All posts by pavel

ইরানি প্রবাদ

زهره اش آب شدن
উচ্চারণ : যাহরে আশ আ’ব শোদান
অর্থ : কারো বুকের পাটা পানি হয়ে যাওয়া
মর্মার্থ : কোন ভয়ানক জিনিস বা সহিংসতা দেখে প্রচ- ভয় পাওয়া বা ঘাবড়ে যাওয়া।
زهر ترک شدن.
উচ্চারণ : যাহরে তারাক শোদান
অর্থ : বুকের পাটায় ফাটল ধরা।
মর্মার্থ : ভয়ে মারা যাওয়ার উপক্রম হওয়া, ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়া।
زهوارش در رفتن.
উচ্চারণ : যাহওয়ারেশ দার রাফতান
অর্থ : কারো ঝালোর হারিয়ে যাওয়া।
মর্মার্থ : অলসতা ও বার্ধক্যের শিকার হওয়া।
زیاده روی کردن.
উচ্চারণ : যিয়া’দে রওয়ী কার্দান
অর্থ : বাড়াবাড়ি করা।
মর্মার্থ : যে কোন কাজে বাড়াবাড়ি করা, অতিরিক্ত খেয়ে উদরপূর্তি করা।
زیر آب کسی را زدن.
উচ্চারণ : যীরে আ’ব কেসী রা’ যাদান
অর্থ : পানির নিচে কাউকে মারা।
মর্মার্থ : কারো কজের পরিবেশ নষ্ট করে দেয়া, কারো বদনাম করে বা গালমন্দ করে মানুষের কাছে মর্যাদাহানি করা।
زیر بار کسی نرفتن.
উচ্চারণ : যীরে বা’রে কেসী না রাফতান
অর্থ : কারো ভারের কাছে না যাওয়া।
মর্মার্থ : কারো চাপিয়ে দেয়া কিছুর কাছে মাথা নত না করা, কারো ইচ্ছার কাছে বশীভূত না হওয়া।
زیر بال کسی را گرفتن.
উচ্চারণ : যীরে বা’লে কেসী রা’ গেরেফতন
অর্থ : কারো ডানার পেছনে ধরা
মর্মার্থ : কারো উন্নতি-অগ্রগতির কারণ হওয়া, কাউকে সাহায্য-সহযোগিতা করা।
زیر بغل کسی هندوانه گذاشتن.
উচ্চারণ : যীরে বগলে কেসী হেন্দেভা’নে গোযা’শতান
অর্থ : কারো বগলের নিচে তরমুজ রেখে দেয়া।
মর্মার্থ : চাপাবাজি করে কাউকে বড় করে দেখানো, নিজের স্বার্থসিদ্ধি করার জন্য কারো মধ্যে আত্ম অহংকার জাগিয়ে দেয়া।
زیر پا کشیدن از کسی.
উচ্চারণ : যীরে পা’ কাশীদান আয কেসী
অর্থ: কারো কাছ থেকে পায়ের নিচে নিয়ে আসা।
মর্মার্থ : প্রতারণা ও কৌশল করে কারো মুখ থেকে কোন কথা বের করে আনা।
زیر پای کسی پوست خربزه گذاشتن.
উচ্চারণ : যীরে পা’য়ে কেসী পুস্তে খরবুযে গোযা’শতান
অর্থ : কারো পায়ের নিচে খরবুজার খোসা রেখে দেয়া।
মর্মার্থ : কারো জন্য মাথাব্যথার কারণ সৃষ্টি করা, কাউকে দিশেহারা করে দেয়া।

অনুবাদ : আবু আব্দুল্লাহ

সংবাদ বিচিত্রা (বিদেশী সংবাদ)

কোরআনের শক্তির কাছে অপশক্তিগুলো অচল : সর্বোচ্চ নেতা
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেছেন, কোরআনের শিক্ষাগুলো মানবজাতির কাছে তুলে ধরা হলে ও তা বাস্তবায়ন করা হলে ইহুদিবাদী ইসরাইলসহ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর অস্ত্র ও শক্তি মুসলমানদের কোনো ক্ষতিই করতে পারবে না।
তিনি গত ৭ জুন ২০১৬ পবিত্র রমযানের প্রথম দিনে পবিত্র কোরআনের-অনুরাগ মাহফিলে এই মন্তব্য করেন। পবিত্র কোরআনের ভাষা ও শব্দের সৌন্দর্য এক অলৌকিক বিষয় এবং এর মধ্য দিয়ে এ মহাগ্রন্থের উচ্চতর ও সারগর্ভ নানা বার্তার দিকে আকৃষ্ট হওয়া যায় বলে তিনি উল্লেখ করেন।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেন, পবিত্র কোরআনের অর্থ বা বার্তার সঙ্গে পরিচয়ের অন্যতম কল্যাণ ও বরকত হলো আত্মিক এবং ধর্মীয় প্রশান্তি লাভ। আর এই প্রশান্তি মহান আল্লাহ ও খোদায়ী শক্তির প্রতি মানুষের ঈমান বাড়ানোর পরিবেশ গড়ে তোলে।
হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেন, নানা সংকট, দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও জটিলতায় ভরপুর বর্তমান বিশ্বে কোরআনের অর্থ ও শিক্ষা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।
তিনি আরও বলেন, কোরআনের উচ্চতর বা গভীর অর্থ যদি সহজ ভাষায় মানুষের কাছে তুলে ধরা হয় তাহলে তা মানুষের ওপর খুব বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে এবং এর মাধ্যমে মানবজাতির প্রকৃত উন্নতির পথ খুলে যাবে। কারণ, সম্মান, শক্তি, বস্তুগত কল্যাণ, আধ্যাত্মিক উন্নতি, চিন্তা ও বিশ্বাসের বিকাশ, আত্মিক আনন্দ ও প্রশান্তি পবিত্র কোরআনের বাণী বাস্তবায়নের ওপরই নির্ভরশীল।
তিনি ইরানে কোরআন বিষয়ক কার্যক্রম, বিশেষ করে ইরানি যুব সমাজের মধ্যে কোরআন চর্চা বিস্তারে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, যদিও পবিত্র কোরআনের ভাষা ও শব্দের সৌন্দর্য এক অলৌকিক বিষয়, কিন্তু এর লক্ষ্য হলো এই মহাগ্রন্থের উচ্চতর ও সারগর্ভ নানা বার্তা এবং কল্যাণে ভরপুর জগতে প্রবেশের পথ খুলে দেয়া।
বর্তমান বিশ্বে চিন্তা, বিশ্বাস ও পরিচিতির সংকটের দিকে ইঙ্গিত করে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেন, বর্তমান যুগেও মানবজাতি কোরআনের শিক্ষার মুখাপেক্ষী, তাই ঈমানের ভিত্তিগুলোকে আরও মজবুত করতে হবে এবং কোরআনের শিক্ষা মানুষের কাছে যথাযথভাবে তুলে ধরার কৌশল আয়ত্ত করে এইসব শিক্ষা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। আর তা সম্ভব হলেই বিশ্বের ওপর কোরআনের প্রকৃত প্রভাব পড়বে এবং এ অবস্থায় নানা পরাশক্তি আর ইহুদিবাদী ইসরাইলের নানা অস্ত্র ও শক্তি মানুষের কোনো ক্ষতিই করতে পারবে না।

তেহরানে ৩৩তম আর্ন্তজাতিক কোরআন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত
ইরানের আওকাফ ও জনকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ‘এক গ্রন্থ, এক উম্মাহ্’ শিরোনামে গত ১১ মে থেকে ১৭ মে ২০১৬ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় কোরআন প্রতিযোগিতা।
তেহরানে অনুষ্ঠিত ৩৩তম আন্তর্জাতিক এ কোরআন প্রতিযোগিতায় কিরাত বিশ্বের ৭৫টি দেশের ১৩০ জন প্রতিযোগী অংশ নেন।
কিরাত বিভাগে প্রথম হন ইরানের হামেদ ওয়ালিজাদেহ। দ্বিতীয় হন আফগানিস্তানের মোহাম্মাদ জাভিদ আকবারি এবং তৃতীয় হয়েছেন ইন্দোনেশিয়ার বাহর আদ দিন সায়িদ। জার্মানির সাইয়্যেদ আব্বাস আলী ও নেদারল্যান্ডের মুস্তাফা আলী যথাক্রমে চতুর্থ ও পঞ্চম হয়েছেন।
আর হিফ্য বিভাগে প্রথম হন ইরানের মুজতাবা ফারদেফানি, মিশরের আবদুল আজিজ আহমেদ দ্বিতীয় ও অস্ট্রেলিয়ার মুহাম্মাদ আলী আবদুল্লাহ তৃতীয় এবং আইভরিকোস্টের খালিদ সানকারাই ও নাইজারের মুহাম্মাদ তাহা হাসান যথাক্রমে চতুর্থ ও পঞ্চম হওয়ার গৌরব অর্জন করেন।
এদিকে ইরানে এই প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয়েছে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের নিয়ে আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতা। এতে প্রথম হয়েছেন ইরানের প্রতিযোগী আবদুল গাফুর জওহারচি। আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় হওয়ার গৌরব অর্জন করেন যথাক্রমে তুরস্ক (আহমাদ সারিকায়া) ও তিউনিসিয়ার প্রতিযোগী। এ বিভাগে মোট ১৬ জন প্রতিযোগী অংশ নেন। ইরানই বিশ্বে প্রথমবারের মতো দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের নিয়ে আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতার আয়োজন করল। বাংলাদেশের ১৮ বছর বয়স্ক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হাফেয তানভীর হোসাইনও এ প্রতিযোগিতায় অংশ নেন।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ থেকে কিরাত ও হিফ্য বিভাগে অংশগ্রহণ করেন যথাক্রমে ক্বারী মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও হাফেয মোঃ শরীফ আল আমিন সিদ্দিকী।

১৮ বছরের চেষ্টায় ইরানে তৈরি হলো সবচেয়ে অলঙ্কৃত ও সুসজ্জিত কোরআন
ইরানের একদল শিল্পী দীর্ঘ ১৮ বছরের চেষ্টায় পবিত্র কোরআনের সবচেয়ে সুসজ্জিত ও অলঙ্কৃত একটি সংকলনের কাজ শেষ করেছেন। এ সংকলনটি তৈরির কাজে ব্যয় হয়েছে ইরানি মুদ্রায় ৬০ বিলিয়ন রিয়াল (সাড়ে ১৩ কোটি টাকা)।
ইসফাহানের জানফাজা পরিবার এককভাবে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছে। ওই পরিবারের বড় পুত্র মেহেদি জানফাজা এ প্রকল্পের ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করেন। মেহেদি জানফাজা তাঁর বাবার ইচ্ছা অনুযায়ী এই মহৎ কাজটি স¤পন্ন করেছেন বলে খবর দিয়েছে ইরানের ইংরেজি দৈনিক তেহরান টাইম্স।
ইরানের খ্যাতিমান খোদাই শিল্পী রেজা কাদেরান ও মোহাম্মদ আলী সায়েই, আলোকচিত্রী মাজিদ সাদেকযাদেহ এবং ক্যালিগ্রাফার গোলামরেজা মাহুরিসহ বিখ্যাত শিল্পীরা গত ১৮ বছর ধরে কোরআনটির সংকলনে নিজেদের মেধা ও দক্ষতা ব্যয় করেছেন। কোরআনটির সংকলনে হাতে তৈরি সোনালি কাগজ ব্যবহার করা হয়েছে। এতে ব্যবহার করা হয়েছে ১৪শ’ মণিমুক্তা। দৈর্ঘ্যে ৫৭ সেন্টিমিটার এবং প্রস্থে ৪২ সেন্টিমিটার আকারের এ পবিত্র কোরআনের পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৭৫টি। যার প্রতিটি পৃষ্ঠা আলাদাভাবে সুসজ্জিত ও অনন্য নকশায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে।
১৩ থেকে ২৮ জুন তেহরানে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক পবিত্র কোরআন প্রদর্শনীতে এ কোরআন শরীফটি প্রদর্শিত হয়। এ কোরআনটি বিক্রি করে যে অর্থ পাওয়া যাবে তা দিয়ে একটি এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করা হবে বলে জানিয়েছে জানফাজা পরিবার।

একজন ইমাম ও বিপ্লবী নেতাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ
গত ৩ জুন ২০১৬ পালিত হয়েছে মহান সংস্কারক ও হাজার বছরের সেরা বিপ্লবের রূপকার ইমাম খোমেইনী (র.)-এর ইন্তেকালের ২৭তম বার্ষিকী। এ উপলক্ষে অন্তত দশ লাখ ইরানি তেহরানের অদূরে ইমামের মাযার প্রাঙ্গণে সমবেত হন। তাঁদের অনেকেই আসেন দূরদূরান্তের নানা প্রদেশ ও জেলা থেকে। ইরানের শীর্ষস্থানীয় রাষ্ট্রীয় নেতৃবৃন্দ, ধর্মীয় নেতা ও সামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত হন তাঁর মাযার প্রাঙ্গণে। এ সমাবেশে যোগ দেন নানা দেশের অনেক চিন্তাবিদ, আলেম ও সমাজকর্মী এবং তেহরানস্থ বিদেশি কূটনীতিকরা।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী ইমাম খোমেইনীর মাযার-প্রাঙ্গণে আয়োজিত এ বিশাল জন-সমাবেশে বলেন, ইমাম খোমেইনী (র) খোদায়ী লক্ষ্য এবং জনগণের প্রতি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। মহান ইমাম ইরানের জনগণকে নানা ধরনের কঠিন সংকটের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করেছেন ও তাদেরকে আল্লাহর ধর্মের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পথে পরিচালিত করেছেন।
তিনি আরও বলেন, ইমাম খোমেইনীর ইন্তেকালের পর ইরানিরা যেসব ক্ষেত্রে বিপ্লবী ভূমিকা রেখেছে সেইসব ক্ষেত্রেই অগ্রগতি হয়েছে। আর যেসব ক্ষেত্রে বিপ্লবী ও জিহাদি ভূমিকায় শৈথিল্য দেখিয়েছে সেসব ক্ষেত্রে তারা পিছিয়ে গেছে।
আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী সতর্ক করে দিয়ে বলেন, স্বাধীনতা হারানো বলতে কেবল এটা বোঝায় না যে, বাইরের কোনো সরকার ইরানকে শাসন করছে; ইসলামি ইরান যদি নতজানু হয় এবং শত্রুদের খেলার শরিক হয় তাহলে আর রাজনৈতিক স্বাধীনতা থাকে না।
এর আগে গত ২ জুন রাতে ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি ইমাম খোমেইনী (র.)-এর মাযার প্রাঙ্গণে দেয়া ভাষণে ইসলামি বিপ্লব, ইসলামি জনশাসনব্যবস্থা ও সর্বোচ্চ ধর্মীয় আইনবিদের নেতৃত্ব তথা বেলায়াতে ফকিহ ব্যবস্থাকে এই মহান ইমামের তিনটি বড় অবদান বলে মন্তব্য করেন।
ইমাম খোমেইনীর ইসলামি জনশাসনব্যবস্থা বিশ্বের সব দেশ ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর জন্য সফল আদর্শ বা মডেল হতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
মরহুম ইমাম খোমেইনীর নাতি সাইয়্যেদ হাসান খোমেইনীও ওই মহাসমাবেশে বলেন, ইমাম খোমেইনীর ইসলামি বিপ্লব সম্মান, ভালোবাসা ও ঐক্য উপহার দিয়েছে।
অন্য এক সমাবেশে ইরানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আলী আকবর বেলায়েতি বলেন, ইমাম খোমেইনী (র.) ছিলেন একাধারে আলেম, ফকীহ, দার্শনিক ও আরেফ। সর্বোচ্চ খোদাভীতি ও খোদা-নির্ভরতার কারণে তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের পরাশক্তিগুলোকে উপেক্ষা করে ইসলামের পতাকা উঁচু করেছেন।
আধুনিক যুগে ইরানের ইসলামি বিপ্লব ও ইসলামি রাষ্ট্র গঠনের প্রভাবে ধর্মের প্রভাব বৃদ্ধিসহ বিশ্বব্যাপী ইসলামি জাগরণ ও ইসলামি মূল্যবোধের পুনরুজ্জীবন ঘটানোর মতো বিষয়গুলো ইমাম খোমেইনী (র.)-এর কাছে চিরঋণী।

ইসলামি বিপ্লব ‘বিশেষ ও অনন্য’ সম্পদ : সর্বোচ্চ নেতা
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী বলেছেন, প্রায় ৩৮ বছর আগে যে চেতনা নিয়ে শত্রুদেরকে দেশ থেকে তাড়ানো হয়েছিল সেই বিপ্লবী চেতনা সমুন্নত রাখতে হবে।
ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা ইমাম খোমেইনী (র.)-এর ২৭তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক সমাবেশে এ আহ্বান জানান আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী। রাজধানী তেহরানের দক্ষিণে অনুষ্ঠিত এ সমাবেশে দশ লাখেরও বেশি মানুষ অংশ নেন। ১৯৭৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ইমাম খোমেইনীর নেতৃত্ব ইরানে ইসলামি বিপ্লব চূড়ান্তভাবে বিজয়ী হয় এবং আড়াই হাজার বছরের রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে।
ইমাম খোমেইনীর নেতৃত্বে সংঘটিত ইসলামি বিপ্লবকে ইরানের জনগণের জন্য ‘বিশেষ ও অনন্য’ স¤পদ হিসেবে উল্লেখ করে আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী বিপ্লবের পথ থেকে যেকোনা রকমের বিচ্যুতির বিরুদ্ধে জাতিকে সতর্ক করেন।
গত বছরের জুলাই মাসে ছয় জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে পরমাণু সমঝোতার পর পশ্চিমা দেশগুলোর আলোচনার প্রস্তাব গ্রহণ করার বিষয়ে সর্বোচ্চ নেতা ইরানের সরকারি কর্মকর্তাদেরকে সতর্ক করেন।
তিনি বলেন, ‘শত্রুরা সবসময় হুমকি-ধমকির ভাষা ব্যবহার করবে তা নয়; বরং কখনো কখনো তারা চিঠি লিখে বা সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাতে পারে। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান যদি তাদের দ্বারা প্রতারিত হয় তাহলে বুঝতে হবে ইরানের সরকার শত্রুদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করে দিচ্ছে।’

ইমাম খোমেইনী (র) ছিলেন ইসলামি আইনের ক্ষেত্রে সৃষ্টিশীল মহান সংস্কারক- কাযেম সিদ্দিকি
ইরানের বিশিষ্ট আলেম ও তেহরানের জুমআ নামাযের অস্থায়ী খতিব হুজ্জাতুল ইসলাম কাযেম সিদ্দিকি ইমাম খোমেইনীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে সবাইকে শোক ও সমবেদনা জানিয়ে বলেন, ইমাম খোমেইনী ছিলেন ফিকাহ বা ইসলামি আইনের ক্ষেত্রে সৃষ্টিশীল এক মহান সংস্কারক ও ইতিহাসনির্মাতা। রাজনীতি হতে ধর্মের পৃথক থাকার দাবিটি যে এক বিপজ্জনক অপবাদ তাও ইমাম খোমেইনী (র.) তুলে ধরেছেন বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি গত ৩ জুন তেহরানের জুমআ নামাযের খুতবায় এইসব মন্তব্য করেন।
হুজ্জাতুল ইসলাম কাযেম সিদ্দিকি বলেন, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেইনী (র) ইসলামের চেহারা থেকে আমেরিকার চাপানো ময়লা ও নানা মহলের কূপম-ূকতা দূর করেছেন।
তিনি আরও বলেন, ইমাম ছিলেন একজন বিজ্ঞ দার্শনিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তিবাদী। তিনি শক্তিশালী, সম্মানজনক, স্বাধীন ও জাগরণকামী এবং যুলুম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামী ইসলামের পুনর্জাগরণ ঘটিয়েছেন।

ইরানের জনগণ ইমামের আদর্শ ও লক্ষ্য বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর : রুহানি
ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি বলেছেন, তাঁর দেশের জনগণ ইমাম খোমেইনী (র.)-এর আদর্শ ও লক্ষ্য বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের স্থপতি ইমাম খোমেইনী (র.)-এর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর মাযারে সমবেত লাখো মানুষের সমাবেশে দেয়া বক্তব্য একথা বলেন রুহানি।
তিনি বলেন, ইরানি জনগণ ইসলামি বিপ্লবে বিশ্বাস করে এবং নিজেদের বিপ্লবী পরিচয়ে গর্বিত। এ ছাড়া, তারা এই বিপ্লব সমুন্নত রেখে একে পূর্ণতায় পৌঁছে দিতে সব ধরনের প্রচেষ্টা চালাবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
প্রেসিডেন্ট রুহানি বলেন, ইমাম খোমেইনী এই বিপ্লবের সহযোগিতায় ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন যা অন্যান্য মুসলিম দেশের জন্য আদর্শ হতে পারে। ইমামের মৃত্যুর পর গত ২৭ বছরে তাঁর প্রতি মানুষের ভালোবাসা ও আনুগত্য দিন দিন বেড়েছে বলে উল্লেখ করে রুহানি বলেন, একটি চরম কঠিন সময়ে ইমাম ইরানে ইসলামি বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সে সময়ে ইরানের শাহ সরকার দেশ থেকে ইসলামের নাম-নিশানা মুছে ফেলতে চেয়েছিল এবং জনগণের দাবির প্রতিও ওই সরকারের কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না। সেই চরম দুর্দিনে শাহ সরকার এবং তার পৃষ্ঠপোষক বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান ইমাম খোমেইনী (র.)।
প্রেসিডেন্ট রুহানি বলেন, বিপ্লবপূর্ব সময়ে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো বিশেষ করে আমেরিকা ইরানকে নিজ ভূখ-ের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করত। এ বিষয়টি ইরানের জনগণ মেনে নিতে পারেনি বলেই তারা ইমামের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইসলামি বিপ্লবে যোগ দেয়। ইসলামি বিপ্লবের আগে মানুষের কাছে মনে হতো শাহ সরকার চিরস্থায়ী এবং তাকে কেউ ক্ষমতা থেকে সরাতে পারবে না। অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো মনে করত, তাদের অনুগত দেশগুলোর তালিকা থেকে কেউ বের হয়ে গেলে তাকে অবশ্যই সোভিয়েত ইউনিয়নের অনুগত দেশে পরিণত হতে হবে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদীদের এই চিন্তাধারাকে ব্যর্থ প্রমাণ করে ইমাম দেশে ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দুই পক্ষের বিরুদ্ধেই কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেন।

বিশেষজ্ঞ পরিষদের প্রধান হলেন আয়াতুল্লাহ জান্নাতি
গত ২৫ মে ২০১৬ ইরানের বিশিষ্ট আলেম ও বর্ষীয়ান নেতা আয়াতুল্লাহ আহমাদ জান্নাতি দেশটির বিশেষজ্ঞ পরিষদের প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা তথা ইসলামি বিপ্লবের নেতা নির্বাচন এবং তাঁর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়নের ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার কারণে এই সংস্থাটি ইসলামি এই দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিষদ হিসেবে বিবেচিত হয়।
আয়াতুল্লাহ জান্নাতি দুই বছরের জন্য এই পরিষদের প্রধান নির্বাচিত হলেন। এর আগে গত ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি এই পরিষদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন।
এই পরিষদের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পাঠানো এক বার্তায় ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেন, সরকারের বিপ্লবী ও ইসলামি পরিচিতিকে সার্বিকভাবে এবং সতর্কতার সঙ্গে রক্ষা করা এই পরিষদের দায়িত্ব। পর¯পরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সরকারের নানা দিক আর বিভাগকে উচ্চতর লক্ষ্যগুলো অর্জনের দিকে পরিচালিত করা এই সংস্থার দায়িত্ব বলে তিনি মন্তব্য করেন। ইরানের অভিভাবক পরিষদের প্রধান হিসেবেও বহু বছর ধরে দায়িত্ব পালন করে আসছেন বর্ষীয়ান নেতা আয়াতুল্লাহ জান্নাতি। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থীসহ বিভিন্ন নির্বাচনের প্রার্থীদের মনোনয়নের বিষয়টি চূড়ান্তভাবে বাছাই করে এই পরিষদ।

আলী লারিজানি ইরানের দশম সংসদের ¯িপকার নির্বাচিত
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের নবনির্বাচিত সংসদ, মজলিশে শুরার ¯িপকার হিসেবে পুনঃনির্বাচিত হয়েছেন ড. আলী লারিজানি। গত ২৮ মে ২০১৬ ইরানের নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে দেশটির দশম সংসদের কার্যক্রম শুরু হয়। ¯িপকার নির্বাচনে আলী লারিজানির পক্ষে ১৭৩ ভোট পড়ে। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী মোহাম্মদ রেজা আরেফ ১০৩টি ভোট পান।
২৯০ আসনের মজলিশে শুরার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন ২৬৫ জন সংসদ সদস্য। এ বারের মজলিশে শুরায় সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন ১৮ জন নারী। এর আগে মজলিশ শুরায় এতো বিপুল সংখ্যক নারী আর নির্বাচিত হয় নি।
সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ীর বাণী পাঠ এবং প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানির ভাষণের মধ্য দিয়ে নতুন সংসদের অধিবেশন শুরু হয়। এ ছাড়া, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুর রেজা রাহমানি ফাজলিও বক্তব্য রাখেন। এরপরই নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যরা আল্লাহর নামে শপথ নেন। মজলিশে শুরার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যরা তাঁদের নিজ নিজ ঐশী গ্রন্থ অনুযায়ী শপথ বাক্য পাঠ করেন।
১০= কৌশলগত চ-বাহার বন্দর নিয়ে চুক্তি করল ইরান, ভারত, আফগানিস্তান
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের চ-বাহার বন্দরকে পরিবহন ও ট্রানজিট মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের লক্ষ্যে এ বন্দরের উন্নয়নের উদ্দেশ্যে ইরান, ভারত ও আফগানিস্তানের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির সাম্প্রতিক ইরান সফরকালে গত ২৩ মে ২০০১৬ তেহরানে তাঁদের ও ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানির উপস্থিতিতে এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
চুক্তি সইয়ের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপের সময় প্রেসিডেন্ট রুহানি বলেন, আজকের দিনটি তিন দেশের স¤পর্কের ক্ষেত্রে একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। চ-বাহার বন্দর নিয়ে চুক্তি এই বার্তা দিচ্ছে যে, আঞ্চলিক দেশগুলো নিজেদের মধ্যকার সহযোগিতা ও সুযোগ-সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে আঞ্চলিক উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম; চ-বাহার বন্দর হচ্ছে তেমন সহযোগিতার এক প্রতীক। তিনি এ চুক্তিকে সংশ্লিষ্ট তিন দেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি বসন্ত স্বরূপ বলে অভিহিত করেন এবং বলেন, এ চুক্তি কোনো দেশের বিরুদ্ধে নয়।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এ ঘটনাকে ‘একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা’ হিসেবে অভিহিত করে বলেন, আজ আমরা সকলে একটি ইতিহাসের সৃষ্টি পর্যবেক্ষণ করছি এবং তা শুধু আমাদের এই তিন দেশের জনগণের জন্য নয়, বরং সমগ্র অঞ্চলের জন্য। তিনি বলেন, এটা একটা সংযুক্তির বন্ধন সৃষ্টি করবে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী জোর দিয়ে বলেন, এ চুক্তিটি হচ্ছে এ অঞ্চলে শান্তি ও অগ্রগতির লক্ষ্যে নতুন নতুন রুট তৈরির জন্য যে প্রচেষ্টা চলছে তারই অংশবিশেষ। এ করিডোর অবাধ অর্থনৈতিক বিকাশের পথ খুলে দেবে এবং এর ফলে যুবকশ্রেণির কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। তিনি আরো বলেন, এ সুবিধা মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতেও পৌঁছে যেতে পারবে। এছাড়া এটি একদিকে দক্ষিণ এশিয়াকে এবং অন্যদিকে ইউরোপকে পরস্পরের সাথে সংযুক্ত করতে সক্ষম হবে।
প্রধানমন্ত্রী মোদী ফারসি কবি হাফেযের একটি গযল থেকে কয়েকটি পঙ্ক্তি মূল ফারসি ভাষায় উদ্ধৃত করেন যাতে বলা হয়, ‘বিচ্ছিন্নতার দিনগুলো শেষ হয়েছে, অপেক্ষার রাত্রিও শেষ হতে চলেছে; আমাদের বন্ধুত্ব চিরস্থায়ী হবে।’
এর আগে প্রেসিডেন্ট রুহানি ও প্রধানমন্ত্রী মোদী তাঁদের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে দুই দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যাপকভিত্তিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করেন।
উল্লেখ্য, ইরান, ভারত ও আফগানিস্তানের মধ্যে পরিবহন ও ট্রানজিটের লক্ষ্যে চ-বাহার বন্দর উন্নয়নের জন্য যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে তা ছাড়াও চ-বাহার থেকে কমনওয়েল্থ্ অব্ ইনডেপেন্ডেন্ট্ স্টেট্স্ (সিআইএস)-এর সদস্য দেশগুলোর সাথে রেল ও সড়ক পথে সংযোগের যে ব্যবস্থা রয়েছে তা-ও ব্যবহৃত হবে।
চ-বাহার বন্দর উন্নয়নের পর এ বন্দর ব্যবহার করে ভারত তার নিজের পণ্য ইরানের ভেতর দিয়ে আফগানিস্তানে পাঠাতে পারবে। তাতে পাকিস্তানের সীমানা পার হওয়ার জটিলতা এড়াতে সক্ষম হবে নয়াদিল্লি। অন্যদিকে, আফগানিস্তানও সমুদ্রপথে ভারতে প্রবেশের সুবিধা পাবে। এ ক্ষেত্রে ইরান বিশ্বস্ত মিত্র দেশের ভূমিকা পালন করবে।

বাংলাদেশের সঙ্গে সাংস্কৃতিক স¤পর্ক আরও জোরদার করতে চায় ইরান : সংস্কৃতিমন্ত্রী
ইরানের সংস্কৃতি ও ইসলামি দিকনির্দেশনা বিষয়ক মন্ত্রী আলী জান্নাতি বলেছেন, বাংলাদেশ-ইরান সাংস্কৃতিক স¤পর্ককে গতিশীল করতে হবে। গত ২৯ মে ২০১৬ ইরানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এ কে এম মজিবুর রহমান ভূঁঞার সঙ্গে বৈঠকে তিনি এ কথা বলেন। ইরানি মন্ত্রী আরও বলেন, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে অনেক মিল রয়েছে। এ স¤পর্ক আরও জোরদার করা উচিত। তিনি আরও বলেন, দুই দেশ সিনেমাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পণ্য বিনিময় করতে পারে। বাংলাদেশ ও ইরানের মধ্যে এ সংক্রান্ত চুক্তি রয়েছে বলেও তিনি জানান।
সংস্কৃতিমন্ত্রী বলেন, ফারসি ভাষা শিক্ষা দুই দেশের স¤পর্ক জোরদারের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে পারে। ইরানিরাও বাংলা ভাষা স¤পর্কে জানতে আগ্রহী বলে তিনি জানান।
এ সময় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত বলেন, ইরানের সঙ্গে বাংলাদেশের স¤পর্ক জোরদারের অনেক ক্ষেত্র রয়েছে। শিক্ষা ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে দুই দেশ পর¯পরকে সহযোগিতা করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর কথাও বলেন তিনি।
এ কে এম মজিবুর রহমান ভূঁঞা আরও বলেন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দুই দেশের মধ্যে ভালো স¤পর্ক রয়েছে এবং এ স¤পর্ক ক্রমেই আরও জোরদার হবে।

ফিনল্যান্ড ও পোল্যান্ডের সঙ্গে ইরানের ১২০ কোটি ডলারের চুক্তি
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ফিনল্যান্ড ও পোল্যান্ডের সঙ্গে ১২০ কোটি ডলারের চুক্তি করেছে। ইরানের একটি প্রতিনিধিদলের দেশ দুটি সফরের সময় এ চুক্তি হয়েছে। ইরানের চেম্বার অব কমার্স, ইন্ডাস্ট্রি, মাইন অ্যান্ড এগ্রিকালচার-এর প্রধান মোহসেন জালালপুর রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা ইরনাকে জানান, বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরানের এ প্রতিনিধিদল পোল্যান্ডের সঙ্গে ৩০টি ও ফিনল্যান্ডের সঙ্গে ২০টি চুক্তি করেছে। এর মধ্যে পোল্যান্ডের সঙ্গে ৭০ কোটি ডলারের চুক্তি হয়েছে।
জালালপুর জানান, পোল্যান্ডের সঙ্গে ২৪ কোটি ডলারের বিদ্যুৎ স্থাপনা ও ২০ কোটি ডলারের মৎস্যখাতে গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি হয়েছে। আর ফিনল্যান্ডের সঙ্গে প্রধানত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক চুক্তি করা হয়েছে।

ইরানি ভাইস প্রেসিডেন্টের মস্কো সফর
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের দায়িত্ব পালনকারী ভাইস প্রেসিডেন্ট সোরেনা সাত্তারী সম্প্রতি রাশিয়া সফর করেন এবং এ সফরকালে তিনি গত ১ জুন (২০১৬) রাশিয়ার প্রতিরক্ষা ও মহাশূন্য শিল্প বিষয়ক উপপ্রধানমন্ত্রী মি. রোগোযিন্-এর সাথে এক বৈঠকে মিলিত হন। ইরান ও রাশিয়ার মধ্যে গঠিত প্রযুক্তি সহযোগিতা সম্পর্কিত উচ্চ পর্যায়ের কমিশনের এ বৈঠকে উভয় নেতা কো-চেয়ারম্যান হিসেবে সভাপতিত্ব করেন।
এ ছাড়াও ভাইস প্রেসিডেন্ট সোরেনা সাত্তারীর সফরসঙ্গী হিসেবে মস্কো সফরকারী এ কমিশনের সাব-কমিটির ইরানি সদস্যবর্গ তাঁদের রুশ সমপক্ষের সাথে বৈঠকে মিলিত হন।
উল্লেখ্য, এটি ছিল উচ্চ পর্যায়ের এ কমিশনের তৃতীয় বৈঠক। কমিশনের এবারের বৈঠকে ইতিপূর্বে দু’পক্ষের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক (এম্ওইউ) সমূহ, যৌথ প্রকল্পসমূহ, প্রস্তাবনাসমূহ ও চুক্তিসমূহের আওতাধীন কার্যক্রমের ধারাবাহিকতাকে এগিয়ে নেয়া হয়।
বৈঠকের শুরুতেই বৈঠকের কো-চেয়ারম্যানদ্বয় সংশ্লিষ্ট সাব-কমিটিসমূহের কার্যক্রমে সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং স্বাক্ষরিত চুক্তি সমূহ অবিলম্বে বাস্তবায়িত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
উল্লেখ্য, উচ্চ পর্যায়ের এ কমিশনের এ তৃতীয় বৈঠকে যেসব সাব-কমিটি অংশগ্রহণ করে সেগুলোর মধ্যে ইরানি পক্ষের নেতৃত্বদানকারী সাব-কমিটিগুলো হচ্ছে নুছরাতুল্লাহ্ যারগ¦াম-এর সভাপতিত্বে মেগা-সায়েন্স সাব-কমিটি, সাইয়্যেদ হেসামুদ্দীন মাদানীর সভাপতিত্বে বায়ো-টেকনোলোজী সাব-কমিটি, সাইয়্যেদ র্সার্ক-এর সভাপতিত্বে ন্যানো-টেকনোলজি বিষয়ক সাব-কমিটি, মানুচেহ্র্ মানত্বেক্বীর সভাপতিত্বে অ্যারোনটিক্স্ সাব-কমিটি, মোহাম্মাাদ তেহ্রানচীর সভাপতিত্বে একাডেমিক কো-অপারেশন সাব-কমিটি এবং আলী র্মোতাযা বিরাঙ্গ্-এর সভাপতিত্বে আঞ্চলিক সহযোগিতা বিষয়ক সাব-কমিটি।

জাকার্তায় আন্তর্জাতিক ইসলামি প্রচার মাধ্যম সম্মেলন
ফিলিস্তিন ও আল্-কুদ্স্ সমস্যার সমাধান উদ্ভাবনের লক্ষ্যে গত ২৫ মে (২০১৬) ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় আন্তর্জাতিক ইসলামি প্রচার মাধ্যম সম্মেলন শুরু হয়।
এ সম্মেলনে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইরান, ফিলিস্তিন, লেবানন, ব্রিটেন, নাইজেরিয়া প্রভৃতি দেশ থেকে ইসলামি প্রচারমাধ্যমের প্রতিনিধিগণ অংশগ্রহণ করেন। ইমাম সুলাইমানের কোরআন তেলাওয়াত ও ড. ইয়াখ্শাল্লাহ্ মানসূরের উদ্বোধনী ভাষণের মধ্য দিয়ে এ সম্মেলন শুরু হয়।
ইয়াখ্শাল্লাহ্ মানসূর তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে ইন্দোনেশীয় সরকার ও এ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদেরকে ধন্যবাদ জানান এবং মুসলিম জাহানের প্রতি ঐক্যের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, এ সম্মেলনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ইসলামি বৈশ্বিক প্রচারমাধ্যমকে তাদের প্রকৃত দায়িত্ব-কর্তব্য ও ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন করা।
জনাব ইয়াখ্শাল্লাহ্ মানসূর আরো বলেন, আমাদের জাতি সমূহের মধ্যে যেসব পারস্পরিক সমস্যা রয়েছে আলোচনা ও সংলাপের মাধ্যমে সেগুলোর সমাধানের লক্ষ্যে আমাদেরকে অবশ্যই আমাদের মধ্যকার অভিন্ন বিষয়গুলোর প্রতি সম্মান দেখাতে হবে।
সম্মেলনের প্রথম দিনে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর তিনটি প্যানেল ডিস্কাশন অনুষ্ঠিত হয়। এ প্যানেল ডিস্কাশনসমূহের বিষয়বস্তু ছিল : ‘মুসলিম জাহানের সঙ্কট ও বৈশ্বিক সঙ্কট সমাধানে ইসলামি প্রচার মাধ্যমের ভূমিকা’, ‘ইসলাম ও মুসলমানদের স্বার্থের হেফাযতে বিশেষ করে ফিলিস্তিন ও আল্-কুদ্স্ প্রশ্নে ইসলামি প্রচারমাধ্যমের সহায়তা’ এবং ‘ইসলামি প্রচারমাধ্যম সমূহের মধ্যে সহযোগিতার লক্ষ্যে পরিকল্পনা উপস্থাপন’।

বিশ্ববাসী চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ইরানকে নতুন করে জানবে
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সিনেমা সংস্থার প্রধান হুজ্জাতুল্লাহ্ আইয়ূবী বলেন, বিশ্ববাসী এখন চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ইরানকে নতুন করে জানবে। তিনি ৬৯তম কান্ চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণের পর গত ২৫ মে (২০১৬) দেশে ফিরে এসে এ অভিমত ব্যক্ত করেন।
কান্ চলচ্চিত্র উৎসবে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরাট সাফল্যে সন্তোষ প্রকাশ করে হুজ্জাতুল্লাহ্ আইয়ূবী বলেন, এ উৎসবে অংশগ্রহণ করে র্ফাহাদী নির্মিত ‘দ্য সেল্স্ম্যান’ চলচ্চিত্রটি বিশ্ববাসীকে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ইরানকে জানার জন্য সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।
হুজ্জাতুল্লাহ্ আইয়ূবী কান্ চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ শেষে ফ্রান্স থেকে তেহরান ফিরে বিমান বন্দরে সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিদের সাথে কথোপকথন কালে উক্ত উৎসবে ইরানের বিরাট সাফল্যের কারণে ইরানি জাতিকে অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, কান্ চলচ্চিত্র উৎসবে ইরানের ‘দ্য সেল্স্ম্যান’ সর্বশ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে পুরস্কৃত হবার পর আমি বিভিন্ন টিভি নেটওয়ার্কের সংবাদ মনিটরিং করেছি এবং তার ফলে দেখতে পেয়েছি যে, ইউরোপের শ্রেষ্ঠ টিভি চ্যানেলগুলো তাদের সংবাদ শিরোনাম সমূহের মধ্যে ইরানের চলচ্চিত্রকে বিশেষ গুরত্ব সহকারে উল্লেখ করেছে।
জনাব আইয়ূবী বলেন, কিছু দেশ বিপুল অর্থ ব্যয় করে ইরানের বিরুদ্ধে ব্যাপক অপপ্রচার চালিয়ে আসছে এবং ইরানকে সন্ত্রাস, যুদ্ধ ও বিভিন্ন অস্বস্তিকর সংবাদের দ্বারা পরিচিত করার অপচেষ্টা চালিয়েছে, কিন্তু এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, আমাদের দেশ তার চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতির জন্য বিশ্বের কাছে সুপরিচিত হচ্ছে। নিঃসন্দেহে এটা একটা বিরাট আনন্দের ব্যাপার।
সম্প্রতি ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সরকারের সংস্কৃতি ও ইসলামি নির্দেশনা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ‘দ্য সেল্স্ম্যান’ চলচ্চিত্রটিকে ইরানে দেখাবার উপযোগী করার জন্য এতে কিছু পরিবর্তন আনা হবে বলে যে উল্লেখ করেছেন সে প্রসঙ্গে জনাব আইয়ূবী বলেন, চলচ্চিত্রের লাইসেন্স প্রদানের জন্য যে পরিষদ রয়েছে সে পরিষদই কোনো চলচ্চিত্র সংশোধনের সিদ্ধান্ত দেয়ার উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি যে, ‘দ্য সেল্স্ম্যান’ চলচ্চিত্রটিতে কোনো সংশোধনের প্রয়োজন নেই। কারণ, চলচ্চিত্রটির নির্মাতা ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য যেসব শর্ত রয়েছে সেগুলো পূরণ করেছেন।
উল্লেখ্য, জনাব আসগ¦ার র্ফাহাদী নির্মিত ‘দ্য সেল্স্ম্যান’ কান্ চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠতম চলচ্চিত্র হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে এবং এ চলচ্চিত্রে অভিনয়কারী জনাব শাহাব হোসেইন এ বছরের শ্রেষ্ঠতম অভিনেতা হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছেন।

ইরানের গ্যাস উৎপাদন ২৩ বিলিয়ন ঘন মিটার ছাড়িয়ে গিয়েছে
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের দক্ষিণ পার্স গ্যাসক্ষেত্রের ১২তম, ১৫তম ও ১৬তম ফেসের উৎপাদনের ফলে ইরানের মোট গ্যাস উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে ২৩ বিলিয়ন ঘন মিটার ছাড়িয়ে গিয়েছে।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সরকারের তেল মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী ও দক্ষিণ পার্সবিষয়ক গণযোগাযোগ দফতরের প্রধান জনাব হামিদরেযা আরাগ¦ী গত ২৫ মে ২০১৬ সংবাদ মাধ্যমের রিপোর্টারদেরকে জানান যে, দেশের তেল উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তা কাজে লাগানোর ফলে গত ২১ মার্চ সমাপ্ত বিগত ইরানি বছরে দক্ষিণ পার্স গ্যাসক্ষেত্রে গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি পরিবেশ দূষণ হ্রাস পাওয়ায় জনকল্যাণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
তিনি বলেন, দক্ষিণ পার্স গ্যাসক্ষেত্রের ১৯তম ফেসে দক্ষিণ পার্স কোম্পানি, পার্স অয়েল অ্যান্ড গ্যাস কোম্পানি ও পেট্রোপার্স কোম্পানির বিশেষজ্ঞগণকে ও সুদক্ষ শ্রমশক্তিকে কাজে লাগানো হয়েছে। এর ফলে জাতীয় সম্পদের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে।
জনাব আরাগ¦ী প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সরকারের প্রশংসা করে বলেন, এ সাফল্য ড. রুহানির দক্ষতারই পরিচয় বহন করে। কারণ, তাঁর সরকার প্রায় খালি হাতে এবং কেবল দেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদ ও সামর্থ্যরে ওপর নির্ভর করে দেশ পরিচালনা করেও এ বিরাট সাফল্যের অধিকারী হয়েছেন।
তিনি দক্ষিণ পার্স কোম্পানির সুদক্ষ জনশক্তিকে তাঁদের বহু বছরের অভিজ্ঞতাকে দক্ষিণ পার্স গ্যাসক্ষেত্রের ১৯তম ফেসের উৎপাদনে ভালোভাবে কাজে লাগানোর এবং প্রকল্পটির জন্য গৌরবময় সাফল্য অর্জনের জন্য আহ্বান জানান।
উল্লেখ্য, ৪৮০ কোটি ডলার ব্যয় সাপেক্ষ দক্ষিণ পার্স গ্যাসক্ষেত্রের ১৯তম ফেসের উন্নয়ন ও অপারেশনের প্রকল্পটি গত ২০০৯ সালের জুন মাসে এ কোম্পানির ওপর অর্পণ করা হয়। ইতিমধ্যেই স্থল ভাগে ও সমুদ্রে এ প্রকল্পের কাজের শতকরা ৯৩.৩ ভাগ অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে এবং আগামী সেপ্টেম্বরে (২০১৬) এ ফেসের উৎপাদন কাজ পুরোপুরি শুরু হবে।

ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী কর্তৃক সদ্য সমাপ্ত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগত প্রকল্পের আবরণ উন্মোচিত
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হোসেইন দেহ্কান গত ১ জুন (২০১৬) তেহরানের মালেক আশতার প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য সমাপ্ত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগত প্রকল্পের আবরণ উন্মোচন করেন। এগুলো হচ্ছে ন্যাশনাল পজিশনিং সিস্টেমের একটি ওয়ান-এম্ডব্লিউ ট্রান্সমিটার, একটি রোবোটিক ভ্যাকুয়াম কোটিং মেশিন এবং ভ্যাকুয়াম র্আক্ রিমেল্টিং (ভিএর্আ) চুল্লি।
জনাব দেহ্কান বলেন, বিজ্ঞান, গবেষণা ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আমাদের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম দেশের প্রতিরক্ষা তত্ত্বের ওপর ভিত্তিশীল। আর আজ যে তিনটি জিনিসের আবরণ উন্মোচন করা হলো তাতে ঐ সব বৈশিষ্ট্য ছাড়াও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, এগুলো একদিকে যেমন ‘প্রতিরোধমূলক অর্থনীতি’র প্রতীক, তেমনি তা শত্রুদের চাপিয়ে দেয়া নিষেধাজ্ঞাকে যে অকেজো ও ব্যর্থ করে দেয়া হয়েছে তা তাদেরকে প্রদর্শনের লক্ষ্যে বাস্তব ও কার্যকর পদক্ষেপ।
ন্যাশনাল পজিশনিং সিস্টেমের ওয়ান-এম্ডব্লিউ ট্রান্সমিটার সম্বন্ধে তিনি বলেন, আমাদের দেশের সকল পজিশনিং, নেভিগেশন ও টাইমিং সার্ভিস জিপিএস্-এর ওপর ভিত্তিশীল। আর যেহেতু এগুলোর দক্ষতা ও নির্ভুলতা, মান ও সংখ্যার ওপরে আমাদের কোনোরূপ নিয়ন্ত্রণ নেই এবং যেহেতু জরুরি অবস্থায় এসব সার্ভিস বন্ধ করে দেয়ার ঝুঁকি সব সময়ই রয়েছে সেহেতু দেশের অভ্যন্তরে উচ্চ মাত্রার নির্ভরযোগ্যতা ও দ্রুততম সময়ে পরিবর্তনযোগ্যতা বিশিষ্ট পজিশনিং সিস্টেম গড়ে তোলা অপরিহার্য হিসেবে অনুভূত হয়।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী আরো বলেন যে, ভবিষ্যতে দেশের ভেতরে যথোপযোগী স্থানসমূহে আরো পাঁচটি শক্তিশালী ট্রান্সমিটার স্টেশন প্রতিষ্ঠা করা হবে যেগুলো বৈশ্বিক মানের ন্যাশনাল জিপিএস্ নেভিগেশন অ্যান্ড টাইমিং সিস্টেম দিতে সক্ষম হবে।
রোবোটিক ভ্যাকুয়াম কোটিং মেশিন সম্বন্ধে তিনি বলেন, এ মেশিন সলিড্ ফুয়েল, ব্যালাস্টিক মিসাইল মায্ল্স্ এবং নিওবিয়াম্, ট্যান্টালুম্, টাংস্টেনক্রোমিয়াম্, মোলিবডেনাম্ প্রভৃতি ধাতব পদার্থের ওপর স্পেশাল কেমিক্যাল করোসিওন্ রেসিস্ট্যান্স কোটিংস হিসেবে ব্যবহার করা যাবে এবং বিভিন্ন বায়োলজিক্যাল্ অ্যাপলিকেশন সহও কোটিং করা যাবে।
ভ্যাকুয়াম র্আক্ রিমেল্টিং (ভিএর্আ) চুল্লি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভিএআর চুল্লি থেকে একদিকে যেমন হস্তচালিত সার্ভিস নেয়া যাবে তেমনি এটাকে স্বয়ংক্রিয় হিসেবেও ব্যবহার করা যাবে। এছাড়া একে টাইটানিয়ামের সংমিশ্রণ গলানো ও বিশোধনের কাজে এবং সুপার এ্যালয় ও স্পেশাল স্টীল পুনঃগলানোর কাজে ব্যবহার করা যাবে।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, বর্তমানে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় পরিপূর্ণরূপে বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে দেশের সশস্ত্র বাহিনীসমূহের প্রয়োজন পূরণ করছে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য একটি নির্ভরযোগ্য রক্ষাকবচ হিসেবে সেবা প্রদান করছে।

বিশ্ব যোগাযোগ দিবসে ইরানের তিনটি আইসিটি প্রকল্পের পর্দা উন্মোচন
বিশ্ব যোগাযোগ দিবসে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান গত ১৫ মে (২০১৬) ট্রাফিক এক্সচেঞ্জ সেন্টার অব্ ন্যাশনাল ইনফরমেশন নেটওয়ার্ক এবং ন্যাশনাল পোর্টাল্ অব্ স্টার্ট গভর্নমেন্ট সার্ভিসেস্ সহ তিনটি আইসিটি প্রকল্পের পর্দা উন্মোচন করেছে।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সরকারের যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মাহমূদ ওয়ায়েযী এবং সুপ্রিম কাউন্সিল অব্ সাইবারস্পেস্ (এসসিসি)-র সেক্রেটারি আবূল্ হাসান্ ফীরূযাবাদীর উপস্থিতিতে ‘সামাজিক প্রভাবের জন্য আইসিটি ব্যবসায়’ স্লোগান সহকারে বিশ্ব যোগাযোগ দিবসের এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
এ অনুষ্ঠানে আইসিটিবিষয়ক মন্ত্রী ন্যাশনাল পোর্টাল্ অব্ স্টার্ট গভর্নমেন্ট সার্ভিসেস্ প্রকল্পটির পর্দা উন্মোচন করেন। এ প্রকল্প জনগণকে তথ্য লাভে সহায়তা করবে এবং সেই সাথে এতদসংক্রান্ত অনুরোধের জন্য সময়ের সাশ্রয় ঘটাবে।
এছাড়া জনাব ফীরূযাবাদী জিএসবি প্রকল্পের পর্দা উন্মোচন করেন। এটি হবে সরকারের ইনফরমেশন শেয়ারিং সেন্টারÑ যা বিভিন্ন নির্বাহী সংস্থার মধ্যে পারস্পরিক ডাটাবেস্ যোগাযোগের কাজ করবে। এর কাজের নমুনা হিসেবে অনুষ্ঠান চলাকালে এটি আইআরআই পোস্ট্ কোম্পানির পোর্টালের সাথে সংযোগ প্রদান করে প্রথম ই-মেইলটি গ্রহণ করে।
এ অনুষ্ঠানে তৃতীয় যে প্রকল্পটির আবরণ উন্মোচন করা হয় সেটি হচ্ছে ট্রাফিক এক্সচেঞ্জ সেন্টার অব্ ন্যাশনাল ইনফরমেশন নেটওয়ার্ক, সংক্ষেপে এনআইএক্স। এটিকে ইরানের ট্রাফিক এক্সচেঞ্জ নেটওয়ার্কের সমন্বিত প্লাটফর্ম হিসেবে গণ্য করা হয়।

ইরানের নাসে ড্রোনের পর্দা উন্মোচন
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের খাতামুল্ আম্বিয়া বিমান প্রতিরক্ষা ঘাঁটি ‘নাসে’ নামে একটি ড্রোন্ তৈরি করেছে। গত ১০ মে (২০১৬) দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হোসেইন্ দেহ্কানের উপস্থিতিতে এক অনুষ্ঠানে এর পর্দা উন্মোচন করা হয়।
উল্লেখ্য, নাসে ড্রোন্-এর পর্দা উন্মোচন ছাড়াও এ দিনে খাতামুল্ আম্বিয়া বিমান প্রতিরক্ষা ঘাঁটির সর্বশেষ প্রতিরক্ষা সাফল্যসমূহের প্রদর্শনী করা হয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী দেহ্কান্ খাতামুল্ আম্বিয়া বিমান প্রতিরক্ষা ঘাঁটির প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল র্ফাযাদ্ ইসমাঈলী সহ প্রদর্শনীস্থল পরিদর্শন করেন।
উল্লেখ্য, খাতামুল্ আম্বিয়া বিমান প্রতিরক্ষা ঘাঁটি ইতিপূর্বে যে কম্ব্যাট্ ড্রোন্ তৈরি করেছিল নাসে হচ্ছে তার উন্নততর সংস্করণ।

কৃত্রিম উপগ্রহ ‘মিস্বাহ্’ কক্ষপথে প্রেরণের লক্ষ্যে ইরান ও ইতালির মধ্যে আলোচনা
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান কর্তৃক নির্মিত কৃত্রিম উপগ্রহ ‘মিস্বাহ্’ কক্ষপথে প্রেরণের লক্ষ্যে গত ৬ জুন (২০১৬) ইরান ও ইতালির মধ্যে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা শেষে ইরানের মহাশূন্য সংস্থার প্রধান জনাব মোহ্সেন্ বাহ্রামী ঘোষণা করেন যে, ইতিপূর্বে ইতালি ইরানের ‘মিস্বাহ্’ নামক যে কৃত্রিম উপগ্রহটি আটক করেছিল তা ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
জনাব বাহ্রামী বার্তা সংস্থা মেহ্র্ নিউজ-এর সংবাদ প্রতিনিধিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ইতিপূর্বে ইতালি আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার বাহানায় ইরানের ‘মিস্বাহ্’ কৃত্রিম উপগ্রহটি আটক করে রাখে এবং ইরানের কাছে হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানায়। তবে সেটি ফিরিয়ে আনার জন্য বর্তমানে ইরান ইতালির সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, ইরানি গবেষকগণ এখন এটিকে কক্ষপথে নিক্ষেপের বিভিন্ন সম্ভাবনার মধ্য থেকে কোন্টির আশ্রয় নেয়া হবে সে সম্বন্ধে চিন্তা-ভাবনা করছেন।
উল্লেখ্য, ইরানের ‘মিস্বাহ্’ কৃত্রিম উপগ্রহ ইতালির কোর্লো গাভায্যী স্পেস্ এস. পি. এ.-র সহযোগিতায় ১৯৯৮ সালে নির্মিত হয় এবং ২০০৫ সালে এটির আবরণ উন্মোচিত হয়। এটি হচ্ছে ভূ-কেন্দ্রিক নিম্ন অক্ষের টেলিযোগাযোগ উপগ্রহ। ইরানের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া ও ইতালি এ ব্যাপারে সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে এটি কক্ষপথে স্থাপন করা সম্ভব হয় নি।

ইরানি কোম্পানি কর্তৃক বৃক্ষের ভঙ্গুরতা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণীকারী মোবাইল সেট তৈরি
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের একটি মোবাইল কোম্পানি এমন একটি মোবাইল সেট তৈরি করেছে যা বৃক্ষের উৎপাটিত হওয়া ও ভেঙে পড়া সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে সক্ষম এবং ‘দেরাখ্ত্-বন্’ (বৃক্ষরক্ষক) নামক এ মোবাইলের ভবিষ্যদ্বাণী শতকরা ৮৭ ভাগ ক্ষেত্রে নির্ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
মোবাইল সেটটির নির্মাতা জনাব নোর্যা নোযারী বার্তা সংস্থা মেহ্র্ নিউজ-এর সংবাদ প্রতিনিধিকে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে বলেন যে, দেরাখ্ত্-বন্ মোবাইল সেট উদ্দিষ্ট যে কোনো বৃক্ষের অবস্থান ও তার আকার-আকৃতি সম্পর্কিত তথ্যাদি সংগ্রহ করতে এবং তা আবহাওয়া দফতরকে অবহিত করতে সক্ষম। সেটটি সংশ্লিষ্ট স্থানের বায়ুর চাপ ও প্রবাহ এবং বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রার সংক্ষিপ্ত চার্ট তৈরি করে সরবরাহ করে। সেই সাথে সেটটি এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে বৃক্ষটি উৎপাটিত হওয়ার বা ভেঙে পড়ার সময় সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে। আর এটির কৃত ভবিষ্যদ্বাণী শতকরা ৮৭ ভাগ ক্ষেত্রে সঠিক প্রমাণিত হয়ে থাকে।
জনাব নোর্যা নোযারী আরো জানান যে, তাঁর উদ্ভাবিত এ যন্ত্রটিতে জিওগ্রাফিক্যাল্ ইনফরমেশন সিস্টেম (জিআইএস্) সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে এবং এটি বাগান রক্ষককে গাছে থাকা খেজুরের ছত্রাক সম্বন্ধে জানিয়ে দিতে সক্ষম, আর এ তথ্য অত্যন্ত উচ্চ মাত্রায় নির্ভুলতার সাথে সরবরাহ করে থাকে।
তিনি আরো জানান, দেরাখ্ত্-বন্ মোবাইল সেট মাটির আর্দ্রতা সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে এবং কখন পানি সিঞ্চন করতে হবে সে সম্বন্ধে যথাযথ সময় নির্দেশ করে পরামর্শ দিতে পারে, ফলে জমিতে পানির ব্যবহার সর্বোচ্চ মাত্রায় যথাযথভাবে করা সম্ভবপর হয়।
দেরাখ্ত্-বন্ মোবাইল সেট গাছপালার বিভিন্ন ক্যাটেগরির তথ্য গ্রহণ করতে, কীট-পতঙ্গ চিহ্নিত করতে, গাছপালায় আরো যেসব সমস্যা দেখা দেয় সেগুলোও চিহ্নিত করতে এবং মালিকে তার সমাধান নির্দেশ করতে সক্ষম।
জনাব নোযারী জোর দিয়ে বলেন যে, এ ধরনের যন্ত্র তিনিই সর্বপ্রথম উদ্ভাবন করেছেন এবং এ পর্যন্ত অন্য কেউই এ ধরনের যন্ত্র উদ্ভাবন করেন নি।

হ্যানোভার আন্তর্জাতিক শুটিং প্রতিযোগিতায় ইরানি মহিলা শুটারদের পাঁচটি পদক লাভ
সম্প্রতি জার্মানির হ্যানোভারে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শুটিং প্রতিযোগিতায় (আইএসসিএইচ) ইরানি মহিলা শুটারগণের দক্ষতা দর্শকদেরকে অভিভূত করে এবং তাঁরা এ প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক সহ মোট পাঁচটি পদক জয় করেন। হ্যানোভারের ন্যাশনাল শুটিং সেন্টারে অনুষ্ঠিত এ প্রতিযোগিতায় গত ২৪ মে (২০১৬) এলাহে আহ্মাদী, মাহালাগ¦া জাম্বোর্যোগ্ ও নাজমা খেদ্মাতীর সমন্বয়ে গঠিত ইরানি শুটিং স্কোয়াড্ মহিলাদের ৫০ মিটার রাইফেল্ প্রোন্ টীম্ কম্পিটিশনের শেষে একটি ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেন।
এ প্রতিযোগিতায় সুইস্ ন্যাশনাল টীম চ্যাম্পিয়ন হয় এবং স্বাগতিক দেশ জার্মানির টীম দ্বিতীয় বা রানার্স আপ হয়। আর মহিলাদের ৫০ মিটার শুটিং-এ ইরানি টীম তৃতীয় স্থান দখল করে।
ইরানি টীমের সদস্যা এলাহে আহ্মাদী এ ইভেন্টে ব্যক্তিগত পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় সর্বোচ্চ পয়েন্ট লাভ করেন ও স্বর্ণপদক জয় করেন। অন্যদিকে নাজমা খেদ্মাতী রৌপ্য পদক লাভ করেন।
উল্লেখ্য যে, হ্যানোভারের আন্তর্জাতিক শুটিং প্রতিযোগিতায় জুনিয়র ও সিনিয়র সেকশনের প্রতিযোগিতা গত ৭ মে (২০১৬) শুরু হয় এবং ১৫ মে সমাপ্ত হয়।

গ্রেকো-রোমান বিশ্বকাপ কুস্তিতে ইরানের শিরোপা জয়
ইরানি জাতীয় টীম শীরাযে অনুষ্ঠিত গ্রেকো-রোমান কুস্তি বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতায় রাশিয়াকে পরাজিত করে শিরোপা অর্জন করেছে।
গত ১৯ মে (২০১৬) শীরাযে দু’দিনব্যাপী এ প্রতিযোগিতা শুরু হয় এবং ইরানি কুস্তিগীরগণ ইউক্রেন, আযারবাইজান ও তুরস্ককে পরাজিত করে ফাইনালে উন্নীত হন এবং পরদিন রাশিয়াকে পরাজিত করে শিরোপা অর্জন করেন।
এ প্রতিযোগিতায় তুরস্ক তৃতীয় স্থান দখল করে এবং বেলারুস, আযারবাইজান, ইউক্রেন ও জার্মানি যথাক্রমে পরবর্তী স্থানগুলো লাভ করে।

ইরানের জাতীয় প্যারাশুটিং টীমের স্বর্ণ পদক বিজয়
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের জাতীয় প্যারাশুটিং টীম হ্যানোভারে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শুটিং প্রতিযোগিতা (আইএসসিএইচ) ২০১৬-তে ৫০ মিটার পিস্তল শুটিং প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করে স্বর্ণ পদক জয় করেছে।
এ প্রতিযোগিতায় ইরানের মাহ্দী যামানী, সারেহ্ জাভার্ন্মাদী ও আলীয়ে মাহমূদী যথাক্রমে ৫২৯, ৫৪৮ ও ৫২৮ পয়েন্ট লাভ করেন এবং এর ফলে এ আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে ইরান শীর্ষ স্থান অধিকার করতে সক্ষম হয়।
এ ছাড়াও ৫০ মিটার পিস্তলের ব্যক্তিগত পর্যায়ের শুটিং প্রতিযোগিতায় সারে জাভার্ন্মাদী স্বর্ণ পদক জয় করেন এবং আলীয়েহ্ মাহমূদী ও মাহ্দী যামানী যথাক্রমে ৫ম ও ৭ম স্থান অধিকার করেন। এভাবে ইরানি প্যারাশুটারগণ দলবদ্ধভাবে একটি স্বর্ণপদক ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে আরো একটি স্বর্ণপদক জয় করলেন।
উল্লেখ্য, হ্যানোভারের আন্তর্জাতিক শুটিং প্রতিযোগিতা (আইএসসিএইচ) গত ৭ মে (২০১৬) শুরু হয় এবং ১৫ মে সমাপ্ত হয়।

৫২ বছর পর অলি¤িপকে খেলার যোগ্যতা অর্জন করল ইরানি ভলিবল দল
ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওতে অনুষ্ঠেয় আসন্ন গ্রীষ্মকালীন অলি¤িপকের টিকিট নিশ্চিত করেছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের পুরুষ ভলিবল দল। রিও অলি¤িপকের চূড়ান্ত আসরে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে ইরানি দল প্রতিপক্ষ পোল্যান্ডকে ৩-১ সেটে হারিয়েছে। শনিবার জাপানের টোকিও মেট্রোপলিটন জিমনেশিয়ামে ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয়।
এ আসরে ইরান ছয়টি দেশের মোকাবেলায় পাঁচটিতে জিতে রিও অলি¤িপকে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। যেসব দেশের বিরুদ্ধে ইরান জয় পেয়েছে সেগুলো হলো অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, চীন ও পোল্যান্ড। আর একমাত্র পরাজিত হয়েছে ফ্রান্সের কাছে। পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমে গ্রীষ্মকালীন অলি¤িপকে খেলার জন্য ৫২ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটালো ইরান। ১৯৬৪ সালে টোকিও অলি¤িপকে প্রথমবারের মতো ভলিবল ইভেন্ট হিসেবে যুক্ত হয়।
রিও অলি¤িপকে খেলার যোগ্যতা অর্জন করায় ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি নিজ দেশের খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের অভিনন্দন জানিয়েছেন। তিনি তাঁর অভিনন্দন বার্তায় বলেছেন, ইরানি ভলিবল দল এ বিজয়ের মাধ্যমে আরো একবার দেশের জনগণের জন্য গর্ব ও আনন্দ বয়ে আনল। বিশ্বের বড় বড় এবং শক্তিশালী দলকে হারিয়ে ইরানের তরুণরা জাতির জন্য সোনালি অধ্যায় রচনা করল।

ইমাম খোমেইনী (র.)-এর দৃষ্টিতে কোরআন মজীদ

মাহদী হাযেরী

কোরআন নাযিলের লক্ষ্য
ইমাম খোমেইনী (র.)-এর দৃষ্টিতে নবুওয়াতি মিশন ও কোরআন নাযিলের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মানবজাতির আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধি। তাঁর নিজের ভাষায় : ‘নবুওয়াতি মিশনের মূল উদ্দেশ্য ছিল কোরআন-এর নাযিল হওয়াকে সুস¤পন্ন করা আর কোরআনকে মানুষের মাঝে পাঠ করে শোনানোর উদ্দেশ্য ছিল যাতে তারা অন্তরের কালিমা ধুয়ে ফেলে আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জন করতে পারে।’ (সাহিফায়ে ইমাম, ১৪তম খণ্ড, পৃ. ৩৮৮)
কোরআন আনুধাবন
ইমাম খোমেইনী (র.)-এর দৃষ্টিতে কোরআন মজীদের মৌলিক শিক্ষাগুলো সকলেই অনুধাবনে সক্ষম এবং প্রত্যেকেই তার নিজের সক্ষমতার ভিত্তিতে এর থেকে সুফল পেয়ে থাকে। কোরআনের শিক্ষা সঠিকভাবে অনুধাবনের জন্য কতগুলো শর্ত মেনে চলতে হয়। আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জনের পথে জিহাদ করা, নীচ ও কুৎসিত আচরণ থেকে মুক্ত থাকা, ব্যবহারিক জীবনে উচ্চমান বজায় রাখা এবং মুক্তির প্রতীক্ষায় মাসুম ইমামগণের (আ.) ধারাকে আঁকড়ে ধরে রাখা হচ্ছে সেরূপ কতিপয় শর্ত।
এছাড়া, আত্ম-অহমিকা এবং বস্তুগত জীবনের প্রতি অতিরিক্ত মায়ার মতো কতিপয় বাধা অতিক্রম করাও কোরআন থেকে সুফল লাভের পূর্বশর্ত। আর এগুলো কোরআনের প্রকৃত শিক্ষা অর্জনের জন্য আবশ্যক। (সাহিফায়ে ইমাম, ১৪তম খ-, পৃ. ৩৮৮)
কোরআন অবলম্বনের তাগিদ
মরহুম ইমাম (র.) কোরআন পাঠ, কোরআন নিয়ে অনুধ্যান, কোরআনী শিক্ষার প্রয়োগ এবং কোরআনের পুনরুজ্জীবনের জন্য বার বার তাগিদ দিয়েছেন। ইমাম তাঁর পুত্রবধু ফাতেমা তাবাতাবায়ীকে এক চিঠিতে লিখেন, ‘কোরআন নিয়ে অনুধ্যান কর, কেননা, তা ঐশী সহযোগিতার উৎসমূল। আক্ষরিকভাবেই, কেবল কোরআন পাঠ করা যেন প্রিয়তমের কাছ থেকে লজ্জাবনত পাঠকের কাছে আসা চিঠি পড়ার মতোই, তবে কোরআনের আয়াতগুলো নিয়ে চিন্তা-গবেষণা প্রীতিদায়ক ফলাফল বয়ে আনে এবং ব্যক্তিকে মহিমান্বিত ও সুউচ্চ মাকামে পৌঁছে দেয়। কোরআন পাকে আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেছেন, ‘তারা কি কোরআন নিয়ে চিন্তা করে না, নাকি তাদের হৃদয় তালাবদ্ধ?’ তাই, কোন যথাযথ ফলাফল লাভই সম্ভব নয় যতক্ষণ না এই তালা বা শিকল থেকে মুক্তি পাওয়া যাচ্ছে। তাই, যে পর্যন্ত তুমি যৌবনে রয়েছ ততক্ষণ আমল ও আত্মিক পরিশুদ্ধির পথে জিহাদ করÑ যতক্ষণ না তুমি অন্তরের তালাটাকে বিচূর্ণ করতে সক্ষম হও। আর এটা এজন্যই যে, একজন বৃদ্ধ নয়, বরং ঐশী দিগন্ত এবং স্বর্গীয় রাজত্বের নিকটবর্তী তরুণরাই সফলকাম হবে।”… (সাহিফায়ে ইমাম, ১৮তম খণ্ড, পৃ. ৪৪৭)
ইমাম খোমেইনী মনে করতেন অতীতে মুসলমানদের উন্নতি এবং শ্রেষ্ঠত্ব লাভের রহস্য নিহিত রয়েছে কোরআনের শিক্ষার প্রতি আমল করার মধ্যেই এবং তাঁর মতে, এটি মুসলমানদের মুক্তির একমাত্র পথ।
তিনি বলেন, ‘কোরআনই দীর্ঘ অর্ধ শতাব্দী কাল ধরে মুসলমানদেরকে রক্ষা করেছে এবং ইসলাম তৎকালীন সকল সা¤্রাজ্যের উপর বিজয় লাভ করেছে। যতক্ষণ আমরা কোরআনের শিক্ষাকে আঁকড়ে থাকব ততক্ষণ শত্রুদের উপর আমাদের আধিপত্য বজায় থাকবে। আল্লাহ না করুন, যদি ইসলামের শত্রুরা আমাদেরকে কোরআন এবং ইসলাম থেকে দূরে সরাতে সক্ষম হয় তাহলে আমরা নিজেদেরকে অপমান, লাঞ্ছনা, হীন অবস্থা এবং দাসত্বের নিগড়ে আবিষ্কার করব। স্বাধীনতা ও মুক্তি নিহিত রয়েছে কোরআন ও সম্মানিত রাসূল (সা.)-এর প্রতি আমাদের আনুগত্যের মধ্যেই।’
কোরআননির্ভর বক্তৃতা দান
কোরআন হচ্ছে সেই প্রচারমূলক গ্রন্থ যা মানবজাতিকে নসিহত ও দিকনির্দেশনার জন্য মহানবী (সা.)-এর উপর নাযিল হয়েছে। কোরআন যে কোন যুগের মানুষকে হেদায়াত করতে সক্ষম। এ ব্যাপারে ইমাম বলেন, ‘মানুষ অসীম, মানুষের প্রশিক্ষক অসীম এবং হেদায়াতের পাথেয় কোরআন মজীদও অসীম… এটা শুধু অদৃশ্য কিংবা ভাবজগতের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটা সবকিছু এবং সর্বত্র। (সাহিফায়ে ইমাম, ১২তম খণ্ড, পৃ. ৪২২)
কোরআনের উপদেশমালার মধ্যে একটি উপদেশ মরহুম ইমামের দৃষ্টিকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছে এবং তিনি বার বার এই নির্দেশটিকে টেনে এনেছেন। প্রকৃতপক্ষে, বলা যেতে পারে যে, এটাই ছিল ইমামের আন্দোলন ও বিপ্লবের মূলমন্ত্র। যখনই কোন ব্যক্তি তাঁর কাছে উপদেশ চাইতে এসেছে তখনি তিনি সূরা সাবা’-এর ৪৬ নং আয়াতের প্রতি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন যাতে এরশাদ হয়েছে :
“(হে রাসূল!) বলুন : ‘আমি তোমাদের কেবল একটি বিষয়ে উপদেশ দিচ্ছি, তা হলো এই যে, তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে দু’ দু’জন করে বা এক-একজন করে উঠে দাঁড়াও….।”
হযরত ইমামের জিহাদের যে প্রাচীনতম (১৯৪৪) নযির পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় যে, তিনি জনগণকে উক্ত ঐশী নির্দেশনা মেনে সত্যের জন্য উঠে দাঁড়াতে এবং বিদ্রোহ করতে উদ্বুদ্ধ করছেন।
উপরিউক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত ইমাম বলেন, ‘এ আয়াতে পাকে আল্লাহ তা‘আলা প্রকৃতির নিকষ অন্ধকার কোণ থেকে শুরু করে মানবতার পথে যাত্রার শেষ প্রান্ত পর্যন্ত তোমাদের জন্য প্রয়োজনীয় সকল কিছুই বর্ণনা করে দিয়েছেন; আল্লাহ তা‘আলা তাঁর অসংখ্য নির্দেশের মধ্যে এ নির্দেশটিকে মানবজাতির জন্য বিশেষভাবে নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আর এটাই ইহকাল-পরকালের মুক্তির জন্য একমাত্র পাথেয়। এটাই আল্লাহর রাস্তায় ক্বিয়াম। এটাই সেই পথ যে পথে আল্লাহর বন্ধু হযরত ইবরাহীম (আ.) তাঁর বন্ধুত্বের মাকামে পৌঁছান এবং নিজেকে প্রকৃতির বিভিন্ন প্রতিভাসের দাসত্ব থেকে মুক্ত করেন….’ (সাহিফায়ে ইমাম, ১২তম, পৃ. ২১)
কোরআনের নির্দেশনা বাস্তবায়ন
ইমাম তাঁর আন্দোলন এবং বিপ্লবকে একমাত্র ইসলামের শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্যই মনে করতেন। ইরাকের নাজাফে দেয়া ‘যোগ্যতাস¤পন্ন ন্যায়বান মুজতাহিদগণের শাসনব্যবস্থা (বেলায়াতে ফাক্বীহ্)’ শীর্ষক বক্তৃতার একাংশে ইমাম বলেন : ‘এই দর্শনের ¯্রষ্টা বর্তমানে আশা করেন যে, জনগণ ন্যায়সঙ্গত আচরণ করবে এবং ঐশী নির্দেশনা অনুযায়ী চলবে। এ দর্শনটি চিরকালের জন্যই প্রযোজ্য। এটি আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত অপরিবর্তনীয় একটি বিধান। তাই আজ এবং সব সময়ের জন্যই ইসলামি ব্যবস্থা ও অনুশাসনসমূহকে বাস্তবায়ন ও পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য শাসক হিসেবে একজন যোগ্যতাস¤পন্ন মুজতাহিদ (ওয়ালিয়ে ফাক্বীহ্)-এর উপস্থিতি অবশ্য প্রয়োজন। এমন একজন শাসক যিনি আগ্রাসন, যুলুম ও অপরের অধিকার হরণকে প্রতিহত করবেন এবং তিনি হবেন বিশ্বস্ত, আমানতদার, আল্লাহর বান্দাদের সমর্থনকারী। তিনি মানুষকে ইসলামের শিক্ষা, বিশ্বাস, আদেশ এবং বিধানসমূহের দিকে পরিচালিত করবেন। তিনি দ্বীন, ইসলামি আইন এবং অনুশাসনের বিরুদ্ধে ইসলামের শত্রুদের অপপ্রয়াসকে নস্যাৎ করবেন। আমীরুল মুমিনীন ইমাম আলী (আ.)-এর খেলাফতের উদ্দেশ্য কি এছাড়া অন্য কিছু ছিল?…’ (বেলায়াতে ফাক্বীহ্, পৃ. ৪০-৪১)
‘ইসলামি বিধান অনুযায়ী দৈহিক সাজা প্রদান’ শীর্ষক আইনটির পক্ষাবলম্বন, উচ্চ আদালত থেকে ক্রমান্বয়ে সকল অনৈসলামি আইন অপসারণ, বিপ্লবোত্তর ইরানে ‘পূর্ব নয়, পশ্চিমও নয়’ শীর্ষক পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়ন, ইসলামের শত্রুদের উপরে প্রভাব বজায় রাখার নীতি গ্রহণ (‘আল্লাহ কখনোই মুসলমানদের উপরে এর শত্রুদের প্রভাবশালী করবেন না’ Ñ এই আয়াতকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ইসলামি নীতি) এবং পবিত্র হজের সময় র্শিক্কে প্রত্যাখানের ও ইসলামি অনুশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ছিল ইমামের কোরআনী ঐশী নির্দেশনা বাস্তবায়নের মিশনের অন্তর্ভুক্ত।
কোরআন : মুসলমানদের ঐক্যের প্রধান অক্ষ
সম্মানিত ইমাম মনে করতেন যে, কোরআন নিজেই মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যের সবচেয়ে বড় উপাদান হতে পারে।
‘তোমরা কোরআন এবং ইসলামের নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করলে শত্রুরা তোমাদের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে দাসত্বের নিগড়ে আবদ্ধ করতে সক্ষম হবে না। উপনিবেশিক শক্তিগুলো তোমাদের সার্বভৌমত্ব এবং সম্মান (জাতিগত) কেড়ে নিতে সক্ষম হবে না।’ (সাহিফায়ে ইমাম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪১১)
আরেক প্রেক্ষিতে ইমাম বিশ্বের সকল মানুষকে (মুসলিম-অমুসলিম) কোরআনের লুক্কায়িত শক্তির সাথে নিজেদের যুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘হে মানুষ! তোমরা যারা কোরআন আর ইসলামের মহাসাগর থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছ, তোমরা তোমাদের বোধশক্তিকে জাগ্রত কর এবং এই মহাসাগরে পুনর্বার যুক্ত হও, এই পরমালোক থেকে ত্রাণ গ্রহণ কর যাতে বৈশ্বিক লুটেরাদের লোলুপ দৃষ্টি তোমাদের থেকে রুদ্ধ হয়ে পড়ে এবং তাদের ঔদ্ধত্ব প্রদর্শন ও যুলুমের হাত খসে যায় আর তোমরা একটা সম্মানের অস্তিত্ব ও মানবিক মূল্য অর্জনে সক্ষম হও।’ (সাহিফায়ে ইমাম, ৬তম খণ্ড, পৃ. ৫১৬)
অনুবাদ : মাহদী মাহমুদ

সম্পাদকীয়

হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-এর ওফাত বার্ষিকী
৩ জুন ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-এর ২৭তম ওফাত বার্ষিকী। ২৭ বছর আগে ১৯৮৯ সালের এ দিনে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাই এ দিনটি ইরানি জাতির জীবনে গভীর শোকাবহ দিনসমূহের অন্যতম। ইরানি জাতির জন্য তিনি যে অবদান রেখে গেছেন সে কারণে তারা তাঁকে প্রতিনিয়ত স্মরণ করে, তবে স্বভাবতঃই এ দিনটিতে ইরানি জনগণ, বিদেশস্থ ইরানি মিশনসমূহ, প্রবাসী ইরানিগণ এবং বহির্বিশ্বে ইসলামি বিপ্লবের সমর্থকগণ তাঁকে বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা সহকারে বিশেষভাবে স্মরণ করেন।
হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) তাঁর অনন্য অবদানের দ্বারা শুধু ইরানি জনগণকেই নয়; বরং সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্কে ও বিশ্বের সকল অধিকারবঞ্চিত জনগণকে চিরদিনের জন্য কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করে রেখে গিয়েছেন।
হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-এর নেতৃত্বে ইরানি জনগণ যে বিপ্লবকে বিজয়ী করে তোলেন তা ইরানি জাতিকে একই সাথে যেমন জাহেলিয়াতের নাগপাশ থেকে মুক্ত করে পূত-পবিত্র ইসলামি পরিবেশে জীবন যাপন করার জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়, একই সাথে তাদেরকে আড়াই হাজার বছরের স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের গোলামি ও বিজাতীয় বলদর্পী শক্তির তাঁবেদারি থেকে মুক্তি দেয়। এভাবে ইরানি জনগণ তার হাজার হাজার বছরের ইতিহাসে এই প্রথম বারের মতো আক্ষরিক অর্থেই প্রকৃত মুক্তি ও স্বাধীনতার অধিকারী হয় এবং হযরত ইমামের (রহ্.)-এর পথনির্দেশ অনুযায়ী ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। ফলতঃ ইরান আধিপত্যবাদী বলদর্পী শক্তির রক্তচক্ষু ও কঠিন চাপকে উপেক্ষা করে বিপ্লব বিজয়ের পর থেকে বলয়মুক্ত প্রকৃত স্বাধীন পথে চলার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হয়Ñ যা বিশ্বের মুসলিম ও অধিকারবঞ্চিত জনগণের জন্য প্রেরণাদায়ক দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠা করেছে।
হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) একদিকে যেমন ছিলেন খাঁটি মুহাম্মাদী ইসলামের পতাকাবাহী মুজতাহিদ, দ্বীনী ও আধ্যাত্মিক নেতা, অন্যদিকে ছিলেন অনন্যসাধারণ সমাজবিপ্লবী। ফলে শুরু থেকেই কেবল ইরানেরই নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের রাজনীতি ও তার গতিধারা প্রতিনিয়ত তাঁর নখদর্পণে ছিল। এ কারণে দেশি-বিদেশি রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে তিনি যেসব ভবিষ্যদ্বাণী করেন তা বাস্তব রূপ পরিগ্রহ করে বিশ্বের পর্যবেক্ষক মহলকে বিস্মিত করেছে।
হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন যে, আগামী দিনের বিশ্ব হবে ইসলামের বিশ্ব এবং এর প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের জন্য তিনি সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্কে উদাত্ত কণ্ঠে আহ্বান জানান, আর তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে এ প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে। তিনি মুসলমানদেরকে ঐক্যের প্রতি আহ্বান জানান এবং ইসলামের দুশমন শক্তির ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সতর্ক করে দেন। তিনি ইসলামের দুশমনদের ক্রীড়নক সালমান রুশ্দীর বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ ঘোষণা করেন যাতে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্ কণ্ঠ মিলায়, ফলে রুশ্দীকে কেন্দ্র করে দুশমনদের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র পুরোপুরি নস্যাৎ হয়ে যায়। এছাড়া হযরত ইমাম কর্তৃক ঘোষিত ‘ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ’ ও ‘কুদ্স্ দিবস’ উম্মাহ্র ঐক্য প্রক্রিয়ায় বিরাট অবদান রেখেছে। তিনি শিয়া-সুন্নি বিভক্তি সৃষ্টি যে ইসলামের দুশমনদের ষড়যন্ত্র তা স্মরণ করিয়ে দিয়ে মুসলমানদেরকে এর বিরুদ্ধে সতর্ক করে দেন। ফলে ইসলামের দুশমনদের বহু বিলিয়ন ডলারের এ ষড়যন্ত্র তাদেরকে তাদের আশানুরূপ ফল দিতে সক্ষম হয় নি।
হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) ফিলিস্তিন সমস্যাকে মুসলিম উম্মাহ্র এক নম্বর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং এর একমাত্র সমাধান নির্দেশ করেন অবৈধ যায়নবাদী ইসরাইলকে উৎখাত করে সমগ্র ফিলিস্তিন ভূখণ্ড জুড়ে অখণ্ড ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। প্রথমে অনেকেই এটাকে উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য ও ইসরাইলকে এক অপরাজেয় শক্তি মনে করলেও হযরত ইমামের (রহ্.) প্রেরণায় গড়ে ওঠা হিযবুল্লাহ্ ও হামাস ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছে যে, হযরত ইমামের এ স্বপ্ন বাস্তবসস্মত।
হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) তাঁর দূরদর্শী রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণ শক্তির বদৌলতে যেসব ভবিষ্যদ্বাণী করেন তার অনেকগুলোই ইতিমধ্যেই বাস্তব রূপ পরিগ্রহ করেছে। তিনি বলেছিলেন যে, এরপর থেকে কমিউনিজমকে ইতিহাসের জাদুঘরে খুঁজতে হবে; বাস্তবেও তা-ই হয়েছে। তিনি সাদ্দাম ও হুসনী মোবারকসহ মুসলিম জাহানের একনায়কতান্ত্রিক ও রাজতান্ত্রিক সরকারগুলোর পতনের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন; এর মধ্যে বেশ কয়েকটির পতন ইতিমধ্যেই বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছে এবং সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় যেগুলো টিকে আছে সেগুলোর অবস্থাও বর্তমানে খুবই নড়বড়ে এবং অদূর ভবিষ্যতে সেগুলোরও পতন অবশ্যম্ভাবী।
আমরা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-এর ওফাত বার্ষিকী উপলক্ষে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্র প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি এবং তাঁর সমুন্নত মর্যাদার জন্য আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে দো‘আ করছি।

খৈয়াম, রুবাইয়াত ও কাজী নজরুল ইসলাম

ড. ফরহাদ দরুদগারিয়ান

গিয়াস উদ্দীন আবুল ফাতাহ উমর ইবনে ইবরাহীম খৈয়াম নিশাপুরী। তিনি ছিলেন একাধারে প্রাজ্ঞ মনীষী, গাণিতিক, জ্যোতির্বিদ ও বিখ্যাত ইরানি কবি। অধিকাংশ প্রাচীন সূত্রে তাঁর খ্যাতি হচ্ছে খৈয়ামী নামে। কিন্তু অপেক্ষাকৃত আধুনিক সূত্রগুলোতে তিনি খৈয়াম নামেই প্রসিদ্ধ। অভিধানে খৈয়াম অর্থ তাঁবুনির্মাতা। জালাল উদ্দীন হুমায়ীর মতে খৈয়ামী নামের শেষে যে ‘য়ী’ প্রত্যয় রয়েছে তা দ্বারা বোঝা যায়, তিনি নিজে তাঁবুনির্মাতা ছিলেন না; বরং তিনি এমন কারো সাথে সম্বন্ধযুক্ত যিনি তাঁবুনির্মাতা ছিলেন। (জালাল উদ্দীন হুমায়ী, খৈয়ামনামে, পৃ. ২২১) বিভিন্ন সূত্রে তাঁকে তাঁর নামের সাথে ‘হুজ্জাতুল হক’ (আল্লাহর হুজ্জাত বা দলিল), ‘খাজায়ে ইমাম’ (মহামান্য ইমাম) ও ‘হাকীমে ফীলসুফ’ (দার্শনিক মনীষী) প্রভৃতি যোগে আখ্যায়িত করা হয়েছে। (রেযাযাদে মালিক, দানেশনামেয়ে খৈয়াম, পৃ. ৪৩-৪৪)
উমর খৈয়ামের জন্মতারিখ সঠিক ভাবে জানা নেই। আবুল হাসান বায়হাকী বলেন, তাঁর জন্ম হয়েছে মিথুনরাশিতে। কয়েকটি সূত্রে যেমন (বায়হাকী, পৃ. ১১২), তীর্থ (ভারতীয় গবেষক, পৃ. ৩২-৩৪) খৈয়ামের জন্মদিন ১৮ মে ১০৪৮ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ৩রা খোরদাদ ৪২৭ ইরানি বর্ষ এবং ৪৩৯ হিজরি সাল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। খৈয়াম জন্মগ্রহণ করেন নিশাপুরে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, তাঁর পূর্বপুরুষরা সবাই ছিলেন এই শহরের আদি বাসিন্দা। বায়হাকীর বর্ণনা অনুযায়ী (পৃ. ৯৭) হাকীম আবুল হাসান আনবারীর কাছে ‘মাজিস্তী’ কিতাবটি অধ্যয়ন করেন। তিনি তখনকার হানাফী ফিকাহশাস্ত্রবিদ শেখ মুহাম্মাদ মানসুরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং ফিকাহশাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। খৈয়াম নিজেই ‘রেসালা আল কাউন ওয়াত তাকলিফ’ গ্রন্থে শায়খুর রাঈস আবু আলী ইবনে সীনাকে নিজের শিক্ষক বলে উল্লেখ করেছেন। তবে ইবনে সীনার মৃত্যু যেহেতু ৪২৮ হিজরিতে অর্থাৎ খৈযামের জন্মের আগেই হয়েছে সেহেতু বলা যায় যে, ইবনে সীনা অন্য কারো মাধ্যমে অথবা তাঁর রচনাবলির সুবাদে খৈয়ামের কাছে শিক্ষক হিসেবে স্বীকৃত হয়েছেন। (রেযাযাদে মালিক, প্রাগুক্ত) আরব ঐতিহাসিক ও জীবনীকার সাফাদী বলেন যে, খৈয়াম ছিলেন ইবনে সীনার বিখ্যাত শিষ্য বাহমানইয়ার ইবনে মরযেবানের শিষ্য। (ইকবাল আশতিয়ানী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪০৪-৪০৭)
খৈয়ামের সমসাময়িক মনীষীবৃন্দ, যেমন: সানায়ী গজনবী, আবুল কাসেম যামাখ্শারী, আরুযী সামারকান্দী ও আবুল হাসান বায়হাকী প্রমুখ যে তাঁকে ‘হাকীম’ (প্রাজ্ঞ মনীষী) ও গাণিতিক হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং কবি হিসেবে তাঁর নাম বা তাঁর রুবাইয়াতের নাম তাঁর সময়ের কোন রচনায় পাওয়া যায় না, তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে, কবিতাচর্র্চা তাঁর আসল পেশা ছিল না; বরং বৈজ্ঞানিক জ্ঞান-গবেষণার ফাঁকে যখন অবসর হয়েছেন তখন তিনি কৌতুহলবশত কবিতা রচনা করেছেন। (ফুরুগী, পৃ. ১৭-১৯) তাছাড়া কবিতাগুলো সংরক্ষণ বা বিন্যস্ত করে রাখার ব্যাপারেও তিনি তেমন গুরুত্ব দিতেন না।
বর্তমানে সবচেয়ে প্রাচীন যে রচনায় খৈয়ামের নামে ফারসি রুবাইয়ের উল্লেখ পাওয়া যায় তা হচ্ছে ইমাম ফখরুদ্দীন রাযীর একটি রেসালা (৬০৬ হিজরি), যা তাফসীরুল কুরআনে সন্নিবেশিত। (মীনাবী, আয খাযায়েনে তুরকিয়ে, পৃ. ৭১)। হিজরি সপ্তম শতকে জামাল খলিল শারওয়ানী রচিত ‘নুযহাতুল মাজালিস’ গ্রন্থ, যাতে ২৯০ জন ফারসি কবির ৪০০০ প্রাচীন রুবাই সন্নিবেশিত আছে, সন্দেহাতীতভাবে বলা যায় যে, তা উমর খৈয়ামের মৌলিক রুবাইসমূহ চিহ্নিত করার একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ সূত্র। তাতে খৈয়ামের নামে মোট ৩৩টি রুবাই পাওয়া যায়। (ফুরুগী, পৃ. ২৯-৩৫)
১৮৫৭ সালে লন্ডনের অক্সফোর্ড বুদলিয়ান গ্রন্থাগারে খৈয়ামের রুবাইয়াতের একটি সংকলন ফিটজিরাল্ডের হস্তগত হয়। তিনি এর ৭৫টি রুবাইয়ের মুক্ত অনুবাদ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং খৈয়ামের আত্মজীবনীসহ বিন্যস্ত করেন এবং ১৮৫৯ সালে সেটার ২৫০ কপি মুদ্রিত করেন। ১৮৬৮ সালে দ্বিতীয় মুদ্রণ প্রকাশ হওয়ার পরই সর্বমহলে বইটির ব্যাপক সাড়া পড়ে যায় এবং বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্জন করে। এরপর রুশ-ইরানবিশারদ যুকুফস্কি (১৮৫৮-১৯১৮ খ্রি.) খৈয়াম সম্বন্ধে এবং ‘উ™£ান্ত রুবাইয়াত’ শিরোনাম দিয়ে তাঁর গবেষণাকর্ম পরিচালনা করেন এবং তাঁর কতিপয় মৌলিক রুবাই মুদ্রিত করেন। ডেনমার্কের বিখ্যাত লেখক আর্থার ক্রিস্টান সেন ‘খৈয়ামের রুবাইয়াত নিয়ে গবেষণা’ শিরোনামে একটি গ্রন্থে তাঁর কতিপয় মৌলিক রুবাই মুদ্রিত করেন। (ক্রিস্টান সেন, পৃ. ৪৬)। তাঁর পরে জার্মান পণ্ডিত ফেডরিস রূযেন (১৮৫৬-১৯৪৫ খ্রি.) খৈয়ামের নির্ভরযোগ্য রুবাই নিয়ে আরেকটি গ্রন্থ জার্মান ভাষায় মুদ্রিত করেন। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি খৈয়ামের রুবাইয়াত নির্ণয় ও বাছাই করার মানদণ্ড হিসেবে ‘রুবাইয়াতে কলীদী’ বা চাবিরূপ রুবাইয়াত মতবাদ উপস্থাপন করেন। (মীনুরেস্কী, পৃ. ৩৬)
ইরানে সাদেক হেদায়াত ও আলী দাশ্তী ছিলেন প্রথম সারীর গবেষক যাঁরা ইউরোপীয় ইরানবিশেষজ্ঞদের রচনাবলি অধ্যয়ন করে ‘রুবাইয়াতে খৈয়াম’ নিয়ে সমালোচনামূলক মূল্যায়ন ও গ্রন্থনায় নতুন পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। সাদেক হেদায়াত ১৩০৩ ইরানি সালে রুবাইয়াতে খৈয়াম (১৯২৪) এবং খৈয়াম সংগীত ১৩১৩ সালে (১৯৩৪) প্রকাশ করেন। তিনি প্রাচীন রচনা থেকে ১৪টি চাবিরূপ রুবাই নিয়ে ১৪৩টি খৈয়াম সংগীত চয়ন করেন। ১৩২০ ইরানি সাল তথা ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মাদ আলী ফুরুগী ৬৬টি রুবাইকে অপর ১১৩টি রুবাই বাছাই করার চাবি হিসেবে ব্যবহার করেন, যা হেদায়াতের কাজের চেয়ে আরো বেশি সমাদৃত হয়। অনুরূপভাবে আলী দাশ্তী, রশীদ ইয়াসেমী ও মুহসিন ফরযানার মতে অন্যান্য ইরানি গবেষকও খৈয়ামের রুবাইয়াত বাছাইয়ের কাজ আঞ্জাম দেন এবং আরো নতুন রুবাই খৈয়ামের বলে শনাক্ত করেন। খৈয়ামের রুবাইয়াতসমূহ অন্যদের সাদৃশ্যপূর্ণ রুবাইয়ের সাথে মিশ্রিত হয়ে যাওয়ার বিষয়টি ফারসি ভাষায় খৈয়াম মতবাদ নামে একটি মতবাদের বিদ্যমানতা প্রমাণ করে। বিষয়টিকে ক্রিস্টান সেন ঠিকই এই রুবাইয়াতের ‘ইরানি প্রাণসত্তা’ নামে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি মনে করেন যে, এ রুবাইসমূহের মৌলিকতা সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ এর কাব্যিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্বকে কিছুমাত্র হ্রাস করে না।
সাম্প্রতিককালে গবেষকগণ রুবাইসমূহ পরিশোধন করে রুবাইয়াতের অর্থের পরিমণ্ডলটি চিহ্নিত করার প্রয়াস পেয়েছেন। সাদেক হেদায়াত রুবাইয়াতে খৈয়ামকে (১) সৃষ্টির রহস্য (২) জীবনের বেদনা (৩) অনাদির লিখন (৪) কালের চক্রবাক (৫) ঘূর্ণায়মান অণু (৬) যাই হবার হোক (৭) মুহূর্তকে কাজে লাগাই প্রভৃতি শিরোনামে বিভাজিত করেছেন। তবে আলী দাশ্তী এসব রুবাইয়াতকে অস্তিত্বের জগত, অনস্তিত্ব, মৃত্যু, জীবনপ্রবাহ, মাটির কলসি ও আদম প্রভৃতি শিরোনামে বিন্যস্ত করেছেন।

উমর খৈয়াম ও কাজী নজরুল ইসলাম
কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৪৪ সালের শেষভাগে কুরআন মজীদের ত্রিশতম পারা আমপারার অনুবাদের সময় রুবাইয়াতে খৈয়ামের বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেন। নজরুল রচনাবলী তৃতীয় খণ্ডে ১০১ থেকে ১৩৯ পৃষ্ঠায় রুবাইয়াতে খৈয়ামের বাংলা অনুবাদ সন্নিবেশিত আছে। এতে বাংলা ভাষায় একটি ভূমিকা ও ১৯৭টি রুবাইয়ের অনুবাদ সন্নিবেশিত আছে। নজরুল ইসলাম কীভাবে খৈয়ামের সাথে পরিচিত হয়েছিলেন এবং কে বা কোন জিনিস তাঁকে উমর খৈয়ামের রুবাইয়াত অনুবাদ করতে অনুপ্রাণিত করেছিল সে ব্যাপারে সঠিক তথ্য জানা নেই। (আহমদ, ২০০১) কেউ কেউ অনুমান করেছেন যে, হয়ত শ্রী কান্তি ঘোষের রচনা পড়ে তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন। কেননা, নজরুল ইসলাম সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে ফিরে আসার আগেই রুবাইয়াতে খৈয়ামের অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। ফিটজিরাল্ডের অনুবাদ দ্বারা তাঁর প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনাও খুবই কম। কেননা, নজরুল ইসলাম ফিটজিরাল্ডের অনুবাদ ঠিকভাবে জানতেন না এবং তার সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন : ‘যারা খৈয়ামের রুবাইয়াত পড়ে তাঁকে ভোগবাদী বলে মনে করেন, তাঁরা ভুলের মধ্যে আছেন। কেননা, শুধু কতিপয় রুবাইয়ের কারণে তাঁর কবিতা সম্বন্ধে এমন মন্তব্য করা যেতে পারে।’ (আহমদ, পৃ. ৭-৮)। ফিটজিরাল্ডের সাথে নজরুল ইসলামের প্রধান তফাত হচ্ছে ফিটজিরাল্ড খৈয়ামকে নাস্তিক বলে গণ্য করেছেন। কিন্তু নজরুল ইসলাম এ কথা স্বীকার করেন নি, তিনি খৈয়ামকে একেশ্বরবাদী, সুফি এবং শরীয়তপন্থী মুসলমান বলে মনে করেন। নজরুল ইসলাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.) সম্পর্কে খৈয়ামের চারটি রুবাই অনুবাদ করেন এবং বলেন : ‘যে ব্যক্তি ধর্মপ্রাণ অথবা শরীয়তের প্রতি আস্থাশীল নন, তিনি কিছুতেই ধর্মীয় মহান ব্যক্তি ও পয়গাম্বরদের প্রতি এমন ভক্তি ও সম্মান দেখাতে পারেন না।’
নজরুল ইসলাম রুবাইয়াতে উমর খৈয়ামকে ছয় ভাগে ভাগ করেন। (১) অভিযোগ (যুগের নানা চালচিত্রের প্রতি অভিযোগ) (২) নিন্দামূলক (৩) বিরহ (৪) বাসন্তি (৫) ধর্মহীনতা (৬) মুনাজাত (প্রার্থনা)।
তিনি রুবাইয়াত অনুবাদে মূল ফারসির সাহায্য নিয়েছেন। তিনি ‘রুবাইয়াতে খৈয়াম’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘বাজারে উমর খৈয়ামের বলে যে ১০০০ এর বেশি রুবাই পাওয়া যায় তা থেকে ২০০ এর কিছু বেশি, তাও ফারসি ভাষায় রচিত রুবাই থেকে চয়ন করেছি। কেননা, আমার দৃষ্টিতে বাকি রুবাইগুলো খৈয়ামের চিন্তাদর্শনের সাথে মোটেও খাপ খায় না।… আমি আমার পাণ্ডিত্য দেখানোর জন্যে খৈয়ামের ভাব, ভাষা ও বর্ণনারীতিকে মোটেও পরিবর্তন করি নি। অবশ্য এ কাজের জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করেছি।’ নিশ্চয়ই যদি নজরুল ইসলাম ফারসি ভাষার উপর পারদর্শী না হতেন তাহলে তিনি এমন দাবি করতে পারতেন না। (আহমদ, পৃ. ১০) কোন কোন লেখক মনে করেন যে, তিনটি কারণে বাংলায় ‘রুবাইয়াতে খৈয়াম’ এর অন্যান্য অনুবাদক, যেমন ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, কান্তি চন্দ্র, সিকান্দর আবু জাফর, উমর আলী শাহ, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও নরেন দেব প্রমুখ তাঁদের অনুবাদে নজরুল ইসলামের মতো সূক্ষ ও তীক্ষè দৃষ্টি, দক্ষতা ও পাণ্ডিত্য দেখাতে পারেন নি, এই কারণগুলো হচ্ছে-
১. নজরুল ইসলাম ‘রুবাইয়াতে খৈয়াম’ অনুবাদের আগেই ‘রুবাইয়াতে হাফেজ’ অনুবাদ করে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করেন।
২. নজরুল ইসলাম ও খৈয়াম উভয়ে ছিলেন মুসলমান, তাঁদের মধ্যে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অনেক অভিন্নতা ও মিল ছিল।
৩. নজরুল ইসলাম ফারসি ভাষা জানতেন এবং সরাসরি ফারসি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন। (সাঈদ, ২০০৪, পৃ. ১১, ১২)
কাজী নজরুল ইসলাম পূর্ণ দক্ষতা, রুচিবোধ ও নিজস্ব শৈল্পিক আঙ্গিকে ‘রুবাইয়াতে খৈয়াম’কে বাংলাদেশের সমাজে উপস্থাপন করতে সক্ষম ও সফল হয়েছেন।

‘রুবাইয়াতে খৈয়াম’ এর বিষয়বস্তু ও বৈশিষ্ট্য
উমর খৈয়াম কবিতার কাঠামো বা শব্দ চয়ন ও পরিভাষা ব্যবহারে কিংবা কাব্যভাবনায় অন্য কোন কবিকে অনুসরণ করেন নি। কেননা, তাঁর কাব্যরীতি সম্পূর্ণ আলাদা। যখন ‘খৈয়াম আদর্শ’ বলা হয় তখন তাঁর কাব্যভাবনাকেই বুঝানো হয়। তিনি কেবল সংক্ষিপ্ততার কাব্যালঙ্কার ব্যবহার করেছেন। তাঁর কবিতার ভাবধারা দার্শনিক। তাও আংশিক ও বাস্তবানুগ। যা সহজে শ্রোতার উপর প্রভাব বিস্তার করে। ফেরদৌসির মতো তাঁর ভাষার বৈশিষ্ট্য ছিল ফারসির প্রতি সর্বাধিক গুরুত্বারোপ। নেহাত প্রয়োজনে আরবি শব্দ ব্যবহার করেছেন। তাঁর কবিতার কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু হচ্ছে :
(১) সৃষ্টিজগতের রহস্য
آنان که محیط فضل و آداب شدند
در جمع کمال شمع اصحاب شدند
ره زین شب تاریک نبردند برون
گفتند فسانه ای و در خواب شدند.
জ্ঞান গরিমায় ঋদ্ধ ও যশস্বী যারা মহিয়ান
পূর্ণতার গুণে যারা সবার মধ্যমণি আজ
আঁধার রাতের ঘোমটা খুলতে পারে নি তারা কেউ
বলেছেন কতক রূপকথা, ঘুমিয়ে গেছেন তার পরে।
(২) জীবনের বেদনা
افسوس که بی فایده فرسوده شدیم
وز داس سپهر سرگون سوده شدیم
دردا و ندامتا که تا چشم زدیم
نا بوده به کام خویش نابوده شدیم.
আফসোস যে অনর্থক নিঃসার ¤্রয়িমাণ হলাম
আকাশের কাস্তে বিছিয়ে দিয়েছে জমিনে নিঃস্ব
হায় আফসোস, হায় বেদনা! চোখের পলক না ফেলতে
ধ্বংসে তলিয়েছি, আশা-আকাক্সক্ষা রয়ে গেল অপূরণ।
(৩) কালের চক্রবাল
افسوس که نام جوانی طی شد
وان تازه بهار زندگانی طی شد
حالی که و را نام جوانی گفتند
معلوم نشد که او کی آمد کی شد.
আফসোস যে যৌবনের সুনাম হারিয়ে গেল
জীবনের এই নতুন বসন্ত ফুরিয়ে গেল
এখন যাকে তারা যৌবন নামে আখ্যায়িত করে
বুঝাই গেল না সে কখন এল, কখন চলে গেল।
(৪) দুনিয়ার তুচ্ছতা
بنگر به جهان چه طرف بر بستم هیچ
وز حاصل عمرم چیست در دستم هیچ
شمع طربم ولی چو بنشیتم هیچ
من جام جمم ولی چو بشکستم هیچ.
দেখ এ জগতটা, চোখ মুদলে তো সব হবে শেষ
জীবনের সঞ্চয়ের আছে কী, আমার হাতে কিছুই না
আমি উৎসবের বাতি বটে তবে বসে গেলে কিছুই না
জামশিদ বাদশাহর বাটি, তবে ভেঙে গেলে কিছুই না।
(৫) মৃত্যুর পর দেহ নিঃশেষ হওয়া
هر ذره که بر روی زمین بوده است
خورشید رخی زهره جبینی بوده است
گرد از رخ آستین به آزرم افشان
کان هم رخ خوب نازنینی بوده است.
পৃথিবীর মাটির উপরে যত অণু পরমাণু ছিল
সূর্য সম আনন, কপাল ছিল সপ্তর্ষি মণ্ডল
আস্তিনের আননের ধুলো পড়েছে আমার লজ্জায়
তাও যে কোন এক প্রেয়সীর সুন্দর আনন ছিল।
(৬) মুহূর্তকে কাজে লাগাই
ای دوست بیا تا غم فردا نخوریم
این یک دم عمر را غنیمت شمریم
فردا که از این دیر کهن در گذریم
با هفت هزار سالگان سربه سریم.
হে বন্ধু! এস কালকের চিন্তা নিয়ে যেন না থাকি
জীবনের এই একটি মুহূর্তকে অমূল্য গণ্য করি
কাল যখন এই পুরনো বসত ছেড়ে চলে যাব
অনন্তকালবাসীদের সাথে হবে বসতবাড়ি।

উপসংহার
আমরা যদি তিনজন ইরানি কবির কথা উল্লেখ করি, যাঁদের কবিতা ইরানের বাইরে ও ভেতরে প্রভাব বিস্তার করেছে এবং শত শত বছর ধরে তা নিয়ে গবেষণা ও আলোচনা-পর্যালোচনা হয়েছে, তাহলে তাঁদের মধ্যে একজন হচ্ছেন হাকীম উমর খৈয়াম এবং তাতে কোন প্রকার সন্দেহের অবকাশ নেই। ইরানপ্রেমিক এই মহান ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিত্ব, প্রাজ্ঞ মনীষী ও অতি উচ্চমানের কবির সঠিক পরিচিতি যদি তুলে ধরা হতো, তাহলে তাঁর প্রকৃত ইতিহাস ও তাঁর চিন্তাধারার গভীরতার চিত্র তুলে ধরা সম্ভব হতো; কিন্তু দুঃখজনকভাবে ফিটজিরাল্ডের অনুবাদ প্রকাশিত হবার পর সংস্কৃতিসেবীদের পক্ষ হতে এমন প্রচার-প্রপাগান্ডার ধু¤্রজাল সৃষ্টি হয়েছে, যার ফলে এই ধু¤্রজালের মাঝে উমর খৈয়ামের আসল পরিচয় ধোঁয়াশা হয়ে গেছে। আলী ইবনে যায়দ বায়হাকী ‘তাতিম্মা সাওয়ানুল হিকমা’ কিতাবে মুহাম্মাদ বাগদাদী সূত্রে হাকীম উমর খৈয়ামের সর্বশেষ যেসব কথাবার্তা এবং এ জাতীয় আরো যেসব শক্তিশালী ও প্রামাণ্য সাক্ষ্য বিদ্যমান আছে, তাতে দেখা যায় যে, উমর খৈয়ামকে নিয়ে যে ধরনের প্রপাগান্ডা চালানো হয়েছে আসল ব্যাপার তার উল্টা। জর্জ সার্টনসহ সকল ঐতিহাসিকের সাক্ষ্য অনুযায়ী হাকীম উমর খৈয়াম ছিলেন জগদ্বিখ্যাত একজন গাণিতিক। ‘চাহার মাকালে’ গ্রন্থে নিযামী আরুযীর বর্ণনা এবং ‘তাযকিরা আরাফাতুল আ‘শেকীন ওয়া আরাসাতুল আরেফীন’ গ্রন্থে তাকিউদ্দীন বালায়ানীর বর্ণনা মোতাবেক উমর খৈয়াম ছিলেন একজন আধ্যাত্মিক দৃষ্টিসম্পন্ন মনীষী এবং আল্লাহর সান্নিধ্যপ্রাপ্ত মহান বুযুর্গ। একই সাথে রুবাই রচনায় একটি নিজস্ব রীতির প্রবর্তক।

তথ্যসূত্র
১. দাশ্তী, আলী, ‘দামী বা খাইয়াম’ (খৈয়ামের সাথে কিছুক্ষণ), ১৩৪৯ (১৯৭০)
২. হুমায়ী, জালাল উদ্দীন, ‘তারাবখানায়ে রুবাইয়াতে খৈয়াম ’, ১৩৬৭ (১৯৮৮)
৩. ফরজানা, মুহসেন, ‘নকদো বাররাসী রুবায়ীহা’য়ে খৈয়াম’, ১৩৫৬ (১৯৭৭)
৪. ফুরুগী, মুহাম্মাদ আলী, ‘রুবাইয়াতে খৈয়াম’, ১৩৭১ (১৯৯২)
৫. ক্রিস্টান সেন, আর্থার, ‘বাররাসী ইন্তেকাদী রুবাইয়াতে খাইয়াম’, ফরীদুন বাদরেয়ী অনূদিত, ১৩৭৪ (১৯৯৫)
৬. মীনুরেস্কী, উইলিয়াম, ‘উমর খৈয়াম’, বাহাউদ্দীন খুররমশাহী অনূদিত, ১৩৭৩ (১৯৯৪)
৭. মুজতবা, মীনাবী, ‘আয খাযায়েনে তুর্কিয়ে’, ১৩৩৫ (১৯৫৪)
৮. নাজম উদ্দীন রাযী, ‘মিরসাদুল ইবাদ’, ১৩৫২ (১৯৭৩)
৯. হেদায়াত, সাদেক, ‘তারানেহা’য়ে খৈয়াম’, ১৩৩৪ (১৯৫৫)
১০. বেলায়াতী, আলী আকবর, ‘হাকীম উমর খৈয়াম, আফরীনান্দেগা’নে ফারহাঙ্গো তামাদ্দুনে ইসলাম ও বূমে ইরান’ (ইসলাম ও ইরান ভূমির সভ্যতা সংস্কৃতির নির্মাতারা), তেহরান, ১৩৮৯
১১. মির্জা ফতেহ আলী, সৈয়দ আলী, ‘রুবাইয়াতে খৈয়াম, দা’নেশনা’মায়ে যাবা’ন ও আদাবে ফা’রসি’, ১৩৮৮ (২০০৯)
১২. বায়হাকী, আবুল হাসান আলী ইবনে যায়দ, ‘তাতিম্মা সাওয়ানুল হিকমা’, ১৩১৮ (১৯৩৯)
১৩. রেযা’যাদে মালেক, রহীম, ‘দা’নেশনা’মেয়ে খৈয়া’মী’, ১৩৭৭ (১৯৯৮)
১৪. নেযামী আরূযী সামারকান্দী, ‘চাহার মাকালে’, ১৩৮৪ (২০০৫)
১৫. নজরুল ইসলাম, ‘নজরুল রচনাবলী’, সম্পাদনা: আব্দুল কাদের, খণ্ড ১-৪, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮৪
১৬. নজরুল ইসলাম, নজরুল ইসলামের ইসলামি গান, সম্পাদনা : আব্দুল মুকিত চৌধুরী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা, ১৯৮০
১৭. আরেফীন, শাহনাজ, ‘কাজী নজরুল ইসলাম ও বাংলাদেশে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের প্রভাব’, তেহরান, ১৩৯৪ (২০১৫)
*ভিজিটিং প্রফেসর
ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

অনুবাদ : ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

শহিদ মুর্তাযা মোতাহহারীর চিন্তাদর্শন ও ইসলামি জাগরণ

ছোট-বড় ঘটনা-দুর্ঘটনা নিয়েই মানুষের সামাজিক পরিবেশ। এসব ঘটনা কখনো সমুদ্রের ঢেউ, কখনো বা আন্দোলন কিংবা ঝড়ের মতো আসে। সমাজেও এরকম বিচিত্র ঢেউ আসে। চিন্তার ঢেউ, মতবাদের ঢেউ ইত্যাদি। মানবসমাজের সবচেয়ে প্রাণময় ও চিরন্তন একটি ঢেউ হলো ধর্মীয় আন্দোলন। মানবীয় প্রবণতা এবং জীবন থেকেই এর উৎস। ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি তুলে মধ্যপ্রাচ্যে যে ইসলামি জাগরণের ঢেউ এসেছে, এই ঢেউ হঠাৎ করে একবারে আসে নি; বরং অনেক আগে থেকেই ভেতরে ভেতরে এর প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। বিভিন্ন দেশ এবং জাতির স্বাধীনতার লক্ষ্যে অনেক জ্ঞানী-গুণী-মনীষী তাঁদের চিন্তা-চেতনা দিয়ে জনগণকে জাগিয়ে তুলেছেন। ধর্মীয় জাগরণের পেছনে জীবন উৎসর্গকারী এরকম একজন চিন্তাবিদ হলেন অধ্যাপক শহিদ মুর্তাযা মোতাহহারী।
শহিদ মুর্তাযা মোতাহহারী ছিলেন একজন তীক্ষè ধীশক্তির অধিকারী পণ্ডিত। ইসলামের দাওয়াতি কাজের শুরু থেকেই তিনি মানবীয় সম্মান-মর্যাদা এবং দ্বীনী জাগরণ নিয়ে ভাবতেন। ব্রিটেনের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ আর্নল্ড টয়েনবি তাঁর স¤পর্কে বলেছেন : ‘একটি সভ্যতাকে যে শক্তিটি অচল করে ফেলে বা মেরে ফেলে, তা হলো শাসককুল কিংবা নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে নতুন নতুন সমস্যা ও জিজ্ঞাসার জবাবে সেই পুরনো উত্তরের পুনরাবৃত্তি করা।’
মোতাহহারী সবসময় নতুন আলোকিত পথের সন্ধানে ছিলেন। ইসলামি দর্শনের ক্ষেত্রে তিনি চেষ্টা করেছেন এই নতুন নতুন পথ উন্মোচন করতে। ফিকাহর ক্ষেত্রে তিনি গবেষণা করতেন এবং ইসলামি আইনের ক্ষেত্রে তুলনা করার চেষ্টা করতেন বা সমন্বয় করার চেষ্টা করতেন। তিনি সবসময় দ্বীনকে অপবিত্রতা থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করতেন। তাঁর দৃষ্টিতে দ্বীন হচ্ছে পানির মতো। পানি যেহেতু মানুষের জন্য জীবনের মতো, সেজন্য মানুষ পানিকে সবসময় পূত-পবিত্র ও দূষণমুক্ত রাখার চেষ্টা করে। দ্বীনও ঠিক সে রকম পানির মতো। তাই আমাদের প্রয়োজনেই দ্বীনকে পবিত্র ও দূষণমুক্ত রাখা উচিত। কেননা, এই দ্বীন আমাদেরকে পানির মতো জীবন দেয়।
মোতাহহারী খুব ভালো করেই জানতেন যে, যেসব নতুন নতুন মতাদর্শ দ্বীনের বিরোধিতা করে তারা নিজেদেরকে এমনভাবে উপস্থাপন করে যেন নতুন কোনো মাযহাব নিয়ে এসেছে এবং পুরনো ধর্মের পরিবর্তে তা প্রবর্তন করবে। এ ক্ষেত্রে তিনি দুটি বিষয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন ছিলেন। এক হলো গোঁড়ামি বা জমাটবদ্ধতা, দুই মূর্খতা। তাঁর ভাষায় : দুটি ভয়ংকর রোগ সবসময় মানুষকে এ ক্ষেত্রে হুমকিগ্রস্ত করে তোলে। গোঁড়ামি রোগ এবং মূর্খতা রোগ। প্রথম রোগের পরিণতি হলো থেমে থাকা, অচলাবস্থা অর্থাৎ উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথ থেকে দূরে অবস্থান করা। দ্বিতীয় রোগের পরিণতি হলো পতন এবং বিচ্যুতি। গোঁড়ামিপূর্ণ সমাজ যা-ই নতুন, তারই বিরোধিতা করে। তারা পুরনোকেই আঁকড়ে ধরে থাকতে চায়।
অধ্যাপক মোতাহহারী তাঁর ‘ইসলামের বিশ্বদৃষ্টির ভূমিকা’ নামক গ্রন্থে ইসলামের খাঁটি এবং শক্তিশালী ব্যবস্থার কুঁড়িগুলোকে ফোটানোর চেষ্টা করেছেন এবং ইসলামকে একটা জীবন্ত দ্বীন, স্বাধীন দ্বীন হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। এই দ্বীন জনগণ এবং সমাজকে দ্রুত স্বাধীনতা ও মুক্তির দিকে ধাবিত করে। ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুযায়ী পবিত্র দ্বীন ইসলাম এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অগ্রসরমান এবং ইসলামের অনুসারীর সংখ্যাও ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ইমানদারদের শক্তিশালী হওয়া, অগ্রগতি এবং ইসলামি আন্দোলনের উন্নয়ন প্রক্রিয়া স¤পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে : ‘তাওরাতে এদের উপমা এরূপ এবং ইঞ্জিলেও এদের উপমা হচ্ছে এরূপ : যেন ছোট্ট বীজ যা দুটি পত্রফলক বের করে; তার পরে তা শক্ত হয়, এর পরে তা মজবুত হয় ও কাণ্ডের উপরে দাঁড়ায়, যা চাষীকে বিস্মিত ও আনন্দিত করে। এভাবেই আল্লাহ মুমিনদের সমৃদ্ধি দ্বারা অবিশ্বাসীদের হৃদয় আক্রোশে পূর্ণ করেন। যারা ইমান আনে ও সৎকাজ করে আল্লাহ তাদের ক্ষমার ও মহাপুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন।’
একটি সমাজের সক্রিয়তা ও জাগরণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে দিকটির প্রতি শহিদ মোতাহহারী বেশি বেশি তাকিদ দিয়েছেন, তা হলো ব্যক্তিত্বের অনুভূতি। একটি জাতি যদি নিজের ব্যক্তিত্বের বোধই উপলব্ধি না করে, সে জাতি কোনোদিনই বিপ্লব কিংবা জাগরণ ঘটাতে পারবে না। তিনি বলেন : ‘এই বিনিয়োগের চেয়ে বড় আর কোনোকিছুর অস্তিত্বই নেই সমাজে। বিনিয়োগটা হলো নিজের ভেতরে ব্যক্তিত্বের বিষয়টি অনুভব করা এবং ব্যক্তিত্বের মানসিকতা পোষণ করা। নিজের আদর্শের ওপর অটল থাকা এবং অন্য কোনো মতাদর্শের ওপর নির্ভর না করাটাই ব্যক্তিত্ব। একটি সমাজ যখন জানতে পারে যে, তার নিজের জন্য, নিজের জীবনের জন্য স্বাধীন একটি দর্শন রয়েছে, সেই দর্শন তার জন্য সবচেয়ে বড় পুঁজি। ঐ সমাজের উচিত তার নিজস্ব দর্শনের জন্য গর্ব করা। যে সমাজ এ ধরনের উপলব্ধি বা অনুভূতি শক্তি হারায় সে সমাজের জন্য দুঃখ হয়।’
আলজেরিয়ার অধিবাসীরা যে দেড় শ’ বছর যুদ্ধ করে ফরাসি উপনিবেশবাদকে ধরাশায়ী করতে সক্ষম হলো এবং স্বাধীনতা লাভ করলো, তা এজন্য সম্ভব হয়েছে যে, তারা নিজেদের ভেতরে স্বতন্ত্র একটি অস্তিত্বের মানসিকতা পোষণ করেছিল। বিশ্বের একটি শক্তিশালী ও ধনী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এভাবে সংগ্রাম করার পেছনে তারা এই ব্যক্তিত্বের অনুভূতি লালন করেছিল যে, আমরা বাঁচলে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বাঁচব অথবা মরে যাব, তবু আমাদের ওপর অন্য কারো শাসন মেনে নেব না।
শহিদ মোতাহহারীর দৃষ্টিতে জাগরণের আরেকটি চালিকা শক্তি হলো দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিশ্বাস। যে বিশ্বাসের শক্তিবলে বলদর্পী উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না, এমনকি সমাজে নিরাপত্তা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানাতেও কুণ্ঠিত হয় না। যে বিশ্বাস দ্বীন এবং রাজনীতিকে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত বলে মনে করে আর অপমান, বলদর্পিতা, পরনির্ভরতা ইত্যাদিকে যথার্থ বলে মনে করে না। ‘আসল কাজ হলো, মানুষকে বিশ্বাস করতে হবে যে,
রাজনৈতিক সংগ্রাম তার ধর্মীয় তথা ইমানী একটি দায়িত্ব। এই বোধটি গড়ে উঠলে কেউ আর লক্ষ্য অর্জনের ব্যাপারে অলসতা দেখাবে না।’
শহীদ মোতাহহারী ইসলামকে যুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও জাগরণের গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি বলে মনে করেন। তাঁর ভাষায় : ইসলাম নিজেকে সমাজের সকল দুর্দশার মোকাবেলায় দায়িত্বশীল বলে মনে করে। ইসলাম এসেছে সমাজ গঠন করতে, ইসলাম এসেছে সরকার এবং হুকুমাত গঠন করতে, ইসলামের দায়িত্ব হলো বিশ্বের সংস্কার, এ ধরনের একটি দ্বীন নির্বিকার থাকতে পারে না।’
ইরানের ইসলামি বিপ্লব স¤পর্কে শহিদ মোতাহহারী বলেছেন : ‘আমি আস্তে আস্তে এই বিশ্বাস লালন করেছি যে, এই ইসলামি বিপ্লব ইরানে সীমাবদ্ধ থাকবে না, কোটি কোটি মুসলমানের ওপর প্রভাব ফেলবে এবং ইরানের জন্য তারা গর্ব করবে এজন্য যে, একটি ইসলামি বিপ্লব শুরু হয়েছে এই ইরান থেকে এবং সমগ্র মুসলিম বিশ্বকে সেই বিপ্লব প্রভাবিত করেছে।’
তাঁর এই বিশ্বাস যে কতটা বাস্তব তা আজকের ইসলামি জাগরণ থেকেই অনুমান করা যায়।

ইমাম খোমেইনীর অসিয়তনামা : মুসলিম উম্মাহর দৃষ্টি আকর্ষণী বিষয়সমূহ

ডা. খিজির হায়াত খান

মানব সভ্যতার ইতিহাসে যুগে যুগে যেসব সমাজ সংস্কারক বিভ্রান্ত মানুষকে পথের দিশা দিতে পৃথিবীতে এসেছেন ইমাম রুহুল্লাহ মুসাভী খোমেইনী তাঁদের অন্যতম। ইরানে ইসলামি বিপ্লবের সফল সংগঠক, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের অবিসংবাদিত নেতা হযরত ইমাম রুহুল্লাহ মুসাভী খোমেইনী (রহ.) ১৯০১ সালে ইরানের কোম শহরের খোমেইন নামক স্থানে জন্মগ্রহন করেন। সারাটি জীবন ধরে তিনি ইসলামি উম্মাহর ইহ-পরকালীন মুক্তি ও কল্যাণের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। এ জন্য জীবনের এক উল্লেখযোগ্য সময় তাঁকে কারাগারে এবং নির্বাসিত হয়ে কাটাতে হয়েছে। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী ইমাম খোমেইনীর সুযোগ্য নেতৃত্বেই ১৯৭৯ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি ইরানের বুকে ইসলামি বিপ্লব সফলতা লাভ করে এবং ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের জন্ম সূচিত হয়। তাই ইরানের বিপ্লবী জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁকে নেতৃত্বে বরণ করে নেয়। ১৯৮৯ সালের ৩ জুন তিনি ইরানের রাজধানী তেহরানে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
ইরানের ইসলামি বিপ্লব সফল হবার পর ইন্তেকালের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত ইমাম খোমেইনী ইসলামি বিপ্লবের হেফাযত, বিকাশ এবং সমগ্র মুসলিম উম্মাহর মুক্তি ও কল্যাণের জন্য কথা, লেখা ও চিন্তার মাধ্যমে সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা করেগেছেন। এমনকি তাঁর ইন্তেকালের পরে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ বিশেষত ইরানের বিপ্লবী জনগণ কিভাবে পথ চলবে সে ব্যাপারে পথনির্দেশনা দানের জন্য তিনি তাঁর অন্তিম বাণী লিখে রেখে যান। অন্তিম বাণীসহ তাঁর এ সমগ্র তৎপরতার একটিই মাত্র লক্ষ্য ছিল, তা হচ্ছে, মহান আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে একজন মুমিন বান্দার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে প্রশান্ত চিত্তে তাঁর সমীপে হাজির হওয়া।
ইন্তেকালের সাড়ে ছয় বছর পূর্বে তিনি তাঁর অন্তিমবাণী রচনা করেন এবং রচনার সমাপ্তিতে হিজরি ১৪০৩ সালের পহেলা জমাদিউল আওয়াল (মোতাবেক ১৫ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৩) স্বহস্তে লিখিত এ বাণীতে সমাপ্তি স্বাক্ষর ও তারিখ লিপিবদ্ধ করেন। এ অন্তিমবাণীর প্রতিটি পৃষ্ঠার শেষে তিনি স্বাক্ষর করেন এবং তাঁর সীলমোহর সহকারে তা ধর্মীয় নগরী মাশহাদে আহলে বাইতের অষ্টম ইমাম হযরত রেযা (আ.)-এর মাযারে হেফাযতের ব্যবস্থা করা হয়। এর একটি অনুলিপি তিনি নিজের কাছে সংরক্ষণ করেন। ইন্তেকালের বছর দুই পূর্বে তিনি তাঁর এ অন্তিমবাণীর মূল কপি মাশহাদ থেকে আনিয়ে নেন এবং কিছুটা সংশাধন করে পুনরায় সীলমোহর করে মাশহাদে পাঠিয়ে দেন।
তাঁর এ অন্তিমবাণী জনসাধারণের উদ্দেশে পড়ে শুনানোর বিষয়েও তিনি এই বলে নির্দেশনা দেন- ‘মৃত্যুর পর এই অসিয়তনামা আহমদ খোমেইনী জনগণকে পড়ে শোনাবেন। যদি তিনি না পারেন তাহলে সম্মানিত রাষ্ট্রপতি অথবা সম্মানিত মজলিশ ¯িপকার অথবা সুপ্রিম কোর্টের সম্মানিত প্রধান বিচারপতি এই কষ্টটুকু বরণ করবেন। আর তাঁরাও যদি অক্ষম হন তাহলে সম্মানিত অভিভাবক পরিষদের কোনো ফকিহ এই কষ্টটুকু কবুল করবেন।’
এ নির্দেশনার আলোকে ইমাম খোমেইনীর ইন্তেকালের পরদিন ৪ঠা জুন (১৯৮৯) সকাল ৯টা ১০ মিনিটে মজলিশে শুরায়ে ইসলামি ভবনে অনুষ্ঠিত নেতা নির্বাচনী বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্যগণ, মজলিশে শুরায়ে ইসলামির সদস্যগণ, মন্ত্রী পরিষদের সদস্যগণ এবং দেশের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যক্তিত্বের যৌথ সমাবেশে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট (বর্তমান রাহবার) হযরত আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী কর্তৃক এ অসিয়তনামা পঠিত হয়। এরপর জাতীয় প্রচারমাধ্যমসমূহে তা প্রচারিত হয়। হযরত আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী কর্তৃক হযরত ইমামের অন্তিম বাণীটি মরহুমের সংরক্ষিত অনুলিপি থেকে পঠিত হয়; পরে এক বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মাশহাদে সংরক্ষিত মূল কপিটি খোলা হয়। হযরত ইমামের স্বহস্তলিখিত এ অসিয়তনামার মূল অংশটি ২৯ পৃষ্ঠা, ৬ পৃষ্ঠা ভূমিকা ও ১ পৃষ্ঠা পরিশিষ্টসহ মোট ৩৬ পৃষ্ঠা।
ইসলামি প্রজাতন্ত্রের প্রায় সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষের জন্য তিনি তাঁর অসিয়তনামায় কিছু কিছু উপদেশ দিয়েছেন। এতে যেমন উপদেশ রয়েছে আলেম, শিক্ষাবিদ, প্রশাসক, প্রচারমাধ্যম, সশস্ত্রবাহিনী, বিচারবিভাগ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের জন্য, তেমনি উপদেশ রয়েছে তরুণ, যুবসমাজ, বক্তা, লেখক, শিল্পী, এমনকি সাধারণ জনগণের জন্য। শুধু তাই নয়; তাঁর অসিয়তনামার একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে বিশ্বব্যাপী মুসলিম উম্মাহর প্রতি হৃদয়গ্রাহী কিছু আবেদন। ইমাম খোমেইনী এ বিষয়টি ¯পষ্ট করেছেন এভাবে- ‘এখানে প্রত্যেককে যা স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করি তা হলো, আমার ধর্মীয়, রাজনৈতিক এই অসিয়ত শুধু ইরানের মহান জনগণের জন্য লিখিত নয়; বরং এটা সকল মুসলমান তথা জাতিধর্ম নির্বিশেষে দুনিয়ার তাবৎ মযলুম জনগণের জন্য এক উপদেশ হিসেবেও পরিগণিত।’
এখানে আমি একটি বিষয় বলে রাখতে চাই যে, আলোচনার শিরোনামের ধরনের কারণে আমি সবক্ষেত্রেই ইমাম খোমেইনীর অসিয়তনামার ঞবীঃ থেকে সরাসরি ছঁড়ঃব করছি যেন আপনারা ইমাম খোমেইনী যে ঝবহপব এ যে কথাটি বলতে চেয়েছেন তা উপলব্ধি করতে পারেন।
হযরত ইমাম খোমেইনীর অসিয়তনামাটি দুটি বৃহৎ অংশে বিভক্ত। প্রথম অংশটি ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, যাতে অনেক বিষয়ের মাঝে তিনি ইসলাম, কোরআন, মহানবী (সা.)-এর অনুসরণ ও কারবালার শাহাদাতের অনুপ্রেরণার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, তিনি মহানবী (সা.)-এর একটি হাদীস উল্লেখ করে তাঁর অসিয়তনামাটি শুরু করেছেন- ‘আমি তোমাদের কাছে অতীব মূল্যবান ও সম্মানিত দু’টি জিনিস (সাকালাইন) রেখে যাচ্ছি : আল্লাহর কিতাব এবং আমার আহলে বাইত। অতঃপর নিশ্চয়ই এ দুটি জিনিস হাউজে (কাউসারে) আমার সাথে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত কখনও পর¯পর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না।’ এই হাদীস স¤পর্কে তিনি বলেন : ‘এটা উল্লেখ করা অত্যাবশ্যক যে, ‘হাদীসে সাকালাইন’ রাসূলে পাক (সা.) থেকে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে (মুতাওয়াতির) বর্ণিত হয়ে এসেছে। সিহাহ সিত্তার হাদীস গ্রন্থাবলি সহ আহলে সুন্নাতের অন্যান্য কিতাবের বিভিন্ন ক্ষেত্রে রেওয়ায়সমূহের অন্তর্নিহিত শাব্দিক তারতম্য সহকারে এই হাদীসের বর্ণনা এসেছে। এই মহান হাদীস সমগ্র মানবজাতির জন্য বিশেষভাবে মুসলমানদের সকল মাযহাবের জন্য এক অকাট্য দলিল (হুজ্জাতে কাতে)।’
মানবজাতির ওপর পবিত্র কুরআনের বৈশ্বিক আবেদনকে ইমাম দেখেছেন এভাবেÑ ‘পাক কোরআন- যে পবিত্র গ্রন্থ মহানবী মুস্তাফা (সা.)-এর ওপর পূর্ণাঙ্গভাবে ও ওহীর সমাপ্তি হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছিল দুনিয়ার মানবজাতিকে সমুন্নত করতে, মুসলমানদের ঐক্য, এমনকি গোটা মানবজাতির ঐক্যের উৎস হিসেবে, যাতে মানবতার যথার্থ উন্নয়ন সাধিত হয়।’
শাহের আমলে সমাজজীবনে পবিত্র কোরআনের শিক্ষার বাস্তবায়নে অবহেলাকে তিনি তুলে ধরেছেনÑ ‘প্রকৃতপক্ষে যে কোরআন মানবজাতির জন্য নিয়ে এসেছে সর্বোৎকৃষ্ট জাগতিক ও আধ্যাত্মিক পথনির্দেশনা সেইদিন পর্যন্ত যেদিন হাউজে কাওসারে নবীর সাথে মিলন ঘটবে, সেই কোরআনুল কারিমকে সমাজ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল।’
কারবালার ময়দানে নবীবংশের ও তাঁদের সাথিদের মহান শাহাদাতের চিরন্তন আবেদনের কথা উল্লেখ করে ইমাম খোমেইনী বলেনÑ ‘জনগণের স্মরণ রাখা উচিত কারবালার প্রেরণাদায়ক ঐতিহাসিক মহাঘটনার স্মৃতিচারণের জন্য ইমামদের নির্দেশনাবলি। নবী (সা.)-এর আহলে বাইতের দুশমনদের ওপর যেসব ধিক্কার ও অভিশাপ আপতিত হয়েছে তা আসলে যুগে যুগে স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জাতিসমূহের বীরত্বপূর্ণ প্রতিবাদ।’
মানবজাতির জন্য মহান ইসলামের নেয়ামত ও গুরুত্বকে ইমাম এভাবে ফুটিয়ে তুলেছেনÑ ‘হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে খাতামুন নাবিয়্যীন রাসূলুল্লাহ (সা.) পর্যন্ত সকল নবী-রাসূল এই ইসলামের হেফাজতের জন্যই কোন বাধাবিপত্তিকে প্রশ্রয় না দিয়ে অবিচল নিষ্ঠা ও সংগ্রামের মাধ্যমে নিজেদের জান কুরবান করেছিলেন, আর কোন বাধাবিপত্তিই তাঁদেরকে এই সুমহান ফারিযা (ফরয কাজ) থেকে পিছু হটাতে পারেনি এবং তাঁদের এই সংগ্রামের দায়িত্ব পরবর্তীকালে নিজেদের কাঁধে তুলে নেন তাঁদের সুযোগ্য সাহাবা ও অনুসারীবৃন্দ এবং পবিত্র ইমাম (আ.) গণ যাঁরা এর হেফাজত ও উন্নয়নের জন্য সাধ্যাতীত চেষ্টা করেছিলেন, এমনকি নিজেদের রক্ত দান করতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি।’
ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে শোষক ও সুবিধাবাদী শ্রেণির বুদ্ধিজীবীরা ইসলামের সমকালীন আবেদন স¤পর্কে অপব্যাখ্যা দিয়ে আসছিল। ইমাম তাদের অপব্যাখ্যার বিষয়টি সামনে রেখে বলেছেনÑ ‘যুক্তি দেখায় যে, চৌদ্দশ’ বছরের পুরোনো ইসলামি অনুশাসনগুলো বর্তমান শতাব্দীর দেশগুলোর প্রশাসন পরিচালনায় অপারগ। কেননা, ইসলাম আধুনিক সভ্যতার প্রতিটি উদ্ভাবন ও প্রগতিবিরোধী পশ্চাৎপদ ধর্ম। তাছাড়া বর্তমান যুগের দেশগুলো দুনিয়ার আধুনিক সভ্যতা এবং আত্মপ্রকাশকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে না। আর একই রকম মূর্খতাপূর্ণ এবং অনেক সময় অসৎ ও বিদ্বেষপূর্ণ শয়তানি প্রচারণাকে অত্যন্ত চমৎকারভাবে ইসলামি কথাবার্তার মোড়কে সাজিয়ে ইসলামপন্থী প্রচারণারূপে উপস্থাপন করে এরূপ ধারণাকে সমর্থনের ছুতা তোলা হয় যে, ইসলাম এবং অন্যান্য ঐশী ধর্ম আসলে আধ্যাত্মিক ব্যাপার স¤পর্কিত, মানবজাতির নৈতিক পরিশুদ্ধির সাথে স¤পর্কিতÑ (এগুলো) পার্থিব কোন কার্যক্রমের সাথে স¤পর্কিত নয়, বরং দুনিয়াকে ত্যাগ করতে আহ্বান জানায়।’
তিনি অসিয়তনামায় আরো লিখেছেনÑ ‘নির্জলা মিথ্যা একটা দাবি যে, ইসলাম নব নব কারিগরি উদ্ভাবনের বিরোধী।… এটা একটা নেহায়েতই আহাম্মকি অভিযোগ ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ, তারা যদি সভ্যতার নিদর্শন ও নতুন কিছুর উদ্ভাবনকে এবং মানুষ ও তার সভ্যতার অগ্রগতিতে অবদান রাখতে সক্ষম কোন আবিষ্কার, নতুন দ্রব্যসামগ্রী ও উন্নতমানের প্রকৌশলকেই বুঝায়, তাহলে তাদের এই ধারণাকে কখনো ইসলাম বা অন্য কোন তাওহীদী ধর্ম বিরোধিতা করেনি এবং ভবিষ্যতেও করবে না। উপরন্তু ইসলাম এবং পাক কিতাব কোরআনুল হাকিম বিজ্ঞানশিক্ষা এবং প্রকৌশল শিল্পের ওপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে।’
ইসলামের সার্বিক বাস্তবায়নের কথা উঠলেই আমরা ইসলামি সরকার প্রতিষ্ঠার কথা বলে থাকি। এই ইসলামি সরকার প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ও এর আবেদন প্রসঙ্গে ইমাম খোমেইনী তাঁর অসিয়তনামায় ¯পষ্ট করেছেন। ‘ইসলামের মহান নবী (সা.) পৃথিবীর অন্য সরকারগুলোর মতোই একটা সরকার গঠন করেছিলেন, কিন্তু তফাতটা ছিল এই যে, নবী করিম (সা.)-এর সরকার গঠনের উদ্দেশ্য ছিল সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রসার ঘটানো।’
‘ইসলাম এবং ইসলামি সরকার হলো খোদায়ী সত্তার প্রকাশ। এর বাস্তব রূপায়ন তোমাদের সন্তানদের জন্য এই জগতের সমৃদ্ধি ও পরজগতের নাজাতের একমাত্র সর্বোত্তম নিশ্চয়তা। ইসলাম অন্যায়, অত্যাচার, লুণ্ঠন, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ এবং দুর্নীতিসমূহের মূলোৎপাটনে সক্ষম। এটা মানবতার সর্বোচ্চ উদ্দেশ্য হাসিলের সহায়ক।’
এ প্রসঙ্গে ইমাম আরো লিখেছেনÑ ‘আপনাদের প্রতি আমার জোরালো নসিহত, কখনো ইসলামের এবং মহান ইসলামি প্রজাতন্ত্রের দুশমনদের বিদ্বেষপূর্ণ প্রচারণায় কর্ণপাত করবেন না। কারণ, ইসলামকে ময়দান থেকে বিতাড়িত করাই এদের মূল উদ্দেশ্য যাতে পরাশক্তিগুলোর স্বার্থ সংরক্ষিত হয়।’
ইমাম খোমেইনীর অসিয়তনামা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, তিনি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন মহানবী (সা.)-এর অন্তিম নির্দেশনা অনুসরণের প্রতি। মুসলিম উম্মাহর স্বকীয় পরিচয় উপলব্ধি, ইসলামি উম্মাহর সর্বক্ষেত্রে কার্যকরী ঐক্য প্রতিষ্ঠা, শত্রু-মিত্র চিহ্নিত করতে উম্মাহর সচেতনতাকে শাণিত করা, পরাশক্তির দাসত্ব থেকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে ও বাস্তব জীবনে স্বাধীনতা অর্জনের প্রতি ছিল তাঁর প্রধান আবেদন। তিনি বলেনÑ ‘আমাদের স্বকীয়তাকে পরখ করার মতো আমাদের আত্মবিশ্বাসকে ধ্বংস করে দিয়েছে যেন আমাদের যা কিছু আছে তা ওদের হাতে তুলে দিয়ে আমরা চুপচাপ অন্ধের মতো বসে থাকি এবং আমাদের দেশ, আমাদের ভাগ্য ওদের হাতে ছেড়ে দেই। এই অন্তঃসারশূন্যতা এবং জড় অনুভূতি বৃহৎ শক্তিগুলো আমাদের মনে গেঁথে দিয়েছে। এই কারণে সকল ক্ষেত্রে আমরা আমাদের নিজস্ব জ্ঞান গরিমা ও ক্ষমতাকে অবিশ্বাস করছি এবং অন্ধের মতো প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অনুসরণ করে চলেছি।’
তিনি আরো লিখেছেনÑ ‘একটা চক্রান্ত হলো উপনিবেশ কবলিত দেশগুলোকে স্ববিরোধিতায় ঠেলে দিয়ে পরমুখাপেক্ষী করা। তাদেরকে পাশ্চাত্য বা প্রাচ্যঘেঁষা করে তোলা। এই হীন চক্রান্ত এত বেশি পরিমাণে প্রভাব বিস্তার করেছে যে, ঐসব দেশ এমনকি তাদের নিজেদের আত্মসম্মানবোধ ও আত্মবিশ্বাসটুকুও হারিয়ে বসেছে। নিজেরা উজ্জ্বল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তম প্রজন্মের অধিকারী হয়েও এখন তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দুই শিবিরকে দুই মূল শক্তিকেন্দ্র বলে বিশ্বাস করেছে এবং স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, তাদের দেশ এই দুই শক্তির যে কোন একটির ওপর নির্ভরশীল না হয়ে থাকতে পারবে না।’
কিছুটা কঠিন ও হৃদয়গ্রাহী ভাষায় ইমাম লিখেছেনÑ ‘হে বিশ্বের নির্যাতিত (মুস্তাযাফ) জনগণ! হে মুসলিম দেশসমূহ!! হে বিশ্বের মুসলমানগণ!!! উঠে দাঁড়ান, সত্যকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরুন এবং পরাশক্তিবর্গ ও তাদের পদলেহী দালালদের প্রচারণামূলক হৈ-চৈ এ ভীতসন্ত্রস্ত হবেন না।’ সমকালীন বিশ্বে ইমাম খোমেইনীর মতো আল্লাহর ওলীর পক্ষেই কেবল এমন ভাষায় কথা বলা সম্ভব হয়েছে।
বিশ্ব ইহুদিবাদী চক্র ও আলআকসা মসজিদ ও ফিলিস্তিন জবরদখলকারী ইসরাইল স¤পর্কে ইমাম খোমেইনী তাঁর অসিয়তনামায় লেখেনÑ ‘আন্তর্জাতিক ইহুদিবাদ, যে নিজের শয়তানি খায়েশ পুরো করার মানসে যে কোন অপকর্ম করতে তৎপর, যার হিসাব লিখতে গেলে কলম থেমে যায়, বর্ণনা দিতে গেলে কণ্ঠ লজ্জায় রুদ্ধ হয়ে আসে। বৃহত্তর ইসরাইল গঠনের ঘৃণ্য দুরাশা তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করে সব রকমের ইবলিসি তৎপরতায়।’
১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের সংঘটনের মধ্য দিয়ে ইমাম খোমেইনী যে স্বাধীনতা, স্বনির্ভরতার পথ দেখিয়েছেন সে অনুপ্রেরণা নিয়ে ইরান আজকে আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। ইমাম খোমেইনী ১৯৮৯ সালে ইন্তেকালের আগেও সেই অনুপ্রেরণাই দিয়ে গেছেন। ইমাম তাঁর অসিয়তনামায় লিখেছেনÑ ‘আমি তাঁদেরকে এই নিশ্চয়তা প্রদান করছি যে, একবার যদি তাঁরা নিজেদের স্বরূপ আবিষ্কার করতে সক্ষম হন, হতাশার চিহ্নটুকু ছুঁড়ে ফেলে দেন, আর অন্যের সাহায্য পাবার প্রত্যাশা পরিত্যাগ করেন, তাহলে অবশেষে আপনারা আপনাদের কর্মক্ষমতা ও সকল কিছুর উৎপাদন ক্ষমতার জ্বলন্ত প্রমাণ রাখতে সক্ষম হবেন। এদের মতো অন্যদের সমপর্যায়েও আপনারা যেতে সক্ষম হবেন, কিন্তু তার শর্ত হলো যে, আপনারা মহাপ্রভু রাহমানুর রাহীম আল্লাহ তাআলার প্রতি পরির্পূণ আস্থা আনবেন।’
ইমাম তাঁর অসিয়তনামায় আরো লিখেছেনÑ ‘আমরা এখন যেহেতু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঐসব ফাঁদ থেকে মুক্ত হয়েছি, আমরা দেখতে পাচ্ছি, বর্তমানের বঞ্চিত জনগণের নবীন বংশধররা আমাদের দেশের শিল্পোন্নয়ন ও প্রযুক্তিগত উন্নতিতে অবদান রাখার জন্য জেগে উঠেছে।’
ইমাম খোমেইনীর এই প্রাণ¯পর্শী আবেদন পরাশক্তির দাসত্বমুক্ত হয়ে ইরানকে একটি উন্নত ও মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে যা মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি প্রেরণাদায়ী মডেল হতে পারে।
পরিশেষে আমি ইমাম খোমেইনীর অসিয়তনামার একেবারে শেষের দিকের অংশ থেকে পাঠ করে আমার বক্তব্য শেষ করব যেখানে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতি ইমাম তাঁর অন্তিম আবেদনে উল্লেখ করেনÑ ‘সকলের প্রতি আমার অন্তিম আবেদন, সদাসর্বদা আল্লাহ তাআলাকে স্মরণ রেখে নিজকে চেনা এবং সকল ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা ও স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে এগিয়ে যান। নিশ্চয় এ ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলা আপনাদের সহায়ক হবেন।’
‘আপনারা শক্তিমত্তা ও দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি সহকারে সম্মুখপানে এগিয়ে যান। সবাই যেন মনে রাখেন, একজন খাদেমের প্রস্থানের ফলে এ জাতির ই¯পাতকঠিন দৃঢ়তায় কোনো ফাটল দেখা দেবে না। কেননা, মহা সম্মানিত খাদেমগণ এ জনগণের সেবায় নিয়োজিত আছেন। আল্লাহই এ জাতি ও বিশ্ব মযলুমদের রক্ষাকর্তা।’
লেখক: পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ

[প্রবন্ধটি হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর ২৭তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে গত ৩ জুন, ২০১৬ বিএমএ মিলনায়তনে ঢাকাস্থ ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র কর্তৃক আয়োজিত আলোচনা সভায় পঠিত হয়।]

ইরান পরিচিতি : কেরমানশাহ

-কামাল মাহমুদ
অবস্থান ও জনসংখ্যা : মধ্য ইরানের পশ্চিমাংশে ইরানের প্রাচীন শহর কেরমান শাহ। এর আয়তন ২৪৫০০ বর্গ কিলোমিটার। ২০১১ সালের হিসেব অনুযায়ী কেরমান শাহ প্রদেশের জনসংখ্যা ১৯,৪৫,২২৭ জন। জনসংখ্যার দিক থেকে এটি ইরানের নবম শহর। এখানকার জমি ফসলের জন্য খুবই উর্বর। এটি মূলত ‘সেফিদে কুহ’ বা সাদা পাহাড়ের ঢালে অবস্থিত। যা পরবর্তীকালে দক্ষিণ দিকে বিস্তৃত হয়েছে সারাব ও ভেলী নদী পর্যন্ত। এ শহর সমুদ্র উপকূল থেকে প্রায় ২০০০ থেকে ৩০০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। তেহরান থেকে কেরমানশাহের দূরত্ব ৫২৫ কিলোমিটার। এটি মূলত ইরানের কৃষি ও শিল্পপ্রধান এলাকার অন্যতম।
ইতিহাস : এটি প্রস্তর যুগীয় ঐতিহ্যের অধিকারী শহর। তৃতীয় শতাব্দীর অনেক শিলালিপি রয়েছে এখানে এবং এগুলোর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক। কেরমানশাহের দক্ষিণাঞ্চলে এর প্রচুর নিদর্শন রয়েছে। বলা হয়ে থাকে প্রায় ৮০০০ থেকে ১০০০০ বছর পূর্বে এখানে লোকালয় বিরাজমান ছিল। বাখতারান, কাহরেমান শহর, কারমিসিন, কারমিনশান, আলিপী, কামবদান নামেও এটি পরিচিত। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পরে স্বল্প সময়ের জন্য এর নামকরণ হয় কেরমান শহর। এর নামকরণ নিয়ে নানা মত প্রচলিত রয়েছে। সবচেয়ে প্রসিদ্ধ মত হচ্ছে চতুর্থ বাহরাম তৃতীয় শতাব্দীতে এ শহর নির্মাণ করে এর নাম দেন কেরমান শাহ।
ইরানের সবচেয়ে বড় কুর্দিপ্রধান এলাকা এটি। কেরমান শাহের দো-আসকাফ্ট, কোবে, ওয়ারওয়ানি, আত-তারিক প্রাচীন যুগের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। এখানে নিকট অতীতের অনেক শিলালিপিও রয়েছে। গাঞ্জ দারেহ, সারাব এবং আসিবাব প্রভৃতি এলাকায় এর নিদর্শনাবলি রয়েছে। ২০০৯ সালে হামাদান বিশ্ববিদ্যালয় এ বিষয়ের ওপর একটি গবেষণা কার্যক্রম গ্রহণ করে। এই বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইরান কালচারাল হেরিটেজ অ্যান্ড টুরিজম অর্গানাইজেশন এর মতে এ শহরের সূচনা হয় খ্রিস্টপূর্ব ৯৮০০ বছর আগে। প্রথম প্রস্তর যুগীয় শহর সাহেহ পশ্চিম কেরমান শাহে অবস্থিত।
কেরমান শাহের মনুমেন্টগুলো হাখামানেশি ও সাসানি যুগের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। পৌরাণিক শাসক পিসদারীয়ানকে এ শহরের প্রতিষ্ঠাতা বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। চতুর্থ বাহরাম চতুর্থ শতাব্দীতে এ শহরের উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন। চতুর্থ হরমুজ ও সাসানি যুগে প্রথম খসরুর সময়কালে এ শহরের অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়। ৬৪০ খ্রিস্টাব্দে আরবরা এবং ১১ শতকে সেলজুকরা এ অঞ্চল শাসন করত। ফতেহ আলী শাহের শাসনামলে (১৭৯৭-১৮৩৪ খ্রি.) অটোমানদের দ্বারা এ শহর আক্রান্ত হয়। ১৯১৫ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে অটোমানদের দ্বারা পুনরায় এ শহরে হামলা হয়। আরব ও অটোমান আক্রমণকালে এ শহর ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে সাফাভি আমলে এ শহরের অনেক উন্নতি ঘটে। ইরাক আক্রমণে এ শহর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। সাব-ই-পোলে জাহাব ও কাস্রে শিরীন এলাকা প্রায় সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয় যা আজো সম্পূর্ণরূপে পুনঃনির্মাণ সম্ভব হয়নি। ইরানের সাংবিধানিক আন্দোলনে এ শহরের ভূমিকা অবিস্মরণীয়।
আবহাওয়া : কেরমান শাহের আবহওয়া মূলত নাতিশীতোষ্ণ। এখানে গ্রীষ্মকালে খরতাপ এবং শীতকালে বৃষ্টিপাত হয়। বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ৪৭৮.৭ মি.মি.। গড় তাপমাত্রা ২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
ভাষা : কেরমান শাহের প্রধান ভাষা কুর্দি, দ্বিতীয় ভাষা ফারসি। এছাড়া এখানে আজেরি ভাষাভাষীও রয়েছে।
যাতায়াত : যাতায়াতের জন্য রয়েছে সাধারণ রেলপথ, সড়কপথ ও আকাশপথ। এখানে রয়েছে একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর যার নাম আসরাফি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এখান থেকে সরাসরি দুবাই, জেদ্দা, দামেশ্ক, ইস্তাম্বুল প্রভৃতি শহরে যাতায়াত করা যায়। ২০০৮ সালে কেরমান শাহে মেট্রোরেল চালু হয়। শহরের মধ্যে এর ১১টি স্টেশন রয়েছে। চলাচলের জন্য বাস, মিনিবাস, টেক্সি প্রভৃতি রয়েছে। তেহরান থেকে হামাদান হয়ে কেরমান শাহ আসতে সময় লাগে ৯ ঘণ্টা, মালায়ার হয়ে ৭ ঘণ্টা।
হোটেল ও বাজার : কেরমান শাহে থাকার জন্য সবচেয়ে ভালো আবাসিক হোটলের নাম জামশীদ। কেনাকাটার জন্য রয়েছে ইসলামি বাজার। এটি কেরমান শাহের তথা ইরানের অন্যতম প্রাচীন বাজার। কাজার আমলে এর গোড়াপত্তন ঘটে। ১৭৪৫ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত এটি সগৌরবে বিদ্যমান। এ বাজার কুর্দিদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকের জন্য বিখ্যাত। এছাড়া এ বাজারে বিভিন্ন প্রকার মসলা, হস্তনির্মিত চামড়াজাত দ্রব্য, ফুল প্রভৃতি রয়েছে। অন্যান্য বাজারের মধ্যে রয়েছে কুর্দি বাজার যা জুয়েলারি, নানা প্রকার রুটি ও বিস্কুটের জন্য বিখ্যাত।
খাবার : বিখ্যাত খাবারের মধ্যে রয়েছে বাযী, নানে রওগ¦ানী, নানে শোকরী, নানে বেরেঞ্জি, নানে খোরমায়ী, তারখীনে, খোরেশ খালাল বাদাম, দানদে কাবাবে কেরমানশাহী, সীবে পালু, অশে আব্বাস আলী, অবগুশতে কেরমানশাহী, অনারে পাবে, আসালে শাহু, আনজিরে রেইজাব প্রভৃতি।
কৃষি ও শিল্প : কেরমান শাহের অর্থনীতি মূলত কৃষি ও শিল্পনির্ভর। এখানে প্রায় ২৫৬টি বিভিন্ন প্রকার কারখানা রয়েছে। এটি ইরানের একটি অর্থনৈতিক জোন। এখানে উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে রয়েছে কার্পেট, চাল দিয়ে তৈরি মিষ্টিÑ যার স্থানীয় নাম ‘নানে বেরেঞ্জি’। এখানকার তেল খুব বিখ্যাতÑ যার স্থানীয় নাম ‘রুনেদান’, আন্তর্জাতিক নাম ‘রোগানে কেরমানশাহী’। ‘কালাম’ নামক এক প্রকার বস্ত্রের বিশ্বব্যাপী খ্যাতি রয়েছে। এছাড়া রয়েছে জাজীম, বিভিন্ন প্রকার বাদ্যযন্ত্র, চামড়াজাত দ্রব্য প্রভৃতি। এখানে উৎপাদিত অন্যান্য কৃষি পণ্যের মধ্যে রয়েছে চাল, সবজি, ফল প্রভৃতি। উৎপাদিত শিল্পপণ্যের মধ্যে রয়েছে চিনি, সিমেন্ট, টেক্সটাইল, আটা, ময়দা প্রভৃতি। এছাড়া পেট্রোলিয়াম শোধনাগার, ফুড প্রসেসিং কারখানা, সুগার রিফাইনারি, ইলেক্ট্রিক উপকরণ প্রভৃতি। ১৯৩২ সালে ব্রিটিশদের সহয়তায় এখানে নির্মিত হয়েছে কেরমান শাহ অয়েল রিফাইনারি কোম্পানি (কেওআরসি)। সাম্প্রতিককালে কেরমান শাহ ইরানের আমদানি-রপ্তানির অন্যতম ট্রানজিট।
দর্শনীয় স্থান : প্রাক-ইসলামি যুগ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রতœতত্ত্ববিদ ও পর্যটকদের কাছে ইরানের অন্যতম দর্শনীয় স্থান হচ্ছে কেরমান শাহ। দারীয়ূশ যুগের পাহাড়ের গাত্রে লিখিত শিলালিপি বিস্তুুন (সময়কাল ৫২২ খ্রিস্টপূর্ব)। এগুলো পাহাড়ের গায়ে প্রায় ১৩০০ মিটার উঁচুতে লিখিত। প্রাচ্যের প্রতœতত্ত্বের এটি অন্যতম নিদর্শন। এটি ইউনেস্কো হেরিটেজ সাইট এর অন্তর্ভুক্ত। কেরমান শাহ থেকে ৪ কিলোমিটার উত্তর দিকে এর অবস্থান। সাসানি স¤্রাট দ্বিতীয় খসরুর সময়কালে (৫৯১-৬২৮ খ্রি.) এগুলোর পুনর্বিন্যাস করা হয়। কানাগাভার আর্কিওলজিক্যাল কমপ্লেক্স কেরমান শাহের অন্যতম দর্শনীয় স্থান। এখানকার নিদর্শনগুলো সাসানি বা তার পূর্বের সময়কার। ১৯৬৮ সালে এটি নির্মাণ করা হয়। পার্সেপোলিসের আদলে এটি গড়ে তোলা হয়েছে।
অন্যান্য দর্শনীয় স্থানের মধ্যে রয়েছে দালাহো, গিলানে র্গাব, ইসলামাবাদে র্গাব, জাভানরুদ, রাভানসার, সোলসে বাবাজানী, সারপুলে যাহাব, কাসরে শিরীন, কোন ব্রীজ, মালেক মাযার, দারবাদ সাহনে, হারকিউলিসের ভাস্কর্য, ইমামুদ্দৌলা মসজিদ, মাসজিদে শাহবাজখান, কেলিসেহায়ে আরামানে, খানকায়ে খাকসার, মাদারাসায়ে কাজ্জাজী, কাভারসারায়ে ফয়েজ আবাদ, তাকীয়ে বেগলবাগী, হার্ন্টাস গুহা, গারে দো আশকাফত, গারে কোবা, গারে কোল দাউদ, গারে অরঅসি, গারে কুলিয়ান, গারে অজমে, তাপ্পে সারাপ, তাপ্পে অসিয়াব, তাপ্পে ভেরগার, কেরমান শাহ জামে মসজিদ, মসজিদে হাজ শাহবাজ খান, মসজিদে আয়াতুল্লাহ বোরুজারদী, মসজিদে চেহেল সেতুন, মাসজিদে শাফেয়ী, মাসজিদে দৌলতশাহ, মাসজিদে শাহজাদে, মাসজিদে নোয়াব, কাজার শাসনামলে (১৭৯৪-১৯২৫ খ্রি.) নির্মিত কেরমান শাহ বাজার মসজিদ, খাজা বুখারী হাউজ প্রভৃতি দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য নিদর্শন। কাজার আমলে প্রতিষ্ঠিত এনথ্রোপলোজি মিউজিয়াম, জাগরেস পালিওলেথিক মিউজিয়াম এবং এপিগ্রাফি মিউজিয়াম, মোয়াভেনাল মূল্ক মসজিদ, কোহেস্তা পার্ক, পার্কে শারফি, পার্কে গারবি, পার্কে কুহেস্তান, পার্কে শাহেদ, পার্কে লব অলু, পার্কে লালে, পার্কে শার, পার্কে শিরিন, পার্কে ফানফার, পার্কে মোয়াল্লেম প্রভৃতি। এছাড়া ব্যতিক্রমী পাখি মিউজিয়াম রয়েছে যেখানে প্রায় দুই শতাধিক পাখির প্রজাতি রয়েছে। এটি কেরমান শাহ থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে কেরমান শাহ ইউনিভার্সিটি অব মেডিকেল সাইন্স, রাযী ইউনিভার্সিটি, ইসলামিক আযাদ ইউনিভার্সিটি অব কেরমান শাহ, কেরমান শাহ ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, পায়ামে নূর ইউনিভার্সিটি, আর্ট্স ইউনিভাসিটি অব কেরমান শাহ, অমুযেশে আলী জেহাদ দানেশগাহে কেরমান শাহী প্রভৃতি। ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে মাদরাসায়ে এসলামিয়া, মাদরাসায়ে মোহতাশেমিয়া, মাদরাসায়ে আকাবের, মাদরাসায়ে দেখতারান প্রভৃতি। ১৯৬৫ সালে কেরমান শাহে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়। এ শহরে ৫টি পাবলিক লাইব্রেরি রয়েছে।
খেলাধুলা : এখানকার খেলাধুলার মধ্যে রয়েছে কুস্তি, ভারত্তোলন, ফুটবল, ভলিবল, তায়াকান্দো, তীর নিক্ষেপ, হকি, হ্যান্ডবল, বাস্কেটবল, কুংফু, রাগবি, কাবাডি, সাঁতার প্রভৃতি। এখানকার বিখ্যাত ফুটবল দলের নাম ‘শিরীন ফারাজ’।
পৃথিবীর প্রাচীনতম শহরের অন্যতম কেরমান শাহ। এখানে একদিকে যেমন রয়েছে কৃষিজাত পণ্য, অন্যদিকে রয়েছে দুই শতাধিক কল-কারখানা। এছাড়া হস্তশিল্প তো রয়েছেই। ইরানের অর্থনৈতিক অন্যতম জোন হচ্ছে কেরমানশাহ। প্রায় দশ হাজার বছর পূর্ব থেকে এখানে লোকালয় গড়ে ওঠে। তবে কেরমান শাহের সবচেয়ে বড় পরিচয় এখানকার ঐতিহাসিক নিদর্শনাবলি। আজো পৃথিবীর ভ্রমণপিপাসু, নৃ-তত্ত্ববিদ ও প্রতœতত্ত্ববিদদের জ্ঞানের খোরাক বিলিয়ে থাকে এই কেরমান শাহ শহরের প্রাচীন স্থাপত্য ও ঐতিহাসিক নিদর্শনাবলি।

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের শিক্ষানীতি

[ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধানে প্রদত্ত ক্ষমতা অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় কল্যাণ নির্ধারণী পরিষদ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে যে সাধারণ নীতিমালা নির্ধারণ করেছেন তার বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে দেশের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ ‘উযমা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নকে একটি অপরিহার্য বিষয় হিসেবে অভিহিত করেন। ‘দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন’ শীর্ষক এ সাধারণ নীতিমালা রাষ্ট্রীয় কল্যাণ নির্ধারণী পরিষদ কর্তৃক প্রণীত ও অনুমোদিত হয়- যাতে দেশের তিন বিভাগের অর্থাৎ বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ ও প্রশাসনের তিন প্রধান অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন।]

‘দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন’ শীর্ষক নীতিমালা
১. দেশের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার ভিত্তি হচ্ছে ইসলামি শিক্ষা দর্শন- যার উদ্দেশ্য হচ্ছে ন্যায় ও ভালো কাজভিত্তিক জীবন গড়ে তোলা (অর্থাৎ ব্যক্তিকে ইসলামি আদর্শ ও অনুসরণীয় হিসেবে সমাজ জীবন গড়ে তোলা), মানুষের ভেতরে নিহিত সম্ভাবনাসমূহের উন্নয়ন সাধন, তাদের আদর্শিক গুণাবলি বৃদ্ধি করা, তাদের জ্ঞান, দক্ষতা এবং শারীরিক ও মানসিক কল্যাণ সাধন, এ লক্ষ্যে নিরক্ষরতার বিলোপ সাধন এবং এমন মানুষ গড়ে তোলা যারা হবে সৎ, খোদাভীরু, নীতিবান, অধ্যয়নশীল, আশাবাদী, কল্যাণকামী, সুখী, সত্যান্বেষী, খোলা মনের অধিকারী, দায়িত্ববান, আইন মান্যকারী, সুবিচারকামী, যৌক্তিক, সৃজনশীল, সমাজ চেতনার অধিকারী, আত্মনির্ভরশীল, ত্যাগী, স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা পোষণকারী এবং যুলুম-নির্যাতন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে অভ্যস্ত।

২. শিক্ষাব্যবস্থার অবস্থানের মানোন্নয়নের মাধ্যমে নার্সারি স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে যার ফলে যথাযথ জনশক্তি গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষেত্র তৈরি হবে- যারা হবে সামাজিক পুঁজি উৎপাদনকারী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এবং অনুমোদিত নীতিমালা ও পথনির্দেশ বাস্তবায়ন ও তার তত্ত্বাবধানের জন্য দায়িত্বশীল। বস্তুত এটি একদিকে যেমন সরকারি দায়িত্ব অন্যদিকে এ কাজে বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠনের সহযোগিতা গ্রহণ করা হবে।

৩. দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের অন্যতম অক্ষ হিসেবে শিক্ষার উপায়-উপকরণসমূহের উন্নয়ন ও বৃদ্ধিকরণ এবং সেই সাথে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করা সহ মানব সম্পদের উন্নয়ন হবে :
৩.১. শিক্ষক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার মানের উন্নয়ন সাধন এবং বৈজ্ঞানিক, পেশাগত ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা সক্ষমতার অনবরত উন্নয়ন সাধন এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে যাঁরা সক্রিয় রয়েছেন তাঁদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, শিক্ষা কেন্দ্রসমূহের ও শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের কারিকুলামের হালনাগাদকরণ, সেই সাথে মটিভেটেড, কার্যকর, দ্বীনী, গঠনমূলক ও যোগ্য শিক্ষক ও শিক্ষাবিদগণেরও শিক্ষাদানের লক্ষ্যে শিক্ষক ও শিক্ষাবিদগণের শিক্ষা পদ্ধতির হালনাগাদকরণ।
৩.২. শিক্ষাব্যবস্থার জন্য কাম্য রিক্রুটিং, প্রশিক্ষণ, সহায়তা, জনশক্তিকে কাজে লাগানোর পদ্ধতির পর্যালোচনা এবং যথাযথ শিক্ষাগত যোগ্যতা ও নৈতিকতার অধিকারী সুযোগ্য ও সুদক্ষ শিক্ষক ও শিক্ষাবিদদের রিক্রুট করার জন্য পথ খুলে দেয়া এবং সে লক্ষ্যে তাঁদের জন্য দক্ষতা বৃদ্ধিকারী কোর্সের ব্যবস্থা করা।
৩.৩. শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সাংস্কৃতিক, বাণিজ্যিক ও সেই সাথে সেবামূলক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে তাঁদেরকে কাম্য পর্যায়ে শিক্ষাসেবা প্রদানের জন্য উৎসাহিতকরণ, সেই সাথে শিক্ষা ক্ষেত্রে কর্মরত সকলের জন্য আর্থিক সমস্যাবলির ও তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যাবলির সমাধানের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ।
৩.৪. শিক্ষকদের মধ্যে পেশাগত দক্ষতা ও জ্ঞানগত মানের উন্নয়ন এবং সেই সাথে চাকুরিরত অবস্থায় প্রশিক্ষণের মানোন্নয়নের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ, তেমনি শিক্ষকদের জন্য বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের তথ্যাবলির হালনাগাদকরণ এবং তাঁদের জন্য উঁচু মানের প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণÑ যাতে তাঁদের মধ্যে সমাজ ও বিশ্বের প্রয়োজন পূরণের উপযোগী কাম্য যোগ্যতা ও দক্ষতা গড়ে তোলা।
৩.৫. শিক্ষা, গবেষণা, সাংস্কৃতিক ও প্রশিক্ষণের উন্নয়নের জন্য নির্ধারিত মানের অধিকারী শিক্ষক গড়ে তোলার লক্ষ্যে এবং সাধারণ, পেশাগত ও বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের শিক্ষার প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে একটি মূল্যায়ন ও পরিমাপন ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
৩.৬. শিক্ষা, গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রসমূহের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়নের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে এ ক্ষেত্রে একটি শিক্ষক সহযোগিতা ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
৩.৭. শিক্ষাব্যবস্থায় কর্মরত সকলের জন্য, বিশেষত শিক্ষকদের জন্য পেশাগত মানসহ বিশেষজ্ঞত্ব, দক্ষতা ও প্রতিযোগিতামূলক কর্মতৎপরতার ভিত্তিতে বেতন-ভাতা প্রদানের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ।

৪. নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর ভিত্তিতে কারিকুলাম ও শিক্ষা পরিকল্পনা তৈরি করা :
৪.১. শিক্ষার বিষয়বস্তুকে হালনাগাদ করা এবং ইসলামি শিক্ষা দর্শনের ভিত্তিতে, দেশের প্রয়োজনের প্রতি দৃষ্টি রেখে এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষার বিষয়বস্তু নির্ধারণ করা ও হালনাগাদ করা এবং ইসলামি ইরানের স্বকীয় পরিচিতি ও সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করা।
৪.২. জনশক্তির ভিতরে চিন্তা, অনুসন্ধান, সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবন ক্ষমতার উন্নয়ন, এ লক্ষ্যে বিভিন্ন শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণ পদ্ধতি কাজে লাগানো এবং বিষয়ভিত্তিক পর্যালোচনা ও গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় যৌক্তিক ও মজবুত চিন্তাক্ষমতা গড়ে তোলা।
৪.৩. শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে আয়াতুল্লাহ উযমা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) কর্তৃক প্রস্তাবিত ধর্মীয় রাজনৈতিক চিন্তাধারা তথা ইসলামি প্রজাতন্ত্রের মূলনীতিসমূহ ও এর মৌল ভিত্তিসমূহ, বিশেষত বেলায়াতে ফক্বীহ (মুজতাহিদগণের অভিভাবকত্ব) এবং দেশের সংবিধানের স্থায়ী ও অপরিবর্তনীয় বিধানসমূহের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ।
৪.৪. ইসলামি সংস্কৃতি ও আদর্শের এবং কোরআনিক শিক্ষার (ক্বিরাআত, তেলাওয়াত ও তাৎপর্য শিক্ষা) বিকাশ সাধন এবং কোরআন মজীদ, হযরত রাসূলে আকরাম (সা.) ও তাঁর আহলে বাইতের সাথে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ততাকে কাজে লাগানো আর নামায আদায়ের সংস্কৃতি গড়ে তোলা।
৪.৫. শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিহিত সক্ষমতা ও সৃজনশীলতার পরিপূরণের লক্ষ্যে তাদের মধ্যকার প্রতিভার স্বীকৃতি দান ও মেধার ঘাটতি চিহ্নিতকরণের মাধ্যমে মূলগতভাবে শিক্ষার্থীদের দ্বারা শিক্ষাদানের পদ্ধতির বিকাশ ঘটানো।
৪.৬. সাংস্কৃতিক ও শিক্ষামূলক কারিকুলাম ও পাঠ-পরিকল্পনা অনুসরণ।
৪.৭. শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিহিত দক্ষতা, জীবন যাপন পদ্ধতি ও সমস্যা সামাধানের যোগ্যতাকে কাজে লাগানো এবং তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের উন্নয়ন সাধনের লক্ষ্যে তারা যা শিখেছে তাদের মাধ্যমে তা বাস্তবে কাজে লাগানো।
৪.৮. কারিগরি ও পেশাগত শিক্ষাকে শক্তিশালীকরণ ও কাজে লাগোনো।

৫. ইসলামি শিক্ষা দর্শন অনুযায়ী, বিশেষ করে নিম্নোক্ত লক্ষ্যে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদেরকে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদান :
৫.১. শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের নৈতিক ও আত্মিক মুক্তি ও উন্নয়নের লক্ষ্যে তাদের মধ্যে ইসলামি জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টিকে শক্তিশালীকরণ এবং সেই সাথে পরিবার পর্যায়ে আধ্যাত্মিকতার উন্নয়নের চেষ্টা চালানো।
৫.২. সামাজিক ক্ষতি ও অচলাবস্থা প্রতিহত করে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক কল্যাণ বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা।
৫.৩. শিক্ষার্থীদের মধ্যে যৌক্তিক শিক্ষার এবং ইসলামি রাজনৈতিক ও সামাজিক আদর্শের উন্নয়নের চেষ্টা করতে হবে, সেই সাথে জাতীয় সংহতি ও ঐক্যকে সুসংহত করা, তাদের মধ্যে দেশপ্রেম গড়ে তোলা এবং বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে বিজাতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আর সেই সাথে স্বাধীনতা, মুক্তি, ধর্মীয় গণতন্ত্র ও জাতীয় স্বার্থের প্রতি সম্মানবোধ গড়ে তোলার জন্য চেষ্টা চালানো।
৫.৪. শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানসিক দিক থেকে সুখ-শান্তি ও প্রফুল্ল ভাব গড়ে তোলার লক্ষ্যে তাদের মধ্যকার সাংস্কৃতিক, আধ্যাত্মিক ও শিল্পকলা সংক্রান্ত মেধা-প্রতিভার উন্নয়ন ও বিকাশ ঘটানো।
৫.৫. স্কুল পর্যায়ে খেলাধুলা ও শারীরিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
৫.৬. শিক্ষা সংক্রান্ত লক্ষ্য ও পরিকল্পনাসমূহের পরিপূরণে সক্ষম সুদক্ষ ও মানসম্পন্ন জনশক্তি গড়ে তোলা ও সরবরাহ করা।

৬. নিম্নোক্ত বিষয়সমূহের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ সহকারে আর্থিক, দাফতরিক ও ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন ঘটাতে হবে :
৬.১. সাংবিধানিক আইনের সাথে মিল রেখে এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারি ব্যবস্থার সাধারণ নীতিমালার সাথে খাপ খাইয়ে, বিশেষ করে শিক্ষা উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় শিক্ষকগণ, পরিবারসমূহ, দ্বীনী শিক্ষাকেন্দ্রসমূহ, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ, সমুন্নত শিক্ষা-গবেষণা কেন্দ্রসমূহ এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংগঠন, সংস্থা ও নির্বাহী প্রতিষ্ঠানসমূহের অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করে প্রতিটি স্তরে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে পুনর্গঠন করা এবং এ লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতাকে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে সক্ষমতা, সংস্কৃতি ও ভিত্তি সমূহকে সক্রিয় ও গতিশীল করে তোলা।
৬.২. এ সাধারণ নীতিমালায় যেসব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়েছে সেগুলোকে বাস্তবে রূপায়িত করার লক্ষ্যে সরকারের বার্ষিক বাজেট অনুমোদনের সময় শিক্ষা খাতের প্রয়োজন পূরণের জন্য যথাযথ বরাদ্দ প্রদানের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার প্রদান করা।
৬.৩. শিক্ষার মানোন্নয়ন ও শিক্ষাব্যবস্থাকে কাম্য পর্যায়ে উন্নীত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উপায়-উপকরণ নিয়োজিত করা এবং তা যথাযথভাবে কাজে লাগাবার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা।

৭. নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপসহ শিক্ষার লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষাঙ্গনসমূহের জায়গার পরিমাণ, অবকাঠামো ও শিক্ষার উপায়-উপকরণসমূহ বাঞ্ছিত পর্যায়ে উপনীত করতে হবে :
৭.১. ইসলামি-ইরানি স্থাপত্য মূলনীতির অনুসরণে স্কুলসমূহকে গড়ে তোলা, পরিচালনা ও বাঞ্ছিত পর্যায়ে উন্নীত করা, সেগুলোর সৌন্দর্য বিধান করা এবং সুসংহত ও নিরাপত্তার বিধান প্রণয়ন করা, শিক্ষাগত প্রয়োজনের প্রতি দৃষ্টি রেখে স্কুলসমূহের স্থান নির্বাচন করা ও তার জায়গাকে বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষাগত প্রয়োজনের ভিত্তিতে বণ্টন করা এবং এরই ভিত্তিতে শিক্ষা কমপ্লেক্সসমূহের ভবন ও ব্লকসমূহ নির্মাণ করা। তেমনি স্কুল প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার ক্ষেত্রে জনগণের সহায়তা আকর্ষণ করা এবং সংশ্লিষ্ট আবাসন ব্যবস্থাপনা করা।
৭.২. প্রয়োজনীয় শিক্ষা ইউনিটসমূহ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সামঞ্জস্য রেখে ও প্রয়োজনীয় ভবন নির্মাণের সম্ভাব্যতার প্রতি দৃষ্টি রেখে নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা।
৭.৩. নতুন স্কুল প্রতিষ্ঠার বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে মডেল প্রদান করা এবং সংশ্লিষ্ট নিয়ম-নীতি ও বিধিমালা কার্যকর করা।
৭.৪. স্কুলসমূহকে তথ্যপ্রযুক্তি উপায়-উপকরণ ও যোগাযোগ উপকরণসমূহ সরবরাহ করা এবং স্কুলসমূহে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তির কাম্য ব্যবহারের ভিত্তি তৈরি করা।

৮. অত্র সাধারণ নীতিমালার প্রথম ধারায় বর্ণিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে স্কুলসমূহের ভূমিকা ও নির্বাচন ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করা এবং স্কুল, পরিবার, সমাজ, প্রচারমাধ্যম ও শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে গঠনমূলক ও প্রকৃত সম্পর্ক গড়ে তোলা।

৯. দেশের সীমান্তবর্তী শহরসমূহে শিক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট এলাকার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সক্ষমতা গড়ে তোলার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা।

১০. বৈপ্লবিক ও মূল্যবোধভিত্তিক আবেদন অনুযায়ী এবং স্কুলসমূহের পরিবেশকে রাজনৈতিক সংঘাতের দ্বারা দূষিত হওয়া থেকে মুক্ত রাখার মাধ্যমে সেগুলোর পরিচালনা ব্যবস্থাকে ভারসাম্যপূর্ণ করে গড়ে তোলা ও স্থিতিশীল অবস্থা বজায় রাখা।

১১. সাধারণ শিক্ষা, উচ্চ শিক্ষা ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থা ও সংগঠনের মধ্যে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, নীতিমালা, পরিকল্পনা ও শিক্ষার বিষয়বস্তুসমূহের মধ্যে সমন্বয় ও সম্পর্ক বজায় রাখা।

১২. ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান সরকারের ২০ বছর মেয়াদি শিক্ষা পরিকল্পনায় যেসব লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে তাতে উপনীত হওয়ার জন্য আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ের মানদণ্ডের প্রতি দৃষ্টি রেখে শিক্ষার স্তরকে গুণগত ও পরিমাণগত দিক থেকে উন্নততর করা।

১৩. দেশের শিক্ষাব্যবস্থার পরিচালনা, পর্যবেক্ষণ, মূল্যায়ন ও নিশ্চয়তা বিধানের লক্ষ্যে একটি সমন্বিত ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের শিক্ষার মৌলিক সংস্কার সংক্রান্ত দলিল
(নিম্নোক্ত দলিলটি ২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসে পবিত্র মাশ্হাদ্ নগরীতে অনুমোদিত হয়।)
‘আমি সংশ্লিষ্ট সকল কর্মকর্তার ও সকল কর্তৃপক্ষের কাছে এ মর্মে সুপারিশ করছি যে, তাঁরা যেন সম্ভাব্য সকল উপায়-উপকরণ বিনিয়োগ করে কিশোর-তরুণদের জন্য নৈতিক, আদর্শিক, বৈজ্ঞানিক ও শিল্পকলা সংশ্লিষ্ট উন্নয়নের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেন এবং তাদের সমুন্নত মূল্যবোধ ও উদ্ভাবনী পর্যায়ে উপনীত হওয়া পর্যন্ত এবং তাদের মধ্যে স্বাধীনতা ও স্বনির্ভরতার চেতনা সংরক্ষণের লক্ষ্যে তাদের সাথে থাকেন।’

হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.), ছাহীফায়ে নূর, ২১তম খণ্ড, পৃ. ৯৬।
বিভিন্ন উপলক্ষে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ উয্মা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ীর বিবৃতি :
আমাদের জন্য শিক্ষার বিবর্তন ও পুনঃপর্যালোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
(২ মে, ২০০৬)
আমাদের দেশে বিদ্যমান বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের চিন্তাধারা, আমাদের ধ্যানধারণা ও আমাদের দর্শনের ওপর ভিত্তিশীল নয়। আমরা এখন যে দর্শনের বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছি আমাদের বর্তমান শিক্ষার ভিত্তি তার ওপরে প্রতিষ্ঠিত নয়।
(২৫ জুলাই, ২০০৭)
‘সংস্কার’ একটি শব্দ মাত্র, কিন্তু তা সত্ত্বেও এ সাদামাটা শব্দটিতে নিহিত তাৎপর্যের বাস্তবায়ন করতে হলে যে পরিশ্রম করতে হবে তার ব্যাপকতাকে একটি মহাসাগরের সাথে তুলনা করা চলে।
(২৫ জুলাই, ২০০৭)
শীর্ষস্থানীয় চিন্তাবিদগণের জন্য শিক্ষার পরিকল্পনা প্রণয়নের লক্ষ্যে অনেক সময় ও শ্রম বিনিয়োগ করা অপরিহার্য। ইসলামি শিক্ষার দর্শন সুস্পষ্ট হতে হবে এবং আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ভবিষ্যৎ দিগন্ত সুস্পষ্টভাবে এ দর্শনের ওপর ভিত্তিশীল হতে হবে। আমরা কিসের সন্ধান করছি এবং আমরা কোন দিকে যাচ্ছি সে ব্যাপারে আমাদের সচেতন থাকতে হবে। শিক্ষার পরিকল্পনাকে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা ও পথনির্দেশের ওপর ভিত্তিশীল হতে হবে। আমাদের জন্য এরই প্রয়োজন রয়েছে। শিক্ষাকে আমাদের অন্যান্য দৈনন্দিন কাজকর্মের ওপর অগ্রাধিকার দিতে হবে। এটাই আমাদের কথার ভিত্তি।
(২ মে, ২০০৬)
দলিল অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষসমূহ :
সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সর্বোচ্চ পরিষদ
শিক্ষা মন্ত্রণালয়
সর্বোচ্চ শিক্ষা পরিষদ

চতুর্থ অধ্যায় : দেশের শিক্ষার জন্য পরিকল্পিত ভবিষ্যৎ চিত্র
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের শিক্ষা সম্পর্কে ২০২৫ সালে যে ভবিষ্যৎ চিত্র নির্ধারণ করা হয়েছে, ইন্ শাআল্লাহ্, তা হবে ইসলামি আদর্শ এবং ইসলামি ও ইরানি সংস্কৃতি ও সভ্যতার ওপর ভিত্তিশীল একটি শিক্ষাব্যবস্থা এবং তা হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর অনুসারী ন্যায়নীতিভিত্তিক একটি বৈশ্বিক সম্প্রদায় গড়ে তোলার ক্ষেত্র তৈরি করবেÑ যাতে উল্লেখযোগ্য ধরনের উন্নয়ন সামর্থ্য তৈরি হবে এবং তা আঞ্চলিক পর্যায়ে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের মর্যাদার জন্য উপযোগী হবে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা হবে এমন যা বিশ্বের অন্যান্য শিক্ষাব্যবস্থার জন্য অনুপ্রেরণা তৈরি করবে এবং সেসব শিক্ষাব্যবস্থার সাথে গঠনমূলকভাবে ও কার্যকরভাবে আন্তঃক্রিয়া করবে। ফলত তা শিক্ষার্থীদের মধ্যে মেধা-প্রতিভার বিকাশ ঘটাবে, তাদের মধ্যে ইসলামি বিপ্লবী পরিচিতি গড়ে তুলবে এবং এতে তাদের ব্যক্তিগত গুণ-বৈশিষ্ট্যসমূহকে বিবেচনায় রাখা হবে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে কার্যকর, শিক্ষণীয়, সুবিচারকামী, অংশগ্রহণমূলক এবং এমন শিক্ষকমণ্ডলী ও পরিচালকগণ দ্বারা সমৃদ্ধ হতে হবে যাঁরা হবেন আল্লাহর প্রতি ঈমানদার, ইসলামি নৈতিকতার অধিকারী, সৎকর্মশীল, আশাবাদী, সংস্কারকামী, বিপ্লবী, ভবিষ্যৎ নির্মাতা, জ্ঞানী, নিষ্ঠার অধিকারী, সততার অধিকারী ও অন্যান্য পছন্দনীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।

২০২৫ সালের ইরানি স্কুল : ভবিষ্যৎ দৃশ্যকল্প
এ ভবিষ্যৎ দৃশ্যকল্প অনুযায়ী ইরানি স্কুলসমূহকে ঐ সময় হায়াতে ত্বাইয়্যেবাহ্ (উত্তম ও পবিত্র জীবন)-এর বাস্তবায়ন করে প্রদর্শন করতে হবেÑ যা শিক্ষা সেবার ও এতদসংক্রান্ত সুযোগ-সুবিধার একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। এটি হবে শিক্ষার্থীদের জন্য এমন একটি ফোরাম যেখানে তাদের পক্ষে তাদের মূল্যায়নের পরিস্থিতি অনুধাবন ও উন্নয়ন সম্ভব হবে, তেমনি তাদের পক্ষে ইসলামি রীতিনীতিভিত্তিক ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্য বিধান করে স্বীয় সমুন্নত পরিচিতি লাভ করা সম্ভব হবে। এর ফলে দেশের সাধারণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার রূপ হবে এই যে, তা বিশ্বজগতের মহান সৃষ্টিকর্তার সাথে ও নিজের সাথে সম্পর্কের ফলশ্রুতিতে একটি সমৃদ্ধ ইসলামি বিপ্লবী সংস্কৃতি প্রদর্শন করবে, ফলত তাদের মধ্যে অন্যান্য বিশেষ নিষ্ঠা, জবাবদিহিতা, আত্মবিশ্বাস, সততা, সুদক্ষতা ও ব্যবসায়িক যোগ্যতা গড়ে উঠবে। তখন তারা অপব্যয়, অপচয় ও বিশ্বের প্রতি নির্ভরশীলতা এড়িয়ে চলতে সক্ষম হবে; তাদের মধ্যে গড়ে উঠবে পারস্পরিক সহমর্মিতা, সম্মানবোধ, আস্থা, নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা, ত্যাগী মনোবৃত্তি, আইন-কানুন ও বিধিবিধান মেনে চলার মানসিকতা, সমালোচনা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা; তারা বৈশ্বিক দাম্ভিক বলদর্পী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করবে, মযলুম, নিপীড়ত ও বঞ্চিতদেরকে এবং ইসলামি বিপ্লবের মূল্যবোধসমূহকে সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করবে। বস্তুত এর ফলে শিক্ষাঙ্গন হবে জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান এবং সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ হবে এর মাধ্যমে দেশের মর্যাদাকে সমুন্নত করা। সেই সাথে স্কুল হবে-
০ স্থানীয় জনগণের জন্য শিক্ষা উন্নয়নের ও জনগণের মানোন্নয়নের কেন্দ্র।
০ এটি হবে স্থানীয়, আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তকারী ও পরিকল্পনা প্রণয়নের যোগ্যতার অধিকারী।
০ এটি ইসলামি রীতিনীতিভিত্তিক ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন এবং সামাজিক প্রক্রিয়া গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সচেতন, প্রাজ্ঞ, দায়িত্বশীল ও নির্বাচনী ভূমিকা পালন করবে।
০ এটি ব্যক্তিদের মধ্যকার পার্থক্যসমূহকে স্বাগত জানাবার জন্য প্রয়োজনীয় সক্ষমতার অধিকারী হবে, বিভিন্ন ধরনের মেধা-প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে তাদেরকে পথনির্দেশ দিতে সক্ষম হবে, সর্বোপরি ইসলামি রীতিনীতিভিত্তিক ব্যবস্থার আওতায় শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনসমূহ পূরণ ও তাদের আগ্রহের নিবৃত্তি করতে সক্ষম হবে।
০ এটি শিক্ষা ও পূর্ণতা অর্জনের স্থান এবং শিক্ষা সংক্রান্ত সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে অব্যাহতভাবে সমুন্নত অবস্থার সন্ধান করবে এবং শিক্ষার জন্য সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি শিক্ষার প্রক্রিয়াকে পথনির্দেশ করবে এবং শিক্ষার জন্য নতুন নতুন সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করবে।
০ এটি হবে আত্ম-মূল্যায়নকারী, দায়িত্বশীল এবং এর বাইরে অবস্থিত পর্যবেক্ষণকারী ও মূল্যায়নকারীর নিকট জবাবদিহি করবে।
০ এটি ব্যক্তিগত ও সামাজিক প্রয়োজনসমূহ পূরণ করবে এবং একটি নৈতিক, বৈজ্ঞানিক, নিরাপদ, সুস্থ, আনন্দদায়ক ও ত্যাগী পরিবেশ তৈরি করে দেবে এবং এতে সামষ্টিক পরিচিতি প্রতিফলিত হবে।
০ এটি নৈতিক ও পেশাগত গুণাবলির অধিকারী শিক্ষকদের সেবার অধিকারী হবে এবং ইসলামি রীতিনীতিভিত্তিক ব্যবস্থার ওপর ভিত্তিশীল একটি সমন্বিত তাওহীদবাদী পরিচিতির অধিকারী হবে।
০ এটি হবে অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থাপনাভিত্তিক আবেদনের অধিকারীÑ যা সমালোচনাকে স্বাগত জানাবে।
০ এটি হবে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মৌল নীতিমালার ওপর ভিত্তিশীল এবং এটি কার্যকর অংশীদারিত্বের সহায়তা গ্রহণ করবে এবং এ থেকে সুবিধা ভোগকারীদের, বিশেষ করে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও পরিবারসমূহের অংশগ্রহণের ওপর নির্ভরশীল হবে।
০ এটি মানসম্মত শিক্ষাসংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি সহায়তার অধিকারী হবে এবং এটি ব্যাপকভিত্তিক উপায়-উপকরণ ও শিক্ষা মাধ্যম (জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগ নেটওয়ার্ক)-কে দৃষ্টিতে রাখবে।
০ এটি দেশের সাধারণ প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সক্ষমতার অধিকারী হবে।
০ এটি মসজিদ ও অন্যান্য দ্বীনী প্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয় জনকেন্দ্রসমূহের সাথে, যেমন : গণপাঠাগারসমূহ ও জনসাংস্কৃতিক কেন্দ্রসমূহের সাথে কার্যকর আন্তঃক্রিয়া সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সক্ষমতার অধিকারী হবে এবং ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ, পণ্ডিত, মনীষী ও বিশেষজ্ঞগণের সাথে যথাযথভাবে সম্পর্ক রাখতে সক্ষম হবে।
০ এটি সমাজের সমস্যাবলির সাথে কার্যকর সম্পর্ক রাখবে এবং জনজীবনে কার্যকর ভূমিকা পালনের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের স্থানীয়, আঞ্চলিক ও জাতীয় বিষয়াদিতে ভূমিকা পালন করবে।

পঞ্চম অধ্যায় : লক্ষ্যসমূহ
১. এমন তাওহীদবাদী ব্যক্তিদের গড়ে তোলা যাঁরা আল্লাহ্র ওপর ঈমান পোষণ করবেন এবং পরকালের ওপর ঈমান পোষণ করবেন, যাঁরা আল্লাহ্র, নিজেদের, অন্যদের ও প্রকৃতির প্রতি স্বীয় দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নিষ্ঠাবান হবেন; যাঁরা হবেন সুবিচারকামী, প্রকৃত অবস্থার সন্ধানী ও শান্তিকামী; যারা যুলুম-নির্যাতন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করবেন ও আল্লাহ্র পথে লড়াই করবেন; যারা হবেন সাহসী, নিষ্ঠাবান, দেশপ্রেমিক, বন্ধুবৎসল, ত্যাগ স্বীকারকারী, সামাজিক ক্ষেত্রে বহুত্ববাদী, আন্তর্জাতিকতাবাদী, ধর্মীয় ফিক্বাহ্র সনিষ্ঠ অনুসরণকারী ও হযরত ইমাম মাহ্দী (আ.)-এর ন্যায়ভিত্তিক শাসনব্যবস্থায় ঈমান পোষণকারী; যাঁরা হবেন বিশ্বের বুকে সুবিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অনবরত সংগ্রামকারী; এমন ব্যক্তিদেরকে লালন করা হবে যাঁরা হবেন আশাবাদী, দৃঢ়প্রত্যয়ী, আত্মবিশ্বাসী, বিশ্বস্ত, বুদ্ধিমান, শক্তিশালী, নেককার, ভদ্র, মধ্যমপন্থী, উদার, ধর্মপ্রাণ, সৃজনশীল, সফল বিনিয়োগকারী, মিতব্যয়ী, সুদক্ষ, আনন্দচিত্ত, সুস্থ, আইন মান্যকারী, সুশৃঙ্খল ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং ইসলামি রীতিনীতির সাথে সামঞ্জস্যশীল একটি ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন শুরু করার জন্য প্রস্তুত।
২. দেশের অগ্রগতি ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে এবং সাধারণ জনগণের সংস্কৃতির ব্যাপক প্রসার ও তাকে চিত্তাকর্ষকভাবে উপস্থাপন, বৈজ্ঞানিক শক্তি ও রেফারেন্সের ভিত্তি তৈরি করে দেয়া এবং বৈশ্বিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য উপযোগী করে ইসলামি-ইরানি সভ্যতার বিবর্তনের লক্ষ্যে সাধারণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার ও পরিবারের ভূমিকার উন্নয়ন।
৩. ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অন্তর্দৃষ্টি অর্জনের ওপর গুরুত্ব আরোপসহ এবং নিম্নলিখিত বিষয়গুলোকে গভীর করাসহ একটি সুবিচারভিত্তিক মাহ্দাভী (ইমাম মাহ্দীর আবির্ভাবে ঈমান পোষণকারী) জনগোষ্ঠী গড়ে তোলা।
৪. জ্ঞান, নৈতিক মূল্যবোধসমূহের প্রতি প্রতিশ্রুতিশীল, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের শাসনব্যবস্থার প্রতি আনুগত্য, ধর্মীয় ফিক্বাহ্ বা আইন-বিধান ও ধর্মীয় গণতন্ত্রের প্রতি বাস্তবে ও তাত্ত্বিকভাবে প্রতিশ্রুতিশীলতা, জাতীয় ঐক্যকে সুসংহতকরণ, জ্ঞানগত মনোবলকে শক্তিশালীকরণ, সামাজিক অধিকারসমূহ প্রতিষ্ঠা ও দায়িত্ব-কর্তব্যসমূহ পালন করা, ঐশী জীবনের প্রতি ঈমান গড়ে তোলা এবং পরিবেশের সংরক্ষণ।
৫. সকলের জন্য সর্বজনীন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ-এর সুযোগ সৃষ্টি ও সম্প্রসারণ করা।
৬. ইসলামি রীতিনীতিভিত্তিক ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে একটি কার্যকর মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা।
৭. দেশের সাধারণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থাকে আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে এতে জনগণের অংশগ্রহণ, বিশেষ করে পরিবারের ভূমিকা ও তার কার্যকরিতা বৃদ্ধিকরণ।
৮. কারিকুলাম উন্নয়ন এবং প্রশাসনিক ও আর্থিক ব্যবস্থাসমূহের এবং অবকাঠামোসমূহের উন্নয়ন ও সংস্কার।
৯. দেশের সাধারণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার কার্যকরিতা ও দক্ষতার উন্নয়ন সাধন।
১০. মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে ও মুসলিম জাহানে সর্বোচ্চ শিক্ষাগত অবস্থান অর্জন এবং বৈশ্বিক স্তরে দেশের শিক্ষাগত অবস্থানকে ক্রমবৃদ্ধিমান করে রাখা।

ষষ্ঠ অধ্যায় : প্রধান স্ট্রাটেজিসমূহ
১. দেশের সাধারণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থাকে ইসলামি শিক্ষার তাত্ত্বিক ভিত্তিসমূহ ও দর্শনের ওপর ভিত্তিশীল করে গড়ে তোলা (তথা সকল লক্ষ্য অর্জন)।
২. সাধারণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার সকল দিক থেকে (১, ২, ৪, ৫, ৬ ও ৮ নং লক্ষ্য) সমুন্নতকরণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় আবেদন সহকারে শিক্ষা সম্পর্কে একটি পবিত্র দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ।
৩. সাব-সিস্টেম-এর সংস্কার কর্মসূচিসমূহের পরিকল্পনা প্রণয়ন, গ্রহণ ও বাস্তবায়নের সূচনা করা (এগুলো হচ্ছে : জাতীয় কারিকুলাম, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, মানবসম্পদ উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা, আর্থিক বরাদ্দ, শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় স্থানসমূহ, প্রয়োজনীয় উপায়-উপকরণ ও যন্ত্রপাতি, গবেষণা ও মূল্যায়নের ব্যবস্থাকরণ), এছাড়া ইসলামি শিক্ষার তাত্ত্বিক নীতিমালা ও দর্শনের ওপর ভিত্তি করে প্রণীত স্বল্প মেয়াদের ও মধ্যম মেয়াদের কর্মসূচি প্রণয়ন এবং সংশ্লিষ্ট লক্ষ্যসমূহ (১, ২, ৩, ৪, ৫ ও ৬ নং লক্ষ্য) অবহিতকরণ।
৪. শিক্ষার ক্ষেত্রে দেশের বিভিন্ন এলাকার মধ্যে সমতা গড়ে তোলা ও তাকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ এবং প্রত্যন্ত এলাকাসমূহে শিক্ষাকে শক্তিশালী করা এবং এ ক্ষেত্রে ইসলামি রীতিনীতিভিত্তিক ব্যবস্থার মূলনীতিসমূহের (২, ৩, ৪ ও ৭ নং লক্ষ্য) সাথে সঙ্গতিশীল করে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের শক্তিশালী করা ও শিক্ষা সংক্রান্ত সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা।
৫. দেশের সাধারণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থায় (২, ৩, ৫ ও ৭ নং লক্ষ্য) জনগণের, পরিবারসমূহের, অর্থনৈতিক সংগঠনসমূহের, শহুরে ও গ্রাম্য ব্যবস্থাপনাসমূহের এবং এ থেকে উপকৃত প্রতিষ্ঠানাদির কার্যকর অংশগ্রহণ ও জবাবদিহিতা সৃষ্টির মাধ্যমে একে শক্তিশালী করা ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ।
৬. দেশের সাধারণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার (১, ২, ৪ ও ৮ নং লক্ষ্য) ক্ষেত্রে জাতীয় বৈজ্ঞানিক ও শিক্ষা সংক্রান্ত অভিজ্ঞতার গবেষণা ও মূল্যায়ন, সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবন, তাত্ত্বিকীকরণ ও ডকুমেন্টেশন।
৭. ইসলামি রীতিনীতিভিত্তিক ব্যবস্থার ওপর ভিত্তিশীল (১, ২, ৩, ৫ ও ৭ নং লক্ষ্য) দেশের সাধারণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থায় বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে আধুনিক প্রযুক্তিসমূহের ব্যবহার।
৮ দেশের সাধারণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও সংস্থা-সংগঠনের, বিশেষ করে পরিবারসমূহ ও প্রচারমাধ্যমসমূহের মধ্যে কার্যকর ও সক্রিয় আন্তঃক্রিয়া গড়ে তোলা, বিশেষত প্রাতিষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার মধ্যকার সীমান্তকে সঙ্কুচিত করে আনার ওপর গুরুত্ব আরোপ (১, ২, ৪ ও ৭ নং লক্ষ্য)।
৯. দেশের সাধারণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থায় একটি সুদক্ষ, কার্যকর ও জবাবদিহিতামূলক ব্যবস্থাপনা সিস্টেম প্রতিষ্ঠা এবং সম্পদ ও তার ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি সুদক্ষ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়া (২, ৪, ৬ ও ৭ নং লক্ষ্য)।
১০. যেহেতু দেশের শিক্ষাব্যবস্থা হচ্ছে মানবসম্পদ উন্নয়ন ও সামাজিক পুঁজি উৎপাদনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন সেহেতু শিক্ষাব্যবস্থার মানের উন্নয়ন ঘটাতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত গভর্নিং বডি গঠনের মাধ্যমে গৃহীত নীতিমালা, পথনির্দেশ ও পরবর্তী পর্যবেক্ষণের বাস্তবায়ন করতে হবে এবং তাতে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করতে হবে (২, ৪ ও ৫ নং লক্ষ্য)।
১১. শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি ও নৈতিকতার উন্নয়ন ঘটানোর এবং পারিবারিক পর্যায়ে আধ্যাত্মিক উন্নয়নে তাঁদের অংশগ্রহণের লক্ষ্যে তাঁদের ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও বিপ্লবী জ্ঞান বৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে হবে (১, ২, ৪ ও ৫ নং লক্ষ্য)।
১২. দেশের সাধারণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ও প্রক্রিয়া গড়ে তোলা ও পুনর্গঠন (১, ২, ৩, ৫, ৬ ও ৭ নং লক্ষ্য)।
১৩. শিক্ষকগণের এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ও শিক্ষা বিভাগের এমন অন্যান্য কর্মকর্তা ও কর্মচারী যাঁরা শিক্ষাদান করেন না তাঁদের আদর্শিক, জ্ঞানগত ও পেশাগত গুণাবলি ও যোগ্যতা বৃদ্ধির জন্য অব্যাহত উন্নয়ন কর্মসূচি।
১৪. দেশের সংবিধানে, দেশের উন্নয়ন কর্মসূচির ভবিষ্যৎ চিত্রকল্পে, সর্বোচ্চ নেতার সাধারণ নীতিমালায় ও দেশের ৫ বছর মেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনায় যেসব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য চিহ্নিত করা হয়েছে তার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে শিক্ষাগত সামর্থ্য ও সক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে যাতে এ ব্যাপারে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সক্রিয় ও গঠনমূলকভাবে উপস্থিতি সম্ভব হয় (২, ৭ ও ৮ নং লক্ষ্য)।
১৫. হায়াতে ত্বাইয়্যেবাহ্ (উত্তম ও পবিত্র জীবন)-এ উপনীত হওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম কার্যকর উপাদান হিসেবে বিজ্ঞানের উদ্ভাবনী ও কাম্যতার বৈশিষ্ট্যের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ সহকারে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি অনুসন্ধিৎসার মর্যাদা বৃদ্ধি করতে হবে (১, ২, ৭ ও ৮ নং লক্ষ্য)।

 

সূত্র: ঋঁহফধসবহঃধষ জবভড়ৎস উড়পঁসবহঃং ধহফ গধহফধঃবফ নু ঃযব ঝঁঢ়ৎবসব খবধফবৎ চড়ষরপরবং অঢ়ঢ়ৎড়াবফ ঋঁহফধসবহঃধষ জবভড়ৎস উড়পঁসবহঃ ড়ভ ঊফঁপধঃরড়হ ঞযব ঘধঃরড়হধষ ঈঁৎৎরপঁষঁসহ নু ঙৎমধহরুধঃরড়হ ভড়ৎ ঊফঁপধঃরড়হ জবংবধৎপয ধহফ চষধহহরহম, গরহরংঃৎু ড়ভ ঊফঁফধঃরড়হ, ও. জ. ওৎধহ.

আমীরুল মু’মিনীন হযরত আলী ইবনে আবি তালেব (আ.)-এর ব্যক্তিত্ব ও অবদান

তানবীর মুহাম্মদ

মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর পর ইতিহাসে সর্বাধিক আলোচিত নাম হলো আমীরুল মু’মিনীন সায়্যিদুনা আলী ইবনে আবি তালেব (আ.)। তৎকালীন আরবে (সপ্তম শতাব্দী) যিনি একাধারে তাত্ত্বিক, সুবক্তা, লেখক, চিন্তক ও কবি হিসেবে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিলেন। তিনি জ্ঞান ও পবিত্রতার সাগর, ধর্মের কুতুব, ধর্মপথের প্রদর্শক, আল্লাহ্র রাসূলের চাচাত ভাই ও শেরে খোদা। তাঁর উপাধি মুরতাজা ও মুজতাবা। তিনি হযরত ফাতিমা (আ.)-এর স্বামী, আল্লাহ্র রাসূলের জামাতা। রাসূলের সাহাবিগণের মাঝে যিনি মর্যাদা ও সত্যের দিক থেকে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। সকলেই একথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন যে, তিনি একজন শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ও অতুলনীয় বীর যোদ্ধা।

আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী ইবনে আবি তালেব (আ.) ২৩ হিজরি পূর্বাব্দের ১৩ রজব শুক্রবার আনুমানিক ৬০০ খ্রিস্টাব্দে মক্কার কুরাইশ বংশের হাশেমী গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মাতার নাম ফাতিমাহ্ বিনতে আসাদ ইবনে হাশিম। তিনি প্রথম ঈমানদারদের একজন। রাসূল (সা.) হযরত আলীকে তাঁর শিশুকালেই নিজ গৃহে নিয়ে আসেন এবং তাঁর পবিত্র বিছানার পাশেই তাঁর দোলনাটি রাখা হয়েছিল। আর রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাঁকে দোল দিতেন, গোসল করাতেন এবং দুধ খাওয়াতেন। এ সম্পর্কে হজরত আলী তাঁর বিখ্যাত ‘খুত্বাতুল ক্বাসেয়াহ্তে বলেছেন : ‘রাসূলের সাথে আমার বিশেষ জ্ঞাতিত্ব ও আত্মীয়তার কারণে আমার মর্যাদা সম্পর্কে তোমরা জান। আমি যখন শিশু ছিলাম তখনই তিনি আমার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তিনি আমাকে তাঁর পবিত্র বুকে চেপে ধরতেন, বিছানায় তাঁর পাশে শোয়াতেন, আমার শরীরে হাত বুলাতেন। তখন আমি তাঁর পবিত্র দেহের সুঘ্রাণ নিয়েছি। তিনি খাবার চিবিয়ে আমার মুখে পুরে দিতেন…. সে সময় থেকেই আমি তাঁকে এমনভাবে অনুসরণ করতাম যেভাবে উটের বাচ্চা তার মায়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। প্রতিদিন তিনি আমাকে কিছু বৈশিষ্ট্য দেখাতেন এবং তা অনুসরণ করতে আদেশ দিতেন। প্রতিবছর তিনি হেরা পাহাড়ে নির্জনবাসে যেতেন। সেখানে আমি ব্যতীত আর কেউ তাঁকে দেখেনি। সে সময় খাদিজার ঘর ব্যতীত আর কোথাও ইসলামের অস্তিত্ব ছিল না আর সেসময় দু’জনের পর আমি ছিলাম তৃতীয় ব্যক্তি। আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ ও ঐশী বাণীর তাজাল্লি আমি দেখতাম এবং নবুওয়াতের সুঘ্রাণ প্রাণভরে গ্রহণ করতাম।’
একান্ত অনুগত বুদ্ধিদীপ্ত আলীকে রাসূল (সা.) ভীষণ ভালবাসতেন। জন্মের পর থেকে আলীও রাসূলকে দেখেছেন খুব কাছ থেকে, একই গৃহের ভেতরে একই ছাদের নিচে একান্ত নিবিড়ভাবে। ছোটবেলা থেকে হযরত আলীর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। মাত্র তের বছর বয়সে তিনি নিজেকে সত্যের পয়গাম গ্রহণকারী, রাসূল (সা.)-এর রিসালাতের স্বীকৃতি দানকারী ও দ্বীনের পথে প্রথম সাহায্যকারী হিসেবে বনু হাশিমের সম্মানিত ব্যক্তিদের সামনে পরিচয় দিয়েছিলেন। তাঁর স্বীকৃতি দানের প্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাঁকে নিজের ভাই, ওয়ালী ও খলিফা বলে উপস্থিত সকলের সামনে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।

কুরাইশদের নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে মহানবী (সা.)-এর নির্দেশে তাঁর অনুসারিগণ হাবশা ও মদিনায় হিজরত করতে শুরু করেন। আল্লাহ্র পক্ষ থেকে চূড়ান্ত নির্দেশ এলে মহানবী হযরত আলী (আ.)-কে নিজের বিছানায় রেখে রাতের আঁধারে মক্কা ত্যাগ করলেন। মহানবী (সা.)-এর হিজরতের পর আলী (আ.) মক্কায় কয়েকদিন অবস্থান করেন। তৃতীয় বা চতুর্থ দিন মদিনার উদ্দেশে প্রকাশ্যে মক্কা ত্যাগ করেন। তাঁর সাথে ছিল তাঁর মা, নবীকন্যা হযরত ফাতেমা, হযরত উম্মে আইমানসহ আরও কয়েকজন মহিলা। তিনি মদিনায় পৌঁছলে মহানবী (সা.) নিজে এগিয়ে এসে তাঁদের কাফেলাকে গ্রহণ করেন এবং তাঁর প্রিয় ভাইকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। এ সময় মহানবীর চোখ মমতা ও আনন্দে ভরে গিয়েছিল।
মদিনায় হযরত আলীর জীবন অত্যন্ত ঘটনাবহুল ছিল। হযরত আলী তখন ২২-২৩ বছরের প্রাণবন্ত যুবক। মদিনা সনদ সম্পাদনের মাধ্যমে একটি জাতি গঠনের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ায় তিনি অংশগ্রহণ করেন। ২য় হিজরিতে বদরের যুদ্ধে হযরত আলী অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করেন। বদরের বিপর্যয়ের প্রতিশোধ নিতে মক্কার কাফেররা পরের বছর পুনরায় যুদ্ধের আয়োজন করে। এই যুদ্ধে মদিনার মুসলমানদের অবহেলার জন্য ইসলামের ইতিহাসে একটি বেদনাদায়ক অধ্যায় সংযোজিত হয়। রাসূলুল্লাহ্র আদেশ অমান্য করার ফলে মুসলমানরা নিশ্চিত জয় থেকে বঞ্চিত হয়ে এক মহা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। রাসূলুল্লাহ্র মৃত্যুর গুজবে মুসলিম বাহিনী হতাশ হয়ে পালাতে থাকে। সেসময়ে হযরত আলী বিপর্যস্ত মুসলিম বাহিনীকে একত্রিত করে কাফিরদের ওপর আক্রমণ করেন। কুরাইশদের পতাকাবাহী নয়জন শ্রেষ্ঠ বীরকে হত্যা করেন। রাসূলুল্লাহ্কে আক্রমণের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে ওহুদের যুদ্ধে হযরত আলীর দেহে সত্তরটির মতো আঘাত লেগেছিল।

৫ম হিজরীতে খন্দকের যুদ্ধে মদিনা যখন মক্কার কাফেরদের দ্বারা অবরুদ্ধ হয় তখন আরবের বিখ্যাত যোদ্ধা ‘আমর ইবনে আবদে উদ্দ’ মল্লযুদ্ধের জন্য মুসলমানদেরকে আহ্বান করে। সে ছিল এক অপরাজেয় বীর। তাই তাকে বলা হতো ‘এক হাজার ঘোড় সওয়ারের সমতুল্য’১০। রাসূল (সা.)-এর অনুমতি নিয়ে হযরত আলী আমর ইবনে আবদে উদ্দকে মুকাবিলার জন্য এগিয়ে যান এবং মল্লযুদ্ধের এক পর্যায়ে তাকে হত্যা করেন।
৬২৮ সালে অর্থাৎ ৬ষ্ঠ হিজরিতে হুদায়বিয়ার সন্ধির লেখক ছিলেন হযরত আলী (আ.)। সপ্তম হিজরিতে মহানবী (সা.) খায়বর অভিযানে বের হন। খায়বরের সুরক্ষিত দুর্গ কামুস জয় করা মুসলমানদের জন্য অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। কামুস দুর্গের প্রধান ছিল ‘হাজার বীরের শ্রেষ্ঠ বীর’ খ্যাত মারহাব। দ্বন্দ্বযুদ্ধের এক পর্যায়ে হযরত আলী (আ.) মারহাবের মাথায় এমন জোরে আঘাত করলেন যে তরবারি মারহাবের শিরস্ত্রাণ পরিহিত মাথা দ্বিখণ্ডিত করে দাঁতের মাড়ি পর্যন্ত নেমে এল। হযরত আলীর নেতৃত্বে দুর্ভেদ্য কামুস দুর্গের পতন ঘটে এবং মুসলমানরা খায়বর জয় করে। খায়বরবাসী খারাজ প্রদানের শর্তে সন্ধি করে।
মক্কা বিজয়ের দিন মহানবী (সা.) হযরত আলী (আ.)-কে নির্দেশ দিলেন সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে তিনি যেন মক্কায় প্রবেশ করেন। হযরত আলী ‘কাদ’-র দিক থেকে মক্কায় প্রবেশ করেন। এক বিন্দু রক্তপাত ছাড়াই হযরত আলী তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করলেন।
মক্কা বিজয়ের পর ঐ একই বছর হোনায়েনের যুদ্ধ সংঘটিত হলো। সেই ভয়াবহ যুদ্ধের দিন ‘হাওয়াযিন গোত্রের’ আক্রমণে মুসলিম সৈন্যবাহিনী যখন দিশেহারা তখন হযরত আলী ও আব্বাস (রা.) সমগ্র আনসার বাহিনীকে একত্রিত করে তুমুল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ফলে মুসলমানগণ জয় লাভ করে।

অষ্টম হিজরিতে হেজাজ অঞ্চলের চতুর্দিকে ব্যাপকভাবে ইসলাম প্রচার শুরু হলো। এরই প্রেক্ষিতে হযরত খালিদ ইবনে ওলীদকে ইয়েমেনে প্রেরণ করা হয়। খালিদ দীর্ঘ ছয় মাস এখানে ইসলাম প্রচার করেন। কিন্তু তাদের কেউই ইসলাম গ্রহণ করল না। মহানবী (সা.) তাঁর স্থলে হযরত আলীকে ইয়েমেনে প্রেরণ করেন। তাঁর পাণ্ডিত্য, আভিজাত্যপূর্ণ মার্জিত ব্যবহার, রাসূলের প্রতিনিধিসুলভ ব্যক্তিত্ব, জীবন যাপনের সারল্য ইয়েমেনীদের মুগ্ধ করল। ইয়েমেনের হামদান গোত্রের সকলেই মুসলমান হয়ে গেল। পরের বছর পুনরায় ইয়েমেনের মাযহাজী গোত্রের কাছে হযরত আলীকে প্রেরণ করা হয়। গোত্রপতিগণ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং সম্পূর্ণ ইয়েমেন ক্রমান্বয়ে ইসলামের ছায়াতলে আসে।
দশম হিজরিতে রাসূল (সা.) শেষ হজ করার জন্য মক্কায় গমন করলে হযরত আলী (আ.) তাঁর সহগামী হন। সেই বিখ্যাত বিদায় হজের ভাষণ শেষ করে মহানবী (সা.) তাঁর সাহাবিগণকে নিয়ে মদিনার দিকে যাত্রা শুরু করেন। ‘গাদীরে খুম’ নামক স্থানে পৌঁছলে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে ওহী অবতীর্ণ হলো। মহানবী (সা.) সমবেত সাহাবিগণকে নিয়ে যোহরের নামায আদায় করে উটের হাওদার তৈরি মঞ্চে আরোহণ করে একটি ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন যা ‘খুত্বায়ে গাদীর’ নামে প্রসিদ্ধ। এই খুত্বাতে মহানবী (সা.) বলেছিলেন : ‘আল্লাহ্ আমার মাওলা এবং আমি মুমিনদের মাওলা ও তাদের ওপর তাদের চেয়ে বেশি অধিকার রাখি এবং তাদের ওপর অধিকার রাখার ক্ষেত্রে উপযুক্ততর। হে লোকসকল! আমি যার মাওলা, আলীও তার মাওলা ও নেতা।’

গাদীরে খুমের ভাষণের সত্যতা লিপিবদ্ধ করেছেন আত তাবারী, আবু নাঈম ইসফাহানী, ইবনে আসাকের, আবু ইসহাক হামুইনী, আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ূতীর মতো বিখ্যাত আলেমগণ।
হযরত আলী তাঁর পূর্ববর্তী তিন খলিফার পঁচিশ বছরের শাসনামলে অধিকাংশ সময় নিজ গৃহে এবং মসজিদে নববীতেই কাটাতেন। এই সময় তিনি যেসব কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন সেগুলো হলো :

প্রথমত, তাঁর পবিত্র ব্যক্তিত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আল্লাহ্র ইবাদতে মশগুল থাকা।

দ্বিতীয়ত, মহাগ্রন্থ আল কোরআনের তাফসীর, মুতাশাবেহ আয়াতসমূহ নিয়ে গবেষণা, দুর্বোধ্য বিষয়াবলির সমাধান অন্বেষণ করা। এই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হযরত ইবনে আব্বাস (রা.)-কে শিক্ষা দান করে তাঁকে নিজের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে প্রস্তুত করে তা উম্মাহ্র মাঝে প্রচার করার ব্যবস্থা করতেন। যার ফলশ্রুতিতে তিনি হযরত আলী (আ.)-এর পরে ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ মুফাস্সির হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

তৃতীয়ত, খলিফাদের দরবারে অনাহূত সমস্যাগুলোর সমাধান বাতলে দেওয়া। জটিল বিষয়ে হযরত আলী তাঁর বিজ্ঞ মত ব্যক্ত করতেন যা সর্বজনগ্রাহ্য ছিল।

চতুর্থত, একদল নিঃস্বার্থ, পবিত্র অন্তর ও আধ্যাত্মিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ ও পরকালীন যাত্রার পথে আগ্রহী অনুসারী তৈরি করা যাঁরা যে কোন পরিস্থিতিতে মানুষকে সৎপথে পরিচালিত করতে পারেন।

পঞ্চমত, বিধবা, অনাথ ও অসহায়দের প্রতিপালন ও পুনর্বাসনের জন্য অনুসারীদের মাঝে কর্ম তৎপরতা তৈরি করা এবং তাদেরকে সাথে নিয়ে বাগান তৈরি করে, কূপ খনন করে সেগুলো ওয়াক্ফ করা।
অর্থাৎ হযরত আলী (আ.) দ্বীন ইসলাম ও উম্মতের খিদমতের জন্য আত্মনিয়োগ করেছিলেন।
এছাড়াও এই পঁচিশ বছর সময়ে তিনি মহাগ্রন্থ আল কোরআনের একটি নুস্খা বা অনুলিপি তৈরি করেন এবং মহানবী (সা.)- এর পবিত্র জীবনের অমিয় বাণী ও সুন্নাহ্র উপর একটি সংকলন তৈরি করেন যা মুসনাদে ইমাম আলী ইবনে আবি তালেব নামে প্রসিদ্ধ।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাতের পর খলিফাদের শাসনকালে হযরত আলী ইসলামি রাষ্ট্রের নিরাপত্তাকেই অধিক গুরুত্ব দেন এবং খলিফাদের বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেন।

হযরত আলীর পরামর্শক্রমেই হযরত ওমর বায়তুল মুকাদ্দাসে যাত্রা করেছিলেন। নিহাওয়ান্দের যুদ্ধ, ইয়ারমুকের যুেদ্ধ হযরত আলীর পরামর্শেই মুসলিম বাহিনী ও রাজধানী মদিনা বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল। খলিফাদের সময় হযরত আলী কর্তৃক প্রদত্ত বিভিন্ন জটিল বিষয়ে ঐতিহাসিক রায়সমূহ মুসলিম আইনের বিভিন্ন কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে। এমনি আরও বহু ঘটনা আমরা ইতিহাসের পাতায় দেখতে পাই।
হযরত আলী তাঁর খিলাফতকালে চেয়েছিলেন মুসলমানদেরকে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর পবিত্র শাসনকালীন অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এবং নেতৃত্বের ক্ষেত্রে মহানবীর পদ্ধতিকে পুনর্জীবিত করে মুসলিম উম্মাহকে আবার সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে। খিলাফতের প্রথমদিকে বাইতুল মালের বণ্টনের ব্যাপারে হযরত আলী (আ.) বলেছিলেন- ‘তোমাদের মধ্যে যারা রাসূলুল্লাহ্র সাথে সাক্ষাতের জন্য অন্যদের ওপর শ্রেষ্ঠত্বের দাবি কর তাদের জেনে রাখা উচিত শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড অন্য কিছুতে। শ্রেষ্ঠত্ব তার জন্য যে আল্লাহ্ ও তাঁর নবীর আহ্বানে সাড়া দেয় এবং ইসলামকে গ্রহণ করে। এমতাবস্থায় অধিকারের দিক থেকে সকলে পরস্পর সমান হবে। তোমরা আল্লাহ্র বান্দা আর ধনসম্পদ হলো আল্লাহ্র যা তোমাদের মাঝে সমভাবে বণ্টিত হবে। এ ক্ষেত্রে কারো ওপর কারো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। আগামীকাল বাইতুল মাল তোমাদের মধ্যে বণ্টিত হবে আর এতে আরব-অনারব এক সমান।’
তিনি পূর্ববর্তী খলিফার সময়ে দুর্নীতিপরায়ণ আঞ্চলিক গভর্নরদেরকে অপসারণ করে তদস্থলে নতুন গভর্নরদের নিয়োগ দেন। একমাত্র সিরিয়ায় মুয়াবিয়া ব্যতীত অন্য সকলেই খলিফার আদেশ মেনে নিয়ে নতুন গভর্নরকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন।
পৃথিবীর ইতিহাসে তিনিই প্রথম মানবিক ও অতি সংবেদনশীল যুদ্ধনীতি ঘোষণা করেছিলেন যা পরবর্তী সময়ে জেনেভা কনভেনশন, আন্তর্জাতিক যুদ্ধনীতিসহ বিভিন্ন দেশের যুদ্ধের ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয়েছে।

আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-এর তেষট্টি বছরের ঘটনাবহুল জীবনের বাস্তব চিত্র পাঠকদের কাছে সম্পূর্ণরূপে পরিস্ফুট না হলে এবং ইসলামের চরম সংকটে তাঁর অবদানের কথা বিস্মৃত হয়ে গেলে ইতিহাসের সত্য দর্শন থেকে বঞ্চিত থাকার সম্ভাবনাই প্রবল।
‘রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জ্ঞাননগরীর দরজা’ খ্যাত হযরত আলী (আ.) মহানবী (সা.)-এর জীবদ্দশাতেই তাঁর তত্ত্বজ্ঞানের জন্য স্বীকৃতি লাভ করেন। ইয়াকীনপূর্ণ জ্ঞান আর বোধে তিনি অদ্বিতীয় ছিলেন। আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা.) মহানবী (সা.) থেকে বর্ণনা করেনÑ ‘আলী আমার উম্মতের মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানী এবং বিচার কার্যে সকলের চেয়ে উত্তম।’ ইয়েমেনের সিংহের গর্তে নিহত ব্যক্তিদের বিচারের ক্ষেত্রে হযরত আলী (আ.)-এর মতামতকে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। ইল্মে শরীয়ত ও ইল্মে মারেফতের নিগূঢ় জ্ঞানরাশি মুহাম্মাদ (সা.) হযরত আলীকে শিখিয়েছিলেন। আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : মহানবী (সা.) আলীকে ডাকলেন এবং তাঁর সাথে একান্তে বসলেন। যখন তিনি ফিরে আসলেন তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম : ‘কী আলোচনা হলো?’ তিনি বললেন : ‘মহানবী (সা.) জ্ঞানের সহস্রটি দ্বার আমার জন্য উন্মুক্ত করলেন, প্রত্যেকটি দ্বার থেকে আবার সহস্রটি দ্বার উন্মুক্ত হয়।’ মহানবী (সা.)-এর ওফাতের পরে হযরত আলী মসজিদে নববীতে জ্ঞানচর্চার মুক্তাঙ্গন প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় খুতবার মাধ্যমে ও সাহাবিগণের আলাপচারিতায় তিনি যে সমস্ত বিদগ্ধ আলোচনা ও বক্তব্য প্রদান করেছিলেন তা পাঠ করলে বোঝা যায় যে, তিনি সত্যিকার অর্থে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর ইল্মে শরীয়ত ও ইল্মে মারেফতের যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন। ইবনে আবিল হাদীদ কর্তৃক ‘শারহে নাহজুল বালাগাহ’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হযরত আলী (আ.)-এর খুতবা ও পত্রগুলো বিশ্লেষণ করলে তাঁর জ্ঞানজগতের বিশালতা ও পরিব্যাপ্তি বোঝা যায়। এই সমস্ত খুতবার বিষয়বস্তু ছিল মহাজগৎ সৃষ্টির রহস্য, আল্লাহ্র অস্তিত্ব, ফেরেশ্তা সৃষ্টি, আদম সৃষ্টি ঈমান, রুহ্, রাসূল (সা.)-এর শ্রেষ্ঠত্ব, মহাগ্রন্থ আল কোরআনের বিভিন্ন আয়াতের ব্যাখ্যা, অন্যান্য আসমানি কিতাবের আলোচনাসহ বিভিন্ন দার্শনিক ও তাত্ত্বিক বিষয়াদির ব্যাখ্যা প্রদান করা। তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর জ্ঞান-নগরীর দরজা হিসেবে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছিলেন। এই সমস্ত জ্ঞানপূর্ণ সমাবেশে রাসূল (সা.)-এর প্রিয় সাহাবিগণ উপস্থিত থাকতেন। তাঁরা তাঁর কাছে বিভিন্ন জটিল বিষয়াদি সম্পর্কে প্রশ্ন করতেন আর হযরত আলী (আ.) অত্যন্ত সুবিজ্ঞ উত্তরসহ মতামত দান করতেন।

 

তানবীর মুহাম্মদ
সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ
সরকারী সিটি কলেজ, চট্টগ্রাম।
গ্রন্থসূত্র:
১. হযরত শেখ ফরীদ উদ্দীন আত্তার (রহ.), মানতিকুত্ তায়োর, বাংলা অনুবাদ- আবদুল জলীল, প্রকাশক- রেহানা হক, সবর্ণ ১৫০, বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম, দোতলা, ঢাকা ১০০০। প্রকাশকাল : আগস্ট ২০০৮।
২. আয়াতুল্লাহ্ জাফর সুবহানী কর্তৃক লিখিত ‘ফুরুগে¦ বেলায়েত’ গ্রন্থটি পড়তে পারেন। এই গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন আব্দুল কুদ্দুস বাদশা ও মোঃ মাঈন উদ্দিন। ‘বেলায়েতের দ্যুতি’ নামে গ্রন্থটি দারুল কোরআন ফাউন্ডেশন থেকে ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে।
৩. আল আবাকিয়াতুল ইসলামিয়্যাহ্, লেখক- আল আক্কাদ।
৪. তারীখে তাবারী, ৩য় খণ্ড, ৬ষ্ঠ ভাগ।
৫. সীরাতুন নবী (সা.), আল্লামা শিবলী নোমানী (র.)।