মুমিত আল রশিদ
দামেগান ছেড়ে আমাদের ছোট্ট বাসটি হেলেদুলে রাজকীয় ভঙ্গিতে শাহরুদের দিকে এগিয়ে চলছে। শাহরুদ নামটি শুনেই কেমন যেন একটি রাজকীয় ভাব মনে হচ্ছে! ফারসিতে শাহ অর্থ রাজা বা বাদশাহ আর রুদ হচ্ছে নদী অর্থাৎ রাজা-বাদশাহদের নদী, তবে শাহ এর আরেকটি অর্থ বৃহৎ অর্থাৎ বৃহৎ নদী। প্রকৃতপক্ষেই যুগ যুগ ধরেই মানব অন্তরে বহমান একজন মহামানব বা বড় মাপের নদীর কাছেই যাচ্ছি। হ্যাঁ, এখানেই রয়েছে মাতৃভক্তির এক পরম অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হযরত বায়েজিদ বোস্তামির মাযার! শৈশবে প্রতিটি বাঙালির মুখে মুখে যে কবিতাটি মুখস্থ ছিল তার একটি কালিদাস রায়ের মাতৃভক্তি কবিতা। বায়েজিদ বোস্তামি- শৈশব হতে জননীর সেবা করিতেন দিবাযামী।/ দুপুর রাত্রে জননী জাগিয়া ডাকিলেন, ‘বাছাধন,/ বড়ই পিয়াস পানি দাও’ বলি মুদিলেন দু’নয়ন।/ দেখিল বালক ঘরের কোণের কলসিতে নেই পানি,/ বহুদূর পথ ঝরনা হইতে কলসি ভরিয়া আনি।/ মায়ের তৃষ্ণা মিটাইবে বলি গভীর অন্ধকারে/ ছুটিয়া বাহির হইল একাকী কলসি লইয়া ঘাড়ে।/ জল ঢালি পিয়ালায়/ সুপ্তা মাতার নয়ন শিয়রে দাঁড়ায়ে রহিল ঠায়।/ ভাঙালে নিদ্রা হবে অপরাধ, কখন ভাঙিবে নিদ,/ সেই ভরসায় পানি হাতে খাঁড়া রহিল যে বায়েজিদ।/ পূর্ব গগন ফর্সা হইল, ডাকিয়া উঠিল পাখি,/ জননী মেলিল আঁখি।/ দেখিল শিয়রে দাঁড়ায়ে রয়েছে দশ বছরের ছেলে/ পানি হাতে কেন, বুঝিল না মাতা প্রথম নয়ন মেলে।/সহসা পড়িল মনে,/ গভীর রাতে পিপাসায় পানি চেয়েছিল বাছাধনে।/ কহিল মা, মরি মরি!/ বাছারে আমার, পানি হাতে করে সারা রাত্রটি ধরি/ দাঁড়াইয়া আছ? ঘুমাওনি আজ?’ চোখে এল জল ভরি।/ পুত্রেরে কোলে নিয়ে মা চুমিল বার বার মুখখানি।/ কহিল জননী, ‘নয়নের মণি, সাধারণ শিশু নও,/ খোদার দোয়ার বরকতে তুমি জগতপুজ্য হও।/ পুত্র গড়বে গর্বিত বুকে, খোদা স্মরি তব নাম,/ তোমারে আমার জীবনের এই সম্বল সঁপিলাম।’/ বিফল হয়নি মায়ের আশিস, হৃদয়ের প্রার্থনা/ জগৎ-বন্দ্য জ্ঞানগুরুদের বায়েজিদ একজনা।
বায়েজিদ বোস্তামির গ্রাম বাস্তাম ও মাযারটির অবস্থান শাহরুদ শহর থেকে ৬ কি.মি. উত্তর-পূর্বে। শাহরুদ শহরটি ইরানের রাজধানী তেহরান থেকে ২১৯ কি.মি. পূর্বে অবস্থিত সেমনান প্রদেশ থেকে ১৭০ কি.মি. দূরে। সেমনান থেকে শাহরুদ যাওয়ার পথটি যেন শুভ্র তুষারের দিগন্ত বিস্তৃত মেলা! মেষবালকেরা মেষপাল নিয়ে মেঘের চূড়া ভেদ করে একেবারে পর্বতশৃঙ্গের উপরিভাগে চলে যাচ্ছে! মনের অজান্তেই এক ধরনের তীব্র আকর্ষণ বোধ করছি ওদের প্রতি, জায়গাটির প্রতি! খুব জানতে ইচ্ছে করছে ওদের কাছে কি মাওলানা জালালুদ্দিন রুমীর হৃদয়বিদীর্ণ করা কবিতার সেই ‘নেই’ (বাঁশিটি) আছে? দূরে আকাশছোঁয়া পাহাড়গুলো হাজার হাজার বছর ধরে দেখে যাচ্ছে ক্ষয়ে যাওয়া মানব সভ্যতা। ইতিহাসের জীবন্ত উত্থান-পতনগুলোর প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। হয়তো এ পথ ধরেই কোন একদিন হযরত বায়েজিদ বোস্তামি ছুটে গিয়েছিলেন সুদূরের সবুজ-শ্যামলে ঘেরা বাংলাদেশে! আমরা যারা নদী-নালা, খাল-বিল, সবুজ প্রান্তর দেখে অভ্যস্ত তাদের কাছে শুভ্র তুষারাবৃত পর্বতগুলো আকাশছোঁয়া কল্পনার মতোই! কখনো কখনো মনে হচ্ছে পাহাড়গুলোর চূড়ায় লালন সাঁইয়ের ও হাসান রাজার গান, পল্লিগীতি বা ভাওয়াইয়া গানগুলোর রূপ-রস-অনুভূতিগুলো ছড়িয়ে দিলে কেমন লাগবে! তবে এটা অনস্বীকার্য যে, প্রতিটি জায়গারই আলাদা একটি সৌন্দর্য রয়েছে।
উল্লেখ্য, ৯০০০ বছর পূর্বে ইরানে প্রথম যে কয়টি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর বসবাসের নিদর্শন পাওয়া যায় তার মধ্যে তাপ্পে সাঙ্গে চাকমাক (চাকমাক টিলার পাদদেশ) অন্যতম। যার অবস্থান বায়েজিদ বোস্তামির বাস্তাম গ্রামে। মাদ (শাসনামল খ্রি. পূ. ৭০৮-খ্রি. পূ. ৫৫০) ও হাখামানশি (শাসনামল খ্রি.পূ. ৫৫০-খ্রি. পূ. ৩৩০) শাসনামলে বাস্তাম গ্রামটি কুমিসিনে বা কুমিশান এবং ইসলাম-পরবর্তী সময়ে কুম্স নামে পরিচিত ছিল। এই অঞ্চলটিতেই ইতিহাসখ্যাত আশাকানি রাজবংশ (শাসনামল খ্রি. পূ. ২৪৮- ২২৪ খ্রি.) এর প্রতিষ্ঠাতা পারত গোষ্ঠীর সাহসী বিচরণ ছিল। সাহসী বীর প্রথম আশক খ্রি. পূ. ২৪৮ অব্দে আলেকজান্ডার দি গ্রেটের পৃষ্ঠপোষকতাসম্পন্ন সুলুকি রাজবংশ (শাসনামল খ্রি. পূ. ৩১২- খ্রি. পূ. ২৪৮)-কে হটিয়ে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। যারথুস্ত্রীয় ধর্মগ্রন্থ আভেস্তার মতে আশাকানি আমলে কুম্স বা বাস্তাম গ্রামটি অন্যতম প্রদেশ হিসেবে গণ্য ছিল। সোহরাব-রুস্তম কাহিনীর সোহরাবকে ঘিরে অসংখ্য চিত্রলিপি শহরটির বিভিন্ন অংশে এখনও বিদ্যমান, পারস্য বীর সোহরাবের উত্থানও আশাকানি আমলেই সিস্তান প্রদেশ থেকে। এই প্রদেশেই রয়েছে হযরত নূহ (আ.)-এর দুই পুত্র সাম ও লামের সমাধি।এছাড়া পবিত্র কোরআন ও বাইবেলে বর্ণিত কাবির ও লূত মরুভূমির মধ্যে লূতের অবস্থান করমান প্রদেশে এবং কাবিরের অবস্থান সেমনান প্রদেশে। পাঠ্য বইয়ে পড়া এই মরুভূমিটির প্রতি ইরানে আসার পূর্বেই এক ধরনের আকর্ষণ অনুভব করেছি! ইরানী বন্ধুদের অসংখ্যবার জিজ্ঞেস করেছি দাশ্তে কাবির ও লূত কিভাবে যাওয়া যায়? এবার সুযোগটি পেয়ে তারবিয়্যাত মোদাররেস বিশ্ববিদ্যালের শিক্ষক ড. ইবরাহীম খোদাইয়ার আমার সিরিয়ান ও সেনেগালি বন্ধুদের নিয়ে নেমে পড়লেন একেবারে রুক্ষ-বিবর্ণ এই মরুভূমির বুকে। মরুভূমি দেখতে কেমন বা মরুভূমির লতা-গুল্মগুলোই বা কিভাবে বছরের পর বছর বেঁচে থাকে? হাজারো প্রশ্ন ভেতরে আন্দোলিত হচ্ছে! তবে বহুদিনের আরাধ্য স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পেরে অসম্ভব রোমাঞ্চিত হলাম!
ইরানের এই প্রদেশটি প্রাচীনকাল থেকেই পানি সংকটে ভুগছে। ইরানে আবহাওয়ার ৪টি ধরন রয়েছে : তার অন্যতম হচ্ছে শুষ্ক ও চরম উষ্ণভাবাপন্ন। এ শহরটিতে এই ঘরানার আবহাওয়া বিদ্যমান। বায়েজিদ বোস্তামির জন্মস্থান সেমনান প্রদেশটির কাবির মরুভূমির কোলে অবস্থিত। আলবোর্য পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত শহরটি কিছুটা হলেও বিবর্ণ মনে হলো! তবে মৃত্তিকার রঙগুলো চোখধাঁধানো! কোনটির রঙ একেবারে হলুদ আবার কোনটি ধূসর, আবার কোনটি আকাশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নীলাভ আকার ধারণ করেছে। ইরানের লোক মজা করে বলেন, ইরানে এখন সেমনানি রাজত্বকাল চলছে! বর্তমান প্রেসিডেন্ট হাসান রূহানী ও সাবেক প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদ এই প্রদেশেরই সন্তান। এছাড়া জগদ্বিখ্যাত দুইজন সুফির স্নেহধন্য শহর শাহরুদ- একজন সুলতানুল আরেফিন হযরত বায়েজিদ বোস্তামি, অন্যজন আবুল হাসান খারাকানি। এই ছোট্ট শহরটিতে প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক আর যিয়ারতকারীর উপচে পড়া ভিড় অবাক করার মতোই!
তবে মজার ব্যাপার হলো ৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে স্রষ্টার সান্নিধ্যে গমন করা সুলতানুল আরেফিন বায়েজিদ বোস্তামির একটি দরগাহ বাংলাদেশের চট্টগ্রামের নাসিরাবাদে রয়েছে। বায়েজিদ বোস্তামির পুরো নাম আবু ইয়াযিদ তাইফুর ইবেন ঈসা ইবনে সারভশান বাস্তাম। উপাধি সুলতানুল আরেফিন। ফারসিতে কখনো কখনো আবুর পরিবর্তে বু উচ্চারণ করা হয়। যেমন ইবনে সিনাকে বলা হয় বু আলী সিনা। তাঁর পিতামহ যরথুস্ত্র ধর্মাবলম্বী ছিলেন, পরবর্তীকালে ইসলাম গ্রহণ করেন। সেমনান বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে নিজের পরিচিতি পর্বে বাংলাদেশে বায়েজিদ বোস্তামির প্রতি অগাধ ভক্তি ও বাংলাদেশের মানুষের দরগাহটি সম্পর্কে পবিত্র দৃষ্টিভঙ্গি বলতেই উপস্থিত অধ্যাপকগণ কৌতূহলী হয়ে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে লাগলেন! শুধু তাই নয় ছোটবেলায় স্কুলে পড়া কালিদাস রায়ের ‘মাতৃভক্তি’ কবিতাটির কাহিনী বর্ণনা করলাম, উপস্থিত সকলের চোখ বিস্ময়ে বিস্ফারিত হচ্ছিল! একের পর এক কৌতূহলী প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছেন আমার দিকে। আমার শিক্ষক ড. ইবরাহীম খোদাইয়ার আমার সাহায্যে এগিয়ে এলেন, তিনি জানালেন আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-এর মূল সমাধি ইরাকের নাজাফ শহরে বিদ্যমান, তবে এর পাশাপাশি আফগানিস্তানের মাযার-ই-শরীফে আরেকটি সমাধি ফলকের উপস্থিতির কথাও উল্লেখ করলেন। সঙ্গে এটাও বললেন, ইসলাম-পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সুফি-সাধক ইসলাম প্রচারে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে গমন করেছেন এবং তাঁরা স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সময় সেখানে অবস্থানকালীন ইবাদতের স্থানটিতে তাঁদের ভক্ত-অনুসারীরা তাঁদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দরগাহ স্থাপন করেছেন।
সেমনান বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষক ড. নাসের রাহিমির মতে, হয়তো বায়েজি বোস্তামি ধর্ম প্রচারে বাংলাদেশে গমন করেছিলেন, তবে তাঁর মূল সমাধি যে বাস্তাম গ্রামে এটা তিনি নিশ্চিত বলেই জানালেন। কেননা, ফারসি সাহিত্যের অসংখ্য ইতিহাসমূলক বইয়ের কোথাও বায়েজিদের বাংলাদেশ ভ্রমণের উল্লেখ নেই! আমাদের গাইড শাহ হুসাইনি জানালেন, বায়েজিদ বোস্তামির নামে আরও একটি দরগাহ রয়েছে ইরানের পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশে। বায়েজিদ বোস্তামির সমাধিস্থলে পৌঁছেই মায়ের প্রতি অদ্ভুত এক ভালোবাসা জেগে উঠল! একেবারে আড়ম্বরবর্জিত সমাধিফলক! আমাদের গাইড জানালেন, কোন এক ভক্ত রাতে স্বপ্ন দেখেছিলেন বায়েজিদ তাঁকে বলছেন তাঁর জন্য একটি গম্বুজ আকৃতির সমাধিফলক বানিয়ে সেখানে বায়েজিদের দেহখানা স্থাপনের জন্য। গম্বুজ তৈরি শেষ হলে একেবারে শেষের দিন অপর এক ভক্ত স্বপ্নে দেখেন বায়েজিদ তাঁকে বলছেন তাঁর দেহখানা উন্মুক্ত আকাশের নিচে রাখার জন্য। সেই থেকেই মাতৃসেবক বায়েজিদ বোস্তামি শুয়ে আছেন উন্মুক্ত প্রান্তরে। তবে বায়েজিদ বোস্তামি সকল মানবপ্রেমী মানুষের অন্তরে শুয়ে আছেন। বায়েজিদের সমাধি থেকে স্বল্প দূরে খারাকান গ্রামে শুয়ে আছেন মুসলিম বিশ্বের অন্যতম সুফি ও বায়েজিদের ভাবশিষ্য আবুল হাসান খারাকানি। বায়েজিদের মৃত্যুর (২৩৪ হিজরি) প্রায় ১১৭ বছর পরে খারাকানির জন্ম (৩৫১/৩৫২ হিজরি)। বায়েজিদ একদা খারাকান গ্রাম দিয়ে অতিক্রমকালে হঠাৎ থমকে দাঁড়ান! ভক্ত-অনুরাগিগণ তাঁকে জিজ্ঞেস করলে বলেন : ‘আমি এই গ্রাম থেকে এক মহৎ ব্যক্তির সুঘ্রাণ পাচ্ছি।’ অবাক হলেও সত্য এখনও খারাকানির সমাধিতে নাক লাগালে সেই ঘ্রাণ পাওয়া যায়। আমি অবাক হয়ে বেশ কয়েকবার সেই ঘ্রাণ নিয়েছি! খারাকানিকে নিয়ে ফারসি সাহিত্যের দুই দিকপাল মাওলানা জালালুদ্দিন রুমী ও ফরিদউদ্দিন আত্তারও লিখেছেন। সুলতান মাহমুদ গাযনাভিও তাঁর সাক্ষাতে এসেছিলেন বলে জানা যায়। তাঁর বেশ কয়েকটি কারামতের মধ্যে দুটি সিংহের বশীভূতকরণের কাহিনী প্রবেশ পথেই চিত্রিত রয়েছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য একটি কবিতা ইরানের প্রায় প্রতিটি মানুষের মুখে প্রচলিত :
‘তোমার সদর দরজায় আসে যদি কেউ রুটির কাঙাল হয়ে
রুটি দিও জীবনের তরে, জিজ্ঞাসিও না, কী তোমার ঈমান ওহে?
খোদার দরজায় কে বেশি মূল্যবান জানবে কী করে!
তোমার আমার কর্মটাই ওহে মনুষ্যত্বের তরে।’
এভাবেই বায়েজিদের ভাবশিষ্য জগতকে আলোকিত করে গিয়েছেন।
তথ্যসূত্র
-অশনায়ি বা জোগরাফিয়া ভা ফারহাঙ : ওস্তানহায়ে ইরান।
-তারিখে ইরান ভা জাহান।
-বাররেসি মানাবে’ ভা মা’খাযে তারিখে ইরান পিশ আয ইসলাম : ড, মোহাম্মদ বাকের তাভাযযোলি।
– যঃঃঢ়://বহ.নধহমষধঢ়বফরধ.ড়ৎম/রহফবী.ঢ়যঢ়?ঃরঃষব=ইধুবলরফথইড়ংঃধসর
লেখক : পিএইচডি গবেষক,
শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয়, তেহরান, ইরান।
সহকারী অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
All posts by pavel
ইরানী নওরোয ও বাংলা নববর্ষ : শাশ্বত ঐতিহ্যের ধারা
অধ্যাপক সিরাজুল হক
নওরোয সম্বন্ধে আলোচনা করতে গেলেই ইরানের কথা আসে। কারণ, নওরোয হচ্ছে শাশ্বত ইরানী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অন্যতম নিদর্শন। নওরোয মানে ‘নতুন দিন’। বাংলাদেশে ও বাংলা ভাষায় এটা এখন আর অপ্রচলিত ও অপরিচিত নয়। ‘রোযা’ ফারসি শব্দ হলেও তা বাংলা ভাষায় মিশে গিয়েছে, আর ‘নও’ কথাটিও বাংলা ভাষার সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে। যেমন বাংলাদেশের একটি পত্রিকার নাম ছিল ‘নওবেলাল’। আরেকটি পত্রিকার নাম ছিল ‘জাহানে নও।’ বর্তমানে ‘নওরোয’ নামে একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে ঢাকা থেকে। এছাড়া বহু যুগ আগ থেকে দিনাজপুরে ‘নওরোয সাহিত্য মজলিস’ নামে একটি সংগঠনও রয়েছে। ‘নওরোয’ কথাটির সাথে আভিধানিক ও পারিভাষিক তাৎপর্য উভয় দিক দিয়েই আমাদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
‘নওরোয’ একটি সুপ্রাচীন ও শাশ্বত ইরানী ঐতিহ্য হলেও এক অর্থে তা ইরান বা পারস্য ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক রূপ পরিগ্রহ করেছে। ভারত উপমহাদেশে বিশেষ করে মোগল যুগে জাঁকজমকের সাথে নওরোয উৎসব পালিত হতো। এখনও বিক্ষিপ্তভাবে পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশে তা কমবেশি পালিত হচ্ছে। এছাড়া আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, তুরস্ক, আযারবাইজান, কুর্দিস্তান এবং কোন কোন আরব ও ইউরোপীয় দেশেও নওরোয উৎসব পালিত হয়ে থাকে।
সম্রাট হুমায়ুন ভারতের উত্তরাঞ্চলে এ উৎসবের প্রচলন ঘটান। এরপর সম্রাট আকবরের রাজত্বের (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রি.) প্রথম থেকেই নওরোয উৎসব উদ্যাপিত হতে থাকে। এ উপলক্ষে হেরেমবাসিনী মহিলারাও শখের বশে দোকান সাজিয়ে মীনা বাজার বসাতেন।
ইরানী সৌরবর্ষের প্রথম মাসের নাম হচ্ছে ‘ফারভারদিন’। আর ফারভারদিনের প্রথম দিনকেই বলা হয় ‘নওরোয’। সকল যুগে পৃথিবীর সকল জাতি-গোষ্ঠীর বর্ষপঞ্জিতে নতুন বছরের প্রথম মাসের প্রথম দিনটি উৎসবের দিন হিসাবে পরিগণিত ও পালিত হয়ে এসেছে। সূর্যের চতুর্দিকে পৃথিবীর ঘূর্ণন, রাত ও দিনের আবর্তন, বিভিন্ন ঋতুর পরিক্রমা, পৃথিবীর চারদিকে চাঁদের পরিক্রমণ প্রভৃতি মানুষকে দিনক্ষণ, মাস ও বছরের হিসাবনিকাশে উদ্বুদ্ধ করেছে, প্রকারান্তরে, বাধ্যও করেছে। আর এভাবেই বর্ষপঞ্জির জন্ম দিয়েছে। বছরের শেষ দিনগুলো যেমন মানব জীবনে অন্তিমের সুর তোলে এবং তা কিছুটা হলেও বেদনাকর, তেমনি বছরের শুরুটা মূলত এক নতুনত্বের সূচনাÑ যা মানুষকে নতুন অনুভূতি, নতুন আশা-আকাক্সক্ষা ও প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করে তোলে। প্রাগৈতিহাসিক কালে ইরানীরা নৈসর্গিক জীবনের সমাপ্তি উপলক্ষে ফারসি সনের শেষ ১১ দিন অর্থাৎ খ্রিস্টীয় হিসাবে ১০ থেকে ২০ মার্চ শোক পালন করতো বলে জানা যায়। নওরোয বা নববর্ষ উপলক্ষে বিশ্বপ্রকৃতিতে নতুন করে জীবনের উপস্থিতিতে এ শোকের সমাপ্তি হতো এবং এ উপলক্ষে আনন্দ-উৎসব হতো। ইরানী সমাজে নওরোয এমনই একটি উৎসব যে, তা অন্যান্য দেশ ও সংস্কৃতির তুলনায় ব্যতিক্রমধর্মী বলা চলে। আর এ কারণেই এর এতটা প্রসিদ্ধি ও হৃদয়গ্রাহিতা রয়েছে।
নওরোয উৎসবের প্রচলনের সঠিক সন-তারিখ অদ্যাবধি যদিও জানা যায়নি, তবে এটি যে অত্যন্ত প্রাচীন উৎসব তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর নিদর্শনগুলো হাখামানশী (অপযধবসরহরধহ) রাজবংশের শাসনামলের (খ্রিস্টপূর্ব ৭০০-৩০০ অব্দ) সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। হাখামানশী সম্রাটদের যুগে নওরোয উৎসব বিশেষ আরম্বরের সাথেই পালিত হতো বলে প্রচুর তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। এছাড়া তাখ্তে জামশীদে রক্ষিত একটি শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, হাখামানশী পূর্ব যুগে মা’দ রাজাদের শাসন আমলেও নওরোয উৎসব পালিত হতো।
ইরানী সৌরবর্ষপঞ্জির ফারভারদিন মাসের প্রথম দিনকে ফারসি ভাষায় ‘নওরোয’ বলা হয় যা শুধু নতুন দিনই নয়, উৎসবের দিন হিসাবেও অভিহিত। হিজরি ৪৬৭ অথবা ৪৭১ সালে জালালী বর্ষপঞ্জির উৎপত্তির পূর্ব পর্যন্ত সৌর বৎসরের হিসাবটা হতো এভাবে : বছরকে ভাগ করা হতো ৩০ দিনের বারো (১২) মাসে যার ফলে মোট ৩৬০ দিন হিসাব হতো। বাকি ৫ দিনকে অন্য একটি মাসের সাথে যুক্ত করা হতো। এভাবে মোট ৩৬৫ দিন পাওয়া যেত। কিন্তু এ সত্ত্বেও ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৫১.৪৫ সেকেন্ড অবশিষ্ট থেকে যেত। এ কারণে প্রতি চার বছরে এক দিন পার্থক্য হতো। এর ফলে ক্রমান্বয়ে ফারভারদিনের প্রথম দিনটি এগিয়ে আসতে থাকে। অর্থাৎ বসন্তের সূচনাদিবসের ওপর নওরোয স্থির ছিল না। ইরানের সর্বশেষ সাসানী রাজা (সম্রাট) ইয়াযদেগার্দ ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন। সে দিনটি ছিল ফারভারদিন মাসের প্রথম দিবস মোতাবেক ১৬ জুন। এরপর নওরোয প্রতি চার (৪) বছরে এক দিন এগিয়ে আসে। ৪৭৬ হিজরি সালে নওরোয ছিল মার্চ মাসের ৩ তারিখ। ঠিক এ বছরই মালিক শাহ সালজুকি জ্যোতির্বিদদের একটি দলকে একত্র করে সৌর বৎসরের একটি চূড়ান্ত ও সূক্ষ্ম হিসাব তৈরি করে ফারভারদিন মাসের প্রথম দিনটি নির্ধারণের আদেশ জারি করেন। এ ব্যাপারে ইতিহাসে উল্লিখিত আরেকটি অভিমত হলো এই যে, প্রখ্যাত মুসলিম বিজ্ঞানী ও কবি ওমর খৈয়াম (১০৪৮-১১২৩) তুর্কী সালজুকী শাসক মালিক শাহের নির্দেশনায় সৌর বা শামসী হিজরি ক্যালেন্ডার প্রণয়ন করেন এবং ফারভারদিন মাসের ১ তারিখকে (যা সাধারণত ২১ মার্চ; কখনো কখনো ২০ মার্চ) নওরোয হিসাবে চিহ্নিত ও নির্র্ধারণ করেন। মার্ভের জ্যোতির্বিদ খাজা আবদুর রহমান খাযেনীর নিরীক্ষার ভিত্তিতে তখন খ্রিস্টীয় বর্ষপঞ্জির হিসাবে প্রথম বারের মতো ফারভারদিন মাসের প্রথম দিবসটি ১৬ দিন পিছিয়ে যায়। আর এভাবেই নওরোয বসন্তের সূচনালগ্নে স্থিরিকৃত হয়। নতুন হিসাব অনুসারে বছরে কোন এক মাসে ৫ দিন যোগ করে পর পর চার বছরকে ৩৬৫ দিন করে হিসাব করা হয়, আর পঞ্চম বছরকে ৩৬৬ দিন ধরা হয়। এ হিসাবের মধ্যে ৫ ঘণ্টা এবং আরও কিছু সময়ও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আর এভাবেই সেই বৎসর থেকে নওরোয বসন্তের প্রথম দিনে নির্ধারিত হয়ে যায়।
১৩০৪ ফারসি সালে (১৯২৫ খ্র্রিস্টাব্দ মোতাবেক ১৩৪৩ হিজরি) সৌরবর্ষপঞ্জি সরকারি বর্ষপঞ্জি হিসাবে গৃহীত হয় যাতে উল্লিখিত হিসাব বিবেচনাধীন রাখা হয়। শুধু বছরে ৫ দিন বৃদ্ধি করার পরিবর্তে বছরের প্রথম ছয় মাসকে ৩১ দিন হিসাবে, পরবর্তী পাঁচ মাসকে ৩০ দিন হিসাবে ও দ্বাদশ মাসকে ২৯ দিন হিসাবে ধার্য করা হয় এবং প্রতি চতুর্থ বছরে দ্বাদশ মাসকে ৩০ দিনে গণনা করা হয়। আর উক্ত বছরকে ফারসি ভাষায় বলা হয় কাবিসা সাল অর্থাৎ লিপ ইয়ার। উল্লেখ্য, ইরানের সর্বজনীন ও সরকারি বৎসর গণনার মানদ- হচ্ছে সৌরবর্ষপঞ্জি। এছাড়া চান্দ্রবর্ষকেও এর পাশাপাশি ধর্মীয় বর্ষপঞ্জি হিসাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
নওরোয উৎসবের ইতিহাস যে অতিশয় প্রাচীন এ ব্যাপারে ইতিহাসবিদগণ ঐকমত্য পোষণ করেন। তবে এর পটভূমি সম্পর্কে বিভিন্ন অভিমত রয়েছে। যেমন ঐতিহাসিক মাসউদী প্রণীত ‘মুরুজুয যাহাব’ গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে যে, কিংবদন্তীর ইরানী সম্রাট জামশীদের সময় তিন বছরব্যাপী স্থায়ী একটি টাইফুন ঝড় ইরানের ভূমিতে আঘাত হানে এবং দেশ ও জনগণের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। এরপর বসন্ত কালের শুরুতে টাইফুন স্তিমিত ও শান্ত হয়ে আসে। ভয়াবহ ও বিপদসংকুল টাইফুন অবসানের পর জনগণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এবং ‘নওরোয’ বা নতুন দিনের উৎসব পালন করে। দীর্ঘ শীতকাল ও শৈত্য প্রবাহের পর মানুষ গুহা, কুঠুরি ও অন্যান্য আশ্রয়স্থল থেকে বের হয়ে এসে বসন্ত উৎসব পালন করে।
প্রাচীনকালে ইরানীরা প্রধানত দুটি উৎসব জাঁকজমকের সাথে পালন করত বলে জানা যায়। এ সম্পর্কে ‘লোগাতনামেয়ে দেহখোদা’য় (আলী আকবার দেহখোদা প্রণীত অভিধান) উল্লেখ করা হয়েছে। নওরোয বলতে সাত মাসব্যাপী গ্রীষ্মকালের শুরু বোঝাতো, আর মেহেরবান উৎসব শরৎকালের প্রথমভাগে হতো যা বর্তমানেও ইরানের যরথুস্ত্রী ধর্মাবলম্বীরা পালন করে থাকে। হাখামানশী রাজবংশের শাসনামলের অর্থাৎ ২৫০০ বৎসর পূর্বের নওরোয উৎসবের ব্যাপারে প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন ও রেকর্ড পাওয়া যায়।
ইরানে বারো মাসে ৪টি ঋতু বা মওসুম গণনা করা হয় : বাহার (বসন্ত), তাবেস্তান (গ্রীষ্ম), পয়িয (শরৎ) ও যামেস্তান (শীতকাল)। এ চার ঋতুর জন্য হাখামানশীদের চারটি ভিন্ন ভিন্ন আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছিল। পারসেপোলিস ছিল তাদের বাহার বা বসন্তকালীন আবাসস্থল ও নববর্ষ উদ্যাপনের কেন্দ্র।
প্রাচীন কালে নওরোযকে দুই ভাগে বিভক্ত করে পালন করা হতো। পাঁচদিনব্যাপী পালিত নওরোযÑ যাতে সর্বস্তরের জনসাধারণ অংশগ্রহণ করত। এ উৎসব বৎসরের প্রথম দিন ১ ফারভারদিন থেকে শুরু হয়ে ৫ ফারভারদিন পর্যন্ত বিরামহীন চলতে থাকত। এ পাঁচ দিন রাজা-বাদশাগণ জনসাধারণকে রাজপ্রাসাদে সাক্ষাৎ দিতেন। তাদের আপ্যায়ন করাতেন, কারাগারের দরজাগুলো খুলে দিয়ে বন্দিদের মুক্তি দিতেন এবং অভাবী লোকদের অভাব-অনটন দূর করার জন্য চেষ্টা করতেন। এ পাঁচ দিনকে ইরানীরা নওরোযে ছগীর (ছোট নওরোয) বলত। এ নামটি বর্তমানে প্রচলিত নেই। তবে অতীত কালের অনেক নিয়ম এখনও বিদ্যমান এবং জনগণ অতীতের মতোই উৎসব-আনন্দে মেতে থাকে।
এছাড়া উপর্যুক্ত পাঁচ দিনের পরেও একটি বিশেষ শ্রেণি ফারভারদিন মাসের ১৩ তারিখ পর্যন্ত আনন্দ-উৎসবের আয়োজন করত। ইরানীরা ফারভারদিনের ১৩ তারিখকে বিশেষ গুরুত্ব দেয় এবং এ দিন সবাই পার্ক, মাঠ, ময়দান বা অনুরূপ বিশেষ স্থানে বেড়াতে যায় ও সন্ধ্যার পর ঘরে ফিরে আসে। এ দিনটি সর্বজনীন ছুটির দিন।
বসন্ত উৎসব
পৃথিবীর সব জাতির মধ্যেই ঋতুরাজ বসন্তের একটি আবেদন রয়েছে। সব দেশেই বসন্ত ঋতুর আগমন একই সময়ে অথবা বছরের শুরুতে ঘটে না। যেমন বাংলাদেশেও নববর্ষ বা ১ বৈশাখ বসন্তকালে শুরু হয় না; বরং ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশে ফাল্গুন-চৈত্র এই দু’মাস হলো বসন্তকাল, আর গ্রীষ্মের দাবদাহ নিয়ে শুরু হয় ১ বৈশাখ বা নবর্বষ। এভাবে অন্যান্য জাতির কথাও বলা যেতে পারে। খিস্টবর্ষ শুরু হয় ১ জানুয়ারি, যখন উত্তর গোলার্ধের সর্বত্রই শীত মওসুম।
ইরানের দ্বাদশ মাস বাহমানের শেষ দিন এবং নববর্ষের প্রথম মাস ফারভারদিনের প্রথম দিনের মধ্যে একটি চমৎকার পার্থক্য পরিদৃষ্ট হয় প্রকৃতিতেÑ গাছ-গাছালি, লতাগুল্ম ও বন-বনানীতে। নওরোয উৎসব হলো প্রকৃতির পুনর্জন্ম উৎসব। এতে চিন্তাশীল মানুষের জন্য অফুরন্ত খোরাকও রয়েছে। ইরানের প্রসিদ্ধ কবি যাকারিয়া আখলাকী বসন্ত ঋতু থেকে শিক্ষা নেওয়ার জন্য বলেছেন :
‘(এ বসন্তে) ফুলকলি আল্লাহর রহস্যের দফতর খুলে দিয়েছে
মরুভূমি ও বনবনানী উপদেশের নতুন নতুন পত্রপল্লব উন্মুক্ত করে দিয়েছে।’
ইরানী জনগণ, বিশেষ করে কবি-সাহিত্যিকদের দৃষ্টিতে বসন্ত ঋতু হচ্ছে ন্যায়-ইনসাফ ও ভারসাম্যের মওসুম। ইরানে বসন্ত নাতিশীতোষ্ণ। শীতের প্রকোপ যেমন থাকে না, তেমনি থাকে না গ্রীষ্মের দাবদাহ। তাই এই ফারভারদিন মাসটাকে তারা দেখে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে।
কবি নাসের খসরু কুবাদিয়ানী বলেন :
‘হ্যাঁ, যখন দিন ও রাত একটি ভারসাম্যের ওপর দ-ায়মান হয়,
জরাজীর্ণ এ পৃথিবীর জীবনটা তখন যৌবনে পূর্ণ হয়।
দেই (ডিসেম্বর) মাসের নিষ্পেষণে নার্গিস ও ফুলকলি অন্ধ হয়ে গিয়েছিল বটে,
কিন্তু দেখ! ফারভারদিনের ইনসাফে তা দৃষ্টিমান হয়ে উঠল।’
ফেরদৌসীর ভাষায় :
‘বসন্তের মেঘমালা থেকে নেমে আসে বৃষ্টির ফোঁটা
মাটির বুক থেকে ধুয়ে ফেলে যতসব দুশ্চিন্তা
পৃথিবী পূর্ণ হয় সবুজের সমারোহে এবং পানিতে নদী
দুঃখীর জীবনে এখন থাকে না কোন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।
ধরাতল সজ্জিত হয় যেন এক বেহেশ্ত রূপে
ইনসাফ ও দানের মহিমায় পৃথিবী পূর্ণ হয়
আর কল্যাণ ও নিরাপত্তায়, আর
দুষ্ট ও দুরাচারের হাত হয় অবরুদ্ধ।
নওরোযের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় দিক
ইরানীরা ‘নওরোয’-কে ‘ঈদে নওরোয’ বলে। ‘ঈদ’ মানে খুশি বা আনন্দ। মুসলিম ইরানে ইসলাম প্রবর্তিত দু’টি ঈদ উৎসব ঈদুল ফিত্র ও ঈদুল আজহা পালিত হওয়ার সাথে সাথে তাদের জাতীয় উৎসব ঈদে নওরোযও পালিত হয়ে আসছে। ইরানে ইসলামের আগমনের পর উমাইয়্যা ও আব্বাসী শাসকরা নওরোয উৎসবের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করতেন বলে জানা যায়। বিশেষ করে প্রাচ্য অঞ্চলে শাসকরা নওরোযে প্রজাদের কাছ থেকে উপহার উপঢৌকনও গ্রহণ করতেন।
রাসূল জাফারিয়ান তাঁর ‘শিয়া সংস্কৃতিতে নওরোয’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেন : ‘হিজরি ষষ্ঠ শতকের প্রথমার্ধে রচিত দো’আ কবুল সংক্রান্ত ‘যাখীরাতুল আখেরা’ গ্রন্থে পারস্যবাসীর নওরোয দিবসের আমল সম্পর্কে একটি অধ্যায় রয়েছে। এর ব্যাখ্যায় মু‘আল্লা ইবনে খুনবাইস-এর হাদীসটি এভাবে উল্লিখিত হয়েছে : হযরত ইমাম (জাফর) সাদেক (আ.) বলেন : ‘নওরোযে তোমরা রোযা রাখ, গোসল কর, সবচেয়ে পরিষ্কার জামা পরিধান কর, খুশবু ব্যবহার কর; যদি পূর্বের নামায ও সুন্নাতগুলো আদায় করে থাক, তাহলে দু’টি সালামের সাথে চার রাকাত (নফল) নামায পড়…।’
এছাড়া নওরোযের সূচনাপর্বে তথা এ দিনের শুরুতে আল্লাহর দরবারে দোআ করা হয় এভাবে : ‘ইয়া মুকাল্লিবাল কুলূব ওয়াল আবসার, ইয়া মুদাব্বিরাল লাইলি ওয়া ন্নাহার, ইয়া মুহাভভিলাল হালি ওয়াল আহওয়াল, হাভভিল হালানা ইলা আহসানিল হাল।’ অর্থাৎ হে অন্তরসমূহ ও দৃষ্টিসমূহের বিবর্তনকারী! হে রাত ও দিবসের পরিচালনাকারী! হে বৎসর ও অবস্থানসমূহের পরিবর্তনকারী! আমাদের অবস্থাকে উত্তম অবস্থায় পরিবর্তন করুন।
এ থেকে নওরোযের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য উপলব্ধি করা যায়।
নওরোযে বিশেষ সাংস্কৃতিক আয়োজন
প্রাচীন ইরানের র্ফাস এলাকায় যরথুস্ত্রীরা নববর্ষের সূচনায় বিভিন্ন প্রতীকী বস্তু দ্বারা সাতটি ট্রে পূর্ণ করে আহুরমাযদা (আল্লাহ তা‘আলা) এর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করত। এই সাতটি ট্রে ছিল সততা, ন্যায়পরায়ণতা, ঈমান, সদুপদেশ, সৎকর্ম, সৌভাগ্য এবং ক্ষমা ও অমরত্বের প্রতীক। অতীতের এসব আনুষ্ঠানিকতা বর্তমানে যে পরিবর্তিত রূপ নিয়েছে তা হচ্ছে এই যে, এ উপলক্ষে বিশেষ ধরনের দস্তরখানা বিছানো হয় এবং তার ওপর বিভিন্ন ধরনের প্রতীকী জিনিস সুন্দরভাবে সাজিয়ে রাখা হয়। এ উপকরণসমূহ হতে হবে বিভিন্ন ধরনের সাতটি উপকরণ যেগুলোর নাম ফারসি বর্ণমালার ‘সীন’ (সাত সীন) নামে বিখ্যাত। হাফ্ত সীন সাধারণত নিম্নোক্ত উপকরণগুলোর মধ্য থেকে বেছে নেওয়া হয়। যথা : সাবযেহ (সবুজাভ) : গম বা ডালের কচি চারার গুচ্ছ, যা নওরোযের অব্যবহিত পূর্বে গজিয়েছে, তা একটি ট্রে বা প্লেটের ওপর বসিয়ে হাফ্ত সীন দস্তরখানায় রাখা হয় যা নব জীবনের প্রতীক: সামানু : কচি গম, বার্লি বা অন্যান্য শস্যদানার আটা দিয়ে তৈরি বিশেষ ধরনের হালুয়া যা প্রাচুর্য ও নে’আমতের প্রতীক; সেনজাদ : এক প্রকার শুষ্ক ফল যা ভালোবাসা ও প্রেমের প্রতীক; সীর (রসুন) : সৌন্দর্য ও সুস্বাস্থ্যের প্রতীক; সোম্মাগ : মশুরের ডালের চেয়ে সামান্য বড় লাল রঙের টক ফলবিশেষ, যা উদীয়মান সূর্যের প্রতীক; সিরকা : দীর্ঘায়ু ও ধৈর্যের প্রতীক; সোমবোল : ছোট আকারের পুষ্পবৎ উদ্ভিদবিশেষ যা বসন্তের আগমনবার্তা বহন করে নিয়ে আসে; সেক্কেহ (মুদ্রা) : সম্পদ ও সমৃদ্ধির প্রতীক।
এখনও ইরানের অধিকাংশ লোকই পুরাতন বছরের বিদায় ও নতুন বছরের আগমন ক্ষণে নতুন পোশাক পরিধান করে মিষ্টিমধুর আচরণ সহকারে পবিত্র স্থানে বা পরিবারের মুরুব্বিদের সাথে কাটাতে পছন্দ করে। সে মুহূর্তে তারা কুরআন তেলাওয়াত করে ও দু’হাত তুলে মহান আল্লাহর কাছে নিজেদের ও পরিবারবর্গের জন্য সুস্থতা ও সমৃদ্ধিপূর্ণ একটি সুন্দর বছর কামনা করে। নওরোযের পছন্দনীয় অন্যান্য রীতির মধ্যে রয়েছে পরস্পরের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ ও কুশল বিনিময়, কারও প্রতি রাগ বা ক্ষোভ থাকলে পরস্পরকে ক্ষমা করে দেওয়া এবং নববর্ষের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন। এছাড়া এ দিনে তারা এমন সব ব্যক্তির সাথে দেখা করতে যায় যারা পুরাতন বছরে কোন প্রিয়জনকে হারিয়ে শোকে মুহ্যমান হয়ে আছে।
নওরোযের আন্তর্জাতিকতা
ইরান ছাড়াও বেশ কয়েকটি দেশে নওরোয উদ্যাপিত হয়ে থাকে। এটা স্ব স্ব জাতিগোষ্ঠীর অভিরুচি ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের অংশবিশেষ, তবে ভাষাও এখানে একটি বড় কারণ বটে। ১ ফারভারদিন তথা ইরানী নববর্ষের প্রথম দিন নওরোয ‘মিরাছে জাহানী’ টহরাবৎংধষ ঐবৎরঃধমব দিবস হিসাবে ২০০৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ইউনিসেফ কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে। ইউনিসেফ কর্তৃক এ ঘোষণার বা অনুমোদনের পর ইরান সরকারের আতিথ্যে বর্তমানে আন্তর্জাতিকভাবে ‘নওরোয’ উৎসব পালিত হচ্ছে।
নওরোয ও পহেলা বৈশাখ
নওরোয ও পহেলা বৈশাখের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে বিশেষ সাযুজ্য রয়েছে। বেশ কাছাকাছি সময়ের ব্যবধানে ইরান ও বাংলাদেশে বসন্তকালের আগমন ঘটে থাকে। ইরানে বসন্ত শুরু হয় হিজরি শামসী সাল বা সৌরবর্ষের প্রথম মাস ফারভারদিনের প্রথম দিন (২১ মার্চ) থেকে, আর বাংলাদেশে বাংলা সনের একাদশ মাস ফাল্গুনের প্রথম দিন (১৩ ফেব্রুয়ারি) থেকে শুরু হয়। বসন্ত কাল শুরু হওয়ার পর ২৩/২৪ দিন পর্যন্ত বাংলাদেশ অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও একই সঙ্গে ঋতুরাজ বসন্তের স্বাদ ও গন্ধ অনুভব করে। অন্যদিকে ইরানী নববর্ষ ও বাংলা নববর্ষের মধ্যে ব্যবধান এই ২৩/২৪ দিন; ইরানে নওরোয ২১ মার্চ, আর বাংলাদেশে ১ বৈশাখ ১৪ এপ্রিল।
ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশে পূর্বে কৃষিকাজ ছিল পুরোপুরি ঋতুনির্ভর। আর ফসল উৎপাদনের সাথে সরকার বা মনিবের খাজনা আদায়ের বিশেষ সম্পর্ক ছিল। তাই বাদশা আকবর খাজনা আদায়ের জন্য পরিবর্তনশীল হিজরি চান্দ্রবর্ষকে ভিত্তিবছর ধরে নতুন সৌরবর্ষপঞ্জি প্রবর্তন করেনÑ বর্তমানে যা বাংলা বর্ষপঞ্জি নামে পরিচিত এবং খাজনা আদায়ের জন্য এর অনুসরণের নির্দেশ দেন। এ বর্ষপঞ্জি কার্যকরী হয় ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ অন্য মতে ১৫৫৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে।
ইরানে ফারসি সৌরবর্ষের সাথে বিশেষত ধর্মীয় হিসাব-নিকাশে হিজরি চান্দ্র বৎসরও ব্যবহৃত হয়। অনুরূপভাবে আমাদের দেশেও বাংলা সনের সাথে সাথে ধর্মীয় কাজ-কর্ম ও হিসাব-নিকাশে হিজরি সনের ব্যবহার রয়েছে। তবে আমাদের দেশে দাফতরিক কাজে ঈসায়ী সাল ব্যবহার হলেও ইরানে তা হয় না।
নওরোযের আদলে বাংলা নববর্ষ পালনের শুরুও হয় মূলত মোগল সম্রাট আকবরের আমলে। অতীতকালে এবং ইংরেজ আমলেও এর পরে বিশেষত জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার (১৯৫৬) পূর্ব পর্যন্ত বাংলার কৃষকরা চৈত্র মাসের শেষ দিন পর্যন্ত মনিবের খাজনা পরিশোধ করত এবং জমিদার ও ভূ-স্বামীদের জন্য উপহার উপঢৌকন নিয়ে যেত। ইরানেও এ ধরনের প্রথা ছিল।
অতীতে বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব ছিল হালখাতা। অর্থাৎ মহাজনী ও ব্যবসায়িক হিসাব-নিকাশের নবায়ন যা সীমিত আকারে হলেও বর্তমানেও চালু আছে। ইরানের মতো বাংলাদেশেও পহেলা বৈশাখের অনেক আগে থেকেই ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, এমনকি অফিস-আদালত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নকরণ ও ধোয়ামোছার কাজ শুরু হয়ে যেত। পহেলা বৈশাখের এ অনুষ্ঠান এখনও যেমন তখনও তেমনি সর্বজনীন ছিল। মুসলিম রাজা-বাদশা কর্তৃক এর প্রবর্তন হলেও হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ ও উপজাতীয় জনগোষ্ঠী সকলেই একযোগে এ বাংলা নববর্ষ পালন করে এসেছে শুরু থেকেই। পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনের সাথে ধর্মীয় অনুভূতিও কাজ করত। বিশেষ করে মুসলমানদের ঘরে ঘরে এবং দোকান-পাটে মিলাদ ও দো’আর অনুষ্ঠান হতো, মিষ্টি বিতরণ করা হতো। এখানেও ইরানের মতো নববর্ষের সূচনাতে আল্লাহর দরবারে চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টি সমভাবে কাজ করত। ইরানের মতোই এ দিনে সামাজিকভাবে জাতিধর্ম নির্বিশেষে একে অন্যের প্রতি সম্ভাষণ জানানোর রীতি রয়েছে।
পহেলা বৈশাখ তথা নববর্ষ নিয়ে ইরানের মতোই আমাদের কবি-সাহিত্যিকরা প্রচুর লেখালেখি করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬), ফররুখ আহমদ (১৯১৮-১৯৭৪) প্রমুখের অবদান এ ব্যাপারে উজ্জ্বল হয়ে আছে।
নববর্ষ উদ্যাপন অতীতকালের তুলনায় বর্তমানে ব্যাপকতর হয়েছে। অতীতে এ উপলক্ষে মেলা বসত। বর্তমানেও বৈশাখী মেলা বসে থাকে। নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনে জনতার ঢল নামে। তবে পূর্বের সে শালীন পরিবেশ এখন ক্ষুণœ হয়েছে বিদেশি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ছোঁয়ায়।
বর্তমানে বিশেষত ইসলামী বিপ্লবোত্তর ইরানে নওরোয উদ্যাপনের কোন প্রকার প্রগলভতা নেই। নওরোয পালনে যেমন ইসলামী বিপ্লব বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি, তেমনি এর অনুষ্ঠানমালায় শালীনতা বিবর্জিত হওয়ার সুযোগ নেই। নির্দোষ এসব মানবীয় আনন্দ-উৎসব মার্জিত ও পরিশীলিত অনুষ্ঠানাদি উদ্যাপনের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হলেই তা হবে সমাজ ও মানবতার জন্য কল্যাণকর।
* লেখক : সাবেক সম্পাদক, নিউজলেটার, সাবেক নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক জনপদ এবং জাতীয় প্রেসক্লাবের স্থায়ী সদস্য।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে ন্যানোটেকনোলজির অগ্রগতি
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিভিন্ন শাখার পাশাপাশি সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ন্যানোটেকনোলজির অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনা করে ২০০০ সাল থেকে বিজ্ঞানের এ শাখার উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে সেন্টার ফর ইনোভেশন অ্যান্ড টেকনোলজি কোঅপারেশন (CITC) ২০০১ সালে ‘ন্যানোটেক পলিশি স্টাডি কমিটি’ গঠন করে। এ কমিটি ২০০১ সাল থেকে ২০০২ সাল নাগাদ ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন সভা, সেমিনার এবং কর্মশালার মাধ্যমে গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২০০৩ সালে ইরান ন্যানোটেকনোলজি ইনিশিয়েটিভ কাউন্সিল (INIC) প্রতিষ্ঠা করা হয়।
ইরানে ন্যানোটেকনোলজি নীতিমালা প্রণয়ন এবং প্রণীত নীতিমালার আলোকে কার্যক্রম পরিচালনা জন্য যে সকল সংস্থা কাজ করছে তাদের পরিচিতি তুলে ধরা হলো।
ইরান ন্যানোটেকনোলজি ইনিশিয়েটিভ কাউন্সিল (INIC)
২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে INIC ন্যানোটেকনোলজি প্রসারের নিমিত্ত শিক্ষা, শিল্প খাতে গবেষণা, বিনিয়োগ এবং নীতি নির্ধারণী সংস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধন করে আসছে। বর্তমানে INIC বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপ-রাষ্ট্রপতির অধীনে পরিচালিত হয়ে আসছে। INIC-এর সাংগঠনিক কাঠামো নিম্নরূপ :
চিত্র-১ : INIC-এর সাংগঠনিক কাঠামো
ন্যানোটেকনোলজি খাতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদারকরণের লক্ষ্যে INIC বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে যা নিম্নরূপ :
* ১০টি সদস্য দেশ নিয়ে ECO-NANO নামক আঞ্চলিক নেটওয়ার্ক স্থাপন;
* UNIDO-এর সহায়তায় ইরানে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ন্যানোটেকনোলজি প্রতিষ্ঠা;
* ইন্টারন্যাশনাল ন্যানোটেকনোলজি স্টান্ডার্ডাইজেশন কমিটি (ISO/TC229)-র সভায় নিয়মিত যোগদান;
* এশিয়ান ন্যানো ফোরামের সদস্যপদ লাভ।
ইরানের ন্যানোটেকনোলজি ল্যাবরেটরি নেটওয়ার্ক (INLN)
২০০৪ সালে ইরানে ন্যানোটেকনোলজি ল্যাবরেটরি নেটওয়ার্ক স্থাপনের মাধ্যমে মৌলিক ও শিল্প গবেষকদের অবকাঠামোগত সুবিধাসহ গবেষণাগার সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। এ নেটওয়ার্কের আওতায় সরকারি ও বেসরকারি খাতে ১১টি প্রদেশে মোট ৪২টি ল্যাবরেটরি কমপ্লেক্স তৈরি করা হয়েছে।
ইরান ন্যনোটেকনোলজি স্টান্ডার্ডাইজেশন কমিটি (ISIR/TC229)
২০০৬ সালে ইরানে ন্যানোটেকনোলজি স্টান্ডার্ডাইজেশন কমিটি স্থাপনের পর থেকে ১৫টি জাতীয় স্টান্ডার্ড এবং ১টি আন্তর্জাতিক স্টান্ডার্ড প্রস্তুত করা হয়েছে।
ইরান ন্যনোটেকনোলজি সেফটি নেটওয়ার্ক (INSN)
২০১১ সালে ইরানে ন্যানোটেকনোলজি স্টান্ডার্ডাইজেশন কমিটি কর্তৃক ইরান ন্যানোসেফটি নেটওয়ার্ক স্থাপনের প্রস্তাবের ভিত্তিতে ২০১২ সালে INSN প্রতিষ্ঠা করা হয় যা ন্যানোটেকনোলজির নিরাপদ ব্যবহার, স্টান্ডার্ড ও নীতিমালা অনুসরণ এবং প্রয়োজনীয় স্থাপনা তৈরি তদারকিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে।
ন্যানোটেকনোলজি অগ্রাধিকার খাতসমূহ
-জ্বালানি (তেল, গ্যাস, পেট্রো-রসায়ন, সৌরকোষ)
-জনস্বাস্থ্য সেবা (রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা)
-পানি ও পরিবেশ
-নির্মাণ
ইরানের ন্যানোটেকনোলজির বর্তমান অবস্থান
ন্যানোটেকনোলজি খাতে ইরানের প্রবৃদ্ধি বিস্ময়কর। ২০০০ সালে ইরান বিজ্ঞান গবেষণা পত্র প্রকাশনার দিক থেকে বিশ্বে ৫৯তম স্থান দখল করে। মাত্র এক দশকে ইরান ন্যানোটেকনোলজি খাতে প্রকাশনার দিক থেকে বিশ্বে ৮ম স্থান দখল করতে সক্ষম হয় (চিত্র-২)।
চিত্র-২: ২০০০-২০১২ সাল নাগাদ ন্যানোটেকনোলজি প্রকাশনার সংখ্যার ভিত্তিতে বিশ্বে ইরানের অবস্থান
ইরানের ন্যানোটেকনোলজি কোম্পানি
বর্তমানে ইরানে ৩৭০টিরও অধিক কোম্পানি স্বাস্থ্য, নির্মাণ, কৃষি ও প্যাকেজিং, পেট্রোলিয়াম, বস্ত্র এবং যানবাহন নির্মাণ শিল্পে ন্যানোটেকনোলজির প্রয়োগ নিয়ে কাজ করছে (চিত্র-৩)।
চিত্র-৩: ইরানে বিভিন্ন খাতে ন্যানোটেকনোলজি কোম্পানির সংখ্যা
ইরান স্বল্প সময়ে ন্যানোটেকনোলজি খাতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে যা নিম্নে তুলে ধরা হলো।
ক্যান্সার নিরোধক ঔষধ SinaDoxosome
এই ন্যানোমেডিসিন জরায়ুর ক্যান্সার, স্তন ক্যান্সার এবং মাইলেমা এবং ক্যাপোসি সারকোমাজনিত এইড্স রোগের চিকিৎসায় সাফল্যের সাথে ব্যবহৃত হচ্ছে।
স্ক্যানিং টানেলিং মাইক্রোস্কোপ (STM)
পরিবাহী এবং আধা-পরিবাহী ধাতব বস্তু, এমনকি ডিএনএ বা এন্টিবডির মাইক্রোগ্রাফ তৈরির জন্য এটি একটি শক্তিশালী অনুবীক্ষণ যন্ত্র। এটির মাধ্যমে নির্ভুল, পরিষ্কার দ্বিমাত্রিক (২উ) এবং ত্রিমাত্রিক (৩উ) ন্যানোচিত্র তৈরি করা সম্ভব।
ডিপ রিঅ্যাক্টিং আয়ন এচিং (DRIE)
এ যন্ত্রের মাধ্যমে উল্লম্ব মাইক্রো এবং ন্যানো কাঠামো তৈরি সম্ভব। এ প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে পলিমার দ্বারা বিভিন্ন বস্তু তৈরি করা সম্ভব। বস্ত্র খাতেও এ প্রযুক্তি প্রয়োগ করা হচ্ছে।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইলেকট্রোরিস মেশিন
ব্যাপক আকারে ন্যানোফিল্টার তৈরির জন্য এ যন্ত্র ব্যবহৃত হয়। ন্যানোফিল্টার বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং যানবাহন তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। ব্যান্ডেজ, মাস্ক, বায়োমেডিক্যাল শিল্পে স্ক্যাফোল্ড তৈরিতে এবং পানি হতে হেভি মেটাল পৃথক্করণের জন্য এ ফিল্টার ব্যবহৃত হয়।
হাই রেসুলিউশন এনিম্যাল SPECT ইমেজিং সিস্টেম
ক্ষুদ্র প্রাণীদের ওপর নব উদ্ভাবিত ঔষধের প্রতিক্রিয়া অনুধাবনের জন্য এ যন্ত্রটি বিশেষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম। স্নায়ুরোগ, ক্যান্সার, হৃদরোগ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং সংক্রামক রোগের ওপর নব উদ্ভাবিত ঔষধ নিয়ে গবেষণায় এ যন্ত্র বহুল ব্যবহারের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।
আয়ন মোবিলিটি স্পেক্ট্রোস্কোপি (IMS)
ক্ষুদ্রায়তনের রাসায়নিক দ্রব্যের উপস্থিতি নির্ণয়ের জন্য এ যন্ত্রটি বিশেষ উপযোগী। এ যন্ত্রের মাধ্যমে বিস্ফোরক দ্রব্য, ঔষধ, ব্লাড প্লাজমা, লালা, রুটি, চুয়িং গাম, গোশত, বড়ি, সিরাপ ইত্যাদিতে রাসায়নিক দ্রব্যের উপস্থিতি নির্ণয় সম্ভব।
প্লাজমা এনহেন্সড কেমিক্যাল ভেপার ডিপোজিশন (PECVD)
কার্বন ন্যানো স্ট্রাকচার, কার্বন ন্যানো টিউব তৈরি এবং ন্যানো ফেব্রিকেশন-এর জন্য এটি একটি অত্যাধুনিক যন্ত্র।
স্পাটারিং অ্যান্ড এচিং সিস্টেম
সেমিকন্ডাক্টর, কমপেক্ট ডিস্ক মেটালাইজেশন, ডাইইলেকট্রিক, অরগানিকস, পলিমারস, এলইডি, সৌরকোষ তৈরিতে এ যন্ত্র ব্যবহৃত হয়।
প্লাজমা অ্যাসিসটেড কেমিক্যাল ভেপার ডিপোজিশন (PECVD)
ধাতব বস্তুর স্থায়িত্ব বৃদ্ধির জন্য এ যন্ত্রের মাধ্যমে সূক্ষ্ম প্রলেপ প্রদান করা যায়।
বহনযোগ্য ন্যানোফিলট্রেশনের যন্ত্রের মাধ্যমে পানি উৎপাদন
২০ ফুট উচ্চতাসম্পন্ন একটি পাত্র যা জলাধারের পানিকে লবণমুক্ত এবং জীবাণুমুক্ত করতে সক্ষম। এ যন্ত্রের সাহায্যে এক দিনে ৬০ ঘনমিটার পানি শোধন করা সম্ভব। ইরানের মোল্লাসানি নামক শহরে নিরাপদ পানি সরবরাহের জন্য এ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে।
অনুবাদ : ড. মো. আলতাফ হোসেন
ইরান পরিচিতি : কোম
-কামাল মাহমুদ
ইরানের সবচেয়ে পবিত্র নগরী হিসেবে খ্যাত হচ্ছে কোম। ইমাম আলী ইবনে মূসা আর-রেযা (আ.)-এর বোন হযরত ফাতেমা মাসুমার মাযারের অবস্থান এ শহরে হওয়ার কারণেই এ সম্মান প্রদর্শন করা হয়। অমুসলিমরা এ মাযারে প্রবেশ করতে পারে। তবে সেজন্য কোন মুসলিম সঙ্গী বা গাইডের সাহায্য নিতে হয়। ৮ম শতকে কোম শিয়া মুসলমানদের কেন্দ্রে পরিণত হয়। ৮১৬ খ্রিস্টাব্দে ইমাম রেযার বোন ফাতেমা মাসুমা কোমে ইন্তেকাল করলে তাঁকে এখানেই সমাহিত করা হয়। সেই থেকে কোম মুসলমানদের কাছে অন্যতম পবিত্র নগরী হিসেবে বিবেচিত। কোম সেই শহর যেখানে ইরানের শাহের অনুগত সেনাবাহিনী ইসলামী বিপ্লব সফল করার লক্ষ্যে গঠিত স্বাধীনতাকামী মিলিশিয়াদের কাছে ১৯৭৯ সালে আত্মসমর্পণ করে এবং ইমাম খোমেইনীর নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লব সফলতা লাভ করে। এরপর থেকে ইমাম খোমেইনী আমৃত্যু কোমে বসবাস করতেন। ধর্মীয় শিক্ষা নগরী হিসেবে কোমের খ্যাতি সুদীর্ঘকালের। ‘হাউজায়ে এলমিয়ে কোম’ ইরানের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে অনেক শীর্ষস্থানীয় ধর্মবেত্তা কোমে বসবাস করেন। ধর্ম শিক্ষার স্কলারশীপের জন্য এ শহর পৃথিবীখ্যাত। ইরান এবং বিশ্বের অন্যান্য স্থানের ধর্মপ্রাণ শিয়া মুসলমানদের কাছে কোম আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্রবিন্দু। এ শহর অনেক ধর্মবেত্তাকে জন্ম দিয়েছে। এখানে ধর্মীয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সংখ্যা ৫০ এবং ধর্ম গবেষণা ও লাইব্রেরির সংখ্যা ২৫০টির মতো। কোমের অদূরে আরেকটি উপশহর ধর্মপ্রিয় মানুষের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। এর নাম হচ্ছে ‘জামকারান’।
ইরানের ৮ম বৃহত্তম নগরী কোম তেহরান থেকে সড়ক পথে ১২৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। ২০১১ সালের হিসেব অনুযায়ী কোমের জনসংখ্যা ১,০৭৪,০৩৬ জনÑ যার মধ্যে ৫৪৫৭০৪ জন পুরুষ এবং ৫২৮৩৩২ জন নারী। কোম নদীর তীরে এ শহরের অবস্থান। কোমের দক্ষিণ-পূর্বে প্রাচীন নগরী কাশান। কোমের সরাসরি দক্ষিণে দেলিজান, মাহালাত নারাক, পারদিসান, কাহাক ও জাসব। পূর্বে রয়েছে তাফরেশ, সাভে, অশতিয়ান ও জাফরিয়াহ।
আবহাওয়া ও ভৌগোলিক অবস্থান : কোমের আবহাওয়া সাধারণত শুষ্ক তবে বছরে কোন কোন সময় বৃষ্টিপাত হয় এবং কখনো কখনো বরফ পড়ে থাকে। বাৎসরিক গড় তাপমাত্রা ২৫.৮০ ফারেনহাইট এবং সর্বনি¤œ গড় তাপমাত্রা ৯.৯০ ফারেনহাইট। অতীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্র ছিল ৪০.১০ সেলসিয়াস এবং সর্বনি¤œ ছিল -২.৩০ সেলসিয়াস। ইরানের রাজধানী তেহরানের দক্ষিণে অপেক্ষাকৃত নিচু ও সমতল ভূমিতে মরুভূমি বেষ্টিত শহর হচ্ছে কোম।
ব্যবসা-বাণিজ্য : বর্তমানকালে কোম শিল্প-বাণিজ্য ও ইউরেনিয়াম উৎপাদনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। পেট্রোলিয়াম ও পেট্রোলিয়াম জাতীয় দ্রব্যের আঞ্চলিক বিতরণকেন্দ্র কোমে অবস্থিত। প্রাকৃতিক গ্যাসের পাইপ লাইন বন্দর আঞ্জালী এবং তেহরান থেকে কোমে এসেছে। অপরিশোধিত তেল লাইন তেহরান থেকে কোম হয়ে পারস্য উপসাগরের রিসাই নগরীতে গিয়ে মিলেছে। তেহরান ও কোমের মধ্যবর্তী স্থান শারাজে ১৯৫৬ সালে বিশাল তেলক্ষেত্র আবি®কৃত হয়। ‘সোয়ান’ নামক এক প্রকার টফি ও কার্পেটের জন্য কোমের খ্যাতি রয়েছে। কোমে প্রায় ২৫০০টি টফি বিক্রির দোকান রয়েছে। ধর্মীয় গ্রন্থাদি বিক্রির জন্য প্রচুর দোকান রয়েছে যা একসাথে ইরানের অন্য কোন জায়গায় দেখা যায় না। কোমে পেট্রোকেমিক্যাল ছাড়াও রয়েছে সিমেন্ট ও ইট প্রস্ততকারী ইন্ডাষ্ট্রি। খাবারের জন্য এখানে রয়েছে অনেক প্রাচীন ও বৃহৎ রেস্টুরেন্ট। এখানকার কাবাব খুবই বিখ্যাত। বিখ্যাত রেস্টুরেন্টের মধ্যে রয়েছে- সালারিয়ে, আলবোর্জ, মোরভারিদ, জাম, মারকাজি, ডিজি বাজার, বামা, শাহরে মা’, ফাদাক, ডলফিন প্রভৃতি। এখানে অনেক ক্যাফে, আইসক্রীম ও জুস শপ রয়েছে।
যাতায়াত : তেহরানের কাছাকাছি হওয়ায় কোমের যাতায়াত ব্যবস্থা বেশ উন্নত। সড়ক ও রেল পথে ইরানের বিভিন্ন শহরের সাথে যাতায়াত সুদীর্ঘকাল থেকেই। ১৯৭০ সালে কোম নদীর পার্শে¦ চলাচলের উপযোগী করে ড্যাম্ব স্থাপন করা হয়। কোমের সাথে তেহরান, আরাক, কাশান, সাভে এবং ইয়ায্দের সড়ক ও রেল যাতায়াত রয়েছে। এখানে সড়কপথে চলাচলের জন্য বাস, ট্যাক্সি ও মোটর বাইক পাবলিক ট্রান্সপোর্ট হিসেবে জনপ্রিয়।
প্রশাসন ব্যবস্থা : কোম শহরের প্রশাসন ব্যবস্থা মেয়র শাসিত। যিনি মিউিনিসিপ্যাল বোর্ড কর্তৃক নির্বাচিত হয়ে থাকেন। কোমের বর্তমান এলাকাসমূহ হচ্ছে- শাহরে কায়েম, পাঞ্জদাহে খোরদাদ, জাহান বীনী, তাবলিগানী টাউন, রাজাক টাউন, ফারহাঙ্গীয়ান টাউন, তাভানীর টাউন, ফাতিমা টাউন, ইমাম হাসান টাউন, ইমাম হোসাইন আবাসিক এলাকা, মাদীয়া টাউন, ইমাম খোমেইনী টাউন, পারদিসিয়ান সিটি, কুদ্স টাউন প্রভৃতি।
দর্শনীয় স্থান : ইরানের ইতিাহাস ও ঐতিহ্য সংস্থা কোমের ১৯৫টি স্থানকে দর্শনীয় স্থান হিসেবে চিহ্নিত করেছে। যার অধিকাংশই ধর্মীয় স্থাপনা। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- জামকারান মসজিদ, ফাতেমা মাসুমার মাযার, আযম মসজিদ, ইমাম হাসান আল আসকারী মসজিদ, আল গাদির মসজিদ, আতীক মসজিদ, কোম বাজার, ফাইজিয়াহ ধর্মীয় স্কুল, মারাসি নাজাফী লাইব্রেরি, জাহাঙ্গীর খান স্কুল, ফতেহ আলী শাহ কাচার মাযার, মোহাম্মাদ শাহ কাচার মাযার, ২য় শাহ আব্বাস এর মাযার, ৩য় শাহ সোলায়মান এবং শাহ সাফী মাযার, গোম্বাদ সাব্জ ঐতিহাসিক গার্ডেন, আলী ইবনে জাফর এর মাযার, শাহ হামযার মাযার, সাইয়্যেদ হাসান বোরুজেরদীর ঐতিহাসিক ভবন, ইয়ায্দান পানাহ ঐতিহাসিক ভবন, আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেইনী (র.)-এর বাসভবন, বাইতুন নূর ভবন, হাজী আসগর খান ঐতিহাসিক গোসলখানা,, গোলী দরবেশ পাহাড়, জামকারান প্রাসাদ, জামকারান এর ৫০০ বছরের পুরোনো বৃক্ষ, ন্যাশনাল কাভীর পার্ক, মারাসী নাজাফী লাইব্রেরি, হাউজিয়ে লেক, কোনে বাজার কমার্শিয়াল সেন্টার, কোনে মসজিদ, কোম কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রভৃতি। জাদুঘরসমূহের মধ্যে রয়েছে- কোম নৃতাত্ত্বিক জাদুঘর, ট্রাডিশনাল আর্ট মিউজিয়াম, ন্যাচারাল হিস্ট্রি ও বন্যপ্রাণী মিউজিয়াম, মিউজিয়াম অব অ্যাস্ট্রোনমি, কোম হ্যান্ডিক্রাফ্ট মিউজিয়াম। বিখ্যাত হোটেলসমূহের মধ্যে রয়েছে- পার্সিয়া হোটেল, হোটেল সাফ, ইরাম হোটেল, অলিম্পিক হোটেল, খোরশীদ হোটেল, আবসার হোটেল, আরিয়া হোটেল, বিবি হোটেল, যায়তুন হোটেল, সালাম হোটেল, ফাখরে আযম হোটেল, নায়নাভা হোটেল প্রভৃতি।
শিক্ষা ব্যবস্থা : কোম ধর্ম শিক্ষার কেন্দ্রস্থল হিসেবে বহুকাল থেকে খ্যাত হয়ে আছে। এখানে প্রচুর ধর্মশিক্ষা কেন্দ্র ও ইন্সটিটিউট রয়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্কলারশীপ দেয়া হয় এ শহরে। এখানে ৫০০০০ (পঞ্চাশ হাজার) এর বেশি ধর্ম শিক্ষার্থী রয়েছে, যারা পৃথিবীর ৮০টির বেশি দেশ থেকে আগত। শুধু পাকিস্তান থেকেই এসেছে ৬০০০ এর বেশি। কোমে নারী ও অমুসলিমদের জন্য ধর্ম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কোমে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিষয়ে শিক্ষাদানের জন্যও অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেমন সাইয়্যেদ হাসান সিরাজী ধর্ম শিক্ষা কেন্দ্র, ইমাম হোসাইন ধর্ম শিক্ষা কেন্দ্র, ইমাম বাগির ধর্ম শিক্ষা কেন্দ্র, রাসূল আযম, রাজাভিয়া, সাতিয়া, আবা-সালি, আল-মাহদী, আল-হাদী, জানবাজান রেসালাত, দাররে আস্তানা, সাইয়্যেদ আবদুল আজিজ ধর্ম শিক্ষা কেন্দ্র প্রভৃতি। কোমের হাউজায়ে এলমিয়ায় (ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে) ২০০ এর বেশি শিক্ষা ও গবেষণা সেন্টার রয়েছে। যেখানে ৪০০০০ (চল্লিশ হাজার) গবেষক ও ছাত্র-ছাত্রী নিয়মিত অধ্যয়ন করছে। কোমের আধুনিক হাউজায়ে এলমিয়ার প্রতিষ্ঠায় ওস্তাদ আবদুল করিম হায়েরীর ব্যাপক অবদান রয়েছে। অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে- ইউনিভার্সিটি অব কোম, মোফিদ ইউনিভার্সিটি, কোম ইউনিভার্সিটি অব মেডিকেল সাইন্স, আল-যাহরা ইন্সটিটিউট, দানেশ ইউনিভার্সিটি, পারদিসে দানেশগাহে তেহরান ইউনিভার্সিটি, আইআরআইবি ইউনিভার্সিটি অব কোম, কোম ইন্ডাট্রিয়াল কলেজ, আযাদ ইসলামী ইউনিভার্সিটি অব পারদিসান, মাসুমিয়া ইউনিভার্সিটি, হিকমাত কলেজ, আল-মুস্তাফা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, কোরআন-হাদীস ইউনিভার্সিটি, ফাখরে ইসলামী ইউনিভার্সিটি, মায়াকে ইসলামী ইউনিভার্সিটি, কম্পিউটার রিসার্চ সেন্টার অব ইসলামিক সাইন্স প্রভৃতি।
কোম নিউক্লিয়ার সেন্টার : কোমে রয়েছে ইরানের অন্যতম নিউক্লিয়ার সেন্টার। কোম শহরের ২০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে ইউরেনিয়াম উন্নতকরণ সেন্টার অবস্থিত। ১ জানুয়ারি ২০১২ সালে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সী (ওঅঊঅ) প্রকাশ করে যে, ইরান মেডিকেল ক্ষেত্রে ২০% ইউরেনিয়াম উৎপাদন করছে। সেই থেকে ইসরাইলসহ অন্যান্য শক্তিধর দেশ ইরানের পরমাণু কর্মসূচির বিরোধিতা করে আসছে। তাদের মনে ধারণা জন্মেছে যে, ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরি করে শক্তিধর দেশে পরিণত হলে তাদের অস্তিত্ব সংকটাপন্ন হবে। তাই প্রতিনিয়ত বিশ্বের অনেকগুলো শক্তিধর দেশ ইরানের পরমাণু কর্মসূচির ঘোর বিরোধিতা করে আসছে। যদিও ইরান এ শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি থেকে পিছু হটেনি। এছাড়া কোমে রয়েছে মহাকাশ কেন্দ্র বা স্পেস সেন্টার। যেখান থেকে ইতোমধ্যেই মহাকাশযান শাহাব-৩ এর সফল উৎক্ষেপণ সম্ভব হয়েছে।
সুদীর্ঘকাল থেকে কোম একদিকে যেমন ধর্মীয় পবিত্র স্থান হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে তেমনি সাম্প্রতিককালে তার খ্যাতি রয়েছে পরমাণু কর্মসূচির জন্য। ইরানের রাজধানী তেহরানের কাছাকাছি শহর হওয়াতে এখানকার জীবনমান বেশ উন্নত। ইরানের পর্যটকরা তো বটেই, বিদেশি পর্যটকরাও ইরানের অন্যান্য স্থানের পাশাপাশি কোম শহরকে ভিন্নরকম গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ইমাম খোমেইনীর শহর কোম বিপ্লব ও ধর্মচর্চার ক্ষেত্রে স্ব-মহিমায় ভাস্বর হয়ে আছে বিশ্ব মুসলিমের কাছে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধান ও শাসন ব্যবস্থা
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধানে একটি ভূমিকা, চৌদ্দটি পরিচ্ছেদ এবং একশ সাতাত্তরটি অনুচ্ছেদ রয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী ইসলামী প্রজাতন্ত্র ব্যবস্থা ইসলামী বিশ্বাস ও মূল্যবোধের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে এবং এই সরকার ব্যবস্থার বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতা বেলায়েতে ফকীহ এবং গণরায়ের ওপর নির্ভরশীল থাকবে। প্রশাসনিক ব্যবস্থাও নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় গণরায়ের মাধ্যমে সম্পন্ন হবে। এই সরকার ব্যবস্থায় রাহবার বা সর্বোচ্চ নেতা হবেন একজন ন্যায় পরায়ণ মুজতাহিদ বা ইসলামী ধর্মতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ। তিনি জনসাধারণের পরোক্ষ ভোটে অর্থাৎ জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত বিশেষজ্ঞ পরিষদের মাধ্যমে নির্বাচিত হবেন। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের কাঠামো বা বিভাগগুলো হবে নিম্নরূপ : আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ এবং বিচার বিভাগ। মজলিসে শুরায়ে ইসলামী বা পার্লামেন্টের সদস্যগণ এবং প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। ইসলামী আইনজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত অভিভাবক পরিষদ ইসলামী মানদ-ের ভিত্তিতে এবং পার্লামেন্টের অনুমোদিত আইন অনুযায়ী তাঁদের দায়িত্ব পালন করবেন।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধানে ইরানী সমাজের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোগুলোর ব্যাখ্যা ইসলামের মূল নীতি এবং আদর্শের ভিত্তিতে উপস্থাপিত হয়েছে, যা ইসলামী জাতির প্রাণের দাবির বহিঃপ্রকাশ। ইরানের মহান ইসলামী বিপ্লবের প্রকৃতি এবং সূচনা থেকে বিজয় পর্যন্ত মুসলিম জনতার সংগ্রামের গতিধারা এই মৌলিক দাবির উদ্ভব ঘটিয়েছে যা সুস্পষ্ট আকার ধারণ করেছে সর্বস্তরের জনগণের দৃঢ় এবং আপোষহীন সেøাগানে। মহান বিজয়ের সূচনালগ্নে এখন আমাদের জাতি পূর্ণ অস্তিত্ব দিয়ে দেই সেই লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে চায়। আদর্শিক এবং ইসলামী চরিত্র এই বিপ্লবকে গত এক শতকে সংঘটিত ইরানের অন্যান্য আন্দোলন থেকে সম্পূর্ণ পৃথক বা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী করেছে। ইরানের মুসলিম জাতি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন উত্তরণের মাধ্যমে যে মূল্যবান অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, তা থেকে তারা উপলব্ধি করতে পেরেছে যে, বিগত আন্দোলনগুলো আদর্শিক না হওয়ার কারণেই সফলতা লাভ করতে পারে নি। যদিও সাম্প্রতিক কালের ঐ সব আন্দোলনে ইসলামী চিন্তা-চেতনা এবং সংগ্রামী আলেমদের নেতৃত্ব মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে, তারপরও প্রকৃত ইসলাম থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণে ঐ আন্দোলনগুলো খুব দ্রুত নিরুদ্যম হয়ে পড়ে। ফলে প্রখ্যাত মার্জায়ে তাকলিদ (উচ্চ প্রজ্ঞাসম্পন্ন ফকিহ বা আলেম) হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খোমেইনী (র.)-এর নেতৃত্বে জাতির জাগ্রত বিবেক খাঁটি ইসলামী এবং আদর্শিক আন্দোলনের অপরিহার্যতা অনুভব করে। তাই দেশের সংগ্রামী আলেম সমাজÑ যাঁরা সর্বদা গণআন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন এবং প্রত্যয়ী লেখক ও বুদ্ধিজীবিগণ (ইমাম খোমেইনীর) নেতৃত্বে নতুন ভাবে উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন। (ইরানী জাতির এই আন্দোলন ১৩৮২ হিজরি মোতাবেক ১৩৪১ ফারসি সাল, ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে সূচিত হয়)
বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ
সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ওপর ইরানের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক নির্ভরশীলতাকে পাকাপোক্ত করতে এবং স্বৈরাচারী শাসনের ভিত্তি শক্তিশালী করতে মার্কিন ষড়যন্ত্রের (শ্বেত বিপ্লব) বিরুদ্ধে ইমাম খোমেইনীর বলিষ্ঠ প্রতিবাদ জাতির ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। পরবর্তীকালে ফারসি ১৩৪২ সালের খোরদার মাসে (জুন-১৯৬৩) সংঘটিত ইসলামী জাতির রক্তাক্ত বিপ্লব প্রকৃতপক্ষে গৌরবময় ও গণজাগরণের পেক্ষাপট তৈরি করেছিল এবং ইসলামী নেতা হিসেবে ইমামের অবস্থানকে শক্তিশালী ও সংহত করেছিল। কলঙ্কজনক আইন কেপিচ্যুলেশনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় তোলার কারণে ইমামকে নির্বাসনে পাঠানো সত্ত্বেও জতির সাথে ইমামের দৃঢ় সম্পর্ক অটুট থাকে এবং এই মুসলিম জাতি বিশেষ করে প্রত্যয়ী বুদ্ধিজীবী ও সংগ্রামী আলেম সমাজ নির্বাসন, মৃত্যুদ- ও জেল-জুলুম উপেক্ষা করে তাঁদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখেন। এভাবে সমাজের সচেতন ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ মসজিদ, মাদ্রাসা এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে জনগণকে অনুপ্রাণিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁরা নিজেরা ইসলাম ও বিপ্লবী আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে চলমান সংগ্রাম সম্পর্কে ইরানের মুসলিম জাতির জ্ঞান ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ফলপ্রসূ ও নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। তৎকালীন স্বৈরাচারী সরকার ইসলামী আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে ফায়জিয়া মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল বিপ্লবী কেন্দ্রের ওপর বর্বরোচিত হামলা শুরু করে; এবং বিপ্লবী জনতার রোষানল থেকে বাঁচার জন্য চরম পাশবিকতার আশ্রয় নেয়। এই পরিস্থিতিতে আমাদের মুসলিম জাতি চলমান সংগ্রামের প্রতি তাদের অনড়-অবিচল অবস্থানের মাসুল দেয় মৃত্যুদ-, মধ্যযুগীয় নির্যাতন ও দীর্ঘমেয়াদি কারাবরণের মাধ্যমে। ইরানের ইসলামী বিপ্লব সেই সব ঈমানদার তরুণ-তরুণীর রক্তে গতি লাভ করে যারা ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়ার আগেই বধ্যভূমিগুলোতে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে ফরিয়াদ করতো কিংবা যারা বিভিন্ন রাস্তা-ঘাটে শত্রুপক্ষের গুলির নিশানায় পরিণত হয়েছিল। বিভিন্ন উপলক্ষে প্রেরিত ইমামের বাণী বা বার্তা এই মুসলিম জাতির মনোবল ও সঙ্কল্পকে করেছে শাণিত।
ইসলামী শাসন ব্যবস্থা
স্বৈরাচারী শাসনামলের চরম শ্বাসরুদ্ধকর সময়ে ইমাম খোমেইনী (র.) বেলায়েতে ফকিহ (শ্রেষ্ঠ ইসলামী আইনজ্ঞের শাসন) ভিত্তিক ইসলামী শাসন ব্যবস্থার পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন, যা মুসলিম জনগণের মাঝে সুনির্দিষ্ট ও নতুন চেতনার জন্ম দেয় এবং ইসলামী ভাবধারার আন্দোলনের প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচন করে। ফলে দেশের ভেতরে ও বাইরে সংগ্রামী এবং আদর্শিক মুসলমানদের তৎপরতা আরো গতিশীল হয়। এই পথ ধরে আন্দোলন অব্যাহত থাকে, অবশেষে একদিকে ভেতরের চাপ ও শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা অপর দিকে সংগ্রামী আলেম ও ছাত্রসমাজ কর্তৃক বহির্বিশ্বে সংগ্রামের খবর প্রতিফলিত হওয়ায় স্বৈরাচারী শাসনের ভিত নড়ে ওঠে। ফলে সরকার ও তার প্রভুরা জনগণের ওপর চাপ কমাতে এবং রাজনৈতিক পরিবেশ উন্মুক্ত করতে বাধ্য হয়। তাদের ধারণা ছিল এই পদক্ষেপের মাধ্যমে তাদের অনিবার্য পতন ঠেকানো যাবে এবং তাদের ওপর জনগণের আস্থার বাতাবরণ তৈরি হবে। কিন্তু ইমামের নিরবচ্ছিন্ন ও দৃঢ় নেতৃত্বে সচেতন, সঙ্কল্পবদ্ধ ও বিপ্লবী জনতা দেশ জুড়ে তাদের ঐক্যবদ্ধ ও সফল আন্দোলন ব্যাপকভাবে শুরু করে।
জনতার ক্রোধ
ফারসি ১৩৫৬ সালের ১৭ দেই (৭ জানুয়ারি ১৯৭৮) শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক আলেমসমাজ বিশেষ করে ইমাম খোমেইনী (র.)-এর উদ্দেশ্যে অবমাননাকর চিঠি প্রকাশিত হলে এই আন্দোলন বেগবান হয়ে ওঠে এবং দেশ জুড়ে জনগণের মাঝে প্রবল ক্ষোভের সঞ্চার হয়। সরকার প্রতিবাদী আন্দোলন দমনের জন্য রক্তাক্ত পথ বেছে নেয়। কিন্তু এই পদক্ষেপের কারণে বিপ্লবের ধমনীতে আরো বেশি রক্ত সঞ্চালিত হয়। বিপ্লবের শহীদদের শাহাদাতের সপ্তম ও চল্লিশতম দিবসে অনুষ্ঠিত স্মরণসভাগুলোতে বিপ্লবের হৃদস্পন্দন দেশ জুড়ে চলমান আন্দোলনে প্রাণের সঞ্চার করে এবং আন্তরিকতা ও ঐক্যের স্পৃহাকে আরো শক্তিশালী করে তোলে। দেশের সকল প্রতিষ্ঠান গণআন্দোলনের সাথে একাত্ম হয়ে এবং সর্বাত্মক ধর্মঘট ও বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দিয়ে স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনকে নতুন মাত্রা দেয়। রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বস্তরের নারী-পুরুষের মধ্যে ঐক্যের এই বন্ধন বিপ্লবী আন্দোলনকে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় অর্থবহ করে তুলেছিল। বিশেষ করে এই মহান জিহাদের সর্ব ক্ষেত্রে নারী সমাজের প্রত্যক্ষ ও সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক মাত্রায়। লড়াইয়ের ময়দান বা মেশিনগানের দিকে সন্তান কোলে নিয়ে মায়েদের ধাবমান হওয়ার দৃশ্যগুলোই প্রমাণ করে এই সংগ্রামে নারীসমাজের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল!
জাতি যে মূল্য দিয়েছে
এক বছরেরও বেশি সময় ধরে নিরবচ্ছিন্ন ও নিরন্তর সংগ্রাম, কয়েক বিলিয়ন তুমান (ইরানী মুদ্রা) আর্থিক ক্ষতি, ৬০ সহস্রাধিক শহীদ, লক্ষ আহত ও পঙ্গুর রক্তে পুষ্ট হয়ে এই বিপ্লবের চারা গাছ ‘মুক্তি, স্বাধীনতা, ইসলামী শাসন ব্যবস্থা’ এই সেøাগানের মধ্য দিয়ে ফলবান হয়ে ওঠে। এই মহাবিপ্লব ঈমান, ঐক্য, সংবেদনশীল ও সঙ্কটময় সময়ে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং জাতির আত্মত্যাগের ফলে বিজয় অর্জন করে এবং সাম্রাজ্যবাদের সকল হিসেব-নিকেশ উল্টে দিতে ও তাদের সকল প্রতিষ্ঠান এবং বন্ধন ছিন্ন করতে সক্ষম হয়। এর মাধ্যমে বিশ্বের বড় গণ বিপ্লবগুলোর ইতিহাসে নতুন অধ্যায় যুক্ত হয়। ফারসি ১৩৫৭ সালের ২১ ও ২২ বাহমান (১৯৭৯ সালের ১২ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি) রাজতন্ত্রের ভিত ধসে পড়ে, এর ফলে অভ্যন্তরীণ স্বৈরাচার এবং বিদেশী আধিপত্যের পরাজয় নিশ্চিত হয়। এই মহা বিজয়ই ইসলামী হুকুমাতের সূচনাকে নিশ্চিত করে যা ছিল মুসলিম জনগণের দীর্ঘ দিনের আকাক্সক্ষা এবং এটি চূড়ান্ত বিজয়ের সুসংবাদ বয়ে আনে। ইরানের জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে এবং দেশের বরেণ্য আলেমগণ ও মার্জায়ে তাকলিদগণ ইসলামী প্রজাতন্ত্রী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তাদের চূড়ান্ত ও বলিষ্ঠ রায় ঘোষণা করেন। ৯৮.২ ভাগ ভোট পড়ে ইসলামী প্রজাতন্ত্রী ব্যবস্থার পক্ষে। সমাজের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ ও এর পারস্পরিক সম্পর্কের নির্ধারক হিসেবে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধানই ইসলামী শাসন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করা এবং বিধ্বস্ত পূর্ববর্তী শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তে নতুন ব্যবস্থার রূপরেখা উপস্থাপন করার পথনির্দেশকের ভূমিকা পালন করবে।
ইসলামে সরকার ব্যবস্থার কাঠামো
ইসলামের দৃষ্টিতে সরকার বা রাষ্ট্রক্ষমতা শ্রেণিগত দৃষ্টিকোণ কিংবা ব্যক্তি বা দলীয় কর্তৃত্বকামিতা থেকে উৎসারিত নয়। বরং তাতে একই চিন্তা ও বিশ্বাসের অধিকারী কোন জাতির রাজনৈতিক আদর্শ প্রতিফলিত হয়। এটি সংঘবদ্ধ এজন্য যাতে আদর্শিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় চূড়ান্ত লক্ষ্যে (আল্লাহর পথে চলার) উপনীত হওয়ার পথ সুগম করা যায়। আমাদের জাতি বৈপ্লবিক পূর্ণতার গতিপথে নিজেদেরকে তাগুতের (খোদাদ্রোহী শক্তির) ময়লা ও মরিচা থেকে মুক্ত করতে পেরেছে এবং বিজাতীয় মতাদর্শের প্রভাব থেকে নিজেদেরকে পবিত্র করে প্রকৃত ইসলামী মতাদর্শ ও বিশ্বদর্শনের দিকে প্রত্যাবর্তন করেছে। এখন তারা ইসলামী নীতিমালার ভিত্তিতে নিজেদের জন্য আদর্শ সমাজ গড়তে চায়। এরই ভিত্তিতে সংবিধানের কর্তব্য হচ্ছে বিপ্লবের আদর্শকে বাস্তবে পরিণত করা এবং মানুষ যাতে ইসলামের সুউচ্চ ও সর্বজনীন মূল্যবোধ অনুসারে প্রতিপালিত হতে পারে সেই পরিবেশ-পরিস্থিতি তৈরি করা। ইরানের বিপ্লব হচ্ছে সবলের (মুস্তাকবিরীন) ওপর দুর্বলের (মুস্তাদআফীন) বিজয়; এর ইসলামী বৈশিষ্ট্যের প্রতি লক্ষ্য রেখে সংবিধান দেশের ভেতরে ও বাইরে এই বিপ্লব অব্যাহত রাখার সুযোগ রাখবে বিশেষ করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইসলামী আন্দোলসমূহ এবং মুসলিম জনগণের সাথে সম্পর্ক বিস্তারের মাধ্যমে বিশ্বে একক জাতি (উম্মাহ) গঠনের পথ সুগম করবে (ان هذه امتكم امة واحدة وانا ربكم فاعبدون) । বঞ্চিত ও নির্যাতিত জাতিসমূহের মুক্তির জন্য এই সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। এই মহাবিপ্লবের মূল বৈশিষ্ট্যের কারণে এই সংবিধান অর্থনীতিতে একচেটিয়া আধিপত্য এবং যে কোন ধরনের সামাজিক ও মানসিক স্বেচ্ছাচারিতাকে প্রত্যাখ্যান করার প্রতিভূ; এবং স্বেচ্ছাচারিতাকে নির্মূল করে জনগণের ভাগ্য জনগণের হাতে অর্পণ করার জন্য সচেষ্ট (ويضع عنهم اصرهم والاغلال التى كانت عليهم) । রাজনৈতিক বুনিয়াদ ও প্রতিষ্ঠানসমূহ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যা সমাজ বিনির্মাণের ভিত্তি; আদর্শিক বিবেচনায় উত্তীর্ণ সৎকর্মশীল ব্যক্তিরাই দেশ ও শাসনকার্য পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন (ان الارض يرثها عبادى الصالحون) । আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠানÑযা সমাজ পরিচালনার নিয়ম-কানুনের ব্যাখ্যাতাÑকোরআন ও সুন্নাহর বৃত্তে আবর্তিত হবে। অতএব, ধর্মপ্রাণ, ন্যায়পরায়ণ, প্রত্যয়ী ইসলাম বিশেষজ্ঞদের (ন্যায়পরায়ণ ফকীহবৃন্দ বা ইসলামী আইনজ্ঞ) আন্তরিক ও নিবিড় তত্ত্বাবধান অত্যন্ত জরুরি। শাসনক্ষমতার উদ্দেশ্য যেহেতু ঐশী জীবন বিধানের দিকে পথ চলায় মানুষের উন্নতি বিধান করা, (و الى الله المصير) যাতে মানব সত্তায় বিদ্যমান ঐশী চরিত্র বা বৈশিষ্ট্যগুলো প্রস্ফুটিত করার লক্ষ্যে (تخلقو باخلاق الله) সহজাত প্রবণতা বা প্রতিভাগুলো বিকশিত করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা যায়, তাই সমাজ পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় সমাজের সকল অংশের সক্রিয় ও ব্যাপক অংশগ্রহণ ব্যতীত এটি সম্ভব হতে পারে না। কাজেই রাজনৈতিক ও ভাগ্য নির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণের সকল ক্ষেত্রে সংবিধান সমাজের সকল সদস্যের অংশগ্রহণের অধিকার নিশ্চিত করবে যাতে মানুষের পরিপূর্ণতা অর্জনের গতিপথে প্রত্যেকেই এর সাথে জড়িত হতে পারে এবং সমাজের নেতৃত্ব, উন্নতি ও অগ্রগতিতে অংশীদার হতে পারে। এটা হবে পৃথিবীতে মুস্তাদআফদের (দুর্বলদের) শাসনক্ষমতা লাভের সেই (প্রতিশ্রুতির) বাস্তবায়ন।
نريد ان نمن على الذين استضعفوا فى الارض و نجعلهم ائمة ونجعلهم الوارثين-
বেলায়েতে ফকিহ
বেলায়েতে ফকিহ বা ন্যায়পরায়ণ ইসলামী আইনজ্ঞের শাসন ইসলামী মৌলিক নীতিমালা এবং ইমামতের ধারার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ; জনগণ কর্তৃক নেতা (রাহবার) হিসেবে স্বীকৃত সার্বিক যোগ্যতার অধিকারী ইসলামী আইনজ্ঞের (ফকিহ) নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে সংবিধান। (مجارى الامور بيد العلماء بالله الامناء على حلاله وحرامه) যাতে প্রকৃত ইসলামী দায়িত্ব ও কর্তব্যের ব্যাপারে বিভিন্ন সংস্থার বিচ্যুতি প্রতিহত করা যায়।
অর্থনীতি হচ্ছে মাধ্যম
অর্থনৈতিক বুনিয়াদগুলো মজবুত করাই অর্থনীতির লক্ষ্য নয়; মূল লক্ষ্য হবে প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের গতিপথে মানুষের প্রয়োজন মেটানো। অন্যান্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মতো শুধু মুনাফা বৃদ্ধি বা সম্পদ পুঞ্জিভূত ও কেন্দ্রীভূত করা এর উদ্দেশ্য নয়। কারণ, বস্তুবাদী মতবাদগুলোতে অর্থনীতি হচ্ছে নিজেই লক্ষ্য; ফলে মানবিক উন্নয়নের প্রবাহে অর্থনীতিই অধঃপতন, দুর্নীতি ও ধ্বংসের কারণ হয়ে ওঠে। কিন্তু ইসলামে অর্থনীতি হচ্ছে মাধ্যম; আর কোন মাধ্যমের নিকট থেকে মূল লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার উত্তম কার্যক্ষমতা ছাড়া অন্য কিছু প্রত্যাশা করা যায় না। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী ইসলামী অর্থনীতির পরিকল্পনা হচ্ছে মানুষের বিভিন্ন সৃজনশীলতা বিকশিত করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। কাজেই সকলের জন্য কর্ম সংস্থান করা, উপযুক্ত ও সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা এবং উন্নয়ন তৎপরতার প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানোর দায়িত্ব ইসলামী সরকারের।
সংবিধানে নারীর অবস্থান
ইসলামী সমাজের ভিত্তিগুলো গড়ে ওঠার পর জনগণÑযারা এ যাবৎ সার্বিকভাবে বিদেশী শোষণের অন্তর্গত ছিলÑনিজেদের আত্মপরিচয় ও মানবিক অধিকার পুনরায় ফিরে পায়। এই ফিরে পাওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই তাগুতি (খোদাদ্রোহী) শাসনামলে সবচেয়ে বেশি বঞ্চনার শিকার নারীসমাজই তাদের অধিকার ফিরে পাওয়ার সবচেয়ে বড় দাবিদার হিসেবে বিবেচিত হয়। পরিবার হচ্ছে সমাজের মৌলিক একক এবং মানুষের নৈতিক উন্নতি ও উৎকর্ষের প্রাণকেন্দ্র। ফলে এই লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার বন্দোবস্ত করা ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব। পারিবারিক একক সম্পর্কে এই উপলব্ধির আলোকে নারী বঞ্চনা, ভোগ্য বস্তুতে পরিণত হওয়া কিংবা ভোগবাদ প্রসারের ক্ষেত্রে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া থেকে মুক্ত হয়ে চৌকস ও আদর্শ মানুষ গড়ে তোলার জন্য মাতৃত্বের কঠিন ও মূল্যবান দায়িত্ব পুনঃঅর্জনের মাধ্যমে জীবনের কর্মশীল ক্ষেত্রগুলোতে হবে পুরুষের সহযোদ্ধা। ফলে নারী অতি গুরত্বপূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ এবং ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদার অধিকারিণী হবে।
ইসলামী মৌলিক বিশ্বাসের প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সশস্ত্র বাহিনী
দেশের সশস্ত্র বাহিনী গঠন ও সুসজ্জিতকরণের ক্ষেত্রে ঈমান ও ইসলামী শিক্ষাকে ভিত্তি ও নীতি হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এই কারণে উল্লিখিত লক্ষ্য অনুসারে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সেনাবাহিনী ও ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনীকে গড়ে তোলা হবে। তারা শুধু দেশের সীমান্ত রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত হবে না; বরং ইসলামী মিশনকে পূর্ণতা প্রদান করতে অর্থাৎ আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ এবং বিশ্বে আল্লাহর আইন বাস্তবায়ন বিস্তৃত করার সংগ্রামও তাদের ওপর ন্যস্ত থাকবে।
(واعدوا لهم ما استطعتم من قوة ومن رباط الخيل ترهبون به عدو الله وعدوكم وآخرين من دونهم)
বিচার ব্যবস্থা
ইসলামী আন্দোলনের ধারা অনুসারে মানুষের অধিকার রক্ষা করা এবং ইসলামী জাতির অভ্যন্তরীণ বিভেদ ও বিভ্রান্তি প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে বিচার ব্যবস্থা অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কাজেই ইসলামী ন্যায়-নীতির ভিত্তিতে এবং ইসলামী বিধি-বিধানের সাথে গভীরভাবে পরিচিত, ন্যায়পরায়ণ বিচারকগণের সমন্বয়ে বিচার বিভাগ গঠনের বিষয়টি বিবেচনায় আনা হয়েছে। সংবেদনশীলতা এবং আদর্শিক দিক বিবেচনা সাপেক্ষে বিচার ব্যবস্থাকে যে কোন ধরনের অসুস্থ সম্পর্ক ও সংশ্লিষ্টতা থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। (واذا حكمتم بين الناس ان تحكموا بالعدل)
নির্বাহী বিভাগ
সাম্য ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের উদ্দেশ্যে ইসলামী আইন ও বিধি-বিধান বাস্তবায়নের যে বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে তেমনি ভাবে জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার ক্ষেত্রে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রয়োজনীয়তার কারণে নির্বাহী বিভাগকে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার পথ উন্মোচনকারীর ভূমিকা পালন করতে হবে। ফলে এই লক্ষ্যে উপনীত হওয়াকে মন্থর কিংবা বাধাগ্রস্ত করতে পারে এমন যে কোন জটিল প্রশাসনিক পদ্ধতি ইসলাম কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হবে। কাজেই আমলাতন্ত্র যা তাগুতি শাসনামলের অর্জন, তা অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে অপসারণ করা হবে যাতে প্রশাসনিক কর্মকা-ে গতি ও দক্ষতা বৃদ্ধি করা যায়।
গণমাধ্যম
গণমাধ্যম অবশ্যই ইসলামী বিপ্লবের অগ্রগতি এবং ইসলামী সংস্কৃতি প্রসারের কাজে নিয়োজিত থাকবে। এ ক্ষেত্রে সুস্থ চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিসমূহ থেকে গণমাধ্যম লাভবান হবে এবং ক্ষতিকারক ও ইসলামবিরোধী প্রথা বা রীতির প্রচলন ও প্রসার থেকে সম্পূর্ণভাবে বিরত থাকবে। যে আইনের মৌলিক বিষয়গুলো মানব জাতির সম্মান ও স্বাধীনতাকে সর্বোচ্চ লক্ষ্য মনে করে এবং মানুষের পূর্ণতা ও উন্নয়নের পথকে সুগম করে দেয় তা অনুসরণ করা সকলেরই কর্তব্য। এটি অত্যন্ত জরুরি যে, মুসলিম জাতি যোগ্য ও ঈমানদার কর্মকর্তাদের নির্বাচিত করে এবং তাদের কর্ম তৎপরতার ওপর অব্যাহত নজরদারির মাধ্যমে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবে। এই প্রত্যাশায়, যাতে বিশ্ববাসীর জন্য অনুকরণীয় ইসলামী আদর্শের সমাজ গঠনে সফল হওয়া যায়। (وكذلك جعلناكم امه وسطا لتكونوا شهداء على الناس)
প্রতিনিধিবর্গ
গণপ্রতিনিধিবর্গের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষজ্ঞ পরিষদ, বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে প্রেরিত প্রস্তাবসমূহ এবং সরকার কর্তৃক প্রস্তাবিত খসড়ার ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়নের কাজ পরিত্রাণকারী জীবন ব্যবস্থা ইসলামের প্রবর্তক নবী করিম (সা.)-এর হিজরতের পনর শতকের সূচনা লগ্নে, ওপরে উল্লিখিত প্রেরণা ও লক্ষ্যসমূহ অর্জনের উদ্দেশ্যে সম্পন্ন করে। এই প্রত্যাশায় যে, বিশ্বে মুসতাদআফীনের কর্তৃত্ব এবং মুসতাকবিরীনের পরাজয় নিশ্চিত হবে। এই সংবিধানে বারোটি পরিচ্ছেদ এবং একশ পঁচাত্তরটি অনুচ্ছেদ সন্নিবেশিত হয়েছে।
সূত্র : ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধান, আল-হুদা পাবলিকেশন।
হযরত ফাতিমা যাহরা (আ.) এর ইবাদত দর্শন
আব্দুল কুদ্দুস বাদশা
ভূমিকা
নবীকন্যা ও বেহেশ্তে নারীদের স¤্রাজ্ঞী হযরত ফাতিমা সালামুল্লাহি আলাইহা। মাত্র আঠারো বছরের সংক্ষিপ্ত আয়ুষ্কালে তিনি জীবনের প্রত্যেকটি অঙ্গনে এমনভাবে কদম রেখেছেন যে, পরম উপাস্যের একত্বের সৌন্দর্য সত্তার শুভ্র তাজাল্লি তাঁর প্রাণের দর্পণে প্রতিফলিত হয়েছে। ফলে স্বয়ং আল্লাহর পক্ষ হতে আয়াত-ই তাতহীর [সূরা আহযাব : ৩৩] অবতীর্ণের মাধ্যমে তিনি নিষ্কলুষ ও নিষ্পাপত্বের মহামূল্যবান মর্যাদার খেতাবটি অর্জন করে নিতে সক্ষম হন। আল্লাহর ইবাদত করাকে তিনি নিজ জীবনের সাথে এমন নিগুঢ়ভাবে মিশিয়ে নেন যে তার সুবাদে তিনি বিরল এক মাকামের অধিকারী হন। সে মাকামটি হলো ‘তাঁর সন্তুষ্টি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টির কারণ এবং তাঁর অসন্তুষ্টি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অসন্তুষ্টির কারণ’ হওয়া। ইবাদতের প্রভাবে তাঁর সত্তা এমন ভাবে মহান আল্লাহর পবিত্র সত্তার তাজাল্লির প্রকাশস্থলে পরিণত হয় যে, তাঁকে কষ্ট দেওয়া স্বয়ং আল্লাহকে কষ্ট দেওয়ার শামিল হয়ে দাঁড়ালো। এ কারণে অত্র প্রবন্ধে আমরা হযরত ফাতিমা সালামুল্লাহি আলাইহা’র ইবাদত দর্শনের একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা উপস্থাপন করার চেষ্টা করব। যাতে বিশ্বজগৎ সৃষ্টির দর্শনের সাথে ইবাদতের সম্পর্কটা জানা যায়। তবে মূল পর্যালোচনায় প্রবেশ করার আগে সংক্ষেপে ইবাদত ও তার প্রভাব সম্পর্কে কিছু ধারণা বুঝে নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে, যা হযরত ফাতিমা যাহরা সালামুল্লাহি আলাইহা’র ইবাদত দর্শনকে সহজে বুঝতে সাহায্য করবে।
ইবাদত-এর অর্থ
ভাষাতত্ত্ববিদগণের অনেকের অভিমত হলো ‘ইবাদত’ কথাটির অর্থ হচ্ছে কথায় ও কর্মে উভয় দিক হতে ‘বিনয়শীল থাকা’ অথবা ‘পরম বিনয়’ প্রকাশ করা, তবে তা অবশ্যই আল্লাহকে উপাস্য হিসাবে বিশ্বাস রেখে এবং তাঁর নৈকট্য লাভের সংকল্প সহকারে হতে হবে। এ কথা থেকে প্রতিপন্ন হয় যে, ইবাদত যতই বিনয় ও অবনত হওয়ার প্রকাশ হোক না কেন, তাই বলে যে কোন বিনয় ও অবনত হওয়াকে ‘ইবাদত’ বলে আখ্যায়িত করা যায় না। উপাস্য হিসাবে বিশ্বাস পোষণ এবং তাঁর নৈকট্য অর্জনের সংকল্পÑ এ দুটি বিষয় ইবাদতের অনিবার্য শর্ত।
আর আভিধানিক ভাবে ‘আব্দ’ তথা ইবাদতকারী সেই ব্যক্তিকেই বলা হয় যে আপাদমস্তক স্বীয় মনিব তথা মাওলার সাথে সম্পৃক্ত। তার ইচ্ছা মনিবের ইচ্ছাধীন। তার চাওয়াও মনিবের চাওয়ার ওপর নির্ভরশীল। সে মনিবের বিপরীতে নিজেকে কোন কিছুর মালিক বলে মনে করে না। আর মনিবের আনুগত্য করতে কোন শৈথিল্যও সে প্রদর্শন করে না। মোটকথা, ইবাদত তথা বন্দেগি হচ্ছে সেই পরম সত্তার প্রতি নিরঙ্কুশ বিনয় জ্ঞাপন, যিনি সকল কিছুর উৎসমূল। একারণে একমাত্র সেই সত্তাই ‘উপাস্য’ হতে পারেন, যিনি সকল অনুগ্রহ ও অনুকম্পার নিরঙ্কুশ দাতা। এক আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ সেই যোগ্যতার অধিকারী নয়। বান্দার দিক থেকে তাই বন্দেগি হলো একজন মানুষের আত্মিক পূর্ণতার চূড়ান্ত মাত্রা এবং মাবুদের সাথে তার নৈকট্যের প্রকাশ।
ইবাদতের স্বরূপ ও তাৎপর্য
ইবাদতের সারকথা হলো মানুষ আল্লাহর পবিত্র সত্তা ব্যতীত অন্য কাউকে উপাসনার উপযুক্ত বলে জানবে না, একমাত্র তাঁরই আদেশ মেনে চলবে এবং সর্বদা তাঁকেই স্মরণ করবে। আর সুখে-দুঃখে সকল বিষয়ে একমাত্র তাঁর সন্তুষ্টিকেই বিবেচনায় রেখে চলবে। এ অর্থে বান্দার ইবাদত কখনো কখনো নামায, রোযা, হজ ও যাকাতের ন্যায় বিশেষ আমলসমূহ পালনের মাধ্যমে; আবার কখনো কখনো মিথ্যাচার, গীবত, ব্যভিচার, হত্যা ইত্যাদি বিশেষ কিছু পাপাচারমূলক কাজ হতে বিরত থাকার মাধ্যমে প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে।
এই ইবাদতের জন্যই আল্লাহ জ্বিন ও ইনসানকে সৃষ্টি করেছেন [وَ ما خَلَقْتُ الْجِنَّ وَ الإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ] । নবী রাসূলগণের প্রেরণের উদ্দেশ্যও ছিল মানুষকে আল্লাহর ইবাদতের প্রতি আহ্বান জানানো [وَ لَقَدْ بَعَثْنا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ]। মানুষ যেভাবেই মূল্যায়ন করুক না কেন, বাস্তবতা হলো মানুষের জন্য ইবাদত তথা বন্দেগির মাকামই হচ্ছে সবচেয়ে উঁচু মাকাম। ইবাদতের মাধ্যমেই মানুষ আধ্যাত্মিকতার উচ্চতর মাকামে পৌঁছতে সক্ষম হয়। নবী-রাসূলগণ ও ওলি-আউলিয়াগণ সকলেই এই ইবাদত ও আনুগত্যের পথ ধরেই আধ্যাত্মিকতার শিখরে উপনীত হতে পেরেছেন। আর এ কারণেই নামাযের তাশাহুদে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে তাঁর রাসূল হওয়ার আগে তাঁর বান্দা হওয়ার সাক্ষ্য প্রদান করা ফরয করা হয়েছে [اشهد أن محمدا عبده و رسوله]।
ইবাদত মানুষকে আত্ম-সংশোধন ও আত্মিক পবিত্রতা দান করে, চিত্তে প্রশান্তি আনে, আল্লাহর নৈকট্যের মাকামে পৌঁছে দেয় এবং বান্দাকে সৃষ্টি জগতের ওপর কর্তৃত্ব শক্তির অধিকারী করে তোলে। তখন সে আল্লাহর অনুমতিক্রমে অলৌকিক কর্মকা- সম্পন্ন করতে পারে। এমর্মে একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) হতে বর্ণিত হয়েছে : [وَ مَا تَقَرَّبَ إِلَي عَبْدٌ بِشَيْءٍ أَحَبَّ إِلَي مِمَّا افْتَرَضْتُ عَلَيْهِ وَ إِنَّهُ لَيَتَقَرَّبُ إِلَي بِالنَّافِلَةِ حَتَّى أُحِبَّهُ فَإِذَا أَحْبَبْتُهُ كُنْتُ سَمْعَهُ الَّذِي يَسْمَعُ بِهِ وَ بَصَرَهُ الَّذِي يُبْصِرُ بِهِ وَ لِسَانَهُ الَّذِي يَنْطِقُ بِهِ وَ يَدَهُ الَّتِي يَبْطِشُ بِهَا إِنْ دَعَانِي أَجَبْتُهُ وَ إِنْ سَأَلَنِي أَعْطَيْتُهُ وَ مَا تَرَدَّدْتُ عَنْ شَيْءٍ أَنَا فَاعِلُهُ كَتَرَدُّدِي عَنْ مَوْتِ الْمُؤْمِنِ يَكْرَهُ الْمَوْتَ وَ أَكْرَهُ مَسَاءَتَهُ] ‘আমার নৈকট্যের সবচেয়ে উত্তম উসিলা হলো ফরযসমূহকে পালন করা। আর মুস্তাহাবসমূহ পালনের মাধ্যমে সে আমার মুহব্বত অভিমুখে অগ্রসর হতে পারে, যতক্ষণ না আমিও তাকে ভালোবাসি। অবশেষে আমি যখন তাকে ভালোবাসি, তখন আমিই হই তার কান যা দ্বারা সে শোনে, আমিই হই তার চোখ যা দ্বারা সে দেখে, আমিই হই তার জিহ্বা যা দ্বারা সে কথা বলে এবং আমিই হই তার হাত যা দ্বারা সে প্রহার করে। সে যখন আমার কাছে দোয়া প্রার্থনা করে, আমি তা মঞ্জুর করি এবং সে যখন আমার কাছে কিছু চায়, আমি তা প্রদান করি।’
ফাতিমা (সা. আ.) শ্রেষ্ঠ ইবাদতকারিণী
হযরত ফাতিমা সালামুল্লাহি আলাইহা সম্পর্কে মানুষ যত বেশি চিন্তা করবে এবং তাঁর জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে যত বেশি অনুধ্যান করবে, ততই সে বিস্ময়ের সম্মুখীন হবে। কীভাবে একজন নারী দুনিয়ায় মাত্র আঠারো বছর আয়ুষ্কালের মধ্যে এমন আধ্যাত্মিক পূর্ণতায় পৌঁছতে সক্ষম হন যে, তাঁকে সৃষ্টির মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসাবে পরিচয় দেওয়া হবে। হযরত ফাতিমা রাসূলের কন্যা হিসাবে নয়, বরং আল্লাহর জযবায় বিগলিত এবং তাঁর আনুগত্যে আত্ম-নিবেদিত হিসাবেই আধ্যাত্মিকতার পরম শীর্ষে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। ইমাম হাসান মুজতবা (আ.) বলেন, হযরত ফাতিমা সালামুল্লাহি আলাইহার চেয়ে অধিক ইবাদতকারী আর কেউ ছিল না। তিনি এত বেশি ইবাদতে দ-ায়মান হতেন যে তাঁর পদযুগলে কড়া পড়ে যেত। [বিহারুল আনওয়ার, খ. ৩, পৃ. ৬১] হাসান বসরী, যিনি একজন অধিক ইবাদতকারী এবং অতিশয় পরহেযগার মানুষ হিসাবে পরিচিত, তিনি হযরত ফাতিমা সম্পর্কে বলেন : নবীদুহিতা এত বেশি ইবাদতে মশগুল হতেন এবং নামাযের মেহরাবে দ-ায়মান হতেন যে, তাঁর পদযুগলে কড়া পড়ে গিয়েছিল।
হযরত ফাতিমার ভীত-বিহ্বল ও বিনয়ী চিত্ত
তাঁর নামায ও ইবাদতের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল আন্তরিক ভীতি ও বিনয়শীলতা। আবু মুহাম্মাদ দেইলামি ‘ইরশাদ-উল কুলুব’ গ্রন্থে এ সম্পর্কে বলেন : كانت فاطمة تنهج فى صلواتها من خوف الله ‘নামাযের হালে আল্লাহর ভয়ে ফাতিমার নিঃশ্বাস যেন গুণে গুণে নির্গত হতো।’ [ইরশাদ-উল কুলুব, খ. ১, পৃ. ১০৫] রেওয়ায়াতে এসেছে যে, আল্লাহ ফেরেশতাদের ডেকে বলেন : তাকিয়ে দেখ আমার কানিজ ফাতিমার দিকে, কীভাবে সে আমার সম্মুখে দ-ায়মান হয়েছে, আমার ভয়ে তার সর্বাঙ্গ কাঁপছে এবং নিজের অন্তরাত্মা দিয়ে আমার ইবাদতে মশগুল হয়েছে! [ফাতিমা মিনাল মাহদ-ই ইলাল লাহদ, পৃ. ১৭৩]
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, হযরত ফাতিমা ছিলেন চৌদ্দ মাসুমের মধ্যে একজন এবং পাঁচ পঞ্জতনের অন্যতম বাতি। ইবাদতের হালে তাঁর এ ভীতির কারণ অন্য কিছু ছিল না, কেবল মহান আল্লাহর প্রতি তাঁর পূর্ণ মারিফাত তথা বাতেনী জ্ঞান ও পরিচিতি ব্যতীত। আল্লাহর ওলি-আউলিয়াগণের ভীতি তখনই সৃষ্টি হয় যখন তাঁরা মাবুদের পরম সত্তার মহিমা, শান ও মহান অভিব্যক্তির সাক্ষাৎ পেয়ে যান। তখন তাঁরা এ ব্যাপারে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন, না জানি কোন পর্দা এসে তাঁর ও তাঁর প্রেমাস্পদের মাঝে অন্তরাল হয়ে দাঁড়ায়!
আর এ অবস্থা ঐ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ছাড়া সৃষ্টি হয় না যাঁরা মহামহিমের বিশালতা ও তাঁর নৈকট্যের অপার্থিব স্বাদ আস্বাদন করার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। একারণে মহান আল্লাহ বলেন :انما یخشی الله من عباده العلماء – আল্লাহর বান্দাদের মধ্য হতে কেবল জ্ঞানীরাই তাঁর ভয় করে। সুতরাং এখানে ‘ভয়’ কথাটি একটি বিশেষ অবস্থার সাথে সম্পৃক্ত। আর হযরত ফাতিমা সালামুল্লাহি আলাইহা ও অন্য মাসুম ইমামগণ (আ.) এর ভয় হলো সেই শ্রেণিভুক্ত।
নামাযের হালে হযরত ফাতিমার ভীতি ও বিনয়
মহান আল্লাহর সনে দ-ায়মান হওয়া ও নামায আদায় করার জন্য হযরত ফাতিমা সালামুল্লাহি আলাইহার একটি নির্দিষ্ট জায়গা ছিল। বিশেষ পরিচ্ছদে, বিশেষ জায়নামাযের ওপর বিশেষ আদবের সাথে এমনভাবে তিনি ইবাদতে মশগুল হতেন যে, তাঁর ঘরই তাঁর জন্য মসজিদে পরিণত হয়। ইবাদতের হালে তাঁকে এক নজর দেখার জন্য আকাশের ফেরেশতারা সেখানে ভীড় জমাতো। এ সময়ে তিনি এমনই বিনয়াবনত ও ভীত অবস্থায় থাকতেন যেন ঈমানের নির্যাস তাঁর অস্থিমজ্জায় ঢুকে গেছে।
স্বয়ং আল্লাহও আপন বান্দাদের কাছে এরূপ বিনয় ও ভয় চান। হযরত মূসা (আ.)-কে উদ্দেশ্য করে বলেন : ‘হে ইমরানের পুত্র! তোমার হৃদয় হতে আমাকে ভয় দাও। আর তোমার দেহ হতে আমাকে বিনয় দাও। আর তোমার চক্ষু হতে রাতের আঁধারে আমাকে অশ্রু দান করো। আর আমাকে ডাকো। নিশ্চয় তুমি আমাকে নিকটেই পাবে সাড়াদানকারী হিসাবে।’ [আমালি আস-সাদুক : ২১৫]
আল্লামা তাবাতাবাঈ (রহ.) বলেন : এ ভয় পরাভূত ব্যক্তিদের মধ্যে উৎপত্তি লাভ করা এক বিশেষ চিহ্ন, যখন সে এক অপরাজেয় দুর্দান্ত প্রতাপশালী সুলতানের বিপরীতে এমনভাবে উপস্থিত হয় যে, তার সমস্ত মনোযোগ ও ধ্যান-জ্ঞান তাঁর দিকেই নিবিষ্ট হয়। আর অন্য সবকিছু হতে তার মনোসংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। হযরত ফাতিমা সালামুল্লাহি আলাইহা ছিলেন তেমনই একজন। তিনি নামাযে দ-ায়মান হয়ে শুধু আল্লাহর ইবাদতের কথাই ভাবতেন। মাবুদ আল্লাহর প্রতি প্রেমভক্তি ও উপাসনা ব্যতীত অন্য কোন স্মৃতি বা চিন্তা তাঁর মনে উঁিক দিত না। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ভাষায়, তার অন্তর কেবল ইবাদতের জন্যই শূন্য ছিল। কেবল সে ছিল আর তাঁর মাবুদ। জীবন কিরূপ, কীভাবে নির্বাহ করতে হবে এসব চিন্তা থেকে সে ছিল পুরোপুরি মুক্ত। [দার মাকতাবে ফাতেমা, পৃ. ১৭০]
ইবাদতের আকুল আকাক্সক্ষা
হযরত ফাতিমা সালামুল্লাহি আলাইহা আল্লাহর বন্দেগিতে ডুবে থাকতেন। একদিন রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁকে বললেন : ‘কন্যা আমার! তুমি আল্লাহর নিকট হতে এমন কিছু চাও যা জিবরাইল আল্লাহর পক্ষ হতে প্রদান করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।’ হযরত ফাতিমা আরজ করলেন : ‘একমাত্র আল্লাহর বন্দেগি করার তৌফিক ছাড়া আমার আর কোন মনোস্কামনা নেই। আমার আকাক্সক্ষা শুধু এটুকু যেন আল্লাহর ‘ওয়াজ্হ’ তথা চেহারায় তাকাতে পারি এবং তাঁর সৌন্দর্য দর্শনে মুগ্ধ হতে পারি।’ [আল-কাফি, হাদিস নং ৫৩৬]
কেনই বা তিনি এরূপ ইবাদতপরায়ণ হবেন না, যখন তিনি লালিত পাালিত হয়েছেন এমন ব্যক্তির ক্রোড়ে যিনি বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদতকারী। যে নবী এত দীর্ঘক্ষণ ধরে নামাযে দ-ায়মান থাকতেন যে, স্বীয় প্রতিপালক তাঁকে বললেন হলেন : ‘ত্বা-হা, আমি আপনাকে কষ্টে নিপতিত করার জন্য এ কোরআন আপনার ওপর অবতীর্ণ করি নি।’ [ত্বা-হা : ১-২] হযরত ফাতিমাও ইবাদতের মর্যাদা ও মূল্যমানকে মহাপ্রতিপালকের প্রতি তাঁর সুগভীর মা’রিফাতপ্রসূত বলেই জানতেন। কাজেই এখানে আশ্চর্য ও বিস্ময়ের কোন অবকাশ নেই যে, কেন এ মহিয়ষী নারী ইবাদত হতে এত বেশি মাত্রায় মজা উপভোগ করতেন। আর কেনই বা তিনি মহান আল্লাহর খাতিরে দীর্ঘ ক্ষণ ধরে দ-ায়মান হয়ে নিজেকে কষ্টে নিক্ষেপ করতেন এবং বিনয় ও হীনতা প্রকাশ করতেন। একটিবারের জন্যও তিনি এ কিয়াম, রুকু ও সিজদার কঠিন সাধনা চালিয়ে যেতে অসন্তুষ্ট হননি।
উপসংহার
তাঁর ইবাদতের গুণ বন্দনার কথা রেওয়ায়াতে বর্ণিত হয়েছে। ‘ইলালুশ শারা’য়ি’ গ্রন্থে এসেছে : ‘তিনি যখন ইবাদতে দাঁড়াতেন, একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায় আসমানের বাসিন্দাদের জন্য আলো ছড়াতেন।’ [খ. ১, পৃ. ২১৫] নামাযের প্রতি এ তাঁর এ প্রবল আকর্ষণের কারণে এক পর্যায়ে হযরত জিরবাইল তাঁকে বিশেষ এক নামাযের তা’লিম দেন। ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেন : ‘আমার মা ফাতিমা সর্বদা জিবরাইল তাঁকে যে দু’রাকাত নামায শিখিয়ে দিয়েছিলেন, তা আদায় করতেন। প্রথম রাকাতে সূরা হাম্দের পরে একশ’ বার সূরা কাদ্র এবং দ্বিতীয় রাকাতে সূরা হাম্দের পরে একশ বার সূরা তাওহীদ পাঠ করতেন। অতঃপর সালাম ফিরিয়ে তাসবীহাতে যাহরা পাঠ করতেন।’
হযরত ফাতিমা ইবাদত-বন্দেগির পথে অনেক সৃজনশীলতারও স্বাক্ষর রেখে গেছেন। যেমন প্রথম দিকে তিনি একটি সুতায় ৩৪টি গিরা দিয়ে তা তাসবীহ হিসাবে ব্যবহার করতেন। কিন্তু হযরত হামযা সাইয়্যেদুশ শুহাদার শাহাদাত বরণের পর তাঁর কবর হতে সংগ্রহ করা মাটি হতে পুঁথি বানিয়ে সুতায় গেঁেথ সেটাকেই তাসবীহ হিসাবে ব্যবহার করা শুরু করেন। এরপর থেকে মানুষের মধ্যে তাসবীহ ব্যবহারের প্রচলন লাভ করে। [ওয়াসায়িলুশ শিয়া, খ. ১৪, পৃ. ১০৩৩]
সম্পাদকীয়
নওরোয- মানবমন ও প্রকৃতির জাগরণের উৎসব
ইরানী বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী বছরের প্রথম দিন পয়লা র্ফার্ভাদীন (খ্রিস্টীয় বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী ২১শে মার্চ)-যা একই সাথে প্রকৃতিতে নতুন প্রাণ সঞ্চারকারী বসন্তের প্রথম দিন-ঐতিহ্যিকভাবে নওরোয নামে পরিচিতি। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে ইরানী জনগণ ও মধ্য এশীয়ার দেশসমূহ সহ আরো কতক দেশের জনগণ অত্যন্ত ধুমধামের সাথে এদিনে উৎসব পালন করে আসছে। বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত বর্ণনা অনুযায়ী প্রাগৈতিহাসিক কালে এ দিনে জনগণের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তৎকালীন পারস্যে (বর্তমানে যা ইরান) একজন স্বৈারাচারী যালেম বাদশাহকে উৎখাত করে সুবিচারের শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল এবং এ উপলক্ষেই নওরোয উৎসব প্রবর্তিত হয়।
নওরোযের উৎসব ইরানী জনগণের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। সাসানী রাজবংশের শাসনামলে (২৬২ থেকে ৬৫২ খ্রিস্টাব্দ) নওরোয উৎসব প্রচলিত ছিল বলে বহু তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাখ্তে জামশীদে প্রাপ্ত একটি শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, হাখামানেশীদের পূর্ববর্তী মদ্ রাজবংশের শাসনামলে নওরোযের উৎসব পালিত হতো। হাজার হাজার বছর আগেই এ উৎসব ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করে এবং ইরান ছাড়াও তুরস্কে, ইরাকে, আযারবাইজানে, মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে ও ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন অংশে এ উৎসব পালন করা হচ্ছে।
প্রাচীন ইরানের র্ফাস এলাকায় যরথুস্ত্রীরা নববর্ষের সূচনায় বিভিন্ন প্রতীকী বস্তু দ্বারা সাতটি ট্রে পূর্ণ করে সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে উৎসর্গ করত। এই সাতটি ট্রে ছিল সততা, ন্যায়পরায়ণতা, ঈমান, সুদপদেশ, সৎকর্ম, সৌভাগ্য এবং ক্ষমা ও অমরত্বের প্রতীক। ইরানে ইসলামের বিস্তার লাভের পরে ইরানের মুসলমানদের মধ্যেও সংশোধিত রূপে এ উৎসব অব্যাহত থাকে এবং পরবর্তীকালে ইরানী বর্ষপঞ্জির পূর্ববর্তী বর্ষগণনাকে সংশোধন করে এটিকে হিজরি সৌর বর্ষপঞ্জিতে পরিণত করা হয়। এছাড়া অনেক মুসলিম কবিই নওরোয ও প্রাকৃতির নব জীবন লাভ নিয়ে কবিতা লিখেছেন।
ইরানী জনগণ নওরোযের সূচনায় কুরআন তেলাওয়াত করে ও বর্ষবরণের বিশেষ দো‘আ পাঠ সহ দু’হাত তুলে মহান আল্লাহ্র কাছে নিজেদের, জাতির ও মুসলিম উম্মাহ্র জন্য একটি সুন্দর এবং সুস্থতা ও সমৃদ্ধিপূর্ণ নতুন বছর কামনা করে। এভাবে নওরোয উৎসব ইরানী সমাজের জন্য নৈতিক ও সামগ্রিক শিক্ষার সহায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন করছে।
শুভ বাংলা নববর্ষ
পয়লা বৈশাখ (মোতাবেক ১৪ই এপ্রিল) বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম দিনÑ বাংলা নববর্ষ। বাংলা বর্ষপঞ্জি ইরানী বর্ষপঞ্জির ন্যায় একটি হিজরি সৌর বর্ষপঞ্জি।
বিশেষ করে কৃষিনির্ভর বাংলা ভূখ-ে পূর্বে প্রচলিত চান্দ্র হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী খাজনা আদায়ের সমস্যা এড়ানোর উদ্দেশ্যে মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলে হিজরি সৌর বর্ষ হিসেবে বাংলা সনের প্রবর্তন করা হয়। জ্যোতির্বিদ আমীর ফতেহ্ উল্লাহ সিরাজী চান্দ্র মাসনির্ভর হিজরি বর্ষপঞ্জি এবং সৌর বর্ষপঞ্জির মধ্যে সমন্বয় সাধন করে ১১ই মার্চ ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে একটি নতুন সৌর বর্ষপঞ্জি প্রস্তাব করলে মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনক্ষমতায় আরোহণের বছর ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দকে ভিত্তি বছর হিসেবে ধরে এ নতুন বর্ষপঞ্জি প্রবর্তন করা হয়।
ফসল তোলা সমাপ্ত হওয়ার পর পরই নতুন বছরের শুরু হিসেবে এক সময় বাংলা সনকে ফসলী সনও বলা হতো। খাজনা আদায় ছাড়াও এ সময় ব্যবসায়ীরা তাদের গ্রাহকদের কাছ থেকে বকেয়া পাওনা আদায় করতো এবং উৎসবের মধ্য দিয়ে নতুন বছর শুরু করতো। এভাবে বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম দিন- বাংলা নববর্ষ একটি উৎসবের দিনে পরিণত হয় এবং সেই শুরু থেকেই এ দিনটি উৎসব হিসেবে পালন করা হয়ে আসছে। বিশেষ করে জীর্ণ আর পুরনোকে বিদায় দিয়ে সুখ-সমৃদ্ধিতে ভরপুর আগামীর প্রত্যাশা সহ নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয় বিধায় পয়লা বৈশাখ বাংলাদেশী সহ বাংলাভাষী সকল জনগণের কাছে ভিন্ন একটি তাৎপর্য বহন করে।
ইরানী বর্ষপঞ্জির নওরোয ও বাংলা বর্ষপঞ্জির নববর্ষ উপলক্ষে আমরা নিউজলেটারের পাঠক-পাঠিকাগণ সহ সবাইকে জানাচ্ছি আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
এছাড়া ২৬শে মার্চ বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আমরা বাংলাদেশের গণমানুষের কল্যাণ, সমৃদ্ধি ও সুস্বাস্থ্য কামনা করছি।
তেমনি বারোই র্ফাভারদীন্ মোতাবেক পয়লা এপ্রিল ইসলামী প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে আমরা নিউজলেটারের পাঠক-পাঠিকাগণ, বাংলাদেশের জনগণ ও ইরানী জনগণকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি।
স্মরণীয় বাণী
মহানবী (সা.) বলেন : দু’টি কাজের চেয়ে উত্তম কোনো পুণ্যের কাজ নেই : আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস এবং আল্লাহ্র বান্দাদের উপকার করা। আর দু’টি কাজের চেয়ে জঘন্য কোনো কাজ নেই : আল্লাহ্র প্রতি র্শিক করা আর আল্লাহ্র বান্দাদের ক্ষতি করা।
মহানবী (সা.) বলেন : জ্ঞান হলো গুপ্ত ভা-ারতুল্য। আর তার চাবিকাঠি হলো প্রশ্ন। অতএব, প্রশ্ন কর, আল্লাহ্ তোমাদের অনুগ্রহ করবেন। কারণ, চার ব্যক্তির জন্য পুরস্কার ও পারিশ্রমিক রয়েছে : প্রশ্নকারী, বক্তা, শ্রোতা আর তাদের ভক্তিকারী।
মহানবী (সা.) ইমাম আলী (আ.)-কে উপদেশ দেন : হে আলী! স্বীয় পরিবার, প্রতিবেশী এবং যাদের সাথে ওঠাবসা ও কথাবার্তা বল তাদের সাথে সদাচরণ করবে যাতে আল্লাহ্র নিকটে সেগুলো সঞ্চিত দেখতে পাও।
মহানবী (সা.) বলেন : যে ব্যক্তি নিজেকে নিঃস্ব হিসাবে প্রকাশ করে সে অভাবগ্রস্ত হয়।
ইমাম আলী (আ.) বলেন : যে ন্যায়পরায়ণতাকে এড়িয়ে চলে সে স্বেচ্ছাচারিতা করে। অল্প তুষ্টি মানুষের জন্য কতই না চমৎকার গুণ! আর মানুষের সঙ্গে থাকা নিকৃষ্টতম জিনিস হলো হিংসা। আর নিরাশ হওয়া দূষণীয় কাজ। কৃপণতা ভর্ৎসনা আনে।
ইমাম আলী (আ.) বলেন : যে ব্যক্তি সংযমী হয়ে চলে সে নিরাপদ থাকে। আর যে ব্যক্তি সত্যকে অতিক্রম করে সে সংকীর্ণতার মধ্যে নিপতিত হয়। আর যে নিজের অংশ রক্ষা করে সে অধিক স্থায়ী হয়।
ইমাম আলী (আ.) বলেন : তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি জানতে চায় আল্লাহ্র কাছে তার মর্যাদা কেমন, সে লক্ষ্য করবে পাপসমূহের বিপরীতে তার অবস্থা কেমন।
ইমাম আলী (আ.) বলেন : সৌভাগ্যবান সেই ব্যক্তি যে অন্যের থেকে উপদেশ গ্রহণ করে এবং উপদেশ মেনে নেয়। নিজেকে সৎ চরিত্র দ্বারা গড়ে তোল। কারণ, সৎ চরিত্রের বান্দা রোযাদার এবং রাত্রি জাগরণকারীর মর্যাদা লাভ করে।
ইমাম হাসান (আ.) বলেন : হে আল্লাহ্্র বান্দারা! আল্লাহ্্কে ভয় করে চল। আর জেনে রাখ, যে আল্লাহ্্কে ভয় করে চলে তিনি তাকে ফেতনা ও পরীক্ষা থেকে উত্তমরূপে উত্তীর্ণ করেন এবং তাকে কাজে সফল করেন। আর সত্যের পথকে তার জন্য মসৃণ করেন এবং তার হুজ্জাত (প্রমাণ)-কে জয়ী করেন এবং তার মুখম-ল শুভ্র করেন এবং তার মনের চাওয়া পূরণ করেন, আর সে ‘নবীগণ, সত্যবাদিগণ, শহীদগণ এবং সৎকর্মপরায়ণদের মধ্য থেকে যাদেরকে আল্লাহ্্ নেয়ামত দান করেছেন তাদের সাথে থাকবে। আর বন্ধু হিসাবে তাঁরা কতই না উত্তম!’ (সূরা নিসা : ৬৯)
ইমাম হোসাইন (আ.) জনৈক আনসারকে বলেন : … এই তিনজনের একজন ব্যতীত কারো কাছে প্রয়োজনের কথা বল না : দীনদার লোক অথবা ব্যক্তিত্ববান অথবা বংশ-পরিচয়সম্পন্ন। কেননা, দীনদার লোক নিজের দীন রক্ষার্থে তোমার প্রয়োজন পূরণ করবে। আর ব্যক্তিত্ববান তার পৌরুষ ও ব্যক্তিত্বের কারণে লজ্জা করে। আর বংশ-পরিচয়সম্পন্ন ব্যক্তি জানে যে, তুমি স্বীয় সম্মান রক্ষায় তার শরণাপন্ন হয়েছ। তাই সে তোমার প্রয়োজন পূরণ করে তোমার সম্মান রক্ষা করবে।
ইমাম আলী ইবনুল হোসাইন (আ.) বলেন : …আল্লাহ্্র কসম! যে জনপদই আল্লাহ্্র অবাধ্যতার পথে চলেছে, তা আযাবের দিকে অগ্রসর হয়েছে। আর যে জনপদই দুনিয়াকে পরকালের ওপর প্রাধান্য দিয়েছে তা-ই শোচনীয় পরিণতি এবং খারাপ ফল পেয়েছে। আল্লাহ্্ সম্পর্কে জ্ঞান এবং তাঁর প্রতি বিশ্বাস হলো আনুগত্যের জমজ ভাইয়ের মতো। যে ব্যক্তি আল্লাহ্্কে চিনবে সে তাঁর ভয় করবে। কাজেই ভয় তাকে কাজে প্রবৃত্ত করবে। নিশ্চয় আল্লাহ্্র আরেফগণ এবং তাঁদের অনুসারীরা হলো তারাই, যারা আল্লাহ্্কে চিনেছে এবং তাঁর জন্যই কাজ করেছে এবং তাঁর অভিমুখী হয়েছে। আর আল্লাহ্্ও বলেছেন : ‘নিশ্চয় জ্ঞানীরাই আল্লাহ্্কে ভয় করে।’ (সূরা ফাতির : ২৮)
ইমাম বাকের (আ.) বলেন : ন্যায়ের পক্ষে উত্থান কর এবং যাতে তোমার কোনো উপকারে নেই তা থেকে দূরে থাক। আর তোমার শত্রু থেকে দূরে থাক এবং তোমার বন্ধু যে সম্প্রদায় থেকেই হোক, তার থেকে সতর্ক থাক শুধু এমন বিশ্বস্ত ব্যক্তি ছাড়া যে আল্লাহ্্র ভয় করে। ব্যভিচারীর সাথে ওঠাবসা করবে না এবং তাকে তোমার গোপন কথা অবগত করবে না। আর তাদের সাথেই পরামর্শ করবে যারা আল্লাহ্্র ভয় করে।
ইমাম বাকের (আ.) বলেন : যদি সদাচার করতে না পার তবে কারো সাথে লেনদেন কর না। এটাই তোমার জন্য উত্তম।
ইমাম বাকের (আ.) বলেন : ইমাম (আ.) বলেন : যুলুম তিন রকম। এক রকম যুলুম রয়েছে যা আল্লাহ্্ ক্ষমা করেন না। আরেক রকম যুলুম রয়েছে যা আল্লাহ্্ ক্ষমা করেন। আর অপর এক ধরনের যুলুম রয়েছে যা আল্লাহ্্ ছেড়ে দেন না। যে যুলুম আল্লাহ্্ ক্ষমা করেন না সেটা হলো আল্লাহ্্র প্রতি র্শিক। আর যে যুলুম আল্লাহ্্ ক্ষমা করে দেন তা হলো ব্যক্তির নিজের প্রতি যুলুম যা তার ও আল্লাহ্্র মাঝের ব্যাপার। আর যে যুলুমকে আল্লাহ্্ ছেড়ে দেন না তা হলো সেই ঋণ যা বান্দারা পরস্পরের প্রতি দায়বদ্ধ থাকে।
(তুহাফুল উকূল থেকে সংকলিত)
অনুবাদ : আব্দুল কুদ্দুস বাদশা
সংবাদ বিচিত্রা (বিদেশী সংবাদ)
নতুন বছরে আরো ভালো অর্থনীতি উপহারের ঘোষণা দিলেন রুহানি
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি নতুন ফারসি বছরে আরো ভালো অর্থনীতি উপহার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি চলতি নতুন বছরে দেশে টেকসই উন্নয়ন, নতুন চাকরির ক্ষেত্র সৃষ্টি এবং তেলবহির্ভূত খাত থেকে রপ্তানি আয় বাড়ানোর অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
২১ মার্চ ফারসি নতুন বছর শুরুর দিন সকালে জাতির উদ্দেশে দেয়া এক বাণীতে প্রেসিডেন্ট রুহানি এ কথা বলেন। প্রতিরোধমূলক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকারকে সহযোগিতা করার জন্য তিনি জনগণের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, জনগণের সমর্থন ছাড়া মুদ্রাস্ফীতি, অর্থনৈতিক মন্দা ও তেলের ওপর নির্ভরতা কমানো সম্ভব হতো না।
ড. রুহানি তাঁর বাণীতে ইরান ও ছয় জাতিগোষ্ঠীর মধ্যকার পরমাণু আলোচনা নিয়েও কথা বলেন। তিনি বলেন, জনগণের সহযোগিতায় প্রতিরোধমূলক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার ফলে বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে আলোচনায় বিজয় অর্জনের পথ খুলে গেছে। তিনি আরও বলেন, ছয় জাতিগোষ্ঠীসহ বড় বড় দেশ বুঝতে সক্ষম হয়েছে যে, ইরানের ওপর আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা ও হুমকি ব্যর্থ হয়েছে।
প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক জোরদার করার কথা উল্লেখ করে ইরানের প্রেসিডেন্ট বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে তেহরানের সমর্থন অব্যাহত থাকবে। মধ্যপ্রাচ্য ও সারা বিশ্ব থেকে সন্ত্রাসবাদ এবং চরমপন্থা নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত ইরান এ সমর্থন অব্যাহত রাখবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
উল্লেখ্য, গত বছরে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী প্রতিরোধমূলক অর্থনীতি বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছিলেন। সে নীতির আওতায় ইরান জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলা ও অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ানো এবং আমদানি নির্ভরতা কমানোর কর্মসূচি হাতে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
‘ইরানের জাতীয় ও বৈশ্বিক লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নযোগ্য’
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী ইসলামী এই দেশটির সার্বিক উন্নয়ন জোরদারের লক্ষ্যে সরকার ও জনগণের পারস্পরিক সহযোগিতার ওপর জোর দিয়েছেন। গত ২১ মার্চ নওরোজ বা ফারসি নতুন বছর (১৩৯৪) শুরু হওয়া উপলক্ষে দেয়া এক বাণীতে তিনি সরকার ও জনগণের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার পাশাপাশি আন্তরিকতা, সহমর্মিতা ও পারস্পরিক আস্থা জোরদারের ওপরও গুরুত্ব দেন। তিনি নতুন এই বছরের জন্য ‘সরকার ও জাতি, সহমর্মিতা ও একই সুর’- শীর্ষক সেøাগান নির্ধারণ করেন।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেন, যদি (সরকার ও জনগণ) উভয় পক্ষই পরস্পরকে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করে তাহলে আমাদের তথা সরকার ও জনগণের আশাগুলো অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে। তিনি বলেন, তাদের পারস্পরিক আন্তরিকতা, সহমর্মিতা ও সহযোগিতাগুলো যতই বাড়বে ততই কাজের অগ্রগতিও বাড়বে।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা এ প্রসঙ্গে আরো বলেন, সরকারকে অবশ্যই জাতির সেবক হতে হবে এবং জনগণই সরকারকে নিয়োগ দিয়েছে। তাই সরকারের উচিত প্রকৃত অর্থেই জাতির মূল্যবোধ, গুরুত্ব ও ক্ষমতাগুলোকে স্বীকৃতি দেয়া এবং জনগণেরও উচিত প্রকৃত অর্থেই সরকারের ওপর আস্থা রাখা।
আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রিয় কন্যা হযরত ফাতেমা যাহরা (সালামুল্লাহি আলাইহা)-এর শাহাদাত (৩ জমাদিউস সানি, ২৪ মার্চ) বার্ষিকী উপলক্ষে শোক প্রকাশ করে বলেন, এই মহীয়সী নারীর উসিলায় নতুন বছরটি সবার জন্য অফুরন্ত বরকত বা প্রাচুর্য বয়ে আনবে এবং তাঁর (পুণ্য) স্মৃতি চলতি বছর আমাদের জনগণের জীবনে গভীর ও স্থায়ী প্রভাব রাখবে বলে আশা করছি।
তিনি নতুন ফারসি বছরে অর্থনৈতিক অগ্রগতি, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শক্তিমত্তা ও সম্মান, জ্ঞান-বিজ্ঞানে প্রকৃত অর্থেই বড় ধরনের অগ্রযাত্রা, বিচার ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার এবং সর্বোপরি ঈমান ও আধ্যাত্মিক উন্নয়নকে জনগণের কয়েকটি বড় ও বাস্তবায়নযোগ্য স্বপ্ন হিসেবে অভিহিত করেন।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বিগত বছরে ইসলামী বিপ্লবের বিজয় বার্ষিকীর শোভাযাত্রাসহ বিশ্ব কুদ্স দিবসের মিছিলে এবং হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের চল্লিশার শোক-মিছিলে ব্যাপক হারে অংশ নেয়ার জন্য জনগণের প্রশংসা করে বলেছেন, এতে ইরানী জাতির দৃঢ় প্রত্যয় ফুটে উঠেছে।
ফ্রান্সের পেজো গাড়ি কোম্পানি ইরানে কাজ শুরু করতে রাজি; চুক্তি সই
ফ্রান্সের বিখ্যাত গাড়ি কোম্পানি পিএসএ পেজো-সিতরোন ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে আবার কাজ শুরু করতে রাজি হয়েছে। এই লক্ষ্যে ইরানের গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ‘ইরান খোদরো’র সঙ্গে একটি চুক্তি করেছে পেজো।
চুক্তির আওতায় ফরাসি কোম্পানি ইরানে একটি যৌথ কারখানা প্রতিষ্ঠা করবে যেখানে তাদের থাকবে শতকরা ৫০ ভাগ বিনিয়োগ আর ইরান খোদরোর থাকবে বাকি ৫০ ভাগ পুঁজি।
ইরানের মেহের নিউজের বরাত দিয়ে প্রেস টিভি জানায়, যৌথ কারখানায় উৎপাদিত গাড়ির শতকরা ৩০ ভাগ বিদেশে রপ্তানি করা হবে। আর এরপর থেকে ইরান খোদরো কোনো গাড়ি দেশে অ্যাসেম্বল করবে না।
উল্লেখ্য, ২০১১ সালে আমেরিকা ও ইউরোপ ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পর চীনা গাড়ি কোম্পানি ইরানের বাজারে প্রবেশ করে। সেই থেকে চীন মাঝারি ও ভারী ধরনের ট্রাক এবং যাত্রীবাহী গাড়ি সরবরাহ করে আসছে।
হামাসের বিরুদ্ধে দেয়া মিশরের আদালতের রায়ের কঠোর প্রতিবাদ জানালো ইরান
মিশরের একটি আদালত অধিকৃত গাজা উপত্যকা নিয়ন্ত্রণকারী ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসকে ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠী’ হিসেবে অভিহিত করায় ইরান কঠোর ভাষায় তার প্রতিবাদ জানিয়েছে।
কায়রোর আদালতের এ রায়কে নিন্দা জানিয়ে ইরানের আরব এবং আফ্রিকা বিষয়ক উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ান গত ১ মার্চ বলেন, হামাস কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী নয়।
তিনি ইহুদিবাদী ইসরাইলকে অবৈধ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, হামাস এবং আরেকটি ফিলিস্তিন প্রতিরোধ আন্দোলন ইসলামি জিহাদ’ এর মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়েছে তেল আবিব।
এ ছাড়া, মিশরের ইখওয়ানুল মুসলেমিন সম্পর্কে ইরানের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন তিনি। তিনি বলেন, মিশরের বিরাজমান বাস্তবতার অংশই হলো ইখওয়ানুল মুসলেমিন। মিশর সরকারের রাজনৈতিক বিরোধী দল এবং সন্ত্রাসীদের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোনো পক্ষ সন্ত্রাসের আশ্রয় নিলে সমগ্র বিশ্ব তার নিন্দা জানাবে।
এ ছাড়া, একই সঙ্গে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ইরানের অবস্থানও পরিষ্কার ভাবে তুলে ধরেন আবদুল্লাহিয়ান। তিনি বলেন, মিশর, ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন, আফ্রিকা এবং এশিয়াসহ সব জায়গার সব ধরনের সন্ত্রাসবাদকে কঠোর ভাবে নিন্দা করে ইরান।
এদিকে হামাসের মুখপাত্র সামি আবু জুহরি এরই মধ্যে মিশরের আদালতের রায় প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, এটি একটি ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত যা কেবল দখলদার ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষা করবে।
রাশিয়ায় ক্যান্সারের ওষুধ রফতানি করবে ইরান
ইরান এই প্রথমবারের মতো ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ রাশিয়ায় রফতানি করবে। চলতি বছরের চতুর্থ ত্রৈমাসিকে উচ্চ মূল্যমানের এসব ওষুধ রফতানি করা হবে। ইরানের শীর্ষস্থানীয় ওষুধ নির্মাণকারী কোম্পানি তৌফিক দারু’র বাণিজ্যিক বিভাগের প্রধান রুহুল্লাহ হায়দারি গত ১৫ মার্চ এ কথা জানান।
তিনি বলেন, রাশিয়ায় যেসব ওষুধ রফতানির পরিকল্পনা করা হয়েছে তার মধ্যে মাল্টিপল স্কেলেরোসিস বা এমএস এবং নানা ধরনের ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ রয়েছে। লাতিন আমেরিকা, তুরস্ক ও পাকিস্তানের বাজারেও এ জাতীয় ওষুধ রফতানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইরান। বর্তমানে ইরান বছরে ২২ কোটি ডলারের সমপরিমাণ ওষুধ রফতানি করছে।
এক বছরে ১০০ কোটি ঘন মিটার প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানি করেছে ইরান
ইরানের ন্যাশনাল ইরানিয়ান গ্যাস কোম্পানি বা এনআইজিসি’র প্রধান হামিদ রেযা আরাকি বলেছেন, গত ফারসি বছরে আগের বছরের তুলনায় ইরানের গ্যাস রপ্তানির পরিমাণ আট শতাংশ বেড়েছে। তিনি গত ১০ এপ্রিল সাংবাদিকদের বলেন, গত বছরে ইরান ১০০ কোটি ঘন মিটার প্রাকৃতিক গ্যাস রফতানি করেছে। উল্লেখ্য, মার্চ মাসের ২০ তারিখে গত ফারসি বছর শেষ হয়েছে।
বর্তমানে তুরস্ক ও আর্মেনিয়ার কাছে গ্যাস রপ্তানি করছে ইরান এবং ইরাকের কাছে গ্যাস রপ্তানি চলতি বছর শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। ২০১১ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে ইরানী গ্যাস আমদানি শুরু করেছে তুরস্ক।
ইরানে যথাযোগ্য মর্যাদায় ইসলামী প্রজাতন্ত্র দিবস পালন
গত ১ এপ্রিল ইরানে যথাযোগ্য মর্যাদায় ৩৬তম ইসলামী প্রজাতন্ত্র দিবস পালন করা হয়। ১৯৭৯ সালে হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের মাত্র দুই মাস পর গণভোটের মাধ্যমে ইরানের জনগণ ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। জনগণ ইসলামী প্রজাতন্ত্র চায় কিনা জানতে চেয়ে এই গণভোটের আয়োজন করা হয়। এতে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের পক্ষে ৯৮ দশমিক ২ শতাংশ ভোট পড়েছিল। ৩৬ বছর পরও ইসলামী প্রজাতন্ত্রের প্রতি ইরানী জনগণের সেই আনুগত্য অব্যাহত রয়েছে।
ইয়েমেন সংকট নিরসনে ইরানের ৪ দফা শান্তি পরিকল্পনা
গত ১৪ এপ্রিল স্পেন সফরের সময় ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাওয়াদ জারিফ ইয়েমেন সংকট নিরসনে তেহরানের চার দফা শান্তি পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন।
এই পরিকল্পনা উপস্থাপনের সময় তিনি বলেন, বিদেশি হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকে ইয়েমেনের জনগণকে তাদের ভাগ্য নির্ধারণের সুযোগ দিতে হবে।
অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি কার্যকরী করা, ইয়েমেনের যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের জন্য ত্রাণ সামগ্রী প্রেরণ, আন্ত-ইয়েমেনি সংলাপ শুরু করা এবং ব্যাপকভিত্তিক জাতীয় সরকার গঠনের কথা প্রস্তাবিত শান্তি পরিকল্পনায় বলা হয়েছে।
ইরানের শীর্ষ কূটনীতিবিদ আবারো ইয়েমেনের বিরুদ্ধে সামরিক আগ্রাসন বন্ধে আলে সৌদ কর্তৃপক্ষের কাছে আহ্বান জানিয়ে বলেন, আরব উপদ্বীপের এ দেশটির বিরুদ্ধে ভয়াবহ হামলা সেখানে চলমান সংঘর্ষের কোনো জবাব এনে দেবে না।
আমেরিকাকে হারিয়ে কুস্তিতে চ্যাম্পিয়ন হলো ইরান
লস অ্যাঞ্জেলেসে বিশ্ব কুস্তি প্রতিযোগিতায় স্বাগতিক আমেরিকাকে পরাজিত করে টানা চতুর্থবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ইরান। গত ১৩ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ফাইনাল রাউন্ডে আমেরিকার কুস্তি দলকে ৫-৩ পয়েন্টে পরাজিত করে এ গৌরব অর্জন করে ইরান। আগের কয়েকটি রাউন্ডে বেলারুশিয়াকে ৮-০ পয়েন্টে, তুরস্ককে ৭-১ পয়েন্টে এবং আযারবাইজানকে ৭-১ পয়েন্টে পরাজিত করে ইরানী কুস্তি দল। বিশ্ব কুস্তি প্রতিযোগিতায় এ নিয়ে ছয় বার চ্যাম্পিয়ন হলো ইরান।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী এক বার্তায় দেশের কুস্তিগীর ও কুস্তি-প্রশিক্ষকদের শুভেচ্ছা জানান। তিনি শুভেচ্ছা বার্তায় বলেন, ইরানের সন্তানেরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আবারও জাতির জন্য সম্মান বয়ে এনেছে। এজন্য আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করছি।
আইআরজিসি দক্ষিণ- পূর্ব ইরানের সন্ত্রাসী চক্রকে নির্মূল করেছে
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিপ্লবী রক্ষী বাহিনী (আইআরজিসি) দক্ষিণ- পূর্ব ইরানে তৎপরতা পরিচালনাকারী একটি সন্ত্রাসী চক্রকে পুরোপুরি নির্মূল করে দিয়েছে। আইআরজিসি-র কুদ্স্ সদর দফতরের জনসংযোগ বিভাগ থেকে প্রচারিত সংবাদ অনুযায়ী এ সন্ত্রাসী চক্রটি একটি বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার দ্বারা গড়ে তোলা হয়েছিল।
আইআরজিসি-র জনসংযোগ বিভাগ থেকে প্রচারিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দক্ষিণ-পূর্ব ইরানের নিক্শাহ্র্ এলাকায় তৎপরতা পরিচালনাকারী এ সন্ত্রাসী চক্রটির নাম ক্বাস্রে ক্বান্দ্ (মিছরির প্রাসাদ); আইআরজিসি এ চক্রটির সদস্যদেরকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছে।
আইআরজিসি-র সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরো জানানো হয় যে, আইআরজিসি এ অভিযানে সন্ত্রাসী চক্রটিকে ধ্বংস করা ছাড়াও তাদের কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে অস্ত্র, গোলা-বারুদ, যুদ্ধে ব্যবহারোপযোগী যানবাহন এবং যোগাযোগ কার্যে ব্যবহার্য যন্ত্রপাতি ও উপকরণ উদ্ধার করেছে।
(৩) রাহ্বার কর্তৃক কয়েদীদের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন (মেহের ৫)
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ দ্বীনী ও রাজনৈতিক নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ্ ‘উয্মা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী সংবিধান প্রদত্ত ক্ষমতাবলে কয়েকশ’ দ-প্রাপ্ত কয়েদির দ- ক্ষমা বা হ্রাস করেছেন। ইসলামী প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে এ উপলক্ষে গত ৩১শে মার্চ (২০১৫) তিনি এ ক্ষমা ঘোষণা করেন।
উল্লেখ্য, ইরানী বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী ১২ই র্ফার্ভাদীন্ (পয়লা এপ্রিল) ইরানের ইসলামী প্রজাতন্ত্র দিবস। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ উৎসবের মধ্য দিয়ে ইরানের ইসলামী প্রজাতন্ত্র দিবস উদ্যাপিত হয়। এ উপলক্ষে রাহ্বার আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী ৮০৯ জন দ-প্রাপ্ত কয়েদির অবশিষ্ট শাস্তি মওকূফ করে দেন বা শাস্তির মেয়াদ হ্রাস করে দেন। এ সব কয়েদি ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিভিন্ন সাধারণ, বিপ্লবী ও সামরিক আদালত কর্তৃক দ-প্রাপ্ত হয়েছিল। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিচার বিভাগের প্রধান হযরত আয়াতুল্লাহ্ সাদেক অমোলীর সুপারিশক্রমে শাস্তি ভোগ কালে উত্তম ও সুশৃঙ্খল আচরণ ও নৈতিক মানোন্নয়নের পরিচয় প্রদানকারী এ সব কয়েদির শাস্তি মওকূফ বা হ্রাস করা হয়।
উল্লেখ্য, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধানের ১১ নং অধ্যায়ের ১১০ নং ধারায় রাহ্বারকে যথোপযুক্ত কয়েদিদের শাস্তির মেয়াদ মওকূফ বা হ্রাস করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তবে শাস্তি মওকূফ ও হ্রাসের এ ধারা সব ধরনের অপরাধীদের জন্য প্রযোজ্য নয়। যে সব ধরনের অপরাধীদের জন্য এ ধারা প্রযোজ্য নয় তাদের মধ্যে রয়েছে বিশেষভাবে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংঘাতে লিপ্ত হবার অপরাধে শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা এবং সশস্ত্র ও সংঘবদ্ধ মাদক দ্রব্য চোরাচালান, ধর্ষণ, সশস্ত্র ডাকাতি, সশস্ত্র চোরাচালান, গুম করণ, উৎকোচ প্রদান ও গ্রহণ বা অগ্নি সংযোগের অপরাধে শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা।
(৬) সরকার রাহ্বারের কাছে কৃতজ্ঞ : প্রেসিডেন্ট রুহানি (মেহের ৭)
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি রাহ্বার হযরত আয়াতুল্লাহ্ ‘উয্মা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী বরাবরে লিখিত এক পত্রে সরকারকে তার কর্মকা-ে এককভাবে সহায়তা ও সমর্থন প্রদানের জন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। এছাড়া প্রেসিডেন্ট রুহানি রাহ্বারের নির্দেশ ও পথনির্দেশনাসমূহ পুরোপুরি ও যথাযথভাবে মেনে চলার জন্য প্রজাতন্ত্রের সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
রাহ্বার যে সরকারের প্রতি পরিপূর্ণ মনোযোগ সহকারে দৃষ্টি রাখেন এবং সরকারকে পূর্ণাঙ্গ সহায়তা ও সমর্থন প্রদান করেন সে জন্য তিনি আনন্দ প্রকাশ করেন এবং প্রজাতন্ত্রের সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ দেশের সকল জনগণের প্রতি রাহ্বারের উপদেশ মেনে চলার জন্য আহ্বান জানিয়ে এ মর্মে আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, জনগণ যে মধ্যমপন্থী সরকারকে নির্বাচিত করেছেন সকল ক্ষেত্রের কর্মকা-ে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সে সরকারকে সহায়তা করে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে নিশ্চিত করবেন।
প্রেসিডেন্ট রুহানি আরো বলেন, সরকার জনগণের খেদমত করাকে স্বীয় প্রাথমিক দায়িত্ব বলে মনে করে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট জোর দিয়ে বলেন, সরকার সব সময়ই সমালোচনাকে স্বাগত জানায় এবং দেশ শাসনের ক্ষেত্রে সকল বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির কাছ থেকে সাহায্য ও পরামর্শ চায়। তিনি জোর দিয়ে বলেন, এতে সন্দেহের অবকাশ নেই যে, চূড়ান্ত লক্ষ্যসমূহ অর্জন করতে হলে সরকারের সকল সংস্থাকে যথোপযুক্ত হতে হবে এবং জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় করার লক্ষ্যকে সামনে রেখে কাজ করে যেতে হবে।
রাহ্বার হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী জাতীয় অর্থনীতিকে সুসংহতকরণ এবং মানব সম্পদ ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ ও সম্ভাবনার পরিপূর্ণ ব্যবহারের ভিত্তিতে পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধনের জন্য যে পরামর্শ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট রুহানি তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, অর্থনৈতিক কর্মতৎপরতার ক্ষেত্রে আরো বেশি প্রচেষ্টা চালানো ও আস্থা সৃষ্টির ক্ষেত্রে সরকারের প্রতি রাহ্বারের সমর্থন ও সহায়তা একটি মূল্যবান সম্পদস্বরূপ এবং তা সরকারকে কর্ম পরিবেশের উন্নয়ন, উৎপাদন ইউনিটগুলোকে ও বিজ্ঞানভিত্তিক ফার্মগুলোকে সহায়তা প্রদান এবং সেই সাথে দুর্নীতি ও চোরাচালান দমনে প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে সরকারকে উৎসাহিত করছে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প সংক্রান্ত আলোচনায় রাহ্বারের পক্ষ থেকে সরকারকে প্রদত্ত নিঃশর্ত সমর্থনে প্রেসিডেন্ট রুহানি সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং জোর দিয়ে বলেন, এ পর্যন্ত পারমাণবিক বিষয়ে আলোচনায় যে সব সাফল্য অর্জিত হয়েছে তা হচ্ছে এই যে, বিশ্ব সম্প্রদায় এ ব্যাপারে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সাথে যোগাযোগ করতে ও আন্তঃক্রিয়া সম্পাদনে সম্মত হয়েছে এবং বৃহৎ শক্তিগুলো ইরানের পারমাণবিক অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
প্রেসিডেন্ট রুহানি বলেন, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সরকার দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের এবং সকল আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের হেফাযতকারী। তাই সরকার বরাবরের মতোই ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের মর্যাদা ও গৌরবের পরিপূর্ণ প্রতিরক্ষা করে যাবে।
প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে রাহ্বারের কল্যাণ এবং ইরানী জাতির উন্নয়ন, অগ্রগতি ও মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য দো‘আ করেন।
(২) নিষেধাজ্ঞার ভিতরেও ইরান পরিপূর্ণরূপে বিকাশ লাভ করছে : রাহ্বার (মেহের ৮)
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ দ্বীনী ও রাজনৈতিক নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ্ ‘উয্মা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী বলেন, নিষেধাজ্ঞার ভিতরেও ইরান সকল ক্ষেত্রে পরিপূর্ণরূপে বিকাশ লাভ করছে। তিনি ইরানী বর্ষপঞ্জির প্রথম দিন নওরোয্ উপলক্ষে গত ২১শে মার্চ দেশের অন্যতম ধর্মীয় নগরী মাশ্হাদে হযরত ইমাম রেযা (আ.)-এর মাযার প্রাঙ্গনে এক বিশাল জনসমাবেশে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে এ কথা বলেন।
রাহ্বার বলেন, নওরোয উদ্যাপন ইসলামী মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। তিনি বলেন, ইরানী জনগণ নওরোযকে ইসলামী মূল্যবোধসমূহকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে ব্যবহার করে থাকে।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী ইসলামের অন্যতম মূলনীতি ‘আম্র্ বিল-মা‘রূফ ওয়া নাহি ‘আনিল্ মুন্কার’ (ভালো কাজের আদেশ দান ও মন্দ কাজে নিষেধ)-এর প্রকৃত তাৎপর্যের ওপর আলোকপাত করে বলেন, ইসলামের দৃষ্টিতে ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সমস্ত রকমের ভালো কাজের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভালো কাজ।
ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার বলেন, ইসলাম জনগণের মধ্যে সহমর্মিতা, সহযোগিতা ও সংহতি আশা করে। তিনি বলেন, ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সরকারকে জনগণ কর্তৃক অনুমোদিত ও সমর্থিত হতে হবে। এটাই হচ্ছে আমাদের দেশে ইসলামী সংহতির নির্যাস।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প সম্পর্কিত আলোচনা প্রসঙ্গে হযরত আয়াতুুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, বেআইনি ও অন্যায় নিষেধাজ্ঞা ইরানের জন্য স্বীয় অর্থনীতিকে একটি স্বাধীন অর্থনীতি হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে।
ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার জোর দিয়ে বলেন, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধে পশ্চিমা শত্রুদের হাতে একমাত্র যে অস্ত্রটি আছে তা হচ্ছে নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু তারা ইরানের অগ্রযাত্রাকে রুদ্ধ করে দিতে অক্ষম হয়েছে, কারণ, তাদের সে অস্ত্র নিষ্ক্রিয় প্রমাণিত হয়েছে। অন্যদিকে নিষেধাজ্ঞার মোকাবিলায় একমাত্র পথ হচ্ছে স্বনির্ভরতা ও স্বয়ংসম্পূর্ণতা। তিনি বলেন, ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প সংক্রান্ত যে কোনো চুক্তি সম্পাদন নিষেধাজ্ঞা পরিপূর্ণরূপে প্রত্যাহারের ওপর নির্ভর করে এবং নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে অন্য কোনো শর্ত গ্রহণযোগ্য হবে না।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, আমেরিকার সাথে আলোচনা একমাত্র এবং একমাত্র পারমাণবিক প্রকল্প সম্পর্কে হবে এবং ইরান কখনোই আমেরিকার সাথে কোনো আঞ্চলিক বা অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আলোচনা করবে না। কারণ, আমেরিকার নীতি হচ্ছে ইরানের নীতির বিপরীত এবং তা মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের স্বার্থেরও বিরোধী।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নওরোয উপলক্ষে ইরানী জনগণের উদ্দেশে প্রদত্ত বাণীতে যে প্রস্তাব দিয়েছেন ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে দেন। উল্লেখ্য, বারাক ওবামা তাঁর বাণীতে বলেন যে, ইরানের জাতীয় অর্থনীতিকে মুক্তি দিতে হলে ইরানীদেরকে অবশ্যই আমেরিকান দিকনির্দেশনা গ্রহণ করে নিতে হবে।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী ইরানী জনগণের প্রতি প্রতিরোধের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানান। তিনি বলেন, প্রতিরোধের অর্থনীতি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্যই সম্ভব সব রকমের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার জোর দিয়ে বলেন, প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বাণীতে যে দাবি করা হয়েছে যে, ইরানে কিছুসংখ্যক লোক পারমাণবিক বিরোধের কূটনৈতিক সমাধানের বিরোধী, তাঁর এ দাবি পুরোপুরি ভুল এবং একটি বিরাট মিথ্যাচার। তিনি বলেন, ইরানে কেউই দেশের পারমাণবিক প্রকল্প সংক্রান্ত সমস্যার কূটনৈতিক সমাধানের বিরোধী নন।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী তাঁর ভাষণের সমাপ্তি টানতে গিয়ে বলেন, বিশেষ করে দেশ যখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি ও উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় তখন সকলকেই মতৈক্য প্রদর্শন করতে হবে এবং সরকারের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানাতে হবে।
ইরানে আর্থিক সাশ্রয়ী হাইব্রিড গাড়ি তৈরি (মেহের ১০)
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে স্থানীয় প্রযুক্তিতে ‘দোনিরু’ নামে এক ধরনের আর্থিক সাশ্রয়ী হাইব্রিড গাড়ি নির্মিত হয়েছে। গত ৪ঠা মার্চ (২০১৫) প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির উপস্থিতিতে নব নির্মিত এ গাড়ির আবরণ উন্মোচন করা হয়।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের ম্যাক্রো-স্কেল ন্যাশনাল প্লান্স শাখার প্রধান ড. পেইমন সালেহী এ পরিবেশবান্ধব যাত্রীবাহী গাড়িটির আবরণ উন্মোচন করেন। এ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে দেশের প্রেসিডেন্ট ছাড়াও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ভাইস প্রেসিডেন্ট ও বেশ কয়েক জন কেবিনেট মন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন।
এ অনুষ্ঠানে ড. পেইমন সালেহী বলেন, দোনিরু হচ্ছে এক ধরনের হাইব্রিড কারÑ যা বিদ্যুতের সাহায্যে চলে এবং এর ব্যাটারি একবার চার্জ করা হলে এটি ৮৫ কিলোমিটার পথ চলতে পারে। তিনি বলেন, এ গাড়িটির গ্যাসোলিন ইঞ্জিনে পরিবর্তন সাধন করে ইঞ্জিনটিকে ব্যাটারি চার্জ করার জন্য ব্যবহার করা হয়; ইঞ্জিনটি সরাসরি গাড়ি চালাতে ব্যবহৃত হয় না।
এ গাড়িটি নির্মাণের উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে ড. সালেহী বলেন, দোনিরু একটি মানসম্পন্ন ও আর্থিক সাশ্রয়ী গাড়ি যার ডিজাইন করা হয়েছে দূষণ হ্রাস করে পরিবেশের হেফাযতের উদ্দেশ্যে।
ড. সালেহী বলেন, প্রেসিডেন্টের দফতরের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ এবং রিনোভেশন অর্গানাইযেশন অব্ ইরান-এর যৌথ অংশীদারিত্বে এ প্রকল্পটির জন্য তিরিশ লক্ষ ডলার ব্যয় করা হয়েছে।
ইরানে নির্মিত ‘সূর্মা’ ক্রুজ মিসাইলের আবরণ উন্মোচন (মেহের ১১)
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দেশীয় প্রযুক্তিতে ‘সূর্মা’ নামে ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য এক ধরনের ক্রুজ মিসাইল নির্মাণ করেছে। ইতিমধ্যেই আনুষ্ঠানিকভাবে এ মিসাইলের আবরণ উন্মোচন করা হয়েছে এবং মিসাইলটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিপ্লবী রক্ষী বাহিনী (আইআরজিসি)-এর এয়ারোস্পেস ফোর্স-এর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। একই সময় আইআরজিসি-র কাছে ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য ‘ক্বাদ্র’ ও ‘ক্বিয়াম’ নামক দু’ধরনের দূর পাল্লার ব্যালেস্টিক মিসাইলও হস্তান্তর করা হয়েছে।
গত ৭ই মার্চ (২০১৫) তেহরানে আয়োজিত এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ‘সূমার’ ক্রুজ মিসাইলের আবরণ উন্মোচন করা হয় এবং এতদসহ বিপুল সংখ্যায় উৎপাদিত ‘ক্বাদার’ ও ‘ক্বিয়াম’ ব্যালেস্টিক মিসাইল আইআরজিসি-র কাছে হস্তান্তর করা হয়। এ অনুষ্ঠানে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হোসাইন দেহ্কান ও আইআরজিসি-র এয়ারোস্পেস ফোর্স-এর প্রধান জেনারেল আমীর আলী হাজীযাদে সহ ইরান সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে জেনারেল দেহ্কান বলেন, ইরান সরকারের এয়ারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ অর্গানাইযেশন (এআইও)-এর বিশেষজ্ঞগণ সূমার ক্রুজ মিসাইলের ডিজাইন করেন এবং এ সংস্থাটি এটি উৎপাদন করে। তিনি বলেন, ইতিপূর্বে নির্মিত মিসাইলসমূহের তুলনায় এ মিসাইলটির পাল্লা যেমন বেশি তেমনি এটির লক্ষ্যভেদ অধিকতর নিখুঁত এবং এছাড়াও এটির আরো কতোগুলো ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
জেনারেল দেহ্কান আরো বলেন, এ সব গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিরক্ষা ও নিরোধক শক্তি বৃদ্ধির পথে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে।
উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে বিরাট বিরাট সাফল্যের অধিকারী হয়েছে এবং প্রয়োজনীয় সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদন ও সিস্টেম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতায় উপনীত হয়েছে।
আরো উল্লেখ্য যে, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান অন্যান্য দেশকে এ মর্মে বার বার নিশ্চয়তা দিয়েছে যে, ইরানের সামরিক শক্তি অন্য কোনো দেশের জন্য হুমকি নয় এবং এ দেশের প্রতিরক্ষা নীতি পুরোপুরি নিরোধের লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছে।
ইরানে গাড়ি পরিষ্কার করার অ্যালকোহল মুক্ত ন্যানো ক্লিনার উৎপাদন (মেহের ১২)
ইরানী গবেষকগণ গাড়ি পরিষ্কার করার জন্য অ্যালকোহলমুক্ত একটি ন্যানো ক্লিনার উৎপাদন করেছেন। এটির দ্বারা পানির সাহায্য ছাড়াই গাড়ি পরিষ্কার করা সম্ভব হবে।
সংশ্লিষ্ট গবেষক ও আবিষ্কারক গ্রুপের সদস্য জনাব মেহ্র্তাশ হেদায়াতী বলেন, এ পণ্যটিতে উপরি ভাগের ধুলা-ময়লা অপসারণে সক্ষম উচ্চ পরিষ্কারক ক্ষমতার একটি নতুন ফরমুলেশন রয়েছে। তিনি আরো বলেন, এ ন্যানো ক্লিনারটিতে একটি হারবাল এন্টি-ব্যাক্টেরিয়াল ব্যাসিস রয়েছে এবং এটি ব্যবহার করে গাড়ি পরিষ্কার করার সময় পানি ব্যবহার করার প্রয়োজন হয় না।
জনাব মেহ্র্তাশ হেদায়াতী বলেন, এ পণ্যটিতে প্রাকৃতিক অ্যালকোহলমুক্ত মিশ্রণ ব্যবহার করা হয়েছে এবং এটি গ্লাস, ফ্রেম, ইঞ্জিন ও টায়ার সহ গাড়ির সকল উপরি তল পরিষ্কার করার কাজে ব্যবহার করা যাবে।
তিনি আরো বলেন, গাড়ি পরিষ্কার করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিমাণে পানির ব্যবহার ও শুকানো সমস্যা বটে। এ ন্যানো ক্লিনারটি ব্যবহার করলে পানির খরচ বেঁচে যাবে এবং এটি পরিবেশ সংরক্ষণেও সহায়ক হবে।
ইরানী নৌবাহিনীতে দামাভান্দ ডেস্ট্রয়ার যোগ (মেহের ১৩)
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের নৌবাহিনীতে ‘দামাভান্দ’ নামক নতুন নির্মিত একটি ডেস্ট্রয়ার যোগ করা হয়েছে। অ্যাড্ভান্স্ড সী-লঞ্চ্ড্ ড্রোন বিমান ও ক্রুজ মিসাইলে সজ্জিত এ ডেস্ট্রয়ারটি গত ৯ই মার্চ (২০১৫) তারিখে কাস্পিয়ান সাগরস্থ ইরানী নৌবাহিনীতে যোগ করা হয়।
এ উপলক্ষে কাস্পিয়ান সাগর তীরবর্তী বন্দর নগরী বান্দারে আন্যালীতে আয়োজিত এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ অংশগ্রহণ করেন। এদের মধ্যে ছিলেন সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সচিব আলী শাম্খনী, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হোসাইন দেহ্কান ও নৌবাহিনীর অধিনায়ক রিয়ার অ্যাডমিরাল হাবীবুল্লাহ্ সাইয়ারী।
উল্লেখ্য, দামাভান্দ হচ্ছে অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী জামারান শ্রেণির ডেস্ট্রয়ার যা ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের উত্তরাঞ্চলীয় পানি সীমার হেফাযতের জন্য দেশের নৌবাহিনীর প্রয়োজন পূরণে সক্ষম। এটি জামারান-এর চেয়ে লম্বা, কিন্তু অপেক্ষাকৃত হাল্কা। এটি যুগপতভাবে সমুদ্র, আকাশ ও ভূমিতে অবস্থিত লক্ষ্যবস্তু চিহ্নিত করতে ও তাতে আঘাত হানতে সক্ষম। এটি ক্রুজ মিসাইল সিস্টেম, টর্পেডো লঞ্চার, ৪০ মিলিমিটার ও ৭৬ মিলিমিটার কামান, রাডার প্রসেসিং সিস্টেম এবং তদসহ ভূমিতে ও আকাশে ব্যবহার্য ট্যাকটিক্যাল রাডার দ্বারা সুসজ্জিত।
উল্লেখ্য, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দেশের অভ্যন্তরে তৈরি প্রথম ডেস্ট্রয়ার ‘জামারান’ পারস্য উপসাগরস্থ স্বীয় নৌবাহিনীতে যোগ করে। ১ হাজার ৪২০ টন ওযনের এ ডেস্ট্রয়ারটি অত্যাধুনিক রাডার সিস্টেম ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক যুদ্ধসরঞ্জামে সুসজ্জিত। ঘণ্টায় ৩০ নটিক্যাল মাইল গতিসম্পন্ন এ ডেস্ট্রয়ারটিতে একটি হেলিপ্যাড্ রয়েছে।
ইরানী মহিলা বিজ্ঞানী ‘ভবিষ্যৎ আইনস্টাইন’ হিসিবে চিহ্নিত (মেহের ১৪)
ইরানী মহিলা বিজ্ঞানী যাহ্রা হাক্কানী বৈজ্ঞানিক তথ্য বিশ্লেষণকারী আইটি ইঞ্জিন ‘র্স্প্যাহো’ কর্তৃক অন্যতম ‘ভবিষ্যৎ আইনস্টাইন’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন।
উল্লেখ্য, ‘র্স্প্যাহো’ হচ্ছে বৈজ্ঞানিক তথ্য বিশ্লেষণকারী এমন একটি আইটি ইঞ্জিন যা প্রিপ্যারেটরি ম্যাচিন লার্নিং অ্যালগোরিদ্ম্ ব্যবহার করে পারসোনালাইয্ড্ সায়েন্টিফিক নিউজ-ফীড সরবরাহ করে এবং স্বীয় বিশ্লেষণকৃত তথ্যাদির ভিত্তিতে মতামত ব্যক্ত করে। র্স্প্যাহো প্রতিদিন দশ হাজারেরও বেশি তথ্যসূত্র পরীক্ষা করে ড্যাটাবেস-এ ১৩ লাখেরও বেশি ডকুমেন্ট বিন্যস্ত করেÑ যার মধ্যে থাকে অধুনাতম প্রবন্ধ-নিবন্ধসমূহ, প্যাটেন্ট, ভিডিও ইত্যাদি। ব্রিটিশ লাইব্রেরির সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে র্স্প্যাহো খ্রিস্টীয় ১৮৯০-এর দশক থেকে শুরু করে তদপরবর্তীকালীন তথ্যাদি বিশ্লেষণ করেছে। এটি আইনস্টাইনের রচনাবলি বিশ্লেষণ করার পর আর যাঁরা অনুরূপ বিষয়াদি নিয়ে লিখেছেন তাঁদেরকে খুঁজে বের করেছে।
২৭ বছর বয়স্কা যাহ্রা হাক্কানী দম্গ¦ন্ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। উক্ত অনুসন্ধানের ফলে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান থেকে সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, বিশ্বে যে স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তির আইনস্টাইনের সাথে সর্বাধিক মিল রয়েছে তিনি তাঁদের অন্যতম।
যাহ্রা হাক্কানী যে সব বিষয় নিয়ে গবেষণা করছেন সেগুলোর অন্যতম হচ্ছে মাধ্যাকর্ষণ, তার বিবর্তন এবং মহাবিশ্ব তত্ত্ব (পড়ংসড়ষড়মু)। তিনি ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত গ্রাভিটি রিসার্চ ফাউন্ডেশনের প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন এবং এতে তিনি তাঁর গধঃঃবৎ সধু গধঃঃবৎ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
যাঁরা আইনস্টাইন কর্তৃক লিখিত বিষয়াদির অনুরূপ বিষয়াদি নিয়ে লিখেছেন তাঁদের মধ্যে যাহ্রা হাক্কানী ছাড়াও আরো যাঁদেরকে ‘সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ আইনস্টাইন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তাঁরা হলেন : নিউ হ্যাভেন্ ইউনিভিার্সিটির তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী নিকোদেন্ পোপ্লাভস্কি, জাপানের ন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল্ অব্জারভেটরির প্রজেক্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হাজিমে সোতানী, টোকিও ইউনিভার্সিটি অব্ সায়েন্স্-এর অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর শিন্জি সুজিকাওয়া ও ইউনিভার্সিটি অব্ ক্যাম্ব্রিজ্-এর জে. ব্রিয়ান পিট্স্।
ইরানী আবিষ্কারক কর্তৃক বিমানের হাল্কা পাখা তৈরি (মেহের ১৫)
ইরানী আবিষ্কারক কভেহ্ কোলার্হ্গা আযারী বিমানের জন্য নতুন ধরনের পাখা তৈরি করেছেন যা মূল মেক্যানিক্যাল ও ডায়নামিক বৈশিষ্ট্যসমূহ বজায় রাখার পাশাপাশি অপেক্ষাকৃত সহজ ও হাল্কা।
কভেহ্ কোলার্হ্গা আযারী বার্তা সংস্থা মেহ্র্ নিউজ্-কে বলেন, বর্তমানে বিমানে যে সব পাখা ব্যবহার করা হয় সেগুলো স্টীলের তৈরি যার ওজন অনেক বেশি। কিন্তু তার বিপরীতে তাঁর উদ্ভাবিত এ নতুন ধরনের পাখার ওজন যেমন অপেক্ষাকৃত কম, তেমনি তা তৈরিতে ব্যয়ও হবে অপেক্ষাকৃত কম।
কভেহ্ কোলার্হ্গা আযারী আরো বলেন, এ নতুন পাখা তৈরিতে পলিমার ও ধাতবের কম্পোজিট ব্যবহার করা হয়েছে যা স্টীল ও অ্যালুমিনিয়ামের মতোই টেকসই। তিনি বলেন, এ নতুন পাখার মেক্যানিক্যাল শক্তি যে কোনো ধাতব উপাদানে তৈরি পাখার চেয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি। অন্যদিকে ক্রুচালিত ও চালকবিহীন উভয় ধরনের বিমানেই এ ধরনের পাখা ব্যবহার করা যাবে।
তিনি আরো জানান যে, তাঁর নির্মিত পাখা বিমানের অতিরিক্ত ভাইব্রেশনেও ঠিক মতো কাজ করবে, অন্যদিকে তা বিমানের অভ্যন্তরে ভাইব্রেশন রোধ করবে।
ইরানী গবেষক কর্তৃক এইচআইভি নির্ণয়ক ফোন অ্যাপ্লিকেশন উদ্ভাবন (মেহের ১৬)
আমেরিকার হার্ভার্ডে কর্মরত একজন ইরানী গবেষকের নেতৃত্বে একদল গবেষক স্মার্ট ফোনের জন্য এমন একটি অ্যাপ্লিকেশন উদ্ভাবন করেছেন যার সাহায্যে এইচআইভি সহ রক্তের যে কোনো ব্যাকটেরিয়া ও রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হবে।
ব্রিগ্হামের বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ও হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের পরিচালনাধীন মহিলা হাসপাতালের মেডিসিন ইন্স্ট্রাক্টর হিসেবে কর্মরত ইরানী নাগরিক ড. হাদী শাফিয়ী ফ্লোরিডা আটলান্টিক ইউনিভিার্সিটি ও স্ট্যান্ফোর্ড ইউনিভার্সিটির একদল গবেষকের সাথে যৌথভাবে গবেষণা চালিয়ে উক্ত অ্যাপ্লিকেশনটি উদ্ভাবন করেন। এ সম্পর্কে তাঁরা ন্যাচার সায়েন্টিফিক্ রিপোর্টস্ সাময়িকীতে লিখিত একটি প্রবন্ধে বিস্তারিত উল্লেখ করেন। প্রবন্ধটির শিরোনাম : “চধঢ়বৎ ধহফ ঋষবীরনষব ঝঁনংঃৎধঃবং ধং গধঃবৎরধষং ভড়ৎ ইরড়ংবহংরহম চষধঃভড়ৎসং ঃড় উবঃবপঃ গঁষঃরঢ়ষব ইরড়ঃধৎমবঃং”
এ প্রবন্ধে তাঁরা উল্লেখ করেন যে, তাঁরা একটি নতুন বায়োসেন্সিং প্লাট্ফর্ম উদ্ভাবন করেছেন যার সাহায্যে এইচআইভি, ই-কোলি, স্ট্যাফাইলোকোক্কাস্ অরিয়াস্ ও অন্যান্য ব্যাকটেরিয়া চিহ্নিত করা যাবে। কেবল আঙ্গুলের ডগা থেকে এক ফোঁটা রক্ত নিয়ে এ বায়োসেন্সিং প্লাট্ফর্মে ব্যবহার করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির শরীরের সমস্ত রক্তে ও প্লাসমায় বিদ্যমান চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট স্পেসিফিটি ও সেন্সিটিভিটি পাওয়া যাবে এবং প্যাথোজেন্স্ চিহ্নিত করা যাবে।
এ প্রযুক্তিটি ব্যবহার করে তাঁরা একটি স্মার্ট ফোন অ্যাপ্লিকেশনও উদ্ভাবন করেছেন যা একটি সেলফোনের ইমেজ ব্যবহার করে রক্তের ভিতরকার ব্যাকটেরিয়া ও রোগব্যাধি নির্ণয় করতে সক্ষম হবে এবং তা বিশ্বের যে কোনো স্থান থেকেই নেয়া হোক না কেন খুব সহজেই বিশ্লেষণ করা যাবে।
কাগজ ও ফ্লেক্সিব্ল্ সাব্স্ট্রেট্স-কে বায়োসেন্সরের উপাদান হিসেবে ব্যবহার করে হাদী শাফিয়ী ও তাঁর সহকর্মিগণ রোগব্যাধি নির্ণয় এবং পয়েন্ট-অব্-কেয়ার সেটিংস্-এর সাহায্যে তার চিকিৎসা নির্দেশের জন্য একটি নতুন দ্রুত কর্মক্ষম ও কম ব্যয়সাপেক্ষ ব্যবস্থা উদ্ভাবন করেছেন। তাঁরা এটা প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছেন যে, কীভাবে তাঁদের উদ্ভাবিত নতুন প্লাটফর্মসমূহ এন্টিবডি ব্যবহার করে বহুমুখী বায়োলজিক্যাল মিডিয়ামসমূহ থেকে নজিরবিহীনভাবে বহুমুখী বায়োটার্গেটকে সেলেক্টিভ্ভাবে, সেন্সিটিভ্ভাবে ও পুনঃপুনঃ বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে ও চিহ্নিত করতে সক্ষম।
উক্ত প্লাটফর্ম কর্তৃক চিহ্নিত ফলাফলসমূহ সেলফোন ও সেগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে বিশ্বের যে কোনো প্রত্যন্ত প্রান্তে প্রেরণ করা সম্ভব হবে।
ড. শাফিয়ী ও তাঁর সহকর্মিগণ আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, স্বাস্থ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে তাঁদের উদ্ভাবিত এ নতুন প্রযুক্তিটি অচিরেই সারা বিশ্বে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হবে।
ইরানী গবেষক কর্তৃক থ্রি-ডি ইমেজিং-এর বৈপ্লবিক উন্নয়ন সাধন (মেহের ১৭)
ইরানী ইলেক্ট্রিক্যাল্ ইঞ্জিনিয়ার আলী হাজীমীরী-র অধীনে কর্মরত ক্যাল্-টেক্ গবেষকগণ একটি নতুন ন্যানোফোটোনিক্ কোহেরেন্ট্ ইমের্জা (এনসিআই) নিয়ে কাজ করছেন যা স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদেরকে থ্রি-ডি ইমেজ স্ক্যান্ করার সুবিধা দেবে।
উল্লেখ্য, একটি থ্রি-ডি প্রিন্টারের সাহায্যে কোনো কিছুর হুবহু কপি করার ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে থ্রি-ডি ক্যামেরার সাহায্যে সংশ্লিষ্ট বস্তুটির উচ্চ রেজ্যুলেশন স্ক্যানিং করা যা বস্তুটির উচ্চতা, প্রশস্ততা ও গভীরতাকে হুবহু ও নির্ভুলভাবে পরিমাপ করবে। বিগত কয়েক দশক যাবৎ এ ধরনের থ্রি-ডি ইমেজিং-এর কাজ চলে এলেও এ সর্বাধিক সংবেদনশীল সিস্টেমটি সাধারণত অনেক বড় এবং কন্জ্যুর্মা অ্যাপ্লিকেশনে তার ব্যবহার খুবই ব্যয়বহুল। তবে ইরানী ইলেক্ট্রিক্যাল্ ইঞ্জিনিয়ার আলী হাজীমীরী ও তাঁর অধীনে কর্মরত ক্যাল্-টেক্ গবেষকগণ যে নতুন ন্যানোফোটোনিক্ কোহেরেন্ট্ ইমের্জা (এনসিআই) তৈরি করেছেন তা যেমন সস্তা, তেমনি অত্যন্ত উঁচু মানে নিখুঁতভাবে কর্ম সম্পাদনকারী এবং এ ডিভাইসটি আবিষ্কৃত হবার ফলে থ্রি-ডি প্রিন্টিং প্রযুক্তি ক্রমান্বয়েই অধিকতর সাশ্রয়ী হচ্ছে।
উল্লেখ্য, এ নতুন ন্যানোফোটোনিক্ কোহেরেন্ট্ ইমের্জা (এনসিআই) লাইট্ ডিটেক্শন্ অ্যান্ড্ রেঞ্জিং (এলআইডিএর্আ) প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। আর এলআইডিএর্আ-এর সাহায্যে একটি বস্তুর ওপর লেজার রশ্মি প্রক্ষেপণ করে বস্তুটি থেকে প্রতিফলিত আলো বিশ্লেষণ করা হয়। অতি ক্ষুদ্রাকৃতিক এন্সিআই চিপ্-টি এক বর্গ মিলিমিটারেরও কম আয়তন পরিমাপ করতে পারে। ড্যাটা বিশ্লেষণ করে তার ভিত্তিতে এ সের্ন্সটি যে কোনো বস্তুর উচ্চতা, প্রশস্ততা ও গভীরতা সংক্রান্ত তথ্য শটের প্রতি পিক্সেলের জন্য সরবরাহ করতে সক্ষম।
জনাব হাজীমীরী বলেন, এ নতুন চিপ-বেস্ড্ ইমেজারটি আয়তনে যেমন খুবই ছোট তেমনি এটির মান খুবই উঁচু। এর ফলে এটির ব্যবহার খুবই কম ব্যয়সাপেক্ষ। ফলে হাজার হাজার নতুন ব্যবহারকারী তাঁদের ব্যক্তিগত ডিভাইসে, যেমন : স্মার্টফোনে, এটি ব্যবহার করতে পারবেন।
ইরানী নাটকের আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ (মেহের ২০)
ইরানী পরিচালিকা র্নাগেস্ অবির্য়া পরিচালিত শর্ট ফিল্ম ড্রামা ঞযরহমং অৎব ঈষড়ংবৎ ঞযধহ ঞযবু অঢ়ঢ়বধৎ রহ ঃযব গরৎৎড়ৎ সম্প্রতি ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে। অতঃপর এটি ইউরোপে অনুষ্ঠিতব্য আরো একটি আন্তর্জাতিক উৎসবে প্রদর্শিত হবে।
এ ড্রামা চলচ্চিত্রটি গত ১৩ই থেকে ২৭শে মার্চ প্যারিসে অনুষ্ঠিত ৩৭তম ঞযব ঈৎল্কঃবরষ ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ডড়সবহ’ং ঋরষস ঋবংঃরাধষ (ঋবংঃরাধষ ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ফব ঋরষসং ফব ঋবসসবং)-এ অংশগ্রহণ করে দু’টি পুরস্কার লাভ করেছে। উল্লেখ্য, মহিলা চলচ্চিত্র পরিচালকদের প্রতিভাকে পরিচিত করে তোলার লক্ষ্যে জ্যাকি বুয়েট্ কর্তৃক ১৯৭৮ সালে এ উৎসবটি প্রবর্তিত হয়।
শুক্রবার, ২০ মার্চ ২০১৫ ১৬:৪২
(৫) ‘ইরানের আলোচকরা পাশ্চাত্যের স্বেচ্ছাচারিতার কাছে মাথা নত করবে না’
২০ মার্চ (রেডিও তেহরান): ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিশিষ্ট আলেম আয়াতুল্লাহ মোহাম্মাদ আলি মোভাহেদি কেরমানি বলেছে, ছয় জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে চলমান পরমাণু আলোচনায় ইরানের অবস্থান সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত ও যৌক্তিক। তাই পাশ্চাত্যেরও উচিত তেহরানের যৌক্তিক অবস্থানকে মেনে নেয়া। আজ রাজধানী তেহরানে জুমার নামাজের খুতবায় এসব কথা বলেন তিনি।
পরমাণু আলোচনায় অংশগ্রহণকারী দেশগুলো এটা মেনে নিয়েছে যে ইরান পরমাণু বোমা তৈরির চেষ্টা করছে না এ কথা উল্লেখ করে আয়াতুল্লাহ কেরমানি আরো বলেছেন, পরমাণু ইস্যুটি তেহরানের ওপর চাপ সৃষ্টির মিথ্যা অজুহাত ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি বলেন, ইরানের ইসলামী বি-বী সরকারের প্রতি বিদ্বেষের কারণেই পাশ্চাত্য নানা অজুহাতে দেশটির ওপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রেখেছে।
জুমার নামাজের খতিব বলেন, ইরানের পরমাণু আলোচক দল কখনোই পাশ্চাত্যের স্বেচ্ছাচারিতার কাছে মাথা নত করবে না এবং জনগণের অধিকার রক্ষায় নিজেদের শক্ত অবস্থান ধরে রাখবে। আয়াতুল্লাহ কেরমানি আইএসআইএল সন্ত্রাসীদের মোকাবেলায় ইরাকের জনগণ ও সেনাবাহিনীর সফলতার কথা তুল ধরে বলেছেন, বিদেশিদের অনুচর এসব সন্ত্রাসীরা পুরোপুরি নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত সাফল্যের এ ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আমরা আশা করি। তিনি সিরিয়ায় পাশ্চাত্যের নীতি বা কৌশল ব্যর্থ হওয়ার ব্যাপারে মার্কিন কোনো কোনো কর্মকর্তার স্বীকারোক্তির কথা উল্লেখ করে বলেছেন, এরপরও তারা এ থেকে শিক্ষা নেয়নি এবং এ অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে সামরিক হস্তক্ষেপ অব্যাহত রেখেছে।
তেহরানের জুমার নামাজের খতিব আরো বলেন, আমেরিকার প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের জনগণের ক্ষোভ ও ঘৃণা ক্রমেই বাড়ছে। তাই আধিপত্যকামী সরকারগুলোর এটা জেনে রাখা উচিত আগ্রাসন, জুলুম-নির্যাতন ও রক্তপাত ঘটিয়ে কিংবা জনগণের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী লেলিয়ে দিয়ে তারা এ অঞ্চলে লুটতরাজের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারবে না। #
শুক্রবার, ০৩ এপ্রিল ২০১৫ ১৬:০৮
(৮) একনজরে ইরান ও ছয় জাতিগোষ্ঠীর যৌথ বিবৃতি
মোহাম্মদ জাওয়াদ-ফেডেরিকা মোগেরিনি
৩ এপ্রিল (রেডিও তেহরান): ইরানের সঙ্গে ছয় জাতিগোষ্ঠীর চূড়ান্ত পরমাণু চুক্তির রূপরেখায় তেহরানের পরমাণু তৎপরতার প্রতি স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। রূপরেখা অনুযায়ী- নাতাঞ্জ, ফোরদো, ইস্পাহান এবং আরাকসহ ইরানের কোনো পরমাণু স্থাপনা বা পরমাণু তৎপরতা বন্ধ বা স্থগিত করা হবে না। বরং ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার কর্মসূচি অব্যাহত রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।
ইরান ও ছয়জাতিগোষ্ঠীর যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, পরমাণু সংক্রান্ত চূড়ান্ত চুক্তি ১০ বছরের জন্য কার্যকর থাকবে। এতে, নাতাঞ্জ পরমাণু স্থাপনায় পাঁচ হাজারের বেশি সেন্টিফিউজ ৩.৬৭ মাত্রা সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম তৈরির তৎপরতা অব্যাহত রাখবে ইরান। এ কেন্দ্রের বাড়তি যন্ত্রপাতি ও অবকাঠামো আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা বা আইএইএ সংগ্রহ করবে। এর বদলে ইরানকে বরাদ্দকৃত মাত্রায় সৃমদ্ধ করার কাজে ব্যবহৃত নতুন যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হবে।
ইরানের বর্তমান সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুদের বিনিময়ে পরমাণু জ্বালানি চক্র তৈরিতে ব্যবহৃত উপাদান উৎপাদন করতে দেয়া হবে কিংবা আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ইউরেনিয়াম বদলে নিতে পারবে ইরান। এ ছাড়া, এতে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি চক্রের শিল্পখাতে উৎপাদনও নিশ্চিত করা হয়।
সমঝোতা চুক্তিতে বলা হয়, ইরান অত্যাধুনিক সেন্ট্রিফিউজ নিয়ে গবেষণা অব্যাহত রাখবে। ১০ বছরের জন্য আইআর-৪, আইআর-৫, আইআর-৬ এবং আইআর-৮ যন্ত্র নিয়ে এ গবেষণা অব্যাহত রাখা হবে।
যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ফোরদো পরমাণু স্থাপনাকে পরমাণু বিজ্ঞান ও পদার্থবিদ্যার গবেষণাগারে পরিণত করা হবে। এ কেন্দ্রে এক হাজার সেন্টিফিউজ রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে। ফোরদো’র দু’সারি সেন্ট্রিফিউজ তৎপরতা বজায় রাখবে। ছয় জাতিগোষ্ঠীর সহায়তায় ফোরদোর অর্ধেককে অত্যাধুনিক পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রে রূপান্তর করা হবে। এ ছাড়া, এ কেন্দ্রে স্থিতিশীল আইসোটোপ উৎপাদন করা হবে। শিল্প, কৃষি এবং ওষুধখাতে এ আইসোটোপের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
এ ছাড়া, আরাকের ভারি পানির পরমাণু চুল্লিও থাকবে। তবে তার আধুনিকায়ন এবং নতুন করে নকশা করা হবে। নতুন করে নকশা প্রণয়ন করার মাধ্যমে এ কেন্দ্রে কর্মতৎপরতা বাড়বে তবে -ুটোনিয়াম উৎপাদনের মাত্রা কমবে।
কিছু সম্পূরক প্রোটোকলও বাস্তবায়িত করবে ইরান। এটি একান্তভাবেই স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়েই করবে ইরান। ইরানের সরকার ও সংসদ সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এই প্রোটোকল বাস্তাবায়িত করবে।
সমঝোতায় বলা হয়েছে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইরানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত সকল ইশতেহার প্রত্যাহার এবং আমেরিকা, ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবরোধগুলো তুলে নেওয়া হবে। পাশাপাশি আর নতুন কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ হবে না।
সুইজারল্যান্ডের লোজেন শহরে টানা আট দিনব্যাপী আলোচনার পর ইরানের সঙ্গে ছয় জাতিগোষ্ঠীর চূড়ান্ত পরমাণু চুক্তির বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে।
পরে এক সংসবাদ সম্মেলেন যৌথ বিবৃতি পাঠ করেছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাওয়াদ জারিফ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান ফেডেরিকা মোগেরিনি।#
ইরান পরিচিতি : ইসফাহান
কামাল মাহমুদ
অবস্থান
ইরানের অন্যতম জনবহুল নগরী ইসফাহান। এটি ইসফাহান, এসফাহান, হিসফাহানসহ নানাভাবে উচ্চারিত হয়ে থাকে। এ শহর তেহরান থেকে ৩৪০ কিলোমিটার (২১১ মাইল) দক্ষিণে অবস্থিত। ২০১১ সালের হিসেব অনুযায়ী এ শহরের জনসংখ্যা ১৯০৮৯৬৮ জন। বৃহত্তর ইসফাহানের জনসংখ্যা ৩৭৯৩১০৩ জন। শহর এলাকা ২৮০ স্কয়ার কিলোমিটার সমুদ্র সমতল থেকে ১৫৯০ মিটার (৫.২১৭ ফুট) উচ্চতায় রয়েছে যাগরোস পাহাড়- যার পাদদেশে ইসফাহান অবস্থিত। ইসফাহান ইরানের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনবহুল শহর। ইসফাহান শহরের প্রসিদ্ধ স্থানের মধ্যে রয়েছে যারীন শহর, ফুলাদ শহর, নাযাফাবাদ, শীদে, শাহীন শহর, মোবারাকে, কালভারযান, চারমাহীন। এ সবগুলোই মেট্রোপলিটন সিটির অন্তর্ভুক্ত।
ইতিহাস
ইসফাহানের ব্যুৎপত্তি ঘটেছে বহু প্রাচীনকাল থেকেই। এর ইতিহাস জানতে আমাদেরকে সেই প্রস্তর যুগে ফিরে যেতে হবে। এ শহর ইলামী সভ্যতা (২৭০০-১৬০০ খ্রি.পূ.) থেকে আরম্ভ করে ধীরে ধীরে বর্তমান রূপ লাভ করেছে। তখন এর নাম ছিল আসফানদানা বা ইসফানদানা। মধ্যযুগে এ শহর ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হওয়ার পর এর নগরায়ন আরম্ভ হতে থাকে। যায়েন্দেরুদ নদীর তীরবর্তী হওয়ায় ক্রমে ক্রমে এ শহরের গুরুত্ব বাড়তে থাকে। ৬৪৮-৩৩০ (খ্রি. পূ.) সনে ইসফাহানে হাখামানেশী সা¤্রাজ্য প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এ সময়ে এ নগরী অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। হাখামানেশীদের পতনের পর পার্থিয়ানদের সময়কালে (২৫০ খ্রি. পূ.-২২৬ খ্রি.) এখানে পারস্য সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক চেতনা বিকাশ লাভ করে। সাসানী আমলে (২২৬-৬৫২ খ্রি.) এ অঞ্চলে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। তারা বিশেষ করে কৃষি সংস্কার ও উৎপাদনে ব্যাপকভাবে মনোযোগী হয়। তারা এখানে যরথুস্ত্র ধর্মমত চালু করে। এসময়কালে এ শহরকে ‘সাফাহান’ নামে ডাকা হতো। পরবর্তীকালে সাতজন বিশিষ্ট ব্যক্তি দ্বারা এ শহর পরিচালিত হতো। যাদেরকে ‘ইসফোহান’ বলা হতো। পরবর্তীকালে এখানে সেনাশাসন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং দ্রুততম সময়ে শহরের ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। এ সময়কালে প্রাচীন সব সড়ক নির্মিত হয় এবং পারসেপোলিসের ভিত্তি স্থাপিত হয়। ১৫৯৮ সালে শাহ আব্বাস দি গ্রেট তুর্কী আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য পারস্যের রাজধানী কাজভীন থেকে এখানে স্থানান্তর করে ইসফাহান নামকরণ করেন। তাঁর সময়কালকে ইসফাহানের উন্নয়নের ‘স্বর্ণযুগ’ বলা হয়ে থাকে। এ সময়ে ইসফাহানে সংস্কৃতি বিকাশ লাভ করতে থাকে এবং নতুন নতুন স্থাপনা নির্মিত হয়। শাহ আব্বাসের সময়কাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত অনেক অভিবাসী ইসফাহানে স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলে, বিশেষত জর্জিয়ানরা। ১৬ শতকে ইসফাহানে কমপক্ষে ২৫০০০০ জর্জিয়ান অধিবাসী ছিল। শাহ আব্বাসের সময় থেকেই ইসফাহান ইউরোপে পরিচিতি লাভ করে। বহু ইউরোপীয় পর্যটক ইসফাহানে ভ্রমণ করতে থাকেন। ১৭৭৫ সালে তেহরানে রাজধানী স্থাপিত হবার পূর্বে বহুবার ইরানের রাজধানী স্থানান্তরিত হয়েছে।
বিশ শতকেও বসবাসের উত্তম জায়গা হিসেবে প্রচুর অভিবাসী ইসফাহানকেই বেছে নিয়েছে। যার ফলে জনসংখ্যার দিক থেকে ইসফাহান ইরানের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরীতে পরিণত হয়েছে। বিশ শতকের শুরুর দিকে ইসফাহানে প্রচুর অধিবাসী আশ্রয় লাভ করে বিশেষত ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময়কালে।
আবহাওয়া
ইসফাহানের আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক। যায়ান্দে নদীর তীরে ও যাগরোস পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত ইসফাহানের ৯০ কিলোমিটার উত্তর দিকে কোন উদ্ভিদ দৃশ্যমান হয় না। এখানে গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড গরম থাকে। আবার শীতকালে বেশ ঠাণ্ডা অনুভূত হয় এবং তুষারপাত হয়। যদিও ১৯৮৬, ১৯৮৭, ১৯৮৯ ও ১৯৯০ সালে এখানে তুষারপাত হয়নি। বার্ষিক সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৭০ সেলসিয়াস, সর্বনি¤œ তাপমাত্রা মাইনাস ১৯.৪০ সেলসিয়াস।
দর্শনীয় স্থান
ইসফাহানের দর্শনীয় স্থানের মধ্যে রয়েছে শাহ মসজিদ, সিয়োহী পুল (স্থাপিত ১৬০২ ইং), নাকশে জাহান স্কয়ার, খাজু ব্রীজ (১৬৫০ ইং), শাহরেস্তান পোল, জুবী পোল (১৬৬৫ ইং), মারনান ব্রীজ প্রভৃতি। বিখ্যাত চার্চসমূহের মধ্যে রয়েছে বেদখেম চার্চ (১৬২৭ ইং), সেন্ট জর্জ চার্চ (১৭ শতক), সেন্ট মেরী চার্চ (১৭ শতক), ভানক ক্যাথেভরাল (১৬৬৪ ইং) প্রভৃতি। পার্ক ও বাগানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বার্ডস গার্ডেন, ইসফাহান ফুল বাগান, প্রভৃতি। বিখ্যাত স্থাপনাসমূহের মধ্যে আছে আলম হাউজ, আমিন হাউজ, মালেক ভিনিয়ার্ড, কাজভীন হাউজ (১৯ শতক), শায়খ-উল-ইসলাম হাউজ, আশরাদ প্রাসাদ (১৬৫০ ইং), হাশ্ত বেহেশ্ত (অস্টম স্বর্গ) প্রাসাদ (১৬৬৯ ইং), চেহেল সেতুন (১৬৪৭ ইং) প্রভৃতি। বিখ্যাত মাযার ও সমাধির মধ্যে রয়েছে- মাযারে আল রশীদ, বাবা কাসেমের মাযার (১৪ শতক), সাফাভী রাজপুতদের মাযার, নিজামুল মুল্ক সমাধি (১৪ শতক), শায়েব মাযার, শাহ শাহান মাযার (১৫ শতক), সোলতান বখ্ত আগার মাযার (১৪ শতক) প্রভৃতি। বিখ্যাত মসজিদসমূহের মধ্যে রয়েছে আগা নূর মসজিদ (১৬ শতক), হাকিম মসজিদ, ইল্চী মসজিদ, জামে মসজিদ (১৬০১ ইং), মোহাম্মাদ জাফর আবাদী মসজিদ (১৮৭৮ ইং), রহিম খান মসজিদ (১৯ শতক), রোকনুল মুল্ক মসজিদ, সাইয়্যেদ মসজিদ (১৯ শতক), শেখ লুতফুল্লাহ মসজিদ (১৬১৮ ইং) প্রভৃতি। এছাড়া অসংখ্য সুউচ্চ মিনার রয়েছে ইসফাহানে। বিখ্যাত যাদুঘরসমূহের মধ্যে রয়েছে কনটেমপোরারি আর্টস্ মিউজিয়াম, ডেকোরেটিভ আর্টস্ মিউজিয়াম, ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম (১৫ শতক) প্রভৃতি।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
শিক্ষাদীক্ষায় প্রাচীনকাল থেকেই ইসফাহানের সুনাম রয়েছে। এখানে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের মধ্যে রয়েছে ইসফাহান ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, ইসফাহান ইউনিভার্সিটি, ইসফাহান ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব মেডিকেল সাইন্স, ইসলামিক আযাদ ইউনিভার্সিটি অব নাজাফাবাদ প্রভৃতি। স্কুলসমূহের মধ্যে চাহারবাগ স্কুল (১৭ শতক), কাশগারিয়ান স্কুল (১৬৯৪ ইং), মাদারেসে খাজু, নিমভার স্কুল (১৬৯১ ইং), সাদ্র স্কুল (১৯ শতক), আদব হাই স্কুল, হারাতী হাইস্কুল, সারেমিয়া হাইস্কুল, সায়েব এডুকেশন কমপ্লেক্স, ইমাম মোহাম্মাদ বাকের এডুকেশন কমপ্লেক্স, মাহবুবে দানেশ, ফারজানগানে আমীন হাইস্কুল, ইমাম সাদেক এডুকেশনাল কমপ্লেক্স প্রভৃতি।
খেলাধুলা
ইসফাহান অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খেলার আয়োজন করে থাকে। ২০০৭ সালে বিশ্ব ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের সফল আয়োজক ইসফাহান। এখানে রয়েছে নাকশে জাহান স্টেডিয়াম, যেখানে ৭৫০০০ (পঁচাত্তর হাজার) দর্শক একসঙ্গে খেলা দেখতে পারে। এখানে তিনটি বিখ্যাত ফুটবল এসোসিয়েশন আছে- সোপাহান ইসফাহান, জব অহান ইসফাহান, গীতি পাসান্দ। এছাড়া রয়েছে ডারবী ও ফুটসাল ক্লাব। কয়েকজন ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব হলেন- ইরানের সাবেক জাতীয় খেলোয়ার ও জাতীয় ফুটবল দলের কোচ মাহমুদ ইয়াভারী, আব্দুল আলী চেঙ্গিস, মানসুব ইবরাহীম যাদে, মোহাম্মাদ নাভীদফিয়া, আরসালান কাজেমী, বিশ্ব কুস্তি চ্যাম্পিয়ন মোহাম্মাদ তালায়ী প্রমুখ।
চত্বর বা স্কোয়ারের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছে নাকশে জাহান স্কোয়ার- যা শাহ স্কোয়ার বা ইমাম স্কোয়ার নামেও পরিচিত। এটি ১৫৯৮ থেকে ১৬২৯ সালের মধ্যে নির্মিত হয়। এটি বর্তমানে ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃত। এটি ১৬০ মিটার প্রশস্ত এবং ৫০৮ মিটার দীর্ঘ। এর চতুর্পাশ্বে রয়েছে নানা ঐতিহাসিক স্থাপনা। পশ্চিম দিকে আলী কুপা প্যালেস, পূর্ব দিকে শেখ লুতফুল্লাহ মসজিদ, উত্তর দিকে কায়সারিয়া গেট যা দিয়ে সরাসরি ইসফাহান শাহী বাজারে প্রবেশ করা যায়। এছাড়া মেয়দানে কোহনে, চাহার বাগ বুলাভার্ড প্রভৃতি। অন্যান্য দর্শনীয় স্থানের মধ্যে রয়েছে আতশগাহ (যরথুস্ত্র অগ্নি মন্দির), নিউ জুলকা (আর্মেনিয়ান কোয়ার্টার, স্থাপিত ১৬০৬ ইং), বাদল উদ্দিন আমেলী গোসলখানা, পিজিয়ন টাওয়ার, তাখ্তে ফুলাদ প্রভৃতি।
যাতায়াত ব্যবস্থা
ইসফাহানের যাতায়াত ব্যবস্থা বেশ উন্নত ও পরিপাটি। এখানে রয়েছে আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর, রেল, মেট্রোরেল ও সড়ক পথ। বিমানবন্দরে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট উড্ডয়ন ও অবতরণ করে থাকে। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া, দুবাই ও দামেস্কসহ নানা দেশের যাত্রীরা ইসফাহান বিমানবন্দর ব্যবহার করে থাকে। ইসফাহানে রয়েছে ৪৩ কিলোমিটার মেট্রোরেলপথ। এর রয়েছে ২০টি স্টেশন। ২০১০ সালে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়। অনেকগুলো রুটে ইসফাহান থেকে রেল চলাচল করে থাকে। ইসফাহান-তেহরান, ইসফাহান-শিরাজ, ইসফাহান-ইয়ায্্দ, ইসফাহান-বন্দর আব্বাস ও ইসফাহান-জাহেদান রুট তন্মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া সড়কপথে চলাচলের জন্য বাস ও ট্যাক্সি তো রয়েছেই।
খাবার
ইসফাহানের খাবারে রয়েছে আলাদা স্বাদ ও ঐতিহ্য। এখানকার বিখ্যাত খাবার হলো বিরিয়ানি। যা উন্মুক্ত আগুনে ছোট কড়াইয়ে রান্না করা হয়। এটি এক প্রকার বিশেষ রুটির সাথে পরিবেশন করা হয়, যার নাম ‘তাফতুন’। এছাড়া অন্যান্য রুটির সাথেও এ বিরিয়ানি পরিবেশিত হয়ে থাকে। কেশেনজান আরেকটি বিখ্যাত খাবার যা মুরগি, ভেড়া বা গরুর গোশত ও চাল দিয়ে তৈরি করা হয়। এছাড়া অন্যান্য খাবারের মধ্যে রয়েছে গাজ, খোরেশেতে মাস্ত, পুলাকীসহ নানা ধরনের সুস্বাদু খাবার।
আধুনিক ইসফাহান
ইরান ইসফাহানের কার্পেট, টেক্সটাইল, স্টীল, হ্যান্ডিক্রাফট প্রভৃতি পণ্য রপ্তানি করছে। ইসফাহানে রয়েছে নিউক্লিয়ার পরীক্ষণ কেন্দ্র ও নিউক্লিয়ার ফুয়েল (ইউএফসি) উৎপাদন কেন্দ্র। ইরানের বৃহত্তম স্টীল উৎপাদন কারখানা ইসফাহানেই অবস্থিত। প্রায় ২০০ কোম্পানি ইরানের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। ইসফাহানে রয়েছে বড় বড় তেল শোধনাগার। এখানে ইরান বিমান বাহিনীর একটি বড় ঘাঁটি ও এয়ার ক্রাফ্ট তৈরির কারখানা রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে ‘আই আর এএন-১৪০’ নামে একটি এয়ার ক্রাফ্ট সফলভাবে তৈরিতে সক্ষম হয়েছে।
ব্যক্তিত্ব
ইসফাহানের অনেক ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব ইরান তথা বিশ্ববাসীকে আলোর দিশা দেখিয়েছেন, সমাজকে করেছেন অগ্রগামী। বিভিন্ন অঙ্গনের মানুষের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য কয়েকজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হলেন ইসলামিক রেভুলেশন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আয়াতুল্লাহ মোহাম্মাদ বেহেশ্তী (১৯২৮-১৯৮১), সাবেক প্রধানমন্ত্রী জনাব মোহাম্মাদ আলী ফোরুগী, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসাইন ফাতেমী (১৯১৯-১৯৫৪), আহমদ আমীর আহমাদ (১৯০৬-১৯৫৬), ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় সেনবাহিনী প্রধান জনাব হোসাইন খারাজী, মোহসেন নূর বাখ্শ (১৯৪৮-২০০৩), পাকিস্তান পিপল্স পার্টির চেয়ারম্যান (১৯৭৯-১৯৮৩) নুসরাত ভুট্টো (জুলফিকার আলী ভুট্টোর স্ত্রী ও বেনজীর ভূট্টোর মা), হেযবে মিল্লাতে ইরান এর প্রতিষ্ঠাতা জনাব দারীয়ুশ ফোরুহার (১৯২৮-১৯৯৮) প্রমুখ।
ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের মধ্যে সালমান ফারসী, আল্লামা মাজলিসী, আল্লামা বেহেশতী, আয়াতুল্লাহ রহিম আরবাব চিয়ারমাহিনী, আয়তুল্লাহ আশরাফী ইসফাহানী প্রমুখ।
ইসফাহানের লেখক ও কবিদের মধ্যে রয়েছেন হামিদ মোসাদ্দেক (১৯৩৯-১৯৯৮), হাতেফ ইসফাহানী, হেলেন আলীয়া নীয়া, হোসাঙ্গ গুলশারী (১৯৩৮-২০০০), কামাল উদ্দিন ইসমাইল (১২ শতক), মির্জা আব্বাস খান শেইদা (১৮৮০-১৯৪৯), মোহাম্মাদ আলী জামালযাদে প্রমুখ।
শিল্পীদের মধ্যে রয়েছেন জালাল উদ্দিন তাজ ইসফাহানী (জন্ম ১৯৫৩ ইং), হাসান কাসায়ী (১৯২৮ ইং), জালীল শাহনাজ (১৯২১-২০১৩), ফরীদুন রাসূলী, মাস্টার আহমাদ আরচাঙ্গ, আলী রেজা ইফতেখারী (১৯৫৬ ইং), নাসরুল্লাহ মঈন (১৯৫১ ইং), হোসমান্দ আগীলী (১৯৫৪ ইং), হাসান সামাঈযাদে, লায়লা ফোরুহার প্রমুখ।
অভিনেতাদের মধ্যে রেজা আরহাম সাদ্র (১৯২৩-২০০৮), অস্কার বিজয়ী পরিচালক আসগর ফারহাদী (জন্ম ১৯৭২ ইং), নাসরুল্লাহ ভাহদাত (১৯২৫ ইং), মোহাম্মাদ আলী কেশভারজ (১৯৩০ ইং), জাহাঙ্গীর ফোরুহার (১৯১৬-১৯৯৭), বাহমান ফরমানরা (১৯৪২ ইং), রাসূল সাদ্র আমেলী (১৯৫৩ ইং), হুমায়ুন আসাদীয়ান, সুরাইয়া ইস্পানদিয়ারী (১৯৫৬-২০০১), হুমায়ুন এরশাদী (১৯৪৭ ইং) প্রমুখ।
চিত্রশিল্পীদের মধ্যে রয়েছেন বোগদান সালতানোভ (১৬৩০-১৭০৩), সুমাবাত দের কিরোগিয়ান (১৯১৩-১৯৯৯), হোসাইন মোসাভীরুল মোলকী (১৮৮১-১৯৬৯), ফরিদুন রাসূলী, ওস্তাদ জাভেদ রোস্তম শিরাজী, মাহমুদ কারসিয়ান (১৯৬০) প্রমুখ।
ইসফাহানের রয়েছে অতীত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। ইসফাহান সুদূর অতীতকাল থেকে আজ পর্যন্ত বিশ্ববাসীর কাছে এক প্রাচীন শহর হিসেবে বিখ্যাত হয়ে আছে। বিশ্ব সংস্কৃতির অনেক নিদর্শন রয়েছে এ ইসফাহানে। সমাজের বিভিন্ন অঙ্গনের লোকেরা তাঁদের কর্মের জন্য পেয়েছেন বিশ্বখ্যাতি। বর্তমান ইরানের অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান গবেষণায় ইসফাহান অসামান্য অবদান রেখে চলেছে। নিউক্লিয়ার পরীক্ষণ কেন্দ্র ও নিউক্লিয়ার ফুয়েল উৎপাদনের কেন্দ্র হওয়ায় ইসফাহান বিশ্বনেতাদের কাছে নতুন করে আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। রেলপথ, মেট্রো, আকাশপথ ও সড়কপথের যোগাযোগে ইসফাহান অসামান্য। সব মিলিয়ে ইসফাহান এখন বিশ্বের অন্যতম আধুনিক নগরীর মর্যাদায় সমাসীন। তাই ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের কাছে ইসফাহান এক আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।