All posts by pavel

চিরায়ত ধারার উৎসব নওরোজ

ড. তারিক সিরাজী

ইরানের সবচেয়ে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী উৎসব হলো নওরোজ। এ উৎসব বহুকাল ধরে চলে আসছে। ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক নানা পট পরিবর্তন ঘটলেও এ উৎসব উদ্যাপনে কোনোরূপ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় নি। নওরোজ ইরানের ঐতিহ্যবাহী নববর্ষের উৎসব। নওরোজকে শাব্দিকভাবে ‘নতুন দিন’ বলা হয়। নওরোজ শব্দটি ‘নও’ ও ‘রোজ’ এই দু’টি ফারসি শব্দ যোগে গঠিত। এটি ইরানি সৌরবর্ষের প্রথম মাসের প্রথম দিনকে গণ্য করা হয়। এই উৎসব ব্যাপক ও বিস্তৃতভাবে ইরানের সর্বত্র পালিত হয়। এটি মার্চ মাসের ২০ অথবা ২১ তারিখে উদ্যাপিত হয়ে থাকে। তবে নববর্ষের প্রথম দিনটি মার্চের ২০ না ২১ তারিখে হবে তা নির্ভর করে পৃথিবী সূর্যের চারিপাশে পরিপূর্ণভাবে ঘুরে আসার ওপর। এছাড়া জ্যোতির্বিদদের মত অনুযায়ী সূর্যের রাশিচক্রে প্রবেশের ওপর ভিত্তি করেই নববর্ষের প্রথম দিনটির সূচনা ঘটে- যাকে বর্ষবরণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। নওরোজের শুরুতেই নব বসন্ত আরম্ভ হয়। আর এই নব বসন্ত প্রকৃতিকে এমনি নতুন ও সুন্দররূপে সাজায় যাতে নববর্ষ তথা নওরোজকে ভালোভাবে উদ্যাপনের একটি আবহ সৃষ্টি হয়।

বিজ্ঞানী আবু রাইহান বিরুনির মতে প্রাচীন পারসিকদের প্রথাগত অনুষ্ঠানাদির অন্যতম উৎসব হলো নওরোজ- যা ইরানি সৌরবর্ষের প্রথম মাস ফারভারদিনের প্রথম দিন। এ কারণে একে নতুন দিন বা নওরোজ হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে যেহেতু এটি নতুন বছরের নতুন ভাগ্য হিসেবে পরিগণিত হয়।

নওরোজ শব্দটি আরবি ভাষায়ও ফারসির ন্যায় প্রচলিত রীতিতেই জের-জবর বসিয়ে তথা ‘নেইরোজ’ উচ্চারণে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

হাকিম ওমর খৈয়াম নওরোজনামে শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, নওরোজ নামকরণের অন্যতম কারণ হলো সূর্য ৩৬৫ দিবারাত্রি ঘুরে প্রথম মুহূর্তে পূর্ণতা লাভ করা এবং ইরানের প্রাচীন বাদশাহ জামশিদ কর্তৃক ঐ দিন ও মুহূর্তটিকে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করা। বাদশাহ জামশিদ এই উৎসবের সাথে কতগুলো বিধিবিধানও যুক্ত করেছিলেন এবং এই উৎসব উদ্যাপনে তাঁর পরবর্তী রাজাবাদশাহগণ ও অন্য ব্যক্তিত্ববর্গ তাঁর অনুকরণ করেছিল। পারসিক বাদশাহগণ সূর্যের পালাবদলের মুহূর্তটিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করার কারণে এটিকে উৎসবে পরিণত করা হলো এবং বিশ^বাসীকে জানিয়ে দেয়া হলো যাতে এই উৎসবকে তারা চিনতে ও বুঝতে পারে এবং এই সময়টিকে গুরুত্বসহকারে সংরক্ষণ করে। রাজ্যের এই ধরনের প্রচলিত প্রথা ও নিয়ম-কানুন বাস্তবায়ন করা তৎকালীন রাজাবাদশাহদের ওপর অত্যাবশ্যক ছিল; যাতে বছরের প্রথম সময়টা মহিমান্বিত, ঐতিহাসিক ও আনন্দময় হয়ে ওঠে। তাদের মতে যে-কেউ এই নওরোজের উৎসব পালন করবে এবং আনন্দে যুক্ত থাকবে সে পরবর্তী নওরোজ পর্যন্ত আনন্দময় জীবন কাটাবে।

অন্য একটি সূত্রে জানা যায় যে, নওরোজ উৎসবের প্রচলন মূলত হাখামানশিদের (অপযধবসবহরফং) যুগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এরা এ উৎসবটি জ্যোতিষ বিদ্যায় অগ্রগণ্য ও প্রসিদ্ধ ব্যাবিলনীয়দের অনুকরণে পারস্যকরণ করে- যা আধুনিক যুগে এসেও এর শাশ্বত ঐতিহ্য নিয়ে টিকে আছে।

অনেকের মতে এর ইতিহাস প্রাচীন হাখামানশীয় রাজাদের যুগের বা তারও আগের বলে অনুমিত হয়। ইসলামোত্তর যুগে পাহলাভি ভাষায় রচিত প্রাচীন গ্রন্থ বোন্দাহেশান্-এ (بُنْدَهِشَن) নওরোজ বিষয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। সাসানি আমলের শেষ দিকে প্রণীত এ গ্রন্থের শিরোনামের অর্থ হলো মূল বা শিকড় সৃষ্টি অথবা প্রথম সৃষ্টি। যেহেতু নওরোজ পরিভাষাটি বোন্দাহেশান্ গ্রন্থে উল্লেখ আছে এবং বিশ^জগতের বিভিন্ন বস্তুর সৃষ্টি সম্পর্কিত বিষয়বস্তু গ্রন্থটিতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, সে কারণে নওরোজ উৎসবেরও জগৎসৃষ্টির সাথে অর্থপূর্ণ সম্পর্ক থাকতে পারে। ইরানে নওরোজ উৎসব শুরু হয় বসন্ত ঋতু শুরু হবার সাথে সাথে। তাই নওরোজ হচ্ছে বিশেষ সংস্কৃতি ও রসম-রেওয়াজেরই অভিজ্ঞান। এর প্রত্যেকটি রীতিনীতিই ইরানি জাতির গভীর সাংস্কৃতিক চেতনার মাঝে প্রোথিত।

যে সময় নওরোজ উৎসবের সূচনা ঘটে তখন অধিকাংশ লোক ‘আলোকে খোদার প্রতীক আর অন্ধকারকে শয়তানের প্রতীক’ হিসেবে গণ্য করত। অতএব, পর্যায়ক্রমে নওরোজে শয়তানের ওপর খোদার বিজয় এবং পৃথিবীর পুনর্জন্মের সূচনা ঘটে। আরব খলিফাদের শাসনামলেও ইরানে নওরোজ উৎসব পালিত হত। কারণ, বলা হয় নবী-রাসূলদের সাথে সম্পর্কিত এমন কতিপয় ঘটনার উৎপত্তি লাভ করে যেগুলো মূলত বসন্তকালেই সংঘটিত হয়েছিল। যেমন হযরত ইবরাহীম (আ.)-কে খোদাদ্রোহী নমরুদ কর্তৃক অগ্নিকু-ে নিক্ষেপ ও এর থেকে মুক্তি লাভ, ফেরাউনের ওপর হযরত মূসা (আ.)-এর সমুদ্র পথে বিজয় এবং হযরত নূহ (আ.)-এর প্লাবন থেকে মুক্তির ঘটনা। যখন মহানবী (সা.) দশম হিজরির জিলহজ মাসের ১৮ তারিখে গাদীরে খুম নামক স্থানে হযরত আলী (আ.)-কে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে ঘোষণা করেন, সেদিনটিও ছিল এই নওরোজের দিন। এমনিভাবে নবম শতাব্দীতে ইরানি রাজ বংশগুলোর উত্থানকালে এটি একটি জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়।

যুগ যুগ ধরে ইরানি জনগণ উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে নওরোজের এ চেতনাকে অন্ধকারের বিরুদ্ধে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে। বিশেষত নওরোজ বা ফারভারদিনকে (সৌর সনের প্রথম মাস) ইরানিরা ন্যায় ও ইনসাফ, মানবাধিকার এবং ইরানি সভ্যতার প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। ইরানিরা অতিশয় উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে ইসলামকে গ্রহণ করেছিল। কারণ, ইসলামের মাঝেই সামাজিক ন্যায়বিচার, ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যমৈত্রীর আদর্শ বিদ্যমান রয়েছে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অনেক গবেষক, পারস্য ও আরবের বিপুল সংখ্যক প-িত ও মনীষী এ উৎসবকে ন্যায় বিচারের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছেন তাঁদের গবেষণায়।

এ ক্ষেত্রে নওরোজ সম্পর্কে মহানবী (সা.)-এর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। বর্ণনা মতে জানা যায় যে, একদল ইরানি, যাঁরা সবেমাত্র ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলমান হয়েছেন, একবার তাঁরা হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন। তাঁরা রাসূল (সা.)-এর সাথে ইরানিদের ঐতিহ্যবাহী নওরোজ উৎসব সম্পর্কে আলোচনা করলেন। তাঁরা বললেন, ‘আমরা বসন্তের প্রথম দিন তথা সৌরবর্ষের শুরুতে একটি উৎসব পালন করি, যার নাম হলো নওরোজ। এই উৎসবটি আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্যগত ধারা অনুযায়ী পালন করে আসছি। আমরা আপনার কাছে জানতে চাই, এই উৎসব সম্পর্কে আপনার কী অভিমত?’ হযরত মুহাম্মাদ (সা.) জিজ্ঞাস করলেন, ‘এই উৎসবে আপনার কী কী করেন?’ প্রতিউত্তরে তাঁরা বললেন, ‘এই উৎসব উপলক্ষে আমরা আমাদের বাড়ি-ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে থাকি- যাকে আমরা ‘খ’নে তেকুনি’ বলি এবং বর্ষবরণের সময় আদ্যাক্ষর সিন যুক্ত সাতটি বস্তুর সমন্বয়ে ‘সুফরেয়ে হাফ্ত সিন’ নামক সুন্দর একটি দস্তরখান (সুফরে) বিছাই। আমরা পরিবারের সকল সদস্য এ দস্তরখানের চারিদেকে বসি এবং এই প্রার্থনা করি যে, বছরটি যেন বেশ সুখকর ও স্বাচ্ছন্দময় হয়। হিংসা, দ্বেষ ও অসন্তুষ্টিগুলো হৃদয় থেকে বের করে দেই। নতুন পোশাক পরিধান করি এবং পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের সাথে দেখা করে কুশল বিনিময় করি। পরস্পরকে বিশেষ করে ছোটদেরকে এই উৎসবে উপহার দিয়ে থাকি। এই উৎসবের ১৩তম দিবসে পার্ক কিংবা মরুদ্যানে বেড়াতে যাই।’ এরপর হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বললেন, ‘কতইনা উত্তম উৎসব! যে উৎসব মনের প্রশান্তি ও আনন্দ যোগায় তা মূল্যবান বলে গণ্য করতে পার।

নওরোজ উৎসবের দিনগুলোতে ঐতিহ্যগতভাবেই অফিস, আদালত, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্যবসাকেন্দ্রসমূহ বন্ধ থাকে। জনগণ এ উৎসবটিকে একে অন্যের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ ও কুশল বিনিময়ের মাধ্যমে পালন করে থাকে। শুধু তাই নয়, তারা একে অপরকে সম্ভাষণ জানায়, উপহার বিনিময় করে কয়েক সপ্তাহব্যাপী। নওরোজের কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই লোকেরা নতুন নতুন পোশাক-পরিচ্ছদ ক্রয় করে, ঘর-বাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে। উৎসবের সেদিনগুলোতে তারা আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করে এবং টিভিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নববর্ষকে স্বাগত জানায় এবং আড়ম্বরের সাথে তা উদ্যাপন করে। এই নওরোজের সময়েই চূড়ান্তভাবে শীতের অবসান ও বসন্তের সূচনা ঘটে এবং মানুষের মাঝে উদ্দীপনা দেখা যায়।
এটি স্মর্তব্য যে, এই পারস্য সংস্কৃতি হিসেবে নওরোজ শুধু ইরানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং এই উৎসব মধ্য এশিয়া, ভারতীয় উপমহাদেশ, তুরস্ক, ইরাক, এমনকি দক্ষিণপূর্ব ইউরোপের সীমানা ছাড়িয়েও এর বিস্তৃতি ঘটেছে। এছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়ও এর বিস্তার লাভ করেছে। এই উৎসবের প্রেরণার মধ্যে আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং জাতীয় মূল্যবোধ যুগ যুগ ধরে প্রথিত রয়েছে।
বিশেষভাবে এর একটি স্থায়ী মূল্যবোধ ইরানের ইতিহাস-সাহিত্য, যেমন ফেরদৌসির মহাকাব্য শাহনামা, হাফিজের গজল, সাদীর কবিতা, রুমির মাসনাভি, বাবা তাহের হামেদানির কাসিদা, নিযামি গাঞ্জাভি, খৈয়াম এবং বিশেষ করে ইরানি গযল ও সংগীতে এর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। নওরোজের এই উৎসব বাণীতে ইরানি সমাজের সংহতি, সামাজিক ন্যায় বিচার, আনন্দ, উৎসব, বন্ধুত্ব, সুখ, সমৃদ্ধি, স্বাধীনতা এবং মানবতার জয়গান প্রত্যক্ষ করা যায়।

উদাহরণ হিসেবে ইরানের বিখ্যাত কয়েকজন কবির কয়েকটি শ্লোক তুলে ধরা হলো। ফেরদৌসি তাঁর শাহনামা কাব্যে নওরোজ ও নব বসন্তের বর্ণনায় উল্লেখ করেছেন :
از ابـــر بــهــاران بــبـاريـد نـم ز روي زمـين رنگ بـزدود غم
جهان گشت پر سبزه و رود آب سر غمكنان اندر آمد به خواب
زميـن چـون بهشـتي شد آراسته ز داد و ز بخشش پر از خواسته
বসন্তের মেঘমালা হতে নেমে আসে বৃষ্টির ফোঁটা,
মাটির বুক থেকে ধুয়ে নেয় দুঃখ ও দুশ্চিন্তা।
পৃথিবী ভরে যায় সবুজের সমারোহে আর নদী পানিতে,
দুঃখীর জীবনে থাকে না উদ্বেগ আর মনস্তাপ।
জমিন সজ্জিত হয় যেন এক বেহশত রূপে
ইনসাফ ও দানের মহিমায় পরিপূর্ণ হয় প্রত্যাশা।
নওরোজ তথা বসন্ত যেন স্রষ্টা প্রদত্ত প্রকৃতির পরিবর্তনের অন্যতম নিদর্শন। শেখ সা’দী খোদা প্রদত্ত প্রকৃতির পরিবর্তনের কথা তুলে ধরে বলেন :
برگ درختان سبز در نظر هوشيار هر ورقش دفتري است معرفت کردگار
বিচক্ষণদের দৃষ্টিতে সবুজ বৃক্ষের পত্র-পল্লবগুলো
যেন এর প্রতিটিই ¯্রষ্টার পরিচিতি লাভের নিদর্শন।

এই নওরোজে আধ্যাত্মিক কবি রুমি ঋতুচক্রের পরিবর্তনের জরাজীর্ণ অবস্থা থেকে নতুন করে জেগে ওঠার আহ্বান জানিয়ে বলেন:
باز آمدم چون عيد نو تا قفل زندان بشکنم وين چرخ مردم خوار را چنگال و دندان بشکنم
যেহেতু নতুন উৎসবের দিন, তাই কারাগারের তালা ভাঙতে পুনরায় ফিরে এসেছি
আর এসেছি এই মানুষখেকো কালচক্রের দাঁত ও থাবা চূর্ণ করতে।
হাফিজ তাঁর কবিতায় উল্লেখ করেন :
سخن در پرده می‌گویم چو گل از غنچه بیرون آی
که بیش از پنج روزی نیست حکم میر نوروزی
পর্দার আড়াল থেকে বলছি, ফুলের মতো কলি থেকে বেরিয়ে এস
কারণ, মিরে নওরোজির আদেশ পাঁচ দিনের বেশি থাকে না ।

কবি নাসের খসরু কোবাদিয়ানি তাঁর কবিতায় নওরোজ সম্পর্কে বলেন :
چون به نقطه¬ي اعتدالي راست گردد روز و شب
روزگار اين عالم فرتوت را برنا کند
نرگس و گل را که نابينا شوند از جور دي
عدل پروردين نگر تا چون همي بينا کند
সত্যিই যখন দিন ও রাত একটি ভারসাম্যের ভিত্তিতে আবর্তিত হয়,
তখন জীর্ণ এই পৃথিবীর জীবনটা যৌবন লাভ করে।
দেই মাসের নিষ্পেষণে যখন নার্গিস ও ফুল নিষ্প্রভ হয়
তখন দেখ, ফারভারদিনের ন্যায়-নিষ্ঠা তা দৃষ্টিমান করে তোলে।
এমনিভাবে অনেক কবিই নওরোজ ও নববসন্ত নিয়ে তাঁদের কবিতা সাজিয়েছেন বিভিন্ন আঙ্গিকে- যা নওরোজের প্রতি তাঁদের ভালোবাসা ও গ্রহণযোগ্যতারই প্রমাণ বহন করে।
নওরোজের আনুষ্ঠানিকতার একটি হচ্ছে সাবজে। যা কোনো একটি গামলা বা পাত্রের মধ্যে গমের চারা উৎপন্ন করে নওরোজের দিন উপস্থাপন করা হয়। ইরানিরা যেহেতু ইসলাম ধর্মের ব্যাপারে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত তাই তাঁরা ঐ দিন এই ধরনের অনুষ্ঠানে ইসলাম ধর্মের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং নওরোজের দস্তরখানে একখানা পবিত্র কুরআন উপস্থাপন করেন।
মূলত নওরোজ হচ্ছে তাদের নতুন করে জীবন লাভের প্রতীকী উৎসব। এ দিন তারা নব জাগরণ ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মাধ্যমে নতুন জীবন লাভ করে। ইরানের সর্বত্রই নওরোজের এই উৎসব একটা ঐতিহ্যম-িত উৎসব হিসেবে পালিত হয়Ñ যাকে বসন্তকালের সাংস্কৃতিক উৎসব হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। ইরানি পরিবারগুলো এ উপলক্ষে তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ, ঘর-বাড়ি, তৈজষপত্র, আসবাবপত্র এবং অন্যান্য গৃহ সামগ্রী নতুন করে সুসজ্জিত করে।
প্রতিটি পরিবার এ উপলক্ষে কমপক্ষে এক সেট করে নতুন পোশাক ক্রয় করে। তারা নববর্ষের প্রথম দিনে তথা ফারভারদিন মাসের ১ তারিখে (২০ অথবা ২১ মার্চ) বয়োজ্যেষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের সাথে নতুন পোশাক পড়ে দেখা-সাক্ষাৎ করে।
নওরোজ উপলক্ষে ইরানি পরিবারগুলো বিভিন্ন ভোজ অনুষ্ঠানে একত্র হয় যেখানে হাফ্ত সিন তথা আদ্যাক্ষরে ফারসি সিন বর্ণ সম্বলিত সাতটি বস্তুর সমাহারে সে দিন দস্তরখান সুসজ্জিত করা হয়। সাতটি বস্তু হচ্ছে সাবজে যা ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে। সামানু (এক ধরনের মিষ্টান্ন), সিব (আপেল), সেরকে (ভিনেগার), সেনজেদ (এক ধরনের শুষ্ক ফল), সির (রসুন), সেক্কে (মুদ্রা) ও সোমমাক (ক্ষুদ্রাকৃতির লাল রঙের ফলবিশেষ) আদ্যাক্ষর ফারসি সিন বর্ণ দ্বারা সূচিত এই সাতটি বস্তু ছাড়াও তারা আরো কিছু জিনিস সাজিয়ে রাখে; তার মধ্যে হলো অ্যাকুরিয়ামে রাখা গোল্ড ফিশ, চিত্রিত ডিম, স্বর্ণমুদ্রা, আয়না ও মোমবাতি।

এর প্রতিটি উপকরণই বিশেষ কতগুলো জিনিসের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, সাবজে হলো নব জীবনের প্রতীক, সামানু হলো অফুরন্ত নেয়ামতের নিদর্শন, সিব তথা আপেল হলো সৌন্দর্য ও সুস্থতার প্রতীক, সেরকে দীর্ঘ জীবন ও সহিষ্ণুতার প্রতীক, সির বা রসুন হলো ঔষধ, রোগ নিরাময় ও সুস্বাস্থ্যের প্রতীক, সোম্মাক হলো প্রভাতের লাল সূর্যের প্রতীক, সেক্কে বা মুদ্রা হলো সম্পদ, সমৃদ্ধি ও সৌভাগ্যের প্রতীক, সেনজেদ হলো প্রেম-ভালোবাসার প্রতীক, সোম্বল হলো বসন্তের নবাগমনের প্রতীক, মোমবাতি হলো আলো ও কল্যাণের প্রতীক আর সোনালি মাছ হলো জীবন ও যৌবনের প্রতীক। আর প্রথাগতভাবে নববর্ষের দিনগুলো হলো আপ্যায়ন এবং উৎসবের দিন।

এদিন পরিবারের সকল সদস্য নতুন পোশাকে সজ্জিত হয়ে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে যোগদান করে। তারা সকলে একত্রে বসে টিভি, রেডিও প্রভৃতি গণমাধ্যমে বর্ষবরণের ঘোষণা শোনার অপেক্ষায় থাকে। ঘোষণা হওয়া মাত্রই তারা সকলে সমস্বরে নিচের দোয়াটি পাঠ করে :
يا مُقلب القلوب و الابصار يا مدبر اليل و النهار
يا مُحوِّلَ الحولِ والاحوال حوِّل حالنا الي احسنِ الحال
ইয়া মুকাল্লেবাল কুলুবি ওয়াল আবছার ইয়া মুদাব্বেরাল লাইলি ওয়ান নাহার
ইয়া মুহাভ্ভেলাল হাওলে ওয়াল আহওয়াল হাভ্ভেল হালানা ইলা আহসানিল হাল
(হে অন্তর ও দৃষ্টিসমূহের বিবর্তনকারী
হে রাত ও দিনের বিবর্তনকারী
হে অবস্থা ও অবস্থাসমূহের বিবর্তনকারী
আমাদের অবস্থাকে তুমি উত্তম অবস্থায় পরিবর্তন কর।)

এ উৎসবে ইরানিরা পরস্পর শুভেচ্ছা বিনিময় করে এবং শিশুদের হাতে উপহার তুলে দেয়। নওরোযের ত্রয়োদশ দিবস হচ্ছে আরেকটি সরকারি ছুটির দিন যাকে ইরানি পরিভাষায় বলা হয় সিযদা বেদার। সে দিন তারা দলবদ্ধ হয়ে ঘরের বাইরে কোনো এক ময়দানে বা পার্কে বেড়াতে যায় এবং নৈস্বর্গিক শোভা উপভোগ করে। এছাড়া তারা বিভিন্ন ভোজ অনুষ্ঠানে পরস্পরে মিলিত হয়। এই নববর্ষের প্রথম দিনে তাদের মধ্যে যে প্রেরণা সঞ্চারিত হয় তা সত্যিই প্রত্যক্ষ করার মতো।

নওরোজ এখন ইরান ভূখণ্ডের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে। ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইরান ছাড়াও বেশ কয়েকটি দেশে এ নওরোজ জাঁকজমকপূর্ণভাবে উদ্যাপিত হয়ে থাকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শান্তি ও সংহতি, পরিবারিক সৌহার্দ, সামাজিক ন্যায় বিচার, আনন্দ-উৎসব, সুখ-সমৃদ্ধি, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, মানবতার জয়গান ও পরস্পরের মাঝে বন্ধুত্বের যে ধারা নওরোজের মাধ্যমে সুদৃঢ় হয়ে থাকে সে বিষয়টি বিবেচনা করে ২০০৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ইউনেস্কো কর্তৃক ইরানি নববর্ষের প্রথম দিন (১ ফারভারদিন) তথা নওরোজকে আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে অনুমোদন দেয়া হয় এবং নওরোজ উৎসবকে ইউনেস্কোর Intangible Cultural Heritage of Humanity-এর তালিকাভুক্ত করা হয়। এরপর থেকে প্রতি বছর ২০ অথবা ২১ মাচ আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই প্রাচীন উৎসবটি উদ্যাপিত হচ্ছে। ইউনেস্কো কর্তৃক এই ঘোষণা ইরানের জন্য গৌরব বয়ে আনে।

তথ্যসূত্র:
আহমেদ তামিমদারী (১৩৯০ সৌরবর্ষ): ফারহাঙ্গে অ’ম্মে, মাহকামে পাবলিকেশন্স, ইরান।
তারিক জিয়াউর রহমান সিরাজী (২০১৪ খ্রি.): ফারসি সাহিত্যেরই ইতিবৃত্ত, বাড পাবলিকেশন্স, ঢাকা।
মাহমুদ বাশিরী, নওরোজ উৎসবের সাংস্কৃতিক তাৎপর্য ও ইরানী সমাজ, নিউজ লেটার (ঢাকাস্থ ইরান দূতাবাসের কালচারাল কাউন্সেলরের দফতরের মুখপত্র), মার্চ-এপ্রিল, ২০০৪ সংখ্যা।
সিরাজুল হক, ইরানী নওরোজ ও বাংলা নববর্ষ শাশ^ত ঐতিহ্যের ধারা, নিউজ লেটার (ঢাকাস্থ ইরান দূতাবাসের কালচারাল কাউন্সেলরের দফতরের মুখপত্র), মার্চ-এপ্রিল, ২০১৫ সংখ্যা।
সাজেমানে ফারহাঙ্গ ওয়া এরতেবাতাতে ইসলামি, ইরান কর্তৃক প্রকাশিত ১৩৮৬ সৌবর্ষের বর্ষপঞ্জি (সালনুমা)
ঢাকাস্থ ইরান দূতাবাসের কালচারাল কাউন্সেলরের দফতর থেকে প্রকাশিত শিশু-কিশোরদের ম্যাগাজিন কিশোর নিউজলেটার, মার্চ-এপ্রিল, ২০১১ সংখ্যা।

ইরানে পর্যটকদের জন্য ৩৪টি অসাধারণ স্থাপত্য নিদর্শন

রাশিদ রিয়াজ

যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী মিডিয়া সিএনএন’ এর সিনিয়র প্রডিউসার ব্যারি নিল্ড ইরানের পর্যটন সম্পর্কে তাঁর প্রতিবেদনের শিরোনাম করেছেন, ‘থার্টি ফোর ইনক্রেডিবল বিউটিফুল রিজন্স টু ভিজিট ইরান’। বলার অপেক্ষা রাখে না, সাত সভ্যতা ও সংস্কৃতির মিশ্রণ যে দেশে কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে সে দেশের ৩৪টি দর্শনীয় স্থানের ছবি তিনি সিএনএন অনলাইনে দিয়েছেন।
ব্যারি নিল্ড তাঁর প্রতিবেদনে বলছেন, দৃষ্টি আকর্ষণীয় বিষয় হলো এসময়ে ইরান নিয়ে সবাই কথা বলছেন। যে যা-ই বলুক, ইরান সবসময় ভ্রমণপিয়াসুদের জন্য অনন্য এক আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে কেন বিবেচিত হয় তা এ প্রতিবেদনে বর্ণিত স্থানগুলো সম্পর্কে আপনার জানা হলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে। ইরানের অসাধারণ এসব স্থানের ছবি ক্যামেরায় বন্দি করেছেন দেশটির প্রখ্যাত চিত্রগ্রাহক মোহাম্মদ রেজা ডোমিরি গাঞ্জি। তিনি ইরানের বিখ্যাত মসজিদগুলোর ছবি তুলে ইতিমধ্যে ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছেন। ইরানের এসব দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে আরো জানতে ও ছবি দেখতে গাঞ্জিকে অনুরোধ করেন ব্যারি নিল্ড। সাড়া দেন গাঞ্জি।
গত ১১ ফেব্রুয়ারি ইরানের ইসলামি বিপ্লবের ৩৮তম বার্ষিকী পালিত হলো। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লব হওয়ার পর থেকে পশ্চিমা বিশ্ব দেশটির ওপর অবরোধ জারি করে রাখে। ইরান সম্পর্কে আলোড়ন মিশানো আবেগ আমাদের মনে থাকার পাশাপাশি একটি বিষয় সুনিশ্চিত আর তা হচ্ছে দেশটির ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি আর সৌন্দর্য যা উদযাটিত হয়ে আসছে।

ইসফাহানের আলী কাপু
ইরানের পশ্চিমাঞ্চল ইসফাহানে নাকশ-ই-জাহান স্কয়ার, যেখানে ৬ তলা প্রাসাদ রয়েছে আর এর নামের অর্থ বলা যায় সিংহদুয়ার। ষোল থেকে সপ্তদশ শতকে শাহ আব্বাসের আমলে এ প্রাসাদ নির্মিত হয়। প্রাসাদে লাল রংয়ের মিউজিক হল রয়েছে যা নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে বিকশিত। প্রাসাদের প্রাচীর সজ্জা দেখার মতো। দারুণ এক প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করে এ প্রাসাদের আবহ।
অনন্য ও গৌরবময় ও বিশেষ ধরনের স্থাপত্যরীতি দেখে গাঞ্জি বিস্ময় বোধ করেন এবং তা ক্যামেরায় ধারণ করতে তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। গাঞ্জি বলেন, প্রাসাদের মিউজিক হলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে মাথার ওপর ক্যামেরা তাক করে আমি ছবি তুলতে থাকি এবং ওয়াইড-অ্যাঙ্গেল লেন্স ব্যবহার করি।

সিরাযের আর্গ-ই কারিম খান
আঠারো শতকে নির্মিত কারিম খানের দুর্গ ঐতিহ্যবাহী শহর সিরাযের কেন্দ্রে অবস্থিত। দুর্গের ভেতরে আবাসিক ভবন অবস্থিত, রয়েছে হাম্মামখানা বা গোসলখানা। দুর্গের চত্বর লেবু গাছে ভরা। বাতাসে পাকা রঙিন লেবুগুলো যখন গাছে দোল খায় তখন তা ভ্রমণকারীদের মনে শিহরণ জাগায়। পারস্যরীতিতে নির্মিত ছিদ্রময় দেয়াল দুর্গের চারপাশে বেষ্টনী তৈরি করে রেখেছে। ওই ছিদ্র দিয়ে শত্রুর আগমন বা কারো অবস্থান সহজেই চিহ্নিত করা যায়। দেয়ালে সুন্দর চিত্রকলা শোভা পাচ্ছে। ক্ষুদ্র চিত্র রয়েছে তাতে।
গাঞ্জি বলেন, অনন্য স্থাপত্য, আলো ও ঐতিহ্যের নিদর্শন হাম্মামখানার মধ্যে প্রবেশ করলেই যে কারো নজর কাড়বে।

তেহরানের বোর্য-ই আযাদি
১৯৭১ সালে নির্মিত এ আযাদি টাওয়ারটি ইরানের রাজধানী তেহরান শহরের একটি প্রতীক হয়ে ওঠে। ২০০৯ সালে তেহরান শহরে মিলাদ টাওয়ার নির্মিত হয়। ৩৬০ মিলিয়ন ডলার খরচে এ টাওয়ারটি নির্মিত হলেও আযাদি টাওয়ারটি তেহরানের বাসিন্দা ও পর্যটকদের আলাদা এক আকর্ষণে টানে। আজাদি টাওয়ারটি নির্মাণ করেন প্রখ্যাত স্থপতি হোসেন আমানত। পারস্য সা¤্রাজ্যের আড়াই হাজার বছরের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আজাদি টাওয়ার নির্মিত হয়।
গাঞ্জি বলেন, আযাদি টাওয়ারের অনন্য স্থাপত্যরীতির জন্য এ নির্মাণ শিল্পকে খুব পছন্দ করি। এছাড়া কোনো বিষয়কে প্রতীকি হিসেবে উপস্থাপন করতে চাই আমি। ছবি তোলার এক মাহাত্ম্যকে আমি ধারণ করতে আযাদি টাওয়ার হয়ে ওঠে আমার কাছে এক নিদর্শন। এধরনের নজির সৃষ্টিতে আমি ক্যামেরার ফিশআই বা বিশেষ ধরনের লেন্স ব্যবহার করি। আযাদি টাওয়ারের মাথায় মেঘমালা আমাকে এধরনের অনন্য ছবি তুলতে সাহায্য করে।

মাযানদারানের বাদাব-ই সুরাত
ইরানের মাযানদারান প্রদেশে প্রাকৃতিক নিসর্গের লীলাভূমি হিসেবে পরিচিত বাদাব-ই সুরাত দীর্ঘকাল থেকে পর্যটকদের নজর কাড়ছে। হাজার হাজার বছর ধরে প্রাকৃতিক এ সৌন্দর্য বিশ্বের পর্যটকদের কাছে টেনেছে। ইরানের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত এ উষ্ণ প্রস্রবণ লবণাক্ত ও সালফারসমৃদ্ধ। পানিতে আকাশের প্রতিচ্ছবি ও চারপাশের নিসর্গময় প্রান্তর এর সৌন্দর্যকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে বলে জানান গাঞ্জি।

কাশানের বোরোজার্দি হাউস
১৯ শতকে কার্পেট ব্যবসায়ীদের বাড়িগুলো কাশানে এখন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে। বাড়িগুলোর নান্দনিক সৌকর্য রয়েছে। কারণ, ১৯ শতকের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী কামাল-ওল-মোলকের অলঙ্কার শোভিত কারুকাজ শোভা পাচ্ছে এ নির্মাণ শিল্পে। ইরানের কার্পেট শিল্প খুবই প্রাচীন এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক শিল্প। এখনো তেলের পরই কার্পেট দ্বিতীয় রফতানি আয়ের স্থান দখল করে রেখেছে। বাড়িগুলোর মেঝের ডিজাইন বিশ্বে সুপরিচিত হয়ে আছে। সিরাযের একটি কার্পেট মেরামত কেন্দ্রের ছবি তোলেন গাঞ্জি। তিনি বলেন, জীবনযাত্রার যে এক মাধুর্য রয়েছে তা এই কার্পেট মেরামত কেন্দ্রের কর্মীরা জানান দিচ্ছে। একটি কার্পেট মেরামতের মধ্য দিয়েও কর্মীরা তার নান্দনিক মান ফুটিয়ে তোলেন।

ইয়াযদের বাগ-ই দৌলত আবাদ
১৮ শতকের দৌলত আবাদ বাগান আধুনিক ইরানের নকশা ধারণ করে আছে। বাগানটি দুই ভাগে বিভক্ত। বাগানের বহির্ভাগ নানা ধরনের ফুলে শোভিত হয়ে আছে। যা বাগানে ঢুকতেই চোখে পড়ে। বাগানের ভেতরে প্রবেশ করতে পারলে আপনি টের পাবেন ইরানি পারিবারিক গোপনীয়তার এক স্থাপত্যময় ধারণা। মরু এলাকায় এসব বাগ-বাগিচা ও তার আশে পাশের ভবনগুলোতে সহজেই বাতাস প্রবেশ করতে পারে। রয়েছে ছাদের ওপর টাওয়ার। একই সঙ্গে এমন এক ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা যাতে প্রাকৃতিকভাবেই বাতাস এর মাধ্যমে প্রবেশ করে ভবনের ভেতরে তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখে। ভবনে রঙিন কাঁচের ব্যবহার ও তাতে আলোর খেলা নানা ধরনের বর্ণময় এক আবেগ সৃষ্টি করে। এক ভিন্ন সৌন্দর্যের আবহ সৃষ্টি করে। গাঞ্জি বলেন, প্রাসাদে বাতাসের খেলা আমার মনোযোগ কেড়ে নেয়। বাতাস এসে প্রাসাদের মাঝখানে একটি ছোট জলাশয়ে আবর্তিত হয় এবং বাষ্পীভূত হয়ে তা ফের বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে এবং গরম হাওয়া ঠা-া করে। পরিবেশ ঠা-া রাখার এমন প্রাকৃতিক পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করেই আধুনিক যুগের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে।

তেহরানের ইমারত-ই বাদগির
তেহরানে ১৯ শতকে নির্মিত গোলেস্তান প্যালেসে এই ইমারতটি নির্মিত হয়। কাজার রাজবংশের মোজাফফর-আদ-দীন শাহর রাজ্যাভিষেক উপলক্ষে এ ইমারত গড়ে তোলা হয়। গাঞ্জি বলেন, ইমারতের অলঙ্করণ, বিশেষ করে রঙিন কাচের ব্যবহার, আয়না ও সুউচ্চ স্তম্ভ ইমারতটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হয়ে আছে।

সিরাযের এরাম গার্ডেন
ইরানের ঐতিহাসিক বাগানের একটি। ১৩ শতকের মাঝামাঝি এ বাগান ও ভবন নির্মাণ হওয়ার ৬শ’ বছর পর সংস্কার করা হয়। বিশাল এক বোটানিক্যাল গার্ডেনই শুধু নয়, নানা ধরনের দুষ্প্রাপ্য গাছগাছালি এরাম গার্ডেনের গুরুত্ব বৃদ্ধি করেছে। গাঞ্জি বলেন, বাগানে হাঁটার সময় চারপাশের সবুজ গাছপালা ও নানা রংয়ের ফুল শোভা বর্ধন করে আমাকে সুস্থ শক্তি যোগায়। এসব গাছগাছালি শুধু গাছ নয়, এর রয়েছে ওষধি ও ভেষজ মূল্য। বাগানের সঙ্গে নান্দনিক স্থাপত্য সৌন্দর্য বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। বাগানের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা লেক প্রাকৃতিকভাবেই পানির যোগান দিয়ে চলেছে। লেকের বুকে বিশাল ভবনের প্রতিফলিত ছবি মুগ্ধ করে। সূর্য অস্ত যাবার সময় আকাশের গোধূলি ও রংয়ের পরিবর্তন ছবি তোলায় নানা বৈচিত্র্যময় পরিবেশ হয়ে ধরা দেয়।

সিরাযের ফোরঘ-আল-মুলক হাউজ
কাজার শাসনামলে নির্মিত এ তিনতলা ভবনটি বর্তমানে যাদুঘর। বিখ্যাত কবি হাফেয সিরাযীর মাযার এখানে। অনেকে আসেন কবির মাযার যিয়ারত করে যান। নিজের লেখা কবিতা গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখে যান। কেউ বসে চা খান। বিভিন্ন হাতের লেখা প্রচুর কবিতা পড়তে পেরে আপনি বিস্ময় বোধ করবেন।

ইয়াযদের জামে মসজিদ
১৫ থেকে ১৬ শতাব্দীতে নির্মিত এ মসজিদ তিমুরিদ শাসনামলের তা বোঝা যায় শিলালিপি ও স্থাপত্য রীতি দেখে। তবে মূল ভবনটি এক শতাব্দীর পুরোনো। গাঞ্জি বলেন, যখন তিনি মসজিদটিতে প্রবেশ করেন, তখন বিস্ময় বোধ করেন, ছাদে অপরূপ স্থাপত্যশৈলী দেখে। সহজেই পর্যটকদের নজর কাড়ে। মসজিদের গম্বুজ আরব স্থাপত্য রীতি মেনে নির্মিত এবং এর চত্বরও জ্যামিতিক আকারে বেশ প্রশস্ত। গম্বুজের গায়ে কোরআনের আয়াত লিপিবদ্ধ রয়েছে যা ঐতিহ্য আর সৌন্দর্যের মিশেল বহন করছে।

কোরদাস্ত বাথ, জুলফা
ইরানের উত্তরপশ্চিমাঞ্চল শহর জুলফায় এ গোসলখানা শাসক ও রাজকীয় কর্মকর্তা কর্মচারীরা এক সময় ব্যবহার করতেন। পরে সাধারণ মানুষের মধ্যে এর ব্যবহার দেখা যায়। ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ, চাঁদনি ও বাসন্তি মন্দির ও গ্রিনহাউজ রয়েছে এখানে। ১৬ থেকে ১৮ শতকে সাফাভি আমলের নিদর্শন হয়ে আছে এ গোসলখানা।

কাশানের কাছে মারানযাব লেক
তেহরানের দক্ষিণে মারানযাব মরুভূমিতে এ লবণাক্ত লেকটি অবস্থিত। এটি আসলে শুকিয়ে যাওয়া এক হ্রদ। প্রবল বর্ষণ ও বরফপাতের পর অনেকে এখান থেকে পানি সংগ্রহ করেন। লেকের বুকে রাতের বেলা হেঁটে হেঁটে ছবি তোলার দারুণ এক অনুভূতির কথা বলেন গাঞ্জি।
মারানযাবের বালুর সৈকতে হেঁটে বেড়ানোর এক মধুর স্মৃতি অনেকের আছে। আবার বরফপাতের সময় আরেক দৃশ্যের অবতারণা হয়। ইরানের এক প্রান্তে শীতে বরফপাত আবার অন্যপ্রান্তে ধুসর মরুভূমিময় দিগন্তের হাতছানি আপনাকে এক অদ্ভুত মায়ার বাঁধনে জড়াবে। বরফে জড়ানো পথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মটরড্রাইভ, তার পর মরভূমির পথে হারিয়ে যেতে কার না ভালো লাগে! সেখানে সূর্যোদয়ের ছবি তুলতে সবাই যেন উন্মুখ হয়ে থাকেন।

সিরাযের নাসির আল-মুলক মসজিদ
কাজার আমলের আরেক সেরা স্থাপত্য নিদর্শন নাসির আল-মুল্ক মসজিদ। এই মসজিদের পূর্ব ও পশ্চিমে শয়নগৃহ রয়েছে। রয়েছে টালির সুদৃশ্য মেঝে, ১২টি স্তম্ভ আর রঙিন জানালা। রঙিন কাচের জানালা দিয়ে সূর্যকিরণ যখন মসজিদের মেঝেতে প্রবেশ করে তখন সারা মসজিদের চত্বর জুড়ে আলোর এক দুর্দান্ত খেলা খেলতে থাকে। রঙিন কাচের খেলা অনেক ভবন জুড়েই দেখা যায় তবে এ মসজিদের দৃশ্যই আলাদা। আসলে এ মসজিদটি পরিপূর্ণ আলোর নাচনে ও খেলায় ভরপুর। তারপর ইরানি রঙিন কার্পেট আর ছাদের কারুকাজময় সৌকর্য, টাইলসের প্যাটার্ন ও রঙ আপনাকে বিমোহিত করবেই।
গাঞ্জি বলেন, আমি এ মসজিদের স্থাপত্যরীতি দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই। শীতের সকালে আলোর অপেক্ষায় এ মসজিদে বসে থেকেছি। আস্তে আস্তে আলো এসেছে, তার পর রঙিন কাচ ভেদ করে মসজিদের মেঝেতে ছড়িয়ে পড়েছে। আলোর নাচন শুরু হয়ে যায় তখন।

তেহরানের নিয়াভারান প্রাসাদ
ইরানে ইসলামি বিপ্লবের আগে এ নিয়াভারান প্রাসাদে রেযা শাহ পাহলভির পরিবার বাস করতেন। এ প্রাসাদে বিদেশি অতিথিরা রেযা শাহ পাহলভির সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। প্রাসাদটি আসলে নির্মিত হয়েছিল কাজার শাসনামলে। মূলভবনটি নির্মাণ হয় ইরানের শেষ শাহ রেযা শাহের আমলেই।

সিরাযের দক্ষিণে আরদাসির প্রাসাদ
তৃতীয় শতাব্দীতে পারস্যের শাসক আরদাসির যিনি সাসানি সা¤্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করছিলেন, তিনি এই প্রাসাদ তাঁর নিজের জন্য তৈরি করিয়েছিলেন। প্রাসাদের বাইরে একটি হ্রদ থেকে পানি সরবরাহ করা হতো। তবে ওই হ্রদটি শুকিয়ে যাওয়ার পর প্রাসাদটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে।

উত্তরপূর্ব সিরাযের পাসারগাদ
পাসারগাজাই হচ্ছে হাখামানেশী সাম্রাজ্যের আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব পাঁচশ পঞ্চাশ সালে নির্মিত এক কমপ্লেক্স ভবন। সিরায শহর থেকে ১৩০ কিলোমিটার উত্তরপূর্বে এটি অবস্থিত। সাইরাস আমলের বিখ্যাত ভবন সলোমনের সময় কারাগার ও পরবর্তীকালে দুর্গ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। পারস্যের অনেক শাসকের কাছেও এ ভবনের গুরুত্ব অপরিসীম ছিল। রাতে এ প্রাসাদে অবস্থান করে তারাভর্তি আকাশ দেখতে পেয়ে অন্য এক আনন্দ ভুবনে চলে যাবেন। আকাশ পরিষ্কার থাকলে গ্রীষ্মকালে এ প্রাসাদ থেকে আপনি সৌর জগতের এক ধারণা উপলব্ধি করতে পারবেন। মিল্কি ওয়ে বা আকাশপথ দেখতে পাবেন।
এই পাসারগাদে সাইরাসের রাজকীয় প্রাসাদ আরেক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। পারস্য সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ বাগবাগিচায় ভরা প্রাসাদের চারপাশ আপনাকে ভিন্ন জগতে নিয়ে যাবে। দর্শকদের জন্য প্রাসাদে এক বিশাল হলরুম রয়েছে। রয়েছে বিস্তীর্ণ এলাকা। গাঞ্জি বলেন, ছবি তোলার এক পর্যায়ে আমি মুগ্ধ হয়ে ঘাসের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে ছিলাম আকাশের দিকে তাকিয়ে। ভাবছিলাম, হাজার বছর আগে এখানেই সাইরাস সম্রাট তাঁর পারিষদ নিয়ে বসতেন, পুরো পারস্য সাম্রাজ্য পরিচালনা করতেন। সমাধি সৌধ থেকে আনত ঢালু ছাদ পাথরের সাতটি স্তরে নির্মিত। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৬ অব্দে আলেক্সান্ডার গ্রেট যখন পারস্য দখল করেন তখন তিনি পাসারগাদ ধ্বংস করেন। রাজকোষ লুট করেন। এমনকি প্রাসাদের অনেক ভগ্নাংশ তাঁর সৈন্যরা নিয়ে যায়।

সিরাযের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পাারসেপলিস (তাখতে-ই-জামশিদ)
পারসেপলিস হচ্ছে পারস্য সাম্রাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর। এ ঐতিহাসিক শহরটিও আলেক্সান্ডার গ্রেটের হাতে ধংস হয় খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ অব্দে। পারসেপলিস হচ্ছে সেই স্মৃতিময় ও ঐতিহাসিক স্থান যেখানে অনেক স¤্রাটের পদধূলি পড়েছে, নানা সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটেছে, সভ্যতা আবর্তিত হয়ে উঠেছে। বলা যায়, সকল জাতির দ্বার উন্মোচন হয়েছে পারসেপলিসে এসে। অতীতের সঙ্গে এক অবিশ্বাস্য সেতু বন্ধন এই পারসেপলিস। পাসারগাদের মতো পারসেপলিসেও রাতে ছবি তুলতে চাইলে অনুমতির প্রয়োজন হয়। এবং এ অনুমতি পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার।

ইসফাহানের ইমাম মসজিদ
ইসফাহান শহরের দক্ষিণাঞ্চলে নাখশ-ই-জাহান স্কয়ারে অবস্থিত এ মসজিদ সাফাভি আমলে নির্মিত। প্রথম শাহ আব্বাসের নির্দেশে এ মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। মসজিদটিতে গম্বুজগুলো ১৭০ ফুট উঁচু। গাঞ্জি বলেন, এ মসজিদের ছাদে যে কারুকাজ যা অন্য কোনো স্থানের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। এক অসাধারণ সৌকর্যের স্থাপত্যরীতি ও শৈলীর ছাপ এখানে দেখা যায়। মসজিদের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে গাঞ্জি ওয়াইড লেন্স ব্যবহার করে তাঁর ক্যামেরায় ছবি তোলেন। যাতে সঠিক প্রতিচ্ছবি ছবিতে উঠে আসে।

ইসফাহানের রয়াল মসজিদ
ইসফাহানের শেখ লোতফোল্লাহ মসজিদ আরেক বিস্ময়। এটিও প্রথম শাহ আব্বাস শাসনামলে নির্মিত। এ মসজিদের মোজাইক বিখ্যাত স্থপতি শেখ বাহাইয়ের নির্দেশনা অনুসারে বিন্যস্ত করা হয়েছে নির্মাণকালে। শেখ বাহাই তাঁর সময়ে সেরা একজন ক্যালিগ্রাফার ও শিল্পী হিসেবে খ্যাত ছিলেন। মসজিদটি মক্কার দিকে পশ্চিমমুখী হয়ে ৪৫ ডিগ্রি কোণে নির্মিত। এ মসজিদটি ইরানে একমাত্র মসজিদ যাতে কোনো উন্মুক্ত চত্বর নেই।

শেখ শাফি আল-দিন খানকাহ এবং মাযার, আরদাবিল
এ হচ্ছে সাফাভি সাম্রাজ্যের আরেক নিদর্শন। এটি এজন্য বিখ্যাত যে, শাহ ইসমাইলের পূর্বপুরুষ শেখ শাফিউদ্দিনের মাযার রয়েছে। পোরসিলেনের স্তম্ভ আর উদ্যানে আচ্ছাদানযুক্ত বিশ্রাম স্থান আপনাকে মুগ্ধ করবে। এখানে আপনি চীনা শাসকদের দেয়া উপহার হিসেবে অনেক বয়াম দেখতে পাবেন।
ইসফাহানের ৩৩ পোলের সেতু যা পরিচিত আল্লাহভারদি খান সেতু হিসেবে। প্রথম শাহ আব্বাসের আমলে এ সেতুটি নির্মিত হয়। পানিতে সেতুটির খিলানপথ সম্প্রসারিত। এ স্থানটি পায়চারি বা ঘুরে বেড়ানোর জন্য বেশ জনপ্রিয়।

কাশানের সুলতান আমির আহমেদ হাম্মামখানা
১১ শতাব্দীর সেলজুক আমল ও কাজার আমলের মিশ্রিত স্থাপত্যরীতিতে সুলতান আমির আহমেদের গোসলখানা তৈরি হয়েছিল। যে চুনের পলেস্তার আপনি এখানে দেখতে পাবেন তা সেই আমলে হামান দিস্তা দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। রয়েছে অলঙ্কারময় কারুকাজ হাম্মামখানার দেওয়ালে। যা দেখে অভিভূত হবেন আপনি। গাঞ্জি বলেন, ছবি তোলার ফাঁকে ফাঁকে আমি অনেকবার এ হাম্মামখানার বিভিন্ন স্থানে বসেছি। কিন্তু কখন যে ঘণ্টা পার হয়ে যেত বুঝতাম না। তারপরও অপেক্ষা করতাম কখন কৃত্রিম আলো নিভে যাবে এবং ছাদের গর্ত দিয়ে অকৃত্রিম আলোর খেলা নাচন দিতে শুরু করবে। মজার কথা হচ্ছে হাম্মামখানার পানির নিচে তাপমাত্রার উৎস থেকে ধোঁয়ার কু-লি পাক খেয়ে আসা বা ছোট শিখার দুলুনি দেখতে পাওয়া যেন এক রহস্যের উদ্ঘাটন।

মাকুতে সন্ন্যাসী থাদিয়েসের মঠ
এ মঠটি ইরানে কালো মঠ হিসেবে পরিচিত। কারণ, কালো পাথর ব্যবহার করা হয়েছে মঠটি নির্মাণে। ইরানের উত্তরপশ্চিমাঞ্চলে এ স্মৃতিস্তম্ভ খ্রিস্টান অঞ্চলের প্রথম বছরগুলোর স্মৃতিচিহ্ন বহন করছে। বিশেষ করে আর্মেনিয়রা তীর্থযাত্রী হিসেবে আসেন এ মঠ পরিদর্শনে। ইরানের অমুসলিম নাগরিকদের কাছে এ মঠ বেশ গুরুত্বপূর্ণ। গাঞ্জি বলেন, কঠিন শীতের রাতে একবার ছবি তোলার সুযোগ বা অনুমতি পেয়েছিলাম এই মঠে। একমাত্র ছোট গার্ডরুম ছাড়া মঠের আর কোথাও তখন কোনো বাতি জ্বালানো ছিল না।

কাশানের তাবাতাবায়ি হাউজ
কাজার সাম্রাজ্যের এক বিখ্যাত কাশান ব্যবসায়ী এ হাউজটি নির্মাণ করেন। ভবনের বিভিন্ন ধাপে ভিন্ন ভিন্ন কারুকাজ রয়েছে, রয়েছে চিত্রকর্ম এবং কাচের বাহারি ব্যবহার যা এক অসাধারণ স্থাপত্য বৈশিষ্ট সৃষ্টি করে আছে।

কাশানের তিমচেহ
এ এক ছোট পান্থনিবাস। কাশান বাজারের কাছে যা অবস্থিত। ছোট ছোট ছাদে নির্মিত এ পান্থনিবাসগুলো ইরানের বিখ্যাত হাতে তৈরি কার্পেট বিক্রির জন্য ব্যবহৃত হতো। কাজার সাম্রাজ্যের সময় শুধু কার্পেট নয়, বিলাসবহুল পণ্য বিক্রির জন্য ব্যবহৃত হতো পান্থনিবাসগুলো। গাঞ্জি বলেন, এসব পান্থনিবাসের ছাদের কারুকাজ দেখার মতো। চারপাশে দৃষ্টিনন্দন কার্পেটের ছড়াছড়ি, ঐতিহাসিক মূল্যবান সব পণ্য সাজানো আর ছাদের নিচেই বড় পুকুর।

সিরাযে মহাকবি হাফেজের সৌধ
১৪ শতাব্দীতে নির্মিত ইরানের বিখ্যাত কবি হাফেজের সৌধ রয়েছে সিরাযে। দীর্ঘ ইতিহাসে এ সৌধ বহুবার সংস্কার করা হয়েছে। সর্বশেষ সংস্কারটি হয়েছে ফ্রান্সের বিখ্যাত স্থপতি আন্দ্রে গোদার্দ ও ইরানের প্রত্নতত্ত্ববিদ আলি সামির দিক নির্দেশনায়। গাঞ্জি বলেন, হাফেজের সমাধি প্রান্তর সবসময় তার ভক্তদের ভিড়ে পরিপূর্ণ থাকে। বিকেল ও সন্ধ্যায় কবি ও কাব্যপ্রেমীদের ভিড়ে, দল বেঁধে বন্ধু, তরুণ দম্পতি যারা এখানে আসে তাদের অনেককেই দেখা যায় কবি হাফেজের রোমান্টিক কবিতা আবৃত্তি করতে। গাঞ্জি বলেন, এসব দৃশ্য ধরে রাখতে ক্যামেরার ফিশআই লেন্স ব্যবহার করি দিনের বেলায়।
একদিন ইরানের দুই জনপ্রিয় ফুটবল দলের খেলা ছিল আর সেদিন সেই খেলা দেখতে অনেকেই ব্যস্ত ছিল বলে কবি হাফেজের সৌধ এলাকা কিছুটা ফাঁকা পেয়েছিলাম।

বিস্ময়কর স্থাপত্যসৌধ : ভাকিল বাথ
১৮ শতাব্দীর জাদ রাজবংশের সময়ে ভাকিল বাথ স্থাপত্যসৌধ তৈরি হয়। এ সৌধে সমাধিক্ষেত্রে পারস্যের পুরানকালের চিত্রকর্মে সজ্জিত। এ সৌধটি সামাজিক যোগাযোগ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার ছাড়াও গোসলখানা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। মানুষ এ সৌধে আসত, তারপর এখানে সেমিট্রিক পুলে গোসল করত। চুনাপাথরে নির্মিত এ সৌধ দেখতে পেয়ে অনেকে বিমুগ্ধ হয়ে পড়েন। গাঞ্জি বলেন, পুলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে আমাকে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হয়।

সিরাযে ভাকিল মসজিদ
এ মসজিদটি জাদ রাজবংশের সময়ে নির্মিত। ইরানের অন্যতম সুন্দর মসজিদ এটি। বর্ণময় সিরামিক ব্যবহার করা হয়েছে মসজিদটি নির্মাণে। গাঞ্জি বলেন, মসজিদটি আমার কাছে খুব আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। কারণ, এর ভেতরে অনেকগুলো স্তম্ভ ব্যবহার করা হয়েছে। মসজিদে যে কেউ ঢুকলেই দেখতে পাবেন এর সৌন্দর্য ও এক রাজকীয় ভাবগাম্ভীর্য রয়েছে এর চত্ত্বরে। ছবি তোলার সময় আমি চেষ্টা করেছি যতটা সম্ভব মসজিদের এসব বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলতে।

ইসফাহানের ভ্যাঙ্ক ক্যাথিড্রাল
সপ্তদশ শতাব্দীতে আর্মেনীয়রা এ ক্যাথিড্রালটি নির্মাণ করেন। এর নির্মাণকাজে দারুণ নীল ও সোনালি বর্ণের ব্যবহার ও তাতে ধর্মীয় পুস্তকের বর্ণনা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে অসাধারণ সব চিত্রকর্মের মধ্যে দিয়ে। এখনো আর্মেনীয় খ্রিস্টানরা চার্চটি ব্যবহার করছেন এবং প্রতিদিন দর্শণার্থীরা এখানে আসেন। গাঞ্জি বলেন, চার্চের ছাদে সোনালি কারুকাজখচিত চিত্রকর্ম ক্যামেরায় ধারণ করতে আমি ওয়াইড লেন্স ব্যবহার করেছি।

হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)- অতুলনীয় যুবক

হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) ছিলেন মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও আত্মত্যাগী সাহাবী। শুরু থেকে জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি মহানবী (সা.)-এর পাশে ছিলেন এবং ইসলামের প্রতি ধারাবাহিক মূল্যবান সেবা প্রদান করেছেন। যেহেতু তিনি প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে ও যুদ্ধ-বিগ্রহে অতি প্রয়োজনীয় ও কার্যকর ভূমিকা পালন করেন সেহেতু মহানবী (সা.) তাঁকে খুব বেশি ভালোবাসতেন।

আলী (আ.) ছিলেন হযরত আবু তালিবের সন্তান। আবু তালিব ছিলেন আরবের সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে প্রসিদ্ধ গোত্র কুরাইশের একজন স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব। হযরত আলীর মা ছিলেন একজন মহীয়সী ও সম্মানিতা নারী যাঁর নাম ছিল ফাতেমা। তিনি ছিলেন আসাদ ইবনে মানাফের কন্যা। তিনিও কুরাইশ বংশের নারী ছিলেন। একারণেই হযরত আলীকে প্রথম শিশু হিসেবে ধরা হয় যিনি কুরাইশ পিতা ও কুরাইশ মাতার মাধ্যমে জন্মগ্রহণ করেন।১

হযরত আলী (আ.) অলৌকিকভাবে পবিত্র কাবাঘরে জন্মগ্রহণ করেন। পৃথিবীর ইতিহাসে আল্লাহর ঘর কাবায় জন্মগ্রহণ করার সম্মান হযরত আলী ছাড়া আর কারো হয় নি। জন্মগ্রহণের পর তিনি তিন দিন কাবাঘরে ছিলেন। তিন দিন পর সেই পবিত্র স্থান থেকে তিনি মায়ের কোলে বের হন। এই ঘটনার ব্যাপারে ইতিহাসে অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে।২

যখন ইসলাম ধর্ম ভীষণ চাপের মধ্যে ছিল এবং কাফের-মুশরিকরা মহানবী (সা.)-এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল সেই সময় হযরত আলী (আ.)-এর পিতা হযরত আবু তালিব আল্লাহর নবী (সা.)-কে সমর্থন করেন ও তাঁর সুরক্ষা দেন। তিনি নবুওয়াতের মিশনের ১০ম বর্ষে ইন্তেকাল করেন। সেই বছরেই কিছুদিন পর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সম্মানিতা স্ত্রী হযরত খাদিজাও ইন্তেকাল করেন। এজন্য মহানবী (সা.) সেই বছরের নামকরণ করেন ‘আমুল হুয্ন’ (শোকের বছর)। মহানবী (সা.) হযরত আলী (আ.)-কে খুব অল্প বয়সেই নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন। আলী (আ.) মহানবী (সা.)-এর বাড়িতেই বড় হয়ে ওঠেন। মহানবী (সা.)-এর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ও নির্দেশনায় তিনি বয়োপ্রাপ্ত এবং উন্নত হন।৩

যখন ওহীর ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) মক্কার নগরীর হেরা গুহায় আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর কাছে অবতীর্ণ হন এবং এই মহান ব্যক্তিও তাঁর নবুওয়াতি দায়িত্ব পালনের নির্দেশপ্রাপ্ত হন তখন আলী (আ.)-এর বয়স ছিল দশ বছর। এই ঘটনা শোনার পর হযরত আলীই ছিলেন সেই আহ্বানে সাড়াদানকারী এবং ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম পুরুষ।৪

মহানবী (সা.) নবুওয়াতি দায়িত্ব পালনের নির্দেশ পাওয়ার পর তিন বছর পর্যন্ত তাঁর কর্মকা- প্রকাশ্যভাবে শুরু করেন নি। নবুওয়াত ঘোষণার তৃতীয় বর্ষে তিনি প্রকাশ্যে জনসমক্ষে ইসলামের আহ্বান জানানোর জন্য মহান আল্লাহ কর্তৃক নির্দেশপ্রাপ্ত হন। প্রথম যেসকল লোককে মহানবী (সা.) আল্লাহর ধর্ম গ্রহণের আহ্বান জানান তারা হলো তাঁরই নিকটাত্মীয়। তিনি তাদের জন্য ভোজের ব্যবস্থা করেন। ভূরিভোজনের সময় তিনি তাদেরকে সম্বোধন করে বলেন : ‘হে আবদুল মুত্তালিবের সন্তানরা! আল্লাহ আমাকে সমগ্র মানবের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য, বিশেষ করে আপনাদের- আমার বংশধরদের জন্য মনোনীত করেছেন। তিনি আমাকে সর্বপ্রথমে আমার পরিবারকে সতর্ক করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন এবং আমার আত্মীয়-স্বজনকে বলতে বলেছেন যেন তারা আল্লাহর অবাধ্য না হয়।’
সেই ভোজসভায় মহানবী (সা.) এই কথা তিনবার পুনরাবৃত্তি করেন। কিন্তু আলী ছাড়া আর কেউ তাঁর আহ্বানে সাড়া দেয় নি। আলী (আ.) সেই সময় তের বছর বয়সের একজন কিশোর ছিলেন মাত্র। মহানবী (সা.) বলেন : ‘হে আলী! তুমি আমার ভাই ও উত্তরসূরি। তুমি আমার উত্তরাধিকারী ও উযির।’৫

আলী (আ.) তাঁর মূল্যবান জীবনকালে মহান আল্লাহর ধর্মের প্রসারে প্রাণপণ চেষ্টা করেন। ইতিহাসে আলী (আ.)-এর প্রচুর সংখ্যক মূল্যবান সেবার কথা উল্লিখিত হয়েছে। আমরা এখানে সেগুলোর মধ্য হতে অল্প কয়েকটি এখানে উল্লেখ করব :

১. মহানবী (সা.)-এর বিছানায় শুয়ে নিজের জীবনের ঝুঁকি নেয়া : নবুওয়াতের চতুর্দশ বর্ষে কুরাইশ গোত্রের নেতৃবৃন্দ আল্লাহর নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয় ও এ ব্যাপারে পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য তারা প্রতিটি গোত্র থেকে একজন করে যুবককে নির্বাচন করে এবং রাতের বেলা আক্রমণ করে মহানবী (সা.)-কে হত্যার পরিকল্পনা করে। মহানবী (সা.) যিনি তাদের শয়তানি অভিপ্রায় সম্পর্কে সতর্ক ছিলেন তিনি আলী (আ.)-কে তাঁর বিছানায় ঘুমানোর জন্য বলেন যাতে মহানবী (সা.)-এর পক্ষে শত্রুদের অবগতি ছাড়াই শহর থেকে বের হয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। মহানবী (সা.)-এর বিছানায় শোয়ার আহ্বানে সাড়া দেয়ার সময় হযরত আলী (আ.)-এর বয়স ছিল ২৩ বছর। আল্লাহর নবী (সা.) গোপনে শহর ত্যাগ করেন এবং মক্কার নিকটবর্তী সাওর গুহায় আশ্রয় নেন। রাতের শেষ ভাগে চল্লিশজন সশস্ত্র ব্যক্তি মহানবী (সা.)-এর গৃহে আক্রমণ চালায়, কিন্তু মহানবী (সা.)-এর বিছানায় হযরত আলীর মুখোমুখি হয়ে তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়।৬

বদরের যুদ্ধ
বদর যুদ্ধ ছিল ইসলামের ইতিহাসের প্রথম সত্য ও মিথ্যার যুদ্ধ। এই যুদ্ধ সংঘটিত হয় দ্বিতীয় হিজরিতে মক্কা ও মদীনার মাঝে বদর নামক একটি কূপের জায়গায়। কাফেরদের সৈন্যসংখ্যা ছিল নয়শ’ পঞ্চাশেরও অধিক আর তার ছিল যথেষ্ট অস্ত্রসজ্জিত, যেখানে মহানবী (সা.)-এর সঙ্গী-সাথির সংখ্যা তিনশ’ তের জনের বেশি ছিল না। কাফেরদের তিনজন প্রসিদ্ধ ও শক্তিশালী যোদ্ধা উতবা, তার ভাই শাইবা ও তার ছেলে ওয়ালিদ যথাক্রমে হযরত আলী ইবনে আবি তালিব, হযরত হামযা বিন আবদুল মুত্তালিব ও হযরত উবায়দা ইবনে হারিস কর্তৃক নিহত হয়। যখন এই যুদ্ধ সংঘটিত হয় তখন হযরত আলীর বয়স ছিল পঁচিশ বছর।৭

উহুদের যুদ্ধ
বদরের যুদ্ধের এক বছর পর মক্কার কাফেররা পুনরায় তাদের শক্তি সঞ্চয় করে। আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে তিন হাজার সৈন্য বিপুল পরিমাণ রসদপত্র নিয়ে উহুদ পাহাড়ের পাদদেশে সমবেত হয়- যার দৈর্ঘ্য ছিল ছয় কিলোমিটার। রাসূলুল্লাহ (সা.) সাত শ’ সৈন্য নিয়ে তাদের মোকাবিলা করেন। প্রথমে তিনি পঞ্চাশজন সুদক্ষ তীরন্দাজকে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়েরের অধীনে সরু গিরিপথ পাহারা দেয়ার জন্য নিযুক্ত করেন। এই পথটি মুসলমান সৈন্যদের পেছন দিকে ছিল। মহানবী (সা.) তাঁর সাহাবীদের সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিলেন যেন তাঁরা কোন অবস্থাতেই সেই স্থান ত্যাগ না করেন।
কাফিরদের বীর যোদ্ধারা- তালহা ইবনে আবি তালহা, আবু সাইদ ইবনে তালহা, হারেস ইবনে আবি তালহা, আবু আজিজ ইবনে তালহা, আবদুল্লাহ ইবনে আবি জামিলা, আরতাত ইবনে শারাহবিল একের পর এক হযরত আলীর হাতে নিহত হয়।
সেই সময় আলী ছিলেন ২৬ বছরের যুবক। মুসলিম বাহিনী প্রাথমিকভাবে বিজয়ী অবস্থায় ছিল। কিন্তু মুসলিম তীরন্দাজরা তাঁদের নেতার আদেশ লঙ্ঘন করে উহুদের সরু গিরিপথ ত্যাগ করলেন। খালিদ ইবনে ওয়ালিদ কয়েকজন অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে মুসলিম বাহিনীকে পেছন থেকে আক্রমণ করে। এই অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার ফলে মুসলমানরা এই যুদ্ধে পরাজিত হয় এবং তাঁদের সত্তর জন শাহাদাত বরণ করেন। যাঁরা এই যুদ্ধে শহীদ হন তাঁদের অন্যতম ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর চাচা হযরত হামযা (রা.)। আলী (আ.) সহ কয়েকজন সাহাবী বুদ্ধিমত্তা ও দক্ষতার সাথে মহানবীকে রক্ষা করেন। হযরত আলী ইবনে আবি তালিব এই যুদ্ধে নব্বইটি আঘাত পেয়েছিলেন। এই যুদ্ধের সময় আসমান থেকে একটি ধ্বনি শোনা যায়- ‘কোন আদর্শ বিজয় নেই আলী ছাড়া, কোন মূল্যবান তলোয়ার নেই যুলফিকার ছাড়া।’৮

খন্দকের যুদ্ধ (আহযাবের যুদ্ধ)
পঞ্চম হিজরির যিলকদ মাসে মক্কার মুশরিকরা মদীনায় ইসলামের নিরাপত্তাধীনে অবস্থানকারী ইহুদিদের সাথে যৌথভাবে আক্রমণ চালিয়ে ইসলাম ধর্মকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করল। তারা মদীনায় বসবাসকারী অন্যান্য গোত্রের কাছ থেকে সাহায্য ও সহযোগিতার বিষয়ে নিশ্চিত হলো। ষড়যন্ত্রকারীরা সম্মিলিতভাবে চার হাজার যোদ্ধাকে যুদ্ধের জন্য সংগ্রহ করল। মক্কার প্রসিদ্ধ বীর যোদ্ধা আমর ইবনে আবদে উদও এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। আমর ইবনে আবদে উদ বদরের যুদ্ধে আহত হয়েছিল। সেজন্য সে তার অন্তরে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রচ- বিদ্বেষ পোষণ করত। সে একটি প্রতিজ্ঞা করেছিল যে, যতদিন না সে রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবী মুসলমানদের ওপর প্রতিশোধ না নিতে পারবে ততদিন পর্যন্ত গায়ে তেল মাখবে না। উল্লেখ্য, আরবের একটি সাধারণ প্রথা ছিল যে, যখনই কোন দল পরাজিত হতো অথবা অন্য কারো দ্বারা দুর্ভাগ্যকবলিত হতো তখন তারা নিজেদের সাথে একটি প্রতিজ্ঞা করত যে, যতক্ষণ না তারা তাদের শত্রুদের ওপর প্রতিশোধ নিতে না পারবে ততদিন পর্যন্ত গায়ে তেল মাখবে না। তারা এমনটি করত এ কারণে যে, ওই সময়ে আরবের প্রথা অনুসারে শরীরে তেল দেয়া হতো তখন যখন তাদের কোন প্রকার দুঃখ থাকত না এবং তারা সুখের শীর্ষে অবস্থান করত।
যখন মক্কার কাফির-মুশরিকরা মদীনায় পৌঁছল তখন বনু কুরায়যার বিশ্বাসঘাতক ইহুদিরা, যারা মহানবী (সা.)-এর সাথে শান্তি ও সহযোগিতার চুক্তি সম্পাদন করেছিল তারা তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে মক্কার কাফিরদের সাথে সহযোগিতা করার জন্য প্রস্তুত হয়। মুসলমানরা হযরত সালমান ফারসির পরামর্শ মোতাবেক মুশরিকদের মদীনায় প্রবেশে বাধা দেয়ার জন্য মদীনা নগরীর চারদিকে একটি খন্দক বা পরিখা খনন করে। মূর্তিপূজারীদের এই অবরোধ সাতাশ দিন পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। অবশেষে কাফিরদের প্রসিদ্ধ বীর যোদ্ধা আম্র ইবনে আবদে উদ খন্দক অতিক্রম করতে সক্ষম হয় এবং মদীনায় প্রবেশ করে। সে চাইল যে, মুসলমানদের মধ্য থেকে কোন প্রতিদ্বন্দ্বী তার সাথে লড়াই করুক। হযরত আলী (আ.) ছাড়া আর কেউ তাকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস পেল না। হযরত আলী সেই মুহূর্তে যুদ্ধক্ষেত্রে পদার্পণ করলেন। মহানবী (সা.) বললেন : ‘সমগ্র ঈমান সমগ্র কুফ্রের মোকাবিলায় অবতীর্ণ হয়েছে।’
আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) কাফিরদের বীর যোদ্ধাকে হত্যা করলেন এবং তাকে জাহান্নামে পাঠিয়ে দিলেন। মহানবী (সা.) বললেন : ‘নিশ্চয়ই খন্দকের যুদ্ধে আলীর আঘাত সকল জীন ও মানুষের সত্তর বছরের ইবাদত অপেক্ষা মূল্যবান।’
আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য এসব মূল্যবান খেদমত আঞ্জাম দেন মাত্র ২৭ বছর বয়সে। এই যুদ্ধের পর মহানবী (সা.) আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)-এর নেতৃত্বে ইহুদি গোত্র বনু কুরাইযার বিশ্বাসঘাতকতা ও অবাধ্যতার জন্য তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার লক্ষে একটি সেনাদল প্রেরণ করেন। ইহুদিদের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি হুয়াই ইবনে আখতাব যুদ্ধে নিহত হয় এবং ইহুদিদের দ্বারা পরবর্তী কোন ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনার সম্ভাবনা সম্পূর্ণরূপে মূলোৎপাটিত হয়। ইহুদিদের সহায়-সম্পত্তি মুসলিমদের হাতে আসে এবং মহানবী (সা.) ও তাঁর সাহাবীরা এরপর থেকে সেখানে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে থাকেন।
হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)-এর সাহস ও বীরত্বের কারণে এই বিরাট বিজয় অর্জিত হয়।৯

খায়বার বিজয়
৭ম হিজরিতে খায়বারের ইহুদিরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে। তারা মদীনার দুশ’ মাইল উত্তরে খায়বারের সাতটি দুর্গকে নানা ধরনের অস্ত্রের গুদাম হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে। চার হাজার ইহুদি এসব দুর্গে বসবাস করত এবং তারা মুসলমানদের জন্য একটি বড় বিপদ হিসেবে পরিগণিত হতো।
এই বিপদের মূলোৎপাটনের উদ্দেশ্যে মহানবী (সা.) এক হাজার পাঁচশ’ পদাতিক সৈন্য ও দুই হাজার অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে খায়বার অভিমুখে যাত্রা করেন। তিনি মুসলিম বাহিনীর পতাকা হযরত আলীর হাতে অর্পণ করেন যখন তাঁর বয়স ছিল ত্রিশ বছর।
এই যুদ্ধে পর্যায়ক্রমে হযরত আবু বকর ও হযরত উমরকে আক্রমণের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়, কিন্তু তাঁরা কেউই সফল হন নি। মহানবী (সা.)-এর নিকট হযরত আলী ইবনে আবি তালিবকে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরণ করা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প ছিল না।
হযরত আলী ইহুদিদের বীর যোদ্ধা মারহাবকে হত্যা করেন। যখন মুসলমান সৈন্যরা দেখলেন যে, শত্রুদলের বীর যোদ্ধা নিহত হয়ে মাটিতে পড়ে আছে তখন তারা ইহুদিদের ওপর প্রচ- আক্রমণ চালায়। আলী (আ.) খায়বারের লোহার ভারী দরজা উপড়ে ফেলেন এবং এটিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন। এই যুদ্ধে শত্রুপক্ষের তিন বীর যোদ্ধা মারহাব, হারিস ও ইয়াসির হযরত আলীর হাতে নিহত হয়। খায়বারের সাতটি দুর্গই বিজিত হয়। যুদ্ধশেষে চল্লিশ জন লোক একত্রে দুর্গের সেই দরজা স্বস্থানে পুনরায় সংযুক্ত করার বহন করে নিয়ে আসেন যেটি যুদ্ধের সময় হযরত আলী এক হাতে বহন করেছিলেন।১০

মক্কা বিজয়
ইসলামি বর্ষপঞ্জির (হিজরি) অষ্টম বর্ষে কোন ধরনের রক্তপাত বা যুদ্ধ ছাড়াই শান্তিপূর্ণভাবে মক্কা বিজয় হয়। মহানবী (সা.) বারো হাজার সাহাবীসহ পবিত্র মক্কা নগরীতে প্রবেশ করেন। মহানবী (সা.) নিজেই আল্লাহর ঘর কাবায় স্থাপিত সব মূর্তি ভেঙে ফেলেন। এরপর তিনি আলী (আ.)-কে তাঁর কাঁধে উঠে সেসব মূর্তি ধ্বংস করার আদেশ দেন যেগুলো কাবাঘরের ওপরের অংশে স্থাপন করা হয়েছিল। আলী (আ.) মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে তাঁর কাঁধে চড়ে কাবাঘরের ওপরে ওঠেন এবং সেসব মূর্তি ভেঙে ফেলেন। নেমে আসার সময় আলী (আ.) মহানবী (সা.)-এর কাঁধে পা দিয়ে নেমে আসার পরিবর্তে কাবাঘরের ছাদ থেকে লাফ দিয়ে মাটিতে নামেন। মহানবী (সা.) তাঁকে জিজ্ঞেস করেন : ‘নিচে নামার সময় কেন তুমি আমার কাঁধে পা রাখলে না?’ আলী (আ.) জবাব দিলেন : ‘আপনি ওপরে ওঠার সময় আমাকে আপনার কাঁধে ওঠার জন্য আদেশ দিয়েছিলেন, কিন্তু যখন আমি নিচে নামার সময় আপনি কিছু বলেন নি। সুতরাং আমি লাফ দিয়ে নিচে নেমেছি। আমি আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই যে, আমি তাঁর নবীর সাথে ধৃষ্টতামূলক আচরণ করি নি।’১১

এখানে যা উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো অতুলনীয় যুবক হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) ইসলামের প্রতি যেসব মূল্যবান সেবা দিয়েছেন তার কয়েকটি মাত্র। তিনি প্রতিটি ঘটনায় কার্যকর ভূমিকা পালন করেন। মহানবী (সা.)-এর জীবদ্দশায় এবং তাঁর ওফাতের পর হযরত আলী (আ.) তাঁর পুরো অস্তিত্ব দিয়ে মুসলমানদের কল্যাণে সংগ্রাম করে গেছেন। হযরত আলী (আ.)-এর প্রশংসায় মহানবী (সা.)-এর বিপুল সংখ্যক হাদিস বর্ণিত হয়েছে।

তথ্যসূত্র
১. বিহারুল আনওয়ার, ৩৫তম খ-, পৃ. ৬৮
২. আল মুসতাদরাকুস সাহীহাইন, হাকিম, ৩য় খ-, পৃ. ৪৮৩; আল গাদীর, ৬ষ্ঠ খ-, পৃ. ২২
৩. উসুলে কাফী, ২য় খ-, পৃ. ৩২৪; আল গাদীর, ৭ম খ-, পৃ. ৩৩০
৪. তারিখে তাবারী, ২য় খ-, পৃ. ২১২; ইহকাকুল হাক, ৭ম খ-, পৃ. ৪৯৭
৫. ইহকাকুল হাক, ৬ষ্ঠ খ-, পৃ. ৪৬১; কানজুল উম্মাল, ৬ষ্ঠ খ-, পৃ. ৩৯৭
৬. ইহকাকুল হক, ৮ম খ-, পৃ. ৩৩৪; সীরাতে হালাবীয়্যাহ, ২য় খ-, পৃ. ২৬
৭. ইহকাকুল হাক, ৮ম খ-, পৃ. ৩৪৮; বিহারুল আনওয়ার, ৪১তম খ-, পৃ. ৭৯; মুফিদ, আল ইরশাদ, ১ম খ-, পৃ. ৬২
৮. ইহকাকুল হাক, ৮ম খ-, পৃ. ৩৬৬; তাযকিরাতুল খাওয়াস, পৃ. ২১; তারিখে তাবারী, ৩য় খ-, পৃ. ৩৭
৯. হাকিম, মুসতাদরাকুস সাহীহাইন, ৩য় খ-, পৃ. ৩২, তারিখে বাগদাদ, ১৩তম খ-, পৃ. ১৯
১০. কানজুল উম্মাল, ৫ম খ-, পৃ. ১১৪; আল মুস্তাদরাকুস সাহীহাইন, ৩য় খ-, পৃ. ৩৭
১১. সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খ-, পৃ. ৪২৯; ইবনে সাদ, তাবাকাত, ২য় খ-, পৃ. ১০২

সংকলন : মিকদাদ আহমেদ

সর্বকালের মেয়েদের জন্য মহানবী (সা.)-এর বাণী

মুহাম্মাদ বাকের আমীনপুর

মহানবী (সা.)-এর বাণী কি শুধুই পুরুষের উদ্দেশে, নাকি তিনি নারীদেরও সম্বোধন করে কিছু বলেছেন?
অন্যান্য নবী-রাসূলের মতোই মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-ও দুটি কারণে মানুষের প্রতি তাঁর দীনী আহ্বান ও পথনির্দেশনা শুরু করেন এবং তা অব্যাহত রাখেন :
১. ঐশী জ্ঞানের সাথে মানুষকে সুপরিচিত করানো ও
২. মানুষের চিন্তা-বিশ্বাস এবং তার আত্মিক ও নৈতিক পূর্ণতা সাধন।
একদিকে সেগুলো হলো ঐশী গ্রন্থ ও প্রজ্ঞার শিক্ষা, অন্যদিকে মানুষের আত্মার পরিশুদ্ধি, যেমনটি পবিত্র কোরআন বলছে : ‘অবশ্যই আল্লাহ বিশ্বাসীদের অনুগ্রহ করেছেন যখন তিনি তাদের জন্য তাদের (জাতির) থেকেই এক রাসূল প্রেরণ করেছেন যে তাদের আল্লাহর আয়াতসমূহ আবৃত্তি করে শুনিয়ে থাকে, তাদের (আত্মাগুলো) বিশুদ্ধ করে এবং তাদেরকে গ্রন্থ ও প্রজ্ঞা শিক্ষা দেয়; এবং নিশ্চয় তারা এর পূর্বে স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে ছিল।’- সূরা আলে ইমরান : ১৬৪
সুতরাং নবী প্রেরণের বিষয়টিকে এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়- তিনি এসেছিলেন সমাজকে ঐশী জ্ঞানের দিকে পরিচালিত করার জন্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিতে এবং সমাজকে পরিশুদ্ধ ও মানুষের আচরণকে সঠিক করার জন্য। তিনি এসেছিলেন মানুষকে ব্যবহারিক দিক থেকে আত্মার পরিশুদ্ধি অর্জনে সাহায্য করার জন্য। এই পথনির্দেশনার সম্বোধিত সত্তা ছিল মানুষের আত্মা, তার দেহ নয়। সুতরাং মহানবী (সা.)-এর বাণীর সম্বোধিত সত্তা পুরুষ ও নারী উভয়েই।
মানুষের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের কেন্দ্র হলো মানুষের আত্মা, তার দেহ নয়, আবার দেহ ও আত্মা একত্রেও নয়। যেটি শিক্ষিত-প্রশিক্ষিত হয় সেটি হলো তার আত্মা; এই আত্মা পুরুষও নয়, নারীও নয়। সুতরাং মানুষের পূর্ণতার ক্ষেত্র, সেটি যা-ই হোক না কেন, জ্ঞান-বিজ্ঞান, আকীদা-বিশ্বাস অথবা নৈতিকতা, তা পুরুষ ও নারীর জন্য অভিন্ন। যদিও প্রশাসনিক ও কায়িক পরিশ্রম সংক্রান্ত কর্মের ক্ষেত্রে মানুষের শারীরিক ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে কিছু অভিন্ন ও কিছু বিশেষ বা ভিন্ন ধরনের দায়িত্ব রয়েছে, কিন্তু তাদের দায়িত্বের ভিন্নতা তাদের পূর্ণতার স্তরের ক্ষেত্রে কোন পার্থক্য সৃষ্টি করে না।
পুরুষের মতো নারীও পূর্ণতায় পৌঁছতে সক্ষম এবং পবিত্র কোরআন যখনই উচ্চ মানবীয় মূল্যবোধের বিষয় আলোচনা করেছে তখন নারীকে পুরুষের সমান হিসেবে উল্লেখ করেছে। এর অর্থ হলো পুরুষের মতোই নারী উচ্চ আত্মিক ও মানবীয় মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছতে পারে।
বিশ্বাস, আনুগত্য, সততা, ধৈর্য, আল্লাহভীতি, রোযা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, আল্লাহর স্মরণ প্রত্যেক নারীর জন্য অর্জন করা সম্ভব এবং নিশ্চয়ই তার পুণ্যকর্মেরও পুরুষের মতোই পার্থিব ও অপার্থিব ফলাফল রয়েছে।
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে : ‘নর হোক অথবা নারী- যে কেউ সৎকর্ম করে এবং সে বিশ্বাসী হয়, আমরা তাকে পবিত্র (অনাবিল) জীবন দান করব এবং অবশ্যই আমরা তাদেরকে তারা যে উত্তম কর্ম সম্পাদন করত তদনুযায়ী প্রতিদান দেব।’- নাহল : ৯৭
এই ভূমিকার আলোকে আমরা নিম্ন লিখিত বিষয়গুলো আলোচনা করব :
মেয়ে হওয়ার জন্য গর্বিত হওয়া
যখন সমাজ নারী হওয়াকে বিব্রতকর মনে করত এবং নারীর প্রতি ঘৃণা এমন এক পর্যায়ে ছিল যে, তারা কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দিত, সেই পরিবেশে ইসলাম কন্যাসন্তানের মর্যাদাকে নতুনভাবে উপস্থাপন করেছে এবং তাকে ‘রায়হানা’ নামে পরিচিত করিয়েছেÑ যার অর্থ গোলাপ কলি। মহানবী (সা.)-এর অন্যতম উপহার হলো নারীর ব্যক্তিত্বের মূল্যায়ন। এ প্রসঙ্গে মহানবী (সা.)-এর নিকট হতে কয়েকটি হাদিস উল্লেখ করা হলো :
 কন্যাসন্তানরা আশীর্বাদস্বরূপ এবং সুন্দর।
 তোমাদের সবচেয়ে উত্তম সন্তানরা হলো তোমাদের কন্যাসন্তান।
 কোন নারীর সৌভাগ্যের একটি নিদর্শন হলো তার প্রথম সন্তান কন্যা হওয়া।
 উত্তম কন্যাসন্তান হলো সেই কন্যা যে দয়ালু, সাহায্যকারী, বন্ধুভাবাপন্ন, এবং সৌভাগ্যবান এবং দুঃখ-কষ্ট দূরকারী।
 যেসব পিতামাতার একটি কন্যাসন্তান রয়েছে তাদের জন্য আল্লাহর সাহায্য, আশীর্বাদ ও অনুগ্রহ রয়েছে।
যখন মহানবী (সা.)-কে কোন কন্যাসন্তানের জন্ম গ্রহণের সংবাদ দেয়া হতো তখন তিনি বলতেন : ‘সে একটি ফুল, যাকে আল্লাহ রিযিক দেন।’
নিজেকে নিয়ে গর্বিত হও এবং তাদের অন্তর্ভুক্ত হও যাদের সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেছেন : ‘সেই মেয়েরা কত উত্তম সন্তান, যারা যথাযথ পর্দা করে চলে এবং নিজেদেরকে (অনৈতিকভাবে) প্রদর্শন করে না!’
সুযোগের সদ্ব্যবহার করা
যৌবনকাল একটি অস্থায়ী সুযোগ। প্রতিটি মুহূর্তে তোমার জন্য রয়েছে মৃত্যু ও (আল্লাহর নিকট) প্রত্যাবর্তন। একটি উক্তি আমরা শুনে থাকি : ‘দুনিয়া একটি মাত্র ঘণ্টা ছাড়া আর কিছু নয়।’
প্রকৃতপক্ষেই জীবন খুবই ছোট এবং একই সাথে এটি খুবই মূল্যবান যাকে অবমূল্যায়ন করা উচিত না। মহানবী (সা.) বলতেন : ‘বিচার দিবসে মানুষের জীবনের প্রতিটি দিনের জন্য ২৪টি নথি খোলা হবে যা একটি দিনের ঘণ্টাসমূহের সমান।’
ধার্মিকরা আলো ও আনন্দে পরিপূর্ণ একটি নথি পাবে এবং এমন বেশি সুখ ও আনন্দ অনুভব করবে যে, যদি তা জাহান্নামের অধিবাসীদের সামনে উপস্থাপন করা হয়, তাহলে তা জাহান্নামের আগুনের সকল কষ্টকে তাদের থেকে অপসারিত করবে। আর এটি হলো আল্লাহর আনুগত্য করার জন্য তাদের প্রতি পুরস্কার।
নিজেকে প্রদর্শন করা হতে বিরত থাকা
নিজেকে প্রদর্শন না করা হলো প্রত্যেক সৌন্দর্যের উৎস। এর অনুপস্থিতিতে কোন উত্তম কর্ম সম্পাদিত হতে পারে না এবং কোন অনৈতিক কর্মও পরিহার করা যায় না। নিজেকে প্রদর্শন না করা হলো পবিত্রতা, ভদ্রতা এবং অনৈতিক কর্মকা- পরিহার, বিশেষ করে যখন কেউ অনুভব করে যে, কেউ তাকে দেখছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন : ‘এজন্য সতর্ক হও যে, আল্লাহ তোমার সকল কর্ম সম্পর্কে অবগত।’
মূসা (আ.) যেভাবে শোয়াইব (আ.)-এর কন্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন এবং শোয়াইব (আ.)-এর কন্যা কীভাবে নিজেকে প্রদর্শন না করে শালীনতার সাথে চলে গিয়েছিলেন তা চিন্তা করে দেখ। এ বিষয়টি তোমার জন্য খুবই অনুপ্রেরণাদায়ক হতে পারে।
সঠিক পোশাক-পরিচ্ছদ নির্বাচন করা
ইসলামের নবী (সা.) নারীর পোশাক পোশাক-পরিচ্ছদের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন এবং অবৈধ প্রদর্শনী ও অশ্লীলতাকে নিষেধ করেছেন। আর পবিত্র কোরআন যখন পুরুষদেরকে নারীর প্রতি না তাকানো এবং তাদের সামনে যথাযথ পোশাক পরিধানের উপদেশ দিয়েছে তখন নারীদেরকেও কামনার দৃষ্টিতে পুরুষের প্রতি না তাকানোর উপদেশ দিয়েছে এবং নিজেদেরকে হেফাজতের উপদেশ দিয়েছে। নিম্নের দুটি আয়াত লক্ষ্য কর :
১. হে নবী! তুমি তোমার পত্নিগণকে, কন্যাগণকে এবং বিশ্বাসীদের নারিগণকে বলে দাও যেন তারা তাদের চাদরগুলোর অবগুণ্ঠন ঝুলিয়ে রাখে; নিশ্চয়ই এটা তাদের (শালীন) পরিচিতির নিকটতর; ফলে তাদের উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ অতিশয় ক্ষমাশীল, অনন্ত করুণাময়।- সূরা আহযাব : ৫৯
২. বিশ্বাসী নারীদের বল, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে (নিষিদ্ধ বস্তু থেকে) নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গকে সংরক্ষণ করে এবং তাদের শোভা প্রকাশ না করে; তবে যা আপনা হতেই প্রকাশিত তা স্বতন্ত্র; এবং তাদের ওড়না দিয়ে যেন গ্রীবা ও বক্ষদেশ ঢেকে রাখে এবং তাদের শোভা যেন তাদের স্বামী, পিতৃবর্গ, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগিনীপুত্র, তাদের (সমধর্মী) নারী, তাদের বাঁদী, সেসব সেবক ও অনুগত পুরুষ যারা নারীদের প্রতি আসক্তিহীন এবং নারীদের গোপনাঙ্গ সম্বন্ধে অজ্ঞ বালক ব্যতীত কারও নিকট প্রকাশ না করে; এবং চলার সময় ভূমিতে এভাবে পদক্ষেপ না করে যাতে যে শোভা তারা গোপন করেছিল তা প্রকাশ পেয়ে যায়।- সূরা নূর : ৩১
পর্দার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কোরআন বলছে যে, তাহলে সম্মানিতরা উত্যক্ত হবে না।
সবসময় জ্ঞান অন্বেষণ করা
সবসময় শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জনের ব্যাপারে আগ্রহী হবে। কারণ, যারা ঈমানদার এবং জ্ঞান অন্বেষণ করে, তাদের মহান আল্লাহ মর্যাদায় উন্নীত করেন। কখনও অধ্যয়ন ও শিক্ষা গ্রহণে ক্লান্ত হয়ো না এবং কখনই প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রির ব্যাপারে চিন্তা কর না। মহানবী (সা.)-এর বাণী স্মরণ রাখবে, যিনি বলেছেন :
‘প্রত্যেক বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী ব্যক্তির চারটি বিষয়ের প্রতি অবশ্যই অনুগত থাকতে হবে: জ্ঞান অর্জন, একে সংরক্ষণ, এর প্রচার প্রসার ও তা অনুশীলন করা।’
‘সকল পাত্রই ধারণক্ষমতা হারায় যখন সেটার মধ্যে কিছু রাখা হয়, কেবল জ্ঞানের পাত্র ছাড়া, যখন এতে কিছু যোগ করা হয় তখন তা আরো ধারণক্ষমতা অর্জন করে।’
মহানবী (সা.) বলেন : ‘আনসার নারীরা উত্তম। লজ্জাশীলতা তাদেরকে ধর্মের ব্যাপারে জ্ঞান অর্জনে বাধা দেয় না।’
সর্বশ্রেষ্ঠ যে জ্ঞান যুবকদের অর্জন করা উচিত সেটি হলো যা তাদের বয়স কালে তাদের জন্য কল্যাণদায়ক হবে এবং তাদের জীবনে তাদের দ্বারা যে জ্ঞান ব্যবহৃত হবে।
পিতামাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া
তোমার পিতামাতার সেবা করতে ইতস্তত কর না এবং তাঁদের প্রতি নম্র ও বিনয়ী হও। সেই সৌভাগ্যবান যে তার পিতামাতার সেবা করে। এক ব্যক্তি মহানবী (সা.)-কে সর্বোৎকৃষ্ট কাজ সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন। তিনি উত্তর দিলেন : ‘প্রথম হলো ওয়াক্তের শুরুতেই নামায আদায় করা, তারপর হলো পিতামাতার সেবায় নিয়োজিত হওয়া।’
একদিন মহানবী (সা.)-এর দুধ বোন তাঁর কাছে এলেন। যখন তিনি তাঁকে দেখলেন তখন আনন্দিত হলেন এবং একটি চাদর বিছিয়ে দিয়ে তাঁকে সেটার ওপর বসালেন। এরপর তিনি তাঁর দিকে ফিরে তাঁর সাথে কথা বললেন ও স্মিত হাসলেন। সেই বোনটি তাঁর নিকট থেকে চলে যাওয়ার পর তাঁর ভাই সেখানে আসলেন। কিন্তু মহানবী (সা.) তাঁর বোনের সাথে যেরূপ আচরণ করেছিলেন, তাঁর ভাইয়ের সাথে সেরূপ আচরণ করলেন না। সাহাবিগণ তাঁকে এই আচরণগত পার্থক্যের কারণ জিজ্ঞেস করলেন। তিনি জবাব দিলেন : ‘কারণ, সে তার ভাইয়ের চেয়ে তার পিতামাতার প্রতি অধিকতর দয়ালু।’
এক ব্যক্তি মহানবী (সা.)-এর কাছে এলেন এবং পিতামাতার সেবা করার বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন। তিনি প্রত্যুত্তরে বললেন : ‘তোমার মায়ের সেবা কর। তোমার মায়ের সেবা কর। তোমার মায়ের সেবা কর।’ এরপর তিনি একথার সাথে একবার যোগ করলেন : ‘তোমার পিতার সেবা কর।’
মহানবী (সা.) প্রথমে মায়ের সেবা করার উপদেশ দিয়ে কথা শুরু করেছিলেন।
আর তোমরা নবীর অনুসারী কন্যারা! অন্যদের দ্বারা সমালোচিত হওয়ার আগেই তোমরা নিজেদেরকে বিশ্লেষণ কর। আর মহানবী (সা.)-এর বাণীসমূহকে মূল্য দাও।
অনুবাদ : মো. আশিফুর রহমান
(মাসিক মাহজুবা, অক্টোবর, ২০১৬)

হযরত ফাতেমা (সা.আ.) ইতিহাসে নারীকুলের জন্য সর্বোত্তম অনুসরণীয় আদর্শ

ইমাম খোমেইনী (রহ্.) ও আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ীর মূল্যায়ন

ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) ও তাঁর উত্তরসূরি ইসলামি বিপ্লবের বর্তমান নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ্ উযমা খামেনেয়ীর দৃষ্টিতে রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর কন্যা খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতেমা যাহরা (সালামুল্লাহি ‘আলাইহা) মানবজাতির ইতিহাসে সমগ্র নারীকুলের জন্য সর্বোত্তম অনুসরণীয় আদর্শ।
হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) ও হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বিভিন্ন সময় তাঁদের ভাষণ ও বাণীতে হযরত ফাতেমা যাহরা সম্পর্কে মূল্যায়ন করেছেন। এ মূল্যায়নে তাঁরা বলেন যে, মানবজাতির ইতিহাসে যে কোনো জনগোষ্ঠী ও যে কোনো সমাজেই বিভিন্ন পরিস্থিতিতে কোনো না কোনো ব্যক্তিত্বকে অনুসরণীয় আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে দেখা যায়- যিনি তাদেরকে মুক্তির আলো প্রদর্শন করেন ও পূর্ণতার দিকে পরিচালিত করে থাকেন। আর মহান আল্লাহ্ তাঁর রাসূলের (সা.) মাধ্যমে যাঁকে বিশ্বের সমগ্র নারীকুলের জন্য আদর্শ হিসেবে পেশ করেছেন তিনি হলেন হযরত ফাতেমা যাহরা (সা.আ.)।
হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) ও হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বিভিন্ন সময় তাঁদের ভাষণ ও বাণীতে হযরত ফাতেমা যাহরা সম্পর্কে যেসব মূল্যায়ন করেছেন আমরা আমাদের এ নিবন্ধে তা থেকে কতক নির্বাচিত অংশ তুলে ধরে তার আলোকে হযরত ফাতেমা যাহরা পূতপবিত্র জীবনের শিক্ষণীয় দিক সমূহ সম্পর্কে অত্যন্ত সংক্ষেপে একটি পূর্ণাঙ্গ ধারণা প্রদানের চেষ্টা করব।
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) এরশাদ করেন : ‘ফাতেমা হচ্ছে বিশ্বের সমগ্র নারীকুলের নেত্রী (সাইয়্যেদাতু নিসায়ীল্ ‘আলামীন) এবং মুসলিম নারীদের জন্য অনুসরণীয় আদর্শ।’
হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর উক্ত হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন : ‘ইসলামের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) হযরত যাহরা’ (সালামুল্লাহি ‘আলাইহা)-এর প্রতি খুবই সম্মান প্রদর্শন করতেন- যাতে সমাজে নারীর গুরুত্বও অত্যন্ত শক্তিশালীভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। এ থেকে বুঝা যায় যে, নারীদের মর্যাদা যদি পুরুষদের তুলনায় বেশি না-ও হয়, তো কম নয়।’
লোকেরা যখন তাদের কন্যা সন্তানকে জন্মের পর পরই জীবন্ত কবর দিত ঠিক এমনি এক সময় হযরত ফাতেমা যাহরা(সা.‘আ.)-র জন্ম হয় এবং তাঁর বরকতময় জন্ম উপলক্ষে সূরা আল্-কাওছার নাযিল হয়। এছাড়া হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) হযরত ফাতেমার হস্ত চুম্বন করতেন এবং তাঁর ফযীলত বর্ণনা করতেন ও তাঁর প্রশংসা করতেন।
হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) এভাবে ইসলামি সমাজে নারীর অবস্থান ও মর্যাদাকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করেন।
বস্তুত হযরত ফাতেমা যাহরা’ (সা.‘আ.) যে নারীকুলের জন্য অনুসরণীয় আদর্শ এটি কোনো স্থান বা কালবিশেষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর উক্তি থেকে প্রমাণিত হয় যে, হযরত ফাতেমা যাহরা (সা.‘আ.) হচ্ছেন মানব প্রজাতির সূচনাকাল থেকে শুরু করে অনাগত ভবিষ্যতে তার সমাপ্তি পর্যন্ত শ্রেষ্ঠতম নারী। এ বিষয়টির ওপর গুরুত্ব আরোপ করে হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন : ‘হযরত ফাতেমা (সা.‘আ.) হচ্ছেন গোটা ইতিহাসে এবং অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কাল নির্বিশেষে সব সময়ের জন্য নারীকুলের অনুসরণীয় আদর্শ। বস্তুত মানুষের ঐশী ও পবিত্র দিকটি তাঁর মধ্যে পরিপূর্ণরূপে প্রকাশিত হয়েছে।’
আমরা যদি মানব প্রজাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাই যে, কতক লোককে কতোগুলো বিশেষ বিশেষ গুণের জন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে- যেসব গুণ-বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে তাঁরা পূর্ণতার অধিকারী ছিলেন। কিন্তু হযরত ফাতেমা যাহরা (সা.‘আ.) হচ্ছেন পূতপবিত্রতা, নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতাসহ নির্বিশেষে মানব জীবনের যে কোনো সমুন্নত দিক থেকেই সকলের জন্যই অনুসরণীয় আদর্শ। তাঁর ‘ইল্মী ও নৈতিক-আধ্যাত্মিক স্তর ছিল খুবই উঁচু এবং তাঁর নিকট ফেরেশতা নাযিল হতেন। তাঁর উন্নত আত্মিক অবস্থা সম্পর্কে বলতে হয় যে, তা এতই সমুন্নত যে, তিনি ছিলেন যে কোনো ধরনের পার্থিব মোহ থেকে মুক্ত- যে কারণে স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলা ও হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) তাঁর প্রশংসা করেছেন। তিনি অনেক বেশি নামায আদায় করতেন এবং নামায আদায়কালে কম্পিত হতেন ও অশ্রুপাত করতেন।
হযরত ফাতেমা যাহরা’ (সা.‘আ.)-এর গুণাবলির কথা উল্লেখ করে হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন : ‘তিনি ছিলেন বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী একজন মানুষ, ইসলামের পথে একজন সাহসী সংগ্রামী, একজন জ্ঞানী মহিলা- যিনি একই সময় একদিকে যেমন একজন গৃহিণীর ভূমিকা পালন করেন অন্যদিকে ছিলেন একজন মমতাময়ী স্ত্রী ও মাতা এবং পূর্ণতার অধিকারিণী; এমনটিই ছিলেন হযরত ফাতেমা যাহ্রা। তাঁর জীবন ছিল খুবই সাদাসিধা এবং তাঁর প্রয়োজন বা প্রত্যাশা ছিল খুবই নগণ্য।’
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বিশ্বের নারীকুলের উদ্দেশে বলেন : ‘হযরত ফাতেমা যাহরা (সা.আ.) ছিলেন সমস্ত নারীর জন্য সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত এবং মুসলমানদের জন্য তাঁর কাছ থেকে শিক্ষণীয় রয়েছে। হযরত যাহরা (সা.আ.) প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, পুরুষদের মতো একজন নারীও নৈতিকতার সমুন্নত পর্যায়ে উপনীত হতে এবং পরিপূর্ণ মনঃসংযোগ সহকারে ইবাদত করতে সক্ষম।’
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন : ‘হযরত যাহরা (সা.আ.)-এর অস্তিত্ব এবং তাঁর বাগ্মিতা, তাঁর রাজনৈতিক ও সামাজিক দক্ষতা ও তাঁর অত্যন্ত শক্তিশালী দূরদৃষ্টি- এ সবকিছুই এটাই তুলে ধরে যে, কীভাবে একজন মুসলিম নারী তাঁর যৌবনকালেই সমুন্নত আত্মিক ও আধ্যাত্মিক অবস্থানে উন্নীত হতে পারেন।’
বস্তুত এ ধরনের একজন বিরাট ব্যক্তিত্ব অনুসরণীয় আদর্শ থাকা অবস্থায় মুসলিম নারীদের কখনোই নিজেদেরকে দুর্বল বা অসহায় বলে অনুভব করা উচিত নয়; বরং তাঁদের উচিত ইসলাম নারীদেরকে যে উচ্চ মর্যাদা দিয়েছে সে সম্বন্ধে আরো বেশি সচেতনতার অধিকারী হওয়া। এ মহীয়ষী মহিলার জীবন চরিত অধ্যয়ন ও পর্যালোচনা করলে তা আমাদের কাছে এটাই তুলে ধরবে যে, প্রতিটি নারীর জন্যই সমুন্নতির পথ পুরোপুরি উন্মুক্ত রয়েছে।
হযরত ফাতেমা যাহরা এ পথে চলে সমুন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করেছেন এবং এ ক্ষেত্রে তিনি স্বয়ং পথনির্দেশ স্বরূপ- যে পথনির্দেশ অনুসরণ করে যে কোনো নারীর পক্ষেই সমুন্নতির সোপানে অনেক ঊর্ধ্বে আরোহণ করা সম্ভব।
এ বিষয়টি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করে হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন : ‘হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) ও হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর জীবনেতিহাসে হযরত ফাতেমা (সা.আ.) ছিলেন একটি সমুজ্জ্বল আলোক বর্তিকাস্বরূপ। সুতরাং এটাই স্বাভাবিক যে, এ মহান অনুসরণীয় আদর্শের অনুসরণ করে মুসলিম নারীরা উপকৃত হতে পারবেন।’
আর হযরত ফাতেমা যাহরা (সা.আ.)-এর জন্মদিবস ২০শে জমাদিউস সানীকে ‘নারী দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) বলেন : ‘এ দিনটি হচ্ছে প্রকৃত নারীত্বের পুনরুজ্জীবনস্বরূপ এবং নারীরা সমাজে যে গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানজনক ভূমিকা পালন করে থাকে তার ভিত্তি প্রতিষ্ঠার দিন।’
হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) একদল নারীর উদ্দেশে প্রদত্ত তাঁর ভাষণে অন্যত্র বলেন : ‘আপনারা যদি আত্মিক-আধ্যাত্মিক উন্নতি, নেক আমল, পূত চরিত্র ও অন্যান্য মূল্যবোধ সম্বন্ধে অধ্যয়ন না করে থাকেন তাহলে আপনারা এমনকি নারীত্বের প্রকৃত তাৎপর্যই অনুধাবন করতে পারেন নি।’
এ প্রসঙ্গে হযরত ফাতেমা যাহরা ‘ইল্মী ব্যক্তিত্বের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তাঁর ‘ইল্মী ব্যক্তিত্ব ছিল অত্যন্ত উঁচু স্তরের- যা বন্ধু ও দুশমন নির্বিশেষে সকলেই স্বীকার করে থাকেন। বস্তুত লোকেরা বিভিন্ন কঠিন ও জটিল বিষয়ের ব্যাখ্যা বা এতদসংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য যখন তাঁর কাছে যেত তখন তিনি তাদের সেসব বিষয়ের ব্যাখ্যা ও প্রশ্নের জবাব দিতেন। তাঁর ভাষণ, কবিতা সমূহ ও বাণী সমূহ বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা, চরিত্রের দৃঢ়তা ও মনের উদারতার সাক্ষ্য বহন করে। তিনি ছিলেন একজন নারীর পক্ষে অর্জনীয় সমস্ত উত্তম গুণ-বৈশিষ্ট্যের মূর্ত প্রতীক। তিনি ছিলেন একজন আদর্শ কন্যা, প্রেমময়ী ও সহায়ক স্ত্রী, একজন স্নেহশীলা মাতা এবং সমাজের একজন শক্তিশালিনী ও সচেতন সদস্যা।
এসব নারীসুলভ গুণ-বৈশিষ্ট্যের মূর্ত প্রতীক হওয়া সত্ত্বেও হযরত ফাতেমা যাহরা (সা.আ.) একজন সাহসী নারীও ছিলেন যিনি তিরিশটি যুদ্ধে হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর সাথে ছিলেন। তেমনি তিনি তাঁর নিজের অধিকারর সমূহ সম্বন্ধেও সচেতন ছিলেন এবং যখনি প্রয়োজন হয়েছে তিনি যুলুম ও বঞ্চনার অসহায় শিকারের মতো অন্যায়কে সয়ে নেয়ার পরিবর্তে স্বীয় অধিকারের সপক্ষে রুখে দাঁড়িয়েছেন। আর তাঁর এ গুণাবলি তাঁর মহান সন্তান হযরত ইমাম হাসান (আ.), হযরত ইমাম হুসাইন (আ.), হযরত যায়নাব (সা.আ.) ও হযরত উম্মে কুলসুম (সা.আ.)-এর জীবনে প্রতিফলিত হয়েছে- যাঁরা তাঁদের পবিত্রতা, নেক আমল, সাহস ও বদান্যতার জন্য সুপরিচিত ছিলেন।
হযরত ফাতেমা যাহরা (সা.আ.) তাঁর মেধা-প্রতিভা, প্রজ্ঞা, চারিত্রিক দৃঢ়তা, অদম্য ইচ্ছাশক্তি, পবিত্রতা, ধৈর্য, জ্ঞান ও উদারতা-কথায় ও কাজে উভয় ক্ষেত্রেই- স্বীয় মহান পিতা হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন। তাঁর বদান্যতা, মহানুভবতা ও দরিদ্রদের জন্য তাঁর মমতা এতই বেশি ছিল যে, কোনো অসহায় বা ভিক্ষুক কখনোই কিছু না পেয়ে তাঁর গৃহদ্বার থেকে খালি হাতে ফিরে যায় নি।
এতে আমরা দেখতে পাই যে, এ মহীয়ষী মহিলা তাঁর স্বল্পকালীন জীবনে এ বিষয়টি তুলে ধরেছেন যে, কীভাবে একজন নারী অত্যন্ত শক্তিশালীভাবে সমাজ জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করতে পারেন এবং স্বীয় সামাজিক অবদানের সাহায্যে ইতিহাসের গতিধারায় ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করতে পারেন।
আমরা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-এর উক্তি উদ্ধৃত করে এই নিবন্ধের উপসংহার টানতে চাই। তিনি বলেন : ‘আমাদের সকলের জন্যই হযরত ফাতেমা যাহরা (সা.আ.)-এর পদাঙ্ক অনুসরণ করা এবং তাঁর নেক আমল, পূত চরিত্র ও জ্ঞান থেকে শিক্ষা গ্রহণের জন্য চেষ্টা করা অপরিহার্য, বিশেষ করে এ কারণে যে, আল্লাহ্ তা‘আলা জ্ঞানকে কেবল স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তির জন্য অর্জনীয় হিসেবে সীমাবদ্ধ করে দেন নি; বরং সকল জ্ঞান সন্ধানীর জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। তেমনি এ কারণেও যে, যে কোনো ব্যক্তির পক্ষেই নেক আমল ও পূতপবিত্রতার সুউচ্চ স্তর সমূহ অর্জন করা সম্ভব- যা হচ্ছে এমন গুণ-বৈশিষ্ট্য যা কেবল অভিজাত গোষ্ঠীর জন্য সীমাবদ্ধ নয়।’

সূত্র : ইন্টারনেট
ইংরেজি থেকে অনুবাদ ও সম্পাদনা : নূর হোসেন মজিদী

সম্পাদকীয়

হযরত ফাতেমা (সা.আ.)-এর জন্মবার্ষিকী ও বিশ্ব নারী দিবস
২০শে জমাদিউস সানী খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতেমা (সালামুল্লাহি আলাইহা)-এর জন্মবার্ষিকী। এ উপলক্ষে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের পক্ষ থেকে এ দিনটিকে বিশ্ব নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে; ইরানি জনগণ, বিদেশস্থ ইরানি কূটনৈতিক মিশনসমূহ এবং বিশ্বের দেশে দেশে বিভিন্ন ইসলামি সংস্থা-সংগঠন এ দিনটিকে যথাযথ দ্বীনী মার্যাদা সহকারে উদযাপন করছে।
যে কোনো আদর্শের জন্যই কেবল তাত্ত্বিক ভিত্তি, নৈতিক শিক্ষা ও বিধি-বিধানই যথেষ্ট নয়; বরং তার অনুসরণযোগ্যতার মূর্ত প্রতীক অপরিহার্য। একমাত্র পূর্ণাঙ্গ ও অবিকৃত আদর্শ ইসলামের মূর্ত প্রতীক রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.)। আর নারীদের জন্য এ আদর্শের মূর্ত প্রতীক হলেন তাঁর কন্যা বেহেশতে নারীকুলনেত্রী হযরত ফাতেমা (সা. আ.)। আর এ ব্যাপারে বিতর্কের অবকাশ নেই যে, তাঁরই জন্মদিন বিশ্ব নারী দিবস হিসেবে উদযাপিত হবার জন্য সর্বাধিক উপযোগী।
আমরা হযরত ফাতেমা (সা.আ.)-এর জন্মবার্ষিকী ও বিশ্ব নারী দিবস উপলক্ষে সমগ্র বিশ্ববাসীকে, বিশেষত মুসলিম উম্মাহ্কে এবং আরো বিশেষভাবে নিউজলেটারের পাঠক-পাঠিকাদেরকে মোবারকবাদ জানাচ্ছি।

ইরানের ইসলামি প্রজাতন্ত্র দিবস
পয়লা এপ্রিল ইরানের ইসলামি প্রজাতন্ত্র দিবস।
ইরানি জনগণের অবিসংবাদিত নেতা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-এর নেতৃত্বে ১৯৭৯ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি ইসলামি বিপ্লবের বিজয় এবং স্বৈরাচারী রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতন ঘটে। এরপর ইরানের ভবিষ্যৎ শাসনব্যবস্থা কেমন হবে তা নির্ধারণের লক্ষ্যে হযরত ইমামের (রহ্.) নির্দেশে ৩০ ও ৩১শে মার্চ গণভোট অনুষ্ঠিত হয় এবং ইরানের জনগণ তাদের বিপ্লবকালীন স্লোগান ‘এস্তেক্বলাল, আযাদী, জোম্হুরিয়ে এস্লামি’ (স্বাধীনতা, মুক্তি, ইসলামি প্রজাতন্ত্র) সহকারে এতে অংশগ্রহণ করে এবং শতকরা ৯৮ দশমিক ২ ভাগ ভোটার দেশকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র করার সপক্ষে রায় প্রদান করে। এর ভিত্তিতে পয়লা এপ্রিল গণভোটের রায় ঘোষণার দিনেই হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) ইরানকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করেন। তখন থেকে প্রতি বছর ইরানি জনগণ বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা সহকারে এ দিনটি উদ্যাপন করে আসছে।
আমরা ইরানের ৩৮তম ইসলামি প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে নিউজলেটারের পাঠক-পাঠিকাসহ ইরান ও বাংলাদেশের জনগণকে মোবারকবাদ জানাচ্ছি।

নওরোয ও বাংলা নববর্ষ : জাগরণের উৎসব
২১শে মার্চ ইরানি বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী বছরের প্রথম দিন পয়লা র্ফার্ভাদীন- যা একই সাথে প্রকৃতিতে নতুন প্রাণ সঞ্চারকারী বসন্তের প্রথম দিন। এ দিনটি নওরোয নামে সারা বিশ্বে পরিচিত। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে ইরানি জনগণ ও মধ্য এশিয়ার দেশসমূহের জনগণ অত্যন্ত ধুমধামের সাথে এদিনে উৎসব পালন করে আসছে। প্রাগৈতিহাসিক কালে এ দিনে জনগণের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তৎকালীন পারস্যে (বর্তমানে যা ইরান) একজন স্বৈারাচারী যালেম বাদশাহকে উৎখাত করে সুবিচারের শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল এবং এ উপলক্ষেই নওরোয উৎসব প্রবর্তিত হয়। আর এ নওরোযেরই তিন সপ্তাহ্ পরে ১৪ই এপ্রিল বাংলা সনের প্রথম দিন- যা নববর্ষ হিসেবে সুপরিচিত- যে দিনটিকে বাংলাদেশের জনগণ অত্যন্ত ধুমধামের সাথে পালন করে থাকে।
নওরোয উৎসব প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে চলে এলেও বর্তমান ইরানি বর্ষপঞ্জি একটি হিজরি সৌরবর্ষের বর্ষপঞ্জি। ইরানি জনগণ নওরোযের সূচনায় কোরআন তেলাওয়াত করে ও বর্ষবরণের বিশেষ দোআ পাঠসহ দু’হাত তুলে মহান আল্লাহর কাছে নিজেদের, জাতির ও বিশ্বমানবের জন্য একটি সুন্দর এবং সুস্থতা ও সমৃদ্ধিপূর্ণ নতুন বছর কামনা করে। এভাবে নওরোয উৎসব ইরানি সমাজের জন্য নৈতিক ও সামগ্রিক শিক্ষার সহায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন করছে।
একইভাবে বাংলা বর্ষপঞ্জি ইরানি বর্ষপঞ্জির ন্যায় একটি হিজরি সৌর বর্ষপঞ্জি।
ফসল তোলা সমাপ্ত হওয়ার পর পরই নতুন বছরের শুরু হিসেবে এক সময় বাংলা সনকে ফসলি সনও বলা হতো। খাজনা আদায় ছাড়াও এ সময় ব্যবসায়ীরা তাদের গ্রাহকদের কাছ থেকে বকেয়া পাওনা আদায় করতো এবং উৎসবের মধ্য দিয়ে নতুন বছর শুরু করতো। এভাবে বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম দিন- বাংলা নববর্ষ একটি উৎসবের দিনে পরিণত হয় এবং সেই শুরু থেকেই মিলাদ-অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতাসহ এ দিনটি উৎসব হিসেবে পালন করা হয়ে আসছে।
ইরানি নওরোয ও বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে আমরা নিউজলেটারের পাঠক-পাঠিকাসহ সবাইকে জানাচ্ছি আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
এছাড়া ২৬শে মার্চ বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আমরা বাংলাদেশের গণমানুষের কল্যাণ, সমৃদ্ধি ও সুস্বাস্থ্য এবং উন্নততর ভবিষ্যৎ কামনা করছি।

স্মরণীয় বাণী

মহানবী (সা.) বলেন : চারটি জিনিস রয়েছে যা আমার প্রত্যেক হৃদয়বান বুদ্ধিমান উম্মতের জন্য আবশ্যক। আরজ করা হলো : হে রাসূলুল্লাহ্! সেগুলো কী কী? তিনি বললেন : জ্ঞান শ্রবণ করা, তা রক্ষা করা, তা প্রচার করা এবং তা মেনে চলা।

মহানবী (সা.) বলেন : আমি আমার উম্মতের ওপর তিনটি জিনিসের কারণে উদ্বিগ্ন : কার্পণ্যের অতিরিক্ত প্রবণতা, রিপুর কামনার অনুসরণ আর পথভ্রষ্ট নেতা।

মহানবী (সা.) বলেন : কল্যাণের চেয়ে কল্যাণকারী হলো উত্তম আর মন্দের চেয়েও মন্দকারী ব্যক্তি নিকৃষ্টতর।

মহানবী (সা.) বলেন : প্রাচুর্য অধিক ধন-সম্পদের অধিকারী হওয়ার মধ্যে নয়; বরং প্রাচুর্য হলো মনের অমুখাপেক্ষিতার মধ্যে।

মহানবী (সা.) বলেন : ভালো কাজসমূহ মন্দ মৃত্যু থেকে রক্ষা করে আর গোপনে দান আল্লাহর ক্রোধকে প্রশমিত করে। আর আত্মীয়তার সম্পর্ককে জোড়া লাগানো আয়ু বাড়িয়ে দেয়। আর প্রত্যেক সদাচারই হলো সাদাকাহ্। আর দুনিয়ার সদাচারী জন পরকালে সদাচার লাভের যোগ্য। আর দুনিয়ার মন্দকারীরা পরকালে মন্দ লাভ করার যোগ্য। আর সদাচারীরাই সর্বপ্রথম বেহেশতে প্রবেশ করবে।

ইমাম আলী (আ.) বলেন : মৃত্যুর নির্দিষ্ট সময়ক্ষণই হলো সর্বোৎকৃষ্ট দুর্গ। কেননা, প্রত্যেকেরই সঙ্গে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রহরীরা রয়েছে যারা তাকে প্রহরা দেয় পাছে কোনো কুয়ায় পতিত হয় কিংবা কোনো দেয়াল তার মাথায় ধসে পড়ে কিংবা কোনো বন্য পশু তার ক্ষতি করে। কিন্তু যখন তার মৃত্যুক্ষণ উপস্থিত হয় তখন তাকে তার মৃত্যুর সামনে ছেড়ে দেয়।

ইমাম আলী (আ.) বলেন : যে ব্যক্তি চারটি জিনিস থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারে তার কোনো মন্দ না হওয়াই সমীচীন। বলা হলো : হে আমীরুল মুমিনীন! সে চারটি জিনিস কী কী? ইমাম বললেন : তড়িঘড়ি, একগুঁয়েমি, স্বার্থপরতা, অলসতা।

ইমাম আলী (আ.) বলেন : যে ব্যক্তি দুনিয়ায় সংযমশীল হয় সে দুনিয়ার লাঞ্ছনা থেকে বিচলিত হয় না। আর যে ব্যক্তি দুনিয়ার সম্মান লাভের জন্য প্রতিযোগিতা করে না, আল্লাহর সৃষ্টির পথপ্রদর্শন (এর প্রতি নির্ভরতা) ব্যতীতই তাকে পথপ্রদর্শন করে থাকেন। আর তাকে শিক্ষা গ্রহণ ব্যতীতই জ্ঞান দান করেন এবং প্রজ্ঞাকে তার বক্ষে স্থির করে দেন আর তার জিহ্বায় প্রবাহিত করেন।

ইমাম আলী (আ.) বলেন : যেহেতু সবকিছুই জুড়ি বাঁধলো, কাজেই অলসতা আর অক্ষমতাও জুড়ি বাঁধলো এবং দরিদ্রতা তাদের থেকে জন্ম নিল।

ইমাম হাসান (আ.) বলেন : জীবিকার জন্য বিজয়ের উদ্দেশ্যে চেষ্টারত ব্যক্তির মতো তৎপর হয়ো না। আবার আত্মসমর্পিতের মতো তাকদীরের ওপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত বসে থেক না। নিশ্চয় রুজির আধিক্য চাওয়া সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত। আর রুজি চাওয়ার ব্যাপারে মধ্যপন্থা অবলম্বন সততার অঙ্গ। আর সততা রুজির প্রতিবন্ধক নয়। আর লোভ আধিক্য আনে না। রুজি হলো বণ্টনকৃত। আর লোভ পাপ আনে।

ইমাম হাসান (আ.) বলেন : … যখন আল্লাহ্ তোমাদের (কাউকে) পুত্র দান করেন আর তাকে অভিনন্দন জানাবার জন্য তোমরা যাবে তখন (তাকে) বলবে : এর দানকারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কর এবং তোমাকে যা দান করা হয়েছে তা মোবারক হোক। আল্লাহ্ তাকে যুবকে পরিণত করুন এবং তাকে ভালোভাবে গড়ে তোলার তৌফিক তোমাকে দিন।

ইমাম আলী ইবনুল হোসাইন যায়নুল আবেদীন (আ.) বলেন : মানুষের কাছে প্রয়োজনের কথা বলা লাঞ্ছনা আনে এবং লজ্জাকে কেড়ে নেয় আর ব্যক্তিত্বের হানি ঘটায়। এটাই প্রকৃত দারিদ্র্য। আর মানুষের কাছে কম চাওয়াই হলো প্রকৃত অভাবমুক্ততা।

ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) বলেন : পাঁচটি বাক্য রয়েছে যদি সেগুলোর পেছনে ধাবিত হও এবং এজন্য তোমার বাহনকে শীর্ণ কর তাহলে এমন কিছু অর্জন করবে যার কোনো তুলনা নেই। কোনো বান্দা নিজের গোনাহ ছাড়া আর কিছুরই ভয় করবে না, আর স্বীয় প্রতিপালক ভিন্ন আর কারো ওপর ভরসা করবে না, অজ্ঞ ব্যক্তি যখন তাকে এমন কিছু জিজ্ঞেস করে যা সে জানে না, তা শিখে নিতে লজ্জাবোধ করে না, আর ঈমানের সাথে ধৈর্যের তেমনই সম্পর্ক, দেহের সাথে মাথার যেমন। যার ধৈর্য নেই তার ঈমান নেই।

(তুহাফুল উকূল থেকে সংকলিত)
অনুবাদ : আব্দুল কুদ্দুস বাদশা

স্মরণীয় দিবস

১ জানুয়ারি : ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) ১৯৮৯ সালের এ দিনে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভের কাছে এক ঐতিহাসিক চিঠি প্রদান করেন।

৭ জানুয়ারি : আহলে বাইতের ১১তম ইমাম হাসান আসকারী (আ.)-এর পবিত্র জন্ম দিবস।

৯ জানুয়ারি : * হযরত মাসুমাহ সালামুল্লাহ আলাইহার ওফাত বার্ষিকী।
* মীর্যা তাকী খান আমীর কাবীর এর শাহাদাত বার্ষিকী।

১১ জানুয়ারি : ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর নির্দেশে ইসলামি বিপ্লবী পরিষদ গঠন দিবস এর বার্ষিকী।

১৬ জানুয়ারি : ১৯৭৯ সালের এ দিনে ইরান থেকে রেজা শাহ পাহলভী পলায়ন করেন।
* নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহর ৯২তম মৃত্যুবার্ষিকী।

২৬ জানুয়ারি : বাংলা ভাষার সনেট কাব্যের জনক ও ‘মেঘনাদবধ’ মহাকাব্যের রচয়িতা মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মবার্ষিকী।

২৯ জানুয়ারি : আততায়ীর গুলিতে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা মহাত্মা গান্ধী নিহত হন।

৩১ জানুয়ারি : দীর্ঘ ১৫ বছর নির্বাসনে থাকার পর ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের প্রাক্কালে এ দিনে বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেইনী স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন।

০২ ফেব্রুয়ারি : ইরানে মহাকাশ প্রযুক্তি দিবস হিসেবে পালিত হয়।

০৩ ফেব্রুয়ারি : হযরত ফাতেমা ও আলী (আ.)-এর কন্যা হযরত যায়নাব সালামুল্লাহ আলাইহার জন্মবার্ষিকী।

০৭ ফেব্রুয়ারি : ইরানে বিমান বাহিনী দিবস।

১১ ফেব্রুয়ারি : * নবীকন্যা হযরত ফাতেমা (আ.)-এর শাহাদাত বার্ষিকী (একটি রেওয়ায়াত অনুযায়ী)
* ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিপ্লবের বিজয়বার্ষিকী। ইরানে আড়াই হাজার বছরের রাজতন্ত্রের পতন।

১৪ ফেব্রুয়ারি : মহানবী (সা.), অন্যান্য নবী (আ.) এবং পবিত্র ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কে অবমাননাকর উক্তি করার দায়ে ১৯৮৯ সালের এ দিনে ইমাম খোমেইনী সালমান রুশদীর মৃত্যুদ-ের ফতোয়া প্রদান করেন।

২১ ফেব্রুয়ারি : আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ১৯৫২ সালের এ দিনে বাংলা ভাষা আন্দোলনে শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিক, জাব্বার, শফিকসহ বেশ কয়েকজন বাঙালি তরুণ।

২৩ ফেব্রুয়ারি : খাজা নাসিরউদ্দিন তূসী স্মরণে দিবস। এটি ইরানে প্রকৌশল দিবস হিসেবেও উদ্যাপিত হয়।

বই পরিচিতি

শিশু কিশোর রচনা সমগ্র
রচনা : কবি মনিরউদ্দীন ইউসুফ
প্রকাশক : আবদুল মালেক
নবরাগ প্রকাশনী
৩৫ বাংলাবাজার, ঢাকা-১০০০
প্রচ্ছদ : মামুন কায়সার
প্রকাশকাল : একুশে বইমেলা ২০১৫
মুদ্রণ : জননী প্রিন্টার্স. ১৯ প্রতাপ দাস লেন, ঢাকা-১১০০
মূল্য : ৪০০ টাকা

বাংলা সাহিত্যে কবি মনিরউদ্দীন ইউসুফের নাম স্বমহিমায় ও উজ্জ্বল হরফে লিপিবদ্ধ রয়েছে। তিনি বাংলা ভাষায় এক অসামান্য কাজ করেছেন যা যুগ যুগ ধরে বাংলাভাষী মানুষের কাছে অটুট থাকবে এবং যা পাঠক ও সাহিত্য গবেষকদের কাছে অম্লান টিকে থাকবে। সেটি হচ্ছে বাংলা ভাষায় ফারসি সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ মহাকবি ফেরদৌসী রচিত অমর মহাকাব্য ‘শাহানামা’র বঙ্গানুবাদ। সতের বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম ও ধৈর্যের ফসল ছিল কবির এই অনুবাদকর্ম। আর মূল ‘শাহনামা’ রচনা করতে ফেরদৌসীর সময় লেগেছিল ত্রিশ বছর।
কবি মনিরউদ্দীন ইউসুফের আলোচ্য গ্রন্থ ‘শিশু কিশোর রচনা সমগ্র’ কবির চারটি শিশুকিশোর গ্রন্থ ও কয়েকটি লেখা নিয়ে সংকলিত হয়েছে। বইগুলো হচ্ছে ‘ছোটদের ইসলাম পরিচয়’, ‘মহাকবি ফেরদৌসী’, ‘ছোটদের রসুল চরিত’, ‘চলো যাই ছড়ার দেশে’। এছাড়া রয়েছে একগুচ্ছ ছড়া যা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। রয়েছে ‘শৈশব কৈশোরের স্মৃতি’, ছাত্রজীবনের ময়মনসিংহের স্মৃতি ও কারবালার কথা।
‘ছোটদের ইসলাম পরিচয়’ বইটিতে রয়েছে ইসলামের প্রাথমিক জ্ঞানসমূহ যা শিশু-কিশোরদের জন্য সহজ ভাষায় রচিত হয়েছে। যে বইটি প্রথম প্রকাশ করেছিল স্টুডেন্ট ওয়েজ ১৩৯৩ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ মাসে। ‘ছোটদের রাসুল চরিত’ কিশোর উপযোগী করে লেখা হয়েছে মহানবী (সা.)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী। এ বইটিও স্টুডেন্ট ওয়েজ বের করেছিল ১৪০৮ বাংলা সনে। মহাকবি ফেরদৌসী গ্রন্থটিতে ‘শাহানামা’র লেখক ইরানের জাতীয় কবি ফেরদৌসীর জীবনীসহ ‘শাহনামা’র কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার সহজ বর্ণনা রয়েছে। এ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ থেকে ১৯৮৮ সনের জুলাই মাসে। ‘চলো যাই ছড়ার দেশে’ নামের শিশুতোষ ছড়ার বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০২ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ শিশু একাডেমী থেকে। তাঁর ছড়াগুলোতে রয়েছে গাছগাছালি, পাখ-পাখালি ও সবুজ পরিবেশের ছোঁয়া। প্রকাশিত অন্যান্য ছড়াতেও রয়েছে শিশুতোষ নানা বিষয়।
বইটি সংগ্রহে রাখলে কবির শিশুতোষ লেখাগুলো সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ ধারণা লাভ করা যাবে।
উল্লেখ্য, কিশোরগঞ্জ জেলার বৌলাইবাড়িতে ১৯১৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি এই মহান কবি জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
□ আমিন আল আসাদ

বাংলা ভাষায় ফারসি শব্দের ব্যবহার

বাংলা রূপ   ফারসি রূপ   আধুনিক ফারসি উচ্চারণ

দোতরফা دو طرفه দো-তারাফে
দৌলত (সম্পদ) دولت দৌলাত্
দেরী دير দী-র
ডেগ ديگ দীগ্
ডেগ (ক) চি ديگچه দীগ-চে
দেও (দৈত্য) ديو দীউভ্
দিওয়ানি (যেমন : দেওয়ানি আদালত) ديوانه দী-ভনে
যিল্লত (অপমান) ذلَّت যেল্লাত্
যিম্মা ذمّه যেম্মে
যিম্মাদার ذمّه دار যেম্মে-দর
যিম্মী ذمّى যেম্মি
রোশনি (উজ্বল) روشنى রৌশানী
জানু زانو য-নু
যবান زبان যা-বন
যবানবন্দি زبان بندى যা-বন বান্দী
যবরদস্ত زبردست যেবার দাস্ত্
যবরদস্তি زبردستى যেবার দাস্তী
যখম زخم যাখ্ম্
যিরাফ زرافه র্যারফেহ্
জাফরানি زعفرانى যা-ফে-রনী
জুলফি زلف যোল্ফ্
যমানা زمانه যা-মনেহ্
আবে জমজম آب زمزم অ-বে যাম্যাম্
যমীন زمين যামীন
জমিদার زمين دار যামীন-র্দ
জিঞ্জির زنجير যাঞ্জীর
যিন্দান زندان যেন্দন্
জিন্দা زنده যেন্দেহ্
জিন্দাবাদ زنده باد যেন্দে-বদ