে বিরত থাকবে।
-বিধর্মীদের পানিতে বিষ প্রয়োগ করবে না
এ সবই চৌদ্দশ’ বছর আগের বিধান যখন ‘জেনেভা চুক্তি’র কোন অস্তিত্বই ছিল না।
সিআইএ নিয়ন্ত্রিত গুপ্ত কারাগারসমূহে ও আবূ গ¦ারীব কারাগারে নৃশংস নির্যাতনের প্রেক্ষাপটে আমরা অত্যন্ত গর্বের সাথেই দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে পারি, যুদ্ধবন্দিদের সাথে আচরণের যে শিক্ষা ও নজির রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর জীবন থেকে আমরা পেয়েছি সেটা, এমনকি একুশ শতকের মানদণ্ডেও অনেক বেশি মানবিক ও শ্রেয় বরং অতুলনীয়।
উপসংহার
‘সভ্যতাসমূহের মধ্যে সংলাপ’-এর অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীকে নবী-রাসূলগণের আদর্শ অনুসরণে উদ্বুদ্ধ করার পন্থা খুঁজে বের করা। তাই সকল ধরনের চরমপন্থীদেরকেই আমাদের প্রত্যাখ্যান করতে হবে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটের সমস্যাগুলো মোকাবেলা করার পন্থা এটা নয় যে, আমরা ধর্মকে হালকাভাবে গ্রহণ করব; বরং আরো দৃঢ়ভাবে ধর্মকে গ্রহণ ও মূল্যায়ন করতে হবেÑ যাতে ধর্মে বর্ণিত মানুষের পারস্পরিক আচরণবিধিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়। মুসলমানদের উচিত রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর শিক্ষার দিকে প্রত্যাবর্তন করা আর খ্রিস্টানদের উচিত নবী হযরত ঈসা (আ.)-এর শিক্ষার দিকে প্রত্যাবর্তন করা; শুধু তখনই বিশ্বে টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।
রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর আহ্লে বাইত্ (আ.) থেকে প্রাপ্ত একটি দো‘আর কথা আমরা স্মরণ করি যেখঅনে উচ্চারিত হয়েছেÑ ‘হে আল্লাহ! তুমিই শান্তি, তোমার থেকেই শান্তি এবং তোমার কাছেই শান্তির প্রত্যাবর্তন।’
সূত্র: …………..
অনুবাদ : মাহদী মাহমুদ

বিশ্বমানবের জন্য (সা.)-এর শিক্ষা

 

বিসমিল্লাহির রাহমানীর রাহীম্

‘(হে রাসূল!) বলুন : এসো আমি পাঠ করি তা তোমাদের রব্ তোমাদের জন্য যা হারাম করেছেন, তা হচ্ছে এই যে, তোমরা তাঁর সাথে কোনো কিছু শরীক করো না এবং পিতা-মাতার সাথে উত্তম আচরণ কর এবং দারিদ্র্যের ভয়ে তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করো না। বস্তুত আমিই তোমাদেরকে ও তোমাদের ব্যতীত অন্যদেরকে রিয্ক প্রদান করে থাকি। আর তোমরা প্রকাশ্য বা গোপনীয় কোনো ধরনের নির্লজ্জতার কাছেও যেও না। আর ন্যায়সঙ্গতভাবে ব্যতীত আল্লাহ্ যাকে হত্যা করাকে হারাম করেছেন এমন কাউকে হত্যা করো না। তিনি তোমাদেরকে এ উপদেশ দিচ্ছেন; আশা করা যায় যে, তোমরা বিচারবুদ্ধি দ্বারা তা উপলব্ধি করবে। আর (তাদেরই) কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে ব্যতীত তোমরা ইয়াতীমের সম্পদের কাছেও যেও না যতক্ষণ না তারা বয়ঃপ্রাপ্ত হয়। আর তোমরা মাপক পাত্র ও তুলাদ-কে ন্যায়সঙ্গতভাবে ব্যবহার কর। বস্তুত আল্লাহ্ কারো ওপরে তার সাধ্যের অতীত দায়িত্ব চাপান না। আর তোমরা যখন কথা বলবে তখন ভারসাম্য ও ন্যায়নীতি বজায় রাখবে, এমনকি তোমাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনের বেলায় হলেও। আর তোমরা আল্লাহ্র সাথে কৃত অঙ্গীকার পূরণ কর। তিনি তোমাদেরকে এ উপদেশ দিয়েছেন, আশা করা যায় যে, তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে।’ (সূরা আল্-আন্‘আম : ১৫১-১৫২)
মক্কা শরীফে সফরের উদ্দেশ্যে আগত এক ব্যক্তিকে এই বলে সতর্ক করা হয়েছিল যে, তিনি যেন হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর কথা না শোনেন, কারণ, (নিষেধকারীদের বক্তব্য অনুযায়ী) তাহলে ঐ সব কথা তাঁকে জাদুগ্রস্ত করে ফেলবে। কিন্তু তিনি ছিলেন বিচারবুদ্ধির অনুসরণকারী একজন মুক্ত বিবেক মানুষ। এ কারণে তিনি তাদের এ মন্দ উপদেশ উপেক্ষা করেন এবং মসজিদুল হারামে গিয়ে রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর সাথে দেখা করেন। অতঃপর কোরআন মজীদের উপরিউক্ত আয়াত দু’টি শুনে তিনি সাথে সাথে অভিভূত হয়ে পড়েন এবং অনুভব করেন যে, এ আয়াত দু’টিতে নিহিত শিক্ষা তাঁর সম্প্রদায়ের সকল গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান করবে।
ঐ ব্যক্তিটি মক্কায় সফরে এসেছিলেন মদীনা থেকে- যে শহরটি অচিরেই রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর নতুন বাসভূমিতে পরিণত হয়। আর তিনি সেখানে উপরিউক্ত ঐশী ও সুবিচারপূর্ণ মূলনীতিমালা এবং অন্তরঙ্গতার ভিত্তিতে একটি নতুন সম্প্রদায় গড়ে তোলেন।
রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর রবের পক্ষ থেকে মানুষকে এ শিক্ষা দেয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন যে, তারা যেন একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলা ব্যতীত আর কারো ইবাদত-বন্দেগি না করে এবং তাঁর সাথে আর কাউকে শরীক না করে। তাঁকে এ দায়িত্ব প্রদান করা হয় যে, তিনি যেন লোকদেরকে পৌত্তলিকতার ন্যায় মানবতার জন্য অবমাননাকর যুলুম থেকে এবং কুসংস্কারের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেন। তিনি লোকদেরকে শিক্ষা দেন যে, তারা যেন একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে আত্মসমর্পণ করে; সমাজের কাছে নয়, শাসকদের কাছে নয় বা সংখ্যাগুরু জনগণের কাছে নয়, কেবল আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে। তিনি এ শিক্ষা প্রদান করেন যে, আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মধ্যেই নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা নিহিত রয়েছে।
মুক্তি ও স্বাধীনতার শিক্ষা দিতে গিয়ে তিনি আমাদেরকে সকল লজ্জাকর গুনাহ্র কাজ পরিহার করার জন্য শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি আমাদেরকে আমাদের নিজেদের কাছে, আমাদের মূল্যবোধ সমূহের কাছে ও আমাদের আদর্শের কাছে ন্যায়নিষ্ঠ ও আন্তরিক হবার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন এবং আমাদেরকে পাপপ্রবণ প্রবৃত্তির আশা-আকাক্সক্ষার মধ্যেÑ যাতে আমাদের প্রকৃত ও চূড়ান্ত ধ্বংস নিহিত রয়েছে, তাতে নিমজ্জিত হওয়া থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ, কোনো ব্যক্তি যখন গুনাহের পথ বেছে নেয় সে ক্ষেত্রে সে যদি এ পথে ধীর পদবিক্ষেপেও অগ্রসর হতে থাকে, তাহলে শেষ পর্যন্ত তার ধ্বংস অনিবার্য।
রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.) আমাদেরকে জীবনের মর্যাদা শিক্ষা দিয়েছেন। আর তিনি এমন এক সময় এ শিক্ষা প্রদান করেন যখন প্রতিশোধমূলক হত্যার ও তথাকথিত মর্যাদা রক্ষার জন্য হত্যার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছিল। তখন অত্যন্ত তুচ্ছ কারণে নারী ও পুরুষ নির্বিশেষে যে কাউকে হত্যা করা হতো। সে পরিস্থিতিতে হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) লোকদেরকে শিক্ষা দেন যে, কেবল ন্যায়সঙ্গতভাবে ও ন্যায়বিচারের ভিত্তি ব্যতীত কাউকে হত্যা করা যাবে না, যদিও ক্ষমা সর্বাবস্থায়ই সর্বোত্তম।
তখন এমন একটি সময় ছিল যখন পিতা কেবল এ কারণে স্বীয় সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুসন্তানকে জীবন্ত কবর দিত যে, সে ভয় করত যে, এ শিশুর ভরণ-পোষণ বহনে সক্ষম হবে না। হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) এ শিক্ষা প্রদান করেন যে, পিতা-মাতা ও সন্তান নির্বিশেষে সকলকে আল্লাহ্ তা‘আলাই রিয্ক্ প্রদান করেন।
বর্তমানে আমরা এমন এক পৃথিবীতে বসবাস করছি যখন প্রতিদিন মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বিস্ময়কর সংখ্যক প্রাণ বিনষ্ট হচ্ছে। যখন প্রাণসমূহ এমনকি মাতৃগর্ভের নিরাপদ আশ্রয় থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই বিনষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমাদের কিছুতেই জীবনের মর্যাদা ভুলে যাওয়া উচিত নয়।
রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.) আমাদেরকে সুবিচার ও সত্য শিক্ষা দিয়েছেন এবং নৈতিকতা ও সামাজিক আচরণের ভিত্তিসমূহ শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন যে, আসমান ও যমীন সুবিচার বা ভারসাম্যের ওপর ভিত্তিশীল। তিনি সব সময় ও সর্বাবস্থায়ই সুবিচারকে সমুন্নত রাখার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি শিক্ষা দিয়েছেন যে, সর্বাবস্থায়ই সত্য বলতে হবে, এমনকি তা আমাদের নিজেদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করলেও।
তিনি বলেন যে, সুবিচার প্রতিষ্ঠার কাজে এক ঘণ্টা সময় ব্যয় করা সত্তর বছর (নফল) ইবাদত করার চেয়েও অধিকতর উত্তম।
আমরা সকলেই বেশ ভালোভাবেই জানি যে, অন্যায়, অবিচার ও মিথ্যাচার, বিশেষ করে তা যখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে হয়, কীভাবে আমাদের এ বিশ্বকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করতে পারে। তিনি আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন যে, ছোট-বড় নির্বিশেষে সকল ক্ষেত্রে সুবিচার ও সত্যবাদিতার ওপর অবিচলতা কীভাবে আমাদেরকে আমাদের পারিবারিক, সামাজিক ও বৈশ্বিক সমস্যাবলির সমাধানে সাহায্য করে।

রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ছিলেন এমন একজন মহান শিক্ষক যিনি সব সময়ই ব্যক্তিগত আচার-আচরণের ক্ষেত্রে গভীর আন্তরিকতা ও অন্তরঙ্গতার পরিচয় দিতেন। কখনো যদি এমন হতো যে, তাঁর কোনো বন্ধু বা স্বজনের সাথে তিন দিন পর্যন্ত তাঁর দেখা হয় নি তাহলে তিনি তাঁকে দেখতে যেতেন এবং তাঁর খোঁজখবর নিতেন। তিনি চলার পথে যদি কোনো শিশুকেও দেখতে পেতেন তাহলে তার প্রতি হাসিমুখে তাকাতেন এবং তাকে আগে সালাম দিতেন। তিনি যখন তাঁর সাহাবীদের সাথে বসতেন তখন তিনি তাঁদের সকলের প্রতি সমানভাবে দৃষ্টিপাত করতেন যাতে সকলেই নিজেদেরকে সমানভাবে ধন্য মনে করতেন এবং অনুভব করতেন যে, তাঁদেরকে সমানভাবে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

তাঁর ক্বওমের লোকেরা তাঁর আন্তরিকতা এবং দয়া-অনুগ্রহে পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। বর্ণিত আছে যে, একবার জনৈকা মহিলা তাঁর পুত্রকে দান হিসেবে কিছু পাবার জন্য রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কাছে পাঠান। যেহেতু মহিলা জানতেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) খুবই দানশীল ছিলেন এবং এ কারণে কখনো কখনো এমন হতো যে, তাঁর কাছে দান করার মতো কিছুই থাকতো না। সেহেতু মহিলা তাঁর পুত্রকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কাছে যদি দান করার মতো কিছু না থাকে তাহলে সে যেন তাঁর কাছে তাঁর গায়ের জামাটি চায়। ঘটনাক্রমে সেদিন তাঁর কাছে দান করার মতো কিছুই ছিল না। তাই ছেলেটি তাঁর কাছে তাঁর পরিধানের জামাটি চায়। তখন তিনি তাঁর কক্ষের দরজা বন্ধ করে তাঁর গায়ের জামাটি খুলে দরজার ফাঁক দিয়ে ছেলেটিকে দান করেন। এরপর আরেকটি জামার ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত তিনি তাঁর গৃহে আবদ্ধ থাকেন।
আরেক বার তিনি তাঁর চাচাতো ভাই, তাঁর ঘনিষ্ঠতম সাহাবী ও তাঁর ওয়াসী হযরত আলী (আ.)-কে তাঁর জন্য একটি জামা কিনে আনতে বাজারে পাঠালেন। হযরত আলী তাঁর জন্য বারো র্দেহাম মূল্যে একটি জামা কিনে আনলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ্ (সা.) অপেক্ষাকৃত কম দামি একটি জামা চাচ্ছিলেন। তাই তিনি হযরত আলীকে সাথে নিয়ে বাজারে গেলেন। তিনি ঐ জামাটি বিক্রেতাকে ফিরিয়ে দিয়ে চার র্দেহাম মূল্যের একটি জামা নিলেন এবং অবশিষ্ট আট র্দেহাম সহ তিনি ঘরে ফিরে আসার পথ ধরলেন। পথে একজন গরীব লোকের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হলো যার গায়ের জামাটি ছিল ছিন্ন ও মলিন। তখন তিনি তাকে চার র্দেহাম্ দিলেন এবং একটি জামা কিনে নিতে বললেন।
এরপর এক ধনী পরিবারের এক ক্রীতদাসী বালিকার সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হলো। মেয়েটির মনিব তাকে চার র্দেহাম্ দিয়ে মুদি দ্রব্যাদি কেনার জন্য পাঠিয়েছিল, কিন্তু সে তা হারিয়ে ফেলেছিল, তাই সে তার মনিবের ভয়ে কাঁদছিল। তখন নবী করীম (সা.) তাঁর অবশিষ্ট চার র্দেহাম্ ঐ মেয়েটিকে দান করলেন। কিন্তু এরপরও সে কাঁদতে লাগল। সে বলল যে, সে দীর্ঘ সময় ধরে সেখানে বসে কাঁদছিল এবং এখন দেরীতে ঘরে ফিরলে তার মনিব তাকে দেরী করার কারণে প্রহার করবে। তখন মেয়েটির মনিব যাতে তাকে প্রহার না করে সে জন্য নবী করীম (সা.) তার সাথে তার মনিবের গৃহে গেলেন।
তিনি মেয়েটির মনিবের গৃহের দরজায় পৌঁছে গৃহবাসীদের উদ্দেশে সালাম করলেন। জবাব আসতে দেরী হওয়ায় তিনি তিন বার সালাম করলেন। এরপর তারা জবাব দিল। নবী করীম (সা.) তাদের গৃহে আসায় তারা নিজেদেরকে ধন্য মনে করল এবং তাঁর সম্মানার্থে মেয়েটিকে ক্ষমা করে দিল। শুধু তা-ই নয়, তাঁর সম্মানার্থে তারা ক্রীতদাসীটিকে মুক্ত করে দিল। হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) তিন বার সালাম না করা পর্যন্ত তাদের জবাব না দেয়ার কারণ জানতে চাইলেন। জবাবে তারা বলল : ‘আমরা আপনার কণ্ঠের সুমিষ্ট সম্ভাষণ তিন বার শুনতে চাচ্ছিলাম।’
রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর নেতৃত্বের সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং বিশ্ববাসীর প্রতি সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ অনুগ্রহ ছিল হযরত আলী (আ.)-কে স্বীয় উত্তরাধিকার হিসেবে মনোনীতকরণ। কারণ, নিষ্পাপ ব্যক্তিত্ব হযরত আলী (আ.) ছিলেন রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর স্থলাভিষিক্ততার জন্য উপযুক্ততম ব্যক্তিত্বÑ যিনি রাসূলুল্লাহ্র নীতিমালা ও শিক্ষাকে সমুন্নত রাখেন, বিশেষ করে তাঁরই মতো সুবিচার ও সত্যকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বাস্তবায়ন করেন।
হযরত আলীকে যখন মুসলিম উম্মাহ্র নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব ও পরিচালনার সুযোগ দেয়া হয় তখন তিনি বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে জনগণের মধ্যে সামাজিক সুবিচার ও সমতা প্রতিষ্ঠা করেন এবং মুসলমানদের নেতৃত্বের জন্য পরিপূর্ণ জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করেন। বস্তুত হযরত আলী (আ.) মানব জাতির মধ্যে সুবিচারের কণ্ঠস্বরে পর্যবসিত হন এবং তিনি সত্য ও সুবিচার নিয়েই বেঁচে থাকেন এবং সত্য ও সুবিচার নিয়েই শাহাদাত বরণ করেন।
অনুবাদ নূর হোসেন মজিদী

সম্পাদকীয়

ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) বয়ে আনুক মুসলিম উম্মাহ্র ঐক্য ও সংহতি
রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জন্মবার্ষিকী ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জনগণসহ সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্কে, বিশেষ করে নিউজ লেটারের পাঠক-পাঠিকাগণকে জানাচ্ছি অভিনন্দন ও মোবারকবাদ।
হযরত মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহ্ তা‘আলার প্রেরিত সর্বশেষ নবী ও রাসূল। তাঁর মাধ্যমে মানব জাতির উদ্দেশে আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর পরিপূর্ণ বাণী পৌঁছে দিয়েছেন এবং এ বাণীকে যে কোনো বিকৃতি ও পরিবর্তন থেকে সংরক্ষিত রেখেছেন। কোরআন মজীদ সম্পর্কে সঠিক ধারণার অধিকারী যে কেউ জানেন যে, এ মহাগ্রন্থ হচ্ছে মানব জাতির মুুক্তির পথপ্রদর্শক। তাই এ মহাগ্রন্থ ক্বিয়ামত পর্যন্ত সমগ্র মানব জাতির জন্য আল্লাহ্ তা‘আলার শ্রেষ্ঠতম নে‘আমত। আর রাসূলুল্লাহ্ (সা.) স্বীয় চরিত্র, আচরণ, শিক্ষা, বিচার ও শাসন ইত্যাদি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কোরআন মজীদের শিক্ষা ও পথনির্দেশের বাস্তব প্রদর্শনী করেছেনÑ যা প্রমাণ করে দিয়েছে যে, কোরআন মজীদ কোনো বাস্তবে কার্যকর-অযোগ্য কাল্পনিক (ইউটোপিয়ান) আদর্শ উপস্থাপন করে নি, বরং মানুষের জন্য তা পুরোপুরি অনুসরণ ও বাস্তবায়নযোগ্য। এ কারণে আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁকে ‘রাহ্মাতুল্লিল ‘আলামীন’ (সমগ্র জগৎবাসীর জন্য অনুগ্রহস্বরূপ) হিসেবে অভিহিত করেছেন।
রাসূলে আকরাম (সা.)-এর জীবনাদর্শ ইসলাম সৃষ্টিকুলের স্রষ্টা আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে এসেছে বিধায় তা ভারসাম্যপূর্ণ ও সুবিচারের পতাকাবাহী। তাই এ দ্বীন গ্রহণের ব্যাপারে জবরদস্তির কোনো স্থান নেই। এর বিস্তারের পন্থা সুস্থ বিচারবুদ্ধির কাছে আবেদন এবং এর প্রতিষ্ঠার পথ শান্তিপূর্ণ। কিন্তু ইসলামের দুশমনরা এ দ্বীনের ওপরে সহিংসতা ও সন্ত্রাসের কলঙ্ক লেপনের অপচেষ্টা চালিয়ে আসছে, আর তা সম্ভব হচ্ছে এ দ্বীন ও রাসূলে আকরাম (সা.)-এর জীবন ও শিক্ষার সাথে সঠিক পরিচিতির অভাবে। তাই এ পরিচিতি অর্জন অপরিহার্য।
আল্লাহ্ তা‘আলা যেসব উদ্দেশ্যে দ্বীন ইসলামকে পাঠিয়েছেন সেসবের অন্যতম হচ্ছে মানবতার ঐক্য গড়ে তোলা এবং এ লক্ষ্যে ইসলামী উম্মাহ্র ঐক্যের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কোরআন মজীদে ন্যূনতম অভিন্ন ‘আক্বায়েদী সূত্র তাওহীদ ও আখেরাতের ভিত্তিতে নাজাতের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে এবং এর ভিত্তিতে আহ্লে কিতাবের প্রতি ঐক্যের আহ্বান জানানোর জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু ইসলামের দুশমনদের ও মুসলিম নামধারী মুনাফিক্বদের ষড়যন্ত্রের ফলে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ, অনৈক্য ও হানাহানি চলে আসছে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের পর এ বিপ্লবের মহান নায়ক হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)-কে ইসলামী ঐক্য গড়ে তোলার চালিকাশক্তিতে পরিণত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। যেহেতু রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জন্মতারিখ নিয়ে কিছুটা মতপার্থক্য আছে এবং বেশির ভাগ মুসলমানই ১২ বা ১৭ই রাবী‘উল্ আউয়াল্কে তাঁর জন্মবার্ষিকী হিসেবে গণ্য করে থাকে সেহেতু ইসলামী ঐক্য গড়ে তোলার প্রয়াসকে অধিকতর শক্তিশালী করার লক্ষ্যে তিনি উভয় তারিখকে সমন্বিত করে ১২ থেকে ১৭ই রাবী‘উল্ আউয়াল্কে ‘ইসলামী ঐক্য সপ্তাহ্’ হিসেবে ঘোষণা করেন এবং ইসলামী ঐক্য গড়ে তোলার লক্ষ্যে যথাযথ মর্যাদায় এ সপ্তাহ্ উদ্যাপনের জন্য সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্র প্রতি আহ্বান জানান। তখন থেকে সারা বিশ্বের মুসলমানগণ, বিশেষ করে ইরানী মুসলমানগণ প্রতি বছর যথাযথ মর্যাদায় এ সপ্তাহ্টি উদ্যাপন করে আসছে।
ইসলামের সুমহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে পাশ্চাত্য জগতের জনগণের মধ্যে যখন ইসলামী আদর্শের সাথে সঠিকভাবে পরিচিত হওয়ার প্রবণতা ও ইসলাম গ্রহণের হার বৃদ্ধি পেয়েছে তখন ইসলামের দুশমনদের ষড়যন্ত্রের বলি হয়ে সেখানকার অনেক তরুণ মুসলমান বিভিন্ন সন্ত্রাসী দলে যোগদান করায় এবং মাঝে মাঝে পাশ্চাত্য জগতে কিছু সন্ত্রাসী কর্মকা- সংঘটিত হওয়ায় ইতিমধ্যেই পাশ্চাত্যে মুসলমানদের প্রতি সন্দেহ ও চাপ সৃষ্টি বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সেখানে ইসলামের প্রচার-প্রসারের বিরুদ্ধে চাপও বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশেষ করে সম্প্রতি ফ্রান্সে এক সন্ত্রাসী ঘটনায় বহু বেসামরিক লোক নিহত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে পাশ্চাত্যে ইসলামবিদ্বেষ তীব্রতর আকার ধারণ করেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের বর্তমান রার্হ্বা হযরত আয়াতুল্লাহ্ ‘উয্মা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী পাশ্চাত্যের যুবসমাজের উদ্দেশে প্রকাশিত এক খোলা চিঠিতে তাদেরকে ইসলামের নামে সন্ত্রাসবাদী ও তাকফীরী গোষ্ঠীসমূহের উত্থানের পিছনে নিহিত ষড়যন্ত্রের ওপর থেকে আবরণ উন্মোচন করে দিয়েছেন এবং নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে ইসলামের সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য সকলের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন।
সব শেষে, পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) ও ইসলামী ঐক্য সপ্তাহ্ ইসলামী উম্মাহ্র ঐক্য ও সংহতির চালিকা শক্তিতে পরিণত হোকÑ আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে এ কামনা করছি।