All posts by pavel

ইরান পরিচিতি : মাশহাদ

-কামাল মাহমুদ
জনসংখ্যার দিক থেকে ইরানের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী হচ্ছে মাশহাদ। এটি রাজাভী খোরাসান প্রদেশের রাজধানী। এর অবস্থান ইরানের দক্ষিণে আফগানিস্তান ও তুর্কমেনিস্তানের সীমান্ত এলাকায়। ২০১০ সালের হিসাব অনুযায়ী এখানকার জনসংখ্যা ৪ মিলিয়ন। এখান থেকে পূর্ব ইরানের মরুদ্যান হয়ে সিল্ক রোড র্মাভ শহরের সাথে সংযোগ স্থাপন করেছে। আহলে বাইতের অস্টম ইমাম আলী রেযা (আ.)-এর মাযারের কারণে মাশহাদ সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ পর্যটক এ মাযার যিয়ারত করতে আসেন। ফেরদৌসীর শহর হিসেবে মাশহাদের খ্যাতি রয়েছে। তাঁর রচিত বিখ্যাত ‘শাহনামা’ ইরানের জাতীয় বীরত্বগাথা হিসেবে বিবেচিত। এছাড়াও অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের জন্মস্থান এ মাশহাদ।

ব্যুৎপত্তি
‘মাশহাদ’ আরবি শব্দ। অর্থ শাহাদাত বরণ করার স্থান। যেহেতু এখানে ইমাম রেযা শাহাদাত বরণ করেছেন এবং তাঁর মাযারও এখানে অবস্থিত তাই এ শহরের নাম মাশহাদ। ৯ম শতাব্দীতে মাশহাদ ছিল একটি ছোট গ্রাম যার নাম ছিল সানাবাদ। এর অবস্থান তুশ শহর থেকে মাত্র ২৪ কিলোমিটার দূরে। ৮০৮ সালে আব্বাসী খলিফা হারুন অর রশীদ এই স্থান অতিক্রম করার সময় অসুস্থ হয়ে মারা যান। তাকে এখানেই সমাধিস্থ করা হয়। এর কয়েক বছর পর ৮১৮ সালে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর চাচাতো ভাই ও জামাতা হযরত আলী ইবনে আবি তালিবের বংশধর হযরত আলী বিন মূসা আর-রেযা খলিফা আল-মামুন কর্তৃক বিষপ্রয়োগে শাহাদাত বরণ করেন। তাঁকে এ স্থঅনেই সমাহিত করা হয়। এরপরেই এ শহরের নাম হয় মাশহাদ আল-রেযা। তখন থেকেই মানুষজন ইমাম রেযার মাযার যিয়ারত আরম্ভ করেন। নবম শতাব্দীর শেষ দিকে ইমাম রেযার মাযারের বিশাল আকৃতির গম্বুজ নির্মাণ করা হয়। এ মাযারকে ঘিরে বহু স্থাপনা, বাজার ও প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। পরবর্তীকালে বহুবার এ মাযার সংস্কার করা হয়।
মোগল আমলের পূর্বে ১২২০ সাল পর্যন্ত এ শহরকে খুব বড় শহর হিসেবে গণ্য করা হতো না। খোরাসানের অনেক শহর আক্রান্ত হবার পরে সেখানকার অধিবাসীরা মাশহাদে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। ১৩৩৩ সালে ইবনে বতুতা এ শহর ভ্রমণ করেন। তিনি মাশহাদকে ফুল-ফল-বৃক্ষ আর নানা রঙের টাইলসে সমৃদ্ধ মাযারের শহর হিসেবে আখ্যা দেন। পরবর্তী সময়ে ১৪১৮ সালে তৈমুরীয় শাসক শাহরুখ মির্যার স্ত্রী গোহারশাদ ইমাম রেযার মাযারের পাশে একটি বিশাল মসজিদ নির্মাণ করেন। এটি গোহারশাদ মসজিদ নামে অভিহিত।
সাফাভী সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা প্রথম শাহ ইসমাঈল এ শহর দখল করেন এবং তৈমুরীয় সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।  প্রথম শাহ আব্বাসের শাসনকালে উজবেকরা এ শহর দখল করে নেয়। ১৫৯৭ সালে বহু কষ্টে হেরাতের যুদ্ধে উজবেকদের হারিয়ে শাহ আব্বাস এ শহর দখল করেন। প্রথম শাহ আব্বাস মাশহাদকে তীর্থস্থানে পরিণত করার জন্য ইরানীদের অনুপ্রাণিত করেন। তাঁর সময়কালে মাশহাদ ধর্মীয় দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ নগরীতে পরিণত হয়।
ধর্মীয় দিক ছাড়াও রাজনৈতিক দিক দিয়েও মাশহাদ বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ১৭৩৬ থেকে ১৭৪৭ সাল পর্যন্ত নাদির শাহের সময়কালে মাশহাদ গৌরবময় হয়ে ওঠে। মাশহাদ আফসারিয়া ও যান্দ, এমনকি আগা মোহাম্মাদ কাচারের সময়কাল (১৭৯৬ সাল) পর্যন্ত এটি খোরাসান অঞ্চলের রাজধানী হিসেবে স্বমহিমায় ভাস্বর ছিল। এছাড়া কিয়ানিদ সাম্রাজ্য, মালেক মাহমুদ সিস্তানী, নাদির শাহ, আদিল শাহ, শাহরূক, নাদির মির্জা, সাফাবী সাম্রাজ্যকালেও মাশহাদ রাজধানী হিসেবে গৌরবময় ছিল।
১৯১২ সালে রাশিয়ান সৈন্যদের দ্বারা নিক্ষিপ্ত বোমায় ইমাম রেযার মাযারের অনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পরবর্তীকালে তা সংস্কার করা হয়। ১৯৩৫ সাল রেযা পাহলভীর ধর্মহীন রাজনীতির ধারকেরা ইমাম রেযার মাযার দখল করে নেয়।  অনেক ভক্ত ও ব্যবসায়ীদের তাড়িয়ে দেয়া হয়। অবশিষ্ট ব্যবসায়ীদের ওপর বিপুল অংকের কর আরোপ করা হয়। জনগন রেযা শাহ পাহলভীকে  ‘নতুন ইয়াযীদ’ আখ্যা দেয়। ১৯৯৪ সালের ২০ জুন ইমাম রেযার মাযারে আত্মঘাতী বোমা হামলা করা হয়। এতে ২৫ জন যিয়ারতকারী নিহত হয়। এজন্য ২০ জুনকে ‘মাশহাদের আশুরা’ বলা হয়।

অবস্থান
মাশহাদ ৩৬.২০০ অক্ষাংশে এবং ৫৯.৩৫০ পূর্ব দ্রাঘিমায় অবস্থিত। বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ২৫০ মিলিমিটার। এখানে একদিকে যেমন তুষারপাত হয় অন্যদিকে তেমনি বেশ গরমও পড়ে। বার্ষিক বৃষ্টিপাত সাধারণত ডিসেম্বর থেকে মে মাসের মধ্যে হয়ে থাকে। এখানকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৫০ সেলসিয়াস (৯৫০ ফারেনহাইট)। শীতকালে শহরের অনেক জায়গা বরফের নিচে চলে যায়। বার্ষিক প্রায় ২৯০০ ঘণ্টা সূর্যালোক ভোগ করতে পারে মাশহাদ। তুর্কমেনিস্তান কাশাক নদীর উপত্যকা অঞ্চলে অবস্থিত। বিনালুদ ও হেযার মসজিদ নামক দুটি পর্বতের মধ্যখানে এর অবস্থান। ফলে এখানের আবহাওয়ায় রয়েছে বৈচিত্র্য। এখানে রয়েছে শীত, বসন্ত, গ্রীষ্ম ও শরৎকাল। এটি তুর্কমেনিস্তান এর আসগাবাদ থেকে মাত্র ২৫০ কি. মি. (১৬০ মাইল) দূরে অবস্থিত।
মাশহাদ ১৩টি প্রশাসনিক ইউনিটে বিভক্ত। ৪ মিলিয়ন অধিবাসীর অধিকাংশ প্রাচীন পারস্যের অধিবাসী। যার ৯৫% শহরে বাস করে। এছাড়া কুর্দি, তুর্কমেনিস্তান জাতিগোষ্ঠার বসবাস রয়েছে মাশহাদে। এখানে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরাক থেকে আসা অনেক অভিবাসী রয়েছে।

অর্থনীতি
ইরানের দ্বিতীয় অটোমোবাইল উৎপাদনের কেন্দ্রস্থল মাশহাদ। এখানকার অর্থনৈতিক সামগ্রীর মধ্যে শুকনো ফল, লবণাক্ত বাদাম, জাফরান, গাজ, সোহান, নানা রকম অলংকারের পাথর, রৌপ্য ও স্বর্ণ অলংকার, পারফিউম, কার্পেট প্রভৃতি। নানা প্রকৃতির কল-কারখানা রয়েছে মাশহাদে। যেমন- কাপড়, চামড়া, টেক্সটাইল, কেমিক্যাল, স্টীল, মিনারেল, নির্মাণ সামগ্রী, মেটাল ইন্ডাস্ট্রি প্রভৃতি। পর্যটন স্বর্গ মাশহাদে বসবাসের জন্য রয়েছে অনেক আবাসিক হোটেল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে লোকেরা মাশহাদ ভ্রমণ করতে আসে। প্রতি বছর ২৫ থেকে ৩০ মিলিয়ন পর্যটক মাশহাদ ভ্রমণ করে থাকে। তেহরানের পরে মাশহাদেই রয়েছে সবচেয়ে বড় প্রদর্শনী সেন্টার। ইলেকট্রিক ও কম্পিউটার সামগ্রীর অনেক বড় বাজার রয়েছে মাশহাদে।

সংস্কৃতি
সুদীর্ঘকাল থেকেই মাশহাদ শিল্পকলা ও বিজ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত। আয়াতুল্লাহ আল কোহী মাদরাসা সতের শতকে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আজও চালু রয়েছে। যেখানে সম্প্রতি আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজাভী ইউনিভার্সিটি অব ইসলামিক সাইন্স শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। মাশহাদে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় পুরোনো লাইব্রেরি।  এর নাম ‘সেন্ট্রাল লাইব্রেরি অব অস্তানে কুদ্স রাযাভী’- যা ছয় তলাবিশিষ্ট। এর একটি অংশ হচ্ছে অস্তানে কুদ্স রাযাভী মিউজিয়াম যেখানে বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিষয়ে ৭০০০০ হাজার পা-ুলিপি রয়েছে। প্রায় ছয় মিলিয়ন ঐতিহাসিক দলিলপত্রও এখানে সংরক্ষিত আছে। এখানে রয়েছে অনেকগুলো গ্যালারি। যেমন- মিরাক গ্যালারি, র্পাস গ্যালারি, সোরুস গ্যালারি, নারভান গ্যালারি প্রভৃতি। শহরের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে নানারকম সৌকর্যপূর্ণ ভাস্কর্য।

কেনাকাটা
কেনাকাটার জন্য মাশহাদে চারটি বৃহৎ বাজার রয়েছে। যথা: বাজার-ই রেযা, এটি একটি দ্বিতল ভবন এবং শহরের প্রধান কেনাকাটার স্থান। সারা-এ বাজারে রেযা- এটি মূলত কাপড়ের জন্য বিখ্যাত।  বাজারে বোজরগে মারকাযী- শিরাজি অ্যাভিনিউ এর কাছে অবস্থিত। শাহরিয়ার স্কয়ারের কাছে কুয়েতি বাজার। এছাড়াও সারগীস্ত ট্রেড সেন্টার- মাযারের উত্তর পাশে, প্রোমা ট্রেড সেন্টার- জানবায স্কয়ারে, আলমাসে র্সাগ- দক্ষিণ খাইয়াম অ্যাভিনিউতে, জীস্ত খাভার- শরীয়াতী স্কয়ারে অবস্থিত প্রভৃতি বাজার সহ নানা প্রকৃতির ছোটখাট বাজার রয়েছে।

খাবার
ইরানে মূলত মসলাসমৃদ্ধ কিন্তু ঝালবিহীন চেলো কাবাব ও বাকেরী কাবাব সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার। বিভিন্ন প্রকার রুটি অন্যতম প্রধান খাবার। এখানকার অনেক রেস্টুরেন্টে ফাস্ট ফুড সচরাচর পাওয়া যায়। বাংলাদেশীদের মতো ভাত, মাছ ও মাংস পাওয়া যায়- যা খুবই দামী। এখানকার আইসক্রীম বেশ জনপ্রিয় ও সুস্বাদু। আইসক্রীমকে ইরানীরা ‘আইচপার্ক’ বলে থাকে। শরীয়তী স্কয়ারের আইসক্রীম খুবই বিখ্যাত। এখানে চকলেট, আপেল, চেরী, স্ট্রবেরী, কফি, পীচসহ বিভিন্ন ফলের ফ্লেভারও পাওয়া যায়- যা ইউরোপ-আমেরিকাতে খুব জনপ্রিয়।

দর্শনীয় স্থান
ইমাম রেযার মাযার কমপ্লেক্স। ইমাম রেযা ১৪৮ হিজরির ১১ জিলকদ জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০৩ হিজরির ১৭ সফর শাহাদাত বরণ করেন। তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। আল-মামুন তাঁকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেন। এখানে ইমাম রেযার মাযার ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও কর্মকা-। কমপ্লেক্সের ভেতরে রয়েছে একটি বৃহৎ লাইব্রেরি, গোহারশাদ মসজিদ। কারুকার্যের দিক থেকে এটি পৃথিবীর প্রধান ও আয়তনের দিক থেকে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মসজিদ। এখানে ব্যাগ ও ক্যমেরা নেয়া নিষিদ্ধ। এখানে বিদেশী পর্যটকদের জন্য রয়েছে ইংরেজিভাষী ইরানী গাইড। তাঁরা এ কমপ্লেক্স সংক্রান্ত নানারকম তথ্য দিয়ে থাকেন। তাঁরা বিনামূল্যে কিছু ধর্মীয় বই ও স্টিকার দিয়ে থাকেন। এখানে রয়েছে মিনিয়েচার, মোজাফফার শাহ আমলের বিশালাকৃতির ঘড়ি- যা মাযারের পশ্চিম বারান্দায় অবস্থিত। হেফ্জখানা, মহিলাদের নামায ঘর, পশ্চিম দিকে রয়েছে বালা সার মসজিদ যা বেশ ছোট আকৃতির। অস্তানে কুদ্স মিউজিয়াম, কুরআন মিউজিয়াম, স্ট্যাম্প মিউজিয়াম, অস্তানে কুদ্স মেহমানখানা, নাদির শাহ মনুমেন্ট, ফেরদৌসী মনুমেন্ট, আখানজান টাওয়ার প্রভৃতি স্থান পেয়েছে এ মাযার কমপ্লেক্সে।
এছাড়া এখানে রয়েছে অনেকগুলো পার্ক ও বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের মাযার। যেমন- শেখ বাহায়ী, শেখ হুররে আমেলী, শেখ তাবারসী, নাদির শাহের মাযার প্রভৃতি। এখানকার কোহ সাদী পার্ক খুবই বিখ্যাত। পার্কে সাদী কমপ্লেক্সে রয়েছে চিড়িয়াখানা, যেখানে অনেক বণ্যপ্রাণী রয়েছে- যা অনেক পর্যটককে আকর্ষণ করে।   শহরের ৬ কিলোমিটার দূরে রয়েছে খাজা মুরাদ ও খাজা রাবীর মাযার। এছাড়া সাফাবী আমলের ক্যালিগ্রাফার রেযা আব্বাসী এবং খাজা আবসালাত এর মাযারও রয়েছে- যা মাশহাদ থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ২৪ কিলোমিটার দূরে তূসে রয়েছে ‘শাহনামা’র কবি ফেরদৌসীর মাযার। ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে শাহ পাবলিক গোসলখানা রয়েছে মাশহাদে- যা অসাধারণ নির্মাণশৈলীতে পূর্ণ। যদিও বর্তমানে এটিকে যাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য দর্শনীয় স্থানের মধ্যে রয়েছে প্রোমা হাইপার মার্কেট, কিয়ান সেন্টার, মাশহাদের মালেক হাউজ, সেন্ট মেসরোপ আর্মেনিয়ান চার্চ, নাদের শাহ মিউজিয়াম, তূস মিউজিয়াম, সানদিজ টুরিস্ট টাউন, ইমাম রেযা হাসপাতাল, হোমা হোটেল প্রভৃতি।

হোটেল-মোটেল
মাশহাদ পর্যটকদের অতি আকর্ষণীয় স্থান। আর সেজন্য এখানে হোটেল-মোটেলের সংখ্যা প্রচুর। হোটেলের মধ্যে রয়েছে র্পাস হোটেল, গাস্র তালেঈ ইন্টারন্যাশনাল হোটেল, পার্ডিসান হোটেল। মাযারের কাছে রয়েছে খাইয়্যাম হোটেল, গাদীর ইন্টারন্যাশনাল, দারবেশী হোটেল, ইরান হোটেল, সায়ে হোটেল প্রভৃতি।

যাতায়াত
এখানে রয়েছে মাশহাদ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট (শহীদ হাশেমী নেযাদ এয়ারপোর্ট)। যেখানে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট ওঠানামা করে। এটি ইরানের মেহরাবাদ বিমানবন্দরের পরেই দ্বিতীয় বৃহত্তম বিমানবন্দর। এছাড়া যাতায়াতের জন্য রয়েছে মেট্রো রেলপথ যা মারকো বা মাশহাদ আরবান রেলওয়ে কর্পোরেশন নামে পরিচিত। যা চার লেনবিশিষ্ট এবং এর পরিধি ৭৭ কিলোমিটার। ২০১১ সালে এটি চালু হয়। এর ২২টি স্টেশন রয়েছে। মাশহাদে মূলত তিনটি প্রধান রেল লাইন রয়েছে যা মাশহাদ-তেহরান, মাশহাদ-বাফ্গ (দক্ষিণ ইরান), মাশহাদ-সারকাশ  (তুর্কমেনিস্তানের সীমানার দিকে)। কিছু কিছু রেল সারকাস থেকে উজবেকিস্তান ও কাজাকিস্তানে যাতায়াত করে। এছাড়া মাশহাদ থেকে হেরাত হয়ে আফগানিস্তানেও রেল যোগাযোগ রয়েছে। পশ্চিমে কাস্পিয়ান সাগর পর্যন্ত রেল লাইন চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে। আর এগুলো রাহ অহান অব ইরান বা ইরান জাতীয় রেল কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। এছাড়া সড়কপথে যোগাযোগ তো রয়েছেই। তেহরান থেকে মাশহাদের দূরত্ব ৯০০ কিলোমিটার।

শিক্ষা
মাশহাদের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘ফেরদৌসী ইউনিভার্সিটি অব মাশহাদ’। এটি দক্ষিণ ইরানের বৃহত্তম গবেষণামূলক বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৪৯ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত। এটি ইরানের তৃতীয় প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়। এটি ইরানের প্রথম পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম। এখানে ব্যাচেলর, মাস্টার্স, পিএইচডি প্রোগ্রামে ইরানী শিক্ষার্থী ছাড়াও আফগানিস্তান, তুরস্ক, লেবানন, সিরিয়া, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, ভারত, চীন, ইয়েমেন, বাহরাইনসহ নানা দেশের শিক্ষার্থী রয়েছে। শিক্ষার্থী সংখ্যা ২৬০০০ (ছাব্বিশ হাজার)। শিক্ষক সংখ্যা এক হাজারের কিছু বেশি। স্টাফ সংখ্যা ২৫০০। এখানে মানবিক, ধর্মতত্ত্ব, বিজ্ঞান, গণিত, কৃষিবিজ্ঞান, এডুকেশন সাইকোলোজি, ভেটেরিনারী সাইন্স, প্রকৌশলবিদ্যা, বায়োটেকনোলজি প্রভৃতি অনুষদ রয়েছে। এছাড়া মাশহাদ ইউনিভার্সিটি অব মেডিক্যাল সাইন্স, ইসলামিক আযাদ ইউনিভার্সিটি মাশহাদ, মাশহাদ টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট, পায়ামে নূর ইউনিভার্সিটি অব মাশহাদ, খোরাসান ইন্সটিটিউট অব হায়ার এডুকেশন, খাইয়্যাম হায়ার এডুকেশন ইন্সটিটিউট, ইমাম রেযা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, রাযাভী ইউনিভার্সিটি অব ইসলামিক সাইন্স, স্পোর্টস সাইন্স রিচার্স ইন্সটিটিউ অব ইরান প্রভৃতি।
বিখ্যাত কলেজসমূহের মধ্যে রয়েছে সালমান ইন্সটিটিউট অব হায়ার এডুকেশন, ইবলিয়ান এডুকেশন সেন্টার মাশহাদ ব্রাঞ্চ। খাবারান ইন্সটিটিউট অব হায়ার এডুকেশন, তূস ইন্সটিটিউট অব হায়ার এডুকেশন, শহীদ বেহেশতী টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, শহীদ খোরশেদী টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, আসগার ইন্সটিটিউট অব হায়ার এডুকেশন, সামিন ইন্সটিটিউট অব হায়ার এডুকেশন, আল-যাহরা গার্লস টেকনিক্যাল কলেজ, বিনালুদ ইন্সটিটিউট অব হায়ার এডুকেশন, ইন্সটিটিউট অব অ্যাপলাইড্ অ্যান্ড প্রাকটিক্যাল সাইন্স, সানদিজ ইন্সটিটিউট অব হায়ার এডুকেশন প্রভৃতি। খেলাধুলার জন্য রয়েছে শহীদ বেহেশতী স্পোর্টস কমপ্লেক্স।

বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব
ইরানের বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের মধ্যে রয়েছেন শাইখ তূসী, নাসিরুদ্দীন তূসী, বর্তমান রাহবার সাইয়্যেদ আলী খামেইনী,  নিজামুল মূল্ক (সালজুক যুগের পণ্ডিত), আল-হুর আল-আমিলী (প্রখ্যাত আলেম ও মুহাদ্দিস), আল-গাজ্জালী (ইসলামী চিন্তাবিদ), তিমুর শাহ দুররানী, আলী আল-সিসতানী, মোহাম্মাদ কাজেম খোরাসানী, হোসাইন ভালীদ খোরাসানী, আবু মুসলিম খোরাসানী, মোহাম্মাদ বাকের গালিবাফ, হাদী খোমেইনী, সাইয়্যেদ জালিলী। লেখক ও বিজ্ঞানীদের মধ্যে রয়েছেন অরিয়ান গোলমাকানী, ফেরদৌসী, আবু মানসুর দাকীকী, আবুল ফাজল বায়হাকী, আবু সাঈদ আবুল খায়ের, আনওয়ারী, মাহদী আখাবানে সালেস, মোহাম্মাদ তাকী বাহার, আবু জাফর আল কাজীন, জাবির ইবনে হাইহান।

ইরানের নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত ড. আব্বাস ভায়েযী দেহনাভীর পরিচিতি

বাংলাদেশে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত ড. আব্বাস ভায়েযী দেহ্নাভী সম্প্রতি আগমন করেছেন এবং গত ১৪ জানুয়ারি বঙ্গভবনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহামান্য প্রেসিডেন্ট জনাব আবদুল হামিদের সাথে সাক্ষাৎ করে স্বীয় পরিচয়পত্র পেশ করেছেন।
ড. আব্বাস ভায়েযী ১৯৬৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং তিনি জন্মসূত্রে ইরানী। তিনি উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপন করার পরে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন এবং এরপর তেহরানের উন্মুক্ত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি তেহরানের পলিটিক্যাল থট্, হিউম্যানিটিস্ অ্যান্ড্ কালচারাল স্টাডিজ রিসার্চ বিভাগ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। এছাড়া তিনি দ্বীনী শিক্ষাকেন্দ্রেও অধ্যয়ন করেন এবং সেখান থেকে সনদ ও হুজ্জাতুল ইসলাম খেতাব লাভ করেন।
কর্মজীবনে তিনি ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মূল্যায়ন ও তত্ত্বাবধান বিভাগের ডিরেক্টর জেনারেল পদে ও এরপর একই বিভাগের উপপ্রধান পদে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিলেক্শন কমিটির প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ইরানী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আফ্রিকা ডেস্কে বিশেষজ্ঞ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে ইরানের বাইরে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও তাঁর পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে; তিনি জিম্বাবুয়েতে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দূতাবাসের ডেপুটি হেড অব মিশন ছিলেন এবং পরে তানযানীয়ায় ইরানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগদানের পূর্বে তিনি ইউনিভার্সিটি অব্ ম্যারিন্ সায়েন্সেস্-এর ইংরেজি ভাষার শিক্ষক, নোওশেহ্র্ ইউনিভার্সিটি অব্ ম্যারিন্ সায়েন্সেস্-এর আদর্শিক ও রাজনৈতিক দফতরের প্রধান এবং তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ভাষা ও ধর্মতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক ছিলেন।
বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের ও গবেষণামূলক লেখালেখি ও অনুবাদের ক্ষেত্রেও তাঁর যথেষ্ট অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাঁর লেখা গবেষণামূলক প্রবন্ধসমূহের মধ্যে রয়েছে ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্কে ভূ-রাজনৈতিক তত্ত্ব’, ‘আবদুর রাহমান কাওয়াকেবীর রাজনৈতিক চিন্তাধারা, লিবার‌্যালিজ্ম্ ও নিও-লিবার‌্যালিজ্ম্’, ‘নির্ভরশীলতা ও ধর্মীয় আবেদন তত্ত্ব’, ‘অ্যারিস্টোটল্ ও সমাজতত্ত্ব’, ‘শায়খ মুরতাযা আনসারীর চিন্তাধারা ও রাজনৈতিক চরিত্র-বৈশিষ্ট্য’, ‘ইবনে খাল্দূন্ : ঐতিহাসিক দার্শনিক ও সমাজতাত্ত্বিক’, ‘ইসলাম ও জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণা : মিল ও অমিল’, ‘ইরানে সেক্যুলারিজ্ম্’, ‘সেক্যুলারিজ্ম্ ও ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান’ এবং ‘৯-১১-র পরবর্তী সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধের আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ও তার সমাধান’। এছাড়া তিনি ‘সোভিয়েত ইউনিয়নে ইসলাম’ শীর্ষক একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধের ফারসি অনুবাদ করেন এবং ‘ফারাবী ও ইবনে খালদূনের দৃষ্টিকোণ থেকে কওম পরিচিতি’ ও ‘ইসলামের তাত্ত্বিক সমাজতত্ত্ব’ শীর্ষক দু’টি গবেষণামূলক গ্রন্থের গ্রন্থসমালোচনা লিখেন।
ড. আব্বাস ভায়েযী ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন ছাড়াও তাঁর ওপরে বিভিন্ন সময়ে অর্পিত অতিরিক্ত দায়িত্বও পালন করেন। এ সবের মধ্যে ছিল : তত্ত্বাবধায়ক সংগঠনসমূহের কাউন্সিলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিত্বকরণ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিভিল্ রাইট্স্ কমিশনের সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ জননিরাপত্তা ও সিভিল রাইট্স্ সংরক্ষণ বিষয়ক টাস্কফোর্সের সদস্য ও সেকটোর‌্যাল স্ট্যাটিস্টিক্স্ কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন। এছাড়া তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইন বিষয়ক সমন্বয় কাউন্সিলের সদস্য, সিলেকশন কমিটির সদস্য, সিলেকশন সায়েন্টিফিক বোর্ডের সদস্য, প্রশাসনিক অপরাধ বিষয়ক বোর্ডের সদস্য, অভিযোগ কমিশনের চেয়ারম্যান, পরীক্ষা বোর্ডের সদস্য, স্বশাসিত সংস্থাসমূহের বোর্ড অব্ ট্রাস্টির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রীর পরামর্শক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
ড. আব্বাস ভায়েযী দেহ্নাভী বিবাহিত এবং দুই সন্তানের পিতা।

রাহবারের খোলা চিঠি সম্পর্কে বিশ্লেষকদের অভিমত

পাশ্চাত্যে যায়নবাদী পুতুলদের সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করবে : ক্যালেব মপিন
আমেরিকার অন্যতম রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ভাষ্যকার ক্যালেব মপিন বলেন, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের নেতা আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী পশ্চিমা যুবসমাজের উদ্দেশে যে খোলা চিঠি প্রকাশ করেছেন তা পাশ্চাত্য জগতে যায়নবাদীদের সম্পর্কে গণসচেতনতা তৈরি করবে।
এ প্রসঙ্গে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে ক্যালেব মপিন পশ্চিমা প্রচারমাধ্যমের সমালোচনা করে বলেন, পশ্চিমা প্রচার মাধ্যম ইসলাম ও মুসলমানদের সম্পর্কে সত্য কথা বলে না। তিনি বলেন, এ কারণে ইরানী নেতা যথোপযুক্ত সময়ে পাশ্চাত্য যুবসমাজের উদ্দেশে তাঁর খোলা চিঠি প্রকাশ করেছেন। এর ফলে আশা করা যায় যে, যায়নবাদের হাতের পুতুল যেসব লোক পাশ্চাত্যে তৎপরতা চালাচ্ছে তাদের ব্যাপারে পাশ্চাত্যের জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হবে।
পশ্চিমা যুব সমাজের উদ্দেশে লেখা ইসলামী বিপ্লবের বর্তমান রাহ্বারের খোলা চিঠি প্রসঙ্গে ক্যালেব মপিন বার্তাসংস্থা ফার্স্ নিউজ এজেন্সির প্রতিনিধিকে যে সাক্ষাৎকার প্রদান করেন তার পূর্ণ বিবরণ নিম্নে দেয়া হলো :
প্রশ্ন : ইরানের ইসলামী বিপ্লবের বর্তমান রাহ্বার হযরত আয়াতুল্লাহ্ উযমা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী পশ্চিমা যুবসমাজের উদ্দেশে লিখিত তাঁর এক খোলা চিঠিতে তাদেরকে ইসলাম ও এর শিক্ষা সম্পর্কে বিকৃত চিত্র ও মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে পরিচালিত বিভ্রান্তিকর প্রচারাভিযান সম্পর্কে সতর্ক থাকতে বলেছেন। তিনি যুবসমাজকে ইসলাম সম্পর্কে এর আদি ও প্রকৃত তথ্যসূত্র থেকে জানার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। বর্তমান সময়ে কী কারণে ইসলামী ইরানের নেতা এ ধরনের একটি খোলা চিঠি লিখতে আগ্রহী হয়েছেন বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর : ইরানের ইসলামী বিপ্লবের নেতা ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার যুবসমাজের উদ্দেশে এ ধরনের একটি খোলা চিঠি লিখেছেন জানতে পেরে আমি খুবই চমৎকৃত হয়েছি। এটি সুস্পষ্ট যে, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সীমান্তের বাইরে কী ঘটছে সে সম্পর্কে তিনি খুবই আগ্রহী এবং তিনি বিশ্বের ঘটনাবলি সম্পর্কে খুবই মনোযোগের সাথে খোঁজ-খবর রাখেন। তাঁর এ পত্র থেকে এ বিষয়টিও অত্যন্ত স্পষ্ট যে, পশ্চিমা প্রচারমাধ্যমের প্রচারতৎপরতা ও তার পদ্ধতি এবং আমাদের ওপর তার প্রভাব সম্পর্কে তিনি পরিষ্কার ধারণা রাখেন। তিনি আরো আভাস দিয়েছেন যে, আমাদের ওপর তাঁর বিরাট আস্থা রয়েছে।
এ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদ ও যুদ্ধাপরাধ আরোপ করে এসেছে। বস্তুত এ দেশের পূর্ববর্তী প্রজন্মের উঁচু জীবনযাত্রার মান রক্তের মূল্যে ক্রয় করা হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যাতে নিজেকে বিশ্বের অর্থনীতিতে কেন্দ্রীয় অবস্থানে ধরে রাখতে পারে সে লক্ষ্যে কোরিয়া, ভিয়েতনাম, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও অন্যান্য স্থানে বহু মিলিয়ন মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হয়। এসব যুদ্ধ যেসব কারণে অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়েছিল তার অন্যতম হচ্ছে এখানকার জনগণের একটি বিরাট অংশের পরোক্ষ সমর্থন।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা এ মর্মে আস্থা পোষণ করেন যে, নতুন প্রজন্ম তাদের পূর্ববর্তীদের তুলনায় অনেক ভালো করতে সক্ষম হবে। আমরা আশা করতে পারি যে, তারা প্রকৃতই সত্য ও সুবিচারের সপক্ষে দ-ায়মান হবে এবং প্রতারণার জাল ছিন্ন করবে ও বিশ্বকে পরিবর্তিত করবে। এ গ্রহের অপর পৃষ্ঠের একজন নেতা আমার ও আমার বন্ধুদের ওপর এ ধরনের আস্থা রাখেন দেখে আমি খুবই আপ্লুত হয়েছি।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা যে জন্য পরামর্শ দিয়েছেন ঠিক তা-ই করার জন্য আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আসলেই, বিস্তারিত অনুসন্ধান না চালিয়ে কোনো কিছু সম্বন্ধে কী বিশ্বাস করতে হবে সে সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নেয়া একটি বিরাট ভুল কাজ। বস্তুত কোনোরূপ আবেগ, গুজব বা অন্ধ বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে কোনো বিষয়ে কোনো অভিমতে উপনীত হওয়া উচিত নয়; বরং প্রকৃত ঘটনাবলির ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।
আমি ইসলাম সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানি না। প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টান হিসেবে জন্মগ্রহণকারী একজন লোক হিসেবে যীশূ খ্রিস্ট [হযরত ‘ঈসা (আ.)] ও তাঁর শিক্ষার প্রতি আমার বিরাট শ্রদ্ধা আছে। আমি ২০১৪ সালে ইরান সফরের পূর্ব পর্যন্ত আমার কাছে এটা অজানা ছিল যে, ইসলামেরও যীশূ খ্রিস্টের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা রয়েছে। তাহলে আমার শিক্ষকগণ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকগণ কেন আমাকে এ ব্যাপারে অবগত করেন নি? কেনই বা আমাদের প্রচারমাধ্যম এ ব্যাপারে কোনো আভাস দেয় নি?
আমি এ ব্যাপারে আস্থা পোষণ করি যে, ইসলাম সম্বন্ধে এমন অনেক কিছু জানার আছে যা আমাকে বিস্মিত করবে। তাই প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য আমি স্বয়ং ইসলাম সম্বন্ধে অনুসন্ধান চালাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
প্রশ্ন : প্রতীয়মান হয় যে, পশ্চিমা সরকারগুলো বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে পাশ্চাত্যে ইসলাম ও কোরআনকে কোণঠাসা করার এবং এরপর ইসলাম-ভীতি সৃষ্টি করার লক্ষ্যে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য সেখানকার প্রচারমাধ্যমের মূল ধারা-যা প্রধানত যায়নবাদীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত-ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা মিথ্যা ধারণা প্রচার করে চলেছে। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?
উত্তর : পাশ্চাত্য জগতে যুবসমাজকে ইসলাম সম্পর্কে অনুসন্ধানে নিরুৎসাহিত করা হয়ে থাকে। কোনো যুবক যদি ইসলামের ব্যাপারে আগ্রহ প্রদর্শন করে এবং এ সম্বন্ধে অনুসন্ধান করতে থাকে তাহলে তার বন্ধুরা বলাবলি করবে : ‘সে কি সন্ত্রাসবাদী হতে যাচ্ছে?’ ছাত্ররা ইসলাম সম্বন্ধে অনুসন্ধান ও গবেষণা করলে সে সম্পর্কে পুলিশের কাছে রিপোর্ট করা হয়।
আমি ওহিও-র ন্যায় ছোট শহরে বড় হয়েছি। সেখানে আমাকে শিক্ষা দেয়া হয় যে, ইসলাম হচ্ছে একটি ‘সন্ত্রাসবাদী ধর্ম’। আমাকে শিক্ষা দেয়া হয় যে, আমেরিকার ৯-১১-র ঘটনায় যে আক্রমণ সংঘটিত হয় তা হয়েছিল ‘আমাদের স্বাধীনতাকে ঘৃণাকারী মুসলমানদের’ দ্বারা। ইরাক যুদ্ধের সময় আমাদের শহরের যুবকরা কেবল এ কারণে সশস্ত্র বাহিনীতে যোগদানের জন্য নাম লেখায় যে, তারা ‘কিছু মুসলমানকে হত্যা করতে চাচ্ছিল’।
আমেরিকার কোটি কোটি লোক, বিশেষ করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ও মধ্যপশ্চিমাঞ্চলের লোকেরা কখনোই কোনো মুসলমানের সাক্ষাৎ পায় নি এবং নিঃসন্দেহে ইসলাম সম্বন্ধে তাদের কোনোই ধারণা নেই। ইসলাম সম্পর্কে তারা কেবল তা-ই জানে যায়নবাদী প্রচারমাধ্যম যা প্রচার করেছে। অবশ্য শহরগুলোতে সহিষ্ণুতা ও জ্ঞানের মাত্রা অপেক্ষাকৃত বেশি, কিন্তু তা সমগ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করে না।
২০০৪ সালে যখন ইরাকের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালানো হয় তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক লোক মনে করত যে, ওসামা বিন্ লাদেন ও সাদ্দাম হোসেন পরস্পরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং অন্য অনেকে মনে করত যে, ইরান ও সউদি আরব পরস্পরের মিত্র।
মার্কিন প্রচারমাধ্যম মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসের সংক্ষেপণ করছে এবং মুসলমানদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর ও সেখানকার বিভিন্ন মুসলিমপ্রধান দেশের মধ্যকার পার্থক্যকে লুকানোর জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা তাকফিরিদের ও ওয়াহাবিদের সম্পর্কে কোনো কথা বলে না; তারা কেবল ‘মুসলমানদের’ সম্পর্কে কথা বলে এবং তাদেরকে কেবল একটিমাত্র সহিংস চরমপন্থী গোষ্ঠী হিসেবে উপস্থাপন করে থাকে।
তারা তাদের এ উপস্থাপনার দ্বারা ইসরাঈলের সেবা করে যাচ্ছে। এ হচ্ছে যায়নবাদী উপস্থাপনা- যা ইসরাঈলকে ভয়ঙ্কর চরমপন্থীদের দ্বারা ঘেরাও হয়ে থাকা একটি মযলুম রাষ্ট্র হিসেবে প্রদর্শন করছে- যার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য- সহায়তা ও সুরক্ষার খুবই প্রয়োজন বলে তুলে ধরা হচ্ছে।
অবশ্য ইরানের সর্বোচ্চ নেতা তাঁর খোলা চিঠিতে ঠিকই বলেছেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুবপ্রজন্মের মধ্যে এর বাইরে দৃষ্টিপাত করার ক্ষমতা আছে। কেউ যদি প্রকৃত বিষয়ে জানতে চায় তাহলে তথ্যপ্রযুক্তি তার জন্য তা খুবই সহজ করে দিয়েছে।
ইতিপূর্বে যে ‘অকুপাই ওয়াল্ স্ট্রিট্’ আন্দোলন ও ‘ব্লাক লাইভ্স্ ম্যার্টা’ নামে আন্দোলন হয় তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ও তার সরকারের বিরুদ্ধে সেখানকার যুবসমাজের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান অসন্তোষেরই প্রমাণ বহন করে।
আমাদের প্রজন্ম পুরোপুরি অসুখী এবং আমাদের এ অসন্তোষের দ্বারাই আমরা এর জবাব সন্ধানের দিকে পরিচালিত হচ্ছি। এর মানে হচ্ছে, আমাদেরকে ইসলাম সম্পর্কে প্রকৃত সত্য জানতে হবে; শুধু ইসলাম সম্পর্কে নয়; বরং যায়নবাদ, সাম্রাজ্যবাদ এবং যেসব শক্তি ইসলামকে দানবরূপে উপস্থাপন করছে তাদের সম্পর্কেও জানতে হবে।
বস্তুত অসত্য কেবল সাময়িকভাবেই টিকে থাকতে পারে। আর শেষ পর্যন্ত সত্যের আগমন ঘটে, আর যখন তার আগমন ঘটে তখন মিথ্যার ওপরে প্রতিষ্ঠিত সব কিছুই ধসে পড়তে বাধ্য।

যায়নবাদের দ্বারা ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মের মধ্যে সৃষ্ট ফাটল ইরানী নেতার খোলা চিঠির দ্বারা মেরামত হবে : মার্ক গ্লেন
মার্কিন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ভাষ্যকার মার্ক গ্লেন বলেন যে, যেহেতু ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী এ ব্যাপারে ভালোভাবেই অবহিত আছেন যে, সংঘবদ্ধ যায়নবাদী শক্তি যুবপ্রজন্মকে যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মের মধ্যে গভীর বিভক্তি সৃষ্টির অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সেহেতু তিনি তাঁর খোলা চিঠিতে পশ্চিমা যুবসমাজকে সরাসরি সম্বোধন করে কথা বলেছেন।
বার্তা সংস্থা ফার্স্ নিউজ এজেন্সিকে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে মার্ক গ্লেন বলেন, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা ইসলামের যে প্রাথমিক ও মূল তথ্যসূত্র থেকে অর্থাৎ কোরআন থেকে ইসলাম সম্পর্কে জানতে বলেছেন, একজন আমেরিকান খ্রিস্টান হিসেবে সে সূত্র থেকে ইসলামকে জেনে এবং আমার কাছে এর শিক্ষাসমূহের সৌন্দর্য খুবই ভালো লাগায় পাশ্চাত্য যুবসমাজের উদ্দেশে তাঁর এ ধরনের আবেদনে আমি খুবই আপ্লুত হয়েছি।
মার্ক গ্লেনের সাক্ষাৎকারের পূর্ণ বিবরণ নিচে দেয়া হলো :
প্রশ্ন : ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ্ উযমা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী তাঁর এক খোলা চিঠিতে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার যুবসমাজের উদ্দেশে বক্তব্য রেখেছেন। অন্লাইনে প্রকাশিত ও টুইটারে শেয়ারকৃত তাঁর এ পত্রে তিনি পশ্চিমা যুবপ্রজন্মকে ইসলামী শিক্ষা ও মূল্যবোধসমূহ সম্বন্ধে ইসলামের প্রাথমিক ও মূল তথ্যসূত্র থেকে প্রত্যক্ষ জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে ব্যাপক অনুসন্ধান ও গবেষণা চালানোর জন্য আহ্বান জানিয়েছেন এবং এ ব্যাপারে পূর্ব প্রতিষ্ঠিত ধারণা ও বিভ্রান্তিকর অপপ্রচার দ্বারা প্রভাবিত হওয়া থেকে সতর্ক থাকার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?
উত্তর : ইরানের সর্বোচ্চ নেতা ইসলামের যে প্রাথমিক ও মূল তথ্যসূত্র থেকে অর্থাৎ কোরআন থেকে ইসলাম সম্পর্কে জানতে বলেছেন একজন আমেরিকান খ্রিস্টান হিসেবে সে সূত্র থেকে ইসলামকে জেনে এবং আমার কাছে এর শিক্ষাসমূহের সৌন্দর্য খুবই ভালো লাগায় পাশ্চাত্য যুবসমাজের উদ্দেশে তাঁর এ ধরনের আবেদনে আমি খুবই আপ্লুত হয়েছি। অবশ্য বেশির ভাগ লোকই ধারণা করবে যে, তিনি কেবল ব্যক্তিগত কারণে অর্থাৎ ইসলামী বিশ্বাসের প্রতি সমর্থন দানের লক্ষ্যে এটা করে থাকবেন। কিন্তু আমি যা বুঝতে পারছি তা হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে তিনি স্বয়ং যুবসমাজের কল্যাণের লক্ষ্যেই এটা করেছেন। তিনি যথার্থভাবেই এবং নির্ভুলভাবেই বুঝতে পেরেছেন যে, সঙ্ঘবদ্ধ যায়নবাদী শক্তি ইসলামকে কলঙ্কিত ও অবমাননা করার লক্ষ্যে যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারাভিযান চালাচ্ছে তার ভোগান্তি যুবসমাজকেই সবচেয়ে বেশি মাত্রায় পোহাতে হবে। কারণ, ইসরাঈল ও তার জনগণ প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে খ্রিস্টান পাশ্চাত্য ও ইসলামী মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে যে যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছে- যা কখনো শেষ হবার নয়- তার ফলে উপর্যুপরি অনেকগুলো যুদ্ধের জন্য পশ্চিমা যুবসমাজকে চড়া মূল্য দিতে হবে এবং তাদের রক্ত ও অর্থের অপচয় ঘটবে; বরং তাদের অস্তিত্বই হুমকির সম্মুখীন হবে।
অধিকন্তু, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা যথার্থভাবেই ও নির্ভুলভাবেই বুঝতে পেরেছেন যে, যে কোনো সমাজের শক্তির মূল কেন্দ্রই হচ্ছে তার যুবসমাজ এবং এক সময় তারাই তাদের বড়দের কাছ থেকে তাদের দেশের শাসনক্ষমতা গ্রহণ করবে। এ কারণে তিনি যে কোনো দায়িত্বশীল মুরুব্বির ন্যায় তাদের পক্ষ থেকে কথা বলেছেন এবং তাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, তাদের সাথে মিথ্যা বলা হচ্ছে এবং তার পিছনে এমন কারণ নিহিত রয়েছে যা তাদের জন্য ধ্বংস ডেকে আনবে- তাদের স্বার্থ ও তাদের ভবিষ্যতকে গুরুতরভাবে বিপন্ন করবে।
বস্তুত ইরানের সর্বোচ্চ নেতা কেবল ইসলামী জাহানের পক্ষ থেকে ভূমিকা পালন করছেন না; বরং তিনি গোটা বিশ্বের পক্ষ থেকে ভূমিকা পালন করছেন- সঙ্ঘবদ্ধ যায়নবাদী শক্তি নিজের স্বার্থে যা করে যাচ্ছে তাতে যদি তারা সফল হয় তাহলে গোটা বিশ্বই ধ্বংসের কবলে নিক্ষিপ্ত হবে।
প্রশ্ন : কুখ্যাত ফরাসি সাময়িকী ‘শার্লি হেবডো’ তার বিগত ১৪ জানুয়ারি সংখ্যায় ইসলামের মহান নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রতি অবমাননাকর একটি কার্টুন প্রকাশ করে। আইএসআইএল-এর সন্ত্রাসীরা প্যারিসে ‘শার্লি হেবডো’র অফিসে হামলা চালালে এবং এতে কয়েক জন লোক নিহত হলে এ কার্টুনটি প্রকাশ করা হয়। এ সাময়িকীটি বিশ্বের ১৬টি ভাষায় প্রকাশিত হয় এবং প্রায় তিরিশ লক্ষ কপি মুদ্রিত হয়। বিশ্বের মুসলিম নেতৃবৃন্দ এ সাময়িকীটির প্রকাশনার নিন্দা করেছেন এবং এ কার্টুনটি প্রকাশের কাজকে নির্জলা উস্কানি ও যুদ্ধসুলভ কাজ বলে অভিহিত করেছেন। প্যারিসে শার্লি হেব্ডো-র অফিসে সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলা ও সাময়িকীটি কর্তৃক অবমাননাকর কার্টুন প্রকাশের প্রেক্ষাপটে ইরানী সর্বোচ্চ নেতা কর্তৃক তাঁর খোলা চিঠি প্রকাশের জন্য এ সময়টিকে বেছে নেয়ার বিষয়টিকে আপনি কোন্ দৃষ্টিতে দেখছেন?
উত্তর : আমি একজন খ্রিস্টান এবং আমি যাঁদেরকে নবী ও গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে জানি কুখ্যাত শার্লি হেব্ডো প্রকাশনা তাঁদের ওপরেও কলঙ্ক লেপন করেছে, সে হিসেবে আমিও সেই সব ইসলামী নেতার সাথে মতৈক্য পোষণ করতে বাধ্য যাঁরা ঐ প্রকাশনাটিকে একটি উস্কানি ও ‘যুদ্ধসুলভ কাজ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
এ সাময়িকীটি এবং এটির ধর্মের প্রতি অবমাননাকর ইসলামবিরোধী ও খ্রিস্টধর্মবিরোধী কর্মকা- সমাজের উন্নয়ন ও সচেতনতা সৃষ্টিতে রত উচ্চতর চিন্তাধারার অধিকারী পাঠকদের অন্তরকে আহত করেছে। শুধু তা-ই নয়; বরং এ সাময়িকীটি যা কিছু পবিত্র তার ওপরেই স্বীয় নোংরামি ছড়িয়ে দিয়েছে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে আমি এ প্রকাশনাটিকে সঙ্ঘবদ্ধ যায়নবাদী শক্তির গোটা ষড়যন্ত্রের একটি সংবেদনশীল শাখা হিসেবে মনে করি। এর পিছনে তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে ইতিমধ্যেই তারা অসদুদ্দেশ্যমূলকভাবে ইসলামী জাহান ও খ্রিস্টান বিশ্বের উভয়ের গায়ে যে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে- যা ইতিমধ্যেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, তাতে আরো জ্বালানি যোগ করা।
গোটা যায়নবাদী পরিকল্পনার ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে যে ইহুদিবাদ তা কোনো ‘বাঁচ ও বাঁচতে দাও’ নীতিতে বিশ্বাসী মতাদর্শ নয়; বরং এটি হচ্ছে এমন একটি মতাদর্শ যার লক্ষ্য হচ্ছে- নিঃসন্দেহে ইসলাম ও খ্রিস্টধর্ম সহ- তার প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য সমস্ত মতাদর্শকে অবমাননা করা ও শেষ পর্যন্ত উৎখাত করা। এ দু’টি শক্তির বিরুদ্ধে প্রথাগত প্রকাশ্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হবার পরিবর্তে যায়নবাদী শক্তি যা করছে তা হচ্ছে, তারা এ দু’টি ধর্ম ও সংস্কৃতিকে পরস্পরের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে বাধ্য করছে। তারা আশা করছে যে, এর ফলে এ উভয় শক্তিই পরস্পরকে ধ্বংস করে ফেলবে যার পরিণতিতে একমাত্র ইহুদিবাদ ও ইহুদি সরকারই টিকে থাকবে।
এ ক্ষেত্রে শার্লি হেব্ডো খ্রিস্টান পাশ্চাত্য ও ইসলামী মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে উত্তেজনা জিইয়ে রাখার ক্ষেত্রে পুরোপুরিভাবে (যায়নবাদীদের) হাতিয়ার হিসেবে ভূমিকা পালন করছে।

সাক্ষাৎকার গ্রহণে : জাভাদ আরাব শীরাযী

পাশ্চাত্য যুব সমাজের উদ্দেশে ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বারের খোলা চিঠি মাধ্যম ছাড়াই ইসলামের সাথে সরাসরি পরিচিত হও

ইসলামী বিপ্লবের বর্তমান রাহ্বার ও ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয়-রাজনৈতিক নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ্ ‘উয্মা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী গত ২১শে জানুয়ারি ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার যুব সমাজের উদ্দেশে লিখিত এক খোলা চিঠিতে তাদেরকে ইসলাম সম্পর্কে ব্যাপকভাবে যে বিকৃত ধারণা ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে তার স্বরূপ উদ্ঘাটন এবং কোনোরূপ মাধ্যম ব্যতিরেকে সরাসরি ইসলামের সাথে পরিচিত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর এ খোলা চিঠির পূর্ণ বিবরণ নিচে দেওয়া হলো :

বিসমিল্লাহির রাহ্মানির রাহীম।
ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার যুব সমাজ,
ফ্রান্সে সংঘটিত সাম্প্রতিক ঘটনাবলি এবং আরো কোনো কোনো পাশ্চাত্য দেশে সংঘটিত এ ধরনের ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে আমি তোমাদের সাথে সরাসরি কিছু কথা বলার প্রয়োজন অনুভব করেছি।
আমি যে তোমাদেরকে সরাসরি সম্বোধন করে কথা বলছি তার কারণ এ নয় যে, তোমাদের পিতা-মাতাদেরকে উপেক্ষা করছি, বরং এর কারণ এই যে, আমি তোমাদের নিজ নিজ জাতি ও দেশের ভবিষ্যৎ তোমাদের হাতে দেখতে পাচ্ছি, এছাড়াও সত্যসন্ধানী অনুভূতি তোমাদের মধ্যে অধিকতর জীবন্ত এবং তোমাদেরকে অধিকতর সতর্ক হিসেবে লক্ষ্য করছি। তেমনি আমি আমার এ পত্রে তোমাদের রাষ্ট্রনেতাদের ও নীতি নির্ধারকদেরকে সম্বোধন করব না, কারণ, আমি নিশ্চিত যে, তাঁরা সচেতনভাবেই তাঁদের নীতি নির্ধারণের পথকে সত্য ও সততার পথ থেকে পৃথক করে নিয়েছেন।
আমি তোমাদের উদ্দেশে ইসলাম সম্পর্কে, বিশেষ করে তোমাদের সামনে ইসলামের যে চিত্র ও চেহারা প্রদর্শন করা হচ্ছে সে সম্পর্কে কিছু কথা বলতে চাই।
বিগত দুই দশককালেরও আগে থেকেই অর্থাৎ মোটামুটিভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ধসে পড়ার পর থেকে মহান দ্বীন ইসলামকে পাশ্চাত্যের জন্য একটি ভয়ানক শত্রু হিসেবে তুলে ধরার লক্ষ্যে অনেক চেষ্টা চালানো হয়েছে। তবে দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার এই যে, পাশ্চাত্য জগতের রাজনৈতিক ইতিহাসে ইসলামের বিরুদ্ধে ভীতি, আতঙ্ক ও  ঘৃণা-বিদ্বেষের অনুভূতি উস্কে দেয়া এবং এ থেকে সুবিধা হাসিলের অপতৎপরতা দীর্ঘ অতীতের অধিকারী।
এ পর্যন্ত পাশ্চাত্য জাতিসমূহের মনে ইসলাম সম্পর্কে যে ভয়ভীতি সৃষ্টি করা হয়েছে আমি এখানে তার বিবরণ দিতে চাচ্ছি না। কারণ, সাম্প্রতিককালে ইতিহাস নিয়ে যে সমালোচনামূলক গবেষণা হয়েছে তা অধ্যয়ন করলে তোমরা নিজেরাই দেখতে পাবে যে, নতুন ইতিহাসে পাশ্চাত্যের সরকারগুলো অন্যান্য জাতির সাথে ও বিশ্বের সংস্কৃতিসমূহের সাথে আন্তরিকতাবিহীন ও মিথ্যাচার সহকারে আচরণ করার কারণে তিরস্কৃত হয়েছে। ইউরোপ ও আমেরিকার ইতিহাস দাসপ্রথা ও দাসব্যবসার কারণে লজ্জিত, ঔপনিবেশিক যুগের কারণে নতশির এবং রেড ইন্ডিয়ান ও অখ্রিস্টানদের ওপর যুলুম-নির্যাতন ও নিপীড়নের কারণে লজ্জায় মাথা নত করেছে। ক্যাথোলিক ও প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যে ধর্মের নামে এবং জাতীয়তা ও গোষ্ঠীবাদের নামে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যে রক্তপাত হয়েছে সে জন্য তোমাদের ঐতিহাসিকগণ গভীরভাবে লজ্জায় মাথা নত করেছেন।
অবশ্য ঐতিহাসিকদের এ ভূমিকা অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে এ দীর্ঘ ইতিহাসের সামান্য অংশবিশেষ সম্পর্কে আমি যে আভাস দিয়েছি তার উদ্দেশ্য পাশ্চাত্যের ইতিহাসকে তিরস্কার করা নয়; বরং আমি চাই যে, তোমরা তোমাদের সমাজের বুদ্ধিজীবীদের কাছে প্রশ্ন কর যে, কেন পাশ্চাত্য জগতের সর্বজনীন বিবেক সব সময়ই কেবল কয়েক দশক বা কোনো কোনো সময় কয়েক শতককাল দেরীতে জাগ্রত ও সচেতন হয়? কেন তাদের সর্বজনীন বিবেক দূর অতীতের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, চলমান সমস্যাবলির প্রতি দৃষ্টিপাত করে না? কেন ইসলামী সংস্কৃতি ও চিন্তাধারার সাথে আচরণের ধরনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সর্বজনীন সচেতনতা সৃষ্টিকে প্রতিহত করা হয়?
তোমরা বেশ ভালো করেই জান যে, অন্যদেরকে তুচ্ছতাচ্ছিল্যকরণ এবং তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা-বিদ্বেষ আর কাল্পনিক ভীতি ও আতঙ্ক সৃষ্টি সব সময়ই যুলুম-নির্যাতন ও নিপীড়নমূলক সুবিধা সন্ধানের জন্য সাধারণ ক্ষেত্র তৈরি করেছে। এখন আমি চাচ্ছি, তোমরা নিজেদের কাছেই প্রশ্ন করো যে, কেন অতীতের ভীতি ও আতঙ্ক ছড়ানোর নায়করা এবং ঘৃণা-বিদ্বেষ বিস্তারকারীরা নতুন করে এবং নজিরবিহীনভাবে ইসলাম ও মুসলমানদেরকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে? কেন বর্তমান বৈশ্বিক শক্তি কাঠামো ইসলামী চিন্তা-চেতনাকে পাশে ঠেলে রাখার ও প্রতিক্রিয়াশীলে পরিণত করে রাখার জন্য চেষ্টা করছে? প্রশ্ন হচ্ছে, কোন্ বাধা ও ইসলামের কোন্ কোন্ মূল্যবোধ বৃহৎ শক্তিবর্গের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে অসুবিধা সৃষ্টি করেছে এবং তারা যে ইসলামের ভুল চিত্র তৈরি করছে তা থেকে তাদের কোন্ স্বার্থ হাসিল হচ্ছে? সুতরাং তোমাদের কাছে আমার প্রথম আবেদন হচ্ছে এই যে, তোমরা এভাবে ইসলামের ওপর কলঙ্ক লেপনকৃত চিত্র প্রদর্শনের পেছনে নিহিত উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রশ্ন কর এবং তা উদ্ঘাটন কর।
তোমাদের কাছে আমার দ্বিতীয় আবেদন এই যে, ইসলাম সম্পর্কে যে কাল্পনিক মতামত ব্যক্ত করা হয় ও নেতিবাচক প্রচার চালানো হয় তার প্রতিক্রিয়ায় কোনো রকমের মাধ্যম ব্যতীত সরাসরি এ দ্বীনের সাথে পরিচিত হবার চেষ্টা করো। সুস্থ বিচারবুদ্ধি ও যুক্তির দাবি হচ্ছে এই যে, তোমাদেরকে যা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে এবং ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলা হচ্ছে তোমরা অন্তত জানবে যে, আসলে তা কী এবং তার প্রকৃতি কী।
আমি তোমাদেরকে ইসলাম সম্পর্কে আমার বা অন্য যে কারো গৃহীত তাৎপর্যকে গ্রহণ করে নেয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করছি না, বরং বলছি যে, তোমরা কাউকে এ সুযোগ দিয়ো না যে, গতিশীল ও আজকের দুনিয়ায় প্রভাব বিস্তারক এ বাস্তবতাকে তোমাদের সামনে অসদুদ্দেশ্যে ও নোংরা লক্ষ্যে পরিচিত করানো হবে। তোমরা কাউকে এ সুযোগ দিয়ো না যে, তোমাদের সামনে মিথ্যা প্রদর্শনীর লক্ষ্যে তাদেরই নিয়োগকৃত সন্ত্রাসীদেরকে ইসলামের প্রতিনিধি হিসেবে পরিচিত করানো হবে।
তোমরা ইসলামকে তার মৌলিক তথ্যসূত্র ও মূল উৎস থেকে জানার চেষ্টা কর। তোমরা কোরআনের মাধ্যমে এবং ইসলামের মহান নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম)-এর জীবনচরিতের সাহায্যে ইসলামের সাথে পরিচিত হও।
এখানে আমি তোমাদের কাছে প্রশ্ন করতে চাই যে, তোমরা কি এ পর্যন্ত কখনো সরাসরি মুসলমানদের মূল দ্বীনী গ্রন্থ কোরআন অধ্যয়ন করে দেখেছ? তোমরা কি ইসলামের মহান নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম)-এর শিক্ষাসমূহ, বিশেষ করে তাঁর মানবিক ও চারিত্রিক শিক্ষাসমূহ অধ্যয়ন করেছ? তোমরা কি এ পর্যন্ত কখনো প্রচারমাধ্যম ব্যতীত অন্য কোনো উৎস থেকে ইসলামের বাণী লাভ করেছ? তোমরা কি কখনো নিজেদেরকে জিজ্ঞেস করেছ যে, এই ইসলাম কীভাবে এবং কোন্ কোন্ মূল্যবোধের ভিত্তিতে সুদীর্ঘ বহু শতাব্দীকাল যাবৎ বিশ্বের সবচেয়ে বড় জ্ঞান-বিজ্ঞানগত ও চিন্তাগত সংস্কৃতিকে লালন করেছিল এবং শ্রেষ্ঠতম জ্ঞানী-গুণী, বিজ্ঞানী, মনীষী ও চিন্তাবিদগণকে গড়ে তুলেছিল?
তোমাদের কাছে আমার আবেদন এই যে, তোমরা কাউকে এ সুযোগ দিয়ো না যে, ইসলাম সম্পর্কে মনগড়া দুর্বল ও হীন-নীচ চিত্র তৈরি করে তোমাদের ও বাস্তবতার মাঝে ভাবাবেগের বাধার দেয়াল তৈরি করে দেবে এবং তোমাদের কাছ থেকে নিরপেক্ষভাবে বিচার- বিশ্লেষণের ক্ষমতা হরণ করে নেবে।
বর্তমানে তো যোগাযোগমাধ্যম ভৌগোলিক সীমান্তসমূহের বাধার দেয়ালকে চুরমার করে দিয়েছে, এমতাবস্থায় তোমরা কাউকে এ সুযোগ দিয়ো না যে, তোমাদেরকে কৃত্রিম ও মনস্তাত্ত্বিক সীমান্তের মধ্যে বন্দি করে রাখবে। যদিও ইতিমধ্যেই যে ফাটল তৈরি হয়েছে তা কোনো এক ব্যক্তির পক্ষেই মেরামত করা সম্ভব নয়, কিন্তু তোমাদের প্রত্যেকেই নিজের ও স্বীয় পারিপার্শ্বিকতার চিন্তা-চেতনাকে সমুজ্জ্বল করার লক্ষ্যে এ সব ফাটলের ওপর একেকটি চিন্তাগত ও সুবিচারের সেতু নির্মাণ করতে সক্ষম।
যদিও ইসলাম ও তোমাদের মতো যুবকদের মধ্যে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী সৃষ্ট এ চ্যালেঞ্জ খুবই অসহনীয়, তবে তা তোমাদের অনুসন্ধিৎসু মন-মগযে কতগুলো নতুন প্রশ্ন সৃষ্টি করতে পারে। এ সব প্রশ্নের জবাব পাওয়ার প্রচেষ্টা তোমাদের জন্য নতুন বাস্তবতা ও প্রকৃত অবস্থা উদ্ঘাটনের একটি বিরাট সুযোগ এনে দিতে পারে। সুতরাং পূর্বপ্রতিষ্ঠিত ধারণা ব্যতীতই ইসলামকে সঠিকভাবে অনুধাবনের এ সুযোগকে তোমরা হাতছাড়া করো না। তাহলে আশা করা যায় যে, তোমরা সত্য ও প্রকৃত বিষয়ের ব্যাপারে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে পারবে এবং তা করলে তার বদৌলতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মসমূহ পাশ্চাত্য ও ইসলামের মধ্যকার আন্তঃক্রিয়ার ইতিহাসের এ অধ্যায়টি অপেক্ষাকৃত কম কষ্ট স্বীকার করে এবং নিশ্চিন্ত বিবেক সহকারে লিপিবদ্ধ করতে সক্ষম হবে।

সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী
১লা বাহ্মান্ ১৩৯৩ ইরানী সাল
(২১শে জানুয়ারি ২০১৫)
অনুবাদ : নূর হোসেন মজিদী

সম্পাদকীয়

ইসলামী বিপ্লবের গৌরবময় অভিযাত্রার ছত্রিশ বছর
১১ই ফেব্রুয়ারি ইরানের মহান ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের ছত্রিশতম বার্ষিকী। এখন থেকে ছত্রিশ বছর আগে ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দের এ দিনে মহান দ্বীনী নেতা ওয়ালীয়ে কামেল হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.)-এর প্রাজ্ঞ ও দূরদর্শী নেতৃত্বে ইরানের ইসলামপ্রিয় জনগণ আড়াই হাজার বছরের স্বৈরাচারী রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ও সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার পদলেহী তৎকালীন শাহের ইসলামবিরোধী ও গণদুশমন সরকারকে উৎখাত করে মহান ইসলামী বিপ্লবকে বিজয়ী করেন। এ বিজয়ের অব্যবহিত পরেই ইরানী জনগণ প্রায় সর্বসম্মত রায়ে ইরানের বুকে একটি পূতপবিত্র আদর্শ দ্বীনী সমাজ ও জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকারব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন।
মানুষের ইহ ও পরকালীন জীবনের সর্বোত্তম কল্যাণ ও সাফল্য নিশ্চিতকারী দ্বীন ইসলামের আদর্শে উদ্বুদ্ধ এ বিপ্লবের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের অভিযাত্রায় ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানী জনগণের দ্বীনী ও চারিত্রিক উন্নয়নের পাশাপাশি পার্থিব উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং আট বছরব্যাপী চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ ও বলদর্পী শক্তিবর্গের চাপিয়ে দেয়া অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও দেশকে স্বনির্ভরতার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেÑ যা শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সমগ্র বিশ্ববাসীর বিস্ময়ের কারণ হয়েছে।
বিগত পঁয়ত্রিশ বছরে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান কূটনৈতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সহ সার্বিক ক্ষেত্রে বিস্ময়কর উন্নতি ও অগ্রগতি হাসিল করেছে, বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সাক্ষরতা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, টেলিফোন, মোবাইল, বিজ্ঞানগবেষণা, বিশেষত আইটি, পরমাণু বিজ্ঞান, ন্যানো-টেকনোলজি, সড়ক, রেল ও বিমান যোগাযোগ, কৃষি, শিল্প, বৈদেশিক বাণিজ্য ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি করেছে এবং এগুলোর মধ্য থেকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উন্নতির গতি বা হারের দিক থেকে বিশ্বের বুকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে শীর্ষস্থান দখল করতে সক্ষম হয়েছে।
সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও ইসলামী ইরান অবিশ্বাস্য সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে। ইসলামী নৈতিক মান রক্ষা করে ইরানে নির্মিত বহু চলচ্চিত্র সারা বিশ্বে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে এবং এমনকি পাশ্চাত্য জগতেও বহু পুরস্কার লাভ করেছে।
তবে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের সবচেয়ে বড় সাফল্য সারা দুনিয়ার মানুষকে ইসলামের সঠিক রূপের সাথে অধিকতর পরিচিত করানো এবং ইসলামী উম্মাহ্কে ঐক্যের পথে আরো বেশি অগ্রসর হতে উদ্বুদ্ধকরণ। সারা দুনিয়ার ইসলামপ্রিয় মানুষ আজ ইরানের ইসলামী বিপ্লবকে অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে গ্রহণ করছেন এবং বর্তমান যুগেও যে ইসলামী আদর্শে রাষ্ট্র পরিচালনা করে জাতির আদর্শিক ও পার্থিব উন্নতি নিশ্চিত করা সম্ভব তার দৃষ্টান্ত হিসেবে তাঁরা ইরানের ইসলামী বিপ্লবের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করছেন। শুধু তা-ই নয়, ইরানের ইসলামী বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ হয়ে ও ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সার্বিক সহায়তায় ফিলিস্তিন ও লেবাননের মুসলিম জনগণ হামাস ও হিযবুল্লাহ্র নেতৃত্বে অবৈধ যায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরাঈলের বিরুদ্ধে কঠিন ও সফল প্রতিরোধ গড়ে তুলে এক নতুন ইতিহাস গড়ে তুলেছেন- যার ফলে ইসলামের প্রথম ক্বিবলা বায়তুল মুকাদ্দাস সহ সমগ্র পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিনকে মুক্ত করার ব্যাপারে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ্র মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে।
ইসলাম হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে সমগ্র মানব জাতির ইহ-পরকালীন মুক্তির জন্য নাযিলকৃত পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। কিন্তু মানবতার দুশমনরা সব সময়ই এ মুক্তির আদর্শ থেকে বিশ্ববাসীকে দূরে সরিয়ে রাখার লক্ষ্যে সর্বাত্মকভাবে অপচেষ্টা তথা ইসলামের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিকর অপ্রপচার চালিয়ে আসছে এবং সাম্প্রতিককালে সেই সাথে নতুন ষড়যন্ত্র যুক্ত হয়েছে; তারা পরিকল্পিতভাবে অজ্ঞ মুসলমানদের মধ্যে উগ্র ধর্মান্ধতা বপন করে তাদের মধ্য থেকে ইসলামের নামে বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী তৈরি করেছে যারা শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে অন্য মুসলমানদেরকে হত্যা করছে এবং একে বাহানা হিসেবে ব্যবহার করে ইসলামের দুশমনরা ইসলামকে একটি সন্ত্রাসবাদী ধর্ম হিসেবে চিহ্নিত করে বিশ্ববাসীর মধ্যে ইসলামের বিরুদ্ধে ঘৃণা-বিদ্বেষ সৃষ্টির ও তাদেরকে মহান দ্বীন ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হবার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইরানের ইসলামী বিপ্লবের বিজয়, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিস্ময়কর সাফল্য এবং প্রকৃত ইসলামের প্রচারকদের অক্লান্ত প্রচারতৎপরতার কারণে অমুসলিমদের মধ্যে, বিশেষ করে পাশ্চাত্য জগতে ইসলাম গ্রহণের হার ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ধারাক্রমে সম্প্রতি ইসলামী বিপ্লবের বর্তমান রাহ্বার হযরত আয়াতুল্লাহ্ উয্মা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী এক খোলা চিঠিতে ইসলাম সম্বন্ধে বিভ্রান্তিকর অপপ্রচারে প্রভাবিত না হয়ে এ দ্বীন সম্পর্কে সরাসরি এর মূল সূত্র থেকে জানার জন্য পাশ্চাত্যের যুব সমাজের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন এবং এ আহ্বানে ইতিমধ্যেই যথেষ্ট সাড়া পাওয়া যাচ্ছে বলে জানা গেছে। আশা করা যায়, ইসলামী ইরানের প্রচেষ্টার ফলে বিশ্ববাসী অচিরেই প্রকৃত ইসলামের সাথে অধিকতর পরিচিত হতে সক্ষম হবে এবং তা বিশ্বপরিস্থিতির গতিপ্রকৃতিকে এক আলোকোজ্জ্বল নতুন পথের দিকে ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম হবে।
ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের ছত্রিশতম বার্ষিকীতে আমরা দেশে-বিদেশে অবস্থানরত ইরানী জনগণ, বিশ্বের মুক্তিকামী মুস্তায্‘আফ্ জনগণ, ইসলামী বিপ্লবের সমর্থকগণ, ইসলামী ইরানের শুভানুধ্যায়িগণ ও নিউজলেটারের পাঠক-পাঠিকাগণের প্রতিম আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি এবং এ বিপ্লবের স্থায়িত্ব, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সার্বিক উন্নয়ন তৎপরতায় অধিকতর গতি সঞ্চার ও বিশ্ববাসীকে ইসলামের সঠিক রূপের সাথে পরিচিত হবার তাওফীক প্রদানের জন্য আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করছি।

স্মরণীয় বাণী

মহানবী (সা.) বলেন : জ্ঞানীদের কাছে প্রশ্ন কর আর হাকিমদের (প্রজ্ঞাবানদের) সাথে সংলাপ কর আর দরিদ্রদের সাথে ওঠাবসা কর।

মহানবী (সা.) বলেন : তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি আমার থেকে সবচেয়ে দূরে যে কৃপণ, কুভাষী ও গালমন্দকারী।

মহানবী (সা.) বলেন : তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে সদাচারীরাই হলো সর্বোত্তম যারা (অপরের সাথে সহজেই) সম্পর্ক গড়ে এবং (তাদের) সম্প্রীতির আহ্বানকে গ্রহণ করে।

মহানবী (সা.) বলেন : লজ্জা দু’টি : বুদ্ধিমত্তার লজ্জা আর বোকামিপ্রসূত লজ্জা। বুদ্ধিমত্তার লজ্জা জ্ঞানের পরিচয় বহন করে আর বোকামিপ্রসূত লজ্জা মূর্খতার পরিচায়ক।

ইমাম আলী (আ.) তাঁর পুত্র ইমাম হোসাইন (আ.)-কে বলেন : …প্রিয় পুত্র আমার! যে ব্যক্তি স্বীয় ত্রুটি দেখে সে অন্যের ত্রুটি থেকে বিরত থাকে। আর যে ব্যক্তি খোদাভীতির পরিচ্ছদ না পরে, কোনো পোশাকই তাকে ঢাকতে পারে না। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ্র বরাদ্দে সন্তুষ্ট থাকে, সে কোনো কিছু হারালে দুঃখ পায় না।

ইমাম আলী (আ.) বলেন : তোমাদের দিনকে এরূপ-সেরূপ আর ‘এই করেছি, সেই করেছি’ বলে পার কর না। কারণ, তোমাদের সাথে প্রহরীরা রয়েছেন যাঁরা তা লিপিবদ্ধ করছেন। মহান আল্লাহ্কে সর্বক্ষণ ও সর্বস্থানে স্মরণ করবে। রাসূল (সা.) ও তাঁর পরিবারবর্গের ওপর দরুদ প্রেরণ কর। কেননা, আল্লাহ্ তোমাদের দোয়াকে তাঁর নবীর স্মরণের মধ্যে এবং তাঁকে মেনে চলার মধ্যে গ্রহণ করেন।

ইমাম আলী (আ.) বলেন : গরম খাবার রেখে দাও যাতে ঠাণ্ডা এবং খাওয়ার উপযোগী হয়। কারণ, রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-কে গরম খাবার পরিবেশন করা হলে তিনি বলেন : ‘ওটাকে রেখে দাও, ঠাণ্ডা হোক, যাতে খাওয়া যায়।’ আল্লাহ্ গরমকে আমাদের ভক্ষণ না করান। আর কল্যাণ রয়েছে ঠাণ্ডার মধ্যে। গরমের কোনো কল্যাণ নেই।

ইমাম হাসান (আ.) বলেন : যেসব লোক পরস্পর পরামর্শ করে চলে তারা সঠিক পথে পরিচালিত হয়।

ইমাম হাসান (আ.) বলেন : যে কল্যাণে কোনো অকল্যাণ নেই তা হলো নেয়ামতের সময় কৃতজ্ঞতা আর বিপদে ধৈর্যধারণ।

ইমাম বাকের (আ.) বলেন : সর্বোচ্চ পূর্ণতা হলো দীনের উপলব্ধি, অনাকাক্সিক্ষত অবস্থায় ধৈর্যধারণ এবং পরিমিত জীবিকায় জীবনধারণ করা।

ইমাম বাকের (আ.) বলেন : তিনটি জিনিস রয়েছে যা দুনিয়া ও পরকালে সম্মান বয়ে আনে : তোমার প্রতি যে যুলুম করেছে তাকে ক্ষমা করা, তোমার সাথে যে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে তার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা আর তোমার প্রতি যখন মূর্খতা প্রদর্শন করা হয় তখন সহিষ্ণু হওয়া।

ইমাম মূসা কাযেম (আ.) বলেন : মুমিন হলো দাড়িপাল্লার দুই পাল্লার মতো। যতই তার ঈমান বৃদ্ধি পায় তার বিপদও বৃদ্ধি পায়।

ইমাম রেযা (আ.) বলেন : যে ব্যক্তি তার ভরণপোষণাধীনদের জীবিকা নির্বাহ করার জন্য রুজি অন্বেষণ করে তার পুরস্কার আল্লাহর কাছে জিহাদকারীর চেয়েও বড়।

সংবাদ বিচিত্রা (বিদেশী সংবাদ)

নতুন বছরে আরো ভালো অর্থনীতি উপহারের ঘোষণা দিলেন রুহানি
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি নতুন ফারসি বছরে আরো ভালো অর্থনীতি উপহার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি চলতি নতুন বছরে দেশে টেকসই উন্নয়ন, নতুন চাকরির ক্ষেত্র সৃষ্টি এবং তেলবহির্ভূত খাত থেকে রপ্তানি আয় বাড়ানোর অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
২১ মার্চ ফারসি নতুন বছর শুরুর দিন সকালে জাতির উদ্দেশে দেয়া এক বাণীতে প্রেসিডেন্ট রুহানি এ কথা বলেন। প্রতিরোধমূলক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকারকে সহযোগিতা করার জন্য তিনি জনগণের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, জনগণের সমর্থন ছাড়া মুদ্রাস্ফীতি, অর্থনৈতিক মন্দা ও তেলের ওপর নির্ভরতা কমানো সম্ভব হতো না।
ড. রুহানি তাঁর বাণীতে ইরান ও ছয় জাতিগোষ্ঠীর মধ্যকার পরমাণু আলোচনা নিয়েও কথা বলেন। তিনি বলেন, জনগণের সহযোগিতায় প্রতিরোধমূলক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার ফলে বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে আলোচনায় বিজয় অর্জনের পথ খুলে গেছে। তিনি আরও বলেন, ছয় জাতিগোষ্ঠীসহ বড় বড় দেশ বুঝতে সক্ষম হয়েছে যে, ইরানের ওপর আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা ও হুমকি ব্যর্থ হয়েছে।
প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক জোরদার করার কথা উল্লেখ করে ইরানের প্রেসিডেন্ট বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে তেহরানের সমর্থন অব্যাহত থাকবে। মধ্যপ্রাচ্য ও সারা বিশ্ব থেকে সন্ত্রাসবাদ এবং চরমপন্থা নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত ইরান এ সমর্থন অব্যাহত রাখবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
উল্লেখ্য, গত বছরে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী প্রতিরোধমূলক অর্থনীতি বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছিলেন। সে নীতির আওতায় ইরান জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলা ও অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ানো এবং আমদানি নির্ভরতা কমানোর কর্মসূচি হাতে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

‘ইরানের জাতীয় ও বৈশ্বিক লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়নযোগ্য’
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী ইসলামী এই দেশটির সার্বিক উন্নয়ন জোরদারের লক্ষ্যে সরকার ও জনগণের পারস্পরিক সহযোগিতার ওপর জোর দিয়েছেন। গত ২১ মার্চ নওরোজ বা ফারসি নতুন বছর (১৩৯৪) শুরু হওয়া উপলক্ষে দেয়া এক বাণীতে তিনি সরকার ও জনগণের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার পাশাপাশি আন্তরিকতা, সহমর্মিতা ও পারস্পরিক আস্থা জোরদারের ওপরও গুরুত্ব দেন। তিনি নতুন এই বছরের জন্য ‘সরকার ও জাতি, সহমর্মিতা ও একই সুর’- শীর্ষক সেøাগান নির্ধারণ করেন।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেন, যদি (সরকার ও জনগণ) উভয় পক্ষই পরস্পরকে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করে তাহলে আমাদের তথা সরকার ও জনগণের আশাগুলো অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে। তিনি বলেন, তাদের পারস্পরিক আন্তরিকতা, সহমর্মিতা ও সহযোগিতাগুলো যতই বাড়বে ততই কাজের অগ্রগতিও বাড়বে।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা এ প্রসঙ্গে আরো বলেন, সরকারকে অবশ্যই জাতির সেবক হতে হবে এবং জনগণই সরকারকে নিয়োগ দিয়েছে। তাই সরকারের উচিত প্রকৃত অর্থেই জাতির মূল্যবোধ, গুরুত্ব ও ক্ষমতাগুলোকে স্বীকৃতি দেয়া এবং জনগণেরও উচিত প্রকৃত অর্থেই সরকারের ওপর আস্থা রাখা।
আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রিয় কন্যা হযরত ফাতেমা যাহরা (সালামুল্লাহি আলাইহা)-এর শাহাদাত (৩ জমাদিউস সানি, ২৪ মার্চ) বার্ষিকী উপলক্ষে শোক প্রকাশ করে বলেন, এই মহীয়সী নারীর উসিলায় নতুন বছরটি সবার জন্য অফুরন্ত বরকত বা প্রাচুর্য বয়ে আনবে এবং তাঁর (পুণ্য) স্মৃতি চলতি বছর আমাদের জনগণের জীবনে গভীর ও স্থায়ী প্রভাব রাখবে বলে আশা করছি।
তিনি নতুন ফারসি বছরে অর্থনৈতিক অগ্রগতি, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শক্তিমত্তা ও সম্মান, জ্ঞান-বিজ্ঞানে প্রকৃত অর্থেই বড় ধরনের অগ্রযাত্রা, বিচার ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার এবং সর্বোপরি ঈমান ও আধ্যাত্মিক উন্নয়নকে জনগণের কয়েকটি বড় ও বাস্তবায়নযোগ্য স্বপ্ন হিসেবে অভিহিত করেন।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বিগত বছরে ইসলামী বিপ্লবের বিজয় বার্ষিকীর শোভাযাত্রাসহ বিশ্ব কুদ্স দিবসের মিছিলে এবং হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের চল্লিশার শোক-মিছিলে ব্যাপক হারে অংশ নেয়ার জন্য জনগণের প্রশংসা করে বলেছেন, এতে ইরানী জাতির দৃঢ় প্রত্যয় ফুটে উঠেছে।

ফ্রান্সের পেজো গাড়ি কোম্পানি ইরানে কাজ শুরু করতে রাজি; চুক্তি সই
ফ্রান্সের বিখ্যাত গাড়ি কোম্পানি পিএসএ পেজো-সিতরোন ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে আবার কাজ শুরু করতে রাজি হয়েছে। এই লক্ষ্যে ইরানের গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ‘ইরান খোদরো’র সঙ্গে একটি চুক্তি করেছে পেজো।
চুক্তির আওতায় ফরাসি কোম্পানি ইরানে একটি যৌথ কারখানা প্রতিষ্ঠা করবে যেখানে তাদের থাকবে শতকরা ৫০ ভাগ বিনিয়োগ আর ইরান খোদরোর থাকবে বাকি ৫০ ভাগ পুঁজি।
ইরানের মেহের নিউজের বরাত দিয়ে প্রেস টিভি জানায়, যৌথ কারখানায় উৎপাদিত গাড়ির শতকরা ৩০ ভাগ বিদেশে রপ্তানি করা হবে। আর এরপর থেকে ইরান খোদরো কোনো গাড়ি দেশে অ্যাসেম্বল করবে না।
উল্লেখ্য, ২০১১ সালে আমেরিকা ও ইউরোপ ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পর চীনা গাড়ি কোম্পানি ইরানের বাজারে প্রবেশ করে। সেই থেকে চীন মাঝারি ও ভারী ধরনের ট্রাক এবং যাত্রীবাহী গাড়ি সরবরাহ করে আসছে।

হামাসের বিরুদ্ধে দেয়া মিশরের আদালতের রায়ের কঠোর প্রতিবাদ জানালো ইরান
মিশরের একটি আদালত অধিকৃত গাজা উপত্যকা নিয়ন্ত্রণকারী ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসকে ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠী’ হিসেবে অভিহিত করায় ইরান কঠোর ভাষায় তার প্রতিবাদ জানিয়েছে।
কায়রোর আদালতের এ রায়কে নিন্দা জানিয়ে ইরানের আরব এবং আফ্রিকা বিষয়ক উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ান গত ১ মার্চ বলেন, হামাস কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী নয়।
তিনি ইহুদিবাদী ইসরাইলকে অবৈধ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, হামাস এবং আরেকটি ফিলিস্তিন প্রতিরোধ আন্দোলন ইসলামি জিহাদ’ এর মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়েছে তেল আবিব।
এ ছাড়া, মিশরের ইখওয়ানুল মুসলেমিন সম্পর্কে ইরানের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন তিনি। তিনি বলেন, মিশরের বিরাজমান বাস্তবতার অংশই হলো ইখওয়ানুল মুসলেমিন। মিশর সরকারের রাজনৈতিক বিরোধী দল এবং সন্ত্রাসীদের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোনো পক্ষ সন্ত্রাসের আশ্রয় নিলে সমগ্র বিশ্ব তার নিন্দা জানাবে।
এ ছাড়া, একই সঙ্গে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ইরানের অবস্থানও পরিষ্কার ভাবে তুলে ধরেন আবদুল্লাহিয়ান। তিনি বলেন, মিশর, ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন, আফ্রিকা এবং এশিয়াসহ সব জায়গার সব ধরনের সন্ত্রাসবাদকে কঠোর ভাবে নিন্দা করে ইরান।
এদিকে হামাসের মুখপাত্র সামি আবু জুহরি এরই মধ্যে মিশরের আদালতের রায় প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, এটি একটি ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত যা কেবল দখলদার ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষা করবে।

রাশিয়ায় ক্যান্সারের ওষুধ রফতানি করবে ইরান
ইরান এই প্রথমবারের মতো ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ রাশিয়ায় রফতানি করবে। চলতি বছরের চতুর্থ ত্রৈমাসিকে উচ্চ মূল্যমানের এসব ওষুধ রফতানি করা হবে। ইরানের শীর্ষস্থানীয় ওষুধ নির্মাণকারী কোম্পানি তৌফিক দারু’র বাণিজ্যিক বিভাগের প্রধান রুহুল্লাহ হায়দারি গত ১৫ মার্চ এ কথা জানান।
তিনি বলেন, রাশিয়ায় যেসব ওষুধ রফতানির পরিকল্পনা করা হয়েছে তার মধ্যে মাল্টিপল স্কেলেরোসিস বা এমএস এবং নানা ধরনের ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ রয়েছে। লাতিন আমেরিকা, তুরস্ক ও পাকিস্তানের বাজারেও এ জাতীয় ওষুধ রফতানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইরান। বর্তমানে ইরান বছরে ২২ কোটি ডলারের সমপরিমাণ ওষুধ রফতানি করছে।

এক বছরে ১০০ কোটি ঘন মিটার প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানি করেছে ইরান
ইরানের ন্যাশনাল ইরানিয়ান গ্যাস কোম্পানি বা এনআইজিসি’র প্রধান হামিদ রেযা আরাকি বলেছেন, গত ফারসি বছরে আগের বছরের তুলনায় ইরানের গ্যাস রপ্তানির পরিমাণ আট শতাংশ বেড়েছে। তিনি গত ১০ এপ্রিল সাংবাদিকদের বলেন, গত বছরে ইরান ১০০ কোটি ঘন মিটার প্রাকৃতিক গ্যাস রফতানি করেছে। উল্লেখ্য, মার্চ মাসের ২০ তারিখে গত ফারসি বছর শেষ হয়েছে।
বর্তমানে তুরস্ক ও আর্মেনিয়ার কাছে গ্যাস রপ্তানি করছে ইরান এবং ইরাকের কাছে গ্যাস রপ্তানি চলতি বছর শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। ২০১১ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে ইরানী গ্যাস আমদানি শুরু করেছে তুরস্ক।

ইরানে যথাযোগ্য মর্যাদায় ইসলামী প্রজাতন্ত্র দিবস পালন
গত ১ এপ্রিল ইরানে যথাযোগ্য মর্যাদায় ৩৬তম ইসলামী প্রজাতন্ত্র দিবস পালন করা হয়। ১৯৭৯ সালে হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.)-এর নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের মাত্র দুই মাস পর গণভোটের মাধ্যমে ইরানের জনগণ ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। জনগণ ইসলামী প্রজাতন্ত্র চায় কিনা জানতে চেয়ে এই গণভোটের আয়োজন করা হয়। এতে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের পক্ষে ৯৮ দশমিক ২ শতাংশ ভোট পড়েছিল। ৩৬ বছর পরও ইসলামী প্রজাতন্ত্রের প্রতি ইরানী জনগণের সেই আনুগত্য অব্যাহত রয়েছে।

ইয়েমেন সংকট নিরসনে ইরানের ৪ দফা শান্তি পরিকল্পনা
গত ১৪ এপ্রিল স্পেন সফরের সময় ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাওয়াদ জারিফ ইয়েমেন সংকট নিরসনে তেহরানের চার দফা শান্তি পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন।
এই পরিকল্পনা উপস্থাপনের সময় তিনি বলেন, বিদেশি হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকে ইয়েমেনের জনগণকে তাদের ভাগ্য নির্ধারণের সুযোগ দিতে হবে।
অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি কার্যকরী করা, ইয়েমেনের যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের জন্য ত্রাণ সামগ্রী প্রেরণ, আন্ত-ইয়েমেনি সংলাপ শুরু করা এবং ব্যাপকভিত্তিক জাতীয় সরকার গঠনের কথা প্রস্তাবিত শান্তি পরিকল্পনায় বলা হয়েছে।
ইরানের শীর্ষ কূটনীতিবিদ আবারো ইয়েমেনের বিরুদ্ধে সামরিক আগ্রাসন বন্ধে আলে সৌদ কর্তৃপক্ষের কাছে আহ্বান জানিয়ে বলেন, আরব উপদ্বীপের এ দেশটির বিরুদ্ধে ভয়াবহ হামলা সেখানে চলমান সংঘর্ষের কোনো জবাব এনে দেবে না।
আমেরিকাকে হারিয়ে কুস্তিতে চ্যাম্পিয়ন হলো ইরান
লস অ্যাঞ্জেলেসে বিশ্ব কুস্তি প্রতিযোগিতায় স্বাগতিক আমেরিকাকে পরাজিত করে টানা চতুর্থবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ইরান। গত ১৩ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ফাইনাল রাউন্ডে আমেরিকার কুস্তি দলকে ৫-৩ পয়েন্টে পরাজিত করে এ গৌরব অর্জন করে ইরান। আগের কয়েকটি রাউন্ডে বেলারুশিয়াকে ৮-০ পয়েন্টে, তুরস্ককে ৭-১ পয়েন্টে এবং আযারবাইজানকে ৭-১ পয়েন্টে পরাজিত করে ইরানী কুস্তি দল। বিশ্ব কুস্তি প্রতিযোগিতায় এ নিয়ে ছয় বার চ্যাম্পিয়ন হলো ইরান।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী এক বার্তায় দেশের কুস্তিগীর ও কুস্তি-প্রশিক্ষকদের শুভেচ্ছা জানান। তিনি শুভেচ্ছা বার্তায় বলেন, ইরানের সন্তানেরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আবারও জাতির জন্য সম্মান বয়ে এনেছে। এজন্য আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করছি।

আইআরজিসি দক্ষিণ- পূর্ব ইরানের সন্ত্রাসী চক্রকে নির্মূল করেছে
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিপ্লবী রক্ষী বাহিনী (আইআরজিসি) দক্ষিণ- পূর্ব ইরানে তৎপরতা পরিচালনাকারী একটি সন্ত্রাসী চক্রকে পুরোপুরি নির্মূল করে দিয়েছে। আইআরজিসি-র কুদ্স্ সদর দফতরের জনসংযোগ বিভাগ থেকে প্রচারিত সংবাদ অনুযায়ী এ সন্ত্রাসী চক্রটি একটি বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার দ্বারা গড়ে তোলা হয়েছিল।
আইআরজিসি-র জনসংযোগ বিভাগ থেকে প্রচারিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দক্ষিণ-পূর্ব ইরানের নিক্শাহ্র্ এলাকায় তৎপরতা পরিচালনাকারী এ সন্ত্রাসী চক্রটির নাম ক্বাস্রে ক্বান্দ্ (মিছরির প্রাসাদ); আইআরজিসি এ চক্রটির সদস্যদেরকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছে।
আইআরজিসি-র সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরো জানানো হয় যে, আইআরজিসি এ অভিযানে সন্ত্রাসী চক্রটিকে ধ্বংস করা ছাড়াও তাদের কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে অস্ত্র, গোলা-বারুদ, যুদ্ধে ব্যবহারোপযোগী যানবাহন এবং যোগাযোগ কার্যে ব্যবহার্য যন্ত্রপাতি ও উপকরণ উদ্ধার করেছে।

রাহ্বার কর্তৃক কয়েদীদের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ দ্বীনী ও রাজনৈতিক নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ্ ‘উয্মা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী সংবিধান প্রদত্ত ক্ষমতাবলে কয়েকশ’ দ-প্রাপ্ত কয়েদির দ- ক্ষমা বা হ্রাস করেছেন। ইসলামী প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে এ উপলক্ষে গত ৩১শে মার্চ (২০১৫) তিনি এ ক্ষমা ঘোষণা করেন।
উল্লেখ্য, ইরানী বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী ১২ই র্ফার্ভাদীন্ (পয়লা এপ্রিল) ইরানের ইসলামী প্রজাতন্ত্র দিবস। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ উৎসবের মধ্য দিয়ে ইরানের ইসলামী প্রজাতন্ত্র দিবস উদ্যাপিত হয়। এ উপলক্ষে রাহ্বার আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী ৮০৯ জন দ-প্রাপ্ত কয়েদির অবশিষ্ট শাস্তি মওকূফ করে দেন বা শাস্তির মেয়াদ হ্রাস করে দেন। এ সব কয়েদি ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিভিন্ন সাধারণ, বিপ্লবী ও সামরিক আদালত কর্তৃক দ-প্রাপ্ত হয়েছিল। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিচার বিভাগের প্রধান হযরত আয়াতুল্লাহ্ সাদেক অমোলীর সুপারিশক্রমে শাস্তি ভোগ কালে উত্তম ও সুশৃঙ্খল আচরণ ও নৈতিক মানোন্নয়নের পরিচয় প্রদানকারী এ সব কয়েদির শাস্তি মওকূফ বা হ্রাস করা হয়।
উল্লেখ্য, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধানের ১১ নং অধ্যায়ের ১১০ নং ধারায় রাহ্বারকে যথোপযুক্ত কয়েদিদের শাস্তির মেয়াদ মওকূফ বা হ্রাস করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তবে শাস্তি মওকূফ ও হ্রাসের এ ধারা সব ধরনের অপরাধীদের জন্য প্রযোজ্য নয়। যে সব ধরনের অপরাধীদের জন্য এ ধারা প্রযোজ্য নয় তাদের মধ্যে রয়েছে বিশেষভাবে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংঘাতে লিপ্ত হবার অপরাধে শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা এবং সশস্ত্র ও সংঘবদ্ধ মাদক দ্রব্য চোরাচালান, ধর্ষণ, সশস্ত্র ডাকাতি, সশস্ত্র চোরাচালান, গুম করণ, উৎকোচ প্রদান ও গ্রহণ বা অগ্নি সংযোগের অপরাধে শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা।

সরকার রাহ্বারের কাছে কৃতজ্ঞ : প্রেসিডেন্ট রুহানি
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি রাহ্বার হযরত আয়াতুল্লাহ্ ‘উয্মা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী বরাবরে লিখিত এক পত্রে সরকারকে তার কর্মকা-ে এককভাবে সহায়তা ও সমর্থন প্রদানের জন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। এছাড়া প্রেসিডেন্ট রুহানি রাহ্বারের নির্দেশ ও পথনির্দেশনাসমূহ পুরোপুরি ও যথাযথভাবে মেনে চলার জন্য প্রজাতন্ত্রের সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
রাহ্বার যে সরকারের প্রতি পরিপূর্ণ মনোযোগ সহকারে দৃষ্টি রাখেন এবং সরকারকে পূর্ণাঙ্গ সহায়তা ও সমর্থন প্রদান করেন সে জন্য তিনি আনন্দ প্রকাশ করেন এবং প্রজাতন্ত্রের সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ দেশের সকল জনগণের প্রতি রাহ্বারের উপদেশ মেনে চলার জন্য আহ্বান জানিয়ে এ মর্মে আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, জনগণ যে মধ্যমপন্থী সরকারকে নির্বাচিত করেছেন সকল ক্ষেত্রের কর্মকা-ে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সে সরকারকে সহায়তা করে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে নিশ্চিত করবেন।
প্রেসিডেন্ট রুহানি আরো বলেন, সরকার জনগণের খেদমত করাকে স্বীয় প্রাথমিক দায়িত্ব বলে মনে করে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রেসিডেন্ট জোর দিয়ে বলেন, সরকার সব সময়ই সমালোচনাকে স্বাগত জানায় এবং দেশ শাসনের ক্ষেত্রে সকল বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির কাছ থেকে সাহায্য ও পরামর্শ চায়। তিনি জোর দিয়ে বলেন, এতে সন্দেহের অবকাশ নেই যে, চূড়ান্ত লক্ষ্যসমূহ অর্জন করতে হলে সরকারের সকল সংস্থাকে যথোপযুক্ত হতে হবে এবং জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় করার লক্ষ্যকে সামনে রেখে কাজ করে যেতে হবে।
রাহ্বার হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী জাতীয় অর্থনীতিকে সুসংহতকরণ এবং মানব সম্পদ ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ ও সম্ভাবনার পরিপূর্ণ ব্যবহারের ভিত্তিতে পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধনের জন্য যে পরামর্শ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট রুহানি তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, অর্থনৈতিক কর্মতৎপরতার ক্ষেত্রে আরো বেশি প্রচেষ্টা চালানো ও আস্থা সৃষ্টির ক্ষেত্রে সরকারের প্রতি রাহ্বারের সমর্থন ও সহায়তা একটি মূল্যবান সম্পদস্বরূপ এবং তা সরকারকে কর্ম পরিবেশের উন্নয়ন, উৎপাদন ইউনিটগুলোকে ও বিজ্ঞানভিত্তিক ফার্মগুলোকে সহায়তা প্রদান এবং সেই সাথে দুর্নীতি ও চোরাচালান দমনে প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে সরকারকে উৎসাহিত করছে।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প সংক্রান্ত আলোচনায় রাহ্বারের পক্ষ থেকে সরকারকে প্রদত্ত নিঃশর্ত সমর্থনে প্রেসিডেন্ট রুহানি সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং জোর দিয়ে বলেন, এ পর্যন্ত পারমাণবিক বিষয়ে আলোচনায় যে সব সাফল্য অর্জিত হয়েছে তা হচ্ছে এই যে, বিশ্ব সম্প্রদায় এ ব্যাপারে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সাথে যোগাযোগ করতে ও আন্তঃক্রিয়া সম্পাদনে সম্মত হয়েছে এবং বৃহৎ শক্তিগুলো ইরানের পারমাণবিক অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
প্রেসিডেন্ট রুহানি বলেন, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সরকার দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের এবং সকল আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের হেফাযতকারী। তাই সরকার বরাবরের মতোই ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের মর্যাদা ও গৌরবের পরিপূর্ণ প্রতিরক্ষা করে যাবে।
প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে রাহ্বারের কল্যাণ এবং ইরানী জাতির উন্নয়ন, অগ্রগতি ও মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য দো‘আ করেন।

নিষেধাজ্ঞার ভিতরেও ইরান পরিপূর্ণরূপে বিকাশ লাভ করছে : রাহ্বার
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ দ্বীনী ও রাজনৈতিক নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ্ ‘উয্মা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী বলেন, নিষেধাজ্ঞার ভিতরেও ইরান সকল ক্ষেত্রে পরিপূর্ণরূপে বিকাশ লাভ করছে। তিনি ইরানী বর্ষপঞ্জির প্রথম দিন নওরোয্ উপলক্ষে গত ২১শে মার্চ দেশের অন্যতম ধর্মীয় নগরী মাশ্হাদে হযরত ইমাম রেযা (আ.)-এর মাযার প্রাঙ্গনে এক বিশাল জনসমাবেশে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে এ কথা বলেন।
রাহ্বার বলেন, নওরোয উদ্যাপন ইসলামী মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। তিনি বলেন, ইরানী জনগণ নওরোযকে ইসলামী মূল্যবোধসমূহকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে ব্যবহার করে থাকে।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী ইসলামের অন্যতম মূলনীতি ‘আম্র্ বিল-মা‘রূফ ওয়া নাহি ‘আনিল্ মুন্কার’ (ভালো কাজের আদেশ দান ও মন্দ কাজে নিষেধ)-এর প্রকৃত তাৎপর্যের ওপর আলোকপাত করে বলেন, ইসলামের দৃষ্টিতে ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সমস্ত রকমের ভালো কাজের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভালো কাজ।
ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার বলেন, ইসলাম জনগণের মধ্যে সহমর্মিতা, সহযোগিতা ও সংহতি আশা করে। তিনি বলেন, ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সরকারকে জনগণ কর্তৃক অনুমোদিত ও সমর্থিত হতে হবে। এটাই হচ্ছে আমাদের দেশে ইসলামী সংহতির নির্যাস।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প সম্পর্কিত আলোচনা প্রসঙ্গে হযরত আয়াতুুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, বেআইনি ও অন্যায় নিষেধাজ্ঞা ইরানের জন্য স্বীয় অর্থনীতিকে একটি স্বাধীন অর্থনীতি হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে।
ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার জোর দিয়ে বলেন, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিরুদ্ধে পশ্চিমা শত্রুদের হাতে একমাত্র যে অস্ত্রটি আছে তা হচ্ছে নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু তারা ইরানের অগ্রযাত্রাকে রুদ্ধ করে দিতে অক্ষম হয়েছে, কারণ, তাদের সে অস্ত্র নিষ্ক্রিয় প্রমাণিত হয়েছে। অন্যদিকে নিষেধাজ্ঞার মোকাবিলায় একমাত্র পথ হচ্ছে স্বনির্ভরতা ও স্বয়ংসম্পূর্ণতা। তিনি বলেন, ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প সংক্রান্ত যে কোনো চুক্তি সম্পাদন নিষেধাজ্ঞা পরিপূর্ণরূপে প্রত্যাহারের ওপর নির্ভর করে এবং নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে অন্য কোনো শর্ত গ্রহণযোগ্য হবে না।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী বলেন, আমেরিকার সাথে আলোচনা একমাত্র এবং একমাত্র পারমাণবিক প্রকল্প সম্পর্কে হবে এবং ইরান কখনোই আমেরিকার সাথে কোনো আঞ্চলিক বা অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আলোচনা করবে না। কারণ, আমেরিকার নীতি হচ্ছে ইরানের নীতির বিপরীত এবং তা মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের স্বার্থেরও বিরোধী।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নওরোয উপলক্ষে ইরানী জনগণের উদ্দেশে প্রদত্ত বাণীতে যে প্রস্তাব দিয়েছেন ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে দেন। উল্লেখ্য, বারাক ওবামা তাঁর বাণীতে বলেন যে, ইরানের জাতীয় অর্থনীতিকে মুক্তি দিতে হলে ইরানীদেরকে অবশ্যই আমেরিকান দিকনির্দেশনা গ্রহণ করে নিতে হবে।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী ইরানী জনগণের প্রতি প্রতিরোধের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানান। তিনি বলেন, প্রতিরোধের অর্থনীতি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্যই সম্ভব সব রকমের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
ইসলামী বিপ্লবের রাহ্বার জোর দিয়ে বলেন, প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বাণীতে যে দাবি করা হয়েছে যে, ইরানে কিছুসংখ্যক লোক পারমাণবিক বিরোধের কূটনৈতিক সমাধানের বিরোধী, তাঁর এ দাবি পুরোপুরি ভুল এবং একটি বিরাট মিথ্যাচার। তিনি বলেন, ইরানে কেউই দেশের পারমাণবিক প্রকল্প সংক্রান্ত সমস্যার কূটনৈতিক সমাধানের বিরোধী নন।
হযরত আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ী তাঁর ভাষণের সমাপ্তি টানতে গিয়ে বলেন, বিশেষ করে দেশ যখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি ও উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় তখন সকলকেই মতৈক্য প্রদর্শন করতে হবে এবং সরকারের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানাতে হবে।

ইরানে আর্থিক সাশ্রয়ী হাইব্রিড গাড়ি তৈরি
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে স্থানীয় প্রযুক্তিতে ‘দোনিরু’ নামে এক ধরনের আর্থিক সাশ্রয়ী হাইব্রিড গাড়ি নির্মিত হয়েছে। গত ৪ঠা মার্চ (২০১৫) প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির উপস্থিতিতে নব নির্মিত এ গাড়ির আবরণ উন্মোচন করা হয়।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের ম্যাক্রো-স্কেল ন্যাশনাল প্লান্স শাখার প্রধান ড. পেইমন সালেহী এ পরিবেশবান্ধব যাত্রীবাহী গাড়িটির আবরণ উন্মোচন করেন। এ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে দেশের প্রেসিডেন্ট ছাড়াও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ভাইস প্রেসিডেন্ট ও বেশ কয়েক জন কেবিনেট মন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন।
এ অনুষ্ঠানে ড. পেইমন সালেহী বলেন, দোনিরু হচ্ছে এক ধরনের হাইব্রিড কারÑ যা বিদ্যুতের সাহায্যে চলে এবং এর ব্যাটারি একবার চার্জ করা হলে এটি ৮৫ কিলোমিটার পথ চলতে পারে। তিনি বলেন, এ গাড়িটির গ্যাসোলিন ইঞ্জিনে পরিবর্তন সাধন করে ইঞ্জিনটিকে ব্যাটারি চার্জ করার জন্য ব্যবহার করা হয়; ইঞ্জিনটি সরাসরি গাড়ি চালাতে ব্যবহৃত হয় না।
এ গাড়িটি নির্মাণের উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে ড. সালেহী বলেন, দোনিরু একটি মানসম্পন্ন ও আর্থিক সাশ্রয়ী গাড়ি যার ডিজাইন করা হয়েছে দূষণ হ্রাস করে পরিবেশের হেফাযতের উদ্দেশ্যে।
ড. সালেহী বলেন, প্রেসিডেন্টের দফতরের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগ এবং রিনোভেশন অর্গানাইযেশন অব্ ইরান-এর যৌথ অংশীদারিত্বে এ প্রকল্পটির জন্য তিরিশ লক্ষ ডলার ব্যয় করা হয়েছে।

ইরানে নির্মিত ‘সূর্মা’ ক্রুজ মিসাইলের আবরণ উন্মোচন
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান দেশীয় প্রযুক্তিতে ‘সূর্মা’ নামে ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য এক ধরনের ক্রুজ মিসাইল নির্মাণ করেছে। ইতিমধ্যেই আনুষ্ঠানিকভাবে এ মিসাইলের আবরণ উন্মোচন করা হয়েছে এবং মিসাইলটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিপ্লবী রক্ষী বাহিনী (আইআরজিসি)-এর এয়ারোস্পেস ফোর্স-এর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। একই সময় আইআরজিসি-র কাছে ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপণযোগ্য ‘ক্বাদ্র’ ও ‘ক্বিয়াম’ নামক দু’ধরনের দূর পাল্লার ব্যালেস্টিক মিসাইলও হস্তান্তর করা হয়েছে।
গত ৭ই মার্চ (২০১৫) তেহরানে আয়োজিত এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ‘সূমার’ ক্রুজ মিসাইলের আবরণ উন্মোচন করা হয় এবং এতদসহ বিপুল সংখ্যায় উৎপাদিত ‘ক্বাদার’ ও ‘ক্বিয়াম’ ব্যালেস্টিক মিসাইল আইআরজিসি-র কাছে হস্তান্তর করা হয়। এ অনুষ্ঠানে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হোসাইন দেহ্কান ও আইআরজিসি-র এয়ারোস্পেস ফোর্স-এর প্রধান জেনারেল আমীর আলী হাজীযাদে সহ ইরান সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে জেনারেল দেহ্কান বলেন, ইরান সরকারের এয়ারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ অর্গানাইযেশন (এআইও)-এর বিশেষজ্ঞগণ সূমার ক্রুজ মিসাইলের ডিজাইন করেন এবং এ সংস্থাটি এটি উৎপাদন করে। তিনি বলেন, ইতিপূর্বে নির্মিত মিসাইলসমূহের তুলনায় এ মিসাইলটির পাল্লা যেমন বেশি তেমনি এটির লক্ষ্যভেদ অধিকতর নিখুঁত এবং এছাড়াও এটির আরো কতোগুলো ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
জেনারেল দেহ্কান আরো বলেন, এ সব গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিরক্ষা ও নিরোধক শক্তি বৃদ্ধির পথে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে।
উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে বিরাট বিরাট সাফল্যের অধিকারী হয়েছে এবং প্রয়োজনীয় সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদন ও সিস্টেম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতায় উপনীত হয়েছে।
আরো উল্লেখ্য যে, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান অন্যান্য দেশকে এ মর্মে বার বার নিশ্চয়তা দিয়েছে যে, ইরানের সামরিক শক্তি অন্য কোনো দেশের জন্য হুমকি নয় এবং এ দেশের প্রতিরক্ষা নীতি পুরোপুরি নিরোধের লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছে।

ইরানে গাড়ি পরিষ্কার করার অ্যালকোহল মুক্ত ন্যানো ক্লিনার উৎপাদন
ইরানী গবেষকগণ গাড়ি পরিষ্কার করার জন্য অ্যালকোহলমুক্ত একটি ন্যানো ক্লিনার উৎপাদন করেছেন। এটির দ্বারা পানির সাহায্য ছাড়াই গাড়ি পরিষ্কার করা সম্ভব হবে।
সংশ্লিষ্ট গবেষক ও আবিষ্কারক গ্রুপের সদস্য জনাব মেহ্র্তাশ হেদায়াতী বলেন, এ পণ্যটিতে উপরি ভাগের ধুলা-ময়লা অপসারণে সক্ষম উচ্চ পরিষ্কারক ক্ষমতার একটি নতুন ফরমুলেশন রয়েছে। তিনি আরো বলেন, এ ন্যানো ক্লিনারটিতে একটি হারবাল এন্টি-ব্যাক্টেরিয়াল ব্যাসিস রয়েছে এবং এটি ব্যবহার করে গাড়ি পরিষ্কার করার সময় পানি ব্যবহার করার প্রয়োজন হয় না।
জনাব মেহ্র্তাশ হেদায়াতী বলেন, এ পণ্যটিতে প্রাকৃতিক অ্যালকোহলমুক্ত মিশ্রণ ব্যবহার করা হয়েছে এবং এটি গ্লাস, ফ্রেম, ইঞ্জিন ও টায়ার সহ গাড়ির সকল উপরি তল পরিষ্কার করার কাজে ব্যবহার করা যাবে।
তিনি আরো বলেন, গাড়ি পরিষ্কার করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিমাণে পানির ব্যবহার ও শুকানো সমস্যা বটে। এ ন্যানো ক্লিনারটি ব্যবহার করলে পানির খরচ বেঁচে যাবে এবং এটি পরিবেশ সংরক্ষণেও সহায়ক হবে।

ইরানী নৌবাহিনীতে দামাভান্দ ডেস্ট্রয়ার যোগ
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের নৌবাহিনীতে ‘দামাভান্দ’ নামক নতুন নির্মিত একটি ডেস্ট্রয়ার যোগ করা হয়েছে। অ্যাড্ভান্স্ড সী-লঞ্চ্ড্ ড্রোন বিমান ও ক্রুজ মিসাইলে সজ্জিত এ ডেস্ট্রয়ারটি গত ৯ই মার্চ (২০১৫) তারিখে কাস্পিয়ান সাগরস্থ ইরানী নৌবাহিনীতে যোগ করা হয়।
এ উপলক্ষে কাস্পিয়ান সাগর তীরবর্তী বন্দর নগরী বান্দারে আন্যালীতে আয়োজিত এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ অংশগ্রহণ করেন। এদের মধ্যে ছিলেন সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সচিব আলী শাম্খনী, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হোসাইন দেহ্কান ও নৌবাহিনীর অধিনায়ক রিয়ার অ্যাডমিরাল হাবীবুল্লাহ্ সাইয়ারী।
উল্লেখ্য, দামাভান্দ হচ্ছে অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী জামারান শ্রেণির ডেস্ট্রয়ার যা ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের উত্তরাঞ্চলীয় পানি সীমার হেফাযতের জন্য দেশের নৌবাহিনীর প্রয়োজন পূরণে সক্ষম। এটি জামারান-এর চেয়ে লম্বা, কিন্তু অপেক্ষাকৃত হাল্কা। এটি যুগপতভাবে সমুদ্র, আকাশ ও ভূমিতে অবস্থিত লক্ষ্যবস্তু চিহ্নিত করতে ও তাতে আঘাত হানতে সক্ষম। এটি ক্রুজ মিসাইল সিস্টেম, টর্পেডো লঞ্চার, ৪০ মিলিমিটার ও ৭৬ মিলিমিটার কামান, রাডার প্রসেসিং সিস্টেম এবং তদসহ ভূমিতে ও আকাশে ব্যবহার্য ট্যাকটিক্যাল রাডার দ্বারা সুসজ্জিত।
উল্লেখ্য, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দেশের অভ্যন্তরে তৈরি প্রথম ডেস্ট্রয়ার ‘জামারান’ পারস্য উপসাগরস্থ স্বীয় নৌবাহিনীতে যোগ করে। ১ হাজার ৪২০ টন ওযনের এ ডেস্ট্রয়ারটি অত্যাধুনিক রাডার সিস্টেম ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক যুদ্ধসরঞ্জামে সুসজ্জিত। ঘণ্টায় ৩০ নটিক্যাল মাইল গতিসম্পন্ন এ ডেস্ট্রয়ারটিতে একটি হেলিপ্যাড্ রয়েছে।

ইরানী মহিলা বিজ্ঞানী ‘ভবিষ্যৎ আইনস্টাইন’ হিসিবে চিহ্নিত
ইরানী মহিলা বিজ্ঞানী যাহ্রা হাক্কানী বৈজ্ঞানিক তথ্য বিশ্লেষণকারী আইটি ইঞ্জিন ‘র্স্প্যাহো’ কর্তৃক অন্যতম ‘ভবিষ্যৎ আইনস্টাইন’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন।
উল্লেখ্য, ‘র্স্প্যাহো’ হচ্ছে বৈজ্ঞানিক তথ্য বিশ্লেষণকারী এমন একটি আইটি ইঞ্জিন যা প্রিপ্যারেটরি ম্যাচিন লার্নিং অ্যালগোরিদ্ম্ ব্যবহার করে পারসোনালাইয্ড্ সায়েন্টিফিক নিউজ-ফীড সরবরাহ করে এবং স্বীয় বিশ্লেষণকৃত তথ্যাদির ভিত্তিতে মতামত ব্যক্ত করে। র্স্প্যাহো প্রতিদিন দশ হাজারেরও বেশি তথ্যসূত্র পরীক্ষা করে ড্যাটাবেস-এ ১৩ লাখেরও বেশি ডকুমেন্ট বিন্যস্ত করেÑ যার মধ্যে থাকে অধুনাতম প্রবন্ধ-নিবন্ধসমূহ, প্যাটেন্ট, ভিডিও ইত্যাদি। ব্রিটিশ লাইব্রেরির সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে র্স্প্যাহো খ্রিস্টীয় ১৮৯০-এর দশক থেকে শুরু করে তদপরবর্তীকালীন তথ্যাদি বিশ্লেষণ করেছে। এটি আইনস্টাইনের রচনাবলি বিশ্লেষণ করার পর আর যাঁরা অনুরূপ বিষয়াদি নিয়ে লিখেছেন তাঁদেরকে খুঁজে বের করেছে।
২৭ বছর বয়স্কা যাহ্রা হাক্কানী দম্গ¦ন্ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। উক্ত অনুসন্ধানের ফলে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান থেকে সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, বিশ্বে যে স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তির আইনস্টাইনের সাথে সর্বাধিক মিল রয়েছে তিনি তাঁদের অন্যতম।
যাহ্রা হাক্কানী যে সব বিষয় নিয়ে গবেষণা করছেন সেগুলোর অন্যতম হচ্ছে মাধ্যাকর্ষণ, তার বিবর্তন এবং মহাবিশ্ব তত্ত্ব (পড়ংসড়ষড়মু)। তিনি ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত গ্রাভিটি রিসার্চ ফাউন্ডেশনের প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন এবং এতে তিনি তাঁর গধঃঃবৎ সধু গধঃঃবৎ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
যাঁরা আইনস্টাইন কর্তৃক লিখিত বিষয়াদির অনুরূপ বিষয়াদি নিয়ে লিখেছেন তাঁদের মধ্যে যাহ্রা হাক্কানী ছাড়াও আরো যাঁদেরকে ‘সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ আইনস্টাইন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তাঁরা হলেন : নিউ হ্যাভেন্ ইউনিভিার্সিটির তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী নিকোদেন্ পোপ্লাভস্কি, জাপানের ন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল্ অব্জারভেটরির প্রজেক্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হাজিমে সোতানী, টোকিও ইউনিভার্সিটি অব্ সায়েন্স্-এর অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর শিন্জি সুজিকাওয়া ও ইউনিভার্সিটি অব্ ক্যাম্ব্রিজ্-এর জে. ব্রিয়ান পিট্স্।

ইরানী আবিষ্কারক কর্তৃক বিমানের হাল্কা পাখা তৈরি
ইরানী আবিষ্কারক কভেহ্ কোলার্হ্গা আযারী বিমানের জন্য নতুন ধরনের পাখা তৈরি করেছেন যা মূল মেক্যানিক্যাল ও ডায়নামিক বৈশিষ্ট্যসমূহ বজায় রাখার পাশাপাশি অপেক্ষাকৃত সহজ ও হাল্কা।
কভেহ্ কোলার্হ্গা আযারী বার্তা সংস্থা মেহ্র্ নিউজ্-কে বলেন, বর্তমানে বিমানে যে সব পাখা ব্যবহার করা হয় সেগুলো স্টীলের তৈরি যার ওজন অনেক বেশি। কিন্তু তার বিপরীতে তাঁর উদ্ভাবিত এ নতুন ধরনের পাখার ওজন যেমন অপেক্ষাকৃত কম, তেমনি তা তৈরিতে ব্যয়ও হবে অপেক্ষাকৃত কম।
কভেহ্ কোলার্হ্গা আযারী আরো বলেন, এ নতুন পাখা তৈরিতে পলিমার ও ধাতবের কম্পোজিট ব্যবহার করা হয়েছে যা স্টীল ও অ্যালুমিনিয়ামের মতোই টেকসই। তিনি বলেন, এ নতুন পাখার মেক্যানিক্যাল শক্তি যে কোনো ধাতব উপাদানে তৈরি পাখার চেয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি। অন্যদিকে ক্রুচালিত ও চালকবিহীন উভয় ধরনের বিমানেই এ ধরনের পাখা ব্যবহার করা যাবে।
তিনি আরো জানান যে, তাঁর নির্মিত পাখা বিমানের অতিরিক্ত ভাইব্রেশনেও ঠিক মতো কাজ করবে, অন্যদিকে তা বিমানের অভ্যন্তরে ভাইব্রেশন রোধ করবে।

ইরানী গবেষক কর্তৃক এইচআইভি নির্ণয়ক ফোন অ্যাপ্লিকেশন উদ্ভাবন
আমেরিকার হার্ভার্ডে কর্মরত একজন ইরানী গবেষকের নেতৃত্বে একদল গবেষক স্মার্ট ফোনের জন্য এমন একটি অ্যাপ্লিকেশন উদ্ভাবন করেছেন যার সাহায্যে এইচআইভি সহ রক্তের যে কোনো ব্যাকটেরিয়া ও রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হবে।
ব্রিগ্হামের বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ও হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের পরিচালনাধীন মহিলা হাসপাতালের মেডিসিন ইন্স্ট্রাক্টর হিসেবে কর্মরত ইরানী নাগরিক ড. হাদী শাফিয়ী ফ্লোরিডা আটলান্টিক ইউনিভিার্সিটি ও স্ট্যান্ফোর্ড ইউনিভার্সিটির একদল গবেষকের সাথে যৌথভাবে গবেষণা চালিয়ে উক্ত অ্যাপ্লিকেশনটি উদ্ভাবন করেন। এ সম্পর্কে তাঁরা ন্যাচার সায়েন্টিফিক্ রিপোর্টস্ সাময়িকীতে লিখিত একটি প্রবন্ধে বিস্তারিত উল্লেখ করেন। প্রবন্ধটির শিরোনাম : “চধঢ়বৎ ধহফ ঋষবীরনষব ঝঁনংঃৎধঃবং ধং গধঃবৎরধষং ভড়ৎ ইরড়ংবহংরহম চষধঃভড়ৎসং ঃড় উবঃবপঃ গঁষঃরঢ়ষব ইরড়ঃধৎমবঃং”
এ প্রবন্ধে তাঁরা উল্লেখ করেন যে, তাঁরা একটি নতুন বায়োসেন্সিং প্লাট্ফর্ম উদ্ভাবন করেছেন যার সাহায্যে এইচআইভি, ই-কোলি, স্ট্যাফাইলোকোক্কাস্ অরিয়াস্ ও অন্যান্য ব্যাকটেরিয়া চিহ্নিত করা যাবে। কেবল আঙ্গুলের ডগা থেকে এক ফোঁটা রক্ত নিয়ে এ বায়োসেন্সিং প্লাট্ফর্মে ব্যবহার করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির শরীরের সমস্ত রক্তে ও প্লাসমায় বিদ্যমান চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট স্পেসিফিটি ও সেন্সিটিভিটি পাওয়া যাবে এবং প্যাথোজেন্স্ চিহ্নিত করা যাবে।
এ প্রযুক্তিটি ব্যবহার করে তাঁরা একটি স্মার্ট ফোন অ্যাপ্লিকেশনও উদ্ভাবন করেছেন যা একটি সেলফোনের ইমেজ ব্যবহার করে রক্তের ভিতরকার ব্যাকটেরিয়া ও রোগব্যাধি নির্ণয় করতে সক্ষম হবে এবং তা বিশ্বের যে কোনো স্থান থেকেই নেয়া হোক না কেন খুব সহজেই বিশ্লেষণ করা যাবে।
কাগজ ও ফ্লেক্সিব্ল্ সাব্স্ট্রেট্স-কে বায়োসেন্সরের উপাদান হিসেবে ব্যবহার করে হাদী শাফিয়ী ও তাঁর সহকর্মিগণ রোগব্যাধি নির্ণয় এবং পয়েন্ট-অব্-কেয়ার সেটিংস্-এর সাহায্যে তার চিকিৎসা নির্দেশের জন্য একটি নতুন দ্রুত কর্মক্ষম ও কম ব্যয়সাপেক্ষ ব্যবস্থা উদ্ভাবন করেছেন। তাঁরা এটা প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছেন যে, কীভাবে তাঁদের উদ্ভাবিত নতুন প্লাটফর্মসমূহ এন্টিবডি ব্যবহার করে বহুমুখী বায়োলজিক্যাল মিডিয়ামসমূহ থেকে নজিরবিহীনভাবে বহুমুখী বায়োটার্গেটকে সেলেক্টিভ্ভাবে, সেন্সিটিভ্ভাবে ও পুনঃপুনঃ বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে ও চিহ্নিত করতে সক্ষম।
উক্ত প্লাটফর্ম কর্তৃক চিহ্নিত ফলাফলসমূহ সেলফোন ও সেগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে বিশ্বের যে কোনো প্রত্যন্ত প্রান্তে প্রেরণ করা সম্ভব হবে।
ড. শাফিয়ী ও তাঁর সহকর্মিগণ আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, স্বাস্থ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে তাঁদের উদ্ভাবিত এ নতুন প্রযুক্তিটি অচিরেই সারা বিশ্বে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হবে।

ইরানী গবেষক কর্তৃক থ্রি-ডি ইমেজিং-এর বৈপ্লবিক উন্নয়ন সাধন
ইরানী ইলেক্ট্রিক্যাল্ ইঞ্জিনিয়ার আলী হাজীমীরী-র অধীনে কর্মরত ক্যাল্-টেক্ গবেষকগণ একটি নতুন ন্যানোফোটোনিক্ কোহেরেন্ট্ ইমের্জা (এনসিআই) নিয়ে কাজ করছেন যা স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদেরকে থ্রি-ডি ইমেজ স্ক্যান্ করার সুবিধা দেবে।
উল্লেখ্য, একটি থ্রি-ডি প্রিন্টারের সাহায্যে কোনো কিছুর হুবহু কপি করার ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে থ্রি-ডি ক্যামেরার সাহায্যে সংশ্লিষ্ট বস্তুটির উচ্চ রেজ্যুলেশন স্ক্যানিং করা যা বস্তুটির উচ্চতা, প্রশস্ততা ও গভীরতাকে হুবহু ও নির্ভুলভাবে পরিমাপ করবে। বিগত কয়েক দশক যাবৎ এ ধরনের থ্রি-ডি ইমেজিং-এর কাজ চলে এলেও এ সর্বাধিক সংবেদনশীল সিস্টেমটি সাধারণত অনেক বড় এবং কন্জ্যুর্মা অ্যাপ্লিকেশনে তার ব্যবহার খুবই ব্যয়বহুল। তবে ইরানী ইলেক্ট্রিক্যাল্ ইঞ্জিনিয়ার আলী হাজীমীরী ও তাঁর অধীনে কর্মরত ক্যাল্-টেক্ গবেষকগণ যে নতুন ন্যানোফোটোনিক্ কোহেরেন্ট্ ইমের্জা (এনসিআই) তৈরি করেছেন তা যেমন সস্তা, তেমনি অত্যন্ত উঁচু মানে নিখুঁতভাবে কর্ম সম্পাদনকারী এবং এ ডিভাইসটি আবিষ্কৃত হবার ফলে থ্রি-ডি প্রিন্টিং প্রযুক্তি ক্রমান্বয়েই অধিকতর সাশ্রয়ী হচ্ছে।
উল্লেখ্য, এ নতুন ন্যানোফোটোনিক্ কোহেরেন্ট্ ইমের্জা (এনসিআই) লাইট্ ডিটেক্শন্ অ্যান্ড্ রেঞ্জিং (এলআইডিএর্আ) প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। আর এলআইডিএর্আ-এর সাহায্যে একটি বস্তুর ওপর লেজার রশ্মি প্রক্ষেপণ করে বস্তুটি থেকে প্রতিফলিত আলো বিশ্লেষণ করা হয়। অতি ক্ষুদ্রাকৃতিক এন্সিআই চিপ্-টি এক বর্গ মিলিমিটারেরও কম আয়তন পরিমাপ করতে পারে। ড্যাটা বিশ্লেষণ করে তার ভিত্তিতে এ সের্ন্সটি যে কোনো বস্তুর উচ্চতা, প্রশস্ততা ও গভীরতা সংক্রান্ত তথ্য শটের প্রতি পিক্সেলের জন্য সরবরাহ করতে সক্ষম।
জনাব হাজীমীরী বলেন, এ নতুন চিপ-বেস্ড্ ইমেজারটি আয়তনে যেমন খুবই ছোট তেমনি এটির মান খুবই উঁচু। এর ফলে এটির ব্যবহার খুবই কম ব্যয়সাপেক্ষ। ফলে হাজার হাজার নতুন ব্যবহারকারী তাঁদের ব্যক্তিগত ডিভাইসে, যেমন : স্মার্টফোনে, এটি ব্যবহার করতে পারবেন।

ইরানী নাটকের আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ (মেহের ২০)
ইরানী পরিচালিকা র্নাগেস্ অবির্য়া পরিচালিত শর্ট ফিল্ম ড্রামা ঞযরহমং অৎব ঈষড়ংবৎ ঞযধহ ঞযবু অঢ়ঢ়বধৎ রহ ঃযব গরৎৎড়ৎ সম্প্রতি ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে। অতঃপর এটি ইউরোপে অনুষ্ঠিতব্য আরো একটি আন্তর্জাতিক উৎসবে প্রদর্শিত হবে।
এ ড্রামা চলচ্চিত্রটি গত ১৩ই থেকে ২৭শে মার্চ প্যারিসে অনুষ্ঠিত ৩৭তম ঞযব ঈৎল্কঃবরষ ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ডড়সবহ’ং ঋরষস ঋবংঃরাধষ (ঋবংঃরাধষ ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ফব ঋরষসং ফব ঋবসসবং)-এ অংশগ্রহণ করে দু’টি পুরস্কার লাভ করেছে। উল্লেখ্য, মহিলা চলচ্চিত্র পরিচালকদের প্রতিভাকে পরিচিত করে তোলার লক্ষ্যে জ্যাকি বুয়েট্ কর্তৃক ১৯৭৮ সালে এ উৎসবটি প্রবর্তিত হয়।
‘ইরানের আলোচকরা পাশ্চাত্যের স্বেচ্ছাচারিতার কাছে মাথা নত করবে না’
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের বিশিষ্ট আলেম আয়াতুল্লাহ মোহাম্মাদ আলি মোভাহেদি কেরমানি বলেছে, ছয় জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে চলমান পরমাণু আলোচনায় ইরানের অবস্থান সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত ও যৌক্তিক। তাই পাশ্চাত্যেরও উচিত তেহরানের যৌক্তিক অবস্থানকে মেনে নেয়া। আজ রাজধানী তেহরানে জুমার নামাজের খুতবায় এসব কথা বলেন তিনি।
পরমাণু আলোচনায় অংশগ্রহণকারী দেশগুলো এটা মেনে নিয়েছে যে ইরান পরমাণু বোমা তৈরির চেষ্টা করছে না এ কথা উল্লেখ করে আয়াতুল্লাহ কেরমানি আরো বলেছেন, পরমাণু ইস্যুটি তেহরানের ওপর চাপ সৃষ্টির মিথ্যা অজুহাত ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি বলেন, ইরানের ইসলামী বি-বী সরকারের প্রতি বিদ্বেষের কারণেই পাশ্চাত্য নানা অজুহাতে দেশটির ওপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রেখেছে।
জুমার নামাজের খতিব বলেন, ইরানের পরমাণু আলোচক দল কখনোই পাশ্চাত্যের স্বেচ্ছাচারিতার কাছে মাথা নত করবে না এবং জনগণের অধিকার রক্ষায় নিজেদের শক্ত অবস্থান ধরে রাখবে। আয়াতুল্লাহ কেরমানি আইএসআইএল সন্ত্রাসীদের মোকাবেলায় ইরাকের জনগণ ও সেনাবাহিনীর সফলতার কথা তুল ধরে বলেছেন, বিদেশিদের অনুচর এসব সন্ত্রাসীরা পুরোপুরি নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত সাফল্যের এ ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আমরা আশা করি। তিনি সিরিয়ায় পাশ্চাত্যের নীতি বা কৌশল ব্যর্থ হওয়ার ব্যাপারে মার্কিন কোনো কোনো কর্মকর্তার স্বীকারোক্তির কথা উল্লেখ করে বলেছেন, এরপরও তারা এ থেকে শিক্ষা নেয়নি এবং এ অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে সামরিক হস্তক্ষেপ অব্যাহত রেখেছে।
তেহরানের জুমার নামাজের খতিব আরো বলেন, আমেরিকার প্রতি মধ্যপ্রাচ্যের জনগণের ক্ষোভ ও ঘৃণা ক্রমেই বাড়ছে। তাই আধিপত্যকামী সরকারগুলোর এটা জেনে রাখা উচিত আগ্রাসন, জুলুম-নির্যাতন ও রক্তপাত ঘটিয়ে কিংবা জনগণের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী লেলিয়ে দিয়ে তারা এ অঞ্চলে লুটতরাজের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারবে না। #
একনজরে ইরান ও ছয় জাতিগোষ্ঠীর যৌথ বিবৃতি
মোহাম্মদ জাওয়াদ-ফেডেরিকা মোগেরিনি
৩ এপ্রিল (রেডিও তেহরান): ইরানের সঙ্গে ছয় জাতিগোষ্ঠীর চূড়ান্ত পরমাণু চুক্তির রূপরেখায় তেহরানের পরমাণু তৎপরতার প্রতি স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। রূপরেখা অনুযায়ী- নাতাঞ্জ, ফোরদো, ইস্পাহান এবং আরাকসহ ইরানের কোনো পরমাণু স্থাপনা বা পরমাণু তৎপরতা বন্ধ বা স্থগিত করা হবে না। বরং ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার কর্মসূচি অব্যাহত রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।
ইরান ও ছয়জাতিগোষ্ঠীর যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, পরমাণু সংক্রান্ত চূড়ান্ত চুক্তি ১০ বছরের জন্য কার্যকর থাকবে। এতে, নাতাঞ্জ পরমাণু স্থাপনায় পাঁচ হাজারের বেশি সেন্টিফিউজ ৩.৬৭ মাত্রা সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম তৈরির তৎপরতা অব্যাহত রাখবে ইরান। এ কেন্দ্রের বাড়তি যন্ত্রপাতি ও অবকাঠামো আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা বা আইএইএ সংগ্রহ করবে। এর বদলে ইরানকে বরাদ্দকৃত মাত্রায় সৃমদ্ধ করার কাজে ব্যবহৃত নতুন যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হবে।
ইরানের বর্তমান সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুদের বিনিময়ে পরমাণু জ্বালানি চক্র তৈরিতে ব্যবহৃত উপাদান উৎপাদন করতে দেয়া হবে কিংবা আন্তর্জাতিক বাজার থেকে ইউরেনিয়াম বদলে নিতে পারবে ইরান। এ ছাড়া, এতে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি চক্রের শিল্পখাতে উৎপাদনও নিশ্চিত করা হয়।
সমঝোতা চুক্তিতে বলা হয়, ইরান অত্যাধুনিক সেন্ট্রিফিউজ নিয়ে গবেষণা অব্যাহত রাখবে। ১০ বছরের জন্য আইআর-৪, আইআর-৫, আইআর-৬ এবং আইআর-৮ যন্ত্র নিয়ে এ গবেষণা অব্যাহত রাখা হবে।
যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ফোরদো পরমাণু স্থাপনাকে পরমাণু বিজ্ঞান ও পদার্থবিদ্যার গবেষণাগারে পরিণত করা হবে। এ কেন্দ্রে এক হাজার সেন্টিফিউজ রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে। ফোরদো’র দু’সারি সেন্ট্রিফিউজ তৎপরতা বজায় রাখবে। ছয় জাতিগোষ্ঠীর সহায়তায় ফোরদোর অর্ধেককে অত্যাধুনিক পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রে রূপান্তর করা হবে। এ ছাড়া, এ কেন্দ্রে স্থিতিশীল আইসোটোপ উৎপাদন করা হবে। শিল্প, কৃষি এবং ওষুধখাতে এ আইসোটোপের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
এ ছাড়া, আরাকের ভারি পানির পরমাণু চুল্লিও থাকবে। তবে তার আধুনিকায়ন এবং নতুন করে নকশা করা হবে। নতুন করে নকশা প্রণয়ন করার মাধ্যমে এ কেন্দ্রে কর্মতৎপরতা বাড়বে তবে -ুটোনিয়াম উৎপাদনের মাত্রা কমবে।
কিছু সম্পূরক প্রোটোকলও বাস্তবায়িত করবে ইরান। এটি একান্তভাবেই স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়েই করবে ইরান। ইরানের সরকার ও সংসদ সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এই প্রোটোকল বাস্তাবায়িত করবে।
সমঝোতায় বলা হয়েছে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইরানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত সকল ইশতেহার প্রত্যাহার এবং আমেরিকা, ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবরোধগুলো তুলে নেওয়া হবে। পাশাপাশি আর নতুন কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ হবে না।
সুইজারল্যান্ডের লোজেন শহরে টানা আট দিনব্যাপী আলোচনার পর ইরানের সঙ্গে ছয় জাতিগোষ্ঠীর চূড়ান্ত পরমাণু চুক্তির বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে।
পরে এক সংসবাদ সম্মেলেন যৌথ বিবৃতি পাঠ করেছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জাওয়াদ জারিফ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান ফেডেরিকা মোগেরিনি।#

ইরানী প্রবাদ

رکاب دادن.
উচ্চারণ : রেকা’ব দা’দান
অর্থ : পা-দানি দেওয়া।
মর্ম : সম্মত হওয়া, অনুগত হওয়া, মেনে নেয়া। কারো কথা বা মতামতের প্রতি সম্মতি প্রকাশ করা, একমত হওয়া।
رگ خواب کسی را بدست آوردن.
উচ্চারণ : রাগে খা’বে কেসী রা’ বেদাস্ত অ’ওয়ারদান
অর্থ : কারো ঘুমের রগ হস্তগত করা।
মর্ম : কারো দুর্বল দিক খুঁজে পাওয়া। কাউকে নিজের ইচ্ছার কাছে বশীভূত করা।
رگ غیرتش جنبید.
উচ্চারণ : রাগে গেইরাতাশ জুম্বিদ
অর্থ : তার আত্মমর্যাদার রগ লাফিয়ে উঠেছে।
মর্ম : কারো আত্মমর্যাদাবোধ ও সাহসিকতা জেগে ওঠা। কারো আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগা বুঝাতে প্রবাদটি প্রচলিত।
رنگ به رنگ شدن.
উচ্চারণ : রাং বেরাং শোদান
অর্থ : রং বেরং হওয়া।
মর্ম : লজ্জা ও অনুশোচনায় চেহারার রঙ বিগড়ে যাওয়া। লজ্জায় চেহারা বিবর্ণ ও ফ্যাকাশে হওয়া।
رنگ زردم را ببین برگ خزان را یاد کن.
উচ্চারণ : রাঙ্গে যারদাম রা’ বেবিন বার্গে খাযা’ন রা’ ইয়া’দ কোন
অর্থ : আমার হলুদ রং দেখ আর শীতের মওসুমের কথা স্মরণ কর।
মর্ম : আমার চেহারাটা দেখ, তারপর আমার ভেতরে কী যাচ্ছে অনুমান কর। বলা হয় : আমার অস্থির অবস্থাই প্রমাণ করছে যে, আমার ভেতরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে।
رو به راه بودن.
উচ্চারণ : রূ বে রাহ্ বূদান
অর্থ : মুখ রাস্তামুখি হওয়া।
মর্ম : সবকিছু প্রস্তুত ও ঠিকঠাক থাকা। কাজ ঠিক মতো এগুচ্ছে বুঝাতে এই প্রবাদের ব্যবহার ব্যাপক।
رو برو کردن.
উচ্চারণ : রো বে রো কার্দান
অর্থ : সামনা সামনি করা।
মর্ম : কোনো তথ্য উদ্ঘাটনের জন্য দু’জন লোককে পরস্পরের মুখোমুখি করা।
رونیست سنگ پا است.
উচ্চারণ : রো নীস্ত সাঙ্গে পা’স্ত
অর্থ : চেহারা নয়, পায়ের পাথর।
মর্ম : আমার প্রতিপক্ষ এমন লোক, যে অত্যন্ত নির্লজ্জ ও বেয়াড়া প্রকৃতির।
روی و سر کله کسی خراب شدن.
উচ্চারণ : রূয় ও সারে কাল্লে কেসী খারা’ব শোদান
অর্থ : কারো চেহারা ও মাথা নষ্ট হওয়া।
মর্ম : অনাহুত কারো মেহমান হওয়া; অযাচিত, অতর্কিত ও গায়ে পড়ে মেহমান হওয়া।
روی سنگ کسی بالا آمدن.
উচ্চারণ : রূয়ে সাঙ্গে কেসী বা’লা’ অ’মাদান
অর্থ : কারো পাথরের উপরিভাগ উপরে উঠে আসা।
মর্ম : অশান্তি ও অস্থিরতায় ছটফট করা; মেজায দেখানো; হাঁকাবকা করা।
روی هم ریختن.
উচ্চারণ : রূয়ে হাম রীখ্তান
অর্থ : পরস্পরের উপর পতিত হওয়া।
মর্ম : পরস্পর মিলে যাওয়া, খাপ খাওয়া।
ریخت و پاش کردن.
উচ্চারণ : রীখ্ত ও পা’শ কারদান
অর্থ : ছারখার করা।
মর্ম : এলোপাতাড়ি খরচ করা। ব্যাপক দান-দক্ষিণা করা। হিসাব ছাড়া টাকা-পয়সা উজাড় করা।
ریش چیزی در آمدن.
উচ্চারণ : রীশে চীযী দার অ’মাদান
অর্থ : কোনো কিছুর দাড়ি গজানো।
মর্ম : ঔজ্জ্বল্য ও মূল্যমান কমে যাওয়া। ব্যবহারের অযোগ্য হওয়া।
ریش خود را به دست دیگری دادن.
উচ্চারণ : রীশে খুদ রা’ বে দাস্তে দীগারী দা’দান
অর্থ : নিজের দাড়ি অন্যের হাতে দিয়ে দেয়া।
মর্ম : নিজের কাজকর্মের ভার ও অধিকার অন্যের হাতে ন্যস্ত করা। কারো অধীনে চলে যাওয়া।
ریش خود را در آسیاب سفید کرده است.
উচ্চারণ : রীশে খুদ রা’ দার অ’সিয়া’ব সাফীদ কারদান
অর্থ : নিজের দাড়ি যাঁতাকলে সাদা করা।
মর্ম : কোনো লোক অভিজ্ঞ, দক্ষ ও ঝানুÑ একথা বুঝাতে প্রবাদটি প্রচলিত।

জীবন যাত্রায় পারস্পরিক সম্পর্কের গুরুত্ব

আকরাম আব্বাসী

আজকের বিশ্বকে বলা হয় সম্পর্ক ও যোগাযোগের বিশ্ব। যোগাযোগ ব্যবস্থার চরম উন্নতির এ যুগে প্রত্যেকে অনায়াসে এক অপরের সাথে, এমনকি অন্যান্য বস্তুর সাথে প্রতি মুহূর্তে কার্যকর যোগাযোগ স্থাপন ও রক্ষা করতে পারে। এই যোগাযোগ ও সম্পর্কের ক্ষেত্রে যারা যত বেশি সফলকাম, তাদেরকে তত সফল ও সুখী মানুষ বলে মনে করা হয়।
আসলে মানুষের জীবনটা এক বিরাট নেয়ামত ও খোদার দান। এই প্রাপ্তি আমরা লাভ করেছি অনায়াসে ও যাচনা করা ছাড়াই। তবে আমরা তখনই এ জীবনে সুখী ও সফল হতে পারব, যখন অন্যদের সাথে কার্যকর যোগাযোগ রক্ষা করে জীবনকে সচল রাখতে পারব। এ কারণে জীবন যাপন আর জীবন অতিবাহিত করাÑ কথা দু’টির মাঝে তফাৎ আছে।
পবিত্র ইসলামে মানুষে মানুষে সম্পর্কের ওপর সবিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এ জন্য দূরের কাছের সব মানুষের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখা এবং সবার সাথে হাস্যোজ্জ্বল মুখে কথা বলা ও সুন্দর ব্যবহার করার জন্য তাকিদ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এর ফলে মানুষে মানুষে সম্পর্ক বৃদ্ধি পায় এবং অন্তরের কদর্যতা দূর হয় ও পরস্পরের মাঝে ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া তা মনে আনন্দ ও উৎফুল্লতা জন্ম দেয়। এ দিকটি সামনে রেখে কীভাবে পারস্পরিক সম্পর্ক ও প্রভাবশালী যোগাযোগ রক্ষা করা যায়, তা নিয়ে আমরা পর্যালোচনা করতে চাই।
যোগাযোগ ও সম্পর্কের ব্যাপকতর পরিসরে বিবাহ বন্ধন, আত্মীয়তা, ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব রক্ষা, পরিচিত জনের সাথে সুসম্পর্ক রাখা, ধর্মীয় বিষয় ও অনুষ্ঠানাদিতে অংশগ্রহণ প্রভৃতি মানুষের জীবনে আনন্দ, সুখ-সমৃদ্ধি ও সাফল্য বয়ে আনে। তখনই প্রাণ ভরে ওঠে আনন্দে আর হাতগুলো হয় সচল ও কর্মঠ।
কার্যকর ও প্রভাবশালী যোগাযোগ ও সম্পর্ক বলতে বুঝায় এমন সম্পর্ক ও যোগাযোগ, যার মাধ্যমে মানুষ নিজের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনে সফলকাম হয়, অন্যদিকে প্রতিপক্ষও সন্তুষ্টি অনুভব করে।
অন্য কথায়, কার্যকর যোগাযোগ বলতে বুঝায়, অন্যদের সঙ্গে এমনভাবে সম্পর্ক বজায় রাখা, যার মাধ্যমে একদিকে নিজের প্রয়োজন পূরণ হয়, অন্যদিকে প্রতিপক্ষেরও সন্তুষ্টি অর্জন হয়। অর্থাৎ উভয়ের লক্ষ্য অর্জন ও পারস্পরিক ভালোবাসা ও সন্তুষ্টি লালন করে।

পারস্পরিক সম্পর্কের গুরুত্ব
পারস্পরিক সম্পর্ক ও যোগাযোগ হচ্ছে অন্যদের কাছ থেকে তথ্য আহরণের একমাত্র মাধ্যম। মানুষ যোগাযোগের মাধ্যমেই নিজের অনুভূতি ও মনোভাব অন্যের কাছে স্থানান্তর করতে পারে। পারস্পরিক ভুল বুঝাবুঝির অবসানও একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যমে সম্ভবপর হয়। ক্রোধ-এর মতো নেতিবাচক উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণ করাও সুস্থ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সম্ভপর হয়।

যোগাযোগের প্রকারভেদ
১. বাকনির্ভর যোগাযোগ
বাকনির্ভর যোগাযোগের ক্ষেত্রে মুখের বাক্য ও বুলির ব্যবহার হয়। তবে তা মুখে উচ্চারণ ও লিখিত আকারে হতে পারে। বাচনিক যোগাযোগে সুর, ছন্দ, স্বরের উঠানামা প্রভৃতি অর্থবহ হতে পারে।

২. নির্বাক যোগাযোগ
এতে চেহারার ভাবভঙ্গি, চোখের ইশারা-ইঙ্গিত, দেহের অঙ্গভঙ্গি প্রভৃতি শামিল আছে। এগুলোই হচ্ছে ব্যক্তি পর্যায়ের সম্পর্ক ও যোগাযোগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।

সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পথ ও পদ্ধতিসমূহ
১. অস্তিত্বের প্রকাশ
এর মধ্যে শামিল রয়েছে নিজের অধিকার অর্জন করা, নিজের বিশ্বাসসমূহের প্রকাশ ঘটানো, সরাসরি ও সততার সঙ্গে নিজের চিন্তা-চেতনা অন্যদের কাছে প্রকাশ করা, আর তা এমনভাবে করা যাতে অন্যের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়।
২. ভিন্নধর্মী বিশ্বাসের প্রকাশ ঘটানো
অন্যদের অযৌক্তিক দাবিসমূহ পরিবর্তন সাধনের জন্য বলা, তবে নিজের দুর্বলতাগুলো স্বীকার করে নেয়া, অন্যদের সাথে লেনদেন ও মেলামেশা করা, ইতিবাচক অনুভূতির প্রকাশ ঘটানো, অন্যদের সাথে সাক্ষাৎ ও বিদায় বেলায় ভদ্রতা ও সম্মানপূর্ণ ভাষার ব্যবহার ও আচরণ প্রকাশ করা।
৩. কথা শোনা
অন্যের কথা এমনিতে শোনা আর ভালোভাবে শোনার মধ্যে কিন্তু তফাৎ আছে। খুব মনোযোগ সহকারে, যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে এবং বিষয় ভেদে গুরুত্ব অনুধাবন করে অন্যদের কথা শুনতে হবে।
৪. মনোযোগ প্রদান
মনোযোগ প্রদান মানে আমাদের চারপাশে যা কিছু ঘটছে, আমরা তা বেশি বেশি পর্যবেক্ষণ করব আর অন্যদের ব্যাপারে মন্তব্য খুব কম করব।
৫. ধৈর্যশীল হওয়া
ধৈর্যশীল হওয়া এমন এক বৈশিষ্ট্য যার মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাগত সুফল পাওয়া যায়।
পারস্পরিক সম্পর্ক ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে ধৈর্যশীল হওয়ার একটি প্রকাশ আমরা দেখতে পাই অন্যের আচরণের বেলায় ধৈর্যের পরিচয় দেয়ার ক্ষেত্রে। বিশেষত অন্যরা যখন কথা বলে তখন তাদের কথা শোনার মধ্যে ধৈর্যের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। যাদের চরিত্রে ধৈর্যের গুণের অভাব রয়েছে তারা অন্যদের আচরণের ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখায়; এমনকি অন্যদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনার ধৈর্যও তাদের থাকে না।
৬. মুখের কোলে হাসি
মুখের হাসি প্রমাণ করে যে, আমরা অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে প্রস্তুত আছি। আমরা যখন হাসিখুশি অবস্থায় থাকি এবং অন্যদের সঙ্গে কথা বলি তখন প্রকৃতপ্রস্তাবে তাকে এ কথা বুঝিয়ে দিতে চাই যে, তাকে আমি গ্রহণ করতে প্রস্তুত আছি বা তার প্রতি আমি আগ্রহী।
৭. চোখে চোখে যোগাযোগ
চোখ হচ্ছে অন্তরের আয়নাস্বরূপ। আমাদের চোখগুলো আমাদের অনুভূতি সম্পর্কে খুব জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি অন্যদের কাছে সরবরাহ করে থাকে। অন্যের দিকে দৃষ্টিপাত করে আমরা তাকে বুঝিয়ে থাকি যে, তার সাথে কথা বলতে বা যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে আমি আগ্রহী।

কার্যকর সম্পর্কের মূলনীতিসমূহ
১. সততা
সততা বলতে বুঝায় মানুষ যা আছে তা কোন হ্রাস-বৃদ্ধি ছাড়াই প্রকাশ করা। অন্যকথা মানুষের ভেতর ও বাহির একই হওয়া।
২. নিঃস্বার্থ ভালোবাসা
এর অর্থ হচ্ছে, অন্যের প্রতি আগ্রহী হওয়া, অন্যের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে তাকানো, অন্যের ভালো খবর ও আনন্দে ইতিবাচক সাড়া ও মনোযোগ প্রদান করা, অন্যের ভালো করার জন্য তৎপর হওয়া; বিশেষত নিজের প্রতিবেশীর জন্য স্বার্থত্যাগ এই নিঃস্বার্থ ভালোবাসার অন্তর্ভুক্ত।
৩. সহমর্মিতা ও দরদিপ্রাণ হওয়া
এর অর্থ হচ্ছে অন্যের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করার শক্তির অধিকারী হওয়া। অর্থাৎ আমরা নিজেকে অন্যের স্থানে রাখব। তারপর সব ব্যাপারকে অন্যের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখব। তারপর নিজের কাছে জিজ্ঞাসা করবে যে, আমি যদি তার জায়গায় হতাম, তাহলে এই পরিস্থিতিতে আমার অবস্থা কী হতো! একমাত্র তখনই আমরা অন্যের অবস্থা ও অনুভূতিকে পুরোপুরি উপলব্ধি করতে সক্ষম হব।
৪. সম্পর্কের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আস্থা। পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যাদের আস্থার মাত্রা অনেক উচ্চে, তারা নিজের কাছের ও ঘনিষ্ঠ লোকদের (যেমন স্বামী-স্ত্রী) কাছ থেকে আন্তরিকতাপূর্ণ ও সম্মানজনক আচরণের আশা করতে পারে।
৫. ক্ষমা ও ভুল শোধরানো
ক্ষমা ও ভুল শোধরানো হচ্ছে এমন সম্পর্ক পুনর্বহালের সুন্দর পদ্ধতি, যে সম্পর্ক ছোটখাট ভুলত্রুটির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষমার দ্বারা মানুষের দৈহিক ও মানসিক অবস্থারও উন্নতি হতে পারে। অর্থাৎ তা আনন্দ ও উৎফুল্লতার কারণ হতে পারে।
আমরা যখন ভুল শুধরে নেই, তখন নিজের মধ্যে পাপের অনুভূতিকেও কমিয়ে আনতে পারি। তাতে আমাদের দৈহিক ও মানসিক অবস্থার উন্নতি হতে পারে। ক্ষমা ও ভুল শোধরানোর জন্য নিজের মধ্যে বিনয় থাকেতে হবে; এর সাথে থাকতে হবে অহঙ্কার বর্জনের প্রবণতা। কারণ, যতক্ষণ আমাদের মধ্যে অহঙ্কার থাকবে ততক্ষণ অন্যকে ক্ষমা করার বা নিজেকে সংশোধন করার প্রক্রিয়াটা আমরা আত্মস্থ করতে পারব না।
৬. মর্যাদাবোধ
মর্যাদাবোধ হচ্ছে পারস্পরিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। আমরা যখন বিশ্বাস করতে পারব যে, সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অন্যদের কাছ থেকে একটি ইতিবাচক আচরণ লাভ করছি, তখনই বুঝতে পারব যে, আমাদের ব্যক্তি পর্যায়ের সম্পর্ক ও যোগাযোগ মজবুত রয়েছে।

যে ব্যক্তি ইতিবাচক ও প্রভাবশালী আচরণ ও ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়, সে প্রথম পর্যায়ে নিজের ও নিজের ভেতরের সাথে সচেতন আচরণ করে থাকে। নিজেকে ও অন্যদেরকে ঠিক যেভাবে আছে সেভাবে গ্রহণ করে। সে নিজের প্রয়োজন, চাহিদা, অনুভূতি, চিন্তা ও মূল্যবোধ সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ থাকে। তার বৈশিষ্ট্য হলোÑ

 সে মানসিক সুস্থতার অধিকারী। নিজের অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করে। কোন মাধ্যমের চেয়ে নিজে সরাসরি অন্যের সাথে সম্পর্ক ও যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করে।
 নিজের চিন্তা, অনুভূতি, চাওয়া-পাওয়া সরলভাবে ও সততার সাথে প্রকাশ করে।
 এমন লোকরা আস্থাভাজন, সংসর্গপ্রিয়, খোলামেলা ও সরলপ্রাণ হয়ে থাকে।
 নিজের ইচ্ছা ও মতামত অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয় না।
 অন্যের অধিকারকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না।
 উচ্চতর আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা লালন করে থাকে।
 যে কোন কাজে প্রথমে উদ্যোগী হয়।
 অন্যের কাছ থেকে বেশি প্রত্যাশা করে না এবং নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে না।
 ধৈর্য ও সাহসিকতার সাথে সবকিছুর মোকবিলা করে।
 যা কিছু শোনে, মনোযোগ সহকারে শোনে।
 যখন সম্মিলিত কাজ করে তখন নিজের চিন্তা-চেতনাকে দুপক্ষের মতামতের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়।
 সে অন্যকে মর্যাদা দেয় এবং মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে।
অনুবাদ : ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

নওরোয উপলক্ষে রাহ্বার আয়াতুল্লাহ্ খামেনেয়ীর ভাষণ

নতুন বছরে সকল ক্ষেত্রে উন্নতি ও অগ্রগতি হাছি¡লের জন্য জনগণ ও সরকারের মধ্যে আন্তরিক সহযোগিতা গড়ে তুলতে হবে
[গত ২১শে মার্চ (২০১৫) ছিল নতুন ইরানী বছর ১৩৯৪ সালের প্রথম দিন। বসন্ত কালের প্রথম দিনে সূচিত ইরানী বছরের প্রথম দিন প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে নওরোয হিসেবে বিখ্যাত এবং ব্যাপক আনন্দ-উৎসবের মধ্য দিয়ে ইরান, আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলো সহ আরো বহু দেশে উদ্যাপিত হয়ে আসছে। এবারের নওরোয উপলক্ষে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ দ্বীনী ও রাজনৈতিক নেতা হযরত আয়াতুল্লাহ্ ‘উয্মা সাইয়্যেদ আলী খামেনেয়ী ইরানী জনগণের উদ্দেশে এক সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। ভাষণটির পূর্ণ বিবরণ নিচে প্রদত্ত হলো।]
بسم اللَّه الرّحمن الرّحيم
يا مقلّب القلوب و الابصار، يا مدبّر اللّيل والنّهار، يا محوّل الحول و الاحوال،حوّل حالنا الى احسن الحال.
পরম দয়াময় মেহেরবান আল্লাহ্র নামে
হে অন্তরসমূহ ও দৃষ্টিসমূহের পরিবর্তনকারী, হে রাত্রি ও দিবসের নিয়ন্ত্রণকারী, হে বছর ও অবস্থা সমূহের বিবর্তনকারী, আমাদের অবস্থাকে সর্বোত্তম অবস্থায় পরিবর্তিত করে দাও।
السّلام على فاطمة و ابيها و بعلها و بنيها.
সালাম ফাতেমার ওপর, তাঁর পিতার ওপর, তাঁর স্বামীর ওপর ও তাঁর বংশধরদের ওপর।
নতুন ফারসি বছরের সূচনা হচ্ছে হযরত ফাতেমা যাহ্রা (সালামুল্লাহি ‘আলাইহা)র শাহাদাত বার্ষিকীর সম সময়ে। তাই নিঃসন্দেহে রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর আহ্লে বাইত, বিশেষ করে তাঁর মহিমান্বিত কন্যা হযরত ফাতেমা যাহ্রার প্রতি আমাদের জনগণের ভালোবাসার কতক দাবি রয়েছে, আর সকলেরই উচিত এ দাবিগুলো পূরণ করা এবং নিঃসন্দেহে সকলেই এ দাবিসমূহ পূরণ করবেন। আশা করা যায় যে, এ দিনগুলো ও সদ্য সূচিত এ ১৩৯৪ ফারসি সাল পরিপূর্ণরূপে ফাতেমী বরকতের অধিকারী হবে এবং এ মহান ব্যক্তিত্বের স্মরণ সকলের জীবনে, বিশেষ করে ইরানী জনগণের যিন্দেগিতে গভীর ও স্থায়ী সুফল বয়ে নিয়ে আসবে। আমি আরো আশা করি যে, প্রকৃতিতে যে বসন্তের আগমন ঘটেছে এবং সেই সাথে নতুন ইরানী বছরের সূচনা হয়েছে তা আমাদের ইরানী জনগণের জন্য এবং যে সব জাতি নওরোয উদ্যাপন করে থাকে তাদের সকলের জন্য বরকতময় হবে।
এ উপলক্ষে আমি বাক্বীয়াতুল্লাহিল্ আ‘যাম্ হযরত ইমাম মাহ্দী (তাঁর জন্য আমাদের প্রাণ সমূহ উৎসর্গিত হোক) সমীপে বিনীত সালাম নিবেদন করছি এবং এ অবকাশে আমাদের মহান নেতা হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্.) ও শহীদানের উদ্দেশে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। আমরা আশা করি যে, আমরা ঐ পবিত্র সত্তাগণের বরকতের ও ঐ প্রিয় পবিত্র ব্যক্তিত্ববর্গের দো‘আর অধিকারী হতে পারব।
এ উপলক্ষে আমি বিগত ১৩৯৩ ফারসি সালের প্রতি একটি সংক্ষিপ্ত এজমালী (সার্বিক) দৃষ্টিপাত করব এবং এই মুহূর্ত থেকে যে চলতি ১৩৯৪ ফারসি সাল শুরু হলো তার সম্ভাব্য অবস্থার প্রতিও সংক্ষিপ্ত এজমালী দৃষ্টিপাত করব।
গত হয়ে যাওয়া ১৩৯৩ ফারসি সাল আমাদের দেশের জন্য যেমন অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে, তেমনি বৈদেশিক ক্ষেত্রে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি ঘটনাবহুল বছর ছিল। এ বছরটিতে আমরা বহু চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করেছি এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নতি করেছি। ১৩৯৩ ফারসি সালের শুরু থেকেই আমাদেরকে যে সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে সে সব চ্যালেঞ্জের পরিপ্রেক্ষিতেই আমরা বছরের শুরুতেই এ বছরটির নামকরণ করেছিলাম ‘জাতীয় দৃঢ় প্রত্যয় ও জিহাদী ব্যবস্থাপনার বছর’।
১৩৯৩ ফারসি সালে যা কিছু সংঘটিত হয়েছে তার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখতে পাই যে, আল্লাহ্ তা‘আলার রহমতে এ বছরে আমাদের জাতীয় দৃঢ় প্রত্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে ও অধিকতর প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের জাতি একদিকে যেমন তার সামনে দেখা দেয়া কতক সমস্যাকে সহ্য করার ক্ষেত্রে দৃঢ় প্রত্যয় প্রদর্শন করে, অন্যদিকে ইসলামী বিপ্লবের বিজয় বার্ষিকীতে, বিশ্ব কুদ্স্ দিবসে ও র্আবা‘ঈনের বিশাল শোভাযাত্রার মাধ্যমে এ দৃঢ় প্রত্যয়ের প্রদর্শনী করে। আল্লাহ্র রহমতে কতক ক্ষেত্রে জিহাদী ব্যবস্থাপনার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে পরিদৃষ্ট হয়। যে সব ক্ষেত্রে জিহাদী ব্যবস্থাপনা লোকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সে সব ক্ষেত্রে আমরা যথেষ্ট অগ্রগতির অধিকারী হয়েছি। অবশ্য জিহাদী ব্যবস্থাপনার জন্য যে আহ্বান জানানো হয়েছিল তা বিশেষভাবে কেবল ১৩৯৩ ফারসি সালের জন্য ছিল না; বরং আমাদের জাতির জন্য চলতি ফারসি বছরে ও ভবিষ্যতের সকল বছরেই জাতীয় দৃঢ় প্রত্যয় ও জিহাদী ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন রয়েছে।
তবে এখন থেকে যে ১৩৯৪ ফারসি সাল শুরু হলো এ বছরটিতে আমাদের প্রিয় জনগণের কতগুলো বড় বড় আশা-আকাক্সক্ষা রয়েছে এবং এ আশা-আকাক্সক্ষাগুলোর সবগুলোই বাস্তবায়নযোগ্য। চলতি ফারসি সালে আমাদের জাতির বড় আশা-আকাক্সক্ষাগুলো হচ্ছে : অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নতি ও অগ্রগতি, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইরানী জাতির শক্তিমত্তা ও সম্মানের বৃদ্ধি, প্রকৃত অর্থে বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে উল্লম্ফন, ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক সুবিচার নিশ্চিতকরণ এবং ঈমান ও নৈতিকতাকে অধিকতর সুদৃঢ়করণÑ যা হচ্ছে অন্য সবকিছুর চাইতে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ এবং অন্য সমস্ত ক্ষেত্রে উন্নয়ন ও অগ্রগতির পৃষ্ঠপোষক। আমাদের দৃষ্টিতে এসব চাওয়ার ও আশা-আকাক্সক্ষার সবগুলোই অর্জনযোগ্য। এসব চাওয়ার ও আশা-আকাক্সক্ষার কোনোটিই এমন নয় যা ইরানী জাতির সাধ্যের অতীত বা দেশের সরকারের নীতির আওতা বহির্ভূত বলে পরিগণিত হতে পারে। কারণ, আমাদের সাধ্য ও সক্ষমতা অনেক বেশি। এ ক্ষেত্রে বলার মতো কথা অনেক আছে, ইন্ শাআল্লাহ্, সেগুলোর মধ্য থেকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সমূহ সম্পর্কে শীঘ্রই আরেক ভাষণে আলোচনা করব।
এই মুহূর্তে প্রিয় ইরানী জনগণের উদ্দেশে যা বলতে চাই তা হচ্ছে এই যে, এ বিরাট ও গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনা নিঃসন্দেহে অর্জনযোগ্য, কিন্তু সে জন্য কতগুলো শর্ত রয়েছে। এসব শর্তের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হচ্ছে জনগণ ও সরকারের মধ্যে আন্তরিক সহযোগিতা। উভয়ের পক্ষ থেকেই যদি এ আন্তরিক সহযোগিতা প্রদান করা হয় তাহলে এতে কোনোই সন্দেহ নেই যে, আমাদের আশা-আকাক্সক্ষা সমূহে যা কিছু শামিল রয়েছে তার সবকিছুই অর্জনযোগ্য এবং আমাদের প্রিয় জনগণ তার সুফল স্বচক্ষে দেখতে পাবেন।
বস্তুত সরকার হচ্ছে জনগণের সামষ্টিক কাজকর্ম সম্পাদনকারী, আর জনগণ হচ্ছে সরকারকে কর্মে বিনিয়োগকারী। তাই জনগণ ও সরকারের মধ্যে আন্তরিকতা যত গভীরতর হবে, পারস্পরিক সহযোগিতা যত বেশি হবে ও সহমর্মিতা যত বৃদ্ধি পাবে ততই জাতীয় কর্মকা- অধিকতর উত্তমভাবে এগিয়ে যাবে।
এ ক্ষেত্রে জনগণ ও সরকারের পরস্পরের প্রতি আস্থা রাখতে হবে। তাই সরকারের কর্তব্য হচ্ছে জনগণকে আক্ষরিক অর্থেই কবুল করা। আর জনগণের মূল্যবোধসমূহকে, জনগণের গুরুত্বকে ও জনগণের সামর্থ্যকে সঠিকভাবে গ্রহণ করতে হবে। তেমনি জনগণেরও কর্তব্য হচ্ছে সরকারের ওপর-যে আক্ষরিক অর্থেই জনগণের মনোনীত কর্ম সম্পাদনকারী- আস্থা রাখা। এ বিষয়ে আমার কিছু বলার মতো কথা আছে এবং কিছু পরামর্শও আছে- যে সম্পর্কে আমি আমার পরবর্তী কোনো ভাষণে আভাস দেব।
মোট কথা, আমার মতে, চলতি ১৩৯৪ ফারসি সালকে জনগণ ও সরকারের মধ্যে ব্যাপক সহযোগিতার বছর বলে গণ্য করতে হবে। তাই আমি এ বছরের জন্য যে জাতীয় সেøাগান নির্বাচন করেছি তা হচ্ছে : دولت و ملّت، همدلى و هم زبانى (সরকার ও জনগণ- সহমর্মিতা ও অভিন্ন কণ্ঠ)। আমি আশা করি যে, এ সেøাগান বাস্তবে রূপায়িত হবে এবং এ সেøাগানের অন্তর্ভুক্ত দু’টি পক্ষ অর্থাৎ আমাদের প্রিয় জনগণ, আমাদের মহান জনগণ, আমাদের হিম্মতের অধিকারী ও সাহসী জনগণ, আমাদের দূরদৃষ্টির অধিকারী ও জ্ঞানী জনগণ এবং একইভাবে আমাদের সেবক সরকার এ সেøাগানকে এতে ব্যবহৃত শব্দাবলির আক্ষরিক অর্থেই বাস্তবে রূপায়িত করবেন এবং সকলে এর সুফল দেখতে পাবেন।
আমি মহান আল্লাহ্র কাছে আমাদের দেশের সকল কাজেই উন্নতি ও অগ্রগতি প্রদানের জন্য প্রার্থনা করছি এবং আমরা সকলেই যাতে দেশ ও জাতির খেদমত করতে পারি সে জন্য তাঁর কাছে তাওফীক কামনা করছি।
ওয়াস্-সালামু ‘আলাইকুম্ ওয়া রাহ্মাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ্।
অনুবাদ : নূর হোসেন মজিদী