All posts by pavel

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে জ্বালানি শক্তি

ভূমিকা : ইরানে জ্বালানি ব্যবস্থাপনার অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো ক্রমবর্ধমান খনিজ জ্বালানি ব্যবহারজনিত জলবায়ু দূষণ। খনিজ জ্বালানি ব্যবহার যথাসম্ভব কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধির লক্ষ্যে ‘পঞ্চম আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন পরিকল্পনা’ গ্রহণ করা হয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ করা হলে ইরানের বৃহৎ এবং ক্ষুদ্র পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণ কল্পে অনেক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। এছাড়াও বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সংকট এবং পরিবেশ সচেতনতার ফলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রযুক্তি রপ্তানিরও সুযোগ তৈরি হয়েছে।
ইরানের নবায়নযোগ্য জ্বালানি সংস্থা (ঝটঘঅ)
১৯৯৫ সালে ইরানের নবায়নযোগ্য জ্বালানি স¤পদের সম্ভাবনা যাচাই, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প (সৌর শক্তি, বায়ু শক্তি, ভূগর্ভস্থ তাপ, হাইড্রোজেন এবং বায়োমাস) বাস্তবায়নের নিমিত্ত ইরানের নবায়নযোগ্য জ্বালানি সংস্থা গঠিত হয়।
ইরানের ভৌগোলিক বৈচিত্র্যের কারণে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস ব্যাপক এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ। যথা: পানি শক্তি, সৌর শক্তি, বায়ু শক্তি, ভূগর্ভস্থ তাপ, বায়োগ্যাস এবং হাইড্রোজেন।
পানি শক্তি (ঐুফৎড় বহবৎমু): ইরানে ২৩-৪২ গিগাওয়াট পানি বিদ্যুৎ তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে। সপ্তম পানি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের ফলে ইরানে বর্তমানে ৮ গিগাওয়াট পানি বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে যা অন্য যে কোন খাত থেকে বেশি। ইরানের ২০২১ সাল নাগাদ ১৪ গিগাওয়াট পানি বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে যা ইরানের বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভাবনার ২০%।
সৌর শক্তি (ঝড়ষধৎ ঊহবৎমু): ইরানে সৌর বিদ্যুৎ তৈরির সম্ভাবনা অসীম। ইরানের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে সারা বছরব্যাপী তীব্র সূর্যালোক পাওয়া যায়। ইরানের দক্ষিণাঞ্চলে প্রতি বর্গমিটারে দিনে গড়ে ৫.০-৫.৪ কিলোওয়াট ঘণ্টা সূর্যালোক পাওয়া যায়। ফলে প্রতি বর্গমিটারে ০.৫ কিলোওয়াট ঘণ্টা অথবা প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৫০০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে। ইরানে মোট আয়তনের এক চতুর্থাশ মরুভূমি। ইরানে মরু এলাকায় মাত্র ১ শতাংশ সৌর কোষ দ্বারা ঢাকা সম্ভব হলে বর্তমানে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয় তার চেয়ে প্রায় ৫ গুণ বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব।
অর্জিত সাফল্য
ইরানে শিরাজ সৌর তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্প মধ্যপ্রাচ্যে সর্ববৃহৎ যার উৎপাদন ক্ষমতা ২৫০ কিলোওয়াট। এ প্রকল্পের উৎপাদিত বিদ্যুৎ ইরানের গ্রামাঞ্চলে সরবরাহ করা হয়।
বায়ু শক্তি (ডরহফ ঊহবৎমু): ইরানের পূর্বাঞ্চলে বায়ু শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং পা¤প চালনার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। ৪৫টি স্থানে গবেষণা পরিচালনা করে দেখা গিয়েছে যে, বায়ু শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ইরানে ৬,৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। ইরানের উইন্ড অ্যাটলাস অনুযায়ী বায়ু শক্তি ব্যবহার করে ১৪০ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। বিদ্যমান অবকাঠামো ব্যবহারের মাধ্যমে ২০-৩০% পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব।
সাফল্য
১. ৬৬০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাস¤পন্ন উইন্ড টারবাইন স্থাপন।
২. মঞ্জিল এবং বিনালোদ নামক দুটি বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন।
ভূগর্ভস্থ তাপ শক্তি (এবড়ঃযবৎসধষ ঊহবৎমু): ইরানে বিভিন্ন স্থানে পর্যাপ্ত পরিমাণ নি¤œ এবং উচ্চ মানস¤পন্ন ভূগর্ভস্থ তাপ শক্তি রয়েছে। উচ্চ মানস¤পন্ন তাপ শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ রয়েছে। অন্যদিকে নি¤œ মানস¤পন্ন তাপ দিয়ে উষ্ণায়ন এবং শীতলীকরণ করা সম্ভব। বোরহোল থারমাল রেসপন্স পরীক্ষার মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ তাপ শক্তি ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। এ পরীক্ষাটি ইরান ব্যতীত বিশ্বের অল্প কয়টি দেশে করা সম্ভব। এ খাতে উল্লেখযোগ্য স্থাপনা হলো ৬০০ কিলোওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাস¤পন্ন মাশহাদ বায়োগ্যাস বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট এবং ১০৬০ কিলোওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাস¤পন্ন সিরাজ বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট।
হাইড্রোজেন এবং ফুয়েল সেল কার্যক্রম
প্রায় ১ দশকে হাইড্রোজেন এবং ফুয়েল সেল গবেষণার অভিজ্ঞতায় ইরানে ৫০টি গবেষণা এবং উন্নয়ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিভিন্ন প্রকল্প পরীক্ষামূলক ভাবে হাইড্রোজেন উৎপাদন, সংরক্ষণ, বিতরণ এবং ব্যবহার করছে।

সাফল্য
১. গ্রিড বহির্ভূত সৌর-হাইড্রোজেন শক্তি এবং ফুয়েল সেল সিস্টেম স্থাপন।
২. হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল সম্বলিত গাড়ি পরীক্ষা এবং উৎপাদন।
৩. হাইড্রোজেন স্টোরেজ ভেসেল ডিজাইন, উৎপাদন এবং পরীক্ষণ।
৪. ২০০ কিলোওয়াট ক্ষমতাস¤পন্ন ওয়াটার ইলেক্ট্রোলাইজার ডিজাইন, উৎপাদন, পরীক্ষণ এবং স্থাপন।
৫. ৫ কিলোওয়াট এবং ১০ কিলোওয়াট ক্ষমতাস¤পন্ন পলিমার ফুয়েল সেল ডিজাইন এবং উৎপাদন।
৬. ফুয়েল সেল যন্ত্রাংশ, যথা: এমইএ, হিউডিফায়ার তৈরি।
৭. সিংগেল সেল সলিড অক্সাইড ফুয়েল সেল ডিজাইন এবং উৎপাদন।
৮. ফুয়েল সেল টেকনোলজি বিষয়ক জাতীয় কৌশল পরিকল্পনা অনুমোদন।
পরিবেশ বান্ধব গাড়ি (ঈষবধহ াবযরপষব)
বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ইন্টেলিজেন্ট ইলেকট্রিক ভেহিক্যাল, ইন্টেলিজেন্ট ইলেকট্রিক ফুয়েল সেল ভেহিক্যাল ডিজাইন এবং উৎপাদন করা হচ্ছে।

অনুবাদ: কৃষিবিদ ড. মো. আলতাফ হোসেন

আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীদেরকে প্রদত্ত সাক্ষাতে রাহ্বার

যে কেউ মতানৈক্য সৃষ্টিকারী কথা বলছে সে জেনে-বুঝেই হোক বা না বুঝেই হোক, দুশমনের লাউডস্পীকার হিসেবে কাজ করছে
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ্ ‘উয্মা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী বিভেদ ও অনৈক্য সৃষ্টির কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের কঠোর সমালোচনা করেছেন। তিনি ২৩ মে ২০১৫ তেহরানে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীদেরকে প্রদত্ত সাক্ষাতে বলেন, যে কেউ মতানৈক্য সৃষ্টিকারী কথা বলছে সে জেনে-বুঝেই হোক বা না বুঝেই হোক, কার্যত দুশমনের লাউডস্পীকার হিসেবে কাজ করছে।
ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার বলেন, মায্হাবী মতানৈক্য, শিয়া-সুন্নি মতানৈক্য, আরব ও আজম্ মতানৈক্য এবং বিভিন্ন দেশ, বিভিন্ন ক্বওম ও বিভিন্ন জাতির মধ্যে মতানৈক্য, সেই সাথে জাতীয়তাবাদী অন্ধত্ব হচ্ছে মুসলিম সমাজসমূহের মধ্যে মতানৈক্য ও বিরোধ সৃষ্টির লক্ষ্যে চালিত দুশমনদের অপচেষ্টাসমূহের অন্যতম; তারা এসব বিরোধের অগ্নি প্রজ্বলিত করার চেষ্টা করছে; একে অবশ্যই প্রতিহত করতে হবে।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, আমরা আশা করি যে, আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদেরকে আহ্লে কোরআনে পরিণত করবেন। এরপর তিনি বলেন, আমরা জাহেলীয়াতকে এ সুযোগ দেব না যে, আমাদের সমাজ সমূহের ওপরে নিজেকে চাপিয়ে দেবে অথবা চাপিয়ে দিয়ে থাকলেও আমরা তাকে মেনে নেব না।
ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার বলেন, আজকের ইসলামী জাহান জাহেলী রাষ্ট্র ব্যবস্থাসমূহের চাপে পড়ে কষ্ট পাচ্ছে। এ কারণেই আজ ইসলামী জাহান দুর্বল ও দরিদ্র হয়ে পড়েছে এবং বিভেদ, অনৈক্য ও পারস্পরিক যুদ্ধ-বিগ্রহে জড়িয়ে পড়েছে।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, আমাদেরকে কোরআনী লক্ষ্য-উদ্দেশ্যসমূহের পানে এগিয়ে যাবার জন্য সুদৃঢ় ও অটল ইচ্ছাশক্তির অধিকারী হতে হবে। আমরা যদি এ পথে এক কদম অগ্রসর হই তাহলে আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদেরকে দ্বিগুণ শক্তি প্রদান করবেন। আর মুসলিম জাতিসমূহকে এ বিষয়টিই বুঝতে হবে। বস্তুত আমাদেরকে এক কদম এক কদম করে অগ্রসর হতে হবে এবং অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে হবে।
ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার বলেন, আমরা ইরানী জাতি অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি এবং আমরা ইসলাম ও কোরআনের দুশমনদের সামনে আত্মসমর্পণ করি নি, বরং তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছি। আর আল্লাহ্ তা‘আলাও আমাদেরকে শক্তি প্রদান করেন; আমরা যত বেশি প্রতিরোধ করেছি ততই আমাদের শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে, আমাদের সামর্থ্য বৃদ্ধি পেয়েছে, ভবিষ্যতের প্রতি আমাদের আশাও বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এটাই হচ্ছে সমস্যাক্লিষ্ট ইসলামী জাহানের নিরাময়ের প্রেসক্রিপশন।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, ইসলামের দুশমনরা ইসলামী উম্মাহ্র অভ্যন্তরে যেসব লক্ষ্য হাসিলের জন্য সদা তৎপর রয়েছে তার অন্যতম হচ্ছে বিভেদ, অনৈক্য ও যুদ্ধ-বিগ্রহ সৃষ্টি। তাই তাদের এ অশুভ লক্ষ্যকে অবশ্যই প্রতিহত করতে হবে। তিনি বলেন, অবশ্য প্রতিহত করার কথা বলা বেশ সহজ, কিন্তু তা কার্যকর করা বেশ কঠিন, তবে কঠিন হলেও পথ আছে এবং পথ খোলা আছে। এ ধরনের মতানৈক্য বিস্তারের মোকাবিলা করার জন্য মূল যেসব উপকরণ প্রয়োজন তা হচ্ছে দৃঢ় সিদ্ধান্ত, অটল ইচ্ছাশক্তি ও দূরদৃষ্টি। বিশেষ করে দূরদৃষ্টির সাথে বন্ধু ও শত্রুকে পরস্পর থেকে পৃথক করে চিনে নিতে হবে।
ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার বলেন, বর্তমানে মুসলিম সংখ্যাগুরু দেশ সমূহের মধ্যে এমন অনেক দেশ আছে যেসব দেশের পরিচালক ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিগণ দূরদৃষ্টির অভাব জনিত ভুলের শিকার হয়ে আছেন এবং এ কারণে তাঁরা তাঁদের বন্ধু ও দুশমনকে সঠিকভাবে চিনে নিতে পারছেন না; তাঁরা দুশমনকে বন্ধু ও বন্ধুকে দুশমন হিসেবে গণ্য করেন এবং এর পরিণামে তাঁরা আঘাতের সম্মুখীন হচ্ছেন। তিনি বলেন, দূরদৃষ্টিবর্জিত এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী যে কোনো দেশই আঘাতের শিকার হয়ে থাকে। তাই দূরদৃষ্টি অপরিহার্য। আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন : قُلْ هَذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللَّهِ عَلَى بَصِيرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِي – ‘(হে রাসূল!) বলুন : এই হচ্ছে আমার পথ; আমি এবং আমাকে যে অনুসরণ করে- আমরা দূরদৃষ্টি সহকারে (লোকদেরকে) আল্লাহ্র দিকে আহ্বান করি।’ সূরা ইউসুফ : ১০৮
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, দূরদৃষ্টির অধিকারী হলে মানুষ সঠিকভাবে পথ চিনতে পারে। তখন সে দৃঢ় সিদ্ধান্ত ও অটল ইচ্ছাশক্তির অধিকারী হতে পারে। তখন সে সহজ পথে চলতে পারে। নুসরাতে ইলাহী বা আল্লাহ্র সাহায্য মানে এটাই। إِنْ تَنْصُرُوا اللَّهَ يَنْصُرْكُمْ وَيُثَبِّتْ أَقْدَامَكُمْ – ‘তোমরা যদি আল্লাহ্কে সাহায্য কর তাহলে তিনি তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের কদমসমূহকে সুদৃঢ় করে দেবেন।’ (সূরা মুহাম্মাদ্ : ৭) এর চেয়ে অধিকতর স্পষ্ট, অধিকতর উত্তম ও দ্ব্যর্থহীন কথা আর কী হতে পারে? আল্লাহ্র সাহায্য মানে এটাই অর্থা- আল্লাহ্র পথের পরিচয় লাভ করা, সে পথকে খুঁজে বের করা ও সে পথে চলা এবং দুশমনের ষড়যন্ত্রের কাছে আত্মসমর্পণ না করা, তার প্রতারণার শিকার না হওয়া ও তার পক্ষ থেকে চাপিয়ে দেয়া কোনো কিছু গ্রহণ না করা। কোরআন মজীদ আমাদের জন্য এটাই নির্ধারণ করে দিয়েছে।
ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী হাফেয ও ক্বারিগণের উদ্দেশে বলেন, আপনাদের এ কোরআনি সমাবেশ আল্লাহ্ তা‘আলার অনুগ্রহে প্রতি বছরই সফল সমাবেশ হিসেবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ক্রমান্বয়ে আমাদের সমাজে কোরআন মজীদ নতুন জীবন লাভ করেছে। যাঁরা কোরআনকে ভালোবাসেন, যাঁরা কোরআনকে আঁকড়ে ধরেছেন এবং যাঁরা কোরআনের সাথে নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন আমাদের সমাজে তাঁদের সংখ্যা দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি বলেন, আপনারা লক্ষ্য করে থাকবেন যে, আমরা কোরআন হেফ্য্ করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করছি, কিন্তু এ কারণে কেউ যেন মনে না করেন যে, কোরআন হেফ্য্ করা ও তেলাওয়াত্ করাই আসল কাজ; আমরা জানি যে, এগুলো আসল কাজ নয়, বরং এগুলো হচ্ছে মাধ্যম, কিন্তু এ সব মাধ্যম ব্যতিরেকে কোরআন মজীদের কাছাকাছি আসা- কোরআন মজীদের সাথে ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি করা সম্ভব নয়।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, যে ব্যক্তি কোরআনের জ্ঞানের সাথে পরিচিত নয় এবং কোরআন নিয়ে চিন্তা ও পর্যালোচনা করে না সে কোরআনের সাথে খাপ খাইয়ে নেয় নি- কোরআনকে ভালোবাসে নি। যে সমাজ কোরআন মজীদের ভিত্তিতে পথ চলতে চায় কি করে এ ধরনের লোকেরা সে সমাজকে পথ দেখাবে? তিনি বলেন, সুতরাং আমাদের সমাজের আলোকিত চিন্তার অধিকারী লোকদেরকে, বুদ্ধিজীবীদেরকে ও যুবকদেরকে কোরআনের সাথে পরিচিত হতে হবে, কোরআনের সাথে তাদের আরো বেশি খাপ খাওয়াতে হবে- কোরআনকে আরো বেশি ভালোবাসতে হবে। মন-মস্তিষ্ক যখন কোরআন ধারণের পাত্রে পরিণত হবে তখন পাত্র থেকে তা-ই চুঁইয়ে পড়বে যা পাত্রের ভিতরে আছে। মন-মস্তিষ্ক যখন কোরআন মজীদের জ্ঞানে সমৃদ্ধ হয় তখন তার প্রভাব ব্যক্তির কথায়, তার কাজে, তার সিদ্ধান্ত গ্রহণে, বিশেষত বড় বড় বিষয়ে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণে ও তার আচার-আচরণে প্রতিফলিত হয়। আর আমাদেরকে এ লক্ষ্য অর্জনের জন্যই চেষ্টা করতে হবে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, দেশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদেরকে আগের মতোই অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে কোরআনের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। কেউ যেন এ বিষয়টিকে কোনো ছোট বিষয় বলে মনে না করেন। কোরআন হেফ্য ও ক্বেরাআত্ শিক্ষায় মশগূল যুবকদের সম্বোধন করে তিনি বলেন, তোমরা- প্রিয় যুবকগণ, কোরআন পাঠ শিক্ষার পথে আছ এবং তোমরা কোরআনকে ভালোবাস; তোমরা যেন এ পথে পথচলা অব্যাহত রাখ। তিনি বলেন, কোরআন মজীদ আমাদের সামনে আমাদের ভবিষ্যৎকে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরে। কোরআন আমাদের জন্য সরল, সঠিক, সুদৃঢ় পথÑ সিরাতুল্ মুস্তাক্বীম্কে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরছে এবং আমাদেরকে সৌভাগ্যের অধিকারী করছে।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, বর্তমানে ইসলামী জাহান অনেক দুর্বলতার শিকার হয়ে আছে। তবে ইসলামী সমাজসমূহে ইসলাম ও কোরআন মজীদের অভিমুখে যে অভিযাত্রা শুরু হয়েছে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যে ইসলামী জাগরণ আত্মপ্রকাশ করেছে তা কখনোই বন্ধ হবার নয়। এ জাগরণ নিজেই সর্বত্র অস্তিত্বমান হবে, ইন্ শাআল্লাহ্। বস্তুত ইসলামী জাগরণ হচ্ছে একটি অনস্বীকার্য বাস্তবতা এবং এ বাস্তবতা, ইন্ শাআল্লাহ্, দিনের পর দিন অধিকতর বৃদ্ধি পাবে।
ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার বলেন, অবশ্য ওলামায়ে কেরামের এবং আলোকিত চিন্তাধারার অধিকারীদের ও বুদ্ধিজীবীদের ওপর দ্বিগুণ দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। লেখকগণ, জ্ঞান-গবেষকগণ এবং আপনারা যাঁরা হাফেয ও ক্বারী আপনাদের সকলের প্রতিই জনগণের বিশেষ দৃষ্টি রয়েছে এবং এ কারণে আপনাদের ওপর দ্বিগুণ দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। সুতরাং কোরআন মজীদ আপনাদেরকে যে পথের সুসংবাদ দিয়েছে আপনাদের কর্তব্য হচ্ছে জনগণকে সে পথের ব্যাপারে আশান্বিত করে তোলা। মহান আল্লাহ্ এ কাজে আপনাদেরকে সফলতা প্রদান করবেন এবং আপনাদের কাজের যথার্থতার সত্যায়ন করবেন, ইন্ শাআল্লাহ্।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী তাঁর ভাষণের শেষ পর্যায়ে এ মর্মে আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, মুসলিম সংখ্যাগুরু দেশ সমূহ ও মুসলিম জাতি সমূহ কোরআন মজীদ থেকে কল্যাণ হাসিল্ করতে সক্ষম হবে। তিনি বলেন, ইন্ শাআল্লাহ্, মুসলিম সরকারগুলো ও শাসকগণ কেবল মুখের কথায় নয়, কাজের মাধ্যমেও কোরআন মজীদের সাথে কিছুটা হলেও ঘনিষ্ঠতা তৈরি করে নেবেন। ইন্ শাআল্লাহ্, ইসলামী জাহান আগামী দিনে কোরআন মজীদের ছায়াতলে সৌভাগ্যের অধিকারী হবে।

ফারসি থেকে অনুবাদ : নূর হোসেন মজীদী

ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-এর ওফাত বার্ষিকী উপলক্ষে প্রদত্ত ভাষণে রাহ্বার

আইএসআইএল-এর অপরাধ আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর পরিচালিত নৃশংসতার ন্যায় সমভাবে নিন্দনীয়
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ্ ‘উয্মা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী বলেন, আইএসআইএল ইরাক ও সিরিয়ার মুসলমানদের বিরুদ্ধে যেসব অপরাধমূলক কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে তা আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে পরিচালিত নৃশংসতার ন্যায় সমভাবে নিন্দনীয়। তিনি গত ৪ঠা জুন (২০১৫) ইরানের ইসলামী বিপ্লবের রূপকার হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-এর ২৬তম ওফাত বার্ষিকী উপলক্ষে মরহুম নেতার মাযার প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত সর্বস্তরের জনগণের সমাবেশে প্রদত্ত ভাষণে এ কথা বলেন।
ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী মরহুম ইমাম খোমেইনীর ব্যক্তিত্ব ও চিন্তাধারাকে বিকৃত করার বা অ¯পষ্ট রাখার মারাত্মক বিপদ স¤পর্কে সকলকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, হযরত ইমামকে কেবল এক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে দেখা ঠিক নয়; বরং হযরত ইমাম ছিলেন ইরানী জাতির এক মহা-আন্দোলনের মূর্ত প্রতীক এবং একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক মতাদর্শের প্রতিষ্ঠাতা। ইরানী জাতি তাঁর এ আদর্শকে মেনে নিয়েছে। আর এ আদর্শের পথে চলা অব্যাহত রাখার জন্য মরহুম ভালোভাবে চেনা জরুরি।
ইরানের ইসলামী বিপ্লবের বর্তমান রাহ্বার বলেন, হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-এর চিন্তাদর্শের প্রথম মূলনীতি হলো খাঁটি মুহাম্মাদী ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করা ও মার্কিন ইসলামকে নাকচ করে দেয়া। ইমামের মতে খাঁটি ইসলাম হলো কোরআন ও মহানবী (সা.)-এর সুন্নাহ্নির্ভর। এ ইসলাম যুগ ও স্থান স¤পর্কিত অভিজ্ঞতার আলোকে ¯পষ্ট ধারণার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং ধর্মতাত্ত্বিক শিক্ষাকেন্দ্রগুলোয় সঠিক ‘ইল্মী পদ্ধতির মাধ্যমে পরিপূর্ণতা পেয়েছে। অন্যদিকে মার্কিন ইসলামের কেবল দু’টি শাখা রয়েছে : একটি শাখা হলো সেক্যুলার বা ধর্মসম্পর্কহীন ইসলাম- যা সমাজকে ইসলাম থেকে পৃথক করে এবং অন্যটি হলো শুষ্ক-নির্দয় ইসলাম- যার ভিত্তি হলো গোঁড়ামি বা কুসংস্কারাচ্ছন্ন চিন্তাধারা। ইমাম এ দু’টি শাখাকেই প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, বর্তমান বিশ্বে সেক্যুলার ইসলাম ও শুষ্ক-নির্দয় ইসলামের (যেমন, আইএসআইএল ও তালেবান) অস্তিত্ব রয়েছে এবং আমেরিকাসহ বিশ্বের মোড়ল শক্তিগুলো এ ইসলামকে সমর্থন দিচ্ছে। ইসলামী ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আরও বলেন, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান যেমন আইএসআইএল-এর অপরাধ ও নৃশংসতার বিরোধিতা করছে ঠিক তেমনি আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর ওপর মার্কিন পুলিশের হিংস্র আচরণেরও নিন্দা করছে। একই সঙ্গে ইরান গাযায় যায়নবাদীদের যুলুম ও অবিচার এবং বাহরাইনে জনগণের ওপর দমন-পীড়ন ও ইয়েমেনে বোমা বর্ষণ তথা আগ্রাসনের নিন্দা করছে।
ইসলামী ইরানের সর্বোচ্চ নেতার মতে, ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-এর চিন্তাদর্শের দ্বিতীয় মূলনীতিটি হলো আল্লাহ্ তা‘আলার ওয়াদার প্রতি দৃঢ় ঈমান পোষণ এবং সাম্রাজ্যবাদী ও বলদর্পী শক্তিগুলোকে প্রত্যাখ্যান। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, এ নীতির ফলে হযরত ইমাম তাঁর বিপ্লবী অবস্থানে অবিচল ও দ্বিধাহীন ছিলেন। যদিও তিনি জানতেন যে, পরাশক্তিগুলো এর ফলে ক্রুদ্ধ হবে, কিন্তু তিনি খোদায়ী শক্তি ও খোদায়ী সাহায্যের ওপর ভরসা করতেন। মহান আল্লাহ কোরআন মজীদে মুমিনদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, যারা আল্লাহর দ্বীনের সাহায্য করবে তিনি তাদেরকে সাহায্য করবেন।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, অন্যদিকে যারা আল্লাহর এ ওয়াদায় ঈমান রাখে না আল্লাহ তাদেরকে অভিশাপ দেন এবং তাদের স্থান জাহান্নামে হবে বলে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা সূরা আল্-ফাত্হ্-এর ষষ্ঠ আয়াতে এরশাদ করেন: “তিনি মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী এবং অংশীবাদী পুরুষ ও অংশীবাদিনী নারীদেরকে শাস্তি দেনÑ যারা আল্লাহ স¤পর্কে মন্দ ধারণা পোষণ করে। তাদের জন্য মন্দ পরিণাম। আল্লাহ তাদের প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন, তাদেরকে অভিশপ্ত করেছেন। এবং তাদের জন্য জাহান্নাম প্রস্তুত রেখেছেন। তাদের প্রত্যাবর্তনস্থল অত্যন্ত মন্দ।”
ইসলামী বিপ্লবের নেতা বলেন, ইসলামী বিপ্লবের রূপকার ইমাম খোমেইনী (রহ্.) জনগণের শক্তির প্রতি আস্থাশীল ছিলেন এবং এ শক্তিকে ব্যাপক গুরুত্ব দিতেন; তিনি সরকারের হাতে সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার বিরোধিতা করতেন। সেই দিনগুলোতে কোনো এক ভুল ধারণার ভিত্তিতে দেশের সমস্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সরকারের ওপর ন্যস্ত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু ইমাম এ বিষয়ে বার বার সতর্ক করেন।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) অর্থনৈতিক, সামরিক, উন্নয়ন ও পুনর্গঠন এবং প্রচারের বিষয়ে ও এ সবকিছুরও ওপরে নির্বাচনসমূহের ব্যাপারে জনগণের ওপর আস্থাশীল ছিলেন। ইমাম খোমেইনী (রহ্.) দশ বছর ইরানের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় নেতা ও শাসক ছিলেন। এ দশ বছরে দেশটিতে ১০টি জাতীয়ভিত্তিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আর এ থেকেই জনগণের প্রতি ইমামের গুরুত্ব দেয়ার বিষয়টি প্রমাণিত হয়। অথচ এ ১০ বছরের মধ্যে ৮ বছরই চাপিয়ে দেয়া এক অসম যুদ্ধে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে ইরানকে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে যাতে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে এক দিনও দেরী করা না হয় সে জন্য তিনি খুবই তাকিদ করতেন। ফলে নির্বাচনগুলো যথাসময়েই অনুষ্ঠিত হয়।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতার মতে, সামাজিক সুবিচারের প্রতি আস্থা, দুর্বল ও বঞ্চিতদের প্রতি সহায়তা এবং প্রাসাদতুল্য ভবনে থাকার ও বিলাসী জীবন যাপনের বিরোধিতা ছিল ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-এর আরেকটি মূলনীতি। ইমাম স্মরণ করিয়ে দিতেন যে, দরিদ্ররাই তাদের উপস্থিতির মাধ্যমে নানা অঙ্গনকে সমৃদ্ধ করেছে এবং তারাই বিপ্লবে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে। তারা হত-দরিদ্র হওয়া সত্ত্বেও বিপজ্জনক নানা ময়দানে উপস্থিত হয়েছে এবং দারিদ্রের বিষয়ে তারা প্রতিবাদও করছে না!

ইসলামী বিপ্লবের নেতা বলেন, বিশ্বের ওপর মোড়লিপনা করতে অভ্যস্ত দাম্ভিক শক্তিগুলোর বিরোধিতা করা ছিল ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-এর অন্যতম মূলনীতি। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, ইমাম দাম্ভিক শক্তিগুলোর সঙ্গে সখ্য রাখতেন না এবং মার্কিন সরকারকে বড় শয়তান বলে উল্লেখ করা ছিল ইমামের অভিনব সৃষ্টিশীলতা। আপনি যখন কোনো প্রতিষ্ঠানকে শয়তান বলে মনে করবেন তখন আপনার আচরণ ও অনুভূতি তার প্রতি কেমন হবে তা ¯পষ্ট। ইমাম জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মার্কিন সরকারকে এমনই মনে করতেন ও তা উল্লেখও করতেন। বস্তুত সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিগুলোকে দাম্ভিক শক্তি বলে উল্লেখ করা এবং স্বীয় ইসলামী আন্দোলনকে দাম্ভিক শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই বলে উল্লেখ করাও ছিল ইমামের অনন্য সৃষ্টিশীলতা যার ভিত্তি ছিল কোরআন মজীদের বাণী।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, জাতির স্বাধীনতায় বিশ্বাস ও আধিপত্যকামিতার প্রতিরোধ ছিল ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-এর অন্যতম মূলনীতি। আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী এ প্রসঙ্গে বলেন, মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে যখন সম্মান দেখানো হচ্ছে তখন একটি দেশের তুলনায় একটি জাতির স্বাধীনতা বিজাতীয়দের ও বিরোধীদের মোকাবেলায় কেনো সম্মানিত হবে না?
ইসলামী বিপ্লবের নেতা বলেন, আল্লাহ তা‘আলা কোরআন মজীদে বলেছেন, ‘আল্লাহ কখনও ঈমানদারদের ওপর কাফেরদের কর্তৃত্বের পথ খোলা রাখেন নি।’ বস্তুত মুসলমানদের স্বাধীনতা নির্ভর করে কাফেরদের প্রতি আস্থা না রাখার মধ্যে এবং তাদের কর্তৃত্ব ও অভিভাবকত্ব মেনে না নেয়ার মধ্যে। কোরআনের দৃষ্টিতে কাফেরদের সঙ্গে মুসলমানদের এমন কোনো সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও অন্য যে কোনো চুক্তি করা অবৈধ যা তাদের ওপর কাফেরদের কর্তৃত্ব বা কাফেরদের প্রতি নির্ভরশীলতা সৃষ্টি করতে পারে।
মরহুম ইমাম খোমেইনী সব সময়ই জাতীয় ঐক্য ও ইসলামী ঐক্যের ওপর জোর দিতেন। হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী এ প্রসঙ্গে বলেন, হযরত ইমাম এরই আলোকে শিয়া-সুন্নি মাযহাবগত বিভেদ বা জাতিগত বিভেদসহ বিভেদকামী যে কোনো বিষয়কে শত্রুদের নীতি বলে মনে করতেন এবং তিনি জাতীয় ঐক্যের ওপর নযিরবিহীন জোর দিতেন। মার্কিন সরকার যেসব সুন্নিকে সহায়তা দিচ্ছে ও যেসব শিয়াকে লন্ডন থেকে বিশ্বের নানা অঞ্চলে মদদ দেয়া হচ্ছে এ উভয় গোষ্ঠীই শয়তানের ভাই। তারা উভয়ই আমেরিকা, পাশ্চাত্য ও সাম্রাজ্যবাদীদের অনুচর।

ইমাম খোমেইনী (র.)-এর আন্দোলন ইমাম মাহদী (আ.)-এর বৈশ্বিক আন্দোলনের পটভূমি

খন্দকার মোঃ মাহফুজুল হক
ইরানের খোমেইন শহরের নাম নিশ্চয়ই সচেতন ব্যক্তিমাত্রই শুনে থাকবেন। কারণ, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের স্থপতি মরহুম ইমাম খোমেইনী (র.)-এর নামের সাথে জড়িয়ে আছে এই শহরটি। এই ঐতিহাসিক শহরের নামের শেষে ‘ই’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে মুসলিম জাহানের অবিসংবাদিত নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ মুসাভী বিশ্বজুড়ে ইমাম খোমেইনী নামে পরিচিতি লাভ করেছেন।
ফেব্রুয়ারি ইরানী জনগণের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস। কারণ, ১৯৭৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি মরহুম ইমাম
খোমেইনীর নেতৃত্বে ইরানে ইসলামী বিপ্লব চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে। শহীদদের এক সাগর রক্তের বিনিময়ে ইরানের জনগণ লাভ করে প্রকৃত স্বাধীনতা ও মুক্তি। চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র কয়েক দিন আগে অর্থাৎ ১লা ফেব্রুয়ারি ইমাম খোমেইনী ১৫ বছরের নির্বাসিত জীবনের অবসান ঘটিয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। এদিনে তাঁকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য ইরানের কোটি কোটি মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন যা ছিল বিশ্ব ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা।
ঠিক তেমনই ১৯৮৯ সালের চৌঠা জুন মুসলমানদের জন্য বিশেষ করে ইরানী জনগণের জন্য একটি শোকাবহ দিন।
এদিন ইমাম খোমেইনী (র.) মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে এ নশ্বর জগৎ ত্যাগ করেন। ১৯৭৯ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি যে পরিমাণ মানুষ ইমামকে স্বাগত জানাতে রাস্তায় নেমে এসেছিল তার চেয়ে কয়েকগুণ মানুষ দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে তাঁকে শেষ বিদায় জানায়।
ইমাম খোমেইনী জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের ভক্তি, শ্রদ্ধা ও অকৃত্রিম ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছিলেন। কারণ তিনি বিশ্বের প্রচলিত ধারার বাইরে নতুন এক ধারা প্রবর্তন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে সংঘটিত ইরানের ইসলামী বিপ্লব আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশ্বের প্রচলিত অনেক সমীকরণ বা হিসেব-নিকেশ বদলে দিয়েছে। বিশ্ব যখন একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদ এবং অন্যদিকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন ধর্মহীন সমাজতন্ত্রের নিগড়ে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল, যখন মুসলিম দেশগুলোর সরকার এবং তথাকথিত ইসলামী দলগুলোর নেতাদের মধ্যেও এই ধারণা বিস্তার লাভ করেছিল যে, দুই পরাশক্তিকে উপেক্ষা করে চলা সম্ভব নয়, ঠিক তখন ইসলামের বিজয় কেতন উড়িয়ে বিশ্ববাসীর সামনে আসেন ইরানের এই অবিসংবাদিত নেতা।
যুগে যুগে নবী-রাসূলগণ দাম্ভিক ও অত্যাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। ফেরাউন ও নমরুদের মতো অত্যাচারী এবং খোদাদ্রোহী শাসকদের হাত থেকে নিপীড়িত জনগোষ্ঠীকে উদ্ধার করতে আল্লাহ পাক দুইজন বিশিষ্ট নবীকে এ ধরাপৃষ্ঠে পাঠিয়েছেন। নবুওয়াতের ধারা পরিসমাপ্তির পর যুগে যুগে আহলে বাইতের মহান ইমামগণ নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। যখনই কোন জনপদে কোন মানবগোষ্ঠী বিভ্রান্তিতে নিপতিত হয়েছে কিংবা অত্যাচারী শাসক কর্তৃক নিপীড়িত-নিগৃহীত হয়ে মহান আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেছে তখনই মহান প্রতিপালক তাদেরকে উদ্ধার করার জন্য তাঁর মনোনীত ব্যক্তিদেরকে এ দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। পবিত্র কোরআনের সূরা নিসার ৭৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “তোমাদের কি হলো যে, তোমরা আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করছ না সেই সব অসহায় পুরুষ, নারী ও শিশুদের জন্যে, যারা (ফরিয়াদ) করে বলছে, ‘হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদেরকে এই জনপদ থেকে উদ্ধার কর; এখানকার অধিবাসীরা যে অত্যাচারী! আর তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য অলি নির্ধারণ করে দাও এবং তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য সাহায্যকারী পাঠাও।”
ইমাম খোমেইনী (র.) ছিলেন এমন একজন অলি যিনি দুর্বল জাতিগুলোকে দাম্ভিক বৃহৎ শক্তিগুলোর আধিপত্য থেকে মুক্তি লাভের পথ দেখিয়েছেন। দিগ্ভ্রান্ত মুসলমানদেরকে দিয়েছেন পথের দিশা। ইসলামের সঠিক ব্যাখ্যা তুলে ধরে তিনি মুসলমানদেরকে ইমানী চেতনায় পুনরুজ্জীবিত করেছেন। তিনি খাঁটি মোহাম্মাদী ইসলাম প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। যে ইসলাম সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কথা বলে না, অন্যায়-অবিচার, যুলুম ও শোষণের বিরুদ্ধে কিংবা রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলে না, তিনি সে ইসলামকে ‘আমেরিকান ইসলাম’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। যুগে যুগে নবী-রাসূল ও ইমামগণ যেভাবে অত্যাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন এবং ইমাম হোসাইন (আ.) যেমনিভাবে ইয়াযীদের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন, ইমাম খোমেইনী (র.) ঠিক তেমনই হোসাইনী চেতনা নিয়ে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে মুসলমানদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
তিনি পুঁজিবাদ ও সমাজবাদের মূর্তি ভেঙে ফেলার ডাক দিয়ে দৃপ্তকণ্ঠে জানিয়ে দিয়েছেন, মানুষের তৈরি করা মতবাদ প্রকৃত শান্তি ও মুক্তি নিশ্চিত করতে সক্ষম নয়, একমাত্র আল্লাহপ্রদত্ত ইসলামী জীবনাদর্শ মানুষের প্রকৃত মুক্তির ব্যবস্থা করতে পারে। তিনি মনে করতেন, ইসলাম শুধু মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকাহ বা ব্যক্তিগত ইবাদতের ধর্ম নয়, ইসলাম হলো সর্বজনীন ও বিশ্ব মানবতার ধর্ম। একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। এই ধর্ম একদিকে যেমন মানুষকে উন্নত চরিত্র ও নৈতিক গুণাবলি অর্জনের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেয় তেমনি সব ধরনের অন্যায়-অবিচার, শোষণ-নির্যাতন, সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানায়। এ ধর্ম জীবনের সর্বক্ষেত্রে সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা ,দারিদ্র্য বিমোচন ও মযলুম মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলে।
ইমাম খোমেইনী (র.) ছিলেন একাধারে একজন বড় দার্শনিক, রাষ্ট্রনায়ক, সচেতন রাজনীতিজ্ঞ, অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামী আইনজ্ঞ ও মুজতাহিদ আলেম, আপোসহীন সংগ্রামী, শ্রেষ্ঠ মানের শিক্ষক, অনুপম লেখক, হৃদয়স্পর্শী বক্তা, আধ্যাত্মিক কবি এবং সর্বোপরি একজন অনন্যসাধারণ আধ্যাত্মিক নেতা ।
সমকালীন যুগে বা হাজার বছরের ইতিহাসে কোনো মুসলিম মনীষীর মধ্যে এতগুলো সফল দিক বা গুণের সমাহার দেখা যায়নি। আধ্যাত্মিক জ্ঞানের দিক থেকে তাঁর অবস্থান ছিল অনেক উঁচুতে। একজন আধ্যাত্মিক সাধক ও পরহেজগার আলেম হিসেবে জনপ্রিয় এই ইমাম কখনও নেতৃত্বের পেছনে ছুটেননি; বরং মযলুম মানুষের প্রতি তাঁর অপরিসীম ভালোবাসা, দেশ ও জাতির স্বার্থে সময়োপযোগী পদক্ষেপ, দূরদর্শী ও সাহসী নেতৃত্ব, আল্লাহর উপর অবিচল আস্থা, আত্মবিশ্বাস এবং যুগোপযোগী অসাধারণ জ্ঞান ও যোগ্যতার কারণেই তিনি মুক্তিকামী মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতায় পরিণত হয়েছিলেন ।
তিনি বলতেন, তাদের হাতে ইসলামের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে যারা উচ্চশিক্ষিত হয়েছে, অথচ আত্মিক দিক থেকে সংশোধিত হয়নি। এজন্য তিনি সরকারি ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের আত্মসংশোধন এবং ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার উপর খুব বেশি গুরুত্ব প্রদান করতেন। তিনি নৈতিকতা শিক্ষার ক্লাসে ধর্মতত্ত্বের ছাত্রদের উপদেশ দিয়ে বলতেন, ‘ধর্মতত্ত্বের একজন প্রবীণ শিক্ষকের মতে আলেম হওয়া খুব সহজ। কিন্তু খুব কঠিন হচ্ছে একজন সত্যিকার মানুষ হওয়া, আর আমি বলব, আলেম হওয়া বেশ কঠিন, আর মানুষ হওয়াটা প্রায় অসম্ভব।’
তিনি প্রায় সময়ই বলতেন, ‘যদি তোমরা পদ ও পদবি গ্রহণ করতে চাও তাহলে সবার আগে অন্তরের বিশুদ্ধতা অর্জন কর। অন্তর পবিত্র না হলে পদ ও ক্ষমতা তোমাকে বিভ্রান্তিতে নিপতিত করবে, একই সাথে তোমার আখেরাতকেও বরবাদ করে দেবে।’
ইমাম খোমেইনী (র.)-এর আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব এবং ইরানের ইসলামী বিপ্লবের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের কারণে আলেমদের অনেকেই একে প্রতিশ্রুত ইমাম মাহদী (আ.)-এর বৈশ্বিক বিপ্লবের পটভূমি বলে অভিহিত করেছেন। বিভিন্ন হাদিস থেকে নিশ্চিতভাবে জানা যায় যে, পৃথিবীতে যখন অবিচার-অনাচার ছড়িয়ে পড়বে, জাতিগুলো বিবাদ-বিসম্বাদ ও হানাহানিতে লিপ্ত হবে, অত্যাচার-অবিচার, হত্যা-খুন ও সন্ত্রাস পৃথিবীকে অশান্ত করে তুলবে, তখন নবী বংশ বা পবিত্র আহলে বাইতের মধ্য থেকে একজন ত্রাণকর্তার আবির্ভাব হবে। তিনি ইমাম মাহদী নামে পরিচিত হবেন। তিনি আগমন করে এই উম্মতকে নেতৃত্ব দেয়ার দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন। ইসলাম ধর্মকে সংস্কার করবেন এবং ইসলামী শরীয়তের মাধ্যমে বিচার-ফয়সালা করবেন। পৃথিবী থেকে যুলুম-নির্যাতন দূর করে ন্যায়-ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করবেন।
ইমাম মাহদী (আ.)-এর আবির্ভাব এবং বিশ্বব্যাপী সৎ ও ঈমানদারদের শাসন কায়েম হওয়ার পূর্বাভাস দিয়ে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকর্ম করে আল্লাহ তাদেরকে ওয়াদা দিয়েছেন যে, তাদেরকে অবশ্যই পৃথিবীতে শাসন কর্তৃত্ব দান করবেন, যেমন তিনি শাসনকর্তৃত্ব দান করেছেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে এবং তিনি অবশ্যই সুদৃঢ় করবেন তাদের ধর্মকে যা তিনি তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং তাদের ভয় ভীতির পরিবর্তে অবশ্যই তাদেরকে শান্তি দান করবেন। তারা আমার ইবাদত করবে এবং আমার সাথে কাউকে শরীক করবে না। এরপর যারা অকৃতজ্ঞ হবে তারাই অবাধ্য।” (সূরা নূর : ৫৫)
ইমাম মাহদী (আ.)-এর আবির্ভাবের বিষয়ে মুসলমানদের সকল মাজহাবের মধ্যে ঐকমত্য রয়েছে। যুগ যুগ ধরে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা তাঁর আত্মপ্র্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছেন। আল্লাহর কাছে তাঁরা প্রার্থনা করছেন যেন এই ঝঞ্ঝাসঙ্কুল পৃথিবীতে তাঁর আগমন ত্বরান্বিত হয়। পবিত্র নবী বংশের অনুসারী শিয়া মুসলমানরা বিশ্বাস করেন শাবান মাসের ১৫ তারিখ অর্থাৎ পবিত্র শবে বরাত তিনি আহলে বাইতের এগারোতম ইমাম হযরত হাসান আসকারী (আ.)-এর ঘরে জন্মগ্রহণ করেছেন। যেহেতু তিনি নবী বংশের সর্বশেষ ইমাম হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করছেন তাই আল্লাহ পাকের ইচ্ছায় বর্তমানে তিনি অন্তর্ধানে রয়েছেন। আল্লাহর ইচ্ছায় তিনি আবার উপযুক্ত সময়ে আত্মপ্রকাশ করবেন এবং তাঁর উপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালন করবেন।
নবী করিম (সা.)-এর বিভিন্ন হাদিস ও ভবিষ্যদ্বাণী থেকে জানা যায় যে, ইমাম মাহদী (আ.)-এর আত্মপ্রকাশের আগে মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করবে, তাঁর আগমনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকবে, ন্যায়নিষ্ঠ আলেম ও ইসলামী ব্যক্তিত্বরা তাঁর আগমনের প্রেক্ষাপট তৈরির জন্য সচেষ্ট হয়ে উঠবেন, মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি হবে। বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, এক্ষেত্রে বিশিষ্ট সাহাবী হযরত সালমান ফারসি (রা.)-এর বংশধর অর্থাৎ পারস্যের আলেমরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের অনেক আগে থেকেই ইরানের বিশিষ্ট আলেমরা মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। এক্ষেত্রে আয়াতুল্লাহ বুরুজের্দি ও শেইখ আহমদ শালতুত (র.)-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ইরানে ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের পর ইমাম খোমেইনী (র.) শিয়া-সুন্নিসহ সকল মুসলমানকে ঐক্যবদ্ধ করার মহতি উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি রাসূলে পাক (সা.)-এর জন্মের মাস রবিউল আওয়ালের ১২ থেকে ১৭ তারিখ ইসলামী ঐক্য সপ্তাহ হিসেবে পালনের নির্দেশ দেন। তিনি ঘোষণা করেন, ‘মুসলিম দেশগুলোতে যারা শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছে, তারা শিয়াও নয়, সুন্নিও নয়; বরং তারা হলো সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল।’ এভাবে তিনি ইসলামী ঐক্য গড়ে তোলার কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।
কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও তাদের তাঁবেদাররা মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য ও বিভেদ সৃষ্টির অপচেষ্টা পরিত্যাগ করেনি। বিভিন্ন দেশে তারা মুসলিম নামধারী এমন কিছু সুবিধাবাদী ব্যক্তি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে যারা এ ক্ষেত্রে ইহুদিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীদের নীল-নকশা বাস্তবায়নের কাজে সক্রিয় রয়েছে। সম্প্রতি সিরিয়া ও ইরাকে সন্দেহভাজন ও উগ্রবাদী একটি গোষ্ঠী হত্যা ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বকে অশান্ত করে তুলেছে। হত্যা, লুটপাট, সন্ত্রাস এবং ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো ধ্বংস করে এই উগ্রবাদী গোষ্ঠীটি এটাই প্রমাণ করেছে যে, তারা আসলে ইসলামকে কলংকিত করার কাজে লিপ্ত রয়েছে। এধরনের উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলোর চরিত্র উন্মোচন করে দিয়ে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, “যখন তাদেরকে বলা হয় যে, দুনিয়ার বুকে দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করো না, তখন তারা বলে, ‘আমরা তো শান্তির পথ অবলম্বন করেছি।’ মনে রেখ, তারাই হাঙ্গামা সৃষ্টিকারী, কিন্তু তারা তা উপলব্ধি করে না।” (সূরা বাকারাহ : ১১)
ইরাক ও সিরিয়ায় জেঁকে বসা উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলোর বেশির ভাগ সদস্য বহিরাগত, অর্থাৎ বহিরাগতরা ইরাক বা সিরিয়ার নাগরিক নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে তাদেরকে সংগ্রহ করা হয়েছে। তাদের কার্যকলাপ প্রত্যেক সচেতন মানুষের মনে কতগুলো প্রশ্ন জন্ম দেয়। যেমন, এই গোষ্ঠীগুলোর শক্তির উৎস কোথায়? কারা এদেরকে অস্ত্র ও রসদ সরবরাহ করেছে এবং এখনো করে যাচ্ছে? যুদ্ধের প্রশিক্ষণ তারা কোথা থেকে পেয়েছে? সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শক্তির কড়া নজর এড়িয়ে কিভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে উগ্রবাদীরা ইরাক ও সিরিয়ায় সমবেত হওয়ার সুযোগ পেল?
এরপর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে, আইএস বা অন্যান্য উগ্রবাদী গোষ্ঠী নিজেদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে যে তাণ্ডব চালাচ্ছে তাতে ইসলামের সম্মান বাড়ছে নাকি কমছে? তাদের কার্যকলাপের ফলে মুসলিম বিশ্ব লাভবান হচ্ছে না কি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে? ইসলামের নামে তারা যে তাণ্ডব চালাচ্ছে তা কি ইসলামী নীতি আদর্শের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুবই স্পষ্ট এবং সবার কাছেই অনুমেয়। অতএব, মুসলিম বিশ্বকে ইসলামের শত্রুদের ষড়যন্ত্র ও ক্রমবিস্তারমান উগ্রবাদের কবল থেকে মুক্ত করতে হলে মুসলমানদের মধ্যে সঠিক ইসলাম স¤পর্কে জ্ঞান ও সচেতনতা বাড়াতে হবে, পাশাপাশি ঐক্য ও সংহতি মজবুত করে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। এ দু’টি বিষয়কে সামনে রেখেই ইসলামের মহান সাধক ও সংস্কারক মরহুম ইমাম খোমেইনী (র.) আজীবন কাজ করে গেছেন।
অতএব, এতে কোন সন্দেহ নেই যে, তাঁর চিন্তা ও আদর্শ অনুসরণ করা হলে এ ক্ষেত্রে অনেক মূল্যবান দিক-নির্দেশনা লাভ করা সম্ভব হবে।
লেখক : মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশ্লেষক

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অনুসরণে ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর কর্মপদ্ধতি

অধ্যাপক মুহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন খান*

বর্তমান বিশ্বের যে কোন মানুষ, বিশেষ করে যে কোন মুসলমানই একবাক্যে স্বীকার করছেন যে, ইমাম খোমেইনী (রহ.) নিঃসন্দেহে একজন শতাব্দীশ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ও নেতা। যাঁরা আরো গভীরভাবে তাকান ও বুঝেন, তাঁরা নিশ্চিত যে, ইমাম খোমেইনী বিংশ শতকে আল্লাহ তাআলার এক অনন্যসাধারণ সৃষ্টি ও নেয়ামত। বিংশ শতকের নির্জীব, নিষ্প্রাণ, হতভাগ্য ও মযলুম মুসলিম উম্মাহর জন্য তো অবশ্যই তিনি এসেছেন রাসূলুল্লাহর তাওহিদী পতাকা হাতে অলৌকিক দিশারি হিসাবে। ইমাম খোমেইনীর জীবনচরিত, তাঁর ধর্মীয়, রাজনৈতিক, দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক রচনাবলি, তাঁর নির্ভীক-নিরলস সংগ্রাম, তাঁর বাণী ও বক্তৃতাসমূহ, তাঁর নেতৃত্বাধীন ইসলামী বিপ্লব এবং ইরানের বুকে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রব্যবস্থা সবই প্রকারান্তারে ইসলামের সূচনা কালের পুনরাবৃত্তি এবং আল্লাহর রাসূল, তাঁর আহলে বাইত ও সাহাবাগণেরই পদাঙ্ক অনুসরণ আর সেই তাওহিদী নির্ভেজাল মুহাম্মাদী ইসলামের পুনঃমঞ্চায়ন।

ইসলামের সোনালি যুগের অবসানের পর গত চৌদ্দশ’ বছর যাবৎ ইসলামের পুনঃজাগরণ ও পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য বহু সংগ্রাম ও প্রচেষ্টা চলে এসেছে সত্য। কিন্তু ইমাম রুহুল্লাহ আল-মুসাভী আল-মুস্তাফাভী আল-খোমেইনী রহমাতুল্লাহি আলাইহির নেতৃত্বে যে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা, প্রজাতন্ত্র ও তাওহিদী সমাজ ইরানের বুকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার নজির আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। ইমাম বলেছেন, এ বিপ্লব আসমানি নূরের বিস্ফোরণ তথা তাজাল্লী। চৌদ্দশ’ বছর পর নবীজী ও তাঁর আহলে বাইতের ভবিষ্যদ্বাণী ইমাম খোমেইনীর নেতৃত্বে ইরানে বাস্তবায়িত হয়েছে ও হচ্ছে।
বিশ্ববাসী, বিশেষ করে বিশ্বের মযলুম-মুস্তাযাফ জনতা এবং মুসলিম জনসাধারণ ইমাম খোমেইনীকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন তাঁর আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ উন্নত গুণাবলির কারণে। তবে আফসোসের বিষয় হলো যখনই কেউ ইমামকে গভীরভাবে জানতে, ভালোবাসতে ও অনুসরণ করতে চান তখনই নফসানি ও শয়তানি জাহেরি-বাতেনি শক্তিগুলো বাধা হয়ে দাঁড়ায় ও চক্রান্ত শুরু করে দেয়। মাযহাবী দ্বন্দ্বের শিয়া-সুন্নির বিষাক্ত তরবারি এসে উম্মতের ঐশী ভালোবাসার পথে মারণাস্ত্র হিসাবে দাঁড়ায়। চৌদ্দশ’ বছর যাবৎ উমাইয়্যা-আব্বাসী রাজতন্ত্রীদের এ বিষাক্ত তরবারি যেমন উম্মাহকে শতধাবিভক্ত করে রেখেছিল তেমনি বিংশ ও একবিংশ শতকের মুনাফেকী শক্তি ও সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির নেতৃত্বে ও চক্রান্তে একই অস্ত্র প্রয়োগ করে চলেছে। উদ্দেশ্য আল্লাহ তাআলা যে নিয়ামত ইসলামী উম্মাহ ও বিশ্বের মযলুম মুস্তাযাফ মানবজাতিকে নাজাতের উপায় হিসাবে দান করেছেন তা যেন কেউ লাভ করে সৌভাগ্যবান হতে না পারে। মযলুম-মুস্তাযাফ মানুষের মুক্তির পথে ইমাম খোমেইনী ও তাঁর অনুসারী বাহিনী যে বিপ্লব, আন্দোলন, লড়াই ও দিশা দিচ্ছেন তা এ যামানার নমরুদ, ফিরআউন, আবু লাহাব, আবু জাহেলদের পতন ঘটিয়ে বিশ্বের দিকে দিকে নাজাতের তাওহিদী পথ খুলে দেবে ও দিচ্ছে। এ কারণেই নফসানি ও শয়তানি শক্তিবর্গ আমাদেরকে ইমাম খোমেইনীর কাছাকাছি ও গভীর জীবন-দর্শন এবং দিক-নির্দেশনার পরশে যেতে দিতে চায় না। এটাই সত্য ও বাস্তব কথা।
আমি সুদীর্ঘ দশ বছর ইমাম খোমেইনীর আধ্যাত্মিক-রাজনৈতিক নেতৃত্বের ছায়াতলে কাটিয়েছি এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে প্রায় দুই যুগের কাছাকাছি সময় খেদমত করার সৌভাগ্য লাভ করেছি। ইসলামী বিপ্লব বিজয় লাভের সময়কাল এবং পরবর্তী সময়ে ইমামের সব বক্তৃতা ও বাণী অনুসরণ, অনুধাবন ও অনুবাদ করে প্রচারেরও বিশেষ তাওফিক অর্জন করি।
এ কারইে আমি দাবি করে বলতে পারি, কেউ যদি এ যুগে সত্যিকারের আল্লাহপ্রেমিক ও রাসূলপ্রেমিক মুসলমান হতে চায়, এমনকি প্রকৃত সুন্নাতের অনুসারী হতে চায় তাহলে তাকে অবশ্যই ইমাম খোমেইনীর চিন্তা-দর্শন, আচরণ ও পদাঙ্ক গভীর মনোযোগ সহকারে অনুসরণ করতে হবে।

বিশেষ করে ইমাম খোমেইনীর আধ্যাত্মিক-রাজনৈতিক ওসিয়তনামা নিয়মিত পাঠ ও অনুসরণ করা নেহায়াত জরুরি। তাছাড়া তাঁর রচিত অতি উচ্চ মূল্যমানের আধ্যাত্মিক গ্রন্থসমূহ, যেমন র্সিরুস সালাত, আদাবুস্্ সালাত, আরবাঈন হাদিস, তালাব ওয়া ইরাদা, মিসবাহুল হিদায়া প্রভৃতি গ্রন্থ বারবার গভীর মনোনিবেশ সহকারে পাঠ করা প্রয়োজন। এটাও মনে রাখতে হবে যে, চোর, ডাকাত, দুর্নীতিবাজ, স্বৈরাচারী, স্বেচ্ছাচারী, ব্যভিচারী, পুঁজিবাদী, ভোগবাদী, উপনিবেশবাদী, সা¤্রাজ্যবাদী এবং ইবলিস শয়তানই কেবল ইমাম খোমেইনী (রহ.) এবং তাঁর পথের বিরোধী যেমন করে এরা প্রকৃত ইসলামেরও বিরোধী।
পরিশেষে আমি বলব, ইমাম খোমেইনীকে গভীরভাবে ভালোবাসা ও তাঁকে অনুসরণ করা বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার যা কেবল আল্লাহপাকই দয়াপরবশ হয়ে তাঁর খাঁটি বান্দাদের দিতে পারেন। আমরা আল্লাহর কাছে মুনাজাত করছি তিনি যেন আমাদেরকে তাঁর নিয়ামতপ্রাপ্ত বান্দাদের দলে পরিচালিত করেন এবং ইসলামী উম্মাহর মাঝে হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর মতো আরো আধ্যাত্মিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা দান করেন। তাহলেই বিশ্বব্যাপী ইসলামের ন্যায়-ইনসাফ ও ভ্রাতৃত্ব-সাম্য এবং মায়া-মমতার প্রতীক হযরত ইমাম মাহদী আলাইহিস সালামের একক বিশ্ব রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র তৈরি হতে থাকবে ইনশাআল্লাহ।

লেখক: পরিচালক, ইউআইটিএস রিসার্চ সেন্টার,
ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেস (ইউআইটিএস)

আল-কুদ্সের মুক্তি, মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সাম্প্রতিক অন্তরায়সমূহ

ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

ভূমিকা
মক্কার মসজিদুল হারাম বা বায়তুল্লাহ ও মদীনার মসজিদে নববীর পর মুসলমানদের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান হচ্ছে বায়তুল মুকাদ্দাস বা মসজিদুল আকসা। রাসূলুল্লাহ (সা.) যে তিনটি মসজিদের উদ্দেশে সফরকে বিশেষভাবে সওয়াবের কাজ হিসেবে উল্লে¬খ করেছেন এর অন্যতম হচ্ছে মসজিদ আল-আক্সা। ফিলিস্তিনের জেরুজালেম নগরীতে অবস্থিত বায়তুল মুকাদ্দাস হচ্ছে মুসলমানদের প্রথম কিবলা। ইসলামের ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সঙ্গে এর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। অসংখ্য নবী-রাসূলের পদধূলিতে ধন্য এ নগরী। এখানে রয়েছে অসংখ্য নবী-রাসূলের ঐতিহ্যবাহী মাজার। এ নামটি শুধু একটি স্থানের সঙ্গে জড়িত নয়, বরং এটি মুসলমানদের ঈমান-আকীদা ও সভ্যতা-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এ পবিত্র নগরীর প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা বিশ্বের প্রতিটি মুমিন মুসলমানের হƒদয়ের গভীরে প্রোথিত।

ঐতিহাসিক পটভূমি
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইবরাহীম (আ.) কাবাঘর পুনঃনির্মাণের ৪০ বছর পর হযরত ইয়াকুব (আ.) জেরুজালেমে আল-আকসা মসজিদ নির্মাণ করেন। হযরত দাউদ (আ.) বায়তুল মোকাদ্দাসে তাঁর আমলের রাজধানী স্থাপন করেন এবং একটি বিশাল ইবাদতখানা নির্মাণে হাত দেন, যা হযরত সুলায়মান (আ.) কর্তৃক জ্বিনদের মাধ্যমে সমাপ্ত হয়। অতঃপর হযরত দাউদ (আ.)-এর পুত্র নবী হযরত সোলায়মান (আ.) জেরুজালেম নগরী পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন এবং মহান আল্লাহর মহিমা তুলে ধরতে সেখানে পুনঃনির্মাণ করে গড়ে তোলেন মসজিদ আল-আকসা। এভাবে বায়তুল মোকাদ্দাসের পবিত্রতার মর্যাদা বাস্তবরূপ লাভ করে। এরপর হযরত ঈসা (আ.)-এর সময় থেকে তাঁর অনুসারীদের এবং মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর নবুওয়াত প্রাপ্তির পর থেকে মুসলমানদের দ্বারা বায়তুল মুকাদ্দাস পবিত্রতম স্থান রূপে গণ্য হতে থাকে। কোরআন মজিদে বায়তুল মুকাদ্দাসকে পবিত্র ভূমি বলে উল্লে¬খ করে বলা হয়েছে, ‘(স্মরণ করো, মূসা তার সম্প্রদায়কে বলেছিল) হে আমার সম্প্রদায়! আল্লাহ তোমাদের জন্য যে পবিত্র ভূমি নির্দিষ্ট করেছেন তাতে তোমরা প্রবেশ করো এবং পশ্চাদপসরণ করো না, তাহলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে।’ (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত: ২১)

মুসলমানদের প্রথম কিবলা ও মিরাজের ঘটনা
মহানবী (সা.)-এর মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের পর মুসলমানদের প্রথম কিবলা ও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মিরাজের ঘটনার অলৌকিক স্মৃতিবিজড়িত পবিত্র বায়তুল মুকাদ্দাস মসজিদ এবং তার আশেপাশের এলাকা। আল্ল¬াহ তাআলা তাঁর কুদরতি নিদর্শনাবলির ব্যাপকতর প্রদর্শনীর লক্ষ্যে নবী করিম (সা.)-কে মিরাজ তথা ঊর্ধ্বলোকে পরিভ্রমণ করিয়েছিলেন। এ নৈশভ্রমণের প্রথম পর্ব সংঘটিত হয়েছিল মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় পর্ব ছিল মসজিদুল আকসা থেকে ঊর্ধ্বলোক। নিঃসন্দেহে মানবজাতির পরিপূর্ণতা ও মর্যাদার চরমতম নিদর্শন এ পরিভ্রমণে বায়তুল মুকাদ্দাসকে মাধ্যম রূপে মর্যাদা প্রদান এর পবিত্রতার স্বাক্ষর বহন করে। পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্টভাবে এ ভূখ-কে দিকনির্দেশ করে এর পবিত্রতা বা বিশেষ মর্যাদা সম্পর্র্কে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘পবিত্র ও মহিমময় তিনি, যিনি তাঁর বান্দাকে রজনীযোগে ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আক্সায়, যার চতুষ্পার্শ্ব আমি বরকতময় করেছিলাম তাকে আমার নিদর্শন পরিদর্শন করার জন্য, নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ (সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত: ১)
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা.)-এর খিলাফতকালে ৬৩৬ খ্রিস্টাব্দের ২০ আগস্ট ঐতিহাসিক ইয়ারমুকের যুদ্ধের মাধ্যমে খ্রিস্টানদের হাত থেকে মুসলমানেরা এ পবিত্র নগরীর কর্তৃত্ব গ্রহণ করে। এরপর থেকে ফিলিস্তিন মুসলমানদেরই দখলে থাকে।

ফিলিস্তিনের ভৌগোলিক অবস্থান ও কর্তৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত
ফিলিস্তিন আয়তনগত দিক থেকে তেমন বড় রাষ্ট্র নয়। এর মোট আয়তন মাত্র ২৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার। অথচ ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে এর গুরুত্ব অপরিসীম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা যাযাবর জাতি ইহুদিদের একটি স্থানে জড়ো করার দাবি তোলে একটি গোষ্ঠী। পাশ্চাত্যের পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও গ্রেট ব্রিটেন এ ব্যাপারে জোরালো অপতৎপরতা চালায়। মুসলমানদেরকে নিগৃহীত করার হীন উদ্দেশ্যে মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদিদের পুনর্বাসন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সে লক্ষ্যে তারা নিজেদের প্রত্যক্ষ মদদে মধ্যপ্রাচ্যের পুণ্যভূমি ফিলিস্তিনে ইহুদিদের এনে জড়ো করে। একটি স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়। জাতিসংঘও এতে সহযোগিতা যোগায়। তখন বলা হয়েছিল এখানে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রও গঠন করা হবে।
কিন্তু এরপর থেকে ফিলিস্তিনের সমস্যা দিন দিন ঘনীভূত হয়েছে। ফিলিস্তিনিদের অধিকারের ওপর পাশ্চাত্যের আধিপত্যের কারণে ফিলিস্তিনে প্রতিদিনই অকারণে নিষ্পাপ শিশু, অসহায় নারী-পুরুষের রক্ত ঝরছে। ইসরাইলি সেনাবাহিনীর বুলেটের আঘাতে অসংখ্য মুসলিমের বুক ঝাঁঝরা হচ্ছে। তাদের ঘর-বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। বাধ্য হয়ে মুসলিম যুবকেরা অস্ত্র হাতে নিয়ে প্রতিরোধ সংগ্রামে যোগ দিচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদীদের সূক্ষ্ম কুটচালের কারণে ফিলিস্তিন ও মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির দিন দিন চরম অবনতি ঘটছে। ইহুদিবাদীরা বিশ্বাস করে যে, আল-আকসা মসজিদের নিচেই তাদের কথিত ‘টেম্পল অব সোলায়মান’ বিদ্যমান রয়েছে। ইহুদি বিশ্বাসের কথিত উপাসনালয়ের গেট আবিষ্কারের জন্যই সাম্প্রতিককালে আল-আকসা মসজিদের ভিত্তিসমূহের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করে তারা ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ব্যাপক বসতি স্থাপন এবং ধ্বংসাত্মক ও পরিকল্পিত খনন কাজ শুরু করে দিয়েছে।

সাম্রাজ্যবাদী চক্রের জবরদখলে প্রতিষ্ঠিত অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল
১৯৪৫ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী চক্র ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমিকে অন্যায়ভাবে জবরদখল করে প্রতিষ্ঠিত করে নতুন আগ্রাসী রাষ্ট্র ইসরাইল। এর ফলে স্ব^দেশ ভূমি থেকে বিতাড়িত হয় লাখ লাখ ফিলিস্তিনি জনগণ। ইহুদিবাদী চক্র তাদের দোসর বিশ্বের তৎকালীন সকল পরাশক্তির গোপন ও প্রকাশ্য ষড়যন্ত্র, প্রশ্রয় এবং বিভিন্ন সাহায্য-সহযোগিতায় বিশ শতকের গোড়া থেকেই মুসলিম জাহানের তেল সম্পদ লুটপাট, ভাগ-বাটোয়ারা ও শোষণ-শাসন করার জন্য জঘন্য চক্রান্ত করতে থাকে। অভ্যন্তরীণ ও বহিঃষড়যন্ত্র ও আগ্রাসনের পাশাপাশি মুসলিম উম্মাহর ভেতরেও চক্রান্তমূলকভাবে সর্বশক্তি নিয়োগ করে নিরীহ নিরস্ত্র ফিলিস্তিনি মুসলমানদের ওপর ক্রমান্বয়ে আগ্রাসী ও সন্ত্রাসী তৎপরতা, গণহত্যা ও বিতাড়ন, জুলুম-নির্যাতন, খুন-জবরদখল ও অবৈধ উচ্ছেদ চাপিয়ে দিয়ে ১৯৪৮ সালের ১৫ মে ইসরাইল নামক অস্বাভাবিক এক সন্ত্রাসী সরকার ও অবৈধ দখলদার রাষ্ট্রের জন্ম দেয়।
রাষ্ট্র গঠনের পর ইহুদিবাদীরা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে এবং মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা করা শুরু করে। ইহুদিদের নির্মম অত্যাচারে আরবরা জান বাঁচানোর উদ্দেশ্যে দলে দলে ফিলিস্তিন ত্যাগ করতে শুরু করে। ১৯৬৭ সালে সংঘটিত আরব-ইসরাইল যুদ্ধে মুসলমানরা পর্যুদস্ত হয় এবং ইসরাইল বায়তুল মুকাদ্দাস মসজিদ দখল করে নেয়। আল-আকসা মসজিদ নিয়ে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে অতীতেও কয়েকবার সংঘর্ষ হয়েছে। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের সময় ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ ফিলিস্তিনের ঐতিহাসিক স্থাপনাসমূহকে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়। আল-আকসা মসজিদের অংশবিশেষ আল-মাগরিবা কর্ণারসমূহ এর মধ্যে রয়েছে। এমনকি আল-কুদসের ম্যাপ থেকে আল-মাগরিবাকে সম্পূর্ণভাবে মুছে ফেলা হয়।
ফিলিস্তিনের ভূমিতে বলপূর্বক ইহুদি রাষ্ট্রটি গড়ে তোলার পর আরব জাহানসহ সমগ্র বিশ্বে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পাশ্চাত্যের বৃহৎ রাষ্ট্রসমূহের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ইহুদি মৌলবাদী রাষ্ট্রটিকে শক্তিশালী করে দাঁড় করানোর অপপ্রয়াস চালানো হয়। আরব এলাকায় একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হওয়া সত্ত্বেও অত্যন্ত দ্রুতলয়ে সেটি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ও সামরিক দিক থেকে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের পথে অগ্রসর হয়। পাশাপাশি অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্রটি ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর তিলে তিলে জুলুম নির্যাতনের স্টিম রোলার চালাতে থাকে। জাতিসংঘ, আরব লীগসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ সেই ঘোরতর অন্যায় ও অত্যাচারমূলক কর্মকা-ের তীব্র নিন্দা প্রকাশ করলেও ইসরাইলের নৃশংস বর্বরতা এতটুকুও হ্রাস পায়নি, বরং দিনে দিনে তা আরো ভয়ংকর রূপ নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ফিলিস্তিনিদেরকে সমূলে ধ্বংস করে ফিলিস্তিনের অবশিষ্ট ভূমিতে ইসরাইলি রাষ্ট্রের সম্প্রসারণের পথ তৈরি করেছে।
ইসরাইলি সৈন্যরা প্রবল প্রতাপে ফিলিস্তিনিদেরকে বিতাড়িত করে, আর ইসরাইলি গৃহনির্মাণ ও বসতি স্থাপন সংক্রান্ত মন্ত্রণালয় সেখানে ইহুদিদের জন্য ঘর-বাড়ি, স্থাপনা তৈরি করে ইসলাইলি রাষ্ট্রের পরিধি বৃদ্ধি করে। ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের মানচিত্রের দিকে তাকালে প্রতীয়মান হয় যে, দিন দিন ইসরাইল দীর্ঘতর হচ্ছে, আর ফিলিস্তিনিরা পশ্চিম তীরের রামাল্লা এবং গাজায় সরু ভূখ-ে সংকুচিত হচ্ছে। তারা শুধু জেরুজালেম ও ফিলিস্তিন ভূখ-ই নয়, গোটা আরব জাহান দখলেরও গভীর ষড়যন্ত্রের পাঁয়তারা করছে।

ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা (পিএলও)-এর আপোসের নীতি
১৯৬৪ সালের ২৮ মে ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বাধীন ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা (পিএলও) গঠিত হয় এবং তখন থেকেই এ সংস্থাটি ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামী দল হিসেবে আন্তর্জাতিক পরিম-লে ব্যাপক সুনামও অর্জন করে। কিন্তু ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির পর থেকেই ষড়যন্ত্রের ফলে ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা (পিএলও)-এর সংগ্রামী চরিত্র বিনষ্ট হয়ে যায়। তারা সংগ্রামের পথ পরিহার করে আপোসের নীতি অবলম্বন করে। বিশেষত ১৯৯৩ সালে ১৩ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটনে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের সহায়তায় আইজ্যাক রবিন-ইয়াসির আরাফাত চুক্তির মাধ্যমে পিএলও জেরিকো ও গাজা উপত্যকায় কয়েক শত বর্গ কিলোমিটারের একটি ছোট ভূখ-ে সীমিত স্বায়ত্ত্বশাসনের অধিকার লাভ করে। বিনিময়ে দখলদার ইসরাইলকে স্বীকার করে নেয় পিএলও। মুসলমানদের জন্য এরচেয়ে চরম লজ্জা ও অপমানের বিষয় আর কি হতে পারে?
ফিলিস্তিন জনগণের মুক্তি সংগ্রামে ‘আল-ইনতিফাদা’ জাগরণ ও বর্তমান পেক্ষাপট
১৯৮২ সালের এপ্রিল মাসে আল-আকসা মসজিদের ভেতরে এক ইসরাইলি সৈন্য যখন গুলি ছোঁড়ে, তখন এরই প্রতিবাদের ফলশ্রুতিতে ‘আল-ইনতিফাদা’ এর আবির্ভাব ঘটে। আরবি ‘ইনতিফাদা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে জাগরণ অর্থাৎ দখলদার ইহুদি স্বৈরশক্তির বিরুদ্ধে ইসলামী উত্থান। ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগ্রামে ইনতিফাদার আহ্বানে সমগ্র ফিলিস্তিনে এক অভূতপূর্ব জাগরণ সৃষ্টি হয়।
ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগ্রামরত জনগণের ঐ তীব্র জাগরণে ষড়যন্ত্রকারী ইসরাইলি জান্তা তাদের দমনের উদ্দেশ্যে মরিয়া হয়ে ওঠে এবং সূচনালগ্ন থেকেই অদ্যাবধি আন্দোলনকারীদের ব্যাপক ধরপাকর শুরু করে এবং তাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে ট্যাংক বহরের চাপে গুঁড়িয়ে দেয় ফিলিস্তিনি জনবসতি। এতদসত্ত্বেও ইনতিফাদার সমর্থকদের মূল পূজি হলো ‘আল্লাহু আকবার’ ও ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ আর এর সাথে যোগ হয়েছে তাদের ঈমানী মনোবলÑ যা মুসলিম জনগণের আন্দোলনের চেতনাকে আরো শাণিত করেছে।
২০০৬ সালে দক্ষিণ লেবাননে হিজবুল্লাহর সাথে ৩৩ দিনব্যাপী যুদ্ধে পরাজয়বরণ ইসরাইলের দুর্বলতাকে স্পষ্ট করে দেয়। এরপর ২০০৮ সালে ইসরাইল গাযায় ২২ দিন ধরে ব্যাপক আক্রমণ চালিয়েও হামাসের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে পারেনি। বরং হামাসের পাল্টা আক্রমণে ইসরাইলের মনোবলে ফাটল ধরে এবং তারা হামলা বন্ধ করতে বাধ্য হয়। ফিলিস্তিনি জনগণের বিজয় অর্জিত হয়। সর্বশেষ ২০১৪ সালের ছয় দিনের যুদ্ধেও তারা ফিলিস্তিনিদের কাবু করতে পারেনি। কঠোর অবরোধ ও নানামুখী ষড়যন্ত্রের মধ্যেও ফিলিস্তিনিদের এই অর্জন বিশ্ব মুসলিমের মনে আল-কুদ্স মুক্তির আকাক্সক্ষা সৃষ্টি করেছে এবং তাদেরকে নব উদ্যোমে ফিলিস্তিনের মজলুম জনগণের পাশে দাঁড়ানোর প্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছে।

ইসলামী উম্মাহর অনৈক্য ও সাম্প্রতিক অন্তরায়সমূহ
সাম্প্রতিক কালে মুসলিম উম্মাহর বিভিন্ন ধরনের সমস্যার নেপথ্যে সবচেয়ে বড় যে ঐতিহাসিক কারণ কাজ করেছে তা হলো মুসলমানদের সুদৃঢ় ঐক্যের ফাটল। মুসলমানদের ঈমানী ও আমলী চরম দুর্বলতার সুযোগে ইসলামী উম্মাহর মধ্যে ভয়াবহ অনৈক্য সৃষ্টি করে বৈশ্বিক সা¤্রাজ্যবাদী পরাশক্তিসমূহ তাদেরকে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ভূখ-গত দিক থেকে চরমভাবে নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত করে আসছে। ষড়যন্ত্রকারী আন্তর্জাতিক ইহুদি ও খ্রিস্টান চক্র মুসলমানদের মধ্যে আরব-অনারব, তুর্কি-পারসি, শিয়া-সুন্নি প্রভৃতি জাতিগত বিভাজনী উপাদান ছড়িয়ে দিয়ে তাদেরকে আজ খ–বিখ- করে ফেলেছে; যা স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনি জনগণের উদ্ধার ও আল-কুদ্স মুক্তির পথে বিরাট অন্তরায় ও প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গ ও ইহুদিবাদী চক্র শুধু ফিলিস্তিনের মুসলমানদের ক্ষেত্রেই তাদের ষড়যন্ত্র সীমাবদ্ধ রাখে নি। তারা বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। প্রচুর অর্থসম্পদ ব্যয় করে কখনো আল-কায়েদা আবার অতিসম্প্রতি ইসলামী রাষ্ট্র (আইএস) প্রভৃতি নামে মুসলমানদের বিভ্রান্ত করে জিহাদের নামে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থান ঘটিয়ে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ তথা গোপনে ও প্রকাশ্যে ইসলাম ও মানবতাবিরোধী হত্যাযজ্ঞের ন্যায় নৃশংস ও জঘন্য বর্বরতম কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং মানবাধিকার সংস্থাসমূহ ইসরাইলের স্বার্থে তাদের জুলুমের পক্ষেই অবস্থান নিচ্ছে। ষড়যন্ত্রকারীরা নতুন নতুন দল ও উপদল সৃষ্টি করে সমরাস্ত্র, অর্থ ও অন্যান্য সহায়তা দিয়ে যুদ্ধের বিস্তার ঘটানোর মাধ্যমে মুসলমানদের শক্তিকে দুর্বল করার চেষ্টায় নিয়োজিত হয়েছে।
এমতাবস্থায় মুসলিম উম্মাহর উচিত ইহুদিবাদীদের গভীর ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং তাদের প্রচার-প্রচারণায় বিভ্রান্ত না হয়ে আল-কুদসের মুক্তি সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়া। বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের পারস্পরিক সুদৃঢ় ঐক্য, সম্প্রীতি ও সার্বক্ষণিক সতর্কতা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যাবশ্যক। ওআইসি, আরব লীগসহ সকল স্বাধীনতাকামী ও মানবাধিকারবাদী গোষ্ঠীর ফিলিস্তিনিদের দাবির প্রতি সমর্থন জানানো ও তাদের আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করা উচিত।

‘বিশ্ব আল-কুদ্স দিবস’ পালনের ঘোষণা
আল-কুদ্স পুনরুদ্ধারে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিপ্লবী বীর, অবিসংবাদিত জননেতা মরহুম আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ ইমাম আল-খোমেইনী (র.)-এর ভূমিকা অবিস্মরণীয়। সত্তর দশকের শেষদিকে ইরানে ইসলামী বিপ্লব বিজয় লাভের পরপরই তিনি আল-কুদ্সের গুরুত্ব অনুধাবন করে ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামের সমর্থনে বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা যাতে সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারেন সেজন্য মাহে রমজানের চতুর্থ ও শেষ শুক্রবারকে ‘বিশ্ব আল-কুদ্স দিবস’ পালনের ঘোষণা দেন। সেই থেকে প্রতি বছর রমজান মাসের শেষ শুক্রবার সারা বিশ্বের মুসলমানেরা ইহুদিদের অবৈধ দখলের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করেন এবং ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের কবল থেকে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রকে মুক্ত করার জন্য পুনরায় দৃঢ় শপথ গ্রহণ করেন।
বাংলাদেশেও ‘আল-কুদ্স কমিটি বাংলাদেশ’-এর উদ্যোগে প্রতিবছর মাহে রমজানের শেষ শুক্রবার সেমিনার, আলোচনা সভা, আলোকচিত্র প্রদর্শনী, বিক্ষোভ, মানব বন্ধন ও বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করা হয়।

ইসলামী উম্মাহর ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ ও ঘৃণা প্রকাশের জন্য সর্বাত্মক গণআন্দোলন
সুদীর্ঘ প্রায় ৬০ বছরের বেশি মুসলমানদের এ পবিত্র মসজিদ আল-আক্সা ইহুদিরা জবরদখল করে আছে। অসহায় ফিলিস্তিনের নির্যাতিত জনগণ দীর্ঘদিন ধরে তাদের আবাসভূমি ও আল-কুদ্স তথা বায়তুল মুকাদ্দাস পুনরুদ্ধারের জন্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। আল-কুদ্স মুক্তি এবং ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত নিরসনে শান্তিপূর্ণ সমাধানে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন মুসলিম বিশ্বের ইস্পাতকঠিন ঐক্য। এবারের আল-কুদ্স দিবসে বজ্রকঠিন ধ্বনিতে দৃপ্ত শপথ হোক মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া ইসরাইলকে সমাধিস্থ করে ফিলিস্তিন ও আল-কুদ্সের আশু মুক্তি। পবিত্র আল-কুদ্স পুনরুদ্ধার ও ষড়যন্ত্রের কবলে ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামের আন্দোলনকে উচ্চকিত ও বেগবান করতে সারা দুনিয়ার আলেমসমাজ ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দকে ‘আল-আকসা’ মসজিদ রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে তীব্র প্রতিবাদ ও ঘৃণা প্রকাশের মাধ্যমে ধিক্কার জানানোর জন্য সর্বাত্মক গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করতে সোচ্চার হতে হবে। মুসলিম উম্মাহ সীসাঢালা প্রাচীরের মতো ঐক্যবদ্ধ হয়ে সামনে অগ্রসর হলে আল-কুদ্সকে মুক্ত করা অসম্ভব নয়। অবশ্য বায়তুল মুকাদ্দাস পুনরুদ্ধারের জন্য পৃথিবীর সকল জাতিকে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তোমরা সকলে আল্ল¬াহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-১০৩)
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের অবিসংবাদিত আধ্যাত্মিক নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ ইমাম আল-খোমেইনী (র.) উদাত্তকণ্ঠে আহবান জানিয়ে বলেছিলেন, ‘কুদ্স দিবস কেবল ফিলিস্তিনিদের জন্য নয়, এটা ইসলামের দিবস, এটা ইসলামের সরকারসমূহের দিন, এটা এমন দিন যে সেদিন সকল দেশে ইসলামের পতাকা উড্ডীন হবে।’
তাই রমজান মাসের শেষ শুক্রবার ‘আল-কুদস দিবস’ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান। মাহে রমজানের সমাপনীসূচক জুমআর নামাজে মসজিদে মসজিদে বিশেষ মুনাজাতে রোজাদার মুসল্লিরা দেশ-জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতি এবং ইসলামী উম্মাহর ঐক্য, সংহতি, শান্তি ও কল্যাণ সর্বোপরি আল-কুদ্সের মুক্তির জন্য আল্লাহর দরবারে পরম ভক্তি ও আন্তরিকতা সহকারে সাহায্য প্রার্থনা করেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মজলুম ফিলিস্তিনি অসহায় মুসলমানদের ষড়যন্ত্রকারী বর্ণবাদী ইহুদিদের অকথ্য নির্যাতনের কবল থেকে আশু মুক্তি দান করুন! আমীন!!

ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সাংগঠনিক সম্পাদক, আল-কুদ্স কমিটি বাংলাদেশ। সহযোগী অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, ইসলামিক স্টাডিজ ও দাওয়াহ বিভাগ, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়। পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহাম্মাদ (সা.)। ইসলাম বিষয়ক উপদেষ্টা, দৈনিক প্রথম আলো। ফৎ.সঁহরসশযধহ@ুধযড়ড়.পড়স

বাংলা ভাষায় ফারসি শব্দের ব্যবহার

বাংলা রূপ  ফারসি রূপ আধুনিক ফারসি উচ্চারণ
খাদেম خادم খ-দেম
খারিজ خارج খ-রেজ
খাস خاص খস্
খাতির خاطر খ-র্তে
খাকী (র.) خاكى খ-কী
খালেস (বিশুদ্ধ) خالص খ-লেস্
খালু خالو খ-লু
খালা خاله খ-লে
খাম خام খম্
খামখেয়ালি خام خيالى খম-খেঅলী
খামুশ خاموش খ-মুশ্
দাখিল داخل দ-খেল্
দাদা دادا দ-দ-
দারোগা داروغه দরুগেহ্
দাগ داغ দগ্
দাগী داغى দগী
দালান دالان দ-লন
দাম (মূল্য) دام দম্
কলমদান قلمدان গালাম দন্
দানা (বীজ) دانه দ-নে
দায়রা (দায়রা কোর্ট) دايره দ-য়েরে
দায়ের (মামলা দায়ের) داير দ-র্য়ে
দাই (নার্স) دايه দ-য়ে
দখল دخل দাখ্ল্
দখলদার دخل دار দাখ্ল্দর
দ্বার (দরজা) در র্দা
রাস্তা راسته রসতেহ্
রাযি راضی র-যী
রান ران রন
রাহাজানী راهزنى রহ্যানী
রায় راى / راى রা’য়
রুযু رجوع রুজু
রহম (দয়া) رحم রাহ্ম্
রহমদিল رحم دل রাহ্ম দেল
রদ (বাতিল করা) رد রাদ্
রসম رسم রাস্ম্
রসিদ رسيد রাসীদ
রফা (সমাধান হওয়া) رفع রাফ’
দফারফা دفع رفع দাফ’ রাফ’
রিফু (সেলাই) رفو রিফু
রকম رقم রাগাম্
রগ رﮒ রাগ্
রঙ رنگ রাংগ্
রঙিন رنگين রাংগীন

স্মরণীয় দিবস

১ মে : শহীদ আয়াতুল্লাহ মুর্তাযা মোতাহ্হারীর শাহাদাত দিবস।
* ইরানে শিক্ষক দিবস হিসেবে পালিত হয়।
* আন্তর্জাতিক শ্রম ও শ্রমিক দিবস।
৩ মে : নবীবংশের সপ্তম ইমাম মূসা কাযেম (আ.)-এর শাহাদাত দিবস।
৪ মে : দার্শনিক ও ধর্মবেত্তা শেখ সাদুক স্মরণে দিবস।
৫ মে : মহানবী (সা.)-এর ‘মাবআছ’ দিবস ও শবে মেরাজ।
১০ মে : মহানবী (সা.)-এর দৌহিত্র ও নবীবংশের তৃতীয় ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্মদিবস।
১১ মে : কারবালার পতাকাবাহী মহান শহীদ হযরত আবুল ফযল আব্বাসের জন্মদিবস।
১২ মে : নবীবংশের চতুর্থ ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর জন্মদিবস।
১৪ মে : মহাকবি হাকিম আবুল কাসেম ফেরদৌসি স্মরণে দিবস।
১৭ মে : মহাকবি হাকিম ওমর খৈয়াম স্মরণে দিবস।
১৮ মে : ইমাম হোসাইন (আ.)-এর পুত্র কারবালার মহান শহীদ আলী আকবারের জন্মদিবস। ইরানে যুব দিবস হিসেবে পালিত হয়।
২১ মে : খ্যাতনামা দার্শনিক মোল্লা সাফ্রাহ স্মরণে দিবস।
২২ মে : ১৫ শাবান, যামানার ইমাম মাহদী (আ.)-এর জন্মদিবস।
৩ জুন : ইসলামি বিপ্লবের নেতা ও ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিষ্ঠাতা হযরত ইমাম আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ মুসাভী খোমেইনীর ওফাত দিবস ও হযরত আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ীকে পরবর্তী রাহবার নির্বাচন।
৯ জুন : ইরানে হস্তশিল্প দিবস হিসেবে পালিত হয়।
১৬ জুন : মহানবী (সা.)-এর প্রিয়তমা স্ত্রী হযরত খাদিজা (রা.)-এর ওফাত দিবস।
২০ জুন : বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. মোস্তফা চামরানের শাহাদাত দিবস।
২১ জ্নু : মহানবী (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র ও নবীবংশের দ্বিতীয় ইমাম হাসান (আ.)-এর জন্মদিবস।
২৫ জুন : আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর আঘাতপ্রাপ্তি দিবস। এই দিনে ফজরের নামাযরত অবস্থায় ইবনে মুলজামের বিষমাখা তরবারির আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হন।
২৭ জুন : ইমাম আলী (আ.)-এর শাহাদাত দিবস।
ইরানে এ দিনে দুশমনের পাতা বোমার আঘাতে আয়াতুল্লাহ ড. বেহেশতী সহ ৭২ জন আলেম, শিক্ষাবিদ, প্রশাসক শাহাদাতবরণ করেন।
স্মরণীয় দিবস
১ মে : শহীদ আয়াতুল্লাহ মুর্তাযা মোতাহ্হারীর শাহাদাত দিবস।
* ইরানে শিক্ষক দিবস হিসেবে পালিত হয়।
* আন্তর্জাতিক শ্রম ও শ্রমিক দিবস।
৩ মে : নবীবংশের সপ্তম ইমাম মূসা কাযেম (আ.)-এর শাহাদাত দিবস।
৪ মে : দার্শনিক ও ধর্মবেত্তা শেখ সাদুক স্মরণে দিবস।
৫ মে : মহানবী (সা.)-এর ‘মাবআছ’ দিবস ও শবে মেরাজ।
১০ মে : মহানবী (সা.)-এর দৌহিত্র ও নবীবংশের তৃতীয় ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্মদিবস।
১১ মে : কারবালার পতাকাবাহী মহান শহীদ হযরত আবুল ফযল আব্বাসের জন্মদিবস।
১২ মে : নবীবংশের চতুর্থ ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.)-এর জন্মদিবস।
১৪ মে : মহাকবি হাকিম আবুল কাসেম ফেরদৌসি স্মরণে দিবস।
১৭ মে : মহাকবি হাকিম ওমর খৈয়াম স্মরণে দিবস।
১৮ মে : ইমাম হোসাইন (আ.)-এর পুত্র কারবালার মহান শহীদ আলী আকবারের জন্মদিবস। ইরানে যুব দিবস হিসেবে পালিত হয়।
২১ মে : খ্যাতনামা দার্শনিক মোল্লা সাফ্রাহ স্মরণে দিবস।
২২ মে : ১৫ শাবান, যামানার ইমাম মাহদী (আ.)-এর জন্মদিবস।
৩ জুন : ইসলামি বিপ্লবের নেতা ও ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিষ্ঠাতা হযরত ইমাম আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ মুসাভী খোমেইনীর ওফাত দিবস ও হযরত আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ীকে পরবর্তী রাহবার নির্বাচন।
৯ জুন : ইরানে হস্তশিল্প দিবস হিসেবে পালিত হয়।
১৬ জুন : মহানবী (সা.)-এর প্রিয়তমা স্ত্রী হযরত খাদিজা (রা.)-এর ওফাত দিবস।
২০ জুন : বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. মোস্তফা চামরানের শাহাদাত দিবস।
২১ জ্নু : মহানবী (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র ও নবীবংশের দ্বিতীয় ইমাম হাসান (আ.)-এর জন্মদিবস।
২৫ জুন : আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর আঘাতপ্রাপ্তি দিবস। এই দিনে ফজরের নামাযরত অবস্থায় ইবনে মুলজামের বিষমাখা তরবারির আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হন।
২৭ জুন : ইমাম আলী (আ.)-এর শাহাদাত দিবস।
ইরানে এ দিনে দুশমনের পাতা বোমার আঘাতে আয়াতুল্লাহ ড. বেহেশতী সহ ৭২ জন আলেম, শিক্ষাবিদ, প্রশাসক শাহাদাতবরণ করেন।

বিশ্বখ্যাত মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মাদ আলীর ইন্তেকাল

গত ৪ জুন ২০১৬ সাবেক হেভিওয়েট বিশ্ব চ্যা¤িপয়ন মোহাম্মাদ আলী ৭৪ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে পারকিনসন্স সিনড্রোমে ভুগছিলেন।
মোহাম্মদ আলী ১৯৪২ সালের ১৭ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের কেন্টাকি রাজ্যের লুইসভিলে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ক্যাসিয়াস মারসেলাস ক্লে-র নামানুসারে প্রথমে তাঁর নাম রাখা হয়েছিল ক্যাসিয়াস মারসেলাস ক্লে জুনিয়র। পরে ১৯৬৫ সালে ইসলাম গ্রহণের পর নিজেই মোহাম্মদ আলী নাম বেছে নেন।
মোহাম্মাদ আলী ১২ বছর বয়স থেকে বক্সিং শুরু করেন। এর মাত্র ৬ বছর পর ১৯৬০ সালে অলি¤িপক এবং ১০ বছর পর (১৯৬৫ সালে) ওয়ার্ল্ড চা¤িপয়ন হন।
শুধু রিংয়েই নয়, রিংয়ের বাইরেও তাঁর মুখ চলত সমান তালে। সরব ছিলেন নিপীড়িত মানুষের অধিকারের দাবিতে। প্রথমবার বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যা¤িপয়নশিপ জেতার মাত্র ৩ বছর পর তাঁকে ভিয়েতনাম যুদ্ধে পাঠানোর চেষ্টা করেছিল আমেরিকান সরকার। কিন্তু আলী তা সরাসরি প্রত্যাখান করে বলে দিয়েছিলেন, তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিপক্ষে৷ কোনো অবস্থাতেই তিনি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেবেন না।
গত সেপ্টেম্বর মাসে তাঁর সর্বশেষ বিবৃতিতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমান প্রবেশ নিষিদ্ধ করার বিষয়ে করা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মনোনয়ন প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রা¤েপর মন্তব্যের নিন্দা জানিয়েছিলেন।
১৩২ শব্দের এক বিবৃতিতে ট্রাম্পকে উল্লেখ না করেই তিনি লেখেন, ‘আমি একজন মুসলমান এবং প্যারিস, সান বার্নারদিনোসহ বিশ্বের অন্য যেকোনো স্থানে নিরপরাধ মানুষ হত্যায় ইসলামিক জিহাদিদের নির্মম সহিংসতা ধর্ম বিশ্বাসের পরিপন্থী, যা প্রকৃত মুসলমানরা জানে। মোহাম্মাদ আলী বিৃতিতে আরো লেখেন, মুসলমান হিসেবে আমাদের ওই ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে, যারা ইসলামকে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধিতে ব্যবহার করে। অনেককেই ইসলাম সম্পর্কে জানতে বিরত রেখেছে তারা। চেষ্টা করা এবং জোরপূর্বক কাউকে ইসলাম গ্রহণ করানো আমাদের ধর্মের বিরুদ্ধে, সত্যিকারের মুসলমানরা এটি জানে অথবা জানা উচিত। মোহম্মাদ আলী আরো বলেন, ‘রাজনৈতিকভাবে কাউকে হেয় করেনি এমন একজন হিসেবে আমি মনে করি, আমাদের রাজনীতিবিদদের উচিত নিজেদের অবস্থান থেকে মানুষকে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে জানানো এবং এটি নিশ্চিত করা বিগথগামী হত্যাকারীরা প্রকৃত ইসলাম সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে ভুল পথে পরিচালিত করেছে।
মোহাম্মাদ আলীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মাদ জাওয়াদ জারিফ। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হোসেইন জাবেরি আনসারিও মোহাম্মাদ আলীর আত্মীয়-স্বজন এবং সারা বিশ্বের ভক্তদের জন্য গভীর শোক ও সমবেদনা জানান। তিনি বলেন, আলী শুধু তিনবারের বিশ্ব চ্যা¤িপয়ন মুষ্টিযোদ্ধাই ছিলেন না; বরং তিনি ছিলেন বর্ণবৈষম্য অবসান আন্দোলনের পথিকৃৎ।
উল্লেখ্য, মোহাম্মাদ আলী ১৯৯৩ সালের ৮ মে ইরান সফর করেন। তখন তিনি ইরানের ইসলামি বিপ্লবের নেতা মরহুম ইমাম খোমেইনীর মাযার যিয়ারত করেন। এছাড়া, তিনি ইরানের মাশহাদ শহরে নবীবংশের অষ্টম ইমাম রেযা (আ.)-এর মাযার যিয়ারত করেন। এ সফরের সময় ইরানের জনগণ মোহম্মাদ আলীকে উষ্ণ আতিথেয়তা জানায়।
মোহাম্মাদ আলী ক্লে ১৯৬৫ সালে ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি পশ্চিমা যুবকদের মাঝে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া এবং বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে ব্যাপক অনুপ্রেরণা জাগিয়েছিলেন। মোহাম্মাদ আলী ১৯৯০ সালে তাঁর ইরাক সফরে নাজাফ শহরে হযরত আমীরুল মুমিনীন আলী (আ.) এবং কারবালা শহরে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মাযার যিয়ারত করেন।
১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন সর্বকালের সেরা বক্সার মোহাম্মদ আলী। সেদিন বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানাতে লাখ লাখ মানুষ উপস্থিত হয়েছিল। ওই সফরে আলীকে বাংলাদেশের নাগরিকত্বও দেয়া হয়েছিল। তাঁর হাতে সম্মানসূচক নাগরিকত্বের প্রতীকী চাবি তুলে দেয়া হয়েছিল। পল্টনের মোহাম্মদ আলী বক্সিং স্টেডিয়াম উদ্বোধন করেছিলেন আলী নিজেই।

তেহরানে মোহাম্মাদ আলীর নামে সড়কের নামকরণের প্রস্তাব
বিশ্বখ্যাত মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মাদ আলী ক্লে-র নামে ইরানের রাজধানী তেহরানের একটি সড়কের নামকরণের প্রস্তাব করা হয়েছে। তেহরান সিটি কাউন্সিলের সদস্য ইকবাল শাকেরি গত ৫ জুন ২০১৬ এ প্রস্তাব দেন। দেশটির রাজধানীর সিটি কাউন্সিলের এক বৈঠকে একটি সড়কের নাম পরিবর্তন করে মোহাম্মাদ আলী রাখার কথা বলেন তিনি।
ওই বৈঠকে শাকেরি বলেন, মোহাম্মাদ আলী ছিলেন বর্ণবাদ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীক। তিনি ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।